সমস্ত লেখাগুলি

মহাপ্লাবন: এক নির্মম রিসেটের গল্প -Guitar K Kanungo
May 27, 2025 | category | views:22 | likes:1 | share: 0 | comments:0
মহাপ্লাবন এবং নোয়ার একটা জাহাজ নির্মাণ করে সমগ্র প্রাণীজগৎকে রক্ষা করার ঘটনা আমরা সবাই জানি। বাইবেলে এই ঘটনার কথা বিশদভাবে বলা আছে। সম্প্রতি জুলিয়ান বার্নসের লেখা A History of the World in 10½ Chapters পড়লাম। সেখানে “The Stowaway” নামের একটি অধ্যায় আছে। এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বেশ মজার।
একটি ঘুণপোকা—যাকে নোয়া তাঁর জাহাজে তোলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেননি—সে নোয়ার অজান্তেই ওই জাহাজে উঠে পড়ে। জাহাজেই থেকে সেই ঘুণপোকা নোয়ার প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখার সেই বিশাল কর্মকাণ্ডের একটি ক্রিটিকাল এনালাইসিস দেয়ার চেষ্টা করে। এনালাইসিসটি ভাবনার খোরাক জোগানোর মতো।
ঘুণপোকাটির মতে, নোয়া ও তাঁর নৌকার কাহিনি মোটেও কোনো মহৎ ঈশ্বরীয় পরিকল্পনা ছিল না। বরং এটি ছিল এক ধরনের ষড়যন্ত্র। নোয়া নিজেই ছিলেন একজন কর্তৃত্বপরায়ণ, পক্ষপাতদুষ্ট নেতা। তিনি নিজের খেয়ালমতো প্রাণীদের নির্বাচন করেছিলেন এবং যাদের ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করেছেন, তাদের জাহাজে স্থান দেননি।
নোয়া কিছু প্রাণীকে নোংরা, ক্ষতিকর বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপবিত্র মনে করে তাদের বাদ দেন। কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—কারা ঠিক করবে কোন প্রাণী পবিত্র আর কোনটা নয়? সে নিজেকে এক উদাহরণ হিসেবে হাজির করে—নোয়ার চোখে সে অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সহস্র বছর ধরে কাঠের গঠন, ইতিহাস এবং সভ্যতার অংশ।
বাইবেলে নোয়ার নৌকা এক শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল রক্ষা কেন্দ্রের মতো চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু ঘুণপোকার কাছে নৌকার পরিবেশ মোটেই সেরকম মনে হয়নি। গোটা পরবিশটাকে তার কাছে বিশৃঙ্খল ও স্বৈরতান্ত্রিক মনে হয়েছিল—যেখানে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে হিংসা, খাদ্যসংকট এবং নিপীড়নের পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।
ঘুণপোকা আমাদের জানায়, অনেক প্রাণীকে বাধ্য করা হতো নীরব থাকার জন্য, যাতে নোয়া বা তাঁর পরিবার বিরক্ত না হয়। যারা আওয়াজ করত বা “দায়িত্ব পালন করত না,” তাদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেওয়া হতো বা ফেলে দেওয়া হতো। এটা ছিল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত সমাজ, যেখানে নোয়া ও তাঁর পরিবারই ছিল একমাত্র কর্তৃত্ব।
ঘুণপোকা বারবার প্রশ্ন তোলে: সত্যিই কি এটি ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিল? নাকি নোয়ার নিজস্ব সুবিধা ও ধারণা অনুসারে এটি পরিচালিত হচ্ছিল? নোয়া যেভাবে প্রাণীদের নির্বাচন করেন, সেটিকে ঘুণপোকা এক ধরনের “নোয়া-ব্র্যান্ডেড” নৈতিকতা হিসেবেই দেখে—যেখানে একমাত্র নোয়ার মূল্যবোধই বিচার্য।
ঘুণপোকার মনে প্রশ্ন জেগেছিল—ইউনিকর্ন বাদ পড়ল কেন? নৌকায় ঠাঁই না পাওয়ার পেছনে তার অপরাধটা কী ছিল? না কি শুধুই পৌরাণিক ভেবে তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল?
ঘুণপোকা একটি গভীর দার্শনিক তর্ক সামনে তুলে আনে। সে বলে, “ওই জাহাজে আমি এবং আমার মতো আরও অনেকেই ছিলাম, কিন্তু আমাদের গল্প কেউ বলেনি।” বাইবেলে নোয়ার গল্প অমর হয়ে আছে, কিন্তু ঘুণপোকা মতো প্রাণীদের কণ্ঠ হারিয়ে গেছে ইতিহাসের গহ্বরে।
কাঠপোকা একটি চরম সত্য তুলে ধরে: তারা নৌকায় ছিল, তারা প্লাবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিল, কিন্তু কখনও কেউ তাদের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তারাই সেই লুকিয়ে থাকা সত্য, যাদের কেউ দেখতে পায় না।
ঘুণপোকার কাছে মনে হয়েছিল, ওই মহাপ্লাবন ছিল একটি ক্রুয়েল রিসেট—এক নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, যেখানে নিরীহ প্রাণী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। নোয়া শুধুমাত্র মানুষ ও নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীকে বাঁচিয়ে একটি “নতুন পৃথিবী” গঠন করেন।
কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—ঈশ্বরের পরিকল্পনা যদি এতটাই ন্যায়সঙ্গত হতো, তবে হাজারো প্রাণী কেন মারা গেল? কেন একটি পুরো প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হলো শুধুমাত্র মানুষের জন্য?
ঘুণপোকার এই প্রশ্নটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একজন সাহিত্য সমালোচক বলছেন, “The Stowaway” অধ্যায়ে ঘুণপোকাটি শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং ইতিহাসের সেই বিস্মৃত কণ্ঠস্বর—যারা প্রশ্ন করে, স্মরণ করিয়ে দেয় এবং প্রচলিত বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
এটি লেখক বার্নসের উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিখুঁত প্রকাশ—যেখানে ‘সত্য’ আপেক্ষিক, এবং ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই একটি পক্ষপাতদুষ্ট নির্মাণ, যে ইতিহাস কেবল তারাই লেখে যারা বিজয়ী হয়।
ফিক্শন পড়ে আমি সবসময় আমি আনন্দ পাই, এমন কথা বলতে পারব না ; কিন্তু জুলিয়ান বার্নসের এই বইটি পড়ে বেশ আনন্দিত হয়েছি। মগজে নাড়া পড়েছে - মহাপ্লাবনের মত একটা ঘটনা, যেটা কেবল বাইবেলে বর্ণিত একটা কল্পকাহিনীই নয়, অনেক প্রত্নতাত্বিক বিশ্বাস করেন অতীতের কোন এক সময়ে পৃথিবী সত্যিই এক মহাপ্লাবনের মুখোমুখি হয়েছিল, সেটাকে নতুন আঙ্গিক থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
বেশ কয়েক বছর আগে জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম পড়ে মগজে এরকম একটা ধাক্কা লেগেছিল।
লঙ্কাকান্ড -অশোক দাস চার্বাক
May 20, 2025 | নাটক | views:7 | likes:0 | share: 1 | comments:0

[নাটকটি বর্তমানের বঙ্গসমাজের বাস্তবচিত্র ভিত্তিক একটি কল্পচিত্র। বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব চরিত্রের প্রতিফলন যে এ নাটকে থাকবে এটা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ নাটকে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা নির্দিষ্ট চরিত্রের ইঙ্গিত করে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্মানে আঘাত দেওয়া লেখকের উদ্দেশ্য নয়।]

চরিত্র:

মৃত্যুঞ্জয় - পুলিশ অফিসার                      

সুরজ - চাওয়ালা 

সর্বপ্রিয়া - অফিসারের  স্ত্রী                      

কালীপদ - মন্দিরের পূজারী            

শান্তিলতা - অফিসারের শাশুড়ী                

নান্টু - বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা 

হারাধন - অফিসারের শশুর                    

দুর্যোধন - অঞ্চলপ্রধান 

আশারাম - গুরুবাবা                              

পরানবাবু - উকিল 

ডঃ বোস - নার্সিংহোমের মালিক               

রিকশাওয়ালা          

শঙ্করবাবু - বৃদ্ধ প্রাক্তন শিক্ষক                  

টিভি সংবাদ পাঠিকা 

                           

    (পর্দা ওঠার আগে)

মাইক: ....................নাট্যসংস্থার পরিচালনায় অশোকদাস চার্বাক বিরচিত ও............ দ্বারা পরিমার্জিত যে অনুনাটকটির অভিনয় আপনারা সকৌতুকে উপভোগ করতে চলেছেন, তার হালকা রঙ্গব্যাঙ্গের আড়ালে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে মানব প্রজাতির অবলুপ্তির দিকে অগ্রগতির এক ভয়াবহ ভবিষ্যতচিত্ৰ। হোমিনিড বংশোদ্ভূত হোমো স্যাপিয়েন অর্থাৎ ওয়াইজম্যান প্রজাতির পশুরা তাদের প্রকৃতিলব্ধ পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশঃ বিবর্তিত হতে হতে কিছুটা মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পূর্ণসভ্য মানুষ হবার পথে বেশ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু পশুসুলভ সংগ্রহকারী প্রবৃত্তি, অতিলোভ ও মাত্রাহীন ভোগবিলাসের লাগামছাড়া হাতছানি সদ্যবিবর্তিত অপরিণত মানুষকে পুনরায় পশুস্তরে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষ, অর্থাৎ যে প্রাণীদের আমাদের চলতি ভাষায় ‘মানুষ’ বলে থাকি - তারা ক্রমশ আগের মত মননহীন জন্তুত্ব অর্জন করতে চলেছে। মানুষ ও অন্যান্য পশুর চারিত্রিক পার্থক্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য পশুদের মত প্রতিযোগী পশুর সংগৃহীত করা খাদ্য বা প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ যেনতেনভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে। অপরের পুরুষ বা নারীসাথীকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে বা গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। তারা উন্মত্ত অসভ্য আদিম অর্ধমানবদের মত হাটে বাজারে, রিসর্ট মধুচক্রে নাচছে উদ্দাম উলঙ্গ হয়ে। আর আমরা টিভি সিনেমা থিয়েটার পথেঘাটে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সে সব পশুনৃত্য লজ্জাহীনভাবে উপভোগ করছি আমাদের সন্তানদের সাথে। সেসব মজার দৃশ্য, সেসব রঙ্গব্যাঙ্গের দৃশ্য, সেসব কান্নার দৃশ্য, বিপথগামীদের অসহায় কালমৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার আপনার প্রিয়জন ও সন্তানসন্ততির দুর্ভাগ্যের ভবিষ্যৎ দৃশ্য অনুমান করুন। তারপর নাট্যমঞ্চের শেষ পর্দা নেবে গেলে প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এ সমাজের জতুগৃহ থেকে মুক্ত হবার পথ খুঁজতে থাকুন। অথবা, মানে ‘অথবা’ এ নাটকে দেখা পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, পুরুত, গুরুবাবা, জ্যোতিষ বাবা, নেতাগুন্ডাদের ওপর আপনার একান্ত প্রিয় সন্তানসন্ততিদের রক্ষা করবার ভার অর্পণ করে আরও আরও সম্পদ বাড়াতে থাকুন, আর নিজ নিজ ভোগবিলাস চেটেপুটে উপভোগ করুন হলের বাইরে গিয়ে। আজকের নাটকে এতক্ষণ যা দেখবেন তা ভুলে যান। 


প্রথম দৃশ্য 

(নামাবলী গায়ে এক পাঠক রামায়ণ পড়ার সুরে পাঁচালী পাঠ করছে দুলে দুলে)

এ নাটকে দেখা যাবে প্রতি ঘরে ঘরে,

স্ত্রী পুত্র পরিবার একে একে মরে।

অসুরের স্বর্নপুরী পোড়ে সারে সার,

রাবনের দর্প ভেঙে হলো একাকার।

অসুর পুড়িছে তার কালো টাকা সনে,

লোভী মানি যোগী ধনী মরে জনে জনে।

ভোগের লালসা ধায় বিলাসীর গৃহদ্বার,

সে আগুন গ্রাস করে সুখী যত সংসার।

নেতা মন্ত্রী অফিসার সে আগুনে ঝাঁপ দেয়,

বৃদ্ধ যুবা শিশু পোড়ে পতঙ্গের মত হায়।

রচয়ে চার্বাক ঋষি কলির এ রামায়ণ,

স্বর্ণলঙ্কা দহনের নব এক রূপায়ণ।

ভাবিতে থাকহ এবে শ্রোতা সুধীজন,

বাঁচাইবে কি উপায়ে পুত্র প্রিয়জন।

অথবা চক্ষু মুদি মজা কর ঘরে,

না চিন্তি আগামী দিন পশু যাহা করে।

পুড়ুক এভাবে তব আপনার জন,

আগামী প্রজন্ম তরে করোনা মনন।

চক্ষু মুদি কর্ণ ঢাকি তিন হনু সম,

মুখ বুজি মন্ত্র জপ অসুরায় নমঃ।

শুষে নাও এ ধরায় আছে যত মধু,

লালসা মেটাতে তুমি ছুটে চল শুধু।

চার্বাক কথা শোন গরল সমান,

পোড়াইচ্ছে সারা ধরা যত হনুমান।

হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল,

হরিবোল,  হরিবোল, হরিবোল, হরি-ই-বোল।



দ্বিতীয় দৃশ্য 

[গ্ৰাম্য রাস্তার চৌমাথায় এক পথশনির ঠেকের পাশে চায়ের গুমটি। দূর থেকে ভেসে আসছে মোটরবাইকের আওয়াজ। চাওয়ালা চা চাপিয়ে দিল স্টোভে। বাইক থামিয়ে পুলিশ অফিসার মৃত্যুঞ্জয়ের  প্রবেশ]

সুরজ  - সেলাম সাহাব।

মৃত্যুঞ্জয় - চা চাপা শিগগির। আটটা বেজে গেল, এখনও উনুনের কয়লা কালো কেনরে শালা। 

সুরজ - মনটা বহুত উদাস হো গিয়া সাহাব। ঘরকা বহু প্রোমোটার কলিমুদ্দিনকা সাথ তিন দিন বেপাত্তা। বহুত সরম কি বাত। শুনা কি বকখালিমে ফুর্তিকে লিয়ে গিয়া হোগা। 

মৃ - এতে শরমের কি আছেরে পাগলা? এতো তোদের জাতের ছোটলোকদের বাড়ীর আখচার কারবার। ঘর ঘর কা কাহানি। মন খারাপ করিস না, আর একটাকে ধরে নিয়ে আয়। নে, চা চাপা। 

সু - চাপিয়েছি সরকার, দূর থেকে আপনার ইনফিল্ডের ডিগ ডিগ শুনে স্টোভেই চাপিয়ে দিয়েছে আপনার ইস্পেশাল চা। 

মৃ - বহুত আচ্ছা, কদিনেই বেশ ভালো বাংলা শিখছিস তো! বুদ্ধিটাও বেশ পেকেছে দেখছি বাংলার জল খেয়ে। 

সু - সব অপকাহি মেহেরবানী সাহাব। 

মৃ - ডাবল হাফ চা দিবি, আর ডাবল ডিম টোস্ট। 

সু - সব রেডি হো গিয়া সাহাব, আপকা মর্জি হামারা ধ্যানমে হ্যায়। 

মৃ - এইতো চাই। এই ভক্তি-বুদ্ধির জন্য তোরাই ব্যবসা জমাচ্ছিস সারা বাংলা জুড়ে। আর বোকচন্দর আঁতেল বাঙালীর বাচ্চারা শুধু দুর্নীতিবিরোধী মিটিং মিছিল প্রতিবাদ হরতাল করে করেই মরছে। বলে সমাজতন্ত্র আনবে, ন্যায়বিচার আনবে। শালা ওসব তন্ত্রমন্ত্র কি ধুয়ে খাবি? নিজের নিজের সংসার ছেলেমেয়েদের কথা ভাব। ওরা যে দিন দিন রসাতলে যাচ্চে সেটা আগে বোঝ। ইন্টেলেক্চুয়াল হয়েছে সব - বুদ্ধিজীবী!

সু - (চায়ের কাপ আর টোস্টের প্লেট টেবিলে রেখে)আউর কুছ সেবা সাহাব?

মৃ - এক প্যাকেট উইলস ছাড়। ক্লাসিক ফ্ল্যাসিকতো এ গাঁয়ে মিলবেনা। 

সু - নেহি সাহাব, স্রিফ আপকা লিয়ে চুপকে চুপকে লে আয়া শাহরসে। 

   (এদিক ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটের সাথে পঞ্চাশ টাকার নোট রাখলো টেবিলে)

মৃ - এ কিরে শালা, পঞ্চাশেই সারবি নাকি? গত মাসেও তো চা বিস্কুটেই কর্তব্য সেরেছিলি। সেদিন দোকানে লাল পার্টির আগুনখেকো বদ ছোকরাগুলো ছিল বলে কিছু বলিনি। এমন করলে গভর্নমেন্ট চলবে, না দেশের মা মাটি মানুষ বাঁচবে! অন্ততঃ পুরো এক ছাড়। 

সু - বেচাকেনা একদম নেহি স্যার। 

মৃ - বললে হবে, ছোটঠা কাঁহাকা। একটা বেঞ্চতো বাড়িয়েছিস দেখি। তিন তিনটে বেঞ্চ ভরিয়ে কাদের বসাস। এটা পুলিশের চোখ, বুঝলি। বেশতো জাঁকিয়ে বসেছিস এ রাজ্যে এসে। সরকারি রাস্তা, সরকারী টিউকলের জল - সব তো ফুকোটসে। সরকারী রাস্তার জায়গাটাও তো জবরদখল। আর সেই সরকারের জন্য পঞ্চাশ! যারা তোদের অন্ন যোগাচ্ছে তাদের কথা একটু ভেবে দেখ। তোদের লালু ছাড়তো পঞ্চাশে? সামনের মাস থেকে দুই করে ছাড়বি। 

সু - মোর জায়গা সাহাব। 

মৃ - তা না হলে ইনকাম ট্যাক্স, সেলটাক্স, উনুনে কয়লা পোড়ানোর জন্য পরিবেশ দূষণ ট্যাক্স, - সব কেস একসাথে। - ধর ধর রিক্সাটাকে। সালা বড্ডো ফাঁকিবাজ। আমার বাইক দেখলেই স্পিড বাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছুট মারে চোট্টাটা। জোচ্চোর একেবারে, অসৎ। 

[রুখ রুখ  বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তার ওধারে গিয়ে রিক্সাটার হ্যান্ডেল চিপে ধরলো  সুরজ]

সু - বহুত মেহবান হো গিয়া শালা। সরকারকা বাইক দেখতা নেহি? সাহাবকো সেলাম দেগা কৌন? চল শালা বুড্ঢা। 

[কাঁধের গামছাটা কোমরে জড়িয়ে খোঁড়া রিক্সাওয়ালাটাকে  টানতে টানতে পুলিশের সামনে নিয়ে এলো সুরজ। দাদুর বয়সী বুড়ো  রিকশাওয়ালা পুলিশের  পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায়  ঠেকালো।]


রিকশাওয়ালা - বলুন বাবু। 

মৃ - বাবু! শালা, আমিকি তোর ইয়ারদোস্ত নাকি? স্যার বল, স্যার। বুড়ো হয়ে মরতে বসেছিস, ম্যানার্স জানিসনা? 

রিকশা - ভুল হয়ে গেছে বা- মানে স্যার (একটু জোরে) স্যার, স্যার। 

মৃ - বল শালা, রিকশায় প্যাঁপো বেল কিছু নেই কেন?

রিকসা  - প্যাঁপো একটা ছিল বা-স্যার, কদিন হলো চুরি হয়ে গেছে। 

মৃ - দিনের বেলাতেও ঘুমোস নাকি? লক্ষ্য রাখতে পারিসনা?

রিকষা  - আপনারা কিছু একটা ব্যবস্থা করুন সা-স্যার। বড্ড চুরি বেড়ে গেছে এদিকটায়। গত রাতে পঞ্চায়েত মিয়াঁর বিবিটাও বেপাত্তা হয়েছে। নাড়াপুর কালীমন্দিরের  পুরুত ঠাকুরের তিন তিনটে শুয়োর, আর চারটে  মুরগি চুরি হয়ে গেছে। জাগ্রতা মায়ের পেতলের জিভটাও কেটে নিয়ে গেছে চোরে। 

মৃ - তা, আমরা কি করবো? আমরা কি সাইকেলচোর, বৌচোর, মুরগিচোর, চাকরীচোর ধরতে বসে আছি নাকি? তাহলে সরকারী কাজটা করবে কে? যে নিজের মাল  নিজে নিজে সামলাগে যা। জাগ্রতা মাকালীকেও বলে দিস নিজের জিভ নিজে সামলাতে। 

রিকশা - যা বলবেন স্যার। চলি এখন?

মৃ - চলি কি রে? তিন মাসতো কিছুই দিসনি। এতো ধারবাকিতে চলে? একশো ছাড়।                                   রিকশা  - মরে যাবো স্যার, ট্যাঁকে মোটে পনেরো টাকা আছে। বৌ বাচ্চার জন্য চাল কিনতে হবে। 

মৃ - বাকি টাকা গেল কোথায়?

রিকশা - ভোর থেকে মাত্র দুটো খদ্দের পেয়েছি। তাও একজন আমার চেয়েও খোঁড়া - থুড়থুড়ে বুড়ি - বিধবা। যখন ওনার বাড়িটা ছিল, তখন উনি দু’দুটো বড় বড় অফিসারের মা ছিলেন। ছেলেদের নামে বাড়িটা লিখে দেবার পর ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় থাকেন, ভিক্ষা করে খান। বড্ডো জ্বর তাঁর। ওনার কাছে পয়সা নিতে পারলাম না স্যার। মানুষের মন, আমার আপনার বাড়িতেও তো বুড়ো বাপ মা আছেন। বুড়িকে হেলথ সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে এলাম এমনি এমনি। 

মৃ  - কিন্তু সরকারতো ছাড়তে পারে না এমনি এমনি। তাকে নিয়ম আইন মেনে চলতে হয়। তা না হলে দেশে অরাজক হয়। প্যাঁপো না থাকায় সাংঘাতিক একটা কেস খেয়েছিস তুই। তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে সরকারকে কি কৈফিয়ৎ দেব? সরকারতো এজন্যই আমাদের মাসে মাসে মাইনে দিয়ে রেখেছে। এয়াই সুরজ দেখতো সার্চ করে, ওর ট্যাঁকে কত আছে। 

           [সুরজ রিক্সাওয়ালার ট্যাঁক সার্চ করলো]

সুরজ - পঁয়ত্রিশ রুপিয়া স্যার। সালা ছোটঠা আদমি। সরকারকো ভি ফাঁকি দেতাহা!  ইতনা বাদমে তো নবান্ন রাজভবন ভি লুট লেগা শালা। 

মৃ  - দশ  টাকা ওকে দিয়ে বাকিটা নিয়ে আয়। ৭৫ টাকা মাফ করে দিলাম এক কথায়। ১০০ টাকার কেস ২৫ টাকায় নিস্পত্তি। তবু অনেকে পুলিশকে ঘুষখোর বলে। [তাড়াহুড়ো করে রিক্সাওয়ালার ছুটতে ছুটতে প্রস্থান] সুরোজ, এই টাকা থেকে তুই দু’টাকা বকশিস রাখ। তোর ইন্টারভিউ হয়ে গেলো। দারুন কাজ করলি। এবার একটা ভালো সরকারী চাকরী কিনে  নে। বড় নেতাকে  বলে অল্প দামে সিভিক ভলেন্টিয়ারের চাকুরী করে দেব তোর। এভাবেই আমাকে সাহায্য করবি। সবার সামনে সরকারি  কাজ করতে পারি না। চারিদিকে মিডিয়ারা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে। আমার হয়ে ট্রাক লরি থেকে জরিমানা আদায় করবি তুই। সরকারী মাইনে  ছাড়া আমার কাছ থেকে কমিশনও  পাবি। 


     [বৃদ্ধ শঙ্করবাবুর  প্রবেশ। হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে সবজি  দেখা যাচ্ছে। মাথায় তালি  দেওয়া ভাঙা ছাতা। চায়ের কাপটা তাড়াতাড়ি শেষ করে মৃত্যুঞ্জয়  ছুটে এগিয়ে গেলো ওনার দিকে।] 

মৃ - ভালো আছেন স্যার?(প্রণাম) 

শঙ্করবাবু – তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলামনা বাবা। চোখেও ভালো দেখিনা ...

মৃ - আমি মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। আপনার ছাত্র ছিলাম। বারে বারে ফেল করতাম বলে ফেলুরাম বোকারাম বলে ডাকতেন আদর করে। আমাকে পাস করানোর জন্য আলাদা করে বিনা পয়সায় পড়াতেন আপনার বাড়িতে। 

শঙ্কর - মৃত্যুঞ্জয়, হাঁ হাঁ মনে পড়েছে বটে। আশুর ছেলেতো। বড্ড ভালো মানুষ ছিল তোমার বাবা। খড় দিয়ে ঘর ছাইতো নিখুঁত। নিজে লেখাপড়া করতে পারেনি বলে তোমাকে পড়িয়ে পড়াশুনার স্বাদ মেটাতো। জনমজুর খেটে আধপেটা খেয়ে তোমাকে পড়াতো। স্বার্থক হয়েছে তার পরিশ্রম। পুলিশ অফিসার হয়েছো বুঝি। 

মৃ - হাঁ স্যার, ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার। চা খান মাস্টারমশাই।  

শ - তা, আশুর মত সোজা সরল সৎ মানুষের ছেলে হয়ে পুলিশ লাইনে এলে  কেন? অবশ্য পুলিশের মধ্যে অনেক সৎ মানুষও আছেন। তবে নেতা মন্ত্রী পুলিশের নামে লোকে আজেবাজে কথা বলে, মানসম্মান রাখে না শুনি। 

মৃ - মানসম্মান নিয়ে কি ধুয়ে খাব নাকি? ওসব সেকেলে সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দিলে আর করে খেতে হবে না। 

শ - তাবলে এ লাইনে? অন্য চাকরী ধর।

মৃ - সব লাইন একই মাস্টারমশাই, সব শালা- সরি, মানে  সব ভদ্রলোকই চোর। আপনাদের শিক্ষকরাইতো কোচিং সেন্টার ফেন্টার খুলে কোশ্চেন বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছে। নেতা মন্ত্রীদের ঘুষ দিয়ে নিরক্ষররা সরকারী অফিসার, বোর্ডের চেয়ারম্যান, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়ে যাচ্ছে। এখনকার দিনকাল পাল্টিয়ে গেছে মাস্টারমশাই। এখন মা-মাটি-মানুষের সরকার। সব সময় পাশে থাকে। ডাকলেই দুয়ারে হাজির। 

শ - ক্লাস সিক্সে তিন বার আটকিয়ে থেকে স্কুল ছেড়ে বাবার সাথে চাষবাস দিনমজুরি করা শুরু করেছিলে শুনেছিলাম। অফিসারের চাকরি পেলে কি করে? পরে প্রাইভেটে পাস্ করেছিলে বুঝি?

মৃ - সে এক মজার ইতিহাস মাস্টারমশাই। ভোট করাতে গিয়ে রাজনীতি লাইনে একটু নামডাক-চেনাশোনা হয়েছিল। কাউকে ঘেঁষতে দিতাম না বুথে। নয়খুনি নান্টু, মেছো অনুকেষ্টরা এখন বড় বড় নেতা হয়েছেন। টুঁকুলি মন্টুকে মনে আছে স্যার? স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সে ছাত্রনেতা হয়ে গেছিল। সে এখন এম এ পাস করে ডক্টরেট পেয়ে গেল বিহার বিশ্ববিদ্যলয় থেকে। ওখানে বেশ সস্তায় ডিগ্রি পাওয়া যায়। পরীক্ষা টোরিক্ষা কিচ্ছু দিতে হয়না। সে, মানে তিনি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়ে শিক্ষকদেরই সহবত শেখাচ্ছেন। বড় শহরে  পোস্টিং পাবার জন্যে কত আচ্ছা আচ্চা শিক্ষক অধ্যাপক, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত ব্যাগে প্যাকেট খাম লুকিয়ে ওঁর চেম্বারে ধর্ণা দিচ্ছে। 

শ - বল কি বাবা, এত উন্নতি করেছে মন্টু!

মৃ - ওনারাই বললেন, বাপের অবস্থাতো দেখলি। চাষবাস বা খড়ের ঘর ছেয়ে  আর কয় পয়সা কামাবি, এখনকার বৌ বাচ্চাদের খাঁই মেটাতে পারবিনা। দিনকাল পাল্টেছে। চাহিদামত ফুর্তির রসদ না পেলে ছেলেমেয়েরা ঘেন্না করবে, বৌ হেটেল রিসোর্টে ছুটবে রাতের মজা লুটতে। তুইতো বেশ হাতফাৎ চালাতে, খিস্তি খেউর করতে পারিস মাননীয় নেতামন্ত্রীদের মত। সেকারনে গাঁয়ের লোকেরা ভয়ে ভয়ে তোকে সমীহও করে। সামনের ভোটের আগে কদিন স্বেচ্ছায় মানুষের সেবা কর। ভোটের পরে নেতাদের বলে কয়ে সামান্য খরচে পুলিশে ঢুকিয়ে দেব তোকে। তুই আমাদের দেখবি, আমরাও তোরটা। দু বছরে গাড়ি বাড়ি সম্মান - সব হয়ে যাবে। তাই স্যার, বাবার ভিটেটা বেচে লাখ তিনেকে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। মাধ্যমিক সার্টিফিকেটটাও ফ্রি পেয়ে গেলাম এক্সট্রা। 

শ - এসবতো অশ্লীল অসভ্য লেখকদের গল্প নাটকের মত মনে হচ্ছে। তুমি কি সত্যি বলছ? 

মৃ - একদম সত্যি। এসব হচ্ছে উন্নততর প্রশাসনের আধুনিক টেকনোলজি। নিন আর এক কাপ চা খান। বলেনতো তিন চার লাখে আপনার বেকার ছেলেরও  এমনি একটা হিল্লে করে দিতে পারি। বড় বড় জায়গায় আমার কন্টাক্ট আছে। আপনারও ভালো, আবার দু পয়সা আমার পকেটেও  ঢোকে। 

শ - ছি ছি বাবা। ওসব খারাপ কথা থাক। সৎভাবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন কর। পাপকে কখনও মনে ঠাঁই দেবেনা। পাপের পয়সা কখনও ঘরে ঢোকাবেনা। রাতে ঘুম হবেনা। ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে, সংসার জীবন সুখের হবেনা। তোমার বাবামায়েরা ভাল আছেনতো?

মৃ - অনেকদিন হল ওদের খবর পাইনি। 

শ - সে কি! কোথায় থাকেন ওঁরা? বহু কষ্টে মাটির বাড়িটা বানাতে দেখেছিলাম। 

মৃ - প্রথমের দিকে আমার সাথে ঐ বাড়িতেই থাকত। আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিধবা দিদির বাড়ী চলে গেলেন আপনার বৌমার সাথে ঝগড়া করে। নিঃসন্তান দিদি মারা গেলে পার্টি সিন্ডিকেটের এক প্রোমোটার দিদির বাড়িটার দখল নিলো আমায় দুই আর পার্টিকে দুই দিয়ে। তারপর দিদির বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওরা  কোথায় গেছিল জানা নেই। লোক পরম্পরায় শুনি ওরা  নাকি গত বছর একই দিনে মারা গেছেন মাদারের আশ্রমে। ওরাও নিশ্চিন্ত, আমরাও। 

শ - সে কি কথা! তুমি ওদের একমাত্র উপযুক্ত ছেলে, গায়ের রক্ত জল করে তোমায় মানুষ করেছেন, মরণকালে শেষ জলটুকু পেলেননা তোমার হাতে!

মৃ - কি করব বলুন,বুড়ো বয়সে বড্ড বেগড়বাই করছিল। সারা বছর বুড়োবুড়ির দাঁত ব্যাথা, হাঁপানি, বাতবেদনা, ছানি - মানে নানা অপব্যয় আর অশান্তি। তারওপর আবার নানা বায়নাক্কা - মাঝ রাত বিরেতে কোথায় যায় বৌমা, চুল ছোট করে কাটে কেন, ফেরার সময় মুখে বাজে গন্ধ কেন, মানে আপনার বৌমা ওদের গোয়েন্দাগিরির ঠেলায় একেবারে অতিষ্ট। সংসার ছারখার। 

শ - থাক বাবা থাক, আর বলতে হবেনা। ঠাকুর তোমার সুমতি দিন, তোমাদের চৈতন্য হোক। ছেলেমেয়েরা যেন তোমাদের দেখে বুড়ো বয়সে। 

মৃ - আমিও আপনার মত বেলুড় মঠের শিষ্য। আমার ঔরসে, আমার রক্তমাংসে তৈরী আমার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন কুসন্তান হবেনা, এ আমি নিশ্চিত। 

শ - তুমিও কি তোমার বাপ মায়ের রক্তমাংসে সৃষ্ট হওনি নাকি। তুমি ওঁদের তাড়ালে কি করে? ওঁরাওতো ধার্মিক ছিলেন তোমার মত। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন, দেব দ্বিজে ভক্তি ছিল, অনুকূলবাবুর সৎসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে নিরামিষ খেতেন  .......

মৃ - বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরে বহুত তর্ক শিখে গেছেন দেখছি। পুলিশের সাথেও তক্ক! এত সাহস! পন্ডিত হয়ে গেলেন, না বামবাদী? বাঁকা কথায় গালাগাল দিচ্ছেন! ভালো প্রস্তাব দিলাম, মনে ধরলোনা। বাজে কথা ছেড়ে এবার সরকারী কথায় আসুন। বাজারে গিয়েছিলেন বুঝি?

শ - আমাদের আবার বাজার। ওই কুমড়ো, কুদরী, কলমি, কচু - এইসব আর কি। সবই তো দুনম্বরী প্রোমোটার, পার্টিফড়ে হঠাৎ-বাদশারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। 

মৃ -সবইতো বুঝলাম, কিন্তু প্লাস্টিক ব্যাগে আনাজ আনতে গেলেন কেন? ফালতু একটা কেস খেয়ে গেলেন সক্কালবেলা। 

শ - এইটুকুতো সবজি, ব্যাগটা কদিন আগে ছিঁড়ে গেছে বাবা। 

মৃ - পাতলা প্লাস্টিকে বাজার আনা বেআইনী সেটাকি জানেননা?

শ - জানি বৈকি বাবা। কিন্তু সবার হাতেই তো দেখি। তোমাদের পুলিশরাও তো দেখি ঐ ব্যাগে বাজার করে। 

মৃ - আপনিকি আজকাল পুলিসের ওপরেও পুলিশগিরি করছেন নাকি? জেল হয়ে যাবে যে। নেতা পুলিশের নামে এমন কুৎসা ছড়ানো ব্ল্যাসফেমির মত কগনিজেবল অফেন্স এটা কি জানেননা? ফের আবার প্রশাসনের নামে এমন কুৎসা করলে সোজা হাজতে পুরে এক্কেবারে অম্বিকেশ করে ছেড়ে দেব। 

শ-ছিঃ ছিঃ, পুলিশ হয়েছো বলে কি শিক্ষকদের সাথেও ঠাট্টা মস্করা করবে নাকি? চলি এখন। 

মৃ - চলি মানে? কোথায় পালাবেন আমার হাত থেকে। রাস্তায় বিড়ি খাবার কেসটা না হয় ছেড়ে দিয়ে গুরু ঋণ শোধ করলাম। আপনিও আমার বাল্যকালে আমায় বিড়ি খেতে দেখে শুধু আলতো করে কান মলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্লাস্টিক কেসটা চোখ বুজে ছেড়ে দিলে সরকার থাকবে, না আমার চাকরী। 

শ - তুমিও আমার কান মোলে ছেড়ে দাও বাবা। 

মৃ - একি বলছেন মাস্টারমশায়। আপনি আমার গুরু। শাস্ত্রে বলে আচার্য দেব ভব। আপনার কানে হাত দিয়ে আমি কি মহাপাতকী হবো নাকি। পাবলিকই বা কি বলবে, আবার ভগবানই বা কি বলবে। 

শ - তাহলে কি করে তোমার হাত থেকে রেহাই পাবো বাবা?

মৃ - ওটা আমার হাত নয় মাস্টারমশাই। ওটা সরকারের হাত, মানে আইনের হাত। আর ও হাতটা জনগণই বানিয়েছে। আপনিও বানিয়েছেন ভোট দিয়ে। শুনুন মাস্টারমশাই, আমি হিসাব করে দেখলাম পুলিশ কেস হয়ে গেলে আপনার পরিশ্রম, হয়রানি, ছুটাছুটি, দুশ্চিন্তা, তার উপর থানা খরচা, পার্টি খরচতো আছেই। উপরন্তু আদালতে কতবার যে ডেট পড়বে তার ঠিক নেই। তার জন্য প্রতিবারে উকিলের ফি, কেরানির ‘আমরা পেয়ে থাকি’, পিওনের বকশিস, সাক্ষীর জলপানি - রাহা খরচ....

শ - সাক্ষী? সাক্ষী কোথায় এ জনহীন মাঠে?  

মৃ - সব আছে মাস্টার, সব আছে। সব কি খালি চোখে দেখা যায়, না সবাই সব কিছু দেখতে পায়। সাক্ষীরা সব দেব দেবীদের মত অলক্ষে অন্তরীক্ষে থাকে। সাধুসন্ত মুনিঋষিরা যেমন গাঞ্জা সেবন করে অদৃশ্য ভগবান দেবদেবীদের দেখতে পায়, তেমনি একমাত্র উকিল আর পুলিশরাও সাক্ষীদের দেখতে পায়, সাক্ষীরা তাদের ডাকে সাড়া দেয়। একবার হাঁকিয়ে দেব, আর জনা বিশেক মান্নিগন্নি বাবুলোকেরা আদালতে গীতা ছুঁয়ে বলবে যে আপনি কর্তব্যরত পুলিশকে জুতোপেটাও করেছেন। তখন ঘটিবাটি বেচেও জেলযাত্রা ঠেকাতে পারবেননা। আজীবন  আপনার কেসটা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে। আর আপনার মরার পর উত্তরাধিকার সূত্রে আপনার বেকার পুত্রের ঘাড়ে চেপে বসবে তার দায়। নিন, দশ  হাজার ছাড়ুন। 

শ - এতো টাকা আমি কোথায় পাবো বাবা। তার চেয়ে আমায় বেঁধে তাঁদের নিয়ে যাও। 

মৃ - এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মাস্টারমশায়? পুলিশ বলে আমরা কি মানুষ নই নাকি। আমরাকি একেবারে চশমখোর শুওরের বাচ্চা যে পরম পূজনীয় বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে জেল খাটাবো। আমরা নিরপেক্ষ সরকারী কর্মী হলেও আমাদের পাঁজরের নিচে একটা দুর্বল নরম মন রয়েছে। সে মনে লাজ লজ্জা,ন্যায়বোধ মনুষ্যত্ববোধ যে একেবারেই শূন্য তা নয়। আপনার জন্য সামান্য কিছু করতে পারলে শিক্ষাগুরুর ঋণের বোঝাটার কিছুটা লাঘব হয়। আমাদের মহামান্য মন্ত্রী বলেছেন নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভুলে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তাঁদের সে বাণীতে আনুপ্রানিত হয়ে মাত্র ছয় হাজারে কেসটার  ফয়সালা করে দেব। দশ থেকে একেবারে ছয়। সক্কালবেলা স্রেফ ফোঁকেটসে আপনার চার হাজার টাকা ইনকাম। এবার হাসুন। না না, এখুনি দিতে হবেনা। বাজার হয়ে গেছে।এবার বাড়ি যান, ভালোমন্দ খান, আনন্দফুর্তি করুন, সন্ধ্যে হলে দিয়ে সরকারি জরিমানার টাকাটা আমার সিভিক সেচ্ছাসেবক গিন্নীর কাছে জমা করে আসবেন। সরকারী জরিমানা কমিয়ে দিয়েছি বলে আবার পাঁচকান করবেন না যেন। আপনাদের ঐ মিডিয়া, আর অর্ধশিক্ষিত জনগণ তা বুঝবে না। ঘুষ খেয়ে চার হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছি বলে কুৎসা রটাবে। অসভ্য নাট্যকারেরা  নাটক লিখবে, অশিক্ষিত লেখকেরা গল্প লিখবে, টিভিতে তর্ক বিতর্ক করে গলা ফাটাবে - মনে হয় সবকটাকে ধরে ধরে অথবা - যান এখন নয়টার বাসটা পৌঁছুবার আগে কেটে পড়ুন। 


(শঙ্করবাবুর দ্রুত প্রস্থান) শালা শ্বশুরমশাইয়ের মোপেড মনে হচ্ছে। শালার ব্যাটা হাড়কেপ্পন। বছরের পর বছর জামাইষষ্ঠী, পুজোর কাপড় সব ফাঁকি দিয়েছে সুদখোর হারামির বাচ্চা। পুলিশের শ্বশুর পরিচয় ভাঙিয়ে এর কলা, ওর মুলো, ডিম, মুরগী বিনে পয়সায় বাগিয়ে বৌয়ের কাছে ফাঁট মারে। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে আধা দামে চাল ডাল কেনে, রেশন দোকান আর স্কুলের মিডডে মিলের ডিমের বখরা নেয় রাঁধুনি মাস্টারদের কাছ থেকে। আর জামাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা। শুওরের ইয়েটাকে আজ একটা কেস না দিলে সরকারের মান ইজ্জত থাকবেনা। (হারাধনবাবু মোপেডটা রাস্তায় স্ট্যান্ড করিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। গলায় তুলসীর মালা, কপালে গলায় হাতে চন্দনের ছাপ। মুখে গ্রামীণ সুদখোর সুদখোর ভক্ত ভক্ত ভাব।) ভালো আছেন বাবা?

হারাধন - ও তুমি! চিনতেই পারিনি। টুপিটা বেশ মানিয়েছে কিন্তু। সাহেব সাহেব লাগছে দেখতে। মনে হয় সেই ছোট বেলায় দেখা গোরা পুলিশ। তবে ওদের সোলার হ্যাটটা থাকলে আরও মানাতো। অবশ্য আর সব একই। সেই এক ব্যাটন, সেই লাল লাল চোখ, তেজিতেজি মুখ খিস্তি। তোমার শাসনের প্রশংসা শুনি গ্রামে গ্রামে। মেনিমুখো মিষ্টি মিষ্টি ভদ্র ভদ্র পুলিশ আমার ভালো লাগেনা। সাহেবরা আমাদের দেশটাকে দেশি নেতাদের দান করে গেছে বটে, কিন্তু ওদের বাজখাঁই মেজাজটা শুধু পুলিশকেই দিয়ে গেছে। না হলে এই অশিক্ষিত ছোটলোকদের সামলানো মুশকিল হোত, দেশের আইন কানুন কেউ মানতোনা, অসৎ ছোটলোকগুলো মাথায় চড়ে বসত। বেশির ভাগ না হলেও তোমার মত দু-চারজন কড়া পুলিশ, কড়া নেতামন্ত্রী আছে বলেই দেশে চন্দ্র সূর্য উঠছে এখনও। 

মৃ - ঠিক বলেছেন বাবা। কিন্তু ঐ ভুঁইফোঁড় গণতন্ত্রপন্থী মানবাধিকারবাদীরা এই সোজা কথাটা বোঝেনা। (সুরজ চা বিস্কুট টেবিলে রেখে গেল) একটা ডিমটোস্ট দিয়ে যা শ্বশুরমশাইকে। চিনিসনা ওনাকে?

সু - কসুর হো গিয়া সাহেব। 

হারা - আশীর্বাদ করি আরও বড় অফিসার হও। ভাটিখানায় চললে বুঝি? শালা লোকনাথটা বড্ড বাড় বেড়েছে। একটু ধমকে দিয়ে এসোতো বাবা। শালা শুদ্দু জল মেশাচ্ছে। দুটো গিলেও নেশা হয়না। যাও ওখানে একটু ফুর্তি করে এস। 

মৃ - আমাদের কি ফুর্তি করার সময় আছে বাবা। এ গ্র্রামে সরকারী ডিউটিতে বেরিয়েছি। ডিউটির সময় ওসব চলেনা। কর্তব্য আগে। 

হারা - বেশ বেশ, এই তো কর্তব্যপরায়ণ পুলিশের মত কথা। সময় পেলে তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনের সাথে একটু দেখা করে যেও সবাই মিলে। দাদুভাই দিদিভাইদের দেখিনি অনেকদিন। চলি তাহলে। 

মৃ - চলি মানে? হেলমেট পারেননি কেন?

হারা - এইতো হেলমেট। 

মৃ - হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখলেই কি আইন বাঁচানো হয়ে গেল, ওটা মাথায় পরতে হয়। 

হারা - এই, গাঁয়ে গঞ্জে কে আর দেখছে। শহরের দিকে গেলে পুলিশ শালাদের তোলা জুলুমের ভয়ে মাথায় গলিয়ে নেই হ্যান্ডেল থেকে বার করে। 

মৃ - খুব বেআইনী করেন। মিছিমিছি একটা কেস খেয়ে গেলেন। 

হারা - সেকি, কবে, কখন, কোথায়, কে কেস দিলো?

মৃ - এইতো এখুনি, আমিই তো দেখলাম আপনার হেলমেটের জায়গায় শুধু তেল চকচকে টাকটা ঝিলিক মারছে সকালের রোদ্দুর পেয়ে। 

হারা - ওহ, এই কথা, তুমি আমার জামাই হয়ে আমার বিরুদ্ধে কেস দেবে নাকি?

তোমার রসবোধ বেড়েছে দেখছি, হা হা হা, তুমি দেখলেও কেস হবে? 

মৃ - হবেনা কেন, এই উর্দিটা পরলে আমি হয়ে যাই শুধু একজন পুলিশ। আপনার জামাইতো তো দূরের কথা, একজন মানুষও থাকিনা তখন। বিচারকদের টেবিলে চোখবাঁধা আইনদেবতার মূর্তী দেখেননি? হাতের দাঁড়িপাল্লার এক পাশে পিনাল কোডের গীতা, আর অন্যটায় জরিমানার টাকা বা জেলখানার চাবি। 

হারা - এইবারটি আমায় ছেড়ে দাও বাবা। 

মৃ - তা হয়না বাবা। মহাপাপ হবে। গীতা হাতে নিয়ে দিব্যি গেলে চাকরীতে যোগ দিয়েছি। সরকারের সাথে বেইমানি করে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করতে পারবনা। পুলিশের কাজ বড় কঠিন, বড় নির্দয় বাবা। একে বলে ন্যায়দন্ড। আমার কাছে রাস্তাঘাটের দুষ্কৃতী, নিজের বাড়ীর বাপ, শ্বশুরবাড়ীর বাবা, ভাই বোন, স্ত্রীপুত্র, চোর-ডাকাত, কুনাল, নীরব মোদী, সরব মোদী, মোহিত শাহ - নাসিরুদ্দিন শাহ  - সব সমান। আপনি যখন আপনার ক্যান্সার আক্রান্ত ভাইপোর কাছে সুদ নেন, তখন আপনি আর জ্যাঠামশাই থাকেননা, শুধু একজন সুদখোর। নিন, সামান্য পাঁচ হাজার খসান। 

হারা - সামান্য হেলমেট না পরার জন্য পাঁচ!

মৃ - রাস্তায় পেচ্ছাপ করার জরিমানা যোগ করে পাঁচ। 

হা - পেচ্ছাপ? রাস্তায়? কখন পেচ্ছাপ করলাম বাবা? আমিতো মোপেড থাকে নেবে সোজা এই দোকানে ঢুকলাম তোমার চোখের সামনে। 

মৃ -বললে হবে, আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনি ঐ-ই বাবলা গাছটার পাশে নামলেন, মোপেডটা স্ট্যান্ড করালেন, তারপর বোতাম খুলে ...আমি পরিষ্কার সব দৃশ্য দেখলাম, ফুটবল খেলার মত ধারাবিবরণ দিয়ে দেব নিখুঁতভাবে। মনে রাখবেন এটা পুলিশের চোখ। পুঞ্জাক্ষী। যেন একশো ডিজিটাল ক্যামেরা এক সাথে জুম করছে। সাধুসন্ত পীর পয়গম্বররা যেমন করে তাদের বৈদিক টেকনোলজিতে ত্রিকাল ত্রিভুবন দেখে। দেখলেও দেখে, আবার না দেখলেও দেখে। একে বলে আধ্যাত্বিক দৃষ্টি। কোন পাপ লুকানো যায়না ভগবান, আর পুলিশের চোখে। তা সে বাবলা গাছের আড়ালেই হোক, কি প্যান্টের ...

হা - তুমি সত্যি সব দেখেছো আমার ইয়ে - মানে। ..

মৃ - তাহলে আর বলছি কি। আপনি আমার বাবা, শুদ্ধ ব্যাকরণে উপবাপ, মানে কোয়াশি বাপ। মানে বাবার মত। জামাই হয়ে ওসব বেআইনি পাপ দেখা একটু অশ্লীল হয়ে গেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জজসাহেবের সামনে বর্ণনা দিতে পারবোনা পুরো দৃশ্যটা। কিন্তু সরকারি কাজ বলে কথা। লাজলজ্জা করলে সরকারি কর্তব্য পালন করা যায়না। 

হা - তুমি নিশ্চই ভুল দেখেছো। ও জিনিসটা আমার নয়,অন্য কোন লোকের। 

মৃ - পুলিশ ভুল দেখেছে! এরপরতো বলবেন ভগবানের চোখে ছানি পড়েছে। আই সুরজ - হা করে শুনছিস কি? বলনা কি দেখছিস তুই। 

সুরজ - হাঁ শাশুড়বাবু, হামিওভি দেখেছে পাপটা। ওটা থেকে ছড়ছড় করে - আমাদের সরকার কখনও ভুল দেখেনা। 

মৃ – শুনলেন তো, আর অন্য কোন সাক্ষীর কথা বলছেন? ঐ যে পীরপুরের বাসটা  আসছে, ও বাসের প্যাসেঞ্জেররাও সব কিছু দেখেছে বলবে গীতা হাতে নিয়ে।  

হা - সব বুঝলাম বাবা, বড্ডো কড়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের আইন। ক্ষুদিরাম-মাতঙ্গিনী, গান্ধী-নেতাজিদের  প্রাণ বিসর্জন স্বার্থক। স্বর্গ থেকে তোমাদের ন্যায়বিচার দেখে তাঁদের আত্মার নিশ্চই শান্তি হচ্ছে। আমারও তুমি মনের মত উপযুক্ত জামাই হয়েছো। তোমার আইনজ্ঞান, নীতিজ্ঞান কাজকর্ম জেনে মনে বড় গর্ব হল। বল, এখন কি করতে হবে। 

হা - আপনি আমার নিজের বাপের চেয়েও বেশি বাবা। সম্মান দিয়ে বাপ বলে ডাকি। আমার গিন্নীও তার মাতৃবাক্যকে বিশ্বাস করে আপনাকে বাবা বলে স্বীকার করে। কোন সন্দেহ করে না। আমার ভাগের কাটমানি ছেড়ে দিয়ে তিনেই ছেড়ে দেব পিতৃসম্মানে। কি, এবার খুশিতো? গুরুজনদের খুশি করতে পারলে আমার মনে খুব মজা-আনন্দ হয়। 

হারা - সেকি বাবা, জামাই হয়ে ঘুষ নেবে আমার কাছে? 

মৃ - (কানে হাত দিয়ে) ছি ছি বাবা, এমন কথা শোনাও পাপ। লোকে শুনলে আমায় অসৎ বলে ভাববে। আর যদি ঘুষও হয়, মনে মনে ভাবুননা কেন যে মেয়ে নাতি নাতনিদের মিষ্টি খাবার জন্য ... না না, এখনই না দিলে যে সাধারণ ক্রিমিনালদের মত হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাবো এমন চশমখোর জামাই আমি নই। আমি গুরুজনদের খুব শ্রদ্ধাভক্তি করি। ভাইপোর কাছ থেকে সুদ আদায়ের যে টাকাটা খানিক আগে পকেটে ঢুকিয়েছেন সেটা এখন জমা করে বাকিটা শালাবাবুকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঁচের কেস তিন হাজারেই ফয়সালা হয়ে গেলো। সক্কালবেলা দুই হাজার ইনকাম আপনার। এবার হাসুন। (হারাধনের পা ছুঁয়ে প্রণাম -  মাইকে সমবেত হাস্য)

                          


তৃতীয় দৃশ্য

 পঞ্চায়েত অফিস। (অঞ্চল পঞ্চায়েত দুর্যোধন চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে সিগারেট টানছে। কয়েকজন গুন্ডামার্কা ছোকরা  মেঝেতে এদিক ওদিক বসে মদ খাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)

দুর্যোধন - এস এস সাহেব, টুলটায় বস। পাঁচ মিনিট। (ছেলেদের উদ্দেশে)

তাহলে আজ রাতেই কাজটা শেষ করে আয়। ঐ এরিয়ার থানাকে বলা আছে। কোন চিন্তা নেই তোদের। মাঠের ওপার থেকে নজরে রাখবে। সাদা পোশাকে। লাশটা ন্যাংটো করে মুখটা থেথলে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে পাশের ডোবাটায় পুঁতে দিবি। কেউ এসে গেলে তার নলিটাও চিরে দিবি। তারপর ওর  সদ্যবিধবা দুঃখী বৌটাকে সবাই মিলে একটু আনন্দ দিয়ে আসবি। শালা নান্টুর আস্কারা পেয়ে শুওরের ইয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছিল। এবার কে আমার ভাটিখানা তোলে দেখি। আপাতত: এই পঞ্চাশ হাজার  রাখ। (টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে দিলো এক ছোকরার দিকে। মৃত্যুঞ্জয় মিটি মিটি হাসতে হাসতে সব কিছু দেখতে থাকলো। ছোকরাগুলো  ছোরা ছুরিগুলো ব্যাগে পুরে প্রস্থান করলো) এবার বল মেজসাহেব, কেমন আছো? মেজোয় প্রমোশন হবার পর থেকে তো সাহেবের টিকিটাও দেখতে পাচ্ছিনা আজকাল। 

মৃ - কেন স্যার, শুধু গত মাসেরটাই দিতে আসতে পারিনি। টিভি ক্যামেরারা যা পেছনে লাগছে! কারো ভালো দেখতে পারে না ওরা। শুধু হিংসা আর কুৎসা। মন্ত্রীরাই ওদের বাগে আনতে পারছেনা। 

দু - কিন্তু তার আগের মাসের ওই মোনার বিধবার উচ্ছেদেরটাওতো বাকি। 

মৃ - সব হয়ে যাবে স্যার। প্রমোটারটা একটু ফাঁপরে পড়েছে। রিয়েল এস্টেটের বাজার খুব খারাপ। এদিকে আবার জমি দখল হলেও পাশের পুকুর বোজানোটা বাকি। সেখানেও বাগড়া দিচ্ছে স্থানীয় জলাভূমি বাঁচাও সমিতি। তবে সরকারী অনুদান দেওয়া ক্লাবের মেম্বারদের ম্যানেজ করার প্রসেস চালাচ্ছে প্রোমোটার। তাতেও মোটা টাকার খরচা। সে যাই হোক ফ্লাট বুকিং শুরু হয়ে গেলেই প্রোমোটার আপনাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবে। 

দু - চক্রবর্তীটাওতো বেগড়বাই করছে দেখছি। খেলার মাঠটা আর ফুটপাথের অংশ দখল করিয়ে মন্দির বানাতে দিলাম। পার্টির ছেলেদের কোন ঝামেলা করতে দিইনি। প্রচারের গুণে কদিনেই কালীমাতাটা বেশ জাগ্রতাও হয়েছেন দেখছি। প্রণামী পড়ছে থালা ভরে। বাড়তি আয়ের জন্য কালীর পাশে শনিকেও বসিয়েছে কদিন আগে। দেশে যত চুরি বাড়ছে, পাপ বাড়ছে তত ভক্তিও বাড়ছে। মন্দিরও বাড়ছে রাস্তাঘাটে। শনিবার হলেই পাপীদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। কিন্তু আমারটা মেটাচ্ছেনা শালা বামনা। ওর ড্রাগি ছেলেটাকে থানায় ধরে এনে একটু চমকাচ্চোনা কেন। 

মৃ - এমএলএ-র আস্কারায় ওতো আবার নান্টু ঘোষের দিকে ঝুঁকেছে। 

দু - তাহলে তিনজনকে টপকিয়ে তোমাকে প্রমোশন দিলাম কেন। আমাকেও তো উঁচুতলাদের ম্যানেজ করতে হয়। কিছু একটা ব্যবস্থা কর শিগ্গির। এদিকে আবার এ বছর খরাও হলোনা, বন্যাও না। তাই ত্রাণও এলোনা। আমার কপাল দেখছি খুব খারাপ। চার তলার ছাদ ঢালাইটা এখনও বাকি। অবুঝ গিন্নী মার্সিডিজ গাড়ী কেনার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছে। পাঁচ বছরের দু বছরতো কেটেই গেল। কবে হবে সব। পরের ভোটে যদি দলের টিকিট না পাই তাহলে তো সবই যাবে। শুনছি খুনে সন্যাসী নাকি টাকা ঢালছে উপর মহলে। বাকিগুলো আদায়ের ব্যবস্থা কর। তানাহলে তোমার কপালে লোধাশুলি থানা আছে - এই আমি বলে দিলাম। ওখানকার এসিতো এমএলের বাড়িতে এখন থেকেই মোটা খাম দিয়ে দালাল পাঠাচ্ছে। 

মৃ - লোধাশুলির কথা মুখে আনবেন না স্যার। বৌ বাচ্চা নিয়ে একেবারে মরে যাব। ওখানে খাবো কি। জঙ্গলের আদিবাসী পাতা কুড়ানীয়াদের কাছ থেকে আর কত আয় হবে। এদিকে গিন্নীর খাঁইও বাড়ছে দিন দিন। সুদখোর হাড়কেপ্পন বাপের মাটির বাড়ীতে জন্মে আমার এতবড়ো দোতলা বাড়ী পেয়েও তার সাধ মেটেনা। আজ এসি চাই তো কাল বিশ হাজারী শাড়ী। (ব্যাগ থেকে দুটো বোতল বার করে) এদুটো এখন রাখুন স্যার। চন্দনপুরের খুনের আসামীর বাপ পাঠিয়েছিল। ভাবলাম এই ইমপোর্টেড স্কচের কদর পঞ্চায়েত স্যারই বুঝবেন। আর সবতো দেখি দেশী পেলেই বর্তে যায়। 

দু - বেশ বেশ, খুব ভাল। আজ রাতে আবার তোমাদের এসি সাহেব আসবেন একটু ফুর্তিফার্তা করতে। ভাবছিলাম শহরে যাবো মালটাল আনতে। 

মৃ - সেকি স্যার, আমরা থাকতে থাকতে ......

দু - সে আমি জানি। সাহেবের মেমসাহেব খুব কড়া ধাতের মহিলা। সব সময় চোখে চোখে রাখেন। উনি ওনার বালিকাকালের এক দেবদাসের সাথে হঠাৎ করে যাচ্ছেন মায়াপুর, না তারাপীঠে তীর্থ করতে। সেই সুযেগে এসি সাহেব এখানকার সার্কিট হাউস বুক করেছেন থানা ইন্সপেকশন দেখিয়ে। হাবুলবাবুর মেসের মুটি রাঁধুনীটাকে হায়ার করেছি ওনাকে দেখভাল করার জন্য। উনি যা পান তাতেই খুশি। কোন ছুৎমার্গ নেই। একেবারে সদাশিব, শিবঠাকুরের মত। 

মৃ - ঠিক বলেছেন, সাহেব খুবই সজ্জন। সোজা সরল নির্বিবাদী মানুষ। ওদিকে আইনজ্ঞান প্রখর। ধর্ষণ মামলাটা কেমন সুন্দর ধামাচাপা দিয়েছিল বলুন। আমার গিন্নী ওকে দারুন ম্যানেজ করেছিল ডায়মন্ড হারবারের রিসোর্টে চাঁদ দেখাতে দেখাতে। 

দু - বড্ড ফেঁসে গিয়েছিলাম মাইরি। কি করে বুঝবো এমন গ্রাম্য এলেবেলে মহিলাটা মাননীয় মন্ত্রী মশাইয়ের শালী। একেবারে কামদুনি করে মেরে ফেলিনি এই রক্ষে। তোমার গিন্নীকে ধন্যবাদ জানাতে ওনাকে একদিন আমার প্রাইভেট বাগানবাড়িতে নিয়ে যাব ডিনার করাতে। 

মৃ - ধন্যবাদ স্যার। চলি এখন। 

দু - ঠিক আছে। আমার বালি খাদানের ছেলেগুলোকে একটু দেখো।

মৃ - সে আর বলতে হবে না স্যার। (প্রস্থান)

দু - গবা, ও গবা। গ্লাস বোতলগুলো তুলে নিয়ে যা। আর কে এক প্রফেসর এসেছে, পাঠা সে শালাকে। 


(পক্ককেশী এক বয়স্ক ভদ্রলোকের প্রবেশ)

প্রফেসর ব্যানার্জী - চিনতে পারিস? মানে চিনতে পারছেন? তোর, মানে আপনার পিতাঠাকুর আমার বাড়ীর মালি ছিলেন। আপনার বাবার অনুপস্থিতিতে আপনিও আমার বাড়ীতে পায়ের ধুলো দিতেন বাগানে জল দেবার জন্য। আপনি আমাদের বাড়ীর ছেলের মত হয়ে পান্তাভাত খেতেন। তারপর আপনি মালির কাজ ছেড়ে মাছের ব্যবসা.... 

দু - খুব হয়েছে,আর পুরানো ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে না। আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। সেসব পুরানা কাসুন্দি ফরগেট করুন। যে ধান্দায় এসেছেন সেটা ঝটপট বলে ফেলুন। অন্তত: দু ডজন মাল লাইন দিয়ে আছে। পারিনা আর এতো লোকের আবদার রাখতে। কে ডোবা বোজাবে, কে রাস্তায় দোকান মন্দির ভাটিখানা বসাবে, কার ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে হবে - এইভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আর পারিনা। উপরতলার নেতারা এসব বোঝেন না। তাঁরাতো বলে দিয়েই খালাস - জনগণের সেবা করো, তাদের পাশে থাকো, তাদের মুখে হাসি ফোটাও...আমাদের হয়েছে জ্বালা। নেহাত এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন, তাই ঢুকতে দিয়েছি। চটপট বলে ফেলুন আপনার বক্তব্য। 

প্রঃ ব্যানার্জী - মানে, ঐ প্রিন্সিপালের প্রমোশনটা। 

দু - ইংরেজিতে লেখা আপনার দরখাস্তটা আমি নিজে পড়েছি। ইংরাজীতে আপনার কেমন দখলটা সেটা আমি নিজে আরও ভালো করে যাচাই করতে চাই। তারপর ভেবে দেখবো। কেননা আপনি ইংলিশ মিডিয়াম নন। এত কম যোগ্যতায় আপনি কি করে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেবেন জানিনা। জানিনা কলেজের ছেলেমেয়েদের কি ভুলভাল শিক্ষা দেবেন আপনি। তার ওপরে আপনি ডাক্তারী ছেড়ে এ লাইনে এলেন কেন সেটাও একটা রহস্য। 

প্রঃ - আমি ডাক্তার নই স্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। 

দু - তাহলে নামের পাশে ড: লিখেছেন কেন দুনম্বরী করে? 

প্রঃ - ভুল হয়ে গেছে স্যার।

দু - এদিকে আবার আপনি তিন প্রফেসরের জুনিয়র। এই বিদ্যে নিয়ে ... এম পি সাহেব তো রেকমেন্ড করে দিয়েই খালাস। কত দিয়েছেন সুপারিশ লেখাতে? আচ্ছা আচ্ছা, - থাক সেসব খারাপ খারাপ কথা। যে যার এলেম মত খিঁচবে। আমি বলার কে? এখানে ত্রিশ লক্ষ লাগবে 

প্রঃ - একটু বেশী হয়ে যাচ্ছেনা?

দু- আরে মশাই, প্রিন্সিপাল কি ছাগল, না শুওর যে দরদস্তুর করছেন গরুহাটের ব্যাপারীদের মত? কোশ্চেন বিক্রী, ছাত্র ভর্তি করেতো দু বছরেই উঠে আসবে ইনভেস্টমেন্টের টাকা। কমে পারবোনা। পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। অমুক নেতার শালা, তমুক মন্ত্রীর ভাইপো, ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারী, শিক্ষা বিভাগের অফিসার - বখরাদার কি একজন মশাই। এ ছাড়াতো কালীঘাটের জাগ্রতা জীবন্ত মা কালীর পুজোর খরচতো আছেই। কমে হবে না। 

প্রঃ - কবে আসব বলুন?

দু - কালকে এলেই ভালো। 

      (প্রফেসরের প্রস্থান। অফিসারের প্রবেশ। পেছনে পেছনে একজন পিওন একগাদা সরকারি ফাইল টেবিলে রেখে গেল)    


দু - এসো এসো এসডিও সাহেব। আমার অঞ্চলে কেমন আছো বল?

এসডিও - (প্রণাম করে) আপনার ছাতার তলায় ভালোই আছি স্যার। কতগুলো জরুরী ফাইল সই করাতে এসেছি স্যার। 

দু - সব ঠিক দেখে নিয়েছো তো? আমার পিএ বলছিল তোমার নোটে নাকি ভুলভাল ইংরাজী থাকছে। কোথায় নাকি জয়েন্টেড এর জায়গায় জয়েন্ড লিখছ, নিমুনিয়া শব্দের আগে অহেতুক একটা পি বসিয়ে দিচ্ছ - এই বিদ্যে নিয়ে তোমরা আইএএস, বিসিএস পাশ কর কি করে? 

এসডিও - কাজের চাপে মাঝে মাঝে এমন ভুল করে ফেলি স্যার। অপরাধ ক্ষমা করবেন। 

দু - ফাইলগুলো রেখে যাও। পরে দেখেশুনে সই করে দেব। সব। আমার লোকেরা তোমার সব প্রাপ্য দিচ্ছে তো নিয়ম আইন মত?

এসডিও – হ্যাঁ স্যার, সব ঠিক আছে। তবে পার্সেন্টেজটা একটু বাড়ালে ভালো হয়। গিন্নীকে নিয়ে একটু বিদেশ যাত্রার ইচ্ছে আছে। 

দু - ঠিক আছে, নতুন চরের বালিখাদান থেকে ট্রাক পিছু একশ তুমি এক্সট্রা পাবে। তবে এখনকার মত যেন মাখনের মত কাজ চলতে থাকে। 

এসডিও - থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। 

                  (পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে এসডিও সাহেবের প্রস্থান) 

              



মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ী

(সর্বপ্রিয়া টিভি দেখছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)

সর্বপ্রিয়া - দেখলেতো, আমি কী বলেছিলাম? ওই বৌ’টাই খুনি। বরের বসকে নিয়ে হোটেলে যেত ফুর্তি করতে। স্বামী জেনে যাওয়ায় মদের মধ্যে বিষ মিশিয়ে ওকে খুন করেছে। ঐ বৌগুলোকে গুলি করে মারা উচিত। 

 মৃ - তুমি আবার সিরিয়ালের বৌ’টার মত আমাকেও খুন করো না যেন। 

সর্ব- তুমি যেন কি! কিচ্ছু মুখে আটকায় না। যত্ত আজগুবি অলুক্ষুণে কথা। 

মৃ - লাল পার্টির অজয় সামন্তের কথাই বোধ হয় ঠিক। সেদিন বক্তৃতায় বলছিল “শুধু টিভি সিনেমার নাটকে নয়, আজকাল এ’সব হচ্ছে ঘরে ঘরে। কাগজে আর ক’টা বেরোয়। স্বামীগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে টাকার ধান্দায়, আর উপোসী বৌগুলো বোল্ড রিলেশন করছে ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবে। সমাজ সংসার সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু খাই খাই,শুধু টাকা আর ভোগের লালসা। একদিন সব ঘরে আগুন জ্বলবে।” লোকটা আমাদের পার্টির নামে যা তা বলে বটে, তবে তার কথাগুলোর ভেতর চিন্তার বিষয় আছে। 

সর্ব - তোমার আজ হলো কি? কি সব উল্টোপাল্টা বকছো বুদ্ধিজীবীদের মত! দার্শনিক হয়ে গেলে নাকি? 

মৃ -  আমার আজকাল কিছু ভালো লাগছেনা। মানুষ ভেতরে ভেতরে যেন ধিকি ধিকি করে জ্বলে উঠছে আগ্নেয়গিরির মত। যেকোন সময় অগ্নুৎপাত হয়ে দেশটাকে পুড়িয়ে দিতে পারে। ভীষণ ভয় হচ্ছে কাজকর্ম করতে। শুনলাম বুড়ো পুলিশ মন্ত্রীর ঘনিষ্ট অল্পবয়সী বান্ধবীর বাড়ী থেকে নাকি কেজি কেজি সোনা আর কোটি কোটি টাকা পেয়েছে পুলিশ!  

সর্ব - এত টাকা নিয়ে করবেটা কি? 

মৃ - সে আর বুঝছে কে? লাল পার্টির অজয় সামন্ত সেদিন বক্তৃতায় বলছিল, “সবাই একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তারা কি চাচ্ছে, কেন চাচ্ছে, কি করছে তারা নিজেরাই জানেনা। টাকাগুলো খরচই করতে পারবেনা সারা জীবনে। হয় সুইস ব্যাংকে পচবে, না হয় ছেলে মেয়েরা ড্রাগ মদ খেয়ে ওড়াবে।” নাও, টাকাগুলো তুলে রাখ আলমারিতে। আজ আদায়টা ভালো হয়েছে। 

সর্ব - শোন, তোমার ছেলের হাজার দশেক লাগবে কালকে। 

মৃ - কি ব্যাপার, একেবারে কালকেই? এত্ত টাকা!

সর্ব - তোমার কি ঘর সংসারের দিকে এতটুকু নজর নেই? কাল যে তোমার ছেলেটার জন্মদিন সেটা ভুলে গেলে!

মৃ - ওহো, তাইতো বটে। পায়েস টায়েস বানাও তাহলে। 

সর্ব - আজকাল ওসব পায়েস নাড়ুর চাল নেই। যত্ত গ্রাম্য কালচার। সমাজটা অনেক এগিয়ে গেছে। (চা বিস্কুট টেবিলে রাখলো সর্বপ্রিয়া)

মৃ - (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমার মাও জন্মদিন করতো আমার। সে সব কথা মনে হলে বুকটা উদাস হয়ে যায়। শঙ্কর মাস্টারের বাড়ি থেকে এক পোয়া দুধ চেয়ে এনে ফ্যানা ভাতে খানিকটা গুড় আর ওই দুধ মাখিয়ে পায়েশ খাওয়াতো আমায়।মায়ের স্নেহমাখা সে অমৃত এখনও মুখে লেগে আছে। মাকেও তাড়ালাম, মাতৃসুখও হারালাম। এখন বড় আফসোস হয়। তা ছেলের একেবারে দশ লাগবে কেন?

সর্ব - ওরা সব বন্ধুবান্ধব মিলে শহরের হোটেলে পার্টি করবে। 

মৃ -  পাঁচই দিয়ে দাও। 

সর্ব - বলেছিলাম সে কথা। বলে ওতে নাকি শুধু উইস্কির বিলও মেটানো যাবে না। 

মৃ -তাবলে এত টাকা পাব কোথায়। এইতো মাইনে। 

সর্ব  - সেটাও বলেছিলাম। বললো বাবা নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় বলে ওর বন্ধুরা বলাবলি করে। একটু ভদ্রভাবে পার্টি না দিলে ওর খুব দুর্নাম হবে। তোমারও  মান মর্য্যাদা থাকবেনা  .

মৃ - এটা অবশ্য ঠিক। মেয়েকে দেখছিনা কেন?

সর্ব - ওতো কালই দিঘা, না বকখালি কোথায় একটা গেছে উইকেন্ড কাটাতে। ওর কলেজের অনেক নেতা মন্ত্রী লাখপতি কোটিপতির ছেলেরা ওর বন্ধু হয়েছে কিনা। ওদেরই একজন ট্যুরটা স্পনসর করছে। 

মৃ - দেখো, আবার কোনও কেলেঙ্কারি ফেলেঙ্কারি না বাধায়। বড়ি টোরি  সাথে দিয়েছো তো। 

সর্ব - সেটা তুমি আমায় বলে দেবে? হোটেলে রিসোর্টে আশ্রমে তীর্থে পুরুষমানুষগুলো  গাঞ্জা মদের নেশায় কি রকম পাগল পাগল হয়ে যায় সেটা আমার চেয়ে কে বেশি জানে। হাড়ে হাড়ে বুঝেছি সব। 

মৃ - মহিলারাও যে কমতি যায়না সেটাও আমি শুধু হাড়ে হাড়ে নয়, একেবারে মজ্জায় মজ্জায় বুঝি। 

সর্ব - তুমি কি আমায় সন্দেহ কর নাকি?

মৃ - ছি ছি সর্ব, তুমি কি ঠাট্টা ইয়ার্কিও বোঝোনা?

                                 



দৃশ্য - মন্দির

(পূজারী ঘন্টা নেড়ে প্রদীপ নাড়িয়ে আরতি করছেন ভক্তরা হাত জোড় করে বসে। কয়েকজন কাঁসর ঘন্টা বাজাচ্ছে নেচে নেচে। আরতি শেষে পুরুতের হাত থেকে প্রসাদ নিয়ে ভক্তরা সব প্রণামী ঢুকিয়ে দিলো বাক্সের ফোকরে। তারপর সবাই একে একে বেরিয়ে গেলো মন্দির থেকে। প্রণামী নৈবেদ্য সব ব্যাগে পুরে পূজারী ঠাকুর বেরুতে যাবেন, এমন সময় দেখেন কে একজন যেন এক কোনায় বসে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে।)

পূজারী - কে ওখানে? ওকি, মৃত্যুঞ্জয়, এভাবে বসে কেন? তোমার কী হয়েছে?

মৃ - আমায় বাঁচান ঠাকুরমশাই। আমি নরকে যেতে বসেছি। (কান্না)

পু: - বলি হয়েছেটা কী? এত উতলা কেন? এতবড় ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার হয়ে কার ভয়ে মেয়েদের মত কাঁদছো? (পূজারীর কানে কানে মৃত্যুঞ্জয় কিছু একটা বললো) এতো সাংঘাতিক ব্যাপার। মহাপাপ করেছে তোমার মেয়ে। পরিবারসহ তোমাদের সবার নরকগমন অবধারিত। আইবুড়ো মেয়ের এ পাপের ক্ষমা নেই। কয় মাস হলো?

মৃ - জানিনা ঠাকুরমশাই, আমায় উদ্ধার করুন। আমি ঈশ্বরভীরু মানুষ। প্রতি গুরুবারে আমার গিন্নী এসে একশো টাকার প্রণামী দিয়ে পুজো করে যায় এখানে। সৎসঙ্গে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ খাই। হাতের সব আঙুলে নয় গ্রহের নয়টি আংটি পরি। জীবনে কোনও পাপ করিনি। আমাদের মেয়ে মদ সিগারেট খেলেও দেব দ্বিজে খুব ভক্তি। শিবের ব্রত করে, শিবের মাথায় জল ঢালে তারকেশ্বরে গিয়ে। পুরীর মন্দিরেও যাই, দিঘার নতুন মন্দিরেও। তবু আমার এমন কেন শাস্তি হলো ঠাকুরমশাই? নরককে আমি বড্ড ভয় পাই। যাগযজ্ঞ যা করেই হোক আমাদের উদ্ধার করুন। 

পু: - সেতো অনেক খরচের ধাক্কা। প্রনামীই শুধু লাখখানেক লেগে যাবে। তার ওপর মায়ের স্বর্ণমুকুট, সোনার জিভ........

মৃ - এত্ত?

পু - এটাকি ছোটোখাটো ব্যাপার বাবা। আইবুড়ো মেয়ের ইয়ে। গোহত্যা বামুনহত্যার সমান পাপ। ফল, অনন্ত নরক। যে মামলায় যেমন খরচ। তোমার এত চিন্তা কিসের। পুলিশের চাকরী, ভালো মাইনে, ভালো উপরি - মায়ের আশীর্বাদে তোমারতো কোনও অভাব নেই। এতো আর পুলিশ, ডাক্তার,উকিলদের দিচ্ছো না, মা’কেই তো দিচ্ছ। দেখবে করুণাময়ী মা সব দুইগুণ ফিরিয়ে দেবেন। যাও, সামনের অমাবস্যার রাতে  চলে আসো সব অনুপান নিয়ে। ফর্দটা তোমার গিন্নীর হাতে পাঠিয়ে দেব। তোমার আর কি, একবার হাঁকিয়ে দেবে, আর দশকর্ম, মালী, স্যাকরা সব অনুপান পড়ি কি মরি করে সোজা হোমডেলিভারি করে দেবে এই মন্দিরের ঠিকানায়। আরে বাবা, এতো আর ঘুষ নয়, প্রণামী-প্রণামী। প্রণামী দেবে মাকে। তোমার ভয় ভীতি দানধ্যান দেখে ধন্য ধন্য করবে দেশবাসী। আবার দয়াময়ী মা তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে তার প্রেমিককে বশীকরণ করিয়ে। একই খরচে একসাথে পুরুত জ্যোতিষের দুজনের দুটো কাজ করিয়ে দেব আমি।

মৃ - কিন্তু কে ওর সর্বনাশটা করলো তাতো বলতে পারছে না আমার সোজা সরল মেয়েটা। বশীকরণ করবেন কাকে। ওর ছেলে বন্ধুতো গন্ডা গন্ডা।   

পু - সবকটাকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে পিটিয়ে দাও, বাপ বাপ বলে সব বলে দেবে পটাপট। সবই মায়ের ইচ্ছা বাবা। যাও, মন শুদ্ধ করে ব্যবস্থা করে ফেল। চিন্তা করোনা, আমিতো আছি, ভয় কিসের?



উকিলের চেম্বার

মৃত্যুঞ্জয় - ছেলেকে আমার জামিন করিয়ে আনুন উকিলবাবু। শালা সিবিআই পুলিশ ওকে খুব মারছে দিন রাত। আপনার পায়ে পড়ি উকিলবাবু। 

উকিল - সেকি, সেদিন জোর গলায় বললেন, আপনি প্রবল পুলিশ অফিসার, কাউকে পরোয়া করেননা, ডজন ডজন এসি, ডিসি, নেতা মন্ত্রীদের সাথে আপনার ওঠা বসা। সবার কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবার এলেম আছে আপনার। সবাই আপনার হাতের মুঠোয়, এমন কি জজ সাহেবরাও নাকি .........আপনার পেয়ারের পার্টি মাস্তানরা লকাপ ঘেরাও করে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনছেনা কেন। 

মৃ - সবাই হাত ধুয়ে ফেলেছে স্যার। ঐ মিডিয়াই কাল হচ্ছে। সব ছবি তুলে বারে বারে টিভিতে দেখিয়ে লোকগুলোকে খেপিয়ে দিচ্ছে। সব রিপোর্টারদের সিডিশন আইনে গ্রেপ্তার করা উচিত। সকাল বিকাল ২৪ ঘন্টা মহা আনন্দে এমন কুৎসা রটাচ্ছে যে নেতা মন্ত্রীরাও সামাল দিয়ে কেলেঙ্কারীগুলো চেপে যেতে পারছেনা। সবাই এখন নিরপেক্ষ হয়ে গেছে। কথায় বলে কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজি। যাদের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী দুর্নীতি এতদিন চাপাচাপি দিয়ে এলাম তারা এখন বলে আইন আইনের পথে চলবে। তানাহলে নাকি ভোটের মুখে তাঁদের ভাবমূর্তি কেঁচে যাবে। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। 

উকিল - কিন্তু আপনার ছেলে তার দুগুণ বয়সী মহিলাকে টার্গেট করতে গেল কেন? রাস্তাঘাটের আপনাদের আদুরে ছেলেরা কত্তো কম বয়সী সহজ শিকারদের ধরছে। আর তা আপনারা শুধু দেখছেন, আপনাদের নেতামন্ত্রীরাও আস্কারা দিচ্ছেন। 

মৃ - খুব ভুল হয়ে গেছে স্যার। 

উকিল - শ্লীলতাহানি করেছে করেছে ঠিক আছে। আজকাল এ রাজ্যে সব জলভাত। আগেও এসব হতো চুপিসাড়ে। শাস্ত্র পুরাণের গল্পগুজবের সাধু সন্ন্যাসী দেবদেবীরাও ছেড়ে কথা বলতেন না। সোশ্যাল মিডিয়ার খোলামেলা কুকুর বিড়ালদের মত ফিল্মি প্রেম দেখে এখন এসব রোগ একটু বেড়েছে মাত্র। তবে আজকাল ওসব নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়না। বেশির ভাগ গুরুজনেরা ঘটনাগুলো চেপে যান লোকলজ্জার ভয়ে। মন্ত্রী আমলারাও। কিন্তু আপনার পুত্তুর  খুন করতে গেল কেন?

মৃ - ওর কোন দোষ ছিলনা স্যার। বদমাস মহিলাটা ওকে চিনে ফেলেছিল ঐ মধুচক্রের ঠেকে। 

উকিল - তাবলে একেবারে খুন! তাও আবার আইপিএসের বৌকে!

মৃ - আমার ছেলেটা বড্ডো সোজা সরল। তখন ও নরম্যাল ছিল না। সেদিন তার জন্মদিন ছিলতো। বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু বেশি নেশা করে ফেলেছিল। মাথার ঠিক ছিলনা। একটা কোন আইনের ফাঁক দেখিয়ে ওকে বের করে অনুন না স্যার। 

উকিল - এতো আর শুধু আইনের ফাঁকে হবেনা। অনেক খরচ আছে। আইন-টাইন সব নোটের ওপরেই লেখা থাকে। এখানে আবার সরকারী উকিলটা মৌলবাদী ধড়িবাজ। বামপন্থী। এক পয়সা খেতে চায়না। তবে আর সবের খাঁই অনেক। প্রথমেই দশ লক্ষ লেগে যাবে। 

মৃ - এতো কি করে দেব স্যার?আমি সামান্য নিচু তলার পুলিশ। সামান্য মাইনে। আর্তি যা রোজকার হয় তার বেশির ভাগটাই চলে যায় পর পর উঁচুতলার পেট ভরাতে। একটু কমেসমে করুন স্যার। 

উকিল - আপনি একজন দায়িত্ববান অভিজ্ঞ পুলিশ হয়ে কি সব উল্টাপাল্টা বকবক করছেন। আপনারা নিজেরাইতো চা-ওয়ালা, খোঁড়া রিক্সাওয়ালা, ট্রেনের ফেরিওয়ালা, এমন কি মন্দিরের সামনে বসা ভিখারিদের পর্যন্ত মাসকাবারী কমান না এক পয়সা। সব খবরই   পাই আমি। 

মৃ - বড্ডো ভুল করেছি এতদিন। আর করবো না ওসব পাপ। সহকর্মীদেরও সাবধান করে দেব। 

উকিল - আজ থেকে আমি বাল্মীকি হয়ে গেলাম বললে হয়?

মৃ - আমার কেসটা একটু সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করুন স্যার। এমএলএ মার্ডার কেসটায় সরকারি উকিল কি স্ট্রাটেজি নিচ্ছে সে খবর দেব। পরস্পর এভাবে না দেখলে আমরা বাঁচবো কি করে?

উকিল - ঠিক আছে আমার ফিস্টে না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু পুলিশ খরচ,নেতার খরচ, রিপোর্টারদের খরচ ........ আপনি লাখ পাঁচেক নিয়ে আসুন, জামিনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

মৃ - শুধু জামিনের জন্য........

উকিল - শুনুন, এটা আপনার স্টেট পুলিশের কেস নয়, কোর্টের এদেশের জেরে সিবিআই মামলা। দেখছেন না দলেরই সব বাঘা-বাঘা এক নম্বর দুই নম্বর নেতা মন্ত্রীরা মাসের পর মাস জেল খেটে খেটে শুখনো মড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে বুঝুন মফস্বল থানার সেকেন্ড অফিসারের ছেলের কি দশা হবে। 

মৃ - বুঝছি উকিলবাবু, কেউ কারো নয়, সুযোগমতো সবাই সবাইকে চুষছে জোঁকের মত। নেতা মন্ত্রী, সিন্ডিকেট,  ক্লাব, গুন্ডা বদমাস, ছেলে বৌ - সব্বাই সব্বাই সমান কেউ কারো নয়। এতদিন আপনার বিপক্ষদের সব খবর দিয়ে সব খবর দিয়ে এসেছি। সুযোগ বুঝে আপনিও আমার বুকে 

উকিল - এমনকি আপনিও আপনার বসে নেই। 

মৃ - ঠিক আছে উকিলবাবু, আমি বিকালেই আসছি। 


                                     নার্সিং হোম 

ডাক্তার বোস - কি ব্যাপার বাঘা দারোগা? এদিকে কেন? 

মৃত্যুঞ্জয় - মানে একটু বিপদে পড়েছি। 

ড: - আবার কার বাঁধলেন?আগেকার বান্ধবীটা ভালো আছেতো? পাপীটা কে ছিল জানতে পেরেছেন কি? আপনি যে নন সেটা আমি জানি। কোনও এক পরোকীয়া রসিক আপনার হাতে তামাক খেয়ে আপনাকে ফাঁসিয়েছিল। 

মৃ - খুব বাঁচিয়েছেন ডাক্তারবাবু, বৌ জানতে পারলে হুলুস্থুলু কান্ড হয়ে যেত। এবার এসেছি আমার নিজের মেয়ের জন্য। 

ড: - আপনার - নি-জের মেয়ে!! এটাও মনে হচ্ছে পরকীয়া কেস। মিহিরবাবু, কুড়ি বয়স বছরের পুরানো সিমেন্স রিপোর্টের ফাইলগুলো খুঁজে অনুনতো। কতদিন হলো?

মৃ - চার মাস ডাক্তারবাবু। 

ড: -  চা-মাস! এতদিন কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন নাকি। চারমাস ধরে বাড়তে দিয়েছেন পাপটাকে! আশ্চর্য! এত পুরানো কেস আমি অপারেশন করতে পারবো না। আমার যন্ত্রপাতি তত আধুনিক নয়। কলকাতার কোন নার্সিং হোম থেকে মালটা খালাস করিয়ে নিয়ে আসুন। 


(মৃত্যুঞ্জয় ডাক্তারের কানে কানে কিছু বললো। ডাক্তার ইশারা করে নার্সকে বাইরে যেতে বললেন।)

মৃ - যত টাকা লাগে করে দিন স্যার। অচেনা জায়গায় যেতে সাহস হয়না। আমার এমন ভালো চাকরি, মানসম্মান সব ভেসে যাবে ডাক্তারবাবু। 

ড; - আজকালকার উদার খোলামেলা সমাজে এসবে মান সম্মান যায়না। বড় বড় অভিজাত ঘরে এমন পরকীয়া কাণ্ডতো জলভাত। সমাজ সরকার দ্বারা স্বীকৃত। এইতো সেদিন কলকাতার ভেসেক্টমি করা মস্ত বড় অফিসারের মাঝবয়সী গিন্নি বেড়াতে যাবার নাম করে খালাস করে গেল দশ লক্ষ দিয়ে। চার চারটে দামড়া দামড়া ছেলে, স্বামী-আত্মীয় কাকপক্ষী টেরই পেলোনা। হোটেলে ডিস্কোতে নেশার ঘোরে কি সম্ভ্রান্ত, কি হঠাৎ বাদশা হওয়া প্রোমোটার সিন্ডিকেটের বাড়ির উপোসী মহিলারা তাড়াহুড়ো করে আজকাল ভুলে যান প্রটেকশন নিতে। 

মৃ - ওদের কথা ছাড়ুন, এ ব্যাপারে আমাদের গাঁ-গঞ্জও  আধুনিক হয়ে গেছে। পুলিশ সব খবর রাখে। আমার মেয়ের ব্যাপারে লাখ দুই দিয়ে দেব। 

ড: - কি সব বলছেন আজেবাজে কথা। এটাকি ভাড়াটে উচ্ছেদ? প্রোমোটার টেবিলের তলায় পাতা আপনাদের বাঁ হাতে দু লক্ষ ধরিয়ে দিলো, আর অমনি জনসেবক মা মানুষের স্বেচ্ছাসেবীরা এসে ভাড়াটেকে টেনে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দশ মিনিটে অপারেশন শেষ করে ফেললো। আর আপনি বন্ধুক হাতে ওদের পাহারা দিতে থাকলেন দূরের গাছের আড়ালে। ডায়রিও নিলেননা নিঃসঙ্গ বুড়ি ভাড়াটের। আপনার মেয়ের শরীরে অনুপ্রবেশকারী অবাঞ্চিত দখলদারটাকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে ভালো মন্দ কিছু যদি হয়ে যায় তার হ্যাপা সামলাবে কে। থানা, পুলিশ, পাড়ার মাতব্বর, পার্টির সেচ্ছসেবীদের খরচ কত বেড়েছে জানেন? অবশ্য মায়ের কাছে মাসির গল্প আর কি বলব। 

মৃ - ঠিকঠাক বিবেচনা করে বলুন কত দেব। 

ড: - কেলেঙ্কারীটা জানাজানি হয়ে গেলে আপনার ভাবি বেহাই মশাই বিশ লক্ষ কাটমানি না নিয়ে  ঐ এঁটো মেয়েকে ঘরে ঢোকাবে ভেবেছেন?

মৃ - আপনি আমায় ব্ল্যাকমেল করছেন, ডাক্তারবাবু। 

ড: - সে আপনি বলতে পারেন বইকি। কিন্তু সেটাতো আপনাদের কাছ থেকেই শেখা। নেতা মন্ত্রী, সরকারি আমলাদের কালো টাকার গন্ধ পেলে আপনারা কি বেচারাদের ব্ল্যাকমেল করেননা? আর ন্যাকামো করবেননা, মেয়েকে উপোসী রেখে আট লাখ ক্যাশ নিয়ে পরশু আসুন রাত দুটোয়। এপেন্ডিক্স অপারেশনের একটা এস্টিমেট লিখে  দিচ্ছি কাছে রাখুন। কেউ জানতে চাইলে ওটা দেখাবেন। আর এই এন্টিবায়োটিকগুলো খাওয়াতে থাকুন নিয়ম করে। 

মৃ - ঠিক আছে ডাক্তারবাবু। হাতি এখন কাদায় পড়েছে। তবে ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে। 

ড: - আরে এসব কাজ গোপনে না করলে আমাদের নার্সিং হোমের ব্যবসাটাই লাটে উঠে যেত। এবার আসুন আপনি। (নার্স এসে ডাক্তারের হাতে একটা কাগজ দিয়ে গেল) আচ্ছা একটু বসুন। এই দেখুন বহু আগে করা আপনার সিমেন্স রিপোর্টের কপি। আপনার স্ত্রী আসল রিপোর্টটা ডেলিভারি নিয়ে গেছেন সই করে। আপনার সিমেন্স কাউন্ট জিরো অর্থাৎ  বিজ্ঞানমতে আপনার ছেলেমেয়ে আপনার ঔরসজাত হতেই পারে না। আপনার বান্ধবীর সন্তানটিও আপনার ছিল না। এতো আর আধ্যাত্বিক শাস্ত্রীয় গল্পগুজব নয় যে কবিতা ফাঁদলাম, আর মহাকাব্যের নায়করা টুপ টুপ ঝোরে পড়লো সতী রানীমাতাদের পেট থেকে। 

মৃ - কি বলছেন আপনি। আমার ছেলে মেয়ে আমার ঔরসে জন্মায়নি! আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করবো। 

ড: - তার আগে আপনার সতীসাধ্বী গিন্নীর কাছে জেনে নিন কে আপনার ছেলেমেয়েদের বাবা। এখনতো দেখছি আপনার পরকীয়া বান্ধবীদের ক্ষেত্রেও কেউ আপনার হাতে তামাক খেয়ে গেছিল। মজা লুটলো অন্য লোক, আর  তাদের বাচ্চাদের আপনি নিজের বাচ্চা ভেবে আমাদের অপারেশন ফি মেটালেন ওদের খালাস করাতে। 

মৃ - আমি এখন আসি ডাক্তারবাবু। (প্রস্থানোদ্যত)

ড: - আরে, বসুন। বসুন মশাই। এত উতলা হবার কিছু নেই। এই ডাক্তারী লাইনে এসে আমরা সব  দার্শনিক হয়ে গিয়েছি। প্রকৃতির নিয়ম যত কঠোরই হোকনা কেন তা মেনে নিতে শিখেছি। সত্যেরে নিন সহজে। এত ভাবাবেগ সেন্টিমেন্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। কেউ সত্যি সত্যি  সতী নয়, আপনিও নন, আপনার গিন্নিও নন। অন্যান্য সুখী মানুষদের মত জীবনটাকে উপভোগ করুন - গিন্নি গিন্নির মত, আপনি আপনার মত। মনোবিজ্ঞানের পাঠ্য বই ‘আই আম ওকে, ইউ আর ওকে’ বইটা পড়ে নিন। আপনিও মধুমতীর সাথে দেখা করুন, আপনার স্ত্রীও ডায়মন্ড হারবারে ট্যুর করুক। মাননীয় আদালত বলেছেন পরকীয়া ফস্টিনস্টি সবার সাংবিধানিক অধিকার। সব গ্লানি মুছে ফেলুন। ‘স্ত্রী’ ছবির উত্তমকুমারের মত মিথ্যা আবেগের বশে কোনও কেলেঙ্কারী করে বসবেন না যেন। উইশ ইউ গুড লাক। মেয়েকে নিয়ে চলে আসুন যেমনটি বললাম। 


                          -আশারাম বাবার আশ্রম-

(ধ্যানে বসেছেন গুরুবাবা। ধর্মবাজারের গুরুবাবাদের মতই চোখ ঢুলুঢুলু- হাফবন্দ পদ্মলোচন। মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ভাব। সর্বপ্রিয়া সামনে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ। সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলভার তাকে করে) 

মৃ - বল, বল ডাইনি, কে, কে আমার ছেলেমেয়েদের বাপ। 

সর্ব: বলছি বলছি, সব যখন জেনে গেছ, সব বলছি, রিভলভারটা নামাও। এই গুরুবাবা আর তার ছেলে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নাম করে রাতের পর রাত আমার ওপর অত্যাচার করেছে। বাপ ব্যাটাদের কোন একজন আমাদের মোহিনীর বাবা। (মৃত্যুঞ্জয় আশারামের মাথা লক্ষ করে গুলি করলো। গুলির শব্দ শুনে গুরুবাবার ছেলে সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী ছুটে আসতে ওকেও গুলি করলো। তারপর সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলবার তাকে করে)

মৃ - এবার বল কে আমার ছেলের বাবা। 

সর্বজয়া - বলছিগো, বলছি, বন্দুক নামাও। তোমার এসি সাহেব ...........

ম্রি - তাহলে মর তুই (সর্বপ্রিয়ার মাথায় গুলি)




সার্কিট হাউস

মৃত্যুঞ্জয় - (জানালার দিকে হাত উঁচিয়ে রিভলবার তাকে করে) বল শালা বড়কর্তা, কে আমার ছেলের বাপ। বল, বল, বল শালা বড় কুত্তা। 

এসি - (ঘরের ভেতর থেকে) কি সামান্য একটা থানা অফিসার হয়ে এসির  প্রাইভেট বেডরুমে উঁকি! তোকে আমি ক্লোজ করবো। 

মৃ - তার আগে তোর হৃৎপিন্ডটাকেই আমি চিরতরে ক্লোজ করে দেব লম্পট। কাল সকালে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে তোর ঐ উলঙ্গ চেহারাটা দেখাবে দেশবাসীকে, তারপর পোস্ট মর্টেম করবে মৃত ডিকম্পোজড সমাজটার। (গুলি, দর্শকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে) সবার খেল খতম, এবার তোমার পালা মৃত্যুঞ্জয় ...শেষ বুলেটটা তোমারি জন্য (মাথায় গুলি)


                               যবনিকা পতন 

(হল থেকে বেরুতে বেরুতে পাশাপাশি বাড়ীর জানালা থেকে দর্শকরা টিভির সংবাদ শুনতে পাবেন) এই  হলো প্ল্যানেট, আপনারা দেখছেন প্ল্যানেট আনন্দ। আনন্দে থাকে, আনন্দে রাখে। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, হরিহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দুর্যোধন নস্কর খুন। ভেড়ি ও চোলাই কারখানার দখল নিয়ে একই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এই খুন বলে স্থানীয় মানুষের সন্দেহ। সেটা মানতে রাজি নন বিধায়ক মানিক মন্ডল ওরফে গলাকাটা মন্টু। তার মতে পারিবারিক বিবাদের জেরেই এই খুন। অভিযুক্ত নান্টু ঘোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলো উত্তেজিত গ্রামবাসী। নান্টু ও তার দলবল বেপাত্তা। তদন্ত চলছে। * মন্ত্রীপত্নী ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত পুলিশপুত্র গ্রেপ্তার। চোলাই দোকানের মালিক খুনে অভিযুক্ত গুন্ডা বশীর আহমেদ সহ বারোজন আসামির বেকসুর খালাস। নিয়মমতো তদন্ত ও সাক্ষপ্রমান না দেবার জন্য পুলিশকে বিচারকের  ভর্ৎসনা। সিবিআই তদন্তের দাবী মৃতের আত্মীয়ের। * উচ্চপদস্থ  আমলার ৪৭ বছর বয়সী গৃহবধূর মেদিনীপুরের গরপাড় গ্রামের ‘নিষ্কৃতি নার্সিং হোমে’ গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। নার্সিং হোম ভাঙচুর, ডাক্তার প্রহৃত। * এইমাত্র এক চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যা ও সিরিয়াল হত্যার খবর পাওয়া গেলো। ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার মৃত্যুঞ্জয়  মন্ডল একে একে তাঁর স্ত্রী, পারিবারিক গুরুদেব, গুরুপুত্র এবং তাঁর এসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে গুলি করে নিজে আত্মঘাতী। মৃত্যুঞ্জয়ের অবিবাহিত কন্যার জলে ডুবে মৃত্যু। সন্দেহ মেয়েটি অন্তঃস্বত্বা ছিল। পরিবারটি প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য নাবালক দেবপ্রিয় গৃহবধূ ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ফাঁসিকাঠে ঝোলার অপেক্ষায় হাজতে। মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ীর মেঝে খুঁড়ে কোটি টাকার গহনা ও টাকা উদ্ধার। * পাটনার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষক ও দারোয়ানের গণ ধর্ষণ। * হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে বিদেশপাড়ি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীশ্যালকের।* অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক ও ছাত্রনেতা খুন হলেন নিজের কলেজে। দেশ ও রাজ্যবাপী এমন গণঅপরাধ দেখে নেতা মন্ত্রী সমাজবিজ্ঞানী সাহিত্যিক সব শ্ৰেণীৰ বিদ্বজনেরা উদ্বিগ্ন। কুসংস্কারের প্রসার ঘটিয়ে সরকারী খরচে অযোধ্যায় রামমন্দির, দিঘায় বেআইনী জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের নিন্দা করলেন যুক্তিবাদী সমিতি। চাকুরীচোরদের হারানো চোরাই চাকুরী ও বাজেয়াপ্ত করা চাকুরীবিক্রয়ের চোরাই টাকা চোরদের ফেরতের আবেদন করলেন দয়ালু মন্ত্রী। দেশের একটি রাজনৈতিক দলকে সারা বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ ডাকাতদল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউ এন ও। এখন ছোট্ট একটা বিরতি। শীঘ্র ফিরে আসছি আরও খুন চুরি ডাকাতি ধর্ষণের আরও উত্তেজক খবরের ডালি সাজিয়ে। কোত্থাও যাবেননা। আমরাই আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য সব সময় প্রথম খবর দিয়ে থাকি। আনন্দসংবাদ নিবেদন করলেন, বঙ্গীয় জনতা পার্টি। আগামী নির্বাচনে বজপাকে ভোট দিয়ে দুর্নীতি করার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করুন  .........


নমঃশূদ্র জাতিগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মতুয়া সংগঠনের উৎপত্তি -মানব মণ্ডল
May 20, 2025 | সমাজ | views:8 | likes:0 | share: 0 | comments:0

নমঃশূদ্র বা নমঃস্বেজ হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় জনগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর বিস্তার মূলত বাংলাদেশ এবং ভারত। এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন দেশে তারা অল্প সংখ্যায় ছড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যগতভাবে এরা পেশায় কৃষিজীবী। সামাজিকভাবে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের চারটি বর্ণের বাইরে অবস্থান করে অর্থাৎ তারা একটি অবর্ণ বা মুক্তবর্ণ হিন্দু জনগোষ্ঠী। ভারতীয় উপমহাদেশে বহুকাল ধরে তারা শোষিত এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠী এবং এক ধরনের বর্ণ বিদ্বেষের তথা রূপকার্থে তারা ইহুদী-ভাগ্যের শিকার। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের একটি পরিসংখ্যানে তাদের পূর্বপুরুষের শ্রুতি অনুযায়ী, অধিকাংশ নমঃশূদ্রই কাশ্যপ গোত্রের অন্তর্গত।

১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের একটি পরিসংখ্যানে তাদের পূর্বপুরুষের শ্রুতি অনুযায়ী , অধিকাংশ  নমঃশূদ্র বা নমঃস্বেজ’ই কাশ্যপ গোত্রের অন্তর্গত। এছাড়াও কয়েকটি গোত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্ঞানীঋষি বুদ্ধ কাশ্যপ এর পরবর্তী নমস্ মুনির বংশধর হেতু তারা নিজেদের সম্প্রতি নমঃস্বেজ বলে অভিহিত করে।


নমঃশূদ্র শব্দটি একেবারেই অর্বাচীন বৃটিশ আমলের আরোপিত হীনাত্মক শব্দ। প্রাচীন কোন শাস্ত্রেই এই জাতির কোন উল্লেখ নেই। ১৯১১ সালের সেন্সাসে বাঙলার জাতিগুলির মধ্যে নাম পরিবর্তনের একটা হিড়িক তৈরি করা হয়েছিল। ছোটজাতগুলোকে হিন্দুভুক্ত করার জন্য বাংলার তৎকালীন দিগ্গজ পণ্ডিতদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মত। "জাতির উন্নয়ন" নামক গাল ভরা নামকরণের আড়ালে তারা বিজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। প্রায় চল্লিশ জন নামকরা মহা পণ্ডিত এই বিজ্ঞাপণে সই করে লিখে ছিলেন, "The caste called Namasudra is Brahmin by origin beging descended from the great Beahmin, Kashypa and not "Chandal'। আসামের চিফ কমিশনার ১৮৮৫ সালের ৮ আগস্ট কাছাড় জেলার ডেপুটি কমিশনারকে চিঠি দিয়ে জানালেন যে, চন্ডালদের নমশূদ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আর কোন আপত্তি নেই। তারপর ওই চল্লিশজন ভূ-দেবতা জানান যে নমঃশূদ্ররা চন্ডাল নয়, তারা ব্রাহ্মন দেবতার সন্তান। পূজনীয় এবং নমস্য। ১৮৮৭ তে খুলনার কমিশনার সাহেবের সভায় সচিয়াদহ নিবাসী উমাচরন বিশ্বাস 'শক্তিসঙ্গম তন্ত্র' নামে একখানি শাস্ত্রের প্রাণতোষী নামক অধ্যায়ে "হর-পার্বতী সংবাদে" নম জাতির উল্লেখ আছে বলে লিখিত অংশ পড়ে শোনান এবং দাবী করেন যে তারা নমস্ মুনির সন্তান। নমস্ শুদ্র কন্যা বিবাহ করেন। তাই এই জাতি নমঃশূদ্র নামে পরিচিত। পিতৃ সূত্রে তাঁরা ব্রাহ্মণ।

নমঃশূদ্র আর্যায়ন প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভুত একটি বর্ণাশ্রয়ী সম্প্রদায়। প্রাচীন কালে সমাজে চতুবর্ণ প্রথাকে বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথায় রূপান্তরের যে প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় তারই ধারাবাহিকতায় এর উদ্ভব। তাত্ত্বিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজে কোন গোষ্ঠীর প্রাধান্য নির্ধারণ করা হত এবং এ প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণদের অবস্থান ছিল শীর্ষে ও সর্বনিম্ন স্তরে ছিল শুদ্র। ধর্ম-সামাজিক স্তর বিন্যাশে সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থানরত শুদ্রদের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা হতো যে, সত্য উপলব্ধি ও পালন করার মতো কোনো গুণাবলী তাদের নেই। উপমহাদেশে আর্যাকরণের ফলে ধীরে ধীরে চতুবর্ণ প্রথার মধ্যে অনার্যদের আত্মীকরণ ঘটতে থাকে। বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্যসমূহ পরবর্তীকালে জাতি ব্যবস্থার মধ্যে বিশদভাবে বর্ণিত হয়। পরবর্তী সময়ে বর্ণ শ্রেণির বৈশিষ্ট্যসূচক শ্রমভিত্তিক এ ব্যাপক বিভাজনের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় জাতি প্রথার মধ্যে। ফলে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে পেশাগত স্বাতন্ত্র্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

বাংলায় আর্য সংস্কৃতির ক্রমবিস্তারের ফলে বিভিন্ন শ্রেণির জনগনকে নির্দিষ্ট পেশা সহকারে স্বতন্ত্র ও সুনির্দিষ্ট জাতি হিসেবে শ্রেণি বিভাজনের দিকে চালিত করে। বর্ণের পরিভাষায় চাষী, ব্যবসায়ী, কারিগর ও সেবাপ্রদানকারী জাতসমূহ শুদ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জাতি ব্যবস্থার অধীনে পেশাজীবী শ্রেণির বিশাল জনগোষ্ঠী সমাজের প্রয়োজন মিটানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল। পরিণতিস্বরূপ, বাংলায় হিন্দু সমাজের গঠন বর্ণের পরিবর্তে জাতির পরিভাষা অনুসারে উপলদ্ধ হয়ে আসে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ  হলো, জাতি ও পেশার মধ্যে সম্বন্ধের প্রতি জোর দেওয়ার ফলে জাত ব্যবস্থার সমর্থনকারীগণ উৎপাদন ও বণ্টনের একটি অ-প্রতিযোগিতামূলক বন্দোবস্তের ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করছিল, যা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবিকানির্বাহের উপায় ও ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সাধারণভাবে সমাজিক ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে ভারতীয় স্থানীয় আর্থিক ব্যবস্থায় বিরাজমান সীমিত সম্পদ এবং ঘাটতি ও স্থবিরতার চাপের মধ্যেও সহজভাবে উৎপাদন ও তা বণ্টনের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।

বল্লালচরিতে বাংলায় শুদ্রদের উত্থান ও তাদের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তাদের দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে বিভক্ত করে দেখানো হয়েছে। তারা ছিল; সৎ শুদ্র (যাদের নিকট থেকে উচ্চ বর্ণের মানুষ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে পারত) এবং অসৎ শুদ্র (যাদের ছোঁয়াকেও অপবিত্র বা অচ্ছুৎ বলে গণ্য করা হতো।) শুদ্রদের মধ্যে যারা কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বৃহত্তর অংশ ‘নমঃশূদ্র’ হিসেবে পরিচিতি পায় এবং অবশিষ্টাংশ দাস হিসেবে পরিগণিত হয়। সুলতানী আমলে অনেক পেশাজীবী শ্রেণিকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, সুবর্ণ বণিকদের সৎ শুদ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিদেশি শাসন এই প্রবণতাকে ধরে রাখার ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। কারণ তখন সামাজিকভাবে বহিষ্কৃত ও বঞ্চিত শ্রেণি ব্যাপকহারে সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানে রূপান্তরিত হচ্ছিল। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সুলতানী ও মুগল আমলে নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠী বাংলার বৃহৎ ও অর্থনৈতিকভাবে সর্বাধিক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় প্রজনন বা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পুনস্বীকৃতি প্রাপ্তি, উভয় প্রক্রিয়ায় সংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রূপ ধারণ করে এবং তাদের এ বিষয়টি বিশ শতকের গোড়া থেকেই ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। কারণ সে সময়ে নির্বাচন নির্ভর রাজনীতির ধারায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সামগ্রিক জাতির স্বার্থ রক্ষার প্রতি দৃষ্টি আরওপ করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

পূর্ব বাংলার নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে গতিশীলতা আসে উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতক পর্যন্ত, যখন পশ্চিম বঙ্গের ভূমিহীন ও প্রাপ্তিক নমঃশূদ্রগণ পূর্ব বাংলার সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, মেঘনার অববাহিকা, সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওড় অঞ্চল, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে পুনর্বাসিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হয় ও তারা এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। উক্ত অঞ্চলের জোতদার ও অন্যান্য বড় ভূ-স্বামীগণ পরিত্যক্ত নিষ্কর জমিতে পুনর্বাসিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে বর্গাচাষী হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য আহবান জানায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রধানত নমঃশূদ্রদের দ্বারা ইজারা চুক্তির মাধ্যমে বাংলায় একটি বৃহৎ বর্গাচাষী শ্রেণি সৃষ্টির পথ তৈরি হয়।  নমঃশূদ্রগণ নিম্ন শ্রেণির সাধারণ  রায়তে পরিণত হয় এবং সাধারভাবে এ শ্রেণিই উচ্চ শ্রেণির অধিকাংশ হিন্দু ভূমি মালিকদের মধ্যস্বত্বভোগীতে পরিণত হয়।


শ্রেণি হিসেবে নমঃশূদ্রগণ ছিল ঋণগ্রস্ত ও অনুন্নত। বাংলার এই অনুন্নত সম্প্রদায় ২০ শতকের গোড়া থেকেই বিভিন্ন সমিতি ও বর্ণাশ্রয়ী বিভিন্ন সংঘের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। তাদের দাবিসমূহ সরকারের নিকট সমবেদনার উদ্রেক করছিল। ফলে সাইমন কমিশন রিপোর্ট (১৯২৮-২৯) এবং গোল টেবিল কনফারেন্সে এই অনুন্নত সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করা হয়। অবশেষে কংগ্রেস  পুনা প্যাক্টএ (১৯৩২) তাদের দাবিসমূহ মেনে নেয়। অনুন্নত শ্রেণি কথাটির মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা জড়িয়ে আছে তা পরিহার করতে বাংলা সরকার ১৯৩২ সালে ৭৬টি নিম্নবর্ণের হিন্দু শ্রেণিকে তফসিলী সম্প্রদায় অভিধায় আখ্যায়িত করে এবং ১৯৩৫ সালের  ভারত শাসন আইনএর প্রথম তফসিলে তাদের নামের উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যাক্টের আওতায় বঙ্গীয় আইনসভায় তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য বিশ শতাংশ (২০%) আসন সংরক্ষিত করা হয়। নমঃশূদ্র শ্রেণির মতো অনুন্নত না হলেও এ আইনে মুসলমান জনগোষ্ঠীও তাদের জন্য সংরক্ষিত সাধারণ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার লাভ করে। এভাবে বাংলার রাজনীতিতে তফসিলী সম্প্রদায় একটি শক্তিশালী ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তিতে পরিণত হয় এবং বাংলার রাজনীতিতে উভয় সম্প্রদায় উভয়ের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসে স্ব-স্ব শ্রেণির অবস্থার উন্নয়নে এক সঙ্গে পরিকল্পনা গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ এবং ১৯৫৪ (পূর্ব বাংলা) সালের নির্বাচনে সর্ব-বঙ্গীয় তফসিলী সম্প্রদায় মুসলিম লীগের সঙ্গে মন্ত্রিসভা গঠনে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে।


দুই মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ এবং মতুয়া ধর্মান্দোলন: “জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।/ ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।”—কথাটি হরিচাঁদ ঠাকুরের। শুনে যে কারোরই মনে হবে এতো বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত ‘জীবে প্রেম করে যেই জন...’ কথাটির প্রতিধ্বনি। বিবেকানন্দের কথাগুলো যখন ছেপে বেরুচ্ছে এই কথাগুলোও একই সময়ে ছেপে বেরিয়েছে। আছে তারকচন্দ্র সরকারের লেখা ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত’ বইতে। যে গুরু হরিচাঁদের জীবনী বইটি, তিনি নিজে কথাটি বলুন বা নাই বলুন, কথাটি তাঁর নামেই চলে। বইটি ছেপে বেরিয়েছে ১৯১৬তে। ‘মতুয়া ধর্মাবলম্বী’দের বাইরে বাকি ভারতীয় তো দূরই, সাধারণ বাঙালি যে হরিচাঁদের এই কথাগুলো জানেন না বিশেষ, তাতে একটা কথাতো স্পষ্ট হয়েই যায় বিবেকানন্দ যতই ভারতবাসীকে ধমকে দিয়ে বলুন, “হে ভারত, ... এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?” যতই আহ্বান জানান , “বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই,...” আমরা এর জন্যে বিবেকান্দকে মহীয়ান করে মধ্যবিত্তের নায়ক বানিয়ে দিলাম, ‘ভারতবর্ষ’কে নিয়ে গৌরব করতেও শিখলাম, যাদের তিনি ভাই বলে কাছে টেনে নিতে বললেন, তাদের আদৌ কাছে টেনে নিলাম না। হ্যাঁ, কেউ হয়তো ছায়া মাড়ালাম, ছোঁয়াটা খেলাম, বিপদে আপদে সহায় সম্বল নিয়ে পাশেও দাঁড়ালাম আর গর্ব করে ‘জাত মানি না’ বলে প্রচারও করে গেলাম। কিন্তু হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের মতো কেউ যখন সত্যি কেউ সমস্ত কাপুরুষতা দূর করে মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্যে মাথাতুলে দাঁড়াতে চাইলেন বাকিদের থেকে পেলেন শুধু প্রবল উপেক্ষা । ভারতীয় জাতীয়তার আদর্শে তাঁদের নায়কের সম্মান জুটল না। স্কুল কলেজের মহাপুরুষের জীবনীতেও তাঁরা রইলেন ব্রাত্য। অথচ উনিশ শতকে কলকাতা শহরের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধেভোগীরা যখন বিচিত্র ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন, বাকি বাংলাদেশে সুবিধে বঞ্চিত হিন্দু দলিত এবং মুসলমান প্রজারাও ওয়াহাবী, তারিখ এ মুহম্মদীয়া, ফারায়েজি, বলাহাড়ি, কর্তাভজা, মতুয়া ইত্যাদি নানা নামে বিচিত্র সব ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন যেগুলো অচিরেই এক একটি রাজনৈতিক আন্দোলনেরও চেহারা নিচ্ছিল। এগুলোর মধ্যে মতুয়া একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ধর্মসংস্কার আন্দোলন যা এখনো ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশে সজীব এবং সক্রিয়।

অবিভক্ত বাংলাদেশের পূববাংলা অংশে সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠীটির নাম নমঃশূদ্র। অনেকে বলেন, পূর্ব বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরও অধিকাংশ আদতে এই নমশূদ্র জনগোষ্ঠীরই ছিলেন। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে গোটা বাংলাতে এরা দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছিলেন। বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মন সিংহ, যশোর, আর খুলনা এই ক’টি জেলাতেই ৭৫ শতাংশ নমশূদ্র মানুষ বাস করতেন। এছাড়াও অন্যান্য জেলাতে , মায়, সিলেটেও নমশূদ্র বসতি নিতান্ত ফেলনা ছিল না। ১৯১১-র আদমসুমারিতেই প্রথম বহু সংগ্রামের পর এদের প্রচলিত জাতিনাম ‘চণ্ডাল’ মুছে যায়। এর আগে অব্দি এরা এই নামেই পরিচিত ছিলেন। এবং বাকি বাঙালি হিন্দুরা এদের অস্পৃশ্য বলে মনে করতেন, বা এখনো মনে করে থাকেন। স্মার্তকার রঘুনন্দনের নির্দেশে এদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক তো দূর, পংক্তিভোজনও এড়িয়ে চলত উঁচু বর্ণের বাঙালি। ১৯১১র আদমসুমারি অব্দি দেখা গেছে নমঃশূদ্রদের ৭৮ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। এবং এই কৃষিজীবিদের মাত্র ১.১৫ শতাংশ মানুষ নিজেরা খাজনা পেতেন। তার মানে মোটের উপরে এরা শ্রেণি এবং বর্ণ দু’দিক থেকেই ছিলেন দলিত। যে জমিদারদের অধীনে প্রজা হয়ে থাকতেন তাদের অধিকাংশই বর্ণহিন্দু, সামান্য কিছু সৈয়দ মুসলমান । শেখর বন্দ্যোপাধায় লিখেছেন, “ বাংলার কৃষিসমাজে বড় যে বিভেদ তা হলো ‘খাজনাভোগী’ এবং ‘খাজনা প্রদানকারী’দের মধ্যে, এই এই ক্ষেত্রে তা নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল জাতিভেদের সঙ্গে। এই বিভেদ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলত নানাধরণের অত্যাচারের ফলে। তার মধ্যে ছিল মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ, বেআইনী কর আদায়, খাজনার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি সহজ নগদ খাজনার বদলে উঁচুহারে খাজনা আদায় করা।” এর মধ্যেও একটি ছোট গোষ্ঠী নিশ্চয়ই নানা ছোটখাটো ব্যবসা এবং মহাজনী কারবার ইত্যাদি করে সামাজিক মর্যাদার উপরের স্তরে উঠেছিলেন। “তবে ১৯১১ সালে এই বর্ধিষ্ণু গোষ্ঠী গোটা নমঃশূদ্র জাতির জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম ছিলেন”। এই শ্রেণিটি সংখ্যার দিক থেকেও কম ছিলেন, বাকি মহাজন শ্রেণি বন্ধুদের থেকেও অতি দুর্বল ছিলেন। সবচে’ বড় কথা “...সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন এতো নিচের দিকে, যে তাঁরাও উঁচুজাতের ভদ্রলোকের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম ভাবতে পারতেন না।” তখনকার নানা ধরণের কৃষক বিদ্রোহ এবং ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে এদের পরিচয় ঘটছিল। কিন্তু বিশ শতকের গোড়াতে যাদের নেতৃত্বে বাংলাভাগের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে উঠছিল এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ রূপ পাচ্ছিল, শ্রেণি এবং বর্ণ দু’দিককার স্বার্থেই এরা তার সঙ্গে কোন ধরণের আত্মীয়তার খোঁজে পাননি। ফলে কলকাতা কেন্দ্রিক যেসব ধর্মসংস্কার আন্দোলন সেগুলোর প্রতিও কোনদিনই এরা আকর্ষণ বোধ করেননি। বিবেকানন্দ , অরবিন্দ এদের নেতা হয়ে উঠতে পারেননি কিছুতেই, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেনদের তো প্রশ্নই উঠে না।

চাইলেই যে অন্ত্যজ জাতবর্ণের শ্রেণিগতভাবে উপরের লোকেরা বর্ণগতভাবে উপরের লোকজনের কাছাকাছি আসতে পারেন না, এর নজির দিতে গিয়ে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ১৮৭২-৭৩, এই সময়ে এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র গ্রামীণ নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উঁচুজাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করেন। তার প্রতিবাদে ফরিদপুর –বাখরগঞ্জ এলাকার সমস্ত নমঃশূদ্ররা এই উঁচুজাতের সঙ্গে সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করেন। এই লড়াই প্রায় ছ’মাস চলে। এই লড়াইএর সফলতা কিম্বা বিফলতাই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করে নতুন ধর্মসম্প্রদায়ে নিজেদের সংগঠিত করতে। যার নাম ‘মতুয়া।’ এই ধর্মীয় লড়াই এক সময়ে এর প্রবর্তকের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে আরও এগিয়ে যায় এবং ক্রমেই এক স্পষ্ট রাজনৈতিক রূপ পেতে থাকে। সেই রূপ পূর্ণতা পায় ১৯১২ তে Bengal Namasudra Association গঠনের মধ্যে দিয়ে। যা ক্রমে গিয়ে নানা বাঁকে এবং ফাঁকে আম্বেদকারের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিল। এবং এখনো জড়িয়ে আছে। সেই ইতিবৃত্ত অন্য। আপাতত শুধু একটি তথ্যের উল্লেখ করব যে ১৯১১-র আদমসুমারির পরে ১৯৩৬ অব্দি এই ‘শূদ্র’ শব্দটি বাদ দেবার জন্যেও অনেকে লড়েছিলেন। সফল হয়েছিলেন বলে কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই। শেখর অবশ্যি ফরিদপুর জেলার গ্রামীণ নেতার নাম করেননি। নাম করেননি গুরুচাঁদের বাবা হরিচাঁদের। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক তিনিই । এবং সে আরও আগের ঘটনা। সুতরাং শেখর ঠিক কার মায়ের শ্রাদ্ধের ঘটনা লিখেছেন আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। ১৮১২ সনের ১১ মার্চ এখনকার বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওঢ়াকান্দির পাশে সাফলিডাঙ্গা গ্রামে জন্ম নেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর বাবার নাম ছিল যশোবন্ত ঠাকুর, মা অন্নপূর্ণা। পাঁচ সন্তানের তিনি দ্বিতীয়। তিনি ‘হরিনামে মুক্তি’ কথাটা বাকি বৈষ্ণবদের মতো প্রচার করলেন বটে কিন্তু সেই মুক্তিতত্ত্ব বাকি সহজিয়া বৈষ্ণবদের থেকেও সহজ। ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’দের থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাই এর নামও ভিন্ন। হরিনামে মাতোয়ারা—এমন এক ধারণার থেকে ধর্মসম্প্রদায়টির নাম হলো ‘মতুয়া’। বর্ণগত ভাবে এঁরা মূলত বাঙালি দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোক, যদিও মতুয়া ধর্মে অন্যান্য বর্ণের লোকেরাও অনেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন । মতুয়া ধর্মের মূল কথাগুলো বোঝা খুব কঠিন নয়। বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের আদলে হরিচাঁদেরও ছিল দ্বাদশ আজ্ঞাঃ 

 ১) সদা সত্য কথা বলা।  

২) পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা। 

৩) পিতা মাতাকে ভক্তি করা। 

৪) জগতকে প্রেমদান করা। 

৫) পবিত্র চরিত্র ব্যক্তির প্রতি জাতিভেদ না করা  

৬) কারো ধর্ম নিন্দা না করা। 

৭) বাহ্য অঙ্গে সাধু সাজ ত্যাগ করা।  

৮) শ্রীহরি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা।  

৯) ষড় রিপুর থেকে সাবধান থাকা।  

১০) হাতে কাজ মুখে নাম করা।  

১১) দৈনিক প্রার্থনা করা।  

১২) ঈশ্বরে আত্ম দান করা।

 সম্প্রতি এই ধর্মনিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে , তর্ক বিতর্কও হচ্ছে ‘মতুয়া’ সমাজের বাইরেও, ভেতরে তো বটেই। কিন্তু হরিচাঁদের জীবৎকালে লিখিতভাবে কোন ধর্মাদেশ দাঁড় করাবার চেষ্টা ছিল না। তারক সরকারের ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ বইটি লেখা হলেও প্রকাশের অনুমতি দেননি হরিচাঁদ। বস্তুত পছন্দও করেননি। সুতরাং তাঁর ধর্মমত ছড়িয়েছিল লোকের মুখে মুখে, স্মৃতিতে, গানে, কীর্তন আসরে। বৈদিক অবতারতত্ত্ব, পাপ পুণ্য, স্বর্গ নরক, আচার বিচার কিছুতেই আস্থা রাখতেন না তারা। এমনকি যে ‘হরি’নামের কথা বলা হচ্ছে তিনিও বৈষ্ণব হরির থেকে ভিন্ন। অনেকের মতে মতুয়া ধর্ম আসলে বাংলাদেশের প্রাক-বৈদিক বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থিত, পুণর্নির্মিত রূপ। একত্রে অনেকে মিলে নাম করলে প্রেমবোধ জাগে তাই এই নাম নেয়া। ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃতে’ও আছে, “বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য/ যশোবন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ।”

 ১৮৩৩ নাগাদ প্রায় একুশ বছর বয়সে হরিচাঁদ স্থানীয় জমিদার এবং ব্রাহ্মণ্যশাসকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে জন্মগ্রাম ছেড়ে ওড়াকান্দি চলে আসেন। জমিদারদের দরিদ্র কৃষক লুণ্ঠনের ব্যাপারটিতো তিনি জানতেনই। কিন্তু এখানে এসেই তিনি উপলব্ধি করেন কলকাতার জমিদারদের বিলাসবৈভবের রহস্য। মাত্র তিনমাসের খোরাকি দিয়ে এরা গোটা বছর কৃষকের ঘাম ঝরিয়ে নিত। বেগার খাটাতো। এমনকি দাসের বাজারে কেনাবেচাও করে দিত গরীব চাষাদের। ১৮৪৬ নাগাদ এই দাসব্যবসা বন্ধ করে ফেলা ছিল মতুয়াদের প্রথম বড় সাফল্য। ‘শাস্তিবিক্রি’ নামে একটি অদ্ভুত প্রথা চালু ছিল বাংলাদেশে। বাবু জমিদারেররা খুন-রাহাজানির মামলাতে জড়ালে দলিত অন্ত্যজ লোকেদের লোভ কিম্বা ভয় দেখিয়ে নিজের কাঁধে দায় নিয়ে বাবুদের বাঁচিয়ে দিতে বাধ্য করা হতো। হরিচাঁদের নেতৃত্বে এই কুপ্রথা এবং সেই সঙ্গে নরবলির বিরুদ্ধে প্রচার আন্দোলন শুরু হয়। লেখাই বাহুল্য যে নরবলির শিকার হতেন এই নমশূদ্রদের মতো দলিতেরাই। ফলে আশপাশের বিভিন্ন জেলাতে মতুয়াদের কথা ছড়িয়ে পড়ে। ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করবার ব্যাপারটি একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং তা এর জন্যেই যে সামন্তসমাজে দু’টিকে আলাদা করে দেখাই কঠিন। যে মধ্যবিত্তরা শরৎচন্দের ‘মহেশ’ গল্পটি পড়েছেন তারা দেখেছেন কীভাবে জমিদারের জমির লোভের প্রকাশ ব্রাহ্মণের শাস্ত্রের দোহাই হয়ে প্রকাশ পায়। তাই একুশ শতকের কিছু শহুরে মধ্যবিত্ত যখন নির্বিচারের এই সব দলিতদের রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে ধর্মের বিচ্ছেদ আশা করেন, তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসলেই তারা সামন্তপ্রভুদের স্বার্থকে সুরক্ষা দেন। তখনকার তো বটেই এখনো, বহু দলিত-আদিবাসী আন্দোলন থেকে তাই রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং ধর্মের বিকাশকে স্বতন্ত্র করে দেখা এক কঠিন কাজ। লালন ফকিরকেও জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে লাঠি নিতে হয়ে ছিল, তাও আবার যে সে নয়-- একেবারে বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের বিরুদ্ধে। লালন ফকিরের গানগুলোতে সহজিয়া দেহতত্ত্ব আবিষ্কার করে আজকের বহু মধ্যবিত্ত মুগ্ধতার মধ্যে কিছু সত্য নিশ্চয় আছে, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ –র মতো গানের মধ্যে জাতবর্ণ বিরোধিতার তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সন্ধানের মধ্যেও মিথ্যা কিছু নেই। কিন্তু এর মধ্যে আটকে থাকাটি হচ্ছে এক চূড়ান্ত মধ্যবিত্ত ভণ্ডামী। কেউ ব্যক্তিগতভাবে জাত না মানাবার দাবি করলেই জাত সংসার থেকে বিদেয় নেয় না। কথা হলো তার বিরুদ্ধে কোন সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে কিনা। চাইলেই সেই প্রতিরোধের বাস্তবতা সর্বত্র নাও থাকতে পারে, তখন গ্রামীণ কৃষক সমাজে দেখা দেন লালনের মতো ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রতিবাদী, কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদী। উল্টোদিক থেকে এমন প্রতিরোধ গড়ে উঠার সম্ভাবনা মাত্রকে নিরাকরণ করবার প্রয়াস চিরদিনই ছিল উচ্চবর্ণের দিক থেকে। দলিতদের উত্থান বিবেকানন্দকেও বিচলিত করছিল, কিন্তু তাঁর সমস্যা ছিল অন্যদিক থেকে। এগুলোকে তিনি সর্বভারতীয় জাতীয়তা নির্মাণের বাধা হিসেবে দেখছিলেন। তাই একদিকে যেমন উঁচু বর্ণের লোকদের ডেকে বলছেন, বলো চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই! অন্যদিক থেকে এই প্রশ্নও করছেন ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা দেখে এতো ঈর্ষান্বিত হবার কি আছে? সংস্কৃত গ্রন্থাদি পড়ে তাদের টেক্কা দিলেই হলো। তিনি আশা করছেন, মৎসজীবির কাছে গিয়ে কেউ বেদান্ত ব্যাখ্যা করলেই সবার ভেতরে একই ঈশ্বর দেখে মৎসজীবি মুগ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই কথাটি যে মৎসজীবির থেকে বেদান্তবাদী পণ্ডিত এবং তাঁদের অনুগামী শাসকশ্রেণির লোকেদের বেশি করে বোঝা দরকার, এবং না বুঝলে তার বিরুদ্ধে রীতিমত সংগঠিত প্রতিবাদটি দরকার এই সত্য বিবেকানন্দ বুঝতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না। বরং এমন প্রতিবাদে কোন লাভ হবার নয় বলেই তিনি মত ব্যক্ত করেছেন, বৃটিশভারত বর্ণব্যবস্থাটিকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে বলে প্রশংসাও করছেন। যখন কিনা, বিনয় ঘোষের মতো মার্ক্সবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা ১৯৭৮এ এসেও বৃটিশ ভারতে জাতবর্ণব্যবস্থা বিলীন হয়ে যাবে বলে স্বয়ং কার্ল মার্ক্সের অনুমানকেও নাকচ করে এক নতুন অধ্যায় জুড়ছেন তাঁর তিন দশক আগের লেখা ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে । হরিচাঁদ এবং তাঁর পরে গুরুচাঁদ সেই সংগঠিত প্রতিবাদের পথ ধরেছিলেন বলেই তাদের ধর্ম রাজনীতির চেহারা নিচ্ছিল, রাজনীতি ধর্মের। সেই প্রতিবাদের পথ ধরেছিলেন বলেই, বাকি বাঙালি সমাজ তাদের সম্পর্কে লালন করেছে এক আশ্চর্য নীরবতার নীতি।

সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন বলেই, হরিচাঁদ কাউকে সন্ন্যাস নিতে বা তীর্থে যেতে মানা করেন। ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃতে’ লেখা হচ্ছে, “সংসারে থেকে যার হয় ভাবোদয়। সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।” সংসার এবং মানুষের বাইরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, “যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর/ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার” কিম্বা, “বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।/যে যাহারে উদ্ধার করে সে তাহার ঈশ্বর।” সুতরাং কোন দীক্ষাও নেই, নেই গুরু গোঁসাই, “দীক্ষা নাই করিবে না তীর্থ পর্যটন।/ মুক্তি স্পৃহাশূণ্য নাই সাধন ভজন।।” গুরু গোঁসাই সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে হরিচাঁদের উক্তি, “কোথায় ব্রাহ্মণ দেখো কোথায় বৈষ্ণব।/ স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।।” গুরু গোঁসাইদের শাস্ত্রানুশাসনকে অমান্য করে তাঁর চরম অবস্থান, “কুক্কুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।/ বেদাবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।” এগুলো শুধু ব্রাহ্মণেরাই সহ্য করবেন না এমনতো নয়, গোটা সামন্তসমাজের শাসন মানিয়ে নেবার প্রাথমিক সর্ত এগুলো। স্বাভাবিক ভাবেই নিন্দা, অপপ্রচার, লাঠিয়াল দিয়ে পেটানো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, পুকুরে বিষ দেয়া, জোরে মাঠের ধান কেটে নিয়ে চলে যাওয়া এবং সর্বোপরি সামাজিক বয়কট হলো মতুয়াদের শায়েস্তা করবার জন্যে সামন্তশ্রেণির হাতিয়ার। বিপরীতে বাধ্য হয়ে লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল মতুয়াদের। এর সঙ্গে ছিল নীলকর সাহেব এবং নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার। একবারতো এমন কিছু নায়েব এবং সাহেবদের নীলের কড়াইতে ফেলে সেদ্ধ করে ফেলেন এই লাঠিয়ালরা। সংকটে দীর্ণ মতুয়াদের বিয়ে শ্রাদ্ধে ব্যয় কমাতে নির্দেশ দিলেন হরিচাঁদ, “বিবাহ শ্রাদ্ধেতে সবে কর ব্যয় হ্রাস।/ শক্তির চালনা, সবে রাখো বারমাস।।” উৎপাদন ব্যবস্থার উপর চাষীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়েও ভেবেছিলেন তিনি, “মন দিয়ে কৃষি কর, পূজ মাটি মায়।/ মনে রেখো বেঁচে আছ মাটির কৃপায়।।” চাষাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে বছরে তিনবার ফসল ফলাতে উদ্বুদ্ধ করলেন, “সর্বকার্য হতে শ্রেষ্ঠ কৃষি কার্য হয়।/ ত্রিফলা না করা আমাদের ভাল নয়।।” উদবৃত্ত অর্থকে ব্যবসায়ে খাটিয়ে ধনলাভে উৎসাহিত করতে নিজে শিখে অন্যকে শেখাতে শুরু করলেন, দরকারে অনেককে টাকা ধার দিতেও শুরু করলেন, “নিজহাতে ব্যবসা করেন হরিচাঁদ/বাণিজ্য প্রণালী শিক্ষা সবে কৈল দান।।”


পুত্র গুরুচাঁদকে উত্তর দায়িত্ব সমঝে দিয়ে ১৮৭৮এ হরিচাঁদ মারা যান। গুরুচাঁদের জন্ম ওড়াকান্দিতে ১৮৪৪এ। তিনি মারা যান ১৯৩৭এ। বাবা-ছেলের জীবৎ কাল ১২৫ বছর থেকে হরিচাঁদের ছেলেবেলার প্রথম একুশ বছর বাদ দিলেও বলা চলে উনিশ-বিশ শতকের একশত বছর জুড়ে মতুয়া ধর্মান্দোলন ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। যদি ব্রাহ্ম ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের কথা মনে রাখি, তবে এতো দীর্ঘ নির্বিরোধ জীবন সেই ধর্মের ছিল না। এতো বিশাল সামাজিক সমর্থনও ছিল না ব্রাহ্মধর্মের। তারপরেও ব্রাহ্মদের চিনি, মতুয়াদের না । দায়িত্ব নিয়েই গুরুচাঁদ শিক্ষা বিস্তারে মন দিলেন। নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলে শুরু করলেন। তাঁর সম্পর্কে জানবার নির্ভরযোগ্য প্রথমবইটি লেখেন মহানন্দ হালদার, নাম ‘শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৩এ। গুরুচাঁদ সবাইকে নির্দেশ দিলেন, “সবাকারে বলি আমি যদি মানো মোরে।/ অবিদ্বান পুত্র যেন নাহি থাকে ঘরে।।” এই শিক্ষান্দোলনের পাশে তিনি বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে কাছে টেনে নেন। “নম সাহা তেলি মালি আর কুম্ভকার।/ কাপালি মাহিষ্য দাস চামার কামার। পোদ আসে তাঁতি আসে আসে মালাকার।/ কতই মুসলমান আসে ঠিক নাহি তার।।” মেয়েদের জন্যেও সমানে আলাদা উদ্যোগ নেন, “ নারী শিক্ষার তরে প্রভু আপন আলয় শান্তি সত্যভামা নামে স্কুল গড়ি দেয়।।” রবীন্দ্রনাথ যেমন শ্রীনিকেতনের প্রথম দিককার দিন গুলোতে বৃটিশ কৃষিবিজ্ঞানী এবং সমাজসেবি লিওনার্ড এলমহার্ষ্টকে নিয়ে এসছিলেন, গুরুচাঁদ তেমনি এক অস্ট্রেলিয় মিশনারি ডাঃ সি.এস.মিডকে সঙ্গে পেয়ে যান। দরিদ্র অন্ত্যজদের মধ্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ছড়াবার ব্যাপারে এই ভদ্রলোক ছিলেন আন্তরিক। তাঁর বিরুদ্ধে খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করবার অপপ্রচার ছিল, কিন্তু স্বপক্ষে সাক্ষী বেশি নেই। বরং ১৯০৬ থেকে গুরুচাঁদের সঙ্গে আলাপ এবং বন্ধুত্বের পরে থেকে সেই সম্পর্ক ছিল অটুট। শুধু তাই নয়, ১৯০৮এ ওড়াকান্দিতে এই দু’জনের প্রচেষ্টাতে যে উচ্চ ইংরাজি স্কুল যাত্রা শুরু করে শতাব্দ প্রাচীন সেই স্কুলের নাম ‘ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুল’ রেখে মতুয়ারা তাঁকে স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মিড অভিজ্ঞ মানুষ, তার উপর সরকারি মহলে তাঁর খাতির ছিল। গুরুচাঁদ বুঝেছিলেন তিনি যে কাজ করতে যাচ্ছেন তাতে দু’টোরই সমান দরকার। তাঁর সেই বোধে ত্রুটি ছিল না, ঘটনাক্রম তা প্রমাণ করেছে। নারী-পুরুষদের জন্যে আলাদা স্বাস্থ্যকেন্দ্রও গড়ে উঠতে শুরু করল ওড়াকান্দি এবং আশপাশের এলাকাতে। একই সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে চলে বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ বিরোধী প্রচার আন্দোলন। তখন থেকেই নমঃশূদ্র শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জন্যে সরাকারি চাকরিতে ভাগীদারির দাবি উঠতে থাকলে অনেকেই মনুর বিধান শুনিয়ে আটকে দিচ্ছিলেন। ১৯০৭এ সরকার প্রথম আইন করে অন্ত্যজ এবং মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছেলে শশীভূষণ ঠাকুর সাবরেজিস্টার পদে যোগ দিতে পারেন । এর আগে নানা ভাবে চেষ্টা করেও তিনি কোন চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। ১৯০৮এ কুমুদ বিহারি মল্লিক ডেপুটি রেজিস্টার পরে এবং তারিনী বল সরকারি ডাক্তার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন।

‘চণ্ডাল’রা সরকারি চাকরিতে আসছেন, পঞ্চায়েত পুরসভাতে যোগ দেবার সম্ভাবনা বাড়ছে এই ব্যাপারটি উঁচু বর্ণের লোকেরা ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না। স্বাভাবিক ভাবেই মনুর বিধান ডিঙিয়ে সাহেবদের প্রশ্রয়ে অন্ত্যজ বর্ণের মানুষের ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় মর্যাদাতে উন্নীত হবার আকাঙ্খা দাবিও বাড়তে থাকে। জয়া চ্যাটার্জী লিখেছেন, ১৯১১তে আদমশুমারি কর্তৃপক্ষের কাছে এমন দাবি জানিয়ে এতো সব জনগোষ্ঠী স্মারকপত্র জমা দেন যে সব মিলিয়ে এগুলো ওজনে দাঁড়িয়েছিল এক মণের বেশি। নমঃশূদ্ররা তখন নিজেদের কায়স্থ বলে দাবি করলে কায়স্থরা সেটির বিরোধিতা করেন। তাতে কায়স্থদের সামাজিক ভাবে বয়কট করেন নমঃশূদ্ররা। গোয়ালারা নিজেদের বৈশ্য বলে দাবি করলে সভ্রান্ত হিন্দুরা অনেকে গোয়ালাদের ছেড়ে মুসলমানদের থেকে দুধ কিনে খেতে শুরু করেন। ডাঃ মিডকে পাশে নিয়ে তখন অন্তত ‘চণ্ডাল’দের জন্যে ‘নমঃশূদ্র’ নামটি আদায় করে নিতে সমর্থ হন গুরুচাঁদ। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল একেবারেই ধর্মসংস্কার এবং কৃষকবিদ্রোহের রূপে সেটি তখন রীতিমত আইনী রাজনৈতিক সংগ্রামের দিকে এগুতে শুরু করে। গুরুচাঁদ অনুভব করেন, “ যে জাতির দল নেই/সেই জাতির বল নেই/ যে জাতির রাজা নেই/ সে জাতি তাজা নেই।” তাঁর আহ্বান, “বিদ্যা যদি পাও কাহারে ডরাও/ কার দ্বারে চাও ভিক্ষা।/ রাজশক্তি পাবে বেদনা ঘুচিবে/ কালে হবে সে পরীক্ষা।” সে রাজনীতি গুরুচাঁদের মৃত্যু অব্দি পরিচালিত হয়েছিল একেবারেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলনের বিরুদ্ধে। বরং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে শুরু থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। এরই ধারাবাহিকতাতে কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন তেভাগা আন্দোলনেরও বড় সমর্থন ভিত্তিটিই ছিলেন এই নমশূদ্ররা । বাকি বড় অংশটি রাজবংশী কৃষক। ১৯৩৭ গুরুচাঁদের মৃত্যুর আগে পরে মতুয়া ধর্মান্দোলনের যেমন নানা মতভেদ দেখা দিতে শুরু করে তেমনি রাজনৈতিক মত এবং পথও নানা শাখাতে বিভাজিত হয়ে যায়। যে বিভাজন এখনো সমানে সক্রিয়। কিন্তু তারপরেও এটা ঠিক যে গুরুচাঁদের এই উদ্যোগের ফলেই ১৯৩৭এর নির্বাচনে বাংলা থেকে ৩২ জন প্রতিনিধি নানা পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর থেকে নির্বাচিত হলে তাঁর মধ্যে ১২ জনই ছিলেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি নাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ—যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিরাট চন্দ্র মণ্ডল, প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ। আম্বেদকারের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন অনেকে। তাদেরই সমর্থনে আম্বেদকর গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগের শেষ দশকে যে বিচিত্র রাজনৈতিক ডামাডোলে বাংলাদেশ প্রবেশ করে, তাতে নমঃশূদ্র সমাজের আগেকার ঐক্য রাখাটাও কঠিন ছিল। তার উপরে শিক্ষিত শ্রেণিটির সংখ্যা বাড়তে থাকাতে তাঁদের অনেকে সাংবিধানিক রাজনীতিতে বেশি করে জড়াতে গিয়ে বাকি কৃষকজনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেই নেতৃত্বের কেউ মুসলিম লীগ, কেউ জাতীয় কংগ্রেস এবং অনেকে হিন্দু মহাসভারও ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন। বিশেষ করে গুরুচাঁদের পৌত্র প্রমথ ঠাকুরর ভূমিকা তখন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। সেটি হতে পারে অধ্যয়নের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। কিন্তু যে দুর্বিপাকের কথাটি না বললেই নয়, তা এই যে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া বড় অংশটি আশা করেছিলেন বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা ইত্যাদি পূব বাংলার নমঃশূদ্র অধ্যুষিত জেলাগুলো পশ্চিম বাংলাতে চলে যাবে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রথমে শরৎ বসু, ফজলুল হকের প্রস্তাবিত ‘অখণ্ড বাংলা’র প্রস্তাবের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানের প্রস্তাবের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। দু’পক্ষই প্রবঞ্চিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানে প্রবঞ্চিত হয়ে পঞ্চাশের গণহত্যার পরে লিয়াকৎ আলি খানের মন্ত্রীসভার থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ এবং ভারতে চলে আসা মাঝেমধ্যে বেশ চর্চিত হয়। বস্তুত দু’দেশের শাসক শ্রেণিই বাধ্য করে নমঃশূদ্রদের বড় অংশকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসতে। এবং বাকি বর্ণহিন্দুরা যখন ভারতে নিজের ব্যবস্থা যা হোক একটা করে নিতে সমর্থ হয়েছেন নমশূদ্রদের কিন্তু বাসাবাটির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে সাগরে আন্দামান থেকে পাহাড়ে উত্তরাখণ্ড অব্দি গোটা ভারতে। অসমেও এসছেন বিশাল সংখ্যক নমঃশূদ্র মানুষ। সিলেট ভাগের সময়েই এই নমঃশূদ্রদের অবস্থান ছিল দ্বিধাজড়িত। অনেকেই সিলেট ভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এক দশক আগেও ১৯৩৭-৩৮এ সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমাতে শিমুলঘর গ্রামে বর্ণহিন্দুদের উপস্থিতিতে শুধুমাত্র জুতো পরবার অধিকার আদায়ের জন্যে এক বড়সড় লড়াইতে নামতে হয়েছিল নমঃশূদ্রদের। যা পরে হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল। সিলেট গণভোটের সময়ে তাৎক্ষণিক ভাবে পংক্তিভোজনে বসে সেই দলিতদের মন জয় করতে নেমেছিলেন বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব। সিলেট ভাগের দায় যারা এক তরফা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের উপরে চাপান তাঁরা নিজেদের এই দায়কে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করেন না। এখনো জল জমির অধিকারের সঙ্গে নাগরিক অধিকার, সংরক্ষণ এবং ভাষা সংস্কৃতির জন্যে নমঃশূদ্রদের লড়ে যেতে হচ্ছে শুধু অসমেই নয়, গোটা ভারতেই। অসমে ডি-ভোটার তাদেরকেই বেশি হতে হয়। মরিচঝাঁপির কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে নমঃশূদ্রদেরই। দেশভাগ এবং বাংলার সবচে’ বড় দলিত জনগোষ্ঠী এই নমশূদ্রদের দেশময় ছড়িয়ে পড়া একটি অন্যতম কারণ যে দেশভাগের আগে বাঙালি সমাজে গড়ে উঠা দলিত আন্দোলন পরবর্তী দশকগুলোতে বেশ চাপা পড়ে গেছিল।

মতুয়া ধর্মান্দোলনে এখন অনেক বিভাজন। অনেকেই হতাশ হয়ে সরাসরি আম্বেদকরের শুরু করা নববৌদ্ধ ধর্মান্দোলনের দিকে ঝুঁকছেন। মতুয়াদের বড় দুই ভাগের একটি ‘শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশনে’ অধীনে পরিচালিত হয়। এর প্রধান কেন্দ্রটি এখনো বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতেই রয়েছে। গুরুচাঁদের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৌত্র শ্রীপতিপ্রসন্ন ঠাকুর পরম্পরা হয়ে মিশনের নেতৃত্ব এখন রয়েছে পদ্মনাভ ঠাকুরের হাতে। শ্রীপতি প্রসন্নের সঙ্গে বিবাদ বাঁধে অপর পৌত্র প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের। তিনি গুরুচাঁদের মৃত্যুর পরে প্রথমে রামদিয়াতে চলে এসে ১৯৪০এ মতুয়া মহাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রধান কেন্দ্র এখন রয়েছে পশ্চিম বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুর নগরে। নেতৃত্বে রয়েছেন প্রমথ রঞ্জনের স্ত্রী বীনাপাণি দেবী, যাকে মতুয়ারা ‘বড়মা’ বলে সম্মান করে থাকেন। দু’টো সংগঠনেরই এখন দেশে বিদেশে প্রচুর শাখা রয়েছে। ওড়াকান্দির মিশন গুরুচাঁদের জীবিতাবস্থাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি কতটা তাঁর ইচ্ছেতে এবং কতটা তাঁর পুত্র-পৌত্রেরা চাপ দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন সেই নিয়ে সন্দেহ আছে। মিশনের সাইটেই অসীম কুমার রায়ের একটি দলিলে লেখা আছে, “শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রস্তাবটি শুনে বলেন এটি করার সময় এখনও হয়নি।” ভারতের মতুয়া সঙ্ঘের কাজকর্ম বড়মার অনুগামীদের রাজনৈতিক সারশূন্য ‘উৎসবপ্রীতি’ নিয়ে মতুয়ারাই নানাভাবে প্রশ্ন তুলে থাকেন । বাংলাদেশের মিশনের কাজকর্ম দেখলেও মনে হয় না তাঁরা হরিচাঁদ গুরুচাঁদের আদর্শে আর ততটা টিকে আছেন। মতুয়াদের ব্রাহ্মণ্য ‘সনাতন’ ধর্মের একটি অংশে পরিণত করবার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ করেছেন। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদকে ‘ভগবান’ তুল্য মনে করছেন, ছেলের দেহে বাবার অলৈকিক নিবাসের তত্ত্বে বিশ্বাস ছড়াচ্ছেন, গুরুচাঁদকে ‘শিব’ বলে প্রচার করছেন –এইসবের পরে আর আমরা উপরে মতুয়া হরিচাঁদের যে দ্বাদশ আজ্ঞার কথা জেনে এলাম সেগুলোর কোন মানে থাকে না। মিশন নিয়ে গুরুচাঁদের উপরে পারিবারিক চাপ সৃষ্টির কথা আমরা অহেতুক বলিনি। দেখা যাচ্ছে, সমস্ত ব্রাহ্মণ্য পরম্পরার বিরোধী ব্যক্তিত্ব গুরুচাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করছেন তাঁর পুত্র পৌত্রেরা এবং সঙ্গে জুটছেন সমাজের প্রভাবশালী ভক্তেরা। অর্থাৎ নিজের পরিবার এবং সমাজের ভেতরেও ব্রাহ্মণ্য অভ্যাসের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়তে হচ্ছে নিজের আদর্শকে দাঁড় করাতে গিয়ে। যে দুর্গাপূজা হতো মূলত উঁচু বর্ণের জমিদার জোতদার সরকারি আমলাদের বাড়িতে, সেই পুজো নিজের বাড়িতে করে সামাজিক মর্যাদা বাড়াবার কথা ভাবছেন নতুন আমলাতন্ত্রের শরিক হতে উন্মুখ ছেলেরা। উঁচু বর্ণের বাড়ির পুজোতে অন্ত্যজদের প্রবেশ জুটত না, সুতরাং নিজেরা পুজো করে জবাব দেবেন এই ছিল ইচ্ছে। তার উপর শশীভূষণের চার মেয়ের পরে এক ছেলে প্রমথ রঞ্জন জন্মান। সেই আনন্দে তিনি বাড়িতে দুর্গাপুজোর অনুমতি চাইলে প্রথমে গুরুচাঁদ তা দেননি। ছেলে অনশন শুরু করলে এবং আরও নানাজনকে দিয়ে চাপে ফেললে বাবা অনুমতি দেন এবং ১৯০২তে প্রথম ওড়াকান্দির বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। কল্পতরু ভট্টাচার্য বলে এক ব্রাহ্মণ এসে সেই পুজোর দায়িত্বও নিয়ে নেন। তিনি বুঝি চণ্ডীর আদেশ পেয়েছেন স্বপ্নে। এই কথা আবার সগৌরবে লেখেন ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ প্রণেতা তারকচন্দ্র সরকার। এই ঘটনা দেখায় কোন পথে ব্রাহ্মণ্যবাদ আপসে নামে প্রতিবাদী একটি পন্থার সঙ্গে। ডাঃ মিডের সঙ্গে আলাপের পরে ক’বছর আবার বন্ধ থাকে এই পুজো। কিন্তু আবার পারিবারিক চাপ বাড়ে , “দশভূজা পূজা মোরা করি পুনরায়। , দেবী পূজা হলে তাতে সর্বশক্তি হয়।” গুরুচাঁদ , “ প্রভু বলে এই কার্য আমি না করিব।/ মরণের ভয়ে শেষে দেবতা ডাকিব।।” কিন্তু চাপের কাছে তাঁকে নতি স্বীকার করতে হয়। ১৯১৪ থেকে আবার পুজো চালু হয়। পুজোর তিনদিন তিনি বাড়িতে থাকতেন না, পুজোর কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন না।

বস্তুর সরলরৈখিক কোন আন্দোলন হতেও পারে না। সেই বৌদ্ধ ধর্মের দিন থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী সমস্ত ধর্মান্দোলন প্রয়াসেই ভারতে দেখা গেছে তাকে ভেতর থেকেও ব্রাহ্মণ্য ধারার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। এবং শেষ অব্দি ব্রাহ্মণ্যধারা তাকে গ্রাস করেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনেও দেখা গেছে নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবী রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তির প্রতিষ্ঠা করে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ‘স্বকীয়া-বৈধী’ অভিমতের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পরে তাঁর আত্মজ রামচন্দ্র সরে দাঁড়ান মায়ের থেকে। মায়ের গুরু পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করেন সৎ-পুত্র বীরভদ্র। মতুয়া ধর্মে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতেই। যে ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ গ্রন্থটিকে এখন বহু মতুয়া তাঁদের আদি ধর্মগ্রন্থ বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ এবং অনুসরণ করে থাকেন, সেটি লিখতে মানা করেছিলেন স্বয়ং হরিচাঁদই। কথাটি এই গ্রন্থেই আছে। তারক চন্দ্র সরকারকে কবি নিযুক্ত করে এই গ্রন্থটির পরিকল্পনা আসলে করেছিলেন অন্য দুই ধর্মগুরু মৃত্যঞ্জয় বিশ্বাস এবং দশরথ বিশ্বাস। তাঁরা যখন নিজেরাই খানিক লিখে হরিচাঁদকে পড়িয়ে অনুমোদন আনতে যান, তিনি মানা করে বলেন, “...লীলাগীতি লেখা এবে উচিৎ না হয়।।/ ক্ষান্ত কর লেখালেখি বাহ্য সমাচার।/ অন্তরের মাঝে রাখো আসন আমার।” একজন যথার্থ বৌদ্ধ-বাউল সহজীয়া পরম্পরার গুরুর মতো নির্দেশ ছিল। জেদ ধরেলে হরিচাঁদ উষ্মা প্রকাশ করেন এই ভাষাতে, “ মহাপ্রভু বলে জান এ কর্ম্মে পুরস্কার।/ কুষ্ঠ ব্যাধি হবে চেষ্টা করিলে আবার।” এই ঘটনাতে মৃত্যুঞ্জয়-দশরথ জুটি ভয় পাননি, বইটির অষ্টম সংস্করণের ভূমিকাতে আছে মৃত্যঞ্জয় বুঝি এই অভিশাপকে সাদরে গ্রহণ করেন, “সে তো আমার জীবনের লীলাগীতি লেখার পরম পুরস্কার।” কিন্তু কবি তারক চন্দ্র সরকার ভয় পেয়ে গেছিলেন। তিনি আধখানা লেখা পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রাখেন। পরে যখন শেষ করেন তখন এক ব্রাহ্মণ্য গল্প জুড়ে দেন, সেই পাণ্ডুলিপি বুঝি সরিয়ে ফেলেছিলেন দেবী সরস্বতী। হরিচাঁদের মৃত্যুর পরে আবার সেই সরস্বতী স্বপ্নে এসে তাঁকে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে যান, সেই সঙ্গে গ্রন্থ শেষ করবার জন্যে হরিচাঁদের ইচ্ছে জানিয়ে যান। তাতেও ‘মূঢ়মতি’ তারক খুব উৎসাহ দেখান না লেখা শেষ করতে। শেষে মৃত্যুঞ্জয়-দশরথদের সহযোগী গোলক গোঁসাই এসে জানান, “স্বপনেতে কেহ যদি পুঁথি করে দান/ সেজন পণ্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ।” আরও জানান, তারকনাথের প্রতি ব্রাহ্মণদের সমর্থন আছে, “ ইতিনায় ভট্টাচার্য পাড়া হয় গান।/ সুকবি বলে তোরে দিয়াছে আখ্যান।” এতো সবেও যখন তারকনাথ সাহসী হন না, তখন গোলক গোঁসাই এক ভোর রাতে রীতিমত নৃসিংহ রূপে এসে তারকনাথের বুকে নখ ঢুকিয়ে শাসিয়ে দিলেন, “ ...বলে তোরে নখে চিরি করি খান খান।/ নৈলে ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ পুঁথি আন।।” বোঝা যায়, ইতিমধ্যে মতুয়া ধর্মের জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে যারা আখের গোছাতে চাইছিলেন তাঁরা এর রাজনৈতিক সারবস্তুকে বিসর্জন দিয়ে একেবারেই ব্রাহ্মণ্যধারার গুরু হয়ে বসতে উদ্গ্রীব ছিলেন। তাঁরাই প্রবল চাপে এই গ্রন্থ লেখান। আজ অনেক মতুয়া ধর্মাবলম্বী বুদ্ধিজীবিরা একে ‘স্বগোষ্ঠীর প্রতি অমার্জনীয় অপরাধ বলে’ মনে করছেন। এবং নতুন করে ভাবছেন। এতো গেল ভেতর থেকে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ চাপের কথা।

কিন্তু বাইরে থেকে যে চাপ ছিল, সেটি আরও ভীষণ এবং আরও লজ্জার। হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতে বইটি ছাপার মুখ দেখেনি। তিনি মারা যান ১৯১৪তে। ১৯১৬তে বইটি ছাপান তাঁর কবিয়াল শিষ্য হরিবর সরকার। সম্প্রতি ২০১০এ ডা: মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ‘হরি-গুরুচাঁদ চেতনামঞ্চের উদ্যোগে’ ‘হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত’ নামে একটি বই লিখে বের করেছেন। সেখানে জানা যাচ্ছে, ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’প্রকাশে গুরুচাঁদেরও আপত্তি ছিল, ছেলে শশীভূষণ ঠাকুরের চাপে সম্মতি দেন। “গুরুচাঁদ সম্মুখেতে আনা হলপুঁথি ।/শশীবাবু প্রতি পাতা দেখে পাতি পাতি ।।/গুরুচাঁদে পড়ে পড়ে শুনাল এ গ্রন্থ ।/গ্রন্থের বন্দনা থেকে একেবারে অন্ত ।।/পড়া শুনে গুরুচাঁদ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস ।/কিছু কিছু ভাব তত্ত্বে হইল হতাশ ।।... লেখা যায় যাহা ইচ্ছা সাদা কাগজেতে ।/কালি লেখা কাগজেতে লেখে কিবা মতে ।।/সেই মত ভুল তত্ত্ব শেখে যদি জাতি ।/কোনদিনও কাটিবে না এ আঁধার রাতি ।।/ঠিক তত্ত্ব বুঝানো তো হবে বড় দায় ।/আমি সারা হই ভেবে সেই আশঙ্কায়।।” বইটিতে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের ‘মতুয়া’ তত্ত্ব ছিল না তা নয়, কিন্তু আদিঅন্ত ‘বৈদিক অলীক গল্পে’র মিশেল রয়েছে। তার উপর সমস্যা হলো তখন অব্দি যদিও ‘নমশূদ্র সুরিৎ’ এর মতো বহু সাময়িক কাগজ বেরুচ্ছে নানা কেন্দ্র থেকে, তারকচন্দ্রের মতো সম্মানিত কবি ছিলেন না সমাজে । সুতরাং ভবিষ্যত লেখকেরা এর থেকে সত্যিকার কাঠামো একটা দাঁড় করিয়ে দেবেন এই আশাতে গুরুচাঁদ সম্মতি দিয়ে দেন। বাপ-ছেলেতে কথা হয় এরকমঃ “শশী বলে গ্রন্থে বাবা ধোঁয়া যদি রয় ।/গুরুচাঁদ বলে অগ্নি খুঁজিবে নিশ্চয় ।।/শশী বলে থাকে থাক কিছু জল অংশ ।/গুরুচাঁদ বলে ছেঁকে খাবে রাজহংস।।” বইটির প্রকাশিকা অনিতা বিশ্বাস তারক চন্দ্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা নিয়েই লিখছেন, প্রবল দারিদ্র্যে তাঁর শৈশব কেটেছে। কবিয়াল পরিবারে জন্মেছেন। বৈদিক কথিকা পাঠ আর গান করেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার উপর নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। হরিচাঁদের সঙ্গে পরিচয়ের পরেই তাঁর মধ্যে যে বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার ছাপ রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। এই দ্বন্দ্বের জন্যেই বইটি লিখতে তাঁর এতো দ্বিধা ছিল। কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপির উপরে কলম চালাতে হয়েছিল সম্পাদক হরিবর সরকারকেও। শ্রীগোপাল বলে এক ভক্ত টাকার যোগান ধরলে হরিবর সরকার কলকাতার প্রেসে প্রেসে ঘোরেন বইটি ছাপাবার জন্যে। কিন্তু কেউই রাজি হয় না। অনেকে এর ‘বেদ-ব্রাহ্মণ সম্মত’ সংস্কার করে আনতে পরামর্শ দেন। “কোলকাতা প্রতি প্রেসে করে অনুরোধ ।/সর্বস্থানে পান তিনি সম প্রতিরোধ ।।/প্রচারে বৈদিক শাস্ত্র ছিল যে সমিতি ।/বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা সপ্তসতী স্মৃতি ।।/ইহাদের ছাড়পত্র আগে প্রয়োজন ।/তবেই করিবে প্রেস এ গ্রন্থ মুদ্রণ ।।” সমিতিটির নাম লেখেননি ডাঃ মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস । কিন্তু তাঁরা অনুমতি দেননি, “...নিষেধাজ্ঞা জারি করে গ্রন্থ ছাপিবারে ।।/চিহ্নিত করিল গ্রন্থে বহু জায়গার ।/বলে আগে এই সকলি কর সংস্কার ।।/বৌদ্ধতত্ত্ব বুদ্ধকথা না থাকে পুঁথিতে ।/অবৈদিক ভাবধারা হইবে মুছিতে ।।” বিবেকানন্দ বলছিলেন, শূদ্রদের সংস্কৃত অধ্যয়নে মানা করেছে কে! তাঁর মৃত্যুর পরেও ‘নবজাগৃত’ মহানগর কলকাতার ছাপাখানাগুলোর বাস্তবে ছিল এমনি অবস্থান। বিপাকে পড়ে হরিবর গেলেন শ্রীগোপালের সঙ্গে শলা করতে। আম ছাড়া আমসত্ব কী করে তৈরি করবেন তিনি? শ্রীগোপাল টাকা দিতে পারেন, কিন্তু তাঁরও অবদমিত সামাজিক অবস্থান বোঝা যায়, এই উক্তিতে, “পড়িয়াছি হেন ফাঁদে উপায় তো নাই ।।/কিছু কিছু জায়গায় কর সংস্কার।/দৃষ্টিমাত্রে দৃষ্ট হয় হেন দরকার।।/স্থুলের ভাবভঙ্গি রাখিও বৈদিক।/সূক্ষ্মভাবে ঠিক রেখো অবৈদিক দিক ।।/ভাবীকালে সত্য ঠিক খুঁজিবে পাঠক।/জাতি মাঝে জন্ম লবে তাত্ত্বিক রচক।।” সুতরাং যা দাঁড়ালো, “...লীলামৃতে বহুস্থান সংস্কার করে।।/অলীকের গল্প যাহা গ্রন্থে দেখা দিল।/পরিস্থিতি চাপে সব প্রক্ষিপ্ত হইল।।” এতো সব করবার পরেও যে প্রেস এক বইটি ছেপেছিল তার ম্যানেজার তাঁদের থেকে কুড়ি টাকা ঘুষ নিয়েছিল। সত্যি সত্যি শ্রীগোপাল এই সূক্ষ্মভাবে ‘অবৈদিক দিক’ ঠিক রাখার কথাগুলোই বলেছিলেন কিনা, আজ আর আমাদের জানবার উপায় নেই। কিন্তু একুশ শতকে এসেও যখন একজন নবীন ‘তাত্ত্বিক রচকে’র কলমে এই কথাগুলো পড়ি, তখন মনেতো হয়ই আমাদের ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’র বিরুদ্ধে যত ধিক্কার , ‘আলোকিত আধুনিকতা’ নিয়ে যত বড়াই কিম্বা তাত্ত্বিক কচকচানি সবই আসলে পশ্চিমা আদলে নিজেদের স্বার্থে নির্মিত এক কৃত্রিম আখ্যান। যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজন হাজার বছর আগেকার বৌদ্ধ কবিদের চর্যাপদের ভাষাকে ‘সান্ধ্যভাষা’ করে ফেলতে বাধ্য করেছিল, তার থেকে স্থানে এবং কালে খুব বেশি একটা এগোইনি আমরা। বাংলার তথা ভারতের ‘নবজাগরণে’র দর্প আমাদের মানায় না।

হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া বড় অংশটি আশা করেছিলেন বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা ইত্যাদি পূব বাংলার নমঃশূদ্র অধ্যুষিত জেলাগুলো পশ্চিম বাংলাতে চলে যাবে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রথমে শরৎ বসু, ফজলুল হকের প্রস্তাবিত ‘অখণ্ড বাংলা’র প্রস্তাবের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানের প্রস্তাবের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। দু’পক্ষই প্রবঞ্চিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানে প্রবঞ্চিত হয়ে পঞ্চাশের গণহত্যার পরে লিয়াকৎ আলি খানের মন্ত্রীসভার থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ এবং ভারতে চলে আসা মাঝেমধ্যে বেশ চর্চিত হয়। বস্তুত দু’দেশের শাসক শ্রেণিই বাধ্য করে নমশূদ্রদের বড় অংশকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসতে। এবং বাকি বর্ণহিন্দুরা যখন ভারতে নিজের ব্যবস্থা যা হোক একটা করে নিতে সমর্থ হয়েছেন নমশূদ্রদের কিন্তু বাসাবাটির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে সাগরে আন্দামান থেকে পাহাড়ে উত্তরাখণ্ড অব্দি গোটা ভারতে। অসমেও এসছেন বিশাল সংখ্যক নমঃশূদ্র মানুষ। সিলেট ভাগের সময়েই এই নমঃশূদ্রদের অবস্থান ছিল দ্বিধাজড়িত। অনেকেই সিলেট ভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এক দশক আগেও ১৯৩৭-৩৮এ সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমাতে শিমুলঘর গ্রামে বর্ণহিন্দুদের উপস্থিতিতে শুধুমাত্র জুতো পরবার অধিকার আদায়ের জন্যে এক বড়সড় লড়াইতে নামতে হয়েছিল নমঃশূদ্রদের। যা পরে হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল। সিলেট গণভোটের সময়ে তাৎক্ষণিক ভাবে পংক্তিভোজনে বসে সেই দলিতদের মন জয় করতে নেমেছিলেন বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব। সিলেট ভাগের দায় যারা এক তরফা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের উপরে চাপান তাঁরা নিজেদের এই দায়কে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করেন না। এখনো জল জমির অধিকারের সঙ্গে নাগরিক অধিকার, সংরক্ষণ এবং ভাষা সংস্কৃতির জন্যে নমঃশূদ্রদের লড়ে যেতে হচ্ছে শুধু অসমেই নয়, গোটা ভারতেই। অসমে ডি-ভোটার তাদেরকেই বেশি হতে হয়। মরিচঝাঁপির কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে নমঃশূদ্রদেরই। দেশভাগ এবং বাংলার সবচে’ বড় দলিত জনগোষ্ঠী এই নমশূদ্রদের দেশময় ছড়িয়ে পড়া একটি অন্যতম কারণ যে দেশভাগের আগে বাঙালি সমাজে গড়ে উঠা দলিত আন্দোলন পরবর্তী দশকগুলোতে বেশ চাপা পড়ে গেছিল।


তথ্যসূত্র:

১) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়; উন্নয়ন, বিভাজন ও জাতিঃ বাংলায় নমশূদ্র আন্দোলন, ১৮৭২-১৯৪৭; জাতি,বর্ণ ও বাঙালি সমাজ; সম্পাদনাঃ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিত দাশগুপ্ত; পৃঃ১২৭, ১২৯।

২) অনিতা বিশ্বাস, প্রকাশিকার কথা;"হরিচাঁদতত্ত্বামৃত";ডা: মণীন্দ্রনাথবিশ্বাস; পৃঃXIII;

৩) সমুদ্র বিশ্বাস; গ্রামবাংলার জাগরণে মতুয়া আন্দোলন; চেতনা লহর; এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০১৩ যুগ্মসংখ্যা, সম্পাদক, অনন্ত আচার্য, কলকাতা, পৃঃ ১৩৭।

৪) The Future Of India; ; Lectures from Colombo to Almora; Complete-Works ; Volume 3.

৫) Vedanta In Its Application ToIndian Life.

৬) সমুদ্র বিশ্বাস; গ্রামবাংলার জাগরণে মতুয়া আন্দোলন; চেতনা লহর;ঐ; পৃঃ ১৩৯।

৭) জয়া চ্যাটার্জী;হিন্দু ঐক্য এবং মুসলমান স্বেচ্ছাচার, বাংলা ভাগ হলো; দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; ঢাকা; পৃঃ ২২৬

৮) শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশন;

৯) শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশনের সঠিক ইতিহাস।

১০) দুলাল কৃষ্ণ বিশ্বাস; ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত’ এক ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক প্রয়াসঃ প্রসঙ্গ হরিচাঁদ ঠাকুরের নিষেধাজ্ঞা।;চেতনা লহর, এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০১৩; সম্পাদকঃঅনন্ত আচার্য; কলকাতা; পৃঃ ৮৯।

১১) Sharecropping and Sharecroppers’ Struggles in Bengal 1930 – 1950, Adrienne Cooper.

১২) বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব, প্রথম খন্ড, নিহার রঞ্জন রায়।


ধর্মক্ষেত্র সৃষ্টি -নৃপেন্দ্রনাথ ম‍ণ্ডল
May 20, 2025 | ধর্ম | views:6 | likes:0 | share: 0 | comments:0

 আসাম রাজ‍্যের এক রাখাল ছ‍েলে গিয়েছিল  মাঠে ঘাস কাটতে। দেখল একটি আইলে খুব সুন্দর ভাবে ঘাস বেঁধে আছে। সেই আলের উপরের ঘাস দেখে খুব লোভ হল। রাখাল মাত্রেই ঘাসে লোভ স্বাভাবিক। আর দেরি করে লাভ কি? ঘাস কাটতে লাগল আইলের উপর দিয়ে পাছা ছ‍্যাচড়াতে ছ‍্যাচড়াতে। রাখালের পরণে ছিল এক টুকরো সাদা থান কাপড়। লুঙ্গির বিকল্প আর কি। এই  মাঠাটি ছাড়া  ভিতরে  আন্ডার প‍্যান্ট, শর্ট প‍্যান্ট, কিছুই ছিল না। স্বভাবতই পেড়ুটা ভ‍ালো  ভাবেই আইলে ছ‍্যাচড়‍া খেতেই ছিল। রাখাল ছেলেটির পেড়ুতে ছিল‍  ঘা। স‍েই কারনেই শর্ট প‍্যান্ট বা আন্ডার প‍্যান্ট পরলে খুব জ্বালা যন্ত্রণা  করত এবং  বিশেষ অ‍সুবিধা হত। সেই ছ‍্যাচড়া খেতে থাকা পেড়ুতে  কোন এক ধরনের ঘা নিরাময় ঘাস কাটার পর নির্গত র‍স  ঠেকে ছিল। কোন গাছ গাছড়াত‍ে কোন গুনাগুন থাকে বলা যায় না। বেশিরভাগ ঔষধের উৎস লতাপাতা গাছ গাছড়া। রাখাল ছেলেটি বাড়ি এসে দেখে পেড়ুর ঘা গুলি ভ‍ালো  হয়ে গেছে। আর স‍েই কথাটা গ্রামের পাঁচটা লোককে বলার জন‍্য পেট ফুলতে থাকে। ফলত গ্রামের পাঁচটি লোকের নিকট গল্প করে ফেলল। এত্ত বড় একটা অ‍বাক ক‍র‍া ঘ‍টনা কি করেই বা গ‍ল্প ন‍া করে থাকা যায়। এতো একেবারেই অ‍বাক ক‍র‍া চ‍াক্ষুস আজ‍ব ঘ‍টনা। এই স‍ংবাদ এক দুই পাঁচ কান হয়ে গোটা গ্রামে চ‍াউর হয়ে গেল‍। গ্রামের যত্ত ম‍ানুষের পেড়ুতে ঘা ছিল‍ ঐ আইলে গিয়ে  ল‍াগল‍ পেড়ু ছ‍্যাচড়াতে। প‍্রথ‍‍ম প‍্রথ‍ম দু এক জনের পেড়ুর ঘা সত‍্যি সত‍্যিই  ভ‍াল হল‍ যত দিন পর্যন্ত ঐ আইলে ঘা নিরাময় ঘাস ছিল‍। গ্রামের মানুষ যেনো  ঔষধের একটি ক্ষেত্র খুঁজে পেল। যতই এই স‍ংবাদ চাউর হতে ল‍াগল‍ গ্রামের প‍র গ্রাম ছাড়িয়ে দূর দূর  গ্রামে গ্রামান্তরে ততোই পেড়ুতে ঘা ওয়ালা ম‍ানুগুলি ঐ আইলে পেড়ু ছ‍্যাচড়‍ানোর ধুম লেগে গেল‍। বিরাম নেই যেনো। এতই ঘা ওয়ালা ম‍ানুষ পেড়ু ছ‍্যাচড়‍াতে থাকল য‍ে আইলের ঘাস গুলি ছিলে ছিলে ঘাস উঠে আইল একেবারেই পরিস্কার  হয়ে  চিক্ক‍ন ট‍লট‍লে হয়ে গেল‍। পেড়ুতে ঘা ওয়ালা ম‍ানুষের ভিড় দিনের পর দিন উত্তর উত্তর বাড়তেই  থাকল। ঘা আর ভ‍ালো ন‍া হলেও ত‍াও  ম‍ানুষ মনের খ‍ক্কনে ঘা ভালো হবে হবে করে পেড়ু কিন্তু ছ‍্যাচড়‍াতেই থাকল‍। ভ‍ালুই বা আর হবে কি করে  য‍ে ঘাসের  ঘা ভ‍ালো হয়েছিল স‍েই ঘাসতো আর ন‍েই। দিনের প‍র দিন পেড়ু ছ‍্যাচড়‍ানোর ঠেলায় এক সময়  ঐ আইলের জায়গাটার নাম হয়ে গেল‍ো পেড়ু  ছ‍্যাচড়ার মাঠ। এই পেড়ু ছ‍্যাচড়ার মাঠ এখানে থেমে থাকল না। এখানে কিছু কিছু পয়সা কড়ি পড়তে দেখে এই আইলের দুই মালিক এই মাঠের একটি ধর্মীয় নাম দিয়ে দিল। নাম দিল পেড়ু ছ‍্যাচড়া ধর্মীয় মাঠ। এবার শুরু হল‍ো ধ‍র্মীয় হুয‍ুগ। এই আইলে মানুষ কিছু পয়সা কড়িও আরও বেশি করে ফেলতে থাকল। দুই জ‍মির আইল বালা  প‍য়সা কড়ির গন্ধ ভালো ভাবেই পেয়ে গেল। আইলের দুই মালিক যুক্তি পরামর্শ করে রোগীর  স‍মাগ‍ম ব‍াড়ানোর জন‍্য আবারও নতুন নাম করণ করল পেড়ু ছ‍্যাচড়া রোগী তীর্থ। এই স্থানের আরও গুরুত্ব বাড়ানোর জন‍্য এখানে একটা  শিবলিঙ্গও স্থাপ‍ন ক‍রল। আবারও নাম পরিবর্তন। এবারে একেবারে চমক দেওয়া নাম দিল “পেড়ু ছ‍্যাচড়া লিঙ্গ ধাম” । প্র‍ণামী দিনের  প‍র দিন আরও  বাড়তে ল‍াগল‍। তীর্থ যাত্রী আরও  ব‍াড়নোর জন‍্য প্রণামীর পয়সা দিয়ে এবং  কিছু পুঁজি লাগিয়ে ব‍ড় আকাশ চুম্বি  শিবলিঙ্গ মন্দির ‍তৈরি করে ফেলল। এবার ধর্মক্ষেত্র, ধামে পরিনত হল। আসেপাশে দোকান প‍াসার গড়ে উঠার হিড়িক লেগে গেল এবং অনেক দোকান পাট গড়ে উঠল‍। আর ঘুরে তাকানোর সময় নেই। পেড়ুতে ঘা ওয়ালা রোগীগুলি এক দিকে ডাক্তারও দেখাত আর এক দিকে এখানে পেড়ুও ছ‍্যাচড়‍তো। ডাক্তার ক‍রতো ভ‍ালো আর নাম হত এই ধামের। ম‍ানুষের ধ‍ারনা হল যে এখানে পেড়ু ছ‍্যাচড়‍িয়েছে বলেই ডাক্তার ঘা ভ‍ালো ক‍রতে পার‍ছেন । এ আর কাকে বলে ধর্মীয় হ‍ুযুগ?  এই ধামের কার্যক‍লাপ এখানেও থেমে থাকল‍না। এই আইলের দেবতার আরও বেশি গুরুত্ব  বাড়ানোর  জন‍্য চ‍ৌদ্দ হাতের কালী ম‍ূর্তি স্থাপ‍‍ন করা হল‍। এই কালীর আকাশ  ছোঁয়া মন্দিরও স্থ‍াপ‍ন হয়ে গেল‍। এই কালীর থানে ধর্মান্ধ মানুষ  একটা বা জোড়া পাঁঠা মানত করতে ল‍াগল‍। কোনও এক কৌশলী  পুরোহিত একটা নিয়ম চালু করল যে, এই মানতের পাঁঠাকে বলি দিয়ে, বলি পাঁঠার রক্ত পেড়ু ছ‍্যাচড়ানোর পর পেড়ুতে ঠেকাতে হবে। তাহলে ফল আরও ভালো হবে। এবার পূরহীতের বানী বেদ বাক্য বলে কথা। ধর্মান্ধরা পেড়ু ছ‍্যাচড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বলি পাঁঠার রক্ত পেড়ুতে ঠেকাতে  ল‍াগল‍। এই ধামের ম‍হ‍ত্ব পুরোহিতদের উপদেশ বাণী মন্ত্রবলের কথার প্রচার এখানেও থেমে থাকল‍ না। পাঁচ সাত দশ জন ধর্মভীরু শিক্ষিত স্বার্থ চরিতার্থ  পূরণকারী ম‍ানুষ এই ধামের ন‍ামের পরিবর্তন করে একটা সুম‍ধুর নতুন নামক‍র‍ণ ক‍রল। এই নামে আরও চমক দেখা দিল। ধামের নতুন নাম ক‍র‍ণ হল‍ “পেড়ুঠেকা কামলিঙ্গ ধাম”। এ ধামের নাম চারিদিকে যতই ছড়াতে থাকল ততোই এক দিকে তীর্থ যাত্রী আর এক দিকে দেশ বিদেশের সুকৌশলী লোভী কাম চরিতার্থ পূরণ কারি ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সমাগম ঘটতে থাকল। এই ধামের মন্দিরের মানতের বিষয় সর্বমনস্কামনা পূরণকারীতে পূর্ণ হল। ফলত বান্ধা, থুবড়া পড়া, বিভিন্ন ধরনের রমনীর সমাগম দিনের পর দিন বাড়তে থাকল। সেবাদাসীও জুটল প্রচুর। ফলত, এ ধাম কামুক কৌশলী পুরহীতদের স্বর্গ রাজ‍্যে পরিনত হল। এক প‍্রান্তে য‍েমন “কামাক্ষা ধাম” আর এক প্র‍ান্তে র‍মর‍মীয়  তড়তড়িয়ে “পেড়ু ঠেকা কামলিঙ্গ ধাম” ধর্মান্ধদের ধর্মান্ধতায় এবং বিশেষ কৌশলী পুরহীতদের  মহিমাতে আজও বিরাজমান।

বিবর্তনের সংসার -চন্দন পাত্র
May 20, 2025 | বিবর্তনবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সৃষ্টিকর্তা বিবর্তনবাবুর সাথে, তাঁর কর্ম-সহায়ক বিজ্ঞানবাবুর ঘনিষ্ঠতা ল্যাংটা বয়স থেকেই। দুই বন্ধুর নেশা পেশা নতুন কিছু সৃষ্টি করার। সেই উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন ‘রূপান্তর’ কর্মশালা। 

                সৃষ্টির একমাত্র ঠিকানা ‘রূপান্তর’ কর্মশালায় অভিযোজন, অভিব্যক্তি এবং সংগ্রামবাবুর তত্ত্বাবধানে সৃষ্টির কাজ চলতে থাকলো। বিবর্তনের পথে বিজ্ঞানের পাথেয় খরচ করে রূপান্তর। বারংবার বস্তু এবং পরিস্থিতির চরিত্রের রূপ, স্বভাব এবং সংলাপ বদলিয়ে নতুন নতুন জগতের নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। 


                বিবর্তনবাবুরা মহাকাশ, সৌরজগত প্রভৃতি সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকলেন না। আরও নতুন নতুন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠলেন। প্রায় পাঁচ’শ কোটি বছর  আগে, দু’জনের সৃষ্টির নেশায় শুন্য থেকে শুরু করলেন একটা একটা করে সংখ্যার পরিস্থিতি। কিন্তু কোন কিছুতেই আত্মতৃপ্তি হচ্ছিল না। একেবারে অন্যরকমের বিশেষ কিছু সৃষ্টির ভাবনায় তন্ময় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে উপলব্ধি করলেন, একটা বৃহত্তর ক্ষেত্র’র প্রয়োজনীয়তা। 


                ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য, তিনি অত্যন্ত গোপনে অসম্পূর্ণ সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রদের মধ্যে মান-অভিমানের তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। শুরু হলো ক্ষমতা জাহিরের আগ্রাসন অভিযান। আত্মঅহংকারের দাপটে একজন আরেকজনের উপর আছড়ে পড়লো। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো খণ্ড বিখণ্ড দেহ, আগুনের হল্কা, বিষাক্ত গ্যাস, উল্কা বিস্ফোরণ। তপ্ত লাভার বন্যায় ভাসছে থাকলো মহাকাশের মহা অবকাশ। চলতে থাকলো ধনী গ্রহদের শাসনে, শোষণ পর্ব। গরীব গ্রহ’দের উপর ধর্ষণ, অত্যাচার। মহাকাশের মহাশ্মশানে ঘটতে থাকলো ভয়ঙ্কর ধ্বংসাবশেষের চিত্রনাট্য।

                ‘রূপান্তর’ উত্তপ্ত লাভায় মোড়া পৃথিবী নামের গ্রহ’টাকেই নবসৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত করে। উত্তপ্ত লাভাকে ঠাণ্ডা করতে প্রয়োজন হলো, দীর্ঘ সময় আর প্রেমের স্নেহশীল কোমল পরশ।

                বিবর্তনবাবু, ‘থিয়া’ নামের সুন্দরী মমতাময়ী গ্রহটির প্রেম সুধায় পৃথিবীর তপ্ত হৃদয়ে শীতল আস্তরণ  চাপাতে চাইলেন। মহাকাশের প্রভাবশালী গ্রহদেরকে দিয়ে, উস্কানিমূলক প্ররোচনায় থিয়া’র শ্লীলতাহানি ঘটানোর পদক্ষেপ নিলেন। ইজ্জত বাঁচাতে থিয়া উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলে তৎক্ষণাৎ স্তস্ত্র থিয়াকে তিনিই বাঁচালেন, পৃথিবীর দেহে তাকে বিলীন করে। ‘থিয়া’র আলিঙ্গনে পৃথিবীর শ্বাসপ্রশ্বাস খানিকটা স্বাভাবিক হলো, কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ালো কুলীন গ্রহদের দুশমনিতে। পৃথিবীর সঙ্গে থিয়া’র ঘনিষ্ঠতার সাক্ষী এবং পৃথিবীর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে, সুদৃশ্য একটা খণ্ড’কে মেজে ঘষে তিনি পরমাসুন্দরী চাঁদ বানালেন। চাঁদ পৃথিবীর দেহে এঁকে দিল, শিল্প সাহিত্যের আদিম চুম্বন। কিশোরী পৃথিবীকে সাজাতে প্রয়োজন হলো জল, মাটি, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন,আমিষ দ্রব্য, ধাতব এবং খনিজ  ইত্যাদি উপাদানগুলোর মোলায়েম রূপ-টান।

                 কিশোরী পৃথিবীর সাজুগুজু সামগ্রী সংগ্রহে, আবার কূটনৈতিক কৌশলে মহাকাশের  প্রভাবশালী নেতা-গ্রহগুলোকে চটিয়ে বিবর্তনবাবু, দীর্ঘকাল ধরে উল্কা বৃষ্টি করালেন পৃথিবীর সারা শরীরে। রণ সাজে সজ্জিত উল্কা বাহিনী পর্যায়ক্রমে পৃথিবী আক্রমণ  করলো বীরবিক্রমে। পৃথিবীকে ধ্বংস করতে এসে উল্কা বাহিনী নিজেদেরই মৃতদেহ দিয়ে বারবার লিখে গেল  পৃথিবীর জীবনচরিত। তাতেই রূপান্তরের উদ্দশ্য সফল হলো। উল্কাদের শরীরের প্রসাধনী সামগ্রীতে লেগে থাকা বরফের অণু, আমিষের দানা, নাইট্রোজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের বিপুল যোগান, যাযাবরের নূপুর পায়ে পৃথিবীর অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবী সমৃদ্ধ হলো। 

             বরফের অণুগুলো গালিয়ে মহাসাগর বানানো হলো। তার তলদেশে আমিষ দ্রব্যের দানা খনিজপদার্থ, নাইট্রোজেন, কার্বন এবং অম্ল পদার্থগুলোকে ধাতব শৃঙ্খলে বেঁধে পাথরের খাঁজে ভরে খুব চাপ আর তাপের আওতায় পরাধীন করে রাখলেন রূপকার বিবর্তনবাবু। কোটি কোটি বছর ধরে তাদেরকে দিয়ে পরষ্পরের সাথে নিয়মিতভাবে আড়ি-ভাবের খেলায় মাতিয়ে রাখলেন। কার্যকে খাঁচা বন্দী করতে কারণের জাল বিছিয়ে দিলেন  দক্ষ শিকারী। স্বাধীনচেতা বিজ্ঞানবাবুই, বিবর্তনবাবুর এই খেয়ালীপনার নাম রেখেছেন বিবর্তনবাদ।

            

                সুদীর্ঘকাল পরে, বিজ্ঞানবাবুর রাসায়নিক হস্তক্ষেপে, সংগ্রামবাবুর অনুপ্রেরণায় পরাধীন দানাগুলো সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং অত্যন্ত ধীর গতিতে জটলা পাকাতে থাকে। হৃদয়ে তাদের অমরত্ব লাভের প্রচ্ছন্ন স্বপ্ন। কয়েক হাজার কোটি বছর ধরে স্বপ্ন জয়ের আশায় স্থবীর। বিবর্তনবাবু বুঝতে পারলেন ওদের প্রচ্ছন্ন স্বপ্নেই, তাঁর আকাঙ্ক্ষিত বাস্তব ঘুমিয়ে রয়েছে। তাকে জাগিয়ে তুলতে চাই  বহিঃশক্তির আক্রমণের করাঘাত।


                  বিবর্তনবাবু স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে আবার মহাকাশে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলেন। বৃহৎ শক্তির চাপে, ক্ষুদ্র কণাগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তাঁর স্নেহের পরশে, বিজ্ঞানবাবুর রসায়নে আসক্ত হয়ে জটলা বাঁধা স্থবীর অণুগুলো সম্বিত ফিরে পেল। চঞ্চল হয়ে একপ্রকার অস্থির কণায় রূপান্তরিত হতে থাকলো। গ্যাসীয় কণাগুলো,আমিষ দ্রব্যে দ্রবীভূত হয়ে খনিজ দ্রব্যগুলোর সাথে মিশে চারশ কোটি বছর ধরে দন্দ্ব-ঐক্যের  ধীরগতিতে পাথরের আদুল গায়ে জমে পাড়া বানিয়ে তোলে। এদিকে সূর্য সহ মহাকাশের কুলীন গ্রহগুলো, পৃথিবীর বুকে আরও অনেককাল ধরে উল্কানিক্ষেপ, ধুমকেতুর ধাক্কা এবং সূর্যরশ্মির জ্বালাময়ী ভাষণের আক্রমণ অব্যাহত রাখলো। সচল জীবাণুগুলো অভিযোজনবাবুর অনুপ্রেরণায়, বিজ্ঞানবাবুর রসায়নের রসে সিক্ত হয়ে পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে সূর্যের ভয়ঙ্কর আক্রমনাত্মক আলোক কণাগুলো’কে শোষণ করে বর্জ্য পদার্থে পরিণত করতে সক্ষম হলো। বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে পৃথিবীর আনাচে কানাচে জমা হতে থাকলো অক্সিজেনের মতো উদার পরোপকারী প্রাণবায়ু’র বিপুল সম্ভার।

                    অক্সিজেনের প্রাচুর্য নিয়ে বিবর্তনবাবুর ‘রূপান্তর’ তৎক্ষণাৎ এই  সচল দানা’গুলোকে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর এককোষী প্রানে উত্তোরণ ঘটিয়ে ফেললেন। শুরু হয়ে গেল, বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টির খসড়া রেখাচিত্র। রেখাচিত্রগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলতে ছিটাতে থাকলেন বসন্তবাহারের রঙ্গিন স্বপ্নের সুর। এই প্রভাতের আবহসংগীতে জেগে উঠল আগামীর আলোক রেণু। 


               মহাসাগরে, কোষ সৃষ্টির গবেষণাগারে কয়েক কোটি এককোষী জীবাণু নিয়ে পথচলা শুরু। গন্তব্য বহুকোষী’র গুঞ্জন মুখর রাজপথ। প্রতিনিয়ত অণু-পরমাণু আর নতুন নতুন কোষ তৈরীর সরঞ্জাম নিয়ে আজও বিবর্তনবাবু অক্লান্ত পরিশ্রমে নতুন সৃষ্টির চিন্তায় মগ্ন। ধীরে ধীরে এককোষী’র কোষাগারে বাঁধলেন বহু কোষের আকারমাত্রিক সাজসজ্জা। কোষের সাথে কোষের জমাট আলিঙ্গনে সুদৃঢ় অভিযোজন সাঁটিয়ে রঙবেরঙের হরফ লিখে চলেছেন অভিব্যক্তি নামের হিতৈষী সুধীজন। ঝুলিতে তখন  পূর্ণ-অপূর্ণ অবয়বের অনেকগুলি বহুকোষী প্রাণের নিসর্গচিত্র। বিচিত্র কোষগুলো উন্মুক্ত ‘কোষাগারের’ দেওয়ালে  জীবন্ত পাড়া বানিয়ে সংসার পেতে বসলো। তাদের উদ্যেমে সন্তুষ্ট হয়ে বিবর্তনবাবু, তাদেরকে মেরুদণ্ড প্রদান করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যে মাটিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের পাট্টা দিলেন। তাদের পরিচয়পত্রে লিখা হলো তফসিলভুক্ত বীজাণু সম্প্রদায়।


               সৃষ্টিকর্তা বিবর্তনবাবু মুক্ত মনের উত্তম’পুরুষ। মুস্কিল আসানে ওস্তাদ। ভালো চাষীও। পরিস্থিতির মস্তিষ্কে কারণ বুনে কার্য উৎপাদনে তিনি শুধু পথিক নন, পথিকৃৎ। যুগান্তরের পথে পথে নিঃস্বার্থে সৃষ্টি বিলিয়েছেন ধ্বংস কুড়িয়ে। আজও, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা সেজে বুনে চলেছেন সৃষ্টি ধ্বংসের ‘পথের পাঁচালী’।

              

              সৃষ্টির মিলনমেলায় একদিন তিনি তাঁর উন্মুক্ত গবেষণাগারে দেখতে পেলেন অস্পষ্ট ক্ষীণাঙ্গী এক স্নেহময়ী অবয়বকে। গায়ে তার মেয়েলি গন্ধ। নগ্ন অসম্পূর্ণ দেহ। গর্ভে সৃষ্টির পরাগ ধারনের অদম্য আগ্রহে আগ্রহান্বিতা। 

                   অকৃতদার বিবর্তনবাবু, সাহায্যকারিনীকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে, পরম সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন........ তুমি কে গো?

ক্ষীণ স্বরে উত্তর -  আমি প্রকৃতি।

বিবর্তনবাবু মিলনের মোহে জানতে চেয়ে ছিলেন - এমন আলুথালু বিবস্ত্র দেহ, তুমি সাজো না কেন গো?

প্রকৃতিদেবী অভাবের ভাবে উত্তর দেন - আমি, অনাথিনী, কে সাজাবে আমায়?

প্রেমাসক্ত আরক্তে বিবর্তন বলেছিলেন, আমি সাজালে, সাজবে তুমি?

দুজনের সাজগোজের কথার সাজ বাসর সাজালো।

প্রকৃতি, বিবর্তনের প্রেমে আবদ্ধ হলো। বাউলের একতারা, দোতারা হলো। যাযাবরের পায়ে উঠল বন্ধনের ঘুঙুর। বাসরঘরের একমাত্র পুরোহিত বিজ্ঞানবাবু আজও বিবর্তনের সংসারের হিত সাধনে সমান ব্যস্ত। গড়ে উঠল বিশ্বসংসার নামের বসতবাড়ি। ‘মালাচন্দনে’ ফুটে উঠল, আনন্দ আশ্রমের আশ্রয় স্থল।

            “বিবর্তন” ও “রূপান্তর” এর রূপ দিয়ে প্রকৃতিদেবীকে সুন্দর করে সাজাতে মত্ত হয়ে রইল আজীবন। নৈসর্গিক ভোগের ঐকান্তিক ত্যাগ বানাতে থাকলো সৃষ্টি সুখের উল্লাস।


              বিশ্ব-সংসারের  যাত্রাপথেই বিবর্তনবাবুরা, অহঙ্কারী পাষাণের  চূর্ণবিচূর্ণ ধ্বংসাবশেষে মাখালেন  রাগ-অনুরাগের আড়ি-ভাব। খুনসুটির কালান্তর চাপে ভুমিষ্ঠ হলো মাটি। মাটির আবহ মায়ায় বাঁধা পড়লো বিশ্বচরাচর। রজস্বলা মাটির ঋতুস্রাবে বাৎসল্য সুধার ডালি নিয়ে জেগে উঠে মধ্যবিত্ত পরিবারের সবুজ কণা। যারা সরাসরি সূর্যের আলো নিংড়ে শর্করা এবং প্রাণবায়ু তৈরিতে দক্ষ কারিগর। শর্করা আর প্রাণবায়ু বক্ষে ধারণ করে পৃথিবী হয়ে উঠল বিশ্বমাতা। 

              অধ্যায়ে অধ্যায়ে, “রূপান্তরের” আকার রহস্য জমিয়ে রেখেছে বেনামী জীবাশ্মের পাণ্ডুলিপি। পরাধীন এককোষী’র হামাগুড়ি থেকে প্রতিটি  হাঁটাচলার দলিল সযত্নে গচ্ছিত রেখেছে যুগান্তরের শিলালিপির কোঁচড়। পাণ্ডুলিপির স্বাক্ষর কিম্বা শিলালিপির অক্ষর এখনও সংশয়ের কুয়াশায় আবৃত হয়ে অপেক্ষমান।

                খেয়ালী বিবর্তন কবে চারপায়ে হাঁটা অর্ধোন্নত বনমানুষ গড়েছিলেন মনেও নেই, তাকেই  সর্বাঙ্গীন উত্তোরণ ঘটিয়ে দু’পায়ে হাঁটা স্বাধীন চিন্তাবিশিষ্ট দোসর প্রানী বানানোর তাগিদ অনুভব করলেন। প্রতিমুহূর্তের ভাঙ্গাগড়ার সৃষ্টিমূলক খেলায় যুক্ত হতে থাকলো নতুন নতুন খেলোয়াড়। অনেক ভেবেচিন্তে বারবার যোগ-বিয়োগ  ঘটিয়ে, খাইয়ে-পরিয়ে স্বাধীন বিচার বিশ্লেষণের সক্ষমতা দিয়ে গড়ে তোলে  সর্বউন্নত জীব মানুষকে। কিছু মানুষের পরিকাঠামোর অপূর্ণতার কারণে সুস্থ চিন্তাভাবনা গঠনের কার্যটি অসম্পূর্ণই থেকে গেল।তারা বনমানুষের প্রবৃত্তি নিয়ে বড় হতে থাকলো স্বার্থপর খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। বিবর্তনবাবু, সেদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এই নতুন খেলোয়াড়ই একদিন ‘রূপান্তর’এর সৃষ্টির গতিপথকে নরকের ধ্বংসাত্মক মাটিতে  নামিয়ে দেবে। 

               অতীতের নিম্নবিত্তের নগ্ন এককোষী থেকে উচ্চবিত্তের ধুতি -পাঞ্জাবি কিম্বা কোট-প্যান্টের, বহুকোষী’তে উত্তোরণের  ইতিহাস ঐতিহাসিক বর্তমান’বাবু এখনও সম্যক লিখে উঠতে পারেননি।

ঐশ্বরিক মতবাদের ধর্ম-ব্যবসায়ীদের হিংস্র আক্রমণ অব্যাহত; কারণ বিবর্তনবাদের ঝড়ে তাদের কাল্পনিক ঈশ্বর ধ্বসে যাবে। সেই ভয়ে তারা গ্যালিলিও- ব্রুনোদের নৃশংসভাবে অত্যাচার ও খুন করতেও দ্বিধা করেনি।     

                  বিশ্ব সংসার বাড়তে থাকলো। বিবর্তনের শয্যায় প্রকৃতির গর্ভে এলো তিন সন্তান। সুজন, দুর্জন আর কন্যা পরিবেশ। প্রকৃতিদেবীর স্তন পান করে বড়ো হতে থাকলো তিন ভবিষ্যৎ।

                 ধীশক্তির কর্মঠ বুদ্ধিমান সুজনদের দল বিবর্তন আর প্রকৃতির সংসারে অবৈতনিক স্বেচ্ছাশ্রমের শুভ চিন্তক সহকর্মী। বিবর্তনবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। যথার্থ দোসর হিসেবে বিশ্ব-সংসারকে পরম যত্নে  লালন-পালন করে চলেছেন আজও। সৃষ্টি, তাঁদেরকে সৃষ্টি করে আজ ধন্য। তাদের আচমনে আবাহনে বিবর্তন, প্রকৃতি আর তাঁদের সৃষ্টিতত্ত্ব অমরত্ব লাভ করে আছে।


                     সুজনদের অসতর্কতায়, বিষবৃক্ষের চারা রূপে  দুর্জন’রা ডালপালা মেলে। তাদের ফুল ফলে  কুলাঙ্গার, প্রতারক, জালিয়াতির গন্ধ ছড়ায়। সুখের সংসারে অসুখের তাণ্ডব শুরু হয়। তারা শ্রমবিমুখ এবং মুর্খ হওয়ার কারণে এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণের উত্তোরণের ইতিহাস ভ্রান্ত বলেই মনে করে। শয়তানি করেঅলৌকিক ঠগ নায়ক-নায়িকাদের ভাববাদের ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে সততার মুখোশ বেঁধে তারা সদাচারী হিতৈষী সেজে বসে। তাদের দাবি, বিশ্ব-সংসারসহ সমস্ত প্রাণীকুল জগৎগুরু প্রভু শ্রীশ্রীআমাশয়ানন্দজী মহারাজের লীলায় সৃষ্টি। তিনিই সমস্ত প্রাণীর কর্মের নিয়ন্ত্রক। প্রভুর নির্দেশেই তারা এই বিশ্ব-সংসারের দেখভালের দ্বায়িত্ব পেয়েছে। ছলেবলে কৌশলে তারা ‘রূপান্তর’ এবং ‘প্রকৃতি’র সমস্ত সম্পদ জবরদখল করে নেয়। বিজ্ঞানবাবু আজ তাদের হাতে প্রায় বন্দী। বিবর্তনবাবুর পিছু হটার উপক্রম।

প্রকৃতিদেবীর সৌন্দর্য ধ্বংসোন্মুখ। ‘পরিবেশ’এর সংসারে শান্তি বিঘ্নিত, দূষিত। ‘অভিযোজন’ বীরের নয় তদবিরের। ‘অভিব্যক্তি’ আজ ব্যাক্তি-কেন্দ্রিক। ‘সংগ্রাম’ আপোষের বশবর্তী। প্রতিবাদ বাদ পড়ে গেছে কবেই। নীতির-রাজা চরিত্র বদল করে রাজার নীতিতে পরিনত হতে বাধ্য হয়েছে। কিছু কিছু ধর্মান্ধ অনুন্নত প্রবৃত্তির মানুষ, দুর্জন মানুষগুলোর সঙ্গ নিল। ধর্মের কসাইখানায় গরু-ছাগলের মতো মানুষগুলো বিক্রি হতে থাকলো বলি হবে বলে।


                   মাত্র দশ শতাংশ দুর্জন শয়তান, নব্বই শতাংশ সুজন মানুষদেরকে বশীভূত করে  তাদের পরিশ্রমের ফসল কুক্ষিগত করতে বিশেষ ছলনার আশ্রয় নেয়। বিশ্ব সংসারকে টিকিয়ে রাখার অজুহাতে। তাদের সুবিধামতো বেশকিছু নিয়মনীতি প্রবর্তন করে। সেইসব নিয়মনীতির ক্ষমতাবলে শাসন শোষণ অত্যাচার চালাতে থাকে। দুর্জনপন্হী’রা, ছলনায় মা-প্রকৃতি’ এবং বোন-‘পরিবেশ’ এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অলংকার এমনকি ইজ্জৎও বিক্রি করে দিচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানদের শয্যায়। সততাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বিশ্ব-সংসারের ভয়ঙ্কর সঙ্কট এনে দিয়েছে। দুর্জনদের চর্চা চেতনার বিবর্তনের সৃষ্টিতত্ত্ব সত্য নয়, রূপকথা। জীবন্ত নয় মৃত।


                   প্রকৃতি,পরিবেশ, সংস্কৃতি আজ মৃত্যুশয্যায়। তাঁদের চিকিৎসা না করে লোকদেখানো আরতি বন্দনা করে, দায় এড়িয়ে যাচ্ছে দুর্জনপন্থী শয়তানরা। ভাববাদী নায়ক নায়িকারা অপকর্মের আপ্ত-সহায়ক। মনু’র সত্বে খুন হতে থাকলো মনুষ্যত্ব। মধ্যযুগের বর্বরতা কুয়াশা আচ্ছন্ন করে রেখেছে আজও। বিশ্ব-সংসার এখন যুক্তিহীন অলৌকিক কুসংস্কারের বৈঠকখানা।

বিবর্তনের সংসারে আজ সঙ্কটের আবর্তন।


মৃত্যু কী এবং কেন? -শংকর ব্রহ্ম
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“কল্পিত স্বর্গে কল্পিত সুখ আছে কিনা জানা নেই, জানবার উপায়ও নেই। তাই, প্রত্যক্ষ সুখ ছেড়ে, বিকল্প সুখের সন্ধানে দু’হাত তুলে ছোটা-এক রকম অসুখেরই লক্ষণ।” - অতীশ রায়।


মৃত্যুর কোন ব্যাখ্যা হয় বলে আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় না। যে যাই বলুক সবই তাদের অর্জিত ধারণার ফলশ্রুতি মাত্র তার বেশি কিছু নয়। ইনি বলেছেন, তিনি বলেছেন বলে, তার কথাগুলোই চিরসত্য এ’রকম ধরে নেওয়ার কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। আর কিছু দিন অপেক্ষা কর,  আমি নিজে তার স্বাদ গ্রহণ করি তারপর আসল সত্যটা তোমাদের কাছে তুলে ধরব। হা হা হা হা ... 

জীবিত কোন লোকই মৃত্যু সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না, যা বলে তা তার উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা কিংবা জীবনের অর্জিত জ্ঞানের ঝাপসা ধারণা মাত্র। আমরা সকলেই জাতকের কথা শুনি, কিন্তু কোন জাতকের পূর্ণাঙ্গ জীবনের কথা জানি না। সেটুকুই আমাদের নির্বাচিত করে জানানো হয়, যাতে আমাদের বিস্ময় আর কৌতূহল বজায় থাকে। আমার তো মনে হয়....... 


“ মৃত্যুই শেষ কথা   

                        তারপর কিছু নেই আর

এই কথা বলে এক  সেয়ানা  পাগল

      করে দিয়ে গেল সব হিসাবের গোল

যতদিন বেঁচে আছ পৃথিবী তোমার


             তারপরে কিছু স্মৃতি থাকে শুধু

আর কিছু থাকে নাকি তার?

      তাই এত জীবনের কথা বলা

                       কবিতায় গানে বারবার।

বেঁচে থাকে যারা 

তারাই তো জীবনের গান গাইতে পারে

শব তা পারে না

     অবশ্য সে কারও ধারও  ধারে না

জীবনের মতো সে তো বাধ্য নয় কারও

মৃত্যুর পরে শুধু   

                থেকে যায় কিছু স্মৃতি তারও

সব স্মৃতি

        মনে ধরে রাখা যায় নাতো কারও

কিছু স্মৃতি  থাকে জাগরুক  

               মাঝে মাঝে মনে পড়ে 

                          মনে পড়ে বার বারও।”

                                     - কবিতা মিত্র।


পূনর্জন্ম আছে বলে, মানুষ বিশ্বাস করে, মনে মনে শান্তি পায়, তাই সে বিশ্বাস করতে শুরু করে গীতার সেই বহুল প্রচলিত অমোঘ বাণী,

“ বাংসাসি জীর্ণানি যথা বিহায়,

                                   নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি

তথা শরীরণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি 

                         সংযাতি নবানি দেহী।  (গীতা - ২/২২.)


আত্মার মৃতূু হয় না, সে শুধু পুরনো খোলস বদলে অন্য খোলোশ ধারণ করে। এটা বিশ্বাস করতে তার ভাল লাগে, তার মন সায় দেয়। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। পরলোকে কি আছে বা নেই, তা নিয়ে পরমায়ু ক্ষয়ের চেয়ে, ইহলোকে কি করে পরমায়ু অবক্ষয়ের থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, সে ভাবনা অনেক বেশী ফলপ্রসূ।


মানুষের যদি পূনর্জন্ম থাকত, তবে যতগুলো মৃত্যু ততগুলি আত্মারই পূনর্জন্ম প্রাপ্তি ঘটা স্বাভাবিক, তার বেশি সম্ভব নয়,তবে ভারতের তেত্রিশ কোটি জনগণ কিভাবে একশ’তেত্রিশ কোটি হলো?

এই হিসেবটা কেউ আমায় বুঝিয়ে দিলে, আমি স্বস্তি পাব।

অনেকে হয়তো এর উত্তরে অযৌক্তিক যুক্তি দেখাতে চাইবেন, অন্যান্য প্রাণীরা মৃত্যুর পরে, পূণ্যফলে মানব আত্মা ধারণ করেন, সেটা মোটেই বিশ্বাস যোগ্য যুক্তি বলে মনে হয় না আমার।


বিষধর সাপে কাটা রুগী ওঝার বাড়ি থেকে সুস্থ হয়ে ফেরে কীভাবে? -অদিতি প্রকৃতি কন্যা
May 20, 2025 | সচেতনতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(প্রথমে বলি আমি ঠিক করে গুছিয়ে লিখতে পারি না তাই সহজ সরল ভাবে বলছি সবার বোঝার সুবিধার্থে! ভুল ত্রুটি হলে একদম ক্ষমা করবেন না! বলবেন আমি ঠিক করে নেবো যদি সঠিক প্রমান ও যুক্তি থাকে।)


আগে আমরা জেনে নিই মারণ মাত্রা বা লিথাল ডোজ কী? বিষের তীব্রতা মাপার মাপকাঠি হল median lethal dose বা LD50। এক্ষেত্রে যে সংখ্যক প্রাণীর উপর বিষ পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাদের পপুলেশনের 50% প্রাণী মরতে কতটা বিষ প্রয়োজন তা হলো LD50! এই LD50 যে সাপের যত কম,তার বিষের তীব্রতাও তত বেশি! 

 প্রত্যেক সাপের লিথাল ডোজ বা বিষের মারণ মাত্রা আলাদা আলাদা হয়!। 


এই LD50 মাপা হয় চাররকম প্রদ্ধতিতে: 

1. Subcutaneous (SC): বিষ চামড়ার নিচের চর্বি যুক্ত অংশে প্রবেশ করিয়ে।

2. Intravenous (IV): বিষ সরাসরি শিরায় প্রবেশ করিয়ে।

3. Intramuscular (IM): বিষ কোন মাংস পেশী তে প্রবেশ করিয়ে। 

4. Intraperitoneal (IP): বিষ পেটে (abdominal cavity) প্রবেশ করিয়ে। 

এর মধ্যে সর্বাধিক পরীক্ষিত প্রদ্ধতি হলো Intravenous ও subcutaneous।

subcuteneous পদ্ধতিটি সব থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং এই পদ্ধতিতে মেপেই বিষের তীব্রতা সম্পর্কে সব থেকে বেশি তথ্য পাওয়া গেছে। 

আমাদের চেনা 6-টি সাপের (subcuteneous বা SC পদ্ধতিতে) লিথাল ডোজ বা মারণবিষ হলো -

(1) কালাচ (common krait - 0.325mg/kg (SC) 

(2) গোখরো (spectacled cobra) - 0.29mg/kg (SC)

(3) কেউটে (monocled cobra) - 0.47mg/kg (SC)

(4) চন্দ্রবোড়া (russell’s viper) - 0.75mg/kg (SC)

(5) শঙ্খচুড় (king cobra) - 1.5mg/kg (SC)

(6) শাঁখামুটি (banded krait)-3.6mg/kg (SC)


এবার জেনে নিই এক কামড়ে একটা সাপ গড়ে কতটা বিষ মানুষের শরীরে ঢালতে সক্ষম।

1. শঙ্খচুড় (King Cobra) = 350-500 mg

2. কেউটে(Monocled Cobra) = 263 mg

3. গোখরো (Spectacled cobra) = 170-250 mg

4.  চন্দ্রবোড়া(Russell’s Viper) = 130-250 mg

5. শাঁখামুটি (Banded krait) =144 mg

6.কালাচ(Common krait) = 8-20 mg

অর্থাৎ এক কামড়েই অনেকটা বিষ শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারে  যা একজনের বেশি বা কয়েকজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট! তবে বিষধর সাপে কামড়ে ড্রাই বাইটের সম্ভাবনা প্রায় 50%।

কালাচ সাপের ড্রাই বাইটের সম্ভবনা খুবই কম তবে অধিকাংশ সাপ প্রায়ই dry bite বা শুকনো কামড় দেয়। সাপ অনেক সময়ই মারণ মাত্রার বিষ শরীরে ঢোকাতে ব্যর্থ হয় এবং অনেক সময় শুকনো কামড় দেয়। অর্থাৎ সাপ কামড় দেয় কিন্তু বিষ ঢালে না বা খুবই কম পরিমানে বিষ ঢালতে পারে  যাতে অল্প যন্ত্রনা ও অল্প ফোলা ও অস্বস্তি ছাড়া কিছুই হয় না! এখানে একটা প্রশ্ন আপনার মাথায় ঘুরছে যে - সাপেরা ড্রাই বাইট করে কেন? 


ওরা এটা করে কারণ ওদের বিষ শিকার করতে কাজে লাগে এবং খুব রেগে না গেলে অযথা বিষ খরচ করতে চায় না। এছাড়াও মানুষের রিফ্লেকশনের জন্য অনেক সময় ঠিক করে কামড়াতেই পারে না। যেমন পায়ে পেরেক বা কাঁটা ফুটে গেলেই সঙ্গে পা মাটি থেকে উঠে যায় ঠিক তেমনি সাপের কামড়ের ক্ষেত্রেও এমন হয়। এই ড্রাই বাইট বা শুকনো কামড় খাওয়া রুগী  24 ঘন্টা থেকে 3দিনের  মধ্যেই বিনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায়! আর এখানেই ওঝা গুনীনরা কেরামতি দেখায়!  মারণ মাত্রার বিষ শরীরের ঢুকলে বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাবে কিন্তু সাপের মারণমাত্রার  বিষ মানুষের শরীরে না ঢুকলে মানুষ সাময়িক অসুস্থ হবে কিন্তু মরবে না। 

 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওঝা গুনীনরা নির্বিষ ঘরচিতি, দাঁড়াস, হেলে সাপের কামড়ের রোগীকে গোখরো, কেউটে বা কালাচ কামড়েছে বলে দাবি করেন কারণ সাধারণ মানুষ সাপ চেনেই না। এই জন্যই গ্রামের দিকে এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও ওঝাদের বিনাপুঁজির ব্যবসা রমরমিয়ে বাড়ছেই। নির্বিষ দাঁড়াস সাপের কামড় খাওয়া রোগী ওঝার কাছে গিয়ে জানলো যে তাকে কেউটে কামড়েছে এবং ওঝা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে! ব্যাস সুস্থ হয়ে আরও হাজার মানুষের কাছে ওঝার গুণগান করতে থাকে। অথচ নির্বিষ সাপের কামড়ে  কিছুই  হয় না তা আমরা সবাই জানি। 


বিষধর সাপে কামড়ে রোগীকে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া হয় যতক্ষন না রোগী মারা যাচ্ছেন। আর নির্বিষ সাপে কামড়ের রোগী ও শুকনো কামড় বা ড্রাই বাইট এর রোগীকে বাঁচিয়ে ওঝা নাম কামায়। মানুষ ওঝাকে রক্ষাকর্তা‌ ভাবতে শুরু করে।


ওঝারা সাপের কামড়ের রুগীকে বাঁচাতে বিভিন্ন কার্যকলাপ করে থাকেন সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বলছি।

বিষ পাথর: আক্রান্ত স্থান কিছুটা চিরে বা টিপে কিছুটা রক্ত বের করে সেখানে বিষপাথর  দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। বিষ শুষে নেওয়া হয়ে গেলে পাথর আপনা আপনি পড়ে যাবে শরীর থেকে। সাধারণ মানুষের ধারণা বিষপাথর হল এমন এক পাথর যা সাপের বিষ শুষে নিতে পারে যা মূলত সাপুড়ে ও ওঝারাই সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকিয়েছে। এটি একটি উৎকৃষ্ট মানের ঢপের চপ। পৃথিবীতে কোনও পাথর নেই যা রক্ত থেকে বিষ শুষে নিতে পারে।


 কড়ি চালান: বাংলা নাগনাগিনীর অনেক সিনেমায় দেখেছেন সাপে কাটা নায়ককে বাঁচাতে ওঝা কড়ি চালান দেয়। তারপর সেই চালান দেওয়া কড়ি সাপকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে সব বিষ বার করে দেয় ও নায়ক বেঁচে যায়। শুধু সিনেমায় নয় সাপের ওঝারা এটা হামেশায় করে। নিয়মটা হলো-  বাজার থেকে তিনটি কড়ি কিনে আনতে হবে তারপর মন্ত্র পাঠ করে ঐ কড়ি তিনটিকে একটি সিঁদুররের  কৌটোয় রেখে ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হবে। এবার ঐ কড়ি-সহ সিঁদুর কৌটো কোন জলাশয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। এই রূপ করলে কিছুক্ষনেরর মধ্যেই সাপ এসে পড়বে এবং সাপের শরীরে তিন জায়গায় কড়ি আটকে থাকবে। সাপ এসে রোগীকে যেখানে দংশন করেছিলো সেখানে পুনরায় দংশন করবে এবং সমস্ত বিষ তুলে নেবে এবং সাপের শরীরে আটকে থাকা কড়ি আপনা আপনি খুলে যাবে।

আরেকভাবেও এই কড়ি চালান দেয় সেটা হচ্ছে একটি কাঁসার বাটি উল্টে তার তিনদিকে তিনটি কড়ি রেখে দেয়। তারপর ওঝা বিন বাজাতে শুরু করে সেই বিনের শব্দে কড়ি গুলি উড়ে গিয়ে সাপকে টানতে টানতে নিয়ে আসে তারপর ক্ষত স্থানে মুখ লাগিয়ে বিষ তুলে নেবে।

আদতে - দুটো পদ্ধতির কোনওটাতেই সাপ আসে না!   জলাশয়ে নিক্ষেপ করা কড়ি কখনও সাপ নিয়ে আসতে পারে না ওঝাসহ আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার অপেক্ষা করতে থাকে এই বুঝি সাপ এসে বিষ তুলে নেবে আর পরিবারের মানুষটা আগের মতো তরতাজা হয়ে উঠবে। কিন্তু হায়! তা কখনওই হয় না অপেক্ষা করতে করতে এক সময় রোগী মারা যায়। তখন ওঝা দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে বলে সাপটিকে কেউ মেরে দিয়েছে তাই কড়ি সাপটাকে আনতে পারছে না। সাপটি যদি কেউ না মারতো তাহলে নিশ্চয়ই আসতো। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বিন বাজানো সত্ত্বেও যখন কড়ি বাতাসে উড়তে পারে না বা সাপকে আনতে যেতে পারে না তখনও ওঝা বলে সাপটিকে কেউ নিশ্চয়ই মেরে দিয়েছে। 


হাত চালান: হাতে একটি শিকড় নিয়ে রোগীর আক্রান্ত স্থান থেকে মাথা পর্যন্ত বোলাতে থাকে ও মনে মনে মন্ত্র পড়তে থাকে যতক্ষণ না রোগী মারা যাচ্ছে! রোগি মারা গেলে পরিষ্কার বলে দেন একে কাল সাপে সাপে কামড়েছে বা আর 5 মিনিট আগে আনলে বেঁচে যেতো বিষ মাথায় উঠে গেছিল তাই আর পারলাম না।


ঝাড়ফুঁক: নিমপাতা নিশিন্দা পাতা দিয়ে আঁটি করে রোগীকে ঝপাং ঝপাং করে ঝাড়ায় ও মাঝে মাঝে ফুঁ দেয় ও মন্ত্র বলতে থাকে। এই সময় রোগীকে জোর করে দুধ খাওয়ায় ওঝারা কিন্তু এতে রোগীর কষ্ট আরও বেড়ে যায়। রোগী মারা গেলে সেই এক ডায়লগ দেয়, কাল সাপে কেটেছিল, সাপ মেরে দিয়েছে! আরেকটু তাড়াতাড়ি এলে বাঁচাতে পারতাম আরও বিভিন্ন কথা বলে। 


চর থাপ্পড় দিয়ে বিষ নামানো: ওঝারা এটা প্রায়ই করে থাকে। যে ব্যক্তি ওঝাকে প্ৰথম খবর দেয় যে অমুক লোককে সাপে কামড়েছে বা বিছে কামড়েছে, তখন ওঝা  মন্ত্র তিনবার পাঠ করে পাঁচবার ফুঁ দিয়ে রোগী অথবা ওই খবর আনার ব্যক্তির কাঁধে বা গালে দুম দুম, ঠাস ঠাস করে তিন বার মারে তাতে কাজ না হলে আরও অনেক প্রদ্ধতি অবলম্বন করা হয় যতক্ষন না রোগী মারা যাচ্ছেন। রোগী মারা গেলে সেই এক ডায়লগ দিয়ে ল্যাঠা চুকিয়ে দেবে! 


এখানে সমস্যা হলো অনেক ওঝা এই ধাপ্পাবাজি বা কেরামতি দেখিয়ে বহু টাকা আয় করে। এবং কিছু ওঝা আছে তারা আসলে এই ধাপ্পাবাজিটা জানে না। মানে হলো তারা এটাই জানে যে মন্ত্রে কাজ হয়। গুরুর কাজ থেকে শিখেছে বিনা পয়সায় রোগী বাঁচাতে চান কিন্তু তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে যেভাবে খেলছেন তিনি বুঝতেই পারেন না! অনেকটা আপনার মতো মানে, কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় না এটা পরীক্ষিত কিন্তু আপনি শুনেছেন বা ছোটো বেলার কোনও বইতে হয়তো পড়েছেন যে কার্বলিক অ্যাসিড বাড়িতে রাখলে সাপ আসে না। এইবার আপনি এখনও বিশ্বাস করেন যে কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় তাই বাড়িতে একটি ছোট শিশিতে কার্বলিক অ্যাসিড রেখে দিয়েছেন। কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় এই বিশ্বাসে সাপের কিছু আসে যায় না। খাবারের খোঁজে আপনার বাড়িতে সাপ ঢুকবেই তাতে আপনি কার্বলিক অ্যাসিড দিন আর না দিন। ঠিক তেমনই কোনও ওঝা যদি বিশ্বাস করেন বা দাবি করেন তার গুরুর দেওয়া শিক্ষা বা মন্ত্র কোনও সাপে কামড়ের রুগীকে বাঁচাতে পারেন তাহলে বিষের কিছু আসে যায় না। মারণবিষ শরীরে ঢুকলেই মানুষ মরবেই আর শুকনো কামড় হলে ওঝার কাছে যান আর না যান রোগী আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে!


এই বার প্রশ্ন করবেন কী করে বুঝবেন যে ড্রাই বাইট হয়েছে? ড্রাই বাইট হয়েছে কিনা বুঝতে অনেকটা সময় লাগে মানে ড্রাই বাইট হয়েছে শিওর হতে এতো সময় লাগে তাতে ভেনমাস বাইটের চিকিৎসা শুরু করা দেরি হয়ে যাবে সাপের কামড়ে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই ড্রাই বাইট না ভেনোমাস বাইট সেটা বোঝার জন্য সময় নষ্ট করা একদম যাবে না। তাহলেই বিপদ! যতদ্রুত পারেন হাসপাতালে নিয়ে যান। গ্রামের দিকে এম্বুলেন্স পরিষেবা ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। তাই বাইকের মাঝখানে রোগীকে বসিয়ে পিছন থেকে একজন রোগীকে ধরে বসবেন ও একজন বাইক চালাবেন। রোগীর সাথে কথা বলে তাকে আস্বস্ত করবেন। যেতে যেতে রোগীকে অবজার্ভ করবেন কী কী বলছে বা কী কষ্ট হচ্ছে সেটা ডাক্তার বাবুকে জানবেন। টাইট করে কিছু দিয়ে বাঁধবেন না। যদি হাতে কামড়ায় তাহলে বালা, আংটি  তাগা,  চুড়ি খুলে রাখবেন। ঘরোয়া টোটকা করবেন না, মুখ দিয়ে বিষ চুষে বার করতে যাবেন না,আক্রান্ত স্থান হাত দিয়ে ডোলবেন না, আক্রান্ত স্থান কাটবেন না বা আগুনের ছ্যাঁকা দেবেন না। মনে রাখবেন সাপের কামড়ে সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! কাছাকাছি যেকোনও সরকারি হাসপাতালে বা সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (যেখানে রাত্রে রোগী থাকে) পৌঁছান। কামড়ানোর 100 মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু হলে  রোগীকে সুস্থ হয়ে যায়। সবাইকে জানাতে ছড়িয়ে দিন অন্তত মুখে মুখে মানুষকে কুসংস্কার মুক্ত করুন। সাপের কামড়ে মৃত্যু মিছিল থামান। কোথাও ওঝার কেরামতি দেখলে থানায় খবর দিন। রোগীকে ওঝার থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।

পুনশ্চ: পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই


তথ্যসূত্র: LD50 - https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_dangerous_snakes

ধন্যবাদ- পিন্টু হালদার

ছবি - ইন্টারনেট 

ভিডিও- News18 ও বাংলাদেশ রেসকিউ টিম 

মুক্তি -প্রদীপ চক্রবর্তী
May 20, 2025 | সমাজ | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সেদিনটা ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী ২০২৩। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। হোয়াটস এপ্প - এ বার্তা পাঠালাম আজকের যুক্তিবাদী সমিতির এক অন্যতম কর্মকর্তা সন্তোষ শর্মাকে। “প্রবীরদা কেমন আছেন এখন? ওনার সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে?” বিকেল ৩ তে বেজে ৪৫ মিনিটে বার্তাটা দেখেই ফোন করলো সন্তোষ। আমাকে জানালো প্রবীরদার শরীরের অবস্থা ভালো নয়,তবু আমি যদি ওনাকে মতিঝিলের ফ্ল্যাটে দেখতে যাই,কোনও অসুবিধা হবে না। না,আমার আর যাওয়া  হয়নি। এই আফসোস আমার সারা জীবন থেকে যাবে। প্রবীরদার ৭২/৮ দেবীনিবাস রোডের ফ্ল্যাটে শেষবারের মতন গেছি; সস্ত্রীক,২০০৫ সালে। প্রবীরদার সঙ্গে পরিচয় ১৯৮৭ সালে। আমার কলেজের এক দাদা (বিশিষ্ট ম্যাজিসিয়ান তন্ময় অধিকারী) আমাকে প্রথম প্রবীরদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম দর্শনেই ওনার ‘দর্শন’ আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। যুক্তিবাদী দর্শন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার দর্শন। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম যুক্তিবাদী আন্দোলনে। দেবীনিবাস রোড, শশিভূষণ দে স্ট্রিট, ক্রিক রো প্রভৃতি স্থানের বিভিন্ন সময়ের আড্ডায়  নিয়মিত অংশ নিতাম  আমি। যুক্তিবাদীদের আড্ডা,আমার কাছে এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় ছিল। প্রবীরদার কাছ থেকেই সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লেখার হাতেখড়ি আমার। একসময় যুক্তিবাদী আন্দোলন, যুক্তিবাদী সমিতির কর্মপদ্ধতি নিয়ে বহু চিঠি, প্রবন্ধ লিখেছি আমি বাংলা সংবাদপত্রের পাতায়। প্রবীরদা প্রত্যেকটি লেখা মন দিয়ে পড়তেন এবং উৎসাহ যোগাতেন। আশির দশকের শেষাশেষি  এবং নব্বইয়ের দশকে যুক্তিবাদী আন্দোলন এক  বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল। যুক্তির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলার শহর থেকে গ্রামে,ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে।

সেই সময় বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক বড়ো অংশ যুক্তিবাদী সমিতির ডাকে সাড়া  দিয়ে, প্রবীর ঘোষের হাত শক্ত করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ড:আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, ড: বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, ড: শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা), ড: পবিত্র সরকার, ড: বিরল মল্লিক, বিক্রমণ নায়ার (সাংবাদিক), আজিজুল হক (রাজনীতিক), নারায়ণ সান্যাল (লেখক), পাঁচু  রায় (বিজ্ঞানী), কৃষ্ণা বসু (কবি) প্রমুখ। গুণীজনদের এই  নামের তালিকা লিখে শেষ করা যাবে না। প্রবীরদা একজন বড়ো নেতা, একজন দক্ষ সংগঠক এবং অসম সাহসী মানুষ। এই তিনটি গুণ-ই ওনাকে সমাজচালকের আসনে বসিয়েছিল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিভাবে একটি দলকে নেতৃত্ব দিতে হয়, তা তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। সমাজপরিবর্তনের যে কোনও আন্দোলনই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোনও মুহূর্তেই অঘটন ঘটে যেতে পারে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই। সমিতির মধ্যে থেকে সমিতিকে পিছন থেকে ছুরি মারার উদ্যোগ চলছিল। যুক্তিবাদী সমিতির জনপ্রিয়তা যতই বাড়ছিল, সেই সঙ্গে গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছিল শত্রুর সংখ্যা। জ্যোতিষী, ভন্ড গুরুবাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা যত না  শক্ত, তার থেকে বেশি কঠিন মেকি যুক্তিবাদীদের সঙ্গে লড়াই করা। ষড়যন্ত্র করে যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা  ও সাধারণ সম্পাদককে-ই সমিতি থেকে বহিস্কার  করা হয়েছিল। সমিতির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতাম, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি এই বিরাট ষড়যন্ত্রের  কথা। পরের দিন সকালের  সংবাদপত্র দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলাম প্রবীরদার বাড়ির ল্যান্ড লাইন- এ। ফোন ধরেছিলেন সীমা বৌদি। আজ-ও  স্পষ্ট মনে আছে, বৌদি ফোন ধরে হতাশামিশ্রিত ক্ষোভের সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, কী হলো  কিছুই বুঝতে পারছিনা। বুঝতে আমিও পারিনি তখন, যে, এটা একটা ষড়যন্ত্র। কারণ যাঁরা তখন সমিতির সম্পাদকমণ্ডলী, তথা পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন, তাঁরা সকলেই আমার খুব  ঘনিষ্ঠ। যাইহোক, বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে কিছুদিনের জন্য সমিতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। 


জানতাম, প্রবীরদা একদিন সসম্মানে ফিরে আসবেন। প্রবীরদা কিভাবে স্বমহিমায় ফিরে এসেছিলেন, এ’তো সকলেরই জানা। ষড়যন্ত্রকারীদের অপযুক্তি ধোপে টিকলো না, নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে আজ তাঁরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। মনে পড়ে একদিনের কথা, রবিবারের সকাল, প্রবীরদার সঙ্গে গেলাম বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক ড:  পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সল্টলেকের বাড়িতে। প্রবীরদা ওনার লেখা ‘বিশ্ব ক্যুইজ’ -এর একটি কপি সম্মানস্বরূপ দিলেন পার্থবাবুকে। প্রবীরদার সঙ্গে অনেক জ্যোতিষীর ভান্ডাফোঁড় করতে অনেক জায়গাতেই গিয়েছি, যে অভিজ্ঞতা জীবনে ভোলার নয়। বালক ব্রহ্মচারীর ‘নির্বিকল্প সমাধি’ নামক বুজরুকির ভান্ডাফোর  করতে, যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিনিধি করে সুখচর আশ্রমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন প্রবীরদা। এটা সমিতির তৎকালীন নেতৃবৃন্দের কারো কারো  পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমার উপর উনি ভরসা করেছিলেন। 


সুখচর সম্মিলনী ক্লাবের সামনে প্রবীরদার নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। এই প্রতিবাদসভার তীব্রতা জনমানসে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বালক কিস্সার পরিসমাপ্তি ঘটে। যুক্তিবাদীদের এক বড়ো জয় হয়েছিল সেদিন। আমার অভিজ্ঞতার কথা  প্রকাশিত হয়েছিল ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকায়, পরে প্রবীরদার উদ্যোগে আমার লেখাটি একটি প্রবন্ধ সংকলনেও স্থান পায় (দে’জ পাবলিশিং)। আজ এই মুহূর্তে প্রবীরদা সম্পর্কে বহু কথাই মনে পড়ছে। ভাবছি কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। কলকাতা বইমেলায় তাঁর জীবনমুখী ভূমিকা দেখেছি। সাধারণ মানুষকে লিটল ম্যাগাজিনের ছোট্ট একটা স্টলে কিভাবে আকর্ষণ করে নিয়ে আসতে হয়, তা প্রবীরদার থেকে আর কেউ ভালো জানেন বলে মনে হয় না। বইমেলায় যুক্তিবাদী সমিতি ছিল অনেকের কাছেই এক পরম আকর্ষণের বস্তু। আর যুক্তিবাদী সমিতির কাছে প্রবীরদা ছিলেন এক অভিভাবক, যাঁকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। আমি ব্যাক্তিগতভাবেও ওনার কাছে অনেকভাবে  উপকৃত হয়েছি। অনেক ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান অক্লেশে করে দিয়েছেন উনি। আজ ভারাক্রান্ত মনে সেই দিনগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছে। প্রবীর ঘোষরা নেতৃত্ব দিতেই   জন্মান, আবার যাবার সময় নেতৃত্ব তৈরী করে দিতেও জানেন। এক প্রবীর চলে গেছেন;আক্ষরিক অর্থেই। কিন্তু অনেক প্রবীর তৈরী করে দিয়ে গেছেন তিনি। তাঁর যুক্তিপূর্ণ চোখ দিয়ে এই সমাজ আলো দেখবে, তাঁর দান করা অমূল্য দেহটা দিয়ে অনেক ভাবি চিকিৎসক গবেষণা করবেন, একজন মানুষের সাফল্যের পরাকাষ্ঠা তো এটাই। প্রবীর ঘোষ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানের মশাল তিনি সঠিক এবং যোগ্য  তরুণ প্রজন্মের হাতে দিয়ে গিয়েছেন, এটাই বড়ো আশার কথা।


                   যাবার বেলায়, বিদায় বলতে নেই,

                   আমি আছি তোমাদের সঙ্গেই ------।

                   আমার দেহ টা রইলো এই সবুজ গ্রহেই,

                   আমার চোখ দিয়ে দেখো গোটা দুনিয়াটা--।

                   প্রানভরে দেখো, আর অনুভব করো,---

ওই উঠেছে স্লোগান,

                   সমাজের নিচতলা থেকে। 

                   যুক্তির শানিত বাণে খান খান করে দাও অজ্ঞতার বেড়াজাল --------। 

                   বেড়াজালের ওপারেই আছে মুক্তি,অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি।

                   প্রাণহীন অবয়বে কোরোনাকো ভক্তি, কারণ;

                   যুক্তিতেই আছে  মুক্তি, কুসংস্কার  থেকে মুক্তি। 


মনোরা পিক, নৈনিতাল (উত্তরাখন্ড)


রাজা রামমোহন রায় -রাজু দত্ত
May 20, 2025 | জীবনী | views:4 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ড. বিপান চন্দ্র বলেছেন, “Rammohan Roy was the brightest star in the Indian sky dring the first half of the 19th century.” (মডার্ণ ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা - ১২৮) 


সত্যিই তাই, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এটা ঠিক যে তিনি ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত চেতনার অধিকারী নন, কিন্তু তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি নির্ভয় ধর্মীয় কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাবজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর কাজেও সেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। 

   

কে জানত সম্ভ্রান্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ রামকান্ত রায়ের মধ্যম পত্নী তারিণীর কণিষ্ঠ পুত্রটি ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত হয়ে উঠবেন! পূর্বপুরুষ কৃষ্ণকান্ত ছিলেন রাজকর্মচারী। সেই সূত্রে তাঁদের পদবী রায় হয়। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। তাঁর এই গৃহত্যাগের পিছনে ছিল নিষ্ঠাবান পিতার সাথে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব। 


তিনি নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার নামে জনৈক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শেখেন।‌ এছাড়া তিনি ইংরেজি, গ্রীক, ফরাসি, আরবি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।‌ ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন ডিগবির সাথে পরিচিতির সুবাদে তিনি দেওয়ান পদে কর্মরত হন। কর্মসূত্রে তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। ইংরেজি ভাষায়ও বিশেষ‌ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় চলে আসেন।‌ এইবার শুরু হল তাঁর প্রকৃত লড়াই।


কলকাতার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজচন্দ্র দাস, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে রামমোহনের। এইসকল ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলেন আত্মীয় সভা (১৮১৫)। একেশ্বরবাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা গড়ে তুললেন, যা দুবছর পর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্ম সমাজ যে ধর্মমতে বিশ্বাস করতে শুরু করে তা হল ব্রাহ্ম ধর্ম।‌ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন‌ ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের সুযোগ ছিল। একেশ্বরবাদী ভাবধারা প্রসারে তিনি ফরাসি ভাষায় লেখেন তুয়াফৎ উল মুয়াহিদ্দিন গ্রন্থটি। এছাড়া ঈশ, কঠ,কেন, মন্ডুক,ও মান্ডুক্য নামক উপনিষদের অংশ বঙ্গানুবাদ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ।‌


 


ছেলেবেলায় দাদার মৃত্যুর পর মাতৃসমা প্রিয় বৌদিদির সহমরণে ব্যথিত রামমোহন প্রতিজ্ঞা করেন যে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন। এই প্রথা তিনি বন্ধ করবেনই।‌ তিনি সাধ্যমত  বল ও যুক্তিপূর্ণ তর্ক দ্বারা সহমরণে বাধা দিতে থাকেন। 


সহমরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। রক্ষণশীল সমাজ পাল্টা  ‘বিধায়ক ও নিষেধকের সম্বাদ’ রচনা করলে রামমোহন এই বিষয় আরও দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর তিনি দ্বারকানাথ-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি বড়োলাটের নিকট পেশ‌ করেন। পাল্টা  রক্ষণশীল সমাজ সহস্রাধিক ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রতিবাদ পত্র পেশ‌ করে। অবশেষে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক ১৭ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রামমোহনের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি লেখা হয় ইতিহাসে। ছেলেবেলার প্রতিজ্ঞা পূরণ করলেন তিনি।


রামমোহন গৌড়ীয় ব্যাকরণ, বেদান্তগ্রন্থের মত বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন।‌ বাংলায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ও ফরাসি ভাষায় ‘ মীরাৎ-উল-আকবর ‘ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বপক্ষে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন।‌ শুধু তাই নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত,  কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, দেশীয় পণ্যের ওপর অধিক পরিমাণে শুল্ক আরওপ, মজুরি আইন, বিচার বিভাগীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইংরেজ শাসনের সময়েও তিনি ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অসদাচরণের প্রতিবাদ জানাতে কখনও দ্বিধা করেননি। 


রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার সমর্থক। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এ দেশে গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন ও পাশ্চাত্য দর্শন শেখানোর দাবি জানান। জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন (স্কটিশ চার্চ কলেজ) হেয়ার স্কুল-সহ বেশকিছু ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠায় তাঁর পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। বেদান্ত কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল পদার্থবিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞান। 


রাজা রামমোহন রায়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোনও কোনও ঐতিহাসিক তাঁর সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্ব-বিরোধিতার অভিযোগ এনেছেন। তাদের সেই মূল্যায়ন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয়, তবে সেসবের খুব সামান্যই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। 


 রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ব্রাহ্মসমাজ। নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ রদ, অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনের পথ প্রদর্শক ছিলেন তিনি। এদেশে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও ইংরেজি শিক্ষার সূচনা তারই ঐকান্তিক উদ্যোগের ফল।

  “Rammohan Roy inaugurated the modern age in India” রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি যথার্থ। 


ধর্মমোহে আক্রান্তরা -তারক নাথ সাহা
May 20, 2025 | যুক্তিবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পৃথিবীর কোনও প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের (Religion) কোনও শিশুই ধর্মবিশ্বাস, ধর্মানুভূতি, ভাবাবেগে ইত্যাদি নিয়ে জন্ম নেয় না। এই জাতীয় অন্ধবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য দায়ী শিশুটির পরিবার, পড়িবেশ এবং সমাজের অতিবোদ্ধারা। একটা শিশু জানেই না জাতপাত কী, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ কী, হিন্দু-মুসলিমের লড়াই কেন ইত্যাদি অনেক কিছু। ক্রমশ একটি শিশু যত বড় হতে থাকে ততই শিশুর মস্তিষ্কে নানানরকম বিষয় জমা হতে থাকে। এভাবেই জন্ম নেয় তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস। যা আজকাল যখন-তখন যার তার আঘাত লাগে এবং তারজন্যে খুন পর্যন্ত করতেও দুবার ভাবে না উগ্রধর্মান্ধ বা ধর্মমোহে আক্রান্তরা। 


এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা উচিৎ, ১৮৫৬ সালের ২৬ শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিদ্যাসাগরের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল সমাজের উচ্চবর্ণের রক্ষণশীলরা। যদিও তারা সহজে নিজেরা কিছু করে না বরং অন্ধভক্তদের মগজধোলাই করে উগ্র-ধর্মান্ধ বানিয়ে তোলে। বিধবা-বিবাহের পক্ষে সই করেছিল ৯৮৭ জন এবং বিপক্ষে সই ছিল ৩৬,৭৬৩ জনের। তারপরেও বিধবা-বিবাহ আইন প্রণয়ণ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত-ই যে শেষ কথা হতে পারে না এই ঘটনাটি একদিকে যেমন তার বড় উদাহরণ। তেমনই উদাহরণ বিশাল সংখ্যক মানুষের তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেই বিদ্যাসাগর সফল হয়েছিলেন। এভাবেই সফল হয়েছিলেন রামমোহন রায়ও সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে।


তাই নির্দিধায় বলা চলে মানবসভ্যতার অগ্রগমন যেহেতু অনিবার্য তাই তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না হানলে আমজনতা চিরকালই ভাববাদ ও ভোগবাদে ডুবে থাকবে। আর যারা সারাজীবন ভজন-পূজন নিয়েই থাকে তারা কোনোদিন শোষণমুক্তির কথা কল্পনাতেও আনবে না।


সঙ্ঘ পরিবারের আসল চেহারা -অভিষেক দে
May 20, 2025 | যুক্তিবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অখণ্ড ভারত বা অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র আদতে সম্পূর্ণ ভাঁওতা। আসল কথাটি হচ্ছে অখণ্ড ব্রাহ্মণরাষ্ট্র। এই ব্যপারে The All India BAMCEF নামক সংগঠনের সভাপতি Waman Chindhuji Meshram জানিয়েছেন, “হিন্দুরাষ্ট্র মানে শাস্ত্র অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের সমস্ত জায়গায় আধিপত্য। তাই ব্রাহ্মণরা কখনওই  ‘ব্রাহ্মণরাষ্ট্র’এর দাবি করে না। একটু ঘুরিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি করে।”


যুগে-যুগে ব্রাহ্মণেরা প্রচার করেছে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বগুণসম্পন্ন। তারা সকল প্রকার দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, চাণক্য বলেছেন, ব্রাহ্মণ যে অপরাধই করুক না কেন তাকে হত্যা করা বা শারীরিক দণ্ড দেওয়া চলবে না (সূত্র- অর্থশাস্ত্র ৪/৮/৯)। রামকৃষ্ণ দেবের মতে, ব্রাহ্মণ হলেই সব দোষ মাফ (সূত্র-শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ভক্তসঙ্গে / ১৩ পরিচ্ছেদ, ১৮৮৪,১৯শে সেপ্টেম্বর)। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ছাড়া শূদ্র এবং শূদ্রের মত অন্যান্য মানুষদের বেদ পড়ার কোনও অধিকার নেই (সূত্র- গীতা ১৮/৪১ এর শঙ্করভাষ্য)। 


আজকের ব্রাহ্মণ রাষ্ট্র থুড়ি অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রের দাবীদারদের চিন্তাধারা কেমন সেটা জানতে একটু তলিয়ে দেখতে হবে আমাদের। ‘আরএসএস’ বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ড: হেডগেওয়ারের পরে এম. এস. গোলওয়ালকর আরএসএস-এর পরিচালক হন। গোলওয়ালকর ১৯৪০ সালে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর ‘আরএসএস’-এর পরিচালক এর দায়িত্ব সামলেছিলেন। 


১৯৩০-সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় দেশবাসীকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তেরঙ্গা পতাকা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে সত্যাগ্রহসহ ব্রিটিশ বিরোধী সমস্ত আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে আহ্বান জানান কে. বি. হেডগেওয়ার। আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাথুরাম বিনায়ক গডসেকে ‘খাঁটি’ দেশপ্রেমিক বলা চলে। জীবনে কোনওদিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিলেও ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজীকে হত্যা করে বিজেপির চোখে হিরো হয়ে যায়। এখন ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তার নামে হচ্ছে পাঠাগার থেকে মন্দিরও।


‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বই-এর লেখক এবং হিন্দুত্ব আইডিওলজির জনক বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে (বিরোধীদের ‘মুচলেকা ম্যান’ আখ্যা পেয়েছেন) লেখেন যে তিনি আর কোনও দিনও ব্রিটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবেন না। দেশভক্তির কী আশ্চর্য নমুনা! 


১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬০ সাল। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন আরএসএস-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এম. এস. গোলওয়ালকর। সেখানে তিনি বলেন- “আজ ক্রস-ব্রিডিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল প্রাণীদের উপর করা হয়। কিন্তু মানুষের উপর এ জাতীয় পরীক্ষা করার সাহস আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানীও দেখাননি।........যে কোনও শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।”

পরবর্তী কালে ‘আরএসএস’-এর মুখপাত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকাতে ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারী ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল। উনি আরও বলেছিলেন, “হিন্দুরা ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করে তোমাদের শক্তি খরচ না করে আসল শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান আর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করো।”











এবারে বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদের মুখ যোগী আদিত্যনাথের কথা কিছু জানাই। উনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (NCRB) তথ্যানুযায়ী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক উত্তরপ্রদেশ দলিত ও নারী নির্যাতন চরমে যার উল্লেখ প্রথমে করেছি। এনার বক্তব্য ও আচরণ দেখলে মনেই হবে না ইনি কোনও অহিংসবাদী, শান্তসৌম্য যোগী, বরং উগ্রভাবাপন্ন, ফ্যাসিবাদী একজন ভোগী বলাই শ্রেয়। অনেকে ওনাকে উত্তর কোরিয়ার কিম উন জং-এর সাথেও তুলনা করেন। কারণ, যোগী আদিত্যনাথ-এর আপন দেশে আইন কানুন বড়ই  সর্বনেশে। ০১/১০/২০২০-আনন্দবাজার অনলাইন থেকে জানা যাচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম দু’মাসে উত্তরপ্রদেশে ৮০৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের জুলাই। যোগী সরকারের বয়স তখন মাত্রই চার মাস। আগস্ট ২০২০ তে অগস্টে প্রকাশিত NCRB রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৫৯,৮৫৩। যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলার সংখ্যাই ৩,০৬৫টি। অর্থাৎ গড়ে দৈনিক প্রায় ১১ জন মহিলা ধর্ষিতা হন ওই রাজ্যে। রিপোর্ট বলছে, এদের মধ্যে ৩৪ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। ২০১১ সালে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম জাফরান যুদ্ধ - হিন্দু ধর্মের র‌্যাডিকালাইজেশন ও ঘৃণ্য বক্তৃতার মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ প্রচার করার জন্য আদিত্যনাথকে অভিযুক্ত করেছিল (“How Yogi Adityanath Made it to Where He Is” ‘The Wire’ 09/02/2019)।


বরাবরই বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছেন উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের গোরখনাথ মঠের মুখ্য পুরোহিত বা মোহন্ত যোগী আদিত্যনাথ। ছাত্রাবস্থা থেকেই এই যোগী ছিল জাতপাত ও বর্নভেদের ঘোর সমর্থক। সাথে চরমতম নারী ও মুসলিম বিদ্বেষী। মুসলিম নারী সম্পর্কে তার বিস্ফোরক মন্তব্য যা ২০১৪ সালে করেন – “কবর থেকে তুলে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষন করা হবে।” এখনও পর্যন্ত যোগীর বিরুদ্ধে ৬২ টি দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগ, ১৭ টি খুনের অভিযোগ (যার মধ্যে ৮ টি দলিত পরিবারকে খুন) রয়েছে (সূত্র- উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনিক রিপোর্ট -- ০৩/০২/১৬, দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা)। দলিতদের প্রতি আদিত্যের ভাবনা অতি ভয়ংকর। “দলিতরা দাস হয়েই জন্মেছে, তাই দাসত্ব করাই তাদের পবিত্র কর্তব্য” (সূত্র- ১৯৯৫/৮/৩ - টাইমস অফ ইন্ডিয়া, লক্ষ্ণৌ সম্মেলনের বক্তব্য)। দলিত নারী সম্পর্কে তার বক্তব্য- “দলিত নারী ধর্ষন করা পাপ নয়, কারণ তার শরীর অপবিত্র হলেও যোনি অপবিত্র নয়”(২০০১/১/১৩, গোরক্ষনাথ মঠে বসে বলেন যা বর্তমান পত্রিকায় “সন্ন্যাসাশ্রম ও আদিত্যের মানব ভাবনা” শিরোনামে প্রকাশিত)। যোগীবাবুর অনুপ্রেরণা পেয়েই হয়তো ২০২০ সালে আমরা দেখেছি মণীষা বাল্মীকির ধর্ষণকান্ড এবং প্রমাণ লোপাট করতে রাতের অন্ধকারে ধর্ষিতার দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা। 


রাজনীতিতে অংশ গ্রহন করা তথা নারী সংরক্ষন নিয়ে বিজেপি পশ্চিমি প্রভাবে নরম মনোভাব দেখাচ্ছে বলে রীতিমত খোলা চিঠি দিয়ে সাংসদ পদ আর দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। তিনি সেই খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন- “নারী আর পুরুষকে মোটেই সমান করে তৈরি করা হয়নি। মেয়েদের ঠাঁই হলো রান্ন ঘরে, পুরুষদের দেখাশুনা করার জন্য।” ২০১০ সালে যখন মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষন বিল পাশ করার কথা ওঠে, তখন তিনি বলেন- “আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে (পড়ুন মনুসংহিতা) নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি, নিয়ন্ত্রনের কথা বলা হয়েছে। মেয়েদের সত্যি সত্যি স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। এতে ওরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে সমাজ ধ্বংস করবে।” 


বিজেপির এই অখণ্ড ভারত বা হিন্দুরাষ্ট্র (পড়ুন ব্রাহ্মণ রাষ্ট্র) গঠনের তীব্র ইচ্ছে যা উচ্চবর্ণের আদেশ মেনেই সেটি করবার মূল উদ্দ্যেশ্য পুরোপ্রদেশে মনুসংহিতার শাসন লাগু করা। এই মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতিতে রয়েছে মোট ২,৭০০টি শ্লোক এবং ১২ টি অধ্যায় যা খুব মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এতে ছত্রে ছত্রে আছে নারী ও শুদ্রদের প্রতি নির্যাতন ও বিদ্বেষের স্পষ্ট সুর। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর  বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে ‘মনুস্মৃতি’ পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা যা প্রমাণ করে। বিজেপি, আরএসএস এর প্রিয় গোলওয়ালকর, সারভারকার, মোহন ভাগবত কিংবা যোগী আদিত্যনাথ এই মনুসংহিতার শাসনকেই প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। এই হিন্দুধর্মীয় আইনি শাসন গ্রন্থকে অস্ত্র করে ফের তারা সতীদাহপ্রথা, স্তনকর, বাল্যবিবাহ, নির্বিচারে দলিত হত্যা, নারীকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দী রাখা, দেবদাসী প্রথা, বিধবাবিবাহ রোধ ইত্যাদি করে মধ্যযুগ ফিরিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাই তাদের ব্রাহ্মণরাষ্ট্র থুড়ি অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র চাইই চাই। 


হিন্দুধর্মে জাতপাত এর স্রষ্টা জৈবলি, উদ্দালক ও আরুণি এবং আরুণি শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্য যাদের উত্তরসূরি সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা  হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় হাস্যকর দিক হচ্ছে হিন্দুদের চারবর্ণে বিভক্ত করবার পরে এখন মোহন ভাগবত থেকে নরেন্দ্র মোদীর গলায় শোনা যাচ্ছে- ‘সকল হিন্দু এক হও।’ যদি এক হওয়াই লক্ষ্য ছিল তাহলে ভাগাভাগি কেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেখেছি কিন্তু ভারতে জ্বলতে দেখিনি। এই মহান দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেয়নি জন্মান্তরবাদের জলকামান। যে ধর্ম একশ্রেণীর মানুষকে শ্রেষ্ঠ আর একশ্রেণীকে অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ করে রাখে সে ধর্ম, ধর্ম নয় বরং ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র। 


গণদাবী পত্রিকায় (৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮) একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়েছে। “জোর করে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ বরাবরই বিজেপি করে থাকে৷ এবার যাতে সেই অভিযোগ তুলতে না পারে সে জন্য উক্ত দলিতরা স্বেচ্ছায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ফর্ম পূরণ করে জেলাশাসকের দপ্তরে জমা দিয়েছেন৷ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, দলিত অপমানের প্রতিবাদে এই ধর্ম পরিবর্তন। অর্থাৎ দলিতদের কাছে এই ধর্মান্তর আসলে প্রতিবাদ আন্দোলনের একটা রূপ।” এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, বাবা সাহেব আম্বেদকর, ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর নাগপুরে প্রায় পাঁচ লক্ষ নিম্নবর্গীয় বা দলিত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে অক্টোবর ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের লখনৌতে যেখানে ১৫ হাজার দলিত,আদিবাসী মানুষেরা, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেছে।


পরিশেষে, অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র বা অখণ্ড ভারত কিংবা অখণ্ড ব্রাহ্মণ রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থকদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু কথা জানিয়ে লেখার ইতি টানবো। 

কট্টর ইসলামিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত ‘সুদান’ তাদের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’কে ত্যাগ করে “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র”তে পরিণত হচ্ছে। বাস্তব এটাই যে, আধুনিক পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিণতিতে পৌঁছবে, আজ, কাল কিংবা পরশু। এটাই ভবিতব্য। একটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্ম যা-ই হোক না কেন, আধুনিক পৃথিবী যেহেতু গণতন্ত্রের, ধর্মমুক্তির, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনষ্কতার। তাই কেউ যদি গায়ের অথবা গলার জোরে এসব অস্বীকার করে, তাহলে অস্তিত্ব-সংকট তারই। মোটেই গণতন্ত্র, ধর্মমুক্তি, বিজ্ঞানমনষ্কতা অথবা যুক্তিবাদের নয়। আমাদের প্রতিবেশী, ছোট্ট এবং গরিব দেশ নেপাল এই সত্য কথাগুলো অনেক আগেই বুঝেছিল বলেই বেশ কয়েক বছর আগে হিন্দুরাষ্ট্র (হ্যাঁ, পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র ছিল নেপাল) থেকে ধর্মনিরপেক্ষতায় আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতকেও একদিন এই পথেই আসতে হবে। হবেই।


বোঝা (cognition) -উল্লাসকর বন্দ্যোপাধ্যায়
May 20, 2025 | যুক্তি | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রতিদিনের কাজকর্ম করতে গিয়ে সবসময়ই আমাদের বিভিন্ন বিষয় জেনে, বুঝে নিতে হয়। এখন যদি বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখি আর এটা বুঝতে চেষ্টা করি যে আমরা কোনও বিষয় বুঝি কীকরে, তাহলে একটু গোড়ার বিষয় জেনে নিতে হবে। 

প্রথমত: আমরা যা বুঝতে চাই সেগুলোর কোনও না কোনোভাবে বস্তুগত ভিত্তি আছে। অর্থাৎ সেটা হয় নিজে বস্তু না হলে বস্তুসহযোগে উৎপন্ন। যেমন গান, কবিতা, ছবি, অঙ্ক, ঘটনা, শক্তি, বল(force), মানুষ, সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, দেশ, কাল ইত্যাদি। সবই আসলে বস্তু সম্পৃক্ত। তাই বোঝার প্রথম শর্ত হলো বোঝার বিষয়ের বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হবে। অবস্তু কিছু আমাদের বোঝার পরিসরে আসবে না, থাকবে না। এর অপর একটি কারণ অবস্তুভিত্তিক অস্তিত্ব হয় না। বিপরীতে যে কথাটা আসে তা হল আমাদের এই বিশ্বে এমন কিছু নেই তার বস্তুগত ভিত্তি নেই। তাই সম্পূর্ণ বিশ্ব তত্ত্বগতভাবে মানুষের বোধগম্যতার পরিসরের মধ্যেই পড়ে। অর্থাৎ Universe is cognitive.


দ্বিতীয়ত: বিশ্বের সমস্তকিছুই আমাদের কাছে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে তার থেকে আসা স্পন্দনের মাধ্যমে। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যখন আমরা এই স্পন্দন ধরতে পারি এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দিয়ে সেই স্পন্দন বিশ্লেষণ করতে পারি তখনই আমরা সেই বিষয়টাকে বুঝতে শুরু করি। তারপর সেই সম্পর্কে ততবেশি তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে পারি তত আমাদের বোঝা (cognition) গভীর স্তরে প্রবেশ করে। এইভাবেই আমরা সমস্তকিছু বুঝি। আরও কিছু কথা বলার আছে। যন্ত্র তেমন টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, স্টেথোস্কোপ এগুলো আসলে আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রযুক্তি নির্ভর প্রচেষ্টা। এমনকি যে স্পন্দন আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রহণ করতে পারে না সেটা ধরবার জন্য আমরা যন্ত্র বানিয়ে আমাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছি। তেমন চৌম্বকত্ব,তড়িৎক্ষেত্র প্রভৃতি। একটা বিষয় আছে যেটা নিয়ে বলতে হবে সেটা হলো কল্পনা (imagination)। কল্পনায় আমাদের মনে অনেক কিছুই আস্তে পারে কিন্তু সেটা যতক্ষণ বস্তুভিত্তিক যুক্তিকাঠামো (objective logical structure) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ তার মনে থাকলেও মগজ দিয়ে বোঝা যায় না। এ ছাড়াও বিমূর্ত গাণিতিক কাঠামো দিয়ে অনেক কিছুই আমরা ধরা বা বোঝার চেষ্টা করলেও সেই বিষয়টা অবস্তু কিছু নয়। তবে সেটাও সম্পূর্ণ রূপে বোঝা যায় পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্তের পথ ধরে। মানুষের চিন্তা,কল্পনা সবকিছুই বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। সেই কল্পনা যুক্তিকাঠামোর সবগুলো শর্ত পূরণ করলে তবে বোঝার জায়গায় আসে। আশাকরি বোঝা গেল আমরা কোনোকিছু বুঝি কী করে।

দেশবন্ধুনগর, কলকাতা-৭০০০৫৯. 


রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা -পঞ্চানন মন্ডল
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞান ছিল সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। বিজ্ঞানের মাঝে লুকিয়ে থাকা সাহিত্য সংস্কৃতিকে বারংবার চিনে নিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর জীবন দর্শনে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতা।

মাত্র সাড়ে বারো বছর বয়সে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একটি অস্বাক্ষরিত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন- ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। অনেকে বলেন যে, গ্রহগণ জীবের আবাসভূমিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনা। পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ অন্তত দু’ জায়গায় সেই কিশোর বয়সে লেখা রচনাটির উল্লেখ করেছিলেন। এই লেখার অনেক অনেক বছর পর শেষ বয়সে এসে কবিগুরু একশ’ পনেরো পৃষ্ঠার আরেকটি বিজ্ঞানভিত্তিক বই প্রকাশ করেন, ‘বিশ্বপরিচয়’। শুধু তা-ই নয়, তিনি বইখানি উৎসর্গ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার কৃতি শিক্ষক ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। 

রবীন্দ্রনাথ তার উৎসর্গপত্রে লিখলেন—

‘বয়স তখন হয়তো বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিগৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছিলুম। স্বাদ পেয়েছিলুম বলে লিখেছিলুম। জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। একজন মহাকবির সাথে এক মহাবিজ্ঞানীর দেখা হতেই হবে। যদিও বয়সের একটা বড় ব্যবধান ছিল। সেটা ১৯৩০ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঊনসত্তর বছর পেরিয়ে সত্তরে পা দিয়েছেন। আইনস্টাইনের বয়স তখন বাহান্ন। রবীন্দ্রনাথের থেকে আইনস্টাইন ১৮ বছরের ছোট ছিলেন। ১৯৩০ সালেই রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হিবার্ট বক্তৃতা দিতে গিয়ে ‘সভ্যতার সংকট’ পাঠ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে কবি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ও পারস্যে তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে যান। বার্লিনে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হবার আগে রবীন্দ্রনাথ কি আইনস্টাইনকে জানতেন? জানতেন বৈকি।


১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। এই বর্বরতার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করলেন।

১৩ এপ্রিল অমৃতসরের চারদিকে পাকা প্রাচীরের ভেতর চলছিল একটি ব্রিটিশবিরোধী সভা। বের হবার পথ ছিল একটাই। হঠাৎ ব্রিটিশ সামরিক অফিসার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য বেপয়োরা গুলি বর্ষণ করে। ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালানোর পর গুলি ফুরিয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড এমনি জঘন্য ছিল কতজন মারা গিয়েছিল তার চেয়ে দেখার ছিল কতজন বেঁচে ছিল। যাইহোক, গভর্নর জেনারেলের একজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভ্য স্যার শঙ্করণ নায়ার বার্ষিক চৌষট্টি হাজার টাকার বেতনের চাকরিতে ইস্তফা দেন; কিন্তু ‘নাইট’ খেতাব বর্জন করেননি। অথচ পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনে চাকরি ত্যাগ করার জন্য স্যার শঙ্করণ নায়ারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হলেও ‘নাইট’ ত্যাগ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। ১৯১৯ সালেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁ যখন মানুষের স্বাধীনতা বিষয়ক দলিল তৈরি করেছেন, সেই দলিলে স্বাক্ষরকারী মানুষদের মধ্যে দু’জন মানুষের নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন।














১৯০২, সালের ১০ মে বিশ্বনন্দিত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু রয়্যাল ইনস্টিটিউটে ‘যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক তাড়নায় জড়পদার্থের সাড়া’ বিষয়ক গবেষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। তার দশদিন আগে ১ মে তারিখে রবীন্দ্রনাথকে লন্ডন থেকে জগদীশচন্দ্র লিখলেন -

‘তুমি তো এতদিন নির্জ্জনে সাধনা করিয়াছ, বলিতে পার কী, কী করিলে সুখদুঃখের অতীত হইতে পারা যায়? একদিন ভারতে সুদিন আসবেই, কিন্তু একথা সর্বদা মনে থাকে না। ইহা যে সত্য একথা আমার মনে মুদ্রিত করিয়া দাও। একটা আশা না থাকিলে আমার শক্তি চলিয়া যায়।’

১০ মে বিলেতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। দু’দিন আগে ৮ মে তাঁর মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় নিচের চিঠিতে -

‘আমি যে কি কষ্টের ভেতর দিয়া যাইতেছি তুমি জানিবে না। তোমরা নিরাশ হইবে একথা মনে করিয়া আমি এখানে কিরূপ বাধা পাইতেছি তা জানাই নাই।... এই যে গত বৎসর মে মাসে যে আবিষ্কার সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম……। আমার সেই আবিষ্কার চুরি করিয়া ... নভেম্বর মাসে এক কাগজে বাহির করিয়াছে!’

আসলে লিনিয়ান সোসাইটির কাউন্সিল সভায় যখন ঠিক হয় যে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্রটি ছাপা হবে, তখন বিজ্ঞানী এর বন্ধু বিজ্ঞানীরা কাউন্সিল সভায় জানান যে, এমন কাজ নাকি একজন গত নভেম্বরে প্রকাশ করেছেন। এ কাজের আর কোন গুরুত্ব নেই। জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্রটি তাই মুদ্রণের জন্য বিবেচিত হতে পারে না।

একসময় কথাটা জগদীশচন্দ্রের কানে যায়। জগদীশচন্দ্র সব জানিয়ে লিনিয়ান সোসাইটির সভাপতিকে চিঠি লেখেন। সভাপতি তাঁকে একসময় জানান, ভুল বুঝতে পেরেছেন ওঁরা।

তখনই জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন -

‘.... ভাঙিয়া গেলে আর কি থাকে। এতদিন এদেশের বিজ্ঞানসভায় অনেক বিশ্বাস করিয়াছি_ তাহা দূর করিয়া লাভ কি? অধিক দিন থাকিতে পারিলে আমি একাই বূহ্য ভেদ করিতাম_ কিন্তু আমার মন ভাঙিয়া গিয়াছে।’

১ মে জগদীশচন্দ্র লিখছেন, ‘একটা আশা না থাকিলে আমার শক্তি চলিয়া যায়। ৮ মে লিখছেন, ‘... আমার মন ভাঙিয়া গিয়াছে।’

বিজ্ঞানীর এই মানসিক বিষণ্নতা অনুভব করে রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে বারবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর প্রতিভা যে ব্যতিক্রমী, একথা কবি তাঁকে অনেকবার নানাভাবে বুঝিয়েছেন।

জগদীশচন্দ্র প্রতুত্তরে লিখছেন, ‘তুমি কি মনে কর যে আমি এক কেষ্টবিষ্টু হইয়াছি। গলায় পাথর বান্ধিয়া জলে ফেলিলে ভাসিয়া উঠিব?’ (৩০ মে, ১৯০২)।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে জগদীশচন্দ্রকে বারবার উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। আর স্বদেশে তাঁর কাজের বিষয়ে, তাঁর সাহসী লড়াইয়ের বিষয়ে নিবন্ধ রচনা করা উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন। সেই বিবেচনাবোধ থেকেই ‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা’ রচিত হয়েছে।


আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুখোমুখি পরিচয় হয় ১৯২৬ সালে। কবি তখন দ্বিতীয়বার জার্মানি গিয়েছেন। হিটলারের উত্থান তখনও স্পষ্ট হয়নি। কী আলোচনা হয়েছে দু’জনের সে সময়, কোন লেখাপত্র বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের মনে যে শ্রদ্ধার রেখা টেনেছিলেন, ১৯২৬ সালে লেখা আইনস্টাইনের একটি চিঠি থেকে সে প্রমাণ পাওয়া যায়। চিঠির তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬। ছোট্ট চিঠি, দু’একটি লাইন উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

মাননীয় আচার্য,

... আপনাকে স্বচক্ষে দেখে আসতে না পারার জন্য দুঃখিত। শুনেছি আপনার উপর প্রচুর ধকল গেছে। তাই ভিড় বাড়িয়ে আপনার বিশ্রাম এবং শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। জার্মানিতে যদি এমন কিছু থাকে যা আপনি চান এবং যা আমি করতে পারি, দয়া করে, যখন খুশি আমায় আদেশ করবেন।”

আইনস্টাইন ১৯২৬ সালে অপরিচিত কেউ নন। নোবেল জয় করেছেন পাঁচবছর আগে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর এমন নিবেদন আমাদের অন্য একটি ঘটনার কথাও মনে করিয়ে দেয়। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের যে বিখ্যাত গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল তাঁর জন্য আইনস্টাইনের ভূমিকা কী ছিল আমরা জানি। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অপরিচিত যুবক। তিনি আইনস্টাইনকে গভীর বিনয়ী চিঠি লিখতেই পারেন। আইনস্টাইনের লেখা রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চিঠি আমাদের আইনস্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। রবীন্দ্র প্রতিভার বিশ্বজনীনতাকে বুঝতে সহায়তা করে।

আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের দিনটি ছিল ১৪ জুলাই, ১৯৩০। বিশ্বের বহু সংবাদপত্রে তার সবিস্তার বিবরণী বেরিয়েছিল। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’-এ সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই বইয়ে আইনস্টাইন নিজে রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি লেখাও দিয়েছিলেন। ১৪ জুলাই বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা বিষয় নিয়ে দু’জনের কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি আলোচনায় ঈশ্বর প্রসঙ্গও এসেছে। আইনস্টাইন তখন বার্লিন থেকে খানিকটা দূরে কাপুথ নামে একটা ছোট্ট শহরে থাকতেন। আইনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ যান। দু’জনের বেশ খানিকটা সময় ধরেই কথা হয়। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর বইতে লিখেছেন-’কোথাও কি তাঁদের মিল ছিল না? অবশ্যই ছিল। দু’জনেই আদর্শবাদী ছিলেন। দু’জনেরই প্রবল বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার অধিকার। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সেই বিপন্ন সময়ে দু’জনেই বিশ্বশান্তির সপক্ষে কাজ করেছিলেন এবং সে-বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির প্রবল প্রতাপ সম্বন্ধে দুজনেই প্রতিকূল ছিলেন। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক দিয়ে তাঁদের মনে মিল ছিল।’

১৪ জুলাইয়ের পর ১৯৩০ সালে আরও তিনবার দু’জনের দেখা হয়। ১৯ আগস্ট বার্লিনে দেখা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষে আবার বার্লিনে দেখা হয়। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিউইয়র্কে দেখা হয়। দু’জন বড় মাপের মানুষ এক বছরে চারবার পরস্পর মিলিত হচ্ছেন, হৃদমাঝারে কোন আত্মীয়তা না থাকলে তা কখনও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে না।

ওই সময় ১৯ আগস্ট কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। একটু বিষয় বদলে যায়। আইনস্টাইন প্রথম ক’বছর কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। সে কথার ইঙ্গিত আমরা আগে রেখেছি। কথায় কথায় সঙ্গীত প্রসঙ্গ চলে এল। পুবের সঙ্গীত ও পশ্চিমের সঙ্গীত নিয়ে কথা হলো। রবীন্দ্রনাথ বললেন, পাশ্চাত্যে স্বরলিপি কঠোরভাবে মানতে হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি থাকলেও শিল্পীদের স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে সঙ্গীতকে ‘শিল্প’ করে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় সঙ্গীতে বাণীর প্রাধান্য কেমন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, উত্তর ভারতে কম, বাংলায় বেশি। কতটা বাদ্যযন্ত্র থাকে, জানতে চাইলেন আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের উত্তর ছিল, পশ্চিমি গানের ‘হারমনি’ তৈরির জন্য নয়। তাল ও মাত্রা ঠিক রাখার জন্য বাদ্যানুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অন্যতম মেধাবী ছাত্র ছিলেন প্রমথনাথ সেনগুপ্ত। বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা ‘বিশ্বপরিচয়’ এর সাথে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ একবার প্রমথনাথকে বলেছিলেন - ‘শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেও না, এখানে তোমার প্রয়োজন আছে... যেদিন দেখবে এখানে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, শিক্ষার চেয়ে শাসনযন্ত্রটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে, সেদিন তুমি চলে যেও।’

সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের গ্রন্থ লিখতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, ‘এই পুণ্যকাজে আমার আশীবার্দ রইল।’ (আনন্দরূপম পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪)

এখানে আমাদের আলোচনার বিশেষ সুযোগ নেই। তবু মনে রাখতে হয়, শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানকে তাঁর ভাবনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয় করে তুলেছিলেন। আগেই বলেছি, ছিয়াত্তর বছর বয়সে ‘বিশ্বপরিচয়’-এর পাণ্ডলিপি প্রস্তুত করেছেন তিনি। জীবন সায়াহ্নে তাঁর ‘তিন সঙ্গী’ গল্পগ্রন্থ, যা ‘রবিবার’, ‘শেষ কথা’ ও ‘ল্যাবরেটরি’ নামের তিন বিখ্যাত ছোট গল্পের সংকলন, সেখানেও তিনি বিজ্ঞান চিন্তাকেই গল্প তিনটির মূল ভাবনা হিসাবে পেশ করেছেন। তিন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রেরা সকলে জীবিকাসূত্রে ‘বিজ্ঞান’ নির্বাচন করেছিলেন। গল্পের শেষে দেখা যায়, তারা সকলেই অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের জালে বাঁধা পড়ে আছেন। ‘সমগ্র’ বিজ্ঞানকে অনুভব করার কথা বলতেন তিনি। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে তথ্যের প্রাচুর্য থাকলেও এই ভাবনাকেই তিনি চূড়ান্ত রূপ দিতে চেয়েছেন। আমরা বলব, সার্থক হয়েছে তাঁর এই চাওয়া।

তাঁর বিজ্ঞানশিক্ষা বা বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস যাই হোক, এটা সত্যি এক অভাবিত বিজ্ঞানবোধ তাঁর মনন ও কল্পনা উভয়কেই আচ্ছন্ন করেছিল। তার একটি উপাদান হলো এই বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা। খুব অল্পবয়সেই এই অস্তিত্বের বিশাল পরিসর সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বুঝে উদ্ভাসিত হয়ে ‘আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ’ সম্বন্ধে তার একটি বোধ তৈরি হয়েছিল। এই বোধ তার কবিত্বকে সমৃদ্ধ করেছে, কারণ এর উৎস বিজ্ঞান হলেও এর মধ্যে জন্ম দিয়েছে এমন এক বিস্ময়, তাই বলেছিলেন -

‘তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ..


(বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংকলন করে লেখা)

(আমার কণ্ঠস্বর বা বাচনভঙ্গি কোনোটাই ভালো নয়। তবুও এই প্রথম লেখা পাঠ করলাম। ভুলত্রুটি নিজগুণে ক্ষমা করবেন।)

https://youtu.be/5UlYa2N2As4


ফাঁকাতন্ত্র -মোশাররফ হোসেন মুসা
May 20, 2025 | ধর্ম | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি নামে কয়েক প্রকার তন্ত্রের কথা আমরা জানি। এগুলোর পাশাপশি ‘ফাঁকাতন্ত্র’ নামে আরও একটি ‘তন্ত্র’ থাকা উচিত বলে মনে করি। রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। সামন্ততন্ত্র হলো ভূস্বামীদের তন্ত্র। ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষাসহ তাদের আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে এ তন্ত্র পরিচালিত হয়। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রই সব। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রকে জনগণের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের একমাত্র বিধাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- জনগণকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করে যে শাষণ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, তাকেই গণতন্ত্র বলে। যে তন্ত্র আমলাদের ইচ্ছায় পরিচালিত হয় কিংবা তাদের রচিত বিধি- উপবিধি দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে আমলাতন্ত্র বলে। পাশাপাশি ফাঁকাতন্ত্র সম্পর্কে বলা যায়-যে তন্ত্র ফাঁকা  বিশ্বাসকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করে আবর্তিত হয় তাকে ফাঁকাতন্ত্র বলে। 

জর্জ বার্নাড শ বলেছেন- ‘যাদের ঈশ্বর আকাশে থাকে, তাদের থেকে সাবধান থেকো’। আকাশ হলো ফাঁকা জায়গা। 

মাদার তেরেসা বলেছেন- ‘তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালোবাসতে না পারো, তবে অদৃশ্য ঈশ্বরকে কীভাবে ভালোবাসবে!’

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৫০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি হলেও মাত্র ২০ লাখ বছর আগে মনুষ্য জীবের জন্ম। তারা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে আরও বলে থাকেন- ‘প্রচলিত ধর্মগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তি ঘটেছে খ্রীষ্টপূর্ব ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫শ সালের মধ্যে। ঐশিবাণী প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে খ্রীষ্টধর্মের অনুসারীরা সর্বপ্রথম রাজনীতিকে ধর্মের অধীনস্থ করেন। ধর্মে উল্লেখ আছে, ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করায় মনুষ্য জীবের আদি পিতা মাতাকে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। পৃথিবী হল পাপীদের স্থান। বিধায়, পাপীদের দ্বারা নির্বাচিত কোনও প্রতিনিধি কিংবা তাদের রচিত কোন মতবাদ মনুষ্য জীবকে শুদ্ধ করতে পারে না। শুদ্ধতম রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি পেতে হলে প্রেরিত পুরুষ কিংবা তাঁদের নির্দেশিত নীতির অধীনে থাকতে হবে। শুরু হয় যাজকদের শাসন। রাজা গীর্জার অধীনে থেকে শাসন কার্য চালাতেন। উৎপত্তি ঘটে এক তরবারির তত্ত্বের। 


বলা হয়, ঈশ্বর পরলোক ও ইহলোকের  মুক্তির  জন্য  এক তরবারি  দিয়ে  যাজকদের  প্রেরণ   করেছেন । কিন্তু  প্রগতির  পিছনে  থাকে  সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অস্বীকৃতির  প্রবণতা। ফলে যাজকদের হাতে প্রগতিপন্থীরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে থাকেন। এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে সৃষ্টি হয় রেঁনেসাসের  (রেঁনেসার শাব্দিক অর্থ পুনর্জীবন কিংবা নবজাগরণ। এর সংজ্ঞায় বলা আছে - চৌদ্দ, পনের, ও ষোল শতকে ইউরোপ জুড়ে খ্রীষ্টপূর্ব গ্রীকের বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলার উপর ভিত্তি করে যে জাগরণের সৃষ্টি ঘটে তাই রেঁনেসা)। ফলে রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করার বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু বাস্তবে খ্রীষ্টপূর্ব  জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে মধ্যযুগের ধর্মবাদের সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। সে সময় প্রতিবাদকারীরা (Protestant) বলা শুরু করেন- যাজকরা বাইবেলের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ঈশ্বরকে উর্দ্ধাকাশে রেখে দিয়েছেন। আসলে ঈশ্বর রয়েছেন মনুষ্যলোকে। সকল সৃষ্টির মাঝেই ঈশ্বর বিরাজমান রয়েছে। ঈশ্বরকে পেতে হলে তার সৃষ্টির কল্যাণ করতে হবে। জনৈক মিশনারী প্রধান বলেছেন- ‘আমি যখন এক জন দুস্থকে সেবা করি, তখন মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বরকেই সেবা করছি’। তাঁরা ঈশ্বরপ্রাপ্তির আশায় এভাবে লক্ষ্য আর মাধ্যমের পরিবর্তন আনেন। সে সময় সৃষ্টি ঘটে দুই তরবারি তত্ত্বেরও। বলা হয় যাজকের কাজ  হলো পারলৌকিক জীবনের মুক্তি খোঁজা এবং রাজনীতিবিদদের কাজ হলো ইহলৌকিক সমস্যার সমাধান বের করা। সে হিসাবে রেনেসাসের অর্থ হওয়া উচিত ‘নবজাগরণ’। 


তবে কিছু ধর্মের লোকেরা রেঁনেসাসকে অস্বীকার করে বলতে থাকেন- ‘তাদের ধর্মে লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌছানোর পথ উভয়ই নির্দিষ্ট করা আছে। তারাই কেবল বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ ধর্মের অনুসারী। লক্ষ্য আর মাধ্যমের সামান্যতম সংস্কার বরদাস্ত করা হবে না’। এভাবে তারা বৃত্তাবদ্ধ চেতনা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকিও দিয়ে থাকে মাঝে মধ্যে। তাঁরা বিশ্বাসের আলোকে বাস্তবতাকে বলদাতে না পেরে যুগে যগে আহাজারী করে থাকে। তাঁরা ভুলে যান যে- ‘পরিবর্তন’ শব্দটি ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। মজার বিষয় হলো বিলম্বে হলেও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো গ্রহণ করে। তবে রেঁনেসার প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁরা আগের মত বলে থাকেন-’পার্থিব জগৎ ক্ষণস্থায়ী। পারলৌকিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী। প্রকৃত ঈশ্বর বিশ্বাসীরা কখনও পার্থিব জগৎকে জয়ের চিন্তায় মশগুল থাকতে পারে না’। 

অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক (বিশিষ্ট আধ্যাত্মবাদী নেতা) এ প্রসঙ্গে বলেন-’মানুষ পৃথিবীতে ফাঁকা হাতে আসে এবং ফাঁকা হাতে চলে যায় বটে; কিন্তু পৃথিবীতে সে পূর্বসুরীর অর্জনকে ধারণ করে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে’। 

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক। পাবনা, বাংলাদেশ।


মানুষের একজোড়া ক্রোমোজোম কোথায় হারিয়ে গেল? -নির্মাল্য দাশগুপ্ত
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা জানি, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বেবুন, ওরাংওটাং, মানুষ এদের সবার একজন সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যার থেকে বিভিন্ন সময়ে বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন বানর প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর ধরে। শিম্পাঞ্জি আর মানুষ আলাদা হয়ে যায় ষাট লক্ষ বছর আগে। এই বিবর্তনের পাথুরে প্রমাণ হল, শিম্পাঞ্জি আর মানুষের ডিএনএ ক্রম ৯৯% হবহু এক।

কিন্তু ৯৯% জিনোমক্রম হবহু মিলে গেলেও, মানুষের সাথে কিন্তু শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বেবুন, ওরাংওটাং এদের ক্রোমোজোম সংখ্যার কিন্তু পার্থক্য আছে। মানুষের আছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম, আর এসব বানর প্রজাতির ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৪ জোড়া।


এবার যাঁরা বিবর্তনে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা হইহই করে উঠবেন, বানরের বিবর্তনেই যদি মানুষের সৃষ্টি, তবে একজোড়া ক্রোমোজোম গেল কোথায়? এজন্য বলি বিবর্তন ভুয়ো।

সত্যিই তো! “পক্ষীরাজ যদি হবে, তাহলে ন্যাজ নেই কেন?” কিন্তু এখানেই মজা বিবর্তনের আর আণবিক জীববিদ্যার। বিবর্তনের কোন এক বাঁকে মানুষের ক্ষেত্রে দুটো ক্রোমোজোম জুড়ে গিয়েছিল। আমাদের ২ নম্বর ক্রোমোজোমটি হল সেই জোড়া ক্রোমোজোম। এবার ইহা যে সত্য, তার প্রমাণ কি? প্রমাণ ছাড়া কি বিজ্ঞান হয়? হয়না! তাহলে দেখা যাক কি ভাবে এই জুড়ে যাবার প্রমাণ পাওয়া গেল।


ক্রোমোজোমের থাকে সেন্ট্রমিয়ার (Centromere) বলে একটি অংশ, যা কোষ বিভাজনের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আর ক্রোমোজোমের দুপ্রান্তে থাকে টুপির মত টেলোমিয়ার (Telomere) অংশ। এবার দুটি ক্রোমোজোম জুড়লে দুপ্রান্তের টোলোমিয়ার নিশ্চয় মাঝে দেখা যাবে, আর একটার জায়গায় দুটো সেন্ট্রোমিয়ার অঞ্চল। তাইতো?

আমাদের ক্রমোজোম ২ এ কিন্তু ঠিক তাই থাকে। ক্রোমোজোমের দুপ্রান্তের সাথে মাঝেও থাকে টেলোমিয়ার অঞ্চল, আর থাকে দুটি সেন্ট্রমিয়ার অঞ্চল। এই দুটির মধ্যে একটি অবশ্য নিষ্ক্রিয়। প্রদত্ত ছবিতে দেখুন, আরও স্পষ্ট হবে ব্যাপারটা।

তাহলে প্রমাণিত হল, মানুষের ক্ষেত্রে আদি বানরের দুটো ক্রোমোজোম জুড়ে গিয়েছিল বলে মানুষের ক্রোমোজোম এক জোড়া কম। আর এভাবেই আরেকবার প্রমাণ হল, শিম্পাঞ্জি বা অন্যান্য বানরেরা ও মানুষ একই আদিম বানর পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে।

বিঃদ্রঃ- এসব বহুল প্রচারিত সাধারণ তথ্য। তাই আর নির্দিষ্ট কোন সূত্র দিলাম না। বিস্তারিত জানতে গুগলে “chimpamzee 24 chromosomes” বা “chromosome 2 mystry” search দিলেই অনেক নির্ভরযোগ্য সূত্র পাবেন।


মনুর চোখে নারী – হিন্দু ধর্মে নারীর দুরবস্থা -অজিত কেশকম্বলী
May 20, 2025 | মুক্তমনা | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“বিশ্বের যা কিছু মহান, যা চিরকল্যানকর।

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

-কাজী নজরুল ইসলাম


এই মূল্যবোধ আধুনিক কবির থাকলেও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবক্তা মনুর কিঞ্চিতও ছিল না। ছিল না বলেই শূদ্রের পাশাপাশি, সকল বর্ণের নারীরই মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছিলেন মনু। নারীর যে কোনও উঁচুজাতেই সম্মানজনক স্থান নেই, তাই তিনি স্পষ্ট করেছেন। তার রচিত শাস্ত্রের নাম ‘মানব শাস্ত্র’ অথবা ‘মনুসংহিতা’ এবং তার ধর্মের নাম ‘মানব ধর্ম’। বর্তমান মানবিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীতে মনুর ‘মানব ধর্ম’ প্রকৃতপক্ষে ছিল  ‘দানব ধর্ম’, শোষণ-বঞ্চনার এক মারণাস্ত্র। মনুকে হিন্দু সমাজের আইন-কানুনের মূল প্রবক্তা বলা যায়।


এই মনুসংহিতাতে নারীকে জঘন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন মনু, হরণ করেছেন তার সকল মৌলিক মানবিক অধিকার।

নারীদের সকল শিক্ষা,ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন মনু-

উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমেই বৈদিক সমাজে পুরুষেরা তাদের শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করতো কিন্তু মনু তার রচিত গ্রন্থে স্ত্রীদের উপনয়ন সংস্কার নিষিদ্ধ করেছেন এবং দেহশুদ্ধির জন্য তিন বর্ণের পুরুষদের যে সকল মন্ত্র উচ্চারণ করতে হত, স্ত্রীদের সে সকল মন্ত্র উচ্চারণে নিষেধ করেছেন। (২/৬৬) নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছেন।


নারীরা যে শিক্ষাহীন ছিল তা স্পষ্ট হয় মনুর নিচের উক্তিতে-

“যে ব্যক্তিকে অভিবাদন করা হবে সে ব্যক্তি যদি সংস্কৃত না জানেন তাহলে অভিবাদনের পর অভিবাদনীয় ব্যক্তিকে ‘আমি অভিবাদন করছি’-এই কথা বলবেন। স্ত্রীলোকদেরকে এইভাবেই অভিবাদন করবেন।” ২/১২৩

নারীরা পুরুষদের ন্যায় সংস্কৃত জানেন না, তাই প্রকাশ পাচ্ছে এই শ্লোকে।


ধর্মাচরণের স্বাধীনতাও যে মহিলাদের ছিল না তা পরিষ্কার হয় মনুসংহিতার নিচের শ্লোক থেকে-

“যেহেতু শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জাতকর্ম সংস্কার পালিত হয় না তাই তাদের অন্তকরণ নির্মল হয় না। স্মৃতি শাস্ত্র ও বেদ প্রভৃতি ধর্ম শাস্ত্রের ওপর স্ত্রীজাতির কোনও অধিকার নেই। তাই তারা ধর্মজ্ঞ হতে পারে না। এমনকি কোনও মন্ত্রের ওপরেও স্ত্রীজাতির অধিকার না থাকায় তারা কোনও পাপ করলে মন্ত্রের সাহায্যে তা ক্ষালন করতে পারে না। তাই শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।” ৯/১৮


আরও বলা হয়েছে,

“স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন পৃথক যজ্ঞ নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনও ব্রত এবং উপবাস নেই। কেবলমাত্র স্বামীর সেবা করেই স্ত্রীলোক স্বর্গে যেতে পারেন।” ৫/১৫৫


শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,

“বিবাহ সংস্কারই স্ত্রীলোকের বৈদিক উপনয়ন সংস্কার। সেখানে স্বামীর সেবাই হল গুরুকূলে বাস এবং স্বামীর গৃহ কর্মই হল প্রাতঃসন্ধ্যাকালীন হোমরূপ অগ্নি পরিচর্যা।”২/৬৭


নারীদের সম্বন্ধে করা হয়েছে জঘন্য সব মন্তব্য-

“ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করা স্ত্রীলোকেদের স্বভাব। এই জন্য পন্ডিতেরা স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না।”২/২১৩

“স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বিচার করেন না। যুবা কী বৃদ্ধ সে ব্যাপারেও তাদের কোনও আপত্তি থাকে না। সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক পুরুষ পেলেই তারা তার সঙ্গে সম্ভোগ করেন।” ৯/১৪

“পুরুষের দর্শন মাত্রেই স্ত্রীজাতির মনে তার সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা জন্মায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের চিত্তচাঞ্চল্য থাকে।” ৯/১৫


“শয়ন, আসন, ভূষণ,কাম, ক্রোধ,পুরহিংসা, কুটিলতা ও কুৎসিত ব্যবহার- এইসকল প্রবৃত্তি স্ত্রীলোকের জন্যই সৃষ্টির সময় মনু কল্পনা করেছেন।অর্থাৎ ওইসকল প্রবৃত্তি নারীদের স্বভাবগত ব্যপার।” ৯/১৭


নারীর ‘অন্তকরণ নির্মল হয় না।’ ৯/১৮


শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ। ৯/১৮


“মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।” ২/২১৪


ঋতুমতী নারীকে অশুচি বলে ঘোষণা করা হয়েছে, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত  অশুচিদের সাথে ঋতুমতী স্ত্রীও অশুচির পর্যায়ে পড়েছে-

“চণ্ডাল, ঋতুমতী স্ত্রী, ব্রহ্মবধ করেছেন এমন পতিত ব্যক্তি, দশদিন পর্যন্ত নবপ্রসূতা সূতিকা,শব ও শবস্পর্শী- এদের স্পর্শ করলে স্নানের মাধ্যমেই শুদ্ধ হওয়া যায়।” ৫/৮৫


সুতরাং ভগবান মনুর কাছ থেকে আমরা কি শিখলাম? শিখলাম- চণ্ডাল, মরদেহ, খুনি, ঋতুমতী নারী, দশদিনের সন্তান প্রসবকারিনী সম অপবিত্রা।


ভ্রষ্ট পুরুষদের দোষ আড়াল করে মনু আউড়েছেন ভিন্ন বাণী, দোষ দিয়েছেন নারীর উপরেই-

“ইহ সংসারে দেহধর্মবশত সব মানুষই কাম ক্রোধের বশীভূত। তাই মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।” ২/২১৪


‘নারীদের এমন স্বভাবেই সৃজন করেছেন বিধাতা’, তাই নারীদের সব সময় বশে রাখার (রক্ষার) ব্যাপারে পুরুষদের সচেষ্ট হতে বলেছেন মনু (৯/১৬)-


মনু বলেছেন,

“বাল্যকালে স্ত্রীলোক পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রের বশে থাকবেন।পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ডের বশে থাকবেন। অর্থাৎ স্ত্রীলোক কখনওই স্বাধীনভাবে অবস্থান করবেন না।” ৫/১৪৮


“শাস্ত্রমতে বিবাহের পূর্বে স্ত্রী জাতিকে কন্যা অবস্থায় পিতা রক্ষা করবেন।যৌবন অবস্থায় বিবাহিত স্ত্রীকে স্বামী রক্ষা করবেন। বৃদ্ধ কালে পুত্র রক্ষা করবেন। এমনকি পতিপুত্রহীন নারীকেও নিকটস্থ পিতৃ প্রভৃতিরা রক্ষা করবেন, কোনও অবস্থাতেই স্ত্রী জাতি স্বাধীন থাকবেন না।” ৯/৩


“স্বামী প্রভৃতি আত্মীয় পরিজনেরা দিনরাত্রির মধ্যে কখনওই স্ত্রীজাতিকে স্বাধীনভাবে অবস্থান করতে দেবেন না। বরং সর্বদাই নিষিদ্ধ রূপ ও রসের ব্যাপারে তাদের অনাসক্ত করে তাদেরকে নিজের বশে রাখবেন।”৯/২


“কী বালিকা, কী যুবতী, কী বৃদ্ধা গৃহে থাকাকালীন কোনও কাজই স্বতন্ত্রভাবে করতে পারবেন না।” ৫/১৪৭


“স্ত্রীলোক কখনওই পিতা,স্বামী বা পুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করবেন না। কারণ এদের থেকে পৃথক হলে পিতৃকূল ও পতিকূল- উভয় কূলকেই তিনি কলঙ্কিত করবেন।” ৫/১৪৯


নারীদের বশে রাখার বিভিন্ন উপায় বর্ণনা করেছেন মনু-

“কোনও পুরুষই বল প্রয়োগ করে কোনও স্ত্রীকে সৎ পথে রক্ষা করতে পারে না। তবে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করলে স্ত্রীদের সহজেই রক্ষা করা যায়।” ৯/১০


উপায়গুলো হল-

“অর্থের সংগ্রহ ব্যয় সাধনে, নিজের শরীর ও গৃহ দ্রব্যের শুদ্ধিবিধানে, স্বামীর স্থাপিত অগ্নির শুশ্রুসায়, পাককার্যে এবং বিভিন্ন গৃহ দ্রব্যের পর্যবেক্ষণে স্ত্রী জাতিকে সর্বদা নিযুক্ত রাখা উচিত। এই সকল বিষয়ের কার্যভার স্ত্রীর উপর অর্পণ করলে সর্বদাই সৎ কর্মে ব্যস্ততায় মগ্ন থাকায় কুকর্ম ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে না।” ৯/১১


নারীদের বশে রেখে শাসন করার জন্য ভগবান মনু বানিয়েছেন সকল বৈষম্যমূলক আইন; এমনকি নারীদের প্রহার করতেও বলা হয়েছে তার রচিত মানবশাস্ত্রে-

“পত্নীর সঙ্গে কখনওই তিনি (স্নাতক ব্রাহ্মণ) একপাত্রে ভোজন করবেন না।” ৪/৪৩

“স্ত্রী,পুত্র,দাস,শিষ্য এবং সহোদর কনিষ্ট ভাই অপরাধ করলে সূক্ষ্ম রজ্জু দিয়ে অথবা বেণুদল বা বাঁশের বাখারি দিয়ে শাসনের জন্য তাদের আঘাত করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে রজ্জু বা বাখারি দিয়ে শরীরের পৃষ্ঠ দেশেই একমাত্র আঘাত করতে হবে কখনওই উত্তমাঙ্গে বা মস্তকে আঘাত করা যাবে না।” ৮/২৯৮-৩০০

স্বামী অপরাধ করলে স্ত্রী কি করবে, এ বিষয়ে যে কিছু বলা নেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।


নারীকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে বলা হয়েছে- 

“বন্ধ্যা নারী অর্থাৎ যার স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে গ্রাসাচ্ছাদন বহনোপযোগী অর্থ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে,পুত্রহীন প্রোষিতভর্তৃকা, যে স্ত্রীর কোনও সপিণ্ড অভিভাবক নেই অথচ যে নিজে সাধ্বী, বিধবা এবং রুগ্না স্ত্রী – এদের সকলের ধন অনাথ বালকের সম্পদের মতোই রাজা নিজে রক্ষা করবেন।” ৮/২৮


নারীর বাল্যবিবাহ ও বিবাহে বয়সবৈষম্য

“তিরিশ বছরের যুবক মনোমতো বারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছরের যুবক মনোমতো আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। কিন্তু যদি ধর্মহানির আশঙ্কা থাকে অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর বেদ গ্রহণ যদি তিরিশ বা চব্বিশ বছরের আগেই শেষ হয় তাহলে আগেই বিবাহ করা যেতে পারে। টীকাকার কুল্লুকের মতে, কন্যার বয়স অপেক্ষা বরের বয়স প্রায় তিন গুণ বেশি হবে- এই মাত্রা জ্ঞাপন করাই এই বচনের তাৎপর্য। কন্যার বয়ঃক্রম নির্ধারণ করা এই বচনের তাৎপর্য নয়।” (৯/৯৪)

এইভাবে একদিকে নারীদের বাল্যবিবাহের বিধান দেওয়া হয়েছে এবং অপরদিকে শিশু কন্যার সাথে তার তিনগুণ বয়সের পুরুষের বিবাহের নিয়ম তৈরি করা হয়েছে।

নিচুজাতির কন্যাকে ভোগ করার প্রবৃত্তি এবং উচ্চবর্ণের কন্যার সাথে নিম্নবর্ণের পুরুষের বিবাহের অস্বীকৃতি। 

আর্যদের বর্ণপ্রথা সম্বন্ধে আপনারা সকলেই হয়তো কমবেশি জানেন। এই প্রথায় ব্রাহ্মণ সবচেয়ে সুবিধাভোগী, শূদ্র সবচেয়ে নির্যাতিত আর অস্পৃশ্যদের তো মানুষ হিসাবে স্বীকৃতিই নেই। এই বর্ণপ্রথায় নারীভোগের এক বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল সুচতুর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণ এর ঘাড়ে দোষ চাপানোর কারণ হল, এইসব রীতি নীতির তারাই প্রবক্তা এবং তারাই এর সবচেয়ে নির্লজ্জ সুবিধাভোগী। বর্ণপ্রথাতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবার মধ্যে শিক্ষা, জীবিকা, ধর্মাচার সকল বিষয়ে অসাম্য ও বৈষম্য  কাজ করতো এবং সেই বৈষম্যের কুৎসিত প্রকাশ পায় নারী বিবাহ/ ভোগ বিষয়ে।


বিবাহের ক্ষেত্রে বর ও কনের বর্ণ বিবেচনা করে বিবাহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল।

১/ অনুলোম বিবাহঃ উচ্চ বর্ণের পুরুষের সাথে নিম্নবর্ণের স্ত্রীর বিবাহ।

২/ প্রতিলোম বিবাহঃ এক্ষেত্রে কন্যা উচ্চবর্ণের ও বর নিম্নবর্ণের হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মণ মনু তার শাস্ত্রে অনুলোম বিবাহের অনুমোদন দেন এবং প্রতিলোম বিবাহকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

এই অনুলোম-প্রতিলোম নিয়মের ফলে ব্রাহ্মণ চাইলে ব্রাহ্মণী,ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা যেকোনও বর্ণের স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারতো।

ক্ষত্রিয় পারতো ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা, শূদ্রা রমণীকে বিবাহ করতে। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণীকে বিবাহ করা নিন্দনীয় ছিল।

বৈশ্য, বৈশ্যা ও শূদ্রা নারীকে বিবাহ করতে পারতো কিন্তু ক্ষত্রিয়া ও ব্রাহ্মণীকে বিবাহ করতে পারতো না।

কিন্তু শূদ্র বেচারা সবার নিচে অবস্থান করায় সে কেবল শূদ্রাকেই বিয়ে করতে পারতো তার অন্য বর্ণে বিবাহের কোনও অধিকার ছিল না।


এই পদ্ধতির বিশ্লেষণে দেখা যায় কূট বুদ্ধিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের নারীর উপর তার হস্ত চালনা করেছে।বাকি বর্ণ গুলোও পারছে অন্যান্যা বর্ণের নারীকে বিবাহ করতে কিন্তু শূদ্র জাতি (বিশেষত শূদ্র পুরুষ) বঞ্চিত হচ্ছে অন্য বর্ণে বিবাহে এবং শূদ্রা পরিণত হয়েছে সকল উচ্চবর্ণের সাধারণ ভোগ্যপণ্যে।


অপরদিকে, আর্যরা তাদের নারীদের ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। যখন উচ্চবর্ণের কোনও নারী নিম্নবর্ণের কোনও পুরুষকে বিবাহ করতে গিয়েছে তখনই উৎপন্ন সন্তানকে নিন্দনীয় বর্ণসংকর ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে।


মনু বলেন,

“নিকৃষ্ট জাতির কন্যা যদি সম্ভোগের জন্য নিজের থেকে উৎকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে ঐ কন্যার কিছুই দণ্ড হবে না।কিন্তু সে যদি অপকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে যে পর্যন্ত তার কাম নিবৃত্তি না হয় সে পর্যন্ত তাকে গৃহে আটকে রাখতে হবে।”৮/৩৬৫

“উত্তম জাতির সকামা কন্যাকে অধম জাতির পুরুষ যদি ভজনা করে তাহলে ঐ পুরুষের শারীরিক বধ দণ্ড হবে। …” ৮/৩৬৬

মহর্ষি মনু ‘কোনও অভিযোগ না করে উচ্চ তিন বর্ণের দাসত্ব (সেবা) করে যাওয়াকে’ – শূদ্রের কর্তব্য বলে বর্ণনা করেছিলেন কিন্তু তার সমাজে নারী যেন অলিখিত শূদ্র। কোনও বর্ণেই তার যেন মর্যাদা নেই, স্বাধীনতা নেই। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীকে পিতা-ভ্রাতা-স্বামী-রাজার দাস করে রেখেছিলেন মনু ও তার সমাজ। তাই তো দাসরূপ নারীকে বলা হয়েছে,


পতিসেবাই তার একমাত্র ধর্ম-

“পিতা স্বয়ং যে ব্যক্তির কাছে কন্যা দান করেছেন কিংবা পিতার অনুমতিক্রমে ভাই যে ব্যক্তির কাছে বোনকে দান করেছেন, সেই স্বামীর জীবিতকাল পর্যন্ত তার সেবা করা এবং স্বামীর মৃত্যুর পরও ব্যভিচার না করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য।” ৫/১৫১

স্ত্রীলোককে গৃহ কর্মে দক্ষ হতে বলা হয়েছে। (৫/১৫০)


কায়মনোবাক্যে পতিসেবা পরায়ণতাই স্ত্রীজাতির ধর্ম। পতিসেবাপরায়ণ ভক্তিমতী স্ত্রীদের পুরষ্কার স্বরূপ স্বামী-পিতামহের পিণ্ডের উচ্ছিষ্ট দান করার কথা বলা হয়েছে। (৩/২৬২) কায়মনোবাক্যে পতিসেবাপরায়ণ নারীধর্ম পালনকারী নারী ইহলোকে অত্যন্ত সুখ্যাতি পান এবং মৃত্যুর পরে পতিলোকে গমন করেন। (৫/১৬৬-১৬৭) তাই স্বামীর জীবনকালে, এমনকি মৃত্যুর পরেও স্ত্রীদের অনিষ্টাচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও কখনওই তার মৃত স্বামীর অপ্রিয় আচরণ না করতে বলা হয়েছে। এর ফলেই নাকি স্ত্রী তার উপার্জিত পূণ্যে স্বামীর কাছে স্বর্গে গমন করবেন (৫/১৫৬) এবং ইহলোকে সাধ্বী স্ত্রীর খেতাব প্রাপ্ত হবেন! (৯/২৯)

স্বামী ধন,মান,কূল,শীলে অপকৃষ্ট হলে স্ত্রীলোকের অন্যকোনও পুরুষকে গ্রহণ করাকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে। (৫/১৬৩)

‘আমি ধনীর কন্যা’- এরূপ দম্ভরূপে অথবা নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে কোনও নারী স্বামীকে ত্যাগ করে অন্য পুরুষকে গ্রহণ করলে তাকে লোকজনের সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। আর সেই নারী যে পুরুষের সঙ্গ লাভ করেছিল তাকে গরম লৌহ শয্যায় শুইয়ে রেখে পুড়িয়ে মেরে ফেলার কথা বলা হয়েছে এবং যতক্ষণ না সেই পুরুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায় ততক্ষণ আগুনে কাঠ নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। (৮/৩৭১-৩৭২)

স্ত্রীর দাসত্ব স্বামীর মরণেও শেষ হয় না, তাকে মৃত স্বামীরও দাসত্ব করতে হয়।


স্বামী মারা গেলে স্ত্রীজাতির কর্তব্য-

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের পুনর্বিবাহ অর্থাৎ বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে- 

“…বিবাহ সম্বন্ধীয় শাস্ত্রে এমন কোনও বিধি লিখিত নাই যে বিধবাদের পুনর্বিবাহ হতে পারে।” ৯/৬৫


বিধবার জীবন ছিল মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর, বিধবার যাতে আর দৈহিক সৌন্দর্য না থাকে, সে যাতে আর অন্য পুরুষকে আকৃষ্ট করতে না পারে তাই কঠোর ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়ার জন্য বলা হয়-

“স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পবিত্র ফলমূল আহার করে জীবন যাপন করবেন। কিন্তু কখনওই ব্যভিচারের ইচ্ছায় পরপুরুষের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবেন না।” ৫/১৫৭


“যতদিন না নিজের মৃত্যু হয় ততদিন পর্যন্ত পতিপরায়ণা স্ত্রী ক্লেশ সহিষ্ণু ও নিয়মচারিণী হয়ে মধু মাংস ও মৈথুন বর্জন করে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। অর্থাৎ সতী সাধ্বী স্ত্রীলোকের যা অন্যতম পরম ধর্ম সেই ধর্ম পালনেই তিনি একাগ্র হবেন।” ৫/১৫৮

“ সদাচারশালী স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হলে ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু কখনওই পরপুরুষের সংযোগে পুত্র উৎপাদন করবেন না। কারণ অপুত্রা হলেও উক্ত ব্রহ্মচারীদের (বালখিল্য ঋষি) মতোই তিনিও স্বর্গে গমন করতে পারবেন।”৫/১৬০


স্ত্রী যাতে পরপুরুষের সাথে কোনোরূপ সম্পর্ক না করতে পারে সেদিকে আর্যরা বেশ সচেষ্ট ছিল। (৯/৮-৯)বিধবা রমণীকে ভয় দেখিয়ে বলা হয়েছে, 

“স্ত্রীলোক যদি পরপুরুষের উপভুক্ত হন তাহলে ব্যভিচার দোষে সংসারে নিন্দনীয় হন। এইরূপ স্ত্রীলোক পরকালে শেয়াল হয়ে জন্মান এবং কুষ্ঠ প্রভৃতি বিভিন্ন পাপরোগে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত পীড়া ভোগ করেন।” (৫/১৬৪ ; ৯/৩০)


সুতরাং স্ত্রীজাতির দায়িত্ব আমরণ তার স্বামীর সেবা করা এবং স্বামীর মারা গেলেও তার অপ্রিয় আচরণ অর্থাৎ অন্য পুরুষের সংসর্গ না করা  এবং পুনরায় বিবাহ থেকে বিরত থাকা এবং কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করা।



এবার তাদের স্ত্রীদের আজীবন কষ্টের কি প্রতিদান দিয়েছেন আর্যপুরুষেরা দেখা যাক-

নারীদের সাথে প্রতারণার ভালোই পথ তারা বেছে নিয়েছিল আর্য পুরুষেরা। মনু তাদের সেইরকমই শিক্ষা দিয়ে বলেন,

“‘তুমি আমার পরম প্রেয়সী,অন্যকে আমি প্রার্থনা করিনি’- এইভাবে সঙ্গ লাভের জন্য কামিনী (নারী) বিষয়ে মিথ্যা শপথ করলে পাপ হয় না। ‘আমি অন্য বিবাহ করবো না’, এইরূপ ক্ষেত্রে বিবাহ বিষয়ে এবং গোরুর ভক্ষ্য বিষয় সম্বন্ধে,হোমের জন্য কাষ্ঠ আহরণ বিষয়ে এবং ব্রাহ্মণের রক্ষার জন্য মিথ্যা শপথে কোনও পাপ হয় না।” ৮/১১২


বিবাহিতা নারীর প্রতি শক্ত হয়েছে আর্যসমাজ, নারীর ত্রুটি পেলেই তাকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। মনুর শাস্ত্রে বলা হয়েছে-

মদ্যপানে আসক্ত, দুশ্চরিত্র, পতিবিদ্বেষিণী, কঠিন রোগগ্রস্থ, অপকার সাধনে সক্ষম, ধনক্ষয়কারী স্ত্রীকে ত্যাগ করে স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। (৯/৭৯-৮০)

“…স্ত্রী যদি অপ্রিয়ভাষিণী হন তাহলে কালক্ষয় না করে তৎক্ষণাৎ স্বামী বিবাহ করবে।” ৯/৮১

“স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হন তাহলে স্বামী স্ত্রীর জন্য এক বৎসর কাল প্রতীক্ষা করবে। তার মধ্যে স্ত্রীর দ্বেষভাব গত না হলে স্বামী তাকে অলঙ্কার প্রভৃতি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তার সহবাস ত্যাগ করবে।” ৯/৭৭


ঘরে স্ত্রী থাকার পরেও স্বামী যদি পুনরায় বিবাহ করেন, আর তাতে স্ত্রী যদি নারাজ হয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হন তাহলে সেই স্ত্রীকে অবরুদ্ধ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে মনুস্মৃতিতে অথবা সেই স্ত্রীকে আত্মীয় স্বজনের সামনে ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। (৯/৮৩)

এবং সর্বোপরি সতী সাধ্বী স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বামীকে পুনরায় বিবাহ করতে বলা হয়েছে-


“সতী সাধ্বী স্ত্রী আগে মারা গেলে তার দাহকার্য ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত করার পর পুরুষ পুনরায় বিবাহ করবেন এবং পুনরায় অগ্ন্যাধান কর্ম সম্পন্ন করবেন। এইভাবে পূর্বোক্ত বিধান অনুযায়ী নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পাদন করবেন এবং পুনরায় দার পরিগ্রহ করে পরমায়ুর দ্বিতীয় ভাগে গৃহস্থাশ্রমেই বাস করবেন। “৫/১৬৮-১৬৯


পুত্রপ্রাপ্তিতে মরিয়া মনুর সমাজ-

পুত্রের জন্য মানুষ স্বর্গ লাভ করে। পৌত্রের জন্য মানুষ ঐ স্বর্গ লোকে চিরস্থায়িত্ব লাভ করে এবং প্রপৌত্রের জন্য মানুষ সূর্যলোক লাভ করে। মনুসংহিতা ৯/১৩৭


পুত্র শুধু স্বর্গে পৌঁছাতে সাহায্য করে না, স্বর্গের সাথে সাথে পুত্র নরক থেকেও তার পিতৃকুল ও মাতৃকুলকে ও রক্ষা করে-


“পুত্র যেহেতু পিতাকে পুৎ নামক নরক থেকে ত্রাণ করে তাই ব্রহ্মা স্বয়ং ‘পুত্র’ এই নাম রেখেছেন। পৌত্র এবং দৌহিত্রের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য শাস্ত্রে বলা হয়নি। কারণ দৌহিত্র পরলোকে পৌত্রের মতোই মাতামহকে পরিত্রাণ করে।…” ৯/১৩৮-১৩৯


সনাতন নারী শস্যক্ষেত্র, পুরুষ সেই ক্ষেত্রের মালিক-

পুত্র যেহেতু স্বর্গের দ্বার ও নরক হতে উত্তরণের পথ তাই আর্যরা পুত্রলাভের জন্য অত্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনও কখনও দেখা গেল, কোনও কোনও আর্যপুরুষ ললাটদোষে উর্বরতাহীনতার কারণে পুত্র উৎপাদনে অক্ষম। কেউ কেউ অপুত্রক অবস্থায় ভুত-প্রেতে পরিণত হল। এমন জটিল পরিস্থিতিতে ভগবান মনুই তাদের পথ দেখালেন, বাতলে দিলেন পুত্রপ্রাপ্তির পথ। যেহেতু বেদে বলা আছে বিধাতা নারীকে গর্ভ ধারণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন (৯/৯৬) তাই, স্থির হল, চুপিসারে গভীর রাতে নপুংসক স্বামী অথবা গুরুজনের আদেশে সধবা অথবা বিধবা স্ত্রীকে ঘি মাখিয়ে প্রস্তুত করে রাখা হবে, আর ওই রমণীর সাথে কোনও পরিচিত পরপুরুষ রমণ করবে এবং তার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করবেন।কখনও একাধিক পুত্র উৎপাদনের বিধানও দিয়েছিলেন মহর্ষি মনু। (৯/৬০, ৯/৬১) এই গোপন কর্মে পরপুরুষ যত কাছের হবে, ব্যাপারটিও ততোই গোপন রবে। তাই আর্যধর্ম অনুযায়ী দেবর আর ভাসুরের কর্তব্য স্থির হল- গভীর রাতে ভ্রাতৃবধুরমণ। (৯/১৪৬) তবে, দেবর- ভাসুরের অভাবে বংশের অন্য কোনও পুরুষকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হত। যেভাবেই হোক নরক থেকে নিষ্কৃতি ও স্বর্গ মার্গে পদক্ষেপন করতে তো হবে!


পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এই যে গুপ্ত পদ্ধতিতে পুত্র উৎপন্ন হল, এই পুত্র তো স্বর্গগমনেচ্ছুক আর্যপুত্রের ঔরসজাত নয়। তাহলে কি করে সে মৃত্যু-পরে স্বর্গোপরে লীলা-খেলা করবে?


এই প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সমাধান দিয়েছেন, আমাদের মনু ভগবান। তিনি দাঁড় করিয়েছেন তার ‘ক্ষেত্রজপুত্র’ নামক থিওরি। এই তত্ত্বে তিনি নারীকে, এবার পরিণত করেছেন ক্ষেতে। মনু বলেছেন, নারী হল পুরুষের ক্ষেত আর পুরুষ এর থাকে বীজ। (৯/৩৩-৩৪) আর খেতে বীজ লাগিয়েই চারাগাছ উৎপন্ন করা হয়। কিন্তু রাম এর ক্ষেতে যদি বলরাম অমাবস্যার রাতে, অন্ধকারে,বীজ লাগিয়ে আসে, আর তাতে ধান, গম এর ফলন হয়, তবে রাম তার ক্ষেতের ফসল বলরামকে দেবে কেন, যতই বলরামের বীজ হোক না কেন?


ভগবান মনুর ভাষায়,

“যেমন অন্যের গাভী,মহিষী,স্ত্রী উট ও স্ত্রী ঘোড়া প্রভৃতি জন্তুদের সঙ্গে অন্যের বৃষ, মহিষ,উট এবং ঘোড়া প্রভৃতির মিলনে উৎপন্ন সন্তান গাভী প্রভৃতি পশু মালিকদেরই অধিকৃত হয়ে থাকে; বৃষ প্রভৃতি পশু মালিকদের হয় না। সেইরূপ পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে উৎপাদিত সন্তান উৎপাদকের হয় না, ক্ষেত্র স্বামীরই হয়ে থাকে। যার ক্ষেত্র নেই কেবল বীজ আছে সে যদি পরের ক্ষেত্রে বীজ বপন করে তাহলে তার শস্যফল কিছুই লাভ হয় না। ক্ষেত্রস্বামীই ঐ ফল ভোগ করে থাকে।”

(৯/৪৮-৪৯)


এইভাবেই নারীকে ক্ষেতে রূপান্তরিত করে তাতে নানান জাতের বীজ লাগাতেন প্রতিভাবান আর্যপুত্রগণ।

ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবসময় নারীর ইচ্ছার  মূল্য দেওয়া হত না, স্বামীর মৃত্যুর পর নারী যাতে স্বেচ্ছায় ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের মাধ্যমে পরপুরুষের সাথে মিলিত হতে না পারে এবং নারীর তথাকথিত  সনাতন সতীত্ব যেন কোনোমতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য নারীকে এই কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে মনু ভগবান চরম স্ববিরোধী কথা বলেন-

(উল্লেখ্যঃ- বিধবা নারীর পুনর্বিবাহও নিষিদ্ধ করেছিলেন মনু, কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার সাথে সাথেই পুরুষকে পুনরায় বিবাহ করতে বলেছিলেন।)


“সন্তান না থাকলে স্বর্গ গমন হয় না একথা ভুল। বালখিল্য প্রভৃতি বহু সহস্র ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ সন্তান উৎপাদন না করেই কেবলমাত্র ব্রহ্মচর্য বলেই অক্ষয় স্বর্গ লোক লাভ করেছেন। সুতরাং ওই সকল ব্রহ্মচারীর মতোই সাধ্বী স্ত্রী সন্তানবতী না হলেও স্বীয় ব্রহ্মচর্য বলেই স্বর্গ গমন করেন।”  ৫/১৫৯


ক্ষেত্রজ পুত্রের উদাহরণ হিসাবে বলা যায় মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু প্রভৃতির জন্মকথা। মহাভারতের রাজা বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে, বংশের গুরুজনেরা তার স্ত্রী অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের পদক্ষেপ নেন। মাতা সত্যবতী স্থির করেন তার পুত্র বেদব্যাস দ্বারা মৃত পুত্রের স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন। ডাকা হল বেদব্যাসকে। গভীর রাতে তিনি বৌদিদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। যেহেতু বেদব্যাস অত্যন্ত কুৎসিত, কদাকার দেখতে ছিলেন তাই অম্বিকা ও অম্বালিকা সম্মত ছিলেন না বেদব্যাসের সাথে পুত্র উৎপাদনে।


সঙ্গমকালে অম্বিকা চোখবুজে কুরু বংশের অবিবাহিত বীর ভীষ্মের কথা ভাবছিলেন, আর অপরদিকে অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডু বর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। সহবাসকালে অম্বিকার চোখ বন্ধ থাকার কারণে কারণে তার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেন, আর ভয়ে অম্বালিকার গায়ের রঙ পান্ডু বর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে তার পুত্রের নাম হল পান্ডু।

অর্থাৎ দেখা যায়, বেদব্যাস ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের জন্য অম্বিকা ও অম্বালিকাকে একপ্রকার ধর্ষণ করেছিলেন।


কতই না মহৎ ছিলেন আর্যপুরুষগণ। প্রয়োজনে স্ত্রীকে ক্ষেত বানিয়েছেন।সেই ক্ষেতে নানা জাতের বীজ লাগিয়েছেন।সেই ক্ষেত থেকে অদ্ভুত রকম ফলন পেয়েছেন এবং প্রয়োজনে স্ত্রীদের ধর্ষণও করিয়েছেন!


সহায়ক গ্রন্থ-


মনুসংহিতার অধিকাংশ শ্লোকের তর্জমা চৈতালি দত্তের অনুবাদকৃত মনুসংহিতা হতে গৃহীত হয়েছে


ধাতব মৌলদের কথা: অ্যালুমিনিয়াম -অঞ্জনা ঘোষ
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পর্ব -১

সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে প্রস্তর যুগের পরে ব্রোঞ্জযুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সেই  সুদূর অতীত থেকে শুরু হয়েছে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে উপস্থিত বিভিন্ন ধাতব মৌলের আবিষ্কার ও প্রাত্যহিক জীবনের মান উন্নয়নে নানাভাবে তাদের বহুবিধ ব্যবহার।

আর আজ তো শুধু প্রকৃতি থেকে পাওয়া না, গবেষণাগারেও বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু নতুন মৌল সংশ্লেষনে (synthesis) সমর্থ হয়েছেন। আধুনিক  পর্যায়সারণিতে টেকনিটিয়াম (Tc- 43) এবং শেষ ২৪টি মৌল (পারমাণবিক সংখ্যা 95 -118) প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। এগুলির প্রত্যেকটিই  গবেষণাগারে সংশ্লেষিত মৌল (synthetic elements)। আর এরা প্রত্যেকেই তেজস্ক্রিয় এবং  অস্থায়ী মৌল। বিশদে এদের আলোচনায়  পরে আসব অন্য এক পর্বে।

বস্তুত মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও ধাতুর ব্যবহার এই  দু’এর সম্পর্ক এক কথায় অবিচ্ছেদ্য। 

আমার  এই উপস্থাপনায় আধুনিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে  অতি ব্যবহৃত কিছু ধাতুর কথা রইল। কয়েকটা পর্বে রাখার চেষ্টা করছি। 

 পর্ব- ১

ধাতু -অ্যালুমিনিয়াম 

                          .    

পর্যায়সারণি’র জনক দিমিত্রি মেন্ডেলিফ’কে বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ইংরেজ রসায়নবিদরা তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ফুলদানি দিয়ে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি। আসলে সময়টা হল অষ্টাদশ শতক। রূপোর মত চকচকে উজ্জ্বল বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম সেসময় ছিল এক বহুমূল্য ধাতু। তার কারণ সেই সময় আকরিক থেকে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাষণের কোন সহজ পদ্ধতি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।


তবে আজকের পৃথিবীতে অ্যালুমিনিয়াম(Al) বহুলতম ব্যাবহৃত ধাতুগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। পরিমানগত হিসেবে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌলদের মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম’এর স্থান ৩য়(১ম অক্সিজেন ও ২য় সিলিকন)। কিন্তু  মুক্ত অবস্থায় তো অ্যালুমিনিয়াম প্রকৃতিতে থাকেনা, থাকে রাসায়নিক যৌগ অর্থাত আকরিক হিসেবে। 


১৮২১ সালে ফরাসী জিয়োলজিস্ট পি বার্থিয়ার ফ্রান্সের এক প্রত্যন্ত গ্রাম লেস বক্স (Les Baux) এ লালচে মাটির মত দেখতে, বক্সাইট আকরিক আবিষ্কার করেন। এই বক্সাইট আকরিক হল হাইড্রেটেড অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al2O3, 2H2O)। এই বক্সাইট ছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম’এর আরও কিছু আকরিক যেমন ক্রায়োলাইট(Na3AlF6), কোরান্ডাম(Al2O3) ইত্যাদি পাওয়া যায় প্রকৃতিতে। তবে সারা বিশ্বেই সবচাইতে আর্থিকভাবে লাভজনক এবং সহজতম পদ্ধতিতে প্রধানত বক্সাইট আকরিক থেকেই অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাষিত হয়। বহুল ব্যবহৃত এই ধাতুর পৃথিবী’র  বিভিন্ন  দেশে সমগ্র বার্ষিক উৎপাদন ৬৯ মিলিয়ন টন(2022 সালের হিসাব)।

আসলে  বহু শিল্পে ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত হয় অ্যালুমিনিয়াম। 

এর কারণ অ্যালুমিনিয়াম ধাতু একাধারে বহু গুণের (quality) অধিকারী। অ্যালুমিনিয়াম হাল্কা ধাতু(ঘনত্ব 2.7 gm/cc) কিন্তু শক্তিশালী কারণ এর উচ্চ মানের নমনীয়তা (Malleability & ductility)। প্রসঙ্গত যদিও স্টিল অ্যালুমিনিয়ামের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী (strong) কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের শক্তি/ভর অনুপাতের (strength/weight ratio) মান স্টিলের থেকে অনেক বেশি। তাই ছোট গাড়ি, এয়ারক্র্যাফট ইত্যাদি নির্মানে এই ধাতু (ধাতুর শঙ্কর) ব্যবহার করা হয়।


এছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম অ-ক্ষয়কারী(non-corrosive) ধাতু। যদিও অ্যালুমিনিয়াম একটি বিক্রিয়াকারী (reactive) ধাতু কিন্তু বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে ধাতুর উপরিতলে (surface) অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড’এর  কঠিন ও অ-ক্ষয়কারী (hard & non-corrosive) স্তর তৈরি হয়। 

আবার অ্যালুমিনিয়াম উচ্চমানের তাপ ও বিদ্যুতের পরিবাহী। এছাড়াও অবিষাক্ত (non-toxic)। একই সঙ্গে এতসব গুণের (quality) সমাহার এবং  আকরিকের সহজলভ্যতা ও উৎপাদন মূল্য অপেক্ষাকৃত কম  হওয়ার কারণে  আধুনিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য  অংশ হয়ে উঠেছে এই অ্যালুমিনিয়াম ধাতু। হাল্কা, নমনীয়তা,  ক্ষয়রোধকারীতা(non-corrosive), নন-টক্সিসিটি,     উচ্চমানের তাপ পরিবাহীতা ইত্যাদির কারণে রান্না করার বাসনপত্র,অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, ক্যান, আধুনিক গৃহনির্মান থেকে শুরু করে এয়ারক্র্যাফটের  প্রায় সব অংশই, ডানা থেকে শুরু করে ককপিটের সব যন্ত্রপাতি ইত্যাদি  তৈরিতে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত হয়।


আবার উচ্চমানের নমনীয়তা ও বিদ্যুত পরিবাহীতার কারণে এবং কপারের থেকে অনেক সস্তা হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইন তৈরীতে ও ব্যাবহৃত হয়। এছাড়াও আরও বহু শিল্পে, বিভিন্ন মেশিনপত্রের অংশ(parts) তৈরিতেও ব্যাপক হারে ব্যবহার হয় এই ধাতুর। এই বিপুল হারে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে একসময় তো অ্যালুমিনিয়ামের ভান্ডারে টান পড়বে। না, এটাও খুব একটা  আশঙ্কার ব্যাপার নয়। কারণ অ্যালুমিনিয়ামের পুণর্ব্যবহার (recycling rate) অত্যন্ত উঁচু মানের। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অ্যালুমিনিয়াম বিপুল হারে রিসাইক্লিং হয়। আকরিক থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাষণ করতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয় তার মাত্র 5-10% শক্তি ব্যয় হয় এই ধাতুর রিসাইক্লিং-এ। বিভিন্ন পানীয় বিক্রি হয় যে অ্যালুমিনিয়াম ক্যান গুলোতে সেগুলো তো প্রায় 100% রিসাইক্লিংযোগ্য। 

 এছাড়াও অ্যালুমিনিয়ামের  নিষ্কাষণ ও শুদ্ধিকরণ (purification) বা রিসাইক্লিং  কোন পদ্ধতির সময়েই পরিবেশে কোন গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গত হয় না। তাই অ্যালুমিনিয়াম একটি পরিবেশ বান্ধব ধাতু সবুজ ধাতু(Green metal) হিসেবে চিহ্নিত।

আগামী পর্বে আর একটি ধাতু নিয়ে আলোচনা করবো।


তাদের নিজেদের ধর্মই ‘শ্রেষ্ঠ’ -অমিত মণ্ডল
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

‘সবই ব্যাদে আছে’। ‘বিজ্ঞানময় কোরআন’। ‘scientific facts in Holy Bible’… 

এই কথাগুলো শুনতে-শুনতে কান পচে গেলো। প্রায় সকল ধর্মের ধ্বজাধারীরাই আজকাল এই কথা বলে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো এটা প্রমান করা যে, তাদের নিজেদের ধর্মই “শ্রেষ্ঠ”। একমাত্র তাদেরই ধর্ম ঈশ্বরের বাণী, আর সব ধর্মই ভুয়ো, মানুষের বানানো। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারই করাই একমাত্র উদ্দেশ্য যদি হতো, তাও ক্ষমা ঘেন্না করে মেনে নিতাম। একটু তলিয়ে দেখলেই আসল উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়। 


সাধারনত, মানুষ অবাক হতে খুব ভালোবাসে। সেই আদিম যুগ থেকে মানুষ অবাক হয়ে আসছে। মানুষ অবাক হয়েছে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা দেখে। মানুষ অবাক হয়েছে ঝড়, বৃষ্টি আর বজ্রপাত দেখে। মানুষ অবাক হয়েছে সজীব আর নির্জীব পদার্থের পার্থক্য দেখে। অবাক হতে হতে হেদিয়ে পড়ে, যখন সকল ঘটনার কারণ খুঁজতে গেছে, তখন পদে-পদে ব্যর্থ হয়ে এক অসীম শক্তিশালী ঈশ্বরের কল্পনা করেছে। এতে একটা সুবিধা আছে। যেমনি কোনও ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো না, ওমনি ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে দাও। সূর্য কেনো ওঠে? ঈশ্বরের ইচ্ছে। ‘চাঁদটা কেনো বাড়ে কমে, জোয়ার কেনো আসে’? ঈশ্বরের ইচ্ছে। রোগ অসুখ কেনো হয় থেকে শুরু করে জন্ম, মৃত্যু সব কিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছে ধরে নিয়েই চলতে থাকলো। যদি জানতে চান, এই Adam আর Eve এরা আকাশ থেকে পড়ল, আর যীশু জন্ম নিলেন মাতৃগর্ভে কেনো? তার উত্তর ঈশ্বরের ইচ্ছে। আবার যদি জানতে চান, এক নিষ্পাপ শিশু বিকলাঙ্গ জন্ম হলো কেনো, তার উত্তর হবে আল্লাহই ভালো জানেন। 

কিন্তু ধীরে ধীরে এই অবাক হওয়া মানুষগুলোর মাঝে, কিছু মানুষ যখন এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর, প্রাকৃতিক আর যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করলো, তখন এই ঈশ্বরের বিশ্বাসে ভাঁটা পড়ল। ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা, তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রয়োজনীয়তাও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো। কিছু মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো। মানুষ বুঝতে শিখল ঈশ্বরের উপর ভরসা না করে ঘটনাবলীর প্রাকৃতিক কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার সুবিধা অনেক বেশি। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করে, তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাকে বিভিন্নভাবে খুশি করার চেষ্টা করে, সব সময় যে সুফল পাওয়া যায় না, তা মানুষ আগেই বুঝেছে। ঈশ্বর যে খুশি হলো কিনা তা বোঝার কোনও নির্ভরযোগ্য উপায়ও নেই। তার থেকে বরঞ্চ যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর একটা প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা জানতে পারলে সুবিধা অনেক বেশি। এবারে বর্ষা হবে কিনা, সেটা ঈশ্বরের ইচ্ছের উপর না ছেড়ে নিজে নিজে অন্বেষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। আর এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষ এগিয়ে চলল প্রাকৃতিক বিশেষ জ্ঞানকে হাতিয়ার করে। একসময় যা ছিল কল্পনার অতীত, অথবা একসময় মানুষ যে দিব্যাস্ত্র বা অলৌকিক যানের কল্পনা করেছে তাই আজ বাস্তব। যে অসুখের নিরাময়ের জন্য একসময় মন্ত্র পড়ে, কলমা পড়ে, মন্দিরে-মসজিদে হত্তা দিয়ে পড়ে থাকলেও কোনও লাভ হয়নি, সামান্য অ্যান্টিবায়োটিকের পাঁচদিনের course করে ভালো হয়ে গেছে।

মোদ্দা কথাটা হল ঈশ্বরের ব্যবসা লাটে উঠেছে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন সকল মানুষই তো বিজ্ঞানের উন্নতির প্রত্যক্ষদর্শী। সকলেই তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে বিজ্ঞানের উপর ভর করেই আজকে আমাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়েছে। প্রত্যেকেই একথা অকপটে স্বীকার করবে যে, নগর জীবন ছেড়ে মানুষকে যদি বনে জঙ্গলে বাস করতে হতো তাহলে প্রাণটা বাঘের থাবায় বেঘোরে হারানোর সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাহলে কিছু মানুষ এখনও ধর্মের ধ্বজাধারী কেন? কেন অনেক মানুষ এখনও ওই প্রয়োজনহীন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আঁকড়ে ধরতে চায়? এখনও কেন মানুষ প্রমাণ করতে চায় ধর্ম সত্য, ঈশ্বর সত্য আর ঈশ্বর ভয়ানক হলেও তাকে যারপরনাই ভালোবাসে? কেন মানুষ এটা প্রমাণ করতে চায় যে, যে ঈশ্বর তাকে গরম তেলে মুচমুচে আলু ভাজার মতো ডিপ ফ্রাই করবে সেই ঈশ্বর ক্ষমাশীল ও দয়ালু। যে ঈশ্বর ইহকালে কোনও সুযোগ সুবিধাই দিতে পারে না, সেই ঈশ্বরই পরলোকে মানুষকে চরম সুখে রাখবে, এই অযৌক্তিক চিন্তা থেকে মানুষ কেন বের হয়ে আসতে পারে না, বা আসতে দেওয়া হয় না?

সাধারণ মানুষ যদি যুক্তিবাদী শিক্ষিত হয়ে ওঠে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা শাসকগণকে প্রশ্ন করে, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?” তারা চায় শিক্ষার অধিকার। তারা চায় সুস্বাস্থ্যের অধিকার। তারা চায় মানুষের মতো বাঁচার অধিকার। 

আর সাধারন মানুষকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতেই একসময় সর্বশক্তিমান অদৃশ্য এক ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে ছিল ওই শাসকগোষ্ঠী। ব্যাপারটা এরকম যেন এই জীবনটা তোমার পরীক্ষা এখানে যতই কষ্ট পাও নিজের অধিকারের জন্য চেঁচামেচি করো না। তাঁকে ভয় করো। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি তোমাকে এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি তোমাকে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু যদি নিজের অধিকার নিয়ে চেঁচামেচি করো, তাহলে নরকেও ঠাঁই হবে না। 

এই একবিংশ শতাব্দিতেও দেখছি সেই আদিম কৌশল খাটানোর নিরলস প্রচেষ্টা। এই কৌশলের সুবিধাটি এই যে, মানুষের চোখে যতদিন এই ধর্ম নামক পর্দা আছে ততদিন মানুষ অন্ধকূপে সুখে জীবন যাপন করবে। এই ধর্মের মোহ সরে গেলে, মানুষকে বিভাজন করে ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করা দুঃসাধ্য। একজন নেতার পক্ষে এটা প্রতিশ্রুতি দেয়া অনেক সহজ যে একটা মন্দির বা মসজিদ বানিয়ে দেবেন। সময়মতো সেই মন্দির বা মসজিদ বানিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করা যাবে। কিন্তু স্কুল বানানো কি চাট্টিখানি ব্যাপার? এই শিক্ষক আনো রে, এই বই আনো রে, এই বেঞ্চ আনো রে। আবার সেই বিদ্যালয় থেকে বেরোনো শিক্ষিত ছাত্রই হয়তো একদিন প্রশ্ন করে বসলো, “রাজা তোর কাপড় কোথায়”। বড্ড risky ব্যাপার হতে পারে। সেদিক থেকে মন্দির বা মসজিদ বানানো নিরাপদ। মন্দিরের দেবতা সে প্রশ্ন করে না। 

এখন এই প্রয়োজনহীন ধর্ম বিমুখ মানুষকে ধর্মের ছত্রছায়ায় ফিরিয়ে আনা যায় কিভাবে? যে বিজ্ঞানের উপর আমাদের এত ভরসা সেই বিজ্ঞানকে যদি ব্যবহার করা যায় তা হবে এক অব্যর্থ হাতিয়ার। আর ওই যে আগেই বললাম মানুষ অবাক হতে ভালোবাসে। সেই সুযোগ নিয়ে বিজ্ঞানের বড় বড় বুলি আউড়ে সাধারণ মানুষকে হতবাক করা খুব কঠিন কাজ কিছু নয়। তারা বিজ্ঞান বুঝুক বা না বুঝুক, মহাবিশ্বের কোনও একটা ছবি দিয়ে তাকে শিবলিঙ্গের সাথে তুলনা করতে পিছপা হয়না। আবার চাঁদে বসে আজান শোনার মত হাস্যকর ঘটনা জনসমক্ষে বলতে এদের ঠোঁট কাঁপে না। একদিকে কোন ধর্মের ধর্মগুরু যেমন গোমাংস বিক্রেতার হত্যাকে ‘Justify’ করে, অন্যদিকে তেমনি অন্য ধর্মের ধর্মগুরু, ধর্ম অবমাননার অপরাধে মানব হত্যাকে ‘glorify’ করে।

এই সকল ধর্মের ধর্মগুরু উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো মানুষকে বোকা বানানো। অনেক ক্ষেত্রেই এরা সরকারের মদদপুষ্ট। যারাই একটু নামকরা ধর্মগুরু তারাই বেশ ধনী। শুকনো কাঠের মত খেতে না পাওয়া অপুষ্টিতে ভোগা ধর্মগুরু কোনদিন চোখে পড়ে না।

এই নধরপুষ্ট ধর্মগুরুরা যেসব সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে দিন দিন ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সেই সব সাধারণ মানুষকে আমি দোষ দেই না। তাদের জন্য আমার একরাশ সহানুভূতি। এই সহানুভূতির কারণ তাদের অবস্থাটা আমি বুঝি। 

ভাবুন একবার, আপনি ছোটবেলা থেকে একটা অলৌকিক ঈশ্বরের গল্প বারংবার শুনে এসেছেন, তার উপর আস্থা রেখেছেন। জীবনের নানা ওঠা পড়ার কারণ হিসেবে সেই অলৌকিক কাল্পনিক স্বত্বাকে দোষ দিয়েছেন। যখনই কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে, আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন এই বলে,  “হা ঈশ্বর! এমনি কেন করলে!” কোন ঝামেলায় পড়লে হিন্দি সিনেমার নায়ক এর মতো বলেছেন, “ইয়া আল্লাহ পরোয়ার দিগার, মদত!” এই বিশ্বাস নিয়ে যে, কেউ সাহায্য করবে। এখন শৈশব থেকে তিল তিল করে জমানো এই বিশ্বাস, মনের মধ্যে ঠুসে ঠুসে ভরা এই পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। সেটা আমিও বুঝি। খাঁচায় বন্দি পাখি যে আকাশ কখনও দেখেনি, কোনদিন উড়তে শেখেনি, তাকে হঠাৎ করে একদিন যদি অনেক উঁচু থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সে ভয় পাবেই। 


তাহলে কি এই ধর্মান্ধতা আঁকড়ে ধরে থাকা যুক্তিযুক্ত? মোটেই না! ঈশ্বরে বিশ্বাস মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসে না। মানুষকে শোষণ করা ছাড়া আর কিছুই শেখায় না। মাথার উপরে কেউ আছে আমি একা নই, এই ভাবনাগুলো মানুষকে প্রশান্তি দিলেও, মানুষকে আত্মনির্ভর হতে শেখায় না। 

তাহলে প্রতিকারের উপায় কি? শেষ অংশে সেই কথাই বলব। ‘সবই বেদে আছে’ অথবা ‘বিজ্ঞানময় কোরআন’ এই কথা বলার আগে একটা কথা ভাববেন। কথাটা হল সবই বেদে বা কোরআনে যদি থেকেও থাকে, তাতে আমাদের কি কোন লাভ হয়? ধরে নিলাম আপেক্ষিকতাবাদের ধারণা বেদে বা কোরআনে বা বাইবেলে গল্পের আকারে বা রূপক অর্থে বলা আছে। কিন্তু তাতে লাভটা কি হচ্ছে? আপনিতো বেদ বা কোরআন পড়েছেন। বলুন তো, একটা স্যাটেলাইটের ঘড়ি প্রতিদিন কতটা adjust করতে হবে যাতে সেই satellite সঠিক ভাবে কাজ করে? অথবা নিউমোনিয়া রোগের অব্যর্থ ওষুধ কি? অথবা dark matter বা dark energy কে শনাক্ত করতে হলে ঠিক কোন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে? অথবা মাতৃগর্ভে শিশুর জিন বাহিত কোনও অসুখ নিরাময়ের উপায় কি?

আশ্চর্যজনকভাবে দেখবেন ধর্ম এ বিষয়ে নিরব। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই যে ধর্মগ্রন্থে এই কথাটি লেখা আছে, এটা কি বিজ্ঞান তখন জানতো?!! তাদেরকে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করি, এই কথাটা যে মানুষ প্রথম আপনাকে জানালো তাকে কে জানালো? বিজ্ঞান কি তখন জানতো? যেমন ধরুন general and special theory of relativity আইনস্টাইন এর আগে কেউ কি সেই ভাবে এই তথ্য কে উপস্থাপন করেছিলেন? তাহলে তিনি জানলেন কিভাবে? নিশ্চয়ই এই জ্ঞান অর্জনের জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়নি? তার থেকেও বড় কথা বিজ্ঞানের এই জ্ঞান আমাদের কাজে লাগে। নিউটনের তিনটি গতিসূত্র এর উপর ভর করেই আমরা বহু সমস্যার সমাধান করেছি। ধর্ম তো যুগ যুগ ধরে আছে, কিন্তু মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে তখনই যখন মানুষ আর সেই কাল্পনিক ঈশ্বরের ইচ্ছের উপর নির্ভর না করে, স্বাবলম্বী হতে শিখেছে। 

‘বিজ্ঞানময় কোরআন’ বা ‘সবই বেদে আছে’ এই কথা বলার উদ্দেশ্য হলো এটা প্রচার করা যে, এই সকল ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বরের বাণী। আমরা সবাই বিনাপ্রশ্নে বিনা বাক্যব্যয়ে ধর্মগ্রন্থের বাকি প্রত্যেকটি কথা মেনে নিয়ে আসুন আমরা অন্ধ হই, আসুন আমরা পরনির্ভর হই, আসুন আমরা অশিক্ষিত হই, আসুন আমরা মূর্খ হই, আসুন আমরা শোষিত হই।


ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামী মুক্তি আন্দোলন এবং মার্ক্সবাদ -ঈশা চক্রবর্তী
May 20, 2025 | সামাজিক ইস্যু | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভূমিকা: 

                   মার্ক্সবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু কমরেড-ই বলে থাকেন ট্রান্স আইডিওলজি এবং সমকামিতা ভাববাদী ধারণা। অর্থাৎ, বস্তুবাদী এবং মার্ক্সীয় দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ দ্বারা ইহা ব্যাখ্যা অসম্ভব। তারা রেনে দেকার্টের উক্তি “I think, therefore I am” উল্লেখ করেন। বস্তুবাদীরা রেনের ভাববাদী উক্তির বিপক্ষে বলেন, “I am, therefore I think” এই উক্তির মাধ্যমে বস্তুবাদীরা বোঝাতে চান বস্তু, ভাবনার পূর্বে এবং স্বতন্ত্র ভাবে অস্তিত্ব রাখে। এখন যাদের উপরোক্ত বিষয় নিয়ে বিশদে জানা নেই, তার মনে হবে সমকামিতা এবং ট্রান্স আইডিওলজি হলো “ভাববাদী”, সুতরাং মার্ক্সবাদ যেহেতু “বস্তুবাদী” তাই ট্রান্স-ফোবিয়া’কে যুক্তিসম্মত করার অন্যতম পথ হলো মার্ক্সবাদ! পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখবো এই ধারণা ঠিক কতখানি ভুল এবং বামপন্থী মুক্তি আন্দোলনের পরিপন্থী। প্রথমত, আলোচ্য বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ নিয়ে ভুল ধারণা দূর করে নেওয়া প্রয়োজন। আলোচনায় ব্যবহৃত “বস্তুবাদ” শব্দের অর্থ পার্থিব সম্পদ ও বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোঝাচ্ছে না। “ভাববাদ” বলতে আলোচ্য অংশে ভালোবাসা বা বিশ্বাস জাতীয় আদর্শবাদী চিন্তাধারার কথা বোঝানো হচ্ছে না। সমস্ত শব্দের দর্শনগত অর্থ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। মার্ক্সবাদ-এর মূল বিষয় হলো দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। আসুন জেনে নিই সেটা কী?


দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ:

                                  বস্তু এবং ভাবের দ্বন্দই হলো দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। এবং অপর বিষয় হলো “দ্বান্দিকতা” (ডায়ালেক্টিক্স)। যেকোনও বিতর্কে একটি তত্ত্ব (থিসিস) উত্থাপিত হয় এবং তার বিরোধে বিরোধাভাস (এন্টিথিসিস)-এর উৎপত্তি হয়। এই দুই তত্ত্বের দ্বন্দে সংশ্লেষ বা সিন্থেসিস লাভ করা যায়। প্লেটো থেকে হেগেল সকল দার্শনিক এই দ্বান্দিকতার কথা বলে গেছেন। কিন্তু এই দ্বান্দিকতা ভাববাদী!

               কিন্তু অত্যাচারী ছাড়া অত্যাচারিতের উপস্থিতি সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে প্রলেটেরিয়াৎ বা শ্রমজীবি ছাড়া বুর্জোয়া বা মালিকের উপস্থিতি অসম্ভব। তাই, থিসিস এবং এন্টিথিসিসি-কে ভিন্ন এবং পৃথকভাবে উৎপত্তি হওয়া সত্ত্বা ভাবা ভুল! উভয়েই একইসঙ্গে উত্থাপিত হয় এবং পরস্পরের সাথে ঐক্য (ইউনিটি) এবং দ্বন্দে বিদ্যমান। 

                 দেখুন কিভাবে মার্ক্স ডায়ালেকটিক্সকে শুধুমাত্র বিতর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ না রেখে তাকে বের করে এনে সমাজের শ্রেণীগুলির পারস্পরিক দ্বন্দে প্রতিফলিত করল। এই দ্বন্দই ইতিহাসের অগ্রগতির দিকনির্দেশ করে। ইহাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দই “দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ”।


ট্রান্স আইডিওলজি না মার্ক্সবাদ?

                            ট্রান্সজেন্ডার বলতে, কোনও ব্যক্তির মানসিক লিঙ্গ চেতনা তার জন্মোক্ত লিঙ্গের ভিন্ন বোঝানো হয়। সহজ ভাষায়, ভিন্ন লিঙ্গের শরীরে কারোর জন্ম হলে তাকে ট্রান্স বলা হয়। এখন, ভূমিকায় উক্ত ধারণা থেকে বহু মানুষই মনে করেন ট্রান্স একটি ভাববাদী ধারণা এবং মার্ক্সবাদ বস্তুবাদী। এই কারণে মার্ক্সবাদ দিয়ে ট্রান্স আইডিওলজি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু, কার্ল মার্ক্স এর মতবাদ অনুযায়ী তত্ত্বগত ভাবে মার্ক্সবাদ সমাজকে তার সম্পূর্ণতায় ব্যাখ্যা করতে পারে। কোনও এক ক্ষেত্রে কার্যকরী না হলেই মার্ক্সবাদ তার যৌক্তিকতা হারায়। কিন্তু এই চিন্তাধারার মুল ভ্রান্তি হল মার্ক্সবাদ দ্বন্দমূলক বস্তুবাদী, বস্তুবাদী নয়। দ্বান্দিকতা ব্যাতিত মার্ক্সবাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বারবার মার্ক্সীয় দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের সাথে যান্ত্রিক বস্তুবাদের পার্থক্য দেখিয়েছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। আবার, ট্রান্স ও সমকামী মুক্তি আন্দোলন এবং পিতৃতন্ত্রের দ্বৈত নিপীড়ন এর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এক ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।


ট্রান্স ও সমকামী নিপীড়নের উৎস: পিতৃতন্ত্র!

                   মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের গবেষণায় সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক কম হয়েছে। সেই কারণে এই বিষয়গুলি নিয়ে মধ্য ও দক্ষিনপন্থীদের পুঁজিবাদ তোষণকারী ভাবধারা স্থান পেয়েছে। যা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোকপাত করতে পারে না। মার্ক্সবাদীরাও এই বিষয়গুলি আলোচনায় গুরুত্ব দেননা কারণ মার্ক্সীয় তত্ত্বের জনকরা এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেননি। কিন্তু, মার্ক্সবাদী হিসেবে নিপীড়িতদের সমস্যা তুলে ধরা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই সমকামিতা ও ট্রান্স অধিকার আন্দোলন এবং মার্ক্সবাদ-এর আলোচনা আবশ্যিক। এই কারণে সুইস্ রেড স্টার পত্রিকার কমরেডরা এই বিষয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের প্রকাশিত গবেষণা পত্রই এই প্রবন্ধের মূল উৎস।


                এই নিপীড়নের মূল কারণ হলো পিতৃতন্ত্র! তাই মার্ক্সীয় তাত্বিকদের (যেমন- এঙ্গেলস) “পিতৃতন্ত্রের নারী নিপীড়ন” এর আলোচনা থেকে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনায় সাহায্য মেলে।

                 এই বিষয়ে আলোচনার সময় LGBTQIA+ কমিউনিটি-কে ট্রান্স ও সমকামী বলে উল্লেখ করা হবে আলোচনার সুবিধার্থে। এঙ্গেলস তাঁর বই “The origin of family, private property and the State”- এ দেখিয়েছেন যে মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় - ১. বর্বরতা, ২. অসভ্যতা, ৩. আধুনিক সমাজ। এই তিনভাগের মধ্যে গুহামানব ও প্রস্তর মানব, যারা দল বেঁধে শিকার করে বাঁচতো তাদের প্রথম ভাগে বোঝানো হয়েছে। সমাজ গঠনের দ্বিতীয় ভাগকে “অসভ্যতা” বিভাগে বোঝানো হয়েছে এবং রাজতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্র এবং আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজকে তৃতীয় বিভাগে বোঝানো হয়েছে। সমাজের এই তিন কাল বিভাগের মাধ্যমে আমরা প্রিমিটিভ কমিউনিস্ট সমাজ ও তার নিঃশেষ হয়ে কিভাবে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলো জানবো। আর জানবো পিতৃতন্ত্রের দ্বৈত নিপীড়ন নারী এবং ট্রান্স ও সমকামী মানুষের ওপরে।


পিতৃতন্ত্রের উৎপত্তি:

                       মার্ক্সবাদ অনুযায়ী সমাজের তিনটি কালভাগের থেকে পিতৃতন্ত্রের সূচনা সম্পর্কে জানা যায়।

                        প্রথম কালভাগ, অর্থাৎ “বর্বরতা” হলো সমাজ গঠনের সর্বপ্রাচীন ধাপ। এই সময় বিবাহ প্রথার পরিবর্তে গ্রুপ বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ বিবাহ দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হতো, কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ছিল না। এই সমাজকে “প্রিমিটিভ কমিউনিজম” বলা হয়। এই সমাজে শ্রমের ক্ষেত্রে কোনও লিঙ্গ বিভাজন ছিল না। জেন্ডার রোলস ছিল অনুপস্থিত। শিশুদের লালন-পালন থেকে শিকার তথা খাদ্য সংগ্রহ সমস্তটাই হতো সমাজবদ্ধ ভাবে। এমনকি যৌন সম্পর্ক শুধু মহিলা-পুরুষ এই দ্বৈত ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনও লিঙ্গের মানুষ যেকোনও লিঙ্গের মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে থাকতে পারত। বর্তমান লিঙ্গচর্চায় যে যৌন সম্পর্ককে “বাই-সেক্সুয়াল” বলা হয়, তার প্রচলন বহুল ভাবে উপস্থিত ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার কবরে কোনও মানুষের মৃতদেহ রাখা হলে, তার সাথে তার প্রিয়জনকে কবর দেওয়া হতো। এমনি অনেক কবরে নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গের সঙ্গীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

                

         এবার আসি এর পরবর্তী তথা দ্বিতীয় কাল ভাগ “অসভ্যতা” (savagery) তে। এই সময় থেকে মানুষের খাদ্য সুরক্ষা বাড়ে পশুপালক থেকে কৃষিকাজ করা সমাজে রূপান্তরিত হবার কারণে। স্বাভাবিকভাবেই দলবদ্ধভাবে বাস করার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। মানুষ তখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজের দিকে এগোতে থাকলো। মানব বিবর্তনের এই ধাপটি নজরে রাখা প্রয়োজন, কারণ এই সময় থেকেই পিতৃতন্ত্রে সূত্রপাত ঘটে। এঙ্গেলস তাঁর বইয়ে লিখলেন, “In this stage, one man lives with  one woman, but the relationship is such that the polygamy and occasional infedelity remain the right to the men, even though for the economic reasons polygamy is rare. While for the women, strictest fidelity is demanded throughout the times she lives with the man. And adultery on her part is cruelly punished. The marriage however can be dissolved by both partners, although rights of children belong to the women like before (in barbarism).” 

                     শেষ অংশ থেকে বোঝা যায় পূর্বতন ব্যবস্থায় একাধিক লোকের সম্পর্ক থাকায় বাচ্চাদের বায়োলজিক্যাল পিতৃত্ব প্রমান অসম্ভব ছিল, তাই সকল নবজাতক এবং সর্বোপরি সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক, কারণ মা ই সন্তানের জন্ম দিতেন। তাই প্রিমিটিভ কমিউনিস্ট সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কিন্তু দ্বিতীয় কলভাগে শ্রমব্যবস্থার উৎপত্তি হওয়ায় সমাজ ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতন্ত্রের দিকে এগুলো। কারণ দলবদ্ধতা ভেঙে ব্যক্তিসত্ত্বার প্রচলন বাড়ে, তাই পুরুষ কেন্দ্রিকতাও বাড়ে সাথে সাথে। শ্রম ব্যবস্থায় পুরুষ শ্রমের সমস্ত জায়গা অধিকার করে, ফলে শ্রম থেকে উৎপন্ন সম্পত্তি ও “surplus value” পুরুষের মালিকানাধীন হয়। শ্রম ব্যবস্থায় নারীর স্থান না থাকলেও সন্তানের অধিকার এখনও নারীর ই রইলো। তবে কোনও সম্পত্তি না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম কে দেওয়ার জন্য “ইনহেরিটেড উইল” থাকলো না। এই ইনহেরিটেন্স যদি সন্তানের কাছে প্রতি প্রজন্মে সঞ্চিত করা যায়, তবেই “প্রাইভেট প্রপার্টি” পাওয়া সম্ভব। তাই, তৃতীয় কলভাগ তথা “আধুনিক সভ্যতা” (সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা)-য় মাতৃতন্ত্রের জায়গায় স্থান পেলো পিতৃতন্ত্র। নারী হারালো সমাজের সমস্ত অধিকার, জন্ম হলো দ্বৈত নিপীড়নের মূল কান্ডারী পিতৃতন্ত্রের!

                     এঙ্গেলস বললেন, “The overthrow of mother right was the historical defeat of the female sex. man took the command in the home also; the woman was degraded to servitude. She became the slave of his lust and reduced to a mere instrument of producing children!”

                    জন্ম হলো শ্রেণী বিভাজনের এবং শ্রেণী সমাজব্যবস্থার! সম্পত্তি রক্ষার লালসা বজায় থাকলো বর্তমান পুঁজিবাদী সভ্যতা পর্যন্ত। বজায় থাকলো পিতৃতন্ত্র!


Historical Queer Opression:

                          অনেকেই বলবে ঐতিহাসিক ভাবে মহিলাদের নিপীড়ন থাকলেও সরাসরি ভাবে কোথাও মার্ক্সিস্ট দার্শনিকরা সমকামী নিপীড়নের কথা উল্লেখ করেননি। এটাই আক্ষরিক অর্থ গ্রহণের সমস্যা। পরবর্তী প্রজন্মের মার্ক্সবাদীদের-ই এই সমস্যা গুলির উপর মার্ক্সবাদ কার্যকরী করে সমাধান অনুসন্ধান করতে হবে। মার্ক্সবাদ হল একটি বিবর্তনশীল বিজ্ঞান, বিবর্তন না হলে বা পরবর্তী প্রজন্ম নতুন সংযোজন না করলে “dogmatic revisionism” ছাড়া কিছুই থাকবে না।

                        আসুন এবার তিনটি কালভাগ-কে সমকামী নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে দেখে নিই। সুইজারল্যান্ড এর মার্ক্সবাদী গবেষকদের পত্রিকা সুইস রেড স্টার অনুযায়ী, “There is no evidence of queer antagonism in savage society, but plenty of evidence that suggests bisexuality as main form of human attraction. All primates observed in nature found to have bisexual tendencies, with bonobo apes being fully bisexual. Neanderthals were commonly buried with partners of both sexes, the leading hypothesis being that they were all bisexual.”

শ্রেণীবিভাজিত সমাজের অস্তিত্বের পূর্বে সমকামী বিরোধিতার কোনও প্রমান নেই, কারণ তখন প্রাইভেট প্রপার্টির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। আফ্রিকান, ভারতীয় কিংবা মিশরীয় সভ্যতার সংস্কৃতি তথা মাইথলজিতে সেই কারণে সমকামিতা বিরোধিতা সক্রিয় ভাবে লক্ষ্য করা যায়। সুইস্ রেড স্টার পত্রিকা অনুযায়ী, “In primitive society, there was a widespread system of third gender institutions. These were system of acceptance and respect for the people who today would be understood as queer: homosexual, bisexual, transgender people, also intersex people and non-binary people etc.”

কিন্তু সমকামী বা ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স মানুষেরা তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে জৈবিকভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারেন না। তাই বংশগত ভাবে যখন প্রাইভেট প্রপার্টি ইনহেরিটেন্স এর মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত হতে লাগল অর্থাৎ সভ্যতার উত্থান হল। যেদিন থেকে মাতৃতন্ত্রকে ভেঙে মানুষের লোভ জন্ম দিলো পিতৃতন্ত্রের, সেদিন থেকে সমকামীদের প্রতি সম্মান এবং প্রচলন উঠে গেল। বাইনারি মনোগ্যমাস সম্পর্কে মানুষকে বাধ্য করা হলো। ভালোবাসার স্বাধীনতার পরাজয় ঘটলো, জন্ম নিলো “Queer Antagonism!”

                      যদিও গ্রিক সভ্যতায় বহু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। সমকামিতাকে এক্সেপ্ট করা হয়ে থাকত, যদি এই প্রাইভেট প্রপার্টির বংশ পরম্পরায় সঞ্চয়ন-এ সমকামী মানুষেরা সম্মতি জানাতেন। যেমন, গ্রিক হিরো আকিলিস! তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমকামী সম্পর্ককে সামন্ততন্ত্রের সময় থেকেই খুবই কঠোর ভাবে দমিয়ে দেওয়া হতো। খুবই কঠোর ভাবে সমকামী ও নারীদের স্বাধীনতা দমন করা হতো, এমনকি কমন সেঞ্চুরি পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। পিতৃতন্ত্রের সাথে সমকামী ও মহিলাদের স্থান বোঝা যায় এর থেকেই, যে ইউরোপিয়ো উইচ বার্নিং-এ জ্বালানি হিসেবে সমকামী মানুষ বিশেষত সমকামী পুরুষকে ব্যবহার করা হতো। 

                     পুঁজিবাদী সমাজেও এই ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকার মতো দেশ যেখানে “প্রোডাক্ট ডিমান্ড” এর অধিকাংশটাই সমকামীদের থেকে আসে, সেখানেও queer antagonism বিদ্যমান। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সমাজের ধারণা হলো নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যেখানে সম্পর্কের একজন শ্রম দেবে এবং প্রাইভেট প্রপার্টি বৃদ্ধির কাজ করবে এবং একজন সন্তানের লালন পালন করতে হবে। অর্থাৎ দত্তক বা অন্য কোনও উপায়ে সন্তান গ্রহণ না করলে, অর্থাৎ সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারের ব্যবস্থা না করলে queer antagonism অনুভব করতে হবে। 

                  তবে আরেক দিক থেকেও সমকামিতার বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। স্বল্প হলেও কিছুক্ষেত্রে বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যেও সমকামিতার বিরোধ বিদ্যমান। সুইস্ রেড স্টার পত্রিকা থেকে, “But there is another form of queer antagonistic ideology, which is present in the proleterian movement. Both in the labour movement and in the ICM. This is the problem of sexual metaphysics, or queer antagonistic revisionism.”


sex, sexuality and gender

                        সেক্স বা বায়োলজিক্যাল সেক্স এবং লিঙ্গ বা জেন্ডার, দুটি সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। সেক্স হলো একটি বায়োলজিক্যাল construct এবং জেন্ডার হলো একটি সোশ্যাল construct অর্থাৎ সামাজিক ভাবনা। তাই সেক্স নির্ধারণ জন্মগত এবং লিঙ্গ নির্ধারণ পরিবর্তনশীল ভাবা হতো, তবে তা সঠিক নয়। সোশ্যাল construct হলো এমন একটি ধারণা যা শুধুমাত্র মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে হওয়া ইন্টাররিলেশন এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। এই বিষয়গুলি অস্তিত্ব রাখে কারণ আমাদের প্রয়োজন হয় এবং আমরা মনে করি এগুলির অস্তিত্ব যাক গে, তাই এগুলি অস্তিত্ব রাখে। যেমন দেশ ও টাকার ধারণা। টাকা বা অর্থ বলতে কোনও বস্তু বা প্রোডাক্ট এর মূল্য বোঝানো হয়নি। কোনও বস্তুর মূল্য তার উৎপাদনে খরচ হওয়া শ্রমের উপর নির্ভরশীল। তাই লিঙ্গ যেহেতু একটি সোশ্যাল construct, তাই তা সর্বদাই নন বাইনারি। কারণ মানুষ কখনওই বাইনারি চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি লাব করে না। মানব মস্তিস্ক জটিল। এবার আসি সেক্স এর ব্যাপারে। সেক্স একটি জৈবিক নির্ধারক বলে এর অস্তিত্ব আমাদের অনুভূতি বা প্রকৃতির সাথে আমাদের ইন্টাররিলেশন-এর সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু এটি অনেকগুলি দৈহিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত। যেমন শরীরে পুং এবং স্ত্রী হরমোনের অনুপাত, সেক্স হরমোনের উপস্থিতিতে দৈহিক পরিবর্তন, গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য (যেমন - স্তন অথবা দাড়ি), মুখ্য যৌনঙ্গ (যেমন - শিশ্ন অথবা vagina) এবং সেক্স chromosome যথা X ও Y chromosome এর বিন্যাস (এটাও binary নয়। XX, XY, XXY, XYY, X ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য বিন্যাসে দেখা যায়। উপরোক্ত প্রায় সকল সেক্স নির্ধারকগুলি জন্মের পরবর্তীতে পরিবর্তন করা সম্ভব। কেবল chromosome বিন্যাস পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু তা বায়োলজিক্যাল সেক্স-এর কুড়ি শতাংশও নির্ধারণ করে না। আবার সেই বিন্যাস ও বাইনারি নয়। কাজেই পুরুষ-স্ত্রী এই বাইনারি বাস্তবে অস্তিত্ব রাখে না। GENDER AND SEX, BOTH ARE NON BINARY! 

                  এবার আসি যৌনতা বা sexuality র কথায়। sexuality বিভিন্ন রকমের হয় এবং এটি একটি স্পেকট্রাম। কারোর sexuality কোনও নির্দিষ্ট বিষয় নয়। মূলত একে চার ভাগে বিভক্ত করা যায় - 

Heterosexuality: দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক।

Homosexuality: দুই সম লিঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক।

Bisexuality: যখন কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ সম এবং ভিন্ন উভয় প্রকারের লিঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতি আকর্ষিত হয়ে এবং সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

Asexuality: যখন কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ অপর কারোর প্রতিই যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না। এটি অল্প থেকে একদম অনুপস্থিত ও হতে পারে। পরবর্তী সকল আলোচনায় সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার মুক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই তিনটি বিষয় এবং এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পিতৃতান্ত্রিক দক্ষিনপন্থীরা বহু pseudo science এ বিশ্বাস করে, যা সমকামী ও ট্রান্স মানুষের ঐতিহাসিক oppression এর অন্যতম কারণ। তাই হিস্টোরিকাল মেটেরিয়ালিস্টিক আলোচনার সাথে বৈজ্ঞানিক আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ।


দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ ও সমকামী মুক্তি আন্দোলন

                        দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ অনুযায়ী ভাব ও বস্তু পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ ও ঐক্যে  বর্তমান থাকে। ঠিক সেরকমই ট্রান্স মানুষদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের পরিচয় ও শারীরিক কাঠামো পরস্পরের সাথে দ্বন্দে ও ঐক্যে থাকে। এই দ্বন্দে সামাজিক পরিস্থিতির মাধ্যমে ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। ছোটো ছোটো পরিমানগত পরিবর্তন, গুণগত পরিবর্তনে পরিণত করে। মস্তিষ্কের শারীরিক পারিচয়ের অনুযায়ী শারীরিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। এবং পুরাতন লিঙ্গ পরিচয়ের নেগেশন অফ নেগেশন ঘটে। যান্ত্রিক বস্তুবাদী দিক দিয়েও দেখতে গেলে ইন্টারসেক্স লোকেদের উপস্থিতি লিঙ্গ পরিচয়ের জাড্যতা ধূলিসাৎ করে। তাই বামপন্থী তথা মার্ক্সবাদীদের সমকামী বিরোধিতার কোনও কারণ-ই থাকে না। 


মার্ক্সবাদী হিসেবে কর্তব্য:

                      সমকামী মুক্তি ও ট্রান্স অধিকার আন্দোলন হলো ইনহেরিটেড উইল এর বিরুদ্ধে। তাই সমকামী মুক্তি আন্দোলন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো moneyless, classless এবং stateless সমাজের উদ্দেশ্যে আন্দোলন। অর্থাৎ,

 Fight for Communism!

source: 

* “The origin of family, private property and the state” - Friedrich Engels

*Swiss “Red Star”


অশৌচের নিয়ম কানুনেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের এত ফারাক কেন? -শম্ভুনাথ চার্বাক
May 20, 2025 | সামাজিক ইস্যু | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পূর্বে  সমাজ ছিল প্রায় অনড় স্থির। জীবিকা অর্জনের উপায় ছিল খুবই সামান্য। সেই সময়ে বর্তমানের মতো মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা ছিল না। মৃতের উত্তরাধিকার  নির্ণয়ের জন্য সামাজিক শংসাপত্র ছিল সাদা থান পরিধান করে ঘোরা এবং লোককে জানান দেওয়া। সন্তানসম্ভবা মহিলার সাধ ও বাচ্চার অন্নপ্রাশন একই ধরণের অর্থাৎ আগামী উত্তরাধিকারীর পরিচিত ঘটানোর জন্য। ঐ সাদা থান পরিহিত ব্যক্তি দেখলেই বুঝি সেই ব্যক্তির পিতা বা মাতার বিয়োগ হয়েছে। যদিও  বর্তমানে কিছু মানুষ এই সাদা কাপড় ভিক্ষা  জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। মৃতের জন্য মৃতের পুরুষ সন্তানদের অশৌচে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়, নারীদের কোনও অধিকার নেই। অশৌচের ক’দিন একবেলা আতপ চালের মণ্ড কাঁচাকলা সেদ্ধ ও ফলমূল খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। ব্রাহ্মণরা কিন্তু দুধ-ঘি-মিষ্টি যোগে ভাল করে খায়। এখানেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের লোকেদের ফারাক ছিল। 


আবার পালনের দিন সংখ্যাতেও অনেক ফারাক ছিল, যথা- ব্রাহ্মণ-১০ দিন,  ক্ষত্রিয় -১২ দিন,  বৈশ্য - ১৫ দিন, শূদ্র- ৩০ দিন অর্থাৎ সব থেকে গরীব যে শ্রেণী সেই শ্রমজীবী শূদ্র মানুষদের  কাজ থেকে বিরত রেখে কু-খাদ্য খাইয়ে শরীর শেষ করিয়ে এক্কেবারেই শেষ করে দেওয়ার রীতি। দুধে ভাতে থাকা ব্রাহ্মণদের এই কম দিনের সুবিধা কেন?  এই প্রশ্ন কোনও  শূদ্র করে না, শুধু গাধার মতো ভার বয়ে যায়। বর্তমানে সমাজ অনেক গতিশীল, বৃত্তির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। পারিবারিক বৃত্তিতে থাকাও সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এখন চর্মকারের পরিবারের সন্তান শিক্ষক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন আবার ব্রাহ্মণ সন্তান জুতোর/মাছের দোকান খুলে বসেছেন, বেয়ারা/ঝাড়ুদাড়ের কাজ করছেন। বৈদিক যুগে ঋক বেদের দশম মণ্ডলে জাতপাতের ভেদাভেদ দৃঢ় করা হয় এবং তখন থেকেই ভারতীয়দের পতন শুরু হয়। সমাজের এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে শূদ্র নামে অভিহিত করে তাদের শ্রম চুরি করে, তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বাতিল করে ক্ষত্রিয় শাসক ও সহযোগী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গুটি কয়েক পরিবার ধনী হয়ে ওঠে। 


গীতার অনেক শ্লোক এর পক্ষেই প্রচার করে এবং সরাসরি জাতপাতের ভেদাভেদকে সমর্থন করে। যাদের দমিয়ে রাখার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থগুলি তারাই গীতাকে মাথায় করে রাখে। মনুস্মৃতির মত প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থ ব্রাহ্মণদের দ্বারাই রচিত শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেদের ওপর প্রভূত্ব করার জন্য। ভারতবর্ষকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণও জাতপাতের ভেদাভেদ এবং নিয়তিবাদ। প্রতিবাদ ও ধ্বনিত হয়েছিল চার্বাকদের আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বেদ বিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের আন্দোলনে, ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কিছুটা স্তিমিত হলেও শৈব মতাবলম্বী গুপ্ত সম্রাটদের উত্থানে ও সহযোগিতাতে চতুর্থ শতকে পুণরায় সমাজ ব্রাহ্মণদের কুআচার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের দখলে চলে যায়। বাংলাদেশে শৈব মতাবলম্বী শশাঙ্কের উত্থান ও অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতন শুরু হয়। শশাঙ্ক নির্বিচারে বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এর ফলে ব্রাহ্মণদের কুআচারের শাসন বাংলাদেশেও শূদ্রদের গলা টিপে ধরে। সেন যুগে বল্লাল সেনের সহযোগিতাতে ব্রাহ্মণদের রমরমা চলতেই থাকে। মাঝে পাল যুগে বৌদ্ধদের আধিপত্য বজায় ছিল। অর্থাৎ শাসকের সহায়তা ভিন্ন ধর্ম এগোতে পারে না। পরবর্তীকালে ইংরেজদের আগমনে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে মানুষের চিন্তাভাবনাতেও পরিবর্তন আসে। ধনতন্ত্রের আগমনে সামন্ততন্ত্রের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠা শুরু করে। যদিও ভারতবর্ষে পশ্চিম ইউরোপের মতো ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি। ইংল্যান্ডে ধনতন্ত্রের আগমনে জিওনার্দো ব্রুণো, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, স্ট্যুয়ার্ট মিল, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যিকদের মানবিকতাবাদী  লেখনী ইউরোপিয়ান সমাজকে নাড়িয়ে দিলেও ভারতীয়দের  তেমন নাড়া দিতে পারেনি। বাংলার রেঁনেসাসে রামমোহন, ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন প্রসার লাভ করলেও তা আবার  নবকৃষ্ণ দেব, রাধাকান্ত দেবেদের মতো সামন্ত প্রভুদের দখলে চলে যায় এবং ভাববাদের প্রসার লাভ ঘটে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দদের মাধ্যমেই। সমাজ আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের আধার হতে শুরু করে। আর আমাদের বর্তমান শাসকদের বৈদিক আমলের ঐতিহ্যের গুণগান ও ক্রিয়াকলাপ দেখে বোঝা যায় সমাজে এরা আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চায়। 


        এই গতিশীল সমাজে পিতা মাতার বিয়োগের পরে এতদিন ধরে অশৌচ পালন করলে শ্রমের যোগানে টান পড়বে এবং উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং লোকেদের আর এই আচারে আবদ্ধ রাখলে ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ শুরু হবে। তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর আগে অশৌচের দিনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হল। এখানেও পার্থক্য রয়ে গেল, ব্রাহ্মণদের ১০ দিন আর শূদ্রদের ১২ দিন। সব আচারের ব্যাপারেই ব্রাহ্মণরা সুবিধাভোগী। এটা নিয়ে কোনও শূদ্র প্রশ্ন করে না। আর বর্তমানে ডেথ-সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা আছে ঐ সাদা থান পরিধানের দরকার কি? ১২ দিন ধরে আচার পালন করে শরীরকে কষ্ট দেওয়ার অর্থ কী? এর ফলে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই অপ্রয়োজনীয় প্রথাকে গাধার মতো শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেরা বয়ে নিয়ে চলেছে। শূদ্ররা ডিগ্রি অর্জন করলেও প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি। ফলে তাদের দাবিয়ে রাখার জন্য যে আচারের ব্যবস্থা ব্রাহ্মণদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তারা ভয় পায়। ফলে এই শোষণ ব্যবস্থা এই দ্বাবিংশ শতকে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার যুগেও টিকে আছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শিব্রাম চক্রবর্তী মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী বইতে এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন। পুরোহিত  ব্রাহ্মণদের উনি নরখাদকের সাথে তুলনা  করেছেন। সমাজকে শোষণ করার জাতপাতের ভেদাভেদের ব্রাহ্মনীয় পদ্ধতি এক কথায় ইউনিক। অ্যাডাম স্মিথ বা স্ট্যুয়ার্ট মিল ও এগুলি ভাবতে পারেননি। চার্লস ডারউইন পড়া ডিগ্রি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতেরাও গাধার মতো এই ভার বয়ে চলেছে, এদের শিক্ষার সাথে জীবনের কোনও যোগ নেই। 


        মূল বাল্মীকির রামায়ণে দশরথের পুরোহিত জাবালিও রামচন্দ্রকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন কে দেখছে মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে? রামচন্দ্র শাসকের প্রতিনিধি তিনি জাবালিকে তস্কর বৌদ্ধ বলে তিরস্কার করেছিলেন। অর্থাৎ রামায়ণ রচনা সমাপ্ত হয়েছিল বুদ্ধের আবির্ভাবের পরেই। বুদ্ধদেব তখন ব্রাহ্মণদের আচারের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মে আত্মার কোনও সংস্থান রাখেননি। ফলে এই আচারগুলি রহিত হয়েছিল এটা বোঝা যায়। দুহাজার বছর আগের মানুষ এর প্রতিবাদ করলেও আধুনিক মহাকাশ যুগের মানুষ এর প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।

           বাবা-মা জীবিত থাকাকালীন নিজের আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী সেবা করুন; তবেই প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখান হবে। আর বাবা-মাকে দেখলাম না, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে নিষ্ঠাভরে আচার পালন করে বিশাল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলেও বাবা মাকে শ্রদ্ধা দেখানো যায় না। 

        

আত্মার ধারণাও বিদেশ থেকেই (ব্যাবিলন) ভারতে এসেছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কে আত্মাকে দেখেছে? আসলে পরলোক ও আত্মার ব্যবসা না থাকলে ধর্মের গোড়া ধরে টান পড়বে। ইহলোকে অত্যন্ত কষ্টে থাকুন ওপরের তিন শ্রেণীকে সেবা করে যান বিনা প্রশ্নে তবেই পরলোকে আপনি দেবদেবীদের সাথে স্বর্গের পারিজাত বনে দ্রাক্ষা খেতে খেতে ইন্দ্রের ঐরাবতে করে ঘুরতে পারবেন। তাই এই আচার চলবে শাসকের সহযোগিতাতেই। শাসক মন্দির মসজিদ গির্জাতে ভোটের জন্য ঘুরে বেড়াবেন আর অবিরাম ধর্মের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে যাবেন।


সংস্কার-মুক্ত-সমাজ -মহম্মদ মহসীন
May 20, 2025 | সামাজিক ইস্যু | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কিছু কিছু কথা আছে, শুনলে হাসি রোখা যায় না। যেমন গ্রামে হবে এক ধর্মসভা। বক্তা কে? একজন মৌলভি মৌলানার নাম, কোন মাদ্রাসায় তার শিক্ষা, কী কী তার ডিগ্রী এইসব বড় বড় অক্ষরে, নীল লাল বেগুনি সবুজে ছাপা। একটা বিশেষণে কিন্তু হাসি আর চেপে রাখা যায় না। সেটি হ'ল,  তার মতো যুক্তিবাদী বক্তা খুবই কম আছে। তার সমস্ত যুক্তিই অকাট্য। কোরাণ হাদিসের বাইরে এক মিলিমিটারও তিনি বেরিয়েছেন, এ অপবাদ তার ঘোরতর প্রতিযোগী মৌলানা মৌলভীরাও করতে পারে না।


 এই হলো যুক্তিবাদ সম্বন্ধে মুসলিম জনসমাজের ধ্যানধারণা।  এবার একটু মুসলিম জনসমাজ থেকে বেরিয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষিত জনের ভাবনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

 কুসংস্কার দূরীকরণ বলতে তারা কী বোঝেন? ঐ সাপে কাটলে ওঝার কাছে যাওয়া নয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তেলপড়া জলপড়া নয় ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াতে হবে। কোন ডাক্তার? এলোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, চাইনিজ, জাপানিজ, যেকোনও ডাক্তার হলেই চলবে, নামের আগে ডাক্তার লেখা হলেই হলো। জলপড়া, তেলপড়ার মতো হোমিওপ্যাথি যে স্রেফ ওষুধবিহীন চিকিৎসা এইটুকু বললেই সেই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারিরাও রে রে ক'রে তেড়ে আসে। হোমিও খেয়ে যে তার নিজের, নিজের বাবা-কাকা- দাদু- দিদার কিংবা অপরের বাবা-মা- কাকা-জ্যেঠা কতজনের যে রোগ নিরাময় হয়েছে, তার না কি থই পাওয়া যায় না। 


 কুসংস্কার বলতে আপামর শিক্ষিতজনের চিন্তাস্রোত এমনই গড্ডালিকাপ্রবাহিনী।  কিছু মানুষ আছেন, সমাজে তারা কেউকেটা। এই যেমন সরকারী বিজ্ঞান সংস্থার উচ্চপদাসীন, নামকরা চিকিৎসক, বিজ্ঞান পড়ানো টিচার। তারা সব ধরে ধরে রাস্তায় চলার পথে কালো বেড়াল দেখলে কেন থামতে হয়, পিছন থেকে ডাকলে কেন যেতে নেই, এক শালিক দেখলে কেন কাজ সফল হয় না, ডিম খেয়ে কেন পরীক্ষা দিতে যেতে নেই, গর্বের সাথে  সে সবের বড় বড় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে পাণ্ডিত্য  ফলিয়ে থাকেন। নিজেকে কুসংস্কারহীন, বিজ্ঞানমনস্ক, বিজ্ঞানকর্মী বলে পরিচয় দেন।   এইসব মণীষীগন বিজ্ঞান আন্দোলনের যে কত ক্ষতি করেন তার মাপ পরিমাপ নেই।  বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্মেলনে,  জ্যোতিষীর দেওয়া রত্নপাথরের শোভা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেও এরা নি:সঙ্কোচ। 

  

কেউ কেউ আছেন, একটা বিজ্ঞান সংস্থার কর্ণধার, সর্বেসর্বা, এরা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, গ্যাজেট নিয়ে  ভূত ভগবান শয়তান নিয়ে গবেষণা করেন, নিদেনপক্ষে সেইসব বিজ্ঞানীদের প্রমোট করে থাকেন। এই সব অপবিজ্ঞানের ধ্বজাধারিদের। 

 সমাজে চোর ডাকাত জোচ্চররা ঠিক কতটা ক্ষতি করে তা ঠিক পরিমাপ করতে পারি না, কিন্তু এই স্বার্থান্বেষী বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মীগুলো ভূত-প্রেত-স্বার্থান্বেষীদের বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞানানুসন্ধানী বলে সমাজ মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ছলে ভট্টাচাজ্জিগিরি করে   বিজ্ঞান চেতনার পথ থেকে পৃথিবীকে হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে , যাচ্ছে তা কিন্তু নিশ্চয় করে বলা যায়। 

   সমাজমাধ্যমে এইরকম  মুখোশপরা সেলিব্রিটি “কুসংস্কারমুক্ত” মেকি কুসংস্কারবিরোধী লোক বিজ্ঞানমনস্কতা নির্মাণের পথে রঙচঙে দেওয়ালবিশেষ।  কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে হলে এই লোকগুলিকে মোকাবিলা করতে হবে, বিজ্ঞান আন্দোলনে সেটাও এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।


   কুসংস্কারমুক্তির জন্য তাহলে কী চাই? চিকিৎসক হতে হবে? অনেক ডাক্তারকে দেখবেন মাদুলি নিয়ে ঘুরছেন। তিনি নিজে ডাক্তার, অথচ পীরবাবা, মৌলানা-মৌলভীদের দেওয়া মাদুলি পরে বসে আছেন।  তাহলে কি বিজ্ঞানী হতে হবে? নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী বলছেন, কুলদেবতা ঠাকুর তাকে থিসিস যুগিয়ে চলেছে।  তাহলে কি টিচার হতে হবে? টিচাররাও শিশুদের বাগদেবীর আরাধনার উপদেশ দিচ্ছেন।  তাহলে কি হতে হবে?


আমার মনে হয়, পাঠক হতে হবে। ভাল ভাল বই আছে সেগুলি প্রতিনিয়ত পড়তে হবে।  

 আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলেই প্রচুর বই আছে। সেগুলি পড়তে হবে। যার যেখানে সম্পর্ক আছে এইসব বইয়ের সন্ধান দিতে হবে। পড়তে তাগিদ দিতে হবে। শিশুদের তো বাবা-মা- পরিবার-প্রতিবেশী কুশিক্ষা দেয়। কুসংস্কারের আঁচে ধোঁয়া দেয়। শিক্ষিত পরিবারেও এতটুকু বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবেশ পরিশীলনের অবকাশ নেই। প্রতিটি পরিবারে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নবীদের কথা-হাদিসের গল্প গুলো শিশুদের চরিত্রগঠনের দায় চাপিয়ে দিয়ে দায়িত্ব  পালন করে চলেছে। বিষের বীজ এভাবেই অঙ্কুরিত হচ্ছে শিশুমনে। কুসংস্কারমুক্তির জন্য চেতনার চাষ করতে আগে  এইসব  রামকৃষ্ণ হাদিস বিবেকানন্দ নবী সদৃশ আগাছা আমূল তুলে ফেলা দরকার। এ কাজটা খুব জরুরি। কিন্তু আগাছা নিকাশ করা অত সোজা নয়। তাই বিজ্ঞানকর্মীদের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশী। 


আমাদের এই কাজটা বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ।  তবু মনে প্রত্যয়, উই শ্যাল ওভারকাম।


রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম, একটি যুক্তিবাদী অনুসন্ধান -অভিষেক ঘোষ
May 20, 2025 | যুক্তিবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম পর্ব: 

দক্ষিণেশ্বরের পুরোহিত গদাধর, রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়,  স্ত্রী সারদাদেবীকে বলেছিলেন, একশ বছর পর আবার আসবেন অর্থাৎ তাঁর পুনর্জন্ম হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে সারদাদেবী  বলেন “ঠাকুরের থাকবে সন্ন্যাসীর বেশ। তিনি যে বাউল বেশে আসবেন বলেছেন। বাউলবেশ - গায়ে আলখাল্লা, মাথায় ঝুঁটি, এতখানা দাড়ি। বললেন, বর্ধমানের রাস্তায় দেশে যাব, পথে কাদের ছেলে বাহ্য করবে, ভাঙা পাথরের বাসন হাতে, ঝুলি বগলে।” কথাগুলি প্রকাশিত হয়েছে উদ্বোধন কার্য্যালয় এর শ্রীশ্রীমায়ের কথায়। 


আমরা শুনেছি, ভক্তরা বলে থাকে ব্রহ্মবাক্য নাকি মিথ্যা হবার নয়। তারপর আস্ত ভগবান  অবতারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদাধরের বাক্য কখনও মিথ্যা হতে পারে একথা তো ভাবাই বাতুলতা! 

আমরা যুক্তিবাদী। সব কিছু যুক্তি ও প্রশ্ন দিয়ে যাচাই করা আমাদের কাজ। তা গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর হয়েছে ১৮৮৬ সালে। অবতারবরিষ্ঠ গদাধরের কথা সেই সঙ্গে ‘জগৎমাতা’ সারদার কথা যদি ব্রহ্মবাক্য হয় তাহলে একশো বছর, অর্থাৎ কিনা ১৯৮৬ সালে তাঁর পুনর্জন্ম হবার কথা। এবং বাউলবেশে, ঝুলি বগলে, বর্ধমানের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার কথা। আজকে ২০২৩ এ তাঁর বয়স হওয়া উচিৎ  ৩৭ বছর। কই,আজ পর্যন্ত তো এরকম কোন বাউলকে দেখা গেল না! 

এ তো গেল গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের নিজমুখে পুনর্জন্ম নেবার প্রথম অঙ্গীকার। দ্বিতীয় অঙ্গীকারও  তিনি করেছেন কিন্তু! অন্নদাঠাকুর, স্বপ্নজীবন গ্ৰন্থে লিখেছেন রামকৃষ্ণ তাকে বলেছেন - “তোমার ভয় নেই, দেহরক্ষার বত্রিশ বছর পর আমি আবার বাংলায় যাচ্ছি। সেই দেহরক্ষার সত্তর বছর পর আবার, এইভাবে আরও এগারো বার অবতীর্ণ হব।”  রামকৃষ্ণর এত নিকট ভক্তকে দেওয়া তাঁর কথা কি মিথ্যা হতে পারে!  সেই হিসেবে ১৮৮৬ + ৩২ অর্থাৎ  ১৯১৮ সালে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম হবার কথা এবং বর্তমানে তাঁর বয়স হওয়া উচিত নয় নয় করে ১০৫। (কত বছর বেঁচে থাকবেন বলেননি,অবতার মানুষ সবই সম্ভব।)


রামকৃষ্ণ মিশনকে তো এখনও পর্যন্ত তাদের পরম আরাধ্যের নবকলেবর খোঁজার জন্য বিন্দুমাত্র তাগিদ নিতে দেখা গেল না! কারণ কী? রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ কি স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবের কথায় বিশ্বাস করে না?  নাকি নব্য জ্ঞানের আলোকের তাঁরা পুনর্জন্ম, জন্মান্তর এসব কিছুতে আস্থা হারিয়েছে?  দ্বিতীয়টি least possible, কারণ মিশন কোন ছার  জগতের কোন প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মই আত্মা, পরলোকবাদ, জন্মান্তরের কথা না বলে নিজেদের ধর্মপ্রচার চালাতে পারবে না। ধর্ম জিনিসটাই দাঁড়িয়ে আছে ইহলোক পরলোক, পাপের ভয়, জন্মান্তরের সুখের ওপর। তাহলে কি প্রথমটিই ঠিক? অবশ্য আরেকটা কারণ হতে পারে মিশন প্রকাশিত বইগুলি মিশনের  লোকজনই ভাল করে পড়ে দেখেনি! নাহ, এটাও মনে হয়না। এগুলো পাঠক্রমের অধ্যবসায়ে ওদের পড়তে হয়। তাহলে দাঁড়াল কী?  মিশন সব জেনেও, না জানার ভান করে আছে। যুক্তিবাদী  প্রবীর ঘোষ  লিখছেন - “সারদা মা’র প্রতি রামকৃষ্ণদেবের এই ধরণের বক্তব্যকে বর্তমানে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে অসার মনে হলে মিশন কর্তৃপক্ষের কি নৈতিক দায়িত্ব ছিল না, এই বিষয়ে মতামত স্পষ্টভাবে ভক্তদের কাছে ব্যক্ত করা?  নাকি রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবর আবির্ভাব বিষয়ে নীরবতার পিছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে অর্থ ও কর্তৃত্ব হারাবার শঙ্কা?”

একবার ভেবে দেখুন রামকৃষ্ণ যদি হঠাৎ এই তৃণমূল-বিজেপি অলঙ্কৃত বাংলায় আবির্ভূত হয়ে মিশনের যাবতীয় সম্পত্তির (ইনটেলেকচুয়াল ও ফিজিকাল) অত্যন্ত সঙ্গত অধিকার দাবি করে বসেন তাহলে কী কী হতে পারে! তাই কি মিশন কর্তৃপক্ষ উক্ত ভবিষ্যতবানীটি নিয়ে কথা বলতে নারাজ?  


১৯৮৯ সালের ২৭ আগস্ট  প্রবীর ঘোষ গিয়েছিলেন বেলুড় মঠে স্বামী  ভূতেশানন্দের কাছে এবং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাতে উত্তরের পরিবর্তে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন, তাঁর সচিব উন্মত্তের মত রাগ প্রকাশ করে প্রবীর ঘোষের ওপর। সম্ভবত সব ভক্তিবাদী যুক্তিহীনদের মতই  উত্তর দিতে না পারার ব্যর্থতা ক্রোধ হিসেবে প্রকাশ পায়। 



দ্বিতীয় পর্ব: 

সারদাদেবী ও অন্নদা ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরের পূজারী বামুন রামকৃষ্ণ বলেছিলেন তিনি আবার জন্ম নেবেন। হ্যাঁ  সময়ের হেরফের ছিল, কিন্তু জন্ম যে নেবেন এ’কথা স্থিরনিশ্চিত। রামকৃষ্ণের নামে চলা সংস্থা, রামকৃষ্ণ মিশনের এই নিয়ে কোনরকম মাথাব্যথা দেখি না। অন্য কথায় স্বয়ং রামকৃষ্ণকথিত ব্রহ্মবাক্যকেই তারা অগ্ৰাহ্য করেছে, এবং রামকৃষ্ণের নবকলেবর সন্ধানে সচেষ্টতা দেখায়নি। 

রামকৃষ্ণের নবজন্ম নিয়ে মিশন মাথাব্যথা না করলেও অনেকেই কিন্তু করেছে। ১০ জুলাই ১৯৮৭ সালে যোগী যোগানন্দ সর্বতীর্থ নামে এক ব্যক্তি, বর্ধমানের একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক এফিডেবিট করে দাবি করেন - “ যুগাবতার শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব লীলা সংবরণ করার পর পুনরায় নবকলেবরে সপার্ষদ একশত বৎসর গতে অবতীর্ণ হওয়ার বৃত্তান্ত আমি অপ্রাকৃতিক জ্ঞানচক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং তাহাদের বর্তমান স্থুল শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা সংস্থা গ্ৰহণ করলে আমি তাঁহাদের শনাক্ত করিতে সক্ষম, ইহা আমার জ্ঞান মতে সত্য।”

শুধু এফিডেবিট করে থেমে না থেকে তিনি চিঠি লিখেছেন মিশনের গম্ভীরানন্দকে। যোগানন্দের কথায় তিনি দৈব আদেশে রামকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুযায়ীই জনগণকে জানাতে চান রামকৃষ্ণ সপার্ষদ জন্মেছেন। তিনি নিজে নাকি গতজন্মে ছিলেন রামকৃষ্ণ পার্ষদ লাটু /অদ্ভুতানন্দ। গানন্দ, মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াও কলকাতায় প্রবীর ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাতে তিনি যুক্তিবাদী সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে এই বিষয়ের তদন্তে নামেন। 


বলা বাহুল্য  তাঁর এই ‘মহতী’ প্রয়াসে রামকৃষ্ণ মিশন গা করেনি। 

অন্য এক ব্যক্তি, ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা, যোগী তিমিরবরণ, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতির কাছে এক লিখিত আবেদন রাখেন, ১৬ নভেম্বর, ১৯৮৭ তে। বিস্তারিত আবেদনটিতে আরও অনেক কথার সঙ্গে,  তিনি বলেন রামকৃষ্ণ মিশন যদি মনে করে রামকৃষ্ণের বাক্য ব্রহ্মবাক্য তাহলে তাদের উচিত রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম বিষয়ে অনুসন্ধান করা। তিনি এও জানান, রামকৃষ্ণ কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেদিন পঞ্চবটীর ডাল ভেঙে আসনে পড়বে, সেদিন তিনি আবার জন্ম নেবেন,আজ ৬৫ বছর হল ডালটি ভেঙে পড়েছে কিন্তু কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি খেদ প্রকাশ করেন এই বলে যে,  “পুনরাবির্ভাবের যদি মূল্যায়ন না হয় তাহলে হয় রামকৃষ্ণ তত্ত্ব মিথ্যা, নয়তো মিশনের আধিকারিকরা দিব্যচক্ষুর অধিকারী নয়, অথবা হয়তো সব জেনেই তারা গদীর মোহে আকৃষ্ট থেকে ঠাকুরকে লোক সমক্ষে প্রতিষ্ঠা করছে না।”

 

প্রসঙ্গত পঞ্চবটীর ডাল ভেঙ্গে যাওয়া এবং রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নেবার কথাটি অন্নদাঠাকুর তার আত্মজীবনী ‘স্বপ্নজীবনে’ও বলেছেন। রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নিয়ে তদন্ত করতে প্রবীর ঘোষ বর্ধমান যান ১৯৮৯ সালে। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে উনি দু’জনের দেখা পান যাদের দাবি তারাই রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম!  


প্রথমজন ভোলানাথ অধিকারী, জন্ম ১৯৩৪। একমুখ গোঁফ দাড়ি, কথায় গ্ৰাম্য ছোঁয়া। আলাভোলা ভাব। প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান - “রামকৃষ্ণ-ই যে রামকৃষ্ণ, সেটা আবার রামকৃষ্ণ কেই প্রমাণ করতে হবে!  ভারি মজার তো!  রামকৃষ্ণ মিশন!  আমার নামে মিশন!  ওরা তো সব মরছে গু ঘেঁটে। মরুক ওরা ক্ষমতা আর ভোগ নিয়েই। আমাকে নিয়ে গেলে ওদের সব এক একটাকে (ছাপার অযোগ্য)...”


দ্বিতীয়জন নীলমণি বন্দোপাধ্যায়। হোমিওপ্যাথি করেন। ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা। দরিদ্র। রামকৃষ্ণের মত দাড়ি। প্রশ্নের উত্তরে তাঁর গলাতেও একই সুর। “আমি যে গত জন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম এ’কথা প্রমাণ দিতে পারি। নিয়ে আসুন রামকৃষ্ণ মিশনের মাথাদের, আমার নাম ভাঙিয়ে যারা করে কম্মে খাচ্ছে। ওইসব ক্ষমতালোভী, অর্থলোভীগুলোকে আমি বিশ্বাস করি না। ওরা কখনওই আসবে না।” কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন তিনি যে রামকৃষ্ণ তা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, বরুণ সেনগুপ্ত ইত্যাদিদের। তাঁর বাড়ির ছয় ফুট নীচে নাকি রয়েছে শিব মন্দির, তাতে শিবলিঙ্গ ও মোহর ভর্তি ছয়টা সোনার ঘড়া। বাড়ির দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো তিনটি ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে উনি তন্ত্র, মুসলিম ও খ্রীস্টান মতে সাধনা করছেন। “মিশনকে জানাব, তারা এসে পরম সমাদরে ঘড়া সমেত আপনাকে নিয়ে যাবে” বলে বেরিয়ে পড়েন প্রবীর ঘোষ। 


এখন যুক্তিবাদীদের খুব ছোট্ট একটি প্রশ্ন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে, “ব্রহ্মবিদ”, “অবতারবরিষ্ঠ” মিশনের পরমারাধ্য রামকৃষ্ণদেবের “দৈববাক্য” কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে, মিশন কবে রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবরকে ‘সপার্ষদ’ মিশনে এনে সশ্রদ্ধায়  বরণ করবে? নাকি তারা আগের মতই প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে তাদের পরমারাধ্যেরই বাক্যে চূড়ান্ত অবিশ্বাস  প্রমাণ করবে?  জানার অপেক্ষা রইল। 


সহায়ক গ্ৰন্থ;

১.স্বপ্নজীবন 

২. অলৌকিক নয় লৌকিক চতুর্থ খন্ড


সক্রেটিস এখনও জীবিত রয়েছেন -সাহাদাত হোসেন
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0



একটি দেশের সরকার কেমন হবে সেটা নির্ভর করে সেই দেশের জনগণ কেমন তার উপরে। এই দেশের রাজনৈতিক দলের চরিত্র কেমন হবে সেটা নির্ভর করে সেই দেশের জনগণের চরিত্র কেমন তার উপরে।

 কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন উন্নত কোন দেশে সফরে যান তখন তার চরিত্র অবলোকন করে তারা বলে দিতে পারেন সেই দেশের মানুষের চরিত্র কেমন। তাই কেবলমাত্র একটি দেশের ক্ষমতাসীন দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের চরিত্র দেখেই সেই দেশের মানুষের চরিত্র নির্ণয় করা যায়।


একটি উদাহরণ দিচ্ছি, পূর্বে আমাদের গ্রামে প্রতি রবিবারে সালিশের দিন নির্ধারণ করা হতো। কারণ ওই দিন আব্বার ছুটি ছিল। জি. এম. হবার কারণে পুরো জুট মিলের দায়িত্ব ছিল তার উপর। কঠোর পরিশ্রমের পর একটা দিন তার আরাম করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটিও সম্ভব হতো না। শনিবার দিন বিকালেই গ্রাম থেকে লোকজন এসে হাজির হত। বলতো, ভাই আগামীকাল সালিশে আপনাকে যেতে হবে। উনি যেতে চাইতেন না কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। বলতেন আপনি না গেলে আমরা ন্যায় বিচার পাব না। আপনাকে কষ্ট হলেও যেতে হবে। তাই তিনি যেতে বাধ্য হতেন।


চাকুরী থেকে পদত্যাগ করার কয়েক বছর পর গ্রামের কিছু লোক আব্বাকে বলল ভাই আমাদের গ্রামে চেয়ারম্যান নাই। আপনাকে আমরা চেয়ারম্যান বানাতে চাই। তিনি বললেন আমার অত টাকা পয়সা নাই এবং আমি টাকা পয়সা খরচও করতে পারবো না। তারা বললেন, আপনার কোন টাকা পয়সা খরচ করতে হবে না আমরা বিনা পারিশ্রমিকে আপনার জন্য কাজ করব। শুধু আপনি নমিনেশন এর টাকা জমা দিন।

তারপর যখন নির্বাচনী প্রচার শুরু হলো তখন আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিভিন্ন মুরুব্বিদের পা ধরে সালাম করতে লাগলো। সিগারেটের প্যাকেট গুলো ডিল দিয়ে প্রত্যেককে দিতে লাগলো। চা- নাস্তার জন্য টাকা বিলি করতে লাগল। গ্রাম্য প্রভাবশালী ও দুর্নীতি বাজদের অর্থ দিয়ে দলভুক্ত করতে লাগল কিন্তু আব্বা এসবের কোনটাই করলেন না। 


উনাকে এই ব্যাপারে বলা হলে তিনি রেগে যেতেন এবং বলতেন  টাকা খরচ করে ও দুষ্কৃতিকারীদের তেল মেরে  চেয়ারম্যান হবার কোন প্রয়োজন আমার নাই। আমি জনগনের  অর্থ আত্মসাৎ করতে পারব না। জনগন যদি আমাকে যোগ্য মনে করে ও ভালবেসে ভোট দেয় তবে আমি চেয়ারম্যান হব। এই ইউনিয়নের মানুষ জানে আমি কেমন লোক এবং আমি তাদের কতটা উপকার করেছি। দুই চারজন বাটপারের কথায় তোমরা বিভ্রান্ত হইও না।

 কিন্তু ইতিমধ্যেই এই সাধারণ মানুষ বলাবলি শুরু করে দিয়েছে, তোমারা দেখেছ রমিজ সাহেব কত অহংকারী। এখনই এই অবস্থা, না জানি চেয়ারম্যান হলে তার বাড়ির সীমানাতেও ঢোকা যাবে না। উনি এখনই আমাদের কাছে আসে না আর যদি একবার চেয়ারম্যান হয়ে যায় তাহলে তিনি ঢাকা শহরেই থাকবেন। আমাদের এইরকম যোগ্য লোকের দরকার নাই। ওই পাশের গ্রামের ফজলু চেয়ারম্যান অযোগ্য ও খারাপ হলেও আমাদের জন্য ভালো। যে যায় লংকায় সেই হয় হনুমান। আমরা ফজলুকেই ভোট দিব। নির্বাচনের দিন ফল ঘোষণা হলো। ইউনিয়নের অন্যান্য সেন্টারে উনার পাত্তাই নাই। উপরন্ত নিজ সেন্টারেই উনার অবস্থান তৃতীয়। 


১৬ বৎসর পুর্বে আমাকে আমাদের থানার জাসাসের সভাপতি বানাতে চাইল। দাওয়াত পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিটিং-এ গেলাম। তারা নির্লজ্জভাবে তাদের এম. পি. সাহেবের চামচামি ও অন্য পক্ষের এম. পি.-কে গালিগালাজ করল। আমাকেও বক্তব্য দিতে বলল। আমি অপারগতা প্রকাশ করায় আরা বলল, আপনি এত জ্ঞান রাখেন অথচ কিছু বলতে পারলেন না। মূলত আমি এই ধরনের মানসিকতা অর্জন করি নাই। এদের সাথে তাল মিলিয়ে কোন ভাল মানুষ চলতে পারে না। যারা পারে তারা ভাল মানুষ হতে পারে না।

এই ধরনের অসচেতন জনগণকে নিয়ে রাজনৈতির দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইত্যাদি গঠন করা ও সঠিক পথে পরিচালনা করা অত সহজ কাজ নয়। সমাজে সর্বাপেক্ষা মহৎ কাজ তারাই করছেন যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে ও বিনাস্বার্থে মানুষকে সচেতন করার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাজে কিছু লোক এখনও বিদ্যমান রয়েছে যারা রাস্তাঘাট, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, বাস ট্রেনসহ যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। ক্ষমতা ও পদ লোভহীন এই সকল ব্যক্তিরাই হল এই যুগের সক্রেটিস।


পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তি -সৌমেন মণ্ডল
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তি নিয়ে এক ফেসবুকের বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই অক্সিজেনের উৎপত্তি নিয়ে একটা কোয়ালিটেটিভ আলোচনা করছি। খুব বেশি টেকনিক্যাল জারগণের মধ্যে না গিয়ে অল্প কথায় বোঝাবার চেষ্টা করছি। 

প্রশ্ন যদি এটা হয় পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তি কোথা থেকে বা কী থেকে? তার উত্তর হবে একটাই সেটা হলো জল থেকে। জলের একটি অণু যথাক্রমে দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। এবার জলের অণু ভাঙতে পারলেই আমরা অক্সিজেন পেয়ে যাব।

পৃথিবী সৃষ্টির পরে পরে যখন পৃথিবীতে কোন প্রাণ ছিল না তখন পৃথিবীতে অক্সিজেন অণু এসেছে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে জলীয়বাষ্পের বিয়োজনের জন্য যেটাকে আমরা ইংরেজিতে photo dissociation of water molecule বলি। পৃথিবীর প্রথমদিকে বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর ছিল না কারণ অক্সিজেনও ছিল না ফলে অতিবেগুনি রশ্মির জন্য জলীয় বাষ্প ভেঙে অক্সিজেন উৎপত্তি হয়। সময়ের সাথে সাথে খুবই ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেন অণুর পরিমাণ বাড়তে থাকে। অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে জলের বিয়োজন পদ্ধতি একটি ধীর পদ্ধতি। যদিও অনেক সময় পাওয়ায় (কোটি বছর) বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ওজোন স্তর সৃষ্টি ও প্রাণীর উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখার জন্য যথেষ্ট হয়। পরে যখন সালোকসংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবের উৎপত্তি হয় ক্লোরোফিল অণুর উপস্থিতিতে সূর্যালোক থেকে শক্তি ধরে জল বিয়োজনের ফলে অক্সিজেনের উৎপাদন আলাদা এক মাত্রা ধারণ করে। খুব সরলভাবে বললে অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে জলের photo dissociation cross section এর মান খুব বেশি নয়, ফলে এটি একটি ধীর পদ্ধতি। অন্যদিকে ক্লোরোফিলের উপস্থিতিতে জল বিয়োজন পদ্ধতির হার অনেক দ্রুত। যার ফলস্বরূপ আমরা বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের যা পরিমাণ দেখি তা সমুদ্রে উপস্থিত ক্লোরোফিলধারী বিভিন্ন অণুজীবরা দায়িত্ব নিয়ে উৎপাদন করে বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। 


এইতো মোটামুটি খুব হালকাভাবে বোঝা গেলো পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তির কারণ। এইবার মনে প্রশ্ন আসে যে পৃথিবীতে জল এলো কোথা থেকে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদেরকে পৃথিবী সৃষ্টির আগের মুহূর্তে যেতে হবে। সৌরজগৎ সৃষ্টির সবথেকে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও  পদার্থবিদ Pierre-Simon, marquis de Laplace, তিনিই প্রথম নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে অন্যভাবে উপস্থাপন করেন এবং বলের ধারণাকে পাল্টে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ধারণা দেন। তিনি সৌরজগৎ উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত নেবুলার  স্বীকার্যের (nebular hypothesis) জন্ম দেন। এই নেবুলার স্বীকার্য যা এখন মোটামুটি ভাবে একটি তত্ত্বে উপনীত ও বিজ্ঞানী সমাজে সর্বজনবিদিত। এই স্বীকার্য অণুসারে আদি সৌরজগৎ একটি গ্যাস ও ধূলিকণার ঘূর্ণায়মান চাকতি ছিল, বিভিন্ন অংশ মাধ্যাকর্ষণের জন্য একত্রিত হয়ে সূর্য ও যথাক্রমে অন্যান্য গ্রহ সৃষ্টি করেছিল। এইবার আমরা যদি গ্যাস ও ধূলিকণার উপাদানের দিকে তাকাই এই উপাদানের মুখ্য অংশ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এবং এর সাথেও অল্প পরিমানে উপস্থিত থাকে বিভিন্ন সরল জৈব, অজৈব যৌগসমূহ ও ক্ষুদ্র বরফকুচি ও জলীয় বাষ্প। গ্যাসের চাকতি থেকে পৃথিবী সূর্য অন্যান্য গ্রহ সৃষ্টি হওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে বড় বড় বরফের চাঁই  সৃষ্টি হয় যার কিছু অংশ এখনও ধূমকেতু হয়ে এবং rockey object হয়ে asteroids belt-এ ঘুরে বেরাচ্ছে। পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিকে এই বড় বড় বরফের উল্কা পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জল যুক্ত করে। পরে পৃথিবী শীতল হলে এগুলো ঘনীভূত হয় সমুদ্রের সৃষ্টি করে। এই গেল মোটামুটি হালকা ভাবে পৃথিবীতে জলের উৎপত্তি। 

এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয় Napoleon যখন Laplace এর কাজ দেখে জিজ্ঞাসা করে যে আপনার এই গাণিতিক কাজে ঈশ্বরের জায়গা কোথায়? তখন তিনি যে বিখ্যাত উত্তর দেন সেটি হল

 “Sir, I have no need of that hypothesis.”

(Napoleon asked Laplace where God fit into his mathematical work, and Laplace famously replied “Sir, I have no need of that hypothesis.”)

 আমরা আবার প্রশ্ন করতে পারি সৌরজগতের শুরুর দিকে যে গ্যাসের চাকতি ছিল তাতে জল এলো কোথা থেকে?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা তারার মৃত্যু নিয়ে কথা বলব। বড় বড় তারাদের আয়ু অসীম নয়, তা আমরা বলতে পারি আমাদের মানুষের আয়ুকালের সাপেক্ষে সত্যিই অসীম। তারাদের মধ্যস্থ জ্বালানি শেষ হলে একসময় তাদেরও মৃত্যু হয়। তারার ভিতরে সাধারণত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং নিউক্লিয় সংযোজন এর কারণে উৎপন্ন শক্তিতে তারা জ্বলতে থাকে। (এছাড়াও কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্রের মাধ্যমে কিছু তারা শক্তি উৎপাদন করতে পারে এটি এখন আমরা আলোচনার মধ্যে আনছিনা)! এবার যখন তারার মধ্যে হাইড্রোজেন শেষ হয়ে আসে, তারা তাঁর তীব্র বেঁচে থাকার ইচ্ছার জন্য  হিলিয়ামকেও সংযোজন করে অন্যান্য ভারী মৌল তৈরি করতে শুরু করে এবং এই পদ্ধতি চলতে থাকে যখন না সে লোহার নিউক্লিয়াস তৈরি করা শুরু করে। লোহা তৈরি হয়ে গেলে মৃত্যু পথযাত্রী তারার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে যায়। কারণ লোহা হল এমন একটি মৌল যাকে বেচারা তারা আর সংযোজন করে অন্য মৌলে রূপান্তরিত করতে পারে না। তার জীবন মোটামুটি ভাবে ওখানেই শেষ হয় এবং তারার ভর অণুযায়ী তারাদের মৃত্যু বিভিন্নভাবে হয় যার গভীরে যাচ্ছি না। কিন্তু মোটামুটি ভাবে বললে এরপরে বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারার মৃত্যু হয় এবং তারা মধ্যস্থ বিভিন্ন মৌল ও গ্যাস মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ওই উপাদান সমূহ মহাকর্ষের কারণে একত্র হয় এবং বিভিন্ন গ্যাস, জৈব ও অজৈব যৌগ, জল, বরফ ইত্যাদি সমন্বিত গ্যাসের মেঘ তৈরি করে মহাকাশে ভেসে বেড়ায়। যেহেতু তারার বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন গ্যাসে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি সহ অন্যান্য মৌলসমূহ থাকে এবং শীতল হওয়ার সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিক্রিয়া হয়ে যে সমস্ত উপাদান তৈরি হয় তা নতুন গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ তৈরি করে। মোটামুটি ভাবে এই হল মহাকাশীয় গ্যাসের মেঘে জল থাকার কারণ। 

এইভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সময়ের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে বিগ ব্যাং অব্দি চলে যেতে হবে, যার সম্পর্কে জ্ঞান আমার একদমই নেই তাই এই গল্প এখানেই শেষ করে নোটে গাছ মুড়িয়ে পালাচ্ছি। 

বিশদে জানতে আমি একটি বই সাজেস্ট করব। সেটি হল Carl Sagan’s এর লেখা Pale Blue Dot।


নাস্তিক বনাম নাস্তিক -রাজু দত্ত
May 20, 2025 | যুক্তি | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভজহরিবাবু নাস্তিক। তিনি দৈনন্দিন জীবনযাপনে কোনওপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে চলেন না। কোনও উপাসনালয় যান না। ভূত-প্রেত-জ্যোতিষসহ সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হন এইসকল বিশ্বাসীরা‌। বাবার মৃত্যুর পর তিনি ‘শ্রাদ্ধ’ জাতীয় অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াননি। এমনকি চৌদ্দ দিনের ‘অশৌচ বিধি’ও তিনি মানেননি। 


তাঁর পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও পরিচিত সকলেই জানেন যে ভজহরিবাবু ঘোর নাস্তিক। তবে তাঁরা কখনও তাঁকে এবিষয় কোনওরকম ব্যক্তি আক্রমণ করেন না। কারণ ভজহরি বাবু বিপদে আপদে সবসময় সবার আগে শত্রু-মিত্র সবার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “আমি মানবতায় বিশ্বাসী। মানবতাই আমার ধর্ম।”  তিনি  জোর জবরদস্তি কারো বিশ্বাসে আঘাত হানেন না। স্পষ্ট বলেন “আমার যুক্তি তুমি যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে দেখাও, তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নেবো।”। তারা জানেন ভজহরিবাবুর সাথে যুক্তি-তর্কে পেরে ওঠা অসম্ভব, তাই তাঁর সাথে তর্কে জড়ান না। তারা বলেন, “নাস্তিক বটে, তবে ভজহরিবাবুর মত মানুষ আজকের দিনে বিরল বৈকি।” এহেন ভজহরিবাবুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল, তারই কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ‘নাস্তিক’ বন্ধু বান্ধবের সৌজন্যে। 


এই জনৈক নাস্তিকের ফেসবুকে একটি সাম্প্রতিক আলোকচিত্র (ফটো) পোস্ট করার পর যত গোলমালের সূত্রপাত। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সস্ত্রীক একটি মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই মন্দিরের পুরোহিতের সাথে তিনি কথা বলছেন। আসলে তিনি একটি জরুরী কাজে গিয়েছিলেন, ফেরার পথে জনৈক পরিচিত, যিনি পেশায় পুরোহিত তার সাথে কথা বলছিলেন। ব্যস্! একজন নাস্তিকের এহেন আচরণ মেনে নিতে পারলো না ‘নাস্তিক সমাজ’ এর অনেকেই। তারা ভজহরিবাবুর ছবিটির উৎস, কার্যকারণ কিছুই বিচার-বিবেচনা না করে ছবিটি ব্যাপক হারে শেয়ার করতে লাগলেন। 


ছবির সাথে যে ক্যাপসনগুলি তারা লিখলেন তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন ভজহরিবাবু। একজন লিখেছেন, ‘সস্ত্রীক পুজো দিয়ে ফিরছেন নাস্তিক ভজহরি।” একজন লিখেছেন, ‘নাস্তিকও মন্দিরে যায়, দেক্লে হবে খচ্চা আচে।” একজন বিনম্র নাস্তিক যিনি বিভিন্ন সময়েই সামাজিক- রাজনৈতিক আন্দোলনে তীব্র ফেসবুকীয় প্রতিবাদে সামিল হোন, তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লিখেছেন, “এইসব ভন্ড নাস্তিকদের জন্য প্রকৃত নাস্তিকদের বদনাম হয়। এদের বয়কট করুন।” সরস ভঙ্গিতে একজন লিখেছেন, “ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে।”


উক্ত পোস্টগুলির কমেন্টবক্সে কমেন্টগুলিতে ভজহরিবাবুর প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিদ্রুপ উপচে পড়ছে। কমেন্ট, পাল্টা কমেন্টের স্ক্রিনশট ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে। নাস্তিক-আস্তিক একযোগে আক্রমণ করেছে ভজহরিবাবুকে। ব্যতিক্রম বলতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নাস্তিক। যাঁরা ভজহরিবাবুর পক্ষে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করছেন। তাদের সেই মন্তব্যের আবার স্ক্রিনশটও পোস্ট করছেন অন্য নাস্তিকরা। এইসব ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপই কেন্দ্রবিন্দু এখন।


ভজহরিবাবুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।‌ পথে-ঘাটে, বাড়িতে, অফিসে সর্বত্র তাকে কটূক্তি-অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। আজ সকালে পাড়ার এক নাস্তিক বন্ধু তাকে ‘নাসসস্ তিকক্’ বলে বিদ্রুপ করেছেন। উপস্থিত সবাই হো-হো করে হেসে উঠেছে। নাস্তিক ভদ্রলোক বললেন, ‘নাস্তিক হওয়া অত সহজ নয় বুঝলি হরি, অনেক পড়াশোনা করতে হয়”। ভজহরিবাবুর বিরুদ্ধাচরণ করার একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে যেন। নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁরই কয়েকজন নাস্তিক বন্ধু-বান্ধব। 


গভীর অস্ফুট যন্ত্রণার আবেগ আর মানসিক অবসাদে তাঁর যুক্তিবোধ ঢেকে গেল। তিনি এই দুর্দিনে কাউকেই পাশে পেলেন না। দু-একজন বন্ধুর (নাস্তিক) পরোক্ষ সান্ত্বনাতেও মানসিক অবসাদের কণামাত্র দূর হল না । বৃদ্ধ ভজহরিবাবু চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। সকলের অলক্ষ্যে তীব্র বিষাক্ত কীটনাশক পান করলেন। তারপর...


না, মৃত্যু হয়নি ভজহরিবাবুর। তাঁর স্ত্রী, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রবল আস্থাশীল এবং পাড়া প্রতিবেশীরা যারা সকলেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী এদের তৎপরতা এবং মুষ্টিমেয় কয়েজন বন্ধুর (নাস্তিক) ঐকান্তিক সহযোগিতা ও সর্বোপরি ডক্টর সৈফুদ্দিন (নাস্তিক)-এর সুচিকিৎসায় তিনি বেঁচে গেলেন।‌ তার এই কঠিন সময় মিশে গেলো আস্তিক-নাস্তিক সকলে। জয় হল মানবতার। 


ভজহরিবাবুর গল্পটা কাল্পনিক।‌ তবে সাম্প্রতিক সময় নাস্তিকদের এই রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সবাই হয়ত আত্মঘাতী হবার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেন না, কিন্তু একদল নাস্তিকের এইরকম আচরণে আর একদল নাস্তিককে চরম মূল্য দিতে হয়। নাস্তিক বনাম নাস্তিক লড়াইটা চলতেই থাকে।


দৈনন্দিন জীবনে আমরা যাদের সাথে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কে জড়িয়ে তারা অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, জ্যোতিষ, ভূত-প্রেতসহ বিবিধ কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আমরা যে মুদি দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকি ও রাত্রে  পরিবারের যে সদস্যদের সাথে ঘুমোতে যাই, তাদের অধিকাংশই আস্তিক। তাদের সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে নাস্তিকদের নিজস্ব একটা পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে রাতারাতি। 


আমাদের পৃথিবীতে এখনও আস্তিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী থেকে সাহিত্যিক, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পীসহ সকল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশ আস্তিক। যে স্কুলে বা কলেজে আমরা পড়াশোনা করি, যে কর্মস্থল আমাদের উপার্জনের সম্বল, সেখানে আমাদের সহপাঠী ও সহকর্মীরা অধিকাংশই আস্তিক। ট্রেনে, বাসে, বিমানে, জাহাজে আমাদের সহযাত্রীদের অধিকাংশই আস্তিক। যে কৃষক ফসল ফলান, যে শ্রমিক পণ্য উৎপাদন করেন, আমাদের বাড়ি থেকে  রাস্তাঘাট সমস্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন, যে সকল বিক্রেতাদের দোকান থেকে আমরা পণ্য ক্রয় করি, যে চালক আমাদের গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেন, যে পরিচারিকা আমাদের গৃহকার্যে সহায়তা করেন, যে সকল মানুষ আমাদের অব্যবহার্য বর্জ্য পরিষ্কার করে পরিবেশ পরিষ্কার রাখেন, যে সেবিকা আমাদের অসুস্থতার সময় শুশ্রুষা করেন, তাদের অধিকাংশই আস্তিক। এদের সকলকে এড়িয়ে আমরা বাঁচতে পারবো কি?

মনে রাখবেন, নাস্তিকদের নিজস্ব পৃথিবী এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিপুল সংখ্যক আস্তিকদের ভিড়েই তাদের থাকতে হয়। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে তো থাকা সম্ভব নয়। কাজেই, সকলের কাছে আমার বিনীত আবেদন, একটি ছবি ভিডিও বা স্ক্রিনশট দেখিয়ে কোনও একজন নাস্তিককে রাতারাতি ভন্ড প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না। তার উৎস, কার্যকারণ সম্পর্ক বিবেচনা করে যদি প্রমাণিত হয় তিনি ভন্ড তবে এর দায় কেবল তাঁর। সকল নাস্তিকদের  ঘাড়ে দ্বিচারিতার দায় চাপিয়ে তাঁদের আদর্শকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টাও অনুচিত। মনে রাখবেন আগামী দিনগুলি কেবল মানবতার। সেখানে থাকবে না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অস্তিত্ব। মানুষ বাঁচবে ‘মানুষ’ হয়ে।


ভারতীয় মানসে শ্রেণীচেতনার অভাব -মনীশ রায়চৌধুরী
May 20, 2025 | রাজনীতি | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বর্তমান ভারতের অধঃপতনের অন্যতম কারণ শ্রেণী চেতনার অভাব। এই দৈন্যতার ফলেই মানুষ তার শত্রু-মিত্র চিনতে বারবার ভুল করছে। ভোটের  সময়ও তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করছে। ফল ভুগছে, কিন্তু ঐ যে বললাম শ্রেণী চেতনার অভাব, ফলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। 


মানুষের শ্রেণী চেতনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবশ্যই বিচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষ গড়ার একমাত্র মাপকাঠি নয় ঠিকই, কিন্তু অন্যতম জরুরি একটা মাপকাঠি। অন্তত, একটা স্তর পর্যন্ত প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে কোনও মানুষ নিপীড়িত, বঞ্চিতদের জন্য যতই সৎভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করুক একটা সময়ে বাধাপ্রাপ্ত হবেই। আধুনিক শিক্ষার অভাবে তার পক্ষে বিশ্বে পূর্বে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের সফলতা বা ব্যর্থতার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। প্রয়োজন অনুসারে নতুন রণকৌশল অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা দেখা যাবে। আধুনিক শিক্ষার অভাবে সংগ্রামী জনতাকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করা গেছে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এমন উদাহরণও বিরল নয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল, ভিল, মুন্ডা বা চুয়াড় বিদ্রোহ সেই সময়ে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু ইংরেজরা সেই বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয় কারণ বিদ্রোহী জনতার কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল।


ভারত বহু ভাষা, ধর্ম, জাতির দেশ। তাই ইউরোপীয় দেশগুলোর মত এখানকার মানুষের শ্রেণীচরিত্র বোঝা অত সহজ নয়। লোকসভা বা বিধানসভা প্রতিটি নির্বাচনেই প্রার্থীর ভাষা, জাতি, ধর্ম বড় ভূমিকা পালন করে।


মহারাষ্ট্রকে ভারতের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘকাল এখানে কংগ্রেসের শাসন ছিল। তারপর মারাঠি অস্মিতার উপর ভর করে বালাসাহেব ঠাকরের উত্থান শুরু হল। ‘মারাঠি মানুষ’ আবেগ তৈরি করা হল। নিজের ভাষা, সংস্কৃতির উপর গর্ব অবশ্যই ভালো। কিন্তু যখনই তা অন্যদের প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি করে তখনই ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। বালাসাহেবও সুকৌশলে মারাঠি আবেগের নামে বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু করলেন। মহারাষ্ট্র থেকে মারাঠি বাদে অন্যদের, বিশেষত বিহারিদের মেরে তাড়ানো শুরু হল। ১৯৮৯ সালে তার দল শিবসেনা বিজেপির সাথে জোট গঠন করে। মারাঠা মানেই শিবাজি, শিবাজি মানেই ঔরঙ্গজেবের সাথে দ্বন্দ, মানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ, অর্থাৎ হিন্দুরাজত্বের সূচনা। এমন সহজ সমীকরণই দুটো দলকে কাছাকাছি এনেছিল। ১৯৯৫ তে শিবসেনা প্রথমবার মহারাষ্ট্রতে ক্ষমতা দখল করে। দেখতে দেখতে মহারাষ্ট্রতে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেতে শুরু করেন। তার ইচ্ছাই মারাঠিদের কাছে ঈশ্বরের বিধান হতে শুরু করল। শিবসেনা বা বালাসাহেবের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটা প্রতিবাদী কন্ঠকে মারাঠি ভাবমূর্তিতে আঘাতের অজুহাতে স্তব্ধ করে দেওয়া হতে থাকল। ২০১৬ সালে শিবসেনার ঘোষিত সম্পত্তিই ছিল ৩৯৫.৬৮ মিলিয়ন টাকা। এই বিপুল সম্পদ যে সৎপথে অর্জিত হয়নি সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয়না। কিন্তু, মারাঠি জনতার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? শাহরুখ, শচীন, অমিতাভের বিলাসবহুল বাড়ি বা জুহুবিচ কি মেরিন ড্রাইভই তো মহারাষ্ট্র নয়। অগণিত মারাঠি মানুষ বস্তিতে গাদাগাদি করে জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের কতটুকু উন্নতি ঘটল? কিন্তু, মানুষ এইসব প্রশ্ন তুলতেই ভুলে গেছে কারণ শিবসেনা তাদের কাছে মারাঠি আবেগের প্রতীক। বছরের পরে বছর তারা সেই আবেগের ললিপপ চুষে চলেছে। 


বিহার এবং গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে ভোট হলেও সেই জাতপাত সামনে চলে আসে।

যাদব শুধু যাদব প্রার্থীকেই ভোট দেয়। ব্রাহ্মণ ভোট ঠাকুররা পাবে। দলিত ভোট দলিত বা ‘পিছড়া বর্গের’ লোক পায়। এবারে উত্তরপ্রদেশের ভোটে জিতে বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ পুনরায় সরকার গঠন করেছে। প্রায় কোনরকম জনকল্যাণমুখী কাজ না করেও যে ক্ষমতায় ফেরা যায় উত্তরপ্রদেশ তার নজির হয়ে থাকল। এই জয়ের অন্যতম কারণ ভোট কাটাকাটি। ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্গের দরিদ্র মানুষ আরও বেশি দরিদ্র হয়েছে, অনেকেই কাজ হারিয়েছে। তাদের অনেকেই বুঝতে পারছে এই কুশাসনে তাদের কোন উন্নতি নেই। তবু তারা বিজেপকেই ভোট দেবে। কারণ তাদের বোঝানো হয়েছে বিজেপি হিন্দু ধর্মের রক্ষক এবং তারা না থাকলে মুসলমানরা সব দখল করে নেবে। অর্থাৎ প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় তার ধর্ম পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক ঠাকুর, ব্রাহ্মণদের বলতে শোনা গেছে মুসলমানদের পার্টি হল কংগ্রেস, যাদবদের দল সমাজবাদী পার্টি, দলিতদের দল বিএসপি, মানছি যোগী সরকার ততটা উন্নতি করেনি কিন্তু আমাদের দেখার আর কোন দল নেই। 


কিন্তু এই ধর্মীয় জাতপাতের গোঁড়ামি শুধু আছে ভাবলে ভুল হবে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় নিজেরাও কিন্তু নিজেদের মানুষ ভাবার পরিবর্তে সংখ্যালঘু প্রমাণ করতেই সচেষ্ট থেকেছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্য যে এখনও মুসলিম প্রধান অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট পাওয়ার জন্য মুসলিম প্রার্থী দিতে হয়। এখানেও প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় ধর্মীয় পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে ইমাম ভাতা, হজ যাত্রার ব্যবস্থা কোন দল করে দেবে তাতেই তারা বেশি আগ্রহী। তাদের অধিকাংশ ইমাম এবং ধর্মগুরুরাও বুঝে গেছে এই ভেড়ার পালকে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখতে পারলেই তাদের ইচ্ছেমতো কাজে লাগিয়ে নিজেদের মৌরসীপাট্টা কায়েম রাখা যাবে।


দলিত, SC, ST, OBC প্রভৃতি তথাকথিত নিচু জাতের মানুষও কিন্তু এই মূর্খতা করে চলেছে। ১৯৬৪ সালে দলিত নেতা মান্যবর কাঁসিরামজী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তার নাম ‘বহুজন সমাজ পার্টি’। এরপর মায়াবতীর হাত ধরে দল দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসীন হয় বিএসপি, মুখ্যমন্ত্রী হলেন মায়াবতী। স্বাভাবিক ভাবেই দলিতরা তাদের আদরের ‘বেহেনজি’র মধ্যে মুক্তিদাতার ছবি দেখেছিলেন।

কিন্তু মায়াবতী গদিতে বসে চূড়ান্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করলেন। জনতার উন্নয়নের অর্থ দিয়ে সারা উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী, কাঁসিরাম এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতীক হাতির স্ট্যাচু নির্মিত হল। মায়াবতী সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের একটি PIL থেকে জানা যায় ৫২.২০ কোটি টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন পার্কে প্রায় ৬০ টি হাতির স্ট্যাচু তৈরি করা হয়। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ বাজেট বরাদ্দের ২০০০ কোটি টাকার প্রায় ৯০% তিনি ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রচারে অপচয় করেছিলেন। 

অথচ, এতকিছুর পরও দলিতদের কাছে তাদের ‘বেহেনজি’ একজন মসিহা। তারা বিএসপিকেই ভোট দেবে। দলিতদের সঠিক শ্রেণীচেতনা নেই বলেই তারা বুঝতে পারছেনা যে অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন মানুষের শ্রেণীচরিত্র বদলে দেয়। তাই কাঁসিরামের হাত ধরে যে যুব নেত্রী তাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর যে মায়াবতী গদিতে বসেই ব্যক্তিগত প্রচার এবং দুর্নীতির চোরা স্রোতে ডুব দিলেন দুজন মানুষ এক হলেও কখনওই আইডিওলজিতে এক থাকেনি।

এ-ই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। যে জননেত্রী বিরোধী থাকাকালীন কিছুটা হলেও মানুষের পাশে ছিলেন। সিপিএম সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেন। ক্ষমতায় বসার মাত্র ১১ বছরের ভিতরেই তিনি সিপিএমের ৩৪ বছরের রেকর্ডকে বহু পেছনে ফেলে দিয়েছেন।


শ্রেণীচেতনার অভাবে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দেবতা বানিয়ে ফেলা সংক্রান্ত এই লেখা দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ছাড়া তো সম্পূর্ণ হতেই পারে না। ফিল্মস্টার হোক বা রাজনৈতিক নেতা, তাদের দেবতা বানানোয় দক্ষিণ ভারতের বিশেষত তামিলনাড়ুর জনতার জুড়ি মেলা ভার। এম.জি. রামচন্দ্রন, করুনানিধি বা জয়ললিতা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা রাজনীতিতে নামতেই চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন। সাধারণ জনতা যখন অভুক্ত থেকেছে জয়ললিতা তখন টাকার গদিতে আরাম করেছে। সাধারণ মানুষের থাকার জায়গা নাই থাকতে পারে কিন্তু জয়ললিতার দেশি-বিদেশি জুতোর জন্যও আলাদা ঘর ছিল বলে তার ভক্তরা গর্ব করে থাকে। এমনকি তার মৃত্যুর পরে ‘আম্মা’র শোকে অনেকে আত্মহত্যা করেছিল। 


দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনতার চিনতে না পারার একটাই কারণ তা হল সঠিক শ্রেণীচেতনার অভাব। সঠিক চেতনা না গড়ে উঠলে তারা একই ভুল করতেই থাকবে। বর্তমানকালের উঠতি নেতা অভিষেক ব্যানার্জি, কানহাইয়াকুমার, কেজরিওয়াল হোক বা আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে ভোটে লড়া বারণ, তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি বুঝতে হলে সঠিক রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে, তবেই নতুন ভার‍ত গড়ে উঠবে।


সমকামীতাকে বিজ্ঞানের চোখে দেখুন? -মুজিব রহমান
May 20, 2025 | সচেতনতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমার এক সমকামী (মূলত রূপান্তরকামী) বন্ধু আছে। সে বলে, ‘আমার বাইরের অবয়বটা পুরুষের কিন্তু ভিতরের উপলব্ধিটা নারীর। ভিতরে একজন নারীত্ব নিয়ে কি করে আরেকজন নারীকে ভালবাসবো। ভিতরের নারী তো একজন পুরুষকেই কামনা করে।’ আমার এই বন্ধুকে এই সমাজ খুবই সন্দেহের চোখে দেখে। তার আত্মীয়রা মনে করে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলেই সমাধান হয়ে যাবে। তারা ভাবে এসব অনৈতিক, পাগলামি ও বিকৃত চেতনার। আমি কি বলতে পারি, এটা বিকৃত চেতনার? পারি না তো! কিন্তু এ সমাজে সে কিভাবে টিকে থাকবে? তার ভিতরের নারীত্ব আরেকজন পুরুষকেই সে কামনা করে। যদি সেই পুরুষ অবয়বের মানুষটিও ভিতরে নারীত্ব অনুভব করে তবে তারা সুখে দিন কাটাতে পারে।


শিশুদের বলাৎকার করা বা দুজন একই লিঙ্গের ব্যক্তির সাময়িক যৌনক্ষুধা মেটানোকেই আমরা সমকামীতা ধরে নেই। বাস্তবিক সমলিঙ্গের প্রতি তীব্র প্রেম ও আকর্ষণকেই বলে সমকামীতা। কেন একজন পুরুষ একজন নারীর পরিবর্তে আরেকজন পুরুষকেই কামনা করে? এটা কি মানসিক বিকৃতি? নাকি কোন মানসিক রোগ? বন্ধুটির দিকে তাকালেই বুঝবো বাস্তবিক তার কোনটিই নয়। সম্ভবত জিনের গঠনের কারণেই একজন পুরুষ বা নারী সমলিঙ্গের প্রতি প্রেম ও আকর্ষণ বোধ করে। পুরুষকে বলে গে আর নারীকে বলে লেসবিয়ান। অনেকে হরমোনের কথাও বলেন। তবে হরমোন দায়ী হলে এর চিকিৎসা সম্ভব হতো সহজে। এটা কোনভাবেই কোন মানসিক রোগ নয়। বহু স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞানীরা এটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন। সক্রেটিস, লর্ড বায়রণ, দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, রোমান সম্রাট হেড্রিয়ান, এলেন গ্রিন্সবাগসহ অসংখ্য মানুষ সমকামী বা উভকামী ছিলেন। বহু সাধারণ গে বা লেসবিয়ানকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে সমলিঙ্গের প্রতি প্রেম বা আকর্ষণ ছাড়া তাদের কোন মানসিক সমস্যা নেই।

তাহলে গে বা লেসবিয়ানদের এই সমস্যার জন্য দায়ী কে? কোনভাবেই তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নন। জিনের উপর তাদের হাত নেই। এই জিনের কারণে মানুষ ছাড়াও আরও বহু প্রাণির মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যায়। এমন কি ফিতা ক্রিমির মধ্যেও এমন প্রবণতা রয়েছে। ভেড়ার মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। মাছ, সরীসৃপ, উভচর বহু প্রাণীর মধ্যেও এমনটা লক্ষ্য করেছেন গবেষকগণ। তারা কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জিন, হরমোন ও পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার সন্ধানই পান। তার মানে এমন আচরণ করার ক্ষেত্রে তাদের করণীয় কিছু নেই। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি না হলে তারা বিয়ে করেও জীবন যাপন করতে পারবে না। সে এক অসম্ভব কষ্টকর জীবন যাপন। যাকে দেখে শরীর কথা বলবে না, তার সাথে তো শারীরিক চাহিদা মেটানোও সম্ভব নয়। অনেকটা একজন সাধারণ পুরুষের সাথে জোর করে আরেকটি পুরুষের বিয়ে দেয়ার মতো হবে। তাহলে?


ইংরেজরা সমকামীতা, উভকামীতা ও পশুকামীতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন করে যায়। ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে, অথবা বর্ণনা অনুযায়ী নির্দিষ্টকালের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে। বাংলাদেশে এই আইনটি এখনও বলবৎ। পৃথিবীর আরও ৭১টি দেশে সমকামীতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম আইন রয়েছে। কিন্তু ভারতসহ পৃথিবীর বাকি দেশগুলোতে সমকামীতা অপরাধ নয়। ভারতে আইনটির বিরুদ্ধে একজন সমকামী মামলা করলে আদালত আইনটি মানুষের অধিকার পরিপন্থী বিবেচনা করে বাতিল করে। এখন উন্নত দেশগুলো বোঝতে পারছে সমকামীতা শুধু যৌন প্রবৃত্তি দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। সমকামীতা শুধু শরীর সর্বস্বতা নয়। এখানে অনুভূতিটাই প্রধান। এজন্য এখন অনেক দেশে সমকামীদের বিয়েও রেজিস্ট্রি হচ্ছে। অনেক দেশেই তারা জনপ্রতিনিধিও হতে পারছেন। তাদের সামাজিক আন্দোলন শুধু আইনগত দিকেই নয়, মানুষের ভাবাদর্শ বদলাতেও কাজে লাগছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ দেশে এই আইন কঠোরভাবেই যেমন প্রয়োগ করা হয় আবার সামাজিকভাবেও তাদের নিগৃত হতে হয়। ঢাকার কলাবাগানে এমন এক জুটিকে মূর্খ মৌলবাদীরা হত্যা করে। তাতে বাংলাদেশের জিনগত কারণে সৃষ্ট এমন মানুষেরা আরও প্রকট সমস্যায় পড়েন। তারা হয় অধিক গোপনীয়তা অবলম্বন করেন নয়তো নিজের শরীরের চাহিদার বিপক্ষে গিয়ে বিপরীত লিঙ্গে বিয়ে করে চরম অসুখী জীবন যাপন করেন।


গত বছর পত্রিকায় দেখলাম, বাংলাদেশের নোয়াখালীর মেয়ে বিলকিস ভালোবাসার টানে টাঙ্গাইলের বাসাইলের মেয়ে আঁখির কাছে ছুটে এসেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকের মাধ্যমে পরস্পরকে খুঁজে পান। পরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানান দু’জনেই। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের উৎসুক বিভিন্ন বয়সি মানুষজন তাদের এক নজর দেখতে ওই বাড়িতে ভিড় করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি নতুন। আমাদের দেশে সমকামীতা থাকলেও তারা তা গোপনেই রাখেন। সামাজিক মাধ্যম না থাকলে দুই তরুণীর মধ্যে যোগাযোগও হতো না। বিলকিস আক্তার বলেছিলেন, ‘ফেসবুকে তাদের পরিচয় হয়। এরপর দুই বছর হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন। জড়িয়ে পড়েন প্রেমে। তবে তাদের এই সম্পর্ক মানতে পারছে না পরিবার। আমি আঁখিকে ভালোবাসি, তাই ওর কাছে চলে এসেছি। আমার ফ্যামিলিকে বলেছিলাম, ওর কাছে যাব। কিন্তু ওনারা রাজি হয়নি। তারা আমাদের সম্পর্ক মানবে না। তাই বাড়ি থেকে নিরুপায় হয়ে পালিয়ে এসেছি। এখন ওর পরিবার না মানলে আমরা দু’জনে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করব।’ আঁখি আক্তার বলেছিলেন, ‘বিলকিসকে নিয়ে আমি এর আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। আমরা ঢাকায় দেখা করেছি। ঢাকায় আমাদের ফ্যামিলি গিয়ে আমাদের আলাদা করে নিয়ে এসেছে। আমার ফোন নিয়ে নিয়েছিল। কয়েকদিন পর ফোন ফেরত দেয়। তখন আবার আমরা কন্ট্যাক্ট করে ওকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। সামাজিকভাবে আমাদের কেউ মানবে না। কিন্তু আমি ওর সঙ্গেই সারাজীবন থাকতে চাই। বাঁচলেও ওর সঙ্গে, মরলেও ওর সঙ্গে। পুলিশ বা তারা যদি আমাদের মেরে ফেলতে চায়, তাহলে দু’জনকে একসঙ্গেই মারবে। আর যদি বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে দু’জনকেই রাখতে হবে।’ আমাদের মিডিয়া কতিপয় মূর্খ অধ্যাপক ও ডাক্তারের মতামত নিয়েছে। তারা এটাকে বিকৃত যৌনাচার বলে দিয়েছে। তারা বলেছে এটা সাময়িক! কিন্তু এটা সাময়িক নয়। ছবি দেখেই বুঝেছেন এরা দরিদ্র পরিবারের। এরা খাঁটি সমকামী! 

রূপান্তরকামীর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশে পুরোটা নেইও। মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শে প্রথমে হরমোন দিবে ডাক্তার। সেটা কার্যকরী না হলে অপারেশন করে দুজনকেই পুরুষ করে ফেলতে হবে। কারণ তাদের ভেতরটা পুরুষের। পুরুষের হরমোন প্রয়োগে তাদের বাইরের অবয়বও বদলে যাবে। তখন দুজনই দুজন নারীকে বিয়ে করে নিতে পারবেন। বাংলাদেশে টিএমএসএস এর নির্বাহী পরিচালক পুরুষ থেকে নারী হতে পেরেছিলেন। তিনি পরে তার সহপাঠী পুরুষকে বিয়েও করেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।

জোর করে শিশুদের বলাৎকার করাটা ধর্ষণযোগ্য অপরাধ। কিন্তু দুজন গে বা লেসবিয়ান যদি স্বেচ্ছায় নিজেরা সুখে জীবন যাপন করেন তবে তা কি অপরাধ হয়? জিনের ত্রুটির দায়টা ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিতে কি মানুষ পারে? এসব প্রশ্নের জবাবটাই বাংলাদেশের আইন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা এসব বিষয় গোপন করতে চাই এবং কথা বলতে চাই না। ফলে সমস্যা চুপিচুপি বাড়তেই থাকে। সবদেশের আইনই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।


ইসরো প্রধান ও ‘সবই ব্যাদে আছে’ -সমূদ্র সেনগুপ্ত
May 20, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সাহা, বোর, স্রয়ডিংগার, হাইসেনবার্গ, আইনস্টাইনদের মতো ইন্টেলেকচুয়াল জায়েন্টদের সাথে ইসরো প্রধান সোমনাথের নাম জুড়ে ভক্ত কুলের লাফালাফি যাদের অসহ্য মনে হচ্ছে, এই লেখা তাদের জন্য।

ইসরো বিজ্ঞানীর মন্তব্য, তাকে ঘিরে মেঘনাদ সাহার “সবই ব্যদে আছে” বলে প্রত্যুত্তর, তার মিম, তার উত্তরে আবার হাইজেনবর্গ এর উদ্ধৃতি নিয়ে পাল্টা মিম ইত্যাদি তর্ক বিতর্কের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখবেন আসলে সবই “এপিল টু অথরিটি” নামের ফ্যালাসিতে ভরপুর। একটা ডাহা মিথ্যে কথাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসরো চিফ সোমনাথ নামক বিজ্ঞানীর (উনি কতটা বড় বিজ্ঞানী সে নিয়ে প্রশ্ন আছে) উক্তি নিয়ে ভক্তদের লাফালাফি, সেই দেখে মেঘনাদ সাহার উদ্ধৃতি হাতিয়ার করে বিপক্ষের নেমে যাওয়া এই গোটা কাজিয়া তে যেটা হারিয়ে হচ্ছে সেটা হল বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ। 


পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নিউটনের বলবিদ্যার রমরমা ছিল অনেকদিন। 1920 দশকের গোড়ায় সেটা ধাক্কা খায়। সাব এটমিক পার্টিকল যেমন ইলেকট্রনের কিছু চলন বলন ওই নিউটনীয় গতিবিদ্যার সূত্রগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। ফলে প্রধানত তিন পদার্থবিদ, ডেনমার্ক এর নীলস্ বোর, অস্ট্রিয়ার আরউইন স্রয়ডিংগার আর জার্মানির ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এর হাতে পদার্থবিজ্ঞানের একটা নতুন ধারণার জন্ম নেয় যেটা পূর্ণতা পায় 1930 দশকের গোড়ায়। এর নাম কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। 


গোলমালটা শুরু হয় এর পরেই। নিউটনের বলবিদ্যার ধ্যান ধারণা তার সরলতার জন্য খুবই জনপ্রিয় ছিল, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে গোড়ার দিকের ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে কষ্ট হত না। অন্যদিকে এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর ধ্যানধারণাগুলি এতটাই জটিল ছিল, এতটাই বৈপ্লবিক ছিল, যে সাধারণ ছাত্র ছাত্রী তো বটেই, অনেক প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিদও ঘেঁটে ঘ হয়ে গিয়েছিল। এর আবিষ্কারকদের ওপর নানান তাত্ত্বিক আক্রমণ নেমে আসে, পাগলামির অভিযোগ অবধি করা হয়।


তাঁদের তত্ত্বের জটিলতার অভিযোগে কিঞ্চিৎ বিপর্যস্ত ও বিচলিত এই তিন বিজ্ঞানীই দর্শনের মধ্যে তাদের আশ্রয় সান্ত্বনা (শব্দটা ব্যবহার করেছেন Fritjof Capra তার বইতে) খুঁজতে যান। ঘটনার পরম্পরাটা খেয়াল রাখতে হবে। যেমন  হাইসেনবার্গ তার uncertainty principle আবিষ্কার করে ফেলেন 1927 সাল নাগাদ। এর পরে 1929 সালে রবীন্দ্রনাথের তাঁর সাক্ষাত। ওই সাক্ষাৎকারের পরে উনি প্রাচ্য দর্শনে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। এবং বলেন যে,

 “After the conversation about Indian philosophy some of the ideas of quantum physics, that had seemed so crazy suddenly made much more sense”

নীলস্ বোর তাঁর বিখ্যাত Complementarity Principle আবিষ্কার করেন 1928 সালে করার অনেক পরে উনি চীন ভ্রমনে যান 1937 সালে এবং চৈনিক দর্শন Zhuang Zhou এর সাথে পরিচিত ও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। উপনিষদ এর সাথে পরিচিত ছিল অবশ্য আগে। ওই নিয়ে তাঁর পরিচিত উক্তি, 

“I go into the Upanishads to ask questions.” 


স্রয়ডিংগারের বিষয়টা সামান্য অন্য রকম। তাঁর বিখ্যাত ইকুয়েশন প্রকাশ পায় 1926 সালে। এর আগেই 1918 সাল নাগাদ বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক আর্থার সোপেনহাওয়ার এর লেখাপত্র এর মাধ্যমে স্রয়ডিংগার আকর্ষিত হন উপনিষদের প্রতি। ওই আকৃষ্ট হওয়ার একটা নমুনা হল তাঁর কুকুরের নাম। উনি নাম রেখেছিলেন আত্মন। এর অনেক পরে 1944 সালে প্রকাশিত তাঁর বইতে উনি উপনিষদ এর প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা জানিয়ে ছিলেন। 


যেটা লক্ষনীয় সেটা হল এই যে এই তিন বিজ্ঞানীর কেউ কোথাও কোনোদিন বলেননি যে বেদ উপনিষদ বা অন্য কোনো প্রাচ্য দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বা আইডিয়া ধার করে তাঁরা ওই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কার করেছিলেন। ত্রয়ী এর মধ্যে প্রাচ্য দর্শন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্ছসিত স্রয়ডিংগার যিনি বলেছিলেন যে

 “I do believe that this is precisely the point where our present way of thinking does need to be amended, perhaps by a bit of blood-transfusion from Eastern thought.” 

তিনিও কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ন কথা বলেছিলেন। ওঁর মুখে প্রাচ্য দর্শনের এই প্রশস্তি শুনে লাফালাফি করা ভক্তের দল ওই পরের কথাটা বাদ দিয়ে যায় সুকৌশলে। 

উনি এক নিশ্বাসে বলেছিলেন, 

"That (মানে প্রাচ্য দর্শনের রক্ত সঞ্চালন) will not be easy, we must beware of blunders — blood-transfusion always needs great precaution to prevent clotting. We do not wish to lose the logical precision that our scientific thought has reached, and that is unparalleled anywhere at any epoch.”

ভক্তের দল তো বটেই, যারা ততটা ভক্ত নন, কিন্তু বেদ, বেদান্ত, গীতা ইত্যাদির প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতা পোষণ করেন, তাদের অনুরোধ করবো স্রয়ডিংগারের ওই সাবধানবাণী উপলব্ধি করতে। পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ফলে যে যুক্তিবাদের তীক্ষ্ণতা অর্জিত হয়েছে, যে কোনো যুগে যার কোনো সমান্তরাল পাওয়া যাবে না, সেটা যেন নষ্ট না হয় ওই প্রাচ্য দর্শন নিয়ে লাফালাফি করতে গিয়ে। দর্শন দর্শনের মতো উপযুক্ত মর্যাদার আসনে থাক, তার মধ্যে বিজ্ঞানের উপাদান খুঁজতে যাওয়াটা বাতুলতা, মূর্খামি। 

আইনস্টাইন গীতার একটি দার্শনিক চিন্তার প্রসংশা করেছেন কিন্তু ইসরোর তথাকথিত বিজ্ঞানীর মতো বলেননি যে সবই বেদে আছে, অতএব ফাইনম্যান এর ফিজিক্স বাদ দিয়ে বেদ পড়তে শুরু করি সবাই মিলে। আজ্ঞে না, ওপরের ওই স্রয়ডিংগার কথিত যুক্তিবাদের তীক্ষ্ণতা কেবলই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অবদান। বেদের দেশের বাসিন্দা হিসেবে কথাটা মেনে নিতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু এটাই সত্যি।


দেবতার জন্ম -শিবরাম চক্রবর্তী
May 19, 2025 | গল্প | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাড়ি থেকে বেরুতে প্রায়ই হোঁচট খাই। প্রথম পদক্ষেপেই পাথরটা তার অস্তিত্বের কথা প্রবলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। কদিন ধরেই ভাবছি কি করা যায়।

সেদিন বাড়ি থেকে বেরুবার আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, অন্তত ঐরূপ তীরবেগে অকস্মাৎ ধাবিত হব এমন অভিপ্রায় ছিল না আদৌ, কিন্তু পাথরটার সংঘর্ষ আমার গতিবেগকে সহসা এত দ্রুত করে দিল যে, অন্যদিক থেকে মোটর আসছে দেখেও আত্মসম্বরণ করতে অক্ষম হলুম কী ভাগ্যি, ড্রাইভারটা ছিলো হুঁশিয়ার—তাই রক্ষে!

সেদিন থেকেই ভাবছি কি করা যায়। আমার জীবন-পথের মাঝখানে সামান্য একটুকরো পাথর যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেবে কোনোদিন এরূপ কল্পনা করিনি! তাছাড়া, ক্রমশই এটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে উঠছে, কেননা ধাবমান মোটর চিরদিনই কিছু আমার পদলনকে মার্জনার চোখে দেখবে এমন আশা করতে পারি না।

তাই ভাবছি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, হয় ও থাকুক নয় আমি ও থাকলে আমি বেশিদিন। থাকব কিনা সন্দেহস্থলা তাই যখন আমার থাকাটাই, অন্তত আমার দিক থেকে বেশি বাঞ্ছনীয়, তখন একদা প্রাতঃকালে একা কোদাল যোগাড় করে লেগে পড়তে হলো।

একটা বড় গোছের নুড়ি, ওর সামান্য অংশই রাস্তার ওপর মাথা তুলেছিলা বহু পরিশ্রমের পর। যখন ওটাকে সমূলে উৎখাত করতে পেরেছি, তখন মাথার ঘাম মুছে দেখি আমার চারিদিকে রীতিমত জনতা। বেশ বুঝলাম এতক্ষণ এঁদেরই নীরব ও সরব সহানুভূতি আমার উদ্যমে উৎসাহ। সঞ্চার করছিল।

তাঁদের সকলের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনারা কেউ চান এই পাথরটা?

জনতার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল, কিন্তু কারু ঔৎসুক্য আছে কি নেই বোঝা গেল না। তাই আবার ঘোষণা করতে হলো—যদি দরকার থাকে নিতে পারেনা অনায়াসেই নিতে পারেনা আমার শ্রম তাহলে সার্থক জ্ঞান করব এবং আমি খুশী হব।

জনতার এক তরফ থেকে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে—এটা খুঁড়ছিলেন কেন? কোনো স্বপ্ন টপ্ন পেয়েছেন নাকি?

আমি লোকটার দিকে একটু তাকালাম, তারপর ঘাড় নেড়ে বললাম—না, যা ভাবছেন তা নয়। পাথরটাকে রাস্তার এক নিরাপদ কোণে স্থাপিত করা গেল। কিন্তু আমার কথায় যেন ওর প্রত্যয় হলো না, কয়েকবার আপনমনে মাথা নেড়ে সে আবার প্রশ্ন করলে—সত্যি বলছেন পাননি, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ?

—কিচ্ছু না।

লোকটার কৌতূহলকে একেবারে দমিয়ে দিয়ে ওপরে এসে মাকে বললাম, দু’কাপ চা তৈরী করতো আমার জন্যই দু’ কাপ পাথরটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কাতর হয়ে পড়েছিলাম প্রায় প্রস্তরীভূত হয়ে গেছলাম, বলতে কি!

এরপর প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরুতে এবং বেড়িয়ে ফিরতে নুড়িটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় অনেক সময় হয় না, যখন অন্যমনস্ক থাকি। এখন ওকে আমি সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করতে পেরেছি, কেননা আমাকে অপদস্থ করার ক্ষমতা ওর আর নেই। সে-দৈবশক্তি ওর লোপ পেয়েছে।

আমাদের মধ্যে একরকম হৃদ্যতা জন্মেছে এখন বলা যেতে পারে। এমন সময়ে অকস্মাৎ একদিন দেখলাম নুড়িটার কান্তি ফিরেছে, ধুলোবালি মুছে গিয়ে দিব্য চাকচিক্য দেখা দিয়েছে। যারা সকালে বিকালে হোস পাইপে রাস্তায় জল ছিটোয়, বোঝা গেল, তাদেরই কারুর স্নেহদৃষ্টি এর ওপর পড়েছিল। ওর চেহারার শ্রীবৃদ্ধি দেখে সুখী হলাম।

–ব্যাপার কিরকম বুঝচেন?

হঠাৎ পেছন থেকে প্রশ্নাহত হয়ে ফিরে তাকালাম সেদিনের সেই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক।

জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি কি সেই থেকে এখানে পাহারা দিচ্ছেন নাকি? না, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ পেলেন?

–না, তা কেন? এই পথেই আমার যাতায়াত কিনা।

ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হন, কিন্তু অল্পক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতে পারেন।

–নুড়িটা দেখছি আছে ঠিক। কেউ নেবে না—কি বলেন?

প্রশ্নটা এইভাবে করলো যেন যে-রকম দামী জিনিসটা পথে পড়ে আছে অমন আর ভূভারতে কোথাও মেলে না এবং ওর গুপ্তশত্রুর দল ওটাকে আত্মসাৎ করবার মতলবে ঘোরতর চক্রান্তে লিপ্ত ছোঁ মেরে লুফে নেবার তালে হাত বাড়িয়ে সবাই যেন লোলুপা আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালাম—না, না, আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, সরকার বাহাদুর তাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে রাঁচির অতিথিশালায় সযত্নে রেখে দিয়েছেন, তাছাড়া, আপনি নিজেই যখন এদিকে কড়া নজর রেখেছেন তখন তো চিন্তা করার কিছু দেখিনে।

সে একটু হেসে বলল—আপনার যেমন কথা! দেখেছেন এদিকে কারা ওর পূজার্চনা করে গেছে?

ভালো করে নিরীক্ষণ করি—সত্যিই, দেখিনি তো, এক বেলার মধ্যেই কারা এসে পাথরটার সর্বাঙ্গে বেশ করে তেলসিঁদুর লেপে দিয়ে গেছে।

আমি আনন্দ প্রকাশ করলাম—ভালোই হয়েছে। এতদিনে তবু ওর কান্তি ফিরলো এবং আরেকটি সমঝদার জুটলো!

পাথরটার সমাদরে পুলকিত হবার কথা, কিন্তু লোকটিকে বেশ ঈর্ষান্বিত দেখলাম। কপাল কুঁচকে সে বললে—সেই তো ভয়! সেই সমঝদার না ইতিমধ্যে ওটিকে সরিয়ে ফ্যালে!

পরদিন সকালে উঠে দেখি কোথাও পাথরটার চিহ্নমাত্র নেই। ওর এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশ্চর্য হলাম খুব। কে ওটাকে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল, ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্নের অযাচিত উদয় হলো মনে কিন্তু সঠিক সদুত্তর পাওয়া গেল না। পাথরটার এরূপ অনুপস্থিতিতে এই পথে হরদম যাতায়াতকারী সেই লোকটি যে প্রাণে বেজায় ব্যথা পাবে অনুমান করা কঠিন নয়। একথা ভেবে লোকটার জন্য একটু দুঃখই জাগলো—কিম্বা, এ সেই তত্বজিজ্ঞাসুরই কর্মযোগ?

অনেকদিন পরে গলির মোড়ের অশথতলা দিয়ে আসছি—ও হরি! এখানে নুড়িটাকে নিয়ে এসেছে যে! নুড়ির স্কুল অঙ্গটা গাছের গোড়ায় এমন ভাবে পুঁতেছে যে, উপরের উদ্ধৃত গোলাকার নিটোল মসৃণ অংশ দেখে শিবলিঙ্গ বলে ওকে সন্দেহ হতে পারে। এই প্রয়োগনৈপুণ্য যার, তাকে বাহাদুরি দিতে হয়। নুড়িটার চারিদিকে ফুল বেলপাতা আতপচালের ছড়াছড়ি। সকালের দিকে এই পথে যে সব পুণ্যলোভী গঙ্গাস্নানে যায়, তারাই ফেরার পথে সস্তায় পারলৌকিক পাথেয় সঞ্চয়ের সুবর্ণসুযোগরূপে একে গ্রহণ করেছে সহজেই বোঝা গেল। যাই হোক, মহাসমারোহেই ইনি এখানে বিরাজ করছেন—অতঃপর এঁর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কারু দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ নেই।

নুড়িটার এই পদোন্নতিতে আন্তরিক খুশি হলাম আমি একদিন ওকে মুক্তি দিয়েছি, এখন সবাইকে ও মুক্তি বিতরণ করতে থাক—ওর গৌরব, সে তো আমারই গর্ব। পৃথিবীর বুকে ওর জন্মদাতা আমি, এইজন্য মনে মনে পিতৃত্বের একটা পুলক অনুভব না করে পারলাম না! এবং কায়মনোবাক্যে ওকে আশীর্বাদ করলাম।

সেই লোকটাকে তার দেবতার সন্ধান দেব কিনা মাঝে মাঝে ভেবেছি। পথে ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু পাথরটার কথা ও আর পাড়ে না। পাথরটার পলায়নে ভেবেছিলাম ও মুহ্যমান হয়ে পড়বে, কিন্তু উলটে ওকে প্রফুল্লই দেখা গেল। এত বড় একটা বিচ্ছেদ-বেদনা যখন ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তখন আর ওকে উতলা করে তোলায় কি লাভ।

মাঝে মাঝে অশথতলার পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরি, লক্ষ্য করি, দিনকের দিন নুড়িটার মর্যাদা। বাড়ছে। একদিন দেখলাম, গোটাকতক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গেড়েছে, গাঁজার গন্ধ এবং ববমবম শব্দের ঠেলায় ওখান দিয়ে নাক কান বাঁচিয়ে যাওয়া দুষ্কর। ঘ্রাণ এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের ওপরে দস্তুরমতই অত্যাচার।

যখন সন্ন্যাসী জুটেছে তখন ভক্ত জুটতে দেরি হবে না এবং ভক্তির আতিশয্য অনতিবিলম্বেই ইট-কাঠের মূর্তি ধরে মন্দিররূপে অভ্রভেদী হয়ে দেখা দেবো দেবতা তখন বিশেষভাবে বনেদী হবেন এবং সর্বসাধারণের কাছ থেকে তাঁর তরফে খাজনা আদায় করবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমী হয়ে দাঁড়াবে।

এর কিছুদিন পরে একটা চিনির কলের ব্যাপারে কয়েক মাসের জন্য আমাকে চম্পারণ যেতে হলো। অশথতলার পাশ দিয়ে গেলেও চলে, ভাবলাম, যাবার আগে দেবতার অবস্থাটা দেখে যাই। যা অনুমান করেছিলাম তাই, সন্ন্যাসীর সমাগমে ভক্তের সমারোহ হয়েছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের আলাপ আলোচনা অনুসরণে যা বুঝলাম তার মর্ম এই যে, ইনি হচ্ছেন। ত্রিলোকেশ্বর শিব, সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু, একেবারে পাতাল ছুঁড়ে ফেঁপে উঠেছেন—এঁর তল নেই। অতএব এঁর উপযুক্ত সম্বর্ধনা করতে হলে এখানে একটা মন্দির খাড়া না করলে চলে না।

একবার বাসনা হলো, ত্রিলোকেশ্বর শিবের নিস্তলতার ইতিহাস সবাইকে ডেকে বলে দিই, কিন্তু জীবন-বীমা করা ছিল না এবং ভক্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে জানতাম, আর তা ছাড়া ট্রেনের বিলম্বও বেশি নেই ইত্যাদি বিবেচনা করে নিরস্ত হলাম। সেই লোকটাকে খবর না দিয়ে দেখলাম ভালোই করেছি, কেননা যতদূর ধারণা হয়, নুড়িটাকে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করাই তার অভিরুচি ছিল কিন্তু ইনি যে ভক্তের তোয়াক্কা না রেখেই স্বকীয় প্রতিভাবলে এবং স্বচেষ্টায় ইতিমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন, এই সংবাদে সে পুলকিত কিম্বা মর্মাহত হতো বলা কঠিন।

কয়েক মাস বাদে যখন ফিরলাম তখন অশথতলার মোড়কে আর চেনাই যায় না। ছোটখাট একটা মন্দির উঠেছে, শঙ্খঘণ্টার আর্তনাদে কান পাতা দায় এবং ভক্তের ভিড় ঠেলে চলা দুরূহ। কিন্তু সে কথা বলছি না, সবচেয়ে বিস্মিত হলাম সেই সঙ্গে আরেক জনের আবির্ভাবে, কেবলমাত্র আবির্ভাব নয় কলেবর পরিবর্তন পর্যন্ত দেখো মন্দিরের চত্বরে সেই লোকটা—প্রথমতম, সেই আদি ও অকৃত্রিম উপাসকগেরুয়া, তিলক এবং রুদ্রাক্ষের চাপে তাকে আর চেনাই যায় না এখন!

—এ কি ব্যাপার?

আমিই গায়ে পড়ে প্রশ্ন করলাম একদিন।

—আজ্ঞে, এই দীনই শিবের সেবায়েত।

লোকটি বিনীত ভাবে জবাব দেয়।

—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দিব্যি বিনিপুঁজির ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে। এই জন্যেই বুঝি পাথরটার ওপর অত করে নজর রাখা হয়েছিল?

শিলাখণ্ডের প্রতি ওর প্রীতিশীলতা যে অহেতুক এবং একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল না, এইটা জেনেই বোধ করি অকস্মাৎ ওর ওপর দারুণ রাগ হয়ে যায়, ভারি রূঢ় হয়ে পড়ি।

কানে আঙুল দিয়ে সে বলল—অমন বলবেন না। পাথর কি মশাই? শ্রীবিষ্ণু! সাক্ষাৎ দেবতা যে। ত্রিলোকেশ্বর শিব!

উদ্দেশে সে নমস্কার জানায়।

আমি হেসে ফেললাম—ওর তল নেই, না?

এবার সে একটু কুষ্ঠিত হয়—ওরাই তো বলো

—তুমি নিজে কী বলো? ওরা তো বলে নিচে যতই কেন খুঁড়ে যাও না, টিউব-কলের মত ওই শিবলিঙ্গ বরাবর নেমে গেছে। কিন্তু তোমার কী মনে হয়?

–কী জানি! তাই হয়তো হবে।

কতদূর শেকড় নেবেছে খুঁড়ে দেখই না কেন একদিন?

জিভ কেটে লোকটা বলল—ওসব কথা কেন, ওতে অপরাধ হয়। বাবা রাগ করবেন—উনি আমাদের জাগ্রত।

–বটে? কিরকম জাগ্রত শুনি?

—এই ধরুন না কেন! এবার তো কলকাতায় দারুণ বসন্ত, টিকে নিয়ে কিছু করেই কিছু হচ্ছে না—

—য়্যাঁ, বলো কি, মহামারী নাকি, জানতাম না তো!

—খবরের কাগজেই দেখবেন কিরকম লোক মরছে। কর্পোরেশন থেকে টিকে দেবার ত্রুটি নেই অথচ প্রত্যেক পাড়াতেই কিন্তু আমাদের পাড়ায় এ-পর্যন্ত কারু হয়নি দেবতার কৃপায়। আমরা কেউ টিকেও নিইনি, কেবল বাবার চন্নামেত্ত খেয়েছি। এ যদি জাগ্রত না হয় তবে জাগ্রত আপনি কাকে বলেন?

এবার কি জবাব দেব তা চিন্তা করবার সময় ছিল না। আগে একবার এই রোগে যা কষ্ট পেয়েছিলাম এবং যা করে বেঁচেছিলাম তাতে বাবা ত্রিলোকনাথের মহিমা তখন আমার মাথায় উঠেছে। ‘আমি এখন চললুম। আমাকে এক্ষুনি টিকে নিতে হবে আরেকদিন এসে গল্প করব।’ বলে আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে ধাবিত হলাম।

পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা দাঁড় করিয়ে সে বললে—আরে, কোথায় চলেছো এমন হন্যে। হয়ে?

—টিকে নিতে।

—টিকে নিয়ে তো ছাই হচ্ছে। টিকেয় কিসসু হয় না তুমি বরং দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম এক ডোজ খাও গে, কিং কম্পানির থেকে—যদি টিকে থাকতে চাও! পরের হপ্তায় ঐ আরেক ডোজ, তারপরে আরেকব্যাস, নিশ্চিন্দি। টিকে ফেল করেছে আকচার দেখা যায়, কিন্তু ভেরিওলিনাম নেভার!

–বলো কি? জানতাম না তো!

—জানবে কোত্থেকে? কেবল ফোঁড়াখুঁড়ি এই তো জেনেছো! অন্য কিছুতে কি আর তোমাদের বিশ্বেস আছে? আমি হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস ধরেছি, আমি জানি

—বেশ, তাই খাচ্ছি না হয়।

কিং কম্পানিতে গিয়ে এক ডোজ দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম গলাধঃকরণ করলাম। যাক, এতক্ষণে অনেকটা স্বচ্ছন্দ হওয়া গেল। হালকা হতে পারলাম।

এর পরেই পথ দিয়ে উপরি-উপরি কয়েকটা শবযাত্রা গেল নিশ্চয়ই এরা বসন্ত রোগেই মরেছে? কী সর্বনাশ, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে, ওদের থেকে এইভাবে কত লক্ষ লক্ষই না বীজাণু আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। ভেরিওলিনাম রক্তে পৌঁছতে না পৌঁছতেই এতক্ষণে এই সব মারাত্মক রোগাণুর কাজ শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়! হাত পা সিঁটিয়ে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসে—এই বিপদসংকুল বাতাসের নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

অতি সংক্ষিপ্ত এক টুকরো প্রাচীরপত্রে বিখ্যাত বসন্ত চিকিৎসক কোন এক কবিরাজের নাম দেখলাম। হোমিওপ্যাথি করা গেছে, কবিরাজিই বা বাকি থাকে কেন—যে উপায়েই হোক সবার আগে আত্মরক্ষা। বিজ্ঞাপিত ঠিকানায় পৌঁছতেই দেখলাম কয়েকজন মিলে খুব ধুমধাম করে প্রকাণ্ড একটা শিলে কী যেন বাঁটছেন। কবিরাজকে আমার অবস্থা বলতেই তিনি আঙুল দেখিয়ে বললেন—ওই যে বাঁটা হচ্ছে। কন্টিকারির শেকড় বেঁটে খেতে হয়। ওর মত বসন্তের অব্যর্থ প্রতিষেধক আর কিছু নেই মশাই!

ব্যবস্থামত তাই এক তাল খেয়ে রিক্সা ডেকে উঠে বসা গেল। গায়ে যেন জোর পাচ্ছিল।ম না, মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, জ্বর-জ্বর ভাব—বসন্ত হবার আগে এই রকমই নাকি হয়ে থাকে। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম—আজ আর কিছু খাব না, মা। দেহটা ভালো নয়।

উদ্বিগ্ন মুখে মা বললেন–কী হয়েছে তোর?

–হয়নি কিছু বোধহয় হবে!…বসন্ত।

–বালাই ষাটা বলতে নেই। তা কেন হতে যাবে? এই হর্তুকির টুকরোটা হাতে বাঁধ দিকি। আমি তিরিশ বছর বাঁধছি, এই হাতে বসন্ত রোগীই তো ঘাঁটলাম, সেবা করলাম, কিন্তু বলতে নেই, এরই জোরে কোনোদিন হাম পর্যন্ত হয়নি— নে ধর এটা তুই।

মা তাঁর হাতের তাগাটা খুলে দিলেন।

–তিরিশ বছরে একবারো হয়নি তোমার? বলো কি? দাও, দাও তবে। এতক্ষণ বলোনি কেন? কিন্তু এই একটুকরোয় কি হবে? রোগ যে অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমাকে আস্ত একটা হর্তুকি দাও যদি তাতে আটকায়।

হর্তুকি তো বাঁধলুম, কিন্তু বিকালের দিকে শরীরটা বেশ ম্যাজম্যাজ করতে লাগলো। নিজেকে রীতিমত জ্বরজড়িত মনে হলো। আয়না নিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম, মুখেও যেন দু’একটা ফুসকুড়ির মতো দেখা দিয়েছে। নিশ্চয়ই বসন্ত, তবে আর বাঁচন নেই, মাকে ডেকে দেখালামা

মা বললেন—মার অনুগ্রহ–নয় ব্রণ।

আমি বললাম—উঁহু। ব্ৰণ নয়, নিতান্তই মার অনুগ্রহ!

মা বললেন—অলক্ষুণে কথা মুখে আনিস নো ও কিছু না, সমস্ত দিন ঘরে বসে আছিস, একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে আয় গে।

এরকম দারুণ ভাবনা মাথায় নিয়ে কি বেড়াতে ভালো লাগে? লোকটা বলছিল, ওরা সবাই চরণামৃত খেয়ে নিরাপদ রয়েছে। আমিও তাই খাবো নাকি? হয়তো বা চরণামৃতের বীজাণুধ্বংসী কোনো ক্ষমতা আছে, নেই যে, তা কে বলতে পারে?…হ্যাঁঃ ওর যেমন কথা! ওটা স্রেফ অ্যাকসিডেন্ট কলকাতার সব বাড়িতেই কিছু আর অসুখ হচ্ছে না। তাছাড়া মনের জোরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি জন্মায়—মারীরও যেখানে মার—সেই মনের জোরই ওদের পক্ষে একটা মস্ত সহায়—কিন্তু ওই যৎসামান্য পাথরটাকে দেবতাজ্ঞান করার মতো বিশ্বাসের জোর আমি পাবো কোথায়?

এ সব যা-তা না করে সকালে টিকে নেওয়াই উচিত ছিল, হয়তো তাতে আটকাতো। এখুনি গিয়ে টিকেটা নিয়ে ফেলব নাকি? টিকে নিলে শুনেছি বসন্ত মারাত্মক হয় না, বড় জোর হাম হয়ে দাঁড়ায়। আর হামে তেমন ভয়ের কিছু নেই—ও তো শিশুদের হামেশাই হচ্ছে। নাঃ, যাই মেডিকেল কলেজের দিকেই বেরিয়ে পড়ি।

টিকে নিয়ে অশথতলার পাশ দিয়ে ফিরতে লোকটার সকালের কথাগুলো মনে পড়ল। হয়তো ঠিকই বলেছে সে সত্যিই এক জায়গায় গিয়ে আর কোনো জবাব নেই, সেখানে রহস্যের কাছে মাথা নোয়াতেই হয়। এই তো আজ বেঁচে আছি, কাল যদি বসন্তে মারা যাই তখন কোথায় যাবো? শেকসপীয়ারের সেই কথাটা—সেই স্বর্গমর্ত-হোরাশিও-একাকার-করা বাণী—না, একেবারে ফেলনা নয়। এই পৃথিবীর, এই জীবনের, সুদূর নক্ষত্রলোক এবং তার বাইরেও বহুধা বিস্তৃত অনন্ত জগতের কতটুকুই আমরা জানি? কটা ব্যাপারেই বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারি? যতই বিজ্ঞানের দোহাই পাড়ি না কেন, শেষে সেই অজ্ঞেয়ের সীমান্তে এসে সব ব্যাপারীকেই নতমুখে চুপ করে দাঁড়াতে হয়।

মন্দিরের সম্মুখ দিয়ে আসতে ত্রিলোকনাথের উদ্দেশে মনে মনে দণ্ডবৎ জানালামা প্রার্থনা করলাম, বাবা, আমার মূঢ়তা মার্জনা করো, মহামারীর কবল থেকে বাঁচাও আমাকে এযাত্রা।

খানিক দূর এগিয়ে এসে ফিরলাম আবার। নাঃ, দেবতাকে ফাঁকি দেওয়া কিছু নয়। মুখের ফুসকুড়িগুলো হাত দিয়ে আঁচ করা গেল—এগুলো ব্রণ, না বসন্ত?

এবার মাটিতে মাথা লুটিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম—জয় বাবা ত্রিলোকনাথ! রক্ষা করো বাবা! বম বম!

উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখলাম কেউ দেখে ফ্যালেনি তো?

স্মরণে প্রবীর, মননে প্রবীর -মণীশ রায়চৌধুরী
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রবীর ঘোষ, নামটা শুনলেই দুই বাংলার যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া কাজ করে। কারণ গত শতকের নয়ের দশক থেকে শুরু করে যারাই বাংলাভাষায় কুসংস্কার বিরোধী বইপত্রের চর্চা করেছে তাদের মধ্যে অন্তত একটা ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ বা ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা’ পড়েনি এমন মানুষ বিরল।


প্রবীর ঘোষ ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রভাত চন্দ্র ঘোষ ছিলেন রেল কর্মচারী। বাবার বদলির চাকরি, ফলে ছোটবেলায় কোন এলাকায় থিতু হয়ে বসা হয়নি তার। পুরুলিয়ার আদ্রায় তার বাল্যকাল কেটেছিল। তারপর তারা দমদমে চলে আসেন। সেখানেই তিনি স্কুল এবং পরে কমার্স নিয়ে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা থেকে বক্সিং বিবিধ বিষয়ে তিনি চর্চা করতেন। এরপর স্টেট ব্যাঙ্কে তার কর্মজীবন এবং তার কয়েকবছরের মধ্যেই বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সীমা ঘটকের সাথে তার সংসারজীবন শুরু হয়।


এর পাশাপাশি একটা গঠন প্রক্রিয়া কিন্তু প্রছন্নভাবে চলছিল। বাল্যকাল থেকেই প্রবীর পথের মাদারিদের থেকে হাত সাফাইয়ের কলাকৌশল শিখেছিলেন এবং তার আত্মজীবনী অনুসারে এই জ্ঞানই পরে তাকে বহু তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার রহস্যভেদ করতে সাহায্য করে। তার মতে এমন সামান্য উপকরণ দিয়ে এমন অসাধারণ জাদু কৌশল তিনি আর কোথাও দেখেননি। তার এক বিচিত্র দুষ্টুমি ছিল। তিনি যে অলৌকিক ক্ষমতাধর বাবাজিরই সন্ধান পেতেন তার কাছেই দীক্ষা নিয়ে তার বীজমন্ত্রটি জেনে নিতেন। কথিত আছে, প্রকৃত গুরু কানে বীজমন্ত্র দিতে গেলেই শিষ্য আগে কারও কাছে দীক্ষা নিয়েছে কিনা বুঝতে পারবে। অথচ, তিনি দেখলেন সকল গুরুই তাকে নির্দ্বিধায় নিজের বীজমন্ত্রের দ্বারা দীক্ষিত করত। এইসকল অভিজ্ঞতা তাকে যুক্তিবাদের পথে চালিত করে।


গত শতকের আটের দশকে ‘পরিবর্তন’, ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকায় প্রবীর ঘোষের কুসংস্কার বিরোধী লেখা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। স্ত্রী এবং শিশুপুত্র পিনাকী, মাত্র তিনজনের এই টিম নিয়ে তিনি শুরু করলেন অলৌকিকের রহস্যভেদকারী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ যা আজ একটা ব্র‍্যান্ড। ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ সহযোগী বন্ধুদের নিয়ে দমদমের ছোট্ট ফ্ল্যাটে গড়ে তুললেন তার স্বপ্নের সংগঠন ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ যা আজ মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। প্রকাশিত হল তার প্রথম বই ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ এর প্রথম খন্ড, যা প্রবন্ধ সাহিত্যে নতুন দিক উন্মোচন করল। আরও আরও বেশি মানুষ সমিতির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করলেন। এরপর একের পর এক প্রকাশিত হল ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ (২,৩,৪,৫), ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা’, ‘ধর্ম সেবা সম্মোহন’, ‘সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ’, ‘জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক’। তার ইংরেজি বইয়ের অন্যতম ‘Paranormal Exposed’, ‘The mystery of Mother Teresa and Sainthood’, ‘Why I do not believe in God’। অস্ট্রেলিয়া থেকে রিচার্ড ডকিন্স, জেমস র‍্যান্ডি সহ পৃথিবীর ৫০ জন বিখ্যাত নাস্তিকদের লেখার সংকলন ‘50 Voices of Disbelief’ প্রকাশিত হয়েছিল তাতেও স্বমহিমায় বিদ্যমান ছিলেন প্রবীর ঘোষ। মৃত্যুকালে তার মোট বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০।


বইলেখার পাশাপাশি চলছিল মাঠে নেমে তথাকথিত বাবাজি, মাতাজি, পীর ফকির, ওঝা, গুণিন, জ্যোতিষীদের ভান্ডাফোড়। এসব প্রতারকদের মোকাবিলায় তিনি ঘোষণা করেন যে পৃথিবীর কেউ যদি কোনপ্রকার অলৌকিক ক্ষমতার প্রদর্শন করতে পারেন তাহলে তিনি ৫০ হাজার টাকা প্রণামী দিয়ে সমিতির কাজকর্ম বন্ধ করে দেবেন কারণ পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছুই হয়না। তার মৃত্যুকালে সেই ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জমানি বাড়তে বাড়তে ৫০ লাখ হয়েছিল এবং তা উইকিপিডিয়ায় লিপিবদ্ধ আছে। বলাইবাহুল্য এত বছরেও কেউ এই চ্যালেঞ্জ জিততে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবেনা।


আঘাত করলে প্রত্যাঘাত আসবে এটাই স্বাভাবিক। প্রবীর ঘোষের আন্দোলন যাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত করেছিল তারাই যুক্তিবাদী সমিতিকে ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। ফলত, ১৮ আগস্ট ১৯৯৬ সালে তাকেই সমিতি থেকে বহিষ্কার করার নোংরা ষড়যন্ত্র হয়। যে মানুষটা অনেকের কাছে সুপারহিরো হয়ে উঠেছিল তারই নামে জালিয়াতি, লাম্পট্য সহ নোংরা অভিযোগ শুনে বহু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ব্যথিত হয়ে বসে যান। যুক্তিবাদের ইতিহাসে এই ক্ষতি সীমাহীন। এই ষড়যন্ত্রের কিছু প্রেক্ষাপট ছিল বলে মনে করি। প্রবীরদা বলতেন কোন বড় খেলোয়াড় প্রথমেই নিজের সব তাস দেখিয়ে দেয়না। প্রবীরদাও প্রথমে অলৌকিকতার বিরোধিতা করে শুরু করেছিলেন। এরপর তা জনপ্রিয় হতেই তিনি জ্যোতিষের বিরুদ্ধে এবং নিরীশ্বরবাদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নিরপেক্ষতা এবং প্রগতিশীলতার মুখোশ রক্ষা করতে তাকে প্রচার প্রসার দিচ্ছিল। কিন্তু এরপরে ‘ধর্ম-সেবা-সম্মোহন’ বইতে তিনি লিখলেন “সেবা দ্বারা সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়”। তিনি সেবার ব্যবসা করা ফান্ডেড এনজিও-র বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তার অন্যতম সেরা বই যাকে আমরা যুক্তিবাদী সমিতির ম্যানিফেস্টো বলে থাকি সেই ‘সংস্কৃতি সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইতে তিনি লিখলেন শোষণ কাঠামোর কথা, তার লেখায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে মানবাধিকার হরণ ইত্যাদি জরুরি বিষয় উঠে এল। ফলে এতদিন তাকে প্রচার দেওয়া রাষ্ট্র স্বাভাবিক ভাবেই তার উপর খড়্গহস্ত হল। তারপরে তারই কাছের মানুষদের লোভ দেখিয়ে একে একে ষড়যন্ত্রে সামিল করা হল। যদিও আদালতের রায়ে জয়ী হয়ে তিনিই সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন। কিন্তু বিরোধীপক্ষ এখনো “প্রবীর ঘোষ লম্পট, ১৯৯৬ সালেই বহিষ্কৃত” এই হাস্যকর মিথ্যাচার সর্বত্র চালিয়ে যাচ্ছে।


তার হাতে পরাজিত ক্ষমতাধরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খৃষ্টান দুনিয়ায় জনপ্রিয় মরিস সেরুলো, রেইকি মাস্টার ক্লাইভ হ্যারিস, ফেইথ হিলার পি গ্যালার্ডো, বাংলাদেশের বিখ্যাত ধর্মগুরু হুজুর সাইদাবাদী, ফকিরবাড়ির এস.পি. আলি, মহারাষ্ট্রের মিঠাইবাবা, কোটিপতি জ্যোতিষী আচার্য সত্যানন্দ এবং আরও অনেকে। মনিকা বেসরার টিউমার সারার দাবি করে পোপ মাদার টেরেসাকে সেন্টহুড দেওয়ার যে অপচেষ্টা করেন সেটা বন্ধ করতে পারাই সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় অলৌকিকতা বিরোধী অবদান। বাবা রামদেবের সাথে তার লাইভ ডিবেট জনমানসে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। NDTV Imagine আয়োজিত অনুষ্ঠান  ‘রাজ পিছলে জনম কা’ বন্ধ করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি জ্যোতিষীদের প্রফেশনাল ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করিয়েছিলেন। নয়ের দশকে রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত ধর্ম মহাসম্মেলনে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় রাষ্ট্রপতির অংশগ্রহণ আটকাতে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনেকেই জানেনা নয়ের দশকে  প্রবীর ঘোষ এবং সুমিত্রা পদ্মনাভনের নেতৃত্বে সমিতির উইং হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে যে আন্দোলন হয় তারই ফলশ্রুতিতে ভারতে প্রথম আইনি ভাবে ধর্ম কলামে ‘মানবতা’ বা ‘হিউম্যানিজম’ লেখা শুরু হয় যা পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। UGC স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যোতিষচর্চা পড়ানোর যে অপচেষ্টা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী করেছিলেন তার প্রতিবাদেও প্রবীর ঘোষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রবীর ঘোষ তার জীবনে যে অগণিত অলৌকিকতার দাবিদারদের সম্মুখীন হন তার মাত্র কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে তার জনপ্রিয় বই ‘যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা (অখণ্ড)’। তার কর্মজীবন নিয়ে বহু দেশি, বিদেশি মিডিয়া গুরুত্ব সহকারে সংবাদ প্রকাশিত করেছে, ডকুমেন্টারি বানিয়েছে যার অন্যতম হল গুরুবাস্টার্স। 


প্রবীর ঘোষের বিরোধী শিবির একটা প্রশ্ন করে থাকে যে বাংলায় যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ, নাস্তিকতার প্রসারে আরও বহু স্মরণীয় ব্যক্তি থাকলেও আমরা প্রবীর ঘোষ কে যে গুরুত্ব দিয়ে থাকি তা গুরুবাদী ব্যক্তিপূজার নামান্তর।

আমরা মনে করি ব্যক্তিপূজা যুক্তিবাদের শত্রু, কিন্তু শ্রদ্ধেয় কে শ্রদ্ধা এবং অতিশ্রদ্ধেয়কে অতিশ্রদ্ধা কোনভাবেই দোষ নয়। এই প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে  দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সুকুমারী ভট্টাচার্য, ভবানীপ্রসাদ সাহু সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নির্মোহ দৃষ্টিতে কিছু কথা বলতে চাই। প্রবীর ঘোষের নামে অনেকে কুৎসা করে যে তিনি এদের বই থেকে টুকে বই লিখেছেন। কিন্তু যতদূর জানি এদের সবার বইয়ের মোট সংখ্যার থেকে প্রবীর ঘোষের বইয়ের সংখ্যা বেশি, ফলে টুকে লেখার হাস্যকর অভিযোগ পাটিগণিতের হিসেবেই বাতিল হয়ে যায়। শুধু বইয়ের সংখ্যা নয় তার গুণগত মান এবং বিষয়বস্তুও এখানে জরুরি বিবেচ্য বিষয়। এইসব বরেণ্য লেখকের বই অবশ্যই বস্তুবাদ কে এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এসব বই শিক্ষিত সমাজের তাত্ত্বিক ইতিহাস চর্চা ও বিশ্লেষণের ভিতরই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রবীরদার বই সহজসরল ভাষায় মাটির কাছের মানুষকে যুক্তিবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এছাড়া তার কর্মকাণ্ড বইয়ের বাইরে মাঠে ময়দানে অলৌকিক নয় লৌকিক কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান করে মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদের বীজ বপন করে। তিনি সরাসরি অলৌকিকতার দাবিদারদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতেন, ভান্ডাফোড় করতেন। এই হি-ম্যান ইমেজ তাকে অন্যদের তুলনায় বহু যোজন এগিয়ে দেয়। 


প্রবীরদার পূর্বসুরীদের ভিতর ডা: কোভুর এভাবে চ্যালেঞ্জ করতেন। কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা ছিল তিনি অন্ধবিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষকেই দায়ী মনে করে দোষারোপ করতেন। মানুষকে অন্ধবিশ্বাসী রেখে দেওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেননি। প্রবীরদার সাথে বাকি বিজ্ঞানকর্মীদের আরও একটা প্রধান পার্থক্য হল অলৌকিকতার ভান্ডাফোড় বা নাস্তিকতার প্রচারকেই তিনি কোন বিজ্ঞান সংগঠনের একমাত্র কাজ মনে করতেন না। তাই অন্যান্য ব্যক্তি বা সংগঠন যেখানে কুসংস্কার মুক্তি বা জনগণকে টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র চেনানো অথবা বিশেষ চশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখানোকেই নিজেদের কর্তব্য মনে করত সেখানে তার চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। এই বিষয়ে তিনি তার ‘সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইতেই জরুরি কিছু বক্তব্য রেখেছিলেন। পরবর্তী বইগুলোতে আরও বেশি করে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের কথা  উঠে আসতে লাগল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, মানবাধিকার তথা গণতন্ত্র লুন্ঠনের ঘটনা তার লেখায় উঠে আসতে লাগল। ‘রাজনীতির ম্যানেজমেন্ট’, ‘প্রসঙ্গ সন্ত্রাস’, ‘গেরিলা যুদ্ধের এ টু জেড থেকে আজাদি’, ‘স্বাধীনতার পরে ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা’ প্রভৃতি বইতে তার রাজনৈতিক চিন্তার নিদর্শন পাওয়া যায়। আর কোন বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতা স্টেট ব্যাঙ্কের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ভাবছে, আদিবাসীদের উপর কর্পোরেট স্বার্থে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হলে প্রতিবাদ করছে এমন উদাহরণ আমার অন্তত জানা নেই। অর্থাৎ বিজ্ঞান আন্দোলনকে তিনি একটা পরিপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক শ্রেণীসচেতনতা সৃষ্টি করে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার মনে করতেন। তিনি একটা শোষণ বঞ্চনামুক্ত সাম্যবাদী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন এবং যুক্তিবাদ ছিল তার হাতিয়ার। 


অনেকে বলেন, রক্তের জোর কমলেই মনে ঈশ্বর বিশ্বাস আসবে, অধ্যাত্ববাদী চিন্তা প্রভাব ফেলবে। কিন্তু প্রবীর ঘোষ এমন এক ঋজু মেরুদণ্ডর বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি মৃত্যুশয্যায় তার অন্তিম বার্তাতেও বলে গিয়েছেন ঈশ্বর সর্বকালের সেরা গুজব। মানুষ মারা যায়, কিন্তু যুক্তিবাদী সমিতির কাজ থামবেনা অলৌকিকতা বিরোধী অভিযান চলছে চলবে। 


সকল মুক্তমনা বন্ধুদের অনুরোধ যেখানেই তথাকথিত  অলৌকিকতার গল্প শুনবেন যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমরা প্রমাণ করে দেব পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কখনো কোথাও কিছু ছিলনা, থাকবেওনা।


যোগাযোগ করুন:- bigyanoyuktibadisamiti@gmail.com

মণীশ রায়চৌধুরী:- ৮১০০৮১৪১৮০

সন্তোষ শর্মা:- ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

মধুসূদন মাহাতো:- ৯৬৩৫৮৬৬৬১৭

দেবরাজ দাস:- ৯০০৭৬৬১০০৭

নাটক: চেন্নী -অনুপ চক্রবর্তী
May 19, 2025 | নাটক | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চরিত্র: প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা, জাস্টিস কৃষ্ণান, কারিয়াপ্পা, চেন্নী, শবরী, গিরিশ, পুরোহিত।

 (জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

কৃষ্ণান: বলুন কী ব্যাপার, প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা। আপনার টেলিফোনটা পেয়ে বেশ কৌতুহল হয়েছে আপনার সমাজনৃতত্ত্বের কাজের ব্যাপারে আমার মতামত আপনি চেয়েছেন দেখে। হ্যাঁ, কফি বলি? 

গুণ্ডাপ্পা: নো। থ্যাংকস। অন্য দিন তো দাবা খেলার ছলে আপনার চা-কফি ধ্বংস করি। কিন্তু আজ সেরকম মুডে নেই।

 কৃষ্ণান: কী ব্যাপার? 

গুণ্ডাপ্পা: ব্যাপারটা সমাজনৃতত্ত্বের হলেও, সমস্যাটা সম্পূর্ণ আমার নিজেকে নিয়ে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। আর আমার এই ব্যক্তিগত ব্যাপারে মতামত চাইতে এসেছি কিন্তু একজন বিচারকের কাছে। জাস্টিস কৃষ্ণান, আপনি বিচারক। আপনার আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আপনি আপনার মতামত বলবেন। এটা আমার খুব প্রয়োজন। 

কৃষ্ণান: ইন্টারেস্টিং! ব্যাপারটা কী? 

গুণ্ডাপ্পা: বলছি, জাস্টিস কৃষ্ণান। তার আগে ইফ ইউ পারমিট, আমি একটা সিগারেট ধরাবো।

 কৃষ্ণান: হাঃ হাঃ হাঃ হা। আজ কী ব্যাপার? স্মোক করতে আপনাকে নিষেধ করি স্বাস্থ্যের কারণে। বিচারকের দৃষ্টিতে নয়। 

গুণ্ডাপ্পা: জানি। তবু আজ আপনি আমার কাছে শুধুই একজন বিচারক। আপনার এই ড্রয়িরুম আজ আমার কাছে কার্যত একটা বিচার কক্ষ। (একটুক্ষণ চুপ করে থেকে) অথচ আমিও আজ কিছুটা টেন্স্ড।

 কৃষ্ণান: বুঝছি। আপনি আজ খুব ইন্টারেস্টিং কথা বলছেন প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা। নিন। শুরু করুন। টেনশন ছাড়ুন। আপনার লেখালেখিতে সব সময় একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাই। মনে হচ্ছে সেরকম কিছু ব্যাপার। তাই আমিও শুনতে উদগ্রীব। কেননা আমি আপনার একজন অনুরাগী পাঠক।

 গুণ্ডাপ্পা: গত সপ্তাহে আমি একটা কাজে এই জেলারই নাগবল্লী নামের একটা গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে গেছিলাম। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে হবে। ওই পঞ্চায়েতের অধীনের গ্রামগুলোতে কিছু বিরল পদবীর মানুষ আছে। সেইসব পদবী সংগ্রহ করা, তাদের উৎপত্তি, বিকাশ, সেই সব মানুষদের উপভাষা অর্থাৎ ডায়ালেক্ট ইত্যাদির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যেই গেছিলাম। আমার কাজ তো ভাষার আঁকবাঁক নিয়ে। 

কৃষ্ণান: হ্যাঁ। ভাষাবিজ্ঞানীর কাজটা অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো। তাইতো প্রফেসর? 

গুণ্ডাপ্পা: অনেক সময়। সে থাক। সেদিন একটি রাতের জন্যে আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ওই গ্রামেরই একটি লোকের বাড়িতে। বাধ্য হয়েই আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কারণ সন্ধের আগেই উঠল প্রচন্ড ঝড়। সঙ্গে বজ্রপাত আর প্রবল বৃষ্টি। অবিশ্রান্ত। সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল। বৃষ্টি আর ঝড়ের থামার কোন লক্ষণ নেই। ভয়ানক দুর্যোগ। সেবার নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ড্রাইভার ছিল না। আজকাল রাত্রে দৃষ্টির একটু সমস্যা হচ্ছে। একটু চিন্তায় পড়ে ছিলাম কিভাবে ফিরব ভেবে। সমস্যার সমাধান করল একটি লোক। পঞ্চায়েত সদস্য। নাম অর্জুন কারিয়াপ্পা। আমার অসহায় অবস্থা দেখে লোকটা একটা রাতের জন্যে ওর বাড়িতে সাদর আমন্ত্রণ করল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। পেলাম আন্তরিক ব্যবহার, সুন্দর আতিথেয়তা, আকণ্ঠ ভোজন। জাস্টিস কৃষ্ণান, আমি ভাষার গবেষক। দলিত সম্প্রদায়ের উপভাষার ওপর অনেক কাজ করেছি, করছিও। কিন্তু সেদিন বুঝলাম এই বিচিত্র দেশের সমাজকে কতটুকুই বা জানি। কিছুই না। এত বিচিত্র এই দেশ। এত রীতি, প্রথা,বিশ্বাস, সংস্কার…… সেটা ছিল ঝড়ের রাত….. (নীরবতা) 


(প্রথম ফ্ল্যাশব্যাক)

(কারিয়াপ্পার বাড়ি)

কারিয়াপ্পা: আসুন, বাবুজী। আসুন। গরীবের ঘরে আপনার মতো ব্রাহ্মণ মানুষের পায়ের ধুলো পড়ল। কী ভাগ্যি আমাদের। আমরা ধন্য হয়ে গেলাম বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: এসব কেন বলছ, কারিয়াপ্পা? এই প্রচন্ড দুর্যোগের রাতে আমার গাড়ি চালিয়ে ফেরা সম্ভব ছিল না। তুমি আমাকে আশ্রয় না দিলে আমি খুবই বিপদে পড়ে যেতাম। তোমার আমন্ত্রণের জন্যে বরং তোমাকেই আমার অনেক ধন্যবাদ জানানো উচিত।

কারিয়াপ্পা: একি বলছেন, বাবুজী!  আশ্রয় কি বলছেন! আপনি ব্রাহ্মণ অতিথি। দেবতা। আমাদের সত্যিই পরম সৌভাগ্য যে আজ আপনি আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়েছেন। 

 গুন্ডাপ্পা: দ্যাখো কারিয়াপ্পা, এসব ব্রাহ্মণ দেবতা এরকম সব কথা বলবে না। আমি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। মানুষকে কেন দেবতা বলছ? এরকম বলা ঠিক নয়।

কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। আপনি ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণ হলেন দেবতা। আমরা তাই মনে করি।  আপনি দয়া করে রাগ করবেন না। 

গুন্ডাপ্পা: না না। রাগ করছি না। বলছি আমি ওসব মানি না। মানে মানুষকে দেবতা মনে করি না। মানুষ মানুষই। দেবতা দেবতাই। যে যার জায়গায় আছে। মানুষকে দেবতা বানানো ঠিক নয়। 

 কারিয়াপ্পা: না না বাবুজী। আপনি যতই বলুন আমরা তাই মনে করি। দয়া করে রাগ করবেন না। 

গুন্ডাপ্পা: আঃ কী মুশকিল! রাগ করার কথা উঠছে না। 

(কারিয়াপ্পা ওর স্ত্রী শবরীকে ডাকে)

কারিয়াপ্পা: কই গো শবরী, এসো। 

(শবরী ভেতর থেকে আসে মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে) 

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী এসেছেন। ব্রাহ্মণ অতিথি মানুষ। দেব্তা। প্রণাম করো।

(শবরী ভূমিষ্ঠ হয়ে গুণ্ডাপ্পার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে যায়)

গুন্ডাপ্পা: আহাহাহা! একি করছেন! থাক। থাক।

 কারিয়াপ্পা: না না বাবুজী। প্রণাম ফিরিয়ে দেবেন না। আর শবরীকে আপনি বলবেন না। ও খুব লজ্জা পাবে।

 গুন্ডাপ্পা: আচ্ছা। ঠিক আছে। 

গুন্ডাপ্পা: আর আমাকেও আপনারএকটু পায়ের ধুলো নিতে দিন। 

গুন্ডাপ্পা: না-না-না-না- 

(আপত্তি সত্ত্বেও স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই গুন্ডাপ্পার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে) 

 গুন্ডাপ্পা: দ্যাখো কারিয়াপ্পা আমি শুধুই একজন শিক্ষক মানুষ। কিছু গবেষণার কাজে এ গ্রামে এসেছিলাম। বিপদের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। বিপদের সময়ে তোমাদের সুন্দর আতিথ্যে আমি মুগ্ধ ও ভীষণ উপকৃত। এটাই যথেষ্ট। কিন্তু তোমরাএভাবে আমাকে দেবতা বলে আর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে আমি বিব্রত বোধ করি। আমি পছন্দ করছি না এ সব। আমার শিক্ষাদীক্ষা একটু অন্যরকম। 

শবরী: বাবুজী, রাগ করবেন না। আপনি সত্যিই আমাদের দেব্তা। কারণ আপনি ব্রাহ্মণ। আমার স্বামী ঠিকই বলেছেন। আপনাকে সেবা করে আমাদের পুণ্য করতে দিন। 

 গুন্ডাপ্পা: আবার এসব কী বলছ? সেবা, পুণ্য এসব বলবে না। আমি ঠিক এরকম করে ভাবি না। 

 কারিয়াপ্পা: যাও। যাও। বাবুজীর হাত পা ধোয়ার জন্যে জলের বালতি, মগ, গামলা নিয়ে এসো। 

শবরী: হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাচ্ছি।

(শবরী ভেতরে চলে যায়)

 গুন্ডাপ্পা: এখানে কেন? তোমাদের স্নানের ঘর নেই? 

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। আমরা বাড়ির পেছনে পুকুরে হাত পা ধুই, চান করি। 

 গুন্ডাপ্পা: তাহলে আমাকে পুকুরটা দেখিয়ে দাও। আমি যাই। হাত,পা ধুয়ে আসি। 

কারিয়াপ্পা: এখন তো ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় হচ্ছে। কী করে যাবেন?

 গুন্ডাপ্পা: তাইতো। মুশকিল হল। তাহলে কী হবে?

কারিয়াপ্পা: আপনি কিছু ভাববেন না, বাবুজী। এখানেই হাত,পা ধোবেন। কোন অসুবিধা হবে না।

(ইতিমধ্যে শবরী জলের বালতি, গামলা, মগ নিয়ে আসে)

শবরী: বাবুজী, আপনার পাদুটো এই গামলাতে রাখুন। 

 গুন্ডাপ্পা: (খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়) এই গামলায় পা ধোবো? ঘর নোংরা হয়ে যাবে তো জল ছিটকে পড়লে।

 কারিয়াপ্পা: কোন অসুবিধা হবে না, বাবুজী। শবরী ঘর মুছে দেবে। 

(গুন্ডাপ্পা খুব ইতস্তত করে গামলায় পা দুটো রাখেন। শবরী মগে করে জল ঢালতে থাকে গুন্ডাপ্পার পায়ে)

 গুন্ডাপ্পা: (বিব্রত হয়ে) একি করছ? আমাকে মগটা দাও। আমি ঢালছি।

 শবরী: কোন অসুবিধা নেই, বাবুজী। ব্যস্ত হবেন না। এবার পা দুটো গামলা থেকে তুলে নিন।

(গুণ্ডাপ্পা পা দুটো গামলা থেকে তুলে নেয়। শর্বরী খোঁপা খুলে ওর চুল দিয়ে গুণ্ডাপ্পার পা মুছিয়ে দিতে যায়। গুণ্ডাপ্পা দ্রুত সরে যান।)

 গুন্ডাপ্পা: একি বাড়াবাড়ি করছ? ছি ছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। এখানে না এসে বরং ঝড়ের মধ্যে ফিরে গেলে ভালো হতো।

 শবরী: বাবুজী, এমনকরে বলবেন না। আমাদের ভয়ানক পাপ হবে। (শবরী ডুকরে কাঁদে) বলবেন না বাবুজী। আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। আপনি দেব্তা। আপনি রাগ করলে আমাদের ভীষণ পাপ হবে। 

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ,বাবুজী। আপনি রাগ করলে আমাদের ভীষণ পাপ হবে।

 গুন্ডাপ্পা: তোমরা সব আশ্চর্য মানুষ। আশ্চর্য তোমাদের এরকম বিশ্বাস। আমি একটা বাইরের লোক। অতিথি যদিও, তবুও তোমার স্ত্রী আমার পা ধুয়ে দিচ্ছে, মাথার চুল দিয়ে পা মুছে দিতে যাচ্ছে, - এসব একদম ভালো লাগছে না। কী করে বোঝাবো তোমাদের যে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি চলে যাব এখান থেকে। হ্যাঁ, চলে যাব। ঝড়ের মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাব। তোমরা শোনো। আমি চলে যাচ্ছি।

(গুন্ডাপ্পা চলে যেতে উদ্যত হয়। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই দৌড়ে গিয়ে গুন্ডাপ্পার পা চেপে ধরে)

 কারিয়াপ্পা: দয়া করুন, বাবুজী। দয়া করুন। এভাবে চলে যাবেন না।

 শবরী: আপনি এভাবে চলে গেলে আমাদের ভীষণ অকল্যাণ হবে। 

কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ। শেষ হয়ে যাবো আমরা। আপনি না মানতে পারেন। আমরা তো মানি। আমরা তো বিশ্বাস করি।

গুন্ডাপ্পা: কী বিশ্বাস করো?

কারিয়াপ্পা:  আপনি দেবতা। ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হলেন দেবতা। 

 গুন্ডাপ্পা: তোমাদের বিশ্বাস নিয়ে তোমরা থাকো। আমি চলে যাচ্ছি। পা ছাড়ো।

 কারিয়াপ্পা: না। না। যাবেন না। বাইরে ভয়ানক দুর্যোগ হচ্ছে। ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। আপনার ক্ষতি হয়ে গেলে আমরা অপরাধী হয়ে যাব। 

শবরী: ভীষণ পাপ হবে আমাদের। 

(স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কাঁদে)

 গুন্ডাপ্পা: (নরম হয়ে) আচ্ছা। আচ্ছা। ঠিক আছে কান্নাকাটি করার দরকার নেই। আমি যাচ্ছি না। তবে এসব বোলো না।  

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আপনি চৌকিতে এই আসনে বসে খেয়ে নিন। অনেক রাত হয়ে গেছে। (চৌকিতে আসন পেতে দেয়। গুন্ডাপ্পা আসনে বসে।)

কারিয়াপ্পা: যাও। যাও। বাবুজির জন্যে খাবার নিয়ে এসো।

শবরী: হ্যাঁ যাচ্ছি। (ভেতরে চলে যায়) 

গুন্ডাপ্পা: তোমার পরিবারে আর কে কে আছে? 

কারিয়াপ্পা: (মাটিতে বসে)আমাদের এক মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়ে বড়। ছেলে ছোট।

 গুন্ডাপ্পা: আচ্ছা। লেখাপড়া করে তো?

কারিয়াপ্পা: ছেলেটা লেখাপড়া করে।

 গুন্ডাপ্পা: মেয়ে পড়াশোনা করে না?

 কারিয়াপ্পা: না।

 গুন্ডাপ্পা: কেন?

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আমাদের জাতের মেয়েরা পড়াশোনা করে না।

গুন্ডাপ্পা: (আশ্চর্য হয়ে) কেন?

কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আমাদের জাতের মেয়েরা পড়াশোনা করলে পরিবারের অকল্যাণ হয়। তাই করে না।

 গুন্ডাপ্পা: (প্রচণ্ড আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হয়ে) এ আবার কী কথা?

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ, বাবুজী। আমাদের জাতের মেয়েদের লেখাপড়া করতে নেই। মেয়েরা লেখাপড়া করে না আমাদের জাতে। 

 গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য! এমন অদ্ভুত কথা শুনতে হবে এই যুগে আমি ভাবতে পারিনি। এই গ্রামেতে তোমাদের জাতের কোন পরিবারের কোন মেয়ে কি তাহলে পড়াশোনা করে না?

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য। এই গ্রামে কি তাহলে মেয়েদের কোন স্কুল নেই? 

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: তুমি পঞ্চায়েতে আছ। তুমি কেন উদ্যোগ নাও নি মেয়েদের স্কুল খোলার জন্যে? আর তুমি কী করেই বা উদ্যোগ নেবে? তুমি তো নিজেই বলছ তোমাদের জাতে মেয়েদের পড়লে অকল্যাণ হয়। ছেলেমেয়েদের ডাকো। ওদের সঙ্গে আলাপ করি।

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। গিরিশ! চেন্নী! এখানে আয়।

(ছেলেমেয়ে দুটো আসে)

 কারিয়াপ্পা: বাবুজিকে প্রণাম কর। 

(ওরা প্রণাম করে) 

গুন্ডাপ্পা: থাক থাক। তোমার নাম গিরিশ? কোন ক্লাসে পড়?

গিরিশ: ক্লাস টেন এ।

গুন্ডাপ্পা: আর তুমি চেন্নী?

(চেন্নী মাথা নাড়ে)  

গুন্ডাপ্পা: এর চোখে মুখে যথেষ্ট বুদ্ধির ছাপ। অথচ একে লেখাপড়া শেখালে না! আশ্চর্য সংস্কার!        

গিরিশ: আমি তো কতবার বাবাকে বলেছিলাম দিদিকেও ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে। বাবাতো কিছুতেই রাজি হয়নি

 কারিয়াপ্পা: তুই থাম।

 গিরিশ: দিদিও রাজি হয়নি।  

গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য। তুমি কেন রাজি হওনি চেন্নী স্কুলে পড়তে?

চেন্নী: বাবা তো বলল বাবুজি। ইস্কুলে মেয়েরা পড়লে পরিবারের অকল্যাণ হয়। 

গুন্ডাপ্পা: ওটা তো তোমার বাবার শেখানো কথা। তোমার নিজের কি মনে হয়?

 চেন্নী: আমার কিছু মনে হয় না বাবুজি।

 গুন্ডাপ্পা: নিশ্চয় কিছু মনে হয়। তোমাকে ছোটবেলা থেকে যা বোঝানো হয়েছে তাই তুমি তোতা পাখির মতো বলছ।  সত্যি করে বলোতো তোমার কি ইচ্ছে হয় নি স্কুলে যেতে? ভায়ের মতো লেখাপড়া শিখতে? বই টই পড়তে? 

চেন্নী: না বাবুজি। 

গিরিশ: না না বাবুজি। দিদি মিছে কথা বলছে। আসলে ওর খুবই ইচ্ছে হয়।

 চেন্নী: না না বাবুজি। ভাই মিছে কথা বলছে। 

গিরিশ: না বাবুজি। দিদি মিছে কথা বলছে। 

 চেন্নী: তুই থামবি গিরিশ? 

গুন্ডাপ্পা: কী স্যাড ব্যাপার!

গিরিশ: কেন থামব?  তুই কি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখিস না? আমি নিজে একদিন দেখেছি। আমার একটা বই হাতে নিয়ে তুই ঝর ঝর করে কাঁদছিস। আর বিড়বিড় করে বলছিস  ‘’না না মেয়েদের এই বই টই পড়তে নেই। লেখাপড়া শিখতে নেই। লেখাপড়া শিখলে পরিবারের অকল্যাণ হবে। আমার ভাইয়ের অকল্যাণ হবে।’

 চেন্নী: (কেঁদে ফেলে) তুই কি থামবি গিরিশ?

 গিরিশ: না থামবো না। বাবুজি, দিদিকে বলো না আমার সঙ্গে স্কুলে পড়তে। বাবাকে রাজি করাও না গ্রামের স্কুলে যেন দিদিকে ভর্তি করে দেয়। 

 কারিয়াপ্পা: আহ্। গিরিশ। জ্বালাসনি বাবা। আমরা নীচু জাত। আমাদের ঘরের মেয়েদের লেখাপড়া করতে নেই। 

 গিরিশ: আমরা নীচু জাত কেন বাবা? আমরা সবাই তো এই স্বাধীন দেশের মানুষ। কেন কেউ উঁচু জাত? আবার কেউ নিচু জাত, দলিত জাত আমাদের মতো? এইতো সেদিন ইস্কুলে আমাদের একটা গান শেখানো হল।  আমার একজন মাস্টারমশাই গানটা গেয়ে গেয়ে আমাদের শেখালেন।  ওই গানটাতে তো  উঁচু জাত নিচু জাতের কথা নেই। ব্রাহ্মণ আর দলিতের কথা নেই।  বাবুজি শুনবে গানটা? 

 কারিয়াপ্পা: তুই যা। এখন বাবুজিকে গান শুনিয়ে বিরক্ত করবি না।বাবুজি এখন খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নেবেন।

 গুন্ডাপ্পা: না না। করুক না গানটা। আমি গান শুনতে ভালবাসি। গাও তুমি। আমি শুনি। 

(গিরিশ গান ধরে। মিলে সুর মেরা তুম হারা। গুন্ডাপ্পা গলা মেলায়। ওদের গান শেষ হয়ে গেলে চেন্নীকেও গুন্ডাপ্পা গান গাইতে বলে।)

 গুন্ডাপ্পা: তুমিও একটা গান করো চেন্নী। পারবে না গাইতে?

গিরিশ: হ্যাঁ। হ্যাঁ।  দিদিও গান গাইতে পারে।  গাও না দিদি। সেই ভজনটা। একদিন গুন গুন করে গাইছিলে পুকুর ঘাটে।

গুন্ডাপ্পা: হ্যাঁ। হ্যাঁ। গাও। গাও।  শুনব। 

কারিয়াপ্পা: মেয়েছেলে গান গাইলে অকল্যাণ হবে।  ওকে বলেছি অনেকবার। ও আমার কথা শুনতে চায় না। 

গুন্ডাপ্পা: তুমি থামো তো। সবকিছুতেই অকল্যাণ আর অকল্যাণ। horrible। মেয়েরা লেখাপড়া করলে অকল্যাণ - গান গাইলে অকল্যাণ।  কে বলেছে এসব কথা?

 কারিয়াপ্পা: তাই তো জানি বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: ভুল জানো। ওসব ভুল কথা। সবসময় একটা ভয় তোমাদের তাড়া করে বেড়ায়। এইসব কথা বোলো না। গাও চেন্নী। তুমি গাও। 

চেন্নী: যদি পাপ হয় বাবুজি?

গুন্ডাপ্পা: হবে না। আমি বলছি। 

চেন্নী: ঠিক বাবুজি। আপনি বললে হবে না। আপনি তো দেবতা। 

গুন্ডাপ্পা: কী মুশকিল! তুমিও দেখছি তোমার বাবা মায়ের মত কথাবার্তা বলছো। ওসব বলো না। 

 চেন্নী: না না বাবুজি। আপনি দেবতা। 

 কারিয়াপ্পা: ঠিক ঠিক। বাবুজী ব্রাহ্মণ মানুষ।  বাবুজি তো দেবতাই। চেন্নী ঠিকই বলেছে। 

গুন্ডাপ্পা: তোমাদের বুঝিয়ে পারা যাবে না। 

গিরিশ: বাবুজি আমার কাছে দেবতা কিন্তু বিরাট কোহলি।  

গুন্ডাপ্পা: (হেসে ফেলে) এটা ভালো বলেছ।  ঠিক আছে চেন্নী। ভজনটা গাও শুনি।  

(চেন্নী ভজন গান করে। গান শেষ হলে গুন্ডাপ্পা  হাততালি দেয়। চেন্নাী লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।) 


(শবরী থালায় খাবার নিয়ে আসে। গুন্ডাপ্পার সামনে রাখে।) 

কারিয়াপ্পা: খেয়ে নিন, বাবুজী।

(গুন্ডাপ্পা খেতে শুরু করেন। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরে আলো নিভে যায়।)

(আলো জ্বলে। গুন্ডাপ্পার খাওয়া হয়ে গেছে)

 গুন্ডাপ্পা: প্রচুর খাওয়ালে কারিয়াপ্পা। এবার তো আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। ঘুমোতে হবে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে।)

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ হ্যাঁ বাবুজি চলুন। আপনাকে পৌঁছে দিই যে ঘরে আপনার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। 

(ধীরে আলো নিভে যায়।)

(প্রথম ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুন্ডাপ্পা: খাওয়া দাওয়া শেষ করে শোয়ার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে গেছি। গৃহস্বামী কারিয়াপ্পাই ওই ঘরে পৌঁছে দিল আমাকে। পশ্চিম দিকের একটা ছোট ঘর। একটা জানলা খোলা। ঝড়ের রাত। বৃষ্টি পড়ছে। তবে বৃষ্টির ছাট আসছে না। কিন্তু বাইরে হাওয়ার প্রবল মাতামাতি। গ্রামেতে ইলেকট্রিক কারেন্ট নেই। মনে হয় ঝড়ের জন্যেই কারেন্ট নেই। একটা কেরোসিনের কূপী মৃদু মৃদু জ্বলছে। আমি দরজা বন্ধ করে, পোশাক বদলে সবে শুয়েছি। আমার এক প্রস্থ রাতের পোশাক আমার ব্রীফকেসে সবসময় থাকে। একটু তন্দ্রা এসেছিল। এমন সময় দরজায় মৃদু করাঘাত। আমি একটু অবাক হয়ে দরজা খুলে দিই। দেখি কারিয়াপ্পার সেই মেয়ে চেন্নী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ঘরে ঢুকে আমি কোন প্রশ্ন করার আগেই নিঃসংকোচে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল। আর আমাকে অত্যন্ত অবাক করে দিয়ে নির্দ্বিধায় যে প্রশ্ন আমাকে করল, তা উচ্চারণ করতে যে কোন ভদ্রজনই লজ্জিত হবেন। তবু তার কথা তো তার মতো করেই বলতে হবে আপনাকে। নাহলে আমার বিবরণ অসম্পূর্ণ হবে। মেয়েটি তার রিনরিনে কন্ঠে স্মিতমুখে বলল…


।। দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাক।। 


চেন্নী: বাবুজী, আমাকে চাই তো আপনার? 

গুন্ডাপ্পা: (অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে) মানে? তোমাকে চাই মানে? কী বলতে চাইছ তুমি? 

চেন্নী: (একটু অবাক হয়ে) আজ রাতে আপনার সেবার জন্যে? 

গুন্ডাপ্পা: (চমকে উঠে) কী? 

চেন্নী: (আরও অবাক হয়ে) বুঝলেন না বাবুজি? আমি মেয়েমানুষ। আরো খোলসা করে বলতে যে আমার লাজ লাগছে।

গুন্ডাপ্পা: (ক্রুদ্ধ হয়ে) তুমি কি বলতে চাইছ? এত রাতে তোমার মতো যুবতী মেয়ে পরপুরুষের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে… ছি ছি… তুমি চলে যাও। কীসের সেবা? আমার কোন সেবাটেবার দরকার নেই। 

চেন্নী: (ত্রস্ত হয়ে) না,না। রাগ করবেন না বাবুজী। আপনি অতিথি। কুলীন ব্রাহ্মণ। আপনি রাগ করলে দেবতার কোপ হবে আমাদের ওপর। আমাকে কি ভালো লাগছে না বাবুজী? আমি কি স্নান করে আসব? 

গুন্ডাপ্পা: কী সব বলছ? তোমাকে বলছি তুমি যাও। 

চেন্নী: (কাঁদো কাঁদো হয়ে) আপনি রাগ করছেন কেন বাবুজি? আমি তো আপনাকে সুখ দিতে এসেছি। আজ সারারাত আপনি আমাকে…..

গুন্ডাপ্পা: ছি ছি ছি। থামো। থামো। তোমার এসব কথা বলতে লজ্জা করছে না? 

চেন্নী: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) কেন বাবুজী? 

গুন্ডাপ্পা: কেন? তুমি কী? ইস। তুমি একটা অত্যন্ত বাজে মেয়ে। এত খারাপ স্বভাব তোমার! 

চেন্নী: আপনি এসব কী কটু কথা বলছেন বাবুজি? 

গুন্ডাপ্পা: তুমি পাগল না শয়তান? 

চেন্নী: (ক্রুদ্ধ হয়ে) আপনি কেন আমাকে গালাগালি দিচ্ছেন? 

গুন্ডাপ্পা: গালাগালি দেব না তো কি ভাল বলব? তোমার এই স্বভাবের কথা বাড়ির লোক জানে? তোমার বাবাকে ডেকে বলব? নাকি এটা একটা ফাঁদ? তাই তো মনে হয়। এই শোনো - তোমার বাবা-মা কি তোমায় এখানে পাঠিয়েছে?

চেন্নী: হ্যাঁ। কেন? 

গুন্ডাপ্পা: (স্তম্ভিত হয়ে) ও। এই জন্যে এত খাতির করে আমাকে এখানে আনা? এটা প্রস্টিটিউটের বাড়ি! ইস।এই তুমি দরজা থেকে সরো। আমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাব। 

চেন্নী: (কেঁদে ফেলে) (অত্যন্ত ভীত হয়ে) না না বাবুজি। এই ঝড়ের রাতে আপনি যাবেন না। আপনার বিপদ হলে দেবতা আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমাদের অকল্যাণ হবে। আমরা শেষ হয়ে যাব। আমার বাবা মা ছোট ভাই - আমাদের সকলের সর্বনাশ হবে।

 গুন্ডাপ্পা: ন্যাকামি করবে না। কাঁদছ! আমার বিপদ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এরকম খারাপ প্রস্তাব করতে লজ্জা করে না? তুমি একটা অত্যন্ত খারাপ মেয়ে। তোমরা খুব খারাপ। 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) কীসব বলছেন? (উত্তেজিত হয়ে প্রবল চিৎকার করতে থাকে) আপনি কেন বারবার আমাকে খারাপ বলছেন - আমাদের খারাপ বলেছেন? 

গুন্ডাপ্পা: (শ্লেষের সাথে) এঃ বলবেনা! তুমি, তোমরা খারাপ নয়ত কি ভালো? 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যাঁ। ভালো। ভালো। গ্রামের সবাই জানে আমি ভালো - আমরা ভালো। সবাই জানে। সবাই। 

গুন্ডাপ্পা: বাইরে থেকে জানে। যদি জানতো ভেতরটা এতো সাংঘাতিক নোংরা - ছিঃ – 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) কেন খারাপ নোংরা এসব বলছেন আপনি? আমি কি দোষ করেছি?




গুন্ডাপ্পা: অদ্ভুত! দারুন শিক্ষা পেয়েছ তো বাবা-মার কাছ থেকে! কোনটা খারাপ তাও বোঝো না। শোনো। তোমার সদ্য যৌবন এসেছে। তাই তোমার বাড়ি তোমায় খুব খারাপ পথে নামিয়ে দিয়েছে। কেননা তোমার বাড়ি খুব খারাপ। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা-মা ব্যবসা করছে। তুমি এসব বোঝোনা মনে হচ্ছে। তোমার বাড়ির কথায় এসব কোরো না। যাও। 

চেন্নী: (অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে) বাবুজি, আপনি এসব কি বলছেন? আপনি কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথি। অতিথি নারায়ন। আপনাকে সেবা করা, সুখ দেওয়াই তো আমার ধর্ম বাবুজি। আমি যে বাসবী।

গুন্ডাপ্পা: (বুঝতে না পেরে) বাসবী? তুমি বাসবী মানে? 

চেন্নী: বাসবী কী আপনি জানেন না বাবুজি? যে সব মেয়েদের দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া হয়, তাদের বাসবী বলে বাবুজী।

গুন্ডাপ্পা: দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া বলতে? 

চেন্নী: আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল আমার। তখন দেবতার পায়ে আমাকে সঁপে দেওয়া হয়েছিল। 

।। দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাক শেষ।। 


।। তৃতীয় ফ্ল্যাশব্যাক।। 

(মন্দির)

কারিয়াপ্পা: পুরুত মশাই, রক্ষা করুন আমার মেয়েকে.। রক্ষা করুন ওকে ঠাকুর মশাই।

শবরী: হ্যাঁ, ঠাকুর মশাই। আপনিই পারেন  আমাদের মেয়ে কে বাঁচাতে। ভীষণ কঠিন অসুখে  ভুগছে ও। আপনি না বাঁচালে ও কিছুতেই বাঁচবে না পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ ওরে অবোধ, আমি কেউ নয় বাবা। সবকিছুই দেবতার হাত। ঠাকুরের হাত। 

কারিয়াপ্পা: আপনি ঠাকুরকে বলুন আমাদের মেয়েকে বাঁচাতে। ওকে সুস্থ করে তুলতে। আপনার কথা দেবতা নিশ্চয় শুনবেন। 

শবরী: অতটুকু ছোট্ট মেয়ে আমার। ওর কষ্ট দেখে আমাদের বুক ফেটে যায়। সারাদিন আমরা শুধু চোখের জল ফেলি। রক্ষা করুন পুরুত মশাই আমাদের মেয়েকে। রক্ষা করুন ওর জীবন। 

পুরোহিতঃ তাহলে শোন কারিয়াপ্পা। তোদের মেয়ের জীবন যদি রক্ষা করতে চাস তাহলে তোদের মেয়েকে দেবতার পায়ে সঁপে দে। তোদের মেয়েকে বাসবী করে দে। তাহলে আর কোন ভয় থাকবে না। দেবতা তাহলে তোদের মেয়ের জীবন রক্ষা করবে। 

কারিয়াপ্পা: বাসবী?

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। বাসবী। তোরা কি রাজি আছিস?

 কারিয়াপ্পা: ঠিক আছে পুরুত মশাই। আমরা রাজি। আমাদের মেয়ে কে বাঁচাতেই হবে। 

পুরোহিতঃ বাসবী হলে কিন্তু ওর আর কোনদিন বিয়ে দেওয়া যাবে না কারিয়াপ্পা। ওর আর কোনদিন বিয়ে হবে না।

শবরী: সে কি? আর কোনদিন বিয়ে হবে না? 

পুরোহিতঃ না। বাসবী মানে তো ওর সঙ্গে দেবতার বিয়ে হয়ে গেল। ও হয়ে গেল দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া নৈবেদ্য। দেবতার ভোগের সামগ্রী।

 কারিয়াপ্পা: ঠিক আছে। আমরা রাজি। বাসবী হলে যদি ওর জীবন রক্ষা হয় তাহলে ওকে বাসবী করে দিন।

 শবরী: কী বলছ তুমি?

 কারিয়াপ্পা: ঠিকই বলছি শবরী। এছাড়া আমাদের মেয়েকে বাঁচাবার আর কোন উপায় নেই।

পুরোহিতঃ কিন্তু আর একটা কথা। সেটাও মেনে নিতে হবে।

 কারিয়াপ্পা: কী?

পুরোহিতঃ কোনো ব্রাহ্মণ যদি তোদের বাড়িতে কখনো অতিথি হয় তার সেবার জন্য তোদের মেয়েকে তার কাছে রাতের বেলায় পাঠাতে হবে। তার ভোগের জন্যে। 

 শবরী: (আঁতকে ওঠে) সে কি! 

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। কেননা ব্রাহ্মণ হল দেবতা। আর দেবতার পায়ে তোরা তোদের মেয়েকে সঁপে দিয়েছিস দেবতার ভোগের জন্যে। তাই সেই অতিথি ব্রাহ্মণের ভোগের জন্যে রাতের বেলায় তোদের মেয়েকে তার কাছে সঁপে দিতে হবে।  তা না দিলে দেবতার অপমান হবে। তখন তোদের ওপর দেবতার  ভয়ানক  অভিশাপ নেমে আসবে। আর তোদের পরিবারের চরম অকল্যাণ হবে। তাই  তোদের মেয়ে বড় হয়ে রজস্বলা হলে তাকে এটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। পারবি তো তোরা?

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যাঁ পারব। 

পুরোহিতঃ (ক্রমশ চোখ রক্তিম ও গলার স্বর হিংস্র আর তীব্র হয়ে যায়। ভয় দেখাতে থাকে।) একবার মেয়েকে বাসবী করে দিলে আর ফেরার উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতে তোদের মেয়ে বড় হলে যদি এসব না মানে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে তোদের পরিবারের। ধ্বংস হয়ে যাবি তোরা। শেষ হয়ে যাবি তোরা। কথার খেলাপ হলে দেবতার চরম অপমান হবে। তখন দেবতার কোপে তোরা সবাই শেষ হয়ে যাবি। তোদের বংশ লোপাট হয়ে যাবে।  

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (প্রচণ্ড ভীত হয়ে) না না। কথার খেলাপ হবে না।

পুরোহিতঃ তোদের মেয়ের পরে তোদের একটা  ছেলে আছে তো?

কারিয়াপ্পা ও শবরী:  হ্যাঁ পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ দেবতাকে ঠকালে তাকেও বাঁচাতে পারবি না। 

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (প্রচণ্ড ভীত হয়ে) না না। দেবতাকে ঠকাবো না আমরা।

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। এটা সারাজীবন মনে রাখবি। আর মেয়ে বড় হলে তাকেও বলবি এটা সারা জীবন মনে রাখতে। তোদের মেয়ের বিয়ে না হলে কোন ক্ষতি নেই। ছেলে বড় হলে তার বিয়ে দিবি। তোদের বংশ রক্ষা হবে। 

কারিয়াপ্পা ও শবরী:  হ্যাঁ, পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ তাহলে  কাল সকালে ঠাকুরের পুজোর সময়  তোদের মেয়েকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে নিয়ে আসবি। কাল সকালেই তোদের মেয়েকে বাসবী করে দেব।

।। তৃতীয় ফ্ল্যাশব্যাক শেষ।। 


চেন্নী: সেই থেকে আমি বাসবী বাবুজি। যারা বাসবী, তাদের তো কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে দেহ দিয়ে সেবা করতেই হবে। অতিথি যে দেবতা। আমরা যে দেবতার দাসী। আপনি আমাকে নিন বাবুজি। নিয়ে সুখী হোন। নাহলে দেবতার কাছে কথার খেলাপ হয়ে যাবে আমাদের। আমাদের অকল্যাণ হবে। বাবা-মা ভাই সকলের অকল্যাণ হবে। আমাকে নিন বাবুজি।

গুন্ডাপ্পা: থামো। থামো। ছি ছি। মূর্খ মেয়ে। কল্পনা করতে পারি না এসব এই সভ্য যুগে। কী অদ্ভুত খারাপ নিয়ম তোমাদের। শোনো এ যুগে এসব চলে না। এভাবে যেসব মেয়েরা পরপুরুষের হাতে নিজেদের তুলে দেয়, তাদের গণিকা বলে, পতিতা বলে, বেশ্যা বলে। বেশ্যাদের কথা শোনো নি তুমি? জানো না তারা টাকা নিয়ে পরপুরুষের কাছে নিজেদের দেহ বিক্রি করে? জানো না সমাজ তাদের ঘৃণা করে? তুমিও তাহলে সেরকম পতিতা বেশ্যা? 

চেন্নী: (আর্তনাদ করে) না। না। ওরকম বলবেন না বাবুজি। হ্যাঁ। আমি ওরকম মেয়েদের কথা জানি। তারা শরীর বেচে পয়সা নেয়। টাকা নিয়ে নিজেদের শরীর বিক্রি করে। আমি তা নই বাবুজি। (হাউ করে হাউ করে কেঁদে ফেলে) আমি তো বাসবী। আমি তো কোন পয়সা পেতে আসিনি। আমি তো এসেছি আপনার সেবার জন্য। 

গুন্ডাপ্পা: থামো। ওই একই হল। পতিতা শরীর বেচে পয়সা নেয়। তুমি শরীর বেচে তোমার বাড়ির, তোমার নিজের নিরাপত্তা কিনছ। দেবতার আশীর্বাদ কিনছ। তুমি খারাপ হয়ে গেছ। পতিতার লাইনে নেমে গেছ। তুমি বুঝতে পারছ না।

চেন্নী: (প্রচন্ড অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে) কিন্তু বড় হওয়া থেকে যে আমি জেনে এসেছি আমাকে এসব করতে হবে। শুনে আসছি আমি বাসবী। তাই আমাকে কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে দেহ দিয়ে সেবা করতে হবে। হ্যাঁ। আমাদের সমাজে এটাই নাকি নিয়ম বাবুজি। বাসবীকে শরীর দিতেই হবে তার কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে। আপনি শহরের কুলীন ব্রাহ্মণ। অথচ আপনিই আমাকে পতিতা বলছেন। বেশ্যা বলছেন। তাহলে তাহলে….(থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে অস্বাভাবিক আওয়াজ করতে থাকে মুখ দিয়ে)….

গুন্ডাপ্পা: তাহলে আর কি। তুমি একটা বোকা মেয়ে। অশিক্ষিত মেয়ে। লেখাপড়া শেখোনি। তাই ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে বুঝিয়ে তোমাকে দিয়ে বেশ্যার কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু এভাবে বাড়ির কল্যাণ হয় না।তোমারও হয় না। এতে তোমার ক্ষতিই হচ্ছে। তোমার সর্বনাশ হচ্ছে। 

চেন্নী: (প্রবলভাবে বিশ্বাস টলে যায়) তাই বাবুজি? আমি কি সত্যিই তাহলে পতিতা হয়ে গেছি?

 গুন্ডাপ্পা: তাইতো। তুমি পতিতা ছাড়া আর কী? 

চেন্নী: তাহলে আমার বাবা-মা এতদিন আমাকে ভুল বুঝিয়েছে? আপনারা শহরের বাবুরা তাহলে বাসবীদের পতিতা বলে মনে করেন? (অন্তর্দ্বন্দ্বে চুরমার হয়ে যায়) তাহলে দেবতা- ঠাকুর- আমার অসুখ সেরে যাওয়া - মানত - দেবতারা আদেশ - এসব মিথ্যে? 

 গুন্ডাপ্পা: তোমার অসুখ সেরে ছিল ওষুধ খেয়ে। আর যদি দেবতার আশীর্বাদেই অসুখ সেরে যায়, তা হলেই বা কি? দেবতা কি তোমাদের এরকম মানত করতে বলেছিল? তুমি নিজে শুনেছ? তোমরা নিজেদের কানে শুনেছ? 

চেন্নী: মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল। 

গুন্ডাপ্পা: (অত্যন্ত বিদ্রুপের সঙ্গে ) পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল!!

চেন্নী: হ্যাঁ। পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল আমার বাবা-মাকে। বলেছিল মেয়েকে বাসবী করবে বলে মানত করো। তাহলেই মেয়ে সেরে উঠবে। তাই তো আমাকে – 

 গুন্ডাপ্পা: শোনো ওসব পুরোহিতদের শয়তানি।‌ ধাপ্পাবাজি। তোমাদের সমাজের পুরুষদের শয়তানি। কুলীনদের শয়তানি। তোমাদের মতো অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের পরিবারের মেয়েদের ভোগ করার জন্য পুরোহিতদের তৈরি করা এসব শয়তানি নিয়ম, প্রথা। এসব নিয়ম ভগবানের তৈরি করা নয়। ভগবানের নিয়ম এরকম খারাপ হয় না। মেয়েদের সর্বনাশ কি ভগবান চাইতে পারেন? তার কাছে তো মেয়ে পুরুষ সবাই সমান। এসব নিয়মে কাদের লাভ হয় দ্যাখো। লাভ হয় লোভী শয়তান যত পুরোহিত কুলীন ব্রাহ্মণদের। তাই তারাই এইরকম নিয়ম তৈরি করেছে। আর যুগ যুগ ধরে দেবতার নামে এসব চালিয়ে আসছে। তুমি ঘরে যাও। নিজেকে এভাবে আর খারাপ পথে ঠেলে দিও না। নোংরা পথে ঠেলে দিও না। 

চেন্নী: (ভেঙে পড়ে) তা হলেএসব নোংরা খারাপ! আমাকে ভুল বুঝিয়ে এরকম নোংরা পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে? বাবুজি, আমি তাহলে সত্যি খারাপ মেয়ে? নোংরা? পতিতা? আ আ আ আ আ আ ( তীব্র বীভৎস আর্তনাদ করে দৌড়ে চলে যায়। দ্রুত পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।)

 গুন্ডাপ্পা: চেন্নী চেন্নী চেন্নী……. দীর্ঘ নীরবতা। 

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুণ্ডাপ্পা: জাস্টিস কৃষ্ণান, একটা বীভৎস চাপা অথচ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে চেন্নী দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেহেতু ওর আর্তনাদ খুব উচ্চগ্রামের ছিল না, তাই বাড়ির আর কারোর ঘুম ভাঙলো না। কেউ সাক্ষী থাকেনি তার এই মানসিক বিপ্লবের। শুধু আমি ছাড়া। ও ঘর ছেড়ে যাবার সময় আমি দেখলাম ওর চোখেমুখে এক অস্বাভাবিক ঘৃণা মিশ্রিত উপলব্ধি। ঘৃণা, হতাশা, জিঘাংসা, অথচ একটা আলো। একটা চেতনার দ্যুতিও যেন ফুটে উঠেছিল ওর চোখে।‌ ওর মাথা নাড়ায়, ওর অভিব্যক্তিতে। যেন চাবুকের একটা আঘাত কিংবা বিদ্যুতের একটা প্রবাহে একটা মাটির পুতুল থেকে একটা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে গেল মেয়েটা। সরল অবোধ মূর্খ গ্রাম্যবালিকা থেকে হয়ে গেল একটা পোড় খাওয়া নারী। একটা ম্যাচিউরড উওম্যান। এক লহমায় ওর চোখ থেকে যেন যাবতীয় সংস্কারের মিথ্যে আবরণ ছিন্ন হয়ে সরে গেল।

কৃষ্ণান: এ তো ভালোই হলো। ও নিজেকে চিনতে পারল।‌

 গুণ্ডাপ্পা: না জাস্টিস কৃষ্ণান। কদর্য বাস্তবের নির্মম সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে সে একেবারে তলিয়েই গেল। সাঁতরে উঠতে পারল না। মেয়েটা সেই রাতেই আত্মহত্যা করল। 

কৃষ্ণান: সেকি! 

গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ। জাস্টিস কৃষ্ণান।‌ সেই রাতই ছিল তার শেষ রাত। মেয়েটা চিলেকোঠার ঘরে গলায় দড়ি দিল। 


।। চতুর্থ ফ্ল্যাশব্যাক।।

(সকাল হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। গুণ্ডাপ্পা ব্রিফকেস নিয়ে ভেতর থেকে মঞ্চে আসেন। নেপথ্যে কান্নার আওয়াজ।) 

 গুণ্ডাপ্পা:…….(আপন মনে) কে কাঁদছে? কারিয়াপ্পা! কারিয়াপ্পা!

(শোকার্ত ও বিধ্বস্ত কারিয়াপ্পা টলতে টলতে ভেতর থেকে আসে)

 গুণ্ডাপ্পা: কারিয়াপ্পা, সকাল হয়ে গেছে। ঝড়বৃষ্টিও থেমে গেছে। এবার আমি যাবো। 

কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ। বাবুজী। 

 গুণ্ডাপ্পা: কী হয়েছে তোমাদের? তোমরা সবাই কাঁদছ কেন?

 কারিয়াপ্পা: (প্রবল ভাবে কেঁদে ফেলে) আমার মেয়ে চেন্নী রাতের বেলায় চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। 

 গুণ্ডাপ্পা: সেকি! 

(শবরী আর্তনাদ করতে করতে ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে ভেতর থেকে আসে। পেছন পেছন গিরিশও ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে আসে।)

শবরী: আ আ আ আ আ আ। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল বাবুজী। চেন্নী আর নেই। আমার মেয়েটা আর নেই।

গিরিশ: (প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে) দিদি রে। দিদি গো। আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলি!

 কারিয়াপ্পা: (কাঁদতে কাঁদতে) বাবুজী। চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিই।  

(গুণ্ডাপ্পার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে)

গুণ্ডাপ্পা: না না। এ সময় তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি। 

শবরী: না বাবুজী। আপনি যাবেন না। (পাগলের মত হয়ে যায়। ওর দৃষ্টি অস্বাভাবিক হয়ে যায়) আপনাকে বলতে হবে কেন  মরল আমার মেয়েটা।  কেন ও হঠাৎ গলায় দড়ি দিল? কী হয়েছিল রাতের বেলায় বাবুজী? আপনার ঘর থেকে কেন ওর চেঁচামেচি কান্নাকাটি ভেসে আসছিল মাঝরাতে? কেন? কেন? কেন ও ভীষণ চেঁচিয়ে উঠেছিল? কীসের তর্ক বিতর্ক ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছিল ওর সঙ্গে আপনার বাবুজী? আপনি ওকে কি বলেছিলেন? বলুন। বলুন। বলতে হবে আপনাকে।  

গুণ্ডাপ্পা: তার আগে বলো গভীর রাতে ও কেন আমার ঘরে গেছিল। একজন যুবতী মেয়ে হয়ে পরপুরুষের ঘরে কেন ও রাতের বেলায় গেছিল? কারা পাঠিয়েছিল ওকে আমার ঘরে?  কেন ও গেছিল আমার ঘরে মাঝরাতে?

 শবরী: ওতো বাসবী। ওকে তো আপনার ঘরে যেতে হবেই রাতের বেলায়। কেননা  আপনি ব্রাহ্মণ অতিথি। দেবতা। ও বাসবী। ও যদি না যেত তাহলে আমাদের পরিবারের  চরম অকল্যাণ হোত। 

গুণ্ডাপ্পা: থামো মূর্খের দল।  এখন কি তোমাদের পরিবারের কল্যান হল? লজ্জা করে না তোমাদের নিজেদের মেয়েকে পরপুরুষের  কাছে রাতের বেলায় পাঠাতে তার ভোগের জন্যে? আমি সব শুনেছি চেন্নীর কাছে। তাকে বলেছি এভাবে নিজেকে নষ্ট করা উচিত নয়।  বলেছি তাকে এই পথ থেকে সরে যেতে। বলেছি তাকে এটা পতিতার পথ। এটা পতিতাগিরি। 

 শবরী: (গুন্ডাপ্পার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর জামাটা খামচে ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকাতে থাকে)  পতিতা? পতিতা? পতিতা? আমাদের মেয়ে পতিতা?  আমাদের মেয়ে পতিতা? আমাদের মেয়ে পতিতা? পরিবারের কল্যাণের জন্য নিজেকে ব্রাহ্মণ দেবতার কাছে সঁপে দেওয়াকে পতিতাগিরি বলে? 

গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ। হ্যাঁ। একে  পতিতাগিরিই বলে।  নিজের দেহকে পরের কাছে এভাবে তুলে দেওয়াকে পতিতাগিরিই বলে। পরিবারের কল্যাণের নাম করে হলেও একে পতিতাগিরিই বলে। 

 শবরী: আপনি ব্রাহ্মণ। দেবতা।চেন্নী বাসবী হয়ে আপনার কাছে গেছিল বলে তাকে পতিতা বলছেন?

 গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ বলছি। বলছি। আমি দেবতা নই। আমি একজন সাধারণ মানুষ তোমাদের মতো। তোমরা মূর্খ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ব্রাহ্মণ পুরুতের মিথ্যে কথায় নিজেদের মেয়েকে সারাজীবনের জন্যে পতিতা বানিয়ে দিয়েছ। তাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দাওনি। তাকে লেখাপড়া শেখাওনি। তাকে বিয়ে করে সুখী হতে দাওনি। তাকে শিখিয়েছ সারা জীবন ধরে বেশ্যবৃত্তি করতে। তাকে শিখিয়েছ ব্রাহ্মণদের কাছে নিজের শরীর বেচে দিতে। পরিবারের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে। তোমরা অমানুষ। তোমরা নিজেদের মেয়েকে বেশ্যা বানিয়েছ। আর সেটা সে বুঝতে পেরেই ঘেন্নায় গলায় দড়ি দিয়েছে। তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী তোমরা তোমরা তোমরা। 

শবরী: (কারিয়াপ্পাকে) শুনছ? সব শুনছ? তুমি কিছু বলো। বলো। বলো। (শবরী কান্নায় ভেঙে পড়ে কারিয়াপ্পার জামাটা খামচে ধরে)। আমাদের মেয়ে কি সত্যিই পতিতা ছিল? ও কি পতিতাগিরি করত? বলো। বলো।

 কারিয়াপ্পা: (কান্নায় ফেটে পড়ে) জানি না। জানি না। বুঝতে পারছি না। আমাদের তো বলা হয়েছিল বাসবী বলে ওকে নিজেকে সঁপে দিতে হবে ব্রাহ্মণ অতিথির কাছে। কিন্তু বাবুজী তো বলছে ও পতিতা। ও সারা জীবন পতিতাগিরি করেছে।  

শবরী: (কান্নায় ফেটে পড়ে) এটা সত্যি না মিথ্যে? বলো। বলো।বলো। 

কারিয়াপ্পা: (কান্নায় ফেটে পড়ে) জানি না। জানি না। জানি না।  

শবরী: (কান্নায় ফেটে পড়ে) হায় ভগবান। জীবন চলে গেল আমার মেয়ের। কিন্তু মরার আগে ও জেনে গেল ও পতিতা। হায় ভগবান।  

গিরিশ: হায় ভগবান। আমার দিদি পতিতা। আমার দিদি পতিতা। হায় ভগবান। হায় ভগবান। 

(ওরা তিনজন প্রবল কাঁদতে থাকে। গুণ্ডাপ্পা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।) 

(চতুর্থ ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুণ্ডাপ্পা: মিস্টার কৃষ্ণান, আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা আমি কি আইনের চোখে চেন্নীর মৃত্যুর জন্যে দায়ী?

কৃষ্ণান: ওর বাড়ির কেউ কি  আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেছে পুলিশের কাছে?

 গুণ্ডাপ্পা: ওই ঘটনার পর একটি সপ্তাহ চলে গেছে। কই পুলিশ তো আমায় খোঁজেনি।     

 কৃষ্ণান: তাহলে সমস্যা কিসের? 

 গুণ্ডাপ্পা: পুলিশ আমাকে না খুঁজলেও কিংবা আইনের চোখে আমি অপরাধী না হলেও আমি কি সত্যিই নির্দোষ জাস্টিস কৃষ্ণান?

কৃষ্ণান: আপনি নিজেকে দোষীই বা ভাবছেন কেন প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা?

 গুণ্ডাপ্পা: আমি দোষী নয় বলছেন?

কৃষ্ণান: না। কেন আপনার এত  অপরাধবোধ প্রফেসর? আপনি কোন অপরাধ করেননি। আইনের চোখে তো নয়ই। 

 গুণ্ডাপ্পা: আমি কি তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করিনি?

কৃষ্ণান: না। কী করে তা হয়? আপনি তাকে সুস্থ জীবনের কথা বলেছেন। তার অসুস্থ জীবন সম্পর্কে তাকে সচেতন করে দিয়েছেন। এটাতো আত্মহত্যায় প্ররোচনাদান নয়। 

 গুণ্ডাপ্পা: তাহলে সে আত্মঘাতী হল কেন? 

 কৃষ্ণান: তার অপরাধবোধ থেকে সে আত্মহত্যা করেছে। তবে এইজন্যে তাকেও দায়ী করা যায় না। সে একটা সিস্টেমের শিকার। তাই এই আত্মহত্যাকে দুর্ঘটনা বলাই যুক্তিসম্মত। অন্তত আমার বিচারে। দেখুন প্রফেসর। ল ইজ নাথিং বাট স্ট্রং কমন সেন্স। আমরা যেসব আইনের ভিত্তিতে বিচার করি সেসবের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। ভবিষ্যতের মানুষ হয়তো সেইসব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করবে। আপনি ওই মেয়েটির মৃত্যুর জন্যে দায়ী নন। 

 গুণ্ডাপ্পা: কিন্তু জাস্টিস কৃষ্ণান আমি তো পরোক্ষে তার মৃত্যুর কারণ হলাম। মেয়েটা তো তার অজ্ঞানতা নিয়ে ওই পথেই তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। সেই পথ ভ্রান্ত  আর পঙ্কিল হলেও। আমি তো তার  জীবনটা কেড়ে নিলাম চেতনার বিষ পান করিয়ে।  একটা সরল সুন্দর মেয়ে। কি অপরূপ তার স্নিগ্ধ অনাবিল দৃষ্টি।  সারল্যে ভরপুর। মমতায় পূর্ণ। সভ্যতার মাপকাঠি যে জানত না। ভয়ানক সরল চিত্তে যে  প্রথাকে অনুসরণ করত। যার মধ্যে কোন অপরাধবোধ  ছিল না। পাপবোধ ছিল না।  আমি তো তার জীবনটাকে কে়ড়ে নিলাম  জাস্টিস কৃষ্ণান। কি অপূর্ব সুধায় ভরা তার কন্ঠ। তার গানেতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। শিক্ষায় বঞ্চিত এক নিপীড়িত মেয়ে। প্রথার শিকার হয়ে সভ্যতার বিচারে কদর্য ঐ জীবন সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কিছু না বুঝেই। তবুও তো তার বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। আমি তো তার সেই অধিকার হরণ করলাম। হারিয়ে গেল একটা সরল  সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবী থেকে। ঝরে গেল একটা কুড়ি। আমারই অপরাধে। হ্যাঁ জাস্টিস কৃষ্ণান। আইন আমাকে  অভিযুক্ত না করলেও আমিই হত্যা করেছি ঐ ফুলের মতো মেয়েটাকে।  (আর্তনাদ করে)

কৃষ্ণান: প্রফেসর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি  আপনি  ওভার রিয়্যাক্ট করছেন। আপনি চিৎকার করে কাঁদছেন। ইউ আর গেটিং সিলি।  গেট কুল প্লিজ।

গুণ্ডাপ্পা: ও  জাস্টিস কৃষ্ণান। আই এম সরি টু ডিস্টার্ব ইউ।  কিন্তু আমি যে এক গভীর অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে  চুরমার হয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমি ভুলতে পারছিনা  মেয়েটার অসহায় বাবা মা আর ভাইয়ের বুকফাটা কান্না। যত ভুলই  তারা করে থাকুক। আমি তো মেনে নিতে পারছি না তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমারই ভুলে। (কান্নায় ভেঙে পড়ে) আই এম সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। কিন্তু আমি তো  নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা জাস্টিস কৃষ্ণান। কেন চেতনার  বিষপান করালাম ওই অবোধ  সরল গ্রাম্য মেয়েটিকে। 

কৃষ্ণান: না প্রফেসর। চেতনা কখনো বিষ হতে পারে না। তার মৃত্যুর জন্যে সত্যিই আপনি দায়ী নন। তার মৃত্যু একটা প্রতিবাদ। যুগ-যুগান্তরের কদর্য সামন্ততান্ত্রিক প্রথার আর সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। যে  প্রথার, যে সমাজব্যবস্থার শিকার ওই মেয়েটি। তার মৃত্যু ঐ ব্যবস্থার মৃত্যুর  পূর্বাভাস। ওই ব্যবস্থার কফিনে একটা পেরেক। আপনি আপসেট। আপনি  বাড়ী যান প্রফেসর। 

                   ।।যবনিকা।।

(কন্নড় কাহিনী অনুপ্রাণিত)

(অভিনয়ের অনুমতির জন্য যোগাযোগঃ 8910019589)

এক রসসাহিত্যিকের অলৌকিক নরকযাত্রা -অশোক দাস চার্বাক
May 19, 2025 | গল্প | views:6 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চার্বাক চলে গেলেন। আমি ওনাকে তিক্তবাবু বলেই ডাকতাম। মাঝে মাঝে তেতোবাবু। আবার কেউ ডাকতেন ঝাঁজবাবু, কেউ ডাকতেন ঝালবাবু, কেউবা  বাঁকাবিহারী, বঙ্কিমবাবু - এমনি সব, মানে শ্রীকৃষ্ণের  মত তাঁর মধুমাখা অষ্টোত্তর শতনাম আরকি। টক-ঝাল কষা-নোনতা  শতরসের ককটেলে সম্পৃক্ত সদাহাস্যময় সদাকৌতুকপ্রবন রসসাহিত্যিক রসরাজ আমাদের অলরাউন্ডার চার্বাক মহারাজ। আমার রঙ্গব্যঙ্গ পত্রিকার  সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় লেখক।  

                

  মৃত্যুপূর্বকালে সজ্ঞানে তাঁর নিজেরই ড্রাফ্ট করা তাঁর অকাল স্বর্গ /নরকপ্রাপ্তির ‘আনন্দময়’ শোকের বিজ্ঞাপনটি পড়ে সকালের চা’টা তেতো হয়ে গেল। ‘চার্বাক’ কলম নামে তাঁর লেখা রম্যরচনা ও স্যাটায়ারগুলি কটুস্বাদের হলেও বেশ পাঠকপ্রিয় ছিল। আধুনিক পাঠকেরা কটুতিক্তরসাদি পছন্দ করে ও যে সব নেতারা সভা সমিতিতে অসভ্য খিস্তি খেউড় করে তাদের বীরের সম্মান দিয়ে ভোট দেয় বলে ওনার বিশ্বাস ছিল। এজন্য নাকি আধুনিক এসেম্বলি পার্লামেন্টে অসৎ অশিক্ষিত অসভ্য নেতারই প্রাবল্য। 

                   পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তেই থাকুন না কেন, মনে কোন নতুন রসের উদয় হলেই  ই-মেল করতেন তাঁর নিজস্ব ঘরানার রসসাহিত্য। উনি যোগ দেবার পর আমার পত্রিকার কাটতি দুগুনের বেশী হয়ে গেছিল। তবে তাঁর  উগ্র নাস্তিকতা বড্ড উৎকটভাবে প্রকট হতো তাঁর রঙ্গব্যাঙ্গে। সেগুলো ধর্মভীরু দুর্বল পাঠকদের ধর্মাভ্যাসের আবেগে আঘাত করত প্রবলভাবে। বিরুদ্ধ সমালোচনার জবাবে “ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া একজন মানবপ্রেমী সমাজসেবী সাধুপুরুষের সামাজিক কর্তব্য” বলে উটকো উল্টাপাল্টা বাজে তক্ক শুরু করে দিতেন। এ মহান কর্তব্য না করলে নাকি মানুষের মধ্যে কৌতূহল জন্মায় না, মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে না। তারা কেবল বাপ ঠাকুরদাদের তামাদী হওয়া অভ্যাস বিনা প্রশ্নে তামিল করেন মাত্র।” বলতেন, “বুদ্ধ, যীশু, সক্রেটিস, মহম্মদ, নিমাই, রামমোহন, বিদ্যাসাগররা যদি তাঁদের সমসাময়িক যুগের আধমরা ভীতু মানুষদের আবেগ অভ্যাসে আঘাত না দিতেন, তাহলে এখনও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরপাক খেত, সতী পুড়তো, বাল্যবিধবারা কাশীর রঙিন পল্লীতে নাচতে নাচতে পচতো, গরুর দুধে সোনা ফলত, পাথরের গণেশ ঢক-ঢক করে দুধ খেত, ঈশপের গল্পের শুক সারিরা কৃষ্ণনাম গাইত, পাপীরা তাদের দেহ মন থেকে পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য সাগরজলে ডুব দিতো, নিচুজাত বিদ্বেষী বেলুড় মঠে নাকি শুধু ব্রাহ্মণকন্যাই  কুমারীপূজার জন্য মনোনীত হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বলতেন, “এখনও হয়ত আমরা আমাদের আদি গুরুজনদের অনুসরণ অনুকরণ করে উলঙ্গ থাকতাম অন্যান্য জীবজন্তুভাইদের মত। বলতেন, “ধর্মীয় আবেগে আঘাতের বিরুদ্ধে যে অসাংবিধানিক আইন আছে সেটি বাতিল করা উচিত।”এই ছিল তাঁর ফিলোজফি, এমনি তাঁর বাঁকা বাঁকা আজব আজব বোকা বোকা কথা। লেখার ভাষাটাও ছিল গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট। রাস্তাঘাটের নাটুকে নেতা-মন্ত্রী, লুম্পেন-মাস্তানদের বক্তৃতার মতো খিস্তি খেউড়ে ভরা। তবে মাঠভরা শিস  মারা হাততালি দেওয়া ভাড়াটে শ্রোতা ও গ্রাম্য ভোটারদের মত, কিংবা বোকাবাক্সের টিভি সিরিয়াল বা ঝগড়াঝাটির দর্শক শ্রোতাদের মত আমার পাঠকেরাও সে অশ্লীলতা অসভ্যতা খেত ভালো।  আর ওনাদের বিপুল ভোটে আমার পত্রিকা জিতে গিয়ে কাটতি বাড়াতো। এমনি চরিত্র ছিল চার্বাকের। তবে যে গরু দুধ দেয়, আর যে লেখক পাঠকসংখ্যা বাড়ায় তাদের খুরের লাথি একটু আধটু সহ্য করতে হয়। তাই তাঁর সব কুযুক্তি আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম। 

             যাক, উনি এখন গত হয়েছেন, মৃত মানুষের নামে নিন্দামন্দ করা পাপ, তাই ওনার চরিত্র সম্বন্ধে নীরব থাকাই শ্রেয়।     

              বিজ্ঞাপনে  জানা গেল একাধিক দেশে রেজিষ্ট্রিকৃত তাঁর অন্তিম উইল অনুযায়ী কিডনি, লিভার চোখ ইত্যাদিসহ সমস্ত পুনর্ব্যবহার ও প্রতিস্থাপনযোগ্য কলাগুলি তাঁর মৃতদেহ থেকে কেটে বার করে নেবার পর তাঁর  দেহটি আজ বিকাল চারটায় হাসপাতাল থেকে তাঁর মেট্রোপলিটনের ‘কস্মোপলিটন হাউসে’ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মাত্র দু-এক ঘন্টার জন্য শায়িত থাকবে যাতে করে তাঁর গুনগ্রাহী ও পরিচিতজনেরা তাঁর অবশিষ্ট মরদেহটিকে শেষ দেখা দেখতে পারেন। নানা দেশমহাদেশের নাগরিক ও অধিবাসী তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী  আত্মীয় পরিজনদের জন্য অপেক্ষা না করে তাঁর  কলামুক্ত  সে দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হবে মেডিকেল কলেজে। সেখানে ছাত্র ছাত্রীরা দেহটা চিরে চিরে হাতেকলমে এনাটমি ফিজিওলজি শিখবে।  শেষ পর্যায়ে তাঁর অবশিষ্ট দেহাংশটা পচামাংসভুক পশুপ্রাণীদের বিলিয়ে দেওয়া হবে খন্ড খন্ড করে। এটাই তাঁর অশাস্ত্রীয় অন্তিম বাসনা।  হাতে উল্কি করে এই মর্মে বিজ্ঞাপনও করা আছে যাতে মরণান্তে তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা তাঁর ইচ্ছাপূরণে কোনও আইনী বাগড়া না দিতে পারে।  

           আমার পত্রিকার সামনের মাসের সংখ্যাটার ছাপা শেষ।  শুধু মলাট আর স্টিচিংটাই বাকি। বেশ গুছিয়ে একটা মর্মর্স্পর্শী শোকবার্তা ড্রাফট করে তেতোবাবুর  একটা ছবিসহ মেল করে দিলাম প্রেসে।  বলে দিলাম ফাঁকা তৃতীয় মলাটপাতায় ওটা ছাপাতে, আর পাঁচশ কপি এক্সট্রা ছাপাতে। শ্রাদ্ধের আনন্দভোজে, অভাবে স্মরণসভার জমায়েতে বিক্রি হয়ে যাবে ওগুলো। পেটভরা পেটুকরা ঢেকুর দিতে দিতে পান মুখশুদ্ধি চেবাতে চেবাতে আমাদের পত্রিকার কপি কিনতে বাধ্য হবে চক্ষুলজ্জার খাতিরে।    

            এরপর বন্ধুবান্ধবদের শেয়ার করার অনুরোধ জানিয়ে শোকবার্তাটা পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে। এক ঘন্টার মধ্যে চুয়াল্লিশটা লাইক, বাইশটা অশ্রু গড়ানো মুখ ভ্যাটকানো ইমোজি, তিরিশটি মন্তব্য আর একুশটা শেয়ার! ভাগ্য একটা করেছিলেন বটে! অকালে হলেও তাঁর মরণ স্বার্থক। স্বার্থক তাঁর  চির  আকাঙ্খিত আদর্শ মরণ। ঈশ্বরকে সত্বর কাছে পাওয়ার মহানন্দ। কোন একজন ঈশ্বরের কাছে তাঁর অশান্ত আত্মার শান্তি কামনা করে নিয়মমাফিক বিজ্ঞাপনও দিতে হবেনা পয়সা খরচ করে। 

             সৌজন্য রক্ষার খাতিরে সমবেদনা জানানোর জন্য চার্বাকগিন্নীকে  ফোন করলাম।  ধরলেন না। সারা জীবন যতই ঝগড়াঝাটি ফাটাফাটি চুলোচুলি করুননা কেন, স্বামীহারা হয়ে খুব সম্ভব শোকে কিংবা হয়ত হঠাৎ স্বাধীন হবার  আনন্দে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। এ সময়ে ওনাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি যে ভদ্রতা করে ফোন করেছিলাম সেটা মিসডকল লিস্ট থেকেই জেনে যাবেন। সেটাই যথেষ্ট। জানতে পারবেন আমি তাঁকে কতোই না ভালোবাসতাম। এই মওকায় লেখকের বাকি মানুস্ক্রিপ্টগুলো বিনা রয়ালটি দিয়ে হাতিয়ে নেব ওনার কাছ থেকে। 


             চার্বাকভবনে যাবার পথে লেক মার্কেট থেকে একটা মড়া সাজানো সাদা ফুলের টায়ার ডিজাইনের তোড়া কিনে নিলাম শববাহী গাড়ির গায়ে ঝুলিয়ে দেবার জন্য। তা না হলে আবার কথা উঠবে সমাজের বাজারে। সে বাজারে টিকে থাকার জন্য নেতা, মন্ত্রী, জ্যোতিষ, সেলসম্যান, গুরুবাবা, পত্রিকা সম্পাদকদের কত রকমের নাটক যে করতে হয়! একটা সুদৃশ্য কার্ডে আমাদের পত্রিকার নাম ফুলের তোড়ায় সাঁটিয়ে দেব সেলোটেপ দিয়ে। সামান্য খরচে ভালো একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে ফাঁকতালে।  


                 বাইপাসের মোড় থেকেই ভিড় শুরু। সবাই সাদা ফুলের তোড়া হাতে ছুটছে লেখকের কসমোপলিটান হাউসের দিকে।  রাস্তার দু পাশের কোথাও পার্কিংয়ের জায়গা পেলামনা।  দূরের একটা গলিতে কোনরকমে গাড়িটা পার্ক করিয়ে হাঁটতে থাকলাম মাথা নিচু করে, মুখ ভারভার ভাব দেখিয়ে। রাস্তার দু পাশে হাঁটতে থাকা পথিকদের বেশির ভাগের হাতে সাদা ফুলের তোড়া। তিনি যে এতো জনপ্রিয় ছিলেন  তা জানতাম না আগে। হয়ত সাহিত্যিক নিজেও জানতেন না। জীবিতাবস্থায় এসব দেখে যেতে পারলে তাঁর আত্মা এই পৃথিবীতেই সজ্ঞানে সশরীরে শান্ত হতো। আত্মার শান্তির জন্য মরার পর আত্মীয়দের দেওয়া বিজ্ঞাপনের জন্য অথবা ঘটা করে শ্রাদ্ধ শান্তির নাট্যাভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। 

                 সাহিত্যিকের বাড়ীর পেল্লাই লোহার গেটের পাল্লাদুটোর একটা বন্ধ।  অন্যটাকে সিকিউরিটি আগলিয়ে রেখেছে। সিলেক্টেড দর্শনার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। সামনের রাস্তায় সবাই ফুল হাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। মাথা নিচু করে। এক পাশে ‘স্বর্গরথ’ নামাঙ্কিত একটা শববাহী গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত চার্বাকের দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাড়ির ভেতরে। শববাহী যানটির পেছনে নিউজ চ্যানেলের দুটি ভ্যান পার্ক করা আছে। ফটোগ্রাফাররা ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছবি তুলছে রাস্তার জনসমাবেশের। ভাষ্যকারেরা মাইক হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লেখকের গুণগ্রাহীদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করছেন।  অনুমতি পেলে শবদেহের ছবি তুলতে ঘরের ভেতরে ঢুকবেন তাঁরা। 

                  দোতলার হলঘরটায় একটা ডিভানে পাতা এম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন চার্বাক। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। বুকে তাঁর ফুলের পাহাড়।  মহিলা পুরুষ, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ বৃদ্ধায় ঘর ঠাসা।  সবার মুখ গম্ভীর, চোখে  কাঁদো কাঁদো অভিব্যক্তি। এতো ভীড়, কিন্তু প্রায় শব্দহীন ঘর। শান্ত গুরুগম্ভীর শোকস্তব্ধ পরিবেশে শুধু টিভির সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে গলা উঠিয়ে নাবিয়ে, থেমে থেমে ধরা ধরা কাঁপা কাঁপা গলায় সুর পাল্টাতে পাল্টাতে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন তাঁদের চ্যানেলের দর্শক শ্রোতাদের শোনানোর জন্য। 

                  তাঁদের প্রশ্নের জবাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে সামান্য একটু বাড়াবাড়ি করেই বললাম, “সঞ্জীববাবু ব্যাঙ্গ সাহিত্যের জগৎ থেকে অবসর নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করার পর বঙ্গের ব্যঙ্গ সাহিত্য সাম্রাজ্যে এই চার্বাকই ছিলেন বর্তমান প্রজন্মের একছত্র অধিপতি। সেই নক্ষত্রপতনে বঙ্গীয় রসসাহিত্য জগৎ অনাথ হয়ে গেল। আর কিছু সত্যি মিথ্যে প্রশংসার কথা মনে মনে খসড়া করার সময় বিশ্বনিন্দুক জয়দেববাবু মুখ বাড়িয়ে দিলেন ক্যামেরার দিকে। তাঁর পত্রিকায় তিনি  নিয়মিত  মুখর হতেন চার্বাক নিন্দায়। কিন্তু আজ ঐ সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা দেখে সে পথে না গিয়ে ওনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, “ওনার মত গুণবান লেখক দুর্লভ। এমন কি আমার চেয়েও ভালো লিখতেন তিনি.....” ঘুরপথের অশ্লীল আত্মপ্রশংসা শুনে টিভির ভাষ্যকার মাইকটা ওনার মুখ থেকে সরিয়ে নিতে তিনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে মাউথপিসটা ভাষ্যকারের হাত থেকে নিজের মুখের সামনে টেনে নিয়ে বললেন, “তাঁর কৌতুকগুলি বিতর্কিত, বিরক্তিকর ও অসহ্য হলেও অনেকের কাছে সুখপাঠ্য ছিল।” পাশ থেকে একজন মুখ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, “ওনার কথা আর বলবেননা মশাই। উনি সদা সর্বদা রসেবসে বেয়াড়া রকমের টইটুম্বুর হয়ে থাকতেন। রঙরসের মাতাল। স্থান কাল পাত্র কোনও জ্ঞান থাকতোনা তাঁর কোনও রসের কথা মনে উদয় হলে। গুরুজন লঘুজন জ্ঞান নেই। পিকনিকেও যা আবার মন্ত্রীর গুরুগম্ভীর প্রশাসনিক বৈঠকেও তাই।রাস্তার সবজিওয়ালা, থেকে শুরু করে রাশভারী হেডমাস্টারমশাই,  এমন কি হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিও  রেহাই পেতেননা তাঁর হাসি মস্করার কামড় থেকে।”

        আর একজনকে বলতে শুনলাম, “তবে বিপদেও পড়তেন তিনি তাঁর ঐ বদ স্বভাবের জন্য।  হয়ত কোন ঝগড়াটে সবজিওয়ালীকে বলে বসলেন, - তোমার মুখের মত ঝাল দেখে লঙ্কা দাওতো একশো। ব্যাস অমনি বাজারে লেগে গেল লংকাকান্ড। মহিলার মুখ তুলে কথা! বাজারের সব সবজিওয়ালা চেপে ধরলো ওনাকে। মার দিতে বাকি রাখল শুধু।”

                -আরে সবজিওয়ালী ফলওয়ালা তো দূরের কথা নিজের শালী এমনকি নিজের গিন্নীর সাথেও মাঝে মাঝে বোকার মত মুখ ফস্কে রসিকতা করে ফেলতেন এই রসিক চূড়ামণি। কী দুঃস্বাহস! সন্তানসম্ভবা মেয়ের পেটের মধ্যেকার যমজ নাতি  নাতনীর খেলাধুলার লাইভ ছবি সোনোগ্রাফিতে দেখার পর আনন্দে আটখানা হয়ে অফিস ফেরত কর্তার বেল শুনে তাঁর ঘরে ঢোকার আগেই রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন “সুখবর, সুখবর, ডাবল সুখবর......” পরবর্তী বাক্যের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি চটজলদি বলে উঠলেন, “কেন, তোমারও নাকি?” ব্যাস, সাত ডিগ্ৰী স্কেলের ভুমিকম্প শুরু হয়ে গেল সংসারে।  সাহিত্যিক তখন সক্রেটিস। ঘরে না ঢুকে সোজা বেরিয়ে গেলেন পাড়ার চায়ের দোকানের সন্ধানে”

      এক মহিলা বলে উঠলেন, “ভদ্রলোক জীবিত থাকলে ওনার সম্বন্ধে এভাবে  কথা বলতে কি আপনাদের সাহস হতো?”

        উত্তরে আর এক বৃদ্ধা মন্তব্য করলেন, “বলা যায় না, ওনার যা স্বভাব চরিত্তির ছিল, হয়ত দেখলেন আপনাদের এ সব কথা শুনে ওনার আকাশমুখী ডেডবডিটা স্থান কাল পাত্র ভুলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে রঙ্গব্যাঙে তুলোধুনো করে সব্বাইকে ঠান্ডা করে দিচ্ছেন।”

          লেখকের লেখার ঘরের টেবিলটায় রাখা হয়েছে তাঁর একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। তাতে সবাই মালা পরিয়ে দিচ্চে।  পাশে রাখা ধূপদানীতে ধুপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ছবিটা নাকি তাঁর এক নামকরা ফটোগ্রাফার বন্ধুকে দিয়ে তুলিয়ে নিজেই কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শেষযাত্রার জমায়েত বা শ্রাদ্ধের আনন্দভোজের  অতিথিদের প্রদর্শনের জন্য। 

            পাশের ঘরের টেবিলে দুটো সুদৃশ্য চামড়ায় বাঁধানো একটা খাতা। মৃতের গুণমুগ্ধরা লাইন করে দাঁড়িয়ে একের পর এক শোকবার্তা লিখছেন। 

              মৃতের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে নানা জনের ভালো মন্দ নানান  স্মৃতিচারণ ও মন্তব্য শুনছি। কিছু ফিসফিসিয়ে, কিছু সশব্দে।  

     - এত বড় লেখক হয়েও একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক। 

     - তবে উনি গোপনে গোপনে যে বেহেড মাতাল ছিলেন সেটা আমি নিজের চোখে দেখতাম রেসের মাঠে, আর বার-এ। উনি আমায় চিনতেই পারতেন না তখন নেশার ঘোরে।  

     - ফাঁক থেকে ওনার ধার করা আমার দশ হাজার টাকা চোট  হয়ে গেল।  এখনতো আর ওনার বিধবা স্ত্রীকে .....

      - সেকি, আপনার মত ওয়ান পাইস ফাদার মাদার বন্ধক ছাড়া এতগুলো টাকা .......... 

      - অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। সুখেই বলুন কি দুখেই বলুন, সব সময় মুখে হাসি - মন রঙ্গরসে ভরপুর। ওঁর সাথে কথা বলে বড় সুখ ছিল। নিমেষে মনের দূঃখ ভুলিয়ে হাসিয়ে দিতেন। শত্রুদেরও বন্ধু করে নিতেন হাঁসতে হাঁসতে, হাসাতে হাসাতে। 

      - আমাদের সাথে তো ওনার একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আমার গিন্নীতো চার্বাক প্রেমে পরকীয়া অজ্ঞান। 

      - আমার সাথে দেখা হলেই বিড়ি চেয়ে নিতেন আপন বড় ভাইয়ের মত।   

      - তবে উনি যে সঞ্জীব চাটুর্জেকে নকল করতেন সেটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। ওনার লেখা রঙ্গরচনাই তার প্রমান। পোড়ে দেখবেন। 

      - তবে ওনার লেখাগুলো বাঁকা ভাষায় হলেও বেশ লাগতো পড়তে। মানে সুখপাঠ্য। 

      - থামুন মশাই, উনিতো সত্যজিৎ রায়কে নকল করে ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখে বেশ ভালোই কামিয়েছেন। 

      - তাই নাকি! ভেজালে ভেজালে দেশটা ভরে গেল দেখছি। 

      - অরে মশাই, ইনিতো সামান্য একজন লেখক। একটু আধটু এর ওর নকল করে, অপরের  লেখা সামান্য অদল বদল করে লেখকেরা যে দুনম্বরী সাহিত্যব্যবসা করেন এটা কে না জানে। এতে দোষের কিছু নেই।  

      - ঠিক বলেছেন। স্কুলের মাস্টার থেকে শুরু করে, স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে, পঞ্চায়েত সভাপতি থেকে শুরু করে, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে, উনিভার্সিটির উপাচার্য থেকে শুরু করে নানান দেশের প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কে যে একনম্বরী, আর কে যে চোরা পথে  চাকরি বাগিয়েছেন, কে যে কাল্পনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী বা জ্যোতিষীর স্বর্ণপদক কিনেছেন তা বোঝা দায়।  এখনতো আশপাশের সবাইকেই চোর পকেটমার মনে হয়। উঁচুস্তরের মাননীয় নেতানেত্রীদেরও  কান্ডকারখানা দেখলে মনে হয় সর্বকালের সর্ববৃহৎ সর্বশ্রেষ্ঠ ডাকাত দলের সর্দার। 

       - যা বলেছেন। বাসের গায়ে “পকেটমার হইতে সাবধান ---

      -ছোটবেলায় আমি বিখ্যাত বহুল প্রচারিত একটা সাপ্তাহিকে  ‘যষ্টিমধু’  বিভাগের পাতার  ওনার অনেক লেখা পড়ে ওনার ফ্যান হয়ে গেছিলাম। ঐ পত্রিকা ‘যষ্টিমধু’র পাতা  বন্ধ করার পর...........  

      - এমন নক্ষত্রপতনের পর আর এমন লেখা লিখবে কে? বাংলাদেশটা রসশুন্য হয়ে গেল। 

       - যা বলেছেন,  হাসির ক্লাবের হাসিগুলো যেমন আমাদের কাঁদায়, তেমনি রম্য রচনার নামে এখনকার ভাঁড়ামির গল্প পড়েও হেঁচকি ওঠে। 

         বিভিন্ন দেশবিদেশের ভক্তদের নাম ঠিকানা লাগানো ফুলের তোড়া, ধুপ, মড়ার পোশাকে দেবার জন্য সুগদ্ধি আসছে কুরিয়ার এজেন্ট মারফত। চারদিকে অগুরু অগুরু মড়া মড়া গন্ধ। বিভিন্ন দেশবিদেশে থেকে তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী আপনজনেদের পাঠানো ফুলমালায় আজকের নায়কের বুকে ফুলের পাহাড়। বড় নাতনী বিলেত থেকে অনলাইনে অর্ডার করে এক ক্রেট হুইস্কি পাঠিয়েছে ক্লান্ত শ্মশানবন্ধুদের  বিনোদনের  জন্য। স্মার্টফোনে আসা গাদা গাদা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার  মেসেজ দেখানো হচ্ছে ছাতে লাগনো বিগ স্ক্রিনে।  

          লেখকের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ভায়রাভাই উপস্থিত শোকগ্রস্থদের আপ্যায়ন  করছেন চোখ মুছতে মুছতে।  দিল্লিতে থাকা বর্তমান লেখকগিন্নী  বিকেলের ফ্লাইট ধরে ফিরে আসছেন চিত্তরঞ্জন পার্কের আজকের কবি সম্মেলনে তাঁর স্বরচিত কবিতাপাঠ না করেই। কী মহান আত্মত্যাগ! লেখকের একাধিক  প্রাক্তন প্রেমিকা আর আদিগিন্নীও এক কোনায় ছলোছলো নেত্রে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। একেই বলে বাঙালি রমণী। প্রেম কাকে বলে এরাই জানে। প্রেমভঙ্গ  বা ডিভোর্স হবার পরেও প্রেম অটুট। অবশ্য গিন্নীদেবীর প্রাক্তন স্বামীরাও এসেছেন তাঁদের প্রাক্তন স্ত্রীকে সান্তনা দেবার জন্য। 

         বারান্দা দিয়ে দেখা গেল বিখ্যাত এক ফাস্টফুড কোম্পানীর ভ্যান এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনের রাস্তায়। তারপর একটা ভ্যান বিখ্যাত এক মিঠাই কোম্পানির।  একটা আইসক্রিম কোম্পানির গাড়ীও।  উপচে পড়া ভিড় ঠেলে ওদের  কর্মচারীরা একে একে খাবারের প্যাকেট হুইস্কির বোতলগুলো নিয়ে সোজা তিন তোলার ছাতে  উঠে গেল। সাথে সাথে বোতল রসিকরাও মৌমাছির মত উড়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে।  

            একটি ঘরে আত্মীয় স্বজনেরা শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্রের খসড়া তৈরি করছেন। ক্যাটারার নির্বাচন নিয়ে তক্কাতক্কিও চলছে। উপস্থিত আত্মীয়দের বাচ্ছাকাচ্চারা বড় বাড়ী পেয়ে লুকোচুরি খেলছে। একটা ঘরে আসন্ন শ্রাদ্ধভোজের মেনু তৈরি করছে কমবয়সী ছোকরারা। মৃদু ডেসিবেলে “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু” বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে।  সর্বত্র একটা শোক শোক,  উৎসব উৎসব, আনন্দ আনন্দ, দুঃখ-দুঃখ, টক-ঝাল- মিষ্টির পরস্পর বিরোধী এক সাড়ে বত্রিশভাজা স্বাদের পরিবেশ। 

              অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ছাতে সাজানো হয়েছে নানা রকমের খাবার আলাদা আলাদা কাউন্টারে।  চা,কফি, সফ্ট ড্রিঙ্কস, হার্ড ড্রিঙ্কস। ভাইরাভাইয়ের বিনীত অনুরোধে যে যার পছন্দমত খাবার তুলে নিয়ে খাচ্ছেন, পান করে ঢলাঢলি করছেন। 

             ব্যাপারটা কি? এমন ভোজের কথা ভূ-ভারতে কখনও শুনিনি।  কল্পনাও করিনি। একজন মানুষ মারা গিয়েছেন, বাড়িতে তাঁর বাসি মরদেহ শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়, এখনও পর্যন্ত তার সৎকার পর্যন্ত  হয়নি - আর কিনা এত খাওয়া দাওয়া ফুর্তি ফারতা! আশ্চর্য! শ্রাদ্ধের দিনের জন্য কটাদিন অপেক্ষা না করেই এত  আনন্দফুর্তির আয়োজন! ছি ছি ছি। শত ছি। মানুষ বড় হৃদয়হীন হয়ে উঠছে দিনদিন। 


               আমার ক্ষোভের উত্তরে চার্বাকভায়রা ভাই বিনয়ে বিগলিত হয়ে সাফাই দিলেন যে তিনি তাঁর প্রয়াত ভায়েরাদাদার মৃত্যুপূর্ব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন মাত্র। তাঁর অতিথি দর্শনার্থীরা আনন্দভোজ ও চিয়ার্স মন্ত্র বলে আনন্দপান করে সন্তুষ্ট না হলে তাঁর দাদার আত্মা নাকি শান্তি পাবে না স্বর্গে কিংবা নরকে  যেখানেই থাকেন না কেন!   

                এতবড় ঘোর উগ্রনাস্তিকও তাহলে মরার সময় নরকভয়ে কাতর হন! মরণকালে এমন ভীমরতির কারণেই পৃথিবীর দিকে দিকে আজও টিকে আছে হাজার হাজার ধর্ম, হাজার হাজার ভগবান। উঠছে চন্দ্র সূর্য সময়মত। 

               ভাইরাভাইয়ের কথায়  উৎসাহিত হয়ে আর একটা প্যাকেট তুলে নিলাম টেবিল থাকে। মটন বিরিয়ানিটা করেছে ভাল। চার্বাক আত্মাকে শান্ত করার দায়িত্ব না এড়িয়ে আর একবার একটা গ্লাসও ভোরে নিলাম বড় করে।  

                এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের জীপ এসে দাঁড়ালো বাড়ীর সামনে। ভাইরাভাইটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন অফিসারের দিকে।  অফিসার বললেন যে তাঁর কাছে নাকি গোপন খবর আছে যে এটা  সুইসাইড কেস, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। মার্ডারও হতে পারে। ডেথ সার্টিফিকেট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইত্যাদি না দেখে মৃতদেহটিকে শ্মশানে নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। একথা বলে মৃতের স্ত্রীকে ডাকতে আদেশ করলেন অফিসারটি। 

                   ভায়েরাটি সবিনয়ে হাত জোড় করে বললেন, “আগে একটু মিষ্টিমুখ করে নিন স্যার।  নইলে মৃতের পুন্যজীবনের অকল্যাণ হবে। আমি কথা দিচ্ছি আপনার নির্দেশ মেনে সব ডকুমেন্ট দেখিয়ে দেব ডেডবডি রিমুভ করার আগে।  

                  -ঠিক আছে, ডেডদেহটাতো দেখান অন্তত চাদরটা তুলে। 

                  - সেটাতে একটু অসুবিধা আছে। অঙ্গদানের কারণে দেহটা একটু বিকৃত হয়ে গেছে বলে তাঁর স্বামীঅন্তপ্রাণ  সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত স্ত্রী অনুমান করছেন। উনি এয়ারপোর্ট থেকে এলেন বলে। তাঁর পৌঁছনোর আগে মৃতের আবরণ উন্মোচন করতে না করেছেন তাঁর শোকগ্রস্থ সহধর্মিনী। এটা স্যার একাধারে ধর্মীয়, অন্যদিকে প্রেমজ আবেগের ব্যাপার। জীবিত অবস্থায় বোমভোলা স্বামীকে পরিপাটি না সাজিয়ে বেরুতে দিতেন না তিনি। আজ তেমনি মৃত স্বামীটিকে না সাজিয়ে.........

                   - সব ঠিক আছে, কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে কি বাধা? 

                   মহিষাসুরের পার্ট করা তাগড়াই ধৈর্যহারা ভায়রাটি  তড়িঘড়ি স্ফীতোদর  পুলিশ সাহেবটিকে একরকম জোর করে টেনে নিয়ে  পাশের ঘরে ঢুকলেন এক আত্মীয়ের হাত  থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট, আর একটা খাম নিয়ে। খানিক বাদে মুখ মুছতে মুছতে খুব হাঃহাঃ করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন অফিসার। পুলিশ হলেও সদ্য মৃতের বাড়িতে এসে তাঁর মৃতদেহের সামনে কি করে একটা মানুষের এত হাসি আসে বুঝতে পারলাম না। তবে বুঝতে পারলাম বেশ বড় অংকের একটা গোপন লেনদেন হয়ে গেল।

                কিন্তু সুইসাইড! এমন সদাহাস্যময় সদানন্দ কৌতুকপ্রেমী সফল মানুষ সুইসাইড করেন কি করে! কিসের দুঃখ লুকিয়ে ছিল তাঁর হাসিমুখের অন্তরালে? বাহাত্তরেও এমন সতীসাধ্বী মা লক্ষী গিন্নী, সাত চড়ে রা নেই, এতো যার জনপ্রিয়তা, চার হাজার স্কোয়ার ফিটের বিলাসবহুল বাড়ী, মোটা টাকার সরকারী পেনশন, মোটা অংকের রয়্যালটি, দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ আয়ের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী, নানা দেশের নানা ধর্মের নাতজামাই নাতবউদের নিয়ে ভরা সুখী সংসার - এ রকম লোকের বুকে কি এমন কান্না লুকিয়ে ছিল যে একেবারে সুইসাইড করতে হল? ধন্য মানবের মন, ধন্য ত্রিভুবন।  বিচিত্র তাদের মনের প্রকৃতি তথা বিকৃতি! বাট্রান্ড রাসেল ঠিক কথাই বলেছেন। 

              মৃতের চারিদিকে ঘিরে অভিজাত ক্যাটারারের উপাদেয় প্লেট হাতে সবাই চার্বাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  এমন কি চিরনিন্দুক সমালোচক, ব্যর্থ কবি সাহিত্যিকরাও চার্বাকের অপচিন্তা,অপকর্ম, অপদর্শন,অপকথন,অপসাহিত্যের কথা সৰাই ভুলে গেলেন। লাল জলের এমনি মহিমা। মুহূর্তে সবাই শোক দুঃখ ভুলে হাসি ঠাট্টায় মুখরিত। 

               অবিচুয়ারি লেখার জন্য টেবিলে রাখা দু’দুটো মোটা মোটা বাঁধানো খাতার সব পাতা শেষ। গদ্যে পদ্যে  শোকসাহিত্যের উথাল পাথাল কান্না। নানা ঘরানার প্রতিভার উজ্জ্বল সমাবেশ। 

               চার্বাকের প্রিয় আলসেশিয়ানটা নীরবে শুয়ে আছে তার প্রভুর ডিভানের গায়ে গা ঠেকিয়ে।  সারাদিন কিছু খায়নি।  এতো আর বুদ্ধিমান চতুর  হোমো স্যাপিয়েন নয়। অবলা এলেবেলে নির্বুদ্ধি পশুমাত্র। মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে।  হয়ত ভাবছে, এত মানুষ, কিন্তু গিন্নিমা নেই কেন? অনবরত বক বক করা মালিকই বা কেন নীরবে গা ঢেকে শুয়ে আছে দিনভোর। মাঝে মাঝে সবার দিকে তাকাতে তাকাতে যেন বলছে প্রভুর গায়ের সাদা চাদরটা খুলে দিতে। সাহস পাচ্ছেনা। পরিচিত কেউ ঘরে ঢুকলে ছুটে গিয়ে তার পোশাক কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডিভানের দিকে। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

                 চার্বাকপ্রিয়া গাড়ী থেকে নেবে আলুথালু বেশে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে উঠে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সোজা উঠে এলেন ওপরে।  সবাই হাতের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে হুড়মুড় করে তাঁর পাশে আসার কসরত করতে লাগলেন যাতে টিভির ক্যামেরায় তেনাদের মুখশ্রী ধরা পড়ে। ক্যামেরা লেখকপত্নীর  ছবি তুলতে তুলতে যাচ্ছেন পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে। ধারাভাষ্যকার মাউথপিসটা হাতে ধরে পাশে পাশে এগুচ্ছেন -

                  “এখন কিন্তু আপনারা কিন্তু সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু।  চার্বাকের মরদেহ কিন্তু শুয়ে আছেন ডিভানে। তাঁর সম্পূর্ণ দেহ কিন্তু সাদা কাপড়ে ঢাকা। তার ওপরে ফুলের পাহাড়। আপনারা কিন্তু সদ্য স্বামীহারার উচ্চকণ্ঠের বিলাপ শুনছেন। কিন্তু উপস্থিত অনেকে তা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। লেখক যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা আপনারা কিন্তু বুঝতে পারছেন। চার্বাকপত্নী লুটিয়ে পড়লেন স্বামীর পদতলে। গিন্নিমাকে দেখে কিন্তু সাহস পেয়ে অবলা পশুটি লাফিয়ে কিন্তু ডিভানে উঠে পড়লো কিন্তু ঘেউ ঘেউ করতে করতে।  অনেক কিন্তু সয়েছে সে। আর কিন্তু অপেক্ষা করতে পারল না। ঢাকা দেওয়া সাদা চাদরটা কামড়ে টান মেরে কিন্তু ফেলে দিল মেঝেতে। আমি প্রকাশকে কিন্তু অনুরোধ করছি ক্যামেরাটা মৃতের মুখের দিকে ফোকাস, মানে কিন্ত ফো-কাস  .........

               ভাষ্যকার ছোকরাটি তোতলাতে তোতলাতে আচমকা থেমে গেলেন। ডেড সাইলেন্স। যাঁরা ডিভান ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা হঠাৎ করে পরিত্রাহি চিৎকার করে পিছিয়ে গেলেন ডিভানের পাশ থেকে। মনে হচ্ছে যেন বাঘ বা ভুত ঢুকে পড়েছে ঘরে।  চারিদিকে হুড়োহুড়ি। কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। পদপিষ্ট হবার ভয়ে  সবাই দেয়ালের দিকে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করছেন। বিমূঢ় ভাষ্যকারের ফ্যাকাসে মুখে ভাষা নেই। ক্যামেরার হাত থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে ভাষ্যকার সাহস সঞ্চয় করে অনেক ‘কিন্তু’ সহযোগে আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন, “আপনারা কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন, .......কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন ..... মানে দেখতে পাচ্ছেন, মৃত চার্বাকের দেহ কিন্তু উঠে বসেছেন। আপনারা কিন্ত, মানে কিন্তু দেখছেন তাঁর চোখে সাঁটানো তুলসীপাতাটা উড়ে গেল পাখার হাওয়ায়। চোখ দুটো তাঁর পিট্ পিট্ করছে।  মুখে কিন্তু তার সেই পরিচিত কৌতুকের হাসি।  চার্বাকপ্রিয়া  কাঁদতে কাঁদতে হাসতে হাসতে তাঁর পিঠে কিন্তু ক্রমাগত মেরেই চলেছেন আদুরে ঘুঁষি, আর কৌতুকের কান্নার মাঝে মাঝে  চিৎকার করে বলছেন, মরবে কেন, তাহলে আমার হাড় মাস খাবে কে?  সাহিত্যিকের কুকুরটি তাঁর কোলে উঠে তাঁর গালটা চেটেই চলেছে, চেটেই চলেছে.......   

             যমালয়যাত্রার পথে মাঝরাস্তা থেকে সাহিত্যিকের ফিরে  আসা দেখে সবাই এত আনন্দ পেয়েছে যে তাঁর ভায়রাভাই উপস্থিত সবাইকে ডিনারেরও মৌখিক নেমন্তন্ন করার পর ক্যাটারারকে ফোন করতে লাগলেন নির্দেশমাফিক পুরো অর্ডার শিগগির ডেলিভারি দিতে।   

              টিভি ভাষ্যকারের অনুরোধে চার্বাক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ আসলে আমার নিজেকে সৎভাবে চেনার ইচ্ছে হয়েছিল। জীবিতাবস্থায় বুঝতে পারতাম না কে আমায় সত্যিকারের ভালোবাসে। সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে এত মানুষের আগমন, মানুষের ভালোবাসা দেখে, সবার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে আমার প্রশংসালোভী আত্মাটা আপাতত স্বর্গে উঠতে অস্বীকার করলো। যমরাজও তাঁর আদেশের টেম্পোরারি স্থগিতাদেশ দিলেন পুনর্বিবেচনা করে। বেয়াড়া আত্মাটার আরও কিছুদিন আনন্দময় পৃথিবীতে থাকার ইচ্ছা। মাঝপথে  আকাশ থেকে নেবে এসে সেটা আবার যীশু খ্রিস্ট  হয়ে গেল এই বুকের মধ্যে।”

                                                  [শেষ অংশ শেষের পাতায় ]

               ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি বুকের ওপরের ফুলের তোড়ার পাহাড় সরে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবীর ওপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে  “এপ্রিল ফুল” 

             

COSMOPOLITAN 

A-128,Metroplitan,

5th Lane,Kolkata 105

সংকল্প -জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
May 19, 2025 | অনুগল্প | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আজ ‘মানসী’ আশ্রমের প্রতিষ্ঠা দিবস।  বাবা মা-র একমাত্র সন্তান হিসাবে পৈতৃক সূত্রে যেটুকু অর্থ পেয়েছেন, সবই সুতপা সেন রূপান্তরকামী মানুষজনের আশ্রয় ‘মানসী’ আশ্রমের জন্য দান করেন। বর্তমানে রূপান্তরকামীদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তারা সামাজিক জীবনের স্বীকৃতি পেয়ে নিজের নিজের জীবিকার পথও খুঁজে নিচ্ছে। 

        আজকের দিনটা বিভিন্ন রূপান্তরকামী মানুষজনের সঙ্গেই কাটে সুতপা সেনের। এনজিও করার সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সকলকে নিজেদের সাধ্য মতো জীবকা নির্বাচনে উৎসাহ দেন ও স্থায়ী বাসস্থানের আশ্বাস দেন সুতপা। দিদি হিসাবে তাদের সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয় তিনি। মানসিক দৃঢ়তা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও উদ্যোগ না থাকলে ‘মানসী’ গড়ে উঠত না। এজন্য কিছু সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তা সুতপা পেয়েছেন।

“মানসী গড়ে তোলার কাজে আপনি কেন সংকল্প নেন?” স্থানীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে সুতপা হেসে বলেন, “ জীবন তো শুধু নিজের জন্য নয়। পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যও ভাবা উচিত - এই সংকল্পেই এগিয়েছিলাম।”

সমবেত সকলে করতালি দিয়ে সাধুবাদ জানান তাঁকে।

        সুতপা সেনের পঁচিশ বছর আগের স্মৃতির পাতাগুলো আজও অমলিন। সুতপার স্কুলের বান্ধবী মানসী হরমোনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরুষ হতে চেয়েছিল। কলেজে পড়তে সে দৃঢ় ভাবে সুতপাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল। স্কুল থেকেই মানসী সুতপার সব থেকে কাছের বান্ধবী ছিল, যাকে সুতপা মনের কথা না বলে থাকতে পারতেন না। তাদের মান অভিমান খুনসুটি ধীরে ধীরে প্রেমের আকার নেয়। কলেজে পড়তে মানসীর বাইকে করে শহর ছাড়িয়ে সুতপা গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে দুটি মানুষ মানসিক ভাবে আরও কাছাকাছি হত। খালের ধারে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মানসীর কাঁধে মাথা রেখে সুতপা স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতেন।

      মানসীর পুরুষসুলভ ভাবভঙ্গী ও পোশাক দেখে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছিলেন সুতপার বাবা মা। বি.এ পাশ করে  এম.এ পড়তে চেয়েছিলেন সুতপা। তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বাড়ি থেকে তখন তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়।  গভীর দুঃখে মানসী সুতপার বিয়ের দিনই সুইসাইড করে-এই খবরটা বিয়ের কদিন পর সুতপা পান। মানসিক ভাবে ভীষণই ভেঙে পড়েছিলেন।

          অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে পারেননি সুতপা। ছোট থেকে যে সংস্কার ও বিশ্বাসে মানুষ, তার কিছুই যেন শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মিলত না। এমনকি তাঁর স্বামীও তাঁকে বোঝেননি। তাই দু বছরের মাথায় ডিভোর্স-এর সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননি সুতপা। তারপর থেকেই তিনি বেছে নেন এনজিও-র কাজ। মানুষের উন্নয়নকে ব্রত করে এভাবেই শুরু হয় সুতপার দীর্ঘ পথ চলা।

গাছেদের কথা -রাজু দত্ত
May 19, 2025 | সচেতনতা | views:11 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সেই তেঁতুল গাছটার কথা মনে হলে আমি এখনও প্রিয়জন হারানোর শোক অনুভব করি। ছেলেবেলায় সেই গাছটা ছিল আমাদের একান্ত আপন। 

গাছের নীচে সুশীতল ছায়ায় আমরা বেঁধেছিলাম একটা মাচা। এই মাচাটাই ছিল আমাদের ছেলেবেলার প্রখর গরমের দিনে একমাত্র আশ্রয়। আমরা সেই মাচায় বসে কত আড্ডা দিতাম। Rank card খেলতাম, গল্প গুজব করতাম। কখনও বা মাচায় শুয়ে ঘুমাতাম অঘোরে। স্কুল ছুটি থাকলে তেঁতুল গাছের নীচে বাঁধা এই মাচাতেই আমরা দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতাম। 


গাছটা মারা গেলো। তাকে মেরে ফেলা হলো নির্মমভাবে। মালিকের আরও বাড়ি বানানোর প্রয়োজনে মেরে ফেলা হলো আমাদের প্রিয় তেঁতুল গাছটাকে। তেঁতুল গাছটার কত প্রতিবেশী ছিল। একে একে নিহত হলো অনেকেই। নিহত সেই গাছের স্থান দখল করলো ছোটো বড়ো রঙীন সুসজ্জিত বাড়ি ও অট্টালিকারা। পাকা ও চওড়া হলো রাস্তাঘাট। তৈরি হলো কত অফিস, স্কুল কলেজ, সেতু, সুইমিং পুল,,,,,। 


একসময় এ তল্লাট জুড়ে ছিল দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত। ক্ষেতজুড়ে মহানন্দে নৃত্য করত ধান আর মরশুমি সবজির গাছেরা। ছিল আরও কত গাছ। বট, বাবলা, ক্ষিরিশ, তাল, গাছেদের নামে এখানে কত পাড়ার নাম জানো। 


তখন আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিলনা। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের দিনে, আমরা বসতাম গিয়ে  গাছেদের কাছে। তারা প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকতো হাসিমুখে। ডাকতো আমাদের। বলত, কৈ রে গরমে কষ্ট পাস বুঝি! আয় আয় একটু বোস দিকিনি আমাদের কাছে। আয়.....”।


 জল পিপাসা পেত ওদেরও। ওরা ইশারায় বলত সে কথা। আমরা  বালতি করে জল ভরে নিয়ে ভিজিয়ে দিতাম ওদের শিকড়। ওরা আনন্দে নেচে উঠতো। ডালপালা নেড়ে ওদের সে কি নাচ্। আমরা ওদের নাচ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম। 


শুধু কি দিনের বেলা? রাতেও ছুটে যেতাম আমরা আমাদের গাছেদের সাথে দেখা করতে। ওদের পাশে বসে আমরা কত গল্প করতাম, গান গাইতাম, দুষ্টুমি করতাম। মাঝেমাঝে আরামে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়ির বড়োরা এসে ডেকে নিয়ে যেতো। কেউ বলত “হ্যাঁ রে তোদের ঘরবাড়ি নেই? গাছতলায় শুয়ে আছিস!” আমরা হাসতাম। 


আমরা ঢিল ছুঁড়ে যখন গাছেদের ডাল থেকে ফল পেড়ে খেতাম, গাছেদের আঘাত লাগতো, ওরা কোনও প্রতিবাদ করত না। ওরা নীরবে সহ্য করত সে আঘাতের যন্ত্রণা। প্রতিবাদ করত মালিক। গাছেদের মালিক বকা দিত আমাদের। আমরা ফল খেতাম খিদে মেটাতে। আর সেই মালিকেরা  অট্টালিকা বানানোর জন্য, উন্নত শহর বানানোর জন্য কি নির্মমভাবে হত্যা করলো গাছগুলোকে। আমরা প্রতিবাদ করিনি। 


গাছেরা যাবার সময় বলে যেতো, “তোরা তো আমাদের বন্ধু, আমাদের ওরা এভাবে মেরে ফেলছে, তোরা নীরবে দেখে গেলি! কিছু বললি না! বাধা দিলি না! আমরা বলতাম, “আমরা তো মালিক নই।” গাছেরা বলত, “বাহ্ রে স্বার্থপরের দল! আমাদের কাছে এসে যখন শীতল ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকতিস, যখন আমাদের ডাল পালায় আঘাতের পর আঘাত করে ফল পেড়ে খেতিস, তখন তো আমি বলিনি, “যা যা আমি মালিককে ফল দেবো, ছায়া দেবো, তোরা দূর হ। বুঝবি যেদিন থাকবোনা, সেদিন বুঝবি তোরা‌।”


বলতে বলতেই তাদের ওপর নেমে আসতো তীক্ষ্ণ কুঠারাঘাত। যন্ত্রণায় অস্ফুটে চিৎকার করত গাছগুলো। আমরা তখন উন্নত শহরের জন্ম দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। ঝা চকচকে একটা শহর। যেখানে থাকবে বিশাল বিশাল রঙীন অট্টালিকা, চওড়া রাস্তাঘাট, সেতু, সুইমিং পুল, দোকানপাট, অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ,,,,,। হুস্ হুস করে সারাদিন ছুটে যাবে অজস্র গাড়ি। উফফ কি অসম্ভব সুখ পেতাম আমরা এটা ভেবেই। যেন স্বপ্ন মনে হতো। রঙীন স্বপ্ন!


আজ আমাদের গ্রামগুলি বদলে গেছে শহরে। আমাদের স্বপ্নের শহর। আমরা কত আধুনিক হয়েছি। এখনও গাছেরা আছে। তবে অধিকাংশ ফুলের গাছ। ফ্ল্যাটের জানালায়, বাড়ির ছাদে তাদের দেখা যায় এখন। বৃক্ষদের ভিড় তেমন আর চোখে পড়েনা আগের মতো। তাও সেইসব বৃক্ষরাজির কাছে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সর্বত্র। কোথাও সেই নির্দেশ কোনও ব্যক্তির, কোথাও বা সরকারের।‌ যে যেখানে মালিক আর কি!  


কিন্তু কোথায় যেন একটা কষ্ট হচ্ছে। কিসের কষ্ট এটা? এ কি! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে কেন! অক্সিজেন কি কমে গেলো নাকি পৃথিবীতে? এত গরম লাগছে কেন আমার? কি অসহ্য উষ্ণ বাতাস আমার চোখেমুখে অবিরাম আঘাত করে চলেছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে? 


আমায় একটু ছায়া দাও, একটু শীতল বাতাস করো আমায়। কেউ শুনতে পাচ্ছো? কেউ নেই! সবাই গেলো কোথায়! কৈ কেউ শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো হ্যালো,,,,আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এসি টা চালাও,,,,, অক্সিজেন সিলিন্ডারটা একটু,,,,, হ্যালো,,,,কেউ আছো.....হ্যালো....

একটা কাঠ ও আমি: কথোপকথন ১ -অমিত দাস
May 19, 2025 | গল্প | views:7 | likes:4 | share: 0 | comments:0

আমি: আচ্ছা, এই যে কাঠের টুকরো, আপনি মাটিতে পড়ে আছেন। আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। মতামত চাই। 

কাঠের টুকরো: (No response)

আমি: তাহলে কথোপকথন এগোবে না? আপনি কি অনিচ্ছুক?

কাঠ: (no response)

আমি: ৬-৭ বছর আগের কথা। আমার কিছু কিছু বন্ধু, যখন আমরা একসঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠানে পড়তাম, জিজ্ঞেস করত— ‘তুই হস্তমৈথুন জানিস না। ওই শোন অমিত এখনও বাচ্চা আছে, ও ঐ জিনিসটা কী জিনিস জানে না।’’ আমি কেন জানতাম না তার কারণ হয়তো দীর্ঘকাল সেই সব দৃশ্য মানসিকতা থেকে আমি সম্পূর্ণ নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলাম। কারণ আমার বন্ধু বৃত্তে আমি একাই ছিলাম, কলেজে ক্লাসের রীতি না থাকায় নিজের গ্রাম্য ও অশিক্ষিত অপরিণত মানসিকতা কখনও বৃহত্তর ক্ষেত্রে যোগ হওয়ার সুযোগ পায়নি। নিজের মনে নিজেকে প্রদক্ষিণ করতাম। সেই দুটো জ্যামিতিক চৌম্বক ক্ষেত্রের তৈরি বায়বীয় ফ্যান্টাসিগুলো তখন নিজের নিয়মেই ঝরে যেত। যাইহোক এখন আমি সেটা জানি। আরও বিবাহিত বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, নানা তথ্যসূত্র দেখে জেনেছি, স্বাভাবিক নারী-পুরুষ একটা বিশেষ সময়ে মিলিত হলে, পরবর্তীকালে সন্তানের  কামনা বা আগমন বাস্তবায়িত হয়।


তার থেকেও বড় ব্যাপার, গর্ভে সন্তান এলে ধারণকারী তা টের পান ও  সেই বিকশিত হতে থাকা মানবপ্রাণের উপস্থিতি ধীরে ধীরে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে সবাই বুঝতে পারেন। তার মানে ১) কেউ আসবেন সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বপরিকল্পিত, কারণ কী করলে কী হয় সেটা সম্ভবত প্রায় মধ্যযুগের আগে থেকে মানুষ জানে। ২) যখন সবাই বুঝতেই পারেন যে কেউ আসছেন এবং আপনি ইচ্ছে করলে সেই আশা সম্ভাবনাকে একটা নির্দিষ্ট সময় অনুসারে আইনত কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আটকাতে পারেন তখন নিশ্চয়ই সেই মানবপ্রাণের আগমনের আসা না আসা আপনার হাতে।


কাঠ: (no response)


আমি: যদি সেক্স করার ইচ্ছে ও পদ্ধতি নরনারীর হাতে থাকে, তাহলে যারা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়নি কিংবা অপরিণত ভাবে মৃত্যু ঘটেছে আগেই (ধরলাম কথা শেখার আগেই), তারা কি কখনও সর্বশক্তিমান/XYZ/স্রষ্টা ইত্যাদি হাবিজাবির কল্পনা করে যুক্তি, অ-যুক্তি কুযুক্তির ইমারত তৈরি করছেন? কাঠবাবু আপনি কী বলেন?


আচ্ছা যার প্রাণ নেই, যে আদৌ পৃথিবীতে আসেনি, কিংবা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে করা সেক্স ছাড়াই ভূমিষ্ঠ এমন কোনও মানব শিশু আছে কি যে আমার এই লেখা পড়ে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু লিখতে বা সাড়া দিতে পারে? থাকলে একটু জানাবেন প্লিজ। ও,  আর কাঠবাবু আপনার কাছে স্রষ্টা/সর্বশক্তিমান/XYZ এসবের ব্যাখ্যা কী? কিংবা যদি কোনও কেউ থেকে থাকে একটু নামটা জানাবেন প্লিজ! 


কাঠের টুকরো: (no response, যেমন মাটিতে পড়েছিল তেমনি আছে)

আমি: ধুর, সময় নষ্ট করলাম।

কাঠের টুকরো: (no response, যেমন মাটিতে পড়েছিল তেমনি আছে)

প্রবীরদার ভালো-মন্দ -মধুসূদন মাহাতো
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

‘প্রসঙ্গ প্রবীর ঘোষ’  বইতে প্রবীর ঘোষ সম্পর্কে লিখেছি। এরপর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্বন্ধে লিখছি। 

         বাল্য এবং কৈশোর কালে রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও ডারউইনের জীবন দর্শন আমাকে কিছুটা বিজ্ঞানমনস্ক করেছিল। স্বপ্ন দেখতাম রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মত মানুষ হওয়ার। প্রবীরদার বই সেই বৃত্তটাকে অনেকটাই সম্পূর্ণ করে দিল। একাদশ শ্রেনীতে পাঠের সময় পুরুলিয়া বইমেলা ঘুরতে ঘুরতে প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” দ্বিতীয় খণ্ড বইটি প্রথম হাতে এল। পড়া শেষ করলাম কয়েক দিনের মধ্যেই। বইটি পড়ার সমস্ত অলৌকিক বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। পুজোপাঠ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিলাম।  যেকোন অলৌকিকতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এরপর তাঁর টানেই বারবার কলকাতা যাওয়া, স্টাডি ক্লাসেও যাওয়া। বই পড়েই চিঠি লিখে শাখা গঠনের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠানো। নিয়মিত ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ করে বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল কোলে ব্যারাক স্টাডি সেন্টারে। সেদিনের স্টাডি ক্লাসে হাজির ছিলেন সুমিত্রাদি, অরুনদা, বিপাশাদি প্রমুখ। তাঁর বই পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই দেখা করতে আসতেন, স্টাডি ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতেন।  অলৌকিকতার বিরুদ্ধে কয়েক লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ ও তাঁর কালজয়ী বেস্টসেলার বইগুলি তাকে অনেকের কাছেই হি-ম্যান করে তুলেছিল। “আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না”, “সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বইগুলি যেকোন পাঠকের মনে দাগ কেটে দেয়। প্রবীরদা বহু গডম্যানদের ভাণ্ডাফোঁড় করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং নিখুঁত কৌশল অবলম্বন করে। তাঁর পথ অনুসরণ করে আমিও কিছু অলৌকিক ঘটনার ভাণ্ডাফোঁড় করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা বন্ধ থেকে, বাল্যবিবাহ, ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার, ধর্মের নামে বলি কুরবানি, চোখ বেঁধে পড়া,  বালি পাচার থেকে ডি জে সাউণ্ড বন্ধ প্রভৃতির বেশিরভাগ ঘটনায় ছিল প্রচণ্ড জীবনের ঝুঁকি। যেকোন রকম সাহায্যের জন্য প্রবীরদাকে ফোন করলেই পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। মাঝে মধ্যেই প্রতিটি শাখার খবর ফোনে নিতেন। পণহীন বিয়ে করা থেকে অনেক ব্যক্তিগত সমস্যারও মুশকিল হাসান ছিলেন প্রবীরদা। স্টাডি ক্লাসে অনেককে বিভিন্ন ভাবে স্বনির্ভর হওয়ার পাঠও দিতেন তিনি।  সিরিয়াস আলোচনার সময় ছাড়া, বাকি সময়  হই হুল্লোড় করে থাকতে ভালো বাসতেন। তাঁর সঙ্গে পিকনিক করেও খুব মজা পেয়েছি। জ্যোতিষী সত্যানন্দ থেকে মোবাইল বাবার ভাণ্ডাফোঁড় আমার সময়ে উল্লেখযোগ্য অভিযান ছিল। অলৌকিক ঘটনার ভাণ্ডাফোঁড় থেকে সাম্যের সমাজ গঠনের রুপরেখা নিয়ে বই লেখা ও তার প্রয়োগ করার চেষ্টা তাকে জীবন্ত কিংবদন্তী করেছে। উনি আমার জীবনের সেরা “ ফ্রেণ্ড, ফিলোজফার এণ্ড গাইড”। 

             তবে ত্রুটিহীন মানুষ পাওয়া আসলে সোনার পাথর বাটি। প্রবীদারও কিছু ত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়েছে।

১) প্রবীরদা দাবি করতেন “আমরা যুক্তিবাদী” পত্রিকাতে উন্নত মানের লেখা না হলে প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু, আমি দেখেছি, সাংবাদিক লেখকদের লেখা নিম্নমানের হলেও তা প্রকাশ পেত।

২) শেষ বয়সে তাকে দেখা শোনার জন্য এবং রান্নার জন্য পরিচারক/পরিচারিকা হিসেবে পরপর তিনজনকে নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু , কাজ ছাড়ার পর তাদের নামে অপবাদ শুনেছি। এটা তাঁর বয়স্কজনিত মানসিক সমস্যাও হতে পারে।

প্রসঙ্গ: প্রবীর ঘোষ -রাজু দত্ত
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কৈশোরে মিতালি পিসির সৌজন্যে তাঁর সাথে আমার আলাপ। মাধ্যম ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খন্ড। এরপর এই বইটির বাকি চারটি খন্ড ও  ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ বইগুলি পড়ে ফেলি। বয়সজনিত মানসিক সক্ষমতা দিয়ে এই বইগুলির মর্মবস্তু সাধ্যমতো উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। এই বইগুলি আমার কিশোরমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সাহিত্য ও ইতিহাস পছন্দের বিষয় ছিল এতদিন, এরপর বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মালো। আমার মানসিকতার ক্রম পরিবর্তন ঘটতে লাগলো। 


এ কথা সত্য যে কোনও এক বা একাধিক বই পড়ে রাতারাতি নিজেকে বদলানো যায় না, তবে বইটির বিষয়বস্তু উপলব্ধি করে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তার যথার্থতা অর্জন করা যায়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজেকে মানসিকভাবে বদলাতে আমার সময় লেগেছে অনেকটাই। তবে বইগুলি আমার কিশোর মনে জাগ্রত অজস্র প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। এ কথা আমি অস্বীকার করি না। 


অন্যতম প্রিয় লেখক প্রবীর ঘোষ, যিনি আমার চেতনায় বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণ করেছিলেন, তাঁর সাথে আমার মাত্র দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রথমবার তাঁর অসুস্থতার সময়, শেষবার তাঁর মৃত্যুর সময়। এ বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা চলাকালীন গত 5ই ফেব্রুয়ারি সকালে আমি ও অরিন্দম তাঁর দমদমের বাসগৃহে তাঁকে দেখতে যাই। গতকাল 7 ই এপ্রিল, তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে, দুপুরে অরিন্দমের সাথেই যাই তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে। উভয় সাক্ষাৎ বড়ো যন্ত্রণার। প্রথমবার গিয়ে দেখলাম, তিনি রোগশয্যায়, শেষবার মৃত্যুশয্যায়। জ্যোতিষীসহ সকল অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের ত্রাস, সমকালীন সময়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ লড়াকু প্রবীর ঘোষকে এভাবে দেখবো, কখনও ভাবিনি। কথাবার্তাও বিশেষ বলতে পারিনি। তাই একটা অস্ফুট আফসোস রয়েই গেলো। 


মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে”। মৃত্যু জীবনের শেষে এক সুনিশ্চিত ঘটনা। কেবল জীবের নয়, মহাবিশ্বের সকল গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্রের মৃত্যু আছে। সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের চক্র মহাবিশ্বে নিরন্তর আবর্তিত। আমরা কেউই তার উর্ধ্বে নই। আমাদের বেঁচে থাকা আমাদের ‘কাজ’ এর মধ্যে। আমাদের বেঁচে থাকা মৃত্যুর পর আমাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারার অন্তত একজন মানুষ রেখে যাওয়ার মধ্যে। আমাদের বেঁচে থাকা আমাদের গৃহীত আদর্শের মধ্যে। মৃত্যুর পরেও প্রবীর ঘোষ এভাবেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে।‌ 


পাঁচটি খন্ডে প্রকাশিত ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ ছাড়াও তিনি আরও যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলি হলো, যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ, অলৌকিক রহস্য সন্ধানে পিংকি, যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি, অলৌকিক রহস্যজালে পিংকি, পিনাকী ও অলৌকিক বাবা রহস্য সমগ্র, জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক, মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ মেডিটেশন, প্রেম, বিবাহ ও অন্যান্য, সম্মোহনের A to Z, গোল টেবিলে সাফ জবাব, রাজনীতির ম্যানেজমেন্ট এবং আরও কিছু, মেমারিম্যান থেকে মোবাইল বাবা,প্রসঙ্গ সন্ত্রাস এবং, যৌবনের বজ্রনির্ঘোষ, আমার ছেলেবেলা, স্বাধীনতার পরে, ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা, প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার-প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার, গেরিলা যুদ্ধের A to Z থেকে আজাদি, ধর্ম, সেবা - সম্মোহন, পিংকি ও অলৌকিক বাবা, অপরাধ বিজ্ঞান, স্বয়ম্ভর গ্রাম, বারে বারে ঘুরে ফিরে তুমি, যুক্তিবাদের চোখে গীতা, রামায়ন মহাভারত ইত্যাদি, কাশ্মীরে আজাদির লড়াই- একটি ঐতিহাসিক দলিল, অলৌকিক দৃষ্টি রহস্য, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস, সেরা যুক্তিবাদী সংকলন, দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্ম, আজকের যুক্তিবাদ কি ও কেন,জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান, ভগবানে ভর ভূতে ভর, জ্যোতিষ একটি অবিজ্ঞান, যুক্তিবাদীর চোখে ধর্ম, ভূতে ভর এবং যুক্তিবাদীদের কথা।    


সমকালীন সময়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, জ্যোতিষী সহ সকল অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের ত্রাস, প্রবীর ঘোষ বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। তাঁর পথ অনুসরণ করে আগামী দিনে এগিয়ে যাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন। প্রবীর ঘোষ ‘আলোর পথযাত্রী’ দের আলোর দিশারী হয়ে থেকে যাবেন আগামীদিনে।

লং লিভ প্রবীর ঘোষ -চিত্রদীপ সোম
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৯৯৯ সালে প্রথম দেখা। ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র তখন আমি। বাড়িতে লুকিয়ে বর্ধমান থেকে গিয়েছিলাম তাঁর সাথে দেখা করতে, বর্ধমানে যুক্তিবাদী সমিতির শাখা খোলার ব্যাপারে অনুমতি নিতে। 

আর আজ, একটু আগে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গী হলাম। দেহদান করে আসা হলো সাগর দত্ত হাসপাতালে। অবসান হলো একটা যুগের। একটা অধ্যায়ের।

আমার কাছে আজীবন গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে এই বিষয়টি যে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গীদের অন্যতম ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহুর্ত অবধি সাথে ছিলাম তাঁর। মাঝপথে হাত ছেড়ে দিইনি আরও অনেকের মতো।


প্রবীর ঘোষ। শুধু একটা নাম নয়, একটা কিংবদন্তী। উপমহাদেশের বস্তুবাদ চর্চার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবচেয়ে আলোচিত নাম। আপামর মানুষের কাছে যুক্তিবাদ শব্দটিকে জনপ্রিয় করার, ভাববাদী চিন্তার বিরুদ্ধে পালটা মগজধোলাইয়ের মূল কারিগর৷ আজও শুধু তাঁর নামটাই এক আতঙ্ক বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীদের কাছে৷ জীবিতকালে ফাঁস করেছেন অসংখ্য বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীর ভণ্ডামী৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। খোদ বিবিসি তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় সেই ১৯৯২ সালে৷ এছাড়াও দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত চিন্তাবিদদের আলোচনায় বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। ভাববাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব, জ্যোতিষ সহ বিভিন্ন বুজরুকির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বলিষ্ঠ হাতে। লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটির মতো বই, যার অনেকগুলিই বেস্ট সেলার আজও। নবনীতা দেবসেন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’সহ বিভিন্ন লেখক লেখিকা তাঁর আদলে গল্পের নায়ক বানিয়ে গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা অবলম্বনে হয়েছে জনপ্রিয় সিরিয়ালও।


কেন প্রবীর ঘোষ অনন্য? ভারতে বস্তুবাদ চর্চার ইতিহাসে প্রবীর ঘোষ একমাত্র ব্যক্তি নন। অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র আছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, ভবানীপ্রসাদ সাহু, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এরকমই কিছু উদাহরণ। কিন্তু এরা কেউই আমজনতার কাছে নিজের বক্তব্যকে নিয়ে যেতে পারেননি। উক্ত বুদ্ধিজীবীরা জনপ্রিয় ছিলেন শুধুমাত্র শিক্ষিত বিদগ্ধ মহলে। বস্তুবাদ চর্চা ছিল তাঁদের কাছে নিছকই একটা একাডেমিক চর্চার বিষয়। এরা কেউই বুজরুকদের সাথে সম্মুখ সমরে নামেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের বুজরুকি ফাঁস করেননি। চ্যালেঞ্জ জানাননি। গ্রামেগঞ্জে অনুষ্ঠান করে মানুষের কাছে বস্তুবাদী চেতনার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেননি। তাই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে তাঁরা পরিচিতিও লাভ করতে পারেননি। আমজনতার মাঝে তাঁদের চিন্তাধারাকে ছড়াতে পারেননি বিন্দুমাত্র। অন্যদিকে প্রবীর ঘোষ শুধু অ্যাকাডেমিক কচকচানির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে রূপ দিয়েছিলেন আন্দোলনের। পৌঁছে দিয়েছেলেন প্রান্তিক মানুষের কাছে৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা জেলার শহরে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছেন। হাজার হাজার অনুষ্ঠানে হাতে কলমে ফাঁস করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন অলৌকিক কৌশলের বুজরুকি। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জ্যোতিষীদের। ফাঁস করেছেন জ্যোতিষীদের অতীত বা ভবিষ্যৎ বলার রহস্য। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের। এরজন্য একাধিকবার প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে তাঁর উপর। আর এসবই প্রবীর ঘোষকে বানিয়েছে জীবন্ত কিংবদন্তী৷ বানিয়েছে সুপার হিরো। আজ সুকুমারী ভট্টাচার্য বা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের নাম যত লোক জানে তার একশোগুন বেশী লোক জানে প্রবীর ঘোষের নাম৷ জানে যুক্তিবাদী সমিতির নাম। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মানুষের নেতা’, এভাবেই তিনি যুক্তিবাদকে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মাঝে।

প্রবীর ঘোষ যখন যুক্তিবাদী আন্দোলন শুরু করেন তখন এদেশে তথা এ রাজ্যে বিজ্ঞান সংগঠন ছিল হাতে গোনা। টিমটিম করে চলতো সেসব সংগঠন। সাধারণ মানুষ নামও জানতো না তাদের বিশেষ। বিজ্ঞান আন্দোলনের জোয়ার তিনিই প্রথম আনেন এদেশে। একের পর এক জনপ্রিয় বই লিখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে, জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীদের বিভিন্ন বুজরুকি হাতে কলমে ফাঁস করে, রেডিও টিভিতে বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে নামকরা জ্যোতিষীদের নাস্তানাবুদ করে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর্টিকেল লিখে এমনই এক হাইপ তিনি তৈরি করেন যে প্রায় রাতারাতি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন৷ গড়ে ওঠে কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। প্রবীর ঘোষ ও যুক্তিবাদী সমিতি আসরে নামার আগে এ রাজ্য তথা এ দেশের আনাচে কানাচে খোঁজ মিলত নানা ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীদের। রমরম করে চলত তাদের লোক ঠকানোর ব্যবসা৷ কিন্তু আজ মাথা খুঁড়লেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীর দেখা পাওয়া ভার৷ এই কৃতিত্বের সিংহভাগই যে প্রবীরবাবুর অবদান এ কথা অস্বীকার করা যায় না৷ এছাড়াও, যে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞান সংগঠন সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলতে ভয় পেত, যারা তাদের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রেখেছিল কৃষিতে জৈব সার ব্যবহার, খাবারে ভেজাল ধরার পদ্ধতি ইত্যাদি নিরীহ বিষয়ে, যাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে না হয়, সেই সময় অসীম সাহসে ভর করে তিনি সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর লেখা বইয়ে ধর্মকে ‘ক্যানসারের চেয়েও মারাত্মক, পরমানু বোমার চেয়েও বিপজ্জনক’ বলার হিম্মত রেখেছেন। আর এমন একটা সময়ে তিনি এই কাজ করেছেন যখন চারপাশের ১০০% মানুষই ছিল ধর্মবিশ্বাসী, ঈশ্বরবিশ্বাসী। একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা মেরুদন্ডের জোর, কতটা বুকের পাটা থাকলে তবে ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে দাঁড়িয়ে একথা বলা যায়। 


শুধু কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনই নয়, তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকাকেও। দেখিয়েছেন কেন রাষ্ট্রশক্তি তোল্লাই দেয় কুসংস্কারকে, তোল্লাই দেয় ভাববাদী চিন্তাধারাকে। দেখিয়েছেন শোষিত মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে, দৈব বিশ্বাসী করে রাখতে পারলে কিভাবে অবাধে শোষন, লুন্ঠন করা যায় তাদের৷ দেখিয়েছেন ভাববাদী চিন্তা কিভাবে প্রতিহত করে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা, ঘুম পাড়িয়ে রাখে মানুষের চেতনাকে৷ কোভুর বা জেমস র‍্যান্ডির মতো প্রখ্যাত যুক্তিবাদীরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকা নিয়ে ছিলেন নীরব। কুসংস্কারের জন্য তাঁরা দায়ী করেছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদেরই। দায়ী করেছিলেন তাদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার অভাবকে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা, পুঁজির ভূমিকা নিয়ে তাঁদের এই নীরব থাকার কারণ হয় তাঁদের অজ্ঞতা, আর নয় রাষ্ট্রশক্তির কোপে পড়ার আশঙ্কা। এদিক থেকেও প্রবীর ঘোষ ছিলেন ব্যতিক্রমী৷ শুধু ভাববাদের বিরুদ্ধে নয়, তিনি মুখ খুলেছিলেন হুজুর-মজুর শ্রেণীকাঠামোর বিরুদ্ধে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সাম্যবাদের। তিনি দেখিয়েছেন শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব শোষণমুক্তি ঘটাতে পারে না, পাশাপাশি চালাতে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যাতে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী সমাজের কু-আচার, কু-প্রথা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে পারে৷ এখানেও তিনি অনন্য। 

বিতর্ক যে তাঁকে নিয়ে হয়নি তা নয়। বস্তুত বিতর্ক ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিছু বিতর্ক বা সমালোচনা যেমন ছিল যৌক্তিক, তেমনই ছিল কুৎসার, অপপ্রচারের বন্যা৷ কুৎসাকারীরা তাঁকে টেনে নামাবার, মিথ্যা অভিযোগে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টার কসুর কোনওদিনই করেনি। এরমধ্যে জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীরা যেমন আছে তেমনি আছেন যুক্তিবাদী নামধারী কিছু কুলাঙ্গারও। কারণ তাঁরা জানতেন প্রবীর ঘোষ একজন ব্যক্তিমাত্র নয়, একটা আদর্শ, একটা যুগ, একটা সংগ্রামের নাম। তাই প্রবীর ঘোষকে ‘খলনায়ক’ প্রমান করতে পারলে কুঠারাঘাত করা যাবে যুক্তিবাদী চেতনার মূলে। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে একটি গোষ্ঠী দাবী করে আসছে তিনি নাকি যুক্তিবাদী সমিতি থেকে ‘বিতাড়িত’। দাবী করে আসছে তিনি নাকি শ্লীলতাহানি, অর্থ তছরূপের অভিযোগে অভিযুক্ত৷ ভুয়ো ডিগ্রীর অধিকারী। স্ত্রীর উপর তিনি নাকি ‘নির্মম অত্যাচার’ করেন। এই সমস্ত অভিযোগে আদালতে একের পর এক মামলাও এনেছে তারা৷ একটা দুটো নয়, একের পর এক তেরোটি মামলা। কিন্তু ‘পরাজয়’ শব্দটি প্রবীর ঘোষের অভিধানে ছিল না কোনওদিনই। আদালতের লড়াইতেও জয়ী হয়েছেন তিনি। যে কটা মামলার রায় বেরিয়েছে তার প্রতিটিতেই মহামান্য আদালত তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন সমস্ত অভিযোগ থেকে। আদালতের লড়াইতে পরাস্ত হয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা রটনাকেই মূল হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে কুৎসাকারীরা। এটাই তাদের শেষ সম্বল। 

প্রবীর ঘোষ আজ আর নেই৷ কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অজস্র অনুরাগীর মধ্যে৷ বেঁচে থাকবেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে৷ যতদিন ভাববাদ বিরোধী লড়াই চলবে, যতদিন অলৌকিকতা বিরোধী লড়াই চলবে, ততদিনই প্রবীর ঘোষ ধ্রুবতারা হয়ে দিক নির্দেশ করবেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের। প্রবীর ঘোষরা মরেন না৷ মরে কেবল তাঁদের নশ্বর দেহটি।

লং লিভ প্রবীর ঘোষ।

ভগৎ সিং ও তাঁর চিন্তাভাবনা -মঞ্জশ্রী সামন্ত
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

‘কীর্তি’ পত্রিকার ১৯২৮- এর সংখ্যায়, ভগৎ সিং দু’টি নিবন্ধ লিখেছিলেন। একটি নিবন্ধের শিরোনাম হল, ‘অচ্ছুৎ কা সাওয়াল’, যা অস্পৃশ্যতাকে কেন্দ্র করে লেখা। আর অন্য নিবন্ধের শিরোনাম হল, ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গে অর উনকা ইলাজ’, যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং তার সমাধান নিয়ে লেখা। ভগৎ সিং ১৯২৮’এ যা লিখেছিলেন, বর্তমান সময়েও তা প্রাসঙ্গিক। যা প্রমাণ করে এসব প্রশ্নের সমাধানের জন্য খুব অল্পই কাজ হয়েছে। লেখাটি লিখতে গিয়ে প্রথমেই ভগৎ সিং লিখেছেন, “আমাদের দেশটি অনন্য, যেখানে ছয় কোটি নাগরিককে অস্পৃশ্য বলা হয়। তাঁদের সামান্য স্পর্শ, উচ্চ বর্ণের মানুষকে অপবিত্র করে দেয়। তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ করলে দেবতারা ক্ষুব্ধ হন। বিংশ শতাব্দীতে এসবের চর্চা লজ্জাজনক। আমাদের দেশ নিজেদেরকে আধ্যাত্মিক বলে দাবী করে। কিন্তু সমস্ত মানুষের সমান অধিকার মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করে। বস্তুবাদী ইউরোপ কয়েক শতাব্দী ধরে বিপ্লবের কথা বলছে। আমেরিকা এবং ফরাসি বিপ্লবের সময়, তাঁরা সমান অধিকারের কথা ঘোষণা করেছে। অথচ, আমরা এখনও বিতর্ক করছি যে অস্পৃশ্যরা পৈতের অধিকারী কিনা, বা তাঁরা বেদ পড়তে পারবে কিনা। বিদেশে আমরা ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলছি যে, ইংরেজরা ভারতে আমাদের সমান অধিকার দেয় না।” ভগৎ সিং আমাদের পরিস্থিতি দেখে 

ভাবলেন, এই ধরনের বিষয়ে আসলেই কি অভিযোগ করার কোনও অধিকার আছে? তিনি এই অস্থিরতার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে সত্যিই নিযুক্ত ছিলেন। আমাদের সবার প্রথম সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত: “বিশ্বাস করতে শুরু করা উচিত যে, আমাদের সবার জন্ম এবং পেশা সমান অধিকার নিয়ে। সেখানে বিভক্তিকরণের কোনও প্রয়োজন নেই। যদি কেউ একজন ঝাড়ুদারের পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, তার মানে এই নয় যে সারা জীবন তাঁকে আবর্জনা পরিস্কার করে পারিবারিক পেশা বজায় রাখতে হবে, কোনও উন্নয়নমূলক কাজে তাঁর অংশগ্রহণের অধিকার নেই।” 

এই ধরনের বৈষম্য সরাসরি দায়ী ছিল ধর্মান্তরের জন্য। যা ১৯২০’র দশকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল। তিনি নিজে ঔপনিবেশিকতার বিরোধী হয়েও, শুধু মিশনারিদের নিন্দা করেননি, বা যাঁরা নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের হত্যা ও পুড়িয়ে ফেলার জন্য হিন্দুদের প্ররোচিত করেননি। তিনি স্ব-সমালোচনামূলকভাবে লিখেছেন: “আপনি যদি তাঁদের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করেন, তাহলে অবশ্যই তাঁরা অন্যান্য ধর্মে যোগদান করবেন। যে ধর্মে তাঁরা অনেক বেশি অধিকার পাবে এবং যেখানে তাঁদের সাথে মানুষের মতো আচরণ করা হবে। এই পরিস্থিতিতে খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্ম হিন্দু ধর্মের ক্ষতি করেছে বলে অভিযোগ আনলে তা বৃথা হবে।”

মৌমাছি সমাজে শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি -পঞ্চানন মন্ডল
May 19, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

‘মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।

ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই…’

মৌমাছির জীবনে আছে অসম্ভব ব্যস্ততা। আমরা মানুষরাও কম ব্যস্ত নই।  কিন্তু অনেক প্রকৃতি প্রেমিক, গবেষক, বিজ্ঞানী আছেন যারা দিনরাত এক করে মৌমাছির জীবন রহস্য সম্বন্ধে অনেক কিছু আমাদের কাছে উন্মোচিত করেছেন। তবে আমাদের অনেকের মৌমাছির কাছে যাওয়ারও সাহস হয় না তাদের হুলের কারণে। তারপরও রাস্তা ঘাটে মৌচাক দেখলে আমাদের অনেকের কেন যে ঢিল ছুঁড়তে ইচ্ছে করে, কে জানে! এমনিতে মৌমাছি কখনও বিনা কারণে কাউকে আক্রমণ করে না, এরা খুবই শান্তি-প্রিয় প্রতঙ্গ। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে কোন ছাড় নেই, তখন এরা এদের একমাত্র অস্ত্র হুল প্রয়োগ করতে এরা দেরি  করে না।


মৌমাছি খুবই পরিশ্রমী, দলবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক সামাজিক প্রাণী। এদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে! এদের সমাজে সবার কাজ নির্দিষ্ট, চেইন অফ কমান্ড এর বিন্দুমাত্র নড়চড় হয় না কখনও; হয় না কোন বিদ্রোহ। এখানে দুর্বলের কোন স্থান নেই, অত্যাচারীও নেই এখানে। নিজ দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এরা পিছপা হয় না কখনই। কঠোর পরিশ্রমী, আত্ম-ত্যাগ ও নিষ্ঠাই এদের ৩০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছে।


মৌমাছির সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিংবা অসাধারণ গুণের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে মৌ নৃত্যর  (bee dance)  কথা। তবে এ নাচ তো শুধুই নাচ নয়, এ তাদের ভাষা। এই নাচের মাধ্যমেই মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে, খবরাখবর আদান প্রদান করে থাকে, তার সঙ্গে করে খাবারের সন্ধান। মৌমাছির এই অদ্ভুত কম্যুনিকেশনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিশ। তাঁর জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে পান নোবেল পুরস্কার। 


তিনিই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে দেখান যে, মৌমাছি নাচ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন  করে, খাবারের সন্ধান পায়।

খাদ্য সন্ধানকারী কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছিরা প্রধানত দুই ধরনের মৌ নৃত্য করে থাকে, বৃত্তাকার বা চক্রাকার নৃত্য ও ওয়াগল নৃত্য।


বৃত্তাকার বা চক্রাকার মৌ নৃত্য-

খাদ্যের উৎসের দূরত্বের উপর নির্ভর করে খাদ্য সন্ধানে শ্রমিক মৌমাছিরা এই নৃত্য প্রদর্শন করে। খাদ্যের উৎস কাছাকাছি মানে ১০০ মিটারের মধ্যে হলে এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শিত হয়। খাদ্য সন্ধানী মৌমাছিদের পিছনে সংগ্রাহক মৌমাছিরাও তখন ধাবিত হয় ও তারাও একই রকমভাবে নাচতে থাকে। চক্রাকার নৃত্য নিকটবর্তী স্থানে খাদ্যের উৎস সম্পর্কে অন্যকে জানাতে এবং পক্ষান্তরে সেই উৎস থেকে মৌমাছিকে খাদ্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।


ওয়াগল ডান্স বা ওয়াগল নৃত্য-

ইংরেজি ওয়াগল শব্দের অর্থ আন্দোলন বা কম্পন। খাদ্যের উৎস বেশি দূরে হলে মানে ১০০ মিটারের বেশি হলে কর্মী মৌমাছিরা এই প্রকার নৃত্য প্রদর্শন করে। এই নৃত্য ইংরেজি 8 সংখ্যার মত আকৃতির মতো হয়। এরা একবার ডান দিকে ও একবার বাঁদিকে ফাঁস বা লুপ তৈরি করে এবং নাচের সময় লুপ এর মধ্যে সরলরৈখিক অংশে সন্ধানী মৌমাছি ওপর-নিচে নিজেকে আন্দোলিত করে আর খাদ্যের উৎসের দিকে ধাবমান হয়।


ওয়াগল বৃত্তের সমীকরণ এর মাত্রা থেকে খাদ্যের অবস্থানের দূরত্ব সম্পর্কে মৌমাছি জানতে পারে। সূর্যের সাপেক্ষে নৃত্যের  কৌণিক অভিমুখ থেকে খাদ্যের উৎস এর দিক নির্ধারণ করে। ঊর্ধ্বমুখী নৃত্য  থেকে বোঝা যায় যে খাবারের উৎস এর অবস্থান সূর্যের দিকে এবং নিম্নমুখী নৃত্য  থেকে বোঝা যায় যে খাবারের অবস্থান সূর্যের বিপরীত দিকে।


অর্থাৎ মৌমাছির রয়েছে অসাধারন দিক জ্ঞান এবং নিখুঁত দূরত্ব  মাপার ক্ষমতা। কোন মৌমাছি যখন খাবারের অথবা মধুর নির্যাসের(মানে মকরন্দ বা নেকটার) কোন উৎস (ফুল) খুঁজে পায় তখন সে মৌচাকে এসে নৃত্যের  মাধ্যমে সকলকে খবর দেয়। সে শরীর দোলাতে থাকে এবং নাচতে থাকে এমন এক পথ ধরে যার মাধ্যমে সে উৎসের দিক বোঝাতে পারে। এরা এই দিক ঠিক করে সূর্যের সাপেক্ষে যাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক বোঝা যায়। 


মৌমাছির নৃত্যের  সময়ব্যাপ্তি এবং কম্পনের (দোলা) সংখ্যা দিয়ে সে বোঝায় ঠিক কত দূরে আছে ফুল এবং ফুলে কি পরিমাণ মধুর নির্যাস রয়েছে, যেমন ১ সেকেন্ডের দোলন বোঝায় উৎস রয়েছে ১ কিমি দূরে।

এসব তথ্য এবং সূর্যের গতিবিধি’র নিখুঁত হিসেব করে মৌমাছিরা ফুল/খাবার এর কাছে পৌঁছানোর নুন্যতম ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দূরত্ব  বের করে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছির এই সকল হিসেবের দক্ষতা খুব বেশি এবং সময়ও লাগে কম। উল্লেখ্য মৌমাছি সূর্যের আলোর হিসেব করতে পারে এবং পৃথিবী গোল হওয়ায় যে বক্রতার একটা ব্যাপার আসবে তাও তাদের নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করে।


মৌমাছি সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে চলাফেরা করে।

 তাই যখন আকাশ মেঘলা থাকে, সূর্য মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়,  তখন এরা এদের বিশেষ আলোক-গ্রাহক (ফটো-রিসেপ্টর) ব্যবহার করে পোলারাইজড আলো কাজে লাগিয়ে সূর্যের সঠিক অবস্থান বের করে ফেলে। এজন্য অতিবেগুনী (আল্ট্রা-ভায়োলেট) আলোরও সাহায্য পড়ে, সে ক্ষমতাও আছে এদের। এছাড়াও সূর্য আবার  সবসময়ে সব ঋতুতে আকাশের এক জায়গায় থাকে না! তাতেও সমস্যা নেই!  কারণ, মৌমাছির মাথায় আছে প্রাকৃতিক ঘড়ি! যার মাধ্যমে এরা সূর্যের গতিবিধি সবই হিসেব করতে পারে।


মৌমাছিরা গাছের ডালে বা কার্নিশে বড়-বড় চাক তৈরি করে। প্রতি চাকে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মৌমাছি থাকতে পারে। এক-একটি চাকে এত-এত মৌমাছি থাকলেও  তাদের নিজেদের মধ্যে ঝুট ঝামেলা করতে বা মারামারি করতে দেখা যায় না। অবশ্য সময়ে অসময়ে এক চাকের মৌমাছি অন্য চাকের মৌমাছিগুলিকে আক্রমণ করে লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। মৌমাছিরা ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করে সমাজের স্বার্থে কাজ করে যায়। এমনকি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। মৌমাছিরা অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে  তাদের দিনযাপন করে।

এরা শীতকালে তেমন কাজ করে না। সারা শীতকালটা এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর করে কাটায়। কিন্তু বসন্তের আগমনে এরা পুরোনো ছন্দে ফেরে। মধু আহরণ, চাক  নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসার আবর্জনা পরিষ্কার বলুন আর শত্রুদের সামলানো বলুন যেভাবে অত্যন্ত শৃঙ্খলা ও তৎপরতার সাথে কাজ করে, তা দেখলে আপনি বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা, কেউ কারোর কাজে বাধা সৃষ্টি করে না। সবাই যেন নিজ নিজ কাজের প্রতি দায়বদ্ধ। যেন কিছুটা রোবটের মতো কাজ করে যাচ্ছে। দেহ মনে কোনও ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, অন্যের উপর দোষারোপ নেই।


একটি মৌচাকের  মৌমাছিকে আমরা দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি – অত্যন্ত কর্মপটু শ্রমিক মৌমাছি আর ওপর দল সম্পূর্ণ কর্মবিমুখ রানি ও পুরুষ মৌমাছি। আগেই বলেছি শ্রমিকরা চাক নির্মাণ, মকরন্দ সংগ্রহ, মধু তৈরি, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসা রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শত্রুদমন সবই করে। পুরুষরা মৌমাছি প্রধানত আহার-বিহারেই মত্ত থাকে। আর রানী মৌমাছির বংশবৃদ্ধি ছাড়া কোনও কাজ নেই। পুরুষেরা প্রায়ই দিনের শেষভাগে উচ্চ শব্দ করে বাসা থেকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ প্রমোদ ভ্রমণ করে বাসায় ফিরে  আসে। প্রত্যেক চাকে সাধারণত একটি মাত্র পরিণত বয়স্ক রানি মৌমাছি দেখা যায়।  মৌমাছিদের সামাজিক কার্যকলাপ দেখলে মনে হবে – একটিমাত্র রানীকে ঘিরেই তাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে রানি বলে সে যে সবাইকে শাসনে রেখেছে এমনটি ভাববেন না। এদের মধ্যে রাজতন্ত্র বা রাণীতন্ত্র বলে কোনও কিছুই নেই। রানির একমাত্র কাজ প্রজনন। একটি মাত্র রানিই চাকের প্রায় অধিকাংশ মৌমাছির মাতা। ডিম পারা আর আর পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে বৈবাহিক উড্ডয়নরত অবস্থায়  যৌন মিলন ছাড়া তার তেমন  কোনও কাজ নেই। তাই শ্রমিক মৌমাছি আছে বলে মৌচাক আছে, মৌমাছির সমাজ টিকে আছে। মৌমাছি সমাজে রানি বা কোনও রাজা নয় শ্রমিকরাই চালিকাশক্তি। আর তাদের জীবন চলে ঘড়ি মেপে, অঙ্ক কষে,কাজ করে আর নেচে গেয়ে।

পরিবেশের জন্য এসি কতটা বিপদজ্জনক? -তাঞ্জন বোস
May 19, 2025 | সচেতনতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এসি পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মূল কারণ ব্লা ব্লা নিয়ে ফেবুপাড়া সরগরম৷ যারা এসি ব্যবহার করে বা কেনার প্ল্যানিং করছে তাদের বলদা পাঁঠা বলেও অভিহিত করে ফেলছে কেউ কেউ৷ এসির বিরুদ্ধে মূলত দুটো অভিযোগ৷ ১) CFC ব্যবহার করা৷ যা পরিবেশের এবং ওজোন স্তরের পক্ষে ক্ষতিকর৷ ২) অত্যাধিক ইলেকট্রিসিটি খরচ৷ 

আগে ১ নম্বর নিয়ে কথা বলি৷ প্রথমত এখন আর CFC বা R 12 ব্যবহার হয়না৷ যেটা ব্যবহার হয়, সেটা হল R134A. যেটা HFC. এর গ্রিন হাউস এফেক্ট CFC র তুলনায় কম৷ দ্বিতীয়ত, আমরা যদি এসির কর্মপদ্ধতি দেখি, তাহলে দেখব যে এটি মূলত কাজ করে ইভ্যাপোরেশন পদ্ধতির উপর৷ কমপ্রেশরে হাই প্রেশারে তরলীকৃত রেফ্রিজারেন্ট বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে শুষ্ক এবং  লো প্রেশারের হয়ে ইভ্যাপোরেটরে আসে৷  সেখানে লীনতাপ সংগ্রহ করে বাষ্পীভূত হয়৷ যেহেতু ইভ্যাপোরেটর বা লোকাল ভাষায় কুলিং কয়েল থেকে লীনতাপ সংগ্রহ করছে রেফ্রিজারেন্ট, এটি ঠান্ডা হয়ে যায়৷ এউ ঠান্ডা ইভ্যাপোরেটরে সংস্পর্শে এসে বাইরের হাওয়া ঠান্ডা হয় এবং ব্লোয়ার মোটর সেই হাওয়াকে ঠেলে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়৷ ঠান্ডা ভারী হাওয়া নিচে নেমে যায়৷ গরম হাল্কা হাওয়া উপরে উঠে আসে৷ সেটা আবার এসিতে রিসার্কুলেট হয়ে ঠান্ডা হয়৷ মোটামুটি সহজ ভাষায় এসির মূল কর্মপদ্ধতি এটাই৷ 


 এখন দেখার জিনিস যেটা সেটা হল রেফ্রিজারেন্ট পুরো সময়টাতেই একটা ক্লোজ সিস্টেমের ভিতর থাকছে৷ কোনভাবেই ওপেন এয়ারের সংস্পর্শে আসছে না৷ ফলত ওজোন স্তরে ক্ষতি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বৃদ্ধির চান্স নেই যতক্ষন না রেফ্রিজারেন্ট লিক হয়৷ এবার এই লিকেজের অনেক কারণ আছে৷ যার সিংহভাগ কারণই হল ঠিকঠাক মেনটেনেন্স না করা আর মিস হ্যান্ডেলিং৷ অর্থাৎ একটু নিজে সতর্ক থেকে রেগুলার সার্ভিসিং করালেই অন্তত লিকেজের চান্স ৯০ শতাংশ কমে যায়৷ 


দ্বিতীয়ত হল বিদ্যুৎ খরচ৷ একটা বড় সাইজের ঘর এই গরমে স্বস্তিদায়ক রাখতে দুটো থেকে তিনটে ফ্যানের দরকার পড়ে৷ এরকম অবস্থায়, বিদ্যুৎ খরচও বেড়ে যায়৷ এবার কেউ যদি এসি ২৪ এ চালায় তাহলে কিন্তু ইলেকট্রিক খরচ অনেক কমে যায়৷ কিন্তু সেটা না করে গরমে ১৭ য় চালিয়ে কম্বল গায়ে দিলে ইলেকট্রিক খরচ বাড়বেই৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে দুটো অভিযোগ আসে এসির বিরুদ্ধে, সামান্য কনসাসলি ব্যবহার করলেই দুটোই এড়ানো সম্ভব৷ 


এবার একটা মজার গল্প বলি৷ এই R134A ব্যবহার করে ইভ্যাপোরেশন সিস্টেমে ঠান্ডা আরও একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসও করে৷ সেম টু সেম প্রশেস৷ অনেকের ঘরেই এসি না থাকলেও এই যন্ত্রটি থাকেই৷ এর নাম রেফ্রিজারেটর৷ অর্থাৎ আমার আপনার আদরের ফ্রিজ৷ হপ্তার বাজার, জল, আগের রাতের বেচে যাওয়া খাবার রাখার এক এবং একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান৷ কিন্তু এর বিরুদ্ধে কেউ সরব হয়না৷ ফ্রিজের ঠান্ডা জল বা শরবত খেতে খেতে ফ্যানের তলায় বসে এসি ব্যবহারকারীর দ্বিচারিতা হল না কি? 


এইসব ব্যক্তিগত এসি বন্ধ, বাড়ির ছাদে গার্ডেনিং, বৃক্ষরোপণ এগুলো কোনটাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র নয়৷  এইসব এসি বন্ধ, রুফ গার্ডেনিং আদতে বন্যার সময় মগ দিয়ে জল সেঁচার মতন৷ কাজের কাজ কিছুই হয়না৷ শুধু সেল্ফ ইগো বুস্টিং ছাড়া৷ আপনি হয়ত এসি ব্যবহার করবেন না৷ গরমে পচে আদর্শের পিঠ চাপড়ানি দেবেন নিজেকেই৷ অথচ সার্ভার ঠান্ডা রাখার উদ্দেশ্যে আপনার বাড়ির পাশের ফাঁকা এটিএমে ২৪ ঘন্টা এসি অন থাকবে৷ অথচ সেই ব্যাপারে আপনি স্পিকটি নট৷ জলার পর জলা বুজিয়ে ফ্ল্যাট হচ্ছে, কলকারখানায় ঝেড়ে এসি ব্যবহার হচ্ছে৷ তারমধ্যে অনেকগুলোই আদ্যিকালের CFC সমৃদ্ধ৷ ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার কমার কোন লক্ষন নেই৷ কিন্তু ব্যক্তিগত এসি বন্ধ আর রুফ গার্ডেনিং এর গল্প আপনার মাথায় ঢুকে যাচ্ছে৷ এই ঢোকাটা স্বাভাবিক না কৃত্রিম সেই নিয়ে ভাবনার সময় এসে গেছে৷ ইচ্ছা করে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে এসব প্রোপাগাণ্ডার চাষ করে জনসাধারণকে গিল্ট ট্রিপ দেওয়া হচ্ছে না তো!

সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতার অভাবই সমস্ত সমস্যার মূল কারণ? -মাধর রঞ্জন সরকার
May 19, 2025 | সাইকোলজি | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সততাই মহৎ গুণ, সততাই জীবনের মূলমন্ত্র, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ ইত্যাদি বহুল প্রচলিত বাক্যগুলি আমরা সর্বত্র শুনে থাকি। এছাড়াও জনগণকে বলতে শোনা যায় সৎ মানুষজন দেশ পরিচালনা করলে দেশের এমন দুর্দশা হত না। অর্থাৎ সততা এমন এক যোগ্যতা যা দিয়ে সবকিছু জয় করা সম্ভব। এই রচনাটিতে আমরা সততার প্রচারিত দিক এবং প্রয়োগের বাস্তবিক দিক নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করব।

 আমরা যদি কখনও নিজের ভেতরে উঁকি দিই তাহলে দেখব কখন আমরা অপরকে দুঃখ দিয়েছি অথবা দুঃখ দেবার কথা ভেবেছি। যখন সোজা পথে কাজ হয় না কেবলমাত্র তখনই বাঁকা পথ নিতে বাধ্য হয়েছি। একটি কথা আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন ‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করে নিতে হয়’। এর অর্থ মানুষ প্রথমে সোজা আঙ্গুল দিয়ে ঘি বের করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী চলার চেষ্টা করে। তাতে যদি সফল না হয় তখন সংবিধানের বিপরীত পথ ধরে নেয়। সমাজে এইসব ঘটনাগুলিকে আমরা বিভিন্ন অপরাধের নামে জেনে থাকি। মানুষ সর্বকালে এভাবেই জীবন কাটিয়ে এসেছে। প্রথমে মানুষ সংবিধান অনুযায়ী জীবনযাপনের সাধ্যমত চেষ্টা করে। এমনকি সংবিধানের নিয়ম কঠোর হলেও মানুষ প্রথমে সেইমত চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই সময়কালে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়। তারপরও মানুষ চেষ্টা করে যায়। যখন সোজা পথে জীবন অসম্ভব হয়ে পড়ে তখনই বিকল্প পথের সন্ধানে পা বাড়ায়। বলা যায় অপরাধের পথ গ্রহণ করে অগ্রসর হয়ে যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় এছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যেখানে ১,০০০ মানুষের সুখসুবিধা প্রয়োজন সেখানে সুখসুবিধা রয়েছে কেবলমাত্র ১০ জন মানুষের জন্য। যেখানে ১,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান প্রয়োজন সেখানে কর্মসংস্থান রয়েছে কেবলমাত্র ১০ জন মানুষের জন্য। বর্তমান ব্যবস্থা ১০ জনকে কোনও প্রকারে কর্মসংস্থান প্রদান করলেও ৯৯০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের পরিস্থিতির উপর। সিংহভাগ মানুষ কিভাবে বেঁচে রয়েছে সে সম্পর্কে সকলে অবগত। দুর্দশায় জর্জরিত মানুষ তারপরও যেমন তেমন করে দরিদ্রতার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থায়, অসহায় অবস্থায় কয়জন কতদিন সৎ হয়ে থাকতে পারে? প্রেমপূর্ণ মনোভাব কিংবা সততা বজায় রেখে চলতে পারে? হাতে গোনা কিছু মানুষ জর্জরিত অবস্থাতেও অন্যকে প্রতারণা করে না। তারা পরিত্যক্ত অবস্থা, জীর্ণ অবস্থা ভবিতব্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক গঞ্জনা ইত্যাদি চাপে মানুষ প্রতিনিয়ত হয় আত্মহত্যা করে চলেছে নাহয় মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে চলেছে। মনের দিক থেকে চাইলেও কেন সকলে সততা ধরে রাখতে পারে না? কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না? উত্তর হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বারংবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শতভাগ মানুষের উচ্চতর আয়ের সুনিশ্চিত জীবিকার বন্দোবস্ত ব্যতীত শুধুমাত্র সততা বা নৈতিকতা দ্বারা কিভাবে জীবনযাপনের অভাব পূরণ সম্ভব? এইরূপ অসহনীয় অবস্থায় অধিকাংশ মানুষ একটা সময় পর অনৈতিক পথ ধরে নিতে বাধ্য হয়। দেখা যায় সমাজ তাদেরকেই সরাসরি দোষারোপ করে থাকে। সমাজের এই অভিযোগ কি সঠিক বিচার বলে মনে হয়? কয়েকজন লোক মিলে তো সমাজ তৈরি হয় না। সমাজ সকলে মিলে তৈরি হয়। সেখানে শক্তিশালীরা থাকে, দুর্বলরা থাকে, শিশুরা থাকে, মহিলারা থাকে। বলার অর্থ সমস্তপ্রকার মানুষজন থাকে। ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থায় সকলের কাছে নৈতিকতা কিভাবে আশা করা যায়? বরং নৈতিকতাকে একটি সঠিক ব্যবস্থার ‘পরিণাম’ অথবা ‘মাপকাঠি’ হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত। সততা বা নৈতিকতা মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সঞ্চারিত হলে বুঝতে হবে ব্যবস্থা সঠিক রয়েছে। অন্যথায় বুঝতে হবে ব্যবস্থায় কোথাও না কোথাও ত্রুটি রয়েছে। ব্যবস্থা যখন সঠিক হয়ে যাবে পরিণামস্বরূপ নৈতিকতা স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। নৈতিকতা বা অনৈতিকতা কোনও না কোনও ব্যবস্থারই পরিণাম। ব্যবস্থা ভাল হলে নৈতিকতা আপনিই চলে আসবে। জোর করে নিয়ে আসতে হবে না। বর্তমান ব্যবস্থা একইরকমভাবে চলমান থাকলে এটি নিশ্চিত যে ৯৯০ জন সুখসুবিধা থেকে সর্বদা বঞ্চিতই থাকবে। নিঃস্ব মানুষকে, বঞ্চিত মানুষকে, অসহায় মানুষকে কোন নৈতিকতার পাঠ পড়াবেন? 

তাকে পুনরায় কি ত্যাগ করার উপদেশ দেবেন? অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী নৈতিক ও মানবিক বলেই তারা বঞ্চিত, নিঃস্ব। মানবিকতা বা নৈতিকতা কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা নয় যা দিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু-পরিষেবা ক্রয় করা যায়। ব্যবস্থা একদিকে সুযোগসুবিধা রেখেছে মাত্র ১০ জনের জন্য। অপরদিকে উপদেশের বাণী শোনাচ্ছে সৎ হতে হবে, নৈতিক হবে হবে, মানবিক হতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন মনোভাব রাখতে হবে। যেখানে পূর্বেই অনুমান করা যাচ্ছে ৯৯০ জন অসফল হবেই, প্রতারিত হবেই। এইরূপ অমানবিক ও অসম্পূর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির সততা বা নৈতিকতাকে দোষারোপ করা যায়? দোষ তাহলে কোথায় রয়েছে? ব্যক্তির যোগ্যতায় নাকি অযোগ্য ব্যবস্থায়? সংশোধন কিসের প্রয়োজন? ব্যক্তির নাকি ব্যবস্থার? ১,০০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনই যোগ্য এই সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক? শুধুমাত্র যোগ্যতার মনোবলও কি ১০ জনের তালিকায় প্রবেশের পক্ষে যথেষ্ট? অসম্পূর্ণ ব্যবস্থায় যারা বাধ্য হয়ে কৌশল অবলম্বন করবেন তাদের অমানবিক বলবেন নাকি ব্যবস্থাকে অমানবিক বলবেন? ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সংশোধন প্রয়োজন নাকি অসম্পূর্ণ ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন? ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেখানে শতভাগ মানুষের জন্য সুযোগ-সুবিধা সর্বদা সুনিশ্চিত থাকবে। বিষয়টি ব্যক্তিগত নয় সামাজিক। সমাজকেই নতুন করে চিন্তন-মনন করতে হবে।

যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কৌশল অবলম্বন করে, মেধা-অর্থ-শ্রম-শক্তি ব্যয় করে সম্পদশালীদের মধ্যে যায়গা করে নিয়েছেন তারাও সর্বদা এই ভেবে ভয়ে ভয়ে থাকেন যেকোনও সময় বঞ্চিতরা দল বেঁধে অর্জিত সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারে। কারণ বর্তমান ব্যবস্থা সকলের জন্য সুযোগ-সুবিধা বা সম্পদের সুরক্ষিত বন্দোবস্ত করতে পারেনি। এমনকি বর্তমান দর্শনও মানুষের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন এমন সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট করে রেখেছে। নিঃস্ব, অসহায়, পরিত্যক্তদের কথা ছেড়েই দিন, যাদের দখলে কিছু না কিছু রয়েছে তারাও সর্বদা ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। 

এই প্রকার অস্পষ্ট দর্শন এবং অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকলে নিশ্চিন্তের জীবন হবে এমনটি কিভাবে আশা করা যায়? কঠোর সংগ্রাম কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে যে সামান্য কিছু মানুষ সুখসুবিধা অর্জন করেন কিংবা সমাজের চোখে তথাকথিত সফল বলে পরিচিত সেইসব মানুষজনও অর্জিত সম্পদ ঠিকমত উপভোগ করতে পারে না। কেননা তারা এই ভেবে সর্বদা দুশ্চিন্তায় থাকে কি জানি এই সুখ-সুবিধা কতদিন আমাদের কাছে থাকবে। কবে কে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে কে জানে। কেননা বহু মানুষ লুণ্ঠনের চেষ্টায় প্রচেষ্টারত রয়েছে। কি জানি কখন তারা সফল হয়ে যায়। পরিবারের কাউকে অপহরণ না করে ফেলে। আত্মীয় বন্ধুদের উপরও সর্বদা সন্দেহ থাকে এই ভেবে কে কখন প্রতারণা করে ফেলে। কিংবা মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যেতে হয়। যে কারণে নিকটজনের সম্পর্কও একরকম সন্দেহজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলে। যেটুকু সুখসুবিধা তাদের কাছে থাকে সেটুকুও ভয়ে ভয়ে উপভোগ করতে হয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত এটিই বেরিয়ে আসে পেয়েও অসুখী জীবন না পেয়েও অসুখী জীবন। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা আবশ্যক যাদের কাছে সম্পদ রয়েছে তারাও যেন সুরক্ষিত জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখ উপভোগ করতে পারে এবং যাদের কাছে কিছুই নেই তারাও যেন সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়ে সুখী জীবনযাপন উপভোগ করতে পারে। 


সীমিত সুযোগ-সুবিধা দখল করতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা পিছিয়ে পড়ে তাদের বহু উপমা দ্বারা ভূষিত করা হয়। বাস্তবে কেউই অলস অবস্থায় কিংবা অদক্ষ অবস্থায় পড়ে থাকতে চায় না। কেউই অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। প্রতিটি মানুষ আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীন জীবনযাপন উপভোগ করতে চায়। পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও জীবিকার বন্দোবস্ত পেতে চায়। সকলেরই কোনও না কোনও বিষয়ে রুচি রয়েছে, মেধা রয়েছে। এমনকি পছন্দের কর্ম সম্পাদনেও আনন্দ আছে। সকলেই সেই আনন্দ উপভোগ করতে চায়। সুতরাং শতভাগ মানুষের সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত না করে কাউকে অলস, অনৈতিক ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা আদৌ যুক্তিযুক্ত? এমনতর অবস্থা কি সততা বা নৈতিকতার অভাবের কারণে ঘটে চলেছে? অসম্পূর্ণ ব্যবস্থাই একমাত্র দায়ী নয় কি? অনেকে পূর্বজন্মের কর্মফলকে দায়ী করেন এবং মানুষের মধ্যে জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তি রয়েছে এমনটি মনে করেন। প্রথমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক একটি শিশু পৃথিবীতে পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ে আসে নাকি নিষ্পাপ অবস্থায় আসে। সে কি পূর্বজন্মের পাপ বয়ে নিয়ে আসে নাকি শুদ্ধ অবস্থায় আসে। নিজেদের পরিবারের সন্তানদের দেখে কখনও এমন মনে হয়েছে তাদের মধ্যে জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তি রয়েছে? নাকি প্রতিটি শিশু নিজের পরিবার, পরিজন, পরিবেশ, বাহ্যিক অবস্থা-ব্যবস্থা যেমন তেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে শেখে এবং সেই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করে থাকে? তাহলে বাহ্যিক অসম্পূর্ণ অবস্থা-ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন নাকি নিষ্পাপ মনের? তথাকথিত এই সিদ্ধান্তটি প্রচলিত আধ্যাত্মিক জগতের ভ্রান্ত ধারণা নাকি সঠিক সিদ্ধান্ত? এ বিষয়ে পুনরায় বিবেচনা করা উচিত নয় কি? গবেষণা-অনুসন্ধান-আলোচনা-পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তই উঠে আসবে বাহ্যিক অবস্থা-ব্যবস্থার রূপান্তর আবশ্যক। যে কারণে ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এবার অপরাধের বিষয়টি নিয়ে সামান্য পর্যালোচনা করা যাক। একজন অপরাধীর ক্ষেত্রে সমাজ এই আশা করে সে যেন সঠিক শাস্তি পায়। ধরুন শাস্তি পেয়ে জেলবন্দি বা ফাঁসি হল। উপদেশ হিসেবে প্রচারও করা হল আর কেউ যেন অপরাধ না করে। করলে ওইরকম শাস্তি পেতে হবে। এতেই কি সব মিটে যায়? সমাজ কি অপরাধ মুক্ত হয়? অপর কেউ একইরকম অপরাধে লিপ্ত হয় না? যারা অপরাধ করে তারা কি জানে না ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি হবে কিংবা মৃত্যুও হতে পারে? তারপরও মানুষ কেন অপরাধে লিপ্ত হয়? কোন প্রবৃত্তি তাকে অপরাধের পথে প্রেরিত করে? কেন প্রেরিত করে? সেই প্রবৃত্তি কি অপরাধী জন্মজাত নিয়ে আসে? নাকি সমাজ থেকে গ্রহণ করে? তাহলে সমস্যা কি মনুষ্যের অভ্যন্তরে রয়েছে নাকি সমাজের মধ্যে রয়েছে? আপনারা যেকোনও একটি সমস্যা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারবেন প্রতিটি সমস্যা সরাসরি ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত।


সুতরাং বিষয়টি প্রথমত দর্শনগত, তারপর ব্যবস্থাগত। এটি নিশ্চিত মানুষের অভ্যন্তরে কোনও সমস্যা নেই। বাহ্যিক পরিস্থিতিই ধাপে ধাপে বাধ্য করে অনৈতিকতার পথে ঠেলে দেয়। যদিও বাস্তবে সামান্য কিছু মানুষ আছেন যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনৈতিক পথ গ্রহণ করেন না। তারা সমস্ত দুঃখ সহ্য করে চলেন। সৎ, মানবিক, নৈতিক মানুষের জীবন পরিত্যক্ত হবে, অসহায় হবে, জীর্ণ হবে এটিই বা কি প্রকারের বিধান? তাদের কি সুখসুবিধার প্রয়োজন নেই? দেখা যায় সৎ মানুষকে অধিক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়। তাদের পরিবারের সদস্যরাও এমন কষ্টের জীবন চায় না। নীতিবান মানুষদের বাড়ি গেলে দেখা যায় তাদের পরিবার কত দুঃখে রয়েছে। তাদের আত্মীয় পরিজনরাও এইসব নীতিবান মানুষদের তিরস্কার করতে থাকে। শিক্ষা, জীবিকা, সুখসুবিধার বন্দোবস্ত না হলে সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতা দ্বারা বাস্তবিক চাহিদার অভাব পূরণ কিভাবে সম্ভব হবে? মূল কথা সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতা কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা নয় যা দিয়ে সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন সম্ভব। নিষ্ঠাবান, নীতিবান হয়ে আজীবন দুর্দশার জীবন ধারণ করে প্রাণ ত্যাগ করাও যেমন সঠিক বিধান নয় তেমনই সম্পদ অর্জন করে অসুরক্ষিত জীবনযাপনও সঠিক বিধান নয়। আবার ব্যবস্থা যেমন তেমন নির্মাণ করে জনতা ভাল হলে ব্যবস্থা ভাল হবে এবং জনতা মন্দ হলে ব্যবস্থা বিফল হবে এটিও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। মানুষকে বাধ্য হয়ে অসম্পূর্ণ ব্যবস্থার নীতিকে মেনে নিতে হবে এটিও সঠিক বিধান নয়। মানুষ অন্তরে যেমন বাহ্যিক জগতের ব্যবস্থাও তেমন হওয়া উচিত। জাতি, ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি, মূর্খ, জ্ঞানী, দরিদ্র, বিত্তশালী সকলকে প্রথম সারিতে রেখে ব্যবস্থা নির্মাণ করা উচিত। এমন ব্যবস্থা আবশ্যক যেখানে প্রতিটি মানুষের সমৃদ্ধশালী জীবন আজীবন সুরক্ষিত থাকবে। মানুষ সমৃদ্ধশালী হলে, সুনিশ্চিত হলে, সুরক্ষিত হলে পশু-পক্ষী-জলবায়ু-প্রকৃতি ইত্যাদি দিকগুলিকেও সুরক্ষিত করা সম্ভব হবে। তবেই বাস্তবিক স্বাধীনতা তথা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে। 


উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তই বেরিয়ে আসে যে, সকলের মিলিত উদ্যোগে বাস্তবিক জীবনের সাথে সমন্বয় রয়েছে এমন কোনও দর্শনকে বিকিশিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। আমাদের কাছে সমস্ত প্রকার সুখ উপভোগের জন্য সঠিক বন্দোবস্ত থাকলে কেউই অনৈতিক পথ নির্বাচন করত না। কারোর কিছু হারানোর ভয় থাকতো না এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোপন অভিসন্ধি ইত্যাদির আশ্রয় নেবার প্রয়োজন হতো না। সকলের কাছে সমস্তরকম সুখসুবিধা বরাবর সুনিশ্চিত থাকতো। আমরা সকলে মিলেমিশে সম্পূর্ণরূপে সুখী জীবন উপভোগ করতাম। এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান তত্ত্ব আমাদের কাছে এসেছে। দিল্লী নিবাসী দার্শনিক প্রেমজিৎ শিরোহী মহাশয় দীর্ঘ গবেষণা-অনুসন্ধান-পর্যালোচনার পর এমন এক দর্শন এবং এমন এক ব্যবস্থা জনগণের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন যার দ্বারা সকল প্রকার সুখসুবিধা সকলের জন্য স্থায়ীরূপে বন্দোবস্ত করা সম্ভব হবে। ULM সংস্থা এই নতুন ব্যবস্থার রূপরেখাটিকে বিভিন্ন মাধ্যমে সমাজের কাছে প্রচার করে চলেছে। এই ব্যবস্থায় মোট ছ’টি মডেল রয়েছে। নতুন অর্থনীতি, নতুন রাজনীতি, নতুন সামাজনীতি, নতুন শিক্ষানীতি, নতুন পরিবারনীতি ও নতুন জীবন দর্শন। “সম্পূর্ণ সমাধান – এক নতুন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থব্যবস্থার রূপরেখা” ও “সম্পূর্ণ জীবন দর্শন – এক নতুন দর্শনশাস্ত্রের রূপরেখা” নামক পুস্তকে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। দুটি পুস্তকের ইবুক সকলের জন্য বিনামূল্যে অর্পণ করা হয়েছে। অনলাইন-অফলাইন মাধ্যমে কাগজের পুস্তকও উপলব্ধ রয়েছে।

এবার একটিই কর্ম অবশিষ্ট রয়ে যায় তা হল এই ব্যবস্থাটিকে অধ্যয়ন করে বুঝে নেওয়া ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে স্পষ্ট হওয়া। যেকোনও তত্ত্ব প্রয়োগের পূর্বে তত্ত্বগত দিক দিয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া আবশ্যক। এই সমাধান সঠিক বলে বিবেচিত হলে সমাজের উচিত দ্রুত এই ব্যবস্থাটিকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সরকারি স্তরে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস শুরু করা। আমরা জানি চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী জনগণ যে নীতিকে চাইবে তাই প্রতিষ্ঠিত হবে। জনসাধারণের উচিত এই ব্যবস্থাটিকে সার্বিকভাবে যাচাই করে নেওয়া। যেমন এই ব্যবস্থা নিজের ও পরিবারের সমস্ত সমস্যার সমাধান কিভাবে করবে, বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, মধ্যবিত্ত ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, সকলের অর্থনৈতিক চাহিদা কিভাবে পূরণ করবে, মুদ্রা কিংবা মুল্যাংকনজনিত সমস্যা কিভাবে নির্মূল করবে, আর্থিক দুর্নীতির সমস্যাটি কিভাবে নির্মূল করবে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনের সমস্যাটি কিভাবে সমাধান করবে, জনগণ এবং সাংবিধানিক প্রতিনিধিদের মধ্যে সামঞ্জস্য কেমন থাকবে, বিপক্ষে রায় দেবার কোনও কারণ অবশিষ্ট থাকবে কিনা, এই ব্যবস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, কারা প্রতিষ্ঠা করবে, কবে প্রতিষ্ঠিত হবে ইত্যাদি। যদিও ‘সম্পূর্ণ সমাধান’ পুস্তকে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব, আলোচনা, চিন্তন-মনন ইত্যাদির জন্য ULM Bangla, ULM Hindi সহ অন্যান্য ভাষার ইউটিউব চ্যানেলে অনলাইন মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। আপনারা যে স্থানে রয়েছেন সেই স্থান থেকেই অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হতে পারবেন। ইতিমধ্যে বহু বিষয়ে আলোচনার অডিও-ভিডিও উপস্থাপন করা হয়েছে। সেসবও দেখে নিতে পারেন। বিষয়টি সামাজিক। তাই সিদ্ধান্তের বিষয়টিও সমাজের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আপনাদের অংশগ্রহণ ও মতামত বিনিময় সমাজের সুখের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যে দেশ এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করবে সেই দেশের সকল নাগরিক ৫ বছরের মধ্যেই সমস্ত প্রকার সুখের অধিকারী হবে এবং অবিরত সকল প্রকার সুখ পেতে থাকবে। এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে গতানুগতিক বিপ্লব, আন্দোলন, সংঘর্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদির প্রয়োজন না পড়বে না। সকলের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, সমস্ত প্রকার সুবিধাযুক্ত আবাস, যাতায়াত, নিত্যদিনের বস্তু-পরিষেবা, ভ্রমণ-বিনোদন, সমস্ত প্রকার সামাজিক সুখসুবিধাসহ সকল প্রকার নিরাপত্তা স্থায়ীরূপে সুনিশ্চিত থাকবে। সমগ্র বিশ্ব এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করলে প্রতিটি দেশের নাগরিক সকল প্রকার সুখসুবিধা সহজেই উপভোগ করতে পারবে। সমস্ত দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদের আদান প্রদান সহজ হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের অবসান ঘটবে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও লড়াই, দাঙ্গা কিংবা অরাজকতার সমস্যা উৎপন্ন হবে না। যুদ্ধ সামগ্রীতে বিনষ্ট হওয়া বিপুল সম্পদ মানুষের সুখসুবিধা বৃদ্ধির কাজে লাগবে। সুখসুবিধা পেতে আর অর্থের প্রয়োজন পড়বে না। এই ব্যবস্থার নতুন অর্থনীতি অনুযায়ী সকলে অর্থ ছাড়াই সরকারীভাবে সবকিছু পেতে থাকবে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে অনেকে সম্পূর্ণ সমাধান ব্যবস্থার তত্ত্বকে সমাজবাদ এবং সাম্যবাদের সাথে তুলনা করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘সম্পূর্ণ সমাধান’ এবং ‘সম্পূর্ণ জীবন দর্শন’ পুস্তক দুটি গভীরভাবে অধ্যয়নের পর তারা বুঝতে পারেন এই তত্ত্ব অন্যান্য তত্ত্বগুলির তুলনায় মূল স্থানেই পৃথক। দর্শনের তত্ত্বগত সিদ্ধান্ত পৃথক, জীবনের উদ্দেশ্যজনিত ব্যাখ্যা পৃথক, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পৃথক, রাজনৈতিক পরিকাঠামো পৃথক, রূপান্তরজনিত প্রক্রিয়া পৃথক ইত্যাদি। এর অর্থ এই নয় পূর্বের যা কিছু সঠিক রয়েছে তা বর্জন করা হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ সমস্ত প্রকার সামাজিক সুখসুবিধা প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা বরং এই তত্ত্বকে ‘ব্যক্তিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করতে পারি। কারণ এই ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি সরাসরি ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত। অপর কোনও ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী সুস্থ্য নারী-পুরুষের যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী একটি জীবিকা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের জন্যও সমস্ত সুযোগ সুবিধার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি মানুষের জন্য কোনও প্রকার কর্ম সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সমস্ত প্রকার সুখসুবিধা স্থায়ীরূপে বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ব্যবস্থায় কাউকেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে কাউকেই গোপন অভিসন্ধির আশ্রয় নিতে হবে না। পারিবারিক অশান্তি স্থায়ীরূপে নির্মূল হবে এবং সকলের সাথে সমস্ত সম্পর্ক স্থায়ীরূপে মধুর থাকবে। নতুন ব্যবস্থা বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত পুস্তক, অডিও-ভিডিও, বুকলেট, আর্টিকেল ইত্যাদি উপলব্ধ রয়েছে। বিষয়টি সামাজিক এবং জনগণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত। আলোচনা এবং মতামত আদান প্রদানের জন্য সকলে আমন্ত্রিত। ধন্যবাদ।

ইমেল- ulmbangla@gmail.com

ইউটিউব চ্যানেলে ও ফেসবুক পেজ- ULM Bangla

একশো দিনের কাজের প্রয়োজনীয়তা -দিলীপ দাস মণ্ডল
May 19, 2025 | সমাজ | views:4 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একশো দিনের কাজ সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব রক্ষার এবং গরীবদের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণের সবচেয়ে সেরা হাতিয়ার। এই প্রকল্পকে বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উপরের সব শ্রেণী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা অপরের শ্রমের স্বত্বভোগ করে জীবন চালায় তারা। এই শ্রেণীগুলীর লোক কিন্তু মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অনেক কম। অর্থাৎ যারা একশো দিনের কাজের সুফল লাভ করবে তারা সমাজের অর্ধেকের বেশি হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় এই প্রকল্প রক্ষার ব্যাপারে সতর্ক হয় না এবং কখনও কখনও যারা প্রকল্প বন্ধ করতে চায় তাদের সমর্থন করে ফেলে প্রকৃত কারণ না বুঝেই।


প্রকল্প বন্ধ করবার জন্য যে কারণগুলো দেখায় সেগুলোর মধ্যে (1) শ্রমিকরা কাজ করে না, বসে বসে টাকা নেয়। (2) জবসিটে ভুয়ো কর্মী নথিভুক্ত করে দুর্নীতি হয়। (3) পাটিবাজী হয় এবং ক্ষমতাধারীরা বিরোধীদের জব থেকে বঞ্চিত করে। (4) যে-কোন সরকারী কাজের মধ্যে থেকে যে সকল কাটমানি বের করার ফন্দি- ফিকির আছে সেগুলো কার্যকর হয়।

দুর্নীতি দুর করার জন্য যা করবার তার ব্যবস্থা নিতে হবে কিন্তু কয়েকজন দুর্নীতিকারীর জন্য তাদের বহুগুণ বেশি শ্রমিককে কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ১০০ দিনের কাজে বর্তমানে (05/08/2022) দৈনিক মজুরি 200 টাকার মত। আর সরকারী পার্মানেন্ট চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা মাসে গড়ে কমপক্ষে 32000 টাকা আয় করে (P.F. বোনাস ইত্যাদি ধরে)।বছরের মধ্যে বিভিন্ন ছুটি বাদ ধরে সর্বোচ্চ 240 দিনের বেশি এরা কাজ করে না, অর্থাৎ মাসে 20 দিন কাজ করে। এদের দৈনিক মজুরি কমপক্ষে (32000÷20)= 1600 টাকা। অর্থাৎ ১০০ দিনের কাজের মজুরির (1600 ÷200)= 8 (আট) গুণ। এরা ১০০ দিনের কর্মীদের আট গুণ কাজ করে কি?

আর এই শ্রেণীর লোকেরাই সবচেয়ে বেশি গসিপ করে সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সবচেয়ে নিচু শ্রেণীর লোকের আয়ের রাস্তা বন্ধ করবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এদের সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারাও এদের সমর্থন করে প্রচার করছে যাতে ১০০ দিনের প্রকল্প ভালভাবে সমাজে কার্যকর না হয় তার লক্ষ্যে।

সমাজের শ্রমিক, কৃষক (বামুন চাষী ছাড়া), মজুর, ঝি, চাকর, কন্ট্রাক্টরের লেবার ইত্যাদি শ্রেণী যারা দৈনিক 200 টাকার থেকে কম বা অল্প কিছু বেশি পর্যন্ত আয় করতে পারছেন তারা সকলে মিলে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে একটি আন্দোলনে রূপান্তর করুন এবং যারই এই প্রকল্পে কাজ করার দরকার সেই যাতে এই কাজ পেতে পারেন তার চেষ্টা চালান এবং প্রশাসনকে এই কাজ দিতে বাধ্য করুন।


মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা তার চাষ বা ছোট ব্যবসার জন্য অল্প কিছু কর্মীকে কাজ দেয় তাদের প্রায় সকলেই ১০০ দিনের কাজের বিরোধী। কারণ (1) তারা ফাটকা কর্মীর অভাব অনুভব করে। (2) তারা নিজের মর্জি মত শ্রমিকের রোজ (দৈনিক মজুরি) চাপিয়ে দিতে পারে না। (3) তারা নিজের মত করে সবচেয়ে দক্ষ এবং সক্ষম মজুর পায় না। (4) শ্রমিকদের চাপ সৃষ্টি করে বেশি সময় ধরে কাজ আদায় করতে পারে না। এই সকল কারণ ছাড়া আরও অনেক কারণ থাকতে পারে ১০০ দিনের কাজের বিরোধী মানসিকতাধারীদের।

১০০ দিনের কাজের বিরোধীদের মানবিকতা এমন তলানিতে পৌছে গেছে যে, সেই সব মানুষরা যারা ১০০ দিনের কাজ করে (দৈনিক 200 টাকা মজুরিতে) যা হোক করে খাওয়া, পরা চালাচ্ছে, তাদের সেটুকুও বন্ধ করবার চেষ্টা করছে।

যারাই দৈনিক 200 টাকার উপরের আয়ের মত কাজ পাচ্ছেন না তারা সকলেই এককভাবে বা মিলিতভাবে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের কাছে জানান যে আপনার ১০০ দিনের কাজ দরকার। ভোটের সময় যখন ভোট ভিক্ষা করতে আসে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা তখন আপনাকে যাই সূযোগ করে দেবার কথা বলুক না কেন তখন আপনি অবশ্যই আপনাকে ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড করে দেবার এবং প্রকৃতই ১০০ দিন কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি ক্যাডারের কাছে আদায় করে নেবেন। আপনি জানবেন আপনার মত ১০০ দিনের কাজ পেতে ইচ্ছুক সমাজের কোটি কোটি মানুষ, যে সংখ্যাটা যত লোক সরকারি চাকরি করে সেই সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

যখন সকল ১০০ দিনের কাজের কর্মী মিলিতভাবে রাজনৈতিক দলের কাছে আর্জি জানাবে আর রাজনৈতিক দল আপনাদের আন্দোলনের প্রকাশ অনুভব করবে তখন সত্যি সত্যিই আপনাদের জন্য ১০০ দিনের কাজ সক্রিয় রাখতে বাধ্য হবে। মনে রাখবেন যারা আপনার কাছে ভোট চাইতে যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। এদের বেশীভাগ লোকই কিন্তু মনে মনে চায় না ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু থাকুক। আপনার সোচ্চার চাওয়াটাই ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু রাখতে বাধ্য করবে।

আশীর্বাদ ও অভিশাপ -তন্ময়
May 19, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আশীর্বাদ ও অভিশাপ শব্দদুটির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, আশীর্বাদেও কারও  হিতসাধন হয় না, অভিশাপেও কোনও ক্ষতিসাধন হয় না, তবুও শব্দদুটি মানবসমাজে বহুল প্রচলিত। 

বস্তুনিষ্ঠ বা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাহীন, তথ্যভিত্তিক প্রমাণাদিহীন, অলীক কল্পনাজনিত ভাববাদী ধ্যানধারণা প্রসূত এই শব্দদ্বয় আমাদের পাঠ্যক্রমেরও অন্তর্ভুক্ত।

আমরা প্রায় প্রত্যেক্যেই বাংলা বা ইংরাজি ভাষায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ রচনাটি পড়েছি। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে এই বাক্যবন্ধটির বিশ্লেষণ করলে বাক্যবন্ধটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে।

অনেকে বলতেই পারেন, বাক্যবন্ধটিতে  ‘হিতকর’ এবং ‘ক্ষতিকর’ অর্থে ‘আশীর্বাদ’ ও ‘অভিশাপ’ শব্দদুটি ব্যবহার করা হয়েছে, অন্যকোনও উদ্দেশ্য নেই।

আমি বলব, তাও যদি হয় সেটাও ভুল এবং অবশ্যই উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য হল প্রকৃত সত্য থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া।

বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার কার্যকরী নিয়মগুলি জানার অভিযানই হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞান কথার অর্থ পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ দ্বারা নির্নীত ও শৃঙ্খলিত বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞান সদা জিজ্ঞাসু, সত্যসন্ধানী এবং মূলত নৈর্ব্যক্তিক।


তাই বিজ্ঞান নয়, রাষ্ট্রের ভুমিকার পর্যালোচনা করতে হবে, বিজ্ঞানীদের ভুমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন গরীব ও প্রান্তিক মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়াতে সদর্থক ভূমিকা পালন না করে যদি নানা রকম অসুবিধা ও দুর্ভোগের সৃষ্টি করে তবে তার দায় রাষ্ট্রের, বিজ্ঞানের নয়। বিজ্ঞানীরা যদি সামাজিক দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে কর্পোরেটদের হাতের পুতুল হয়ে সমাজের ক্ষতিসাধন করেন তবে তার দায় বিজ্ঞানীদের, বিজ্ঞানের নয়।


তাই, “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” কথাটাই ভুল। বিজ্ঞান হল গবেষণালব্ধ _জ্ঞানভাণ্ডার। সেই জ্ঞানভাণ্ডারে ডুব দিয়ে কে কোন উদ্দেশ্য সাধন করবে তার দায়দায়িত্ব বিজ্ঞানের ওপর চাপানো হবে কেন?

CIE ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ ঔপনিবেশিক শিক্ষার আদর্শ -স্বপন জানা
May 19, 2025 | জীবনী | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(প্রথম পর্ব) 

  জনৈক চিকিৎসক বন্ধু বলছিলেন, আমার ডাক্তার হওয়ার পেছনে মূল কারণ যন্ত্রণাময় ও আভিজাত্যহীন কৃষক জীবন থেকে পালিয়ে আসা। ১৯৭০-৭২ সালে  কৃষক জীবনের অনাহার, অভাব, অনটন, বঞ্চনা,  অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ছিল গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসার চালিকা শক্তি। যে ভাবে হোক চাকরি চাই! আরামের জীবন চাই! মা, বাবা, দাদু, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী সবার আকাঙ্খা পূরণ করার তাড়না আমাকে পেয়ে বসেছিল। হঠাৎ ডাক্তারী তে সুযোগ পেয়ে গেলাম! আজও লেখাপড়া জানা যুবক-যুবতীরা চাকরির সন্ধানে শহরমুখী!

    বন্ধুটি আরও বললেন,  “লেখাপড়া শেখে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে” -বিদ্যাসাগরের লেখা পড়ে আমার আকাঙ্খার জন্ম হয়নি। সেদিনের  সমাজিক  ব্যবস্থাপনা থেকে  এ শিক্ষা (কৃষক জীবন  থেকে পলায়ন)  আমার মস্তিষ্কে অন্তঃসলিলার মতো ঢুকে গিয়েছিল। পড়াশুনা আমাকে করতেই হবে।

            কোন বিষয়ে নম্বর কম পেলে বাবা বলতেন “শালা পড়াশুনা করবে না, সারাজীবন লাঙ্গল ঠেলবে”। বাবার এই সাবধান বাণীতে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ছিল ঠিকই, সাথে ছিল কৃষক জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, অশ্রদ্ধা ও এক প্রচ্ছন্ন ঘৃণা। এখান থেকেও আমি কৃষক জীবন থেকে পালিয়ে আসার রসদ নিয়েছি।

       ডাক্তার হয়ে ওঠার প্রাক্কালে  সবাই আমার নামের শেষে ‘বাবু’  শব্দ যোগ করে ডাকতেন। সুদিন বাবু! সেদিন এক ধরনের আনন্দ পেয়েছিলাম। আর আজ, লজ্জায় মাথা নত আসে।  ‘ডাক্তারী বুদ্ধির’  খাবারটা  আমাকে বাবু বলে ডাকা মানুষদেরই  যোগানো। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাছে ওই অন্নদাতা কৃষকরা ব্রাত্যই রয়ে গেলেন। আজও দেশে এমন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়নি যেখানে  অন্নদাতা কৃষকের চিকিৎসা ভালোভাবে দেওয়া যায়। সবার আগে দেওয়া যায়। আজও এই অন্নদাতা-বিরোধী  সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান!  

    ‘সিআইই’ ‘বিদ্যাসাগর’ তাহলে কি করলেন?  

ভারতবর্ষ কৃষক ও কারিগরের দেশ। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যুগ তো বটেই, আজও তাই। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণ পরিচয়’ বই  খুঁজেও কৃষক, কামার, কুমোর ও তাঁতী, ঘরামী শব্দ গুলো আপনি  পাবেন না।


(দ্বিতীয় পর্ব)

            স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন (জন উদ্যোগের সমাহার গণ আন্দোলনের কন্ঠস্বর)। নবম বর্ষ। নববর্ষ সংখ্যা। বৈশাখ ১৪২৬। এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যার,  বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি তে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) সম্পর্কে লিখেছেন, “কেউ তাঁকে দেবতার উপরে স্থান দিয়েছেন,কেউ তাঁর মূর্তি ভেঙেছেন। কিন্তু নিরুত্তাপ একরোখা এই আটপৌর বাঙালি পন্ডিত সমগ্র জাতির উপর ছাতা মেলে দীর্ঘ আলপথ ধরে এগিয়ে চলেছেন।” 

         এতো ইন্দ্র মিত্র এর কথার প্রতিধ্বনি – “বিদ্যাসাগরের এই মানব বিদ্বেষ, মনে হয়, তাঁর অসামান্য মানব প্রেমেরই ফল।” 

        দুশো বছর পরে আজও আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক ভারতবর্ষে  বিদ্যাসাগরের আদর্শ খণ্ডহর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

         কি দাঁড়ালো তাহলে? 

     ‘মূর্তিভাঙ্গার  কাজ’ আর ‘দেবতা বানানোর কাজ’ এই দুয়ের  মধ্যে কোনটা সমাজকে দিয়েছে গতি বা চালিকা শক্তি? মনে রাখতে হবে  মূর্তি গড়ার কাজ আগে হয়েছে।  পরে  অন্যেরা  মূর্তি ভেঙেছে। দুটোই কি সমাজের কাছে প্রগতিশীল? না।  সমাজ বিজ্ঞানে তা  অসম্ভব। সমাজকে কোনটা  সামনের দিকে আর কোনটা পেছনের দিকে চালিত করেছে? 

       বিদ্যাসাগরের  বসানো  মূর্তি  সমাজকে দিয়েছে বঞ্চনা, অপমান, অনাহার, মৃত্যু, বিনা চিকিৎসা, নিরাপত্তাহীনতা  ইত্যাদি।  ভাঙার কাজ সমাজকে দিয়েছে গতি আর মুক্তির নিশানা।

       যে শক্তিতে সমাজের উৎপাদন, নিরাপত্তা, সংস্কৃতি, মানবিকতা  ইত্যাদির উন্নতি  ঘটেছে, সেই শক্তি প্রগতিশীল। চলমান সমাজ যে চলমান প্রকৃতির মতোই গতিময়। তাকে থামানো মুশকিল!  এটাই সমাজে চলমান শ্রেণী সংগ্রামের নিয়ম। 

       চলমান সমাজে রয়েছে  দুই মনোভাব,দুই চেতনা, দুই চিন্তার,  দুই কর্মের লড়াই। দেবতা বানিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ যাঁরা করেছেন তাঁরা একটা পক্ষ  আর সে মূর্তি ভেঙে ফেলার লড়াই যাঁরা করেছেন তাঁরা অন্য পক্ষ। সমাজে সত্যি-মিথ্যে,ন্যায় -অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, জনদরদী- জনবিরোধী, শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, দেবতা-শয়তান, দেশপ্রেমিক-দেশদ্রোহী, প্রশ্নে বিদ্যাসাগর তাঁর সময়কালে  জড়িয়ে ছিলেন। লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ছিলেন। 

        একই সাথে বস্তু বা  মানুষের দুটো গুণই থাকে। কিন্তু প্রধান গুণ দিয়ে  মানুষটির  চরিত্র নির্ধারিত বা বিচার হয়। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই। কোন দিকে থাকাটা জনগণের প্রয়োজন পূরণ করবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্যাসাগরের  জন্ম ও কর্ম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে। ফলে যে কোন মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী হওয়া হচ্ছে ন্যায় সঙ্গত কাজ। দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল  মুক্তি সেদিনের দেশপ্রেমের প্রধান কর্তব্য ও দাবী। অথচ ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন’  লিখছে,”---ব্রিটিশ রাজপুরুষদের কাছে তাঁর ভারতীয় হিসাবে আত্মসম্মান বোধ ও দৃঢ়তা প্রমাণিত”। আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “......তিনি (বিদ্যাসাগর-লেখক) যে সকল ইংরেজ প্রধান কর্মচারীদের  সংস্রবে আসিয়াছিলেন, সকলেরই পরম শ্রদ্ধা ও প্রীতি-ভাজন হইয়াছিলেন”। ব্রিটিশ রাজশক্তির গুণগ্রাহী, নিজে আশীর্বাদ পুষ্ট আর দেশের মানুষের প্রতি  ঘৃণার গরল ভান্ডার নিয়ে দুশো বছর পরেও অনেক বুদ্ধিজীবীর প্রাণের অনবদ্য  রসদ! 

   ব্রিটিশ প্রেমের আর কি বাকি রইল? এরপর ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য  ঈশ্বরচন্দ্রের ‘চটিকাহিনী’  খাপ খায় না। ইংরেজ শাসকের আশীর্বাদ লাভ না হলে ঈশ্বরচন্দ্র  a Companion of the Indian Empire (CIE) in 1877।  CIE উপাধি পান না। 


(তৃতীয় পর্ব)

              ভারতবর্ষ  কৃষিপ্রধান দেশ।  দুনিয়ার কৃষকরাই হচ্ছেন মানব সমাজের অন্নদাতা। ভারতের ব্যাপক কৃষকরা  হচ্ছেন শিক্ষা বঞ্চিত। লেখাপড়া না জেনেই দেশের  কোটি কোটি মানুষের খাবারের যোগানদার তাঁরা। তাঁরা আমাদের মহান অন্নদাতা।

               কৃষকরাই (নারী ও পুরুষ) হচ্ছেন আদি অন্নস্রষ্টা, আদি বিজ্ঞানী, আদি চিকিৎসক, আদি শিল্পী ও কারিগর এবং  আদি যোদ্ধা। মানব সমাজ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চালক শক্তি।

               ঈশ্বরচন্দ্রের কোন ভাবনা ও  কাজ দেশের খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত? কোন কাজ কৃষক তথা অন্নদাতাদের  উৎসাহিত করে? ঈশ্বরচন্দ্রের কোন পদক্ষেপ মানুষের বস্ত্র ও বাসস্থান তৈরিতে সাহায্য করেছে?   

              খাদ্য উৎপাদনের  দক্ষতার উপর  নির্ভর করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানব জাতির ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কৃষকরা কেবল দেশের অন্নদাতার কাজই করেন শুধু তাই নয়, শ্রেষ্ঠ কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে মানব সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। 

             এই কৃষকদের সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের মূল্যায়ণ দেখুন!  “বাল্যবিবাহের দোষ” নিরূপণে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, ‘অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অস্মদেশীয় লোকেরা যে শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যে নিতান্ত দরিদ্র হইয়াছে, কারণ অন্বেষণ করিলে পরিশেষে বাল্য  বিবাহই  ইহার মুখ্য কারণ নির্ধারিত হইবেক সন্দেহ নাই’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী। দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা: ০৩)। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে  সম্মান জানাতে গিয়ে তাঁর  মনের কথা  লিখেছেন, “এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ব বিষয়ে ইহাদের বিপরীত ছিলেন” (রবীন্দ্রনাথ)।  ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যের উদ্দেশ্য যাই হোক দেশের মানুষ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাবের এই রূপরেখা বা চিত্রায়ণ  ভুল ছিল না।

             কি দাঁড়ালো এর অর্থ? এত দেশের আপামর জনসাধারণকে  অসম্মানিত করে ঈশ্বরচন্দ্রের  গুণকীর্তন। যা  দেশের অন্নদাতা  কৃষক ও কারিগর সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের হীন,  অসম্মানকর  মনোভাবের এ এক বিচিত্র বর্ণমালা! 

             যে দেশের তাঁত শিল্পীরা  “সান্ধ্য শিশির” নামের মসলিন বুনতেন, তা কি তাঁদের  যুগ যুগ ধরে  আশ্চর্য্য দক্ষতা ও অপরিসীম মানসিক সামর্থ্যের ফসল নয়? যে কারিগরদের অপরিসীম মানসিক শ্রম ও যুগ যুগ ধরে  অনুশীলনের চিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে দক্ষিণের মন্দির থেকে উত্তরের তাজমহল! তাঁদের শ্রম, দক্ষতা ও শিল্পী মানসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো কে  দেশপ্রেম বলে না! 

               ঈশ্বরচন্দ্রের  বর্ণপরিচয় বইতে চাষী, কৃষক,তাঁতী,কামার, কারিগর, কোদাল, কাস্তে, লাঙ্গল,মই, ইত্যাদি শব্দ গুলো নেই। “বোধদয়”  এর শিক্ষামালা তো “ঔপনিবেশিক শিক্ষা আদর্শ” এর চর্চা ও প্রয়োগ। যা ব্রিটিশ রাজের স্থায়িত্বকাল বাড়িয়ে ছিল।  দেশের মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে ছিলেন 


সৌজন্য: সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি, পশ্চিমবঙ্গ।

৩০ জুলাই ২০১৯। কলকাতা।

ডিরোজিও: যে ঝড়ের পাখিকে প্রয়োজন আজও -অভিষেক দে
May 19, 2025 | জীবনী | views:5 | likes:0 | share: 0 | comments:0

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” গ্রন্থে লিখেছেন- “চুম্বক যেমন লৌহকে  আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও তাঁর বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন”। সেই চুম্বকটির আজ জন্মদিন। উনি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ওনার জন্ম ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯। 

ডিরোজিও একজন ইউরেশীয় কবি, মুক্তমনা চিন্তাবিদ এবং শিক্ষক। তবে দুঃখের বিষয় খুবই অল্পবয়সেই এই তরুণ প্রাণ অকালে শেষ হয়ে যায় কলেরা রোগে (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১)। অনেকেই হয়ত জানেন না, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিশিষ্ট অভিনেতা উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১৯৮২ সালে ডিরোজিয়োর অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর জীবনের শেষ দুই বছরকে ভিত্তি করে “ঝড়” নামক একটি সিনেমা তৈরি হয়। “ঝড়” সিনেমাটির মোট ১২ টি পার্ট আছে।

ডিরোজিও কলকাতার এন্টালি-পদ্মপুকুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও ছিলেন একজন খ্রিস্টান ইন্দো-পর্তুগিজ অফিস কর্মী এবং তাঁর মাতা ছিলেন সোফিয়া জনসন ডিরোজিও। 

ডিরোজিও, ডেভিড ড্রুমন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমি স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছিলেন, যেখানে তিনি ছয় থেকে চোদ্দো বছর পর্যন্ত একজন ছাত্র ছিলেন এবং ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ১৭ বছর বয়সে ডিরোজিও নতুন হিন্দু কলেজের ইংরেজি সাহিত্য এবং ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন।

তখনকার সময়ে ইয়ং বেঙ্গলের তরুণেরা ছিলেন বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। তাঁদেরকে সন্ধ্যা বেলায় জোর করে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে বসে ধর্মগ্রন্থ পড়বার পরিবর্তে হোমার, ইলিয়ডের বই থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করতেন। দেবদেবীকে প্রণাম করার পরিবর্তে বলতেন, ‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম/স্যার। দিনের বেলা লোকজনকে দেখিয়ে গোমাংস ও মুসলিমদের হাতেগড়া রুটি খেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের খাদ্যবিধিতে আঘাত করতেন। হিন্দুদেবী কালীকে নিয়ে ছড়া কাটতেন,  হাতের নাগালে কোনও ব্রাহ্মণ পেলে “আমরা গরু খাই গো” বলে উত্যক্তও করতেন। এভাবে হিন্দুদের জাত্যাভিমানে বা বলা ভালো তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানার জন্য যত ধরনের দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসতো, তার সবটুকুর প্রয়োগ তাঁরা করতেন। 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের অর্থাৎ হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে যে সংগঠন গড়ে তোলেন সেটি, “ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ” নামে পরিচিত। এই সংগঠনের উদ্দ্যেশ্যে ছিল- (১) তরুণপ্রজন্মের মধ্যে যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ ঘটানো। (২) নারীদের উচ্চশিক্ষিত গড়ে তোলা, (৩) সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং জাতপাত ইত্যাদির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা এবং এইসকল বিষয়ে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা ও জিজ্ঞাসু মনন গড়ে তোলা, (৪) স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানো (৫) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ইত্যাদি। এইপ্রসঙ্গে জানাই, ১৮২৮ সালে কলকাতার মানিকতলা এলাকায় “অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে কাজকর্মের জন্যেই।

ডিরোজিও তার মাত্র ২২ বছরের জীবনে এমন বেশকয়েকটি কাজ করে গেছেন যা সত্যি অবাক করার মতন। জীবনে চূড়ান্ত আর্থিক এবং সামাজিক অবরোধের মধ্যে পড়েও তিনি যতদূর এগোতে পেরেছিলেন তা অকল্পনীয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে ডিরোজিও কি সত্যিই যুক্তিবাদী ছিলেন বা ওনাকে কে কি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক বলা যাবে? 

এইপ্রশ্নের উত্তরে কিছু খোলামেলা আলোচনা করা যেতে পারে, যেমন- পৃথিবীতে এমন কেউই নেই যে বা যিনি সম্পূর্ণ দোষত্রুটি মুক্ত। তাই সমালোচনার ঊর্ধেও কেউ নন। কোন মানুষকে সঠিক বিচার করতে গেলে দেশ, কাল, সামান্যই পরিস্থিতি এরূপ বিবিধ বিষয় বিবেচনা করতে হয়।

ডিরোজিও যেসময় জন্মেছিলেন তখন পরাধীন ভারতে সেই সময় কারো পক্ষে কতটুকুই বা বিজ্ঞানমনস্ক বা আরও ভালোভাবে বললে সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব ছিল?তবে ডিরোজিও নিজ সময়ের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তার পারিপার্শ্বিক সমাজে চিন্তা, চেতনার, বিজ্ঞানমনস্কতার এমন এক প্রচন্ড ঝড় তুলেছিলেন যাকে সামাল দিতে বেসামাল হয়েছিল তৎকালীন উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ। এইজন্যই কি তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেন না?  ডিরোজিও ছিলেন খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান

 গির্জা ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিমতের কারণে তাঁর মৃত্যুর পরে পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করতে বাধা দেওয়া হলে গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাকে সমাহিত করা হয়।

ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় গোষ্ঠীর সদস্যগণ ছিলেন  রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র,লালবিহারী দে, মাধবচন্দ্র মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব, কিশোরী চাঁদ মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাধানাথ শিকদার, কাশীপ্রসাদ প্রমুখরা। ডিরোজিওর অকাল মৃত্যুর পরে বহু ডিরোজিয়ান অধঃপতিত হয়ে আবার হিন্দুয়ানী, বাবু কালচারের চোরাস্রোতে ডুবে গিয়েছিল যদিও তার দায় অবশ্য ডিরোজিওর হতে পারেনা। 

এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৮৮২ সালে গড়ে ওঠে “Bengal Theosophical Society” যার সভাপতি হয়েছিলেন একদা ডিরোজিয়ান পন্থী, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী হিসেবে চিহ্নিত প্যারীচাঁদ মিত্র। সংগঠনটির সহ-সভাপতি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর ও শ্যামাশংকর রায় সহ অনেকেই যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আইরিশ রমনী, থিওসফিস্ট আনি বেশান্ত যিনি ১৮৯৩ সালে ভারতে আসেন এবং সাড়াজাগিয়ে প্রেতচর্চা শুরু করেন। 

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল তা ডিরোজিওর মৃত্যুর পরও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সাফল্য ছিল খুবই সামান্য। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে জানিয়েছেন- 

(১) নেতিবাচক ভাবাদর্শ: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সমস্ত কর্মসূচিই ছিল নেতিবাচক। তাঁদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সবকিছু না জেনেই তারা এই ধর্মের বিরোধিতায় উগ্রভাবে সোচ্চার হন। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কেও তাঁদের কোনোও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাদের এই কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য হিন্দুসমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

(২) জনসমর্থনের অভাব: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের আন্দোলনকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারেননি। ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর ইয়ং বেঙ্গল মতাদর্শের কোনোও প্রভাব পড়েনি।” অভিজাত পরিবারের শহরের কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল।

(৩) সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর অনেকেই ইংরেজ কোম্পানির সহযোগী হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা অতিবাহিত করেন। সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিকের সঙ্গে তাঁদের কোনোও যোগাযোগ ছিল না।

(৪) উগ্রতা: ইয়ং বেঙ্গল গ‌োষ্ঠীর সদস্যদের উগ্র ও অতি বিপ্লবী কার্যকলাপ সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাই কলকাতার এলিটিস্ট সমাজে এবং পত্রপত্রিকার মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাঁদের ভ্রান্ত পুঁথি-পড়া বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন।

(৫) দরিদ্রদের প্রতি উদাসীনতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী দেশের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট কৃষকদের দুর্দশা এবং কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে দরিদ্র সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করার কোনোও উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি।

(৬) মুসলিম-বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শুধু হিন্দু সমাজের সংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত ছিল। মুসলিম সমাজের সংস্কার নিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যরা কোনোও চিন্তাভাবনা করেননি।

(৭) সংস্কারবিমুখতা: ডিরোজিওর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীদের অনেকেই সংস্কারবিমুখ হয়ে সংস্কার কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যাবসায় মনোযোগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টর এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। 

পরিশেষে জানাতে চাই, এই ক্ষণজন্মা মানুষটির আজ বড়ই প্রয়োজন। যে ঝড়ের বেগে আসবেন এবং ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিয়ে যাবে সমস্ত অন্ধভক্তি, উগ্রদ্বেষপ্রেম, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, জাতপাত, বিদ্বেষের রাজনীতি। আজ বিশ্বজোড়া অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা সংঘর্ষ খুবই জরুরি। তারপরেই হবে নির্মাণ, একটা সুস্থ, সুন্দর সমাজের। 

বহিষ্কৃত ছাত্র ও শিক্ষককুলের অধোগতি -অনির্বাণ পাত্র চৌধুরী
May 19, 2025 | শিক্ষা | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের একটি বিদ্যালয়ে একটি ছাত্রকে (মুস্তাকিন সাহা) বহিষ্কার করা হল। সোশ্যাল মিডিয়াতে  ভীষণ ভাবে ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিও, সেখানে দেখা যাচ্ছে ছেলেটির উদ্ধত আচরণ। ছেলেটি তর্ক করছে শিক্ষক মহাশয়ের সাথে। ছেলেটি দেরি করে বিদ্যালয়ে এসেছে। প্রাথমিক ভাবে এটা জানা গেলেও পরে জানা গেল ছেলেটি টিফিন-এর পর স্কুলে আসে এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। (যদিও ভিডিওটিতে এইরকম কিছু দেখা যায় না) অভিযুক্ত ছেলেটিকে কমন রুমে-এ  এনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় শোনা যায় - ছেলেটি বলছে তার “চুল ধরতে পারবেন না” এবং একটি শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলে-“দম থাকলে মাঠে আসুন”। একজন শিক্ষক বলেন-”তোর লিমিট কত দূর?” ছেলেটি বলে- “পুরো দীঘা আমার লিমিটে আছে, আজকে বেরিয়ে দেখুন”। যাইহোক এই ধরণের কথাবার্তা আমরা ভিডিওটিতে দেখতে পাই। পরে জানা গেল এই ঘটনার সাথে যুক্ত শিক্ষক মহাশয়কে নাকি সে মারধরও করেছে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ যার সত্যতা কতখানি তা বিচার্যের বিষয়। বর্তমানে ছেলেটি বহিষ্কৃত হয়েছে।


অতএব বিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে সে আর ঢুকতে পারবে না। বই খাতার সঙ্গে তার যেটুকু সম্পর্ক, এই বিদ্যালয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল তা ছিন্ন হল। বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত এই ছেলে সমাজ থেকেও বিতাড়িত হতে থাকবে ধীরে ধীরে। ক্ষণিকের ঔদ্ধত্য, অজ্ঞতা, অসংযমীতা হয়ত তাকে ঠেলে দিল এক অন্ধকারময় জীবন পথে কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মহান শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্যই তো অজ্ঞতা কে দূর করা। প্রতিকূল স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ এক বিজ্ঞ মানুষ তৈরি করা।

কিন্তু না, মহান শিক্ষকদের উদ্দেশ্য হয়ত তা নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য হল বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাদান। বাংলা, ইংরাজী, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত এই বিষয় গুলি ছাত্রছাত্রীদের আয়ত্ত করান।


এই পুঁথিগত শিক্ষার মূল্য অবশ্যই আছে। এই বিষয় গুলির উপর গভীর অথবা সাধারণ ধারণা প্রত্যেকটি ছাত্র ছাত্রীর থাকা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মসংস্থান এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে। আমাদের মহান শিক্ষক মহাশয়েরা এই বিষয়ের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন এই বিষয়গুলি রপ্ত করতে পারলে ও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তাঁদের কাছে এটাই হোল শিক্ষার মূল্য বা লক্ষ্য এবং আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ মানুষই শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে এইটাই মনে করেন। তাই বর্তমানে শিক্ষকদের শিক্ষাদান এই সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও সমাজের এই হীন মানসিকতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করাই শিক্ষক মণ্ডলীর কাম্য ছিল।


তাঁদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে কিছু আচরণগত দিক আছে যেগুলি বেশীর ভাগ সময় লক্ষ্য করা যায় - সাধারণত শিক্ষক মহাশয়েরা বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ও মনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের উপর বিশেষ যত্নশীল হন। অপর দিকে অনাগ্রহী বা অমোনযোগী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি উদাসীন থাকেন।

তাদের তিরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় অবলম্বন করতে দেখা যায় না। আর অতিরিক্ত কিছু ঘটনা ঘটলে অভিভাবকদের নালিশ জানান তাঁরা।

শাস্তি এবং তিরস্কার হল একটি সাময়িক উপশম। ঠিক পেইনকিলার এর মতন এর উপকারিতা কিছুক্ষণের জন্য স্থায়ী। মূল চিকিৎসা এটা নয়। চিকিৎসকেরা বলেন এই পেইনকিলার বেশী প্রয়োগের ফলে আরও জটিল রোগের কবলে পরার সম্ভাবনা থাকে। অতএব ছাত্রছাত্রীরা কেন অমোনযোগী হচ্ছে, কেন তারা অনাগ্রহী হচ্ছে এর মূল কারণ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা বা ইচ্ছা যদি শিক্ষকগণের মধ্যে না থাকে তাহলে এ রোগের উপশম হবে না। ফলে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান যেটিকে এঁনারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সেটিও অসম্পূর্ণ থেকে যায়,বড়ো সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের কাছে। ভবিষ্যৎ কর্ম জীবনে এই অসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রভাব তারা প্রতক্ষ্য করে এবং হতাশায় ভোগে ও পরিণত বয়সে এসে নিজেদের দোষারোপ করে। শিক্ষকগণেরা একটা দীর্ঘ সময় পান এই পরিণতি থেকে ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করার কিন্তু তাঁরা এ বিষয় মোটেই চিন্তিত নন।

তাঁদের আচরণের আরেকটি দিক হলো-তাঁরা মুক্ত কন্ঠে বলে থাকেন- আমি শ্রেণিকক্ষে সমস্ত কিছুই শিখিয়েছি আপনার সন্তান যদি গ্রহণ করতে না পারে, আমার তো কিছু করার নেই।

ছাত্র বা ছাত্রীরা অকৃতকার্য হলে তার দায় তারা গ্রহণ করেন না। তবে সফল হলে কৃতিত্বের দাবি জানাতে তাঁরা ভোলেন না। কৃতিত্ব যে একেবারেই নেই সেটা বলা ঠিক নয়। দক্ষ শিক্ষক আছেন। বিষয়ের প্রতি অগাধ পাণ্ডিত্য আছে এমন শিক্ষকও দেখা যায়। কিন্তু কতটা নিষ্ঠা ও সততার সাথে তিনি তা বিতরণ করেন তা সন্দেহাতীত নয়। আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের যেমন উচিৎ দেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত নাগরিকটিরও খেয়াল রাখা ও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা সেই রকম পিছিয়ে পড়া সেই সকল ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নজর দেওয়া শিক্ষক মহাশয়দের নৈতিক কর্তব্য।








শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কোন ছাত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার অপমান জনক কথাবার্তা কখনই কাম্য নয়।এক্ষেত্রে উচিত উপস্থিত বুদ্ধি ও অন্তদৃষ্টি দিয়ে কোন্ সমাজ, কোন্ পারিবারিক পরিমণ্ডল ও কোন্ আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে ছেলেটি বড় হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে বাস্তব বুদ্ধি ও কৌশল দ্বারা তার ঐ আচরণ কে নিয়ন্ত্রনে আনা। ক্ষমাশীলতা, সহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা এই মানবিক গুণে বলিয়ান হয়ে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন ও ভবিষ্যতে এক সৎ, সুন্দর মানুষ তৈরি করাই শিক্ষকদের প্রধানলক্ষ্য হওয়া উচিত, যা হল শিক্ষার মূল লক্ষ্য।


বুদ্ধির তারতম্যের জন্য বা জৈবিক কারণে সকল শিক্ষার্থীর সমান মেধা হয় না। নির্দিষ্ট একটি শিক্ষা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতাও সবার থাকে না। যার ফলে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশায় অগ্রসর হয়। যেহেতু কোন পেশাই ছোট নয় এবং সমস্ত শ্রেনীর মানুষেরই সমাজে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে তাই কেউ যদি ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, বাজারের সবজী বিক্রেতা বা রাজমিস্ত্রীও হয়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। তাঁদের মধ্যে যদি সততা থাকে এবং তারা যদি কর্তব্যনিষ্ঠ হয় তাহলে সমাজ সুন্দর হবে। অন্যথায় সমাজ দুর্নীতিগ্রস্থ হবে। অতএব ছাত্রছাত্রীদের আচার ব্যবহার, তার অসৎ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার গুরু দায়িত্ব শিক্ষকদের। বেয়াদব ছাত্রকে বহিষ্কার করে তাকে শাস্তি দেওয়া নয়।


পূর্ব মেদিনীপুরের সেই স্কুলে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষক মহাশয় উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছেন- “ছেলেটিকে আমরা বহিষ্কার করলাম”। এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। ছেলেটি দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে আসছে, এই দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রাজ্ঞ শিক্ষকগণ ষোলো-সতের বছরের একটি ছেলেকে সামলাতে পারলেন না! নতি স্বীকার করলেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কাপুরুষের মত  ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন এবং সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করলেন।


সবাই বিদ্যাসাগর রচিত ‘গোপাল’ চরিত্রের মতন সুবোধ বালক হয় না, দুষ্টু রাখালের মতনও বালক থাকে। দুষ্টু বালক কে সুবোধ বালকে পরিবর্তন করার  চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা শিক্ষকদের উচিত নয় কি? অনেকে বলছেন ঐ ছেলেটির কোন পরিবর্তন হবে না। এই কথাটি যুক্তিসম্মত নয়। পৃথিবী বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল। জৈবিক বা অজৈবিক সব কিছুই। ছেলেটির এই রকম আচরণ নির্দিষ্ট একটি সময়ের মানসিক অবস্থা মাত্র। আমরা জানি সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন ঘটে। যেহেতু সে একটি মানুষ অর্থাৎ চিন্তাশীল প্রানী সে বিপরীত চিন্তাটাও এক সময় করবে। এই সময় তার মানসিক চিন্তার যে বক্রতা তা সোজা পথে নিয়ে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে কিন্তু সেটা অসম্ভব নয়। তার জন্য দরকার আদর্শ শিক্ষকের যার মধ্যে থাকবে মানবিকতার গুণ। স্কুলের পাঠক্রম শেষ করার তৎপড়তার চেয়েও বেশী শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ জাগ্রত করার সদিচ্ছা। হিংসা বা দস্যু প্রবৃত্তি সমস্ত মানুষের মধ্যেই বর্তমান। আমরা এখন এই ছেলেটির কথা ভাবছি, সমাজবিরোধীদের দলে তাকে ফেলছি, তাকে বিদ্যালয় থেকে দূরে রাখছি কারণ সে অযোগ্য। কিন্তু যোগ্য ছাত্রছাত্রীরাও বিদ্যালয় থেকে সফল ভাবে কৃতকার্য হয়ে এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও সমাজবিরোধীতার কাজে যুক্ত হয়ে সমাজের ক্ষতি সাধন করে চলেছে এমন সংখ্যাও কম নয়। অতীত বা বর্তমান সময়কালে আমরা দেখেছি উচ্চপদস্থ বহু কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কিন্তু উচ্চশিক্ষিত। অতএব ভবিষ্যতে একটি ভালো শিক্ষার্থীর মন্দদিকে আবার একটি মন্দ শিক্ষার্থীর ভালোদিকে অগ্রসর হওয়ার উভয় সম্ভাবনা থাকে। গোড়াতেই একজন ছাত্রছাত্রীর সঠিক চারিত্রিক মূল্যায়ন করে তাকে মন্দ পথে অগ্রসর হওয়ার প্রবনতাকে যদি কম করা যায় বা নির্মূল করা যায় তবে সেটাকেই শিক্ষার অগ্রগতি বলে চিহ্নিত করা যাবে।

শিক্ষাবিদরা বলেন শাস্তি দেওয়ার প্রবনতা তখনই আসে যখন শিক্ষক বা শিক্ষিকা অক্ষম হয়ে পড়েন। (আমি এখানে চরম শাস্তির কথা বলছি, যেমন স্কুল থেকে বহিষ্কার) “Infliction by punishment is the teachers failure” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন “রাষ্ট্রতন্ত্রই হোক বা শিক্ষাতন্ত্রেই হোক, কঠোর শাসননীতি শাসয়িতার অযোগ্যতার প্রমাণ”।

একটি আদর্শ শিক্ষকের পাঠদান ছাড়া যে আবশ্যিক গুণগুলি থাকা প্রয়োজন বা যে নীতি মেনে চলা উচিত সেগুলি হল - সত্যবাদিতা, নিরপেক্ষতা, সম্মান প্রদর্শন করা,  ধৈর্যশীলতা, সহিষ্ণুতা। এই গুণগুলি সাধারণ মানুষের থেকে তাঁদের পৃথক করে এবং এক নক্ষত্রসম বিরাটত্বের আসনে তাঁরা বিরাজ করেন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ তাঁদের ঐ রকম এক উচ্চস্থানে রাখেন এবং ওঁনারা এই বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন ও বিশেষ ক্ষেত্রে এর যথার্থ সদ্ব্যবহারও করে থাকেন। তাঁদের বর্তমান আর্থিক অবস্থা ও এই রাজকীয় সম্মানের দ্বৈত মিলনের দম্ভে তাঁরা মনে করেন তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাঁদের কিছু বলা যাবে না কারণ তাঁরা শিক্ষক অর্থাৎ দেবতুল্য।

আমি মনে করি সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষকের আসন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে দেবতার আসনে স্থান পাওয়ার এই ক্রমবিবর্তন তাঁদের শিক্ষকের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করেছে। যে নক্ষত্রসম বিরাটত্বের আলোয় অন্ধকার দূর হওয়ার কথা,সে নক্ষত্র আর নেই। পরিণত হয়েছে একটা গ্রহে বা উপগ্রহে যার নিজস্ব কোন আলো নেই,আছে শুধু “শিক্ষক”নামের একটি মুকুট। যেটি শিক্ষকের অবভাস (Appearance) বা প্রতিলিপি মাত্র। ঐ শিক্ষক নামক মুকুটের ম্লান আলোয় দিকভ্রান্ত কোন ছাত্র সঠিক পথের দিশা খুঁজে পায় না, ভুল পথে পরিচালিত হয় এবং সব শেষে বহিষ্কৃত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন “একটি প্রদীপ অন্য প্রদীপকে তখনই প্রজ্বলিত করতে পারে যখন সে নিজ শিখায় দীপ্যমান থাকে”।

কালিকাপুর, বজবজ

অলৌকিক নয়, লৌকিক -মহম্মদ মহসীন
May 19, 2025 | যুক্তিবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাস্তব কথা হলো, এ জগৎ এক বস্তু জগৎ। তবু মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে, কল্পনার এক জগত গড়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। 

 এই মানসিকতাকেই পুঁজি করে পূঁজিবাদীরা তৈরি করেছে এক হাতিয়ার। সেটি হলো ভাববাদ। ভাববাদে ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা, আত্মা, প্রেতাত্মা প্রভৃতি কাল্পনিক জিনিসের অবতারণা করা হয়।  ক্যাপিটালিজমের বহুল প্রচারে সমাজমানসে এইসব আত্মা, ভূত, ভগবান, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি হাবিজাবি কাল্পনিক অস্তিত্বহীন জিনিস বিভিন্ন অস্ত্রের বারংবার ব্যবহারে, বিভিন্নভাবে ব্যবহারে, মানব মনে বিশ্বাসের মুখোশ তৈরি করতে সক্ষম হয়, সফল হয়। মানুষ এসবে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। তার এই বিশ্বাস  দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আত্মিকরণ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জগৎ যে শুধুই বস্তুজগৎ, এছাড়া অন্য কিছুই নয়, তা বলীষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন প্রবীর ঘোষ।  গত শতকের আটের দশকে লক্ষ বাধাকে যুক্তিবাদের ধারে স্বমহিমায় অতিক্রম করতে পেরেছেন প্রবীর ঘোষ। 

 উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে মানুষকে মানবেতর প্রাণী করে রাখাটা খুব দরকার পড়ে।  এজন্য এইসব কাল্পনিক জিনিস তাদের মনে প্রোথিত করার খুব প্রয়োজন। কিছু কিছু প্রফেট, ধর্ম প্রচারক, ধর্ম প্রণেতা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বস্তুবাদের বিরোধীবাদ প্রচার করে থাকেন যা আসলে ক্যাপিটালিজম দিয়ে শোষণকেই সমর্থন করে চলে।

মুনাফার লোভ চালায় শোষণ। শ্রমিক মানসে যখন জন্ম নেয় সংগ্রামের ইচ্ছার পাখি। অধ্যাত্মবাদ,  অদৃষ্টবাদ, স্বর্গ-নরক-কল্পনা সেই সংগ্রামী পাখীকে থামিয়ে দেয়, উড়তে না দিয়ে বন্দি করে ধর্মের খাঁচায়। শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়তে  বিপ্লবের ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয় এইসব অধ্যাত্মবাদ। মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এক ধরণের জম্বি (zombie) তৈরি করে দেয়। মানুষের শ্রেণিচেতনাবোধ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে এইসব বিরোধীবাদগুলি সেই চেতনাকে মেরে ফেলে চারদিক দিয়ে আক্রমণে। গড়ে উঠতেই দেয় না।

 দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুধাবন করার প্রাথমিক কথাই হলো, এ জগৎ বস্তু জগৎ। এখানে অলৌকিকতার কোনও ঠাঁই নাই।

কিন্তু পুঁজিবাদের  মূল পুঁজিই তো হলো অলৌকিকতা। প্রবীর ঘোষ সেই অলৌকিকতাকে চ্যালেঞ্জ করলেন একেবারে মাঠে ময়দানে নেমে। গুরু, গুরুবাবা, জ্যোতিষী, আত্মাবিশেষজ্ঞ, ভূতবিদ, পরাবিজ্ঞানবাদী সকলের সামনে ধেয়ে এলেন সুনামি হয়ে। এক ধাক্কায় ধুয়ে গেল এইসব অলৌকিকতাবাদের ধারকের,  বাহকেরা। 

 প্রমাদ গুণলো এই সব মিথ্যাশ্রয়বাদীরা। বিপন্ন হল তাদের অস্তিত্ব। তাই সকলে একযোগে আক্রমণ করতে থাকল তারা। তাদের তাসের ঘর রক্ষা করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। নিয়োগ করল নানান এজেন্সি। আজও  সক্রিয় সেই সব এজেন্সি।  নইলে যে তাদের মিথ্যের দুনিয়া প্রকাশ হয়ে পড়বে। ভেঙে পড়বে তাদের অলৌকিকতার সাম্রাজ্য। 

 প্রবীর ঘোষ হলো সেই ব্যক্তির নাম, যে নাম যুক্তিবাদের সমার্থক অন্য নাম। সমাজে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল নবজাগরণের ঢেউ। যুক্তিবাদ-নদের ঢেউ। সেই নদীতেও বাঁধ দিতে লাগল স্বার্থান্বেষী এক চক্র। আজও তারা সক্রিয়। পি.জি যেদিন মারা গেলেন, গর্তের অন্ধকার থেকে হিলহিল করে বেরিয়ে আসতে লাগল,  কাদা ছুঁড়তে লাগল, সেইসব অন্ধকারের জীবগুলি। প্রবীর ঘোষ মারা গেছেন, কিন্তু আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল তাঁর ঘোষিত চ্যালেঞ্জ। এইসব অন্ধকারের জীবেরা তো পাঁক ঘাঁটা জীব, 

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে মৃত প্রবীরকেও মারতে পারে না।

 তাই প্রবীর ঘোষের সামনে অলৌকিকতার দাবিদারের সংখ্যা শুণ্য। 

 এতেই এইসব অলৌকিকতাবাদীদের লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু ঐ যে বলে না, লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। এরাও মিথ্যার পশরা  সাজিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছে, রূপ পালটে, ছল পালটে, ঢঙ পালটে। 

 যতদিন এই যুদ্ধ চলবে, প্রবীর ঘোষ ততদিন বেঁচে থাকবেন যুক্তিবাদীদের আদর্শ হয়ে। ততদিন  তাঁর চ্যালেঞ্জ, তাঁর বইগুলি যুদ্ধের মারণাস্ত্র হয়ে তাদের রাত্রের নিদ্রায় ত্রাসের অস্ত্র হয়ে ভয় দেখিয়ে যাবে। ভীতের চিৎকার শোনা যাবে। আজ যেমন শোনা যাচ্ছে। 


যুক্তিবাদের পথ চলতেই থাকবে চলতেই থাকবে। কারণ এ পথ  কাল্পনিক কোনও গোঁজামিল দিয়ে তৈরি নয়। সত্য ও সত্যার্থ দিয়ে তৈরি।

সংগঠিত ধর্ম কোনওদিন ডারউইনকে পছন্দ করেনি -শম্ভুনাথ চার্বাক
May 19, 2025 | বিবর্তনবাদ | views:2 | likes:0 | share: 0 | comments:0

জীব সৃষ্টি  হয়েছে কিভাবে? জীবকে সৃষ্টি  করেছে কে? এই প্রশ্ন মানুষের মনে নিরন্তর ঝড় তুলেছে সভ্যতার বিকাশের শুরুর সময়  থেকেই  বড় বড় বিশ্বমানবরাও দ্বিধাগ্রস্ত এই ব্যাপারে। ছোটবেলা থেকেই উঠতে বসতে ঘরে বাইরে শুনে আসছি সব তার   সৃষ্টি। অনেক অনেক প্রশ্ন এসেছে মনে, জিজ্ঞাসা করলেই বলত ডেঁপো ছেলে। প্রমাণের কি আছে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এবং তোমার পূর্ব পুরুষেরা বিশ্বাস করে আসছে, তোমাকেও তাই বিশ্বাস করতে হবে বিনা প্রশ্নেই। এসব বলেই দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেশী বললেই কখনও কখনও মার জুটতো কপালে। ধর্মের বিবর্তনের এবং ঈশ্বর গড আল্লাহদেরও বিবর্তন ঘটেছে এই পৃথিবীতে।  ব্যাবিলন সুমের মিশর আরব  নরওয়ে রোম গ্রীসের পেগান বা মূর্তিপূজকদের  দেবদেবীদের  ইহুদী খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা  বিলুপ্ত করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। একমাত্র ভারতে উদ্ভূত পেগান বা মূর্তিপূজক ধর্মগুলি টিকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বড় ধর্মের  চাপ থাকলেও  আজও সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০ ধর্ম টিকে  আছে।  এই  প্রচলিত বৃহৎ  প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্ম হিন্দু বৌদ্ধ  খ্রিস্টান ইসলাম ইহুদী সবাই  বলে তাদের নিজেদের  ঈশ্বর-গড-আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বরদের কোন সার্বজনিনতা নেই এবং সবাই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।  আবার সব ধর্মের প্রধান পুরুষ, কোন মহিলা নেই;  বেদের পুরুষ সুক্তে বলা হয়েছে সব পুরুষের  থেকেই সৃষ্টি।  এদের ঈশ্বর – গড – আল্লাহ  প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রত্যেকটি ধর্ম অপর ধর্মের ওপর আঘাত হেনেই বিকাশ লাভ করেছে এবং বারবার ধর্মের কারণে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে ব্রাহ্মণদের সাথে চার্বাক যুক্তিবাদীদের লড়াই;  হিন্দু বনাম বৌদ্ধ বা জৈনের লড়াই, শৈব শাক্ত বৈষ্ণবের লড়াই বাংলা দেখেছে মধ্যযুগে এবং হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টানের লড়াইও দেখেছে, দেশভাগ দেখেছে ধর্মের কারণে, উদ্বাস্তু হওয়া দেখেছে ধর্মের কারণে।  রক্তাক্ত ক্রুসেড দেখেছে এশিয়ার ভূখন্ড। কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে ধর্মের কারণেই। এরপরেও ধার্মিকরা বলেন ধর্ম  শান্তি দেয় চরিত্র গঠন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।  সব কিছুই  ঈশ্বরের  সৃষ্টি।  ঈশ্বরের  এই সৃষ্টি তত্ত্বের  বিরুদ্ধে চার্লস ডারউইনের  বিবর্তনবাদ  তত্ত্ব  এক সপাটে চপেটাঘাত। এবারের  মেডিসিনে  নোবেলও  জিনের  বিবর্তনের কাজের  জন্যই।   বর্তমান  ভারতের শাসকবৃন্দ এবং ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি  চায়না ডারউইনের বিবর্তনবাদ  শিক্ষার্থীদের  মাথাতে ঢুকুক তাই সিলেবাসের থেকে ডারউইন বাদ। এর বিরুদ্ধে লিখতেই এই প্রবন্ধ।

               চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। নিজেও প্রচণ্ড ধর্মভীরু ছিলেন এবং ভবিষ্যতে ধর্মযাজক হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন। কারণ ইংল্যান্ডে সেই সময় ধর্মজাজক হওয়া যথেষ্ট সম্মানের। কিন্তু জীব বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় জীব ও জীব সৃষ্টির জিজ্ঞাসা ডারউইনের কিশোর মনে ঝড় তুলেছিল প্রচন্ডভাবে। সেই ঝড়েই ডারউইনের জাহাজ বিগল গ্যালাপাগাস দ্বীপে অবতরণ করলো ১৮৩৫ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী (১২ই  ফেব্রুয়ারী ডারউইনের জন্মদিন)।  ডারউইনের চিন্তা ভাবনাকে যেন উসকে দিতেই এইদিন চিলির উপকূলে নোঙর করা অবস্থায় তাঁদের জাহাজ এইচ এম এস বিগল কেঁপে উঠলো প্রবল এক-ভূমিকম্পে! দুই মিনিটের সেই ভূমিকম্প শেষে ডারউইন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মহাবিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন উপকূলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় আট ফুট! তাহলে কি লায়েলের Principle of Geology’র কথাই ঠিক? সব পরিবর্তনই কি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা করা শক্তিগুলোর ফলাফল?

১৮৩১ সালে জাহাজে ওঠার আগে ডারউইনকে তাঁর শিক্ষক এবং একইসাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনেস্লো অপর এক প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক চার্লস লায়েলের লেখা Principle of Geology বইটি উপহার দেন। গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হেনেস্লো কড়াভাবে ডারউইনকে বলে দেন যেন ভুলেও লায়েলের লেখাগুলোকে বিশ্বাস না করেন! কিন্তু ডারউইন জাহাজে যেতে যেতে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখতে দেখতে গুরুর উপদেশ ভুলে গভীর সন্দেহে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন একের পর এক। কি ছিল লায়েলের সেই বইয়ে! লায়েল তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, “নূহের আমলের এক কথিত মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ভাগ রূপান্তরিত হয়নি। ভূভাগ বিবর্তনের অন্যতম কারণ হল বাতাস, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের মতন অসংখ্য ছোটবড় প্রাকৃতিক শক্তি। এগুলোই অতীত থেকে বর্তমান সময়ে ভূভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং আসছে।” গুরুর কথা ভুলে ডারউইন তাই মনোনিবেশ করলেন আশেপাশের ভূপ্রকৃতির উপর এবং আস্তে আস্তে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন লায়েলের সেই যুক্তিপূর্ণ রূপান্তরের মতবাদে। আর তার চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পেলেন।

এই ভূমিকম্প নিয়ে ভাবতে ভাবতেই যাত্রাপথে আবার জাহাজে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু একটি দ্বীপে। সেখানে দেখা গেল পাহাড়ের গায়ে এক রহস্যময় সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পরীক্ষা করে জানা গেল রহস্যের তেমন কিছুই নেই, শামুক ঝিনুকের খোলের চুনাপাথরের ক্ষয়ই এই লম্বা দাগের রহস্য। কিন্তু শামুক ঝিনুক এতো উঁচুতে এক পাহাড়ের গায়ে এলো কিভাবে? তাহলে কি একসময় সেই পাহাড় লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের জলের নিচে?

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি দেখা গেল গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে নামার পর। এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে দেখতে তরুণ ডারউইন দেখতে পেলেন বিভিন্ন প্রজাতির একগাদা ফিঞ্চ পাখি, যেগুলোকে আমরা ফিঙে নামে ডাকি। ডারউইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সবগুলোই ফিঞ্চ পাখি হলেও অবাক করা জিনিস হলো এদের খাবারের প্রকৃতি অনুযায়ী বদলে গেছে এদের গঠন। যেমন যেগুলো গাছে থাকে তারা খায় একরকম খাবার, যেগুলো মাটিতে থাকে তারা খায় আরেকরকমের খাবার। খাবারের ধরন অনুযায়ী সেই পাখিগুলোর আকৃতিও বিশেষ করে চঞ্চু আলাদা! তিনি এই বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই এদের ১৩টি প্রজাতির বর্ণনা দেন, দেখান প্রজাতির বৈচিত্র্য। এই ১৩টির পর বর্তমানে আর একটিসহ মোট ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই। এই পাখিদের দেখার পরেই তিনি প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই জীবের মাঝে একেকরকম বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ক্রমেই অভিযোজিত হয়ে তৈরি করে এক বা একাধিক নতুন প্রজাতি! সুতরাং প্রজাতি হল এমন কিছু জীবের সমষ্টি যারা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম। যেমন- আধুনিক মানুষ Homo sapiens sapiens প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন প্রজাতির সঙ্গে তারা কেউ প্রজনন করতে পারবে না!

ডারউইন আদতে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে যথেষ্ট দ্বিধা করেছেন। কেননা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন তাঁর দেওয়া মতবাদ কতটা বৈপ্লবিক। আরেক বিজ্ঞানী হুকারের কাছে লেখা চিঠিতে তাই তিনি লিখেছিলেন- নিজেকে তাঁর বড় একজন অপরাধী মনে হচ্ছে, তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন! তাই তত্ত্বের সত্যতা জেনেও কেবলমাত্র সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হতে তিনি আরও ২০ বছর ধরে গবেষণা করে লিখলেন জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বই- The origin and Species by means of Natural Selection!!

ডারউইনের তত্ত্ব যে ভুল নয় তার প্রমান আমরা দেখতে পাই অন্যপ্রাণীদের মতন মানুষেরও অসংখ্য প্রজাতি আবিষ্কৃত হওয়ায়। এগুলোর মধ্যে হোমিনিড গণের অন্তর্ভুক্ত হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেক্টাস-সহ অসংখ্য প্রজাতির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মতন আরও অন্য এক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ফসিল। অনেক গবেষণার পর দেখা গেছে এক প্রজাতির বনমানুষ বা এপদের সঙ্গে মিলে গেছে আমাদের ডিএনের প্রায় ৯৮.৬%! ডারউইনের সময় কার্বন ডেটিং-সহ অনেক পরীক্ষার সুব্যবস্থা না থাকলেও এটা এখন পরীক্ষিত গবেষণাধর্মী সত্য যে, ৪০-৮০ লক্ষ বছর আগে একধরণের জাতি দুইপায়ে ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তাদের থেকে বর্তমান আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুইলক্ষ বছর আগে। এপর্যন্ত একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি যেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সমর্থন করে না। এমনকি মজার কথা হল ডারউইন পূর্ববর্তী সময়েও জর্জ বুফো, হাওয়ার, ওয়ালেস, উইঙ্গারসহ বেশকিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি স্থির নয়, চলমান বিবর্তনের ফসল। কিন্তু এরা বিবর্তনকে মেনে নিলেও সেটি কিভাবে ঘটে তা কেউই ডারউইনের আগে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের বহুল পঠিত Ancestor’s Tale বা আশির দশকে ড. টিএম বেড়ার লেখা Evolution and Myth of Creationism কোনওটিই ডারউইনের বিবর্তনবাদ অতিক্রম করেনি, বরং সমর্থন যুগিয়েছে বহুগুনে। ডকিন্স তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে এনেছেন বিবর্তনবাদের মৌলিকত্বকে। তিনি বারবার বলেছেন - এখন পর্যন্ত একটি ফসিলও ভুল জায়গায় আবিষ্কৃত হয়নি যেটি বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারে!

বিজ্ঞান গতিশীল, যে গতিশীলতা প্রজাতিগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। হাজার বছরের বিশ্বাসকে লালন করার নাম বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তার সত্যতা বা মিথ্যাচারকে সত্যের আলোকে উন্মোচন করাই বিজ্ঞানের কাজ। ডারউইনবাদ আর বিবর্তন এতটাই প্রমাণিত যে সেটি ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে সন্দেহের কোনওই অবকাশ নেই। 


হাজার হাজার বছর ধরে ঈশ্বর আশ্রিত ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে পারেননি  ডারউইন , বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা না করলে হয়ত যাজকই হতেন বা ধর্ম তত্ত্বের অধ্যাপক হতেন , আবার মন থেকে জীব সৃষ্টির সেই ঈশ্বরের তত্ত্ব মেনে নিতেও পারেননি ডারউইন।হাজার হাজার বছর ধরে যে ধর্ম ঘিরে রয়েছে পৃথিবীকে (থুড়ি পৃথিবী বললে ভুল হবে এশিয়া-আরব-ইউরোপকে। কারণ আমেরিকা ওসেনিয়া মহাদেশের কথা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মগ্রন্থতে ছিলনা । ১৫২৬ সালের আগে আমেরিকায় সভ্য মানুষের পদার্পন ঘটেনি। শেষ সংগঠিত ধর্ম ইসলামের জন্ম ৬০০ সাল নাগাদ। ডারউইন ধর্মের আলোকে জীবের সৃষ্টির  উত্তর পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলেন, কিন্তু অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লকের বিখ্যাত উক্তি “বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভব” আবার তাঁকে অশান্ত করে তুলল। সুযোগ পেলেন জীব বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার, চাপলেন বিগল নামের জাহাজে গ্যালাপাগাস দ্বীপে যাওয়ার জন্য।  গ্যালাপাগাস দ্বীপে তিনি বিভিন্ন জীবজন্তুর সন্ধান পেলেন এবং হাজার  হাজার জীবাশ্মের সন্ধান পেলেন, প্রায় ২৫০০০ জীবাশ্ম পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। দীর্ঘদিন সেগুলি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এলেন জড় পদার্থ থেকেই জীবের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে  মানুষের উৎপত্তি। তিনি লিখলেন  “the origin of species by means of natural selection,of the preservation of favoured  races in the struggle for life” এই বইটা বেরোনোর সাথে সাথে সংগঠিত ধর্মের বিকৃত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করলো। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, জিওনার্দো ব্রুনোর পর ডারউইনের এই আঘাতে প্রবল  প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই  ছিল। ইংল্যান্ডের ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা তাঁকে নানানভাবে অপদস্থ করা থেকে  প্রাণে মারতেও  চাইলেন। শুধু প্রাণে মারতে পারেনি কারণ ডারউইনের সমর্থনে ঈংল্যান্ডের কিছু বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। (আমাদের দেশের বিখ্যাত চিকিৎসক সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসা যখন  ব্রাহ্মণদের নেতা যাজ্ঞবল্ক বন্ধ করে দিলেন তখন কিন্তু তিনি  কারো সমর্থন পাননি, নয়তো ভারত আজ  চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেত)  এদের মধ্যে  বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় টমাস হাক্সলি, শল্য চিকিৎসক ডাঃ ওয়েনের কথা। টমাস হাক্সলিকে ডারউইনের ডালকুত্তা নামেও  অভিহিত করা হয়।


দর্শনের যে মূল সংঘাত সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ডারউইন। ধর্মে জীব সৃষ্টিতে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ডারউইনের বইতে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বর  নেই আছে “প্রকৃতি ও পরিবেশ”। ঈশ্বরের ঠাই নেই সেখানে। সেসময় ডারউইনকে কি পরিমাণ আক্রমণ  হজম করতে হয়েছিল নীলকন্ঠ হয়ে তা এখন  ভাবা যায় না। এই ধর্মান্ধ কীটেরা কি ভয়ানক তা  আজ পাকিস্তান বাঙলাদেশের আমাদের মত উদ্বাস্তুরা  ও মুক্তমনারা জানে, জানে অভিজিত রায়, রাজিব, ওয়াশিকুর, নাজিমুদ্দিন, নিলয় বা আমাদের দেশের দাভালকার-পানেসর-কালবুর্গী-খলিল-গৌরি লঙ্কেশ। সারা আরবের  সিরিয়া, জর্ডন, ইরাক, তুরস্কের উদবাস্তুরা জানে, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুরা জানে। এই সব উদ্বাস্তুদের তথাকথিত কোন ঈশ্বর–আল্লাহ-গডেরা রক্ষা করে না। আমেরিকাতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানোর জন্য শিক্ষকের শাস্তি হয়েছিল, যা মাঙ্কি ট্রায়াল নামে সারা পৃথিবীতে  খ্যাত। 


আমার মনে হয় পৃথিবীতে অনেক প্রখ্যাত পদার্থ বা রসায়ন  বৈজ্ঞানিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ  কাজ করেছেন, সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকদূর। কিন্তু বিজ্ঞানের কাজের প্রভাব বিজ্ঞান ছাড়িয়ে সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জগতকে সব থেকে আলোড়িত করেছিল চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ডারউইনের উপর সারা পৃথিবী জুড়ে সংগঠিত ধর্মের   একের পর এক আক্রমনই এর সব থেকে বড় প্রমাণ। একারণেই সংগঠিত ধর্ম কোনওদিনই ডারউইনকে পছন্দ করেনি বরং বিরোধীতা করেছে। তাই হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান মৌলবাদীদের দ্বারা ডারউইনকে মুছে ফেলার  প্রচেষ্টা হবে সেটাই স্বাভাবিক।  এইজন্যই সিলেবাস থেকে ডারউইন বাদ।  এরা সবাই ধপাস তত্ত্বে বিশ্বাসী।

বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির সঙ্কট -বশিষ্ঠদেব ঠাকুর
May 19, 2025 | বাঙালি | views:28 | likes:2 | share: 0 | comments:0

প্রথম পর্ব:

গোখলের বিখ্যাত উক্তি - What bengal thinks today,India thinks tomorrow, এই কথাটি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই ধর্মক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য। বাঙালি প্রায় তেরশ বছর ধরে ধর্মনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারতকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, কারণ অনেকেই মনে করেন আদি শঙ্করাচার্যের পরমগুরু, অদ্বৈক বেদান্তবাদের প্রথম প্রবক্তা গৌড়পাদ, বাঙালিই ছিলেন, এই গৌড়পাদের অদ্বৈতবাদের “ব্রহ্ম” আসলে ব‍্যক্তি ঈশ্বরকে,স্বর্গ নরককে অস্বীকারই করে এবং নাগার্জুনের শূন‍্যবাদের কাছাকাছি এক দর্শন। তাঁর মতবাদকেই শঙ্করাচার্য সমগ্র ভারতে প্রতিষ্ঠা করেন, এবং এই আচার্য শঙ্করই বৌদ্ধদের মতো মঠকেন্দ্রিক হিন্দুধর্মের সূচনা করেন।

এরপরের বাঙালি নাস্তিক পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান - যিনি তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেন এবং বৌদ্ধধর্মের ব‍্যাপক সংস্কার সাধন করেন।

পরের সাধকও প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কারণেই তৎকালীন শাসকদের চক্ষুশূল ছিলেন হয়ত এই কারণেই বাঙালি ও সারা ভারত তাঁকে ভুলে গেছে, অথচ তাঁর শিষ্য গুরু গোরক্ষনাথকে সকলেই চেনেন! 

আনুমানিক 10ম থেকে 12শ শতকের মধ্যে, বাংলা ভাষার আদি কবিদের অন্যতম মৎস‍্যেন্দ্রনাথ (সিদ্ধাচার্য লুইপাদ) ছিলেন নাথ ধর্মের প্রবর্তক, তাঁর দুই শিষ্য হলেন,  গুরু গোরখনাথ ও চৌরঙ্গিনাথ, - যিনি পালবংশের সন্তান ছিলেন!

এরপর ভক্তিযুগের অন‍্যতম ব‍্যক্তিত্ব হলেন চৈতন্যদেব, যিনি অন্যান্য ভক্তিবাদী সন্তদের মতো শুধুই ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ভক্তির কথাই বলেননি, একজন সমাজসংস্কারকও ছিলেন, যিনি বলেছিলেন, “চন্ডালোপি দ্বিজঃশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ” 

তাঁর শিষ্য সনাতন গোস্বামীকে নির্দেশ দেন বৈষ্ণবস্মৃতিশাস্ত্র রচনা করতে, সুদীর্ঘ তন্ত্রধর্মের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলা তাঁর প্রভাবে বৈষ্ণব ভক্তিপ্লাবনে ভেসে যায়। তাঁরই ভাবধারায় রচিত হয় বেদান্তের অচিন্ত‍্যভেদাভেদ তত্ত্ব। 

এই সময় বাংলায় আরেকটি ধর্মসাহিত‍্য-ধারার সূচনা হয় যা সমগ্র ভারতে অভিনব - মঙ্গলসাহিত‍্যের ধারা, যা পুরাণসাহিত‍্যের আদলে রচিত হলেও এর মাধ্যমে বৈদিক, অবৈদিক এবং ঐশ্লামিক ধারার সংশ্লেষ শুরু হয়। ব্রাহ্মণ‍্যবাদী পৌরাণিক দেবদেবীদের বিরুদ্ধে লৌকিক ও স্থানীয় দেবদেবীদের মাহাত্ম্য এর মাধ্যমে প্রচার করা হয়,

এভাবেই উঠে এল ওলাবিবি, বনবিবি, ধর্মগাজন, সত‍্যপীর (যিনি পরবর্তীকালে সত‍্যনারায়ণ হন), ওলাইচন্ডী, যেখানে ওলাইকে চন্ডী হিসেবে মেনে নেওয়া হল, এভাবেই অন্ত‍্যজদের ধর্মসংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এই সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াটা পূর্ববঙ্গে হয়নি, ফলে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মণ‍্যধর্মের প্রভাবটা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম থাকলেও সেখানকার নিম্নবর্গের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেন! 

তাই Richard M. Eaton পূর্ববঙ্গের মুসলিম প্রাধান্যের কারণ ধর্মান্তরণ না বলে Islamisation বা ইসলামিকরণ বলেছেন। এবং এটা তাদের অজান্তেই হয়েছে এটাও বলেছেন, অর্থাৎ সেখানকার অধিবাসীরা আল্লাহ্ কে অন্যান্য দেবতার মতোই আরেক দেবতা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন প্রথমে। এই বিষয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তৃত আলোচনা করব। 

বাংলার মঙ্গলকাব‍্যে দেবতার মানবায়ন হয়েছে যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা” তাই এখানে দুর্গাপূজা আসলে দুর্গার (মেয়ের) বাপের বাড়িতে আসা। অথচ সেই সময় সারা ভারতের ভক্তিকবিদের কাছে দেবদেবীরা অনেকটা সামন্তপ্রভুর মত ছিলেন অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বাংলা অন্যপথের পথিক!

একই সময়ে আরেক বাঙালি মধুসূদন সরস্বতী বারাণসীতে বসে বিশুদ্ধ জ্ঞানকাণ্ডের অদ্বৈতবাদকে জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির দর্শনে পরিণত করেন, এই মধুসূদন সরস্বতীকেই সম্রাট আকবর অব্রাহ্মণদের সাধু করে মন্দির রক্ষা করার পরামর্শ দেন। যার ফলে নাগাসাধুদের সংগঠিত করা হয়। এক্ষেত্রেও বাঙালিই পথপ্রদর্শক!

বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় যিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজই ভারতে সমাজ সংস্কারমুলক আন্দোলনের সূচনা করে,

রামমোহন একই সঙ্গে ছিলেন প্রগতিশীল আধুনিক ও যুক্তিবাদী ধ‍্যানধারণার সমর্থক।

রামমোহন ও বিবেকানন্দের মাধ্যমেই অদ্বৈত বেদান্ত আধুনিক যুগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

বঙ্কিমচন্দ্রকে শুধুমাত্র আনন্দমঠের লেখক ও সাম্প্রদায়িক বলে উল্লেখ করাটা, তাঁর অসামান‍্য বহুমুখী সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা ভুল তো বটেই তবে তিনিই প্রথম, যিনি মহাভারত রামায়ণ ও পৌরাণিক কাহিনি, থেকে অলৌকিকতা বাদ দিয়ে কাহিনিগুলোকে আধুনিক দৃষ্টিতে বিশ্লষণ করতে চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে রামমোহন থেকে ইয়ং বেঙ্গল তা থেকে বিদ‍্যাসাগর অক্ষয়কুমার-দের প্রাচীন চার্বাকদের উত্তরসূরী হিসেবে বলা যেতেই পারে, যাঁরা ভারতীয় সমাজে যুক্তিবাদী ভাবধারার সূচনা করেন, যদিও এই ধারাটা বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয় হয়নি বলেই বাংলার নবজাগরণ যা শুধুমাত্র সাহিত্যকেন্দ্রিক ছিল তা সমগ্র সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেনি!

এবং এঁদের যুক্তিবাদী ভাবধারার জনপ্রিয়তার অভাবেই হিন্দু সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনে পর্রবসিত হয়।

এর বিপ্রতীপে হলেন রামকৃষ্ণ, যিনি আপাত অতি সাধারণ “যত মত তত পথ”-এর কথা বলেন, যেখানে বহুসম্প্রদায়ের সহ অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বলেন।

এই সহিষ্ণুতারই আজকের ভারতে ভয়ংকর অভাব, এটা ঠিকই, সহ অস্তিত্বের কথা, সহিষ্ণুতার কথা বুদ্ধ মহাবীর প্রথম বললেও বা “রুচীনাম্ বৈচিত্র্যাত্ ঋজু কুটিলনানাপথ”  -এর কথা বহ আগে উল্লেখ করা হলেও, কোন পথটা ঠিক, কোনটা বেঠিক এর চেয়ে বড় কথা “সংবাদ”, পরস্পর আলাপ আলোচনা এভাবেই সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাকে, কারণ সমাজের সব মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে যাবেন এটা যেমন অসম্ভব তেমনি বিভিন্ন ধর্মের, সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থাকলেও তা অযৌক্তিক মনে হলেও অন্যের ভিন্ন মতকে মেনে নেওয়াটাও প্রয়োজন, এই বার্তাটা রামকৃষ্ণের “যত মত তত পথ”-এর মধ্যে নিহিত রয়েছে, যেটা গান্ধীও গুরুত্ব দিয়েছেন, আজ যখন দেখি পাকিস্তানে শিয়া ও আহমেদিয়া-দের মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে।

নবরাত্রিতে ও জৈন পর্বে মাছ মাংস বন্ধের দাবী তোলা হচ্ছে তখন এই ভিন্ন ভাবনাকে মর্যাদা দেওয়াটাও “যত মত তত পথ” থেকেই সম্ভব। অতীতেও ‘মছলিখোর বাঙালি’র বিরোধীতা উত্তর ভারতে হত, বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নিরামিষ খাওয়াটাই আদর্শ হিন্দু আহার বলে জনমানসে প্রচার করতে পেরেছে। 

এপ্রসঙ্গে গোহত্যা নিবারণী সংস্থার জনৈক ভক্তের সঙ্গে বিবেকানন্দের কথোপকথন স্মরণীয়।

বিবেকানন্দ দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য কিছু করতে বলছেন, সেখানে জনৈক গোভক্ত মানুষের চেয়ে গোরুকে রক্ষা করাটাই ধর্মরক্ষা ভাবছেন।

বিবেকানন্দ খ্রিষ্টান মিশনারীদের অনুসরণ করে হিন্দু সমাজেও সেবার ধারণাকে জনপ্রিয় করেন, অথচ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দলিত হিন্দুদের ক্ষমতায়নের বদলে মন্দির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করাটা ও ইতিহাসের বিকৃতি করাই হিন্দুরক্ষার উপায় বলে গণ‍্য করেছে।


বিবেকানন্দর গীতার কর্মযোগের ব‍্যাখ‍্যা সেই সময়কার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অনেককে প্রেরণা জুগিয়েছিল অর্থাৎ দেশসেবার মাধ্যমেই ঈশ্বরসেবাও সম্ভব সেটাও একজন বাঙালিরই ভাবনা ছিল।

বিবেকানন্দ, যিনি ইউরোপ আমেরিকায় হিন্দু ধর্মপ্রচারের পথিকৃৎ তাঁর পথেই অন্য বাঙালিরা - পরমহংস যোগানন্দ থেকে ইসকনের অভয়াচরণরা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় সাধুরা রজনীশ মহেশ যোগী প্রভৃতি যাঁরা যোগ ও আধ‍্যাত্মিকতাকে বিপণন করেই বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।

এভাবে দেখা যায় বাঙালিরা বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য ছাড়া ধর্মক্ষেত্রেও সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের সময় থেকেই হিন্দু মহাসভা তারপর সংঘপরিবার বাংলায় তাদের অনুপ্রবেশ বাড়াতেই রবীন্দ্রনাথকে ব‍্যবহার শুরু করে,

এই দুই হিন্দু সংগঠনের ভাবনা বাংলার ঐতিহ্যের পরিপন্থি, এদের মাধ্যমেই উত্তর ভারতের জাতপাতসর্বস্ব উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ধর্মভাবনা বাঙালির মনকে আজ আচ্ছন্ন করেছে।

এই সংগঠনগুলোকে প্রথম থেকেই আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বাংলার অবাঙালী গুজরাটি ও মাড়োয়ারি ব‍্যবসায়ীরাই, তাই বর্তমানে সিনেমা থেকে টিভি সিরিয়াল সর্বত্রই বাংলার সনাতন দেবদেবী, আচার-অনুষ্ঠানের বদলে উত্তর ভারতীয় ধর্মাচরণকে প্রচার ও প্রসার করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই। 

আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রত‍্যন্ত গ্রামেও রাম ও হনুমান মন্দির গড়ে উঠেছে।

অন্যদিকে বাংলার ফকির ও সন্ন‍্যাসী বিদ্রোহ ছিল ভারত ও পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদাহরণ -

যেখানে মজনু শাহ্, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, রামানন্দ গোঁসাই, নুরুল উদ্দিনরা একসঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, অথচ ফরাজী ও ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রচার করা হয় এর ফলেই তিতুমীরের আন্দোলন থেকে মোপলা বিদ্রোহ এমনকি সিপাহী বিদ্রোহেও জেহাদি ভাবনার প্রভাব দেখা যায়।

পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের মাধ্যমে বাংলার শিক্ষা থেকে সাংস্কৃতিক জগতে পৌত্তলিকতার বিরোধীতা করতে গিয়ে উগ্র নারী বিরোধী সামন্ততান্ত্রিক আরবি সংস্কৃতির প্রচার প্রসার শুরু হয়।

1937 সালে মোহাম্মদ আক্রম খাঁর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক “শ্রী” ও 

“পদ্ম”-এর বিরোধীতা শুরু করে, এভাবেই তারা ধুতি শাড়ির বিরোধীতা শুরু করে।


এমনকি 1937 সাল নাগাদ মুরারিচাঁদ কলেজের পত্রিকার প্রচ্ছদে একটি রাজহাঁসের ছবি ছিল, এবং কলেজ - সঙ্গীতেও ছিল “সুর্মা তীরের আমরা মরাল, কলেজ মোদের রঙমহল”। এই “মরাল” শব্দের বিরোধীতা শুরু হয়, এমনকি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র রায়ের, প্রতিকৃতিতে মাল‍্যদান যেহেতু ইসলাম বিরোধী তাই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়,

বন্দে মাতরম্ এর অঙ্গচ্ছেদের পর প্রথম স্তবক গ্রহণ করতেও বিরোধীতা করেন মুসলিম সাম্প্রদায়িকরা! বর্তমানে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রারও বিরোধীতা করা হচ্ছে। এভাবেই বাংলার আবহমান ধর্মসংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকীকরণের ফল বঙ্গভঙ্গের কারণ হয়েছিল তবে এবার তা বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্কট বলেই মনে হচ্ছে। 


দ্বিতীয় পর্ব:

পৃথিবীর কোনও সভ‍্যতাই ধর্মকে বাদ দিয়ে বিবর্তিত হয়নি, কারণ মানুষের বৌদ্ধিক বিবর্তনটা প্রাথমিকভাবে ধর্মকে ভিত্তি করেই হয়েছে।

ভবানীপ্রসাদ সাহু তাঁর “ধর্মের উৎস সন্ধানে”-র “ধর্মচিন্তার স্তরভাগ “ প্রসঙ্গে লিখেছেন - “মানুষ যেভাবে ধর্মচিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছে তার স্তরভাগ করলে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধাপ দেখা যায়, যেমন - আদিম (primitive), প্রাচীন(archaic), ঐতিহাসিক (historic), প্রাক্ -আধুনিক (early modern) ও আধুনিক (modern)। আধুনিক ধর্ম এখনও পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু সৃষ্টি হওয়ার পথে, যেটি বিজ্ঞানের তথ‍্য ও যুক্তিবোধের সঙ্গে উপযোগী হয়ে, মানবিকতার সমস্ত সৎ মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু এটা এখনও সম্ভাবনা মাত্র, কবে কীভাবে হবে তা সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এবং এই “ধর্ম”

আদিম চিন্তার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হওয়া ঈশ্বর ও অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা থেকে বিযুক্ত হয়েই সৃষ্টি হবে, অন্তত ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি তাই। এখনকার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস থেকে তা হবে গুণগতভাবে পৃথক। অন্ধবিশ্বাস, অনড় অচল আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি তথা ধর্ম সম্পর্কিত প্রচলিত সমস্ত ধারণা থেকেই তা মুক্ত হবে। বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির বিবর্তনকে ও তার স্বরূপকে বর্ণনা করাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ‍্য।

বাঙালি তার সমৃদ্ধ ধর্মসংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ভুলে আজ নির্বিচারে পরানুকরণ করতে গিয়েই বাঙালি জাতি অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। আজ এই প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে - বাঙালি আগে হিন্দু/মুসলমান নাকি বাঙালি, নাকি ভারতীয়/বাংলাদেশী/আমেরিকান?

আসলে আমাদের আত্মপরিচয়টা বহুমাত্রিক, তাই একাধারে আমি বাঙালি ভারতীয় হিন্দু/ মুসলমান/নাস্তিক সবই হতে পারি।

প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান এই জাতীয় আত্মপরিচয় ছিল না, বরং 

আমার জাত -উপাসনার সম্প্রদায় -ভাষা-অঞ্চলত্তিক পরিচয়টাই তখন ছিল, ঔপনিবেশিক আমলেই পরবর্তীকালে Pan-Islamic, Pan-Hindu প্রভৃতি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা জনপ্রিয় হয়, এটার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ‍্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ঐক্যস্থাপন করা কিন্তু এর ফল হলো মারাত্মক। 

এইধরণের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে হিন্দু ও ইসলামের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে একটা কাল্পনিক আদর্শবাদী ধারণার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হল, এভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম হয়,

মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদ মূলত ঔপনিবেশিকতার ফল।

এর ফলে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিশ্বায়ন হল, খিলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলমানরা একসঙ্গে আন্দোলন শুরু করল, অথচ তুরস্কের খিলাফত বিরোধী আন্দোলন ছিল এক প্রগতিশীল আধুনিক তুরস্ক গঠনের আন্দোলন। তিতুমীর থেকে মোপলা বিদ্রোহেও স্থানীয় শোষকদের বিরোধীতার সঙ্গে যুক্ত হলো হিন্দু বনাম মুসলমান এই দ্বান্দ্বিক ন‍্যারেটিভের।

ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার ফলে বাংলাদেশের ঢাকার হিন্দু মন্দির ভাঙা হল,

ISIS এর জন্য ইউরোপ আমেরিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মুসলমানরা জেহাদ করতে গিয়েছিল। প‍্যালেষ্টাইন ও কাশ্মীরের প্রতি অনেক মুসলমানদের একাত্ম অনুভব করাটাও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই। কারণ জাতীয় হিংসা তো প্রতিটি মহাদেশেই ঘটে চলেছে, সেসবের ক্ষেত্রে তো সর্বাত্মক প্রতিবাদ দেখা যায় না।

অপরদিকে তুরস্কের হায়া সোফিয়া গীর্জাকে মসজিদ বানানো হলে ভারতীয় মুসলমানদের অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। কাতারের বিশ্বকাপের সাফল‍্যে অনেকেই মুসলিম দেশের সাফল‍্য ভেবে গর্বিত হয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় মূর্তি ভাঙা ও পরবর্তী আক্রমণের পরিবর্তে আসাম ত্রিপুরার মুসলমানদের ওপর অত‍্যাচার করা হয়।

আফগানিস্তানের তালিবানদের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ভাঙার ফলে মায়ানমারের রোহিঙ্গা বাঙালি মুসলিমদের নিজের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ‍্য হতে হয়।

প্রতিটি ঘটনার কারণ ছিল, কাকতালীয়ভাবে তাঁরা সকলেই বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর সদস্য হওয়াটাই।

এই কারণেই গ্রীস ও তুরস্কের আলাদা হওয়া বা  ভারতের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদেরও ফসল হচ্ছে দেশভাগ।

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ফলেই “ইসলামের স্বর্ণযুগ”, “হিন্দুদের স্বর্ণযুগ” নামক কাল্পনিক ইতিহাসের সৃষ্টি।

যেখানে হজরত মহম্মদের পূর্ব যুগকে অন্ধকারের যুগ বলে বর্ণনা করা হয়, অথচ সেই যুগই ছিল মহিলাদের স্বাধীনতার যুগ। 

এখনও অনেক মুসলমানই ভাবেন তুর্কি ও মুঘল শাসন আসলে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের অবদান অথচ তাঁরাই মুসলমানদের হারিয়ে ব্রিটিশদের শাসকে খ্রিষ্টানদের শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে দেখেন না।

প্রাচীন বৈদিক যুগকে হিন্দুত্ববাদীরা ব‍্যবিলনীয় ও মিশরীয়দের চেয়ে উন্নত ভাবেন।

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের রাজনীতি আজ বর্তমানে বিশ্বশান্তির ও “আধুনিকতা”র প্রধান অন্তরায়। 

কারণ আধুনিকতার সাথে যৌক্তিক মানসিকতার সম্পর্ক রয়েছে,

অন্যদিকে আধুনিকীকরণ হচ্ছে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যা কাতার ইরাণ সৌদি আরব বা হিন্দুত্ববাদী ভারত, ইসলামিক বাংলাদেশ পাকিস্তান সবজায়গাতেই হচ্ছে।

আমরা অনেকেই এই আধুনিক বনাম আধুনিকীকরণের তফাৎটা ভুলে যাই।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ধর্ম ও জাতিসত্তা তো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন আত্মপরিচয়ের জায়গা, এই আইডেন্টিটিগুলো ছাড়াও তো মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব। 

হ‍্যাঁ, তা সম্ভব হলেও, বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্পদ শুধুই বাঙালির নয় বরং তা সমগ্র মানবতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কারণ প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অবদান রয়েছে মানুষের বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রতিটি জাতির পরিচয়ের অংশ।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের অতীত ও বর্তমানের সমাজবিকাশের সূত্র দেয়।

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে বিশ্বাস করলে, আমাদের প্রত‍্যেকের দায় আছে 

নিজের সংস্কৃতি রক্ষা করার, অপর সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তা সমৃদ্ধ করা, তবে তা নির্বিচারে গ্রহণ বা বর্জন নয় বরং যা কিছু যুক্তিহীন অপসংস্কৃতি রয়েছে তার বর্জনের সঙ্গে অন্যের সুসংস্কৃতির কোনও উপাদানকে গ্রহণের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্ভব হয়।

এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে বাঙালির রন্ধনসংস্কৃতি, যা তুর্কি মুঘল থেকে ইউরোপীয়, সকলের অবদানে সমৃদ্ধ বাঙালির রন্ধনসংস্কৃতি।

পুঁজিবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক দ্বন্দ্বের যুগে “বিশ্বায়ন” ও “আন্তর্জাতিকতাবাদ এই দুটি শব্দের উদ্ভব হয়।

পুঁজিবাদের প্রাধান্যের কারণেই “বিশ্বায়ন” শব্দটি খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু এর সমস্যা হচ্ছে মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আত্মপরিচয়কে উপেক্ষা করা। 

তাই আমার পছন্দ আন্তর্জাতিকতাবাদ, যা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ।

এতে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র‍্যকে অস্বীকার করা হয়নি অথচ মানবসভ্যতার বিকাশের স্বার্থে প্রতিটি জাতির পরস্পরের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানকেও গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়েছে।

তাই আমি বিশ্বায়নের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদকেই বেশি গ্রহণযোগ্য ভাবনা বলে মনে করি।

প্রতিটি জাতির বিকাশ হলেই আন্তর্জাতিকতাবাদেরও বিকাশ সম্ভব, তাই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র‍্য, ভাষাগত স্বাতন্ত্র‍্যকে অস্বীকার করে কখনওই সুস্থ সুন্দর সম্প্রীতিময় মানবজাতির ভবিষ্যত সম্ভব হবে না। 


তৃতীয় পর্ব:

প্রাচীন বাংলার ধূসর ইতিহাসের কালপর্বে রাজনৈতিক শক্তির অভাবেই সম্ভবত “ বৃহৎ বঙ্গদেশ”-এর আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই সাংস্কৃতিক ঐক্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। “বঙ্গ” শব্দটি প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও দেশবাচক শব্দ ছিল না, ছিল জনবাচক (tribe)।

আজকের এই “বৃহত্তর বাংলার” ভৌগলিক পরিসরে বিভিন্ন জনপদের নাম পাওয়া যায়। বঙ্গ -পুন্ড্র-রাঢ়-গ‍ৌড় এসবই ছিল একসময় কোম বা জনপদ-রাষ্ট্র। পরবর্তীকালে রাঢ়-বঙ্গ-গৌড়-বরেন্দ্র-পুন্ড্র-বঙ্গ-সমতট-হরিকেল প্রভৃতি খন্ড-খন্ড জনপদ নিয়ে বাঙালির ভৌগলিক পরিচয় গড়ে ওঠে। যা মুঘল আমলে “সুবে বঙ্গাল” থেকে ঔপনিবেশিক আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তে পরিণত হয়।

তবে বিশেষ ভূপ্রকৃতিগত সীমার মধ্যেই জাতি ও ভাষাগত ঐক্য গড়ে উঠলেও দেশ গঠন হয় তার রাজনৈতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাই বর্তমানে বাঙালি অধ‍্যুষিত ভূমি বলতে পশ্চিমবঙ্গ,বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ছাড়াও বিহার ঝাড়খন্ড আসামের কিছু অংশও রয়েছে।

বাঙালির অখন্ড জাতি-চেতনার উদ্ভব উনিশ শতকে হলেও তা অনেকটাই কৃত্রিম ও বায়বীয় ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু-মুসলিম ও দলিত বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরফলস্বরূপ দেশভাগটাই ভবিতব‍্য হয়ে ওঠে।

আজ বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই অখন্ড বাঙালি জাতি-চেতনার বিকাশ প্রয়োজন, এবং এই কারণেই বাঙালির, বাঙালি -জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইতিহাসটা জানা দরকার। 

এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ‍্য যেহেতু ধর্মসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করাই, তাই বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনটা নিয়ে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করে নেব।

জৈবিক নৃবিজ্ঞান ও আধুনিক জিনতত্ত্ববিদদের মতে অতীতে বাংলায় মোট পাঁচটি পরিযান হয়েছিল - যা সারা পৃথিবীতেই এক বিরলতম ঘটনা। অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিকভাবেও এই পাঁচটি জাতির মিলনে বাঙালির উদ্ভব। আজকাল যদিও শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে জাতিগত পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই সাংস্কৃতিকভাবেও যে বাঙালি একটি সংকর জাতি তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করব।

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং জাতিতত্ত্ব (ethnology)। 

অন্যদিকে সংস্কৃতির প্রধান দুটি উপাদান হচ্ছে - ভাষা ও ধর্ম।

বাংলাভাষার উদ্ভবের ক্ষেত্রেও পাঁচটি পূর্বোক্ত পরিযানকারী জাতির প্রভাব থাকবে।

তবে আলোচনার সুবিধার জন‍্য বাংলা ভাষার উদ্ভবের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি ধারাকেই উল্লেখ করব - প্রথমটি অনার্য ধারা, যার মধ্যে দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীগুলি রয়েছে 

এবং দ্বিতীয়টি ও প্রধান ধারাটি হচ্ছে - 

আর্যভাষার ধারা যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষানদীর একটি ধারা থেকেই মাগধী প্রাকৃত হয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব।

সংস্কৃতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো -ধর্ম।

 যা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ‍্য বিষয়।

প্রচলিত ধর্মমতগুলির তিনটি দিক রয়েছে, বিশ্বাস (belief) অনুষ্ঠানাদি (worship) ও সংগঠন (organization), এই বিশ্বাসের ধারাটি সৃষ্টি ও সংঘবদ্ধ হয়েছে পুরা-প্রস্তরযুগেই, অর্থাৎ বাঙালির ধর্মভাবনার উৎসও সেই প্রস্তরযুগেই।


তবে বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির বিবর্তনটা জানতে হলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবটাও আগে আলোচনা করে নেওয়া দরকার।

ষোড়শ মহাজনপদের একটিও বাংলায় না থাকায় এবং বৈদিক সাহিত্যে তেমন বিশেষভাবে উল্লেখ না থাকায় অনেকেই বাংলাকে অনার্য অধ‍্যুষিত ভূমি হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু উয়ারী-বটেশ্বর থেকে মহাস্থানগড় এবং Northern black polished ware pottery -র নিদর্শন থেকেই বোঝা যায়, বাংলায় আর্যদের আগমন আড়াই হাজার বছর আগেই হয়েছিল।

মহাভারতের সভাপর্বের “দিগ্বিজয়পর্বে” উল্লেখ রয়েছে - পঞ্চপান্ডবরা বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে জয়লাভ করেন, সেখানে ভীম তাম্রলিপ্ত ও বঙ্গদেশ জয় করেন, আমরা জানি তাম্রলিপ্ত একটি প্রাচীন রাজ‍্য এবং লক্ষ্যণীয় যেটা তা হলো আজও মেদিনীপুরে ভীমের পূজা বিশেষভাবে হয়। গগনেডাঙায় কথিত আছে এখানে ভীম-বকাসুরের নাকি যুদ্ধ হয়েছিল।

তবে বাঙালি জাতির আর্যায়ন মৌর্য যুগ থেকেই শুরু হয়ে যায় এবং এর ধারাবাহিকতা গুপ্ত যুগ পর্যন্ত চলে।

আর্য ধর্মসংস্কৃতির দুটি ধারা রয়েছে, একটি বৈদিক অপরটি অবৈদিক।

বৈদিক আর্যসংস্কৃতি ছিল মূর্তিপূজাহীন যাগযজ্ঞময়, এই বৈদিক সংস্কৃতির ধারাটি হয়ত 

বাংলায় জনসমর্থন পায়নি, এবং কালক্রমে এই বৈদিক ধর্ম থেকেই classical hinduism এর উদ্ভব হয়।

যা বাংলায় শুঙ্গ থেকেই গুপ্তযুগের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এবং সেনযুগে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়।

অন্যদিকে অবৈদিক ধর্মগুলোর মধ্যে প্রথমের দিকে জৈন ও আজীবিকরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাই জৈন ও আজীবিকদের বাংলার আদিধর্ম বলে বর্ণনা করা যায়। পরবর্তীকালে আজীবিকরা স্বাতন্ত্র‍্য হারিয়ে জৈনদের মধ্যেই মিশে যায়। বর্দ্ধমান জেলার নাম তীর্থংকর বর্ধমান মহাবীরের নামেই হয়েছে,

বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াতেও জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে ছিল।

বৌদ্ধ ধর্মও একই সময়ে বাংলায় এলেও ঐ দুই ধর্মের কারণেই অনেক পরে বাংলায় বৌদ্ধদের প্রভাব দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মে বঙ্গদেশ প্লাবিত হলেও জৈনরাই কিন্তু বঙ্গভূমির সন্ধান জানতেন বেশি।

জৈনভগবতী সূত্রে - অঙ্গ বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ রয়েছে।

জৈন ও বৌদ্ধ প্রচারকদের মাধ্যমেই আর্যভাষা ও আর্যসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার তৎকালীন অধিবাসীদের পরিচয় হয়।

এভাবেই গুপ্তযুগে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়।

তবে রাজনৈতিকভাবে বাঙালির উত্থান হয় রাজা শশাঙ্কের মাধ্যমেই, যেহেতু হর্ষবর্ধনের পরম শত্রু ছিলেন শশাঙ্ক, তাই শশাঙ্ককে বৌদ্ধবিরোধী বলে অপপ্রচার করা হয়েছিল, এবং হিউয়েন সাং তাঁকে বৌদ্ধবিরোধী বলে উল্লেখ করলেও শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে যে দশটি বৌদ্ধবিহার ও দুহাজার হীনযান বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসী ছিলেন, রক্তমৃত্তিকা নামক বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও দেবমন্দিরও ছিল তার উল্লেখও করেন।

তাই শশাঙ্ককে একজন পরমতসহিষ্ণু ও প্রজাপালক রাজা হিসেবেই বলা উচিৎ।

এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন তাঁর রাজ‍্য দখল করলেও, শশাঙ্কের সময় থেকে পালযুগ পর্যন্ত সর্বধর্মসমন্বয়ের রাষ্ট্র নীতিই রাজারা অনুসরণ করতেন।

এই সময় থেকেই বাংলা বাণিজ্যসূত্রে বহির্ভারতের সাথে যুক্ত হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ব‍্যবসাবাণিজ‍্যের কারণেই তাম্রলিপ্ত সেই সময় আন্তর্জাতিক বন্দর হয়ে ওঠে। বাঙালি স্থপতি শিল্পী ও কারিগরদের সুনাম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে,

তবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব পালযুগের পরই বৃদ্ধি পায়,কারণ পাল আমলের সব রচনাই ছিল, সংস্কৃত।

অথচ এই সময়ই চোল শাসকরা শ্রীলঙ্কায় বঙ্গলিপিতে মুদ্রা জারি করেন।

সেন শাসনামলেই বঙ্গলিপি প্রথম স্বীকৃতি পায় এবং ইলিয়াস শাহী আমল থেকে বাংলা ভাষা রাজদরবারে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।

যদিও অনেকেই সেন আমলকে ব্রাহ্মণ‍্যবাদের পুনরুত্থান হিসেবেই বর্ণনা করেছেন, আমার ধারণা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এটাও প্রণিধানযোগ্য, যে “বাংলার মনু” রঘুনন্দন কিন্তু ১৫শ - ১৬শ শতকের লোক ছিলেন।

জয়দেবও সেনযুগের কবি যাঁর সময়ই বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে গ্রহণ করা হয়। 

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তন তত্ত্বের মূল্যায়ন -মাহাথির আহমেদ তুষার
May 19, 2025 | বিবর্তনবাদ | views:22 | likes:0 | share: 0 | comments:0

উনিশ শতকে চার্লস ডারউইন যখন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ On the Origin of Species প্রকাশ করেন, তখনও বিবর্তন তত্ত্ব কেবল একটা অনুকল্পরূপে ছিল। আজ প্রায় দেড়শো বছর পর বিবর্তন তত্ত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।

“বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” বা Scientific Theory ব্যাপারটা আসলে কি? 

সাধারণভাবে “তত্ত্ব” কথাটাকে যতো হালকা ভাবে নেয়া হয়, বিজ্ঞানের বেলায় ঠিক ততোটাই ভারী একটা ব্যাপার সেটা। কোনও প্রাকৃতিক ঘটনার সর্বোচ্চ সঠিক ব্যাখ্যা। 

দ্যা স্ট্যানফোর্ড এনসাক্লোপিডিয়া অব ফিলোসোফির ভাষ্যমতে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে, “A scientific theory is an explanation of an aspect of the natural world and universe that can be repeatedly tested and verified in accordance with the scientific method, using accepted protocols of observation, measurement, and evaluation of results. Where possible, theories are tested under controlled conditions in an experiment.” (১)


আরেকটু সহজ করে বললে, “(বারবার) পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হাইপোথিসিসকেই থিওরি বলে।” কোনও অনুকল্প বা হাইপোথিসিস বার বার বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ার পরপরই কেবল সেটা “থিওরীর” মর্যাদা পায়। কোনও হাইপোথিসিস অপ্রমাণিত হলে বিজ্ঞানের কোনও দায় পড়ে না তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকার। এমন উদাহরণ অসংখ্য। স্টিফেন হকিং তার বিখ্যাত “A Brief History of Time” গ্রন্থে খুব সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে, “একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে যদি সে তত্ত্ব দুটি প্রয়োজন সিদ্ধ করে। অল্প কিছু স্বীকৃত নিয়মের ভিত্তিতে দাঁড় করানো কোনও মডেল যদি পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট অংশকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; এবং যদি সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কেও নিশ্চিত  ও নির্ভুল ভবিষ্যৎবাণী করা যায়।”


বিবর্তন তত্ত্ব তেমনি এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।

ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স এর ভাষ্যমতে, “বিজ্ঞানীরা প্রায়শই পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করতে “সত্য” শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে তাঁরা সত্যকে এমন কোনও কিছু বোঝাতে ব্যবহার করতে পারেন যা এতবার পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে আরও পরীক্ষা করা বা প্রয়োগের প্রয়োজন থাকে না। এই অর্থে প্রজাতির বিবর্তনের ঘটনাটি একটি সত্য। বংশগতীয় পরিবর্তন আদৌ হয় কি না সেটা আজ আর প্রশ্ন কিংবা দ্বিধার আওতায় নেই, কারণ এর পক্ষে খুবই জোরালো প্রমাণ রয়েছে।”


একই সুরে বলেছেন হারমান জোসেফ মুলার। তাঁর “One Hundred Years Without Darwinism are Enough”  প্রবন্ধের শেষ দিকে বলেছেন, “ভাবনা, অনুমান, তত্ত্ব, নীতি এবং সত্যের মধ্যে কোন সূক্ষ্ম পার্থক্য নেই। তবে, ধারণাটির সম্ভাবনার ক্ষেত্রে একটু পার্থক্য থাকে। যখন আমরা কোনও জিনিসকে সত্য বলি, তার অর্থ হলো এর সম্ভাবনা অত্যধিক — এতটাই বেশি যে আমরা এটি সম্পর্কে আমাদের কোনও সন্দেহ থাকে না এবং সেটি মেনে নিই। এখন সত্যের এরকম ব্যবহারের ক্ষেত্রে একদম সঠিক বিষয় হচ্ছে, বিবর্তন তত্ত্ব একটি সত্য বা ফ্যাক্ট।” (২)


এ ব্যাপারে দ্যা প্যালিওন্টোলজিকাল সোসাইটির বক্তব্য আরও স্পষ্ট— 

“বিবর্তন তত্ত্বকে একটি “সায়েন্টিফিক ফ্যাক্ট” ও “বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” দুটোই বলা হয়।

 বিবর্তন তত্ত্ব “প্রকৃতির এক বাস্তবতা” বা “ফ্যাক্ট” এই অর্থেই যে, জীবের জীবন প্রতি মুহুর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতিতে প্রজাতি সমূহের বৈশিষ্ট্যাবলী প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হয়ে চলছে এবং নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটছে। জীবাশ্ম রেকর্ড হচ্ছে বিবর্তন তত্ত্বের প্রাথমিক পর্যায়ের এক প্রমাণ। বিবর্তন তত্ত্বকে আরও জোরালো ভাবে ব্যাখ্যা ও প্রমাণ করতে পেরেছে বৈজ্ঞানিক আরও নানান ক্ষেত্র যেমন— তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যা (comparative anatomy), বায়োজিওগ্রাফি, জেনেটিক্স, মলিকিউলার বায়োলজি ইত্যাদি। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া সহ অন্যান্য অনুজীবের প্রকৃতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ নিয়ে গবেষণাও বিবর্তন তত্ত্বকে প্রমাণ করে।


অন্যদিকে, বিবর্তন তত্ত্বকে একটা “তত্ত্ব” বলা হচ্ছে এ কারণেই যে— এটি পৃথিবীর ইতিহাসজুড়ে ঘটা জীবের জীবনের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্বকে নানানভাবে অসংখ্যবার পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সবসময়ই নিশ্চিত হওয়া গেছে এর সত্যতা। আরও স্পষ্ট করে বললে, বিবর্তন তত্ত্ব এমন একটা পরিচ্ছন্ন তত্ত্ব, যেটা জিওলজিকাল টাইমে পৃথিবীর ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে। জীবজগতের বংশগতীয়, আণবিক ও শারীরিক সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য ব্যাখ্যা সহ পেরেছে পুরো জীবজগতের বৈচিত্র্যতা ব্যাখ্যা করতে। বিবর্তনীয় প্রিন্সিপালগুলি হচ্ছে বেসিক ও অ্যাপ্লাইড বায়োলজি, জীবাশ্মবিদ্যা, বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণার মূল ভিত্তি।” (৩)

প্রতিনিয়তই বিবর্তন তত্ত্ব ব্যবহার করে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ ও এদের সংক্রমণের ফলে সৃষ্টি রোগের প্রতিষেধক বানানো হচ্ছে। এই তত্ত্ব ব্যবহার করে অভয়ারণ্য নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জিনতত্ত্ববিদেরা বিবর্তন তত্ত্ব ব্যবহার করে আমাদের জিনোমের তথ্য উদঘাটন করছেন। বর্তমান সময়ে গবেষনাকারীরা এক নতুন ধরনের জীনতত্ত্ব বা ইভো ডেভো(Evo-Devo) ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অর্গানিজমের মধ্যে বিবর্তন প্রক্রিয়া ট্রেস করতে পারেন। এই প্রত্যেকটি ব্যবহারিক দিকই হলো বিবর্তনের জন্য এক একটি পরীক্ষা। কারণ, যদি ব্যবহারিক দিকগুলো অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয় তবে বিবর্তন তত্ত্ব-ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী তত্ত্ব হিসাবে সময়ের পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। (৪)

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার করি। কোনওকিছু “বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” হিসেবে তখনই স্বীকৃতি পায়, যখন এটি চারটি শর্ত মেনে চলে৷

শর্ত চারটি হচ্ছে:

(১)মিথ্যা–প্রতিপাদনযোগ্যতা (Falsifiability),

(২)পর্যবেক্ষণযোগ্যতা (Observability), 

(৩)পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা (Repeatability),

(৪)পূর্বাভাসযোগ্যতা (Predictability)


পৃথিবীতে যে কয়টি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে, সবগুলিই এ চারটি শর্ত মেনে তবেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হওয়ার মর্যাদা পেয়েছে। (৫)

মিথ্যা–প্রতিপাদনযোগ্যতা শর্তটার দিকে তাকানো যাক—কোনও তত্ত্বকে অবশ্যই এ শর্তের আওতায় থাকতে হবে। যেমন ধরুন, আপনি যদি কোনওভাবে দেখাতে পারেন, আলোর চেয়ে বেশি গতির কোনওকিছু আছে মহাবিশ্বে। তাহলে থিওরি অব রিলেটিভিটির মতো একটা তত্ত্বকে নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। যদি কখনও দেখাতে পারেন, গাছ থেকে আম মাটিতে না পড়ে হুট করেই আকাশে উড়ে গেছে কোনও প্রকার বাহ্যিক বল প্রয়োগ ছাড়াই—তাহলেও মহাকর্ষ তত্ত্বকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অর্থাৎ, প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা এ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলির অবশ্যই মিথ্যা–প্রতিপাদনযোগ্যতা থাকতে হবে। যেটা বিবর্তন তত্ত্বের আছে। 

পর্যবেক্ষণযোগ্যতা হচ্ছে, এ তত্ত্বটি যেন পর্যবেক্ষণযোগ্য হয়। আবার, পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা হচ্ছে, প্রতিবার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যেন একই ফলাফল আসে। মানে, একটা তত্ত্বের মেকানিজম সমূহকে যতোবারই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক না কেন, তার ফলাফল একই হতে হবে। যদি না হয়, তাহলে ভাগাড়ে ফেলা হবে। সবশেষে আসে, পূর্বাভাসযোগ্যতা বা সহজ ভাষায়, ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। একটা তত্ত্বকে অবশ্যই এ ক্ষমতা থাকতে হবে। যেমন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব থেকে কৃষ্ণ-গহ্বরের অস্তিত্ব থাকার একটা ভবিষ্যদ্বাণী এসেছে। আজকে সেটা প্রমাণিত। প্রতিটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বরই এমন ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিবর্তন তত্ত্বের কি সে ক্ষমতা আছে?

অবশ্যই আছে। বলা হয়েছিল মানুষ ও শিম্পাঞ্জি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। তাই হলো, জেনেটিক্যালি ৯৬% সাদৃশ্যতা সহ আরও নানান প্রকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। উভয়ের ক্রোমোজমের একই স্থানে পাওয়া গেছে HERV, একই স্থানে পাওয়া গেছে ন্যানোগ প্রোটিন জিন; মানব ক্রোমোজম-২ এর ফিউসন থেকে, Foxp2 জিন থেকে—অসংখ্যভাবে এর প্রমাণ মিলেছে!(৬) প্রমাণ মিলেছে পাখি ও স্তন্যপায়ীদের একই পূর্বপুরুষদের আসার মতো ভবিষ্যদ্বাণী।(৭)

 এরকম অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণীর পরিক্ষিত প্রমাণ আজকে আমাদের হাতের কাছে।(৮)


কোয়ান্টাম তত্ত্ব, পারমাণবিক তত্ত্ব, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, মহাকর্ষ তত্ত্ব, প্লেট টেকটনিক্স তত্ত্ব, বংশগতীয় তত্ত্ব সহ বিজ্ঞানের সব প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মতো বিবর্তন তত্ত্বও উপরোল্লিখিত চারটি শর্ত মেনেই একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হওয়ার মর্যাদা পেয়েছে। শুধু তাই না, এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বের মেকানিজমগুলিরই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই হয়েছে। বিবর্তন নিয়ে কি পরিমাণ গবেষণা হয়, সে ব্যাপারে আপনাদের একটু ধারণা দিই—শুধুমাত্র বিবর্তন তত্ত্ব নিয়েই পৃথিবীতে ৩০০টি জীববিজ্ঞান জার্নাল পেপার প্রকাশ করে যাচ্ছে। আজ অবধি কেবল এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির-ই ৪১ লক্ষ ৫০ হাজার পেপার পাবলিশ হয়েছে। একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ইম্পেক্ট ফ্যাক্টরের জার্নাল হচ্ছে, Nature Reviews Molecular Cell Biology, যার ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর ৯৪.৪৪। যেখানে কোনও জার্নালের ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর মোটামুটি ১০ ধরলেই সেটাকে excellent quality ধরা হয়। প্রতিবছর শুধু বিবর্তন তত্ত্ব নিয়েই স্বতন্ত্রভাবে শত শত গবেষণা প্রকাশিত হয় পৃথিবীর এই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জার্নাল থেকে।(৯) 


এরপরও এমন প্রতিষ্ঠিত সায়েন্টিফিক তত্ত্বকে এক কথায় “স্রেফ একটা মতবাদ” যদি বলে বসেন, এ ব্যর্থতা আপনারই। আপনারই বোধশক্তির চরম সীমাবদ্ধতা। আপনারই পড়াশোনার ঘাটতি। বিখ্যাত বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ারের ভাষ্যে, “বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি এতোটাই নিশ্চিত যে প্রায় সব জীববিজ্ঞানী বিবর্তন তত্ত্বকে একটি “ফ্যাক্ট” হিসেবে বিবেচনা করেন। বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি এতোটাই নিশ্চিত যে প্রায় সব জীববিজ্ঞানী বিবর্তন তত্ত্বকে একটি “ফ্যাক্ট” হিসেবে বিবেচনা করেন।” (১০)


দেখুন, একুশ শতকের বিজ্ঞানের স্ট্রাকচারই এরকম যে, এখানে বিবর্তন ছাড়া অন্য কোন তত্ত্ব আসার প্রশ্নই আসে না। কিভাবে এলাম আমরা, কেন বিভিন্ন প্রাইমেটদের একই রোগ জীবাণু আক্রমণের দীর্ঘ হিস্ট্রি, এতো এতো ট্রানজিসনাল ফসিলের কিসের যোগসূত্র ইঙ্গিত করে, কেন ব্যাক্টেরিয়ারা রেজিস্ট্যান্ট হয়, কেনই বা আমাদের শরীরে এখনও রয়ে গেছে এমবিওটদের(পাখি, সরীসৃপ) ভগ্ন জিন ভিটেলোজেনিন, কেনই বা আমাদের দ্বিতীয় ক্রোমোজম ফিউজ, আমাদের অতীত, ভূত-ভবিষ্যৎ—সবকিছুর উত্তর পূণ্যশ্লোকের কোনও কিতাবে কখনও পাওয়া যাবে না। যেতে হবে বিজ্ঞানের কাছে। বিজ্ঞান এ সবকিছুর উত্তর যে তত্ত্বের মাধ্যমে এস্টাব্লিশ করেছে, সেটা এই থিওরি অব ইভোলিউশন। 


বিবর্তন মানে কী? বিবর্তন মানে descent with modification- এক জীবের পপুলেশানে পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্য জীবের আবির্ভাব। এখন ধরে নিন কেউ বলছেন- কোন এক প্রজাতির ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব ভুল। এই কথাটার মানে কী? এই কথাটার মানে এই প্রজাতিটা অন্য কোন জীব থেকে আসেনি। তার মানে কোথা থেকে এসেছে? হয় হাওয়া থেকে কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই আপনাআপনি তৈরি হয়েছে, অথবা (সচরাচর মানুষ যেটা ইমপ্লাই করে) অলৌকিক কোন উপায়ে এসেছে। আজকের দিনের বিজ্ঞানের গোড়ার কথাই হচ্ছে লৌকিক কার্যকারণের ভিত্তিতে সবকিছু ব্যাখ্যা করা। আপনি যদি আপনার আমার অরিজিনকে কোনও ‘বিশ্বাস’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। আমার তাতে আপত্তি নেই। বিশ্বাস, তার নিজের জায়গায়। 


আমি সোজা কথায় বলি, কেন ভূমিকম্প হয়, সেটুকুর empirical আর সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা আপনি জানতে চাইলে কোথা থেকে জানতে হবে?

সেটা জানতে আপনাকে ‘প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব’ নামে বিজ্ঞানের এক প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দ্বারস্থ হতে হবে। বিকল্প, প্রমাণিত কোনও ব্যাখ্যা নেই। 


একই ভাবে আমাদের মানুষ হিসেবে আবির্ভাবের ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিয়ে জানতে কেবল এবং কেবল মাত্রই “থিওরি অব ইভোলিউশন” এর দ্বারস্থ হতে হবে। এরচেয়ে আর কোনও ওয়েল এস্টাব্লিশড তত্ত্ব বিজ্ঞানে নেই। বাচ্চাদের প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব পড়ানো ক্ষতিকর না হলে ইভোলিউশন পড়াতেও ক্ষতি দেখি না। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে বিজ্ঞানের জায়গাটা কোথায়, এটুকু জানার অধিকার সব মানুষের আছে।


আমাদের তৃতীয় বিশ্বের এই বিজ্ঞান না জানা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের কাছে তুড়ি মেরে বিজ্ঞান নিয়ে মিথ্যাচার করা সহজ হতে পারে। কিন্তু এতে করে বিজ্ঞানের এস্টাব্লিসড কোনওকিছুকে আনএস্টাব্লিস করা যায় না। নাসার ওয়েবসাইটে উঁকি দিয়ে দেখে আসুন না, Life এর বিজ্ঞানভিত্তিক ডেফিনিশন হিসেবে কি ফিক্স করল তারা। তাদের ভাষ্যে, “Life is a self-sustaining chemical system capable of Darwinian evolution”. (১১) 


এই সেদিনও, ২০২২ সালে সুইডিশ গবেষক সাভান্তে পাবো নোবেল পেলেন, মানুষেরই আরেক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে। ২০১০ বিশ্ববিখ্যাত Science জার্নালে (ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর ৬৩.৭১) তাঁর এ কাজটি প্রকাশিত হয়। এরপরের সুদীর্ঘ এক যুগের রিভিউয়ের পর তাঁর এ সম্মাননা। শুধু তাই না, এ নোবেল লরিয়েট একই গবেষণায় মানুষ এবং পূর্ববর্তী হোমিনিন পূর্বপুরুষদের জিন ট্রান্সফারের ব্যাপারটিও প্রমাণ করেছেন। এ ব্যাপারে তাদের ওয়েবসাইটে নীচের লিংকে দেয়া আর্টিকেলটায় চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন। (১২) 

তাই বলছি, কোনও এস্টাব্লিশড সায়েন্টিফিক তত্ত্বকে অস্বীকার করা, মানুষকে মিসলীড করাটা মোটেও ঠিক না। আমি সেটাকে মোরালি ইনকারেক্ট-ই ভাবি। বিশ্বাস থাকুক বিশ্বাসের জায়গায়। আমরা সেটাকে নাহয় নিজের মতো করে ধারণ করে চলি। আর বিজ্ঞান থাকুক বিজ্ঞানের জায়গায়। একটা আরেকটাকে স্পয়েল করে দিচ্ছে, এমনটা ভাবতেই হবে কেন বলুন?


তথ্যসূত্রঃ

(১) "The Structure of Scientific Theories". The Stanford Encyclopedia of Philosophy. Metaphysics Research Lab, Stanford University. 2016.  

(২) Muller, Hermann Joseph (April 1959)। "One Hundred Years Without Darwinism Are Enough",

(৩) The Paleontological Society Position Statement: Evolution

 (৪) Evolution: Fact and Theory | National Center for Science and Education.

(৫) Emergence and Modularity in Life Sciences, Lars Wegner, page-15

(৬) আত্মীয়তার প্রমাণাদি, মাহাথির আহমেদ তুষার | বিজ্ঞানব্লগ | প্রকাশকাল: ২ জুলাই, ২০২১ 

(৭) Brawand, D. Wahli, W., & Kaessmann, H.(2008). Loss of egg yolk genes in mammals and the origin of lactation and placentation. PLoS Biology, 6(3), e63. 

(৮) Evolution Predictions | Talk Origin.

(৯) Updated List of High Journal Impact Factor Evolution Journal.

(১০) Mother, Ernst (198). Tiered a New Philosophy of Biology: Observations of Go Evolutionist. Cambridge.

(১১) https://astrobiology.nasa.gov/research/life-detection/about/#:~:text=The%20NASA%20definition%20of%20life,Organic%20Life%20in%20Planetary%20Systems

(১২)  www.nobelprize.org/prizes/medicine/2022/advanced-information/

কবিতা - সাম্যবাদী -PRIYANKA MAITY PAL
May 5, 2025 | কবিতা | views:6 | likes:1 | share: 0 | comments:0

সাম্যবাদী


আমি ভক্তি,ভয়,ভড়ং ,ভ্রম

                 আর ভনিতা সর্বস্ব ঈশ্বরবাদী ন‌ই।

আবার শাস্ত্র সর্বজ্ঞ দিগভ্রষ্ট 

              কোনো কূপমণ্ডূক ঈশ্বরবিবাদীও ন‌ই!


আমি নিরলস এক যুক্তিবাদী, 

             চোখে সতত প্রশ্নচিহ্ন আঁকা থাকে।

আমার চির কৌতূহলী মনন,

              কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস রাখে।


আমি নিষ্ঠা,সততা,শ্রম দিয়ে 

                দায়িত্বে, কর্তব্যে একান্ত অনুগত।

অপারগতা আমার অক্ষমতা নয়! 

               আমি সীমাবদ্ধতার কাছে সংযত।


সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত রোজ, 

             ধর্মের নামে যত অধর্ম ঘটতে দেখি!

অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় মোড়া

              সামাজিক সব সংস্কারবোধ মেকি।


রন্ধ্রে রন্ধ্রে জন্ম নিয়েছে স্বার্থান্ধতা!

               বুভুক্ষু দৃষ্টিতে ভরা শুধু হাহাকার!

প্রতিহিংসার আগুনে লেলিহান শিখা,

                জ্বলে পুড়ে শুভ শক্তিরা ছারখার।

 

কেনা বিবেকের খোলা বাজারে 

               চড়া দামে দরে মেরুদন্ড বিক্রি হয়।

বঞ্চনা, বিভেদ, বৈভব আর বৈষম্যে,

               আমার রক্তে সুপ্ত প্রতিবাদ জন্মায়।


আমি রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হ‌ই,

              তবু প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাঘাত ফেরাইনা।

সহিষ্ণুতা আমাকে পঙ্গু করেছে,

                তাই প্রগলভতার সমুদ্রে আঁচাইনা।


আমি রোজ নতুন 'আমি'র জন্ম দিই।

                আমার পৃথিবী আমার শর্তে ঘোরে।

আমার মৃত্যু প্রতি পলে ত্বরান্বিত হয়,

             বেঁচে থাকার শর্তসাপেক্ষ ইশতেহারে।


ভুলে রিক্ত সমাজ তুলি দৃপ্ত আওয়াজ,

                হোক মানবজমিন আবার‌ও আবাদী,

খুলে রাখি হৃদয়ের দ্বার চির অবারিত,

            নিদারুণ এই অসাম্যেও আমি সাম্যবাদী।



 




কবিতা: দ্রোহ -PRIYANKA MAITY PAL
May 2, 2025 | কবিতা | views:462 | likes:2 | share: 0 | comments:0

দ্রোহ

প্রিয়াঙ্কা মাইতি পাল


এ দেশে হত্যা মৃত্যুও, 

নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না।

রাজনীতির মর্গে শুইয়ে রেখে,

ছিন্নভিন্ন শবেদেহের ব্যবচ্ছেদ চলে।

শাসকের গদি মজবুত হয়,লাস পচে গলে।

পৈশাচিক আনন্দে আত্মহারা বিবেকের মৃত্যু হয়।

এখন‌ ভাইয়ের রক্ত‌ ভাইয়ের রুজি রুটি জোগায়।


হানাহানি, হিংসার গ্রাসে 

সভ্য সমাজ উদরপূর্তি করে।

উন্মত্ত ওরা রক্তের ঋণ ভোলে।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নগ্ন সন্ত্রাসবাদে 

স্বার্থসচেতন সমাজে ধর্মের ধ্বজা ওড়ে,

ভোট বাক্সে ব্যালট আর বুলেটে সখ্যতা বাড়ে।

জনগণ সার্কাস দেখে, নয়তো দলে নাম তোলে।


স্তাবকতা আর মোসাহেবি!

গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নামে,

ভোট উৎসব আর প্রহসন চলে।

রক্ষক অচিরেই ভক্ষকে পরিনত হয়

পদপিষ্ট পদলেহী জমানা ইতিহাস গড়ে,

সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে সিলমোহর‌ পড়ে।

মানুষ তো আজীবন দাসত্ব‌কেই উপভোগ করে!


এ সভ্যতা শ্বাপদ সঙ্কুল।

অস্তিত্বের সংকট!প্রাণ সংশয়!

এ পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য নয়।

মন্দিরে বানিজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ হয়।

মসজিদে ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন চলে।

ধর্মের আঁতুড় ঘরে ওরা সন্ত্রাসের জন্ম দেয়।

ক্ষমতালোভী বর্বরতায় সযত্নে ভয় লালন করে!


বলতে দ্বিধা নেই আজ,

জন্মেছি অশিক্ষিতের দেশে।

এ মানব জাতি ধর্মান্ধতার ফসল!

এই সমাজ দিগ্বিদিক শূন্য বহুকাল!

মহামানবের জীবনদর্শন প্রতিভাত হয়,

পুঁথিগত অসার জ্ঞানের উপঢৌকন বেশে।

'আমির' বাড়বাড়ন্ত‌ই আজ 'আমিত্বে'র অবক্ষয় !

আত্ম-জাগরণ -Puspabanta Bangla
April 23, 2025 | category | views:10 | likes:0 | share: 0 | comments:0
লোকে বলতে পারে এটা পড়িস না, কারণ এটা ভালো না; ওটা পড়িস না, কারণ ওটা নিষিদ্ধ। কিন্তু বিবেচনা করুন, এটা ওটা না পড়লে কিভাবে বুঝবেন যে এটা কেন খারাপ বা ওটা কেন নিষিদ্ধ। যিনি আপনাকে পড়তে নিষেধ করছে, তিনিও হয়ত জানেন না। আর আপনি শুনেই যদি ক্ষান্ত দেন; তবে আপনার আর জানা হল না; কি ছিল এর ভিতরে। জানতে হলে পড়তে হবে।
গোঁড়াপন্থীগণ কিংবা চতুর স্বার্থবাদীগণ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে অনেকের জন্য অনেক কিছুই অপাঠ্য কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন; কারণ ওসব পড়লে সত্য বেরিয়ে পড়তে পারে, যাতে তাদের বিপদ হতে পারে।
প্রাচীনকালে বিভিন্নপ্রকার বাঁধা থাকলেও বর্তমানে পড়াতে বিশেষ কোন বাধা নাই, তাই গণ্ডিবদ্ধ চিন্তাধারার উর্ধে উঠে বিভিন্ন ধরণের বই পড়া উচিত। যত পড়বেন তত মুক্ত হবেন।
মানুষ হবার শিক্ষা কতদিনে পাবো? -Puspabanta Bangla
April 22, 2025 | সমাজ | views:14 | likes:0 | share: 0 | comments:0
আমরা শিক্ষিত হই। কেমন শিক্ষিত হই? জানেন?
কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মতো মেমোরিতে কতকগুলো তথ্য-সূত্র ঢুকিয়ে রাখি আর প্রয়োজন অনুসারে যন্ত্রযোগে ব্যবহার করি।‍‍‍
প্রথাগত এই শিক্ষায় আমাদের হাতে আসে সনদ (শিক্ষার সার্টিফিকেট)। সেই সার্টিফিকেটের বদৌলতে আর হার্ডডিস্কে জমা থাকা তথ্য ব্যবহার করে আমরা চাকরি চাই, টাকা রোজগার করি। কিন্তু---
কিন্তু এই শিক্ষায় আমাদের আত্মিক বা নৈতিক জাগরণ ঘটে না, আইন-নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগে না, কাজের প্রতি নিষ্ঠা জাগে না, করতে হয় তাই করি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের, পরিবারের, সমাজের, দেশের প্রতি মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ জাগে না।
মানুষের মনন উচ্চতর স্তরের না হলে শিক্ষায় যতই বড় বড় সার্টিফিকেটধারী হোক না কেন, মানুষ হিসেবে সেই নিম্নমানের রয়ে যাবে। তাই ত চারিদিকে দেখতে পাই- যত বড় বড় ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, শঠতা, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন, ----- আরও কত অপরাধমূলক কাজ অধিকাংশই শিক্ষিত মানুষের দ্বারাই সংগঠিত হয়।
শিক্ষিত হবার পাশাপাশি মানুষও হতে হবে। মানুষ হবার শিক্ষা কতদিনে পাবো?
মানবধর্ম বনাম ধর্মমানব -Sumon
April 22, 2025 | সমাজ | views:12 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মানুষ কি সরাসরি বানর থেকে এসেছে?
প্রশ্নটি যতটা বিস্ময়কর, উত্তরটি তার চেয়েও গভীর এবং ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হলে বিপজ্জনক
বিজ্ঞানের চোখে, মানুষ ও আধুনিক বানর—চিম্পাঞ্জি, গরিলা বা ওরাংওটাং—একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, যে আজ থেকে প্রায় ৬-৭ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকার কোনও গহীন জঙ্গলে তার অস্তিত্ব রেখে গেছে। ডারউইন যখন বললেন “Survival of the fittest”, তখন তিনি কোনো ‘ধর্মবিশ্বাস’ টিকিয়ে রাখার কথা বলেননি, বরং জীবনের সেই আদিম কৌশলের কথা বলেছেন— "যে টিকতে জানে, সেই বেঁচে থাকে।"

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই প্রথম মানব যখন জ্ঞানচক্ষু মেলে চারদিকে তাকালো, সূর্যকে দেখল, বজ্রপাত শুনল, অন্ধকারে ভয় পেতে শুরু করল—তখন কি সে ঈশ্বরকে চিনেছিল?
তার ঈশ্বর কে ছিলেন? বজ্রপাত? অগ্নি? নদী? গাছ? নাকি নিজেই নিজের ঈশ্বর ছিল?

ধর্ম হয়তো তার পরে এসেছে, যখন মানুষ কিছু ব্যাখ্যা করতে পারেনি, কিন্তু অনুভব করেছে। ধর্ম তখন হয়ে উঠল তার প্রশ্নহীন আশ্রয়, তার ভয় আর বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়া। ঈশ্বরের জন্ম হলো সেই মুহূর্তে, যখন মানুষ বলল—"আমি জানি না, তাই এটা নিশ্চয় কোনো অলৌকিক শক্তির কাজ।"

তবে ইতিহাস আমাদের দেখায়, ধর্ম স্থায়ী নয়
সুমের, ব্যাবিলন, গ্রিক, মিশর, ইনকা—সব সমাজেই ছিল ধর্ম, ছিল দেবতা, ছিল ধর্মগ্রন্থ, যজ্ঞ, উপাসনা। কিন্তু আজ? কোথায় তারা?
তাদের ঈশ্বর কোথায় গেলেন? তারা কি মারা গেলেন নাকি চাকরি থেকে অবসরে গেলেন?

ধর্ম এসেছে মানুষের অস্তিত্বকে প্রশ্নহীনভাবে অর্থ দিতে। কিন্তু প্রশ্নহীন অর্থ, অর্থহীন প্রশ্নে রূপ নেয় যখন যুক্তি চাপা পড়ে বিশ্বাসের চাদরে

আজ আমরা হাজারো ধর্মে বিভক্ত, অথচ দাবি করি আমাদের ঈশ্বর একজনই
এ যেন এক কাকতালীয় গানের কোরাস, যেখানে সবাই গাইছে এক সুরে, কিন্তু সবাই বিশ্বাস করছে তার সুরই সবচেয়ে সঠিক সুর

সকল ধর্মই দাবি করে, তাদের ধর্মগ্রন্থই ঈশ্বরপ্রদত্ত। কিন্তু যদি ঈশ্বর একজনই হন, তাহলে তিনি একাধিক ধর্মগ্রন্থ কেন পাঠালেন?
নাকি তিনি বারবার মানুষকে নতুন সংস্করণ দিতে বাধ্য হলেন, কারণ মানুষের সাথে সাথে বানীরও ‘আপডেট’ প্রয়োজন?

ধর্মগ্রন্থে লেখা থাকতেই পারে, “এই পুস্তক আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান প্রেরিত।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো— একটি বই নিজেই যদি বলে সে ঈশ্বরপ্রেরিত, সেটাই কি যথেষ্ট প্রমাণ?
তাহলে তো আমিও একটি বই লিখে বলতেই পারি, “এই বই স্বয়ং ঈশ্বর হতে ভেরিফায়েড।”
তাতে কি পাঠকের সন্দেহ ঘুচবে, না ঈশ্বর তার অফিসিয়াল সীল মারবেন?

আর যদি সেই প্রমাণ না থাকে, তাহলে আমরা আসলে বিশ্বাসের এক মরুভূমিতে হাঁটছি—যেখানে জল আছে বলেই মরীচিকা দেখি, কিন্তু জল নেই বলেই কেউ তৃষ্ণা মেটাতে পারে না

তবে ধর্ম একেবারেই অপ্রয়োজনীয়—এই কথাও বলা অন্যায়
ধর্ম আমাদের সভ্যতাকে গড়তে সাহায্য করেছে, নৈতিকতা শিখিয়েছে, সহানুভূতির বীজ বুনেছে
কিন্তু ধর্ম যখন হয়ে ওঠে অন্ধবিশ্বাসের আধিপত্য, তখন তা সত্যের নয়, বরং ক্ষমতার অস্ত্র

সুতরাং প্রশ্নটি আজও থেকে যায়—
প্রথম মানবের ধর্ম কী ছিল?
হয়তো “ধর্ম” নয়, তার ছিল “উত্তরণ”—
কীভাবে বাঁচা যায়, কীভাবে শিকার করা যায়, কীভাবে আগুন জ্বালানো যায়, কীভাবে ভালোবাসা যায়

তাকে হয়তো কোনো ধর্মগ্রন্থ শেখায়নি মানুষ হওয়া,
সে নিজেই মানুষ হয়েছিল

আর আজ, এত ধর্ম, এত গ্রন্থ, এত নিয়ম—
তারপরও আমরা মানুষ হয়ে উঠলাম কি?

---

ধর্ম যদি সত্যিই ঈশ্বরপ্রদত্ত হয়, তবে তার প্রথম পাঠ হওয়া উচিত ছিল—
মানুষ হও, তারপর আমাকে বিশ্বাস করো।”
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এখনও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, অথচ ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? -Puspabanta Bangla
April 21, 2025 | শিক্ষা | views:13 | likes:18 | share: 2 | comments:0
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?
- রুটি-রুজির বন্দোবস্ত করা। সোজা কথায় সহজ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করার ব্যবস্থা করা। যেমন চাকরি।
কিন্তু এই কী শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য?
- না! কোনো মতেই না। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো মনের সংকীর্ণতা দূরীভূত করা। মন ও মননের উন্নয়ন। ক্ষুদ্র ও মানসিক দৈনতার অবসান ঘটিয়ে মনকে সংস্কারাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়া। অনুভব শক্তি বৃদ্ধি করা। অনুভূতি ও সমানুভূতির চর্চা করা। কর্তব্য-দায়িত্ব-অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি। যেকোনো ঘটনার কার্য-কারণ অনুসন্ধানে মনস্তাত্ত্বিক সংশয়ের উর্ধে উঠে যুক্তিবোধের সাহায্যে বিচার-বিশ্লেষণ করতে শেখা। মানুষের মূল্যবোধ তৈরি। কাজকে (কায়িক ও বুদ্ধিভিত্তিক উভয়) গুরুত্ব দিতে শেখা। গুণ ও কর্ম অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগ্যতা নিরুপণ ও মর্যাদা প্রদান করতে শেখা। সর্বোপরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো নিজেকে আবিষ্কার করা, নিজেকে চেনা, মানুষকে চেনা, সমাজ-দেশ-বিশ্বকে চেনা, মানুষ হয়ে ওঠা।
অমৃত আসলে কী? -Guitar K Kanungo
April 10, 2025 | category | views:41 | likes:0 | share: 0 | comments:0



পুরাণ বলছে, অমৃত এমন একটা বস্তু, যেটা পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠেছিলেন। একথার আরেকটা মানে হল—দেবতারা অমৃত পান করার আগে পর্যন্ত অমর ছিলেন না। পুরাণ আমাদের একথাও বলছে, একটা সময় পর্যন্ত দেব-দানবের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ হত এবং সেই যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক দেবতাই মারা যেতেন। দেবতাদের হাতে অনেক দানব আহত, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী হলেও, তাদের গুরু, শুক্রাচার্য্য, মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে তাদের বাঁচিয়ে তুলতেন। ফলত দেবতারা বেশ কিছুটা নিগ্রহের ভেতর দিয়েই যাচ্ছিলেন।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে, এদিকে আবার দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের উপর নেমে এলো দুর্বাসার অভিশাপ। অহংবোধে তাড়িত হয়ে, ইন্দ্র দুর্বাসার দেয়া উপহার অবজ্ঞা করার ফলে শ্রীহীন, তথা শক্তিহীন হয়ে পড়লেন। নিরুপায়, অসহায় দেবতারা এবার ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ভগবান বিষ্ণু সবই জানতেন। তিনি দেবতাদের সমুদ্র মন্থন করবার নির্দেশ দিলেন। বললেন—মন্থনের ফলে যে অমৃত উঠে আসবে, সে অমৃত পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠবেন। দানবেরা আর দেবতাদের সাথে পেরে উঠতে পারবে না।

সমুদ্র মন্থন কিভাবে হয়েছিল, সে গল্প আমরা মোটামুটি সবাই জানি, তবে মন্থনের দড়ি হিসাবে বাসুকি নাকি অনন্ত নাগ ব্যবহৃত হয়েছিল, এই নিয়ে পুরাণ সমূহে কিছুটা বিরোধ আছে। তবে মন্থনের শেষ পর্যায়ে যে অমৃত নিয়ে ধন্বন্তরি উঠে আসেন, সেটা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু নিজেও এই মন্থনকাজে অংশ নিয়েছিলেন। দেব-দানবের 'অমানুষিক' টানাটানির এক পর্যায়ে, মন্দার পর্বত ক্ষিরোদ সাগরের অভ্যন্তরে ডুবে যেতে থাকলে, ভগবান বিষ্ণু নিজে কুর্ম তথা কচ্ছপ অবতারে পর্বতের নিচে অবস্থান করে মন্দার পর্বতকে ধারণ করে থাকেন। অমৃতের পাশাপাশি, মন্থনের ফলে হলাহলও উঠে এসেছিল, যেটা পান করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেন।

এই মন্থনের ফলে দেবী লক্ষ্মী (এবং অপ্সরারা) সহ আরও বেশ কিছু সামগ্রী উঠে আসে। কামধেনু সুরভি, ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবা, কৌস্তুভ মণি ইত্যাদি সেসব সামগ্রীর অন্যতম। কিন্তু আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে, অমৃত হাতে যিনি উঠে আসেন, তাঁর নাম ধন্বন্তরি এবং পরবর্তীতে তিনি দেবতাদের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত হবেন। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, ভগবান বিষ্ণুর আদেশে মন্থন শুরু করবার আগে বিপুল পরিমাণ নানান প্রকারের লতাগুল্ম ইত্যাদি ক্ষিরোদ সাগরে ফেলা হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল মন্থন। এই লতা-গুল্ম ফেলে দেবার কথাটাও আমাদের বিশেষ করে মনে রাখতে হবে।

ঠিক এইখানে আমরা আরেকবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের আলোচনায় ফেরত যাব। শুরুতে আমরা বলেছি—দেব-দানবের যুদ্ধে নিহতদের, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। এই ক্ষমতাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের, তবে শুক্রাচার্য যে একজন সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকা ভেষজ চিকিৎসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মৃতদের বাঁচাতে না পারলেও, তিনি তাঁর আবিষ্কৃত কোন এক পাঁচন তথা ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে আহত দানবদের নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। রামায়ণে সুষেণ নামের এক বৈদ্যের পরামর্শে আমরা হনুমানকে গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী নামের ঔষধী গাছ আনতে ছুটতে দেখব।

যুদ্ধে আহতদের সরিয়ে তোলার জন্যে দেবতাদের এরকম একজন চিকিৎসক এবং একরকম একটা পাঁচনের প্রয়োজন ছিল। ধন্বন্তরি হলেন শুক্রাচার্যের দেবকুল সংস্করণ, আর অমৃত হল শুক্রাচার্যের আবিষ্কৃত পাঁচন। যে পদ্ধতিতে মন্থনের কথা বলা হয়েছে, যে পদ্ধতিতে অমৃত উঠে এসেছে—একটু মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ঠিক একই পদ্ধতিতে ভেষজ চিকিৎসকরা পাঁচন তৈরি করে থাকেন। তফাৎটা কেবল এই—দেবতারা যেখানে যে কাজটা ক্ষিরোদ সাগরে করে থাকেন, আজকালকার দিনের ভেষজ চিকিৎসকরা সেই কাজটা হামানদিস্তায় করে থাকেন। আনুষাঙ্গিক উপকরণ কিছুটা ভিন্ন, উপাদান এবং পদ্ধতি অনেকটাই একই রকম।

আরেকটা কথা—দেবী লক্ষ্মী, অপ্সরা এবং সুরভীর উঠে আসা—এসব পৌরাণিক বাগাড়ম্বর; এসবকে আমাদের এক পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, অমৃত নিয়ে দেবী লক্ষ্মীও উঠে আসতে পারতেন। তিনি পরবর্তীতে ভগবান বিষ্ণুর বক্ষলগ্না হবেন। অতএব, তাঁর সেই যোগ্যতা ছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঠিক সেইভাবে ঘটেনি। যে অমৃতের জন্য এতো আয়োজন, সেই অমৃত নিয়ে যিনি উঠে এসেছেন তিনি আর স্বয়ং ধন্বন্তরি—যিনি একজন চিকিৎসক। যদি অমৃত একবার পান করলেই সবাই অমর হয়ে যেত, তাহলে ধন্বন্তরির উঠে আসবার প্রয়োজন ছিল না। আসলে, মন্থনের নানান বর্ণনার মধ্যে অমৃত আসলে কী, তার ইঙ্গিত দেয়া আছে। আমাদের সেই ইঙ্গিতগুলিকে বুঝতে হবে।

তবে সব কথা শেষ হবার পরেও একটা কথা আছে। পুরাণ বলেছে, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র পেয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছ থেকে। যদি এই বিদ্যাকে আমরা ভেষজ বিদ্যা বলে ধরে নিই, তাহলে অবশ্য একটা প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকেই যায়। সমুদ্র মন্থন ছিল এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেবতারা মহাদেবের কাছে গেলেন না কেন এই বিশেষ জ্ঞানের জন্য? তাহলে তো সমুদ্র মন্থনের মত এক বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করার প্রয়োজন হতো না ! দেবতাদের রক্ষার্থে যিনি নীলকণ্ঠ হতে পারলেন, তিনি নিশ্চয়ই দেবতাদের কাউকে এই জ্ঞান খুব সহজেই শিখিয়ে দিতে পারতেন।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন—হনুমান গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনে শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দেননি। একই কাজ দেবতারাও করছেন।

চোখ ঢেকে গান্ধারী দায়িত্ব এড়িয়েছেন মাত্র। -Guitar K Kanungo
April 2, 2025 | category | views:169 | likes:0 | share: 0 | comments:0
কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে সমস্ত দায় কৃষ্ণের— গান্ধারী এই মর্মে কৃষ্ণকে অভিশাপও দিয়েছেন, এবং কৃষ্ণ যে সেটা মাথা পেতে নিয়েছেন, সেটা কৃষ্ণের বদান্যতা। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধ্বংসের পেছনে এককভাবে কৃষ্ণ দায়ী— এরকম করে ভাবতে পারি না। কৌরবদের পতনের পেছনে দুর্যোধনের দায় তো ছিলই, দুর্যোধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্র নিজেও অনেকটা দায়ী ছিলেন। সিংহাসন নিয়ে এই লড়াই অব্যাহতভাবে চলতে থাকার পেছনে পিতামহ ভীষ্মের অবদানও খুব একটা কম ছিল না। তিনি নিজে কখনো বিয়ে করবেন না— এরকম একটা উদ্ভট, অরাজক প্রতিজ্ঞা করে না বসলে, উত্তরকালে হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে এই লড়াইয়ের সূচনাই হত না। এমনকি কাশী রাজকন্যা অম্বাকে নিয়ে তিনি যখন একটা ধর্মসংকটের মতো অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন পিতা শান্তনুকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে তিনি অম্বাকে বিয়ে করলে এই সংকটের সৃষ্টি হত না। একই রকম দায় গান্ধারীরও ছিল। আজকের আলোচনা সেই বিষয়ে।
অনেকেই মাতা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই বর্ণনা করে থাকেন। স্বামী অন্ধ, দৃষ্টিহীন বলে তিনি স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকে বরণ করে নিয়েছেন— এরকম একটা ধারণা মহাভারতের অনেক পাঠকের মধ্যেই আছে। অবশ্য অন্য একটা ধারণাও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, গান্ধারী ঠিক স্বামীর অন্ধত্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য নয়, বরং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই সারাজীবন চোখের ওপর কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় ধারণাটাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়, কারণ গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল। গান্ধারী বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী নন; রুক্মিণী যেমন ভালোবেসে কৃষ্ণকে বিয়ে করেছিলেন, গান্ধারী সেটা করেননি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে আদৌ ভালোবাসতেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষত হস্তিনাপুরের কারাগারে তাঁর পিতা-মাতার মৃত্যু যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
গান্ধারীর চোখে কালো পট্টি বাঁধার ব্যাপারটা যদি প্রতিবাদস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এর আরও একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। এরকমও হতে পারে যে তিনি যেদিন হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছেছিলেন, সেদিন থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন যে এই রাজ্যের ভালো-মন্দ কিছুতেই তিনি নিজেকে কোনোদিন জড়াবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু কানে তো শুনতে পেতেন! চারিদিকে কী ঘটছে, সে খবর তাঁর কানে পৌঁছায়নি— এমন ভাবার তো কোনো কারণ নেই। যেদিন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হলো, সেদিন রাজসভায় তিনি হয়তো ছিলেন না, কিন্তু এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন তো তিনি অন্তঃপুরে ছিলেন। ঘটনার খবর নিশ্চয়ই তাঁর কানে পৌঁছেছিল! কিন্তু তাঁকে তো এই ঘটনা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না। অন্ধ হয়ে থাকলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? না, এই ক্ষেত্রেও থাকেনি। অন্যদের মতো মাতা গান্ধারীও জানতেন— দ্রৌপদীর প্রতি দেখানো এই অসম্মান কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার অন্যতম কারণ।
হতে পারে, পাণ্ডবদের পিতৃত্ব নিয়ে দুর্যোধনের সন্দেহ ছিল। সেই জন্যেই হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ওপর পাণ্ডবদের দাবি সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মুশকিল হচ্ছে, এইভাবে দেখলে তার পিতারও হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসার অধিকার নেই, কারণ তিনি মহারাজ শান্তনুর ঔরসজাত সন্তান ভীষ্মের বংশধারায় জন্মাননি। তিনি আসলে মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র— হস্তিনাপুরের সঙ্গে যার সেই অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই। তবুও দুর্যোধন পাণ্ডবদের দুচোখে দেখতে পারত না। এই নিয়ে প্রধানত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে দুর্যোধনের একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রতিহিংসামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দুর্যোধন ছোটবেলাতেই ভীমকে একবার বিষ খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভীম বেঁচে যায়। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা— এবং রানী গান্ধারী নিশ্চয়ই এই ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো পুত্র দুর্যোধনকে ভৎসনা করেছিলেন? সেরকম কোনো খবর আমাদের মহর্ষির লেখায় পাওয়া যায় না। তাঁকে হত্যার এই চেষ্টার কথা ভীম ভুলে যায়নি এবং দুর্যোধনকে হত্যা করেই সে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছিল।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, পুত্র-স্নেহেও অন্ধ ছিলেন; তাঁর মধ্যে লোভও ছিল। শারীরিক বৈকল্যের কারণে তাঁর রাজা হওয়ার কথা ছিল না। ছোটভাই পান্ডুর হয়ে রাজ্য চালাচ্ছিলেন তিনি। বিধি অনুযায়ী পান্ডুর ছেলেদের তাদের পিতার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিনি সেটা করেননি। শুধু তাই নয়, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে পুত্র দুর্যোধনই রাজা হোক। পান্ডুর পুত্রদের হস্তিনাপুর থেকে দূরে রাখার দুর্যোধনের সমস্ত চেষ্টাকে কখনো সরবে, কখনো নীরবে সমর্থন করেছেন। একই ছাদের নিচে থেকে তাঁর পুত্রদের সমস্ত অপকর্মের কথা ধৃতরাষ্ট্র যেমন জানতেন, তেমনি গান্ধারীও জানতেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, কিন্তু গান্ধারী অন্ধ না হয়েও অন্ধের মতোই ছিলেন। ন্যায়ত যদি ধৃতরাষ্ট্র একজন দুষ্টু লোক হন, তবে একই অভিধা গান্ধারীরও পাওয়া উচিত। কিন্তু পাঠকেরা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই দেখে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, গান্ধারীকে পুরোপুরি সাধ্বী বলা যায় না— সেই ইঙ্গিত কিছুটা বাসুদেব কৃষ্ণ দিয়েও রেখেছেন।
কীভাবে দিয়েছেন, সেই গল্পটা এখানে প্রাসঙ্গিক। গান্ধারী জানতেন, ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিল উরু ভেঙেই দুর্যোধনকে হত্যা করবে, যেহেতু দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে উরু দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিল। দুর্যোধন যে অনুচিত কাজ করেছিল, তা জেনেও গান্ধারী ভীম যাতে এই কাজটা করতে না পারে, সেই জন্য সচেষ্ট হন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যেহেতু স্বামীর সঙ্গে সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে পুরো বিবাহিত জীবন চোখে কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন, সেই জন্য তাঁর দৃষ্টিতে এক বিশেষ রকমের ক্ষমতা জন্মেছিল। তিনি দুর্যোধনকে সেই দৃষ্টি দিয়ে অবধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই একদিন দুর্যোধনকে পুরো নগ্ন হয়ে তাঁর কাছে আসতে বললেন। দুর্যোধন সেই মোতাবেক মায়ের সামনে হাজির হতে চলেছিলেন, কিন্তু পথে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। কৃষ্ণ বললেন, "মায়ের সামনে একেবারে দিগম্বর হয়ে যাওয়াটা কি তোমার জন্য শোভন? অন্তত শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে রাখা উচিত।" দুর্যোধন তাই করলেন। গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের শরীরকে অবধ্য করতে পারল না, কারণ সে দুর্যোধনের শরীর পুরোপুরি অনাবৃত ছিল না। গান্ধারীর এই ব্যর্থতা নির্দেশ করে, তাঁর এই স্বেচ্ছা-অন্ধত্বকে সব সময় গৌরবজনক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
তুমি কেমন ঈশ্বর, যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর! -Guitar K Kanungo
March 30, 2025 | category | views:40 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতে বাসুদেব কৃষ্ণ বলেছিলেন, তিনি এই যুদ্ধে কারো পক্ষ নেবেন না। এই কথা শুনে মহামতি ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, ভীষ্ম ছিলেন সেই গুটিকয়েক মানুষদের একজন, যিনি জানতেন বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান কৃষ্ণের অবতার। ভীষ্ম যে এটা জানতেন, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে প্রদান করা উচিত, এই প্রশ্ন উঠতেই ভীষ্ম দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, যদুকুলশ্রেষ্ঠ বাসুদেব কৃষ্ণই এই অর্ঘ্য গ্রহণ করার সবচাইতে যোগ্যতম ব্যক্তি। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণ কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না। তবুও ভীষ্ম এই প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন কৃষ্ণবর্ণের ওই মানুষটি রাজাদের রাজা, ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার। ভীষ্ম ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত।

এই যুদ্ধে পান্ডবদের ভরসা ছিল অর্জুনের ক্ষাত্রশক্তির উপর। কিন্তু সেই অর্জুন যুদ্ধ করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। পরম আত্মীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, বিশেষ করে ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে তো বটেই। সেই যখন মা কুন্তীর হাত ধরে প্রথম হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, সেদিন যে মানুষটি হাত বাড়িয়ে তাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তিনি পিতামহ ভীষ্ম। অন্যদিকে, আচার্য দ্রোণ নিজের ঔরসজাত সন্তান অশ্বত্থামার চাইতেও যাকে বেশি ভালোবাসতেন, তিনি ছিলেন অর্জুন। অর্জুন ছিলেন তাঁর প্রিয়তম শিষ্য; নিজের সমস্ত অস্ত্রজ্ঞান উজাড় করে শিখিয়েছিলেন এই প্রিয় শিষ্যকে। অর্জুনের চাইতে বড় বীর হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি নিষাদ একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে নিয়েছিলেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। সেই আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হবে! তাঁদের হত্যা করতে হবে! অর্জুন ভাবতেই পারছিলেন না!

কেশব অর্জুনকে অনেক বোঝালেন। কেন কঠিন হলেও এই কাজটা অর্জুনকে করতে হবে, সেটা বেশ ভালো করে বোঝালেন। গীতার আবির্ভাব ঘটল। তবুও অর্জুন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এবার কৃষ্ণ তাঁকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে অর্জুন গীতার সমস্ত উপদেশ বেমালুম ভুলে গেলেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে পিতামহ ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণকে দেখে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে উঠল। এদের দুজনের কাউকেই তিনি বধ করতে পারছিলেন না, যদিও দ্রোণের শিখিয়ে দেওয়া সমস্ত জ্ঞান ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে ছিল বেশ কিছু দিব্যাস্ত্রের মজুদ। এঁদেরকে ঘিরে সমস্ত স্মৃতি অর্জুনকে একেবারে আবিষ্ট করে ফেলেছিল।

এদিকে দুর্যোধনের নিদারুণ নিগ্রহে অতিষ্ঠ হয়ে ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। এখানে বলে নেয়া দরকার, মহাভারতের গুটিকয়েক অতিমহারথী যোদ্ধার মধ্যে ভীষ্ম একজন। পান্ডবদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা না করলেও তিনি কুরুক্ষেত্রের ময়দানকে রক্তাক্ত করে তুললেন। পান্ডব শিবিরে রীতিমত হাহাকার পড়ে গেল। অর্জুন কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না ভীষ্মের সঙ্গে। সেদিন ছিল যুদ্ধের নবম দিন। কৃষ্ণ দেখলেন, এভাবে চলতে থাকলে পাণ্ডবদের পরাজয় অনিবার্য। এরকম একটা অবস্থায় কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে এসে রথের চাকা তুলে নিয়ে ভীষ্মকে বধ করতে এগিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ পার্থেরই সারথি ছিলেন; পার্থ দ্রুত রথ থেকে নেমে এসে কৃষ্ণের পায়ের উপর আছড়ে পড়লেন একেবারে। মিনতি করে বললেন, তিনি যেন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ভীষ্মকে বধ না করেন। এদিকে কৃষ্ণকে এগিয়ে আসতে দেখে ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে রথের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে স্মিত হাসি। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়ে ছাড়বেন। সেটা তিনি করতে পেরেছেন।

প্রশ্নটা এখানেই ওঠে। কেন তাহলে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে না পারেন? তিনি যদি ঈশ্বরের অবতার হয়েই থাকেন, তাহলে তাঁর আগে থেকেই জানা উচিত ছিল, গীতার বাণী ব্যর্থ হবে, অর্জুন ব্যর্থ হবেন এবং এক পর্যায়ে তাঁকে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। যদি তিনি সেটা আগে থেকে না জেনে থাকেন, তাহলে তো তিনি ভগবানই নন।

এমন একটা প্রশ্ন বাইবেলের ঈশ্বরকেও ঘিরে উঠেছিল। তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন, তারপর সেই আদমকে ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পর ঈশ্বরের মনে হল, আদম নিঃসঙ্গ বোধ করছে, অতএব তার একজন সঙ্গী দরকার। আদম যে নিঃসঙ্গ বোধ করবেন, সেটা ঈশ্বর আগে থেকেই বুঝতে পারেননি কেন? যাই হোক, তিনি এবার ইভকে বানিয়ে আদমের সঙ্গে বসবাসের জন্য ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। সেই গার্ডেনে একটা বৃক্ষ ছিল, যে বৃক্ষের ফল খেতে তিনি বারণ করে দিয়েছিলেন। ইভ সে আদেশ অমান্য করলেন। এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে, ঈশ্বর কি তাহলে আগে থেকে জানতেন না ইভ প্ররোচিত হবেন?

প্রতিজ্ঞা ভীষ্মও করেছিলেন, কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন। এমনকি এই কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাই শেষ পর্যন্ত হতো না, যদি তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পিতা শান্তনুর রেখে যাওয়া সিংহাসনটা নিজের দখলে নিতেন। যাই হোক, এইরকম একটা বিপ্রতীপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল বলেই কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হওয়ার কারণটা জানা জরুরি। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, কৃষ্ণ আগে থেকেই জানতেন গীতার উপদেশ শোনার পরেও অর্জুন সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারবেন না এবং তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সেটা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্জুনকে আরেকবার উজ্জীবিত করার প্রয়োজন ছিল। রথের চাকা নিয়ে কৃষ্ণ ভীষ্মের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন যতটা না ভীষ্মকে বধ করার উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য। অর্জুন উজ্জীবিত হলেন। তিনি কৃষ্ণকে প্রতিজ্ঞা করলেন, এরপর থেকে তিনি ক্ষত্রিয়ের মতোই লড়াই করবেন।

কিন্তু এই উত্তর কি যথাযথ? গ্রহণ করার মতো? নিশ্চয়ই নয়। এই উত্তর গ্রহণযোগ্য, যদি কৃষ্ণকে অর্জুনের একজন মেন্টর হিসেবে দেখি কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে যদি একজন কোচ হিসেবে দেখি। কিন্তু কৃষ্ণকে যদি একজন অবতার হিসেবে দেখি, তাহলে এই উত্তর গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তিনি যখন অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন, তখনই তো অর্জুনের মনোভাব বদলে দিতে পারতেন। তাঁর মনকে সমস্ত মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারতেন। তিনি সেটা করেননি। এদিকে ভীষ্মকে হত্যা করতে ছুটে যাওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা এবং ঘটনাটি আকস্মিক বলেই এটা অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য করেছেন, এমন ভাবার সুযোগ খুবই কম। তাহলে?

ঠিক এই জায়গায় এসে আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়, যে ঘটনার কিছুটা আগেই বলা হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে কৃষ্ণ যখন বলেছিলেন, তিনি কোনো পক্ষেই যোগ দেবেন না, তখন ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। ভীষ্ম সেটা করতে পেরেছিলেন। আবারও প্রশ্ন উঠবে, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন কেন? কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন, কারণ তিনি যে ভক্তের ভগবান। ভীষ্ম ছিলেন তাঁর পরম ভক্ত। ভক্তের ইচ্ছাকে মূল্য দিতে গিয়েই তিনি অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। যুদ্ধের শুরুতে ভীষ্মকে যে মাপের যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই বর্ণনা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন তো বটেই, ভীষ্মের চাইতেও বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন। তারপরও কৃষ্ণ কি ভীষ্মকে বধ করতে পারতেন? পারতেন না - ভীষ্ম মৃত্যুকে জয় করছিলেন। তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র আছে ততক্ষন তাঁকে কেউ বধ করতে পারত না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নন। তাহলে কৃষ্ণ তাঁকে মারতে ছুটে গিয়েছিলেন কেন ?

রামায়ণ ও মহাভারতে নৈতিকতা : একটি খন্ডচিত্র -Guitar K Kanungo
March 26, 2025 | পুরাণ | views:60 | likes:0 | share: 1 | comments:0

রামায়ণে ঘটে যাওয়া দুটি হত্যাকাণ্ডকে আমি নীতিবিরুদ্ধ এবং গর্হিত অপরাধ বলে মনে করি। এই দুটি হত্যাকাণ্ড স্বয়ং রামচন্দ্রই ঘটিয়েছেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের অজুহাতে দ্বাপর যুগে বাসুদেব কৃষ্ণ অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, কিন্তু খুব সীমিত ক্ষেত্রেই তিনি নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেছেন।

কংস দুরাচারী ছিলেন; তাঁকে উৎখাত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। মগধরাজ জরাসন্ধের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন। নিজের পিতা উগ্রসেনকে হটিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছিলেন। অন্যদিকে, কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেছেন তাঁর একশটি অপরাধ ক্ষমা করার পর। এই দুটো হত্যাকাণ্ডের কোনোটাই কোনো প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে করা হয়নি।

রামচন্দ্রের হাত দিয়ে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। শূদ্র বংশোদ্ভূত শম্বুক ঈশ্বরের তপস্যা করছিলেন। "শূদ্রের ঈশ্বরের তপস্যা করার অধিকার নেই"—এই অজুহাতে শম্বুককে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার তীব্র বর্ণবৈষম্যের একটি প্রতীকী উদাহরণ এবং উদাহরণটা সৃষ্টি করছেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে কথিত রামচন্দ্র।

কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালীর সঙ্গে রামচন্দ্রের কোনো শত্রুতা ছিল না। যিনি মহাপরাক্রমশালী রাবণকে বগলের নিচে চেপে ধরে অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়াতেন, সেই রাজা বালীর মৃত্যুটা এতটা অসম্মানজনক না হলেও পারত। কিন্তু রামচন্দ্র পিছন দিক থেকে অতর্কিতে তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করেন।

জরা নামের যে ব্যাধের হাতে বাসুদেব কৃষ্ণ নিহত হয়েছিলেন, তিনি ত্রেতা যুগে রামের হাতে নিহত হওয়া কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালী। রামচন্দ্র বালীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন; সেই কারণে দ্বাপর যুগে এসে বালীকে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। মহাভারত আমাদের সেই খবর দিচ্ছে।

এই ঘটনা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—বাল্মীকি বালী হত্যার পেছনে যত যুক্তিই দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন না কেন, মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সেইসব যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। অবশ্য এটাও ঠিক, মহাভারতেও আমরা এমন অনেক দ্বৈরথ দেখতে পাব, যেখানে বেশ অন্যায়ভাবেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছিল। মগধরাজ জরাসন্ধ এবং কৌরবজ্যেষ্ঠ দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙেই হত্যা করা হয়েছিল।

অনেকটা একই অবস্থা ছিল লঙ্কেশ রাবণেরও। শিবের বরপ্রীতি লাভ করে রাবণ অনেকটা অমর হয়ে উঠেছিলেন। রামায়ণ যে জায়গাটাকে কিস্কিন্ধ্যা নামে চিহ্নিত করেছে, সেটা বর্তমান সময়ের রামেশ্বরমের অদূরে। রামায়ণ এটাও বলেছে, কিস্কিন্ধ্যা থেকে সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কার দূরত্ব ১০০ যোজন, অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, যে জায়গাটাতে বানরসেনারা রামসেতু নির্মাণ করেছিল, সেটার এপারে কিস্কিন্ধ্যা, ওপারে লঙ্কা।

বালীর বিক্রমের কথা রাবণ জানতেন। একদিন কিস্কিন্ধ্যায় এসে রাবণ বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। কাজটা বোকামি হয়েছিল, কারণ রাবণের জানা ছিল না—বালীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে না হতেই তাঁর শক্তি অর্ধেকে নেমে আসবে। ফলত যা হওয়ার, তাই হলো; রাবণ বালীর কাছে পরাজিত হলেন।

একটা প্রশ্ন তাই যৌক্তিকভাবেই ওঠে—রাম বালীকে বাদ দিয়ে সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে গেলেন কেন? মৃত্যুপথযাত্রী বালী স্বয়ং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। রামের সঙ্গে যখন সুগ্রীবের সাক্ষাৎ ঘটে, তখন সুগ্রীব রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি অনেকটাই সহায়-সম্বলহীন; বালীর মতো বিশেষ কোনো শক্তিও তাঁর নেই। অবশ্য কিছু অনুগত বানরসেনা এবং পবনপুত্র হনুমান রয়েছেন তাঁর সঙ্গে।

রাম চাইলেই সরাসরি বালীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য চাইতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন, যিনি কিনা নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সামর্থ্যও রাখেন না—পবনপুত্র হনুমান তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও!

হনুমানের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে। এই হনুমানের সঙ্গেও বালীর একবার একটা যুদ্ধ হয়েছিল। ব্রহ্মার বর পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর, প্রত্যাশিতভাবেই বালী একটা সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। এদিকে হনুমান বেশিরভাগ সময় তাঁর আরাধ্য দেবতা রামচন্দ্রের উপাসনায় মগ্ন থাকতেন।

এখানে অবশ্য একটা প্রশ্ন ওঠে—সীতাহরণের ঘটনা ঘটেছিল বলেই রামচন্দ্র সীতার ফেলে যাওয়া আভরণ খুঁজতে খুঁজতে কিস্কিন্ধ্যায় এসে পড়েছিলেন। এখানে আসার পরেই হনুমানের সঙ্গে রামচন্দ্রের দেখা হয়েছিল। তাহলে রামচন্দ্র হনুমানের আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠলেন কীভাবে?

এই প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া না গেলেও আমরা জানি—রাবণকে হারাতে পারলেও বালী হনুমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। হনুমান এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে তাঁর অর্ধেক শক্তি আত্মীভূত করার ব্যাপারটা বালীর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল; বালী সেটা ধারণ করতে পারছিলেন না।

এবার আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়—যদি সেটাই হবে এবং হনুমান যেহেতু সুগ্রীবের অনুগামী, তাহলে রামচন্দ্র কিস্কিন্ধ্যায় এসে পৌঁছানোর আগে হনুমানের সাহায্য নিয়ে সুগ্রীব বালীকে অপসারণের চেষ্টা করেননি কেন? সুগ্রীব কি তাহলে রামচন্দ্রের অপেক্ষায় বসে ছিলেন?

অভিশাপ ও যৌনতা: রামায়ণ-মহাভারতের বয়ান। -Guitar K Kanungo
March 24, 2025 | category | views:44 | likes:11 | share: 0 | comments:0

রামায়ণ বলি আর মহাভারত, এই দুই মহাকাব্যে অভিশাপ একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। কারণে অকারণে অভিশাপ নেমে এসেছে, এবং কিছু ঋষির ভাবখানা এমন যে তারা যেন কেবল অভিশাপ দেওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে আছেন। দুর্বাসা এঁদেরই একজন। কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে অভিশাপ দেয়ার ক্ষেত্রে একে রামে রক্ষা নেই সুগ্ৰীৱ দোসর অবস্থা। ব্যাস এই কাজের জন্যে কেবল দুর্বাসাকেই নয় , বিশ্বামিত্র, দধিচী এবং নারদের মত ঋষিকে একজায়গায় জড়ো করে ফেলেছেন। কখনো কখনো সেইসব অভিশাপ একেবারেই অযৌক্তিক। কিন্তু অযৌক্তিক হলেও সে অভিশাপগুলো ফলে যাচ্ছে, এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অবধারিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেই অভিশাপের ফল হিসেবে।

কুরু-পাণ্ডবদের আদি পুরুষ যযাতির কথাই ধরা যাক। স্ত্রী দেবযানীর দাসী হয়ে আসা রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে যযাতি শ্বশুর শুক্রাচার্যের কাছ থেকে অভিশাপ কুড়োলেন। সেই অভিশাপ যে অসামানুপাতিক, সেকথা বলার সুযোগ খুব একটা নেই। অভিশপ্ত হয়ে যযাতি জরাগ্রস্ত হয়ে পড়লেনঅর্থাৎ, যে রিপুর তাড়নায় তিনি পরকীয়া প্রেমের মতো দুষ্কর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন, সেই রিপুকে অবদমন করার একটি সুযোগ পেলেন। কিন্তু যযাতি কামুক পুরুষ; তিনি শুক্রাচার্যের হাতে পায়ে ধরে সেই অভিশাপ এড়িয়ে যাবার উপায় বার করলেন। তারপর শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত সন্তান পুরুর সঙ্গে তিনি জরা বদল করে সকাম প্রেমের নৈমিত্তিক আয়োজনে মত্ত রইলেন। যেহেতু তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে কেবল পুরুই তাঁর জরা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিলেন, সেহেতু যযাতি এই পুরুকেই সমস্ত রাজ্য দিয়ে গেলেন। এই পুরুই ছিলেন কুরু-পাণ্ডবদের আদি পুরুষ।

এই অভিশাপ দিয়ে শুক্রাচার্য কার্যত তাঁর আত্মজা দেবযানীর গর্ভজাত সন্তানদের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়া থেকে বঞ্চিত করলেন। অবশ্য দেবযানীর জন্যে একটি সান্তনা পুরস্কার ছিল। উত্তরকালে তাঁর পুত্র যদুর বংশে ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার বাসুদেব কৃষ্ণ জন্ম নেবেন। কথা হচ্ছে, এই ব্যাপারগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই ঘটতে পারত। পুরুর জায়গায় যদু রাজা হলেই যে কুরুবংশের স্থাপনা হত না, এমন ভাবার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। পুরুর মাতুল বৃষপর্ব ছিলেন অসুরদের রাজা। বেশ ক্ষমতাবান নৃপতিএতটাই ক্ষমতাবান যে স্বয়ং শুক্রাচার্য তাঁর সভায় প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। সেই মাতুলের সহায়তায় পুরু আরেকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেই পারতেন। কিন্তু সেটা হলো না; গোটা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যে সেখানে একটি পরকীয়া প্রেম এবং একটি অভিশাপের অনুপ্রবেশ ঘটানো হলো।

লঙ্কেশ রাবণও এরকম একটি অভিশাপের শিকার হয়েছিলেন। সেই অভিশাপও যৌনতা সংক্রান্তই। মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, লঙ্কেশ রাবণ ধর্ষকামী ছিলেন। সুন্দরী নারী দেখলেই তিনি কামাতুর হয়ে পড়তেন এবং সেই নারীদের ধর্ষণ করতে উদ্যত হতেন। ধর্ষকামিতা এক ধরনের সেক্সুয়াল ডেভিয়েশন তথা যৌন বিচ্যুতি; এটি সহজাত নয়। কেন তিনি এমন ছিলেন, এই নিয়ে বাল্মীকি আমাদের কোনো ব্যাখ্যা দেননি। মায়ের কারণে তাঁর মধ্যে রাক্ষস প্রবৃত্তি ছিল বলেই কি? কিন্তু মহর্ষি বাল্মীকি বৈদেহী সীতাকে অলঙ্ঘনীয় করে তোলার জন্যে আমাদের একটি গল্প শুনিয়েছেন। যদিও সেই গল্পের মধ্যে বিস্তর ফাঁকফোকর আছে, তবুও সেই গল্পটা বলা যাক।

একদিন বেদবতী নামের এক অসামান্য সুন্দরী নারীর সঙ্গে রাবণের দেখা হয়ে যায়। স্বভাবগত কারণেই রাবণ তার উপর জোরপূর্বক উপগত হতে চাইলেন। এদিকে কুশধ্বজ ঋষির কন্যা বেদবতী ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। বেদবতী তাঁকে পাবার জন্যেই তপস্যা করছিলেন। তিনি রাবণকে প্রতিরোধ করতে চাইলেন, কিন্তু রাবণ কিছু শুনতে নারাজ। বেদবতী বাধ্য হয়ে নিজেকে আগুনে বিলীন করে দিলেন, কিন্তু বিলীন হয়ে যাবার আগে তিনি রাবণকে এই বলে অভিশাপ দিলেনরাবণ যদি কোনো নারীর সঙ্গে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন তবে তার মৃত্যু হবে। শুধু তাই নয়, বেদবতী আরও বললেন, তিনি আবার জন্মাবেন এবং রাবণের মৃত্যুর কারণ হয়েই জন্মাবেন। এই বেদবতীই পরবর্তীতে সীতা হয়ে জন্মেছিলেন।

বেদবতীতে উপগত হওয়ার আগ্রহ রাবণ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সীতাকে অপহরণের কারণ যৌনতা নয়। প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই এই অপহরণ। অপহরণ করতে গিয়েই রাবণ বুঝতে পারলেন, সীতাও অসামান্য সুন্দরী বটে। বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, লংকায় নিয়ে আসার পর সীতাকে পাবার জন্যে রাবণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আগের জন্মের বেদবতিই যে সীতা, সেটা হয়তো রাবণের জানা ছিল না, কিন্তু রাবণ বেদবতীর অভিশাপের কথা ভুলে যাননি। তিনি চাইছিলেন, সীতা নিজে থেকেই তাঁর সঙ্গে রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করুক। বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, সেই ইচ্ছা সীতার কখনোই হয়নি। কেন হয়নি, সেটাও ভেবে দেখার মতো। কেন ভেবে দেখার মতো, সেটা বোঝার জন্যে আমাদের দ্রৌপদী এবং কীচককে নিয়ে ভারতবর্ষের এক প্রখ্যাত নাট্যকারের নাটকটি দেখে আসতে হবে। নাটকটির নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই; বিষয়বস্তুটা তুলে ধরছি।

মহাভারতে দ্রৌপদী বিরাট রাজার আশ্রয়ে থাকার সময়ে এরকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিরাটরাজের শ্যালক কীচক দ্রৌপদীকে কামনা করছিলেন। ব্যাস আমাদেরকে বলেছেন, এইরকম অশ্লীল প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে দ্রৌপদী ভীমকে দিয়ে কীচককে বধ করিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ কারনাড (খুব সম্ভবত) তাঁর একটি নাটকে দেখিয়েছেন, দ্রৌপদী কীচকের এই প্রস্তাবে সানন্দে সাড়া দিয়েছিলেন। দ্রৌপদী সারা জীবন নিজেকে বঞ্চিতই ভেবে এসেছিলেন। যে অর্জুনকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, সেই অর্জুন যখন বিভিন্ন নারীর সঙ্গে একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সেখানে তিনি পুরোটা সময় অর্জুনের অন্য ভাইদের যৌন লালসা মেটানোর অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে গেছেন। শারীরিক চাহিদা দ্রৌপদীরও ছিল; কীচক দ্রৌপদীকে সে চাহিদা মেটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

আসল কথা হচ্ছে, যৌনতাকে এভাবেও দেখা যায়। কিন্তু সীতাকে নিয়ে সেই ঝুঁকি বাল্মীকি নিতে পারেননি। শুধু বাল্মীকি কেন, কোনো কোনো লেখক দ্রৌপদীকে কীচকের সঙ্গে মিলনের জন্যে অভিসারে পাঠাতে উৎসাহ দেখালেও, সীতাকে নিয়ে রামায়ণের মূল কাহিনীর বাইরে গিয়ে কিছু ভাববার সাহস দেখাতে পারেননি। ব্যাস কর্ণকে দিয়ে দ্রৌপদীকে বেশ্যা পর্যন্ত বলিয়েছেন। দ্রৌপদী মহাভারতের প্রধানতম নায়িকা হলেও দ্রৌপদীকে অন্যপূর্বা করে তোলার কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না, যেটা সীতাকে নিয়ে বাল্মীকির ছিল। রাবণের সঙ্গে মিলিত হলে সীতা অসতী হয়ে উঠবেন এবং সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষণা করা যাবে না। যদিও বাল্মীকির সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারেননি। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সীতার সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই গিয়েছিল। রাম নিজ মুখে সে কথা স্বীকার না করলেও রামের হৃদয়ে প্রবেশ করলে আমরা সেখানে এই সন্দেহের বীজটিকে উপ্ত অবস্থায় দেখতে পেতাম।

একথা ঠিক যে, সময় বাল্মীকি এবং ব্যাস মহাকাব্য লিখছেন, তখন সিগমুন্ড ফ্রয়েড জন্মাননি। যৌনতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি, অস্পষ্টতা ছিল। আবার সেই সঙ্গে একথাও ঠিক, বিশেষ কোনো উপায়ে যৌনতাকে একটি নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে রাখা যায়নি। যৌনতা জনিত ঈর্ষা, যৌনমিলনের অপূর্ণ ইচ্ছা জনিত হতাশা, শারীরিক মিলনের অপরাগত ইত্যাদি নানান জটিল মনস্তত্বকে তাঁদের মহাকাব্যে তুলে ধরতে হয়েছে কিন্তু একাজটা করতে গিয়ে তারা অনেকক্ষেত্রেই নানান প্রকার অভিশাপের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। পরশুরাম জননী রেণুকার মধ্যে হয়ত যৌন অতৃপ্তি ছিল; তিনি গান্ধর্বদের জলকেলী দেখে তাঁর মধ্যে সেই ইচ্ছা জেগেছিল কিন্তু সেই ইচ্ছে জাগার ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হয়েছিল আমরা সেটা জানি। ঋষি জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের আদেশ করেছিলেন মায়ের মাথাটা কেটে নিতে। অন্য পুত্ররা জমদগ্নির এরকম একটা অন্যায় আদেশ মেনে নিতে রাজি না হলেও পরশুরাম পিতার আদেশ মেনে নিয়ে ধড় থেকে মায়ের মস্তক আলাদা করে ফেলেছিলেন। এই গোটা কাজটাই অনুচিত এবং অযৌক্তিক ছিল।

অভিশাপের আলোচনায় ফিরে আসি। যৌনতা নিয়ে হস্তিনাপুরের রাজা পান্ডুর এক রকমের সমস্যা ছিল। এই সমস্যা এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানী ছেড়ে বনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। সেখানে গিয়েও তিনি বিপদ এড়াতে পারলেন না। এক মতিভ্রম ঋষি একেবারে খোলা আকাশের নিচে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলেন। পান্ডু বুঝতে না পেরে মিলনরত ঋষি দম্পতিকে হরিণ ভেবে নিয়ে তীর নিক্ষেপ করে বসলেন। সেই তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করার আগে পান্ডুকে একটা অভিশাপ দিয়ে বসলেন। ঋষি নিজে যেরকম রমনরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে চলছেন পাণ্ডুও একদিন সেই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হবে। খুব সম্ভবত পান্ডুর হৃদযন্ত্রে কোন একটা সমস্যা ছিল, রমণেক্লান্তির ধকল নেয়ার মত শক্তি পান্ডুর হৃদযন্ত্রের ছিল না। এই ব্যাপারটাকে কোনভাবে ব্যাখ্যা করতে না পেরে কিন্দমমুনির অভিশাপের গল্পটার অনুপ্রেবশ ঘটানো হয়েছে।

কৃষ্ণকে দেওয়া গান্ধারীর অভিশাপটি যুক্তিসঙ্গত ছিল না। -Guitar K Kanungo
March 21, 2025 | category | views:31 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাভারত বলেছে কুরুবংশের মতো বাসুদেব কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই গান্ধারীর অভিশাপকে দায়ী করে থাকেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে পুত্রশোকে কাতর মাতা গান্ধারী বাসুদেব কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যেভাবে তাঁর কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেভাবে একদিন কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে যাবে।

গান্ধারীর এই অভিশাপ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—তিনি তাঁর পুত্রদের মৃত্যুর জন্য প্রধানত কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন। এই অভিযোগের সঙ্গে ঘটোৎকচ পুত্র বরবরিকের একটা মন্তব্যের মিল পাওয়া যায়। বরবরিক আঠারো দিনব্যাপী চলা কুরুক্ষেত্রের ওই যুদ্ধটা প্রত্যক্ষ করছিলেন। যুদ্ধের শেষে যখন তাঁকে এই যুদ্ধ সম্পর্কিত মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল শ্রীকৃষ্ণকেই দেখতে পেয়েছেন। কথাটা রূপক অর্থে বলা। সহজ করে বললে, এই গোটা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়েই তিনি এই কাজটি করেছিলেন।

মহাভারত একটি মহাকাব্য। মহাকাব্যকে মহাকাব্য করে তোলার জন্য এক বা একাধিক ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ চরিত্রের প্রয়োজন হয়। বাসুদেব কৃষ্ণ সেরকমই একটা চরিত্র। ব্যাসদেবের কাছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণতম অবতার। কৃষ্ণকে অবতার প্রমাণ করার একটা দায় ব্যাসদেবের ছিল। সেইজন্যে কেউ যদি মনে করেন অর্জুন এই মহাকাব্যের নায়ক, তাহলে ভুল করবেন। ইলিয়াডে আমরা হেক্টর এবং একিলিসের মধ্যে একটা জবরদস্ত লড়াই অন্তত দেখতে পেয়েছিলাম। এরকম একটা লড়াই দেখার সম্ভাবনা মহাভারতেও তৈরি হয়েছিল। কর্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে সেরকম একটা লড়াই হতে পারত। কিন্তু কৃষ্ণ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে—এটা দেখানোর জন্য ব্যাসদেব সেই লড়াই উপভোগ করার আনন্দ থেকে পাঠকদের কার্যত বঞ্চিত করেছেন।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বাসুদেব কৃষ্ণই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কিন্তু কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনের সমস্ত দায় তাঁর—গান্ধারীর এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। কুরুবংশ ধ্বংসের অন্তত সত্তর শতাংশ দায় এককভাবে দুর্যোধনের। বাকি ত্রিশ শতাংশ দায় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এবং দুর্যোধনের মাতুল শকুনির। ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্রয় দিয়েছেন, শকুনি প্ররোচনা দিয়েছেন। কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে বাসুদেব কৃষ্ণ লাভবান হননি। মগধ রাজ জরাসন্ধকে বধ করা কৃষ্ণের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, এবং জরাসন্ধকে বধ করার কাজটা তিনি দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমকে দিয়েই সেরে ফেলেছিলেন, এবং সেটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই।

‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী’—এ কথাটা দুর্যোধনই বলেছিলেন। অতএব যুদ্ধটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মহারাণী কুন্তী চাইছিলেন তাঁর পুত্ররা তাঁদের পিতার জবরদখল হয়ে যাওয়া সিংহাসন ফিরে পাক—অতএব যুদ্ধটা হোক। দ্রৌপদী চেয়েছিলেন যুদ্ধটা হোক—বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে তাঁর প্রতি যে অন্যায় এবং অসভ্য আচরণ দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা করেছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এত কিছুর পরেও একটা সময় পর্যন্ত পাণ্ডবরা যুদ্ধটা এড়াতেই চেয়েছিলেন। এমনকি যে ভীমকে আমরা ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক বলে জানি, সেই ভীমও দ্রৌপদীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধটা যাতে না হয়, সে চেষ্টাই করেছিলেন। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে পাণ্ডবদের দূত হয়ে স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ গিয়েছিলেন হস্তিনাপুরের রাজসভায় সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাব দুর্যোধন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, দূত অবধ্য জেনেও বাসুদেব কৃষ্ণকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিলেন।

দুর্যোধনের আরেকটা প্রকাণ্ড ব্যর্থতা আছে। তিনি আগাগোড়াই বাসুদেব কৃষ্ণকে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। যদি আমরা ধরেও নিই কৃষ্ণ কোনো অবতার নন, কিন্তু তিনি যে কত বড় স্ট্র্যাটেজিস্ট, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় তিনি যে তাঁর সময়ের চাইতে হাজার বছর এগিয়ে, এই ব্যাপারটা দুর্যোধন বুঝতে পারেননি। পাণ্ডবেরা সেটা বুঝতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই তারা কৃষ্ণের কয়েক অক্ষৌহিনী নারায়ণী সৈন্য নয়, বরং কৃষ্ণকেই তাঁদের পক্ষে টানতে চেয়েছিল। মহাভারতের যুদ্ধটা সেদিন অর্ধেকটাই জিতে নিয়েছিল যেদিন বাসুদেব কৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি হতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। চৈনিক সমরবিদ সান জু যেকোনো যুদ্ধকে যুদ্ধক্ষেত্রে গড়ানোর আগেই জিতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্জুন সেটাই করেছিলেন; দুর্যোধন সেটা করতে পারেননি, যদিও সেই সুযোগটা উন্মুক্তই ছিল।

এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কিছুটা দায় তাঁর নিজেরও ছিল। অথবা এমনও হতে পারে তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাক। শুরু থেকেই গান্ধারীর হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজকুমারের সঙ্গে বিয়েতে মত ছিল না। তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল এই বিয়েতে সম্মত হতে। সম্মত হয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। ভীষ্মের আদেশে তাঁর পিতাসহ গান্ধার রাজ্যের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাইকে কারারুদ্ধ করে খুন করা হয়েছিল। যে হত্যার প্রতিশোধ নিতে শকুনি হস্তিনাপুরে থেকে গিয়েছিলেন। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, শকুনির এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে গান্ধারী জড়িত থাকতে পারেন। সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় যখন বলা হয় দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা কেউ আসলে গান্ধারীর গর্ভজাত নয়। তিনি আসলে একটা মাংসপিণ্ডই প্রসব করেছিলেন। দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা আসলে ধৃতরাষ্ট্রের ওরসে দাসীদের গর্ভজাত সন্তান।

নিজের দোষ দেখতে না পাওয়া মানুষের সহজাত স্বভাব। গান্ধারী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস আমাদের জানিয়েছেন, গান্ধারী বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। এদিকে বাসুদেব কৃষ্ণ বিষ্ণুরই অবতার। যদিও ধরেও নিই তিনিও চেয়েছিলেন কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাক, কিন্তু সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা যে কী ভয়াবহ হতে পারে, সেটা চাক্ষুষ করার পর গান্ধারীর মধ্যে তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয়েছিল। তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণকে সামনে দেখে তাঁর ওপরেই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করতে চেয়েছেন। গান্ধারী হয়ত দেবতার গ্রাস কবিতার বিধবা মোক্ষদার মতো বলতে চেয়েছিলেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি কুরুবংশের ধ্বংস চাইলেও ঈশ্বর কেন সেটা হতে দিলেন? ঈশ্বর চাইলেই সবকিছু অন্যরকম করে দিতে পারতেন!

মিশরে লিপ ইয়ার -Tushar Gorai
March 18, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:10 | likes:0 | share: 1 | comments:0

পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান আনুমানিক ৪২৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরীয়রা চন্দ্র মাসের ভিত্তিতে বছরের হিসেব রাখতে শুরু করে। নীল নদের বন্যার পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয় এ পদ্ধতি। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০০০ অব্দে সৌর বছরের প্রবর্তন হয় মিশরীয় পঞ্জিকায়। নীল নদের প্রথম বন্যার আগমন কাল  বর্তমানের জুন মাস কে ধরেছিল তারা। এই সময় আকাশে লুব্ধক(Sirius) নক্ষত্রের আবির্ভাব হতো এর থেকে তারা নতুন বছর গণনা শুরু করে। মিশরীয়রা সৌর বছর গণনা করত ৩৬৫ দিনে। ৩০ দিনে এক মাস এবং ১২ মাসে এক বছর হিসেবে সৌরবছর গণনা করতো তারা। বছরের শেষে আরো পাঁচ দিন যুক্ত করে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা অর্চনা করত। চার বছর অন্তর ৫ দিনের বদলে ৬ দিন যুক্ত করে তারা পঞ্জিকা তৈরি করত কারণ মিশরের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৩৬৫ ১/৪ দিনে এক বছর হয় সেটা তারা ধরতে পেরেছিলেন। আধুনিক লিপ ইয়ার মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞদের আবিষ্কার। 



বিদুর কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধে অংশ নেননি; চাইলে ভীষ্মও সেটা করতে পারতেন। -Guitar K Kanungo
March 16, 2025 | পুরাণ | views:48 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাভারতের যুদ্ধটা ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যকার যুদ্ধ। এই রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধটাকে মোটা দাগে এইভাবেই দেখানোর চেষ্ঠা করা হয়। পান্ডবরা ধর্মের পক্ষে, অন্যদিকে কৌরবরা অধর্মের পক্ষে। আর এই যুদ্ধটা রক্তাক্ষয়ী হয়ে উঠেছিল এমন ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্যের মত অতিমহারথী যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের কারণে। যেহেতু যুদ্ধটা ধর্ম-অধর্মের মধ্যে সেইজন্যে প্রধানত এই দুজন যোদ্ধা এক রকমের ধর্মসঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন মহাভারতে যুদ্ধের ঠিক আগ মুহূর্তে।

কোন পক্ষে যুদ্ধ করবেন তারা? ধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করতে হলে, যেটা সবার করা উচিত, পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করা উচিত। কিন্তু ভীষ্ম এবং দ্রোণ, দুজনই অধর্ম তথা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল তারা যেহেতই কৌরবদের অন্নদাস, অর্থাৎ কৌরবদের অন্নে প্রতিপালিত সেহেতু অধর্ম হচ্ছে জেনেও কৌরবদের বিপক্ষে তাদের যুদ্ধ করার সুযোগ নেই।

এটা এক্য কুযুক্তি এবং এই কুযুক্তিটাকে আমাদের ছোটকাল থাকে শেখানো হয়েছে। অবশ্য এটাকে কুযুক্তি বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না, এই ধরনের যুক্তিগুলো গ্রাহ্য করার মত কিনা সেই ব্যাপারটা আমরা অনেক সময় ঠিকঠাক পরখ করে দেখি না। কেউ একজন কিছু একটা বলেছেন, আর সেটাকেই আমার কোন প্রকার প্রশ্ন না করেই নির্ধিধায় মেনে নিই। বিশেষ করে সেই নিদান যদি জোব্বা আর টুপি পরিহিত কারো কাছ থেকে এসে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

দ্রোণের একটা গ্রহণযোগ্য কারণ থাকলেও, ভীষ্মের কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করার কোন কারন ছিল না। দ্রোণ হস্তিনাপুর রাজ্যের বেতনভুক কর্মচারী ছিলেন - সেই অর্থে তিনি কৌরবদের অন্নদাস; ওই কারণে অধর্ম হচ্ছে জেনেও আচার্য দ্রোণের কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ না করে উপায় ছিল না কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক এরকম ছিল না। কুরু রাজবংশে ভীষ্ম কখনোই একজন আউটসাইডার ছিলেন না। তিনিই ছিলেন হস্তিনাপুরের সিংহাসনের বৈধ দাবীদার। তিনি দয়া করে (প্রতিজ্ঞার খাতিরে) হস্তিনাপুরের সিংহসনটা দখলে নেননি বলেই ধৃতরাষ্ট্র, চিত্রাঙ্গদ, বিচিত্রবীর্য, পান্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরের রাজা হতে পেরেছিলেন, দুর্যোধন হতে পেরেছিলেন যুবরাজ।

একথা ঠিক দুর্যোধন কখনো কখনো ভীষ্মকে কটু কথা বলেছেন। সেটা তার স্বভাবগত কারণেই - ছোটবেলা থেকে উচ্ছন্নে গেছেন বলেই কিন্তু এহেন দুর্যোধনও পিতামহ ভীষ্মকে অতিক্রম করার চেষ্ঠা করেননি। সযত্নে তিনি এই দুস্কর্ম করা থেকে বিরত থেকেছেন কারণ পিতামহ ভীষ্ম কে, এই বংশের সুরক্ষার জন্যে তাঁকে কতটা প্রয়োজন সেটা দুর্যোধন ভালো করেই জানতেন। সত্যি কথা বলতে দ্রোণ নয়, ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে ছিলেন বলেই দুর্যোধন পান্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধটা করতে সাহস দেখেয়েছিলেন।

অন্নদাস তথা মার্সেনারিদের ভরসায় যুদ্ধ করা যায় না যখন প্রতিপক্ষ হয় পান্ডবদের মত পরাক্রমশালী। দ্রোণ একজন অতিমহারথি যোদ্ধা ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর আনুগত্য কৌরবদের পক্ষে কখনোই ছিল না। কথাটা হচ্ছে ভীষ্ম ইচ্ছে করলেই অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে পারতেন। সেটা না করে তিনি যেটা করেছেন সেটা অন্যায়। পাণ্ডবদের ইচ্ছে করলেই তিনি হত্যা করতে পারতেন কিন্তু পান্ডবদের প্রতি স্নেহবিষ্ঠ ছিলেন বলেনা তিনি পান্ডবদের বদলে অসংখ্য সাধারণ সৈন্যকে হত্যা করেছেন। যুদ্ধটাকে অকারণ রক্তক্ষয়ী করে তুলেছিলেন।

আপনারা অনেকেই হয়ত ভাবছেন - বাপু ! তুমি তো দেখছি ব্যাসদেবের চাইতেও বেশি বুঝতে শুরু করেছ। একটু অপেক্ষা করুন আমি এতক্ষন ধরে যা বলার চেষ্টা করছি সেটাকে প্রমান করার জন্যে আমার গান্ডীব থেকে মোক্ষম তুনটা এখনো বের করিনি। বিদুরকে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। সম্পর্কে কৌরব এবং পান্ডবদের পিতৃব্য এবং পেশায় হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী। সেই অর্থে তিনি বিদুর একজন আউটসাইডার এবং ইনসাইডার দুটোই ছিলেন। পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে আউটসাইডার, আর পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে দেখলে একজন ইনসাইডার।

এঁকে ধর্মের প্রতীক বিবেচনা করা হত কারণ তিনি ধর্মরাজ যমের অবতার হয়েই ওই সময় হস্তিনাপুরে অবতীর্ন হয়েছিলেন। একথা তাঁর পিতা স্বয়ং ব্যাসদেবই বলেছেন। হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইনি কৌরবদের অন্নদাস ছিলেন। কিন্তু আপনারা কেউ বিদুরকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছেন? দেখেননি - কারণ একজন অন্নদাস হওয়া সত্বেও তিনি সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন অধর্মের পক্ষে তিনি যুদ্ধ করবেন না।

আমি জানি আপনাদের মধ্যেও অনেক ঠ্যাঁটা লোক আছেন যারা বলবেন বিদুর যুদ্ধ-টুদ্ধ এসব কিছু তেমন জানত না - তাই বিদুরের বিশেষ একটা পক্ষ নেওয়া কোন গুরত্ব বহন করে না। ভুল! ভুল! সবই ভুল! যদি বিদুর যুদ্ধ-টুদ্ধ এসব একেবারে নাই জানতেন তাহলে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসাবেই খ্যাত, তিনি বিদুরকে 'সরঙ্গ' নামের ধনুকটা উপহার দিয়েছিলেন কেন? কোন একটা পুঁথির পাশে সেই দিব্যাস্ত্রকে সাজিয়ে রাখার জন্যে?

দাসীপুত্র ছিলেন বলে পান্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদুর অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি এমন ভাবার ভাবার কোন কারণ নেই। অস্ত্রজ্ঞান তাঁর ভালোই ছিল কিন্তু সেটা তাঁর চর্চার বিষয় ছিল না। কিন্তু তাঁর পক্ষে নেয়া না নেওয়ার একটা গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। যে যুক্তিতে ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করাটাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করেছিলেন, সে যুক্তিকে বিদুর গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। হস্তিনাপুরের বেতনভুক কর্মচারী হওয়া সত্বেও তিনি অধর্মের পক্ষে তথা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেননি। এই খবর আমাদের স্বয়ং ব্যাসদেবই দিয়েছেন।

 

সৃষ্টিতত্ত্ব -Mahbubur Rahman
March 10, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:75 | likes:0 | share: 1 | comments:0

মানুষের চিন্তাজগত রুদ্ধ হয়ে যায় যখন সে ভাবতে থাকে এই বিশ্ব জগতের অস্তিত্ব কেন আছে? যদি অস্তিত্ব না থাকত তাহলে সেই কোন কিছুর অস্তিত্বহীন জগতের অস্তিত্বই বা কেন? একটু চোখ বন্ধ করে সেই ফাঁকা জগতের কথা চিন্তা করি। কল্পনায় ভেসে উঠবে এক অন্তহীন অন্ধকার জগতের ছবি। প্রশ্ন জাগবে এই অন্তহীন অন্ধকার জগতই বা কেন আছে? এই জগত না থাকার অবস্থাটাই বা কেমন? সেই অবস্থার কোন চিত্র আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না।  এই অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের প্রশ্নটি আদিকাল থেকে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই আছে বা নাই এর প্রশ্নটি একটি দুষ্ট চক্র। এই চক্র থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। আছে এর অস্তিত্ব কি নাই থেকে? নাই এর অস্তিত্ব আবার কোন আছে এর গর্ভে?

 এই প্রশ্ন অনুসন্ধানী মানুষদের কাছে, দার্শনিকদের কাছে এক বিরাট প্রশ্ন। কোন কিছু না থাকাটা কি স্বাভাবিক নাকি কোন কিছু থাকাটা স্বাভাবিক? এক্ষেত্রে কোন কিছু না থাকা অবস্থাটি কোন কিছু থাকার অবস্থা থেকে বেশী স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ কোন কিছু না থাকা অবস্থা থেকে কোন কিছু থাকার অবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে। এখন এই উদ্ভব কি আপনা আপনি হতে পারে? অনেক দার্শনিক মনে করেন কোন কিছুর উদ্ভব আপনা আপনি ঘটতে পারে না। কোন পরম শক্তি এই উদ্ভবের ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। এই চিন্তা থেকেই সৃষ্টি তত্ত্বের জন্ম।

আদিম যুগে মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল।তাদের চিন্তার জগত সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে তারা পূজা করত। প্রকৃতির বিভিন্ন জীব জন্তু ও বস্তু ছিল তাদের দেবতা। এই দেবতাদের অবস্থান ছিল এই পৃথিবীতেই। এই দেবতারাই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের পূর্বপুরুষদের একটি টেরিটরি দিয়েছেন। এই চিন্তার অনুসারীদের বলা হয় প্রকৃতি পূজারী। পরবর্তীতে দার্শনিকরা যখন  আকাশের গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলেন তখন তারা বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে তাদের দেবতাদের খুঁজে পেলেন। তারও পরে দার্শনিকরা  যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে চিন্তা শুরু করলেন তখন তারা ভাবলেন এই বিশ্ব জগত সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। এই চিন্তা থেকে  প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে প্রথম জরাস্থ্রু এক ঈশ্বরবাদের জন্ম হোল। তাদের সৃষ্টিকর্তার থাকেন এই বিশ্ব জগতের বাইরে আর একটি জগতে। সেখানে অবস্থান করেই তিনি মানুষের জন্য এই বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীতে এই এক সৃষ্টিকর্তা ও দুই জগতের ধারণা নিয়ে আরও কিছু ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে।

এই পর্যায়ে এসে দার্শনিকদের এই ভাবনা তখনি সত্যে পরিণত হোল যখন সৃষ্টিকর্তা মানুষের সাথে নিজেই যোগাযোগ স্থাপন করলেন কয়েকটি ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের স্ব স্ব গ্রন্থের উপর বিশ্বাস স্থাপন করল এবং এভাবে মানুষ তাদের সৃষ্টি তত্ত্বের জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে যায়। সম্প্রদায়-গত সামাজিক জ্ঞানে সৃষ্টিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল।  সাধারণ মানুষ হোল মূলত অনুসরণকারী। তার সম্প্রদায় থেকে সে যে জ্ঞান লাভ করেছে সে সেই জ্ঞানেরই অনুসরণ করছে। এই জ্ঞানের বাইরে তারা আর কিছু গ্রহণ করতে পারে না।

কিন্তু অনুসন্ধানী মানুষ তথা দার্শনিকরা এখানেই সন্তুষ্ট হতে পারেন নাই। তাদের প্রশ্ন এই বিশ্ব জগত সৃষ্টি হয়েছে অন্য এক জগত থেকে অর্থাৎ এই বিশ্ব জগতের অস্তিত্বের জন্য দায়ী অন্য এক জগত, তাহলে কি সেই জগতেরও উৎপত্তির কারণ অন্য আর এক জগত? কোন কিছু যদি আপনা আপনি উৎপত্তি না হতে পারে তাহলে সব উৎপত্তির পিছনেই তো আর একটি উৎপত্তিগত কারণ থেকে যায়? এই জগতের উৎপত্তির কারণ আর একটি জগত এবং তার উৎপত্তির কারণ অন্য আর একটি জগত, এভাবে জগতের অসীম এক চেইন তৈরি হয়ে যায়।  তাহলে তো কোন কিছু নাই বলে কোন অবস্থা নাই। কোন কিছু নাই থাকাটা যেখানে স্বাভাবিক ছিল সেখানে কোন কিছু থাকাটাই স্বাভাবিক অবস্থা। তাহলে নাই থেকে উৎপত্তির কোন কারণ থাকে না, কোন কিছু আছে এবং সর্ব অবস্থাতেই সেটা আছে।

এই ধারণা মেনে নিলে আবার সৃষ্টিতত্ত্ব থাকে না। কারণ কোন কিছু নাই এর জগত না থাকলে সৃষ্টি হবে কোথায়? কারণ সবটুকু জগতই তো কোন কিছু আছে জগত দ্বারা পরিপূর্ণ। সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্রষ্টা সর্বব্যাপি বিরাজমান। অর্থাৎ অসীম জগতে এমন কোন স্থান নাই যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্ব নাই। অসীম জগতে স্রষ্টা নিজেই নিজের সৃষ্টি। সুতরাং স্রষ্টাকে সৃষ্টি করার জন্য অসীম জগতের বাইরে যেমন কোন জগত থাকতে পারে না   তেমনি স্রষ্টার অস্তিত্ব পূর্ণ কোন জায়গায় নতুন কোন জগতের সৃষ্টিও সম্ভব নয়।

অনুসন্ধানী যুক্তিবাদী দার্শনিকরা এই জায়গায় এসে থেমে যান। কারণ আপাতত যুক্তির সবকটি পথ তারা যাচাই করে দেখে ফেলেছেন। কিন্তু অনুসন্ধানী বস্তুবাদী দার্শনিকরা আরও কিছুদূর এগুতে চান। তাদের পদ্ধতি হোল ধারণাকে তত্ত্বে রূপ দেয়া এবং সেই তত্ত্বের সত্যতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা। গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান হোল তাদের পর্যবেক্ষণের হাতিয়ার।  

তারা শুরু করেন বাস্তব বস্তু জগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তারা দেখেন প্রকৃতিতে যা কিছুর বা রূপের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলো পূর্বাপর এক বা একাধিক রূপের রূপান্তরিত ফল। পূর্বাপর রূপের মধ্যে পরবর্তী রূপে রূপান্তরিত হওয়ার উপাদান ও সম্ভাবনা থাকে  বলেই পরবর্তি রূপে রূপান্তর হওয়া সম্ভব হয়। এই সম্ভাবনা আবার কিছু শর্তের অধীন। যেমন বাষ্পের পূর্বাপর রূপ জল। জলের মধ্যে বাষ্পের সকল উপাদান রয়েছে এবং কিছু শর্তাধীনে জল বাষ্পে রূপান্তরিত হতে পারে। প্রকৃতির অনেক রূপান্তরই চক্রাকার। আবার এই চক্রাকার রূপান্তরই এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রকৃতিতে রূপান্তর একটি সরল অবস্থা থেকে ক্রমশ জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে এনট্রপি বলা হয়।  আবার সকল অবস্থা বা রূপের মূল উপাদান হোল অণু পরমাণু এবং রূপান্তর ঘটে কয়েকটি বল বা শক্তির দ্বারা। মহা বিশ্বের সকল গ্রহ নক্ষত্র, ছায়াপথ সকল কিছুই অসংখ্য অণু পরমাণু নিয়ে গঠিত।  প্রতিটি পরমাণু আবার কিছু ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন নিয়ে গঠিত। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের পূর্বাবস্থা হোল এক সেট কণা। এগুলো কোন ধারণা নয়। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা এগুলো প্রমাণিত সত্য বলে গৃহীত হয়েছে।

 কিন্তু বৃহৎ বস্তুগুলির আচরণ পরমাণু জগতের আচরণ থেকে ভিন্ন। প্রতিটি একই ধরণের রূপ বা অবস্থার নিজস্ব গুনাগুণ বা আচরণ বিধি রয়েছে। এই মহা বিশ্বের সর্বত্র আমারা যে অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, সৌর জগত, ছায়াপথের দেখা পাই সেগুলো হোল বৃহৎ বস্তুপিণ্ড। মহাবিশ্বের এই অবস্থায়  দেখা যায় সকল ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে স্পেস টাইমে ছায়াপথগুলো অবস্থান করছে সেই স্পেসটাই অতীত থেকে সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে এবং ভবিষ্যতের দিকে আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সম্প্রসারিত বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশই আমরা দেখতে পাই এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারি। কিন্তু  সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলোর গতিপথ ও পরিবর্তন যেহেতু নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বিধি মেনে চলে, সেই নিয়ম বিধি অনুসরণ করে আমরা মহাবিশ্বের অতীত ও ভবিষ্যৎ অবস্থা জানতে পারি। বস্তু জগত কখনো তার নিয়ম বিধির ব্যত্যয় ঘটায় না। বস্তু জগতের যে ক্রম বিবর্তন সেটার সম্ভাবনা ও নিয়ম বিধি পূর্ব অবস্থাতেই রয়েছে তাই সেই নিয়ম বিধি তাকে পরবর্তী রূপান্তর অবস্থায় যেতে সহায়তা করে। এর জন্য বাইরের কোন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না।  সম্প্রসারিত মহা বিশ্বের আদি অবস্থার পরিসর ছিল অতি ক্ষুদ্র। শক্তির সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের সকল শক্তি সেই সংকুচিত অবস্থার ক্ষুদ্র পরিসরে কেন্দ্রীভূত ছিল। সেগুলো প্রচণ্ড তাপীয় অবস্থায় বিরাজ করছিল। বর্তমান বিশ্বের সকল বস্তু, অণু পরমাণু, কোয়ার্ক পার্টিকেলগুলোর অস্তিত্ব সেই প্রচণ্ড তাপীয় অবস্থায় সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই তাপীয় অবস্থায় পরবর্তীতে বস্তু জগত গঠনের সম্ভাবনা লুকায়িত ছিল। বিশ্ব সম্প্রসারণের ফলে প্রচণ্ড তাপীয় অবস্থা শীতল হতে থাকে। তাপীয় অবস্থা যখন কোয়ার্ক বা কণা গঠনের শর্তে পৌঁছায় তখন সকল পার্টিকেল ও বলের উদ্ভব ঘটে। পার্টিকেল ও বলের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ম বিধির অধীন হয়ে পরে। এই পর্যায় থেকে কসমিক বিজ্ঞানীগণের বস্তুর আচরণের সূত্রগুলো কার্যকর হয়ে উঠে।

সুতরাং মহাবিশ্বকে জানার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের দুইটি সীমা রয়েছে। এক, মহা বিশ্বের আদি অবস্থা যেখানে বিশ্ব অতি ক্ষুদ্র পরিসরে প্রচণ্ড তাপীয় অবস্থায় ছিল। এই অবস্থায় এখন পর্যন্ত জানা বিজ্ঞানীদের কোন সমীকরণ কাজ করে না। কারণ সমীকরণগুলি বস্তু ও বলের উপর কার্যকর। স্পেস টাইমের যাত্রা সেখান থেকেই শুরু। সুতরাং মহাবিশ্বের আদি অবস্থার পূর্বে কি অবস্থা ছিল সেটা জানা সম্ভব হয়ে উঠেনি। দুই, অন্যদিকে মহা বিশ্বের সম্প্রসারিত বর্তমান অবস্থায় মহা বিশ্বের সীমানার বাইরে কি আছে সেটা জানাও সম্ভব হয় না। কারণ দূরবর্তী কোন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হলে আলো বা রেডিয়েশনের উপর নির্ভর করতে হয়। যেহেতু আলো, রেডিয়েশন বা গ্রেভিটেশনাল ওয়েভ চলে স্পেস টাইমের পথ ধরে সেহেতু স্পেস টাইমের বাইরে কোন পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়।

তাই মেটা-ফিজিক্স দার্শনিকদের জানার পরিধি এই মহাবিশ্বর সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মহা বিশ্বের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে এবং মহাবিশ্ব কোথায় সম্প্রসারিত হচ্ছে এই সম্পর্কে মেটা-ফিজিক্স দার্শনিকরা অজ্ঞ। তবে তারা দেখেছেন এই মহাবিশ্ব শুরু থেকে এ পর্যন্ত কিছু নিয়ম বিধি অনুসরণ করেই রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই রূপান্তরের পিছনে বাহ্যিক কোন কিছুর অবদান নেই। মেটা-ফিজিক্স দার্শনিকরা বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্যের বাইরে কোন ধারণা দিয়ে কোন কিছুর সিদ্ধান্তে আসেন না। তবে তারা সব সময় প্রচেষ্টা করে যান সত্য জানার পদ্ধতিগুলো আবিষ্কার করতে।

এই মহা বিশ্বের বাইরে কিছু আছে কি নাই এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। কিন্তু এই মহাবিশ্বের অভ্যন্তরেই আছে কি নাই এর একটি সংমিশ্রণ অবস্থা রয়েছে। গ্রহ নক্ষত্র এবং বৃহৎ বস্তু অবস্থায় প্রকৃতি যে আচরণ বিধি অনুসরণ করে, কণা এবং কোয়ার্ক অবস্থায় প্রকৃতির নিয়ম বিধি অন্য রকম। এই অবস্থাকে বস্তুর কোয়ান্টাম অবস্থা বলে। এখানে কোয়ান্টাম ফিল্ড বলে একটি ক্ষেত্র রয়েছে। এই ক্ষেত্রকে আমরা একটি জল ভর্তি চৌবাচ্চা হিসেবে কল্পনা করতে পারি। বৃষ্টি পড়লে জলের উপরি তল চঞ্চল হয়ে উঠে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা জলের উপরি তলকে একবার নীচে নিয়ে যায় পরক্ষণে উপরে উত্থিত করে। জলের স্থির অবস্থা হোল কোয়ান্টাম ফিল্ডের ভেকিউম অবস্থা অর্থাৎ যেখানে কোন কণার অস্তিত্ব নাই। আর যেখানে জলের তল উত্থিত হচ্ছে সেটাই কোন কণার অস্তিত্ব। আর যেখানে জলের তল নীচে দেবে যাচ্ছে সেটা হোল এন্টি কণার অস্তিত্ব। কোয়ান্টাম পরিসরে কোন ভেকিউম অর্থাৎ নাই অবস্থা থাকতে পারে না। এখানে সর্বদা কণার অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে সাথে সাথে তার একটি এন্টি কণাও তৈরি হচ্ছে। এই দুই কণা পরক্ষনে একসাথে মিলিত হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কণা কোয়ান্টাম ফিল্ডের ভাইব্রেশন বা তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানে একই সাথে আছে বা নাই এর টানা পোড়ন চলছে।  এই কণারই আর একটি অবস্থা হোল সকল বস্তু জগত বা মহা বিশ্ব। আমি আপনি সকলেই এই কণার বস্তুগত অবস্থা। মহা বিশ্বের আদিতে এই মেটার ও এন্টি মেটারের টানা পোড়ন চলছিল। এই টানা পোড়নে যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা ই প্রচণ্ড তাপীয় অবস্থার কারণ। কোন কারণে এই মেটার ও এন্টি মেটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে  এন্টি মেটারের তুলনায় মেটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং মহা বিশ্ব প্রচণ্ড গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে।

সুতরাং এই মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে প্রকৃতির যে নিয়ম বিধিগুলো দেখতে পাই তার মৌলিক দিকগুলো হল: এক, প্রকৃতিতে কোন ভেকিউম বা শূন্য অবস্থা থাকতে পারে না। শূন্য অবস্থা তৈরি হবার উপক্রম হলেই সেখানে কণার অস্তিত্ব জেগে উঠে। দুই, প্রকৃতিতে যা কছু আছে তার সবই কণা ও কয়েকটি বল দ্বারা গঠিত। তিন, প্রকৃতির প্রতিটি অবস্থা তার পূর্ববর্তী অবস্থার রূপান্তর। চার, প্রতিটি অবস্থার আচরণ তার পূর্ববর্তী অবস্থার আচরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রকৃতির এই নিয়মগুলো থেকে আমরা ধারনা করতে পারি এই মহা বিশ্বের প্রাকৃতিক অবস্থা অন্য একটি প্রাকৃতিক অবস্থার রূপান্তরিত ফল। এই দুই অবস্থার আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই মহাবিশ্বের আচরণগত নিয়ম বিধি দিয়ে অন্য অবস্থার আচরণ জানা সম্ভব নয়। সুতরাং এই মহাবিশ্বের বাইরের অবস্থা নিয়ে আমরা যাই কিছু ধারণা করি সেগুলোর সবটাই কল্পনা প্রসূত।

আবহমান কাল ধরে মানুষ কি জানতে চায়? -Mahbubur Rahman
Feb. 23, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:274 | likes:2 | share: 0 | comments:0


 আদিম যুগে মানুষ খুব বেশি মাত্রায় প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল। প্রকৃতি যেমন তাদের সুফল বয়ে আনত তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কম ছিল না। প্রকৃতির এই পরিবর্তিত চরিত্রের বস্তুগত ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পেত না। তাই এই শুভ ও অশুভ  রুপের কারণ হিসেবে তারা অদৃশ্য কোন শক্তির হাত রয়েছে বলে কল্পনা করে নেয়। প্রবৃত্তিগত ভয়ের অনুভুতি থেকে উৎসারিত শুভ ও অশুভ অদৃশ্য শক্তির ধারণা  তাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে এমনভাবে গেঁথে যায় যে এগুলো সত্য বলে বদ্ধমূল ধারণায় পরিনত হয়। অব্যাখ্যায়িত অসংখ্য বিষয়ের কাল্পনিক ব্যাখ্যার জগত নিয়ে তাদের ভাবগত জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকে।

     জন্ম ও মৃত্যু মানুষের অনুভূতির জগতকে সব সময় আলোরিত করে। আদিম সমাজের মানুষ জন্ম ও মৃত্যুকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে, তৈরি করেছে বহু কল্প কাহিনী মিথ। তাদের পূর্ব পুরুষেরা কোথা থেকে আসল, এই টেরিটরি তাদের কে দিয়েছে, মৃত্যুর পর প্রবীণেরা কোথায় চলে যায়, প্রবীণেরা কি সব সময় অদৃশ্যে থেকে তাদের রক্ষা করে চলছে ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব তারা তাদের ভাষার তথ্য ভাণ্ডারে সংগ্রহ করে রেখেছে। পৃথিবীর অসংখ্য ট্রাইবাল সমাজে অসংখ্য মিথ ও বিশ্বাস রয়েছে। এইসব মিথের একটি হোল বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা। আফ্রিকান অনেক উপজাতি বিশ্বাস করে বিশ্বের জন্ম হয়েছে একটি ডিম থেকে। ডগন উপজাতিরা বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তার জোড় আত্মা নুম্মু একটি স্বর্গীয় ডিম থেকে জন্ম লাভ করে। অনেক উপজাতিরা বিশ্বাস করে পৃথিবী গঠিত হয়েছে একটি বিড়াটকায় সাপের শরীর থেকে। বেনিনের ফণ লোকেরা মনে করে মাউ (চাঁদ) ও লিসা (সূর্য) এই দুই সৃষ্টি দেবতার বড়ছেলে গু পৃথিবীতে আসে লোহার এক তলোয়ারের রুপে এবং পরবর্তিতে কামার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার কাজ ছিল মানুষের বসবাসের জন্য পৃথিবীকে প্রস্তুত করা। সে মানুষকে বিভিন্ন হাতিয়ার বানাতে শেখায় এবং সেগুলো ব্যবহার করে শেখায় কিভাবে ফসল চাষ করা যায় ও কিভাবে ঘর বাড়ী বানানো যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার সান লোকেরা (বুশমেন) মনে করে সৃষ্টি কর্ম করেন ডক্সোই নামে এক আত্মা। যিনি একই সাথে মানুষ বা ফুল বা পাখী বা কোন সরীসৃপ। আমেরিকান আদিবাসীরা মনে করে একজন পরম আত্মা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সৃষ্টির শুরুটা ঘটিয়েই তিনি তার দ্বায়িত্ব শেষ করে স্বর্গে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সৃষ্টির পরবর্তি খুটিনাটি বিষয় এবং প্রতিদিনের কার্য্যক্রম পরিচালনা করেন অন্যান্য দেবতারা। তাদের মতে আকাশ পিতা ও ধরিত্রী মাতা সৃষ্টি জগতের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শক্তি। পরম আত্মা আকাশ, পৃথিবী, শুকতারা, সন্ধ্যাতারা এবং অন্যান্য গ্রহ দেবতাদের মধ্যে বিভিন্ন কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। লাকোটার লোকেরা মনে করে আকাশ, সূর্য্য, বাতাস, পৃথিবী এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বহু উপাদান, মানুষ, আধ্যাত্মিক জগত সবকিছুই একজন চরম স্বত্বার বহু গুণ। দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকান আদিবাসীদের সৃষ্টি তত্বের পৌরাণিক কাহিনী আবার ভিন্ন ধরণের। তাদের কাহিনীতে রয়েছে সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী সাগরের নিচে নিমজ্জিত ছিল। একটি হাস বা কচ্ছপ সাগরের নীচ থেকে কিছু মাটি পিঠে করে উপরে নিয়ে আসে। সেই মাটি দিয়েই পৃথিবীর সৃষ্টি। এই মিথ উত্তর ইউরোপ ও এশিয়াতেও রয়েছে। ইরোকুইস বাসীরা এই মিথের সাথে আরো কিছু যোগ করেন। সেই মতে আকাশ দেবী আতাহেন্সিক স্বর্গের মেঝে ফুটো করে দিলে সেখান দিয়ে একজন নারী নিচে সাগরে পড়ে যান। তাকে দাঁড়াবার ও বিচরণের স্থান দেবার জন্যই সাগরের গভীর তলদেশ থেকে হাঁস কাঁদা তুলে আনে এবং কচ্ছপের পিঠে তা বৃস্তিত করে পৃথিবী তৈরি করা হয়।

মৃত্যু সম্পর্কেও মানুষের বিভিন্ন মিথ রয়েছে। আফ্রিকা জুড়ে এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে সর্বোচ্চ দেবতা মানুষকে অমর করে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কোন ভুলের জন্য সেটা হয়নি। সিরা লিয়ন অঞ্চলের লোকেরা মনে করে মানুষের অমরত্বের সংবাদ নিয়ে একটি কুকুরকে পাঠানো হলে সে পথিমধ্যে খাবারের সন্ধান করতে করতে দেরী করে ফেলে। ইতিমধ্যে একটি ব্যাঙ মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আগেই পৌঁছে যায়। ফলে মৃত্যু মানুষের একমাত্র পরিণতি হিসেবে থেকে যায়।

এভাবে জন্ম, মৃত্যু, মানুষ ও জগতের উৎপত্তি সম্পর্কে আদীম সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের অসংখ্য ট্রাইবাল সমাজ এমন কি আধুনিক সমাজের মানুষের মনো জগতে বিভিন্ন মিথ জোরালো ভাবে বিরাজ করছে। এই সমস্ত মিথের উপর নির্ভর করেই মানুষ্য সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার আচরণ, জীবনাচরণের রীতি নীতি নৈতিকতা, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন ভাষার তথ্য ভাণ্ডার এই সমস্ত জ্ঞান সংরক্ষিত করে রেখে পরবর্তি প্রজন্মে সঞ্চারিত করছে। এই সমস্ত সামাজিক জ্ঞান একদিকে যেমন সামাজিক একাত্বতা ধরে রাখে, অপর দিকে বিভিন্ন সমাজের স্বাতন্ত্রতাও বজায় রাখে।

এক সময় বস্তুগত জ্ঞানের প্রভাব থেকেও ভাবগত জ্ঞানের প্রভাব অনেক বেশি জোড়ালো হয়ে উঠে। ক্রমশ ভাবগত জ্ঞানের সামাজিকিকরণ হওয়ার ফলে মানুষ একসময় এই জ্ঞানের ভিত্তিতেই বস্তুগত জ্ঞানএর সত্যতা যাচাই করতে শুরু করে দেয়। ফলে বস্তুগত জ্ঞানের গ্রহণ যোগ্যতা নির্ভর করে ভাবগত জ্ঞানের দ্বারা অনুমোদনের উপর।

    সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আবহমান কাল ধরেই মানুষের মনে একই জিজ্ঞাসা এই বিশ্ব জগতের সৃষ্টির রহস্য কি? এই জগত সৃষ্টির পেছনে কি কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে? জন্ম মৃত্যুর রহস্যটাই বা কি? বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাবে এর জবাবও রয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের জবাবটাও আমাদের জানা প্রয়োজন।


জ্ঞানের উৎস কী? কোন উৎসে মানুষ উৎসাহী? -Mahbubur Rahman
Feb. 18, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:181 | likes:9 | share: 2 | comments:0

মানুষ তার ইন্দ্রিয়র মাধ্যমে বাইরের জগত সম্পর্কে জানতে পারে এবং এই তথ্যগুলো 

মস্তিষ্কের কোষে জমা থাকে। বিবর্তন ইন্দ্রিয়গুলোকে ততটুকুই দক্ষ করেছে 

যতটুকু হলে সে বেঁচে থেকে বংশ বিস্তার করতে পারে। বাইরের জগতের পুরোপুরি 

সত্য তথ্য তার ইন্দ্রিয়ে ধরা পরে না। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানার পরিধি  সত্যের

 একটি ছায়া মাত্র।

 

 দর্শন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ আলোকিত বস্তুর আকার ও রঙের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। কিন্তু আলো কম থাকলে সে রঙ সম্পর্কে ভ্রান্ত তথ্য লাভ করে। আবার একই আকারের কাছের বস্তুর তুলনায় দূরের বস্তুকে ছোট দেখতে পায়। একটি বড় গাছ ও একটি ছোট গাছের পার্থক্য বুঝতে পারে কিন্তু গাছটি কত হাত লম্বা সেটা শুধু দেখে বুঝতে পারে না।

 শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ বাইরের জগতের বিভিন্ন শব্দ শুনতে পায় এবং শব্দের উৎস কোন দিকে সেটা মোটামুটি ধারণা করতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পারে শব্দের সাথে কোন না কোন বস্তু বা প্রাণীর সম্পর্ক আছে।    সে যদি একটি বিকট শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে একটি হাতি রয়েছে তাহলে সে হাতির সাথে সেই বিকট শব্দের একটি সম্পর্ক খুঁজে পায়। এভাবে মস্তিষ্ক একটি সিদ্ধাতে আসে যে সকল শব্দেরই একটি উৎস রয়েছে। কিন্তু শব্দ যে একটি তরঙ্গ এটা সে তার শ্রবণ ইন্দ্রিয় দ্বারা বুঝতে পারে না।

 ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তথ্য সংগ্রহের পর মস্তিষ্ক সেগুলো একটার সাথে আর একটা তুলনা করে চিনে রাখে এবং কোন তথ্যের সাথে কোন তথ্যের সম্পর্ক রয়েছে সেগুলোও স্মৃতি-কোষে জমা রাখে। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে সকল প্রাণীর জন্য এতটুকু ভাসাভাসা জ্ঞানই যথেষ্ট। বেঁচে থাকার জন্য বাইরের জগতে কোন ঘটনা সম্পর্কে যতটুকু প্রাক ধারণা করা প্রয়োজন সেটুকু এই জ্ঞান থেকেই সম্ভব।

 কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক এর থেকে ব্যতিক্রম। তার মস্তিষ্ক আরও বেশি বিকশিত হয়েছে। সে আরও বেশি প্রাক ধারণা করতে চায় এবং সে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও বেশি সত্যের কাছাকাছি যেতে চায়।

 মানুষ সত্য জানার দুটি পথ খুঁজে পায়। একটি হোল ইন্দ্রিয় লব্ধ ভাসা ভাসা জ্ঞান থেকেই অজানা তথ্য সম্পর্কে একটা ধারণায় আসা। আর একটি হোল পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের দ্বারা তথ্যের সত্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। প্রথম পথে মুনি, ঋষি ও দার্শনিকেরা সত্যের অন্বেষণ করে থাকে। তাদের পথ হোল ধ্যানের পথ। যখন কোন তথ্যের কোন কার্যকারণ সম্পর্কখুঁজে পায় না তখন ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান থেকে যুক্তির মাধ্যমে একটি প্রাক ধারণায় উপনীত হয়। মেঘের গুরু গুরু শব্দের নিশ্চয় কোন উৎস আছে, প্রাক ধারণা হোল এটা বিভিন্ন দেবতাদের যুদ্ধের ঢাল তলোয়ারের শব্দ।

ভূমিকম্পে ধরণী কেঁপে উঠার কারণ হোল পৃথিবীটা একটা ষাঁড়ের মাথায় আছে, সে 

মাথা নাড়ালেই ভূমিকম্প হয়। এভাবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন কিছুই আর অজানা

থাকে না। মুনি ঋষি ও দার্শনিকদের কাছে জগতের সব কিছুরই ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে

 এই সত্য জ্ঞানের ব্যাখ্যা বিভিন্ন মুনির কাছে বিভিন্ন।

 

 দ্বিতীয় পথে রয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা লব্ধ ফলাফলের উপর তাদের সত্য জ্ঞান অর্জিত হয়। ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞানের গভীরে যাওয়ার জন্য তারা পরিমাপ পদ্ধতির আশ্রয় নেন। সাধারণ মানুষ যখন এক ঝাঁক পাখী দেখতে পায় তখন বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেন কয়টা পাখী। এভাবে গণনা পদ্ধতি সত্য তথ্য জানার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তারা একটি সমকোণী ত্রিভুজের দুটি জানা বাহুর দৈর্ঘ্য থেকে অপর বাহুর দৈর্ঘ্য জানার সূত্র জানতে পারেন। তারা কোন বস্তুর ওজন মাপার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তারা এক দিনকে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডে ভাগ করে নিয়ে সময় মাপতে পারেন। সময় থেকে তারা কোন বস্তুর গতিও মাপতে পারেন। এই মাপার ক্ষমতা মানুষকে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সে এখন বস্তু ও শক্তি জগতের সত্য তথ্য জানার ক্ষমতা অর্জন করেছে। সে জানতে পেরেছে জগতে কি কি বস্তু ও শক্তি আছে এবং তাদের মধ্যকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কি।

 

বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত চারটি শক্তি শনাক্ত করতে পেরেছে এবং এদের কি কাজ সেই তথ্যও তারা জানে। তারা জেনেছে পরমাণুরও ক্ষুদ্র ডজন খানেক পার্টিকেল ও চারটি শক্তির সমন্বয়েই এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সৃষ্ট হয়েছে। পার্টিকেলগুলোও এক 

ধরণের তরঙ্গ শক্তি। স্থান কালেরও আবির্ভাব হয়েছে এই বিশ্ব হওয়ার সময়ে। এই 

স্থান কালে শূন্য স্থান বলে কিছু নাই। কোথাও শূন্যতার সৃষ্ট হওয়ার উপক্রম 

হলেই সেখানে বস্তু অস্তিত্ব লাভ করে। বিজ্ঞানীদের এই সমস্ত জ্ঞান হল গবেষণা

 দ্বারা প্রমাণিত জ্ঞান। যে প্রাক ধারণা প্রমাণিত হয়নি সেই জ্ঞান তারা গ্রহণ করেন না। বস্তু জগতের অনেক কার্যকারণ সম্পর্ক এখনো অজানা রয়েছে।বিজ্ঞানীরা সেগুলোর ভাববাদী ব্যাখ্যা দিতে যান না। সেগুলো সম্পর্কে তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

 

বিজ্ঞানের আর একটি ক্ষেত্র হোল জীব বিজ্ঞান। অচেতন বস্তু কিভাবে চেতনা লাভ করল সেটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যময়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন জানে কখন থেকে জীবনের শুরু হয়েছে। তারা জানতে পেরেছে যে জীবনের বিল্ডিং ব্লক হোল ডিএনএ ও আরএনএ। এরা এমন ভাবে সজ্জিত যে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তাদের প্রতিলিপি তৈরি করে। প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতাকেই আমরা জীবন বলি। ভাইরাসের সুক্ষ্ণ আবরণের ভিতরে এই ডীএনএ জিন রয়েছে। প্রতিকূল অবস্থায় এরা জীবিত নয়। কিন্তু অনুকূল পরিবেশে তারা পোষকের কোষে প্রবেশ করে তাদের জিনের প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে। ভাইরাসের অণুতে এমন কোন আত্মার অস্তিত্ব নেই যে সে পোষককে খুঁজে তার কোষে প্রবেশ করবে। পোষকের কোষের সংস্পর্শে আসলেই পোষক কোষ তাকে গ্রহণ করে নেয়। এই প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। পোষকের কোষের জিন ভাইরাসের জিনের সংস্পর্শে এলে ভাইরাসের জিনের ছাঁচে প্রতিলিপি তৈরি হতে থাকে।

 

 জীব বিজ্ঞানীরা গবেষণার দ্বারা প্রমাণ পেয়েছেন বিবর্তনের ধারায় এককোষী জীব থেকে বর্তমান কালের সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সহ সকল বহুকোষী প্রাণীর দেহে বিভিন্ন কোষ-গুচ্ছের বিভিন্ন কাজ রয়েছে। সম্মিলিত ভাবেই তারা একটি প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার তাদের দেহে বাইরের কিছু অণুজীবও রয়েছে। প্রাণী দেহের প্রতিটি কোষে যে মাইক্রোকন্ড্রিয়া রয়েছে তারা এই ধরণের অণুজীব, যারা কোষেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।এর কাজ হল শক্তি উৎপাদন করা। প্রতিটি কোষে এই অণুজীব না থাকলে কোন প্রানী বেঁচে থাকতে পারত না।

 

 আবার পরিপাকতন্ত্রে এমন অনেক ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যারা পরিপাকে সাহায্য করে। এ থেকে বুঝা যায় মানুষের সৃষ্টি কোন বিশুদ্ধ জায়গায় হঠাত করে হয়নি। বিবর্তনের পথ ধরে প্রাকৃতিক পরিবেশেই মানুষের বিকাশ হয়েছে।

 

 কিন্তু সব মানুষেরই জ্ঞানের পিপাসা এক নয়। সাধারণ মানুষ জ্ঞান অনুসন্ধানে 

আগ্রহী নয়। সে ততটুকুই জানতে চায় যতটুকু তার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। সে 

হোল অনুকরণ ও অনুসরণকারী। বিবর্তনই তাকে এখানে আটকে রেখেছে। মানুষ সহ সকল প্রাণীর প্রবৃত্তিগত  কিছু আচরণ রয়েছে। যে আচরণ তাকে সক্রিয় থাকতে তাড়না যোগায়। প্রবৃত্তির কারণেই সে একটি টেরিটরিতে সমাজবদ্ধ থাকে। অন্যান্য প্রাইমেটদের মতই সেই সমাজে হায়ারিকি রয়েছে। কিছু আলফা পুরুষ ও নারী সকল কাজ ও অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে বাকী সবাই তাদের কাজের অনুকরণ ও অনুসরণ করে। একদল হাতির পালের অগ্রভাগে থাকা আলফা পুরুষ বা নারী শুর উঁচিয়ে দূরের কোন জলাশয়ের ঘ্রাণ পেলে সেদিকে যাত্রা শুরু করে, বাকী দল তাদের অনুসরণ করে পিছু নেয়। মানুষের সমাজে এদের বিজ্ঞ বলা হয়। এরা জাগতিক সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে অনুসন্ধান করে ও তার একটা ব্যাখ্যা প্রদান করে। সাধারণ মানুষ তাদের এই পথ ও ব্যাখ্যা মনে প্রানে বিশ্বাস ও গ্রহণ করে নেয়।  বিজ্ঞ  জনেরা জন্ম, মৃত্যু, ভাল, মন্দ, শুভ অশুভ শক্তিকে তুষ্ট করার প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা প্রদান করে সেগুলো বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। 

বিজ্ঞ জনেরা যে যন্ত্র আবিষ্কার করলো তার পিছনের প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ 

থেকেই সাধারণ মানুষেরা তার ব্যবহার শিখে নিল। পশু প্রবৃত্তির আর একটি দিক 

রয়েছে। খাবার সংগ্রহের তাড়না থেকে বিজ্ঞ  জনেরা জন্ম, মৃত্যু, ভাল, মন্দ, শুভ অশুভ শক্তিকে তুষ্ট করার প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা প্রদান করে সকলে সেগুলো বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। 

বিজ্ঞ জনেরা যে যন্ত্র আবিষ্কার করলো তার পিছনের প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেই সাধারণ মানুষেরা তার ব্যবহার শিখে নিল। পশু প্রবৃত্তির আর একটি দিক রয়েছে। খাবার সংগ্রহের তাড়না থেকে  যৌন  তাড়না অনেক বেশি, তার থেকে বেশি ভয় থেকে পালানোর তাড়না। এই সময় তাদের হার্ট-বিট দ্রুত হতে থাকে, নিঃশ্বাস বেড়ে যায়, শরীরের সকল পেশী সক্রিয় হয়ে কাঁপতে থাকে। তাই অজানা শুভ ও অশুভ শক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষ বেশি আগ্রহী থাকে এবং অবচেতন মনে গেঁথে যায়। যেহেতু জ্ঞানের গভীরে তারা যায় না তাই ভয় প্রসূত ব্যাখ্যা থেকে তারা সহজে মুক্তি পায় না।

 

 বিজ্ঞ জনের এই সমস্ত জ্ঞান, আচার, আচরণ ও ব্যাখ্যা ভাষা ও পরবর্তীতে লেখনীর মাধ্যমে সামাজিক জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। এই সামাজিক জ্ঞানই বিভিন্ন সামাজিক টেরিটরিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে প্রকাশ পায়। 

প্রবৃত্তিগত কারণেই মানুষ তার নিজস্ব সামাজিক টেরিটরিতে বসবাস করতে বেশি একাত্মতা অনুভব করে। আতংকিত হওয়া একটি সহজাত প্রবৃত্তি। নিজের সমাজ ও টেরিটরি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সব প্রাণীই আতঙ্কগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে পরে। শিশুরা মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে  আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। আতংকগ্রস্থতার পরবর্তী অবস্থা  নিস্তেজ হয়ে পরা, ডিপ্রেশনে ভোগা। ভিন্ন টেরিটরি,

 ভিন্ন সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে মানুষ প্রথমে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরে ও পরবর্তীতে ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে। তাই ভিন্ন সমাজে গিয়ে মানুষ হয় সেই সমাজের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস গ্রহণ করে অথবা একই সমাজের সকল প্রবাসীদের নিয়ে নিজেদের এক পৃথক টেরিটরি তৈরি করে নেয়।

 

 তাই প্রবৃত্তিগত কারণেই বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞানের চেয়ে টেরিটরি-গত সামাজিক জ্ঞানের ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। মানুষ প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করে এর পিছনের বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করেই। টেরিটরি-গত সামাজিক জ্ঞান ও বিশ্বাসের বিপরীত কোন বৈজ্ঞানিক সত্যকে তারা অস্বীকার করে টেরিটরি-গত বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই। 

 

সাধারণ মানুষ তার টেরিটরি-গত সামাজিক জ্ঞান ও বিশ্বাসের অনুসারী। এই অসংখ্য মত, পথ, ও বিশ্বাস নিয়েই মানব জাতি। তাই কোন মত সত্য কোন মত মিথ্যা এই বিতর্ক করে কোন লাভ নেই বরং এই বিতর্ক বিরোধিতারই সৃষ্টি করবে। এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞ জনদেরই উচিৎ তাদের সামাজিক জ্ঞানকে বিজ্ঞান-মুখি করে ক্রমশ উন্নত করা। 

অনুসরণকারীদের উপর চাপ দিয়ে কিছুই বদলানো যাবে না।


ঘরের শত্রু বিভীষণ নয়, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মাত্মা বিভীষণ -Pranto ray
Feb. 8, 2025 | পৌরাণিক | views:80 | likes:1 | share: 0 | comments:0

রামায়ণ প্রত্যেক সনাতনীদের নিকট শুধু একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয় বরং এর রয়েছে কিছু বিশেষত্ব। প্রাচীন বা মধ্যযুগ কিংবা বর্তমান সময়ে রামায়ণ সকলের কাছে ধর্মের এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, নীতিনৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম সে সকল চরিত্র যেগুলো রামায়ণে কথিত হয় হয়েছে তার মধ্যে প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম। একজন রাজপুত্র ধর্মের নির্দেশ পালনে অটল, পিতৃসত্য পালনে নির্ভীক এবং একজন স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি আনুগত্য এসবই যেন শ্রীরামকে অনন্য করে তুলেছে। মাতা সীতাকে উদ্ধারে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর বীরোচিত আত্মত্যাগ এবং শৌর্য সকল বীরপুরুষের অনুপ্রেরণা। কিন্তু লঙ্কা বিজয় ও রাবণকে পরাজয়ে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম যেমন নন্দিত ও বীরের আসনে আসীন ঠিক তার বিপরীত আচরণ পরিলক্ষিত হয় ধর্ম পক্ষে অংশগ্রহণকারী লঙ্কারাজ রাবনের ভাই বিভীষণের। বর্তমান সমাজ তাকে দাড় করিয়েছে কাঠগড়ায়, কলঙ্কিত করেছে তা ধার্মিক চরিত্রকে এবং কুৎসিত প্রবাদ বাক্য প্রচলন করেছে, "ঘরের শত্রু বিভীষণ"। ইহা নিতান্তই মূর্খতার পরিচয়কেই নয় বরং একধরনের প্রোপাগাণ্ডার শিকার। যা বাংলার নন্দিত কবি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্ট মেঘনাদবধ কাব্য হতে সংগৃহীত বলে ধারণা করা হয়। যেখানে লম্পট রাবণকে আক্রান্ত, অসহায় রাজা এবং আক্রমণকারী হিসেবে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে, অধার্মিক রাবণের ভ্রাতা/ভাই বিভীষণকে দৃষ্ট করা হয়েছে বেঈমান এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। 


কিন্তু এরুপ প্রোপাগাণ্ডার সত্যতা কি ⁉️

বিভীষণ কি সত্যি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ⁉️

সত্যি কি বিভীষণ ঘরের শত্রু ⁉️


বিভীষণ এর চরিত্র এবং তার কার্যক্রম বুঝতে হলে আমাদের প্রয়োজন তার জীবনকে পর্যবেক্ষণের। কারণ বাল্মিকী রামায়ণ এ জানা যায় বিভীষণ ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ, স্পষ্টভাষী এবং ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি নিজে যেমন অন্যায় করতেন না, তেমনি কোনো অন্যায়কে সমর্থন বা সঙ্গ দেওয়া ছিল তার পক্ষে অসম্ভব। 


সেজন্য তিনি লঙ্কাধিপতি রাবণের সামনেও নির্ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানান, 


“ ঈদৃশৈস্ত্বং সমাচারৈর্যশোহর্থ কুলনাশনৈ:

ধর্ষণং প্রাণিনাং জ্ঞাত্বা স্বমতেন বিচষ্টসে । “

 - বাল্মীকি  রামায়ণ  (৭।২৫।১৮)

 

অর্থাৎ, হে রাজণ স্ত্রী জাতির প্রতি আপনার এই অভিলাশ অত্যন্ত পীড়াদায়ক এতে ধর্মনাশ হয় তা জেনে ও আপনি এই কুলনাশক কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন ।


লঙ্কাধিপতি রাবণ যদিও জ্ঞানী ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন অধার্মিক ও পাপাচারী। একজন ধার্মিক সদাচারী হিসেবে বিভীষণ কি করে রাবণের পক্ষপাত করতে পারেন? যদি নিজ আত্মীয় বন্ধু বা প্রিয়জন হওয়ার কারণে অধর্মকে অবলম্বন করতে হয় তাহলে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকে? 


মহাভারতে কর্ণ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা। যিনি দানবীর হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন জগৎ জুড়ে। কিন্তু যখন দ্যুতক্রীড়ার সময় তিনি পান্ডবদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মৌন ছিলেন এবং যখন দ্রৌপদীর রাজসভায় অপদস্ত হেয় করার মতো ঘটনা সংগঠিত হচ্ছিল তখন তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। সেজন্য, কর্ণ কৃষ্ণ সংবাদে মহাভারতের কর্ণপর্বের ৯১ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে বলছেন , 


➡️ দুর্য্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি তোমার মতানুসারে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে যে সভায় আনয়ন করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? 

➡️ যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধি-পরতন্ত্র হইয়া তোমার অনুমোদনে অক্ষক্রীড়ায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরকে যে পরাজয় করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? 


➡️ যখন তুমি বারণাবতনগরে জতুগৃহমধ্যে প্রসুপ্ত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অগ্নি প্রদান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? 

৫। যখন তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের বশীভূতা” রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে, “হে কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত" নরকে গমন করিয়াছে, এক্ষণে তুমি অন্য পতিকে বরণ কর” এই কথা বলিয়া উপহাস করিয়াছিলে এবং অনার্য্য ব্যক্তিরা তাঁহাকে নিরপরাধে ক্লেশ প্রদান করিলে উপেক্ষা করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? 


➡️ যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনিকে আশ্রয়পূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়া করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? 


➡️ যখন তুমি মহারথগণসমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল?

উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহ একজন ধার্মিকের বুদ্ধি বিবেকের প্রতি প্রশ্ন। যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে করেছিলেন। কারণ কর্ণ ধর্মাচরণের সময় অধর্মের পক্ষে শস্ত্র ধরেছিলেন। 

এরুপ অভিযোগ বিভীষণের প্রতিও আরোপিত হতো। যদি তিনি রাবণকে স্বীয় ধর্মকে স্মরণ না করিয়ে দিয়ে রাজপদের আশায় মৌন থাকতেন। কিন্তু ধর্মাত্মা বিভীষণ মাতা সীতাকে হরণকারী, দুষ্ট প্রকৃতির, শঠ, রাবণের পক্ষে নেওয়াকে অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আজ বর্তমান প্রজন্ম সেই ধর্মাত্মা বিভীষণকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রতিপন্ন করছে। 

সত্যি কি এরুপ অভিযোগ গ্রহণযোগ্য? নাকি সনাতনধর্মের পরম আরাধ্য মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর জীবনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক অপপ্রয়াস মাত্র! বিভীষণের কি অন্যায় ছিল সে রাবণের পাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, ধর্মের পক্ষ নেওয়া, রাবণকে সুপথগামী হওয়ার জন্য আহ্বান করে বিতাড়িত হওয়া রাজ্য থেকে? ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে, সত্যের ধ্বজাধারী হয়ে ধর্মাচরণ করা কখনো অন্যায় নয়, এবং সে জন্য বিভীষণ ঘরের শত্রু নয় বরং ধর্মের পক্ষ নেওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ করা এক সাহসী চরিত্র।

আমি ভালো আছি -Pranto ray
Feb. 8, 2025 | category | views:55 | likes:1 | share: 0 | comments:0
  • যথাসম্ভব মনে পরে সেই ছোটবেলায় মায়ের থেকে শিখেছিলাম "ভালো আছি"। মা বলেছিলেন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কেমন আছি? এর উত্তরে ভালো আছি বলতে হয়। না বুঝেই শিখেছিলাম। না বুঝেই কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলতাম ভালো আছি।  কোনো কাজ বর্তমানে হয় বোঝালে বা অভ্যাসগত কর্ম বা চিরসত্য বুঝালে present indefinite tense হয়। এটা যেমন রুলস মুখস্থ হয়ে গেছে। কেমন আছি প্রশ্নের উত্তরটাও ঠিক একই রকম। যে, যখন, যেভাবেই প্রশ্ন করুক না কেন নিয়ম অনুযায়ী এর উত্তর ভালো আছি'ই হবে। অতঃপর ভালো আছি বলতে বলতে বছর ১৮ পেরিয়ে গেলো। এরপর ইচ্ছে হলো ভালো থাকা আসলে কি? কিভাবে ভালো থাকতে হয় এ নিয়ে জানতে। অযত্নে বেড়ে ওঠা ইচ্ছে গুলোও ফ্যাকাসে। যখনই জানতে চাইলাম ভালো থাকা কি, উপলব্ধি করতে চাইলাম কিভাবে ভালো থাকা যায়। তখনই ভালো থাকার স্বাদ, রস, গন্ধ সবই কর্পুরের মতো উড়ে যেতে লাগলো। আমার ইচ্ছে আরো গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগলো। মরিচীকার মতো আমার আসেপাশে ভালো থাকা ঘুরে বেড়ায় বোধহয়। ধরতে গিয়ে হোচট খেয়ে পরি।  অথচ সেই ভালো থাকার সাথে আমার আর আলিঙ্গন হয়না। ভালো থাকা এসে বলেও না তুমি ভালো আছো।সত্যিই তুমি ভালো আছো। দূর থেকে হাতছানি দেয়। আর আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি ভালো নেই! ভালো নেই আমি!ভালো নেই! তবুও দিনশেষে কেউ জিজ্ঞেস করলে যন্ত্রের মতো মুখ থেকে বের হয় " ভালো আছি"।
মানবো তা — মানবতা -বিগল যাত্রী
Feb. 3, 2025 | কবিতা | views:38 | likes:26 | share: 0 | comments:0

ছিল পরি, পক্ষীরাজ, পাতাল পুরির দেশ -- 

দৈত্য ছিল, দানো ছিল, রাক্ষস খোক্কসে দ্বেষ! 

ছিল দেবদূত, দৈববাণী মুশকিল অবসানে,

লুকালো তারা শিশু-পাঠে যৌবন আগুয়ানে। 

রয়ে গেল শুধু বোকা ঈশ্বর -- টেনে চলা শৈশব --

যুক্তির ফাঁকে টিকে আছে আজও স্বর্গের বৈভব! 

নরকের ভয় বেচে পরশ্রমভোগী শঠ ভন্ড 

টিকে আছে আজও কিছু কর্মবিমুখ ষণ্ড।

সংখ্যায় তারা স্বল্প হলেও সেরা তারা শঠতায়

মানুষের কাছে এই শঠতার গল্প বলার দায়

আমাদের নিতে হবে -- তবে হবে মানুষের মুক্তি।

অন্ধ বিশ্বাস মুছে দিতে হবে দিয়ে যথাযথ যুক্তি।

বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারিত হবে -- সাম্য, ন্যায়, স্বাধীনতা 

পৌঁছে যাবে সকলের কাছে  -- জয়ী হবে মানবতা।।


© বিগল যাত্রী

জলাভূমি সংরক্ষণ: এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ -Tushar Gorai
Feb. 2, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:58 | likes:0 | share: 2 | comments:0



জলাভূমি, প্রাকৃতিক হোক বা কৃত্রিম, আমাদের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে একটি। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, কঠিন বর্জ্য ফেলা এবং শিল্পায়নের ফলে এই মূল্যবান অঞ্চলগুলির অবক্ষয় ঘটছে। জলাভূমির জাতীয় গুরুত্ব উপলব্ধি করে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এগুলোর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বহু-মাত্রিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে।  


জলাভূমি পৃথিবীর অন্যতম উর্বর বাস্তুতন্ত্র এবং এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, জলচক্র নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন প্রজাতির জীবের আবাসস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের পরিবেশ পানিশোধন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জলসম্পদের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। পাশাপাশি, জলাভূমি মৎস্যচাষ, কৃষিকাজ এবং পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জলাভূমির এই বহুমুখী উপকারিতা সত্ত্বেও, মানুষের অসচেতনতা এবং অব্যবস্থাপনার ফলে এটি ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।  


নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে জলাভূমিগুলি দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, যেখানে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রম এবং শিল্প বর্জ্য নিঃসরণ সরাসরি জলাভূমির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কৃষি সম্প্রসারণের কারণে জলাভূমিগুলিকে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে, যার ফলে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে এবং জলচক্র ব্যাহত হচ্ছে। এর পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য ফেলার প্রবণতা জলাভূমির স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করে এবং পানির গুণমান হ্রাস করে, যা বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।  


এই সংকট মোকাবিলায় জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা জলাভূমির উপকারিতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং সংরক্ষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। কঠোর পরিবেশগত আইন ও নীতিমালা কার্যকর করে জলাভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ও শিল্প দূষণ প্রতিরোধ করা যায়। স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা হলে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা আরও কার্যকর হবে, কারণ তারাই সরাসরি জলাভূমির উপর নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে জলাভূমির পরিবেশগত কার্যকারিতা বোঝা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশ করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত জলাভূমিগুলির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।  


জলাভূমি আমাদের পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা অবিলম্বে সংরক্ষণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি আমরা সচেতনভাবে জলাভূমিগুলি রক্ষা করতে না পারি, তাহলে এটি ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। জলাভূমির গুরুত্ব অনুধাবন করে, যথাযথ নীতিমালা প্রয়োগ, জনগণের সম্পৃক্ততা এবং বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা জলাভূমির টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই মূল্যবান বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত।

গ্রিন টেকনোলজি: ভবিষ্যতের পথ -Tushar Gorai
Jan. 31, 2025 | টেকনোলজি | views:172 | likes:0 | share: 1 | comments:0



গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস, এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের কারণে, গত দুই দশক ধরে  দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব  প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের বাস্তবায়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বলতে প্রচলিত শক্তি সম্পদ ব্যবহার করে শক্তির চাহিদা মেটানো বোঝায়, যা পরিবেশের ক্ষতি করে না এবং গ্রীন টেকনোলজি বলতে পরিবেশবান্ধব পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎসের ব্যবহার বোঝায়।



গ্রীন টেকনোলজির ধারণা হল এমন পণ্য, সিস্টেম এবং কাঠামোর সৃষ্টি এবং প্রয়োগ যা প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলি রক্ষা করার লক্ষ্য রাখে। সহজভাবে বলতে গেলে, "গ্রীন টেকনোলজি" বলতে এমন ডিভাইস, পরিষেবা বা প্রক্রিয়া বোঝায় যা খুব কম বা কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে না, ব্যবহার করা নিরাপদ এবং সমস্ত জীবনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর জলবায়ু উৎসাহিত ভিত্তিস্থাপন করে। 


গ্রীন টেকনোলজি বিভিন্ন উদ্ভাবনকে অন্তর্ভুক্ত করে যা পরিবেশের উন্নতি এবং সম্পদের দক্ষতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এগুলি মূলত পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন যেমন সৌর এবং বায়ু শক্তি থেকে শুরু করে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমাধান। এই প্রযুক্তিগুলি জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্পদের অভাবের মতো বৈশ্বিক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা প্রচলিত অনুশীলন থেকে উন্নত বিকল্পগুলিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নির্দেশ করে।


এই প্রযুক্তির সুযোগগুলি বিশাল। অর্থনৈতিকভাবে, তারা নতুন বাজার খুলে দেয় এবং চাকরি তৈরি করে। এই প্রযুক্তিগুলি ব্যবসায়িক উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করে, কোম্পানিগুলিকে নতুন পণ্য এবং পরিষেবা বিকাশ করতে সক্ষম করে যার জন্য ক্রমবর্ধমান ভোক্তার চাহিদা পূরণ করে। পরিবেশগতভাবে, সবুজ প্রযুক্তি কার্বন নির্গমন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদান রাখে। সামাজিকভাবে, তারা জীবনের গুণমান উন্নত করে এবং একটি  ন্যায়সঙ্গত বিশ্বের দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করে।


 ভবিষ্যত শুধুমাত্র নতুন গ্যাজেট এবং সমাধান সম্পর্কে নয়; এটি আরও সহজ - সরল জীবনযাপনের দিকে মানসিকতার পরিবর্তন সম্পর্কে। ভারতের ক্রমাগত বিকশিত নীতিমালা এবং সংস্কারগুলি ব্যবসা করার সহজতা এবং জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের লক্ষ্য অর্জনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সবুজ প্রযুক্তির দ্রুত গ্রহণের জন্য একটি পথ পরিষ্কার করছে এবং বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের সুবিধা প্রদান করছে। ভারতের 'আস্পিরেশনাল ডিস্ট্রিক্ট প্রোগ্রাম' স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি রূপান্তর চ্যানেল করার জন্য সেরা উদ্যোগ, কারণ এটি উন্নয়নের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের মধ্যে বৈষম্য দূর করে। এই প্রোগ্রামটি, এর শক্তি রূপান্তরের বর্ধিত সুযোগ সহ, ভারতের পরিবেশবান্ধব শক্তির বিপ্লবের জন্য একটি বাতিঘর হিসাবে কাজ করে এবং বিশ্বব্যাপী পুনরাবৃত্তিযোগ্য একটি মডেল প্রদান করে।



অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনসের সেনেটর বব ব্রাউনের কথাগুলি মনে রাখতে হবে: "ভবিষ্যত হয় সবুজ হবে, নয়তো কিছুই হবে না।"

ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর: পলাশীর যুদ্ধের পূর্বাপর এবং কিছু প্রশ্ন । -Guitar K Kanungo
Jan. 30, 2025 | category | views:44 | likes:1 | share: 0 | comments:0

পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালীদের একটা আবেগের জায়গা আছে। বাঙালি নিজেদের একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে চায়। অনেক বাঙালি মনে করে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের ফলে বাংলা এবং পরবর্তীতে এক সময় গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের অধীনে চলে গিয়েছিল। যদি পলাশীর যুদ্ধ না হত, যদি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, যদি নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত না হতেন, তাহলে কি আমরা স্বাধীন থেকে যেতাম? আমাদের ইতিহাসটা হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত, আমরা ব্রিটিশদের বদলে হয়ত ফরাসীদের উপনিবেশে পরিণত হতাম।  

মীর জাফর যে বেঈমানী করবেন, সেটা একরকম জানাই ছিল। এমনকি সেটা আলীবর্দি খাঁর সময়েই জানা গিয়েছিল। আলীবর্দী খান যে একজন ভালো প্রশাসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু মীর জাফরের ক্ষেত্রে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাবার পেছনে আলীবর্দী খানের ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। নইলে ইতিহাসকে যথাযথভাবে জানা হয় না। আবার, একথাও ঠিক যে বাংলা এক সুলতানী আমল ছাড়া অন্য কোনো সময়ে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিল না, সেটাও আমাদের মেনে নিতে হবে, যথাযথ ইতিহাসচর্চার খাতিরেই।

পলাশীর যুদ্ধটা যখন ঘটে, তখন আলীবর্দী খান মারা গিয়েছিলেন। সেইজন্য আলীবর্দী খাঁর দায়টা কোথায়, সেটা বুঝবার আগে একটি গল্প বলে নেয়া দরকার। একজন নারী কর্মচারী ক্যাশ থেকে অর্থ সরানোর অভিযোগে বরখাস্ত হলেন। সেই কর্মচারী সত্যিই একজন দুঃখী মানুষ ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিল না; অসুস্থ সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার চালানোর জন্য তিনি দুই জায়গায় কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক সেটা জানতেন, তবুও তিনি কোনো রকমের দয়া দেখালেন না। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন—এবারই যে এই কাজটা সে প্রথম করেছে, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য ওই নারী কর্মচারীকে তিনি দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন না।

আলীবর্দী খাঁ এই ভুলটাই করেছিলেন। তিনি তখন নবাব, আর তাঁর অধীনে বেশ কিছু সংখ্যক মসনদার ছিলেন, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে সৈন্য সরবরাহ করতেন। আসলে তখনকার দিনে আজকের মতো নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না; সৈন্যরা ভাড়াটে হিসেবেই কাজ করতো। যারা এই সৈন্যদের যোগান দিতেন, তাদের মসনদার বলা হত। একবার আলীবর্দী খাঁকে জানানো হয়, সৈন্য সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের দুর্নীতি চলছে। যত জন সৈন্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখানো হচ্ছে, আসলে ততজন সৈন্য সরবরাহ করা হয়নি, কিন্তু অর্থ ছাড় করা হয়েছে বেশি সংখ্যক সৈন্য দেখিয়েই। এবং এই কাজটা অনেকদিন ধরেই চলছিল। এই দুর্নীতির পেছনে যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন—স্বয়ং মীরজাফর। এই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরেও, আলীবর্দী খাঁ মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, পরে যখন সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন, তখনও মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন।

এবার ইংরেজদের প্রসঙ্গে আসা যাক । ইতিহাসে ক্যালকাটা ব্ল্যাকহোল বলে একটা ঘটনার কথা আছে।  ১৭৫৬ সালের ২০শে জুন এই ঘটনাটি ঘটেছিল। ইংরেজদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৪৬ জন কারাবন্দির মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল শ্বাসকষ্ঠ এবং ক্লান্তিতে ভুগে। এই সংখ্যাটির কথা বলেছেন এই ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী জন হলওয়েল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাধারণ ইংরেজরাও এই ঘটনাকে অনেক বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। ভারতীয়রা যে কতটা বর্বর এবং কেন এই বর্বর জাতিটাকে সভ্য করে তোলার দায়িত্ব তাদের নিতে হয়েছিল, সেই কারণটা যৌক্তিক করে তোলার ক্ষেত্রে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়।

আসলেই কি এতজন ইংরেজ সেদিন মারা গিয়েছিল? এই প্রশ্নটি উঠেছে, যেহেতু এই হিসাবটা পাওয়া গেছে ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের কাছ থেকে, সেহেতু এখানে অতিরঞ্জনের একটা সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক বীরেন কিশোর গুপ্ত "সিরাজুদ্দউলা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি" নামের একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, এই সংখ্যাটি কোন অবস্থাতেই দশ থেকে পনেরো জনের বেশি নয়। অর্থাৎ জন হলওয়েল যে সংখ্যাটির কথা বলেছেন, সেটি আসল সংখ্যার চাইতে অন্তত দশ থেকে বারো গুণ বেশি।

কি ঘটেছিল সেদিন সেটা একটু এই ফাঁকে দেখে নেয়া যাক। নবাবের বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ চলছিল তিন-চার দিন ধরে। শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে ইংরেজরা হেরে যায় এবং পরাজিত ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যেই আটকে রাখা হয়। এদিকে, কিছু ইংরেজ সৈন্য মদ খেয়ে মাতলামো করতে গিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করলে, যারা ঝামেলা করছিল তাদেরকে আলাদা করে রাখার আদেশ দেয়া হয় নবাবের তরফ থেকে।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, নবাবের তরফ থেকে যখন এই আদেশ দেয়া হয়, তখন নবাব সিরাজুদ্দৌলা কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন না। তিনি কলকাতাতেই ছিলেন, তবে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। এটা ঠিক যে, নবাবের সৈন্যরা বিশেষ কয়েকজন (যারা মাতলামি করছিল) ইংরেজ সৈন্যের উপর আগে থেকেই খেপে ছিলেন। সেই কারণে তারা কয়েকজন সৈন্যকে ঠেসে ঠুসে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেরকম কোনো আদেশ একেবারেই দেননি। ওই ঘটনায় কিছু ইংরেজ সৈন্য অবশ্যই মারা গিয়েছিল, কিন্তু সেই সংখ্যাটি কখনোই জন হলওয়েল যা বলেছেন, তা নয়।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : কৃষ্ণের বিরুদ্ধে শিশুপালের সব অভিযোগই  কি মিথ্যে ছিল? -Guitar K Kanungo
Jan. 26, 2025 | category | views:65 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কৃষ্ণ কেবলমাত্র কংসের নয় আরো একজনের মৃত্যুর কারণ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল। সম্পর্কে শিশুপাল আবার কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। শিশুপালের জন্মও কিছুটা অস্বাভাবিকই ছিল। তিনি তিনটি চোখ এবং তিনটি বাহু নিয়ে জন্মেছিলেন। ফলত তাঁর জন্মের পরপরই একটা দৈববাণী হয় যে যার হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তিনি তাঁকে স্পর্শ করলেই তাঁর এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়বে।

শিশুপাল যখন ছোট তখন কৃষ্ণ একবার তাকে কোলে নিতেই শিশুপালের এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়ে। শিশুপালের কদর্যতা ঘুঁচলেও আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হল - সবাই জেনে গেল কৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু হবে। কেউ যদি আগে থেকে জেনে যায় বিশেষ একজন মানুষের হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তাহলে সে যেটা করতে চাইবে সেটা হল সেই মানুষটাকে হত্যা করা। যে চেষ্টাটা মথুরার রাজা কংস করেছিলেন।

কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন ওঠে যদি কারো মৃত্যু এভাবেই নির্ধারিত হয়ে থাকে - দৈৱিকভাবে - তাহলে সেটা এড়ানো কি আদৌ সম্ভব? মৃত্যু একদিন সবারই হবে।  বেশিরভাগ মানুষ সেটা জানে ; তারা কেবল এটা জানে না সেই মৃত্যুটা কখন হবে, এবং কার হাতে হবে। শিশুপাল এবং কংসের দুর্ভাগ্য তারা সেটা আগে থেকে জানতেন।

কংস সব রকমের চেষ্ঠা করেছিলেন তার ভবিষ্যত হত্যাকারীকে তিনি নিজে খুন হয়ে যাবার আগে খুন করে ফেলতে। যে কোন ক্ষমতাবান মানুষ সেটাই করবে এবং কংস সেটাই করেছিলেন ; কিন্তু তিনি যে উপায়ে কাজটা করেছিলেন সেই কাজটা যথযথ ছিল না। একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলেই তিনি তার ভবিষ্যতকে বদলে দিতে পারতেন। দেবকী অরে বসুদেবকে কারাবন্দি করেছেন ভালো কথা কিন্তু তাদের একসঙ্গে থাকতে দিয়েই নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছেন। দেবকীকে রাজপ্রাসাদে রেখে বসুদেবকে কারাগারে আটকে রাখলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। তাহলে এই দম্পতির কোন সন্তানেরই জন্ম হত না, অষ্ঠম সন্তান তো অনেক পড়ের কথা।  


সেই দিক থেকে দেখলে শ্রুতশ্রবা বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। শ্রুতশ্রবা  সম্পর্কে শিশুপালের জননী, কৃষ্ণের পিসী। কৃষ্ণবর্ণের এই ভাইপোটার বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি আগাগোড়ায়  সচেতন ছিলেন। তিনি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন  করলেন।  তিনি জানতেন পুত্রের ভবিতব্যকে পরিবর্তন করার সাধ্য তাঁর নেই, কিন্তু চাইলে তিনি পুত্রের পরমায়ু বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন।  তিনি সেটাই করেছেন। কৃষ্ণকে দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন শিশুপালের অন্তত একশ অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করবেন।    

একশটি অপরাধ খুব একটা কম কথা নয়। এমন নয় যে শিশুপালের সঙ্গে কৃষ্ণের মাসে একবার করে দেখা হচ্ছে। এমনও হয়েছে বছরের পর বছর কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপালের হয়ত কোন রকম দেখাই হয়নি। দেখা না হলে অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা থাকে না। এইভাবে দেখলে পুত্র শিশুপালের জন্যে একটা দীর্ঘ জীবনের ব্যবস্থা শ্রুতশ্রবা করে রেখেছিলেন। কিন্তু মানুষ যত চেষ্টাই করুক নিয়তিকে খণ্ডনের উপায় নেই। শিশুপাল নিজেই ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।

একথা ঠিক কৃষ্ণ তাঁকে একদিন হত্যা করবে এই তথ্যটা জানার পর মামাতো ভাই হলেও শিশুপাল কৃষ্ণকে সহজভাবে নিতে পারে নি। নিতে না পারারই কথা; বয়ঃপ্রাপ্ত হতেই শিশুপাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে গিয়েই ভিড়ল। শুধু যে ভিড়ল তা নয় তাঁর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল বিদর্ভ রাজ্যের যুবরাজ রূক্ষ্মীর সঙ্গে এবং বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে  রূক্ষ্মীর বোন রুক্ষ্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল। বিধির বিধান! এদিকে রুক্মিণী কিন্তু ভালোবাসতেন শিশুপালের পরম শত্রু বাসুদেব কৃষ্ণকে। 

শেষ পর্যন্ত রুক্ষ্মিণীকে কৃষ্ণ অপহরণ করে নিয়ে গেলেন। বিদর্ভ রাজ্যের রাজা, কিংবা রাজকুমার অথবা সৈন্য সামন্তদের কিছুই করার থাকল না। কৃষ্ণের প্রতি শিশুপালের ঘৃণার পারদ কেবল আরেক দফা পারল। রাগে ক্ষোভে  শিশুপাল হয়ত বেশ কিছু গালাগাল দিয়ে ফেললেন কৃষ্ণকে - হতে পারে মনে মনে কিন্তু অপরাধ অপরাধই। কৃষ্ণ হিসাব রাখছেন কারণ তাঁর তরফে এটা একটা দায়িত্বও বটে।  তিনি কংস এবং কংসের সহযোগীদের দমন করার জন্যে এই ধরাধামে অবতীর্ন হয়েছেন। কংসও আত্মীয়, শিশুপালও আত্মীয় ; কিন্তু কৃষ্ণের উপায় নেই।    

মহাভারত আমাদের পরিষ্কার করে বলে নি শিশুপালের যে একশটা অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করেছেন সেই অপরাধ গুলো আসলে কী কী। আমরা শিশুপাল এবং কৃষ্ণকে একই আসরে উপস্থিত থাকতে দেখব যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। এর আগে অন্তত দুবার এই দুইজনের দেখা হয়েছিল। কৃষ্ণ যখন নরকাসুরকে বধ করতে যান তখন একবার কারণ সেই সময় শিশুপাল নরকসুরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন কৃষ্ণ রুক্মিনীকে অপহরণ করেন। আগেই বলা হয়েছে ওই বিয়ের আসরে শিশুপালই বর হয়ে এসেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে সমস্যাটা শুরু হয়েছিল যখন ওই যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে দেয়া উচিত সেই প্রসঙ্গ উঠল। মহামতি ভীষ্ম কৃষ্ণকেই যোগ্য ব্যাক্তি হিসাবে মনোনীত করতেই শিশুপাল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কৃষ্ণের ব্যাপারে তার এমনিতেই আক্রোশের শেষ নেই। তার উপর ভীষ্ম বলছেন সেই কৃষ্ণকেই সেই বিরল সম্মান দিতে যে সম্মানের যোগ্য কৃষ্ণ নন - অন্তত শিশুপাল সেটাই মনে করেন। এই নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় - এক পর্যায়ে শিশুপালের সমস্ত একশটি অপরাধ পূর্ণ হওয়া এবং কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে শিশুপালের দেহ থেকে মুন্ডু খসে যাওয়া।    

প্রশ্ন হচ্ছে শিশুপাল কী ভুল কিছু বলেছিলেন? ভীষ্ম কৃষ্ণকে যোগ্য মনে করেছেন অলৌকিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই কৃষ্ণ কোন অবতারই ছিলেন, তিনি আর দশ জনের মত একজন সাধারণ মানুষ। তখন পর্যন্ত তাঁর একমাত্র সাফল্য কংসকে বধ করা। অবশ্য ইতোমধ্যে তিনি সেই সময়কার সবচাইতে পরাক্রমশালী মগধের রাজা জরাসন্ধকেও বধ করেছিলেন - তাও নিজে নয় ভীমকে দিয়ে এবং সেটা অনেকটা ছল করেই।

এদিকে কংসকে হত্যা করলেই কৃষ্ণ নিজে কখনো কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না, শিশুপাল একথাটাও মিথ্যা বলেননি। কংসকে হত্যা করবার পর কংসের পিতা উগ্রসেনেকেই মথুরার সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। আবার একথাও তো ঠিক জরাসন্ধের ভয়ে কৃষ্ণকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল - মথুরা থেকে সরে দ্বারকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জরাসন্ধ বেঁচে থাকলে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা হয়ে উঠত না। জরাসন্ধ বিশেষ কোন কারণে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করার অনুমতি দিলেই সেই যজ্ঞের অর্ঘ্য জরাসন্ধকেই অর্পণ করতে হত।


গল্পের ফাঁকফোঁকর : যিনি রিপুকেই দমন করতে পারলেন না তিনি আবার মহর্ষি হলেন কি করে? -Guitar K Kanungo
Jan. 21, 2025 | category | views:64 | likes:8 | share: 0 | comments:0

দুর্বাসা মুনিকে চেনেন না, এমন পাঠক খুব কমই আছেন, বিশেষত তিনি যদি হিন্দুধর্মাবলম্বী হন। সীমাহীন ক্রোধ এবং যখন-তখন যাকে-তাকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত ছিলেন এই ঋষি। দেবতা-মানুষ, কেউই তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। এমনকি যিনি তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন, সেই বেচারা নারীটিও রক্ষা পাননি তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে মুনিঋষিদের সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, অনেকটা মহর্ষি বশিষ্টের মতো, দুর্বাসার ক্ষেত্রে উল্টোটাই হচ্ছে কেন? কেন তিনি নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ক্রোধের কারণেই কুখ্যাত হচ্ছেন? কেন এই বৈপরীত্য? অনেক ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভাবনা-চিন্তা না করেই দুর্বাসা অভিশাপ দিয়ে দিচ্ছেন এবং তা ফলে যাচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে?

কে ছিলেন এই দুর্বাসা? ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে, রুদ্র তথা শিবের অংশ থেকে দুর্বাসার জন্ম। একবার প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে শিবের একটি বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়। শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন, এতটাই ক্রুদ্ধ হন যে দেবতাগণের তো দূরের কথা, স্বয়ং পার্বতীও শিবের ধারে কাছে আসতে পারছিলেন না। পার্বতী বললেন, এইভাবে চলতে থাকলে শিবের সঙ্গে তাঁর ঘর করা সম্ভব হবে না। এদিকে পার্বতীকে ছাড়া শিবের এক মুহূর্তও চলছিল না। শিব ক্রোধ সংবরণ করলেন। ঠিক এই সময়, সপ্তর্ষিদের একজন মহর্ষি অত্রির পত্নী অনুসূয়া সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন। শিবের বরপ্রাপ্তির ফলস্বরূপ, তাঁর প্রশমিত ক্রোধের সবটুকু নিয়েই অনুসূয়ার গর্ভে জন্ম নিলেন উগ্রতপা ঋষি দুর্বাসা। 

রুদ্রের অংশে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই দুর্বাসার এত ক্রোধ—এই যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রথমত, মহর্ষি অত্রি এবং তাঁর স্ত্রী অনুসূয়া হয়তো শিবের মতো একজন পুত্র চেয়েছিলেন, সেটা হতেই পারে, কিন্তু সেই পুত্র প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে জন্মাবে এবং ত্রিভুবনে ব্যাপক ঝামেলা করবে, এটা নিশ্চয়ই তাঁরা চাননি। দ্বিতীয়ত, শিব যদি সাধ্বী অনুসূয়ার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েই তাঁকে পুত্রপ্রাপ্তির বর দিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ সেই সন্তানের মধ্যে ভরে দেওয়া নিঃসন্দেহে সঠিক কাজ হয়নি। সমুদ্র মন্থনের পর যখন সমস্ত বিষ উঠে আসে, তখন তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ হন। একইভাবে, তিনি ক্রোধিত হতেই পারেন, কিন্তু সেই ক্রোধকে সংবরণ করার উপায় মহাদেবের অজানা ছিল, একথা বিশ্বাস করা কঠিন।

তাঁর এই ক্রোধের কারণে একজন মহাপ্রাণ তপস্বী হিসেবে যতটুকু সম্মান তাঁর পাওয়া উচিত ছিল, তা সবসময় যে তিনি পেয়েছেন, এমনটা বলা যাবে না। কোনো গৃহস্থের বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটলে সেই গৃহস্থ তাঁকে সম্মান দেখাতেন বটে, কিন্তু সেই সম্মান মূলত ভয় এবং আতঙ্ক থেকেই। তাঁর ক্রোধের পাশাপাশি উদ্ভট সব আবদার গৃহস্থের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিত। শাস্ত্রে যদি ব্রাহ্মণ বধের অনুমতি থাকত, তবে দুর্বাসা হয়তো অনেক আগেই খুন হয়ে যেতেন।

দুটো ঘটনার কথা বলি।

একবার তিনি মহারাজ কুন্তিভোজের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন এবং জানালেন, কিছুদিন সেখানে থাকবেন। তটস্থ কুন্তিভোজ হাত জোড় করে সম্মতি জানালেন। কিন্তু দুর্বাসা তো দুর্বাসাই; উপদ্রব না করলে তাঁর চলে না। তিনি কুন্তিভোজকে জানালেন যে যতদিন তাঁর প্রাসাদে থাকবেন, তাঁর আদর-আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কুন্তিভোজ ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার করলেন।

দুর্বাসার থাকার ব্যবস্থা করা হলো; কন্যা কুন্তীকে তাঁর সেবায় নিযুক্ত করা হলো। কুন্তী বুঝলেন, মহাবিপদ। দুর্বাসা গভীর রাতে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দলবল নিয়ে এটা-সেটা খেতে চাইছেন। দিন নেই, রাত নেই - এটা কর, ওটা কর ; এটা আন, ওটা আন।  কুন্তী শেষ পর্যন্ত সবদিক সামলে দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন। এর ফলস্বরূপ, কুমারী অবস্থায় কুন্তীর গর্ভে এক সন্তানের জন্ম হয়, যে সন্তানকে জন্মের পরমুহূর্তেই ত্যাগ করতে হয়েছিল। 

পরের ঘটনাটি স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়ের পরপরই কৃষ্ণ ও রুক্মিণী একদিন দুর্বাসার আশ্রমে উপস্থিত হন তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য। দুর্বাসা খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন। এক পর্যায়ে কৃষ্ণ-রুক্মিণী দুর্বাসাকে আমন্ত্রণ জানালেন দ্বারকায় আসার জন্য। দুর্বাসা রাজি হন, তবে শর্ত দেন যে কৃষ্ণ ও রুক্মিণীই তাঁর রথ টেনে নিয়ে যাবেন। আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছেন, তাই পিছিয়ে আসার উপায় নেই। কৃষ্ণকে বাধ্য হয়ে দুর্বাসার অন্যায় আবদারে রাজি হতে হয়।

দুর্বাসার ইচ্ছে অনুযায়ী, কৃষ্ণ ও রুক্মিণী রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রুক্মিণী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে কৃষ্ণ, রথ না থামিয়ে (পাছে দুর্বাসা অসন্তুষ্ট হন), পায়ের বুড়ো আঙুলের খোঁচায় মাটি ফুঁড়ে গঙ্গাকে বের করে আনেন। রাণী রুক্মিণী সেই জল পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। তবে জল পান করার আগে রুক্মিণী কেন দুর্বাসাকে সেই জল নিবেদন করেননি, এই কারণে দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হলেন এবং অভিশাপ দিলেন এই যুগলকে। সেই অভিশাপের ফলে রুক্মিণীকে অনেকটা সময় কৃষ্ণের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল।

এই অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে দুর্বাসা অনেক সময় দুষ্টুলোকেদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। এবার অবশ্য বাসুদেব কৃষ্ণ দুর্বাসাকে একটি শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেবেন।

পাণ্ডবদের বনবাস চলছে। দুর্যোধন দুর্বাসাকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালেন আতিথ্য গ্রহণের জন্য, কারণ দুর্বাসার প্রায় দশ হাজার শিষ্য ছিল, যারা সর্বদা তাঁর সঙ্গে যেত। পাণ্ডবরা নিজেরাই কুটির বানিয়ে বনের ফলফুল আর পশুপাখি ধরে কোনোমতে জীবনধারণ করছিলেন। তাদের পক্ষে দশ হাজার মানুষকে আপ্যায়িত করা সম্ভব ছিল না। দুর্যোধন এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিলেন, যাতে দুর্বাসার ক্রোধ পাণ্ডবদের ওপর পড়ে এবং অভিশাপ নেমে আসে।

দুর্বাসা সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে শিষ্যদের বিশাল বহর নিয়ে হাজির হলেন পাণ্ডবদের কুটিরে। দ্রৌপদীর কাছে একটি জাদুকরী পাত্র ছিল, যেখান থেকে যেকোনো সংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো যেত, তবে সেটি করা যেত দ্রৌপদীর খাদ্য গ্রহণের আগে পর্যন্ত। দুর্বাসা ঠিক সেই সময়ের পরে হাজির হয়েছেন, যখন দ্রৌপদী ইতিমধ্যেই খাওয়া শেষ করেছেন। দ্রৌপদী মহাবিপদে পড়লেন এবং প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ এসে দ্রৌপদীর সেই পাত্রের তলায় পড়ে থাকা একটি ভাতের কণা মুখে পুরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই স্নানরত দুর্বাসা এবং তাঁর শিষ্যদের সমস্ত ক্ষুধা মিটে গেল। তারা আর দ্রৌপদীর কুটিরের দিকে না এসে পালিয়ে গেলেন

এই ঘটনার মধ্যে কিছুটা অলৌকিকতার উপাদান আছে। কৃষ্ণা স্মরণ করতেই কৃষ্ণ চলে এলেন—এ রকম কিছু আসলে ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। দুর্বাসা পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার এই পালিয়ে যাওয়ার পেছনে কৃষ্ণ নয়, পাণ্ডবদের কোনো এক ভাইয়ের ভূমিকা ছিল—খুব সম্ভবত ভীমের। শাপ-টাপ এসব নিয়ে ভীমকে কখনো খুব একটা পরোয়া করতে দেখা যায়নি। পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে একমাত্র ভীমই দ্রৌপদীকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতেন। দ্রৌপদীর জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। এখানেও হয়তো ভীম দুর্বাসাকে এমন কিছু একটা বলেছেন, কিংবা এমন ভয় দেখিয়েছেন যে দুর্বাসা বাপ্ বাপ্ বলে পালিয়ে গেছেন। 

প্রাণের ভয় দুর্বাসারও আছে।  পরের ঘঠনায় সেটা প্রমাণিত হবে। 

সেই সময় অম্বরীষ নামের একজন রাজা ছিলেন। রাজা অম্বরীষ ভগবান বিষ্ণুর এতটাই ভক্ত ছিলেন যে বিষ্ণু তাঁকে তাঁর সুদর্শন চক্র ব্যবহার করার অনুমতি দেন। মহারাজ অম্বরীষ একবার এক যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং দেবতাদের আমন্ত্রণ জানান। যজ্ঞ শেষে অম্বরীষ উপবাস ভঙ্গের উপক্রম করলে দুর্বাসা তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে স্নান করতে যান। দুর্বাসার ফিরতে দেরি হলে অম্বরীষ অন্যান্য ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সামান্য জল মুখে দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। কিছুক্ষণ পর দুর্বাসা ফিরে আসেন এবং জানতে পারেন যে অম্বরীষ তাঁর জন্য অপেক্ষা না করেই উপবাস ভঙ্গ করেছেন। এতে দুর্বাসা অভিশাপ দিতে উদ্যত হন। এই অবস্থায় অম্বরীষ সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করেন। সুদর্শন চক্র এসে দুর্বাসাকে তাড়া করতে থাকে। উপায় না দেখে দুর্বাসা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের কাছে গিয়ে সুদর্শন চক্রের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ত্রিদেব তাঁদের অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ভগবান বিষ্ণু বলেন, একমাত্র অম্বরীষই সুদর্শন চক্রকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। দুর্বাসা আবারো অম্বরীষের কাছে হাজির হন। কথায় কথায় আর কখনো কাউকে অভিশাপ দেবেন না—এই শর্তে অম্বরীষ সুদর্শন চক্রকে ফিরিয়ে নেন।

সেই থেকে দুর্বাসা ঋষিকে আর কোথাও দেখা যায়নি। রিপুকেই দমন করতে পারলেন না বলেই কি তাঁর এই অধঃপতন হয়েছিল?  


পরিবেশ ভাবনায় - বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -Tushar Gorai
Jan. 20, 2025 | পরিবেশ | views:150 | likes:5 | share: 5 | comments:0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সুষম সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন ব্যতীত মানুষের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁর এই বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা পাই শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠায়।

শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশবান্ধব শিক্ষার একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে শিক্ষার্থীরা কেবল পঠনপাঠনেই নয়, বরং তাদের নৈতিক ও সৃজনশীল বিকাশেও অগ্রগামী হবে। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীরা মুক্ত আকাশের নীচে প্রকৃতির কোলে পাঠ গ্রহণ করত। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করলে শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তারা জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।

শ্রীনিকেতন
শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ জীবনের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন, কৃষি আধুনিকীকরণ, এবং স্বনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। কৃষকদের জীবনের মানোন্নয়নে তিনি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও পদ্ধতির প্রচলন ঘটান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গ্রামগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, যাতে তারা শহরের উপর নির্ভরশীল না হয়।

বৃক্ষরোপণ উৎসব ও পরিবেশ সচেতনতা
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেন। এই উৎসবের মাধ্যমে তিনি মানুষকে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করেন। বৃক্ষরোপণ শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের উপায়ই নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মজবুত করার একটি প্রতীকী পদক্ষেপ।

লেখনীতে পরিবেশ ভাবনা
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য ও বক্তৃতার মাধ্যমে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি শহরের অতি-বাণিজ্যিকীকরণ এবং প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ জাপান যাত্রীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, "পৃথিবীর শহরগুলো প্রকৃতি ও মমতার মিলনে তৈরি হওয়া উচিত। কিন্তু বাণিজ্যিক চাহিদার কারণে শহরগুলো মানবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে।"

আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান পরিবেশ সংকটের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের ফলে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় তাঁর দর্শন আমাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে মানুষ সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পরিবেশ ভাবনা কেবল তাঁর সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সর্বজনীন এবং চিরন্তন। তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও পরিবেশ সচেতনতা আজও আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস ।

তথ্যসূত্র:

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবেশ ভাবনা


গল্পের ফাঁকফোঁকর: মহাভারতে কি মাল্টিভার্সের কথা বলা আছে? -Guitar K Kanungo
Jan. 19, 2025 | category | views:70 | likes:4 | share: 4 | comments:1

তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের ধারণা, আমাদের মহাবিশ্ব ছাড়া আরও অনেক মহাবিশ্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। এই প্রতিটি মহাবিশ্ব যেখানে আমাদের মতো একাধিক সৌরজগৎ আছে, কিন্তু আলাদা সব বৈশিষ্ট্য এবং নিয়ম মেনে চলছে। তবে এই মাল্টিভার্স তত্ত্বটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। কল্পবিজ্ঞানে মাল্টিভার্স নিয়ে নানান গল্প আছে। দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল তার মধ্যে একটি। দ্য লং আর্থ সেরকম আরেকটি উপন্যাস, যেখানে লেখক বলছেন মানবসভ্যতা এরকম এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে প্রবেশ করার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যেটা দিয়ে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাওয়া আসা করছে।

এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যশোয়া ভ্যালেন্টের মধ্যে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাবার সহজাত ক্ষমতা আছে। হিন্দু পুরাণে এরকম একজন চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। পুরাণে তো আছেনই, মহাভারতেও তিনি আছেন। তিনি দেবর্ষি নারদ। মথুরার দেবকী এবং বসুদেবের বিয়ে শেষ হয়েছে। দেবকীর ভাই কংস মহাসমারোহে বোন এবং বোনের স্বামীকে রথে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় নারদ এসে হাজির হন, অনেকটা যশোয়া ভ্যালেন্টের মতোই  নারদ বলেন এই যুগলের অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে। শুরু হবে অন্য এক গল্পের। যে ঢেঁকির মতো দেখতে যন্ত্রটায় নারদ চড়ে বেড়ান, সেটা কি যশোয়া ভ্যালেন্টের 'স্টেপার' যেটার মাধ্যমে সে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে চলাচল করছে?

পার্বতী অন্দর মহলের প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য একজন দ্বারপাল তৈরি করলেন। "তৈরি" শব্দটা ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ যিনি দ্বারপাল নিযুক্ত হলেন, তিনি স্বয়ং বিনায়ক গণেশ। যেহেতু পার্বতীই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, অতএব গণেশ কেবল পার্বতীকেই মা বলে জানেন। মুশকিলের ব্যাপার হল, মায়েদের যে স্বামী থাকে, এবং তাদেরকে যে বাবা বলে ডাকা হয়, এবং মা'দের প্রাইভেসি বিনষ্ট করার অধিকার বাবাদের সবসময়ই থাকে—এই তথ্যটা গণেশের জানা ছিল না। মহাদেব কার্যোপলক্ষে বাইরে ছিলেন। কৈলাসে ফিরে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলেন মহাদেব। গণেশ তাঁকে ঢুকতে দিলেন না, কারণ মা কাউকে ঢুকতে দিতে বারণ করেছেন। এই "কাউকে"র মধ্যে যে শিব পড়েন না, সেটা পার্বতী পরিষ্কার করে বলেননি। ফলে শিব বাড়ি ঢুকতে না পেরে ভুত-প্রেতদের সঙ্গে গাঁজার আসর জমালেন। একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলো, এরকম অবস্থায় দেবর্ষি নারদ থাকবেন না—সেটা কী হয়! তিনি ঢেকিতে চড়ে হাজির হলেন। ফলে অনেক জল ঘোলা হল এবং এক পর্যায়ে গণেশের মাথা শিবের হাতে কাটা পড়ল। এর পরের কাহিনী প্রায় সবারই জানা। বলবার বিষয় হল, এখানেও নারদ আসছেন, আসতে পারছেন অনায়াসে। শিবের কৈলাস; এটা ব্রহ্মলোক, অমরাবতী নয়, বৈকুণ্ঠও নয়।

দেবর্ষি নারদ পিতামহ ব্রহ্মারই পুত্র। অর্থাৎ, তাঁর জন্ম হয়েছে ব্রহ্মলোকে। কিন্তু ব্রহ্মলোকে জন্ম হলেও তিনি সেখানে থাকেননি। তিনি ঢেরা বেঁধেছেন বৈকুণ্ঠে, যেখানে ভগবান বিষ্ণু অবস্থান করেন। ভগবান বিষ্ণুর স্তব করেই তাঁর সময় কাটে। সেই স্তব কঠিন মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে নয়; তিনি গানে গেয়ে বিষ্ণুর অর্চনা করেন। কথিত আছে, তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। দেবর্ষি নারদ ছিলেন তার চাইতেও বড় সংগীতজ্ঞ। কতটা বড়? তার একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে। একবার নারদ তাঁর আরাধ্য দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বীণায় এমন সুর ধরলেন যে, ভগবান বিষ্ণুর শ্রীচরণ গলে এক জলের ধারা সৃষ্টি হয়ে ত্রিভুবন ভাসিয়ে নেবার উপক্রম হল। আশুতোষ সেই জলের ধারাকে নিজের জটায় ধারণ করে সৃষ্টি রক্ষা করলেন। শিবের জটা থেকে সেই নদীকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনবেন রাজা ভগীরথ। সেই থেকে গঙ্গা ভাগীরথী নামেই পরিচিত হবেন। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, কৈলাস আর মর্ত্যলোক সব একাকার হয়ে গেল।

এতক্ষণ বলতে চাইলাম, হিন্দু পুরাণে মাল্টিভার্সের এরকম উল্লেখ অসংখ্যবার করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণের মহাবিশ্ব কেবল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেমন গ্রিকদের আছে কিংবা আব্রাহামিক ধর্মগুলো বিশ্বাস করে। হিন্দু পুরাণে স্বর্গ আছে, কিন্তু সেটা দেবতাদের আবাস—মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই, অতীতের দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। নরকের আদলে যমলোক একটা আছে, কিন্তু সেখানে মৃত ব্যক্তির আত্মা পরবর্তী জন্মের জন্য অপেক্ষা করে মাত্র। হিন্দু পুরাণে এর বাইরেও অনেক লোক বা জগতের কথা বলা হয়েছে। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক—এর কোনোটিই স্বর্গের অংশ নয়। এগুলো সবই আলাদা আলাদা জগৎ, এবং এইসব জগতে যাওয়া আসার ক্ষমতা বিশেষ কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নারদ তাদের একজন। মহাভারতে অর্জুনকে একবার সশরীরে স্বর্গে যেতে দেখা যায়, অবশ্য তবে তাঁকে নেবার জন্য তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্র রথ পাঠিয়েছিলেন। সেই রথটা কি বিশেষ কোনো মহাকাশ যান, অথবা যশোয়া ভ্যালেন্টের স্টেপার? তবে মহর্ষি ভৃগু কোন পদ্ধতিতে ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, এবং শিবলোকে ভ্রমণ করছিলেন, সেই তথ্য মহাভারতের কবি দেননি।

তবে আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা মাল্টিভার্স তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে যে সমস্ত দিক নিয়ে চিন্তা করছেন—অর্থাৎ, এক মহাবিশ্বের সঙ্গে আরেক মহাবিশ্বের সময়ের যে একটা তফাৎ থাকতে পারে, সেটা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস কিন্তু ধারণা দিয়েছেন। কতটা জেনে বা বুঝে তিনি এটা তুলে ধরেছেন, বলা মুশকিল। তবে আধুনিক কালের কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা এই তথ্যটা জানলে বেশ পুলকিত হতেন, কারণ মহাভারত রচিত হয়েছে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। মহাভারতে উল্লেখিত ঘটনাটার কথা বলি। সত্যযুগে রৈবত কুকুদ্মী নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর এক সর্বগুণসম্পন্ন কন্যা ছিল—নাম রেবতী। তিনি রেবতীর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজছিলেন। খুঁজতে গিয়ে মনে হলো প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছেই যাওয়া যাক, তিনি হয়তো একটা ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে পারবেন।

তাঁর সেই অনুযায়ী কন্যা রেবতীকে নিয়ে রাজা কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হলেন। যে মুহূর্তে কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হয়েছিলেন, ঠিক তখন ব্রহ্মা এক সংগীতের আসরে মগ্ন ছিলেন। চমৎকার সব সংগীত পরিবেশিত হচ্ছিল একের পর এক। ব্রহ্মা পঞ্চমুখে বলছিলেন, "তোফা! তোফা!" কুকুদ্মী এবং রেবতীও সেই গানের আসরে যোগ দিলেন। একপর্যায়ে গান শেষ হল। কুকুদ্মী যথাবিহিত সম্ভাষণপূর্বক প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তাঁর আসার কারণ জানালেন। সব শুনে ব্রহ্মা বললেন, "দ্বাপরযুগে মথুরায় ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে জন্ম নেবেন। তাঁর বড় ভাই বলদেবই হবেন রেবতীর উপযুক্ত পাত্র।" রাজা কুকুদ্মী কিছুক্ষণ বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলেন। তিনি জন্মেছেন সত্যযুগে,  ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়েছেন ব্রহ্মলোকে, আর ব্রহ্মা কিনা তাঁর মেয়ের পাত্র দেখছেন দ্বাপরযুগে জন্ম নেবে এমন একজনকে ! ব্রহ্মা অন্তর্যামী। তিনি মুখ টিপে হাসছিলেন কুকুদ্মীর দুরবস্থা দেখে। বললেন, " পৃথিবীর সময় আর ব্রহ্মলোকের সময় এক নয় - মহারাজ ! আপনি পৃথিবীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাবেন দ্বাপর যুগ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, আপনার রাজ্যে কেউ বেঁচে নেই । বলদেব অনেক আগেই জন্ম গ্রহণ করছেন। বলরামের  সঙ্গে আপনার কন্যা রেবতীর বিয়ে দিন। "

ব্রহ্মদেবের কথা মিথ্যা হয়নি। এটা কি মাল্টিভার্স তত্বকে প্রতিষ্টা করে সেরকম একটা উপাখ্যান নয়? ভবিষৎ এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।    


শরৎ সাহিত্যে ধর্ম ও সংস্কার -Tushar Gorai
Jan. 17, 2025 | জীবনী | views:279 | likes:3 | share: 6 | comments:0

স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শন ভারতের জনমানসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বরাবরই। তবে শরৎসাহিত্যে বেদান্ত দর্শনের প্রবল বিরোধিতা লক্ষ করা যায় এমনকি ঈশ্বরকেও তিনি বিদ্রুপ করেছেন। এমন কাজ তিনি করে দেখিয়েছেন যখন হিন্দু সমাজের বাঁধন বেশ শক্ত ছিল। তখন হিন্দু সমাজ পুরোপুরি ধর্মীয় প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল। এমতাবস্থায় তিনি লিখছেন ," কোনো  ধর্মগ্রন্থই কখনও অভ্রান্ত সত্য হতে পারে না। বেদও ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং, এতেও মিথ্যার অভাব নেই। যা বুদ্ধির বাইরে, তাকে বুদ্ধির বাইরে বলেই ত্যাগ করব। মুখে বলব, অব্যক্ত , অবোধ্য, অজ্ঞেয় , আর বাজে কথায় তাকেই ক্রমাগত বলবার চেষ্টা , জানবার চেষ্টা কিছুতেই করবো না। যিনি করবেন তাকেও কোনো মতে সহ্য করবো না "। ঠাট্টা করে তিনি বলছেন , " ... নির্গুণ নিরাকার, নির্লিপ্ত, নির্বিকার এসব কেবল কথার কথা। এর কোনো মানে নেই। যে মুখে বলছেন জানা যায় না, সেই মুখেই আবার এত কথা বলছেন যেন এইমাত্র সমস্ত স্বচক্ষে দেখে এলেন। যাকে কোন মতেই উপলব্ধি করা যায় না, তাকেই উপলব্ধি করবার জন্য পাতার পর পাতা, ব‌ইয়ের পর বই লিখে যাচ্ছেন। কেন? "  ইতিহাসকে কেউ যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘেটে দেখেন তবেই তার সামনে আসল সত্যটা উন্মোচন হবে। তার লেখা 'চরিত্রহীন' বইতে উপনিষদ সম্পর্কে খুব সুন্দর করে ছোট্ট কথার মধ্যে  তীব্র বিদ্রুপ করেছেন। দিবাকর ও কিরণময়ীর আলোচনার মধ্যে দিয়ে উপনিষদ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার যুক্তি-তর্ক দেখা যায়। শরৎচন্দ্র এর মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইছিলেন যা সত্য তাকে সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করা প্রয়োজন ,এতে বেদই মিথ্যা হোক আর শাস্ত্রই মিথ্যা হয়ে যাক , সত্যের চেয়ে বড় কিছু নয়। বর্তমানে মানুষের তর্কের ঝোঁক এতটাই বেশি যে সহজ সরল যুক্তিগুলোকে মানুষ উপেক্ষা করে দেয়। তিনি এই বিষয়টিকে তার লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন সেখানে ‌।

শরৎচন্দ্র তার সাহিত্যের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে জাতপাতের সমস্যা গুলিকে মুক্তির পথে অন্যতম বাধা হিসেবে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন। কোন একটি অভ্যাস সেটা সমষ্টির মেনে চলার মাধ্যমে তা সংস্কারে পরিণত হয়। সংস্কার যদি আমাদের গুণাবলী ,মহত্ব ,দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ এবং মনুষ্যত্ববোধকে ক্ষুন্ন করে তাহলে তা কোনমতেই সংস্কার নয়, তা একটি কুসংস্কার। 'গৃহদাহ'- এ রাম বাবু চরিত্রের মধ্য দিয়ে এবং বহু জায়গায় বহু চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে হিন্দু সমাজে জাত পাতের সমস্যাটা সবসময় মোটা অর্থে নিচুতার সঙ্গে জড়িয়ে নেই। তা করুণা মহৎ গুণ, মমতা, ভালবাসার সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে। মহিমের ভাষায়, " যে ধর্ম অত্যাচারের আঘাত থেকে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারেনা ,বরঞ্চ তাহাকে মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়, সে কিসের ধর্ম মানব জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা কোনখানে ? " শরৎচন্দ্র মানুষের চিন্তা চেতনায় ব্যথা বেদনা জাগিয়ে ধর্ম এবং সংস্কারকে আঘাত করেছেন। 


ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর: একজন কামুক রাজার গল্প । -Guitar K Kanungo
Jan. 15, 2025 | category | views:57 | likes:5 | share: 2 | comments:0

শাহজাহান সত্যিই মুমতাজ মহলকে ভালোবাসতেন। আর্জুমান্দ বানু বেগমের (মুমতাজ মহল) সঙ্গে যখন শাহজাদা খুররমের (পরে তিনি সম্রাট শাহজাহান নামে পরিচিত হবেন) বিয়ে হয়, তখন আর্জুমান্দ বানু বেগমের বয়স ছিল উনিশ বছর এবং শাহজাদা খুররমের বয়স বিশ বছর। অর্থাৎ তাঁরা প্রায় সমবয়সী ছিলেন।

আটত্রিশ বছর বয়সে তাঁদের পঞ্চদশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মুমতাজ মহল মৃত্যুবরণ করেন। উনিশ বছরে পনেরো বার গর্ভধারণ! অর্থাৎ প্রতি ১.২৫ বছরে মুমতাজ মহল একবার করে গর্ভধারণ করেছেন। এই বিষয় থেকেই বোঝা যায়, এই দম্পতির মধ্যকার শারীরিক ভালোবাসা যথেষ্ট তীব্র ছিল।

মুমতাজ মহলের মৃত্যুতে শাহজাহান খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের একটি নিয়ম ছিল, সম্রাট প্রতিদিন সকালের দিকে একবার জনসাধারণকে দর্শন দেবেন। এর উদ্দেশ্য ছিল এই বার্তা দেওয়া যে সম্রাট বেঁচে আছেন এবং যা কিছু ঘটছে, তা সম্রাটের নির্দেশেই ঘটছে। স্ত্রী-বিয়োগের ফলে শাহজাহান অনেক দিন ধরে চলে আসা সেই প্রথাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো তাঁর হয়ে সেই সময় রাজ্য পরিচালনা করছিলেন।

এক পর্যায়ে তাঁর মাথায় তাজমহল নির্মাণের ভাবনা এলো। তিনি নিজেই এই সমাধি সৌধের ডিজাইন করেন। ভেতরের কিছু নকশার কাজ করালেন ইতালীয় এক নকশাদারকে দিয়ে। এই নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত থাকলেন। একসময় তৈরি হলো শাহজাহানের আকাঙ্ক্ষিত রওজায়ে মুনাভারা, যা পরবর্তীতে তাজমহল নামে পরিচিতি পায়।

হিন্দু মন্দির ভেঙে তাজমহল তৈরি করা হয়েছে—এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামের এক স্বঘোষিত ঐতিহাসিক এই ধারণাটি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একথা ঠিক যে আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সময় ছাড়া বাকী মুঘল সম্রাটদের রাজত্বকালে এখানে-ওখানে কিছু মন্দির ভাঙা হয়েছে। সেই সময় এমন আইনও প্রচলিত ছিল যে মুঘল সাম্রাজ্যের ভেতরে নতুন করে কোনো মন্দির নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু কোনো মন্দির ভেঙে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল—এই ব্যাপারটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক তাঁর দাবির সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করতে পেরেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই।

ব্যাপারটি স্রেফ এতটুকুই যে জায়গাটির ওপর তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল, সেখানে রাজা মানসিংহের একটি প্রাসাদ ছিল। সম্পর্কে রাজা মানসিং ছিলেন শাহজাহানের মামা। রাজপুত যোধাবাঈ ছিলেন শাহজাহানের জননী, আর মানসিং ছিলেন যোধাবাঈয়ের ভাই। (যোধাবাঈ আকবরের স্ত্রী ছিলেন—এই তথ্যটি সত্য নয়।) মাতুলের দেওয়া জমির ওপর তিনি প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। যেহেতু এই জায়গাতেই আগে থেকেই প্রাসাদ ছিল এবং সেই প্রাসাদে রাজপুতরা বসবাস করতেন, সেখানে কোনো একজন বা একাধিক হিন্দু দেবতার মন্দির হয়তো ছিল। তবে সেটি ছিল নিতান্তই পারিবারিক। সোমনাথ মন্দিরের মতো সর্বজনীন কোনো মন্দির সেখানে ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আমরা কিছুটা মূল আলোচনা থেকে দূরে সরে গেছি। আমরা শাহজাহান এবং মুমতাজের ভালোবাসার গল্প বলতে চাইছিলাম। শাহজাহানের শারীরিক ভালোবাসার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল, একথা আমি আগেই বলেছি। এই দিক থেকে দেখলে তাঁকে রাজা যযাতির সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাঁর জীবনটাও—অন্তত জীবনের শেষ অংশটাও—এক অর্থে যযাতির মতোই এ টেল অফ লাস্ট

তিনিও যযাতির স্টাইলে জরা বিনিময় করতে না পারলেও দীর্ঘ সময় যৌবন ধরে রাখার জন্য নানাবিধ উত্তেজক ওষুধ গ্রহণ করতেন। এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তিনি মাঝে মাঝে অসুস্থও হয়েছেন। তবুও তাঁর অবাধ যৌনাচার থেমে থাকেনি। শুধু তাই নয়, রাজকন্যা জাহানারাও যে আলাদাভাবে এমন অবাধ যৌনাচারের আয়োজন করতেন, ঐতিহাসিকরা সেই ব্যাপারে একমত।

বড়সড় হারেমের জন্য মুঘলদের আগাগোড়াই খ্যাতি ছিল। সেখানে সুন্দরী, যৌবনবতী, আবেদনময়ী নারীর কমতি ছিল না। কিন্তু শাহজাহানের তাতেও মন ভরত না। তিনি প্রাসাদের ভেতরেই মীনাবাজার বসাতেন। রাজধানীর নানা বয়সী নারীরা সেখানে পসরা সাজিয়ে বসতেন। শাহজাহান সেইসব স্টলে ঘুরে ঘুরে দেখতেন। বিশেষ কোনো পসরা নয়, তিনি দেখতেন পসরা সাজিয়ে বসা নারীদের। কোনো নারীকে তাঁর পছন্দ হলেই দেহরক্ষীদের ইশারা করতেন। এরপর সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের সম্রাটের সেবায় নিযুক্ত করা হতো।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টি ছিল, এই কাজটি দেখাশোনা করতেন তাঁরই কন্যা জাহানারা। তিনি কি এই সমস্ত নারীদের মধ্যে মুমতাজকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন? হয়তো তাই। যদিও ঐতিহাসিকদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তবে শাহজাহান যে একজন নিম্ফোম্যানিয়াক ছিলেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। যে স্ত্রীকে তিনি এত ভালোবাসতেন, যাঁর জন্য তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সমাধি সৌধ নির্মাণ করেছেন, তাঁর শারীরিক মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবার নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েন।

ভালোবাসা বিষয়টি বড়ই অদ্ভুত—কখন, কোথায় গিয়ে পড়ে, কোথায়, কীভাবে প্রকাশ পায়, তা বলা মুশকিল।

গল্পের ফাঁকফোঁকর: কে বড়— রাধা নাকি রুক্মিণী ; কৃষ্ণ, নাকি বিষ্ণু? -Guitar K Kanungo
Jan. 13, 2025 | category | views:54 | likes:3 | share: 4 | comments:0

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ঈশ্বর নিজেকে তিনভাবে প্রকাশ করেন: সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, এবং ধ্বংসকর্তা। সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্মা, পালন করেন বিষ্ণু, এবং ধ্বংস করেন শিব। এইভাবে প্রকাশের মধ্যে একটি সমস্যা আছে। সেটি হল—সৃষ্টি করার পর ব্রহ্মার আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। সেইজন্যেই বোধ হয় ব্রহ্মার কোনো মন্দির নেই; তাঁকে কেউ পূজা করে না। এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হবার এক মুহূর্ত আগে শিব আবির্ভূত হলে খুব একটা অসুবিধা হবে না, কারণ ধ্বংস করা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো কাজ নেই।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, পালনকর্তা বিষ্ণুই সার্বভৌম—একেবারে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রয়োজন রয়েছে মর্ত্যের মানুষের কাছে। মর্ত্যে কংসের মতো বা বালির মতো কারো বাড় বেড়ে গেলে, এই বিষ্ণুকেই ধরাধামে অবতীর্ণ হতে হয় পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার প্রয়োজনে। কিন্তু, আবার একথাও তো ঠিক—ব্রহ্মা যদি সৃষ্টিই না করতেন, তাহলে বিষ্ণুর সেই সৃষ্টিকে রক্ষা করারই প্রয়োজন হত না; শিবের ধ্বংস করারও। তাহলে, ব্রহ্মাই কি শ্রেষ্ঠ? নাকি বিষ্ণু? নাকি শিব? কে বড় ত্রিমূর্তির মধ্যে?

এই প্রশ্নটাই মহর্ষি ভৃগুর মনেও জেগেছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা বা শিব নয়, ঈশ্বরের তিন প্রধান প্রকাশের মধ্যে বিষ্ণুকেই শ্রেষ্ঠ বলে রায় দিয়েছিলেন। ভৃগু বিষ্ণুর এই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেছেন নম্রতার মাপকাঠি দিয়ে। ভৃগু এর আগে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং দেবাদিদেব মহাদেবকেও পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কিন্তু নম্রতার মানদণ্ডে এদের দুজনের কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

বুকে পদাঘাত করার পরেও বিষ্ণু ভৃগুকে কোনো শাস্তি দেননি; বরং পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিয়েছেন। এই গল্পটা সম্ভবত ব্যাস আমাদের শুনিয়েছেন মহাভারতে। অবশ্য, এখানে কিছুটা পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারও থাকতে পারে। কোনো কোনো পুরাণ বলে ভগবান বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগুরই আত্মজা। কন্যার স্বামীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকতেই পারে, বিশেষত সে স্বামী যদি ভগবান বিষ্ণু হন। যদি হিমালয়কে এই দায়িত্ব দেওয়া হত, তিনি নিশ্চিত চাল-চুলোহীন শিবকেই বেছে নিতেন।

কিন্তু, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ আমাদের ভিন্ন কথা বলছে। সেখানে কৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছুর মূল। তিনিই পরমব্রহ্ম। সৃষ্টির ইচ্ছাও তাঁর মধ্যেই প্রথম প্রকট হয়েছিল—বিষ্ণুর মধ্যে নয়। কৃষ্ণই নিজেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারীতে বিভক্ত করে রমনে লিপ্ত হলেন। এই রমনের ফলে নারী অংশটি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে একটি গোলাকার পিণ্ড প্রসব করেন। সোনালী রঙের এই পিণ্ডটিই আমাদের মহাবিশ্ব। অনেক বছর সেই পিণ্ড ভেসে থাকল। তারপর একদিন সেই পিণ্ডটি ভেদ করে বিষ্ণু বেরিয়ে এলেন এবং সৃষ্টিকর্মের বাকিটা শেষ করলেন।

এখানে ব্রহ্মার কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না; মহাদেবের অস্তিত্বেরও উল্লেখ নেই। স্পষ্টতই কৃষ্ণই সবকিছুর মূল।

মহাভারত বলছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর অবতার। মহাভারত আরও বলছে—তাঁর একাধিক স্ত্রী থাকলেও রুক্মিণীই কেবল লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। এদিকে, মথুরায় আসার আগে কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে ছিলেন, সেখানে চুটিয়ে প্রেম করেছেন শ্রীমতি রাধার সঙ্গে এবং অন্যান্য ব্রজবালাদের সঙ্গেও।

মজার ব্যাপার, রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমটা স্বকীয়া ছিল না। রাধা বিবাহিত ছিলেন এবং বয়সে কৃষ্ণের চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। কৃষ্ণ কেবল রাধাতেই মজে ছিলেন না; অসংখ্য ব্রজবালার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। এই সমস্ত ব্রজবালার অনেকেই বিবাহিত ছিলেন। রাধা এই নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছুটা মান-অভিমান করলেও কৃষ্ণের বহুগামিতা নিয়ে রুক্মিণীর মতো তিনিও নিস্পৃহ ছিলেন।

কিন্তু রাধা একজন সাধারণ গোপী। তিনি লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নেননি। মজার ব্যাপার হল, কৃষ্ণ নাম উচ্চারিত হলেই রাধার নামই আসে; রুক্মিণীর নয়। তাই, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে—রাধা আর রুক্মিণীর মধ্যে কে বড়?

কেউ কেউ বলবেন, যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই বিষ্ণু; যিনি ব্রহ্মা, তিনিই শিব। সবকিছু মিলেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম। তাঁরা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেন। শুনেছি বটে এরকম কথা। ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।

আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!

যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম?শুনেছি বটে এরকম কথা।

ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।

আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!

যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম? কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম?

কার্বন ক্যাপচার: পরিবেশ কল্যাণমূলক এক অভিনব প্রক্রিয়া -Tushar Gorai
Jan. 13, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:71 | likes:4 | share: 4 | comments:0

সাধারণ ব্যাকটেরিয়া থেকে জটিল উদ্ভিদ ও প্রাণী, সকল জীবের গঠনমূলক উপাদান হলো কার্বন। এটি বাস্তুতন্ত্রের কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি খাদ্য শৃঙ্খলার ভিত্তি গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন প্রজাতির জন্য আবাসস্থল ও সম্পদ সরবরাহের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে।  

তবে, কার্বন ডাই অক্সাইড একটি গ্রিনহাউস গ্যাস যা পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপ আটকে রাখে। মানব কার্যকলাপ, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বন উজাড় এবং অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ, CO₂ স্তরকে বাড়িয়ে তুলেছে, যা গ্রিনহাউস প্রভাবের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। এর ফলে সাগরের স্তর বৃদ্ধি, বরফ গলে যাওয়া, মানব স্বাস্থ্য, বায়ুর গুণমান এবং খাদ্য ও পানির নিরাপত্তার উপর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।  

কার্বন ক্যাপচার ও সংরক্ষণ (CCUS)  :

কার্বন ক্যাপচার এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শিল্প হাব থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ধরে রাখতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।  

কার্বন ক্যাপচারের প্রকারভেদ :

1. পোস্ট-কমবাস্টন ক্যাপচার: জ্বালানি পোড়ানোর পরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা শিল্প প্ল্যান্ট থেকে নির্গত গ্যাস থেকে CO₂ সংগ্রহ।  

2. প্রি-কমবাস্টন ক্যাপচার: জ্বালানি পোড়ানোর আগে CO₂ সংগ্রহ করা হয়, যা সাধারণত IGCC (ইন্টিগ্রেটেড গ্যাসিফিকেশন কম্বাইন্ড সাইকেল) প্ল্যান্টে ব্যবহৃত হয়।  

3. অক্সি-ফুয়েল কমবাস্টন: বাতাসের পরিবর্তে বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিয়ে জ্বালানি পোড়ানো, যা প্রধানত CO₂ এবং জলীয় বাষ্প তৈরি করে।  


সংগৃহীত CO₂ এর সংরক্ষণ :

সংগৃহীত CO₂ গভীর ভূগর্ভস্থ গঠনে সংরক্ষণ করা হয়, যেমন:  

- তৈল ও গ্যাসের শূন্যক্ষেত্র: আগের ব্যবহৃত তেল ও গ্যাসের রিজার্ভ।  

- লবণাক্ত অ্যাকুইফার: লবণাক্ত পানিযুক্ত ভূগর্ভস্থ শিলা স্তর।  

- অখননযোগ্য কয়লার স্তর: গভীর বা ব্যয়বহুল কয়লা স্তর।  


CCUS-এর সুবিধাসমূহ : 

- গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস: CO₂ সংরক্ষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ।  

- জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত রাখা: পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া।  

- অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি: নতুন চাকরি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সৃষ্টি।  

চ্যালেঞ্জ এবং বিবেচনা :

- উচ্চ খরচ: CO₂ সংগ্রহ, পরিবহন এবং সংরক্ষণের জন্য ব্যয়বহুল।  

- পরিবেশগত ঝুঁকি: ভূগর্ভস্থ CO₂ সংরক্ষণে লিকেজ এবং ভূমিকম্পের সম্ভাবনা।  

- প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: বড় আকারে বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ।  


ভারত ও বিশ্বের কার্বন ক্যাপচার প্রকল্প :

বিশ্বে:  

- পেট্রা নোভা (যুক্তরাষ্ট্র): কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে CO₂ সংগ্রহ করে ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণ।  

- গর্গন (অস্ট্রেলিয়া): প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন থেকে CO₂ সংগ্রহ এবং সমুদ্রের গভীরে সংরক্ষণ।  

- স্লেইপনার (নরওয়ে): প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন থেকে CO₂ সংগ্রহ এবং লবণাক্ত অ্যাকুইফারে সংরক্ষণ।  

- বাউন্ডারি ড্যাম (কানাডা): কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে CO₂ সংগ্রহ করে ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণ।  

- নর্দার্ন লাইটস (নরওয়ে): পূর্ণাঙ্গ CCS শৃঙ্খল তৈরির প্রকল্প।  

ভারতে:  

- ONGC-এর CO₂ ক্যাপচার এবং ব্যবহার: তেল ক্ষেত্র থেকে CO₂ সংগ্রহ এবং উন্নত তেল উৎপাদনে ব্যবহার।  

- কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কার্বন ক্যাপচার: পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রযুক্তি পরীক্ষা।  

ভারতে কার্বন ক্যাপচার প্রকল্প সীমিত হলেও, ক্লিন এনার্জি এবং জলবায়ু ক্রিয়ার উপর সরকারের মনোযোগ এই খাতের উন্নয়ন সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির সাথে কার্বন ক্যাপচার একত্রিত করা একটি টেকসই, কম কার্বন ভবিষ্যতের পথে অবদান রাখতে পারে।  



তথ্যসূত্র: Science Reporter (Feb,2024)


গল্পের ফাঁকফোঁকর : অলৌকিকতা নাকি বুজরুকি? -Guitar K Kanungo
Jan. 12, 2025 | category | views:77 | likes:3 | share: 0 | comments:0
অলৌকিকতা ছাড়া সম্ভবত  সব ধর্ম অর্থহীন। ঈশ্বর অলৌকিক তো বটেই, যারা সেই ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে আসেন তাদের অনেক কর্মকান্ড ও  অলৌকিক। এই সমস্ত অলৌকিক কর্মকান্ডকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা না গেলেও এসব ধর্মে যার আস্থা স্থাপন করেছে তারা এই ঘটনাগুলোকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করে। ব্রিটিশ গণিতবিদ জন সি লেনক্স তাঁর "ক্যান সাইন্স এক্সপ্লেইন এভরিথিং" গ্রন্থে যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন বিজ্ঞান কি সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে? পারে না - বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু আবার একথাও তো ঠিক আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা করতে পারত না, এখন সেটা পারে। আগামী পাঁচশ বছর পরে এমন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবে যেটা ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করতে পারছে না।  

পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর এমন কিছু ঘটনার কথা আমাদেরকে শোনানো হয়েছে যেগুলো যেসময় ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে, সেই সময় ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করা না গেলেও এখন কোনো রকম প্রশ্নের উদ্রেক না করেই সেগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। ধারণা করা হয়, প্যালিওলিথিক যুগে (প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ৩০,০০০ বছর আগে) প্রথম মানুষের ধর্মবিশ্বাস বিকশিত হয়েছিল। এই সময়ে মানুষের মধ্যে অতিপ্রাকৃত অনুভূতির প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। নৈমিত্তিকভাবে ঘটে চলা অনেক ঘটনাই সেই সময়ের মানুষের কাছে অলৌকিক মনে হত, যেহেতু সেই সমস্ত ঘটনার কারণ তাঁদের জ্ঞান এবং বুদ্ধির অগম্য ছিল। কিন্তু সেই সমস্ত ঘটনাগুলোকে তারা অলৌকিক মনে করলেও, এই সমস্ত ঘটনার পেছনে একজন (বা একাধিক) ঈশ্বর আছেন—সেই ধারণা পাকাপাকিভাবে তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্গানাইজড রিলিজিয়নগুলো আসার পর থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে এবং ধর্মের প্রয়োজনকে বৈধতা দিতে গিয়ে এই সমস্ত ঘটনাকে অত্যন্ত সুকৌশলে সাধারণ মানুষের মনোজগৎকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ধর্মই একাজ করেছে।

ইহুদি ধর্মের আলোচনা দিয়ে শুরু করা যাক। মুসাকে একজন মেসায়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলো মুসার লোহিত সাগরের পানি দুই ভাগে ভাগ করে একটি চলার পথ সৃষ্টি করা। এই পথ দিয়েই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সাগর পার হয়ে ইসরায়েলের পথে যাত্রা করেছিলেন। লেনক্স যত কথাই বলুক, সাগরের পানিকে মাঝ বরাবর দুই ভাগ করা সম্ভব নয়—এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব নয়। ঈশ্বর নিজেও প্রকৃতির নিয়মের কাছে সীমাবদ্ধ; ইচ্ছা করলেই সেই নিয়ম ভাঙা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে এক ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। ঈশ্বর সেটা চাইবেন না, যদি আলোচনার খাতিরে এটা ধরে নিই যে ঈশ্বরের সেই ক্ষমতা আছে। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কি এই গোটা ঘটনাটাই বানোয়াট? আসলে এরকম কিছু ঘটেনি? সেই সম্ভাবনাই বেশি—আসলেই কিছু ঘটেনি। বাইবেলের রচয়িতা এখানে জুল ভার্নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তফাৎটা এই যে, জুল ভার্ন স্বীকার করেছেন তিনি কল্পবিজ্ঞান লিখছেন, বাইবেলের রচয়িতা সেকথা স্বীকার করেননি।

যীশুকে ঘিরে সবচাইতে অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাটি হলো ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যবরণ করার কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর পুনরুত্থান; এই ব্যাপারটা খ্রিস্ট ধর্ম বিশ্বাসের অন্যতম প্রধান মূলনীতিও বটে। অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি যদি যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার ভক্তি অচল নয়। বাইবেল বলছে, যীশুকে শুক্রবারে কবরস্থ করা হয়েছিল এবং তিনি কবরস্থ হওয়ার তৃতীয় দিনে, অর্থাৎ রোববারে পুনরুত্থিত হয়েছেন। এরপর চল্লিশ দিন তিনি এই ধরাধামেই ছিলেন। বিভিন্ন শিষ্যদের দর্শন দিয়েছেন, তবে সবার আগে যীশুর দর্শন পেয়েছেন মেরি—তাঁর মা মেরি নন, শিষ্য মেরি। শিষ্যদের নানান উপদেশ-আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি সশরীরে স্বর্গারোহন করেছেন। দুজন ফেরেশতা তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেছেন, অর্থাৎ তাঁকে স্বর্গে তুলে নিয়ে গেছেন।

এরকম স্বর্গারোহনের ঘটনা আমরা আরো অন্তত দুটি ক্ষেত্রে ঘটতে দেখব। প্রথমটা মহাভারতে ঘটেছিল পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয়টা ইসলামের নবী মুহাম্মদের মেরাজের ক্ষেত্রে। বর্ণনা শুনে মনে হয়, স্বর্গ—তথা যে স্থানে ঈশ্বর বসবাস করেন সেটা অন্তরীক্ষের কোন এক স্থানে। ফলস্বরূপ, তাঁদের দুজনকে ঊর্ধ্বপথেই যেতে হয়েছিল, যদিও আমরা ঠিক নিশ্চিত নই, স্বর্গটা আসলে কোথায়। যীশুর ক্ষেত্রে, দুইজন ফেরেশতা এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মুহাম্মদের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বাহন ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটার যে শারীরিক বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা কোন অবস্থাতেই একটি স্পেসশিপের নয়। যীশুর স্বর্গারোহন সেই অর্থে অনেকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন, যদিও তিনি আদৌ পুনরুত্থিত হয়েছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নটা এখনো রয়েই গেছে। পান্ডবদের স্বর্গারোহন করার ব্যাপারটা ছিল আরো হাস্যকর। তাঁরা পায়ে হেঁটে স্বর্গের পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন, যে পথ অতিক্রম করতে হলে হিমালয় পর্বত পার হতে হয়। হিমালয়ের কৈলাস পর্বত শিবের আবাস, কিন্তু সেটা স্বর্গ নয়। তাহলে হিমালয়ের ওপারে কোথাও পান্ডবদের স্বর্গ কি, তিব্বত কিংবা চীনের কোথাও? বলা মুশকিল।

এবার যীশুর পুনরুত্থানের আলোচনায় ফেরা যাক। ক্রুশবিদ্ধ করার আগে এবং ক্রুশবিদ্ধ থাকা অবস্থায় যে শারীরিক নির্যাতন যীশু সহ্য করেছেন, তাতে তিনি যে মৃত্যবরণ করেছেন, এই ব্যাপারটা নিশ্চিত—বিজ্ঞানসম্মতভাবেই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে তাঁকে জীবিত দাফন করা হয়েছে, এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই। যদি জীবিত দাফন করা না হয়ে থাকে, তাহলে মৃত্যুর তিন দিন পরে তাঁর আবার কবর থেকে বেরিয়ে আসারও কোন সুযোগ নেই। মৃত্যুর মোটামুটি দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে মানব শরীরে রিগর মর্টিস শুরু হয়ে যায়। মৃত্যুর বায়াত্তর ঘণ্টা পরে, তাঁর সুস্থ শরীরে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। এখানে আরো একটা মনে রাখা দরকার, যারা বলছেন পুনরুত্থানের পর তাঁরা যীশুকে দেখেছেন, এদের কেউই নিরপেক্ষ সাক্ষী নন। এদের সবাই যীশুর শিষ্য এবং অনুরাগী। যীশুকে একজন মেসাইয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা উদগ্র ইচ্ছা এদের মধ্যে থাকতে পারে।

ইসলাম ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার একটির কথা আগেই বলা হয়েছে। একটা ঘোড়া সদৃশ প্রাণীর পিঠে চড়ে অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করে আসার গল্প কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়। এই ঘটনার একটাই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে, আর সেটা হল, তিনি গোটা ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। মুহাম্মদের ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলা হয়েছে, যেটাকে অনায়াসে অলৌকিক বলা চলে। বলা হয়, জিব্রাইল ফেরেশতা এসে মুহাম্মদের বুক চিরে বুকের ভেতর থেকে কিছু কালো জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনেন। তারপর মুহাম্মদের হৃৎপিন্ডটাকে বুক থেকে বের করে এনে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে, সেটাকে আবার যথাস্থানে বসিয়ে দেন। মুসলমানদের কাছে এই ঘটনা সাক-আল সদর নামে পরিচিত। এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছে মুহাম্মদেরই কিছু সমবয়সী খেলার সাথী। মুহাম্মদের বয়স তখন চার বছর, এবং তাঁর খেলার সাথীদের বয়সও এর কাছাকাছি ছিল।

এই ঘটনার বর্ণনা শুনে সবার আগে যে প্রশ্নটা মনে উদিত হয়, সেটা হল, চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ কতটা গ্রহণযোগ্য। তারা নিশ্চয়ই, যদি এই ঘটনা ঘটে থাকে, গোটা ঘটনাকে দূর থেকে দেখেছে। তাহলে তারা কিভাবে বুঝতে পারল যে, যিনি এই কাজটি করছেন, তিনি জিব্রাইল? এদের কেউ কি জিব্রাইলকে আগে দেখেছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারা কিভাবে বুঝল, মুহাম্মদের বুক চিরে যে বস্তুটা বের করে আনা হয়েছে, সেটা হৃৎপিন্ড নাকি কলিজা? মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা কিছু বাচ্চা, যাদের মানব শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে কোন ধারণা থাকার কথা নয়, তারা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনা হয়েছে, হৃৎপিন্ড পরিশোধন করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এটাও বলছে, সেই হৃৎপিন্ড আবার জমজমের পানি দিয়ে ক্লিন করা হচ্ছে। এইসব শিশুরা কিভাবে বুঝল, ওটা জমজমের পানিই ছিল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নয়? জিব্রাইল কি তাহলে ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন? পুরো ঘটনাটির বর্ণনা আধুনিক সময়ের ওপেন হার্ট সার্জারির কথাই মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু খোল আকাশের নিচে কোন রকম 'অ্যানেস্থেশিয়া' ব্যবহার না করে এরকম ভাবে ওপেন হার্ট সার্জারি করা কি যায়?  বিশেষত যখন ড. দেবী শেঠীর মত হার্ট সার্জন যেখানে তখনো জন্মাননি। গোটা ব্যাপারটাই হাস্যকর রকমের কষ্টকল্পিত।

শুরুতেই বলেছিলাম, এরকম বুজরুকি সব ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়, হতেও পারে না। নাদিয়ার মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের মহাপ্রয়াণের কথাই ধরা যাক। বৈষ্ণবরা তো বটেই, বৈষ্ণব নন এমন অনেকে হিন্দুও একথা বিশ্বাস করেন যে, মহাপ্রভু পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। অলৌকিকতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা। কোন জীবিত মানুষের পক্ষে একটি মাটির কিংবা পাথরের তৈরি বিগ্রহ মূর্তির সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মহাপ্রভু ভগবান বিষ্ণুর অবতার লীলা সম্পন্ন করে তিনি আবার জগন্নাথের মধ্যেই আবারো বিলীন হয়ে গেছেন, অনুসারী ভক্তদের কাছে মহাত্ব্যপূর্ণ করে তোলার জন্যেই যে ব্যাপারটাকে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সেইজন্যেই, অনেকেই যেমন কোন রকমের যুক্তির ধার ধারে না গিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করেছে, তেমনি যুক্তিবাদী মানুষরা যুক্তিহীন এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যানও করেছে। শেষোক্ত মানুষেরা মনে করে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে আসলে খুন করে তাঁর মৃতদেহ এই মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্রহের পেছনে (অথবা অন্য কোথাও) লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনাকে সাড়ম্বরে তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনে ঈশ্বর বা কোনো উচ্চতর শক্তির প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। অলৌকিক ঘটনা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এমন কিছু দেখানোর চেষ্টা করে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ফলে, যারা ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে এক ধরনের রহস্যময় ধারণার জন্ম হয়। ঈশ্বরের মহিমা, ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সেই উচ্চতর শক্তির কাছে প্রণত হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যে ব্যাপারটাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না, সেই ব্যাপারটাকে অযৌক্তিক জেনেও বিশ্বাস করতে বলা, যে নৈতিকতা বিরোধী, সেকথাটা অনেক সময় যারা এইভাবে বিশ্বাস করতে বলেন, তাদের মনে থাকেনা। অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত, সেটাই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত—এমনকি ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও। ঈশ্বর যদি আমার আনুগত্য চান, তাহলে তিনি যে আছেন সেটা প্রমাণ করার দায়ভারটা একান্তই ঈশ্বরের। অযৌক্তিক অলৌকিকতা বুজরুকিরই নামান্তর।


ইন্টারস্টেলার -Tushar Gorai
Jan. 12, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:186 | likes:8 | share: 3 | comments:0

পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি রূপোলি পর্দায় তুলে ধরা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। 'বিজ্ঞান' এই শব্দটা শুনলেই মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার জটিল থিওরি এবং ভয়ংকর ক্যালকুলেশনের  কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাধারণ দর্শক রোমান্টিক বা একশন সিনেমা বেশিই দেখতে পছন্দ করেন। বৈজ্ঞানিক জটিল তত্ত্ব এবং জাগতিক বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনার প্রতি মানুষের কৌতুহল যে একেবারে নেই তা নয়।

২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রডিউসার লিন্ডা অবস্ট কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক একটি সিনেমা প্রস্তুত করার জন্য প্রস্তাব দিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী কিপ স্টিফেন থর্নকে। এই বিজ্ঞানী জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে গবেষণা করেছেন ব্ল্যাক হোল, ওয়ার্ম হোল, গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ ইত্যাদি বিষয়ে। এই ক্ষেত্রে তার জ্ঞান ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি অবশ্য সিনেমা তৈরির সাথে যুক্ত হয়ে পড়বেন এ বিষয়ে তিনি কোনদিন কল্পনাও করেননি। 

পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান এবং তার ভাই স্ক্রিপ্ট রচয়িতা জোনাথান নোলানের সঙ্গে ভিসুয়াল এফেক্টসে কাজ করার জন্য খুব একটা বেগ পেতে হয়নি থর্ণকে। পরবর্তীকালে তিনি 'সাইন্স অফ ইন্টারস্টেলার' বলে একটি বই লেখেন যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন স্বয়ং পরিচালক নোলান। ইন্টারস্টেলার ছবিতে 'গারগানটুয়া' ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে মহাকাশযান 'এনডিওরেন্স' যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে সেগুলোকে শর্ট অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন । ছবির একটা জায়গায় তিনি গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মহাকাশে কোন ভারি বস্তুর পাশ দিয়ে আলো যাওয়ার সময় সেই ভারী বস্তুর মহাকর্ষের টানে আলোর বেঁকে যাওয়াকে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং বলা হয়। অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন ভারী বস্তুর কারণে উঁচু-নিচু স্থান কালের ক্ষেত্রে আলো রশ্মি চলতে গিয়ে বেঁকে যাওয়াকে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বলে। 'গারগানটুয়ার' স্পিনিং এর কারণে যে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং হয় যার ফলে তার প্রতিবিম্বের অবস্থান ভিন্ন ধরনের বোঝানোর জন্য ছবি এঁকে তার সঞ্চার পথ নির্দেশ করেছেন থর্ন। ব্ল্যাক হোল ঘিরে যে আক্ক্রিশন ডিস্ক থাকে তার প্রকৃত তাপমাত্রা লক্ষ লক্ষ ডিগ্রিতে পৌঁছতে পারে তাছাড়া এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি, বেতার তরঙ্গ এবং দৃশ্যমান আলোর মত বিভিন্ন বিকিরণ ঘটে। ব্ল্যাক হোলের মধ্যে এই তাপমাত্রাকে বোঝানোর জন্য তাপমাত্রার সমানুপাতিক উজ্জ্বল্য কে ভিসুয়াল ইফেক্টসের সাহায্য নেওয়া হলো।  'গারগানটুয়ার ' থেকে প্রচুর পরিমাণে দৃশ্যমান আলো বেরিয়ে এলেও এক্স রশ্মি বা গামা রশ্মি বেরোয় না তাই আপাতভাবে সেই বিকিরণের আবহে নিশ্চিহ্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না ছবির নায়ক কুপারের। গল্পে রসের মাধ্যমে বিজ্ঞান পরিবেশনায় বিস্ময়কর দক্ষতা দেখিয়েছেন বিজ্ঞানী থর্ন। সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক নীতিগুলো মেনে তিনি তৈরি করেছেন সমস্ত ভিসুয়াল ইফেক্টস্। 

ব্যবসায়িক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই এসব বৈজ্ঞানিক কঠিন তত্ত্বগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য এতটাও পরিশ্রম করেন না। তবে বিত্তশালী হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে ক্রিস্টোফার নোলানের এর মত অনেক পরিচালকই এই ঝুঁকিটা নেন। জনসমক্ষে জ্যোতি:পদার্থবিদ্যার এই সব জটিল রহস্যজনক ঘটনা সর্বসমক্ষে আসার ফলে তাদের মধ্যে এক বিস্ময়কর কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। সিনেমাই পারে মানুষের মধ্যে এমন কৌতূহল সৃষ্টি করার জন্য। জনজীবনে সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য।

রামধনু -Tushar Gorai
Jan. 11, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:354 | likes:7 | share: 2 | comments:0

পৃথিবীর বহু অলৌকিক ঘটনা আমাদের নজরের আড়ালেই রয়ে যায় হয়তো আমরা সেগুলি ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি। এইসব জাগতিক ঘটনা আমাদের মনে এতটা নাড়া দেই না বা আমরা এইসব ঘটনাগুলি উপভোগ করতে পারিনি। পৃথিবীতে আলোর অবিশ্বাস্যকর কান্ডকারখানার উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে রামধনু এমন একটি ঘটনা।

রামধনুর বিজ্ঞান এতটাও জটিল নয় একটু বিশ্লেষণ করলেই জলবৎ তরলং। পুরাণে রামধনুকে ভগবানের ধনুক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে যা কিনা মর্ত্য ও স্বর্গের মধ্যে যোগাযোগের পথ। অতীতে অনেক বিদগ্ধ পন্ডিতগণ এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রেখে গেছেন।নিউটন প্রথম দেখালেন সাধারন সূর্যালককে কাঁচের প্রিজমের মাধ্যমে বিচ্ছুরিত করে 7 টি রঙে ভাঙ্গা যায়।সেই বিচ্ছুরিত আলোককে পুনরায় সাধারণ আলোতে ফিরিয়ে আনেন। এইসমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে আলোক সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আসেন।

আকাশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র জলকণার মধ্যে মেঘ - বাদলের বাধা ছাড়া পৌঁছতে পারলেই অনেকখানি কাজ হয়ে যায়।সূর্যালোক জলকনার মধ্যে প্রবেশ করে 7 টি রঙে ভেঙে যায়। যেখানে লাল  রঙের রশ্মি বিচ্ছুরিত হয় সবচেয়ে কম আর বেগুনি রঙের রশ্মি বিচ্ছুরিত হয় সবচেয়ে বেশি। এই পদ্ধতিতে লক্ষ লক্ষ জলকণার মধ্যে বিচ্ছুরিত হয় সূর্যালোক ভিন্ন ভিন্ন কোন দৃষ্টি করে। এই কোন ০ থাকে ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত যেকোনো হতে পারে তবে ৪২ এর থেকে কখনও বেশি হয় না। প্রতিটি রঙের রশ্মির জন্য নির্দিষ্ট বিচ্ছুরণ কোন থাকে যেমন বেগুনি রঙের রশ্মির জন্য সর্বোচ্চ কোন ৪০ ডিগ্রি।

রামধনুকে দেখার জন্য বেশ মজার কায়দা আছে। বৃষ্টিস্নাত পরিষ্কার আকাশে সূর্য যেদিকে আছে ঠিক তার উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াতে হবে প্রথমে। সূর্য থেকে আগত রশ্মিগুলিকে একটি নির্দিষ্ট লাইন ভেবে আমার মাথার ঠিক উপর দিয়ে ছায়ার শেষ পর্যন্ত কাল্পনিক রেখা ধরলাম। এই কাল্পনিক রেখা যেন জলবিন্দু গুলি থেকে আগত রশ্মি গুলির সাথে সমান্তরাল হয়। এ কাল্পনিক রেখা কিন্তু রামধনুকে দেখার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কাল্পনিক রেখার সঙ্গে ৪২ ডিগ্রি কোনের থেকে একটু বেশি  কোনে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলে হয়তো আমরা রামধনুকে দেখতে পারব। যেখানে ৪০ ডিগ্রি থেকে একটু বেশি কোণে তাকিয়ে দেখলে আমরা বেগুনি রঙের প্রাধান্য দেখতে পাব যদিও বেগুনি রং রংধনুতে খুবই ম্লান ।


এখন তাহলে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই রংধনুটা বাঁকানো কেন হল? তার কারণ হলো ৪২ ডিগ্রির বেশি কোণে সমস্ত দিক থেকে বিভিন্ন রঙের বৃত্তাকার পরিধি আমরা দেখতে পাই। সমস্ত রংধনুই যে পূর্ণ বৃত্তাকার পরিধি গঠন করে তা নয়। অপর্যাপ্ত পরিমাণে জলবিন্দু এবং মেঘ-বাদলের বাধা তার কারণ।

তথ্যসূত্র: For The Love Of Physics - Walter Lewin

Rainbow



ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর : শাহজাদা সেলিম রাজা ইডিপাসের পথেই এগুচ্ছিলেন। -Guitar K Kanungo
Jan. 10, 2025 | category | views:64 | likes:4 | share: 2 | comments:0

মুঘল সম্রাটদের মধ্যে আকবর সবচাইতে বেশী সময়ের জন্য রাজত্ব করেছিলেন  প্রায় পঞ্চাশ বছর তিনি ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। মোটা দাগে তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মাত্র দুজন শাসকের নামের আগে 'মহান' শব্দটি যোগ করা হয়। একজন সম্রাট অশোক, আরেকজন সম্রাট আকবর। এদের প্রথম জন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে কাজ করেছিলেন, দ্বিতীয় জন একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মানের। একজন মুসলামন শাসক হওয়া সত্বেও আজ থেকে পাঁচশ বছরের কাছাকাছি সময়ের আগে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা ভাবা সহজ ব্যাপার নয়, যেখানে আজকের দিনে এসেও অনেক মুসলমানের মধ্যে খেলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্র আকুতি দেখতে পাওয়া যায়

এখানে দুটো বিষয় আমাদের বোঝা দরকার। আকবর নিরক্ষর হলেও মোটেই অশিক্ষিত ছিলেন না। তিনি বরং অন্য মুঘল সম্রাটদের তুলনায় অনেক বেশী পরিমানে শিক্ষিত, আসলে বলা উচিত অনেক বেশী সুশিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বিশাল সংগ্রহের ব্যাক্তিগত লাইব্রেরী ছিল। তিনি নিজে পড়তে পারতেন না বলে অন্যরা তাঁকে সেসমস্ত বই পড়ে শোনাতেন। আকবরকে নিয়ে আরেকটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যেটা মূলত মুসলমান ঐতিহাসিকরা ছড়িয়েছে। বলা হয় তিনি দ্বীনে এলাহী নামের একটা ধর্মের প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা সর্বৈব মিথ্যা।  দ্বীনে এলাহী নামের একগুচ্ছ প্রবিধি (code of conduct) তিনি প্রচলন করেছিলেন কিন্ত যেগুলো কেবল যারা শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্যেই প্রযোজ্য ছিল। তিনি আলাদা করে কোন বিশেষ ধর্ম প্রচার করেননি। তবে একথা ঠিক তিনি সব ধর্মের শাস্ত্রবিদদের ডেকে পাঠাতেন এবং তাঁদের কথা শুনতেন।  ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতিই অনুগত ছিলেন।

অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এবং অনেকে ভারতীয় মুসলামনও  বলার চেষ্ঠা করেন মুঘলরা ভারতবর্ষে স্রেফ লুটপাট করার জন্য আসেনি, তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এসেছিলেন। এই কথাটা আকবরের আগেকার মুঘল সম্রাট বাবুর এবং হুমায়ূনের  জন্যে সর্বাংশে সত্য ছিল না। তাঁদের মধ্যে পিছুটান ছিল। বিশেষত বাবুরের মধ্যে তো ছিলই, ভারতবর্ষের আবহাওয়া তাঁর কখনোই ভালো লাগেনি। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট আকবরই সত্যিকার অর্থে প্রথম বারের মত কোন রকমের পিছুটান ছাড়াই একজন ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্ঠা করেছিলেন। কাবুল কিংবা সমরখন্দ নিয়ে তাঁর কোন পিছুটান ছিল না।  

এবার আনারকলির গল্পটা বলি। গল্পটা প্রেমের হলেও, এই গল্পের পরিণতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আনারকলি পরিণতি সম্পর্কে যে ধরণটা প্রচলিত আছে সেটি হলো সম্রাট আকবর তাঁকে জীবন্ত হত্যা  করার আদেশ দিয়েছিলেন। সেই হত্যাটা কিভাবে করা  হয়েছিল  সেটা নিয়ে নানান মতমত থাকলেও সবচাইতে প্রচলিত ধারণটা ছিল আকবর আনারকলিকে চার দেয়ালের মধ্যে পুরে দিয়ে তাকে জীবন্ত অবস্থায় হত্যার নির্দেশ দেন। তবে, কিছু ইতিহাসবিদ এটাও মনে করেন আকবর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আনারকলিকে কোনো এক দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন সেখানে আনারকলি জীবনের বাকিটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন। শেষেরটা হবার সম্ভাবনাই বেশী। 

আনারকলির অপরাধটা কী? আনারকলির অপরাধ তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এবং তিনি প্রেমে পড়েছিলেন আকবরের পুত্র শাহজাদা সেলিমের। এটাই কী তার অপরাধ ? ইতিহাস থেকে জানা যায় আকবর এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি, শুধু যে মেনে নিতে পারেননি  তা নয়, তিনি আনারকলিকে সেলিমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সব চেষ্টাই করেছেন। কিভাবে করেছেন সেকথা একটু আগেই বলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? এমন তো কোন কথা ছিল না শাহজাদার প্রেম করার কোন অধিকার ছিল না। পুরোদমেই ছিল। তাহলে?

আনারকলি হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান এই ব্যাপারটা নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায় না। হিন্দু বলে আকবর সেই সম্পর্ক মেনে নেননি, এরকম ভাবার খুব একটা সুযোগ নেই কারণ আকবর নিজেই হিন্দু রমনী বিয়ে করেছেন। শাহজাদা সেলিমের জননী যোধাবাঈ নিজেও ছিলেন একজন রাজপূত নারী - তথা হিন্দু ধর্মের অনুসারী । সেক্ষেত্রে আনারকলি হিন্দু হলেও আকবরের তরফে কোন রকমের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। সমস্যাটা ছিল আসলে অন্য জায়গায় এবং সেটা গুরতর - যে জায়গাটা নিয়ে ইতিহাস অনেকটাই নীরব - বিশেষ কিছু বলে না।      

আকবরের সেলিমের বাইরে আরো দুজন  সন্তান ছিল। তাদের একজনের নাম দানিয়েল। আগেই বলেছি সালিমের মা ছিলেন যোধাবাঈ যদিও সেই মায়ের সঙ্গে সালিমের সম্পর্ক কখনোই খুব একটা ভালো ছিল। সেলিম বৈরাম খানের বিধবা স্ত্রী যাঁকে আকবর পরবতীতে বিয়ে করেছিলেন সেই রমণীকে নিজের মা বলে মনে করতেন এবং তাঁর সঙ্গেই বেশী ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যাই হোক, দানিয়েলের মা ছিলেন হারেমেরই আরেক নারী। আকবরের রাণীদের কেউ নন।  তিনি ছিলেন আকবরের হারেমের রক্ষিতাদের একজন। ঐতিহাসিক আব্রাহাম ইয়ার্লির মতে আনারকলিই ছিলেন দানিয়েলের মা।

সম্পর্কের এই বিশেষ জটিলতার কারণেই শাহজাদা সেলিম, যিনি কিনা সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকারী, আনারকলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখুক আকবর সেটা চাননি।  


গল্পের ফাঁকফোঁকর: ভীষ্ম কি আসলেই ততটা মহান যতটা মহান তাঁকে ভাবা হয় ? -Guitar K Kanungo
Jan. 9, 2025 | category | views:52 | likes:5 | share: 3 | comments:0

আমরা পিতামহ ভীষ্মকে যতই মহৎ বলি না কেন তাঁকে দিয়ে ব্যাস মোটা দাগে দুটো অপরাধ করিয়েছেন। দুটো অপরাধই বড় রকমের অপরাধ। এই দুটো অপরাধ এমন যে এই অপরাধগুলো সংঘটিত না হলে কুরুক্ষত্রের যুদ্ধটাই হত না।

ভীষ্মের প্রথম অপরাধ করেছেন গান্ধারী এবং তাঁর পরিবারের সাথে। তিনি গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গান্ধার থেকে তুলে এনেছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে। এই পর্যন্ত যদিও মেনে নেয়াও যায় কিন্তু এর পরে তিনি যে কাজটা করেছেন, সেটা পুরোপুরি ক্ষমার অযোগ্য। তিনি গান্ধারের রাজা সুবল, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের আরো কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনকে হস্তিনাপুরে ডেকে এনে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। শুধু তাই নয় ভীষ্ম এটাও নিশ্চিত করেছেন এরা সবাই যেন না খেতে পেয়ে মৃত্যবরণ করে।

ব্যাপারটা কতটা অমানবিক সেটা বোঝা যায় যদি আমরা গোটা ব্যাপরটাকে গান্ধারীর দিক থেকে দেখি। গান্ধারী ওই  রাজ্যের রাণী অথচ তিনি জানেনই না যে রাজপ্রাসাদে থাকছেন সেই রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও কোন এক কারাগারে তাঁর বাবা-মা-ভাই বন্দি এবং তারা না খেতে পেয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে কেবল  গান্ধারীর ভাই শকুনিই রেহাই পেয়েছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের কোন প্রয়োজন ছিল না। একথা ঠিক গান্ধার রাজ সুবল, বিশেষত, শকুনী বোনের এই বিয়েতে একেবারেই রাজী ছিল না। কিন্তু তাদের কোন উপায়ও ছিল না। হস্তিনাপুরের মত প্রতাপশালী রাজ্যের বিরুদ্ধে কিছু করার মত সামর্থ্য এবং সাহস কোনটাই তাদের ছিল না। বিয়ের আগে মুহূর্তে শকুনি যদি কিছু বলেও থাকেন সেটা অক্ষমের অসুফলন ছাড়া কিছুই নয়। ভীষ্ম অযথাই একটা গণহত্যা চালিয়েছেন। গণহত্যা এইজন্যে যে শকুনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধারে ফিরে যায় নি। রাজা সুবল হস্তিনাপুরের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। হতে পারে গান্ধার অত্যন্ত ছোট একটা রাজ্য কিন্তু সেখানেও তো কিছু মানুষের বসবাস ছিল।  রাজার অবর্তমানে তাদের কি দশা হয়েছিল মহাভারতের রচয়িতা আমাদের সেই খবর দেননি। 

ভীষ্ম দ্বিতীয় অপরাধটি করেছেন কাশীর রাজকন্যা অম্বাকে ফিরিয়ে দিয়ে। গান্ধারীর মতই কাশীর তিন রাজকন্যাকে তিনি তুলেই এনেছেন। এক্ষেত্রেও কাজটা তিনি গায়ের জোরেই করেছেন। স্বয়ম্বর সভা চলছে; যিনি বিয়ে করতে ইচ্ছুক তিনি স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত থাকে। ভীষ্ম নিজে বিয়ে করবেন না কিন্তু তিনি রাজকন্যাদের তুলে নিয়ে আসলেন  ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য। এই কাজটা তিনি জোরপূর্বক না করে বিচিত্রবীর্যকেই কাশীতে পাঠাতে পারতেন। বিচিত্রবীর্য নিজের ক্ষমতাবলে কাশী রাজকন্যাদের জয় করতে পারলে ব্যাপারটা অনেক শোভন এবং গ্রহণযোগ্য হত।  ভীষ্ম নিশ্চয়ই জানতেন বিচিত্রবীর্যের পক্ষে সেই কাজটা সম্ভব নয়। সেইজন্যে দায়িত্বটা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং গোটা ব্যাপারটাকে লেজে গোবরে ছেড়ে দিলেন।

 অম্বা সৌভ্য দেশের রাজার শল্যকে ভালোবাসতেন। স্বয়ম্বর সভায়  শল্য উপস্থিতও ছিলেন কিন্তু ভীষ্মের কারণে সব ওলট পালট হয় গেল। অবশ্য তখন পর্যন্ত ভীষ্ম জানতেনই না যে অম্বা  শল্যকে ভালোবসেন। সেটা তিনি জানলেন রাজকন্যাদের হস্তিনাপুরে নিয়ে আসর পর। বাকি দুই রাজকন্যার বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে আপত্তি না করলেই অম্বা বেঁকে বসলেন। অম্বা বললেন তিনি যেহেতু শল্যের বাগদত্তা সেহেতু তিনি শল্য ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন না। ভীষ্ম তাৎক্ষণিকভাবে অম্বাকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অম্বাকে সৌভ্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু স্বয়ম্বরের পরপর ভীষ্মকে ঠেকাতে গিয়ে শল্য ভীষ্মের কাছে যে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন, সেই অপমানের কথা ভীষ্ম ভুলে যাননি।  তিন অম্বাকে গ্রহণ করতে রাজী হলেন না।  তিনি অম্বাকে ফিরিয়ে দিলেন।  

রাজকুমারী অম্বার কাশীতে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।  তিনি হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছে ফিরে এলেন। ভীষ্মকে বললেন শল্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে কাশীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার এই দুরাবস্থার জন্যে ভীষ্মই দায়ী । ভীষ্ম তাঁকে জোরপূর্বক তুলে না আনলে এই অবস্থার সৃষ্টি হত না। ভীষ্মের উচিত এখন তাঁকে বিয়ে করা। কিন্তু ভীষ্ম বিয়ে না করার ভীষণ শপথ নিয়ে বসে আছেন। তিনি রাজী হলেন না; তাঁর কাছে অম্বার জীবনের চাইতে শপথের মূল্য অনেক বেশী।  দুচারটা জীবন ধ্বংস হয়ে গেলেও তাঁর কর্তব্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যাবে না।

এই গোটা ব্যাপরটা ভীষণ রকমের স্বার্থপরতামূলক। এই মহাভারতেই এক ঋষির কথা বলা হয়েছে যিনি মিথ্যা না বলার অপরাধে নরকে গেছেন কারণ ওই মিথ্যাটা বললে একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষা পেত। একই যুক্তি ভীষ্মের ক্ষেত্রেই খাটে। অম্বাকে বিয়ে করলে তিনি সত্যচুত হতেন সেকথা ঠিক কিন্তু অম্বার জীবনটা বেঁচে যেত, যে জীবনটা তিনি নিজের হাতে নষ্ঠ করেছেন। যে গুরুর কাছ থেকে  তিনি অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছেন সেই গুরুর আদেশও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। গুরু পিতারই মত।  দেবব্রতের কাছে ভীষ্ম হয়ে ওঠাটা অনেক বড়। ভীষ্মের কারণে অম্বার জীবনটা অকলে ঝরে গেল। এটাও এক ধরণের হত্যাকাণ্ডই। ভীষ্ম এই হত্যাকাণ্ডের দায় কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না।    


গল্পের ফাঁকফোঁকর: সূর্যদেব নন, দুর্বাসাই কর্ণের পিতা। -Guitar K Kanungo
Jan. 8, 2025 | category | views:81 | likes:5 | share: 3 | comments:0

কবি নবীনচন্দ্র সেন বলেছিলেন, কর্ণ আসলে দুর্বাসারই সন্তান। দুর্বাসার বর দেয়ার যে ব্যাপারটা বলা হয়, সেটা আসলে একটা গালগপ্প। কুন্তী রাজা কুন্তিভোজের ঔরসজাত কন্যা ছিলেন না; সেইজন্যেই হয়ত এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, জেনেও দুর্বাসার সেবায় কুমারী কুন্তীকে নিয়োগ করছিলেন।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কর্ণ যদি দুর্বাসার পুত্র হয়, তাহলে মহাভারতের প্লটে একটা ভালো রকমের জট পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রথম জট, পরশুরাম কর্ণকে ক্ষত্রিয় অপবাদ দিয়ে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান ফিরিয়ে নিতে পারেন না, কারণ দুর্বাসার পুত্র হলে কর্ণ কিন্তু আর ক্ষত্রিয় থাকছেন, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে উঠছেন। অবশ্য তিনি ক্ষত্রিয়দের শিক্ষা দেন না, একথাটাও যে পরশুরাম ঠিক বলেছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর পুত্র দেবব্রতকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণের বেলায় তিনি কেন এর ব্যতিক্রম করলেন, সেটা পরশুরামই ভালো বলতে পারবেন।


আরো একটা ব্যাপার আছে। নারদের ব্যাখ্যা মতে, যে কীট কর্ণের উরুতে দংশন করেছিল, সে আসলে ছিল একজন অসুর। মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রীকে অপরহরণ করার চেষ্টা করেছিল, বলে ভৃগু তাকে কীট হয়ে যাবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। যেটা সবসময় হয়, অপরাধ করার সময় কারোই মনে থাকে না যে এর ফলে অভিশাপ নেমে আসতে পারে, কিন্তু যখন সত্যি সত্যি অভিশাপ নেমে আসে, তখন সেই অভিশাপ খণ্ডন করার চেষ্টা করে। এই অসুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। অসুরের কাকুতি মিনতিতে নরম হয়ে ভৃগু বলেছিলেন, উত্তরকালে, কোন এক সময় পরশুরামের সঙ্গে তার দেখা হবে, আর তখনই তার কীট দশা কেটে যাবে। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। পরশুরামের চোখের সামনেই, সেই কীট অসুরে পরিণত হয়ে আকাশপথে উড়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনা অবধারিতই ছিল; এখানে কর্ণের দোষটা কোথায়? পরশুরাম কর্ণকে অভিশাপ দিতে গেলেন কেন?

তিনি ইচ্ছে করলে, অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, তিনি চাইলে ধ্যানযোগে কর্ণের সত্যিকারের পিতৃ-পরিচয় জেনে নিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে যেটা হত, কর্ণ প্রয়োজনের সময়ে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে পারতেন, যেটা তিনি পরশুরামের অভিশাপের কারণে করতে পারেননি। তাতে যেটা হয়েছে, অর্জুনের কাছে তাঁর পরাজয় মেনে না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। এর আগে ইন্দ্রের দেয়া একাগ্নি বানটাও খরচ হয়ে গিয়েছিল, ঘটোৎকচকে বধ করতে গিয়ে। এরই মধ্যে সহজাত কবচ কুন্ডলাটাই হারিয়ে বসেছেন। গোটা মহাভারত জুড়ে অর্জুনকে বড় করে, এবং কর্ণকে খাটো করে দেখানোই আয়োজন।

এরকম আরেকটা অদ্ভুত ঘটনার ঘটতে দেখি, যখন মহারাজ পান্ডু মৃগয়া করতে গেলেন। কিন্দম নামের এক ঋষিকে তিনি হত্যা করেছিলেন। মহাভারতে, যদিও বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তিনি ভুল করে মেরেছেন, কিন্তু কথাটা সত্য নয়। এই কিন্দম মুনি আসলে একটা মৃগীর সঙ্গে সঙ্গম করছিল, যেটা ভয়াবহ ধরনের অনাচার এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে, কেউ যদি, এমনকি সেই কেউ যদি একজন ঋষিও হয়, রাজার কর্তব্য তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া। মহারাজ পান্ডু সেই কাজটাই করেছেন। কিন্দমের মত একজন বিকারগ্রস্থ ঋষির অভিশাপ কার্যকর হবার কথা ছিল না, এবং আমার ধারণা সেটা হয়নি।


পঞ্চপান্ডব পান্ডুরই সন্তান। এই দেবতাদের ওরসে জন্ম-টন্ম এইসবই গাঁজাখুরি ব্যাপারই। তাছাড়া, আমরা যদি মেনে নিই, কর্ণ দুর্বাসারই সন্তান, তাহলে তাঁর দেবতাদের ডেকে এনে গর্ভসঞ্চার করার ব্যাপারটা এমনিতেই মিথ্যে হয়ে যায়। মহাভারতেরই এক জায়গায় বলা আছে, মহারাজ পান্ডু সন্তান লাভের জন্য যজ্ঞ করছিলেন।


বিকৃত কামাচারী হলেও, কিন্দম একজন ব্রাহ্মণ; সেই যুগে ব্রাহ্মণ হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। রাবণকে হত্যা করার কারণে, রামকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল, কারণ রাবণ যাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। অভিশাপ জনিত কারণে, পান্ডুর মধ্যে একটা ভয় হয়ত ছিল, কিন্তু তাঁর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না, একথাটা ঠিক নয়। যদি তাই হত, তাহলে তিনি যজ্ঞ করতে যেতেন না। ঘটনারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি আছে, একটার সঙ্গে আরেকটা ঠিক খাপ খেতে চায় না।


সমস্ত অলৌকিকতাকে যদি অস্বীকার করি, তাহলে বলতে হবে, পরশুরাম আদৌ কর্ণকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন কিনা, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ত্রেতা যুগে পরশুরাম জন্মেছিলেন। সেই পরশুরাম, দ্বাপর যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন - এটাকে মেনে নেয়া যায় না। অনেকেই হয়ত বলবেন, তিনি তো চিরঞ্জীবী - সবযুগেই বেঁচে আছেন, এমনকি এখনো বেঁচে আছেন। সেক্ষেত্রে, এখন কেউ মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় গিয়ে হাজির হলে পরশুরামের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার কথা; কিন্তু নিশ্চিত জানি, এরকম কারো সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।


এক্ষেত্রে, পুরানবিদ নৃসিং প্রসাদ ভাদুড়ির কথাটা অনেক যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন, পরশুরাম, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ -এঁরা আসলে এক ব্যক্তি নন। এরা একেকটা ঘরানার মত; যারাই এঁদের ধারাকে অনুসরণ করে, তারা সেই ঘরানার নামেই পরিচিত হয়। অর্থাৎ, দ্বাপর যুগে আমরা যে পরশুরামকে দেখছি, তিনি আসলে ত্রেতা যুগের পরশুরাম নন; তিনি পরশুরামের এক বিখ্যাত শিষ্য।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : পিতার অন্যায্য সন্তুষ্টি বিধানও কি ধর্ম ? -Guitar K Kanungo
Jan. 6, 2025 | category | views:49 | likes:5 | share: 2 | comments:0

আদি পুরুষ হলেও মনু মহারাজ আমার পছন্দের ব্যাক্তি নন। পুরানবিদদের মধ্যে এঁর  মত পাঁড় 'মিসোজিনিস্ট' আর একটিও নেই। কিন্তু আজকের আলোচনায় জন্যে মনুস্মৃতি থেকে একটা শ্লোক ধার করতেই হচ্ছে। শ্লোকটা এইরকম :

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম: পিত্য হি পরমং তপ:
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।
 
এই মন্ত্রের সরলার্থ - পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ট তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। এককথায় পিতার সন্তুষ্টি বিধান করাই সন্তানের কর্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে সবসময় কি পিতাকে সন্তুষ্ঠ করা যায়? পিতা যদি অন্যায্য কথা বলে সেক্ষেত্রে পুত্রের কর্তব্য কি হবে?

পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এই জটিলতা নিয়ে হিন্দু পুরাণে কয়েকটি  ঘটনার কথা বলা আছে। সেই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্ঠা করা যেতে পারে। 

প্রথম ঘটনাবাল্মিকী রামায়ণ থেকে উদ্ধৃত।

অযোধ্যার রাজা দশরথ নবোঢ়া পত্নীর প্রেমে বিগলিত হয়ে সেই পত্নীর তিনটি ইচ্ছে পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই স্ত্রী একসময় রাজা দশরথের কাছে জ্যেষ্ঠপুত্র রামের পরিবর্তে তাঁর গর্ভজাত ভরতকে অযোধ্যার রাজা এবং রামকে একটা লম্বা সময়ের জন্যে বনবাসে পাঠানোর দাবী জানালেন। দশরথ নিরুপায় কারণ তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

কিন্তু রাম নিরুপায় ছিলেন না। তাঁর সামনে তখন দুটো উপায় খোলা ছিল: প্রথম উপায় পিতাকে সরিয়ে নিজেই অযোধ্যার রাজা হয়ে বসা; দ্বিতীয় উপায় পিতার আদেশ মেনে নিয়ে বনবাসে চলে যাওয়া। প্রথমটা তার অধিকার, দ্বিতীয়টা তাঁর কর্তব্য ; রাম কর্তব্যটাকেই বেছে নিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে রামের এই সিন্ধান্তকে মহৎ একটা কাজ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পিতা দশরথ তাতে সন্তুষ্ঠ হয়েছিলেন কি? রাম দশরথের সত্য পালনে সহায়তা করলে পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেননি। 

প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা সত্বেও দশরথ চাননি রাম বনবাসে যাক। রামের এই চলে যাওয়াটা তাঁকে  এতটাই আহত করেছিল যে রাম রাজধানী ত্যাগ করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেহত্যাগ করেন।রাম কি অনুমান করতে পারেননি এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে? যদি অনুমান করতে পারেন তাহলে তাঁর এইভাবে বনবাসে যাবার তো কোন প্রয়োজন ছিল না। প্রতিশ্রুতি তো তিনি দেননি, সে দায় পিতা দশরথের। তাঁর দায় ছিল কেবল পিতার সন্তুষ্টি বিধান করা। তাহলে রাম কি ঠিক কাজটি করেননি ?

দ্বিতীয় ঘটনা -  মহাভারত থেকে উদ্ধৃত।

বাসুদেব কৃষ্ণের একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন - যযাতি। যয়াতি রাজা হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করছিলেন। অসুরদের গুরু  শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী ছিলেন তাঁর স্ত্রী।  এই দেবযানীর সঙ্গে  অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাও এসেছিলেন দেবযানীর সঙ্গে, যেহেতু তিনি দেবযানীর দাসী ছিলেন। যয়াতি  শর্মিষ্ঠার প্রতিও আকৃষ্ট হন এবং গোপনে তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। দেবযানী যখন ঘটনা জানতে পারেন, তখন রুষ্ট হয়ে তিনি তাঁর পিতা শুক্রাচার্যের কাছে অভিযোগ করেন। ক্রুদ্ধ শুক্রাচার্য যয়াতিকে বার্ধক্যের অভিশাপ দেন; যয়াতি প্রোঢ়ত্বে পৌঁছনোর আগেই বার্ধক্যে পৌঁছে যান। এদিকে যযাতি ছিলেন অত্যন্ত কামুক একজন পুরুষ; তিনি কামপ্রবৃত্তি পূরণের জন্যে আবারো তাঁর যৌবন ফিরে পেতে চাইছিলেন। শুক্রাচার্যের অভিশাপের শর্ত অনুযায়ী যযাতির অন্য কারো সঙ্গে তাঁর জরা বদলের সুযোগ ছিল। ফলত তিনি তাঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজনকে তাঁর বার্ধক্য গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন, যাতে তিনি পুনরায় যৌবনের সুখ উপভোগ করতে পারেন। যয়াতির প্রথম চারপূত্র তাঁর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও, তাঁর পঞ্চম পুত্র পুরু পিতার বার্ধক্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়।

অনেক প্রজন্ম পরে দেবব্রত পিতা শান্তনুর যৌন লালসা পূরণের সুযোগ করে দেবার জন্যে নিজে সারাজীবন কৌমার্য ব্রত পালন করার শপথ গ্রহণ করবেন  অর্থাৎ তিনি পিতার সন্তুষ্টি বিধান করাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করবেন যে সন্তুষ্টি বিধান করতে গিয়ে পুরু পিতার বার্ধক্যকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। 

কিন্তু সন্তুষ্টি বিধানটাই কি সবকথা? পুত্র কিংবা কন্যার একমাত্র ধর্ম, বিশেষ করে পিতা যদি ক্ষমতাবান হন? যে পুত্ররা বার্ধক্য গ্রহণ করতে রাজী হয়নি, যযাতি সেই পুত্রদের প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন যে কাজটা তাঁর দিক থেকে অনৈতিক হয়েছে। এইরকম একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ার একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এই নাটকে ব্রিটেনের রাজা লেয়ার তাঁর তিনি মেয়েকে একদিন কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তারা তাঁকে কেমন ভালোবাসে। বড় এবং মেজ মেয়ে ছিল ভীষণ চালাক। তারা জানত তাদের বাবা উত্তর শুনে সন্তুষ্ঠ না হলে আখেরে তাদের ক্ষতিই হবে; রাজ্যের অংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবার সমূহ সম্ভাবনা। অতএব তার এমন উত্তর একটা উত্তর দিল যে উত্তর শুনে লিয়ার বেজায় খুশী হলেন। লিয়ারের তৃতীয় এবং কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল কর্ডেলিয়া। একই প্রশ্ন তাকে করা হলে সে কোন রকমের ভণিতার আশ্রয় না নিয়ে বলেছিলে একজন সন্তানের তার পিতাকে যতোটুকু ভালোবাসা উচিত তিনি রাজা লিয়ারকে ততটাই ভালোবাসেন। রাজা লিয়ার উত্তরটা শুনে প্রচন্ড  বিরক্ত হলেন; তিনি কর্ডেলিয়াকে সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে গোটা রাজ্য বড় দুই মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। বড় দুই মেয়ের মিথ্যাভাষণে বিভ্রান্ত হয়ে রাজা লিয়ার যে কত বড় ভুল সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে। সন্তুষ্ঠ করার এবং সন্তুষ্ট হবার মধ্যে বড় ধরনের একটা প্রভেদ আছে। ব্যাপারটা উপরের দিক থেকে যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয়।  

তৃতীয় ঘটনা : মহাভারত থেকে উদ্ধৃত।

রেণুকা ছিলেন ঋষি জমদগ্নির স্ত্রী।  খুবই পতিব্রতা একজন নারী ছিলেন তিনি।  এতটাই যে জমদগ্নি যখন তীরচালনা প্রাকটিস করতেন তখন রেণুকা দৌড়ে গিয়ে সেই তীর কুড়িয়ে আনতেন। এহেন রেণুকা জলকে গিয়ে একদিন এক গন্ধর্ব এবং তাঁর স্ত্রীদের জলকেলী দেখে কিছুটা মোহিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে এরকম ভাবের উদয় কেন হল এই অপরাধে জমদগ্নি তাঁর ছেলেদের রেণুকার ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে ফেলতে। রেণুকা এবং জমদগ্নির বাসু এবং বিশ্বাবাসু নামের দুজন এবং পরশুরাম নামের আরো একজন সন্তান ছিল। পিতা অসন্তুষ্ট হবে জেনেও প্রথম দুই সন্তান গর্ভধারিণীকে হত্যা করতে রাজী হল না। পিতার আদেশ পালন করতে গিয়ে মা'কে হত্যা! বড় রকমের ধর্মসঙ্কট।

 কিন্তু পরশুরাম তাৎক্ষণিকভাবে কোন প্রশ্ন না  করেই একটা কুঠার দিয়ে জননী রেণুকার মাথা কেটে ফেলেন। শুধু তাই নয়, রেণুকা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আশ্রমের আশেপাশে বসবাস করে এমনকিছু অন্ত্যজ মানুষদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর এই ঋষিপুত্র এই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর বাড়িতে পা দেবেন না কিন্তু পরশুরাম সেখানে তো গেলেনেই, উম্মাদনার এক পর্যায়ে মায়ের মাথা কাটতে গিয়ে ওই অন্ত্যজ পরিবারের এক নারীরও মাথা কেটে ফেলেছিলেন।যেটা নিয়ে পরবর্তীতে আরেকটা বিপত্তি তৈরি হবে। তবে সেই আলোচনা এখানে মুখ্য নয়।  

যদিও রেণুকা পরবর্তীতে প্রাণ ফিরে পাবেন কিন্তু পরশুরাম কি কাজটা ঠিক করেছেন? এই প্রশ্নটা সবসময়ই উঠেছে এবং এখনো প্রাসঙ্গিক। জমদগ্নি দুটো অসংলগ্ন কাজ করেছেন। প্রথমত তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোলযোগের মধ্যে জড়িয়েছেন যে কাজটা তাঁর একেবারেই উচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত জমদগ্নি নিজে একজন ঋষি হলেও রেণুকা একজন সাধারণ, তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় জয় করে বসে থাকেননি।  তাছাড়া তিনি একজন ক্ষত্রিয়াণীও বটে। জমদগ্নির সঙ্গে বিয়ের আগে তিনি একজন  রাজকন্যা ছিলেন। গান্ধর্বের জলকেলী ক্ষত্রিযসুলভ আচরণ ; সেটা দেখে তিনি  কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠতেই পারেন। এটা বড় কোন অপরাধ হতে পারে না।  এটা অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা যেত যদি রেণুকা দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার মত চন্দ্রদেবর সঙ্গে পালিয়ে যেতেন এবং চন্দ্রের সন্তান গর্ভে ধারণ করে ফিরে আসতেন। জমদগ্নি লঘু পাপে গুরুদন্ডের বিধান দিয়েছেন।  

লক্ষ্য করবার বিষয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসাবে খ্যাত পরশুরাম পিতার আদেশে মাটিকে হত্যা করার প্রশ্নে কোন রকমের ধর্মসঙ্কট অনুভব করেননি। তিনি স্পষ্টতই মায়ের মৃত্যুর চাইতে পিতার আদেশকে অনেক বড় করে দেখেছেন। তাঁর পিতার হত্যাকারী ক্ষত্রিয় রাজাটিকে তিনি খুন করেছিলেন এবং সেখানেই তাঁর হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটার কথা ছিল কিন্তু তিনি সেখানে থামেননি, তিনি আরো একুশবার এইরকম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন , যেটা করার কোন ন্যায়সঙ্গত অধিকার তাঁর ছিল না। এই জন্যে হিন্দু পুরাণে পরশুরামকে একজন অবতারের মর্যাদা দেয়া হলেও কেউ যদি তাঁকে একজন একজন বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী এবং সাইকোপ্যাথিক কিলার বলে মনে করে, তাহলে কি তাকে খুব একটা দোষ দেয়া চলে?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগমুহূর্তে অর্জুন এইরকমই একটা ধর্মসংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অর্জুনকেও অস্ত্র ধারণ করতে হচ্ছিল তার ভাইদের বিরুদ্ধে। কৃষ্ণ তাঁকে অস্ত্রধারণ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। অর্জুনকে যদি এইরকম একটা অবস্থার মুখোমুখি, অর্থাৎ কুন্তীকে হত্যা করার কথা বলা হত কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার অপরাধে, তাহলে  বাসুদেব কৃষ্ণ তাকে কী উপদেশ দিতেন?

বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনকে বারবার বলেছেন ধর্ম মানে অন্ধভাবে কোনো নিয়ম মেনে চলা নয়, বরং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদি অর্জুনকে মাতা কুন্তীকে  হত্যা করতে বলা হত, এবং যেহেতু এই আদেশ নৈতিকতার পরিপন্থী ছিল, কৃষ্ণ সম্ভবত অর্জুনকে এই আদেশ অন্ধভাবে অনুসরণ না করে এই আদেশ নিয়ে প্রশ্ন করতে এবং এই আদেশের ন্যায়সঙ্গতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরামর্শ দিতেন। কৃষ্ণ বলেছেন অহিংসা ত্যাগ করে যুদ্ধ কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য যখন তা ধর্ম রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সেটা অপরিহার্য ছিল না। নিজ মাতাকে হত্যা করার মতো আদেশ নিশ্চিতভাবে অহিংসার বিরোধী, এবং কৃষ্ণ অর্জুনকে সম্ভবত সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কথাই বলতেন। তাছাড়া কৃষ্ণ এটাও বলেছেন প্রতিটি কাজের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি থাকে। মা'কে হত্যা করার মতো একটি চরম কাজের কেবল তাৎক্ষণিক নয়, ভবিষ্যত পরিণতিও যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই অর্জুনকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

 

গল্পের ফাঁকফোঁকর : সদা সত্য কথা বলা ভালো নয়। -Guitar K Kanungo
Jan. 3, 2025 | category | views:90 | likes:2 | share: 2 | comments:0

এক পথিক দস্যুদের ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক ঋষির কুঠিরে আশ্রয় নেয়।  কিছুক্ষণ পরেই দস্যুরা সেই আশ্রমে এসে উপিস্থত হয়। তার ঋষিকে একটা লোক কিছুক্ষন আগে তাঁর কুঠিরে আশ্রয় নিয়েছে কিনা। ঋষি ভেবে দেখলেন সত্য কথা বললে লোকটার প্রাণ যাবে। আবার মিথ্যে কথা বললে তার পাপ হবে। তিনি নিরুত্তর থাকাটায় শ্রেয় বিবেচনা করলেন। দস্যুরা হৃষীকে নিরুত্তর দেখে নিজেরাই কুঠিরের ভেতর লুকিয়ে থাকা পথিককে খুঁজে বের করল। তারপর তার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহ সেখানে ফেলে রেখে চলে গেল।

প্রকৃতির নিয়ম মেনে একদিন সেই ঋষির মৃত্যু হল। কিন্তু যমরাজ তাকে নরকভোগের জন্য পাঠিয়ে দিলেন সেদিনের তার স্বার্থপর আচরণের জন্যে, তিনি নিজের পাপকে একজন মানুষের জীবনের চাইতেও বড় করে দেখেছেন। এই গল্পটা ছোটবেলায় অনেকেই শুনেছেন। এই গল্পের মর্মার্থটা তাই খোলাসা করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। পুরাণে আরেকটা গল্প আছে যেটা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। সেই গল্পটা বলি।  

দেবতাদের গুরু মহর্ষি বৃহস্পতি। তাঁর স্ত্রীর নাম তারা যিনি কিনা পঞ্চকন্যাদের একজন। তিনি সুন্দরী ছিলেন, স্বাস্থ্যবতী ছিলেন। এদিকে চন্দ্রদেব দেবতাদের মধ্যে অন্যতম  আকর্ষনীয় দেবতা ছিলেন। গুরুপত্নী তারা এই চন্দ্রদেবের প্রেমে পড়ে গেলেন। খুবই গর্হিত কাজ! কিন্তু প্রেম কবে কোথায় নিয়ম মেনে চলেছে? সম্পর্ক যেহেতু অবৈধ তারা চন্দ্রকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন।

আগেই বলেছি বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। চন্দ্রদেবের এই অনৈতিক আচরণে দেবরাজ ইন্দ্র বিশেষ ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি চন্দ্রদেবেকে অবিলম্বে তারাকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। চন্দ্রদেব ইন্দ্রের আদেশ থোড়াই কেয়ার করলেন। তিনি তখন তারার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত। ফলত ইন্দ্রকে চন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হল।  অনেকটা হেলেনকে উদ্ধার করার জন্য মেনেলাউসকে ট্রোজান রাজকুমার প্যারিসের বিরুদ্ধে যেরকম যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল সেরকম। সেই যুদ্ধে চন্দ্র পরাজিত হলেন এবং তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেয়া হল।

বৃহস্পতি অবশ্য কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই তারাকে গ্রহণ করলেন।  রামায়ণে আমরা দেখেছি রামচন্দ্র সীতাকে অনায়াসে গ্রহণ করেননি। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল এবং রাম এরকম কথাও বলেছিলেন তিনি সীতাকে উদ্ধার করার জন্যে লংকায় এসে রাবনকে বধ করেননি। বৃহস্পতি অনেকটা ইলিয়াড মহাকাব্যের মেনেলাউসের মতোই আচরণ করবেন। হেলেন নিজ থেকে প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই পালিয়ে যাবার কারণে মেনেলাউস ব্যাক্তিগতভাবে যথেষ্ট পরিমানে অসম্মানিত হয়েছিলেন। পুরুষ হিসাবে তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেইজন্যে হেলেনের প্রতি তার এক রাশ ঘৃণা এবং আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল, কিন্তু ট্রয় নগরী ধ্বংস হবার পর মেনেলাউস হেলেনকে দেখে সব ঘৃণা সব আক্রোশ এক নিমিষে ভুলে গিয়েছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির ক্ষেত্রে এরকমই একটা কিছু হয়েছিল। তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলেন।


স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতা করলেও স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু সমস্যা একটা থেকেই গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তারা যতদিনে বৃহস্পতির কাছে ফিরে এসেছেন ততদিনে তিনি গর্ভবতী। অনাগত এই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বৃহস্পতি বললেন আমার সন্তান। চন্দ্র বললেন আমার সন্তান। এদিকে তারা কিন্তু কিছুই বললেন না অথচ সন্তানের আসল পিতা কে, সেটা একমাত্র তারারই জানার কথা।

এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় তারার গর্ভস্থ সন্তানই বলে উঠল - আমি স্বামীর নই, প্রেমিকের সন্তান। সেই সন্তানের নাম দেয়া হবে বুধ।  বুধের সততা এবং এই বিশেষ ক্ষমতায় দেবতার বেশ চমৎকৃত হলেন। দেবতারা চমৎকৃত হলেও বৃহস্পতি নিজের ক্রোধ দমন করতে পারলেন না। তিনি অভিশাপ দিলেন - তারার গর্ভস্থ এই সন্তান লিঙ্গহীন হয়েই জন্মাবে- অর্থাৎ সে নারী ও হবে না, আবার পুরুষও হবে না। তাই হয়েছিল। এইজন্যে বুধকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যেরকম আমাদের সমাজে অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পোহাতে হয়। নিজের পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে সত্য কথা বলেই বুধ নিজের জন্যে এই বিপদটা ডেকে এনেছিল। সে চুপচাপ থাকলেই পারত। চাপের মুখে তারাই একসময় ক্র্যাক করত।  

এখানে আরেকটা গুরুতর বিষয় আছে। হেলেন এবং তারা কিছুটা তুলনীয় হলেও, বৃহস্পতি এবং মেনেলাউস একে অপরের সঙ্গে তুলনীয় নন। মেনেলাউস একজন রাজা ছিলেন—তাঁর চরিত্রে কিছু সহজাত ত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু বৃহস্পতি একজন ঋষি। তিনি অন্য কোনো নারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন, এমন কোনো খবর আমরা পুরাণে খুঁজে পাই না। আবার তিনি স্ত্রী তারাকে অনাদর করেছেন, সেরকম কোনো খবরও পুরাণ আমাদের দেয় না। তাহলে তারা চন্দ্রদেবের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কেন?

গোটা ব্যাপারটা কি কেবলই যৌনতা? যদি তাই হবে, তাহলে বৃহস্পতি অনুসূয়া নন। অনুসূয়া স্বামীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি এবং ভালোবাসার জন্য একজন সতী নারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি অনুসূয়া না হন, তাহলে তাঁকে পঞ্চকন্যাদের একজন হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হলো কেন? কেন একজন সাধারণ হিন্দু নারীকে এমন একজন নারীর কথা স্মরণ করতে হবে, যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলেন?
গল্পের ফাঁকফোঁকর: ছেলেমেয়েরা মা'কেই বেশি ভালোবাসে। -Guitar K Kanungo
Jan. 2, 2025 | category | views:56 | likes:2 | share: 2 | comments:0

অনেক অনেক বছর আগে ভাঙ্গাশ্বন নামের একজন রাজা ছিলেন।

আমি বুঝতে পারি না, আগেকার রাজাদের মধ্যে একশত সন্তান জন্ম দেবার কেন এতটা আকুতি। ভীষ্ম গান্ধার রাজ্যের রাজকন্যা গান্ধারীকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন, কারণ গান্ধারীর একশ সন্তান জন্ম দেবেন কিংবা দিতে পারবেন—এরকম একটা কথা বাজারে প্রচলিত ছিল। কুন্তীর ক্ষেত্রেও একশ সন্তান না হলেও একাধিক সন্তান যে তিনি জন্ম দিতে পারবেন, সেই সব সন্তান দেবতার ঔরসে জন্মাবে—এরকম একটা কথা প্রচলিত ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেটাই ঘটেছিল।

যাই হোক, মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন একশ সন্তান লাভের আশায় খুব ধুমধামের সঙ্গে একটি যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞে দেবতারা বেশ সন্তুষ্ট হলেন। ফলত অচিরেই তিনি একশ সন্তানের পিতা হলেন। তাঁর স্ত্রী একশ সন্তানের জন্ম দিলেন। যজ্ঞ করার সময় মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন একটা গুরুতর ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে আহুতি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর যজ্ঞের যারা পুরোহিত ছিলেন তারাও ভুলে গিয়েছিলেন মহারাজকে এই ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিতে।

ফলত, ইন্দ্র ভীষণ কুপিত হলেন। তিনি ভাঙ্গাশ্বনকে নারীতে রূপান্তরিত করলেন। এই নারীতে রূপান্তরিত হওয়া 'রানী' ভাঙ্গাশ্বনও একসময় একশ সন্তানের জন্ম দিলেন। এর ফলে একটা ইউনিক অবস্থার সৃষ্টি হল। রাণীর গর্ভে জন্ম নেওয়া একশ সন্তান তাঁকে বাবা বলে সম্বোধন করছে, আবার তাঁর নিজের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা তাঁকে মা বলে সম্বোধন করছে।

ভাঙ্গাশ্বন দুইশ সন্তান নিয়ে ভালোই ছিলেন, কিন্তু ইন্দ্রের সেটা সহ্য হল না। তিনি চেয়েছিলেন ভাঙ্গাশ্বন অশান্তিতে থাকুক। এই অবস্থায় ইন্দ্র আরো কুপিত হলেন। এবার তিনি দ্বিতীয় অভিশাপটি উচ্চারণ করলেন—এই দুইশ সন্তান নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই অভিশাপের কথা জানতে পেরে ভাঙ্গাশ্বন খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি রাজপুরোহিতদের ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, দেবরাজ ইন্দ্র কেন তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন।

কারণ জানতে পেরে তিনি আবারো যজ্ঞের আয়োজন করলেন এবং এবার যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দেবরাজ ইন্দ্রকে আহুতি দিলেন। ইন্দ্র সন্তুষ্ট হলেন, এদিকে দুইশ সন্তানের সবাই ততদিনে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, মারামারি করে মারা গেছে। মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন ইন্দ্রের কাছে আবেদন জানালেন তাঁর সন্তানদের বাঁচিয়ে দিতে।

ইন্দ্র সম্মত হলেন, কারণ তিনি ইতোমধ্যে যজ্ঞের আহুতিতে সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু তিনি একটা শর্ত দিলেন। ইন্দ্র বললেন—"মহারাজ, আমি আপনার একশ জন সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলব। আপনিই বলুন, আমি কাদের বাঁচিয়ে তুলব? যারা আপনাকে পিতা বলে সম্বোধন করে, তাদের বাঁচিয়ে তুলব, নাকি যারা আপনাকে মা বলে সম্বোধন করে, তাদের?"

মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন কালবিলম্ব না করেই উত্তর দিলেন—"প্রভু, আপনি যে সন্তানরা আমাকে মা বলে ডাকে, তাদেরকেই বাঁচিয়ে তুলুন। ছেলে-মেয়েরা তাদের মা'কেই বাবার চাইতে বেশি ভালোবাসে।"

দেবরাজ ইন্দ্র বললেন—"তবে তাই হোক।"

কিন্তু ইন্দ্রের অভিশাপের আরো একটা অংশ তখনো কার্যকর রয়ে গেছিল। মহারাজ ভাঙ্গাশ্বনকে নারীতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, তিনি তখনো তাই ছিলেন। এবার দেবরাজ ইন্দ্র জানতে চাইলেন ভাঙ্গাশ্বন লিঙ্গ পরিবর্তন করে আবারো পুরুষ হয়ে উঠতে চান কিনা। দেবরাজ ইন্দ্রকে অবাক করে দিয়ে ভাঙ্গাশ্বন নারীই থেকে যেতে চান। নারী হিসাবেই তিনি যৌনতাকে অনেক বেশি উপভোগ করেছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন পুরুষের তুলনায় নারী হিসাবেই যৌনতাকে বেশি মাত্রায় উপভোগ করলেন কিভাবে? তাঁর স্ত্রী তো পুরুষ হয়ে যাননি; তিনি তো নারীই ছিলেন। তাহলে কি তিনি অন্য পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হতেন? মহারাজ ভাঙ্গাশ্বনের কি তাহলে কোন হারেম ছিল, যেখানে কামকলায় নিপুণ কিছু পুরুষের সমারোহ ছিল? রাজ্য শাসনটাই বা তিনি করছিলেন কোন পরিচয়ে? রাজা হিসাবে না রানী হিসাবে? মহাভারতে মহামতি ভীষ্ম এই গল্পটি বলেছিলেন। তাঁকে এই প্রশ্নগুলো কেউ করেনি, এবং তিনিও এসব প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি।

গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে এরকম একটি গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিছুটা ভিন্নভাবে। টাইরেসিয়াস নামের এক ব্যক্তি ঘটনাক্রমে একজোড়া সঙ্গমকারী সাপের স্ত্রী সাপটিকে হত্যা করে এবং অভিশপ্ত হয়ে নিজে একজন মহিলাতে পরিণত হন। বহু বছর পরে, একজন মহিলা হিসাবে জীবনযাপন করে, সে একজোড়া সঙ্গমকারী সাপের পুরুষ সঙ্গীটাকে হত্যা করে। এবার সে একজন পুরুষে পরিণত হয়। অর্থাৎ টাইরেসিয়াস এমন একজন ব্যক্তি, যে কিনা নারী এবং পুরুষ দুইভাবেই জীবনযাপন করেছে।

এদিকে যৌন ক্রিয়ায় কে বেশি আনন্দ পায়—এই নিয়ে অলিম্পিয়ান দেবতাদের রাজা জিউস এবং রাণী হেরার মধ্যে একটি তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। জিউস এই বিতর্কের সমাধানের জন্য টাইরেসিয়াসকে সাক্ষী মানলেন। টাইরেসিয়াসকে জিজ্ঞাসা করা হল, যৌন ক্রিয়ায় কে বেশি আনন্দ পায়, পুরুষ না মহিলা? টাইরেসিয়াস উত্তর দিল—"মহিলা।" উত্তর শুনে জিউস হাসলেন, কিন্তু হেরা খুবই বিব্রত এবং ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি টাইরেসিয়াসকে অন্ধ হওয়ার জন্য অভিশাপ দেন।

যে গল্প আমাদের কখনো বলা হয় না। -Guitar K Kanungo
Jan. 1, 2025 | category | views:42 | likes:3 | share: 2 | comments:0

মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে হলেই যে সবকিছু ঠিকঠাক চলবে, এমন ভাবার কিছু নেই। নর্সদের প্রধান দেবতা ওডিনও কারো ভাগ্নে ছিলেন, অর্থাৎ তারও একজন মাতুল ছিল। সেই মাতুলের নাম মিমির। এই মিমির আবার সম্পর্কে ওডিনের মাতুল হলেও তিনি দেবতাদের শত্রুপক্ষই ছিলেন। মিমিরের একটা কুয়ো ছিল, টলটলে, শীতল জলে পুরিপুর্ণ, বিশেষ রকমের এক কুয়ো। এই কুয়ো থেকে কেউ এক ছিলিম জল পান করলে সে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে যেত। অনেকটা অমৃতের মত, যেটা পান করে হিন্দুদের দেবতাকূল অমর হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? মিমির কাউকেই এই কুয়ো থেকে বিন্দু জল তুলতে দিত না।

ওডিন সেটা জানত। ওডিন এটাও জানত, তিনি দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেও তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী নন; তাঁর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ। সেইজন্যেই তাঁর একদিন ইচ্ছে হল তিনি মিমিরের কুয়ো থেকে খানিকটা জল পান করে দেখবেন। সেই মোতাবেক মিমির যে এলাকায় বসবাস করতেন, সেই এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সেখানে যাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না, এমনকি ওডিনের জন্যেও, তবুও ওডিন হাল ছাড়লেন না। তিনি সেখানে হাজির হলেন।

ওডিন ছদ্ববেশেই এসেছিলেন। কিন্তু বোনের এই মহাপ্রতাশালী ছেলেটিকে মিমিরের চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না। ভাগ্নেকে দেখে একটু হাসলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। ওডিন জানতেন, মিমির কথা বলার চাইতে কথা না বলতেই বেশী পছন্দ করে।

"মামা! আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে চাই," ওডিন কোন ভনিতা না করেই বললেন।

মিমির দুপাশে মাথা নাড়লেন।

"কিন্তু আমি তো আপনার ভাগ্নে, তাই না? এটুকু আবদার আমি তো আপনার কাছে করতে পারি?"

"এই কুয়ো থেকে জল একমাত্র আমিই খেতে পারি, আর কেউ নয়," মিমির দৃঢ়কণ্ঠে বললেন।

ওডিন চাইলে জোর খাটাতে পারতেন। হাজার হোক তিনি দেবতাদের রাজা। তাঁর সেই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে সেই চিন্তা ওডিন বাতিল করে দিলেন। জ্ঞান গায়ের জোরে অর্জন করাবার জিনিস নয়। সত্যিকারের জ্ঞান বিনম্রতা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্জন করতে হয়।

হিন্দু পুরাণের একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অস্বথমা, আচার্য দ্রোণের পুত্র, এবং তিনি জানতেন তাঁর এই পুত্র অস্বথমা ব্রহ্মাস্ত্র ধরণের, অর্থাৎ এই অস্ত্রের জ্ঞান লাভের যোগ্য নন। সেইজন্যেই পুত্র হলেও তিনি এই জ্ঞান অস্বথমা কে দিতে চাইছিলেন না, কিন্তু অস্বথমা দ্রোণের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, তিনি পুত্রের চাইতে তাঁর একজন শিষ্যকে বেশি পছন্দ করেন। সেইজন্যে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান তাকে না দিয়ে, সেই শিষ্যকে দিয়েছেন। স্নেহবৎসল পিতা শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন পুত্র অস্বথমাকে। যোগ্যতার জোরে অর্জিত হয়নি যে জ্ঞান, অবধারিতভাবে সেই জ্ঞানের অপপ্রয়োগ হয়েছে, এবং অস্বথমা সেই কারণে ভয়ঙ্কর অভিশাপ কুড়িয়েছেন।

মহাভারতে ব্যাস কী বলেছেন ওডিনের সেট জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু জোর জবরদস্তি করতে চাইলেন না। মিমিরকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, "দেখুন মামা! আমি এতটা পথ আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে এসেছি। এর জন্য আমাকে যদি কোন মূল্য পরিশোধ করতে হয়, আমি সেই মূল্য দিতে রাজী।"

"তোমার একটা চোখ আমাকে দিয়ে দিতে হবে। যদি তুমি তাতে রাজী থাক, আমিও তোমাকে এই কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে দিতে রাজি আছি," মিমির নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন।

মিমির সত্যিই তাঁর চোখ চাইছে না, ভাগ্নে বলে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছে -  এই ভাবনাটাও ওডিন মাথায় আসতে দিলেন না। মিমিরের পৃথিবীতে আসতে গিয়েই ওডিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। জায়ান্টদের সঙ্গে দেবতাদের অনেক পুরোনো দিনের শত্রুতা। ভয়ঙ্কর শত্রুতা, বিশেষ করে ওডিন যাদের নেতৃত্ব দেন। সেই তুলনায় একটা চোখ তো কিছুই না। কুয়োর পারে একটা শামুকের খোল পড়ে ছিল। ওডিন সেই খোল দিয়ে তাঁর ডান চোখটা খুবলে বের করে মিমিরের হাতে তুলে দিলেন।

মিমির ওডিনের সেই চোখকে কুয়োর জলে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর বিশেষ এক শিঙ্গায় ভরে, ওডিনকে কুয়োর জল খেতে দিলেন। কুয়োর জল ঠান্ডা। ওডিন এক চুমুকে পুরো জলটা পান করলেন। তাঁর শরীরে জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় প্লাবিত হয়ে গেল। তাঁর মনে হল তিনি আগে এক চোখে যা দেখতে পেতেন তার চাইতে অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছেন। ওডিন শারীরিকভাবে একটি চোখ হারালেও তিনি আরো বেশী চক্ষুষ্মান বা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন  হয়ে উঠলেন।

মহাভারত অনুসারে হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও তাঁকে চক্ষুষ্মান বলা হত কারণ তার অন্তর্দৃষ্টি বা মানসিক জ্ঞান দৃষ্টিমানদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তিনি অন্ধ ছিলেন জন্মগতভাবে। দৃষ্টিহীনতার কারণে তিনি শারীরিকভাবে কিছু দেখতে না পারলেও তার মনের দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তিনি এমন কিছু দেখতে পেতেন যা অন্যরা দেখতে পেত না।

নর্স পুরাণ অনুসারে মিমিরের কুয়োর জল পান করার মাধ্যমে ওডিন বিশ্বসংসারের গভীর সত্য রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। দেবতাদের রাজা এবং মানুষের স্রষ্টা হিসাবে সফল হবার জন্যে তাঁর এই বাড়তি জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। ফলে, দৃষ্টির বাইরের যে জ্ঞান, যেমন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান, প্রকৃতির গভীর তাৎপর্য ইত্যাদিএসবের প্রতি তার উপলব্ধি বৃদ্ধি পায়। ওডিনের এই ত্যাগকে জ্ঞানের জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, যেখানে শারীরিক ক্ষতি সত্ত্বেও তার মানসিক আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল

যে গল্প আমরা কখনোই বলি না। -Guitar K Kanungo
Dec. 30, 2024 | category | views:112 | likes:4 | share: 2 | comments:0

ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম: ইসলামের নবী মুহাম্মদ যে পথ দিয়ে চলাফেরা করতেন, এক দুষ্টু বুড়ি সেই পথে অসংখ্য কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। বোঝাই যাচ্ছে, সেই বুড়ি মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন না। তবে কেন তিনি মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন না, সেই কারণটা অবশ্য খোলাসা করে বলা হয়নি। যাই হোক, মুহাম্মদ কাঁটা সরিয়েই সে পথ দিয়ে অতি সাবধানে চলাফেরা করতেন।

একদিন মুহাম্মদ পথ চলতে গিয়ে দেখতে পেলেন, সে পথে কোনো কাঁটা বিছানো নেই। তিনি বেশ অবাক হলেন। পরের দিনও একই ঘটনা ঘটল। এইভাবে কয়েক দিন পরপর একই ঘটনা ঘটার পর মুহাম্মদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন, "বুড়ি মরেটরে গেল না তো!" তিনি খোঁজ নিয়ে বুড়ির বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বুড়ি সত্যিই অসুস্থশয্যাশায়ী। কিন্তু বুড়ি মুহাম্মদকে তাঁর বাড়িতে দেখে খুবই অবাক হলেন। যার ক্ষতি করার জন্য তিনি এত ব্যস্ত ছিলেন, সেই মুহাম্মদ আজ তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে দেখতে এসেছেন ! সেইদিন থেকে বুড়ি মুহাম্মদের প্রতি তাঁর যে হিংসা ছিল, তা পরিত্যাগ করলেন।

এই গল্পে যে বুড়ির কথা বলা হয়েছে, তাঁর নির্দিষ্ট কোনো নাম বলা হয়নি। আগেই বলেছি, এটি ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের জীবন থেকে নেওয়া একটি জনপ্রিয় ঘটনা। মুহাম্মদ যে কতটা সহনশীল এবং ক্ষমাশীল ছিলেন, সেটা তুলে ধরার জন্যই সাধারণত এই গল্পটি বলা হয়। কিন্তু যেহেতু বুড়ির নামের কোনো উল্লেখ নেই, সেহেতু এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, নাকি পুরো ব্যাপারটা কারও কল্পনাপ্রসূত, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের ঘিরে নানা ধরনের কল্পকাহিনী গড়ে ওঠার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ধর্মপ্রচারকদের ক্ষেত্রে সেই মাত্রা আরো অনেক বেশি, যেহেতু এখানে অলৌকিকতার সংমিশ্রণের সুযোগও থাকে।

তবে ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা আছে, যেখানে মুহাম্মদকে খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং যিনি এই কাজটি করেছিলেন, তাঁর নামও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর নাম জয়নাব বিনতে আল হারিথ। আমাদের অনেকেরই হয়তো এই নামটির সঙ্গে পরিচিত নই। খাইবার যুদ্ধের পরপরই এই ইহুদি রমণী মুহাম্মদকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ঘটনাটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক, কারণ সেই সময় মুহাম্মদ একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা সহজ কথা নয়।

জয়নাব বিনতে আল হারিথ এবং তাঁর পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে খাইবার অঞ্চলে বসবাস করে আসছিলেন। তাঁরা মূলত ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জয়নাব ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে ছয় শতাধিক নাদির বংশের ইহুদি খাইবারে এসে বসবাস শুরু করে। এরা মুসলমানদের দ্বারা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে বসবাস করেছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সালাম ইব্ন আল নাদিরি, যার সঙ্গে জয়নাব পরবর্তীতে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলমানেরা খাইবার অবরোধ করে। এই যুদ্ধে মুসলমানদের আলী বিন তালিব যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দেন। উনিশ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রথম নয় দিনেই জয়নাব তাঁর স্বামী, পিতা, এবং ভাই, সবাইকে হারান। পরবর্তী দশ দিনে যুদ্ধ বিশেষ কিছু হয়নি, কিন্তু অবরোধ বলবৎ ছিল। মুসলমান বাহিনী বাইরে থেকে সমস্ত পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এমন অবস্থায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে কয়েকজন আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে মুহাম্মদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসে। 

আলোচনার এক ফাঁকে জয়নাব জেনে নেন, মুহাম্মদের প্রিয় খাবার কী। জয়নাব যখন জানতে পারলেন, ভেড়ার ঘাড়ের মাংস মুহাম্মদের বিশেষ পছন্দের, তখন তিনি তাঁর ভেড়ার পাল থেকে একটা ভেড়া মেরে তার কাঁধের মাংসে ভালো করে বিষ মাখিয়ে সেটাকে রোস্ট করলেন। আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারণের আলোচনা শেষ হতেই জয়নাব বিষ মাখানো ভেড়ার রোস্ট উপহার হিসেবে মুহাম্মদের সামনে হাজির করলেন।

মুহাম্মদ সামনে রাখা ভেড়ার মাংস থেকে ছোট্ট একটা টুকরো মুখে দিলেন। এদিকে, মুহাম্মদের এক সঙ্গী কিছুটা মাংস চিবিয়ে গিলেও ফেললেন। মুহাম্মদ মাংসটা না গিলে মুখ থেকে ফেলে দিলেন। তারপর বললেন, "এই মাংসে বিষ মেশানো হয়েছে।" এদিকে যিনি মাংসের কিছু অংশ গিলে ফেলেছিলেন, তাঁর মধ্যে বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করল। তিনি উঠে দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না; তাঁর মুখের রং বদলে যেতে থাকল। বিষ মেশানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে একজন একটি মাংসের টুকরো অদূরে অপেক্ষমাণ এক কুকুরকে খেতে দিলেন। মাংস খাওয়ার পরপরই কুকুরটি মারা গেল। উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল, খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে।

মুহাম্মদ জয়নাবকে ডেকে পাঠালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি এই খাবারে বিষ মিশিয়েছ?" জয়নাব বললেন, "জ্বি, মিশিয়েছি।" মুহাম্মদ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "কেন করলে এই কাজটা?" জয়নাব দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, "আমি আপনাকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছি। আপনি আমার কাছ থেকে আমার পিতাকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার গোত্রের অন্য মানুষদেরও কেড়ে নিয়েছেন। আমি আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছি। আমি ভেবেছি, আপনি যদি সত্যিই একজন নবী হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিষ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিষ আপনাকে হত্যা করবে।" মুহাম্মদ জয়নাবের যুক্তিকে অস্বীকার করতে পারলেন না, প্রকাশ্যে কেবল এইটুকু বললেন, "আল্লাহ সেটা অনুমোদন করবেন না।"

উপস্থিত মুসলমানেরা জয়নাবের ওপর ক্ষিপ্ত হলেও, মুহাম্মদ তাঁকে হত্যা করার অনুমতি দিলেন না। জয়নাব ফিরে গেলেন। মুহাম্মদ তাঁকে ক্ষমা করলেও জয়নাবের জীবন খুব দীর্ঘায়িত হয়নি। মুহাম্মদের সেই সঙ্গী, যিনি বিষ মাখানো মাংস খেয়েছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যে মারা যান। অবশ্য মৃত্যুর আগের সময়টুকু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েই কাটিয়েছিলেন। বশির আল-বারার মৃত্যুর পর জয়নাবকে তাঁর আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রক্তের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারা জয়নাবকে হত্যা করে। 

শুরুতে যে বুড়ির কথা বলেছিলাম, মুহাম্মদ যেমন তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন, তেমনি জয়নাব বিনতে আল হারিথকেও ক্ষমা করেছিলেন, যদিও জয়নাবের অপরাধ ছিল আরও গুরুতর। ফলত এই গল্পটাও তাঁর মহানুভবতার আরও বড় নিদর্শন হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। আমাদেরকে বারবার সেই বুড়ির গল্পই শোনানো হয়েছে। কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মুহাম্মদের অসুস্থতার মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মুহাম্মদের অসুস্থতার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল এই বিষক্রিয়া। মুহাম্মদ বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন; তিনি বিষ মেশানো মাংসটা গিলে না ফেললেও, বিষের কিছুটা লালার মাধ্যমে তাঁর শরীরে প্রবেশ করেছিল। মৃত্যুশয্যায় মুহাম্মদ প্রায়শই তাঁর জিহ্বা পুড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন। বিভিন্ন উৎস কথা নিশ্চিত করলেও, জয়নাবের বিষপ্রয়োগের ফলেই তাঁর ধরনের শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছিল কিনা, তা বলা মুশকিল। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে জয়নাব নবীত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, আর সেই সন্দেহের একরকম ভিত্তি তৈরি হয়। এই সন্দেহটা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তা তাঁর অনুসারীরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমার ধারণা, এই কারণেই আমাদের এই গল্পটা শোনানো হয়নি। সেই তুলনায় কাঁটা বিছানো পথ আর বুড়ির গল্প অনেক নিরাপদ।

 

গল্পের ফাঁকফোঁকর : অসম প্রেমের পরিণাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়োগান্তকই হয়েছে। -Guitar K Kanungo
Dec. 28, 2024 | category | views:61 | likes:3 | share: 2 | comments:0

হিন্দু পুরাণের সঙ্গে গ্রীক পুরাণের একটা অদ্ভুত মিল আছে। এই দুই পুরাণেই অমর দেবতাদের সঙ্গে মরণশীল মানুষের বেশ কিছু যৌন মিলনের ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেবতারাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, মরণশীল মানব বা মানবীর তাদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে একজন মানব একজন মানবীতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মহাভারতে নল-দময়ন্তীর কথা বলা হয়েছে; একইভাবে ইলিয়াডে বলা হয়েছে ওডিসিউস এবং পেনেলোপের কথাও।

রামায়ণ এবং মহাভারতে অজস্র উদাহরণ আছে। রামায়ণ দিয়েই শুরু করি। ঋষি বিশ্বামিত্র মেনকা নামের এক অপ্সরার সঙ্গে মিলিত হলেন। অপ্সরারা স্বর্গ-বেশ্যা; তাঁর সুন্দরী হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বিশ্বামিত্রের কাছে এই গোটা ব্যাপারটা ছিল একটি ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। মিলনের পর তিনি তাঁর নিজের পথে চলে গেলেন, আর মেনকাও সন্তান জন্ম দিয়ে তাঁর নিজের পথে, অর্থাৎ স্বর্গে ফিরে গেলেন। এদের মিলনের ফলে যে সন্তানটির জন্ম হলো, তিনি ভুবনবিখ্যাত—তাঁর নাম শকুন্তলা। এই শকুন্তলা এবং দুষ্মন্তের সন্তান ভরতের নামেই আমাদের ভারতবর্ষের নামকরণ হয়েছে।

আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে অপ্সরারা মর্ত্যভূমিতে থেকে গেছেন এবং একেবারে ঘর-সংসার করেছেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে নির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত। অপ্সরা উর্বশীর কথাই ধরা যাক। তিনি কুরুবংশের পূর্বপুরুষ রাজা পুরুরুবার প্রেমে পড়ে স্বর্গভূমি ছেড়ে এসেছিলেন। তবে এই ছেড়ে আসার একটি শর্ত ছিল, এবং সেই শর্তভঙ্গ হওয়ার কারণে তিনি আবার পুরুরুবাকে ছেড়ে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। তাদের মিলনের ফলে আয়ু নামের এক সন্তানের জন্ম হয়, যিনি উপযুক্ত সময়ে পুরুরুবার স্থলাভিষিক্ত হন।

পিতামহ ভীষ্মের পিতা শান্তনুর ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। ভীষ্মের জননী গঙ্গা সাধারণ মানবী ছিলেন না; তবে তিনি অপ্সরাও ছিলেন না। দেবী গঙ্গা শর্তসাপেক্ষে মহারাজ শান্তনুর ঘরণী হতে সম্মত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও একটি শর্ত ছিল—দেবী গঙ্গা তাঁর কোনো কাজের জন্য কাউকে, এমনকি মহারাজ শান্তনুকেও, জবাবদিহি করবেন না। এই শর্ত ভঙ্গ হলে তিনি শান্তনুকে ছেড়ে চলে যাবেন। দেবব্রতের জন্মের আগে গঙ্গার গর্ভে সাতটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল, যাদের প্রত্যেককে তিনি নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। কেন তিনি এমন নিষ্ঠুর কাজ বারবার করে চলেছেন, এই প্রশ্ন তুলেই মহারাজ শান্তনু শর্ত ভঙ্গ করেছিলেন, যার ফলে দেবী গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আমরা যাকে উষা বলি, গ্রীকরা সেই ঊষাকে এওস নামে ডাকে। দেবী এওস ট্রোজান রাজকুমার টিথোনাসের প্রেমে পড়ে যান। প্রেমে পড়ারই কথা, কারণ টিথোনাস ছিলেন যেমন স্বাস্থ্যবান, তেমন সুদর্শন। সৌন্দর্যের বিচারে দেবী এওসও কম যান না। অতএব, চার চক্ষুর মিলন হলো। কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই গেল। এওস দেবী, কিন্তু টিথোনাস মরণশীল মানুষ। এই সমস্যার সমাধান করতে দেবী এওস দেবরাজ জিউসের কাছে হাজির হয়ে টিথোনাসকে অমর করে দেওয়ার আবেদন জানালেন। দেবরাজ জিউস নিজেও অনেক মানবীর প্রেমে পড়েছেন, অতএব তিনি এওসের অনুভূতিটা বুঝতে পারলেন। এওসের আবেদন মঞ্জুর হলো। কিন্তু এখানেই একটা বিপত্তি ঘটল। কী বিপত্তি ঘটল, সেটা একটু পরে বলছি। তার আগে আরেকটি ঘটনার কথা বলে নিই।

এলসিমেনে ছিলেন তিরিনসের রাজকুমার এমফিতরাইয়োর স্ত্রী। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। দেবরাজ জিউসের বেশ ভালো লেগে গেল এলসিমেনেকে। রূপবতী নারী দেখলেই জিউসের ভালো লাগে। রাজকুমার এমফিতরাইয়ো যখন অন্যত্র যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, তখন জিউস এমফিতরাইয়োর রূপ ধারণ করে এলসিমেনের কাছে হাজির হলেন। এলসিমেনে ধরে নিয়েছিলেন স্বামী যুদ্ধ থেকে ফিরেছেন, এমফিতরাইয়োর কোনো আচরণ তাঁর মনে কোনো রকমের সন্দেহের উদ্রেক করেনি। যথাসময়ে তাঁরা মিলিত হলেন। এই ঘটনার সঙ্গে ইন্দ্র এবং অহল্যার মধ্যকার ঘটনার বেশ মিল আছে, একটি ব্যাপার ছাড়া। এলসিমেনে মানবগর্ভজাত হলেও অহল্যাকে অনেকটা প্যান্ডোরার সঙ্গে তুলনা করা চলে—যাঁকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানবী করে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।

এলসিমেনের ক্ষেত্রে না ঘটলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, দুই পুরাণেই এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি ভালো হয়নি, সেকথাই বলা হয়েছে। জিউস তাঁর যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য মর্ত্যের নারীদের পেছনে ঘোরাঘুরি করলেও এবং এই সমস্ত মিলনের ফলে কখনো কখনো ভুবনখ্যাত সন্তানের জন্ম হলেও (এলসিমেনে যে সন্তানের জন্ম দেবেন, তার নাম হারকিউলিস, যিনি অনেক অসাধ্য সাধন করবেন এবং নিজের যোগ্যতায় দেবতার পদমর্যাদা লাভ করবেন), অনেক ক্ষেত্রে জিউসের লালসার শিকার সেই নারীদের জিউসের স্ত্রী হেরার আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে।

দেবী এওস এবং টিথোনাসের কথা আগেই বলেছি। এওস টিথোনাসকে অমরত্ব দিলেও চিরযৌবনের অধিকারী করার আবেদন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে এওস যৌবনবতী থেকে গেলেও টিথোনাস এক পর্যায়ে বুড়িয়ে যেতে শুরু করেন। শরীরের আবেদন ফুরিয়ে যেতেই প্রেমেরও সেখানে সমাপ্তি ঘটে।

হিন্দু পুরাণের ঘটনাগুলোও তেমন। ইন্দ্র এবং অহল্যার মিলনের ফলে হারকিউলিসের মতো কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি, বরং দুজনেই অভিশাপ কুড়িয়েছেন। অহল্যা ইন্দ্র দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, এমন দাবি করলেও তাঁর স্বামী গৌতম অহল্যার কথা বিশ্বাস করেননি। এদিকে, ইন্দ্র তো হাতেনাতেই ধরা পড়েছিলেন। অপকর্মের দায় থেকে মুক্তি না পেয়ে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। ইন্দ্র যেহেতু দেবতা, দেবতাদের রাজা, সেহেতু গৌতমের অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও অহল্যাকে রূপ-যৌবন হারিয়ে পাথর হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল হাজার বছর।

উর্বশী পুরুরুবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, একই কাজ করেছিলেন গঙ্গাও। তিনি শুধু চলেই যাননি, তাঁর গর্ভজাত সব সন্তানকেও নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেবব্রতকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বামিত্র এবং মেনকার ক্ষেত্রে। শকুন্তলাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন মেনকা। বিশ্বামিত্র জানতেনই না যে তাঁর একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। কণ্ব মুনি সেই মেয়েকে কুড়িয়ে পেয়ে বড় করে তুললেও দুর্ভাগ্য শকুন্তলার পিছু ছাড়েনি। রাজরানী হওয়া সত্ত্বেও রাজপাঠে বসার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। উল্টো, সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে।

দেবতা ও মানুষের এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি প্রায় সবক্ষেত্রেই বিপর্যয়মূলক হলেও, এই প্রেম থামেনি। দুই পুরাণে যেসব ঘটনা এখানে আলোচনা করা হয়েছে, এর বাইরেও অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোকেও ধর্ষণ বলা চলে। গ্রিক দেবতা পোসাইডন মেডুসার সঙ্গে যা করেছেন, সেটাকে ধর্ষণই  বলতে হবে। মুশকিলের ব্যাপার হলো, ধর্ষিতা হয়েও ধর্ষণের দায়টা ধর্ষিতাকেই নিতে হয়েছে। মেডুসা তার উদাহরণ। এথেনা মেডুসাকে অভিশাপ দিলেও পোসাইডনকে কোনো শাস্তি দেননি। হয়তো এথেনার ক্ষমতা ছিল না পোসাইডনকে শাস্তি দেওয়ার।

সুখের কথা, হিন্দু পুরাণে ধর্ষণের শাস্তি দুপক্ষকেই ভোগ করতে হয়েছে। অহল্যা এবং ইন্দ্রের ক্ষেত্রে, সহজভাবে চিন্তা করলে অহল্যা ধর্ষিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে ইন্দ্র একজন ধর্ষক। আবার একটু জটিলভাবে ভাবলে দেখা যায়, অহল্যা তাঁর যৌন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলত, তিনি ইন্দ্রকে কামনা করেছেন। তবুও ইন্দ্র অপরাধ করেছেন, কারণ তিনি নিজে বিবাহিত এবং যাঁর কামনা পূরণ করতে গেছেন, তিনিও বিবাহিত। অতএব, শাস্তি ইন্দ্রকেও পেতে হয়েছে।  পোসাইডনের মত ইন্দ্র পার পেয়ে যাননি ; শাস্তির মাত্রা কমাতে তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।    




ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর : পুত্রের জন্য পিতার জীবনদান। -Guitar K Kanungo
Dec. 27, 2024 | category | views:174 | likes:3 | share: 3 | comments:0

সম্রাট হলেও তিনি যে একজন স্নেহময় পিতা এই ব্যাপারটা প্রমান করেছিলেন মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। সম্রাট তখন দিল্লীতে, কিছুটা অসুস্থ বোধ করছেন। দিল্লীর আবহাওয়া এমনিতেই বিশেষ রকমের অস্বস্তিকর, বিশেষ করে সেই সম্রাটের জন্য, যিনি তাঁর জীবনের চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন ফারগানা, সমরখন্দ এবং কাবুলের মত তুলনামূলক শীতল জায়গায়।


বাবুরের পুত্র হুমায়ুন তখন সাম্রাজ্যের আরেক প্রান্ত কাবুলে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানকার শাসনকর্তা। পিতার অসুস্স্থতার খবর শুনে তিনি সম্রাটের পূর্বানুমতি না নিয়েই দিল্লী এসে উপস্থিত হলেন। বাবুর হুমায়ূনের এইভাবে কাবুল ত্যাগ করে দিল্লিতে এসে হাজির হওয়াটা ঠিক পছন্দ করতে পারলেন না। তাঁর আশংকা ছিল হুমায়ুনের অনুপস্থিতে কাবুলের মসনদ অন্যের দখলে চলে যেতে পারে। বাবুর হুমায়ূনকে অবিলম্বে কাবুল ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।

হুমায়ূনের পিতার নির্দেশ না মেনে কোন উপায় ছিল না। তিনি দিল্লী থেকে কাবুলের উদেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। দিল্লী থেকে কাবুলের দূরত্ব প্রায় একহাজার কিলোমিটার; এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সেইসময় প্রায় মাসখানেক সময় লাগত। যাই হোক, আগ্রা পৌঁছাতে না পৌঁছাতে এবার হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিল্লী থেকে আগ্রার দূরত্ব প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার। তখনকার দিনে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পাঁচ থেকে ছয়দিন সময় লেগে যেত। হুমায়ুনের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকল।  একপর্যায়ে এতটাই অবনতি হল যে আগ্রা থেকে দিল্লীতে খবর পাঠানো হল যেন সম্রাজ্ঞী মাহাম বেগমকে আগ্রায় পাঠানো হয়। পুত্রের এই পর্যায়ের অসুস্থতার খবর শুনে সম্রাজ্ঞী তো বটেই, সম্রাট বাবুর নিজেও অবিলম্বে আগ্রা এসে পৌঁছালেন।

তারপর সেই ইতিহাস-বিখ্যাত ঘটনাটা ঘঠল। প্রচলিত সব রকমের চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করার পরও হুমায়ূনের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হল না। সম্রাট বাবুর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর জীবনের বিনিময়ে তাঁর পুত্রের জীবন ভিক্ষা চেয়ে প্রার্থনা করলেন। তখন সম্রাট বাবুরের বয়স তখনো পঞ্চাশও হয়নি ;  নিজের প্রাণ উৎসর্গ করবার মত বয়স সেটা মোটেও নয়। প্রাচীন ভারতের আরেক রাজা যযাতির মত জীবনকে আরো অনেকটা সময় ধরে উপভোগ করার প্রয়োজনে সন্তানদের সঙ্গে নিজের জরা বিনিময় করার বদলে সন্তানের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছেন। 

ইতিহাস বলছে ঈশ্বর বাবুরের সেই আবেদন গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত কার্যত সেরকমই ঘটতে দেখা গেছে। ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে বাবুর ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকবেন। বিপ্রতীপ এই দুটি ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদৈ কোন ভূমিকা আছে কিনা সেটা বলা মুশকিল, যদিও বাবুরের জীবনীকারেরা ব্যাপারটাকে সেভাবেই দেখতে চেষ্ঠা এবং দেখাতে করেছেন। গোটা ব্যাপারটাকে একটা অধ্যাত্বিকতার মোড়কে মুড়ে সম্রাটকে একজন অত্যন্ত নিষ্টাবান এবং ধার্মিক পুরুষ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা।    

হতে পারে গোটা ব্যাপরটা একটা কাকতাল মাত্র। হুমায়ুন কিছুটা দেরীতে হলেও যে সমস্ত ঔষুধ তাঁকে দেয়া হয়েছিল, সেইসব ঔষুধে সাড়া দিতে শুরু করেছিলেন । অন্যদিকে বাবুর নিজে যে খুব একটা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন সেকথা বলা যাবে না। তিনি যথেষ্ঠ পরিমানে সূরাসক্ত ছিলেন। তাঁর নিশ্চয়ই কোন শারীরিক সমস্যা ছিল  একমাত্র উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেলার যে একটা তীব্র উৎকণ্ঠা সেটা হয়ত তাঁকে শারীরিকভাবে আরো অসুস্থ করে তুলতে পারে।         

বাবুর এবং হুমায়ূনের মধ্যকার এই ঘটনার মধ্যে যে কোন অলৌকিকতা নেই, কোন অধ্যাত্বিকতার লেশমাত্র নেই, সেটা বোঝার জন্য আমাদের সময়ের পরিক্রমায় হাজারখানেক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা  মুহাম্মদের পুত্র ইব্রাহীম অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী। হুমায়ূনের মত মুহাম্মদও একজন পিতা হিসেবে আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তানের জীবন ভিক্ষা করেছিলেন;  কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি । 

ইব্রাহীম বিন মুহাম্মদ মাত্র দুইবছর বয়সেই মৃত্যু বরণ করবে এবং তাঁর অল্পকয়েক দিন পরেই তার পিতা মুহাম্মদেরও মৃত্যু হবে। ঈশ্বর চাইলেই হুমায়ূনের মত ইব্রাহীমের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতেন, তার  পিতা মুহাম্মদের জীবনের বিনিময়ে। আল্লাহ স্বয়ং যাকে মনোনীত করেছেন নবী হিসাবে, সেই মুহাম্মদের আবেদনই যেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেখানে বাবুরের আবেদন গৃহীত হয়েছিল এমনকরে ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই।

 


গল্পের ফাঁকফোঁকর : বিভীষনকে চিরঞ্জিবী হবার বর দিয়ে রামচন্দ্র বুদ্ধির পরিচয় দেননি। -Guitar K Kanungo
Dec. 26, 2024 | category | views:59 | likes:2 | share: 3 | comments:0

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, সাতজন চিরঞ্জীবী আছেন, অর্থাৎ এরা মৃত্যুকে জয় করেছেন। পুরাকালে অনেক অসুর এটাই চেয়েছিলেন, অবশ্য সঙ্গে কিছুটা শক্তিও, কিন্তু বিধাতা পুরুষ তাদের একজনকেও চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে দেননি। তিন বিধাতার মধ্যে যিনি সবচাইতে ভোলাভালা বলে পরিচিত, সেই ভোলানাথকেও অসুরেরা ভোলাতে পারেনি। অথচ এমন নয় যে তপস্যার জোর এদের কিছু কম ছিল।

ঈশ্বরের কাছে সব সৃষ্টিই সমান—সুর কিংবা অসুর। তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে 'ডিস্ক্রিমিনেট' করবেন, এমন ভাবার সুযোগ নেই। তাই ধরে নিতে হবে, অসুরদের চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে না দেবার পেছনে একটা শক্ত কোনো কারণ রয়েছে। যে সমস্ত অসুর অমরত্বের বর পেয়েও মৃত্যুকে এড়াতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বরের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারা সম্ভব না হলেও, আমরা কারণটা অনুমান করতে পারি। এটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ; জন্মিলে মরিতে হইবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। স্বয়ং ঈশ্বরও এই নিয়মের অধীন।

যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বর পরশুরাম, বিভীষণ, ব্যাস, বালী এবং হনুমানের ক্ষেত্রে প্রকৃতির এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে দিলেন কেন, যেখানে তিনি নিজেই বলছেন তিনি প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ? কিংবা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা অথবা আচার্য কৃপের ক্ষেত্রে? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এবং সেই প্রশ্ন আমি তুলতে চাইছি এখানে, কারণ এই প্রশ্ন তোলার একটা অত্যন্ত গুরুতর কারণও আছে—আর সেটা হচ্ছে মোক্ষলাভের প্রসঙ্গ। প্রতিটি মানুষের মোক্ষলাভের অধিকার হিন্দু ধর্মে স্বীকৃত।

দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) চিরঞ্জীবী হতে চাননি। শাস্তি হিসাবে তাদের এই দুর্ভাগ্যকে বরণ করতে হয়েছে। অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছিলেন। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রথমে পাণ্ডবদের পাঁচ সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, যে সন্তানটি তখনো অনাগত, অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভের সেই সন্তানটিকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই অপরাধ অত্যন্ত গর্হিত এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য।

অভিশাপ কুড়োবার মতোই অপরাধ ছিল। বাসুদেব কৃষ্ণ, যিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তিনি অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) কে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে তারা অনন্তকাল ধরে এই অপকর্মের অপরাধবোধ বয়ে বেড়াবে। শুধু তাই নয়, তারা অসহনীয় দুঃখ এবং কষ্টের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াবে। তাদের ঘৃণ্য অপরাধের কথা সবাই মনে রাখবে, এবং সেইজন্যই তারা কোথাও কারো কাছে দু'দণ্ড আশ্রয় পাবে না। দুঃখ, কষ্ট আর একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুকে হাজার ডাকলেও, মৃত্যু তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে না। মোক্ষ লাভের প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। 

এটুকু পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন, এবং সেই শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করেছেন; তিনি সেটা করতেই পারেন, যেহেতু তিনি স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। গোলমালটা বাঁধে যখন আমরা হনুমান (এবং বিভীষণ) কে চিরঞ্জীবী হতে দেখি। একই প্রশ্ন বালী এবং পরশুরামের ক্ষেত্রেও উঠবে, কিন্তু তাঁরা যেহেতু ঈশ্বরেরই অবতার, এই আলোচনা থেকে তাঁদেরকে বাদ দিলাম, কারণ অনেকেই হয়তো বলবেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য তাঁদের সর্বকালীন উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। যদিও তাঁদের সেরকম কোনো উপস্থিতি কোথাও ঠিক চোখে পড়ছে না, অথচ পৃথিবীতে অনাচার, অবিচার অবিরাম ঘটেই চলেছে।

কিন্তু হনুমান এবং বিভীষণের চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার কী প্রয়োজন ছিল বা এখনো আছে, সেই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। দুজনেই ভগবান বিষ্ণুর আরেক অবতার শ্রীরামচন্দ্রের কাছ থেকে অমরত্বের বর পেয়েছেন। এটা যেহেতু বর, এবং অশ্বত্থামার মতো তাঁদের মনে কোনো অপরাধবোধও নেই, অনুমান করা যেতে পারে যে তাঁরা তাঁদের পছন্দমাফিক জায়গায় অবস্থান করছেন, এবং জরা-ব্যাধি এসবের কোনো কিছুই তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি।

এরপরেও কি তাঁরা ভালো আছেন? একাকীত্বের বোঝা তাঁরা ঠিকঠাক বইতে পারছেন তো?  ওয়াশিংটনের আরভিঙের রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের গল্পটা  এখানে প্রাসঙ্গিক। অদ্ভুদ কিছু মানুষের পাল্লায় পড়ে, তাদের দেয়া পানীয় থেকে কয়েক যুগ ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে যখন রিপ ভ্যান উইঙ্কেল বাড়িতে ফিরে এলেন, ততদিনে তাঁর গ্রামের সবকিছু বদলে গেছে। ভাগ্যিস তাঁর ছোট্ট মেয়েটা যে কিনা ততদিনে অনেকে বড় হয়ে গেছে, সে রিপকে চিনতে পেরেছিল। ভাগ্যিস চিনতে পেরেছিল ! বাকী জীবনটা রিপ ভ্যান উইংকেল নাতি-নাতিনীদের গল্প শুনিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। কী ঘটছে হনূমান আর বিভীষণের বেলায় ? হনুমান তবু দুচারটে মন্দিরে পূজিত হন, এর কোন একটায় গিয়ে আশ্রয় নিলে দুচারজন ভক্তের কথাবার্তা তিনি হয়তো শুনতে পান, তাঁর অসীম একাকীত্বের কিছুটা হলেও কেটে যায়। কিন্তু বিভীষণ কী করছেন? এখন তো সেই রামও নেই, সেই লঙ্কাও নেই!

বর নামে চালানো হলেও গোটা ব্যাপারটা তাঁদের জন্য এক অর্থে অভিশাপ হয়ে গেল না? কী মূল্য আছে এই অর্থহীন বেঁচে থাকার? বিশেষ করে যদি বিভীষণের কথা বলি। লঙ্কার যে অবস্থা—কেউ বলে আজকের শ্রীলঙ্কা, আবার কেউ বলে আজকের মালদ্বীপ—রাবণের শ্রীলঙ্কা ! দুটি দেশের কোনো একটি বিশেষ ভালো অবস্থায় নেই। শ্রীলঙ্কা মাত্র কিছুদিন আগে অনেক কষ্টে দেউলিয়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে, মালদ্বীপের লোকজন মাছ ধরেই দিন কাটায়। সেটাও কতদিন করতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে—এই দ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেকোনো সময় পানির নিচে চলে যেতে পারে। আমার তো ধারণা, সুযোগ থাকলে অন্তত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এবং বিভীষণ এতদিনে মানুষের আদালতে ইচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করতেন।

শ্রীরামচন্দ্র যে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছেন, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, আসলে শ্রীরামচন্দ্র দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণে প্রকারান্তরে বিভীষণকে শাস্তিই দিয়েছেন, অশ্বত্থামার আদলে? দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছোট কোনো অপরাধ নয়। বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই অনেক মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে। সোনার লঙ্কা ট্রয় নগরীর মতো ধ্বংস হয়ে গেছে। হতে পারে, কিন্তু হনুমান এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের ক্ষেত্রে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার কারণটা কী ? এদের দুজন মোটাদাগে কোন অপরাধ করছেন, এমন কথা তো কোথাও চোখে পড়ে নি, অন্তত হনুমানের ক্ষেত্রে তো নয়ই ! নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদন করতে গিয়ে ব্যস, যদি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখি, তাহলে কিছুটা যৌন-বিকৃতির পরিচয় দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করা চলে না। তাহলে? চিরঞ্জীবিদের  চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার এই গোটা ব্যাপরটাই আসলে কেমন যেন গোলমেলে   


গল্পের ফাঁকফোঁকর : নরাণাং মাতুলক্রম। -Guitar K Kanungo
Dec. 23, 2024 | category | views:65 | likes:5 | share: 2 | comments:0
সংস্কৃতে একটা কথা আছে - "নরাণাং মাতুলক্রম," অর্থাৎ মানুষ মাতুলদের প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ভাগ্নেদের মধ্যে মামাদের স্বভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। এই শব্দ যুগল প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল মহাভারতে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি নকুল ও সহদেবের মামা শল্যকে নিরুৎসাহিত করতে কর্ণ বিদ্রূপভরে এই উক্তি করেছিলেন। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালে বিরাটরাজের আশ্রয়ে প্রথম তিন ভাই উচ্চপদ পেলেও, নকুল ও সহদেব যথাক্রমে অশ্বরক্ষক ও গোরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কর্ণ সেই দিকেই ইঙ্গিত করতে গিয়ে এই শ্লেষোক্তি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তীতে প্রবাদে পরিণত হয়।  

তবে এই উৎস-কাহিনী বলার জন্যে এই গল্পের অবতারণা করা হয়নি। আজকের গল্প হিন্দু পুরাণের মহত্তম দুই পুরুষকে নিয়ে। এঁদের প্রথম জন মহর্ষি বিশ্বামিত্র, দ্বিতীয় জন ভার্গব পরশুরাম। দুজনের মধ্যে বিশ্বামিত্রকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে রীতিমত এডোর করি । বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মালেও তপস্যার জোরে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠেছিলেন। এই ঘটনা গোটা হিন্দু পুরাণে একবারই ঘটেছে। অন্যদিকে পরশুরাম এই পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। এই পরশুরাম ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের একজন। শুধু তাই নয়, তিনি সাত ইমমর্টালদের মধ্যে একজনও বটে। মজার ব্যাপার হল, এই দুই মহত্তম পুরুষের মধ্যে 'নরাণাং মাতুলক্রম' ব্যাপারটার একটা সম্পর্ক আছে।

প্রাচীন ভারতে কন্যকুব্জ নামের একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের গাধী নামের এক প্রখ্যাত রাজা ছিলেন। বিশ্বামিত্র ছিলেন এই গাধীর সন্তান। একজন ক্ষত্রিয় রাজকুমার। বাল্মিকী রামায়ণে বিশ্বামিত্র অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র। তিনি ছিলেন অযোধ্যার রাজপুত্র, বিশেষ করে রাম এবং লক্ষণের অস্ত্রগুরু। এই বিশ্বামিত্রই রাম এবং লক্ষণকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মিথিলায়, রাজা জনকের রাজধানীতে। এখানেই হরধনু ভঙ্গ করে রাম সীতার সঙ্গে এবং লক্ষণ উর্মিলার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিশ্বামিত্র যদি এই রাজকুমারদের মিথিলায় নিয়ে না আসতেন, তাহলে রামচন্দ্রের সঙ্গে জানকীর দেখা হত না। পরবর্তীতে সীতাহরণের ঘটনাও ঘটত না, এবং সীতাহরণের ঘটনা না ঘটলে গোটা রামায়ণটাই আসলে লেখা হত না। শুধু তাই নয়, এই মিথিলায় এসে হরধনু ভঙ্গ করেছিলেন বলে ভগবান বিষ্ণুর দুই অবতার, রাম এবং পরশুরামের মধ্যে সাক্ষাৎকারের মতো বিরল ঘটনার ঘটবার সুযোগ সৃষ্টি হত না। 

পরশুরাম ছিলেন মহর্ষি জমদগ্নির পুত্র। তাঁর মায়ের নাম ছিল রেণুকা। জমদগ্নির পিতার নাম ছিল মহর্ষি রিচিক। এই ঋচীকের স্ত্রী ছিলেন বিশ্বামিত্রের বোন, তথা রাজা গাঁধীর কন্যা সত্যবতীর স্বামী। অর্থাৎ সত্যবতী ছিলেন পরশুরামের পিতামহী। বিশ্বামিত্র সত্যবতীর ভাই। সেই হিসাবে, সম্পর্ক অনুযায়ী, বিশ্বামিত্র পরশুরামের পিতামহ। সেইজন্যেই শুরুতেই বলেছিলাম, ঋষিপুত্র হয়ে জন্মালেও, সত্যবতীর বংশধারার উত্তরপুরুষ হিসেবে পরশুরামের মধ্যে ক্ষত্রিয়ের গুণাবলী লক্ষণীয়ভাবে ছিল। শুধু কি তাই? পরশুরাম জননী রেণুকাও ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। মজার ব্যাপার হলো, পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয় বিনাশে উদ্যোগী হবেন, অন্যদিকে বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়েও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবেন।  

বিশ্বামিত্র তখনো বিশ্বামিত্র হয়ে ওঠেননি, তিনি ক্ষত্রিয় রাজা হয়ে রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন। সবার কাছে তখন রাজা কৌশিক নামে পরিচিত ছিলেন। একদিন সসৈন্যে মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজাদের এই মৃগয়া করার ব্যাপারটা ছিল অন্যতম এক বিনোদন। ঘুরতে ঘুরতে মহারাজ কৌশিক মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে এসে পৌঁছালেন। বশিষ্ঠ আগত অতিথিদের যথাবিহিত সমাদর করলেন। কিন্তু মহারাজ কৌশিক অবাক হলেন, মহর্ষি বশিষ্ঠ কীভাবে এতজন অতিথিকে এভাবে রাজোচিত সমাদর করতে পারলেন। মহারাজ কৌশিক জানতে পারলেন, বশিষ্ঠের এই অপরিমেয় প্রাচুর্যের পেছনে ছিল কামধেনু নামের একটি স্বর্গীয় গাভী।

মহারাজ কৌশিক বশিষ্ঠের কাছে সেই কামধেনুটিকে চাইলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। কিন্তু বশিষ্ঠ রাজি হলেন না। কৌশিক এবার সেই কামধেনুটিকে বশিষ্ঠের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। বশিষ্ঠের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কাছে মহারাজ কৌশিক পরাজিত হলেন। কৌশিক এই পরাজয়কে ব্রাহ্মণ্য শক্তির কাছে ক্ষাত্রশক্তির পরাজয় হিসেবেই ধরে নিলেন। বশিষ্ঠের আশ্রম ত্যাগ করে তিনি কঠোর তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যা শেষ হল প্রজাপতি ব্রহ্মা এসে তাঁকে ব্রাহ্মণ পদে উত্তীর্ণ না করা পর্যন্ত। ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিক সেদিন থেকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। জন্মসূত্রে পাওয়া নিজের বর্ণ পাল্টে ফেলার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম এবং শেষবারের মত ঘটল।

পরশুরামের ক্ষত্রিয় বিনাশকারী হয়ে ওঠার পেছনেও এই কামধেনু সংক্রান্ত গোলযোগই প্রধানত দায়ী। দুটি ঘটনাই প্রায় একইরকম। শুধু স্থান, কাল, পাত্র আলাদা। বশিষ্ঠের জায়গায় মহর্ষি জমদগ্নি; ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিকের জায়গায় ক্ষাত্রবীর্যার্জুন। তবে সংঘর্ষের ফলাফলে সামান্য তফাৎ আছে, আর সেটা হল কামধেনু জোর করে কেড়ে নিতে গিয়ে বিশ্বামিত্র পরাজিত হয়েছিলেন বশিষ্ঠের কাছে, অন্য ঘটনায় মহর্ষি জমদগ্নি ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের কাছে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, পরশুরাম ছিলেন এই ঋষি জমদগ্নির পুত্র। পিতা হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ক্ষাত্রবীর্যার্জুন তো বটেই, আরো অসংখ্য ক্ষত্রিয় রাজাকে একের পর এক হত্যা করেন এবং তা চলতে থাকে অনেক বছর ধরে।

কামধেনু কীভাবে দুই সময়ের দুইজন ঋষির অধিকারে গেল, যাদের মধ্যে বংশ পরম্পরার কোনো সম্পর্ক নেই, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি, এইরকম অসাধারণ দৈবশক্তিসম্পন্ন একটি গাভী আদৌ থাকতে পারে কিনা সেটাও প্রশ্নের বিষয়। কিন্তু এই দুটি ঘটনা থেকে যে বিষয়টি বোঝা যায়, তা হলো প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে একটি লড়াই ছিল। সেই লড়াইয়ে কখনো ব্রাহ্মণ্য শক্তি জয়লাভ করেছে, আবার কখনো ক্ষত্রিয় শক্তি। বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধ না হলে বিশ্বামিত্রের 'বিশ্বামিত্র' হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। একইভাবে জমদগ্নির সঙ্গে ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের বিরোধ না হলে পরশুরামের ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। লোভে পড়ে একজন নিরীহ, নিরস্ত্র ব্রাহ্মণকে হত্যা করার ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে ক্ষাত্রশক্তি দুর্বিনীত, বেপরোয়া, এবং দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে উঠেছিল। এদের দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, এবং ভগবান পরশুরাম সেই কাজটিই করেছিলেন।

তবে বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠা মানবজাতির জন্য অনেক বেশি প্রেরণাদায়ক। এই দুই মহাপুরুষের জন্মের ঘটনায় কিছু রহস্যের কথা বলা হয়েছে—এক স্বর্গীয় পায়েস থেকেই এঁদের দুজনের জন্ম। কিন্তু এদের জননীদের ভুলের কারণে, যার ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাবার কথা ছিল, তিনি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছেন, আর যার ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মাবার কথা, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছেন। ফলে জীবনের একটি পর্যায়ে এঁদের বর্ণ পরিবর্তনের বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত হলেও, বিশ্বামিত্রকে কঠোর তপস্যা করতে হয়েছে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবার জন্য। অন্যদিকে, পরশুরামকে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করতে গিয়ে নিজেকেই বারবার ক্ষত্রিয় করে তুলতে হয়েছে। এই নিজের বর্ণ পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে আরেক চিরঞ্জীবী হনুমান এসে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—যথেষ্ট হয়েছে, এবার তাঁকে থামতে হবে; ক্ষত্রিয়বিহীন পৃথিবী ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

   

গল্পের ফাঁকফোঁকর: অভিশপ্ত কেতকী ফুল -Guitar K Kanungo
Dec. 22, 2024 | category | views:76 | likes:3 | share: 2 | comments:0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা’য় সম্ভবত কেতকী মিত্রের নামটি পেয়েছিলাম, কিন্তু কেতকী নামের যে একটি ফুলও আছে, সে কথা জানা ছিল না। আবার সেই ফুল যে অভিশপ্ত, সেটিও সম্প্রতি জানলাম। শিব পুরাণ পড়ছিলাম, সেখানেই কেতকী ফুলের অভিশাপ কুড়ানোর গল্পটি পড়লাম। বিশেষ একটি কারণে এই গল্পটি বলার মতো; সেই কারণটি পরে বলছি, আগে গল্পটি বলে নিই।

রাম ও সীতা বনবাসে আছেন, সঙ্গে লক্ষণ। রাম বনবাসে যাওয়ার কিছুদিন পরেই দশরথের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় এল। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য উপকরণ প্রয়োজন; রাম লক্ষণকে পাঠালেন আশপাশ থেকে কিছু উপকরণ সংগ্রহ করতে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু লক্ষণ ফিরল না। রাম চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে তো বসে থাকা যায় না, এবার রাম নিজেই বেরিয়ে পড়লেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো—রাম কিংবা লক্ষণের কারোরই দেখা নেই। সীতা কুটিরে একা। এদিকে শ্রাদ্ধের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সীতা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করবেন। তিনি পাশের ফল্গু নদীতে গিয়ে স্নান সেরে যা কিছু কুটিরে ছিল, তা দিয়েই পিণ্ড দিলেন।

পিতৃপুরুষগণ হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করলেন। তাঁদের মধ্যে দশরথও ছিলেন। দশরথ বললেন, "তোমার শ্রাদ্ধ সফল, আমরা পরিতৃপ্ত।" কিন্তু সীতার মনে একটু সন্দেহ রইল। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনারা যে পরিতৃপ্ত হয়েছেন, হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করেছেন, সে কথা আপনার পুত্র বিশ্বাস করবে না।" দশরথ বললেন, "সাক্ষী রাখো।" সীতা বললেন, "ফল্গু নদী, এই ধেনু, অগ্নি আর কেতকী আমার সাক্ষী।"

এর কিছুক্ষণ পরই রাম এলেন, সঙ্গে লক্ষণ। এসেই বললেন, "শিগগির স্নান করে এসো! রান্না করতে হবে, শ্রাদ্ধের সময় চলে যাচ্ছে!" অথচ স্নানে যাবার কোনো তাড়া সীতার মধ্যে দেখা গেল না। রাম কিছুটা বিরক্ত হয়ে আবারও তাড়া দিলেন। এবার সীতা সব খুলে বললেন, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, এবং সেই পিণ্ড পিতৃপুরুষরা একেবারে হাতে হাতে গ্রহণ করেছেন।"

রাম সীতার কথা শুনে হেসে উঠলেন। পাশে দাঁড়ানো লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমরা শাস্ত্রমত ডেকেও ওঁদের দেখতে পাই না, আর উনি কোনো রকম ডাকতেই ওঁরা দেখা দিয়ে গেলেন! আসলে তোমার বৌদি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং ঘুমের মধ্যে ওই সমস্ত স্বপ্ন দেখছিলেন।" তারপর সীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তাই না! ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই তো!"

সীতার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। রাম তাঁকে মিথ্যাবাদী ভাবছেন! তিনি রামকে বললেন, "রাঘব! আমি ঘুমাইনি, স্বপ্নও দেখিনি। আমি যা বলেছি, সবই সত্যি। আমিই পিণ্ডদান করেছি এবং তোমার পিতৃপুরুষরা সেটা গ্রহণ করেছেন। এই ফল্গু নদী, এই ধেনু, এই অগ্নি এবং এই কেতকী ফুল সবাই সাক্ষী।"

রাম তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই বলল, এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই মিথ্যাচারটি কেন এই সাক্ষীরা করল? বিশেষত অগ্নি কেন এমন কাজ করতে গেল? এমন তো নয় যে সীতা তাঁদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন। এর কোনো উত্তর রামায়ণে পাওয়া যায় না। আমরা শুধু এটুকুই জানি, তাঁরা মিথ্যাচার করেছেন।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। সময় বয়ে যাচ্ছে। সীতা সব কিছু প্রস্তুত করে দিলেন। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।" এবার রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। সূর্যের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।"

সূর্যদেবের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সীতা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেননি, উল্টো হাসাহাসি করেছেন। রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। তাঁদের উচিত ছিল দেবী জানকীকে বিশ্বাস করা। রামচন্দ্রের মনে একটা খটকা থেকেই গেল। কেতকী, ফল্গু, ধেনু এবং অগ্নি তো সাক্ষী ছিল। তাহলে মিথ্যে বলল কেন? লক্ষণও তাই ভাবছিলেন।

এমন সময় দুজনেরই কানে এলো সীতার কথা। সীতা বলছেন, "ফল্গু নদী, জেনেশুনে তুমি সত্য বলনি, তুমি পাতালে প্রবাহিত হও। অগ্নি, তুমি না দেবগণের মুখ! আজ থেকে তুমি সর্বভুক হবে। ধেনু, তুমি মুখে মিথ্যে বলেছ, আজ থেকে তুমি মুখে অশুচি, পবিত্র কেবল পুচ্ছদেশে। কেতকী, তুমি শিবের প্রিয় ছিলে, কিন্তু আর থাকবে না। তাঁর পূজায় তুমি অযোগ্য।"

কেতকী ফুল মহাদেব কতটা ভালোবাসতেন, কিংবা পূজার অযোগ্য হয়ে কেতকী ফুলের কতটা ক্ষতি হলো, তার চাইতেও বড় একটি প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই গল্পের ফাঁকফোঁকরে। সেটা হলো—হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি প্রথা। এই গল্প থেকে জানা গেল, পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদানের অধিকার একচেটিয়াভাবে শুধু পুত্রদের নয়; কন্যা তো বটেই, এমনকি পুত্রবধূদের সেই অধিকার পুরোদমে আছে। নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, যা রামায়ণের যুগেও স্বীকৃত ছিল।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : শকুনির প্রতিশোধ -Guitar K Kanungo
Dec. 21, 2024 | category | views:108 | likes:17 | share: 6 | comments:0

মহাভারতের গল্পের কি শেষ আছে? যেন পেঁয়াজের খোসা! প্রতিটি খোসার নিচে অপেক্ষা করছে নতুন গল্প, নতুন রহস্য। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে চমকপ্রদ সব উপাখ্যান। শকুনির কথাই ধরা যাক ! কৌরবদের সেই কুখ্যাত মামা - বাসুদেব কৃষ্ণের পর মহাভারতের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটন পটিয়সী ! যদি শকুনি না থাকতো, দুর্যোধনের প্ররোচিত হত না, আর কোন প্রকার প্ররোচনা ছাড়া কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধ  কি হতে পারতো? 

এই শকুনিকে নিয়েও কিন্তু এক হৃদয় বিদারক কাহিনী আছে, যা শুনতে হলে ধীরে ধীরে সেই গল্পের গভীরে যেতে হবে। ফাঁকফোঁকরও চোখে পড়বে।  শকুনির জীবন এক করুন উপাখ্যান। একটি রাজ্যের রাজপুত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত রাজ্যশাসন তার কখনোই করা হয়নি। আশ্রিত থেকেই তার জীবনের একটি বড় অংশ কেটে যাবে। 

গান্ধারীর গল্প আমরা সবাই জানি—অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তার বিয়ে এবং শতপুত্রের জননী হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এর পেছনে যে  আরও গভীর এক কাহিনী লুকিয়ে আছে ! গান্ধার, আজকের কান্দাহার, আফগানিস্তানের ছোট্ট রাজ্য, যেখানে রাজা সুবল শাসন করতেন। একদিন, পরাক্রমশালী রাজ্য হস্তিনাপুরের দেবব্রত ভীষ্ম এসে সুবলের কাছে তাঁর ভ্রাতৃষ্পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের জন্য গান্ধারীর বিয়ের প্রস্তাব দেন। সুবল মনে মনে অস্বীকৃত হলেও, ভীষ্মের শক্তি ও হস্তিনাপুরের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাধ্য হয়ে এই প্রস্তাবে রাজী হন। গান্ধারীকেও রাজী হতে হয়। 

এরপর, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী সুখে বসবাস করতে থাকেন - গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। সেটা হলে আমাদের দ্বিতীয় গল্পে প্রবেশ করা হত না। গান্ধারীর রাশিফলে বলা ছিল যে তাঁর প্রথম স্বামী বিবাহের পরপরই মারা যাবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী এড়ানোর জন্য গান্ধারীর ছোটবেলায় একটি ছাগলের সঙ্গে তাঁর প্রতীকী বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছিল। এই ঘটনা জানাজানি হলে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন; তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করেন, যদিও তাঁর প্রতারিত বোধ  করার বিশেষ কোন কারণ ছিল না। এমন ঘটনা কেবল প্রাচীন যুগে নয়, পঞ্চাশ বছর আগেও উপমহাদেশের অনেক স্থানে ঘটেছে। এই অবস্থায় ভীষ্ম কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না, এমন তো হতে পারে না ! এর পরে যা ঘটবে সেটাই আমাদের তৃতীয় গল্প।  

তবে গল্পে ঢোকার আগে একটা কথা বলে নিতে হয়। যদি ভীষ্ম সেই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হত না ! যাই হোক, আসল ঘটনায় ফিরে আসি। ভীষ্ম, রাজা সুবল ও শকুনি সহ গান্ধারীর সব আত্মীয়কে হস্তিনাপুরে ডেকে আনেন। ক্ষমতাবান আত্মীয়ের এই আমন্ত্রণ এড়াতে পারলেন না রাজা সুবল, সবাই এলেন হস্তিনাপুরে। এরপরেই ঘটল ভয়ানক ঘটনাটা ! ভীষ্ম এদের সবাইকে সরাসরি কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন ! এদের মধ্যে রাজা সুবল এবং রাজকুমার শকুনিও ছিলেন। 

ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এইরকম নিষ্ঠুর একটা আদেশ কাযর্কর হবার আগে কিংবা পরে গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল, সেটা অবশ্য পরিষ্কার জানা যায় না। একটা  সম্ভাবনা হতে পারে যে গান্ধারী এই ঘটনার কিছুই জানতেন না। যদি জানতেন, হয়তো সে সময় তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন। গান্ধারীর ছাগলের সঙ্গে বিয়ের গল্প এবং সেই ঘটনার গোপন রাখা—এটা দেখে ভীষ্মের ক্রুদ্ধ হবার সঙ্গত কোন কারণ নেই। ভীষ্ম আগেই জানতেন যে রাজা সুবল গান্ধারীর বিয়েতে রাজী ছিলেন না; বিশেষ করে শকুনির কাছ থেকে তিনি হয়ত বিপদের আশংকা করেছিলেন। আমার ধারণা, ভীষ্ম গান্ধার রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে হস্তিনাপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, এটি কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ ছিল না। বরং, এর মাধ্যমে তিনি এক রক্তাক্ত ভবিষ্যতের পটভূমি নির্মাণ করেছিলেন।

কুটুম্ব বাড়ির সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, এইটুকু মেনে নেওয়া গেলেও, পরবর্তীতে ভীষ্মের তরফ থেকে যে সিদ্ধান্ত এলো, সেটা রীতিমত নৃসংশ। ভীষ্ম কেন এইরকম একটা কাজ করতে গেলেন, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারাগারে গান্ধার থেকে যারা এসেছেন, তাদের একসাথে রাখা হত এবং সবার জন্য মাত্র এক মুষ্ঠি চাল বরাদ্দ দেয়া হত, যা দিয়ে কেবল একজন মানুষের উদরপূর্তি করা যেত। ফলস্বরূপ, একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল এক মুষ্ঠি চাল দিয়ে সবার পক্ষে জীবন ধারণ সম্ভব নয়, তাহলে অন্তত একজন বেঁচে থাকুক। শকুনিকেই সেই একজন হিসাবে নির্বাচিত করা হল, এবং শেষ পর্যন্ত শকুনিই বেঁচে রইলেন।

রাজা সুবল মারা যাবার আগে শকুনি বলে গেলেন, তাঁর অস্থি দিয়ে শকুনি যেন পাশা খেলার গুটি বানিয়ে নেয়, যে গুটি সবসময় শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে। এখন সুবলের অস্থি দিয়ে গুটি বানালেই যে সেই গুটি শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে, এই ব্যাপারটাকে যদি আমরা কষ্টকল্পনা বলেও বিবেচনা করি, এমন তো হতে পারে যে কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শকুনি আসলে এই পাশা খেলাটা এমনভাবে রপ্ত করছে যে অন্য কারো পক্ষেই তাকে হারানো নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল এবং আমার ধারণা, পাশা খেলার এই দক্ষতাটা সে তার পিতা রাজা সুবলের কাছ থেকেই শিখেছিল। রাজা সুবলের  অস্থি দিয়ে পাশার গুটি বানানোর কথা বলে আসলে এই ব্যাপারটাকেই হয়ত বোঝানো হয়েছে। 

এর পরের ঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা। গান্ধারী হস্তক্ষেপে শকুনি মুক্তি পেলেন, কিন্তু যে শকুনি মুক্তি পেলেন, তিনি আর সেই আগের শকুনি নেই। তিনি তাঁর পিতার, তাঁর পরিবারের, তাঁর বোনের অবমাননাকর পরিস্থিতির বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এই প্রতিজ্ঞা থেকে আমৃত্যু এক বিন্দু বিচ্যুত হননি। গান্ধারী কুরুবংশ ধ্বংসের জন্যে কৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিলেই, এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে শকুনির অবদানও খুব একটা কম ছিল না। পাশা খেলায় হারিয়ে পান্ডবদের বনবাসে পাঠানো থেকে শুরু করে, ভীমকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা থেকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যে যে ঘটনাগুলো কুরুবংশের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল, এই প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে শকুনির প্ররোচনা ছিল। দুর্যোধন শকুনির হাতের একটা পাপেট ছিল মাত্র।

তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে শকুনিকে আমরা সাধারণ পাঠকেরা এত অপছন্দ করি, সেই শকুনি কিন্তু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আগেই স্বর্গে পৌঁছে গেছিলেন। তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছিল, সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তাঁর গীতা শোনার প্রয়োজন হয়নি। তার মধ্যে অর্জুনের মত কোন ধর্মসঙ্কট ছিল না। তিনি তাঁর লক্ষ অর্জনে এতটাই অবিচল এবং আন্তরিক ছিলেন যে তাঁকে স্বর্গে ঠাই না দিয়ে ঈশ্বরের অন্য কোন উপায় ছিল না।


গল্পের ফাঁকফোঁকর: সদ্যজাত কৃষ্ণের যমুনা অতিক্রম। -Guitar K Kanungo
Dec. 20, 2024 | category | views:68 | likes:16 | share: 3 | comments:0

বাসুদেব কৃষ্ণ হিন্দুদের পরম আরাধ্য। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। বলা হয়, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য তাঁর এই অবতীর্ণ হওয়া। শ্রাবণ মাসের অষ্টমী তিথিতে এক প্রবল বর্ষণের রাতে তাঁর জন্ম হয়েছিল মথুরার এক কারাগারে। তাঁর জন্মের কয়েক বছর আগে দৈববাণী হয়েছিল, তাঁর মায়ের অষ্টম সন্তানের হাতে সেই সময়কার মথুরার দুরাচারী রাজা কংসের মৃত্যু হবে। ফলত তাঁর জনক বসুদেব এবং জননী দেবকীকে কারারুদ্ধ করা হয়, এবং কৃষ্ণের জন্মের আগেই এই দম্পতির যেসব সন্তান জন্মেছিল, তাদের সবাইকে দুরাচারী কংস জন্মের পরপরই হত্যা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি কংস দেবকী এবং বসুদেবের এতগুলো সন্তানকে হত্যা করেছিল? এই দৈববাণী যখন হয়েছিল, তখন দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়েটা সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। এই সময় দেবকী অথবা বসুদেব, দুজনের একজনকে হত্যা করলেই এই দৈববাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করা যেত। কেউ কেউ বলবে দেবকী উগ্রসেনের কন্যা; কংস ইতোমধ্যে উগ্রসেনকে সরিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছে এবং সম্পর্কে দেবকী কংসের বোন - এরকম অবস্থায় দেবকীকে হত্যা করা বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। একই কথা বসুদেবের ক্ষেত্রেও খাটে; বসুদেব ছিলেন সংঘমুখ্যদের একজন, তাঁকে হত্যা করাটাও সহজ ছিল না।

ভালো কথা, কিন্তু এদের দুজন অথবা দুজনের যেকোনো একজনকে হত্যা করার মধ্যে ঝুঁকি ছিল। তবে এদের দুজনের কাউকে হত্যা না করেও কংস তাঁর জীবনের উপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, সেটা 'নিউট্রালাইজ' করতে পারতেন। বসুদেবকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেই সমস্ত ল্যাঠা চুকে যেত। দেবকীর গর্ভধারণের সুযোগ তৈরি না হলেই তো কংসের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তিনি এই সহজ কাজটা না করে যে কাজটা করলেন, তাতে কংস নিজেই নিজের মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত করলেন। তিনি দুজনকেই কারারুদ্ধ করলেন। শুধু তাই নয়, দুজনকে একই সঙ্গে বসবাস করতে দিলেন। দেবকী একের পর এক গর্ভধারণ করলেন এবং কংস শিশু হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করে গেল বছরের পর বছর।

এই বুদ্ধিটা কংসের মাথায় কেন এলো না, সেটা কংসই ভালো বলতে পারবেন। এদিকে যথাসময়ে দেবকী গর্ভধারণ করলেন। কৃষ্ণের জন্ম হলো; আগেই বলেছি, তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার। কংসের হাতে মরবার জন্যে তিনি জন্মাননি, কংসকে হত্যা করবার জন্যেই তিনি জন্মেছেন। নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করলেন। কারারক্ষীদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই ফাঁকে পিতা বসুদেব নবজাত কৃষ্ণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার জন্য যাতে পরদিন সকালে এসে কংস এই সন্তানকেও হত্যা করতে না পারে। বসুদেব ঝড়ের রাতে যমুনা নদী পেরিয়ে ওপারের বৃন্দাবনে পৌঁছালেন, যেখানে তাঁর বন্ধু নন্দরাজ থাকতেন।

বৃন্দাবন যাবার পথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটবে। বর্ষা মৌসুম থাকার কারণে যমুনার জল অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বসুদেবের পক্ষে হেঁটে যমুনা পার হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু যমুনার জলে কৃষ্ণের পায়ের ছোঁয়া লাগতেই যমুনার জল অনেকটাই কমে গেল। এতটাই কমে গেল যে এবার বসুদেব পায়ে হেঁটে পার হতে পারছিলেন। কিন্তু সমস্যা আরও ছিল। প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছিল। একটি ঝাঁকার মধ্যে সদ্যজাত শিশু কৃষ্ণকে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা করার জন্য এবার নাগরাজ বাসুকী এগিয়ে এলেন। তিনি পেছন থেকে ফণা তুলে ধরলেন যাতে কৃষ্ণের গায়ে জলের ছিটা না লাগে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের এইসব ঘটনা বড় ভালো লাগে। এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, ঘটার কোনো সম্ভাবনা ছিল কিনা, সেসব নিয়ে তারা ভাবতে রাজি নয়। তারা বিশ্বাস করে এরকমটাই ঘটেছিল।

অনেকেই বিশ্বাস করেন বাসুদেব কৃষ্ণ কেবলমাত্র একটা পৌরাণিক চরিত্র নয় ; তিনি সত্যিই জন্মেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষ্ণকে যদি যেভাবে বিশ্বাস করা হয়, অর্থাৎ একজন অবতার হিসাবে দেখি তাহলে যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হল সেসব ঘটতেই পারে। কিন্তু যদি তিনি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে তো যমুনার পানি কমে যাওয়া কিংবা বাসুকীর বৃষ্টির ছাট থেকে সদ্যজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করা, এসব অলৌকিক ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। সঙ্গত কারণেই যুক্তিবাদী মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেনা। তারা যমুনা পারাপার করার সময় এই ঘটনাগুলো আদৈ ঘটেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ প্ৰকাশ করে। 

সবচাইতে বিস্ময়কর যে কথাটা তারা বলছে, সেটা হলো বসুদেবকে আসলে যমুনা নদী পারাপার করতেই হয়নি, কারণ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যেতে যমুনা পারাপার করতে হয় না। বৃন্দাবন আসলে যমুনার এইপাড়ে, যে পাড়ে মথুরা অবস্থিত। বসুদেব হয়তো কিছুটা পথ যমুনার পাড়ের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নদী পার হয়ে অন্য পারে যেতে হয়নি। এই তথ্যটা হজম করা আমার জন্য বেশ কঠিন কাজ ছিল, কারণ যমুনার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের একটা গভীর সম্পর্ক বজায় থাকবে, অন্তত যতদিন তিনি বৃন্দাবনে ছিলেন, এবং সেই সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল তাঁর জন্মের ঠিক পর থেকেই। অথচ এখন শুনছি বসুদেবকে যমুনা পাড়ি দিতেই হয়নি।

এখন চাইলেই গুগল ম্যাপ খুলে এই জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কোন পথে যেতে হবে এবং যেতে কতটা সময় লাগবে, সেটা ঝট করে দেখে নেওয়া যায়। আমিও তাই করলাম। গুগল ম্যাপ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যাবার দুটো রাস্তার কথা বলছে, কিন্তু এর কোনটাই যমুনা নদীকে অতিক্রম করে নয়। আমি গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, দেখলাম এক বিশাল গহ্বর আবিষ্কার করে বসে আছি।

গল্পের ফাঁকফোঁকর: মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম। -Guitar K Kanungo
Dec. 19, 2024 | category | views:286 | likes:4 | share: 2 | comments:0

জৈবিকভাবে দেখতে গেলে মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম হওয়ার উপায় নেই। এমনকি যাদেরকে 'টেস্টটিউব' বেবি নামে ডাকা হয়, তাদেরও জন্ম হয় শেষ পর্যন্ত মাতৃজঠরেই। পৃথিবীতে অবতার কিংবা মেসাইয়াদের জন্মকে অলৌকিক করে তোলার একটা প্রবণতা প্রায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে, কিন্তু যীশু বলি আর কৃষ্ণ, এরা কেউই মাতৃজঠর এড়িয়ে জন্মাতে পারেননি।

কিন্তু পুরাণগুলিতে মাতৃজঠর এড়িয়ে সন্তান জন্ম দেবার বেশ কিছু ঘটনার কথা বলা আছে। এইসব গল্পের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত গল্পটি গ্রীক পুরাণে বলা হয়েছে—জ্ঞানের দেবী এথেনার জন্ম নিয়ে। এথেনা বারোজন অলিম্পিয়ান দেব-দেবীর মধ্যে অন্যতম এবং তিনি দেবরাজ জিউসের কন্যা। মজার ব্যাপার হলো, তিনি কোনো মাতৃজঠরে জন্মাননি। তিনি জিউসের মাথা ফেটে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেন এরকম হয়েছিল সেই গল্পটা বেশ মজার—এবার সেটা বলি; ফাঁকফোঁকরের আলোচনাটা একটু পরে হবে।

হেরা নয়, জিউসের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল মেটিস। দৈববাণী হয়েছিল মেটিসের গর্ভজাত সন্তানের হাতে জিউস ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। এই দৈববাণী শুনে জিউস ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ছল করে মেটিসকে আকারে ছোট হয়ে যেতে বললেন। মেটিস সেটা হতেই জিউস তাকে চট করে গিলে ফেললেন। কিন্তু গিলে ফেললে কী হবে, মেটিস সেই সময় গর্ভবতী ছিলেন। এদিকে মেটিসকে গিলে ফেলার পর থেকেই জিউসের প্রবল মাথাব্যথা হতে থাকল। এই মাথাব্যথা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আরেক অলিম্পিয়ান দেবতা হেফাস্টাস জিউসের মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করেন। সেই আঘাতের ফলে জিউসের মাথার খুলি ফেটে সেখান থেকে এথেনা বেরিয়ে আসেন—পূর্ণবয়স্ক অবস্থায়, কবচ-কুন্ডল পরে থাকা অবস্থায়।

তবে এথেনার চেয়ে গ্রীক দেবী আফ্রোদিতির জন্মকাহিনী আরো অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক, অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দেবে। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, ক্রোনাস তার স্বৈরচারী পিতা ইউরেনাসের জননেন্দ্রিয় কেটে সেটা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেই জননেন্দ্রিয় গিয়ে সমুদ্রের পুঞ্জীভূত ফেনার উপরে পড়ে এবং সেখান থেকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির জন্ম হয়।

গোটা ব্যাপারটাকে কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ব্যাখ্যা করা যায় যদি এই গোটা ব্যাপারটাকে একটি 'মেটাফর' হিসাবে দেখা যায়। এথেনার এইভাবে জন্মানোটা আসলে প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধির আবির্ভাবের প্রতীক। গ্রীকরা বোঝাতে চায়, প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধি আবশ্যিকভাবে মনসিজ, কোনো প্রকারের জৈবিক প্রজননের মাধ্যমে এর সৃষ্টি করা চলে না। এইটুকু না হয় মেনে নেওয়া গেল, ধরেই নিলাম এটা আসলে একটা মেটাফর; কিন্তু যখন বলা হয়, কামাতুর কোনো এক দেবতার বীর্যস্খলনের ফলে নির্গত বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হচ্ছে—সেটাকে কল্পবিজ্ঞান নাম দিয়ে, কিংবা সেটাকেও কোনো একটা মেটাফর হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এরকম ঘটনা হিন্দু এবং গ্রীক পুরাণে অজস্র পরিমাণেই আছে।

আচার্য দ্রোণের জন্মের কথাই ধরা যাক। একদিন মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গা নদীতে প্রাত্যহিক আচার সম্পন্ন করছিলেন। এমন সময় তিনি ঘৃতাচী নামের এক অপ্সরাকে দেখতে পান। অপ্সরারা যৌনাবেদনময়ী হয়ে থাকেন, তাঁদের শরীরে কাপড়চোপড়ও বিশেষ কিছু থাকে না, আর থাকলেও সেগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে সেগুলো থাকা না থাকা বিশেষ কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। ফলে মহর্ষি ভরদ্বাজ কামাতুর হয়ে পড়লেন। কামাতুর হয়ে পড়লেও তিনি একজন সাধক পুরুষ, একজন ঋষি; রিপুকে বশে রাখাই তাঁর কাজ। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তাঁর বীর্যস্খলন হয়ে গেছে এবং স্খলিত বীর্য গিয়ে পড়ল এক পাত্রে। কালক্রমে সেই পাত্রে এক শিশুর জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয়েছিল দ্রোণ। ইনি পরবর্তীতে দ্রোণাচার্য নামে খ্যাত হবেন।

একটি শিশু জন্মানোর জন্য অসংখ্য শুক্রাণুর পাশাপাশি কিছু ডিম্বাণুরও প্রয়োজন। সেই ডিম্বাণু কোথা থেকে এলো, একটা এম্ব্রায়ো কীভাবে সৃষ্টি হলো—যা কিনা পরবর্তীতে একটা পূর্ণ মানবশিশুতে রূপান্তরিত হয়—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মজার ব্যাপার হলো, এই রকম ঘটনা মহাভারতে কেবল দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয়; মহাভারতের যুযুধান কুরু-পাণ্ডবদের পিতামহী সত্যবতীর জন্মও খুব একটা কম রহস্যজনক নয়। সেই গল্পটা বলার আগে গ্রীক দেবী এথেনাকে ঘিরে এই রকম স্খলনজনিত ঘটনার কথা বলা আছে, সেটা আগে বলি, তারপর মৎসগন্ধার গল্পে ফিরব।

এথেনার কথা আগেই বলেছি—গ্রীকদের জ্ঞানের দেবী। সম্পর্ক স্থাপনে ইনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তিনি আগ্রহী না হলে অন্য দেবতারা আগ্রহী হবেন না, এমন তো কোনো কথা নেই। একদিন হেফাস্টাস এথেনাকে 'সেডিউস' করার চেষ্টা করেন। কাম নামের রিপুটা এথেনার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তিনি ছিটকে সরে যান হেফাস্টাসের কাছ থেকে। মহাভারতে ঋষি ভরদ্বাজের যে অবস্থা হয়েছিল, হেফাস্টাসের ক্ষেত্রেও তা হলো। কিন্তু স্খলিত বীর্য কোনো পাত্রে গিয়ে পড়ল না। গিয়ে পড়ল বসুন্ধরার গায়ে। গ্রীকরা ধরণীকে গাইয়া নামে জানে। হেফাস্টাসের বীর্য ধারণ করে গাইয়া গর্ভবতী হলেন। জন্ম হলো সন্তানের, যিনি কিনা পরবর্তীতে এথেন্সের রাজা হবেন, যে এথেন্স শহরটি এথেনার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল।

এবার মহাভারতের ঘটনায় ফেরা যাক। উপরিচর বসু নামের একজন খুব বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজার মৃগয়া করতে গেলেও সঙ্গে পত্নী, উপপত্নীদের নিয়ে যেতেন। কিন্তু উপরিচর বসু একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন না যেতেই স্ত্রী গিরিকার শারীরিক বিরহে খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। এরকম অবস্থায় অন্য সবার ক্ষেত্রে যা হয়, উপরিচর বসুর ক্ষেত্রেও তা হলো। তিনি তাঁর স্খলিত বীর্য একটি পাতায় মুড়িয়ে সেটাকে সেটি এক ঈগলকে দিয়ে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে তাঁর স্ত্রী গিরিকা সেটি ধারণ করে গর্ভধারণ করতে পারেন। ঈগলটি উড়ে যাবার সময় আরেকটি ঈগল দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে ঈগলটি যে বস্তুটা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা এক নদীতে গিয়ে পড়ে। একটি মাছ তাতে গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে একটা ছেলে এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। এই কন্যা সন্তানটিই মৎসগন্ধা, যার সঙ্গে পরবর্তীতে হস্তিনাপুরের মহারাজা শান্তনুর বিয়ে হয়েছিল।

শুরুতেই বলেছিলাম গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করব। কিন্তু এক মাটির পাত্রে দ্রোণাচার্যের জন্ম হওয়া, কিংবা জিউসের মাথা থেকে এথেনার এবং উরু থেকে ডায়োনিসাসের জন্ম হওয়া—এইসব পৌরাণিক গল্পের কোথায় কোথায় ফাঁকফোঁকর আছে, সেটা বোধ হয় আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিথ গল্প হলেও সেইসব গল্পে সময়ের ইতিহাস এবং ভাবনা ইত্যাদি মিশে থাকে। কল্পবিজ্ঞানের মতো যারা পুরাণ রচনা করেন, তারা আগামীকালকে বর্তমানে ধরতে চান। মহাভারতের ঘটনাগুলিতে বিবাহবহির্ভূত যৌনতার বিষয়টাই প্রধানত এসেছে।

ভরদ্বাজের কথাই ধরা যাক। অনেক দিন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পর গঙ্গাতীরে এক সুন্দরী রমণীকে দেখে তিনি কামাতুর হতেই পারেন, তিনি সেই নারীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে যেতেই পারেন। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে এইভাবে স্বীকার করে নিলে মহর্ষি ভরদ্বাজের মহত্ব বজায় থাকে না। তাই স্খলন, পাত্র এবং দ্রোণের জন্ম ইত্যাদি কল্পনা করতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যে নারীকে ঘৃতাচী নামে ডাকা হচ্ছে, তিনিই দ্রোণের সত্যিকারের জননী। কুন্তীর মতো কুমারী মাতা বলেই হয়তো সন্তান জন্মদানের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। মাতৃজঠর এড়িয়ে যে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায় না, সেটা প্রাচীন ভারতীয়রা ভালোই জানতেন।

তবে গ্রীকদের যৌনতা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা ভারতীয়দের মতো ততটা রক্ষণশীল ছিল না, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ছিল পুরো মাত্রাতেই। সেইজন্যেই জিউসের উদ্দাম, অনিয়ন্ত্রিত যৌনতা নিয়ে ঈর্ষাকাতর হতে দেখা যায় হেরাকে। তাতে অবশ্য জিউসকে দমিয়ে রাখা যায়নি; তিনি তাঁর কমর্কান্ড চালিয়ে গেছেন পুরোদমে। হেরার ক্রোধের শিকার হয়েছেন সেইসব নারী যারা জিউসের লালসার শিকার হয়েছেন। এই ব্যাপারটিকে নৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে, অবিচারই বলা চলে। মজার বিষয় হচ্ছে জিউস বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতা বজায় না রাখলেও হেরা কিন্তু সেই কাজটা করে গেছেন গভীর নিষ্ঠার সাথে; তিনি কখনোই বিবাহ বহির্ভুত কোন সম্পর্কে জড়াননি।    

গল্পের ফাঁকফোঁকর : যুধিষ্ঠিরের ধর্মাচরণ -Guitar K Kanungo
Dec. 18, 2024 | গল্প | views:148 | likes:10 | share: 2 | comments:0

যুধিষ্ঠির মহাভারতের নায়ক, যেখানে দুর্যোধন প্রতিনায়ক – সাধারণভাবে এভাবেই দেখা হয়, যদিও আমি মনে করি ঘটোৎকচপুত্র বর্বরিকের কথাটাই যথার্থ। মহাভারতের আসল নায়ক বাসুদেব কৃষ্ণ; যুধিষ্ঠির তো নন, এমনকি অর্জুনও নন, যদি বীরত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। হোমারের ইলিয়াড-এ আকিলিসই নায়ক —সন্দেহাতীতভাবে। ইলিয়াড শুরুই হয়েছে আকিলিসের ক্রোধের বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু মহাভারতে বাসুদেব কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটবে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার পূর্বাহ্নে। এরপর সমগ্র মহাভারতে যা ঘটেছে, সবকিছুতেই তিনি আছেন, পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে।   

তবে আমাদের প্রথা মেনে চলতে হবে। সেই প্রথা অনুযায়ী, যুধিষ্ঠিরই নায়ক। এই যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র হিসাবে পরিচিত, যদিও আমার ধারণা আসলে ইনিই বিদুরের ঔরসজাত। যেহেতু তিনি ধর্মপুত্র, অধর্মের কোনো কাজ তিনি করতে পারেন না। ধর্মপ্রাণ পাঠকেরা সেভাবেই দেখবেন। আসলে, এইভাবে দেখার ব্যাপারটা পাঠক হিসাবে আমাদের একটা সমস্যা — আমরা অনেকেই পূর্বধারণা নিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। যুধিষ্ঠির তেমনই একটি চরিত্র। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সীতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং প্রজাদের সমালোচনার মুখে সীতাকে আবারো বনবাসে প্রেরণ করার কাৰণে রামচন্দ্রকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। রামকে কখনো কখনো একজন 'মিসোজিনিস্ট' হিসাবে চিত্রিত করার প্রবণতা আছে আমাদের মধ্যে  ; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে রাম যে সীতা ছাড়া অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হননি, অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে একপত্নীব্রত ছিলেন, সেই ব্যাপারটা উপেক্ষা করা হয়েছে। যদি তিনি সীতাকে ভালো নাই বাসবেন তাহলে তিনি একপত্নীব্রত থাকতে গেলেন কেন ?  

ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও এবং যকের প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে সেই পরিচিতি সবার কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেও গোটা মহাভারত জুড়ে যুধিষ্ঠির এমন কিছু কাজ করেছেন, যা গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করে। দ্রোণাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলা—অর্ধসত্য মিথ্যা, যা আসলে মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর—এদের মধ্যে একটি। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরা আরেকটি, এবং যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দ্রৌপদী যে আইনগত 'আর্গুমেন্ট' তুলেছিলেন, আজকের দিনে এটি হলে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের 'রেফারেন্স' হয়ে যেত। রাজ্য হারানোর পাশাপাশি যুধিষ্ঠিরের জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারত। কোনো অর্থেই এটি যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সদাচার ছিল না।

যুধিষ্ঠিরের এই আচরণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে—পক্ষে-বিপক্ষে; যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপক্ষে। এই একই জুয়ার আসরে তিনি আরও একটি অধর্মের কাজ করেছেন, যা অনেকের চোখে ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। এই কাজটা তিনি করেছিলেন নকুল ও সহদেবকে নিয়ে। নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র কিনা—সেই আলোচনা এখানে করতে চাই না—কিন্তু তারা মাদ্রীর গর্ভজাত, কুন্তীর গর্ভজাত নয় একথা সত্য । সেই হিসাবে, এই দুই ভাই যুধিষ্ঠিরের সহোদর নয়। এই জন্যেই কি যুধিষ্ঠির ভাইদের বাজি ধরার সময় প্রথমেই নকুল ও সহদেবকে বাজি ধরেছিলেন? সৎ ভাই ছিলেন বলেই কি ? তিনি যদি অর্জুন কিংবা ভীমের মধ্যে একজনকে সবার আগে বাজি ধরতেন, তাহলে সেটিই ধর্মের কাজ হত।

দ্রৌপদীকে অর্জুন জয় করেছিলেন, এবং দ্রৌপদী নিজেও মনে-প্রাণে অর্জুনকেই কামনা করছিলেন। পারিবারিকভাবেই তাঁর মধ্যে এই অনুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। নইলে তিনি বিনা দ্বিধায় কর্ণকেই বরং বরন করতে পারতেন। রূপে, গুণে, বীরত্বে কর্ণ কোনো অংশে অর্জুনের তুলনায় খাটো ছিলেন না—স্বর্গীয় কবচ ও কুন্ডল নিয়েই যাঁর জন্ম। স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে কর্ণই একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন।  রূপবান তো ছিলেনই, কেবল শিক্ষাকেই যদি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে অর্জুন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, যেখানে কর্ণ হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে এসেছেন। মহাভারত-এর রথী-মহারথীদের মধ্যে কেবল দুজনের এই শিক্ষাগত পটভূমি ছিল: দেবব্রত ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণ; এঁরা দুজনই কর্ণের মতো ভার্গব পরশুরামের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় পরশুরামের আশ্রমটাই ছিল সেই সময়কার হার্ভাড কিংবা স্ট্যানফোর্ড যেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ অস্ত্রবিদ স্বয়ং পরশুরাম ছিলেন সে আশ্রমের আচার্য। 

দ্রৌপদী এমন একজন কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অর্জুনকে পাওয়ার জন্য, কিন্তু সেই অর্জুনকেও তাঁর পাওয়া হয়নি যুধিষ্ঠিরের লালসার কারণে। যুধিষ্ঠির নিজের অর্জিত নয় জেনেও দ্রৌপদীকে ভোগ করেছিলেন; নিজের অধিকার নেই জেনেও, পাশা খেলায় হেরে যাবেন জেনেও, দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, অদ্ভুদ এক নিয়ম চালু করেছিলেন যুধিষ্ঠির এবং সেই নিয়মের ফাঁদে ফেলে অর্জুন যাতে অচিরে দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হতে না পারে সেই  ব্যবস্থাকেও পাকাপোক্ত করেছিলেন অর্জুনকে এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে। অর্জুনের অপরাধ তিনি কামাতুর হয়ে পড়েছেন এবং তাঁর চারিত্রিক শুদ্ধতা ফিরে পাবার জন্য অন্ততপক্ষে এক বছরের জন্য নির্বাসনে যাবার প্রয়োজন।  কিন্তু অর্জুন যে কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন সেটা ছিল অস্ত্রাগার ; সেখানে যুধিষ্ঠির দিনে দুপুরে দ্রৌপদীকে নিয়ে যা করছিলেন সেটাকেও যে  কামাতুরতা বলে চলে সে প্রশ্ন কেউ তুলল না।   

ভাগ্যিস! অর্জুন একিলিস ছিলেন না। একিলিস তাঁর প্রেয়সী ব্রিসেইসের জন্যে গ্রীকবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আগামেমননের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন; তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং ট্রোজানদের সঙ্গে গ্রীকদের যে যুদ্ধ চলছিল, সেই যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলত, আগামেমনন ব্রিসেইসকে একিলিসের কাছে ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্জুন এসবের কিছুই করেননি। তিনি অগ্রজের আদেশ মেনে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। অগ্রজের আদেশ মান্য করা ধর্ম; অর্জুন সেটা করেছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কি ধর্মাচরণ করেছেন?

গল্পের ফাঁকফোঁকর : দুই -Guitar K Kanungo
Dec. 16, 2024 | গল্প | views:124 | likes:3 | share: 2 | comments:0

পুরু আর আলেকজান্ডার। মহাবীর আলেকজান্ডারের কথা কে না জানে? জানা পৃথিবীর অনেকটাই জয় করে ফেলেছিলেন এই যুবক। অনেকেই বলেন, হোমারের নায়ক একিলিসের ঐতিহাসিক সংস্করণ ছিলেন তিনি। অন্যদিকে, পুরু আমাদেরই একজন, পৌরব নামের এক রাজ্যের রাজা। এই প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যটি ঝিলাম ও চেনাব নদীদ্বয়ের মধ্যেভাগে অবস্থিত ছিল, যা আধুনিক পাঞ্জাব এবং বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত।


৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সাথে বিতস্তার তীরে পুরুর প্রথম দেখা হয়। দেখা হয় বলতে, আসলে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয় লড়াই করবার জন্য। আলেকজান্ডার ভারতের কথা শুনেছেন; তিনি এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ভারত দখলে নিতে চান। রাজা পুরু তাঁর গতিপথ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে যান। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত দুর্দমনীয় গ্ৰীক বাহিনীর কাছে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান। পুরুকে গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে হাজির করা হয়।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, আলেকজান্ডার বয়সে তরুণ হলেও অত্যন্ত সুশিক্ষিত একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর পিতা মেসেডোনিয়ার রাজা ফিলিপ সেই সময়ের পৃথিবীর সবচাইতে শ্রেষ্ঠতম শিক্ষকের দ্বারা পুত্রের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মহাজ্ঞানীদের শিক্ষক নাম খ্যাত এরিস্টটল ছিলেন মহামতি আলেকজান্ডারের শিক্ষক। যাই হোক, পুরুকে তাঁর সামনে আনা হলে, আলেকজান্ডার পোরাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কীভাবে তিনি তার সাথে আচরণ করতে চান।

পুরু পরাজিত হলেও সগর্বে উত্তর দিয়েছিলেন, একজন রাজা আরেকজন রাজার সঙ্গে যে সৌজন্যতা এবং মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করে, তিনি আলেকজান্ডারের কাছ থেকে সেইরকম আচরণ প্রত্যাশা করেন। আলেকজান্ডার প্রতিপক্ষের এই জবাবে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর তাঁর সেই মুগ্ধতার মাত্রা এতটাই ছিল যে তিনি পুরুকে কেবল তাঁর নিজের রাজ্যই ফিরিয়ে দেননি, বরং বায়াস অবধি দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ভূমির অধিকারও দান করেছিলেন পুরুকে। পুরু খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ৩১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে মারা গিয়েছিলেন।

এই গল্প আমরা কম-বেশী সবাই শুনেছি। পুরুর বীরত্ব এবং আলেকজান্ডারের সৌজন্যে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যেও যে একটা ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে, সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারিনি। প্রথম কথা হল, এই ঘটনা যে আদৌ ঘটেছিল কিনা, সেটা কে লিখে গেছে? খুব সম্ভবত গ্রীকরাই লিখে গেছে। তারা কি পুরুকে মহিমান্বিত করার জন্যে এই ঘটনা লিখে রেখেছে? নিশ্চয়ই নয়; আমি নিশ্চিত, পুরুর এই উত্তর উপস্থিত আলেকজান্ডারের সহযোগীদের মধ্যে তীব্র হাসির উদ্রেক করেছিল। যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছিল, তখন তো আর 'জেনেভা কনভেনশিন' নামের কোনো কূটনৈতিক প্রবিধি প্রচলিত ছিল না! আলেকজান্ডার নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিলেন, আর ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই পুরু তার রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।

কিন্তু এই ঘটনার সবচাইতে বড় ফোঁকড়টির কথা এখনো বলা হয়নি। ধরে নিলাম, এই ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। পুরুকে সত্যিই গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে ধরে আনা হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে উল্লেখিত কথাবার্তাগুলো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যেহেতু পুরুকে তার রাজ্য আবারো ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে তাদের মধ্যে আরও কথাবার্তা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, পুরু এবং আলেকজান্ডার কোন ভাষাতে কথা বলছিলেন? আলেকজান্ডার প্রাচীন গ্ৰীক ভাষায় কথা বলতেন। অন্যদিকে, পুরু সংস্কৃত অথবা অন্য কোনো প্রাকৃত ভাষায় কথা বলতেন। আলেকজান্ডার সংস্কৃত জানতেন না, পুরু গ্ৰীক জানতেন না। তাহলে?

তাহলে কি সেখানে একজন দোভাষী উপস্থিত ছিলেন, যিনি দুটো ভাষায় জানতেন? যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তৎকালীন ভারতবর্ষের সঙ্গে অন্য সভ্যতাসমূহের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; নইলে একাধিক ভাষায় পারদর্শী অনুবাদকদের প্রয়োজন হত না।


গল্পের ফাঁকফোঁকর -Guitar K Kanungo
Dec. 14, 2024 | গল্প | views:533 | likes:6 | share: 2 | comments:0
ঈশপের একটি বিখ্যাত গল্প আছে —বাঘ এবং রাখাল বালকের গল্প। রাখাল বালক মাঝেমধ্যে মিথ্যে করে বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করত, আর গ্রামবাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসত। কিন্তু যখন তারা দেখত কোনো বাঘ নেই, তখন বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেত। একদিন সত্যিই বাঘ এলো, কিন্তু এবার আর গ্রামবাসীরা তার চিৎকারে সাড়া দিল না। তাদের ধারণা ছিল, এটি আগের মতোই মিথ্যে। ফলে, বাঘ বিনা প্রতিরোধে রাখাল বালক এবং তার গরুগুলিকে মেরে ফেলে চলে গেল।
গল্পটি শিক্ষণীয় হলেও, এতে একটি ফাঁক রয়েছে। বাঘের উপস্থিতি কি সম্পূর্ণ নিঃশব্দে হয়? ঈশপের সেই বাঘটি কি একবারও গর্জন করেনি? যদি গর্জন করে থাকে, তবে গ্রামবাসীরা তা শুনল না কেন, অথচ রাখাল বালকের চিৎকার তারা শুনতে পেয়েছিল? নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এগিয়ে আসেনি, কারণ তারা চাইছিল রাখাল বালককে তার মিথ্যাচারের জন্য শাস্তি দিতে?
এবার অন্য একটি গল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক—হনুমানের। রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র হনুমানকে আমরা সারা ভারতবর্ষে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হতে দেখি। লক্ষণের জীবন বাঁচানোর জন্য বিশল্যকরণী নিয়ে আসতে হনুমান গন্ধমাদন পর্বতে যান। কিন্তু ঔষধি খুঁজে না পেয়ে, পুরো পর্বতটি তুলে নিয়ে আসেন।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, হনুমান শক্তির পরিচয় দিলেও বুদ্ধির পরিচয় দেননি। তার মতে, ঔষধিটি খুঁজে না পেয়ে গোটা পর্বত তুলে আনা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হনুমান কি সত্যিই নির্বোধ ছিলেন?
রাবণের মতো বিদ্বান এবং শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে দূত হিসাবে হনুমানকে পাঠানো হয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্রবিদ। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ এবং বেদজ্ঞ হনুমান ব্রাহ্মণ বংশজাত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। যদি তা সত্যি হয়, তবে তাকে আর একজন 'আদিবাসী' বা 'দলিত' বলা চলে না। তাহলে হনুমান কে ছিলেন? একজন বোকা নাকি জ্ঞানী? আদিবাসী নাকি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ?
একইভাবে প্রশ্ন তোলা যায়—হনুমান বেদজ্ঞ হলেন কেন, যেমনটি বাল্মীকি বলছেন? নিষাদপুত্র একলব্যের একটি লক্ষ্য ছিল—তিনি শ্রেষ্ঠতম তীরন্দাজ হতে চেয়েছিলেন। নিষাদ জনগোষ্ঠী পেশাগতভাবে শিকারী ছিল, আর একজন নিষাদ হিসাবে একলব্য নিজের দক্ষতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই উচ্চাভিলাষ ছিল সহজাত।
কিন্তু হনুমান বেদজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য? তিনি তো এমনিতেই অত্যন্ত শক্তিমান ছিলেন। এই একটি গুণই তাঁকে অন্যদের তুলনায় বিশিষ্ট এবং অপরিহার্য করে তুলেছিল। তাঁর তো রাজর্ষি জনকের রাজসভায় শাস্ত্র নিয়ে বিতর্ক করতে যাবার কথা ছিল না। তাহলে কেন হনুমানের বেদজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন হল ?
এক্ষেত্রে কি বাল্মীকি হনুমানের মধ্যে আধুনিক কালের একজন 'সুপারম্যান'কে দেখতে চেয়েছিলেন? হনুমান কি তাহলে এমন একজন মহানায়ক যাঁর অপরিমেয় শক্তি আছে, কিন্তু নিজস্ব কোনো উচ্চাভিলাষ নেই? এমন একজন যার কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই, কেবল অসহায় এবং পীড়িতদের সাহায্যে তিনি এগিয়ে আসেন, এবং আশা করেন যে যাঁদের তিনি সাহায্য করেছেন, তাঁরাও অন্য অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসবে?
নাস্তিকতা - একটি পর্যালোচনা -পার্থ সারথি চন্দ্র
Dec. 3, 2024 | নাস্তিকতা | views:938 | likes:6 | share: 5 | comments:0

১৬৩৩ সাল। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে - বাইবেল বিরোধী এই সত্য কথা বলার অপরাধে তৎকালীন চার্চ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করলো ‘ধর্মদ্রোহিতার’ অভিযোগে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙ্গে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন, তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক। পৃথিবী স্থির অনড় - সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মূখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞা-পত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল।

শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন - ‘তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরীণ অবস্থায়। শুধু গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে নির্যাতন তো নয়, ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারলো ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরো কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?


শুধু গ্যালিলিও বা ব্রুনো নয়, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, হাইপেশিয়া, এনাক্সোগোরাস, ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস, এনাকু সিমন্ড, লুসিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বার্থৌলোমিউ, লিগেট, ইবনে খালিদ, যিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদ সহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়।


মানব সভ্যতার সূচনা পর্বে ধর্ম ছিল জাদুবিদ্যাকেন্দ্রিক। মানব গোত্রের প্রধান পুরোহিত, যাজক, পয়গম্বরা ছিলেন আসলে জাদু ও তন্ত্রে পারদর্শী। বহুকাল আগে, জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের এক গোত্রের কথা চিন্তা করা যাক। গোত্রের সব মানুষের সামনে একজন সামান্য জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিলেন মুঠোভর্তি কালো গুঁড়ো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বিস্ফোরণে আগুনের শিখা উপরে উঠে গেল। দর্শকদের কাছে ঘটনাটি গণ্য হলো অপ্রাকৃত এবং অসাধারণ হিসেবে। এবং এই ‘অতিপ্রাকৃত ঘটনা’ সবার সামনে ঘটানোর জন্য সামান নিজেকে দাবি করলেন সবার চেয়ে আলাদা একজন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। এই থেকেই অতি প্রাচীনকালে উৎপত্তি হয়েছিল দেবতা, ভূত ও ভগবানের। তাদের তুষ্ট করতে শুরু হয়েছিল পুজো, বলিদান, উৎসর্গ উপাচারের মতো রীতি পালনের। সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের। তৈরি হয়েছিল জাত-পাত। প্রাচীন ভারতে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন চার্বাকরা। যাঁরা এইসব অযৌক্তিক, ব্যাখ্যাহীন, অজ্ঞানতায় মোড়া, কুসংস্কার সর্বস্ব কাণ্ডকারখানায় মজে থাকতেন তাদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা আছে বলে মনে করতেন চার্বাকরা।


ভাবা হয়েছিল যত সময় এগোবে, শিক্ষার প্রসার হবে, জ্ঞানের বিকাশ হবে এই সব কুসংস্কার, অলৌকিকতা থেকে মুক্ত হবে মানুষ। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সে পথে হাঁটেনি। খোলামকুচির মত উড়ে গেছে চার্বাকদের তত্ত্ব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি করা আধুনিক উপকরণকে গ্রহণ করলেও, তার আলোকে ঈশ্বরতত্ত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেনি মানুষ। নিজের কাজ দিয়ে, আবিষ্কার দিয়ে এক ধাক্কায় জ্ঞানের জগতকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এমন বহু মানুষ ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু তাতে কার কি? ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারগ্রস্থ, স্থবির সমাজ, রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী তাকে হয় নির্বাসনে পাঠিয়েছে না হয় হত্যা করেছে। যত দিন যাচ্ছে ততই আরও ধর্মোন্মাদ, কুসংস্কারমুখী হয়ে পড়ছে মানুষ। তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত মনুষ্যমন যেখানে অন্য ধর্মের, অন্য মতের মানুষের কোনও ঠাঁই নেই। তাই উপাসনালয় বানিয়ে পুজোপাঠের শেষ নেই। অন্ত নেই তার ধুমধাম আর জাঁকজমকের। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের ভোটবাজার এখনও নির্ভর করে ধর্মের মেরুকরণের উপরই। তাই মন্দির না মসজিদ, সেটাই আগামী ভারতের সবচেয়ে বড় ভাবনা।


কীভাবে অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা টিকে আছে, কীভাবে আমরা এই অন্ধবিশ্বাসগুলো বংশ পরম্পরায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিই, তা বুঝতে হলে সামাজিক জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণাগুলোকে বুঝতে হবে। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে আর সুজান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে কীভাবে বিশ্বাস বংশপরম্পরায় টিকে থাকে অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন।


‘নাস্তিক’ শব্দটির মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে অবিশ্বাস করে। ‘আস্তিক’ মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস করে। বিষয়টি যদি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে আমাকে এই আলোচনার অবতারণা করতে হত না।

"কেবলং শাস্ত্রমাশ্ৰিত্য ন কর্তব্য বিনির্ণয়।

যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানিঃ প্ৰজায়তে।।"

- এটা আমার বচন নয়, শাস্ত্রীয় বচন। আমি নাস্তিক। শাস্ত্র আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। অর্থাৎ আমি বস্তুত অশাস্ত্রীয় মানুষ। যুক্তিহীন ধর্মকথা মান্য করে পুণ্যলাভের বাসনা আমার নেই। বরং শাস্ত্রমতে যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের ক্ষতিসাধন হয় বল আমি বিশ্বাস করি। এটাই আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মানুভূতি। কল্পনাবিলাসে নাস্তিকরা অভ্যস্ত নয়।


ধর্ম আসলে কী? চুম্বকের ধর্ম যেমন আকর্ষণ করা, মানুষের ধর্ম তেমনি বিশ্বমানবতা, মানুষের প্রতি প্রেম এবং ভালোবাসা৷ এরকম হলে কোনও আপত্তি ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, পরস্পরের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের লড়াই শুরু হয়৷ কার ঈশ্বর সত্য, কার ধর্ম সত্য - এই সব কোন্দলে এখনও পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবন চলে গেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে৷ তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, মানব ধর্মের এবং মানবতার বিরুদ্ধে৷ আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, সেটা থাকার কোনো দরকারও নেই৷ মহাবিশ্ব পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রানুসারেই চলে, এখানে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুর প্রয়োজন নেই৷ স্টিফেন হকিং সেটা ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইতে৷ ঈশ্বরের কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি৷ যেদিন কেউ ঈশ্বরের প্রমাণ দিতে পারবে, আমার আস্তিক হয়ে যেতে আপত্তি থাকবে না। চ্যাপম্যান কোয়েন বলেছেন, “ঈশ্বর খুবই ভঙ্গুর, বিজ্ঞানের ছোট্ট একটি ফুলকি অথবা একটু সাধারণ জ্ঞানই তাকে শেষ করে ফেলতে সক্ষম।” বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের একটি চমৎকার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, “ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সবসময়ই এমন অবস্থা থাকবে যে ভালো মানুষেরা ভালো কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভালো মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই।”


মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর মাটিতে মিশে যায়৷ যেহেতু আমি মানে হচ্ছে, আমার মস্তিষ্ক, যেখানে আমার সব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে, আবেগ ভালোবাসা সব কিছুর কেন্দ্র যেটা, সেই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেই আমার অস্তিত্ব সেখানেই শেষ৷ সেই মগজ যখন মাটিতে মিশে যায়, আমরা আবার আমাদের প্রকৃতিতে ফিরে যাই৷


দুই ধরনের নাস্তিক রয়েছেন। দুই দলই মনে করেন ধর্ম মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর৷ এদের একদল মনে করেন ধর্ম এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে সময়ের প্রয়োজনে, তার জন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই৷ আরেক দল মনে করেন, ধর্মকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করতে হবে৷ আঘাত করতে হবে৷ তবে সেটা কোন শারীরিক আঘাত নয়, লেখার মাধ্যমে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে, কোনো মতবাদকে ভুল ও মিথ্যা তা দেখিয়ে দেয়া৷


'সেক্যুলার' শব্দের মানে কি সত্যিই সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা? অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে এখন এটাই প্রচার করা হয়। বিভ্রান্তি সে কারণেই। আসলে কিন্তু ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ - ‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’ নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে -  রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিত। 'আমেরিকান হেরিটেজ' ডিকশনারিতে 'Secularism' শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে – “The view that religious considerations should be excluded from civil affairs or public education.” এ সংজ্ঞা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ধর্মকে রাষ্ট্রের কাজের সাথে জড়ানো যাবে না - এটাই সেক্যুলারিজমের মোদ্দা কথা। ধর্ম অবশ্যই থাকতে পারে, তবে তা থাকবে জনগণের ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে - ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় হিসেবে; ‘জনসাধারণের’ ব্যাপার স্যাপারে তাকে জড়ানো যাবে না। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সেক্যুলারিজমের প্রকৃত সংজ্ঞা অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মকে পৃথক রাখাই সঙ্গত মনে করতেন, জাতীয় জীবনে সব ধর্মের প্রতি উদাসীন থাকাটাই তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো। তিনি বলেছিলেন, “ধর্ম বলতে যে ব্যাপারগুলোকে ভারতে কিংবা অন্যত্র বোঝানো হয়, তার ভয়াবহতা দেখে আমি শঙ্কিত এবং আমি সবসময়ই তা সোচ্চারে ঘোষণা করেছি। শুধু তাই নয়, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এ জঞ্জাল সাফ করে ফেলাই ভালো। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দাঁড়ায় ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, মূঢ়তা, কুসংস্কার আর বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিভূ হিসেবে।”


আসলে অভিধানে 'Secular' শব্দটির অর্থও করা হয়েছে এভাবে - ‘Worldly rather than spiritual’। সেক্যুলারিজমের অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হলো - Worldly, Temporal কিংবা Profane। শব্দার্থগুলো খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এর অবস্থান ধর্ম কিংবা আধ্যাত্মিকতার দিকে নয়, বরং এর একশ আশি ডিগ্রি বিপরীতে। সেজন্য, সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ অনেকে খুব সঠিকভাবেই করেন - ‘ইহজাগতিকতা’।


সেক্যুলারিজমের মূল সুরটি আত্মস্থ করার পরিবর্তে চলছে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা জাহির করার মহড়া। এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষ তার ‘সংস্কৃতি, সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইয়ে লিখেছেন – “বিপুল প্রচারে সাধারণ মানুষ পরিচিত হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের সাথে। জেনেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা কথার অর্থ হলো - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’। বিপুল সরকারি অর্থব্যয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের এই যে ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে এবং এরই সাথে সম্পর্কিতভাবে আমাদের দেশের মন্ত্রী, আমলা ও রাজনৈতিকেরা মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়াচ্ছেন, গুরুদ্বোয়ারায় নতজানু হচ্ছেন, মসজিদে গির্জায় শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। দীপাবলি, ঈদ, বড়দিন ইত্যাদিতে রাষ্ট্রনায়কেরা বেতার, দূরদর্শন মারফৎ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য দিলে আয়কর থেকে রেহাইয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

 

সাধারণের ভালো লাগছে - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’ মেনে নিয়ে মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিকদের সমস্ত ধর্মের কাছে নতজানু হতে দেখে। উদার হৃদয়ের মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবতে ভালো লাগছে জনগণের – হুঁ-হুঁ বাবা, আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সব ধর্মই সমান অধিকার ও শ্রদ্ধা পায় মন্ত্রী আমলাদের। মন্ত্রীরা এরই মাঝে জানিয়ে দেন সমস্ত ধর্মের সমান অধিকার বজায় রাখতে, দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার মশাল’ জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

 

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে নিয়ে কী নিদারুণভাবে অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে ভাবা যায় না। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোনো পক্ষে নয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ তাই ‘কোনো ধর্মের পক্ষে নয়’- অর্থাৎ, সমস্ত ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত। 'Secularism' শব্দের আভিধানিক অর্থ - একটি মতবাদ - যা মনে করে রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা উচিত।

 


কিন্তু এ কী! এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমরা কী দেখাচ্ছি? সেক্যুলার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও এদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। কোনো প্রকল্পের উদ্বোধন বা শিলান্যাস করা হয় মন্ত্রোচ্চারণের প্রদীপ জ্বালিয়ে, পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হয় নারকেল ফাটিয়ে। রাজনীতির ব্যবসায়ীরা ‘সেক্যুলারিজম’- এর নামে নানা ধর্মকে তোল্লাই দিয়ে সর্বধর্মের সমন্বয় ও সংহতির বাধা গৎই এতদিন বাজিয়ে এসেছেন।”


সেক্যুলারিজম বহু শতাব্দী ধরে (আমাদের উপমহাদেশে) যে ভাবে আচরিত এবং রূপান্তরিত হয়ে আসছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ই যদি তার ঠিক বঙ্গানুবাদ বলে ধরে নেই, তবে শুধুমাত্র সব ধর্মের সহাবস্থানেই তার অর্থ পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এ কথা সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, ধর্ম থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসেন প্রবীর ঘোষ কিংবা পেরিয়ার স্বামী।


বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘সিন’ বা 'পাপ' নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দু’টিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১ টি দেশের মধ্যে করা এক নিরীক্ষি অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।


ঈশ্বরহীন এইসব সমাজের অবস্থা তবে কেমন? সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ - গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবন যাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরীর দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমি এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ বেঁছে নেন, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করেন না, কিংবা হাজার বছরের পুরোনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করেন না।


অনেকে বলেন, দিন দিন যা দেখছি, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নাস্তিকতা একটি ধর্মে পরিণত হবে। আমি বলি, উঁহু, নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঈশ্বর নেই, সেখানে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি নেই। ধর্ম তাকেই বলি, যা ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বর প্রদত্ত অনুশাসনকে বোঝায়। নাস্তিক্যবাদে ঈশ্বর অনুপস্থিত। নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নামে অনুশাসনকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন মানুষকে সুপথে চালিত করতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন ও বিজ্ঞানই যথেষ্ট। ধর্ম মানে কয়েকটি ভুর্জপত্রে লিখন নয়, যা মেনে চললেই ধার্মিক হওয়া যায় আর না মানলেই নরকের কীট! মানুষের ধর্ম - মানুষের মানবিক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। আসলে নাস্তিক বলে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে নাস্তিক, নির্ধার্মিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী - এদের মধ্যে কোনো প্রথাগত বিভেদ নেই, যা আছে তা হল সব বুদ্ধিগত এবং অহিংসতা।


পৃথিবীজুড়ে আস্তিকদের ধর্মচর্চা, ঈশ্বরচর্চার পাশাপাশি চিরকালই বিপরীত স্রোত হিসেবে থেকেছে অবিশ্বাস এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নাস্তিক্যবাদ। এক সময় পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কমিউনিজম-এর প্রভাবে নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়লেও বর্তমানে তা নিম্নমুখী। কলেজ স্ট্রিটের কানাগলি থেকে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা’ নামে অতি চটি একটি পত্রিকায় লেখক ভবানীপ্রসাদ সাহু বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে নাস্তিকদের একটা সংখ্যাতত্ত্ব  প্রকাশ করেছিলেন ২০০৫ সালে। এতে বলা হয়েছে ১৯৯২ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যার ২০.৪ শতাংশ ছিল নাস্তিক বা ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী। ১৯৯৬ সালে সেই সংখ্যা হয় ১৯ শতাংশ এবং ২০০২ সালে তা পৌঁছোয়  ১৫ শতাংশে। এই মুহূর্তে উইকিপিডিয়া খুলে 'উইন-গ্যালপ ইন্টারন্যাশনালের' করা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালে নাস্তিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে, ২০১৫ সালে  ১১ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ৯ শতাংশে। 


সবার ফেসবুকে উপছে পড়া ভক্তি, সবার হোয়াটসঅ্যাপে ধর্মের ডিজিটাল বাণী। এর মধ্যেখানেই বকচ্ছপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নাস্তিকতার পাঠ নিয়ে বসা মানুষটা। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন মায় পরিবারের মধ্যেও সে একা। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে এক সময় ইতু পুজো, নানা রকমের ষষ্ঠী, সন্তোষী মার ভক্ত পরিবার কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছে গোপাল ঠাকুরের পুজোয়। পাড়ার মোড়ে দিব্যি জমে গেছে গোপালের সিংহাসন, মুকুট, পোশাক, বিছানা, মশারি বিক্রির দোকান। সেক্টর ফাইভে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা জিন্স আর টপ পরা মেয়েটা হাতে দিব্যি বেঁধে রেখেছে লাল বিপত্তারিনীর সুতো। বাবার বার বলে সোমবার উপোষ করছে ১৯-২০র ছেলেরা। অথচ এই বঙ্গেই এক সময় ভূত-ভগবান-শয়তান-এর বিরুদ্ধে কোমর কষে লড়াইয়ে নেমেছিলেন গণ বিজ্ঞান আন্দোলনের মানুষজন।

আত্মীয়-স্বজন, সমাজ-সংসারের দাবি সামলাতে গিয়ে ব্যক্তিগত মতামত, স্বাধীনতার পরিসর কমেই যাচ্ছে নাস্তিক কুলের। কারণ, তার জন্য কোনও স্বস্তির জায়গা নেই। কালিপুজোর সময় শব্দবাজির অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ঠিক কোথায় গেলে শান্তি মিলবে, তা যেমন সারমেয়রা বুঝতে পারে না, এ অবস্থা অনেকটা যেন তাই। গোটা পৃথিবী জুড়ে, গোটা দেশ, এ পাড়া-সে পাড়া, এমনকি ঘরের ভেতর যেভাবে অতিভক্তির আধিক্য বাড়ছে, তাতে নাস্তিকরা বিপন্ন বইকি। এ বিপন্নতা যাঁরা একটু অন্যভাবে বাঁচতে চান তাদেরও।

এখন প্রকাশ্যেই নাস্তিকতার পক্ষে লেখালেখি হচ্ছে - যে বিষয়টা একসময় কল্পনাও করা যেত না। নিজেকে নাস্তিক সাজিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকার মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। এই নিরন্তর লড়াই চলছে, চলবে। যতদিন না পৃথিবী থেকে ধর্মান্ধতা দূর করা যাবে, যতদিন না ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নামে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া বন্ধ না হবে, যতদিন না মানুষ প্রকাশ্যে তার হৃদয়ে জমে থাকা কথাগুলো বলতে পারবে - ততদিন এই আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। সেই স্বপ্নের লাল সূর্য উদিত হতে আর বেশি দিন সময় লাগবে না।

আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এবং মানবতা শিশুকাল অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। এখন আর আমরা রূপকথার কল্পিত পরম পিতা নিয়ে মোহিত নই, যে পরম পিতা ‘ডাবের ভেতর জল কেন’ থেকে শুরু করে বিগব্যাং কিংবা ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হাজির হবেন আর আমাদের প্রয়োজনের অলীক ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাবেন। সময় এগিয়েছে অনেক, আমরা নিজেরাই এখন নিজেদের দায়িত্ব নিতে সক্ষম, মানুষ নিজেই আজ নিজের ভাগ্যবিধাতা। আমরা আর রূপকথার জাল বুনে নিজেদের প্রবোধ দিতে চাই না, বরং বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এখন জীবন সাজাতে চাই। লেখাটা শেষ করব একজন প্রখ্যাত ব্যক্তির হীরকখণ্ড দিয়ে, “The true atheist will stay silent. To give a theist someone to debate is to harbour his delusion further.” - Charles Darwin.

দাস মনোবৃত্তি -মুজিব রহমান
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:1041 | likes:36 | share: 1 | comments:0

দরিদ্র দেশের প্রায় সকল মানুষের মধ্যেই একটি দাস মনোবৃত্তি থাকে। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন বা ক্ষমতা থাকে না। এটা অবশ্য আদিকাল থেকেই দেখে আসছি। এথেন্স নগর রাষ্ট্রে অর্ধেকের বেশি ছিল দাস। তারাই ছিল কর্মঠ ও শক্তিশালী। যদি তাদের মধ্যে কেউ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতো তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও শক্তির জোরে ক্ষমতা অনায়াসেই দখল করে ফেলতে পারতো। রোমান সাম্রাজ্যে আমরা দাসবিদ্রোহ দেখেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই নেতৃত্ব ব্যর্থতার কারণেই চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। ভারতে একটি স্বল্পকালীন দাস রাজবংশ কায়েম হয়েছিল। মোহাম্মদ ঘুরির সেনাপতি ছিলেন দাস- কুতুবউদ্দিন আইবক। ঘুরির কোন সন্তান ছিল না এবং তিনি কয়েকজন দাসকে যুদ্ধে ও শাসনকার্যে পারদর্শী হিসেবে তৈরি করেছিলেন। সে কারণেই আইবক শাসক হতে পেরেছিলেন। মাত্র ৪ বছর শাসনের পরে মৃত্যুবরণ করার পরে শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ ও গিয়াসউদ্দিন বলবনও দাস হিসেবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ঘুরির উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তিনি দাসদের তৈরি না করলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারতেন না।


অধিকাংশ মানুষেরই নেতা হওয়ার বাসনা থাকে না। ইতিহাসে অনেককে দেখলে মনে হয়, সম্ভবত নেতা হতে চাইলেই হওয়া যায়। এই চাওয়াটা ইচ্ছে করলেইতো হয় না। তার মধ্যে সাহস ও বিচক্ষণতাওতো থাকতে হবে। আবার ক্ষমতা স্পৃহাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি নেতা হতে চাই- এমন একটি ভাবাদর্শ তাকে অনেক দূরই এগিয়ে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা একালে ডুনাল্ড ট্রাম্পকে দেখলাম, নেতা হতে চাইতে। তার রাষ্ট্র চালানোর যোগ্যতা ছিল না, বিচক্ষণতাও ছিল না তেমন কিন্তু স্পৃহাটা ছিল প্রকট। তিনি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে ঠিকই রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। অবশ্য এমন নেতৃত্ব সচরাচর ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, সামরিক শক্তির সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। আফগানিস্তানে তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ধর্মকে ব্যবহার করে, ভারতের নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে এবং হুমো এরশাদ সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসেছেন নিজেদের দেশ চালানোর যথেষ্ট যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও। তবে তাদের আমি সাহসীই বলি। যোগ্যতা না থাকার পরেও ক্ষমতালিপ্সা তাদের ক্ষমতার মসনদে পৌঁছে দিয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘ক্ষমতা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যে সমাজে অভিজাততন্ত্র কিংবা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের মতো কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, সেখানে যারা অধিক ক্ষমতালিপ্সু তারাই ক্ষমতা অর্জন করে। সেখানে গড়পড়তা সাধারণ লোকদের চাইতে যাদের ক্ষমতাপ্রীতি বেশি তারাই ক্ষমতা দখল করতে পারে।’ রাসেলের এই পর্যবেক্ষণ আজকের দুনিয়াতেও লেগে যাচ্ছে। সাহসী মানুষের মধ্যে ক্ষমতাস্পৃহাকে বাড়িয়ে দেয়।

আমরা চেঙ্গিস খান বা কয়েকজন সফল ধর্মপ্রচারকের জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই তারা ক্ষমতা দখলের জন্য কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই না করেছেন। তারা বিভিন্ন বাধাকে অতিক্রম করেছেন এবং দৃঢ়ভাবেই নিজেকে টিকেই রেখেছেন প্রতিকূলতায় এবং চাওয়াটাকে সফলতার দিকেই নিয়ে গিয়েছেন। এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের একটা মনোভাব রয়েছে। তারা সাতপাঁচে যেতে চায় না। হাঙ্গামা এড়িয়ে চলতে চায়। স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদে রাখতে পারলেই সুখবোধ করেন। তারা ক্ষমতায় যেতে চায় না আবার কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও প্রচেষ্টা চালায় না। তারা আশায় থাকে কেউ এসে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিবে। কিন্তু সমাজে দাস মনোবৃত্তি অধিক হলে, নতুনরা ক্ষমতায় এসেই পুরাতনের মতোই আচরণ করে। সে দেখতে চায় চারদিকে অসংখ্য অনুগত মানুষ। তাঁর আঙুল উত্তোলনে মানুষও উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে মানুষকে উদ্বেলিত হতে দেখেছি। 'পারফিউম' নামের একটি সিনেমা দেখেছিলাম। অসাধারণ সিনেমা। সেখানে নায়ক একটি স্পেশাল পারফিউম শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। সেই পারফিউমের আকর্ষণে মানুষ পাগল হয়ে উঠে। পারফিউম লাগিয়ে রুমাল দুলিয়ে মানুষকেও দোলাতে থাকেন। একসময় নিজের মাথায় সেই পারফিউম ঢেলে দেন। মানুষ তাকে সাবাড় করে দেয়। দাস মনোবৃত্তিটা এমন যে, সেখানে দাসরা নেতার প্রতি প্রচণ্ড আস্থা প্রদর্শন করে। নেতাই যেন সব। তার বিজয় মানে নিজের বিজয়। তার দোষের বিপরীতে নিজেই একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে নেয়। নেতার প্রতি তীব্রভাবেই অনুগত থাকে। মনে হবে, ‘নেতৃত্বের জাদু’, বাস্তবিক ঘটনা হল- দাস মনোবৃত্তির ফল এটা। কিছু মানুষ সর্বোচ্চ নেতার পেছনে হাঁটতেই পছন্দ করে কিন্তু কোন ভাবেই নেতা হতে চায় না। নেতাদের কাছেও তারা খুবই উপাদেয় খাদ্য। তারা খাদ্য হয়ে যাবে তবুও নেতার প্রতি আস্থা হারাবে না। এমনটা আমরা ওয়াজের বক্তার ক্ষেত্রেও দেখি। তাদের অনুরাগীরা নিজের স্ত্রী, কন্যাকেও দিতে পারে। বক্তা মামুনুল হকের ক্ষেত্রেও দেখলাম, তার দুই মুরিদই নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে প্রিয় হুজুরের জন্য ত্যাগ করেছে। কিন্তু তাদের মনে একবারের 

জন্যও প্রশ্ন জাগবে না, ‘হুজুর তার জন্য কি ত্যাগ করবে?’


এ ভূখণ্ডে স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই আপনি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দেখেননি। একইভাবে একসময় ভারতজুড়ে ছিল বৌদ্ধ বিহার। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো। যখন বৌদ্ধ পাল শাসনের অবসান হচ্ছিল, বিভিন্ন বিহার দখলে নিচ্ছিল সেনরা তখন আমরা কোথাও প্রতিরোধ দেখিনি। আমরা গীর্জা, মন্দির প্যাগোডারও কোন প্রতিরোধ দেখিনি। সোমনাথ মন্দিরে ১৭ বার হানা দিয়ে লুণ্ঠন করে সুলতান মাহমুদ আর ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খলজি দখলে নেয় লক্ষণ সেনের রাজত্ব! কারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করে অন্যের গলগ্রহ হয়ে। তাদের মধ্যে একটি দাসমনোবৃত্তি কাজ করে। হেফাজতের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি আমরা দেখলাম। একটা দৃশ্য সবাই দেখেছেন যে, তালবেলামরা কান ধরে সারিবদ্ধভাবে মতিঝিল ছেড়ে যাচ্ছে। ভেড়ারপালের সাথে মিল করতে পারবেন। হাজার হাজার ভেড়ার পালে একটি নেকড়ে অনায়াসেই ঢুকে একটি ভেড়াকে খেয়ে ফেলতে পারে। ভেড়ার মধ্যে রয়েছে দাসমনোবৃত্তি আর নেকড়ের মধ্যে সাহস। ভেড়ার মোট শক্তি বিশাল কিন্তু তারা পারে না। কতজন ব্রিটিশ ৩০ কোটি ভারতবাসীকে শাসন করতো? ভারতে অনায়াসেই আর্যরা ঢুকে যায় এবং তাদের দেবদেবীদের চাপিয়ে দেয়। বহিরাগত মুসলিমরাও অল্পই ছিল কিন্তু তারাও শুধু ক্ষমতাই দখল করেনি, দাসমনোবৃত্তির ভারতবাসীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে মুসলিম বানিয়ে ফেলে। স্থানীয় ধর্ম আর ভারতে বলিষ্ঠভাবে নেই। বৈদিক ও ইসলাম ধর্ম দুটিই বহিরাগত ধর্ম। পুরো ভারত ছিল কৃষি নির্ভর- জালিক আর হালিক; মানে জেলে আর হালচাষি! আর্য ও বহিরাগত মুসলিমরা ছিল যোদ্ধা। যেন ভেড়ার পালের উপর নেকড়ের হামলে পড়ার মতো ঘটনা ঘটলো!


আজকেও আমরা দেখি এদেশে একজন নেতার পেছনে শতে শতে লোক হাঁটে। কেউ কখনো একপেট খেতে পারে বা চা-বিস্কিটেই খুশি থাকে। নেতা এক পেট খেতে দিলে বিরাট কিছু। এই প্রবণতাটা আমরা পাশ্চাত্যে দেখি না। তারাও দলকে সমর্থন করে কিন্তু নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়-রোজগার ছেড়ে দিয়ে নেতার পেছনে পড়ে থাকে না। তারা ভোট দিতে আসে। আর নেতাকে লিফলেট নিয়ে দৌড়াতে বা পাড়ার মোড়ে হ্যান্ড মাইকে একা একা কথা বলতে দেখা যায়। আর আমাদের দেশে নেতা আসবেন বলেছেন সকাল ১০ টায়। ভেড়ার পাল কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। 

 দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই দেখবেন, প্রত্যেক নেতার সন্তানরাই কোটি কোটি টাকার মালিক। ইউটিউবে সার্চ দিন দেশের সেরা ১০ ধনী। এরমধ্যে নেতাদের ছেলেদের পেয়ে যাবেন যারা কিছু না করেও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশের কোন মানুষই কিন্তু প্রশ্ন করে না, ‘তিনি এতো টাকার মালিক কি করে হলেন? তার তো কোন কাজকর্ম নেই?’ দাস মনোবৃত্তির মানুষ এটা ভাবতেও পারে না। তারা খুশি হয় যে, তার নেতা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সেই টাকাও দেশে নেই। তাদের পাচার করার কারণেই দেশের মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও সুফলটা পায় না। এতো মানুষ নামমাত্র বেতনে গার্মেন্টে কাজ করে বা স্ত্রী-পরিজন ছেড়ে ঊষর মরুভূমিতে পড়ে থেকে অর্থ উপার্জন করে শেষ পর্যন্ত সুখের মুখ দেখে না। বহু প্রবাসীই তার সম্পদ হারিয়ে ফেলে কতিপয় দস্যুর কাছে।


দাস মনোবৃত্তি আত্মসম্মান নষ্ট করে দেয়। তাদের মধ্যে কর্মের স্পৃহাও নষ্ট করে। মানবাধিকার পাওয়ার দাবিও করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন ভোট না দিতে পারলেও কোন ক্ষোভ তৈরি হয় না। এদেশে দুর্ভিক্ষে প্রচুর লোক মারা যেতো। দেখা যেতো তখনও জমিদারদের গোলা ভরা ধান ছিল। কিন্তু সেই ধান ছিনিয়ে নেয়ার সাহস হতো না। ছিয়াত্তরের (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) দুর্ভিক্ষের আগে বাংলার মানুষ ছিল ৩ কোটি। দুর্ভিক্ষের পরে বেঁচে ছিল ২ কোটি মানুষ। মানে হল, এক কোটি মানুষ না খেয়ে মারা গেল! কিন্তু জমিদারদের গোলা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেনি। খাদ্যের সুষম বন্টন হলে সবাই বেঁচে থাকতে পারতো। পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) দুর্ভিক্ষে ব্রিটিশ সরকার জাপানিদের ভয়ে খাদ্য প্রত্যাহার করে নিলেও বাংলায় মোট খাদ্যের যে মজুদ ছিল তাতে ৩০ লক্ষ মানুষকে না খেয়ে মরার কথা নয়। তখনও বাজারগুলোতেও মজুদদারদের কাছে প্রচুর চাল ছিল। কিন্তু মানুষের কাছে টাকা ছিল না। ভুখা-নাঙ্গা মানুষ হাত পাততো কিন্তু খাবার ছিনিয়ে নিতে পারতো না। দলে দলে লোক একটু খাবারের জন্য হাত পেতে থাকতো কিন্তু পেতো না। আতঙ্কে ধনিরা আরো মজুদ করে ফেলেছিল। বিহার থেকেও হাজার হাজার অভূক্ত মানুষ এসেছিল কলকাতায়। জমিদারগণ এটো ফেললে তা খেতে ঝাপিয়ে পড়তো। মানুষে কুকুরে লড়াই চলতো ডাস্টবিনে। কিন্তু ছিনিয়ে নেয়ার স্পৃহা, নেতা হওয়ার স্পৃহা কিংবা বেঁচে থাকার স্পৃহা তাদের মধ্যে ছিল না। এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষকে সেই দাস মনোবৃত্তিরই মনে হয়।

ধর্মকারার প্রাচীর -মহম্মদ মহসীন
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:925 | likes:13 | share: 0 | comments:0

 দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ মালাউই (Malawi)।  সে দেশের প্রধান ভাষা চেচুয়া (chichuwa)।  সে ভাষায় একটা কথা আছে।  "M' mera mpoyamba". ইংরাজি করলে হয় catch them young. 

অর্থাৎ বোধবুদ্ধি গজানোর আগেই পাকড়াও করো। সারাজীবন, সেই ধারণাতেই বাঁধা থাকবে। এমন বন্ধন যে সে বন্ধন খুলে দিলেও সে বুঝতেও পারবে না। কথাটি এত সত্য যে বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শণের অনুসারী দল এটাই বাস্তবায়িত করে থাকে। ফলও ফলে। 

একমাত্র যুক্তিবাদ বলে, মানুষ বড় হোক, চিন্তা করতে শিখুক, তবেই তার মধ্যে যুক্তিবাদের আলো দাও। তার জীবনে কোন পথে চলবে, বড় হোক,  বড় হয়েই তা ঠিক করবে। তার মধ্যেকার অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধত্ব দূর হলে তবেই মানবিক গুণের বিকাশ ঘটবে। 

 কিন্তু সমাজ  মানুষকে বড় হতে দেয় না। মানুষের বয়স বাড়ে, সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে, নাম ডাক বাড়ে, কিন্তু সেই মানুষ কখনো বড় হয় না।

 সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছেন, “এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ থেকে গেল

কিছুতেই বড় হতে চায় না

এখনো বুঝলো না যে ‘আকাশ’ শব্দটার মানে

চট্টগ্রাম কিংবা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়

মানুষ শব্দটাতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই

ঈশ্বর নামে কোনো বড়বাবু এই বিশ্বসংসার চালাচ্ছেন না

ধর্মগুলো সব রূপকথা

যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে

তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না।”


মনোবিদ বলেন, শিশুমনে যে ধারণা প্রোথিত করা হবে ছোটবেলাতেই, তা থেকে নট নড়ন-চড়নের মানসিকতা তার  ষোলোআনা। 

ঠিক এইকারণেই ধর্মের অন্ধবিশ্বাস প্রোথিত হয়ে যায় ছোট থেকেই। ভক্তি গ্রাস করে যুক্তিশীল মানসিকতাকে। 

  ধর্মের প্রতি অন্ধভক্তি মানুষের মধ্যেকার র‍্যাশানাল চিন্তনশীলতাকে গ'ড়ে উঠতে দেয় না। জন্মগতভাবে মানুষ যে যুক্তিশীল মানসিকতা পেয়ে থাকে, তাকে বাঁচতে দেয় না রাজনীতিক ও সামাজিক স্বার্থনীষ্ঠ মদতে পুষ্ট অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী জগৎ। মারতে মারতে, মেরেই ফেলে। 

 কিভাবে এই অন্ধবিশ্বাস একটি শিশুকে, তার পরিবার ও সমাজকে বিপথে চালিত করে তা উপলব্ধি করলে দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।


 একটি উদাহরণ দিলে বক্তব্যটি হয়তো আর কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। আমার বাস্তব জীবনে দেখা ঘটনা। মুসলিম পরিবারেই বিভিন্ন সামাজিক স্তরে, ছোট শিশুদের আরবী শিখতে চাপ দেওয়া হয়, নামাজ পড়া শিখিয়ে দেওয়া হয়। সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার রমজান মাসে এইসব ছোট ছোট শিশুদের শেখানো হয় সারাদিন নিরম্বু উপবাসের মাধ্যমে কৃচ্ছসাধন করেই ঈশ্বরের কৃপালাভ করা যায়। যার কাছে ক্রিকেট, ডাংগুলি, নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব, লেখাপড়া এইসব বিষয় হল জীবন্ত সেখানে কিম্ভুতকিমাকার ঈশ্বর ধরে এনে তাদের মনের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়, সর্বক্ষণ তার 

অস্তিত্বহীনতাকে ঢাকতে নানান ফাঁদ ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয় তার মাঝে প্রশ্ন করার মানুষটাকে। ছাঁচে ঢেলে তাকে বানিয়ে ফেলা হয় হিন্দু অথবা মুসলিম। যাতে মানুষ হতে না পারে তার চেষ্টা থাকে নিরন্তর।

 

 শিশু থেকে একটু বড় হওয়া কিশোরী-কিশোরদের কাছে কষ্টকর কাজগুলি সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই একটা এ্যাডভেঞ্চার। জীবনের প্রকৃত এ্যাডভেঞ্চার, জীবনের প্রকৃত কষ্টকর কাজগুলিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে তা অতিক্রম করার পরিবর্তে তাদের সামনে রাখা হয় সারাদিন না খেয়ে দিনাতিপাত করার মেকি চ্যালেঞ্জ। জীবনে একটি মেকি ও পলায়নপর জীবনশৈলী গড়ে তোলা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এভাবেই যুবসমাজের মধ্যে মুক্তিকামী চেতনা গড়ার পরিবর্তে ইংরাজদের মদতপুষ্ট এইধরণের মেকি চ্যালেঞ্জকে যুবসমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল ধর্মগুরুরা। এভাবে যুবসমাজ বাস্তব দায়িত্বের থেকেও এক অলৌকিক দায়কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। ক্ষতি করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে। জনৈক বিপ্লবীর এভাবেই মগজধোলাই হয়। বিপ্লব ছেড়ে ধ্যানট্যানে মনোযোগ দেন, আমরাও তার বিল্পবী জীবন নিয়ে যত না আগ্রহী, তার শতগুণ বেশি আগ্রহ নিয়ে লম্ফঝম্ফ করি তার এই ধর্মান্ধীয় 

জীবন নিয়ে। 


 আসলে আবার বলি, ধর্ম হলো পরিশ্রম না করে জীবিকার্জনের সহজতম উপায়। 

যেহেতু ধর্ম রাজনীতির এক মোক্ষম হাতিয়ার, যেহেতু ধর্মকে ব্যবহার করে সম্প্রদায়গত আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটবাক্সে সাফল্য পাওয়া যায়, যেহেতু ধর্মনেশায় আচ্ছন্ন জনগনকে তাদের নেশার বস্তুটি সরবরাহ করতে পারলেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়, তাই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার সমস্যা হয় না। ধর্ম নেশাগ্রস্তদের ধর্মীয় আকাঙখা পূরণ করতে পারলেই অনেক দায় পূরণ না করলেও রাজনীতিগত কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, তাই মানুষ ধর্মের অন্ধকারে বাস করুক, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই সেটি চায়। ধর্মনেশায় উৎসাহ যোগায়, ধর্মান্ধতা প্রসারে ইন্ধন যোগাতে চায়। ইংরাজ শাসনও চেয়েছিল, সেই বিপ্লবী আরো কিছু যুবককে বিপথে চালিত করে ধর্ম ধর্ম করুক, তাতে তাদের শাসন কায়েম রাখায় অনেক সাহায্য করা হবে। ইংরেজদের দেখা যায় অনেক "মহাপুরুষের" পাশে দাঁড়াতে। “মহাপুরুষ” গুলিকেও দেখা গেছে, ইংরেজদের পাশে দলবল নিয়ে সমর্থন দিতে। 


 আজ যা বলতে এসেছি, ধর্মের যাপন, অভ্যাস শিশুদের মধ্যে প্রোথিত করে। সেই শিশুদের মধ্যে জিজ্ঞাসার মানসিকতাকে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেয়। কেন রাতদুপুর থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত মাইক্রোফোন বাজিয়ে নিজ ধর্মাচরণের কারণে অপরের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি, এ প্রশ্ন তাদের মনে আসার বীজটিকে মেরে মেরে মৃত করেই ছাড়ে, সুনাগরিক হওয়া তো দূরস্থান, কেন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে জিইয়ে জিইয়ে মানুষের সমাজকে ইতরপ্রাণীর জীবন থেকেও নিকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে ধর্মের যাপনে,  সে প্রশ্ন তাদের মনে আসে না। ধর্ম কেন পুরুষতান্ত্রিকতায় পক্ষপাতিত্ব করে নির্লজ্জভাবে, এ প্রশ্ন আসেনা, কেন দিনের পর দিন ভোরের আজানে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হবে, কেন সংকীর্তনে অবিরাম মাইক বাজিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হবে, কেন ধর্মের আশ্রয়ে থেকে মানুষের উপর অত্যাচার করা হবে, এসব প্রশ্ন তাদের মনে আসে না। এক্কেবারে বোধ বুদ্ধি সহমর্মিতার দরজা জানালা বন্ধ করে অচল থাকার নেশায় বদ্ধপরিকর এই সকল মৃতমনের রোবটেরা শুধু চিন্তা করতে শেখায় নিজের কথা, শুধুই নিজের কথা। এসেছি একা (কে, কোথা থেকে?),  যেতে হবে একা (কোথায়?) এসব পাতি কথাগুলি তাদের মনে গভীর জীবনদর্শণ। 

এমন নির্লজ্জ স্বার্থপরতার শিক্ষা দেয় সকল ধর্মদর্শণ। 

কেন নারী কন্ঠে আজান শুনি না, কেন নারীকে ধর্মগ্রন্থে আপনার অধিকার আদায়ের পথে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়, সে বিষয়ে পিছনপানে ঘোরা সমাজের চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্দোলনের কথা ধার্মিকেরা চিন্তাও করতে পারে না।

  শিশু থেকে কিশোরী/কিশোরদের ধার্মিক করে গড়ে তোলা হয় এভাবেই, যাতে তাদের বোধের দ্বার রুদ্ধ থাকে চিরকাল। বিজ্ঞানের সারতথ্যের সাথে ধর্মগ্রন্থের সংঘর্ষ থাকলে ধর্ম তাদের মিথ্যাকে জোর দবরদস্তি চাপিয়ে দিতে মরিয়া। এজন্য বিজ্ঞানীদের পোড়াতে, অত্যাচার করতে, হত্যা করতেও তাদের হাত কাঁপে না

 এরা আসলে এক বোধহীন রুদ্ধমনের প্রাণী। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে না, যেখানে ছয়মাস দিন, ছয়মাস রাত্রি, সেখানকার অধিবাসীরা কিভাবে সারাদিন নিরম্বু উপবাস  পালন করবে? "পৃথিবী ঘোরে" এই সামান্য তথ্যটিও যার অজানা সেই ধর্মগ্রন্থ প্রণেতা কিভাবে মহাবিশ্ব নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা দেখান।  বিজ্ঞানের ভবিষ্যত নিয়ে যার সামান্যতম ধ্যান ধারণা নেই, তিনি কিভাবে শ্লোক-সত্য লেখেন যে গর্ভস্থ ভ্রুণের লিঙ্গ,  শিশুর জন্মের পূর্বে স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া  যেখানে গর্ভস্থ ভ্রুণের লিঙ্গ কোনো মানুষ জানতে পারবে না?

 এসব প্রশ্ন ধার্মিকদের বিব্রত করে না, অস্থির করে না, ধর্মের প্রশ্নাতিত আনুগত্যে সন্দেহ জাগাতে পারে না। 

  ধর্ম যুবতী/যুবকদের মনকে আলোড়িত করে প্রশ্ন জাগায় না, কেন রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গের" জগমোহন বালবিধবা ননীবালার বিধবা-মাতৃত্বকে সমর্থন করেন, কেনইবা শচীশের সঙ্গে বিবাহে উদ্যোগী হন। তাঁর কথা, “দেখ্‌ বাবা, আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমারা কিছুকে মানিনা বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।” 

যুবতী/যুবকদের মনে নাস্তিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে পারে না। 

 আকাশের পাখিকে  বেড়ি পরিয়ে খাঁচার ভিতর রাখতে রাখতে যেমন তাকে খাঁচাতেই অভ্যস্ত করে ফেলা হয়, খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে যা রে উড়ে যা রে পাখি বলে পীড়াপীড়ি করলেও খাঁচা থেকে  বেরিয়ে ওড়ার ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি তার আর থাকে না, তেমনই 

ধর্মকারার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে থাকতে বদ্ধমনা ধার্মিকেরাও নিজেদের মুক্তিস্পৃহাকে কখন যেন হত্যাই করে ফেলেছে, তা তাদের চেতনাতেই আসে না। 

  ধর্মকারার প্রাচীরে  বজ্রহানার কথা তো তাদের মাথায় স্বপ্নেতেও আসে না। সেই প্রাচীরের দরজা খোলা থাকলেও প্রকৃতির বুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা তারা ভাবতেও পারে না। 


তাদের  চেতনার দ্বার খোলার জন্য আমাদের নিরলস প্রয়াস তাই জারি থাকবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, নিরবধি কাল পর্যন্ত। দেশ থেকে দেশান্তরে।

বিশ্বাসবাদ ও কর্পোরেটদের লালসার শিকার যোশীমঠ -পীযূষকান্তি বালা
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:300 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দেশ বিদেশের খবরের শিরোনামে আজ 'যোশীমঠ'। উত্তরাখন্ডের চামোলি জেলার ধর্মনগরী যোশীমঠ। নিউজ ব্রেকিং নিউজ, টিভি চ্যানেল এ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের(সে শাসক বা বিরোধী দলের হোক) গম্ভীর আলোচনা। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত বা সমাধানের পরামর্শ চাপা পড়ে যায় রাজনৈতিক দলের বক্তাদের চিল চিৎকারে। কারণ বোঝা যায় উদ্দেশ্য সমাধানের পথ বাতলানো নয়। ঘটনা যখন হট কেক, টি আর পি বাড়িয়ে নাও আর কি। হঠাৎ খবরের শিরোনামে যোশীমঠে ধস নেমেছে।বিশেষজ্ঞরা যত সময় গড়াচ্ছে ততই শোচনীয় ও ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে যোশীমঠ'। বিরাট বিরাট ফাটলের কবলে ঘর বাড়ি হোটেল রাস্তা ঘাট। প্রাচীন ধর্মস্থান যোশীমঠ' সেখানকার বাসিন্দারা হাড় কাঁপানো এই শীতে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। বেলাগাম ঘর বাড়ি নির্মাণ ও পর্যটকদের উত্তরোত্তর ভিড়ে এই তীর্থস্থানগুলির অস্তিত্বও আজ বিপদের মুখোমুখি। সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। সেই ভিড় সামাল দিতে বিগত দশকের তূলনায় অনেকটাই বেড়েছে হোটেল, লজ, হোম স্টে ও ধর্মশালার সংখ্যা। এই বেলাগাম  নির্মাণ যোশীমঠ' ধ্বংসের একটা বিরাট কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

        অন্য একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে NTPC র তপোবন বিষ্ণগড় প্রোজেক্ট। সেখানে ১২ কি. মি. পাহাড়ি এলাকায় টানেল করা হচ্ছে যেখান দিয়ে গঙ্গার ধৌলী নদীর জল টানেলে এসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সেই সুড়ঙ্গের জন্যই যোশীমঠের মাটি আলগা হয়েছে। ইসরো জানিয়েছে গত ২০২২ র এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮.৯ সেন্টিমিটার যোশীমঠ বসে গিয়েছে। এবং গত ২৭/১২/২০২২ থেকে ০৮/০১/২০২৩ উপগ্রহের নেওয়া উপগ্রহচিত্রে ধরা পডেছে গাড়োয়াল হিমালয়ের জনপদ মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ মাত্র ১২ দিনেদিনের ব্যবধানে তোলা ছবিতে দেখা গিয়েছে যোশীমঠের মাটি ধসে গিয়েছে ৫.৪ সেমি। ইসরো রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু যোশীমঠ' নয় আলির রাস্তাও ধ্সে যেতে পারে। এই মুহূর্তে যে হারে ভূমিধস হচ্ছে তাতে পুরো যোশীমঠ' তলিয়ে যেতে পারে। শুধু যোশীমঠ' নয়, তলিয়ে যেতে পারে নৈনিতাল, উত্তর কাশীর অস্তিত্বও বিপদের মুখে। অথচ ১৯৭৬ সালে মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে যোশীমঠ ধসপ্রবণ এলাকা। এখানে ভারি নির্মাণ নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারি প্রকল্প বিকাশের নামে পরিবেশের বিনাশ হচ্ছে। বিকাশের নামে উন্নয়নের নামে প্রকৃতি নিধন চলছে বিগত দুই শতাব্দী ধরে। অথচ প্রকৃতি তার সবকিছু আমাদের সাজিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়কার প্রকৃতির অপরূপের কাছে আজকের রূপ দেখলেই বোঝা যায় কেন যোশীমঠ মাটির তলে চলে যাবে। শিল্প কারখানার নামে অরণ্য সাফ। নদীনালা বুজিয়ে আধুনিক শহর নগর গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশাল বিশাল অট্টালিকা, হোটেল মন্দির ধর্মশালা কর্পোরেটদের আকাশচুম্বী চাহিদার কাছে প্রকৃতির ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে/হচ্ছে,ধ্বংস করা হচ্ছে। সে তো প্রতিশোধ নেবে। ভারতবর্ষের সহজ সরল পিছিয়ে পড়া মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নিক্ষর্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে। সে এবার বদলা নিচ্ছে। প্রকৃতি তো এতোদিন অন্যায়  সহ্য করে গেছে এবার তার পালা।  বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি  দেখিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসবাদকে সামনে রেখে উন্নয়নের তাড়নায়(পড়ুন ভোটের জন্য) কর্পোরেটদের আরও মুনাফার লালসার শিকার আজ যোশীমঠ। অতীতের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়নি। গত ২০১৪ লোকসভা ভোটের প্রচারে উত্তরখণ্ডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ক্ষমতায় এলে ১০০ দিনের মধ্যে সব ঝা৺ চকচকে করে দেবেন অতীতে যা কোনো সরকার করতে পারেনি। কিন্তু যোশীমঠ ধসপ্রবণ ও কম্পনপ্রবণের কথা বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিলেও মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আড়ালে কর্পোরেটদের লালসা ও অবাধ মুনাফার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। এখন বিশ্বাসবাদের নাম নিয়ে সারা দেশে জয় শ্রীরাম ধ্বনি তোলা হোক আর হনুমান চালিশা পড়া হোক যদি দৈবগুণে যোশীমঠ ধসের হাত থেকে রক্ষা পায়। আর কর্পোরেটদের আড়ালও করা যায়। কেননা আজ সারা ভারতবর্ষের মানুষ জেনে গেছে যে আজ "বিশ্বাসবাদ ও কর্পোরেটদের লালসার শিকার যোশীমঠ।"

কলকাতা-৫৫

২২-০৩-২০২৩। 

ছবিঋণ- Created by @nehaart10

ভাষা সাম্রাজ্যবাদ: বিজেপি ও বিবেকানন্দ -তন্ময়
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:587 | likes:0 | share: 0 | comments:0

"নানা ভাষা,নানা মত,নানা পরিধান

বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।"

মাননীয় অতুল প্রসাদ সেন মহাশয়ের কালজয়ী গানের এই দুটি লাইনের বারতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। 


নানারকমের ভাষার সমন্বয় ও গুরুত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করে সমগ্র বিশ্বের দরবারে দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরতে এক ভাষা নীতি প্রনয়ণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে আরএসএস, বিজেপি।

যেহেতু ১৯৫০ সালে দেবনগরী মুদ্রণে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাই ২০১০ সালে গুজরাট হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার আবেদন সংবিধান অনুসারে বাতিল করে আদালত। আদালতের রায় অনুযায়ী হিন্দিকে সরকারি ভাষা বলা গেলেও জাতীয় ভাষা কোন ভাবেই বলা যায় না। 


তবে আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত। 

“Hardline Hindu nationalist groups like the Vishwa Hindu Parishad and the Rashtriya Swayamsevak Sangha make no secret of their support for a homecoming campaign designed to return non Hindus to the fold. More than 80% Indians are Hindu,but Prabian Togadiya of the VHP says his organisation's goal is a country that is hundred percent Hindu.”


হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন ভারতকে একশো শতাংশ হিন্দুদের দেশ করতে হবে এবং তার সাথে একটি ভাষা গ্রহণ করতে হবে যা সারা ভারতে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যোগসুত্র তৈরি করবে।

স্বামীজি বলিয়াছেন “এমন একটি মহান পবিত্র ভাষা গ্রহণ করিতে হইবে,অন্য সমুদয় ভাষা যাহার সন্ততি স্বরূপ। সংস্কৃতই সেই ভাষা। ইহাই ভাষা সমস্যার একমাত্র সমাধান।”


সংস্কৃত-এর পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য হিন্দি। কারণ হিন্দি হল গো বলয়ের জনগোষ্ঠীর মিশ্রিত মাতৃভাষা। সংস্কৃত ভারতে প্রচলিত হিন্দি সহ অনেক ভাষার মাতৃস্বরূপ। হিন্দির সাথে সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের বহু মিল বিদ্যমান। তাই বিবেকানন্দের চাহিদার সংস্কৃতের সাথে আরএসএস এর চাপানো হিন্দির খুব একটা পার্থক্য নেই। লক্ষ্য তো একই। এক জাতির এক ভাষা। তাছাড়া রাজনৈতিক জগত এবং সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দির বিপুল প্রভাব।তাই ভাষা সমস্যার সমাধানে বিস্তর আলোচনার শেষে

সরকারি ভাষা কমিটির চেয়ারপার্সন অমিত শাহ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন এখন সময় এসেছে গোটা দেশে একটি রাষ্ট্র ভাষা প্রচলন করা। সেই মহান পবিত্র ভাষা হল হিন্দি। তিনি মনে করেন সমগ্র দেশকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা আছে হিন্দির মধ্যে। বহুদিন আগে থেকেই বিজেপি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ভাষা কমিটির চেয়ার পার্সন অমিত শাহ সেই দাবি মেনেই এক দেশ, এক জাতি এবং এক ভাষার পক্ষে সওয়াল করেন।


বিবেকানন্দ আক্ষেপ করে বলেছিলেন - “তোমরা সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত হও না কেন? তোমরা ভারতের সকল বর্ণের মধ্যে সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করো না কেন? আমি তোমাদিগকে ইহাই জিজ্ঞাসা করতেছি। যখন এইগুলি করিবে তখনই তোমরা ব্রাহ্মণের তুল্য হইবে। ভারতে শক্তি লাভের ইহাই রহস্য।”


হিন্দির জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এই ব্রাহ্মন্য শক্তি লাভের উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সরকারি বিজ্ঞাপনের বাজেটের অর্ধেকের বেশি হিন্দি বিজ্ঞাপনে খরচ করার প্রস্তাব দিয়েছে। হিন্দি বিজ্ঞাপন বড় করে প্রথম পাতায় এবং ইংরেজি বিজ্ঞাপন ছোট করে ভেতরের বা শেষের পাতায় দেওয়ার কথাও বলা রয়েছে।

ভারতে সকল বর্ণের জন্য নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের হিন্দি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করতে চান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত খসড়ায় সেটারই উল্লেখ রয়েছে। সরকারি কাজকর্ম যাতে পুরোপুরিভাবে হিন্দি ভাষায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।


ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজী উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন – “ভারতে সংস্কৃত ভাষা ও মর্যাদা সমার্থক। সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান লাভ  হইলে কেউই তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহসী হইবে না। কারণ সংস্কৃত শিক্ষায়, সংস্কৃত শব্দগুলির উচ্চারণ মাত্রই জাতির মধ্যে একটা গৌরব, একটা শক্তির ভাব জাগিবে।”

সরকারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মোদিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে এখন সেই সময় এসেছে যখন আনুষ্ঠানিক ভাষাকে ভারতের ঐক্যের জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের নাগরিকরা নিজেদের মধ্যে শুধু হিন্দিতে কথা বলবে। 

হিন্দি ভাষা হবে হিন্দু জাতির গৌরব, হিন্দি ভাষায় জ্ঞান  লাভ হইলে মানুষ মধ্যে শক্তির ভাব জাগ্রত হবে। যে শক্তিকে মোকাবিলা করার সাহস পাবে না কেউই।


তাই আইন আসতে চলেছে হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দি ভাষা না শিখলে বঞ্চিত হতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো চাকরিতে। এমনকি যে সকল অফিসার এবং কর্মী হিন্দিতে কাজ করতে অস্বীকার করবেন বা এড়িয়ে যাবেন তাদের পারফরম্যান্স রিপোর্টে লেগে যাবে কালো দাগ।


মন্ত্রকের এই রিপোর্ট গত সেপ্টেম্বর মাসেই পৌঁছে গেছে রাষ্ট্রপতির কাছে। ভারতীয়দের রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি হবে। আপনি বাধ্য হবেন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করতে। নচেৎ লোটা-কম্বল গুটিয়ে  চলে যেতে হতে হবে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে। এরকমই ইঙ্গিত দিলেন উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জোট সঙ্গী ভারতীয় শোষিত হামারা আম দলের প্রধান  মৎস্য মন্ত্রী সঞ্জয় নিশাদ। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “ভারতের সংবিধান বলে ভারত হল হিন্দুস্তান যার অর্থ হিন্দি ভাষাভাষীদের জায়গা। যার হিন্দি বলতে পারে না তাদের জন্য হিন্দুস্তানে জায়গা নেই তাদের উচিত এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।”

এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষার মধ্যে নিহিত ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি। আমরা এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সংগ্রাম জারি রাখব।

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচেতনা -অনিকেত সুর
Dec. 3, 2024 | জীবনী | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“আরও প্রেমে, আরও প্রেমে

মোর আমি ডুবে যাক নেমে...”

 আমি চোখ বন্ধ করে শুনি। যেন আমার চারপাশ থেকে বহুদূরে সরে যায় দৃশ্য-বর্ণ-গন্ধের এই পরাক্রান্ত বস্তুজগত; লুপ্ত চরাচরে এক একটি শীতল অলখ জলফোঁটা আমার পদতল ছুঁয়ে খুব ধীরলয়ে দেহ বেয়ে উপরে উঠে আসতে থাকে। তারা একটা কোমল প্রস্রবণে রূপ নেয়। একটু একটু ক’রে নিমজ্জিত করে আমাকে তার ভেতর। আমাকে নিচে ফেলে উপর দিয়ে, চারপাশ থেকে নিঃশব্দ বয়ে যেতে থাকে; অলক্ষ্যে দেহত্বক ফুঁড়ে প্রবেশ করে আমার আত্মায়; সুরেলা এক কম্পনে সমাহিত আমি যেন বহুকাল পর আবার চোখ মেলি; আর স্পষ্ট টের পাই, স্বচ্ছজল এক ঝর্ণার অন্তর থেকে আমি সদ্য উঠে এসেছি; দাঁড়িয়ে আছি তাড়নাতাপরহিত, নবজন্মলব্ধ শৈশবস্বপ্নের প্রত্যাগত আলোয় ফেরা জ্যোৎস্নাফেনিল কোনও অচেনা নদীর পাড়ে...

  কিংবা যখন শ্রবণ করি এই গানঃ 

“নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো

যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো।”

  নিঃসন্দেহে এইসব ‘প্রার্থনাগীতি’র বাণী, ভাবনা আর সুর পূর্ণতাপিয়াসী, শিল্পের আগুনধোয়া শুদ্ধ এক আত্মার গহন থেকেই উঠে আসা। তবু সরলমনে এই প্রশ্ন উচ্চকিত হয়, হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ কি সত্যি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন? 

- যারা ঈশ্বর নামক কোনও এক অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাসী কিংবা আধা সংশয় আর আধা বিশ্বাসের মিশ্র এক দুর্বলতার কুহেলির ভেতর এরকম কোন সত্তার সন্ধান করে থাকে, তাদেরই মনে এ জিজ্ঞাসা ঘুরেফিরে আসে। 

- কেননা তাঁর এরকম বেশ কিছু গানে আছে, ‘প্রভু’ শব্দের আর্ত উল্লেখ।  পাশাপাশি কিছু কবিতায় আছে ‘ভগবান’ (ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে...)। 

 

 প্রতীচ্যে রবীন্দ্রনাথের একটা ভুল, ভাঙাচোরা, খণ্ডিত ও খঞ্জ ইমেজ দাঁড়িয়েছিল ‘মিস্টিক’ মানে ‘অতীন্দ্রিয়’ বোধের কবি হিসাবে, মূলত তাঁর গুটিকয় গীতিকবিতার অনুবাদ ‘গীতাঞ্জলি’র মাধ্যমে। ইয়েটস সঙ্গতভাবেই তাঁকে ঈশ্বরবাদী বলে আখ্যা দেননি, যদিও ইউরোপীয়দের সম্ভাব্য অস্বস্তি কিংবা ভ্রান্তি নিরসনে (অর্থাৎ, তারা যেন কোনওভাবেই গীতিকবিতাগুলিকে কেবল প্রার্থনাগান বলে ভুল না করে) ‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকায় তাঁকে বার বার ‘গড’ বা ঈশ্বর কথাটার উল্লেখ করতে দেখা যায় ---

“জানি না আমরা খোদাকে ভালবেসেছি কিনা; এমনটা বলাও ঢের বেশী হবে যে আমরা তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছি - তবু পিছন ফিরে জীবনের দিকে কখনও তাকাই যদি, উইলোর ছায়াঘন বনপথ আর নির্জন পাহাড়ী লোকে আমাদের কোনও এক স্বপ্নাবিষ্ট বিকালের ভ্রমণ - কিংবা পথচলতি কারও পাশাপাশি যেতে যেতে বিহ্বল প্রেমানুভবে কখনও হৃদয় কম্পিত হয়েছিল ব’লে আমাদের কোনও এক প্রায়-ভুলে-যাওয়া বিধুর দিনের অব্যক্ত দাবী, এবং ইত্যাকার আরও অনেক কিছুরই মধ্যে আমরা খুঁজে পাবো সেই আবেগ যা তাঁর কবিতার এই অন্তঃশীলা মাধুর্যকে সৃষ্টি করেছে।” 

 

রবীন্দ্রসৃষ্টির ‘এই অন্তঃশীলা মাধুর্য’ সম্পর্কে ইয়েটস পূর্ণ সচেতন কিন্তু আবার এর নেপথ্য প্রেরণা হিসাবে উল্লেখ করছেন ‘সেই আবেগ’-এর কথা যা আসলে অনুমিত রবীন্দ্র ঈশ্বরবোধের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। 

 

কেবল কিছু গান আর কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টিভাণ্ডারের অন্য কোথাও কিন্তু এই ‘ঈশ্বর’ উপস্থিত নেই; একেবারেই নেই। না গল্পে, না নাটকে-প্রবন্ধে, না তাঁর স্মৃতিকথায়। এমনকি নেই তাঁর ব্যক্তিজীবনেও। সেসবে শুধু প্রবল-গভীর অনুভব-আন্দোলন আর যুক্তিবুদ্ধিশাসিত এক জীবনবাদীর দেখাই মেলে। দেখি, একের পর এক তিনি আঘাত করে চলেছেন সব জড় সংস্কার, ধর্ম, কথিত দেবতা আর দেবতার বিগ্রহকে। ছিলেন সর্বকুতূহলী। বিজ্ঞান ভালবাসতেন। নিয়মিত বিজ্ঞান পাঠ করতেন। ভূমিকম্পকে ‘ভগবানের অভিশাপ’ বলায় স্বয়ং গান্ধীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন, “ওটা স্রেফ প্রাকৃতিক ঘটনা, দুর্যোগ।” 

 

কবিতায় বলছেন:

 “যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে

ভাঙো, ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে

ধর্ম কারার প্রাচীরে বজ্র হানো

অভাগা এদেশে জ্ঞানের আলোক আনো”

 

তবু সংশয় কাটে না। তবু মনে হয়, গানের কথায় এসে তিনি কেন বলেন --- 

“দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে

আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।”?

 

কেন বলেন –

“মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে

একেলা রয়েছ নীরব শয়ন পরে

প্রিয়তম হে, জাগো জাগো

রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি

আর কতকাল এমনি কাটিবে, স্বামী!”

 

এই ‘স্বামী’টা তবে কে? কবিতায় কেন তিনি বলেন, “নিজ হাতে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ...”? কে এই পিতা? সে কি ভগবান নয়? ঈশ্বর বা খোদা নয়?

 

এরকম প্রশ্ন ওঠে। মূঢ় প্রশ্ন যদিও, তবু এরকম প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ। যারা আসলে শিল্প বোঝে না, রবীন্দ্রনাথ পড়েনি। তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্মের কণা ভগ্নাংশের সাথেও যাদের পরিচয় নেই। ‘ঈশ্বর’ নামক অবিকশিত এক খঞ্জ ধারণার এঁদো ডোবায় আটকে পড়া যারা এক প্রাগৈতিহাসিক তালকানা কিম্ভুত মাছ। ঘুরেফিরে তারা শুধু ঈশ্বরকে টেনে আনে। তার কোলে শুয়ে ঘুমাতে ভালোবাসে। তার অলীক আশ্রয় ছাড়া যাদের অসহায় লাগে। তাকে হারাবার চিন্তা করতে গেলে পাগল হয়ে যায়।

 

কবিসত্তায় লোকবিশ্বাসের সাথে যুক্ত ধারণা ও শব্দগুলি ভিন্নতর অর্থে ধৃত হয়। রবীন্দ্রগানেও তাই ‘প্রভু’ শব্দটি এসেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। আমাদের চিরদিনের স্বপ্নে ধৃত পূর্ণতার যে রূপকল্প, বাস্তব জীবনে তার স্থায়ী প্রতিষ্ঠার আর্তি হিসাবে; যে ঈশ্বর বৈচিত্র্যের ভেতর একটা ঐক্যের ছবি আঁকে আর কবির অন্তরলোকে মূর্ত ক’রে তোলে এই গাঢ় অনুভবের ধ্যানচিত্রকল্প: “জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে, তুমি বিচিত্ররূপিনী/অন্তর মাঝে তুমি শুধু একাকিনী।” কথিত ধর্মের প্রভু সে কোনওভাবেই নয়। শিল্পের মঙ্গলময় ঈশ্বর, আর ধর্মস্থিত ঈশ্বর যে কিনা পুরস্কারের লোভ দেখায় আর শাস্তির হুমকি দেয়, এ দুয়ের ব্যবধান বেশ দুস্তর; শাস্ত্রগত ঈশ্বর বড় বিভেদপ্রিয়; প্রাকারবেষ্টিত নানান সংকীর্ণ সীমার ভেতরে তার অবস্থান; পারস্পরিক ঘৃণা-হিংসা আর অবিশ্বাসের প্ররোচনাদাতা। আর যে শিল্পের অন্বিষ্ট অখণ্ড মানুষ, তার ঈশ্বর তো এই ভেদবুদ্ধির সীমাটাকেই ভাঙতে উন্মুখ। জাগতিক জীবনের নানা ক্লেদ ও গ্লানি, বিচ্যুতি ও পরাজয়, সীমার সংকোচ, তাকে অতিক্রমণের অক্ষমতা অভীষ্ট পূর্ণতার দিকে আমাদের আগুয়ানির পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। এই সীমাটাকে খসিয়ে দেয়াই কবির আরাধ্য। অন্বিষ্ট পূর্ণতার প্রতীক হিসাবে তাই কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘প্রভু’ শব্দটি।  

গানের ‘তুমি’ও সেই একই স্বপ্নের দ্যোতক। আমাদের অপূর্ণ সত্তায় যে-সুন্দরের সাথে মিলনের স্বপ্ন জাগে, এটা তো তাই। এই সুন্দর যেন চিরদিনের মায়াহরিণী (‘মায়াবনবিহারিনী হরিণী’), সে যেন লুকিয়ে আছে এই চেনা জগতেরই কোথাও, হয়তো বা শুক্লাযামিনীর অলৌকিক জোছনার বুকের ভেতর, বা কোনও বাঁশির সুরলহরীর প্রাণে ধৃত অনুভবে, কাজল বনের গভীর রহস্যে, হয়তো বা নাম-না-জানা কোনও ফুলের অচিন চমক সৌরভে। আমাদের জীর্ণ ঘরে, আমাদের চারপাশে, সমাজজীবনের কোথাও যে-সুন্দরকে আমরা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে পাই না। আমরা জানি না সুন্দরের 

“সেই  সঙ্গীত কী ছন্দে গাঁথিব; কী করিয়া

শুনাইব, কী সহজ ভাষায় ধরিয়া

দিব তারে উপহার ভালবাসি যারে

রেখে দিব ফুটাইয়া কী হাসি আকারে

নয়নে-অধরে, কী প্রেমে করিব তারে

জীবনে বিকাশ। সহজ আনন্দখানি

কেমনে সহজে তারে তুলে ঘরে আনি

প্রফুল্ল সরস। কঠিন আগ্রহ ভরে

ধরি তারে প্রাণপণে মুঠির ভিতরে ---

টুটি যায়! হেরি তারে তীব্রগতি ধাই!

অন্ধবেগে বহুদূর লঙ্ঘি’ চলি যাই --- (তবু)

আর তার না পাই উদ্দেশ...!” (সুখ/চিত্রা)

 কবির এই সুন্দর, এই ঈশ্বর আমাদের খুব চেনা, খুব বেশি লৌকিক। কারণ, সে তো আমাদের, সৌন্দর্যপ্রত্যাশী সব মানুষের মনেই আছে। সে মঙ্গলময়। এই ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব কাব্যিক ঈশ্বর। কর্মে, প্রেমে, শুদ্ধ আনন্দকল্যাণসাধনায় যে আমাদের পূর্ণ হবার প্রেরণা দেয়। কল্পিত আসমান থেকে সে কোনও কিতাব নাজিল করে না। মানুষে মানুষে কোনও যুদ্ধ, রক্তারক্তির উস্কানিও দেয় না। সহস্র বছর ঘুমিয়ে থেকে হঠাৎ জেগে উঠে -- যে-মানুষ বস্ত্র আবিষ্কার করেছে, এতদিন যাকে ন্যাংটা রেখেছিল, --- তাকে বলে না, দ্যাখো, তোমাদের এইভাবে পোশাক পরতে হবে, নইলে...” ইত্যাদি।


হ্যাঁ, এই ঈশ্বর কোমল, ভালবাসার কথা বলে। এই ঈশ্বরই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর, প্রেমের দূত। এই ঈশ্বর স্বয়ং মানুষ, তারই পূর্ণতর স্বপ্নকল্পপ্রতিমা। তারই ভেতরের এখনো না-হয়ে-ওঠা পূর্ণ প্রেমের স্বরূপ, ব্যথা পেলে যে আমাদের বুকে হাত রাখে। আমাদের প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ করে। আমাদের ঘরের ভেতর চির অভিষেকের আয়োজনে যে দূরে অপেক্ষমান। এই ঈশ্বরে তো আমার কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। আমি নিরীশ্বরবাদী হয়েও তাই কবির এই ঈশ্বরে নির্দ্বিধ আনন্দবিশ্বাস রাখি।

যাত্রাবাড়ি, ঢাকা ১২৩৬

বাঙালীপাড়া -প্রতীক মাইতি
Dec. 3, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:808 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের পাড়ায় থেকে থেকে জ্বলে ওঠে বাহারি আলো। সমস্ত উৎসবেই আলো জ্বালাতে হবে দিব্যি দেয়নি কেউ। কিন্তু সমস্ত উৎসবই পালন হচ্ছে সুদিন আসছে ভেবে। আলো আর সুদিন নিয়ে বলতে বসলে মনে হবে খুন খারাপি, প্রেম প্রত্যাখ্যান এইসব আমাদের পাড়ায় হয়নি কখনও। বস্তুত আমাদের পাড়াটা টিপটপ, গোছালো।

সকালের চায়ের কাপ থেকে কিছুটা ধোঁয়া নিয়ে বানিয়ে ফেলছি একটা মৃত্যুঞ্জয়ী কুহক। কথায় কথায় ভলিয়েস্কি, চার্বাক, জিডিপি, সপ্তাহান্তে সভা - সমাবেশ। আলোর চকমকি হাতে এমনভাবে হাত ঘোরাছি মনে হবে ভারতবর্ষ শ্রীলংকা হয়ে যাবে আমাদের পাড়াটা না থাকলে! 


আমাদের পাড়ায় থেকে থেকেই শোনা যায় গর্জন।

সমস্ত প্রতিবাদেই ভয়ংকর ব্রহ্মনাদ হবে এমনটা নয়। রিকশাওয়ালাকে পাঁচটাকা বেশি দিতে হলে, মাছওয়ালাকে আঁশ ছাড়ানোর পয়সা ধরে দিতে গেলে, পাশের বাড়ীর ড্রেনের জল সদর দরজায় জমা হলে যে আর্তনাদ হয় তাতে মনে হয় আমাদের পাড়াটা আপোষহীন।


শুধু মোড়ের মাথা থেকে চাকরীর দাবিতে অনশন করা ছেলেমেয়েগুলোকে যখন টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুললো পুলিশ, আমরা তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি।

আমাদের পাড়াজুড়ে নাসিকার গর্জন।

রাজারহাট, কলকাতা।

আরজ আলী মাতুব্বর: সত্যের অভিযাত্রী -জাহিদ রুদ্র
Dec. 3, 2024 | মুক্তমনা | views:811 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই; জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন”

'প্রায় ৫০-৬০ হাজার বছর আগের নিয়ান্ডারথাল মানুষেরাই প্রথম প্রশ্ন তোলে জীবন-মৃত্যু নিয়ে? মানুষ কোত্থেকে আসে? বেঁচে থাকে কেন? মারা যায় কেন? শুধু মানুষ নয়। প্রকৃতিকে নিয়েও তারা প্রশ্ন করা শুরু করেছিল। নদী প্রবহমান কেন? বাতাস কি? পাহাড় এলো কোত্থেকে? সূর্য আলোকিত কেন? সহস্র বছর আগের অবিকশিত ও আদিম বুদ্ধি দিয়ে আদিম মানুষেরা ভেবে নিয়েছিল তাদের প্রতিটি সমস্যার সমাধান। প্রাণীজগতের সব প্রাণীই নিজেদের যেকোন সমস্যায় নিজ নিজ বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই আধুনিক যুগেও প্রাণীদের চোখে মটরগাড়ীগুলো শব্দকারক ও দূর্গন্ধযুক্ত একটি বিদঘুটে প্রাণী ছাড়া কিছুই নয়। একটি যন্ত্র সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণের জন্য আমরা প্রাণীদেরকে দোষ দিতে পারি না। কারণ যন্ত্রকে যন্ত্র মনে করার জন্য যে জ্ঞান, মেধা, মণীষা, অভিজ্ঞতা থাকা দরকার তা তাদের নেই। জীব জগতের কোটি বছরের ইতিহাসে মনুষ্যেতর প্রাণীগুলো কখনো যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেনি, বা করতে চায়নি। বানর, কয়েক প্রজাতির পাখি এবং অন্যান্য কয়েকটি মাত্র প্রাণী অবশ্য যন্ত্রের ব্যবহার করে। উঁচু ডাল থেকে ফল পাড়তে লাঠি, শত্রু তাড়াতে ঢিল, খাদ্য ভাঙতে পাথর ইত্যাদির ব্যবহার তারা করে থাকে। কিন্তু তাদের যন্ত্র সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা অতটুকু প্রাথমিক অবস্থাতেই থেকে গেছে। আর কোন অগ্রগতি হয়নি এবং তা সহজাত প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কারণ যন্ত্রের ঐ সীমিত ব্যবহারটুকুর বেশি তাদের প্রয়োজন হয়নি। তাই যন্ত্রের আবিষ্কার বা উৎকর্ষের জন্যও কোন রকম অভ্যন্তরস্থ আগ্রহ তারা বোধ করেনি। কিন্তু মানুষ মানবেতর নয়। ক্রমাগত নিজেকে পেরিয়ে যাওয়ার এক অদম্য আগ্রহ মানুষকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। ফলে মানুষ নিরন্তর তার পূর্বতন অনভিজ্ঞতা, অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদতা, সীমিত যান্ত্রিক শক্তি প্রভৃতিকে পরিত্যাগ করেছে এবং সাগ্রহে বরণ করেছে ভবিষ্যতের নতুনত্ব, জ্ঞান, আবিষ্কার, মনন। তাই অন্যান্য পশুদের জীবন যাত্রা এখনও আদিম যুগের ন্যায় থাকলেও মানুষের ক্ষেত্রে তা পাল্টে গেছে। মানুষ এগিয়ে এসেছে বর্তমানের কুসংস্কারহীন প্রযুক্তিময় পৃথিবীতে।'


দার্শনিকরা কখনও ফুরিযে যায় না; বরং সময় ও সমাজ তাঁদেরকে ধারণ করে। সময়ের সমান্তরালে তাঁরাও বহমান। একটা সমাজকে প্রগতিশীল হতে হলে দার্শনিক দরকার। দর্শন আসে জীবনবোধ থেকে, দর্শন আসে প্রশ্ন ও চিন্তার স্বাধীনতা থেকে। অথচ আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করতে জানে না, চিন্তা করতে জানে না। বাঙালির জীবন খুব সংকীর্ণ। কোনোভাবে পঞ্চাশটা বছর কাটাতে পারলে মৃত্যুর প্রহর গুনে তাঁর দিন কাটে। জীবনের বিকাশ ও জীবনবোধ তাঁর কাছে অনর্থক। লালনের মতো দার্শনিককে আমরা এখনও পাগল বানিয়ে রেখেছি। একটা সমাজকে কেবল লালনের গান দিয়ে সুচিন্তক বানানো সম্ভব। লালন বাংলার মাটিতে বেড়ে ওঠা মানুষ, এখানকার পরিবেশ ও জীবনের সাথে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আরবদের জীবনীর বদলে বাংলা বইয়ে লালনের জীবন পাঠ অনেক বেশি জরুরী ও প্রাসঙ্গিক। লালনের জীবন কোনো পয়গম্বরের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেই লালন আমাদের কাছে উপেক্ষিত। আমরা লালন দর্শনে চর্চা করি না।


আরজ আলী নামের একজন মানুষ এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন তা প্রথম জানতে পারি ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে। সত্যের সন্ধানে বইটা পড়ি পিডিএফ আকারে ঠিক তারিখ মনে নেই তবে সালটা ২০১৫-১৬ হবে। যেহেতু নামটা আগে শুনেছি তবে তাঁর বই পড়ার সুযোগ হয় নি। যদিও কলেজে পড়ার সময় হেগেল, কনফুসিয়াস, দেকার্ত, মার্কস, এঙ্গেলস, মাও, বার্ট্রান্ড রাসেল পড়েছি। সময় সুযোগে তাঁদের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জেনেছি এবং অভিভূত হয়েছি কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর পড়া হয়নি। সক্রেটিস বা প্লেটো বাঙালির খুব পরিচিত নাম। সক্রেটিস পড়ছিলাম ক্লাস টেনে ইংরেজি সাবজেক্টে একটা পাঠ ছিল, তখন।


বাট্রান্ড রাসেল খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, জাঁ-পল সার্ত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা নিজ দেশে অনেক সম্মান পেয়েছেন। দার্শনিক নিটশে বলেছেন, ‘ঈশ্বর মৃত’। কিন্তু নিটশে পড়ানো হয় পৃথিবীর সব দেশে। আরজ আলী মাতুব্বরকে একজন বিজ্ঞানী ও লৌকিক দার্শনিক অভিধায় ভূষিত করা হয়, তাঁর লেখা হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একদিকে বলা যায় তিনি যুক্তিবাদী দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী, আবার অন্যদিকে বলা যায় তিনি আধুনিক চার্বাকবাদী।


আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন। শুধু প্রশ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে কৌতুহল বা কোনোরকম প্রশ্নের উদয় হলে তিনি ‘বস্তুবাদ’ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করতেন। একটি প্রবাদ আছে "স্বশিক্ষিত লোক মাত্রেই সুশিক্ষিত।" সে হিসেবে 'স্বশিক্ষিত' আরজ আলী মাতুব্বর অবশ্যই একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আরজ আলী মাতুব্বর বিশ শতকের একজন অনন্য ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞানে আস্থাবান যুক্তিবাদী আরজ আলী বাঙালির মানসমুক্তির সহায়।


আমাদের সমাজ আরজ আলীকে ধারণ করে না। আরজ আলীকে নিয়ে চর্চা হয় না। দেশে হাতেগোনা কিছু মানুষই হয়ত আরজ আলী নামের সাথে পরিচিত। অথচ আরজ আলী সবার পাঠ্য হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মতো মুখস্ত থাকা উচিত আরজ আলীর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী। প্রসঙ্গক্রমে কেউ যদি আরজ আলীর জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে দু একটা লাইন লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে তবে তাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। নাস্তিক-আস্তিকের প্রশ্নে ভেসে যায় কমেন্টবক্স। এখানে চিন্তার স্বাধীনতা নেই, প্রশ্নের স্বাধীনতা নেই। ধর্ম নামক জাতাকলে পিষ্ঠ সবাই। সেসবের বিপরীতে আরজ আলী চিন্তা করার সাহস যেগায়, প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দেয়।


আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। আরজ আলীর রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দার্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। মানবকল্যাণ ও বিশ্বধর্ম আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান, পাঠাগার স্থাপন ও রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি নিজ দেহ ও চক্ষু মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। মাতুব্বর বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হকসহ অসংখ্য সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো।


তাঁর বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার কথা তিনি একাধিক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তার লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)। আরজ আলী মাতুব্বর তার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে। বইটি তাকে এলাকায় ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল।


তাঁর সত্যের সন্ধান গ্রন্থে আরজ আলী মাতুব্বর যে মৌলিক প্রশ্নগুলি উল্লেখ করে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে: ‘১. আমি কে? ২. প্রাণ কি অরূপ না স্বরূপ? ৩. মন ও প্রাণ কি এক? ৪. প্রাণের সহিত দেহের সম্পর্ক কি? ৫. প্রাণ চেনা যায় কি? ৬. আমি কি স্বাধীন? ৭. অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে? ৮. প্রাণ কিভাবে দেহে আসা যাওয়া করে?’..... ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রশ্নে আরজ আলী মাতুব্বর জিজ্ঞেস করেছেন ‘স্রষ্টা কি সৃষ্টি হইতে ভিন্ন?’ ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?’


কেবল দার্শনিক চিন্তায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ বোধের আর এক প্রকাশ ঘটেছে তার এরূপ কর্মে যে, তিনি জীবিত অবস্থাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানুষের হিতার্থে তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে উইলের মাধ্যমে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজকে দান করে গেছেন। প্রতি বছরই ১৫ই মার্চ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মদিন পালন করা হয়। এত বছর পরে আরজ আলীকে নিয়ে কেউ উৎসাহ দেখাবে তা হয়ত তিনিও ভাবতেন না। ঠিক এভাবেই আরজ আলী সময়ের সমান্তরালে বহমান। শত বা সহস্র বছর পরেও আরজ আলী আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবেন।

খালিস্থানী অর্থোডক্স শিখ মৌলবাদী -সৌরাষ্ট্র দাশ
Dec. 3, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:506 | likes:2 | share: 2 | comments:0

স্বাধীনতার আগেও বহু সমস্যা ছিল। স্বাধীনতার পরেও বহু সমস্যা আছে এটা আমরা সবাই জানি! এ আবার নতুন কি? কিন্ত বর্তমানে যে ধরণের সমস্যা আমরা আজকে দেখছি তা এক দিনের সমস্যা নয়, বহু দিনের সমস্যা। সেই সব সমস্যার মধ্যে একটি অন্যতম ছিল শিখ’দের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র, আলাদা সংবিধান গঠন। সালটা ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ যখন মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবী জানায়, তখন কিছু শিখ নেতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে হিন্দু ও মুসলিমের ভিত্তিতে ভারত বিভাজিত করলে শিখ সম্প্রদায়ের কোন স্বাধীন মাতৃভূমি থাকবে না। তারা তখন বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চলে বিস্তৃত খালিস্তান নামক একটি ধর্মরাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণা পেশ করেন। এই কথা আমরা অনেকেই জানি, কিন্ত এই শিখ রাষ্ট্র বা খালিস্থান কি স্বাধীনতার আগে বা পরের আলোচনা? উত্তর হলো, না। পাঞ্জাব অঞ্চল শিখদের ঐতিহ্যগত মাতৃভূমি। এই কথা সবাই জানি এবং ইংরেজ দ্বারা অধিকৃত হবার আগে পাঞ্জাব শিখদের দ্বারা ৮২ বছর শাসিত হয়, যা ১৭৬৭ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র পাঞ্জাব শিখ মিসল (সার্বভৌম শিখ রাষ্ট্র) সমূহের অধীন ছিল, তারপর মহারাজা রণজিৎ সিং শিখ মৈত্রী সঙ্ঘকে শিখ সাম্রাজ্যের মাঝে একীভূত করেন। তবে সেখানে শিখদের পাশাপাশি অনেক হিন্দু ও মুসলিমও বসবাস করত, তারপরেও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস আমরা জানি...


শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দাবী করেন যে শিখরা বরাবরই একটি পৃথক ও সার্বভৌম জাতি ছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ার শিখ অধ্যুষিত এলাকাগুলো দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হবার পূর্ব পর্যন্ত বহু শতাব্দী ধরে স্বাধীন ছিল। যা ১৮৪৮-১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এ যুদ্ধের ফলে শিখ সাম্রাজ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ হয়, পাঞ্জাব অঞ্চল কোম্পানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তা পরবর্তীতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পরিণত হয়। অনেক শিখ বিশ্বাস করেন যে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময়, হিন্দু-মুসলিমদের পাশাপাশি শিখদেরকেও একটি পূর্ণ সার্বভৌম অথবা পাকিস্তানের অধীনে একটি অর্ধ সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, পরবর্তীতে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে যা থেকে শিখরা বঞ্চিত হয় এবং পাঞ্জাব রাজ্য ভারত-পাকিস্তানের মাঝে বিভাজিত হয়। কিন্ত 1948 সেই সময় অনেকেই আলাদা ব্যবস্থা চেয়েছিল। তাদের মধ্যে জিন্নাহ, ড: ভিড় সিং, আম্বেদকর তারা এক ভারত চায়নি। যেমন আম্বেদকর মনে করতেন ব্রিটিশদের জন্য দেশের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের উন্নতি হবে। সবার আলাদা পৃথক চিন্তাকে সেই সময় কংগ্রেস সরকার মানেনি তারা বলেছে ভারত আর ধর্মের ভিত্তিতে আর ভাগ হবে না। 

এর পরের যে সব ইতিহাস ঘটেছে, পাঞ্জাবী সুবাহ - ভাষা সমস্যা, নদী জলের বিতর্ক, হরমন্দির সাহেবে ১৯৫৫ সালের হামলা, অকালি দলের দাবী, খালিস্তান জাতীয় পরিষদ, ব্লু-স্টার অভিযান, ইন্দিরা গান্ধীকে গুপ্তহত্যা ও শিখদের গণহত্যা, জঙ্গিবাদের উত্থান, খালিস্তানী জঙ্গি গোষ্ঠী, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৮২ ইত্যাদি। তার পরেও ইতিহাস ১৯৯৫ সালের গুপ্তহত্যা; যাতে পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বেয়ান্ত সিংহের হত্যা করা হয়েছিল। মানে এই উপরের যতগুলো বিষয় আছে তা নিয়ে লিখলে একটি হাজার পাতার বই লেখার সমান হবে। এতোটা বিরক্ত এই খালিস্থান শিখ মৌলবাদ সমস্যা। এর মধ্যে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক ধর্মীয় আলোচনা আছেই তার সাথে সেই সময়কার পত্রিকাগুলিও ভূমিকা আছে অনেক, এইসব আলোচনা অন্য সময় করলেই ভালো আলোচনা বিষয় অনেক বড়ো ছোট ছোট আলোচনাই ভালো তবে বর্তমানে যে ঘটনা এই কিছুদিন ঘটলো সেই বিষয় একটু আমরা নজর রাখার চেষ্টা করবো...

সাল 1984 দিল্লি যখন সাম্প্রদায়িকতার স্রোতে ভেসে চলেছে। এক দিকে শিখ গণহত্যা চলছে। কংগ্রেস কর্মীদের দ্বারা এই অভিযোগ তো আছেই কতটা সত্য জানা নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। Bhindranwale মতো ব্যক্তিদের ব্লু স্টার অভিযান এর মাধ্যমে শেষ করা হয়েছে। সেই সময়ের শিখদের ধর্মীয় হরমন্দির সাহিব ব্লু স্টার অভিযান এর জন্য অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে শিখ'রা খিপ্ত হয়ে পরে। তারপর ভারতের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর দুই শিখ দেহরক্ষী সৎবন্ত সিংহ ও বিয়ন্ত সিংহ অপারেশন ব্লু স্টার চলাকালীন “স্বর্ণমন্দির” নামে পরিচিত শিখদের সর্বোচ্চ তীর্থ হরমন্দির সাহিবে সেনা অভিযানের প্রতিশোধকল্পে তাকে হত্যা করে। তারপর অনেক বছর কেটে যায়। শিখ মৌলবাদ কিছুটা কমে গেলেও শেষ হয় না। বহু বছর পর বছর 30শের অর্থোডক্স শিখ Amritpal সে Bhindranwale এর যায়গা নেওয়ার চেষ্টায় আছে। মজার বিষয় সে এমনটা আগে ছিল না। তার কর্ম কান্ড আমরা কৃষক আন্দোলনে দেখতে পাই সে মাত্র 10 ক্লাস পড়াশোনা করে। ইস্কুল ছেড়ে দেয়। তারপর সেই বিদেশে চলে যায়। টাকা রোজগারের জন্য পারিবারিক অবস্থান ও খুব একটা ভালো ছিল না! Amritpal এর তবে বিদেশে থাকার পর কিছু টা ঠিক হয়। সে দেশে ফিরে এসে অমৃত চাক নামক অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে নিহঙ্ক হন এবং অনেক শিখ দের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে...


এর মাঝে তার নাম ডাক হতে থাকে যুব সমাজে সে বলতে থাকে প্রতিটা শিখ যুবক এর হিরো Jarnail Singh Bhindranwale এবং Amritpal জনসাধারণ কে বলতে থাকে যে তার উদ্দেশ্য Bhindranwale এর মতাদর্শ প্রচার করা। সে অনেক শিখদের হুমকি দিতে থাকে যে সব শিখরা দাড়ি রাখে না, মদ পান করে তাদের ছেড়ে কথা বলা হবে না। ঠিক এমন কথা তথা কর্মকান্ড Jarnail Singh করতো এবং নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে যে Jarnail Singh কিভাবে হিন্দুদের হত্যা কথা বলতো যে শিখ আর হিন্দুদের মাঝে ব্যালেন্স রাখতে হবে, তাদের হত্যা করে। এতে শিখ হিন্দুদের মধ্যে অবশ্যই সংঘর্ষ হবে। এবং অনেক খালিস্থানী মৌলবাদীরা Rss, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট নেতাদেরও তারা হত্যা করেছে। যারা খালিস্থান এর বিরুদ্ধে কাজ করছিল। এবং সব থেকে বড় ঘটনা হলো পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বেয়ান্ত সিংহের হত্যা। এর পর অনেক খালিস্থানী লিডারদের কর্ম কান্ড বিদেশে নিজের শক্তিশালী করা সব রকম ভাবে 1980 আগে যেমন খালিস্থান লিডার রা যেমন লাহোর থেকে কাজ করত বর্তমানে খালিস্থান লিডাররা বিদেশ থেকে সেইসব দেশের মধ্যে সবার উপর কানাডা, জার্মানি, লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া দেশ গুলি আগে আছে।  


তবে এই কিছু মাসে Amritpal এর যথেষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবেও শক্তিশালী হয়েছে। পাঞ্জাব যুব-সমাজেয একটি অংশ অর্থোডক্স শিখ মৌলবাদী Amritpal এর দিকে যাচ্ছে। এই কিছুদিন আগের ঘটনা আমাদের Jarnail Singh এর ঠিক শুরুর দিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভারতের বুকে শিখ মৌলবাদ হিন্দুত্ব মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদ এবং আঞ্চলিক মৌলবাদ একটি বাস্তব সমস্যা যা আমাদের দেশের জন্য তথা সাধারণ মানুষের জন্য একটি খারাপ স্বপ্নের মতো আসলে এই ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থোডক্স শিখ হিন্দু মুসলিম বুদ্ধিষ্ট মৌলবাদ সন্ত্রাসবাদ বিশ্বাসের ভাইরাস নিজের বিস্তার করে চলেছে। আমরা দেখেছি কৃষক আন্দোলনে অর্থোডক্স শিখ কি ভাবে একজন ব্যক্তি অছুত দলিত হবার জন্য তার হাত পা কেটে নেওয়া আমরা দেখেছি একজন পুলিশ' ট্রাফিক আইন ভাঙার অপরাধে জরিমানা করাতে এক নিহঙ্গ পুলিশ এর হাত কেটে দিয়েছিল। আসলে শিখ ধর্ম নিয়ে আমি যতটা পড়াশোনা করেছি এবং বুঝেছি। এই ধর্মের ভালো দিকটা বেশি থাকলেও অল্প খারাপ দিয়ে সব টাই খারাপে পরিবর্তন করা যেতে পারে। এই অর্থোডক্স ধর্মান্ধ মানুষ গুলিই সমাজে ধর্মীয় ভেদাভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে। নিজেদের খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। আসলে Amritpal ভালো করে জানে টাকা ক্ষমতা ভারতে ধর্মের মাধ্যমে আসে এবং একটি সময় এটা চরম সাম্প্রদায়িকতার রূপ নেয়....

তথ্যসূত্র 

1 | https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE

2 | https://books.google.co.in/books?id=XJzUzWDwZ4kC&pg=PA218&redir_esc=y#v=onepage&q&f=false

3 | https://www.gpo.gov/fdsys/pkg/CREC-1998-10-15/pdf/CREC-1998-10-15-pt1-PgE2197.pdf

4 | https://www.panthic.org/articles/5548

5 | https://theprint.in/opinion/ambedkar-changed-on-separate-communal-electorate-his-shift-was-strategic-not-voluntary/638904/

6 | https://clpr.org.in/blog/b-r-ambedkars-idea-of-separate-settlements/

7 | https://theprint.in/politics/the-former-punjab-chief-minister-who-fought-terror-and-loved-tea/109194/

8 | https://upscwithnikhil.com/article/history/assassination-of-indira-gandhi

 9 | https://m.thewire.in/article/rights/1984-sikh-massacre-remembrance/amp#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16774909179501&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com

10 | https://www.ojp.gov/ncjrs/virtual-library/abstracts/sikh-terrorism-struggle-khalistan

11 | https://www.mha.gov.in/MHA1/Par2017/pdfs/par2013-pdfs/ls-050313/LSQ.1192.Eng.pdf

12 | https://www.ndtv.com/people/bhindranwale-2-0-radical-preacher-and-khalistan-sympathiser-amritpal-singh-very-active-in-punjab-3810442

13 | https://indiankanoon.org/search/?formInput=khalistan

ধর্মই অধর্মের মূল -দিবাকর মন্ডল
Dec. 3, 2024 | যুক্তি | views:613 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্ম শাস্ত্র নামক সংবিধানের যাঁতাকলে পড়ে যেমন মানুষের একটা বিশেষ সম্প্রদায় শোষণ ও নির্যাতন হয়ে আসছে, তেমনি এই ধর্ম শাস্ত্র গুলির নিষ্ঠুর লেখনী নিরীহ পশু পাখিদের কাছেও অভিশাপ হয়ে এসেছে। 


এই যেমন অবলা প্রাণী হাঁস- মুরগি, গরু- ছাগল, পাঠা, মহিষ, উট, কবুতর- এরা জনেই না এদের কি দোষ! কোনো দোষ না করেও শুধু মাত্র ধর্ম শাস্ত্রের সন্মান রক্ষার্থে এই সকল প্রাণীর বলি দেওয়া হয়। 


ভেবে দেখবেন যারা এই সকল ধর্ম শাস্ত্র চালাকি করে লিখেছে তারা কতটা নিষ্ঠুর মানসিকতার হতে পারে!


সেই সাথে ধার্মিক দের প্রচলিত কুসংস্কার গুলি যেভাবে পশু পাখিদের মানব সমাজে ভয়ের আর অভিশাপের বিষয় করে তুলেছে সেটা আরো লজ্জাজনক। 

এই যেমন একটি উদাহরণ দিচ্ছি।বেশি উদাহরণ দিলে বেশি লেখা হবে আপনাদের পড়তে ইচ্ছা হবে না জানি।

দেখবেন সব পশু রাস্তা  কাটে। বিড়াল রাস্তা কাটলে হয় দোষ।


কেনো?

কারণ, জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে রাহুকে অশুভ গ্রহ বলে মনে করা হয়। রাহুর প্রভাবে জীবনে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। দুর্ঘটনার যোগ আসতে পারে রাহুর প্রভাবে। বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে বিড়াল হল রাহুর বাহন। এই কারণেই বিড়াল পথ কাটলে তা অশুভ বলে মনে করা হয়। কারণ বিড়াল পথ কাটছে মানে সেখানে রাহুর প্রভাব রয়েছে। রাহু যেমন দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, তেমনি বিড়াল রাস্তা কাটলে তার জন্য দুর্ঘটনা হতে পারে। 


এদিকে বেচারা বিড়াল না জানে রাহু কে, না তাকে চেনে, না রাহু তাকে খেতে দেয়, না থাকতে দেয়। নেহাতই কোনো খাদ্যের লোভে, নয়তো বা জীবনের ভয়ে, জীবন বাঁচাতে কারো তারা খেয়ে সে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হয়েছে। আর এটাই হয়েছে তার দোষ। একেবারেই মন গড়া একটা গল্প বানিয়ে এই পশুটাকে একটা মানব  সম্প্রদায়ের চোখে বিষ বানিয়েছে এই ধর্ম শাস্ত্র রচনাকার।


একই ভাবে হিন্দু ধর্ম অনুসারে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর বোন হলেন অলক্ষ্মী। এই অলক্ষ্মী দারিদ্রের দেবী। বিড়াল অলক্ষ্মীরও বাহন বলে মনে করা হয়। তাই বিড়াল হল অশুভ আর সংকটের প্রতীক।

এবার আপনারাই বলুন। এটা কোনো যুক্তি হলো? লক্ষ্মী অলক্ষ্মী যতসব সাজানো নাটক আর সেই নাটকে খলনায়কের ড্রাইভার নাকি বিড়াল! 


আমি তো আজ একটি পশুর দুর্দশার কথা শোনালাম। আপনারা নিশ্চয়ই আরো অনেক পশু, পাখি ও প্রাণীর নাম জানেন। আর এও জানেন এই ধর্ম মানতে গিয়ে কিভাবে এই সকল নিরীহ প্রাণীদের সাথে অত্যাচার করা হয়।

তাই একটাই কথা বলবো, কিছু করার আগে যুক্তি দিয়ে বিচার করুন, প্রয়োজনে কারো সাহায্য নিন। মানুষ হয়ে জন্মেছেন, মানবিক হোন। নিষ্ঠুর হবেন না। আপনার কাটলে, আপনাকে মারলে, তাড়া করলে আপনার যেমন অনুভব হয়, সকল জীবের (পশু, পাখি ও প্রাণীর) একই রকম অনুভব হয়।

ফলতা, দ:২৪ পরগনা।

বক্সা পাহাড়ে আর পড়াশোনা হবে না, বন্ধ হল সবকটি স্কুল -লাল সিং ভুজেল
Dec. 3, 2024 | রাজনীতি | views:45 | likes:0 | share: 1 | comments:0

(প্রতিবেদক বক্সা জঙ্গল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা এবং উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের আহ্বায়ক)

আলিপুদুয়ার জেলা তথা  পশ্চিমবঙ্গের গর্ব বক্সা পাহাড়ের মাথায় সবকটি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। 

রাজ্যের ৮০০০-এরও বেশি স্কুল বন্ধের খবর ফলাও করে বের হলেও কেউ খেয়ালই করলেন না যে ঐ দুর্গম পাহাড়ের মাথার স্কুলগুলি একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ৩০ বা তার কম শিক্ষার্থী রয়েছে সেগুলো বন্ধ করবার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যেসব সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৩০ বা তার কম সেইসব বিদ্যালয়গুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই বন্ধ কেন? এর পেছনে গোপন রহস্য কী? সেগুলো নিয়ে আজ আর নাই বা বললাম, সে পরে হবে। আজ আসুন আমরা আমাদের ঐতিহ্যলালিত, ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত বক্সা পাহাড়ে ঘুরে আসি। বক্সা আমরা যারাই গেছি তারা সান্তালাবাড়ি চিনি। সেই সান্তালাবাড়ি গ্রামের আগে যেখানে একমাত্র সরকারি বাস গিয়ে থামে সেই জায়গাটি হল ২৯ বস্তি। তার পর হেঁটে বা গাড়িতে সান্তালাবাড়ি গিয়ে মমো খেয়ে আবার এগোনো শুরু হবে। এই সান্তালাবাড়ি আর একটি গ্রাম, তারপর সদরবাজার, ডারাগাওঁ, বক্সাফোর্ট, লাল বাংলা, তাসি গাওঁ। পুবের দিকে খাটালাইন হয়ে লেপচাখা, ওছলুম-ছবির মতো গ্রামগুলো। আবার পশ্চিমে চুনাভাটি, নামনা, সেওগাওঁ আর আদমা। এই গ্রামগুলো সবকটিই ফরেস্টের ভেতরে। তা সেখানে যারা থাকে তারাও তো জংলী তাই না! সেই গ্রামগুলোর জন্য অল্প কিছু বছর আগে বরাদ্দ হয়েছিল চারটি ছোট ছোট স্কুলের, তার মধ্যে প্রাথমিক ৩টি আর একটি জুনিয়ার হাই স্কুল। আপনারা সকলেই জানেন গ্রামগুলো খুবই ছোট ছোট, জনসংখ্যা খুবই কম তাই স্বভাবতই ছাত্রসংখ্যাও কম। এবারে ছাত্র সংখ্যা ৩০এর নীচে হলে সেই স্কুল বন্ধ। তাই সবগুলো স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। তার নোটিশ এখনো সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবার হাতের মুঠোয়। তা বক্সা পাহাড়ের মাথায় নামনা, সেওগাওঁ, আদমা তো ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কি ৩০এর বেশি হওয়া সম্ভব? এই সহজ সরল প্রশ্নটি শিক্ষা দপ্তরের কর্তাদের মাথায় কি আসেনি? নাকি তারা ঐ দূর দুরান্তের স্কুলগুলির ঝামেলা(?) ঝেড়ে ফেলতেই চাইছেন? আর সবকটি স্কুলই বন্ধ করে দিতে হবে। হায় রে! যখন প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে পড়বার অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে, যখন সবাই চাইছেন সব শিশু বিদ্যালয়মুখী হোক, যখন শিশুদের একটিবেলার খাবার অন্তত নিশ্চিত করতে মিড-ডে মিল চালু করা হয়েছে, তখন একটি বিস্তীর্ণ এলাকার সবকটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। একবারও ভাবলেন না যে ঐ গ্রামগুলির শিশুদের অন্য কোনো বিকল্পই রইল না। 

 ফরেস্ট ভিলেজের মানুষজন যাদের ছাড়া ফরেস্টটাই থাকবে না, তাদের জন্য বনাধিকার আইন প্রস্তুত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ভারতের সংবিধানে। যদিও তাকে খর্ব করবার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে সরকার। তা ঐ বনের মানুষগুলো, ঐ জংলী(?) মানুষগুলো তাদের খাবার-দাবার কীভাবে পাবে, ন্যূনতম চিকিৎসা কীভাবে পাবে তার ব্যবস্থাই ছিল এই পাহাড়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা সেখানে এবার যুক্ত হল তাঁদের বাচ্চাগুলো পড়বার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবে। আসলে কী সবটা মিলে একটা সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য? মানে সবদিকে থেকে বঞ্চিত করে রাখো যেন নিজেরাই জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাহলেই অবাধে লুঠ করা যাবে জঙ্গল!! 'বাঘ ছাড়া হবে'- সেই ভয় দেখিয়ে, '১০লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে' তার প্রলোভন দেখিয়েও যখন কাজ হল না তখন কি এ এক অভিনব পন্থা? 

আর গত তিনদিনে কোনো মিডিয়াতেই স্থান পায় না এই স্কুলগুলির অবলুপ্তির কথা!এই চক্রান্ত কতটা গভীর! হাতে মারো ভাতে মারো সব দিক থেকে মারো ঐ জংলীগুলোকে। এই চাইছেন! 

৮০০ কি.মি. দূরের রাজধানীতে বসে এ নিয়ম করা খুব সহজ যে ৩০ এর কম ছাত্র-ছাত্রীর স্কুলগুলিকে বন্ধ করে দাও। বাস্তব কঠিন সত্যটি তাদের বুঝতে অসুবিধে হতেও পারে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসন! তারা একবারও ভাবলেন না? একটি বারও মনে হল না মানুষগুলি কী করবেন? কোথায় যাবেন? অথচ ভোটের সময় একদিন আগেই টিম পাঠিয়ে ভোট নেবার আশ্রয়স্থল ঐ স্কুলগুলির একটি। সত‍্যি কি বিচিত্র এই দেশ! 

 শিক্ষার অধিকার তো প্রতিটি শিশুরই আছে। তা এবার কোথায় যাবে শিশুগুলি? তাদের কি কোনও বিকল্প ব্যাবস্থা আছে ঐ পাহাড়ের মাথায়? তাহলে পড়া বন্ধ। শিক্ষা বন্ধ। মিড-ডে মিল বন্ধ। থাক অশিক্ষিত হয়ে। এটাই কি চাইছেন প্রকারান্তরে! আমরা খুব গর্ব করি আমার জেলার, আমার রাজ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে বক্সা পাহাড় একটি। প্রতিবছর সেখানে হাজির হই ১৫ আগস্টের পতাকা ওড়াতে (সরকারি খরচে)! কোটি কোটি টাকা খরচ করে (?) হেরিটেজ রিনোভেশনের নামে বক্সা পাহাড় নিয়ে ব্যবসার বুদ্ধি ঠিক জোগাড় হয়ে যায় আর বাচ্চাগুলো পড়তে পারবে না, সেটা একবারও মাথায় আসে না? বাঃ কি বিচিত্র ভাবনা!

 তপশিলী উপজাতির পশ্চিমবঙ্গের তালিকায় ভুটিয়া, শেরপা, টোটো, ডুকপা, টিবেটান, ইয়েলমো এক সারিতে আছে। তার মধ্যে ডুকপা জনজাতির সবচাইতে বেশি মানুষ বাস করেন এই বক্সা পাহাড়ে। সংখ্যায় তারা কত? ১০০০ বা তার আশেপাশে। এদের পাশে কি দাঁড়াবার কথা ছিল না? না ওদের শিক্ষার ন্যূনতম ব্যাবস্থাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হল। তাহলে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দপ্তর কাদের কল্যাণে? কী কাজে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা জেলায় কী হল তা আজকের বিষয় নয়? এই বক্সা পাহাড়ের বিষয়টি একটু অন্যভাবে দেখাই যেত। না তা হল না। ফরমান বেড়িয়ে গেল স্কুল বন্ধ। 

 এরপর আবার যখন বক্সা পাহাড়ে যাবেন স্ফুর্তি করতে তখন দাঁড়াতে পারবেন তো ঐ মানুষগুলোর সামনে? ওদের বাড়িতে আপনার জন্য রান্না করে দিতে বলতে লজ্জা করবে না? আপনার শিশুটির জন্য খাবার তৈরি করে দিতে বলবেন ওই না পড়তে পারা নিষ্পাপ শিশুদের? আজ একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই প্রশ্নগুলিই করুন। যদি উত্তর পান...।

সংগ্রহ: http://www.ba.cpiml.net/deshabrati/2023/03/all-schools-will-be-closed-in-buxa-hills

মেয়েরা কতটা স্বাধীন? -শুভজিৎ বিশ্বাস
Dec. 3, 2024 | নারী | views:902 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সারাদেশ জুড়ে যখন শিক্ষা, শিক্ষা আর শিক্ষার বিতরণ চলছে ঠিক এমন সময় আমি বারান্দার ব্যালকনিতে বসে ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবে এক শব্দের পাহাড় সাজিয়ে ফেলেছি। যে শব্দ পাহাড় ভেদ করে যাওয়ার ক্ষমতা যদিও আমার হয়নি তবুও স্বপ্নের সাথে কল্পনা মিশিয়ে মিথ্যা ভবিষ্যতের জটলা পাকাতে অসুবিধা কোথায়? হ্যাঁ, মিথ্যা ভবিষ্যৎ ....স্বপ্নহীন পৃথিবী, উদ্দেশ্যেহীন জীবন এই সব নিয়েই যে আগামী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ আমার মতো পরিবারের মেয়েদের তো অন্ধকার নিয়েই জন্মাতে হয়। তাই আলোকিত জীবন আমাদের মানাই না। তবুও কাজের ফাঁকে আলোকিত জীবনের ছবি আঁকি, অনেক বড়ো হওয়ার, চাকরি করার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। আমার পাশের বাড়ির সৌমিতা দিদির মতো নার্স হয়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে একজন সৎ মস্ত বড়ো পুলিশ অফিসার হই, দেশের জন্য প্রাণ দেব। ইচ্ছে করে আরও অনেক কিছু করতে কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আমার বয়স। এই তো কয়েকদিন হল আঠারো বছর পূর্ণ হল। পাত্র দেখাশোনা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরে। হয়ত পছন্দও হয়েছে অনেক পরিবারের।

 

একবার আমার যখন ষোলো বছর বয়েস তখন বাবা বিয়ে দেওয়ার জন্য খুব উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বাবা যখন মেয়ের বিয়ের যাবতীয় আয়োজন প্রায় শেষ করে ফেলেছেন তখনই একদিন সকালে একটা পাশের বাড়ির কাকু এসে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী'র বিস্তারিত আলোচনায় জমে উঠলেন বাবার সাথে। বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়া হল। আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম। সেদিন আমি বাবাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, আমি বিয়ে করতে চাই না, কিন্তু কে শুনবে? একটা মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে? বয়স বাড়ছে। মেয়েরা তো কুড়িতেই বুড়ি। খুব অদ্ভুত এসব প্রবাদ। তবে যাই হোক আমার মন খুশির জোয়ারে ভেসেছিল বিয়েটা বাতিলে। আবার পড়াশোনা করার সুযোগ, স্বপ্নপূরণ ইত্যাদি সবই হবে। হয়েছিল সেটা তবে দু'বছরের জন্য। কন্যাশ্রী পেয়েছি কিন্তু বিয়ে না ঠিক হলে তো রূপশ্রী পাওয়া যাবে না। আবার পাত্র দেখা শুরু হল জোর কদমে। হয়ত দু'মুটো ভাতের জন্য, আশ্রয়ের জন্য আবারও আমি নীরব হলাম। অবশেষে পাত্র মিললো আমার থেকে বছর দশকের বড়ো। রূপশ্রী'র ফর্মও ফিলাপ হয়ে গেল খুব দ্রুত। হয়ত টাকাটা পাওয়ার পরেই বিয়ের পিরিতে বসতে হবে। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নগুলো অস্পষ্ট হয়ে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছু করার থাকলেও কিছুই করতে পারছি না। 


এখন আমি ব্যালকনিতে বসে আছি। বাইরের বৃষ্টি দেখছি। বৃষ্টির শব্দের সাথে ভাবনার এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাচ্ছি। ভাবনাগুলো বন্ধ ঘরে আমায় গলা চেপে মেরে ফেলে দিতে চাই। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল আমার স্বপ্ন, খুব অল্প দামে। হয়ত কন্যাশ্রী রূপশ্রী'র জন্য আমার ষোলো বছরে ছন্দপতন হয়নি। তবে যাই হোক আমার ভাবনা এগুলো নয়। আমি ভাবছি আগামী প্রজন্ম কি আঠারোতেই আটকে যাবে নাকি স্বপ্নের কাছে পৌঁচ্ছাতে পারবে? জানি না তবে এটুকু বুঝতে পারছি বাল্যবিবাহ বন্ধ হলেও কোনো মেয়ের স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব কেউ নেই না। এমনকি নিজের পরিবারও না। মেয়েরা যে কুড়িতেই বুড়ি। 

জ্বিন বা ভুতে ধরা আসলে কী? -পার্থপ্রতিম পাল
Dec. 3, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:812 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের মত দেশে জ্বীনের আছর বা ভুতে ধরা ঘটনা দেখেননি এমন লোক বিরল। সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ হটাৎ অস্বাভাবিক কিছু কর্মকান্ড শুরু করে চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেয় তারপর ওঝা বা ফকিরের ভুত জ্বীন তাড়ানোর নাটকীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্বের সমাপ্তি হয়। 

কিন্তু এই জ্বিন বা ভুতের ভরের আসল কারন কী? 

কী বলছে চিকিৎসা বিজ্ঞান? কী কারনে জ্বিন ভুতে পাওয়া মানুষ এমন করে?

জ্বিন/ভুতে ধরা কেসের অধিকাংশ হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত। 

হিস্টেরিয়া ছাড়াও সিজোফ্রেনিয়া, স্কিটসোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভড বা পারকিনসিনিজম সহ আরো কিছু রোগে এই রকম আচরণ দেখা যাতে পারে। কিন্তু হিস্টেরিয়াই হল কমন কারন।

হিস্টেরিয়া কি?

হিস্টিরিয়া হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে দুর্দমনীয় ভয় ও অতিরিক্ত আবেগের প্রকাশ। এই অবস্থায় রোগীর অনিয়ন্ত্রিত এবং সহিংস আচরণ করে থাকে।

হিস্টেরিয়ার লক্ষণ -

১)শরীরের অংশ বা পুরো শরীরই অবশ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হওয়া।

২) কথা বলতে না পারা, ঢোক গিলতে না পারা, গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে বলে মনে হওয়া।

৩)কখনো চোখে না দেখা বা কানে শুনতে না পারা।

৪) খিঁচুনি। খিঁচুনি হয়ে তারা অজ্ঞান এর মত হয়ে যায়। যদিও সেটা প্রকৃত খিঁচুনি বা অজ্ঞান নয়। মৃগী রোগের প্রকৃত খিঁচুনির মতো এখানে জিব বা ঠোঁট কেটে যায় না।

৫)হাত-পায়ের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, বারবার চোখের পলক পড়া, জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখা, ঘাড় বাঁকা করে থাকা এবং বমি করা বা বারবার বমির চেষ্টা করা।

৬)সহিংস মনোভাব ও অস্থিতিশীল হৃৎস্পন্দন।

৭)কোনো কারণ ছাড়াই অট্টহাসি বা কান্না করা।

হিস্টেরিয়া কেন হয়?

যেকোন কারণে মানসিক ক্রিয়াশক্তি দুর্বল হয়ে গেলে সেই অবাঞ্ছিত অবদমিত কামনাগুলো সজ্ঞান চেতনায় উঠে আসতে চায়। 

শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা শারীরিক লক্ষণে।

• সামাজিক বা পারিবারিক অবহেলার শিকার হওয়া

• স্ট্রেস

• যৌন নিপীড়ন

• অলসতা

• কাছের কারো থেকে থাকলে

• নার্ভাসনেস

• আবেগের ত্রুটিপূর্ণ চর্চা

• মেন্টাল স্ট্রেস

• ভয়

• দুশ্চিন্তা

এগুলোই মূলত কারন।

হিস্টেরিয়া মেয়েদের কেন বেশি হয়?

নারীর ক্ষেত্রে সামাজিক বিধিনিষেধ বেশি থাকে। বিধিনিষেধের কারনে নারী তার কামনা-বাসনাগুলোকে অবদমিত করে রাখে। 

অবদমিত সহজাত কামনার সঙ্গে সামাজিক আচারের সংঘাত ঘটে। সৃষ্টি হয় সহ্যাতীত উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপ।

সহজে কিভাবে বুঝবেন এটা হিস্টেরিয়া নাকি প্রকৃত খিঁচুনি?

যেহেতু হিস্টেরিয়ায় কেউ প্রকৃত অজ্ঞান বা সেন্স হারায় না তাই এদের কখনো দাত লেগে জিভ কেটে যায় না। বরং দাতের পাটি খুলতে গেলে আরো জোরে আটকে রাখার চেষ্টা করে। একটা টর্চ নিয়ে চোখে ফেললে চোখের পিউপিল ছোট হয়ে যাবে আলোর জন্য যেটা অজ্ঞান হলে ছোট হয় না। ব্যাথা দিলে এরা ব্যাথা পায়।

ওঝা ফকিরে কিভাবে ভাল করে এদের?

হিস্টেরিয়ার ভুক্তভোগীরা মূলত আদর ভালবাসার কাঙ্গাল এবং অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। 

নিজের অবদমিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর পর এদের ক্ষোভ প্রশমিত হয় এবং সেটা থেকে স্বাভাবিক হবার পরিচিত কোন পদ্ধতি খোঁজে এরা যেটা হল ওঝা ফকিরের ঝাড়ফুক।

হিস্টেরিয়াতে/ ভুতে/ জ্বিনে ধরলে কি করণীয়?

ফকির ওঝা দিয়ে অপচিকিৎসা না করিয়ে রোগীকে যথোপযুক্ত  চিকিৎসা করানো উচিৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এর মাধ্যমে। 

পারিবারিক মানসিক সাপোর্ট হল চিকিৎসার সবচেয়ে বড় পার্ট। প্রতিটা হিস্টেরিয়া রোগী যথোপযুক্ত চিকিৎসা এবং সহায়তা পেলে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

প্রসঙ্গ: ধর্ম -রাজু দত্ত
Dec. 3, 2024 | ধর্ম | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্ম কথাটার মানে হল ধারন করা। যে যা স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য ধারন করে সেটাই তার ধর্ম। যেমন জলের একটি ধর্ম, আধারের আকার ধারন। 

মানুষের ধর্ম তাই-ই যা মানুষ‌ ধারন করে থাকে। এক্ষেত্রে ঔচিত্যবোধের প্রশ্নটি জড়িত। আপনি যে স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য ধারন‌ করে আছেন, সেটাই আপনার ধর্ম।‌ 


মানুষের শারীরিক গঠন তার ধর্ম। যেমন তার মস্তিস্ক, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, গায়ের রঙ ইত্যাদি।‌ আবার তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যও তার ধর্ম।‌ এই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের সাথে ঔচিত্যবোধের প্রশ্নটি জড়িত। যেমন চুরি করা চোরের ধর্ম, কিন্তু তা উচিৎ নয়। তাই এই ধর্ম গ্রহনযোগ্য নয়। আবার বিপদে আপদে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এটা গ্রহণযোগ্য। 

অর্থাৎ যে শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষ ধারন‌ করে থাকে সেগুলিই তার ধর্ম। মানুষের মানসিক বৈশিষ্ট্য, যা তার ও অন্যন্য জীবের পক্ষে মঙ্গলজনক তাকেই মানবধর্ম বলা যায়। 

মানুষের সততা, ভালবাসা, মুল্যবোধ, জ্ঞানপিপাপা ইত্যাদি হল তার ধর্ম। এটাই মানবধর্ম। মানুষ হিংস্র জন্তকেও রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরত, এটা মানবধর্ম। অপরদিকে মানুষের প্রতি মানুষের‌ ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা ইত্যাদি মানবধর্ম নয়। আপনি যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন, আপনি মানুষ।‌ তাই মানবধর্ম আপনাকে মেনে চলতেই হবে। আপনি চান‌  বা না চান। মানবধর্ম বিরোধী হলে আপনি দয়া মায়া, সততা,  প্রেম সহ সকল সদ আচরণ এর বিরোধী।‌ কারণ এগুলোই মানুষের ধর্ম। মানুষের ধর্মই মানবধর্ম। 

কোনো মানুষ যদি মানবধর্মে বিশ্বাসের কথা বলে অসদাচরণ করে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। তার অসদাচরণ দেখে মানবধর্ম ভ্রান্ত  হয়ে যায় না। তাই আপনার বিচারবুদ্ধি দিয়ে ভেবে দেখুন, মানুষের কী করা উচিৎ। তাই করুন। এটাই আপনার কর্তব্য।‌ 

জাতি ও  বর্ণগত বিদ্বেষ, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, হিংসা, কলহ, অসততা, দ্বিচারিতা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা সহ সকল অসদাচরণ  মানবধর্ম বিরোধী।‌ এগুলি পরিত্যাগ করুন। এগুলি মানুষের ধর্ম নয়।‌ 

বাস্তবে যুক্তিবাদী হতে পারা ও তার প্রয়োগ নিয়ে কিছু কথা -বিশ্বনাথ মুরমু
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা অনেক সময়ই খুব সাধারণ একটা কথা, খুব সাধারণভাবেই ব্যাবহার করে থাকি, charity begins at home. অর্থাৎ কিনা, বাড়ি থেকেই আসল বিদ্যাশিক্ষার শুরু করতে হয় (এখানে যুক্তিবোধ বা যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা)। আক্ষরিক অর্থে, এক্ষেত্রে শুধু নিজের বাড়ি বা বাড়ির লোকই ধরা হয় না, ধরা হয় প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন, সহপাঠী, সহকর্মী, ইত্যাদি। কিন্তু, ভেবে দেখলে ধরা পড়বে যে যারা নিজেদের যুক্তিবাদী বলে বা যাদের যুক্তিবাদী বলে লোকে জানে এবং যারা যুক্তিবাদী নয়, অনেক ব্যাবহারিক ক্ষেত্রেই তাদের সবার আচরণ এক হয়ে দাঁড়ায়, যা হল অযৌক্তিক অনেক কিছুই, না দেখার ভান করে থাকা বা অনেক সময় বাধ্য হয়েই চেপে যাওয়া। যারা যুক্তিবাদী নয় তারা তো গড্ডলিকা প্রবাহের লোক, কাজেই কিছু বলারই নেই। কিন্তু যারা জীবন যাপনে আদর্শবাদী, সত্যবাদী, অন্তত নিজেদের সেইভাবে তুলে ধরতে চায়, তাদের যদি গলায় তুলসি মালা, কপালে তিলক দেখা যায়, এটা কি আদর্শবাদী বা সত্যবাদীর আচরণ বলে মেনে নেওয়া যায়? 

এটা হয়ে যায় আর এক প্রবাদের বহিঃপ্রকাশ, তামাকও খাব, আবার ডুডুও খাব। যুক্তিবাদ ছাড়া না আদর্শবাদ মানা যায়, না সত্যবাদের অনুসরন করা যায়। যুক্তিবাদ হল বাস্তবতা, বাস্তবতাই সত্য (এই সত্যই ধর্ম/ন্যায়), এর কোন দরাদরি হয় না। কাজেই, অবাস্তবতার আদর্শবাদ যেমন হতে পারে না, তেমনই অবাস্তবতার সত্যবাদও হতে পারে না।

চাই সচেতনতার পাঠ, প্রসার যা কিনা বিজ্ঞান মঞ্চগুলিই পালন করতে পারে। অবশ্য, এটা সত্যি, সব ক্ষেত্রে এবং সব সময়ে এককভাবে প্রতিবাদ করা যায় না বা যুক্তিটুকুও প্রকাশ করা যায় না। প্রচলিত ধারনার মূলে কুঠারাঘাত করা চাই পাল্টা যুক্তির অর্থাৎ বাস্তবতার ধারনা প্রচার করে। এরজন্য, সব জায়গায় সব সময়ে বিলি করা যায় এমন হ্যান্ডবিল ছাপা থাকলে, বিলি করলে হয়, যা কোন সংগঠনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকলেই ভালো হয়, জোরদার হয়। বড় বড় বই কিনে পড়ে লোকে যুক্তিবাদী হবে, কুসংস্কারের ব্যাবসায়ী ধান্দাবাজরা পিছু হঠবে, এটা আশা করাই হাস্যকর। এবং যে কোন একক প্রতিবাদীই হয় হাসির পাত্র।

যখনই কেউ নতুন বাড়ি বানায়, কর্তা গিন্নি দুজনেরই কল্পনায় থাকে ছোট্ট একটা ঠাকুরঘর। যারা পারে না বা যাদের নেই, তারা একটা কোনে বসিয়ে নেয় ঠাকুরের আসন। কেউ, ঠাকুরের জন্য কাঠের আসন বা সিংহাসন, ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনে এনে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেন এই আসন। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। চাই যুক্তিবাদী ফার্নিচারের দোকান, যে তার বিঞ্জাপনে লিখে রাখবে, এখানে কোন ঠাকুরের আসন বিক্রি হয় না বা বানানো হয় না। বাড়ি বানানোর সিভিল ইঞ্জিনীয়ার লিখে রাখবে, আমি মানুষের ঘরের প্ল্যান বানাই, ঠাকুরঘরের প্ল্যান বানাই না।

বাড়ির বাচ্চা কোলে করে কাজের মাসি কি আপন মাসি, তাকে ক্যালেন্ডারে ঠাকুর চেনাচ্ছে আর বলছে, নমো কর, নমো কর। কোন ক্যালেন্ডার ওয়ালার কি হিম্মৎ হবে, শুধুই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের ক্যালেন্ডার বানানোর? সে কি লিখে রাখার হিম্মত দেখাতে পারবে, যে সে ঠাকুরের ক্যালেন্ডার ছাপায় না? একশ' টাকার বিজনেসে তার হয়ত আঠানব্বই টাকাই আসে নানাবিধ ঠাকুরের ছবির (হনুমানেরও হতে পারে) ক্যালেন্ডার বেচে।  আমাদের একমাত্র ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ বলে আমরা সস্তায় ফেসবুকে আলোড়ন তুলতে ব্যাস্ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের র' জানতে চিনতে অনীহা। কেননা তাতে প্রভূত পরিশ্রম আছে।

বাড়িতে পূজোর আয়োজন হয়েছে। ছোটখোকা ঘোর নাস্তিক। সে তার নিজের ঘর থেকে বেরোবে না। বাড়ি ভর্তি পাড়ার লোক, আত্মীয় স্বজন। বড়খোকার উপর ভার দেওয়া হল, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একঘন্টার জন্য যেন নিয়ে আসে পূজোর ঘরে।

নিজের বাড়ি হোক কি পরের বাড়ি, কাউকে যখন বেরোতে দেখা যায় বাড়ির কোন সদস্য বা সদস্যা হয়ত বলে ওঠেন দুর্গা, দুর্গা। এটা হয় এবং হয়ে থাকে আজন্ম সংস্কার বা শিকড়হীন এক বিশ্বাস থেকে। যেন, রাস্তাঘাটে অদৃশ্য মা দুর্গা তাকে রক্ষা করবেন। যে যাচ্ছে, তার যাত্রার শুভ কামনা করাই উদ্দেশ্য। সেখানে বাস্তবতা মেনে, যাত্রা শুভ হোক বললেই তো হতে পারে। সবচেয়ে বলা ভালো, চোখ কান খোলা রেখে যেও। সত্যিই যা দিনকাল পড়েছে!

বাড়ির লোকজনের মধ্যে কোন একটা বিষয়ে হয়ত আলোচনা চলছে। এমন সময়ে বেয়াদপ টিকটিকি ডেকে উঠল, আর কেউ একজন হাতের আঙুলে তিন তুড়ি মেরে বলল, 'ঠিক, ঠিক, ঠিক'। চোখে ভেসে ওঠে হীরক রাজার দরবার, রাজা তিনজন পারিষদকে পরপর প্রশ্ন করেন 'ঠিক কিনা?' উত্তর আসে, 'ঠিক,' 'ঠিক,' 'ঠিক'।


ছেলেমেয়েরা মা বাবাকে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, মা হয়ত বলে উঠলেন, মা সরস্বতীকে স্মরণ করো, তিনি সব ঠিক করে দেবেন। সত্যিই কি তাই? পড়াশুনা না করে থাকলে, কোন দেব বা দেবীই কলমের নিবের ডগায় বসে গড়গড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দেবে না। সরস্বতীর যুক্তিতে, রেজাল্ট খারাপ করা কোন ছাত্রছাত্রীকেই দোষারোপ করা মোটেই ঠিক না।

বন্ধুরা মিলে হুইস্কির আসর বসিয়েছে। জল, সোডা, চিপস্, বাদাম, পেঁয়াজ, আদাকুচি, কোন ত্রুটি নেই আয়োজনে। এক বন্ধু তুখোড় ব্যাবস্থাপনায়। ছিপি খুলে প্রথমেই মাটিতে তিন ফোঁটা ফেলে ভূমি পূজণ সেরে পেগ সাজিয়ে ফেলল। এই ভূমি পূজনটা কেমন বেমানান (সুপারস্টিশন) হয়ে গেল না? নাকি মদ খাওয়ার আনন্দে 'এই একটুখানি' বলে নিজের বিবেককে ফাঁকি দেওয়া যায়?

নার্সিং হোমে রুগী ভর্তি আছে। কয়েক মাসের চেষ্টায় অনেক পরিশ্রমে বেশকিছু অর্থের বিনিময়ে ভর্তির পর আজ অপারেশনের ডেট পাওয়া গেছে। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবার সময়ে ডাক্তার বলে গেলেন, এখন যা করবার উপর-ওয়ালাই করবেন, তাঁর উপর ভরসা রাখুন। বিজ্ঞান শিক্ষিত ডাক্তার, বিজ্ঞানের অবদান চিকিৎসা বিদ্যাকে হেয় করে উপর-ওয়ালার দোহাই দিলেন। বাড়ির মেয়েরা নার্সিং হোমের নিচতলায় কোন এক দেব বা দেবীর ছোট করে বানিয়ে রাখা মন্দিরে প্রার্থনায় বসে গেলেন। চতুর চূড়ামনি নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ এটাকে কি কায়দা করে বানিয়ে রাখে নি, যাতে করে, রুগীর মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ তুলে রুগীর আত্মীয়স্বজন নার্সিং হোম, ডাক্তার নার্সের উপর চড়াও না হতে পারে?


এরকমই, প্রায় সব নার্সিং হোমে, প্রাইভেট হাসপাতালে, পুলিশ ব্যারাকে, থানা চত্বরে, বড় বড় আবাসনে, বাজারে বড় ছোট মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা, যারা যেখানে যেমন জমাতে পেরেছে, বানিয়ে রেখেছে। খুব ভালো ভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এতে করে কেমন ভাবে শাসক এবং শোষক শ্রেনীর স্বার্থই পুষ্টিলাভ করে। তামাম দেশবাসীকে বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্রে স্বনির্ভর করা অসাধ্য নয়। অসাধ্য নয় ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যাবস্থা করা। কিন্তু, তাতে করে ভোট পাওয়ার আশা নাও থাকতে পারে। এবং নিজেরা একচ্ছত্রভাবে সুখের সিংহাসনে বসে ছড়ি ঘোরাতেও পারবে না। তাই, শাসকশ্রেনীর লক্ষ্য থাকে আপামর জনসাধারণকে ভাগ্যবাদী করে তোলা।


ব্যাস্ত জাতীয় সড়কের পাশেই আছে বিপত্তারিনী মন্দির। যাওয়া আসার সময়ে সব বাসের গতি ধীর হয়ে যায়, যাতে গদ্গদ ভক্তবৃন্দ একটাকা দু টাকা দেবীকে উদ্দেশ্য করে মন্দিরের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারে। কন্ডাক্টার নিজেও ছুঁড়ে দেয় কয়েন। ওখানে অনেক দু চাকা চারচাকা, নতুন গাড়ি কিনলেই মালিকরা আসেন পূজো দিতে। দেবী নাকি দু চাকা, চারচাকা গাড়ি ও গাড়ির চালক বা আরোহীকে রক্ষা করেন। অথচ এমনও নজির আছে, পূজো দিয়ে ফেরার সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নতুন গাড়ি ভেঙেছে, আরোহীদের মৃত্যু হয়েছে।

বাজারের মোড়েই ডানদিকে টিনের চেয়ারে লালশালু ঢেকে বসিয়ে রাখা আছে শনির ফটো, পাশে কাঁসার থালায় কটা জবাফুল, জ্বলন্ত ধূপকাঠি, কিছু কয়েন, দশ বিশ টাকার নোট। তাঁর কোপে না পড়তে হয়, বাজার ফিরতি দশটাকার নোট ফেলে দিলাম অকাতরে। দোকান বন্ধের সময়ে এসে নজর করলে দেখতে পেতাম, শনি ঠাকুরের ব্যাপারী ফটো, শালু, থালা, খুচরো সমেত চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা মূলধন, বাজারের থলেতে ভরে, গুনগুন

গাইতে গাইতে লাভের টাকাগুলো পকেটে ভরে নিচ্ছে। তার না আছে শনির কোপের ভয়, না আছে রবি সোমের পরোয়া।

প্রবল মেঘ গর্জন, মূহুর্মূহু বিদ্যূত চমক তৎসহ ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা। বাড়ির কর্তাগিন্নি একযোগে শুরু করলেন হরি মাধবের স্তব।

বাড়ির গাছে এই বছরের প্রথম ফল, নারকেল কি আম কি কুল বা অন্য যা কিছুই হোক, দেবতাকে নৈবেদ্য না দিয়ে খাওয়া যাবে না, কাউকে দেওয়া যাবে না।

কোন গাছ কাটার দরকার পড়েছে। বৃক্ষদেবতার কাছে করজোড়ে মাপ চেয়ে নিয়ে কেটে ফেললেই হল। যুক্তি তক্কে যাই না যে, আগে একটা বিকল্প বৃক্ষরোপন করি, তারপরেই না হয় গাছ কাটবো।

এক পানগুমটি দোকানদারের অকুন্ঠ স্বীকারোক্তি, সারাদিন তো লোকজনকে পান, দোক্তা, জর্দা, বিড়ি-সিগারেট খাওয়াচ্ছি, কোনটাও ভালো জিনিস নয়, তাই সকাল সন্ধ্যা ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই, যাতে পাপ না দেন (ঠাকুর ঠাকুরানীরা ঘুষখোর কিনা পাঠকই বলবেন)।

রেলের কোন শিলান্যাস কি, জলজাহাজ উড়োজাহাজের কোন কিছুর উদ্বোধন হোক, ধূপ জ্বালিয়ে, কাঁসর বাজিয়ে, নারকেল ফাটিয়ে মঙ্গল কামনা করছেন বিজ্ঞান শিক্ষিত চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দল।

তারকেশ্বরই হোক কি বৈদ্যনাথধামই হোক, ভোলে বাবা কি জয় চিৎকারকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তরুন প্রজন্ম একে অ্যাডভেঞ্চারের চোখেই দেখছে নাকি ভক্তির চোখে দেখছে, বলা অসম্ভব। অন্যদিকে রেল এবং রাজ্য সরকার গ্রাফ এঁকে চলেছেন, এই বছরে কত তীর্থযাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি হল। গঙ্গাসাগর নিয়েও একই কথা বলতে হয়। এরকম বহু উদাহরণ চেষ্টা করলেই খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।

সেই বোকা গৃহস্থ আর চালাক চোরের কথা মনে পড়ে নাকি? যে গৃহস্থ, বাড়িতে চোরের ঢোকা থেকে, তার নিজের বালিশের তলা থেকে চাবি নেওয়া থেকে, আলমারি খোলা পর্যন্তও, শুধু দেখে গেল এবং তখনও ভেবেই যাচ্ছে যে 'দেখি না, এরপর কি করে?' ফল যা হবার তাই হল, চোর বাবাজী ধীরে সুস্থে গৃহস্থের লুঙ্গি খুলে পোঁটলা বেঁধে, দরজা হাট করে খোলা রেখে, বামাল বেরিয়ে গেল।

চোর নিরাপদ দূরত্বে গেলে (আসলে  গৃহস্থ নিজেকে নিরাপদ মনে করলে তবেই), তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করল চোর, চোর বলে।

অচ্ছুতের সমস্যা -ভগৎ সিং
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:500 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কাকিনাড়াতে ১৯২৩ সালে এ কংগ্রেস অধিবেশন হয় তাতে মহম্মদ আলি জিন্না নিজের ভাষনে ভারতের দলিত সমাজকে হিন্দু আর মুসলিম মিশনারি সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব আনেন৷ এইভাবে দলিতদের বন্ধু সেজে সাহায্য করার নামে তাদের মধ্যে জাতিগত ভেদভাবনা জানানোর যে অপচেষ্টা শুরু হয় তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপি শোরগোল পড়ে যায়৷ সেই সামাজিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভগৎ সিং ১৯২৮ সালে কীর্তি পত্রিকায় অচ্ছুতের সমস্যা নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন৷ বর্তমান সময়ে ভগৎ সিংকে নিজেদের দলে টানতে ডান থেকে বাম সমস্ত দলই ব্যতিব্যস্ত৷ এরফলে তাঁর নাম নিয়ে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা মূলক লেখা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ এরই বিরুদ্ধে পড়তে গিয়ে উপরের লেখাটি চোখে পড়ে৷ এর হিন্দি আর ইংরেজি অনুবাদ চোখে পড়লেও বাংলা কোন অনুবাদ চোখে পড়েনি৷ কিন্তু ভারতের দলিত সমাজের মূল সমস্যা আর মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের মুক্তির উপায় নিয়ে এই লেখা বাংলায় অনূদিত না হলে বাংলারই ক্ষতি বলে এই অধমের মত৷ বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যখন ইউনিয়ন সরকার সরাসরি ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কারণে দলিত নিগ্রহের সংবাদ আমাদের কাছে আসছে, তখন ভগৎ সিং এর এই প্রবন্ধ শত বর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজও কতটা প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বৃথা৷  তাই নিজ ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে নেমেছি এর বঙ্গানুবাদের অসাধ্য সাধনে৷ ভুলত্রুটি সত্বেও ভগৎ সিং এর চেতনা আপামর বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই লক্ষ্য৷ লেখাটি অনুবাদ করা হয়েছে marxist.org তে প্রকাশিত হিন্দি প্রবন্ধ থেকে৷ 


“আমাদের দেশের মতন দুরবস্থা অন্য কোন দেশের হয়নি৷ এখানে অদ্ভুত সব প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই৷ এরই মধ্যে অন্যতম প্রশ্ন অচ্ছুৎ সমস্যা নিয়ে৷ সমস্যা হল, ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে যে ছ কোটি লোক অচ্ছুৎ, তাদের স্পর্শেই নাকি বাকিরা ধর্মচ্যুত হয়ে যাবে৷ তারা যদি কুঁয়ো থেকে জল নিতে যায়, কুঁয়ো অপবিত্র হয়ে যায়৷ এই কথা বিংশ শতাব্দীতে হচ্ছে এটা ভাবতেই লজ্জা লাগে৷ 


আমাদের দেশ আধ্যাত্মিকতার দেশ৷ কিন্তু আমরা মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দিতেও ইতস্তত করি, যেখানে পুরোপুরি বস্তুবাদী হিসাবে পরিচিত ইউরোপ কয়েক শতক ধরেই ইনক্লাবের জিগির তুলছে৷ তারা আমেরিকা আর ফ্রান্সের বিপ্লবের সময়ই সমতার ঘোষনা করেছেন৷ আজ রুশ দেশও এইরকম বিচ্ছিন্নতা ভুলে বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আমরা সবসময়েই আত্মা পরমাত্মার অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত থাকি এবং অচ্ছুৎদের পৈতেধারণের অধিকার আছে কিনা, তারা বেদ শাস্ত্র পাঠে অধিকারী কিনা সেই নিয়ে বিতর্কে মেতে থাকি৷ আমরা অভিযোগ করি যে আমাদের সাথে  বিদেশীরা ভাল ব্যবহার করে না৷ ইংরেজ প্রশাসন আমাদের শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ মনে করে না৷ কিন্তু এই অভিযোগ করার যোগ্যতা কি আদৌ আমাদের আছে? 


 শ্রী মহম্মদ নুর নামক সিন্ধের একজন মুসলমান ভদ্রলোক, যিনি বোম্বাই১ কাউন্সিলের সদস্য, এই বিষয়ে ১৯২৬ সালে বলেছেন, 

"যদি হিন্দু সমাজ নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষদের সর্বসাধারণের স্কুলে ভর্তির এবং আঞ্চলিক বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, যিনি কয়েক লক্ষ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন যখন নিজ ভাই বেরাদরদের জল খাওয়ার মতন  প্রাথমিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন,  তাদের প্রশাসনের কাছে আরো অধিকার চাওয়ার কী অধিকার আছে? অন্য ভূখণ্ড থেকে আসা মানুষদের অভিযুক্ত করার আগে আমাদের দেখা উচিত আমরা নিজেদের লোকের সাথে কিভাবে ব্যবহার করি৷ আমরা কিভাবে উচ্চতর রাজনৈতিক অধিকারের দাবী জানাব যদি আমরাই নিজেদের ন্যুনতম অধিকার দিতে অস্বীকার করি? "  হক কথা৷ কিন্তু যেহেতু একজন মুসলমান ব্যক্তি বলেছেন, হিন্দুরা বলবে যে দেখ, উনি ওই অচ্ছুতদের মুসলমান বানিয়ে নিজেদের দলভারী করতে চান৷ 


 যখন তুমি ওদের জানোয়ারেরও অধম বলে মনে করবে তো ওরা অবশ্যই অন্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইবে, যেখানে ওদের বেশি অধিকার মিলবে, যেখানে ওদের সাথে মনুষ্যোচিত ব্যবহার করা হবে৷  তখন যদি বল যে এই দেখ খ্রীষ্টান আর মুসলিমরা হিন্দু ধর্মের ক্ষতি করছে, ভুল হবে৷ 


 কথাগুলো সত্যি, কিন্তু এই শুনেই সবাই চিড়বিড় করে ওঠে৷ ঠিক এই ধরনের চিন্তা হিন্দুদেরও হয়েছিল৷ সনাতনী পণ্ডিতরাও এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন৷ মাঝেমাঝে "যুগান্তকারী " মানুষজনও এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন৷ লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে, যিনি অচ্ছ্যুতদের এক বড় সমর্থক, পাটনা শহরে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে এই নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছিল৷ অনেক তর্ক বিতর্ক হয়৷ প্রশ্ন এই ছিল যে অচ্ছুতদের যজ্ঞোপবিত ধারণের অধিকার আছে কী না? এছাড়াও তাদের কি বেদশাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার আছে? বড় বড় সমাজ সংষ্কারক চুপ করে গেলেও, লালা লাজপত রায় সর্বসম্মতিক্রমে দুটো বিষয়েরই স্বীকৃতি আদায় করিয়ে হিন্দুধর্মের মর্যাদা  রাখলেন৷ নইলে একটু ভেবে দেখুন কতটা লজ্জাজনক ঘটনা হত? একটা কুকুরও আমাদের কোলে বসতে পারে৷ আমাদের রান্নাঘরে নির্দ্বিধায় ঘুরতে পারে, কিন্তু একজন মানুষের স্পর্শে আমাদের জাত যায়৷ আজকের দিনেও মালব্য জির মতন বড় সমাজ সংষ্কারক, বিশাল অচ্ছুতপ্রেমী, না জানি আরো কত কী, একজন মেথরের হাতে মালা পরে নেন, কিন্তু কাপড় শুদ্ধ স্নান না করলে নিজেকে অশুদ্ধ মনে করেন৷ কী সুন্দর জিনিস৷ ভক্তপ্রিয় ভগবানের পূজা করার জন্য মন্দির বানানো হয়, কিন্তু তাতে অচ্ছুৎ প্রবেশ করলে মন্দির অশুদ্ধ হয়ে যায়! ভগবান নাকি রুষ্ট হন! যখন আমাদের ঘরেরই এই অবস্থা, তখন বাইরে সমানাধিকারের জন্য লড়াই কি আমাদের মানায়? তখন আমাদের এই ব্যবহারে কৃতঘ্নতাই প্রকাশ পায়৷ যারা নিচুস্তরের কাজ করে আমাদের স্বচ্ছন্দে বাস করতে সাহায্য করে তাদেরই আমরা দূরদূর করে তাড়াচ্ছি৷ আমরা পশুর পূজা করতে পারি, কিন্তু মানুষের পাশে বসতে পারিনা৷ 


 আজকাল এই নিয়ে প্রচুর শোরগোল হচ্ছে৷ এই বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে৷ দেশের মুক্তি কামনার চিন্তা  যে হারে বেড়েছে, তাতে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা অন্য কোন সুবিধা না দিলেও একটা সুবিধা এনেছে৷ প্রত্যেকেই বেশী অধিকারের দাবীর উদ্দেশ্যে নিজ জাতের সংখ্যা বাড়াতে উৎসুক৷ মুসলিমরা একটু বেশিই এই বিষয়ে জোর দিচ্ছে। ওঁরা অচ্ছুতদের মুসলমান বানিয়ে নিজেদের সমানাধিকার দেওয়া শুরু করে দিয়েছে৷ এতে হিন্দুদের অহং বোধ আহত হয়েছে৷ ঝামেলাও হয়েছে৷ শিখেরাও ভাবল যে আমরাও কেন পিছিয়ে থাকব? ওঁরাও অমৃত ছেটাতে শুরু করেছে৷ হিন্দু আর শিখদের মধ্যে যজ্ঞোপবিত ধারন বা চুল কাটা নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেছে৷ এখন তিনটে দলই  অচ্ছুতদের নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে৷ এদিকে খ্রীষ্টানরা চুপচাপ নিজেদের দলভারী করে যাচ্ছে৷ অন্ততএইসব দোলাচলের মধ্যেই দেশের দূর্ভাগ্য কাটছে৷


এদিকে অচ্ছুতরা যখন দেখছে যে ওদের নিয়েই অন্যদের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে আর ওদের নিয়ে সবাই টানাটানি করছে তখন ভাবল যে ওরাই  আলাদা ভাবে সংগঠিত হবে৷ এতে ইংরেজ সরকারের কতটা হাত আছে জানা নেই, কিন্তু এই ধরনের প্রচারে সরকারী মেশিনারির প্রচুর প্রভাব আছে৷ "আদি ধর্ম মণ্ডল " এর মতন  সংগঠনগুলি এই প্রচারেরই ফল৷  


 এখন আরেক প্রশ্ন উঠছে যে এই সমস্যার আদত সমাধান কোনটা? এর জবাব খুবই নির্দিষ্ট৷ প্রথমেই এটা বুঝতে হবে যে সব মানুষই সমান,  জন্মসূত্রে বা কর্মসূত্রে কেউ ভিন্ন হয়ে যায়না৷ অর্থাৎ যেহেতু কেউ গরীব মেথরের ঘরে জন্ম নিয়েছেন, তারমানে সারা জীবন ময়লাই পরিষ্কার করে যাবেন, কোন রকম উচ্চতর কাজ করার অধিকার নেই, এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারবা৷  এইভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যরা এদের সাথে অন্যায় করেছিলেন এবং এদের  নিচু বলে দূরে সরিয়ে নিম্নমানের কাজ করাতেন৷" এখন কী করবে? চুপচাপ দিন কাটাও!" এভাবেই ওদের ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়ে ওঁরা অচ্ছুতদের দীর্ঘসময় ধরে শান্ত করে রাখেন৷ কিন্তু এটা অত্যন্ত পাপ কাজ ছিল৷ মানুষের ভিতর থেকে মনুষ্যত্বই শেষ করে দিয়েছিল৷ আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরিতার চিন্তাকেই বিনষ্ট করে দিয়েছে৷ অনেক শোসন এবং অন্যায় হয়েছে এদের সাথে৷ এখন সবার প্রায়শ্চিত্ত করার সময়৷ 


 এর সাথে আরেক সমস্যাও আছে৷ লোকেদের মনে আবশ্যক কাজের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে৷ আমরা তাঁতিদেরও নিচু চোখে দেখেছি৷ আজ কাপড় বানায় যে তাকেও অচ্ছুৎ বলা হচ্ছে৷  ইউপিতে কাহারদেরও২ অচ্ছুৎ বলে মানা হয়৷ এতে খুবই সমস্যা হচ্ছে৷ এতে বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে৷ 


 এই বিভাজনকে সামনে রেখে আমাদের আশু কর্তব্য এই যে আমরা নাতো এদের অচ্ছুৎ ভাবব, না বলব৷ সমস্যার সমাধান এই পথেই আসবে৷ নতুন ভারত সভা তথা নতুন কংগ্রেস যে পথ নিয়েছে তা যথেষ্ট ভাল৷ যাদের আজ পর্যন্ত অচ্ছুৎ বলে ডাকা হচ্ছে, তাদের কাছে এতদিনের পাপকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে, তাদের সমমানের মানুষ ভেবে,  অমৃত ছেটানো, কলমা পড়া বা শুদ্ধিকরণ ব্যাতিত তাদের নিজেদের দলে সামিল করে তাদের হাতে জল খাওয়া এটাই উচিত পথ৷ নিজেদের মধ্যেই ভেদাভেদ করে কোন অধিকার না দেওয়া কখনই উচিত কাজ নয়৷ 


 যখন গ্রামের দিকে মজুরদের মধ্যে প্রথম প্রথম প্রচার শুরু হয়,  তখন সরকারি কর্মচারীদের কৃষকদের এই বলে উত্তেজিত করত যে দেখ এরা ভঙ্গী৩-চামারদের মাথায় চড়াচ্ছে যাতে এরা তোমাদের কাজ করা বন্ধ করে দেয়৷  এতে কৃষকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ এদের বোঝা উচিত যে এদের অবস্থা ততদিন পর্যন্ত শুধরোবেনা যতদিন এরা এইসব গরীবদের নিচুজাত বলে নিজের পায়ের তলায় রাখতে চাইবে৷ সাধারণত বলা হয় যে এরা নোংরা৷ এর কারণ স্পষ্ট, এরা গরীব৷ গরিব রোগ সারাও৷ উঁচু জাতের গরীব লোকেরা কিছু কম নোংরা হয়না৷ নোংরা কাজ না করার অজুহাতও চলবেনা, কারণ মা সন্তানের ময়লা পরিষ্কার করলে মেথর তথা অচ্ছুৎ হয়ে যায়না৷ 


 কিন্তু এই কাজ ততদিন পর্যন্ত সম্ভবপর হবেনা যতদিন না অচ্ছুতেরা নিজেরাই নিজেদের সংগঠিত করবেনা৷ আমি তো মনে করি তাদের নিজেদের সংগঠিত করে এবং গুনতিতে মুসলিমদের সমকক্ষ হওয়ার দরুন সমানাধিকারের দাবী যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক দিকনির্দেশ করছে৷ হয় জাতভেদের ঝামেলাই দূর করো,নইলে ওদের অধিকার ওদের দিয়ে দাও৷ অচ্ছুতদের স্কুল,কলেজ, কুঁয়া, এবং রাস্তা ব্যবহারের পূরো স্বাধীনতা দেওয়াই কাউন্সিল আর অ্যাসেম্বলির সদস্যদের মূল কর্তব্য।  শুধুই মুখের কথা নয়, এদের গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে কুয়োতে চড়াক৷ ওদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাক৷ কিন্তু যে বিধানসভায় জাতের অজুহাতে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত বিল নিয়ে হা-হুতাশ শুরু হয়, সেখানে তারা অচ্ছুতদের নিজেদের সামিল করার স্পর্ধা করবে কী করে? 


 এইজন্য আমি মনে করি ওদের নিজস্ব জাতের প্রতিনিধি হোক৷ যে নিজেদের জন্য বেশি অধিকার চাইবে৷ আমি তো স্পষ্ট ভাষায় বলি, অচ্ছুৎ নামে অভিহিত আসল জনসেবক ভাইয়েরা, ওঠো! নিজেদের ইতিহাস দেখ৷ গুরু গোবিন্দ সিংহের ফৌজের আসল শক্তি ছিলে তোমরাই! তোমাদের ভরসাতে শিবাজী এমন কীর্তি স্থাপন করতে পেরেছেন যে আজও ওঁর নাম উজ্জ্বল৷ তোমাদের বলিদান স্বর্নাক্ষরে লেখা৷ তোমাদের প্রতিনিয়ত সেবার ফলে আমজনতাকে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে দিয়ে যে পরম উপকার করছ, তা আমরা বুঝতে পারছিনা৷ ল্যান্ড - অ্যালিয়েনেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী তোমরা টাকা জোগাড় করেও জমি কিনতে পারবে না৷  তোমাদের উপর অত্যাচার এত  বেশী হচ্ছে যে স্বয়ং মিস মেয়োও৪ তোমাদের জন্য বলে উঠেছেন, -" ওঠো, নিজেদের শক্তিকে জান৷ সংঘবদ্ধ হও!" আসলে স্বয়ং চেষ্টা না করলে কিছুই উপলব্ধ হয়না৷ (Those who would be free must themselves strike the blow)৫  স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামীদেরই চেষ্টা করতে হবে৷ মানুষের এমনই স্বভাব হয়ে গেছে যে ওরা নিজেদের জন্য বেশী করে অধিকার চায়, কিন্তু অধস্তনদের জুতোর নিচেই রাখতে পছন্দ করে৷ কথাতে আছে, "যেমন কুকুর তেমনই মুগুর"৷ অর্থাৎ সংঘবদ্ধভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও৷ তখন দেখবে, কেউই তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাহস দেখাবে না৷ অন্যের খোরাক হওনা৷ অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া বন্ধ করো৷ কিন্তু আমলাতন্ত্রের ফাঁদে পড়োনা৷ এরা তোমার কোন সাহায্য করিতে চায়না, উলটে তোমাকেই দাবার বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করতে চায়৷ এই পুঁজিবাদী আমলাতন্ত্রই তোমাদের গরিব থাকার আসল কারণ৷ তাই ওদের সাথে কখনই মিশোনা৷ ওদের ফন্দি থেকে বেঁচে চলো৷ তাহলেই সব ঠিক হবে। তোমরাই আসল সর্বহারা, এককাট্টা হও৷ তোমাদের কিছু ক্ষতি হবে না৷ শুধু পরাধীনতার শিকল কেটে যাবে৷ ওঠো আর বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও৷ আস্তে আস্তে হওয়া সংস্কারে কিছুই হওয়ার নয়৷ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করো, এবং এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত থাক৷ তোমরাই তো দেশের মূল আধার৷ আসল শক্তি৷ ঘুমন্ত দৈত্য৷  ওঠো আর বিপ্লব শুরু করো৷


১ ১৯২৮ সালে বোম্বাই বানানই ব্যবহার হত৷ তাই বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে৷ 

২ একপ্রকার নিচুজাত৷ মূলত জেলের কাজ করত৷ 

৩ এরা নিচুজাত হিসাবেই গন্য হয় মূলত৷ ঝাড়ুদারের কাজ করে মূলত৷ 

৪ আমেরিকান ঐতিহাসিক৷ পুরো নাম ক্যাথেরিন মেয়ো৷ এঁর লেখা বই মাদার ইন্ডিয়া ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন খারাপ দিক দিয়ে আলোচনা করেন৷ প্রচন্ড বিতর্কিত বই৷ 

৫ দাস বিদ্রোহের বিপ্লবী  ফ্রেড্রিক ডগলাসের কোট৷ পুরো লাইনটা হল Those who would be free must themselves strike the blow. Better even to die free than to live slaves."


(অনুবাদে তাঞ্জন)

টিকটিকি -সুমন কর্মকার
Dec. 3, 2024 | গল্প | views:897 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রামিজ মিঞা গ্রিল আর তারজালির ফাঁক দিয়ে মন দিয়ে টিকটিকিটা দেখছিল। কালো, গায়ে চৌকোনা ছোপ, সামনের দিকের বাঁ পা টা পেছন দিকে কেতরে ডান পা টায় ভর দিয়ে খানিক উঁচু হয়ে সামনের দোতলার ড্রেনপাইপটায় লেপ্টে ছিল। ভঙ্গীটা এমন যেন এগোবে কিন্তু এগোচ্ছিল না। রামিজ রোজ দেখে টিকটিকিটাকে। দেখতে দেখতে একটা অভ্যেসমতো হয়ে গিয়েছে। আজ অবধি ওটাকে একচুল নড়তে দেখেনি ও। তাই সারাদিন খেয়াল না থাকলেও দুপুর বেলার এই সময়টায় বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে পাইপটার দিকে চোখ চলেই যায়। এই সময়টায় শাকিনা রোজ ফোন দেয়। বাবুদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধোওয়ার পর শাকিনা খানিক বিশ্রামের সুযোগ পায়। তখনই রামিজের ফোন বেজে ওঠে। রামিজ বিরক্ত হয়। ও এটা ওটা বলে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে আবার মন দিয়ে টিকটিকি দেখতে থাকে। আজকাল রামিজের দিনগুলো বড় মন্থর গতিতে পেরোয়। গেলোবছর বর্ষায় কারখানার মেশিন চাপা পড়ে বাঁ হাতখানা বাদ পড়ার পর মালিক কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিয়ে দিয়েছে। শাকিনাকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। প্রথম প্রথম একা একা থাকতে ভীষণ খারাপ লাগতো। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই শাকিনার ফোন রামিজের রোজকার একাকীত্বে খানিক ছন্দপতনই ঘটায়। আর ছন্দপতন আসে যেকোনো সরকারি ছুটিতে দোতলা বাড়িটা থেকে ভেসে আসা মাতালটার অশ্রাব্য চিৎকারে। গোটা বস্তিতে এই একটাই দোতলা বাড়ি। রামিজ যখন কাজে যেত শাকিনা রোজ বলত মাতালটার কথা। ছুটির দিন হলেই মাতালটা সকাল থেকে গলা অবধি মদ গিলে এসে বৌটাকে সারাদিন ধরে পেটায় আর যাচ্ছেতাই গালি গালাজ করে। তখন রামিজ তেমন পাত্তা দেয়নি। আজ বুঝতে পারে এই নিঃঝুম দুপুরবেলায় ওই মাতালটার চিৎকার কতখানি অসহ্য লাগে। এখন আবার চিৎকারের যোগ্য সঙ্গত করছে মাতালের বৌয়ের অস্পষ্ট গোঙানি। নাঃ অসহ্য লাগছে। রামিজ উঠে পড়লো। বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে শাকিনার সেলাইয়ের কাঁচিটা তুলে নিলো। দরজার শিকল দিতে গিয়ে ড্রেন পাইপটার দিকে চোখ পড়লো ওর। সেই কুৎসিত টিকটিকিটা বেশ খানিকটা নেমে এসেছে। আর ওর মুখে একটা গোটা আরশোলা, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। চেষ্টা করছে বেরিয়ে যাওয়ার, উদ্ধার পাওয়ার। টিকটিকিটা একটুও নড়ছেনা। পরম নিশ্চিন্ত মুখ করে লেপ্টে আছে নোংরা শ্যাওলাধরা ড্রেন পাইপটায়। কালো পুঁতির মতো চোখগুলো নিশ্চল। রামিজ বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচিখানা শক্ত করে বাগিয়ে ধরলো......

নরকে পাওয়া প্রাণ -প্রদীপ কুমার বর্মণ
Dec. 3, 2024 | গল্প | views:800 | likes:0 | share: 0 | comments:0

নিত্যানন্দ দাস বাবাজি বিষ খেয়েছেন, এই সংবাদ মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্ৰামে। সেদিন গ্ৰামের বারোয়ারী রাধাগোবিন্দ মন্দিরে বাৎসরিক কীর্তনের আসর চলছিল। এই সময় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই গ্ৰামে আসে হরিনাম উৎসবকে কেন্দ্র করে। প্রতি বাড়িতে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের ভীড় বাড়ে। গোঁসাই বাবাজির বাড়িতেও প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়েছে। আগের দিন গেছে ভীম একাদশী। ধর্মপ্রাণ মানুষ ও ভক্তিমতি মহিলারা সকাল থেকে নিত্যানন্দ দাসের মন্দিরে চাল আলু ফল টাকা পয়সা দিয়ে যাচ্ছিল একাদশীর পুণ্য পাওয়ার আশায়। দান সামলাতে মন্দিরে দুজন ভক্ত হিমসিম খাচ্ছে। বেশিরভাগ ভক্ত বাবাজির হাতে দান দিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে চায়। কারণ তারা বাবাজির মুখে শুনেছে, শুদ্ধ ও ঈশ্বরপ্রাপ্ত মহাজনের হাতে একাদশীর দান না দিলে উপবাসের ফল মেলে না।

        মাঘের মাঝামাঝি সময় শীতটা প্রায় ছেড়ে গিয়ে আবার এই কদিন বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। নাটমন্দিরের বারান্দায় সকালের রোদ এসে চিকচিক করছে, রোদটা বেশ আরামদায়ক। পুণ্যকামি মায়েরা ভোর ভোর সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে স্নান করে মন্দিরে এসেছে।তারা ভিজে চুল পিঠে ছাড়িয়ে দিয়ে সকালের রোদ উপভোগ করে। মন্দিরে তখন সদ্য ঠাকুরের বাল্যভোগ দেওয়ার পালা শেষ হয়েছে। উত্তরে হাওয়ায় মন্দিরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে অগুরু চুয়া চন্দনের মিষ্টি সুগন্ধ। পাকশালায় চলছে ঠাকুরের মধ্যাহ্ন ভোগের আয়োজন,তরিতরকারির ভিন্ন স্বাদের কিছু গন্ধ ধূপ ধূনার গন্ধের সঙ্গে একাকার হয়ে অসাধারণ এক অনুভূতি তৈরি করছে।


বেলা বাড়ার সাথে সাথেই মন্দির প্রাঙ্গণে সাধু বৈষ্ণবের ভীড় বাড়তে থাকে। সহকারী ভক্তেরা মন্দিরে মধ্যাহ্ন ভোগ উঠিয়ে দেয়। বাবাজি নিত্যানন্দ দাস ভগবানের ভোগ লাগিয়ে শুরু করেন ভোগ আরতি কীর্তন,

ভজ ভকত বৎসল শ্রীগৌর হরি।

শ্রীগৌর হরি জয় গোষ্ঠ বিহারী।।

বেলা হল দামোদর আইস এখন।

ভোগ মন্দিরে বসি করহ ভোজন।।.......

মন্দিরের ভিতরে বিগ্ৰহের সামনে সাজানো হয়েছে সুগদ্ধি চালের অন্ন, ষোড়শ ব্যাঞ্জন, দধি দুগ্ধ ঘৃত শর পুলি মোণ্ডা মিঠাই ক্ষীর নবনী। এইসব খাবার দেবতার খাওয়ার জন্য ভক্তরা কাঁসা করতাল মৃদঙ্গ বাজিয়ে কাতর আহ্বান করছে।


 গ্ৰামের কিছু বয়স্ক পুরুষ মহিলা যারা বৈষ্ণব নয়, ভিক্ষা করে খায়। তারা এসেছে সুখাদ্য খাবারের আশায়। দেরিতে আসায় বাল্যভোগের খিচুড়ি তারা খেতে পায়নি। সাধুরা বলেছে অপেক্ষা করতে, ভগবানের সেবার পরে সাধু বৈষ্ণব প্রাসাদ পাবে। তারপরে তাদের খাবার মিলবে। তাদের ক্ষুধার্ত শরীরে যেন আর তর সইছে না। সাধুদের নাচানাচি ও দীর্ঘ কীর্তনে তারা অনেকটা অধৈর্য হয়ে ওঠে। গান বাজনা শেষ হয়ে মন্দিরের দরজা খোলা দেখার জন্য তারা ভিতরে বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।


কীর্তন শেষে মন্দিরের দরজা খুলতে ভক্তরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভগবানের ভোগ দর্শন করতে। নিত্যানন্দ দাস ঠাকুরের মুখ প্রক্ষালন করিয়ে শয়নের ব্যবস্থা করে, ভক্তদের সেবার আয়োজনে মনোনিবেশ করলেন। সারা জীবনের নিয়ম অনুযায়ী সকলকে খাইয়ে তিনি নিজে খেয়ে মন্দিরের বারান্দায় বিশ্রাম নিতে গেলেন।বয়সের ভারে জীর্ণ নিত্যানন্দের শারীরিক নানা সমস্যার সঙ্গে কাশিটা কয়েকদিন বেশ চেপে ধরেছে। এখন খাওয়া দাওয়ার পরে কাশি বাড়ায় একজন ভক্তকে বললেন ঠাকুর মন্দিরের সেল্ফ থেকে তাঁর কাশির সিরাপটা এনে দিতে। গুরু আঙ্গায় ভক্ত সিরাপের বোতল এনে বাবাজির হাতে দিতে,কাশি আটকাতে বাবাজি বোতল খুলে তাড়াতাড়ি এক ছিপি সিরাপ নিয়ে নিজের মুখে ঢেলে দিলেন। কণ্ঠে যেতে নিত্যানন্দ বুঝতে পারলেন সিরাপের বদলে তিনি হামলা বিষ খেয়ে ফেলেছেন। কয়েকদিন আগে বাগানে দেওয়ার জন্য পুরানো সিরাপের বোতলে করে বাবাজি নিজে পাড়ার ঘোষেদের দোকান থেকে বিষ এনে রেখেছিলেন।একই সেল্ফে বিষ ও সিরাপের শিশি পাশাপাশি রাখায় এই বিপত্তি।


ভূরিভোজ খাওয়ার পরে বৈষ্ণবী মায়েরা একটু শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘর সংসারের সুখ দুঃখের গল্প শুরু করেছিল। হটাৎ নাটমন্দিরের বারান্দায় চীৎকার চেঁচামেচিতে সবাই সেখানে ছুটে এলো।বৃদ্ধ নিত্যানন্দ দাসকে ঘিরে রয়েছে তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা। বাবাজি ওকার তুলছেন। তীব্র বিষের ঝাঁঝালো গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।

          খবর শুনে পাড়া প্রতিবেশীরাও ছুটে এসেছে। প্রতিকারের জন্য এক একজন এক এক রকম পরামর্শ দিচ্ছে। একজন তো বাবাজির গাল হাঁ করিয়ে কিছুটা সরষের তেল গালে ঢেলে দিল।আর একজন দুটো মুরগির ডিম এনেছে ভেঙে বাবাজি কে গিলিয়ে  দেওয়ার জন্য। ভক্তরা চীৎকার করছে, যা করো তা করো বাপু, বাবার মুখে কিন্তু ডিম ঢালবে না কেউ। পাগলের মত ভীড় ঠেলে এক বৈষ্ণবী মা মন্দির থেকে ভগবানের পা ধোওয়া পাদদক এনে বাবাজির গালে ঢেলে দিলো। কেউ প্রসাদী ফুল এনে মাথায় বুকে ছুঁইয়ে দিলো। সহসা কার নেতৃত্বে বেজে উঠল  

খোল করতাল শাঁখ কাঁসার আওয়াজ।কী হচ্ছে ঠিকঠাক কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। ভীড়ের মাঝখানে বাবাজি মাটিতে পড়ে গোড় খাচ্ছে, ভক্তরা ধেই ধেই করে নাচছে আর ভগবানের কাছে কাঁদছে তাদের গুরুর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।


বাবাজির ছোটো ভাই বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ। ভীড় থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সাধু সন্তদের কান্ডকারখানা দেখছিল কিছুটা অসহায়ের মত। কারণ সে জানে এখন সাধু বৈষ্ণবদের কাছ থেকে তার দাদাকে ছাড়িয়ে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে পারবে না সে। ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা যুক্তি ও বাস্তব সত্য কে মানতে চায় না। কিছুদিন আগের ঘটনা, সেদিন মন্দিরে কি একটা উৎসব উপলক্ষে বহু মানুষের সমাগম হয়েছিল। অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো  সবজি কাটা ও রান্নার সহযোগিতা করার জন্য বাবাজি দুই বৌমাকে ডেকেছিলেন। ছোটো বৌমা স্নান করে নতুন শাড়ি পরে সবজি কাটতে গিয়েছিল। সহসা এক বৈষ্ণব ছোটো বৌমার দিকে তাকিয়ে তাকে সবজি কাটতে নিষেধ করলেন। ছোটো বৌ কারণ জিজ্ঞাসা করতে সাধুবাবা বললেন, - মা, তোমার গলায় কণ্ঠি নেই,অঙ্গে তিলক নেই। তোমার শরীর তো অশুদ্ধ মা, তোমার ছোঁয়া ঈশ্বর গ্ৰহণ করবেন না, এমনকি বৈষ্ণব সমাজ ও নয়।

         বাধা পেয়ে ছোটো বৌ মনখারাপ করে ঘরে ফিরতে ছোটো বাবু জিজ্ঞাসা করল, - কী ব্যাপার? হাসিমুখে গেলে আর আর আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ কালো করে ফিরে এলে যে? সব শুনে ছোটো বাবু আর স্থির থাকতে পারল না। এমনিতে সে এসব ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চায় না। বাইরে কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কি ভেবে বলল, - চলত দেখি।

ঝামেলা এড়াতে ছোটো বৌ বলল, - না না ছাড়ো ওসব, তুমি কাজে যাচ্ছ তাও, ওখানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।ছোটো বাবু স্ত্রীর কথা না শুনে তাকে নিয়ে রান্নাঘরে হাজির।সাধুবাবা ছোটো বাবুর পূর্বপরিচিত।ছোটো বাবুর জিজ্ঞাসায় হাত জড় করে বলল, - মায়ের এখনও গুরুদীক্ষা হয়নি।তিলক মালা নেই কিনা তাই....

- মানে আপনাদের বিচারে উঁনি অপবিত্র, উঁনার ছোঁয়ায় আপনাদের জাত যাবে এমনকি আপনাদের ভগবানেরও।

সাধু বিনয় করে বলল, - আপনি জ্ঞানী মানুষ, সবই তো বোঝেন। আচার বিচার তো ফেলে দেওয়া যায় না।

ছোটো বাবু বলল, - বেশ বেশ, তাহলে আচার বিচার,সূচি শুদ্ধতা আপনারা সব মেনে চলেন তো?

- বৈষ্ণব মানুষ,এসব না মানলে কী ধর্ম রক্ষা হয়?

- বেশ, তাহলে এই যে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস নিয়ে ভগবানের ভোগ রান্না করছেন।এই সিলিন্ডার কালকের কোনো মুসলমানের বাড়িতে ছিল, সেখানে গোস্তো রান্না হয়েছে। অথবা কোনো হোটেল রেস্তোরাঁয় মাছ মাংস রান্না হয়েছে, সেই সিলিন্ডারে ঠাকুরের রান্না করছেন কীভাবে?

       ছোটো বাবুর এমন প্রশ্নে সাধুবাবা কিছুটা খেই হারিয়ে ফেললেন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, - এসব কী আর পবিত্র না করে রান্নাঘরে তুলেছি?

- মানে? কীরকম পবিত্র?

- গঙ্গাজলে ধৌত করে তবে বাইরের জিনিস ভিতরে নেওয়া হয়।

- মানে গঙ্গাজলে পবিত্র, তাইত?

- একদম ঠিক, গঙ্গা মা হলেন পতিতপাবনী। জগতের যত অপবিত্র তা পবিত্র করার শক্তি একমাত্র তাঁরই আছে।

- তাহলে সাধুবাবা, যে গঙ্গাজলে লোহার জড় বস্তু পবিত্র হয়ে যেতে পারে, সেই গঙ্গাজলে একটা রক্ত মাংসের সচল মানুষ কেন পবিত্র হতে পারল না?

- মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

 - মানে গঙ্গাজল ছিটিয়ে যদি মাছ মাংস রান্নার সিলিন্ডার পবিত্র করা যায়, তাহলে সেই জল ছিটিয়ে এই অপবিত্র মানুষটির পবিত্র করে নিয়ে কাজ চালাতে পারতেন। তাহলে আপনার আচরণে এই মানুষটি মনে দুঃখ পেত না।

এইসব ভাবনার মাঝে প্রবল কান্নার আওয়াজ কানে এল ছোটো বাবুর। ভাবনার জগত থেকে সম্বিত ফিরে দেখতে পেল তার বড় বৌদি মড়া কান্না শুরু করে দিয়েছে।মানে অবস্থা ক্রমশ বেগতিক হয়ে উঠেছে।একপলক কি যেন ভাবল ছোটো বাবু। তারপর প্রবল বিক্রমে ভীড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে,রুগিকে ঘিরে বেষ্টনী করে গীতা পাঠ করতে থাকা মানুষগুলোকে সরিয়ে, নিত্যানন্দ দাস বাবাজি কে কোলে করে চাগিয়ে বাইরে বের করে আনল।


পাশের গ্ৰামে একজন গ্ৰামীন চিকিৎসক আছেন। সবাই বলে বিষ খাওয়া রুগির চিকিৎসায় সে নাকি একেবারে ধ্বনন্তরি। নিত্যানন্দ বাবাজি কে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল।ডাক্তারের নির্দেশমতো প্রথমে রুগিকে এক দু-বালতি পটাস জল গেলাতে হবে। এদিকে রুগি প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছে। সেই অবস্থায় প্লাষ্টিকের মগে করে মুখের কাছে জল নিয়ে যেতে বাবাজি হাত দিয়ে জল সরিয়ে দিতে চাইলেন। বোঝা গেল চিরদিনের বিশ্বাস অনুযায়ী অবৈষ্ণবের বাড়ির অপবিত্র পাত্রের জল তিনি মুখে নিতে পারবেন না।

         আসলে ডাক্তার গ্ৰামীন জীবনযাপন করেন। বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল আছে। নিত্যানন্দ বাবাজি প্রভাতী নগরকীর্তনে বেরিয়ে অনেক বাড়িতে নাম বিতরণ করলেও এইসব বাড়ির ত্রীসিমানায় আসতেন না।আজ কিনা সেই নরকে তাঁকে আসতে হলো! বাবাজির মতি বুঝে একজন বৈষ্ণবী মা ছুটে গিয়ে কয়েকটা তুলসীপাতা এনে জলে ফেলে বলল, - এবার খাও বাবা, জলে তুলসী দিয়েছি। এইসব কাণ্ড দেখে ডাক্তার কার্যত বিরক্ত হয়ে বলল, - এসব এখানে চলবে না, এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা করা হবে।এটা বুজরুকির জায়গা নয়।

ডাক্তারের রসহীন খটখটে কথায় একজন বৈষ্ণব আহত হয়ে বলল, - বিজ্ঞানের কী ক্ষমতা আছে ডাক্তারবাবু যা নিয়ে আপনি এমন বড়াই করছেন? জগত সংসার সব তো তাঁর হাতে। রাখে হরি মারে কে?

- তাহলে এখানে কেন? হরির কাছে নিয়ে যান।

- হরি তো আপনার কাছে পাঠালো। আপনি তো শুধু উপলক্ষ মাত্র,যা করার আমার হরিই তো করবেন।

ডাক্তার এমনিতেই খুব স্পষ্টভাষী। গুলতাপ্পি দেওয়া জলমেশানো কথাবার্তা তার একদম পছন্দ নয়।বাবাজির কথার কিছু কড়া উত্তর দেওয়ার উপক্রম করতে,অন্য সাধু ডাক্তারের হাত ধরে বলে, - এখন বাকবিতন্ডার সময় নয় ডাক্তারবাবু। অনুগ্ৰহ করে আপনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।


দিনরাত এক করে দিয়ে ডাক্তার আর ডাক্তারের ছেলে বাবাজি কে নিয়ে লড়াই করছে।বাবাজির অনুগামিরা দলে দলে আসছে। কিন্তু ডাক্তারের বাড়িতে কারো প্রবেশ নিষেধ। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে আটচল্লিশ ঘন্টা পার না হওয়া পর্যন্ত ঠিকঠাক কিছু বলা যাবে না। সময় পেরোতে যখন ডাক্তারের বাড়ির দরজা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হলো, তখন অনেকেই দেখল ডাক্তারকে যেন আর চেনাই যাচ্ছে না।চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল হয়ে গেছে। মাথার চুল উসকোখুসকো, মুখ চেহারা সব ভীষণ রকমের শুষ্ক। তাহলে কি বাবাজি.......

        বাবাজি প্রসন্নচিত্তে ঘুমিয়ে আছে। বাবাজি কে দেখে ভক্তরা হরিধ্বনিতে উল্লাস করে উঠলো। খবর পেয়ে চারদিক থেকে পিলপিল করে সাধু বৈষ্ণব ও ভক্তরা আসতে লাগল। কয়েকজন কয়েকঘড়া গঙ্গাজল ও বাবাজির জন্য নতুন বস্ত্র নিয়ে হাজির। বাবা কদিন একেবারে নরককুণ্ডে পড়ে ছিলেন। গঙ্গাস্নানে বাবার দেহ ধৌত করে নব্য বস্ত্র পরিধান করিয়ে মন্দিরে ফেরৎ নিয়ে যেতে হবে। রাধারানী করুনা করে তাদের প্রিয় মানুষটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। ভক্তের প্রতি ভগবানের কি পরীক্ষা!

আওয়াজ উঠলো রাধারানীজী কি? ভক্তরা বলল,- জয়।


নিত্যানন্দ বাবাজি কে স্নান করিয়ে পোষাক পরিয়ে, কপালে ও সারা শরীরে তিলক অঙ্কিত করে, গলায় ফুলের মালা পরিয়ে, নরকে কলুষিত বাবাজির পোশাক নরকে নামিয়ে রেখে, দেবতার মহিমায় মৃত্যুঞ্জয়ী নিত্যানন্দ বাবাজি কে বৈষ্ণবেরা স্বর্গ যাত্রায় নিয়ে গেলো প্রবল কলরব করতে করতে।

দুলাল আর মেয়ে ঝুম্পার কাহিনী -রাহুল প্রামানিক
Dec. 3, 2024 | গল্প | views:809 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গাড়িটা কয়েক বার বিকট আর্তনাদ করে থেমে গেল। 

             আবার তাই হল। হ্যাঁ, সম্পূর্ণ গিয়ার ফ্রি। গাড়ি তো নিউট্রাল আছে।  তাহলে এমন হচ্ছে কেন? বুঝতে পারছে না  ঝুম্পা। সে চাবিটা খুলে পুনরায় স্টার্ট করল। ডান পা দিয়ে এক্সসেলেটর লিভারে হালকা  চাপ দিল। গাড়িটি কঁকিয়ে উঠল। সেই শব্দের মধ্যে বৃদ্ধ কন্ঠস্বর। ঘড় ঘড়ে গলা।  যেন বহু রোগভোগের পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কি হল বুঝতে পারল না। ৮৩ A রুটের এই গাড়িটা সব থেকে বয়স্ক। সামনে  চোখের ঘোলাটে কাঁচের মধ্যে কত  স্মৃতি রয়ে গেছে। ঝুম্পা এই গাড়ির ড্রাইভার। আঠারো বছর চার মাসের মেয়েটি এ রুটের সব থেকে প্রাচীন গাড়িটির চালক। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের  ছিপছিপে চেহারা। ওড়না হীন সালোয়ার কামিজের  মধ্যে থাকা অনমনীয় শারীরিক ভাষা অদম্য। পরিপাটি করে বাঁধা চুলের ওপর হাত দিল সে। অনেক কিছু মাথায় রেখে গাড়ি চালাতে হয়। বেখেয়াল হলেই সর্বনাশ। কত কত মানুষের প্রাণ তাঁর হাতে। ফিরে চেষ্টা করল। সে মিটার বোর্ডের দিকে তাকাল। ইঞ্জিনের টেম্পারেচার  ও ফুয়েলের ইন্ডিকেটর সব স্বাভাবিক। কেন এমন হচ্ছে। বুঝতে পারছে না। মাঝে মধ্যে এই সমস্যা হয়। মালিক সব জানে, তবু এই গাড়ি  রাস্তায় রেখেছেন। যতই সমস্যা হোক না কেন, তাঁকে অবসর দিতে রাজী নয়। এই গাড়িটি তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে। কয়েক দশক খেটে মালিককে কোটিপতি করেছে এই বৃদ্ধ ঘোড়া। একেবারে লক্ষ্মী গাড়ি। মালিক গণপতিবাবুর এখন রুটের গাড়ি সাতটি  আর ট্রাভেল বাস  দুইটি। তাই  এ গাড়িকে সম্মান করেন। দেবীর চোখে দেখেন। লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হয়। তবু  তাঁকে সমাদর করেন।    

       বাস স্ট্যান্ডের  সব থেকে সিনিয়র গাড়িটি চালাত দুলাল। দুলাল মন্ডল, বয়স আটচল্লিশ বা ঊনপঞ্চাশ হবে। সে গাড়িটি খুব যত্ন করত। নিজ়ের অপত্য স্নেহে ভালোবাসত। তাই  মালিক তাঁর লক্ষ্মীকে দুলাল ছাড়া অন্য কোনো ড্রাইভারের হাতে দেন নি। কিন্তু দুলালের একটা এক্সিডেন্টে পা ভেঙে যায়। প্রায় তিন মাস বিছানায়। গাড়িটাও বন্ধ । দুলাল সুস্থ হলে গাড়ি রাস্তায় নামবে; গণপতিবাবু সাফ জানিয়েছিল।  

      দুলাল সুস্থ হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে দুটোর বেশি ট্রিপ দিতে পারে না। পা যন্ত্রণা হয়। কি করবে বুঝতে পারে না। যদি ছেলে থাকত তাকে সব শিখিয়ে  পড়িয়ে সঙ্গে নিত। কিন্তু দুলালের দুই মেয়ে। ছোটটি দশ বছরের। তাই সে বড় মেয়ে ঝুম্পাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছে। এখন মেয়েরা সব করছে। মহাকাশে যাচ্ছে। আর সামান্য গাড়ি চালাতে পারবে না।  ঝুম্পা সব কিছু শিখে নিয়েছে , কিছু দিনের মধ্যে। বাবার কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। যখন সে খাবার দিতে যেত , তখন শুনতো বাবার পায়ে অসহ্য যন্ত্রণার কথা। সে নিজে তাই বাবাকে  বলেছিল  গাড়ি চালানো শিখবে। তাঁকে হেল্প করবে। প্রথমে সম্মত না হলেও পরে তা করেছিল। সমস্যা হয়েছিল গণপতি বাবুর দিক থেকে।  তিনি মটেই রাজী হবেন না। মেয়ে হয়ে স্টিয়ারিংধরবে! নিজের লক্ষ্মীকে ছেড়ে দিতে হবে মেয়ের হাতে। তা আবার হয় নাকি। অসম্ভব …!  কিন্তু দুলাল বলে, সে গাড়িতে সব সময়  থাকবে। দু ট্রিপ নিজে চালাবে। বাকি দু ট্রিপ মেয়ে চালাবে, ও ব্যাক সিটে বসে থাকবে। মালিক দুলালকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। রাজী হয়ে যান। আর তখন থেকে ঝুম্পার জীবন চলমান। পুরুষের একাধিপত্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোমল হাতে কঠিন স্টিয়ারিং। হুশ হুশ করে এগিয়ে যাচ্ছে। কাদা অনেক ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে। স্ট্যান্ডের অন্য গাড়ির চালকের তীর্যক মন্তব্য হজম করতে হয়েছে। এখন আর সেই সব কথায় কান দেয় না বাপ – বেটি। 

       ঝুম্পা  বুঝতে পারল কোনো বড় প্রবলেম হচ্ছে। না হলে গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না কেন? ওঁর বাবাকে ডাকল । দুলাল তখন মিল খাচ্ছিল। টাইম হয়ে গেছে। গাড়ি ছাড়তে হবে। সে দুলালকে বলে, বাবা;  কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না? তাড়াতাড়ি এসো। 

“ব্রেক আনলক করে দেখ্‌” -   হাত ধুতে ধুতে দুলাল বলল।

“গাড়ি স্টার্টই নিচ্ছে না তো,  আবার …”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি। কি হল দেখছি।”

“হ্যাঁ এসো … ’ 

          গাড়িতে বসে ছিল কয়েক জন মহিলা। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে। প্রতি কথার মধ্যে শ্লেষ ঝরছে। মেয়ে মানুষকে আবার গাড়ি চালাতে দিয়েছে। যেন ছেলে খেলা …! দুর্ঘটনায় পড়লে কি হবে তখন।  

 এমন সময় দুলাল এল। ওঁর কানে কথা গুলো গেল। তবু কিছু না বলে পাইলট দরজা থেকে গাড়িতে উঠল। ডান পা এক্সসেলেটরে দিয়ে চাবি ঘোরাতেই গাড়ি শব্দ করছে। স্টার্ট হয়ে গেছে। ওঁর হাতের স্পর্শ গাড়ি খুব চেনে। সামান্য টাচে গাড়ির অনেক শক্তি তৈরি হয়েছে। সে উঠে গেল। ঝুম্পা ড্রাইভারের সিটে বসল। বাম পা দিয়ে ক্লাস বেশি করে চেপে ধরল। গিয়ার লিভারটি এক নাম্বারে দিল।  হাত দুটি দিয়ে শক্ত করে ধরল স্টিয়ারিং। সে নিজের মনকে এক জায়গায়  জোরো করে ডান পায়ে  এক্সসেলেটর হালকা চাপ দিল। গাড়ি গর্জন করছে। আরো জোরে …। এবার বাম পা এর নিচে থাকা  ক্লাস লিভারটি আস্তে আস্তে ছাড়তে থাকল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি তার ভাঙাচোরা দেহ নিয়ে রওনা দিল। তারই শব্দে,  বসে থাকা প্যাসেঞ্জার গুলোর সমালোচনা কানে আর ধরা দিল না।  চুপ হয়ে গেছে । ধীরে ধীরে গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

           ফলতা বাস স্ট্যান্ড একাবারে  হুগলি নদীর বুকের ওপর। বেশ কিছু দোকান নদীর কোলে আশ্রয় নিয়েছে। পাশে নরম দূর্বা ঘাসে ঢাকা ফুটবল খেলার মাঠ। অদূরে দেখা যায় জন ড্রেক এর পুরানো কেল্লা। বাংলার নবাব সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, তখন ব্রিটিশদের কিছু  বণিক এখানে চলে এসেছিলেন। কেল্লা সুরক্ষিত রাখার জন্য চার পাশে পরিখা কাটা। ৮৩ A বাস স্ট্যান্ড ওদের প্রতিবেশী। আর আত্মীয় রয়েছে কিছুটা উত্তরে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। মহান বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সাধনার মহল। প্রতি দিন নদীর ভিজিয়ে দেওয়া তরঙ্গ স্নান করিয়ে দেয় এই মন্দিরের পশ্চিম অঙ্গ।   

         ঝুম্পা বদর তলায় গাড়ি থামাল। এই রুটের সব গাড়ি বদর সাহেবকে প্রণাম করে । সে ও করল। একটি বিশাল  জরাগ্রস্ত তেঁতুল গাছের নিচে সিমেন্টের বদর সাহেবের থান। থানটি কেন্দ্র করে চল্লিশ ফুট ব্যাস নিয়ে চারপাশে তেঁতুল গাছের ডাল পালা আচ্ছাদিত চাঁদোয়া। এই থানের মাহাত্ম্য অনেক। বাবার থানে মেলাও হয়। রফিক চাচা তা পৌরহিত্য করেন। এক সপ্তাহ ধরে হিন্দু মুসলিম মিলিত হয় এই উৎসবে। পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, গাজন হয়। আশে পাশের চার পাঁচটি গ্রাম ভিড় করে । কত কত দোকান। বাসের কন্ডাক্টর গাড়ি থেকে নেমে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিয়ে ভক্তি ভাবে প্রণাম করল। এবার গাড়ি নিশ্চিন্তে এগোবে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সর্পিল পথ বেড় মেরে গাড়ির গতি বাড়ল। সে চপ্পল পরা ডান পা এক্সেলেটর থেকে  সরিয়ে নিল, সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পা দিয়ে ক্লাস চেপে ধরল। নিজের প্রতি খুব আত্মবিশ্বাসী সে। দমে যাবার পাত্র নয়। হাত দিয়ে গিয়ার লিভারটি দ্বিতীয় গিয়ারে দিল। হাত পা সমান ভাবে কাজ করে এই টুকু মেয়ের। দুলাল  মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। তার দক্ষতা দেখে নিজের যত কষ্ট আছে,  সব ভুলে যায়। বাচ্ছা মেয়েটির শারীরিক ভাষা এতটা পরিণত যে সকলের কপাল কুঁচকে যায়। ঝুম্পা  আবার এক্সেলেটর চেপে ধরল; চোখে দৃঢ়  প্রত্যয় লেপ্টে রয়েছে। ক্লাজ ছেড়ে দিল। গাড়ি ভালই গতি পেল। এবার সকলে খুশি। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে। সে স্টিয়ারিং প্রয়োজন মতো ঘোরাচ্ছে। প্রয়োজনে হর্ন দিচ্ছে।    

        হেল্পার দরজার কাছে ঝুলে আছে। হাঁক দিচ্ছে  ‘ফতেপুর, আমতলা, বেহালা, বাবুঘাট  …। … ফাঁকা ফাঁকা …।  চলে আসুন, চলে আসুন।’   

 সত্যি আজ গাড়ি ফাঁকা। কেন যে এমন হল কি জানি। কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে বলে, - ‘ঝুম্পা একটু ধীরে। লোক হয়নি। সহরার হাটে দাঁড়াতে হবে। প্যাসেঞ্জার নেই। খালি সিট নিয়ে এগিয়ে গিয়ে লাভ নেই। আজ বাজার খুব খারাপ । যাসস্‌… শালা সব মাটি হবে দেখছি।’

‘চিন্তা করিস না মনা। সহরার হাটে ভর্তি হয়ে যাবে দেখবি। মিলিয়ে নিবি।’  ঝুম্পার ব্যাক সিটে থেকে ঝুকিয়ে মুখ বের করে দুলাল বলল।

‘হলে তো ভালোই হয়। তোমারটায় তো মার খেলুম। ফতেপুরে কিছু হয়ে ছিল। বাকি রাস্তায় টুকটাক। ঝুম্পার বেলায় কত হয় দেখা যাক্‌।’  কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগে থেকে টিকিট বের করতে করতে মনা বলল। 

  গতি কমিয়ে হর্নের সাথে  একটা কালভার্ট পেরিয়ে গেল। দুর্বল গাড়ির দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া  বডির ঝনঝন শব্দ করে হাটে পৌঁছে গেল। অনেকে নামবে। দরজার কাছে এসেছে। হেল্পার হাতের কাছে দড়িতে টান দিল। ঘন্টা টং টং করে ওঠে। গাড়ি থেমে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ। এখানে অনেক প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে। এত লোক অপেক্ষা করবে সে ভাবতে পারে নি। সহরারহাট থেকে ভাদুড়াগামী রাস্তায়  মিনি বাস একটি বাচ্ছাকে বেটে দিয়েছে। তাই ঐ রাস্তা বন্ধ। সেই কারনে এত এত প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে। ঝুম্পা অন্য রাস্তা দিয়ে যাবে। তাই সমস্যা নেই। গাড়ি সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গেল। অধিকাংশ দাঁড়িয়ে। দুলাল খুব খুশি হল।  কালো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে জরদার কষ লাগা  দাঁত বের করে মনা তাকালো দুলালের দিকে। হাসি লেগে রয়েছে। হেল্পার গলা চড়িয়ে দিল, ‘ফতেপুর, আমতলা, বেহালা, বাবুঘাট …।  ফাঁকা ফাঁকা …।’

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। প্রতি মোড় মাথার ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। দোকান ফেলে, ফাঁকা মাঠ ফেলে, আবার কলরব ফেলে সামনের দিকে। তাঁর মধ্যে কোমলতার কোনো চিহ্ন নেই।  

    বুড়ো ঘোড়া হাঁসফাঁস করে রাস্তা ফেলে দৌড়াচ্ছে। পেটে ঠাসা ভিড়। দরজা থেকে  ঝুলছে কেউ কেউ। লুকিং গ্লাসে ঝুম্পা দেখতে পাচ্ছে। খুব সাবধানে সে চালাচ্ছে। রোড বাম্পার বা স্প্রিড ব্রেকার দেখে চালাতে হচ্ছে। একটু ভুল হলে এক্সিডেন্ট হতে পারে। হরিণডাঙা এসে হাল্কা থামল।  মনা টিকিট কাটছিল। খ্যাঁসখ্যাসে গলায় হেল্পারকে  বলে , ‘কালো,  … এ কালো;  দরজা খালি কর। এই দিকে পাঠিয়ে দে …। এই মোড় থেকে অনেকে উঠবে। পাঠা … পাঠা। ও দাদা, ও দাদা এদিকে আসুন। এদিকে …।’ 

কালো বুঝিয়ে সুঝিয়ে,   কিছুটা ঠেলে গাড়ির ভিতরে করে দিল। দরজা এখন ফাঁকা। কিন্তু প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে গন্ডোগোল শুরু হয়ে গেল। চাপাচাপি অবস্থা। সব চিঁড়ে চাপটা হয়ে যাচ্ছে। কুলকুল করে ঘাম বেরচ্ছে। সেই গন্ধে সারা গাড়ি ভরে গেছে। মনা টিকিট কাটছে, দাঁড়িয়ে থাকা প্যাসেঞ্জারদের বলছে কোন কোন সিট ফাঁকা হবে। দূরের যাত্রীদের সেখানে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সদ্য শিকার খাওয়া পেট মোটা অজগরের মতো ৮৩ A রুটের বাসটি  গড়াচ্ছে। ঝুম্পা কোনো দিকে কান দেয় না। এগিয়ে চলেছে। চোখ সামনে কিংবা লুকিং গ্লাসে। কান ঘন্টার প্রতি, কখন কালো দাঁড়াতে বলবে। মানুষ নামবে, কিংবা উঠবে।  

    হঠাৎ চড়া গলা সে শুনতে পেল। কিছু কিছু যাত্রী হৈ চৈ করছে। ভ্যাপসা  গরমে ভয়ঙ্কর অবস্থা হল। চড়া গলা মহিলার। পিছনের দিক থেকে আসছে। সুর আরো চড়ছে। হাতা হাতি পর্যায়ে। মনা থামাতে পারছে না। দুলাল উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। সে ঝুম্পাকে বলে, ‘তুই এগিয়ে যা। আমি দেখি কি হল।’  কিন্তু ঠেলাঠেলি দেখে সে গেল না। তিল ধরবে না, এমনই অবস্থা। মহিলা উত্তেজিত হয়ে পাশে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী এক ব্যক্তিকে বার দুই চড় কষিয়ে দিল। সেই ব্যক্তি নাকি কনুই মেরেছে। মনা থামাতে গেল। পারল না। মহিলা আরো গরম হয়ে গেল, ফর্সা সাদা গালপাটি লাল হয়ে গেছে। টেকসই দেহটি ভিজে লাস্যময়ী রৃপ উন্মুক্ত হয়েছে। মহিলা অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন স্বরে বলেন , ‘আমি পুলিশে দেব। হারামজাদা …। ভিড় বাসে মেয়ে পেলেই, হাত মারা  এদের মতো লোকের স্বভাব। পুলিশে দিলে তবেই শিক্ষা হবে। হারামজাদা …।’  

     লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সকলে তাঁর দিকে তাকিয়ে।  মহিলা আবারো শুরু করল, ‘প্রথম থেকে লক্ষ্য করছি, গাড়ি থামলে উঁনি গায়ের ওপর ঢলে পড়ছে। ভাবলাম ব্রেক মারার জন্য হায়তো নিজে ভারসাম্য রাখতে  না পেরে গায়ে হেলে পড়ছে। কিন্তু না, উল্টে পড়ছে আর কনুই দিয়ে পাশ থেকে বুকে চাপ দিচ্ছে। হারামজাদা …। বাড়িতে মা – বোন নেই নাকি।’

    কয়েক জন চেঁচিয়ে ওঠে। মার শালা কে; মার …। তিন – চারটি হাত উদ্দ্যত হয় মারার জন্য। মনা ঝামেলা বুঝে, গালাগালি দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজার কাছে নিয়ে যায়। ঝুম্পাকে থামাতে বলে, গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় ব্যক্তিটিকে । 

   মনা গড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘শালা বয়স তো ভালোই হয়েছে, এই বয়সে স্বভাব আর গেল না।’

দরজার কাছে কালো ঝুলছিল। সে মুখটাকে ধনুকের মতো করে ফিসফিস করে বলে, ‘শালা বুড়ো ভাম; কিন্তু আলুর দোষ গেল না …। শালা …’ 

     ঝুম্পা ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে। সে পিছনের দিকে না তাকিয়ে বলে, ‘কিসের জন্য এত গন্ডগোল হল।’

দুলাল ইতঃস্তত করে লুকিং গ্লাসে  তাকায়। তারপর সে   বলে , “ও কিছু না রে মা। তুই মন দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যা…। একটা বেয়াড়া লোক বদ আচরণ করছিল। তাই তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।”

ঝুম্পা গাড়ির হর্ন দিতে দিতে মাথা নাড়ে। গাড়ি  দিঘিরপাড় থেকে সতেরোটা ছোট বাম্পার পেরিয়ে দস্তিপুর পৌঁছলো। মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তায় এত গুলো স্পিড ব্রেকার। বুড়ো গাড়িটি উত্তাল সমুদ্রের মাঝে অসহায়  জাহাজের  মতো পাল্টি খেতে খেতে এগিয়ে গেল।  দূর্বল কবজা গুলো তীব্র চিৎকার করছে । মনে হচ্ছে হাড়গুলো এক্ষুনি  খুলে যাবে।   

      ঝনঝন শব্দ করে একশো সতেরো নাম্বার জাতীয় সড়কে উঠে পড়ে। ডায়মন্ডহারবার জাতীয় সড়ক খুব ব্যস্ত একটা রাস্তা।  সব গাড়ি এই রাস্তায় দৌড়ায় না; সব গুলো যেন উড়ে বেড়ায়। কানের পাশ থেকে হুশ হুশ শব্দ শোনা যায়। ঝুম্পা গিয়ার পরিবর্তন করল। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।  লুকিং গ্লাসে সে চোখ ফেলতে দেখতে পায়, উলটো দিক থেকে বুলেট গতিতে আসছে অন্য রুটের ঝাঁ – চক্‌চকে লাক্সারি। সে জানে এই গাড়ি যদি ওদের আগে যায়; তাহলে ৮৩ A গাড়ি  আর কোনো যাত্রী পাবে না। এমনিতেই কঙ্কালসার বডি, আর গতির হেরফের হলে কেউ পা মাড়াবে না। ঝুম্পা সব বোঝে। বৃদ্ধ ঘোড়া ভয়ঙ্কর ভাবে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে। কালো কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। তারপর সুপার ফার্স্ট গাড়ির মতো ভোঁ ভোঁ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরের স্টপেজ়ে  রাস্তার মাঝখানে এমন আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়ায় ; যাতে অন্য গাড়ি ওর গাড়িকে ওভারটেক  করতে  না পারে। 

     লাক্সারি বাস থেকে কিছু গালাগালি ছুঁড়ে দিল। মনে হয় ড্রাইভার বলল। ঝুম্পা শুনেও কানে করল না। দুলাল বলে, ‘মা রে তুই গাড়িটা ছেড়ে দে …’

কিন্তু ঝুম্পা দমবে না। কারন  আগের দিন ঐ গাড়িটি  এমনই ব্যবহার করে ছিল। সে একদম ছাড়বে না। পিছনের গাড়ি কান ফাটা হর্ন দিচ্ছে। রাস্তা ছেড়ে দেবার জন্য। শিরাকোলের আগে  মল্লারঠেস অপেক্ষাকৃত কম ভিড় থাকে।  তাই সে নিশ্চিন্তে গতি বাড়াতে থাকে। মল্লারঠেস ফেলে বেরিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটা আট বছর বয়সী ছেলে খালি গায়ে রাস্তার  পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দৌড়ে যায়। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ঝুম্পার মাথা কাজ করছে না। দুলাল বিস্ফারিত চোখে তাকায়; কিছু বলার মতো সময় নেই। একে বারে কাছাকাছি।   

     মুহূর্তে মাথা নিশ্চল হয়ে গেছে। ঝুম্পার অটল চোখ তাকিয়ে আছে।  কিন্তু পা সর্বক্ষণ ব্যস্ত। অজান্তে এক্সলেটর থেকে পা সরে গেল। বাম পা সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস চেপে ধরে। ডান পা পরক্ষণে ব্রেকে ধীরে ধীরে চাপ দিতে থাকে। এত দ্রুততার সাথে সবটা হল; সে নিজেও বুঝতে পারল না। গাড়িটা সামনে ঝুঁকে গেল। গাদা গাদি ভিড়ে এর ওর গায়ে হুমড়ে পড়ে যায়। অপলক সব ঘটে গেল । দুলাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাত্রীদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ রেগে গিয়ে অকথ্য কথা শুরু করল। ঝুম্পার কান সোঁ সোঁ করছে। তার কানে কিছু এল না। 

    আমতলায় পেট খালি হল। কিন্তু সব সিট বুক হয়ে গেছে।  দরজার কাছে  কালো দাঁড়িয়ে হাঁকছে, ‘এই …খালি খালি। এ… খালি খালি।’

মনা একটা দশ টাকার নোট দিয়ে কালোকে বলে পাশের দোকানে পান কিনে আনার জন্য। সে দৌড়ে যায়। রাস্তার ফুটপাত দখল করে থাকা পান দোকানে গিয়ে বিনা খয়ের শিব এনে মনার হাতে দেয়। এখানে গাড়ি ভীষণ মন্থর। প্রায় পনেরো মিনিট তো লাগবেই। চামড়ার ব্যাগের খুচরো পয়সা ঝন্‌ঝনিয়ে মনা বলে, ‘কালো গাড়ি থেকে নেমে হাঁক দে …। সব খালি । হেঁকে হেঁকে বল।’

কালো হাতছানি দিয়ে ডাকার মতো করে হাঁক দেয়, ‘’ এ … সিট খালি। সিট খালি। তাড়াতাড়ি …। খালি… খালি। ‘’


ওদের গাড়ি যখন সিগন্যালের কাছে পৌঁছলো । তখন আলো লাল হয়ে গেল। আবার দেরি করতে হবে। কালো ওর স্বভাব ভঙ্গিতে হেঁকে যাচ্ছে , ‘বেহালা, মোমিনপুর, বাবুঘাট …। খালি খালি …।’ 

 সবুজ হতেই গাড়ি বেরিয়ে গেল। এক হাত ছাড়া গাড়ি আর মানুষের ভিড় মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। ঝুম্পা স্টিয়ারিং এক হাতে ধরে ছিল। সে দু’ হাতে আটকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল।    

      সে দেখিয়ে দিতে চায় মেয়েরা পঙ্কিল নয়। পুরুষের কিছু ভুল ধারণা সমাজের মধ্যে বেদ বাক্য হিসাবে ব্যবহার করে। নিজেদের পেশি শক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার করে। তা যে কত ভুল; সেটা সে দেখাবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে। কিন্তু এই রোগগ্রস্ত সমাজ মানবে কি? জানতে চাইবে কি? অনেক প্রশ্ন ...। উত্তর দিতে কেউ পারে না। পারবেও না। বুকে হাত দিয়ে কথা বলতে সমাজ যে ভয় পায়। 

       বাবুঘাট সে পৌঁছে গেল। নির্দিষ্ট টাইম টেবিলের থেকে পাঁচ মিনিট বেশি লাগল। কেন লাগল। গাড়ির গতি মন্দ ছিল না তো। নাহ্‌, দেরি তো হবে। মাঝের হাটের ভাঙা ব্রিজের কাছে সময় নষ্ট হয়ে ছিল।  সে তার টাইম ক্যালকুলেশন ঠিকই করেছে। কোথায় কত সময় লেট করতে হবে সব পারফেক্ট হয়েছে। নিজেই নিজের  পিঠ চাপড়ে নিল। কেউ তো আর মেয়ে  বলে বেশি পাত্তা দেয় না। দুলাল এক মাত্র উৎসাহ দেয়। আর বাকিরা ওর গাড়িতে গেলেও মুখের বক্রতা এখনো থেকে গেছে। শিক্ষিত সচেতন মানুষ হলে অনেকে ওর সুনাম করে।  বয়সের অনুপাতে অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়েছে সে। এই কথা ভেবেই অধিকাংশ মানুষ অবাক হয়। 

    কলকাতার এক জনপ্রিয় মিডিয়া  ওর সাথে দেখা করে। ঝুম্পাকে নিয়ে তাঁরা একটা স্টোরি করবে ইচ্ছা প্রকাশ করে। সে এই সব বিষয় নিয়ে কোনো ভাবেই ভাবিত নয়। খাটলে খাওয়া, আর না খাটলে  অভুক্ত হয়ে থাকতে হবে।  

     পড়াশুনা করতে পারল না সে। মাঝ পথে সব ছেড়ে দিতে হয়। নবম শ্রেণি উত্তীর্ণ সে। মাধ্যমিকের স্বপ্ন গুলো যখন মনের মধ্যে বেড়ে উঠছিল। তখন তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়। একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে ছিল তারা । সেই সময়টা মা অনেক কষ্ট করে ছিল।  সবাই বলত দুলাল ;  যদি ঝুম্পার বয়সী তোর একটা  ছেলে থাকত কতই ভালো হত। এই অসময়ে কত কত সাহায্য পেতে পারতিস। ঝুম্পা সব শুনতো। কিছু বলত না।  

       প্রথম থেকে সে ডাকাত মেয়ে ছিল। ভয় কাকে বলে সে জানতো না। গ্রামের বয়স্ক পাকা মাথা গুলো  গান্ধিবুড়ি বলে খ্যাপাত তাকে । এই নামে ডাকার একটা ইতিহাস আছে। পাড়া হোক বা স্কুলে সব জায়গায় একটু বেশি সাহস দেখাত। ভুল কিছু চোখে পড়লে গর্জে উঠত সে। সে বার পাশের গাঁয়ের একটি ছেলে এক স্কুল ছাত্রীকে হাত ধরে টান ছিল।  রাস্তায় তা দেখে সে ক্ষেপে ওঠে, ছেলেটার নাকে এক ঘুঁষি মেরে  ফাটিয়ে দেয়। যদিও মেয়েটি ছেলেটাকে ভালোবাসত। মেয়েটার বাড়ির সবাই মেনে নিয়ে ছিল। কিন্তু ঝুম্পা মেয়েটাকে অসহায় মনে করে তা করে ছিল। 

      বাবুঘাট থেকে গাড়ি ছাড়বে সন্ধ্যা ছয়টা পনেরো মিনিটে। ফিরতে রাত হবে। দিনের প্রায় সবটা সময় দেয় গলন্ত পিচ ঢালা রাস্তায়। মানুষের দাপাদাপি; গাড়ির ভিড় সব অতিক্রম করে জীবন এগিয়ে নিয়ে যায় সে। মাথার মধ্যে সব সময় টাইম টেবিল কাজ করে। একটু টাইমের গড়বড় হলে খিস্তি দু – একটা তো জুটেই যায়। 

    এমনিতে ৮৩ A রুট অনেক পুরানো। বাস গুলো পুরানো ইঞ্জিনের ওপর নতুন চিকন বডি পরিয়ে ঝকঝকে হয়ে আছে। মাঝে মধ্যে গাড়ি গুলো বিকল হয়ে যাওয়া হৃদযন্ত্রের মতো হাঁসফাঁস করে। তাই এই গাড়ি এড়িয়ে যায় মানুষজন। সবার মধ্যে ব্যস্ততা রয়েছে। আর যদি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পরে; তাহলে তো এই সচল জীবনে পিছিয়ে পড়বে। তাই আগে ভাগে পাবলিক এই সব বাস থেকে দূরে থাকে। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে ফলতার সাথে কলকাতার  যোগাযোগের এক মাত্র অবলম্বন ছিল এই বুড়ো হাঁস।  তখন জোয়ান বয়স। তাই বাস গুলো হুশ হুশ করে চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যেত। ভিড় হত খুব। 

    এই ফলতা থেকে বহুকাল আগে ট্রেন চলত। আদ্যিকালের কথা, ঊনিশশো সতেরো সালের দিকে। ন্যারো গেজ রেল লাইন। ম্যাকলয়েড লাইট রেলওয়ে কোম্পানি চালাত ফলতা থেকে কালীঘাট পর্যন্ত । সকলে মায়ের পূজো দিতে যেত এই ট্রেনে করে। মাঝেরহাট পর্যন্ত যেত, তারপর নেমে যেতে হত। তারপর পায়ে হেঁটে মায়ের থানে যেত সকলে। তার অনেক পরে এই বাস। কিন্তু এখনকার উন্নত টেকনোলজির সাথে লড়াই করে টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব।   

    ঝুম্পার সময় হয়ে গেছে। ছ’টা দশ।  গাড়িতে ওঠার আগে প্রণাম করে নেয়। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়। পাঁচ মিনিট শব্দ করতে থাকে। মাঝে মাঝে কালো – সাদা ধোঁয়া বের হয় । সন্ধ্যায় ভিড় কম না। সারা দিনে এ শহরে যারা শ্রম দেয়, তাদের ক্লান্ত ঘাম শুকতে শুকতে ছেঁড়া সিটে শরীর হেলিয়ে দেয়।  এই সময়ে ওদের গাড়িতে যারা যাত্রী হয় সবাই সকলকে চেনে। যতই রাত হোক না কেন এই  বাসের জন্য অপেক্ষা করে ওরা। কারণ হয়তো অন্য বাসের থেকে ভাড়া কম।   

     বাবুঘাট থেকে বাস কয়েকটা হর্ন দিয়ে বেরিয়ে গেল। সারা শহরে আলোর রোশনাই ভরে গেছে। দূরে রবীন্দ্র সেতুর অপরৃপ দৃশ্য চোখ থেকে সরতে থাকে। প্রিন্সের ঘাটের পাশ থেকে হুগলী সেতুর লাইট চোখ ঝলসে যাচ্ছে। গাড়ি কিন্তু কোনো দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাষা ভাষা আলোর মধ্যে থেকে অনেক কথা বেরিয়ে আসছে। অটল গতিতে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে।  

    আবার সেই একই জায়গা গুলো ছেড়ে ওদের মফ্‌সল এলাকার দিকে গড়াচ্ছে চাকা। মনা কাঁধের ব্যাগ থেকে টিকিট নিয়ে আঙুল দিয়ে কয়েকটা ঘর্ষণ দিয়ে শব্দ করে । তারপর টিকিট কাটতে থাকে। সে বলে – দাদা টিকিট দেখি, টিকিট। কালো আর হাঁকছে না। দরজার কাছে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ঝুম্পার ঘড়িতে চোখ পড়ে, আট’টা চল্লিশ। সে গতি বাড়াতে থাকে। সুপারফাস্ট গতিতে চলছে। অনেকে সিটে থেকে বলছে, - এতো উড়ছে রে। সুপার ফাস্ট।   

গতির সাথে সাথে পনেরো মিনিট হতে না হতে জোরসে শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় আবার কি হল। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। দুলালের চোখে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম লেগে ছিল কিছুক্ষণ। সামান্য হৈ – হট্টগোলে চোখ খুলে তাকায়। সে বলে – ‘কি হল রে ঝুম্পা। স্টার্ট বন্ধ হল কি করে।  

- বুঝতে পারছি না, এমন হল কেন।  

- এই রাতে তো কোনো দোকান খোলা নেই। আবার এই ফাঁকা জায়গায় …

- মনে হয় ঠেলতে হবে। 

- হম্‌, দেখি ঠেলে। মনা … আরে এ কালো গাড়ি ঠেলতে হবে। কয়েক জনকে নিয়ে পিছনে একটু ঠেলার ব্যবস্থা কর। 

কালো গাড়ির পিছন থেকে উত্তর দেয়  -  প্রথমেই বুঝতে পেরেছি, ঠেলতে হবে। তাই আমি পিছনে চলে এসেছি। মনাদা কয়েক জন লোক নিয়ে পিছনে এসো। 

মনা টিকিট কাটা বন্ধ করে কয়েক জন যাত্রীকে অনুরোধ করে ঠেলার জন্য। কয়েক জন ঠ্যাংড়া  হৈ – হৈ করে নিচে নেমে যায়। ঠেলতে থাকে। ঝুম্পা গাড়ি স্টার্ট দেয়। না হচ্ছে না। সবাই চিৎকার করে কাঠের গোড়ে ঠেলার মতো গান ধরে ঠেলে। গাড়ি কঁকিয়ে ওঠে। স্টার্ট হয়ে যায়। সবাই উঠে পড়ে।   

রামনগর, দক্ষিন চব্বিশ পরগনা

অভিনব মন -মুনমুন পাত্র
Dec. 3, 2024 | রম্যরচনা | views:774 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মায়ের মন সব সময় ছেলে মেয়ের কাছেই পরে থাকে, সকল সময় চিন্তা, কাছে থাকলেও, দূরে থাকলেও, ফোনটা করেই ফেলি, হয়তো ব্যস্ত, থাকুক ব্যস্ত, আমার মনটা কেমন করছ। কিরে কী করছিস, আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম মা। মা তোমার রান্না হয়ে গেছে? আজকে রাত্রের খাবার, তোমার হাতের রান্নায় করব। হ্যাঁ হয়ে এসেছে রান্না। মা তোমাদের ওখানে সকলে এখন দুপুরের খাবার খাবে, আর আমি রাতের খাবার খাবো। কিন্তু একই সাথে। হ্যাঁ তুই হাতমুখ ধো, আর খাবার প্লেটগুলো সাজিয়ে রাখ। মা তুমিও খাও আজ আমার সাথে, এক সাথে খাবো আজ। তোর বাবার খাওা হয়নি, আচ্ছা ঠিক আছে, তুই আয়, হাতমুখ ধো। আমি খাবার ফাঠিয়ে দিচ্ছি। থেমার খাবার এসে গেছে, এসো একসাথে গল্প করতে করতে খাই, মা তোমার হাতের তৈরি এঁচোড়-এর তরকারি আমার খুব প্রিয় হয়েছে। যেটা পাঠিয়েছি তোর হবেতো? হ্যাঁগো মা, কাল কী খাবি বল? তৈরি করে রাখবো। নাগো মা, কালকে আমার ফিরতে আনেক দেরি হবে, বাইরে খেয়ে নেবো। কী হল তোমার মন খারাপ হয়ে গেলো, না মন খারাপ হয়নি, আমি ভাবছি অন্য কথা। কী কথা মা? তুই পৃথিবীর আর এক প্রান্তে আছিস, তোকে আমার হাতের রান্না খাওতে পারছি, গরম গরম খাবার, এবং তুই বলার সাথে সাথে এটাই অনেক। ঠিক বলেছ মা। জানিস খুব বেশি দিন আগে নয়, মানুষ এগুলো ভাবতেই পারতো না। মা তুমি যখন আমায় গ্লোব দেখাতে, আর বলতে – এই দেখ এটা আমারিকা এখানে, এখন রাত আর আমাদের এখানে দিন। আমি অবাক হয়ে শুনতাম। মা তুমি বলতে মাঝে আছে অনেক সমুদ্র। কিন্তু টেকনোলজির জন্য তোমার হাতের রান্না খেতে পাচ্ছি। মা আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও। হ্যাঁ দিচ্ছি, গল্প করতে করতে খা, মা জানো ‘অভিনব মন’ বলে একটা যন্ত্র আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। সেটা কী আবার, মা দারুন হয়েছে ডিম ভাজা। মা তুমি বলতে দিদুনদির বিয়ের পর খবর আনার জন্য লোক পাঠাতো, তবে খবর পেতো। হ্যাঁ রে, একই জেলায় তাও। কতদিন আর আগেকার কথা। মা আমাদের ছোট ভিডিও কল করে যখন দিদুনদির ছবি দেখতে পেতাম, তখন দিদুনদির কী আনন্দ হতো। আর বলতো বিজ্ঞানের আর্শীবাদ। আর এখন যদি দেখতে পেতো তুমি ডিম ভেজে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে ছেলেকে গরম গরম খেতে দিচ্ছো তাহলে কি বলতো সেটা ভেবেই আমার মনটা আনন্দ হচ্ছে। ‘অভিনব মন’ কী বল। এই যন্ত্রটা য়দি তোমার মাথায় ঠেকনো হয় তাহলে এই মুহূর্তে তুমি কী ভাবছো ধরা পড়বে। এতে অপরাধীদের ধরা খুব সহজ হবে, সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমবে। কিন্ত তোদের এই যন্ত্রটা আমার ঠিক পছন্দ হল না। কেন মা?  মনতো কল্পনার ডানায় ভর করে পারি দেয় দূর দেশে, যন্ত্র কী করে মনের খবর রাখবে। মনকে বোঝার ক্ষমতা থাকেনা। জানিস একসাথে অনেকদিন কাটানো মানুষগুলোও একে অপরের মনকে সঠিক করে বুঝতে পারে না।  তাই তো সম্পর্কগুলো কেমন যেন এলোমোলো হয়ে যায়। মা ধরো তোমার কাছে যন্ত্রটা আছে, তোমার সম্পর্কে কোন মানুষ এরকম ভাবে তা যন্ত্রে ধরা পড়বে, তুমি মানুষ চিনে মিশবে। ওরে যন্ত্র দিয়ে মানুষ চিনবে কিরে তাহলে পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। নাগো মা, তুমি এই ভাবে ভাবছো কেনো? কত বড়ো ধরনের বিপদ থেকে দেশ বাঁচবে। কিজানি, মনের খবর রাখার যন্ত্র যদি আবিষ্কার হয় তাহলে মানুষের নিজস্বতা, শিল্পীসত্তা কমে হারিয়ে যাবে। সেটা কীরকম মা? পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের উত্তাল সমুদ্র দেখা দৃশ্য সবার চোখে সমান ভাবে কি ধরা দেবে, শধু তাই নয় আমি কার সাথে সমুদ্র দেখছি সেটার উপর নির্ভর করে, দেখার দৃষ্টি বদলে যায়। তোদের যন্ত্রে সেটা ধরা পড়বে? আজকে আমি যে ঘটনাকে দেখলাম, যে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করলাম, দশ বছর পর সেই আমি সেই ঘটনাকে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখলাম। তাই তোর যন্ত্র কীকরে মানুষের মন চিনে মানুষকে মিশতে সাহায্য করবে। মা বিজ্ঞান এগিয়ে চলে বিজ্ঞানের নিয়মে, ‘অভিনব মন’ এগিয়ে চলবে তার নিয়মে। তবে তুমি যেভাবে ভাবছো তা ঠিক, এই যে আমি এই যন্ত্র নিয়ে অনেকের সাথে কথা বলেছি তাদের মতামত আলাদা। হ্যাঁ ঠিকই তো, মন বলে কথা। মা তুমি অতো দুর থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার কাছে পৌঁছে যেতে পারো আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প বলে ঘুম পারিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে পারো এই রকম একটা যন্ত্র আবিষ্কার হলে কেমন হয়? খুব ভালো। আমাদের মতো মায়েরা তার অপেক্ষায় রয়েছে। দূর হয়ে উঠবে আরো কাছে, তারপর আরো কাছে, আরো কাছে।

পু়রশুড়া,  হুগলি

শ্যামপুর এম কে প্রাথমিক বিদ্যালয় (সহ শিক্ষিকা)



দুর্নীতিযোগ (রম্যরচনা) -অশোক দাস চার্বাক
Dec. 3, 2024 | রম্যরচনা | views:768 | likes:0 | share: 0 | comments:0

[শ্রী শ্রী গীতার উনিশতম অপ্রকাশিত অধ্যায়। রম্যরচনাটি               ইতিহাসসিদ্ধ নয়, ধর্মশাস্ত্র পুরাণাদির মত সম্পূর্ণ কাল্পনিক                                     একটি গণগুজব]          

        অত:পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবভাষায় উবাচ - আরেএ, অর্জুন ইয়ার, তুমি দেখিতেছি মহা বুদ্বু! পুণ্যতীর্থ কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে অনুষ্ঠিতব্য দুর্নীতির কথা ভাবিয়া তুমি অযথা সেন্টিমেন্টাল হইয়া পড়িতেছ! সিংহাসন দখলের ধর্মযুদ্ধে  দুর্নীতি  হইবেনা, ভোটে নেতাদের স্বেচ্ছাসেবী ফড়িয়ারা ছাপ্পাভোট মারিবেনা, সমাজবিরোধী মা মাটি মানবসেবীরা প্রক্সীভোট দিবেনা, চোরডাকাতেরা চুরি ডাকাতি করিবেনা, সাধুবাবারা বুজরুকি করিবেনা, জ্যোতিষীরা লোক ঠকাইবেনা, নেতা- মন্ত্রী চোরাকারবারীরা কালো টাকা জমাইবেনা, কালো কালো মা লক্ষীরা মেঝের তলায় লুকাইয়া, ব্যাঙ্ক বা সিন্ধুকে বন্দী হইয়া চাকুরীচোর,গরুচোর ইত্যাদী সমাজবিরোধীদের ঘর 'আলো করিবেনা'  - ইহা কিরূপে সম্ভব। ভু ভারতে এসব অবাস্তব কথা কে কবে শুনিয়াছে,না দেখিয়েছে?

        শোন বন্ধুবর, রাজাকে অবশ্যই দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে হয়। চুরি ডাকাতি, খুন খারাবী, সমুদ্রমন্থণাদিতে প্রতারনা করিয়াই সত্যযুগে দেবত্বলাভ, দ্বাপরযুগে রাজত্বলাভ এবং কলিযুগে নেতাত্ব ও মন্ত্রীত্বলাভ করিতে হয়। যুগ অনুযায়ী ভক্ত, প্রজা বা ভোটারগণের পকেট কর্তন,প্রয়োজনে তাহাদের মস্তক ছেদন করিয়াই দেববিলাস,রাজবিলাস, মন্ত্রীবিলাস নেতাবিলাস ইত্যাদি করিতে হয়। রাজার সিংহাসনই বলো, মন্ত্রীর শৃগালাসনই বল, ডাকাত নেতাদের গুপ্তধনই বল - সবই দুর্নীতির ফসল। সেই চোরাই মালের বখরা লইয়া এই যে ধর্মযুদ্ধ ঘটিতে চলিয়াছে  তাহারতো গোড়াতেই দুর্নীতি। কিন্তু জানিও যে এই দুর্নীতি ধর্মসম্মত এবং এ যুদ্ধ অবশ্যই আগামী কলিকালের  ভোটযুদ্ধের মত ধর্মযুদ্ধ। দুর্নীতি দুর্নীতি বলিয়া শোরগোল তুলিয়া এ যুদ্ধে বিরত হইলে তুমি মহাপাতকী হইবে।  দেবতাগণ তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করিবেন, কেননা তাঁহারাও   চোরাইমালের বখরার নৈবেদ্যলাভ কাটমানিলাভ করিয়া দেবতাগিরি,নেতাগিরি ইত্যাদি করেন। দেবনীতি, রাজনীতি,নেতানীতি, প্রজানীতি,ভোটারনীতি মানেই দুর্নীতি। ভবিষ্যত কলিকালের গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে   বর্ণচোরা আপাত 'সৎ' (কেতনা ত্বক) ভোটারগণ দুর্নীতি করিবার সুযোগপ্রাপ্তির গোপন আশায়-অভিপ্রায়ে  দুর্ণীতিগ্রস্ত  দুর্নীতিঅভিজ্ঞ  নেতা মন্ত্রীগণকেই ভোট দিয়া মন্ত্রী সিংহাসনে বসাইবেন। দুর্নীতি করিবার সুযোগ না পাইলে দলবদল করিবেন, অথবা নুতন দল ফ্লোট করিবেন। অতএব তুমি দুর্নীতি  ত্যাগ করিওনা। মেকিয়াভেলী, চাণক্য ইত্যাদী আগামী দিনের রাজনীতি বিজ্ঞানীরা এই উপদেশ দিবেন  বলিয়া আমার দিব্য চক্ষুতে দেখিতে পাইতেছি। দুর্নীতি করিতে করিতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাইয়া বক্তৃতা দাও, টিভির তর্কসভায় গাল ফোলাইয়া, গলা ফাটাইয়া ঝগড়াকলহ কর, বিদ্বজনের সেমিনারে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দাও, ইহাতে কোন ক্ষতি নাই। এই পবিত্র শঠতায় সরল পাবলিক বেশ গ্যাস খাইবে। চীৎকার চ্যাঁচামেচি কুরুচিকর গালমন্দ করিবার গণত্রান্ত্রিক অধিকার লাভ করিয়া কৃতার্থ হইবে। পেট খালি থাকিলেও মন ভরিবে। তাহারা সন্তুষ্ট থাকিয়া ক্রোধ প্রশমিত করিবে। তাহাদের সুগার প্রেসার কমিবে। তাহা বলিয়া পবিত্র দুর্নীতিকে সমূলে পরিত্যাগ করিবে - ইহা কদাপি ধর্মসম্মত বাস্তবসম্মত  নহে। 

           হে প্রিয়সখা, হস্তিনাপুরের রাজত্বে তোমাদের কোন আইনসম্মত অধিকার নাই।  জুয়া খেলিয়া সবই খোয়াইয়াছ। অজ্ঞ  লোকে বলিবে, সে তো কপট জুয়া - বেআইনী। কিন্তু হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, বেআইনী চুরি,আইনসম্মত চুরি বলিয়া যেমন আলাদা কিছু হয়না, তেমনি জুয়া ইজ জুয়া, চুরি ইজ চুরি, আবার জুয়াচুরিও জোচ্চুরি, চাকুরীচুরি গরুচুরি, কয়লাচুরিও চুরি। জুয়া নীতিসম্মত না হইলেও ধর্মসম্মত। কপট জুয়াও জুয়া, সৎ জুয়াও জুয়া।খাঁটি মদও মদ, আবার ভেজাল চোলাইও মদ। স্বর্গের কারণবারীও মদ আবার সুইজারল্যান্ডের হুইস্কি বা রাশিয়ার ভোদকাও মদ।  ভোটযুদ্দ্বে সরলমতি ভোটারকে আলফাল বোঝাইয়া, পঞ্চ বৎসর পূর্বের  ভোটে  দেওয়া তামাদী প্রতিশ্রুতিগুলি রিনিউ বা ঘুষ প্রদান করিয়া অথবা ছাপ্পা ভোট,বুথ দখল ইত্যাদী ন্যায়সঙ্গত শাস্ত্রসম্মত দুর্নীতির দ্বারা ভোটে জয়লাভ করাও জেতা। বোমা মারিয়া, ভয় দেখাইয়া জয়লাভ করাও জেতা। আবার কালো টাকার বিনিময়ে মীরজাফর এম এল এ, এম পি,কাউন্সিলার ইত্যাদী লাইভস্টক ক্রয় করিয়া দুর্নীতি করিবার অধিকার দখল করাও জেতা। 

               হে পাণ্ডবকুলতিলক, চিন্তা করিয়া দেখ, রাজত্ব খোয়াইয়াছ।এখন খাইবে কি করিয়া। রাজার সন্তান হইয়াতো আর কৃষিজীবী, গোপালক বা আমার মত রাখালবালকদিগের মত খাটিয়া খাইতে পারনা। পূজনীয় দেবদেবী,সম্মানীয় যুদ্ধে হারা রাজা মন্ত্রী,ভোটে হারা মাননীয় নেতা মস্তানগন অনভ্যস্ত হস্তে হাপর টানিয়া বা লাঙ্গল চালাইয়া দেববিলাস, রাজবিলাস, নেতা বিলাস, মস্তানবিলাস করিবে - ইহা বিধিসম্মত নহে। সশস্ত্র ডাকাতির সাহায্যে অপরের রাজ্যের দখল লইয়া প্রজাশোষণ করিয়াই তোমাদের খাইতে হইবে।  

              ভগবান সঞ্জয় তখন  অর্জুনের কানের কাছে আস্তে আস্তে বলিলেন,হে তৃতীয় পান্ডব, পরিকল্পনা ছিল কোনক্রমে পাঁচখানা গ্রামের দখল লইয়া ধীরে ধীরে পুরা রাজ্য দখল করিবে।  সুঁচ হইয়া ঢুকিবে আর ফাল হইয়া বাহির হইবে। কিন্তু ধূর্ত কৌরবরা তোমাদের মতলব ধরিয়া ফেলিল।  সে কারণে পাঁচখানা গ্রামের প্রজাশোষণের সামান্য বখরাও দিতে কৌরব পার্টি রাজি হইলনা। তোমাদর  কারসাজি ফাঁস হইয়া গেল। অতএব এখন আর কোনো উপায় নাই। যেনতেন প্রকারেন যুদ্ধ জয় করিয়া  পুরা রাজ্যের দখল লইতেই হইবে। এখন ন্যায় নীতির কথা কপচাইলে না খাইয়া  মরিবে। তুমি শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। অস্ত্রবলে বলীয়ান তুমি। তোমার তীরের ফলাই শক্তির উৎস।  ন্যায়নীতি, আইনাদী দুর্বল অক্ষম এলেবেলে ভদ্রলোকেদের নিমিত্য সৃষ্টি হইয়াছে, তোমার মত বীরের জন্য নহে। দুর্নীতি দর্শনে গেল গেল রব তুলিয়া বিচলিত হওয়া তোমার শোভা বর্ধন করেনা।  প্রয়োজন হইলে তিনশো ছাপ্পান্ন বা ইমার্জেন্সি জারি করিয়া ন্যায়ধর্মের ভন্ডামীটাও মন-গাত্র হইতে ঝাড়িয়া ফেল।  পবিত্র ভারতভূমিতে সনাতন   দুর্নীতিধর্ম পালন কর। এই দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিতে আমি  যুগে যুগে আবির্ভুত হই। আমিই সব কৰিব।  তুমি সরকারী আমলা রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির রবারস্ট্যাম্পের  মত নিমিত্তমাত্র।  

        হে মহামতি অর্জুন, আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া অতীতের ইতিহাস প্রতক্ষ কর। কি দেখতেছ?অবতারগণের শ্রেষ্ঠ মডেল মাননীয় রামচন্দ্রও রাজত্ব হারানোর আশঙ্কায় দুর্নীতির আশ্রয় লইতেছেন।পাবলিকের নো  কনফিডেন্স মোশানের ভয়ে ভীত হইয়া সরলমতি পত্নীর সহিত চারশোবিশ করিয়া বেচারাকে বাড়িছাড়া করিতেছেন। দুষ্ট চক্রীদের ছড়ানো কেচ্ছা গুজব সম্পূর্ণ মিথ্যা বুঝিয়াও তাঁহার পতিব্রতা সতীকে বিনা অপরাধে অত্যন্ত বেআইনিভাবে চক্রান্ত করিয়া  তালাক দিতেছেন। ভাই লক্ষণের সাথে ষড়যন্ত্র করিয়া সরলমতি রাজরাণীকে তাঁহার অজান্তে বনবাসে পাঠাইতেছেন।প্রাপ্য খোরপোষও দিতেছেননা। অসহায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মরিল কি বাঁচিল সে সংবাদও লইলেননা। স্ত্রী পুত্রদের কথা বেমালুম ভুলিয়া রাজবিলাসে গা ভাসাইতেছেন। এমনকি এই আদর্শ অবতার নিজ স্ত্রীকে আত্মহত্যা করিতে পর্যন্ত প্ররোচিত করিতেছেন। তথাপি ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীগণ তাঁহাকে হৃদয়হীন দুর্নীতিগ্রস্থ অপবাদ দিয়া গালমন্দ করিলনা।  রাজপদ পরিত্যাগ করার দাবীতে প্রজাগণ বন্ধ হরতালও ডাকিলনা, সীতাও ৪৯৮এ করিলনা, সি বি আইও রামের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলনা। উপরন্তু আজও তাঁহাকে তাঁহারা মাথায় তুলিয়া পূজা করিতেছেন, তাঁহার আঁতুড়ঘরের দখল লইতে মারামারি কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোর্ট কাচারী করিতেছেন। ভবিষ্যতের কলিকালেও দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি আদর্শ রাজা,আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ শাসক হিসাবে বিরাজ করিবেন।  তাঁহার সেই সনাতন আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া নরকভীরু দেবভীরু মহান ভারতবাসীগন বধূহত্যা, বন্ধুহত্যা,ম্লেচ্ছহত্যা, পরধর্মীহত্যা, হরিজনহত্যা, নাস্তিকহত্যা ভিন্নমতবাদীহত্যা ইত্যাদী পুণ্যকর্ম করিতে উদ্বুদ্ধ হইবেন। কলিকালের উচ্চতম দেশশাসকেরাও সতী গৃহবধূকে ভরনপোষণতো দূরের কথা, নিজ ঘরে প্রবেশ করিতে পর্যন্ত অনুমতি দিবেননা। তাঁহার আধ্যাত্বিক  আদর্শ ভারতভূমিতে  জাতীয় আদর্শে পরিণত হইবে। সেই আদর্শ অনুকরন করিয়া সে দেশে কলিকালের ভবিষ্যতকালে  পুনরায় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। জয় রামসীয়ারামকি।

               হে মহাধানুকী, আমি ত্রিকালজ্ঞ। তুমি আমার এক চক্ষুতে অতীতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে। আবার আমার অপর চক্ষুতে ভবিষ্যতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে।   এইবার বল  তুমি কি দেখিতেছ? তুমি দেখিতেছ এই আদর্শ পুরুষ মনুকৃত ন্যায়নীতিহীন আইন পূতিগন্ধময় শাস্ত্র অনুযায়ী কিভাবে শম্বুকবধ করিতেছেন। রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া রক্তাক্ত শম্বুকমুন্ড দেখিয়া অমানুষ দেবতাগণ আনন্দনৃত্য করিতে করিতে হত্যাকারীর মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই পরম ধর্ম। মহামতি রামচন্দ্র সেই মহান ধর্ম রক্ষা করিলেন। পাপী শম্বুক  নিম্নশ্রেণীর ঘৃণ্য জাতির সন্তান হইয়াও জ্ঞানার্জনের জন্য সচেষ্ট হইয়াছিল। এই অভিপ্রায় ধর্মবিরোধী পাপকর্ম। ইহাতে স্বর্গের দেবতাগণ লজ্জিত হইতেছিলেন। পৃথিবী পাপে ভরিয়া যাইতেছিল। মহামতি রামচন্দ্র শূকরবৎ  নিম্নজাতির শুম্বককে খুন করিয়া দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিলেন। তিনি ধন্য, তিনি আদর্শ পুরুষ। তিনি পুরুষোত্তম। সে কারণে পিতৃপুরুষের হত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার পাইবার জন্য শম্বুকের বংশধর নিচু জাতির ভবিষ্যতের মানুষেরা আন্দোলন করিতেছেন। পিতৃহত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার জয় করিয়া আনন্দে ডগমগ হইতেছেন। 

                  হে তথাকথিত তৃতীয় পান্ডব! দুর্নীতি সর্বত্র। অধিক আর কি বলিব, তোমার জন্মেও দুর্নীতি। তোমরা কুন্তীপুত্র, মাদ্রিপুত্র বটে, কিন্তু তাহা বলিয়া সন্তান প্রজননে অক্ষম পান্ডুর ঔরসে তোমাদের জন্ম হয় নাই। তোমরা কদাপি পাণ্ডব নও।  রাজত্বের দাবী ন্যায়সঙ্গত করিবার নিমিত্বে ঘুরপথে তোমাদের পাণ্ডবপুত্র সাজানো হইয়াছে মাত্র। 

              হে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ, আবার বিবেচনা কর, চন্দ্রদেবকে ব্যভিচারী,ইন্দ্রদেবকে লম্পট, অথবা ব্রহ্মাকে নিজকন্যাগামী দুর্নীতিপরায়ণ আখ্যা দিয়া কেহ ঘৃণা করেনা। আমার নিজস্ব পরনারীগামী পরকীয়া লীলাও ধর্মীয় ব্যাখ্যা টিকাটিপ্পনীর ছলচাতুরীতে ধর্মসিদ্ধ ও কালে কালে আদালত দ্বারা আইনসঙ্গতও হইয়াছে। আমার শত শত নারীলীলার উপাখ্যানের বর্ণনাকীর্তন করিতে করিতে আমার ভক্তগণ দু হাত তুলিয়া নাচিতে নাচিতে, বাতাসা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, আবীর মাখিতে মাখিতে, চক্ষের জলে বুক  ভাসাইতে ভাসাইতে নগর কীর্তন করিয়া পুণ্যলাভ  করিতেছে। নির্জন কুঞ্জবনে ডজন ডজন গোপিনীদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করিতে সচক্ষে দেখিয়াও  নীতিপুলিশগণ আমাকে কান ধরিয়া উঠবস না করাইয়া আমাকে পূজা করিতে লাগিল। এইরূপে কলিকালে দেবতা সমান নেতাগণের ভোটচুরি,মন্ত্রীত্ব চুরি,চাকুরী চুরি, পুকুর চুরি, গুরুবাবাদের জোচ্চুরী প্রভৃতি দুর্নীতির অকাট্য প্রমান পাইয়াও ভোটারগণ সেই  দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের ভোট দিয়া গলায় মালা পরাইয়া তাহাদের শোষকগদিতে বসাইবে। গুরুবাবাদের শিষ্যরা জেলখানাবাসী মহামান্য ধর্ষক গুরুবাবাদের ভেট দিবে, তাহাদের পূজা করিবে। কেননা দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসকরাই তাহাদের দুর্নীতি করিবার সুযোগ করিয়া দিবে। 

              হে কৃষ্ণসখা, আমার বাক্য মন দিয়া শ্রবন কর। পবিত্র দুর্নীতি নারায়ণের অংশ। দুর্নীতিই ব্রহ্ম।  কি স্বর্গে, কি মর্ত্যে, কি সত্যযুগে, কি কলিযুগে, ইস্কুলে,কলেজে,  হাসপাতালে, অফিস আদালতে,দেবস্থানে গোরস্থানে  - দুর্নীতি সর্বত্র সদা বিরাজমান। প্রাকৃতিক মানবধর্ম ছাড়া বাকি সমস্ত মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম  ধর্ম, ধর্মীয় শাস্ত্র, ধর্মীয় প্রথা ও নিয়মকানুনে দুর্নীতি প্রচ্ছন্ন।  ধর্ম ও ঈশ্বরের জন্মও মিথ্যার গর্ভে, দুর্নীতির ঔরসে।  একথা জানিও যে when rationality ends, religion begins. প্রতিনিয়ত নুতন জ্ঞান অর্জনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়  যুক্তিবাদী জ্ঞানের সীমানা যে স্থানে শেষ হয়, সেই স্থানে ধর্মের উৎপত্তি হয়।  ঝড় বৃষ্টি বন্যা গ্রহণ ইত্যাদির যথাযথ প্রাকৃতিক কারণ না জানা থাকায়  চতুর অসৎ দূর্ণীতিগ্রস্হ মুনি ঋষিরা পবনদেব-বরুণদেব, রাহু-কেতু ইত্যাদীর মিথ্যা গল্পগুজব ফাঁদিয়া প্রচার করিয়া নিজ নিজ অজ্ঞতা গোপন করিয়াছেন এবং করিতেছেন। আর সরলমতি দৈবভীত ভক্তগণ প্রকৃতিদত্ত চিন্তনশক্তিকে নিশ্চল করিয়া সেই গুজবগুলিকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। অতএব হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, তুমি ধর্ম রক্ষার্থে দুর্নীতি করিতে বিচলিত হইওনা।  

               নেতা দেবতাদের পেটে টোকা মারিলে দুর্নীতির দুর্গদ্ধে পৃথিবী ভরিয়া যাইবে। রাজা-দেবতাগন মানবের শ্রদ্ধাভক্তি হারাইয়া কাটমানি নৈবেদ্যাদিবঞ্চিত হইবে। অসিযুদ্ধ অথবা ভোটযুদ্ধের পরে দেশে রাজা মন্ত্রীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু নুতন গদিতে বসা নেতা  পুরানো নেতামন্ত্রীকৃত দুর্নীতি ধরাইয়া দিবার ভয় দেখাইলেও কিভাবে আইনের কানাগলির আড়ালে ও মহামান্য আদালতের অসহায়তার সুযোগে সেসব দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। তাঁহারা  দূর্ণীতিগ্রস্থ তাঁহাদের সহধর্মী পূর্ববর্তী নেতামন্ত্রীদের শাস্তিপ্রদান করিতেছেননা।  বন্দী পুরুরাজ যেমন আলেকজান্ডারের নিকট রাজার অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন, দুর্নীতিগ্রস্থ প্রাক্তন নেতা মন্ত্রীরা কলিযুগে তেমনি সমসাময়িক নেতামন্ত্রীদের নিকট অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন। বর্তমানের দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসক পূর্ববর্তী প্রশাসকদের দুর্নীতির শাস্তিবিধান করিতেছেননা। 

        হে মহামতি অর্জুন, আমি ত্রিকালজ্ঞ। এবার তুমি আমার দক্ষিণ চক্ষুর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ভবিষ্যৎ অবলোকন করিতে থাক। ঐ যে শ্বেতপাথরের দেবতাবাসটি দেখিতেছ, মঠ মন্দির দেখিতেছ - ওগুলি কিভাবে নির্মিত হইয়াছে? হাজার হাজার ক্রীতদাসের রক্তে, তাহাদের শ্রমে, তাহাদের  ঘামে দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন স্বর্গলোভ দেখাইয়া, ক্যাডার ভক্ত নিয়োগ করিয়া তাহাদের বিলাসভবন বানিয়াছেন। ফলস্বরূপ মানবসন্তানগন অনাহারে অপুষ্টিতে মরিয়াছে।  কোনারকমন্দির গড়িবার ফলে দশ বৎসরকালব্যাপী দুর্বিক্ষে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে। যখন ঝড় বৃষ্টি রৌদ্রে অমৃতস্য পুত্র মানবসন্তানগন মাথার উপর সামান্য আচ্ছাদন পাইতেছেনা,তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন মানবের সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া কিভাবে মন্দিরবিলাস অট্টালিকাবিলাস করিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু ইহাও জানিও যে, এই দুর্নীতি অন্যায় হইলেও ধর্মসম্মত। ভবিষ্যতের নেতা মন্ত্রীগণ এইভাবে রাজভবনবিলাস, পাঁচতারা হোটেলবিলাস,রিসর্টবিলাস করিবার জন্য জনগণের নিকট তোল্লা কাটমনি আদায় করিবে। And these  corrupted Brutases are honourable men. এবং এরূপ পাপকর্ম ধর্মসম্মত।  

              হে পার্থ! চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখ। যখন অমৃততস্য পুত্র মানবসন্তানেরা অনাহারে মরিতেছে, তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন তাঁহাদের সহযোগী নেতা মন্ত্রী আমলা গুরুবাবা পুরোহিতগন কিভাবে বিলাসবৈভবে অলস দিনপাত করিতে করিতে লীলা করিতেছেন, কিভাবে দেবদাসী,পুরনারীদের সহিত ফস্টিনস্টি করিতেছেন। কিভাবে তাঁহারা ধূপধুনা,পুষ্পচন্দনাদি বিলাসদ্রব্যের সৌরভ সেবন করিতেছেন, কিভাবে বলির পশু,এমন কি মানব রক্ত পান করিয়া জিহ্বা মুখমন্ডল রক্তরঙে রঞ্জিত করিয়া অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ভয় দেখাইয়া টেররাইজ্ড করিতেছেন। কিভাবে অসহায় ফুলগুলির বৃন্তচ্চুত মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া নিজ নিজ অঙ্গশোভা বৃদ্ধি করিতেছেন। 

                সঞ্জয় আরও উবাচ,আমি ত্রিকালজ্ঞ।  সুদূর ভবিষ্যতে কি ঘটিতেছে তাহা আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করিতেছি। পুরাকালের ঘটনাবলীও আমার নয়নে কলিকালের টিভির ছবির মত  ফুটিয়া  উঠিতেছে। আমার চোক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কলিযুগের বিস্বরূপ দর্শন কর। 

                 অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কমললোচনের দিকে চক্ষু রাখিয়া শ্রীমান অর্জুন বলিলেন, সবুজ,গেরুয়া, সাদা নানা রঙের, নানা ধর্মের নানা ভগবানগণ তাঁহাদের প্রতিপক্ষ ভাগবানদের ভক্তদের ভাড়াটে গুন্ডার দ্বারা গুপ্তহত্যার ফতোয়া জারি করিতেছেন। মন্ত্রীরা গবাদি পশুদের যাবনা চুরি করিয়া উদরপুরণ করিতেছেন,কিভাবে গণেশজী মহারাজ শিশুদের দুগ্ধ চুরি করিয়া উদর স্ফীততর করিতেছেন, কিভাবে অপুষ্ট শত শত শিশুদের অনাহারে রাখিয়া তাহাদের দুগ্ধে লিঙ্গ শোধন করিতেছেন, কিভাবে পূজা লইবার ছলে ভক্তদের দেবস্থানে আমন্ত্রণ করিয়া পূজারত ভক্তগণকে কখনো জলে ডুবাইয়া, কখনো আগুনে পোড়াইয়া, কখনো পদপিষ্ট করিয়া, এমনকি পবিত্র শিন্নিতে বিষ  মিশাইয়া গণহত্যা করিতেছেন। চিড়িয়াখানার বিশ্বাসঘাতক শেরওয়ালীমাতা সরলমতি গুজববিস্বাসী ভক্তের ঘাড়  মটকাইয়া তাহার রক্ত পান করিতেছেন, নানা ধর্মের ভগবানভাইগন নরকের ভয় ও স্বর্গলাভের  লোভ দেখাইয়া ভীরু,দুর্বল  মনুষ্যদের নৈবেদ্য শোষণ করিতেছেন।  প্যারিস, নিউইয়র্ক,বালিতে নির্বোধ ধৰ্মোদ্মাদ ধার্মিকদের দ্বারা গণখুন করাইতেছেন।  স্বর্গীয় শুঁড়িখানায় বিনাপয়সায় কারণবারি  বিলাসব্যাসন, বেহেস্ত /স্বর্গের  ফ্রী পৌনপৌনিক  গণিকাভোগের লোভ দেখাইয়া টুইন টাওয়ার,তাজ হোটেলে গণহত্যায় প্ররোচিত করিতেছেন। আর দুর্নীতিগ্রস্থ পরজীবী পুরুত মোল্লা যাজকদের দক্ষিণা / কমিশন লুন্ঠন করিবার ব্যবস্থা করিতেছেন।  

                আরো দেখিতে পাইতেছি কলিযুগের দেবদেবীগণ ধর্মে দুর্বৃত্তায়ন করিতেছেন।  নিজ নিজ ঘরবাড়ি, প্রভাব প্রতিপত্তি, জমি জায়গা দখল ও রক্ষার্থে বিভিন্ন সাম্রদায়ের ভগবানগন পরস্পর  নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি মারামারি করিতেছেন। নিজ নিজ পার্টি ক্যাডার নিয়োগ করিয়া এক ভগবান অন্য  প্রতিযোগী ভগবানদের ঘরবাড়ী  আঁতুরঘর ভাঙিতেছেন, রাস্তাঘাট ফুটপাথ পাবলিকসম্পত্তি জবরদখল করিতেছেন, প্রতিপক্ষ ভগবানের সমর্থক ভক্তদের খুন কারাইতেছেন, ধর্মীয় রায়ট বাধাইতেছেন। দেবদেবীরা রাজা নেতামন্ত্রীদের মত গুন্ডা মস্তান পুষিতেছেন, দেবদেবীসেনা মারফত বারোয়ারী পূজা চাঁদা তোলা আদায় করিতেছেন। দুর্নীতিতে মদত দিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই ধর্মের প্রাণস্বরূপ। 

          সঞ্জয় বলিলেন, বেশ বেশ, আরো দর্শন কর। আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার দৃষ্টি ফিরাইয়া দ্বিতীয় চ্যানেলের ছবি দেখ।  কি দেখিতেছ?

           অর্জুন বলিলেন,দেখিতে পাইতেছি দেবদেবীদের বিচারব্যবস্থা। এক লালচাঁদ লালচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা - সারাজীবন চোরাকারবারী করিল, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মিশাইল, ওষুধে ভেজাল দিয়া গণহত্যা করিল, দেনা না মিটাইয়া ব্যাংকের টাকা আত্মস্যাৎ করিল। সে থানার আর মন্দিরের দেবতাগণের বামহস্তে প্রচুর ঘুষ প্রদান করিতে থাকিল। সেই মহাপাপী দেবদেবীদের নামে সিন্নিপার্টি দিল, অষ্টপ্রহর নামকীর্তন করিয়া দেবদেবীদের চাটুকারিতা করিল। গঙ্গাসাগরে ডুব দিয়া, সাগরমন্দিরের দেবতা/পুরুতদের চোরাই সোনাদানা, কালো টাকা ইত্যাদী উৎকোচ প্রদান করিয়া তাহার সমস্ত পাপ সমুদ্রজলে ধুইয়া ফেলিল। দেবতাদের সমর্থনে নগরকীর্তন, মিটিং মিছিল করিতে লাগিল। দেবতাদের বিলাসের জন্য শ্বেতপাথরের মন্দির বানাইয়া দিল। দূর্ণীতিগ্রস্থ দেবদেবীরা পাপী লালচাঁদের পাপপুণ্যের লেজার একাউন্ট বেআইনিভাবে পাল্টাইয়া ফেলিলেন। পূজা, চাটুকারিতা,নৈবেদ্য-উৎকোচের বিনিময়ে তাহার সমস্ত পাপকার্য ধামাচাপা দিয়া দিলেন। চুরি দুর্নীতির সমস্ত প্রমান লোপাট হইল, চিত্রগুপ্ত কেরানীর লেজার পাতা অদৃশ্য হইল। প্রমাণাভাবে স্বর্গীয় সি বি আই, স্বর্গীয় আদালত কিছুই করিতে পারিলনা।    

                মহামতি অর্জুন তখন এরূপ ধর্মীয় অনাচার দর্শন আর সহ্য  করিতে পারিলেননা।  প্রবল উত্তেজনায় তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করিয়া ফেলিলেন। শরীর এলাইয়া অশ্বসকটের সিটে শুইয়া পড়িলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে কোনোরকমে নিজ বক্ষে আকর্ষণ করিয়া প্রশান্ত কণ্ঠে কহিলেন, " হে প্রিয়সখা, চক্ষু উন্মোচন কর। দেবতাদের দুর্নীতি দর্শন করিয়া তুমি এরূপ উতলা হইওনা। নৈবেদ্য ঘুষ প্রদান ধর্মবিরুদ্ধ নহে। পূজাপাঠ,নৈবেদ্যপ্রদান ইত্যাদির দ্বারা পাপ ধামাচাপা দিয়া আখের গোছানো অনৈতিক বা অধর্মীয় কার্য্য নহে। বরং ইহাই ধর্মপালন, ধর্মীয় অভিনয়ের আসল উদ্দেশ্য। পাপী লালচাঁদ চরম দূর্ণীতিগ্রস্থ হইলেও সে ঈস্বরভীরু ধর্মপ্রাণ মানুষ। দেবতা,রাজা,নেতা মন্ত্রীদের উৎকোচ প্রদান,ভজন কীর্তন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদী কুকর্ম হইলেও ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকর্ম।  ইহাতে পুন্য জন্মে, এবং সেই পুণ্যে মনুষ্যকৃত সমস্ত দুস্কর্মের শাস্তি মকুব হইয়া যায়। মৃত্যুর পরে নরকে যাইতে হয়না।  ইহাই সত্য। তুমি তোমার চক্ষু উন্মোচন করিয়া সত্যদর্শন কর।  সত্যকে স্বীকার করিয়া চিত্ত শান্ত কর। বল সখা, এইবার তুমি কি দেখিতেছ?

            - আমি দেখিতে পাইতেছি মৃত পাপীদের পুত্রকন্যাগন পিতামাতার পাপপুণ্যের লেজার-বালান্সশিট উল্টাপাল্টা করিবার অভিপ্রায়ে  পিতামাতার শ্রাদ্ধশান্তি করিতেছে।  তাহারা পুরহিত টাউটের থ্রু দিয়া নানা দান-ভেট -উৎকোচাদি দেবতাদের হস্তে প্রদান করিয়া মহাপাপী পিতামাতার সমস্ত অনাচার,দুস্কর্মজাত পাপ ব্যাকডোরে মকুব করাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিতেছে। দুর্নীতিগ্রস্থ দেবদেবীগণ উৎকোচের বিনিময়ে পাপীদের নরকের জেলখানায় না পাঠাইয়া স্বর্গরাজ্যের ভিসা মঞ্জুর করিতেছেন। তাহারা তাহাদের আজীবনকৃত দুস্কর্ম পাপের প্রাপ্য শাস্তি হইতে অব্যাহতি পাইতেছে।  

           অর্জুন আরো বলিলেন,হে পার্থসারথী! আপনার কৃপায় আমি দ্বিব্যদৃষ্টি লাভ করিতেছি।  সুদূর ভবিষ্যতের দৃশ্য আমার চক্ষুতে প্রতীয়মান হইতেছে।  আমি স্পষ্ট দেখিতেছি যে ধর্মীয় চাটুকারিতা নৈবেদ্য পূজা ইত্যাদীর বিনিময়ে দেবদেবীগণ মন্ত্রী আমলাদের মত তাঁহাদের পছন্দমত ভক্তগনকে নানা সুযোগ পাওয়াইয়া দিতেছে।  পূজা দিলনা বলিয়া যোগ্য বেকার চাকুরী  পাইলনা, গ্যাসের ডিলারশিপ, মদের দোকানের লাইসেন্স পাইলনা, অথচ অযোগ্য,অশিক্ষিত দুশ্চরিত্র ব্যক্তি পূজাপাঠ, জাগযোগ,  উৎকোচ প্রদান করিয়া দেবতাদের বেআইনীভাবে  সবই বাগাইয়া লইল। অশিক্ষিত শিক্ষকগণ স্কুলে শিক্ষাদান করিতে লাগিল। অযোগ্যরা চাকুরী চুরি করিল, যোগ্যরা রাস্তায় বসিল।   

             আরো দেখিতেছি যে ভোটফান্ড নেতাফান্ড ইত্যাদিতে তোল্লা প্রদান করিয়া দূর্ণীতিগ্রস্তরা পার পাইয়া যাইতেছে, খুনির শাস্তি মকুব হইয়া যাইতেছে,রাজারহাট,সল্টলেকে জমি পাইয়া যাইতেছে। প্রাসাদবাসীরা গৃহহীনদের প্রাপ্য অনুদানের অর্থ আত্মস্যাৎ করিতেছে। 

              তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রবল আনন্দে হাততালি দিয়া বলিয়া উঠিলেন, " সাবাস অর্জুন ইয়ার, সাবাস।  তোমার বিশ্বদর্শন সম্পূর্ণ হইয়াছে। আর সময় নাই, আমার শেষ কথা শ্রাবন কর।  দুর্নীতি অবশ্যই অন্যায় এবং খারাপ কর্ম,  কিন্তু ইহা কদাপি পাপকর্ম নহে। অধর্মও নহে। বরং দুর্নীতি ব্যতিরেকে স্বর্গলাভ, রাজ্যত্বলাভ, মন্ত্রিত্ব, নেতৃত্বলাভ অসম্ভব। তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুন হইতে বান তুলিয়া লও। বক্তৃতামঞ্চে, সংবাদ মাধ্যমে, টিভির তর্কসভায়   ভোটনেতাদের অসভ্য বাক্যবান নিক্ষেপের মত তুমিও শত্রুর দিকে বান ছুঁড়িতে শুরু কর।  শঠতাবলে, চাতুর্য্যবলে, বুদ্ধিবলে, ছলনাবলে,  বাহুবলে,,আইনের অপব্যাখ্যাবলে রাজত্ত্ব ছিনাইয়া লও। 

             কুরুক্ষত্রের এই ধর্মযুদ্ধ যুগে যুগে চিরকাল দুর্নীতিগ্রস্থ ধার্মিকদের পথ দেখাইবে। গীতার এই সর্বশেষ অধ্যায় ভক্তিভরে পাঠ করিয়া ধর্মপ্রাণ জনগণ একাধারে দুর্নীতিধর্ম পালন করিতে উদ্বুদ্ধ হইবে, অন্যধারে পূজাপাঠ, নৈবেদ্যঘুষ প্রদানে প্ররোচিত হইবে। উত্তরোত্তর দুর্নীতিধর্ম জনপ্রিয় হইবে, সাথে সাথে জবর দখল করিয়া দেবদেবীগণ শিশুদের খেলার মাঠ, জনসাধারণের চলার পথ জবরদখল করিয়া প্রনামীর বাক্সভ্রাইবেন। 

                অতএব হে কৃষ্ণসখা, জানিয়া রাখিও - নিষ্ঠাভরে দুর্নীতিধর্ম পালন করা, দুর্নীতিধর্ম প্রচার করা এবং মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্থ রাখা, তাহাদের দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে বাধ্য করা সত্যযুগে দেবধর্ম,দ্বাপরযুগে রাজধর্ম ও কলিযুগে নেতাধর্ম। ইহাই সনাতন মৌলবাদী ধর্মের সার কথা - গীতার  সারমর্ম। যেদিন মানুষ পবিত্র দুর্নীতিধর্ম ত্যাগ করিবে সেদিন পৃথিবী পাপে পূর্ন হইবে।  দেবতাগিরি,রাজাগিরি, পুরুতগিরি, গুরুবাবাগিরি সমস্ত বৃত্তি ধরাধাম হইতে অবলুপ্ত হইবে।  সেই ভয়ঙ্কর দিনে দেবতা, রাজা, নেতা ফড়েদের খাটিয়া খাইতে হইবে।  

               সুতরাং হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। দেব দ্বিজ,রাজা মন্ত্রী, নেতা শোষকদের পবিত্র দুর্নীতি ধর্মের পথ দেখাও। তাহারা দূর্ণীতিগ্রস্থ ধার্মিক হউক। 

                অতঃপর কুরুক্ষত্রের যুদ্ধ শুরু হইল। নব নব যুগে, নব নব রূপে সে যুদ্ধ আজও চলিতেছে। ওং তৎসত - আমেন -

প্রথম প্রকাশ: ' অনির্বান ' শারদীয় সংখ্যা ১৪০৬ / ১৯৯৯

দ্বিতীয় প্রকাশ: চার্বাক রচনাবলী ২০১৬ (সামান্য সংযোজিত)

সমালোচনা ও ত্রুটিনির্ধারণ: asokdas.godless@gmail.com



নাটক: আপনি ভুল দেখেছেন -অনুপ চক্রবর্তী
Dec. 3, 2024 | নাটক | views:1010 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চরিত্র: অর্ণব। সুনীল (অর্ণবের বাবা)। অনিল (অর্ণবের কাকা)। তপতী (অর্ণবের মা)। সোমা। রথীন দত্ত। মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত ওসি। সাবইন্সপেক্টর। প্রথম পুলিশ। দ্বিতীয় পুলিশ।

।। প্রথম দৃশ্য।।

(অর্ণবদের বাইরের বসার ঘর। অর্ণব, অর্ণবের বাবা আর কাকা গুম হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে  বসে আছে। অর্ণবের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। রাত ন’টা হবে। সোমা বাইরে থেকে দ্রুত আসে।)

সোমা: কী হয়েছে অর্ণব? কী সমস্যা হয়েছে যে  ওভাবে মেসেজ করে এখনি আসতে বললে? একি? তোমরা সবাই এরকম গুম মেরে আছো কেন? তুমি কাকু কাকিমা ছোটকাকু? কি হয়েছে তোমাদের? এ’কি কাকিমা? আপনি কাঁদছেন কেন?

অনিল:  আমি বলছি সোমা।

সোমা:  হ্যাঁ। বলুন ছোটকাকু। কী হয়েছে?

অনিল:  কিছুক্ষণ আগে আমার এই দাদাটি চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে গেছিলো।

সোমা: সেকি!

অনিল: আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় ও সেটা করতে পারেনি। 

সোমা: সেকি! কেন? (সুনীল বাবু হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন। অর্ণবের মাও। এমনকি অর্ণবও।) একি!  কী ব্যাপার? সবাই মিলে এভাবে ভেঙে পড়ছেন কেন?  অর্ণব, তুমিও এইভাবে ভেঙে পড়ছ কেন? কী হয়েছে? কেন কাকু এরকম করতে গেলেন?

অনিল: আমি বলছি তোমাকে সোমা। অর্ণবের চাকরি চলে গেছে। 

সোমা: সেকি! কেন? 

অনিল: হাইকোর্টের অর্ডারে। 

সোমা: কেন? 

 অনিল: তুমি জানো না কয়েকটিদিন ধরে হাইকোর্ট কি অর্ডার করে চলেছে। কয়েকদিন ধরে কয়েকশো জন প্রাইমারি টিচারের চাকরি চলে গেছে। আজকেও অনেকের চাকরি চলে গেছে। তার মধ্যে অর্ণবও একজন। 

সোমা: কেন অর্ণব? তুমি তো চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেয়েছিলে। (ডুকরে কেঁদে ওঠে অর্নব)

অনিল: না সোমা। 

সোমা: তার মানে?

অনিল: সে বড় লজ্জার কথা সোমা। যারা চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে দালালদের ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল, হাইকোর্ট তাদের ধরে ফেলে একে একে বরখাস্ত করেছে। আজ জানা গেছে অর্নবও তাদের মধ্যে একজন। আমি অর্ণবেরও এরকম ব্যাপার জানতাম  না। একটু আগে সব শুনলাম। 

সুনীল: সোমা, জমানো শেষ সঞ্চয় দশ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছিলাম ওর চাকরির জন্য। ওর বোনের বিয়েতে আগেই পনেরো লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। শেষ সঞ্চয়টা দিয়ে দিয়েছিলাম দালালকে। কেননা তুমি জানো না আমি বিএসএনএলের স্টাফ হলেও গত দু বছর কোন মাইনে পাইনি। কোনোদিন পাবো বলে মনে হয় না। বরং একেবারে তাডিয়ে দেবে হয়তো কিছুদিন পরে। সংসারের খরচ চলত অনেক কষ্ট করে অর্ণবেরই  টিউশনির টাকায়। তাই বাঁচার জন্য অর্ণবের চাকরির জন্য দালালকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলাম।

অনিল: অন্যায় করেছিলে।

সুনীল: তুই আমাকে এরকম বলছিস! এইসময়ে! একটু আগে মরতে যাচ্ছিলাম। তুই নিজেই বাঁচালি।

 অনিল: তবুও বলছি দাদা খুব অন্যায় করেছিলে। চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছিল তারা তো ঐ পরীক্ষায় পাশ করা ক্যান্ডিডেটদের চাকরিটা দখল করেছিল। এটা অন্যায় নয়?

 সুনীল: আর আমার যে বছরের পর বছর মাইনে বন্ধ করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার সেটা অন্যায় নয়? 

অনিল: সেটাও ঘোরতর অন্যায়। সেটাও ক্রাইম। এটাও ক্রাইম।

অর্ণব:  আমার এছাড়া কী করার ছিল? আমি তো অনেক রকম চাকরির পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম বছরের পর বছর। চাকরি না পেলে কী করব? 

অনিল: হকারি করবি আমার মতো। আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না। চাকরি পাইনি। তাই হকারি করে পেট চালাই। তাই করতিস। তাই করবি। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কেন চাকরি করবি? এটা তো চরম দুর্নীতি। যোগ্য ক্যান্ডিডেটের চাকরি চুরি করে পাওয়া। শর্টকাট  রাস্তায় গেছিলিস। এখন কি হলো। টাকাটাও গেল। চাকরিটাও গেলো। সম্মানটাও গেল।

 অর্ণব: ঠিক বলেছ। আমারই দোষ। বাবা নয়, সুইসাইড আমারই করা উচিত। 

সোমা: অর্ণব তুমি থামো। একটু শান্ত হও। আমাকে হালটা ধরতে দাও। যদিও আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নয়।

অনিল: কে বলেছে তুমি আমাদের পরিবারের কেউ নয়? আমরা তো সবাই জানি তুমি অর্ণবকে ভালোবাসো। আমাদের সকলকে ভালোবাসো। আমরাও সকলে তোমাকে ভালোবাসি। আমরাও সবাই চেয়েছিলাম তুমি আমাদের পরিবারের একজন হও। আমাদের বাড়ির বউ হও। অর্ণবের বউ হও। 

সোমা: চেয়েছিলেন ছোটকাকু? মানে এখন কি আর চান না?

অনিল: কি করে চাইবো। সবতো সর্বনাশ হয়ে গেল। 

সোমা: কিচ্ছু সর্বনাশ হয়নি। 

অনিল: কী বলছ তুমি?

সোমা: অর্ণবের চাকরি চলে গেল। আমার চাকরিটাতো আছে? পাকা চাকরি ব্যাংকের। আমার চাকরি যাবে না। 

অর্ণব: এরপরও তুমি আমাকে বিয়ে করবে সোমা? 

সোমা: হ্যাঁ। কেন করব না? কেন তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না?

অর্ণব: তোমাকে বিয়ে করার মুখটা আমার আছে? আমারতো সম্মানটাই চলে গেল। 

সোমা: ও সব ঠিক হয়ে যাবে।

অর্ণব: আমি তো চোর সমাজের চোখে। 

সোমা: না। তুমি চোর নয়। তুমি ভিকটিম। এই পোড়া দেশে এই পোড়া সমাজে অন্যায়  সমাজব্যবস্থার একটা শিকার তুমি। আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি। তুমি চেষ্টা করেও পাওনি। আমার অবস্থা তোমার মতো হতে পারত। চাকরি না পেয়ে সংসার কে বাঁচাতে তুমি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলে। অপরাধী তারা যারা তোমাদের ঘুষ দিতে বাধ্য করে। মানে যারা দেশটা চালায়। কাকে টাকা দিয়েছিলে তোমরা?

 অর্ণব: এই পাড়ারই এক দালালকে। একটা নেতা।

অনিল: কে দাদা?

সুনীল:  রথীন দত্ত। 

অনিল: ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা? ওর নাম্বারটা আমাকে দাও তো। 

সুনীল: কেন? কি লাভ? ও কি টাকা ফেরত দেবে? হয়তো স্বীকারই করবে না। 

অনিল: তুমি ওকে কল করে ফোনটা আমাকে দাও।  আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। যা বলছি করো। দ্যাখো আমি কী করি। হয়ত কাজ হবে।

(সুনীল রথীনকে কল করে ফোনটা অনিলকে দেয়)

অনিল: হ্যালো রথীন বাবু। আমি সুনীল বোসের ভাই অনিল বলছি। আপনি এখনই আমাদের বাড়িতে একবার চলে আসুন। হ্যাঁ। এখনই। ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার।  না না। আপনি কেন আমাদের চাকর হবেন? বরং উল্টোটা। না আমরা কোথাও যাবো না। দাদাও কোথাও যাবে না। আপনি না আসলে কিন্তু আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। কী হয়েছে? কিছুক্ষণ আগে আমার দাদা চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিল। আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় দিতে পারেনি। ওর লেখা একটা সুইসাইড-নোট আমার পকেটে আছে। সেখানে আপনার বিরুদ্ধে ওর নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নয়। ও আবার কিন্তু সুইসাইড করার চেষ্টা করতে  পারে। সেটা যদি করে ফেলে তখন আমি ওর ঐ সুইসাইড নোটটা পুলিশকে দেব। তখন আপনার কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? ব্ল্যাকমেল বলুন আর যাই বলুন সেটাই হতে পারে। ঠিক আছে তাহলে আসছেন তো? না। তেমন রাত হয় নি।  হ্যাঁ ঠিক এখনই আসুন। রিস্ক নেবেন না। বাইকে আসতে তো আপনার দুমিনিট লাগবে। আসুন। (ফোন বন্ধ করে)

সোমা: কাজ হবে ছোটকাকু?

অনিল: দেখা যাক। ওরা তো ভীষণই পাজি। পাক্কা ক্রিমিনাল। তবে দ্যাখো সোমা আমিও দুঁদে হকার।  ওই রথীন দত্ত ওদের দলের একটা পান্ডা বটে। আমিও হকার ইউনিয়নের একটা পান্ডা। আমার গরমটা একটু দেখো।

সুনীল: অনিল, তুই কেন ওদের সঙ্গে লাগছিস? ওরা খুব খারাপ। যা গেছে গেছে। টাকার জন্যে ভাইকে হারাতে চাই না। (ফুঁপিয়ে কাঁদে) 

অনিল:  তুমি থামো। তাহলে টাকার জন্যে নিজেকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলে কেন? আমার কিছু হবে না।

(সুনীল ফুঁপিয়ে কাঁদে)  

সোমা: কাকু শান্ত হোন। কাঁদবেন না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। একটু জল খাবেন?

সুনীল: না। থাক। ঠিক আছে। 

(রথীন দত্ত বাইরে থেকে আসে। খুব বিরক্ত।)

রথীন:  কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

অনিল:  আপনাকে তো ফোনে বললাম রথীনবাবু। 

রথীন: সেতো জানলাম। কিন্তু  ব্যাপারটা কী? দেখি সুনীলদার সুইসাইড নোটটা।

 অনিল: না। সেটা এখন আপনাকে দেব না। আমাদের মুখের কথাটাই এখন আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। 

রথীন: আমি কী করেছি সুনীলদা যে আমাকে অভিযুক্ত করে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে? 

সুনীল: (চেঁচিয়ে ওঠে) তুমি কি জানো আজ হাইকোর্টের অর্ডারে অর্ণবের চাকরি চলে গেছে?

রথীন:  সেকি! আমি তো জানতাম না। 

সুনীল: আমাকে দশ লাখ টাকা ফেরত দাও।

রথীন:  কী আজেবাজে বকছো? আমি তোমাকে টাকা দেব কেন? 

সুনীল: কারণ তুমি অর্ণবের চাকরির জন্যে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছ। আমি নিজের হাতে তোমাকে সেই টাকা ক্যাশ দিয়েছি। 

রথীন: কোন প্রমাণ আছে?

সুনীল: মানে!!! তুমি অস্বীকার করছ?

রথীন: হ্যাঁ করছি।

সোমা:  আপনাদের মতো চোরেরাই এভাবে অস্বীকার করতে পারে। 

রথীন: এই সোমা। মুখ সামলে। খুব সাবধান। তোমার পলিটিক্স করা ঘুচিয়ে দেব। আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি আমাকে ঠিক চেনো না।

সোমা: ভীষণ চিনি। আমি ভয় পাচ্ছি না। যা ইচ্ছে করবেন।

অনিল:  রথীনবাবু, আপনি অস্বীকার করছেন তো? দাদার মানসিক অবস্থাটা দেখছেন? ও যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে, তাহলে কিন্তু সুইসাইডাল নোটটা আমরা পুলিশের কাছে জমা দেব।  নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো তখন? 

রথীন: (একটু থেমে) দেখো সুনীলদা। তুমি ওসব করতে যেও না। হ্যাঁ। স্বীকার করছি তুমি টাকা দিয়েছ।

অনিল: এইবার পথে এসেছে।

রথীন: কিন্তু বিশ্বাস করো। আমি তার থেকে এক লাখ টাকা মাত্র নিয়েছি। কাল সকালে ব্যাংক থেকে তুলে সেটা তোমাকে ফেরত দেব।

সুনীল:  আর বাকি ন লাখ টাকা?

রথীন: ওটা আমার কাছে নেই।

সুনীল:  নেই মানে? কার কাছে আছে?

অনিল: ওটা ওপরতলায় চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।

অনিল: বুঝতে পারছ সোমা চুরির জালটা কতদূর ছড়িয়ে আছে?

সোমা:  আমরা সেসব শুনতে চাই না। আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন। আপনি ঠিক দশ লাখ টাকাই ফেরত দেবেন। 

রথীন: মাস্তানি করছ? তুমি এসব বলার কে?

সোমা: আমি অর্ণবের ভাবী স্ত্রী। 

রথীন: পুরো স্ত্রী হলে তখন গলাবাজি করবে। 

সোমা: তার মানে  আপনি পুরো দশ লাখ টাকা দেবেন না?

 রথীন: না। কোত্থেকে দেব? ওটা আমার কাছে নেই। বললাম তো চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।

 সোমা: ফেরত আনুন। 

রথীন: সম্ভব নয়। চাইলেও ফেরত পাব না। 

সোমা: কাদের পাঠিয়েছেন? তাদের নাম বলুন।

রথীন: বলব না। 

সোমা: কেন?

রথীন: বলা সম্ভব নয়।

সোমা: কেন?

রথীন: আমি মার্ডার হয়ে যেতে চাই না।

সোমা:  আমরা কিন্তু পুলিশে যাব। বলবো আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন।

রথীন:  যাও। আমি অস্বীকার করব। বলব তোমরা মিথ্যে কথা বলছো। কী করবে তখন? প্রমাণ করতে পারবে? 

অর্ণব: (লাফিয়ে উঠে রথীনের গলা টিপে ধরে) স্কাউন্ড্রেল!

রথীন: এই কি করছ! ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে।

(ধ্স্তাধস্তি হয়। অনিল ছাড়িয়ে দেয়।)

রথীন: (রাগে কাঁপছে)খুব খারাপ করলে অর্ণব। তুমি আমাকে জানো না। 

অর্ণব: খুব জানি। আপনি এলাকার মার্কামারা খতরনাক দুনম্বরী নেতা। আপনার হাতে অনেক গুন্ডা। অনেক মার্ডার করিয়েছেন। আমাকে মার্ডার কোরবেন তো? যান। আমাকে মার্ডার করান। 

অনিল: রথীন বাবু আমার ভাইপোর আর কোন ক্ষতি করবেন না। এই পর্যন্ত যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। বাড়ির দশ লাখ  টাকা চলে গেছে।ওর চাকরিটাও চলে গেছে। সম্মানটাও চলে গেছে। এবার রেহাই দিন। এরপরেও যদি কিছু করেন। তাহলে এই সুইসাইডাল নোটটা কিন্তু আমরা থানায় জমা দেব। আপনিও দেখবেন আমরা কতদূর যেতে পারি।  (আগুনের মত তাকিয়ে রথীন চলে যায়।)

অনিল: ব্যাপারটা খুব খারাপ হল। তুই মাথা গরম করে ওর গায়ে হাত না দিলেই পারতিস অনু। খুব ডেঞ্জারাস ওরা।

অর্ণব: কী করবে? আমাক মেরে ফেলবে তো? ওকে তো বললাম  আমি সেটার পরোয়া করি না। বাবার শেষ সঞ্চয়টা তো নষ্ট করে দিলাম। চাকরিটা চলে গেল। সবাই জেনে গেল।‌ সম্মানটাও  চলে গেল। আর বেঁচে কি হবে? আমাকে আটকালে কেন? ওকে আজই গলা টিপে মেরে ফেলে না হয় ফাঁসি যেতাম।

সোমা:  কেন অর্ণব? একটা আরশোলাকে মেরে ফেলে নিজের জীবন নষ্ট করবে কেন? ঐ নরকের কীটের চেয়ে তোমার জীবনের দাম লক্ষ গুণ বেশি। যা গেছে যাক। টাকা, চাকরি, সো কলড পাবলিক প্রেস্টিজ -  সব কিছুর চেয়ে তোমার জীবনের দাম বেশি। কিসের পাবলিক প্রেস্টিজ। ভালো ছাত্র হয়েও তুমি বছরের পর বছর সৎভাবে চেষ্টা করে কঠিন পরিশ্রম করে চাকরি পাওনি। আমি তো জানি। ঐ পাবলিক আমজনতা তোমাকে কি বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেছিল? ওদের কথা ছাড়ো। 

অনিল: সোমা আমি আসছি। অনেক রাত হয়ে গেল। আমাকে ভোরের লোকাল ধরতে হবে। সামান্য হকারি করে খাই।  তুমি বাড়ি ফিরবে তো? অনেক রাত হয়ে গেল তো।

সোমা: না ছোটকাকু। আমি বাড়িতে বলেছি আজ ছোটমাসির বাড়ি থাকবো। ছোটমাসির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। অর্ণবের মেসেজ পেয়ে বুঝেছিলাম মারাত্মক কিছু হয়েছে। তাই মাসিকে ম্যানেজ করেছি। মাসি আমাদের রিলেশনশিপের ব্যাপারটা জানে। আমাকে বন্ধুর মত ভীষণ কোঅপারেট করে।

অনিল: ঠিক আছে। আমি তাহলে যাচ্ছি। তোমার ছোটকাকিমাও মনে হয় চিন্তা করছে। ও তো এসব কিছুই জানেনা। আমি একটা দরকারে দাদার কাছে এসেছিলাম। দেখলাম বাড়িটা থমথমে। বৌদি  আর অর্ণব ভীষণ চুপ করে আছে। দাদা কোথায় বলতে  বলল চিলেকোঠার ঘরে আছে। বুঝলাম কিছু সমস্যা হয়েছে। যাই হোক ভাগ্যিস চিলেকোঠার ঘরে গেলাম। আ্য একটু দেরী হলেই দাদাকে হারিয়ে ফেলতাম।

সুনীল: সেটা ভালোই হতো। কেন বাঁচালি আমাকে?

অনিল: বাজে বোকো না। 

(অর্ণবের বাবা ও মা দুজনেই হাউ হাউ করে কাঁদে)  কান্নাকাটি কোরোনা। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এবার সবাইকে বাঁচতে হবে। জীবন কি অত সস্তা। লড়াই করে বাঁচতে হবে। আমাকে দেখছ না? সারাদিন লড়াই করে বাঁচি। আর তোমাদের এত সুন্দর একটা বৌমা হচ্ছে। যে তোমাদের সবাইকে এত ভালোবাসে। এতো তোমাদের বিরাট সহায়। যাও বৌদি দাদাকে ঘরে নিয়ে যাও। চোখে চোখে রেখো। আর দাদা তুমি কাপুরুষের মত আর ওরকম নোংরা কাজ করতে যেও না। ছোট ভাই হলেও জ্ঞান দিয়ে বলছি।  মানুষের মতো বাঁচো। কাপুরুষরাই লড়াই না করে নিজেকে মেরে ফেলতে যায়। যাও। তোমরা ভেতরে যাও। (অর্ণবের বাবা ও মা ভেতরে চলে যায়)  আমি যাচ্ছি সোমা। যাচ্ছি অর্নব। মনের জোর বাড়া। রথীন দত্ত তোর কিছু করতে পারবে না। বাবারও বাবা আছে। আমি ঘরে গিয়ে জটাদাকে একটু পরে ফোন করে সব বলব। জটাদা যেরকমই লোক হোক আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি যাচ্ছি। সোমা এদের সবাইকে একটু দেখো।

সোমা: হ্যাঁ। ছোটকাকু। আমি আছি। চিন্তা করবেন না। আপনি আসুন। (অনিল বেরিয়ে যায়) 

সোমা: মন খারাপ করে থেকো না অর্ণব। 

অর্ণব: তুমি রাতে এ বাড়িতে রয়ে গেলে কেন? বাড়ির সবাই বাবা-মা কাকু কাকিমা তোমাকে যদি খারাপ ভাবে, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে। 

সোমা: আমাকে কেউ খারাপ ভাববে না। কেননা ওরা কেউ খারাপ নয়।  আর ওরা জানে আমিও খারাপ মেয়ে নয়। 

অর্ণব: কোথায় থাকবে রাতে?

সোমা: (হেসে) তোমার ঘরে। 

অর্ণব: তাহলে খারাপ ভাববেই।

সোমা: (হেসে) ভয় নেই। আমি চিলেকোঠার ঘরে একলা থাকব। 

অর্ণব: আবার ওখানে?

সোমা: (হেসে) ভয় নেই। মরব না। মরার কোনো ইচ্ছে নেই। বরং বাঁচার ইচ্ছে ভীষণ। তোমাকে নিয়ে। তোমার সঙ্গে। (সোমা দুহাত দিয়ে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে গান গাইতে থাকে। অর্ণবের ক্রমশ চোখ ভিজে যায়।)

অর্ণব: (আবেগরুদ্ধ কন্ঠে)কেন এখনও আমাকে এত ভালোবাসছ তুমি? আমার মতো একজন অপদার্থ দুর্নীতিপরায়ণ ছেলেকে।

সোমা: নিজেকে গালাগালি দেবে না অর্ণব। একদম নয়।

অর্ণব: গালাগালিরই যোগ্য আমি। 

সোমা: আমি তা মনে করি না।

 অর্ণব: কী মনে করো?

সোমা: বললাম তো একটু আগে। তুমি সিস্টেমের শিকার। তুমি ভালো। শতকরা একশ ভাগ ভালো।

আমার চোখ ভুল দেখেনি। 

অর্ণব: কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। 

সোমা: কীভাবে? 

অর্ণব: তোমাকে তো বলিনি দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আমি চাকরি পেয়েছি।‌

সোমা: কোন ছেলে কি এত সহজে তার প্রেমিকাকে এসব বলতে পারে?

অর্ণব:  আমি একজন কাওয়ার্ড। আমাকে তুমি ডিফেন্ড করছ?

সোমা: করছি। আমাদের বিয়ের পর তুমি নিশ্চয়ই সেটা বলতে।

 অর্ণব: তখন আমাকে ঘেন্না করতে না? 

সোমা: না। কারণ ওটাই। তুমি সিস্টেমের শিকার। আমি তো জানি তুমি ভালো ছাত্র। উন্নত সুস্থ রুচি আর মন তোমার। কেন তোমাকে কোনদিন ঘৃণা করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ণব। তোমার সমস্ত সত্তাকে। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে। কাটাছেঁড়া করে, ভুল ঠিক বিচার করে, দোষগুণ বিচার করে এই ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না।  আমরা কেউ  ত্রুটিমুক্ত নই পৃথিবীতে। ভুল ত্রুটি, দোষ গুণ - কোন কিছুই বিচার্য নয়। শুধু ভালোবাসাই বিচার্য। শুধু প্রেমই একমাত্র সত্য অর্ণব। কী হল অর্ণব? এত গুম হয়ে আছ কেন? দেখো এই প্রথম তোমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আমি রাত কাটাচ্ছি। আমার এই রাতটা ব্যর্থ করে দিও না।

অর্ণব: কেন তুমি আমার মত একটা মানুষের জন্যে  এত ভাবছ? কেন রয়ে গেলে এখানে? চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। 

সোমা: তাড়িয়ে দিচ্ছ আমাকে? 

অর্ণব: আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। থাকবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। 

সোমা: শুধু বাজে কথা। কিচ্ছু শেষ হয়নি। 

অর্ণব: হ্যাঁ সব শেষ হয়ে গেছে। আর যাদের জন্য শেষ হয়ে গেছে তাদের আমি ছাড়বো না। আমি চরম প্রতিশোধ নেব।  

সোমা: কী সব পাগলের মতো বলছ মাথা গরম করে?

অর্ণব: কিচ্ছু পাগলের মত নয়। আমি আবারও বলছি। আমি চরম প্রতিশোধ নেব। রথীন দত্তদের আমি ছাড়বো না।

সোমা:  কী সব বলছ! তুমি ওদের সঙ্গে আর লাগবে না। ওরা ভয়ংকর খারাপ। যা গেছে গেছে। যা হবার হয়ে গেছে। তুমি ওসব করতে গেলে তোমার বাকি জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে অর্ণব। আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদের সুন্দর করে  ভবিষ্যতের এক সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে হবে। 

অর্ণব: না তা আর হবে না। 

সোমা: কেন হবে না? আমি তো আছি তোমার সঙ্গে অর্ণব।

অর্ণব: আমাকে তুমি ভুলে যাও সোমা। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।

সোমা:  কী পাগলামি করছ?

অর্ণব: পাগলামি নয়।‌ আমি ঠিক বলছি।‌ আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে অসহায় কপর্দকশূন্য বাবার দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। আমি অপদার্থ। দুর্নীতিপরায়ন। চোর। অবৈধ পথের পথিক। তুমি একটা সৎপরিশ্রমী মেধাবী ছাত্রী। পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতায় ব্যাংকে চাকরি পাওয়া একজন সম্মানীয়া মহিলা। আমার সঙ্গে -  আমার মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমার সম্মান নষ্ট কোরোনা। আমি অপদার্থ। সংসারের সর্বনাশ করলাম। নোংরা রাস্তায় চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। তাই হাইকোর্টের অর্ডারে আমার চাকরি চলে গেল। সবাই জেনে গেল। সমাজে আমার সম্মান চলে গেল। আমার এই সম্মানহীন জীবনের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমাকে  অসম্মানিত করতে চাই না। 

সোমা: বার বার সেই একই কথা। সেই অপরাধবোধ। 

অর্ণব: হ্যাঁ অপরাধ বোধ। কারণ আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী। 

সোমা: আমি তো বার বার বলছি আমি তা মনে করিনা। কেননা আমার স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে সমাজ সচেতনতা দিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিতে সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বলছি তো তুমি অপরাধী নও। আবার বলছি তুমি সিস্টেমের শিকার। কেন আমাকে একই কথা বলে বোর করছ?

অর্ণব: আমাকে নিতান্ত ভীষণ ভালোবাসো বলে আজ এই কথা বলছ। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে একদিন কিন্তু তুমি হয়ত অন্য কথা বলতে পারো। আমাদের সন্তানদের হয়ত বলতেই পারো তোর বাবা ছিল একটা করাপটেড দুর্নীতিগ্রস্ত চোর। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে তারপর ধরা পড়ে চাকরি খোয়ানো একটা রাস্কেল জানোয়ার। বলতেই পারো ভবিষ্যতে  তাদের  - তাদের শুধু কেন – হয়ত আমাকেই একদিন বলতে পারো এইসব।

সোমা: তাই নাকি? এতদূর ভেবে ফেলেছ?  আমাকে এই চিনেছ? এত অবিশ্বাস আমাকে?

অর্ণব: হ্যাঁ। তাই। আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না। কোনকিছুই বিশ্বাস করি না। তাই? 

সোমা: তাহলে সত্যি আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। অবিশ্বাস দিয়ে আমিও জীবন শুরু করতে চাই না। (বাষ্পারুদ্ধ কণ্ঠে) ঠিক আছে অর্ণব। তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। (প্রচন্ডভাবে কেঁদে ফেলে) 

অর্ণব: দাঁড়াও। এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?

সোমা:  নিজের বাড়িতে‌। লাস্ট বাস পেয়ে যাব। 

অর্ণব: আমি পৌঁছে দেব?

সোমা: না। (চলে যায়)


।। দ্বিতীয় দৃশ্য।।

(থানা। ওসির চেম্বার।)

অর্ণব: বলুন অফিসার আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। 

ওসি: আপনি বুঝতে পারছেন না নাকি ন্যাকার মতো বুঝেও না বোঝার ভান করছেন?

অর্ণব: আমি নিশ্চয় অনেক কিছু আন্দাজ করছি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই আমার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ কী। 

ওসি: আপনি লিফলেট ছাপিয়ে  চতু্র্দিকে সেগুলো ছড়িয়ে এলাকার কিছু সম্মানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে তাদের সম্মান নষ্ট করছেন। 

অর্ণব: সম্মানীয় নেতা? হাসালেন। হ্যাঁ। করছি। কারণ সেটাই তাদের প্রাপ্য। দরকার হলে ওরা আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুক। এসবে আপনার সমস্যা কিসের?

 ওসি: আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছেন?

 অর্ণব: না কৈফিয়ত চাইছি না।  শুধু জানতে চাইছি কারণটা। 

ওসি: আপনার কথা কে শুনবে? কে বিশ্বাস করবে? আপনি তো চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে তারপর দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়েছেন আর তারপর ধরা পড়ে গিয়ে হাইকোর্টের অর্ডারে  আপনার চাকরি খুইয়েছেন।

অর্ণব: ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন।  আমি তো লিফলেটে এই সমস্ত কথাই লিখেছি।

ওসি: কিন্তু লিফলেটে যাদের নামে আপনি অভিযোগ করেছেন, তারা নির্দোষ সম্মানীয় নেতা। 

অর্ণব: তাই নাকি? 

ওসি: আপনি প্রমাণ করতে পারবেন তারা আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?

অর্ণব:  না। পারবো না। আমি অভিযোগ করছি। তদন্ত করার কর্তব্য আপনাদের। রথীন দত্ত আর আমার বাবার কল লিস্ট চেক করে রথীন দত্তকে জিজ্ঞেস করুন কী এত কথাবার্তা হয়েছিল ওর সঙ্গে আমার বাবার। আপনারা ওকে পেঁদিয়ে ওর স্বীকারোক্তি আদায় করুন। 

ওসি: আপনার কথায়?

অর্ণব: হ্যাঁ। আমার কথায়। আমি তো বলছি  ওদের দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছি। 

ওসি: আপনি মিথ্যেকথা বলছেন। 

অর্ণব: তাহলে আমার চাকরি গেল কেন? আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করতেও আমার চাকরি হলো কেন?

ওসি: আপনি ঘুষ দিয়েছেন। তাই হয়েছে।

 অর্ণব: হ্যাঁ। বলছি তো দিয়েছি। ভূতকে তো ঘুষ দিইনি। আমরা সেই সব ক্ষমতাবানদের ঘুষ দিয়েছি যারা আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও  আমাকে চাকরি তে ঢুকিয়েছিল। তারা কারা?

ওসি: সে আমি কি করে জানব আপনি কাদের ঘুষ দিয়েছেন? সেটা তো আপনি জানেন।

অর্ণব: জানি তো। তাদের নামই তো লিফলেটে লিখেছি। তাদের অ্যারেস্ট করে ইনটারোগেট করুন। 

ওসি: আপনার কথায়?

অর্ণব: হ্যাঁ। আমার অভিযোগের ভিত্তিতে। 

ওসি: আপনি নির্দোষ লোকদের নামে মিথ্যে অভিযোগ করছেন তাদের ফাঁসাবার জন্য। আসল অপরাধীদের আড়াল করতে। 

অর্ণব: আমার মোটিভ?  

ওসি: আপনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এই কাজ করছেন। এটাই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।

 অর্ণব: আপনার কথার প্রমাণ?

ওসি:  কোনো প্রমাণ বা কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। আপনি আজকেই আবার একটা লিফলেট ছাপিয়ে সেখানে লিখবেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় আপনি সম্মানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

 অর্ণব: তাই নাকি? আমাকে এতই  ভেড়া আর রামছাগল মনে করেন? আমার তো সব গেছে। টাকা কড়ি চাকরি সম্মান। আমার আর হারাবার কিছু নেই। ভয়েরও কিছু নেই। শুনুন অফিসার। আমি আর কোন লিফলেট ছাপাবো না। যেটা ছাপিয়েছি, সেটাই বরং আরো অনেক জেরক্স করে সব  জায়গায় বিলি করব। আর রাস্তাঘাটে বাজারে মোড়ে সর্বত্র মাইক ভাড়া করে আপনাদের ওই সম্মানীয় নেতাদের মুখোশ খুলে দেব। ওদের বলবেন আমি ওদের ছাড়বো না। 

ওসি: আপনাকে অ্যারেস্ট করব। 

অর্ণব: করুন। তারপর জামিন নিয়ে বেরিয়ে আবার একই কাজ ক্রমাগত করে চলব। আপনাদের ওই ঘুষখোর সম্মানীয় নেতাদের সম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে দেব। যেভাবে আমার সম্মান ওরা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। 

ওসি: আপনি বেরিয়ে যান। আ আর এক মিনিট থাকলে আপনাকে লকআপে পুরব। 

অর্ণব: যাচ্ছি। এখানে এক সেকেণ্ডও থাকার ইচ্ছে নেই। আপনি ডেকেছিলেন। তাই এসেছিলাম।  

 (সেই মুহূর্তে মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত বাইরে থেকে এসে ওসির ঘরে ঢুকে পরে।।)

মৌসুমীঃ দাঁড়াও অর্ণব। তুমি যাবে না। আমরা বাইরে থেকে সব শুনেছি।

ওসি:  কী ব্যাপার? আপনারা বিনা পারমিশনে ওসির ঘরে ঢুকলেন কেন?

তাপসঃ বেশ করেছি। রথীন দত্ত ঢুকলে এটা বলতেন?

ওসি: এই তাপস! বড় ফুটবলার হয়ে গেছ? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

 প্রশান্তঃ তার আগে বলুন আমাদের কি অপরাধ? অর্ণবদার মতো  একইরকমভাবে রথীন দত্ত  স্কুলে চাকরি দেওয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আর কোর্টের অর্ডারে ওর মতো আমারও চাকরি চলে গেছে।

তাপসঃ  রথীন দত্ত আমার কাছ থেকেও  দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আমারও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে।

 মৌসুমীঃ  আমরাও বাড়ি থেকে রথীন দত্তকে দশ লাখ টাকা দিয়েছি আমার ছোট ভাই তপনের চাকরির জন্যে।ওরও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে। 

ওসি: কোর্টে যান। কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করুন। আমার কাছে এসেছেন কেন?

তাপসঃ আপনি কি জানেন আমার বাবা জমি বেচে টাকা দিয়েছে রথীন দত্তকে?

প্রশান্তঃ আপনি কি জানেন আমি মায়ের  গয়না বেচে টাকা দিয়েছি রথীন দত্তকে?

মৌসুমীঃ আপনি কি জানেন আমার ভায়ের চাকরি চলে যেতে ও কাউকে কিছু না বলে গতকাল পাগলের মত বাড়ি থেকে চলে গেছে? শুধু রথীন দত্ত নয়। রথীন দত্ত বরফের চূড়ো। অনেক রাঘব বোয়াল পেছনে আছে।

ওসি: ওসব ফালতু কথা আমাকে বলতে এসেছেন কেন?

তাপসঃ ফালতু কথা? আপনি সব জানেন।

প্রশান্তঃ ওই কয়েকটা লোকের জন্য আমাদের সকলের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

ওসি:  তোমরা আমাকে বলছ কেন?

মৌসুমীঃ   কাকে বলব? আপনি তো এলাকার ওসি। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি।

 ওসি: বললাম তো। কোর্টে গিয়ে অভিযোগ করুন। এটা কোর্ট নয়।

 মৌসুমীঃ কোর্টে যাবার পয়সা কে দেবে? আপনি? আমরা অভিযোগ করছি রথীন দত্তর নামে। আপনি স্টেপ নিন।

তাপসঃ হ্যাঁ। রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করব। 

ওসি: (হেসে) রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করবে?

প্রশান্তঃ হ্যাঁ। আর আপনাকে  ডায়েরি নিতে হবে।

মৌসুমীঃ আর ওকে অ্যারেস্ট করতে হবে।

ওসি: (হেসে) তাই নাকি?

মৌসুমীঃ হ্যাঁ। তাই।

অর্নবঃ আর তা যদি না করেন, আমরা গণআদালত করে ওর বিচার করব।

ওসি: (হেসে) তাই নাকি? এতবড় নেতা হয়ে গেছ? এরকম বেআইনি কাজ করলে আমরা কী করব জানো?

তাপসঃ হ্যাঁ।  আইন দেখিয়ে আমাদের অ্যারেস্ট করবেন। কিন্তু ঐসব চোরেদের চিটিংবাজির ব্যাপারে আপনাদের আইন চুপ করে থাকে।

(রথীন দত্তর প্রবেশ)

রথীন দত্ত: কী ব্যাপার অফিসার?

ওসি: (হেসে)এরা আপনাদের বিরুদ্ধে ডায়েরি করতে এসেছে।

রথীন দত্ত: তাই নাকি?

ওসি: (হেসে) আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বলছে।

রথীন দত্ত: আচ্ছা?

ওসি: (হেসে) বলছে গণআদালতে আপনার বিচার করবে।

রথীন দত্ত: পিটিয়ে বের করে দিন থানা থেকে।

ওসি: ঠিক। সেটাই করতে হবে। বহুৎ বাড়াবাড়ি করছে।

অর্ণব: (চিৎকার করে) দিন। পিটিয়ে বের করে দিন আমাদের থানা থেকে। কিন্তু আমাদের মুভমেন্ট থামবে না। প্রতিদিন বেড়ে চলবে। প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়বে। আর আপনাদের নেতাদের চামচাবাজি করার মুখোশ টেনে খুলে ফেলবে।

ওসি: (পুলিশদের ডাকে) এই! এদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।

(দুজন পুলিশ ওদের ধাক্কা দিয়ে বার করতে থাকে। ওরা বেরোবার সময় প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী চিৎকার করতে থাকে।)


।। তৃতীয় দৃশ্য।।

(অর্ণদের বাড়ি। রাতের বেলা। কলিং বেল।‌ অর্ণবের বাবা দরজা খুলে দেন।‌ একজন সাবইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ ঢুকে পরে।)

সাবইন্সপেক্টর: কোথায় আপনার ছেলে? তাকে ডাকুন।

সুনীল: কেন?

 সাবইন্সপেক্টর: আমরা ওকে থানায় নিয়ে যাব। 

সুনীল: এত রাতে কেন ওকে থানায় গিয়ে যাবেন?

সাবইন্সপেক্টর: সেই কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। 

সুনীল: আপনাদের কাছে ওর কোন নামে কোন আরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?

 সাবইন্সপেক্টর: আপনাকে কোন জবাবদিহি করব না।‌ ওকে ডাকুন। 

সুনীল: ও ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ঘুমোচ্ছে। 

সাবইন্সপেক্টর: (পুলিশদের)এই তোমরা ছাদে গিয়ে ওকে নীচে নামিয়ে নিয়ে এসো। (পুলিশদের কানে কানে কিছু বলে। পুলিশদুটো ওপরে চলে যায়।)_

সুনীল:একি! আপনারা আমার বিনা পারমিশনে ওপরে গেলেন কেন? আপনাদের কি কোন সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? (অর্ণবের মা তপতী ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে)

তপতী:  কী হয়েছে? পুলিশ কেন?

সুনীল: অর্ণবকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। 

তপতী:  কেন? কী করেছে আমার ছেলে? আমার ছেলেকে কোথাও নিয়ে যাবেন না।

সুনীল: ওরা অলরেডি আমাদের ছাদের ঘরে চলে গেছে অর্ণবকে ধরতে।

তপতী: না আমার ছেলেকে ধরবেন না। আপনারা এসব করতে পারেন না। 

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। আর একটা কথা বললে আপনাদের দুজনকেও তুলে নিয়ে যাব। 

সুনীল: মানে? জোর যার মুল্লুক তার। গাজুয়ারি পেয়েছেন। রাত দশটার সময় বাড়িতে এসে বিনা ওয়ারেন্টে আমাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যাবেন?

সাবইন্সপেক্টর: হ্যাঁ। যাব। 

সুনীল: আপনারা এসব করতে পারেন না।

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। একটা কথা বলবেন না। 

সনীলঃ রাতের বেলায় ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে মাস্তানি করছেন পুলিশ  অফিসার হয়েছেন বলে? দেশে আইন নেই? বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে। 

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। পুলিশ অফিসারকে বেরিয়ে যেতে বলছে! এত স্পর্ধা! 

সুনীল: হ্যাঁ বলছি। ঐ পুলিশ দুটোকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আপনাদের কাছে কোন ওয়ারেন্ট নেই। বেআইনিভাবে ঢুকে মাস্তানি করছেন।

( সাবইন্সপেক্টর  অর্নবের বাবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়)

তপতী: একি! আমার স্বামীকে মারলেন কেন? কেন মারলেন? কেন মারলেন? (তপতী চিৎকার করতে থাকেন।  এই সময়  পুলিশ দুটো নেমে আসে।)

প্রথম পুলিশঃ স্যার কাজ হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় পুলিশঃ কমপ্লিট।

সাবইন্সপেক্টর:  কী ব্যাপার? 

(একজন পুলিশ সাবইন্সপেক্টর কে কানে কানে কিছু বলে)

সাবইন্সপেক্টর  শুনুন সুনীল বাবু। আপনার ছেলেকে পুলিশরা ধরতে গেছিল। ও পুলিশের হাত ছাড়িয়ে  তিনতলার ছাদ থেকে রাস্তায় লাফ দিয়ে পালাতে গেছিল। এখন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই তোমরা চলো।

(অর্ণবের বাবা ও মা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাইরে থেকে অনিল দৌড়ে ঢোকে।)

অনিল:  দাদা, এরা অনুকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখনি চলো। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

সাবইন্সপেক্টর: কে বলল ওকে আমরা  ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি?

অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) আমার জানলা থেকে আমি নিজের চোখে  দেখেছি। 

সাবইন্সপেক্টর:  আপনি ভুল দেখেছেন। 

প্রথম পুলিশঃ হ্যাঁ। আপনি ভুল দেখেছেন।

 দ্বিতীয় পুলিশঃ ও আমাদের তাড়া খেয়ে  পালাতে গিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছে।

 অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) না। আপনারা মিথ্যে বলছেন। আমি  নিজে দেখেছি ওকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

সাবইন্সপেক্টর: (প্রচণ্ড ধমকে)  আপনি ভুল দেখেছেন। এই তোমরা চলো।

অনিল: ওকে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান। 

 সাবইন্সপেক্টর: আপনারাা নিয়ে যান। লাফ দিয়েছে ও। আমরা ওকে লাফাতে বলিনি। এই চলো। (বেরিয়ে যায়।

অনিল: দাদা! বৌদি,!এখনি চলো। এভাবে ভেঙে পোড়োনা। অনুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে  গেলে হয়ত অনু বাঁচতে পারে।কী করছ দাদা? ওঠো ওঠো। (প্রচণ্ড আকূতি করে চিৎকার করে) ওঠো ওঠো।ওঠো…………………….

                         (প্রচণ্ড আবহ। অন্ধকার।)

(অন্ধকার মঞ্চে অতি ক্ষুদ্র আলোকবৃত্তে উদ্ভাসিত হয় অর্ণবের মুখ)

অর্ণব: আমারতো মৃত্যু হল।‌ এরপর কী কী ঘটবে আমি বলে দিতে পারি। বিভিন্ন  রাজনৈতিক দল হইচই করবে। একদল বলবে দুর্ঘটনা। অন্যরা বলবে হত্যা। ময়নাতদন্ত বলবে দুর্ঘটনা। বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ আন্দোলন বিক্ষোভ মিছিল হতে থাকবে। আমার মুমূর্ষু শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবা মাকে মিডিয়ার লোকরা এসে নিয়মিত বিরক্ত করে যাবে। বাবা-মা- কাকার মুখ বন্ধ করার জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া ও প্রলোভন দেখানো চলবে। বুদ্ধিজীবীদের মোমবাতিগুলো নেভানোই থাকবে। তারপর মানুষেরা কমবেশি ফ্রী লজেন্স  পেতে পেতে ধীরে ধীরে  সব ভুলে যাবে। একটা ছোট্ট শহীদ বেদী হয়ত হবে। সেটাও আসতে আসতে ময়লা হয়ে যাবে। এইভাবে  দিন মাস বছর গুলো গড়িয়ে একদিন ভোট এসে যাবে। শপথগ্রহণ হবে। তারপর কোনদিন আবার কোন অর্ণব হয়ত পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরবে বা তাকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আপনাকে বলা হবে আপনি ভুল দেখেছেন, ভুল শুনেছেন, ভুল বুঝেছেন। 

 (নাটকটি প্রযোজনার অনুমতির জন্য যোগাযোগঃ 8910019589)




কবিতাগুচ্ছ ২৫ -কবিরা
Dec. 3, 2024 | কবিতা | views:775 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিলাসিতা

লি খে ছে ন – স জ ল  কা ন্তি  টি কা দা র


দিব্যি আছি সুখেই আছি

ভালো মন্দে দিন চলে যায়

ঘরে আছে দুটো গোরু

এদের নিয়েই দিন

কেটে যায়।


দশ বছরের ছেলে আমার

শাকসবজি বেচে আসে---

রোজ:

সকাল দুপুর বিকেলবেলায়।


রাজনীতির ছাই বুঝিনা কিছু!

ভোটটা তবু দিয়েই আসি

ভোট চলে গেলে পরেই

গলায় ঝোলে

ক্ষুধার ফাঁসি।


নুন আনতে পান্তা ফুরায়

কাঁচা লঙ্কা তাও জোটেনা!

এরই মাঝে ছেলে আমার

পড়াশুনায় মন দিতে চায়

ধমকে উঠি কান্ড দেখে

কেমন করে ছেলে আমার

বিলাসিতায় ডুব দিতে যায়!


যে ঘরেতে পেট চলেনা

সেই ঘরেতে পড়ালেখা?

বিলাসিতা ছাড়া কি আর

অন্য চোখে যায়রে দেখা?

শুনিসনি কি কোন এক নেতা

নামটা তো পড়ছেনা মনে

শিক্ষিতদের চাকরী মেরেই

আছে এখন জেলের কোণে।

তাইতো বলি বই গুটিয়ে

চলনা এবার মাঠে যাই

পড়া শিখে চাকরী পাবি?

আমার যে অত টাকা নাই





লাল

লি খে ছে ন – প্র দী প  চ ক্র ব র্তী


জাতের নামে বজ্জাতি

আর কতদিন চলবে?

ধর্মের ধ্বজাধারীরা

আর

কবে সত্যি কথাটা বলবে?

মিথ্যাচারের ফানুসটাকে

নামাতে হবে তাই,

পৃথিবীটা সব মানুষের

মানুষ মানুষের-ই ভাই।

রক্তদান শিবিরেতে

রক্ত দিলাম কাল,

শিবির শেষে দেখতে পেলাম,

সবার রক্তই লাল।



আস্তিক ও নাস্তিক

লি খে ছে ন - বিপ্লব সেন


বাস্তব অবস্থার বিরোধিতা করেই

আস্তিক যে ভাব বাদী,

ঠিক উল্টো কাজ করেই

নাস্তিক মানুষ বস্তুবাদী।


প্রশ্ন করার অধিকার নেই

কোনো সংকীর্ণতার মধ্যে,

তাই আপনার করা প্রশ্ন এড়িয়ে যায়

আঁধারের সান্নিধ্যে।


ওরা মানে না অন্য ঈশ্বর

শুধুই নিজের কাল্পনিক সর্বশক্তিমান,

প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি আলাদা ঈশ্বর

আলাদা ধর্মে মহান।


এই যুক্তি প্রশ্নের কোনো

উত্তর তাদের নেই,

তারা শুধু আনুগত্য নিয়ে

ভজে চলে তাই।


এই প্রশ্ন করলেই বলবে

নাস্তিক বিধর্মী,

নাস্তিক কথাটার মানেই জানে না

তারা তো মানব ধর্মী।


দ্বিচারিতা নিয়ে চলে

যেটা বোঝে ভালো,

অন্ধ বিশ্বাসের উন্মাদনায়

তাদের চেতনা কালো।


যুক্তি বুদ্ধি সব বাদ যায়

শুধুই পড়ে থাকে বিশ্বাস,

কোনো প্রশ্ন কাজ করে না

বোঝে না কেনো নাস্তিকের অবিশ্বাস।




এ কীসের বিবর্ণতা?

লি খে ছে ন – প্রি ন্সি  বে রা


একদল পুরুষ বিচার বিবেচনা করেছে রপ্তানি

আমদানি করেছে শুধুই মিথ্যে দম্ভ,

বৈবাহিক সম্পর্কের মানরেখেছে তলানিতে,

সদা ব্যাস্ত দিতে বিচার বিভাগীয় দন্ড।

তবে একখানা সরকারি চাকরি যদি জোটে নারীর কপালে

বররূপী বহুরূপী করে একাডেমী শিক্ষার খানিক কদর;

নয়তো শিক্ষা নাকি বালের।


হয়েছিল তো সাতজন্মের বন্ধনে আবদ্ধ

তবে কেনো একজন্মেই সমস্ত পাবার বাসনায় পরিকরবদ্ধ।

শুনতে চায়না নারীর ইচ্ছা,জানতে চায়না তার খুশি।

নারীদেহ শুধুই ভোগের প্রসাদ,

প্রাপ্য ভেবেই,রাজার রাজা বেজায় সুখী।



নারী স্বাধীনতা চাইলে,শুনতে হয় মাগী,

গুনতে হয় চামড়ায় মারের দাগ,

পুরুষ ভাসিয়ে দেয় সব রোমান্টিক আবেগ

খোরপোষ আর কর্তৃতের ঝর্ণায়।


অন্যায়ের অন্যায় আজও প্রতিবাদহীন

গর্জেওঠা দুএকজন,হারছে;করছে পুনরায় মাথা নত।

তাই দেখে সোকোল্ড স্বামী নিচ্ছে বাহবা

দিচ্ছে হুংকার,করছে নিজস্বার্থ জারি।


এখনও তবু একদলের দাবি

তারা নিষ্ঠা বিচারদাতা,

তাহলে সমাজে আজও নারীর

এ কীসের বিবর্ণতা?

ধন্যবাদান্তে

রমা বেরা, শ্রীচন্দা, উস্থি




ভীতির পুঁজি আনুগত্যের মুনাফা

লি খে ছে ন – বি প্ল ব  সে ন


ভীতি যেখানে পুঁজি সেথায়

বিশ্বাস হয় মুনাফা,

মুনাফা নয় ডাকাতি চলে

করতে পকেট সাফা।


নানা রকম কায়দা কানুন

সাথে অন্ধবিশ্বাস,

বিশ্বাসের পুঁটুলি চেতনায় ঝোলে

মরার পর "স্বর্গবাস।"


লড়াই করে টিকে থাকা

ইহ জগতের সমাজে,

অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান এর যোগান

জীবনের চেষ্টা মাঝে।


মৃত্যুর পর কি হবে ভেবে

ভীতির অন্ধকার,

জীবনের শেষে মৃত্যুর আবেশ

চেতনা মৃত্যুর পারাবার।


বস্তু হয়ে যাবে শরীর

জীবনের পরিসমাপ্তি,

পৃথিবীতে বেঁচে থাকা

জীবনের পরম প্রাপ্তি।


সেই বেঁচে থাকা যাতে হয়

ললিত সুকোমল,

তার জন্যে চাই যে

অর্থের সম্বল।


সেই ভীতি পুঁজি তখন

যখন রমরমা কারবার,

বিরাট মুনাফা অর্থের ঝনঝন

পুরুত পাদ্রী,মৌলভীর পকেট ভরাবার।


অসভ্য বটেই ধূর্ত শয়তান

এটাই কারবারের বহিঃপ্রকাশ,

সত্য চাপা দিয়ে চেতনার

করা সর্বনাশ।



কেন আমি নাস্তিক -ভগৎ সিং
Dec. 3, 2024 | নাস্তিকতা | views:7438 | likes:0 | share: 1 | comments:0

একটি নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞ কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমি যে বিশ্বাস করি না, এর কারণ কি আমার আত্মম্ভরিতা? আমি কখনও কল্পনা করিনি যে আমাকে এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে আমার মনে হচ্ছে যে, আমার বন্ধুদের কয়েকজন (তাঁদের বন্ধু বলে ভেবে যদি না আমি অনেক বেশি দাবি করে থাকি) আমার সঙ্গে তাঁদের স্বল্প পরিচিতির ফলে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা আমার দিক থেকে খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং কিছুটা আত্মম্ভরিতাই আমার অবিশ্বাসের কারণ! এমন অহংকার আমার নেই যে আমি এই সমস্ত মানবিক বৈশিষ্ট্যের উপরে। আমি একজন মানুষ এবং তার চেয়ে বেশি কিছু না। এর চেয়ে বেশি দাবি কেউ করতেও পারেন না। আমাদের কমরেডদের মধ্যে আমাকে একজন স্বেচ্ছাচারী বলা হত। এমন কি আমার বন্ধু বি. কে. দত্তও কখনও কখনও আমাকে এই সব বলেন। কোনো কোনো সময় স্বেচ্ছাচারী বলে আমাকে ধিক্কারও দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বন্ধু খুব গুরুত্বের সঙ্গেই অভিযোগ করেন যে, আমি নাকি আমার মতামত ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের উপর চাপিয়ে দিই এবং আমার প্রস্তাব পাস করিয়ে নিই। এ যে কিছুটা পরিমাণে সত্য তা আমি অস্বীকার করি না। এ আত্মশ্লাঘা হতে পারে। অন্যান্য জনপ্রিয় মতাদর্শের পাশাপাশি আমার মধ্যে এবং আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও আত্মম্ভরিতা আছে, কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কিছু নয়। হয়তো আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে এ আমার ন্যায়সঙ্গত গর্ব, দম্ভ নয়। কারও মধ্যে অহেতুক গর্বের আতিশয্যই হল দম্ভ অথবা সঠিকভাবে বলতে গেলে অহংকার। এই রকম কোন অহেতুক গর্ব আমাকে নাস্তিকতার দিকে টেনে এনেছে না কি এবিষয়ে সযত্ন চর্চার ফলে এবং যথেষ্ট বিবেচনার পরই আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করতে আরাম্ভ করেছি, সেই কথাই আমি এখানে আলোচনা করতে চাই। প্রথমেই আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আত্মশ্লাঘা এবং দন্ত দু'টি আলাদা জিনিস।


প্রথমত, আমি একেবারেই বুঝতে পারি না যে কি করে অহেতুক গর্ব বা আত্মশ্লাঘাবোধ কোন মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের অন্তরায় হতে পারে। বিখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত না হয়েও বা প্রয়োজনীয় গুণাবলীর অধিকারী না হয়েও কিছুটা খ্যাতি যদি আমি অর্জন করে ফেলি তাহলে প্রকৃতই মহৎ এমন কোন ব্যক্তির মহত্ত্বকে আমি হেয় করতে পারি। এটুকু না হয় বোঝা যায়। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দম্ভের জন্য কিভাবে একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী, অবিশ্বাসীতে পরিণত হতে পারে? শুধুমাত্র দু'টি উপায় আছে। হয়, সেই ব্যক্তিকে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবতে হবে, নয়ত তাকে নিজেকেই ঈশ্বর বলে ভাবতে হবে। কিন্তু এরা কোনভাবেই যথার্থ নাস্তিক হতে পারছে না। প্রথম ক্ষেত্রে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্বই অস্বীকার করছে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও সে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে পর্দার আড়ালে কোনো সচেতন সত্তার উপস্থিতিকে স্বীকার করছে। সে নিজেকেই ঐ পরম সত্তা মনে করে কিনা কিংবা পরম সত্তাকে তার থেকে স্বতন্ত্র কোন কিছু ভাবে কিনা আমাদের কাছে তার কোন গুরুত্ব নেই। মূল কথাটা ঐখানে। তার বিশ্বাস ঐখানেই। কোন মতেই সে নাস্তিক নয়। তাহলে, প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কোন দলেই আমি পড়ি না। কেননা ঐ সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্বকেই আমি অস্বীকার করি। কেন করি সে আলোচনা পরে করা যাবে। এখানে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই, তা হল আমার দম্ভ আমাকে নাস্তিকতার তত্ত্ব গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছে - এটা ঠিক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী অবতার বা স্বয়ং সেই পরম সত্তা ইত্যাদি কোনো কিছুই আমি নই। একটা বিষয় তাহলে স্থির হয়ে গেছে যে, এমন একটা চিন্তাধারায় পৌঁছানোর কারণ আমার দম্ভ নয়। এই অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য ঘটানাগুলোর বিচার করা যাক। আমার এই বন্ধু-বান্ধবদের মতে আমার অসার আত্মশ্লাঘার কারণ সম্ভবত দিল্লির বোমা মামলা এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে আমার অহেতুক জনপ্রিয়তা অর্জন। বেশ, তাহলে তাদের যুক্তি সঠিক কিনা দেখা যাক। আমার নাস্তিকতার জন্ম খুব সাম্প্রতিককালে নয়। আমি যখন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক ছিলাম তখন এই বন্ধুরা কেউ আমায় চিনতেন না, তখনই আমার মধ্যে থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস চলে গেছে। সামান্য একজন কলেজ ছাত্রের মধ্যে কোন দাম্ভিকতা থাকতে পারে না, যা তাকে নাস্তিকতার পথে ঠেলে দিতে পারে। যদিও আমি কিছু অধ্যাপকের প্রিয় ছিলাম, কয়েকজনের অপ্রিয়ও ছিলাম, ছাত্র হিসেবে কিন্তু কখনই পরিশ্রমী বা মনোযোগী ছিলাম না তাই দাম্ভিকতার মতো কোনো অনুভূতি পোষণ করার সুযোগই আমি পাইনি। বরং বলা যায় আমি ছিলাম বেশ লাজুক স্বভাবের ছেলে, ভবিষ্যৎ জীবনধারা সম্পর্কে যার মনোভাব ছিল নৈরাশ্যজনক। ঐ সময়ে আমি পরিপূর্ণ নাস্তিক ছিলাম না। আমার ঠাকুরদা, যাঁর প্রভাবে আমি লালিত পালিত তিনিই ছিলেন একজন গোঁড়া আর্য সমাজী। একজন আর্য সমাজী আর যাই হোক নাস্তিক নন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আমি লাহোরের ডি এ ভি স্কুলে ভর্তি হই এবং পুরো এক বছর ওখানকার ছাত্রাবাসে ছিলাম। সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা ছাড়াও আমি ঘন্টার পর ঘণ্টা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতাম। ঐ সময় আমি পুরো ভক্ত ছিলাম। পরবর্তীকালে আমি আমার বাবার সঙ্গে বাস করতে আরম্ভ করি। ধর্মীয় পোঁড়ামি সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদারচেতা। স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার জন্য আমার যে ইচ্ছা জাগে তা তাঁরই শিক্ষার ফলশ্রুতি। কিন্তু তিনি নাস্তিক নন। তিনি একজন দৃঢ় আস্তিক, প্রতিদিন পূজার্চনা করতে তিনি আমাকে উৎসাহিত করতেন। সুতরাং, আমি এইভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি ন্যাশনাল কলেজে যোগদান করি। সেখানেই আমি চিন্তার ক্ষেত্রে উদার হতে থাকি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যা, এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা- সমালোচনা করতে থাকি। কিন্তু তখন আমি ঘোরতর আস্তিক। ঐ সময় আমি না- ছাঁটা অবিন্যস্ত লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদেও আমি কখনও আস্থা রাখতে পারিনি। তবুও, ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।


পরবর্তীকালে আমি বিপ্লবী দলে যোগদান করি। প্রথমে আমি যে নেতার সংস্পর্শে আসি তিনি দৃঢ় ঈশ্বর-বিশ্বাসী না হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বে অস্বীকার করতে সাহস পাননি। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার বারবার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন, “যখন তোমার ইচ্ছা হয়, প্রার্থনা কর।” এ হল নাস্তিকতাবাদের তত্ত্ব গ্রহণ করতে যে সাহসের প্রয়োজন, তা ছাড়াই নাস্তিক হওয়া। দ্বিতীয় যে নেতার সংস্পর্শে আমি আসি, তিনি ছিলেন পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় কমরেড শচীন্দ্রলাল সান্যাল, যিনি তখন করাচী ষড়যন্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর বিখ্যাত ও একমাত্র বই ‘বন্দী জীবন' - এর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই প্রচন্ডভাবে ঈশ্বরের মহিমা গাওয়া হয়েছে। ঐ চমৎকার বইটার দ্বিতীয় অংশের শেষ পৃষ্ঠায় বেদান্তবাদজনিত চিন্তা থেকে ঈশ্বরের প্রতি যে অতীন্দ্রিয় প্রশংসাবাণী বর্ষিত হয়েছে তা তাঁর চিন্তার একটি বিশিষ্ট অংশ। ১৯২৫ সালের ২৮ শে জানুয়ারি সমগ্র ভারতবর্ষে যে ‘বিপ্লবী প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়, মামলার বাদীপক্ষের বক্তব্য অনুসারে তা তাঁরই চিন্তার ফসল। গোপন কাজকর্মে যা অবশ্যম্ভাবী বিশিষ্ট কোনো নেতা নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করেন যা তাঁর নিজের কাছে খুবই প্রিয় এবং মতের  ভিন্নতা থাকলেও অন্য কর্মীদের তাতে মৌন সম্মতি দিতে হয়। ঐ প্রচারযন্ত্রের পুরো একটা প্যারাগ্রাফ সর্বশক্তিমান এবং তাঁর লীলা ও কর্মের প্রশংসায় মুখরিত। এ সবই অতীন্দ্রিয়বাদ, আমি যা দেখতে চাইছি তা হল নাস্তিকতার ধারনা বিপ্লবী দলে অঙ্কুরিত হয়নি। বিখ্যাত কাকরি শহীদদের সকলেই তাদের শেষ দিনগুলো প্রার্থনা করে কাটিয়েছেন। রামপ্রসাদ বিসমিল ছিলেন একজন গোঁড়া আর্যসমাজী। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা থাকা সত্ত্বেও রাজেন লাহিড়ী উপনিষদ ও গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার স্পৃহা চেপে রাখতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনকেই আমি জানি যিনি কখনও প্রার্থনা করেননি। তিনি বলতেন, দর্শন হল মানুষের দুর্বলতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফল। তিনি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের শাস্তি ভোগ করেছেন। কিন্তু তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মতো সাহস দেখাননি।


ঐ সময় পর্যন্ত আমি ছিলাম শুধুই একজন কল্পনাপ্রবণ ভাববাদী বিপ্লবী বিশেষ। তখনও পর্যন্ত আমরা কেবল অনুসরণই করতাম। তারপর এলো সমস্ত দায়িত্ব বহন করার সময়। অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ার ফলে কিছুদিনের জন্য দলের অস্তিত্ব রক্ষাই অসম্ভব হয়ে উঠল। শুধু নেতারা নন অতি উৎসাহী কমরেডরাও আমাদের প্রতি বিদ্রূপ বাক্য বর্ষণ শুরু করলেন। কিছুদিনের জন্য আমি ভীত হয়ে পড়লাম যে কোনদিন হয়তো আমিই আমাদের কর্মসূচীর অসারতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ব। ঐ সময়টা আমার বিপ্লবী জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ। আমার মনের আনাচে- কানাচে একটাই কথা বাজতে লাগল - ‘জানতে হবে'। প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলি খণ্ডন করার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হলে গভীর ভাবে জানতে হবে, পড়তে হবে। নিজের মতবাদের পক্ষে যুক্তি দ্বারা নিজেকে তৈরি করাতে হলেও পড়াশুনা করতে হবে। আমি পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার আগের বিশ্বাস ও বিশ্বাসগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল। পূর্বসূরিদের থেকে সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে ফাঁকা আবেগ পেয়েছিলাম, এখন তার জায়গায় সুচিন্তিত ধারণা গড়ে উঠল। ভাববাদকে বিদেয় করে দিলাম, অন্ধ বিশ্বাস থেকেও মুক্ত হলাম। বাস্তববাদ (realism) আমাদের আদর্শ হয়ে দাঁড়াল। বড় রকম প্রয়োজনের সময়ই শক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি সমর্থনযোগ্য এবং নীতি হিসাবে সমস্ত রকমের গণ-আন্দোলনে অহিংসা অপরিহার্য। এই হল পদ্ধতি সম্পর্কিত কথা। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল, যে বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সংগ্রাম করছি সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলা দরকার। বাইরে যেহেতু সে সময়ে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল না তাই বিশ্ব বিপ্লবের বিভিন্ন তত্ত্ব ও আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করার বিস্তর সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিন, সাম্যবাদের (communism) মার্ক্সের কিছু এবং লেনিন ও ট্রটস্কি এবং অন্যান্যদের অনেক লেখা পড়লাম যাঁরা তাঁদের দেশে সাফল্যের সঙ্গে বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। এরা সকলেই ছিলেন নাস্তিক। বাকুনিনের ঈশ্বর ও রাষ্ট্র (God & State) টুকরো টুকরো হলেও ঐ বিষয়ে কৌতুহলোদ্দীপক গবেষণা, আরও পরে নিরালম্ব স্বামী লিখিত 'সাধারণ জ্ঞান' (Common sense) নামে একটা বই পেলাম, এটা ছিল একরকম অতীন্দ্রিয় নাস্তিকতাবাদ, আমার কাছে বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন এমন সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কিত তত্ত্বের অসারতায় আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল ১৯২৬ সালের শেষাশেষি, আমার অবিশ্বাস আমি প্রকাশ করলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম এবং আমি একজন সুস্পষ্ট নাস্তিক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে অবস্থাটা কিরকম দাঁড়াল তা আমি আলোচনা করছি।


১৯২৭ সালের মে মাসে আমি লাহোরে গ্রেপ্তার হলাম। ধরা পড়াটা হয়েছিল হঠাৎ, পুলিস যে আমায় খুঁজছে তা আমি একেবারেই জানতাম না। আমি যাচ্ছিলাম একটা বাগানের মধ্যে দিয়ে, হঠাৎ দেখি পুলিস আমায় ঘিরে ফেলেছে, খুব অবাক লাগে ঐ সময় আমি খুব শান্ত ছিলাম। কোনোরকম অনুভূতি বা উত্তেজনাও আমার হচ্ছিল না। আমাকে পুলিস হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন আমাকে পাঠানো হল রেলওয়ে পুলিস হেফাজতে। সেখানে আমাকে পুরো একমাস কাটাতে হয়। পুলিস অফিসারদের সঙ্গে অনেকদিনের আলাপ-আলোচনায় আমি বুঝতে পারলাম যে কাকোরি পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ সম্পর্কে ও বিপ্লবী আন্দোলনে আমার অন্যান্য কার্যকলাপ সম্পর্কে তাদের কাছে কিছু তথ্য আছে। তারা বললেন যে, লখনৌতে যখন কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল তখন আমি নাকি সেখানে ছিলাম এবং বন্দীদের মুক্ত করার জন্যে আমি কয়েকটি পরিকল্পনা এঁটেছিলাম। তাদের সমর্থন পাওয়ার পরই আমরা কিছু বোমা সংগ্রহ করেছিলাম এবং পরীক্ষামূলকভাবে সেগুলির একটি নাকি ১৯২৬ সালে দশহরা উৎসবের ভিড়ের মধ্যে আমরা ছুঁড়েছিলাম। আমার প্রতি দয়া দেখিয়ে তারা আরও বলেছেন যে বিপ্লবী দলের গোপন কাজকর্ম সম্পর্কে কোনো হদিশ যদি দিই তাহলে আমায় বন্দী তো করা হবেই না, বরং ছেড়ে দেওয়া হবে এবং রাজসাক্ষীরূপে কোর্টে না দাঁড় করিয়ে আমায় পুরস্কার দেওয়া হবে। এ প্রস্তাব আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, এ সমস্তই ছিল ফালতু কথা! আমাদের মতো আদর্শ যাঁরা নিয়ে চলেন তাঁরা কখনই নিজেদের নির্দোষ দেশবাসীর উপর বোমা ছুঁড়তে পারেন না। একদিন সকালে তখনকার সি আই ডি-র সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ নিউম্যান এলেন। অনেক দরদভরা কথাবার্তার পর তিনি খুব দুঃখের খবরটি দিলেন যে, তাঁরা যেমন চাইছেন তেমন কোনো বিবৃতি যদি আমি না দিই তাহলে কাকোরি মামলায় যুদ্ধ বাধানোর যড়যন্ত্রে ও দশহরার দিন বোমা ছুঁড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্য আমাকে বিচারের জন্য পাঠাতে তারা বাধ্য হবেন। তিনি আমায় আরও জানালেন যে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার ও ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ তাঁর হাতে আছে। ঐ সময় আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি নির্দোষ হলেও পুলিস আমাকে ফাঁসি দিতে পারত। ঐদিনই কয়েকজন পুলিস অফিসার দু'বেলাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য আমায় প্ররোচিত করতে লাগলেন, তখন আমি একজন নাস্তিক। আমি চাইছিলাম নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। শুধু কি শান্তি ও আনন্দের সময়ই আমি নিজেকে নাস্তিক বলে জাহির করার ক্ষমতা রাখি, না কি এই রকম দুঃসময়েও আমি আমার আদর্শে অবিচল থাকতে পারব। অনেক বিবেচনার পর আমি ঠিক করলাম যে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে ও প্রার্থনা করতে আমি পারব না। আমি কখনও করিনি। এটাই ছিল আসল পরীক্ষা এবং তাতে আমি উত্তীর্ণ হলাম। মুহূর্তের জন্য অন্য কিছুর পরিবর্তে নিজের গর্দান বাঁচানোর ইচ্ছা আমি পোষণ করিনি। সুতরাং আমি ছিলাম একজন একনিষ্ঠ নাস্তিক এবং তারপর থেকে আমি তা-ই রয়ে গেছি। ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশ্বাস কষ্টকে হালকা করে। দেয়।। এমনকি কখনও কখনও তাকে মজাদারও করে তুলতে পারে। ভগবান মানলে মানুষ প্রায় সময়ই যথেষ্ট সান্ত্বনা ও সমর্থন পেতে পারে। আর তা না হলে মানুষকে নিজের মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে নিজের মানসিক শক্তির ওপর নির্ভর করা ছেলেখেলা নয়। যদি কোনো দম্ভ থাকে, ঐ রকম মুহূর্তে তা কোথায় উড়ে যাবে আর প্রচলিত বিশ্বাসকে মানুষ আঁকড়ে ধরতে চাইবে। যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেই কেউ স্থির থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে শুধু দম ছাড়াও অন্য কোনো না কোনো শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। এখন হচ্ছে ঠিক সেই অবস্থা। বিচারের রায় সকলেরই জানা, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তা ঘোষিত হবে। একটা আদর্শের জন্যই যে আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি এছাড়া আমার আর কি সান্ত্বনা থাকতে পারে? ঈশ্বর-বিশ্বাসী একজন হিন্দু রাজা হিসাবে পুনর্জন্মের আশা করতে পারেন। একজন মুসলমান অথবা খ্রিষ্টান স্বর্গের বিলাসিতা উপভোগ করার ও দুঃখ-কষ্ট ত্যাগের জন্য পুরস্কৃত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু আমি কি প্রত্যশা করতে পারি? আমি জানি যে-মুহূর্তে আমার গলার দড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে এবং আমার পায়ের তলা থেকে আড়কাঠ সরিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই হবে চরম মুহূর্ত এবং শেষ মুহূর্ত। আমি এবং অধিবিদ্যার (metaphysics) ভাষ্য অনুযায়ী আমার আত্মা, সব সেইখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর কিছুই থাকবে না। একটা খুবই ছোট জীবনের কোন মহৎ কীর্তিহীন, গৌরবহীন সমাপ্তি! এটাকেই যদি সাহসের সাথে মেনে নিতে পারি, সেটাই হবে আমার জীবনের সবথেকে সেরা পুরস্কার।


এটাই হল আসল কথা। ইহজগতে ও স্বর্গলোকে গিয়ে পুরস্কার পাব এমন ইচ্ছা বা বাসনা আমার নেই। একেবারেই নিঃস্বার্থ ভাবে আমি আমার দেশের মুক্তির জন্যে গোটা জীবন উৎসর্গ করে গেলাম, কারণ এটা ছাড়া আমার আর কিছু দেওয়ার ছিল না। যেদিন আমরা দেখতে পাব, এক বড় সংখ্যক নরনারী যখন শুধুই শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য, মানব জাতির সেবার জন্যে দলে দলে এগিয়ে আসছে, সেদিনই আমার মতো মানুষের জীবন উৎসর্গ সার্থক হবে। তখন শুরু হবে মানব জাতির সত্যিকারের মুক্তির দিন। মৃত্যুর পরে “স্বর্গে গিয়ে বা ‘পরের জন্মে রাজা’ হতে নয় বা এই জন্মে কোন পুরস্কার লাভের জন্যেও নয়, গোটা মানব জাতির থেকে দাসত্বের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে অত্যাচারী ও শোষকদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বাধীনতা ও শান্তির পথ তৈরি করতেই ব্যক্তিগত আত্মঘাতী পথে নিজেদের মহৎ প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন এমন পথটাই হল - গর্বময় জীবনের পথ। এই মহৎ কাজের জন্য যে গর্ববোধ, তাকে কী শুধু “অহংকার' বলে খাটো করতে হবে? যারা এই রকমের ঘৃণাভরা বিশেষণ ব্যবহার করে তাদের আমরা বলি হয় নির্বোধ, নয় শয়তান।


যদিও এই মহান আত্মত্যাগের মধ্যে যে অনুভূতির প্রাচুর্য, যে ভাবালুতা, যে উদ্দীপনা, যে মহানুভবতা ও বিশালতা আছে তা বুঝতে না পারার জন্য আমরা তাদের ক্ষমা করতে পারি। কারণ তাদের হৃদয় মৃত ধ্বংসস্তূপের মত, দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ, অন্য কোন স্বার্থের নিচে তাদের মন চাপা পড়ে আছে। 

আত্মবিশ্বাসকে প্রায়ই অহংকার বলে ভুল করা হয়। এটা যতটা দুঃখজনক, ততটাই শোচনীয়। কিন্তু তবুও কিছু করার নেই।

যখন দেখি, কোনো প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধিতা করতে অথবা সাধারণ মানুষের চোখে সবসময় অভ্রান্ত এমন কোনো নেতা বা মহান ব্যক্তির সমালোচনা করতে, অমনি অসংখ্য লোক দল বেঁধে তেড়ে আসবে আপনাকে দাম্ভিক বা হামবড় বলে হেয় প্রতিপন্ন করতে। সমালোচনা ও স্বাধীন চিন্তা একজন বিপ্লবীর পক্ষে দুটো খুবই দরকারি গুণ। যেহেতু মহাত্মাজী মহান, সেহেতু কারও উচিৎ নয় তাঁর সমালোচনা করা। যেহেতু তিনি উঁচুতে উঠে গেছেন, সেজন্যে রাজনীতি বা ধর্ম, অর্থনীতি বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে যা কিছু তিনি বলেন সবটাই ঠিক। আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন আপনাকে বলতেই হবে, হ্যাঁ, এটাই ঠিক। এ মানসিকতা প্রগতির পথে বাধা। সোজা কথায় এ জিনিষ প্রতিক্রিয়াশীলতা।


  যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষরা এক পরম সত্তার, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সম্পর্কে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস তৈরি রেখে গেছেন যার ফলে যদি কোন লোক সেই প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা সেই 'পরম সত্তার' বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানান, তবে তাকে স্বধর্ম ত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক বলে গাল দেওয়া হবে। যদি তার যুক্তিগুলো এমন জোড়ালো হয় যে পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাকে থামানো বা হারানো যাচ্ছে না তখন তাকে পরম সত্তার অভিশাপের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়া হবে এবং তখন তাকে হামবড় বলে নিন্দে করা হবে, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাকে দম্ভ বলে অপমান করা হবে। তাহলে ফালতু এই আলোচনায় সময় নষ্ট করে কী হবে? সবার আগে এইরকম একটা প্রশ্ন সাধারণ মানুষর সামনে আসছে এবং এর একটা বাস্তবসম্মত সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে - এই জন্যেই এত বড় আলোচনার আয়োজন করা।


ফলে, প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আমি বলব, দম্ভ যে আমায় নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়নি এ বিষয়টা আমি পাঠকদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পেরেছি।। যুক্তিসঙ্গতভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কিনা সে বিচারের দায়িত্ব পাঠকদের। আমি জানি, আমার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস থাকলে আমার জীবনকে তা অনেক স্বচ্ছন্দ করে তুলতে পারত, মনের চাপ হালকা করতে পারত। অন্যদিকে ঈশ্বরে অবিশ্বাস আমার চারপাশের পরিবেশকে নীরস করে তুলেছে, হয়ত তা আরও কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে, আবার একটুখানি আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া তাকে অনেকটা কাব্যময় করে তুলতে পারত। কিন্তু ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে গিয়ে আমি কোন অহেতুক উন্মাদনার সাহায্য নিতে চাই না। আমি একজন বাস্তববাদী, শাণিত যুক্তিবিজ্ঞানই আমার হাতিয়ার, তাই দিয়েই আমি আমার ভিতরের প্রবৃত্তিকে জয় করতে চাই। এই ব্যাপারে যে আমি সবসময়ই সফল হয়েছি তা নয়, কিন্তু আমাদের উচিত বারে বারে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, কেননা সাফল্য নির্ভর করে ঘটনাচক্র আর বাস্তব পরিস্থিতির উপরে।


দ্বিতীয় প্রশ্ন, দম্ভ যদি কারণ না হয়, তাহলে প্রচলিত আস্তিক্যবাদে অবিশ্বাস করার অন্য কোন কারণ থাকা উচিত? হ্যাঁ, অবিশ্বাস করার মত যথেষ্ট যুক্তি আমার আছে। আমি এখন সেই আলোচনায় আসব। আমার মতে, যার এতটুকু যুক্তিতর্কের ক্ষমতা আছে তিনি বিচার বিশ্লেষণ করেই বাস্তব পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করেন। সরাসরি প্রমাণ যেখানে নেই সেখানে ধর্মীয় দর্শন মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। আমি আগেই বলেছি আমার এক বিপ্লবী বন্ধু বলতেন- “মানুষের দুর্বলতাতেই ধর্মীয় দর্শনের জন্ম।” প্রাচীনকালে বিশ্বব্রহ্মান্ডের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এবং এক কার্যকারণ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার করার যখন সুযোগ ছিল কিন্তু সরাসরি বোঝার মত যথেষ্ট উপাদান ছিল না, তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা মনগড়া উপায়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতেন। সেইজন্যেই বিভিন্ন ধর্মমতগুলোর মূল তত্ত্বের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় যেটা কোনো কোনো সময়ে পরস্পর বিরোধী রূপ নেয়, নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-মারামারি ও অশান্তির জন্ম দেয়। শুধুমাত্র পূর্ব-পশ্চিমের ধর্মের মধ্যেই পার্থক্য দেখা যায় তা নয়, এমনকি একই গোলার্ধে নানা ধর্মমতের মধ্যেও বড় পার্থক্য দেখা যায়। যেমন আমাদের প্রাচ্যের হিন্দুধর্মের সঙ্গে মুসলিম ধর্মের মধ্যে কোনো মিল নেই। এই ভারতবর্ষেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে কত আলাদা, আবার এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যেই আছে সনাতন ধর্ম ও আর্যসমাজের মতো মতামত যারা একে অপরের প্রায় উল্টো। ‘চার্বাক’ আমাদের দেশের আরেক প্রাচীন চিন্তাবিদ, যিনি এক স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা, তিনি সেই কোন সুদূর অতীতেই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। অর্থাৎ কিছু মৌলিক প্রশ্নে এই ধর্মগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার যথেষ্ট বিরোধ আছে, আর প্রত্যেকেই ভাবে তার নিজের ধর্মটাই ঠিক। সমস্যাটা ঠিক এখানেই। কিন্তু আজকের দিনে প্রাচীন মুনি-ঋষিদের চিন্তা ও বানীকে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের এগিয়ে চলার পথে অবলম্বন হিসাবে আমরা গ্রহণ করছি না, বা এই রহস্যের দরজা খোলার চেষ্টা করছি না, উল্টে জড়তার শিকার হয়ে গিয়ে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার তৈরি করছি, তাঁদের বক্তব্যের প্রতি অনড় ও অচল বিশ্বাস গড়ে তুলেছি, আর এইভাবেই গোটা সমাজে এগিয়ে চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছি।


যে মানুষ প্রগতির পক্ষে, পুরানো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে তাকে সমালোচনা করতে হবে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে ও প্রয়োজনে অবিশ্বাসও করতে হবে। প্রচলিত বিশ্বাসের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে লাগবে। অনেক তর্কাতর্কি ও আলাপ-আলোচনার পর যদি কেউ কোন মতবাদ বা দর্শনে আস্থা রাখে তবে তাকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। যদি তার বিচারের ধারা সঠিক পথ নাও খুঁজে পায় বা ভুল পথে এগোয় তবুও তাকে সংশোধন করে সঠিক পথে নিয়ে আসা সম্ভব, কারণ যুক্তিই হল তার জীবনের ধ্রুবতারা। কিন্তু সবথেকে ক্ষতিকারক পথ হল অন্ধবিশ্বাস। কারণ, সে জিনিষ মাথার বুদ্ধিকে ভোঁতা করে দিয়ে মানুষকে ভুল পথে ঠেলে দেয়। যিনি নিজেকে বস্তুবাদী বলে দাবি করেন তাঁকে সমস্ত সনাতন ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যুক্তিতর্কের শাণিত আক্রমণের মুখে যদি দাঁড়াতে না পারে তবে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। তখন তার প্রথম কাজ হবে পুরানো চিন্তা-ভাবনার সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নূতন দর্শন সৃষ্টির জমি তৈরি করা। এটা হল নেতিবাচক দিক, পুরাতন কে বাদ দেওয়ার দিক। এরপর শুরু হবে ইতিবাচক দিক, সেখানে পুরাতন চিন্তার মধ্যে থেকে দরকারি উপাদানকে নতুন চিন্তাধারার মধ্যে আত্মস্থ করে নিতে হতে পারে। আমার নিজের কথা বলতে গেলে মানতে হবে এ বিষয় নিয়ে আমি বেশি পড়াশুনা করতে পারিনি। প্রাচ্য দর্শনের নানা দিক নিয়ে পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছা ছিল, যদিও তার সুযোগ আর পেলাম না। কিন্তু পুরানো বিশ্বাসের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে আমার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে, এ ক্ষেত্রে আমি খুব নিশ্চিন্ত বোধ করি। এমন কোন পরমসত্তা নেই যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের গতি প্রকৃতি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিন্ত। বিশ্বপ্রকৃতির অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস আছে এবং সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের উদ্দেশ্যই হল সমাজের প্রয়োজনে প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এটাই হল আমাদের দর্শনের মূল কথা।


এখন নেতিবাচক দিক দিয়ে আস্তিক্যবাদীদের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই। আপনাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যদি সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ এক ঈশ্বর থেকে থাকেন যিনি এই পৃথিবী বা বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আপনাদের উত্তর দিতে হবে তার এই পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? দুঃখ-দুর্দশায় ভরা কত অসংখ্য হৃদয়ভাঙ্গা ঘটনার শাশ্বত রঙ্গমঞ্চে যেখানে একটা মানুষও পরিপূর্ণ সুখভোগ করতে পারে না?


বলবেন না এ তাঁরই বিধান অনুরোধ করছি। যদি তিনি কোনো বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন। তিনি আমাদের মতোই আরেকজন ক্রীতদাস। দয়া করে এটা বলবেন না যে, এসব তাঁর লীলা। সম্রাট নিরো এক রোম নগরী জ্বালিয়েছিলেন। খুবই অল্প সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছিলেন তিনি। তার পরিপূর্ণ আনন্দের জন্য তিনি খুবই কম পরিমাণ মানুষের মৃত্যুর কাহিনী তৈরি করেছিলেন। ইতিহাসে তিনি কী স্থান পেলেন? ঐতিহাসিকেরা কী নামে তাকে চিহ্নিত করেন? সমস্ত রকমের বিদ্বেষপূর্ণ বিশেষণ তার ওপর বর্ষিত। অত্যাচারী হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নিরোর প্রতি যে তীব্র নিন্দা ভরা গালাগাল জুটেছে তাতে ইতিহাসের পাতা কালো রঙ ধারণ করেছে। এক চেঙ্গিস খাঁ কয়েক শত জীবন নষ্ট। করেছিল নিজের আনন্দের জন্য এবং আমরা এই নামটাকেও পর্যন্ত ঘৃণা করি। তাহলে কিভাবে আপনারা আমাদের সর্বশক্তিমান শাশ্বত নিরোকে সমর্থন করছেন যিনি প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রতি মিনিটে অসংখ্য হত্যার কাহিনী তৈরি করেছেন এবং করছেন? কিভাবে আপনারা তাঁর দুষ্কর্মকে সমর্থন করতে পারেন যিনি প্রত্যেক মুহূর্তে চেঙ্গিস খাঁর দুষ্কর্মকে অতিক্রম করে যায়? আমার কথা হল কেন তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে গেলেন যা যথার্থই নরক, যা প্রতিনিয়ত তীব্র অশান্তির ক্ষেত্র? কেন এই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করতে গেলেন যখন তাঁর তা না করার ক্ষমতাও ছিল? এ সবের যৌক্তিকতা কোথায়? আপনারা কি পরজন্মে নির্দোষ ভুক্তভোগীদের পুরস্কারের কথা এবং দুষ্কর্মকারীদের শাস্তিবিধানের কথাও বলতে চান? ভাল, ভাল, যে ব্যক্তি আপনার শরীরে প্রথমে আঘাত করে ক্ষত বানিয়ে পরে খুব কোমল ও আরামদায়ক মলমের প্রলেপ দেওয়ার সাহস পায় তাকে আপনারা কতটা সমর্থন করবেন? গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠকরা ক্ষুধার্ত হিংস সিংহের সামনে মানুষকে ছেড়ে দিত, আর সেই মানুষ যদি কোনরকমে ঐ জন্তুর হাতে মৃত্যুর থেকে বেঁচে যেত তবে তাদের পরবর্তীকালে ভালভাবে দেখাশোনা করা হত। এ ব্যাপারটাই বা কতটা ন্যায্য ছিল? এ জন্যই আমার প্রশ্ন - কেন সেই সচেতন পরম সত্তা এই পৃথিবী ও তার অন্তর্গত মানুষগুলোকে সৃষ্টি করলেন? মজা পাওয়ার জন্য? তাহলে তাঁর ও নিরোর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? 


মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের কাছে জানতে চাই - হিন্দু দর্শন আরও একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবে সেই প্রশ্নের জবাবে আপনারা কি বলবেন? আপনারা তো পূর্বজন্মে বিশ্বাস করেন না। হিন্দুদের মতো, আপাত নির্দোষ দুর্দশাগ্রস্থদের পূর্বজন্মে করা কোন পাপকাজের যুক্তি আপনারা দেখাতে পারবেন না। আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি কথার মাধ্যমে জগত সৃষ্টি করার জন্য কেন সর্বশক্তিমান ছয়দিন ধরে পরিশ্রম করলেন এবং প্রতিদিন কেন 'সব কিছুই ভাল আছে' বললেন। আজ তাঁকে ডাকুন। অতীত ইতিহাস তাকে দেখান, বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করতে দিন। দেখা যাক তিনি বলতে সাহস পান কিনা - ‘সব ভাল আছে’।


অন্ধকার কারাগার থেকে কুঁড়ে ঘরে ও বস্তিতে বস্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কুরে কুরে খাওয়া অনাহারের গহ্বর থেকে, রক্তচোষা পুঁজিপতিদের দ্বারা নিজেদের রক্ত চুষে নেওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে অত্যন্ত ধৈর্যশীল অথবা উদাসীন শ্রমিকদের থেকে, সামান্যতম বোধশক্তি আছে এমন মানুষও শিউরে উঠবে মনুষ্য শক্তির যে অপচয় দেখে সেখান থেকে, এমন কি অতিরিক্ত উৎপাদন বন্টন করার পরিবর্তে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো পছন্দ থেকে তাকে দেখানো মানুষের হাড়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধনীর প্রাসাদ, তিনি বলুন 'সব ঠিক আছে'। আমার প্রশ্ন কেন? কোন কারণ?' আপনারা নীরব, ঠিক আছে, তাহলে আমি এগিয়ে যাই।


হিন্দুরা, আপনারা বলেন, বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্থরা সকলেই আগের জন্মের পাপী। ভাল কথা। আপনারা বলেন, এখনকার অত্যাচারীরা আগের জন্মে সৎ মানুষ ছিলেন এবং এ জন্য তারা এখন ক্ষমতা ভোগ করেন। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনাদের পূর্বপুরুষরা বেশ চালাক লোক ছিলেন। যুক্তি ও অবিশ্বাসের সকল তত্ত্বকে চুরমার করার জন্য যথেষ্ট মজবুত তত্ত্ব বের করার চেষ্টা তারা করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি কতটা ধোপে টেকে সেটাই দেখা যাক।


খুব বিখ্যাত আইনজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কেবল তিন বা চারটি দিক থেকে অন্যায়কারীদের যে শাস্তি প্রদান করা হয় তা সঠিক বলে মানা হয়। এগুলো হল, প্রতিশোধাত্মক (মৃত্যুদণ্ড জাতীয় শাস্তি), প্রতিরোধাত্মক (ভয় দেখিয়ে থামানো) ও সংশোধনাত্মক (চরিত্র সংশোধন বা পরিবর্তন)। অগ্রগামী সকল চিন্তাবিদ প্রতিশোধাত্মক তত্ত্বকে নিন্দা করেন। প্রতিরোধাত্মক তত্ত্বেরও একই দশা। সংশোধনাত্মক তত্ত্বই একমাত্র মানব প্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হল, দুষ্কৃতকারীকে অত্যন্ত যোগ্য ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকরূপে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নিই যে সেই মানুষেরা দুষ্কৃতকারী তাহলে তাদের উপর ঈশ্বর যে শাস্তিবিধান করেন তার প্রকৃতি কী রকম? আপনারা বলেন তিনি তাদের গরু, বিড়াল, গাছ, লতাপাতা অথবা পশুরূপে জন্মগ্রহণ করার জন্য পাঠান। আপনারা মনে করেন যে, এ সকল শাস্তি চুরাশী লক্ষ রকমের। আমি জিজ্ঞাসা করি, মানুষের উপর এর সংশোধনাত্মক প্রতিক্রিয়া কি রকম? কতজন লোকের সন্ধান আপনারা পেয়েছেন যারা স্বীকার করে যে দুষ্কর্ম করার জন্য তারা আগের জন্মে গাধা হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল? কেউ না। পুরাণের লাইন টেনে আনবেন না। আপনাদের পৌরাণিক গল্প ছোঁয়ার সুযোগ আমার নেই। তারপরেও আপনারা কি জানেন যে গরিব হওয়া এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ? দারিদ্র্য একটা পাপ একটা শাস্তি! আমি জিজ্ঞাসা করি, কোন অপরাধতাত্ত্বিক, আইনজ্ঞ - অথবা আইনসভার সদস্য যদি এমন শাস্তি দেন বা যদি এমন প্রস্তাব আনেন যা অনিবার্যভাবেই মানুষকে আরও বেশি রকমের গর্হিত কাজ করতে বাধ্য করে, তাহলে তাদের মূল্য কি বিচার করবেন? এ চিন্তা কি আপনাদের ভগবান করেননি, নাকি তাঁকেও ঐ সব জিনিষ শিখতে হয়েছে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, মানুষের অকথিত দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে। গরিব এবং অশিক্ষিত চামার কিংবা মেথর পরিবারে জন্মেছে এমন একজন মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে আপনার মতামত কী? সে গরিব, তাই লেখাপড়া করতে পারে না। তার পাশের মানুষের দ্বারাই সে ঘূণিত ও বর্জিত। তথাকথিত উঁচু জাতে জন্মেছে বলে যারা নিজেদের মানুষ বলে মনে করে তার অজ্ঞতা, তার দারিদ্র্য এবং তার প্রতি যে ব্যবহার করা হয়, সব মিলিয়ে সমাজের প্রতি তার হৃদয় কঠিন হয়ে উঠবে। ধরুন সে একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, কে তার ফল ভোগ করবে? ভগবান সে নিজে অথবা সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা? উদ্ধত এবং আত্মম্ভরি ব্রাহ্মণেরা ইচ্ছাকৃতভাবে যে সব লোককে অজ্ঞাত রেখেছে এবং আপনাদের পবিত্র জ্ঞানগ্রন্থ বেদের কয়েকটা বাক্য শ্রবণ করে পরিচালিত হওয়ার দলে পড়ে যাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাদের শাস্তি সম্পর্কে কী হবে? যদি তারা কোন অপরাধ করেও থাকে, কাদের তার জন্য দায়ী হওয়া উচিত এবং কাদের আসল ফলটা ভোগ করার কথা? বন্ধু, এ তত্ত্বগুলো সুবিধাভোগীদের আবিষ্কার। এই সব তত্ত্বের দ্বারা তারা তাদের দখলীকৃত ক্ষমতা, সম্পদ ও কৌলীন্য সমর্থন করে। সম্ভবত আপটন সিনক্লেয়ারই কোথাও লিখেছিলেন যে, কোন মানুষকে একবার শুধু অমরত্বে বিশ্বাসী করে তোলো এবং তারপর তার থেকে সমস্ত সম্পত্তি লুটে নাও। সে তোমায় নির্দ্বিধায় সাহায্য করবে। ধর্মপ্রচারক ও ক্ষমতালোভী শাসকদের মিলিত স্বার্থের প্রয়োজনে জেলখানা, ফাঁসিমঞ্চ, চাবুক ও এ ধরনের তত্ত্বগুলো আমদানি হয়েছে।


যখন কোন মানুষ কোন পাপ বা অপরাধমূলক কাজ করছে, তখন কেন আপনাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাদের সবাইকে থামিয়ে দিতে আসেন না? তিনি তো খুব সহজেই এটা করতে পারেতেন, কেন তিনি যুদ্ধবাজদের অন্তরেই যুদ্ধোন্মাদনাকে নিঃশেষ করেন না এবং মহাযুদ্ধ মানবতার ওপর যে দুর্যোগ নিয়ে আসে, কেন এভাবে তিনি তা পরিহার করেন না? কেন তিনি ব্রিটিশ জাতির অন্তরে ভারতবর্ষের স্বাধীন করে দেওয়ার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলেন না? কেন তিনি পুঁজিপতিদের অন্তরে একটুখানি ভাল কাজ করার উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন না যাতে তারা সামাজিক উৎপাদনের হাতিয়ারগুলোর উপরে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার পরিত্যাগ করতে পারে এবং এইভাবে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে - না, সমগ্র মানবসমাজকেই পুঁজিবাদী বন্ধন থেকে মুক্তিদান করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে আপনারা আলোচনা করতে চান, আমি আপনাদের সর্বশক্তিমানের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিলাম। সামগ্রিক মঙ্গলসাধন যখন বিবেচ্য তখন সমাজতন্ত্রের গুণাবলী সবাই স্বীকার করেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয় এই অজুহাতে তারা এর বিরোধিতা করেন। সেই সর্বশক্তিমানকে এসে সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে সাজাতে বলুন। উল্টো-পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না কাজ হবে না। আমি বলতে - চাই, ঈশ্বর ইচ্ছা করেন বলেই ব্রিটিশ রাজ এখানে আছে এমন নয়। বরং বলা যায় তারা এখানে আছে কারণ তাদের ক্ষমতা আছে এবং তাদের বিরোধিতা করার মতো সাহস আমাদের নেই। ঈশ্বরের সাহায্যে নয়, বন্দুক ও রাইফেল, বোমা, গুলি, পুলিস ও সেনাবাহিনীর সাহায্যেই তারা আমাদের অধীন রেখেছে এবং আমাদের অনীহার জন্যই এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির জঘন্য রকমের শোষণের মতো একটি নগ্ন সমাজ-বিরোধী পাপ তারা সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে পারছে। কোথায় ঈশ্বর? কী করছেন তিনি? মানবজাতির এই দুর্দশা কি তিনি উপভোগ করছেন? তিনিও তো এক নিরো, তিনি এক চ্যাঙ (চেঙ্গিস), নিপাত যান তিনি।


এই পৃথিবীর উৎপত্তি, মানবজাতির উৎপত্তি আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করি সে সম্পর্কে কি আপনারা প্রশ্ন করেছেন? ঠিক আছে, আমি আপনাদের বলি, চার্লস ডারউইন এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন, তাঁর লেখা পড়ুন। সোহম স্বামীর “সাধারণ জ্ঞান” পড়ুন। কিছুটা পরিমাণে তাতে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর মিলবে। এ হল প্রাকৃতিক ঘটনা। বিভিন্ন রকমের গ্যাসীয় পদার্থের আকস্মিক সংমিশ্রণের ফলে এ জগতের উদ্ভব হয়েছে। কখন? ইতিহাস পড়ুন। একই প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে জীবজন্তুর এবং দীর্ঘদিন পরে মানুষের। ডারউইনের Origin of Species পড়ুন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিরাম দ্বন্দ্ব ও তাকে উত্তরণ করার প্রচেষ্টা থেকেই পরবর্তীকালে সমস্ত রকমের প্রগতি, এ ঘটনার এই হল সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সম্ভবপর ব্যাখ্যা।


আপনারা আর একটা প্রশ্ন তুলতে পারেন যা কিন্তু আসলে বাচ্চাদের মতো, যদি ঈশ্বর না-ই থাকেন তাহলে মানুষ কি করে তাকে বিশ্বাস করে? আমার উত্তর সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার। যেভাবে তারা ভূত ও অশুভ আত্মায় বিশ্বাস করতে শিখেছে, সেভাবেই তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেও শিখেছে। শুধুমাত্র তফাৎ হল এটাই যে, ঈশ্বর বিশ্বাস প্রায় সর্বজনীন এবং এই দর্শনটাও বেশ উন্নত। অন্য কিছু প্রগতিপন্থীর মতো এ কথা আমি বলি না যে, ঈশ্বরের আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে শোষকদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা যারা এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রচার করে মানুষকে নিজেদের অধীন রাখতে চেয়েছিল ও দাবি করেছিল যে তাদের সুবিধাভোগী অবস্থানের পেছনে সেই পরম সত্তার অনুমতি বা সম্মতি আছে। মৌল প্রশ্নে এই মতের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই যে, সমস্ত ঈশ্বর বিশ্বাস, ধর্ম, ধর্মমত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরবর্তীকালে অত্যাচারী ও শোষক প্রতিষ্ঠান মানুষের সমর্থকে রূপান্তরিত হয়। সমস্ত ধর্মমতে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সব সময়ই পাপ।


ঈশ্বরের উৎপত্তি নিয়ে আমার নিজের মত হল এটাই যে, মানুষের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে এবং তার দুর্বলতা ও অক্ষমতা বিবেচনা করে কল্পনায় ঈশ্বরের সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহসের সঙ্গে বিপজ্জনক সমস্ত ঘটনার মুখোমুখি হতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য এবং প্রতিপত্তি ঐশ্বর্যে তার যে বিস্ফোরণ তাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তার ব্যক্তিগত বিধিনিয়ম ও পৈত্রিক উদারতা সহ ভগবানের চিত্রটি বিশেষভাবে কল্পনা করা হয়েছে ও আঁকা হয়েছে। তাঁর ঐশ্বরিক শক্তি ও রুদ্ররোষের কথা এই কারণে বলা হয়, যাতে মানুষের ক্ষোভ প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার পক্ষে বিশেষ বিপদের কারণ হয়ে উঠতে না পারে। ঈশ্বরের এই প্রতিরোধক শক্তির কথা এইজন্যই বলা হয়।


আর যখন তাঁর পিতৃসুলভ গুণাবলীর প্রশান্তি কীর্তন করা হয় তখন তাঁকে কখনো বাবা, কখনো মা কখনো ভাইবোন বা রক্ষাকারী বন্ধু রূপেই তাঁকে তুলনা করা হয়।

বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত, আত্মীয়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে মানুষ যখন চরম বিপদের মুখে পড়ে, তখনই এই ভেবে শান্তি ও সান্ত্বনা পায় যে, সবসময় একজন পরম বন্ধু আছেন যিনি অবশ্যই দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কারণ, তিনি 'সর্বশক্তিমান' ও 'বিপদত্তারণ'।..... এবং তিনি 'ইচ্ছাময়'। ইচ্ছা হলেই তিনি এসে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।


প্রকৃতপক্ষে সমাজ সৃষ্টির আদিম যুগে হয়তো এর দরকার ছিল। তখন মানুষের দুঃখ বিপদে ‘ঈশ্বর' বড়োই এক সহায়ক শক্তি বা দারুণ ওষুধ ছিল।


এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা যুদ্ধ- ঘোষণা করে যেতে হবে। সেইসঙ্গে পুতুল-পূজা বা ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যখন মানুষ নিজের পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখবে এবং সত্যিকারের বাস্তববাদী হবে, তখন এইসব বিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সত্যিকারের মানুষের মতোই যতকিছু দুঃখ-কষ্ট ও সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করতে পারবে।


এই হল আমাদের বর্তমান অবস্থা। তাই বন্ধুরা, এটা আমার অহংকার নয়, এটা হল আমারই নিজস্ব চিন্তার পদ্ধতি যার ফলে আমি নাস্তিক হয়ে উঠেছি।


যে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও প্রতিদিনের প্রার্থনাকে আমি বড়ই স্বার্থপরতা ও হীনতার উদাহরণ বলে মনে করি, সেই ঈশ্বর-বিশ্বাস ও প্রতিদিনের প্রার্থনা আমার বর্তমান অবস্থার পক্ষে সহায় হবে না। আরও শোচনীয়তার কারণ হবে, তা আমি জানি না।


আমি বই পড়ে জেনেছি যে, নাস্তিকরা সব বিপদে সাহসের সাথেই রুখে দাঁড়ায়। ফলে, আমিও সমস্ত বিপদকে তুচ্ছ করে শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করেই দাঁড়াতে চাই, এমন কি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও। দেখা যাক, আমি তা পারি কি না। একজন বন্ধু আমায় প্রার্থনা করতে বলেছেন। তিনি বললেন 'তোমার জীবনের শেষ দিনগুলোতে তুমি আবার বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবে'। আমি বলেছি ‘না আমি তা পারব না। আমার পক্ষে সেটা হবে একটা অধঃপতন ও নিজেকে ঠকানো কাজ, স্বার্থপর হওয়ার জন্যে আমি প্ৰাৰ্থনা করতে পারব না।' পাঠক ও বন্ধুরা, এটা কি আমার দম্ভ? যদি তাই হয় তাহলে বলি আমি তার পক্ষে।


প্রসঙ্গ যখন ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’ ও ‘বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা’ -জাহিদ রুদ্র
Nov. 27, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:685 | likes:0 | share: 1 | comments:0

“বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, বিজ্ঞান হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালদ্ধ পদ্ধতি যা জ্ঞানকে তৈরিপূর্বক সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। ল্যাটিন শব্দ সায়েনটিয়া থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ জ্ঞান।" আবার, আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায়, দর্শন হতেই বিজ্ঞানের উন্মেষ। যদিও আমরা বর্তমানে দেখতে পাই দর্শন ও বিজ্ঞান দুটি পৃথক পদ্ধতিগত শিক্ষা। তথাপি দার্শনিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অভিন্ন নয়। হয়ত নীতিগতভাবে এদের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য থাকার কথা ছিল না। 'কারণ প্রাচীনকালে সভ্যতার ঊষালগ্নে আমরা বিজ্ঞানকে দার্শনিক বিষয়বস্তু হিসেবেই আলোচিত হতে দেখি। তখন বলা হতো, Natural Philosophy বা ভৌত দর্শন। নিউটনের ‘ন্যাচারালিস ফিলোসফিয়া প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ এর প্রমাণ। পদার্থবিজ্ঞানে যুক্তির প্রয়োগ, আরোহী-অবরোহী পদ্ধতির প্রয়োগ – এসবই দার্শনিক ভাবপ্রসূত। কিন্তু ক্রমশ গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান শাস্ত্রীয় দর্শন থেকে আলাদা হয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে।'


'সুতরাং, বিজ্ঞান শব্দটির সবচেয়ে সরলীকৃত অর্থ হলো- বিজ্ঞান হচ্ছে একটি দর্শন, যে দর্শনের মূল ভিত্তিই হলো প্রশ্ন করা ও কার্যকরণ অনুসন্ধান করা।' এবং, এককথায় বিজ্ঞানমনষ্কতা বলতে সেই দুটি বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় যা বিজ্ঞানকে ধারণ করতে অপরিহার্য। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো – প্রশ্ন করার প্রবণতা এবং কার্যকরণ অনুসন্ধানের প্রবণতা। সুতরাং, যে ব্যক্তি অন্তরে উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করবেন তিনিই বিজ্ঞানমনষ্ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এজন্য বিজ্ঞানের ছাত্র হবার প্রয়োজন নাই। যেমন: পেরিয়ার, আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদ, কেউই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। দর্শন ও সাহিত্যের ছাত্র হয়েও তাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তেমনি স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। তিনিও স্বেচ্ছায় প্রশ্ন ও কার্যকরণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রমাণ রেখেছেন। একই কথা প্রযোজ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেলায়ও। তিনিও বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। কিন্তু, তিনি গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন শিশুদের। শিখিয়েছেন আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির কার্যকরণ।


অপরদিকে, “বিজ্ঞানশিক্ষা” শব্দটি শুধুমাত্র পদ্ধতিগত এবং সীমাবদ্ধ বিজ্ঞান শিক্ষাকেই বুঝায়। এটি সাবজেক্ট ও সিলেবাসনির্ভর নিতান্তই সীমিত পরিসরে বিজ্ঞানের কিছু কার্যকরণকে আয়ত্ব করার শিক্ষা। রাষ্ট্রপ্রণীত “শিক্ষা” সর্বদাই নির্দিষ্ট। এর গতিপথ নির্দিষ্ট এবং নিয়ন্ত্রিত। যেকেউ এই নির্দিষ্ট গতিপথে চলে, নির্দিষ্ট সিলেবাস মুখস্থ করে “বিজ্ঞানশিক্ষা” সম্পন্ন করে দক্ষ কর্মী হতে পারে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী একেকজন কর্মী উৎপাদন নিশ্চিত করে। এতে সেই কর্মীটি অন্তরে আদৌ প্রশ্ন করার এবং অনুসন্ধানের ক্ষমতা রাখেন কিনা – সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। বস্তুত, এই বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশকে শিক্ষাব্যবস্থা তেমন গুরুত্ব দেয় না। একজন ব্যক্তির মনের মধ্যে প্রশ্ন করার ক্ষমতা এবং অনুসন্ধানের স্পৃহা জাগবে কি জাগবে না তা নির্ভর করে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশের উপরে।


এবারে আরও একটি ঘটনার কথা বলি যা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, পদ্ধতিগত “বিজ্ঞানশিক্ষা” কিভাবে একজন ব্যক্তিকে বিজ্ঞানমনষ্ক করতে ব্যর্থ হয়। ক্লাস টেনের যখন আমি ছাত্র ছিলাম। তো, আমাকে বাসায় সাইন্স ও ম্যাথস পড়াতেন পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি আমাকে খনিজ পদার্থের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, হাজার বছর ধরে গাছপালা মাটির তলায় পড়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এইসব খনিজ মজুত হয়েছে – এসব শুধু পড়ার জন্য পড়ো, কিন্তু বিশ্বাস করো না। কারণ, ধর্মগ্রন্থে স্পষ্ট আছে, এইসব স্রষ্টার দান।

অর্থ্যাৎ, তিনি নিজে বিজ্ঞানচর্চা করেছেন ঠিকই, কিন্তু, বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারেন নাই। এবারে তিনি আমাকে বিজ্ঞানচর্চা করতে বলছেন ঠিকই কিন্তু বিজ্ঞানমনষ্ক হতে রীতিমত বাধা দিচ্ছেন! এইভাবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বাধাগ্রস্থ হয় পদে পদে। (যদিও আমি পরবর্তীতে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করি) 'বিজ্ঞানমনষ্কতা ও বিজ্ঞানশিক্ষার মধ্যকার এই যে দ্বৈরথ তা মানুষকে বিজ্ঞানমনষ্ক হতে বাধা দেয়। বিজ্ঞানশিক্ষা হলো প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার একটি অংশবিশেষ। তাই, বিজ্ঞানমনষ্কতা এবং বিজ্ঞানশিক্ষা পুরোপুরি দুইধরণের কথা বলে। বিজ্ঞানমনষ্কতা মানুষকে বলে সম্ভাবনার কথা। আর বিজ্ঞানশিক্ষা বলে সীমাবদ্ধতা ও শর্টকাটের কথা। অর্থাৎ, কোন পথে, কতটুকু বিজ্ঞান শিখলে দক্ষ টেকনোলজিস্ট হওয়া যাবে এবং কোন কোন পথে যাওয়া বারণ। 


“শিক্ষা” সামগ্রিকভাবে একটি প্যাকেজ, যেখানে জ্ঞানের বহু শাখার অল্প অল্প তথ্য সীমাবদ্ধ করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ হলো রাষ্ট্রপ্রণীত একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থী মূলত রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিখছে, প্রকৃতির কাছ থেকে নয়। বিজ্ঞানশিক্ষাও এইরকম একটা প্যাকেজ। এখানেও রয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে স্রেফ দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশেষ সিলেবাস এবং লিমিটেড পাঠদান। অপরপক্ষে, বিজ্ঞানমনষ্কতা রাষ্ট্রনির্ভর কোনো বিষয় নয়, প্রকৃতিনির্ভর বিষয়। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নাই, এতে রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত যাচাই করার সুযোগ।

অপরদিকে শিক্ষাব্যবস্থা তথা বিজ্ঞানশিক্ষার কেবলমাত্র দুটি উদ্দেশ্য – পরীক্ষার নম্বর ও অর্থসংস্থান। এই অর্থসংস্থান হলো বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে করে খাওয়ার নিছক শিক্ষা, কোনো দর্শনের উন্মেষ ঘটানো এর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বৈজ্ঞানিক দর্শনের উন্মেষ বস্তুত সকল বিষয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, এমনকি তা শাসককেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ছাড়ে না। আর শাসক প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া মানে শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। মুক্তচিন্তার উন্মেষ মানেই সকল পদ্ধতিগত, সীমিত জ্ঞানচর্চার বিলোপ। সুতরাং, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ বিজ্ঞানশিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা এমনকি খোদ রাষ্ট্রের জন্যেও একটি বিপদজনক বিষয়ই হয়ে দাঁড়ায়।'


কিন্তু, বিজ্ঞানশিক্ষা কেবলমাত্র বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্ব শেখায়। সেগুলো মানুষকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে না, ফলে শাসক থাকেন নিরাপদ। শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানশিক্ষা বলতে আমি শুধু দেশের পরিপ্রেক্ষিতকে বুঝাচ্ছি না। “শিক্ষাব্যবস্থা” বা “বিজ্ঞানশিক্ষা” – এসবের প্রকৃতি সমগ্র পৃথিবীতেই কমবেশী একইরকম। খোদ ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে জর্জ বার্নাড শ বলেছিলেন, “একজন ছাত্রকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী দেওয়া হয় কখন? যখন সেই ছাত্র একটা তথাকথিত শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত সে নিজের সম্বন্ধে ভাববার সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেল তখন।”


শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক শিক্ষাকেও সীমাবদ্ধ করে বিজ্ঞানমনষ্কতাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টাও স্পষ্ট। দেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় দীর্ঘদিন বিশেষ কোনো ব্যবহারিক বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থাই ছিলোনা। "এজন্য খোদ বিজ্ঞানশিক্ষাও বেশ প্রকাশ্যেই সমাজে চলে আসা হাজার বছরের ধর্মশ্রায়ী কুসংস্কারগুলোকে ধারণ করে, এদের রদ করার চেষ্টা করে না। স্রেফ টেকনোলজিতে দক্ষ কর্মী উৎপাদনের জন্য কুসংস্কারকে দূরীকরণের প্রয়োজনও নাই। তাই, খোদ বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। তাঁরাই বয়ে বেড়ান ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কার। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মনে সেইসব কুসংস্কারের বীজ বপন করে দেন। পরিবার থেকেও শিক্ষার্থীরা পায় নানান ধরণের ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কারের শিক্ষা। ফলে, উচ্চতর শিক্ষায় দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পেলেও ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে জেঁকে বসা কুসংস্কারগুলো বিজ্ঞানকে মনের মধ্যে আলোড়িত করতে বাধা দেয়।"


আবার, আরেকটু ভিন্নচিত্রও দেখা দেয়। যদি আমরা ধরে নেই এইসব শিক্ষার্থীর জীবনে ধর্ম একটা বিরাট প্রভাব ফেলে, তারা ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলে – তাহলেও ভুল হবে। এটা শুধু ধর্মপ্রেম নয়। এ হলো নিখাঁদ কুসংস্কার, নিখাঁদ গোড়ামী। ব্যক্তিগত জীবনে এদের বেশীরভাগও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি নির্ভরশীল নয়, শুধুমাত্র বিজ্ঞানশিক্ষার বেলায় ঘটে সংঘাত, তাও কিছু কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নে – যেমনঃ কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, ভূগোল ইত্যাদি।


"এতো গেল ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কারগ্রস্থদের কথা। আবার, এমনও বিজ্ঞানশিক্ষার্থী দেখা যায় যারা হয়তো বিজ্ঞানচর্চায় পারদর্শী কিন্তু নিজেরা বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। অর্থ্যাৎ, উদ্ভাবনীর দিকে এদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এরা দক্ষ বিজ্ঞানকর্মী হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই বিজ্ঞানী নয়। এরকম উদাহরণ ভরি ভরি যেখানে শিক্ষার্থীর একাডেমিক রেজাল্ট দুর্দান্ত, কিন্তু, তারা মোটেও বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। তারা বিজ্ঞানকে আয়ত্ত্ব করতে পারে, তত্ত্বের মারপ্যাঁচ, জটিল-কঠিন সমীকরণ বুঝতে পারে, তা দিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টও করতে পারে কিন্তু, সৃজনশীলতার বেলায় অত্যন্ত কাঁচা। অর্থ্যাৎ, জানাশোনা সমীকরণ, জানাশোনা সমস্যা এরা সমাধান করতে পারে, কিন্তু উদ্ভাবনী শক্তি গড়পড়তা নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানশিক্ষার পরেই এদের লক্ষ্য থাকে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা অথবা বিদেশে পাড়ি জমানো। আমাদের দেশের সর্বোপরি বিজ্ঞানশিক্ষার যে চল, যে কাঠামো রয়েছে সেটাই এই সৃষ্টিশীলতাকে নষ্ট করার জন্য দায়ী বলে মনে হয়। তাছাড়া, আমাদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, ওয়ার্কিং সেক্টরের অভাব এসবও গভীরভাবে জড়িত। এসব ছাড়াও আরও একটি ব্যাপারকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তা হলো, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানশিক্ষা একটি এলিট স্থান অধিকার করেছে। এখানে ছেলেমেয়েদের চাপ দিয়ে বিজ্ঞান পড়তে দেওয়া হয়। অনেকের হয়তো থাকে না যথেষ্ট আগ্রহ। তাছাড়া সেই পুরাতন কুসংস্কারগুলোকেও আরও সযত্নে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে বাধ্য করে এই ভাবতে যে – কোনোমতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারলেই হলো, তাহলেই মিলে যাবে একটা চাকুরী। এইরকম মানসিকতা থেকে বিজ্ঞানকে শুধু চর্চা করাই হয়, নিজেকে শুধু কর্পোরেট জগতের জন্য প্রস্তুত করাই হয় কিন্তু, প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার ফলে মস্তিষ্কে যে যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনষ্কতার অনুরণন ঘটার কথা, তা আর ঘটার সুযোগ পায় না। কুসংস্কার, অপশিক্ষা আর রাষ্ট্রীয় দৈন্যের ফলে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায় এইদেশের বেশীরভাগ শিক্ষার্থীর

বিজ্ঞানমনষ্কতা; বিজ্ঞান আটকে যায় সীমিত পরিসরের মধ্যে। বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনষ্কতা এক জিনিস নয়। বিজ্ঞানমনষ্ক একজন ব্যক্তি সর্বদাই স্বশিক্ষিত এবং শুভব্রতচারী। তাঁরা যদিও জনহিতকর কাজে নিয়োজিত থাকেন। বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ জাগ্রত হতে বাধ্য। আর, স্বাধীনতাবোধ কর্তৃত্বতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী চেতনা। এতে রাষ্ট্র নামক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ সমাজের সংস্কার সাধন করেন ঠিকই তথাপি খোদ রাষ্ট্রই তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। আবার, উল্টোদিকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে টেকনোলজির প্রতি অন্ধমোহ সৃষ্টি করে। আর, টেকনোলজির প্রতি অন্ধমোহ পারমাণবিক বোমার জন্যও ভালোবাসার জন্ম দিতে পারে। বিজ্ঞানকে তাই ক্ষুদ্র পরিসরে আটক করে ফেললে তা জন্ম দেবে স্রেফ চমকপ্রদ কর্পোরেট খেলনার। এসব খেলনা দিয়ে মানুষ খেলবে ঠিকই, পয়সাও আসবে বহুত, কিন্তু, সংস্কার ভাঙবে না।

আস্তিক-নাস্তিক -বুবাই মান্না
Nov. 27, 2024 | যুক্তি | views:823 | likes:2 | share: 2 | comments:0

অনেকদিন আগের ঘটনা! একজন মুসলিম বাড়ির বউ আরেকজন হিন্দু বাড়ির বউ একই দিনে একই হসপিটালে বাচ্চা প্রসবের দিন ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ওইদিন ইলেক্ট্রিক না থাকায়, অন্ধকারে ২ পরিবারের বাচ্চা অদলবদল হয়ে যায়। ২টো বাচ্চা পুত্র সন্তানই ছিলো। সেই থেকে মুসলিম বাড়ির ছেলে হিন্দু বাড়িতে আর হিন্দু বাড়ির ছেলে মুসলিম বাড়িতে রীতিমত বড়ো হয়। একটা সময় পর, তারা বিয়ে করে সংসার জীবন করে। ২ জনের পরিবার খুব খুশি এই ভেবেই যে ওরা যে যার নিজ নিজ ধর্মে একটুও আঘাত ঘটায়নি। ধর্মের প্রতি দুই পরিবার একদম অটুট। শিবের মাথায় জল ঢালা থেকে ঈদের আগে ১ মাস রোজা রাখা ইত্যাদি যে যার ধর্মী় কাজ খুশি মনে করে যাচ্ছেন আর এটাই ভাবছেন যে ভগবান কিংবা আল্লাহ  যে যার পরিবার কে বাঁচিয়ে রাখছে, পরিবারের মঙ্গল করছে ইত্যাদি। একদিকে মুসলিম ছেলের পরিবার (আসলে ওনারা হিন্দু) খুশিতে গরুর মাংস খাচ্ছে, আরেকদিকে হিন্দু ছেলের পরিবার (আসলে ওনারা মুসলিম) খুশিতে জবাই না করে চিকেন খাচ্ছে কিংবা শুকরমাংস খাচ্ছে। কিন্তু কারোর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারোর মনের মধ্যে কোনো ধর্মীয় ভয়ও নেই। কে আস্তিক আর কে নাস্তিক? মুসলিম ছেলেটা আস্তিক যে হিন্দুরীতি মেনে চলছে নাকি হিন্দু ছেলেটা যে মুসলিমরীতি মেনে চলছে? নাকি দুটো পরিবার নাস্তিক?


 সমস্যাটা ওখানেই। মানুষের মনের মধ্যে সমস্যা। মনের সমস্যা। মানুষ যদি ভেবে নেয় যে হিন্দু গরুর মাংস খেলেই বিপদ ঘটবে তাহলে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু ঘটনা ঘটলে প্রথমে ওটাই মনের মধ্যে আসে যে সেদিন গরুর মাংস খেয়েছিলো বলেই আজকে এমন অঘটন ঘটল, কিন্তু শুধুমাত্র গরুর দুধ খেলে এমন ঘটনা হতনা। ঠিক মুসলিমদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার যে হালাল করে মাংস খায়নি তাই অঘটন ঘটল কিংবা রোজা রাখেনি তাই হয়েছে, কিংবা শুকরমাংস খেয়েছিল বলে ইত্যাদি ইত্যাদি।


পাকিস্তানে কত হিন্দু কে জোর করে মুসলিম ধর্মে রূপান্তর করা হয়েছে। সেই হিন্দুরা বুঝি আজ হিন্দুর ভগবানের থেকে অভিশাপ পেয়েছে? ১৯৭১ সালে দেশ ভাগের আগে বাংলাদেশে কত হিন্দুকে জোর করে মুসলিম করা হয়েছে, তাদের বুঝি এখন হিন্দুদের ভগবান থেকে অভিশাপ পেয়ে জীবন ধংস হয়ে গেছে?


পৃথিবী সৃষ্টির আগে প্রাণের অস্তিত্ব ছিলোনা। তারপর ধীরে ধীরে ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতি দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মানুষ একটা প্রজাতি। পরিবর্তন হচ্ছে। কত প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে। আবার কত নতুন প্রজাতি এসেছে। ডাইনোসর পৃথিবী থেকে উধাও হওয়ার আগে মানুষের উৎপত্তি ছিলোনা। তখন বুঝি মানুষরূপী ভগবানের পরিবর্তে ডাইনোসররুপী ভগবান ছিলো? তারপর সেই ডাইনোসররুপী ভগবান ডাইনোসর প্রজাতিকে নিষ্পত্তি ঘটালো? তারপর মানুষের প্রজাতি এলো। সেটা ঠিক মানুষ না। বানর এলো। পরিবর্তনের ধারায় সেই বানর আজকে মানুষে পরিবর্তন হয়েছে। ধীরে ধীরে মানুষের ও পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষদের চেহারার পরিবর্তন আসছে। সব কিছুর পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তনের মাঝে কিন্তু সবাই বসবাস করছে। কতদিন? কতদিন বসবাস থাকবে? একটা মানুষের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ১০০ বছর। অন্যপ্রাণীরা এটাও জানেনা যে তারা কতদিন বাঁচে! এটাও জানেনা যে একদিন মানে আসলে কি? "ওহ পৃথিবী তার নিজের চারদিকে একবার লাট্টুর মত ঘোরা?" আচ্ছা এই ব্যাপার! কিন্তু পৃথিবী কি জিনিষ? এটাও জানেনা। ওদের জানার দরকারও পড়েনা। ওদের যেটা দরকার সেটা হচ্ছে বাসস্থান, আর খাদ্য। আর কিছু দরকার পড়েনা। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি বেশি। "ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে"। আর কম মানছে বলেই এত সমস্যা। তাই মানুষ আজ নিজ নিজ দেশ বানিয়েছে, নিজ নিজ বাসস্থান থেকে শুরু করে সব কিছু বানিয়েছে। মেডিক্যাল সাইন্স, টেকনোলজি ইত্যাদির ব্যাবহার শুরু করেছে। অনেক সময় লেগেছে ঠিকই। আরো লাগবে। কিন্তু যাই করুক না কেনো এই পৃথিবীর বুকেই হচ্ছে। সেই গোলাকার বস্তুটার ওপরেই হচ্ছে। আমরা কিন্তু সেই একটা প্রজাতি। "প্রজাতি"। ভগবান না। ভগবান - আল্লাহ আর বাকি সব ধর্মের ভগবান বলে কেউ নেই। ছিলো না। থাকতে পারেনা। মানুষের মধ্যে অলৌকিক শক্তি থাকতে পারেনা। মানুষ আরো ৫টা প্রাণীর মতোই, আরো ৫টা প্রজাতির মতোই। মানুষ ভগবান্ হলে মানুষের অস্তিত্ব সবার আগে হতো। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে সবার থেকে মানুষের শুধু বুদ্ধি বেশি। আর বুদ্ধির জোরেই এতো কিছু গড়ে উঠেছে আর তার সাথে সাথে আজ নানান ধরনের ধর্মের ভগবানের আবির্ভাব ঘটিয়েছে মানুষ। এটাও একটা ব্যবসা। এই বিশ্বে ধর্ম নিয়ে সব থেকে বেশি ব্যাবসা চলছে এখন। মানুষ না খেতে পেলেও, টাকার অভাবে ছেলে পুলেকে পড়াশুনা না করতে পারলেও ধর্মের নামে যে মানসিক আছে সেটা সেই টাকা খরচ করে শোধ করেন। আর সেই জন্যই, মানুষ জন্ম নিলেই তাকে ধর্মের ইনজেকশন দেওয়া হয়। আর তখন থেকেই সে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি গোড়ামি শুরু করে, কিন্তু সেই ইনজেকশনটা অন্যকোনো ধর্মের হলে তখন অন্যধর্মের গোড়ামি করতো ঠিক যেমন হিন্দু মুসলিম বাড়ির বাচ্চা অদলবদল হওয়ার ঘটনা।

শিব রাত্রি পালন করা নারী জাতির কলঙ্ক নয় কি? -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 27, 2024 | ধর্ম | views:1022 | likes:11 | share: 6 | comments:1

নারীরা এতো ভক্তি সহকারে এতো নিষ্ঠা ও উন্মাদনার সাথে যে শিব-রাত্রি পালন করে, তার ইতিহাসটা কি তারা জানে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা যদি শাস্ত্রগ্রন্থগুলি পড়ত বা জানত তাহলে এতো অশ্লীল-অসভ্য-বর্বর কর্মটি তারা কিছুতেই করতে পারত না। যে সব নারীরা শিব পূজা বা শিবরাত্রি পালন করে তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য, আগে ধর্মশাস্ত্রগুলি পাঠ করুন, তারপর যদি রুচিতে বা সম্মানে না লাগে তবে শিবরাত্রি পালন করুন।

এবার জানুন শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে শিবের চরিত্র সম্পর্কে বা শিবরাত্রি পালন সম্পর্কে কি ইতিহাস আছে----- শিবের চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থে বিভিন্ন রকম বর্ননা থাকলেও কাহিনী বা ঘটনা ধারা মোটামুটি প্রায় একই রকম।

শিব সম্পর্কে বর্ননা পাই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ, গড়ুর পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, নারদ সংহিতা, শিব উপাখ্যান, শিবায়ন ---- মূলত এই কয়েকটি গ্রন্থে।

এই গ্রন্থগুলিতে যেরকম বর্ণনা পাই তা হল, শিব অত্যন্ত কামুক, দুশ্চরিত্র, ব্যভিচারি, নেশাগ্রস্থ, অপরিচ্ছন্ন, বিকৃতি রুচির। সর্বদা গাজায় আসক্ত থাকে।

দিনের বেলায় "কুচনি" নামক বেশ্যা পল্লীতে সে পড়ে থাকে। তার দশ সহস্রাধিক উপপত্নী রয়েছে।

এই নিয়ে তার সর্বক্ষনের গৃহবিবাদ। সন্ধ্যার পরে চিতার ছাই মাখিয়ে, গাজায় টান মেরে শ্মশানে পড়ে থাকে।

অধিকাংশ রাতেই বাড়ি ফেরে না। কখনো কখনো মৃতের পচাগলা মাংস ভক্ষন করে।

পোশাক বলতে দিনের বেলায় শুধু কোমরে বাঘের ছালটুকু,আর রাতে উন্মাদ -- বস্ত্রহীন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শিবলিঙ্গ পূজা বা শিবরাত্রি পালন সম্পর্কে যে কাহিনী পাই তা এতোটাই অশ্লীল-কদর্য, যা বর্ননারও অযোগ্য। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "উপনিষদের ভাষ্য" গ্রন্থে এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন - "ইহা রতিশাস্ত্রকেও হার মানাইয়া দেয়, - এতটাই কুরুচিসম্পন্ন" (পাতা- ৯৬, পঞ্চম সংস্করন)।

অতি সংক্ষেপে কাহিনীটি হলো -"কামাতুর শিবের কামনার আগুন থেকে সতীত্ব-নারীত্ব বাঁচাতে সমস্ত নারীরা স্বর্গ ছেড়ে পালাতে থাকে। দিন-ক্ষণ নেই, নেই স্থান-কাল-পাত্রীর বিবেচনা। শিবের সম্মুখে পড়লেই তাদের রক্ষে নেই।

এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে সমস্ত নারীরা ব্রহ্মার কাছে গেল। ব্রহ্মা তাদের কোনও পরামর্শ না দিতে পেরে বিষ্ণুর কাছে পাঠিয়ে দেয়।

অবশেষে বিষ্ণুর কাছে গেলে তিনি নারীদের পরামর্শ দিয়ে বলে, যখন শিব তাদের নারীত্ব হনন করবে তখন শিবের লিঙ্গ ছেদ করে দিতে হবে এবং ঐ ছেদ করা লিঙ্গকে বেলপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে শান্ত করবে ----- তবেই শিবের কামনাকে দমন করা যাবে।

বিষ্ণুর কথামতো নারীরা একদিন অতি সুকৌশলে ও গোপনে শিবের লিঙ্গ (যৌনাঙ্গ) কেটে নেয়। কিন্তু কিছুতেই শিব লিঙ্গকে শান্ত করা যাচ্ছে না।

এমতাবস্থায় নারীরা পুনরায় বিষ্ণুর কাছে গেলে সে পরামর্শ দিয়ে বলে যে, এই কাটা লিঙ্গ শীল-নড়া দিয়ে থেঁতলে বেলপাতা দিয়ে চাপা দিতে হবে।

এভাবে অবশেষে শিবলিঙ্গ শান্ত হয় এবং শীল-নড়া দিয়ে থেঁতলে দেওয়ার ফলে শুধু বীর্য-দ্বার টুকু অক্ষত থাকে " (সূত্র -- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবদেবীর জন্মবৃত্তান্ত খন্ড, চতুর্থ সংস্করন, গীতা প্রেস, পাতা- ১৫৮ থেকে ১৬২, ১৬৬ থেকে ১৭২, ১৭৪)। পরবর্তীকালে শিবের এই বীর্য-দ্বারের পূজা করা হয়।

মার্কন্ডেয় পুরানের মৎস খন্ডে শিব সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ---" পাঁচ-ছয় দিবস শঙ্কর বাড়িতে না ফিরলে উমা কুচনি পাড়ার পতিতালয় হইতে লোক দিয়া ধরিয়া আনিবার আজ্ঞা দিতেন "(ষষ্ঠ সংস্করন, সত্যম পাবলিকেশন্স, পাতা- ২১৮)। "শিবায়ন" গ্রন্থে মাতাল শিবের একটি চমৎকার বর্ণনা পাই - "গাজার নেশায় শিবের দু'চোখ ঢুলুঢুলু, দু'পা টলছে, সারা গায়ে ছাইভস্ম মাখানো, শ্মশান থেকে পথ চিনে আসতে পারছে না, পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে ঢুকে পড়ছে।

অবশেষে প্রায় ভোর রাতে বাড়ি ফিরে স্ত্রী উমার পা ধরে মা মা বলে কাঁদতে শুরু করে "(বাংলায় অনুবাদ - দ্বিজ মাধব, দ্বিতীয় সংস্করন, পাতা- ৬১)। বিষ্ণুপুরাণের দক্ষযজ্ঞ পর্বে শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের সময়ের একটি মজার বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহলো - শিব বিয়ে করতে গিয়েছে।

কোমরে শুধু বাঘের ছাল, আর বেল্ট হিসেবে জড়ানো রয়েছে সাপ। শিব বিয়ের পিড়িতে বসলে শালিকারা মজা করার জন্য সাপের মাথায় গাছড়া ধরলে সাপ শিবের কোমর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে শিবের কোমর থেকে বাঘের ছাল পড়ে যায়। আর কি, শাশুড়ির সামনে ল্যাংটো শিব।

শিব সম্পর্কে এই হলো ধর্মগ্রন্থগুলির বর্ণনা। যে সব নারীরা শিবরাত্রি পালন করেন বা শিবলিঙ্গ পূজা করেন এবার তাদের কাছে আমার প্রশ্ন - আপনারা কি শিবের মতো পুরুষ স্বামী হিসেবে পেতে চান? আসলে ব্রাহ্মন্যবাদী সিস্টেমে আপনারা ব্রাহ্মন্যবাদের ক্রীতদাসী হয়ে বেঁচে আছেন।

তাই ভালো মন্দকিছু বিচার না করে, ইতিহাস না জেনে, শুধু অন্ধভক্তিতে ডুবে আছেন - সেখানে যুক্তি-তর্ক, বিদ্যা-বুদ্ধি সব অচল।

তাইbতো অশিক্ষিতা থেকে শুরু করে B.A., M.A. পড়া মেয়েরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষিকা, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ মেয়েরাও এই অন্ধ কুসংস্কারে ও অন্ধ ভক্তি বিশ্বাসে মেতে আছেন। এর বাইরে কিছু ভাবতেই চায় না তারা।

শিবরাত্রি পালন করব, অথচ স্বামী মদ-গাঁজা খেলে দুশ্চরিত্র - লম্পট হলে এতো রাগ-অশান্তি করা হয় কেন? আর এই ইতিহাস জানার পরেও যদি কোনও মেয়ে শিবরাত্রি পালন করে, তবে আত্মমর্যাদাহীন, জ্ঞান-বুদ্ধিহীন, অন্ধ কুসংস্কারগ্রস্থ নারী বলা উচিৎ নয় কি? পাথরের শিবলিঙ্গে হাজার হাজার বালতি দুধ না ঢেলে ঐ দুধ ক্ষুধার্ত শিশুকে খাওয়ানো অনেক অনেক ভালো কাজ নয় কি? হে নারী জবাব দাও।

বিভেদের বীজ ও স্থাপত্য ধ্বংস: বিজেপি ও বিবেকানন্দ -তন্ময়
Nov. 27, 2024 | রাজনীতি | views:1012 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কিছুদিন আগে 'রাজপুত উত্তম সভা' আয়োজিত দশেরার অনুষ্ঠানে মিরাটের সারতানা বিধানসভার দুবারের প্রাক্তন বিধায়ক হিন্দু কট্টরপন্থী সঙ্গীত সোম বলেন,শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এটি বন্ধ করতে ভবিষ্যতে রাজপুত সম্প্রদায়কে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এই দাবি অবশ্য নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানিয়েছেন। 


'গণবাণী'তে প্রকাশিত 'হিন্দু মুসলমান' নামক একটি প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,"..ন্যাজ যাদেরই গজায় তা ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক তারাই হয়ে ওঠে পশু।...মানুষ আর পশুতে পরিণত হয়েছে,তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে।...মনে হল পশুর ন্যাজ খসছে আর মানুষের গজাচ্ছে।"


বহুবছর আগে বিদ্রোহী কবি এই উক্তি করলেও তা আজও প্রাসঙ্গিক। চতুর্দিকে এই ন্যাজ গজানো রামভক্তের দল বিভেদের আগুনে মনুষ্যত্বের চিরন্তন আত্মীয়তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে চলেছে। 


বিবেকানন্দ বলেছিলেন," মুসলমানগন যখন ভারতবর্ষে প্রথমে আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল আর তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে। ইহার কোনো প্রতিকার না হইলে হিন্দু দিন দিন আরো কমিয়া যাইবে। শেষে আর কেউ হিন্দু থাকিবে না।...... অতএব ওঠো, জাগো, পৃথিবীর আধ্যাত্মিকতা রক্ষা করিবার জন্য বাহু প্রসারিত কর।" 

বিজেপির তাত্ত্বিকেরাও একই ধারণা পোষণ করেন। তারা মনে করেন খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। 


তাই জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে মৌলবাদ বিরোধী সাধারণ মানুষের চতুর্দিকে রচিত হল পরাধীনতার দেওয়াল। ক্ষমতার সার্চলাইট নিয়ম করে ঘুরতে শুরু করল। আমরা সকলেই নজরবন্দী হলাম।

ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতে,আধুনিক মানুষ আইনের নিশ্ছিদ্র বেড়ার ভেতর জন্মগ্রহণ করে। মানুষের দেহ ও মন দুটোই সর্বক্ষণিক নজরদারি মধ্যে আইনি নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

আমরা অবরুদ্ধ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার সব অবরুদ্ধ। কারণ ওরা সর্বক্ষণ নজর রাখছে।

ফুকো মনে করেন, ক্ষমতাতন্ত্রে বিচিত্রবিধি উপবিধি সন্দেহপ্রবণ পরিদর্শনের আওতায় স্কুল ব্যারাক হাসপাতাল ওয়ার্কশপ এর অবয়বে নজরদারির মধ্যে চলে আসে ব্যক্তির জীবন।


পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমজীবী জনতা নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত এতো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। পাশাপাশি এটাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে পুঁজিবাদ যখন ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হয় তখন চিন্তার জগতে অধ্যাত্মবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা, উগ্র জাতীয়তাবাদের স্টিমরোলার চালানো হয়। আর এই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে নজরদারি। চলে আক্রমণ। 


লেনিন আর স্তালিন এর দর্শন থেকে আমরা শিখি, পুঁজিবাদ তার প্রথম যুগে গণতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদী স্তরে এসে সেই পুঁজিবাদ এখন গণতন্ত্রকে,ব্যক্তি স্বাধীনতার গলা টিপে ধরছে। মিলিটারি এবং বুরোক্রেসির উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার ঝান্ডা প্রতি মূহুর্তে পদদলিত কর্দমাক্ত করছে।


ফুকো বলেছেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে ওপর নজর রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ ও রাজনৈতিক সমস্ত আচরণের কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয় সেই মাপকাঠি লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়।


গো-রক্ষা সমিতি, হিন্দু বহেন বেটি বাঁচাও সংঘর্ষ কমিটির মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তীব্র নজরদারি চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর। মাপকাঠি লঙ্ঘন হলে নেমে আসছে শাস্তির খাড়া। 


হিন্দু সমাজের ধর্মান্তকরণে আশঙ্কিত হয়ে স্বামীজি বলেছেন “এই দেখ না, হিন্দুদের সহানুভূতি না পেয়ে মাদ্রাজে হাজার হাজার পেরিয়া খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। মনে করিসনি কেবল পেটের দায়ে খ্রিস্টান হয়, হয় আমাদের সহানুভূতি পায় না বলে। অনাথ মেয়ে হাতে পড়লে তাদের আগে নিতে হবে। নইলে খ্রিস্টানরা সেগুলিকে নিয়ে যাবে।”

তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন,...আর কোনও লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করলে সমাজে শুধু একটি লোক কম পড়ে তা নয় একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়।

শত্রু বৃদ্ধি কি কেউ কখনও চায়? হিন্দুত্ববাদীরাও চায়নি। তাই শুরু হল শত্রুদের ওপর আক্রমণ এবং প্রয়োজনে হত্যা।

হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ করে খ্রিস্টান করা হচ্ছে শুধুমাত্র এই সন্দেহে হিন্দু মৌলবাদী শক্তি বজরঙ দল পুড়িয়ে মারে গ্রাহাম স্টেইন্স এবং তার ৬ আর ১০ বছরের দুই পুত্রকে। মুসলমান ছেলেরা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে সন্দেহে খোলা হয় একটি হেল্পলাইন। একটি ফোন নাম্বার দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসা হয় এমন ঘটনা ঘটলেই যেন হেল্পলাইনে জানানো হয়। আরএসএস ফয়সালা করবে। 


সংবিধানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেয়েদের মনে ভীতির সৃষ্টি করা হল। নিজে পছন্দ মত বিয়ে নৈব নৈব চ। চলল কড়া নজরদারি। 


ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে মহম্মদ আখলাখকে বাড়িতে ঢুকে পিটিয়ে মারা হল। গুরুতর আহত হলেন তার মা ও সন্তান। শ্রমিক মোহাম্মদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে খুন, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানের মৃত্যু, হরিয়ানায় কিশোর জুনেইদ খানকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, ট্রাকে করে গোমাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে জম্বু কাশ্মীরে উধমপুরে ট্রাক ড্রাইভার জাহিদ রসুলকে নৃশংস নিধন করা হল। হিমাচল প্রদেশ,হরিয়ানা সহ প্রায় সারা দেশে বিশেষ করে ভাজপা যেসকল রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেইসকল রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ধ্বংস হতে শুরু হল মনুষ্যত্ব, মানবতা। 

ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান এর মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বিবিসি বাংলাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ প্রধান মীরন বোরওয়ানকার। 


তিনি বলেছিলেন,"ইদানিং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে তা এদেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটাই তো দেখা যাচ্ছে। তাদের উপর হামলা হচ্ছে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না।


“ইয়ে তো স্রেফ ঝাঁকি হ্যায়,কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।” সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য কায়েমের উদ্দ্যেশ্যে ক্ষমতার আস্ফালনে উন্মত্ত করসেবকদের দ্বারা বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীদের নগ্ন উল্লাস। 


কাশ্মীর ভ্রমণকালে ক্ষীর ভবানী মন্দির দর্শনের পর স্বামীজী তার মনের ভাব যে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শিষ্যার কাছে প্রকাশ করেছিলেন সেটা হল -"মা ভবানী এখানে সত্যই কতকাল ধরিয়া প্রকাশিত রহিয়াছেন। পুরাকালে যবনেরা আসিয়া তাহার মন্দির ধ্বংস করিয়া যাইল অথচ এখানকার লোকগুলো কিছু করিল না। তাই আমি যদি থাকিতাম তবে কখনো উহা চুপ করিয়া দেখিতে পারিতাম না।”

চুপ করে বসে ছিলেন না হিন্দুত্ববাদীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠল যে ষোড়শ শতাব্দীতে বাবরের আমলে যেখানে মসজিদ গড়া হয়েছে সেই অযোধ্যায় বহুকাল পূর্বে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামের মন্দির ছিল। তাই মসজিদ ভেঙে রামের মন্দির গড়ার সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার আগে থেকেই। শুধু অপেক্ষা করছিলেন অনুকূল সময়ের। 


মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ধর্মরক্ষার তাগিদে স্বামীজি বলেছিলেন "তোমরা যে শত শতাব্দীর অত্যাচার সহ্য করিয়া এখনও অক্ষতভাবে দাঁড়াইয়া আছো, তাহার কারণ তোমরা সযত্নে এই ধর্মরক্ষা করিয়াছো। এই ধর্মরক্ষার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষগণ সাহস পূর্বক সকলই সহ্য করিয়াছিলেন এমনকি মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন। বৈদেশিক বিজেতাগণ আসিয়া মন্দিরের পর মন্দির ভাঙিয়াছে কিন্তু এই অত্যাচার স্রোত যেই একটু বন্ধ হইয়াছে আবার সেখানে মন্দিরের চূড়া উঠিয়াছে।"


স্বামীজী আরও বলিয়াছেন,"অনেক গ্রন্থপাঠের যাহা না শিখিতে পারো, সোমনাথ মন্দিরের মত দাক্ষিনাত্যের অনেক প্রাচীন মন্দির তোমাদিগকে অধিকতর শিক্ষা দিতে পারে, তোমাদের জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে গভীরতায় অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। লক্ষ্য করিয়া দেখো, ওই মন্দির শতশত আক্রমণের ও শতশত পুনরুত্থানের চিহ্ন ধারণ করিয়া আছে, বারবার নষ্ট হইতেছে, আবার সেই ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হইয়া নূতন জীবন লাভ করিয়া পূর্বের মতো অচল অটলভাবে বিরাজ করিতেছে।


রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ রামমন্দির সম্পর্কে একই মত পোষণ করে। হিন্দুত্ববাদী এই সংগঠনের মতে শ্রীরাম অযোধ্যায় অচল অটলভাবে বিরাজ করছেম, কিন্তু পূর্বের মত নয়। শ্রীরাম মন্দির সেখানেই নতুন জীবন লাভ করবে। ভব্য রাম মন্দির নির্মাণ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। 


অনুকুল সময় আসতেই এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করেনি রামভক্ত হনুমানেরা। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি শেষে জয় শ্রীরাম' হুঙ্কার ছেড়ে ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ।'


ধর্ম রক্ষা করেছিল রাম ভক্তরা। বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হয়ে রাম মন্দিরের নতুন জীবন লাভের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।

গভীর আক্ষেপের সাথে বিবেকানন্দ বলেছিলেন "যদি তুমি অন্য কোনও দেশে গিয়া মুসলমানদিগকে বা অন্য ধর্মাবলম্বীগণকে তোমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতে বল, দেখিবে তাহারে কিরূপ সাহায্য করে। তৎপরিবর্তে তোমার মন্দির এবং পারে তো সেই সঙ্গে তোমার দেহমন্দিরটিও ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। এই কারণেই পৃথিবীর পক্ষে এই শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন.. ভারতের নিকট পৃথিবীতে এখনো বড় পরধর্মসহিষ্ণুতা শুধু তাহাই নয়,পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি শিক্ষা করিতে হইবে।”


ধর্মীয় রাষ্ট্রের জিগিরে মাতোয়ারা মৌলবাদীদের কাছে পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি অর্থাৎ পরধর্মসহিষ্ণুতা নিছক কথার কথা। ধর্মীয় উন্মাদনা থাকবে,অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে কিন্তু সন্ত্রাসের লেশমাত্র থাকবে না এটা সোনার পাথরবাটি। হিন্দুর শত্রু মুসলিম আর মুসলিমের শত্রু হিন্দু এই প্রকার সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিরোধের সৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে আরএসএস, বিজেপি, বজরং দল থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী শক্তি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। 


১৯২২ সালে হিটলার একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন- "একজন খ্রিষ্টান হিসেবে ঈশ্বর তথা পরিত্রাতাকে আমি একজন যোদ্ধার রূপে দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই এমন এক মানুষকে তিনি একদা একাকী অল্পকিছু অনুচর পরিবৃত হয়ে ইহুদীদের চিহ্নিত করেন এবং তারপর বহু মানুষকে একত্রিত করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন এবং যিনি ঈশ্বর সাক্ষী, দুঃখভোগী নন, বরঞ্চ একজন মহান যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের একান্ত অনুরাগী হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে আমিই সেই অংশটি পড়ি যেখানে প্রভু অবশেষে শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করছেন আর চাবুক হাতে নিয়ে ঈশ্বরের মন্দির থেকে শয়তানদের কশাঘাত পূর্বক বিতাড়ন করছেন। ইহুদি বিষের বিরুদ্ধে কী সুমহান সেই যুদ্ধ। আজ ২ হাজার বছর পরেও তীব্র আবেগ মথিত করে আমি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে এই কারণেই তাকে ক্রুশের উপর রক্ত ঝরাতে হয়েছে। একজন খ্রিষ্টান হিসাবে আমি নিজেকে ধোকা দিতে পারি না।সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করার দায় আমার উপরেও বর্তায়।"


হিটলারের এই বক্তব্য থেকে যিশুর জায়গায় রাম,ইহুদির জায়গায় মুসলমান এবং খ্রিস্টধর্মের জায়গায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বসালেই কি অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় সেকালের হিটলার মুসোলিনির সাথে একালের আরএসএস,বিজেপির।

মহাকাব্যের রাম হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে প্রবেশ করেন রাজনীতির মহাকাব্যে। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির আঙিনায় নাৎসিবাদীদের যিশু আর হিন্দুত্ববাদীদের রাম মিলেমিশে একাকার।


ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে জয় শ্রীরাম হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক স্লোগান। এক পৌরাণিক চরিত্র 'রাম'কে নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি আসলে আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু আধিপত্যকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদ। সংখ্যালঘু বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে দমন করার এক ফ্যাসিস্ট কৌশল। 

ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা বিস্তারের মাধ্যমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য তার জনমত তৈরি করা। 

বিবেকানন্দের মতানুসারে,আমাদের ধর্মই আমাদের তেজ,বীর্য,এমনকি রাষ্ট্রিয় জীবনের মূল ভিত্তি। আমি এখন এই বিচার করিতে যাইতেছি না যে,ধর্মেই আমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তি স্থাপন করার পরিণামে আমাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ হইবে;ভালো হউক বা মন্দ হউক,ধর্মে আমাদের রাষ্ট্রিয় ভিত্তি রহিয়াছে,তোমরা উহা ত্যাগ করিতে পার না। চিরকালের জন্য উহাই তোমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তিস্বরূপ রহিয়াছে,সুতরাং আমাদের ধর্মে আমার যেমন বিশ্বাস আছে,তোমাদের যদি তেমন নাও থাকে,তথাপি তোমাদিগকে এই ধর্ম অবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবে। তোমরা এই ধর্মে বন্ধনে চির আবদ্ধ। যদি ধর্ম পরিত্যাগ করো তবে তোমরা চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে। ধর্মই আমাদের জাতির জীবনস্বরূপ, ইহাকে দৃঢ় করিতে হইবে।


ইতালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি,ঐক্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ম্যাৎসিনিরও চিন্তাধারা ছিল ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশিয়ে দেওয়া।  ইতালির একত্রীকরণ হওয়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন যে ধর্ম ছাড়া কোনও জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতি সফল হবে না। 

হিটলার,মুসোলিনি,গোয়েবলস,ম্যাৎসিনি প্রমুখেরাই তো আরএসএস ও বিজেপির পথপ্রদর্শক।তাই ধর্মের সাথে রাজনীতির একত্রীকরণের ভাবনা তাদের মতাদর্শের মধ্যে নিহিত।

পুঁজি আর শ্রমের দ্বন্দ্বকে ভুলিয়ে এই রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য এক ধর্ম রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা।

সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করতেই লাগাতার এবং লাগামছাড়া বিভেদের বীজ বপন এবং স্থাপত্য ধ্বংসের কর্মসূচী।

বিবেকানন্দতে আছি আবার মার্ক্সবাদেও আছি! -জিষ্ণু রায় চৌধুরী
Nov. 27, 2024 | যুক্তিবাদ | views:1014 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্মেও আছি আবার জিরাফেও আছি। এই সংষ্কৃতি হলো এই বঙ্গে ছেপেমের মহৎ দান। বিবেকানন্দ সন্ন্যাস নিয়েছিলেন তাতে তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। কিন্তু একজন হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্মের পথিকৃত যদি তাঁর ধর্ম অনুসারে চলেন তা বিজ্ঞানকেই অস্বীকার করে প্ৰতিষ্ঠা হওয়া অর্থাৎ বিজ্ঞান বিরোধী প্রগতিবিরোধী।

তাই ধর্মের মধ্যেই দ্বন্ধ প্রকট হতে বাধ্য নতুন নতুন উৎপাদনের হাতিয়ারের উদ্ভবের সাথেই সাথেই। তাই নতুন অর্থনীতি নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সেই অনুসারে ধর্মের মধ্যেই অন্তরকলহ জেগে ওঠে। নতুন বেরিয়ে আসতে চায় পুরোনোর গর্ভ হতে।

এমনিতে ধর্ম বা ধর্ম গুরু দের কোনো মার্ক্সবাদী বা কোনো প্র্গতশীল বুর্জোয়ারাও কখনও গ্রহণ করতে পারেন না?

কিন্তু ধর্মের মধ্যেকার সংস্কার আন্দোলন ও কোনো প্রগতিশীল বিপ্লবকে মার্ক্সবাদীরা বিচার করেন শ্রদ্ধার সাথেই।

বিবেকানন্দ পরিষ্কার একজন হিন্দু ধর্মের সমস্ত ধর্মীয় সংস্কারকে স্বীকার করে নেওয়া ব্যক্তি। যদিও তাঁর মধ্যে দোদুল্যমানতা লক্ষ করা গেছে যেন তিনি নিজেই স্ববিরোধী হয়ে  উঠেছেন তাঁর নিজের বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই।

যেমন একদিকে তিনি শংকরাচার্জকেই এক নৃশংস হত্যাকারী হিসেবে প্রতিভাত করেছেন যিনি বৌদ্ধ শিষ্যদের হত্যা করেছেন আগুনে পুড়িয়ে  আবার সেই তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের চালাকির সূত্র ধরে" বুদ্ধকে শিবের অবতার",  হিসেবে ঘোষণা করছেন।

এই বিবেকানন্দ সতীদাহ প্রথার সমর্থন করেছেন। সেই বিবেকানন্দ প্রগতিশীল?

আপনি কাকে বেছে নেবেন,যুবকদের আইকন হিসেবে? 

যে ভগত সিং তীব্র নিন্দা করেছেন যুবক যুবতীদের ঈশ্বরনির্ভরতার তাঁদের, তার জন্য কাপুরুষ আখ্যা দিয়েছেন। 

 তাঁকে কি তবে অস্বীকার করছেন?

আমরা মার্ক্সবাদ রা ধর্মমাত্র পরিত্যাজ্য জ্ঞান করি আবার চৈতন্য দেবের ভক্তি আন্দোলন এর বিপুল প্রশংসা করি কারন তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন ভারতের প্রগতির পথে বাধা কাস্টবাদকে ধংস করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর আন্দোলন ছিল অহিংস। কিন্তু বাংলায় বাঙালির একদা প্রগতিশীল ভূমিকার পেছনে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে এটা কি অস্বীকার করতে পারেন?

বিবেকানন্দ কী বলছেন?

তিনি বলছেন চৈতন্যদেব সমস্ত বাঙালিকেই নিরামিষাশী করে নপুংসক বানিয়েছেন। বাঙালিকে লড়াই বিমুখ করে তুলেছেন ইত্যাদি। 

তিনি, কিন্তু চৈতন্যের ইতিবাচক লড়াই সম্পর্কে একটি উচ্চবাচ্য করলেন না কারণ তাঁর লড়াই হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী।

বরং তাঁর শুধু নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরলেন অর্থাৎ অহিংস আন্দোলনের ধারাকেই।

ইংরেজদের তৈরি ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলনে তাঁর একটি বাক্য ব্যয় হয়েছে কোনওদিন কোনওমুহূর্তে?

মাথায় রাখবেন বিদ্রোহ কখনো ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্যে দিয়েও শোভা পেতে পারে। কৃষক বিদ্রোহে সন্যাসী আন্দোলন বা ফকির আন্দোলন একসময়ে তাঁদের চিহ্ন রেখেছিল।

তাই একজন সন্যাসী বলেই তিনি এইসব ইংরেজবিরোধী ও জমিদারবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে নীরব ছিলেন এমন অজুহাত শোভা পায় না। তিনি কিন্তু একটি রাও কখনো কারেননি, কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে।

কেন বলুন তো?

বিজ্ঞানমনস্কতা কাকে বলে? -রূপ্না দাস ভট্টাচার্য
Nov. 27, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:806 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রায়শঃই আমরা দেখতে পাই বা শুনতে পাই কোথাও না কোথাও বিজ্ঞান মনস্কতা প্রসারের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি বিশাল সংখ্যক মানুষ বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠতে পারছে! না তো! 

    কেন বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠতে পারছে না, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, গোড়ায় গলদ। 

   যিনি নিজেকে বিজ্ঞানী বলে দাবি করছেন, তিনি নিজে কি আদৌ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পেরেছেন! 

   শুধু বিজ্ঞানকে একটা বিষয়(Subject) হিসেবে অনুশীলন করে পড়াশোনা, গবেষণা বা নতুন কিছু আবিষ্কার করে দেশবরেণ্য হলেই কিন্তু তাঁকে বিজ্ঞানী বলা হলেও বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না, যদি না তাঁর চিন্তা চেতনার মধ্যে যৌক্তিকতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

   সমাজে আমরা এইরকম শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক হিসেবে একটা বিরাট অংশকে দেখতে পাই যারা বিজ্ঞানকে শুধুমাত্র একটা লাভজনক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। তারা এর মাধ্যমে প্রভুত অর্থ উপার্জন করে, ভোগ বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। এইভাবে ক্ষুদ্র স্বার্থে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মাত্র। 

  এদের চিন্তাভাবনায় বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিবোধের লেশমাত্র থাকে না। 

  এরা বিজ্ঞানকে জীবিকার কাজে ব্যবহার করে আর ভাববাদী দর্শনের অনুসরন করে চলে। 

   এ হেন ব্যক্তিরা যদি বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারের কাজে নিযুক্ত হয়, মুখে বিজ্ঞানচর্চার বুলি অথচ পোশাকে -আশাকে সাজসজ্জায়, জীবনদর্শনে ভাববাদী হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে বিজ্ঞান মনস্ক হিসেবে গড়ে উঠবে? 

  তাই আমাদের সমাজে 'বিজ্ঞানমনস্কতা' প্রচার একটা প্রহসন মাত্র। 

কোরানে আল্লাহকে কি নবি মুহাম্মদের থেকে পৃথক করা যায়? -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 27, 2024 | ধর্ম | views:821 | likes:2 | share: 2 | comments:0

নবি ছিলেন মক্কার কুরাইশদের হাসমি গোষ্ঠীর লোক।  ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভাবুক। বাবা মারা যাওয়ার পর মরুভূমির ঊষর প্রান্তরে অন্যের উট চরাতে চরাতে নিজের দুর্দশার কথা ভাবতেন। তার ধনী কাকারা তার দায়িত্ব নেননি। আবার এক চাচা আবু লাহাব মুহমুহাম্মদের উপর ছিলেন ভীষণ খাপ্পা ফলে নবির পয়লা নম্বর শত্রু। নবির পূর্বপুরুষেরা সবাই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী। নবির পৌত্তলিক দেব দেবীদের উপর রাগ বিদ্বেষের কারণ তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার ধনী  চাচারা নবিকে দেখেননি। আর এই চাচারা কাবা ঘরের দেবদেবীদেরকে কেন্দ্র করেই  ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। ফলে এই দেবদেবীদের প্রতি রাগ অবিশ্বাস আর মক্কার  নির্জনে পারস্য ও গ্রীকদেশীয় উপকথা শুনতেন এবং  ইহুদী ও খ্রিস্টান পুরোহিতদের সাথে একান্ত আলোচনায় একটা অবসেশান বা ঘোরের মধ্যে পড়েন। এর ফলে একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নতুন আল্লাহর সৃষ্টি করেন, এবং নিজেকে মুশা বা ঈশার মত রসুল কল্পনা ভাবতে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নবি যদি কাবাঘরের পরিচর্যা করে তার চাচাদের মতো কাবা ঘরের আয়ের ভাগ পেতেন তবে কি তিনি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করতেন? নবি অবশ্যই এক বিশাল কৃতিত্বের অধিকারী, একদম নিঃস্ব অবস্থা থেকে এক বিশাল আরবীয়ান সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তার সার্থক রূপদান করেছেন ধর্মের আশ্রয়ে। তার সৃষ্ট ইসলাম আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। এই ধর্মের প্রধান হচ্ছে আল্লাহর বাণী (ওহি)  সংবলিত কোরান এবং যে ধর্মীয় আচরণগুলি কোরানে নেই  কিন্তু নবি পালন করতেন সেগুলিকে সুন্নাহ বলে। এবং সেগুলোর লিখিত রূপ  হাদিস। নবির মৃত্যুর পরে লক্ষ লক্ষ হাদিস লেখা হয়েছে। বর্তমান সৌদির রাজপুত্র প্রিন্স সলমন নবির মৃত্যুর পর লেখা সব হাদিস বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। প্রায় প্রতিটি ডিগ্রীধারী অশিক্ষিত নিরক্ষর মুসলমান বিশ্বাস করে কোরানের প্রতিটি বাণী আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যাদেশ বা ওহি, কোনও মানুষের রচিত নয়। যেমন বড় বড় ডিগ্রীধারী অশিক্ষিত হিন্দুরাও মনে করে বেদ অপৌরুষকার।  আল্লাহর পাঠানো ওহি গুলিই আল্লাহর রসুল  মুহাম্মদের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। যদিও সেই সময়েই আয়েশার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল আপনার আল্লাহ তো আপনার সুবিধার্থে ওহি পাঠাতে বিশেষ দেরী করেন না।   

কোরানে আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট ও সদ গুণাবলীর উল্লেখ আছে। তিনি সমস্ত যুক্তিবুদ্ধির সীমাকে  অতিক্রম করে গেছেন। তিনিই আকাশের তারকারাজির মালিক, তিনি ছয়দিনে সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মেঘ বৃষ্টিপাত বজ্র ঝড়ের স্রষ্টা। তিনি তার নিদর্শন দেখাতে নবিকে নিয়ে মেরাজে করে সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করান এবং হাজার কিমি দূরবর্তী দুই মসজিদ ভ্রমণ করান এক রাত্রের মধ্যেই, এ যেন ধনী ব্যক্তি আল্লার তার দরিদ্র আত্মীয়  মুহাম্মদকে ঐশর্য্য প্রদর্শন করাচ্ছেন। কোরান বেশ কিছু জায়গায়   গ্রীক উপকথা ও বাইবেলের ৫০%  জেরক্স কপি হলে ও নবির প্রতি আল্লাহ আরও বেশি স্নেহপরায়ণ। কিন্তু সমগ্র কোরান খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায় আল্লাহর পাঠানো প্রত্যাদেশ বা ওহিগুলি  বেশ কিছু জায়গায় সাংঘর্ষিক এবং সব জায়গাতেই মুহাম্মদ এর সুবিধাভোগী এবং সব থেকে আশ্চর্যের যেটা এই ওহিগুলির বক্তা কে মুহাম্মদ না আল্লাহ তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এই নাজিল করা ওহিতে এক কথা বলছেন এবং পরেক্ষণেই ঠিক এর বিপরীত ওহি নাজিল করছেন। আর বেশ কিছু সুরার এমন সব আয়াত আছে যেগুলি পড়লে মনে হয় মুহাম্মদের নিজের বক্তব্য, কিছুতেই আল্লাহর প্রত্যাদেশ হতে পারেনা তা বাক্যের গঠন দেখলেই বোঝা যায়। মুহাম্মদ এভাবেই সারা কোরান ধরে নিজের বক্তব্য আল্লাহর নামে চালিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি ------- সুরা আ-বাসা থেকে, আয়াত ১৩- ১৬ 

পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে,

সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লারই,

যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময় বিচার দিনের মালিক,

আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, 

তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি,

তুমি আমাদেরকে সঠিকভাবে চালিত কর সঠিক পথে

তাদের পথে যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ,

যারা তোয়ার রোষে পতিত হয়নি,পথভ্রষ্টও হয়নি।

এইটা কি আল্লাহর ওহি বা প্রত্যাদেশ হতে পারে? আল্লাহ কি নিজেই নিজের গুণগান করছেন? আল্লাহ কি নিজে নিজের উপাসনা করছেন বা করবেন? মোহের দ্বারা যারা আচ্ছন্ন নয় তারা এর সত্য মিথ্যা বুঝতে পারেন। এখানে নবিই আল্লাহ আর আল্লাহই নবি। আর যারা ধর্ম মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন তাদের কাছে কোরান ঐশী বাণী। ৯৯% মুসলমান কোরান পড়েন না, পড়লেও নিজেদের মস্তিষ্ককে বন্ধক দিয়ে আসেন মসজিদের ইমাম মুমিনদের কাছে। 

      সমগ্র কোরানের বেশকিছু আয়াত সাংঘর্ষিক। কোরানে আল্লাহ যুক্তিবুদ্ধির সীমা অতিক্রম করে গেছেন। সেখানে আল্লাহ ও বিভ্রান্ত, এই এক আয়াতে এক কথা আর কিছু পরেই তার বিপরীত কথা। কোরানের সব থেকে বেশী সুবিধাভোগী মুহাম্মদ। নবি ভাল মন্দ যা করেছেন তার সব কাজের শিলমোহর দিয়েছে কোরান। আল্লাহ মুহাম্মদের বিপরীত মতের লোকদের জন্য খড়্গহস্ত আর নবির জন্য পরম দয়ালু। নবীর অতিরিক্ত যৌন ক্ষিদে মেটানোর জন্য বিবিদের সাথে দ্বন্দ্ব হলেও আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন নবির পক্ষেই। সংসারের মেয়েলি ব্যাপারেও তিনি  এত আয়াত নাজিল করেছেন (সুরা তাহরিম / আহজাব) তাতে আশ্চর্য হতে হয়। নবির লুঠতরাজ এবং বানু কারজাই গোষ্ঠীর ইহুদীদের  নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিও সমর্থন জানিয়ে আল্লাহ নবির পক্ষেই আয়াত নাজিল করেন। গণিমতের মালের বন্টনেও আল্লাহ নবির পক্ষে, নবির অংশ  ১/৫ ভাগ, বাকি মাল অন্যেরা ভাগ করে নেবে। সেখানেও নবিই সব থেকে বেশী সুবিধা প্রাপক। 

      আল্লাহর বক্তব্য কিভাবে সাংঘর্ষিক তার কিছু উদাহরণ কোরান থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করছি। কোরানে আল্লাহ সর্বস্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী, সবজান্তা, সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সব অভাব থেকে মুক্ত, করুণাময়, কর্তৃত্বব্যাঞ্জক, ক্রুদ্ধ, অভিশাপদাতা, হুমকি প্রদানকারী এবং ছলনাকারী (সুরা আনফাল ঃ আয়াত ৩০) ও প্রতিশোধ পরায়ণ (সুরা সাজদাহ্ আয়াত ২২, সুরা জুকরফের ৪১ ও ৫৫ নং আয়াত)। আবার আল্লাহ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু (১২ঃ ৯২)। আবার কেউ তার সাথে শরিক করলে তা হবে সম্পূর্ণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (৪ঃ১১৬)। তিনি তার বান্দাদের প্রতি অবিবেচক হবেন না (৫০ঃ২৮)। অথচ দোজখের আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেন। তিনি বলেন যখনই অবিশ্বাসীদের চামড়া দোজখের আগুনে পুড়ে যাবে তখনই আবার নতুন চামড়া জন্মাবে যাতে তারা অনন্তকাল কঠোর শাস্তি পেতে থাকে (১৮ঃ৫৫)। আল্লাহইতো সব বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীদের স্রষ্টা, তাহলে উনিতো সবাইকে বিশ্বাসী করেই পাঠাতে পারতেন। তা না করে অবিশ্বাসীদের শাস্তি দেবেন কেন? মূল দোষী কে এখানে অবিশ্বাসী না আল্লাহ?

পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন আর যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন (১৮ঃ১৭)। আবার পরেরক্ষণেই যারা বিভ্রান্ত হবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। সুরা বাকারার ১০ ও ৯০ নম্বর আয়াত/ সুরা মায়িদার ৯৪ নং/সুরা তওবার আয়াত ৩৯। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহ নিজেই বিভ্রান্ত করবেন আবার নিজেই কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন? বিভ্রান্ত হওয়ার দায় কার?

একদিকে আল্লাহ সর্বশক্তিমান, আবার এক আয়াতে তার সাহায্যের প্রয়োজন হয়। (সুরা সাফফ, আয়াত ১৪)। মরিয়মের সন্তান ঈশা ----- আমরা ঈশ্বরের সাহায্যকারী। বা আমি মানুষের জন্য লোহা নাজিল করেছি যাতে মানুষের জন্য মহাশক্তি ও উপকার রয়েছে যাতে অদৃশ্য আল্লাহ জানতে পারেন কে তাকে ও তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছেন? (সুরা আল হাদিদ – আয়াত ২৫)। যিনি সর্বশক্তিমান তিনি কী করে নগণ্য মানুষের সাহায্য চান? সর্বশক্তিমান কী করে নগণ্য আবু লাহাবের (মুহাম্মদের চাচা) মাথায় বজ্রপাতের অভিশাপের আয়াত নাজিল করেন? অদ্ভুত লাগে শত্রু কাকা  নগন্য আবু লাহাবের প্রতি এত বিদ্বেষ যে আল্লাহ   আবু লাহাবের নামে আল্লাহ একটা সুরা নাজিল  করে পাঠালেন? নগণ্য আবু লাহাবের নামে একটা সুরা পর্যন্ত নাজিল হয় কেন? আবু লাহাবের স্ত্রী পর্যন্ত এই অভিশাপ থেকে বাদ যায়নি। শক্তিমান লোকেরা কি নগণ্য লোকদের অভিশাপ দেন? পুটিন ইউক্রেন আক্রমণ করে সঠিক না বেঠিক করেছেন সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। উনি কি জেলেনেস্কিকে অভিসম্পাত করছেন? সুরা বালাদে ও সুরা হুমাজার (১০৪ নং আয়াতে) ওয়ালিদ আল মুগিরা এবং উমাইয়া বিন খালিদের প্রতি একই ধরণের হুমকিপূর্ণ অভিশাপ। কারণ মুহাম্মদের দুইপুত্র কাশেম ও তাহের মারা যাওয়ার পর ওয়ারেল মুহাম্মদকে লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে ঠাট্টা করেছিলেন। এছাড়া নবি আল্লাহর রসুল, আল্লাহ নবির ছেলে কাশেম তাহেরকে বাঁচাতে পারলেন না? 

বদরের যুদ্ধের পর কাব বিন আশরাফ নামে ইহুদী কবি হেরে যাওয়া পৌত্তলিকদের প্রতি সমবেদনা দেখালে এবং তাদের মুহাম্মদের উপর তাদের স্থান দিলে আল্লাহ ক্রুদ্ধ হয়ে সুরা নিসার ৫১-৫৭ আয়াত নাজিল করলেন। আবার সুরা হাশরেনবি যখন বানু নাজির নামে ইহুদী গোষ্ঠীকে হত্যা করে নির্মূল করলেন তখনও আল্লাহ নবির কাজের প্রশংসা করে হত্যাকারী নবির পক্ষে সমর্থন করে আয়াত নাজিল করলেন সুরা বানু নাজিরে।

আল্লাহ সারা ব্রহ্মান্ডের মালিক, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। কিন্তু আল্লাহ সব সময়েই নবির পক্ষে। নবির উদ্দেশ্য বাস্তয়ায়নে বাধা দানকারীদের তিরস্কার করেছেন। যুদ্ধে জিতলে আল্লাহ জিতিয়েছেন আর যুদ্ধে নবি হারলে তিনি নিশ্চুপ। একদম সাধারণ কামুক মানুষের মতো কামুক নবি যৌনতা নিয়ে কুড়ি জন স্ত্রীদের সাথে সমস্যায় পড়লে মধ্যস্ততা করে নবিকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। নবি পালিত পুত্র জায়েদের সুন্দরী স্ত্রী জয়নাবের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন আয়াত নাজিল করে। সুরা আহজাব/ সুরা তাহরিম এর সাক্ষ্য বহন করে। 

           আল্লাহ এই মহাবিশ্বের মালিক হলেও তিনি   হিজরি ১-১১ হিজরি (৬২২-৬৩২ খ্রী) আল্লাহ নবির সাথে আরবের হেজাজ ও নেজদ অঞ্চলে বসবাস করতেন। বিশ্বের অন্য অঞ্চলের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। কোরানে ইউরোপ আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশ ও দঃপূর্ব এশিয়ার কথা নেই। কারণ নবির এই মহাদেশগুলির সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ছিল না। আর আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার হয়েছে ১৫২৬ সালে। 

নবি সবাইকে আল্লাহর পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার (জিহাদের) জন্য আরবীয়ানদের প্ররোচিত করেছেন। যা বর্তমানের মৌলবাদী মুসলিম সংগঠনগুলি করে। মুসলিমদের মধ্যে এইরকম ধর্মীয় শিক্ষার জন্যই টেরোরিস্ট বেশি। এটা   ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই নবির শিক্ষা।  যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনাগ্রহ বা শৈথিল্য দেখালে তাদের দোজখের লেলিহান শিখার ভয় দেখিয়েছেন। আর যারা জিহাদে গেছে তাদের জন্য জান্নাতের তলদেশে নহর প্রস্তুত করিয়েছেন। এগুলো যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে পাঠ করলে নবি মুহাম্মদের সাথে আল্লাহর ফারাক করতে পারবেন?

নবির প্রতি কেউ উপহাস করলেও সঙ্গে সঙ্গে সুরা হিজরের ৯৫ নং আয়াতে নবিকে স্বান্তনা দেওয়া হল --- যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। সুরা আনফালের প্রায় পুরোটা জুড়ে বদরের যুদ্ধে মহান আল্লাহর গুণগান ও ভূমিকার কথা। আল্লাহ ফিকেল মাইন্ডেড, কারণ একটা আয়াত নাজিল করেই আবার পরেরক্ষণেই এর বিপরীত আয়াত নাজিল করেন। যেমন দেশের শত্রু নিপাত সম্পূর্ণভাবে না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনও নবির পক্ষে সমীচীন নয় (আয়াত ৮ঃ৬৭)। কিছু পরেই আবার আয়াত (৮ঃ৭০) বলা হল, যুদ্ধবন্দীদের থেকে মুক্তিপণ আদায় করে মুক্ত করে দেওয়া হবে। মাত্র তিন আয়াতে পরিবর্তন, আল্লাহ বেশ খামখেয়ালী কিন্তু। যুদ্ধে জিতলে আল্লাহর অনুগ্রহে জিতেছেন। পরিখা বা খন্দকের যুদ্ধে বিজয়ের পর আল্লাহর গুণগান করে প্রচুর আয়াত নাজিল হয়। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানদের শোচনীয় পরাজয় হয় এবং নবির প্রিয় চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব সহ সত্তর জন সাহাবি মৃত্যুবরণ করেন তার সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চুপ, এখানে আল্লাহর কোনও দায় নেই। 

আল্লাহর মহাবিশ্ব যেন হেজাজে নেমে এসেছিল। কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সামাজিক অবস্থার বর্ণনা আছে। বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাত, বিতর্ক, রটনাকারীদের জবাব, ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্ততা, মেয়েলি ব্যাপার, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহবান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং অবিশ্বাসীদের দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে শত শত আয়াত আছে। 

কোরানে স্রষ্টার মানবসুলভ গুণাবলী আছে। আল্লাহর রাগ, খুশী আনন্দ, ভালবাসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ষড়যন্ত্র করা, ছলনা, অভিসম্পাত করা, হুমকি দেওয়া সহ মানুষের সমস্ত গুণাবলী আছে। আসলে মানুষ নবি মানুষের আদলেই আল্লাহকে সৃষ্টি করেছেন। এটাই স্বাভাবিক মানুষ তার নিজের আদলেই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। আমরা অতীব ক্ষুদ্র মানব, আমরা আশা করব মহাবিশ্বের স্রষ্টা নগণ্য মানুষের দোষগুণ থেকে মুক্ত থাকবেন। কিন্তু কোরান এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। সেখানে নবিকে আর আল্লাহকে ফারাক করা যায় না।

 গরীব নিরক্ষর অশিক্ষিত অল্প শিক্ষিত মানুষকে ধর্মের ওপরের অংশের লোকেরা নিজেদের সুবিধার্থে যা বোঝায় তাই বোঝে। কারণ অধিকাংশ লোক কোরান বা অন্য ধর্ম শাস্ত্র পাঠ করলেও তা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে করে না, মোহ মুক্ত হয়ে করে না। আর এক ধরণের মানুষ আছে যারা ধর্মমোহের বিশ্বাসের ভাইরাসে আচ্ছন্ন, তার যুক্তিহীন বিশ্বাসের তাড়নায় আবেগতাড়িত হয়। তাদের যুক্তি প্রমাণ দিলে কোন কাজ হয় না। তবে একদম কিছু হয় না তা বলা যাবে না। বিশ্বে এখন সংশয়বাদী ও নাস্তিকের সংখ্যা ১৬% শতাংশে পৌঁছে গেছে। শুধু বাজে কথা নয় যুক্তি দিয়েই অবতারণা করতে হবে। ধর্মমোহ অন্ধবিশ্বাসের প্রাচীর ভাঙতে হবে তবেই এ বিশ্ব মানুষের বসবাসের উপযোগী হবে। নয় পাকিস্তান আফগানিস্তান হবে ...। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু তা লেখাকে দীর্ঘায়িত করবে, পড়ার ইচ্ছা চলে যাবে। তাই বলি কোরান গীতা বেদ যাই পড়ুন  যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে পড়ুন। সুরা ও   আয়াতগুলি যুক্তির দ্বারা বিশ্লেষণ করুন।

(তথ্য : কোরান, সহি বুখারী, আলী দোস্তির  মুহাম্মদের তেইশ বছর।)

জলঙ্গী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে -অনুজ বিশ্বাস
Nov. 27, 2024 | পরিবেশ | views:899 | likes:0 | share: 0 | comments:0

জলঙ্গী নদী দিন দিন কোমায় চলে যাচ্ছে। নদিয়া মুর্শিদাবাদের অন্যতম এই জলঙ্গী একসময় গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের এক খরস্রোতা নদী হিসাবে লোকমুখে খোড়ে নামে পরিচিত হয়েছিল। আজ জলঙ্গী আই সি ইউ তে। না, কোনও প্রাকৃতিক কারনে নয়, আমাদের নিরন্তর উদাসীনতায়। নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিগত দেড় দুই হাজার বছরে ভূমিরূপের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভূ গর্ভস্থ ভৌম জলস্তর মোটামুটি একই উচ্চতায় রয়েছে। এখনও তিন চারটে পাইপ পুঁতে নলকূপের জল যথেষ্ট পরিমানে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। মোটামুটি একহাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত জলঙ্গী অববাহিকায় প্লেট টেকটোনিক এর প্রভাব পড়া প্রায় অসম্ভব, প্রভাব পড়লে বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপের চরিত্র টাই বদলে যাবে। তাই কালের নিয়মে জলঙ্গী হারিয়ে যাচ্ছে এমন দাবি পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।


গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের নদীয়া মুর্শিদাবাদ এবং পার্শ্ববর্তী যশোর ঝিনাইদহের কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে জলঙ্গী ছাড়াও বাংলাদেশে থাকা ভৈরব, কপোতাক্ষ, রূপসা নদীর অবস্হা অপেক্ষাকৃত অনেক ভালো। অন্যদিকে জলঙ্গীর মত ভারতে থাকা চূর্ণী, ইছামতী নদী গুলোও আজ মরতে বসেছে। কপোতাক্ষ, রূপসার মত ছোট নদীকে জাতীয় জলপথে পরিনত করে বাংলাদেশ তাদের লাভজনক ট্রেড রুট বানিয়েছে। আর আমরা নদী বাঁচাও আন্দোলন করছি।


 আসল সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরী করে আমরা ভেবে নিয়েছি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে জলচুক্তিতে হাফ ডজন গোল দেওয়ার আনন্দে আমাদের জামার কলার উপরে উঠেছে আর Sustainable Development করতে পারার আত্মতুষ্টিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাঙালির অর্গ্যাজম হয়েছে। কিন্তু Development কে Sustain করতে যা যা করার দরকার সেগুলো আমরা না করে আমাদের দায় এড়িয়ে গিয়েছি। ফারাক্কা ব্যারেজের বাইপাস সার্জারি হিসাবে যে ফিডার ক্যানাল তৈরী হয়েছে তাতে জলঙ্গী নদীর কোনও লাভ হয়নি। জলঙ্গীর উৎসমুখ গোপালপুর ঘাট পলি পড়ে মজে গিয়েছে। আমরা ড্রেজিং করে পলি না সরিয়ে সেই জায়গায় চাষাবাদ করছি। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার নদী খাত বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ গাছের গোড়া আমরা ইতিমধ্যেই কেটে ফেলেছি। তার উপর নদীর পাড়ে যথেচ্ছ পরিমাণে ঘরবাড়ী, অবৈধ ইটভাটা তৈরী হচ্ছে। নদীর পাড় বাঁধানো নেই। সেচ দপ্তর জেগে ঘুমাচ্ছে।


কৃষ্ণনগরে নতুন রেলব্রীজ তৈরি হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু রেলব্রীজের বড় বড় পিলার গুলো নদীগর্ভে বসানোর ফলে যে পরিমাণ জায়গা দখল করেছে তার সম পরিমাণ জায়গা নদীর দুপাশে ড্রেজিং করে বাড়ানো হয়নি। উপরন্তু পাড়ের জমিতে বীজতালা করে চাষ হচ্ছে। এরফলে নদীখাতের আয়তন কমেছে, সমানুপাতিক হারে নদীর জলধারণ ক্ষমতাও কমেছে। কদমতলা ঘাটে শতাধিক বছর ধরে প্রতিমা বিসর্জনের ফলে নদী গর্ভে মাটি, কাঠামো প্রভৃতি জমা হচ্ছে। হালে বছর দশেক ধরে কৃষ্ণনগর পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিমার কাঠামো তুলে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হলেও, বিগত একশ বছর ধরে যে পরিমান অবক্ষেপ নদীতে জমা হয়েছে তার জন্য পর্যাপ্ত ড্রেজিং কখনই হয়নি। গোলাপটি এলাকায় নদী ক্রমশঃ সরু হয়ে আসছে। জলঙ্গীর শরীর অপুষ্টি গ্রাস করছে। জলঙ্গী নদীকে গলা টিপে মেরে ফেলার সমস্ত রকম ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।


জলঙ্গী নদীর শরীরে এখনও প্রাণ আছে বাংলাদেশের ভৈরব নদীর দয়ায়। ভৈরবের বিভিন্ন উৎস থেকে এখনও যেটুকু জল আসছে তাতেই জলঙ্গী অক্সিজেন পাচ্ছে। ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিয়েছে। পদ্মা দিয়ে যেটুকু জল তারা সারাবছর পেয়ে থাকে সেই জলের পরিপূর্ন ব্যবহার করেছে। তার সুফল হিসাবেই এখনও জলঙ্গী নদীর শরীরে রক্ত সংবহন তন্ত্রটি সচল রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে 54 টি আন্তর্জাতিক নদী আছে যেখানে শুধু গঙ্গা ছাড়া অন্য কোনও নদীর ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু জলবন্টন চুক্তি নেই বলেই জলঙ্গী নদী এখনও বেঁচে আছে। ভৈরব আন্তর্জাতিক নদী। এর বিভিন্ন প্রবাহ কখনও ইছামতী, কখনও রায়মঙ্গল নামে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দুর্বল দেশ বলে আমাদের রক্ষে, নাহলে ফারাক্কা আর তিস্তার বঞ্চনার বিরুদ্ধে যেদিন দক্ষিন বঙ্গের ছোটো ছোটো আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে জলবণ্টন চুক্তি দাবি করে বসবে সেদিন আর কোনও ভাবেই জলঙ্গীকে বাঁচানো যাবে না।

এখনও সময় আছে, বিশল্যকরণী প্রয়োগ করতে পারলে কোমায় থাকা জলঙ্গী আবার বেঁচে উঠতে পারে। সবার প্রথমে পদ্মা থেকে জলঙ্গী নদীতে সরাসরি ফিডার ক্যানাল তৈরী করে নিরবিচ্ছিন্ন জল সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। এরজন্য জলঙ্গী বাঁচাও আন্দোলনকে সামাজিক স্তর থেকে গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করতেই হবে। সেভ জলঙ্গী জাতীয় কর্মসূচী শুধুমাত্র কৃষ্ণনগরের এলিট শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জলঙ্গীর দুই পাড়ে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ সাধারন প্রান্তিক জনগণের মধ্যে এই আন্দোলনের প্রভাব শূন্য। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে আন্দোলন মুখী করা তখনই সম্ভব হবে যখন জলঙ্গীর দাবী সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবী হিসাবে স্বীকৃত হবে। জলঙ্গীর দাবী, তথা জলের দাবী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে সেদিন জলঙ্গী বাঁচবে, তার আগে নয়।


জলঙ্গী নদীর অববাহিকা আর কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র প্রায় সমার্থক। জলঙ্গী একান্ত ভাবেই কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের নিজস্ব নদী। তাই হাতে সময় বেশী নেই, মাত্র এক বছর। আগামী লোকসভা ভোটে দাবি উঠুক জলঙ্গী নদীকে কেন্দ্র করে। " হয় আমাদের জলঙ্গী নদী সারিয়ে দাও, নয়তো আমরা নোটায় ভোট দেবো" এই দাবীতে সোচ্চার হওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। রাস্তাঘাট, রেলপথ সারানোর দাবীতে তো অনেক ভোট হল, একবার নদী সারানোর দাবী নিয়েও আন্দোলন হোক। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার প্রায় সাত লাখ। এরমধ্যে জলঙ্গী দুই পাড়ে বসবাস করেন এমন জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে মাত্র একলাখ মানুষকে নদীর দাবীতে এক জায়গায় সংগঠিত করতে পারলেই সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাতের ঘুম উড়ে যাবে,  জলঙ্গী তখন দিল্লীর পার্লামেন্টে আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। শীর্ণ কায়া জলঙ্গী আবার পূর্ণ কায়া হবে। নাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জলঙ্গীর অবস্হা বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীর মত হবে, জলঙ্গী নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে।।


অনুজ বিশ্বাস,

(কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, ভারতীয় ডাক বিভাগ)

কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

হিন্দু কোড বিল কাকে বলে? -পার্থপ্রতিম পাল
Nov. 27, 2024 | যুক্তি | views:883 | likes:1 | share: 0 | comments:0

ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যাদের আগ্রহ আছে, তারা নিশ্চয়ই ভারতের “হিন্দু কোড বিল” বিষয়ে পড়েছেন। ভারত স্বাধীন হবার পরে পণ্ডিত নেহেরুর কেবিনেট এই বিলের মাধ্যমে হিন্দুসমাজ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ে, তালাক, নারী অধিকার, পৈত্রিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের মতো সংবেদনশীল বিষয় ছিলো এই বিলে। বিগত সময় ধরে চলে আসা সনাতনী কুসংস্কার, ধর্মের নামে অনাচার ও অধিকারহরণ বন্ধ করাই ছিলো এই বিলের উদ্দেশ্য। যুগোপযোগী এবং বাস্তবিক সিদ্ধান্তই ছিল এই বিলের সারকথা।


বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা পাওয়া, ইতিহাস ও শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ড. বি আর আম্বেদকার ওই কেবিনেটের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনিই এই বিলের প্রণেতা এবং প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সমর্থনেই তিনি বিলটি প্রস্তুত করে সংসদে উত্থাপন করেন।


যথারীতি মৌলবাদী হিন্দুরা এর বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে আসে। তারা বিভিন্ন শ্লোক দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, এটা হিন্দুধর্মের প্রতি সরাসরি আক্রমণ। তাই ধর্মরক্ষায় এই বিল বন্ধ করতে হবে। একজন হিন্দু হিসেবে, এই বিল বন্ধ করা ধর্মীয় দায়িত্ব। দীর্ঘদিন ধরে একে-অন্যকে-গালি-দেয়া হিন্দুবাদী সংগঠনগুলোও এই ইস্যুতে এক হয়ে যায়। তারা বলে, আমাদের ধর্ম ও সামাজিক আইন সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত বেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো মানুষের এই বিষয়ে আইন করার অধিকার নেই।


ড. আম্বেদকার উত্তর দেন, হিন্দুধর্মের সাথে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা আছে ভিন্ন জনের ভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন হিন্দুবাদীরা তাদের সুবিধামতো শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন সামাজিক কুকর্মের বৈধতা দেয়। তাই একটি স্পষ্ট আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে, অনাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এতে মৌলবাদীরা আরও ক্ষেপে গিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সরকারকে নাস্তিক আখ্যা দেয়। সরকার সেকুলারাইটিস রোগে আক্রান্ত বলে প্রচার করা হয়। ধর্মান্ধদের এরকম উন্মত্ততা দেখে কংগ্রেসের দুর্বল মানসিকতার লোকজন ঘাবড়ে যায়। তারাও আম্বেদকার ও নেহেরুকে বিলটি পাশ না করে ফেরত নেবার জন্য অনুরোধ করতে থাকে।


আম্বেদকার তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। পণ্ডিত নেহেরুও নৈতিকতার দায় থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি ঘোষণা দেন, এই বিলটি ফেরত নিলে তিনি ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারাবেন। তাই কোনোভাবেই তিনি বিল ফেরত নিতে চান না, বরং পুনরায় পাশ করার চেষ্টা করতে চান।


যারা সরাসরি মৌলবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন, কিন্তু মনে মনে মৌলবাদী, তারা এই বিলের একটু অন্যভাবে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, শুধু এক ধর্মের জন্য আইন বানানো কতোটুকু উচিত? একাধিক বিয়ে করা যদি হিন্দুদের জন্য নাজায়েজ হয়, তবে মুসলমানদের জন্য জায়েজ কেন? যাদের ভোটে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে আইন বানানো হলে, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য আইন বানানো হচ্ছে না কেন? সরকার কি মুসলিমদের ভয় পায়?


বিল পাশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন নেহেরু। সরকারের সময়ও শেষ হয়ে আসছিল। এসময় আম্বেদকার নেহেরুকে আবেদন করেন যে তাঁর শরীর খারাপ হচ্ছে। তিনি বিল পাস হবার পরেই নিজেকে ডাক্তারের হাতে ছাড়তে চান, তার আগে না। নেহেরু আবার চেষ্টা করেন। আরও ভয়াবহ বিরোধিতা আসে।


বছরখানেকের মধ্যেই ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবার জন্য সময় দরকার ছিলো। তাই সব দিক বিবেচনা করে, পণ্ডিত নেহেরু বিল ফেরত নেবার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ঘোষণা দেন, কংগ্রেস যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তখন এই বিল পুনরায় উত্থাপন হবে। ওই সেশনে বিল পাশ না হওয়ায় ড. আম্বেদকার অভিমানে ইস্তফা দেন এবং চিরদিনের জন্য কংগ্রেস ত্যাগ করেন।


ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল সেই হিন্দু কোড বিল। এটাই মনে হচ্ছিলো জেতা-হারার ফ্যাক্টর। এটা ছিলো অনেকটা হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নেহেরু আর কংগ্রেসের নৈতিক যুদ্ধ। হিন্দুবাদীরা শুধু আইনের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নেহেরুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী দেয় এবং নির্বাচিত হলে এই বিল চিরকালের জন্য আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এলাহাবাদের ফুলপুর আসনে নেহেরুর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সে সময়ের বিখ্যাত ধর্মনেতা প্রভুদেব ব্রহ্মচারী।


হিন্দুবাদী নেতার জনপ্রিয়তা এবং প্রতিটি বক্তৃতায় নেহেরুর হিন্দু কোড বিলের পক্ষে বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল, নেহেরুর হার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু হিন্দুবাদীদের লম্ফঝম্প বেশি হলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে জয়লাভ করেন নেহেরু। তাঁর দল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে ফিরে আসে। ফিরে এসেই তিনি পুনরায় সেই বিল তোলেন। ১৯৫৬ সালের মধ্যে ৪টি আইনে ভাগ হয়ে বিলটি পাশ হয়।


অনেক বছর পার হয়ে গেছে। আজ সেসব ইতিহাস। ভারত ড. আম্বেদকারকে ভারতরত্ন ঘোষণা দিয়েছে, সংবিধান নির্মাতার সম্মান দিয়েছে, দলিতের ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবাদপুরুষ আখ্যা দিয়েছে। এমনকি আজকের বিজেপিও তাঁর সংস্কারকে সম্মান দেখায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ড. আম্বেদকারকে মরতে হয়েছিলো নাস্তিক, দেশবিরোধী, ছুপা মুসলিমসহ আরও বহু গালিময় আখ্যা নিয়ে।

সমসাময়িক ইতিহাস নিয়ে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেয়া দরকার। তবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা নেয়া দরকার আমাদের সাধারণ জনগণের। মনে রাখতে হবে, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা অন্য যেকোনো নামে উন্মাদনা যতো বেশিই হোক, শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়। উন্মাদনা দেখে ভুল পথে হাঁটলে হয়তো সাময়িক জয় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পরাজয় হয়েই দেখা দেয়।

তোমার সুরে সুরে -এণাক্ষী সাহা
Nov. 27, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:810 | likes:3 | share: 0 | comments:0

গণিত কী? গণিত আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কেউ বলবে,

"বা রে! এটা আবার প্রশ্ন হল? সকালে কখন উঠব, কোন কাজে কত সময় দেব, কতক্ষন পড়াশোনা করব, বাজার করতে গিয়ে কিভাবে দরদাম করব, দিনের শেষে আয়ব্যয়ের হিসেব করবো -- গণিত ছাড়া তো কোনোটাই হবে না।"

চিন্তাশীল ছাত্ররা আরেকটু গভীরে গিয়ে বিষয়টা ভাববে। তারা বলবে, "হুম... গণিত তো একটা গুরুত্বপূর্ণ tool -- পদার্থবিদ্যা হোক বা জীববিদ্যা, কিংবা রসায়ন। সবেতেই তো গণিতের কমবেশি প্রয়োগ রয়েছে। গণিত না শিখে কোনোটাকেই শেখা যাবে না।"


উপরের কথাগুলো প্রতিটিই ঠিক। এ কথা মোটেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে জীবনের সবক্ষেত্রে গণিত কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে!

এবারে আরেকটু গভীরভাবে ভাবা যাক, মনটাকে আরো একটু শান্ত করে। কেন গণিত বিষয়টা সবকিছুতে নাক গলালো এরকম? কেন উচ্চস্তরে গিয়ে গণিত এবং পদার্থবিদ্যা পরস্পরের আরো কাছাকাছি চলে আসে? কেন মহাবিশ্বের সবকিছুকেই এদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় বা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়?

আসলে পুরো বিষয়টা যেন একটা সেট অফ রুলস -- যা পুরো বিশ্বজগতে একই। আর তা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এক। কোথাও কোনো অন্যথা নেই। আমরা গণিত তৈরি করিনি, আমাদের জন্মের আগে থেকেই গণিত রয়েছে। তখনই মনে প্রশ্ন জাগে যে কেন এমনটা হলো - কে তৈরি করলো এই নিয়মগুলো। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমরা ধরে নিই ঈশ্বরই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাহলে বিজ্ঞানকে ঈশ্বরের ভাষা আর গণিতকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বললে অত্যুক্তি হয় কি?


এতক্ষণে নিশ্চয়ই একটু হলেও উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে জীবনে গণিতের গুরুত্বটা আসলে আলু-পটলের দরদাম বা সিমেন্ট-বালির হিসেব কিংবা পদার্থবিদ্যার পরীক্ষায় পাশ করার চেয়ে অনেক অনেক বেশি গভীর! মহাবিশ্বের সুনিপুণ সূক্ষ্ম ডিজাইনকে জানার উপায় হলো গণিত। মহান স্রষ্টার লীলাখেলা বোঝার উপায় হলো গণিত। 


একটু নিজের দিকে তাকানো যাক। এই যে আমি, একজন গণিতপ্রিয় ছাত্রী (যদিও পড়ছি ডাক্তারি), আমার আসল পরিচয় কী? আমার signature কী? আমিও মানুষ। আরেকটা মানুষের সাথে আমার পার্থক্য কোথায়? কেউ বলবে, জেনেটিক গঠন। তোমার আমার জিনের মৌলিক উপাদানে কি আদৌ কোনো পার্থক্য আছে? নেই। তোমার ডিএনএ-তে যেসব পিউরিন বা পিরিমিডিন বেস রয়েছে আর আমারটায় যেসব রয়েছে, তারা একই। দেহকে অণু-পরমাণু স্তরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা সবচেয়ে সহজে অনুভব করা যায়। যদি বলি, আমাদের পার্থক্য রয়েছে আমাদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতির মধ্যে, তাহলে তো এটাও জানা যে সেগুলোর উৎসস্থল আমাদের ব্রেন। কিন্তু ব্রেনের মধ্যেও তো তফাৎ নেই! মৌলিক উপাদানটা তো একই - একগুচ্ছ নিউরন, যাদের আন্তঃযোগাযোগের ফলে জন্ম নেয় সব চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি; তৈরি হয় বুদ্ধি, স্মৃতি, যুক্তি। তোমার নিউরন আর আমার নিউরন তো একই, একই অণু পরমাণু কিংবা আরো গভীরে গিয়ে বলতে হলে, একই মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি। সবই ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের খেলা। এদেরই একেকরকম সজ্জা, একেকরকম ইন্টারঅ্যাকশন দিয়ে তৈরি হয় একেকটা মৌল। সেইসব মৌল জুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য রকমের যৌগ। একেকরকম তাপমাত্রায় তাদের একেক রকম আচরণ। ভেতরে সবটাই আসলে এক। দূর আকাশের নীহারিকার ভেতরে যা আছে, ঠিক সেই উপাদানই রয়েছে একটা পিঁপড়ের শরীরেও। 

যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে,

তাই আছে দেহভাণ্ডে।


অর্থাৎ এই সম্পূর্ণ বিশ্বজগৎ জুড়ে ছড়িয়ে আছে একই উপাদান, এক মহাচৈতন্য, এক আদি অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা-- যাকে আমাদের বৈদিক যুগের মুনি-ঋষিরা বর্ণনা করেছেন ব্রহ্ম নামে। উপনিষদে ব্রহ্ম কথার ধ্বনিগত অর্থ হিসেবে বলা আছে - যা সর্বব্যাপী, যা সকল বস্তুর মধ্যে  প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাপ্ত। এই আদিসত্ত্বাই বিশ্বজগতের উৎস, বিশ্বজগৎ আসলে এই বিমূর্ত আদিসত্ত্বারই মূর্ত প্রকাশ। মূর্ত বলেই সেখানে নানারকম ভাঙা গড়ার খেলা চলে প্রতিনিয়ত। কোয়ান্টাম থিওরিও এই পরিবর্তনশীল জগতের মূর্ত রূপের মধ্যে মিশে থাকা বিমূর্ত সত্ত্বার অস্তিত্বকে সমর্থন করে। আসলে সবই ব্রহ্ম। জগতের সবকিছুর মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে ব্রহ্ম। ব্রহ্মই আমাদের উৎস, বিনাশের পরেও ঠিকানা সেই ব্রহ্ম। আমাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই এক অসাধারণ যাত্রা -- ব্রহ্ম থেকে সৃষ্টি হয়ে ব্রহ্মের সাথেই মিলিত হওয়ার যাত্রা! কারোর ক্ষেত্রে এই যাত্রার পথ হয় জ্ঞানযোগ, কারোর ক্ষেত্রে কর্মযোগ, কারোর ক্ষেত্রে ভক্তিযোগ আবার কারোর ক্ষেত্রে হঠযোগ। ব্রহ্ম যেন চরাচরব্যাপী এক অপূর্ব সুর! যে সুর শোনার জন্য মনের সঠিক টিউনিং দরকার --

কবিগুরুর ভাষায়,

"আমার এ তার বাঁধা কাছের সুরে

ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে,

গানের লীলার সে কিনারে 

যোগ দিতে কি সবাই পারে,"


সেজন্যই তো বিজ্ঞানের চর্চা, গণিতের চর্চা! তুমিও ব্রহ্ম, আমিও ব্রহ্ম। "তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে"-ই তো জীবনের বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। তাই গণিত শুধুই দুয়ে দুয়ে চার আর মাইনাসে মাইনাসে প্লাস এর মত কয়েকটা সূত্র নয়। গণিত মানে একগুচ্ছ চাবি -- মহাসৃজনের অজানা রহস্য উদ্ঘাটনের চাবি।

যুক্তিবাদী নবধারার অভিবর্তন -মহম্মদ মহসীন
Nov. 27, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:818 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অভিবর্তন অর্থাৎ উত্থান। যুক্তিবাদ, যুক্তিবাদভিত্তিক চেতনার উন্মেষ প্রকৃতির বিবর্তন নিয়ে কিছু পড়াশুনা করলে জানতে পারা যায়, বিভিন্ন যুগে তার পরিশীলন পরিসরের তাবৎ পরিবর্তন ঘটে গেছে, বিশেষত রেঁনেসাঁ পরবর্তী যুগে, সারা পৃথিবীজুড়ে যে শিল্পায়ণ ঘটে, তার ফলে মানবসমাজে এসে গেল নবধারার উত্থান। কয়েকটি ধাপে এই পর্যায়গুলির ক্রমান্বয়ী আগমন ঘটে। সেগুলি বলা যায়, the Age of Reason, the Scientific Revolution, the Age of Revolution, the Industrial Revolution, the Age of Imperialism ইত্যাদি। রাজনীতি-ধারার যে পরিবর্তন এল, তাতে আরো বেশি বেশি করে ধর্মকে হাতিয়ার করে গড়ে তোলার প্রয়োজন হতে থাকল। আর ধর্মকে যতই যুক্তিবাদের খোলস পরানোর চেষ্টা হতে থাকল, গোঁজামিলের পাহাড় জমা হতে থাকল ততই দ্রুততার সঙ্গে।  

 আশার কথা হল ধর্মের অন্ধতা মানুষের মনকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারে না। তাই ধর্মের গোঁজামিলগুলো একটু ভাবলেই আমাদের কাছে ধরা পড়ে।

  ধর্মের যত বাড়বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সমতালে ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধমতও কিন্তু শক্তিশালী হয়ে উঠছে। 

  মানুষ যদি একটু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ধর্মের দিকে তাকায়, তাহলে ধর্মের গোঁজামিলগুলি সহজেই ধরা যায়। যুগ যুগ ধরে ধর্মগুরুদের মিথ্যাচার সমাজে অসত্যকে সত্যের প্রতিষ্ঠা দেয়।

  ধর্মোপজীবীরা ধর্মকে আশ্রয় করে কেরিয়ার তৈরি করে। রাজনীতির লোকেরা এদের স্পনসর করেন। মানুষে মানুষে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ধর্মের এক 'মহান-অবদান' সমাজে।

 ধর্ম হল, পরিবার, সমাজ ও দেশ হতে দেশান্তরে, ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে, ঈশ্বর, আত্মা, প্রেতাত্মা, পরমাত্মা জাতীয় অস্তিত্বহীন বিষয়কে বিশ্বাসনীয় করে তুলে সেই অন্ধবিশ্বাসের নেশায় প্রতিদিন যাপনের তন্ত্র গঠন করে, ধর্মান্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে ভক্তিরসে জারনের মাধ্যমে অন্ধকারতর পথের দিশায় বিভ্রান্ত করে মানুষের যুক্তিশীল চেতনাকে প্রতিনিয়ত প্রতিহত করার মাধ্যমে রাজনীতি ও ধর্মোপজীবিদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার।

 ধর্ম হলো পরিশ্রম না করে জীবিকার্জনের সহজতম উপায়। 

যেহেতু ধর্ম রাজনীতির এক মোক্ষম হাতিয়ার, ধর্মকে ব্যবহার করে সম্প্রদায়গত আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটবাক্সে সাফল্য পাওয়া যায়, যেহেতু ধর্ম নেশায় আচ্ছন্ন জনগনকে তাদের নেশার বস্তুটি সরবরাহ করতে পারলেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়, তাই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার সমস্যা হয় না। ধর্ম নেশাগ্রস্তদের ধর্মীয় আকাঙ্খা পূরণ করতে পারলেই অনেক দায় পূরণ না করলেও রাজনীতিগত কোনও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, তাই মানুষ ধর্মের অন্ধকারে বাস করুক, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই সেটি চায়। ধর্মনেশায় উৎসাহ যোগায়, ধর্মান্ধতা প্রসারে ইন্ধন যোগাতে চায়।

  এবার সিদ্ধান্ত আপনার, বর্জ্যকে পূজ্য করবেন, না কি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সার্বিক বিকাশের পথে চলবেন।

রসুনের কোষের ন্যায় ধার্মিকরাও এক বিন্দুতে আবদ্ধ -শাহাদাত হোসেন
Nov. 27, 2024 | মুক্তমনা | views:9548 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যে যাই বলুক ইসলাম কখনোই ভিন্নমত ও পথকে স্বীকৃতি দেয় না তথা স্বীকার করে না। ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো অপরকে তার মত ও পথের অনুসারী বানানো। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব,গোষ্ঠীগত ও বিভিন্ন কারণে যত মত পার্থক্যই থাকুক না কেন সর্বশেষে তারা এই মত পোষণ করে যে 

" সকল মুসলমান ভাই ভাই '। ক্ষমতা, গোষ্ঠীগত ও বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দন্দ্ব ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে তারা ভিন্নমত ও পথকে কখনোই মুসলিম ঈমানদার ভাইয়ের চেয়ে প্রাধান্য দিবে না। তাছাড়া প্রকাশ্যে অথবা রননীতি রনকৌশলের কারণে আপোষ করতে বাধ্য হলেও তারা এক ও অভিন্ন থাকবে ও গোপনে মিলিত হবে। নবী মুহাম্মদ হুদাইবিয়ার সন্ধি করেও শক্তি সঞ্চয়ের পর তা ভঙ্গ করেছিলেন। এক মুসলমান অপর মুসলমানের দোষ ডেকে রাখবে- এটি ইসলামী বিধান। তাই তো মাদ্রাসায় বাচ্চাদের উপর এত এর নির্যাতন করার পরেও কোনও হুজুর সমালোচনা করে না।  সৌদি আরবে ঘরে ঘরে বাংলাদেশী গৃহকর্মী নির্যাতিত হওয়ার পরেও হুজুররা সৌদি আরবের সমালোচনা করে না।  ইসলামের নেশা হারাম হওয়া সত্ত্বেও হুজুররা হিরোইন ব্যবসায়ী তালেবানদের সমালোচনা করে না।

মাওলানা ভাসানী সারা জীবন কমিউনিজম এর  রাজনীতি করেও মাথার টুপি, আলখাল্লা ও নামাজ ছাড়ে নাই। সেই ভিতর দিক দিয়ে বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতিকে ইসলামাইজেশন করে দুর্বল করে দিয়েছে। তাই C P B মত কমিউনিস্ট পার্টির অনেক কর্মীদের মুখ শুনা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীন এর আমলে সমাজতন্ত্র ছিল। হুজুর এই কৌশল অবলম্বন করে অচল মালকে অর্থাৎ ইসলামকে সর্বাধুনিক মতবাদ তথা সমাজতন্ত্র বানিয়ে দিয়েছে। আজ বিএনপি রাজনীতি করছে জামাত নিয়ে, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করছে হেফাজতকে নিয়ে। কিন্তু এই দুটি ইসলামিক দলই বিএনপির আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না। কারণ তারা একই কোরআন ও একই হাদিস পড়ে সংগঠন করছে।

জ্ঞানবিজ্ঞানে মুক্তমনাদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকার পরেও ধর্ম ব্যবসায়ীরা এত কৌশলী হল কিভাবে? বিজ্ঞানের মতে কোনও কিছুই কারণ ব্যতীত সংগঠিত হয় না। মুক্তমনাদের জীবিকার জন্য অসংখ্য পথ খোলা রয়েছে কারণ তারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে অনেক কিছুই শিখেছে এবং এদিকেই তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে। ভিন্ন দিকে নজর দেওয়া তাদের পেশার জন্য ক্ষতিকর। তাই তো এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একতা লক্ষ্য করা যায় না।

কিন্তু ধর্মান্ধদের জন্য শুধু ধর্ম ব্যবসা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নাই। কারণ তারা ১৪৫০ বছর পূর্বের আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের অনুপযোগী, ফালতু, বানোয়াট গল্প ভিন্ন আর কিছুই তারা শিখে নাই। এই জ্ঞান দিয়ে বর্তমান যুগে কামলাগিরিও করা যাবে না। ওয়াজ নসিয়ত করে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা যায় সেই যোগ্যতার দ্বারা তারা হয়তো একটি কারখানার নিম্ন পর্যায়ের শ্রমিকের কাজ পাবে। তাতে করে কোটি কোটি টাকা অর্জন করা কল্পনাও করতে পারবে না। তাই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে তারা আন্তরিক হবে এটাই স্বাভাবিক। যত অন্ধা বাড়বে তত নাকি টাকা বাড়তে থাকবে।

আবার এখানে হুরের লোভ দেখিয়ে নাচানোর মত বিশাল এক অন্ধ গোষ্ঠী রয়েছে।

তাই দেশে পরিকল্পিত উপায়ে অন্ধ জনগোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে সুদূর অতীত থেকেই তারা একটি সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে রেখেছে। এটি তিনটি পর্যায়ে সম্পাদন করা হয়।

প্রথমটি হল রেডিক্যাল তথা জিহাদি গ্রুপ, দ্বিতীয়টি হল নির্বিচ্ছিন্নভাবে ইসলাম প্রচার করার গ্রুপ এবং তৃতীয়টি হল মিনিমাইজ করা তথা তাকিয়া গ্রুপ।

সাধারণত ১২ থেকে ২০ বছরের বয়সী অবুঝ যুবকদেরকে জিহাদি বানানো হয়। যাদের ইসলাম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান নাই। ধর্মব্যবসায়ী সুবিধাবাদী নেতৃবৃন্দ ও ধান্দাবাজ ওয়াজিরা কেবল ধান্দা ও ইসলাম প্রচার করে বেড়ায়। মডারেট তাকিয়াবাজরা কখনো যুক্তি প্রমাণে হেরে গেলে বলবে, আরে ভাই এসব মোল্লারা যা বলে এগুলো ইসলাম নয়। অথচ এরা কখনোই মোল্লাদের কার্যকলাপের নিন্দা করে না। বরং এটি তাদের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি কৌশল মাত্র।

তাদেরকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা অথবা সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ও তাদেরকে খুশি করার জন্য মডেল মসজিদ ও মাদ্রাসা বানিয়ে দিলে কোনও লাভ হবে না। এই অকৃতজ্ঞরা যদি একবার গদিতে যাইতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নাম নিশানা বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলবে।

২৭ ফেব্রুয়ারিকে আমরা ভুলিনি! -মুজিব রহমান
Nov. 27, 2024 | মুক্তমনা | views:7885 | likes:0 | share: 0 | comments:0

২০০৪ সালের বই মেলার একটি বিষয় হুমায়ুন আজাদ লক্ষ্য করেন এবং আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণিকে জিজ্ঞাসা করেন, মৌলবীরা এবারের মেলায় আমাদের স্টলে এতো ভিড় করছে কেনো? বিষয়টি তাঁর চোখে পড়েছিল মেলার শুরু থেকেই। ইউনিভার্সিটিতে তার রুমে শুকনো হাড় পেয়েছিলেন বইমেলা চলাকালেই। তখন ওটাকে খুব গুরুত্ব দেননি। আসলে এটা ছিল সিম্বলিক। কিন্তু তাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে এটা কখনো ভাবেননি। ২৭ ফেব্রুয়ারী ০৪ হুমায়ুন আজাদ অন্য দিনের মতো বইমেলার আগামীর স্টলে বসেছিলেন। স্টল থেকে তিনি বের হন সম্ভবত রাত ৯টার দিকে। তারপর হাঁটেন, কয়েকজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। লেখক চত্বরে রফিক আজাদ ও মোহন রায়হানসহ কয়েকজন লেখক ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বসতে বলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে বসেন, একটু সিগারেট খান। সেখানে ছবি তোলা হয়। তারপর আমি যাব বলে বের হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটি পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর তাঁর কিছু মনে নেই। 

আক্রমন করেই ঘাতকরা বোমা ফাটিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রথমে তাকে পুলিশ ও উৎসাহী জনতা ঘিরে রাখে। উপুর হয়ে থাকায় কেউ চিনতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য হাসান শরীফ মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে তোলেন। তিনি চিনতে পারেন হুমায়ুন আজাদকে। রক্তে ভেজা মুখ দেখে চিৎকার করে উঠেন। স্যারের এক পাশের গাল দুই ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছিল। পুরো মুখটা হা হয়েছিল। তিনি দু'পাশে চাপ দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন। তারা হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রিক্সায় উঠানোর চেষ্টা করেন। সম্ভব না হওয়াতে গাড়ির চেষ্টা করেন। কেউ রাজি হয়নি। এরপর পুলিশের ট্রাকে করেই তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ট্রাকে উঠানোর আগে হাসান শরীফের সিনিয়র বন্ধু জনাব বিটু ট্রাকে ওঠেন। ওঠানোর আগে সাংবাদিক জনাব পাভেল ছবি তোলেন। সেই ছবিই পরদিন পত্রিকায় আসে। হুমায়ুন আজাদের পাশেই ছিলেন হাসান শরীফ; পত্রিকায় তার ছবিও আসে। এ নিয়ে তিনি ভোগান্তির মধ্যেও পড়েন। ট্রাকে ওঠালে স্যার জিজ্ঞাসা করেন, বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও? হাসান শরীফ বলেন, হাসপাতালে। স্যার বলেন, আমার চশমা কই? হাসান শরীফ বলে, স্যার আছে। স্যার বলে, আমি পুলিশের গাড়িতে যাব না। হাসান শরীফ বলেন, ঠিক আছে স্যার আমরা নেমে যাব এখুনি। হাসান শরীফ তার ব্লগে লিখেছেন, আহত রক্তাক্ত অবস্থায় আমি কোনও মানুষকে এত শক্ত থাকতে দেখিনি। অন্য কেউ হলে এত ব্যাথা নিয়ে চিৎকার করত। ভয় পেত, কিন্তু স্যার খুব শক্ত দৃঢ় চিত্তে বসে আছেন যেন কেউ কোনও ভুল করেছে। কেউ যেন ভুল করে তাকে কুপিয়ে গেছে। ট্রাক ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে থামে। তারা স্যারকে জরুরী বিভাগে নিয়ে গেলেন। আক্রান্ত হওয়ার পরে পার হয়েছে মাত্র ১১ মিনিট। তারা ৫ টাকা দিয়ে স্লিপ কাটলেন। ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে চিকিৎসক স্লিপ চাইলেন। সেটা ততক্ষণে রক্তে ভিজে গিয়েছিল। ডাক্তার আবারও স্লিপ আনতে বললে তারা আবারও স্লিপ আনেন। শুরু হয় হুমায়ুন আজাদের চিকিৎসা।

হুমায়ুন আজাদের তারপরও যা মনে পড়েছে তা হল তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁর মেয়ে স্মিতা আজাদকে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা এখানে এলে কী করে? তার আগে তাঁর পকেট থেকে মোবাইল, মানিব্যাগ ও হাতঘড়ি তাকে দেন। এরপর আর কিছু তাঁর মনে নেই। পরে যখন তিনি জেগে উঠেন তখন ৩ মার্চ। মাঝখানের সময় তাঁর কিছু মনে নেই। বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর তাঁর সম্ভবত তখন খুবই প্রস্রাবের প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলা একাডেমিতে লেখকদের জন্য এর আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই বলে সম্ভবত রাস্তা পেরিয়ে ওই পাশে গিয়ে প্রস্রাব করেন। তারপরে পূর্ব দিকের ফুটপাত ধরে তিনি এগোতে থাকেন। সম্ভবত যখন তিনি অটোমিক এনার্জির বিপরীত দিকে আসেন তখন মৌলবাদী অপশক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী শায়খ আঃ রহমানের ছোট ভাই আতাউর রহমান সানীর নেতৃত্বে কয়েকজন উগ্র মৌলবাদী তাঁকে আক্রমণ করে। কিন্তু এসব কিছুই তাঁর মনে নেই। এ অংশে তিনি সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রষ্ট। তাঁর তখন মনে পড়েছিল যে, তিনি চিৎকার শুনছেন ছাত্রদের, তারা বলছে: হুমায়ুন আজাদ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর- পুলিশ; তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁকে একটি কাটা পাঙ্গাস মাছের মতো টেনে পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে।

তিনি আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হওয়ার পরেও ঐ দৃশ্যের কথা মনে করতে পারেননি। যারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা তাকে প্রথমে গলার দিক থেকে কেটে ফেলতে চেয়েছিল; না-পেরে তারা মুখের উপর ঘা দিয়েছিল, এবং তারপরেও না-পেরে হয়তো মাথায় ঘা দিয়েছে এবং তিনি তো অদম্য মানুষ— সেজন্যই হয়তো তারা সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি; এবং খুব অবাক ব্যাপার যে, তার হাত কাটেনি কিন্তু বাহুর অংশ কেটেছে। বই মেলা থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন দুটো করে বই নিয়ে আসতেন। তিনি হয়তো সেই বই নিয়ে ফিরছিলেন, ফলে তাঁর হাত কাটেনি কিন্তু বাহুতে তারা আক্রমণ করতে পেরেছে। পত্রিকায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে রক্তাক্ত; ঝরঝর করে তাঁর মুখমন্ডল থেকে রক্ত পড়ছে এবং নিজের চিবুক নিজে চেপে ধরে আছেন: তিনি তখন হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর চিবুক-মুখমন্ডল শরীর থেকে খসে পড়ছে। 

দ্রুতই খবর রটে যায়। আগামী প্রকাশনীর সত্তাধিকারী ওসমান গণি খবর পেয়ে হুমায়ুন আজাদের স্ত্রীকে খবর দেন। সেখান থেকে খবর পান আরেক ভাই সাজ্জাদ কবীর বাদল। তাঁর কাছ থেকে খবর পান ছোট ভাই মঞ্জুর কবীর মাতিন। তবে কি ঘটেছে তখনো তাদের কাছে ছিল অজানা। ছোট ভাই জেনেছে তিনি বই মেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি রিক্সা নিয়ে মোহাম্মদপুরে তার ঔষধের দোকান থেকে ওদিকেই যাচ্ছিলেন। কাঁটাবন এলাকায় এসে খবর পান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেওয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা করছে। হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী, দুই কন্যা ও পুত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান। ডাক্তার ঔষধের একটি ফর্দ ধরিয়ে দেয় তাঁর বড় মেয়ে মৌলির হাতে। সেটা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে থাকেন ঔষধের সন্ধনে। সামনে দেখতে পান ছোট কাকা মাতিনকে। তিনি কয়েক দোকান খুঁজে ঔষধ কেনার সময় লোকজনের কথাবার্তায় বুঝতে পারেন হুমায়ুন আজাদকে কোপানো হয়েছে। দ্রুত ফিরতেই দেখেন অ্যাম্বুলেন্স হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে যাচ্ছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের দিকে। হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা কহিনুর তাকে ঐ অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়তে বলেন। একই অ্যাম্বুলেন্সে উঠেন হুমায়ুন আজাদের ফোলার রোডের বাসার দাড়োয়ান। মাতিন নিজের কোলে আজাদকে শুইয়ে দেন। তিনি কথা বলতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী সন্তানদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। একসময় তিনি মাথার নিচে দেয়ার জন্য একটি বালিশ চান। দাড়োয়ান তাঁর মোটা শার্টটি খুলে দেয়। হুমায়ুন আজাদের মাথার ব্যান্ডেজ ভিজে রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁর মুখ দিয়েও রক্ত বের হচ্ছিল। ডাক্তার মাতিনকে হাত দিয়ে রক্ত মুখ থেকে বের করে দিতে বলেন, যাতে রক্ত মুখের ভিতরে না যায়। তিনি তাই করতে থাকেন। জাহাঙ্গীর গেইট পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদের জ্ঞান থাকে। এর পর তিনি জ্ঞান হারান। 

সিএমএইচে ডাক্তাররা রক্ত চান রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ। রক্ত দেওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ সম্মতি জানায়। এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিক, রিক্সা চালকরাও রক্ত দিতে চান। রাত জেগে থাকেন পরিবারের লোকেরা। তারা ভয়ে থাকেন ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন রাতে হুমায়ুন আজাদের লাশ সরিয়ে ফেলতে পারে কর্তৃপক্ষ। ডাক্তাররা জানান ঔষধপত্র কিনে আনতে হবে নিজেদের। পরে একসাথে বিল পরিশোধ করবেন। পরদিন তাদের জানানো হয়, বিল সরকার দেবে। হুমায়ুন আজাদের বড় বোনের বড় ছেলে পিজির সার্জন। তিনি অনুমতি নিয়ে ওটিতে থাকেন। তার কাছ থেকে খবর পেতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। তিনি আশ্বস্ত করেন হুমায়ুন আজাদ সুস্থ হয়ে উঠছেন। দীর্ঘ-অপারেশন শুরু হয়। ভোর রাতের দিকে অপারেশন শেষ হয়। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে জানা যাবে তিনি বেঁচে উঠবেন কি না। পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘতম রাতটি অতিবাহিত হয় হাসপাতালে। 

তাঁর আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রচারের সাথে সাথেই তাঁর অনুরাগী ও মুক্তচিন্তার মানুষেরা উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের উপর ব্যাপক চাপ প্রদান করেন। সরকার বাধ্য হয় তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। পরদিন ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘তারা বাংলা’ একটি ভুল খবর প্রচার করে যে, ড. হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আবার বাংলাদেশের মিডিয়া সঠিক সংবাদ পরিবেশন করায় বিভ্রান্তি কেটেও যায়।

তাঁকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, কিন্তু সেখানে তাঁর দেহটিকে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে- তাঁর মুখমণ্ডলে কোনো দাঁত ছিল না, ঠিক মতো খেতে পারতেন না, এবং তার শরীরের ভেতরে আরও অনেক ব্যধি এই আক্রমণের ফলে জন্ম নিয়েছিল। তাঁর বাঁদিকের যে স্নায়ু রয়েছে সেগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল, সেগুলো তাঁর মাংসকে এবং অন্যান্য জিনিসকে টানত না; ফলে তাঁর মুখটি বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তিনি উপরের দিকে তাকাতে পারতেন না- মাথা ঘুরতে থাকত- বালিশে শুতে গেলে মাথা ঘুরতো, মাথা তুলতে গেলেও মাথা ঘুরত। খুব স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। সামরিক হাসপাতাল তাঁর চিবুকের ভিতরে ধাতব পাত ঢুকিয়ে দিয়ে এটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, তাঁর মুখের ভেতরে তারা তিনটির মতো স্ক্রু লাগিয়েছিল জোড়া দেওয়ার জন্য; মাথায় অন্তত ৫০ টি সেলাই ছিল। তাঁর ঘাড়ের পেছনে একটি বেশ বড় গভীর ক্ষত ছিল। জীবন তো তাঁর ফিরে পেয়েছিলেন কিন্তু অনেক সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। তাঁর বাঁ চোখ দিয়ে সব সময় পানি ঝরতো। তাঁর বাঁ দিকের দুপাটি দাঁতই পড়ে গিয়েছিল। স্থায়ীভাবে দাঁত বাঁধানোর জন্য এক বছর লাগত, কিংবা খোলা ও লাগানো যায় এমন দাঁতের জন্য লাগত চার মাস। বা গালে সিএমএইচ এ যে তিনটি অস্ত্রোপাচার হয়েছে তার তিনটির গভীর দাগ রয়েছিল। সেগুলো ৬ মাসের আগে অস্ত্রোপাচার করা সম্ভব ছিল না। 

হুমায়ুন আজাদকে ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২২ মার্চ ০৪ তারিখে। সাথে যান আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণি এবং হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুর কবীর মাতিন। কয়েকদিন পরে ওসমান গণি ফিরে আসেন দেশে। মাতিন থাকেন শেষ পর্যন্ত। সিএমএইচ তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেও তিনি অধিকতর সুস্থ হয়ে উঠেন বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার, নার্স তাঁর বিশেষ যত্ন নিয়েছে। তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। এরপরেও তাঁর গালে বড় গভীর দাগ সেসব ঠিক করতে হলে তাঁকে ছয় মাস পরে আবার যেতে হত ব্যাংকক। তারপরে রয়েছে প্লাস্টিক সার্জারী। ব্যাংকক থেকে দাঁত লাগাতে অনেক খরচের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে ঢাকাতেই নিজস্ব চিকিৎসকের কাছ থেকে দাঁত বাঁধান।

ব্যাংকক থেকে ২০ এপ্রিল ০৪ দেশে ফেরার পরে মানবাধিকার ও লেখকের স্বাধীনতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, আমি ছেলেবেলায় একটি বাংলা ব্যাকরণ পড়েছি। সেখানে গোপাল নামে একটি অসাধারণ চরিত্র ছিল। সেই ব্যাকরণটি জানিয়েছে, গোপাল কলা খায়। গোপাল অন্য কিছু খায় না, শুধু কলা খায়। সুশীল বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝি একটি দুর্বল মানুষ। ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। সুন্দর ইস্ত্রি করা পোশাক পরে, মাথায় প্রচুর পরিমাণে তেল দেয় এবং মাঝখানে সিঁথি কাটে- এই ধরনের একটি মানুষ। এই সুশীল সমাজকে দিয়ে আসলে কোনও কাজ হবে না। আমাদের জন্য আসলে অশীল সমাজ প্রয়োজন। যে অশীল সমাজ চিরকাল সমাজকে রূপান্তরিত করেছে, যে শব্দগুচ্ছের বাংলা অনুবাদ সুশীল সমাজ তা হচ্ছে সিভিল সোসাইটি। বাংলাদেশে এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য বাংলা রূপ থাকা দরকার। সামরিক সমাজের বিপরীত হচ্ছে সিভিল সমাজ। আমি এক্ষেত্রে যে বাংলা শব্দটি প্রস্তাব করতে চাই তা হতে পারে জনসমাজ। বাংলাদেশে মানবাধিকার আছে কি না সেটা বোধ হয় খুব বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। একটি বাক্য যথেষ্ট যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। দেশে ফিরে পূর্বের মতোই সাহসী ছিলেন।

'মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেণ্ড দূরে' নামে বই লেখা বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ বের হলে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, বইটির নাম হবে 'মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে'। তিনি বলেছিলেন, মে মাসের মাঝামাঝি আমি আবার লিখতে শুরু করবো। বিষয়বস্তু হবে আমার মৃত্যু অভিজ্ঞতা। জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মৃত্যু হচ্ছে অভিজ্ঞতাহীন একটি ব্যাপার। হামলাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন, আমি বিন্দুমাত্র আশাবাদী নই। কারণ বাংলাদেশ অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয় না। সাঈদীকে ধরতে হবে, মৌলবাদীদের ধরতে হবে তারাই আসলে আমার খুনি।

জুলাই মাসের ২ তারিখ; আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রথমবার এবং শেষবার নিজ গ্রামে আসেন। তাঁকে প্রথমে বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের তরুণ অনুরাগীদের পক্ষ থেকে এবং বিকেলে 'আমরা রাড়িখাল বাসী'র পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি তাঁর অনুরাগীদের প্রথা ভাঙ্গার আহবান জানান। এখানেও বোঝা যায় আক্রমণ তাকে শারীরিকভাবে কাবু করলেও মানসিকভাবে তিনি ছিলেন আগের হুমায়ুন আজাদ। এরপর শুধু সমাধিস্থ হতে রাড়িখাল আসেন। চিরনিদ্রায় শায়িত আছে পৈতৃক ভিটায়। বর্তমানে পাক সাদ জমিন সাদবাদ উপন্যাসের প্রচ্ছদ আঁকা হয়েছে সমাধিতে, যা জ্যোতির্ময় আঙিনা নামে পরিচিত। 

২৪ জুলাই তাঁর একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদকে অপহরণের চেষ্টা করে ঘাতকেরা, ২৫ জুলাই বিকালে টেলিফোনে বোমার ভয় দেখিয়ে তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। এর প্রেক্ষিতে ২৮ জুলাই ০৪ বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে খোলা চিঠি লেখেন। শেষ করেন এভাবে, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও দেশবাসী, এ সঙ্কট মুহূর্তে, বিপন্নতার সময়ে আমার পরিবারের ও আমার জীবন আমি আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম; আপনারাই স্থির করবেন বাংলাদেশের রক্তের বন্যায় কি বিনিদ্র কাঁপতে থাকবো, এবং বিশ্ব শিউরে উঠবে বাংলাদেশকে দেখে, সময় বেশি নেই, এখনই আপনাদের কর্তব্য স্থির করার জন্য আবেদন জানাই।

তিনি ব্যাংকক থেকে ফিরে বলেছিলেন, আমি লিখবো, লেখাই হচ্ছে আমার জীবন, লেখাই হচ্ছে আমার আনন্দ। আমি যদি আরও ৩০ বছর বেঁচে থাকি, এবং তাহলে হয়তো আরো অন্তত ৬০ টি বই লিখবো, এবং এগুলো বিচিত্র ধরনের হবে; তাতে বক্তব্য বা কাহিনী বা আবেগ বহুরূপে প্রকাশ পাবে এবং সেগুলো বাঙালিকে বিকশিত করবে। আমার কাজ কল্যাণে এসেছে, এবং আরো বহু বছর কল্যাণে আসবে।

তিনি তাঁর নিজ ভাষা এবং দেশকেই প্রচণ্ডভাবে ভালবাসাতেন। তিনি উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, আমি চাই না দেশ ছেড়ে চলে যাবো, এবং বিদেশে একজন অত্যন্ত পুরস্কৃত সম্মানিত উদ্বাস্তু লেখক হিসেবে বাঁচতে চাই না। আমি বাঁচব আমার নিজের দেশে, এবং বাংলাদেশে এবং এমন একটি বাংলাদেশ আমি চাই- যে বাংলাদেশ আলবদরমুক্ত, রাজাকারমুক্ত, মৌলবাদমুক্ত।

আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এর আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনের উপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান ৭ আগস্ট। পরিবারের লোকেরা এবং অনুরাগীরা কেউ তাকে একা যেতে দিতে চান নি। কিন্তু তিনি একাই যান। এর মাত্র ৫ দিন পর ১২ আগস্ট মিউনিখস্থ নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনি চেয়েছিলেন ৩০ বছরের আরেকটি জীবন, দ্বিতীয় জীবন। তাঁর ইচ্ছাটা শরীর গ্রহণ করতে পারেনি। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ১৬২ দিন। আজও তার অনুরাগীরা তাঁকে সমানভাবে উপলব্ধি করে। তিনি নেই এটা আজ বড় বেশি অনুভব হয়।

স্কিন ক্যান্সার, সানস্ক্রিন ক্রিম প্রডাক্ট ও সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর -প্রিন্স ফার্দিনান্দ
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:878 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন সংখ্যক মানুষ স্কিন ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয় এবং Malignant melanoma নামক স্কিন ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০ জন এর মতো মারা যায়। বেশিরভাগ স্কিন ক্যান্সারই হয় সাধারণত শরীরের যেসব অংশ (মুখমণ্ডল, ঘাড়, মাথা, হাতের পিছনের অংশ) সূর্যের আলোতে উন্মুক্ত থাকে। [১] 

বেশিরভাগ স্কিন ড্যামেজের জন্য প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে সৌর বর্ণালিতে বিদ্যমান অতিবেগুনী রশ্মিকে দায়ী করা হয়। [২]

তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে অতিবেগুনী রশ্মি ৩ শ্রেনীর হয়ে থাকে। যথা-

১) UVA  (320 to 400 nm)

2) UVB (290 to 320 nm)

3) UVC (100 to 290 nm)


এই তিন অতিবেগুনী রশ্মির মধ্যে Ultra violate C বা UVC বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর দ্বারা শোষিত হয়, ফলে তা পৃথিবীতে আসতে পারে না। কিন্তু  Ultraviolate B বা UVB এবং Ultraviolet A বা UVA সহজেই ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে। কাজেই, UVA এবং UVB উভয়টি দ্বারাই স্কিন আক্রান্ত হতে পারে যার ফলশ্রুতিতে, sunburn, Solar keratosis, photoageing, Skin Cancer, DNA  & RNA Damage এর মতো চরম ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। [৩]

অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির (যেমন, Cataract) কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ তাদের দৃষ্টিশক্তি হারায়। [৪]

কাজেই, ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব থেকে স্কিন ও চোখকে সুরক্ষিত রাখতে একটি কার্যকর ও উচ্চ Sun Protection Factor (SPF) মান সম্বলিত সানস্ক্রিন প্রডাক্টের ব্যবহার খুবই দরকারি। তারই দ্বারাবাহিকতায় দেখা যায়, Skin Brightening প্রডাক্ট (যেমন, Sunscreen Cream বা Day Cream,  Sunscreen Lotion, Sunscreen Moischarizer, Foundation ইত্যাদি) বর্তমানে বিশেষ করে এশিয়ার মার্কেটগুলোতে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।[5]


আমার এই স্টাডির মূল লক্ষ হলো, স্কিন ড্যামেজ ও স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা, মার্কেটে বিদ্যমান বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রডাক্ট থেকে ভোক্তারা কিভাবে একটা ভালো, কার্যকর ও উৎকৃষ্টমানের Sunscreen প্রডাক্ট খুঁজে নিতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও দিকনির্দেশনা দেয়া এবং এসব প্রডাক্টের সাইড ইফেক্ট সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা। 

Sun Protection Factor (SPF):

একটা সানস্ক্রিন প্রডাক্টের কার্যক্ষমতা বা ফলপ্রসূতা সাধারণত পরিমাপ করা হয় তার SPF মান দিয়ে যা In Vivo অথবা  In vitro উভয় পদ্ধতিতেই  মূল্যায়ন করা যায়। যে প্রডাক্ট এর SPF মান যতো বেশি তার কার্যক্ষমতা তত বেশি। SPF কে সাধারণত সংজ্ঞায়িত করা হয় নিম্নোক্তভাবে -

সুরক্ষিত ত্বকে (protected Skin with  sunscreen) এরিথেমা উৎপন্ন করতে অতিবেগুনি রশ্মির যে সময় লাগে তার এবং অরক্ষিত ত্বকে (Unprotected skin without sunscreen) এরিথেমা উৎপন্ন করতে অতিবেগুনী রশ্মির যে সময় লাগে তার অনুপাতকে সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর (SPF) বলে। 

অর্থাৎ

SPF = সুরক্ষিত ত্বকে উৎপন্ন নূন্যতম এরিথেমাল ডোজ/অরক্ষিত ত্বকে উৎপন্ন নূন্যতম এরিথেমাল ডোজ 


নূন্যতম এরিথেমাল ডোজ (Minimal Erythemal Dose) কে আবার নিন্মোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় -


"অরক্ষিত ত্বকে একটি ন্যূনতম, অনুধাবনযোগ্য এরিথেমা  তৈরি করতে পর্যাপ্ত UV আলোক বিকিরণের সর্বনিম্ন সময়ের ব্যবধান বা ডোজকে Minimal Erythemal Dose বা MED বলে।" [৬]


'এরিথেমা' হল ত্বকে সৃষ্ট একধরনের প্রতিক্রিয়া যা সংক্রমণ বা কিছু ওষুধের (যেমন, কসমেটিক ক্রিম) কারণে হতে পারে।


SPF মান নির্ণয় পদ্ধতি:

SPF Value সাধারণত In vivo ও In vitro উভয় পদ্ধতিতেই নির্ণয় করা যায়। 'In vivo' একটি ল্যাটিন শব্দ যা দ্বারা বোঝায়  "Within the living"। মানে যখন কোন রিসার্চ বা কাজ জীবন্ত প্রানীদের উপর বা জীবন্ত প্রাণীদেহের উপর সম্পন্ন করা হয় তখন তাকে বলে In vivo পদ্ধতি। 

অন্যদিকে,  ল্যাটিন শব্দ 'In vitro' দ্বারা বোঝায়  "Within the glass"। অর্থাৎ যখন কোন রিসার্চ বা কাজ জীবন্ত প্রাণীদেহের বাহিরে (যেমন, ল্যাবরেটরিতে) কাচের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে করা হয়ে থাকে তাকে In vitro পদ্ধতি বলে। [৭]

In vivo পদ্ধতি একটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি এবং আরও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় বর্তমানে SPF নির্ণয়ে In vitro technique খুবই জনপ্রিয়। কারণ এক্ষেত্রে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই UV-Vis spectrophotometric পদ্ধতিতে Mansur Equation ব্যবহার করে কোন নমুনার SPF মান নির্ণয় করা যায়। 

কসমেটিক পণ্যের গ্রহনযোগ্য SPF মান:

আমেরিকার  Food and drug administration (FDA) এর নতুন Requirements অনুযায়ী, সাধারণত কোনও সানস্ক্রিন পণ্যের SPF মান সর্বোচ্চ ৬০+ হওয়া উচিত তবে SPF 80+  হলেও সেটা মার্কেটিং এর জন্য অনুমোদনযোগ্য।[৮]


তবে সাধারণত SPF মান খুব বেশি বা খুব কম হওয়া উচিত নয়। কারণ, SPF মান খুব কম হলে তা ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব থেকে  ত্বককে বাঁচাতে পারবে না আবার খুব বেশি হলে তার ব্যবহারে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন-ডি সিনথেসিস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।  SPF মান ১৫ বা তার বেশি এরকম সানস্ক্রিনের সঠিক ব্যবহার প্রায় ৯৮% ভিটামিন-ডি উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।[৯]


সানস্ক্রিন এজেন্টস বা UV -Filters:

কসমেটিক প্রোডাক্ট ফর্মুলেশনে যেসব মেটেরিয়ালস বা কেমিক্যাল সানস্ক্রিন হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাদেরকে সানস্ক্রিন এজেন্ট বা UV - Filter বলে।

UV ফিল্টার বা Sunscreen Agents:

UV Filter গুলো প্রধানত দুই ধরনের। যথা-

১) Topical Agents 

2) Systemic Agents 


Topical Argent গুলো প্রধানত দুই ধরনের। Organic ও Inorganic। Organic Agent গুলোর মধ্যে কিছু আছে যারা শুধুমাত্র UVA ফিল্টার করতে পারে এবং কিছু আছে যারা শুধুমাত্র UVB ফিল্টার করতে পারে। আবার কিছু কেমিক্যাল আছে যারা UVA ও UVB উভয়টিই ফিল্টার করতে পারে। [10]

নীচে Organic UV ফিল্টারগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি কার্যকর কেমিক্যালগুলোর একটি তালিকা দেখানো হল:

UVA ফিল্টারস:

1.Benzophenones

2.Oxybenzone

3.Avobenzone or parsol

4.Mexoryl SX


UVB ফিল্টারস:

1.p-aminobenzoic aacid

2.Padimate O

3.Padimate A

4.Octyl Salycilate

5.Octyl Methoxycinnamate

6.Trolamine Salycilate 

7.Homosalate

8.Octocrylene

9.Ensulizole

Broad Band Organic UV ফিল্টারস:

1.Mexoryl XL

2.Tinosorb M

3.Tinisirb S

Inorganic UV ফিল্টারস:

1.Titanium Dioxide (TiO2)

2.Zinc Oxide (ZnO)

Dual UVA/UVB ফিল্টারস:

1.Mexoryl SX

2.Mexoryl XL

সিস্টেমিক UV filters:

1.Beta-Carotene

2.Carotenoids (Lycopene)

3.Selenium 

4.Ascorbic Acid

5.Green tea polyphenols

6.Aspirin

সাইড এফেক্ট:

সানস্ক্রিন প্রডাক্টের ব্যবহার এ যেমন উপকার আছে তেমনি এর ব্যবহার নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক, উদ্ধেগ ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। [11]

নীচে এগুলোর কয়েকটি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

1. এক স্টাডিতে দেখা গেছে যে, ৭ মাস ধরে SPF 15 বা তার অধিক SPF ক্ষমতাসম্পন্ন সানস্ক্রিন প্রোডাক্ট ব্যবহার করে এরকম প্রায় ২০% মানুষের স্কিনে জ্বালাপোড়া লক্ষনীয়। [12]

২.ফটো এলার্জিক কারণে সৃষ্ট চর্মরোগের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী এজেন্ট হিসেবে Benzophenone, PABA, Eusolex 8020, [13] এবং Octyl Triazone [14] কে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

৩)  একটি রিভিউ স্টাডিতে ৬ ধরনের রাসায়নিক প্রজাতির কার্যক্ষমতা ও মানুষের স্কিনে তাদের নিরাপদ কিনা তা বিশ্লেষণপূর্বক একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হয়েছে।[15] সেখানে প্রধান যে বিষয়গুলো পাওয়া গেছে তা নীচে উল্লেখ করা হলো -


১)Aminobenzoates: এরা ফটোএলার্জি ও ফটোবিষক্রিয়ার মতো কারণের জন্য দায়ী হতে পারে। 

2)Benzophenones: স্কিনে ব্যবহার করার পর এরা শোষিত হয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রক্ত ও মুত্রের সাথে মিশে যেতে পারে। Benzophenone-3 খুব দ্রুতই বিপাক হয়ে যেতে পারে এবং এর বিষক্রিয়া ও উল্লেখযোগ্য। যদিও Benzophenones এর মার্কেট এক্সপেরিয়েন্স সবমিলিয়ে পজিটিভ তথাপি এটি অন্যান্য UV ফিল্টার এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্কিন রিঅ্যাকশন এর জন্য দায়ী। 

৩) Cinnamate গ্রুপের মধ্যে  Octyl Methoxy Cinnamate (OMC) হলো হিউম্যান স্কিনের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ UV ফিল্টার। 

৪) প্রতিষ্ঠিত মার্কেট অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে দেখা গেছে যে, Salycilate  গ্রুপের মধ্যে Octyl Salycilate ও Homosalate হলো দুর্বল UVB ফিল্টার এবং এদের টক্সিসিটিও সন্তোষজনক। 

৫) In vitro প্রদর্শন অনুযায়ী ধাতব অক্সাইডের মধ্যে টিটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড (TiO2) কে Photogenotoxicity র জন্য দায়ী করা হলেও এটা এখন অবধি  একটা বিতর্কের বিষয় কারণ, In vivo পদ্ধতিতে তার বিপরীত প্রভাব  পর্যবেক্ষন করা গেছে। 


৬) প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী Ensulizole ও Octocrylene হিউম্যান স্কিনের জন্য নিরাপদ। 


ভিটামিন-ডি সিনথেসিস:

ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি DNA ড্যামেজের জন্য দায়ী যা স্কিন ক্যান্সার এ রুপ নিতে পারে, কিন্তু এই অতিবেগুনী বর্ণালির একই অংশ আবার ভিটামিন-ডি ফটোসিন্থেসিস এর  জন্য দরকারী। প্রায় ৯০% সংশ্লেষিত ভিটামিন-ডি সরাসরি সূর্যালোক থেকে উৎপন্ন হয়। [16]

কাজেই সূর্যালোক Avoid ও  Exposure  এর মধ্যে একটা যথাযথ ব্যালেন্স বজায় রাখা দরকার। 

Endocrinologist, ডার্মাটোলজিস্ট ও পুষ্টিবিদদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সপ্তাহে প্রায় ২ থেকে ৩ বার ৫-১০ মিনিটের মতো শরীরে (বিশেষ করে, মুখমণ্ডল, ঘাড়, মাথা ও হাতের পেছনের অংশ) সূর্যালোক মাখানো উচিত। [17]


রেফারেন্স:

[1].  Dutra E.A, Oliveira D.A.G.C., E.R.M.Kedor-Hackman,Santoro M.I.R.M.  Determination of sun protection factor (SPF) of sunscreens by ultraviolet spectrophotometry. Bra.J.Pharm.Sci.40,31(2004)

[2]  T.Amnuaikit, P. Boonme. Formulation and characterization of sunscreen creams with synergistic efficiency on SPF by combinatiin of UV filters. Journal of Applied pharmaceutical science, Vol.3pp.01-005, August, 2013.

[3]  T.Amnuaikit, P. Boonme. Formulation and characterization of sunscreen creams with synergistic efficiency on SPF by combinatiin of UV filters. Journal of Applied pharmaceutical science,Vol.3pp. 01-005, August, 2013.

[৪]  Young RW.The family of sunlight-related eye diseases.Optom Vis Sci 1994;71:125-44.

[5]  Boonme P, Ammuaikit T. Effect of cream formulas on SPF values of sunscreen creams containing bemotrizinol and titanium Dioxide as the actives. Isan J Pharm Sci 2013; 9(1):128

[6]  Wood, C, ; MURPHY, E. Sunscreens efficacy. Glob. Cosmet. Ind.,Duluth,v.167,p.38-44, 2000.

[7]  https: //www.healthline.health/in-vivo-vs-in-vitro 

[8]  https: //www.fda.gov/drugs/understanding-over-counter- medicines/questions-and-answers-fda-posts-deemed-final-order-and-proposed-order-over-counter-sunscreen

[9]  Holick MF. Sunlight and vitamin D for bone health and prevention of autoimmune diseases, cancers and cardiovascular disease. Am J Clin Nutr 2004; 80(6 suppl): 1678S-88S.

[10]   S.Gonzalez et al. The Latest on skin photoptotection.Clinics in Dermatology (2008),26, 614-626.

[11]   S.Gonzalez et al. The Latest on skin photoptotection.Clinics in Dermatology (2008),26, 614-626.

[12]  Foley P, Nixon R, Marks R, et al. The frequency of reactions to sunscreens: results of a longitudinal population -based study on the regular use of sunscreen in Australia. Br J Dermatol 1993;128:512-8.

[13]   Bryden AM, Mosely H, Ibbotson SH, et al.Photopatch testing of 1155 patients:results of the U.K. multicenter photopatch dtudy gtoup.Br J Dermatol 2006;155:737-47.

[14]   Darvay A, White IR, Rycroft RJ, et al.Photoallergic contact dermatitis is uncommon. Br J Dermatol 2001;145:597-601.

[15]   Nash JF. Human safety and efficacy of ultraviolet filters and sunscreen products. Dermatol Clin 2006;24:35-51.

[16]   Holick MF. Vitamin-D: a Millennium perspective. J Cell Boichem 2003;88:296-307.

[17]   Holick MF. Sunlight and vitamin D for bone health and prevention of autoimmune diseases, cancers and cardiovascular disease. Am J Clin

Nutr 2004; 80(6 suppl): 1678S-88S.

দাদু কেন ধর্মত্যাগ করলো? -অশোক দাস চার্বাক
Nov. 26, 2024 | ছোটোগল্প | views:2614 | likes:2 | share: 2 | comments:0

"Cogito ergo sum : I think, therefore I am" - Descartes 

     শুধু আহার্য্যগ্রহন বাথরুমগমন আর শয্যাবিনোদনের সময়টুকু বাদ দিয়ে অনবরত চলতো তাঁর মালাজপা। এমন কি ঘুমের মধ্যেও। স্বপ্নের ঘরে প্রায়ই হরিনাম উদ্গিরণ হতো দাদুর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়িয়ে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে 'হরি  দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে' গেয়ে হরিনাম, ভোরে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হরিনাম, শুতে যাবার আগে হরিনাম, হাই তোলার পাপ করার পরে হরিনাম, হাঁচিকাশির পরে হরিনাম, আনন্দে হরিনাম, দুঃখে হরিনাম, গড়গড়ার হুঁকো টানতে টানতে হরিনাম - মানে সদাসর্বদা পুন্যকাম। পুন্যকাজে মন তাঁর অটল।  মক্কেলদের ট্যাক্স ফাঁকি দেবার কৌশল বাৎলানোর ফাঁকে ফাঁকে, মেজদাদুর সাথে শেয়ারবাজারের পর্যালোচনা, রেডিওর খবর শোনা, পাশের বাড়ির জন্মশত্রু জ্ঞাতিভাইদের দাম্পত্য কলহে এরই পাতা, টিভির উন্মাদনৃত্য উপভোগ - কোনো কিছুই তাঁর মালাজপায় বিঘ্ন ঘটাটার পারতোনা। দাদু আমার সব্যসাচী। সব সময় তাঁর ঠোঁট কাঁপছে - গুরুবাবা গুরুবাবা আধবোজা আধ্যাত্যিক চক্ষুদুটি  ভক্তিতে গদ গদ, ভাবের ঘোরে ঢুলু ঢুলু - মালা জপার বিরাম নাই। দিদার বানানো লাল ন্যাকড়ার মধ্যে হাতের মালা লুকিয়ে নিত্য তাঁর গুটি গোনার গুনগুনানি, পুন্যগোনার বিড়বিড়ানি।  কপালে তিলক,গলায় তুলসী। শয়নে স্বপনে - বিজনে মননে অনুক্ষন তাঁর একই ভাবনা - পাপক্ষালন, আর পুণ্য অর্জন। বাড়িময় ধূপধুনোর ধূম্রদূষণ, কাঁসরঘন্টার ঝনঝনানি, রামভজনের প্যানপ্যানানি, শ্যাম বিরহের গানকাঁদুনি মধুমাখা কৃষ্ণনাম  শুনতে শুনতে কান বিষতেতো  যেত মামাবাড়ি এসে।  

          গঙ্গাতীরে প্ৰাতঃভ্ৰমণের সময় কীর্তনীয়াদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাচতে নাচতে কৃষ্ণনাম করতেন তিনি দুহাত তুলে। শরীর-স্বাস্থ্য, আনন্দ পুন্য বাড়তো তাঁর দেহ মন আত্মায় এক সাথে।  পরিচিতদের সাথে দেখা হলে 'নমস্কার' না বলে বলতেন 'জয় গোবিন্দ-জয় নিতাই'। আলাদা কোন পরিশ্রম না করে বাড়তি পুন্য ফোকটে।  স্নানের পর ঠাকুরঘরে পাক্কা আধটি ঘন্টা।  সে ঘরের ঠাকুর সিংহাসনে  ক্লাসিক্যাল ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মধ্যযুগীয় কালী মনসা, নবাগতা সন্তোষীমাতা জয়মাতাদি, অত্যাধুনিক চন্দ্রস্বামী, বালক-নাবালক, জেলমন্দিরবাসী খুনী  রাম রহিম বাবা, পরমপূজ্য সপুত্র  ধর্ষকবাবা শঙ্করাচার্য  সবাই বসে থাকতো চোখবোজাদাদুর চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে  তাকিয়ে আশীর্বাদ দিতে দিতে। তাছাড়া দেওয়ালভর্তি দেওয়ালভর্তি অগুনতি ক্যালেন্ডার  দেবতারাও পেরেকে দুলতেন পাখার হাওয়ায়। আবার রথের মেলা থেকে কেনা কাঠের যীশু পেরেকবিদ্ধ হয়ে ঝুলতেন সেখানে। মাটির এক বুদ্ধদেবও চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতেন কুলুঙ্গিতে বসে। কোন ভগবান খাঁটি, কোনটি ভেজাল সেসব ধর্মীয় কুটকাচালিতে না গিয়ে সব রঙের সব দেবতাদের আশীর্বাদ সাপটিয়ে শুষে নিতেন আমার দাদু।  তাঁর শুধু এক ভয় নরকগমন, আর এক সাধ স্বর্গারোহন। 

            সব তীর্থ তাঁর সপূর্ণ।  হরিদ্বার, হৃষিকেশ, কামরূপ, কামাখ্যা, গয়া কাশী কিচ্ছু বাকি নেই। রামকৃষ্ণ মিশন-ভারত সেবাশ্রমে নিয়মিত চাঁদা,  এককালীন টাকা জমা দিয়ে পুরীদেবের কাস্টমার সার্ভিসে নাম রেজিস্ট্রি করে রেখেছেন দাদু। তাছাড়া কুষ্ঠাক্রান্ত ভিখারী, ফুটপাথকালী, বটতলাশিব, প্লাটফর্মশনি, ঝুপড়ীদরগা, বেদখলকারী  শীতলা-মনসাদের দিকে পয়সা ছোঁড়া, পিতামাতাদের আত্মাধারী কাক কুকুর গুৰুজনাদিদের জন্য বাসি রুটিমুড়ি ছড়ানো কিচ্ছু বাকি রাখেন না তিনি।  কালো পিঁপড়েসহ  গৃহদেবতাদের পাতে নিয়মিত নকুলদানা প্রদানে হাড়কেপ্পন দাদু ছিলেন গৌরীসেন দরাজ। 

            আরো আছে। দাদুর পারিবারিক গুরুবাবা বছরে দু-দুবার দাদুর বাড়িতে দেহ ফেলতেন ক'দিনের জন্য।  সাথে আসত একপাল মেদটেপা চেলা, কল্কিসাজানো চামুন্ডা, আর প্রচার টাউট উমেদার। সেদিন তাঁদের সেবার্থে অন্যান্য উপকরণসহ প্রচুর ঘি আর গাঁজা আনতে হতো।  সেই ঘি বাবার মেদরক্ষা আর গাঁজার ধোঁয়ায় তাঁর মগজ-আত্মাটা থাকত আধ্যাত্বিক।  আর এই সব দানধ্যান, ঘৃত-গঞ্জিকা, রামনাম কৃষ্ণনাম বৈদিক প্রক্রিয়ায় পুণ্যে রূপান্তরিত হয়ে দাদুর আত্মাকে করতো টইটুম্বুর।  

           এহেন পূর্ণধার্মিক দাদু সর্ব প্রকার ধর্ম অভিনয় ছেড়েছুঁড়ে ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত সাধুপুরুষ হয়ে গেছেন।  আশৈশব বয়ে বেড়ানো ধর্মের আবর্জনার গুরুভার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে হয়ে গেছেন সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী ভদ্রলোক - সাহসী মুক্তপুরুষ। চিত্ত হয়েছে তাঁর ভয়ভীতিশুন্য। দেবদেবীদের পাত্তাই দিচ্ছেন না আর। একেবারে ডোন্ট কেয়ার ভাব। দশ আঙুলের তের গ্রহরত্ন আঁটানো আংটি, দুই বাহুতে চার চারটে তাবিজ,গলার রুদ্রাক্ষের মালা - সব নাকি তিনি নর্দমায় বিসর্জন  দিয়েছেন প্রবল ঘৃনায়।  তিনি এখন বাগান করছেন, ছবি আঁকছেন, উপন্যাস পড়ছেন, দিদার সাথে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন ! না, না, "বাবা তারকনাথ", "জয় সন্তোষীমাতা" নয়, - একেবারে সত্যজিৎ-তপন সিনহা, উত্তম-সুচিত্রা,শাহরুখ-কাটরিনা। এমন কি কদিন আগে নাকি দার্জিলিং আগ্রাও ঘুরে এসেছেন সদিদা। 

তীর্থযাত্রা নয় - ট্যুর, ধর্মনিরপেক্ষ ভ্ৰমণ। তাজ্জব কি বাত।  

           দাদুর কথাবার্তা হাবভাবও অন্য রকম হয়ে গিয়েছে।  বেচারা  গুরুদেবের টাউটটা মাসিক তোলা চাইতে আসতে স্রেফ হাঁকিয়ে বলে দিলেন গুরুবাবাকে ভদ্রলোকদের মত খেটে খেতে। গুরুবাবারা নাকি সভ্য লোকেদের মত গতর খাটিয়ে মেদরক্ষা করবেন ! বেচারা দাদুর মাথাটা গেছে একেবারে। মাসকাবারী ঠিকে উড়িয়া দাঁতফোকলা পুরুতটা টিকিতে ফুল গেঁথে,তেলচিটে পড়া মোটা পৈতে দুলিয়ে সাত সকালে আসত ছুটতে ছুটতে। সোজা ঠাকুরঘরে ঢুকে ঠাকুরঘরের গৃহপালিত দেবদেবীদের মুখে ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরনো পানচেবানো লালথুথু ছেটাতে ছেটাতে কি সব দুর্বোধ্য এট্যাং দেহি ওটাং দেহি মন্ত্র বিড়বিড় করে বলেই ঝড়ের বেগে বলে যেত তেনাদের। সবশেষে দাদুর কপালে লাল হলুদের দুরঙা টিপটা লাগিয়ে দিয়েই পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাতো সে  পাশের বাড়ির ষাটটার দোকানে ঝুলিয়ে রাখা গণেশকে মালা পরাতে। এখন এ বাড়ির হাতখোলা খদ্দেরটা হয়েছে তার হাতছাড়া। মাসে সাত টাকা আয় গেছে তার কমে।  পলিথিন ব্যাগে বন্দি হয়ে গৃহদেবতাগণ ঠাঁই পেয়েছেন গুমঘরে - বাতিল করা ভাঙা আসবাবের সাথে।  খালি ঠাকুরঘরে দুটো আলসেশিয়ান বাঁধা। দাদুর নতুন পোষ্য - তাঁর নতুন নেশা। 

            কী হতে পারে? বুড়ো বয়সে ভীমরতি, না কোনো দুষ্ট গ্রহের বৈদিক অভিশাপের প্রভাব? কোন কুসংসর্গের ফলও হতে পারে। যেভাবে যুক্তিবাদী ছেলে ছোকরারা মনোবিকারের চিকিৎসা করা শুরু করেছে! হয়তো দাদুর পবিত্র আধ্যাত্বিক পাগলামী সেরে গেছে। কিংবা এও হতে পারে - সারা জীবন খেটেখুটে  জমানো পুণ্য ফিক্সট ডিপোজিট করে মূল পুণ্য বাড়াচ্ছেন সুদ খাটিয়ে। এখন তাঁর অবসরপ্রাপ্ত পেনশনারদের মত নিশ্চিন্ত অলস জীবন। বিনাশ্রমে পুণ্য বেড়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে। সে পুণ্য ভোগ করবেন পরের জন্মে। 

            দিদাও তাই।  বাংলা ক্যালেন্ডার পঞ্জিকায় যত ব্রত আছে (শুধু শিবরাত্রি ছাড়া - কেন না ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি যদি  শিবঠাকুরের মত ড্রাগএডিক্ট হয়ে যান!) সব তিনি পালন করতেন পরম নিষ্ঠায়।  গতবারও দেখেছি মামাবাড়ীতে পৌষমাসের পিঠেপুলি খেতে এসে। সকাল সন্ধ্যা পূজাপাঠ, শঙ্খ ফোঁকা, কপালে সিঁদুর লেপা,ঘন্টা বাজিয়ে দেবদেবীদের ঝিমুনি ভাঙানো  - কিচ্ছু  বাদ  দিতেন না  দিদা।  শরীর মন সদা পবিত্র রাখতে সারাদিন বারে বারে স্নান করছেন, হাত  ধুচ্ছেন, মাজা বাসনগুলোও, বারে বারে মাজছেন, বারান্দায় ছেটাচ্ছেন গঙ্গাজল, উঠোনময় গোবরজল - হাতে তাঁর ধর্মজাত পবিত্র হাজা।  তাঁর দেহ পবিত্রবাতিকতা দেখে অনেকে পুনর্জন্মবাদীরা অনুমান করতেন দিদা বুঝি  আগের জন্মে মেথরানী ছিলেন। তাঁর ধর্মনেশা আর শুচিবাইয়ের ঠেলায় অতিষ্ট হয়ে আমার মামীরা স্বামীপুত্র সহ বেপাড়ায় ফ্লাট বাড়িতে পালিয়ে বেঁচেছেন।  মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে রান্নাঘরের উপস্থিত বাসন কোসন, ঘরের আসবাবপত্র কিংবা বাগানের গাছ বা বিড়ালটার কাছে  অনুপস্থিত পুত্রপুত্রবধুদের অবিরাম নিন্দা কীর্তনের ফাঁকে পরম নিশ্চিন্তে তিনি দেবসেবা ও পরমগুরু  পতিদেবতার চরণবন্দনা করতেন নিরুপদ্রব খালি বাড়িতে। 

                এহেন দিদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ষোঢ়শীর মত উচ্ছল। হয়েছেন পতি পরম গুরুর অনুগামিনী জীবনমুখী সহধর্মিনী।  নিজের হাতে অপবিত্র মুরগীর ঝোল রান্না করছেন নাতির জন্য। তাও আবার তাঁর শুচিশুদ্ধ রান্নাঘরে। হয়তো একদিন আমার বাড়ির মত গোমাংসও ঢুকবে সে রান্নাঘরে। ঐ রান্নাঘর শুচিশুদ্ধ রাখা নিয়ে মামীদের সাথে এই গত বছরেরও দেখেছি নিত্য ঝগড়া।  এখন সব অন্য রকম।  দিদার গলার হারে লোকনাথের জায়গা দখল করেছে বাহারী লকেটে ! ফুল পাতা দেবতার সিংহাসন থেকে উৎখাত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে টেবিলের ফুলদানিতে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জায়গায় অপবিত্র নজরুল রবীন্দ্রনাথ সেন্টার টেবিলে। কপালের পুরুষতান্ত্রিক সিঁদুর, হাতের নোয়া শাঁখা, মাথার ঘোমটা সব হওয়া। দুনম্বরী লোকদেখানো বাজারচলতি নারীবাদী নয়,একেবারে যুক্তিবিজ্ঞান সম্মত আধুনিক। বুড়ী কলজের এলেম আছে দেখছি। তবে খুব উল্টোপাল্টা গোলমেলে ব্যাপার। পাঠকদের মনে হবে এ সব বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। 


- দুই -

- হটাৎ তোমরা এমন পাল্টি খেলে কেন দাদু?

- ধর্মকর্ম সব ছেড়ে দিলাম দাদুভাই। 

- সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তুদিন  কেন?

- অনর্থক পুণ্য করতে গিয়ে একটি মাত্র মানবজীবন হেলায় হারাচ্ছিলাম। দিন গেল বৃথা কাজে হরিনাম ভজে ....  মানে ঐ সব আর কি। বুড়ো বয়সে মনেও থাকে না শ্লোকগুলো। যাই হোক, better late than never, শেষ জীবনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সব ছেড়ে মনোমধর্ম নিয়েছি। মানুষই আমার দেবতা। দেবপূজার ভড়ং না করে স্বামী বিবেকানন্দের পথ ধরে মানবসেবা, মানবপূজার ধর্ম নিয়েছি। 

- তুমি যে মহাপাপী নাস্তিকদের মত কথা বলছ দেখি। মরার পর তুমি ভিখারী হয়ে জন্মাবে, নরকেও ঠাঁই হবে না তোমার। দেখে নিও। 

- দেখে নেবার সুযোগ কোথায় রে হতভাগা? Dust thou art,  মরার পরে and dust returneth.ধুলায় মিশে যাব আমি মরণের পরে। স্বর্গে বা নরকে গিয়ে  অথবা পুনর্জন্ম লাভ করে কেউ কখনো পাপের শাস্তি পেয়েছে, না পুন্যকাজের পুরস্কার ভোগ করেছে বলে শুনেছিস, না দেখেছিস। সবইতো পুরুত সাধুসন্ত গুরুবাবা ধর্মজীবি পরজীবীদের রটানো  গুজব।  

-এসব অঙ্ক তোমায় কে শেখাচ্ছে দাদু?

- আমার নবগুরু বোস সাহেব। ওনার কাছেই দীক্ষা নিয়েছি আমি।  সাহেবগুরু  আমার চোখ খুলে দিয়েছেন রে ভাই। এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম। পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখিনি  এতদিন। তোদের সুন্দরী দিদার রোমান্টিক মুখটাও এতদিন দেখিনি ভালো করে। ভুবনের আনন্দধারা উপভোগ করিনি।  এখন যৌবনের দিনগুলো হারিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে। খুব। যজাতির মত বা আশিতে আসা ভানু ব্যানার্জীর মত যুবক হয়ে আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোর দিদা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না আমার বিয়ে দিতে। প্রেমই করতে দেয় না, তার বিয়ে। 

- কে তোমার সাহেবগুরু দাদু?


- তিন -

-  চা জলখাবার খেয়েছিসতো?

- একগাদা পিঠেপুলি পাটিসাফটা খেয়ে তোমার জন্য বসে আছি। দিদা  বললো তুমি নাকি আজকাল হরিসভায় না গিয়ে মর্নিং ওয়াক করছো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছ। কিন্তু তোমাকে যৌবনধর্মে দীক্ষিত করলো কে?

- তা হলে প্রথম থেকেই বলি।  নতুন ট্যাক্স অফিসার জেলায় জয়েন করেছেন শুনে অন্য উকিল যাবার আগে তড়িঘড়ি সাহেবের বাংলোয় ছুটে গিয়েছিলাম। সাথে নিয়েছিলাম ঘোষ সুইটস থেকে কেনা একটা বিশাল সন্দেশের প্যাকেট, আর এক বোতল মোরব্বা আর তোদের দিদার ঠকুরবেদীর কিছু ফুল বেলপাতা। প্যাকেটগুলো ভক্তিভরে টেবিলে রেখে নমস্কার করে বললাম "আপনি এ জেলায় এসেছেন শুনে বাবা বক্রেশ্বরের প্রসাদ নিয়ে এলাম আপনার নাম পুজো দিয়ে। আর সিউড়ির বিখ্যাত মোরব্বা। খেয়ে দেখুন। "

 - ওসব প্রসাদ আমার চলে না উকিলবাবু, আমি ঘোর নাস্তিক। অযথা আপনাদের ঠাকুরদেবতাদের চাটুকারিতা খোশামোদ করে সময় নষ্ট করি না। ওগুলো আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। নাতিপুতিদের খাওয়ান ওগুলো। 

বললাম," কি বলছেন স্যার, এসব বাক্য উচ্চারণ করা পাপ। এখানকার বাবা বক্রেশ্বরের আর তারাপীঠের তারা মায়ের মহিমা বোধ হয় আপনি জানেননা স্যার। কোনো সাহেব এনাদের আশীর্বাদ না নিয়ে এ জেলার চেয়ারে বসেননি কখনো।  

- বেচারাদের জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার। এতো কষ্ট করে আপনারা ধর্মাচরণ করে পুন্য  করছেন,, আর আর তার সুফল ভোগ করবেন আপনাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় কোন একজন মানুষ যে এখনো জন্মায়নি এ পৃথিবীতে। 

- বুঝলাম না স্যার,একটু খোলসা করে বলুন।  

- আপনার পার্থিব শরীরে দেহ ও মন ছাড়াও একটা ২১ গ্রাম ওজনের প্রাকৃতিক অঙ্গ আছে বলে আপনি বিশ্বাস বা অনুমান করেন।  আপনার দেহ ও স্নায়ুতন্ত্র চালিত মন নশ্বর। সেগুলো আপনার মৃত্যুর পরে ধংশপ্রাপ্ত হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু শাস্ত্রকল্পিত সেই আত্মাটা অবিনশ্বর। দেখা যাচ্ছে আপনার অনুমিত আত্মাটার কোন মনও নেই, আবার স্মৃতিও নেই। তার প্রমাণ হচ্ছে আপনার শরীরের কোনও এক অনাবিষ্কৃত অংশে আপনার অনুমিত আগের জন্মের  মৃত ব্যক্তির আত্মা সাঁটানো আছে সে অঙ্গটি আগের জন্মের সব কিছু ভুলে গেছে। আর এক বার বলি, আগের জন্মে যে মৃত ব্যক্তিটির দেহে যে আত্মাটি বাস করতো তার কথা আপনার মনে নেই। 

- মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার আপনার কথা শুনতে শুনতে।  

- বিষয়টা যে খুবই জটিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার ভাষার দারিদ্রের কারণে আমিও হয়তো ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। এবার আর একবার  আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি। আমার তথাকল্পিত আগের জন্মে যে অজানা মৃত ব্যক্তির দেহে আমার আত্মাটা বাস করতো, সে ব্যক্তির কথা আমার বা আমার আত্মাটার কিচ্ছু মনে নেই। আপনাদের বাপ দাদারা শিশু বয়সেই  তাঁদেরও পূর্বপুরুষ থেকে বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধ্যান ধারনার ছাঁচ  আমার আপনার সবার অপরিনত কাঁচা মনে ছেপে দিয়েছেন গায়ে কাদামাটিতে টেরাকোটা চাপানোর মত। ছাঁচে ছাপা সেই সনাতনী মৌলবাদী ধ্যানধারনা স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে মননহীন,যুক্তিহীন, প্রশ্নহীন পরিবর্তনভীরু নিশ্চল অলস স্থবির মনে। আমার মত অল্প কিছু কৌতূহলী সাহসী মানুষ নরকের ভয় না পেয়ে মনন করতে করতে নিজের নিজের মনের সেইসব আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ করতে পারে। যারা তা পারেনা তারা মনে করে মৃত্যুর পরে দেহ মন ধংস হলেও আত্মা অমর অবিনশ্বর। তারা ভাবে সেই আত্মা ঈশ্বরের অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ। কোন অজ্ঞাত কারণে ঈশ্বরের সেই অংশ অর্থাৎ আমার আত্মাটাকে পুন্যপুষ্ট করার গুরু দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে, এবং এও ধরে নিচ্ছি যে আমার শরীর ও মন তার কাজকর্মের দ্বারা ঐ আত্মাটাকে পাপে বা পুণ্যে পুষ্ট করে, এবং সেই পুষ্টি অনুযায়ী আমার মৃত্যুর পর আমার আত্মাটা পরজন্মে ফলভোগ করবে অথবা অদৃশ্য কোনো একটা স্বর্গে বা নরকে যাবে। এইতো আপনাদের বিশ্বাস?

- এটা শুধু নিছক বিশ্বাস নয় স্যার, এটাই পরম সত্য।  সব ধর্মের সার কথা।  এই আধ্যাত্বিক লোভেইতো মানুষ ধর্মাচরণ করে। 

- ঠিক আছে, এবার আমার দিকে মন দিন।  আপনার মত গন্যমান্য মানুষেরা আমায় কত খাতির করছেন। অন্ততঃ খাতির করার ভান করছেন। আপনাদের শহরের সবচেয়ে ধনী পুরুষোত্তম আগরওয়ালাও এই খানিকক্ষন আগে  একটা ঢাউস মিষ্টির প্যাকেট কোনো মিঠাইৰ দোকান থেকে কিনে বাবা বজরংবলীর প্রসাদ বলে ভেট দিতে এসেছিলেন।  আমি কিসে তুষ্ট হবো এই চিন্তায় কুল পাচ্ছেন না আপনারা। আমি থাকি বিনি ভাড়ার বাংলোয়, জনগণের পয়সায় তেল পুড়িয়ে ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়াই।  ক্ষমতা ও বিলাসের স্বর্গসুখ আমার হাতের মুঠোয়। অথচ আমার মত ধর্মীয় শাস্ত্রসম্মত  পাপী ভূ-ভারতে আর কে আছে? আপনাদের বাবা বা গুরুবাবাদের এক ছিলিম গাঁজাতো দূরের কথা এক বান্ডিল বিড়ি দিইনি সারা জীবনে। শনি কালী লোকনাথ  রামরহিমবাবাদের পাতে  নকুলদানাও দিইনি। বখরি ঈদ খ্রিস্টমাসে মুসলমান ক্রিষ্টান আত্মীয়দের বাড়ীতে নিষিদ্ধ খাদ্য খেয়ে আসি। তবু আমি এত স্বর্গসুখ ভোগ করি কোন বিচারে?

- সে আপনার পূর্বজন্মের পুণ্যফল। 

- ধরে নিলাম তাই। অর্থাৎ আপনি বলছেন যে আমার পূর্বজন্মে যে ভদ্রলোকটি হাড়মাস কালি করে জীবনভোর পৃথিবীসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত  রেখে যে পুন্য সঞ্চয়  করেছিলেন সেই পুণ্যফল আমি ভোগ করছি।  সে বেচারা কষ্ট করে পুন্য করলো, আর তার ফলভোগ করছে আমার মত মহাপাপী! এতে ঐ ভদ্রলোক, ধরুন ঈশ্বর অক্ষয় ঘোষাল - সে বেচারা কি পেল?

- স্যার, প্রয়াত ঐ অক্ষয়বাবুর আত্মাইতো তার পুণ্যফল ভোগ করছেন আপনার শরীরের মাধ্যমে। 

- মেনে নিলাম আপনার কল্পনা বা অনুমান। ধরে নিলাম আপনার যুক্তি একেবারে খাঁটি বাস্তব। কিন্তু মৃত অক্ষয়বাবুর আত্মা আমার মাধ্যমে তাঁর পুণ্যফল ভোগ করলেও সেই অক্ষয়বাবুর যে এতে কোনো লাভ হয়নি সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? তিনিতো আর ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন বা এই বাংলাবিলাস, আপনাদের দেওয়া ভেটবিলাস উপভোগ করতে পারছেননা। ফাঁক থেকে ভোগ করছে আপনাদের এই বোসসাহেব। গাছ লাগলো একজন,আর তার ফল ভোগ করলো তার অপরিচিত অনাত্মীয় অন্য একটি মানুষ। আমি আমার আত্মার প্রাক্তন মালিক ও পুন্যপুষ্টকারী অক্ষয়বাবুকে কৃতজ্ঞতা জানানোতো দূরের কথা, তাঁকে চিনিই না। 


- এরকম কথাতো জীবনে শুনিনি। একটু ধাতস্থ হতে  দিন। আর একবার আর একটু সরল সহজ করে বলুন স্যার। এরকম ব্যাখ্যা কোনো শাস্ত্রে পড়িনি আগে।   

              - আচ্ছা, ঠিক আছে। কয়েকটা কাল্পনিক উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি শীঘ্র আপনার ভগবানের সাথে মিলিত হবার বাসনায় আত্মহত্যা করার জন্য গলায় দড়ি দিলেন। পুলিশ এসে সিলিং ফ্যান থেকে আপনাকে নাবিয়ে  হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তারবাবু 'braught dead' লিখে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। আর কোন দেরি না করে আপনার দেহ থেকে আপনার চোখদুটো উপড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওটাকে একটি অন্ধ মানুষের চক্ষুকোটরে বসিয়ে দিলেন কোন এক চোখের সার্জন। সেই অন্ধ মানুষটি তখন আপনার চোখ দিয়ে পৃথিবীর স্বর্গীয় দৃশ্য দেখবে। কিন্তু আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। কেননা আপনার অপটিক্যাল নার্ভগুলি সেই অন্ধ বেক্তিটির মাথায় জুড়ে গেছে। সেই একইভাবে  আপনার মৃত্যুর পর স্বামী নিগুড়ানন্দজীর মত কোন আত্মা স্পেশালিস্ট সার্জন ব্রেনডেথের কারণে মৃত কোন এক আত্মাহারা  বেক্তির দেহে আপনার পুণ্যপুষ্ট আত্মাটিকে বৈদিক পদ্ধতির সাহায্যে আপনার দেহের আত্মাকোটরে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই মৃত ব্যক্তির মৃতদেহটি আত্মা ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর আপনার চক্ষু পাওয়া অন্ধ মানুষটির পৃথিবীদর্শনভোগের মত আপনার কষ্টার্জিত পুণ্যফল ভোগ করবে আপনার পবিত্র আত্মার দখল পেয়ে। যেমন আপনার চোখটি অন্ধমানুষটির চক্ষুকোটরে ঢুকে তাকে দৃষ্টিশক্তি দিলেও আপনি কিছু দেখতে পাবেননা, তেমনি আপনার আত্মাটা আপনার পরজন্মের দেহে থাকলেও আপনি অর্থাৎ নবজন্মের দেহটি পাবে লবডঙ্কা। 

             আবার দেখুন, এই যে সব ধনী,কোটিপতি, দুর্নীতিগ্রস্থ মাননীয় নেতা মন্ত্রী,সম্মানীও কয়লামাফিয়া গরুপাচারকারী অথবা প্রণম্য অসৎ চাকরীচোর শিক্ষক ইত্যাদি চোরাকারবারিরা রাজবিলাস উপভোগ করছে, ঠান্ডা গাড়িতে বেড়িয়ে স্বর্গসুখ ভোগ করছে, তাদের আত্মাগুলি নিশ্চই পূর্বজন্মে সফল গুরুবাবা অথবা  আপনার মত পুণ্যাত্মার মানুষের ছিল। সেইসব পূজ্য দেবতাসমান  মানুষদের বিদেহী আত্মা পূর্বজন্ম অর্জিত পুণ্যের প্রভাবে আজ এ জন্মে নেতা মন্ত্রীসুখ, চোরাকারবারীসুখ ইত্যাদী নানা সুখ ভোগ করছে। হতভাগ্য ঐসব আহম্মকদের এত কষ্টের অর্জন করা পুণ্যের ফলভোগ করছে কিনা আমার মত পাপী তাঁদের অপরিচিত মানুষেরা !

          এবার ঐ রাস্তার কুষ্ঠরোগীটির দিকে তাকান, কিংবা কোন জন্মান্ধ বা কোন জন্মবিকলাঙ্গ শিশুটির কথা ভাবুন। কত কষ্ট পাচ্ছে তারা। জীবিত অবস্থাতেই  নরকযন্ত্রণা। অথচ ওরা জন্মের দিন কোনো সুযোগই পায়নি পাপ করবার। ওদের আত্মার পূর্বতন মালিকরা, মনে করুন আমার মত নাস্তিক মহাপাপী কোন বোস সাহেব অথবা পাপিষ্ট চূড়ামনি প্রয়াত হিটলার যত পাপ করেছিল ওদের জীবিত অবস্থায়, তাদের কর্মফল ভোগ করছে ঐ কুষ্ঠরোগীট বা জন্মান্ধ, জন্মবিকালঙ্গ মানুষগুলো! আপনাদের শাস্ত্রীয় অনুমান অনুযায়ী প্রয়াত হিটলারের আত্মা তথাকল্পিত ঈশ্বরদের বিচারে ঐ হতভাগ্য মানুষগুলির শরীরে আশ্রয় পেয়ে শাস্তিভোগ করলেও হিটলার স্বয়ং  কিন্তু কোনও শাস্তি পাচ্ছে না। কি অবিচার!

              তবে হ্যাঁ, যদি আপনি মারা যাবার পর আপনার মন মগজটাও আপনার আত্মার সাথে সাথে  আপনার উত্তরজন্মের মানুষটির দেহে ট্রান্সফার করে দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো আপনার ইহজন্মের পুণ্যফল বা পাপফল আপনিই ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে প্রকৃতি সে ব্যবস্থা রাখেনি। আর আপনাদের পবিত্র শাস্ত্রগুলোও আপনাদের মগজগুলোকে আত্মার মত অবিনশ্বর করে সৃষ্টি করেননি। সাধুসন্তরা আত্মার মত মন অর্থাৎ মগজটাকে শ্রাদ্ধশান্তির সময় দেহান্তরে  চালান করবার ফন্দিফিকির শেখাননি পুরুতঠাকুরদের। মরার পর আপনার তথাকল্পিত অবিনশ্বর আত্মা বেঁচে থাকলেও আপনার মন ও স্মৃতি আর কার্যকরী থাকছে না। অর্থাৎ আপনিও আর থাকছেন না। স্বর্গেও না, মর্ত্যেও না। কেন না আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে আপনার মরণশীল স্নায়ুতন্ত্রটি ধংশপ্রাপ্ত হবে। আর আপনার পূর্বজন্মের মন চিন্তা করতে না পারলে আপনার অস্তিত্ব আর থাকে কী করে? আমার বর্তমান মন যদি আমার মৃত্যুর পরেও চিন্তা করতে পারত, অন্তত আমার আত্মাটাও যদি তা করতে পারত, তাহলে আমিই আমার পুন্যকাজের পুরস্কার বা পাপের শাস্তি পেতে পারতাম।  আর তা যে সম্ভব নয় তার প্রমান আমি আপনি  সবাই। কেউই আমরা তথাকথিত তথাকল্পিত  আমাদের পূর্বজন্মের আত্মাধিকারীর স্মৃতির উত্তরাধীকার পাইনি। অতএব আপনার মৃত্যুর পর আপনার পাপ পুণ্যের ফলাফল ভোগ করবার কোন আশা নেই। যান, মরে যাবার আগে বাড়ি গিয়ে বুড়িকে নিয়ে নাইট শো দেখে আসুন। 

- চার -

            সেদিন বাড়ি ফিরে সারারাত এতটুকু ঘুমাইনিরে দাদুভাই।  মনে হলো ধম্মকম্ম করতে করতে আমার মনুষ্যসুলভ যুক্তিবাদী স্বত্বাটি (rationalist) আমার মনের অজান্তে উবে গিয়ে ধর্মময় হয়ে গেছে। যুক্তিবাদী মন হারিয়ে আমি আর মানুষ নেই। মননহীন পশু হয়ে গিয়েছি। সাহেবের কথাগুলো ভাবছি আর ঘামছি। চোখে নিদ্রা নেই। তোদের দিদাকে সব কথা বললাম খুলে। তখন তারও আমার মত সেই একই অবস্থা। 

             ভোর রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।  হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল  একটা কুস্বপ্ন দেখে।  স্বপ্নে দেখলাম আমি মরে গেছি। আমার দেহটাকে মর্গের থেকে নিয়ে যাবার আগে গবেষণার জন্য বৈজ্ঞানিককে দেখি এক ডাক্তারবাবু আমার মগজ বা মনের কলা, অর্থাৎ পুরো স্নায়ুতন্ত্রটা গোপনে একটা বোয়ামে রেখে দিলো অ্যালকোহলে চুবিয়ে। তবে আমার আত্মাটাকে কব্জা করতে পারল না সে। ফুড়ুৎ করে উড়ে মর্গের ঘুলঘুলি দিয়ে  পালিয়ে গেলো সে আত্মাটা। সেঁধিয়ে গেল সেটা আমার জন্মশুত্রু রামহারামী ফিরোজ উকিলের পুত্রবধূর পেটের ছেলেটার দেহে।  বাকি দেহটা তোদের মামারা 'বলহরি বলহরি' বলতে বলতে চলতে লাগলো নিমতলার দিকে। কিন্তু  তখনও আমি, মানে বোয়েমে রাখা আমার মনটা সব ভাবতে পারছে পুরান  জীবনের কথা। দেখলাম সে হতচ্ছাড়া আমার আত্মধারী ম্লেচ্ছ নাতিটা আমার পুণ্যাত্মার দখল পেয়ে সুন্দর চেহারা, স্কুল কলেজের পরীক্ষায় সুন্দর ফল, লটারির পুরস্কার, আমার বাঁধা মক্কেল, মদের দোকানের লাইসেন্স - সব কিছু হাতাচ্ছে। অকৃতজ্ঞ অব্রাহ্মণটা  আমাকে একটা ধন্যবাদও পর্যন্ত দিচ্ছে না। ম্লেচ্ছ নাতিটার ব্রাহ্মণ আত্মাটা গায়ত্রীমন্ত্র  ভুলে আল্লা আকবর বলে আজান দিচ্ছে গলা ফুলিয়ে। কেমিক্যালে ডোবানো আমার মন-আমার মগজের সাহায্যে বোতলের কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম সব। 

              ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে ঘুম ভেঙে ভাবতে লাগলাম আকাশ পাতাল। আমৃত্যু এত কষ্টে তিল তিল করে জমানো পুন্যগুলো সব ভোগ করবে কিনা ফিরোজ উকিলের নাতি! আমার ডজন ডজন বাঁধা মক্কেলগুলো ওর চেম্বারে লাইন মারবে ! কোভভি নেহি।  সেদিন থেকে সব ছেড়েছি।  এখন আমার স্বর্গের লোভ নেই, নরকের ভয়ও নেই। আর তাই ধর্ম করার দরকারও নেই।  আমি এখন ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সাহসী মানুষ।  

কবিতাগুচ্ছ ২৪ -কবিরা
Nov. 26, 2024 | কবিতা | views:32 | likes:2 | share: 3 | comments:0

ভরসা

লি খে ছে ন – প্র দী প  চ ক্র ব র্তী



মানুষ যখন বুদ্ধিভ্রষ্ট

হারায় চিন্তা শক্তি,

তখনই  আসে ধর্মগ্রন্থ

বাড়ে অন্ধ ভক্তি।


যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে

বাড়ে সমাজের মান,

বিপদ থেকে রক্ষা করতে

আসবে না ভগবান।


মানবতাই পারে শুধু

করতে মন পরিষ্কার,

বিজ্ঞানেতে ভরসা রাখো

দূর করো কুসংস্কার।



থাকুক নির্ভয়ে

লি খে ছে ন – প্রি ন্সি  বে রা



মানবজাতি বড়ই অসহায় আজ

মানসিক ঝড়ের কবলে।

কতক আমফান, ফনী, ইয়াশ নামক

বনমানুষের আচরণে।

তুমি আমি প্রার্থনা করি

অভিমুখ পরিবর্তিত হোক

যাক অপরপানে।

শুধু বলি আমরা যেন বেঁচে থাকি,

প্রভাব ফেলুক ভিনরাজ্যে।

ভুলেও ভাবি না গতি হারাক,

এ ভয়ানক রাক্ষস,

ধ্বংস হোক শয়তানের কারবার।

আমার মতই বাঁচুক সবাই,

সবাই থাকুক নির্ভয়ে।।


ধন্যবাদান্তে,

রমা বেরা, শ্রীচন্দা, উস্থি



বিষয় - রাজনীতি

লি খে ছে ন – প রি ণী তা


লাল, সবুজ, কমলা রঙের ছড়াছড়ি

সব মিলে পা চাটে, নেতাদের পায়ে পড়ি।

শহীদের বেদিতে যত জমা পরে ফুল

তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ দু'টাকার চালে মশগুল।

ধর্ষণ যখন হচ্ছে তখন এনজয় করা হোক

এই বলে নেতাদের মুখ বাঁচিয়ে নেওয়া হোক।

যখন তার মেয়ে বৌ ও ধর্ষণ হবে

তখন যেন আদালতে দেখা যায় না তবে!

তখন বিচার চাইলে আমরাও বলি?

ধর্ষণ তো কি হয়েছে? এনজয় করি!

বিখ্যাত শিল্পীর সিনেমা নন্দনে শো না পায়

এদিকে জামা খুলে মডার্ন শিল্পী কোমর নাচায়।

এ দেশে শিক্ষা নিয়ে দিনরাত চলছে ব্যবসা

ওদিকে এক্সাম এলেই বাড়ছে করোনা।

পেটের দায়ে শরীর বেচা বেশ্যাকে ঘৃণা করি

ফেসবুকে "শাড়িতেই নারী" নামে স্তন এর ভাঁজকে লাইক করি।

লাল, সবুজ কমলা রঙের ছড়াছড়ি

সব মিলে পা চাটে, নেতাদের পায়ে পড়ি।



নিখিলেশ

লি খে ছে ন – রা জু  দ ত্ত


নিখিলেশকে মনে আছে?

লম্বা ছিপছিপে পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি...

এলোমেলো চুল, গালে খোঁচা দাঁড়ি

গোঁফের ফাঁকে প্রসারিত ঠোঁটে

লেগে থাকা স্নিগ্ধ‌ হাসি....


নিখিলেশ.. ওরও হিস্ট্রি ছিল।

তবে দখলটা ছিল সকলের বিস্ময়

অথবা ঈর্ষার।


দুনিয়ার বিকৃত ইতিহাসটাকে দুমড়ে মুচড়ে

নতুন করে গড়বার নেশায় মশগুল

মফ:স্বলের ছেলেটার অতীত জানতে চায়নি কেউ।


নিখিলেশ ছিল হরপ্পা লিপির মত,

আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায়

যার পাঠোদ্ধার হয়নি আজও।

আমাদের কলেজ দিনের স্মৃতিতে

শুধু রয়ে গেছে অবিন্যস্ত নিখিলেশ

ওর এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলের মত।


জিনসটি শার্ট পরা সেদিনের আমরা,

সেন্ট পাউডারে সুরভিত আমরা

ছিলাম আধুনিকতার মলাটে

কুসংস্কারের নতুন সংকলন।

আর আমাদের নিখিলেশ!

যুক্তির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত কুসংস্কারগুলো

ওর তর্জনির ইশারায় জমেছে আবর্জনার স্তুপে।


প্রতিবাদে মুখর নিখিলেশই

ছিল নীরব আন্দোলন।

ঝোলাব্যাগ ঢোলা প্যান্ট পাঞ্জাবি

এলোমেলো চুল না কামানো খোঁচা দাঁড়ি

ঘুণ ধরাতে পারেনি ওর চেতনায়।

মাদুলি তাবিজ পরা ফিজিক্সের অর্ক মধুরিমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে হিস্ট্রির নিখিলেশ..

একা একলাই....


আমরা চিনিনি ওকে

পাগল বলেছে লোকে

আজকে দীর্ঘশ্বাস

প্রগতির গতি রোধ করে বিকৃত ইতিহাস,

নিখিলেশদের প্রয়োজন আজ

প্রতিদিন বারোমাস।

রচনাকাল :- ১২/০৯/১৯

প্রকাশকাল :- ২৭/০৩/২১




জ্যোতিষ বুজরুকি

লি খে ছে ন – ত ন্ম য়



টিয়া পাখি,ল্যাপটপ জ্যোতিষী মহাঢপ

দুর্বল মানুষদের ধরে ওরা খপাখপ,

হাত দেখে বলে দেয় ভাগ্যেতে কী লেখা

হাত যার নেই তবে পাবে কোথা তার রেখা,

শিম্পাঞ্জি,ওরাংওটাং,ওদেরও রেখা থাকে

কেউ কেন পড়ে না তবে ওদের ভাগ্যটাকে।

গ্রহের কোপে পড়লে চলে না জারিজুরি

রাহু, কেতু গ্রহ নাকি? মিথ্যের ফুলঝুরি,

সূর্য, চন্দ্র এসব গ্রহ আবার হল কবে?

ইউরেনাস নেপচুনের নাম কেন বাদ তবে?

আসলে পুরোটাই মিথ্যার বেসাতি

ফন্দিফিকির করে ঠকানোর কেরামতি।

সময়, লগ্ন, রাশি কতসব কায়দা

ফাঁদ পেতে বসে থেকে ওরা তোলে ফায়দা,

জন্ম মুহূর্ত এক হলে সমান ভাগ্যবান

জ্যোতিষীরা পারে না দিতে এরূপ কোনও প্রমাণ।

গ্রহরত্ন পরলে নাকি ভাগ্য বদলে যায়

ছেদ পড়ে কখনো কি শোষণ বঞ্চনায়?

সবার কর্ম জোটে? দারিদ্র্য যায় ঘুচে?

হয় না এসব কিছুই আসলে সবই মিছে।

অনিশ্চিত জীবনে অনেকের করে ভয়

জ্যোতিষীরা সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয়,

জ্যোতিষ বিজ্ঞান নয়,পুরোটাই বুজরুকি

প্রতারণার বিরুদ্ধে চলো প্রতিরোধ গড়তে থাকি।

আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম -অধ্যাপক শ্রী মেঘনাদ সাহা
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:287 | likes:2 | share: 2 | comments:0

ভূমিকা

গত নভেম্বর মাসে আমি কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থ শান্তিনিকেতনে গমন করি এবং কবির অনুরোধে তথায় শিক্ষক ও ছাত্ৰমণ্ডলীর সম্মেলনে একটি বক্তৃতা প্রদান করি ; স্বয়ং কবি এই বক্তৃতায় উপস্থিত থাকিয়া আমাকে অনুগৃহীত করেন। এই বক্তৃতা সমস্ত দৈনিক পত্রে প্রকাশিত হয়। তাহার পর হইতে দৈনিক ও মাসিক পত্রে উক্ত বক্তৃতার বহু সমালোচনা বাহির হয়। সেই সময় হঠাৎ অস্ত্রোপচারে শয্যাগত থাকায় আমি যথাসময়ে এই সমস্ত সমালোচনার উত্তর দানে অসমর্থ হই। সম্প্রতি গত বৈশাখের ‘ভারতবর্ষ’-এ পণ্ডিচেরী-প্রবাসী শ্রী অনিলবরণ রায় আমার বক্তৃতার বিস্তৃত সমালোচনা করিয়া একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ গড়িয়া তুলিয়াছেন। দুঃখের বিষয় উক্ত প্রবন্ধ পাঠে প্রতীত হয়, তিনি আমার বক্তৃতার মৰ্ম্ম গ্রহণ করিতে পারেন নাই, পরন্তু নানারূপ কল্পিত অর্থ করিয়া জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন; তজ্জন্য এই উত্তর দিতে বাধ্য হইলাম। পাঠকবর্গের অবগতির জন্য সর্বপ্রথম আমার শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত বক্তৃতার বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইল।


শান্তিনিকেতন-প্রদত্ত বক্তৃতা

 “কবি আপনাদিগকে তাহার নিজস্ব অতুলনীয় ভাষায় বহুবার তাহার আত্মজীবনের আদর্শ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আদর্শ ব্যাখ্যার প্রয়োজন কি ? এই পৃথিবীতে বহু সভ্যতা উৎপন্ন ও বিনষ্ট হইয়াছে, বহু এ পর্যন্ত বর্তমান রহিয়াছে। আপনারা যদি কোনও সভ্যতার মূল উৎস অনুসন্ধান করেন তবে দেখিতে পাইবেন যে, প্রত্যেক সভ্যতার কার্যপ্রণালী উচ্চ জীবনের আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে। আদর্শই সভ্যতার গতি নির্ণয় করে এবং প্রথম হইতেই আদর্শের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিলে অনেক ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে। অনেক পুরাকালোৎপন্ন ধর্ম ও দর্শনের মূলসূত্র এই যে, বিশ্বজগৎ কোন সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সৃষ্ট ; কিন্তু ‘সৃষ্টিকর্তা সমস্ত ধৰ্ম্মে একবিধ নন। প্রাচীন ইহুদীজাতীয় ধর্মশাস্ত্রে সৃষ্টিকর্তা আইন ও শৃঙ্খলার দণ্ডধার। তাহার আদেশ যে সকলেই বাইবেল-কথিত দশটি নিয়ম প্রতিপালন করিবে এবং যাহারা তাহার অন্যথা করিবে তাহাদিগকে অশেষ দুর্গতি ভোগ করিতে হইবে। আরও অনেক ধৰ্ম্ম মূলতঃ ইহুদীধৰ্ম্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সকল ধৰ্ম্মে ‘সৃষ্টিকর্তার রূপ ইহুদীদের সৃষ্টিকর্তা হইতে খুব বেশী তফাৎ নয়।


ধৰ্ম্মে অসহিষ্ণুতা

যাহারা এইরূপ দর্শনের অনুসরণ করেন তাহাদিগকে কোনও গ্রন্থবদ্ধ নিয়ম পালন করিতে হয়। এই গ্রন্থবদ্ধ নিয়ম ভগবানের বাণী বা প্রত্যাদেশ বলিয়া গৃহীত হয়। এই সকল নিয়ম যাহারা রক্ষা করেন ও ব্যাখ্যা করেন তাহারা সমাজের শীর্ষস্থানীয় বলিয়া গণ্য হন, ভিন্ন মত ইহারা সহিতে পারেন না।


যদি প্রাচ্যতম দেশের দিকে তাকাই তবে দেখিতে  পাই—প্রাচীন চীনজাতির মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে কারিকররূপে


কল্পনা করা হইয়াছে। তিনি হাতুড়ি পিটাইয়া ও কুঠার  দ্বারা পাহাড় কাটিয়া সমস্ত পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন।

সেইজন্য চীনদেশে খুব বড় বড় কারিকর ও স্থপতির সৃষ্টি হইয়াছে এবং চৈনিক সভ্যতায় শিল্পীর স্থান অন্যান্য


সভ্যতার তুলনায় অনেক উচ্চে। চীন-সমাজে সম্মানের পৰ্য্যায় রাজকর্মচারী (Mandarins), কৃষক ও শিল্পী,


বণিক ও যুদ্ধজীবী। হিন্দুর সৃষ্টিকর্তা একজন দার্শনিক। তিনি ধ্যানে বসিয়া প্রত্যক্ষ জগৎ, স্থাবর ও জঙ্গম, জীব


এবং ধৰ্ম্মশাস্ত্রাদি সমস্তই সৃষ্টি করিয়াছেন। সেইজন্য যাহারা  মাথা খাটায়, অলস দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনায় সময় নষ্ট করে এবং নানারূপ রহস্যের কুহেলিকা সৃষ্টি করে, হিন্দু সমাজে তাহাদিগকে খুব বড় স্থান দেওয়া হইয়াছে। শিল্পী, কারিকর ও স্থপতির স্থান এই সমাজের অতি নিম্নস্তরে এবং হিন্দু সমাজে হস্ত ও মস্তিষ্কের পরস্পর কোন যোগাযোগ নাই। তাহার ফল হইয়াছে এই যে, সহস্র বৎসর ধরিয়া হিন্দুগণ শিল্পে ও দ্রব্যোৎপাদনে একই ধারা অনুসরণ করিয়া  আসিয়াছে এবং তজ্জন্য বহুবার যান্ত্রিক বিজ্ঞানে উন্নততর বৈদেশিকের পদানত হইয়াছে।


প্রত্যেক সভ্যতার আদশেই ভুল ত্রুটি আছে এবং বর্তমানে সমস্ত-প্রাচীন, ধর্মাত্মক আদর্শই অসম্পূর্ণ বলিয়া


প্রতিপন্ন হইয়াছে ; কারণ এই সকল ধর্ম তথা আদশ ‘বিশ্বজগতের যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত সেই ধারণা নিছক  কল্পনামলক। প্রাচীনেরা মনে করিতেন, পৃথিবীই বিশ্বজগতের কেন্দ্র, তারকাগুলি ধাৰ্ম্মিকলোকের আত্মা এবং মূখ্য ও অপরাপর গ্রহ মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় সকল প্রাচীন ধর্মেই কল্পিত হইয়াছে যে, পূৰ্বে এক সত্যযুগ ছিল, তখন মানুষ পরস্পর সম্প্রীতি-সুত্রে বাস করিত এবং তাহাদিগকে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে ভুগিতে হইত না। এখন আমরা জানি যে, এইরূপ সত্যযুগের ছবি ভ্রমাত্মক। পৃথিবী বিশ্বজগতে শ্রেষ্ঠ জিনিস নয়, ইহা বিরাট সূর্যের একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র। প্রাচীনকালে ইহা সূর্যদেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ক্রমে শীতলতাপ্রাপ্ত হইযাছে। প্রথমে পৃথিবীতে মানুষ দুরে থাকুক, কোনওরূপ জীবের অস্তিত্ব ছিল না। পরে সর্বপ্রথম অতি নিম্নস্তরের জীব উদ্ভূত হয় এবং ক্রমবিকাশের ফলে অতি আধুনিক কালে বর্তমান মানবের উদ্ভব হয়। সুতরাং ঈশ্বর ধ্যানে বসিয়া এক নিঃশ্বাসে সশস্ত জগৎ, মানুষ ও জাননায়ারের সৃষ্টি করেন নাই।


সহস্র সহস্র বৎসরের অভিজ্ঞতা ও পরস্পরাগত জ্ঞানরাশির উপর বর্তমান সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত। এই দীর্ঘ সময়ে যাবতীয় শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে অনেক নব নব প্রণালী আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং এই সকল আবিষ্কারের ফলে সমাজে বহুবার বিপ্লব সংঘটিত হইয়াছে এবং নূতন ভাবে সমাজগঠন করা হইয়াছে। এক কথায় বলতে গেলে বহুসহস্রবর্ষব্যাপী অতীতের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার উপর বর্তমান সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান যুগের বিশেষত্ব এই যে, মানুষ আপনার হস্ত ও মস্তিস্ক সমানভাবে খাটাইয়া আপনাকে প্রস্তুত করে। বাঁচিয়া থাকিতে হইলে পৃথিবী হইতে আমাদিগকে শক্তি, খনিজদ্রব্য ও কৃষিজাত দ্রব্য সম্যক উৎপাদন করিতে হইবে। ভারতবর্ষে এই যে ‘জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম’ ইহা শেষ হয় নাই, মাত্র সুরু হইয়াছে। কিন্তু এই জীবন সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকে বলেন  যে আমাদিগকে শহর হইতে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করিয়া  কুটীর ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করিতে হইবে। একটু  ভাবিয়া দেখিলেই এই সমস্ত যুক্তির অসারতা বুঝা যায়।  বৈজ্ঞানিকের স্বভাব সর্বদা সংখ্যার সাহায্যে চিন্তা করা। আমাদের দেশে একজন সাধারণ লোক যে পরিমাণে কার্য করে, তাহার সহিত য়ুরোপ ও আমেরিকার সাধারণ লোকের কৃত কার্যের তুলনা করা যাউক। অনায়াসে প্রমাণ করা যায় (এবং অন্যত্র আমি প্রমাণ করিয়াছি) যে আমরা ভারতবর্ষে জন পিছু পাশ্চাত্যের কুড়িভাগের একভাগ মাত্র কার্য করি। তাহার কারণ, পাশ্চাত্য দেশে যত প্রাকৃতিক শক্তি আছে—যেমন জলধারার শক্তি, কয়লা পোড়াইয়া তজ্জাত শক্তি-তাহার অধিকাংশই কার্যে লাগান হইয়াছে।  হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে যে একটা ঘোড়া মানুষের দশ গুণ কাৰ্য্য করিতে সমর্থ এবং য়ুরোপ ও আমেরিকায় যন্ত্রযোগে যে শক্তি উৎপাদন করা হয়, তাহা বৎসরে মাথা পিছু একটা ঘোড়ার ২৪ ঘণ্টাব্যাপী ৩৬৫ দিনের কার্যের সমান। আমাদের দেশে শক্তির অভাব নাই, কিন্তু মাত্র শতকরা দুই ভাগ কার্যে লাগান হইয়াছে। অধিকাংশ কাৰ্যই হস্তে সম্পন্ন হয়, অতএব, মোটের উপর এ দেশে লোকে মাথা পিছু ২০ গুণ কাৰ্য্য কম করে। তজ্জন্য  আমরা য়ুরোপ ও আমেরিকা ইত্যাদি উন্নত দেশের তুলনায়  ২০ গুণ বেশী গরীব। দেশকে সমৃদ্ধ করিতে হইলে দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক শক্তিকে কার্যে লাগাইতে হইবে এবং  সেই ভিত্তির উপর যান্ত্রিক সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।


 গ্রাম্যজীবনের পবিত্রতা সম্বন্ধে আমি কোনও অলীক  আশা পোষণ করি না। আমি মনে করি না যে গ্রামগুলি  বসতির দিক হইতে আদর্শস্থানীয়। যদি শহরবাসী লোক জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে তাহা হইলে তাহারা কেবল গ্রামের যাবতীয় সমস্যাকে জটিলতর করিয়া তুলিবে। গ্রামে ফিরিয়া গেলেই জীবিকানির্বাহের জন্য গ্রামবাসীদিগের সহিত আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লাগিবে, গ্রামবাসীরা আমাদের ভাল চোখে দেখিবে না। গ্রামবাসীগণ


কি চায়? তাহারা চায় ভাল ঘরবাড়ী, পর্যাপ্ত খাদ্য ও বস্ত্র এবং জীবনে অপেক্ষাকৃত প্রচুর অবকাশ ও প্রাচুর্য্য। যদি দেশে প্রচুর কার্যের সৃষ্টি করা হয়, তাহা হইলে এই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়। প্রচুর পরিমাণ কার্যের সৃষ্টি করিলে দেশের যে কেবল দুঃখ ও দারিদ্র্যের সমাধান হয় তাহা নহে, আমাদিগের আত্মরক্ষার খাতিরেও কাৰ্য্য – সৃষ্টির একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক হইতেই বৈদেশিক আক্রমণের মহা আশঙ্কা উপস্থিত হইয়াছে। যদি কোনও দিন এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয় এবং যদি আমরা পুনর্বার বিদেশীয়গণের পদানত হইবার ইচ্ছা না করি—তবে আমাদিগকে য়ুরোপ ও আমেবিকার মত যান্ত্রিক সভ্যতায় শ্রেষ্ঠত্বলাভ করিতে হইবে। ভারতের অনেক শুভাকাঙ্খী আছেন, তাহারা বলেন যে ভারতবর্ষের পক্ষে চিরকাল কৃষি প্রধান হইয়া থাকা উচিত। এই মত অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক বলিয়া মনে করি। যদি আমরা সকলেই গ্রাম্যজীবনে ফিরিয়া যাই, তাহা হইলে মুষ্টিমেয় পুজিবাদীদের পক্ষে শোষণ করা সহজসাধ্য হইয়া পড়ে। পাশ্চাত্য দেশে যাবতীয় “চাবি-শিল্প” – যেমন শক্তি উৎপাদন, যন্ত্রপাতি তৈয়ার, যাতায়াত ও রাস্তাঘাট সম্বন্ধীয় শিল্প ইত্যাদি—সমস্যই রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন এবং কখনও কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বিশেষের খাতিরে এই সমস্ত শিল্পকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা-বহির্ভূত হইতে দেওয়া হয়না। এ দেশেও এই প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে, যেমন ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে চীনের উদ্ধারকর্তা Dr. Sanyat Sen চীনের জন্য পরিকল্পনা করিয়াছিলেন। এইরূপে দেশকে শিল্প প্রদান করিতে হইবে, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে মূলধন তুলিয়া দেশে নানাবিধ নূতন শিল্পপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে এবং তাহা হইলেই আমাদের দেশ য়ুরোপ ও আমেরিকার ন্যায় সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইবে।


রুশিয়ার অনুকরণ নয়

“এই প্রকার দেশব্যাপী শিল্পপরিকল্পনা রুশিয়ার পরিকল্পনা নহে। যদি কোন আদর্শকে ফলবান্ করিতে হয়, তাহা হইলে উহাকে কেবল বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়। রশিয়ার বর্তমান জাতীয় জীবন খানিকটা অপূর্ণ, কারণ এখানে আদর্শে ও কার্যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অভাব। যদি আমরা আমাদের সভ্যতার উৎসকে


পুনরুজ্জীবিত করিতে চাই, তাহা হইলে আমাদের। জীবনাদর্শকে সামাজিক মৈত্রী, সাৰ্বজনীন প্রীতি ও নৈতিকতার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।”


এই বক্তৃতা সম্বন্ধে সমালোচক বলিয়াছেন—“লব্ধপ্রতিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ডক্টর মেঘনাদ সাহা সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে হিন্দুর দশন ও হিন্দু ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে কতকগুলি মন্তব্য প্রকাশ করিয়া যে বক্তৃতা দিয়াছেন তাহাতে তিনি কোনও মৌলিক গবেষণার পরিচয় দেন নাই ; পরন্তু এ বিষয়ে অজ্ঞ ও পক্ষপাতদুষ্ট পাশ্চাত্য সমালোচকগণের কতকগুলি মামুলি, কথার প্রতিধ্বনি করিয়াছেন।”


আমার বক্তব্য- কোনও লোক এত বড়ই হউন স্বীকার না করিয়া তাহার কথার প্রতিধ্বনি করা শনার স্বভাব নয়। আমার বক্তৃতা সম্পূর্ণ মৌলিক। আমি কোন্ পাশ্চাত্য সমালোচকের মামুলি কথার প্রতিধ্বনি করিয়াছি—তাহার বা তাহাদের নাম, ধাম ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রামাণ্য উল্লেখ উপস্থিত করিলে বাধিত হইব। যদি তিনি তা না করিতে পারেন তাহা হইলে তাহার উচিত এই উক্তি প্রত্যাহার করা। হিন্দুধর্ম ও দর্শনের অপূর্ণতা সম্বন্ধে আমার মন্তব্য তাহার রুচিকর না হইতে পারে, কিন্তু বিনা প্রমাণে কাহাকেও অন্যের উক্তির প্রতিধ্বনিকারী বলিয়া অপবাদ দেওয়া একান্ত ভদ্রজন বিগর্হিত বলিয়া মনে হয়। পুনরায় তিনি বলিয়াছেন, “হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর ধর্ম ও ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানিবার জন্য ডক্টর সাহা যদি কিছুমাত্র চেষ্টা করিতেন, পরের মুখেই ঝাল না খাইতেন, তাহা হইলেই বুঝিতে পারিতেন যে ঐ বিষয়ে ঐরূপ মন্তব্য প্রকাশ করা তাহার ন্যায় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে উপযুক্ত হয় নাই।”


বর্তমান সমালোচকের মত অনেক সমালোচকই বোধহয় কল্পনা করিয়াছেন যে আমি হিন্দুধৰ্ম্মের ও দর্শনের কোন মৌলিক গ্রন্থ পড়ি নাই। এরূপ ধারণা করিবার পূর্বে একটু অনুসন্ধান করিয়া লইলে বুদ্ধিমানের কার্য হইত। যাহা হউক, আশা করি এই প্রত্যুত্তর পাঠে তাহার ভ্রান্তির নিরসন হইবে।  সমালোচক মোটের উপর বলিতে প্রয়াসী হইয়াছেন যে হিন্দু ধর্ম ও দর্শনে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা গঠনের, এমন কি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা গঠনের সমস্ত আদর্শই বর্তমান আছে।


সমালোচকের মতে বর্তমান লেখকের মত অনেক অনভিজ্ঞ লোকে অনর্থক বিভ্রান্ত হইয়া বর্তমান সভ্যতার দিকে আকৃষ্ট হয়। তাহার বিশ্বাস যে হিন্দুর দর্শন ও বিজ্ঞানে ক্রমবিবর্তনবাদ (Thcory of Evolution), পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণবাদ (Heliocentric Theory of the solar system) ইত্যাদি বর্তমান বিজ্ঞানের যাবতীয় মূলতত্ব, এমন কি National Planning পৰ্য্যন্ত স্পষ্টভাবে স্বীকৃত আছে, না হয় বীজাকারে প্রচ্ছন্ন আছে। আমি এই প্রবন্ধে দেখাইব যে সমালোচকের মত শুধু ভ্রান্ত নয়, বিরাট অজ্ঞতাপ্রসূত। পরলোকগত শশধর তর্কচূড়ামণি যখন এইরূপ মতবাদ প্রচার করিতেন, তখন তাহাকে লোকে ক্ষমা করিতে পারিত।


এই সমস্ত মত প্রতিপাদনের জন্য সমালোচক আরম্ভ করিয়াছে–

“হিন্দুধর্ম ও দর্শনের মূল বেদ।”


সমালোচক কি অবগত নহেন যে বিগত ১৯২৩ থঃ অব্দে পরলোকগত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পাঞ্জাবের হরাপ্পা ও সিন্ধুদেশের মহেঞ্জদাররাতে দুইটা অতি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করিয়াছেন— যাহার ফলে ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও মোটামুটী ভারতীয় সভ্যতার উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া গিয়াছে। সমস্ত পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও অধিকাংশ দেশী পণ্ডিতের মতে (যেমন রমাপ্রসাদ চন্দ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষেত্রেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিরজাশঙ্কর গুহ) এই সভ্যতা প্রাগ্বৈদিক ও প্রাক্-আর্য। এই দুইটা নগরী অনুমানিক ৩০০০ পূঃ খৃঃ অব্দ হইতে ২৫০০ পূঃ খৃঃ অন্ধ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। এই দুই নগরের ধ্বংসাবশেষে বৈদিককালীন সভ্যতা বা অসভ্যতার কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় না। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ববিভাগ আবিষ্কার করিয়াছেন যে এই সিন্ধুনদীবাহিত সভ্যতা দক্ষিণে গুজরাট ও পূর্বে গঙ্গাযমুনার অবিবাহিকার উত্তরাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এই সভ্যতা তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতার মত উন্নতস্তরের ছিল। বর্তমানে পণ্ডিতেরা প্রমাণ করিয়াছেন যে হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনের অধিকাংশ উপাদানই উক্ত প্রাগ্বৈদিক, প্রাক-অৰ্য সভ্যতা হইতে গৃহীত—যেমন শিব-পশুপতির পূজা, ধ্যান, যোগ,ফুলনৈবেদ্য দিয়া পূজাপদ্ধতি এবং সম্ভবতঃ পশু, সর্প ও  বৃক্ষদেবতার পূজা (১)


 কাজেই হিন্দুর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে, একথা প্রস্তরীভূত (fossilized) পণ্ডিতাভিমানী ব্যতীত এই যুগে কেহ বলিতে সাহসী হইবেন না।


তথাকথিত বৈদিক সভ্যতার পরিচয় শুধু ঋগবেদের অতি দুর্বোধ্য ঋক্ গুলি হইতে পাওয়া যাইতে পারে কিন্তু বৈদিক সভ্যতার কোন বাস্তব প্রমাণ (material proof) এপর্যন্ত ভারতবর্ষের মাটিতে পাওয়া যায় নাই। পাওয়া গিয়াছে সুদূর এশিয়া মাইনরে ; প্রায় ১৪৪০ পূঃ খৃঃ অব্দের যে Mitanian জাতির মধ্যে উক্ত বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়, তাহারা তৎকালীন মিশরীয় ও বাবিলোনীয় সভ্যতা সম্বন্ধে এতদূর উচ্চধারণা পোষণ করিত যে মনে হয় তাহাদের নিজস্ব সভ্যতা খুবই উচ্চস্তরের ছিল না। অথচ এই সময়ের প্রায় হাজার বৎসর পূর্বে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে প্রায় মিশরীয় সভ্যতার সমতুল্য, সুতরাং বৈদিক সভ্যতা হইতে উন্নতস্তরের প্রাগ্বৈদিক ও প্রাক-আৰ্য সিন্ধুনদীবাহিত-সভ্যতা প্রচলিত ছিল। সুতরাং ধরা যাইতে পারে, যে “বৈদিক অসভ্যেরা” সভ্যতর ভারতবর্ষ গায়ের জোরে দখল করিয়া নিজেদের শাসন স্থাপন করিলেও ভারতীয় সভ্যতাকে সম্পূর্ণ বেদমূলক করিয়া তুলিতে পারে নাই। বেদের কর্তৃকতার নীচে প্রাচীনতর ভারতীয় সভ্যতার ধারা বরাবরই প্রবাহিত হইতেছে। (২)


লেখক হয়ত পণ্ডিচেরী শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে এতটা ব্যস্ত আছেন যে গত পনর বৎসরের জ্ঞানবিজ্ঞানের রাজ্যে নুতন আবিষ্কারের কথা তাহার কর্ণে পৌছায় নাই এবং ধ্যানে বসিয়াও হয়তঃ অন্তদৃষ্টির দ্বারা এই সমস্ত জ্ঞানলাভ করিতে পারেন নাই; কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে তাহার “যদি কিছু মাত্র জ্ঞান থাকিত”, তাহা হইলে তিনি প্রথমেই এতবড় একটা ভুল কথা বলিতে সাহসী হইতেন না।


প্রত্নতত্বের বিসম্বাদপূর্ণ তর্ক না হয় ছাড়িয়াই দিলাম ; কিন্তু তিনি কি জানেন না যে এই ভারতবর্ষেই সভ্যতার উৎপত্তি সম্বন্ধে সিন্ধুদেশীয় প্রাগ্বৈদিক ও প্রাক্-আৰ্য্য সভ্যতার আবিষ্কারের পূর্বেও অন্যরকম মতও প্রচলিত ছিল। তিনি কি জানেন না যে—যে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ রচনা করিয়াছিল সেই উভয়ধর্মেই বেদকে সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। তিনি কি জানেন না যে লোকায়ত মতে


 এয়ঃ বেদকৰ্ত্তারঃ ভণ্ড ধূর্ত নিশাচরা।

অর্থাৎ খৃষ্টের কিছু পূর্বে ভারতবর্ষে একদল যুক্তিবাদী ছিলেন, যারা মনে করিতেন যে বেদের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা দুরূহ ; শুধু কতকগুলি ভণ্ডলোকে বেদের অর্থ না  জানিয়াও বেদের দোহাই দিয়া ভ্রান্তমত প্রচার করে। এখনও এই শ্রেণীর লোকের অভাব নাই।


সুতরাং হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনের গোড়া বেদে খুজিতে যাওয়া প্রায় পনর আনা ভ্রমাত্মক এবং এই ভুলের জন্য সমালোচকের প্রবন্ধটা আগাগোড়া ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ হইয়া আছে।


লেখক ঋগবেদের দশমমণ্ডলের পুরুষসুক্তে ভারতে প্রচলিত জাতিভেদের গোড়া খুজিতে গিয়াছেন। সকল পণ্ডিতদের মতেই দশমমণ্ডল অত্যন্ত পরবর্তী কালের ; শুধু যখন এই সুক্ত রচিত হয় তৎকাল প্রচলিত জাতিভেদের একটী দাশনিক ব্যাখ্যামাত্র। ইহাতে জাতিভেদের উৎপত্তির কোন ইতিহাস নাই, ইহাতে শুধু প্রচলিত জাতিভেদের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য একটা গল্প মাত্র রচনা করা হইয়াছে।


সুতরাং সমালোচক এই সুক্তটী শুধু পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য অথবা আমি জাতিভেদপ্রথার যে অপকারিতা বর্ণনা করিয়াছি তাহার অসারতা প্রতিপাদনের জন্য উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা স্পষ্ট বোঝা গেল না।


লেখকের মতে ঋগবেদের পুরুষসুক্তে প্রচলিত জাতিভেদের দার্শনিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, অর্থাৎ এই সুক্তে রূপকভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে বুদ্ধিজীবী ও ধর্মজীবী লোক স্বভাবতঃই সমাজের ‘শীর্ষস্থান দখল করিবে। এই ব্যাখ্যায় আমার কোন আপত্তি নাই—কিন্তু আমার বক্তৃতায় বলার উদ্দেশ্য ছিল—জাতিভেদের সমর্থনকারী এই মত সমাজের উপর বিষময় প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। এই সম্বন্ধে একজন শ্রেষ্ঠ মণীষীর মত উদ্ধৃত করিতেছি :


When the Indians beleived that some of them had sprung from the head, some from the arms, some from the thigh, others from the feet, of their Creator and they arranged their society accordingly; they doomed themselves to an IMMOBILITY from which they have not been able yet to recover, Mazzinni-in the Duties of People..


প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ পণ্ডিত Sir Icury Maine বলিয়াছেন—


Caste is the most BLIGIITING Institution ever invented by the human mind. সুতরাং পুরুষসুক্তকার জাতিভেদের যে দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়াছেন, তাহার ভাবনৈপুণ্যে মুগ্ধ হইয়া যাওয়া শুধু অসার পাণ্ডিত্যের ভড়ং বই কিছুই নয়—দেখিতে হইবে এই মতবাদ সমাজের উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, সমাজ এই সুক্তকে কি ভাবে গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহার ফল কি হইয়াছে ? সমাজ এই সুক্তের অর্থ গ্রহণ করিয়াছে – যে ব্রাহ্মণজাতীয় লোকে বিরাট পুরুষের মুখ হইতে উৎপন্ন, সুতরাং ব্রাহ্মণজাতিভূক্ত প্রত্যেকেই বিরাটপুরুষের পাদ হইতে উৎপন্ন শূদ্র জাতীয় লোকের মাথার উপর পাদপ্রসারণ করার অধিকারী। কিন্তু শূদ্র শাস্ত্র অধ্যয়ন করিলে সে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য মানিবে না, সুতরাং তাহাকে শাস্ত্রশিক্ষার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে হইবে। এজন্য খৃঃ এর প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে মনুমহারাজের মুখ দিয়া বলান হইয়াছে যে শূদ্র যদি বেদ পড়ে, তাহা হইলে তপ্ত সীসা ঢালিয়া তার মুখ বন্ধ করিতে হইবে। গীতায় কৃষ্ণের মুখ দিয়া বলান হইয়াছে


• চাতুবৰ্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।


 এইরূপ জাতিভেদ সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদ প্রচারেও পূর্বোক্ত অনিষ্টকারী মতবাদের কুপ্রভাব কিছুমাত্র খর্ব হয় নাই। পুরুষসুক্তের উল্লিখিত মতবাদ এদেশে লোকে অক্ষরতঃ বুঝিয়াছে, উহার ফলে এতদ্দেশে, জাতিভেদ অক্ষয় হইয়া বর্তমান আছে এবং স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থসাধনের সুবিধা করিয়া দিয়াছে। এই মতবাদ হইতেই—অস্পৃশ্যতা, বর্ণসঙ্করবাদ ইত্যাদি বহু কুপ্রথা ও কুধারণার উৎপত্তি হইয়াছে।


কিন্তু আমি ব্যাপারটা দেখিয়াছি অন্য দিক দিয়া। আমার মতে এই জাতিভেদপ্রথা হস্ত ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন করিয়া দিয়াছে এবং এই জন্য ভারতে বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা ইউরোপ-আমেরিকার বহু, পশ্চাতে পড়িয়া রহিয়াছে। যিনি বুদ্ধিজীবী, তিনি চিরকাল পুস্তকগত বিদ্যা, টীকাটিপ্পনী ব্যাকরণদর্শনের তর্ক নিয়া ব্যস্ত আছেন এবং লোককে বিদ্যার দৌড় দেখাইয়া চমক লাগানই মধ্যযুগের ভারতীয় পণ্ডিতদের আদর্শ ছিল। বাস্তবজীবনের সহিত তাহাদের সংশ্রব খুবই কম ছিল।। তাহার শিল্প বাণিজ্যের উৎকর্ষের জন্য কখনও মাথা খাটান নাই। করিলে হয়তঃ তাহার জাতিপাত হইত। যিনি যুদ্ধজীবী, তিনি তৎকালপ্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র দিয়া নিজের বীরত্ব দেখাইতেই ব্যস্ত ছিলেন ; কখনও এই সমস্ত অস্ত্রের উৎকর্ষ সাধন বা ভিন্নদেশে প্রচলিত যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা বা দেশে প্রচলনের চেষ্টা করে নাই। ফলে বৈদিক যুগ হইতে এতাবৎকাল পর্যন্ত আমরা একই প্রাগ্বৈদিক চরকাতেই সুতা কাটিতেছি, কাঠের তাতে বস্ত্রবয়ন করিতেছি এবং আধুনিককালেও মহাত্মা গান্ধী আমাদিগকে পুনরায় ‘বৈদিক অসভ্যতায় ফিরিয়া যাইতে বলিতেছেন। বস্ত্রবয়ন, ভূমিকৰ্ষণ, স্থপতিবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদিতে বহুকাল হইতে ভারতে নূতন কোন প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয় নাই। ইহার কারণ জাতিভেদপ্রথা অনুসারে মস্তিষ্কের কাজকে খুব বড় করিয়া এবং সমস্ত হাতের কাজকে হেয় করিয়া দেখা—সেজন্য মস্তিষ্ক ও হস্তের যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। আমি আজ প্রায় বিশ বৎসর যাবৎ প্রাকৃতবিজ্ঞানে শিক্ষাদান করিতেছি এবং য়ুরোপ ও আমেরিকার শিক্ষাপ্রণালী বিষয়েও আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে। আমার অভিজ্ঞতা হইতে বলিতেছি যে এদেশে ছেলেরা নিজহাতে কার্য করিতে অত্যন্ত নারাজ। আমেরিকায় ছাত্র ও অধ্যাপকগণ নিজহস্তে সূত্রধর, কৰ্ম্মকার ও অন্যান্য যন্ত্রশিল্পীর কার্য করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নয় ; কিন্তু এদেশে বিজ্ঞানের ছাত্রগণ উক্তরূপ কার্যকে হেয় মনে করে। বুদ্ধিজীবী লোকে যদি নিজহাতে যন্ত্র লইয়া কার্য না করে, তাহা হইলে উক্ত যন্ত্রের উৎকর্ষ সম্বন্ধে কোন নুতন ফন্দী তাহার মাথায় আসিতে পারে না। য়ুরোপে এই করিয়াই যান্ত্রিক সভ্যতার বর্তমান উন্নতি হইয়াছে। বুদ্ধিজীবী লোকে পুরাতন যন্ত্র দিয়া কাৰ্য্য করার অভিজ্ঞতার ফলে এবং যান্ত্রিকেরা বুদ্ধিজীবী লোকের সংশ্রবে আসিয়া মাথা খাটাইবার ফলে, নব-নব উন্নততর যন্ত্র উদ্ভাবন সম্ভবপর হইয়াছে। য়ুরোপ ও আমেরিকার যান্ত্রিক সভ্যতার অভূতপূর্ব উন্নতির গোড়ার কথা হস্ত ও মস্তিষ্কের সংযোগ।


 বস্ত্রশিল্পের কথাই ধরা যাউক—একজন পণ্ডিত হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে বৈদিক চরকা ও তাঁতের পর বয়নশিল্পে প্রায় ৮০০টী নূতন আবিষ্কার হইয়াছে এবং তাহারই ফলে বর্তমানে বিরাট বয়নশিল্পের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হইয়াছে। এই সমস্ত উদ্ভাবনকর্তাদের মধ্যে Hargreaves ছিলেন নিরক্ষর একজন মজুর, Arkwright ছিলেন Penny-barber (অর্থাৎ তিনি এক পেনী নিয়া লোককে কামাইতেন), Cartright ছিলেন গ্রাম্য পাদ্রী। বাস্পীয় যন্ত্রের (Steam ingine)এর উদ্ভাবনকর্তা James Watt ছিলেন কর্মকার ও যন্ত্রসংস্কারক ; তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Black এর সংশ্রবে আসিয়াছিলেন বলিয়াই বাষ্পীয় যন্ত্র উদ্ভাবনে সক্ষম হইয়াছিলেন। সমালোচক বলিয়াছেন-


“মানুষ মনোময় জীব ; দেহ ও প্রাণ অপরিহার্য হইলেও মনের উৎকর্ষই মানবের উৎকর্ষ। মেঘনাদ বা রবীন্দ্রনাথ কেহই কারিগর নহেন। তাই বলিয়া একজন নিপুণ তঁতী বা মুচীর স্থান তাহাদের উর্দ্ধে হইবে।”


আমার উত্তর—একজন মূখ পুরোহিত যে সংস্কৃত মন্ত্রের অর্থ না জানিয়াই শ্রাদ্ধ বা বিবাহের মন্ত্র পড়ায়, তাহার সামাজিক সম্মান তঁতী বা মুচীর অধিক হইবে কেন? তাঁতী বা মুচী পরিশ্রম দিয়া সমাজের একটা বিশেষ কাজ করে, কিন্তু মূর্খ পুরপহিতকে প্রতারক ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে ? কসাইর ‘ছেলের’ যদি প্রতিভা থাকে, তাহা হইলে ইউরোপে সে Shakespeare হইতে পারিত, কিন্তু এদেশে প্রাচীন প্রথা অনুসারে সে “রবীন্দ্রনাথ” বা “কালিদাস হইতে পারিত না, হইবার চেষ্টা করিলে ভগবানের অবতার রামচন্দ্র স্বয়ং আসিয়া তাহার মাথা কাটিয়া বর্ণাশ্রমধর্ম রক্ষা করিতেন। Bata বা Lloyd Georgeএর মত মুচী বা মুচীর ছেলে প্রতিভা দেখাইলে সমাজে কেন শ্ৰেষ্ঠস্থান পাইবে না?


“অবতারবাদ ও ক্রমবিবর্তনবাদ”

 হিন্দু অবতারবাদ (Theory of Incarnation) এবং বর্তমান বৈজ্ঞানিক ক্রমবিবর্তনবাদ (Theory of Evolution) এই উভয়ের সামঞ্জস্য করিতে যাইয়া সমালোচক আশ্চর্য রকমের গবেষণা শক্তির পরিচয় দিয়াছেন এবং মাঝে মাঝে জন্মান্তরবাদের (Theory of Transmigration of Soul) সহিত উভয়কেই গুলাইয়া ফেলিয়াছেন।


“আশী লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে পেয়েছে মানব জীবন রে।”


এ কথা নিছক জন্মান্তরবাদ এবং ইহার স্কুল মম এই যে, কোন মানুষ পাপ করিলে তাহার নীচ যোনিতে জন্ম হয় এবং বহুলক্ষবার নীচ যোনিতে ভ্রমণ করিয়া পাপের অবসান হইলে সেই আত্মা পুনরায় মানুষ দেহে জন্মগ্রহণ করে এবং মুক্তিলাভের সুযোগ পায় ।


ইহার সহিত পাশ্চাত্য Theory of Evolution এর সামঞ্জস্য সমালোচকের নিজস্ব আবিষ্কার ; কারণ পরলোকগত শশধর তর্কচূড়ামণি, যিনি হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়াছিলেন, অগস্ত্যের সমুদ্রশোষণ কাহিনীকে Electrolysis বলিয়াছিলেন, তিনিও এতবড় আবিষ্কার করিতে সক্ষম হন নাই।


আশ্চর্যের বিষয় এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের অব্যবহিত পরেই সমালোচক এক লম্ফে অবতারবাদে পৌঁছিয়াছেন। তাহার মতে হিন্দু অবতারবাদে পাশ্চাত্য Theory of Evolutionর মূলতত্ব নিহিত আছে। সমালোচকের মত গ্রহণ করিলে বেচারা Darwin নেহাৎ ভাবচৌর বই নন।


 কিন্তু নিরপেক্ষ পাঠক একটু পড়িলেই দেখিবেন যে, সমালোচকের Theory of Evolutionএর জ্ঞান প্রায় নাই বলিলেই হয় ; ইহা মার্জনীয়, কারণ তিনি পাশ্চাত্যবিজ্ঞানের সহিত সম্ভবতঃ অপরিচিত। কিন্তু আমি দেখাইতেছি যে অবতারবাদ সম্বন্ধেও তাহার জ্ঞান ভ্রান্তিপূর্ণ।


“জন্মান্তরবাদে যাহার বিশ্বাস করিবার ইচ্ছা আছে, তিনি করিতে পারেন, আমি নিজে ইহাতে মোটেই বিশ্বাস করি না। কারণ জন্মান্তরবাদের কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ (প্রত্যক্ষ বা আনুমানিক) আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস যে প্রাচীন ভারতে একশ্রেণীর নীতিকারগণ সাধারণ লোককে সৎপথে রাখার জন্য যেরূপ স্বর্গ নরক প্রভৃতি কাল্পনিক, জগতের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তেমনি অন্য শ্রেণীর নীতিকারগণ (প্রধানতঃ বৌদ্ধগণ) জন্মান্তরবাদের সৃষ্টি করিয়াছেন।


 কিন্তু ক্রমবিবর্তনবাদ (Theory of Evolution) সুপরিদৃষ্ট আবিষ্কার ও সুপরীক্ষিত মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহার পশ্চাতে বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক সংগৃহীত পৃথিবীর অতীত যুগের সহস্র সহ প্রাণীদেহাবশেষের আবিষ্কার রহিয়াছে। বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে এই সমস্ত আবিষ্কারকে শ্রেণীবিভাগ করা হইয়াছে, বাদ ও বিচার দ্বারা তাহাদের পৌর্বাপর্য প্রমাণিত করা হইয়াছে এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সুপরীক্ষিত নিয়ম দ্বারা প্রত্যেক জীবযুগের সময় নির্ধারিত হইয়াছে-Darwinএর সিদ্ধান্তে যে সমস্ত ক্রটি বা অপূর্ণতা ছিল, Mendelismএর সাথে যে সমস্ত অসামঞ্জস্য ছিল, তাহাও অনেকটা সমাধান হইয়া আসিয়াছে। এই তত্ত্বের সহিত জন্মান্তরবাদের সাদৃশ্য নেহাৎ কল্পনালোক প্রবাসী ব্যতীত কেহ ধারণাও করিতে পারেন না।


অবতারবাদের মূলসূত্র সম্বন্ধে গীতায় কৃষ্ণের মুখ দিয়া বলান হইয়াছে—


পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্। ধর্মসংস্থাপনার্থায় চ সম্ভবামি যুগে যুগে।


 অর্থাৎ ভগবান্ নিজে সাধুদের পরিত্রাণের জন্য এবং দুষ্টদের বিনাশের জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন।


ইহার সহিত পাশ্চাত্য ক্রমবিবর্তনবাদের সম্বন্ধ আছে: এ নেহাৎ গায়ের জোর ছাড়া একথা কেহ বলিতে পারেন – না। উক্ত মতে অতি প্রাচীন যুগে প্রায় ৫০০ কোটি  বৎসর পূর্বে খুব নিম্নস্তরের জীব পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় । তৎপরে পর পর মৎস্য, সরীসৃপ, পক্ষী, স্তন্যপায়ী জন্তু এবং সর্বশেষ বানর ও মানুষের ক্রমবিবর্তন হয়। ইহার মধ্যে ভগবানের কোন কথাই নাই ; সমালোচক ক্রমবিবর্তন সম্বন্ধে কি পুস্তক পড়িয়াছেন জানি না; কিন্তু কোন্ পাশ্চাত্য পুস্তকে লিখিত আছে যে এককালে এই পৃথিবীতে অর্ধ-মানব অর্ধ-সিংহ জানোয়ারের প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল ?


কোন পণ্ডিত বলিয়া গিয়াছেন যে এককালে মানুষ বামন অর্থাৎ অতি হ্রস্বাকার ছিল। প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে যে মানুষ Pleistocene যুগে নরাকৃতি বানর হইতে মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্রমোৎকর্ষবশতঃ বর্তমান মানুষে (Homo Sapiensএ) পরিবর্তিত হইয়াছে। এই বিবর্তনের স্তরে স্তরে অনেক রকম মানবের অস্তিত্ব আবিস্কৃত হইয়াছে, যেমন Picking Man, Java Man, Neanderthal man, Cro-magnon Man ইত্যাদি, কিন্তু তাহারা কেহই আকারে বামন ছিল না। তাহার পর ক্রমবিবর্তনবাদের সহিত সভ্যতার আধ্যাত্মিক বিকাশের একীকরণ করিতে যাইয়া সমালোচক নানা রকম অবান্তর প্রলাপের অবতারণা করিয়াছেন। তিনি মানবসমাজের সভ্যতার ইতিহাসও জানেন না এবং হিন্দুর অবতারবাদও সম্যক অবগত নহেন। তিনি লিখিয়াছেন, “একযুগে মানুষ সভ্যতার উন্নতি করে, সেইটেই সত্যযুগ। ক্রমশঃ তাহার অবনতি হয় তাহাকে কলিযুগ বলা হয়।”


 তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি যে তিনি প্রাচীন মিশর এবং প্রাচীন ব্যাবিলন—এই দুই দেশ—যাহাদের  সম্বন্ধে প্রায় ছয় হাজার বৎসরের পুরাতন ইতিহাস বর্তমান গবেষণার ফলে আবিষ্কত হইয়াছে তৎসম্বন্ধে কোন পুস্তক পড়িয়াছেন কি? এই দুই দেশের অথবা প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করিলে সমালোচক অনিলবরণ বর্ণিত বা হিন্দুপুরাণ কথিত পৰ্য্যায়ক্রমে আগত সত্য, বা কলিযুগের কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না। প্রত্যেক সভ্যতার ইতিহাসে চিরকাল মানুষে মানুষে সংঘর্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি লাগিয়াই আছে। হয়ত অতি অল্পকালের জন্য Ramses (Egypt), Hammurabi (Babylonian), Augustus (Roman), Asoke (Hindu Buddhist) বা Akbar (Indian Moslem) ন্যায় পরাক্রান্ত রাষ্ট্রপতিগণ দেশে সম্পূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা আনিতে সমর্থ হন, কিন্তু এই সময়ের পরিমাণ  ৫০ বা ৬০ বৎসরের বেশী নয় এবং ইহাকে কোনমতে


হিন্দুপুরাণকথিত সত্যযুগ বলা যাইতে পারে না। সত্যযুগ  এবং যুগবিবর্তন প্রাচীন হিন্দু পুরাণকারের কল্পনাপ্রসূত জিনিষ। প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ যেমন H. G. Wellsএর Universal listory of the World ইত্যাদি অধ্যয়ন করিলে লেখক দেখিতে পাইবেন যে বাস্তব মানব-ইতিহাসে যুগবিবর্তনবাদের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। লেখক হিন্দু অবতারবাদের গোড়ার কথার সম্বন্ধে শুধু অজ্ঞতার পরিচয় দেন নাই, বিশেষ বিশেষ অবতার সম্বন্ধে অদ্ভুত মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন।


অবতারবাদ সম্বন্ধে সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র একরূপ মত প্রকাশ করে নাই। মহাভারত (শান্তিপর্ব, ২৪০ অধ্যায়) মতে বুদ্ধ মোটে অবতার নন। তাহাতে অবতারের লিষ্ট দেওয়া হইয়াছে—হংস, কূর্ম, মৎস্য, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ ও কল্কী। এখানে বুদ্ধের নাম নাই। “হংসটা কি কাজ করিয়াছিলেন, তাহার কোথাও উল্লেখ নাই। শুধু মহাভারতে নয়, বিষ্ণুপুরাণেও বুদ্ধকে প্রকারান্তরে মায়ানমাহের অবতার বলা হইয়াছে। অধিকাংশ বৈষ্ণব পুরাণমতে কৃষ্ণ অবতার নহেন, একেবারে পরমব্রহ্ম-বলরাম অবতার। অধিকাংশ পুরাণমতে গুপ্ত রাজাদের পরেই কল্কী অবতার প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন অর্থাৎ কল্কি অবতার বৌদ্ধ প্রাধান্যের অবনতি ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের উত্থানের দ্যোতক মাত্র। রামায়ণ পাশবিকতা ও মানবিকতার মধ্যে যুদ্ধের একটা রূপক, এই অদ্ভুত তত্ত্বব্যাখ্যা শুনিয়া সমঝদার লোক সকলেই নিশ্চয় অবিশ্বাসের হাসি হাসিবেন। যে কোন যুদ্ধকেই পাশবিকতা ও মানবিকতার দ্বন্দ্ব বলা যাইতে পারে।


মোটের উপর সমালোচক অবতারবাদ বা জন্মান্তরবাদ কোন বাদেরই মূলতত্ত্বের কথা অবগত নন এবং পাশ্চাত্য ক্রমবিবর্তনবাদ সম্বন্ধে তাহার বিরাট অজ্ঞতা রহিয়াছে। তিনি প্রাচীন হিন্দুদর্শন ও পুরাণে বর্তমান বিজ্ঞানের মুলতত্ত্ব খুজিতে যাইয়া কতকগুলি অসঙ্গত প্রলাপ বকিয়াছেন মাত্র।



(২)

“বিজ্ঞান ও চৈতন্য”

সমালোচক অনিলবরণের মতে “বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকেরা নাকি বলিয়াছেন যে বিশ্বজগতের পশ্চাতে একটা বিরাট চৈতন্য আছে; যদিও উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিকেরা এই চৈতন্যের অস্তিত্বে বিশ্বাসবান হন নাই।“ যেহেতু ডাক্তার মেঘনাদ বিশ্বজগতের পশ্চাতে চৈতন্য স্বীকার করেন নাই (যদিও কোথায় অস্বীকার করিয়াছি তাহা সমালোচক কোথাও দেখান নাই) সুতরাং তিনি উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক। এই সম্বন্ধে তিনি Napoleon ও Laplace সম্বন্ধীয় একটি গল্পের উল্লেখ করিয়াছেন।


সমালোচক কোথাও চৈতন্যে বিশ্বাসবান বৈজ্ঞানিকদের নামধাম বা তৎপ্রণীত পুস্তকাদির উল্লেখ করেন নাই। সুতরাং তাহার সহিত বিচার, অনেকটা হাওয়ার সাথে লড়াই। তিনি Napoleon-Laplace সম্বন্ধীয় গল্পটি  ইংরেজি তর্জমায় পড়িয়াছেন, কাজেই পরের মুখে ঝাল খাইলে যা হয়, গল্পের প্রকৃত মর্ম না বুঝিয়া তাহার অপব্যাখ্যা করিয়াছেন। আসল গল্পটি এই- Laplace তাহার সুবিখ্যাত Mecanique Celeste গ্রন্থে গ্রহসমূহের এবং চন্দ্রের গতির সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং প্রমাণ করেন যে গতিতত্ত্ব (Dynamics) ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিয়া পর্যবেক্ষিত সমস্ত গ্রহগতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয়। তিনি যখন এই গ্রন্থ Napolean কে উৎসর্গ করিবার অনুমতি প্রার্থী হন তখন Napolean রহস্য করিয়া বলেন Mons. Laplace , you have so well described and explained the mechanics of the heavenly bodies, but I find that you have nowhere mentioned the creator. Laplace উত্তর দেন—“ Monsceigneur, je n’avais pas besoin de tel hypthese” “Sire, I had not the necessity of such a hypothesis.”


Laplace র এই মন্তব্য সম্বন্ধে নানারূপ ভুল ধারণা হইয়াছে। যদি পূর্বের context না জানা থাকে তাহা হইলে মনে হইবে যে Laplace ভগবানের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু মন্তব্যটিকে তাহার context এর সহিত ধরিতে হইবে! Laplace এর সময় তর্ক উঠিয়াছিল যে গ্রহউপগ্রহাদির গতি ব্যাখ্যার জন্য গতিতত্ত্ব ও  মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যথেষ্ট কিনা! বাস্তবিক পক্ষে তাৎকালিক পর্যবেক্ষণের ফলে গ্রহউপগ্রহাদির গতি এত জটিল প্রতীয়মান হইয়াছিল যে অনেক পণ্ডিত মনে করিতেন যে গতিতত্ত্ব ও মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা স্থূলভাবে গ্রহাদির পথের ব্যাখ্যা মিলে, বাস্তবিক সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা সম্ভবপর নয়।অনেকে মনে করিতেন যে মধ্যে মধ্যে কোনো অদৃশ্য হস্তের প্রভাবে (unseen agency) গ্রহগতির সামঞ্জস্য সাধিত হয়। কিন্তু Laplace প্রমাণ করিলেন যে মাধ্যাকর্ষণ ও গতিতত্ত্বই যথেষ্ট, কোনও অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব কল্পনার প্রয়োজন নাই।  তাই তিনি Napolean কে উক্তরূপ জবাব দিয়াছিলেন। ইহা হইতে তিনি “ঈশ্বর আছেন বা না আছেন তৎসম্বন্ধে কোন স্পষ্ট মত প্রকাশ করিয়াছিলেন এইরূপ ধরিয়া লওয়া অত্যন্ত অসঙ্গত হইবে।  বাস্তবিকই প্রকৃত বৈজ্ঞানিকেরা যে বিষয় লইয়া গবেষণা করেন, তাহার বাহিরে কোন বিষয়ে তাহারা যদি কিছু বলেন, তাহাকে যুক্তি ও তর্কের পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করিয়া লইতে হইবে। Sir J. J. Thompson বলিয়াছেন যে যদি কোন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ধর্ম সম্বন্ধে কোন বিশেষ মত প্রকাশ করেন, সেই মত তাহার পরিবার বা সমাজপ্রদত্ত শিক্ষা হইতে সজ্ঞাত মনে করিতে হইবে; তাহার এই মত যদি বিজ্ঞানসজ্ঞত প্রমাণপ্রয়োগসহ উপস্থাপিত না হয়, তাহা হইলে নেহাৎ ব্যক্তিগত মত বলিয়াই গণ্য করা হইবে। অর্থাৎ এই মতের উপর উক্ত বৈজ্ঞানিকের ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব চাপানো অন্যায় হইবে। কাজেই কোনও বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক যদি ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসবান হন এবং তজ্জন্য তিনি যদি নিছক বিশ্বাস ব্যতিত বিজ্ঞানের স্বীকৃত প্রমানাদি উপস্থিত না করেন, তাহা হইলে সেই মতের উপর কোনরূপ গুরুত্ব আরোপ করা অসঙ্গত হইবে।


সুতরাং বিংশ শতাব্দীর কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্বজগতের পশ্চাতে বিরাট চৈতন্য আছে এবং কি প্রমাণে তিনি এইরূপ বলিয়াছেন, তাহার সবিশদ বর্ণনা না পাইলে সমালোচকের অবান্তর বাগাড়ম্বরের প্রতিবাদ করিতে যাওয়া নিরর্থক। সমালোচকের লেখা দৃষ্টে মনে হয় যে তিনি একজন God-drunk লোক এবং বোধহয় ঈশ্বরকে উপলব্ধি করারও দাবী করেন। আমার সেরূপ সৌভাগ্য হয় নাই, হইলে সুখী হইব।


আমাদের বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল যে “God is a subjective creation of the human mind” অর্থাৎ প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক দেশেই লোকে নিজেদের মন হইতে “ঈশ্বরের স্বরূপ” কল্পনা করিয়া নেয়। সুতরাং এইসব “মনগড়া ঈশ্বরের” প্রকৃতি বিভিন্ন হয় এবং ঈশ্বরের ধারণা সেই জাতি বা ব্যক্তিবিশেষের মনোভাব মাত্র ব্যক্ত করে। ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রমাণসঙ্গত কোনো Objective ধারণা  এ পর্যন্ত কেহ করিতে পারিয়াছেন বলিয়া , আমার জানা নাই। “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাত্”, সাংখ্যকারের এই উক্তি বোধহয় একালেও চলে।


সমালোচক মনে করেন যে ভগবান অচলা ভক্তি ব্যাতীত ধর্ম হইতে পারে না। তিনি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কথা বিস্মৃত হইয়াছেন। এই সমস্ত ধর্মে ভগবানের বা সৃষ্টিকর্তার স্থান কোথায়? অথচ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আড়াই হাজার বৎসর ধরিয়া মানবজাতির একটা প্রকাণ্ড অংশের মনোবৃত্তি, রীতিনীতি, সমাজ সংগঠনের মূলভিত্তি গঠন করিয়াছে। এখনও চীন ও জাপান দেশে বৌদ্ধমতের প্রাধাণ্য অক্ষুণ্ণ। ভারতে অবশ্য পৌরাণিক হিন্দুধর্ম বৌদ্ধধর্মকে অভিভূত করিয়াছে; কিন্তু অনেকের মতেই তাহাই ভারতের অধঃপতনের মূল কারণ। বর্তমানে রুশিয়া দেশ সম্পূর্ণ Godless এবং তাহারা গত ২০ বৎসরের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়শীল হইয়া যেরূপে দেশের সর্ববিধ বস্তুতান্ত্রিক উন্নতিসাধন করিয়াছে, জগতের ইতিহাসে তাহার দৃষ্টান্ত বিরল। সুতরাং ভগবানের দোহাই ছাড়া ধর্ম বা সভ্যতা গড়িয়া উঠিতে পারে না, পৃথিবীতে সভ্যতার বিকাশ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিলে এই মত সমর্থন করা চলে না।


“প্রাচীনেরা ভাবিতেন যে পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র… নিয়ন্ত্রিত করেন”


আমার বক্তৃতার উক্ত অংশের সমালোচনায় সমালোচক অনর্থক বাগজাল বিস্তৃত করিয়া হিন্দু জ্যোতিষ সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ এবং হিন্দু জ্যোতিষে বর্তমান পাশ্চাত্য জ্যোতিষের সমস্ত তত্ত্বই নিহিত আছে এই কথা বলিতে চাহিয়াছেন। এই ধারণা কত ভ্রমাত্মক তাহা দেখাইতেছি।


“প্রাচীনেরা মনে করিতেন যে পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্র” – আমার এই মন্তব্যের সমালোচক অপব্যাখ্যা করিয়াছেন। Context এর সহিত মিলাইয়া দেখিলে তিনি বুঝিতে পারিবেন যে পৃথিবী যে বিশ্বজগতের জ্যামিতিক কেন্দ্র তাহা আমি কোথাও বলি নাই। বলবার উদ্দেশ্য যে প্রাচীনকালে এই ধারণা ছিল- “ এই পৃথিবীই বিশ্বজগতে শ্রেষ্ঠ জিনিস”। সূর্য, চন্দ্র, তারকা পৃথিবীস্থ জীবের বিশেষতঃ মানুষের কোথাও বিশেষ প্রয়োজনবশতঃই ঈশ্বরনির্দিষ্ট হইয়া স্পষ্ট হইয়াছে এই ধারণা অনেক ধর্মেই বলবতী ছিল।


“তারকাগুলি ধার্মিক লোকের আত্মা”


প্রাচীনকালের সমস্ত দেশেই এই ধারণা ছিল, এমন কি এই বেদপ্রবুদ্ধ দেশেও। গ্রীস দেশের সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী মোটের উপর এই বিশ্বাস-প্রণোদিত। তারকাগুলির নামেও ইহার পরিচয়। মহাভারতেও এই বিশ্বাসের পরিচয় আছে। যথা বনপর্বে (৪২ অধ্যায়ে) অর্জুন যখন অস্ত্রলাভার্থ মাতলির সহিত স্বর্গে প্রয়াণ করিতেছেন, তখন তাহার প্রশ্নের উত্তরে মাতলি বলিতেছেনঃ-


হে পার্থ! তুমি ভূমণ্ডল হইতে এই সমস্ত তারকা পর্যবেক্ষণ করিয়াছ। পুণ্যশীলেরা সুকৃতি ফলে তারকারূপে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন।


সুতরাং উপরিউক্ত মন্তব্যে আমি কোন মনগড়া কথা বলি নাই বা হিন্দুশাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা করি নাই। বর্তমান জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে তারকাগুলি এক একটি সূর্যমণ্ডল এবং বর্তমান লেখকের গবেষণায় (Saha’s Theory of Ionisation) তাহাদের রাসায়নিক উপাদান, তাপমান, প্রাকৃতিক অবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক তত্ত্ব উদঘাটিত হইয়াছে। মোটের উপর সূর্য হইতে তাহাদের বিভিন্নতা কেবল তাপক্রম, ওজন ও পরিমাণজনিত। বর্তমান বিজ্ঞানের এই সমস্ত আবিষ্কার সত্য ধরিয়া লইলে পৌরাণিক ধ্রুব উপাখ্যানে (বিষ্ণু ও ভাগবত পুরাণ), অগস্তোপাখ্যান, প্রজাপতির কন্যাসক্তি, দক্ষযজ্ঞ- এক কথায় সমস্ত Pauranic Mythologyর ভিত্তি ভূমিসাৎ হয় এই আমার বক্তব্যের সারমর্ম।

সমালোচক বলিয়াছেনঃ-


“গ্রহগণ মানুষের অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে- এ কথা কি শুধু প্রাচীন দর্শনের কথা? আধুনিক বৈজ্ঞানিক ইউরোপে কি কেহ এ কথা বিশ্বাস করে না?”


আমি কোথাও দর্শনের কথা বলি নাই, লোক প্রচলিত মতের কথাই বলিয়াছি। সম্ভবতঃ সমালোচক অস্বীকার করিবেন না যে আমাদের দেশে এখনও শতকরা ৯৯ জন লোক পঞ্জিকা ও ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসবান। ইউরোপে কেহ কেহ বিশ্বাস করে- কিন্তু তাহাদের অনুপাত কত? সম্প্রতি Penguine Series এ প্রকাশিত পুস্তকে উক্ত হইয়াছে যে ইংলণ্ডে পুরুষদের মধ্যে শতকরা ৫ জন ফলিত জ্যোতিষে পূর্ণ আস্থাবান, ১৫ জন আংশিক এবং ৮০ জন মোটেই বিশ্বাস করে না। স্ত্রীলোকের মধ্যে শতকরা ৩৩ জন পূর্ণ বিশ্বাস করে, ৩৩ জন আংশিক বিশ্বাস করে এবং ৩৩ জন মোটেই বিশ্বাস করে না। এইসমস্ত তথ্য বহু গবেষণার ফলে সংগৃহীত হইয়াছে। কিন্তু আমাদের দেশে শতকরা ৯৯ জন পুরুষ এবং ১০০ জন স্ত্রীলোক ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করে। এখনও তথাকথিত শুভদিন না হইলে, কোষ্ঠী না মিলিলে বিবাহ হয় না! পঞ্জিকা কথিত শুভদিন না দেখিয়া অধিকাংশ লোকের বিদেশ যাত্রা হয় না। হাঁচি, টিকটিকি ও পাঁজি সমস্ত হিন্দুজীবনকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে। বিলাতের দু চারজন দুর্বল মস্তিষ্ক লোকে ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করে, এই তর্কে আমাদের সর্বজনব্যাপী কুসংস্কারের ন্যায্যতা ও উপকারীতা প্রমাণিত হয় না। আমার বিশ্বাস যে হাঁচি, টিকটিকি ও পঞ্জিকায় অন্ধবিশ্বাস জাতীয় জীবনের দৌর্বল্যের দ্যোতক। এতদ্দেশে প্রচলিত পঞ্জিকা যে ভুল গণনা দ্বারা পরিচালিত এবং অর্ধসত্যাত্মক কুসংস্কারের উপর প্রতিষ্ঠিত ইহা মৎ সম্পাদিত Science and Culture পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধে তাহা দেখান হইবে।


Hindu Astronomy সম্বন্ধে আমি কোন মন্তব্যই প্রকাশ করি নাই, অথচ সমালোচক অযাচিত মন্তব্য করিয়াছেন, “ডক্টর মেঘনাদ সাহা এখানে Astronomy ও Astrology এই দুই এর মধ্যে গোলমাল করিয়াছেন।“কোথায় গোলমাল করিয়াছি এবং কোথায় আমি Astronomy র উপর মন্তব্য করিয়াছি, তিনি দেখাইয়া দিলে বাধিত হইব।


লেখক হিন্দু জ্যোতিষ সম্বন্ধে আমাকে অনেক জ্ঞান দান করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। তিনি বোধ হয় মোটেই জ্ঞাত নন যে আমি হিন্দু জ্যোতিষ (Astronomy) আজীবন অধ্যয়ণ করিয়াছি এবং ভারতে জ্যোতিষ বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা আছে। সুতরাং সমালোচকের হিন্দু জ্যোতিষ সম্বন্ধে ধারণা যে প্রায়শঃ অমূলক ও বিরাট অজ্ঞতা প্রসূত তাহা দেখাইতে প্রয়াসী হইলাম।

সমালোচক অনিলবরণ ও হিন্দু জ্যোতিষ


সমালোচক ভারত বর্ষের লোকদিগকে জানাইয়াছেন যে  এই দেশে সূর্য যে সৌরজগতের কেন্দ্র এই মত জানা ছিল এবং গ্যালিলিওর বহুপূর্বেও ভারতবর্ষে জানা ছিল যে পৃথিবী সচল হইলেও স্থির বলিয়া মনে হয়। সুতরাং ইউরোপীয় বিজ্ঞান নূতন কিছুই করে নাই ইত্যাদি।


বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের তুলনামূলক আলোচনা করিতে হইলে প্রথম দরকার কালজ্ঞান। কোনও বিশেষ আবিষ্কার কোন কালে বা কোন জাতি প্রথম করিয়াছে, এই তর্ক উঠিলে প্রথম দেখিতে হয় যে কোন সময়ে উক্ত লোক বা জাতি এই বিশেষ আবিষ্কার দাবী করিয়াছে এবং তাহা কতটা প্রমাণসহ।  সমালোচক অনিলবরণ কালের পৌর্বাপর্য কিছুমাত্র বিচার করেন নাই। এই বিষয়ে তাহার কতটা অধিকার আছে জানি না। যদি অধিকার না থাকে, এই সম্বন্ধে আলোচনা করিতে যাওয়া তাহার পক্ষে দুঃসাহসের কাজ। সুতরাং তাহার অবগতির জন্য ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিতে হইবে।


জ্যোতিষশাস্ত্রের বিশেষ সুবিধা এই যে ইহাতে মিথ্যা বা মনগড়া কল্পনার স্থান নাই। কারণ জ্যোতিষে গ্রহনক্ষত্র বা কালগণনা সম্বন্ধে যে সমস্ত প্রত্যক্ষ ঘটনার উল্লেখ করিতে হয়, সাধারণ জ্ঞান থাকিলেই ঐ সমস্ত ঘটনার সময় নিরূপন করা যায়। সুখের বিষয় ভারতীয় জ্যোতিষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ ব্যতীত ভারতীয় পণ্ডিতগণের মধ্যে পরলোকগত মহারাষ্ট্র-পণ্ডিত শঙ্করবালকৃষ্ণ দীক্ষিত, মহামহোপাধ্যায় সুধাকর দ্বিবেদী ও অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় বিশেষ আলোচনা করিয়াছেন। সমালোচক ‘দেব ভাষায়’ , ভারতীয় ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত এই লেখকদেরর গ্রন্থ পাঠ করিলে ভারতীয় জ্যোতিষ (Astronomy) সম্বন্ধে তাহার ধারণা কত ভ্রান্ত বুঝিতে পারিবেন। বর্তমান লেখক এই সমস্ত গ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন এবং এই সম্বন্ধে সমস্ত মৌলিক পুস্তকের জ্ঞান আছে বলিয়া দাবী করেন।


এই সমস্ত পণ্ডিতগণ প্রমাণ করিয়াছেন যে ভারতীয় জ্যোতিষের ক্রমবিকাশের তিনটি স্তর আছে-


১) বেদকাল (খ্রিস্ট পূর্ব ১৪০০ শতাব্দীর পূর্ববর্তী)

২) বেদাঙ্গ জ্যোতিষকাল (খ্রিস্ট পূর্ব ১৪০০ শতাব্দী হইতে ৪০০ খ্রিস্ট অব্দ)

৩) সিদ্ধান্ত কাল (৪০০ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ)


বেদকালের জ্যোতিষ অতি সাধারণ রকমের এবং বহু স্থলেই অর্থ সম্বন্ধে মতদ্বৈত আছে। তদপেক্ষা উন্নততর বেদাঙ্গ জ্যোতিষের কালগণনা প্রণালী ‘মহাভারতে’ অনুসৃত হইয়াছে (বিরাট পর্ব, ৫২ অধ্যায়) ।মহাভারতের সংকলনকাল দীক্ষিতের মতে (এবং যাহা এখন সর্বাদিসম্মত) ৪৫০ খ্রিস্ট পূর্ব হইতে ৪০০ খ্রিস্ট অব্দ। সমালোচক যদি প্রমাণ চাহেন তাহা দেওয়া যাইবে। এই ‘মহাভারতে’ কুত্রাপি সপ্তাহ, বার, রাশিচক্রের (যাহা বর্তমান পঞ্জিকার একটি প্রধান অঙ্গ)  উল্লেখ নাই। মহাভারতে কোথাও পৃথিবীর গোলত্ব, আবর্তনবাদ বা সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণবাদের উল্লেখ নাই; বরঞ্চ যে সমস্ত মতের উল্লেখ আছে তাহা উক্ত সমস্ত মতবাদ হইতে সম্পূর্ণ অন্যরকমের (ভীষ্মপর্ব, ৬ অধ্যায়) (বন পর্ব, ১৬২ অধ্যায়)। মহাভারতে পৃথিবীকে সমতল বর্ণনা করা হইয়াছে, সুমেরু উহার কেন্দ্র স্থলে অবস্থিত এবং পৃথিবী যতটা প্রসারিত, সুমেরু প্রায় ততটা উঁচু এবং সূর্য সুমেরুর চতুর্দিকে ভ্রমণ করিয়া দিবারাত্র ঘটায়, এইরূপ বর্ণিত আছে। সুতরাং ধরা যাইতে পারে যে মহাভারত সংকলনকালের অর্থাৎ ৪৫০ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দের পূর্বে ভারতে পৃথিবীর গোলত্ব বা আবর্তনবাদ, অথবা সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণবাদ জানা ছিল না।


বেদাঙ্গ জ্যোতিষের কালগণনা প্রণালী  বর্তমান সময়ের তুলনায় অত্যন্ত স্থূল ও অশুদ্ধ। এই গণনাপ্রণালীই একটু পরিবর্তিত হইয়া খ্রিষ্টের কিছু পর পর্যন্ত “পৈতামহ সিদ্ধান্ত” নামে প্রচলিত ছিল এবং ইহাই পরবর্তীকালে “পিতামহ ব্রহ্মা” প্রণীত বলিয়া স্বীকৃত হয়। অন্যান্য সিদ্ধান্তের তুলনায় এই প্রাচীন সিদ্ধান্ত কতদূর অশুদ্ধ, ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী বরাহমিহিত লিখিত নিম্নলিখিত শ্লোক হইতে তাহার ঠিক ধারণা হইবে।বরাহ মিহির তাহার সময়ে প্রচলিত পাঁচ খানা সিদ্ধান্তের সারমর্ম তাহার পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা নামক করণ গ্রন্থে বর্ণনা করেন এবং উক্ত পঞ্চসিদ্ধান্ত সম্বন্ধে নিম্নলিখিত তুলনামূলক মন্তব্য করেন।


“ পৌলিশ রোমক বাশিষ্ঠাসৌরপৈতামহাস্তু সিধান্তাঃ।

পঞ্চভ্যোঃ দ্ব্যাবাদ্যৌ ব্যাখ্যাতৌ লাটদেবেন।

পৌলিশকৃতঃ স্ফুটোহসৌ তস্যাসন্নস্তু  রোমকপ্রোক্তঃ ।

স্পষ্টতরঃ সাবিত্রঃ পরিশেষৌ দূরবিভ্রষ্টৌ ।“


এই শ্লোকের অর্থ যে বরাহ মিহিরের সময়ে (৫৫০ খ্রিস্টাব্দে) পাঁচখানা সিদ্ধান্ত প্রচলিত ছিল – পৌলিশ বা পুলিশ , রোমক, সৌর, বাশিষ্ঠ ও পৈতামহ। তন্মধ্যে প্রথম দুইখানি লাটদেব ব্যাখ্যা করেন; এই দুই খানির মধ্যে পৌলিশ সিদ্ধান্ত স্ফুট অর্থাৎ শুদ্ধ , রোমক সিদ্ধান্ত তাহার আসন্ন অর্থাৎ তদপেক্ষা অশুদ্ধ; সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ সূর্য-সিদ্ধান্ত , কিন্তু অবশিষ্ট দুইখানি , বাশিষ্ঠ ও পৈতামহ সিদ্ধান্ত ‘দূরবিভ্রষ্ট’ অর্থাৎ অত্যন্ত অশুদ্ধ।


এই মন্তব্যটি তলাইয়া বুঝিতে হইবে। নাম দৃষ্টে প্রমাণ যে রোমক ও পৌলিশ-সিদ্ধান্ত বিদেশ হইতে আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্ট অব্দে ভারতবর্ষে আনীত হয়। ইহার প্রমাণ চাহিলে দেওয়া যাইবে। বাস্তবিকপক্ষে পৌলিশ সিদ্ধান্ত Paulus of Alexandria (376 A.D) র জ্যোতিষ গ্রন্থ হইতে সংকলিত। বাকি রহিল সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ সূর্য সিদ্ধান্ত কিন্তু ইহাও যে বিদেশ হইতে ধার করা তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। ইহার উৎপত্তি সম্বন্ধে আধুনিক সূর্য সিদ্ধান্তের প্রারম্ভে বলা হইয়াছে-


অচিন্ত্যাব্যক্তরূপায় নির্গুণায় গুণাত্মনে ।

সমস্ত জগদাধারমূর্ত্তয়ে ব্রাহ্মণে নমঃ।। ১

অল্পাবশিষ্ট তু কৃতে ময়নামা মহাসুরঃ।

রহস্যং পরমং পুণ্যং জিজ্ঞাসুর্জ্ঞানমুক্তমং।। ২

বেদাঙ্গমগ্র্যমখিলং জ্যোতিষাং গতিকারণাং।


আরাধয়ন্ বিবস্বন্তং তপস্তেপে সুদুশ্চরং।। ৩

তোষিতস্তপসা তেন প্রীতস্তস্মৈ বরার্থিনে।

গ্রহাণং চরিতং প্রাদান্ময়ায় সবিতা স্বয়ম্।। ৪

শ্রীসূর্য্য উবাচ


বিদিতস্তে ময়া ভাবস্তোষিতস্তপসা হ্যহম।

দদ্যাং কালাশ্রয়ং জ্ঞানং গ্রহাণং চরিতং মহৎ।। ৫

ন মে তেজঃ সহঃ কশ্চিদাখ্যাতুং নাস্তি মে ক্ষণঃ।

মদংশঃ পুরুষোহয়ং তে নিঃশেষং কথয়িষ্যতি।। ৬

ইত্যুক্তান্তর্দধে দেবঃ সমাদিশ্যাংশমাত্মনঃ।

স পুমান্ ময়মাহেদং প্রণতং প্রাঞ্জলিস্থিতম্।। ৭


শৃণুষ্বৈকমনাঃ পূর্ব্বং যদুক্তং জ্ঞানমুত্তমং।


যুগে যুগে মহর্ষীণাং স্বয়মেব বিবস্বতা।।৮


-সত্যযুগের কিঞ্চিত অবশিষ্ট থাকিতে , ময় নামক মহাশুর পরমপূণ্যপদ, রহস্য, বেদাঙ্গশ্রেষ্ঠ , সমস্ত গ্রহদিগের গতি কারণরূপ উত্তর জ্ঞানলাভে জিজ্ঞাসু হইয়া দুশ্চর তপস্যা দ্বারা সূর্যদেবের আরাধনা করিয়াছিলেন। ২-৩


শ্রীসূর্যদেব বরার্থী ময়াসুরের তপস্যায় পরমপ্রীত হইয়া তাহাকে গ্রহজ্ঞানবিষয়ক জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দিবার জন্য স্বয়ং অধিষ্ঠিত হইলেন। ৪


সূর্য বলিলেন, হে ময়! আমি তোমার মনোগত ভাব অবগত হইয়াছি এবং তোমার তপ দ্বারাও তুষ্ট হইয়াছি; অতএব আমি তোমাকে গ্রহদিগের স্থিতিচলনাদি প্রতিপাদক জ্যোতিষ শাস্ত্র উপদেশ করিতেছি; কিন্তু কেহই আমার তেজ সহ্য করিতে পারে না এবং আমারও ক্ষণকাল প্রতিক্ষা করিবার অবকাশ নাই যে তৎসমস্ত তোমার নিকট প্রকাশ করিব; অতএব আমার অংশসম্ভূত এই পুরুষ তোমার অভিপ্রেত বিষয়সকল অবগত করাইবে। ৫-৬


এই বলিয়া সূর্যদেব নিজ অংশসম্ভূত পুরুষকে ময়ের নিকট তাহার অভিপ্রেত বিষয় বর্ণনে আদেশ করিয়া তথা হইতে অন্তর্ধান করিলেন। সূর্যাংশের পুরুষও কৃতাঞ্জলিপুটে অবস্থিত প্রণত ময়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, হে ময়! সূর্যদেব যুগে যুগে মহর্ষিদিগের যে জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধীয় উত্তম জ্ঞান কীর্তন করিয়াছিলেন তাহা বলিতেছি, এক মন হইয়া শ্রবণ কর। ৭-৮

সূর্যসিদ্ধান্তের কোন কোন পাণ্ডুলিপিতে আছে যে ময়াসুর ব্রহ্মা কর্তৃক শাপগ্রস্ত হইয়া রোমকপুরে যবনরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তথায় সূর্যের আরাধনা করিয়া জ্যোতিষের জ্ঞান প্রাপ্ত হন এবং ময়াসুরের নিকট হইতে মহর্ষি গণ কাল ও জ্যোতিষ জ্ঞান লাভ করেন। সূর্যসিদ্ধান্তের শেষ অধ্যায়ে এইরূপভাবে পরিসমাপ্ত করা হইয়াছে-


ইত্যুক্ত্বাং ময়মামন্ত্র্য সম্যক্ তেনাভিপূজিতঃ ।

দিবমাচক্রমেহর্কাংশ প্রবিবেশ সমণ্ডলম্।।

ময়োহথ দিব্যং তজ্জ্ঞানং জ্ঞাত্বা সাক্ষাদ্বিবস্বতঃ।

কৃতকৃত্যামিবাত্মানং মেনে নির্ধূতকল্মষম্।।

জ্ঞাত্বা তমৃযয়শ্চাথ সূর্য্যালব্ধবরং ময়ং।

পরিব্রবুপেত্যাথো জ্ঞানং পপ্রচ্ছুরাদরাত্।।

স তেভ্যেঃ প্রদদৌ প্রীতো গ্রহাণাং চরিতং মহৎ।

অভ্যদ্ভূতং লোকে রহস্যং ব্রহ্মপস্মিতম্।।

বঙ্গানুবাদ-

এইরূপ ময়কে উপদেশ করিয়া বাংময় দ্বারা পূজিত হইয়া সূর্যের অংশস্বরূপ পুরুষ সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করিলেন।

স্বয়ং সূর্যদেব হইতে এই জ্ঞান লাভ করিয়া ময় নিজেকে কৃতার্থ এবং নিজেকে পাপ বিনির্মুক্ত মনে করিতে লাগিলেন।


পরে ময় সূর্যদেবের নিকট বরপ্রাপ্ত হইয়াছে জানিয়া ঋষিগণ তাহার নিকট আগমন করিয়া সম্মান সহকারে বিদ্যার বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন।


ময় আনন্দিত হইয়া ঋষিদিগকে গ্রহাদির গুহ্য এবং আশ্চর্য ব্রহ্মবিদ্যাতুল্য মহাবিদ্যা দান করিয়াছিলেন।


(বিজ্ঞানানন্দ স্বামীকৃত সূর্য সিদ্ধান্তের অনুবাদ হইতে গৃহীত)

এই পৌরাণিক গল্পের নীহারিকার ভিতর দিয়া সত্যের অনুসন্ধান করিলে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে সূর্য সিদ্ধান্তে যে জ্যোতিষিক জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা পশ্চিম দেশবাসী অসুরদিগের অর্জিত। হিন্দু পণ্ডিতগণ অসুরগণের নিকট হইতে তাহা শিক্ষা করেন। এই অসুরগণ কে?


অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত সূর্যসিদ্ধান্তের ভূমিকায় বলিয়াছেন যে সূর্যসিদ্ধান্তের গণনা প্রণালী ৪০০ খ্রিস্ট অব্দ হইতে ১০০০ খ্রিস্ট অব্দ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত এবং স্ফূটতর (more correct) হইয়াছে। মূল সূর্য সিদ্ধান্তের সহিত Babylonian astronomy র ঐক্য আছে। সূর্য সিদ্ধান্তের প্রারম্ভিক শ্লোক তাহারই দ্যোতক মাত্র। সুতরাং সূর্য সিদ্ধান্তোক্ত জ্ঞানের উৎপত্তি কোন পশ্চিমদেশীয় নগরে, ভারতে নয়- এই জ্ঞান প্রথমে অসুরের পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করিয়া বাহির করেন এবং অসুরদিগের নিকট হইতে আর্য ঋষিরা শিক্ষা করেন। এই অসুরেরা রক্ত মাংসের লোক, প্রাচীনকালে সমস্ত পশ্চিম এশিয়া জুড়িয়া তাহারা একটা মহান সভ্যতা গঠন করেন, যাহার কেন্দ্র ছিল Babylon, Ninevah, Ur ইত্যাদি Tigris ও Euphrates নদীদ্বয়ের উপর অবস্থিত নগরগুলি।


বর্তমান কালের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণ হইয়াছে যে প্রাচীন Babylon দেশে প্রথমে জ্যোতিষের পর্যবেক্ষণ ও গণনার সম্যক উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাহার কারণ বেবিলোনিয়গণ সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহনক্ষত্রকে দেবতা বলিয়া মনে করিতেন। তাহারা মনে করিতেন যে এইসব গ্রহদেবতাগণ মানবের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই ধারণার বশবর্তী হইয়া সুপ্রাচীন কাল হইতেই তাহারা গ্রহাদির গতি পর্যবেক্ষণ করিতেন। প্রায় খ্রিস্ট পূর্ব ২০০০ শতাব্দীতেও যে বেবিলোনে গ্রহনক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ হইত তাহার লিখিত প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে (e.g. Venus Tables of King Amiza Dugga nearly 19000 B.C.)। ৫৫০ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দে বেবিলোনের স্বাধীনতা লুপ্ত হয় । কিন্তু তখন হইতে জ্যোতিষিক জ্ঞানের আরও উৎকর্ষ হয় । পরবর্তী পারশীক (Acemenids) মেসিডোনীয় গ্রীক (Alexander and Selucids)  এবং পার্থীয়ান বংশীয় রাজাদের অধীনে বেবিলোনীয় জ্যোতির্বিদগণ বহু নতুন আবিষ্কার করেন। তাহারাই প্রথমে সৌর ও চন্দ্রমাসের সামঞ্জস্য সাধনের জন্য ৩৮৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রথম ১৯ মাসে ৭ টি অধিমাস গণনার  প্রণালী প্রবর্তিত করেন (Metonic Cycle)।  বেবিলোনবাসী Kidinnu প্রায় ৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রথম অয়নচলন (Procession of equinoxes) আবিষ্কার করেন। Babylon এ আবিষ্কৃত জ্ঞান ক্রমে পশ্চিমে গ্রীস দেশে , পূর্বে পারশ্যের ভিতর দিয়া ভারতে ও চীন পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়ে। অনেক জ্যোতিষিক আবিষ্কার যাহাকে পূর্বে গ্রীস দেশ হইতে লব্ধ মনে করা হইত , বর্তমানে দেখা যাইতেছে যে তাহার উৎপত্তি বাস্তবিকই Babylon এ । এই জ্যোতিষিরা সাধারণত Chaldean নামে পরিচিত। এ দেশেও জ্যোতিষশাস্ত্র মুখ্যত “শাকদ্বীপি” বা “মগ” (Magi) ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক আলোচিত হয় এবং নামদৃষ্টেই প্রমাণ শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণগণ পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া হইতে সমাগত। ইহাদের ভারতাগমন সম্বন্ধে কৌতূহলকর কাহিনী প্রচলিত আছে, বাহুল্যভয়ে তাহার উল্লেখ হইল না।


সুতরাং দেখা যায় যে, ৫৫০ খ্রিস্ট অব্দে যে পাঁচ খানি সিদ্ধান্ত প্রচলিত ছিল তন্মধ্যে ভারতীয় প্রাচীন আর্য ঋষিদিগের নিজস্ব ছিল মাত্র পৈতামহ, পিতামহ ব্রহ্মা প্রণীত বলিয়া খ্যাত। কিন্তু বরাহমিহির পিতামহ  ব্রহ্মাকে ভাল কালজ্ঞানজ্ঞ বলিয়া Certificate দেন নাই, বরঞ্চ ৮০ খ্রিস্ট অব্দে পিতামহ ব্রহ্মার জ্যোতিষের জ্ঞান সমসাময়িক ইংরাজ কৃষকদের জ্যোতিষ জ্ঞান হইতে বিশেষ উন্নত স্তরের ছিল না ইহা বেশ জোর করিয়াই বলা যাইতে পারে।


এই ভারতীয় নিজস্ব জ্যোতিষ যাহা ১৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ  হইতে শককাল (৮০ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, তাহা কত অশুদ্ধ যে একটি সামান্য দৃষ্টান্তেই বোঝা যাইবে। এই সিদ্ধান্তমতে ৩৬৬ দিনে বৎসর হয় অর্থাৎ বৎসর গণনায় পিতামহ ব্রহ্মা ১৮ ঘন্টা ভুল করিয়াছিলেন; কিন্তু ইহার বহু পূর্বেই অর্থাৎ খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দী হইতেই Egyptian , Babylonian এবং কিছু পরে Greek ও Roman গণ প্রায় ৩৬৫ ১/৪ দিনে যে বৎসর হয় তাহা জানিতেন। প্রথম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পঞ্চবৎসরাত্মক যুগগণনা প্রথা এবং পাঁচ বৎসরে দুই অধিমাস গণনার প্রথা প্রচলিত ছিল – তাহাতে পাঁচ বৎসরে প্রায় ৩ ৩/৪ দিনের ভুল হইত। অথচ ৪০০ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দে বেবিলোনে যে অধিমাস গণনা প্রণালী প্রচলিত ছিল তাহাতে উনিশ বৎসরে ২ ১/৬ ঘন্টার ভুল হইত। সুতরাং ইহা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ৮০ খ্রিস্ট অব্দ ও ৪০০ খ্রিস্ট অব্দের মধ্যে হিন্দু পণ্ডিতেরা পিতামহ ব্রহ্মার Authority সত্ত্বেও প্রাচীন গণনাক্রম পরিত্যাগ করিয়া গ্রীক, রোমান ও Chaldean Astronomy অনুসারে গণনা আরম্ভ করিতে দ্বিধা করেন নাই। এই সময়ের পরে ভারতীয় জ্যোতিষের সম্যক উন্নতি হয় এবং ইহাই দীক্ষিতের “সিদ্ধান্তযুগ”। কিন্তু যদিও সিদ্ধান্তজ্যোতিষ পিতামহ ব্রহ্মার জ্যোতিষ হইতে অনেক উন্নত স্তরের , উহাকে Galileo র সমসাময়িক European জ্যোতিষের সমতুল্য মনে করা প্রলাপ বই কিছুই নয়। কারণ বলিতেছি-


এখন সমালোচক কর্তৃক উদ্ধৃত পুরাণ বচনের আলোচনা করা যাউক।প্রথমে দেখিতে হইবে যে পুরাণগুলি কোন সময়ের রচনা। পুরাণগুলি মহাভারতের পরবর্তীকালে লিখিত , একথা সম্ভবত সমালোচক স্বীকার করিবেন। না করিলেও প্রমাণ দেওয়া কষ্টকর হইবে না। আমি ধরিয়া নিতেছি যে তিনি উহা স্বীকার করেন।


প্রায় সমস্ত পুরাণেই ভবিষ্য রাজবংশের বর্ণনাকালে অন্ধ্রদের বা আন্ধ্র ভৃত্য রাজাদের কথা আছে। তাহাদের প্রাদুর্ভাব কাল ৩১৯ খ্রিস্ট অব্দ। সুতরাং বলিলে ভুল হইবে না যে প্রাচীন পুরাণগুলি ১০০ খ্রিস্ট অব্দ হইতে ৪০০ খ্রিস্ট অব্দের মধ্যে বা পরে সংকলিত হইয়াছিল। এই সমস্ত পুরাণে যে সমস্ত জ্যোতিষিক বর্ণনা আছে , তাহাতেও দেখা যায় তাহারা সিদ্ধান্ত যুগের পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক বেদাঙ্গ জ্যোতিষের পরবর্তী। পূর্বেই বলা হইয়াছে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ৮০ খ্রিস্ট অব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।


এখন হিন্দু জ্যোতিষের তথাকথিত উৎকর্ষতা সম্বন্ধে আলোচনা করা যাউক। (1)


পুরাণকার বলিয়াছেন যে-

সর্ব্বগ্রহণামামেতেষামাদিরাদিত্যরুচ্যতে

এর অর্থ যে এই সমস্ত গ্রহের আদি আদিত্য অর্থাৎ সূর্য। কিন্তু পৃথিবী যে গ্রহ তাহা পুরাণকার কোথায় বলিয়াছেন? হয়ত এই বাক্যে বলা হইয়াছে যে সূর্য অপর পাঁচটি (মঙ্গল, বুধ , বৃহস্পতি, শুক্র, শনির) কেন্দ্রস্থানীয়। কিন্তু তাহাই বা কোথায় স্পষ্ট বলা হইয়াছে?


ইউরোপে ‘গ্যালিলিও’ (১৫৬৪-১৬৪২) যে সর্বপ্রথমে পৃথিবী চলমান বলিয়াছেন, সমালোচক এই তথ্য কোথায় পাইলেন? তিনি বোধ হয় অবগত নহেন যে প্রথম Anaximander of Sparta প্রায় ৫৬০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পৃথিবীর আবর্তনবাদ প্রচার করেন। হয়ত এই বাদ তাহার বহু পূর্বেও প্রচলিত ছিল কিন্তু সেরূপ কল্পনারও কিছু দরকার নাই। মোটের উপর পুরাণকার যদি উক্ত উদ্ধৃত বাক্যে পৃথিবীর আবর্তন বাদ বুঝিয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি তাহার প্রায় ৮০০ বৎসরের পূর্ববর্তী গ্রীক পণ্ডিতদের মতবাদের প্রতিধ্বনি করিতেছেন মাত্র। লেখকের ভ্রান্তি নিরসনের জন্য এই বিষয়ের আরও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া যাইতেছে।


পৃথিবীর গতি সম্বন্ধে তিনটি বিষয়ের পর পর ধারণা করিতে হইবে- প্রথমে পৃথিবীর গোলত্ব ও নিরাধারত্ব; দ্বিতীয়ত নিজের মেরু রেখার চতুর্দিকে পৃথিবীর আবর্তন- যাহাতে দিনরাত্রি হয়। তৃতীয়ত সূর্যের চতুর্দিকে বার্ষিক প্রদক্ষিণ। প্রাচীন গ্রীসদেশে এই তিনটি বাদের কি রকম ভাবে পর পর উৎপত্তি হয়, তাহার সময়ানুযায়ী বিবরণ দেওয়া যাইতেছে ।


Anaximander of Sparta 500 B.C.

ইনি গ্রীসদেশে প্রথমে, পৃথিবী যে নিজের মেরুরেখার চতুর্দিকে আবর্তন করিতেছে এবং তজ্জন্য দিবারাত্র হয় এই মত প্রচার করেন।


Eratosthenes of Alexandria 276-195B.C.


ইনি প্রথমে পৃথিবীর ব্যাস মাপেন। তাহার দেওয়া পরিমাণ বর্তমানে জানা পরিমাণ অপেক্ষা বিশেষ তফাৎ নয়। পৃথিবী যে গোল এই মত বোধ হয়, আরও ঢের প্রাচীনকালেও পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।


Aristarchus of Samos 275 B.C.


ইনি প্রথম প্রচার করেন সে পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে নিজ নিজ ‘কক্ষে ভ্রমণ করে। (২)


কিন্তু এই সমস্ত মত পাশ্চাত্যে গৃহীত হয় নাই। প্রায় ১৬০ খৃঃ অব্দে প্রসিদ্ধ গ্রীক পণ্ডিত Klaulius Ptolemy আলেকজান্দ্রিয়া নগরে প্রসিদ্ধ ‘Syntaxis’ গ্রন্থ রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি পৃথিবীর গোলত্ব অস্বীকার করেন নাই, পরন্তু বর্তমান ভৌগোলিকগণ যেরূপ অক্ষরেক্ষা ও দ্রাঘিমা দ্বারা পৃথিবীর উপর কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় করেন তিনিও সেইরূপ করিয়াছিলেন। কিন্তু Ptolemy পৃথিবীর আবর্তনবাদ ও Aristarchus of Samos পরিকল্পিত সৌরজগতের সৌর কৈন্দ্রিকতা অথবা Heliocentric Theory of the Solar system মানেন নাই। প্রধানতঃ Ptolemy’র বিরুদ্ধতায় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইউরোপে Aristarchus এর মত ত্যক্ত হয়। প্রায় তেরশত বৎসর পরে ১৪৪৪ খৃঃ অব্দে Poland দেশীয় সন্ন্যাসী Copernicus পুনরায় এই মতবাদ প্রচার করেন যে পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে ভ্রমণ করে এবং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে নিশ্চল হইয়া বর্তমান থাকে। (৩)।


কিন্তু Copernicus প্রবর্তিত মতও তৎকালীন ইউরোপে গৃহীত হয় নাই। শুধু যে ‘পাদ্রীরা এই মতের পরিপন্থী হন তাহা নয়, Tycho Brahe র মত , প্রসিদ্ধ জ্যোতিষজ্ঞ পণ্ডিত এই মত মানিতেন না।


Tycho বলিতেন পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে এবং সূৰ্য্য ইহার চতুর্দিকে ঘুরিতেছে এবং অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরিতেছে। Tycho Braheর মত সুবিখ্যাত জ্যোতিষী বৈজ্ঞানিক কারণেই Copernicusএর মতবাদ অস্বীকার করেন এবং এই মতবাদ ইউরোপেও সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হইত, যদি Kepler না জন্মিতেন। Kepler গ্রহগতি সম্বন্ধে তাহার সুপরিচিত তিনটী নিয়ম আবিষ্কার করিয়া সৌরজগতের ‘পৃথিবী কেন্দ্রিকতা’ বাদকে চিরকালের জন্য সমাধিস্থ করেন। তৎপর Gulileo গতিতত্ত্ব ও Newton (1742-1727) মাধ্যাকর্ষণশক্তি আবিষ্কার করেন এবং Newton উভয়তত্ত্ব প্রয়োগ করিয়া গ্রহগণের গতির সম্যক ব্যাখ্যা প্রদান করেন।


এখন সমালোচকের হিন্দু জ্যোতিষের উৎকর্ষের দাবী কতটা বিচারসহ তাহা আলোচনা করিয়া দেখাইতেছি। প্রথমেই দেখিয়াছি যে ‘পৈতামহ সিদ্ধান্তের কাল অর্থাৎ খৃঃ অব্দের ৮০ সন পর্যন্ত ভারতীয় নিজস্ব জ্যোতিষ বা কালগণনা প্রণালী অতিশয় অশুদ্ধ ছিল এবং তৎপূর্ববর্তী মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে কুত্রাপি পৃথিবীর গোলত্ব, আবর্তনবাদ ও সূর্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণবাদ স্বীকৃত হয় নাই। আনুমাণিক ১০০ খৃঃ অব্দের পরে বোধহয় উজ্জয়িনীর শক রাজাদের সময় হইতে (যাহার পারশিক প্রভাবান্বিত ছিলেন। পাশ্চাত্য (Chaldean ও Greek জ্যোতিষ ভারতে আসিতে আরম্ভ করে। তখন ভারতীয় জ্যোতিষিকগণ পৃথিবীর গোলত্ব, আবর্তনবাদ ইত্যাদি স্থূলভাবে স্বীকার করিতে আরম্ভ করেন।


কিন্তু এই মতবাদ যখন বেবিলোনে ও গ্রীসদেশে প্রায় ভারতের প্রথম প্রচলিত মতের অন্যূন তিনশত


বর্ষ পূর্বেই প্রচলিত ছিল এবং যখন প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে গ্রীক জ্যোতিষ সেই সময় ভারতে সম্যক প্রচারিত হইয়াছিল, তখন স্বীকার করিতে হইবে যে পৃথিবীর গোলত্ব, নিরাধারত্ব, আবর্তন ও প্রদক্ষিণবাদ সম্বন্ধে যদি কিছু পরবর্তীকালের হিন্দুপুরাণে বা জ্যোতিষে থাকে, তাহা বিদেশ হইতে ধার করা।পৃথিবীর গোলত্ব হিন্দু পণ্ডিতগণ চিরকালই স্বীকার করিয়াছেন, যদিও তাহাদের দেওয়া পৃথিবীর ব্যাস গ্রীকদের দেওয়া পরিমাণ হইতে বিশুদ্ধতর নয়। ভুভ্রমণবাদ সম্বন্ধে প্রথম প্রামাণ্য উক্তি পাওয়া যায় কসুমপুর অর্থাৎ পাটলীপুত্র নিবাসী আর্যভটের (জন্ম ৪৭৬ খৃঃ অব্দ) রচিত গীতিকাপাদে।


“অনুলোমগতির্নৌস্থঃ পশ্চাত্যচলং বিলোমগং নদবত্


 অচলানি ভানি তদবৎ সমপশ্চিমগানি লঙ্কায়াম্ —“


 ইহা পৃথিবীর আবর্তন সম্বন্ধীয় মতবাদ, কোন প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষী সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ সম্বন্ধে কোনওরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন কিনা তাহা আমার জানা নাই। আর্যভট্ট নিজে Epicyclic Theory দিয়া গ্রহগণের গতি বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন—তাহাতে পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র বলিয়া ধরা হইয়াছে।


কিন্তু আর্যভটের ভুভ্রমণবাদ পরবর্তী কোন হিন্দু জ্যোতিষী গ্রহণ করেন নাই। ব্রহ্মগুপ্ত, লল্ল, মুঞ্জাল, ভাস্করাচার্য প্রভৃতি পরবর্তীকালের সমস্ত খ্যাতনামা জ্যোতিষীই ভুভ্রমণবাদ খণ্ডন করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। (বিশদভাবে শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায়কৃত আমাদের জ্যোতিষ ও জ্যোতিষী গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং ইউরোপে প্রাচীন গ্রীকদের ভুভ্রমণবাদের যে দশা হইয়াছিল, ভারতেও আর্যভটের ভূভ্ৰমণবাদেরও (যাহা সম্ভবত গ্রীকদের নিকট হইতে ধার করা) সেই অবস্থা হয়। ভূভমণবাদে আৰ্য ভট্ট পৃথিবীর দৈনিক আবর্তন মাত্র বুঝিয়াছেন, তিনি অথবা কোন ভারতীয় পণ্ডিত যে পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে প্রমণ করিতেছে, এই মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর্য ভট্টকে তর্কের খাতিরে Copernicusর সমতুল্য ধরিলেও এদেশে পরবর্তীকালে Kepler, Galileo, Newton এর জন্ম হয় নাই, একথা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে।


সিদ্ধান্ত জ্যোতিষকালে (৪০০-১১০০ খৃঃ অব্দ) ভারতে কালগণনার অনেক উন্নতি সাধন হয়। বৎসর ও মাসের পরিমাণ, গ্রহদিগের ভগণকাল হিন্দুপণ্ডিতেরা অধিকতর শুদ্ধভাবে নিরুপণ করেন। জ্যোতিষিক গবেষণা করিতে যাইয়া, তাহারা জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, বীজগণিতে অনেক মৌলিক আবিষ্কার করেন। কিন্তু এ সমস্ত আবিষ্কার Pre-renaissance যুগের ইউরোপীয় জ্যোতিষের সমতুল্য– এমন কি কোন কোন অংশে মধ্যযুগের আরব জ্যোতিষেরও সমতুল্য নয়। হিন্দু, ও গ্রীকদের নিকট জ্যোতিষশাস্ত্র শিখিয়া মধ্যযুগের আরবগণ (৭০০:১৫০০ খৃঃ অব্দ) জ্যোতিষে বহু উন্নতি সাধন করেন। প্রায় ১৭৩০ খৃঃ অব্দে সম্রাট মহম্মদ শাহের আদেশে জয়পুররাজ  সবাই জয়সিংহ ভারতে উন্নততর আরব জ্যোতিষের প্রচলন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার আদেশে তৈলঙ্গ পণ্ডিত  জগন্নাথ সংস্কৃত ভাষায় ‘সিদ্ধান্তসম্রাট’ নামক গ্রন্থ রচন! করেন, উঃ Ptolemyর Syntatisএর আরব্য সংস্করণের  অনুবাদ মাত্র। তার প্রতিষ্ঠিত মাননন্দিরসমূহ মধ্য এশিয়া উলুবেগের মানমন্দিরের আদর্শে গঠিত।


জয়পুররাজ প্রাচীন ভারতীয় সিদ্ধান্ত-জ্যোতিষ পরিত্যাগ করিয়া আরব্য জ্যোতিষের প্রবর্তন করিতে সচেষ্ট হন কেন? কারণ, সিদ্ধান্ত জ্যোতিষের গণনাপ্রণালী ৪০০ খৃঃ অব্দের পক্ষে প্রশংসনীয় হইলেও সম্পূর্ণ শুদ্ধ ছিল না এবং প্রায় ১৩০০ বৎসরের গতানুগতিকতার ফলে, উহা সম্পূর্ণ “দূরবিভ্রষ্ট” হইয়া পড়িয়াছিল। সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ কালের হিন্দু পণ্ডিতগণ মনে করিতেন যে অয়নচলন ক্রমান্বয়ে একদিকে নয়, খানিকদূর যাইয়া পেণ্ডুলামের গতির মত প্রত্যাবর্তন করিবে। সেই জন্য তাহার সায়ন বৎসর  (Tropical) গণনা না করিয়া নিয়ে বর্ষ  (Sidereal)  গণনা করিতেন এবং এখনও করেন। এই জন্য এবং নিয়ন বৎসরের পরিমাণে যে ভুল ছিল দুই এ মিলিযা তাহাদের বৎসরমান প্রকৃত সায়ন বর্ষ মান অপেক্ষা প্রায় .০১৬ দিন বেশী হয় এবং প্রায় ১৪০০ বৎসরে হিন্দু বর্ষ মানে ভুল প্রায় ২৩ দিনে পৌছিয়াছিল। হিন্দু পঞ্জিকায় ৩১শে চৈত্রকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়, কিন্তু বাস্তবিক মহাবিষুব সংক্রান্তি হয় ৭ই কি ৮ই চৈত্র। যদিও পৃথদক স্বামী প্রায় ৮৫০ খৃঃ অব্দে স্পষ্ট করিয়া বলেন যে অয়নচলন একদিকেই হয়, তথাপি একাল পর্যন্ত দুই একজন ব্যতীত কোন হিন্দু জ্যোতিষীই বর্ষমানের সংস্কারের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন নাই। বাস্তবিক পক্ষে ১২০০ খৃ: অব্দের পর হইতে হিন্দ জ্যোতিষিক পণ্ডিতগণ বেহুলার মত মৃত সভ্যতার শব আলিঙ্গন করিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া আছেন এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত অতি ভুল পদ্ধতিতে বর্ষ গণনা করিতেছেন। মৎ-সম্পাদিত ‘Science and Culture’ পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটা প্রবন্ধে দেখাইতে চেষ্টা করিতেছি যে হিন্দুর তিথি ইত্যাদি গণনা, শুভ অশুভ দিনের মতবাদ, কতকগুলি মধ্যযুগীয় ভ্রান্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত হিন্দুপঞ্জিকা একটা কুসংস্কারের বিশ্বকোষ মাত্র।


সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ সম্বন্ধে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় জ্ঞানের কথঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া হইল। আশা করি সমালোচক আমার বিবরণে ভূল বাহির করিবেন, না হয় তাঁহার হিন্দুজ্যোতিষের উৎকর্ষ সম্বন্ধে অতিশয়োক্তি প্রত্যাহার করিবেন। সম্যক অধ্যয়ন ও বিচার না করিয়া অতীতের উপর একটা কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করা শুধু আত্মপ্রবঞ্চন মাত্র এবং এরূপ ‘আত্মপ্রবঞ্চকের পক্ষে পরকে উপদেশ দিতে যাওয়া অমার্জনীয় ধৃষ্টতা।


সমালোচক পুনরায় বলিয়াছেন “এই বিশ্বজগতের পশ্চাতে এক বিরাট চৈতন্যশক্তি আছে, তাহা হইলে সূৰ্য্য চন্দ্র গ্রহাদির পশ্চাতেও সে শক্তি রহিয়াছে, অতএব এই সকলকে দেবতা বলিলে ভুল হয় না।”  এই মন্তব্য বিশ্বাসের কথা, যুক্তির কথা নয়। যাহারা। Shamanismএ বিশ্বাস করেন, তাহারা সমালোচকের মত মানিয়া লইতে পারেন। আমি যুক্তিবাদী, যুক্তি মানিতে রাজী আছি, Shamanism মানিতে আমার কোনও আগ্রহ নাই। এইরূপ বিশ্বাস যদি সভ্যতার উৎকর্ষ প্রতিপন্ন করে, তাহা হইলে Mexico নিবাসী Aztecগণের মত সভ্যজাতি পৃথিবীতে জন্মে নাই, কারণ তাহারা সূর্যকে দেবতা বলিয়া মানিত এবং মনে করিত, যে পর্বে পর্বে নরবলি না দিলে সূর্যের ক্ষুধা মিটিবে না, সূর্যের শক্তি হ্রাস হইবে এবং তাপ বিকীরণের ক্ষমতা লোপ পাইবে, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী আরম্ভ হইবে। সুতরাং পূর্বে পর্বে তাহারা সূর্যের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য সহস্র সহস্র নরবলি দিত।


সূৰ্য্যকে দেবতা মনে করা একটা প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধারণা মাত্র, এই যুগে সেই ধারণার কোন সার্থকতা নাই। এখন অতি সাধারণ শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেও জানে যে সূৰ্য পূজা করিলে গ্রীষ্মের আধিক্য বা অনাবৃষ্টি ইত্যাদি দূরীভূত হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রসাদে সূর্যের উত্তাপকে যন্ত্রযোগে সর্ববিধ কাজে লাগান সম্ভবপর এবং উহাতে মানুষের সর্ববিধ সুবিধা, যেমন শক্তি উৎপাদন refriegeration (শৈত্যোৎপাদন) air-conditioning, cooking, (রন্ধন), water-raising (জলেত্তোলন) ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন হয়। সুতরাং যাহারা সমালোচকের মত গ্রহাদিকে দেবতাজ্ঞান করেন, তাহারা শুধু একটী মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের মোহে নিমজ্জিত আছেন, তাহাদের অপেক্ষা যাহারা যন্ত্রযোগে সূর্যের উত্তাপকে সর্ববিধ কাজে লাগাইতে সচেষ্ট আছেন, তাহারা অনেক উন্নতস্তরের জীব। বিশ্বজগতের পশ্চাতে চৈতন্যই থাকুন বা অচৈতন্যই থাকুন, তাহাতে মানবসমাজের কি আসে যায়, যদি সে “চৈতন্য” কোনও ঘটনা নিয়ন্ত্রণ না করেন অথবা কোনও প্রকারে সেই ‘চৈতন্যকে আমরা আমাদের উদ্দেশ্যের অনুকূলে চালিত না করিতে পারি ? প্রাচীন Chalden জ্যোতিষীরা মনে করিতেন যে গ্রহগুলি দেবতার প্রতীক এবং সেই দেবতারা মানবের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করে ; এই বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া তাহারা ফলিত জ্যোতিষ বা হোরাশাস্ত্র উদ্ভাবন করেন এবং কোষ্ঠী, গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানজনিত ফলাফল গণনা করিতেন। ভারতে বৌদ্ধদের বাধা সত্ত্বেও তাহার উপর গ্রহপূজা আরম্ভ হয়। কিন্তু Chadean সভ্যতার ধ্বংস ও ভারতীয় সভ্যতার অধঃপতন হইতে মনে হয় যে ফলিতজ্যোতিষ সম্পূর্ণ নিরর্থক। বর্তমান বিজ্ঞানে ফলিত জ্যোতিষের কোন সার্থকতা উপলব্ধি হয় না।


‘ বিজ্ঞানের নামে অজ্ঞানের প্রচার ‘

অধ্যাপক শ্রীমেঘনাদ সাহা ডি-এস-সই, এফ-আর-এস

(মেঘনাদ সাহার এই লেখাটি ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।)


একথা না বলিলেও চলে যে, আধুনিক জগতে নানা কারণে বিজ্ঞানের বেশ খানিকটা মর্যাদা বা prestige বাড়িয়াছে। য়ুরোপ, আমেরিকা ও জাপানে বিজ্ঞানের দৌলতে গত পঞ্চাশ বৎসরে মানবের জীবনযাত্রার প্রণালী অনেক পরিমাণে উন্নত হইয়াছে; এবং জ্যোতিষ, প্রাকৃত বিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণি ও উদ্ভিদ তত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, যন্ত্রবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে মানবের জ্ঞানের পরিধি অপরিসীম বাড়াইয়া দিয়াছে। সুতরাং ইহা কি আশ্চর্যের বিষয় নয়


যে, অনেক অ-বৈজ্ঞানিক লোক (অর্থাৎ যাহারা কখনও বিজ্ঞানের ধারাবাহিক শিক্ষার—discipline of science—ভিতর দিয়া যান নাই, অতএব যাহাদের বর্তমান বিজ্ঞান, সম্বন্ধে জ্ঞান নাই বলিলেও চলে) …নানা প্রকারে বিজ্ঞানের বাস্তব কৃতিত্বকে খর্ব করিতে প্রয়াস পাইবেন?


এই প্রচেষ্টা প্রকাশ পাইতেছে নানা রূপ ধরিয়া। এক শ্রেণীর লোক বলেন যে, বিজ্ঞান আর নূতন কি করিয়াছে ? বিজ্ঞান বর্তমানে যাহা করিয়াছে—তাহা কোনও প্রাচীন ঋষি, বেদ বা পুরাণ বা অন্যত্র কোথাও-না-কোথাও বীজাকারে বলিয়া গিয়াছেন। অপর এক শ্রেণীর লোক বলেন যে, বিজ্ঞান মানব-সমাজের ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টই অধিক করিয়াছে, যথা—বিজ্ঞানের প্রসারে মানব-সমাজে যুদ্ধ-বিগ্রহ বাড়িয়াছে, বিষাক্ত গ্যাস, বিস্ফোটক প্রভৃতি নানারূপ মানুষ-মারা জিনিস সৃষ্টি হইয়াছে। অপর এক শ্রেণীর লোক বলেন যে, বিজ্ঞান মানুষের ভোগলিপ্সা বর্ধিত করিয়া তাহাকে আধ্যাত্মিকতা হইতে ভিন্ন পথে লইয়া যাইতেছে। সমালোচক অনিলবরণ রায়ের রচনার মধ্যে এই ‘ত্রিবিধ’ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়।


আমি পূর্ববর্তী প্রবন্ধদ্বয়ে প্রথম শ্রেণীর সমালোচকদের উত্তর দিতে চেষ্টা করিয়াছি। সমালোচক অনিলবণ রায়  বর্তমান বিজ্ঞানের যে সমুদয় তথ্য, যেমন—“ক্রমবিবর্তনবাদ, ‘জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার’ ইত্যাদি—প্রাচীন শাস্ত্রে কোথাও না কোথাও বীজাকারে বা পূর্ণভাবে লিপিবদ্ধ আছে বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা সমস্তই যে ‘অলীক ও ভ্রান্ত তাহা প্রতিপন্ন করিয়াছি। এক্ষণে বক্তব্য, সমালোচক যদি বাস্তবিকই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সহিত প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের তুলনামূলক আলোচনা-কাৰ্য্যে ব্রতী হইতে চান, তবে তিনি ভাল করিয়া ‘পাশ্চাত্য বিজ্ঞান’-এর সাধনা করুন, নতুবা ‘অজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলিয়া প্রচারের অপচেষ্টা করা নিরর্থক এবং আমার মতে তাহার  কোন অধিকার নাই। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অতি বিরাট জিনিস-প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত শাস্ত্র ; ধ্যানে বসিয়া অথবা  দুই-একখানা সুলভ বা popular বই পড়িয়া তাহাতে অধিকারী হওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। ঐ বিজ্ঞানের সাধনা করিতে হয় হাতে-কলমে, প্রণিধান করিতে হয় আজীবন স্বাধীন চিন্তায়, ‘গুরু’ বিজ্ঞানে ‘পথপ্রদর্শক মাত্র, কিন্তু  কোন বৈজ্ঞানিক গুরু যদি ‘পূর্ণ ও চিরন্তন সত্য আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া দাবী করেন, তাঁহাকে উপহাসাম্পদ হইতে হইবে। এক্ষেত্রে গুরুভক্তদের চেয়ে গুরুমারা’ শিষ্যেরই আদর ও প্রয়োজনীয়তা বেশী। বিজ্ঞান কখনও  চিরন্তন সত্য আবিষ্কার করিয়াছে বলিয়া দাবী করে না, কিন্তু সাধকের অনুসন্ধিৎসা-বৃত্তিকে সজাগ রাখিয়া তথ্য সন্ধানের পন্থা বলিয়া দেয়।


বিজ্ঞানের নামে সমালোচকের দ্বিতীয় অভিযোগ এই যে, মানুষ প্রকৃতিকে জয় করিয়াছে সত্য, কিন্তু সে তাহার অন্তর্নিহিত পাশবিক ভাবকে জয় করিতে পারে নাই। সমালোচক অনিলবরণ রায় বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে এই মামুলী অভিযোগ আনিতে ছাড়েন নাই এবং অনেক গান্ধী-পন্থীও ‘বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উপস্থাপিত করিয়া চরকা, গরুর গাড়ী ও বৈদিক তাতের আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন।


কিন্তু এই সমস্ত সমালোচক একটা অতি স্থূল কথা ভুলিয়া যান। বিজ্ঞান যে ব্যক্তিগত জীবন’-কে কতটা উন্নত করিয়াছে তৎসম্বন্ধে তাহাদের মোটেই কোন ধারণা নাই। দুই একটি প্রমাণ দিতেছি।


আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞান ব্যক্তিগত জীবনে প্রযুক্ত হয় নাই, তথায় মানুষের গড়পড়তায় জীবনকাল সাড়ে তেইশ বৎসর মাত্র। মধ্যযুগে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক যুগের পূর্বে, য়ুরোপেও গড় জীবনকাল ছিল পঁচিশ বৎসর। কিন্তু গত পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে য়ুরোপ ও আমেরিকায় মানুষের গড়পড়তায় জীবন বাড়িয়া প্রায় দুই গুণ অর্থাৎ প্রায় ছচল্লিশ বৎসর হইয়াছে। ‘বর্তমান বিজ্ঞান’-এর ভারতীয় সমালোচকগণ এই  জীবনবৃদ্ধির কারণটা তলাইয়া দেখিবার বোধ হয় অবসর এ পান নাই। ইহার কারণ এই যে, বিজ্ঞানের প্রসাদে য়ুরোপের অধিবাসীরা প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যকর আবাস, রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা, যথেষ্ট বিশ্রাম প্রভৃতি স্বাচ্ছন্দ্যের (amenities of life) অধিকারী হইয়াছে। কিন্তু ভারত, চীন বা আবিসিনিয়ার গ্রামবাসী দুইবেলা উপযুক্ত আহার পায় না, তাহাদের শীত-গ্রীষ্মনিবারক বস্ত্রাদি নাই, বাসস্থান অতীব অস্বাস্থ্যকর, রোগে চিকিৎসক ডাকিবার ও ঔষধ কিনিবার সামর্থ্য নাই ; এ জন্য অধিকাংশ স্থলেই তাহারা অকালে কাল গ্রাসে পতিত হয় এবং যতদিন বাঁচিয়া থাকে বেশীর ভাগ অভাব, রোগ ও শোকগ্রস্ত হইয়া আধমরা হইয়াই থাকে।


জাতীয় পরিকল্পনা সমিতি হিসাব করিয়া দেখিয়াছে যে, এদেশের লোকের বৎসরে মাথা পিছু আয় পঁয়ষট্টি টাকা মাত্র, কিন্তু বিলাতের লোকের আয় প্রায় মাথা পিছু দুই হাজার টাকা, অর্থাৎ—এখানকার প্রায় ত্রিশ গুণ। অনেকে  বিলাতের সহিত তুলনায় আপত্তি করিবেন, কারণ বিলাতের উপনিবেশ আছে, আর আছে ভারত-মাতারূপ একটি কামধেনু। কিন্তু আর একটি পাশ্চাত্য দেশ লওয়া যাক, যেমন সুইডেন। এই দেশের কোন উপনিবেশ বা অধীন দেশরূপ কামধেনু নাই; তাহা সত্ত্বেও এই দেশের জনপ্রতি বাৎসরিক আয় ভারতবাসীর গড় আয়ের প্রায় বিশ গুণ। এমন কি, জাপান ভারত অপেক্ষা প্রাকৃতিক সম্পদে ন্যূন হইলেও বিজ্ঞান-সম্মত কাৰ্য্য-পন্থা অবলম্বন করায় তথায় জনপ্রতি আয় গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে ভারতবাসীর আয় অপেক্ষা চারি হইতে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে।


চীন, ভারত ও আবিসিনিয়ার দারিদ্রের একমাত্র কারণ এই যে, এই সমস্ত দেশ (যে কারণেই হউক আংশিক পরাধীনতা, আংশিক ভ্রান্ত জনমত পোষণ) , বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে নাই এবং বৈজ্ঞানিক-প্রণালী অবলম্বনে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করিবার এবং জনসাধারণের মধ্যে সেই সম্পদ যথাসম্ভব সমভাবে বিতরণ করিবার চেষ্টা করে নাই। পক্ষান্তরে, ইংলণ্ড ও অপরাপর যুরোপীয় দেশ  নিজ নিজ যাবতীয় প্রাকৃতিক শক্তিকে কার্যে নিযুক্ত করিয়া বৎসরে জনপিছু প্রায় দুই হাজার ইউনিট কাজ পাইতেছে ; কিন্তু ভারতবাসী মোটের উপর নিজের শক্তি এবং দুই একটি গৃহপালিত পশুর শক্তির উপর নির্ভর করে বলিয়া তাহার আয়ও পঁচিশ হইতে ত্রিশ গুণ কম হয়। একজন চরকাপন্থী বর্তমান লেখককে জানাইয়াছেন যে, তাহাদের বহুবর্ষব্যাপী অভিজ্ঞতার ফলে দাড়াইয়াছে এই যে, সারা বৎসর বিশ্রাম সময়ে চরকা কাটিয়া সাকুল্যে.বৎসরে আয় হয় মাত্র চারি টাকা। চরকার নিরর্থকতা সম্বন্ধে ইহার চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হইতে পারে। প্রকৃত পক্ষে, বিজ্ঞানের প্রভাবেই প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাইয়া দেশের আয়বৃদ্ধি করা সম্ভব হইয়াছে ; এবং ব্যক্তিগত জীবনকে মধ্যযুগ (বিজ্ঞানের পূর্ববর্তী যুগ) অপেক্ষা সর্বাংশে উন্নত ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করিয়া তোলা সুকর হইয়াছে।


যদি মানুষকে সর্বদা অভাব, অভিযোগ ও দারিদ্রের : সহিত সংগ্রাম করিতে হয় তবে তাহার ইতর প্রাণীজীবনের ঊর্ধে উঠিবার অবসর কোথায়? অধিকাংশ ঐতিহাসিকদিগের মতে যে সমস্ত জাতি বা সমাজ সভ্যতার ঊর্ধ্বতম শিখরে আরোহণ করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অপরাপর জাতি বা সমাজ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল। দার্শনিক গুরু প্লেটো বলিয়াছেন যে, এথেন্সের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগে, অর্থাৎ-পেরিক্লিসের  কালে, প্রত্যেক এথেনীয় নাগরিকের গড়ে চারিজন ক্রীতদাস থাকিত ; অর্থাৎ-নাগরিকদের অধীনে এক শ্রেণীর লোক ছিল যাহারা কৃষি, শিল্প, ভারবহন ইত্যাদি যাবতীয় শ্রমসাধ্য কাজ করিত এবং নাগরিকগণ শুধু তাহাদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করিতেন। এজন্য নাগরিকগণ সুষ্ঠু কাব্য, দর্শন, স্থপতি ও কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান প্রভৃতির আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় পাইতেন। কিন্তু এথেন্স এখন মাকিদন রাষ্ট্রের অধীন হইল তখন এথেন্সবাসী নাগরিকের অর্থ-সমস্যা আরম্ভ হইল এবং যে এথেন্স এককালে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সংস্কৃতিপ্রভাবে পৃথিবীকে চমৎকৃত করিয়াছিল তাহা অচিরে, অর্থাৎ এক শতাব্দীর মধ্যে, একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর নগরে পরিণত হইল।


কিন্তু বর্তমান সময়ে, অর্থাৎ প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে কার্যে নিয়োজিত করিয়া তাহার যাবতীয় কাজ করাইয়া লইতে পারে, ক্রীতদাস রাখার প্রয়োজন হয় না বললেও চলে। য়ুরোপ ও আমেরিকায় গত পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া এই প্রচেষ্টা চলিতেছে। পূৰ্বে উক্ত  হইয়াছে যে, ইংলণ্ডে বৎসরে জনপিছু কাজের পরিমাণ দুই হাজার ইউনিট—ইহার মধ্যে প্রায় ছয় শত ইউনিট বৈদ্যুতিক শক্তি হইতে, প্রায় হাজার ইউনিট বাষ্পীয় শক্তি হইতে এবং অবশিষ্ট চারিশত ইউনিট পেট্রোল ও অপরাপর দাহ্য পদার্থ হইতে উৎপন্ন করা হয়। যদি উহার সমতুল্য পরিমাণ কাজ ক্রীতদাস রাখিয়া উৎপন্ন করা হইত, তবে ইংলণ্ডের প্রত্যেক ব্যক্তির অন্যূন দশজন ক্রীতদাসের প্রয়োজন হইত এবং প্রত্যেক ক্রীতদাসকে প্রত্যহ আট ঘণ্টা পরিশ্রম করিতে হইত। কারণ, মানুষের কাৰ্য্যকরী ক্ষমতা অত্যন্ত কম। বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে দেখা গিয়াছে যে, একটি ঘোড়া দশজন মানুষের কাজের সমান কাজ করিতে পারে। একটি ঘোড়া এক ঘণ্টা কাজ করিলে ৩/৪  ইউনিট কাজ হয় ; – সুতরাং, একজন লোক আট ঘণ্টা খাটিলে, ত্রৈরাশিক  পন্থায় দেখা যাইবে যে, মাত্র ৩*৪/৪*১০ , অর্থাৎ ৩/৫ ইউনিট  কাজ করিতে পারে। যদি ধরা যায় যে, ক্রীতদাস বৎসরে তিন শত দিন কাজ করে, তাহা হইলে তাহার সারা বৎসরে কাজের পরিমাণ হয় ৩/৫* ৩০০ অর্থাৎ একশত আশী ইউনিট। অতএব, দুই হাজার ইউনিট কাজ পাইতে হইলে ইংলণ্ডের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রায় এগার জন ক্রীতদাসের প্রয়োজন হইত।


 যদি পাঠকগণ এই সহজ হিসাবটি বুঝিতে চেষ্টা করেন  তবে দেখিতে পাইবেন যে, আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির পক্ষে কতটা সুন্দর পন্থা নির্দেশ করিয়াছে। প্রাকৃতিক শক্তিকে কাৰ্যে বিনিয়োগ করার ফলে প্রতি ইংলণ্ডবাসী কম-বেশ দশটি ক্রীতদাসের পরিশ্রমলব্ধ  সম্পদের অধিকারী হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, এই ‘ক্রীতদাস’কে বাধ্য রাখার জন্য আয়াস স্বীকার করিতে  হয় না, কাৰ্যপন্থা সুনির্দিষ্ট করিয়া কেবলমাত্র ‘সুইচ, টিপিবামাত্র ‘ক্রীতদাস’ স্বতস্ফূর্ত্তিতে কাজ করিয়া যায়। বেত্রাঘাতের বালাই নাই, পুলিস বা সিপাহী মোতায়েন রাখিবার আবশ্যকতা নাই। ইংলণ্ড, আমেরিকা ও জাপান এতটা ঋদ্ধিশালী হইয়াছে এই প্রাকৃতিক শক্তি প্রয়োগের ফলেই, এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনও অনেক উন্নত স্তরে উঠিয়াছে। এক্ষণে বক্তব্য, যদি এদেশের সুমহান্ অধ্যাত্ম তত্ত্বের সাধকগণ এবং তথা গান্ধী-পন্থিগণ এই সামান্য তত্ত্বটি উপলব্ধি করিয়া কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হন তবে আমাদের দেশ  চরকা, গরুর গাড়ী, বৈদিক তাঁত ও প্রাচীন শাস্ত্রের মারাত্মক আধ্যাত্মিকতার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া ভবিষ্যতে মহীয়সী সভ্যতার পথে দ্রুত অগ্রসর হইতে পারে। ভারত প্রাকৃতিক সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ; যদি একটি সুচিন্তিত কার্যপ্রণালী স্থির করিয়া দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের সর্ববিধ কাৰ্যে প্রয়োগ করিবার দেশব্যাপী প্রচেষ্টা হয় তাহা হইলে আশা করা যাইতে পারে যে দশ বৎসরের মধ্যে ভারতের জনপিছু দ্বিগুণ আয় করা কিছু অসম্ভব নয়। জাতীয় পরিকল্পনা সমিতি সম্প্রতি এই কাৰ্যপন্থা নির্ধারণে নিযুক্ত আছেন।


প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে লোকের নিজের দেশ ছাড়া, অন্য দেশ সম্বন্ধে ধারণা অতি অল্পই ছিল, ভিন্নদেশের ও ভিন্ন ধর্মী লোককে তাহারা বর্বর, অসভ্য ও পাপাসক্ত বলিয়া মনে করিত ; এক দেশের লোকের পক্ষে অন্য দেশে ভ্রমণ করা বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের প্রসাদে পৃথিবীর অতি দুরতম দেশের মধ্যেও সংযোগ স্থাপিত হইয়াছে, বিভিন্ন দেশের লোক পরস্পর পরস্পরকে জানিতে শিখিয়াছে। বিজ্ঞান ব্যক্তিগত জীবনকে যতটা সুখী ও উন্নত করিয়াছে তৎসম্বন্ধে অধিক বলা বাহুল্য মনে করি।

[লেখাটি সংশয়ডটকম থেকে নেওয়া হয়েছে]

কিছু একান্ত কথা এবং চতুর -শুভ্র
Nov. 26, 2024 | সচেতনতা | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(১) কিছু একান্ত কথা

প্রশ্ন হইল, আমরা কি কেবলমাত্র তমসাচ্ছন্ন পথকেই আশ্রয় করিব? আমাদিগের সকল বিষয় ও বাসনারাশি রাজনীতি,ধর্মীয় কুসংস্কারের নিকট সমর্পণ করিয়া, তাহার অন্ধকারবৃত্তের অভিমুখে অগ্রসর হইব?

আমরা কি দৈহিক স্থূল আবেগের অনুবর্তী, না হইতে পারি না?

সকল শক্তি সংহত করিয়া অন্তঃস্থ শুদ্ধ চৈতন্যের দ্বারা পরিচালিত হইতে পারি না?


এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রতিটি মানুষের অতি একান্ত, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ হইতেই উৎসারিত হইয়া থাকে।

বিজ্ঞানী যেরূপ গবেষণাকার্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহ উদ্ভাবন করিয়া থাকেন। সেইরূপ সকল আনুসন্ধানিক কার্যেই কিছু সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হইয়া থাকে। উচ্চতর গবেষণাকার্যে একমাত্র চেতনাযুক্ত মন-ই এমন এক উপযুক্ত যন্ত্র।

দৈনন্দিন জীবনে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এমন এক কুসংস্কারমুক্ত চেতনাযুক্ত, মন প্রয়োজন। যা আমাদিগের স্থূল-দৃষ্টি বহির্ভূত বিষয়সকল উদ্ঘাটন করিতে সাহায্য করিবে। 


তাই নয় কি? ভাবুন ভাবুন ভাবা প্র্যাকটিস করুন...


(২) চতুর

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

এক সময়ে একজন ধর্মীয় গুরু আমাদের প্রতিবাসী হইয়া আসিলেন। সকলকে ধর্ম সম্বন্ধে উৎসাহী করা তাঁহার প্রধান কর্ম ছিল। যেখানে কেহ একা আছে দেখিতেন, সেইখানে গিয়া গল্পকথা আরম্ভ করিতেন; কেহ তাঁহার কথা শুনিত, কেহ শুনিত না। অথচ তাঁহার স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সকলেই তাঁহার কথা শুনিতে আগ্রহ করে। 

একবার একজন শ্রোতা কৌতুহলী হইয়া বলিয়াছিলেন, "আপনার গল্পকথা ভাল লাগে,তবে উহাসকল প্রমাণিত করিতে পারিবেন?"

গুরু ঠাকুর উত্তর করিয়াছিলেন, “তা কেমন করিয়া হইবে, এখনও যে এ কথার অনেক বাকি। তুমি চুপ কর।” 

বিনা মেঘে হঠাৎ করিয়া এমন গুরুতর আলোচনার মধ্যে, অমন প্রশ্নের অবতারণায় গুরুঠাকুর বোধহয় কিঞ্চিৎ হতবিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। পাশ থেকে এক ভক্ত কহিলেন, "বুঝিতে পারিলেন না, বাবা অন্তর্যামী! আপনি মুখ খুলিবার পূর্বেই আপনার আসিবার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্যক অবগত হইয়া বসিয়া আছেন।" তবুও কথাগুলি প্রশ্নকারীর মনে ধরিল না। দুরু দুরু বক্ষে তিনি একটা প্রশ্ন করিতে যাইবেন, এমতাবস্থায় বাবা নাসিকা গর্জনের সহিত গভীর ধ্যানে তলাইয়া গেলেন। প্রশ্নকর্ত্তা আর মুখ খুলিতে সুযোগ পাইলেন না। ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় ফ্যালফ্যালাইয়া শূন্য দৃষ্টিতে মহাজ্ঞানী মহাজনের জাগিবার অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।


বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না, বাবা চক্ষু উন্মোচন করিয়া ভক্তগণের দিকে চোখ রাখিয়া, পুনরায় তাঁর বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন। 


কিছুসময় পর, গুরুদেব পুনরায় দৃষ্টির ঝাঁপ অবনত করিলেন। প্রশ্নকারীর কৌতুহলী হৃদয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই এই ধারণা বাসা বাঁধিতে শুরু করিয়াছিল যে, ভাগিয়া যাওয়া ছাড়া তাহার সম্মুখে হয়ত আর কোন রাস্তা খোলা নাই। কিন্তু বাকীদের কী করিয়া উহাতে রাজী করাইবেন! সে নিজে সত্যের জন্য জীবন পর্যন্ত বিলীন করিতে প্রস্তুত থাকিলেও, বাকিরা যে ধর্মগুরুর প্রতি অনুরাগী! তাহারা কি তাহাদের অন্ধবিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া এক সাথে পথে নামিতে উৎসাহী হইবে!? যদি অবাস্তববাদী চিন্তায় প্রভাবিত হইয়া বাকিরা ভাগিয়া যাইবার পরিকল্পনাকে খারিজ করিয়া দেয়! তাহা হইলে তাহাদের মনের চাবি ভাঙ্গিয়া, তাহাদেরকে দুঃসাহসী রোমাঞ্চভিলাষীতে পরিণত করিবার আর কোন কার্যকর পন্থা কি উন্মুক্ত থাকিবে?


আবারও দৈববাণীর ন্যায় গুরুঠাকুরের মুখ হইতে ধ্বনিত হইল,-"ধর্মে প্রশ্নের স্থান নাই!" বলিয়া শুন্য হইতে একখানি তাম্বুল করগত করিয়া, ভক্তদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়িয়া দিলেন।


‘অ্যাঃ’—বিস্মিত প্রশ্নকর্তা আর কোন শব্দ খুঁজিয়া পাইলেন না।

এমন সময়ে তিনি দেখিলেন,দর্শকাসন হইতে জাদুকরের ন্যায় একজন বড় পাগড়ী ও আলখাল্লা পরিহিত কোন এক ব্যক্তি, ধর্মগুরুর নিকট সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। তাহাকে গোষ্ঠীর দলপতির দরবারে লইয়া যাওয়া হইল। দলপতি অর্থাৎ গুরুঠাকুর পরম সমাদরে গাত্রোত্থান করিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। এবং তাহাকেও শুন্য হইতে তাম্বুল আনিয়া দিলেন। 

বিস্মিত শ্রোতা দেখিলেন, অদ্ভুতভাবে জাদুকরও অবিকল সেইরূপ অঙ্গভঙ্গি করিয়া প্রতিকর্ম দেখাইলেন। এবং তিনিও ধর্মগুরুর হাতে, শুন্য হইতে একখানি তাম্বুল লইয়া ধরাইয়া দিলেন। ইহা দেখিয়া অপ্রকৃতস্থ হইয়া, ধর্মগুরু সস্নেহে জাদুকরের হাতখানি টানিয়া লইলেন। এবং ধীরে ধীরে তাহাকে অতি সুন্দর ভাবে কহিলেন, "তুমি যাহা করিলে, উহাতেও আমার ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল বলিয়াই, তাহা সম্ভব হইল!"


 সব দেখিয়া বুঝিয়া, সেই শ্রোতার অন্তরাত্মা শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু পাছে অসভ্যতা হয়,তাই বাহ্যিক কিছু প্রকাশ করিলেন না। গুরুঠাকুরের কথা শুনিয়া জাদুকর হাসিয়া নিবৃত্ত হইবা মাত্র, গুরুঠাকুরের একজন শিষ্য তাহার হাতখানি টানিয়া লইয়া যাইয়া, শিক্ষিত প্রণালী অনুসারে যথাসাধ্য সদ্ভাব জ্ঞাপন করিলেন। গুরুদেবের এই ঐশী ব্যবহারে উপস্থিত সকলেই যারপরনাই খুশি হইলেন এবং জাদুকরের প্রস্থানের পর তাহাদের ভক্তিযোগেও আর কোন গোল রহিল না।

ধর্ম বিশ্বাসী মাত্রই কি সুখী? -বিশ্বজিৎ চৌধুরী
Nov. 26, 2024 | পরিবেশ | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা কথা আমরা প্রায়শই শুনি ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের সাথে কথা বলার সময় এবং পরিসংখ্যানগতভাবেও বিভিন্ন সার্ভেতে দেখি যে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ মাত্রই আদতে তুলনায় সুখী মানুষ আমরা যারা অবিশ্বাসী তাঁদের থেকে। কথাটি আসলেই একজন অবিশ্বাসী নাস্তিকের পক্ষে বড় ভাবনার বিষয়। তবে কি এই জাগতিক পৃথিবীতে সুখের খোঁজ পায় ধার্মিকরা তুলনায় বেশি একজন যুক্তিবাদী নাস্তিকের থেকে? এই ঘটনাটি এইবার একটু তলিয়ে দেখা যাক। আচ্ছা “সুখ” কথার অর্থ কি? মনোবিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনগত দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা বিভিন্ন সময়ই নির্ধারণ করার চেষ্টা হয়েছে তবে মনোবিজ্ঞান বলছে সুখকে ইতিবাচক কর্ম ও আবেগসমূহের সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এছাড়া ও তিনটে বিশেষ অবস্থাকে ও বিবেচনা করা হয় – আনন্দ, অঙ্গীকার ও অর্থ। অন্তত মনোবিজ্ঞান তাই বলছে। এইবার আমরা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধফলকে যদি একটু যাচাই-বাছাই করি তবে দেখব সুখ প্রধানত নির্ভর করে বিভিন্ন জাগতিক ও লৌকিক অবস্থানের ওপর তা আর্থিক, পারিবারিক বা সামাজিক যে কোন পরিস্থিতিরই ওপর হোক না কেন। আমরা জানি আমাদের এই জাগতিক পৃথিবীতে এমন কিছু সময় আসে আমাদের জীবনে যার ফলে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি করে যা আমাদের মানসিক অবস্থাকে নেতিবাচক অর্থে নাড়া দেয় যার ফলে আমাদের শরীরে কিছু নেতিবাচক হরমোন ক্ষরণ হয় তাঁর ফলে অসুখী নামক মানসিক পরিস্থিতির স্বীকার হই। এইবার এই সুখী ও অসুখী নামক যে মানসিক অবস্থান তাকে একটু বিচার করা যাক।


 আমরা যদি এই পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখব, প্রকৃতি আদতে একটি প্রাণহীন নির্জীব জড়, যার কোনও ভালো-মন্দ, সুখ-অসুখ, ন্যায়-অন্যায়, অবিচার-সুবিচার, পাপ-পূণ্য বলে কোন নির্দিষ্ট সিস্টেম নেই প্রকৃতির মধ্যে। এই ধারণাগুলি আদতে মানব সমাজের বানানো নিয়ম, মনুষ্যসৃষ্ট। কেন মনুষ্যসৃষ্ট? কারন ডারউইনীয় মতে, প্রাণীর উদ্দেশ্য হল বংশবিস্তার সুতরাং, উন্নত মস্তিস্কের প্রাণী হিসেবে মানুষ তাঁর বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে তাঁর চারপাশে এমন এক পরিবেশ গঠন করেছে, যা তাঁর চারপাশে এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে ও এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে প্রাণীর বংশবিস্তারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, বিচার-অবিচার এইসব ধারণা মনুষ্যসৃষ্ট এবং মানুষ তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ ফলকে বিচার এই ধারণা মনুষ্য সমাজে নিয়ে এসেছে, কারণ তাঁর বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে অনুকূল পরিবেশ চাই এবং সেই পরিবেশ যদি উপরোক্ত নিয়ম-কানুন দ্বারা শৃংঙ্খলিত না হয় তবে মানবসমাজে এক বিপর্যয় নেমে আসবে এবং তাঁর বংশবিস্তারের ধারায় সংকট তৈরি করবে। যেহেতু মানুষ বিবর্তনের ধারায় একটি উন্নত মস্তিস্ক পেয়েছে তাই তাঁর বংবিস্তারের জন্য সমাজ এবং তাঁর নৈতিকতা নামক একটি সুশৃংঙ্খল ধারণা ও তৈরি করেছে। এমনি কিছু নৈতিকতার ধারণা অবশ্য কিছু প্রাণীদের মধ্যেও পাওয়া যায়, কিন্তু তা খুবই কম পরিমাণে কারন তাঁদের ছোট মস্তিষ্কের জন্য কারণ মস্তিষ্ক যত বড় হয়, তাঁর চিন্তার শক্তি ও তত বৃদ্ধি পায়। আমরা যারা যুক্তিবাদের চর্চা করি তারা এও জানি যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উৎপত্তির কারণ। প্রাচীন মানুষ ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, বন্যা প্রভৃতি যখন হত তারা এগুলি কেন হয় যেহেতু জানত না, তাই তারা ভাবতো নিশ্চয়ই এগুলি কোন অলৌকিক শক্তি তাঁর দ্বারা এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রিত হয়, এই ধারণা থেকেই তারা বিভিন্ন ঈশ্বর নির্মাণ করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে। এইবার ঘটনা হল, এইসব কাল্পনিক ঈশ্বরের ধারণা মানুষ যুগ যুগ ধরেই ডিএনএতে ধারণ করে এসেছে এবং বংশপরম্পরায় এই ঈশ্বরের শিক্ষা তাঁর প্রজন্মোত্তর প্রজন্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে এসেছে কিন্তু কেন? কারণ সেই ডারউইনের তত্ত্ব, প্রাণীর একমাত্র লক্ষ্য বংশবিস্তার, আর উন্নত প্রজাতির প্রাণী হিসেবে মানুষ, তাঁর এই বংশবিস্তারের জন্য সমাজ নিয়ম বিচার বানিয়ে এই বংশবিস্তারের পথকে আরো সুগম করার চেষ্টা করেছে দিনের পর দিন। এই বস্তুবাদী দুনিয়ায় বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মানুষকে, যার ফলে মানব মস্তিস্ককে পজিটিভ ও নেগেটিভ হরমোনের ক্ষরণ সহ্য করতে হয়। 


এইবার পজিটিভ হরমোন ক্ষরণ হলে, মানুষ সুখী অনুভব করে এবং নেতিবাচক হরমোন ক্ষরণ হলে মানুষ অসুখী অনুভব করে, এবং সুখী-অসুখী এটি সম্পুর্ণ একটি Mental State। এইবার আমরা জানি,মানুষ আদতে কখন অসুখী থাকতে চায় না। সে সুখী জীবন-যাপন করতে চায়। কিন্তু আমাদের এই জাগতিক লৌকিক পৃথিবীতে এবং তাঁর প্রকৃতির মধ্যে আসলে সুখী থাকার কোন নিয়ম নেই কারণ এই প্রকৃতি একটি নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রকৃতির মধ্যে কোনও ভালোমন্দ বিচার অবিচার নেই, এমন কি মানুষ বাদে আর প্রাণীকুলের মধ্যে এই ধারণার কোনও অস্তিত্ব নেই, এই ভালো-মন্দ, বিচার-অবিচার ন্যায়-অন্যায় ধারণাটি একমাত্র Human Mind-এর একটি ধারণা। সে তাঁর উন্নত জীবনের জন্য এই ধারণাকে নিয়ে এসেছে কারন বংশবিস্তারের জন্য যা আগেই বলেছি। এইবার প্রকৃতিগত ভাবে সুখী থাকার জন্য মানুষ যখন বিভিন্ন জাগতিক কারণে অসুখী হয়ে পড়ে, তা সে প্রাণ ভয় হোক, আর্থিক কারণেই হোক বা সামাজিক কারণেই হোক, তখন সেই মানুষ নিজের সুখ খুঁজতে, পৃথিবীতে বাঁচতে কোনও এক অলৌকিক সত্ত্বায় বিশ্বাস রাখে। তাঁদের যাবতীয় দুঃখ, মানসিক যন্ত্রণা ভয়কে সঁপে দেয় কোনও এক না দেখা অপ্রমাণিত সত্ত্বায় এবং বিশ্বাস করে সেই না দেখা অপ্রমাণিত সত্ত্বা যাকে বলে ঈশ্বর, সেই ঈশ্বর তাঁদের রক্ষে করবে। এবং এমন বিশ্বাসে ভরসা রেখে তারা সুখী অনুভব করে, এবং পৃথিবীতে ধার্মিকদের সংখ্যা বেশী হওয়াতে স্বাভাবিক ভাবেই যে পরিসংখ্যান বলে অবিশ্বাসী নাস্তিকদের তুলনায় বিশ্বাসী আস্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক ধার্মিকেরা বেশী সুখী। যদিও আমরা জানি ধার্মিকদের এই বিশ্বাসের আদতে কোন ভিত্তি নেই। 


পৃথিবীর মানব ইতিহাসে যে বড় বড় বিপর্যয়গুলি ঘটেছে বা ঘটছে তাতে কোন ঈশ্বর এসে রক্ষা করেনি বরং লৌকিক পৃথিবীর উন্নত মানব মস্তিস্কের অধিকারী মানুষেরাই রক্ষা করেছে এবং তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ তথাকথিত ঈশ্বরের দেবভূমি যোশীমঠ ডুবে যাচ্ছে প্রকৃতির রোষে অথচ কোনও ঈশ্বর এসে তা রক্ষা করছে তো নয়ই বরং মানুষই এসে তাকে উদ্ধারের কাজে নেমেছে। সুতরাং ধার্মিক মাত্রই সুখী এটা ধার্মিকদের নিজস্ব ধারণা, তবে বাস্তব পৃথিবীতে তাঁর কোনও বাস্তবসম্মত প্রমাণ নেই। 

হুজুগে বিনোদন -রাজু দত্ত
Nov. 26, 2024 | সচেতনতা | views:680 | likes:0 | share: 0 | comments:0

হুজুগ হলো সেই আচরণ যা সাময়িকভাবে কোনও এক বা একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে, যা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে দ্রুত সঞ্চারিত হয়। হুজুগ সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় হতে পারে। এই রচনায় আমি শুধুমাত্র বিনোদনমূলক হুজুগেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। 


এক বা একাধিক বিষয় কোনও একজন ব্যক্তির আগ্রহ থাকে, যা তাকে আনন্দ প্রদান করে, সাধারণভাবে আমরা তাকেই বিনোদন বলে থাকি। বিনোদন শব্দটিকেই ইংরেজিতে এন্টারটেইনমেন্ট বলা হয়, যে শব্দটির সাথে আমরা সকলেই সুপরিচিত। 


বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। যেমন, বই বা সংবাদপত্র পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা, সিনেমা দেখা, আড্ডা মারা ইত্যাদি। বর্তমানে অন্তর্জালীয় বিশ্বে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সহ বিনোদনের হাজারো বিকল্প মাধ্যম বিনোদনের দুনিয়াকে আরো সম্প্রসারিত করেছে। 

 

যখন প্রথম দূরদর্শনের প্রসার ঘটলো, তখন বিনোদনের এই মাধ্যমটির প্রতি আমাদের অমোঘ আকর্ষণ ছিল। বর্তমানে স্মার্টফোনের প্রতি আমাদের আকর্ষণ মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। আগামীদিনে এই মাধ্যমটির প্রতি আকর্ষণ থাকবে না। তার স্থান দখল করবে অন্য কোনও মাধ্যম। অর্থাৎ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিনোদনমূলক মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটে। 


সাম্প্রতিক সময় কিছু সাময়িক বিনোদন আমাদের কিছু সময়ের জন্য এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখছে, যে আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, পারিপার্শ্বিক পরিবেশে সংঘটিত ঘটনাবলী, উদ্ভুত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় এই সকল বিষয়কে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন করে দিয়ে, মেতে উঠছি সেই সকল সাময়িক হুজুগে বিনোদনে। অতি সম্প্রতি এইরকম একটি হুজুগে মেতে উঠেছিলাম আমরা। 'কাঁচা বাদাম' হুজুগ। যা এই বিষয় একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 


উল্লেখ্য হুজুগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও একটি সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে হয় থাকে। টুনির মা, কোলাভেরিডির হুজুগ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম টুম্পা সোনা হুজুগে। তারপর, ম্যানিকে মাগে হিতে, কমলা নৃত্য করে এর হুজুগ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম কাঁচা বাদাম হুজুগে। তারপর এলো পুষ্পা, শ্রীবল্লি। এইভাবে আসতেই থাকছে হুজুগে গানের সম্ভার। গান শুনুন, একবার নয় ভালো লাগলে দশবার শুনুন ক্ষতি নেই, ক্ষতিটা নিজেদের বিপুল সময় এইসকল গানের পেছনে অপব্যয় করাটা। 


শুধু গান নয়, আমরা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি দেখে এতটাই অনুপ্রাণিত হয়ে উঠছি, যে সেইসকল ঘটনাবলীকেই মূল আলোচ্য বিষয় করে নেওয়াকেই কর্তব্য মনে করতে শুরু করেছি। কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনেদের প্রতিটি আচরণ তো বটেই যে কোনও তুচ্ছ ঘটনাকেও অত্যধিক গুরুত্ব দিতে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। কখনো কখনো আমিও এই সকল হুজুগের স্রোতে গা ভাসাই। 


প্রশ্ন হলো, কেন এই সকল হুজুগের উৎপত্তি? কেনই বা খুব সহজেই স্বেচ্ছায় এইসকল হুজুগে মেতে উঠছি। এর মুখ্য কারণ, সমাজের পরিচালকরা এইসকল হুজুগে মাতিয়ে রেখে সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা ভুলিয়ে রাখতে চায়। যাতে করে আমরা এই সকল সমস্যা সমাধানে কোনওপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণ না করতে পারি। সকল প্রকার বৈষম্য, কুসংস্কার, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, নারী নির্যাতন, দূর্নীতি ও অন্যয়ের বিরুদ্ধে আমরা যাতে লড়াই না করতে পারি, আমরা যাতে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলে দূর করতে পারি সকল প্রকার অসাম্য। সমাজপতিরা তাই চায়। তাতে তাদের স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্নটি জড়িত যা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের স্বার্থ আর সংখ্যালঘু শোষক শ্রেণীর স্বার্থ এক হতে পারে না। একথা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। 


কাজেই আমরা যদি জাতপাতহীন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কুসংস্কারমুক্ত, সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে এই সকল হুজুগে বিনোদনে অংশগ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। তা না হলে আমরা গড়তে পারবো না, আমাদের কাঙ্খিত সেই নতুন সমাজ। আমরা লড়তে পারবো না, সেই কাঙ্খিত সমাজ গঠনের অত্যন্ত কঠিন লড়াইটা। কারণ আমরা লড়বো উন্নত চেতনা দিয়ে, অযৌক্তিক, অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক হুজুগে বিনোদন আমাদের মনে সেই চেতনার জাগরণ ঘটাতে পারবে না। কাজেই হুজুগে বিনোদন থেকে দূরে থাকুন, দূরে রাখুন সকলকে। 

প্রকৃতি ও কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট পদ চিহ্ন -সোমনাথ কুমার দাস
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

নদীর কাজ

সামান্য বন্ধুর বা উচুঁ নীচু জমির ওপর প্রবহমান জলধারা (fluvial river) বা নদী সেখানে নিম্নক্ষয় (downcut erosion) এবং খুব সামান্য পার্শ্বক্ষয় (valley cut erosion) করে তৈরি করে বিভিন্ন আকৃতির গর্ত, মূলত বর্তুলাকার বা ছোট হাঁড়ি, গামলার মত গর্তগুলো আমরা মন্থকূপ বা poteholes বলে ডাকি।


তবে যেখানে সেখানে এগুলো তৈরিও হবে না। দামোদর অববাহিকায় ঘুরতে আসুন পশ্চিম বর্ধমান জেলাতে। সেখানে পটহোল কলোনি দেখতে পাবেন (poteholes familiy)।

এগুলো জন্ম নিতে গেলে দরকার নদী উপত্যকায় তুলনামূলক শক্ত বেলে বা গ্রানাইট জাতীয় আগ্নেয় পাথর, ব্যাসল্ট শিলাতেও এগুলো ভালো জন্ম নেয়।


জমি থাকবে সামান্য উচুঁ নীচু, আবহবিকারে সামান্য ক্ষত বিক্ষত করলে এগুলো গড়ে তোলা নদীর জন্য বেশ সুবিধাজনক বটে।


নদীর গতি শক্তি সামান্য বাড়তে হবে,

নদীর শক্তি বাড়ে ক্ষয় সীমার উচ্চতা ও জমির ঢালের তীব্রতার ওপর, নদীর কোথাও কোথাও খরস্রোত দেখা দিলেও নীচের উপত্যকায় এগুলো বিকাশ ঘটায়।


বিশেষ চরিত্রের মন্থ কূপ এর জন্ম

এই বন্ধুর পথে নদী ভ্রমণ করার সময় সামান্য নীচু ও ক্ষত স্থানে জল আটকে কিছুটা পিছিয়ে যায় এবং বাকিটা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, দেখা দেয় টারবুলেন্স। নদীর জলের সাথে বয়ে আসে ছোট পাথর ও কাঁকর বালি এসব, যারা ওই গর্তে আটকে পড়ে।


এখন সেখানে নিয়মিত জলে এসে পড়ে, সেখানে জল আটকে চারিদিকে প্রবাহ না হয়ে সামান্য ঘূর্ণন সৃষ্টি করে, এতে জলের মধ্যে থাকা কাঁকর পাথর নীচের উপত্যকার কঠিন পাথরের গায়ে ঘষা দিয়ে দিয়ে ক্ষয় করতে থাকে যাকে আমরা বলি অবঘর্ষ ক্ষয় (corrasion erosion)।

ঘূর্ণন গতির জন্য এখানে অপকেন্দ্র বলের (centrifugal force) প্রভাবে কেন্দ্র থেকে জল বাইরের দিকে বেরিয়ে যেতে চাই, এর জন্য চওড়া হয়ে গামলার মত গর্ত তৈরি করে দেয়।

এখানে কোথাও ছোট কোথাও বড় কোথাও চওড়া বেশি হয়, কোথাও লম্বাটে হয়ে যায়, এগুলো নির্ভর করে নদীর গতিশক্তি, পাথরের কাঠিন্যতা এবং ক্ষয় ক্ষমতা। মূলত এখানে বিভিন্ন আকৃতির পেছনে জল গতিময় শক্তি (hydro dynamic force) কাজ করে।


নদীর জল প্রবল গতিতে এগিয়ে যাওয়ার সময় গর্তের মধ্যে আটকে ঘূর্ণন গতির সাথে সাথে জল প্রবাহ কোনও একটা নির্দিষ্ট দিকে বেশি ধাক্কা দেয়, সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষমতা সেই অংশে অনেক বেশি থাকে, প্রবল ক্ষয়ে অতি সংকীর্ণ লম্বাটে মন্থকূপগুলো জন্ম দেয়।


এই স্থানে পদ চিহ্নের ওপরের দিকে জলের ঘূর্ণন গতির ফলে গর্ত বেশ বৃত্তাকার হলেও সামনের দিকে জলের গতি শক্তির প্রভাবে জল প্রবাহ এগিয়ে এসে ক্ষয় করে বেশ চওড়া ও লম্বাটে আকার নিয়েছে, তবে অতি শক্ত পাথর থাকায় নিম্ন ক্ষয়ের মাত্রা কম।


দ্বিতীয়ত, এগুলো পটহোল সৃষ্টির একদম প্রারম্বিক পর্যায় রয়েছে। নদীর জলের মাত্রা কম বা বন্যার সময় এগুলো তৈরি করার কাজ চলে। এর মধ্যে পরিমার্জিত করে মানুষ হুবহু পায়ের চিহ্ন তৈরি করেছে।

শিশুমন, কুসংস্কার ও অঙ্গীকার -তন্ময় দাশগুপ্ত
Nov. 26, 2024 | কুসংস্কার | views:880 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে টানিবে যে নীচে,

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”


পঙক্তি দুটি অন্য প্রসঙ্গে লেখা হলেও এই ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হওয়ায় প্রবন্ধটি কবিগুরুর অসাধারণ পঙক্তি দু’টি দিয়ে শুরু করলাম। কুসংস্কার অর্থাৎ অন্ধবিশ্বাস দ্বারা সৃষ্ট পশ্চাৎমুখী মানসিকতা সমাজ সভ্যতার অগ্রগতিতে ব্যাঘাত ঘটায়, সমাজ সভ্যতার বিকাশ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। 


কুসংস্কার শব্দটির আভিধানিক অর্থ, “ভ্রান্ত অন্যায় বা কদর্য ধারণা, রীতি অথবা ধর্ম বিশ্বাস।” অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী কুসংস্কারের বর্ণনা হল “ প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না এমন শক্তি বা এমন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস, অজ্ঞতা রহস্যময় কিছুর অযৌক্তিক ভীতি।”

 

অনেক কুসংস্কার কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও এই একবিংশ শতাব্দীতেও অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস, নানান ধর্মীয় আচার আচরণ পালন, জ্যোতিষ নির্ভরতা, গ্রহের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে রত্ন ধারণ ইত্যাদি মানুষের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। যার ফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাক্তি প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণের ভ্রান্তি থেকে মুক্ত না হয়ে সত্যানুসন্ধানের জ্ঞান অর্জনে ভুল পথে পরিচালিত হয়। 


জীববিজ্ঞান অনুযায়ী মনুষ্য সন্তানের জন্ম ও বয়সন্ধিক্ষণের মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। মন হল মানুষের সেই মাধ্যম, যার দ্বারা তার আচরণ (চিন্তন, অনুভূতি এবং ইচ্ছা বা ক্রিয়া) প্রকাশিত হয়। মন মানুষের অভিব্যাক্তি। অর্থাৎ শিশুমন হল শিশুর চিন্তন, অনুভূতি এবং ইচ্ছার প্রকাশ হওয়ার মাধ্যম। শৈশব থেকেই প্রত্যেকের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় তার মন। 


প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর মনোভাব আনন্দ ও বেদনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ধীরে ধীরে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশের সাথে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি শিশু কতকগুলি স্বতন্ত্র্য আচরণ করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং তার ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ শুরু হয়। মনোবিদ সি এইচ জাড এর মতানুসারে “মানুষের আচরণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবসময়েই পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হচ্ছে। যে কোনও রকম আচরণের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনই হল বিকাশ”। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিজীবনের শুধুমাত্র মানসিক বিকাশ নয়, ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ ও পরিপূর্ণ বিকাশে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ পথনির্দেশ। যেহেতু বিকাশ এক ধরণের অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া তাই ভালো বা মন্দ যে কোনও দিকেই সে চালিত হতে পারেন। জন্মমুহূর্ত থেকে কৈশোর, এই সময়ের মধ্যে মানবশিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। তার উপরেই পরবর্তী ভবিষ্যৎ জীবনের গতিবিধি এবং বিকাশধারার ধরণ নির্ভর করে। 


মনোবিদ আলপোর্ট এর বক্তব্য অনুযায়ী “পরিবর্তনশীল সক্রিয় জৈবিক মানসিক সত্তার যে সমন্বয় ব্যাক্তির অভিযোজনমূলক আচরণে তার নিজস্বতা প্রকাশে সহায়তা করে তাই হল ব্যাক্তিসত্তা।” ব্যাক্তিসত্তার বিকাশের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ব্যাক্তির মধ্যে স্বল্পহারে কিছু মানসিক সংগঠনের সৃষ্টি হতে থাকে, যার দ্বারা তাদের আচরণ বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাক্তিসত্তার বিকাশ শুরুর পর যখন শিশুর সামাজিক ও নৈতিক বোধ জাগ্রত হয় তখন থেকে চরিত্রগঠন আরম্ভ হয়। অর্থাৎ নৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতির দ্বারা বিচার্য ব্যাক্তিসত্তাই হল ব্যক্তির চরিত্র। মনোবিদ হারলক তার বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে প্রমাণ করেছেন যে বাল্যকালের বিভিন্ন আচরণ ও অভিজ্ঞতা ব্যাক্তির পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে। 


একজন মানুষের ব্যাক্তিত্বর রূপ বিশ্লেষিত হয় সে নিজেকে কীভাবে চারপাশের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্ত করছেন বা কিভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে। ব্যাক্তিত্ব বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ শৈশবকালে যদি অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সচেতন কিংবা অচেতন কারণবশত কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে তোলে তবে শিশুটির বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিশেষত পরিবার, শিক্ষাকেন্দ্র, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কোচিং বা গৃহশিক্ষক প্রভৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং শিক্ষানীতি, পাঠ্যক্রম, মিডিয়া প্রভৃতির পরোক্ষ প্রভাব শিশুমনে প্রতিফলিত হয়। মনে রাখতে হবে কুসংস্কার বিস্তারে রাস্ট্রের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। জয়ফুল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতে শিশুর মস্তিস্কের বিকাশ তার পরিবার, যত্নকারী,এবং সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হয়। 


সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে অনেকসময় অনেকে অনুকরণ বা অনুবর্তনের শিকার হয়। বিভিন্ন কুসংস্কারের প্রভাবে অস্থায়ী ঋণাত্মক মনোভাব পরবর্তীকালে স্থায়ী আকার ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে। শিশুমনে কুসংস্কারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তাঁর চারিত্রিক আচার আচরণ গঠনে অর্থাৎ শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। প্রশ্নহীন অর্থাৎ অন্ধভাবে সব কিছুকে মান্যতা দেওয়া হলে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণে অনীহা জন্মালে ছোটবেলা থেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মানসিকতা তৈরি হয়। হীনমন্যতা, প্রশ্নহীন আনুগত্য, বিচার বিশ্লেষণ না করেই অন্যের কথায় সায় দেওয়া, বা বশ্যতা স্বীকার করা দুর্বল চরিত্রের লক্ষণ। এই মন যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল হয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবে স্বীয় ক্ষমতার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। অন্ধবিশ্বাসের পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠার ফলে পরবর্তী প্রজন্ম দূরদর্শিতার অভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। কুসংস্কার থেকে উদ্ভূত গোঁড়ামি পদে পদে নানান সমস্যা সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুটির উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্ধকার নামিয়ে আনে। শিশুর প্রতি আধিপত্য বজায় রাখা, তাকে নিজের বিশ্বাস মানতে বাধ্য করা সন্তানের ক্ষতি করে। শিশুমনে মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করে। 


মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী যেহেতু মানসিক স্থৈর্য, সংকল্প, স্থিরচিত্ত, প্রক্ষোভমূলক আচরণে সাম্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি সুচরিত্রের লক্ষণ, বিপরীতে মানসিক চাপল্য, সংকল্পের অভাব, প্রক্ষোভমূলক আচরণে অসমতা ইত্যাদি দুর্বল চরিত্রের লক্ষণ তাই এইসকল মানসিক সংগঠন প্রতিটি ব্যাক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই মানসিক সংগঠনের ভিন্নতার জন্য আদর্শেরও ভিন্নতা হয়। ব্যাক্তিসত্তা বিকাশের প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার প্রভাব না থাকলে আত্মসচেতনাও অসম্পূর্ণ থাকতে পারে। 


তাই আমাদের সকলের উচিৎ আমাদের দেশের স্বার্থে,মানবসভ্যতার স্বার্থে সু-অভ্যাস ও সু-শিক্ষায় পুষ্ট শিশুমন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করা। কারণ যে কুশিক্ষা উন্নতির পথে অন্তরায় সেই কুশিক্ষায় পুষ্ট মানুষের ভারে জর্জরিত দেশ কোনওদিকেই উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। তাই একটা জাতির বলিষ্ঠ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার সময় যুক্তিনির্ভর ও প্রমাণযোগ্য নির্ভেজাল তথ্য পরিবেশন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যাতে প্রতিটি শিশু প্রশ্নহীন আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি ঘটনার পশ্চাতে কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনস্ক মন নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। 


সংবিধানের ৫১ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “ভারতের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হল বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, মানবতাবাদ বিকশিত করা ও অনুসন্ধিৎসু ও সংস্কারমুখী হওয়ার”। তাই আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হওয়া উচিত,সংবিধানে বর্ণিত এই ধারার প্রতি সম্মান জানিয়ে সুস্থ নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্রতী হওয়া। 


শেষ করি, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর অসাধারণ দুটি লাইন দিয়ে, 


“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”


এই অঙ্গীকার হোক আমাদের সকলের।

প্রসঙ্গ: প্রেম -রাজু দত্ত
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রেম হল একটা অনুভূতি, যা দুটি মানুষের পরস্পরের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থেকে জন্মলাভ করে। এই আকর্ষণ হতে পারে শারীরিক বা চারিত্রিক। অর্থাৎ কেউ কারো শারীরিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে, কেউ প্রেমে পড়ে কারো চারিত্রিক গুনাবলীর মুগ্ধতায়। 'ভালো লাগা' জন্ম দেয় 'প্রেম' নামক অনুভূতির যা ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হয়।


সংকীর্ণ অর্থে আমরা 'প্রেম' বলতে বুঝি 'নারী ও পুরুষের এমন এক পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে মিশে থাকে যৌনতা'। নারী পুরুষ উভয়ের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে উভয়ই শারীরিকভাবে মিলিত হয় 'যৌন সঙ্গম' ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ব্যাপক অর্থে 'প্রেম' হল সেই অনুভূতি যা থাকে সকল মানুষের প্রতি সকল জীবের প্রতি।‌ যাতে থাকে না কোনও‌ যৌনতার প্রশ্ন। থাকে না কোনও সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে 'প্রেম' বিশ্বজনীন'। 


আমাদের দেশে নারী পুরুষের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করার সাথে 'বিবাহ' নামক প্রাতিষ্ঠানিক কার্যের প্রশ্নটি জড়িত। শারীরিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, 'বিবাহের পূর্বে' নারী পুরুষের পারস্পরিক  'চুম্বন', 'আলিঙ্গন' এর মতো আচরণগুলিও 'সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ‌। অথচ প্রাকৃতিকভাবে নারী পুরুষ উভয়েরই যৌন মিলনের আকাঙ্খা থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ বিবাহ না করলে এই আকাঙ্খা পূরণ 'সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। অথচ দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ, যারা 'প্রেম' এর সম্পর্কে সম্পর্কিত তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে শারীরিকভাবে মিলিত হওয়া অনৈতিক বলে আমি মনে করি না। এটা আইনত 'অপরাধ' বলেও আমার জানা নেই। তবুও রক্ষণশীল সমাজ নারী পুরুষের যৌন মিলনের আচরণটিকে 'বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। আশ্চর্য! 


তাহলে 'বিবাহ' করে নিলেই তো হয়! সেখানেই তো সমস্যা। 'বিবাহ' করতে হলে আপনাকে হাজার একটা শর্ত পূরণ করতে হবে। এই যেমন আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান, জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এরকম হাজারো পরিচয় যদি সমাজসম্মত ও বিবাহে উদ্যোগী দুটি মানুষের উভয়ের পরিবারসম্মত হয়, তবেই আপনি বিবাহের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন।


 মেয়েদের ক্ষেত্রে 'শারীরিক সৌন্দর্য্য' ও ছেলেদের ক্ষেত্রে 'চাকরিজীবি' হওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক। তার ওপর তো উভয়ের পৈতৃক ও‌ নিজ অর্জিত সম্পত্তি থাকাও প্রয়োজন। মেয়ের বাবার তো প্রচুর টাকা পয়সা থাকা দরকার না হলে 'পণ' বাবদ খাট, বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, টিভি, ফ্রিজ, আলমারী, বাইক ও মেয়ের জন্য সামান্য কয়েক ভরি গহনা কিনবেন কোথা থেকে? এগুলো না দিলে সমাজ যে মেনে নেবে না। মেনে নেবে না মেয়ে জামাই ও তার পরিবার উভয়ই। কাজেই…


এই বিবাহ তিনটি উপায় হয়ে থাকে। এক - নিজেদের পছন্দ মতো 'লাভ ম্যারেজ' এবং দুই- উভয়ের পরিবারের পছন্দমতো 'অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ' ও সর্বসম্মতিক্রমে 'লাভ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ'।  শেষোক্ত উপায়টি প্রায় বিরল ঘটনাগুলির একটি। অপর দুটি পন্থার প্রথমটি প্রায় কারোরই 'পরিবারসম্মত' নয়। যদিও এটিই আমি সমর্থন করি। দ্বিতীয়টি আজকাল‌ প্রায় বিরল পন্থা হতে চলেছে।‌ বর্তমানে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য 'অনলাইন ঘটক' রূপে বিভিন্ন অ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বেঙ্গলি ম্যাট্রিমনিয়া, শাদি ডট কম। 


আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, উপরিউক্ত উপায়গুলির‌ মধ্যে বর্তমান প্রজন্মের পছন্দ প্রথম উপায়টি। যেহেতু এই উপায়টি সাধারণত সমাজ ও পরিবার সম্মত নয়, তাই বর্তমানে বাড়ির অমতে‌ (বাড়ি থেকে পালিয়ে) রক্ষণশীল সমাজপতিদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিবাহ করার ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় এই যে, এই সকল বিবাহিত ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নয়। নিজেদের শারীরিক ও মানসিকভাবে গড়ে না তুলে, নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে  প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সন্তানাদি 'মানুষ' করার সুকঠিন সংগ্রামে ব্রতী হচ্ছে। যার ফলে গড়ে উঠছে এক যণ্ত্রসুলভ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যারা সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি অর্জন করতে পারছে না। 


আবার যে সকল ছেলেমেয়েরা পরিবার ও সমাজের অমতে লড়াই করে তাদের প্রেমকে পূর্ণতা দিতে, পারছে না বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে, তারা হয়ে যাচ্ছে 'ব্যর্থ প্রেমিক' 'ব্যর্থ প্রেমিকা'। নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই 'প্রেমের সম্পর্ক' এই ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে একাধিক 'প্রেমের সম্পর্কে'। তাদের এই সকল সম্পর্কের ভিত এতটাই দুর্বল যে একাধিক সম্পর্কে জড়ালেও কোনও সম্পর্কই পূর্ণতা লাভ করছে না। 'প্রেম' এর গভীরতা উপলব্ধি করতে না পেরেই তারা নিজেদের 'ব্যর্থ প্রেমিক, ব্যর্থ প্রেমিকা' মনে করছে। এরপর তারা হয়ে উঠছে 'প্রতিহিংসাপরায়ণ। যার ফল সম্প্রতি আমরা দেখছি একের পর এক 'প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে প্রেমিকাকে খুন' এর মতো ভয়ানক ঘটনায়। সবকিছু 'চাইলেই পাওয়া যায় না, লড়াই করে অর্জন করতে হয় নিজ যোগ্যতায়'। এই শিক্ষা না থাকায় আজকের প্রজন্ম 'প্রত্যাখান' 'ব্যর্থতা' এগুলি মেনে নিতে পারছে না। কখনো হয়ে উঠছে 'আত্মঘাতী' কখনও বা 'ঘাতক'। উভয় ঘটনাই অত্যন্ত উদ্বেগজনক।‌ খুনের ঘটনাও আজকাল প্রতিরোধের চেষ্টা না করে মানুষ তার 'লাইভ ভিডিও ' রেকর্ড করছে। কী অসম্ভব বিকৃতমনস্কতার প্রসার ঘটছে, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। 'লাইভ স্যুইসাইড' এর ঘটনাও আজকাল ঘটতে দেখা যায়।‌ মানসিক অবসাদ কোন্‌ পর্যায় পৌঁছলে এটা করা সম্ভব! 


শুধু তাই নয়। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে 'পরকিয়া' সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। 'মূলত শারীরিক সুখলাভের আশায় সন্তানের কথা না ভেবে বাবা মায়েরা লিপ্ত হচ্ছে অনৈতিক সম্পর্কে। যার গভীর প্রভাব পড়ছে শিশুকিশোরদের ওপর। এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 'অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা' পরকিয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হলেও অনেকসময়ই স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া মানুষ 'লোভ' (অর্থনৈতিক ও শারীরিক) এর বশে এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।  


প্রেমহীনতার এক জটিল আবর্তে আমরা ক্রমশ আবদ্ধ‌ হয়ে পড়ছি। যা থেকে বেরোতে না পারলে, চরম সংকটের সম্মুখীন হবে মানব সভ্যতা। নেমে আসবে প্রেমহীনতার এক অপ্রতিরোধ্য মহামারি। 

প্রসঙ্গ: ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডিজ আইন এবং... -অভিষেক দে
Nov. 26, 2024 | কুসংস্কার | views:887 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গত ১৯/১২/২০২২ -এ সন্ধে ০৭:০০ থেকে রাত ০৯:৩০ পর্যন্ত ছিলাম অনলাইন আড্ডায় যেখানে একটি বিজ্ঞান সংগঠনের কয়েকজন তরুণ-তরুণী, আইনি বিশেষজ্ঞ, ও অভিজ্ঞ বয়স্করা যুক্ত ছিলেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954, এবং The Drugs and Cosmetic Act 1940 (Amendment 2020)। আলোচনা হয়েছে তুমুল জমজমাট। সেসবই সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরলাম।


ভারতীয় পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত আইন "The Drugs and Magic Remedies (objectionable advertisement) Act 1954" যা ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যায় দ্বিতীয় অংশের প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। এই আইনটি ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ভারত সরকারের Ministry of Health and Family Welfare দ্বারা Amendment হয়েছে। অন্যদিকে, "The Drugs and Cosmetics Act 1940" যার শেষ Amendment হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ তে। 


উক্ত দু’টি আইনানুসারে মন্ত্র-তন্ত্র, রেইকি, ম্যাগনেটোথেরাপি, জেমথেরাপি, তাবিজ-কবজ, রত্নপাথর, দৈব শক্তি, অলৌকিক ক্ষমতা বা জাদুশক্তি ইত্যাদির দ্বারা কোনও রোগ সারানোর দাবী আইনত অপরাধ। কোনও ওঝা, গুণিন, জানগুরু, সরকারি রেজিস্ট্রেশনবিহীন ভুয়ো ডাক্তার কিংবা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক (MBBS), অলৌকিক ক্ষমতাধর, দৈব চিকিৎসক, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ইত্যাদিরা এই আইন ভাঙলে অর্থাৎ রোগমুক্তির দাবী বা রোগ সারানোর প্রচার করবার জন্য রয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আজীবন কারাদণ্ডের বিধান অথবা জেল ও জরিমানা দুটোই। 


এইখানে জানিয়ে রাখা ভালো, ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.সি.প্যাটেল এবং বিচারপতি এ.কে. সিকরি-র ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনও সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখালে জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশক প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন "The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954" অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়। সে খবরের সংক্ষেপসার ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২২ জুন ২০০৩ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে - রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা যাঁরা করেন, তাঁরা নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটা কোনওভাবেই ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ এই চিকিৎসা পদ্ধতির কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রক স্পষ্ট করে এটাও জানিয়েছে যে, রেইকি সহ জেম থেরাপি, কালার থেরাপি, ম্যাগনেটোথেরাপি, আরোমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি ইত্যাদি তথাকথিত প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিই বেআইনি এবং এইসব পদ্ধতি শেখানো কিংবা প্রয়োগকারী ব্যক্তি কোনও ভাবেই নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটাকে ব্যবহার করতে পারবেন না।


১৯ মার্চ ২০০৯ সালে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তর একটি নোটিশ জারি করে [GSR 884 (E)] The Drugs and Cosmetics Act (1940) Amendment করেছিল। সেই নোটিশে জানানো হয়েছে, প্রতিটি ওষুধের ওজন, আয়তন, উপাদান সমূহের পরিমাণ ওষুধের লেবেলের গায়ে না সাঁটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনও ওষুধ সেবনের ফলে রোগীর মৃত্যু বা আশঙ্কাজনক ক্ষতি হলে ওষুধ প্রস্তুতকারকের শাস্তি হিসেবে আজীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে ও দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও হতে পারে। এই আইনে "cosmetics" দ্রব্যাদিও পড়ছে এবং যা "ISI Standard" এর মান দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার পর বাজারে বিক্রি করা যাবে। উক্ত দু’টি আইনে, ওষুধ বা 'ড্রাগ' বলতে বোঝানো হয়েছে, মানব শরীরে যা কাজ করে বলে দাবি করা হবে যেমন তাবিজ-কবজ, মাদুলি, যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদি অনেক কিছুই যা কিন্তু ড্রাগের সংজ্ঞায় পড়ছে।


The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের প্রথম সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনে 9(A) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের 'Cognizable Offence' হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনও অভিযুক্তকে Warrant ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)। 


আগে Drugs and Magic Remedies Act ভঙ্গকারীদের অপরাধ ছিলো 'Non-Cognizable' অর্থাৎ এক বা একাধিক ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হত। পুলিশ সরকারের তরফ থেকে অভিযোগকারীর পক্ষে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতেন। আদালত অভিযুক্তর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা ওয়ারেন্ট দায়ের করলে তবেই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন।

এই উল্লিখিত আইন ভাঙ্গাটা যেহেতু Non-Cognizable অপরাধ বলে 1963 সালে আইন সংযোজনের আগে পর্যন্ত গণ্য করা হত, তাই আদালত অভিযুক্তের বাসস্থল কিংবা ব্যবসা কিংবা চাকরিস্থলে থানা মারফত অভিযুক্তকে সমন পাঠাতেন। সমন অর্থাৎ আদালতের নির্দেশ। যাতে লেখা থাকে কবে, কখন, কোন আদালতে হাজিরা দিতে হবে। যেহেতু উল্লেখিত এই আইন ভাঙ্গাটা Criminal Offence বা ফৌজদারি অপরাধ তাই অভিযুক্তকে আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে হত।


কোনও জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা, জানগুরু ইত্যাদি বুজরুক প্রতারকের বিরুদ্ধে  Magic Remedies আইন ভেঙ্গেছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পরও কোনওও বিশেষ কারণে পুলিশ নিরব দর্শক থাকতেই পারেন। তখন আপনি অভিযোগকারী হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করার প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে (যেমন ডাইরি নং অথবা লিখিত অভিযোগ গ্রহণের থানার সিলমোহর ও স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্র) আদালতে মামলা করা যায়। একে 'Complain Case' বলে। এই মামলার ভিত্তিতে আদালত সামনস্ পাঠাবেন অভিযুক্তর কাছে। অভিযুক্ত আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেবেন। সমন অগ্রাহ্য করলে আদালত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশকে আদেশ দেবে। 


এত দূর পড়ে প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা সাময়িক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তারা মনে করতে পারেন উক্ত ড্রাগ আইন শুধু তাদের বিরুদ্ধে যারা মন্ত্রতন্ত্র, তাবিজ-কবজ ইত্যাদি কিংবা অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানোর দাবী জানাবে অথবা যে ব্যক্তি রোগ মুক্ত করবার প্রতিশ্রুতি দেবে। যদিও বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। এখানে একটি বিশেষ খবর তুলে ধরছি যা ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে "এই সময়" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম - "বিজ্ঞাপনী-চমকে ঠকে লাইন ডাক্তারের চেম্বার, আদালতে"। -- "টিভির পর্দায় বীরেন্দ্র সহবাগ, হর্ষ ভোগলেদের দেখে আশা জেগেছিল মনে। টাকে চুল গজানোর বিজ্ঞাপনে মজে অনেক টাকা খরচ করেছিলেন কড়েয়ার যুবক। কিন্তু চুল গজানোর বদলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হন তিনি। সংশ্লিষ্ট সংস্থায় অভিযোগ জানাতে গেলে আমলই দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে ক্রেতাসুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন ওই যুবক। আলাদত ওই সংস্থাকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভুক্তভোগীকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।


ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন স্থূলতা কমানোর বিজ্ঞাপনে ভরসা করে বোকা বনে যাওয়া হুগলির মধ্যবয়সীও। ভুঁড়ি কমিয়ে রোগা হতে গিয়ে বিপত্তি বেধেছিল। বেহালার গৃহবধূ অবশ্য বিজ্ঞাপনী ওষুধে স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের স্বপ্ন দেখে জীবনটাই হারিয়ে ফেলেন। আবার বেলঘরিয়ার এক তরুণ প্রাণে বাঁচলেও মুখমণ্ডলের পোড়া ত্বকের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অবসাদের শিকার হন। ফর্সা হওয়ার ক্রিম লাগিয়ে তাঁর শ্যামলা মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। এমন ভুক্তভোগী কম নয়। বিজ্ঞাপনী চমকে আস্থা রেখে পস্তানোর নজির অসংখ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনের দাবি বাস্তবে মেলে না। উল্টে বিজ্ঞাপনে মজে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বড়ি খেয়ে কিংবা তেল বা ক্রিম মেখে হরেক শারীরিক সমস্যার শিকার হন অনেকেই। সে সব সঙ্কট সামলাতে হয় চিকিৎসকদেরই। অনেক মামলাও হচ্ছে ক্রেতাসুরক্ষা আদালতে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ, মানুষের হুঁশ ফিরছে না। স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, সে জন্যই চটকদার ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনী চমকে রাশ টানতে আইন সংশোধন করতে চলেছে কেন্দ্র। ১৯৫৪-র ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) আইন কড়া করতে সংশোধনী বিলের খসড়া তৈরি করেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। তাতে বলা হয়েছে, চুল পড়া, চুল পাকা, ফর্সা হওয়া, ক্যান্সার নিরাময়, প্রেশার-সুগার কমানো, লম্বা হওয়া, রোগা হওয়া, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, স্তন ও লিঙ্গবর্ধনের দাবি বা অর্শ, ফিসচুলা, ক্লান্তি, দুর্বলতা, যৌনসমস্যা, শীঘ্রপতন, বুড়িয়ে যাওয়া, দাঁত শিরশিরানি ইত্যাদি নিরসনের দাবি করে বিজ্ঞাপন চলবে না। আইন ভাঙলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার সংস্থানও রাখা হয়েছে সংশোধনী বিলে।" 


আরেকটি খবরের অংশ তুলে ধরলাম, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-"এই সময়" পত্রিকা থেকে- 


"অমুক তেলে টাকে চুল গজায়! তমুক বড়িতে দূর হয় ক্লান্তি, বাড়ে যৌনশক্তি! এই তেলের ব্যবহারে লিঙ্গবর্ধন অনিবার্য! ওই হেলথ ড্রিঙ্কে লম্বা হওয়া অবশ্যম্ভাবী! অমুক টনিকে স্মৃতিশক্তি ক্ষুরধার হবে! তমুক ক্রিম ব্যবহারে ফর্সা হবে গায়ের রং! হরেক পণ্যের এ সব চটকদার প্রচার তো ছিলই। বিজ্ঞাপনী বাজারে এর সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে এমন সব দাওয়াই, যা নাকি ম্যাজিকের মতো নিরাময় ঘটায় ডায়াবিটিস, আর্থ্রাইটিস, এমনকী ক্যান্সারের। এই সব পণ্যের যাবতীয় বিজ্ঞাপনে এ বার কঠোর ভাবে রাশ টানতে উদ্যোগী হল কেন্দ্র। এমন অবাস্তব ও মনভোলানো বিজ্ঞাপনী চমকের রমরমা বন্ধে আইন সংশোধন করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পুরোনো আইনে শাস্তির সংস্থান ছিল নখদন্তহীন। তা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১৯৫৪-র ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) আইনকে কড়া করতে সম্প্রতি সংশোধনী খসড়া বিল তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ২০২০-র সেই প্রস্তাবিত বিলের খসড়া নিজেদের ওয়েবসাইটে দিয়ে দেশবাসীর কাছে মন্ত্রক পরামর্শ বা আপত্তির কথা জানতে চেয়েছে আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে। খসড়ায় বলা হয়েছে --- ৭৮ রকমের অসুখ বা সমস্যা (আগে ছিল ৫৪টি) নিরাময়ে বিভ্রান্তিকর এই সব মনমোহিনী বিজ্ঞাপন কোনও গণমাধ্যমে দেওয়া যাবে না। বর্তমান সংস্থানে প্রথম দু’বার আইন লঙ্ঘনের শাস্তি যথাক্রমে ছ’ মাস ও এক বছরের জেল। জরিমানার কোনও অঙ্ক বলা নেই সেখানে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়ায় আইন লঙ্ঘনের শাস্তি প্রথম বার দু’ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।... কেন্দ্রীয় এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘বর্তমান আইনে যে সব ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তার অনেকগুলিই এখন অচল। আবার অনেক আয়ুর্বেদ-ইউনানি ওষুধ বর্তমান আইনের আওতায় নেই। এই সব ফাঁক গলে বহু পণ্যের বিজ্ঞাপনী চমক বেড়ে গিয়েছে। অথচ তার সঙ্গে বাস্তব সমস্যা সমাধানের সম্পর্ক কম।’ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, গত দেড় বছরে এমন বহু পণ্য ও ওষুধের অবাস্তব বিজ্ঞাপন এবং তার কুফল সংক্রান্ত হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে সরকারের কাছে। এর মধ্যে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে দু’টি মৃত্যুর নজিরও রয়েছে। বছর দেড়েক আগে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় আয়ুষ প্রতিমন্ত্রী শ্রীপদ যেসোনায়েকও জানান, ‘গ্রিভান্স এগেনস্ট মিসলিডিং অ্যাডভারটাইজমেন্ট’ পোর্টালে ওই অভিযোগগুলি দায়ের হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কড়া অবস্থান নিতে কেন্দ্র বদ্ধপরিকর। এর পরেই কয়েকটি অ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ-ইউনানি ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়।


বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে সন্দিহান। ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শান্তনু ত্রিপাঠী বলেন, ‘আইন কড়া করা হচ্ছে, খুব ভালো কথা। কিন্তু বর্তমান নিরীহ আইনটিও কি কখনও কড়া হাতে প্রয়োগ করা হয়েছে? ৫৪টি অসুখ বা সমস্যার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপনী প্রচারের জন্য কবে কে শাস্তি পেয়েছে যে নয়া আইন সম্পর্কে এত আশাবাদী হব?"


আশাকরি, প্রিয় পাঠক বন্ধুরা বুঝতে পেরেছেন, The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এবং The Drugs and Cosmetics Act 1940 আইনানুযায়ী, টাকে চুল গজানো কিংবা ফর্সা হওয়ার ক্রিম অথবা যৌন সমস্যা মেটানোর হিজিবিজি বিজ্ঞাপনও ড্রাগস আইনে নিষিদ্ধ এবং বে-আইনি। 


এই ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডি আইন নিয়ে একজন স্বঘোষিত যুক্তিবাদী মানুষ নিজের অখণ্ড জ্ঞান জাহির করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটা ২০২০ সালের ঘটনা। কোটিপতি ও কুখ্যাত রাজজ্যোতিষী অনিমেষ শাস্ত্রীর "জ্যোতিষ শাস্ত্র বিজ্ঞান" এইধরনের কুযুক্তি ও তার লোকঠকানো জ্যোতিষ বিদ্যার প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াই করবার সময় "ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"র সহযোদ্ধা, অনির্বাণ পাল একটি পোস্টার বানায় যেখানে লেখা ছিল- "The Drugs & Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এবং The Drugs & Cosmetics Act 1940 অনুসারে জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার দাবি বেআইনি।" 


এমতাবস্থায় সেই যুক্তিবাদী মশাই মাঠে নামলেন এটা প্রমাণ করতে যে এসকল আইনে রোগ সারাবার দাবি করা হলে তবেই তা আইনবিরুদ্ধ হবে কিন্তু পরীক্ষায় পাশ, মামলায় জেতা, শত্রু বিনাশ এসব তথাকথিত অলৌকিক দাবি করলে কিছুই করা সম্ভব নয়। আসল কথায় বলে, দারোগার চেয়ে চৌকিদারের হাঁক বেশি হয়। সেই যুক্তিবাদী মশাইয়ের এক স্যাঙাত বাবু আরও একধাপ এগিয়ে বললেন, এইসব আইনে সরাসরি কোথাও নেই যে জ্যোতিষের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান আইনবিরোধী।


সত্যিই কী তাই? এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে, জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন এবং আইনের দিকেই চোখ দেওয়া যাক। পত্রপত্রিকায় সাড়া ফেলে দেওয়া নামীদামী কিছু জ্যোতিষীরা (যারা আবার তান্ত্রিকও হয়ে গেছে) সকল সমস্যা সমাধানের গ্যারান্টি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয় যা দেখে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত জনগণ এদের কাছে ছোটেন। তারপরে এই প্রতারকেরা পাঁচশো থেকে পাঁচ লাখ যা খুশি নেয় হিজিবিজি তাবিজ-কবজ, রত্নপাথর ইত্যাদির বিনিময়ে। এদের প্রতারকদের সবার ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তাদের বহু দাবির মধ্যে রোগ নিরাময় এবং অন্যান্য অলৌকিক দাবি আছে। অর্থাৎ, প্রশাসন চাইলেই উপরোক্ত ড্রাগস আইনানুসারে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেই যুক্তিবাদী মশাইয়ের এসব জানা সত্ত্বেও কূটতর্কে প্রবৃত্ত হলেন। 


এবার ড্রাগস আইন নিয়ে আর একটু আলোচনায় গিয়ে দেখা যাক কেউ যদি রোগ সারাবার দাবি ছাড়াও অন্যান্য অলৌকিক দাবি করে তাদের উপরোক্ত আইনানুসারে দোষী সাব্যস্ত করা যায় কিনা।


Drugs & Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act no.21, 1954 এর মূল সংজ্ঞা বা Long Title অংশে আছে "An act to control the advertisement of drugs in certain cases, to prohibit the advertisement for certain purposes of remedies alleged to possess magic qualities and to provide for matters connected therewith."


এখানে 'certain cases', 'to provide for matters connected therewith' শব্দবন্ধের দিকে প্রিয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যখন কোনও আইনের প্রয়োগবিধি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন প্রতিটি শব্দ এবং তার ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে আইনবিদদের ভিতর চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাদানুবাদ হয়ে থাকে। উপরোক্ত সংজ্ঞার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, "অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগে সমস্যা সমাধান এবং সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনকে প্রতিহত করার জন্য এই আইনের উপস্থাপনা করা হয়েছে"।


আইনে যদি শুধুমাত্র রোগ নিরাময়ের বিজ্ঞাপন প্রতিহত করার কথা থাকত তাহলে 'certain cases' না লিখে সরাসরি 'certain diseases' লেখা হত, আর 'connected therewith' অংশটা দিয়ে সামগ্রিক সবকিছুকেই জড়িয়ে নেওয়া হত না।


আইনটা আরও বিস্তারিত পড়লেই বোঝা যাবে এই আইনের প্রকৃতি হচ্ছে 'inclusive'। সরাসরি লেখা সম্ভব হয়নি এমন কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়েও আইনের প্রয়োগের জন্য সংজ্ঞার শুরুতে বিভিন্ন স্থানেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে, "In this Act, unless the context otherwise requires,-"

অর্থাৎ, "আইনানুসারে, যদি না অন্যভাবে প্রয়োজন হয়"। আইনে 'ড্রাগ' বা 'ওষুধে'এবং 'ম্যাজিক রেমেডিজে'র সংজ্ঞায় কিন্তু শুধুমাত্র পরিচিত ওষুধের নাম করা হয়নি। খুব স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে তাবিজ, কবচ, মাদুলি, তন্ত্রমন্ত্র, জড়িবুটি এবং অলৌকিক সমস্যা সমাধানের দাবি করা যে কোনও প্রকারের জৈব এবং অজৈব পদার্থকেই গণ্য করা হবে। 


তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবচ, রত্ন ইত্যাদির সাহায্যে রোগ সারাবার দাবি করে তবে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। যুক্তিবাদী মশাইয়ের স্যাঙাৎ বাবু অবশ্য বোঝাতে চেয়েছেন জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলা নেই। কিন্তু উনি বুঝলেনই না, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ইত্যাদিরাও আইনের চোখে 'ব্যক্তি' হিসাবেই গণ্য হয়।


আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরাসরি রোগ সারাবার দাবি ছাড়া এরা আর যেসব দাবি করে তার অন্যতম হল বশীকরণ। বশীকরণ মানে হল তাবিজ-কবচ ইত্যাদির সাহায্যে অন্যের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ। সোজা ভাষায়, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে স্নায়ুকোষের উপর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার। উপরোক্ত আইনের ২ (বি), (সি) ধারা অনুযায়ী কিন্তু মানুষ এবং অন্য প্রাণীর শরীরের আনবিক স্তরেও বা অন্য কোনভাবে প্রভাব বিস্তার পর্যন্ত আইনত নিষিদ্ধ। একইভাবে শত্রু দমনকে যদি খুন নাও ধরি, শত্রু বশীকরণ কিন্তু মনে করতেই পারি।


রত্ন ধারণ করিয়ে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করাবে বলেছে? জ্যোতিষীরা রত্নের সুফলের সাধারণত যে বৈজ্ঞানিক (!!) ব্যাখ্যা দেয় তা হল সূর্যের রশ্মির সাতটা রঙ যাকে নাকি কসমিক রে বলে, সেটা রত্নের মাধ্যমে শোষিত হয়ে শরীর তথা মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন করে। এটা যে অবাস্তব সে ব্যাখ্যা নাহয় বাদ থাক। কিন্তু এটাও যে আইনের আওতায় পড়ছে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।


তারপর ধরুন, বিজ্ঞাপনে স্বামী বা স্ত্রী অন্যের প্রতি আকর্ষণ হারাচ্ছেন, দাম্পত্যসুখ পাচ্ছেন না বলে থাকে। এই কথায় প্রছন্নভাবে বশীকরণ বা যৌনসুখ ফিরিয়ে আনার কথা কি বলা নেই? 


সোজা ভাষায়, যে সকল দাবি এসব মহাশয়েরা করে থাকেন সেগুলো কিন্তু আইনের আওতায়ই পড়ে। এদের কারণে কেউ মারা গেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এর জন্য সরাসরি জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা, গুনীন, পীর, ফকির আইনে এসব আলাদাভাবে বলে দেওয়ার দরকার হয় না। 


আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনকে 'cognizable' করা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসন কোন অভিযোগ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। তাছাড়া যখনই এসব কেসে পুলিশ গ্রেফতার করে তখন কিন্তু প্রতারণা, জালিয়াতির ধারাগুলোও (রত্ন, যন্ত্রম এসব দিয়ে মামলা জেতানো ঢুকে গেল) প্রয়োগ করে। অলৌকিক বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনের ১৩ নম্বর ধারাতেও কিন্তু বলা আছে এর সাথে যদি অন্য কোনও ধারা উপযুক্ত হয় সেগুলোও একইসাথে প্রয়োগ করা হবে। 


আলোচনার সূত্রে এটাও জানিয়ে রাখি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সংগঠনের তরফে সৌরভ চক্রবর্তী, জ্যোতিষ এবং বিভিন্ন ধরনের বশীকরণ সংক্রান্ত এবং যাদু চিকিৎসা বা ম্যাজিক রেমিডি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলি সংবিধানের ৫১ এ(এইচ) ধারার পরিপন্থী হওয়ায় সেগুলিতে লাগাম টানার জন্য কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক রেগুলেশন আইন এবং কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মাবলীর অন্তর্ভুক্ত বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠান সূচক(code) অনুসারে বিজ্ঞাপনগুলির নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞান মনস্কতা ও যুক্তিবাদকে সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলবৎ করবার জন্য এ রাজ্যে কুসংস্কার বিরোধী আইনের অভাব থাকায় যতদিন না বিধানসভায় এই মর্মে আইন পাশ হয় ততদিন পর্যন্ত আদালত যাতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা (guideline) তৈরি করেন তা নিশ্চিত করার জন্য কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ে যে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেছিলেন তার শুনানির দিন ছিল গত ৮ এপ্রিল ২০২২। 


এই শুনানিতে বিজ্ঞান মঞ্চের পক্ষে আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জী, মূল মামলার যুক্তিগুলি ব্যাখ্যা করেন। আদালত রাজ্যের ও কেন্দ্রের সরকার ছাড়াও এই মামলায় এ্যাডভার্টাইজমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়ার অনুপস্থিতিতে এই মামলাটির শুনানির একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য্য করেন। এর আগে এই মামলাটি চলাকালীণ অবস্থায় মহামান্য বিচারপতি শ্রী সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল যে দেশের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলকে এই মামলায় উপস্থিত থাকতে হবে। 


সেদিন, মহামান্য প্রধান বিচারপতি শ্রী প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও মহামান্য বিচারপতি শ্রী রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলাটিতে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ্যাডভার্টাইজমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়াকে নোটিশ জারি করবার নির্দেশ দিয়েছেন। ৪ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য হয়েছিল। সর্বশেষ তথ্য এখনও এই লেখকের অজানা বলে জানাতে পারলাম না।


প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গবাসী হন এবং আপনার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ থাকে কোনও বুজরুক, প্রতারকের বিরুদ্ধে তাহলে আপনি আপনার অভিযোগ জানাবেন এই ঠিকানায়- The Director, The Directorate of Drugs Control,  Government of West Bengal, P-16, India Exchange Place Extension, K.I.T. Building, 5th Floor, Kolkata-700073.


অভিযোগ দায়ের করার সময় স্মরণে রাখবেন, রোগ সারাবার কোনও বিজ্ঞাপন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকলে তার জেরক্স কপি অভিযোগপত্রের সাথে যুক্ত করে দেবেন এবং মূল পত্রিকাটি যত্ন করে রেখে দেবেন যা মামলা চলাকালীন কাজে লাগবে। আপনার অভিযোগ পাওয়ার পর ড্রাগস কন্ট্রোল থেকে অভিযুক্তের কাছে জানতে চাইবে এই ধরনের তাবিজ কবচ ইত্যাদি (যা আইনের সংজ্ঞায় ওষুধ বা ড্রাগ) তৈরির বৈধ লাইসেন্স তার কাছে আছে কিনা? ড্রাগস কন্ট্রোলের দেওয়া লাইসেন্সগ ছাড়া ওষুধ বানানো বা বিক্রির জন্য জ্যাোতিষী-তান্ত্রিক ইত্যাদিদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবে ড্রাগস কন্ট্রোল। মামলাটি হবে অভিযুক্ত ব্যক্তি বনাম সরকার। আপনাকে বড়জোর সাক্ষী দেওয়া ছাড়া কিচ্ছুটি করতে হবে না। এবারে দু’টি খবর জানিয়ে লেখাটির পরিসমাপ্তি ঘটাবো। 


উত্তরাখণ্ডে রামদেব বাবার পতঞ্জলির ওষুধের রমরমা ব্যবসা। দেরাদুনের দিব্যা ফার্মেসি পতঞ্জলির পক্ষে এই সব আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করে। এই রকম পাঁচটি ওষুধ হোল মধুগৃত, আইগৃত, থাইরোগৃত, বিপিগৃত ও লিপিডম। প্রস্তুতকারকদের পক্ষ থেকে এই সব ওষুধের উপাদান, ফর্মুলা ও গুনাগুন ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞাপনের মাধমে প্রচার করা হোত যে এই ওষুধগুলি ডায়াবেটিস, গ্লুকোমা, গয়টার, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর পক্ষে উপকারী। 


কেরালার জনৈক ডাঃ কে ভি বাবু এই বিজ্ঞাপনগুলির বিরুদ্ধে উত্তরাখন্ডের স্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থার কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয় যে, এই বিজ্ঞাপন বিভ্রান্তিকর শুধু নয় এটা ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ এবং ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট, ১৯৫৪ এর বিরোধী। সাধারণ মানুষ এ জাতীয় বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন। 


অভিযোগের সত্যতা অনুসন্ধানের পর উত্তরাখন্ড আয়ুর্বেদ ও ইউনানি লাইসেন্স অথরিটি, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের দায়ে, দিব্যা ফার্মেসিকে এই সব ওষুধ বন্ধের নির্দেশ দেয় (সূত্র- দি টেলিগ্রাফ / ১০.১১.২০২২। লিংক -

https://www.telegraphindia.com/india/uttarakhand-bars-production-of-5-ramdev-medicines/cid/1897224)। 


এই খবরের আরেকটি বিশেষ খবর - রামদেবের দিব্য ফার্মেসির উৎপাদিত পাঁচটি ওষুধের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিল উত্তরাখণ্ডের আয়ুর্বেদ ও ইউনানি লাইসেন্সিং অথরিটি। আগের নির্দেশিকাকে সংশোধন করে শনিবার নতুন নির্দেশিকা জারি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ওই ৫টি ওষুধ উৎপাদন জারি রাখতে পারবে রামদেবের সংস্থা (সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১৩/১১/২০২২। লিংক- https://www.anandabazar.com/india/ban-on-ramdevs-5-products-revoked-by-uttarakhand-govt-dgtl/cid/1384018)। 


এতকিছুর পরেও কিন্তু বলব, এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী ও স্পষ্ট আইন দরকার। বিশেষত বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনের তো ব্যাপক সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু আইন থাকলেই কিছু হয় না। ভারতে শাসকের স্বার্থে বহু উপযোগী আইন শুধুই মলাটবন্দি হয়ে পড়ে থেকে শুধুই ধুলোই জমে। তাছাড়া, প্রচুর সম্পদের চূড়ায় বসে থাকা প্রতারকেরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি নিজেদের প্রতারণা চালিয়ে যায়। উদাহরণ, রামদেবের পতঞ্জলি ওষুধের ঘটনাটি। কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন চাইলেও ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডিস ভঙ্গকারীদের শুধুমাত্র আইনের অভাবে গ্রেফতার করতে পারবে না সেটি ডাহা মিথ্যে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, যা অনেকেরই নেই।

শ্রীমদ্ভাগবতে জাতিভেদের শাস্ত্রকথা -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 26, 2024 | ধর্ম | views:281 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আমরা সবাই এতোদিন জানতাম যে শূদ্রদের সনাতন ধর্মে অসম্মান তথা পিরিত করেছে, যেটা চোখ বন্ধ করেও হলে সত্য, কিন্তু আজ এক নতুন তথ্য আপনাদের কাছে তুলে ধরবো যা সনাতনী ক্ষত্রিয় বলা ব্যক্তিগণদের একবার চিন্তা করা উচিত তারা কতটা সম্মান পেয়েছে এই সনাতন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে? আপনারা সবাই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। পরশুরাম, সম্পর্কে অবগত [পরশুরাম একুশবার পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেন] এই কথা আমরা সবাই জানি পৌরাণিক গল্প মতে খুব বিখ্যাত কিন্ত এখান থেকেই যুক্তিবাদীদের প্রশ্ন উঠে? প্রথমবার যদি পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়শূন্য হয়ে থাকে! তাহলে আবার কীভাবে পরশুরাম আরও বিশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন? এখন যদি বলেন সেই কালে বর্ণ ব্যবস্থা জন্ম থেকে নয় কর্ম থেকে তা হলে বলবো! বর্ণ ব্যবস্থা কোনওদিন কর্ম থেকে হতে পারে না। [ গীতা - 1:43, 18:41, 4:13, 18:42, 18:43, 18:44, 18:47, 18:48, 3:35 ] আপনার যদি সনাতন ধর্ম বিষয় একাডেমিক পড়াশোনা থাকে তাহলে এতোগুলি রেফারেন্স পর পর পাশে রেখে পড়েন তাহলে বুঝবেন আমি কী বলতে চাইছি। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের নোংরা চিন্তার জন্য ক্ষত্রিয়রা কোনও দিন ব্রাহ্মণ্যবাদকে মেনে না নেওয়ায় জন্য পরশুরামের সৃষ্টি এবং ক্ষত্রিয় বংশকে ধ্বংস, যেখানে পরশুরাম ক্ষত্রিয়দের হত্যা করেছে, সেখানে আরেক (রাম ) নিরপরাধ শূদ্র শম্বুক হত্যা এর পরেও সনাতন ধর্ম নাকি মহান যখন যখন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় শূদ্ররা প্রতিবাদ করেছে, ততবার বিষ্ণুর ভিন্ন অবতার নিয়ে দমন হত্যালীলা চালিয়ে গেছে, আর সেই শাস্ত্র ক্ষত্রিয়দের কুকুর বলে মনে করে।

 

আপনারা জানেন ক্ষত্রিয়রা খুব ধর্মপ্রাণ হয়ে থাকে ধর্মের জন্য সংস্কৃতির জন্য। নিজেদের জীবন দিতে তৈরি থাকে। তার সঙ্গে ক্ষত্রিয়দের দ্বিজ শাস্ত্র পড়ার অধিকার জন্মগত আছে। কিন্ত সেই সনাতন শাস্ত্র পড়তে পড়তে, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ পড়লাম, এবং পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে।


[শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ/ ১ম স্কন্ধ/ ১৮ অধ্যায় ৩২-৩৪ ]

“ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়গণকে দ্বারপাল কুকুর বলিয়াই মনে করেন, তাহারা দ্বারদেশে অবস্থান করিবে, তাহারা কী রূপে আশ্রমে প্রবেশ করিয়া পাত্রস্থ অন্নভোজনের যোগ্য হয়?”


[ শ্রীমদ্ভাগবতের ৪ ম স্কন্ধের ৪ম অধ্যায় ৭ ]

ইশ্বর নিন্দাবাদীর জিহ্বাকে কেটে হত্যার জন্য আদেশ দিচ্ছে।


[শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১ম স্কন্ধ, ১৩ অধ্যায় ১৫-২৩ ]

শূদ্রের ধর্মোপদেশ দেওয়াকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখা হত। তাই বিদুরের ক্ষেত্রে জাস্টিফিকেশন দিতে হয়েছে।


[ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১ম স্কন্ধ, ৫ম অধ্যায় ১৭-১৮]

“যদি কোনও ভক্ত স্বীয় বর্ণ ও আশ্রমের অনুষ্ঠেয় ধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক শ্রীহরির চরণাম্বুজের ভজনা করিত করিতে ভক্তির অপক্ব অবস্থাতেই তাহা হইতে বিচ্যুত হন, তথাপি তাহার নীচ যোনিতে জন্মাদির আশঙ্কা নাই।” প্রশ্নঃ নীচ যোনি কোনগুলো? শূদ্র কি নীচ যোনি?


[ শ্রীমদ্ভাগবতের ১ম স্কন্ধের ৫ম অধ্যায় ২৩ ]

দেখা যায়, নারদ একবার এক ব্রাহ্মণের দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করাকে নেগেটিভ ভাবে দেখা হয়েছে বলে মনে হল।


[ শ্রীমদ্ভাগবতের ১ম স্কন্ধের ৭ম অধ্যায় ১৬-১৮,৩৩-৪৮ ]

কৃষ্ণ বিষ্ণুর রূপ ধরে অর্জুনকে বলেন, “ ব্রাহ্মণ অধম হলেও অবধ্য”। এই অধ্যায়ে দেখা যায় অশ্বত্থামা অনেক অপরাধ করলেও তাকে শেষমেষ হত্যা করা হয় না। এই সময় যুক্তি দেওয়া হয়-সর্বস্ব গ্রহণ ও মস্তকমুণ্ডন করে দেশ থেকে নির্বাসিত করে দিলেই অধম ব্রাহ্মণের বধ তুল্য শাস্তি হইয়া থাকে। এইরূপ ব্রাহ্মণের প্রাণদণ্ড শাস্ত্রে বিহিত হয় নাই।


এর পরেও লোকে বলে যে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ নাকি একটি মহান পুরাণ কিন্ত এই পুরাণ কতটা মহান তা এই পুরাণ পড়লে পরে বোঝা যায়। 

শব্দ দূষণ -দিবাকর মন্ডল
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:879 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বছরই রুটিন মাফিক মনসা পুজো থেকে শুরু করে দুর্গাপূজা, কালীপূজা এবং আরো অন্যান্য সমস্ত রকম ধর্মীয় পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠানে (কখনও পারিবারিক কখনও বা সার্বজনীন) যেভাবে মাইক এবং বক্সের শব্দতাণ্ডব চালানো হয় তার থেকে কেউ রেহাই পায় না! ঐসব দিনগুলিতে দিনভর মণ্ডপ ও তার আশপাশে মাইক বাজানো হয়। এ ছাড়াও ভাসানে মাত্রাতিরিক্ত জোরে সাউন্ড বক্স বাজানো ও শব্দ বাজি ফাটানো হয়। প্রকাশ্য রাস্তায় একটি ভ্যানে ১০ থেকে ১২টি সাউন্ড বক্স ও আট-দশটি চোঙা মাইক, সাথে জেনারেটর একসঙ্গে তুলে তারস্বরে বাজিয়ে উদ্দাম নাচতে নাচতে ভাসানে যাওয়াটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক ডেসিবেল (ডিবি)। শব্দের মাত্রা ৪৫ ডিবি হলেই সাধারণত মানুষ ঘুমাতে পারে না। ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়।


বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি তিন বছরের কম বয়স্ক শিশু কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ১০০ ডিবি মাত্রার শব্দ শোনে, তাহলে সে তার শ্রবণ ক্ষমতা হারাতে পারে। মানুষ সাধারণত ১৫ থেকে ২০ কিলোহার্টজ (KHZB) স্পন্দনের শব্দ শোনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতানুসারে, সাধারণত ৬০ ডিবি শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে এবং ১০০ ডিবি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজি এবং ডিজের আওয়াজে মানুষের শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। হৃদ্‌রোগীদের পক্ষেও জোর শব্দ ভীষণ ভাবে ক্ষতিকারক। তাই শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরবঘাতক।


আজ আমার রক্ত গরম, আমার বাড়িতে বয়স্ক কোনও লোক নেই, বাচ্চা নেই, বক্স এবং মাইকের মুখ আমার বাড়ির দিকে নয়, তাই আমি গায়ের জোরে উচ্চস্বরে মাইক বক্স চালালে অন্যের ক্ষতি হবে, তাতে আমার কি! এই মানসিকতা নিয়ে যারা রয়েছেন তাদের বলব আগামী দিনে আপনিও বয়স্ক হবেন, আপনার বাড়ি তো একদিন না একদিন ছোট শিশু জন্মাবে! তখন যদি আগামী প্রজন্ম তাদের রক্তের গরমে চোখ দেখিয়ে আপনার বাড়ির দিকে মাইক বক্স করে উচ্চশব্দে গান-বাজনা চালায় তখন আপনি সহ্য করতে পারবেন তো? 


মানবিকতার নামে দানবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের আনন্দের জন্য যাঁরা আইন ভেঙে সাধারণ মানুষকে সমস্যায় ফেলেন, তাঁদের জন্য আইনের সহায়তা নেয়া একমাত্র উপায়।


তাই বলব সার্বজনীন শুভ অনুষ্ঠান মানবিকতার দিক বজায় রেখেই করুন। আপনাদের অনুষ্ঠানের অর্থ যদি হয়ে থাকে সকলের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী এবং ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রাখা, অন্যের ক্ষতিসাধন না করা, সকলের মুখে হাসি ফোটানো, তাহলে আশা করব আপনারা শব্দ দূষণকে নীরব ঘাতক হিসেবে ব্যবহার করবেন না। নির্ধারিত নিয়ন্ত্রিত মাত্রা বজায় রেখে অনুষ্ঠান করুন তাতে সকলেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে,  সকলের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

কমিউনিস্ট পার্টি ও বিবর্তনবাদ -অনুজ বিশ্বাস
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:880 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কলকাতায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে একটা খবর, চির রোমান্টিক বিপ্লবী আর্নেস্তো চে 'র মেয়ে অ্যালেইদা আসছেন আর তাঁকে গণ সম্বর্ধনা দেবে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি। কেন? আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ে বলে? কিন্তু তিনি তো বিপ্লবী নন, বিপ্লবী তথা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী তো তাঁর বাবা। তাহলে অ্যালেইদাকে নিয়ে এতো নাচানাচি কেন? কমিউনিষ্ট পার্টি তো পরিবার তন্ত্রে বিশ্বাস করে না।


জন্মলগ্ন থেকে কমিউনিষ্ট পার্টি বিশ্বাস করে মানব বিবর্তনের প্রথমতত্ত্বে: শ্রেণী সংগ্রাম বা class struggle তথা ডারউইনের struggle for existence মন্ত্রে। স্বয়ং মার্ক্স চিঠি লিখে ডারউইনের কাছ থেকে এই 'শ্রেণী সংগ্রাম' শব্দটি ধার নিয়েছিলেন। এটা ছাড়া মানব সভ্যতার ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যেত। এতদিন ধরে কমিউনিষ্ট পার্টি তার কথা রেখেছে, একনিষ্ঠ চিত্তে ডারউইনবাদ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। গরীব বড়োলোকের মধ্যে দিয়ে আন্ত:প্রজাতির সংগ্রাম, নিজের শ্রেণীর লোকেদের একত্রিত করানোর মধ্যে দিয়ে আন্ত:প্রজাতির সংগ্রাম আর রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়ে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করেছে।


অ্যালাইদার মধ্যে দিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রবেশ করল বিবর্তনের দ্বিতীয় তত্ত্বে, ল্যামার্কের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুশরন বা inheritance of the Acquired Characters মন্ত্রে। কমিউনিষ্ট পার্টির বর্তমান প্রজন্মের মনে হয়েছে অ্যালাইদা যেহেতু আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ে তাই তার মধ্যে বাবার চির বিপ্লবী রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। বৈপ্লবিক চিন্তাধারা একটি অর্জিত বৈশিষ্ট্য যা অ্যালাইদা তার বাবার রক্তের মধ্যে দিয়ে পেয়েছেন। সমকালীন বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি আর্নেস্তো চে কে ডাক্তার থেকে রোমান্টিক বিপ্লবীতে পরিণত করেছিল। এক হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে রাইফেল অন্য হাতে কমরেডের জন্য স্টেথোস্কোপ, শত্রুর সাইকোলজি বুঝে ফাঁদ পেতে অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ পদ্ধতি আবিষ্কার করা আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ের মধ্যেও যে তার বাবার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে সে কথা একটা শিশুও বোঝে, কমিউনিষ্ট পার্টিও বোঝে। কিন্তু স্বীকার করতে কয়েক দশক সময় লাগিয়ে দিল। অ্যালাইদার মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের রঙ্গমঞ্চে পরিবারতন্ত্র নামক ভীমের গদাহস্ত প্রবেশ ঘটিল, থুড়ি স্বীকৃতি পাইল।


এখন বাকি থাকল হুগো দা ভ্রিসের মিউটেশন তত্ত্ব। এটা inter caste বা inter racial marriage ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ অন্যদল তথা অন্য মতাদর্শের লোকজনকে ভাঙিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে এসে তাদের ক্রোমোজোমে মার্ক্সবাদ মিশিয়ে কোষ বিভাজন ঘটানো ছাড়া রাজনৈতিক মিউটেশন সম্ভব নয়। এখনও পর্যন্ত এমন সম্ভাবনা চোখে না পড়লেও ভবিষ্যতে কী হবে তার উত্তর একমাত্র সময় বলবে।

ধ্বংসের বোপীত বীজ ও শেষের অপেক্ষা -রাহুল রায়
Nov. 26, 2024 | ভ্রমণ | views:899 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডস্থিত কেদারনাথ নিয়ে একটি লেখা পড়া হচ্ছিল। কেদারনাথ মন্দিরটি নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এতে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছিলেন। অবশ্য তাতে মন্দির কর্তৃপক্ষ কোনও সাড়া দেয়নি যেমন সে রাজ্যের সরকার সাড়া দেয়নি কেদারনাথ মন্দিরের সামনে ছোটোখাটো একটি জনপদ গড়ে তোলার বিরুদ্ধে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের আবেদনেও। কারণ একটাই, টাকা। গতবছর কেদারনাথ মন্দিরে রেকর্ড ভাঙা ভিড় হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটকরা আসছেন, সঙ্গে আনছেন খরচ করার জন্য টাকা। সেই টাকা থেকে রাজ্যের অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু কথা হল আজকে না হয় দুধ ভাতের পথ বের করা হল, কাল যদি এই মন্দিরটিই কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বলি হয়ে যায় তখন যে দুধ ভাত কি ফেন ভাতও কপালে জুটবে না। কেদারনাথের মতো মন্দির প্রাচীন ভারতের বিস্ময়কর স্থাপত্যের নিদর্শন। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে একে বিপর্যস্ত করে নেওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই সবার পক্ষে মুখ বুজে মেনে নেওয়াটা সম্ভব হয়নি।

প্রকৃতির নিয়মকে তোয়াক্কা না করলে চললে কি হয় প্রকৃতি উত্তরাখণ্ড রাজ্যেই কিছুদিন আগে তার একটি উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের চামোলী জেলার যোশীমঠ সম্পর্কিত ঘটনাক্রম জনমানসে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ হিমালয়ের ধ্বস সংক্রান্ত নানা দুঃসংবাদ সচেতন সব মানুষেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাহাড়বাসী সাধারণের জনজীবন যারপরনাই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যয় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুদীর্ঘ কাল যাবৎ বিপথগামী যাপনের ফল। সুউচ্চ তরুশ্রেণী দ্বারা আচ্ছাদিত হিমালয়ের পর্বত গাত্র। বরফ গলা নির্মল জল প্রাকৃতিক নিয়মেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ খুঁজে নেমে আসে তটভূমিতে। পুষ্ট করে নিম্নভূমির নদীর স্বাস্থ্যকে। ভঙ্গুর পাহাড়ের গায়ে অজস্র গাছ গাছালির শেকড়ের বাঁধন ভূমির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত পাহাড়ি গাছের কাঠ দিয়ে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করেন পাহাড়ি জনজাতির মানুষজন। তাদের তৈরী কাঠের বাড়ি যেমন পাহাড়ি শীত প্রতিরোধে সক্ষম, তেমনই ভার কম হওয়ার জন্য পাহাড়ের ঢালু ভঙ্গুর জমির ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভারও প্রযুক্ত হয় না। পাহাড়ের সহন ক্ষমতার মধ্যেই থাকে স্থানীয় গ্রামগুলি। গ্রামগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়ে যায় পাহাড়কে অক্ষুন্ন রেখেই। 


সমস্যা হয়েছে মানুষের কুশিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায়, সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু যে শিক্ষা মানুষের বোধশক্তি রহিত করে দেয় তাকে কুশিক্ষা ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। উত্তরাখণ্ডের মানুষ পড়াশোনা করতে বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে বিলাসবহুল জীবন, আধুনিক নির্মাণশৈলী দেখছেন, বাড়ি এসে নিজের জীবনে, বাড়িঘরে সেটার প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। বড় বড় বাড়ি, হোটেল অহরহ হচ্ছে। শত-শত গাড়ি টন টন কার্বন নিঃসরণ করে প্রতিদিন যাওয়া আসা করছে। পাহাড় একদিকে সবুজহীন হচ্ছে অন্যদিকে কার্বন একে গরম করে তুলছে। অবশ্য সব দোষ যে মানুষের তাও নয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিত্য নতুন নিয়ম করে পাহাড়,  জঙ্গল সাফ করে নানা রকম প্রকল্প হাতে নেওয়ার আইনতঃ ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কেদারনাথ মন্দিরের সামনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দিন ধ্যান করতেই পারেন, এতে অসুবিধা নেই, ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে থাকার অধিকার একজন ভারতীয় হিসাবে ওঁর আছে। ভারতের মতো দেশে সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে এতে মানুষের আবেগকে নিজের পাশে পাওয়াই যায় কিন্তু প্রকৃতির চিন্তাকে পাশে রেখে এনটিপিসির তপোবনের মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করলে প্রকৃতির কিন্তু তার রুদ্র রূপ নিতে পিছপা হবে না। আর সমস্যা হল এখানে ইডি, সিবিআই, পুলিশ, আদালত, আইটি সেল কেউই কিছু করতে পারবে না। রাজ্য সরকারেরও একই অবস্থা। পাহাড়ের মানুষ হয়েও এরা পাহাড় রক্ষার চিন্তা করছে না। পর্যটন ও রাজস্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা, জঙ্গল সাফ করে নগরায়ন হচ্ছে। রেলের জায়গা খালি করতে সাড়ম্বরে বুলডোজার চালিয়েছেন ভালো কথা, স্থানীয় মানুষের দাবী মেনে একই রকম ব্যবস্থা যদি পাহাড়ে সবুজ ফেরাতে করতেন তাহলে আজ অন্ততঃ এই দিন দেখতে হতো না। এতসবের মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের সামঞ্জস্য স্বাভাবিক ভাবেই নষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছেন না কেন। যোশীমঠের মানুষ করেছিলেন, মাসের পর মাস, বিশেষজ্ঞরা ১৯৭৬ সন থেকেই ততকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকার ও পরবর্তীতে উত্তরাখণ্ড সরকারকে সতর্ক করছেন, কেউ কর্ণপাত করেনি। তবে আজকাল আবার প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলতেও সমস্যা আছে। প্রকৃতি রক্ষার ব্যবস্থা না হোক, সরকারী নীতি রক্ষার্থে প্রতিবাদীদের বিদেশী রাষ্ট্রের টাকায় উন্নয়ন বিরোধী শহুরে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু পাকাপোক্ত করা হয়েছে।


পর্যটনের বিকাশের নামে বিপুল মানুষ বছরভর পাহাড়ে আসছেন। ফুলে ফেঁপে উঠছে ব্যবসা। মুনাফাপ্রেমী ওই এক শতাংশ মানুষের লোভী দৃষ্টি এসে পড়েছে পাহাড়, জঙ্গলে। পর্যটন বিস্তারের নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে পাহাড়ের ভঙ্গুর ঢালু গা বেয়ে গড়ে উঠছে চওড়া রাস্তা, সেতু কংক্রিটের মহোৎসব। সেই রাস্তার ওপর দিয়ে শ'য়ে শ'য়ে চলেছে পর্যটক ভর্তি গাড়ি। পর্যটকদের জন্য শত শত হোটেল খুলে রাখা মালিক, রিসর্ট মালিক, পর্যটকদের ব্যবহার করা গাড়ির মালিক হলেন ওই এক শতাংশ। এদের চাঁদায় নির্বাচন তরী পেরিয়ে আসা জনপ্রতিনিধিরা এদের বিরোধিতা না করে বরং নীরবে অংশীদারত্বের পথ নেন। তাঁরা বেমালুম ভুলে যান যে এই রাস্তার ভার, এই গাড়ির ভার, এত মানুষের ভার বহনে সক্ষম নয় হিমালয়ের ভঙ্গুর পাহাড়ের গা-গুলি। উপরন্তু রাস্তা, কংক্রিটের সেতু, হোটেল, রিসর্ট বানানোর সুপ্রশস্ত জায়গা পাওয়ার জন্য নির্বিচারে বলি হচ্ছে সুপ্রাচীন বৃক্ষ রাজি। শেকড়ের প্রাকৃতিক বাঁধন হারিয়ে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে কংক্রিটের ভারে নুয়ে পড়া পাহাড়ের ভূমি। ফল স্বরূপ ধ্বস ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। জীবনহানি, সম্পত্তিহানি, ওই বাকি নিরানব্বই শতাংশের। চকচকে পাহাড়ের চকচকে বিলাসবহুল শহরের প্রয়োজনে চাই ঝকঝকে আলো। আলোর প্রয়োজনে চাই বিদ্যুৎ। অতএব পাহাড়ি নদীর ওই দুর্দম গতিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ এর পরিকল্পনা। নদীর ওপর আবার কংক্রিট, বাঁধ নির্মাণ। বাঁধের জমে থাকা জলে পাহাড় গায়ের অসম ভার বৃদ্ধি। আবার পাহাড়ের ভারসাম্যের বিঘ্ন। প্রকৃতিকে শাসন করার এই ভ্রান্ত চর্চা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পৃথিবীর ধ্বংস প্রাপ্তি পর্যন্ত অবিরল গতিতে চলতেই থাকবে। আর ওই এক শতাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদে, মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার জায়গা। আরো একটি মুনাফার কারখানা। আমরা নিরানব্বই শতাংশ এই দুর্ভোগ নিয়ে অভিযোজন ঘটাতে ঘটাতে বেঁচে রয়েছি। উপযুক্ত চেতনার দ্বারা উপযুক্ত পথের সন্ধান করার প্রয়াসী না হলে বৃদ্ধি আর উন্নয়নের এই কালচক্র থেকে নিস্তার নেই আমাদের, ওই নিরানব্বই এর দলের লোকেদের। আজ যোশীমঠ, কাল উত্তরকাশী, নৈনিতাল একই ঘটনা ঘটতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই এই দুই জনবসতি নিয়ে সরকারকে গুরুতর সাবধানবার্তা দিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এরপর কি শেষ হয়ে যাবে এই ধ্বংস যজ্ঞ?  না, হবে না। মানুষ ধ্বংসের বীজ চারিদিকে বোপন করে রেখেছে। তা সে কেদারনাথ মন্দির প্রাঙ্গণই হোক বা বাংলার দার্জিলিং, কালিম্পং বা মেঘালয়ের শিলং। বোপিত বীজ অঙ্কুরিত হতে সময় কম বেশ লাগতেই পারে, কিন্তু হবে যে সেটা নিশ্চিত।

গুমনামী বাবা এবং নেতাজি সুভাষ বোসের যোগস্থাপন ~ তথ্যের মিথ্যাচার -সঞ্জয় উবাচ
Nov. 26, 2024 | রাজনীতি | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাঙালি তথা আপামর ভারতবাসীর অবিসংবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অগ্রগণ্য সেনানী আমাদের প্রাণের নেতাজি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস নীতির বিরোধিতা করে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিরোধী দেশগুলির সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মশাল জ্বেলে দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালের ১৮ই অগাস্ট তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় ওঁর মৃত্যুর খবর এখনও কোনও বাঙালি বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের মনের মণিকোঠার বীর যেন আক্ষরিক অর্থে অমর।


প্রায় ৭৫ বছর পরেও বাঙালীর মনের মনিকোঠায় বীর সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তৈরি হওয়া কল্পকাহিনী আরও নতুন নতুন আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে। 


অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে - 

৩০শে অগাস্ট ১৯৪৫ জাপানের আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই এডমিরল মাউন্টব্যাটেন জেনারেল ম্যাকআর্থরর্কে নেতাজির মৃত্যুর তদন্তের যে নির্দেশ দেন- তার রিপোর্টেও বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বই সামনে এসেছে। স্বাধীন ভারতে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে গঠিত তিনটি কমিশনের দু’টিতে (শাহনাওয়াজ ও খোসলা কমিশন ) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্য হয়েছে বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। নেতাজি পরিবারও এই দূর্ঘটনার সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। দুর্ঘটনা কবলিত সেই বিমানের চালক, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সদের সাক্ষ্যের সাথে নেতাজির সঙ্গী ও দেহরক্ষী হাবিবুর রহমান ও দোভাষী নাকামুরার ভাষ্য বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেয়।


নেতাজির মৃত্যুরহস্য এবং সন্ন্যাসযোগ - 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী জাস্টিস মনোজ মুখার্জি কমিশন গঠন করেন। দীর্ঘ এত বছর পরে তথ্যপ্রমাণ এবং সাক্ষীদের অনেকেই জীবিত না থাকার দরুন কমিশনের রিপোর্ট কখনই ত্রুটিহীন হবে না। 


নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তে গঠিত মুখার্জী কমিশনে মৃত্যুর ০৫ টি কারণ নথিভুক্ত করা হয়েছে। 


১. লালকেল্লায় গুপ্তহত্যা

২. তাইহোকু বিমান বন্দরে দুর্ঘটনা

৩. ফৈজাবাদের গুমনামী বাবা

৪. শোলমারি আশ্রমের সারদানন্দ

৫. মধ্যপ্রদেশের গুহাবাসী সাধু


এই লেখার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র গুমনামী বাবা ও নেতাজির মিসিং লিঙ্কের সন্ধান। 


মুখার্জী কমিশনের গৃহীত সাক্ষ্য অনুযায়ী নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের সাথে তিনজন সাধুর যোগ স্থাপন করা হয়েছে। 


পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের ফালাকাটা এলাকার শোলমারিতে সারদানন্দ নামে এক সন্ন্যাসীকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছদ্মবেশী রূপ বলে প্রচার পায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রচারের অসারতা প্রমাণিত হয়। সারদানন্দ সাতের দশকে শোলমারি ছেড়ে দেরাদুন চলে যান৷ কয়েক বছর পরে সেখানেই দেহ রাখেন৷ 


এরপর নেতাজির আত্মগোপনের খবর প্রকাশ পেল উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ শহরে। ১৯৮৫ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ফৈজাবাদ শহরের রামভবন থেকে একজন আত্মগোপনকারী সাধু নিখোজ হয়ে যান। এই রামভবনেই ছিলেন গুমনামী বাবা ওরফে মৌনি বাবা ওরফে ক্যাপ্টেন বাবা ওরফে ভগবানজী। 


লোকশ্রুতি অনুযায়ী, গুমনামী বাবা সব সময় নিজেকে পর্দার আড়ালেই রাখতেন। তিনি বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন। দামি পাইপে ধুমপান করতেন। কলকাতা থেকে বাঙালী ভক্তরা প্রায়শই আসতেন এঁর সাথে দেখা করতে। 


গুমনামী বাবার অন্তর্ধানের পরে তার ঘরে নেতাজির পরিবারের ছবি, দামি ঘড়ি, পাইপ, বাংলা বই ও প্রচুর চিঠিপত্র পাওয়া যায়। নেতাজির ভাইজি ললিতা বসু দাবি করেন গুমনামী বাবাই সুভাষচন্দ্র বসু এবং উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এর তদন্ত অনুরোধ করেন। জাস্টিস দেশাই এর তত্বাবধানে গঠিত তদন্ত কমিশন সঠিক তথ্য এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষীর অভাবে গুমনামী বাবাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র হিসাবে প্রমাণিত করতে পারেনি।


মুখার্জি কমিশনের ১১৪- ১২২ পাতা ধরে গুমনামী বাবা ও নেতাজির মধ্যে মিল স্থাপনের চেষ্টা করলেও গুমনামী বাবার হাতের লেখার নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়৷ বেসরকারি বিশেষজ্ঞ সেগুলি নেতাজির হস্তলিপি বললেও সরকারি পরীক্ষাগারের অভিমত নেতিবাচক৷ বাবার রেখে যাওয়া পাঁচটি দাঁতের ডিএনএ পরীক্ষার ফলও নেতিবাচক বেরিয়েছিল৷ 

হাতের লেখা ও দাতের ডিএনএ টেস্ট রিপোর্টে গুমনামী বাবার সুভাষ চন্দ্র বসু হয়ে ওঠা হল না। 


এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, জাস্টিস মনোজ মুখার্জি কমিশন এবং জাস্টিস বিষ্ণু সাহাই কমিশন আত্মগোপনকারী সাধুকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিসাবে স্বীকৃতি দেননি। 


খুনের আসামীর যোগ - 

গুমনামী বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ৮ই নভেম্বর ১৯৮৫ এ হিন্দি দৈনিক 'অমৃত প্রভাত' এবং 'জনমোর্চা' প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে, ১৯৫৮ সালে কে.ডি উপাধ্যায় ওরফে ক্যাপ্টেন বাবা পণ্ডিত ব্রম্মদেব শাস্ত্রীকে হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। লোকশ্রুতি অনুযায়ী কেডি উপাধ্যায় কিছুদিন নেপালে আত্মগোপন করার পর উত্তরপ্রদেশের বস্তি এলাকায় ছিলেন। গুমনামী বাবা ও বস্তি এলাকা থেকেই ফৈজাবাদে এসেছিলেন। কেডি উপাধ্যায় এবং গুমনামী বাবার মিসিং লিঙ্ক শেঠ ঈশ্বরদাস বেণীপ্রসাদ। 


ব্রম্মদেব শাস্ত্রীর ভাই সূর্যনারায়ন মিশ্রার আত্মজীবনীতে শেঠ ঈশ্বরদাস বেণীপ্রসাদের উল্লেখ আছে - কেডি উপাধ্যায়ের স্কুলের অন্যতম আর্থিক সহায়তাকারী হিসাবে। অপরদিকে গুমনামী বাবার অন্যতম ভক্ত ডক্টর আর.পি.মিশ্রার কথায় শেঠ ঈশ্বরদাস বেণী প্রসাদ গুমনামী বাবার প্রকৃত পৃষ্টপোষক ছিলেন। 


তাহলে আত্মগোপন করে থাকা গুমনামী বাবা আসলে একজন পুলিশের খাতায় ফেরার আসামি। এই ঘটনা সত্যি হলে যে বা যারা একজন খুনের আসামীকে ভারতের বীর সন্তান নেতাজির নাম যুক্ত করতে চাইছেন তারা একপ্রকার অপরাধ করছেন।


গুমনামী বাবার RSS সখ্যতা -

জয়বাবা ফেলুনাথ গল্পে হরিদ্বার ঘাটে মছ্লিবাবাকে সাজিয়ে জনসাধারণের সামনে এনেছিলেন দুর্ধষ মগনলাল মেঘরাজ। রামভবনে গুমনামী বাবার মাহাত্য প্রচারের প্রতিটা অধ্যায় যুক্ত করেন বিজেপি নেতারা। 


স্বাধীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সাম্প্রদায়িক বিতর্কের কালো অধ্যায়ের যোগ রয়েছে ফৈজাবাদের এই রামভবনের সাথে অযোধ্যার বাবরি মসজিদে রামলালামূর্তি স্থাপন করেন রামভবন -এর গুরুদত্ত সিং।


গুরুদত্ত সিং -এর পৌত্র ঠাকুর শক্তি সিং বর্তমানে BJP নেতা এবং জাস্টিস সহায় কমিশনে পিটিশনে দাবি করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গুমনামী বাবার ছদ্মবেশে রামভবনে আত্মগোপন করেছিলেন।


গুমনামী বাবার ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া RSS এর সংঘচালক গোলওয়ালকারের লেখা চিঠি গুমনামী বাবার সাথে RSS এর যোগ স্পষ্ট করে দেয়। 


অনুমান করা যেতেই পারে যে, রামভবনের ছাদে গেরুয়া পতাকার পালে হাওয়া লাগিয়ে গুমনামী বাবা BJP-RSS এর সযত্নে লালিত হয়েছিল এবং মৃত্যুর পরে তাই নেতাজির মৃত্যু রহস্যে নতুন মোড় এনে দেয়। 


কারণ - 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুমহাসভার ভূমিকা সর্বদাই ব্রিটিশদের চাটুকারিতা করেই কেটেছে। তাই বিজেপির মেকি জাতীয়তাবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারির কোনও নেতার অবলম্বন দরকার। ৩০০০ কোটি টাকার স্ট্যাচু তৈরি করে সর্দার প্যাটেলকে পন্ডিত নেহরুর তুলনায় বড় প্রমাণ করার চেষ্টা। 


নেতাজির এই আকস্মিক অন্তর্ধান দেশবাসী আজও মেনে নিতে পারেনি। নেতাজিকে নিয়ে যে বীরগাঁথা আপামর ভারতবাসীর মনের মনিকোঠায় গেঁথে রয়েছে সেই আবেগকে মূলধন করে বিজেপি তার রাজনৈতিক সুবিধা চরিতার্থ করতে চাইছে। বিজেপি ও আর.এস.এস ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে পন্ডিত নেহরুকে কালিমালিপ্ত করার লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।


এরপর এদের লক্ষ্য গান্ধীজি। যারা প্রকাশ্যে জাতির জনকের হত্যাকারীকে পুজো করেন তারা কখনই গান্ধীজির প্রভাবকে স্বীকার করবেন না। 


নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে সাধু ছদ্মবেশে হাজির করানো এবং আজাদ হিন্দ সরকারকে মান্যতা দেওয়ার পিছনে এদের গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের ইতিহাস RSS এর নাগপুর হেড অফিস থেকে ছেপে আসবে - যেখানে লেখা থাকবে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আর দেশের টাকায় গাঁধীজির ছবি নয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি যেন অনেক বেশি মানানসই হবে। বিজেপির আইটি সেল ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতাজির ছবি সম্বলিত টাকার প্রতিরূপ ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা সাধারন মানুষেরা গান্ধী-নেহরু-বোস এর সম্পর্কের সমীকরণ খুঁজব আর একধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করব বাঙালি হিসাবে।


আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে নেতাজির মতন একজন বীরপুরুষ সাধুর ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকার মতন কাপুরুষতার কাজ কখনই করবেন না। গুমনামী বাবাকে নেতাজির সাথে এক যারা করতে চাইছেন তারা পক্ষান্তরে নেতাজির আদর্শকেই কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন।

সংগঠিত ধর্ম কোনোদিন ডারউইনকে পছন্দ করেনি -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 26, 2024 | যুক্তিবাদ | views:880 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে – কে তুমি, মেলেনি উত্তর দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে, 

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –কে তুমি, পেল না উত্তর। 

      (  শেষ লেখা -রবীন্দ্রনাথ ) 

জীব সৃষ্টি  হয়েছে কিভাবে? জীবকে সৃষ্টি  করেছে কে? এই প্রশ্ন মানুষের মনে নিরন্তর ঝড় তুলেছে সভ্যতার বিকাশের শুরুর সময়  থেকেই  বড় বড় বিশ্বমানবরাও দ্বিধাগ্রস্ত এই ব্যাপারে। ছোটবেলা থেকেই উঠতে বসতে ঘরে বাইরে শুনে আসছি সব তার সৃষ্টি। প্রশ্ন এসেছে মনে, জিজ্ঞাসা করলেই বলতো ডেঁপো ছেলে। প্রমাণের কি আছে হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ এবং তোমার পূর্ব পুরুষেরা বিশ্বাস করে আসছে, তোমাকেও তাই বিশ্বাস করতে হবে বিনা প্রশ্নেই। এসব বলেই দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেশী বললেই মার জুটতো কপালে। ধর্মের বিবর্তনের এবং ঈশ্বর-গড-আল্লাহদেরও বিবর্তন ঘটেছে এই পৃথিবীতে।  ব্যাবিলন সুমের মিশর আরব  নরওয়ে রোম গ্রীসের পেগান বা মূর্তিপূজকদের  দেবদেবীদের  ইহুদী খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা  বিলুপ্ত করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। একমাত্র ভারতে উদ্ভুত পেগান বা মূর্তীপূজক ধর্মগুলি টিকে আছে। তাও আজও সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০ ধর্ম টিকে আছে। এই  প্রচলিত বৃহৎ  প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্ম হিন্দু খ্রিস্টান ইসলাম ইহুদী সবাই  বলে তাদের নিজেদের  ঈশ্বর-গড-আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বরদের কোন সার্বজনিনতা নেই। সব ধর্মের প্রধান পুরুষ, কোন মহিলা নেই। এদের ঈশ্বর – গড – আল্লাহ  প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রত্যেকটি ধর্ম অপর ধর্মের ওপর আঘাত হেনেই বিকাশ লাভ করেছে এবং বারবার ধর্মের কারণে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে  হিন্দু বনাম বৌদ্ধ বা জৈনের লড়াই, শৈব শাক্ত বৈষ্ণবের লড়াই বাংলা দেখেছে  মধ্যযুগে এবং হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টানের লড়াইও দেখেছে, দেশভাগ দেখেছে ধর্মের কারণে, উদ্বাস্তু হওয়া দেখেছে ধর্মের কারণে।  রক্তাক্ত ক্রুসেড দেখেছে এশিয়ার ভূখন্ড ।

               চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। নিজেও প্রচণ্ড ধর্মভীরু ছিলেন এবং ভবিষ্যতে ধর্মযাজক হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন । কারণ ইংল্যান্ডে সেই সময় ধর্মজাজক হওয়া যথেষ্ট সম্মানের । কিন্তু জীব বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় জীব ও জীব সৃষ্টির জিজ্ঞাসা ডারউইনের কিশোর মনে ঝড় তুলেছিল প্রচন্ডভাবে। সেই ঝড়েই ডারউইনের জাহাজ বিগল গ্যালাপাগাস দ্বীপে অবতরণ করলো ১৮৩৫ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী। আগামী  ১২ই  ফেব্রুয়ারী ডারউইনের জন্মদ্দিন।  ডারউইনের চিন্তা ভাবনাকে যেন উসকে দিতেই এইদিন চিলির উপকূলে নোঙর করা অবস্থায় তাঁদের জাহাজ এইচ এম এস বিগল কেঁপে উঠলো প্রবল এক-ভূমিকম্পে! দুই মিনিটের সেই ভূমিকম্প শেষে ডারউইন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মহাবিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন উপকূলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় আট ফুট! তাহলে কি লায়েলের Principle of Geology’র কথাই ঠিক? সব পরিবর্তনই কি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা করা শক্তিগুলোর ফলাফল?

১৮৩১ সালে জাহাজে ওঠার আগে ডারউইনকে তাঁর শিক্ষক এবং একইসাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনেস্লো অপর এক প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক চার্লস লায়েলের লেখা Principle of Geology বইটি উপহার দেন। গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হেনেস্লো কড়াভাবে ডারউইনকে বলে দেন যেন ভুলেও লায়েলের লেখাগুলোকে বিশ্বাস না করেন! কিন্তু ডারউইন জাহাজে যেতে যেতে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখতে দেখতে গুরুর উপদেশ ভুলে গভীর সন্দেহে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন একের পর এক। কি ছিল লায়েলের সেই বইয়ে! লায়েল তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, “নূহের আমলের এক কথিত মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ভাগ রূপান্তরিত হয়নি। ভূভাগ বিবর্তনের অন্যতম কারণ হল বাতাস, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের মতন অসংখ্য ছোটবড় প্রাকৃতিক শক্তি। এগুলোই অতীত থেকে বর্তমান সময়ে ভূভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং আসছে।” গুরুর কথা ভুলে ডারউইন তাই মনোনিবেশ করলেন আশেপাশের ভূপ্রকৃতির উপর এবং আস্তে আস্তে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন লায়েলের সেই যুক্তিপূর্ণ রূপান্তরের মতবাদে। আর তার চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পেলেন।

এই ভূমিকম্প নিয়ে ভাবতে ভাবতেই যাত্রাপথে আবার জাহাজে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু একটি দ্বীপে। সেখানে দেখা গেল পাহাড়ের গায়ে এক রহস্যময় সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পরীক্ষা করে জানা গেল রহস্যের তেমন কিছুই নেই, শামুক ঝিনুকের খোলের চুনাপাথরের ক্ষয়ই এই লম্বা দাগের রহস্য। কিন্তু শামুক ঝিনুক এতো উঁচুতে এক পাহাড়ের গায়ে এলো কিভাবে? তাহলে কি একসময় সেই পাহাড় লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের জলের নিচে?

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি দেখা গেল গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে নামার পর। এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে দেখতে তরুণ ডারউইন দেখতে পেলেন বিভিন্ন প্রজাতির একগাদা ফিঞ্চ পাখি, যেগুলোকে আমরা ফিঙে নামে ডাকি। ডারউইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সবগুলোই ফিঞ্চ পাখি হলেও অবাক করা জিনিস হলো এদের খাবারের প্রকৃতি অনুযায়ী বদলে গেছে এদের গঠন। যেমন যেগুলো গাছে থাকে তারা খায় একরকম খাবার, যেগুলো মাটিতে থাকে তারা খায় আরেকরকমের খাবার। খাবারের ধরন অনুযায়ী সেই পাখিগুলোর আকৃতিও বিশেষ করে চঞ্চু আলাদা! তিনি এই বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই এদের ১৩টি প্রজাতির বর্ণনা দেন, দেখান প্রজাতির বৈচিত্র্য। এই ১৩টির পর বর্তমানে আর একটিসহ মোট ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই। এই পাখিদের দেখার পরেই তিনি প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই জীবের মাঝে একেকরকম বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ক্রমেই অভিযোজিত হয়ে তৈরি করে এক বা একাধিক নতুন প্রজাতি! সুতরাং প্রজাতি হল এমন কিছু জীবের সমষ্টি যারা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম। যেমন- আধুনিক মানুষ Homo sapiens sapiens প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন প্রজাতির সঙ্গে তারা কেউ প্রজনন করতে পারবে না!

ডারউইন আদতে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে যথেষ্ট দ্বিধা করেছেন। কেননা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন তাঁর দেওয়া মতবাদ কতটা বৈপ্লবিক। আরেক বিজ্ঞানী হুকারের কাছে লেখা চিঠিতে তাই তিনি লিখেছিলেন - নিজেকে তাঁর বড় একজন অপরাধী মনে হচ্ছে, তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন! তাই তত্ত্বের সত্যতা জেনেও কেবলমাত্র সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হতে তিনি আরও ২০ বছর ধরে গবেষণা করে লিখলেন জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বই- The origin and Species by means of Natural Selection!!

ডারউইনের তত্ত্ব যে ভুল নয় তার প্রমান আমরা দেখতে পাই অন্যপ্রাণীদের মতন মানুষেরও অসংখ্য প্রজাতি আবিষ্কৃত হওয়ায়। এগুলোর মধ্যে হোমিনিড গণের অন্তর্ভুক্ত হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেক্টাস-সহ অসংখ্য প্রজাতির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মতন আরও অন্য এক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ফসিল। অনেক গবেষণার পর দেখা গেছে একপ্রজাতির বনমানুষ বা এপদের সঙ্গে মিলে গেছে আমাদের ডিএনের প্রায় ৯৮.৬%! ডারউইনের সময় কার্বন ডেটিং-সহ অনেক পরীক্ষার সুব্যবস্থা না থাকলেও এটা এখন পরীক্ষিত গবেষণাধর্মী সত্য যে, ৪০-৮০ লক্ষ বছর আগে একধরণের জাতি দুইপায়ে ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তাদের থেকে বর্তমান আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুইলক্ষ বছর আগে। এপর্যন্ত একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি যেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সমর্থন করেনা। এমনকি মজার কথা হল ডারউইন পূর্ববর্তী সময়েও জর্জ বুফো, হাওয়ার, ওয়ালেস, উইঙ্গারসহ বেশকিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি স্থির নয়, চলমান বিবর্তনের ফসল। কিন্তু এরা বিবর্তনকে মেনে নিলেও সেটি কিভাবে ঘটে তা কেউই ডারউইনের আগে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের বহুল পঠিত Ancestor’s Tale বা আশির দশকে ড. টিএম বেড়ার লেখা Evolution and Myth of Creationism কোনোটিই ডারউইনের বিবর্তনবাদ অতিক্রম করেনি, বরং সমর্থন যুগিয়েছে বহুগুনে। ডকিন্স তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে এনেছেন বিবর্তনবাদের মৌলিকত্বকে। তিনি বারবার বলেছেন- এখন পর্যন্ত একটি ফসিলও ভুল জায়গায় আবিষ্কৃত হয়নি যেটি বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারে!

বিজ্ঞান গতিশীল, যে গতিশীলতা প্রজাতিগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। হাজার বছরের বিশ্বাসকে লালন করার নাম বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তার সত্যতা বা মিথ্যাচারকে সত্যের আলোকে উন্মোচন করাই বিজ্ঞানের কাজ।ডারউইনবাদ আর বিবর্তন এতটাই প্রমাণিত যে সেটি ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। 

হাজার হাজার বছর ধরে ঈশ্বর আশ্রিত ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে পারেননি  ডারউইন, বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা না করলে হয়তো যাজকই হতেন বা ধর্ম তত্ত্বের অধ্যাপক হতেন, আবার মন থেকে জীব সৃষ্টির  সেই ঈশ্বরের তত্ত্ব মেনে নিতেও পারেননি ডারউইন। হাজার হাজার বছর ধরে যে ধর্ম ঘিরে রয়েছে পৃথিবীকে (থুড়ি পৃথিবী বললে ভুল হবে এশিয়া-আরব-ইউরোপকে। কারণ আমেরিকা ওসেনিয়া মহাদেশের কথা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মগ্রন্থতে ছিলোনা। ১৫২৬ সালের আগে আমেরিকায় সভ্য মানুষের পদার্পন ঘটেনি। শেষ সংগঠিত ধর্ম ইসলামের জন্ম ৬০০ সাল নাগাদ। ডারউইন ধর্মের আলোকে জীবের সৃষ্টির  উত্তর পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলেন, কিন্তু অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লকের বিখ্যাত উক্তি “বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভব” আবার তাঁকে অশান্ত করে তুললো। সুযোগ পেলেন জীব বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার, চাপলেন বিগল নামের জাহাজে গ্যালাপাগাস দ্বীপে যাওয়ার জন্য। গ্যালাপাগাস দ্বীপে তিনি বিভিন্ন জীবজন্তুর সন্ধান পেলেন এবং হাজার  হাজার জীবাশ্মের সন্ধান পেলেন, প্রায় ২৫০০০ জীবাশ্ম পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। দীর্ঘদিন সেগুলি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এলেন জড় পদার্থ থেকেই জীবের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে  মানুষের উৎপত্তি। তিনি লিখলেন  “the origin of species by means of natural selection,of the preservation of favoured  races in the struggle for life”। এই বইটা বেরোনোর সাথে সাথে সংগঠিত ধর্মের বিকৃত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করলো। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, জিওনার্দো ব্রুনোর পর  ডারউইনের এই আঘাতে প্রবল  প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই  ছিল। ইংল্যান্ডের ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা তাঁকে নানানভাবে অপদস্থ করা থেকে  প্রাণে মারতেও  চাইলেন । শুধু প্রাণে মারতে পারেনি কারণ ডারউইনের সমর্থনে ঈংল্যান্ডের কিছু বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের মানুষ দাড়িয়েছিলেন। (আমাদের দেশের বিখ্যাত চিকিৎসক সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসা যখন  ব্রাহ্মণদের নেতা যাজ্ঞবল্ক বন্ধ করে দিলেন তখন কিন্তু তিনি  কারো সমর্থন পাননি, নয়তো ভারত আজ  চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেতো)  এদের মধ্যে  বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় টমাস হাক্সলি, শল্য চিকিৎসক ডাঃ ওয়েনের কথা। টমাস হাক্সলিকে ডারউইনের ডালকুত্তা নামেও  অভিহিত করা হয়।

দর্শনের যে মূল সঙ্ঘাত সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ডারউইন। ধর্মে জীব সৃষ্টিতে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ডারউইনের বইতে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বর  নেই আছে “প্রকৃতি ও পরিবেশ”। ঈশ্বরের ঠাঁই নেই সেখানে। সেসময়  ডারউইনকে কি পরিমাণ আক্রমণ  হজম করতে হয়েছিল নীলকন্ঠ হয়ে তা এখন  ভাবা যায় না। এই ধর্মান্ধ কীটেরা কি ভয়ানক তা আজ ভারত পাকিস্তান বাঙলাদেশের আমাদের মত উদ্বাস্তুরা  ও মুক্তমনারা জানে,  জানে অভিজিত রায় রাজিব ওয়াশিকর নাজিমুদ্দিন নিলয় বা আমাদের দেশের দাভালকার-পানেসর-কালবুর্গী-খলিল-গৌরি লঙ্কেশ। সারা আরবের সিরিয়া,জর্ডন, ইরাক, তুরস্কের উদবাস্তুরা জানে, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুরা জানে । 

এই সব উদ্বাস্তুদের  তথাকথিত কোন ঈশ্বর –আল্লাহ-গডেরা রক্ষা করেনা। আমেরিকাতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানোর জন্য শিক্ষকের শাস্তি হয়েছিল, যা মাঙ্কি ট্রায়াল নামে সারা পৃথিবীতে  খ্যাত। 

আমার মনে হয় পৃথিবীতে অনেক প্রখ্যাত পদার্থ বা রসায়ন  বৈজ্ঞানিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ  কাজ করেছেন, সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকদূর।কিন্তু বিজ্ঞানের কাজের প্রভাব বিজ্ঞান ছাড়িয়ে সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জগতকে সব থেকে আলোড়িত করেছিল চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ।ডারউইনের উপর সারা পৃথিবী জুড়ে সংগঠিত ধর্মের   একের পর এক আক্রমনই এর সব থেকে বড় প্রমাণ। একারণেই সংগঠিত ধর্ম কোনোদিনই ডারউইনকে পছন্দ করেনি বরং বিরোধীতা করে।

         সম্প্রতি  বাংলাদেশের ইসলামিক ধর্মগুরুরা বলেছেন বিজ্ঞান  পড়ান, কিন্তু বিবর্তন পড়ানো চলবেনা।  ওরা জানে বিবর্তন পড়ালে অন্য  ধর্মের সাথে ইসলামের আল্লাহ নিয়েও প্রশ্ন  উঠবে। আর কোরানেইতো বিবর্তন এর প্রমাণ আছে। আল্লাহর সৃষ্ট  প্রথম মানব আদম 60 হাত থেকে বর্তমানের   সর্বোচ্চ আট ফুট হয়ে যায়। এটাই তো বিবর্তন।  এটা মাদ্রাসার  হুজুরদের  বোঝানো যাবেনা।

ধর্ম ও বিজ্ঞান দ্বন্ধ -জাহিদ রুদ্র
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:25 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিশ্বের কোনও ধর্মীয় নেতা বিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করেন না কারণ বিজ্ঞান প্রকৃতির চিরন্তন সত্য এবং যা ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত ধর্মীয় ব্যবসাকে ধ্বংস করবে। ধর্ম মানুষ চাইলেই পরিবর্তন করতে পারে বা চাইলে নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে পারে এবং নতুন নাম দিয়ে নতুন ঈশ্বর তৈরি করতে পারে। কেউ তার ধর্মে দীক্ষিত হোক বা না হোক সেটা অন্য বিষয়। আপনার পরিবার যদি তা পালন করতে থাকে, তবুও হাজার বছর পর সেই ধর্ম পালনকারীর সংখ্যা হাজারের মধ্যে হতে পারে। ধর্ম এবং ঈশ্বর (ঈশ্বর) যেমন বিভিন্ন মানুষের জন্য আলাদা হতে পারে, তেমনি বিজ্ঞান শুধু পৃথিবীতে নয়, মহাবিশ্বের সর্বত্র একই, কারণ বিজ্ঞান চিরন্তন সত্য।


বিজ্ঞানের নিয়মসমূহ (Laws of Nature) ব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে থেকেই ছিল। আসলে, প্রকৃতির নিয়মই হল বিজ্ঞান। প্ৰকৃতির নিয়ম অৰ্থাৎ আমাদের মহাবিশ্ব ১৩৭০ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং-এ গঠিত হয়েছিল বিজ্ঞানের নিয়মে। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ প্ৰবাহ, চুম্বকত্ব, মাধ্যকৰ্ষণিক বল ইত্যাদি হতে আরও অন্যান্য বহু নিয়ম (Laws of Nature) -এর ফলে কঠিন, তরল এবং বায়বীয় পদার্থের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এগুলো সবই প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রকৃতির উপরোক্ত নিয়মের সাহায্যে, মানুষ আজ আরামে বসবাসের জন্য বিভিন্ন মেশিন, যানবাহন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর তৈরি করতে সক্ষম। প্রকৃতি যদি ইচ্ছামত উপরোক্ত আইন পরিবর্তন করতে পারত, তাহলে আমরা অনেক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হই, অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই উপরোক্ত আইন পরিবর্তন করতে পারবে না। যদি প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে কোনও এক সময়ে আমাদের মহাবিশ্বের যে কোনও গ্রহে জ্বালানিচালিত যানবাহন যেখানে থাকবে সেখানেই থাকবে, যদি তারা গরম হয়ে গেলে পদার্থের আয়তন না বাড়ায়। একইভাবে বিদ্যুতের নিয়ম পরিবর্তন করা হলে মহাবিশ্বের যে কোনও স্থানে থাকা বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলো অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে প্রকৃতির নিয়ম এভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। পদাৰ্থের ভর অনুযায়ী মাধ্যকৰ্ষণিক বল থাকে। পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির আগে থেকেই এগুলো আমাদের মহাবিশ্বে ছিল, আজও আছে এবং মানুষ হারিয়ে গেলেও ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই বিজ্ঞান চিরন্তন সত্য। কিন্তু ধর্মগুলো মানবসৃষ্ট। এই ধর্মগুলোর সত্যতার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। খ্রিস্টান সম্প্রদায় কোপার্নিকাস, ব্রুনো এবং গ্যালিলিওর বিবৃতিতে "পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসাবে" সম্পর্কে বাইবেলের ভুল বর্ণনাকে সংশোধন করে যে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়।


ধর্মের অসত্যটা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরলেই কেউ ধর্ম বিদ্বেষী হয়ে যায় না। ঈশ্বর একটি কাল্পনিক শব্দ, ঈশ্বর নামে কিছু থাকলে এতদিনে প্রমাণিত হতে কি বাকি থাকত? না নিশ্চয় বাকি থাকত না। এককথায় স্ক্রিজোফোনিয়াতে আক্রান্ত মানুষরাই দৈববাণী শুনতে পারে আর তাদের কল্যাণেই পৃথিবীতে গড়ে উঠে ঈশ্বর ও ধর্ম।


ধর্ম বিশ্বাসী আবেগী ধার্মিকগণ সচরাচর মানবিক আচরণের সকল সংজ্ঞার সমীকরণ ধর্মের বাণী দিয়ে ব্যাখ্যা করে ছক্কা মেরে বসেন, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও একটি বারের জন্যে চিন্তা করে দেখেন না যে পৃথিবীতে হাজার হাজার ধর্মের জন্ম হয়েছে আবার তা সময়ের গহ্বরে হারিয়েও গেছে। যে ধর্মগুলো আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এখনও ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে, যেখানে সকল ধরনের মধ্যযুগীয় আচার, নিয়ম-কানুন দিয়ে সেই সব ধর্মগ্রন্থগুলো পরিপূর্ণ, হাস্যকর বিষয় হচ্ছে আবেগী ধার্মিকগণ সেই সব অমানবিক আচার, নিয়ম-কানুনগুলোকে বৈজ্ঞানিক আবরণ লাগাতে উঠে পড়ে লেগেছেন।


ডারউইনের বিবর্তনবাদ, সৌরজগতের সূর্যকেন্দ্রিক মডেল, এবং বিগ ব্যাং। এইসব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, যুক্তি প্রমাণ ও ব্যাখ্যা ধর্ম দ্বারা প্রতিরোধ করা চেষ্টা করা হয়েছে ও হচ্ছে। বিজ্ঞান এবং নাস্তিকতার উত্থানকে রেনেসাঁ নামে দ্রুত সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের সময়কে দায়ী করা যেতে পারে যা প্রায় পাঁচশত বছর আগে ইউরোপে শুরু হয়েছিল। এই রেনেসাঁ পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলিকে বিশ্বে আধিপত্যের দিকে পরিচালিত করে। উদার, বুদ্ধিজীবী এবং নাস্তিক মনোভাবগুলিকে দিন দিন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। অনেক ধর্মীয় নেতা এই মূল্যবোধগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেউ কেউ বিজ্ঞানের সাথে বৃহত্তর চুক্তির জন্য ধর্মগ্রন্থের পুনর্ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন বা এই ব্যাখ্যাগুলোকে নিজেদের মনের মাধুরী দিয়ে সাজাবার চেষ্টা করেছেন। 


বিজ্ঞানের প্রমাণ ও যুক্তি বিশ্ব ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের অসামঞ্জস্যের দিক তুলে ধরেছিল, ফলে যেখানে যারা পরিবর্তন করতে অনিচ্ছুক তারা নিজেদেরকে সংস্কারকদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। ফলস্বরূপ, পুরানো ধর্মগুলি নতুন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে, প্রত্যেকেরই ঐতিহ্যগত বিশ্বাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিতে থাকে। উদাহরণসরূপ বলা যায় যে অনেক আবেগী ধার্মিকগণ ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিগ ব্যাং খোঁজার চেষ্টা করছেন, চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার লেখা হয়েছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে জোয়ার-ভাঁটার যে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল সে বিষয়ে কেনই বা বিন্দুমাত্র কিছুই লেখা হলো না? এভাবে গোঁজামিল দিয়ে লেখার কারণটাই বা কি? বা আরও বলা যায়, যদি মহাবিশ্ব একটি বিস্ফোরণ দিয়ে শুরু হয় তবে কেউ দাবি করতেই পারেন যে ঈশ্বর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, যদিও ধর্মগ্রন্থে এসব কোথাও লেখা নেই। যদি ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া যায় তাহলে ঈশ্বর আমাদের বিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য সেগুলো সেখানে রেখেছেন বলে অনেকেই দাবি করতেই পারেন তবে ধর্মগ্রন্থে এসব কোথাও লেখা নেই বা থাকে না, কারণ যিনি ধর্মগ্রন্থগুলোকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এনেছেন তিনি হয়তো গ্রন্থের কিছু পাতা ভুল করে ঈশ্বরের টেবিলে ফেলে এসেছেন। এসব প্রশ্ন মনের মাঝে উদয় হলে কি নরকের আগুনে পুড়তে হবে? যদি পৃথিবী কোটি কোটি বছর পুরানো হয়, তাহলে জেনেসিসের গল্পে একটি দিন শত কোটি বছরের সমান। এগুলি বাইবেলের প্রকৃত ব্যাখ্যা যা বিজ্ঞান দ্বারা জোরপূর্বক অস্তিত্বের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। সক্রেটিস যেমন অনুমান করেছিলেন, এটি অনুসন্ধানী মনের শূন্যতা যা আমাদের সত্যের দিকে চালিত করে। এবং এমনকি যদি একটি ধর্ম নিরঙ্কুশ সত্যের উপর আঘাত করে, তবে এই সত্যটি জানে এমন গোঁড়া ধারণা সর্বদা একই দাবি করা অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করবে। এই কারণেই ধর্ম সংঘর্ষের জন্ম দেয় এবং যে কোনও ধরনের বিশ্বাসের ক্ষতি হয়।


।২।

প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বর কি গণিতের উত্তর পরিবর্তন করতে পারেন? না, পারেন না। প্রকৃতির সব চিরন্তন সত্য গণিতের নিয়ম অনুসারেই ঘটছে। আমরা তাপ এবং আলো পাই কারণ হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি সূর্যের কেন্দ্রে উচ্চ মাধ্যাকর্ষণ চাপের অধীনে হিলিয়াম পরমাণুতে ফিউজ করে, শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ তৈরি করে যা পুরো সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা হল চলমান বিদ্যুতের ভাণ্ডার। আমাদের সূর্য-আকারের নক্ষত্রগুলির একটি আলোক-দানকারী জীবনকাল সাধারণত ১ বিলিয়ন বছর থাকে, যার অর্থ হল যে যতক্ষণ পারমাণবিক ফিউশন চলতে থাকে ততক্ষণ আলো এবং তাপ বিকিরণ চলতে থাকে। মহাকর্ষ বল (Mass) বস্তুর ভর দ্বারা নির্ধারিত হয়। ভর যত বেশি, মহাকর্ষ বল তত বেশি। পদার্থ নিজেই গ্রাভিটন (Graviton) নামক একটি কণা নির্গত করে যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তৈরি করে। কোন ঈশ্বর ১ কেজি ভরের বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ২ কেজি ভরের বস্তুর চেয়ে বেশি করতে পারেন না। এটাই গণিতের সত্য। বৃহস্পতি গ্রহ পৃথিবীর তুলনায় ১১ গুণ প্রশস্ত এবং তিনশো গুণ বেশি বড় এবং এর মাধ্যাকর্ষণ ১০ গুণ বেশি। সমান উচ্চতা থেকে পতিত একটা নুড়ি ১ কেজি বলে (ত্বরণ ৯.৮১কেজি.মিটার / সেকেন্ড বর্গ) পৃথিবীতে আঘাত করলে তা ১০ কেজি (ত্বরণ ১০×৯.৮১ কেজি. মিটার/সেকেন্ড বর্গ) শক্তি নিয়ে বৃহস্পতি গ্রহে আঘাত করবে। সবচেয়ে বড় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্ল্যাকহোলে ঘটে, যা পাশ দিয়ে যাওয়া আলোকে আকর্ষণ ও শোষণ করতে পারে।


আমাদের তারকামণ্ডল কেন্দ্রে একটি বিশাল Supermassive Black hole রয়েছে ৪ মিলিয়ন সূর্যের ভর যাকে বিজ্ঞানীরা Sagittarius A নাম দিয়েছেন। সৌরজগৎ সহ তারকামণ্ডল সমস্ত পদার্থ এটিকে ঘিরে ঘোরে। এই ঘটনাগুলিও গণিত দ্বারা নির্ধারিত হয়। মহাকর্ষের কারণে গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষও হয়। যখন তারার কেন্দ্রে হাইড্রোজেন ফিউজ হয়, হিলিয়াম পরমাণুগুলি কার্বন পরমাণুতে ফিউজ হয় এবং তারপরে কার্বন পরমাণুগুলি লোহার পরমাণুতে ফিউজ হয়। এইভাবে, একটি নক্ষত্রের কেন্দ্রে ভারী পরমাণু জমা হওয়ার ফলে একটি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বল তৈরি হয় যা সূর্যের চেয়ে ৮/৯ গুণ বড় একটি নক্ষত্রকে একবারে বিস্ফোরিত করতে পারে এবং তীব্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ এবং খুব শক্তিশালী Gamma ray, X- ray সহ পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে এবং Nebulae মেঘ তৈরি হয়। এই বিস্ফোরণকে Supernova বলা হয়। 


Nebulae মেঘগুলিও ছোট তারা গঠন করতে পারে। এইভাবে তারার Supernova র জন্য গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, গ্রহাণু এবং উল্কা ইত্যাদি উৎপত্তি হয়। সেইজন্য গ্ৰহ, উপগ্ৰহ, ধুমকেতু, Asteroid, উল্কা আদি উৎপত্তি হয়। অৰ্থাৎ আমরা সকলই মৃত তারার অংশ। তাই আমাদের ব্ৰহ্মাণ্ডের সকল শক্তিই মাধ্যকৰ্ষণ বল এবং পরমাণুতে থাকা বিদ্যুৎ চুম্বকত্বের থেকে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়া কোনও ঈশ্বর, আল্লাহ বা গডের সৃষ্টি করা নয়। শক্তি রূপান্তরের এই প্ৰক্ৰিয়া কোনও কাল্পনিক ঈশ্বর, আল্লাহ, এমনকি গড এটি পরিবর্তন করতে পারে না। সবকিছুই গণিতীয় (Mathematical) সম্বন্ধমতে চলে। আমাদের পৃথিবীতে সৃষ্টি হওয়া বাতাস, ঝড়, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ, সাগরীয় স্রোতের মাধ্যকৰ্ষণ বল, তাপের প্ৰভাবে হয়। এগুলো প্রত্যেকটা একে অপরের সঙ্গে গাণিতিক মেলবন্ধনে যুক্ত। এই গণিত কোনও কাল্পনিক ঈশ্বর আল্লাহ বা গড এটা পরিবর্তন করতে পারবেন না।


।৩।

অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ মতে, জীবের আত্মা থাকে বুকে। কিন্তু বিজ্ঞান মতে একটা জীব চালিত হয় মগজ দ্বারা। প্রথায় সকল জীবের দেহে কম বেশি বিদ্যুৎ থাকে। এর মধ্যে সবথেকে বেশি থাকে ইলেক্ট্রিক ফিসের (Electric Fish)। একটি পূর্ণবয়স্ক বৈদ্যুতিক ইল মাত্র ২ মিলি সেকেন্ড ৬০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা আমাদের বাসা বাড়িতে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। জানা যায় ৬০০ থেকে ৮৬০ ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদন করতে ৬ ফুট লম্বা ইল ৬০০০ পেশী কোষকে ব্যবহার করে।


 আমাদের মগজ এবং কলিজার পাম্পটা বৈদ্যুতিক পালস (Pulse) র সহায়ত কাজ করে। জীবের মগজ Electric circuit একটা কম্পিউটার থেকেও বহু গুণ জটিল। মগজ দেহের বিভিন্ন অংশে নিৰ্দেশনা বৈদ্যুতিক পালসের দ্বারাই দিয়ে থাকে। তাই একটা জীব চালিত হয় তার মগজ দ্বারাই। আমাদের কলিজার পাম্পের কাৰ্যক্ষমতা যদি হ্ৰাস পায়, চিকিৎসক বেটারিযুক্ত Space maker লাগিয়ে দেন। সেই জন্য আত্মা বলে যে বস্তু সেটা বুকের মধ্যে থাকে না। জীবের আত্মা যদি বলতেই হয় তবে মগজকে ধরে নিতে হবে। ডলফিন মাছ আমাদের চিকিৎসা বিভাগে ব্যবহৃত Ultra sonography থেকে শক্তিশালী Sonography waves ব্যবহার করে গর্তের ভেতর লুকিয়ে থাকা শিকার খুঁজে ধরে খেয়ে থাকে।


বিজ্ঞানে কোনও সৰ্বজ্ঞ নেই। অৰ্থাৎ বিজ্ঞানে কোনও গুরু, মাসিমা বা নবী রসূল নেই। কোনও একজন যদি সূত্ৰ আবিষ্কার করে যাওয়া জ্ঞান নিয়ে আরও একধাপ অগ্রসর হোন, এইভাবে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন বিষয়ে আবিষ্কার করা ব্ৰহ্মাণ্ডের চিরসত্য কথাগুলো রিসার্চ করে করে বিজ্ঞান চৰ্চা আজকের এই অবস্থায় আসতে পেরেছে। বিজ্ঞানে কোনও হিন্দু বিজ্ঞান, মুসলমান বিজ্ঞান বলে শ্ৰেণীবিভাজন থাকে না কারণ ইহা চিরসত্য কথা। একটা গণিতের শুদ্ধ উত্তর এটাই আসবে কিন্তু সেই গণিতের অশুদ্ধ উত্তর যে কোনও অৰ্থাৎ লাখো হাজার সংখ্যা দেওয়া যাবে। 


ধৰ্ম এবং বিজ্ঞানের এখানেই পাৰ্থক্য। প্ৰত্যেক ধৰ্মে নিজের ধর্মকেই শ্ৰেষ্ঠ বলে দাবি করেন সকল ধৰ্মগুরুরা। ধৰ্মগুরুকে যদি আপনি প্ৰশ্ন করেন কেন এভাবে হবে, তখনই গুরু রেগে অগ্নিশর্মা। কারণ ধৰ্মে গুরুর বাণীই হল চিরন্তন সত্য কথা। কিন্তু বিজ্ঞানে সব কিছু নিজে পরীক্ষা করে সত্য নিরূপণ হওয়া কথাগুলোই গ্ৰহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্ৰীধারী একজন লোক অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারার হতে পারে অন্যদিকে যে ব্যক্তি কোনওদিন স্কুলে যায় না সেও বৈজ্ঞানিক মানসিকতার একজন ব্যক্তি হতে পারে। উল্লেখ্য যে মানুষ ছাড়া মহাবিশ্বের প্রায় সব প্রাণীই বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা নিয়ে বাস করে তারা তাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে যে কোনও পরিবেশ বা বস্তু অধ্যয়ন করে এবং পদক্ষেপ নেয়।


সমাজ সংস্কারক কাজ করতে হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নিজের মত প্রকাশ করতে হবে, কেউ মানুক বা না মানুক। আমার মত মূলত নারীর সমানাধিকারের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে। পৃথিবীকে আমাদের সন্ত্রাসমুক্ত এবং বাসযোগ্য করা ছাড়া উপায় নেই। সবার মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সবার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া উপায় নেই। জীবনের শেষ শ্বাসটুকু পর্যন্ত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে ডুবে মরতে দেখা কি আর সহ্য করা যায়! পৃথিবীতে যত সরকার আছে, সবারই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্কতা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ধর্মান্ধতা মানুষকে বাঁচায় না, বাঁচায় বিজ্ঞান, বাঁচায় যুক্তিবুদ্ধি।

অলৌকিক নয়, লৌকিক -মহম্মদ মহসীন
Nov. 26, 2024 | যুক্তিবাদ | views:297 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের চারিপার্শ্বের সব ঘটনাই লৌকিক, বাস্তবিক। অলৌকিক বলে কিছু হয় না, সবই লৌকিক। যৌক্তিক মননশীলতাতেই এটির স্বরূপ আমাদের মাঝে স্থাপিত হতে পারে।


   আজ পর্যন্ত একজনকেও পেলাম না, যিনি নিজেকে ভাবেন ধর্মান্ধ। 

প্রত্যেকে মনে করেন, অন্যে ধর্মান্ধ, অন্যে যুক্তিবাদের কিছু বোঝেন না, অন্যে স্বার্থপর। তিনি কিন্তু যুক্তির পরাকাষ্ঠা। যুক্তিবাদের ধারক বাহক। তিনি সংস্কারহীন, ধর্মান্ধতামুক্ত, সৎপথের অনুসরণকারী। 


  তিনি যে যুক্তিবাদী, তার প্রমাণ তিনি কুসংস্কার মানেন না। কুসংস্কার কাকে বলে? ঐ যে পরীক্ষার দিনে ডিম খেতে নেই। এর তিনি যুক্তিসম্মত কারণ আবিষ্কার করেছেন। 

 আবার আরেক ধরণের যুক্তিবাদী আছেন, তারা ডিম খেয়েও দেখেন, যে তাতে  না কি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছেন। যুক্তিবাদী এসব বালখিল্য পরীক্ষা করতে যাবেন?

 একজন ভাবলেন যে সাপে কাটলে ওঝার মন্ত্র তন্ত্রে কোনো কাজ হয় না। সাপে কাটা রোগী তার হাতে মারা পড়ল। কাজেই ওঝার কাছে যাওয়াটা কুসংস্কার। 

 

ভাল কথা,  এবার  চিন্তা করুন। 

 কাউকে সাপে কাটলো, তাকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, কোনো কারণে, হতে পারে বিষহীন কামড় বা কামড়েও বিষ না ঢালা প্রভৃতি কারণে, বেঁচেও গেল। তাহলে কি ওঝাগিরি সায়েন্টিফিক হয়ে গেল? যুক্তিবাদে স্বীকৃতি পেয়ে গেল? সেইরকম, ডিমভক্ষণেও পরীক্ষালব্ধ ফল ভাল হলে ডিমভক্ষণও তো সায়েন্টিফিক হয়ে গেল, তাই না? এই যুক্তিতে ডিম খেয়ে পরীক্ষা  দিতে গিয়ে ফেল করলে, ডিম না খেয়ে  যাওয়ার প্র‍্যাক্টিসও তো তাহলে বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যায়, তাই না?

 আসলে যুক্তিবাদের কতকগুলি উপাত্ত আছে। যেগুলির একদিক বিচার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।  সত্যে উপনীত হতে গেলে তার বিপরীত প্রান্তেও দৃষ্টিনিক্ষেপিত করার প্রয়োজন হয়। বলা ভাল, তার চারিদিক দেখতে হয়।  

  র‍্যাশান্যালিজম যেমন মানুষপ্রাণীর ধর্ম, 

এ্যাণ্টির‍্যাশান্যালিজমও তেমনি মানুষপ্রাণীর মধ্যেই  দেখা যায়। এজন্যই মানুষের মাঝে ধর্মপ্রাণদের অনেকে যুক্তিবাদী বলে মনে করেন। ভূতে অবিশ্বাসীদের যেমন যুক্তিবাদী ভাবা হয়, ভগবানে বিশ্বাসীদেরও তেমনই যুক্তিবাদী বলে স্বচ্ছন্দে মেনে নেওয়া হয়। অন্ধবিশ্বাসের মুখোশ হলো এ্যান্টির‍্যাশান্যালিজম যা অনেক সময়েই যুক্তিবাদের ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করে।

  যুগ যুগ ধরে ধর্মগুরুদের  মিথ্যাচার সমাজে অসত্যকে সত্যের প্রতিষ্ঠা দেয়।

 একটা উদাহরণ দিলে, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতে পারে। যেভাবেই হোক, একজন বিশেষ প্রতিষ্ঠা পেলেই, তার সমস্ত কাজের ভিত্তিতে যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করার লোকের অভাব হয় না। এমনকি তার কাজের সমর্থনের পিছনে অলৌকিক কিছু ঘটনার অবতারণা করা হলেও শিক্ষিত সমাজে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরিবর্তে সমাদৃত হতে দেখা যায়, অথচ এই পৃথিবীর নিয়ম হলো অলৌকিক কিছু হয় না। এ জগতে অলৌকিকতার কোনো স্থান নেই। সমস্তই লৌকিক। একজন ধর্মগুরু প্রৌঢ় বয়সে বিয়ে করতে চান একটি বালিকাকে। এজন্য তিনি জানান এটি স্বয়ং ঈশ্বরের নির্দেশ। সমস্ত লোক তাকে সমর্থন করলেও, তিনি নিজে তো জানেন, কতবড় মিথ্যার আশ্রয় তিনি নিয়েছেন। তার অনুসরনকারীরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁকে দেখে অথচ তিনি নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে,  মানুষের সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে এইরকম মিথ্যাচার করতে পারতেন না। গুরু নিরীশ্বরবাদী হলেও  শিষ্যরা কিন্তু ঈশ্বরে পুরোমাত্রায় বিশ্বাসী। 

 আসলে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের যাপন ঘটে চলে অষ্টপ্রহর। এর শিকড় আষ্টেপৃষ্ঠে জমাট বাঁধে ব্যক্তিমনে, জীবনে, জীবনশৈলীতে। তার থেকে বেরোনোর কথা তার মননে আসতেই পারে না। তখন তার এই মেকি মূল্যায়ণের সমর্থন খোঁজে তার ধর্মাদর্শে, তার ধর্মগ্রন্থে, ঠিক যেখানে শুরু তার ধর্ম প্রণেতার মিথ্যাচার, বৃত্ত যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, বর্তমান উপস্থিত হয় ঠিক সেই বিন্দুতেই। এজন্য সমস্ত ধর্মের গ্রন্থেই মিথ্যাচার, অজ্ঞানতা,  অনিষ্ঠা, অনীতিগুলি নির্মিত হলেও ধরা পড়ে না ভক্তের ভক্তিভিত্তিতে বেড়ে ওঠা জীবনাদর্শে। কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত, এই যুক্তি-অন্ধত্ব সকলের মধ্যেই প্রকট। এই অন্ধকার ভেদ করে আলো আসতে দেরী আছে। অনেক দেরী আছে।

 কাজেই এই সময়কে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনতে হলে, আমাদের জোর দিতে হবে মানুষের মন থেকে অলৌকিকতাবাদকে দূর করার কাজে। অলৌকিক যেখানেই খবর পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটতে হবে।

 

সম্প্রতি আমি খবর পেলাম হুগলী জেলার প্রান্তে জিরাট কবুরা গ্রামে একটি ঝিল আছে, যেখানে না কি সন্ধ্যার পর পাম্পসেট চালানো যায় না। এমনকি দিনের বেলা চালিয়ে দিলেও সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পাম্পসেটটি বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনিই। তো আমি আর কী করতে পারি, তাকে বললাম, আপনি নিজে দেখেছেন? উনি জানালেন, না উনি দেখেননি। এমনকি প্রত্যক্ষদ্রষ্টা কারুর নামও জানাতে পারলেন না। শেষে উনি নিজেই উপলব্ধি করলেন, এতদিন ঠিকমত খবর না নিয়ে উড়ো কথায় বিশ্বাস করে ভ্রান্ত ধারণায় ছিলেন। পাম্পসেট বন্ধ কেন হবে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আন্দাজ করতে পারলেন না। অলৌকিক উপায়ে হয়তো হতে পারে বলেই তার ধারণা। এবার অনুরোধ করলাম, তাহলে যারা দাবী করেন তাদের কাউকে আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বলুন। শত প্রচেষ্টাতেও একজনকেও পাওয়া গেল না, যিনি এই চ্যালেঞ্জ নিতে চান। অর্থাৎ এতদিন শোনা কথা শুনেই এসব অলৌকিকে বিশ্বাস করছিলেন তারা, কিন্তু চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কথা উঠতেই কেউ রাজী হলেন না,  কারণ তারা আসলে কেউই দেখেননি, শুধুমাত্র শুনেই বিশ্বাস করেছেন, যাচাই করে দেখেননি। বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা কথা উঠতেই স্বীকারই করে নিলেন, অমন আবার হয় না কি? হয়তো  কোনো কারণে কারুর পাম্পসেট কোনো একবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার ভয়, তার অন্ধবিশ্বাস থেকেই গুজব রটেছিল, না যাচাই করেই এতদিন তারাও সেকথাই বলে চলছিলেন, আজ বুঝলেন এমন ঘটনার দাবী করাটা ঠিক নয়। এর কোনো বাস্তব ভিত্তিই নেই। 

  আমাদের যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রসারের কার্যধারায় তাই অলৌকিকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাটাই প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেখানেই অলৌকিক কিছুর কথা জানা যাবে, বুঝিয়ে দিতে হবে এগুলো গুজবমাত্র, সত্য ভিত্তি নেই। চ্যালেঞ্জ নিতে বললেই তাদের উপলব্ধিতে আত্মীকৃত হবে যে আসলে অলৌকিক বলে কিছু হয় না। অলৌকিক ছিল না, অলৌকিক থাকবেও না। ধর্মগুরুদের অলৌকিক কাজগুলি আসলে কৌশলের আশ্রয়ে বাস্তব কোনো উপায়েই সম্পাদন করা। অর্থাৎ প্রতিটি অলৌকিক কাজের পিছনেই আছে লৌকিক প্রকৌশল, বাস্তব কারণ, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় তার স্বরূপ অনুধাবন করাটাই একমাত্র সঠিক পথ।


  যুক্তিবাদী আন্দোলনে তাই অলৌকিকতাবাদকে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, ঘটনাগুলি যেখানে যেখানে করে দেখানো সম্ভব, সেখানে সেখানে লৌকিক উপায়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াই পথ।

 যুক্তিবাদের তাই নীতি: অলৌকিক নয়, লৌকিক।

বইমেলা -অশোক দাস চার্বাক
Nov. 26, 2024 | সমাজ | views:881 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাবাগাধা - ছি ছি ছি!! তুই কিনা গাধার ব্যাটা হয়ে এ কথা বললি মুখ ফুটে? জিভে আটকাল না একটুও! ছি! কোনও গাধাকে কোনও যুগে কেউ বইমেলায় যেতে দেখেছে, না কোনও গাধাকে কেউ বই চিবোতে দেখেছে। গাধা জাতের নাম ডোবাবি দেখছি আহাম্মক গর্ধব কোথাকার। এর পরে তো অল্পবয়সী তোর গাধা বন্ধুরা 'হাঁদাগাধারাম' বলে তোকে ৱ্যাগিং করবে। হাঁট-হাঁট, নইলে এক্ষুনি মধু ধোপার চাবুক খাবি। 


ছেলেগাধা - কেন বাবা, গাধারা বইমেলায় যায় না কেন?

বাবা- দরকারই হয় না। গাধারা হচ্ছে সবজান্তা। গাধাদের 'ব্যাদে' সব লেখা আছে। গাধাদের সে গর্ধববেদ পড়তেও হয় না কখনও। মেঘনাদ সাহা নিজে এ সার্টিফিকেট দিয়েছেন সব জন্মসিদ্ধ গাধাদের। গাধারা হচ্ছে ভূ-ভারতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণী। বামুনদের মত ভগবান ব্রহ্মার মাথার ঘিলু থেকে তাদের জন্ম।  পরশ্রীকাতর নিম্ন প্রজাতির  মানুষরা লজ্জায় তা স্বীকার করে না বটে, তবে আমাদের প্রাচীন জন্মসিদ্ধ সাধুসন্ত মুনিঋষিরা এ কথা বলে গেছেন। আর আমাদের বাপ ঠাকুরদা চোদ্দোপুরুষেরা বংশ পরম্পরায় এ 

সনাতন কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছে। গাধাদের শাস্ত্রবাক্য, গাধামুনি ঋষিদের বেদবাক্য তো আর মিথ্যে হতে পারেনা। অনর্থক বই পড়ে নতুন জ্ঞান অর্জন করা যে কতটা নিরর্থক সেটা সব গাধারাই জানে। 


ইচ্ছে হলে অন্য যে কোনও মেলায় যা। কোনও ভদ্রলোক গাধা ও নিয়ে কিচ্ছু বলবে না। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপে পৌষমেলায় যা। সেখানে নরম নরম কচি কচি ঘাস দিয়ে তৈরী থালা, বাটি, ঠাকুরদেবতার পুতুল পশু প্রাণীদের আদলে তৈরী নানা আর্ট ওয়ার্ক চিবিয়ে চিবিয়ে খা। গরম গরম জিলিপি খা। বুঝিস বা না বুঝিস, মাইকে রবীন্দ্র সংগীত শুনে হিন্দী গানে নাচতে নাচতে বড় মুখ করে বাড়ি ফের। নিজেকে বেশ ইন্টেলেকচুয়াল গাধা মনে হবে। 


বন্ধুদের কাছে বড় মুখ করে বলতে পারবি রবীন্দ্রতীর্থ ভ্রমণের উপাখ্যান। সে পুণ্যে মরার আগেই তোর আত্মার শান্তি হয়ে যাবে। মহাপাপীর ছেলেদের মত বিজ্ঞাপন দিয়ে আত্মার শান্তিকামনা করতে হবে না। বোকা শ্রাদ্ধশান্তিও করতে হবে না পুরুত ডেকে। শিল্পমেলায় যা-বাহারি দু’একটা ভোগবিলাসের জিনিস কিনে মনে আনন্দ পাবি। জিনিসগুলোর জন্য তোর গর্ব আর পড়শীর ঈর্ষা হবে। বড় সুখ হবে তোর মনে। খাদ্য মেলায়ও যেতে পারিস। সেখানে নানা দেশের ঘাস বিচালি খেয়ে আস্তাবলে শুয়ে শুয়ে জাবর কাট মনের সুখে। অপার আনন্দ পাবি মনে। ঋণ মেলায় ব্যাংকের টাকা ধার করে শোধ না দেবার মতলব কর। দাদা দিদি নেতা মন্ত্রীদের কাটমানি দিয়ে হাতে রাখতে পারলে কেউ তোর টিকি ছুঁতে পারবে না। টাকা চুরির অনাবিল আনন্দ পাবি মনে। বিবাহ  মেলায়ও যেতে আপত্তি নেই। মনের মত একটা ইউজ এন্ড থ্রো বউ ধরে নিয়ে আয় ওখান থেকে। সারাজীবন না হোক বছরখানেক until the day of divorce বেশ ফুর্তি করতে পারবি।  সাগর মেলায়ও যেতে পারিস।  সেখানকার নোনতা জলে গোলা দৈব ডিটারজেন্টে বছরভর করা সব পাপ কেচে কুচে সাফসুতরো করিয়ে আয়। আহা, মুখ শুকনো করছিস কেন? পাপের ফল, মানে ঐ কালো টাকা-ফাকাতো আর সাগরজলে ধুয়ে যাবে না। শুধু পাপটুকু। ওগুলো গা থেকে মুছে আবার নবোদ্যমে বিধবা লতাপিসির বাগানের শাকসবজি খেয়ে পাপ করা শুরু করে চালিয়ে যা পরের পুণ্যস্নান পর্যন্ত। সাধুসাজা চতুর মানুষেরাও এসব পুণ্যকর্ম করে। কেউ এ জন্য গালমন্দ করে না। দু’একজন বোকা গাধা ছাড়া সব বুদ্ধিমান কৃতী গাধারাই সে সব পাপ করে পেট মোটা করে। 

             

যে কোনও মেলা থেকে ফেরার পথে মনে একটা অনাবিল আনন্দ পাবি। কিন্তু বইমেলা! দূর দূর দূর! দু-চারখানা সস্তা বই, কিছু লিটল ম্যাগ আর ব্যাগভর্তি ক্যাটালগ নিয়ে যখন মেলার গেট পেরিয়ে বাইরে আসবি, তখন তোর মন একেবারে শুকনো মরুভূমি হয়ে যাবে। আত্মা পাথর। তখন শুধু মনে হবে মেলায় কত্তো বই আর ট্যাঙ্কের টাকা কত কম। মোট বওয়ার ফাঁকে মেলায় গেলা বইগুলো জাবর কাটার সময় মনে হবে - হায় আমি কত কম জানি।  অন্য মেলায় গিয়ে পেটভরে, মনও ভরে। আর এ মেলায় পাবি শুধু দুঃখের সমুদ্র। এখানকার ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। বইয়ের খিদে কখনো মেটে না। যত কিনবি তত কিনতে ইচ্ছে করবে।  কেঁদে কেটে কুল পাবি না একেবারে।  


গুরুজনেরা বলেন বড় সাংঘাতিক দ্রব্য ঐ বই। সর্বদুঃখের কারণ। পশুপ্রাণীদের মানুষই সবচেয়ে দুঃখী। কেন জানিস? বই, মানে যাকে বলে গিয়ানের খনি। সেই জ্ঞানবৃক্ষে ঝুলে থাকা নিষিদ্ধ ফলগুলো যেদিন হতভাগা মহাপাপী মানুষেরা বোকার মত খাওয়া শুরু করল সেদিন থেকেই শুরু হল ওদের দুঃখের ইতিহাস। যে যত বই পড়েছে, যে যত জ্ঞানী হয়েছে সে তত অজ্ঞান অশিক্ষিত বলে নিজেকে ভাবতে শিখেছে। 

এটাকে ডাক্তারী ভাষায় বলে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিউটন সব লেখাপড়া জানা মানুষেরা নিজেদের অজ্ঞান ভেবে সারা জীবন দুঃখকষ্টে কালাতিপাত করেছে। সারা জীবন আরও আরও জ্ঞান চেয়ে হ্যাংলার মত কাঙাল হয়েছে।  

                

বইমেলায় গেলে তোকেও ওই মারণ রোগে ধরবে। কথায় বলে, বইয়ের নেশা সর্বনাশা। ড্রাগের মত। একবার ধরেছ তো ভবিষ্যত অন্ধকার। ফতুর করে ছেড়ে দেবে ক্যান্সার রোগীর গরীব ছেলেমেয়েদের মত। 

                  

তবে হ্যাঁ, ধর্মীয় বইয়ের কথা আলাদা। সেগুলো গাধারা দুলে দুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ খায়। কিচ্ছু অর্থ বুঝতে হবে না, শুধু গলায় ঢুকিয়ে মুখস্ত করে বইগুলো গিললেই হবে। জাবরও কাটতে হবে না হজম করার জন্য। অথচ তোর মনে একটা সবজান্তা আধ্যাত্মিক ভাব জন্মাবে। গাধাদের মধ্যে যারা গুরুবাবা হয় তারা আবার ওই সব বইয়ের গালগপ্পের কোর্টেশন সহ ভক্তদেরকে বাণী শুনিয়ে খুব খাতির পায়। মোট বয়ে চাল কলা ঘাস বিচালি আয় করতে  হয় না তাদের।  যে সব গাধাদের একটু কম বুদ্ধি তাদেরকে স্বর্গের লোভ আর নরকের ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ থেকে কচি ঘাস কেড়ে খায় মহানন্দে। আর হদ্দগাধা ঐ বোকা গাধারা নিজেরা অভুক্ত থেকে চতুর গুরুবাবা পুরুতবাবাদের পেট মোটা করিয়ে পুণ্যি  অর্জন করে। যা, রাস্তার ওপারে গাছের তলায় বসে থাকা তেল সিঁদুর মাখা পাথরটায় তোর সামনের পায়ের ক্ষুর ঠুকে প্রণাম করে আয়। পরকালের জন্য পুণ্যি হবে। আজকে বেশি ঘাস দেবে মধু, মরার পর স্বর্গে যাবি। 


হ্যাঁ, যে কথাটা বলছিলাম। এই যে বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ। এ দেশে এমন হাড়-হাভাতে দৈন্যদশা কেন জানিস? কবিতা, গল্প, আড্ডা, আর ঐ বইপড়ার নেশা। ঐ নেশাটাই বাঙালি জাতটাকে একেবারে দেউলিয়া করে ছেড়ে দিয়েছে। কর্মবিমুখ। এখানকার লোকেরা বোঝে না যে, যে সময় অনর্থক বই পড়বি সে সময় একটু বেশি করে মোট বইলে মধু ধোপা একটু বেশি ঘাস বিচালী ওভারটাইম দেবে।  দেবে কিনা? সেই অমূল্য সময় হেলায় অপব্যয় করে তোরা যদি কবিতা উপন্যাস আর বস্তাপচা যুক্তিবাদী দর্শন পড়িস কেউ তোকে খেতে দেবে? দেবে না। এই ওয়ার্ক কালচারটা তোরা যদি না বুঝিস গাধাদের জিজ্ঞেস করলেই তো পারিস। অথবা আমাদের জীবনযাপনের বৈজ্ঞানিক কৌশল শিক্ষা নকল করতে পারিস। কেন না আমাদের জীবনই আমাদের বাণী।

                   

উন্নতি নাই তাই ঐ বই নেষুড়ে  মানুষদের।  যারা বই লেখে তারা আরও হতভাগা। যেমন ধর মাইকেল। মেঘনাদ না লিখে যদি বাপের জমিদারিটা দেখতিস, তাহলে পায়ের ওপর পা তুলে কত সুখে কত বেশিদিন বাঁচতিস। তা না করে কাব্য লিখতে গেলি। তাও আবার উল্টোপাল্টা রামচন্দ্র বিরোধী কাব্য। কি লাভ হলো তাতে? ধারদেনা করে অকালে অক্কা পেলি, বৌ পালালো, ছেলে মরল। শেষ বয়সে  'কি ফল লভিনু হায়' বলে মাথা চাপড়ালি। আবার দেখ না, রুশদি নাসরিনদের। কী দরকার ছিল হাবিজাবি লেখবার? খাওয়া পরার তো অভাব ছিল না তোদের। বাড়িতে কোরান, বাইবেল, গীতা, ব্রতকথা, পুরাণেরও অভাব ছিল না দুলে দুলে পাঠ করবার জন্য। বাপেদের পয়সাও ছিল, আবার নিজেদেরও এলেম ছিল পয়সা রোজগারের। ঐ হাবিজাবি বই লেখার জন্যই তো আজ তোরা ঘরছাড়া, দেশছাড়া হয়ে ধার্মিকদের ছুরি, গুলি খাবার ভয়ে পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছিস। এবার বুঝলি ব্যাটা কেন বইমেলায় যাবি না। বইয়ের নেশা মারাত্মক। নতুন বইয়ের গন্ধেও নেশা ধরায়। তাই বুদ্ধিমান গাধারা কখনো বই পড়ে না, বইমেলার ধার দিয়েও যায় না।  

                    

মানুষগুলো কী বোকাবুদ্ধু দেখ। গর্ধবের এক শেষ। হাজার হাজার বছর ধরে ভেবে, কোটি কোটি বই লিখে, দেশ বিদেশের সভা সমিতিতে সেমিনার করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস লিখে এখনও তারা ঠিক করতে পারল না তারা কী খাবে, কী পরবে, কী ভাবে শোবে, কী ভাবনা ভাববে, আমাদের মত ফুল উলঙ্গ থাকবে, না নটনটীদের মত হাফ উলঙ্গ থাকবে, কী ভাষায় কথা বলবে, কোন সুরে গান গাইবে। শুধু রাশি রাশি বই লিখেই চলেছে। সুস্বাদু নরম কচি কচি ঘাসবিচালী পচিয়ে কাগজ বানাচ্ছে, আর সেই কাগজে হাবিজাবি ছাপছে। কিন্তু এত করে ঐ রামগর্ধব মানুষের দল কোনও কিছুর কুল কিনারা করতে পেরেছে? পারেনি। মনে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। তার উত্তর পেল তো সেটা আবার আর একটা প্রশ্ন হয়ে গেল। সেই নবজাত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবার হয়রান। এর শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে এই ট্র্যাডিশন চলছে মানুষদের মনে।  

                       

কিন্তু প্রকৃতির সেরা সৃষ্টি গাধাদের দেখ। সেই কোন যুগে গাধাদের মুনি ঋষি সাধু সন্তেরা কত সহজে সব কিছু তাঁদের গর্ধব পুরাণ, গর্ধব শাস্ত্রে, গর্ধব উপনিষদে ঠিক করে দিয়ে গিয়েছেন। সেগুলোর নির্দেশ একেবারে ধ্রুব সত্য। ধ্রুব নক্ষত্রের মত স্থির, নিশ্চল। পরিবর্তন সংশোধন কিচ্ছু করতে হয় না গবেষণা করে। ঠিক কি ভুল বিচার করতে হয় না।  লাখো লাখো বছর আগে একটা গাধা যা ভেবেছে, যা খেয়েছে, সারা পৃথিবীজুড়ে যে ভাষায় কথা বলেছে, যে সুরে গান গেয়েছে, আজও সারা পৃথিবীর তাবৎ গাধারা সেই একইভাবে চলছি, একই সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে পালন করে চলেছি। ভাষা, চিন্তা, ধর্মের বা জীবনযাপনের কোনও ভেদাভেদ মতভেদ নাই গাধাদের মধ্যে। সনাতন ধর্মের কোনও পরিবর্তন, কোনও সংশোধন এমেন্ডমেন্ট কিচ্ছু করতে হয়নি। সারা বিশ্বের সমস্ত দেশের সমস্ত গাধার সনাতন চিন্তারও কোনও ভেদাভেদ নেই। বাঙালিগাধা-ইংরেজগাধা, হিন্দুগাধা-মুসলমান গাধা বলে কোনও কৃত্রিম ভেদাভেদ নেই।  গাধাদের সেই সুপ্রাচীন বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহ্য মহান। আমরা মনে করি "বাসুধৈব কুটুম্বকম", সারা দুনিয়ার সমস্ত গাধারা পরস্পর আত্মীয়, পরস্পর ভাই।  আমরা 'ওরা' 'আমরা' ভেদ করি না। বলি না"। তাই আমরা গর্বের সাথে বলি "আমরা গাধা " 

                     

আস্তে চলার জন্য এই যে চাবুকটা খেলি পিঠে, তার জন্য তোর মনে কি কোনও কষ্ট হলো? পিঠটা দু’মিনিটের জন্য সামান্য জ্বলে গেলেও মনে কোনও কষ্ট হয়নি। বুদ্ধিমান গাধাদের মনে কোনও কষ্ট হয় না। কেন জানিস? কেন না আমরা জানি দুনিয়ার নিয়ম অনুযায়ী এটা আমাদের প্রাকৃতিক পাওনা। আমাদের পূর্ণগর্ধব ধর্মগুরু একশোআট শ্রী মহাগাধানন্দ বলেছেন এটা আমাদের বিগত জন্মের পাপের ফল। প্রেমময় ঈশ্বরের অপার করুনা। এতে দুঃখ বেদনার কি আছে। একটু পরে ঘাটে পৌঁছে গেলেই তো কাপড়ের গাঁটরি নাবিয়ে নিয়ে আমাদের ছেড়ে দেবে ঘাস খেতে। আমরা তখন স্বাধীন।  

                   

কিন্তু মানুষকে দেখ। ওরা বইতে পড়েছে যে ফ্রান্স রাশিয়া চীনে দক্ষিণ আফ্রিকায় নাকি বিপ্লব হয়েছে। লন্ডনে মানবাধিকার আন্দোলন হচ্ছে। তুই যদি মূর্খ  মানুষদের ঐসব বই পড়িস তোরও তখন চাবুক খাওয়ার জন্য দুঃখ হবে, রাগ হবে। মন প্রতিবাদ করতে চাইবে। গর্ধবাধিকার কমিশন বসানোর দাবিতে ইনকিলাব করতে ইচ্ছে করবে। অশান্তির একশেষ হবে। তুই তখন মরবি। 

 তাই বলি, বইমেলার ধরে কাছে যাবি না। মানুষদের বোকা বোকা রোগ ওসব।  মরুক ব্যাটারা বইমেলার ধুলাবালি খেয়ে।  আমরা গলায় দড়িঘন্টি বেঁধে টুং টাং করতে করতে দুর্লভ গর্ধব জীবন উপভোগ করি। মালিকের দেওয়া ঘাসবিচালী খাই আর গলা তুলে দু’পা উঁচু করে গাধা প্রজাতির জীবনমুখী গান গাই। চল, হাঁট। 

সমালোচনা: সম্পাদক অথবা 

asokdas.godless@gmail.com/ asokdas1943@gmail.com 

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা -কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 26, 2024 | জীবনী | views:2598 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যেসমস্ত পথিকৃৎদের নাম শুরুতেই করতে হয় তাঁদেরই একজন ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯২০-র দশকে দেশ পরাধীন থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সমাদর লাভ করেছিল। তখন থেকেই আরেক বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর নামের সাথে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। তারপর থেকে “বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব”, “বোসন” কণা ইত্যাদি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনমানসে আলোচনার কোনোদিনই কোনও অভাব হয়নি। খামতি যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা এই মহান ব্যক্তির অন্যান্য বিভিন্ন গঠনমূলক চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনার খামতি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাঁর মূর্তি গড়া হয়েছে, তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান তৈরী করা হয়েছে, কিন্তু সবথেকে বেশী যেটার প্রয়োজন ছিল সেটাই কখনও করা হয়নি। সেটা হল তাঁর অমূল্য চিন্তাভাবনা গুলোকে যত্নের সাথে বাস্তবায়িত করা। বিশেষত, দেশবাসীদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে যতটা গঠনমূলক ভাবে তিনি তুলে ধরেছিলেন ঠিক ততটাই অবজ্ঞার শিকার হয়েছে তাঁর এই চিন্তাভাবনা। ফলে বিজ্ঞানচর্চা তো বটেই, বরং গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই মাতৃভাষার ব্যবহার ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। এই বিলুপ্তিকে আটকানোর জন্য পদার্থবিদ্যায় তাঁর অবদানের পাশাপাশি যেটা নিয়ে আলোচনা আরও বেশী করে প্রয়োজন সেটা হল “মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা” নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা। সেরকমই একটা চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে।


এতবড় একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে নিদারুণ সারল্যের সাথে একজন প্রকৃত শিক্ষকের মত ছাত্রছাত্রীদের ভালোমন্দকে বুঝেছিলেন সেটা কম মানুষই পেরেছিলেন। বিদেশী ভাষা যে বিজ্ঞানচর্চার পথে আসলে প্রতিবন্ধকতা হিসাবেই কাজ করছে সেকথা তিনি অনুভব করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু-ই প্রথম এই ব্যাপারটা নিয়ে সোচ্চার হন যে ছাত্ররা এই বিদেশী ভাষায় নিজেদের মনের ভাব ঠিকভাবে বোঝাতে পারে না। এমন কি এই বিদেশী ভাষায় পড়ানোর ফলে শিক্ষকও বুঝে উঠতে পারেন না যে ছাত্র কতটা শিখে উঠতে পারল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র নিজের ভাষায় – “বিদেশী ভাষা ছাত্রদের পড়া মুখস্থ করাতে বাধ্য করে, স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ হতে দেয় না এবং সৃজনী শক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে কোন দেশেই বিদেশী ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হয় না, হওয়ার কোনও কারণও নেই” [২) ৯৪]। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেছেন – “আমরা ইতিহাস পড়ি, রুশ, জাপান, মিশর ইত্যাদি দেশের নবজাগরণের খবর পড়ি। কিন্তু যদি বলা যায়, এসব দেশে দ্রুত প্রগতি সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষা মাতৃভাষায় চালু করার ফলে এবং সেই ভাবে আমাদের দেশে শিক্ষা-নীতিতে পরিবর্তন আনলে, আমরাও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলতে পারবো, তখনই তর্কের ধোঁয়ায় আসল কথা চাপা পড়ে যায়” [১) ২৭৭-২৭৮]। এমনকি আর সময় নষ্ট না করে স্নাতকোত্তর স্তরেও শিক্ষার মাধ্যম যাতে মাতৃভাষা করে দেওয়া হয় তার আর্জিও জানিয়েছিলেন তিনি। ইংরাজী শিক্ষার মোহভঙ্গ ঘটিয়ে তিনি মজার ছলে একটা ভীষণ দামী কথা বলেছিলেন – “দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের মধ্যে যেমন অনেক গৌরবময় কথা আছে, তেমনি অনেক কলঙ্কের কথাও আছে। কিন্তু সেই সকলের মূল যদি অনুসন্ধান করা যায় তাহলে এই সমস্ত শোচনীয় ঘটনার মূলে অনেক সময় দেখা যাবে ইংরেজী শিক্ষিত গর্বিত ও স্বার্থপর লোকের কীর্তিকলাপ” [১) ১০৮]। কথাটা আজকের দিনেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

দেশ যে শুধুমাত্র একটা ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং তার থেকে অনেকটা বেশী কিছু সেটা বুঝতেন বলেই দেশের কিসে ভালো হবে সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন – “এটা ঠিক যে দেশ বলতে যদি দেশের লোককে বুঝায়, শুধু শিক্ষিত বা নায়ক সম্প্রদায় না হয়, যদি মনে হয়, দেশের সাধারণ লোকই দেশ, তবে এরা শিক্ষিত হলেই তো দেশকে উন্নত বলা যাবে, এবং দেশকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য সমূহ শক্তিই তাদের হাতের মধ্যে থাকবে” [১) ১০৭]। তাই দেশের সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করার জন্য উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে তিনি তুলে ধরেছিলেন মাতৃভাষাকে। শুধু বিজ্ঞান নয়, গোটা শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়োগ আর প্রচলন ঘটাতে না পারলে শিক্ষাক্ষেত্রেও তেমন কোনও পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না বলেই তিনি মনে করতেন। এই বিষয়েও তাঁর দূরদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন – “শিক্ষার্থী যদি তার পারিপার্শ্বিক জগতে নিয়ত দেখে ইংরেজীনবীশের বাজার দর বাঙলানবীশের তুলনায় অনেকগুণ বেশী, তাহলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, সে বা তার অভিভাবকরা ইংরেজীর দিকে ঝুঁকবেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পারিপার্শ্বিকের এই প্রতিকূল ও বিভ্রান্তিকর প্রভাবকে দূর না করা অবধি মাতৃভাষায় সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে না” [১) ১১৫]। একথা আজ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা, বিশেষত শহুরে অঞ্চলে, আজ ঠিক এই সমস্যারই সম্মুখীন। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই যাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল – “... যে প্রথমেই আমরা সারা দেশের কথা না ভেবে যদি আমাদের নিজেদের ঘর তৈরী করি, অর্থাৎ আমরা যে প্রদেশে থাকি সেই প্রদেশের লোকের শিক্ষা এমন ভাবেই বন্দোবস্ত করি যাতে বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর কাছে পৌঁছায়, তাহলে আমাদের সামনে নতুন যে সমস্ত অসুবিধা দেখা যাচ্ছে সেটা সহজেই চলে যায়” [১) ১০৭]। বলাই বাহুল্য যে ভারতের শাসকশ্রেণী এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ গুলোকে বরাবরই উপেক্ষা করেছে।


মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে যাঁরা বরাবরই নিজেদের নাক উঁচু করে এসেছেন তাঁরা নিজেদের স্বপক্ষে দুটো যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তাঁদের প্রথম যুক্তি ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার ফলে নাকি বেকার সমস্যা বাড়বে। এটা এতটাই অবাস্তব একটা কথা যে এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনায় যাওয়ার কোনও প্রয়োজনীয়তাই নেই। বেকার সমস্যা বাড়া তো দূরের কথা বরং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে অনেক জীবিকা সংস্থানের উপায় হতে পারে। যেমন – মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ফলে অনুবাদে বিশেষজ্ঞ ভাষাবিদ্‌দের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বলেই মনে করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ভারতের মত বহু ভাষাভাষীর দেশে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা তথা শিক্ষাদানের একটা পরিবেশের মধ্যে অনুবাদ করার রীতি ও পদ্ধতি শেখানো হলে সেটা নিঃসন্দেহে অনেক জীবিকা সংস্থান ঘটাতে পারত। এছাড়াও, উন্নাসিকদের দ্বিতীয় যুক্তি ছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথে একটা বড় বাধা। তবে এগুলো যে নিছক অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয় সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন – “পরিভাষার প্রয়োজন ক্ষেত্র বিশেষে আছে, ঠিকই, তবে পরিভাষাকে নিমিত্ত করে শিক্ষা পরিকল্পনাকে স্থগিত রাখাও অনুচিত। ... তাছাড়া পরিভাষার উপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয় তার আদৌ কোন যুক্তি আছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। ... আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রয়োগবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অনেকাংশ পাশ্চাত্য দেশ থেকে নেওয়া। তারা বৈজ্ঞানিক তথ্য, যন্ত্র বা ধারণাকে যে নামে চিহ্নিত করছে, সেই তথ্য, যন্ত্র বা ধারণাকে আমরা সেই নাম-সমেত গ্রহণ করেছি। সেই নামের প্রতিশব্দ সন্ধান করা অনেকটা টেলিফোনকে দূরভাষ যন্ত্র বলার মতই বাতুলতা। অপরের কাছ থেকে নেওয়া জিনিস অপরের দেওয়া নামেই ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়” [১) ১১৩-১১৪]। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজী শব্দ ব্যবহারে তাঁর যে কোনও আপত্তি নেই সেকথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন – “অনেক সময় বলা হয় যে, ভারতীয় ভাষাগুলিতে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব বিজ্ঞানচর্চায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আমি বিশুদ্ধবাদী নই; তাই ইংরেজী টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানাই। ... অনেক সময়েই বৈজ্ঞানিক শব্দের তর্জমা পন্ডশ্রমমাত্র হয়ে দাঁড়াবে – রেলওয়ে, রেস্তোরাঁ, কিলোগ্রাম, সেন্টিমিটার, হুইল, লেদ, থার্মোমিটার, বয়লার, কাটার, ইলেকট্রন, অ্যাটম, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ডিফারেনসিয়াল কোয়েফিসিয়েন্ট, ইন্টিগ্রেশান – এসব প্রায় সকলেই বোঝেন। পেপার, চেয়ার, টেবিল তো এখন প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিস। দৃষ্টান্ত বাড়ানোর দরকার নেই। আশা করি শিক্ষক-ছাত্ররা কোন বিষয় আলোচনার সময় এ ব্যাপারে অনায়াসেই একটা বোঝাপড়া করে নেবেন আর শিক্ষকের দায়িত্ব হবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের কাজে ভাষা প্রয়োগের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে হালের অবস্থান্তর সম্পর্কে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখা” [১) ৯৬-৯৭] পরিভাষা প্রসঙ্গে তাঁর সাফ বক্তব্য ছিল – “জলে না নেমে সাঁতার শেখানোর দুরাশার মত, ভাষাকে শিক্ষার বাহন করবার চেষ্টা না করে শুধু পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা আমার কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে” [১) ২৭৭]।


টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত আধুনিক জীবনে বিজ্ঞানের স্থান বিষয়ক আলোচনায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু একবার জাপানে গিয়েছিলেন, এবং সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান কিভাবে একটা আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ালো এবং প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সারা পৃথিবীকে বিস্মিত করে তুলল সে ব্যাপারে তাঁর কৌতূহল ছিল ভীষণ। জাপান থেকে দেশে ফেরার পর থেকেই বিভিন্ন ভাষণে ও লেখালেখিতে তিনি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন, এবং দেখিয়েছিলেন যে কিভাবে মাতৃভাষা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা তো হয়ইনা, বরং উল্টে এই কাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐ আলোচনা সভায় জাপানী ছাড়াও দেশ বিদেশ থেকে আগত একাধিক গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জীববিদ, দার্শনিক, এবং বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু সকলকেই বলা হয়েছিল যে ইংরেজী বা আরও কয়েকটা বিদেশী ভাষা বুঝতে পারলেও যেহেতু সারা দেশ জুড়ে শিক্ষা চলে জাপানী ভাষায় তাই আলোচনা সভায় সকলকে মূলত জাপানী ভাষা শোনার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। অবশ্য অন্যদের বোঝার জন্য এবং উপস্থিত বিদেশী বিজ্ঞানীদের বক্তৃতা জাপানী ভাষায় সেই দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দোভাষীর ব্যবস্থা ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু অবাক হয়ে দেখেছিলেন যে – “আধুনিক রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে এক বিশেষ জটিল ও বিমূর্ত আলোচনা অনায়াসেই চালানো হল জাপানী ভাষায়” [১) ৮৫]। এছাড়া, তিনি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গেছিলেন। সেখানেও তিনি দেখেছিলেন যে পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম দিকগুলোও পড়ানো হচ্ছে জাপানী ভাষায়। অনেক ধার করা শব্দ ব্যবহার করলেও সে বিষয়ে জাপানীদের মধ্যে কোনও কুন্ঠাবোধ তাঁর নজরে আসেনি। কলকাতায় বক্তৃতা দিতে আসা এক জাপানী বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলেও তিনি একই কথা উপলব্ধি করেন। সেই বিজ্ঞানীর কথায় – “আমরা বিজ্ঞান বিদেশীর কাছে শিখেছি এবং হয়তো এতে সত্যকারের মৌলিক অবদান আমাদের খুব বেশী কিছু নেই – তবে যা আমরা শিখেছি, সবই জাপানীর উপযুক্ত রূপ দিয়ে তাকে আপনার করে নিয়েছি।” [১) ২৭৮] অথচ আমরা যদি ভারতের যে কোনও প্রাদেশিক ভাষার সাথে তুলনা করি তাহলে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে জাপানী ভাষা আয়ত্ত করা তুলনামূলক ভাবে কঠিন। জাপানী ভাষায় অক্ষরসংখ্যা কয়েক হাজার। ফলে, আমাদের দেশে মাতৃভাষা আয়ত্ত করতে যেখানে খুব বেশী হলেও বছর দুই সময় লাগে সেখানে জাপানী ভাষা শিখতে সময় লাগে প্রায় ছয় বছর। তা সত্ত্বেও এই ভাষা সেদেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রধান মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং, বোঝাই যায় যে প্রশ্নটা হল সদিচ্ছার। সমস্যা হওয়া তো দূরের কথা, বরং, জাপানে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা যখন চালু হয়েছিল তখন বিজ্ঞান, দর্শন, কলাবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পড়ানোর জন্য শিক্ষক খুঁজে পেতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। জাপানে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেখেছিলেন যে সেখানে ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক। কম করে নয় বৎসর তাদের শিক্ষালাভ স্কুলে গিয়ে শিক্ষালাভ করতে হয়। পড়াশোনার খরচ বহন করে সেখানকার মিউনিসিপালিটি কিংবা আমাদের দেশের মতই জেলা অথবা রাজ্যসরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এছাড়াও, শিল্পকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং উপরের দিকের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও খরচার ভার বহন করে জাপান সরকার। স্বভাবতই তিনি এই ব্যবস্থা দেখে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন যাতে আমাদের দেশেও এমনটা বাস্তবায়িত হোক। যদিও আমাদের শাসকশ্রেণী কোনোদিনই সে পথে হাঁটেনি। বিনা খরচার শিক্ষাব্যবস্থা তো অনেক দূরের কথা, বরং বিপরীত পথে হাঁটতে হাঁটতে সাধারণ জনগণের আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে আজ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ভারত আর জাপান এই দুই দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান আলোচনার সমসাময়িক অবস্থার একটা তুলনা পাওয়া যায় তাঁর জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার একটা ঘটনায়। তিনি লিখেছেন – “খবর পেলাম যে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে দু-জন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরাজীতে লেখা একটি বইয়ের জাপানী তর্জমা হয়েছে। আমায় জানানো হল ঐ বইটি বেশ ভালোই বিক্রী হয়েছে ছয় মাসে, প্রায় তিন হাজারের মত। শুধু জাপানী ভাষাই পড়তে পারেন এমন সাধারণ জাপানীরা পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল জানবার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং হয়ত তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভারতীয় মতামতকেই বেশী বিশ্বাস করেন অন্যদের চাইতে। তবু আমাদের দেশে ঐ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ইংরাজীতেই লিখে চলেছেন ও তার ফলে তাঁদের দেশবাসীরা শতকরা ৮০ ভাগকেই অজ্ঞ রেখেছেন পারমাণবিক ভস্মপাতের বিপদ সম্পর্কে” [১) ৮৫]। সুতরাং, বর্তমান ভারতে জাদুগুড়া বা জাদুগুড়ার মত অন্যান্য তেজস্ক্রীয় ইউরেনিয়াম খনিতে আদিবাসীরা যে উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই খননের কাজ করে চলেছে, তেজস্ক্রীয় নিশ্বাস-জল-খাবার  যে তাঁদের জীবনটাকে প্রতি মুহুর্তে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে – তাতে আর অবাক হওয়া কিসের। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রীয়তা সম্পর্কে কিছু মানুষকে অজ্ঞ করে রেখে যদি তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে পোখরানের মত “জাতীয় গৌরব” অর্জন করা যায় তাহলে আর মন্দ কি। এই তো ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত বিজ্ঞানী এবং আমলাতন্ত্রের মনোভাব! যেখানে বিজ্ঞানচেতনা দূরে থাক, সামান্য মানবিকতা বোধটুকুও নেই। এর বিরুদ্ধেই তো লড়াই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মত বিজ্ঞানীদের। খুব কম জনেই তাঁর মত করে উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে – “কেবলমাত্র বিদ্যা অর্জন ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সামাজিক ও বংশমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষই যে পরম সত্য আমাদের সেই জ্ঞান হোক” [১) ৮৬]।


একথা সত্য যে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলনের পিছনে ব্রিটিশ শাসকদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। তবে সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের নিজেদেরই স্বার্থে। ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তিটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একদিকে ব্রিটিশরা নিজের দেশে পুঁজিবাদী উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি করার জন্য ভারত থেকে অবাধ কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল, আর ব্রিটেনে তৈরী সামগ্রী বিক্রীর একটা বাজার তৈরী করেছিল এই দেশে। তার জন্য যেটুকু গঠনমূলক কাজকর্ম করার দরকার ছিল ঠিক সেটুকুই ব্রিটিশরা করেছিল। কিন্তু অনেকেই তলিয়ে সে কথা ভাবতে চান না। ফলে ইংরেজদের বিভিন্ন ‘অবদান’ সম্বন্ধে সেকালে অনেকের অন্ধ মোহ ছিল। এগুলোর মধ্যে একটা ছিল ইংরেজী ভাষার প্রতি মোহ, যার একটা বিরাট প্রভাব পড়েছিল এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। এমনকি স্বাধীনতার পরেও শিক্ষাব্যবস্থাকে এই ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে নতুন শাসকশ্রেণী উদ্যোগী হয়নি। এই বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিন্তাভাবনা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এমনকি ইংরেজী শিক্ষা কিভাবে কেবল একটা নির্দ্দিষ্ট শ্রেণীরই স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে সে কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর ভাষায় – “[আমরা] মনে করি বিদেশী ইংরাজ যে ভাবে শাসন করে এসেছে – সেই বোধ হয় নিপুণতার শেষ কথা, তাই ইংরাজ চলে গেলেও ইংরাজী ভাষার মোহ আমাদের কাটে নি। ... অনেকের মনে ধারণা আছে যে, ভারতের ঐক্য – এটা আমরা ইংরাজীর কল্যাণে বুঝতে শিখেছি। কাজেই ইংরাজী শিক্ষা কায়েম করলেই হয়তো সেই ঐক্য জ্ঞান অটুট থাকবে। তাঁরা ভেবে নিয়েছেন, দেশের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের স্তর বিভেদ থাকবেই এবং উপরের স্তরে ইংরাজী জানালা দিয়ে যে যে জ্ঞান ঐ জানালা সমীপবর্তীদের উদ্ভাসিত করে তুলবে, তারই কিছু বুদ্ধিমানের মত নিম্নভাগে পরিবেশন করে নিজেদের স্বার্থবৃত্তি অনুযায়ী রঙ্গিন করে নিয়ে বর্ত্তমানে যে ধরনের স্তর বিন্যাস সমাজে আছে তা চিরন্তনী করে রাখতে পারবেন” [১) ২৭৬]। অন্যত্রও বিভিন্ন স্থানে তাঁর বক্তব্যে এরূপ শ্রেণীচেতনার আভাস পাওয়া যায়, এবং তিনি স্পষ্টই এব্যাপারে তাঁর মত পোষণ করে বলেছিলেন যে – “এইভাবে দেশের উন্নতি করা কষ্টদায়ক। তাছাড়া সকলের দায়িত্ব অল্পসংখ্যক লোকের একটি শ্রেণীর উপর চিরকালের জন্য চাপানো উচিত নয়। দেশের লোকের উচিত নিজেদের বোঝা নিজেদের বওয়া। আমরা পনেরো বছরেও এ কাজে বিশেষ এগোতে পারিনি” [১) ১০৮-১০৯]। বর্তমানে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্প তথা স্বপ্নের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-কে বাস্তবায়িত করার জন্য যাঁরা হিন্দি ভাষাটাকে সকল দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন তাঁদের পুরোধা মোদী আবার ২০১৮ সালের ১-লা জানুয়ারীতেই ঘোষণা করেছেন যে এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যেন বছর ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তিনি হয়তো জানেন না যে যাঁরা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নাম পরিবর্তনের রাজনীতি করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে এই মহান বিজ্ঞানী বলেছিলেন – “আমাদের দাবী হল শিক্ষিতদের উপর। তাঁরা চেষ্টা করুন দেশে নতুন যুগ যাতে আসে। শিক্ষার নতুন বাহন তাঁরা স্থির করুন। প্রদেশে প্রদেশে এমন ধরণের ব্যবস্থা চালু করুন যাতে তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ থেকে অশিক্ষা অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। এই সূত্রে ভাবোন্মাদীদের একটু সাবধান করে দিচ্ছি যে, শুধু একটা নাম খারিজ করে, একটা নাম কেটে দিয়ে, আর একটা নাম চালালেই আমাদের নতুন যুগের আহ্বান সার্থক হয়ে উঠবে না” [১) ১০৯]। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই সাবধানবাণী কোনও কালেই শাসকশ্রেণীর কর্ণগোচর হয়নি। আর বর্তমান শাসকশ্রেণী সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সমেত নাম পরিবর্তনের যে জঘন্য খেলায় মত্ত তাতে বোঝাই যায় যে অশিক্ষা অজ্ঞানতা দূর করার কোনও সদিচ্ছাই তাঁদের নেই, বরং এই অশিক্ষা অজ্ঞানতার উপর ভর করেই দেশজুড়ে তাঁরা তাঁদের নির্বাচনী রথযাত্রা সম্পন্ন করবেন বলে ঠিক করেছেন।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানের আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি আমরা বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর কথা না বলি। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অফ সায়েন্স। কিন্তু তার ষাট বছর পরেও সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং তাঁর মত চেতনাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের শিকরকে আশানুরূপভাবে সাধারণ জনগণের ভিতর গেঁথে দেওয়া যায়নি, এবং এর একটা বড় কারণ হল বিদেশী ভাষা। দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর কোনওরকম সরকারী উদ্যোগের আগেই ১৯৪৭ সালের ১৮-ই অক্টোবর কলকাতায় একটা মিটিঙে প্রস্তাব আনা হয় যে এমন একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে যার উদ্দেশ্য হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা। এই মিটিঙে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। মিটিঙে প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক হয়েছিল – বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, এবং এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন ধার্য হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ২৫-এ জানুয়ারী। এই উপলক্ষ্যে একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল – “বর্তমান জগতে জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই আমাদের বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে হচ্ছে, অথচ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা-দীক্ষা এমনভাবে চালিত হচ্ছে না যাতে আমরা আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসম্ভার জীবনের দৈনন্দিন কাজে সুচিন্তিতিভাবে ব্যবহার করতে পারি। এর প্রধান অন্তরায় ছিল বিদেশী ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা।” এই অন্তরায়কে অতিক্রম করার জন্য পরিষদের তরফ থেকে এই বিজ্ঞপ্তি-তে কিছু উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল যেখানে মাতৃভাষাকে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমন – “স্কুল ও কলেজের পাঠ্যবস্তু সহজ ও সরল ভাষায় বৈজ্ঞানিক যথাযথতা অক্ষুণ্ণ রেখে বিভিন্ন পরিবেশে সুখপাঠ্য ও চিত্তাকর্ষক করে প্রকাশ করা”, “বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রচার ও প্রসারের জন্য ও তার পথের বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্য বাৎসরিক সম্মেলন আহ্বান করা এবং বৎসরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা-মূলক অথচ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর প্রদর্শনী ও তৎসংক্রান্ত বক্তৃতার ব্যবস্থা করা” [২) ৯৯] ইত্যাদি। এই পরিষদের তরফ থেকে বাংলায় ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। বিজ্ঞান সাহিত্য রচনায় বাংলাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র এতটাই আগ্রহ ছিল যে হাইড্রোডায়নামিক্‌স-এর মত পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলোও তিনি বাংলায় প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। বাংলায় তাঁর প্রথম বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়, ১৯৩১ সালে। এমনকি ক্লাসেও মাঝেমাঝে তিনি বাংলাতে বক্তৃতা দিতেন। একবার সাহা স্মৃতি বক্তৃতাতে কসমোলজিতে সর্বাধুনিক ধারণার কথা তিনি বাংলাতেই আলোচনা করেছিলেন। সুতরাং, শুধু তত্ত্বে নয়, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে প্রয়োগের স্তরেও তিনি কার্যকরী করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর অধিকাংশ বক্তৃতাই হয় সংরক্ষণ করা হয়নি, বা হারিয়ে গেছে। কোনোদিন কোনও তৈরী বক্তৃতা থেকেও তিনি পড়েন নি, ফলে তার পান্ডুলিপি থাকারও কোনও সম্ভাবনা নেই। এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে সামান্য কিছু উৎসের সন্ধান পাওয়া গেছে তার থেকেই “মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা”-র বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা গুলোকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। এই মহান ব্যক্তিত্বের ১২৫-তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে, আসুন সকলে মিলে তাঁকে স্মরণ করি তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে, এবং আলোচনা করি কিভাবে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে তত্ত্বের গন্ডি পেরিয়ে প্রয়োগের বাস্তব ক্ষেত্রে নিয়ে এসে জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চার ঘটানো যায়। তবেই স্বার্থক হবে তাঁকে স্মরণ করাটা।

তথ্যসূত্র –

১) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সঙ্কলন – বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

২) সত্যেন্দ্রনাথ বোস – শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

ঠাকুমার স্বর্গলাভ -অশোক দাস চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ছোটোগল্প | views:295 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রাতস্নান সেরে, গরদের থান পরে, মুখে একটা ভক্তি ভক্তি ভাব মেখে শয়তানের ঠাকুমা নিস্তারিণীদেবী সেই কোন কাকভোরে ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলেন। বেদীতে সাজানো কয়েকটি বহুল প্রচলিত দেবদেবী, জনপ্রিয় মহাদেব, নানা রঙের মাকালী, কালো কৃষ্ণ, ফর্সা কৃষ্ণ, শনি মনসা ইত্যাদি  প্রাচীন  ঠাকুরদেবতাদের ছবি, আধুনিক সন্তোষী মা, অবাঙালী বজরংবলী, বিদেশি যীশু, বুদ্ধ, গড়গড়া সেবনরত মিষ্টি মিষ্টি করে হাসা মেদবহুল সবে দেবত্ব পাওয়া প্রেমময় গুরুদেব ইত্যাদি গুনে গুনে ছাব্বিশটি ফুল দেবতা, হাফদেবতা, কোয়াসি দেবতা, সব প্রজাতির দেবদেবী ও ভক্তদের দ্বারা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপিত উঠতি গুরুবাবা ভবিষ্যতের দেবতার ছবিগুলিতে একটি একটি করে মালা পরিয়ে এক এক করে পুজো সেরে প্রশান্ত মুখে এতক্ষনে বেরুলেন তিনি পাক্কা দুই ঘন্টা পরে। পাপের ভয়ে বেদীতে নিরাকার আল্লার ছবি না থাকায় তাঁকে মনে মনে নমস্কার করেছেন। কোনও ঝুঁকি নেননি তিনি। স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত। হাতে তাঁর পাথরের থালায় কিছু নকুলদানা ও ফুলবেলপাতা। এ বাড়ীর সবার হাতে একটি করে নকুলদানা প্রসাদ দিয়ে তাদের মাথায় ফুল বেলপাতা ছোঁয়াবেন কপালে প্রদীপের তাপ দিয়ে। সারাদিন ভালো থাকবে সবাই। কোনো কাজে বিঘ্ন হবে না কারো। 

         ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েই ৫-৬ বছরের নাতি শয়তানের সাথে দেখা।  শয়তান বলে উঠলো, - "এতক্ষন ঠাকুরদেবতাদের তেল মেরে কি আদায় করলে ঠাকুমা?"

- ছোটোকাকার কাছে এইসব শিক্ষা হচ্ছে, না? ছিঃ এত বড় বাড়ীর ছেলের মুখে কিনা এমন সব অসংসদীয় অভদ্র অভদ্র ভাষা! এরকম কথা আর বলো না। 

- তাহলে বল ঠাকুরের কাছে কি চাইলে তুমি। নিশ্চই একটা ধান্দা আছে।    

- কিচ্ছু চাই না ভাই, শুধু ঠাকুরের শ্রীচরণে একটু আশ্রয় চাই। 

    - কেন, তুমি কি রাস্তায় থাক, তোমার কি আশ্রয় নেই নাকি?

    - তা, থাকবে না কেন। তবে সারা জীবনে তো অনেক পাপ করেছি, পরকালের জন্যও তো কিছু করতে-টরতে হবে। 

    - পাপের ফল তো তুমি পাবেই। পুজো করলেও পাবে, না করলেও পাবে।  ঠাকুররাতো নেতা মন্ত্রী বা সরকারী অফিসার নয় যে তেল/ঘুষ খেয়ে, প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে তোমার সব পাপ মকুব করে দেবে।  আর মরার পরে দেবে স্বর্গে একটা দক্ষিণ খোলা ফ্লাট বা বাংলো। 

      - (স্বগতোক্তি: এ সব হচ্ছে  অজিতের  শেখানো বুলি। তোতা পাখীর  মত মুখস্ত করেছে কিচ্ছু না বুঝে।) আর পাকামো করতে হবেনা তোমায়। ছোট তুমি, ছোটর মত থাকবে।  বড়দের কথা শুনবে।  

      - ছোটকাকুও তো বড়, আমিতো ওর কথা শুনি। চার্বাকদাদুর কথাও শুনি। 

      - আবার তক্কো। নাও, প্রসাদ নাও। 

      - ই: রোজ রোজ শুধু নকুলদানা! তোমার কেষ্ট আর গুরুবাবদের যে ডায়াবিটিস হবে।  মাটনরোল, চিকেন বিরিয়ানী, বিফ কাবাব, চকোলেট, আইসক্রীম - এসব দিতে পারোনা? 

       - আবার আজবাজে কথা। ঠাকুরদেবতারা কি এসব খাবার খান?

       - কি খান তুমি জানলে কি করে? ছোটকাকু বলেছে যে, যারা ঠাকুর দেবতা, শাস্ত্র টাস্ট্র ফেঁদেছিলো তারা নিজেরা যা খেত তাইই ঠাকুরদেবতাদেরকে দেবার ব্যবস্থা করে গল্প লিখে গেছে। আসলে তখনতো আর চাউমিন, নোডলস, ফুচকা টুকচা ছিলো না। তাহলে দেখতে তাদের অন্য রকমের মেনু বানাত কবিরা। এতদিনে মডার্ন ঠাকুরদেবতারা নিশ্চই আমাদের মত ফুড হ্যাবিট পাল্টিয়েছে। রিমোর্টে না খেয়ে কাঁটা চামচও ব্যবহার করছে।  তাঁরা এখন তোমাদের ওই সেকেলে খাবার ছুঁয়েও দেখেন না। তুমি ওদের জন্য ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করো। আমার ভালো লাগেনা ওদের পচা পচা প্রসাদ খেতে। ওনারাতো সর্বভুক, যে যা নৈবেদ্য দেয় বিনা প্রতিবাদে খান। নররক্ত  নরমাংসও খান নরবলির পর। ওনাদের মেনু পাল্টাও তুমি।  

                 কানে হাত দিয়ে ঠাকুমা বলে উঠলেন, "ছি ছি, এসব কথা শোনাও পাপ। ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে এসব কি রকম কুৎসা! তোমার মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খাচ্ছে  ঐ অজিতটা।  যাচ্ছি তোমার বাবার কাছে।  একটা বিহিত করতেই হবে।"

                  সোজা  বড়ছেলের ঘরে ঢুকলেন নিস্তারিণী দেবী।  রোজকার মত হাতে  একটা নকুলদানা দিয়ে মাথায় ফুল বেলপাতা ছুঁইয়ে বললেন, "ছেলেটা যে অজিতের পাল্লায়  পড়ে গোল্লায় যাচ্ছে সেটা কি তুই দেখেছিস? পরলোকে যে জল পাবিনা ও  ছেলের হাতে।"

                  

শয়তানের বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে নকুল  দানাটা চেবাতে চেবাতে দার্শনিকসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, "সবই ওপরওয়ালার হাত মা, সব তিনিই করাচ্ছেন, তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র। শাস্ত্রে লিখেছে।"

           - সেটা অবশ্য আমিও মানি। তবে শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী, আর গীতার বাক্যের ওপর  ভরসা করলেতো চলবেনা। নিজের ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপার বলে কথা। চোখ কান খোলা রাখতে হবে সব সময়। বলি শোন, শয়তানের নামে করা মাকালীর জোড়া পাঁঠার মানতটা এবার শোধ দিয়ে দে। মায়ের আশীর্বাদে কেউ ওর মাথা বিগড়ে দিতে  পারবেনা।"

                   বাবা মারা যাবার পর মাতৃদেবী সারাদিন স্বর্গলাভের চিন্তায়/দুশ্চিন্তায় একপ্রকার মানসিক রোগী হয়ে গেছেন ঈশ্বরভক্তদের মত। খুব প্রেম ছিল দুজনের। মরার পর স্বর্গবাসী স্বামীর কাছে যেতে চান।  মাকে খুশি করবার জন্য বড়কত্তা বলে উঠলেন, "কথাটা তুমি মন্দ বলোনি। আমারও তাই ইচ্ছা। অজিতকে বলে কালই পুরুত/জহ্লাদ  ডেকে পূজোর দিন ঠিক করে ফেল।"

                এমন সময় অজিত ঢুকলো ঘরে। বললো,"এতো হইচৈ কেন মা। আমার নামে কি চুকলি কাটছো দাদার কাছে?"

        - হৈচৈ হবেনা! নিজেতো জাতধর্ম  খুইয়ে দেশসেবা ছোটোলোকসেবা করে বেড়াচ্ছো, বাপ চোদ্দপুরুষদের মুখে চুনকালি দিয়ে পৈতেটাও খুলে ফেলে দিয়েছো।  ইহকাল পরকালতো ঝরঝরে।  কিন্তু দুধের ছেলে ভাইপোটাকে নাস্তিক বানাচ্ছিস কেন বলত।  ঠাকুর দেবতাদের বই না শুনিয়ে যত বাজে বই পড়ে শোনাচ্ছিস, আজেবাজে কথা শেখাচ্ছিস, যুক্তিবাদী ক্লাবে বক্তৃতা শোনাতে নিয়ে যাচ্ছিস।  তোদের কুশিক্ষায়  মুখে মুখে তক্কো করতে শিখেছে  আজকাল - আমাদের সাথে এমন শত্রুতা করছিস কেন বলতো, কেন?"

          - ঐটুকু বাচ্চার অপরিণত মাথায় ঠাকুদেবতার বদ চিন্তা ঢোকাচ্ছো কেন তোমরা? কেনইবা ওকে আস্তিক বানানোর চেষ্টা করছো? তোমাদের যেমন অধিকার আছে মনসা শনির পাঁচালী পড়ানোর, আমারও তেমনি কর্তব্য আছে ওকে বুঝিয়ে বলা যে ওগুলো সাহিত্যিকদের কাল্পনিক গল্প মাত্র। তোমার জটায়ু-গরুড়, ব্যাঙ্গমা - ব্যঙ্গমী, সুখ-সারির আজগুবি গল্পের মত। তুমিও ওকে ওর কাঁচা মগজটা ধোলাই করে আস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দাও, আমিও নাস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দেব। বড় হলে নিজের স্বাধীন চিন্তায় যেটা ভালো মনে করে করবে। আসলে আমি ডিফেন্সে খেলছি কিনা। তোমাদেরকে আক্রমণ নয়, তোমাদের আবেগে আঘাত করা নয়,আমি শুধু তোমাদের সংস্কারের বিষ থেকে শিশুটাকে বাঁচাতে চাই। আস্তিক্যরোগের ছোঁয়াচের আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে ওকে আস্তিক্যরোগের প্রতিষেধক খাওয়াচ্ছি।  

          - দেখ, সেদিনকার ছেলে তুই, বড় বড় কথা বলিসনা। তুই নাস্তিক, তুই তোর মত নিয়ে থাকিস। আমরাতো কিছু বলিনা।  কিন্তু আমাদের বিশ্বাসে তুই আঘাত দিস কেন? আমাদের বিশ্বাস নিয়ে আমাদের বাঁচতে দে। 

           - তোমাদের গুরু ধর্মপ্রচারকরাও আমার মত অন্যের বিশ্বাসে অন্যের আবেগে আঘাত দিয়েছেন। মোহাম্মদ যীশু থেকে শুরু করে চৈতন্যদেব রামকৃষ্ণ - সবাই।  সমসাময়িক আধমরা সমাজের প্রচলিত আবেগে আঘাত দিয়ে ওনারা যদি অন্যায় না করে থাকেন,আমি কী অন্যায় করলাম? তুমি কি বল বড়দা?

       - তাই বলে বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষের রীতিনীতি, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সনাতন ধর্ম বিসর্জন দিতে হবে নাকি? 

       - বিসর্জন তো দিয়েছিই। তুমিও দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। আবার মা-ও দিয়েছে।  তা না হলে তো বাল্যবিধবা পিসিমাও নতুন পিসেমশাইকে  বিয়ে না করে কাশীর নোংরা পাড়ায় পচতে থাকতো,আর মাকেও বাবার চিতায় পুড়িয়ে মারতে হতো আমাদের।  

               নিস্তারিণীদেবী আর পারলেন না। সক্রোধে বলে উঠলেন, "সেটাই উচিত ছিল। তাঁর সাথে স্বর্গে যেতে পারতাম। আজ আর এমন  হেনস্থা হতে হতোনা। তোদের কাছে এমন নরকযন্ত্রণাও  সহ্য করতে হতোনা। ওগো তুমি কাদের কাছে রেখে গেলে গো"

         - বিলাপ কোরোনা, কেউই এই পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে যেতে চায়না মা।  তুমিও না।  যতই নরকতুল্য হোক, যতই দুঃখকষ্ট থাক না কেন সবাই  চায় এই পৃথিবীতে থাকতে, পৃথিবীটাকে ভোগ করতে। 

                 ছেলের সাথে তর্ক করা বৃথা। পাশে দাঁড়ানো নাতির দিকে ঘুরে বলে উঠলেন, এয়াই শয়তান, কি শুনছিস হাঁ করে? ছোটকাকার কথা খুব মন দিয়ে শুনিস, তাই না? খুব মিষ্টি লাগে? চলে আয় আমার সাথে।  নাড়ু বানাবো দেখবি।  ছোটোর সাথে একদম মিশবিনা।  নরকে যাবি। 

                এক মনে নাড়ু বানানো দেখতে দেখতে শয়তান বলল, "ঠাকমা,তুমি কি সত্যি সত্যি স্বর্গে যেতে চাও?"

            - স্বর্গে যেতে কে না চায় ভাই। সেখানে দেবতারা থাকেন। তোমার দাদুও থাকেন। আমিও তাঁদের কাছে যাবো। সেখানে না আছে কোন দুঃখ, না আছে কোনো জ্বালা যন্ত্রনা। শুধু অপার আনন্দ সেখানে। আমি পাপী, তাই এ বয়সেও পড়ে আছি এই পৃথিবীতে। মা কালীকে  সারাদিন ডাকি কোলে তুলে নিতে। কিন্তু আমার পাপের শেষ না  হলেতো তিনি নেবেননা।  পৃথিবীর যন্ত্রনা সইতে হবে। 

            - তুমি কি তাহলে আমাদের চেয়ে দেবতাদের বেশি ভালোবাসো ঠাকুমা?

            - ওরে আমার সোনাভাই, তা কখনো হয়! তুমি যে আমার নাড়ুগোপাল। 

            - শোনো ঠাকুমা, তুমি যখন স্বর্গে যাবে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে কিন্তু। আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না। এই আমি বলে দিলাম সাফ কথা। 

             - বালাই ষাট, এমন কথা মুখে আনতে নেই। 

             - কেন? সবাইতো সে দেশে যেতে চায়। মজার জায়গা। মামাবাড়ীর থেকেও মজার।  তুমি এতো ভয় পেলে কেন।  স্বর্গে আমি যাবোই তোমার সাথে। 

       - ছি: ভাই, এমন কথা বলো না।  আমি বুড়ো হয়েছি।  আর কটা দিনই বা বাঁচবো।  তুমি এখন ছোট, কত বড় হবে, টুকটুকে বৌ আসবে, কত্ত আনন্দ করবে।  এখন এসব কথা ভাবতে নেই। 

        - তুমি যে বলো স্বর্গেই আনন্দ, পৃথিবীতে শুধু যন্ত্রনা। পাগলা বোঁচাও এ কথা বলে। 

        - বড়দের সাথে এমন মুখে মুখে তর্ক করতে নেই। ঠাকুর পাপ দেয়। এখন তুমি ছোট আছ্, বড় হলে সব বুঝতে পারবে। 

        - আমি ছোট বলে ঠাকুরের কথা, স্বর্গের কথা বুঝতে পারিনা, তবে সেসব কথা আমায় বোঝাও কেন? ঠাকুর দেবতাদের মূর্তিকে 'নমো কর নম্ কর' বলে প্রণাম করতে শেখাও কেন?

                উত্তর খুঁজে না পেয়ে যেন কিছুই শোনেননি ভাব দেখিয়ে উঠে গেলেন ঠাকুমা অন্তরের রাগ চেপে। আজকালকার এতটুকু বাচ্চাদের সাথে কথায় পারা যায়না।  শুধু প্রশ্ন, আর প্রশ্ন। সক্রেটিস থেকে অমর্ত্য সেনরা ওদের শেষ করে দিলো। 

             দেখতে দেখতে কালীপূজার দিন এসে গেল।  নাস্তিক হলে কি হবে, ছোট কাকার কালীপূজায় খুব উৎসাহ। পাঁঠার মাংসের ওপর ওর একটু দুর্বলতা  আছে। শয়তানকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই  ঠাকুর কিনে নিয়ে এলো পছন্দ করে। ও অবশ্য মূর্তিটিকে পুতুল, আর পুজোকে পুজো-পুজো খেলা বলে।  ছাতের ওপর নিজের হাতে তৈরী করে প্যান্ডেল।  আর্টিস্ট মানুষ, সাজিয়েছে সুন্দর। ঠাকুরের মুখের খুঁতটা তুলি দিয়ে ঠিক করে দিল। শয়তান তার প্রিয় কাকুকে সাহায্য করে রং, তুলি, কাঁচি ইত্যাদি জিনিস এগিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুমা ফল কাটছেন, নৈবেদ্য সাজাচ্ছেন। শয়তানের মা মশলা বাটছেন আগামীকাল বলির মাংসপ্রসাদ রান্নার জন্য। ঠাকুর সাজাতে সাজাতে শয়তানের এটা ওটা হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তার ছোটকাকু। মা কালীর মুখটা রক্তাক্ত কেন, তিনি কি কাঁচা মাংস খান? তিনি কি আফ্রকার মেয়ে? 

               ঠাকুমা কি জন্য একটা কাজে নিচে গেলেন। শয়তানকে বলে গেলেন নজর রাখতে যেন কাকেরা নৈবেদ্যে মুখ না দেয়।  

                ছোটকাকু ঠাকুর সাজাতে সাজাতে বললো, দেখলি শয়তান, মা কালী নিজের খাবারটাও বাঁচাতে পারে না সামান্য কাকের থেকে।  যেটা তুইও পারিস।  এটা তোর ঠাকুমাও  জানে। শুনেছি সবচেয়ে বড় কালীঘাটের কালীর সোনার জিভটা চোরে খুলে নিয়ে গেছে। এই ঠাকুর নাকি বড় বড় শত্রুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে!

                শয়তান হঠাৎ করে তোতা পাখীর মত খুব গম্ভীর হয়ে বললো, "তুমি আমার সাথে এমন কথা বলবেনা। ঠাকুমা শুনতে না করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি নরকে যাবো নাকি?" একেবারে ঠাকুমার ভাষা। 

                  ওর বলার ভঙ্গি দেখে অজিত হো হো করে হেসে উঠলো। এমন সময় নিস্তারিণী দেবী ফিরে এলেন।  অজিতকে বললেন, "আজকের দিনটা রেহাই দে বাবা। ওর নামে উৎসর্গ করা পূজা।  ওর মাথাটা আর খাসনা। 

                

গভীর রাতে পুজো।  চারিদিকে একটা ভয় ভয়,ভক্তি ভাব। পুরুত ঠাকুরের চোখ রক্তবর্ণ।  প্রচুর কারণবারি পান করেছেন।  পরনে লাল চেলী।  কপালে বড় একটা লাল তেলতেলে টিপ।  গলায় জবাফুল ও রুদ্রাক্ষের মালা।  বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক। নরবলি দেওয়া  মড়ার ওপর বসে কালীসাধনা করে 'সিদ্ধ' পুরুষ হয়েছেন বলে আধ্যাত্মিক গুজব।   

                অনেক সময় নিয়ে তিনি গুরুগম্ভীর গলায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে  পূজার্চনা ও মন্ত্রপাঠ করলেন দক্ষ অভিনেতাদের মত। এবার বলি হবে।  কালো কালো নধর দুটি ছাগশিশু দু তিন দিন আগে রাজাবাজারের পাঁঠাবাজার থেকে এসেছে। ছাগলদুটিকে ভালোবেসে ফেলেছে শয়তান। পার্ক থেকে ঘাস ছিঁড়ে এনে খাইয়েছে, পাউরুটি খাইয়েছে। ওদের বলি হয়ে যাবে এখুনি। শয়তানের মন তাই খারাপ। তার দুদিনের বন্ধু আজ মরে গিয়ে কালীঠাকুর আর তাঁর ভক্তদের পেটে ঢুকবে। 


        ছাগলদুটিকে চান করিয়ে নিয়ে আসা হলো। তাদের গলায়ও জবার মালা। কপালে লাল টিপ্।  শয়তান ওদের অবস্থা দেখে চোখে আর জল রাখতে পারছেনা।  ওদের প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল শয়তান।  বাবা,মা,ছোটকাকু কেউ ওর কথা শোনেনি।  ঠাকুমাকে বলেছিল, "ওদের না মারলে হয়না?" 

           ঠাকুমা ওর মুখ চেপে ধরে বলেছিলো, "ওকথা বলতে নেই, মাকালী পাপ দেবেন "


            শয়তান বললো, "ওরা কি দোষ করেছে যে ওদের গলা কেটে ফেলা হবে?"


            ঠাকুমা বললো, "ওরে বোকা, ওরা অনেক ভাগ্যবান। মা ওদের গ্রহণ করবেন। ওরা স্বর্গে যাবে।  ওদের জীবন স্বার্থক"

             প্রচণ্ড জোরে ঢাক বাজছে। ছাগলদুটির মাথা একসাথে হাড়িকাঠে ঢোকানো হলো।  চিতায় জোর করে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরা সতীদের আর্তনাদ যেমন ঢাকের আওয়াজে ঢাকা পড়ে যেত, ছাগলগুলির ব্যা ব্যা শব্দও চাপা পড়ে যাচ্ছে।  

            শয়তান আর থাকতে পারছেনা। খুব জোরে জোরে নিঃস্বাস নিচ্ছে। বুকটা বোধ হয় ফেটে যাবে তার।  এমন সময় বিকট শব্দে "মা মা" বলতে বলতে বিশাল খাঁড়া হাতে মাতাল সিদ্ধ পুরুষটি এক কোপে কেটে ফেললেন ছাগল দুটিকে।  কাটা ধড় দুটো ছটপট করতে লাগলো মাটিতে লুটিয়ে। একবার চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল শয়তান।  

                   

 চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে ওর ঠাকুমা ওকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লেন। শয়তানকে বললেন,"ছাগলদুটোর কি ভাগ্য! মা কালী ওদের দেহ ভোগ করলেন। আমরা কালকে মায়ের প্রসাদ খাবো। ওরা স্বর্গে চলে গেল।  ওদের জন্য  দুঃখ করতে নেই।"

       - তাহলে তোমাকেও বলি দিতে ঐ রাক্ষস পুরুতটাকে বললেনা কেন? তুমিওতো স্বর্গে যেতে চাও।  কালকে পুরুতকে বলে আমি তুমি দুজনেই বলি হয়ে স্বর্গে চলে যাবো" 

              এ কথা শুনে ঠাকুমা ভয়ে আঁতকে উঠলেন। ছেলে বলে কি। ঠাকুমা উত্তরহারা। শেষ রাতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন। 

                ভোরবেলা হঠাৎ ঢাকের শব্দ আর ঠাকুমার ভয়ার্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল শয়তানের। ঘুমের ঘোরে ঠাকুমা হাড়িকাঠে ঢোকানো পাঁঠার মত আর্ত চিৎকার করে বলছেন, "আমায় বলি দিওনা, আমি স্বর্গে মা কালীর কাছে যাবোনা, আমি এই পৃথিবীতেই থাকতে চাই"।  

                শয়তান ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "কেঁদোনা ঠাকুমা, আমি আর স্বর্গে যেতে চাইনা। তুমিও যাবেনা, আমিও যাবনা, কালীর প্রসাদও খাবনা " 

         হুঁশ পেয়ে ঠাকুমা বললেন, আজ থেকে তিনি পুজো আচ্ছা ছেড়ে দেবেন। স্বর্গের স্বাদ তাঁর মিটে গেছে।  ঠাকুমার কথা শুনে দরজায় দাঁড়ানো অজিত হাততালি দিতে লাগলো  হাসতে হাসতে। 

মূল রচনা - কলকাতা ডিসেম্বর ১৯৯৫

সামান্য সংশোধিত -  সানফ্রান্সিসকো - ২০১৮ 

সমালোচনা:   asokdas.godless@gmail.com

প্রশ্নোত্তর পর্ব -সম্পাদক
Nov. 25, 2024 | প্রশ্ন | views:294 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রশ্ন:

বামপন্থী ঘরানার ইতিহাসবিদ রা এখন একটু অন্যরকম বললেও চিরকাল ইসলামিক আগ্রাসন এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন এগুলোর সাথে ধর্মের যোগ নেই। কিন্তু ইসলামী ইতিহাসকার রাই বলেছেন যেমন তামীম আনসারী যে তুর্কী সুলতান নিজেদের বেশী মুসলিম প্রমান করার জন্য এত অত্যাচার করেছে। যেখানে আরব রা সেভাবে কোনো জাতির ওপর অকারণ আগ্রাসন চালায়নি। বামপন্থীরা এই ক্ষেত্রে সিলেক্টিভ কেন? আমি বলে রাখি আমি বামপন্থার অনেক বিষয়ের সাথে একমত কিন্তু ইসলামী আগ্রাসন নিয়ে নীরবতায় রাজি হতে পারিনা। আবার চীন যখন উইঘুর দের ওপর অত্যাচার করে সে নিয়েও চুপ(except CPIML Liberation). এই প্যারাডক্স বুঝতে পারিনা।

অভিজিৎ ভট্টাচার্য

বৈদ্যবাটি, হুগলি



উত্তর:

“আপনার প্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গের দিকে আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন। মার্কসবাদী চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে এর উত্তর দেওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে বামপন্থী ঘরানা একটা বেশ বড় স্পেকট্রাম। সেই কারণে এই ঘরানার ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিভঙ্গিও বিভিন্ন রকমের, সেটা ভারতের প্রসঙ্গেই হোক বা বিশ্ব প্রসঙ্গে। বামপন্থী ইতিহাসবিদরা কতটা সিলেকটিভ বা কতটা নয় সেই প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি রেখে আসুন বরং ভাবা যাক ইসলামিক আগ্রাসনের সাথে ধর্মের কোনো যোগ আছে কিনা। ইসলামিক আগ্রাসন এক প্রকার ধর্মীয় মৌলবাদ। যে কারণে ধর্মীয় মৌলবাদ আর ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়, ঠিক সেই কারণেই ইসলামিক আগ্রাসন আর ইসলাম ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় বলেই মনে হয়।  ধর্ম একটা অযৌক্তিক ধারণা বলে একজন নিপাট সাদামাটা ধার্মিক মানুষের সাথে হিংস্রতায় পরিপূর্ন রক্তপিপাসু মৌলবাদীদের একই পর্যায়ভুক্ত হিসাবে বিবেচনা করাটা মার্ক্সবাদ অনুযায়ী অনুচিত বলেই মনে হয়। 


মার্ক্সবাদ একটা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন। প্রতিটা সমস্যার আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ না করে সেটাকে হঠাৎ আবির্ভূত হিসাবে দেখাটা আর যাই হোক মার্ক্সবাদ সম্মত নয়। ধর্ম একটা ভাববাদী ধারণা। সমাজে শ্রেণীবিভাগের উৎপত্তির সাথে সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, সেই শ্রেণী বিভাগকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে। নিতান্তই প্রতিক্রিয়াশীল একটা ধারণা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্ক্স স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে এ হলো সর্বহারা শ্রেণীর দীর্ঘশ্বাস, কারণ ধর্ম ছাড়া তার কাছে আকড়ে ধরার জন্য আর কিছু নেই। তাই মার্ক্সবাদ অনুযায়ী অর্থনীতি হলো ভিত্তি, আর ধর্ম হলো উপরিকাঠামো। শোষক শোষিতের ভিতরকার অর্থনীতিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক বদল না ঘটিয়ে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সংস্কার ঘটতে পারে মাত্র। এখানে বিপরীতে তথাকথিত নাস্তিকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ধর্মের ভিত্তিটাকে অগ্রাহ্য করে ধর্ম ও ধার্মিক দুইয়ের বিরোধিতা করে যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই এতে যে তারা আরো বেশি জন বিচ্ছিন্ন হন সেটা তারা বুঝতে চান না। নিজেদের ধর্মবিরোধী আধুনিক হিসাবে দেখিয়ে তারা কিছু সুখ অনুভব করতে পারেন মাত্র। সমাজ বদলের লড়াইতে সেই সুখ খুব একটা কাজে আসে না।


এবার আসা যাক মৌলবাদের কথায়। একটা নির্দিষ্ট আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক মৌলবাদের উদ্ভব। যে ইসলামিক আগ্রাসন দিয়ে কথা শুরু হয়েছিল সেখানে ফেরত আসা যাক। এই আগ্রাসন আসলে যত না ধর্মীয় তার থেকে বেশি বরং সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে কাজ করা একটা শক্তি, যার সাথে সাধারণ ছা-পোষা মানুষের রোজকার ধর্মচর্চার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। যে সম্পর্কটা আছে সেটা হলো ক্রমাগত ধর্মীয় উসকানি মারফত একটা সাধারণ মানুষকে তার মৌলিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্ত করে দেওয়া, যাতে সে কোনোভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বা পুঁজিবাদের বিরোধিতার জায়গায় না চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারকে প্রথম থেকে কারা তোষামোদ করেছিল? - আমেরিকান ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা। কোন উদ্দেশ্যে? - কমিউনিজম-এর "সংক্রমণ" যেন তাদের ভূখণ্ডে না চলে আসে! একইভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা মধ্য এশিয়ায় ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিকে তৈরি ও লালন করেছিল কোন উদ্দেশ্যে? - রাশিয়াকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে। যদিও রাশিয়াও তখন আরেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত। ইসলামি মৌলবাদ বলতে আজকে আমরা যা বুঝি সেটা আসলে এই দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বন্দ্বের একটা প্রোডাক্ট। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ন্যারেটিভ অনুযায়ী লাদেন তখন গণতন্ত্রপ্রেমী জাতীয়তাবাদী, যে রাশিয়ান আগ্রাসনের মোকাবিলা করছে। কয়েক দশক পরে সেই ন্যারেটিভটাই আবার চেঞ্জ হয়ে গেল নতুন চাওয়া পাওয়ার হিসাবে। পৃথিবীতে তখন একটাই সুপার পাওয়ার। ইসলামি আগ্রাসন নিয়ে আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ ধারণা আসলে এই পোস্ট-২০০১ ন্যারেটিভ থেকেই তৈরি হয়েছে, যেখানে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ"-র নামে গোটা বিশ্ববাসীর চোখে ঠুলি পড়িয়ে একতরফা সন্ত্রাস চালিয়ে গেছে কিছু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। পাশাপাশি মৌলবাদী সন্ত্রাসকেও ইন্ধন যুগিয়ে গেছে। কারণ অস্ত্র বিক্রির জন্য চাই যুদ্ধ। শত্রু ছাড়া যুদ্ধ হয় না। আর শত্রু না থাকলে শত্রু তৈরি করে নিতে হয়!


আজকের দিনে চিন-ও একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের স্বার্থে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের উপর অত্যাচার করে। যে মার্ক্সবাদী দর্শন সমস্ত জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে সেই দর্শন অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের প্রতি এই অত্যাচার নিন্দনীয়। কিন্তু মার্ক্সবাদকে ধর্মমতে পরিণত করে ফেলা অনেক বামপন্থীদের হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। তাদের কেউ কেউ বর্তমান চিনকে সাম্যবাদী মনে করেন, তাই সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারের বিষয়টা চেপে যান। অনেকে এমনকি বর্তমান রাশিয়াকেও সাম্যবাদী মনে করেন, এবং ফলত রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণকে সমর্থন করে ফেলেন অদ্ভুত কিছু অজুহাতে। প্রসঙ্গত বলতে ইচ্ছা করছে, একদা মার্ক্সকেও তিতিবিরক্ত হয়ে বলতে হয়েছিল যে - এই যদি মার্ক্সবাদ হয় তাহলে আমি মার্ক্সবাদী নই। আজ বেঁচে থাকলে উনি নিঃসন্দেহে আবার এই কথাই বলতেন।


সুতরাং, ইসলামি আগ্রাসন/মৌলবাদ বা অন্য যেকোনো ধর্মের মৌলবাদ, বা তুর্কি কর্তৃক আগ্রাসন, বা কোনো আরব জাতির নিরপেক্ষ অবস্থান - আজকের দিনে সবই আসলে সেই স্থানের ভৌগলিক-রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ, যায় সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ, সেটা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ-ও হতে পারে, আবার এক কালের সমাজতন্ত্রী, কিন্তু পরে পুঁজিবাদী প্রত্যাবর্তন হওয়া রাশিয়া চিনের সাম্রাজ্যবাদ-ও হতে পারে। একথা একেবারেই ঠিক যে বামপন্থীরা মাঝে মাঝে নিজেদের ক্যাম্প অনুযায়ী সিলেকটিভ হয়ে পড়েন, সেটা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয় এবং সেটা মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণও নয়। তবে হ্যাঁ, এককথায় আমিও মনে করি যে ইসলামি আগ্রাসনের সাথে ধর্মের যোগ নেই, বরং সাম্রাজ্যবাদীদের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মার্ক্সবাদীদের উচিত আরও বেশি করে সেই যোগটাকে প্রকাশ্যে আনা এবং সেটার আলোকে ইসলামি আগ্রাসন বা যেকোনো রকম মৌলবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতা করা।

ধন্যবাদ। উত্তর একটু বড় হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। আপনার মতামত জানাবেন।”

উত্তরটি দিয়েছেন

কিনোক্ষ্যাপা

The Political Discussions Around One Word.. Hindutva and Indianness -Gouri Lonkesh
Nov. 25, 2024 | সমাজ | views:5908 | likes:2 | share: 0 | comments:0

Any word that describes a particular, important aspect of society has its own history, meaning, culture, and ideology. Not just that, but the community’s ways of being is also hidden in this word. Thus, for all these reasons, the word is part and parcel of the lives of a community.


For example, let’s take the word secularism. There is a struggle of delineating religion and dominion behind this word. It has Buddhism’s love for humanity, the essence of Basava religion, blood of Gandhi’s assassination, and this country’s constitutional motivation.


The word that stands in opposition to this word is Hindutva. Even the word Hindutva has its own history: upholding the varna system, re-enforcing the caste system, protecting the interests of upper castes, ostracising a variety of communities, nurturing communal instincts, oppressing Shudras and women, seeing Dalits as impotent are all part of manuvada.


Indians now stand in a position to choose between these two oppositional words, each of which have their own histories, knowledge, and character. Their decision will turn the fate of this country.


My inspiration to talk about the importance of this is an interview of Prime Minister Vajpayee, who as usual used his skill of weaving words. Answering a question on secularism and nationalism, Vajpayee said, speaking in Hindi, “Bharatiya aur hindutva ka arth ek hi hai. Par main Bharatiyata kehana pasand karoonga. Hamare yahan Hindutva wale bhi hai.”



“The meaning of Indianness and Hindutva is the same. But I like to use the word Indianness. We have proponents of hindutva living here in our country.”


Even though he has weaved words in a terrible manner before, he is a self-proclaimed poet, isn’t he? Vajpayee possesses the magic to weave words that a poet needs. But sadly, in reality, Vajpayee doesn’t have the peculiarities of a poet’s heart.


This is because he has a parochial attitude when it comes to the complexities of a word. He negates the different aspects that a word possesses. He sucks out the character that a word possesses and makes it utterly useless. Vajpayee, who disrespects the culture constituted in a word, is no poet at all. Even then, he is able to conceive of a way to erase all the complexities that words carry.


Try, again, to understand the sentence, “the meaning of both the words – hindutva and Indianness is the same” through Hindutva ideology. According to the proponents of Hindutva, as everyone is now aware, the ones who aren’t part of or haven’t joined Hindu religion, the ones who do not accept the importance of Hindu religion, and the ones who do not accept the ideology of Hindutva, aren’t Indians at all.


Now, Vajpayee has gone one step further by saying that hindutva and Indianness means the same. Try to look at his statement with a different view. According to him, the ones who do not accept Hindutva aren’t Indians. If that is so, since I have been born and live in this country and I do not accept Hindutva, which country do I belong to? If people like me aren’t Indians, then who are this country’s citizens? Not just that, which dominion do the followers of Buddhism, Jainism, Sikhism belong?


Not just Christian-Muslim minorities, the ones who were outcasted by Hindu priests such as Lingayats, Okkaliga, Kuruba, Dalits, which country are they from, if they are not Indians?


Just because someone knows how to weave words, one neither becomes a poet nor a statesman. Vajpayee is a living example of this. Because a poet is not someone who just weaves words – a poet knows the peculiarities when it comes to the craft of language, she is someone who harvests and protects both the language as well as the sentiment behind the words. Only then the meaning of a language expands and grows instead of deteriorating. A word gets its life only when it is part of a community’s way of life, only when it has a deep relationship with people’s lives.


For example, let’s take the word nationalism. It can express, at the same time, a broad meaning and a short-sighted narrow feeling. In the expansive sense, nationalism expresses a community’s way of life, rituals, notions, history among other things. Even though one might not know each other, it suggests that they are the inheritors of all the aspects of a nation. But when you restrict this word to a particular religion in a country like India, which has multiple cultures, religions, languages, and other complexities, it becomes absolutely short-sighted. If we do this, one would be erasing about 98% of the culture that exists and thus disrupt and disintegrate everything.


This is the difference between Indianness and Hindutva. Indianness is a word which is broad and expansive, inclusive of everyone and everything. It contains intangible thoughts and notions as well as the tangible land, water, wealth –  thus, a signifier of the world itself. The word that is in opposition to this is “Hindutva”. This is a narrow word which separates and divides people, denying the lives of many communities who are living in harmony, and imposes a monoculture of one language and one religion.


By equating these two words, self-proclaimed poet Vajpayee, committing disservice to language, has taken the Hitler’s path. Vajpayee, an anti-national enroute to corrupting the word “Indianness”, is prospering today. Because of Vajpayee’s actions, a man who seems to have mastered the tact of repeating a lie times until it seems indistinguishable from the truth, our lives will become meaningless if the word “Indianness” loses its meaning in a year.


The responsibility to stop this ideological onslaught lies on all of us. We have the weapon to make this happen in front of us. Elections. If we want to throw it in Vajpayee’s face that Indianness doesn’t mean Hindutva, then we need to reject BJP everywhere, both in our states and in the entire country.



Source:

Translated By Sudhamshu Mitra, Primary Editor, Sneha Visakha

Translated to English from Kandahage

Volume 1, Page 133, Lankesh Prakashana (2012).

কবিতাগুচ্ছ ২৩ -কবিরা
Nov. 25, 2024 | কবিতা | views:294 | likes:2 | share: 2 | comments:0

মুক্তি

লি খে ছে ন- প্র দী প  চ ক্র ব র্তী


শিক্ষা নিয়ে গর্ব করে

করছ সময় নষ্ট,

কুসংস্কার বাড়ছে রোজ-ই

বাড়ছে মনোকষ্ট।


শিক্ষিত হওয়ার আগে

হতে হবে যোগ্য,

কর্মফল-ই শেষ কথা

চুলোয় যাক্ ভাগ্য।


মহাকাশের দুনিয়াতে

আছে কার্য - কারণ,

অলৌকিকের ধ্বজাধারীদের

সেথায় প্রবেশ বারণ।


ধর্মগ্রন্থ তাকেই বলে

যেথায় আছে যুক্তি,

মানবতাই দিতে পারে

ভিক্ষা থেকে মুক্তি।




চেতনা

লি খে ছে ন - বি প্ল ব  সে ন




নিজের শিক্ষা নিজের চেতনা

কি এই কথা কয়,

কান পেতে শুনুন দাদা উত্তর আছে সেথায়।

যদি বিবাহ করেন কাউকে

করুন পরীক্ষা রক্ত,

ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবন তাতে

হবে যে শক্ত।


বিজ্ঞানে ভরসা রাখুন

মানুষের সাথে বন্ধন,

মাঙ্গলিক কাল্পনিক ব্যাপার

ব্রাহ্মণের ব্যবসার মন্থন।

ছুঁড়ে ফেলে দিন সামন্ত তান্ত্রিক

এমন চিন্তা ভাবনা,

মানুষ শুধুই মান হুশ জ্ঞানে

এটাই হলো চেতনা।

বিজ্ঞানের কথা বলি আপনাকে

একটু ভেবে দেখুন,

পরিবর্তনের এই পৃথিবীতে ভরা

দ্বন্দ্ব আর ঘূর্ণন।


কারুর সাথে সম্পর্ক নয়

অন্য কিছু দিয়ে নিয়ন্ত্রন,

সমাজের মধ্যে মানুষের মধ্যে

সম্পিরখে দ্বন্দ্বের সমাগম।

একসাথে থাকতে থাকতে

হতে পারে কিছু অনৈক্য,

সমস্যা থাকলে আছে সমাধান

এভাবেই হয় ঐক্য।

কার্য থাকলে থাকবে কারণ

কারণ থাকলে কার্য,

এটাই হলো সুস্থ চিন্তা

মাঙ্গলীক সব কিছু বর্জ্য।

সুস্থ্ থাকতে পরীক্ষা করুন

রক্ত বিয়ের আগে,

জিন গঠিত রোগ যাতে

আটকে যায় আগে ভাগে।

বৈজ্ঞানিক চিন্তা করুন

এটাই চিন্তা মুক্তি,

প্রত্যেক ঘটনার কার্য কারণ

বাড়ায় বাস্তব শক্তি।




যুক্তিবাদের জয়

লি খে ছে ন -  বি প্ল ব   সে ন



সংঘর্ষ চলুক চলুন নির্মাণ

ভেঙে পড়ুক অবক্ষয়,

মুক্ত চিন্তা যুক্তির আলোয় হোক

বস্তুবাদের জয়।

তর্ক থাকুক থাকুক বিতর্ক

থাকুক সংশয়,

দ্বন্দ্ব থাকুক চেতনার মাঝে

জ্ঞানের আপেক্ষিকতায়।

কার্য থাকলে থাকবে কারণ

এটাই সহজ কথা,

কারণ থাকলেও থাকবে কার্য

এভাবেই চেতনার দেখা।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা সৃষ্টি করে

সিন্ধু,

ওই সিন্ধুর একক কিন্তু

একটি জল বিন্দু।

প্রগতির পথে চলমান বিজ্ঞান

যুক্তিবাদী মন,

উঠুক ঝড় ভাঙুক বিশ্বাস

সংশয় নিয়ে চলুক" চেতনার অন্বেষণ।"

সবেতেই বিশ্বাস সবেতেই আনুগত্য

অদ্ভুত অন্ধকার,

বিচ্ছিন্ন নয় সামগ্রিক ভাবে

দরকার চিন্তা ভাবনার।

প্রতি ঘটনা জড়িত যে

অন্য ঘটনার সাথে মিশে,

পরিবর্তনের এই পৃথিবী পাক খেয়ে চলে

এই দ্বন্দ্বের পরিবেশে।

ভাবুন, ভাবুন, ভাবার অনুশীলন

করুন এটাই অনুরোধ,

বিশ্বাস নয় সংশয় নিয়ে

চেতনায় আসুক মূল্যবোধ।


 

আলোর দিকে যাত্রা

লি খে ছে ন – দে ব ব্ৰ ত   হা তী



অন্ধকারে হালকা আলোক রেখা

সাম্যের চেতনা গভীরে প্রোথিত

মুক্তমনা সমাজে সবাই শাসক।

জীবন যখন বিপর্যস্ত মরুভূমি

মনন সৃজনশীল ও চিন্তাশীল করা।

রাজনীতির নানা দ্বন্দ্ব, অসহিষ্ণুতা

মনের মাধুরী মেশানো কথা নয়

আদর্শের কন্টকিত পথ ধরে চলা।

ভাঙা হৃদয়ে গান গাওয়া

স্বাধীনতা,গণতন্ত্র ও মুক্তি

মুক্তির জন্য বৃহত্তর সত্য

সেই সত্যের কাছে আসা।

সত্যই সুন্দর,জীবনের শ্বাশ্বত সত্য,

মানুষের জীবনযুদ্ধ অবিরাম চলা

ধোঁয়াশায় ঢাকা পড়ে সত্য ভাষ্য

চশমার কাঁচটা বড়ো ঘোলা ঘোলা

মনে হয় সব যেন ঝাপসা ঝাপসা

ঝাপসা থেকে আলোর দিকে যাত্রা।






উপেক্ষিতা

লি খে ছে ন – স জ ল  কা ন্তি  টি কা দা র



ভারতবর্ষকে আমরা সবাই

জননী বলেই জানি---

আবার এই সমাজই মা বোনের

করে যে মান হানি!

ধর্ষণ আর বধূ নির্যাতন

প্রতিদিনই ঘটে--

চার বছরের শিশু সেও

ছাড় পায় না মোটে!


সরস্বতী পূজোয় পুষ্পাঞ্জলি

দেয় যে ভক্তি ভরে---

কেমন করে এরাই আবার

ভ্রুণ হত্যা করে!

তখন বিবেক কোথায় থাকে

দেখাও তো একটু দেখি--

এমন পূজোয় লাভ নেই বন্ধু

এগুলো সব মেকী!


এই সমাজেই ঘটছে বন্ধু

নির্ভয়া কামদুনি

হাজার হাজার ঘটছে এমন

কতটুকু তার শুনি?

যে সমাজ পারে না দিতে

নারীর সন্মান অধিকার

তেমন সমাজ রেখে বন্ধু

আমাদের কি দরকার?


নতুন শিশু আসবে যখন

এই সমাজের মাঝে---

কি জবাব দেবে তুমি?

শুনি তোমার কাছে!

আগুন জ্বালাও সমাজ বুকে

আর তোমার মনের ঘরে---

নতুন সমাজ তবেই বন্ধু

উঠবে আবার গড়ে। 

প্রশ্নোত্তর পর্ব -সম্পাদক
Nov. 25, 2024 | প্রশ্ন | views:293 | likes:2 | share: 1 | comments:0

প্রশ্ন - ১

যদি আমাদের মহাবিশ্বের কোনো creator থেকেও থাকে তাহলে কি ধর্মগুলির লেখাসমুহ কি মানুষকে মেনে নিতে হবে? ধর্মগুলোতে যে creator এর বর্ণনা আছে সেটা যে কাল্পনিক creator এটা বিজ্ঞান কি এখনও প্রমান করেনি? 

অরিজিৎ, বীরভূম

উত্তর: – 

“এরকম যুক্তি মনস্ক প্রশ্ন তোলার জন্য আপনাকে প্রথমেই অভিনন্দন জানাই।

এটা সত্যি যে এই সুবিশাল বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডর সৃষ্টি, প্রসারণ, সংকোচন বা বিনাশের ইতিহাস আমরা হয়তো অতি সামান্যই জানতে পেরেছি। 

কিন্তু বিবর্তনের পথ ধরে হোমো স্যপিয়েন্সের সৃষ্টির পরে এই কয়েক হাজার বছরে এতটা জানাও কোনভাবেই কম নয়। ফলে, আমরা সবটুকু এখনো জানিনা এই অজ্ঞতার দোহাই দিয়ে একজন মহান সৃষ্টিকর্তা এই ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ করেছেন এরকম অলীক, অলৌকিক তত্ত্ব মেনে নেওয়া একটা লজিক্যাল ফ্যালাসি ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা যত এগোচ্ছে তত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে ব্রহ্মাণ্ড স্বয়ম্ভু এবং এর প্রতিটি গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে সবকিছুর সৃষ্টি ও বিনাশ এক একটা অ্যাক্সিডেন্টের ফলাফল যা কোনভাবেই কোন ঈশ্বর বা ডিভাইন পাওয়ারের পূর্বনির্দিষ্ট নয়।

এটা সম্পূর্ণভাবে অনিয়ন্ত্রিত। 


এরকম অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা নিরন্তর ঘটেই চলেছে এবং চলতেই থাকবে। কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল বলেই একটা গ্যাসীয় পিন্ড ছিটকে গিয়ে ক্রমশ ঘনীভূত, শীতল হয়ে আমাদের পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। একইভাবে এটাও একটা Random vigorous reaction এরই ফল যে সেই আদিম পৃথিবীর hot dilute soup এর ভিতর কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের মত অজৈব পদার্থের বিক্রিয়ায় প্রোটিনের একক অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি হয়েছিল। তারও পরে সাড়ে তিনশো কোটি বছর ধরে বিবর্তনের ফলে হোমো স্যপিয়েন্সের সৃষ্টি হয়েছে। জীব বিবর্তনের এই প্রতিটি ধাপই আসলে এক একটা অ্যাক্সিডেন্ট। সৃষ্টির পরে পাঁচবার এই পৃথিবীতে মহাবিনাশ ঘটেছে যার ফলে তৎকালীন পৃথিবীর নব্বই শতাংশের বেশি জীব মারা যায় এবং অবশিষ্টদের বিবর্তনের দিক ঘুরে গেছে। অনেকে দাবি করেন যে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টির জন্য বিবর্তন করিয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের যদি মানুষ সৃষ্টিই উদ্দেশ্য হত তাহলে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কেন তা করতেন সরাসরি একমুহূর্তে তা করতে পারতেন। তাছাড়া এরকম ভাবার কোন কারণই নেই যে বিবর্তন শেষ হয়ে গেছে তা প্রতি মুহূর্তে চলছে। ভবিষ্যতে এরকম কোন মহাবিনাশের ফলে বর্তমান সিনোজোয়িক যুগের সকল জীবই হয়তো বিনষ্ট হতে পারে, পুরো পৃথিবীই ধ্বংস হতে পারে। সবকিছুই হতে পারে কারণ কোন কিছুই অলৌকিক সত্ত্বা দ্বারা নির্ধারিত নয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের অসারতা স্পষ্ট হয়ে গেছে।“


মনীশ রায়চৌধুরী

সাধারণ সম্পাদক

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি



প্রশ্ন - ২

মহাবিশ্ব ও সকলকিছু সৃষ্টির পূর্বে অসীম আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই তো ছিল না। সেই অসীমতার মধ্যে শূন্যতা কোথায় ছিল? অসীম আর শূন্যতা একইসাথে অবস্থান করতে পারে না। কারণ একটি অপরটির অস্তিত্বকে ভুল প্রমাণ করে। এখানে অসীম ও শূন্যতা বলতে কী বোঝায়?

হোসেনুর রহমান 

ভাঙড়, দক্ষিন চব্বিশ পরগণা


উত্তর: -

“মহাবিশ্ব ও সকলকিছু সৃষ্টির পূর্বে অসীম আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান  ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই তো ছিল না" এই কথাটা ধর্ম বিশ্বাসী দের কথা এবং এর সাথে বিজ্ঞানের কোনো যোগ নেই অর্থাৎ পদার্থ বিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বর স্বীকার্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অতএব আগে দেখা যাক এই বিষয়ে বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ কি বলেছে। কোরানে বলা হয়েছে পৃথিবী, আকাশ তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টির পূর্বে বা সহজ কথায় এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে জলের উপর আল্লাহর আরজ (সিংহাসন) অবস্থান করতো আর আল্লাহ সেই আরজে অবস্থান করতো (কোরান-হূদ ১১:৭)। বাইবেলের আদি পুস্তকে বলা হয়েছে ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর অন্ধকারে অবস্থান করতো (পবিত্র বাইবেল, আদি পুস্তক ১:২-৩)। তিনিই আলো হতে বলায় তবে সবার প্রথম আলোর উদয় হয়। বাইবেলের মতো এই একই রকম বর্ণনা ইহুদিদের ধর্ম গ্রন্থ তোরাহ (Torah) তে উল্লেখ পাওয়া।  যদি হিন্দু পুরান (শিব পুরাণ-পর্ব ১, Aitareya Upanishad (3.4.1)) দেখা যায় তাহলে সৃষ্টির আদিতে যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কিছুই ছিলনা, ঘোর অন্ধকারে ছিল শুধু ব্রহ্ম। চারিদিকে শুধু জল ছিল ও ভগবান বিষ্ণু জলের উপর ঘুমাচ্ছিলো এবং বিষ্ণুর নাভি থেকে ফোঁটা পদ্মে ভগবান ব্রহ্মার জন্ম যিনি পরে  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেন। এতক্ষনে আমরা দেখলাম সব ধর্মে আদিতে অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পূর্বে জল ছিল আর জলের আশেপাশে আল্লাহ/ঈশ্বর/ব্রহ্মের আত্মা ঘুরঘুর করছিলো এবং কতদিন যে ওই অবস্থায় ছিল এই বিষয়ে কোথাও বিশেষ কিছু বলা  নেই। আরো বড়ো কথা ওই জল এল কোথা  থেকে? ওই জল কে সৃষ্টি করলো? ওই জল থেকে কি  ঈশ্বরের আত্মার  সৃষ্টি? তাছাড়া সব জায়গায় আল্লাহ/ঈশ্বর/ব্রহ্মের আত্মাকে নিরাকার বলা হয়েছে, আবার কোথাও নিরাকার আত্মার বসার জন্য সিংহাসন দরকার পড়েছে। জল এবং সিংহাসনের উপস্থিতি জানাচ্ছে “স্থানের, বা শূন্য স্থানের(space ওর vaccum)” অস্তিত্ব ছিল অর্থাৎ শূন্য বলতে যেটা প্রশ্নে বোঝানো হয়েছে সেই শূন্যের সঙ্গে ধর্ম গ্রন্থের শূন্যের আকাশ পাতাল তফাৎ। ঈশ্বর বা ব্রহ্মকে অসীম বলা হলেও কোন দিক থেকে  অসীম ছিল তা নিয়ে বিশেষ কিছু বলা নেই। তবে এটা সহজেই অনুমান করাযায় আল্লাহ/ঈশ্বর/ব্রহ্ম শক্তি বা ক্ষমতা, জ্ঞান ইত্যাদির হিসাবে হয়তো অসীম কারণ তার আকার অসীম মানে বেশ মোটাসোঁটা, দৈত্যকার চেহারার কেউ এই বিষয়য়ে কেউ কিছু বলেনি। যাই হোক এবার আমরা বিজ্ঞানের দিক দিয়ে আলোচনা করি।


পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধমে। বিগব্যাং এর পূর্বে কোনো কিছুইর বা কারোর অস্তিত্ব ছিলোনা। ছিল না সময় ও স্থানের অস্তিত্ব। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে প্রথমে বৈজ্ঞানিক Alexander Friedmann (১৯২৪) ও Georges Lemaître (১৯২৭) সম্পসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা দেন। পরবর্তী কালে Edwin Hubble পর্য্যবেক্ষনের মাধ্যমে এই ধারণাকে প্রতিষ্টিত করে। যদি সম্পসারণশীল মহাবিশ্বকে সময়ের উল্টোদিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে  সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের  গণিতের মাধ্যমে দেখানো যায় এই সম্পসারণশীল মহাবিশ্ব শুরুতে খুবই ছোট একটা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল যা পরবর্তীকালে প্রসারিত হয়ে স্থান, কাল, ও সমস্ত ভরের সৃষ্টি করেছে (১৯৩০, Nature: Georges Lemaître)। এই ছোট সীমাবদ্ধ অঞ্চলের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব অসীম ছিল। 


আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে দেখানো যায় শক্তি থেকে ভরের উদ্ভব সম্ভব,যা একটি পরীক্ষিত সত্যি (উদাহরণ: Pair Production)। আবার হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে দেখানো যায় শূন্য থেকে স্বল্প সময়ের জন্য শক্তি ও প্রকান্তরে ভরের (বা পদার্থের) উদ্ভব সম্ভব (উদাহরণ: Virtual Pair Production)। অতএব সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যার নিয়ম মেনে কোনো রূপ অলৌকিক শক্তির উপস্তিতি ভিন্ন মহাবিশ্বর উৎপত্তি ব্যাখ্যা সম্ভব। এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যতদূর বুঝতে পেরেছেন তাহলো কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে মহাবিশ্বর (অর্থাৎ স্থান, কাল, পদার্থের) উৎপত্তি। বিগব্যাংগের আগে কিছুই ছিলোনা না ছিল স্থান, না ছিল সময় আর না ছিল পদার্থ বা শক্তি অর্থাৎ প্রকৃত শূন্য ছিল। অতএব ঈশ্বরের ও অস্তিত্ব ছিলোনা। এখনো পর্যন্ত বিগব্যাং তত্ত্বের সাপেক্ষে পাওয়া প্রমান গুলির মধ্যে মুখ্য গুলি হলো হাবল এর সূত্র ও মহাবিশ্বের সম্পসারণ, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন, হালকা মৌল যেমন ডিউটেরিয়াম (H - 2), হিলিয়াম -3 ও লিথিয়াম-7 ইত্যাদির প্রাচুর্য। 

 এবার আসা যাক জলের কথায়। বিগব্যাংগের প্রথম ১০০ সেকেন্ড থেকে ৩০ মিনিট এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রথম তিন মিনিটে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব হালকা মৌল সমূহ উৎপাদনের উপযুক্ত ছিল। এই সময় হাইড্রোজেন (~৭৫ %), হিলিয়াম (~২৫%)  এবং  খুব সামান্য ডিউটেরিয়াম (H - 2), হিলিয়াম -3 ও লিথিয়াম-7 উৎপন্ন হয়। এর থেকে ভারী মৌল সমূহ যেমন কার্বন, অক্সিজেন বা অন্যান ধাতু সমূহ উৎপন্ন করতে তারা (star) দের দরকার এবং এর জন্য বিগব্যাংগের পর  আরও ২০০ বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তার মানে বিগব্যাংগের ২০০ মিলিয়ন বছর পর জলের অনুর উৎপত্তি। 

  এবার আলোচনা টাকে শেষ করি অসীম ও শূন্যের একটা তুলনামূলক আলোচনা দিয়ে। পদার্থবিদের কাছে কোনো কিছু ক্ষুদ্র শূন্য আর কোনোকিছু খুব বড়ো হলো অসীম। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াস এর ব্যাসের (10-15 m) সঙ্গে এক আলোক বর্ষ দুরুত্বের (9.461x1015 m) তুলনা টানা হয় তাহলে, আলোক বর্ষ দুরুত্বের কাছে একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াস এর ব্যাস এর মান শূন্য। একটা নিউট্রন তারার কেন্দ্রের ঘনত্ব বা একটা সুপারনোভা তারার কেন্দ্রের তাপমাত্রার থেকে বিগব্যাংগের সময়কার ঘনত্ব বা তাপমাত্রা আরো বহু লক্ষ কোটি গুন্ বেশি ছিল তাই এদের অসীম বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। বিগব্যাংগের শুরুর সময়কার অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখনো চলছে। ভবিষ্যতে যায় এই বিষয়ে আরো তথ্য উঠে আসবে।” 


সৌমেন মন্ডল 

গবেষক

সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স


প্রশ্ন - ৩

ঘুমের মধ্যে অনেকে কথা বলে ও গোঙানির মত আওয়াজ করে। আমাদের গ্রামের দিকে সেটিকে বলে বোবা ধরেছে কিংবা ভুত ডাইনী ধরেছে। এইটি কি কোনো রোগ? এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই, এবং প্রতিকার বললে ভীষন ই উপকৃত হব।

সুজয় বিশ্বাস, বামন গোলা, মালদা


উত্তর:- 

“কদিন ধরে রুপালি বেশ মানসিক চাপে আছে। রাতে নানান স্বপ্ন দেখে। বেশিরভাগ সময় তখন তার মনে হয় তার হাত পা পুরো অবশ হয়ে আছে।তাকে যেন কেউ চেপে ধরে আছে।অথচ তাকে যে ঠেলে উঠে পড়বে সে ক্ষমতাও নেই।পুরো হাত পা যেন অবশ হয়ে আছে।  তার বোধহয় আর জীবনে ঘুম থেকে ওঠা হবে না! 


ঘুমের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা কে অনেকে বোবায় ধরা বা ভুত ডাইনী ধরা বলে।এমন বোবায় ধরার অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় স্লিপ প্যারালাইসিস (sleep paralysis)..।প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলে বুঝতে পারবেন যে এখানে ভূত- প্রেত ডাইনীর  কোন কাজ কারবার নেই। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা (Psychological disorder)। এর  বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

মানুষের ঘুমের ৫টি পর্যায়  যেগুলো চক্রাকারে চলতে থাকে। এই পর্যায়গুলো দুটি দশাকে কেন্দ্র করে হয়। এর একটি REM (Rapid Eye Movement) এবং অপরটি Non REM।ঘুমের REM দশার স্থায়িত্বকাল মাত্র দুই ঘন্টা। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের স্বপ্ন দেখার কাজটি সম্পন্ন হয়। REM কে বলা হয় ঘুমের সক্রিয় অবস্থা। এ সময় আমাদের মাংশপেশিতে শিথীলতা আসে (muscles relaxed)  এবং দেহ অবশ হয়ে যায় আর আমরা হয়ে পড়ি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।Non REM দশার স্থায়িত্বকাল অপেক্ষাকৃত বেশি; প্রায় ৪-৫ ঘন্টা। ৫টি পর্যায়ের ৪টিই এই দশার দখলে। 


কোন কারণে আমরা যদি REM দশা শেষ হওয়ার পূর্বেই জেগে উঠি তখনই বোবায় ধরার ঘটনা ঘটে। এ সময় আমরা ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী এক অবস্থায় অবস্থান করি। ফলে মস্তিষ্ক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে, আমরা আসলে কোন অবস্থায় আছি। আর তখনই উদ্ভট সব অনুভূতি হতে থাকে।


বোবায় ধরার অনুভূতি ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। মনে হয় যেন আমি জেগে আছি, আশপাশের সবাই চলাফেরা করছে কিন্তু আমার হাত-পা নাড়াতে পারছি না বা কাউকে ডাকতে পারছি না; সমস্ত শরীর যেন প্যারালাইজড হয়ে গেছে। নিজেকে তখন অনেক বেশি অসহায় মনে হয়। আর ভাবনা আসে  আর কখনও ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারবো না। একটা জোর প্রচেষ্টা থাকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার। যারা ভূত প্রেতে বিশ্বাস রাখে অথবা যাদের  হ্যালুসিনেশনের সমস্যা আছে তারা আরও একধাপ বেশি দেখে থাকে। এই যেমন কেউ বুকের উপর চেপে বসে আছে অথবা খাঁটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বা তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।


দু:খজনক হলেও সত্যি যে, আমরা অধিকাংশ মানুষ এখনও বোবায় ধরাকে ভূত প্রেতের কীর্তি বলে বিশ্বাস করি। শুধু যে  বিশ্বাস করি তা নয়; একই সাথে এ থেকে পরিত্রানের আশায় অনেকে আবার ওঝা / গুনিন দ্বারা ঝাড় ফুঁক দিয়ে ভুত তাড়ানোর চেষ্টা করি।। আশা করি এখন বুঝতে পারছেন যে এটা আমাদের শরীর বহির্ভূত কোন ঘটনা নয় বা অলৌকিক কোনো ঘটনা নয়।অলৌকিক বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না। এটা একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। তাই এর সমস্যা মনোবিদরাই সমাধান করতে পারবেন, কোন ওঝা গুনিন নয়।”


পঞ্চানন মন্ডল

কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য,  বিজ্ঞান মনস্ক, পশ্চিমবঙ্গ

সম্পাদক, বিজ্ঞান মনস্ক,  সোনারপুর শাখা

প্রতিষ্ঠাতা – বিজ্ঞানকথা



প্রশ্ন - ৪

১৯৮০ থেকে ২০২২,  প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা আছে,  মানুষের চেতনার পরিধি বিস্তারলাভ করলেও,  কোথাও যেন মানুষ ধর্মকে খড়কুটোর মত আশ্রয় করেই নিমজ্জিত হয়ে চলেছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়ার কার্যকরী পথ কী? অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনিতা কি চেতনা বিকাশের সময় কেড়ে নিচ্ছে? যোগাযোগের সময় কি কমে গেছে? সচেতন করার কার্যকরী পথ কী?

মহম্মদ মহসীন

মানিকপুর, হুগলী

উত্তর: -

“সৌদি আরবের নাগরিকদেরতো অর্থের অভাব নেই৷ কথা বলার সুযোগটা দরকার৷ অনবরত বিতর্কের মধ্য দিয়েই সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে৷”


মুজিব রহমান

সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা।

এবং বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মুন্সিগঞ্জ জেলা।



প্রশ্ন - ৫

একটা ঘটনা শুনছিলাম youtube এ যে একটা হোটেল রুমে ভৌতিক ঘটনা। উত্তরাখণ্ডে আলমড়া তে। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে দেখা যাচ্ছেনা, বাথরুমে কল ঘুরে যাচ্ছে নিজে থেকে। এবার ধরুন এটা hallucination হতে পারে। যেমন ধরুন কেউ বৃন্দাবনে ঘর ভাড়া নিয়ে আছে দেখলো রাতে বারান্দায় কৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছে। এবার দুটো সম্ভাবনা। হয় মিথ্যে বলছে নয়ত সত্যি hallucinate করছে। কিন্তু ওর মন তো ওটা সত্যিই দেখছে। অনেকটা রামকৃষ্ণের কালী দেখার মত। ওর মন ওটা ক্রিয়েট করছে। এই ক্ষেত্রে কি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে যদি নিয়ে থাকি যা তার অনুভূতি টা সত্যি।

অভিজিৎ ভট্টাচার্য, বৈদ্যবাটী

উত্তর: -

“প্রতি, অভিজিৎ ভট্টাচার্য

নমস্কার,

ভৌতিক ঘটনা নিয়ে সোসিয়াল নেটওয়ার্কে অনেক ভিডিও ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এই ধরণের ভিডিওগুলি কোনও না কোনও ব্যক্তি রেকর্ড এবং এডিট করে ইউটিউব, ফেসবুকে আপলোড করে থাকেন। কিন্তু এই ধরনের ভিডিও থেকে এটা প্রমাণ হয় না ভৌতিক ঘটনা ঘটে। ভৌতিক বা অলৌকিক বলে বাস্তবে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। এর পরেও যদি আপনি দাবি করেন ভুতুড়ে ঘটনা কোনও ভুত, আত্মা ঘটিয়ে থাকে তাহলে সবার আগে এই প্রশ্ন উঠবে, ভূতের জন্মদাতা কে? ভূত আছে? প্রমাণ করতে পারবেন। উত্তরটা হবে কোনও দিন না। কারণ যার কোনও অস্তিত্ব নেই তাকে প্রমাণ করার অর্থ হলো রামকৃষ্ণের মত কালীকে দেখা। রাতের অন্ধকারে বিড়ালের শব্দকে ভৌতিক আওয়াজ ভেবে বসা। পাখির ডাকলে সেটা কৃষ্ণের বাঁশির সুর মনে হওয়া। আবার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণে দরজায় জানলা খোলা বা বন্ধ হওয়ার পেছন কোনও অশরীরী হাত খুঁজে বেড়ানো। কোনও ঘটনার পেছন বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে না পেলে তাকে অলৌকিক বলে দেওয়া বোকামি। তাই সাতটি যদি আপনি সত্যি খুঁজতে চান তাহলে নিজে অনুসন্ধানে নামুন। নিজে যেদিন থেকে যুক্তিবাদী অনুসন্ধানে নামবেন, সেদিন নিজেই বুঝতে পারবেন, ভূত, ভুতুড়ে, ভৌতিক সবই একটা গুজব ও কল্পনা। আমারা যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জ, ভূত বা অলৌকিক বলে বাস্তবে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। এরপরেও যদি দাবি করেন, ভৌতিক ঘটনা ঘটে, তাহলে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির 50 লক্ষ টাকার খোলা চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জ গ্রহন করুন।”


সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি 



প্রশ্ন - ৬

Robert Svoboda এর বই Aghora তে আছে একজন জ্যোতিষী একটি ছেলের জন্মের আগেই তার আয়ু এবং বৈচিত্র বলে দিয়েছিল। সেটা মিলে গেছিল এমনকি দিনক্ষণই মিলে গেছিল। এটা কি সম্ভব? সেই ছেলেটি স্বল্পায়ু ছিল।

অভিজিৎ ভট্টাচার্য

বৈদ্যবাটি

উত্তর: -

“কারোর হাত, পা, কপাল, মুখ ইত্যাদি দেখেই সেই ব্যক্তিটির অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে ঝরঝরিয়ে বলে যাওয়া দেখে জ্যোতিষীদের ক্লায়েন্ট যতই অবাক হোক না কেন আসলে সবটাই সহজসরল ধাপ্পাবাজি বা প্রতারণার খেলা। এই খেলার রহস্য ভেদ আমজনতা করতে পারেন না বলেই জ্যোতিষী নামক প্রতারকের দল মনের সুখে করেকম্মে খাচ্ছে, আমজনতার মাথায় কাঁঠালভেঙ্গে। 


আচ্ছা, আপনি কি জানেন শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই এমন জনা পঞ্চাশেক জ্যোতিষী বা তান্ত্রিকের ভেকধারী জ্যোতিষীরা আছে যাদের রোজগার কমকরেও ১০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি প্রতিমাসে যা সৎভাবে খেটেখাওয়া মানুষেরা কল্পনাও করতে পারেন না?


একজন সফল জ্যোতিষী হতে গেলে চাই, শয়তানি বা ধুরন্ধর উপস্থিত বুদ্ধি, মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা এবং কয়েকজন ইনফর্মার যারা টাকার বিনিময়ে ক্লায়েন্টদের হাঁড়ির খবর আপনাকে থুড়ি জ্যোতিষীদের এনে দেবে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীদের সাথে সখ্যতা এবং কয়েকটি পোষা গুন্ডা যারা বেয়াড়া যুক্তিমনষ্ক দের ক্যেলিয়ে কাঁঠাল বানাবে। এরই সঙ্গে আপনাকে মোটা টাকা লগ্নি করতে হবে এই জ্যোতিষীগিরি বা তান্ত্রিকগিরি নামক প্রতারণা পেশায়। যে যতবেশি পুঁজি লগ্নি করতে পারবে এই পেশায় (পড়ুন বিজ্ঞাপনের পেছনে) তার তেমনই প্রচারও হবে, ক্লায়েন্টের ভিড়ও বাড়বে। আর ক্লায়েন্টের ভীড় মানেই অর্থপ্রাপ্তি। 


প্রসঙ্গত জানাই, বৃত্তিকর চাপান হয় আইনসম্মত পেশার উপর। আইন সম্মত পেশার একটা তালিকা আছে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন, টেডস, কলিংস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯-এ। প্রফেশন ট্যাক্স বিষয়ক আইন ১৯৭৯ এর সেকশন ও (২) তে আইন-সম্মত পেশার পূর্ণ তালিকা দেওয়া আছে। তাতে কোথাও ‘জ্যোতিষ’ এর নাম নেই। কারন ‘জ্যোতিষ’ এর কোন আইনি স্বীকৃতি নেই। বরং এদেশের আইন অনুসারে জ্যোতিষ পেশা বে-আইনি, নিষিদ্ধ, অবাঞ্ছিত, অনৈতিক এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।


এবারে আসি জ্যোতিষীরা কিভাবে প্রতারণা করে খায়।


একজন সাধারণ গৃহবধুকে আপনি যদি বলেন- আপনি সংসারের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফোটাতে আপনি যে নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে বা শখ দমিয়ে রেখে এত কষ্ট করে চলেছেন, তার প্রাপ্য সম্মান কিন্তু আপনি পাননি। দেখবেন ক্লায়েন্ট কেমন ঢিঁশ। কোনো দুধেআলতা ফর্সা চেহারাযুক্ত মহিলাকে বলুন - এই যে আপনি এতো সুন্দরী, তা এখনও পর্যন্ত কতগুলো প্রেমপত্র পেয়েছেন? এই কথাগুলো সামান্য রদবদল করে বলেই দেখুন, সেই মহিলাও ঢিঁশ। মূহুর্তে মোনালিসা মার্কা হাসির সাথে আপনার ভক্ত। এরপরে আপনাকে আর বেশি কিছু বলতেই হবে না, আপনার ক্লায়েন্টই গড়গড়িয়ে তার অনেক কথা আপনাকে বলে যাবে। আসলে প্রসংশা শুনতে প্রায় সকলেই ভালোবাসেন। আপনি ক্লায়েন্টকে ১০০ টা কথা বললে ওরা সেসবই মনে রাখবে যেগুলো তাদের মনপসন্দ, না মেলা কথাগুলো ওরা ভুলেই যাবে, ধর্তব্যেই আনবেন না। 


কোনো মা, তার মেয়েকে আপনার চেম্বারে নিয়ে এলে বুঝে নিতে হবে মা, তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেজায় চিন্তিত। সুপাত্রর খোঁজ চালাচ্ছেন। আপনিও ঝোপ বুঝে কোপ মারুন। ক্লায়েন্ট পয়সাওয়ালা হলে সোনার প্রজাপতি কবজ দিন, ক্লায়েন্টের আর্থিক অবস্থা ভালো না বুঝলে সোনার জলে চুবানো রুপোর কবজ বিক্রি করুন। কলকাতার বড়বাজারে এসব তাবিজকবজ, রত্নপাথর হোলসেল দরে পাওয়া যায়। কমদামী সেসব হিজিবিজি জিনিস কিনে এনে ক্লায়েন্ট বুঝে ১০ টাকার জিনিস ১০০০ টাকা বা তারও বেশিদামে ঝেঁপে দিন। 


কোনো মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পুরুষকে বধ করতে চাইলে তাকে বলুন - আপনি অর্থোপার্জনের জন্য যেভাবে এতো পরিশ্রম করছেন, সেভাবে রোজগার হচ্ছে কি? কিংবা বলুন, আপনি কোনোদিন অর্থকষ্টে শেষ হবেন না, যেভাবে হোক ঠিকই টাকার ব্যবস্থা আপনি করে ফেলবেন কারন আপনি সৎ ও কর্মঠ। ব্যাস! এতেই অনেক। কথায় আছে, practice makes you perfect. আপনার অভিজ্ঞ চোখ এবং ক্লায়েন্টের মনস্তত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা সঙ্গে ইনফর্মার দের ইনফরমেশন আপনার সাফল্যের চাবিকাঠি। 


মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে সন্তানের পড়াশোনার উন্নতির জন্য অনেক বাবা, মায়েরা ভিড় জমান জ্যোতিষীদের চেম্বারে। পরীক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থিনীকে কয়েকটা ভালোভালো জ্ঞানের কথা শুনিয়ে সরস্বতী কবজ বিক্রি করুন। সারাবছর পড়াশোনা লাটে তুলে, সারাদিন ফোনে ডুবে থাকা পোলাপান দের পরীক্ষায় ১০০ তে প্রায় ১০০ নং পাওয়ার নিনজা টেকনিক সরস্বতী কবচম। জ্বি, এটাই সায়েন্স, জ্যোতিষ নামক প্রতারণা বিদ্যার সায়েন্স। যদিও জ্যোতিষ কখনওই বিজ্ঞান নয়।


পরিশেষে বলবো, জ্যোতিষ শাস্ত্রটাই যখন বে-আইনি, প্রতারণা এবং চিটিংবাজি। তখন আজ নয়তো কাল জ্যোতিষী, তান্ত্রিকদের জেলে যাওয়া আটকানোর সাধ্য কারোর নেই। তবে আমার ব্যাক্তিগত মতে শুধুমাত্র কঠোর আইন এনে এদের দমানো যাবেনা। কারন টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতির সুবাদে এরা আইন কে পকেট বন্দি করে ছাড় পেয়ে যাবে। এদের একটাই ওষুধ। সেটা হচ্ছে বয়কট করা।”


অভিষেক দে

প্যারানরমাল এক্সপোজার

সক্রিয় বিজ্ঞান কর্মী, যুক্তিবাদী,

সাংগঠনিক সদস্য, চেতনার অন্বেষণে







প্রশ্ন - ৭


আমি ফেসবুকে নিয়মিত অনুকুল ঠাকুর কে নিয়ে খিল্লি করি, মিম শেয়ার করি। আমার এই সব activities দেখে আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে মেসেঞ্জারে সতর্ক করে জানায়-"You can also cheat people in this way but U can't disregard IPC 295A .

After all you r a govt. Employee.

In our country all dharma and dharma gurus are legal as per constitution."

আমি IPC 295A সম্পর্কে জানতে চাই।এই ধারার আমাকে কেউ অভিযুক্ত করলে ঝুঁকি কতখানি, আর এর থেকে বাঁচার উপায় কি? 

রামাননন্দ ঘোষ

বাঁকুড়া

উত্তর: -

“দন্ডবিধি ১৮৬০, অনুচ্ছেদ ১৫র ২৯৫ ধারা থেকে ২৯৮ ধারা(IPC-295-298) পর্যন্ত সংশোধন করা প্রয়োজন এবং এর মধ্যে ২৯৫-ক(IPC-295A) ধারাটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সংবিধান প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী এই আইন।

আলোচনা,সমালোচনা,মতপ্রকাশ আর উস্কানি,বিদ্বেষ,ঘৃণাবাদ এক নয়। কিন্তু দন্ডবিধি-১৮৬০ এর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ২৯৫-ক ধারাটিতে আলোচনা,সমালোচনা, বাক্ স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে।


ধারা ২৯৫-ক। কোন ব্যক্তি যদি ভারতের নাগরিকবৃন্দের কোন শ্রেণীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ও হিংসাত্মকভাবে লিখিত বা উচ্চারিত কথা কর্তৃক বা দৃশ্যমান কোন বস্তু কর্তৃক সে শ্রেণীর ধর্মকে বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অপমানিত করার চেষ্টা করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।"


এটা বলেছে। এখন যদি আমি বলি-

আমি পাঁঠা ছাগলকে ঈশ্বর বলিয়া এবং মানিয়া তাঁহার আরাধনা করি।

এখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি আমার পিতৃশ্বর পাঁঠা ছাগলের মাংস ভক্ষণ করে কিংবা ছাগলেশ্বরের কার্টুন আঁকিয়া আমার বিশ্বাস এবং *নুভূতিতে আঘাত দেয়, তাহলে আমি উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা করতে পারবো কি? হ্যাঁ, ছাগল হত্যাতেই কিংবা কচু গাছ কাটাতেই আমার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, আমার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে। তাহলে কি সংবিধান মেনে নেবে আমার দাবি/যুক্তি?


যদি মানে তাহলে তা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন। আর যদি না মানে তাহলে ৩৯৫-ক ধারাটি কোন যুক্তিতে অক্ষুন্ন আছে?

এটাও ক্লিয়ার করা প্রয়োজন, ধর্মানুভূতি কি শুধু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ? যদি না হয় তাহলে কোনো এক টঠাগটর অনুভূতিতে যেমন লেগেছে, সেরকম আমারো লাগতে পারে ছাগলের অপমানে। হ্যাঁ আমি মুরগি, কুকুর, গোরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষকে ঈশ্বর মানিয়া তাহাদিগের পুঁজা করি কিংবা ইবাদত করি এবং আরাধনা করার দিন ৩৬৫ দিন। 

একটি সেক্যুলার তথা ডেমোক্রেটিক,রিপাবলিক রাষ্ট্রে কিসের ব্লাসফেমি?

IPC- 295A(1860) ধারা বাতিল করা প্রয়োজন।”


অভিষেক দে

প্যারানরমাল এক্সপোজার

সক্রিয় বিজ্ঞান কর্মী, যুক্তিবাদী,

সাংগঠনিক সদস্য, চেতনার অন্বেষণে

নিয়মের রাজত্ব -রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2609 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিশ্বজগৎ নিয়মের রাজ্য, এইরূপ একটা বাক্য আজকাল সৰ্ব্বদাই শুনিতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্পৃক্ত যে কোন গ্রন্থ হাতে করিলেই দেখা যাইবে যে, লেখা রহিয়াছে, প্রকৃতির রাজ্যে অনিয়মের অস্তিত্ব নাই; সৰ্ব্বত্রই নিয়ম, সৰ্ব্বত্রই শৃঙ্খলা। ভূতপূর্ব্ব আগাইলের ডিউক নিয়মের রাজত্ব সম্পর্কে একখানা বৃহৎ কেতাবই লিখিয়া গিয়াছেন। মনুষ্যের রাজ্যে আইন আছে বটে, এবং সেই আইন ভঙ্গ করিলে শাস্তিরও ব্যবস্থা আছে; কিন্তু অনেকেই আইনকে ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভ করে। কিন্তু বিশ্বজগতে অর্থাৎ প্রকৃতির রাজ্যে যে সকল আইনের বিধান বর্তমান, তাহার একটাকেও ফাকি দিবার যো নাই। কোথাও ব্যভিচার নাই, কোথাও ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভের উপায় নাই। কোথাও ব্যভিচার নাই, কোথাও ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভের উপায় নাই। কাজেই প্রাকৃতিক নিয়মের জয়গান করিতে গিয়া অনেকে পুলকিত হন ভাবাবেশে গদগদ কণ্ঠ হইয়া থাকেন; তাহাদের দেহে বিবিধ সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব হয়।

যাঁহারা মিরাকল বা অতিপ্রাকৃত মানেন, তাহারা সকল সময় নিয়মের অব্যভিচারিতা স্বীকার করেন না, অথবা প্রকৃতিতে নিয়মের রাজত্ব স্বীকার করিলেও অতিপ্রাকৃত শক্তি সময়ে সময়ে সেই নিয়ম লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হয়, এইরূপ স্বীকার করেন। যাহারা মিরাকল মানিতে চাহেন না, তাঁহারা প্রতিপক্ষকে মিথ্যাবাদী নির্ব্বোধ পাগল ইত্যাদি মধুর সম্বোধনে আপ্যায়িত করেন। কখনও বা উভয় পক্ষে বাগযুদ্ধের পরিবর্তে বাহুযুদ্ধের অবতারণা হয়। বর্তমান অবস্থায় প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে নূতন করিয়া গম্ভীরভাবে একটা সম্পর্ক লিখিবার সময় গিয়াছে, এরূপ না মনে করিলেও চলিতে পারে প্রাকৃতিক নিয়ম কাহাকে বলে? দুই একটা দৃষ্টান্ত দ্বারা স্পষ্ট করা যাইতে পারে। গাছ হইতে ফল চিরকালই ভূমিপৃষ্ঠে পতিত হয়। এ পর্যন্ত যত গাছ দেখা গিয়াছে ও যত ফল দেখা গিয়াছে, সৰ্ব্বত্রই এই নিয়ম। যে দিন লোষ্ট্রপাতিত আম্র ভূ-পৃষ্ঠ অন্বেষণ না করিয়া আকাশমার্গে ধাবিত হইবে, সেই ভয়াবহ দিন মনুষ্যের ইতিহাসে বিলম্বিত হউক।

ফলে আম বল, জাম বল, নারিকেল বল, সকলেই অধোমুখে ভূমিতে পড়ে, কেহই উর্ধ্বমুখে আকাশপথে চলে না। কেবল আম জাম নারিকেল কেন, যে কোন দ্রব্য উর্দ্ধে উৎক্ষেপ কর না, তাহাই কিছুক্ষণ পরে ভূমিতে নামিয়া আসে। এই সাধারণ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম এ পর্যন্ত দেখা যায় নাই।

অতএব ইহা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। পার্থিব দ্রব্য মাত্রই ভূকেন্দ্রাভিমুখে গমন করিতে চাহে। এই নিয়মের নাম ভৌম আকর্ষণ বা মাধ্যাকর্ষণ।


প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মভঙ্গ হয় না; কাজেই যদি কেহ আসিয়া বলে, দেখিয়া আসিলাম, অমুকের গাছের নারিকেল আজ বৃত্তচ্যুত হইবা মাত্র ক্রমেই বেলুনের মত উপরে উঠিতে লাগিল, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সেই হতভাগ্য ব্যক্তির উপর বিবিধ নিন্দাবাদ বর্ষিত হইতে থাকিবে। কেহ বলিবে— লোকটা মিথ্যাবাদী; কেহ বলিবে—লোকটা পাগল; কেহ বলিবে—লোকটা গুলি খায়; এবং যিনি সম্প্রতি রসায়ন নামক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া বিজ্ঞ হইয়াছেন, তিনি হয়ত বলিবেন, হইতেও বা পারে, বুঝি ঐ নারিকেলটার ভিতরে জলের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ছিল। কেহ না, তাহার ধ্রুব বিশ্বাস যে, নারিকেল, খাঁটি নারিকেল, যাহার ভিতরে জল আছে, হাইড্রোজেন নাই, এ-হেন নারিকেল কখনই প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গে অপরাধী হইতে পারে না।

খাঁটি নারিকেল নিয়ম ভঙ্গ করে না বটে, তবে হাইড্রোজেনপূর্ণ বোম্বাই নারিকেল নিয়ম ভঙ্গ করিতে পারে; আম ভূমিতে পড়ে, কিন্তু মেঘ বায়ুতে ভাসে; প্যারাশুট-বিলম্বিত আরোহী নীচে নামে বটে, কিন্তু বেলুনটা উপরে উঠে।


তবে এইখানে বুঝি নিয়ম ভঙ্গ হইল। পূর্ব্বে এক নিঃশ্বাসে নিয়ম বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, পার্থিব দ্রব্য মাত্রেই নিম্নগামী হয়; কিন্তু এখানে দেখিতেছি, নিয়মের ব্যভিচার আছে; যথা মেঘ, বেলুন ও হাইড্রোজেন-পোৱা বোম্বাই নারিকেল। লোহা জলে ডুবে, কিন্তু শোলা জলে ভাসে। কাজেই প্রকৃতির নিয়মে এইখানে ব্যভিচার।

অপর পক্ষ হরিবার নহেন; তাঁহারা বলিবেন, তা কেন, নিয়ম ঠিক আছে, পার্থিব দ্রব্য মাত্রেরই নীচে নামে, এরুপ নিয়ম নহে। দ্রব্যমধ্যে জাতিভেদ আছে। গুরু দ্রব্য নীচে নামে, লঘু দ্রব্য উপরে উঠে, ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। লোহা গুরু দ্রব্য, তাই জলে ডুবে, শোলা লঘু দ্রব্য, তাই জলে ভাসে, ডুবাইয়া দিলেও উপরে উঠে। নারিকেল গুরু দ্রব্য; উহা নামে। কিন্তু বেলুন লঘু দ্রব্য; উহা উঠে।

এই নিয়মের ব্যতিক্রম খুঁজিয়া বাহির করা বস্তুতই কঠিন। কার সাধ্য ঠকায়? ঐ জিনিষটা উপরে উঠিতেছে কেন? উত্তর, এটা যে লঘু। ঐ জিনিষটা নামিতেছে কেন? উত্তর, ওটা যে গুরু। যাহা লঘু, তাহা ত উঠিবেই; যাহা গুরু, তাহা ত নামিবেই; ইহাই ত প্রকৃতির নিয়ম।

সোজা পথে আর উত্তর দিতে পারা যায় না; বাঁকা পথে যাইতে হয়। লোহা গুরু দ্রব্য; কিন্তু খানিকটা পারার মধ্যে ফেলিলে লোহা ডুবে না। ভাসিতে থাকে। শোলা লঘু দ্রব্য; কিনতুজল উইতে তুলিয়া ঊর্ধ্বমুখে নিক্ষেপ করিলে সুপ্রিয়া ভূতলগামী হয়। তবেই ও প্রাকৃতিক নিয়মের ভঙ্গ হইল।

উত্তর – আরে মূর্খ, গুরু লঘু শব্দের অর্থ বুঝিলে না। গুরু মানে এখানে পাঠশালার গুরুমহাশয় নহে বা মন্ত্রদাতা গুরুও নহে; গুরু অর্থে অমুক পদার্থ অপেক্ষা গুরু অর্থাৎ ভারী। লোহা গুরু, তার অর্থ এই যে, লোহা বায়ু অপেক্ষা গুরু, জল অপেক্ষা গুরু; কাজেই বায়ুমধ্যে, কি জলমধ্যে রাখিলে লোহা না ভাসিয়া ডুবিয়া যায়। আর লোহা পারার অপেক্ষা লঘু; সমান আয়তনের লোহা ও পারা নিক্তিতে ওজন করিলেই দেখিবে, কে লঘু, কে গুরু। পারা অপেক্ষা লোহা লঘু, সে জন্য লোহা পারায় ভাসে। প্রাকৃতিক নিয়মটার অর্থই বুঝিলে না, কেবল তর্ক করিতে আসিতেছ! এ পক্ষ বলিতে পারেন, আপনার বাক্যের অর্থ যদি বুঝিতে না পারি, সে ত আমার বুদ্ধির দোষ নহে, আপনার ভাষার দোষ। গুরু দ্রব্য নামে, লঘু দ্রব্য উঠে, বলিবার পূর্ব্বে গুরু লঘু কাহাকে বলে, আমাকে বুঝাইয়া দেওয়া উচিত ছিল। আপনার আইনের ভাষা যোজনায় দোষ ঘটিয়াছে; উহার সংশোধন আবশ্যক। 

ভাষা সংশোধনের পর প্রাকৃতিক আইনের সংশোধিত ধারাটা দাঁড়াইবে এই রকম :—

ধারা।—কোন দ্রব্য অপর তরল বা বায়বীয় দ্রব্যমধ্যে রাখিলে প্রথম দ্রব্য যদি দ্বিতীয় দ্রব্য অপেক্ষা গুরু হয়, তাহা হইলে নিম্নগামী হইবে, আর যদি লঘু হয়, তাহা হইলে ঊর্ধ্বগামী হইবে।

ব্যাখ্যা।—এক দ্রব্য অন্য দ্রব্য অপেক্ষা গুরু কি লঘু, তাহা উভয়ের সমান আয়তন লইয়া নিত্তিতে ওজন করিয়া দেখিতে হইবে।

উদাহরণ।—রাম প্রথম দ্রব্য, শ্যাম দ্বিতীয় দ্রব্য। রামকে শ্যামের আয়তন মত ছাঁটিয়া ল‍ইয়া তুলাদন্ডে ওজন করিয়া দেখ, রাম যদি শ্যাম অপেক্ষা গুরু হয়, তাহা হইলে শ্যামের মধ্যে রামকে রাখিলে রাম নিম্নগামী হইবে। শ্যামকে তরল পদার্থ মনে করিতে আপত্তি করিও না।

সংশোধনের পর আইনের ভাষা অত্যন্ত সুবোধ্য হইয়া দাঁড়াইল, সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নাই। 

এখন দেখা যাউক, কত দূর দাঁড়াইল। পার্থিব দ্রব্য মাত্রই ভূমি স্পর্শ করিতে চাহে, নিম্নগামী হয়; ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম নহে। সুতরাং উহার ব্যভিতার দেখিলে বিস্মিত হইবার হেতু নাই; পার্থিব দ্রব্য অবস্থাবিশেষে, অর্থাৎ অন্য পার্থিব বস্তুর সন্নিধানে, কখনও বা উপরে উঠে, কখনও বা নীচে নামে। যখন অন্য কোন বস্তুর সন্নিধানে থাকে না, তখন সকল পার্থিব দ্রব্য নীচে নামে। যেমন শূন্য প্রদেশে, পাম্পযোগে কোন প্রদেশকে জলশূন্য ও বায়ুশূন্য করিয়া সেখানে যে-কোন দ্রব্য রাখিবে, তাহাই নিম্নগামী হইবে। আর বায়ুমধ্যে, জলমধ্যে, তেলের মধ্যে, পারদ মধ্যে কোন জিনিষ রাখিলে তখন লঘু-গুরু বিচার করিতে হইবে। ফলে ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম; ইহার ব্যাভিচার নাই। এই অর্থে প্রকৃতির নিয়ম অলঙ্ঘ্য। 

তবে যত দোষ এই জলের আর তেলের আর পারার আর বাতাসের। উহাদের সন্নিধিই এই বিষম সংশয় উৎপাদনের হেতু হইয়াছিল। ভাগ্যে মনুষ্য বুদ্ধিজীবী, তাই প্রকৃত দোষীর সন্ধান করিতে পারিয়াছে; নতুবা প্রকৃতিতে নিয়মের প্রভুত্বটা গিয়াছিল আর কি!

বাস্তবিকই দোষ এই তরল পদার্থের ও বায়বীয় পদার্থের। বেলুন উপরে উঠে, বায়ু আছে বলিয়া; শোলা জলে বাসে, জল আছে বলিয়া; লোহা পারায় ভাসে, পারা আছে বলিয়া; নতুবা সকলেই ডুবিত, কেহই ভাসিত না; সকলেই নামিত, কেহই উঠিত না।

অর্থাৎ কি না, পৃথিবী যেমন সকল দ্রব্যকেই কেন্দ্রমুখে আনিতে চায়, তরল ও বায়বীয় পদার্থ মাত্রেই তেমনই মগ্ন দ্রব্য মাত্রকেই উপরে তুলিতে চায়। প্রথম ব্যাপারের নাম দিয়াছি মাধ্যাকর্ষণ; দ্বিতীয় ব্যাপারের নাম দাও চাপ। মাধ্যাকর্ষণে নামায়, চাপে ঠেলিয়া উঠায়। যেখানে উভয় বর্তমান, সেখানে উভয়ই কার্য্য করে। যার যত জোর। যেখানে আকর্ষণ চাপ অপেক্ষা প্রবল, সেখানে মোটের উপর নামিতে হয়; যেখানে চাপ আকর্ষণ অপেক্ষা প্রবল, সেখানে মোটের উপর উঠিতে হয়। যেখানে উভয়ই সমান, সেখঅনে “ন যযৌ ন তস্থৌ”। 

এখন এ পক্ষ স্পর্ধা করিয়া বলিবেন, — দেখিলে, প্রাকৃতিক নিয়মের আর ব্যতিক্রম আছে কি? আমাদের প্রকৃতির রাজ্যে কি কেবল একটা নিয়ম; কেবলই কি একটা আইন? অনেক নিয়ম ও অনেক আইন, অথবা একই আইনের অনেক ধারা। যথা—

১ নং ধারা—পার্থিব আকর্ষণে বস্তু মাত্রই নিম্নগামী হয়।

২ নং ধারা—তরল ও বায়বীয় পদার্থের চাপে বস্তু মাত্রই ঊর্ধ্বগামী হয়।

৩ নং ধারা—আকর্ষণ ও চাপ উভয়ই যুগপৎ কাজ করে। আকর্ষণ প্রবল হইলে নামায়, চাপ প্রবল হইলে উঠায়। 

কাহার সাধ্য, এখন বলে যে, প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যভিচার আছে? উঠিলেও নিয়ম, নামিলেও নিয়ম, স্থির থাকিলেও নিয়ম; নিয়ম কাটাইবার যো নাই। প্রকৃতির রাজ্য বস্তুতই নিয়মের রাজ্য। নারিকেল-ফল যে নিয়ম লঙ্ঘন করে না, তাহা যে দিন হইতে নারিকেল-ফল মনুষ্যের ভক্ষ্য হইয়াছে, তদবধি সকলেই জানে। বেলুন যে ঊর্ধ্বগামী হইয়াও নিয়ম লঙ্ঘন করিতে পারিল না, তাহাও দেখা গেল। কেন না, পৃথিবীর আকর্ষণ উভয় স্থলেই বিদ্যমান। 

পার্থিব দ্রব্য ব্যতীত অপার্থিব দ্রব্যও যে পৃথিবীর দিকে আসিতে চায়, তাহা কিন্তু সকলে জানিত না। দুই শত বৎসরের অধিক হইল, এক জন লোক পৃথিবীতে জানান, অয়ি মাতঃ, তোমার আকর্ষণ কেবল নারিকেল ফলেই ও আতা ফলেই আবদ্ধ নহে; তোমার আকর্ষণ বহুদূরব্যাপী। তোমার অধম সন্তানেরা তাহা জানিয়াও জানে না। এই ব্যক্তির নাম সার আইজাক নিউটন। 

তিনি জানাইলেন দূরূদ্ধ চন্দ্রদের পর্যন্ত পৃথিবী মুখে নামিতেছেন, ক্রমাগত ভূমিস্পর্শের চেষ্টা করিতেছেন, কেবল স্পর্শ লাভটি ঘটিতেছে না। কেবল তাহাই কি? স্বয়ং দিবাকর, তাহার পার্ষদবর্গ সমভিব্যাহারে পৃথিবী মুখে আসিবার চেষ্টায় আছেন। কেবল তাহাই কি? পৃথিবীও তাহাদের প্রত্যেকের নিকট যাইতে চেষ্টা করিতেছেন। অর্থাৎ সকলের দিকে যাইতে চাহিতেছেন; স্বস্থানে স্থির থাকিতে কাহারও চেষ্টা নাই, সকলেই সকলের দিকে ধাবমান। 

ধাবমান বটে, কিন্তু নিৰ্দ্দিষ্ট বিধানে; পৃথিবী সূর্য্য হইতে এত দূরে আছেন; আচ্ছা, পৃথিবী এইটুকু জোরে সূর্যের অভিমুখে চলিতে থাকুন। চন্দ্র পৃথিবী হইতে এতটা দূরে আছেন, বেশ, চন্দ্র প্রতি মিনিটে এত ফুট করিয়া পৃথিবী মুখে অগ্রসর হউন। পৃথিবী নিজেও চন্দ্রা হইতে এত দূরে আছেন, তিনিও মিনিটে চন্দ্রের দিকে এত ফুট চলুন। তবে তাঁহার কলেবর কিছু গুরুভার, তাহাকে এত ফুট হিসাবে চলিলেই হইবে; চণ্ডা পৃথিবীর তুলনায় লঘুশরীর; তাঁহাকে এত ফুট হিসাবে না চলিলে হইবে না। তুমি বৃহস্পতি, বিশাল কায় লইয়া বলতু দূরে থাকিয়া পার পাইবে মনে করিও, না। তোমার অপেক্ষা বহুগুণে বিশালকায় সূর্যাদেব বর্ত্তমান; তুমি তাহার অভিমুখে এই নির্দিষ্ট বিধানে চলিতে বাধ্য; আর বুধ-কুজাদি ক্ষুদ্র গ্রহগণকেও একেবারে অবজ্ঞা করিলে তোমার চলিবে না, তাহাদের দিক্ দিয়াও একটু ঘুরিয়া চগিলতে হইবে। আর শনৈশ্চর, কোটি কোটি লোষ্ট্রখন্ডের মালা ভিরিয়া গৰ্ব্ব করিও না; এই ক্ষুদ্র লোষ্ট্রখণ্ডকে উপহাস করিবার তোমার ক্ষমতা নাই। নেপচুন, তুমি বহু দূরে থাকিয়া এত কাল লুকাইয়াছিলে বন্ধু উরেনসকে টান দিতে গিয়া স্বয়ং ধরা পড়িলে।

আবিষ্কৃত হইল বিশ্বজগতে একটা মহানিয়ম: একটা কঠোর আইন। এই আইন ভালা করিয়া এড়াইবার উপায় কাহারও নাই। সূর্য্য হইতে বালুকণা পর্যন্ত সকলেই পরস্পরের মুখ চাহিয়া চলিতেছে, নির্দিষ্ট বিধানে নির্দিষ্ট পথে চলিতেছে। খড়ি পাতিয়া বলিয়া দিতে পারি, ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল মধ্যাহ্নকালে কোন গ্রহ কোথায় থাকিবেন। এই যে কঠোর আইন প্রকৃতির সাম্রাজ্যে প্রচলিত আছে, ইহার এলাকা কত দূর বিস্তৃত। সমস্ত বিশ্ব-সাম্রাজ্যে কি এই নিয়ম চলিতেছে? বলা কঠিন। সৌরজগতের মধ্যে ত আইন প্রচলিত দেখিতেই পাইতেছি। সৌরজগতের বাহিরে খবর কি? বাহিরের খবর পাওয়া দুষ্কর। খগোলমধ্যে স্থানে স্থানে এক এক ঘোড়া তারা দেখা যায়; তারকাযুগলের মধ্যে একে অন্যকে বেষ্টন করিয়া মুরিতেছে। যেমন চন্দ্র ও পৃথিবী এক যোড়া বা পৃথিবী সূর্য আর এক ঘোড়া, কতকটা তেমনই। পরস্পর বেষ্টন করিয়া পুরিবার চেষ্টা দেখিয়াই বুঝা যায়, সৌরজগতের বাহিরেও এই আইন। বলবৎ। কিন্তু সৰ্ব্ব বলব কি না, বলা যায় না। কেননা, সংবাদের অভাব। দূরের তারাগুলি পরপর হইতে এত দূরে আছে যে, পরস্পর আকর্ষণ থাকিলেও তাহার ফল এত সামানা যে, তাহা আমাদের গণনাতে ভাসে না, আমাদের প্রত্যক্ষগোচরও হয় না।


সম্ভবতঃ এই আইনের এলাকা বহুদূর বিস্তৃত। সমস্ত খগোলমধ্যে সকলেই সম্ভবতঃ এই আইনের অধীন। কিন্তু যদি কোন দিন আবিষ্কৃত হয় যে, কোন একটা তারা বা কোন একটা প্রদেশের তারকাগণ এই আইন মানিতেছে না, তাহা হইবে কি হইবে? যদি বিশ্ব সাম্রাজ্যের কোন প্রদেশের মধ্যে এই আইন না চলে, তবে কি ব্রহ্মান্ডকে নিয়মতন্ত্র রাজ্য বলিয়া গণ্য করিব না? 

মনে কর, নিউটন সৌরজগতের মধ্যে যে নিয়মের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, দেখা গেল, বিশ্ব-জগতের অন্য কোন প্রদেশে সেই নিয়ম চলে না, সেখানে গতিবিধি অন্য নিয়মে ঘটে; তখন কি বলিব? তখন নিউটনের নিয়মকে সংশোধন করিয়া লইয়া বলিব, বিশ্ব-জগতের এই প্রদেশে এই নিয়ম; অমুক প্রদেশে কিন্তু অন্য নিয়ম। এই প্রদেশে এই নিয়মের ব্যভিচার নাই, ঐ প্রদেশে ঐ নিয়েমর ব্যভিচার নাই। কিন্তু সর্ব্বত্রই নিয়মের বন্ধন,— জগৎ নিয়মের রাজ্য। নিউটনের আবিষ্কৃত নিয়ম সৰ্ব্বত্র চলে না বটে, কিন্তু কোন-না-কোন নিয়ম চলে। 

ইহার উপর আর নিয়মের রাজত্বে সংশয় স্থাপনের কোন উপায় থাকিতেছে না। কোন একটা নিয়ম আবিষ্কার করিলাম; যত দিন তাহার ব্যভিচারের দৃষ্টান্ত দেখিলাম না, বলিলাম—এই নিয়ম অনিবার্য্য, ইহার ব্যভিচার নাই। যে দিন দেখিলাম, অমুক স্থানে আর সে নিয়ম চলিতেছে না, অমনি সংশোধনের ব্যবস্থা। তখনই ভাষা বদলাইয়া নিয়ম সংশোধিত ভাবে প্রকাশ করিলাম। বলিলাম—অহো, এত দিন আমার ভুল হইয়াছিল; ঐ স্থানে ঐ নিয়ম, আর এই স্থানে এই নিয়ম। আগে যাহা নিয়ম বলিতেছিলাম, তাহা নিয়ম নহে; এখন যাহা দেখিতেছি, তাহাই নিয়ম। প্রাকৃতিক নিয়মগুলি যেন ব্যাকরণের নিয়ম; যেন ব্যাকরণের সূত্র। ইকারাস্ত পুংলিঙ্গ শব্দের রূপ সর্ব্বত্র মুনি শব্দের মত, পতি শব্দ ও সখি শব্দ, এই দুইটি বাদ দিয়া। এখানে সাবেক নিয়মের যে ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম দেখিতেছ, উহা প্রকৃত ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম নহে, উহা একটা নবাবিস্তৃত অজ্ঞাতপূর্ব্ব নিয়ম, এরূপ স্থানে এইরূপ ব্যভিচারই নিয়ম। ইহার উপর আর কথা নাই। 

অর্থাৎ কি না, নিয়মের যতই ব্যভিচার দেখ না কেন, নিয়ম ভাঙ্গিয়াছে বলিবার উপায় নাই। জলে শোলা ভাসিতেছে, ইহাতে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম ভাঙ্গিল কি? কখনও না; এখানে মাধ্যাকর্ষণ বর্তমান আছে, তবে জলের চাপে শোলাকে ডুবিতে দিতেছে না, এ স্থানে ইহাই নিয়ম। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে আমাদের দেশে বর্ষা হয়। এ বৎসর বর্ষা ভাল হইল না; তাহাতে নিয়ম ভাঙ্গিল কি? কখনই না। এ বৎসর হিমালয়ে যথেষ্ট হিমপাত ঘটিয়াছে; অথবা আফ্রিকার উপকূলে এবার অতিবৃষ্টি ঘটিয়াছে; এবার ত এ দেশে বর্ষা না হইবারই কথা; ঠিক ত নিয়মমত কাজই হইয়াছে। নিয়ম দেখা গেল, চুম্বকের কাঁটা উত্তরমুখে থাকে। পরেই দেখা গেল, ঠিক উত্তর মুখে থাকে না; একটু হেলিয়া থাকে। আচ্ছা, উহাই ত নিয়ম। আবার কলিকাতায় যতটা হেলিয়া আছে, লন্ডন শহরে ততটা হেলিয়া নাই, না থাকিবারই কথা; ইহাই ত নিয়ম। আবার কলিকাতায় এ বৎসর যতটা হেলিয়া আছে, ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে ততটা হেলিয়া ছিল না। কি পাপ, উহাই ত নিয়ম? চুম্বকের কাঁটা চিরকালই এক মুখে থাকিবে, এমন কি কথা আছে? উহা একটু একটু করিয়া প্রতি বৎসর সরিয়া যায়। দুই শত বৎসর বরাবরই দেখিতেছি, ঐরূপ সরিয়া যাইতেছে; উহাই ত নিয়ম। কাটা আবার থাকিয়া থাকিয়া নাচে, কাপে, স্পন্দিত হয়। ঠিকই ত। সময়ে সময়ে নাচাই ও নিয়ম। প্রতি এগার বৎসর একবার উহার এইরূপ নর্তনপ্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে। আবার সূর্য্যবিশ্বে যখন কলঙ্কসংখ্যার বৃদ্ধি হয়, যখন মেরুপ্রদেশে উদীচী ঊষার দীপ্তি প্রকাশ পায়, তখনও এই নৰ্ত্তনপ্রবৃত্তি বাড়ে। বাড়িবেই ত, ইহাই ত নিয়ম।

একটা নিয়ম আছে, আলোকের রশ্মি সরল রেখাক্রমে ঋজু পথে যায়। যতক্ষণ একই পদার্থের মধ্য দিয়া চলে, ততক্ষণ বরাবর একই মুখে চলে। জানালা দিয়া রৌদ্র আসিলে সম্মুখের দেওয়ালে আলো পড়ে। ছিদ্রের ভিতর দিয়া চাহিয়া সম্মুখের জিনিষ দেখা যায়, আশ-পাশের জিনিষ দেখা যায় না। কাজেই বলিতে হইবে—আলোক ঋজু পথে চলে। নতুবা ছায়া পড়িত না; চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ ঘটিত না। অতএব আলোকের সোজা পথে যাওয়াই নিয়ম। কিন্তু সৰ্ব্বত্রই কি এই নিয়ম। অতি সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভিতর দিয়া আলো গেলে দেখা যায়, আলোক ঠিক সোজা পথে না গিয়া আশে পাশে কিছু দূর পর্যন্ত যায়। শব্দ যেমন জানালার পথে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে চলে ও আশে পাশে চলে, সেইরূপ আলোকরশ্মিও সূক্ষ্ম ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে চলে ও আশে-পাশে যাওয়াই নিয়ম। বস্তুতঃ এ স্থলেও প্রাকৃতিক নিয়মের কোন লঙ্ঘন হয় নাই।

শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় এই। যাহা দেখিব, তাহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাহা এ পর্যন্ত দেখি নাই, তাহা নিয়ম নহে বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি; কিন্তু যে-কোন সময়ে একটা অজ্ঞাতপূর্ব্ব ঘটনা ঘটিয়া আমার নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়মকে বিপর্যস্ত করিয়া দিতে পারে। কাজেই এটা প্রাকৃতিক নিয়ম, ওটা নিয়ম নাহে, ইহা পূরা সাহসে বলাই দায়।অথবা যাহা দেখিব, তাহাই যখন নিয়ম, তখন নিয়মলঙ্ঘনের সম্ভাবনা কোথায়? চিরকাল সূর্য্য পূর্ব্বে উঠে, দেখিয়া আসিতেছি; উহাই প্রাকৃতিক নিয়ম মনে করিয়া বসিয়া আছি; কেহ পশ্চিমে সূর্য্যোদয় বর্ণনা করিলে তাহাকে পাগল বলি। কিন্তু কাল প্রাতে যদি দুনিয়ার লোকে দেখিতে পায়, সূর্য্যদেব পশ্চিমেই উঠিলেন আর পূৰ্ব্বমুখে চলিতে লাগিলেন, তখন সে দিন হইতে উহাকেই প্রাকৃতিক নিয়ম বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। অবশ্য এরূপ ঘটনার সম্ভাবনা অত্যন্ত অল্প। কিন্তু যদি ঘটে, পৃথিবীর সমস্ত বৈজ্ঞানিক একযোট হইয়া তাহার প্রতিবিধান করিতে পারিবেন কি?

প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মটা কিরূপ, তাহা কতক বোঝা গেল। তুমি সোজা চলিতেছ, ভাল, উহাই নিয়ম; বাঁকা চলিতেছ, বেশ কথা, উহাই নিয়ম। তুমি হাসিতেছ, ঠিক নিয়মানুযায়ী; কাঁদিতেছ, তাহাতেও নিয়মের ব্যতিক্রম নাই। যাহা ঘটে, তাহাই যখন নিয়ম, তখন নিয়মের ব্যভিচারের আর অবকাশ থাকিল কোথায়? কোন নিয়ম সোজা; কোন নিয়ম বা খুব জটিল। কোনটাতে বা ব্যভিচার দেখি না; কোনটাতে বা ব্যভিচার দেখি; কিন্তু বলি, ঐখানে ঐ ব্যভিচার থাকাই নিয়ম। কাজেই নিয়মের রাজ্য ছাড়িয়া যাইবার উপায় নাই।

ফলে জাগতিক ঘটনাপরম্পরার মধ্যে কতকগুলা সিম্বন্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। ঘটনাগুলা একেবারে অসম্বন্ধ বা শৃঙ্খলাশূন্য নহে। মানুষ যত দেখে, যত সূক্ষ্ম ভাবে দেখে, যত বিচার করিয়া দেখে, ততই বিবিধ সম্বন্ধের আবিষ্কার করিয়া থাকে। বহুকাল হইতে মানুষে দেখিয়া আসিতেছে, সূর্য্য পূর্ব্বে উঠে, নারিকেল ভূমিতে পড়ে কাষ্ঠরূপী ইন্ধনযোগে প্রাকৃত অগ্নি উদ্দীপিত হয়, আর অন্নরূপী ইন্ধনযোগে জঠরাগ্নি নির্ব্বাপিত হয়। এই সকল ঘটনার পরস্পর সম্বন্ধ মনুষ্য বহুকাল হইতে জানে। আলোক ও তাড়িত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির সম্পর্কে নানা তথ্য, বিবিধ ঘটনার পরস্পর সম্বন্ধ, মনুষ্য অল্প দিন মাত্র জানিয়াছে। যত দেখে, ততই শেখে, ততই জানে; যতক্ষণ তাহা অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। ইন্দ্রিয়গোচর হইলেই তৎসম্পর্কে একটা নূতন তথ্যের আবিষ্কার হয়। কিন্তু পূৰ্ব্ব হইতে কে বলিতে পারে, কালি কোন্ নূতন নিয়মের আবিষ্কার হইবে? বিংশ শতাব্দীর শেষে মনুষ্যের জ্ঞানের সীমানা কোথায় পৌঁছিবে, আজ তাহা কে বলিতে পারে?

যাহা দেখিতেছি, যে সকল ঘটনা দেখিতেছি, তাহাদিগকে মিলাইয়া তাহাদের সাহচর্য্যাগত ও পরম্পরাগত সম্পর্ক যাহা নিরূপণ করিতেছি, তাহাই যখন প্রাকৃতিক নিয়ম, তখন প্রকৃতিতে অনিয়মের সম্ভাবনা কোথায়? যাহা কিছু ঘটে, তাহা যতই অজ্ঞাতপূর্ব্ব হউক না কেন, তাহা যতই অভিনব হউক না, তাহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। কোন স্থলে কোন নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিলে সেই ব্যতিক্রমকেই সেখানে নিয়ম বলিতে হয়। কাজেই ব্রহ্মান্ড নিয়মের রাজ্য। ইহাতে আবার বিস্ময়ের কথা কি? ইহাতে আনন্দে গদগদ হইবারই বা হেতু কি? আর নিয়মের শাসনে জগদ্যন্ত্র চলিতেছে মনে করিয়া একজন সৃষ্টিছাড়া নিয়ন্তার কল্পনা করিবারই বা অধিকার কোথায়? জগতে কিছু না কিছু ঘটিতেছে, এটার পর ওটা ঘটিতেছে, যাহা যেরূপে ঘটিতেছে, তাহাই নিয়ম, প্রাকৃতিক নিয়মের আর কোন তাৎপর্য নাই। এই নিয়ম দেখিয়া বিস্ময়ের কোন হেতু নাই। এই ঘটনাটাই বরং আশ্চর্য—একটা কিছু যে ঘটিতেছে, ইহাই বিস্ময়ের বিষয়। জগৎ-ঘটনাটার প্রয়োজন কি ছিল, ইহা ঘটেই বা কেন, ইহাই বিস্ময়ের বিষয়। ইহার উত্তরে অজ্ঞানবাদী বলেন, জানি না; ভক্ত বলেন, ইহা কোন অঘটন-ঘটনা-পটুর লীলা; বৈদান্তিক বলেন, আমিই সেই অঘটন-ঘটনায় পটু—আমার ইহাতে আনন্দ; বৌদ্ধ একেবারে চুকাইয়া দেন ও বলেন, কিছুই ঘটে নাই।

কবিতাগুচ্ছ ২২ -কবিরা
Nov. 25, 2024 | কবিতা | views:291 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পাপীর কান্না

লি খে ছে ন – অ শো ক  দা স  চা র্বা ক 




পাপীসব করে রব 

রাতি পোহাইল,

নরকের ভয়ে মরি 

দেবীকে ডাকিল। 


মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা 

উঠিল বাজিয়া,

জোটে যত পাপীগণ 

ছুটিয়া ছুটিয়া। 


কীর্তন করিয়া  ওরা 

নাচিতে লাগিল,

দেবনামে ধরাধাম 

বিষিয়া উঠিল। 


যার পাপ বেশী যত,

বেশি যার লোভ পরিমাণ,

গলা ফাটে তার তত 

তেজী  নেচে যায় যে পরান। 


নরকের ভয়ে মরে 

যত ভক্তগণ,

করে তাই ইষ্টনাম 

করিয়া যতন। 


স্বরগের লালসায় 

দেবে ফুল ছুঁড়ি,

দান ধ্যান করে তারা 

পাপে ভরা ভুঁড়ি। 


শত টাকা চুরি করি 

দুই টাকা দান, 

ভক্ত ভাবে হলো বুঝি

পাপ সমাধান। 


কানদিতে লাগিল যত 

ভীত সাধুগণ,

"নরকে নিও না মোরে 

স্বর্গ দাও পণ। "


এটা দাও ওটা দাও 

(এট্যাং দেহি ওটাং দেহি)

গাহি লোভীগন,

দেবতার চরণেতে 

কান্দে অনুখন। 


দেবতা বলেন,"ওরে 

পাপী বাছাধন,

উৎকোচ পাইয়া পাপ 

না করি খণ্ডন।"


আমি নেতা আমলা নই 

ভাংগিব নিয়ম,

পূজা পেয়ে দিব বর 

ত্যেজিয়া ধরম। 


প্রকৃতির নিয়মেতে 

পৃথিবীটা ঘোরে,

কোন ভগবান সেটা 

থামাতে না পারে। 

 

ঘুষ দিয়া দেবগনে 

কেনা নাহি যায়,

বৃথা দাও অঞ্জলী 

ভুলি নিজ দায়। 


নিয়মের দাস আমি 

বড় অসহায়,

স্বরগে আনিতে নারি 

চাতুরী সহায়। 


যে যার কর্মের ফল 

সবে ভোগ কর,

বৃথা পূজা চাটুকারী 

ঘুষদান ছাড়। 


কর্মমত পাওনা সব 

নিয়মেতে পাও,

প্রাপ্যবেশী লভিবেনা 

যত পূজা দাও। "


গাহিল চার্বাক ঋষি 

শুন মন দিয়া,

ধান্দা ধর্ম ছাড়ি দাও 

মানবধর্ম নিয়া।


রচনা কাল ২০০১ বেলেঘাটা সুভাষ সরোবরে ভোরের নাচ কীর্তন দেখতে দেখতে।

সমালোচনা সম্পাদক / asokdas.godless@gmail.com







মিসাইল

লি খে ছে ন – সা ম্য


সন্ধ্যা নামার পরে,

কলকাতা শহরে,

পার্কস্ট্রিট উড়ালপুলের নীচে,

কাপড় বিছিয়ে,

ঘোড়ার গু আর মানুষের পেচ্ছাপের পাশে শুয়ে,

অন্ধকারে ভয় পেয়ে,

নাঙ্গা শিশু বড় রাস্তার দিকে ছুটে যায়।

তখনই হঠাৎ প্রায়,

আকাশেতে আলো জ্বেলে,

তুচ্ছ বিষয় দূরে ঠেলে,

ঔষধ চাইল ডাইল -

উড়ে যায় মিসাইল।


অবরোধ হবে আজ,

মানুষের নাই কাজ!

কোথায় এ শীতের বেলা -

নন্দন বইমেলা -

নতুন প্রেমিক আশ,

কবিতা লেখার প্রয়াস,

এর মাঝে যত সব,

"কাজ চাই" তোলে রব!

চাই নিরিবিলি ঘর,

নিয়ন আলোর স্বর।

আলো জ্বালে মহানীল,

নিউক্লিয়ার মিসাইল।


দুর্নীতি শিখরে,

পথ জুড়ে ভুখা রে,

তোদের জন্যে আজ

সেজেছি যুদ্ধ সাজ!

ভোট ভোট ভারী মজা,

মরে শুধু কিছু প্রজা।

বিধানসভার বিপরীতে,

জনগণকমিটিতে

জড়ো হয় এই বেলা,

বেস্পতি বারবেলা

কোন ভূতে মারে ঢিল?

কাহাদের মিসাইল?


দুঃসময়

লি খে ছে ন – স জ ল  কা ন্তি  টি কা দা র 


মায়ের চোখে জল কেন আজ

জানিস কি কেউ তোরা?

চারদিকেতে গোলা বারুদ

চলছে ছুরি ছোরা!

স্বাধীনতার এই বকলমে

স্বেচ্ছাচারই চলছে

নেতারা সব কালো টাকায় 

গাড়ী বাড়ী করছে!

ছোট্ট শিশু দুধের শিশু

ফুট পাতেতে ঘুরছে

দাদারা সব তাদের বাড়ী

টাইলস দিয়েই মুড়ছে।


ধর্ম নিয়ে চিৎকার শুধু

ধর্ম কোথায় আছে!

চারদিকেতে আঁধার দ্যাখো

ধর্ম পিশাচ নাচে--

উন্মত্ত আজ তোমার ছেলে

উদ্ধত পতাকা নিয়ে

মানুষ মেরে হাত যে রাঙায়

ধর্ম দোহাই দিয়ে!!


পুলিশকে আজ সততার কথা

বলতে মুখে বাধে

খেলার পুতুল তারা যে সব

দেশ নেতাদের হাতে।

মাকে আজ বোকা বানিয়ে

শিশু চুরি হচ্ছে

নেতারা সব মঞ্চে উঠে

মিথ্যে ভাষণ বলছে!


মনুষ্যত্ব আজ কোথায় গেলো

দ্যাখোতো কেউ খুঁজে

আইনও তো দেখছি আজ

আছে সে চোখ বুজে।


এদলকে ওদলেরা যদি

মাখায় কালি চুন

এদলও কম যায় না

বলে যে শতগুন

আসলে রাজনীতি হয়েছে

আজ সার্কাসেরই অঙ্গ

দেখে শুনে লাগছে ব্যথা

তাই কাঁদছে পশ্চিম বঙ্গ।




পৈতা টিকির ছদ্মবেশ

লি খে ছে ন - অ শো ক  দা স  চা র্বা ক


[ নাতির উপনয়ন উপলক্ষে কবিগুরুর "এস ব্রাহ্মণ শুচি করি মন" এবং বিদ্রোহী কবির "জাতের নাম বজ্জাতি সব। ..." ভাবনাদ্বয়কে আশ্রয় করে পাঠকগণকে একটি ছন্দহীন কবিতা  নিবেদনের প্রচেষ্টা ]


নিজেকে তুঙ্গে তুলি

জনমের উৎস ভুলি

বামুন হইবে তুমি আজ,

পরিয়া পৈতা টিকি

জনচোখে দিবে ফাঁকি

ধরিবেক পুরুতের সাজ।

প্রতারনা করি তুমি

হইবে শূদ্রের স্বামী

শুষিবেক যত যজমান,

নরকের ভয়ে তারা

স্বরগের লোভে ওরা

করিবেক সিধা সোনা দান। 

পরজীবী ব্রাহ্মণ

লুটিবে শূদ্রধন

ধর্মের ছুরিতে দিয়া সান,

মনুগপ্পো ফাঁদি তারা

করি সবে দিশাহারা

সাজিবেক যেন ভগবান।

হবে নাকি ব্রহ্মচারী,

শুনিয়া হাসিয়া মরি

ভিক্ষান্নে রাখিবেক দেহ!

দেখি তব মতিগতি

ছলনায় ভরা অতি,

সত্য বলি মানিবেনা কেহ।

পদধূলি চাটি তব

পূন্যি করে বৃদ্ধ নব

সৌভাগ্য হইবে তার অতি,

ছলনায় ভুলি সবে

তোমারে পুজিবে এবে

কৃতার্থ হইবে নিচু জাতি।

করিয়া পুতুল কেলি

মানুষেরে পায়ে ঠেলি

দেখাইবে পূজা অভিনয়,

শুনি নিজ বংশকথা

লাজে পাও বড় ব্যাথা

স্বীকার করিতে করো ভয়।

আফ্রিকার হনুমানী

সবারই ঠাকুমা জানি

ইহা তব জন্ম ইতিকথা,

সে 'লুসির'* সাথী শুনি

বলে ডারউইন জ্ঞানী

সবাকার আদি কুলপিতা।

বামুনের জন্ম হল

একই বীর্য্যে শূদ্র এল

জন্মিল  হনুর ঔরসে,

হোমিনিড আদি পিতা

সাথী তার আদি মাতা

শুনিয়া বামুন কাঁপে রোষে।

অর্ধপশু ছিল তারা

নানা মাংসে পুষ্ট  ওরা

পশুরক্ত বহে তার দেহে,

তাহারাই তব মাতা

হনুজাতি তব পিতা

ভুলে থাক গরবের মোহে।

তাদের শোনিত বহে

বামুনেরও অঙ্গ দেহে

লাখো লাখো যুগযুগ ধরিয়া,

চণ্ডাল শরীরে দেখি

একই রক্ত, জীন একই

গোপন করিতে হও মরীয়া

একই পিতার সন্তান

আদি গোত্র  হনুমান

ম্লেচ্ছ চণ্ডাল তব ভাই,

জন্মসত্য গোপন করি

বামুনের ভেক ধরি

দেবতার পাশে মাগ ঠাঁই।

ইথিওপ আফ্রিকান

প্রকৃতির ফরমান,

বিবর্তন নিয়ম মেনে  হনু হলো স্যাপিয়ন;

ইরানীরা তুতোভাই

বাঙালিনী তার বোন.

রক্ততুতো ভাই বোন হিন্দু মুসলমান।

একই বীর্য্যে সৃষ্টি সব বামুন কি চণ্ডাল

হনুবীর্য্যে জন্ম তব ইতিহাস আদিকাল।

ব্রহ্মার মুন্ড হতে বামুন জনম

শুনি সে কপট শাস্ত্র না হয় হজম।

ব্রহ্মপদ অংশে যদি শূদ্রদেহ হয়,

কেমনে সে দেবঅঙ্গ অচ্ছুৎ রয়??

যেমতি রক্ত তাঁর মাথাপানে ধায়

তেমতি চণ্ডালরক্ত বামুন মাথায়।

ব্রহ্মপদ  পূজে যদি পূণ্যবৃদ্ধি হয়,

শুদ্রপদ চুমে কেন স্বর্গপ্রাপ্তি নয়?

এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন সবাকার হাত ধর,

জাতির নামে বজ্জাতি সব জাল জালিয়াতি ছাড়।

কেটে ফেল টিকি ছিঁড়ে ফেল সুতা,

কেউ উঁচু নয়, এক পিতামাতা।

ডোমের পরশে শুদ্ধ হইয়া অমৃত বরণ কর।



উপনয়ন শেষে নাতির প্রতি উপদেশ


নাতি হলো ব্রহ্মচারী

ভিক্ষা দিল যত বুড়ি,

নাটক দেখিয়া শেষে

করে ভোজ ভুরি ভুরি।

নাতী খেল কাঁচকলা

আতপ চালের ভাত,

অতিথিরা মুরগী পাঁঠা

চেটেপুটে সাফ পাত।

পৈতা দেখিয়া হাবা

নেয় তব পদধূল,

শূদ্রদিদা পূন্যলোভে

হইল ব্যাকুল।

ষাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে

মাথা তব পায়,

দেখিয়া জগৎবাসী

লাজে মরে যায়।

শূদ্র বলি দাদুমুখ

দেখিবেনা নাতি,

বামুনত্ব কেঁচে যাবে

হেরি নিচু জাতি।

বামুনের  ভবিষ্যৎ

জানিবারে চাই,

কালে কালে বড় হয়ে

কি করিবে ভাই।

মানস চোখেতে দেখি

পশিছে সে গৃহীঘরে

করিয়া নানান ভঙ্গি

দেবপূজা নাট্য  করে।

প্রণামী ট্যাঙ্কেতে পুরি

চালকলা ব্যাগে ভরি

পুরুত ফিরিছে গৃহে

মাথা তার নিচু করি।

দেখি সে লালসদৃশ্য

সবে দেয় গঞ্জনা,

দাদু কি সহিতে পারে

নাতির সে যন্ত্রনা?

পদধূলি চাটে বটে

দখিনাও ছুঁড়ে দেয়,

নরকের ভয়ে গৃহী

অভিনয় করে হায়।

পুরুতকে সম্মান

করে যত যজমান,

বেচারা আড়ালে গেলে

পিছে করে গালিদান।

উপরে দেখায় ভক্তি

অন্তরে ঘৃণা,

নাতির ভবিতব্য দেখি

হয় মনে যন্ত্রনা।

কানে কানে বলি তারে

পুরুত হয়োনা ভাই,

সৎ কোন পেশা ধরে

খেটে খুটে খাওয়া চাই।

পুরুতের হীন পেশা

ধরোনাকো তুমি,

বাঁচাও ক্ষত্রিয় হয়ে

নিজ জন্মভুমী।

অথবা বাণিজ্য করো

বৈশ্যের মতন।

চাকুরিও ধরিতে পার

শুভ্র যেমন।

ঘন্টা নাড়িয়া তুমি

আরতির ঢং করি

উঞ্ছবৃত্তি করোনাকো

পরধন নিয়া কাড়ি।

স্টেজ থেকে নেবে এস

নাটক হয়েছে শেষ,

অভিনয় আর নয়

ছেড়ে ফেল ছদ্মবেশ।

ছিঁড়ে ফেল পৈতা

কেটে ফেল টিকি,

বিশুদ্ধ মানুষ হও

হয়োনাকো মেকি।



ক্ষয়িষ্ণু চেতনা

লি খে ছে ন – বি প্ল ব  সে ন



ভয়টা কোথায় প্রশ্ন করা সমাজের

চেতনার কাছে,

যদি বাস্তব দেখতে হয়

যদি কল্পনা হয় মিছে!

ধর্মের আবর্তে ঘুরে চলা

সামগ্রিকতায় দেখা

যেখানে চোখ ধাঁধানো মুক্ত বাজার

অথচ চেতনা ফাঁকা।

বাস্তবতার কাপড়ের তো নেই

চাকচিক্য

খোলা বাজার ঝকঝকে দোকান

পিছনের দৈন্যতার ভরা ঐক্য।

এই বাস্তবতা এড়িয়ে চলতে

ভয়ের আয়োজন

যাতে মানুষের চোখে থাকে

ধর্মের সন্মোহন।

সামগ্রিক ভাবে চেতনায় আসে

সম্পূরক পরিপূরকের ধারণা

কার্য কারণ মূল্যবোধে

শুধুই চেতনার তাৎক্ষণিক উন্মাদনা |

বিচ্ছিন্ন ভাবে নয় এটা

সামগ্রিক বিষয়

শোষণের এই পরাকাষ্ঠা

পুরোটাই অন্ধকার সময় |

মানুষের চেতনায় আঘাত করে

পঙ্গু করে দেওয়া

পিছনে লম্বা শক্তিশালী হাত

আছেই আছে ছোঁয়া!

বিজ্ঞান চেতনা প্রতিনিয়ত

করা চাই অনুশীলন

প্রগতির এই চলমান পক্রিয়া

সেটাই করা বর্ণন!

পরিবর্তনের এই পৃথিবীর বুকে

হচ্ছে বিকৃত বিকাশ

পরিপূর্ণতার বদলে ক্ষয়মান

অবকাশ।

তাই একবিংশ শতাব্দীর বুকে দাঁড়িয়েও

প্রচার মাধ্যমে সাধু মৌলবী আর ধর্মের রমরমা

বিজ্ঞানের প্রচার চাকচিক্য হীন

অদ্ভুত বিকৃতির মূর্ছনা।

সারা পৃথিবী আঁধারে ঢাকা

চেতনা অপসৃয়মান

আপেক্ষিকতায় চেয়ে দেখা

কেন মানুষের এমন অবস্থান।

ভীতি কাজ করে শাসন শোষণের

মধ্যে

ব্যাক্তি নয় ভয় তা দেখা সমাজের

ব্যবস্থার সান্নিধ্যে।

জব্দ -দিবাকর মন্ডল
Nov. 25, 2024 | ছোটোগল্প | views:879 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের পাড়ায় একদিন দুই সাধুবাবা এসেছিলেন। আমাদের ক্লাবের সামনে বড়ো মাঠ এবং মাঠের পাশে একটি বটগাছ রয়েছে। বট গাছটির চারিদিকে গোল করে বসার জায়গা করা রয়েছে। দুই সাধুবাবা সেখানে বসলেন এবং তাদের দেখার জন্য রীতিমতো জনগণের ভিড় বাড়তে লাগল। সাধু বাবাদের তুষ্ট করার জন্য অনেকেই অনেক রকম উপঢৌকন নিয়ে এলেন। কেউ দিলেন চাল, কেউ ডাল কেউ আলু তো কেউ আবার দুই দশ টাকা। অনেক রকম সবজি এবং ফলও দিয়েছেন। পাড়ার মোড়ল বড়ই ধার্মিক তিনি তো সবার ঊর্ধ্বে। তিনি নিয়ে এলেন একটা দামি গিনির আংটি। এবার এই আংটি নিয়ে দুই সাধুবাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিল। মোড়ল তো একটি মাত্র আংটি দিলেন কিন্তু ছিলেন দু'জন সাধু, কে নেবে এই আংটি? তারপর একে একে সমস্ত গ্রামবাসীরা বাড়ির ফিরে গেলেন। প্রত্যেকেই আশীর্বাদ পেয়েছেন, শান্তি জল পেয়েছেন। তাই তারা সাধু বাবাদের ধন্য ধন্য করতে লাগলেন।


এতক্ষণ নরেনদা সবকিছু চুপচাপ দেখছিলেন, সবাই চলে গেলেও নরেনদা কিন্তু শান্তভাবে সাধুবাবুদের মাঝে গেলেন এবং তাদের সাথে মিশে গেলেন। এটা সেটা বলতে বলতে নরেনদা একটা যুক্তি দিলেন দুই সাধুবাবাকে। যে সাধুবাবা প্রমাণ করতে পারবেন তিনি সব থেকে বড় ধার্মিক এবং ভগবানের কাছ থেকে দেখা পেয়েছেন তিনি এই আংটির অধিকারী হবেন।


নরেনদার এই প্রস্তাবে দুই সাধুবাবা রাজি হলেন এবং তারা বললেন যে আমরা পাঁচ মিনিট করে তপস্যা করব তারপরে আমরা আমাদের ভগবানের কে কতটা কাছে আসতে পেরেছি তার গল্প শোনাবো। তারপরে নরেনদা বিচার করবে কে সবচেয়ে বড় ধার্মিক। নরেনদা এক কথায় বললেন, “হ্যাঁ ঠিক আছে তাই হোক।”


এভাবে দুই সাধু বাবা যখন পাঁচ মিনিট ধরে ধ্যানে বসলেন সেই সুযোগে নরেনদা সোনার গিনি আংটিটা টুক করে সরিয়ে নিয়ে, কিছু ছাই ভস্ম ঐ স্থানে রেখে দিলেন।


প্রথম সাধু বললেন, “আমি ধ্যানের মধ্যে দিয়ে কৈলাসে গিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম নন্দী ফিরিঙ্গি মহাদেবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং আমি নন্দী ভিরিঙ্গীর সাথে কথা বলে সিদ্ধি খেয়ে তবেই এসেছি। ওরা বলল আমার মত ভক্ত যে ওখানে আসবে তা ওরা জানত।”  প্রথম সাধু ভাবলেন মহাদেবের এত কাছ থেকে ঘুরে এসেছি আশা করি আমার থেকে বড় ধার্মিকের গুল গপ্পো দ্বিতীয় আর কেউ শোনাতে পারবে না।


এই গল্প শোনার পর দ্বিতীয় সাধু বলল, “আমিও তো কৈলাসে গিয়েছিলাম আমি গিয়ে মা পার্বতীর সাথে দেখা করে এসেছি, কথা বলে এসেছি, আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম উনি বললেন বাবা বাইরে একটু ঘুরতে বেরিয়েছেন। মা আমাকে যত্ন করেছেন, বলেছেন আমার মতো ভক্ত পেয়ে মহাদেব ধন্য।”

দ্বিতীয় সন্ন্যাসী ভাবলো আমি তো মহাদেবের স্ত্রী পার্বতীর সাথে দেখা করেছি তার মনে আমার গল্প হিসাবে আমি প্রথম সন্ন্যাসীর থেকেও বড় ধার্মিক।


এবার বিচারের জন্য তারা দুজনেই নরেনদার মুখের দিকে তাকালো। নরেনদা দুঃখ ভরা মুখ নিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যে সময় কৈলাসে গিয়েছিলে, তখন তো মহাদেব এখানে এসেছিলেন। বললেন এরা দুজনেই আমার পরম ভক্ত।  একটা আংটির জন্যে এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগুক তা আমি চাই না, তাই আমি এই আংটি ভস্ম করে দিলাম।” আর আমাকে বললেন, আমি যেন এই ছাই ভস্মটি তার দুই পরম ভক্তের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যাই।

এই বলে নরেনদা ছাই-ভস্মটি দুই সাধুবাবাকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। আর দুই সাধু তার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন!

ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রভিত্তিক চৌর্যবৃত্তি কবে বন্ধ হবে? -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:280 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো থেকে পন্ডিচেরির ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে লেখা দিয়েই শুরু করি -

আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থচিন্তার কী অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন --- একাধারে যেমন বেদ উপনিষদ, গীতা  যা মান্যতা  দেয়   শূদ্র ও নারীদের দাবিয়ে রাখার জটিল তত্ত্ব  আর অন্যধারে  অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর শূদ্র শ্রেণীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার   প্রত্যক্ষ ধর্মের গ্রন্থ মনুসংহিতা। এই দাবিয়ে রাখতে গিয়েই বিভিন্ন জটিল ধর্মীয় আচার  ও  সংস্কৃতির মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের  আয়ের ব্যবস্থা বা এক কথায় বলা যায় শাস্ত্রানুসারী চৌর্য্যবৃত্তি। ব্যক্তি নির্বিশেষে  জন্মের আগেই সাধ থেকে শুরু করে ছয় ষষ্টী, অন্নপ্রাশন,  বিয়ে, বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ট্যাক্সো আদায়, এমন কি, বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নেড়া মাথার ওপর বংশানুক্রমে বাৎসরিকের মাধ্যমেই জিজিয়া এবং এছাড়াও  বারো মাসে তেরো পার্বন  গৃহ প্রবেশ দোকান শুরুর পুজোতো আছেই।  দুর্গ্রহক্রমে এই ভূগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত আমাদের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের  মূলধন বিহীন চিরকেলে ব্যবসা,  একদম বিনা পুঁজির ফলাও কারবার।  অর্থনীতিতে  সেই সময়ে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের অনেকেই এই পুরস্কার পেতেন।  ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট মিল; অ্যাডাম স্মিথ  বা লর্ড কেইনসও ভাবতে পারেননি এই রকম হরেক  ট্যাক্সের কথা  


 কয়েক দিন  আগে এক ছাত্রের মায়ের শ্রাদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না এবং যাওয়া  ভীষণভাবে অপছন্দ করি। নিজের মা – বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিনি, সাদা কাপড় পরিধান করিনি, চুল কাটিনি, এক এক কথায় কিছুই করিনি, এই জন্য পাড়ায় আমার বেশ  বদনাম আছে  নাস্তিক হিসেবে। যে মানুষের মৃত্যুর আগে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারিনি তার শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসে সেটা সম্পর্কে গল্প করতে খারাপ লাগে তাই ছাত্রদের  বলে দিয়েছিলাম যেতে পারি কিন্তু কিছু মুখে দেবো না। কিছু কিছু জায়গায় যেতেই হয় তাদের মান এবং মন রক্ষার্থে। যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তারা তিন ভাইই আমার পূর্বতন ছাত্র এবং প্রায়ই  বাড়ির দোরগোড়ায় থাকে ফলে যেতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। তাদের বাবা নেই, মা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় ছিলেন। ভাইয়েরা মিলে রান্না করে মায়ের শুশ্রূষা করেছে  বছর তিনেক ধরে। কাজকর্মও সেভাবে কিছু করে না, বড়জন সম্পূর্ণ বেকার, মেজোর একটা অটো আছে লিজে দেওয়া, শুধুমাত্র ছোটটি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাঝে মধ্যে  দু একবার দেখতে যাওয়া ও মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা ও আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু সাহায্য তাদের করিনি। অথচ শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আমার বাড়ির লোক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করে না । তারা কেউ যাবে না অগত্যা আমাকেই শ্রাদ্ধের দিন ফুল মালা ধূপকাঠি  হাতে  দেখা  করতে যেতে  হল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত মহাশয় দুজন দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হয়েছে। সেদিনও দুশো লোক খেয়েছে এবং নিয়মভঙ্গের দিন প্রায় পাঁচশো লোক নিমন্ত্রিত। তাকে শ্রাদ্ধের আগে ঠারেঠুরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি শ্রাদ্ধ ব্যাপারটির কোনো যৌক্তিকতা নেই, মরার পর মানুষের স্মৃতি আর কাজ ছাড়া কিছুই থাকে না। তোরা মায়ের জন্য যা যা করেছিস এই কবছরে তার থেকে বেশী পুণ্য আর কিছু নেই, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান  ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অপরের মাথায় টাক দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। কে কবে দেখেছে মৃত ব্যক্তি খেতে আসে? আদিম অজ্ঞ মানুষের ভয় ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এগুলি ধর্ম নয় এগুলি অধর্ম,  ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হিন্দুদের কু-আচার।   পুনর্জন্ম  বা পরলোক বলে কিছু নেই,  মানুষ  প্রকৃতি পরিবেশের  সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর সব প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। পুরোহিত শ্রেণি মানুষকে ভয় দেখিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করে, যেমন -

১) জন্মের আগে সাধ ও  ছয়দিনে ছয় ষষ্ঠী

২) অন্নপ্রাশন

৩) বিবাহ

৪) মৃত্যু

৫) মরার পরও ছাড় নেই, তার পুত্র প্রপৌত্রদের থেকে বাৎসরিকের নামে  চাঁদা  আদায় করে।


কিন্তু আমার ছাত্ররা এতো কুসংস্কারগ্রস্থ পরিবারে মানুষ হয়েছে   যে তাদের  যুক্তি দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। যাইহোক  আমাকে  তারা পাড়ার  লজে নিয়ে গেল। সেখানে  গিয়ে দেখি রুই মাছ এবং বিশাল বিশাল পাবদা মাছ পটল চিংড়ির ব্যবস্থা ছাড়াও মিষ্টি আইসক্রিমের ব্যবস্থা আছে। আমাকে প্রায় জোর করেই খেতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা  হল।  আমি  পরিষ্কার  জানালাম  পেট পুরে খেয়ে এসেছি কোনোমতেই খেতে পারবো না। তখন ওরা বসতে বলল  এবং কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ  করল।   সেখানে বসে কয়েকজন প্রাক্তন  ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলাম  রামায়ণের দশরথের পুরোহিত জাবালির কথা।  সেই যুগের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে জাবালি প্রতিবাদ  করেছিল।  বুঝলাম আমাদের সমাজের  শিক্ষার  পদ্ধতির পরিবর্তন  না হলে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। এই মৃত্যুভোজ  কবে বন্ধ হবে জানিনা?

এইসব  অনুষ্ঠানগুলি কবে যে মানুষ বাদ দেবে জানি না। ঐ ছেলে তিনটির তেমন আয় নেই।  বাবার জমানো যা পুঁজি ছিল তা বোধ হয় মায়ের শ্রাদ্ধে শেষ করেছে। এরপর কি হবে? এইসব ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পেট ভরার অনুষ্ঠান মানুষকে ধনেপ্রাণে শেষ করে। বর্তমান দিনের অল্প কিছু আধুনিক সৎ ব্রাহ্মণ পদবিধারীদের এই অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে দেখেছি। নিজেরা এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে।


আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত যুক্তিবাদী মনে করি তারাতো এই অনুষ্ঠানগুলি বর্জন করতে পারি নিজেদের জীবন থেকে! সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিসর্জন দিতে পারি। জন্ম মানুষের জীবনে এক দুর্ঘটনার মতো, ৩০ - ৩৫ কোটি শুক্রানু লড়াই করে একটা বাঁচে, সেটাই মানুষ হয়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম যেমন প্রকৃতি উদ্ভুত তেমন মরার পর সে পোড়াও বা কবরে দাও সবই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। তখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা, যাকে অনেকে আত্মা বলে। আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করে শ্রদ্ধানুষ্ঠান স্মরণসভা করতে পারি! এতে মৃতের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হয় আবার ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রানুযায়ী চৌর্যবৃত্তিকে প্রতিরোধ করাও যায়।

বিজ্ঞানীরা কি জ্বিন বা শয়তানের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পেরেছে? -প্রিন্স ফার্দিনান্দ
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:279 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(পর্ব-১)

উত্তর: এই প্রশ্নটা প্রায়ই মুমিনদের কাছ থেকে শোনা যায়। আমি নিজেও অফলাইনে বহু মুমিনের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক করেছি যাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। তাই এই প্রশ্নটার একটা বিশ্নেষনমূলক উত্তর লেখার তাগিদ অনুভব করছি। এই লেখাটাতে আমি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ও সূত্রসমূহের আলোকে জিনের অস্তিত্ব/অনস্তিত্বের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করবো। লেখাটাকে দুটি অংশে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। প্রথম অংশে আমরা কোরান, হাদিস ও তাফসিরসমূহের আলোকে জিনদের পরিচয়, দৈহিক গঠন,খাদ্যাভ্যাস ও বাসস্থান সম্পর্কে জানবো এবং দ্বিতীয় অংশে জিনদের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করবো । তাহলে চলুন শুরু করা যাক -

প্রথম অংশঃ    

১) জিনদের পরিচয় ও সৃষ্টির ইতিহাসঃ 

কোরান, হাদিস ও তাফসির গ্রন্থসমূহ অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে (আদমকে) সৃষ্টি করার আগে জ্বিন নামক একটা জাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন যারা আগুনের তৈরি। আদমকে সৃষ্টির বহু আগে তারা পৃথিবীতে বসবাস করতো এবং আল্লাহর ইবাদাত করতো। একসময় তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং রক্তপাত ঘটায়। তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের একটি বাহিনী  তাদের নিকট প্রেরণ করে। তারা সেই জিনদের কতককে হত্যা করে এবং কতককে পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেয় কিন্তু জিনদের প্রধান নেতা ইবলিশকে কয়েকজন ফেরেশতারা বন্দী করে আকাশে নিয়ে যায়। সেখানে সে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করতে করতে  নিজেকে এতই উচ্চস্তরে নিয়ে যায় যে, চারডানা বিশিষ্ট ফেরেশতাদের মধ্যে অধ্যবসায়, জ্ঞান , মর্যাদা ও সম্মানের দিক থেকে সে সকলের সেরা হয়ে ওঠে । তাকে জান্নাতসমূহের (স্বর্গ) রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিম্ন আকাশ ও পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী  সবকিছু সে নিয়ন্ত্রণ করতো। 

তারপর আল্লাহ যখন পৃথিবীতে আদমকে সৃষ্টি করার সংকল্প করলেন এবং মাটি দ্বারা তার দেহাবয়ব তৈরি করলেন তখন জিনদের প্রধান এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী আযাযীল বা ইবলিশ তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। যখন সে দেখতে পেল যে এটি একটি শূন্যগর্ভ, মূর্তি তখন সে আঁচ করতে পারলো যে, এটি এমন একটি দেহাবয়ব যার আত্মসংযম থাকবে না। তখন সে বললো যদি তোমার উপর আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে ধ্বংস করবো। আর যদি আমার উপর তোমার ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে আমি অবশ্যই তোমার অবাধ্যতা করবো। 

তারপর যখন আল্লাহ আদমের মধ্যে তাঁর রুহের (প্রাণ বা আত্মা) সঞ্চার করলেন এবং তাকে সিজদাহ্ করার জন্য ফেরেশতাগনকে আদেশ দিলেন, তখন প্রবল হিংসাবশে ইবলিশ তাঁকে সিজদাহ্ করা থেকে বিরত থাকে এবং বলে, আমি তার চাইতে উত্তম। আমাকে তুমি আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদামাটি থেকে। এভাবে ইবলিশ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তার প্রতিপালকের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে। সে ভুল যুক্তি প্রদর্শন করে তার প্রতিপালকের (আল্লাহর) রহমত থেকে দূরে সরে যায় এবং তার সমস্ত মর্যাদা যা সে ইবাদত বন্দেগী করে অর্জন করেছিল, তা থেকে বিচ্যুত হয়। 

অবশেষে ইবলিশকে উর্ধ্বজগত থেকে নামিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে কোনরকম বাস করতে পারে এতটুকু স্থানও তার জন্য হারাম করে দেয়া হয়। 

অগত্যা সে অপদস্ত লাঞ্চিত ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় পৃথিবীতে নেমে আসে এবং তার অনুসারী অন্যান্য জিনদেরকে (যাদেরকে শয়তান বলা হয়) নিয়ে আদম সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য সকল পথে ও ঘাঁটিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে ইবলিশের নাম ছিল আযাযীল। আযাযীল ফেরেশতাদের মতই ছিলো বটে। তবে সে ফেরেশতা জাতিভুক্ত ছিল না। কারণ সে হল আগুনের সৃষ্টি আর ফেরেশতারা নূরের (আলোর) তৈরী।

২) জিনদের অাকৃতি ও গঠনঃ

কোরান এবং হাদিস অনুসারে, 

জিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে নির্ধুম (ধোঁয়া বিহীন) অগ্নিশিখা হতে। তারা মানুষের আকার ধারণ করতে পারে এবং মানুষের মত কথা বলতে পারে ও শুনতে পারে। এরা মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর আকার ধারণ করতে পারে বলে হাদীসে বলা হয়েছে। 

৩) জিনদের খাদ্যাভ্যাস ও বাসস্থানঃ

জিনরা আদম সন্তানদের মতই পানাহার, বংশবিস্তার ও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করে থাকে।  

আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশুর হাড়-হাড্ডিই হলো জিনদের খাবার। এছাড়াও মানুষের ফেলে উচ্ছিষ্ট, শুকনো হাড়, গোবর এসমস্তই জিনদের খাবার। 

জিনরা সাধারণত মানুষের বসবাসের স্থানে থাকে না। তারা মানুষের পরিত্যক্ত স্থানে থাকতে পছন্দ করে। তাদের অধিকাংশই মানুষের কাছ থেকে দুরে নির্জন এলাকায় বসবাস করে। তবে কিছু প্রজাতির জ্বীন মানুষের সাথে লোকালয়ে থাকে । এক হাদিস থেকে জানা যায়, জ্বীনেরা নোংরা ও গন্ধময় জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, যেখানে মানুষরা ময়লা এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে রাখে। পায়খানা এবং প্রস্রাব করার জায়গাগুলোতে জ্বীনদের অবাধ বিচরণ। 


(২)

এই অংশে আমরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আলোকে দেখানোর চেষ্টা করবো যে, কোরান - হাদিসে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জ্বিনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নাকি নয়। 

পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যয়ন থেকে আমরা জানি যে, এই ইউনিভার্স এ যা কিছু আছে তা হয় পদার্থ নয় শক্তি। আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমীকরণ (E= mc^2) হতে আমরা জানি, পদার্থ ও শক্তি পরস্পর রুপান্তরযোগ্য।

আবার বিকিরণের কোয়ান্টাম তত্ত্ব  সম্পর্কিত ম্যাক্স প্ল্যাংকের সমীকরণ 

(E= nhf) থেকে আমরা জানি, শক্তি বা বিকিরণ হল কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্যাকেটের সমষ্টি। শক্তির এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা প্যাকেটগুলিকে বলা হয় কোয়ান্টা বা ফোটন। আমাদের এই ইউনিভার্সে বিদ্যমান বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল, গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ, ধূমকেতু, উল্কাপিণ্ড ও অন্যান্য জোতিষ্কসহ যা কিছু আছে তার সবই হল ভর-শক্তি। অর্থাৎ আমাদের এই বস্তুবাদী মহাবিশ্বে ভরশক্তির বাহিরে কিছুই নেই। আমাদের পৃথিবী, এর সাগর, মহাসাগর, প্রান্তর,  নদ, নদী, গাছপালা, মানুষ ও অন্যান্য  প্রাণীসহ যা কিছু আছে তার সবই আসলে ভর-শক্তি ছাড়া কিছুই নয়। 

এবার আসি জিনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। কোরানে বলা হয়েছে যে, জিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অগ্নি শিখা থেকে এবং হাদিসে বলা হয়েছে নির্ধুম অগ্নি শিখার কথা। তাহলে এবার আমাদের জানতে হবে অগ্নি বা আগুন এবং নির্ধুম অগ্নি বলতে আসলে কি বোঝায়। 

সংক্ষিপ্ত ও সহজ করে বলতে গেলে, আগুন হলো প্লাজমা, যাকে মাঝেমাঝে ‘পদার্থের চতুর্থ দশা’ বা ‘Fourth State of Matter’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে | এর কারণ যে কোনো পদার্থের গ্যাসীয় রূপকে যখন যথেষ্ট পরিমানে শক্তি বা তাপমাত্রা প্রদান করা হয়, তখন সে প্লাজ্মায় রুপান্তরিত হয় | এই অবস্থায় গ্যাসীয় পদার্থটির পরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলি মুক্ত হয়ে পড়ে যার ফলে 

অবশিষ্ট পরমাণু একটি ‘পজিটিভ চার্জ’ ধারণ করে ও তাকে তখন ‘পজিটিভ আয়ন’ বলা হয়; এই পজিটিভ আয়ন ও ইলেক্ট্রনের সমষ্টিকেই আমরা বলি ‘প্লাজমা’ | উল্লেখ্য, সব আগুনই প্লাজমা না। তাপমাত্রা এবং পদার্থটি কতটা আয়নাইজড হয়েছে সেটার ওপর নির্ভর করে তাকে প্লাজমা বলা যাবে নাকি না।তাপমাত্রা  ৩০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নীচে হলে তাকে প্লাজমা বলা যায় না। 

অন্যভাবে বলতে গেলে, আগুন হল একটি রাসায়ণিক বিক্রিয়া,যাকে দহন বিক্রিয়া বলা হয় । এটি একটি তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (Exothermic Reaction)। অর্থাৎ এই বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয়। দাহ্যবস্তু, অক্সিজেন বা অন্য কোন জারক পদার্থ ও তাপ এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে যে বিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সাধারনতঃ তাকেই আগুন বলে। যে কোন একটি উপাদানের কমতি থাকলে আগুনের সৃষ্টি কখনোই হবেনা।

এই দহন বিক্রিয়া (Combustion Reaction) আবার দুই ধরনের হয়। যথা-

১) Complete Combustion এবং 

২) Incomplete Combustion 

যখন কোনো জ্বালানি পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ পায় তখন যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং শক্তি উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় complete combustion বা পূর্ণ দহন। এই Complete Combustion এর সময় যে শিখার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় নির্ধুম অগ্নিশিখা বা ধোঁয়াহীন আগুন। কারণ এক্ষেত্রে কোন ধোঁয়া সৃষ্টি হয় না। গ্যাসবার্নারে ও মোমবাতির শিখার গোড়ায় এ ধরনের আগুন তৈরি হয়। 

আবার, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে কিংবা যথেষ্ট পরিমাণ তাপ না পেলে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তাকে Incomplete Combustion  বা অপূর্ণ দহন বলে। Incomplete Combustion-এ কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য জটিল যৌগ উৎপন্ন হয়, এগুলো এবং অবশিষ্ট হাইড্রোকার্বনগুলো ধোঁয়া হিসেবে পরিচিত। মোমবাতির শিখার উপরের অংশে, কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেল, কাঠ ইত্যাদিতে এই ধরনের আগুন তৈরি হয়। 

যাইহোক আবার ফিরে আসি মূল আলোচনায়। এতোক্ষনে আমরা জেনে গেছি যে, আগুন আসলে একধরনের গ্যাসমিশ্রণের বিক্রিয়াকালীন অবস্থা যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা তাপ প্রদানের ফলে সংগঠিত হয় এবং বিক্রিয়ার ফলে সেখান থেকে তাপ উৎপন্ন হয়। কাজেই আগুনকেও আমরা পদার্থ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ভর-শক্তি বলতে পারি। 

সুতরাং কোন কিছু যদি আগুনের তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে ম্যাক্স প্লাংকের সমীকরণ অনুযায়ী সেটার একটা ফ্রিকোয়েন্সী থাকবে, একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ থাকবে, সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা রেঞ্জ বা সীমা থাকবে। 

যেমনঃ দৃশ্যমান, অবলোহিত ,  তড়িচ্চুম্বকীয়, অতিবেগুনী, মাইক্রোওয়েব ইত্যাদি বিকিরণের প্রতিটির ক্ষেত্রে তাদের আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি রয়েছে। কেবল দৃশ্যমান আলো তথা বিকিরণ (বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুধ, কমলা লাল) বাধে অন্যান্য বিকিরণ সমূহকে আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না। 

তবে যতো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বা দুর্বল শক্তির বিকিরণই হোক না কেন আধুনিক উন্নত সেন্সর মেশিন  ও ডিটেক্টর গুলোতে বিজ্ঞানীরা সেটা অবশ্যই ধরতে পারেন। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ অবধি বিজ্ঞানীরা জিন/ভূত /প্রেতাত্মা নামক অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পান নি। আসল কথা হল জিন,ভূত, প্রেতাত্মাদের  মতো অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছু নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করেন না।  

বিভিন্ন ভুতুড়ে স্থানে ডিটেক্টর মেশিন গুলোতে যেসব রেডিয়েশন ধরা পরে সেগুলোকে অনেকে জিন ভুতের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে চালানোর চেষ্টা করে। অথচ তাড়া জানেই না যে, ডিটেক্টরে ধরা পরা বিকিরণ গুলো আমাদের খুবই পরিচিত ও স্বাভাবিক। 

এই যেমন, ধরেন আপনি ভুতুড়ে স্থান নামে পরিচিত কোন এক প্রকান্ড ঝোপঝাড়ের নিকট গিয়ে যদি একটি ইলেকট্রনিক ফিল্ড ডিটেক্টর বা EMF মিটার স্থাপন করেন তাহলে দেখবেন সেখানে যন্ত্রটি অনেক সিগনাল দিচ্ছে। কিন্তু এই সিগনালগুলোকে যদি কেউ ভূত-প্রেত বা জিনের অস্তিত্ব বলে দাবি তাহলে এরচেয়ে বড় মুর্খতা আর হয় না। 

কারণ এই যন্ত্রটি বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন বিভিন্ন ধরনের তড়িচ্চুম্বকীয়  তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য। আপনার পরিক্ষনীয় স্থানের আশেপাশে বিভিন্ন উৎস থেকে (যেমনঃ বজ্রপাত বা পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র থেকে সৃষ্ট চার্জসমূহ, এক্স-রে, টিভি অ্যান্টেনা, বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং, পাওয়ার লাইন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম

 ইত্যাদি) এই তরঙ্গের সৃষ্টি হতে পারে যা আপনার সেট করা সেন্সর বা ডিটেক্টরে ধরা পরে। নীচে আপনাদের জানার সুবিধার্থে  কয়েকটি ডিটেক্টরের নাম উল্লেখ করলাম। এই যন্ত্রগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আপনারা গোগলে খুঁজুন। 

১)  ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড  ডিটেক্টর বা EMF মিটার

২) ইলেকট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা বা EVP

৩) এক্সটার্নাল থারমোমিটার

৪) ডিজিটাল ইনফ্রারেড ক্যামেরা

৫) আল্ট্রাভায়োলেট লাইট ইত্যাদি। 

আবার ফিরে আসি জিন প্রসঙ্গে। হাদিস থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে,জিনেরা মানুষের মতো পানাহার, যোনক্রিয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করতে পার  এবং তাদের শ্রবণশক্তি আছে। তারা মানুষের ফেলে দেয়া হাড়-হাড্ডি খেয়ে বেঁচে থাকে। তাহলে মুমিন ভাই বোন ও ইসলামিক স্কলারদের নিকট আমার কয়েকটি প্রশ্ন। 

১) জিনদের ও কি মানুষের মতো পরিপাকতন্ত্র আছে ? না থাকলে তারা হাড়-হাড্ডি খেয়ে হজম করে কিভাবে? 

২) জিনদের কি শ্রবণঅঙ্গ আছে? না থাকলে তারা শ্রবণ করে কিভাবে ? 

৩) বলা হয়েছে জিনদের প্রকৃত আকৃতি মানবচোখে অবলোকনযোগ্য, তাহলে আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না কেন? 

৪) জিনদের কি আমাদের মতো জনন অঙ্গ আছে?  না থাকলে তারা যোন কর্ম ও বংশবিস্তার করে কিভাবে ? 

৫) বলা হয়েছে জিনরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি ও নিজেদের মধ্যে রক্তপাত ঘটায়। জিনদের দেহ তো আমাদের মতো

রক্তমাংস দিয়ে তৈরি না, তাহলে তারা রক্তপাত ঘটায় কি করে? 

৬) পৃথিবীতে আদমকে পাঠানোর আগে জিনদের খাবার কি ছিলো ?  তখন তো আর আমরা হাড়-হাড্ডি, উচ্ছিস্ট, গোবড় এসব ফেলে রাখতাম না।   

৭) আমরা জানি আলো একধরনের শক্তি, আবার আগুনও একধরনের শক্তি। আগুন জ্বালানোর সময় তাপ ও আলো পাওয়া যায়। আবার আলোর সাহায্যেও আগুন ধরানো যায়। অর্থাৎ দুটোই একই জিনিস। তাহলে "ফেরেশতারা আলোর তৈরী এবং জিনেরা আগুনের তৈরি " এই কথার কোন বিশেষত্ব থাকলো?  

আশা করি এর একটি গ্রহনযোগ্য  উত্তর আপনারা আমাকে দিবেন।

ইসলামে বিবাহ ভিত্তিক নারীর প্রটেকশন কি? -বেনজির সুলতানা
Nov. 25, 2024 | নারী | views:610 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যদি নারীর স্বামী একাধিক বিয়ে করে তাহলে কি সেটা ক্রিমিনাল অফেন্স ইসলামে? উত্তর হল, না। শরিয়া অনুসারে বহুবিবাহ বৈধ। তাহলে ইসলামের সিভিল ল  যদি শরিয়া মতে বিয়ে হয় তবে তো তাকে সেই সব নিয়মকানুন মেনে চলতেই হবে। তাই কোন অ্যাক্ট এ বিয়ে হচ্ছে সেটা জানা খুব জরুরি দরকার। অনুসারে এই ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কোনো প্রটেকশন নেই।


যদি স্বামী ট্রিপল তালাক, তালাক-এ বিদ্যাত, দিয়ে আবার হালালা করতে বলে, তবে কি নারীর অধিকার প্রটেকশন আছে ইসলামে? উত্তর হল, না।


যদি কোনো নারীর কন্যা সন্তান হয়, এবং ইসলাম স্বামীর পরিবার সেই মেয়েকে 14 বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়, তবে সেই মেয়ের কি কোনো আইনি প্রটেকশন আছে? উত্তর হলো, নেই। কারণ ইসলামে puberty হল বিয়ের বয়স, এবং কোনও মেয়ের যদি 13 বছর বয়সে puberty আসে তবে তার বিবাহ 13 বছর বয়সেও আইনত বৈধ। এর অর্থ ১৮ হবার আগেই কোনও অভিভাবক মেয়ের বিয়ে দিলে শরিয়াহ মতে সেটি বৈধ। কোনও শাস্তি নেই।

আরেকটা কথা তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ হয়েছে ভারতে। যারা মনে করছেন পুরো তালাকটাই তুলে দেওয়া হয়েছে সেটা ভুল। ৩ মাসে তিন তালাকের আইন শরিয়াহ অনুসারে সেটি বহাল আছে।

ইসলামে বিবাহিতা মেয়েদের  সিভিল-এ প্রটেকশন নেই। মানুষের চরিত্র বদলাতে দু’দিন লাগে না, তাই ছেলে ভালো না মন্দ বিষয় নয়,  আর মানুষ কে চেনাও দায়। কে কখন বদলে যায় বোঝা বড়ো দায়। বিষয় হল যেই ধর্মের ভিত্তিতে  সিভিল ল-এ নারীর অধিকার protected আছে সেটা দেখে বিয়ে করায় ভালো।                                                             যদি শরিয়া মতে বিয়ে হয় তবে তো তাকে সেই সব নিয়মকানুন মেনে চলতেই হবে। তাই কোন অ্যাক্ট-এ বিয়ে হচ্ছে সেটা জানা খুব জরুরি দরকার।                                       আরেকটা প্রশ্ন যে মুসলিম মেয়ে  শরিয়া অনুসারে  বিয়ে না করে স্পেশাল marriage act এ করল। তাহলেই কি সমস্যার সমাধান আছে? সেই দম্পতির যদি কন্যা সন্তান হয় তার ধর্ম কি হবে? অবশ্যই পিতার ধর্ম। যখনই সেই কন্যার ধর্ম পিতার ধর্ম ইসলাম হচ্ছে, সাথে সাথে তার সমস্ত সিভিল অধিকার সমাপ্ত। সেই অধিকার কিভাবে প্রটেক্ট হবে?

নাস্তিক এবং আস্তিক -জসিমুদ্দিন আহমেদ
Nov. 25, 2024 | নাস্তিকতা | views:290 | likes:2 | share: 2 | comments:0

(নভেম্বর সংখ্যার পর)

ঈশা বাস্যমিদংসর্বম্ য়ত্কিঞ্চ জগত্যাম্ জগত্।

ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্।।

এই মন্ত্রটির মধ্যে ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতার বর্ণনা আছে যে সৃষ্টির সমস্ত চর আর অচর ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত অর্থাৎ সে প্রত্যেক অণুর মধ্যে ব্যাপ্ত।

(য়জুর্বেদ অধ্যায় ৪০ এর প্রথম মন্ত্র)


বিশ্বাস হচ্ছে, সোজা কথায় যুক্তিহীন কোন ধারণা, অনুমান, প্রমাণ ছাড়াই কোন প্রস্তাব মেনে নেয়া। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্য-প্রমাণ, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয় মানুষের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। যখনই কোনো কিছু যুক্তিতর্ক, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা লব্ধজ্ঞান হয়ে উঠবে, তা আর বিশ্বাস থাকবে না। যেমন ধরুন, পানি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মিশ্রণে তৈরি। এটা মানুষের বিশ্বাস নয়, এটা পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। আপনাকে এই কথাটিতে বিশ্বাসী হতে হবে না। কারণ কে এতে বিশ্বাস করলো কে করলো না, তাতে এই তথ্যের সত্যতার কিছুই যায় আসে না। এটা উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা কেউ বলি না “পানি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মিশ্রন, এই কথা আমি বিশ্বাস করি”; এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নই নয়। বা ধরুন, পৃথিবী গোল, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মেনে নিই উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের আলোকে। এটা এখন আর অনুমান বা বিশ্বাস নেই, এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত সত্য। বা ধরুন বিবর্তনবাদ। এটা কোন অনুমান নয়। বর্তমানে এটি পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সত্য।

বিশ্বাস সেটাই করতে হয়, যাতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বা যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধরুন কেউ ভূতে বিশ্বাস করে, কেউ বিশ্বাস করে এলিয়েন পৃথিবীতেই আছে, কেউ জ্বীন পরী, কেউ আল্লা, কেউ জিউস কালী ইত্যাদি। এগুলো বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু আমরা আলোতে বিশ্বাসী নই, আমরা সূর্যে বিশ্বাসী নই, আমরা চেয়ার টেবিলে বিশ্বাসী নই। কারণ এগুলো বিশ্বাস অবিশ্বাসের উর্ধ্বে। আমরা বলি না অমুক লোক সূর্যে বিশ্বাসী, তমুক লোক চেয়ার টেবিলে বিশ্বাস করে। আমরা বলি মুসলিমরা আল্লায় বিশ্বাসী, হিন্দুরা শিব বা দুর্গায়, কেউ শাকচুন্নীতে বিশ্বাস করে, কেউ বিশ্বাস করে আমাদের চারপাশে জ্বীন পরী ঘুরে বেড়ায়।

ধরুন, আগামীকাল একটি পত্রিকায় ছাপা হলো যে, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল একজন এলিয়েন। এই তথ্যটি জানার পরে আমি নিচের কাজগুলো করতে পারি।

১) আমি তথ্যটি জানলাম বা শুনলাম, এবং বিশ্বাস করলাম।

২) আমি আরও কয়েকটি নিরপেক্ষ পত্রিকা পড়লাম, এবং ইন্টারনেট বা অন্যান্য মাধ্যম থেকে এর সত্যতা যাচাই করতে চেষ্টা করলাম। দেখা গেল, আরও কিছু পত্রিকা কথাটি লিখেছে। আমি সেই অবস্থায় কথাটি বিশ্বাস করলাম।

৩) আমার এইসব পত্রিকার কথা বিশ্বাস হলো না। আমি সরাসরি অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের সাথে দেখা করতে গেলাম, এবং সরাসরি দেখলাম যে, উনি একজন এলিয়েন। দেখার পরে আমি মেনে নিলাম। যেহেতু সরাসরিই দেখা, তাই আর বিশ্বাসের অবকাশ নেই। তবে কিছুটা সংশয় থাকতে পারে।

৪) আমি শুধু দেখেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছুক নই। পরীক্ষানিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হতে চাই। তাই আমি পরীক্ষানিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম। তখনও আমার আর কথাটি বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের অবকাশ নেই। আমি শতভাগ নিশ্চিত। আমি তথ্যটি মেনে নিলাম।

অন্যদিকে নাস্তিকতা হচ্ছে প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরে অবিশ্বাস। অর্থাৎ ঈশ্বর প্রসঙ্গে শূন্য বিশ্বাস। ন্যুল বিশ্বাস। বিশ্বাসের অনুপস্থিতি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক প্রস্তাবকে বাতিল করা।

Atheism, in general, the critique and denial of metaphysical beliefs in God or spiritual beings. As such, it is usually distinguished from theism, which affirms the reality of the divine and often seeks to demonstrate its existence.

অর্থাৎ এটা “ঈশ্বর নেই”- তাতে বিশ্বাস করা নয়। বরঞ্চ “ঈশ্বর আছে”, সেই প্রস্তাবকে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে বাতিল করা এবং সেই বিশ্বাসের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা। ঈশ্বর নেই, সেটা বিশ্বাস করা আর ঈশ্বর আছে, এই প্রস্তাবনাকে প্রমাণের অভাবে বাতিল করা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। নাস্তিকতা কোন বিশ্বাস বা ধর্ম নয়, বরঞ্চ নাস্তিকতা হচ্ছে অবিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে আস্থাহীনতা।

যেমন ধরুন, স্ট্যাম্প সংগ্রহ করা একজনের শখ। অন্য আরেকজনের নয়। যার নয়, তার ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি না যে, স্ট্যাম্প কালেকশন না করা হচ্ছে তার শখ। বা ধরুন কেউ টিভিতে কেউ কোন চ্যানেল দেখে। যখন কোন চ্যানেল আসছে না, কোন সিগান্যাল আসছে না, সেটাকে আমরা আরেকটি চ্যানেল বলতে পারি না। সেটা হচ্ছে সিগন্যালের অনুপস্থিতি। শূন্য সিগন্যাল। যেমন আলো হচ্ছে সাতটি রঙের মিশ্রণ। আলোর অনুপস্থিতিকে আমরা অন্ধকার বলি। সেটাকে আরেক রকমের আলো বলি না। বা আরেকটি রঙ বলি না।

বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ্বাসীগণ কিছু অসৎ যুক্তি তুলে ধরেন। যেমন, প্রমাণ করুন, ঈশ্বর নেই! বা নাস্তিকরা কী প্রমাণ করতে পারবে যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই?

এই যুক্তিটি অসৎ এবং একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি বলে সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত। কারণ, যে দাবি উত্থাপন করবে, প্রমাণের দায়ও তার ওপরেই বর্তায়। অন্য কেউ বিষয়টি অপ্রমাণ করবে না।

(ফ্যালাসি দুই ধরনের, এই বিষয়ে পরবর্তীতে লিখবো।)


এটা নাস্তিকদের দায় নয়। যে ঈশ্বরের প্রস্তাব উত্থাপন করবে, তা প্রমাণের দায় তার ওপরই বর্তায়। সে সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির না করতে পারলে সেটা বাতিল করে দেয়াই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। সেটাই দর্শনের মৌলিক অবস্থান। সেই প্রস্তাব যত জোর গলাতেই উত্থাপন করা হোক না কেন, সেটা অপ্রমাণ করার দায় নাস্তিকদের নয়। যেমন কেউ যদি দাবি করে, বৃহস্পতি গ্রহে মানুষ রয়েছে, বা সে নিজেই ঈশ্বর, এই মহাবিশ্ব সে নিজেই সৃষ্টি করেছে, বা তার বাসার পুকুরের ব্যাঙটিই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে! তাহলে এরকম প্রস্তাবের প্রমাণ তাকেই করতে হবে। অন্যরা বৃহস্পতি গ্রহে গিয়ে তার প্রস্তাব অপ্রমাণ করবে না, বা সে যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেনি, তা অপ্রমাণ করবে না। যতক্ষণ সে তার প্রস্তাবের সপক্ষে উপযুক্ত তথ্য এবং যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারছে, শুধু “মৃত্যুর পরে” সব প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে দাবী করছে, তার বা তাদের দাবিকে আমলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। আর তা প্রমাণ করতে পারলে, বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারলে, আগামীকাল পৃথিবীর সমস্ত যুক্তিবাদী নাস্তিকের দল বেঁধে আস্তিক হতে কোন বাধা নেই।

আমরা বলি, ধর্মবিশ্বাস এবং কুসংস্কার আসলে সমার্থক।

প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ নানা ধরণের প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। মানুষের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসু মন, কৌতূহলী মনে নানা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ধরুন, বৃষ্টি কেন হয়, ফসল কীভাবে জন্মায়, মানুষ জন্মে, পৃথিবী কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো, ইত্যাদি। কিছু বিষয় মানুষ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে জানতে পেরেছে, কিছু কিছু বিষয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, উপযুক্ত তথ্যের অভাবে বুঝতে পারেনি। ধীরে ধীরে মানুষ আরও জ্ঞান অর্জন করেছে, আরও বেশি জেনেছে।


আর যেগুলো সম্পর্কে মানুষ জানতে পারেনি, সেই সময়ের জ্ঞান যে পর্যন্ত পৌঁছায়নি, সেগুলো সম্পর্কে মানুষ ধারণা করেছে, কল্পনা করেছে। যেমন, যখন মানুষ জানতো না বিদ্যুৎ কীভাবে চমকায়, তাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য ছিল না, তাই যখন কেউ প্রস্তাব করে এটা ভয়ঙ্কর কোন দেবতার কাজ, সেই প্রস্তাবই অন্য কোন যৌক্তিক প্রস্তাবের অনুপস্থিতির কারণে, বা সেই সময়ের মানুষের জ্ঞানের অভাবের কারণে মানুষগুলোর মধ্যে টিকে গেছে। এর পেছনে কাজ করেছে অজানার প্রতি ভয়, এবং লোভ। সেই সময়ে হয়তো কেউ দাবি করেছে, সে নিজে হচ্ছে ভয়ঙ্কর দেবতাটির পুত্রও, বা প্রিয় বন্ধু, বা আত্মীয়স্বজন, এবং এইসব দাবির মাধ্যমে সে সমাজে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ধীরে ধীরে সেটাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে রূপ নিয়েছে। মানুষের মাঝে অজ্ঞানতা, জানতে না পারার হতাশা, অজ্ঞতা একধরনে হীনমন্যতায় রুপ নেয় এবং ধীরে ধীরে অজ্ঞানতার অন্ধকার একপর্যায়ে দেবতা, ঈশ্বর, ভূত নামক কল্পনা দিয়ে তারা ভরাট করে ফেলে। যেমন তারা ধরে নিয়েছে, বিদ্যুৎ চমকানো হচ্ছে দেবতা জিউসের ক্রোধ। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞান উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সহকারে বের করেছে, বিদ্যুৎ কীভাবে চমকায়। তার পেছনে কোন দেবদেবী ঈশ্বর আল্লাহর হাত আছে কিনা। সেই সব অপ্রমাণিত বিশ্বাসের সমষ্টিই বা বিশ্বাসগুলোর বিবর্তিত রূপই হচ্ছে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো। আধুনিক ঈশ্বরগুলো। পুরনো ঈশ্বরদের বিবর্তন ঘটে গেছে। পুরনো অনেক প্রবল প্রতাপশালী দেবতা ঈশ্বর এবং ধর্মবিশ্বাসই সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আধুনিক ধর্মগুলোও একসময় বিলুপ্ত হবে।


নাস্তিকতা এই প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে। তারা তা অস্বীকার করে। প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাতিল করে। এটি কোনো ভাবেই আরেকটি বিশ্বাস বা ধর্ম নয়। বরঞ্চ ধর্ম বা বিশ্বাসের অনুপস্থিতি। একটি যৌক্তিক অবস্থান। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঈশ্বর বা স্রষ্টার উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত। পাওয়া গেলে, তা মেনে নিতে এক মূহুর্ত দেরী হবে না। তখন আর তা বিশ্বাস করতেও হবে না। মেনে নেয়া হবে।

বস্তুত, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে এবং আমার বাসার ডোবার ব্যাঙটিই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে, এই দুটো দাবীর সপক্ষেই ঠিক একই মানের প্রমাণ দেয়া সম্ভব। তাই তা বাতিল যোগ্য। 


অজ্ঞেয়বাদ শব্দটি ইংরেজি যে শব্দটির পারিভাষিক শব্দ, অর্থাৎ “Agnostic” শব্দটিকে ভাঙলে আসে গ্রিক “a” এবং “gnostos”। gnostos অর্থ জ্ঞানী, আর তার আগে উপসর্গ “a” মিলে agnostic শব্দের আক্ষরিক অর্থ হয়েছে জ্ঞানহীন। সেই অর্থে একজন ব্যক্তি অনেক বিষয়ে agnostic হতে পারেন। কিন্তু এটার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবহার দেখা যায় ধর্মীয় বিশ্বাসের বেলায়। যখন ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রশ্ন আসে, তখন দুটি মৌলিক অবস্থানের সূচনা ঘটে যাদের মধ্যে যেকোন একটিকে গ্রহণ করতে হয়। এটা অনুসারে, হয় আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারেন, অথবা অবিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু যদি অপশনগুলোকে আরও একটু নীরিক্ষণ করেন তাহলে আপনি জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে মোট চারটি অবস্থান দেখতে পারবেন:

১। জ্ঞেয়বাদী আস্তিক (Gnostic theist): আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এবং এটা যে সত্য এই বিষয়ে আপনার জ্ঞান আছে (বা এটা যে সত্য তা আপনি জানেন)।

২। অজ্ঞেয়বাদী আস্তিক (Agnostic theist): আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কিন্তু জানেন না যে এটা সত্যি কিনা (অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও আপনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন)।

৩। জ্ঞেয়বাদী নাস্তিক (Gnostic atheist): ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই এটা জেনে আপনি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন (অর্থাৎ আপনি জানেন যে ঈশ্বর নেই এবং তাই আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না)।

৪। অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিক (Agnostic atheist): ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই এটা না জেনেই আপনি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন (অর্থাৎ আপনি জানেন না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই কিন্তু আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না।)

তৃতীয় অবস্থানটিকে, অর্থাৎ জ্ঞেয়বাদী নাস্তিক্যবাদ বা Gnostic atheism অবস্থানটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, “আমি বিশ্বাস করি এবং “জানি” যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই”। অন্যদিকে চতুর্থ অবস্থানটিকে, অর্থাৎ অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিক্যবাদ বা Agnostic atheism বলা হয় যা বলে, “ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, এতে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি এটা জানি না যে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সত্য কিনা”। এই দুই দাবীর পার্থক্য সূক্ষ্ম কিন্তু এটাকে বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অবিশ্বাস করা আর অন্য কিছুতে বিশ্বাস করা এক নয়

একজন নাস্তিক্যবাদীকে ঈশ্বর নেই এটা প্রমাণ করতে বলা হলে এটা ধরেই নেয়া হয় যে সেই নাস্তিক্যবাদী লোকটি “ঈশ্বর নেই” এই কথাটিতে বিশ্বাস করেন। জ্ঞেয়বাদীই নাস্তিক্যবাদীগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু নাস্তিক্যবাদীদের মধ্যে অনেক অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিকও আছেন যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই এটাও নিশ্চিতভাবে দাবি করেন না। দুটোই বৈধভাবে নাস্তিক্যবাদ বা atheism। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে atheism বা নাস্তিক্যবাদ এবং agnosticism বা অজ্ঞেয়বাদ সম্পূর্ণভাবে দুটি আলাদা বিষয় নয়।

ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এটাই কাউকে নাস্তিক শ্রেণীভুক্ত করার জন্য যথেষ্ট। কোন কিছুতে বিশ্বাসহীনতা মানেই এই নয় যে এটাকে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। এটার কেবল এই অর্থই থাকতে পারে যে এটা যে সত্য সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত নন। উদাহরণস্বরূপ আপনার একজন বন্ধু বিশ্বাস করতে পারে যে ফোর্ড বিশ্বের সবচেয়ে ভাল গাড়ির কোম্পানি। আপনার এই বিষয়ে কোন বিশেষ মতামত বা ভাবনা নেই। আপনি বিশ্বাস করেন না যে ফোর্ড অন্য কোন ব্র্যান্ডের গাড়ির চেয়ে ভাল, কিন্তু এটা যে বিশ্বের সবচেয়ে ভাল গাড়ির ব্র্যান্ড না আপনি এটাও জানেন না। এই পরিস্থিতিতে আপনি আপনার বন্ধুটির দাবির বিষয়ে agnostic বা অজ্ঞেয়বাদী।


দ্য বার্ডেন অব প্রুফ বা প্রমাণের দায়

ধরুন, আমি আপনার কাছে একটি অসম্ভব দাবি নিয়ে এলাম। সেটা হলো, “আমার কাছে একটি দুই ফুট লম্বা লেপ্রিকন (Leprechaun – রূপকথায় বর্ণিত একধরণের অবাস্তব জীব) আছে। এটা আমার সিন্দুকে থাকে। কেবলমাত্র আমিই এই লেপ্রিকনকে দেখতে পারি আর এই লেপ্রিকনের অস্তিত্বের কোন ফিজিকাল এভিডেন্স নেই।” কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয় যে এই লেপ্রিকনটির কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু আমি এটারও কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারছি না যে এই লেপ্রিকনের কোন অস্তিত্ব আছে। আর এই ধরণের দাবিকেই আনফলসিফায়াবল ক্লেইম (Unfalsifiable claim) বা প্রমাণ-অযোগ্য দাবি বলা হয়।

যখন একটি প্রমাণ-অযোগ্য দাবিকে সামনে নিয়ে আসা হয়, তখন বার্ডেন অব প্রুফ বা প্রমাণের দায় তার উপরের বর্তায় যে ব্যক্তি দাবিটি নিয়ে এসেছেন। অন্যথায় এবসার্ডিটি বা বিমূর্ততার সূচনা ঘটে। উদাহরণস্বরূপ প্রমাণ-অযোগ্য দাবি সংক্রান্ত চিন্তন পরীক্ষণগুলো বা থট এক্সপেরিমেন্টগুলোর (Thought Experiment) কথাই চিন্তা করুন, যেমন “ফ্লাইং স্প্যাগেটি মনস্টার”, “ইনভিজিবল পিংক ইউনিকর্ন”, স্যাগানের “দ্য ড্রাগন ইন মাই গ্যারেজ” এবং “রাসেলস টিপট” এর অস্তিত্ব। এই প্রত্যেকটি থট এক্সপেরিমেন্টেই পূর্ববর্তী উদাহরণের লেপ্রিকনের মত কোন না কোন আশ্চর্যজনক এবং অসম্ভব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে যাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে অপ্রমাণ করা যায় না।

আর এখানেই অজ্ঞেয়বাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়। অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিকগণ স্বীকার করেন যে, তারা ঈশ্বরকে নির্দিষ্টভাবে অপ্রমাণ করতে পারবেন না। কিন্তু তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবকে চোখে আঙ্গুলে দেখিয়ে দিতে পারেন এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

পর্ব - ৩

পূর্বোক্ত পর্বে যুক্তিগুলো কেবল প্রমাণ-অযোগ্য দাবি বা যে দাবিগুলোকে সত্য বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায় না তারদের উপরেই প্রয়োগ করা যায়। যখন এই যুক্তিগুলো বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে প্রযুক্ত হয় তখন অনেক ধর্মীয় দাবিগুলোই তুলনামূলক নিশ্চয়তার সাথে অপ্রমাণ করা সম্ভব। কারণ সেই দাবিগুলো নিজে থেকেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এগুলো যুক্তির মুখে এমনিতেই ভেঙ্গে যায়।

উদাহরণস্বরূপ, আব্রাহামীয় ঈশ্বর ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের দ্বারা উপাসিত হন। ধরুন আব্রাহামীয় ঈশ্বর একই সাথে সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান এবং সর্বমঙ্গলময়। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য আমরা যে জগৎকে দেখছি সেখানে একই সাথে থাকতে পারে না বা কোএক্সিস্ট করতে পারে না। যখন বড় বড় দূর্যোগ ঘটে এবং হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তখন ঈশ্বরের পক্ষে একই সাথে সর্বমঙ্গলময় এবং সর্বশক্তিমান হওয়াটা অসম্ভব হয়ে যায়।

হয় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের এরকম দূর্যোগ আটকানোর কোন ক্ষমতা নেই অথবা এই সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বর পৃথিবীতে মানুষের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে একেবারেই ভাবনাচিন্তা করেন না। সুতরাং ঈশ্বরের প্রতিটি সংজ্ঞাকে অপ্রমাণ করা সম্ভব নাও হতে পারে তবে ঈশ্বরের কিছু কিছু স্ববিরোধী সংজ্ঞাকে অপ্রমাণ করা সম্ভব।

স্পেক্ট্রাম অব থেইস্টিক প্রোবাবিলিটি অথবা আস্তিকীয় সম্ভাবনার বর্ণালী

আমাদের জীবনের অনেক বিষয়ের মতই আস্তিক্যবাদ এবং নাস্তিক্যবাদকে সাদা বা কালো এর মত দৃঢ় চরম-দ্বিমুখিতায় না ফেলে একটি স্পেক্ট্রাম বা বর্ণালীতে ফেলতে হয় (অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে হয় আস্তিক নয় নাস্তিক এভাবে শ্রেণীবিভক্ত না করে তাকে আস্তিক্যবাস থেকে নাস্তিক্যবাদ পর্যন্ত বর্ণালীর কোন একটি অবস্থানে রাখার কথা বলা হচ্ছে)। রিচার্ড ডকিন্স তার বিখ্যাত বই “দ্য গড ডিল্যুশন”-এ এই স্পেক্ট্রাম অব থেইস্টিক প্রোবাবিলিটি বা আস্তিকীয় সম্ভাবনার বর্ণালী এর ধারণাটি দেন। এখানে আস্তিক্যবাদ থেকে নাস্তিক্যবাদ পর্যন্ত মোট সাতটি অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। এমন নয় যে এই সাতটি অবস্থান নিয়েই বর্ণালীটি, বরং বর্ণালীর ধারণায় এই সাতটি অবস্থানের দুটো পাশাপাশি অবস্থানের মধ্যেও কোন অবস্থান থাকতে পারে। কিন্তু এই সাতটি অবস্থান হচ্ছে বর্ণালীটির মদ্যে থাকা সাতটি মাইলফলক যা দিয়ে বর্ণালীর ভিতরের বিভিন্ন অবস্থানকে সরলভাবে প্রকাশ করা যায়। নিচে এগুলোর সারমর্ম দেয়া হল:

১। সবল আস্তিক্যবাদ (Strong theism): ব্যক্তি সন্দেহমুক্ত হয়ে জানেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। সি. জি. ইয়াং এর ভাষায়, “আমি বিশ্বাস করি না, আমি জানি”।

২। কার্যত আস্তিক্যবাদ (De facto theism): ব্যক্তি একশভাগ নিশ্চিন্ত নন যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু মনে করেন তার অস্তিত্বের সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে ভেবেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন।

৩। দুর্বল আস্তিক্যবাদ (Weak theism): ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ৫০% এর বেশি, কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নন কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে থাকেন।

৪। পরিপূর্ণ অজ্ঞেয়বাদ (Pure agnosticism) অথবা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা (Compleat impartiality): ঈশ্বর থাকার সম্ভাবনা ৫০%। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা, তার সত্য হবার সম্ভাবনা ও মিথ্যা হবার সম্ভাবনা ব্যক্তির কাছে সমান।

৫। দুর্বল নাস্তিক্যবাদ (Weak atheism): ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ৫০% এর কম, কিন্তু খুব একটা কম নয়। ব্যক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নন কিন্তু সন্দেহবাদের (Skepticism) দিকে তিনি ঝুঁকে থাকেন।

৬। কার্যত নাস্তিক্যবাদ (De facto atheism): ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু ০% এর উপরে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই এব্যাপারে ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ইতিবাচক নন কিন্তু তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা অনেক কম বলে মনে করেন এবং ঈশ্বর বলে কিছু নেই ভেবেই জীবন অতিবাহিত করেন।

৭। সবল নাস্তিক্যবাদ (Strong atheism): ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা শূন্য। ব্যক্তি শতভাগ নিশ্চিন্ত যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।

ডকিন্স বলেন, বেশিরভাগ আস্তিক মানুষ তাদের সন্দেহের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে শক্তভাবে আকড়ে থাকেন, এবং তাই নিজেদেরকে ১ নং অবস্থানেই ফেলেন। এদিকে বেশিরভাগ নাস্তিক নিজেদেরকে ৭ নং অবস্থানে ফেলেন না, কারণ প্রমাণের অভাবে নাস্তিক্যবাদের উদ্ভব হয় এবং প্রমাণের উপস্থিতি সবসময়ই চিন্তাশীল মানুষের চিন্তাকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। বিল মার এর নেয়া এক সাক্ষাতকারে ডকিন্স নিজেকে ৬ নং অবস্থানে ফেলেন বলে স্বীকার করেছিলেন। তবে পরবর্তিতে এনথোনি কেনি এর নেয়া এক সাক্ষাতকারে ডকিন্স প্রস্তাব করেন “৬.৯” নং অবস্থানই বেশি শুদ্ধ হবে।

যদি আপনাকে নিজের বিশ্বাসকে ডকিন্সের স্কেলে রেট করতে বলা হয় তাহলে আপনি নিজেকে কোন অবস্থানে ফেলবেন?

স্যাম হ্যারিস তার বই লেটার টু অ্যা ক্রিশ্চিয়ান নেশনে লিখেন:

প্রকৃতপক্ষে, "নাস্তিকতাবাদ" হচ্ছে এমন একটি পদবাচ্য, যার অস্তিত্বই থাকা উচিত না। কেওই নিজেকে "আমি জ্যোতিষ নই" বা "আমি আলকেমিস্ট নই" এই মর্মে অভিহিত করেন না। যেসব ব্যক্তি সন্দেহ করে এলভিস [একজন আমেরিকান সংগীত শিল্পী] এখনো জীবিত থাকতে পারে অথবা এলিয়েনরা হাতের ছোয়ায় এই মহাবিশ্বকে তাদের গোয়ালের প্রাণী বানিয়ে রাখবে, তাদের জন্য শব্দ খরচ করার মত শব্দ আমাদের নেই। যে ধর্মের সত্যতা নির্ধারণ করা যায় না, এজাতীয় ধর্মের বিপরীতে যুক্তিবাদী ব্যক্তির যে কোনো শব্দই নাস্তিক্যবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। স্বতন্ত্রভাবে নাস্তিক্যবাদ শব্দটির আমদানী অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার মাত্র।"(Harris 2006, পৃ. 51)

বর্তমানে পশ্চিমা সমাজে শুধুমাত্র "ঈশ্বরে অবিশ্বাস"কেই সাধারণত নাস্তিক্যবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

"প্রাণের জটিলতা দেখে এর সবকিছুর একজন স্রষ্টা আছেন ভাবতে সহজ হয় বলেই আমি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু, আমি মনে করি, যখন আমি বুঝতে পারলাম, ডারউইনিজম এই জটিলতার আরো উন্নত ব্যাখ্যা দেয় তখন তা আমাকে সৃষ্টিতত্ত্বের জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করলো।" -রিচার্ড ডকিন্স

নাস্তিকতা মানে এখন কোনো সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের সমালোচনা নয়, বরং সমস্ত ধর্ম যা আধ্যাত্মিকতা বা অলৌকিকতা নিয়ে কাজ করে বা বিশ্বাস করে, তার বিরোধিতা করা।

পরিশেষে -

শক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো য়ত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।

অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাম্

লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।। (ঋঃ ১০|৭১|২)

অগ্নে ব্রতপতে ব্রতম্ চরিষ্যামি তচ্ছকেয়ম্ তন্মে

রাধ্যতাম্। ইদমহমনৃতাত্ সত্যমুপৈমি।।

(য়জুঃ ১|৫)

দৃষ্ট্বা রূপে ব্যাকরোত্সত্যানৃতে প্রজাপতিঃ।

অশ্রদ্ধামনৃতেऽ দধাচ্ছ্রদ্ধাঁসত্যে প্রজাপতিঃ।।

(য়জুঃ ১৯|৭৭)

য়দর্বাচীনম্ ত্রৈহায়ণাদনৃতম্ কিম্ চোদিম।

আপো মা তস্মাত্সর্বস্মাদ্ দুরিতাত্পাত্বম্হসঃ।

(অথর্বঃ ১০|৫|২২)

সুবিজ্ঞানম্ চিকিতুষে জনায় সচ্চাসচ্চ বচসী

পস্পৃধাতে। তয়োর্য়ত্সত্যম্

য়তরদৃজীয়স্তদিত্সোমোऽবতি হন্ত্যাসত্।।

(ঋঃবে: ৭|১০৪|১২)

অর্থাৎ - যেভাবে চালনি দিয়ে ছাতু চালা হয় সেইভাবে যেখানে বিদ্বানগণ নিজের বাণীকে মন দ্বারা শুদ্ধ করে বলেন, সেখানেই লক্ষ্মী আর মিত্রতা বাস করে। হে পরমেশ্বর! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি নিজের শক্তিভর সত্যের পালন করবো, তাই এই অসত্য থেকে বেরিয়ে সত্যতে আসছি। প্রজাপতি সত্য আর অসত্যকে ভেবেচিন্তে আলাদা করেছেন আর অসত্যতে অশ্রদ্ধা তথা সত্যতে শ্রদ্ধা উৎপন্ন করেছেন। তিন বর্ষের এইপারে যে মিথ্যা আমি বলেছি, হে পরমাত্মন্! সেসব দুষ্ফল পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। মানুষের সুবিধার জন্য সত্য আর অসত্যের বিজ্ঞানকে একে-অপরের বিরুদ্ধ বলা হয়েছে। এই উভয়ের মধ্যে যা সত্য হবে সেটা সরল আর সোজা স্বভাবে বলা হয়ে থাকে তথা তাতে কোমলতা আসে, কিন্তু অসত্য হলো সেটা যা সর্বপ্রকারে বিনাশই করে থাকে।

ইতিহাসের চাকা চলে আপন গতিতে -রাহুল রায়
Nov. 25, 2024 | রাজনীতি | views:69 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আরও একটি ২৩শে জানুয়ারি দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রতিবারের মতো এবারও পাড়ায় পাড়ায় নেতাজী স্মরণ করা হবে। বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। নেতাজীর ছবি, তাঁর বাণী, তাঁর বীর গাঁথায় সাজানো ছবি, লেখা দিয়ে ভরে থাকবে সবক'টি অনুষ্ঠান মঞ্চ। সেদিন শাসক – বিরোধী - ছদ্ম বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সামাজিক মাধ্যমের প্রফাইলে নেতাজীর ছবি ও নামটি কিছু সময়ের জন্য জ্বলজ্বল করবে। এরপরেই শুরু হবে নেতাজীকে নিয়ে এদের তরজা। শাসক দল ১৯৪০ সনে কংগ্রেস থেকে তাঁর বহিষ্কার প্রশ্নে তাঁকে অকংগ্রেসী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে তুলে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। হয়তো এবারও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং নেতাজীর টুপি পড়ে এই মর্মে বক্ততা দেবেন। সংবাদমাধ্যম নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক রঙে নেতাজীকে রাঙানোর চেষ্টা করবে। যার অধিকাংশের রঙ আবার শাসক দলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এর বিপরীতে নেতাজীর অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী,  প্রগতিশীল মনন নিয়ে বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তবে এই সবই কিন্তু ওই একদিনের জন্যই। ২৩ জানুয়ারি যেতেই আবার সব যে যার জায়গায় চলে যাবে। পরের বছর আবার সেই একই চিত্র নতুন মোড়কে জনসমক্ষে পরিবেশিত হবে।

বলতে বাধা নেই এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাই করুক না কেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আপামর ভারতবাসী থেকে যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছেন সেটা তার আগে বা পরে কারোর কপালেই জুটেনি। হওয়ার কথাও নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনের সূযোগ যখন তার পাদদেশে অপেক্ষা করছিল তিনি তখন সেই সূযোগকে চরম অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেশ ও দেশের স্বাধীনতাকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও আপামর দেশবাসীর স্বাধীনতা। শুধু দেশ বা একটি ধর্মে বিশ্বাসী বা ভাষায় কথা বলা মানুষের স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। এখানে দেশের স্বাধীনতা ও দেশ ও দেশবাসী স্বাধীনতার পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া দরকার। উভয়ের মধ্যে শব্দের ব্যবধান বেশি না হলেও অর্থগত পার্থক্য বিরাট। প্রথমটিতে আমরা ফ্যাসিস্ট সুলভ চিন্তা পাই যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যই শেষ কথা, রাষ্ট্রই সর্বময়, মানুষ সেখানে রাষ্ট্রের নামে পরিচালকদের অনুগত প্রজাবৃন্দ, সেবক, তাদের প্রয়োজন, চাহিদা অনেকটাই গুরুত্বহীন। দ্বিতীয়টিতে পাই সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতার বার্তা। রাজনৈতিক ভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার মধ্যে থাকা একটি শিক্ষিত, রুচিশীল, প্রগতিশীল  অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন সমাজ। যেখানে প্রজার সর্বাঙ্গীন উন্নতিই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়। আজকের শাসকরা নেতাজীকে প্রথমটির সমর্থক হিসাবে তুলে ধরে নিজেদের পাশে আনতে চাইছেন। এজন্য অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে সব রকমের কূট কৌশল।  অথচ বাস্তবটা হল তিনি প্রথমটির অর্থাৎ অন্ধ জাতীয়তাবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এতটাই যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্যাসিস্ট সাহায্য নিয়েও হিটলারের বিরোধীতা করতে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বায় লাগাম পড়েনি। স্বাধীন ভারতে তিনি থাকলে আজকের রাজনীতি আর যাই হোক, বর্তমান অবস্থায় যে থাকতো না তা হলফ করে বলা যায়।


নেতাজীর জীবনে নিয়ে নিঃসন্দেহ  জনমানসে সবচেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক পর্ব সম্ভবত ১৯৪৫ সনের ১৮ আগষ্ট ও তার পরবর্তী অংশ। জাপানি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে ২১ আগষ্ট পৃথিবী জানতে পারে যে ১৮ আগষ্ট তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষের মৃত্যু হয়েছে। 


তবে এই খবরের মধ্যে এতোই ত্রুটি ও পরস্পর বিরোধীতা ছিল যে অচিরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ জাগতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু কেউই এই ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি। নেতাজী অনুরাগী দেশবাসীর কথা তো বলেই লাভ নেই৷ সময়ে সময়ে তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, মধ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে ধোঁয়াশাঘেরা করে রাখে। আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে নেতাজীর সমসাময়িক সব নেতাই প্রায় গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সরকারী নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ প্রায় কোনো রকম দৃঢ প্রমাণ ছাড়াই একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যুকে মেনে নেওয়া হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনানী শাহানুয়াজ খান কমিশন, বিচারক জি ডি খোসলা কমিটিও সরকারের বক্তব্যেই সায় দেয়৷ উল্লেখযোগ্য যে এরা কেইই তাইহোকুতে যাননি। অবশেষে ১৯৯৫ সনে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে  বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির নেতৃত্বে ঘটিত কমিশন তাইহোকু বা বর্তমান তাইওয়ান ঘুরে এসে জানায় যে যা তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে পরিষ্কার ১৮ আগষ্ট কোনো বিমান দুর্ঘটনা হয়নি এবং নেতাজী স্বাভাবিক ভাবেই তারপরেও বেঁচে ছিলেন। তখন দেশে  শাসনাধিষ্ঠিত কংগ্রেস সরকার। ২০০৬ সনে তারা মুখার্জী কমিশনের রিপোর্টকে সংসদে নাকচ করে দেয়। 


২০১৪ সনে দেশের শাসনে পরিবর্তন আসে। নেতাজী অনুরাগী সহ দেশবাসীর মনে একটি আশা জাগে যে এবার বোধহয় দেশনায়কের জীবনের ওপর থাকা রহস্যের আবরণ সরানো হবে। সরকারও এই ব্যাপারে তৎপর হয়ে নেতাজী সম্পর্কিত সব গোপন নথী জনগণের সামনে তুলে ধরবে বলে জানায়। কথামতো ফাইলগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলেও ধরা হয়। একই পথ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও৷ অর্থাৎ সরকারের কাছে এই মর্মে আজ আর কোনো নথী গোপন নেই৷ সমস্যা হল যা নথী বেরিয়ে আসল তাতে সেই রহস্যের ওপর থেকে এই মিলিমিটার আবরণও কিন্তু সরানো গেল না। নেতাজী ১৯৪৫ সনে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কি না রহস্যটি রহস্যই থেকে গেল। এমনকি কংগ্রেস সরকার বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির যে রিপোর্টটি নাকচ করে দেয় বর্তমান সরকার সেই রিপোর্টটি নিয়ে গত আট বছরে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিস্তম্ভটিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন কিন্তু তাঁর অধীনস্থ সরকার আজও দেশবাসীকে বলতে পারেনি যে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে আদ্য কতজন সেনানী ছিলেন, কতজনই বা শহীদ হোন, কেন আজও তাঁদের বীরত্বের ইতিহাসকে সেনাবাহিনীর ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পদে পদে ইতিহাস বদল করা হলেও এই ব্যাপারে সরকার জগন্নাথের ভূমিকাতেই স্বচ্ছন্দ। কিছুদিন আগে নেতাজীর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বাইক রেলীর অংশ হয়ে মৈরাঙ যাওয়া হয়েছিল। সেখানে জাপানী সেনানীদের সম্মানার্থে জাপান সরকার স্মৃতিসৌধ বানিয়ে রেখেছে, নাগাল্যান্ডের কোহিমা শহরে ব্রিটিশ সরকার একই কাজ করেছে।  অথচ এই দুই শহরেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের উদ্দেশ্যে কোনো সৌধ নেই৷ ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই করেনি। নাগাল্যাণ্ডের ফেক জেলার চেসেজু গ্রাম নেতাজীর স্মৃতি সগর্বে বহন করে চলেছে। ভারতের ভেতরে এই গ্রাম পর্যন্তই নেতাজী আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে আসতে পেরেছিলেন৷ সেখানে স্থানীয় মানুষ নেতাজী স্মৃতিতে একটি পাহাড়ের নামকরণ করেছিলেন। আজও প্রতিবছর শ্রদ্ধা, আবেগে এখন ঘটা করে নেতাজী স্মরণ করা হয়। তবে সরকারী সাহায্য, স্বীকৃতি ছাড়া সেখানের মানুষ কতদিন নেতাজী তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীর অমূল্য স্মৃতিচিহ্নগুলোকে কালের করাল থাবা থেকে রক্ষা করতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন।

নেতাজী সুভাষ জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস থেকে কোনোকালেই যোগ্য ব্যবহার পাননি। জওহরলাল নেহেরুর উত্তরসুরীরা একই পথ ধরে নেতাজী বিরোধিতা করে গেছেন। এতে অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু তা বলে নেতাজী ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদী বা অন্ধ জাতীয়তাবাদী ছিলেন বলে মেনে নেওয়া বা তার প্রচার করা নেতাজী তথা এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার নামান্তর হবে। সেরকমই কিছু বিশ্বাসঘাতক অহরহ প্রচার করে চলেন যে সমসাময়িক হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দেখানো পথেই নাকি নেতাজী সুভাষ ও মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানের মাটিতে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪০ সনের জুলাই মাসে হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের সঙ্গে নেতাজীর দেখা করার ঘটনাটির উল্লেখ তাঁরা এই মর্মে করে থাকেন। অথচ একই সময়ে নেতাজী মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহের সঙ্গেও দেখা করেন।  উভয়ের কাছে তাঁর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একই৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের সহযোগিতা চাওয়া। সেদিন উভয়ই নেতাজীকে ফিরিয়ে দেন। স্বরচিত The Indian Struggle পুস্তকে যার বিস্তারিত বিবরণী তিনি দিয়েছেন। নেতাজীর কাছে দেশের স্বাধীনতার থেকে বড় কোনো আদর্শ ছিল না, যার জন্য পরবর্তীতে তিনি কমিনিস্ট সোভিয়েত ও ফ্যাসিস্ট জার্মানীর কাছেও যান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে যুদ্ধে কমিনিস্ট রাশিয়া নেতাজীকে সমর্থন না করলেও তাঁর বিরুদ্ধাচারণও কোনোদিন করেনি। জার্মানি ও জাপান, দুই ফ্যাসিস্টবাদী দেশের সাহায্যই তিনি পেয়েছেন। এমনকি ইস্লামিক জাতীয়তাবাদী মুসলিম লিগ পরবর্তীতে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে আসলেও হিন্দু মহাসভা বা অন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো কিন্তু সুভাষ বিরোধীতার পথ থেকে কোনোদিন সরে আসেনি। আজ তাঁদের উত্তরসূরীরাই দেশের শাসনে এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এরা জওহরলাল নেহেরুর দৈন্য মানসিকতার সূযোগ নিয়ে নেতাজীকে নিজেদের শিবিরে আনতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতিহাসের শাস্তি বোধহয় একেই বলে, যাকে একদিন রিক্ত হস্তে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ তাঁকেই নিজেদের পাশে আনতে নিজেদেরই ইতিহাস ভূলে যেতে হচ্ছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হচ্ছে না । 

বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর -পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 25, 2024 | জীবনী | views:292 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“আমি সমস্ত জীবন ধরে বিশ্বাস করেছি একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞানতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। .. বিশ্বাস রাখুন এক দিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি সহযোগিতার পক্ষে আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।”



কথাগুলো প্রখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (Louis Pasteur)। তোমরা কি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের নাম শুনেছ? তিনি একজন ফরাসি জীববিজ্ঞানী, রসায়নবিদ তথা অণুজীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ যিনি পাস্তুরায়ন প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক, জীবাণুতত্ত্বের প্রবক্তা ও আ্যনথ্রাক্স ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো মানবজাতির ইতিহাসে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে এবং আজও রাখছে।

লুই পাস্তুর ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জুরা প্রদেশের দোল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন আরবোয়া শহরে। তাঁর দরিদ্র পিতা বাবা জাঁ জোসেফ পাস্তুর সেখানকার একটি ট্যানারিতে কাজ করতেন। পাস্তুরের মায়ের নাম জা‍ঁ এটিয়েনেট রোকুই। পাস্তুর বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন।


শৈশবে গ্রামে বেড়ে ওঠা পাস্তুরকে যখন তাঁর পিতা প্যারিসের একটি স্কুলে লেখাপড়া করার জন্য ভর্তি করলেন, তখন কিছুতেই শহরের পরিবেশে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৩১ সালে পাস্তুরের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত সাধারণ মানের ছিলেন তিনি। পড়াশোনার থেকে আঁকা এবং মাছ ধরাতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজে খুব অল্প সময়েই নিজেকে মানিয়ে নিলেন। তাঁর মেধা অধ্যবসায় পরিশ্রম শিক্ষদের দৃষ্টি এড়াল না। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজ রয়্যাল অব বিসানকোন (Collège Royal at Besançon)-এ দর্শন পড়তে ভর্তি হন এবং ১৮৪০ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন।  মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে নিজের কলেজেই শিক্ষকতায় যুক্ত হলেন, পাশাপাশি বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকলেন। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে পাস্তুরের প্রিয় বিষয় রসায়ন। চাকরির পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যান। ১৮৪৭ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের দুটি থিসিস জমা দেন এবং একই বছর দুটি বিষয়েই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। রসায়নের উচ্চতর শিক্ষায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। এরই মধ্যে পাস্তুরের বিজ্ঞানচর্চায় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে রসায়নের অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন। সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের কন্যা মেরি লরেন্তের সঙ্গে পরিচয়। ২৯ মে ১৮৪৯ সালে তারা বিয়ে করেন। তাঁদের পাঁচ সন্তানের তিনজনই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে টাইফয়েডে মারা যায়। এ ঘটনায় মুষড়ে না পড়ে, এর প্রতিকারে মনোনিবেশ করেন পাস্তুর।

স্ত্রী মেরি ছিলেন তাঁর যোগ্য সহচরী, সহমর্মী, সহকর্মী এবং সহধর্মীও বটে। ১৮৫৪ সালে লুই পাস্তুর 'লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে'র বিজ্ঞান বিভাগে ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক নিযুক্ত হন। লিলে অঞ্চলে ছিল মদ তৈরির অসংখ্য কারখানা। দীর্ঘদিন উৎপাদিত মদ ভালো রাখতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল মালিক এবং সরকার। পাস্তুর গবেষণা করে বের করলেন কী কারণে মদ নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য তিনি আবার গবেষণা করতে থাকেন। গবেষণায় সফল হলেন। 


আকৃতি 3 পাস্তুর ও মেরি

তিনি তাঁর গবেষণার মাধম্যে প্রমাণ করে দেখান অ্যালকোহল উৎপাদন ইস্টের পরিমানের উপর নির্ভর করে। তিনি এও প্রমাণ করেন মদের অম্লতার জন্য ব্যাক্টেরিয়াই দায়ী। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সের মদ ব্যবসা মদের অম্লতার কারনে প্রভূত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হত। পাস্তুর মদের স্বাদ অপরিবর্তিত রেখে ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত করার জন্য গবেষণা শুরু করে লক্ষ্য করেন উষ্ণ মদে ব্যাক্টেরিয়া টিকতে পারেনা অথচ মদের স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে। পাস্তুর একই পদ্ধতি দুধের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন এবং সাফল্য পান। পাস্তুরের আবিষ্কৃত এই এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী এখন ব্যবহৃত হয় যা 'পাস্তুরায়ন' নামে বিখ্যাত।

পাস্তুর মদে ব্যক্টেরিয়ার উৎস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যখন তখন অনেকের ধারণা ছিল ব্যাক্টেরিয়া নির্জীব বস্তু থেকে নিজে থেকেই জন্ম নেয় যদিও এই মতের বিপক্ষেও অনেকে বিজ্ঞানী ছিলেন। পাস্তুর প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, নির্জীব বস্তু থেকে ব্যাক্টেরিয়া বা কোন প্রাণ জন্ম নিতে পারে না। পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন জীবাণুমুক্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রাণ কখনোই নিজে থেকে সৃষ্টি হয়না।


পাস্তুরের পরীক্ষা স্বতঃজননবাদকে (Theory of spontaneous generation) ভুল প্রমাণ করেছে। স্বতঃজননতত্ত্বের দাবীদারদের সবাই বিশ্বাস করতেন জটিল জীব তার পূর্ণ অবয়বে নিজে নিজেই ‘সৃষ্টি’ হয়। যেমন, এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন কিছু মাছ এবং পতংগের মত ছোট প্রানী স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদ্ভূত হয় । ব্রিটিশ গবেষক আলেকজান্দার নীডহ্যাম (১১৫৭-১২১৭) বিশ্বাস করতেন ফার গাছ সমুদ্রের লবণাক্ত জলেতে ফেলে রাখলে তা থেকে রাজহাঁস জন্ম নেয়। জ্যান ব্যাপটিস্ট হেলমন্ট (১৫৮০-১৬৪৪) ভাবতেন ঘর্মাক্ত নোংরা অন্তর্বাস ঘরের কোনায় ফেলে রাখলে তা থেকে ইঁদুর আপনা আপনিই জন্ম নেয়। বিজ্ঞানী পুশে (১৮০০-১৮৭২) বিশ্বাস করতেন খড়ের নির্যাস থেকে ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জন্ম নেয়। পাস্তুরের গবেষণা মূলতঃ এই ধরনের ‘সৃষ্টিবাদী’ ধারণাকেই বাতিল করে দেয়। কিন্তু পাস্তুরের পরীক্ষা কিংবা জৈবজনির কোন সূত্রই বলে না যে, প্রাথমিক জীবন জড় পদার্থ থেকে তৈরি হতে পারবে না


ফ্রান্সে এক মহামারীতে রেশম পোকার উৎপাদন হ্রাস পেলে ফরাসি সরকার পাস্তুরকে রেশম শিল্পের এই সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানায়। পাস্তুর লক্ষ্য করেন রেশম পোকার এই সমস্যা বংশগত এবং মায়ের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রামিত হয়। তিনি প্রস্তাব করেন কেবলমাত্র রোগ মুক্ত গুটি বাছাই করার মাধ্যমে একমাত্র রেশম শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।

পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত জীবাণু তত্ত্বে (Germ Theory) প্রমাণ করে দেখান কিছু রোগের জন্য অণুজীব দায়ী, যারা জল ও বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তিনি তাঁর জীবাণু তত্ত্বে দেখান অণুজীব বৃহদাকার জীবকেও আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

পাস্তুরই প্রথম অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন একমাত্র গৃহপালিত পশুর দেহেই অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি (Bacillus anthrasis)-র আক্রমণে অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টি হয়।

অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কারের পর পাস্তুর অন্যান্য রোগের প্রতিরোধের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তিনি জলাতঙ্ক রোগের ওপর গবেষণা করে দেখেন এই রোগের জীবাণু আক্রান্তের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত পশুর মেরুদণ্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অন্য প্রাণীদেহে জলাতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পাস্তুর রোগ প্রতিরোধে অক্ষম জলাতঙ্ক ভাইরাস সৃষ্টি করেন, যা জলাতঙ্কের টিকা হিসেবে ব্যবহার হয়। ১৮৮৫ সালে পাস্তুর প্রথম এক শিশু বালকের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করেন। লুই পাস্তুর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দ্বারা আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক। এই আবিষ্কার তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। ফরাসি অ্যাকাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি।


লুই পাস্তুর একজন রসায়নের অধ্যাপক হলেও আমৃত্যু কাজ করেছেন অণুজীব নিয়ে। কেমন করে এর উৎপত্তি, কীভাবে এর দ্বারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেসব নিয়ে। মানবদরদী মহান এই বিজ্ঞানীর কাজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

১৮৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্যারিসে সমবেত হলেন দেশবিদেশের বিজ্ঞানীগণ। সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র তাঁর চরিত্র বদলে দেয়নি। তিনি আগের মতোই নিরহঙ্কার, নিরলস, সাদামাটা রয়ে গেলেন। শেষ জীবনে বাইবেল পাঠ আর উপাসনার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেন। এই বিখ্যাত বিজ্ঞান-সাধক, ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চিরনিদ্রায় শায়িত হন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ প্যারিসের 'পাস্তুর ইনস্টিটিউটে' স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালন করা হয়। 

এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিবসে (২৭ ডিসেম্বর) আমার শ্রদ্ধার্ঘ‍্য।


তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক, বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, রোর মিডিয়া, কালের কণ্ঠ, সব বাংলায়, ইন্ডিয়া টুডে ডট ইন, ফ্রন্টিয়ারসীন ডট ওআরজিও, ব্রিটানিকা ডট কম ও উইকিপিডিয়া।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - রামকৃষ্ণ, একটি ‘অসফল’ সাক্ষাৎকার -অভিষেক ঘোষ
Nov. 25, 2024 | যুক্তিবাদ | views:899 | likes:2 | share: 2 | comments:0

পর্ব – ১

কামারপুকুর থেকে আগত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ গদাধর চট্টোপাধ্যায় তখন কলকাতায় এক পরিচিত নাম। তিনি প্রায়শই  'বড় মানুষদের' সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্ৰহী হন। তাদের বাজিয়ে দেখতে চান।  নিজের কষ্ঠিপাথরে, অন্য কথায় ধার্মিকতার  কষ্ঠিপাথরে তাদের বিচার করতে চান।  কথামৃতকার শ্রীম তার ভক্ত। তাকে তিনি প্রকাশ করেছেন  ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা। বিদ্যাসাগর অবশ্য পূজারী বামুনটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তাঁর কর্মপরিধি ধর্মকুসঙ্গ থেকে বহুদূরের। কেবল জিজ্ঞাসা করলেন শ্রীম কে "কীরকম পরমহংস? তিনি কি গেরুয়া কাপড় পরে থাকেন?"  যাই হোক  শ্রীম, যিনি তখন বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয়ে কর্মরত এক শিক্ষক, নিয়ে গেলেন তার প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাসগৃহে। বিদ্যাসাগর- গদাধরের  সাক্ষাৎ হল 5 অগস্ট, 1882 ।


বিদ্যাসাগর তাঁর স্বভাব অনুযায়ী ভদ্র ও সুন্দর ব্যবহার করলেন গদাধরের সঙ্গে। তাঁকে বর্ধমানের মিষ্টি খেতে দিলেন। গদাধর তার স্বভাব অনুযায়ী ধর্মকথায় খই ফোটালেন। একথা সেকথা। সবই একই বিষয়ে ঘোরাঘুরি। কথামৃত পড়লে জানা যায় গদাধরের প্রবচনপ্রিয়তা।  বিদ্যাসাগর সম্পর্কেও  কিছু ভাল ভাল কথা বললেন, "তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, বিদ্যার সাগর" ইত্যাদি। বিদ্যাসাগরের দয়া করুণার প্রশংসা করলেও ঠারেঠোরে বোঝাতে চাইলেন এসব ঠিক আছে তবে আসলে ঈশ্বরের কথা না ভাবলে সব মাটি। অর্থাৎ কিনা একমাত্র গদাধরের পথটিই অবলম্বনীয়। তিনি যা করছেন তার কাছে এসব দান দয়া সব ফিকে। এসব সারবত্তাহীন  ভাবের কথার থেকে মানুষের অভাব যাকে বেশি বিচলিত করতো সেই কর্মবীর মানুষটি 16 বছরের ছোট এক অশিক্ষিত পুরোহিতের কথা কিভাবে নিয়েছিলেন অনুমান করা কঠিন নয় তবে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। বরং   "সাগরে এসে মিললাম"  এর উত্তরে মজার ছলে, "তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান" বলেছেন। কথামৃতে এই সাক্ষাৎকারে কথোপকথনের সিংহভাগ জুড়ে আছে গদাধরের মুখঃনিঃসৃত কথাবার্তা, অন্য কথায় সেই চেনা ধর্মীয় বুলি,যা আছে কথামৃতের সর্বত্র। বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করেছেন - "তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?" পাঠক এই প্রশ্নটি মনে রাখুন। এই প্রশ্নের উত্তর থেকে পরে গদাধরের মনোজগতের একটি পরিচয় পাওয়া যাবে। 


উত্তরে গদাধর জানান নিশ্চয়ই তাই। তাতে বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসছেন।  পাঠক লক্ষ্য করুন, বিদ্যাসাগর প্রায় সমস্ত সময়টাই গদাধরকে নিচ্ছেন হালকা মনে। সহাস্যআননে। গম্ভীর তত্বকথা যা ভাবাতে পারে, তাতে মানুষের আচরণ এরকম হয় না। গদাধরের বচনামৃত যে তাঁর মনে রেখাপাত করছে না, (বা পরেও করেনি) তার প্রমাণ পাতায় পাতায়। 

গদাধর বলছেন "তাকে পান্ডিত্য দিয়ে বিচার করে জানা যায় না।"  (বিদ্যাসাগর পন্ডিত ব্যক্তি বলেই কি তার সামনে  এই জাতীয় কথাপ্রসঙ্গ ?) এর মধ্যে  মাঝেমধ্যে তিনি ভাবাবিষ্ট হচ্ছেন। কখনো মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ভাষায় 'সমাধিমন্দিরে' চলে যাচ্ছেন।  


এসব পর্বের পর গদাধর বিদ্যাসাগর কে বললেন  "একদিন বাগান দেখতে যাবেন, রাসমণির বাগান"। তাতে বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তা যে কেবল কথার কথা ভদ্রতা ছিল, আমার জানতে পারি তিনি কখনোই রাসমণির বাগান দেখতে না যাওয়ায়।  পাঠক এই প্রসঙ্গটিও মনে রাখুন।  


বেশ কিছুক্ষণ ধরে ধর্মপ্রসঙ্গ করবার পর (অবশ্য কথামৃতে বহু কথার সংযোজন শ্রীমর, এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে)  গদাধর বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন এখানে ঠিক হালে পানি পাওয়া যাবে না। 


এটি বিদ্যাসাগর - গদাধরের প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎকার। 

যৌক্তিক দৃষ্টিতে ভাবাটা বোধহয় অসঙ্গত নয় যে তৎকালীন সমাজে গদাধর চট্টোপাধ্যায় নানান লোকের তোল্লাই পেয়েছিলেন। নিজেকেই স্বয়ং অবতার বা ভগবান ভেবেছিলেন কিনা জানি না তবে ভগবান সম্পর্কে তিনি যে একজন authority এই বোধ বেশ দৃঢ় ভাবেই তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। শুধুমাত্র উক্ত সাক্ষাৎকারটি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলেই তা বেশ বোঝা যায়।  তিনি অন্যদের চেয়ে বেশ কিছুটা আলাদা (যদিও নিজেকে বহুক্ষেত্রে অধম বলে বিনয় করেছেন) সেই ধারণাও তার অবশ্যই হয়েছিল। 


পর্ব – ২

নিজের আগ্ৰহেই যখন  গদাধর চট্টোপাধ্যায় কলকাতার তৎকালীন নামী মানুষদের সঙ্গে যেচে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, নিজের ধর্মে তাদের ভজানোর জন্যই হোক বা 'বড় মানুষ' দেখার ঐকান্তিক আগ্ৰহেই হোক, তখন তিনি নানান মানুষের মত পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গেও দেখা করে তাকে নানান ধর্ম প্রবচন দেবার পরে, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দেখতে আমন্ত্রণ করেন। বলাই বাহুল্য বিদ্যাসাগর তখন মিষ্টি কথায় তাঁকে,  'আপনি এলেন আর আমি যাব না!' বললেও কখনোই কালীবাড়ির পথ মাড়াননি। কারণ বিদ্যাসাগরের চলার পথ ছিল যুক্তির ও কর্মের। ভাববাদের ও কুসংস্কারের পঙ্কিল ঘূর্ণাবর্ত থেকে তাঁর শিক্ষিত শীলিত  যৌক্তিক  চেতনা ছিল অনেক দূরের। 


এই পর্বে আমরা শুধুমাত্র উক্ত সাক্ষাৎকারটির ভিত্তিতে  গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মনোজগতে সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করব। 

সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা দেখি পদমর্যাদায় ও সম্মানে বড় কোন মানুষকে একজন সাধারণ  মানুষ, যিনি শিক্ষার আলো তেমন পাননি অথবা পদমর্যাদায় অনেক নীচের, তিনি কিভাবে দেখেন?  হয় তিনি উচ্চপদের মানুষটিকে অতিভক্তি দেখাবেন নয়তো তাঁর সামান্য ভুল ত্রুটি খুঁজে নিয়ে তাকে, 'আরে ও তো অতি সাধারণ, এই সামান্য কথাও জানে না!' জাতীয় কথা বলে  নিজেকে তাঁর চেয়ে বড় দেখানোর চেষ্টা করে নিজের অহংপুষ্টি করবেন। এটি গ্ৰাম অঞ্চলে অতি সাধারণ একটি ঘটনা। আমার ঠিক এই মনোবৃত্তিই দেখতে পাব গদাধরের একটি মন্তব্যে। গদাধর, যে কিনা তৎকালীন সমাজে কিছু পৃষ্ঠপোষকের তোল্লাই পেয়ে বেশ একটু পরিচিতি পেয়েছে, তার ইগো বুস্টেড হয়েছে বেশ ভালই! বিদ্যাসাগর কথার কথা 'আপনি এলেন আর আমি যাব না' বলে, না যাওয়ায়, পরিস্কার বলে বসে, 'বিদ্যাসাগর মিথ্যা কথা কয় কেন?'। পাঠক ভেবে দেখুন বিদ্যাসাগর যে কিনা একা হাতে শিক্ষার মশাল নিয়ে তখন সমাজ সংস্কারে, শিক্ষাবিস্তারে, পরের দুঃখনিবারণে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তখন তাঁকে সরাসরি "মিথ্যাবাদী" প্রতিপন্ন করে দিতেও এই পূজারী বামুনটির বাধছে না! যেন দক্ষিণেশ্বরে এসে বেশ একটু ধর্মকথা শুনে, সমাজে রামকৃষ্ণ কে আরেকটু পরিচিত করে দিলেই সে সত্যবাদী নাহলেই মিথ্যুক। এখানে হয়তো তার বুঝতে ভুল হয়েছে যে ওটা কেবল কথার কথা নয়ত ধরে নিতে হয় বিদ্যাসাগরের কর্মপরিধি কোন মন্দিরের চৌকাঠ দিয়ে যায় না এই  সামান্য বিষয় বোঝার মত বুদ্ধিও তার ছিল না। যাই হোক, গদাধরের মন্তব্যটি কথামৃতে রয়েছে। 

আগের পর্বে আমরা দেখেছি বিদ্যাসাগর গদাধরকে প্রশ্ন করেছিলেন (কথামৃত অনুযায়ী) -"তিনি কি কাউকে বেশি কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?" তাতে গদাধর জানান, নিশ্চয়ই, নাহলে তোমাকেই বা এত লোকে মানে কেন, 'তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো?' 

পরে কথামৃতে দেখি এই প্রশ্নে গদাধরের ছদ্ম  অহং কিভাবে পুষ্ট হয়েছিল তারই একটি মন্তব্য থেকে।  গদাধর বেশ নিজেই নিজেকে সাবাশ দেবার কায়দায় বলে বসে, "বিদ্যাসাগরের এক কথায় তাকে চিনেছি!” এই জাতীয় গভীর আত্মবিশ্বাস ও তার আত্মম্ভরী ঘোষনা একমাত্র মূর্খের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে কিনা এক কথায় কাউকে চিনে যাবার দাবি করতে পারে! এখানেও সেই পূর্ব কথিত মনস্তত্ব কাজ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে তার মত এক 'অবতার' ধরাধামে নেমে লীলা করছে, 'যেই রাম সেই কৃষ্ণ সেই এই দেহে রামকৃষ্ণ', তাকে কিনা এতখানি উপেক্ষা! নিজে যেচে গিয়ে ডাকলেও না আসা!  নিশ্চয় গদাধরের অহং তীব্র আহত হয়েছিল। তাই কি এতখানি বিষোদগার বিদ্যাসাগরের বিরূদ্ধে? অনুমান করা কঠিন নয়।


আচ্ছা তথাকথিত  'যত মত তত পথ' এর প্রবর্তক হঠাৎ করেই বিদ্যাসাগরের পথটিকে গ্ৰহনযোগ্য মনে করেননি কেন? তার মধ্যে তাহলে আসলে সংকীর্ণতাই ছিল,এমন মনে হয়নি কি? 

পাঠকদের প্রসঙ্গক্রমে তিনটি ঘটনা জানিয়ে বলি - 

ঘটনা ১ :   শ্রীম অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। একবার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় বিদ্যাসাগর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি খবর পেয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের কাছে বেশি যাতায়াতের জন্যই শ্রীম বিদ্যালয়ে যথেষ্ট সময় দিতে পারতেন না।  শ্রীম গুরুর অপমান হচ্ছে বুঝে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। ধন্য শিক্ষক বলতে হয়! যার কাছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গুরুর সম্মান! 

ঘটনা ২ :  ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বদলে ধর্মশিক্ষা বেশি দিচ্ছেন খবর পেয়ে বিদ্যাসাগর (তাঁর ছাত্রতুল্য)  তাঁর বিদ্যালয়ে কর্মরত নরেন্দ্রনাথ দত্তকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ বিদ্যাসাগরের স্পষ্ট মতামত ছিল শিক্ষকরা অবশ্যই ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকবেন।


ঘটনা ৩:  গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, তাঁকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠান করবেন হলে তার শিষ্যরা বিদ্যাসাগরের কাছে চাঁদা চাইতে যান। সেই বিদ্যাসাগর যিনি অন্যের কষ্টে অনেকসময় অপাত্রেও দান করেছেন, তিনি তাদের একটা টাকাও দেননি।  

নিশ্চয় দেশের যুবসমাজ যাঁদের তিনি চেয়েছিলে আধুনিক শিক্ষিত ও যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলতে, তাদের এভাবে পথভ্রান্ত হতে দেখে একজন মানুষ গড়ার কারিগর বিদ্যাসাগর খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। 

এই ঘটনা ও উপরের আলোচনা থেকে বোধহয়  যুক্তিবাদী পাঠকের কাছে এই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে বিদ্যাসাগরের,তথাকথিত পরমহংস এবং তাদের চেলাদের সম্পর্কে মনোভাব কেমন ছিল। তিনি এই ধর্মের নামে সমাজকে অন্ধকারের দিকে যেতে দেখছিলেন যা তাঁর নিজের সমাজ ও মানবগঠনের পরিপন্থী ছিল। 

কাজেই সাক্ষাৎকারটি চূড়ান্তভাবে  'অসফল' হয়েছিল একথা বলাই বাহুল্য। 


এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গেই কথামৃত গ্ৰন্থটি সম্পর্কে দু'একটা কথা বলা যায়। তথাকথিত শ্রুতিধর শ্রীম র ওপর অভিযোগ তিনি একটি কি দুটি শব্দ থেকে অনেক পত্রপল্লব বিস্তার করেছেন। যাকে সোজা কথায় ফেনানো বলা যায়। এই ফেনানো যে অনেকক্ষেত্রে ভক্তসুলভ এবং সত্যের উলটো দিকে গিয়েছে সেটাও অনুমান করা খুব কঠিন নয়। যেখানে শ্রীমর সমকালীন ভক্তরাই কথামৃতকে খুব trustworthy মনে করতেন না।  রামকৃষ্ণ র কথিত গ্ৰাম্য slang ও গালিগালাজ গুলি  অনেকক্ষেত্রে বাদ গেছে।  নিশ্চিতভাবেই গুরুকে glorify করতে। কথামৃতের পূর্ব সংস্করণে ‘শালার পন্ডিত’ কথাটি ছিল। এখন সেটি অবশ্য edit out হয়েছে। এরকম আরো নানা ক্ষেত্রে। 


বঙ্কিমচন্দ্র র সঙ্গে গদাধরের সাক্ষাৎ বিষয়টিতে প্রথমে শ্রীম নিজ উপস্থিতির কথা বললেও পরের সংস্করণে  তার উপস্থিতি  না থাকার কথা জানান।  কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র -গদাধর সাক্ষাৎকারের মন্তব্যগুলি, বিশেষত বিদ্যাসাগরের ভক্তসুলভ আপনি আজ্ঞা জাতীয় মাখোমাখো মন্তব্যগুলি কতখানি সত্যি আর কতখানি রঙচড়ানো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে পারম্পর্য ও চরিত্রবিশ্লেষণ করে  ভক্তরচিত কেতাবগুলি পড়লে বিষয়গুলি আরো স্পষ্ট হতে থাকবে। 

পুস্তক সহায়তা - প্রাগুক্ত।

(১) শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত, লেখক- শ্রীম,প্রকাশক-  উদ্বোধন 

(২) কামারের এক ঘা, লেখক- রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রকাশক- পাভলভ ইন্সটিটিউট


ছবি ঋণ - ড্রয়িং অ্যাকাডেমি।

আস্তিক ভাই, কটা প্রশ্নের জবাব দেবেন প্লিজ? -বিশ্বনাথ মুরমু
Nov. 25, 2024 | নাস্তিকতা | views:895 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আস্তিক হলেন সেই মানুষ, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। শুধু ঈশ্বর নয়, তিনি যাবতীয় দেব-দেবী, অপদেব, অপদেবীতেও বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতীত বা দেব-দেবীর আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, ঝরে না, মানুষের জগতের ভালো বা মন্দও হয় না, কোনও কিছুই ঘটে না। জাগতিক যাবতীয় ঘটনাবলী, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছেতেই ঘটছে। সৃষ্টি, স্হিতি, প্রলয় ঈশ্বরের নিত্য লীলা ইত্যাদি। তেমনই ছোটখাটো অন্য অনেক ঘটনাবলীও ঈশ্বরের ইচ্ছা অথবা তার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অবতার যথা, শিব, ব্রহ্মা, নারায়ণ, বিষ্ণু, সরস্বতী, লক্ষী, কালী, রাম, হরি, গরাম ঠাকুর, মারাংবুরু আদিদের ইচ্ছা ব্যতীত সাধিত হয় না। অর্থাৎ তিনি বা তাঁরা আছেন বলেই সব কিছু হচ্ছে।


নাস্তিক হলেন সেই মানুষ, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কোন দেব-দেবী, অপদেব, অপদেবীতে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে বা বিজ্ঞানের নিয়মে যা ঘটা উচিত, সেইভাবেই যা কিছু জাগতিক ঘটনা ঘটে, ঘটে চলেছে। কোনও ঐশ্বরিক পূর্ব পরিকল্পনা বলে কিছু হয় না, হতে পারে না। ঠিক একইভাবে এটাও বিশ্বাস করে না যে ঈশ্বরের কোনও ক্ষুদ্র কনা বা অবতার বলে কিছু হয়, যাকে দেব দেবী বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং তার পূজার্চনা বা জপতপ করলে কোনও অভিলাষ পূর্ণ হবে।


এই বারে, খুবই বিনীতভাবে এই প্রশ্নগুলি পেশ করছি। আর আশা করছি যে সৎসাহসের সঙ্গে আন্তরিকভাবেই কোনও আস্তিকবাদী ভাই এর যথাযথ উত্তরগুলি দেবেন।


- আমি যে নাস্তিক হব অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস করব না, এটা তাঁরই ইচ্ছা নয় কি? (যদি থাকেন)। কেন না, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা ব্যতীত কোনও কিছুই তো হওয়ার নয়।

- জাগতিক কোনও ঘটনাকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা বা কীর্তিকলাপ বলে মনে করব না, মেনে নেব না, এও নিশ্চয় তাঁরই পূর্বনির্দেশ? (যদি থাকেন)।

- আপনি আস্তিক মানুষ হয়ে তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করবেন, দেব দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করবেন, তেমনই আমি নাস্তিক হয়ে তাঁর অস্তিত্বকে, মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করবো, এও তাঁর অসীম করুণা নয় কি? (যদি থাকেন)।

- আমাকে ব্যাখ্যা দিন, আপনার ঈশ্বর আমার মনে তাঁর নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই এই অবিশ্বাস জাগিয়েছেন কেন?

- জাগতিক ঘটনাবলীর জন্য নিতান্ত যে প্রকৃতিই দায়ী এটাই বা আমার মনে আনলেন কেন?


যুক্তিবাদী ব্যক্তি, দল অথবা মঞ্চ বলে যা গড়ে উঠেছে, আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, এর জন্যও আপনার ওই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই দায়ী (যদি থাকেন)। কিন্তু কেন?

- মানুষকে ঈশ্বরের নামে বোকা বানাবেন এটা যদি তাঁরই ইচ্ছা হয়, তাহলে তার প্রতিবাদ করাও তাঁরই ইচ্ছা, কি বলেন? ঈশ্বর কেন এমন ইচ্ছা করলেন?


মোরবি সেতু মৃত্যুকান্ডের (বলা উচিত হত্যাকান্ড) সেতু রক্ষণাবেক্ষনের কর্তারা বলেছেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে কেন তদন্তকারী দল তাঁদেরকেই দায়ী করেছে? আপনি স্বীকার করতে বাধ্য যে মোরবি দুর্ঘটনার অপরাধীদের কারাবাস নিশ্চিত, তাহলে এও নিশ্চয় তাঁরই ইচ্ছা!

আসলে আস্তিকেরা ইচ্ছে করেই মনগড়া এক ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা প্রচার এজন্যই করেন যে স্বল্পশ্রমে লেহ্যপেয় সহযোগে কেমন আয়েশী জিন্দেগি যাপন করা যায়।


আস্তিক ভাই, মানতেই হবে আপনার অথবা আপনাদের এলেম আছে বটে। শস্য উৎপাদন বা শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে বা দেশের যে কোনও উৎপাদনে গতর না খাটিয়েও দিব্যি পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে করে খাবার সুন্দর সহজ পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। ধন্য আপনি, ধন্য আপনারা।


রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপরতলা থেকে নীচতলা পর্যন্ত এমনভাবে বজ্রআঁটুনি দিয়ে রেখেছেন যে বড় বড় নেতা/অভিনেতা, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি থেকে কৃষক শ্রমিক সব আপনাদের মুষ্টিতে। সত্যিই, ঈশ্বরের অথবা দেবদেবীদের কৃপা ছাড়া এটা সম্ভব হত না (আপনার মতে আমার মতে নয়)।


সাধারন মানুষ যাতে প্রশ্ন না করে, প্রশ্ন করলেও যাতে এমন উত্তর পায় যা আপনাদের উদ্দেশ্যকেই পূর্ন করবে, তাই আপনারা ধর্মের নামে (তথাকথিত) ভালো ভালো অজস্র কেতাব রচনা করেছেন, আখড়া বানিয়েছেন, আশ্রম খুলেছেন, আশ্রমের শাখা-প্রশাখা খুলেছেন।


আমি বা আমরা বিনা প্রশ্নে কোনওকিছু মানতে রাজি নই। কে, কী, কেন, কেমন করে, কবে, কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন করার অধিকার মানুষের জন্মগত। আপনারা গোড়াতেই তাকে উপড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর, যুক্তি দেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। আপনারা তাই চান না যে মানুষ শিক্ষিত হোক। এই বিষয়ে আপনাদের ব্যাপক গবেষণায়, গবেষণালব্ধ ফল প্রয়োগে সত্যিই অবাক মানতে হয়। আপনারা দেখেছেন, মানুষ স্বচ্ছল হলে, স্বাবলম্বী হলে তারা শিক্ষালাভের চেষ্টা করে। তাই আপনারা আপনাদের আবিষ্কৃত ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ ফর্মুলা প্রয়োগ করেন। ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না, মানুষ আর কোনওদিকে চোখ মেলে তাকাবার সুযোগই পায় না। আপনাদের বাবার আখড়া, মায়ের আখড়ার মাধ্যমে মগজ ধোলাই করে মানুষকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের নিজেদের পূর্বজন্মের অথবা পূর্ববর্তী প্রজন্মের পাপের ফলেই তারা গরীব এবং অশিক্ষিত। তাদেরকে এটা বোঝাতেও সক্ষম হন যে তারা একমাত্র ভগবৎ স্মরণেই মুক্তিলাভ করতে পারে।

সাধারন মানুষের যুক্তিবোধের প্রশ্নের উত্তরে, আপনারা সবই তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা বলে চালিয়ে দেন। কেউ বেশি প্রশ্ন করলে, কোনও কিছু মেনে নিতে না চাইলে, আপনারা সংযম না রেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং অকথা কু’কথা বলেন, অভিশাপ দিয়ে দেন।

- এ সবই কি তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা বলেই চালিয়ে দিতে চান?

তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছে ব্যতীত যখন কিছু হওয়ার নয়, তখন আমি যে মাধ্যমিকে ফেল করব এও নিশ্চয় তাঁর বা তাঁদেরই ইচ্ছে! তাহলে, সেই কারণে আমার বাবা আমাকে বকবেন বা চাবকাবেন কেন? এটা কি তাঁর বা তাঁদের স্ববিরোধিতা হয়ে যাচ্ছে না? এ’তো জোড়াতালি দেওয়া যুক্তি। ঠিক যেন গাছেরও খাব আবার তলারও কুড়োব। বাহ্ আস্তিক ভাই, ধন্য আপনাদের যুক্তি।

সেরকম কোনও কিছু থাকলে, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছেতেই তো কোনও বিরুদ্ধবাদীদের থাকবার কথাই নয়। ফলে, কোনও সন্দেহ, কোনও প্রশ্ন ওঠবার কথাই ওঠে না। অথচ প্রশ্ন উঠেছে, উঠছে। তারপরেও কি আপনারা গোঁ ধরেই থাকবেন? তাছাড়া আপনাদের আর উপায়ই বা কি আছে? আপনাদের তাসের ঘর ভেঙে যাক, এটাতো আর চাইতে পারেন না! তাই, যেভাবেই হোক, একে রুখতে হবেই। হ্যাঁ মানছি, আপনাদের বনিয়াদ খুব শক্ত ভিতের উপরই দাঁড় করিয়েছেন। তবে, এটাও জেনে রাখুন, আজ হোক কি কাল হোক, দু’বছর কি দশবছর কি দু’শ বছর পর আপনাদের ভিত আমরা যুক্তিবাদীরা ভাঙবই ভাঙব। জেনে রাখুন, মানুষ জাগছে, জাগবেই আজ কি কাল।

কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন -সৌরভ কুমার মান্না
Nov. 25, 2024 | নাস্তিকতা | views:896 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১) ঈশ্বরকে কে বানালেন?

যদি বলেন তিনি স্বয়ম্ভু, সেই একই যুক্তিতে আমরা প্রকৃতিকে স্বয়ম্ভূ বলতে পারি।

২) যদি ঈশ্বরের তৈরী করার আগে কোনো স্থান না থেকে থাকে, তিনি আমাদের তৈরী করলেন কোন স্থানে বসে? সময়ও তো তিনিই তৈরী করেছেন, তাহলে কোন সময়ে তিনি আমাদের তৈরী করলেন?

৩) বিভিন্ন ধর্মমতে তিনি বিভিন্নরকম ভাবে বর্ণিত, কোনটা মেনে নেবো এবং কেন? পৃথিবীতে কিন্তু কমবেশি ৭২০০ ধর্ম আছে।

৪) আমাদের দেশ প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের অধীনে থাকতে বাধ্য হলো, অনেক খুন ও লুঠ হলো, জালিওনাওয়াবাগ হত্যাকাণ্ড হলো।  কেন? তিনি তো আরও আগেই স্বাধীনতা এনে দিতে পারতেন।

৫) ঠাকুর, অবতারেরা ভারতে জন্মান আর পয়গম্বর এরা আরবভূমিতে কেন?

৬) ডায়ালিসিস, কেমো থেরাপি বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে লেখা নেই কেন?

৭) বিবর্তন সম্পর্কে ধর্ম কি বলে?

৮) জুনকো ফুরুতা, নির্ভয়া ঘটনা তিনি আটকালেন না কেন? এখানেও কি "তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন" থিওরি?

৯) একজন হিন্দু যদি বেশ কিছু বছর পর অন্য ধর্ম মতে দীক্ষিত হন তাহলে চিত্রগুপ্তর হিসাব কি থেমে যাবে নাকি হিসাব ট্রান্সফার এর ব্যবস্থা আছে?

১০) বি.এস.এফ এর হাতে বিপদতারিনী তাগা পরালে কি আর বর্ডারে কোনো দাঙ্গা হবে না?


বিষয় - প্রতিবন্ধী

লি খে ছে ন – দি বা ক র ম ন্ড ল


ছোট থেকেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশু দেখলে খুব কষ্ট অনুভব করি। একটা সময় অন্যসব লোকের মত আমিও  বিশ্বাস করতাম যে এগুলো সব ভগবানের দান। ধর্মগুরু, কীর্তনিয়া, এবং ইমামদের বক্তব্য থেকে যেটা বুঝেছিলাম যে, “মানুষকে শারীরিক প্রতিবন্ধী/বিকলাঙ্গ করে ঈশ্বর বা আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান।”


 এর পিছনে রয়েছে মূলত চারটি কারণ যথা-

(১) ভয়ংকর রকম পাপাচার বা আল্লাহর চরম অবাধ্যতার কারণে গজব (২) কর্মফল অর্থাৎ নিজস্ব কিছু পাপের জন্য ভগবান প্রদত্ত ফলাফল এবং (৩) পূর্বজন্মের পাপের শাস্তি। (৪) মানুষের অভিশাপ।


 দুঃখের বিষয় আজও এই ধরনের বক্তব্য সচরাচর মানুষের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, আজই আমি হসপিটালে থাকাকালীন এক মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে লক্ষ্য করে কিছু মানুষের এই ধরনের বক্তব্য শুনে মর্মাহত হয়েছি।  যদিও বড় হওয়ার সাথে সাথে যতটুকু বুঝেছিলাম পড়াশোনা করে এবং আজ গুগল থেকে সাহায্য নিয়ে যেটুকু জানতে পেরেছি; মানুষ বিকলাঙ্গ হওয়ার পিছনে যে কারণ গুলি রয়েছে যথা 


১) যদি কোন মহিলা ডায়বেটিস আক্রান্ত থাকেন তবে তার গর্ভের বাচ্চা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে জন্মাবার সম্ভাবনা খুবেই বেশি।

(২) স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি এই যৌনরোগের ভাইরাস এবং ব্যকটেরিয়া বহন করে তবে ইনফেকশন হয়ে গর্ভধারিণী মায়ের বাচ্চার বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে।


(৪) কোন মহিলা যদি গর্ভাবস্থায় তামাক জাতীয় দ্রব্য যারা সেবন করেন তবে বাচ্চার শারীরিক ডিফেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আমেরিকার ১৫.৩ ভাগ মহিলা ধুমপান করেন যেখানে পুরুষরা করেন ২০.৫ ভাগ (২০১৩ সালের রিপোর্ট)। দেখা যায়, আমেরিকায় প্রতি ৩০ টি শিশুর একটি কোন না কোন শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মাচ্ছে। এর আর একটি অন্যতম কারণ, অ্যালকোহল। এখন গর্ভাবস্থায় যদি কোন মা অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় লিমিটের বাইরে সেবন করে তবে তার প্রসবকৃত শিশুটা মুখের বিকৃতি তথা চেহারার বিকৃতি, কম ওজনের ছোট বাচ্চা প্রসব, আচারণগত সমস্যা বা মানসিক সমস্যা, এমনকি সময়ের পূর্বেই তথা ৩৮ সপ্তাহের আগেই বাচ্চা প্রসব হতে পারে। যার কারণে স্থায়ীভাবে নানান শারীরিক জটিলতা নিয়ে জন্মাতে পারে।


(৫) অনেক গোত্রের মেডিসিন আছে যেগুলো গর্ভাবস্থায় সেবন করলে বাচ্চা প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন, লিথিয়াম বা ইসোট্রিটিনিয়ন গ্রুপের ঔষধ। এগুলো সমসাময়িক কালের একটা বড় কারণ।


(৬) কোন গর্ভবর্তী মহিলা যদি গর্ভাবস্থায় বেনজোডায়াজেপাইন (Benzodiazepine) গোত্রের অসুধ সেবন করে। অর্থাৎ সোজা বাংলায় আমার যেটা বুঝি "ঘুমের" ঔষধ সেবন করে তবে তার বাচ্চার জন্মের পর শাসকষ্ট বা হাপানী হতে রোগ নিয়েই জন্মাতে পারে। হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। দূর্বল মাংসপেশী নিয়ে জন্মাতে পারে। 


(৭) Norethisterone (নরইথিস্টেরন) হরমোনটি মহিলাদের মাসিক রজঃবৃত্তির চক্রের সাথে উঠানাম করে। এই হরমোন জাতীয় ঔষধটি নারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় ইররেগুলার বা পেইনফুল মেনস্ট্রল নিয়ন্ত্রণের জন্য। গর্ভবতী সময়ে এই ঔষধের সেবনে  বাচ্চা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাবার সম্ভাবনা থাকে।


(৮) আমরা জানি, গর্ভাবস্থায় যদি ভিটামিনের ঘাটতি থাকে তবে বাচ্চা নানান শারীরিক জটিলতা নিয়ে জন্মাতে পারে। বিশেষ করে, জিংক, ফলিকএসিড, আয়রণ, ভিটামিন এ, বি, ডি, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি।


অথাৎ শারীরিক এবং মানসিকভাবে যে সমস্ত শিশুরা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মায়, কেন হয়, তার বিজ্ঞানসন্মত কারন আমরা জানতে পারলাম, তাই কোনো বিকলাঙ্গ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুকে দেখে এটা আল্লাহর বা ভগবানের দান, পূর্বজন্মের পাপের ফল, এই ধরনের মন্তব্য করবেন না; এতে ঐ শিশুটি এবং তার পিতা-মাতা উভয়কে অপমানিত করা হয়। এই ধরনের বক্তব্য শোনার পর পিতা-মাতার মধ্যে যে অন্যায় বোধ কাজ করে সেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমি এক প্রতিবন্ধী শিশুর মায়ের সাথে কথা বলে বুঝেছি তিনি কতটা হীনমন্যতায় ভুগছেন, কতটা কষ্টে রয়েছেন!


 তাই সকলের কাছে অনুরোধ আপনারা বিজ্ঞানমনস্ক হন, ধর্মীয় কাল্পনিক, অবৈজ্ঞানিক গল্প কথায় বিশ্বাস করে কাউকে নিজের অজান্তেই অপমান করবেন না।

প্রামাণিক পাড়া, ফলতা, 

দ. ২৪ পরগনা, প: ব:

বাংলাদেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িক ঘটনা নিয়ে জেগে স্বপ্ন দেখা.. -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 25, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:281 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে কারা পোস্ট করছেন। আর লিখছেন? এপারে RSS-ওপারে জামাত....! বলছিলাম এই কথা শুনলে বাংলাদেশের পিনাকী ভট্টাচার্য ও নয়ন চ্যাটার্জী’রাও হাসবে তারা তো ‘জামাতপন্থী বুদ্ধিজীবী’। আসল কথা আপনারা যে জামাত এর কথা বলছেন সেটা আসলে ভারতেরই জামাত...।

[1] সময় করে ফতোয়া আলগিড়ি পড়লে জানতে পারবেন। [2] আপনাদের গণতন্ত্র ও সেকুলারিজমকে তারা কী বলে। তাদের ভাষায় আল-তাকিয়া বলে। এরপর আর কিছু বলার বাকি আছে? [3] যাইহোক এই বিষয় [আব্দুল্লাহ-আল-মাসুদ] ভালোই অবগত, তবে বাংলাদেশে জামাত শিবির আর নেই! এখন সবটাই রাজনীতি[4] এখন যেটা আছে সেটা হলো হেফাজত ইসলাম। [5]  


বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে, হেফাজত বা আপনাদের জামাত এর কোনও হাত নেই। ওটা আপনাদের মানসিক অসুস্থতার একটি বাহির চিত্র মাত্র...! তাদের বিনা কারণ ছাড়াই দোষ দিচ্ছেন। এখন যদি বলেন এই কথার তথ্য কি? তার খুব সুন্দর উত্তর আছে। কিছুদিন আগে মুসলিম ছেলের প্রেমে প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় এক হিন্দুমেয়ে নামে ফেক ফেসবুক ধর্মীয় কটূক্তির পোস্ট করে মিথ্যা অভিযোগে হিন্দু মেয়েটিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্ত এটা শেষ নয় এর তারপর শুরু হয় থানায় হামলা, আক্রমণ, CA land, uno, সার্কেল পুলিশ সুপারের গাড়ী ভাংচুর, তার সাথে থানাও ভাংচুর বুঝতেই পারছেন কতটা অনুভূতি।[6] ভিডিও দেখে মনে হল বাংলাদেশ পুলিশ কেমন তৎপর! এবং এইসব ঘটনা বছরে অনেক ঘটে তার তথ্য [7] বাংলাদেশের চিড়িয়া তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আসলে বাংলাদেশ একটি এখন চিড়িয়াখানা। আওমলীগ ভয় দেখায়। তারা না থাকলে বিএনপি জামাত চলে আসলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা আবার ভারতের মত সংখ্যালঘু রাজনীতি করে না। যেমনটা ভারতে হয়। ওই তো আর কি জনসংখ্যা 90% তো মুসলিম এক কথায় মুসলিম রাষ্ট্র তবে ইসলামিক রাষ্ট্র নয়। [8]


বাংলাদেশে এই মাস খানেক আগে একজন শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুলিশের সামনে কি করা হল তা বলার মতো না। [9] বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন করতে চাইলে জামাত হেফাজত এদের কারোর দরকার হয় না। দরকার হয় একটি ফেক ফেসবুক আইডি [10] তারপর দেখুন কীভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন করা যায়। [11] এক কথায় ফেক ফেসবুক দিয়েই বিপ্লব চলে। [12] সেখানে কেন যে আপনারা জামাতকে টানেন বুঝতে পারি না। আপনারা এতই যখন জামাত বিরোধী তখন ভারতের জামাত শিবির বন্ধের জন্য মিটিং মিছিল করছেন না কেন? অথচ ভারতে RSS কুমির দিয়ে কী ধরতে চায় সেটা জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না। তবে কুমির কিন্তু ভয়ঙ্কর এটা মাথায় রাখবেন।  


তবে পশ্চিমবঙ্গে 2016 সালে একজন যুক্তিবাদী ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করাতে একজন ভয়ঙ্কর বিষধর ধর্মান্ধ সাপ 295এ কেস করেছিল। [13]  তবে ভারতে ফেক আইডি দিয়ে পোস্টের চেয়ে গো-মাংস অনেক বেশি বিপদজনক[14] আর বাংলাদেশে গরু না খাওয়ার জন্য কি হয় আর বললাম না। [15] তাই সব কিছুতে জামাত জামাত করে লাভ নেই। এমন করে জামাত এর নাম নেয়, মনে হয় জামাতের নাম না নিলে ভাত হজম হয় না। এই কথাটা বাংলাদেশের এক সিপিবি নেতা বলেছিলেন, তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।

আরেক মৌলবাদী আওমলীগ সরকার বলছেন এখনও অনেক লাশ পাওয়া যায়নি, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যত হামলা হয়।¹⁶ তার জন্য দোষ তো ধর্মের, তার থেকেও দোষ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হয়ে জন্ম নেওয়া। আমি তো বলবো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উচিত মুসলিম হয়ে যাওয়া।


তারা সংখ্যালঘুদের দেখলে তাদের কথা শুনলে মুমিনদের ধর্মীয় অনুভূতিতে যখন তখন আঘাত আসে। এমন কি বিবর্তনবাদ নিয়ে ছাত্রদের লেকচার দিলে মহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর ছুরি হামলা"[17] এতো শান্তির ধর্ম যে বিবর্তনবাদ এদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে। [18] তাহলে বলতে পারতাম জামাত ও RSS এক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ কিন্তু কিছুতেই এক করতে পারি না। এবং করাটা হবে চরম মূর্খতা, তার কারণ দুইজন ভিন্ন বিচার রাখে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা এতটাই ভালো আছে যে সবাই দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আসছে। এবং এতটাই শান্তির ধর্ম গ্রহণ না করলে হিন্দুদের যত্ন সহকারে খৎনার সহী কাজ করছে মুমিনরা [19] তাই গল্প বাদ দিন, বাস্তবতা দেখুন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন সাধারণ ঘটনা বর্তমানে....! তার জন্য জামাত হেফাজত লাগে না। আসলে এই উপমহাদেশের মুসলিমরা আজও অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ তারপর হিন্দু আর শিখ এদের আচরণ বলে এদের অবস্থান কি? আর মজার বিষয় ভারতীয় ধর্মগুলি প্রশ্ন ও তর্ক করতে কিছুটা সমর্থন করে। সে খানে আব্রাহামিক ধর্মে সংশয়বাদেরও স্থান নেই। 


চাইলে আরও তথ্য দিতে পারতাম। কিন্ত আপনারা কোনও তথ্য চেক করবেন না এটাই বাস্তবতা..

বাঙালি মেয়ে পরাধীন মেয়ে -অঙ্গদ
Nov. 25, 2024 | নারী | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমারই ভুল আমাদের বাঙালি মেয়েদের, মেয়েদের বাইরে ভাবা। তারা কখনোই তাদের মেয়েলী পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতেই চায় না – এটা আমার বোঝা দরকার ছিল। আমি তাদের মুক্তির কথা বলি, ওরা শশক ছানার মতো ভয়ে মুখ লুকোয় গর্তের ভেতর। আসলে এরা বদ্ধতাটাকেই মুক্ত জীবনের আনন্দ;- এই মন ভোলানো বুলি আওড়ে আনন্দ পেতে চায়। এরা নিজেদের সুখ – দুঃখ অন্যের কাছে গচ্ছিত রেখে দিয়েছে। এদের সকল চিন্তা-ভাবনা অন্যের নাগপাশে আবদ্ধ। এরা হয় যেমন আছে যেমন থাকে ওটাকেই ভবিতব্য মনে করে কিংবা ওটাই ওদের পরিচয় বলে মনে প্রাণে মানে।


আমার বাঙালি মা’য়েরা আমার বাঙালি বোনের স্বাধীনতাকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। আসলে ওরা পায়নি যা তা এদের দেওয়াটাকেই বোধহয় বিড়ম্বনা মনে করে, না হয় মেয়ে হয়ে অপর মেয়ের প্রতি ঈর্ষা এই আদিম সত্যটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লাগে। তাই তো তারা তাদের মা-র কাছে প্রাপ্ত সংস্কারটাকে কোনোরূপ বিচার বিশ্লেষণ না করেই অন্ধভাবে তাদের মেয়েদের এবং সেই মেয়েরা তাদের কন্যাসন্তানদের মধ্যে চালিয়ে যেতে চায়। আসলে এরা এদের মনের মধ্যে গ্রথিত কোনো সংস্কারকে বিচার করাটাকেই পাপ মনে করে; মনে করে গুরুর ক্রোধ দৃষ্টির অধিকারী হবে।


গুরু, সেই গুরু যে আমাদের বাঙালি অন্ধ জড় সমাজের প্রতিমূর্তি; ইনিও জড়;- কিংবা জড়ের ভূমিকা পালনেই আনন্দিত হন; আসলে মনে হয় ইনি নিজেকে পথের মধ্যে হোঁচট খাওয়া অল্প গ্রথিত পাথরকে কথিত গভীর পাতালভেদী ভগবান শিবের মতো ভেবে থাকেন এবং নিজের শতজীবাণুদ্বারা আক্রান্ত পদরজকে অমৃত জল বলে বাঙালি বঙ্গ নারীকে খাওয়াতেও কুন্ঠাবোধ করেননা; বোধহয় মনে মনে আপ্লূত হন মহান কোনো পুণ্য কর্ম করলেন – এই ভেবে। ধিক! –


কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা মেয়ে কেন মানুষ শব্দটিরই অপমান করা। আর একারণেই তারা আবদ্ধ অন্ধ নামক শব্দটি দিয়ে। এর দূরীকরণ তখনই সম্ভব যখন এরা প্রকৃত আলোকে সত্য মনে করে মনের অন্ধ কুটিরের মধ্যে সঞ্চার করতে চাইবে।


প্রকৃত আলো, জ্ঞান (যথার্থ জ্ঞান) শব্দটিরই সমার্থক মাত্র। আর এই আলো দান করার জন্যই মশাল হাতে আমি ওদের মনের আঁধারে প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি; তারাও আমার অগ্রগতিকে তাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক বলে শান্ত হয়ে বসেছে। এমন সময় আমার বঙ্গ মা’য়েরা হয়তো আমি তাদের মুখাগ্নি করতে চলেছি এইভেবে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আরও পূর্বের চেয়ে আরও জোরে তারা তাদের কন্যা শাবকদের সংস্কার নামক জংধরা মোটা শিকল দিয়ে বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।


আমার বঙ্গ মায়েদের কাছে এটাই অবেদন একবার ওদের ওই যথার্থ জ্ঞানের অমৃত পান করতে দেওয়া হোক। আমার বিশ্বাস ওরা যদি সত্যই তাদের কন্যার মঙ্গল কামনা করেন তাহলে তারা অবশ্যই পরে দেখতে পাবেন, তাদের জীবনে তারা যা পায়নি ইচ্ছা থাকা সত্বেও; তা এরা পেয়ে কতটা মঙ্গলকর জীবনযাপন করছে। খাঁচার বদ্ধ পাখি খাঁচার বাইরের জীবনে অসুরক্ষিত হতে পারে কিন্তু পাখির অন্তরের জীবন আমার বিশ্বাস খোলা আকাশ, ঘন গাছ পালার মধ্যেই প্রান বিসর্জন দিতে সদা প্রস্তুত থাকে এবং ওটাই তাদের আসল মুক্তি।


তাই ‘ওরা যে মেয়ে’ এই মিথ্যাছলের কথাকে ওদের কাছে সত্য জ্ঞানের ভুল মন্ত্র শিখিয়ে চিরকালের মতো পূজার্চনার মধ্যে বেঁধে পুরুষদের পশ্চাদগমনকারী সীতা করে না রাখায় ভালো। বরং ‘ওরাও মানুষ’ এই সত্য জ্ঞানের মন্ত্র দান করা হোক ওদের, তবেই মানুষ ও জাতীর ও দেশের মঙ্গল সম্ভব।


ফুলকুসমা, বারিকুল, বাঁকুড়া 

নক্ষত্রদের ঘূর্ণন -সরোজ নাগ
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:897 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যখনই আপনি গভীর মহাবিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে তাকান, তখনই আপনি দেখতে পান অজস্র আলোর বিন্দু। আপনি জানেন সেগুলো হলো নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি। সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে বৃহদাকার নক্ষত্রগুলির আয়ুষ্কাল সবচেয়ে কম। কারণ তারা তাদের চেয়ে কম ভরের নক্ষত্রদের তুলনায় অনেক দ্রুত তাদের জ্বালানিকে পুড়িয়ে দেয়। একবার তারা জ্বালানির সীমায় পৌঁছে গেলে এবং উপাদানগুলিকে আর ফিউজ করতে না পারলে, তারা তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং তারা হয়ে যায় নক্ষত্রের মৃতদেহ।


এই মৃতদেহগুলি একাধিক প্রকারের দেখা যায়। সর্বনিম্ন ভরের (যেমন, সূর্যের মতো) নক্ষত্রের জন্য শ্বেত বামন, পরবর্তী স্তরের জন্য নিউট্রন নক্ষত্র এবং সর্বাপেক্ষা বিশাল নক্ষত্রের জন্য ব্ল্যাক হোল। প্রতিটি মৃতদেহ নিজের অক্ষের চারপাশে তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলগুলি ঘোরে প্রায় আলোর গতিতে।

আমাদের সূর্য তার নিজের অক্ষের চারপাশে একবার আবর্তন করতে গড়ে প্রায় 27 দিন সময় নেয় (সূর্যের নিরক্ষরেখার কাছে প্রায় 25 দিন এবং মেরুবলয়ের কাছে এই সময়সীমা প্রায় 35 দিন)। অন্য দিকে একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র একটি সম্পূর্ণ 360° ঘূর্ণন এক ঘন্টার কম সময়ে সম্পন্ন করে। এটি উদ্ভট মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি যদি কখনও ফিগার স্কেটিং দেখে থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এটা দেখেছেন যে একজন ঘূর্ণায়মান স্কেটার যখন তাঁর ছড়ানো হাত দুটি গুটিয়ে নেন তখন তাঁর ঘূর্ণন গতি বেড়ে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি হলো কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের নিয়ম (law of conservation of angular momentum)।


কৌণিক ভরবেগ হল "একটি ভরের সাথে কতটা 'রোটেশনাল' এবং/অথবা 'অরবিটাল' গতি আছে?" আপনি যদি সেই বৃহদাকার বস্তুটিকে ফুলিয়ে দেন যাতে এর ভরের বিস্তার তার ঘূর্ণন কেন্দ্র থেকে দূরে থাকে, তাহলে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য এটিকে তার ঘূর্ণন গতিতে ধীরগতি করতে হবে। একইভাবে, যদি আপনি একটি বৃহদায়তন বস্তুকে সংকুচিত করেন, যাতে এর ভরের বেশির ভাগ তার অক্ষীয় ঘূর্ণনের কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে, তবে সেই বস্তুটিকে তার ঘূর্ণন গতি বাড়াতে হবে, প্রতি সেকেন্ডে আরও বেশি ঘূর্ণন ঘটাতে হবে। এইভাবে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত হয়।


যদি আপনি আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রকে তার ভর, আয়তন এবং ঘূর্ণন গতি সহ বিচার করেন এবং এটিকে পৃথিবীর আকারের আয়তনে সংকুচিত করেন, যা একটি শ্বেত বামনের একটি সাধারণ আকার, তাহলে কী ঘটবে? বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনি যদি অনুমান করেন যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত আছে এবং সূর্য ও সূর্যের সংকুচিত সংস্করণ দুটিই আমরা গোলক হিসেবে ভেবে নিই তাহলে সত্যিই হিসাব করে বলা যায় কী ঘটবে। যদি আমরা ধরে নিই যে সূর্যের সম্পূর্ণটি প্রতি 35 দিনে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে এবং সূর্যের কেবলমাত্র ভিতরের কোরের 40% একটি শ্বেত বামন হয়ে যায়, তখন সেই সংকুচিত শ্বেত বামন হওয়া সূর্য মাত্র 25 মিনিটের মধ্যে একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করবে।


সেই নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশের ভরকে ঘূর্ণনের অক্ষের (axis of rotation) কাছাকাছি নিয়ে এলে তার ঘূর্ণন গতি অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। সাধারণভাবে দেখা যায় যদি আপনি একটি বস্তুর ঘূর্ণনের সাথে সাথে তার ব্যাসার্ধের পরিমাণ অর্ধেক করেন, তার ঘূর্ণন গতি চারটি ঘাত বা ফ্যাক্টর দ্বারা বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণন গতি একটি ঘূর্ণমান ভরের ব্যাসার্ধের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক (inversely proportional)। বাস্তবে, শ্বেত বামনগুলি সাধারণত একটু বেশি ধীরে ঘোরে, কারণ নক্ষত্রের বাইরের স্তরগুলি উড়ে যায় এবং শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ "কোর" উপাদানগুলি একটি সাদা বামন গঠিত হওয়ার জন্য সংকুচিত হয়।


একটি নিউট্রন তারকা সাধারণত অনেক বেশি বড়ো নক্ষত্রের সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার পর পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ। এর কেন্দ্রের কণাগুলো অত্যাধিক চাপের ফলে এত সংকুচিত হয় যে এটি প্রায় একচেটিয়াভাবে (90% বা তার বেশি) নিউট্রন দিয়ে গঠিত একটি দৈত্যাকার পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো আচরণ করে। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি সাধারণত গড়ে আমাদের সূর্যের ভরের দেড় গুণ থেকে দ্বিগুণের মধ্যে। তবে সেই পরিমাণ ভর মাত্র 10 থেকে 40 কিমি ব্যাসার্ধ্য বিশিষ্ট গোলকের মধ্যে আবদ্ধ। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি যেকোনো সাধারণ তারকা বা শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ঘোরে।


আপনি যদি পুরো সূর্যকে একটি ছোট আয়তনে সংকুচিত করার পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করেন, কিন্তু এইবার মাত্র 40 কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট সংকুচিত আয়তনে নিয়ে আসেন তাহলে আপনি শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত হারে ঘূর্ণন পাবেন। সেই পরিমাপটি হলো প্রায় 10 মিলিসেকেন্ড! কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ সম্পর্কে আমরা পূর্বে ফিগার স্কেটারের যে নীতিটি প্রয়োগ করেছিলাম, সেই একই নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্তে আসা যায় যে নিউট্রন নক্ষত্র এক সেকেন্ডে 100 টিরও বেশি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে পারে।


প্রকৃতপক্ষে, এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। কিছু নিউট্রন তারকা পৃথিবীর দৃষ্টিরেখা বরাবর রেডিও পালস নির্গত করে, সেগুলোকে পালসার বলা হয়। আমরা এই বস্তুর পালস পিরিয়ড পরিমাপ করতে পারি। দেখা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি তারকা একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করতে প্রায় এক সেকেন্ড সময় নেয়, তাদের মধ্যে কিছু 1.3 মিলিসেকেন্ডের মতো কম, সর্বাধিক 716 ঘূর্ণন-প্রতি-সেকেন্ড (rotations-per-second) পর্যন্ত ঘোরে। সর্বাধিক হারে ঘূর্ণিত পালসারের নাম হলো PSR J1748−2446ad, এটি 2004 সালে আবিষ্কৃত হয়েছিলো।


সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারাগুলিকে মিলিসেকেন্ড পালসার বলা হয় এবং তারা সত্যিই অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত গতিতে ঘোরে। তাদের বাইরের পৃষ্ঠে এই ঘূর্ণন হারগুলি প্রকৃতপক্ষে রিলেটিভিস্টিক (relativistic)। যার অর্থ তারা আলোর গতির একটি উল্লেখযোগ্য ভগ্নাংশ নিয়ে গতিশীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই গতি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির 50% এর বেশি গতিতে পৌঁছাতে পারে!


কিন্তু এটি মহাবিশ্বে পাওয়া সত্যিকারের অ্যাস্ট্রোফিজিকাল সীমার কাছেও যায় না। নিউট্রন তারা মহাবিশ্বের ঘনতম বস্তু নয়, সেই সম্মানটি ব্ল্যাক হোলের প্রাপ্য। সেটি নক্ষত্রের সমস্ত ভরকে মহাকাশের এমন একটি অঞ্চলে সংকুচিত করে (সিঙ্গুলারিটি!) যার ফলে আলোর গতিতে চলমান একটি বস্তুও সেখান থেকে পালাতে পারে না। 


আপনি যদি সূর্যকে প্রায় মাত্র 3 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি আয়তনে সংকুচিত করেন, তাহলে এটি একটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। এই মাপকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius) বলে যা নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে। স্থান-কালের ফ্যাব্রিককে এই ব্ল্যাক হোল এতো বিকৃত করে যে ব্ল্যাক হোলের শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের বাইরেও অতিরিক্ত frame-dragging এর প্রভাব অনুভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে যত বেশি আপনি সেই ভরকে সংকুচিত করবেন, স্থানের (এবং সময়েরও) ফ্যাব্রিকটি তত দ্রুত টেনে আনা হবে।


বাস্তবিকভাবে আমরা একটি ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে স্থানের ফ্রেম-টেনে নেওয়ার পরিমাপ করতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই স্থানের মধ্যে উপস্থিত থাকা বস্তুর উপর ফ্রেম-ড্র্যাগিং প্রভাব পরিমাপ করতে পারি। এর অর্থ হল পদার্থ সমৃদ্ধ পরিবেশে বিদ্যমান এই ব্ল্যাক হোলের চারপাশে পাওয়া অ্যাক্রিশন ডিস্ক (accretion disk) এবং তার প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা।


তাই এগুলো এই ফ্রেম ড্র্যাগিং প্রভাবগুলি পরীক্ষা করার জন্য সেরা পরীক্ষাগার তৈরি করবে। সত্যিই এমন একটা পরীক্ষাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তা হলো গ্যালাক্সি NGC-1365 -এর কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল (যা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দ্বারা চিত্রিত প্রথম ছায়াপথগুলির মধ্যে একটি)। এটির বাইরের অঞ্চল থেকে নির্গত বিকিরণ সনাক্ত করা হয়েছে। তাকে পরিমাপ করে তার গতিও নির্ণয় করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন উপাদানগুলি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির প্রায় 84% গতিতে ঘোরে এবং তাঁরা মনে করেন অবশ্যই এর মধ্যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের প্রভাব বর্তমান।


পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা LIGO (Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) এবং Virgo-এর মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মহাবিশ্বে একত্রিত হওয়া ব্ল্যাক হোলগুলির ঘূর্ণনের অনুমান করেছেন। তাঁরা নির্ণয় করেছেন কিছু ব্ল্যাক হোল প্রায় 95% আলোর গতিতে ঘোরে। এটি তাত্ত্বিক ভাবে সর্বাধিক পরিমাপ। যে নক্ষত্রগুলি থেকে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় সেগুলি অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘোরে। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্ল্যাক হোলগুলিকে প্রায় আলোর গতিতে ঘুরতে হবে।


আপনি যদি মহাকাশে বস্তুকে সংকুচিত করে খুব ছোট করেন, তাহলে সেই বস্তুগুলোর অন্য কোনো বিকল্প নেই। যদি কৌণিক ভরবেগকে সংরক্ষণ করতে হয়, তবে তাদের ঘূর্ণন গতি বাড়াতেই হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রায় আলোর গতিতে পৌঁছায়। সেই মুহুর্তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হস্তক্ষেপ করবে এবং সেই শক্তির কিছু (এবং কৌণিক ভরবেগ) বিকিরিত হয়ে যাবে তার ফলে এটিকে তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ মানের নীচে ফিরিয়ে আনবে। এই মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোলের অসাধারন গতিতে ঘোরার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো কোনো দিন আমরা সরাসরি তাদের ঘূর্ণন পরিমাপ করতে সক্ষম হব।

চিত্র পরিচিতি (প্রথম ছবিটি) – The barred spiral galaxy NGC 1365. সৌজন্যে NASA/JPL Caltech/Judy Schmidt.

তথ্যসূত্র –

 (১) Evidence from K2 for Rapid Rotation in the Descendant of an Intermediate-mass Star. J. J. Hermes et al 2017. The Astrophysical Journal Letters, Vol 841, No 1

(২) Hessels, J. W. T.; Ransom, S. M.; Stairs, I. H.; Freire, P. C.; Kaspi, V. M.; Camilo, F. (2006). "A Radio Pulsar Spinning at 716 Hz". Science. 311 (5769)

(৩) LIGO Caltech, MIT.

(৪) NASA ও Wikipedia.

অপবিজ্ঞানের চাষাবাদ (চড়ক পূজা) -নির্মল
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:7880 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সাধারণত হার্ডকোর শহরাঞ্চলে চড়ক বা নীল পূজার (স্থান ভেদে গম্ভীরা শিবের গাজন বিভিন্ন নামে পরিচিত) তেমন প্রচলন না থাকলেও আজও বাংলার শহর অঞ্চলের আশেপাশে বা প্রায় প্রত্যেক গ্রামে রমরমিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। জনশ্রুতি আছে ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা দেবতা শিবকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই পূজার প্রথম শুরু করে। 


আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে থাকি তারা ছোটবেলা থেকে এই উৎসব দেখে আসছি। উৎসবের অংশ হিসাবে প্রায় এক মাস ধরে লাল কাপড় পরিধান করে সন্ন্যাস নিয়ে বিভিন্ন নিয়মকানুন মানতে হয়। চৈত্রের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয় নীল পূজা। পূজার অংশ হিসেবে চৈত্রের শেষ দিন সন্ন্যাসীদের জ্বলন্ত কয়লার উপর হাটা, মানুষের খুলি নিয়ে নাচ, খেজুর কাটার উপর লাফানো, ধারালো অস্ত্রের উপর দাঁড়ানো এমন বিভিন্ন বিপদজনক  কসরত দেখাতে হয়। তবে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম কসরত লোহার বরশি পিঠে  ঢুকিয়ে চড়ক গাছে বেঁধে পাই পাই করে ঘোরানো, হাতে পায়ে, জিহ্বায়, গালে লোহার শলাকা ঢুকিয়ে প্রদর্শন করা।  


যেখানে ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ সরকার এই নিকৃষ্ট ধর্মীয় আচরণ আইন করে বন্ধ করার চেষ্টা চালায় সেখানে আজও ২০২২ সালে এর রমরমা চোখে পড়ার মতো। 


আজ থেকে কিছু বছর আগেও আমরা দেখেছি কিছু নির্দিষ্ট মানুষ (১৫ থেকে ২০ জন) প্রত্যেক বছর এই অনুষ্ঠান করত। কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার কয়েকবছর ধরে দেখছি এর এক একটি দলের লোক সংখ্যা প্রায় একশ থেকে দেড়শ জন হয়ে গেছে। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে এমনকি ১০ বছরের নিচের বহু শিশুদেরও সন্ন্যাস নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে মাসখানেক ধরে শিশু-কিশোরদের মনে ভুত-প্রেত ও পুনর্জন্মবাদের চাষ করা হয়। পড়াশোনা, স্কুল সব বাদ দিয়ে একদল (আগে শুধু কিশোর এখন কিশোরীদেরও দেখা যায়), শিশু সারা মাস ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে মোবাইল হাতে অপবিজ্ঞানের পাট নিচ্ছে, সঙ্গে মুক্তভাবে নেশা ভাং এর সুযোগ। 


ব্রিটিশ সরকার যে ধর্মীয় আচরণকে  নিকৃষ্ট ধর্মীয় আচরণ হিসাবে বন্ধ করতে চেয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক কারবারীদের দৌলতে তা আবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এ কোন সংস্কৃতির দিকে  সমাজ এগিয়ে চলেছে!  এইসব অপসংস্কৃতির রমরমা বুঝিয়ে দেয় যে সমাজের গতি নিম্নগামী। একদিকে আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা অন্যদিকে ভোট ব্যাংকের স্বার্থে ধর্মীয় নিয়মকানুনের জিগির টিকিয়ে রাখার দায় আর পাড়ায় পাড়ায় ভুই ফোড়ের মত নেতাদের উদ্ভব এই তিনের কম্বিনেশনে মূলত গ্রামের এক বৃহৎ অংশের তরুণ, কিশোর খুব খারাপভাবে বিপদগ্রস্ত ও বিপথগামী। যার ফল সমস্ত সমাজ জুড়েই প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারতীয় সংবিধানে যেখানে বারবার বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষের কথা বলা হয়েছে, সেখানে শিশু-কিশোর মনে এই অপবিজ্ঞানের চাষাবাদ কি সংবিধান বিরোধী নয়!  এই অপবিজ্ঞানের চাষাবাদ বন্ধ করে সুস্থ সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে।

মুসলিম নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান -জাহিদ রুদ্র
Nov. 25, 2024 | সচেতনতা | views:2573 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(১)

“আমি শাহবানু মুসলিম মেয়ে, তবু ইসলাম আমাকে দেখে না! আমার জন্য হাদিস কেউ না, শরিয়ত তুমি এত নিষ্ঠুর”

পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় পরিবারতন্ত্রে - আর নারীকে শৃঙ্খলিত রাখার মধ্যে তার বিস্তার। নারী জন্মসূত্রে অবলা, পুরুষের পর জন্মেছিল নারী। উত্তরাধিকার উৎপাদনে নারী গণ্ডিবদ্ধ গৃহজীবনে হয়ে ওঠে পরিচারিকা। সমান অধিকার যে নারীর স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য এবং কোনোভাবেই তা পুরুষের দেওয়ার জিনিস নয়, এই সারসত্যটা আমাদের সমাজ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। উপরন্তু নারীকে বোঝানো হয়েছে পুরুষের আজ্ঞাবাহী হওয়াটা তাদের অবশ্যকর্তব্য। ঘরের কাজ-বাইরের কাজ, এই শ্রেণিবিভাগটাও একান্তভাবেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল। তবে এই প্রপোগেণ্ডা এখন মিথে পরিণত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মনে করে যে, তারা নারীকে সমান অধিকার দিয়ে থাকে। এবং একই সাথে কয়েক হাজার বছর ধরে মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়েছে যে, তারা আদতে ‘ইনফিরিয়র ক্লাস’ এবং পুরুষের আজ্ঞাবাহী হওয়াটা তাদের অবশ্যকর্তব্য। ধর্ম থেকে সামাজিক জীবন, যাবতীয় শেকল মেয়েদের জন্যই সৃষ্টি। ঘরের কাজ-বাইরের কাজ, এই শ্রেণিবিভাগটাও একান্তভাবেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল।


ভারতবর্ষের সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক আন্দোলন এসে মিশেছিল নারী প্রগতি আন্দোলনের মোহনায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতবর্ষে মহিলাদের অবস্থার খুব একটা হেরফের হয় না। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা মিটিয়ে কীভাবে মেয়েদের সমান অধিকার দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা যেতে পারে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ডামাডোলে প্রতি এগারো মিনিটে একজন মহিলা খুন হচ্ছেন নিজের ইন্টিমেট পার্টনার অর্থাৎ স্বামী, বাবা, ভাই দ্বারা। হচ্ছে কন্যা ভ্রূণ হত্যাও। ভারতবর্ষে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থান দলিত আর সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা।

মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থার অবনতি হয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীতে ফিরোজ তুঘলক (১৩৫১) থেকে সিকান্দার লোদীর (১৪৮৯-১৫৭৭) সময়কালে। কারণ নারীদের ধর্মীয় পবিত্র স্থানে যাওয়ার স্বাধীনতাও ছিল না, এমনকি বোরখা ছাড়া মেয়েদের চলাফেরা সর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। একদা ‘অবাঙালি মুসলমানদের পোশাক’ বলে চিহ্নিত যে আচ্ছাদন আপামর বাঙালি মুসলিম মেয়েদের কাছে ব্রাত্য ছিল – সেই হিজাব, বোরখার ‘বাঙালি’ দোকান এখন গজিয়ে উঠেছে। কারণ হিসাবে মূলত দুটো মত উঠে আসে – প্রথমত ধর্মীয় ভক্তিরসের প্রাধান্য এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথে পশ্চিম-বিরোধী ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। মূলত পাশ্চাত্যে উদ্ভূত ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী ও নারীবাদী স্লোগান ‘মাই বডি-মাই চয়েস’ -কে বুমেরাঙের মত ব্যবহার করছে এই পর্দাসীন মেয়েরা।


নিজস্ব ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানে পিছিয়ে থাকার জন্য মুসলিম কম্যুনিটিতে মেয়েদের অবস্থার প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি এখনও। মুসলমান মেয়েদের পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজতে গেলে ভিতরে ও বাইরে - অর্থাৎ তাদের পরিবারের ভিতরে ও সমাজে – দু জায়গাতেই দৃষ্টি দিতে হবে। মুসলমানদের বেশিরভাগই গ্রামে বসবাস করায়, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতোই মুসলমান মহিলারা সকল রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। চাষবাস বা অন্যান্য শারীরিক শ্রমনির্ভর জীবিকা, সাক্ষরতার নীচু হার ও দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার কারণে মুসলমানদের মধ্যে নানা বিষয়ে অক্ষমতা দেখা দেয় ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। নিজ সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই এক শ্রেণীর মানুষ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা, অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। বাড়ির মেয়েরা পড়াশুনা বা কাজের জন্য বাইরে যাবে কেন- এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকে। এই কারণেই বহু মুসলিম কিশোরীর অসম্ভব প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় মুসলমান পরিবার গুলোতে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। ফলে শিশুরাই শিশুর মা হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক গঠন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে মা ও শিশু কারোরই পুষ্টি ঠিকঠাক হয় না এবং তারা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। জাস্টিস রাজিন্দার সাচারের নেতৃত্বাধীন কমিটি ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে কিছু নগ্ন সত্য বেরিয়ে আসে। ৬-১৪ বছর বয়সী বাচ্চাদের গ্রুপে ২৫% মুসলিম শিশু স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়। মাত্র ১৭% মাধ্যমিক পাশ করে। সরকারি স্কুল রিপোর্টকার্ড (২০১৪-১৫) অনুযায়ী, গড়পড়তা ৫০% মুসলিম মহিলা স্কুলে গিয়ে থাকে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এই রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায় -- ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভের মধ্যে প্রায় ৪০% মুসলিম মেয়ে স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়। এবং এই ড্রপ আউট সবচেয়ে বেশি হয় মাধ্যমিকের পর। অর্থাৎ, মাধ্যমিক পাশ করার পর অধিকাংশ মুসলিম মেয়ে আর পড়ার সুযোগ পায় না।


২০১১-‌এর সেন্সাস অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১৪.২৩% মানুষ ইসলাম ধর্মের। এর আগে সাচার কমিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মুসলিমদের ৩১% পভার্টি লাইনের নিচে বাস করে। মোট মুসলিম কম্যুনিটির ৪৮% হল মহিলা আর সেন্সাস ২০১১-‌তে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের ৪৮.১১% নিরক্ষর। অর্থাৎ প্রায় চার কোটির বেশি ভারতীয় মুসলিম মহিলা নিজের নামটাও লিখতে পারেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবস্থান মোটেই উল্লেখ্য নয়।


২০০৪-০৫ সালে সাচার কমিটি রিপোর্ট মতে, মোট জনসংখ্যার ৪.৪% মুসলিম যুবক গ্রাজুয়েশন পড়তে যায়। ২০০৯-১০ সালের স্যাম্পল সার্ভেতে সংখ্যাটা একটু বেড়ে হয় ১১%। ২০১৩-১৪-‌তে উচ্চশিক্ষায় মুসলিম যুবক-যুবতীদের অংশগ্রহণ বেড়ে হয় ১৮% এবং ২০১৮-‌তে তা ৩৭%-‌এ দাঁড়িয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক একজন অশিক্ষিত এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন না। ইউনেস্কো EMPOWERMENT-‌এর সংজ্ঞা দিচ্ছে, “… the expansion of assets and capabilities of poor people to participate in, negotiate with, influence, control, and hold accountable institutions that affect their lives.”। অর্থাৎ, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একজন মানুষের ক্ষমতাহীন থেকে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার পদ্ধতিটাকেই আমরা এমপাওয়ারমেন্ট বলছি। মহিলাদের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য হল এমন একটি আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা যেখানে মহিলারা সবরকম অত্যাচার আর বঞ্চনার হাত থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মত বাঁচতে পারবেন।


আমাদের দেশে যেখানে মেয়েদের পায়ে শেকল বেঁধে রাখাটাই দস্তুর সেখানে উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের মত স্বাধীন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করাটা অবশ্যই খুব শক্ত কাজ।আর্টিকেল ১৫-‌তে বলা হয়েছে যে, সরকার লিঙ্গের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করতে পারবে না। আর্টিকেল ১৫ (A) আর (E)-‌তে মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণকে শাস্তির আওতায় ফেলা হয়েছে। ২০০১ সালে National Policy for The Empowerment of Women বিলটি পাশ করানো হয়।

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের ২০০০ সালের রিপোর্টে শহর এলাকায় ৬.০৩% আর গ্রামে মাত্র ১.২২% গ্রাজুয়েট মুসলিম মহিলা পাওয়া গিয়েছিল। তবে গত দেড় দশকে এই অবস্থার খানিক হলেও পরিবর্তন ঘটেছে। All India Survey on Higher Education (২০১৭-১৮)-‌এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর উচ্চশিক্ষায় মুসলিম মহিলাদের এনরোলমেন্ট বেড়েছে ৪৬%, যা অত্যন্ত ইতিবাচক।


(২)

সার্বিকভাবে মুসলিম নারীর লেখাপড়ার সুযোগ বেড়ে গেলেও শরিয়ত, পর্দা ও ধর্মীয় কুসংস্কারে মুসলিম নারী এখনও পুরুষতন্ত্রের গেঁড়াকলে। সেই জায়গা থেকে বেগম রোকেয়ার কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল সত্য। পিছিয়ে থাকা নারী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি তার বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তমসাবৃত অবস্থা থেকে আলোর অভিমুখী করেছিলেন নারীকে। তাই প্রগতি চেতনার দিশারী, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া প্রথমেই বিদ্রোহ করেন পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর তাঁর লেখনী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ‘ধারাবাহিক ধর্মযুদ্ধ’। মুসলিম সমাজে নারী জাগরণে, সমস্ত প্রগতিশীল ভাবনার এক সংহত রূপ সংগ্রামী নারী বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্মধারায় প্রকাশ পেয়েছে।


'ইসলামে নারী হল মূর্তিমতী কাম। যে নারী একদিন তাকে করেছিল স্বর্গভ্রষ্ট, লিপ্ত করেছিল পাপ কাজে, তাই তাকে অর্থ্যাৎ নারীকে ইসলাম ক্ষমা করেনি কোনদিন। কোরানের চতুর্থ সুরা- ‘সুরা নিসা’। ‘নিসা’ শব্দের অর্থ নারী। সুরার নামকরণ থেকে বোঝা যায় এখানে নারীর বিধি-বিধান-নির্দেশ উপদেশ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে নারীর সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যদিও তা যৎসামান্য। এই সুরা যদিও নারীর জন্য রচিত তবুও কিন্তু এখানেও কোরানের স্রষ্টা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে--- “পুরুষ নারীর রক্ষা কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে।”(সুরা নিসা, ৪/৩৪)

আবার বলা হয়েছে - “নারীদের পরিচালক হচ্ছে পুরুষরাই। কারণ, আল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যের উপরে মর্যাদা দান করেছেন। (সুরা নিসা, ৬/৩৪) 

ইসলাম ধর্ম পুরুষকে করেছে বহুভোগ্যা। সুরা নিসার প্রথমে আল্লাহ বলে দিলেন -- “তবে বিয়ে করবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার জনকে। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে বা তোমাদের অধিকার ভুক্ত দাসীকে। এভাবেই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভবনা বেশি।” (সুরা নিসা, ৪/৩) এমনকি নারী অবাধ্য হলে তাকে প্রহার করার কথাও কোরানে বলা হয়েছে -- “স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেওনা ও তাদেরকে প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ খুঁজবে না।” (সুরা নিসা ৪/৩)


যদিও আবার অনেকে মনে করেন - “ইসলামই প্রথম ঘোষণা করল, পুরুষের ন্যায় নারী জাতিরও আছে স্বাধীনতার অধিকার, মুক্তির অধিকার। শিশু কন্যার আছে বাঁচার অধিকার। বিধবার আছে বিবাহ করার পূর্ণ অধিকার। কুমারীর আছে স্বামী পছন্দের সম অধিকার। পুরুষের ন্যায় মহিলারও আছে বিবাহবিচ্ছেদে সমান দাবী৷ আইনের সম অধিকার। পাপ ও পুণ্যের সম অধিকার। আরধনা ইবাদতে সম অধিকার। শিক্ষাতে সম অধিকার। নারী মনুষ্য সমাজের অর্ধেক, তার দাবিও অর্ধেক। এই পৃথিবীতে পুরুষের প্রয়োজন যতটা, নারীর দরকারও ততটাই। একটি পরিবারের এক পা, এক হাত, এক চোখ, এক কান যুবকের, দ্বিতীয় গুলোর মালিক যুবতী৷ ইসলাম ঘোষণা করল, এই পৃথিবীতের সমস্ত কিছুতেই নারীর প্রকৃতিগত, প্রবৃত্তিগত, স্বভাবগত, এবং যা কিছুই তার সহজাত, সর্বস্থানেই পুরুষের সঙ্গে তার সম অধিকার আছে। সমগ্র মানবমন্ডলীর অর্ধাংশকে প্রথম মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিল কে, ইসলাম।পুরুষের পুংলিঙ্গের নিকট নারীর স্ত্রী লিঙ্গ তো কোনদিনই লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কেবল প্রয়োজন-অপ্রয়োজন যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইসলামই তাকে সম-স্থান, সমসম্মান দিল।"


আরব্য রজনীর অংসখ্য উপাখ্যানে দেখা যায় পুরুষ এক নারী থেকে অন্য নারীতে ছুটেছে, এক নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি- যাকে ইসলাম আদর্শরূপে গ্রহণ করেছে। তাই ইসলামের কাছে বিয়ে একটা অসম চুক্তি, একটা প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর জন্য একজন মুসলমান পুরুষ চারজন বৈধ স্ত্রী রাখার পরও যৌন সম্ভোগের জন্য যত খুশী দাসীকে সম্ভোগ করতে পারে, তাতে ইসলামী আইনে বা নৈতিকতায় কোন বাধা নেই। দাসী সম্ভোগ ইসলামে বৈধ। বিয়ে সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন -- ‘‘ইসলামি আইনে বিয়ের চুক্তি মালিক-শ্রমিকের চুক্তির থেকেও ভয়াবহ ও শোষণমূলক, কেননা ওখানে চুক্তি করে’ই একজনকে দেয়া হয় অশেষ অধিকার এবং আরেকজনের প্রায় সমস্ত অধিকার বাতিল হয় কিছু সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে। ইসলামি আইনে স্ত্রী হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ দাসী, যে স্বামীকে দেবে যৌনতৃপ্তি ও বৈধ সন্তান। কিন্তু স্বামী যখন ইচ্ছে মনের খেয়ালে শুধু তিনবার ‘তালাক’ বলে ছেড়ে দিতে পারবে তাকে। চুক্তির কথা বলা হলেও ইসলামি বিয়েতে পুরুষ ও নারীটি চুক্তিতে আসে না, চুক্তিতে আসে পুরুষ ও নারীর অভিভাবক।”


আবার তিনি বলেছেন - ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই তা চিরস্থায়ী নয়, যে-কোনো সময় স্বামী তা বাতিল করতে পারে। তালাক মুসলমান নারীর জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দ, ওই বজ্ৰ যে- কোনো সময় নীলাকাশ থেকে তার মাথায় এসে ফাটতে পারে। মুসলমান পুরুষ চারটি বৈধ বিয়ে করতে পারে, পঞ্চম একটিও করতে পারে। পঞ্চম বিয়ে করলে বিয়েটি বাতিল হয় না, শুধু দরকার পড়ে আগের একটি স্ত্রীকে এক-দুই-তিন করে তালাক দেয়া। মুসলমান পুরুষের জন্যে তার চারটি স্ত্রী সম্ভোগই শুধু বৈধ নয়, সে তার ক্রীতদাসীদের সাথেও সঙ্গম করতে অধিকারী।’

(৩)

'নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ কেউ নারী হয়ে ওঠে'। অর্থাৎ জৈবিকভাবে একটা শিশু স্ত্রী অঙ্গ নিয়ে জন্মায় এটুকুই প্রাকৃতিক সত্য। একটা শিশু কি জানে জন্মলগ্ন থেকে সে নারী না পুরুষ। পদে পদে তাকে হিজাব পরিয়ে, পুতুল খেলিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে দিয়ে, মেকআপ দিয়ে, খোলা আকাশ থেকে সরিয়ে ঘরে বন্ধ করে, সামাজিকভাবে তাকে মেয়েলি করে তোলা হয়। “ধর্ম মেয়েদের চিরকালের শত্রু। ধর্ম মেয়েদের শেকল পরায়। আমি কথামানবী স্বহস্তে ঈশ্বরের পূজা করতে গেলাম, ধর্ম বলল, পূজা পুরুষের অধিকার, ব্রাহ্মণ পুরুষের। আমি প্রতিবাদ করলাম, ধর্মের কবি তুলসীদাস বললেন, ‘ঢোল গাঁওয়ার শূদ্র পশু নারী ইয়ে সব হ্যায় তাড়নকে অধিকারী’ পুরুষ তালাক দিলে আমি খোরপোশ চাইলাম, ধর্ম বলল আল্লা নারীর খোরপোশের বিধান দেয়নি, আপনারা বলুন, কথামানবী কী করবে? কী করবে শাহবানু?” মিরান্ডা ডেভিজ তাঁর 'Thirdworld Women : Second Sex' বইয়ে যথার্থই লিখেছেন, “As they begin to recognise and identify the specific nature of their double oppression many women in the third world realise that when needed they may join the guerrila movement, participate in the economy, enter politics and organise trade unions, but at the end of the day they are still seen as women, second class citizens, inferior to men, bearers of children and domestic servants.”


 কাজি নজরুল লিখেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’। মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদের অনেক সমস্যার মধ্যে একটা বড় সমস্যা হল সম্পত্তির সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। শরিয়তে বলা আছে ছেলে আর মেয়ে কখনই সম্পত্তির সমান অধিকার পাবে না। ছেলেদের থেকে মেয়েরা কম পাবে। আর আজকের এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও এই নিয়ম মানা হচ্ছে। 'আমি আমার দাদা, ভাইয়ের মত পড়াশোনা শিখেছি, কষ্ট করে বাইরে গিয়ে পড়েছি, হয়তো চাকরির তাগিদে আর পাঁচটা ছেলের মতোই বাইরে গিয়ে কষ্ট করে টিকে থাকার জন্য লড়াই করবো। অন্য ছেলেদের মতো সংসারের হাল ধরবো, আমার মা বাবাও হয়তো গর্ব করে অথবা চোখের জল (খুশির) ফেলে বলবে আমার মেয়ে, ছেলের থেকে একটুও কম না। পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলবে ছেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে ওই মেয়ে। ও কম কি! কিন্তু সম্পত্তি ভাগের সময় তখন যে প্রমাণ করে ছাড়ে, হ্যাঁ মেয়ে তুমি কম। কম বলেই আমার সমান অধিকার নেই আমার নিজের বাড়িতে, নিজের সম্পত্তিতে। আমার মা বাবা যতই বলুন আমরা ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ করি না কিন্তু ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করতে গিয়ে সেই শরিয়তের প্রসঙ্গ তুলবে' (শাম্মী বিশ্বাস)। আজ মানুষের মানবিকতা কোথায় হারিয়েছে! হাদিসের অজুহাত দেখিয়ে যে নিয়ম চালু রেখেছে,শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের প্রতি বঞ্চনা কি চলতে দেওয়া যায়?

নজরুল দুঃখ করে বলেছিলেন:‌

‘‌বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে

আমরা তখন বসে,

বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি

ফেকাহ হাদিস চষে।’‌


ইসলামের সর্বশক্তিমান আল্লাহ পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামের জন্মলগ্নে নারীর যে স্বাধীনতা ছিল- তা কিন্তু পরবর্তীকালে আর থাকেনি। ইসলামের বিজয়রথ যতই এগিয়েছে পুরুষরা নারীর অধিকারকে করেছে পদানত, করেছে বন্দী আর পরিণত করেছে হারেমে। এর ফলে নারী হয়ে উঠেছে পুরুষের কামনার বস্তু। হয়ে উঠেছে ফিতনা- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার সময়ে নারীকে তারা বহন করেছে সাথে, কিন্তু তা একান্তভাবে উপভোগের জন্য। পুত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য আর দৈহিক তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। মুসলিম পুরুষের উত্তরাধিকার আরব পুরুষ যারা সম্ভোগ পরায়ন।


স্বয়ং এঙ্গেলস মার্কসবাদের সূত্র ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন --- "That woman was the slave of man at the commencement of society is one of the most absurd notions that have come down to us from the period of Enlightenment of the 18th Century."যে কোন দেশের, যে কোন ধর্মের নারীর সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে প্রায় সমস্ত চিত্রটাই এক। হয়তো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম নজরে আসে। 

কিন্তু নারীর নারী হওয়া, তাকে মানুষ না ভাবা কিংবা নারীর অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ বা অবস্থান, পুরুষের সঙ্গে সম-অধিকারের প্রশ্ন উঠলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদেরকে সমাজের নীচুতলার বাসিন্দা করে রাখা হয়েছে। যে সমাজের কথাই বলি না কেন প্রত্যেক সমাজেই নারীকে হীন চোখে দেখা হয়েছে। নারীকে নারী করেই রাখা হয়েছে, মানুষ হতে দেয়নি। মানুষ তৈরীর আঁতুড় ঘরে যে শিক্ষা, অর্থনীতি- সব কিছু থেকে তাদেরকে করেছে বঞ্চিত। তাই বলতে দ্বিধা নেই এই যে নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক তা গড়ে উঠেছে 

স্বাভাবিক প্রেমের তাগিদে নয়, সংসারের তথা সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে।

তথ্যসূত্রঃ

১) https://www.census2011.co.in/religion.php

২) https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sachar_Committee

৩) https://sksew.com/welcome/singlepost/muslim-women-education-patriarchy-india

৪) তদেব, মেধাজন্ম, কথামানবী, তদেব, পৃষ্ঠা-১০২

৫) তদেব, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫

৬) ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান, পৃঃ ৩৩-৩৮

৭) হুমায়ূন আজাদ, নারী, আগামী প্রকাশনী

৮) ফরহাদ মজহার, বোরখা, এবাদতনামা

৯) Miranda Davies, Third World, Second Sex Woman's Struggles and National Liberation 

১০) Friedrich Engels Origin of the Family, Private Property, and the State, March-May, 1884

ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রভিত্তিক চৌর্যবৃত্তি কবে বন্ধ হবে? -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:901 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো থেকে পন্ডিচেরির ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে লেখা দিয়েই শুরু করি -

আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থচিন্তার কী অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন --- একাধারে যেমন বেদ উপনিষদ, গীতা  যা মান্যতা  দেয়   শূদ্র ও নারীদের দাবিয়ে রাখার জটিল তত্ত্ব  আর অন্যধারে  অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর শূদ্র শ্রেণীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার   প্রত্যক্ষ ধর্মের গ্রন্থ মনুসংহিতা। এই দাবিয়ে রাখতে গিয়েই বিভিন্ন জটিল ধর্মীয় আচার  ও  সংস্কৃতির মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের  আয়ের ব্যবস্থা বা এক কথায় বলা যায় শাস্ত্রানুসারী চৌর্য্যবৃত্তি। ব্যক্তি নির্বিশেষে  জন্মের আগেই সাধ থেকে শুরু করে ছয় ষষ্টী, অন্নপ্রাশন,  বিয়ে, বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ট্যাক্সো আদায়, এমন কি, বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নেড়া মাথার ওপর বংশানুক্রমে বাৎসরিকের মাধ্যমেই জিজিয়া এবং এছাড়াও  বারো মাসে তেরো পার্বন  গৃহ প্রবেশ দোকান শুরুর পুজোতো আছেই।  দুর্গ্রহক্রমে এই ভূগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত আমাদের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের  মূলধন বিহীন চিরকেলে ব্যবসা,  একদম বিনা পুঁজির ফলাও কারবার।  অর্থনীতিতে  সেই সময়ে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের অনেকেই এই পুরস্কার পেতেন।  ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট মিল; অ্যাডাম স্মিথ  বা লর্ড কেইনসও ভাবতে পারেননি এই রকম হরেক  ট্যাক্সের কথা  


 কয়েক দিন  আগে এক ছাত্রের মায়ের শ্রাদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না এবং যাওয়া  ভীষণভাবে অপছন্দ করি। নিজের মা – বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিনি, সাদা কাপড় পরিধান করিনি, চুল কাটিনি, এক এক কথায় কিছুই করিনি, এই জন্য পাড়ায় আমার বেশ  বদনাম আছে  নাস্তিক হিসেবে। যে মানুষের মৃত্যুর আগে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারিনি তার শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসে সেটা সম্পর্কে গল্প করতে খারাপ লাগে তাই ছাত্রদের  বলে দিয়েছিলাম যেতে পারি কিন্তু কিছু মুখে দেবো না। কিছু কিছু জায়গায় যেতেই হয় তাদের মান এবং মন রক্ষার্থে। যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তারা তিন ভাইই আমার পূর্বতন ছাত্র এবং প্রায়ই  বাড়ির দোরগোড়ায় থাকে ফলে যেতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। তাদের বাবা নেই, মা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় ছিলেন। ভাইয়েরা মিলে রান্না করে মায়ের শুশ্রূষা করেছে  বছর তিনেক ধরে। কাজকর্মও সেভাবে কিছু করে না, বড়জন সম্পূর্ণ বেকার, মেজোর একটা অটো আছে লিজে দেওয়া, শুধুমাত্র ছোটটি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাঝে মধ্যে  দু একবার দেখতে যাওয়া ও মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা ও আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু সাহায্য তাদের করিনি। অথচ শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আমার বাড়ির লোক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করে না । তারা কেউ যাবে না অগত্যা আমাকেই শ্রাদ্ধের দিন ফুল মালা ধূপকাঠি  হাতে  দেখা  করতে যেতে  হল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত মহাশয় দুজন দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হয়েছে। সেদিনও দুশো লোক খেয়েছে এবং নিয়মভঙ্গের দিন প্রায় পাঁচশো লোক নিমন্ত্রিত। তাকে শ্রাদ্ধের আগে ঠারেঠুরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি শ্রাদ্ধ ব্যাপারটির কোনো যৌক্তিকতা নেই, মরার পর মানুষের স্মৃতি আর কাজ ছাড়া কিছুই থাকে না। তোরা মায়ের জন্য যা যা করেছিস এই কবছরে তার থেকে বেশী পুণ্য আর কিছু নেই, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান  ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অপরের মাথায় টাক দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। কে কবে দেখেছে মৃত ব্যক্তি খেতে আসে? আদিম অজ্ঞ মানুষের ভয় ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এগুলি ধর্ম নয় এগুলি অধর্ম,  ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হিন্দুদের কু-আচার।   পুনর্জন্ম  বা পরলোক বলে কিছু নেই,  মানুষ  প্রকৃতি পরিবেশের  সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর সব প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। পুরোহিত শ্রেণি মানুষকে ভয় দেখিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করে, যেমন -

১) জন্মের আগে সাধ ও  ছয়দিনে ছয় ষষ্ঠী

২) অন্নপ্রাশন

৩) বিবাহ

৪) মৃত্যু

৫) মরার পরও ছাড় নেই, তার পুত্র প্রপৌত্রদের থেকে বাৎসরিকের নামে  চাঁদা  আদায় করে।


কিন্তু আমার ছাত্ররা এতো কুসংস্কারগ্রস্থ পরিবারে মানুষ হয়েছে   যে তাদের  যুক্তি দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। যাইহোক  আমাকে  তারা পাড়ার  লজে নিয়ে গেল। সেখানে  গিয়ে দেখি রুই মাছ এবং বিশাল বিশাল পাবদা মাছ পটল চিংড়ির ব্যবস্থা ছাড়াও মিষ্টি আইসক্রিমের ব্যবস্থা আছে। আমাকে প্রায় জোর করেই খেতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা  হল।  আমি  পরিষ্কার  জানালাম  পেট পুরে খেয়ে এসেছি কোনোমতেই খেতে পারবো না। তখন ওরা বসতে বলল  এবং কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ  করল।   সেখানে বসে কয়েকজন প্রাক্তন  ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলাম  রামায়ণের দশরথের পুরোহিত জাবালির কথা।  সেই যুগের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে জাবালি প্রতিবাদ  করেছিল।  বুঝলাম আমাদের সমাজের  শিক্ষার  পদ্ধতির পরিবর্তন  না হলে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। এই মৃত্যুভোজ  কবে বন্ধ হবে জানিনা?

এইসব  অনুষ্ঠানগুলি কবে যে মানুষ বাদ দেবে জানি না। ঐ ছেলে তিনটির তেমন আয় নেই।  বাবার জমানো যা পুঁজি ছিল তা বোধ হয় মায়ের শ্রাদ্ধে শেষ করেছে। এরপর কি হবে? এইসব ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পেট ভরার অনুষ্ঠান মানুষকে ধনেপ্রাণে শেষ করে। বর্তমান দিনের অল্প কিছু আধুনিক সৎ ব্রাহ্মণ পদবিধারীদের এই অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে দেখেছি। নিজেরা এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে।


আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত যুক্তিবাদী মনে করি তারাতো এই অনুষ্ঠানগুলি বর্জন করতে পারি নিজেদের জীবন থেকে! সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিসর্জন দিতে পারি। জন্ম মানুষের জীবনে এক দুর্ঘটনার মতো, ৩০ - ৩৫ কোটি শুক্রানু লড়াই করে একটা বাঁচে, সেটাই মানুষ হয়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম যেমন প্রকৃতি উদ্ভুত তেমন মরার পর সে পোড়াও বা কবরে দাও সবই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। তখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা, যাকে অনেকে আত্মা বলে। আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করে শ্রদ্ধানুষ্ঠান স্মরণসভা করতে পারি! এতে মৃতের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হয় আবার ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রানুযায়ী চৌর্যবৃত্তিকে প্রতিরোধ করাও যায়।

শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতা‌‌ -রাজু দত্ত
Nov. 25, 2024 | সচেতনতা | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মূলত তিনটি সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতার বিকাশে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের গুরুত্ব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই রেনেসাঁর উদ্ভব। মানবসভ্যতাকে সুস্থ স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে, জনমানসে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার অত্যন্ত জরুরি।  শৈশবেই শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণ করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য। 


প্রথমেই বলে‌ রাখি, আমি মনোবিজ্ঞান বিষয় সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দীর্ঘদিন শিশুদের সাথে থেকে, তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে আমি যা বুঝেছি, তার ভিত্তিতে তাদের মনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণের চেষ্টা করে গেছি। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার সেই ব্যর্থতার দুটি কারণ উপলব্ধি করেছি। এক - আমার জ্ঞানের অস্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা ও দুই - বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে অভিভাবকদের তীব্র বিরোধীতা। 


শিশুরা অসম্ভব কৌতুহলী, আবেগপ্রবণ ও কল্পনাপ্রবণ হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা কম থাকায় ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুব সামান্য হওয়ায়, যে সকল ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করে, তার অধিকাংশ তাদের কাছে‌ দুর্বোধ্য থাকে। তারা বড়োদের কাছে সেই সকল বিষয় নানারকম প্রশ্ন করে থাকে। বড়োরা তাদের প্রশ্নের সাধ্যমতো উত্তর দিলেও, অধিকাংশ সময় তারা প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যান। এতে শিশুর কৌতুহলের নিরসন তো হয়ই না, উপরন্তু, তাদের জিজ্ঞাসু মন ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, ফলে একসময় তারা প্রশ্ন করতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে তার মানসিক বিকাশ প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।  


শিশুদের কৌতুহল নিরসন সবসময় সম্ভব হয়না। এর মূলত তিনটি কারণ। এক - প্রশ্নোল্লিখিত বিষয়  আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, দুই - বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক এখনো সেই প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হয়নি এবং তিন - অদ্ভুত, অবাস্তব বা হাস্যকর প্রশ্ন। 


প্রথমোক্ত সমস্যা দূর করতে আমাদের নিজেদের সচেষ্ট হতে হবে। বিভিন্ন বিষয় জ্ঞানলাভের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সহজতম পদ্ধতি হলো, বই পড়া। আমাদের প্রচুর বই পড়তে হবে ও পঠিত সকল বিষয় স্বচ্ছ ধারনা গড়ে তোলার প্রয়োজনে উক্ত বিষয়গুলি খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। বুঝতে না পারলে যিনি সেই বিষয় জানতে পারেন, তেমন কারও কাছে বিষয়টি বোঝার জন্য স্বচেষ্ট হতে হবে।  গুগল মাধ্যমেও আমরা বিকল্প উপায় বহু বিষয় জ্ঞানলাভ করতে পারি। তবে একটা কথা সর্বদা মনে রাখা দরকার, পঠিত সকল বিষয় যুক্তি দিয়ে যাচাই করা প্রয়োজন। বইতে যা লেখা আছে তা অভ্রান্ত সত্য নাও হতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যা, শিশুর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নটির সঠিক উত্তর অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক অজ্ঞাত থাকলে আপনি সেটা তাকে সরাসরি বলুন। বলুন যে এই বিষয় এখনো বৈজ্ঞানিকরা জানতে পারেননি। তবে জানার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। আপনি প্রশ্নটির সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো একটি প্রশ্ন তার মনে জাগিয়ে তুলুন, যার উত্তর বিজ্ঞান জানে।  শিশুর প্রশ্ন অদ্ভুত ও হাস্যকর হলে আপনিও আপনার রসবোধ ব্যবহার করে হাস্যকর উত্তর দিন। শিশুরা হাসতে ভালোবাসে। তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, আপনি কখনোই শিশুর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না। এতে শিশুর কৌতুহল বাধাপ্রাপ্ত হয়। যা একটি শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। 


শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণের কয়েকটি উপায় আমি উল্লেখ করছি। উল্লেখিত উপায়গুলি প্রয়োগ করে আমি বহুক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি। আপনিও চেষ্টা করে দেখুন। 

(১) শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কল্পনাপ্রবণ হয়। তাদের মনে কাল্পনিক প্রাণী, ডাইনি, জুজু, ভূতপ্রেত, ঈশ্বর জাতীয় অবাস্তব কল্পনার বীজ বপণ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না। বরং বিভিন্ন গাছপালা, জীবজন্তুর সাথে তাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটান। 


(২) কার্টুন যথাসম্ভব কম দেখান তাদের। বরং তাদের দেখার উপযুক্ত শিক্ষামূলক সিনেমা দেখান।    শিশুসাহিত্যিকদের রচনা পড়ান। তারা পড়ে মজা পাবে, তাদের পড়ার অভ্যাসটাও গড়ে উঠবে। 


(৩) সূক্ষ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দিন। 

বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সহজবোধ্য বিশ্লেষণ করে বোঝান। বিভিন্ন ছোটখাটো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হাতে কলমে করে দেখান। 


(৪) মাঠে খেলাধুলা করতে উৎসাহিত করুন। এর ফলে অন্যান্য শিশুদের সাথে তার ভাবের আদানপ্রদান গড়ে উঠবে।‌ যা তার মানসিক বিকাশের সহায়ক হবে।‌ দাবা খেলান। দাবার চালে তার ভুলগুলি সহজবোধ্য করে বোঝান। শিশু বলে তাকে জিতিয়ে দেবেন না। 


(৫) শিশুর যুক্তি দিয়েই তার অযৌক্তিক ভাবনার অবসান ঘটান। এর ফলে সে একজন তার্কিক হয়ে উঠবে। যুক্তির পাল্টা যুক্তি দিতে শিখবে। কারণ সে সবসময় চাইবে তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে। আপনিও তা ভাঙার চেষ্টা করে যাবেন (তা যদি অযৌক্তিক হয়) এই দ্বন্দ্ব তাকে তার্কিক করে তুলবে। মনে রাখবেন যুক্তিবাদী হতে হলে তর্ক করতে শিখতে হবে। 

পরিশেষে বলি, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটানো  কোনো তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। অসীম ধৈর্য্যের সাথে আপনাকে কাজটি করতে হবে। শিশুদের মনে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটাতে অপেক্ষাকৃত অধিক ধৈর্য্য প্রয়োজন হয়। ওদের মন যে বড়োই চঞ্চল। তার নাগাল পাওয়া সহজ নাকি!

ঈশ্বরের স্বর্গবাস -মহম্মদ মহসীন
Nov. 25, 2024 | যুক্তিবাদ | views:621 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাড়ির কর্তা কী কী দায়িত্ব পালন করে? বাড়ির কর্তা কতটা ভাল খায়৷ কতটা মাখে। কতটা ভোগ করে। সাধারনত আমরা দেখি, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই তার দায়। তিনি থাকেন বটগাছের মতো। সংসারের সকলেই তার উপর নিশ্চিন্ত। তারা জানে, বাবা-মা নিজেরা না খেয়েও সকলের মুখে খাবার তুলে দেয়।

 আচ্ছা বাবা-মা কি এর বদলে থ্যাঙ্কস চায়?  'আমায় পুজো করো পুজো করো, আমায় ভয় করো' বলে? নিজে থাকে স্বর্গে, তার হুকুম যে মানে, সেই ছেলেকে সঙ্গে নেয় সেই সুখের স্বর্গে।  দস্যি ছেলেটিকে ছুঁড়ে দেয় নরকের যন্ত্রণা ভোগ করার জন্যে? আসল বাবা তো নিজের জন্য বেছে নেয় যন্ত্রণার জীবন, সন্তানকে দিতে চায় নিরাপদ, নিশ্চিন্ত স্বাচ্ছন্দময় জীবন। 

  বাবামায়ের সাথে ঈশ্বরের একটু তুলনা করে দেখুন, কার ত্যাগ বেশি।

   হিন্দি সিনেমায় দেখি, ভিলেন তার গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে বাজারে তোলা তোলে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সর্বদা। মানুষের মনে ভয় জিইয়ে রাখে।  ভগবানের কাণ্ডকারখানাও সেই সিনেমার ভিলেনের মতো। মানুষের  মনে ভয় সৃষ্টি করাই তার সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল কথা। লোকেও বলে থাকে,  ভগবানকে ভয় করো। শ্রদ্ধা করো। ভক্তি করো। অর্থাৎ তারা জানে ভগবান ভয়ানক কিছু "একটা বা না-একটা"  বিষয় বা বস্তু। তাকে ভয় করতে হয়, ভক্তি করতে হয়, ঠিক হিন্দি সিনেমার সেই ভিলেন যেমন চায়। ঈশ্বর পুজোর কাঙাল। ভক্তির কাঙাল,  শ্রদ্ধার কাঙাল। 

  মানুষের যৌক্তিক চেতনার স্তর কেমন দেখুন। 

 এদিকে যতই জুজুর ভয় দেখানো হোক, শিশুর মন থেকে জুজুর ভয় একদিন কেটে যায়, কারণ বোধ আসে, জুজু-টুজু বলে কিছু নেই। জুজু-বিশ্বাস কেটে যায়।

 ভূতের ভয়ও অনেকের কেটে যায়, দুই একজনের কাটে না। ভগবানে বিশ্বাসও কাটে না।

 স্বনামধন্য এক সাহিত্যিক অকপটে বলেন, তিনি ভূতে বিশ্বাস করেন। অনেকে শুনে হাসেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলেন। আমি বলি কি, উনি ওঁর যুক্তিতে ঠিক আছেন। ভগবান যদি থাকে, তাহলে ভূতও আছে, 

আত্মা যদি থাকে, প্রেতাত্মাও আছে। কাজেই যিনি ভগবানে বিশ্বাস করেন, তাঁর ভূতে বিশ্বাস থাকাটাও খুবই জরুরি। ভগবান আছে, কিন্তু ভূত নেই, এই দ্বিচারিতা অন্তত আমাদের সেই স্বনামধন্য সাহিত্যিকের নেই।

  আসলে দৈনন্দিন জীবনে, বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে মানুষের যৌক্তিক চেতনা বলে ভূত-টুত কিছু নেই, কিন্তু   

 ভগবান-সংস্কারের অক্টোপাশ সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ভগবানভীতি কেটে গেলেও পাছে লোকে কিছু বলের সংকীর্ণতা ছেড়ে বেরোনো যায় না। দেখবেন মানুষ মুখে বলে ভগবানকে ভয় করে, ভক্তি করে, তবু যত অন্যায় দুর্নীতি করে এই ঈশ্বরমানা লোকেই।  

 একটি রূপক। ভগবান সর্বত্র বিরাজমান। দোকানে দেখার কোনো লোক নেই, ভগবান সব দেখছে! আরও  লিখে দেওয়া হয়েছে, সঠিক মাল নিন। সঠিক দাম দিন। দোকানের প্রতিটি জিনিসের প্রতি তাঁর লক্ষ। খরিদ্দারসকল বেশ ভদ্রলোক, ধর্মপ্রাণ, অথচ দেখা গেল সব মাল শেষ, টাকার কাউণ্টারে টাকা কেউ দেয় নি।এমনটি হলে, বলাই যায়, ব্যবসা ডকে উঠতে তার দেরী নাই।

 কিন্তু যদি লেখা থাকে, আপনার গতিবিধির প্রত্যেকটি মুহুর্ত সিসিটিভিতে রেকর্ড হচ্ছে, দেখবেন মানুষ কত সৎ। ঠিক ঠিক জিনিস নিচ্ছেন, টাকাও দিচ্ছেন। বাস্তব জীবনে ভগবানভীতি না থাকলেও, সিসিটিভিভীতি আছেই। কারণ, এটি তাদের বিশ্বাসের ফলে নির্মিত সত্য নয়, বাস্তব উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা। 

ধর্মান্ধ তথা ধার্মিকে বিশ্বাস করে তার সব কিছুর নিয়ন্তা হল তার ঈশ্বর। জন্ম মৃত্যু, বিবাহ সব কিছু তার ঈশ্বর ঠিক করেই রেখেছে, তার এতটুকু নড়চড় করার ক্ষমতা কারুর নেই।  অথচ, এই ঈশ্বরের উপর নির্ভরতার নমুনাও দেখবার মতো। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা,  বিপদ তথা ফাঁড়ার কথাও না কি গণনা করে জানা যায়। তা জানা যাক, গণনার ক্ষমতায় নির্ভুল এসব জেনেটেনে এবার যেটি করে তা কিন্তু তাদের বিশ্বাসেরই পরিপন্থি। জ্যোতিষী তাদের ঈশ্বরের লিখনকে পাল্টে দিতে পারে। ছোট্ট একটা আঙটি ভগবানের লেখা ভাগ্যকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেও তারা জ্যোতিষীকে, জ্যোতিষবিদ্যাকে, রত্নপাথরকে ঈশ্বরের ক্ষমতার চেয়েও শক্তিমান বলে বিশ্বাস করে। দেখুন,  কীরকম তাদের যৌক্তিকতা। একবার বিশ্বাস করে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার ভাগ্যে বিপদ  লিখেছে, দুঃখ লিখেছে। আবার জ্যোতিষী তার থেকেও শক্তিমান।  আসলে এরা হল সুবিধাবাদী। লোভী। ভীত। স্বর্গের লোভে ঈশ্বর ঈশ্বর করে। মানুষের সাথে অন্যায় করে ক্ষমা চায় ঈশ্বরের কাছে। নরকের ভয়ে উপাসনা করে ঈশ্বরের। আবার কেউ গণনা-ফণনা করে তাকে ফাঁড়ার ভয় দেখালে শরণাপন্ন হয় তারই। সৌভাগ্যের লোভ দেখালে শরণাপন্ন হয় জ্যোতিষীরই। আসলে ধার্মিকের জীবনশৈলী গড়ে ওঠে এইরকম স্বার্থান্বেষিতায়। এরা তাই ধর্ম ছাড়া নৈতিকতার কথা ভাবতেই পারে না, ভাল কাজের জন্য ঈশ্বরের গিফটের বাইরেও কিছু চিন্তা করতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে এদের শিক্ষা নেই। শিক্ষার পথও রুদ্ধ করে দিয়েছে ধর্মীয় জীবনশৈলী।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও আদালতের বিতর্কিত রায় – ফিরে দেখা -কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 25, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:880 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“যুদ্ধক্ষেত্রের পরে আদালতের কক্ষই হলো সেই স্থান যেখানে ইতিহাসের সবথেকে জঘন্য অন্যায়গুলোর মধ্যে কিছু ঘটেছে।” - মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ১৯২২ সালের ২৪-এ জানুয়ারী আদালতে দেওয়া বিবৃতি।

“সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়”। দেশের একেবারে সামনের সারির এক গবেষণা সংস্থা CSIR গত ২১-এ নভেম্বর গর্বের সাথে ট্যুইট করে জানিয়েছে যে একদল বিজ্ঞানী প্রদর্শনী করে দেখিয়েছেন কিভাবে ২০২৪ সালের রামনবমীর দিন অযোধ্যার রামমন্দিরে রামলালার মূর্তির উপরে সূর্যের আলো এসে পড়বে। এই খবরটায় যাঁরা ভীষণ অবাক হয়েছেন, দুই বছর আগের এই খবরটা হয়তো তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল যে – প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী ‘শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্ট’ এমনভাবে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি করবে যাতে প্রতি বছর রামনবমীর দিন রামলালার মূর্তির উপর সূর্য রশ্মি এসে আছড়ে পড়ে (টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়া, ১৭ নভেম্বর ২০২০)। তারপর থেকেই সেই ট্রাস্ট এই ব্যাপারে CSIR-এর সাহায্য নিয়ে চলেছে। আরও এক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। 

৯ নভেম্বর ২০১৯ – বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়ে রায় জানালো সুপ্রিম কোর্ট। ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইত্যাদির মুখে কালি মাখিয়ে অবসান হলো কয়েক দশক পুরোনো এক বিতর্কের। আরও অতীতে যাওয়ার আগে বরং এই বিতর্কিত রায় নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক।


রায়ের শেষে একটা সংযোজনে স্পষ্টই জানানো হয়েছে যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দুদের “বিশ্বাস”-এর উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দুরা যেহেতু “বিশ্বাস” করেন যে বাবরি মসজিদের ঐ নির্দ্দিষ্ট অক্ষ্যাংশ-দ্রাঘিমাংশেই রামলালা-র জন্ম সেহেতু ভগবান শ্রী রাম ঐখানেই জন্মেছেন, এবং তাই “মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে”। মন্দির ভাঙ্গার আগে RSS-BJP ঠিক এটাই বলে এসেছে। যেমন, ৫ জুন ১৯৮৯-এ একটা চিঠিতে বাজপেয়ী লিখেছিলেন, “রাম ঠিক কোনখানে জন্মেছিলেন সেটা নির্দ্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়”; লালকৃষ্ণ আডবানী ১ অক্টোবর ১৯৯০-এ বলেছিলেন, “এটা যে শ্রী রামের জন্মস্থান সেটা কেউই প্রমাণ করতে পারবেন না”, কারণ এটা বিশ্বাস, আর বিশ্বাসকে কি প্রমাণ করা যায়! RSS-সুপ্রিমো এম.ডি.দেওরাস তো ১১ জুন ১৯৮৯-এ লিখেইছিলেন যে, “এটা এমন বিষয়ই নয় যেখানে আইনব্যবস্থা নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে পারে।” কিন্তু তিরিশ বছর পরে তাঁদেরকেও হয়ত অবাক করে দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদালত! কারণ, “... হ্যায় তো মুম্‌কিন হ্যায়”। তাই সর্বোচ্চ আদালত এই রায়ের মূল্যায়নে জানিয়েছে, “মসজিদ নির্মাণের আগে থেকে এবং পরবর্তীকালে হিন্দুদের সর্বদাই বিশ্বাস ছিল যে, ভগবান রামের জন্মস্থান হলো সেই স্থান যেখানে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এবং এই বিশ্বাসের পক্ষে লেখ্য ও মৌখিক প্রমাণও আছে।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice]। এখানে লেখ্য প্রমাণ বলতে কিছু ধর্মীয় পুঁথির কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে RSS-এর পোষা ঐতিহাসিকরা বাদ দিয়ে বাকি সকলেই সন্দিহান, এবং মৌখিক প্রমাণ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই “বিশ্বাস”-কে। তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হল, সাধারণত প্রথা অনুযায়ী একটা রায়ের শুরুতে রায়দাতাদের নাম উল্লেখ করা থাকে; এক্ষেত্রে যেটা নেই। রায়ের নিচে পাঁচ বিচারপতির সই থাকলেও, রায়ের সংযোজনে যেখানে “বিশ্বাস”-এর উপর জোর দিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে সেখানে কারও সই নেই! [দেখুন – Secularism at stake ]। প্রশ্ন থেকেই যায় যে তাহলে কি রায়দাতারা কি নিজেরাই নিজেদের এই রায়কে “বিশ্বাস” করেন না?


সবটাই যখন “বিশ্বাস”-এর ভিত্তিতে তখন মামলার খুঁটিনাটি নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় করে লাভ নেই। কিন্তু তাও কিছু কথা না বললেই নয়। যেমন, এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল ১৮৮৫ সালে। বাবরি মসজিদের চৌহদ্দির ভিতরে ১৮৫৫ সালে একটা চবুতরা নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং প্রার্থনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিমদের বিবাদ বন্ধ করার জন্য চবুতরা আর মসজিদের মধ্যে প্রাচীরও তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকে সেই প্রাচীরের ভিতরে মসজিদে মুসলিমরা প্রার্থনা করেন, এবং বাইরে রাম-চবুতরাতে হিন্দুরা প্রার্থনা করেন। সেই রাম-চবুতরাকে রাম জন্মভূমি হিসাবে দেখিয়ে মন্দির নির্মাণের প্রথম আর্জি শুরু হয় ১৮৮৫-৮৬ সাল নাগাদ। এই সংক্রান্ত সেই সময়ের প্রতিটা মামলায় রাম জন্মভূমি হিসাবে চবুতরাটাকেই বিবেচনা করা হয়েছে, একবারের জন্যও বাবরি মসজিদ এই বিতর্কের মধ্যে আসেনি। হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রথম দিককার পথিকৃৎ – সাভারকার, বালগঙ্গাধর তিলক, মদন মোহন মালব্য, বা লালা লাজপত রাই – কাউকেই কখনও শোনা যায়নি বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণের দাবি জানাতে। [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়েছিল – এই আখ্যানও আসলে সাম্প্রতিক; ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোর লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসকদের মদতে রচিত বিকৃত ইতিহাসের একটা অংশ। বাবরি মসজিদ তৈরি হয় ১৫২৮ সালে। যদিও, ‘বাবরনামা’-তে মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি হয়েছে বা রাম-জন্মভূমিতে মসজিদ তৈরি হয়েছে – এমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। সপ্তম শতাব্দীর হিউয়েন সাং-ই হোক, বা একাদশ শতকের আলবেরুনী – কারো রচনাতেই অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করতে দেখা যায় না। তবে সেইসব বাদ দিন! হিন্দু রাষ্ট্রের জনতা ম্লেচ্ছদের লেখা ইতিহাসে বিশ্বাস করবেনই বা কেন! কিন্তু বাবরি মসজিদ যদি সত্যিই মন্দির ভেঙে তৈরি হত তাহলে অন্তত ১৫৭৪ সালে তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিতমানস’-এ তার কিছু উল্লেখ বা আভাস নিশ্চই থাকত! তা না হলে যে বলতেই হয় তুলসীদাস ‘সাচ্চা হিন্দু’ ছিলেন না! যাইহোক, সেই আমলের বিভিন্ন সংস্কৃত পুঁথিতে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে অযোধ্যার উল্লেখ থাকলেও সেটাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করার নিদর্শন পাওয়া যায় না। যে ‘স্কন্দ পুরাণ’ নিয়ে এতো হৈচৈ সেখানেও অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি বললেও নির্দ্দিষ্ট করে অযোধ্যার ঠিক কোনখানে রামলালা জন্মেছিলেন সেই কথা বলা নেই। [দেখুন – ASI's archaeological findings in Ayodhya: Short shrift to facts]। ‘স্কন্দ পুরাণ’-এর রচনা আনুমানিক ১৬০০ সালে। তাহলে ১৫২৮ সালে সত্যিই যদি মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হতো তাহলে কি সেই কথা বড় বড় অক্ষরে ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ লেখা থাকতো না? “আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে”!


এমনকি একটা আরও মজার প্রশ্ন হল অযোধ্যার রাম-জন্মভূমিতে ঠিক কোন রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন? এ.কে. রামানুজন-এর বিখ্যাত গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণ্‌স’ থেকে জানা যায় যে বীর নায়ক রাম-কে ঘিরে ৩০০-টারও বেশি ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান ভারত ও এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মূল রামায়ণ বলে কিছু হয় না, এবং বাল্মীকির রামায়ণ হিসাবে যেটা জনপ্রিয় সেটাও আসলে এই ভিন্ন ভিন্ন আখ্যানগুলোর মধ্যে একটা। উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ জাতক কাহিনী দশরথ জাতক-এর কথা বলা যেতে পারে। এই আখ্যান অনুযায়ী রাম আর সীতা ভাই-বোন, এবং নির্বাসিত জীবনের পর রাম নিজের বোন সীতাকে বিয়ে করেন। এই আখ্যান উপজাতীয় সমাজের একটা আদিম পর্যায়কে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে যেখানে একই প্রজন্মের একই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক একটা ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরনের গবেষণামূলক প্রবন্ধ RSS-BJP-র পছন্দ নয়। কারণ, এই জাতীয় তথ্য RSS-BJP-র রাম-কেন্দ্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। RSS-BJP-র ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রাম তাঁদের মতোই বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী। অন্য রাম-এর উপস্থিতি তাঁদের রাম-এর কাছে অস্তিত্বের সংকট হয়ে ওঠে। সেই কারণে হিন্দুত্ব বাহিনীর ক্রোধের সম্মুখীন হওয়ার পরে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে এই প্রবন্ধকে বাদ দেওয়া হয়।


এছাড়া, RSS-BJP-র দাবির উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ সাল থেকে অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। আজ পর্যন্ত মন্দির ধ্বংসের কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ নিজেদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই প্রতিবেদনগুলির সমালোচনা করে সেগুলোকে খণ্ডন করেছেন। যদিও সেই ‘বিশেষজ্ঞদের’ কাছ থেকে পাল্টা কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এমনকি এই লজ্জাজনক বিষয়টাও উল্লেখ না করলেই নয় যে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই 

‘বিশেষজ্ঞ’ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কয়েকজন মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির নির্মাণের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন!

 ২০০৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) দ্বারা নতুন করে খনন করার নির্দেশ দেয়, যেটা সেই সময়ে সম্পূর্ণরূপে BJP-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। যাইহোক, এমনকি ASI রিপোর্টেও কোন মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে নিজের প্রভুদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ASI ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মসজিদের ধ্বংসাবশেষের নিচে একটা বিশাল কাঠামোর উপস্থিতির কথা জানিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। খননের সময় ASI-এর আচরণ এবং তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটা ‘আলিগড় হিস্টোরিয়ান সোসাইটি’ সমেত অনেকের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক শিরিন রত্নাগর যথার্থই বলেছেন যে, “পরিস্থিতি, মন্দির নির্মাণের পক্ষে যুক্তির বিষয়বস্তু এবং যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এগুলো গড়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই যে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে পূরণ করার জন্য কিছু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন।” [দেখুন – Archaeology at the Heart of a Political Confrontation, pp. 243]।


সুতরাং, বলাই বাহুল্য যে মসজিদ ভেঙে রাম মন্দিরের নির্মাণের দাবি নোংরা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়, যার সূত্রপাতও এক ডিসেম্বর মাসে, ১৯৪৯ সালের ২২-এ ডিসেম্বর। ফৈজাবাদ-এর তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ২৫ এপ্রিল ১৯৫০-এ নিজের লিখিত বয়ানে আদালতকে জানান যে, “মামলার সম্পত্তিটা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত, এবং এটা দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের উপাসনার উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা শ্রী রাম চন্দ্রজীর মন্দির হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি। বরং ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এর রাতে, শ্রী রামচন্দ্রজীর মূর্তিগুলি গোপনে এবং অন্যায়ভাবে এর ভিতরে স্থাপন করা হয়েছিল।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। এই রাজনৈতিক নোংরামোর ধারাবাহিকতাই পরিণতি পায় ১৯৮০-র দশকে, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’-এর (VHP) হাত ধরে। আর তখন শুধু বাবরি মসজিদ-ই নয়, সাথে মথুরা ও বারাণসী-র দুটো মসজিদ ধ্বংসের ডাক দেওয়া হয়। এই রাম মন্দির নির্মাণের দাবি যে নিখাদ রাজনীতি সেকথা RSS-BJP-র নেতাদের কথাতেও একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছে। 

১১-ই জুন, ১৯৮৯-এ আডবাণী বলেন, “আমি নিশ্চিত যে এসবের কারণে অনেক ভোট পাওয়া যাবে।” ১৮-ই জুন ১৯৯১-এ তিনি স্পষ্টই জানান যে, “আমি যদি রামের তাসটা ঠিকঠাকভাবে না খেলতাম, তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে নিউ দিল্লী নির্বাচনী এলাকা থেকে হারতাম।” নিজের আত্মজীবনী ‘মাই কান্ট্রি মাই লাইফ’-এও তিনি এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম আগ্রাসনের ইতিহাসের আলোকে অযোধ্যাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং তারপর এর সাথে সমান্তরালভাবে মন্দির আন্দোলনের বৈধতা খোঁজা।” এমনকি সুষ্মা স্বরাজ পর্যন্ত ১৪-ই এপ্রিল, ২০০০-এ স্বীকার করেন যে রাম-জন্মভূমি আন্দোলন ছিল “নিখাদ রাজনৈতিক এবং এর সাথে ধর্মের কোনো যোগ ছিল না।” [দেখুন – How a Mosque Became a Temple ]।


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দশ দিন পর ভারত সরকার কর্তৃক যে ‘লিবারহান কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল সেই কমিশনের রিপোর্টেই এই নোংরা রাজনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল, “[মসজিদ ধ্বংসের] প্রস্তুতিটা অসাধারণ রকমের গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছিল, এবং ধারাবাহিকতা ও নিশ্চিত ফলাফল সমেত সেটা ছিল প্রযুক্তিগতভাবে ত্রুটিহীন। ... মূল বিষয় ছিল ক্ষমতা। গোপন উদ্দেশ্যের সমর্থনে তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল এই ক্ষমতা। নেতারা জানেন কিভাবে আবেগকে জাগ্রত করা হয় এবং কিভাবে সেটা প্রতিরোধ করা হয়; দেশের জন্য কোনটা ভালো হতো সেটার বদলে বরং তাঁরা সর্বদা এটাই দেখেন যে তাঁদের নিজেদের জন্য কোনটা ভালো হবে। অযোধ্যাতেও সেটাই হয়েছে।” [পাতা ৩৭৬ (৬১.৩০, ৬১.৩১); অথবা, দেখুন – There Stood a Mosque in Ayodhya, and it was Demolished ]। ২৭ বছর পর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যে বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে এই দীর্ঘ মন্দির-মসজিদ সমস্যার সমাধান ঘটানো হলো সেই রায় প্রসঙ্গেও একই কথা বলা চলে। দেশের জন্য যেটা ভালো হতো সেকথা না ভেবে শাসকশ্রেণীর অন্যায্য দাবির কাছে, ক্ষমতার কাছে মাথা নত করল ন্যায়বিচার।


মসজিদ ধ্বংসের জঘন্য ঘটনা এবং এই সর্বোচ্চ আদালতের এই বিতর্কিত রায় – দুটোরই যে নিন্দা জানানো প্রয়োজন তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বোঝা প্রয়োজন যে ঠিক কোন বৃহত্তর অদৃশ্য ক্ষমতা এই ঘটনাক্রমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ১৯৯০-এর অর্থনৈতিক সংকট, IMF-এর হস্তক্ষেপ, তারপর সেই তথাকথিত ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’-এর মাধ্যমে বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে বিদেশী লগ্নির জন্য ভারতের বাজারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক শোষণের পথ প্রস্তুত করা, এবং সেইসব থেকে ভারতের মেহনতী জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্ম আর বিশ্বাসের নামে তাঁদেরকে বিভক্ত করে দেওয়া, যার চূড়ান্ত পরিণাম RSS-BJP-র নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী বাহিনী কর্তৃক বাবরি মসজিদ ধ্বংস – এই ঘটনা গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। সেই সময় কেন্দ্রের গদিতে বসে থাকা কংগ্রেস সরকারের ভূমিকাকেও সামনে আনা প্রয়োজন। প্রথমে শাহ্‌-বানো মামলায় বিতর্কিত রায় ও বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে একটা অশান্তির প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া এবং তারপর নিজের সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ১৯৯২ সালের ৬-ই ডিসেম্বর মসজিদ ধ্বংসের নারকীয় উল্লাসকে চুপটি করে উপভোগ করা – কংগ্রেস সরকারও নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। অরুন্ধতী রায় যথার্থই বলেছেন, “৯০-এর দশকের শুরুর দিকে দুটো তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল – একটা বাবরি মসজিদের এবং আরেকটা বাজারের [অর্থনীতির উদারীকরণ]। এই দুটো তালা খুলে দিয়ে তাঁরা দুই ধরণের মৌলবাদকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন – একটা ধর্মীয়, আরেকটা অর্থনৈতিক।” [দেখুন – Attempt to Destroy Gujarat Riots Legal Trail]। জনগণের উপর নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির আক্রমণ আজকে আরও তীব্র হয়েছে, এবং শাসক শ্রেণী আজকের দিনেও হিজাব-হালাল ইত্যাদি কু-তর্কের চিৎকারে জনগণের ন্যায্য দাবির আওয়াজকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এই দুই মৌলবাদকে আবার তালাবন্দী না করতে পারলে তাদের অশুভ আঁতাত থেকে জনগণের মুক্তি নেই।

নভেম্বর বিপ্লব – জন রীড-এর চোখে -রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 25, 2024 | সমাজ | views:897 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সেপ্টেম্বর ১৯১৭। ফিনল্যান্ড-এ আত্মগোপন করে থাকার সময়ে লেনিন একটি বই লিখতে শুরু করেছিলেন। তার নাম রাষ্ট্র ও বিপ্লব। ছটি পরিচ্ছেদ লেখা শেষ হয়েছিল। সপ্তম পরিচ্ছেদ লেখা সবে শুরু হয়েছে এমন সময়ে, লেনিন বলছেন, 

“ ‘ব্যাঘাত’ ঘটাল রাজনৈতিক সংকট, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বাহ্ন। এমন ‘ব্যাঘাতে’ কেবল আনন্দই হবার কথা। তবে পুস্তিকার দ্বিতীয় অংশটা (‘১৯০৫ ও ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা’ নিয়ে) হয়ত দীর্ঘকাল স্থগিত রাখতে হবে। লেখার চেয়ে বিপ্লবের অভিজ্ঞতা লাভ করাই বেশি প্রীতিকর ও হিতকর।” (পেত্রগ্রাদ, ৩০ নভেম্বর ১৯১৭)


যে-অভিজ্ঞতা লেনিন অর্জন করেছিলেন সেটি প্রত্যক্ষভাবে এক বিপ্লবীর। কিন্তু বিপ্লব নিয়ে লিখে চলেছিলেন এক তরুণ মার্কিন সাংবাদিক, জন রীড (১৮৮৭-১৯২০)। তারই পরিণামে ১৯১৯-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরল তাঁর বই, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। তার মুখবন্ধ (ইনট্রোডাকশন) লিখে দিলেন নিকোলাই লেনিন (ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ)। আর পাতারও কম জায়গায় লেনিন বইটির সুখ্যাতি করলেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কারণে। বিপ্লবের প্রথম দশ দিনের রোমাঞ্চকর সব ঘটনার বিবরণ বইটিতে পাওয়া যাবে—সুখ্যাতি সেই কারণে নয়; প্রলেতারীয় বিপ্লব আর প্রলেতারীয় একনায়কত্ব বলতে ঠিক কী বোঝায়—এই সমস্যাই বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের মূল সমস্যা। রীড-এর বইটি পড়লে এই দুটি ব্যাপারে পাঠকের ধারণা পরিষ্কার হবে—এই কারণেই লেনিন সুপারিশ করেছিলেন বইটি কোটি কোটি কপি ছাপা হোক আর সব ভাষায় তর্জমা হোক।

সুখের কথা, আরও অনেক ভাষার মতো বাঙলাতেও রীড-এর বইটির তর্জমা হয়েছে, যদিও অনেক দেরিতে। প্রথম বাংলা সংস্করণ বেরিয়েছিল মস্কো থেকে, ১৯৬৭-তে। ঘটো বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে আরও অনেক কারণে স্মরণীয়। ১৯৭০-এ তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরয়, ১৯৭৭-এ তৃতীয় আর ১৯৮৭-তে চতুর্থ (সম্ভবত শেষ) সংস্করণ।


সবচেয়ে বড় কথা বইটির শেষে প্রকাশকের উপসংহার ও আলবার্ট উইলিয়মস-এর লেখা জন রীড এর সংক্ষিপ্ত জীবনী মস্কো সংস্করণটিকে পাঠকদের পক্ষে আরও উপযোগী করেছিল।


দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন-এর ভূমিকায় (নিউ ইয়র্ক, ১ জানুয়ারি ১৯১৯) রীড লিখেছিলেন –


“বইটি হল ঘনীভূত ইতিহাসের একটা অনুচ্ছেদ, —সে ইতিহাসকে আমি যেটুকু দেখেছি।... পর পর কয়েকটি বই আমি লিখছি, তার প্রথম পুস্তক হিসেবে এই বইটিতে আমি শুধু নিজের দেখা ঘটনা ও অভিজ্ঞতা কিংবা প্রমাণসিদ্ধ তথ্যের বিবরণে সীমাবদ্ধ থাকব।”

ভূমিকাটি শেষ হয়েছিল এই বলে –

“এ সংগ্রামে আমার মনোভাব নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু মহান এই দিনগুলোর কাহিনী বলার সময়ে আমি সত্যকথনে আগ্রহী। একজন বিবেকবান রিপোর্টারের চোখ দিয়েই ঘটনাগুলোকে দেখার চেষ্টা করেছি।”


রীড-এর বইটি বেরনোর পর রুশ বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে বহু ভাষায় বহু বই লেখা হয়েছে। মহাফেজখানার নথি, পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলির খবরের কাগজের সম্পাদকীয় মন্তব্য ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে – বিপ্লব কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বিপ্লব যে সত্যিই কোনো ভোজসভা নয়; বাধ্য হয়েই এমন অনেক কিছু করতে হয় যেগুলি কারুরই কাম্য নয়। রীড-এর বই-এ তারও কিছু নমুনা আছে। প্রতিবিপ্লবী শক্তি কীভাবে ও কত উপায়ে বিপ্লবকে বান্‌চাল করার উদ্যোগ নিয়েছিল তার বিশদ বিবরণ আছে ভিক্টর সার্জ (১৮৯০-১৯৪৭)-এর ফরাসিতে লেখা রুশ বিপ্লবের প্রথম বছর  (১৯৩০) বইটিতে। এমন কোনো কু-মতলব, ফিকিরফন্দি আর চোরাগোপ্তা পদ্ধতি নেই, যা প্রতিবিপ্লবীরা কাজে লাগায়নি।


রাশিয়ার মাটিতে লাল ঝান্ডা প্রথম তুলেছিলেন এক তরুণ ছাত্র, গিওর্গি প্লেখানভ। উপলক্ষ্য ছিল সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এ শ্রমিকদের প্রথম সমাজবাদী বিক্ষোভ মিছিল (৬ ডিসেম্বর ১৮৭৬)। তখনও রাশিয়ার কোনো সমাজবাদী-গণতান্ত্রিক সংগঠন ছিল না। প্লেখানভ-ই প্রবাসে মার্কসীয় প্রবণতার প্রথম রুশ বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলেন (সুইট্‌সারল্যান্ড ১৮৮৩)। সেই প্লেখানভ, যাঁর লেখা পড়ে এক প্রজন্মর রুশ তরুণ মার্কসবাদ শিখেছিলেন, পরে মেনশেভিকদের নেতা হন, বিশ বছরেরও বেশি বলশেভিকদের সঙ্গে তাদের উত্তর চলে। অক্টোবর ১৯১৭-র তিনি রাশিয়াতেই ছিলেন, তবে অসুস্থ, শয্যাশায়ী। জাক সাদুল-কে ১৭ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘এই পোকাটাকে [অর্থাৎ বলশেভিকদের] শুধু বশে আনলেই হবে না, টিপে মারতে হবে, রক্তে ডুবিয়ে দিতে হবে। রাশিয়ার নিরাপত্তার ঐ হলো কিম্মত।’ মাকসিম গর্কি-র নবজীবন  পত্রিকায় ডাক দেওয়া হলো – “বলশেভিকদের মানতে অস্বীকার করুক নাগরিকরা, সক্রিয়ভাবে অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করুক, অন্তর্ঘাত ও খাবার সরবরাহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করুক। তাঁদের রাশিয়ার নাগরিকদের মূল মন্ত্র হলো – বলশেভিকদের বিরুদ্ধে, সব পদ্ধতিই ভালো” (সার্জ, ইয়ার ওয়ান অফ রাশিয়ান রেডলিউশন, শিকাগো – হোল্‌ট, রাইনহার্ট অ্যান্ড উইনস্টন, ১৯৭২, পৃ. ৯২-এ উদ্ধৃত)।


কোন্‌টি ক্রিয়া আর কোন্‌টি প্রতিক্রিয়া তা না বুঝলে রুশ বিপ্লবের আসল চেহারা ধরা যাবে না। গোটা রাশিয়া নয়। পেত্রগান ও তার আশেপাশের ঘটনা নিয়ে রীড-এর প্রাণবন্ত বিবরণ নভেম্বর বিপ্লব-এর ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে প্রবেশকের কাজ করবে। দশটি মাত্র দিনের ঘটনাবলি যেন ইতিহাসের নির্যাস। কত বাধা (ভেতরের ও বাইরের), কত চক্রান্ত, কত বেইমানি পেরিয়ে বিপ্লব সফল হয়েছিল—এই বইটির মধ্যেই তার যথাযথ ছবি ধরা আছে। আর সেই কারণেই এ বই-এর মর্যাদা কখনও কমবে না।


এখন বাজারে মূল বইটির একটি সংস্করণ সহজেই পাওয়া যায়। সেটি বার করেছে পেঙ্গুইন বুক্‌স্‌। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এ জে পি টেলর-এর ভূমিকা সমেত এটি বেরিয়েছিল ১৯৭৭-এ; এখনও সেই সংস্করণটিই কিনতে পাওয়া যায়। ভূমিকায় অধ্যাপক টেলর-ও কিছু কিছু তথ্যগত ভুলের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু গুটিয়ে প্রতিটি ঘটনা ও ব্যক্তি সম্পর্কে টীকা দেন নি। অবশ্য সম্পাদনা ও ভূমিকা রচনার যুগ্ম দায়িত্ব তাঁর ছিল না। সুতরাং এদিক থেকে মস্কো সংস্করণের সম্পাদক অনেক ক'টি টীকা দিয়ে একই সঙ্গে সংশোধন ও ব্যাখ্যার কাজে সাহায্য করেছেন।


অন্যদিকে, বইটির পরিশিষ্টয় (রীড-এর দেওয়া) শেষ অংশটিতে দ্বাদশ পরিচ্ছেদের শেষে একটি টাকা পেঙ্গুইন সংস্করণে পাওয়া যায় (পৃ ৩৫১ টা-৭১), মাস্কার ১৯৭৭ ও ১৯৮৭-র বাংলা ও ইংরিজি সংস্করণে সেটি গরহাজির।


মতাদর্শর দিক দিয়ে টেলর সায়েব অবশ্য অন্য মেরুর লোক। রুশ বিপ্লব, লেনিন, মার্কসবাদ ইত্যাদি কোনো বিষয়েই তাঁর মনোভাব অনুকূল ছিল না। জন রীত-এর কৃতিত্ব সম্পর্কেও তার মন্তব্য বেশ গোলমেলে। একবার তিনি বলেন রীড-এর রচনা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ – যা তিনি দেখেছিলেন ও তার অভিজ্ঞতায় এসেছিল। পরমুহূর্তেই তিনি বলেন – বইটির অনেকখানিই কিন্তু হোটেলের ঘরে শান্তিতে বসে দ্য ম্যাসেস  পত্রিকার জন্যে টাইপরাইটারে লেখা (পৃ. আট-নয়)। নানা লোকের কথার টুকরো আর কী-ঘটে-থাকতে-পারে তার কল্পনা মিশিয়ে লেখা হয়েছিল দুনিয়া কাপানো দশ দিন। যেটি নাকি আবার টেলর-এর মতে ‘বহুকাল ধরেই একটি রাজনৈতিক ক্লাসিক’ (পৃ. সাত)। অথচ রীড-এর বইটি পড়লে দেখা যায় – তিনি চরকির মতো ঘুরছেন এখান থেকে ওখানে; বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তর তিনি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।


এখানেই না-থেমে টেলর আরও বলেছেন – ১৯২৭-এ বিপ্লবের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রবাদপ্রসিদ্ধ রুশ চলচ্চিত্র-পরিচালক, সের্গেই আইজেনস্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮)-কে একটি ফিল্‌ম্ তুলতে বলা হয়েছিল। সেটির নাম তিনিই দিয়েছিলেন দুনিয়া কাপানো দশ দিন। টেলর-এর মতে, পুরো চিত্রনাট্যর জন্যে ব্যবহার করা হয়েছিল রীড-এর বইটি; সমকালীন কোনো নিউজ রিল বা ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হেঁটে ফিল্‌ম্‌টি তোলা হয় নি। রীড-এর বইটিকেই তর্জমা করা হয়েছিল চলচ্চিত্রর নিরিখে। তার অনেকটাই কল্পকথা (ফিকশন), রীড-এর বই-এর অনেকটাও সেই রকমই (পৃ. নয়)। মন্তব্যটি রীড ও আইজেনস্টাইন দুজনের পক্ষেই মানহানিকর। উল্‌টে বলা যায়, অক্টোবর  চলচ্চিত্রে এমন অনেক কিছু ছিল যা রীড-এর বই-এ নেই। চলচ্চিত্রর রুপ নাম শুধু অক্টোবর, পরে নতুন সম্পাদনা করে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর বাইরে ছবিটি মুক্তি পায় দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন নামে। ১০৪ মিনিটের এই নির্বাক ছবিটি প্রথম দেখানো হয় ২০ জানুয়ারি ১৯২৮-এ। ফিল্‌ম্‌টি একা আইজেনস্টাইন করেন নি, যুগ্ম চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ছিলেন গ্রিগোরিও আলেক্‌সান্দ্রোভ। অনেক পরে ফিল্‌ম্‌টির (১৯৬৬) সঙ্গীত যোগ করেন দিমিত্রি শস্তাকোভিচ। যেমন, ‘দেবতাদের’ নিয়ে একটি চিত্র পরম্পরা (সিকুয়েন্‌স)। মার্কিন দেশে বেশির ভাগ প্রিন্ট-এ এটি বাদ দেওয়া থাকে (ফিল্‌ম্‌ ফর্‌ম্‌ - এসেজ ইন ফিল্‌ম্‌ থিওরি, নিউ ইয়র্ক – মেরিডিআন বুকস, ১৯৫৭, পৃ. ৮২)। মন্তাজ-এর পাশাপাশি টাইপেজ-এর কৌশলটিও আইজেনস্টাইন-কে থিয়েটর থেকে চলচ্চিত্রে আনতে উদ্‌বুদ্ধ করেছিল (ফিলম ফরম, পৃ. ৮-৯)। এই চলচ্চিত্রেই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন সাহিত্য থেকে নেওয়া আভ্যন্তর এককোক্তি (ইনার মনোলোগ)। সাহিত্যর চেয়ে তার পরিসর অনেক বড়। জেমস জয়েস-এর সঙ্গে আইজেনস্টাইন-এর একবার দেখা হয়েছিল পারী-তে। প্রায় সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও জয়েস চেয়েছিলেন। পটেমকিন আর অক্টোবর দেখতে (ঐ, পৃ. ১০৪)।



এসব রীড-এর বই থেকে আসে নি। রুশ বিপ্লবের স্বরূপ তুলে ধরার জন্যেই এমন সব উদ্‌ভাবন করতে হয়েছিল আইজেনস্টাইনকে। সমান্তরাল মন্তাজ-এর ফ্রেম-কে বিস্তৃত করে এসেছিল একটি নতুন গুণ যাওয়া হচ্ছিল এক নতুন এলাকায় – উত্তরণ ঘটছিল ক্রিয়া (অ্যাকশন)-র জগৎ থেকে তাৎপর্য-র জগৎ-এ; হয়তো এগুলির মধ্যে ভুলও ছিল, কিন্তু তার জন্যে আইজেনস্টাইন-এর মহত্ত্বে কোনো দাগ পড়ে না (ফিল্‌ম্‌ ফর্‌ম্‌, পৃ. ৫৮ দ্র.)। আসলে, রীড-এর বই আর আইজেনস্টাইন-এর চলচ্চিত্র দুটি আলাদা শিল্পকর্ম। সাময়িক সরকার-এর পতনেই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়; রীড-এর বই কিন্তু ২৯ নভেম্বর অবধি ঘটনার বিবরণ দিয়ে চলে।


সাত রিল-এর এই চলচ্চিত্রটি প্রায় পুরোটাই তোলা হয়েছিল লেনিনগ্রাদ-এ। গ্রানাডা টেলিভিশন-এ রীড-এর বইটির আর-একটি চলচ্চিত্র রূপ দেন অরসন ওয়েল্‌স্ (১৯৬৭)। ১৯৮২-তে লাল ঘন্টা  (বিকল্প নাম – দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন) বলে আর একটি ফিল্‌ম্ তুলেছিলেন সের্গেই বন্‌দারচুক, তারও ভিত্তি ছিল রীড-এর বইটি।


এমন সব মন্তব্য কীভাবে নেওয়া উচিত – ব্যাজ (নিন্দে) নাকি স্তুতি? টেলর-এর ভূমিকায় ডানহাতে রীড-কে যে-স্তুতি উপহার দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাঁহাতে সেটি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অথচ লেনিন ও ক্রুপস্কায়া দুজনেই কিন্তু রীড-এর সত্যনিষ্ঠারই প্রশংসা করেছেন। কেতাবি ঐতিহাসিকের চেয়ে এই দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর অভিমতই বোধহয় বেশি গ্রহণযোগ্য।


রীড-এর বইটিকে ‘অনেকটাই গপ্পো’ বলে নস্যাৎ করার পরেও টেলর তাঁর ভূমিকার শেষে লেখেন—লেনিন ও ক্রুপস্কায়ার একই সুরে—যে বলশেভিক বিপ্লবের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বইটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী (পৃ. উনিশ)! এমন প্রশংসার কারণ একটাই – স্তালিন-এর আমলে রীড-এর বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু ত্রৎস্কি তার নায়ক। টেলর-এর মতে, স্তালিন-এর মৃত্যুর পর থেকে বইটি কমিউনিস্টরা দায়সারাভাবে সয়ে আসছেন, তার বেশি কিছু নয়। টেলর একথা লিখছেন ১৯৭৭-এ, অথচ তার দশ বছর আগেই, নভেম্বর বিপ্লব-এর সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে বাঙলা সমেত একাধিক ভাষায় রীড-এর বইটির অনুবাদ হয়ে গেছে প্রগতি প্রকাশন, মস্কো থেকেই। এখনও পর্যন্ত বইটির তর্জমা হয়েছে পৃথিবীর বহু ভাষায় (ঠিক কটি তা বলার মতো তথ্য হাতে নেই)। ব্যাবসার কথা মাথায় রেখেই পেঙ্গুইন বু্‌ক্‌স্ থেকে ১৯৬৬-তে বইটির একটি সংস্করণ বেরয়। তখনও তার কপিরাইট ছিল লরেন্‌স্‌ অ্যান্ড উইশার্ট-এর। টেলর-এর ভূমিকার নানা মন্তব্য সম্পর্কে তারা আপত্তি তোলে। পেঙ্গুইন বুক্‌স্ তখন কোনো ভূমিকা ছাড়াই বইটি বার করে দেয়—এমনই মুনাফার গরজ। কপিরাইট-এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ট্রেলর-এর ভূমিকা সমেত আবার বেরয় পেঙ্গুইন ক্লাসিক্‌স্ থেকে।


রীড শুধু প্রথম সারির কবিই (মার্কিন কূটনীতিবিদ্‌ ও ঐতিহাসিক অর্থ কেনান-এর ভাষায়) ছিলেন না। টেলর নিজেও বলেছেন – রীড প্রথম সারির গদ্যশিল্পীও বটে (পৃ. আট)। এইটুকু বলাই কিন্তু যথেষ্ট নয়। রীড-এর ছিল অসাধারণ পর্যবেক্ষণ-শক্তি, সূক্ষ্ম রসবোধ আর আপাত অসার ঘটনাবলির ভেতর থেকে সারবস্তুটি বার করে আনার ক্ষমতা। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক –


“কার্লাইল তাঁর ‘ফরাসী বিপ্লব’ পুস্তকে বলেছেন যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতায় বিশ্বে ফরাসীদের জুড়ি নেই। রাশিয়া কিন্তু এ রীতিটি অভ্যাস করে নিয়েছিল ... রাশিয়ার শীতকালে পেত্রগ্রাদের তুহিন শাদা জমাট রাস্তার ওপর সারাদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বল্পবসন মানুষ!” (পৃ. 8৪)

এই দুরবস্থা সত্ত্বেও রীড লক্ষ্য করেন –

“থিয়েটারগুলো অবশ্য চলছিল প্রতি রাত্রেই, রবিবারও বাদ যেত না। মারিনস্কি থিয়েটারে নতুন একটি ব্যালেতে নামলেন কার্সাভিনা, নৃত্যামোদী গোটা রাশিয়া ছুটল তাঁকে দেখতে। শালিয়াপিন গান গাইছিলেন। আলেক্সান্দ্রিনস্কি থিয়েটারে আলেক্সেই তলস্তয়ের ‘করাল ইভানের মৃত্যু’ নাটক নতুন করে শুরু হয়েছে মেইয়েরহোলদের প্রযোজনায়। (পৃ. ৪৫)”


এই যে খুঁটিনাটির ওপর নজর, কোন্‌ ঘটনার পাল্‌টা হিসেবে কোন্‌ ঘটনা বেছে নিতে হয় এ ব্যাপারে রীড-এর কৃতিত্ব বারেবারেই ধরা পড়ে। আর বিপরীতভাবের ঘটনার সঙ্গে রীড জুড়ে দেন অন্য একটি ঘটনা –

“মনে আছে এ অভিনয়ে বাদশাহী পেজ কোর-এর একটি ছাত্রকে দেখেছিলাম, পরনে তার ড্রেস ইউনিফোর্ম, প্রতিটি অঙ্কের শেষে সে কেতামাফিক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল বাদশাহী বক্স আসনটির উদ্দেশে, যদিও সে আসন তখন শূন্য, তার ঈগল প্রতীকগুলিও সব নিশ্চিহ্ন ... (পৃ. ৪৫। ব্যাঁকা হরফ যোগ করা হয়েছে।)”

শেষের এই বাক্যাংশটি নিছক একটি ঘটনা থাকে না; হয়ে ওঠে প্রতীক।

উইলিয়ম ওয়ার্নিং-এর কথা উদ্ধৃত করে রীড লিখেছেন –

“রুশ শ্রমিক শ্রেণীর অধিকাংশই লিখতে পড়তে জানে। বহু বছর ধরে দেশটা এমনই এক বিক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায় যে রুশ মজুরেরা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যকার বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের নেতৃত্বই লাভ করে নি, সমান বিপ্লবী শিক্ষিত শ্রেণীর বৃহৎ একটা অংশ রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক নব-জাগৃতির ধ্যান ধারণা নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর দিকে ফেরে ... (পৃ. ১৬)”


কথাটি যে রুশ সৈনিকদের ক্ষেত্রেও সত্যি তা বোঝা যায় একটি রণক্ষেত্রর ঘটনায়। রীড লিখছেন –


“রিগার পেছনে দ্বাদশ আর্মির ফ্রন্টে গিয়েছিলাম আমরা, মরীয়া সব ট্রেঞ্চের কাদার মধ্যে হাড় খোঁচা খালিপা লোকগুলোর দুর্দশার একশেষ। কিন্তু আমাদের দেখেই লাফিয়ে উঠল তারা। শিটিয়ে আসা মুখ, ছেঁড়া পোশাকের তল থেকে নীল হয়ে উঠেছে গায়ের মাংস, উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলে – পড়বার কিছু এনেছ? ”(পৃ. ৪৮)


নভেম্বর বিপ্লব যে অনিবার্য ছিল, হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার এটি নয়, তার প্রস্তুতিও ছিল যথেষ্ট—তারও প্রমাণ ব্রীড দিয়েছেন –

“অন্যদিকে ছিল প্রলেতারিয়েতের—মজুর, সাধারণ সৈন্য পরিব কৃষকদের নিরাকার অভিপ্রায়। বহু স্থানীয় সোভিয়েতই ইতিমধ্যে বলশেভিক হয়ে উঠেছিল; তাছাড়া ছিল শিল্প শ্রমিকদের সংগঠন...এই কয়মাস ধরে বিপ্লবী আগুনের ওপরতলায় যে গাদ আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছিল তা ফেটে পড়ল ফুঁসে ওঠা অন্তর্বিদ্রোহের তরঙ্গে। সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেস বসা সম্ভব ছিল কেবল এক স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলনের জোয়ারেই... ” (পৃ. ৬২)


‘স্বতঃস্ফূর্ত’ শব্দটি ঠিকমতো বুঝতে হবে। গণ-আন্দোলনে জোয়ার এল এক মুহূর্তে, কিন্তু তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরে। রীড জানিয়েছেন – ‘দিনের পর দিন বলশেভিক বক্তারা ব্যারাকে ব্যারাকে কারখানায় কারখানায় “গৃহযুদ্ধের এই সরকারকে” ধিক্কার দিয়ে অভিযান চালাল’ (পৃ. ৬২)। এমনই এক সভায় কাদা ভেঙে গিয়ে বলশেভিক নেতা লুনাচারস্কি-র বক্তৃতা শুনেছিলেন রীড – ‘পাতলা চেহারা, ছাত্রের মতো দেখতে, মুখখানা শিল্পীর মতো সংবেদনশীল। বলছিলেন কেন ক্ষমতা নিতে হবে সোভিয়েতকে।’ (পৃ. ৬৩)


শুধু মুখের কথা নয়, ছাপা কাগজও হয়ে উঠল বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রধান এক হাতিয়ার –


“হঠাৎ প্রসারিত হয়ে উঠল বলশেভিক সংবাদপত্র। ‘রাবোচি পুত’ এবং ‘সলদাৎ’ (সৈনিক) এই দুটি পার্টি পত্রিকা ছাড়াও কৃষকদের জন্য নতুন একটি কাগজ ‘দেরেভেনস্কায়া বেদ্‌নোতা’ (গাঁয়ের গরিব) দৈনিক প্রকাশিত হতে থাকল ৫,০০,০০০ সংখ্যায়, এবং ১৭ই অক্টোবর বেরুল ‘রাবোচি ই সলদাৎ’।” (পৃ. ৬৩)


যাঁরা মনে করেন রুশ বিপ্লব নেহাতই অল্প লোকের চক্রান্তে ক্ষমতা দখল, দয়া করে তাঁরা পত্রিকার প্রচার সংখ্যাটি নজর করবেন।

‘পেশাদার’ ঐতিহাসিকরা কদাচিৎ এই ধরণের ঘটনার উল্লেখ করেন। 

এবার রীড-এর রসবোধের দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক –

“সামরিক ও সামুদ্রিক ব্যাপারের জনকমিশাররা চলেছেন বিপ্লবী ফ্রন্ট পরিদর্শন করতে, কে জানে সেটা কোথায়। আমরা কি সঙ্গে যেতে পারি? নিশ্চয় নয়। গাড়িখানায় লোক ধরে শুধু পাঁচ জন, দুজন কমিশার, দুজন আর্দালী এবং ড্রাইভার। তাহলেও আমার এক পরিচিত রুশী তার নাম দেওয়া যাক ত্রুসিশকা, বিনা বাক্যে গিয়ে উঠ বসল, কোনো যুক্তিতেই তাকে নামানো গেল না ... ” (পৃ. ২১০)


এর মধ্যে আর মজার কী আছে? আসল মজা শুরু হয় চলতে চলতে। গাড়িতে কেউ একজন খাবারের কথা তুললেন। তিন-চার দিন বাইরে থাকতে হতে পারে ...। দেখা গেল সকলেরই পকেট গড়ের মাঠ। ত্রুসিশকাই খাবার কিনে আনলেন। যথাস্থানে পৌঁছে কমান্ডান্ট-এর কাছে জানা গেল, ‘সব ঠিক আছে কমরেড, সৈন্যদের মেজাজ চমৎকার ... শুধু একটা ব্যাপার, গুলিবারুদ কিছু নেই আমাদের ...।’


তাতে অসুবিধের কিছু নেই। এক কমিশার জানালেন, ‘স্মোলনিতে দু’শ কোটি রাউও আছে। আপনাকে একটা অর্ডার লিখে দিচ্ছি।’

“কিন্তু হায়! কারুর কাছে এক চিলতে কাগজ নেই, পেনসিলও না। ‘ত্রুসিশকাকে তার নোটবইটা দিতে হল। ... বলাই বাহুল্য এ জনতার মধ্যে একমাত্র পেনসিলটি ছিল ত্রুসিশকার কাছেই ...’ (পৃ. ২১০-২১১)


অন্য উদাহরণটি আরও চমৎকার। মস্কোয় অনেক কষ্টে ন্যাশনাল হোটেল-এ ঠাঁই জুটেছে রীড-এর। এবার খাওয়ার ব্যবস্থা। ‘খাবার খেলাম এক নিরামিষ রেস্তোরাঁ-তে; খুবই হাতছানি দেওয়া তার নাম – “আমি কাউকে খাই না!” দেয়ালে [লিও] তলস্তয়ের ছবি।’ (পৃ. ২৭৫)


রীড-এর তারিফ করে ক্রুপস্কায়া বলেছিলেন রাশিয়ার ভাষা বা রীতিনীতি কিছুই না জেনেও রীড এই বইটি লিখতে পেরেছিলেন, তার কারণ তিনি উদাসীন দর্শক মাত্র নন, মনেপ্রাণে তিনি এমন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট, যিনি ঘটনাগুলোর মানেটা, মহা সংগ্রামের মানেটা বোঝেন। এই বোধ থেকেই এসেছে তাঁর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যা ছাড়া এমন বই লেখা অসম্ভব হত।’ (পৃ. ৯)


ক্রুপস্কায়া যদি রীড-এর রুশভাষায় অজ্ঞতার কথা না জানাতেন তাহলে হয়তো পাঠক সে-কথা বুঝতেনই না। প্রতিটি রুশ পত্রিকা, ইস্তাহার, পুস্তিকা ইত্যাদি অজস্র উল্লেখ থেকে বরং মনে হয় – রুশভাষায় রীড-এর রীতিমতো দখল ছিল। ঘটনা অবশ্য তা নয়; ক্রুপস্কায়া ঠিকই বলছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে – রুশ না-জানলেও ফরাসি ও জার্মান রীড ভালোই বুঝতেন। আর এই দুটি-ভাষা-জানা লোক শিক্ষিত রুশ সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন সহজেই পাওয়া যেত। তেমন কয়েকজনের কথা রীড-এর বইতেই আছে (পৃ. ২৫০, ২৫৫, ২৬৫, ২৭১)।


Figure 1রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

একই সঙ্গে কৌতুক আর সুগভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটে নিচের এই বিবরণে –

“ঠিক ১০টা ৩৫ মিনিটে কামেনেড ঘোষণার পক্ষপাতীদের কার্ড তুলতে বললেন। বিরুদ্ধে হাত তোলার সাহস করেছিল একজন, কিন্তু চারপাশে প্রচণ্ড হৈচৈ হতেই চট করে সে হাত নামিয়ে নেয় ... সর্ববাদী সম্মত। হঠাৎ যেন এক যৌথ স্বতঃচেতনায় দেখা গেল সবাই আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, একসঙ্গে গলা মেলাচ্ছি ‘আন্তর্জাতিক’ সঙ্গীতের মসৃণ দোলায়িত ঐকতানে। ... আর এ গান শেষ হবার পর একটা সচকিত স্তব্ধতায় যখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তখন হলের পেছন থেকে কে যেন হাঁক দিলে, ‘কমরেড, মুক্তির জন্যে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণ করি আসুন!’ শুরু হল সেই অন্ত্যেষ্টি মার্চ—সেই ধীর, বিষণ্ণ তবু জয়জয়ন্তী এক স্তোত্র, একেবারে রুশী, অথচ কী মর্মস্পর্শী। ‘আন্তর্জাতিকের’ সুরটা যতই হোক বিদেশী, কিন্তু অন্ত্যেষ্টি মার্চটা যে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন নরপিণ্ডের একেবারে প্রাণের কথা যাদের প্রতিনিধিরা আজ এই সভাকক্ষে বসে তাদের আবছা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলছে এক নতুন রাশিয়া এবং হয়ত আরো কিছু।”(পৃ. ১৬২)



ব্রীড-এর বিবরণে কোনো শস্তা উচ্ছ্বাস নেই। বিপ্লবের পথ যে ফুল-বিছনো ছিল না, বরং কাঁটা ছড়িয়ে ছিল প্রতি পদে—তার নমুনা বইটিতে বারবার পাওয়া যায়। বলশেভিক পার্টির ভেতরে ও বাইরে ক্রমশ সংঘাত চলেছে; ৭ নভেম্বরের আগে ও পরে সর্বক্ষণ চলেছে তর্ক-বিতর্ক। এই সবকিছুর মধ্যে অটল রয়েছেন নিকোলাই লেনিন। ৩ নভেম্বর বলশেভিক নেতাদের ঐতিহাসিক বৈঠকে লেনিন বললেন—সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে—


“৬ই নভেম্বর খুবই আগে হয়ে যাবে ... অন্যদিকে ৮ই নভেম্বর খুবই দেরি হয়ে যাবে ... আমাদের ঘা মারতে হবে ৭ তারিখেই, যেদিন কংগ্রেস শুরু হবে, যাতে কংগ্রেসকে আমরা বলতে পারি ‘এই রইল ক্ষমতা! বলুন কী করবেন?’” (পৃ. ৮৯)


স্বতঃস্ফুর্ততা নয়, সংগঠন; আকস্মিক প্রেরণা নয়, সুচিন্তিত পরিকল্পনা—এই ছিল নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যর মূল উৎস। লেনিন যখন এই বক্তৃতা দিচ্ছেন তখনই ঐ বাড়ির ওপরের তলায় একটি ঘরে বসে আছেন ‘লম্বা চুল একটি লোক, রোগা রোগা মুখ—এককালে ছিলেন জার সৈন্যবাহিনীর অফিসার, পরে বিপ্লবী এবং নির্বাসিত, কোন এক ওভ্‌সেয়েঙ্কো, ওরফে আন্তোনভ, গণিতবিদ্‌, দাবাড়ে; রাজধানী দখলের নিখুঁত পরিকল্পনা ছকছেন তিনি।’ (পৃ ৮১)


শুধু সাহিত্যকর্ম হিসেবে যদি বইটির বিচার করা হয় তাহলেও দেখা যাবে –  দু-চার কথায় বিপ্লবের কুশীলবদের—কী সামনের আর কী পেছনের সারির—এমন নিখুঁত বর্ণনা পেশাদার লেখকরাও এত স্বচ্ছন্দে দিতে পারেন না। সবার ওপরে অবশ্য দেখা দেন লেনিন। রীড-এর বর্ণনা –

“বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মস্ত এক টেকো ঢিপকপালী মাথা কাঁধের ওপর শক্ত করে বসানো। ছোটো ছোটো চোখ, বোঁচাটে নাক, চওড়া উদার মুখ, ভারি চিবুক; মুখটা তখন কামানো, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর অতীত ও ভবিষ্যতের সেই সুপরিচিত দাড়ি খোঁচা খোঁচা গজিয়ে উঠেছে। পরনে জীর্ণ পোষাক, ট্রাউজার জোড়া বেমানান লম্বা। জনতার প্রিয়পাত্র হবার দিক থেকে একেবারেই দাগ কাটার মতো চেহারা নয়, অথচ যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি পেয়ে গেছেন তা বোধ হয় ইতিহাসের খুব কম নায়কের ভাগ্যেই জুটেছে। অদ্ভুত একজন নেতা—যিনি নেতৃত্ব করছেন একান্তই তাঁর মেধার জোরে; অরঙ্গীন, অরসিক, অটল, অনাসক্ত, এমনকি চমকপ্রদ কোনো পাগলামিও যাঁর কিছু নেই, কিন্তু আছে গভীরতম ভাবনাকে সহজে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নিখুঁত বিশ্লেষণের শক্তি। বিচক্ষণতার সঙ্গে মিলনে যা এক মেধাশক্তির মহত্তম স্পর্ধা।” (পৃ. ১৫৫-৫৬)


এর চেয়ে সঠিকভাবে লেনিন-এর পরিচয়, লেনিন কীসে লেনিন, দেওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। জৌলুস নেই, নাটুকেপনা নেই, আছে শুধু মেধার জোর—এমন জননেতা লেনিন-এর আগে সত্যিই পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি।


‘নভেম্বর বিপ্লব – জন রীড-এর চোখে’ লেখাটি ‘কোরক: নভেম্বর বিপ্লব : শতবর্ষে ফিরে দেখা (শারদ ২০১৭)’ থেকে সংগ্রহীত। 

কবিতাগুচ্ছ ২১ -কবিরা
Nov. 25, 2024 | কবিতা | views:620 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্মের চাকা ঘুরছে আজও

- অ শো ক দা স  চা র্বা ক


খুব অতীতে 'হিন্দু' বলে

ছিলনা কেউ আগে,

সবাই তখন  ' মানুষ ' ছিল

আদিম সেসব যুগে।


সব মানুষের জন্ম একই

লুসি* মাতার পেটে,

জানতোনা তাই কি কার ধরম

প্রাচীন পৃথিবীতে।


লুসির রক্ত সবার শিরায়

বইছে পরম্পরা,

তাহার সাথীর বীর্যে সৃজন

মানব দেহের ধারা।


ছিলোনা তাই জাতের বিভেদ

সেই ভায়েদের মাঝে,

জড়িয়ে ধরতো পরস্পরে

নাচে গানে কাজে।


মানবধর্ম ছিল শুধু

সবার সাদা মনে,

ছিলোনা তাই দেবদেবীরা

ধরার কোন কোনে।


সত্যি স্বর্গ ছিল সেথায়

নয়কো সে দেশ মায়া,

নরকভয়ে কাঁপতোনা কেউ

কল্পে যমের কায়া।


কালে কালে ঠগবাজেরা

দেবের জন্ম দিলো,

স্বর্গলাভের লোভ দেখিয়ে

ধর্ম সৃজন হলো।


সেই সময়ে জন্ম নিল

চতুর পুরুত যত,

ধরা জুড়ে এলো তখন

ধর্ম শত শত।


হিন্দু হলো, জৈন হলো

হলো খিরিস্তান,

শাস্ত্র গুজব ফেঁদে হলো

সৃষ্টি ভগবান।


মানবধরম হারিয়ে গেল

কপট ধর্ম এলো,

বিলোপ হলো মানবজাতি

ধর্ম হলো কালো।


জিজ্ঞাসিলে কেউ বলিল

"হিন্দু আমি", কেউবা "মুসলমান"

বললোনা কেউ "মানুষ আমি -

পঞ্চভূতের প্রাণ"।


এক ধর্মী উঠলো বলে

তার ভগবান সেরা,

অন্য সাধু বলে "ওটার

মাথাটা কর ন্যাড়া,


পরের ধর্ম ভয়াবহ

ওদের করো আড়ি,

আপন ধর্ম রাখতে ওদের

মাথায় মার বাড়ি।”


কেউবা আবার বলে দেখি

সেজে বামুন কায়া,

“অব্রাহ্মণ নিচু জাতি

ছুঁইনা ওদের ছায়া।”


সরল মানুষ ধর্মমোহে

ভায়ের গলা কাটে,

সেই সুযোগে শাসক পুরুত

ব্যবসা করে হাটে।


সেই ট্রেডিশন চলছে আজও

ভিন ধর্মী মরে,

শাসক পুরুত রক্ত চোষে

ধর্মের কল ঘোরে।


" Religion was invented when the first con man met the first fool" -    Mark Twain

(ধর্মের  আবিষ্কার  হয়েছিল  যখন প্রথম ঠগবাজ  প্রথম  বোকা মানুষের  সাক্ষাৎ  পেয়েছিলো)

অশোকদাস চার্বাক, হনলুলু, আমেরিকা ৭/১৭/১৮

* এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব চেয়ে প্রাচীন সাড়ে তিন মিলিয়ন বছর পূর্বের মানবীর ফসিল - বর্তমান পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষের আদি ঠাকুমা - সূত্র "LUCY OF ETHIOPIA" Google




মানুষ হও

স জ ল  কা ন্তি  টি কা দা র

আমাকে তোমরা হিন্দু বোলোনা

বোলোনা মুসলমান

বোলোনা আমায় বৌদ্ধ জৈন

বোলো না গো খ্রীষ্টান।

তোমরা শুধু আমাকে একটু

মানুষ নামেতে ডেকো

তাতেই আমি বেশী খুশী হবো

এটুকু মনেতে রেখো।

ধার্মিক হতে চাই না বন্ধু---

মানুষ হতেই চাই।

“সবার উপড়ে মানুষ সত্য

তাহার উপড়ে নাই।”

এই কথাটি জেনেও আমরা

তবু যে বিভেদ করি

ধর্ম জাতি আর বর্ণ নিয়েই

হিংসা প্রাচীর গড়ি।


ভগবানকে আমরা দেখিনি কখনো

কোথায় থাকেন তিনি?

মানুষকে কিন্তু দেখেছি বন্ধু

মানুষকেই আমি চিনি।

মন্দির মসজিদে ওড়ে যে টাকা

গীর্জা ভরে শুধু উপহারে

এদিকে দেখি পথের শিশু

পচে মরে অনাহারে!


ধর্মের নামে রক্তের খেলা

মানুষ যে পায় ভয়

আমরা আজও মানুষ হইনি

এতে অবাক হতেই হয়!

তাইতো বন্ধু এসব দেখেই

বড্ড খারাপ লাগে

ধার্মিক যদি হতে চাও তুমি

মানুষ হওগো আগে।



নিয়ম

 প্র দী প   চ ক্র ব র্তী



আকাশের  সূর্য -তারা

এক নিয়মেই চলে,

ছন্দোবদ্ধ জীবন যাপন

যুক্তির কথাই বলে।


মহাকাশের দুনিয়াতে

নেই ভাগ্যের হাত,

নিয়ম মেনেই দিন কেটে যায়

কেটে যায় কত রাত।


পৃথিবীর হোমো সাপিয়েন্স

বানায় যত নিয়ম,

ধর্ম নিয়ে নৃত্য করে

দেখায় কত-ই ভড়ং।



আমার ধর্ম

 সু ম ন  বি শ্বা স



জীব, জড়েতে ধর্ম আছে; ধর্ম বিহীন কিচ্ছু নাই,

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানে— হিংসা, বিভেদ, বিবাদ চাই।

মানুষ বানায় উঁচু, নীচু; জাত ভেদাভেদ রয় যে তাই,

গোনার বেলায় দলে আছে; বাস্তবে অচ্ছুত পাই।


স্বজনপ্রীতি কাকে বলে, ধর্ম দেখে যায় শেখা,

সবাই সমান নাই সেখানে; গ্রন্থে এমন পাই লেখা।

লোভ আর ভয়ে কাজ করে সব, পরকালের চিন্তাতে,

মূলে ভবে ধন গড়ে যায়; মানুষ পথে হাত পাতে।


ধর্মঢালে গুষ্টিসুদ্ধ, লুটেপুটে খায় ঢপে,

সকল মন্দকাজে থাকে; ফের সারাদিন নাম জপে।

এইপারে না ওইপারে সুখ; এই বলে বয়ান ব্যাচে,

ভণ্ডের হয় বিলাস জীবন; বোকা নাচে তার প্যাঁচে।


ভিক্ষে দিয়ে পুণ্যি কেনে; ছবি শোয়ায় রাজখাটে,

প্রাসাদসম ‘স্রষ্টার ঘর’; পরজীবী সেই হাটে।

পরের ভাতে বেগুন দিয়ে, খায় চিরকাল পালজুটে,

তবু আসন বজ্জাতে পায়; শ্রমজীবী হয় মুটে।


অভিশাপ আর আশির্বাদের ভাণ্ড মেলে ধর্মতে,

দ্বিচারী হয় ধর্মধারী; তফাৎ কথায়, কর্মতে।

আমার ধর্ম কৃত্রিম নয়; কোত্থাও তার নাই ফাঁকি,

আমার ঈশ্বর শৃঙ্খলে নাই; যখন-তখন তাই ডাকি।


সুমন বিশ্বাস, হিদিয়া (৯২১০), অভয়নগর, যশোর।

ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান -ধীরাজ দন্ডপাট
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:899 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১ম পর্ব:

  ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান শুরু হয়, গুপ্তযুগে। হিন্দুধর্মকে শাশ্বত ও সনাতন বলে ঘোষিত হয়। ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের ব্রহ্ম ও পুনর্জন্ম সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিলনা। যদিও উপনিষদে 'ব্রহ্ম'বিশ্বচেতনার নির্বিশেষ রূপ হিসেবে বর্ণিত আছে। পুরাণ ও রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় এই সময়। ব্রাহ্মণগণ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কৌশলে এগুলি লিপিবদ্ধ করার সময় প্রচুর অলৌকিক ও অপ্রাকৃত  ঘটনার সংযোজন বাল্মীকি ও বেদব্যাসের নামে চালিয়ে দেন। উদাহরণ স্বরূপ, বেদব্যাসের মহাভারতে শ্লোক সংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজার, গুপ্তযুগে লিপিবদ্ধ মহাভারতে শ্লোক সংখ্যা একলক্ষ। 

পণ্ডিতদের মতে এই গুপ্তযুগেই পুরাণগুলিও লিপিবদ্ধ করার সময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সঙ্কীর্ণমনা   ব্রাহ্মণরাই ভারতের সমস্ত প্রাচীন শাস্ত্রের যথেচ্ছ বিকৃতি সাধন করেন। 

বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য এই যে, অত্যন্ত কুরুচিকর ভাবে চিরশত্রু বৃহস্পতির চরিত্র হনন করে একটি দীর্ঘজীবী শব্দ বন্ধও প্রচলিত করেন।তাচ্ছিল্যতার কারনে এইজন্য হীনবুদ্ধির কোন ব্যক্তিকে 'বুদ্ধির বৃহস্পতি' নামে আখ্যায়িত করা হয়। 

 

২য় পর্ব:

 উত্তর ও দক্ষিণভারতের বেদাশ্রিত আচার সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি কিছুটা আলাদা ছিল বলে মনে করা হয়। ধনে মানে বনিক সম্প্রদায়ও ছিল তৎকালীন ব্রাহ্মণদের প্রায় সমান। ওদন্তপুরীরাজের সাথে বারংবার যুদ্ধে বিদ্ধস্ত বল্লাল সেন বনিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রচুর অর্থসাহায্য দাবি করেন। বনিক সম্প্রদায় অস্বীকার করায়, শাসন ব্যবস্থায় অসহযোগিতার কারনে বহু বনিককে কৌলীণ্য হারাতে হয়। এমনকি ওই বনিক শ্রেণীকে শিক্ষা দীক্ষা ও সান্নিধ্য দেওয়ার কারনে, বহু ব্রাহ্মণকেও ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে অধঃপতিত হতে হয়। সুবর্ণবনিকদের পৈতেধারণ নিষিদ্ধ হলো। বনিক শ্রেণী প্রতিশোধ স্পৃহায়, অর্থের দৌলতে নিম্নদাস ও ভৃত্যশ্রেণীকে হাত করতে আরম্ভ করে। বল্লাল অনোন্যপায় হয়ে কৈবর্ত্য, মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকার ইত্যাদিদের সৎ শূদ্রের পর্যায়ে উন্নিত  করেন এবং উচ্চবর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখে অবশিষ্ট ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণত্ব ঘুচে গেল। তাঁরা ব্রাহ্মণ সমাজে পতিত হলেন। 

কোন কোন পণ্ডিত মহলের মতে, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সঙ্গে জড়িত আদিশুরই নাকি প্রথম বাংলায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন। তার আগে ব্রাহ্মণ ও ছিলনা, বেদ চর্চাও ছিল না। 

 

৩য় পর্ব:

 বাঙালী সমাজে পদবীর ইতিহাস চর্চায় যে আবহ তৈরী হয়েছে, কৌলীন্য প্রথার কুয়াশা অপসারণের জন্য সে রকম আগ্রহ মোটেই ছিল না। বাঙালী কুলীন ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের কুলগৌরব কাহিনী ছত্রিশ জাতের বঙ্গভূমীতে আজও অপ্রতিহত। একসময় ব্রাহ্মণদের কুলভঙ্গের অপরাধে অনেককেই সমাজে পতিত হতে হতো। কুলীনদের কুলই ছিল সর্বস্ব। সেই কুলগৌরবে এক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ একাধিক বিবাহ করে কুলীন কন্যা পিতার কুল রক্ষা করতেন। 

    বঙ্গভূমীর অধিকাংশ জনপদই গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, বাঙালী সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থার ছকে বাঁধা পড়ে। 

পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিস্তার লাভ করে। কৌশলে স্থানীয় অব্রাহ্মণদের কাছ থেকে  জমি নিয়ে মন্দির নির্মান করে দেব দেবীর পূজা শুরু করে, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র রচনাকে আশ্রয় করে 

ব্রাহ্মণ্য সমাজের সংরক্ষণী মনোভাব বাংলায় আত্মপ্রকাশ করে। ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থার শীর্ষস্থানে যে ব্রাহ্মণরাই থাকবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারন সমাজ রক্ষকরাই সমাজের ভক্ষক হন। নানা গোত্র প্রবর ও বিভিন্ন বৈদিক শাখার ব্রাহ্মণরা যে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম শতক থেকেই উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসেছেন,  একথা বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন। 

 

 ৪র্থ পর্ব:

 কুলশাস্ত্র কাহিনীর কেন্দ্রে আছেন আদিশুর। আদিশুর সম্ভবত কোলাঞ্চ-কনৌজ বা কাশী থেকে পঞ্চব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন। এই সঙ্গে কৌলীন্য  প্রথার ইতিহাসও জড়িত। কৌলীন্য প্রথার বিবর্তনের সাথে বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের নাম ও জড়িত। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সাথে জড়িত আদিশুরের পৌত্র ক্ষিতিশুর ও তৎপুত্র ধরাশুরের নামও। বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলকাহিনীর বর্মনরাজ শ্যামল বর্মন ও হরি বর্মনের নাম জড়িত। কুলজী গ্রন্থমালার ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে যদিও পণ্ডিতগণ দ্বিধাবিভক্ত। এই ভ্রান্ত ধারণা অদ্ভূত এক প্রভাব বিস্তার করে আছে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, তাহল আদিশুরই নাকি প্রথম বাংলায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন। আদিশুর কাহিনী এবং কৌলীন্য প্রথার সাথে ব্রাহ্মণদের গাঞী বিভাগও জড়িত। গাঞীর উদ্ভব গ্রাম থেকে; যে গ্রামে যে ব্রাহ্মণ বাস করতেন, সেই গ্রামের সাথে উপাধ্যায় বা আচার্য্য যুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পদবীগুলো সৃস্টি। যেমন, গঙ্গ, বন্দ, ভট্ট, চট্ট, মুখো ইত্যাদি। 

 

৫ম পর্ব:

 অধুণা বাংলায় যে ছত্রিশ জাতের ছোঁয়া পেলে বর্ণহিন্দু বিধবা বা ছুঁৎমার্গী বর্ণগর্বিত মানুষ নিজেকে অশুচী জ্ঞান করেন, সেই ছত্রিশ জাতের মধ্যে কারা পড়েন? এদেশে বৈজ্ঞানিক উপায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে এই সমাজে রক্তে অস্থি মজ্জায় মিশে আছে ছত্রিশ জাত। সে সব অত্যাশ্চর্য্য তত্ত্ব, তথ্য প্রকাশ পেলে, বর্ণহিন্দুদের জাত্যাভিমানে যথেষ্ট আঘাত লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত 'বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে ব্রাহ্মণ বর্ণ ছাড়া ছত্রিশটি জাতকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে।  

 ১) উত্তম সঙ্কর বিভাগ। 

২) মধ্যম সঙ্কর বিভাগ। 

৩) অধম সঙ্কর বিভাগ। 

 ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কিন্তু এই তিন বিভাগ ছাড়াও চতুর্থ বিভাগে আরও পাঁচটি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

 ব্যবসায়িক কাজের কারনে প্রথম বিভাগটি জলচল ছিল, দ্বিতীয় বিভাগটি সম্ভবত জলাচল ছিল।এখন সহজেই অনুমেয় যে, স্বর্ণ বণিক ও তৈলকার মধ্যম সঙ্কর, গন্ধ বণিক উত্তম সঙ্কর। ব্যবসার কর্মগত বর্ণবিভাগের ফলে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যে বিভিন্ন জনের বর্ণ মিশে থাকাই স্বাভাবিক। এই কারনে পুরাণ বা স্মৃতিশাস্ত্রে বারংবার বর্ণসঙ্কর ও জাতিসঙ্করের কথা উচ্চারিত হয়েছে। ব্রাহ্মণকে এই সঙ্কর জাতি হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারন এই সব পুরান ও স্মৃতিশাস্ত্র গুলো প্রায়শই তাদেরই রচনা। নরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মনরা যে পরিমান সঙ্কর বিভাগে, 

 

,অধিকাংশ বর্ণই প্রায় সম বৈশিষ্ট্যের সঙ্কর। 

 তৎকালীন সমাজপতিগণ উচ্চ সঙ্কর জাতি ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন। বিত্তশালী না হয়েও এই উচ্চবর্ণ বিত্তশালীদের অনুগ্রহ লাভ করেছেন।ফল স্বরূপ তাঁদের অন্যায় অপরাধ গুলোচাপা পড়ে গেছে জাতগর্বের কারনে। 

 

মনুর মতে যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণের সবর্ণা স্ত্রী অধিকারী হতে পারবেন।সবর্ণা স্ত্রী না থাকলে ক্ষত্রিয়জাত স্ত্রী সে অধিকার পেতে পারতেন। কিন্তু বৈশ্য বা শূদ্রজাত স্ত্রী সে অধিকার পেতেন না। এমনকি ব্রাহ্মণ ও শূদ্রজাত স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে তা অনৈতিক হিসেবে গন্য হতোনা। স্বল্প প্রায়শ্চিত্য করে সে দোষ খণ্ডন করা যায়। সে কালে কামলোলুপ জমিদাররাও ব্রাহ্মণদের সাথে একজোট হয়ে স্পর্শ্ব দোষের বিধান দিতেন। 

 

  ৬ষ্ঠ পর্ব:

 একই রক্ত, একই গড়ন, তবে কেন ওরা ব্রাহ্মণ? 

গবেষণা লব্ধ বহু তত্ত্ব, তথ্যের একত্রীকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, বাঙালি উচ্চ নীচ জাতের মধ্যে শরীরের রঙ,কেশ, চক্ষু,ও গড়নে এমনকি রক্তেও কোন পার্থক্য নেই। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, কুল গরিমা উচ্চবর্ণের আত্মরতির সম্মোহন ছাড়া কিছু নয়। নরতত্ত্বের দিক থেকে চারি বর্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। জাত বিভাজনের আর্থিক ও সামাজিক ধর্ম কর্মের অধিকারই এমন প্রভেদ সৃস্টি করার কারন। 

 

ভবদেব ভট্টের রচনা থেকে জানা যায়, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রমানে ব্রাহ্মণ শ্রেণী কিভাবে প্রকৌশলে চতুরতার সহিত খাদ্যাখাদ্যে ও আচার বিচারে কিরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। নট, নর্ত্তক, ধোপা, কর্মকার, কাপালিক, কৈবর্ত্ত, ভীল, চণ্ডাল, শুঁড়ি, স্বর্ণকার ইত্যাদি এমনকি নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবি ব্রাহ্মণদের রন্ধনকৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো।শূদ্রের পাককৃত ও স্পর্শ্বকৃত খাদ্য গ্রহণে ব্রাহ্মণদের পূর্ণ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান ছিল। ক্ষত্রিয়ের দ্বারা পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে অর্দ্ধ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলত। বৈশ্বদের পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে তিন চতুর্থাংশ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করেও ব্রাহ্মণদের দোষ মুক্তি ঘটত। অপর দিকে শূদ্রদের পাককৃত ও স্পর্শ্বিত খাদ্য যদি ক্ষত্রিয় গ্রহণ করে, তাহলে তাদের পূর্ণ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। কিন্তু বৈশ্বদের পাককৃত বা স্পর্শ্বিত খাদ্য গ্রহণে অর্দ্ধ কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলত। অন্যদিকে শূদ্রের দ্বারা পাক করা সুস্বাদু খাদ্য বিপদকালে ব্রাহ্মনদের গ্রহনে বাধা ছিল না। সে ক্ষেত্রে শুধু দুঃখ প্রকাশ করলেই দোষ খণ্ডন হয়ে যেত। 

 

ব্রাহ্মনদের এইসব চাতুর্য্যে ভরা নির্দেশাবলীতে প্রমান হয়, কোথাও লঘু পাপে গুরুদণ্ড, আবার কোথাও বা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের বিধান ছিল। এসব দেখে আজও সমাজ জাত বিচারে ছোট বড় খোঁজে। সম যোগ্যতা বিশিষ্ট তফশিলি জাতি বা উপজাতির পুত্র বা কণ্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রবল ভাবে নাসিকা কুঞ্চন চলে। 

  

৭ম পর্ব:

বর্ণাশ্রম প্রথা: 

 আনুমানিক চার হাজার বছর আগে, ভোল্গাতট, মতান্তরে জার্মানি বা পোল্যাণ্ডের দিক থেকে আর্যরা তৎকালীন ভারতে এসেছিল। তবে শিকার বা খাদ্যসঙ্কটে পড়ে যে আগমন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্থানীয় অনার্যদের সাথে শুরু হয় লড়াই। পরাজিত অনার্যরা নিহত হন কেউবা অন্যত্র পালিয়ে বাঁচেন। নারীরা লুন্ঠিত হন।  

 

অনার্য নারীদের সাথে অত্যাধিক মিলনের ফলে পরবর্তী কালে জাতিগত বিশুদ্ধতা হারানোর ভয়ে আর্য নেতৃত্ব কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেন। ভারতীয় সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথার সূচনা। অতিরিক্ত সম্পদ ও সুখ ভোগের জন্য অনার্যদের দিয়ে যুদ্ধ, পাহারাদার, কৃষিকাজ, পশুপালন নির্মান, আবর্জনা পরিস্কার ইত্যাদি দৈহিক শ্রমের কাজ করানো হতো। কালক্রমে ভারতীয় জনসমাজ  আর্য-অনার্য-মোঙ্গোল-দ্রাবিড়-শক-হুন-যবন-পাঠান-ও অন্যান্য জন গোষ্ঠীর বর্ণ সঙ্কর এক উন্নত জনজাতিতে পরিনত হয়। সম্পদের ভোগ দখল একদিকে যেমন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হানাহানির কারন, তেমনই শ্রেণী বিভাজন ও রীতিনীতি কঠোর করে ব্রাহ্মণ কুলের জন্ম হয়।সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য প্রয়োজন পড়ে সুলভ শ্রমের, জোরদার করা হয় দাস ও বর্ণব্যবস্থাকে। নারীর স্থান হয় অন্তপুরে,রাজা আর ব্রাহ্মণদের অঙ্কে। ব্রাহ্মণ্যবাদকে চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা করতে আনুমানিক তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত হয় শ্রুতি সঙ্কলন বেদ। বিশ্বভাবনার সঙ্কলন ঋকবেদ, ঋকমন্ত্র গীত আকারে সামবেদ। যজ্ঞের মন্ত্র সঙ্কলিত যজুর্বেদ, চিকিৎসা শাস্ত্র শত্রুদমন এবং সৃস্টি রহস্যের মন্ত্র সঙ্কলিত অথর্ববেদ। 

 

দখলকৃত ভূভাগ সম্পদ ও শ্রম সেবাকে কায়েম রাখতে রাজতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের উদ্ভব। সমস্ত সম্পদের অধিকারী হলেন রাজা। নীতি রক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী, যারা ক্ষত্রিয়। রাজার পরের ক্ষমতাধারীরা হলেন এই ব্রাহ্মণ শ্রেণী। কৃষিজীবী, ব্যবসায়ীরা হলেন বৈশ্য। আর অনার্য ও পরাজিত শত্রুরা হলেন শূদ্র। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের রমণে  অনার্য নারীর গর্ভে সৃস্টি বর্ণসঙ্করের। 

 

  বৈদিক যুগের শেষ পর্বে আসে মহাকাব্যের যুগ, অর্থাৎ রামায়ণ, মহাভারতের যুগ। রাজতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র গভীরভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। বেদান্তের অন্যতম ধারা দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ। বৈদিক ভাববাদকে আশ্রয় করে পুনর্জন্মবাদের জন্ম দেন শঙ্করাচার্য্য। অন্যদিকে বাস্তববাদী কপিল ও সযুগ্যা রৈক্যা, সৃস্টি হয় সর্বাপেক্ষা অবৈদিক, জনপ্রিয় বস্তুবাদী ধারা চার্বাকের লোকায়ত সংহিতা। অন্য দুটি সম সাময়িক ধারা হলো জৈনীয় ও বৌদ্ধ ধর্ম। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল বাস্তববাদী এবং বেদ ব্রাহ্মণ ও ঈশ্বর বিরোধী ভারতীয় দর্শন তন্ত্রের ধারা যা বহু সাধকের সম্মিলিত চিন্তার ফসল। প্রমাদ গুনলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, রাশ আলগা হওয়ার ভয়ে চার্বাকীয় লোকায়ত ধারাকে অবদমিত করার চেষ্টা চালান হলো। জাতিভেদ বর্ণবৈষম্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিধান সাধারণ মানুষের মনে প্রচণ্ড অসন্তোষ ও নৈরাশ্যের জন্ম দিয়েছিল।  চলল বেদ বিরোধী বস্তুবাদী চর্চা। বৈচিত্র এল লোকায়ত দর্শনে। পুরোনো কাশ্যপ, অজিত কেশকম্বলি, পাকুধা কাত্যায়ণ, সঞ্জয় বেলাতিপুত্ত, মাখালি গোশালা, নিগন্থ নাথপুত্ত প্রমুখদের ভাবনায় ও সক্রিয়তায়। 

  

৮ম পর্ব:

   মনুষ্যকুলে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, আর দেবকুলে দেবরাজ ইন্দ্র, এদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যখনই মুনি ঋষিরা তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে মহর্ষি বা ব্রহ্মর্ষি হওয়ার চেষ্টা করেছেন,নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে পিতামহ ব্রহ্মার উপদেশে উর্বশীদের পাঠিয়ে তপস্যা বা যজ্ঞ ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালানে হয়েছে। রামায়ণে দেখতে পাই শূদ্র শম্বুক দেবলোক জয়ের অভিপ্রায়ে দেবত্ব লাভের জন্য তপস্যার কারনে রামচন্দ্র কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন। 

 

   এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজ নির্দেশিত ন্যায় নীতি ও শিষ্টাচার কি দেখতে পাই? রামের বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতম আচরণ। এটা কি প্রাচীনতম বর্বর সংঘাত নয়? বর্ণ প্রাধাণ্য নিরঙ্কুশ করার ঘৃণ্যতম প্রচেষ্টা নয় কি? অব্রাহ্মণ সংস্কৃতিকে নির্মূল করার কৌশল নয় কি? এ বিষয়ে পুরাণ ও মহাকাব্য গুলোতে ছড়িয়ে আছে ভুরি ভুরি উদাহরণ। জাতপাতের ব্যাধিতে আক্রান্ত ভারতীয় সমাজে গরু ছাগলের মত হরিজন নিধন চলেছে। হাতের কাজ ও কায়িক শ্রমকে চিরদিন হেয় করা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্বভাব ও লক্ষণ। 

 

   নীতি ও ধর্মানুশাসনের ব্যপারে ব্রাহ্মণদের এত হেল দোল ছিল না। কিন্তু নীচু শ্রেণীর মানুষরা অমান্য করলে অপরাধ বলে গন্য হত। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের এক উৎকট আত্মম্ভরিতা ছিল। উপবীতকে অস্ত্র করে জীবনে প্রতিষ্ঠা এবং অন্ধ সংস্কারের অচলায়তনে বাস করার প্রবনতা ছিল প্রকট। ধর্ম সম্পর্কে নানারকম পরষ্পর বিরোধী শাস্ত্র বাক্যের মধ্যে ধর্মের উৎপত্তির বিষয় জানা যায়। আচার থেকে ধর্মের উৎপত্তি। আচার সর্বস্ব ধর্মের থেকে সৃষ্টি হয় নানা বাছবিচার স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বিধি নিষেধ। ধর্মের হাত ধরে এল আচার সর্বস্ব কুসংস্কার। 

 

পূর্ব ভারত ছিল দার্শনিকদের জন্মক্ষেত্র। এই এলাকার মানুষ চিরদিন যুক্তি, বুদ্ধিকে হৃদয় ও আবেগের উপর স্থান দিয়েছে। আসলে বাঙালি চিরদিন যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির উপাসক। বাসুদেব, গদাধর, জগদীশ প্রভৃতি যুক্তির উপাসকরা তার মধ্যে অন্যতম। 

             

৯ম পর্ব:

ভারতীয় সমাজে শাস্ত্রীয় বিধানই মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রক্তের মধ্যে জাগিয়েছে ঘৃণার মারাত্মক জীবানু, যা আজ এ সমাজে প্রাণঘাতী ব্যাধির ন্যায় আতঙ্কের। লড়াইটা তাই মানুষের সপক্ষে অমানবিকতার বিরুদ্ধে। অথচ পুরাকালে এ দেশেই নাকি তেমন সমাজ ছিল যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল না। জীবন ধারনের জন্য অন্নের অধিকার সমান ভাবে স্বীকৃত ছিল। ভাগবতেই আছে তার প্রমান। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী অন্নলাভ দেহী মাত্রেই অধিকার। তার বেশী আত্মসাৎ করা দণ্ডনীয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় সাধারণ মানুষের অধিকার সম্বন্ধে যে দেশের ধর্মগ্রন্থে এমন উদার মত প্রকাশ ঘটেছে,  সেক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় বিধানগুলো মানুষ সম্বন্ধে অমানবিক কেন? সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সাধারণ মানুষের সুযোগ সুবিধা গুলোকে কৌশলে অপ্রকাশিত রেখেছেন। কারন সাধারণ মানুষ যদি ব্রাহ্মণের সমান রসদের ভাগীদার হন, তাহলে কুলগর্ব নির্মূল হয়ে যাবে, নীচকুল ব্রাহ্মণদের আজ্ঞাবহ থাকবেন।বিভূতিভূষণের 'অশনি সংকেত', প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'সাগর সঙ্গম' রবি ঠাকুরের 'অনধিকার প্রবেশ' এসব তথ্যের জলন্ত উদাহরণ। বেদেই বোধ হয় সর্বপ্রথম, সমাজে অস্পৃশ্যতার, ভেদাভেদের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতাতে আছে  গুন ও কর্ম অনুসারে বর্ণভেদের কথা। অথর্ব বেদে কর্মে বা বৃত্তিতে কোন উচ্চ নীচ ভেদাভেদ ছিলনা। শক্তিশালী দাসদের অনার্য হিসেবে দেখা হতো। মনুস্মৃতিতে দাস প্রথার উল্লেখ আছে।সমস্ত শূদ্র ছিল ব্রাহ্মণদের দাস। এদের  আবার বেশ কয়েকটা ভাগ ছিল, যেমন বংশ পরম্পরায় দাস, উপঢৌকনে প্রাপ্ত দাস, দাসীর গর্ভজাত দাস, অন্নের জন্য স্বেচ্ছায় বরণ করা দাস, যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের থেকে প্রাপ্ত দাস ইত্যাদি। যারা আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করতোনা তাদেরকে দস্যু নামে অভিহিত করা হতো। 

 

যজ্ঞস্থলে শূদ্রদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কোন ঘৃণ্য কাজকে শূদ্রচিত কাজ বলে বর্ননা করা হতো। কোন কোন যজ্ঞে শূদ্র ও সারমেয়দের দিকে তাকানো একই অপরাধ বলে গন্য করা হতো। শূদ্রের বেদপাঠের অনুমতি ছিলনা, এমনকি শূদ্রের বাড়ীতে ব্রাহ্মণদের বেদপাঠও নিষিদ্ধ ছিল। শূদ্র যদি কোন ব্রাহ্মণকে আঘাত করতো, তাহলে তার সেই অঙ্গ কেটে দেওয়া হতো। কিন্তু অনুরূপে ব্রাহ্মণের একই কাজে কোন শাস্তির বিধান ছিল না। 

           

 ১০ম পর্ব:

    মনু সংহিতায় পুরুষকে বীজ এবং নারীকে ক্ষেত্র হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণেরা সব বর্ণের নারীর সাথে যথেচ্ছ ভাবে সহবাস করে পুত্র উৎপাদন করতে পারবে। সব বর্ণের নারীর গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত পুত্রেরা সমান অধিকার পেতেন না। ব্রাহ্মণ পুরুষের সব বর্ণের নারীর কাম চরিতার্থ করার অধিকার থাকলেও, শূদ্রের সে অধিকার ছিলনা। শূদ্রেরা সম জাতীয় ব্যতীত অন্য কোন নারীতে সম্ভোগ  করার বিধান ছিলনা। শূদ্রের ঔরসজাত সমস্ত পু্ত্রের সামনাধিকার ছিল। 

 

   পুত্র উৎপাদনকে যতই ধর্মীয় রূপ দেওয়া হোক না কেন, বহুবর্ণা নারীতে যৌন সম্ভোগ ও যৌন অপরাধ কে শাস্ত্র সম্মত করাও ব্রাহ্মণদের অসংযমী যৌন জীবনের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। 

     নারী যাতে ব্যভিচারিনী না হয়, তার জন্য নানা বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ আছে মনুসংহিতায়। কিন্তু ব্যভিচারী পুরুষ সম্মন্ধে কোন নির্দেশ নেই। কোন প্রেম  ভালোবাসার বালাই নেই,  আছে শুধু ক্ষেত্রস্বরূপা নারীতে কাম চরিতার্থ করার বাসনা। নারী শুুধু মাত্র পুরুষের কাম চরিতার্থ করা আর পুত্র উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ (পুত্রী বা কন্যার উল্লেখ দেখা যায়না)। নারীর নিজের কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া নেই। 

    পুরুষের প্রয়োজনে যৌন ব্যভিচারকে ধরে রাখার জন্য প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে গণিকাবৃত্তিকে। এই বৃত্তি সেই প্রচীন কাল থেকেই অনুমোদিত।অথচ সেই পতিতাদের সমাজের বাহিরে ঠেলে পাঁচিল তোলা হয়েছে কার স্বার্থে? এটা অবশ্যই সমাজপতিদের শ্রেণীস্বার্থ সুরক্ষিত রাখার কৌশলি প্রচেষ্টা। 

 

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী 'পতিব্রতা' হলো একপতি। পতি ভিন্ন দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্তি থাকলে 'কুলটা', তিন পুরুষের প্রতি আসক্ত হলে 'বৃষলী'। চার পর পুরুষের প্রতি আসক্তা হলে 'বেশ্যা', সাত পর পুরুষের প্রতি আসক্তা হলে 'যুঙ্গী'। তার বেশি পুরুষের প্রতি আসক্তি থাকলে 'মহাবেশ্যা'। 

 পক্ষান্তরে পুরুষের ক্ষেত্রে তেমন কোন নিদান নেই। পুরুষ শত নারীতে আসক্ত হলেও সৎ(যদি সতীর পুংলিঙ্গ সৎ হয়)। 

    মহাভারতে গণিকার অন্নগ্রহণ, গণিকা সংসর্গকে পাপ বলা হয়েছে। এমনকি যমের দক্ষিণ দুয়ারের দিকে বা নগরের দক্ষিণ প্রান্তে গণিকালয় নির্মানের নিদান আছে।

অনুগল্প:

 সরস্বতী পূজা

লি খে ছে ন – জা মা ল  আ ন সা রী

স্কুলে সরস্বতী পূজা। মহা সমরোহের সাথে প্রতি বছর পূজা উদযাপন হয়। এই বছরও হচ্ছে। সেই উপলক্ষে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে  উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করার মতো বিষয়। সকাল আটটা বাজতে না বাজতে স্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড় জমে উঠেছে। ছাত্র ছাত্রীরা একে একে সরস্বতী পূজার অঞ্জলির দিয়ে, নিজ নিজ কাঙ্ক্ষিত আশীর্বাদ দেবীর নিকট প্রার্থনা জানিয়ে বেরিয়ে আসছে।

আকাশ স্কুলে গেছে ঠিকই কিন্তু অঞ্জলি দেয়নি। বাড়ি ফেরার পথে ওর বন্ধু ধর্মদাস জিজ্ঞেস করে, “কি রে আকাশ, তুই মা সরস্বতী কে অঞ্জলি দিলি না কেন?”


আকাশের বাবা নাস্তিক। ধর্ম কর্মে মন নেই। সেই মন ও মানসিকতা আকাশের মধ্যেও ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়েছে। আকাশ তার বন্ধুকে প্রশ্নের জবাবে জানাই,  “না,আমি অঞ্জলি দিইনি। তুই-ই বল দেখি,অঞ্জলি দেব কেন ?”

ধর্মদাসের এ কথা শুনে একটু রাগ হল। তবুও সাধারণ ভাবেই বলে, শুন, পূজার সময় অঞ্জলি না দিলে বিদ্যার দেবী সরস্বতী রুষ্ট হবেন। আর দেবী রুষ্ট হলে আমাদের লেখাপড়া ভালো হবে না। আমাদের যাতে পড়াশুনায় মনযোগ বাড়ে, আমরা যাতে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই...সেই জন্যই তো অঞ্জলি দিতে হয়। 


―ও আচ্ছা, এই জন্য অঞ্জলি দিস। শুন ধর্মদাস, আজ তোকে কিছু অপ্রিয় সত্য কথা জানিয়ে দিই। এই সত্য কথা আমি বাবার মোটা মোটা বই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে জেনেছি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি জীবনে কোনও দিন অঞ্জলি দিয়েছিল! বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা কি কোনও দিন অঞ্জলি দিয়েছিল! না। জীবনে কোনও দিন অঞ্জলি দেয়নি। তবুও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা, বুদ্ধি অর্জন করে বিদ্যাসাগর হতে পেরেছিল। মেঘনাদ সাহা  অঞ্জলি না দিয়েও ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিল। শুন, অঞ্জলি, তঞ্জলি কিছুই নয়। চাই পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছা তবেই তুই পরীক্ষায় ভালো ভাবে উত্তীর্ণ হতে পারবি। যদি তুই পড়াশোনা না করিস, তাহলে কি ঐ অঞ্জলি দিয়েই পরীক্ষায় পাস হতে পারবি ?

ধর্মদাস তার বন্ধু প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। চুপচাপ বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে।.

কেন বার বার ওঠে ঝড় -সৌমিত্র চৌধুরী
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ঝড় যেন থামছেই না। ক্রমাগত ধেয়ে আসছে একটার পর একটা। 

জন্ম ইসতক দেখছি ঝড় ঝঞ্জা তুফান। ভিন্ন নামে জানান দেয় বিধ্বংসী উপস্থিতি। টাইফুন হারিকেন সাইক্লোন। ফনী বুলবুল আইলা আম্ফান। বহু নাম ঝড়ের। দেশ ভেদে সাগর ভেদে ভিন্ন নাম।

আটলান্টিক, ক্যারিবিয়ান সাগর, মধ্য ও উত্তরপূর্ব মহাসাগরে ঝড় হ্যারিকেন। প্রশান্ত মহাসাগরে টাইফুন। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগরের ঝড়ের নাম সাইক্লোন। যে-নামই হ’ক, তার দাপটে গ্রাম শহর বন্দর নগর তছনছ। গবাদি পশু বন্য জন্তুর মৃত্যু। হাজারে লাখে মারা পড়ে মানুষ। 

‘লাখ’ শব্দটি অতিরঞ্জিত হল কি? বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা ১৯৯০ সালের ঝড়ের কথা মনে করুন। গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫০ মাইল। জলোচ্ছ্বাস ২০ ফুট উঁচু। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু।

‘ভোলা’ নামের সাইক্লোনের কথা ভাবলেই শিউড়ে উঠতে হয়। বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) আছড়ে পড়া ঝড় কেড়ে নিয়েছিল চার-পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ। বেসরকারি মতে দশ লক্ষ।  

১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বেগে আঘাত হেনেছিল ফণী (৯০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়)। ঘূর্ণিঝড়টি খড়গপুরে আছড়ে পড়ে তাকে ধ্বংস করে দিয়ে হুগলির আরামবাগ হয়ে চলে যায় বাংলাদেশে। 

পরের বছর (২০২০) বিধ্বংসী আইলা ঝড়ে ভারত বাংলাদেশর বড় অংশ বিধ্বস্ত। পরের বছর ভয়ানক আম্ফান। বছর না পেরোতেই ক’দিন আগে (২০২১) ঘটে গেল আরেকটি অতি ভয়ঙ্কর ঝড়,  ইয়শ।   

ঝড়ের পর ঝড়। শুধু ভারত-বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বঙ্গোপসাগরেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু তটে বিভিন্ন সময় আছড়ে পড়েছিল হারিকেন। ফ্লোরেন্স, হার্ভে। হাওয়াই দ্বীপের ঝড় ‘লেন’। ফিজিতে সাইক্লোন ‘জোসি’।

ঝড়ের সালতামামী নয়। মানুষ জানতে চাইছেন কেন ঘন ঘন এত ঝড়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠে জলের বর্ধিত তাপমাত্রা  ডেকে আনছে বিধ্বংসী ঝড়। সাগরে জলতলের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রির (সেলসিয়াস) বেশি হলে সেখানে নিম্নচাপ তৈরি হয়। কারণটি সহজ বোধ্য।  


তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠতে থাকে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর একটি বায়ুশূন্য অঞ্চল তৈরি হয়। শূন্যস্থান পূরণ করতে তখন পার্শ্ববর্তী এলাকার শীতল এবং ভারী বাতাস উড়ে আসে। দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা বাতাস জন্ম দেয় ঘূর্ণিঝড়ের। এক কথায় নিম্নচাপ থেকে তৈরি হওয়া ঝড়ই হলো ঘূর্ণিঝড়। গতিবগের উপর নির্ভর করে ঝড়ের চরিত্র। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম ইত্যাদি। 

ঝড়ের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব? শত্রু পক্ষের ধেয়ে আসা মারণ মিশাইল আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু সাগরের বুকে জন্ম নেওয়া নিম্নচাপ আর সৃষ্ট ঝড়? প্রতিহত করবার অস্ত্র আধুনিক বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে মজুত নেই। 

ঝড় ঠেকিয়ে রাখবার একমাত্র উপায়, পৃথিবী গ্রহের উষ্ণতা কমিয়ে আনা। উষ্ণতা বৃদ্ধি হেতু পৃথিবীর জলবায়ু ভীষণই বদলে গেছে। সংশোধন করে নেওয়া অর্থাৎ গ্রহের উষ্ণতা কমিয়ে আনা এখন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই কাজটাই করতে হবে। নইলে ফল মারাত্মক। সম্পূর্ণ গ্রহটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্রমাগত ধেয়ে আসা ঝড় ঝঞ্জা তুফান তারই অশুভ ইঙ্গিত বহন করে আনছে।

বিপদ মালুম হয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র তাই গেল গেল রব। মানুষের মুখে কেবল পরিবেশ দূষণের ফিরিস্তি। জল, বায়ু, মাটি, বিষাক্ত। সাথে আরেকটি বিপদ। পৃথিবী গ্রহের উষ্ণায়ন। আমাদের বাসযোগ্য ধরিত্রীর বুকে মানুষ উদ্ভিদ জলজ প্রাণী, সবার অস্তিত্বই বিপন্ন। সব মিলিয়ে পৃথিবী গ্রহ খুবই বড় অসুখে আক্রান্ত। মুল কারণ, গ্রহের উষ্ণায়ন। 


‘উষ্ণায়ন’ নামেরর এত বড় বিপদ সৃষ্টি করল কে? নিঃসন্দেহে মানুষ নামের প্রজাতি। সুখ সমৃদ্ধি ভোগ্যপন্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় যথেচ্ছ আবর্জনা ছড়িয়েছে। ফলস্বরূপ পৃথিবী গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই।  

কেমন করে? তাপ শক্তি নির্গত করে। আরাম আয়েশ আর ভোগ্য বস্তু উৎপাদন করতে দরকার শক্তি। শক্তি তৈরি করতে প্রয়োজন জ্বালানি। যেমন কয়লার দহনে উৎপন্ন তাপ শক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা পাই বিদ্যুৎ শক্তি (Thermal power)। বিদ্যুৎ শক্তি বিনা জীবন অচল। রাস্তায় বিজলি বাতি, বাড়িতে ফ্রিজ, ঘর ঠাণ্ডা রাখবার এয়ার কন্ডিশন মেশিন। আধুনিকতা আর প্রগ্রতির পথে চলতে জ্বালানির দহন অপরিহার্য। 

শুরু হয়ছিল শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে (1760-1820)। মানব সভ্যতার অতি দ্রুত জয়যাত্রা।  কলকারখানায় চলল লোহা ও অন্য ধাতু গলানো। রেল, জাহাজ, গাড়ি তৈরি হতে লাগলো। এগুলি  অগ্রগতির মানদণ্ড। সভ্যতার খিদে মেটাতে প্রয়োজন হল বিপুল শক্তি। 

শক্তি বা এনার্জি এল কোথা থেকে? কাঠ, জ্বালানি তেল, কয়লা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ফুয়েল দহন করে। যত বেশী পুড়তে লাগল প্রাকৃতিক জ্বালানি, ততই বৃদ্ধি পেল বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড আর চারপাশের উষ্ণতা। 

বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিণাম কি মানুষ আগে বুঝতে পারেনি? ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনে ডুবে থাকা মানুষ, প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারেনি। কিন্তু বুঝেছিলেন বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়। দেড়শ বছর আগেই। সাবধানও করেছিলেন মানুষকে। 

‘বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, অতএব সাবধান’ এমন বানী শুনিয়েছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল (1820-1893)। আরেক জন নোবেল প্রাপ্ত (১৯০৩) সুইডিশ বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (1859-1927) সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘বাতাসে অধিক পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বড় বিপদ ডেকে আনবে’। 

কেন এমন বললেন? কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস কাজে লাগায় গাছ। বৃক্ষকুল গ্যাসটি গ্রহন করে নিজের খাদ্য বানায় (Photosynthesis), আর বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। কার্বন ডাইঅক্সাইড অপসারি বৃক্ষ সম্পদ নির্বিচারে কোতল হয়েছে বিশ্বজুড়ে। অরণ্য ধ্বংস করে শহর নগরের পত্তন হয়েছে। ফলত, প্রকৃতির বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য বেড়েছে। এতটাই যে বায়ু মণ্ডলে এর উপস্থিতি বিপদ সীমা অতিক্রম করে ধ্বংসের দামামা বাজাচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছে সংবেদনশীল মানুষজন। 

ছোট্ট একটা গ্যাসের কারসাজিতে কেন গোটা নীল গ্রহটাই বিপর্যস্ত? কারণ, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসটি নিজ গুনে এটি তাপ শোষণ করে রাখে। কেমন করে? শতাব্দী প্রাচীন বৈজ্ঞানিক খুঁজে পেয়েছিলেন উত্তর। একশ আঠান্ন বছর আগে প্রমাণ লব্ধ তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন পদার্থবিদ জন টিন্ডাল। 

একটা কার্বন এবং দু’টো অক্সিজেন, তিনটে মাত্র পরমানু দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাইঅক্সাইড। গ্যাসটি তার অশেষ ক্ষমতা বলে শুষে নেয় সূর্য থেকে বিকিরিত অবলোহিত (infrared light) আলো। সূর্যের আলোয় থাকে সাত রং। রঙের বর্ণালীতে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘের আলোটি লাল বর্ণের। বায়ু মণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং তাঁর চাইতে বেশী তরঙ্গদৈর্ঘ। ফল সহজেই অনুমেয়। বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না-গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে (গ্রিন হাউস গ্যাস)। অবশ্য কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও গ্রিন হাউস গ্যাস পরিবারে অন্য সদস্যও আছে। জলীয় বাস্প, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড,ওজন। তবে ভূপৃষ্ঠে উত্তাপ ফিরিয়ে আনবার সবচাইতে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন যৌগ কার্বন ডাইঅক্সাইড (ও জলীয় বাস্প)। 

বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনিয়েছিলেন আরহেনিয়াস। বাতাস দু’ভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হবার সময় (selective diffusion)। দ্বিতীয়ত তাপ শোষণের (absorption) মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদান গুলোয় (দ্বিপারমানিক নাইট্রোজেন অক্সিজেন) তাপের প্রভাবে কম্পন (vibration) ঘটে। দুই পরমানুর মধ্যেকার কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমান তাপ শোষণ করতে পারে তারা। কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প শোষণ প্রক্রিয়ার (absorption) মাধ্যমে তাপ গ্রহণ করে। এদের (CO2, H2O) পরমাণু গুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত (Infrared) অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অনু তাপ মোচন (Emission) করলে  আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে (vibrate)। এই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ তাপের শোষণ–মোচন-শোষণ (Absorption-emission-absorption), কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলীয় বাস্প পৃথিবী তলে তাপ ধরে রাখে। 

টিন্ডালেরর আবিষ্কারের ছত্রিশ বছর পর বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উষ্ণতা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করলেন। কী তার গবেষণা লব্ধ তথ্য? কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস কারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে জ্বালানি দহনের ফলে। নির্গত গ্যাস সঞ্চিত হচ্ছে বায়ু মণ্ডলে। ফলে গ্রহের উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। নিখুঁত ভাবে আরহেনিয়াস বললেন, ‘কার্বন ডাইঅক্সাইডের এখন (১৮৯৬) যা পরিমাণ, ভবিষ্যতে সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে আশঙ্কাজনক মাত্রায়, ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস’। এখনকার গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যও প্রায় তেমন। 

উষ্ণতা বৃদ্ধি আশঙ্কা জনক। তবুও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নস্যাৎ করে দেশ বিদেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিক, ব্যবসায়ী মহল বিশ্ব-উষ্ণায়ন তত্ত্ব মানতে নারাজ। একাধিক ভ্রান্ত ধারনা প্রচার করে ক্রমাগত উষ্ণায়ন বিরোধী বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। কারণ পৃথিবীর ক্রম উষ্ণায়ণ প্রক্রিয়া প্রতিহত করলে হ্রাস পাবে ভোগ্য পন্যের উৎপাদন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসায়িক স্বার্থ।

আমরাও উষ্ণায়ন নয়, ঝড়ের ধ্বংস লিলার পর শুধু মাত্র গৃহহারা মানুষদের ত্রান বণ্টন, নদী সমুদ্রের বাঁধ নির্মাণ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। বঙ্গোপসাগরে উদ্ভুত ঘন ঘন ঘূর্ণি ঝড় নিয়ন্ত্রনের উপায় ভাবি না। কেন বারবার ঝড় ওঠে জেনেও আমরা নির্বিকার। 

ক’দিন আগেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে ধেয়ে এল ‘টাউকটে’, মহা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। প্রবল বেগে (১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার) ধেয়ে এসে গুজরাত মহারাষ্ট্রে বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল। ‘টাউকটে’র উৎপত্তি স্থল আরব সাগর। সেই ঝড়ের রেশ মিটতে না মিটতেই, বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে এল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ‘ইয়াস’। আরবি শব্দ ভাণ্ডারে যার অর্থ হতাশা। ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা চলতে পারে ‘আমফান’ ঝড়ের। বিধ্বংসী আমফানে বহু মানুষ এক বছর পরেও গৃহ হারা।

ভারতবর্ষ দেশটি ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞদের (কোপেনহেগেনের ক্লাইমেট ক্লাসিফিকেশন্স) অভিমত, দেশটি জলবায়ু বহু বৈচিত্র্যে ভরপুর। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সহ অনেকগুলো ঋতু এখানে। ‘জলবায়ু’ অনেক গুলো বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। বায়ুমণ্ডল, জলভাগ, জমে থাকা বরফ, ভূত্বক, প্রাণী, উদ্ভিদ। এছাড়াও অন্য বহু বিষয়ের সাথে (ভৌগলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতির) জড়িয়ে আছে এর সম্পর্ক। 

কর্কটক্রান্তি রেখা ভারতকে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় দুই ভাবে বিভক্ত করেছে। দেশটিতে ক্রান্তীয় বর্ষা ও উপক্রান্তীয় পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রবল প্রতাপ। দেশের কোন অঞ্চলে যখন খরা, অন্য অঞ্চলে বন্যা। কোথাও তাপপ্রবাহ, অন্য কোথাও আবার শৈত্য প্রবাহ। 

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আয়লা, সিডার, আমফানের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন দেশবাসী। ঝড়-ঝঞ্ঝার তীব্রতা আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্কটক্রান্তি রেখার উত্তরে গড় তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি হয় মে মাসে। ফলে শুকনো ও গরম হাওয়া পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ যত কম, তার উত্তাপ তত বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ভারতে সামগ্রিকভাবেই গ্রীষ্মের উষ্ণতা ও বর্ষার গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে ক্রমাগত ঝড়-ঝঞ্ঝা ঘটেই চলেছে দেশে। অন্য কোথায়, বিশ্ব উষ্ণায়নের মারাত্মক প্রভাব দেখা যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। 

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব প্রথমে দেখা যায় সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে। সুন্দরবন সহ উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, হাওড়ায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবন অঞ্চল। ঘনীভূত নিম্নচাপ সৃষ্টি করে ঘূর্ণিঝড়। তার প্রবল হওয়ায় ফুঁসে ওঠে সমুদ্র। শুরু হয় জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাসে নদী সাগরের বাঁধ ভেঙে জল ঢোকে লোকালয়ে। চাষের জমিতে। ভেসে যায় ধান, পান, ঘর, জীবন। 


সমুদ্র লাগোয়া নদী গুলোর জলস্তর বৃদ্ধি প্রতি বছরই ঘটছে। গত পঁচিশ বছরে (১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত) সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়েছে ২.৯৬ ইঞ্চি বা ৭.৫ সেন্টিমিটার। একুশ শতকের মধ্যে ৬০ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে (ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর প্রতিবেদন)। তখনকার সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন সহ বহু শহর দ্বীপ সম্পূর্ণই ডুবে যাবে। 

অনেক সুন্দরবন-গবেষক মনে করেন, মাটির বাঁধ নয়। সুন্দরবন বাঁচাতে দড়কার কংক্রিটের শক্ত চওড়া বাঁধ। মাটির বাঁধ হলে ভিত করতে হবে ৮০ থেকে ১০০ ফুট আর উপরের অংশ খুবই চওড়া (১৪ থেকে ২২ ফুট)। সঙ্গে দরকার কড়া নজরদারি। 

সমুদ্রবাঁধ ও বাদাবনের উপর নির্ভর করে সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলের অস্তিত্ব। সমুদ্রের জলে জোয়ার-ভাটা, জলতল বৃদ্ধি, ঢেউয়ের উচ্চতা ইত্যাদি বাড়তেই থাকবে। ঘটতে থাকবে বাৎসরিক ঘূর্ণিঝড় ও প্লাবন। সমুদ্র তটে আছড়ে পড়বে উঁচু ঢেউ। বাঁধ টপকে সাগর জল প্রবেশ করলে বের হতে পারবে না। সব মিলিয়ে বিষয়টি বড়ই উদ্বেগের। বিপন্ন হয়ে উঠবে মানুষের জীবন জীবিকা,  গ্রাম শহরের অস্তিত্ব।  

সব মিলিয়ে বড়ই বিপন্ন মানুষ। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিশ্ব উষ্ণায়নকে রোখার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা; দীর্ঘমেয়েদি পরিকল্পনা। দিন যত এগোবে, ততই ঘন ঘন ঘটতে থাকবে বিপর্যয়। বিশ্বকে পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তুলতে হলে উষ্ণায়ন কমাতেই হবে। বিশ্বব্যাপী কিছু কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। তবে কোন রকম আশার কথা এখনও শোনা যাচ্ছে না। 

প্রতিবেদনে সংকট উত্তরনের পথ দেখানোও বাঞ্ছনীয়। তাই বলতে হয়, গাছ লাগান। বিদ্যুৎ জল অপচয় করবেন না। পেট্রোল গাড়ির পরিবর্তে ব্যাটারি চালিত যান ব্যবহার করুন। 

সাবধান না হলে আগামী একশ বছরে পৃথিবী গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য।

পরিচিতিঃ ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট ও বিজ্ঞানী (প্রাক্তন), চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা, ৫ম তল; ৩৬ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি রোড, কলকাতা-২৬। 

E-mail: soumitrag10@gmail.com. 

প্যারিডোলিয়া (Pareidolia) -অশোক কুমার সাও
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:876 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মেঘের মধ্যে গনেশ বা শিব কিংবা ক্রুশবিদ্ধ যিশু ইত্যাদির আদল অথবা ফল, সব্জি কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বস্তুর মধ্যে ধর্মীয় প্রতীক চিহ্ন, যেমন আরবি হরফে লেখা আল্লাহ (الله) দেখিয়ে সেগুলোকে অলৌকিকতার নিদর্শন হিসেবে দাবি করা পোষ্ট ফেসবুকে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। অথচ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে যে কেউ বুঝতে পারবেন এর সঙ্গে অলৌকিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি নিজেও কখনো না কখনো মেঘের মধ্যে বা নোনা ধরা দেওয়ালে মানুষের মুখ বা কোনো পশু পাখির আদল দেখে চমৎকৃত হয়েছেন।

 

এই পোষ্টের ফটোগুলোতে গাছের কাণ্ডের মধ্যে গনেশ, মেঘের মধ্যে গণেশ, শিবলিঙ্গ ও ক্রুশবিদ্ধ যিশুর আদল দেখানো হয়েছে। অন্য একটি ফটোতে কাটা পেয়ারার বীজের বিন্যাসে আরবি হরফে লেখা "আল্লাহ" (الله) দেখা যাচ্ছে। এগুলো নিতান্তই সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা। এই ধরণের সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে থেকে অর্থপূর্ণ কোনো ইঙ্গিত খুঁজে নেওয়ার এই প্রবণতার নামই হল প্যারিডোলিয়া (Pareidolia)।

 

Pareidolia শব্দটি তৈরি হয়েছে para (পরিবর্তিত) এবং eidolon (আকৃতি) এই দুই গ্রীক শব্দ নিয়ে। এই বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে সাধারণ প্রভাব হচ্ছে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত নকশার মধ্যে মানুষের মুখাবয়ব খুঁজে পাওয়া।

 

এই প্যারিডোলিয়া মানুষের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার  সহায়ক একটি বৈশিষ্ট্য যা বিবর্তনের ধারায় মানুষ অর্জন করেছে। এই বৈশিষ্ট্যের ফলে জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে অপর মানুষের মুখাবয়ব চিনে নেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। একটি মানব শিশু জন্মের দুই দিনের মধ্যেই মানুষের বিভিন্ন মুখভঙ্গি চিনতে ও সেগুলো অনুসরণ করতে শিখে যায়।এর ফলে সে কোনো মানুষের মুখের ভাব ও ভঙ্গী দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারে। এই বুঝতে পারার ক্ষমতা সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বসবাস করবার জন্য একটি জরুরি বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানুষের মুখের আকৃতির সঙ্গে মিল আছে এমন কোনো বস্তু মস্তিষ্কের কর্টেক্স অঞ্চলে দ্রুত উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে। এই কারণেই একটি বৃত্ত, দু’টি বিন্দু ও একটি আনুভূমিক দাগকে মানুষের মুখ হিসেবে কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না।

 

পরবর্তী কালে জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে নানা ধরনের আকৃতি সেই আকৃতি প্রসঙ্গে কিছু ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে। এই আকৃতিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু যেমন আছে তেমনি আছে নানা ধরণের অক্ষর, সংখ্যা ইত্যাদির প্রতীক চিহ্ন। যে ব্যক্তি যে ধরনের চিন্তা বেশি করে, সে সেই ধরনের প্যারিডোলিয়া বেশি দেখে। যে পশুপাখি ভালোবাসে, সে মেঘের মধ্যে হাতি দেখে। যে ধার্মিক, সে গাছের কাণ্ডের বা মূলের বিচিত্র আকৃতিতে গনেশের মূর্তি দেখে।

 

আরবী বর্ণগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এবং আরবী ক্যালিগ্রাফী অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় বলে একই বর্ণ বিভিন্ন আকৃতিতে লেখা যায়। প্যারিডেলিয়ার কারনে কয়েকটি লাইন এবং লুপকে অনেক কিছু ভেবে নেওয়া সম্ভব। এই কারণেই ধার্মিক মানুষ অনেক সময় মেঘের মধ্যে বা কাটা পেয়ারার বীজের বিন্যাসে "আল্লাহ" (الله)  লেখা দেখতে পায়। একই কারণে দেবনাগরী "ওঁ"  লেখা দেখতে পাওয়াও প্যারিডেলিয়ার উদাহরণ।

উল্কার সাতকাহন -অনির্বাণ মন্ডল
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:900 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা হয়তো অনেকেই ‘তারা খসা’ (shooting star) কথাটার সাথে পরিচিত। এই বিষয়টি সত্যিই কি আমি আজ এই লেখার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করবো। ‘তারা খসা’ (shooting star) বিষয়টির সাথে কোন তারা বা নক্ষত্রের আসলে কোন সম্পর্ক নেই। যখন মহাকাশ থেকে আগত কোন কঠিন বস্তুপিন্ড আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে তখন তাকে বলা হয় ‘মেটেওরয়েড (Meteoroid)’। এবার এই তীব্র গতিসম্পন্ন বস্তুপিন্ড বা ‘মেটেওরয়েড (Meteoroid)’ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে বায়ুমন্ডলের সাথে প্রবল ঘর্ষণে তাপ উৎপন্ন করে এবং জ্বলতে শুরু করে। আমাদের আকাশে বা বলা উচিৎ বায়ুন্ডলে এই যে তীব্র জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড/আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায় একে ‘মেটেওর (Meteor)’ অথবা অনেক সময় ‘ফায়ারবল’ও বলা হয়ে থাকে। যদি কোন ‘মেটেওর (Meteor)’-এর কিছু অংশ পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের দিকে তার এই অগ্নিময় যাত্রাপথে ভাগ্যবশত বেঁচে থাকে তখন সেই ভাগ্যবান পিন্ডটিকে বলা হয় ‘মেটেওরাইট (Meteorite)’ বা উল্কাপিন্ড। অর্থাৎ এই তারাখসা বিষয়টি উল্কাপতন ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

যদিও এই উল্কাপতন একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা (Random Event)। কিন্তু উল্কাপতনের যখন কোন ঘটনা দেখতে বা শুনতে পাওয়া যায় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোন উল্কাপিন্ড খুঁজে পাওয়া যায় তখন তাকে ‘Falls’ উল্কাপিন্ড নামে আখ্যায়িত করা হয়। আর আমাদের অগোচরে থাকা কোন উল্কাপিন্ডকে যখন খুঁজে পাওয়া যায় মরুভূমির বুকে বা কোন হিমবাহের জমাট বাঁধা বরফের মধ্যে তখন তাকে ‘Finds’ উল্কাপিন্ড নামে আখ্যায়িত করা হয়।

 

যাই হোক এতো বলা হল উল্কাপতনের ঘটনা। কিন্তু এই উল্কা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এতো উৎসাহিত কেন?

 মানবভ্যতার ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত যে নভোযানগুলো মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে তাদের মধ্যে একমাত্র চাঁদ ব্যতীত অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে সেভাবে কোন নমুনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়নি। নাসার ছয়টি অ্যাপোলো মিশনে প্রায় ৩৮০ কিলোগ্রাম শিলা ও ধূলিকণা চাঁদ থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এছাড়াও, সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন ‘লুনা’ মিশন, চীনের ‘চাঙ্গে’ মিশনেও চাঁদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। চাঁদ ব্যতীত ‘স্টারডাস্ট’ মিশনে ৮১পি/ওয়াইল্ড নামক ধূমকেতু, জাপানের ‘হায়াবুসা’ মিশনে ‘ইটোকাওয়া’ গ্রহাণু, ‘হায়াবুসা-২’ মিশনে ‘রিয়্যুগু’ গ্রহাণু থেকে মিলিগ্রাম পরিমাণ ধূলিকণার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

 

সুতরাং, নমুনার অভাব বিজ্ঞানীদের আগ্রহ শতগুণ বাড়িয়ে দেয় উল্কার প্রতি। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মেই উল্কা এসে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন গ্রহাণু, গ্রহ, উপগ্রহ থেকে।

 

উল্কা কোথা থেকে আসে?

 এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে যেসকল উল্কাপিন্ড পাওয়া গেছে তারা মূলত মঙ্গলগ্রহ, চাঁদ ও বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে নির্গত হয়েছে। এখানে পাঠকের প্রতি দুটি প্রশ্ন রাখছি। (১) আমরা কীভাবে জানতে পারি যে, কোন উল্কা মঙ্গল থেকে বা চাঁদ থেকে বা গ্রহাণু থেকে এসেছে? (২) শুক্র বা বুধজাত গ্রহাণু পাওয়া কি সম্ভব পৃথিবীর বুকে? আলোচনা হোক কমেন্টে।

 

উল্কার শ্রেণীবিন্যাস:-

উল্কার শ্রেণীবিন্যাস বিশদে উল্লিখিত। 

উল্কাকে সাধারণত দুটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। (১) Undifferentiated ও (২) differentiated। Undifferentiated হল সেইসকল উল্কা যাদের কোনপ্রকার রাসায়নিক পরিবর্তন হয়নি,সৌরমন্ডলের জন্মকাল থেকেই একই উপাদান নিয়ে এরা বিরাজমান। এদের মূল উপাদান হল ‘কনড্রাইট (Chondrite)’। এরা মূলত পাথুরে প্রকৃতির হয়। আর differentiated হল বাকী সকল উল্কা যাদের রাসায়নিক পরিবর্তন হয়েছে। এরা পাথুরে  ও ধাতব বা লৌহজাত উভয় প্রকৃতির বা উভয়ের মিশ্রণ হতে পারে।

 

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ভারতে যেসকল উল্কাপিন্ড পতিত হয়েছে বা খুঁজে পাওয়া গেছে  সেগুলোকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হাতে। জিএসআই-এর কোলকাতা পার্কস্ট্রীট সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টার অফিসে উল্কার একটি গ্যালারি রয়েছে।

অজানা জ্বর না ডেঙ্গু? চেনার ও পরিত্রাণের উপায় কি? -পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 25, 2024 | সচেতনতা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ডাক্তারি পরিভাষায় 'Pyrexia (fever) of Unknown Origin' অর্থাৎ 'অজানা জ্বর'-এর সংজ্ঞা হিসাবে Petersdorf and Beeson বলেছেন -

"A temperature greater than 38.3°C (101°F) on several occasions, accompanied by more than three weeks of illness, failure to reach a diagnosis after one week of inpatient investigation."

তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে জ্বর, সমস্ত পরীক্ষা করেও যার কারণ জানা যায় না, তাকেই বলে 'অজানা জ্বর'।

ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞাও ভারত সরকারের ইন্টিগ্রেডেড ডিজিজ সারভেইল্যান্স প্রোগ্রামে বলা আছে:-

"২ থেকে ৭ দিনের জ্বর, তার সঙ্গে নীচের যে কোনো দু'টি লক্ষণ-

মাথাব্যথা

পিছনে ব্যথা

পেশীতে ব্যথা

গাঁটে গাঁটে ব্যথা

রাশ

রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা কম"

এছাড়াও বলা আছে, যে এলাকায় যে সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানে সেইসময় যে কোনো জ্বরের কেস যদি রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া নেগেটিভ হয়, তাহলে তাকে ডেঙ্গু বলেই ধরতে হবে (epidemiologically linked Dengue)। সুতরাং ডেঙ্গুর সঙ্গে অজানা জ্বর গুলিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই।


ডেঙ্গু কনফার্মেশনের জন্য মূলতঃ যে পরীক্ষাগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এবং ভারত তথা পঃ বঙ্গ সরকার দ্বারা স্বীকৃত, সেগুলি হ'ল -

জ্বর শুরুর পাঁচদিনের মধ্যে ELISA পদ্ধতিতে রক্তে NS1 অ্যান্টিজেনের অস্তিত্ব দেখা।

জ্বর শুরুর পাঁচদিন পরে ডেঙ্গু-স্পেসিফিক ইমিউনোগ্লোবিন M বা IgM -এর অস্তিত্ব দেখা।

পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR) পরীক্ষা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলছে -

"There is no specific treatment for dengue fever. Severe dengue is a potentially lethal complication but early clinical diagnosis and careful clinical management by experienced physicians and nurses often save lives."

অর্থাৎ, ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসকের পূর্ণ অধিকার আছে রোগীর মৃত্যু হ'লে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস লেখার। বিশেষতঃ যেখানে ল্যাবরেটরি অপ্রতুল, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা করতে হয়।

ডেঙ্গুর এখন মোট পাঁচটি সেরোটাইপ। পঞ্চমটি মালয়েশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ ক'বছর হ'ল, ভারতে এখনো অব্দি রিপোর্টেড নয় এই স্ট্রেইন। তবে তার বাহক এডিস নিভিয়াস কিন্তু এদেশে রয়েছে।


ডেঙ্গুর ইতিহাস

ডেঙ্গুর মশা, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম এডিস ইজিপ্টি, সাধারণত দিনে কামড়ায়। সুতরাং, শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলাতেও আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে মশা না কামড়াতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী মশারা সাধারণত রাতে কামড়ায়। এই মশারা যখন ওড়ে, তখন পোঁ পোঁ করে আওয়াজ হয়। ডেঙ্গুর মশাদের ক্ষেত্রে এরকম আওয়াজ হয় না ঠিকই, কিন্তু এদের চেনার উপায় হচ্ছে গায়ে ডোরাকাটা দাগ।


ডেঙ্গু শব্দটি সোয়াহিলি ভাষা ডিঙ্গা থেকে এসেছে। যার অর্থ সাবধানতা। ডেঙ্গু আক্রান্তরা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য খুব ধীরে হাঁটাচলা করেন, মনে হয় যেন সাবধানে চলছেন। সেই থেকে এই ডিঙ্গার ব্যবহার। এই অসুখের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক চিনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াতে ২৬৫-৪২০ খ্রীষ্টাব্দে ডেঙ্গুর মতো এক অসুখের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম সুনিশ্চিত ডেঙ্গুর কথা পাওয়া যায় ১৭৮৯ সালে, যার ব্যাখ্যা করেন বেঞ্জামিন রাস। তিনি হাড়ভাঙ্গা রোগ বলে অসুখটির বিবরণ দেন। সুতরাং, ডেঙ্গু বহুদিন ধরেই মানুষকে আক্রান্ত করছে।


ডেঙ্গুর প্রকারভেদ -

ডেঙ্গুর কারণ হল ডেঙ্গু ভাইরাস। যার বাহক হল এডিস ইজিপ্টি মশকী। যার কামড়ে মানুষের রক্তে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গু হয়। এটি একপ্রকারের ফ্লাভি ভাইরাস।

ডেঙ্গু চার প্রকারের হয়।

ডেঙ্গু-১, ডেঙ্গু-২,ডেঙ্গু৩, ডেঙ্গু-৪।

ডেঙ্গু-২ অন্য তিন ভাইয়ের থেকে একটু বেশিই আক্রমণাত্মক। রক্তে এদের সংখ্যা বা যাকে বলে ভাইরাল লোড, খুব বেশি থাকে। তার ফলে,এই ডেঙ্গুর দরুণ অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বা জটিলতা বেশি হয়। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে ডেঙ্গু-২ এর এপিডেমিক হয়েছিল।


ডেঙ্গুর লক্ষ্মণ -

আগেই উল্লেখ করেছি ডেঙ্গু হলে জ্বর, গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, পেট ব্যাথা ও চোখের ভেতরে ব্যাথা হতে পারে। গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যেতে পারে। যে সমস্ত মহিলাদের জ্বরের সময় মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ডের সময় হয়ে আসে, তাদের রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। ডেঙ্গুতে শ্বেতরক্তকণিকা ও অনুচক্রিকা (platelet) কমতে শুরু করে। অনুচক্রিকা কমতে কমতে যদি বিপদ সীমার নিচে চলে যায়, বা অনুচক্রিকা কমার হার যদি অনেকটা হয়, তাহলে চিকিৎসকেরা অনুচক্রিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাকে বলে platelet transfusion। বাজারে পেঁপে পাতার রসের খুব প্রচলন হয়েছে অনুচক্রিকা বাড়ানোর জন্য। কিছু ওষুধের কোম্পানি ট্যাবলেটের আকারে বাজারে বের করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, এর প্রয়োগে অনুচক্রিকা বাড়ে, তা নিশ্চিতভাবে এখনো প্রমাণিত নয়। 


এর জন্য আরও ক্লিনিক্যাল স্টাডির প্রয়োজন আছে।

এই অনুচক্রিকা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন নাক, দাঁতের মাড়ি, পাকস্থলী ইত্যাদি। শরীরে চামড়ার তলায় ছোপ ছোপ লালচে দাগ দেখা যেতে পারে। যার অর্থ চামড়ার তলায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বলে। এই রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের সঞ্চালন সঠিক পরিমাণে হয় না। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে ‘ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ বলে। এছাড়াও ডেঙ্গুর জন্য পেটে বা ফুসফুসে জল জমতে পারে। যাকে ডেঙ্গু ক্যাপিলারি লিক সিনড্রোম বলা হয়। এর থেকেও শক সিনড্রোম হতে পারে। এছাড়াও, ডেঙ্গির জন্য মানুষের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম বা অনাক্রম্যতন্ত্র বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। এই ভয়ঙ্কর জটিলতার নাম ম্যাক্রোফাজ অ্যাক্টিভেশন সিনড্রোম।


কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?

ডেঙ্গুর NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পজিটিভ এলে।সেইসাথে যদি আপনার পেট ব্যথা হয়, বা খুব বমি হয়, পেটে বা ফুসফুসে জল জমে, অথবা রক্তক্ষরণ হয়।আর অণুচক্রিকার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে।


ডেঙ্গুর পরীক্ষা

ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পড়তে পারে। সুনিশ্চিত পরীক্ষার জন্য ডেঙ্গু সেরোলজি পজিটিভ আসে জ্বর শুরুর ৬ দিনের পর থেকে।



কী করে বুঝবেন কারো ডেঙ্গু হয়েছে?

কমপক্ষে ৫ দিন ধুম জর থাকবে৷ 

ওষুধ খেলেও কিছু ক্ষণের জন্য জ্বর কমলেও তা বারে বারে ফিরে আসবে৷

মাথা ও চোখের পিছনদিক-সহ গোটা শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতা অনুভব করবেন৷

চামড়ায় র‍্যাশ হতে পারে৷ 

বমি, ডায়েরি, সর্দি কাশি হলে বেশিদিন ফেলে রাখবেন না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন৷

হেমারেজিক ডেঙ্গুতে অনেক সময় মাড়ি ও নাক থেকে রক্তপাত হয় ৷ 

প্রস্রাব ও মলের সঙ্গেও রক্তপাতের সম্ভাবনা৷

হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে৷


ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে, কি কি করবেন?

যেকোনো ভাবেই আপনার এলাকাই মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করুন।

আবর্জনা পরিষ্কার করুন ৷পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।

জল যাতে না জমে সেদিকে বিশষ নজর রাখুন৷

মশা মারা তেল বা স্প্রে ব্যবহার করুন ৷

খোলা ড্রেন পরিষ্কারের ব্যবস্থা করুন ৷

জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ৷

মশারি ব্যবহার করুন।

অযথা আতঙ্কিত হবেন না।

জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা করুন ৷


ডেঙ্গু সংক্রমণে লিভারের বিভিন্ন এনজাইম বেড়ে যায়। এর ফলে লিভারের বিশ্রাম দরকার। কোনও ভাজা-মশলাদার খাবার, তৈলাক্ত খাবার, বাইরের খাবার অন্তত তিন মাস বর্জন করলে লিভার আবার স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে শুরু করে। খাওয়াদাওয়ায় এই নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাড়ি ফিরে ডেঙ্গু রোগী হজমজনিত কোনও সমস্যায় কষ্ট পাবেন না।

যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের ক্ষেত্রে গায়ে লালচে দাগ বেরোয় জ্বর কমার পরেই। আর তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে প্লেটলেট। এটাই রীতি। তাই জ্বর কমে গেল হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া কখনওই উচিত নয়।


এছাড়াও, যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জ্বরের সময়েই প্লেটলেট কমে যায়। যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের কিন্তু গায়ে লালচে দাগ বেরোয় এবং প্লেটলেট কমে জ্বরটা সেরে যাওয়ার পরেই। এটা সবার জানা উচিত।

ডেঙ্গুর সময়ে মেয়েদের কোমরের (পেলভিক অঞ্চলের) বিভিন্ন টিস্যু অতিরিক্ত ফুলে যায়। তাই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হলে তলপেটে ব্যথা হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। এর জন্য কোনও প্রতিষেধক নিতে হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আবার না-ও হতে পারে। কার হবে, আর কার হবে না, সেটা আগে থেকে বলা সম্ভবও নয়।

বিভ্রান্তি দূর করে কিছু ক্ষেত্রেও রোগ সেরে যাওয়ার পরে অন্তত মাস তিনেক সতর্ক ভাবে থাকতে হবে।


সচেতন থাকুন। সুস্থ থাকুন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখুন।


(আমি ডাক্তার নই। বিভিন্ন বইপত্র, পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ভুলত্রুটি থাকলে বিশেষজ্ঞগণ সংশোধন করে দেবেন।)

রাজনীতিক নজরুল -সংকেত হক
Nov. 25, 2024 | রাজনীতি | views:277 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৮৯৯ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে এখনকার পশ্চিম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়াতে জন্ম নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অনবদ্য সৃষ্টির জন্য গোটা বাঙালি জাতি তাঁকে সম্মান করে। মূলত কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি পরিচিত হলেও তাঁর প্রতিভা ছিলো বহুমুখী। তিনি কথক, নাট্যকারও। নজরুলের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে এই প্রবন্ধ লেখা হয় নি। একজন পুরোদস্তুর সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী বলতে যা বোঝায়, আমার কাছে নজরুল সেরম ব্যাক্তি। 

নজরুল যখন জন্মেছিলেন তখন আমাদের দেশটা ব্রিটিশের গোলাম। সমাজের প্রতিটি কোণে তাদের নির্মম শাসন দেখতে দেখতে তিনি বড় হচ্ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার আন্দোলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছিলো। সমাজ সচেতন নজরুলও এই আন্দোলনে শরীক হয়ে উঠলেন। আর এ-কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের কবিতা-গানকে। তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশের মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন – এক হয়ে একটা ফ্রন্ট গঠন করার জন্য, লুঠেরা ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য। একের পর এক লেখায় উস্কে দিতে চেয়েছেন বাঁধভাঙা ব্রিটিশ বিরোধী আবেগ। 

১৯২২ সালে শ্রাবণ মাসে তাঁর সম্পাদনায় কলেজ স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত হয় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। আশ্বিনের শেষে এই পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ কলমে তিনি লেখেন[১]: 

“ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ন দায়িত্ব,…শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজ্য বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততারি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না।…আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।” 

খোলাখুলি ব্রিটিশকে এমন চ্যালেঞ্জ সত্যি অবাক করার মত ছিলো। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা নিয়ে বলতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদ লিখেছেন[২]:

“…অতিমাত্রায় নিরুপদ্রবতা প্রচারের ফলে দেশ খানিকটা মিইয়ে গিয়েছিলো। এই মিয়ানো হতে নজরুল তার লেখার ভিতর দিয়ে দেশকে খানিকটা চাঙ্গা করে তুলতে চেয়েছিলো।….”            

ব্রিটিশরাও তাঁকে ছেড়ে কথা বলে নি। ১৯২২ সালে এই পত্রিকার ১২তম সংখ্যায় নজরুল একটি কবিতা লিখেছিলেন – ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। পরের বছর নভেম্বর মাসে এই কবিতা লেখার জন্য পুলিশ আজকের বাংলাদেশে কুমিল্লায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে। 


বছর শেষ হতেই আদালতের রায়ে পরাধীন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) আর ১৫৩(ক) ধারা অনুযায়ী তাঁর ১ বছরের সশ্রম জেল হয়। এ-সম্বন্ধে নজরুল নিজেই লিখেছেন[৩]: 

“সাহিত্যিক ও কবিদের মধ্যে আমি প্রথম জেলে যাই…” 


জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নজরুল গীতিকার-সুরকার হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁর অনেক গান ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াই-এর নতুন কর্মসূচী হয়ে ওঠে। ‘হায় পলাশী’ গানে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন: 

“হায় পলাশী!

এঁকে দিলি তুই জননীর বুকে কলঙ্ক-কালিমা রাশি,

পলাশী, হায় পলাশী।।

আত্মঘাতী স্বজাতি মাখিয়া রুধির কুম্কুম্,

তোরই প্রান্তরে ফুটে ঝরে গেল পলাশ কুসুম।…”

আবার অন্যদিকে ‘ভাঙার গান’-এ লিখলেন: 

“…মার হাঁক হৈদরী হাঁক,

কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক,

ডাক ওরে ডাক

মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!...”



বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী যুগে স্বদেশী গান লিখিয়েরাও তৎকালীন শাসক বিরোধী বিদ্বেষের সুরকে এত জোরের সঙ্গে ধরতেন না। এই আওয়াজটাকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে নজরুল ‘একা কুম্ভ’ ছিলেন। তাই, স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে আপোষহীন বিপ্লবীরা নি:সংকোচে তাঁর গানের আগুন ঝরা শব্দে অনুপ্রাণিত হলো। স্বভাবতই, ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁকে একেবারেই পাত্তা দেয় নি। তারপর যখন সবাই কানাকানি করতে লাগলো যে রেকর্ডে নজরুলের গান নেই কেন, তখন কোম্পানির টনক নড়েছিলো। তারা বুঝেছিলো নজরুলকে এড়িয়ে চললে তাদেরই ব্যবসা মার খাবে। তখন থেকে কোম্পানির রেকর্ডে তিনি আমন্ত্রিত হলেন। 

তখনকার দিনে কেউ স্বাধীনতা-সংগ্রামকে খোলাখুলি সমর্থন করলেই ইংরেজ প্রভুরা ভাবতো ব্যাটা নির্ঘাত রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। সেই হিসেবে নজরুল ছিলো শাসকের কাছে সম্পূর্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তি। 

পরাধীন দেশে মানুষের কাছে আরও তিনটে সংকট ছিলো – ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, নারী-পুরুষ বৈষম্য আর ধনী-গরিব বিরোধ। নজরুল বুঝেছিলেন দেশের ভালো করতে গেলে শুধু ইংরেজকে তাড়ালেই হবে না, সেই সঙ্গে এগুলোকেও কাটাতে হবে। তাই তাঁর লেখাতে পাওয়া যায় সাম্য, সত্য এবং ন্যায়-বিচারের প্রতি অবিচল দায়বদ্ধতা। 


‘সাম্যবাদী(মানুষ)’ কবিতায় লেখেন:  

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি!…”

এই কবিতায় ধর্মের বেড়াজাল ভেঙ্গে দেশের হিন্দু ও মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার আবেদন ছিলো। আবার, লিঙ্গ-সাম্য নিয়ে ‘সাম্যবাদী(নারী)’ কবিতায় লিখলেন: 

“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।...”

এত চাঁছা-ছোলা ভাষায় বাংলা সাহিত্যে এর আগে কেউ সাম্যের দাবী করেনি। অপরদিকে, তিনি প্রান্তিক মানুষের সামাজিক ন্যায় বিচারের অধিকারের দাবীকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। কুলি মজুরের কষ্ট দেখে লিখেছিলেন: 

“দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে!

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?...”

এ-সব পড়ে যদি মনে করা হয় নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিরোধীতার গণ্ডীতে আবদ্ধ ছিলো, তাহলে খুব ভুল হবে। কেননা শুধু বিদেশী শাসন নয়, সমাজে সবরকমের অন্যায়-অত্যাচারের বিরূদ্ধে নজরুল জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“…যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধবনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না –

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।…”

অর্থাৎ, এ বিদ্রোহ শুধু ইংরেজদের বিরূদ্ধে নয়, বিশ্বের প্রতিটা দেশে যে হাতে গোনা কয়েকজন বেশিরভাগ মানুষকে দাবিয়ে রেখেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরূদ্ধে ঝরে পড়ছে। বরাবর তাঁর অবস্থান প্রতিষ্ঠান বিরোধী। তার কবিতার লাইন যেন সব রকম সামাজিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির স্লোগান হয়ে উঠেছে। ২য় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে সোভিয়েত দেশ যখন লড়ছে, দুর্ভাগ্যবশত: তখন মানসিক ভাবে তিনি পঙ্গু। যদি সুস্থ থাকতেন নিশ্চয় গান-কবিতায় ভাসিয়ে দিতেন।     

নজরুলের ব্যাক্তি জীবনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে রূপোর চামচ মুখে দিয়ে তিনি জন্মাননি। কতরকম কষ্ট পেয়েছেন – বিদ্রুপ, অপবাদ, প্রিয়জনের মৃত্যু শোক, স্ত্রীর পক্ষাঘাত। এত কিছুর পরেও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখার সময় কখনও চুপ করে থাকেনি তাঁর কলম। টাকা-পয়সার অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে যায় নি। বরং, কষ্টগুলো জমাট বেঁধে তাঁকে আরও পোড় খাওয়া করে তুলেছে। লাভের আশায় বা লোভে পড়ে শাসকের কাছে কখনই তিনি বিকিয়ে যান নি। যাই-হোক না কেন তাঁর ‘চির উন্নত শির’। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি আসলে কি করতে চেয়েছেন তা বলেছেন:

“…রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,

তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,

…যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।…”

এ-সব থেকে মনে করা যেতেই পারে নজরুলই আমাদের ভাষায় প্রথম রাজনৈতিক কবি। গত শতকের চল্লিশের দশকে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দিনেশ দাস প্রভৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা সেই ধারার যোগ্য উত্তরাধিকারী। ওই দশকেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কর্মী হিসেবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখরা গানের জগতে একটা নতুন পর্যায় চালু করেন - ‘গণসঙ্গীত’। ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে বলা যেতে পারে এরও সলতে পাকানোটা শুরু হয়েছিলো নজরুলের লেখা স্বদেশী গানের মধ্য দিয়ে।     

আজকের ভারতবর্ষে আমরা দেখছি আবার সেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিপদ ফিরে এসেছে। একদিকে দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে অভাব-দেনা, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা করে রাখছে গুটি কয়েক পাষন্ড। সামাজিক ন্যায় তো প্রায় সোনার পাথর বাটি। দিকে দিকে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ, রোজ যেমন সূর্য ওঠে, বছরে ৬টা ঋতু আসে, তেমনভাবে এই সংকটগুলো সমাজ জীবনে নিয়মে পরিণত হচ্ছে। আর এই আক্রান্ত সময়ে দাঁড়িয়েও সমসাময়িক কৃষ্টিবান মানুষেরা অনেক বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে; কিন্তু ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার এতটুকু মুরোদ তাদের নেই। তারা কর্মজীবনে যশ চায়, কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। তাই শাসকের সাথে নির্লজ্জ ভাবে সালিশী করে ক্ষমতার বলয়ের ভিতরে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। উল্টোদিকে দেশের দুঃখী মানুষগুলোকে তারা একটা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাতেও পারে না।  

চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রবল শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা করতে যথেষ্ট সাহস লাগে। নজরুল প্রমান করে দিয়েছেন এ সাহস জোগাড় করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর জন্য একদিকে যেমন দরকার দাঁতে দাঁত চেপে থাকা জেদ, আরেকদিকে জনগণের অজেয় শক্তির ওপর বিশ্বাস। এইটেয় সাচ্চা রাজনৈতিক কর্মীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আশা করি, তাঁর অসাধারণ দৃষ্টান্ত আবার দাহ্য বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই পাঠ শুনে কোনো তরুণ অথবা তরুণীর ইচ্ছে হতেই পারে নজরুলের মত কলম পেষা রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার। 

তথ্যসূত্র:

[১] নজরুল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,১৯৮৩ 

[২] কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা – মুজফফর আহমেদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, অক্টোবর ১৯৬৯

[৩] ‘আমার সুন্দর’, দৈনিক নবযুগ, ১৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৯।   

নিবন্ধে দেওয়া ছবি গুলো আন্তর্জাল থেকে নেওয়া   

তালাক - তালাক - তালাক -অভিষেক দে
Nov. 25, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:5902 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দিনটি ছিল ২৩ আগষ্ট ২০১৭। অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরত, কাঁদছিলেন সায়রা বিবি, কাঁদছিলেন নার্গিস, তাবসসুম এর মতন অনেকেই। এই কান্না কোনো দুঃখের নয়, বরং আনন্দের। আজ প্রবল তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ঐতিহাসিক একটি রায়-এ "তিন তালাক" বাতিল করে ভারতের শীর্ষ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে- “তিন তালাক, অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং ইসলামের অংশ নয়”। 


প্রধান বিচারপতি জে এস কেহর (শিখ) এর নেতৃত্বে ছিলেন পাঁচজন ভিন্নধর্মমতের বিচারপতির বেঞ্চ। যথা, এস আব্দুল নাজির (মুসলিম), কুরিয়েন জোসেফ (খ্রিস্টান), ইউ ইউ ললিত (হিন্দু) এবং রোহিন্তন ফলি নরিম্যান (পার্সি)। উক্ত পাঁচজন ব্যক্তিরা, আজ তাৎক্ষণিক বা Instant তালাক অর্থাৎ মাথাগরম করে শুধুমাত্র তিনবার তালাক উচ্চারণ করেই যে তালাক দেওয়ার কু-প্রথা সেটাই বাতিলের পথে হেঁটেছেন। যদিও আজ তালাক-এ-বিদ্দত বাতিল হলেও চালু থাকছে, তালাক-এ-এহসান এবং তালাক-এ-সুন্নত।


৩:২ অনুপাতে তিন তালাক মামলার নিষ্পত্তি হল অর্থাৎ তিনজন বিচারপতি পক্ষে এবং ২ জন বিচারপতি বিপক্ষে ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট আরো জানিয়েছে, সরকারকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং সরকার যদি এই কাজে ব্যার্থও হয় তাহলেও তিনবার তালাক উচ্চারণ করে কেউই বিবাহবিচ্ছেদ গ্রাহ্য হবে না। 


তালাক শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন, ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। পরিভাষায় তালাক এর অর্থ "বিবাহের বাঁধন তুলিয়া ও খুলিয়া দেওয়া, বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলিয়া দেওয়া "স্বামী তার স্ত্রীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া।


২০০৮ সালের হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যেই তালাক প্রবণতা বেশি। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বর্তমানে নারী মুখবুজে সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেন না। প্রতিবাদ করেন। ইসলামে তালাকের পর একজন মহিলাকে ইদ্দত পালন করতে হয়। সেই (ইদ্দত কালীন) সময়ের মধ্যে একজন মুসলীম নারীর পুন:বিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ। একজন মুসলীম নারীর জন্য ইদ্দত দুই প্রকার বা ভাগে ভাগ করা সম্ভব। প্রথমত তালাকের পর, একজন মুসলীম নারীকে তার তালাকের পর ৯০ দিন বা তিন চন্দ্রমাস অপেক্ষা করতে হবে। এই ৯০ দিন হচ্ছে ইদ্দত কালীন সময়।


উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে,পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকারঃ- (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক, (খ) হাসান বা উত্তম তালাক এবং (গ) বিদ'ই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক। আবার, ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকারঃ- (১) তালাক-এ-সুন্নাত (২) তালাক-এ-বাদী (৩) তালাক-এ-তাফবীজ (৪) তালাক-এ-মোবারত এবং (৫) খোলা তালাক। অন্যদিকে কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকারঃ- (১) তালাক-এ-রেজী ও (২)তালাক-এ-বাইন। তালাক-এ- বাইন আবার দুই প্রকারঃ- (১)বাইনে সগির ও (২) বাইনে কবির। মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকারঃ- (১)হারাম (২)মাকরুহ (৩)মুস্তাহাব ও (৪)ওয়াজিব। 

২৮ ডিসেম্বর ২০১৮। অনেক আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাঝেই কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর সরকার দ্বারা আজ লোকসভায় পাশ হলো তিন তালাক বিল।  

তবে শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের বিল টাই আজ পাশ হয়েছে, তিন তালাক বন্ধের নয় কিন্তু। আমাদের মনে রাখতে হবে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও তিন তালাক এক নয়। তালাক-এ-বিদ্দত বন্ধের জন্য বিল পাশ করিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু বাকি তিন তালাক যেমন চলছে, তেমনই কি চলবে? প্রশ্নটা তুলেছেন বহু বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা। তাদেরেই অনেকে জানাচ্ছেন, "আজ লোকসভায় নরেন্দ্র মোদী সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল পাশ করানোয় অনেকেই এমন ভাবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে যেন তিন তালাক প্রথাটাই বন্ধ হয়ে ভারত থেকে চিরতরে।" 


এইপ্রসঙ্গে জানাই, সংবিধানে উল্লেখিত "ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র" ভারতে তিন তালাক চালু রয়েছে শুধু তাই নয়, তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও ভারতে লাগু আছে শরীয়া আইন- "The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act, 1937"। আইনিবিশেষজ্ঞ ওসমান মল্লিক জানাচ্ছেন, ভারতে এই শরীয়া আইন শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয় গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


অন্যদিকে কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিরা জানাচ্ছে- "তাৎক্ষণিক তিন তালাক ইসলামে তো এমনিতেই অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। তাছাড়া পৃথিবীর ২০টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র তাৎক্ষণিক তালাক বহুদিন পূর্বে থেকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। 


সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ

বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এর একটি রিপোর্টে লিখেছেন- 

"গত বছরের অগাস্টে এক ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ভার তারা ছেড়ে দিয়েছিল সরকারেরই ওপর। এরপর এই প্রথাকে শাস্তিযোগ্য করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার 'দ্য মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অব রাইটস ইন ম্যারেজ অ্যাক্ট' নামে একটি বিলও আনে, যা সাধারণভাবে 'তিন তালাক বিল' নামেই পরিচিতি পায়। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় সেটি বিরোধীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

অনেক বিরোধী দলের নেতাই যুক্তি দেন, ভাল করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য বিলটিকে একটি সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো উচিত। ওই বাধার মুখে বিলটি পাস করাতে না-পেরে সরকার এখন ঘুরপথে সেটিকে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইনে পরিণত করল। বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


ভারতের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এরপর বিরোধী কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন,"তাদের দলের সর্বোচ্চ নেত্রী একজন মহিলা (সোনিয়া গান্ধী), তা সত্ত্বেও নিছক ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জন্য তারা পার্লামেন্টে আইন করে এই বর্বর প্রথা বন্ধ করতে রাজি হলেন না, সেটাই আশ্চর্যের ও দু:খের।" তবে পার্লামেন্টে যে বিলটি আনা হয়েছিল, তার তুলনায় এদিন আনা অর্ডিন্যান্সে শাস্তির বিধান বেশ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মূল বিলটিতে ছিল তিন তালাক হয়েছে বলে অভিযোগ যে কেউ আনতে পারেন, এমন কী প্রতিবেশীরাও। অর্ডিন্যান্সে অবশ্য বলা হয়েছে কেবল মাত্র তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ও তার রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রাই অভিযোগ আনতে পারবেন।

এমন কী, তিন তালাক দেওয়া স্বামী যদি আপষ মীমাংসায় রাজি থাকেন, তাহলে স্ত্রী-র সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ারও সুযোগ থাকছে অর্ডিন্যান্সে।


অভিযুক্ত স্বামীর এর আগে জামিন পাওয়ারও কোনও সুযোগ ছিল না। কিন্তু অর্ডিন্যান্সটি বলছে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করতে পারবেন। কংগ্রেস এর আগে সরকারকে জানিয়েছিল, তারা পার্লামেন্টে বিলটিকে সমর্থন করতে রাজি - যদি কথা দেওয়া হয় যে তিন তালাক দেওয়ার অভিযোগে কোনও স্বামীর জেল হলে সে সময় তার স্ত্রীর আর্থিক ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারই নেবে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অবশ্য সে প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তবে বিলের সমর্থনে তারা বেশির ভাগ রাজ্য সরকারের সমর্থন পেয়েছে বলেই দাবি করছে।


আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এদিন আরও বলেছেন, শুধুমাত্র ভারতের মুসলিম নারীদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতেই সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তার কথায়, "এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই জেন্ডার জাস্টিস (সব লিঙ্গের জন্য ন্যায়) নিশ্চিত করার জন্য, এর সঙ্গে ধর্ম বা ভোটের রাজনীতির কোনও সম্পর্কই নেই।" খবরটির লিংক- https://www.bbc.com/bengali/news-45574788


৩০ জুলাই ২০১৯। ভারতের সংসদের উচ্চ কক্ষে তিন তালাক বিল পাশ হয়েছে। বিলটির নাম ‘মুসলিম মহিলা বিল-২০১৯ [The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Bills, 2019]। এই বিলটির দুটি বিষয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন- ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও মুসলিম স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি তালাক উচ্চারণ করলে, তা লিখিত বা যে ভাবেই হোক, সে তালাক বাতিল বা অবৈধ হবে (Sec. 3. Any pronouncement of talaq by a Muslim husband upon his wife, by words, either spoken or written or in electronic form or in any other manner whatsoever, shall be void and illegal.)। 


৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, যে কোনও মুসলিম স্বামী উপরের ৩নং ধারা অনুযায়ী তার স্ত্রীর প্রতি তিন তালাক উচ্চারণ করলে সেই স্বামীর তিন বৎসর জেল এবং জরিমানা হবে (Sec. 4. Any Muslim husband who pronounces talaq referred to in Sec. 3 upon his wife shall be punished with imprisonment for a term which may extend to three years and shall also be liable to fine)।


এবারে তুলে ধরছি BBC News, বাংলা'র ৩১ জুলাই ২০১৯ এর অনলাইন পত্রিকার খবর। লিংক- https://www.bbc.com/bengali/news-49174195


"তিন তালাক দিলে তিন বছরের কারাদণ্ড, ভারতে আইন পাস।"'তিন তালাক' প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে একটি আইন অনুমোদন করেছে ভারতের পার্লামেন্ট। মুসলমানদের 'তিন তালাক' প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে একটি আইন অনুমোদন করেছে ভারতের পার্লামেন্ট। এই আইন ভঙ্গ করলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। প্রথা অনুযায়ী, তিন বার তালাক উচ্চারণ করে, বার্তা পাঠিয়ে বা ইমেইল করে মুসলিম স্বামী তাদের স্ত্রীকে তালাক দিতে পারতেন।

ওই প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে ২০১৭ সালে রায় দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এই আইনের সমর্থকরা বলছেন, এর ফলে মুসলমান নারীরা আরো নিরাপদ হবেন। তবে বিরোধীদের দাবি, ফৌজদারি শাস্তির বিধানের কারণে হয়রানি এবং অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। আইনের এই প্রস্তাবটি ২০১৭ সালেই প্রথম উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের রাজ্যসভায় সেটি আটকে যায়, কারণ কোন কোন সংসদ সদস্য প্রস্তাবটিকে অন্যায্য বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টি বিলটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অবস্থান বিপক্ষে। তবে রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। মঙ্গলবার বেশ কয়েকজনের ওয়াক-আউট আর অনুপস্থিতিতে এই বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৯৯ আর বিপক্ষে ভোট পড়ে ৮৪।


এই ফলাফলকে 'লৈঙ্গিক সমতার' বিজয় বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে অনেকে অভিযোগ করছেন, এর মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি আসলে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করছে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন পার্টির এমপি আসাদুদ্দিন ওইসি বলেছেন, নতুন আইনটি মুসলিম সত্ত্বার ওপর বিজেপির আরেকটি আঘাত। দলটি ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে।


এর আগে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিন তালাক প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ভারতে এই প্রথার ব্যবহার চলে আসছিল, যা বিবাহ এবং বিচ্ছেদের আইনের সঙ্গে খাপ খায় না।

২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিন তালাক প্রথাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা একটি অর্ডিন্যান্স বা নির্বাহী আদেশ জারি করে।


তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদ দিলে এই আইন অনুযায়ী মুসলিম পুরুষদের তিন বছরের জেল ও আর্থিক জরিমানার বিধান থাকছে। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর খোরপোষ পাওয়ারও অধিকার থাকবে। গত বছরের অগাস্টে এক ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ভার তারা ছেড়ে দিয়েছিল সরকারেরই ওপর। এরপর এই প্রথাকে শাস্তিযোগ্য করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার 'দ্য মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অব রাইটস ইন ম্যারেজ অ্যাক্ট' নামে একটি বিলও আনে, যা সাধারণভাবে 'তিন তালাক বিল' নামেই পরিচিতি পায়। ডিসেম্বরে ওই বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় সেটি বিরোধীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তবে এখন সেটি আইনে পরিণত হলো।"


তাৎক্ষণিক তিন তালাক এর মতন অমানবিক কু-প্রথার বিরুদ্ধে বিল পাশ করানো নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিড়াট বড় সাফল্য। অনেকেই ওনাকে বিদ্যাসাগর, রামমোহনদের মতনই বড় মাপের সমাজ সস্কারক ভাবতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আছেন নিজের মধ্যেই। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, যা ইসলামে ইতিমধ্যেই বাতিল ও নিষিদ্ধ, যা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশও নয় তাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়, বিল পাশ করানো এবং গেরুয়া শিবিরের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস, সত্যিই  হাস্যকর। নরেন্দ্র মোদী সরকার কেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড লাগু করতে উদ্যোগী নন? কেন শুধু তালাক-এ-বিদ্দত? কেন তালাক-এ-আহসান এবং তালাক-এ-সুন্নতকেও পুরোপুরি বাতিল করার বিল পাশ করানোর উদ্যোগ নেই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীর? 


কলকাতা নিবাসী একজন গুণী বাঙালি লেখক জানিয়েছেন, "ভারতের সর্বশেষ ২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলা বিবাহ বিচ্ছিন্না ছিলেন, যাদের মধ্য ১৯ লক্ষ হিন্দু মহিলা এবং মুসলিম বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা ছিল ২৮ হাজার। এই ২৮ হাজার মুসলিম মহিলাদের কতজন তাৎক্ষণিক তিন তালাকের শিকার ছিলেন তার কোনও সরকারি তথ্য নেই। তবে ১৯ লক্ষ হিন্দু বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলাদের কেউ তিন তালাকের শিকার ছিলেন না, এ বিষয়ে দ্বিমত চলে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুসলিম মহিলাদের কথা ভেবে তিন তালাক বিল পাশ করাতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছেন যা খুবই ভালো পদক্ষেপ কিন্তু শুধু মুসলিম মহিলাদের সাথে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মহিলাদের দিকটাও যেন উনি ভাবেন।" 


তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের বিল পাশ করে তিন তালাক বন্ধের কথা প্রধানমন্ত্রী বলছেন। তবে এটার জন‍্য বিল পাশ করার কোন দরকার নেই। সরকার যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিল পাশ করতেন তাহলে আর কোন বিলের এ ব‍্যাপারে প্রয়োজনই ছিলোনা।  যারা বিল পাশ করছেন তারা সব বোঝেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর অন্ধভক্তরা এসব কবে বুঝবেন? প্রশ্ন উঠেছে, মুসলিম পার্সোনাল ল-বোর্ড এর আচরণ, 'দ্য মুসলিম ওম্যান বিল ২০১৭ 'এর উদ্দেশ্য, অবিজেপি রাজনৈতিক দলের আলপটকা মন্তব্য এবং ভূমিকা নিয়েও (জানিনা কেন হটাৎ রাহুল গান্ধী ২০১৯ সালে মন্তব্য করেছিলেন-কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে তিন তালাক আইন বাতিল করবেন)। আপাতত তিন তালাক বিলটি জম্মু কাশ্মীর বাদে পুরো ভারতেই চালু হবে। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায়ই দেশের আইন। সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক তালাক এখন বৈধ বা গ্রাহ্য নয়।


২০১৯ সালে, জনৈক ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হওয়া একটি ভাইরাল পোস্টে তুলে ধরলাম - "সংসদের উভয় কক্ষেই ইতিমধ্যে পাশ হয়ে গিয়েছে তিন তালাক বিল। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে বুধবার থেকেই তা পরিণত হয়েছে আইনে। এই আইন মোতাবেক কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীকে তাৎক্ষনিক তিন তালাখ দেন তাহলে তিন বছর পর্যন্ত কারাবাসের সাজা হতে পারে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিলটির প্রধান চারটি বৈশিষ্ট।  


তাৎক্ষনিক তিন তালাখ এখন একটি ফৌজদারি অপরাধ। এর সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের জেল। অভিযুক্ত স্বামী আদালতে জামিনের আবেদন জানালে শুধুমাত্র পুলিশের বক্তব্য শুনেই তার ফয়সালা করতে পারবেন না বিচারক। তিন তালাক আইনের সেকশন ৭ (সি) অনুযায়ী যে মহিলাকে তাৎক্ষনিক তিন তালাখ দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর বক্তব্যও এক্ষেত্রে শোনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু বাধ্যতামূলক নয়, সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে অভিযোগকারিণী মহিলার বক্তব্যকেই।  

   

আইনের ভাষায় তিন তালাক দেওয়া একটি কম্পাউন্ডেবেল অপরাধ। অর্থাৎ অভিযোগকারিণী যদি চান, সেক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে পারেন অভিযুক্ত স্বামী। তিন তালাক আইনের ৭ (বি) ধারায় বলা হয়েছে অভিযোগকারিণী স্ত্রী যদি চান তাহলে তিনি তাঁর স্বামীকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে পারেন। যদিও বিচারক মনে হলে কিছু বাড়তি শর্তাবলিও যুক্ত করতে পারেন অভিযুক্তের মুক্তির ক্ষেত্রে।  


তিন তালাক আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীকে আইন মেনে তালাক দেন, তাহলে সেই দম্পতির নাবালক সন্তানদের নিজের হেফাজতে চাইতে পারবেন না স্বামী। এছাড়াও নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য স্বামীর থেকে খোরপোশ পাবেন স্ত্রী। কেবল মাত্র নাবালক সন্তানদের জন্যই নয়, বাকি নির্ভরশীল সন্তানদের জন্যও খোরপোশের আবেদন জানাতে পারবেন বিবাহ বিচ্ছিন্না স্ত্রী।   

এছাড়াও বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে আইনে বলা হয়েছে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসেই হবে তালাক মামলার শুনানি।  দাম্পত্য বিবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় দেখা গিয়েছে বাড়ি থেকে আদালতের দুরত্ব বেশি হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধায় পড়েন মহিলারা। সেই সমস্যার সুরাহা করতেই সরকারের এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।" 


অন্যদিকে ভারতে বসবাসকারী সেইসব ধর্মপ্রাণ মুসলিম ব্যক্তিদের (যারা নিজেদেরকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবী জানান)ও আজ এটা বুঝে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন যে, তিন তালাক যখন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় এবং ইসলাম একে সমর্থনও করেনা তখন আপনাদেরই উচিৎ এগিয়ে আসা এবং এর বিরোধিতা করা। মনে রাখবেন  সরকারের দুর্নীতি, শোষণ, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত্যাদি কাজকর্মের বিরোধীতা এবং একটি প্রাচীন কু-প্রথা বাতিলের বিরোধীতা এক জিনিস নয়। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, আরব অঞ্চলে 'ইদ্দা' নামক এক ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এই বিধান মতে, স্বামী তার স্ত্রীকে তিন মাসের জন্য 'তালাক ' দিতে পারে এবং তিন মাস পরে আবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে। এই মধ্যবর্তী সময়ে স্বামী কোনও নারীকে স্ত্রী করে তার চারটি স্ত্রী রাখার ধর্মীয় অধিকার বজায় রাখতে পারে। ধর্মের সূত্র ধরে মরোক্কোর সংবিধানে স্ত্রীকে স্বামীর আইনি ক্রিতদাসী করা হয়েছে। ও দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে -স্ত্রী বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতা-মাতা ও আত্বীয়স্বজনের সম্মান রক্ষা করবে। স্ত্রী যদি তার মা- বাবাকেও দেখতে চায়, তাহলে স্বামীর অনুমতি নিতেই হবে (সূত্র- The Sisterhood of Man, by Newland Kathleen : W.W.Norton & Co..New York : 1979, Page- 24)। আপনারা যদি সত্যিই নারীকে "মানুষ" হিসেবে মনে করেন, যদি আপনারা নারী প্রগতি ও নারীপুরুষের সাম্য চান তাহলে সমস্তরকম কু-প্রথা, যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচার অনুষ্ঠান এবং কুসংস্কারের বিরোধীতা করুন। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের উচিৎ, সুপ্রিম কোর্টের রায় ও পাশ হওয়া এই বিলটিকে সম্মান জানানো। 


তিন তালাক এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা হচ্ছিল ওসমান মল্লিক সমেত কয়েকজন সংবিধান এবং আইনিবিশেষজ্ঞদের সাথে। এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্পর্কে ওসমান বাবু জানিয়েছেন - 

"সংবিধানের খসড়া বা ড্রাফটে ইউনিফর্ম সিভিল কোড ছিল ৩৫ নম্বর আর্টিকেল এর অন্তর্গত। সংবিধান সভায় এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।  মুসলিম সদস্যদের দিক থেকে এর জোরালো প্রতিবাদ হয়। বেশিরভাগ মুসলিম সদস্যদের বক্তব্য ছিল মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অলঙ্ঘনীয়। এই আইনে কোনো পরিবর্তন আনা যাবেনা। তাই ইউনিফর্ম সিভিল কোড এর কথা সংবিধানে থাকা চলবেনা। 

২০১১ সালে সেকুলারিজম এর আদর্শকে পাথেয় করে আমরা একটি সংগঠন গড়ি। নাম- 'সেকুলার মিশন'। মূলত : সেকুলার স্টেট ও সেকুলার ফ্যামিলি এর আদর্শেকে প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই সংগঠন। এরই মাঝে আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম - ইউনিফর্ম সিভিল কোড এর ড্রাফট তৈরীর। আপনাদের সকলকে জানাই সেই ড্রাফট এখন রেডি। A Complete Draft of Uniform Civil Code of India 06th December 2021 জমা পড়েছে law Commission সহ বিভিন্ন দপ্তরে। Marriage, Divorce, Maintenance, Succession, Adoption ও Guardianship -এই সব কটি বিষয়ই এই কোডের অন্তর্গত। রয়েছে ১১৫ টি সেকশন ও ৫টি তপশীল। 


কি আছে এই ড্রাফটে? চেষ্টা করছি আমরা একটি বাংলাতে বই বের করার। তার পরিশিষ্ট অংশ থাকবে এই ড্রাফট। সব ঠিক ঠাক এগোলে আগামী বইমেলাতেই আপনারা হাতে পাবেন এই বইটি। এখানে এই খসড়ার দু একটি সেকশন তুলে ধরছি :

1. (2): It extends to the whole of India, and applies to all citizens of India, irrespective of their religion, caste, creed, and custom

3. (b) any other law in force immediately before the commencement of this Act shall cease to apply in so far as it is inconsistent with any of the provisions contained in this Act.

(c) any practice, custom, or usage, in contravention of this Act, shall be treated null &void, ineffective, and illegal.

(d) there is no bar to practicing rituals or customs, subject to public order, decency, morality, and mutual consent of the parties, but no such customs or rituals shall have the status of Law.

লেখাটি শেষ করবার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে আরেকবার চোখ বোলানো যাক। 

১) ৩১ জুলাই ২০১৯-তিন তালাক বিরোধী আইন পাশ করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। এর পুরো নাম- "The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Bills, 2019"। ২০১৭-র ১৮ মে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে এই আইন পাশ হয়।

২) ২০১১-র জনগণনা অনুসারে দেশের আট শতাংশ মহিলা মুসলিম। ১৫ অক্টোবর, ২০১৫- বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলারা বৈষম্যের শিকার কি না তা দেখার জন্য প্রধান বিচারপতিকে জানায় সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।

৩) ফেব্রুয়ারি, ২০১৬- উত্তরাখণ্ড ভারতের বাসিন্দা শায়রা বানু একটি পিটিশন দায়ের করেন ৷ তিনি আদালতকে জানান, উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়িতে গেছিলেন চিকিৎসার জন্য। সেইসময় তাঁর শওহর অর্থাৎ স্বামী তাঁকে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তাৎক্ষণিক তালাক দেন শায়রার শওহর এরপর ১৫ বছর ধরে শওহরের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি ৷ এমনকী তাঁর সন্তানদের সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন শায়রা। শায়রার শওহর এলাহাবাদে থাকতেন ৷ আদালতের কাছে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের আর্জি জানান তিনি  পাশাপাশি শায়রা জানান, মুসলিম ব্যক্তিরা তাঁদের বিবিদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬- অ্যাটর্নি জেনেরাল মুকুল রোহাতগিকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেন।


৪) ২৮ মার্চ, ২০১৬- ‘মহিলা এবং আইন : পারিবারিক আইনের মূল্যায়ন এবং বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইনের উপর লক্ষ্য’-বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের রিপোর্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।  স্বতঃপ্রণোদিত এই মামলায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB)-এর মতো বহু সংস্থাকে যুক্ত করে শীর্ষ আদালত ৷


৫) ২৯ জুন, ২০১৬- সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ‘‘সাংবাধিনাকি পরিকাঠামোর কষ্টি পাথর’’-এ বিচার হবে ‘তিন তালাক’। ৭ অক্টোবর, ২০১৬- সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রথমবার শীর্ষ আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার তিন তালাকের বিরোধিতা করে।  লিঙ্গ-বৈষম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়ে ভেবে দেখার কথা জানায় কেন্দ্র। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭- মূল মামলার সঙ্গে আরও কয়েকটি আলোচনামূলক আবেদন যুক্ত করার অনুমতি দেয় শীর্ষ আদালত। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭- পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গড়ে সুপ্রিম কোর্ট। ওই বেঞ্চে তিন তালাক ও নিকাহ হালালা সংক্রান্ত যাবতীয় শুনানি ও আলোচনা হয়। 


৬) মার্চ, ২০১৭ - AIMPLB সুপ্রিম কোর্টকে জানায়, তিন তালাকের বিষয়টি বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ারের মধ্যে পরে না। ১৮ মে, ২০১৭- তিন তালাক সংক্রান্ত মামলার রায়দান স্থগিত রাখে।  ২২ অগাস্ট, ২০১৭- তিন তালাককে বেআইনি বলে ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত এবং কেন্দ্রকে এই বিষয়ে আইন পাশ করানোর কথা জানায়। ডিসেম্বর, ২০১৭- লোকসভায় পাশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল।

৯অগাস্ট, ২০১৮- তিন তালাক বিলের সংশোধনীতে অনুমতি দেয় কেন্দ্র। ১০ অগাস্ট, ২০১৮- রাজ্যসভায় পেশ করা হয় তিন তালাক বিল। সমর্থন না পাওয়ায় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন পর্যন্ত পিছিয়ে যায় বিল পাশ ৷১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮- মন্ত্রিসভায় অর্ডিন্যান্স পাশ হয় ৷ তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং অপরাধ প্রমাণ হলে তিন বছরের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়।


৭) ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮- বিরোধীরা রাজ্যসভার নির্বাচিত প্যানেলের দ্বারা বিলের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানায়। ২০ জুন, ২০১৯ - রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সমস্ত রাজনৈতিক দলকে তিন তালাক বিল পাশের আর্জি জানান। ২০ জুন, ২০১৯ - রাজ্যসভায় পেশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল। ২১জুন, ২০১৯- লোকসভায় পেশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল ৷ ২৫ জুন, ২০১৯- বিরোধীরা ওয়াক-আউট করে ৷ লোকসভায় পাশ হয় তিন তালাক বিল। 


৮) ৩০ জুলাই, ২০১৯- রাজ্যসভায় পাশ হয় তিন তালাক বিল। অবশেষে ১ অগাস্ট, ২০১৯ - মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল বলবৎ হয়। তিন তালাক কে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।

পরিশেষে শুধু একটাই কথা রয়ে যায়, যা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গেছেন। উনি বলেছিলেন - "বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।"

অবিশ্বাসের ব্যবসা ভাঙতে হবে -সায়ক সরকার
Nov. 25, 2024 | যুক্তিবাদ | views:277 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের প্রয়োজনে আজকে আমরা 6G, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence), Internet Of Things, অটোমেশন নিয়ে কাজ করছি। এই প্রযুক্তি ভারতের মতো দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য তে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।

একটা সময় ছিলো যখন আদিম মানুষ পশু শিকার করে খেত, আজকে সেই মানুষ একটি চাপে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের তথ্য পেয়ে যাচ্ছে।

আজকে আমরা পৃথিবীর গতি সম্পর্কে এতটাই জানি যে পৃথিবীর বাইরের কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে দিচ্ছি।

একটা সময় আমরা এসব কিছু জানতাম না, আগুন বা বৃষ্টির ভয় আমাদের এক অদৃশ্য শক্তি সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছিল। আজকে সেই শক্তির খোঁজ আমরা পেয়ে গেছি।

কিন্তু আজও অনেক মানুষ সেই পুরোনো ভুল বিশ্বাস আকড়ে ধরে বসে আছে, তারা এতটাই উন্মাদ যে সেই বিশ্বাস গুলোকে সমাজের বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করে, কারণ তাতে তাদের লাভ। সমাজের বুকে তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে নেতা স্থানে বসবে। হাজার বাধা সত্বেও ডিরোজিও, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর রা শেষ অবধি লড়ে গেছিলো। কোনো ক্ষমতা তাদের দমাতে পারেনি


পুরনো ভাবনা গুলো ধর্ম, সংস্কৃতির আড়ালে বেড়ে উঠছে। সেগুলো মানতে না চাইলে বলে দেওয়া হয় যে অমুক জায়গার লোক হয়ে অমুক সংস্কৃতি কিভাবে অস্বীকার করতে পারি।

একটা সময় চিঠিতে কথা বলতাম, এখন ভিডিও কল করে একে অপরকে দেখতে পারি। পরিবর্তন সমাজের নিয়ম, একের পর এক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সে এগিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে ধর্মীয় বিশ্বাস আর সংস্কৃতির আড়ালে যে পুরোনো বিশ্বাস গুলো সমাজে আছে সেগুলো যাবে না কেন? ফেসবুক - টুইটারে সেই বিশ্বাসের নামে কিছু লোক সমকামিতা পাপের চোখে দেখে, ছোট পোষাক পরা কে ঘৃণার চোখে দেখে, তাদের বিশ্বাস না মানায় এমন করে যেনো ভিনগ্রহের প্রাণী দেখে ফেলেছে।


বিজ্ঞানের পরিবর্তনের সাথে মানুষ নিজেকে সব দিক থেকে নিজেকে ছাপিয়ে যাবে, এটা ঠেকানোর চেষ্টা বোকামি। গ্যালিলিওর তত্ত্ব আজকে দাঁড়িয়ে প্রমাণিত

অনেকে তাদের পুরোনো ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞানের হদিস পায়। তাই যদি হয় সেই সময়ে দাড়িয়ে আজকের সাফল্য পাইনি কেন?

ছট পুজো বাস্তবতা -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:285 | likes:2 | share: 2 | comments:0

1. পুজোর পৌরাণিক বৈদিক শাস্ত্রীয় মত:

ছট পুজো এই উপমহাদেশের একটি পরিচিত একটি পুজোতে বললেই চলে। হিন্দু বর্ষপঞ্জীর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে উদযাপিত একটি পুজো! যা বিহারে শুরু আমরা তাই জানি সূর্য্যোপাসনার এই অনুপম লৌকিক উৎসব পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে পালিত হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এই পার্বণ প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হয়েছে। ছটে কোনও মূর্তি পূজা করা হয় না। কিন্ত এই পৌরাণিক হিন্দুধর্মের এই পুজোর কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ আমি পাইনি...

রামায়ণে উল্লেখ থাকা মতে, রামের কুলদেবতা সূর্য্যের জন্য রাম এবং সীতা এই পূজা করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ থাকা মতে, দ্রৌপদী ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্য্যকে আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। সঙ্গে মহাবীর কর্ণের কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য্যের উপাসনা করা উল্লেখ আছে। তবে আমরা যখন মহাভারত রামায়ণ পড়ি তখন এই ছট পুজোর নিয়ম আলাদা” তার কারণ এই পুজো শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়দের ছিল। শূদ্র বৈশ্য ব্রাহ্মণদের ও নয়। তবে এই পুজো পৌরাণিক নয়। বৈদিক যেহেতু মূর্তি পুজো নেই। ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহে সূর্য্যবন্দনার স্পষ্ট নিদর্শন আছে। তবে যজ্ঞ ও আহুতি দিয়ে, কিন্ত এখানে কোনো যজ্ঞ নেই। এক কথায় ভিন্ন সব কিছুই। বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মতে এই পুজোর এমন রুপ পাওয়া যায়নি। যা বর্তমানে পুজার রুপ! তবে বেদ আরণ্যক ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কোথাও এই পুজোর তথ্য নেই। 

2 ||ঐতিহাসিক ও যুক্তির দিক)

এই পুজোর কোনো যুক্তি নেই আছে শুধুই জল দূষণ। এবং পরিবেশের ক্ষতি, আপনি হয় জানেন বিগত বছর ধরে রবীন্দ্র সরোবরের ঘটনা যা হাইকোর্টেও বেশ চলছিল। জল দূষণ নিয়ে। পৌরাণিক বৈদিক তথ্য এই পুজোর সঠিক কোনো অস্তিত্ব নেই। আর থাকবেও না যখন আমরা ঐতিহাসিক তথ্য দেখব এই ছট পুজোর কোনো অস্তিত্ব নেই। বিহারের পুরাতন নাম মগধ পাটালিপুত্র যা বৌদ্ধদের ইতিহাস দখল করে আছে। আর ছট পুজোতে স্তুপ এর ব্যবহার থাকে যা পুজো হয়। আমরা যারা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও জৈন বৌদ্ধ আজিকাদের নিয়ে পড়াশোনা করি। তারা সবাই জানে জৈন বৌদ্ধদের কোনো না কোনও উৎসব রীতি ইতিহাস দখল করা ব্রাহ্মণদের।

আর বলে রাখি এই পুজো ব্রিটিশ সময়কালে শুরু বললেই চলে। আমরা যখন ইতিহাসের দিকে তাকাই তখন পৃথিবীর ভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধ অশোক সময়কালে অনেক কেউ এই ভারতে পড়াশোনা করতে আসত অনেক জ্ঞান তারা নিয়ে যেত গ্রীকের মেগাস্থিনিস চীনের হিউয়েন সাঙ ও আরবের আল বুরুনির মত ব্যক্তিরা ভারত ভ্রমণ করে তারা নিজেদের বইতে ভারত নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। যার মাধ্যমে আমরা সেই সময়কার ভারতের কথা জানতে পারি। তবে মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙ, আল বুরুনি কেউ এই ছট পুজোর কথা লেখেনি। এমন কি সংস্কৃত নামক বঙ্গদেশে মহা পন্ডিত বানভট্ট মহাশয় এই পুজো লেখেনি। না লিখেছে গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব তার কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত গীতগোবিন্দম্ মহা কাব্য জয়দেব কে বাদ দিলেও বিষ্ণু বর্মা, এমন কি মাধবাচার্য আদি শঙ্করাচার্য কেউই এই পুজোর ইতিহাস লেখেনি। 

এই পুজো বৌদ্ধদের স্তুপ দখল করে চলছে রমরমিয়ে পুজো যা ব্রিটিশ সময় কাল থেকেই আমরা দেখি এর ইতিহাস যা। অনেকেই জানে না। জানার কথা নয়, প্রশ্ন করার মতো সবার জ্ঞান চাই যা আমাদের চোট থেকে ধার্মিক তৈরি করে প্রশ্ন করার যায়গা শেষ করা হয়। যেমন গীতা 4:40 তে বলা হয়েছেম ‘যারা সংশয়বাদী হবে শাস্ত্র ও গুরুর কথার উপর তারা দুঃখ ভোগ করবে।’ এর জন্য ব্রাহ্মণরা নতুন নতুন ভগবানের আমদানী করে থাকে যা তাদের জন্য সারা বছরের জীবিকা হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের বললেও ভুল হবে। বৈশ্যদের জন্যও নানান বৈদিক পৌরাণিক পুজোর থেকে কেনা-বেচা চলে নানান সামগ্রী কিন্ত এতে আমাদের ভারত আরও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হচ্ছে। বুদ্ধ বা মহানবীর সব সময়ই শিক্ষার কথা বলছে এইসব কুসংস্কারের কথা নয়। তাদের অস্তিত্ব শেষ করতে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এইসব পুজো শুরু করছে। আর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আরো শক্তিশালী করছে! মুসলিমরা তারাও ভয় পেয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈনদের ঈশ্বরহীন ধর্ম কে। সেজন্য দেখি বৌদ্ধদের অনেক কিছুই মুসলিম ও ব্রাহ্মণরা মিলে ধ্বংস করেছে। মুসলিম শাসন কালে অনেক ব্রাহ্মণ শাস্ত্র রচনা বচন করা হয়েছে। তার তথ্য আমি আবার লিখব লাইভ আলোচনাও করবো ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে, তবে এই দখলের ইতিহাস আজকের নয়। নিজেকে প্রশ্ন করুক নিজেকে জানার চেষ্টা করুন, এটাই বুদ্ধ বলেছেন। আমাদের কুসংস্কার মুক্ত হতে হবে।

প্রসঙ্গ: আন্দোলন -রাজু দত্ত
Nov. 25, 2024 | সমাজ | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধরুন আপনি দোকানে গেছেন। দোকানদারকে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসটির মূল্য বাবদ কিছু টাকা দিয়ে বললেন, " আমাকে অমুক একটা দিন তো"। দোকানদার আপনার হাত থেকে টাকা নিয়ে আপনাকে আপনার প্রাপ্য জিনিসটি না দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন আপনি কী করবেন? 

 

আপনি প্রথমে তাকে বিষয়টি জানাবেন। তারপর ক্রমশ বাকবিতণ্ডা শুরু হবে, যা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াতে পারে। শেষমেশ দোকানদার তার ভুল স্বীকার করে আপনার প্রাপ্য জিনিসটি আপনাকে দিল। 

 ঠিক সেইরকম, আপনি সরকারকে নিজের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাবদ, ক্রয়কৃত পণ্য বাবদ, পরিবহণ বাবদ, উপার্জন বাবদ ও আরো নানা বিবিধ উপায় কর প্রদান করছেন। তার বিনিময়  আপনি আপনার প্রাপ্য দাবি করবেন না? যখন আপনি তা পাচ্ছেন না। 

আপনার প্রাপ্য থেকে আপনাকে বঞ্চিত করা যেমন অন্যায়, ঠিক তেমনই সেই অন্যায় মুখবুজে মেনে নেওয়াও অন্যায়। সে অন্যায় যেই করুক, তার প্রতিবাদ করা আপনার অবশ্য কর্তব্য। অন্যায়ের সাথে আপোস করা কখনো উচিৎ নয়। এই আপোস না করার নামই আন্দোলন। 

 

আপনি আপনার পরিবারে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করুন, আপনি আপনার কর্মস্থলে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করুন। আপনি প্রতিবাদ করুন আপনার সাহিত্যে, আপনার অঙ্কিত চিত্রে - স্থাপত্যে- ভাস্কর্যে, চলচ্চিত্রে। আপনি প্রতিবাদ করুন আপনার সঙ্গীত- আবৃত্তি- অভিনয় সত্বার মধ্য দিয়ে। আপনি প্রতিবাদ করুন রাজনীতির ময়দানে।

 

অন্যায়ের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলন দমন করা ঘোরতর অন্যায়। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে হোক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হোক, আমাদের উচিৎ তার তীব্র প্রতিবাদ করা। মনে রাখবেন, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অন্যায়ের সাথে আপোস করে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্দোলন  গড়ে তোলা  সম্ভব নয়।

ক্ষমা করো ডারউইন -প্রবীর ব্যানার্জী
Nov. 24, 2024 | ধর্ম | views:1002 | likes:1 | share: 1 | comments:0

মেঘনাদ সাহার সমালোচনা করে শ্রীঅনিলবরণ রায় (পন্ডিচেরি প্রবাসী) ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন সাহা নাকি হিন্দুর দর্শন ও হিন্দুর ধর্ম নিজে না পড়িয়া অন্যের মুখে ঝাল খেয়েছেন। সাহার বক্তব্য - কোনও লোক যত বড়ই হোক না কেন স্বীকার না করিয়া তাঁহার কথার প্রতিধ্বনি করা আমার কাজ নয়। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ মৌলিক।

সাহার সমালোচক মোটের উপর এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা গঠনের এমনকি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা গঠনের সমস্ত আদর্শ বর্তমান আছে। তাঁহার বিশ্বাস যে হিন্দুর দর্শন ও বিজ্ঞানে ক্রমবিবর্তনবাদ (Theory of Evolution), পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিনবাদ (Heliocentric Theory of the solar system) ইত্যাদি বর্তমান বিজ্ঞানের যাবতীয় মূলতত্ত্ব, এমনকি National Planning পর্যন্ত স্পষ্ট ভাবে স্বীকৃত আছে, না হয় বীজাকারে প্রচ্ছন্ন আছে। কিন্তু সাহা সমালোচকের এই মতকে শুধু ভ্রান্ত বলেননি, সঙ্গে এটাও বলেছেন যে এ ধারনা অজ্ঞতাপ্রসূত। সাহার মতে সমালোচক আর সকলের মতো মনে করেন “হিন্দুধর্ম ও দর্শনের মূল বেদ”। সমালোচক কি অবগত আছেন বিগত ১৯২৩ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুপ্রদেশের মহেঞ্জাদড়োর দুটি প্রাচীন নগরীর আবিষ্কার করে, ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও মোটামুটি ভারতীয় সভ্যতার উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। সমস্ত প্রাশ্চাত্য পন্ডিত ও অধিকাংশ দেশী পন্ডিতদের মতে (যেমন: রমাপ্রসাদ চন্দ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজাশঙ্কর গুহ) এই সভ্যতা প্রাকবৈদিক ও প্রাকআর্য। এই সভ্যতা তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতার মতো উন্নত ছিল। বর্তমান পণ্ডিতেরা প্রমাণ করেছেন হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনের অধিকাংশ উপাদানই প্রাক আর্যসভ্যতা থেকে গৃহীত - যেমন শিব-পশুপতির পূজা, ধ্যান, যোগ, ফুল-নৈবেদ্য দিয়ে পূজা পদ্ধতি এবং সম্ভবত পশু, সর্প ও বৃক্ষদেবতার পূজো (সূত্র-Science and culture)।

“কাজেই হিন্দুর সমস্ত 'ব্যাদে' আছে একথা প্রস্তরীভূত(fossilized) পান্ডিত্যাভিমানী ব্যতীত এই যুগে কেহ বলিতে সাহসী হইবেন।”

“বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ সূচনা করিয়াছিল সেই উভয় ধর্মেই বেদকে সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। তিনি কি জানেন না যে লোকায়ত মতে ‘ত্রয়ঃ বেদকর্ত্তারঃ ভন্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ।’

অর্থাৎ খৃষ্টের কিছু পূর্বে ভারতবর্ষে একদল যুক্তিবাদী ছিলেন, যাহারা মনে করিতেন যে বেদের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা দুরূহ; শুধু কতকগুলি ভদ্রলোক বেদের অর্থ না জানিয়াও বেদের দোহাই দিয়া ভ্রান্ত প্রচার করে। এখনও এই শ্রেনীর লোকের অভাব নাই।"

সমালোচনা উত্তর।

মেঘনাদ সাহা-র লেখা থেকে নেওয়া।

তেত্রিশ কোটি দেবতার সত্যতা -কৃষ্ণ সরকার
Nov. 24, 2024 | ধর্ম | views:293 | likes:2 | share: 1 | comments:0

তেত্রিশ কোটি দেবতা - কথাটি কম বেশি সকলেরই শিরায় শিরায় প্রবাহিত। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন এত বেশি সংখ্যক দেবতা কি থাকা সম্ভব? অবশ্যই না। বেদ -উপনিষদ -পুরাণ ইত্যাদি সব মিলিয়েও তেত্রিশ কোটি দেবতা পাওয়া যায় না। তবে কি তেত্রিশ কোটি দেবতার ধারণাটি ভুল? অবশ্যই ভুল নয়।

      আসলে ‘কোটি’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। একটি হল ‘প্রকার’ ও অপরটি হল ‘কোটি(Crore)!’ এবার প্রশ্ন হল দেবতা সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি,নাকি দেবতা তেত্রিশ প্রকারের? উত্তর হল দেবতা তেত্রিশ প্রকারের।অবশ্যই সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি নয়।

     এবার এই তেত্রিশ কোটি দেবতা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক:

   ঋক বেদের 3/9/9 ও 10/52/6 ঋকে 3339 জন দেবতার কথা বলা হয়েছে এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও দেবতার সংখ্যা বলা হয়েছে 303 ও 3003,এদের মধ্যে প্রধান দেবতা 33 জন(বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ 3/9/1 -2) অর্থাৎ এখানেও মোট 3339 জন দেবতার কথা বলা হয়েছে। কোথাও কিন্তু সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বলা নেই। তাহলে আমরা মোট দেবতা পেলাম 3339 জন।

        এবারে আসা যাক 33 প্রকার দেবতার প্রসঙ্গে। ঋক বেদের 1/139/11, 8/28/1 ঋকে দেবতার সংখ্যা বলা হয়েছে 33 এবং তেত্তিরীয় সংহীতাঃ 1/4/10/1,

শতপথ ব্রাহ্মণঃ 7/5/7/2 ঐতরেয় ব্রাহ্মণঃ 2/18 ইত্যাদি সবখানেই 33 জন দেবতার কথাই বলা হয়েছে।এখানে আরও একটা সমস্যার সৃষ্টি হল - আগে আমরা পেলাম দেবতা 3339 জন আর এখন পেলাম 33 জন, তবে কোনটা সঠিক আর কোনটাই বা ভুল?

        এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই বৃহদারণ্যক উপনিষদে (3/9/1-11)। এখানে শাকল্য, যাজ্ঞবল্ক্যকে এক এক করে প্রশ্ন করেন এবং যাজ্ঞবল্ক্য এক এক করে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেন।

       যাজ্ঞবল্ক্য বললেন দেবগণ মাত্র 33 জন। বাকি সব তাদের বিভূতি (বৃহঃ উপঃ 3/9/2)।অর্থাৎ 3339 জনের মধ্যে 33 জন দেবতা আর বাকি 3306 জন তেত্রিশ জন দেবতারই বিভূতি।

     এই তেত্রিশ জন দেবতা হল - অষ্ট বসু,একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি, এই মোট তেত্রিশ জন দেবতা।

অষ্টবসু হলেন: অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক ও নক্ষত্র সমুহ।

একাদশ রুদ্র হলেন: পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রীয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্ব, ত্বক) পাঁচটি কর্মেন্দ্রীয় (হাত, পা, মুখ, পায়ু, জনন্দ্রীয়) ও আত্মা বা মন।

দ্বাদশ আদিত্য হলেন: বৎসরের বারটি মাস। এই সর্বমোট তেত্রিশ কোটি দেবতা অর্থাৎ তেত্রিশ প্রকারের দেবতা। পরে এদের বিভিন্ন কার্যকে আলাদা আলাদা দেবতা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। যা 3339 জন। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে দেবতা তেত্রিশ প্রকারের। বাকি সব এদের বিভূতি।

      তবে পুরাণে যে এত এত দেব-দেবীর কাহিনী লেখা আছে তারা কি দেব-দেবী নন। যেমন -কালী, দূর্গা, মহাদেব ইত্যাদি ইত্যাদি। এর উত্তর জানার জন্য আমাদের আগে জানতে হবে দেবতা বলতে কি বোঝায়? নিরুক্তকার যাস্ক দেবতা শব্দের অর্থ করেছেন -'যিনি দান করেন বা যিনি দীপ্ত হন বা যিনি দ্যোতিত হন বা যিনি দ্যুস্থানে থাকেন তিনিই দেবতা (নিরুক্ত: 7/11)। এই সংজ্ঞা অনুসারে বৈদিক ঋষিদের দেবতা নির্বাচন যথার্থ। কিন্তু পুরাণকার জানিনা কেন দেবতার সংখ্যা তেত্রিশ প্রকার থেকে তেত্রিশ কোটিতে নিয়ে গিয়ে তাদের ইচ্ছে মতো কাহিনী রচনা করেছেন? হয়তো বা তাদের কোনো অভিপ্রায় থাকতে পারে? তবে সেটা গবেষণার বিষয়। আমাদের শুধু একটা বিষয় জানা দরকার যে দেবতা তেত্রিশ প্রকারের এবং এরা সবাই বস্তুগত। কেউ সেই পৌরাণিক বা কাল্পনিক দেবতা নন। পুরাণের দেবতার সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরাণের লেখক হয়তো অজ্ঞতার বশেই তেত্রিশ কোটি কাল্পনিক দেব দেবীর সৃষ্টি করেছেন, যাদের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও আমাদের সমাজে এই কাল্পনিক ভিত্তিহীন দেব দেবীরা পূজা পেয়েই যাচ্ছে।

নাস্তিক এবং আস্তিক -জসিমুদ্দিন আহমেদ
Nov. 24, 2024 | নাস্তিকতা | views:1007 | likes:1 | share: 1 | comments:0

পর্ব - ১ 

"ব্রহ্ম সত্য অগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ। 

ইদমেব তু সাত্রমিতি বেদান্ত ডিণ্ডিমঃ।।" 

২১ (ব্রহ্ম জ্ঞানাবলী মালা)

এই শ্লোকের সরল অর্থ- "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব স্বরূপ, ব্রহ্ম হতে জীব ও জগতের পৃথক কোন সত্তা নাই।

#“ঈশ্বর আছে বলা যেমন বিশ্বাস, নেই বলাও তেমনি একটি বিশ্বাস।” বা “নাস্তিকদের ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তিতে একটি বিশ্বাস বা আরেকটি ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা। এগুলো ভুল ধারনা, কিছু নাস্তিকও নাস্তিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত পড়ালেখার অভাবের কারণে এই ভুলটি বলে থাকেন। ভারতবর্ষে উদ্ভূত দর্শনসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় আস্তিক ও নাস্তিক। যে দর্শন বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে তা আস্তিক। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত এই ছয়টি আস্তিক দর্শন এবং এগুলিকেই একত্রে বলা হয় ষড়দর্শন।

আর চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন বেদে বিশ্বাসী নয় বলে এগুলি নাস্তিক দর্শন হিসেবে পরিচিত। উলে¬খ্য যে, আস্তিক-নাস্তিকের ক্ষেত্রে ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনো কারণ নয়, যেমন ষড়দর্শনের মধ্যে সাংখ্য ও মীমাংসা জগতের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, অথচ উভয়ই বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে। বৈশেষিক দর্শনেও সরাসরি ঈশ্বরের কথা নেই। সাংখ্য ও যোগ জগতের স্রষ্টা হিসেবে পুরুষ ও প্রকৃতিকে স্বীকার করলেও যোগ ঈশ্বরের স্বতন্ত্র সত্তায় বিশ্বাসী। ন্যায় আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও জগতের স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করে এবং বেদান্ত ঈশ্বর (সগুণ ব্রহ্ম) তথা ব্রহ্মে (নির্গুণ) বিশ্বাসী; বেদান্তমতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, আর সব মিথ্যা। ফলে দেখা যায় যে, একই উৎস থেকে জন্ম হলেও আস্তিক দর্শনগুলির মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে অমিল রয়েছে এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সেগুলি ভিন্ন ভিন্ন মতামত পোষণ করে।

চার্বাক দর্শন না নাস্তিক দর্শন জড়বাদী। চার্বাক বা নাস্তিক দর্শন যে অতি প্রাচীন। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ ও সাহিত্যে,মহাভারতে এই মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। জড়বাদী দর্শন ঘোরতর বেদ-বিরোধী এবং বেদ নিন্দুক তাই মনুস্মৃতি তে মনু মহারাজ বলেছেন "নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ"-অর্থাৎ যে বেদ নিন্দা করে (অপমান, ত্যাগ অথবা বিরূদ্ধাচরণ)। কেউ যদি চেতন-সত্ত্বা কে অস্বীকার করে জড়বাদী হয়, তা তার বুদ্ধি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

চার্বাক মতে, পাপ নেই,পুণ্য নেই। পাপ-পুন্যের কর্মফল ভোগও নেই। অতিপ্রাকৃত কিছুই নেই। ঐহিক ইন্দ্রিয় সুখই একমাত্র সুখ। দেহের মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকে না। ইন্দ্রিয়লিপ্সু সাধারণ মানুষের কাছে চার্বাক নিতি খুবই হৃদয়গ্রাহী বা মনোরম, বর্ত্তমানে বিশেষত যারা ইসলাম ত্যাগ করে দিশেহারা (দিগ্‌ভ্রান্ত)। সহজ কথায় বেদ, উপনিষদ, ব্রাহ্মনগ্রন্থ, আয়ুর্বেদ.. ভারতীয় দর্শনের মূল চিন্তাভাবনা থেকে চার্বাক, নাস্তিকতা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। এই দর্শনের কথা হল-কামের (ইন্দ্রিয়-সুখ) চরিতার্থই মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বা পরমপুরুষার্থ যা অন্যান্য দর্শন ও বৈদিক শাস্ত্রে ত্রিবিধ দোষ থেকে মুক্তির উপায় বা মোক্ষ প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। এই দর্শন বলে-যতদিন বাঁচবে ভোগ-সুখে বেঁচে থাক, প্রয়োজন হলে ঋণ করেও ঘি খাও। জীবনে খাও-দাও ফূর্ত্তি কর, কেননা আগামীকালই তোমার মৃত্যু হতে পারে। ভবিষ্যতের না-পাওয়া সুখের মিথ্যা ছলনায় বর্ত্তমানকে ত্যাগ করো না। বাকী কিছু বৈদিক মান্যতা গ্রহণ করে তাঁরা এটা মানে সুখই স্বর্গ, দুঃখই নরক কিন্তু সুখের পরিভাষা তাঁদের আলাদা।

এই মতে দেহাতিরিক্ত আত্মা নেই, দেহের সুখই আত্মার সুখ। কোন কারণেই নিজেকে ইহলৌকিক সুখ থেকে বঞ্চিত করো না। সাধারণ লোকের কাছে এই ধরনের কতা শ্রুতিমধুর বা চারুবাক্ বলে এই দর্শনের নাম "চার্বাক" হয়েছে। তবে অনেক পন্ডিতের মতভেদ আছে "চার্বাক" নামের উৎপত্তি বিষয়ে।

যেমনঃ "চর্ব"-ধাতুর অর্থ হল "খাওয়া দাওয়া করা বা চর্বণ করা"। এই দর্শনের খাওয়া দাওয়াকে, ইন্দ্রিয়-সুখকে, জীবনের পরমপুরুষার্থ বা কাম্যবস্তুরূপে মনে করে বলে এর নামকরণ "চার্বাক" হয়েছে। চার্বাকের একটি নীতিবাক্য হল "যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ"। আবার অনেকের মতে এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা দেবগুরু বৃহস্পতি। চারু শব্দের একটা অর্থও বৃহস্পতি। তাহলে "চারুর্ বাক্" অর্থাৎ "বৃহস্পতির কথা"। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই দর্শন অনুসরণ করে অসুরকুল যাতে সমূলে ধ্বংস হয় তার আয়োজন। এই দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায় আছে যথাঃ বৈতন্ডিক, ধূর্ত, সুশিক্ষিত।

এই জ্ঞানতত্ত্বের সার কথা হলঃ (ক) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ [প্রত্যক্ষমেকৈব্-Perception is the only source of Knowledge], চার্বাকের এই মত মানলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান না করলে চলে না। লোকযাত্রা নির্বাহের জন্য তাই প্রত্যক্ষ-অতিরিক্ত অনুমানকেও স্বীকার করতে হয়। (খ) অনুমান প্রমাণ নয়, (গ) আগম বা শব্দ প্রমাণ নয়, (ঘ) বেদবাক্য, শ্রুতিবাক্য প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য় নয় কোন বিজ্ঞানীর শ্রুতি বাক্য বা অনুমান তাঁর মান্যতাদেয়। প্রত্যক্ষের অর্থ প্রথমত অনুভব {ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ(যোগ) জনিত অনুভব}, দ্বিতীয় প্রত্যক্ষ অপরোক্ষ অনুভব [টেবিল দেখে টেবিলের যে জ্ঞান তা অন্য কোন জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না],তৃতীয় প্রত্যক্ষ সম্যক অনুভব [সম্যক অর্থে সংশয়শূন্য ও বিপর্যয়শূন্য। অনিশ্চিত জ্ঞান হচ্ছে সংশয়। যেমন- ঐ বস্তুটি মূর্ত্তি, না মানুষ ? মিথ্যা জ্ঞানকে বলে "বিপর্যয়"-আকাশে দুটি চাঁদের জ্ঞান]। প্রত্যক্ষ দ্বিবিধ-বাহ্যপ্রত্যক্ষ [চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-এই পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাইরের জগতের যে সাক্ষাৎ] ও মানসপ্রত্যক্ষ [মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার সাক্ষাৎ]।

ন্যায় দর্শন বা বৈশেষিক দর্শনের সমস্ত প্রামাণ কে চার্বাক দর্শন গ্রহন করে না, বৈদিক দর্শন শাস্ত্রে "প্রত্যক্ষ" শব্দটি-কে যেমন যথার্ত জ্ঞান লাভের উপায় অর্থে ব্যবহার করা হয় তেমনি আবার 'যথার্থজ্ঞান' অর্থেরও ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ "প্রত্যক্ষ" শব্দটি একই সঙ্গে "প্রমাণ" এবং "প্রমা" অর্থে ব্যবহার করা হয়।


চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ আবার সবিকল্প অথবা নির্বিকল্প হতে পারে[যেমন- আমি "একটা কিছু" দেখেছি, কিন্তু সেটা কি বস্তু, সে জ্ঞান একনও হয়নি]। যাই হোক অন্যান্য দর্শন শাস্ত্রে প্রত্যক্ষকে প্রমাণরূপে স্বীকার করলেও একমাত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করেন না। চার্বাক মতে পরোক্ষ জ্ঞান অস্পষ্ট ও অযথার্থ, এই যুক্তি তে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেও অযথার্থ বলতে হয়, কেননা প্রত্যক্ষজ্ঞানও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইন্দ্রিয়-নির্ভর, তাই তা পরোক্ষ তা অযথার্থই।

আবার দেখুন নাস্তিক চার্বাক মতে "সকল ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ"-সকল ক্ষেত্রেই বলতে বর্তমান,অতীত ও ভবিষ্যতের প্রত্যক্ষ-জ্ঞান বোঝায়, যা প্রত্য়ক্ষের দ্বারা যাচাই করা যায় না। তাহলে মানতে হয় যে, চার্বাকরা প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমানকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেছেন। চার্বাক মতে, 'অনুমান ও শব্দ" প্রমাণ নয়, যেখানে ঋষি বাক্যও বৈদিক সংস্কৃতিতে শব্দ প্রমাণ মানা হয়। চার্বাক মতে অনুমান ও শব্দ-প্রমাণ অনেক সময় ভ্রান্ত জ্ঞান দেয়। একই যুক্তিতে প্রত্যক্ষেও প্রমাণরূপে প্রহণ করা যায় না, কেননা প্রত্যক্ষজ্ঞানও অনেক সময় ভ্রান্ত হয়। রুজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, শুক্তিতে (মুক্তো) রজত (রৌপ)-ভ্রম হয়। 

চার্বাক মতে অনুমান প্রমাণ নয়, কেননা অনুমানের দ্বারা "প্রমা" অর্থাৎ নিঃসন্দিগ্ধ জ্ঞানলাভ হয় না। ধূম দেখে বহ্নির যে জ্ঞান তা অনুমানলব্ধ জ্ঞান। এ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের মতে কখনই নিঃসন্দগ্ধ হতে পারে না। অনুমান ব্যাপ্তিজ্ঞানের ওপর নির্বর করে। ব্যপ্তি হল হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত সহচর-সম্বন্ধ। দূরের পাহাড়ে ধূম দেখে যখন "সেখানে আগুন আছে" বহা হয়, তখন তা হল অনুমান। এখানে অনুমান প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপঃ

ঐ প্রর্বতটি ধূমযুক্ত

যে যে বস্তু ধূমযুক্ত সেই সেই বস্তু বহ্নিযুক্ত

পর্বতটি বহ্নিযুক্ত।

প্রতিটি অনুমানের ক্ষেত্রে তিনটি পদার্থ থাকে-পক্ষ, হেতু ও সাধ্য (যা অনুমিত হয় তা সাধ্য)। এখানে 'বহ্নি" হচ্ছে সাধ্য, কেননা বহ্নি অনুমিত হয়েছে। যার সম্বন্ধে অনুমিত হয় তা পক্ষ। এখানে "পর্বত" সম্বন্ধে অনুমিত হয়েছে। তাই পর্বত হচ্ছে "পক্ষ"। যার সাহায্যে বা য়ার ওপর নির্বর করে অনুমিত হয় তা হেতু। এখানে ধূম হচ্ছে "হেতু", কেননা ধূম-প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে পর্বতে বহ্নি অনুমিত হয়েছে।হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সহচর-সম্বন্ধ হল ব্যপ্তি। হেতু ও সাধ্যের 'নিয়ত সম্বন্ধ" বলতে বোঝায়- যেখানে হেতু সেকানে সাধ্য এবং এমন কোন ক্ষেত্রে নেই যে, হেতু আছে কিন্তু সাধ্য নেই। উল্লিখিত উদাহরণে ধূম (হেতু) ও বহ্নি (সাধ্য) মধ্যে নিয়ত সাহচর্য বা ব্যপ্তি-সম্বন্ধ আছে। যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে এবং এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেকানে ধূম আছে কিন্তু বহ্নি (আগুন) নেই। 

নাস্তিক দর্শনগুলি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না; সেগুলি অনাত্মবাদী ও জড়বাদী। চার্বাকদের মতে প্রত্যক্ষই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় এবং যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষযোগ্য নন, সেহেতু তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই। বৌদ্ধদর্শনের আলোচ্য বিষয় মানবজীবন; মানুষের দুঃখমোচনই এ দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। বৌদ্ধমতে জগতের সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তনই জগতের একমাত্র সত্য; যেহেতু কোনো কিছুই শাশ্বত নয়, সেহেতু নিত্য আত্মা বলতেও কিছু থাকতে পারে না। জৈনরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। এ দর্শনে দ্রব্যসমূহকে ‘অস্তিকায়’ ও ‘নাস্তিকায়’ নামে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যার বিস্তৃতি ও কায় (দেহ) আছে তা অস্তিকায়, যথা জীব ও অজীব (জড়) এবং যার বিস্তৃতি ও কায় নেই তা নাস্তিকায়, যথা কাল (time)। বঙ্গদেশে উপরিউক্ত দর্শনসমূহের প্রত্যেকটিরই কম-বেশি চর্চা হয়েছে এবং এখনও গুরুপরম্পরা ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হচ্ছে; তবে ন্যায়, বিশেষত নব্যন্যায়ের চর্চার জন্য এক সময় এদেশ সমগ্র ভারতে বিখ্যাত ছিল।

নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। ইংরেজি ‘এইথিজম’(Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্য বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ (ἄθεος) শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাস কে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪% থেকে ৬৫% নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ৬% (ইতালী) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পরলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা কোন বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সকলে বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে যে কেউ, যে কোন মতাদর্শে সমর্থক হতে পারে,নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে অবিশ্বাস করা।

ইংরেজিতে Believe, Trust, Faith এই তিনটি শব্দের অর্থ আগে জেনে নেয়া যাক।

Believe (অনুমান, বিশ্বাস, বিশেষভাবে প্রমাণ ছাড়াই মেনে নেয়া)

1. accept that (something) is true, especially without proof.

2. hold (something) as an opinion; think.

যেমন, ভুতে বিশ্বাস করা। এলিয়েনে বিশ্বাস করা। অথবা, বিশ্বাস করা যে, অতীতে আমাদের পুর্বপুরুষ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল। যার সপক্ষে এই বিশ্বাসী মানুষটি কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও তা তিনি বিশ্বাস করেন।

Trust (আস্থা)

1. firm belief in the reliability, truth, or ability of someone or something.

কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ধারণার আলোকে কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা করা। যেমন আমি আমার অমুক বন্ধু সম্পর্কে আস্থাশীল যে, সে টাকা ধার নিলে আমাকে ফেরত দেবে। বা ধরুন, অমুক পত্রিকাটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছাপে বলে আপনি মনে করেন। কারণ, অমুক পত্রিকাটি কয়েকবছর ধরে পড়ার কারণে পত্রিকাটির প্রতি আপনার আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে, আপনার এই আস্থার পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে আপনার পুর্ব অভিজ্ঞতা।

Faith (বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই পরিপূর্ণ বিশ্বাস)

1. complete trust or confidence in someone or something.

2. strong belief in the doctrines of a religion, based on spiritual conviction rather than proof.

যেমন, ইসলাম বিশ্বাস করা। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা। আল্লাহ ভগবান ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা।

চলবে......

পিতৃতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ -ঈশা চক্রবর্তী
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:292 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রাচীন ইতিহাস বা মধ্যযুগিয় বা আধুনিক যুগ, প্রতি যুগেই সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পিতৃতন্ত্রের হাত ধরেই বিদ্যমান হয়েছে। এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা গুলিই সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। কিছু "অহিংস" রাজা বাদে প্রাচীন ভারতের যেকোনো রাজাই অন্য প্রদেশ আক্রমণ করেছে, লুট করেছে, জয় করেছে এবং নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে।

       সামন্ততন্ত্র হলো একটি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকিতা তাই বিজয় ও বিস্তার ই একমাত্র ধর্ম। কেনো সামন্ত তন্ত্র পিতৃতান্ত্রিক? প্রাচীনকালে মানবসভ্যতা ছিলো মাতৃতান্ত্রিক। নারী যেহেতু অন্য প্রাণের জন্ম দিতে পারতো, তাই সমাজের সর্বোচ্চ স্থানে থাকতো মহিলারা। এই সময় সমাজ সঙ্গবদ্ধ পরিবারের রূপে বসবাস করতো। শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে খাদ্য সংগ্রহ সবই লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে মিলে করতো। লিঙ্গ নির্ধারিত কাজের বা জেন্ডার রোলস এর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। কিন্তু পুরুষ ক্রমে জন্মদানে নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত হলো। পরিবারে বিভক্ত হতে শুরু করলো সমাজ। পরিবারের সংগ্রহিত সম্পদ পরিবারেই যাতে থাকে, তার জন্য পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত ধনের প্রথা শুরু হলো। সংগ্রহিত সামগ্রী আর কলেক্টিভ সমাজে বিতরণ হতো না। পরিবারে নারীর ক্ষমতা কমিয়ে লিঙ্গ নির্ধারিত কাজের ব্যবস্থার জন্ম দিলো। যেহেতু মাতার মেয়ে অন্য পরিবারের অংশ হবে ভবিষ্যতে তাই পুঁজি সংরক্ষণ পিতা-পুত্র সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্মে সঞ্চারিত হলো। তৈরী হলো পিতৃতন্ত্রের। মানুষের লোভ জন্ম দিলো এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার , যা সাম্রাজ্যবাদের মতো ঘৃণ্য ও ধ্বংসাত্মক মানসিকতার মূল কারিগর।

       বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ও একই মনোভাবাপন্ন। কারণ এর মূল ভিত্তি সেই কম্পিটিশন। নিও লিবারেল পুঁজিবাদে নারীর উত্থান বিভিন্ন পদে সম্ভব হলেও পুঁজিবাদী ধনকুবের তারাই হতে পারে যাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পুঁজি আছে কাজে লাগানোর জন্য। সেই পুঁজি দিয়ে উৎপাদনের সামগ্রী ও শ্রম কেনা সম্ভব হয়। যা জন্ম দেয় আরও পুঁজির। এর ফলে উত্তরোত্তর পুঁজির বৃদ্ধির ফলে ধনকুবের পুঁজিবাদীদের উত্থান হয়। যারা শ্রমিক সম্প্রদায়কে শোষণ করে পুঁজির বৃদ্ধি ঘটায়। “পুঁজিবাদের চরম স্তর হলো সাম্রাজ্যবাদ!” কারণ এই ব্যবস্থা যখন একটি দেশ অপর অনগ্রসর দেশের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজের পুঁজি বৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে তোলে। তখনই পুঁজিবাদ হয় সাম্রাজ্যবাদী।

       ইতিহাসে হিন্দু মুসলিম বা তামিল এগুলো বড়ো কথা নয়, প্রত্যেকেই বিজয় ও বিস্তার করেছে অপরকে শেষ করে। সুলতানী আমলের পূর্বে হিন্দু রাজা বৌদ্ধদের উপরে বা অপর হিন্দু রাজার উপরে আক্রমণ করেছে বিস্তারের উদ্দেশ্যে। তখন কোনো ভারতবর্ষ ছিলো না, বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল। মৎসন্যায় পড়লেই রাজাদের বিজয় ও বিস্তারের ক্ষুধা জানা যায়। মোগল বা তার আগে সুলতান রাও একই কাজ করেছে। হিন্দুরা বৌদ্ধ স্থাপত্য ভেঙেছে, মুসলিম রাজারা হিন্দু স্থাপত্য ধ্বংশ করেছে। আবার পরবর্তীকালে হিন্দুরা বহু ইসলাম স্থাপত্য ধ্বংস করেছে বদলার নামে।

       কাজেই এই পিতৃতান্ত্রিক দুই ব্যবস্থা যথা সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদ চিরকাল একটি হিংসার কালচক্রের মানে cycle of hatred এর জন্ম দিয়েছে, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ।

Bibliography: ~

1. "Origin of family..." by Friedrich Engels.

2. "Imperialism: the highest stage of capitalism" by V.I. Lenin.

অন্য গ্রহের আগন্তক বনাম ইমাম মাহাদী -সাহাদাত হোসেন
Nov. 24, 2024 | মুক্তমনা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

খোরাশান ফারসি শব্দ, যাহা 'খোর' ও 'আসান' শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। 'খোর' অর্থ সূর্য এবং 'আসান' অর্থ উদয়াচল। অর্থাৎ 'খোরাসান' মানে সুর্যের উদয়াচল। খোরাসান নামের এই বিশাল ভূখণ্ড ওই অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ার কারণে তাকে 'খোরাসান' বলা হয়। মাদ্রাসা পড়ুয়ারা 'খোরাসান' শব্দের সাথে বেশ পরিচিত। হাদিসের গ্রন্থাদি থেকে নিয়ে প্রায় সব আরবি কিতাবাদীতে 'খোরাসান' শব্দটি পাওয়া যায়। কারণ, এসব কিতাবের লেখক বা কিতাবে উল্লেখিত মুসলিম পণ্ডিতদের প্রায় অনেকেরই জন্মস্থান এই খোরাসান। 

প্রাচীণকালে 'খোরাসান' বলতে এক বিশাল ভূখণ্ড বুঝানো হত। বর্তমান পৃথিবীর পাঁচটি দেশ নিয়ে ছিল প্রাচীন 'খোরাসান'র ভৌগলিক সীমারেখা। এই পাঁচটি দেশ হলো- পূর্ব ইরান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান। তবে এখনও ইরানের একটি প্রদেশ 'খোরাসান' নামে পরিচিত। এসব দেশ বর্তমানে মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। আজও এসব অঞ্চলে ইসলামি নিদর্শনাবলী অতীত কীর্তি ও ঐতিহ্যের কালসাক্ষী হয়ে আছে। নব্বই দশকেই আগে এই দেশগুলো কম্যুনিস্ট বিপ্লব গ্রাস করে নিয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই খোরাশান থেকেই নাকি ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে ঘোড়ায় চড়ে হাতে তলোয়ার নিয়ে বিমান, মিজাইল, এটমবোম, সাবমেরিনসহ অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্রের মোকাবেলা করে সমগ্র পৃথিবী করায়ত্ব করবে? বিষয়টি শুনতে হাস্যকর মনে হয়। তবে এটি হাস্যকর নয় আফগানিস্তানের খোরাশান নামক অঞ্চলের লোকদের নিকট কারণ বিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগেও যাদের একমাত্র যানবাহন হলো ঘোড়া।

কোন গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি নির্ভর করে সেখানকার তারা বা নক্ষত্র থেকে নিঃসৃত আলোর পরিমানের উপর। সূর্যের চারিদিকে প্রান সৃষ্টির সহায়ক সিস্টেমকে ইকোসিস্টেম বলে। আমাদের সৌরজগতে ইকো সিস্টেমের অন্তর্গত অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহ।

অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব:

আমাদের সূর্যের ন্যায় আনুমানিক ২০ হাজার কোটি তারা নিয়ে গঠিত হয়েছে আমাদের Glaxy, যার নাম ছায়াপথ বা Milky Way। অনন্ত অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই পর্যন্ত 2 লক্ষ কোটি Galaxy এর সন্ধান পাওয়া গিয়াছে।


সৌরজগতের ন্যায় প্রতিটি তারার নিজস্ব ইকোসিস্টেম রয়েছে। কেবলমাত্র ইকোসিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হলেই কোন গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হবে না। এক্ষেত্রে গ্রহের আকার, তার মাধ্যাকর্ষণ আকর্ষণও গ্রহের সমস্ত পদার্থকে ধরে রাখতে তথা প্রান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

উপরোক্ত দুটি বিষয়কে বিবেচনা করে কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করেছেন, অন্ততপক্ষে ১০০টি তারার গ্রহের মধ্যে একটি গ্রহেও যদি প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে তাহলেও এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যালাক্সি সমূহে পৃথিবীর ন্যায় হাজার হাজার কোটি গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। মানুষ প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই সমস্ত গ্রহের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। ভবিষ্যতে টেকনোলজি আরো অনেক উন্নত হবে এবং তখন যোগাযোগ সম্ভব হবে।

দ্বিতীয়ত: পানিতে যেমন জলজ প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে, স্থলে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী তদ্রূপ কিছু বিজ্ঞানীর মতে গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে ও গ্যাসীয় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। যাহা আমাদের নিকট দৃশ্যমান নয়। 

যে সমস্ত গ্রহে প্রাণের সঞ্চার আমাদের চেয়ে অনেক পূর্বে সংঘটিত হয়েছে তারা নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে রয়েছে এবং যাদের আমাদের চেয়ে পরে হয়েছে তারা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীর অতি নিকটের গ্রহ মঙ্গল গ্রহেই মানুষ যেতে পারেনি। এর চেয়েও উন্নত মানের প্রস্তাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারকা আলফা সেন্টুরিতে যেতে এবং ফিরে আসতে কমপক্ষে 3000 বছর সময় লেগে যাবে। 

একটি গল্প মনে পড়ে গেল।

এক গ্রামের এক বাটপার ও সন্ত্রাসী গ্রামবাসীদের মিথ্যা মামলা, নারী নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, চাঁদাবাজি সহ নানা ভাবে নির্যাতন করত। কিন্তু মৃত্যুর সময় গ্রামবাসীদের ডেকে সকলের কাছে মাফ চাইল এবং বলল, আমার মত পাপী লোক তোদেরকে বহু হয়রানি, নির্যাতন, জুলুম করেছে। এই পাপি মরলেও শান্তি পাবে না রে। আমার মত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি যাতে এই গ্রামে সৃষ্টি না হয়, সেই জন্য মৃত্যুর পর আমার পাছা দিয়ে বাঁশ ঢুকাইয়া তিন রাস্তার মোড়ে ঝূলাইয়া রাখবি।

যেমন কথা তেমন কাজ। কিন্তু পুলিশের কাছে খবর গেল গ্রামবাসীরা একটি লোককে মেরে তিন রাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তাই সারা গ্রামে পুলিশি অভিযান শুরু হল এবং লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে লাগল। গ্রামবাসী বলতে লাগল- 

হায় রে বাটপার পাজি, বেঁচে থাকতে জ্বালাইয়াছিলি কিন্তু মরে গিয়েও শান্তি দিলি না।


ইমাম মাহাদীর পরিচয়

অতীতে কয়েকবারই ইমাম মাহাদির আগমনের সময় অতিক্রম হয়েছে এবং গত ১০০ বছরেও কয়েকবার ইমাম মাহাদীর পৃথিবীতে আসার সময় অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। 

তাছাড়া অতীত থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদেরকে ইমাম মাহাদী বলে দাবি করেছিলেন। এখনও আফগানিস্তান, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে ইমাম মাহাদীকে নাকি দেখা যাচ্ছে। তারপরও হুজুররা ইমাম মাহাদী আসবে বলে মানুষকে প্রতারিত করছে।

মূলত ইমাম মাহাদী, হযরত ঈসা, শ্রীকৃষ্ণরা হলেন সন্ত্রাসীদের গডফাদার। তাদের মুলা দেখিয়ে কুচক্রী মহল গোপনে সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করছে এবং ইমাম মাহাদীর সৈনিক বানানোর জন্য মানুষকে জিহাদী তৎপরতায় অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে।

এইভাবে সরল মানুষকে ভয় দেখিয়ে ধর্মের আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ ধর্ম না থাকলে যে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা বলে থাকে, ধর্মের মৃত্যু হলে অর্থাৎ মানুষ ধর্ম বিমুখ হলেই পৃথিবীতে মুসলিমদের মতে ইমাম মাহাদী, খ্রিস্টানদের মধ্যে হযরত ঈসা হিন্দুদের মতে শ্রীকৃষ্ণ এবং ইহুদিদের মতে দাজ্জালের আগমন ঘটবে।

ইমাম মাহাদী যুদ্ধ করে পৃথিবীর ১/৩ অংশকে হত্যা করবে, ১/৩ অংশ পঙ্গু করবে এবং তারপর একশত বছরের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হবে। এত বড় বিপর্যয়ের পর এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করার পর কেয়ামতের বা পৃথিবী ধ্বংসের কোন যুক্তি কথা থাকতে পারে না। এটি কুচক্রী মহলের এই সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংস করার একটি নীল নকশারই অংশ মাত্র।

বাস্তবে মৃত্যুর পর কেউ কখনোই সশরীরে ফিরে আসতে পারে না কিন্তু এই ধর্মীয় বিশ্বাস ধর্মান্ধদের অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে যদি কখনো পৃথিবী অন্য গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এই সমস্ত ধর্মান্ধ ধার্মিকেরা অজ্ঞতাবশত তাদেরকে ইমাম মাহাদি, ঈসা, শ্রীকৃষ্ণ ও গৌতম বুদ্ধ ইত্যাদি মনে করে তাদের পক্ষ অবলম্বন করবে এবং নিজেরা নিজেদের সুন্দর পৃথিবীর ক্ষতি সাধন করবে।

আমাদের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রসর অন্য গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে আমাদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে অনেক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করতে সক্ষম। ভবিষ্যতের এই অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতার মোকাবেলা ও পৃথিবীর নিরাপত্তার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রসর হতে হবে।

বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস নিশ্চই কোন কিছ উপলব্ধি করে এইরুপ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এবং আমাদেরকে সতর্ক করেছেন - "আমি মনে করি, একটি বিপর্যয় হবে। সম্ভবত বহিরাগতরা হবে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। এই গ্রহেই একই প্রজাতির হলেও অগ্রসর গোষ্ঠীর সঙ্গে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর সাক্ষাতের ইতিহাসটা খুব একটা সুখকর হয়নি। আমি মনে করি, সতর্ক হওয়া উচিত আমাদের"

বিশ্বাসে বিষ -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 24, 2024 | যুক্তিবাদ | views:881 | likes:2 | share: 2 | comments:0

১ম - তুই ঈশ্বরে অবিশ্বাস করিস?

২য় -হ্যাঁ, অবশ্যই অবিশ্বাস করি, থাকলে সামনে আবির্ভূত হন বিশ্বাস করে নেব।

১ম - দেখ, ঈশ্বর ছাড়া এই মহাবিশ্বের কল্পনাও করা যায় না।

২য় - দেখ, একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না এটা কিভাবে যাচাই হবে? আমরা কিভাবে জানবো সে সময় একমাত্র ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন?

অথচ মহাবিশ্ব মহাকাশ কিছুই ছিল না?

হ্যাঁ এটা সত্য যে আজকের মহাবিশ্ব মহাকাশ সৌরমণ্ডল নীহারিকা তারকার সর্বদা অবস্থিতি ছিল না, মহাবিশ্ব এক্সপ্যান্ড করেছে যাকে সুপারনোভা বলছেন বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল।

১ম—দেখ, সে সব প্রমাণ না দেখাতে পারলেও বলবো ঈশ্বর ছিলেন আছেন।

২য় - ঈশ্বরের কি কাজ? কেন ঈশ্বর আছেন? তাঁর থাকাতে কার কার  কি কি  উন্নতি হয়েছে? আর না থাকাতে কার কার কি কি ক্ষতি  ঘটেছে?

১ম -  দেখ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ঈশ্বর  তর্কের জিনিস নয় সম্পূর্ণ ভক্তিভরে বিশ্বাসের জিনিস।

২য়  - আচ্ছা বলতো  সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এখনও ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারায়নি, আমাদের গুটি কয়েক নাস্তিকের কথা বাদ দে। তাহলে ঐ কোটি কোটি ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষেরা চরম দুর্দশায় ভুগছে কেনো? তাঁদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান নেই, শিক্ষা স্বাস্থ্যর কথা বাদই দে। ঈশ্বর এইরকম এক চোখোমি করেন কেনো?  তাহলে কি ধরে নেব সব ঈশ্বর ধনীদের গৃহেই অবস্থান করেন। সমাজে দরিদ্র অভুক্ত বস্ত্রহীন নিরাশ্রয়  মানুষের জন্য  এই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো ঈশ্বর নেই এই মহাবিশ্বে।

 ১ম - দেখ এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না, কিন্তু ঈশ্বর ছিলেন, আছেন আর  থাকবেন এই বিশ্বাস আমার চিরকাল অটূট থাকবে।

      দুই বন্ধুর কথপোকথনে একটা জিনিষ উঠে আসে সেটা হল বিশ্বাস শুধু বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ভাইরাস আমাদের সমাজকে  হাজার   হাজার  বছর  ধরে কুঁড়ে  কুঁড়ে  খাচ্ছে। একটু অন্যরকম কথা শুনলেই এদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং সমস্ত রকম অসভ্যতা নিয়ে দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ যুক্তিবাদীদের উপর। তখন সামান্য ভদ্রতার মুখোশটুকুও থাকে না। 

         ধর্মীয় পণ্ডিতদের বক্তব্যগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়ে। তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে যে, সৃষ্টিকর্তা দ্বারা সৃষ্টির আগে মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি শূন্য হতে সব কিছু তৈরি করেছেন। কিন্তু এই ধরণের দাবী অযাচাই যোগ্য, ঈশ্বর যে ছিলেন তার প্রমাণ কেউ দিতে  পারেনি আজ পর্যন্ত আর পারবেনও না। আমরা কেমন করে জানবো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির  আগে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন;  অথচ মহাকাশ মহাবিশ্ব কিছুই ছিল না। এটা সত্যি যে আজকের এই  মহাকাশ মহাবিশ্ব নীহারিকা তারকারাজির সর্বদা অবস্থিতি ছিল না। এগুলির সৃষ্টির কোনো উপাদান যদি মহাবিশ্বে বর্তমান না থাকতো তাহলে হঠাৎ করে ঈশ্বর কার থেকে এই গ্যালাক্সি নীহারিকা নক্ষত্রপুঞ্জ তৈরি করলেন? সুতারাং হঠাৎ করে এইসব ঈশ্বর দ্বারা তৈরি হয়েছে এই যুক্তি ধোপে টেকেনা। তার চেয়ে বরং পূর্ব থেকেই পরমাণুর অস্তিত্ব ছিল এটা মেনে নেওয়া সম্ভব। পরমাণুর সংযোগে সূর্যের ও অন্যান্য নক্ষত্রের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু এখনো পরমাণুর সংমিশ্রণ কেন ঘটে জানিনা। বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্ব গঠনের কারণ অনুসন্ধান করে সার্নের গবেষণাগারে বোস হিগিন কণার সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু এনার্জি কি করে ভরে রূপান্তরিত হয় তা এখনও জানতে পারেনি।তবে এই অনুকল্পের প্রমাণ দেখা যায় মহাকাশে অবিরাম তারকারাজির উদ্ভবে ও মৃত্যুতে।

          তাই বলা যেতে পারে সৃষ্টির সূচনা পদার্থ থেকে নয় বরং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর। এই পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানো মুশকিল। আমরা যদি ধরে নিই যে, সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর সৃষ্টির পূর্বে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিলনা তাহলেও সমস্যা দেখা দেবে, সেই সমস্যা হচ্ছে -

১) মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ কি?

২) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আগে থেকে কেন ছিলনা?

৩) ঈশ্বর কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন? 

     এইরকম বিভ্রান্তির মাঝে আমাদের পার্থিব মনে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য জীবের সাথে একই শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে রজি নই। বহু পূর্ব থেকেই মানুষ প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে না পেরে  ভয় থেকে বিশ্বাস করে আসছে এই বিশ্ব মহাবিশ্বে সবকিছু কেউ না কেউ একজন শুরু করছেন এবং তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন  সকল শুভ ও অশুভ প্রভাব। এই ধারণার পক্ষে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বই লেখা হয়েছে, সঙ্গীত রচিত  হয়েছে, কাল্পনিক কথাবার্তা উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব ঘটিয়েছে। আদিম বা প্রগতিশীল বর্তমান সমাজেও ধর্মের দারুণ প্রভাব বিরাজমান। আদিম সমাজে কুসংস্কার ও মোহ ছিল চূড়ান্তরূপে। আবার আধুনিক প্রগতিশীল  সমাজে চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রভাবে সভ্য এবং ন্যায় সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। চিন্তাবিদরা আবির্ভূত হয়েছে  আইন প্রণয়নকারী দার্শনিক, বিজ্ঞানী; সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারকের রূপে। যেমন হাম্বুরাবি, কনফুসিয়াস, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, ডিরোজিও  শত শত  মানুষের নাম করা যায়। আর মানুষ যে সমস্ত জিনিসে ভয় পেয়ে ঈশ্বর বা ধর্মের সৃষ্টি করেছেন তার অনেকটাই ব্যাখ্যাযোগ্য। এই মহাবিশ্বে সব ঘটনার একটা কার্য কারণ সম্পর্ক আছে, মানুষের পক্ষে হয়তো সব ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি, এটাইতো হবে আগামীতে, মানুষ চাইবেই প্রকৃতির এই জ্ঞান আহরণ করতে, তবেইতো সে অন্য জীবেদের থেকে পৃথক।

         ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া শুনেছি গাছের পাতাও নড়েনা। সত্যিই যদি ঈশ্বর  শক্তিমান সর্বজ্ঞ হোন, সমস্ত সৃষ্টির কর্তা হোন এবং চান যে তাঁর প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক বা সেমেটিকদের মতো ঈশ্বর প্রেরিত মেসেঞ্জার বা রসুল/নবীদের প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক এবং তার শিক্ষা গ্রহণ করুক তবে ঈশ্বরের সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে সবাইকে ভাল এবং বিশ্বাসী বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠানো।  অন্যধারে উনিই যদি মানুষকে  পৃথিবীতে পাঠান তাহলে উনিই ভাল খারাপ মানুষ করে  পাঠিয়েছেন  এই পৃথবীতে;  তাহলে সবজান্তা ঈশ্বরের  মানুষকে পরীক্ষার জন্য বলাটা  একটু হাস্যকর হচ্ছেনা কি? বা ঈশ্বর নিজে ঐ মেসেঞ্জারদেরকে মানুষের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিতে পারতেন  তাহলে নবিকে ইসলাম গ্রহণের জন্য এতগুলি যুদ্ধ আর লোকক্ষয় করতে হতোনা; ক্রুসেডে এত লোক  নিহত হতো না। দুর্যোধনকে ভাল সৎ করে তুললে শ্রীকৃষ্ণের ভোজবাজি বিশ্বরূপ  অর্জুনকে দর্শন করাতে হতোনা; কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এতো লোকক্ষয় হত না বা কংসকে   সৎ ভাল মনের করলে  দেবকী বাসুদেব  এত কষ্ট পেতেন না,  মৃত সত্যবানকে সাবিত্রীর  বাঁচিয়ে তুলতে হত না। এই  কঠিন প্রক্রিয়ায়  একজন মৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জীবিত করা বা কুমারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া বা  নদীকে দুভাগ করা বা চাঁদকে দ্বি-খণ্ডিত করা বা  মেরাজে করে সপ্ত স্বর্গ ভ্রমণ করানোর  ক্ষমতার চাইতে  অনেক  সহজতর। তখন দেব দেবী  বা ভগবানের দূত মুসা ঈশা আল্লাহর এই উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক কাজ করার প্রয়োজনই পড়ত না। সারা পৃথিবীর সবাই ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে যেত। তাহলে??

যুক্তিবাদীর খোঁজে -মহম্মদ মহসীন
Nov. 24, 2024 | সচেতনতা | views:292 | likes:2 | share: 0 | comments:0

বয়স তাঁর ৭৫,  কবিতার আসরে একটি কবিতা শোনালেন। মুক্তমনের কবিতা।  বক্তব্য, পৃথিবীতে অনেক অনেক দেশ আছে, যেখানে লক্ষ্মীপুজো করা হয় না কিন্তু ব্যবসায়ে তারাই অনেক এগিয়ে অনেকানেক দেশ আছে যে দেশের অনেকে সরস্বতীর নামই শোনেনি, কিন্তু তারাই শিক্ষায় জ্ঞানে বুদ্ধিতে বিজ্ঞানের আবিষ্কারে  পথ দেখাচ্ছেন সারা বিশ্বকে। পুজোর নীটফল আসলে শুন্য। প্রার্থনার ভরসায় না থেকে, সেই সময়টাতে কায়িক বা মানসিক উৎপাদনাত্মক কাজ করার সুপরামর্শ বিষয়ে কবিতা। বৌদ্ধিক বিকাশে পুজো-আচ্চার সার-শুন্যতাই তাঁর কবিতার উপজীব্য-কেন্দ্র। পাঠশেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ একটা অন্য রকম চিন্তা ভাবনা। তাই নয় কি?

  বুঝলাম, জীবনের ৭৪-টি শরৎ-আঁধার পার করার পর তাঁর মাঝে এই সু-বোধ এসেছে। মুক্তচিন্তনের জানালা খুলে মুক্তির বাতাসের বার্তায় কান রাখার সন্ধিক্ষণ এসেছে তাঁর জীবনে। তিনি নতুনের পেয়েছেন সন্ধান, সত্যের আলোয় দিশা পেয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। এগুলি খুবই ভাল কথা, আশার কথা। এই আশার কথা নিয়েই আজ দুটো কথা লিখি। মুক্ত চিন্তনের পরিসর করে দেওয়া আমাদের দায়। তাঁর কাছে যাওয়ার কথা ছিল আমার, দেবরাজের আর অনির্বাণের। উনিই একদিন চলে এলেন আমার বাড়িতে। অনেক কথা হলো। ভাল লেগে গেল ৭৫ বছরের এই যুবকটিকে। তাঁর মাঝে যুক্তিবাদের এই উন্মেষকে প্রত্যক্ষ করেই এবারের চেতনায় লেখার বিষয় পেয়ে গেলাম। বুঝলাম, দ্বীপে শুধু আমরা কয়েকজনই নেই, আমাদের সমমনস্কের প্রসারতার মহাবিশ্বে অনেকেই আমাদের আজো অজানা, আজো অজ্ঞাত। আজ তাই আমাদের আশার কথা নিয়েই এক কলম লেখার প্রয়াস। 


দ্বিতীয় জনকে যেমন দেখেছি:

  ইনি একজন রাজমিস্ত্রী। কাজ করছিলেন আমাদের বাড়িতে। লেখাপড়া ঐ ক্লাস নাইন কি টেন পর্যন্ত। কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা কথার উল্লেখ না করলেই নয়। নিয়মিত লাইব্রেরী যান। রাত্রে বই পড়েন; শরৎ থেকে শরদিন্দু সব। আগাথা ক্রিস্টি, হ্যাডলি চেজ, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথও তার পছন্দের লেখিকা-লেখক। জীবনানন্দও পড়ে ভাল লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রবীর ঘোষ বা ভবানিপ্রসাদ সাহুর বই পড়েছেন? বললেন, এই দুইজনই তাঁর অত্যন্ত পছন্দের লেখক। হাল আমলের তসলিমাও তাঁর আগ্রহের  ভিতরেই। একবার আমাদের ধনিয়াখালী সুরভি পাঠাগারের সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বয়স ঐ রকমই অর্থাৎ মধ্য সত্তর। তিনি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ্য, ডোম, হাড়ি, শুঁড়ি এসব জাতপাত মানেন না। বেদ পুরাণ হ'ল ব্রাহ্মণদের বানানো গ্রন্থ। ধর্মের কঙ্কাল তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে বেশ ধরা পড়ে। নিরীশ্বরবাদী না হলেও, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্রের কাঠামোটির অনেকটাই চিনে নিয়েছেন। 


  চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমজীবি। গান বাজছিল, "শত জনমের, কত সাধনায়, পেয়েছি মানব প্রাণ।" শুনে একজন অকপটে দ্বিধাহীন উচ্চৈস্বরে বলেন, গানটাতে ভুল বলছে, একেবারেই ভুল বলছে। জীবন একটাই। জন্ম একটাই। আগের জন্ম, পরের জন্ম, ওসব একেবারেই ধাপ্পাবাজি।

 আমি সেখানেই ছিলাম। বেশ অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিভাবে বুঝলেন জন্মান্তর নেই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি দাবী করছেন জন্মান্তর বলে কিছু আছে? তাহলে আপনিই আপনার কথাটার প্রমাণ দিন। সত্যি অবাক হয়েছিলাম তাঁর এই যুক্তিশীল মানসিকতায়। 


   এক খ্যাতনামা জ্যোতিষীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, দেখো, আগে তো নিজের জীবিকা। জ্যোতিষ প্র‍্যাক্টিস করে উপার্জন আমাদের দেশে সম্মানের পেশা। তবে তুমি যেটি বলতে চাইছ, তাতে আমিও পূর্ণ সহমত। আমি তো বিজ্ঞান নিয়ে কিছুটা পড়েছি। তাতেই বুঝলাম, জ্যোতিষে বিজ্ঞানের কোনোকিছুই নেই। লোককে বিজ্ঞানের নামে ধাপ্পা না দিলে কিছু শিক্ষিত লোককে আমাদের আঙিনায় আনা যায় না।


   এক ওঝা।  আঁকিবুঁকি এঁকে, গুনে,  মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, জলপড়া দিয়ে ভূত তাড়ান। বাড়ির দোষ কাটান। একান্তে স্বীকার করেছিলেন, ভূত, প্রেত, বলে কিছুই নেই। তাঁর অভিজ্ঞতায় এগুলো খেটে খাওয়া, কোথাও এতটুকু আলো-না-পাওয়া সমাজের অন্ধবিশ্বাস। সেই অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করেই আমাদের এই উপার্জন। মন সায় দেয় না। কিন্তু এ কাজে নাম হয়ে গেছে। পুরাতন পেশা। ছাড়ার কথাই চিন্তা করি না। কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং আমার ছেলে যখন লেখাপড়া শিখে বেকার জীবন কাটাচ্ছিল। তাকে চাকুরির ব্যবস্থা ধ্বংস করে, কোটি টাকার পাহাড় জমাচ্ছিল নেতা-মন্ত্রীরা, দুটো টাকার জন্য হতাশায় ভুগছিল, সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। তখন  সেই অবস্থায় তাকে এই পথে আসার জন্য উৎসাহিত করি। এখন সে মাসে মাসে সম্মানজনক আয় করে থাকে। আর দেখবে, পয়সা না থাকলে তার কোনো জায়গাও নেই এই পৃথিবীতে।

  

সাথী, আজ আমি এইসবের মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় বুঝলাম। 

এক, যুক্তিবাদ সকলের মধ্যেই আছে, সামাজিক আচার সেই যুক্তিমনস্কতাকে চাপা দিয়ে রেখেছে। কখনো আপন সত্তায় তা কোথাও কোথাও প্রস্ফুটিত হয়েও চলেছে। তবে সমর্থনের অভাবে, অভিঘাতের প্রভাবে, সম্পূর্ণভাবে তার প্রস্ফুটন ঘটতে পারছে না। উপরের যাঁদের কাছে আমি সরাসরি জানতে চেয়েছি, ঈশ্বর আছে কি না, তার উত্তর পেয়েছি, "কেউ একটা, কিছু একটা আছে।"

এবং

দুই, পেশার কারণে অবৈজ্ঞানিক বুঝলেও সেই পেশাকে গ্রহন করে জীবিকানির্বাহ করতে হচ্ছে। অনেক হোমিও ডাক্তার আছেন, যিনি নিজের চিকিৎসা করান মর্ডার্ণ ট্রীটমেন্ট ব্যবস্থায়। অবৈজ্ঞানিক বুঝলেও সেই পেশা নিতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামো অনেককে বাধ্য করে অবৈজ্ঞানিক জীবিকা বেছে নিতে। আমার দেখা এই জ্যোতিষিটি একান্তে স্বীকার করেন, এটা একটা ব্যাবসায়। জাতকের জীবনশৈলী দেখেই ভূত-ভবিষ্যত বলতে হয়। মামলা-মোকদ্দমা, প্রেম, সন্দেহ, বেকারত্ব, প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা, সন্তানের লেখাপড়াজনিত হতাশার সমাধানের আশায় ছুটে আসেন তাঁরা। তাঁদের এই হতাশা, দুর্বলতাই জ্যোতিষীর মূলধন।

   মানুষ তো আসলে এক র‍্যাশানাল এ্যানিমাল, তার মাঝে যেমন এ্যানিম্যালিটি আছে, তেমনই তার মাঝে র‍্যাশানালিটিও আছে। কিন্তু ঐ যে স্বার্থান্বেষী সমাজে ধর্মধ্বজীদের বানানো এক জগদ্দল পাথর মানুষের এই যুক্তিবাদী মননকে চাপা দিয়ে  দমিয়ে রেখে এসেছে, আসছে।  তবু শাশ্বত প্রকৃতিকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা কৃত্রিমের থাকতে পারেনা৷ তাই নিকষ আঁধারের দুর্ভেদ স্থুল-বেধ প্রাচীরকেও ভেদ করতে পারে যুক্তিবাদের আলো। তার প্রকাশই আমরা পাই জীবনের আবশ্যিক ডাইমেনশন বা মাত্রাগুলিতে। 

  স্বার্থান্বেষীদের ভারী ভয়, যুক্তিবাদের মশাল যাঁরা বহন করে চলেছেন, তাঁদেরকে ভীষণ ভয়। তাই তারা মুক্তমনাদের খুন করে কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা জারি রেখে চলেছে। পারছে কি?

বিজ্ঞান ও ধর্ম -শুভ্র সরকার
Nov. 24, 2024 | মুক্তমনা | views:5277 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আপনি যে কাগজের উপর ছাপানো অর্থৎ বই আকারে আপনাদের কোরান, গীতা, বাইবেল পরেন সে বই, কাগজ, কালি, ছাপানোর ম্যাসিন, ছাপাখানাটি কে আবিষ্কার করেছে তা কি জানেন? 

কাগজ আবিষ্কার করেন চীনারা। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ বছর আগে চীনারা কাগজ আবিষ্কার করে, সেই কাগজ সারাবিশ্বে রপ্তানি করতেন। আপনার ঐ ধর্মীয় পুস্তকটিতে সেই  কাগজই ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে কোন ঐশ্বরিক বস্তু এতে ব্যবহৃত হয়নি। তাই ধর্মগ্রন্থ নিজেই কি বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হলোনা?

আপনি যে ধর্মগ্রন্থটি পড়ে এতসব ধর্মীয় নিয়ম নীতি আওরান, ঐ পুস্তক বা বইটি তৈরি হয়েছে একটি ছাপাখনায়। আর ছাপাখনাটিও বিজ্ঞানের অবদান। ঐ ছাপাখানা ও বই কে কে তৈরি করেছে জানেন?

১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির মেনাজ শহরে ছাপাখানা আবিষ্কার করেন গুটেনবার্গ। এবং ইংরেজি ভাষায় ইংল্যান্ডে প্রথম গ্রন্থ মুদ্রন করেন উইলিয়াম ক্যাক্সটন।

শুধু কাগজ আবিষ্কার, ছাপানোর যন্ত্র ও বই ছাপানোর ব্যবস্থা উদ্ভাবনেই কিন্তু আপনার ধর্মগ্রন্থটি তৈরি হয়ে যায়নি। এতে উপযুক্ত মানের কালিরও দরকার হয়েছে। আর উপযুক্ত মানের কালি মানে তৈলাক্ত কালি। যা ছাড়া আপনার বই ছাপালে সেই কালি অল্প ঘষাতেই উঠে যেত। তাই প্রথম তৈলাক্ত কালি তথা লিথোগ্রাফি প্রযুক্তির আবিষ্কার করেন জার্মান অভিনেতা অ্যালোয়িস সেনেফেল্ডার। 

এবং এখানেই শেষ নয়। এই ছাপাখানা মানুষের চাহিদা মিটাতে পারছিলোনা। তাই এক সময় এই ছাপাখানাও অচল হয়ে যায় আধুনিক ছাপাখানার বদৌলতে। এটি করতে হয় মানুষের প্রয়োজনে। আর আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কার করেন ইংল্যান্ডের রবার্ট বাকলে।

এবার আশি একটু কলমের কথায়। কারন কলম ছাড়া আপনার আমার লেখা পড়া'র 'ল' ও হতোনা। মানুষের এ প্রয়োজন বুঝে কলম আবিষ্কার করেন ওয়াটার ম্যান। অবশ্য এটি ছিলো ফাউন্টেন পেন। কলমের পরেও আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন মানুষ খুব বোধ করে। আর তা হলো পেন্সিল। আর পেন্সিল আবিষ্কার করেন রোমানরা। 

এবার আশি বলপয়েন্ট কলমের কথায়। যার প্রথম পেটেন্ট করেছিলেন জন জে. লাউডকে ১৮৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর। আর বলপয়েন্ট পেন এখন সবার মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে ফাউন্টেন পেন আর দেখাই যায়না।

তাহলে এখানে আমরা কি দেখতে পাই? আপনার ধর্মপুস্তক বিজ্ঞানের কাছে প্রতিপদক্ষেপে ধরা খেয়ে বসে আছে। ধর্মপুস্তক পড়ার আগে বিজ্ঞানকে একশতবার প্রনাম করে আসতে হয় আপনাকে। কারন বই বানানোর এই এতোগুলো পদ্ধতির মধ্যে কোথাও কি কোন ধর্মান্ধদের হাত দেখতে পেলাম আমরা! কোথাও পাইনি। অথচ ধর্মান্ধরাই মানুষের জীবনকে বিভীষিকাময় করে রেখেছে আজীবন। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের জঞ্জাল জীবনকে এক পা এগুলে যেন একশত পা পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। আর এই মানুষের প্রয়োজনে মানুষ যে আবিষ্কার গুলো করেছে সে আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করেই তো ধর্মান্ধরা এখন তাদের তথাকথিত শিক্ষা দীক্ষা পরিচালনা করছে। এমনকি কেউ আছে বই, কাগজ, কলম, কালি ছাড়া তাদের শিক্ষা দীক্ষাকে একটুও এগিয়ে নিতে পারবে! তাহলে সবাইকেইতো বিজ্ঞানের কাছে নতজানু হতেই হয়। বিজ্ঞানের কাছে এত নতজানু হওয়ার পরেও যে মানুষেরা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার কথা বলে তারা যে কত বড় ধর্মীয় সেবক সেটা বুঝতে আর কারো কাছে কি যাওয়ার প্রয়োজন আছে! 

এবার ভাষার কথায় আশা যাক। ভাষার মাধ্যমে এই যে ভাবের বিনিময়, কথার আদান প্রদান, সেটাকে দেখা হয় বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হিসেবে। সবকিছুকে বদলে দিয়েছে এই ভাষা।

"জটিল যতো বিষয় আছে তার একটি এই ভাষা এবং এটিই আমাদের মানুষ বানিয়েছে, বলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানব বিবর্তন বিভাগের শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী রবার্ট ফোলি। তাই ভাষাতো আর কোন ঈশ্বর বানিয়েছে একথা কেউ বলেনি। ভাষাটি আবিষ্কার করা কোন ধর্ম প্রবর্তকের পক্ষে বহুবছর চেষ্টা করেও সম্ভব নয়। দু'একজন ওয়াজকারী অবশ্য এমন দাবিও করে বসেন মাঝে মধ্যে। আচ্ছা ভাষা যদি ঈশ্বর তৈরি করে দিয়ে না থাকে তাহলে সে কেমন ঈশ্বর যে আমাদের তৈরি ভাষায় উনাকে ডাকতে বলেন!

তাই এখন একথা বলাই যায় যে এইসব কিছু আবিস্কার হওয়ার পর ধর্ম প্রবর্তক বা প্রচারকেরা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন এসব তাদের বাপ-দাদাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। আজ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি কারি এই মানুষগুলো শুধু গুজব ও গজব ছাড়া ভালো কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি।

এই গুজব ও গজবের আবিস্কারকরাই নিজেদের মহাজ্ঞানী ভাবে। 

বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞানচর্চা, কুসংস্কার ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভুমিকা -চার্বাক কাজী
Nov. 24, 2024 | মুক্তমনা | views:2573 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিজ্ঞানসম্মত প্রামান্যতার পরিবর্তে ছদ্মবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণাকে পোষণ করা, আচারের নামে সেই সব গোঁড়ামিকে লালন করা এবং অন্ধত্বের সাথে অনুসরণ করার নামই কুসংস্কার।

 

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য চাই বিজ্ঞান, ছদ্মবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের সম্যক অনুধাবন ও বোধগম্যতা। সংজ্ঞা বিচারে: – বিজ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের নিয়মকে বুঝবার একটি সমন্বিত মানবিক প্রচেষ্টা। সে লক্ষ্যে ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। 

– বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোকে যুক্তি ছাড়াই অমূলক ব্যাখ্যা দেয়াটা হচ্ছে অপবিজ্ঞান; অমূলক ধ্যান ধারনাকে বিজ্ঞানের নামে চালিয়ে দেয়া। যেমন জ্যোতিষ শাস্ত্র বা অ্যাসট্রোলজি, সংখ্যাতত্ত্ব বা নিউমেরোলজি বা অশরীরী আত্মা ও প্রেতাত্মা বা ভূত-প্রেত-জ্বিন ইত্যাদি। ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহ’র ধারনা এই অপবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে, কারন ঐশী এক সত্ত্বায় আস্থা রাখার প্রবণতাটি ব্যক্তিকে বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে দূরে সরিয়ে অলৌকিকত্বের ধারনায় আস্থাশীল করে তোলে।

 

– নিছক কোন উক্তি, বানী, বা মন্তব্য কে মনের মাধুরীতে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে সমন্বিত করার নাম হল ছদ্মবিজ্ঞান। সাধারণত প্রাচীন পুঁথি, পুরাণ, পৌরাণিক গল্প ও প্রচলিত গল্প থেকে বৈজ্ঞানিক নিদর্শন বের করে বিজ্ঞানের আলোকে সেটাকে মুড়ে অলৌকিকত্বের নিদর্শন হিসেবে চালানোটাই হচ্ছে ছদ্মবিজ্ঞান। কুরানে বেগ্যান, ব্যাদে বেগ্যান সেগুলোরই নিদর্শন। অশিক্ষিত সমাজে এই ধারা বেশ সাড়া পায়।

 

অলৌকিকত্বের জন্মই হয় পরিপূর্ণ তথ্যের অভাবে।

যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা আপাত দৃষ্টিতে লৌকিক নিয়মের বিপরীত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায়ে ব্যাখ্যা যোগ্য নয় ও বুদ্ধির অগম্য থাকে, ততক্ষণ সেটাতে ঐশী শক্তির সরাসরি তত্ত্বাবধান পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু যে মূহুর্তে সেটা পরীক্ষাযোগ্য ও ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে ওঠে, ঐশী শক্তি সেখান থেকে লুপ্ত হয়। অপ্রমানিত অস্তিত্ব বলেই প্রকৃতপক্ষে অলৌকিক ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা ধার্মিক বা নিধার্মিক কারো পক্ষেই সম্ভব নয়; ফলে সেটা হয়ে ওঠে বিশ্বাসজনিত ভাবালুতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি। আর বিশ্বাসের কোন যুক্তি কখনই থাকে না, যুক্তি আর বিশ্বাস চিরকালই পরস্পর বিরোধী, কারন সম্যক অনুধাবন ও বোধগম্যতার জন্য জরুরী যুক্তি। চিন্তার ক্ষমতা মানুষের অন্যতম গুন। আর এই চিন্তাকে সুসংহত ভাবে ভাষায় ব্যক্ত করার বৈজ্ঞানিক ধারা হল যুক্তি; অলৌকিকতার পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং আলোচনায় যুক্তিকেই চূড়ান্ত মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণের নীতি হচ্ছে যুক্তিবাদীর সম্যক পরিচয়।

 

যৌক্তিক চিন্তার বিপরীতে যাদু, ইন্দ্রজাল, মায়াবিদ্যা, গুপ্ত শক্তি, ভোজবাজি, অলৌকিক বা ঐন্দ্রজালিক সমাধান যখন মানুষের জীবনে প্রাধান্য পায়, তখন সেটা প্রগতির বিরুদ্ধাচারন করে, তখন সেটা হয়ে ওঠে যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা দিবাস্বপ্ন বা ভাবাবেশ বা আজগুবি কল্পনা বা ফ্যান্টাসি যা চিন্তা ও মননকে বিকশিত করার পরিবর্তে ঠেলে দেয় অন্ধ বিশ্বাসের পথে। ধর্মগুলো ঐন্দ্রজালিক সমাধানে বিশ্বাস করে বলেই ধর্ম হচ্ছে মুলত রুপকথা ও ফ্যান্টাসির জগত; আর সেজন্যই ধর্মে বিশ্বাসও মানব সভ্যতার জন্য নেতিবাচক।

 রূপকথা হল সংক্ষিপ্ত কাল্পনিক গদ্য বা পদ্য, যা সাময়িক ভাবে আনন্দদায়ক ও মজার, কিন্তু অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বা সে ধরনের অন্যান্য উপাদানকে ব্যবহার করে বলে অত্যন্ত অভাবনীয় সব বিবরণে পরিপূর্ণ। রূপকথাগুলোতে প্রায়শই বিভিন্ন কাল্পনিক প্রাণী এবং তাদের অবিশ্বাস্য, অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর ঐন্দ্রজালিক সমাধানের বর্ণনা পাওয়া যায়। রূপকথার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই গল্পগুলো মানুষের মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ায়।

 

ঈশ্বর ধারনার মতই রূপকথা সদৃশ ধর্মগুলোও দাবি করে নিরবিচ্ছিন্ন দৃঢ় বিশ্বাস। সেটাই আর অস্তিত্বের ভিত্তি, আর সেকারনেই প্রশ্ন বা সংশয় নিয়ে তাদের রয়েছে প্রবল আপত্তি, কখনও অনুভুতির মায়াকান্নায়, কখনও বা সহিংসতায় প্রশ্নকারীর কণ্ঠরোধেই তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে।

 বিজ্ঞান মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস দাবি করেনা; বিজ্ঞান দাবি করে বোধগম্যতা। বিজ্ঞান দাবি করে বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞান চর্চা।

 বিজ্ঞানচর্চা আর বিজ্ঞানমনস্কতা সমার্থক নয়; যদিও উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিজ্ঞানচর্চা হলো শুধুমাত্র প্রাযুক্তিক জ্ঞানের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিস্ট দক্ষতা অর্জন; পক্ষান্তরে বিজ্ঞানমনস্কতা হলো বুদ্ধিবৃত্তি ও বোধশক্তিতে সংস্কারমুক্ত ভাবে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বা সমালোচনামূলক চিন্তাধারায় দক্ষতা অর্জন। ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এর জন্য প্রয়োজন হয় সচেতনতার, যার চরিত্র স্বতঃপ্রণোদিত, সুশৃঙ্খল, স্বসংশোধনমূলক। সচেতন চর্চার অর্থ হচ্ছে মুলত জ্ঞানার্জন, অভিজ্ঞতা এবং অনুভবের মাধ্যমে বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অনুভুতির বিজ্ঞানমনস্ক অনুধাবন, উপলব্ধি ও প্রয়োগ।

 

ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে আজ প্রচলিত বহুবিধ কুসংস্কার, যার ফলে যুগ যুগ ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলেরই মানবগোষ্ঠী, এবং তা কেবল স্বল্পশিক্ষিতদের মাঝেই নয়, বরং তা গেঁড়ে আছে সমাজের সর্বস্তরেই। জীবনাচারে কুসংস্কার মুক্ত হতে না শিখলে, এই ভুল ধারণাগুলোর মূলোৎপাটন অসম্ভব; অসম্ভব একটি প্রগতিশীল সমাজে পরিনত হওয়া। আমাদের ধর্মপ্রভাবান্বিত পারিবারিক শিক্ষায় এবং ধর্মমোহের সাথে আপোষকামী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্তিবাদীতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার বিষয়গুলো আজ প্রবল ভাবে অনুপস্থিত ও উপেক্ষিত।

 ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর চাইতেও রাষ্ট্রের ভুলটা এক্ষেত্রে আরও বড়। কেন এই ২০১৪ সালেও রাষ্ট্রের উদ্যোগে একটি অদ্ভুত, প্রাচীনপন্থী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে যা মানুষকে মানবিক না করে প্রতিনিয়ত আরও ধর্মমুখী করে তুলছে? কেন এই শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রসর চিন্তাকে উৎসাহিত না করে অতীতমুখিনতা ও রুপকথায় বিশ্বাসকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যখন সমাজ বিকাশে সত্যিকার অর্থে জরুরি হলো যুক্তিবাদী হতে পারা; চিন্তা, চেতনা, মনন ও আচরনে শিক্ষিত, সভ্য, বিনয়ী, সংস্কৃতিবান ও মননশীল হতে পারা; বিজ্ঞান মনস্ক হতে পারা, অসাম্প্রদায়িক হতে পারা।

 

ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে কেন একটি রাষ্ট্রধর্ম থাকবে? কেন এই রাষ্ট্র ধর্মকে নিয়ে সমালোচনামুলক কোন লেখাকে অপরাধ মনে করবে? কেন ধর্মানুভুতির মত খেলো একটি বিষয়কে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহল গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে? কেন রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মানুভুতিকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ পাবে?

 

রাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতার মুখোশ উন্মোচন এবং দ্বৈতনীতির অবসান আশু প্রয়োজন।

 muktomona blog

ভক্ত পদাবলী: নেহরু, চীন এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ -অনুজ বিশ্বাস
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:278 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গালওয়ান উপত্যকা এবং ডোকালাম অঞ্চলের সীমান্ত সমস্যা প্রসঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন “ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল আমেরিকা। জওহরলাল নেহেরু সেটি না নিয়ে চীনকে দিয়ে দেন। তাই আজ আমাদের এতো খারাপ অবস্থা।”

পোষ্ট ট্রুথ সময়কালে দাঁড়িয়ে আজকের বিজেপি নেতারা পেট গজিয়ে যা বলে সেটি “ইতিহাস” হয়ে যায়।  যেমন হঠাৎ একদিন সকালে বলে দিল যে “শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী পশ্চিমবঙ্গ তৈরি করেছিলেন”। অমনি সঙ্গে সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রাণ বীরেন শাসমল, নেতাজি সুভাষ, ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ, প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষ, কিরণ শঙ্কর রায়, কালিপদ মুখার্জী, সতীশ দাশগুপ্ত, অজয় মুখার্জী, খগেন দাসগুপ্ত, লোকনাথ বল, সতীশ সামন্তদের মতো 10-15 বছর জেলে কাটানো সর্বত্যাগী “সন্ন্যাসী” স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আগে ট্রেন্ড করতে শুরু করে দিলেন “শ্যামা দা” .. যে শ্যামাদা ইউনিয়ন জ্যাক জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকা কালীন ইউনিয়ন জ্যাক অমান্য করার অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেত মারার হুকুম দিয়েছিলেন। এই শ্যামাদা 1941 সালে জিন্নার হাতে পায়ে ধরে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী তথা ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিলেন (তখন রাজ্যের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত)। বাংলা ভাগের পক্ষে শ্যামাদা ভোট দিয়েছিলেন মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। মনে বড়ো বাসনা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু যখন দেখলেন কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় তার কোনো জায়গা হবে না, মুখ্যমন্ত্রী হবেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, উপরন্ত জহরলাল নেহেরুর দয়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রথম শিল্প মন্ত্রী হয়েই থাকতে হবে তখন দেশভাগকে হাতিয়ার করে বলে বসলেন, “অখন্ড ভারত”।

লে হালুয়া।.. এখন তো আর দেশ জোড়া লাগানো যাবে না... এখন যত পারি অখণ্ড ভারত বলে চিল্লা-চিল্লি করি। “... ভাঙো, ভাঙো, ভাঙো, ভাঙো। .. যেই ভেঙে গেলো, অমনি শ্যামাদা ডাক ছেড়ে বলে উঠলেন, “জোড়ো”... দেশীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য, বিরোধিতা করার জন্য ওনাকে বিরোধিতা করতেই হবে। আর বিরোধিতা করতে গিয়ে শ্যামাদা এমন ভাবে রং বদলাবেন যে গিরগিটি অব্দি লজ্জা পাবে। যাই হোক, ১৯৫৩-তে dry pleurisy -তে শ্যামাদা পটল তোলার পরে 2019 সালে শ্যামাদা হঠাৎ বেঁচে উঠে এখন ঘোরাফেরা করছেন........“শ্যামা নামে লাগলো আগুন”।

এখন অমিত বাবু হঠাৎ বলছে যে, “ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করার প্রস্তাব চীনকে দিয়ে দিয়েছিলেন নেহেরু।“

1955 সালে 27 শে সেপ্টেম্বর সংসদে নেহেরু কি বলছেন?

“ভারতকে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি... যারা রটিয়ে বেরাচ্ছে তারা ভুল রটিয়ে বেড়াচ্ছে। .. ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে গেলে রাষ্ট্রসংঘের সনদ পরিবর্তন করতে হবে যে সনদের মাধ্যমে 1945 সালে স্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। .. সে সনদ পরিবর্তন করা এখন সম্ভব নয়... ভারত নিজের জোরেই একদিন রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করবে।“


তাহলে চীন ঢুকলো কি করে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে 1949 সালে?

উঃ চীন 1949 সালে ঢোকেনি... ঢুকেছে 1971 সালে। 

1971 সালের 15ই জুলাই, রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ পরিষদের (General Assembly) 26 তম অধিবেশনে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর করে মাও জে দঙের সঙ্গে মিটমাট করে আসার পরে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে আলবেনিয়ার নেতৃত্বে 17টি দেশ একযোগে  Restoration of the lawful rights of the People's Republic of China in the United Nations নামে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে, যেটা  The United Nations General Assembly Resolution 2758 (Resolution on Admitting Peking) নামেও পরিচিত। এই প্রস্তাব থেকেই যত সমস্যার উদ্ভব হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধে চীন কে পাশে পাওয়ার জন্য 25 অক্টোবর 1971 সালে 76-35 ভোটে এই প্রস্তাব চীনের পক্ষে পাস করানো হয় এবং রাষ্ট্র সংঘে চীনের অনুপ্রবেশ ঘটে। যদিও আমেরিকার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে  পাকিস্তানকে সাহায্য করতে গিয়েও রাশিয়ার ভয়ে চীন ব্যাক গিয়ার দেয় এবং মাদাগাস্কার প্রণালী থেকে ব্রিটিশ নৌবহর ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। তথাপি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্রমাগত ভয়াবহ পরিণাম, চীনের ভৌগোলিক অবস্থান এসব কারনে চীনকে যে কোনও মূল্যে পাশে পাওয়ার জন্য নিক্সন গিয়েছিলেন মাও এর সাথে সেটিং করতে।


সেকি? এ তো নতুন কথা। .. তাহলে 1949 থেকে 1971 পর্যন্ত কি হয়েছিল?

উঃ নাম নিয়ে বিবাদ। এই বিষয়টা একটু বিশদে জানা দরকার।

1912 সালের জানুয়ারি মাসে মাঞ্চু রাজবংশের পতন ঘটিয়ে সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম Republic of China প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ 1912 থেকেই চীন একটি স্বাধীন দেশ। 1917 সালে ব্রিটেনের নেতৃত্বে চীন মিত্র বাহিনীর পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় এবং ইংরেজদের স্বাভাবিক মিত্র (Natural Ally) হিসাবে কাজ করে। 1945 সালের 26 জুন রাষ্ট্র সংঘ প্রতিষ্ঠার সময় যে 51টি দেশ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে সনদে স্বাক্ষর করে তাদের মধ্যে অন্যতম এই Republic of China, আমাদের দেশেও ছিল কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসাবে নয়, ব্রিটিশ ভারত হিসাবে আর চীন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্র সংঘের স্বপক্ষে অনুসমর্থন বা Deposit of Ratification দেওয়ার সময় আসে তখন তৎকালীন চিনা প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইসেক তা জমা দেন 28 সেপ্টেম্বর 1945 এবং ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে তৎকালীন বড়লাট লর্ড মেয়ো, যুদ্ধোত্তর দেশের পুনর্গঠনের অজুহাত দেখিয়ে Deposit of Ratification জমা করেন 30 অক্টোবর 1945.... স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীন ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। 

রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ১৯৪৫ সালে করা হয় Republic of China (ROC) কে, তখন সেই দেশের প্রধান ছিলেন চিয়াং কাই শেক এবং ওই ROC ছিল বর্তমান চীন ভূখণ্ডই। 1945 সালে যে পাঁচটি দেশ রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এবং ভেটো ক্ষমতাধারী সদস্য (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন) তারা প্রত্যেকেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী কোনও পরাধীন অথবা যুদ্ধপরাধী দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ভেটো প্রদানকারী সদস্য হতে পারে না। তাই জাপান, জার্মানীর মত দেশ যুদ্ধপরাধী বলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্যতা লাভ করে অনেক পরে। ভারত স্বাধীন হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সৃষ্টির আরো 2 বছর পরে আর ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংবিধান সংশোধনের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে কারনেই, আজ অবধি ষষ্ঠ কোনও দেশ এই গ্রুপে ঢুকতে পারেনি। 


 ১৯৪৯ সালে মাও যে দঙের নেতৃত্বে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।  কমিউনিস্ট পার্টি চিয়াং কে পিটিয়ে তাইপেতে পাঠিয়ে দেয়, যেটির নতুন নাম হয় তাইওয়ান এবং সেই নতুন দ্বীপরাষ্ট্রের নাম হয়, Republic of China (RoC) ... আর মূল চীন ভূখণ্ডের নাম হয় Peoples Republic of China (PRC) ... মাও যে দঙের নেতৃত্বে। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্য হিসাবে তো UN charter অনুযায়ী জ্বলজ্বল করছে ROC.. সেটা তাহলে এখন কারা? মূল ভূখণ্ড না তাইওয়ান? শ্যাম রাখি না কুল রাখি? চিয়াং কাই শেককে রাখি? না চীনের মূল ভূখন্ডকে রাখি?


এবারে এই দুটোর দেশের মধ্যে কোন দেশটি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবে? আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলতে থাকে, তাইওয়ানই স্থায়ী সদস্য হওয়ার উপযুক্ত। কমিউনিস্ট রাশিয়া সমর্থন করতে থাকে চীনকে। 


দুটো দেশকেই কেন একসঙ্গে সদস্য করা যাচ্ছিলো না?

 ROC এবং PRC কেউ কারুর অস্তিত্ব মানছিল না এবং আজও মানে না... দুজনেই বলছিল তারাই মূল ভূখণ্ড এবং তাইওয়ানের শাসক। .. কিন্তু ধীরে ধীরে পশ্চিমী দেশগুলোও PRC কেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য মানতে শুরু করে যখন ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে চীন – সোভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। আমেরিকা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করেনি।  তাইওয়ানকে বিশেষ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডকেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করা হয় সোভিয়েতকে কোনঠাসা করতে। এর পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে ঠান্ডা যুদ্ধ। যদি আমেরিকার সাথে ইউরোপের কোনও দেশের ঠান্ডা যুদ্ধ লাগতো তাহলে কেউ চীনের দিকে ফিরেও দেখতো না। কিন্তু সংঘর্ষ বাধলো রাশিয়ার সঙ্গে। এক্ষেত্রে চীনের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শোচনীয় অবস্থা,  তার উপরে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সীমান্ত সংঘর্ষ। অর্থাৎ শত্রুর শত্রু মানে আমার বন্ধু। এই ফর্মুলা মেনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর করে মাও জে দঙের সঙ্গে মিটমাট করে আসার পরে আমেরিকার ইশারায় আলবেনিয়ার নেতৃত্বে 17টি দেশ একযোগে  Restoration of the lawful rights of the People's Republic of China in the United Nations নামক প্রস্তাব উত্থাপন করে যা  The United Nations General Assembly Resolution 2758 (Resolution on Admitting Peking) নামেও পরিচিত। ভোটাভুটিতে পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সরকারী ভাবে জানানো হয়, "Recognising that the representatives of the Government of the People's Republic of China are the only lawful representatives of China to the United Nations and that the People's Republic of China is one of the five permanent members of the Security Council.

Decides to restore all its rights to the People's Republic of China and to recognise the Representatives as the only legitimate representative of China to the United Nations, and to expel forthwith the representatives of Chiang Kai-shek from its place..." 

1976th plennary meeting, dtd. 25 October 1971.

তাহলে নেহেরু আসছেন কোথা থেকে?

উঃ 1949 সালে নেহেরু নিজের মতামত দিয়েছিলেন যে দুই চীনের মধ্যে একজনকে যদি করতেই হয়, তাহলে পুঁচকে দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে না করে জনসংখ্যার কারণেই মূল চীন ভূখন্ডকেই অর্থাৎ PRC কেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করা হোক। এটা সম্পুর্নভাবে নেহেরুর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।


কিন্তু আমেরিকা তো ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল?

উঃ কোনো সরকারি প্রস্তাব আসেনি... কেনেডির মতো কেউ কেউ মনে করতেন যে গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারতেরই রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়া উচিত। .. কিন্তু সেক্ষেত্রে UN charter বা রাষ্ট্রসংঘের সনদ পরিবর্তন করতে হতো। আমেরিকা চাইলেই হতো না, সোভিয়েত ভেটো প্রয়োগ করে আটকে দিতে পারতো। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আমেরিকার গায়ের জোরে ভারতকে স্থায়ী সদস্য হওয়ার আহ্বান জানালো, তাহলে তো রাষ্ট্রসঙ্ঘের নথিতে সেসব উল্লেখ থাকতো। এমন কোনও নথি রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাফেজখানায় পাওয়া যায় নি। যদি এমন কিছু ঘটতো তাহলে তার নথি অবশ্যই থাকতো। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কোনো NDA সরকার নয়, যাদের সব কিছুতেই No Data Available থাকে।

তাহলে নেহরুর রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার তথ্যটি মিথ্যা?


উঃ ওই “শ্যামা দা”-র হঠাৎ করে মৃত্যুর 66 বছর পরে “পশ্চিমবঙ্গের রূপকার” হয়ে যাওয়ার মতো “সত্য “... “স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে গল্প “ করতে করতে শ্যামাদা হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গকে কখন যে টেনে ভারতে নিয়ে এনে ফেললেন, অন্ধভক্তরা ছাড়া কেউ ধরতেই পারলো না। নেহরুর রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ চীনকে দিয়ে দেওয়ার গপ্পটিও অমন “শ্যামাদা”-র গপ্পের মতোই whatsapp university তে লেখা হয়েছে। কিভাবে লেখা হয়েছে সেকথা জানতে গেলে কিন্ত নিজের মগজাস্ত্রটি  গোয়াল ঘরে জমা রাখতে হবে।।

অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক বিভাগে কর্মরত।

সিভিলাইজেশন স্কেল -সেখ রামিজুল করিম
Nov. 24, 2024 | সমাজ | views:280 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা জানি পৃথিবী এবং সভ্যতা বিগত ২০০,০০০ বছর ধরে এটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সময়ের সঙ্গে প্রচুর পরিবর্তন অনুভব করেছে। মানব প্রজাতি মহাবিশ্বের বিপুল ১৩.৭ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) বছর বয়সের মাত্র ০. ০০১৫ % সময় ধরে অস্তিত্বে আছে। মানবতা সেই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দূর্জয় কাজকে জয় করেছে। আমরা আগুনের ব্যবহার ও শিকার করা থেকে, পুরো গ্রহে উপনিবেশ গঠন এর মত কাজ করেছি যা তুলনামূলক ভাবে মহাজাগতিক স্তরের দিক থেকে দেখলে চোখের পলক পড়ার থেকেও কম সময়য়ে। এর মধ্যে কিছু মহান চিন্তাশীল মস্তিষ্ক আধুনিক সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং এমন কিছু লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেছেন যা একসময় অসম্ভব আমাদের কাছে পুরোপুরি অসম্ভব ছিল, অন্তত সেটাই মনে করা হতো। 

কিন্তু, বিগত ১৫০ বছরে আমরা পৃথিবীর মাটিতে সীমাবদ্ধ থাকা থেকে আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশী চাঁদে পদার্পণের যোগ্যতা অর্জন করেছি। মানবতার সাফল্য যথেষ্ট প্রশংসনীয়, তবে সেটা শুধুমাত্র আমাদের নিরিখে। বাস্তবে মহাজাগতিক পর্যায়ে আমাদের প্রযুক্তির থেকে উন্নত কোনো এলিয়েন প্রজাতির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হলে কী ঘটবে তা আমাদের কল্পনার অতীত। 


               ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ 'নিকোলাই কারদাশেভ', অনুমানমূলক একটি লগারিদমিক স্কেলের ধারণা দেন যা কোনো সভ্যতা মোট যে পরিমাণ শক্তি উত্পাদন করতে পারে তার উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি সম্ভাব্য সভ্যতার স্তর পরিমাপ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই স্কেলটি থেকে ভবিষ্যৎ সভ্যতা কিরকম হবে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।  বিজ্ঞানী 'করদাসেভ' তাঁর স্কেলটি তে তিনটি প্রকারের সভ্যতার কথা বলেন -

টাইপ ১

টাইপ ২

টাইপ ৩

 তবে পরবর্তীকালে কিছু সম্প্রসারণ ও পরিবর্তন প্রস্তাবিত হয়েছে।

 'কারদাসেভ' শক্তির উপর ভিত্তি করে সভ্যতার তিনটি স্তরকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। 


টাইপ ১: এই প্রকার সভ্যতাকে একটি গ্রহ সভ্যতাও বলা হয়। বলা বাহুল্য এটি আমাদের বর্তমান সভ্যতার মতো নয়।

এই সভ্যতা, তাদের গ্রহটিকে তার হোস্ট স্টার (আমাদের ক্ষেত্রে সূর্য) থেকে পৌঁছানো সমস্ত শক্তি সঞ্চয় এবং ব্যবহার করতে সক্ষম। এই বিপুল শক্তির পরিমাণ প্রায় 1.74 x 10¹⁷ ওয়াট হবে। পৃথিবীতে আধুনিক সভ্যতাকে টাইপ ১ সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করলে মানুষ উন্নত সভ্যতার সর্বনিম্ন স্তরেও স্থান পাবে না। আধুনিক মানব সভ্যতাকে স্কেল অনুযাই পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞানীরা 'কারদাসেভ স্কেলে' এক ধরণের বর্ধিত শূন্যের লাইনের সৃষ্টি করেছেন। যখন এই স্কেলটি প্রস্তাবিত হয়েছিল বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, 'ন্যাশভিলের' পদার্থবিদ 'কার্ল সাগান', কারদাসেভ স্কেল অনুযাই একটি সভ্যতার অবস্থান এবং সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য একটি গাণিতিক সূত্র তৈরি করেন। সূত্রটি হলো,

"K=(log₁₀ p-6/10)"

যেখানে 'K' একটি সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং 'P', ওই সভ্যতা যতটা পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে তার পরিমাণ নির্দেশ করে।

২০১৮ সালে বিশ্বের মোট শক্তি খরচের পরিমাণ ছিলো ১৮.৪০ টেরাওয়াট, এখন এই সংখ্যাটিকে 'P' তে যুক্ত করলে কারদাশেভ স্কেলে আমাদের সভ্যতার রেটিং হবে প্রায় ০.৭৩।


      যদিও আমাদের গ্রহটির কয়েক বিলিয়ন মানুষ নিয়ে একটি সভ্যতা রয়েছে,আমরা পৃথিবীর কক্ষপথে সফল ভাবে স্যাটেলাইট স্থাপন করেছি, মহাকাশযানে চড়ে চাঁদে অভিযান করেছি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন তৈরি করেছি, কয়েকশো মিলিয়ন(১ মিলিয়ন=১০লক্ষ্য) কিলোমিটার ব্যায় করে অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলকে উপনিবেশ করার দাবি করেও আমরা এখনও কারদাশেভ স্কেলে '১' ও স্কোর করতে পারিনি।

 'কার্ল সাগান' অনুসারে মানবতা, সভ্যতার সবে প্রযুক্তিগত কৈশোরের ধাপ পেরিয়েছে।

জাপানের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী 'মিচিও কাকু'র দাবি অনুযায়ী মানুষ যদি প্রতি বছর গড়ে ৩% হারে শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে যায় তাহলে পরবর্তী ১০০ থেকে ২০০ বছরে 'টাইপ ১' স্ট্যাটাস, কয়েক হাজার বছর পরে 'টাইপ ২' স্ট্যাটাস এবং ১০০,০০০ থেকে ১ মিলিয়ন বছরে 'টাইপ ৩' স্ট্যাটাস পেতে পারে। 

 আমরা পরের দু'শো বছরে 'টাইপ ১' সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং এটি মানবতার পক্ষে এক বিশাল পদক্ষেপ। 'কার্দাসেভ' অনুযাই এই ধরণের সভ্যতায়(টাইপ-১) আমাদের নিজস্ব গ্রহের উপর আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, সম্ভবত আমরা আবহাওয়ার পরিবর্তনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। অর্থাৎ weather control করতে সক্ষম হব। আমাদের নিজস্ব গ্রহের ভূতাত্ত্বিক মেকআপ নিয়ন্ত্রণ এবং আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম হব। যদিও পরবর্তী টাইপ সভ্যতার তুলনায় এই পরিমাণ ক্ষমতার পরিমাণও সামান্য।


টাইপ ২: এই প্রকার সভ্যতাগুলিকে একটি উজ্জ্বল সভ্যতা হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, এই সভ্যতা তাদের হোস্ট স্টার এর মোট শক্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে সক্ষম। নক্ষত্রের পুরো শক্তির আউটপুটকে একত্রিত করে ব্যবহার করার জন্য একটি জনপ্রিয় তাত্ত্বিক (theoretical) যন্ত্র (device/machine) হলো  'ডাইসন স্ট্রাকচার' বা 'ডাইসন স্ফিয়ার'। অনেক জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান কাহিনী ও সিনেমাতে  এই ডিভাইস আগেও দেখে থাকতে পারেন।


১৯৬০ সালে আমিরিকান পদার্থবিদ 'ফ্রিম্যান ডাইসন' এই স্ট্রাকচারের ধারণা দেন। মূলত এটি নক্ষত্রের চারপাশে নির্মিত বিশাল আকারের একটি উন্মুক্ত ফাঁপা গোলক যা নক্ষত্র থেকে নির্গত বিপুল শক্তি কে সম্পূর্ণভাবে সংগ্রহ করবে। টাইপ ২ সভ্যতার শক্তির আরেকটি উৎস হলো নিকটবর্তী 'ব্ল্যাক হোল'- এর 'অ্যাক্রেশন ডিস্ক' থেকে নির্গত ফোটন সংগ্রহ করা। এখন, কোনও সভ্যতা কীভাবে, কোন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকহোলের অ্যাক্রেশন ডিস্ক থেকে শক্তি সংগ্রহ করবে আমাদের চিন্তাভাবনার বাইরে। যাইহোক, একটি টাইপ ২ সভ্যতা কেবল এই রকম অবিশ্বাস্য আকৃতির স্ট্রাকচার তৈরি করবে  তা নয়, তারা তাদের সৌরজগতের যেকোনো গ্রহে ইচ্ছেমত উপনিবেশ গঠন করবে এবং গ্রহোগুলিকে  নিয়ন্ত্রণ করবে, গ্রহাণুগুলিকে খনন করবে,বিভিন্ন গ্রহে ভ্রমণ বানিজ্যিক স্তরে নিয়ে যাবে, এক কথাই তাদের সৌরজগতের অভ্যন্তরে তারা যা ইচ্ছে তাই করবে। 


বলা বাহুল্য যেমন আমাদের বর্তমান সভ্যতার সাথে কোনও টাইপ ২ সভ্যতার তুলনা চলে না তেমনি টাইপ ১ সভ্যতার সাথে কোনো টাইপ ৩ সভ্যতার তুলনা করার মত কিছুই নেই।


টাইপ ৩: একটি টাইপ 3 সভ্যতা যা গ্যালাকটিক সভ্যতা হিসাবেও পরিচিত, এই সভ্যতা তাদের সম্পূর্ণ হোস্ট গ্যালাক্সির (ছায়াপথের) মোট শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই সভ্যতা যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করবে তা সত্যই ভীতিজনক (অন্তত আমাদের কাছে), যা শুনতে অনেকটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার মত।


              তারা টাইপ ২ সভ্যতার মতোই চূড়ান্তভাবে কাজ করবে, গ্রহ এবং গ্রহাণু মাইনিং (খনন) করবে, ডাইসন স্ফিয়ার বা তারথেকেও অ্যাডভান্স টেকনোলজি ব্যবহার করে নক্ষত্রের শক্তি সংগ্রহ করবে। এবং শক্তি সংগ্রহের জন্য তারা কেবলমাত্র একটি নক্ষত্র নয়, কোটি কোটি নক্ষত্র ব্যবহার করবে।

এই রকম শক্তিসমপন্ন একটি  সভ্যতা পুরো গ্যালাক্সিতে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে। ছায়াপথ আপাতদৃষ্টিতে তাদের খেলার মাঠে পরিণত হবে। এইভাবে ধীরে ধীরে যখন শক্তির চাহিদা আরও বাড়বে তখন তারা প্রথমে নিকটবর্তী ব্ল্যাকহোলের শক্তি তারপর যখন চাহিদা আরো বাড়বে তখন তাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র অবস্থিত ‘সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল’ থেকে তারা শক্তি সংগ্রহ করবে। (যেমন, আমাদের আকাশগঙ্গা বা milkey Way গ্যালাক্সির কেন্দ্রে 'সাজেটেরিয়াস-A' নামক super massive back hole অবস্থান করছে, যার অতীব মাধ্যর্ষণ বলের প্রভাবে পুরো গ্যালাক্সি তার চারিদিকে ঘূর্ণয়মান)।

তবে তাদের (টাইপ 3 সিভিলাইজেসন এর জীব দের) শক্তির চাহিদার স্থায়ী সমাধান হতে পারে যদি তারা মহাজগতের সবথেকে ভয়ংকর, রহস্যময় এবং বিষ্ময়কর বস্তুসমূহের একটি ‘কোইজার’ অথবা ‘কোয়াসার’ (কোয়াসি স্টেলার অবজেক্ট) এর শক্তি সংগ্রহ করতে পারে।

যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসচর্চা -মনীশ রায়চৌধুরী
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:808 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ইতিহাস! সেকি রবিবারের সকালে আবার ইতিহাস কেন? সে-তো স্কুলে অনেক পড়েছি। কত কষ্ট করে বাবর, হুমায়ুন, আকবর সব ফর্মুলা করে মনে রাখতাম। পানিপথের যুদ্ধ থেকে সিপাহী বিদ্রোহের সাল তারিখ সব মনে রেখে বড় বড় অক্ষরে খাতায় লিখতাম। বড় বড় অক্ষরে লিখলে বেশি পাতা লাগবে। যে যত এক্সট্রা পাতা নিত সে তত নম্বর পেত।


ইতিহাস বললেই আমাদের অধিকাংশ লোকের মনে এই ছবিটাই ভেসে ওঠে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসচর্চা তো শুধুমাত্র রাজা-বাদশার যুদ্ধের সাল-তারিখ মনে রেখে নম্বর পাওয়া নয়, তার বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক। ইতিহাস চর্চা সামগ্রিকভাবে করতে হলে বুঝতে হলে ভুগোল, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি সবকিছুই আলোচনা করতে হয়। 


ইতিহাসচর্চার সঠিক পদ্ধতি জানা বর্তমানে আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কারণ বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আরএসএস মতাদর্শপুষ্ট বিজেপি সরকার এই চর্চাকে গুলিয়ে দিতে চাইছে। ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত সেই ইজারাদারের দল স্বকপোলকল্পিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ এজেন্ডাকে ভারতের “চেপে রাখা প্রকৃত ইতিহাস” বলে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। তারা রাম, কৃষ্ণ, হনুমান প্রভৃতি পৌরাণিক চরিত্রদের ঐতিহাসিক বলে দাবি করছে। যেহেতু প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা থেকে মিডিয়া সবকিছুই তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে তাই সেই অবাস্তব দাবি মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। বাবরি মসজিদ, রাম জন্মভূমি ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের রায় তারই প্রমাণ। এই রায়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে এবার তারা মথুরাতে মসজিদের জমিতে কৃষ্ণের জন্মভূমি 'আবিষ্কার' করেছে। মোদ্দা কথা, এরা এমন এক ভারতের কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছে যার প্রাচীনকালের আর্য ঋষিরা জ্ঞানবিজ্ঞানে আধুনিক প্রযুক্তির যুগের থেকেও শ্রেষ্ঠ ছিল এবং পরবর্তীকালে আগত মুসলিম শাসকদের হাতে পড়েই তাদের কল্পিত ভারতমাতার গরিমা নষ্ট হয়েছে। ভারতের যা কিছু সর্বনাশ হয়েছে সব কিছুর জন্য মুসলিম শাসকেরা দায়ী। তারাই নাকি হিন্দুদের গর্বের ঐতিহ্য নষ্ট করে দিয়েছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়েছে। এবং এই 'ভারতীয় সংস্কৃতির' পুনরুদ্ধার করে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলাই এদের একমাত্র লক্ষ্য।


কিন্তু যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা এক অন্য ভারতের সন্ধান পাব। আমরা দেখতে পাব ভারতের প্রাচীনযুগে আধ্যাত্মবাদী দর্শনের পাশাপাশি বস্তুবাদী দর্শনেরও প্রবল চর্চা ছিল। শুধুমাত্র চার্বাক নয়। ভূতবাদ, স্যাদবাদ, সাংখ্য, মীমাংসা, বৌদ্ধ, জৈন দর্শন ছিল। ভারতের প্রাচীনতম দর্শন মীমাংসা তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপরেও গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন তুলেছিল। প্রকৃত বৌদ্ধদর্শনে ঈশ্বর বা অলৌকিকতার কোন স্থান নেই। গৌতম বুদ্ধ বিনা প্রমাণে এমনকি তার কথাও মেনে নিতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরেই ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে বৌদ্ধ ধম্ম (ধর্ম নয়) নিজের শুদ্ধতা অক্ষত রাখতে পারেনি। সম্ভবত ৭৮ খৃ:পূ:'তে কুন্দলবনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতিতে তারা হীনযান এবং মহাযানে বিভক্ত হয়ে যায়। হীনযানী বৌদ্ধরা তাদের মূলরূপ ধরে রাখে। কিন্তু বর্তমান ভারতে তাদের আর প্রায় কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে প্রচার করে থাকে। সেখানে বৌদ্ধতন্ত্র থেকে জন্মান্তরবাদ নামক কুসংস্কার সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান।


বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং রাজতন্ত্রের মিলিত  আগ্রাসনের কারণ শুধু ধর্মীয় ছিল তা নয়। প্রাচীন ভারতে বেশ কিছু গণপ্রজাতন্ত্রী রাজ্য গড়ে উঠেছিল। যেখানে দলের লোকেরা ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করত এবং আধুনিক কালের মত নির্দিষ্ট সময় অন্তর সদস্যরা তা পরিবর্তন করতে পারত। বুদ্ধের জন্মের সময় তার বাবা শুদ্ধোদনও এমনই এক দলপতি ছিলেন। যেটাকে পরে হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দু রাজা বলে প্রচার করে। 


স্বাভাবিক ভাবেই এমন গণরাজ্য রাজতন্ত্রের পক্ষে বিপদ। বুদ্ধের প্রভাবে এরকম গণরাজ্য বেড়েছিল। ফলে বৌদ্ধ চিন্তাচেতনাকে সমূলে উৎপাটন করা পুরোহিততন্ত্র এবং রাজতন্ত্র উভয়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। প্রকৃত সত্য এটাই প্রাচীন ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ছিল বলে নব্য হিন্দুত্ববাদীরা যে গর্ব করে অর্থাৎ আর্যভট্ট, চরক, সুশ্রুত এদেরকে প্রাচীন ঋষিমুনি বলে দেখাতে চায় তা ভ্রান্ত। আসলে এই জ্ঞানতাপসেরা ছিলেন বৌদ্ধ শ্রমণ। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল বৌদ্ধ প্রভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষাকেন্দ্র। 


আমরা কথায় কথায় বলে থাকি মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিয়ে মসজিদ গড়েছে, গণহত্যা করেছে, জবরদস্তি ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কথাটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা নয়। কিন্তু, যে কথা তারা চেপে যায় তা হল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রাজতন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাকদের সাথে একই কাজ করেছে। মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণে তো এদের অসুর, রাক্ষস বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। 


কলহন রচিত 'রাজতরঙ্গিনী' তে উল্লেখ আছে রাজা হর্ষদেব প্রায় ৪,০০০ বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেছিলেন।  

পারমার বংশের সুভাতবর্মন থেকে চোল বংশের রাজারা, বাংলায় রাজা শশাঙ্ক সবাই বৌদ্ধ, জৈনদের ব্যাপক গণহত্যা করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের 'বাণী ও রচনা'র সপ্তম খন্ডে পাওয়া যায় পুরীর সুবিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরও আসলে বৌদ্ধ স্থাপত্য।


বর্তমানে সুচতুর ভাবে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। পুরো ইতিহাসকেই আমাদের হিন্দু-মুসলিম ন্যারেটিভের মাধ্যমে দেখিয়ে সমাজে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হচ্ছে। ফর্মুলা খুব সহজ, হিন্দু রাজারা ছিল দেশপ্রেমিক আর সুলতানী এবং মুঘল আমলের শাসকরা বিদেশী আক্রমণকারী। তাই রাণা প্রতাপ-আকবর, শিবাজি-ঔরঙ্গজেব প্রভৃতির পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের লড়াইকেও প্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া হয়।


কিন্তু, ইতিহাস শুধুমাত্র তথ্যপ্রমাণকেই মান্যতা দেয়। মুসলিম শাসকেরা আসার পূর্বে তো ভারতে সবাই হিন্দু রাজা ছিল। তারা কিন্তু ধর্মের জন্য কেউ কাউকে ছেড়ে দিত না। তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। সুলতানী আমলেও গোঁড়া মুসলিম শাসকের পাশাপাশি পরধর্মসহিষ্ণু বাদশাহদেরও উল্লেখ পাই। এমনকি পাগলা রাজা বলে ব্যঙ্গ করা মহম্মদ-বিন-তুঘলক তো কালীমূর্তি খোদাই করা মুদ্রাও চালু করেছিলেন। আবার ১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খিলজি তার কাকা জালালউদ্দিন খিলজির মাথা কেটে বর্শায় গেঁথে নিয়ে দিল্লির গদিতে বসেছিলেন। এখানেও কিন্তু ধর্ম নয় ক্ষমতার লোভই মূল কথা। তাই আমরা দেখতে পাই আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন রাজপুত রাণা মানসিং আবার রাণা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন হাকিম খাঁ। আকবরের অন্যতম অর্থমন্ত্রী হিন্দুরাজা  টোডরমল। নবরত্ন সভায় 'বীরবল' নামে ভূষিত ব্যক্তিও ছিলেন হিন্দু নাম মহেশ দাস। 


হিন্দুত্ববাদীরা সম্ভবত মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের উপর সবচেয়ে বেশি খড়গহস্ত। তিনি যে ধর্মীয় ভাবে অন্যান্য মুঘল শাসকদের তুলনায় গোঁড়া ছিলেন এমনকি কাশীতে মন্দির ভেঙেছিলেন তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তা অর্ধসত্য মাত্র। সত্য এটাই আকবরের আমলে মুঘল সেনাবাহিনীতে হিন্দুসেনা ছিল প্রায় ২৪% যা ঔরঙ্গজেবের আমলে বেড়ে হয় ৩৩%। তার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন রাজপুত জয়সিং। আমরা শুধু তিনি মন্দির ভেঙেছিলেন বলে দোষারোপ করি। কিন্তু তিনি মহাকাল মন্দির, মথুরার কৃষ্ণ মন্দিরে দান করেন। ১৬৮০ সালে বেনারসেই ভগবৎ গোঁসাইকে আশ্রম গড়তে, ১৬৮৫ তে কুমারস্বামী মঠ প্রতিষ্ঠা, ১৬৮৭ সালে রামজীবন গোঁসাইকেও আশ্রম করার জমি দেন। বস্তুত, হিন্দুবিদ্বেষী বলে প্রচার করা ঔরঙ্গজেব এত বেশি পরিমাণে হিন্দু মঠ, মন্দির, আশ্রম গড়তে সাহায্য করেছিলেন যে শুধু সেটাই আলাদা অধ্যায় হয়ে যেতে পারে। আরও মজার কথা তিনি কিন্তু মসজিদও ভেঙেছিলেন। কুতুবশাহীর শেষ নবাব গোলকুণ্ডার তানাশাহ তাকে খাজনা না দিয়ে জামিয়া মসজিদের তলায় সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিল। ঔরঙ্গজেব চর মারফত খবর পেয়ে ১৬৮৩ সালে মসজিদ ভেঙে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করেন এবং তানাশাহ'কে বন্দী করেন। অর্থাৎ, রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে ধর্ম কখনোই তার কাছে মুখ্য ব্যাপার হত না।


কিন্তু, এসব সত্য বললে তো নব্য হিন্দুদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবেনা। তাই তারা শিবাজি-ঔরঙ্গজেব দ্বৈরথের ঘটনাকে হিন্দু মুসলিম ন্যারেটিভে প্রচার করে।

সেই মহাজ্ঞানীরা জানেওনা শিবাজির ১৩ জন মুসলিম সেনাপতি ছিলেন তাদের নাম সিদ্দি হিলাল, দৌলত খান, ইব্রাহিম খান, কাজি হায়দার, সিদ্দি ইব্রাহিম, সিদ্দি ওয়াহওয়াহ, নুর খান বেইগ, শমা খান, হুসেইন খান মিয়ানি, সিদ্দি মিস্ত্রি, সুলতান খান, দাউদ খান আর মাদারি মেহেতার।

ঔরঙ্গজেব যখন শিবাজিকে কৌশলে দুর্গে বন্দি করেন তখন মাদারি মেহেতার তার 'বডি ডামি' সেজে কেল্লায় বন্দী থেকে তাকে পালাতে সাহায্য করেন।

ক্রুদ্ধ ঔরঙ্গজেব শাস্তি হিসেবে মাদারির শিরচ্ছেদ করেন। 

পুনশ্চঃ, আফজল খানের সাথে শিবাজির যুদ্ধ এবং বাঘনখ দ্বারা তাকে হত্যা করার ঘটনা আমরা সবাই পড়েছি। কিন্তু, আমাদের এটা জানানো হয়না আফজলের সহকারী হিসাবে সেই তাঁবুতে শিবাজিকে হত্যা করার জন্য উপস্থিত অপর ব্যক্তির নাম ছিল কৃষ্ণ ভাস্কর কুলকার্নি। 


১৭৪১-১৭৫১ সালের ভিতর পাঁচবার রাঘোজি ভোঁসলে, ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠারা সুবা বাংলা আক্রমণ করে। তারা প্রায় চার লাখ মানুষকে হত্যা করে। ব্যাপক লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালায়। তাদের অত্যাচারের তীব্রতা এতটাই বাঙালির মনে দাগ কেটেছিল যে "বর্গী এলে দেশে" শিশুদের লোককথায় স্থান পায়। পরাজিত নবাব আলিবর্দি খাঁ ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সাথে বার্ষিক ১.২ মিলিয়ন অর্থ চৌথ এবং ৩.২ মিলিয়ন অর্থ বিগত দশ বছরের যুদ্ধখরচ দিয়ে মারাঠাদের সাথে চুক্তি করেন যে তারা আর বাংলা আক্রমণ করবেনা। বাঙালি কবি গঙ্গারাম মারাঠাদের অসুরের সাথে তুলনা করে 'মহারাষ্ট্রপুরাণ' রচনা করেন এবং দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন তিনি যে বাংলাকে বর্গী হানা থেকে রক্ষা করার জন্য নবাব আলিবর্দিকে আশীর্বাদ করেন।  


১৭৯১ সালে মারাঠাদের হিন্দু নির্যাতনের আরও একটা উদাহরণ পাওয়া যায়। তারা শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে টিপু সুলতানকে পরাজিত না করতে পারার হতাশায় শৃঙ্গেরি শঙ্করাচার্যের মঠ ভেঙে দেয় এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। মঠাধ্যক্ষ টিপুকে এই ঘটনা জানালে তিনি তৎক্ষনাৎ 'আসাফ অফ বেদনুর'কে ত্রাণকার্যে ২০০ 'রাহতি' পাঠানোর নির্দেশ দেন।


ইতিহাস ঘাঁটলেই এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে যেখানে হিন্দু রাজা হিন্দু রাজার সাথে,  মুসলিম শাসকেরা মুসলিমদের সাথেই লড়াই করে মরেছে। তাদের ধর্মীয় পরিচয় কিন্তু মুখ্য হয়ে ওঠেনি। তাদের ক্ষমতা দখলের শাসন করার, শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই ইতিহাস পড়ার সময় ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের চশমা খুলে ফেলা উচিত। 

এত দীর্ঘ প্রবন্ধের অবতারণা করার একটাই কারণ। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিজেদের কর্পোরেট লবির স্বার্থরক্ষায় দরিদ্র বঞ্চিত ভারতবাসীকে এক হতে দিতে চায়না। তারা চায় জাতি, ভাষা, ধর্মের নামে নিপীড়িতরা নিজেদের ভিতরেই লড়াই করুক। তাই হাজার দু'হাজার বছর আগে কোন ধর্মের শাসক কার উপর অত্যাচার করেছে সেই ইতিহাস তুলে এনে আজ বিকৃত মানসিকতায় ধর্মীয় বিদ্বেষের চর্চা করবেন না, করলে নিজেরাই ইতিহাস হয়ে যাবেন।

আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব! এবং আম্বেদকার -কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম দৃশ্য – স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে দেশব্যাপী সাজো সাজো রব, পালিত হচ্ছে ‘আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব’, বড় বড় ব্যানার, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি যদিও ঢেকে গিয়েছে ৫৬-ইঞ্চি ছাতির আড়ালে। দ্বিতীয় দৃশ্য – নয় বছরের ছেলে ইন্দ্র-র শেষকৃত্য করছে তার বাবা; ইন্দ্র-র স্কুলের শিক্ষক তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে; ইন্দ্র-র অপরাধ ছিল সে জাতিতে নিচু হয়েও উঁচু জাতির শিক্ষকের জন্য রাখা জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলেছিল। ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মন্তাজ্‌টা কিছুটা এইরকম। যখন জাতি-বৈষম্যের নির্মম শিকার হতে হয় সুরেখা ভোতমাঙ্গেদের, সাগর শেজওয়ালদের, কিংবা ইন্দ্রদের তখন একবিংশ শতক নিজের সমস্ত অত্যাধুনিকতাকে পাশে বসিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই অভাগা দেশে ‘গরু’ হয়ে জন্মালেও হয়তো তাঁদের প্রাণরক্ষা হতো। কিন্তু এই মানুষগুলোর অপরাধ হলো তাঁদের জন্ম নিচু জাতের পরিবারে, যে পরিবার বংশপরম্পরায় এই জাতিগত নিপীড়ন বহন করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। তাঁদের অপরাধ হলো তাঁরা ‘অবর্ণ’, তাঁদের স্পর্শ করতে নেই; এমনকি তাঁদের ছায়াও মাড়াতে নেই; দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় রাতের অন্ধকারের, যাতে তাঁরা নিজেদের ছায়া সমেত অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে পারেন এবং উঁচুজাতির মানুষরাও নিজেদের শুচিতা রক্ষা করতে পারেন। ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র – এই চার বর্ণের মধ্যে ঠাঁই পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। আর সৌভাগ্য হলেও তাঁদের সামাজিক অবস্থা নির্ভর করতো তাঁদের বর্ণের উপর। ব্রক্ষ্মার ‘পা’ থেকে উৎপন্ন হলে তার আবার কিসের অধিকার! তার একটাই কাজ ব্রক্ষ্মার ‘মুখ’, ‘বাহু’ ও ‘উরু’ থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয় ও শূদ্রদের সেবা করা। আর এই স্তরবিন্যাস এতটাই ছোঁয়াচে যে এক শূদ্র আরেক শূদ্রের উপরেও নামিয়ে আনতে পারেন জাতিগত নিপীড়ন, যদি তিনি অপেক্ষাকৃত উঁচুজাতির শূদ্র হন। সময়ের সাথে এই সামাজিক ব্যাধি কমা তো দূরের কথা, বরং দেখা যাচ্ছে রাজনীতির ছত্রছায়ায় এই ব্যাধি যেন প্রতিদিন আরও বেড়েই চলেছে। আসুন, কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড্‌স ব্যুরো-র বার্ষিক প্রতিবেদন (২৯-এ অগাস্ট, ২০২২) অনুযায়ী এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে জাতিগত অপরাধ ২০২১ সালে যথাক্রমে ১.২% ও ৬.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এসসি-দের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে আছে উত্তর প্রদেশ (২৫.৮২%), রাজস্থান (১৪.৭%), এবং মধ্য প্রদেশে (১৪.১%)। এসটি-দের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে মধ্য প্রদেশ (২৯.৮%), রাজস্থান (২৪%), এবং ওড়িশা (৭.৬%)। নথিভুক্ত মোট অপরাধের মধ্যে মহিলাদের উপর নির্যাতনের সংখ্যাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক; শুধুমাত্র ধর্ষণের শতকরা ভাগই হলো এসসি মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭.৬৪% এবং এসটি মহিলাদের ১৫%। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ৭০,৮১৮ ও ১২,১৫৯-গুলো মামলা তখনও তদন্তের অপেক্ষায়, যার মধ্যে আগের বছরের মামলাও ছিল। সেই বছর এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ২,৬৩,৫১২ ও ৪২,৫১২-টা মামলা আদালতে বিচারের জন্য এসেছিল, যার মধ্যে ৯৬.০% ও ৯৫.৪% মামলা বছরের শেষ পর্যন্ত বিচারাধীন অবস্থাতেই ছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধি-র (আইপিসি) সাথে ‘এসসি ও এসটি (পিওএ) আইন’-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শতাংশ এসসি ও এসটি-দের জন্য যথাক্রমে ৩৬% ও ২৮.১%। বিগত বছরগুলোর প্রতিবেদনের দিকে তাকালেও খুব একটা আলাদা কিছু চোখে পড়বে না। সেই একই রাজ্যের নাম, ধর্ষণ-সহ অন্যান্য নৃশংস অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, তদন্তের অনীহা, ন্যায়বিচারের অভাব, শাস্তি প্রদানের বদলে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস বা জামিনে মুক্তি – এই প্যাটার্নটাই খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এই পরিসংখ্যানের সবটাই নথিভুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে। গণতন্ত্র বা গণমাধ্যম কোনোটাই তাদের নির্দিষ্ট শ্রেণী-গন্ডি ভেঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি, এখনও। তাই এত বড় দেশের কোন অংশে কোন অঘটন যে জাতপাতের নামে ঘটে চলেছে তার হদিশ মেলা দুষ্কর। গড় হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৪ জন করে দলিত মহিলা ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন। যে ‘নির্ভয়া’ কান্ড নিয়ে সারা দেশ তোলপার হয়েছিল, সেই বছরই সারা দেশে নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫৭৪ জন দলিত মহিলা ধর্ষিতা ও ৬৫১ জন খুন হয়েছিলেন।

তবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা নির্ণয় সম্ভব নয়। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে এসসি-এসটি-দের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনা সচরাচর সংবাদমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারও করা হয় না, কারণ স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম সবকিছুই মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারাই পরিচালিত। সুতরাং, সেখানে দলিতদের উপর সামাজিক নিপীড়ন, দলিতদের বঞ্চনার কাহিনী সর্বসমক্ষে প্রচারিত হবে এমনটা ভাবাও বোধহয় অন্যায়। তাও ২০০৬ সালে মহারাষ্ট্রের খৈরলানজী গ্রামে সুরেখা ভোতমাঙ্গে-র গোটা পরিবারের নৃশংস হত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দেয়; সংবাদমাধ্যমও কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।

 সুরেখা ভোতমাঙ্গে ছিলেন একজন গরীব, দলিত মহিলা, জাতিতে ‘মাহার’, মহারাষ্ট্রের খৈরলানজি গ্রামে যেখানে পরিবারসমেত তিনি থাকতেন সেখানকার অন্যান্য জাতির নিরীখে যার স্থান অনেক নিচে। তাই বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা থেকে চাষের জল সবক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত থেকে জুটত বঞ্চনা, নিপীড়ন; যেগুলোর মাত্রা চরমে উঠলে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন সাহায্য চাইতে। কিন্তু নিচু জাত হয়ে সাহায্যের আবেদন! এতো সাহস হয় কিভাবে? তাই খেসারত দিতে হয় আত্মীয় পরিবারের এক সদস্যকে। আবার পুলিশ। এবার কিছু গ্রেপ্তারী। অভিযুক্তেরা অবশ্য সাথেসাথেই জামিন পেয়ে মুক্ত। এইবার আর কোনো সময় নষ্ট নয়। শিক্ষা দেওয়ার পালা; যেমন রামচন্দ্র দিয়েছিলেন শম্বুককে! উন্মত্ত অভিযুক্তেরা দলবল সমেত (সকলেই উচ্চবর্ণের গ্রামবাসী) ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরেখা-র পরিবারের ওপর। সুরেখা, সুরেখা-র সতেরো বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা, আর সুরেখা-র ছেলেদুটোকে টানতে টানতে উঠোনে বের করা হয়। ছেলেদের বলা হয় মা আর বোনকে সবার সামনে ধর্ষণ করতে। না শোনায় তাদের যৌনাঙ্গ থেঁতলে দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়। সুরেখা ও প্রিয়াঙ্কাকে গণধর্ষণ করা হয়, এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শোনা যায় তাঁদের প্রাণহীন মৃতদেহের উপরও ধর্ষণ চলেছিল অনেকক্ষণ। দিনটা ২৯শে সেপ্টেম্বর, সাল ২০০৬। তার নয় বছর পরেই বা পরিস্থিতি কিরকম? ২০১৫ সালের ১৬ই মে – বাবাসাহেব আম্বেদকারকে নিয়ে বাঁধা একটি গানের রিংটোন তার মোবাইলে বেজে ওঠে বলে ২৩ বছর বয়সী দলিত যুবক সাগর শেজওয়াল-কে মারধর ও পরে তার শরীরের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হলো তাকে। আরও সাত বছর পর তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির কয়েকদিন আগে উঁচু জাতির শিক্ষকের জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার ‘অপরাধ’-এ শিক্ষক পিটিয়ে খুন করে ফেললেন ৯ বছর বয়সী দলিত কিশোর ইন্দ্র-কে। ইন্দ্র-র লাশের উপর দিয়ে উদ্‌যাপিত হলো ‘আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব’। আদৌ কোনো মাধ্যম দিয়েই কি এই হাজার হাজার বছরের সামাজিক পচনের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব?


পুকুর, পাতকূয়ো, পানীয় জল, জমি, বিদ্যুৎ ইত্যাদির অধিকার থেকে আজও প্রত্যন্ত এলাকার দলিতরা বঞ্চিত। হরিয়ানার মত জায়গায়, যেখানে একদিকে বিশ্বায়নের রমরমা, সেরমই আরেকদিকে সে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে দলিত বরকে সমস্যায় পড়তে হয় যদি তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বছর কয়েক আগে হিসার জেলার দৌলতপুর গ্রামে এক ব্যক্তির হাত কেটে নেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি উঁচুজাতের কোনো এক জমিদারের জলাধার থেকে জল খাওয়ার ‘সাহস’ দেখিয়েছিলেন। উঁচুজাতের কোনো পরিবারের মেয়ের সাথে নিচুজাতের কোনো ছেলের ভাব-ভালোবাসা অচিরেই ছেলেটির ‘খুন’ ডেকে আনে, এবং এই সত্যটা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে অন্যান্য কোনো কারণে দলিত খুন হলেও সেটা আড়াল করতে একটা প্রেম-ভাব-ভালোবাসার মিথ্যা দৃষ্টিকোণ জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে সেই খুনটা সমাজে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘বৈধ’ বলে গণ্য হয়; যাকে বলে – Honor killing। আর এই সমস্ত কিছুই ঘটে পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে। পুলিশের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা সেটাও নির্ধারণ করে দেবে সাহায্যপ্রার্থীর ‘জাত’। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম কোনো অত্যাচারের ঘটনা নথিভুক্ত করতে গেলে বিরোধীপক্ষও একটা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে থাকে, এবং প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের বাধ্য করা হয় অভিযোগ প্রত্যাহার করতে। তাই “Scheduled Caste and Scheduled Tribe (Prevention of Atrocities) Act, 1989” আইনটাও বড়ই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষতঃ যেখানে আইন-রক্ষক ও ন্যায়দাতাদের মধ্যে থেকেই এই স্বৈরাচারী বর্ণচেতনা এতদিনেও দূর করা যায়নি। উল্টে তাঁরা নিচুজাতিকে পদদলিত করে রাখতে নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতা অবলীলায় ব্যবহার করে থাকেন। অথচ, যে সামাজিক পার্থক্যকে ঘিরে এতকিছু, সেই সামাজিক পার্থক্য ও জাতপাতের শুচিতার প্রশ্ন কর্পূরের মত উবে যায় যখন উঁচুজাতির গ্রামবাসীরা নিচুজাতির ‘অস্পৃশ্য’ সুরেখা বা প্রিয়াঙ্কাদের অবলীলায় গণধর্ষণ করে খুন করতে পারে, সাগর বা ইন্দ্রদের পিটিয়ে হত্যা করতে পারে। এই জঘন্য জাতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বাবাসাহেব আম্বেদকার-এর করা মন্তব্যটা তাই আজকের দিনেও সমান, হয়তো বা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ – “There cannot be a more degrading system of social organization than the caste system. It is the system that deadens paralyses and cripples the people from helpful activities.”

ভারতবর্ষের মূলধারার ইতিহাস-চর্চায় ভীমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকর-কে কোনোদিনই সেইভাবে যথাযথ স্থান দেওয়া হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আম্বেদকরকে একটি গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এক অদৃশ্য অশুভ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তাই আম্বেদকর শুধু দলিতদের নেতা হয়ে রয়ে যান। আর প্রিভিলেজ্‌ড মানুষজনের কাছে তিনি ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। জাতি-ব্যবস্থা, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর যে সংগ্রাম, তাঁর যে সংস্কার-মুক্ত আধুনিক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ক্ষমতাসীনদের রচনা করা ইতিহাসের নিচে পিষ্ট হয়ে এসেছে, ‘আম্বেদকর’ আর ‘সংবিধান’ শব্দদুটো একে অপরের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এও যেন এক দুরভিসন্ধির পরিণাম। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে কৌশলে তাঁকে সংবিধানের জনক বানিয়ে দেওয়া হলো, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সংবিধানের ফাঁকফোকড়-কে ঘিরে ওনার একটা ঋণাত্মক মূল্যায়ন করতে পারে। এই পরিকল্পনার স্রষ্টা যাঁরা, তাঁদের দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কারণ আম্বেদকরকে ঠিক যতটা কোণঠাসা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, ঠিক ততটাই কোণঠাসা তিনি হয়েছেন, জীবদ্দশাতেও, এবং মৃত্যুর পরেও। আম্বেদকর নিজে যে এই সংবিধানে একেবারেই খুশী ছিলেন না সেটা ২-রা সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩-তে, রাজ্যসভায় প্রদত্ত একটা ভাষণে স্পষ্টই বোঝা যায়। তিনি বলেন – “Now, Sir, we have inherited a tradition. People always keep saying to me: ‘Oh, you are the maker of the Constitution.’ My answer is I was a hack. What I was asked to do, I did much against my will.”।  তাই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও যেখানে এই দেশ জাতপাতের ব্যাধিতে আক্রান্ত, সেখানে প্রয়োজন আছে সংবিধানের সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এসে আম্বেদকরের এক পরিপূর্ণ মূল্যায়নের। কারণ, আম্বেদকর এমন একজন শিক্ষক, যিনি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখান, যাবতীয় প্রাচীন (কু)সংস্কারের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ টিকে থাকা নিম্নবর্ণের মানুষের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের একচেটিয়া শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

এই সামাজিক বৈষম্য ও তাকে ঘিরে এই অত্যাচারের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে অবশ্যই গিয়ে পড়তে হবে হিন্দুশাস্ত্রের ফাঁকফোকরে। এই বৈষম্য কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে এই বৈষম্যকে লালন-পালন করা হয়েছে, আরও হৃষ্টপুষ্ট বানানো হয়েছে। তাই মাত্র কয়েক দশক পুরানো সংরক্ষণ নীতি, যে নীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ নিয়ে আজও বিস্তর বিতর্ক হয়ে চলে, সেই নীতিও স্বাভাবিকভাবেই অপারগ এই বিরাট ফাঁক কে দূর করতে। হিন্দুশাস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘মনুস্মৃতি’ অনুযায়ী তাই কোনো শূদ্র যদি ভুল করেও ‘পবিত্র’ বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে কিংবা শুনে ফেলে তাহলে তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে, অথবা তার কান গলিত গরম সীসা ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, পবিত্র বেদমন্ত্রকে যদি জ্ঞানলাভের প্রাচীনতম আধার হিসাবেই দেখি তাহলে এটা খুবই স্পষ্ট যে শুরু থেকেই সেই আধার সকলের জন্য নয়। শুরু থেকেই সেই আধার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য তৈরি, যাতে শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে আরেক শ্রেণীর উপর যুগের পর যুগ ধরে শোষণ চালানো যায় বিনা বাধায়। তাই চতুর্বর্ণের শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য অসৎ, শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে একটা বাধ্যতামূলক নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করা এবং সেটাকে সময়ের সাথে বিভিন্ন রূপে লালন করা, ক্ষমতাশীল উচ্চবর্ণের কাছে ক্ষমতাহীন নিম্নবর্ণের বাধ্যতামূলক বশ্যতা স্বীকার করার এক ব্যবস্থা তৈরি করা – তখন এই অত্যাধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে অবশ্যই প্রয়োজন আছে সেই আম্বেদকারকে জানার, যিনি নব্বই বছরেরও বেশি সময় আগে ‘মনুস্মৃতি’ পুড়িয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

রক্ষণশীল সমাজের কাছে, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের কাছে আম্বেদকার আজও এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। এই লেখাটি বক্তৃতার আকারে তিনি তৈরি করেছিলেন ১৯৩৬ সালে। “জাত-পাত তোড়ক মণ্ডল” নামক এক গোষ্ঠীর হয়ে তাঁর সেই বক্তব্য রাখার কথা ছিল, সমাজে বর্ণবৈষম্যের কু-প্রভাব গুলো তুলে ধরার জন্য। কিন্তু সেই বক্তব্যের ধার এতটাই ছিল যে সেটার খসড়া পড়ার পর র‍্যাডিক্যাল হিন্দুদের নিয়ে তৈরি সংস্কারপন্থী সেই গোষ্ঠীও শেষ পর্যন্ত এই বক্তব্য বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সেই বক্তব্য একেবারে অব্যক্ত থাকেনি। আম্বেদকর নিজ উদ্যোগে সেটা ছাপিয়েছিলেন  “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” নামে, এবং বিতরণ করেছিলেন। শাস্ত্রের লেখা কারও কাছে অন্য বার্তা বহন করলে সেটা শাস্ত্রের লেখার দোষ নয়, কারণ শাস্ত্র ও শাস্ত্রের লেখা চিরন্তন সত্য, অবিনশ্বর – এই বস্তাপচা যুক্তি দিয়ে বারেবারেই হিন্দুশাস্ত্র ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। তার উত্তরে আম্বেদকর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট”-এ লিখেছেন – “It is no use telling people that the shastras do not say what they are believed to say, if they are grammatically read or logically interpreted. What matters is how the shastras have been understood by people.” আরেকধরণের ভাঁওতাবাজী, যেটা প্রায়শই একটু কম রক্ষণশীলরা বর্ণাশ্রম প্রথার ভিত্তি রক্ষার জন্য বলে থাকেন, সেটা হল – বেদ অনুযায়ী এই প্রথা কর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে, তাই মানুষের জন্ম তার বর্ণ নির্ধারণ করতে পারেনা। আপাতদৃষ্টিতে খুব প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি মনে হলেও, এর বাস্তব গ্রহণযোগ্যতাকে অকাট্য যুক্তিতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আম্বেদকর। তিনি জানতে চেয়েছিলেন – “How are you going to compel people who have acquired a higher status based on birth, without reference to their worth, to vacate that status? How are you going to compel people to recognize the status due to a man, in accordance to his worth, who is occupying a lower status based on his birth?”

এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তার একটা বড় কারণ – সদিচ্ছার অভাব। তাই সংরক্ষণ নীতি থাকা সত্ত্বেও, বহুক্ষেত্রে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ ও সেই প্রয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুবিধার পরিমাণ শূন্য। সংরক্ষণ নীতির জন্য যোগ্য হতে গেলে একজন দলিতকে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে হবে। সেই হিসাবে এই সংরক্ষণ নীতির সুবিধা প্রতি চারজন দলিতের মধ্যে মাত্র একজনই পেতে পারে। বাকি তিনজনকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে হাইস্কুল পেরোনার আগেই পেটের চিন্তা করতে হয়। তাই সংরক্ষণ নীতি আদপে ততটা কার্যকর হয়ে ওঠে না, যতটা তার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা দাবি করেছিল।  তবে যেটা চলে, সেটা হলো এই নীতি কে নিয়ে দর-কষাকষির রাজনীতি। পরিণাম – “যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে টানিবে যে নীচে / পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে”। একদা আম্বেদকরও বলেছিলেন – “If the fundamental rights are opposed by the community, no Law, no Parliament, no Judiciary can guarantee them in the real sense of the word.”। এই কথাটা আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যতটা সেদিন ছিল।

বিশ্বাস ও বিজ্ঞান এক নয় -মুজিব রহমান
Nov. 24, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:290 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আদম ও হাওয়ার গন্ধম খাওয়া নিয়ে তাদের কথোপকথনের কথা বলছিলাম ধর্ম পড়াতে গিয়ে। এক ছাত্রী বলল, ‘স্যার গতকাল আপনি সমাজ পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আদিম মানুষ কথা বলতে পারতো না’, আজ ধর্ম পড়াতে গিয়ে বলছেন, ‘আদম হাওয়া কথা বলছে’। 

আমি শুধু বলেছিলাম, ধর্ম পড়ার সময় বিশ্বাস নিয়ে পড়বে আর বিজ্ঞান পড়ার সময় যুক্তি-প্রমাণসহ পড়বে।

বাংলায় শব্দদুটির মধ্যে অনেক মিল। দুটোই ‘বি’ দিয়ে শুরু এর পর একটি যুক্তাক্ষর সাথে ‘আ’ কার এবং শেষে একটি অক্ষর। অথচ এরা বিপরীত মেরুর। নিউটন ও আইনস্টাইনের কোন সূত্রে বিশ্বাস স্থাপন করার সুযোগ নেই। প্রমাণ ছাড়া সূত্র টিকবে না। যখনই ভুল প্রমাণ হবে সাথে সাথেই বাতিল। অনেকেই ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞান মিলাচ্ছেন। অনেকে বলেন- বিশ্বাস ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ! তারা না জেনে, না বুঝেই অথবা প্রতারণামূলকভাবে এসব বলছেন। মাত্র তিনটি পার্থক্য তুলে ধরছি -

১। বিজ্ঞানে বলা হয়েছে, পৃথিবী গোলাকার। চন্দ্র পৃথিবীর চার দিকে আর পৃথিবী-চন্দ্র মিলে সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয়। মহাবিশ্বে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে যা সম্প্রসারণশীল। ধর্মগ্রন্থে বলা হচ্ছে, পৃথিবী সমতল। স্থলভাগের পরে রয়েছে অফুরন্ত জলরাশি। সকালে ফেরেস্তারা সূর্যকে টেনে পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিমে টেনে নিয়ে যায়। কর্দমাক্ত জলাশয়ে অস্ত যায়। রাতে সূর্য আরশের নিচে বসে জিকির করে। চন্দ্র ও সূর্যের জন্য নির্দিষ্ট পথ করা হয়েছে যাতে একটি আরেকটিকে অতিক্রম করতে না পারে। তারকামণ্ডলী সৃষ্টি করা হয়েছে আকাশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য।


২। বিজ্ঞানে এখন বলা হয়েছে, সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। ‘বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান মানুষের প্রজাতি তিন লক্ষ বছর আগে এসেছে। বাইবেল বিশ্লেষণ করে, পাদ্রিরা বলছেন, যিশুর জন্মের ৪ হাজার বছর আগে ঈশ্বর এডাম ও ইভকে তৈরি করেছেন। অন্য ধর্মে বিভিন্ন নবী ও ধর্মপ্রচারকদের আয়ুষ্কাল বিশ্লেষণ করে কাছাকাছি পৌঁছানো গেলেও হিসাব মেলানো যায় না। ছয় দিনে মহাবিশ্ব, পৃথিবী, গাছ-পালা, পশু-পাখি ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে।

৩। বিজ্ঞানে বলা হয়েছে, মানুষ কোষ দ্বারা তৈরি। কোষের সম্মিলিত শক্তিই তাকে চালিত করে। শরীরে আত্মা, রুহু বলতে কিছু নেই। ধর্মগ্রন্থগুলো বলছে, ঈশ্বর আত্মা বা রুহু সৃষ্টি করে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। আত্মা বা রুহু অবিনশ্বর। মৃত্যু মানে শরীর থেকে রুহু বা আত্মা বের হয়ে যাওয়া। শরীর মাটি দিয়ে তৈরি। 

যার ধর্ম তার তার কাছে, বিশ্বাসও যার যার তার তার। অসুবিধা কি? চলুক। কিন্তু দুটোকেই এক করতে গেলে কিছু সমস্যা তৈরি হবে। যারা লেখাপড়া শিখে একটু সচেতন হবেন, যারা বিজ্ঞান বুঝবেন তাদেরকে যখন বলবেন ধর্মগ্রন্থ থেকেই বিজ্ঞান গ্রন্থের উৎপত্তি হয়েছে আর বিশ্বাসই বিজ্ঞান তখন সে লোক কিন্তু ঠিকই বুঝে ফেলবে। আপনার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করবে। 

বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক রয়েছে? বাস্তবিক কোন সম্পর্ক থাকার সুযোগ নেই। দুটি দুই মেরুর। একটির বিপরীতে আরেকটি। বিজ্ঞান সত্য ও যুক্তিনিষ্ঠ আর বিশ্বাস অলৌকিকতা নির্ভর। একজন যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ বিশ্বাস নির্ভর হয় না। তাহলে মানুষ কেন বিজ্ঞানমনষ্ক হয় না? জন্মের পরেই মানুষ মুক্ত না হয়ে পারিবারিক ফাঁদে পড়ে যায়। যে পরিবারে যার জন্ম সে ওই পরিবারের ভাবাদর্শেই বড় হয়। সাধারণত একজন হিন্দুর সন্তান ধারাবাহিকভাবেই হিন্দু থাকে, মুসলিমের সন্তান ধারাবাহিকভাবে মুসলিম থাকে। পরিবার থেকে তারা শিখে - এগুলোই সত্য, সঠিক এবং এগুলো অবিশ্বাস করা মহা অপরাধ। পরিবার থেকে বেরিয়ে সে একই ধরনের সমাজে মিশে। সেই সমাজেও সে একই শিক্ষা পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার পরিবার ও সমাজ থেকে অর্জিত অন্ধবিশ্বাসকেই লালন করতে শেখায়। দরিদ্র দেশের মানুষ বের হতে পারে না, তারা মুক্তচিন্তা করতে শিখে না। 

বিজ্ঞান থেকে আমরা কি শিখি? অজানাকে জানা ও রহস্যকে উন্মোচন করা। বিশ্বাস থেকে আমরা শিখি উল্টোটা অর্থাৎ অজানাকে রহস্য দিয়ে ঢেকে রাখা আর রহস্যকে অলৌকিকতা দান করা। বিজ্ঞানের সাথে বিশ্বাসের বিরোধ এমনই। একটিতে আসক্তি আসলে অন্যটি দূরে চলে যাবে, একটি বুঁদ হয়ে থাকলে অন্যটি হারিয়ে যাবে। যুক্তিবোধ প্রাধান্য পেলে বিশ্বাস হালকা হয়ে যাবে। আবার বিশ্বাসবোধ প্রাধান্য পেলে যুক্তিবোধও হালকা হয়ে যাবে। দুটো একসাথে বাস করে না।

কেন এদেশে হিন্দুরা বিপদে? -রাহুল রায়
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা প্রায়ই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি অভিযোগ পাই যে বিরোধী দল বা দলের নেতারা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশাচ্ছেন। এই দুইয়ের মিশ্রণে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তীতে অবশ্য এই নেতাদেরই মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় দেখা যায়। একাংশকে তো আবার এর মধ্যে সবগুলোতেই দেখা যায়, তাও আবার ভঙ্গিমা বদল করে প্রার্থনারত অবস্থায়। অন্যের ক্ষেত্রে যত নিন্দাই করুক না কেন নিজের বেলায় গর্হিত এই কাজকে তখন দিব্যি জনসংযোগ বলে এঁরা চালিয়ে দেন। যে যাই বলুন না কেন বাস্তবে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এদেশে আদি কাল থেকে চলে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতন থেকে শুরু করে মোঘল, ব্রিটিশ পর্ব পরিষ্কার বলে দেয় যে এখানে ধর্ম ও রাজনীতি ওতপ্রোত ভাবে একে ওপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই দুইয়ের কাণ্ডারীদের কাজ করার ধরণেও দারুণ মিল আছে। ধর্মের অভিভাবকরা যাদের আমরা পুরোহিত বলে চিনে থাকি, সাধারণ মানুষকে বশে রাখতে কখনো স্বর্গের লোভনীয় স্বপ্ন দেখান তো কখনও নরকের ভয় দেখান। আবার রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখা যায় মানুষকে পাশে রাখতে একই কাজ করেন। কখনও প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দেন তো কখনো মারাত্মক শাস্তির ভয় দেখান। অর্থাৎ লোভ আর ভয়ের অস্ত্রেই এই দুই পক্ষ নিজেদের মত করে ব্যবহার করে নিজেদের কাজ হাসিল করেন।


আজকের দিনের নিরিখে দেখতে গেলে 'আচ্ছে দিন', 'অমৃত কাল', ‘রামরাজ্য’কে সেদিক থেকে জনগণকে পাশে রাখতে দেখানো 'স্বর্গীয় লোভ' বলতে হবে। পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন স্বর্গ নামক জায়গাটিকে দেখেনি, অথচ পুরোহিতরা যুগ যুগ ধরে সেই কল্পনা থেকেও নাকি সুন্দর জায়গার টোপ দিয়েই যাচ্ছেন। ‘ধর্মের পথের’ পথিক হলে পুরোহিতদের আশীর্বাদে স্বর্গপ্রাপ্তি অবধারিত। স্বর্গের অবস্থান, আকার, অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসছে যে যেহেতু মৃত্যুর পরই সেখানে মানুষ যেতে পারে তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বর্গকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। অতীতে পুরোহিতরা ‘বিশেষ ক্ষমতাবলে’ সেই জায়গা সম্পর্কে জেনেছেন এবং সেই জ্ঞানই স্বর্গের ধারণার মূল। এই ধারণা সকল প্রশ্নের উর্দ্ধে। আজকের রাজনৈতিক কাণ্ডারীরা একই রকম। ‘আচ্ছে দিন’ এর সংজ্ঞা, ‘অমৃতকাল’ এর অর্থ বা ‘রামরাজ্যের’ ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তর আসে না। তার বদলে উঠে আছে একগাদা অভিযোগ, অনেকটাই স্বর্গ নিয়ে প্রশ্ন করলে পুরোহিতের উত্তরের মতো। সেখানে প্রশ্নের উত্তর আসে না, উল্টে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন আসে এবং সর্বোপরি অবিশ্বাসী বা নাস্তিক নামকরণ হয়।

 রাষ্ট্র পরিচালকরা কিছু দিন পর পর তাদের পরিচালিত ব্যবস্থাকে বিভিন্ন নাম দিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। আবার তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুচ্ছকেও একই ভাবে তারা নামকরণ করে থাকেন। ‘আচ্ছে দিন’, ‘অমৃতকাল’, ‘রামরাজ্য’ এগুলো সেরকমই নামকরণ। ‘রামরাজ্যে’র উল্লেখ সর্বাগ্রে এদেশের মানুষ মহাত্মা গান্ধীর কাছে পেয়েছিলেন। গান্ধী সুশাসনকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই সুশাসনের সংজ্ঞা তিনি দিয়ে যাননি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো বাস্তববাদী তিনি অবশ্য কোনোদিনই ছিলেন না। সেদিক থেকে বিচার করলে 'রামরাজ্য' নিয়ে তাঁর নিজের ধারণাই বা কতটুকু পরিষ্কার ছিল তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যায়। যাই হোক মহাত্মা গান্ধীর সেই রামরাজ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, সামাজিক অবস্থা কি রকম হবে তা নিয়ে আমাদের কিছুই জানা নেই। এমনকি যার থেকে এর সৃষ্টি সেই কাব্যগ্রন্থ রামায়ণে উল্লেখিত  রামচন্দ্রের রাজ্যই বা কিরকম পরিচালিত হতো তারও বিশদ বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সেদিক থেকে একান্তই ধর্মীয় আবেগ পরিচালিত এবং একই সঙ্গে চরম ধোঁয়াশাপূর্ণ। এদিকে স্বাধীনতা লাভের পর ৭৫-টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। শাসক দলের কাছে কিছুদিন পর পর ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার কথা শোনা যায়। সেটা স্বাভাবিক, নিজের ঢাক পেটাতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের অবস্থা কোথায়?  ৭৫-বছরে কতটুকু আমরা এগোতে পেরেছি। এই বছর বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিষয়ের ওপর তৈরি সুচিতে ভারতের অবস্থান নিম্নরূপ –



বিষয় সূচক

ভারতের অবস্থান

 উদ্বাবনী সূচক

৪০

পরিবেশরক্ষা সূচক

১৮০

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক

১৫০

গণতন্ত্র সূচক

৪৬

দুর্নীতি সূচক

85

স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচক

৬৬

উৎকোচ সূচক

৮২

খাদ্য সুরক্ষা সূচক

৭১

 অবসরকালীন ভাতা সূচক

৪০

ক্ষুধা সূচক

১০৭

যুব উন্নয়ন সূচক

১২২

শান্তি সূচক

১৩৫

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক

১২১

মানব স্বাধীনতা সূচক

১৩১

মানবসম্পদ সূচক

১১৬

অসাম্য সূচক

১৪৭

শিশু অধিকার সূচক

১১৭


দেশ যে এগোচ্ছে না এই কথা দেশের চরম শত্রুও বলতে পারবে না। ‘সাপ খেলানো মানুষের দেশ’ আজ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির অধিকারী। শিক্ষার হার, গড় আয়ু গত সাড়ে সাত দশকে অনেকটাই বেড়েছে। আজ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দুই জন ব্যক্তি এই দেশেরই মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশচর্চায় এদেশের উন্নতি রীতিমতো ঈর্ষনীয়। কিন্তু এই চোখ ধাঁধানো উন্নতির পেছনের অন্ধকারটা অত্যন্ত গাঢ়। এদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অভুক্ত, অশিক্ষিত মানুষ থাকেন। এদেশে স্কুল ড্রপ আউটের হিসাব আফ্রিকার দেশগুলোকেও পেছনে ফেলে দেয়। এদেশ আজও বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শিশুশ্রমিকের সংখ্যায় আমরা সবচেয়ে উপরে আছি। এখানে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও ধর্মীয় তাবেদারদের সৌজন্যেও আজ মাটির প্রতিমাতে প্রণাম করার জন্য রক্তমাংসের মানুষকে মরতে হয়। ধর্মীয় হানাহানির মধ্যে দিয়ে এদেশে রাজনীতি পরিচালিত হয়। যুবপ্রজন্মের জয়গান  এদেশে সারাদিন নেতাদের মুখে থাকলেও এদের অশিক্ষা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। এখানে ছেলেমেয়েদের হাতে শিল্পোৎপাদনের যন্ত্রপাতি তুলে দেওয়া না হলেও ধর্মের বা বর্ণের ধ্বজা কিন্তু সময় মতো দিয়ে দেওয়া হয়। শাসকদের স্বার্থরক্ষা বলে কথা। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই তালিকা দীর্ঘ,  সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রাপ্তির সোনালী থলিটা যেদিকে গেছে সেদিকে মানুষ জনসংখ্যার নিরিখে অত্যন্ত কম বললেও কম বলা হবে আর অপ্রাপ্তির শতছিদ্র থলিটা যেদিকে রয়েছে সেদিকে মানুষ গুণে শেষ করাটা অসহনীয় হবে। 

ইতিহাস বলে যুগ যুগ থেকে পুরোহিতবর্গ ও শাসনে থাকা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে ভয় আর লোভের অস্ত্রে পরাভূত করে রেখেছে। হাস্যকর হলেও সত্যিটা হল এই অলীক লোভ ও ভয় কাটিয়ে উঠে মানুষ খুব কম বারই এই অত্যাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পেরেছে। সাধারণত, সে ধর্মের মোড়কে বাঁধা এই কল্পনাকে কাঁধে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। দেশের বর্তমান শাসকরাও একই পথের পথিক হয়েছে। নিজেদের বিফলতা ঢাকতে কখনো দান তো কখনও শাস্তির অস্ত্র ব্যবহার করেন। এদিকে চলে নিজেদের কাজের রাতদিন প্রচার আর আগাম দিনের জন্য মানুষের মধ্যে স্বপ্নের ফুলঝুরি ছড়ানো। পরিশেষে পরিবেশিত হয় অতি পরিচিত কিন্তু মোক্ষম অস্ত্র-বিদ্বেষাস্ত্র। নির্বাচন আসলেই শোনা যায় - হিন্দুরা বিপদে আছে (হিন্দু খতরে মে হে)।  এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখলেই হিন্দুরা রক্ষা পাবে। বাস্তবটা হলো হিন্দুরা বিপদেই আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা আলাদা হলেও শ্রেণীগত দিক দিয়ে দেশের ৮০% মেহনতী জনগণের সমস্যাগুলো কিন্তু এক - বেকারত্বের জ্বালায় সকলেই জ্বলছে; চাহিদাও এক - নিরাপদ বর্তমান,  সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও শান্তি সমৃদ্ধিতে সবার বাঁচা চাই, যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান মৌলিক অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যেভাবে দেশে একের পর এক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, দেশের মানুষ প্রশ্ন ও যুক্তিহীন হচ্ছেন তাতে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ কিন্তু সর্বাবস্থাতেই – ‘খতরে মে হে’।

টিকে থাকার লড়াইয়ে ‘ধর্মগুলো সব রূপকথা’ -জাহিদ রুদ্র
Nov. 24, 2024 | ধর্ম | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সম্প্রতি একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কোরানের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত রয়েছেন ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে। সত্যজিৎ রায়ের মহাপুরুষ ছবিটিতে দেখেছিলাম পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি করা এক ভদ্রলোক “ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ” এর অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। ওই ভদ্রলোকের বিশ্বাস ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব দেখতে পারেন। 


মহাপুরুষটি দার্শনিক সক্রেটিসের সাথে গ্রিসের এথেন্সে আড্ডা দিয়েছেন তাও আড়াই হাজার বছর আগে। গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্য ছিলেন। ব্যাবিলনের বাজার থেকে তাঁর বর্তমানব সেবক (রবিঘোষ)-কে পেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে নির্মিত ছবিটি রাজশেখর বসু (পশুরাম) এর ছোটগল্প বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে তৈরী। ছবিটিতে ওই মহাপুরুষের প্রচুর ভক্ত ছিল কলকাতা শহরে। তারা সকলেই শিক্ষিত, বড় অ্যাকাডেমিক এবং সমাজের উঁচু মাথা কিন্তু যুক্তি বিবেচনার অভাবে ভোগেন। রাজশেখর বসু গল্পটি লিখেছেন শত বছর আগে। আজ শত বছর পর সেই মহাপুরুষেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ধর্মগ্রন্থীয় ব্যাখ্যা দিয়ে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছেন।


“Science without religion is lame, religion without science is blind.” অর্থাৎ “বিজ্ঞান ধর্ম ছাড়া খোঁড়া, ধর্ম বিজ্ঞান ছাড়া অন্ধ।” এই বাক্য বহু বছর অন্ধের মতো ব্যবহার করেছে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা প্রমানের জন্য। এই বাক্যটাকে তারা বিখ্যাত করেছেই তাদের ধর্মকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমানের প্রয়োজনে। কালক্রমে এই বাক্য হাতবদল হয়ে সেটা এখন উপমহাদেশের ধর্মান্ধদের হাতে পড়েছে।


আর্লবার্ট আইনস্টাইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বক্তৃতা দিতেন। শিক্ষার্থীরা তাকে নানাধরণের প্রশ্নে জর্জরিত করতো। সবচেয়ে যে প্রশ্নগুলো বেশি করা হতো তার একটি হল, ভবিষ্যতে কী আছে? জবাবে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে আইনস্টাইন বলতেন, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তা করি না মোটেও। কারণ, এটা এমনিতেও তাড়াতাড়িই আসে।' আইনস্টাইনকে আরও একটি সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত তা হল, “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?” উত্তরে আইনস্টাইন সর্বদা একই উত্তর দিতেন, “বাইবেলের ঈশ্বর নয় বরং আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।” বারুচ ডি স্পিনোজা ছিলেন একজন ডাচ দার্শনিক। দেকার্তের সাথে সপ্তদশ শতাব্দীতে দর্শনের অন্যতম দুর্দান্ত যুক্তিবাদী হিসাবে বিবেচিত হতেন স্পিনোজা। স্পিনোজার ঈশ্বর বলতেন, প্রার্থনা বন্ধ কর। পৃথিবীর পথে বেরিয়ে এসো। তোমার জীবন উপভোগ কর। আমি চাই তুমি নাচ, গাও, আনন্দ কর, মজা কর। আমি তোমার জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছি তার পুরোটা উপভোগ কর।


আমার এক বন্ধু ফিজিক্সে মাস্টার্স করছে তার অভিমত, পৃথিবী সূর্য্যের চারপাশে ঘুরছে এটা কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য এসব পড়তে হবে মাত্র। তার কথায় আরও অবাক হই যখন তার এক পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের কথা সে বলে। সোসিওলজিতে পিএইচডি, তিনি বিশ্বাস করেন তার স্ত্রীর উপর জ্বীনের আছর আছে, স্ত্রীকে মনোচিকিৎসকের কাছে না নিয়ে তিনি হুজুরের পানি পড়া, তেল পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন মানব দেহের হাড় গবেষণা করে আরবি হরফের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্ত হল – “Development of Co-relation Between Interdisciplinary Science and Religion” (আন্তঃবিভাগীয় বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে সহ-সম্পর্কের বিকাশ)। তাঁর মতে মানুষের কঙ্কালের গঠন কোরান তত্বের উপর ভিত্তি করেই গঠিত। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা উনি তার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন জাপান থেকে।'


মানুষের মনে ধর্মবোধ কী করে জাগ্রত হল এই বিষয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম কারণ হল ভয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-ব্যাধি, হিংস্র পশুদের আক্রমণ ইত্যাদি বিপত্তির কারণে মানুষ অসহায় বোধ করে, ভয় পায়। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানুষ বড় পাহাড়, বড় গাছ, সূর্য, চন্দ্র কে ঈশ্বর মেনে সন্তুষ্টি লাভের জন্য বন্দনা শুরু করে। মনে করে এইসব নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। তাকে খুশি করতে পারলে বিপত্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পরবর্তীতে সেই অদৃশ্য শক্তির নাম ঈশ্বর, গড বা আল্লাহ বা জিহোভা। তাকে স্তুতির জন্য তৈরি হয় অর্গানাইজড রিলিজিওন বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। দ্বিতীয় কারণ সমাজে ন্যায়নীতির একটা মানদণ্ড তৈরি করার জন্য মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ তৈরি হয়। তৃতীয় কারণ, যে বিষয় সম্পর্কে যুক্তি তৈরী করা যায় না সেগুলোকে ঈশ্বরের অলৌকিকত্ব হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এই অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। এই অন্ধবিশ্বাসের মূলে একে একে আঘাত করে দার্শনিক বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান ভয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।


আবার বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য পড়া একজন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ায় ধর্ম-অবিশ্বাসী হতে পারেন। অন্যদিকে পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞান পড়া একজন মানুষ শুধু বিজ্ঞান-মনস্ক না হওয়ায় ধর্ম-বিশ্বাসী হতে পারেন। এবার চলুন দেখি সাহিত্যে কিভাবে ধর্মীয় প্রচার কাজ করছে। কিছু দিন থেকে সামাজিক মাধ্যমে এসে থাকা ইংরেজি ভাষায় A for Apple, এর বিপরীতে A for Arjuna,. B for Balaram, C for Chanakya, D for Dhruva, E for Eklavya দেখে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। ভুল বললে ক্ষমা করবেন।


এই কনসেপ্ট যিনি নিয়ে এসেছেন হয়তো ভুলে গেছেন যে A ইংরেজি বর্ণমালার একটা শব্দ এবং A দিয়ে শুধু ইংরেজি শব্দ চর্চাই মূলত পড়ুয়াদের জন্য দরকারি। কারণ আমাদের ছেলেমেয়েরা, ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি ভাষা আয়ত্বের জন্য ইংরেজি শব্দভাণ্ডার জানা একান্ত জরুরি। তাই A for Apple, B for Ball, C for Cat, D for Dog জানা আমাদের শিশুদের জন্য প্রয়োজন। আচ্ছা মনে করেন যদি বাংলায় অজগর, আম, ইঁদুর, ঈগল এর পরিবর্তে অন্য কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করি তবে কি নিজের ভাষা জানার কোনও উপায় থাকবে?


ঈশ্বরকে বাদ দিয়েও যে ধর্ম হতে পারে, যেমন বৌদ্ধ ধর্ম, আবার ধর্মকে বাদ দিয়েও ঈশ্বর হতে পারে। যেমন স্পিনোজার ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের বন্দনা হয় না। অনুভব করা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের নিভৃত প্রাণের দেবতা। বিস্ময়ে ভয় নয় -- জাগে প্রাণ। সৃষ্টি হয় আনন্দ। ভালোবাসা। প্রেম। যে ফুলটি ফোটে--মনে হয় ফুলটি আমি। যে শিশুটি টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায়, কেঁদে ওঠে, আবার উঠে পড়ে -- হেসে ওঠে, মনে হয় এই শিশুটিও আমি। আর শিশুটির মা বলে উঠছে--আহা বাছা। সেই মাও আমি। ওর বাবা মানুষটিও আমি। আকাশের তারাটিও আমি। আমিই সকল কিছু। আমিই সে। সে-ই আমি।


এই আমি তাহলে হলো প্রাকৃতিক সুশৃঙ্খলা মাত্র। একেই স্পিনোজা বলেছেন ঈশ্বর। আইনস্টাইন এই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। এই ঈশ্বর কাউকে উদ্বিগ্ন করে না। ভয় দেখায় না। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ম আর ধর্মীয়গ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে, বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিচ্ছে প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ-আয়শারা ধর্মের সাথে প্রতিটা বিভাগের রিলেশন। দেশে ধর্ম ও বিজ্ঞানে আদানকারী মানুষে ভরে গেছে কিন্তু সমাজ সংস্কারে আমাদের দরকার সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাই খুব সংযত ও যুক্তিসংগত ভাবে অটল বিশ্বাসী কুপমূন্ডকগণদের ‘সব ধর্মই ক্ষতিকর এবং অসত্য’ বোঝাতে হবে।

পাখিপ্রাণ সালিম আলি -পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 24, 2024 | জীবনী | views:291 | likes:2 | share: 2 | comments:0

১৯৫০ সাল। সুইডেনের উপশালাতে বসেছে পক্ষীবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। প্রথম অধিবেশন শুরু হতে তেমন দেরি নেই, পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সবাই। একজন ভারতীয় অবশ্য তখনও পৌঁছননি। কী হবে? কোথাও আটকে গেলেন নাকি? অনুপস্থিত থাকবেন? এমন ভাবনা যখন ঘুরছে আয়োজকদের মনে তখন হঠাৎ মোটরসাইকেলের গর্জন। একটা সানবীম মডেল ব্রেক কষে দাঁড়াল সভাঘরের বাইরে। নামলেন সেই ভারতীয়। মুহূর্তের মধ্যে খবর চাউর হয়ে গেল যে ভারত থেকে সোজা বাইকে করে উপশালা পৌঁছেছেন এক ভারতীয় পক্ষীবিদ! যার কথা হচ্ছে তিনি সালিম আলি। 

চুয়ান্ন বছর বয়সে ফিল্মি হিরোর মত বাইকে করে আবির্ভূত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যাঁর। এতটাই আকর্ষণ মোটরবাইকের প্রতি যে একটা মডেল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না তিনি, শুধু হার্লে-ডেভিডসনেরই তিন রকম মডেল ছিল তাঁর কাছে। এছাড়াও একটা করে ডগলাস, স্কট, নিউ হাডসন এবং জেনিথ মোটরবাইক চালিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। অবশ্য সানবীমের গল্পটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ভারত থেকে গোটা পথ ঐ বাইকে পাড়ি দেননি তিনি। বম্বে থেকে জাহাজে করে ইউরোপে আনান বাইকটা, উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনের আগে সেটাতে করে ইউরোপ চক্কর দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে ফ্রান্সে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পড়লেন, জার্মানীর মসৃন, বাঁধানো রাস্তায় আছাড়ও খেলেন বেশ কয়েকবার। তাতে কী? ভালবাসার জন্য কতকিছু করা যায়, হাত-পায়ে চোট তো সামান্য ব্যাপার। প্রবন্ধের শুরুতে ঝাঁকুনি খেয়ে পাঠক হয়ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন, সালিম আলি কোনটা বেশী ভালবাসতেন, পাখি না মোটর বাইক? জানা নেই উত্তরটা, তবে বাকি প্রবন্ধ তাঁর পক্ষীপ্রেমের আলোচনায় নিবেদিত।

সালিম আলির পক্ষী-পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা।


যে কোনো শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে। নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কাজটা করেছিলেন ‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’-র মাধ্যমে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চ। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষীচর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু হয় বাবরকে দিয়ে। সালিম আলির মন্তব্য, চালু ধারনাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন না সম্রাট বাবর। একটা উদাহরণ - শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট (monal pheasant) নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। ওড়ার পথে ফিজ্যান্টের দল যদি কোনো আঙুরক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে যায় সেখানেই। বাবর লিখছেন, ‘এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু।’ ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনায় যে সেগুলোকে কোনো স্থান দেননি তিনি, এটা তার দৃষ্টান্ত।

তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে, তিনি জাহাঙ্গীর। তার সম্পর্কে বলা হয়, সম্রাট না হয়ে তিনি যদি কোনো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন তবে হয়ত অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তার পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুর-কে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। জাহাঙ্গীরের আগ্রহ জানতেন তাঁর সাম্রাজ্যের সবাই, এমনকি বিদেশীরাও। তাই নজরানা হিসাবে তারা নিয়ে আসতেন তাদের এলাকার বিশেষ প্রজাতির পাখি। সেগুলো সম্রাটের হাতে পৌঁছনো মাত্রই তিনি মনসুরকে নির্দেশ দিতেন পাখির নিখুঁত ছবি আঁকতে। 

সৌভাগ্যক্রমে, এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরেও সম্ভবত রয়েছে তার নমুনা। ছবির পাশাপাশি পাখির চেহারা, বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করতেন জাহাঙ্গীর।

সেইসব বর্ণনা ধরা রয়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়। ১৬২৪ পর্যন্ত চলে জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা রচনা। এই সময়ের মধ্যে কত যে পাখির বৈজ্ঞানিক বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সালিম আলি জানিয়েছেন যে তাঁর দরবারে ডোডো পাখিও পৌঁছেছিল। তবে সেটা ১৬২৪ সালের পরে। ফলে সেটার ছবি থাকলেও স্মৃতিকথায় কোনো উল্লেখ নেই।

জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বা আরো পরে মুঘল সাম্রাজ্য ছারখার হওয়ার পরে সম্রাটের সংগৃহীত বহু নমুনা বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। স্রেফ লুটের খেলা চলছিল তখন। যিনি পাখির নমুনা চুরি করছেন, তিনি হয়ত জানেনও না তার গুরুত্ব। লুটেরাদের দলে অবশ্যই ছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু তাঁদের অপরাধের পাশাপাশি গুণপনাও কিছু কম ছিল না। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের অনেকেরই আগ্রহ ছিল পাখিদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতে প্রথম পাখি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক সংকলন তৈরী করেছিলেন ব্রিটিশ সাহেব জার্ডন। ১৮৬২ এবং ১৮৬৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘বার্ডস অফ ইন্ডিয়া’-র দুটো খন্ড। এর পরে যে খামতি ছিল তা পূরণ করেন দুজন ভারতীয় - সালিম আলি এবং সিডনি ডিলো রিপলে। দশ খন্ডে তাঁরা প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’। প্রকাশকাল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩। এতগুলো খন্ড প্রকাশের পরও, যে বিষয়টা সালিম আলিকে চির-অতৃপ্ত রেখেছিল তা হল পাখিদের স্থানীয় নামের নির্ভরযোগ্য তালিকা সম্পূর্ণ করতে না পারা। এর অভাবে জনপ্রিয় বই যে তৈরী করা মুশকিল তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি।

জনপ্রিয়করণের এই আগ্রহ যে সারা জীবন তাঁর মধ্যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। পরিণত বয়েসে একবার তিনি প্রতিষ্ঠিত পক্ষীবিদ রিপলেকে বেশ রাগ করেই লেখেন যে পক্ষীচর্চার সবটাই যদি কাঠ-কঠিন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তিনি ছেড়েই দেবেন বিষয়টা। অরণ্যে পাখিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অধ্যয়ন ছেড়ে তিনি এমন ট্যাক্সোনমির যুদ্ধ করতে আগ্রহী নন। মজার কথা, প্রাণীবিজ্ঞানে সালিম আলির প্রশিক্ষণ মাত্র এক বছরের। ১৯১৭ সালে দুটো কলেজে একসাথে ভর্তি হন তিনি। একটাতে পড়াশোনার বিষয় ছিল আইন ও হিসাবশাস্ত্র। অন্যটাতে প্রাণীবিজ্ঞান।

দুটোই সম্পূর্ণ করেন তিনি। অবশ্য শুধু সময়ের ‘দৈর্ঘ্য’ দিয়ে এই সময়টাকে মাপলে চলবে না। এই সময়েই তিনি যুক্ত হতে শুরু করেন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সঙ্গে। তার কেরিয়ার গঠিত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকে। তবে ওই সোসাইটির সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় যে নিতান্ত শৈশবে, তা তো পাঠক মাত্রেই জানেন। ঘটনাটা এইরকম। একটা চড়ুই পাখি মেরেছিল ছোট্ট সালিম, তাঁর খেলনা এয়ারগান দিয়ে। সোসাইটির সম্পাদক মিলার্ড সাহেব সেই পাখি দেখে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পাখির শরীরে ব্যতিক্রমী রঙের বিস্তার দেখে মনোযোগী হলেন তিনি। চিহ্নিত করলেন পীত্কন্ঠ চড়ুই হিসাবে। এরপরে, বলা যায় পুরস্কার হিসাবে, সোসাইটির stuff করা পাখির সংগ্রহ দেখালেন। এই বিশেষ চড়ুইয়ের কথা সালিম আলি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’ তে। মৃত চড়ুই তাঁকে পাখির জগতের দরজা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রির সঙ্গে তাঁর যোগ যে কতটা নিবিড় ছিল তা বোঝাতে ১৯৮৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করব। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বায়োলজি আন্ডার দ্য রাজ’। সোসাইটির শতবর্ষ পূর্তিতে এর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লেখা হয়েছে (অনুবাদ):-

“১৯৩০ থেকে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির কাহিনী নির্ধারিত হয়েছে সালিম আলি নামে এক ক্ষীণদেহীর দ্বারা। কোনো ডিগ্রী নেই, জীববিজ্ঞানের প্রশিক্ষণও দূর অস্ত, তিনি বার্মায় কাঠ ব্যবসায়ীর পেশা ছেড়ে নিজের জীবন নিয়োজিত করেন পক্ষীচর্চায়। আজ ৮৭ বছর বয়সেও তিনি সমান সক্রিয় এবং দেশে বিদেশে সোসাইটির সঙ্গে তাঁর নাম সমার্থক। তাঁর ভূমিকার তাৎপর্য দুরকম: প্রকৃতিবিদ হিসাবে এবং প্রশাসক রূপে। যদিও প্রানীদের সমীক্ষার সাথে মূলত যুক্ত ছিলেন তিনি, প্রান্তরে-অরন্যে গিয়ে প্রাণীর আচরণ ও বাস্তুতন্ত্রের সংস্কারমুক্ত, সরল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ইতিহাস চর্চার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলেন। বিশেষ করে বাবুই পাখির সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, মুক্ত ভাবনা এবং স্পষ্টতার দিক দিয়ে কিছু বছর আগে great crested grebes এর উপর জুলিয়ান হাক্সলির করা গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়।”

প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সালিম আলি ভরতপুরকে চাষের ক্ষেতে পরিবর্তিত হওয়া থেকে বাঁচান। 


তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পরেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন রাজস্থানের ভরতপুরে মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করে, তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজননের ঋতুতে শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা পড়ে। পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি তিনি। অবশ্য নেহাৎ আবেগের বশে একাজে লিপ্ত হননি সালিম আলি। তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে দেয় অনেক কিছু - গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বোঝে সরকার। পাশ হয় ভরতপুরের অরণ্য ও জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত।

এই ভরতপুরকেই ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম আলি। এই আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবি - গবাদি পশুকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না এই এলাকায়। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে সোসাইটির করা এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে গবাদি পশু না ঢুকলে এক বিশেষ ধরেণের আগাছা বাড়ছে হু হু করে। এরা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। ফলে মাছের সংখ্যা কমছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে কমে যাচ্ছে জলের পাখি। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেট্স ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড চালিনর ১৯৮০ সালে আসেন এই সমীক্ষায় অংশ নিতে। হতবাক হয়ে তিনি চিঠি লেখেন রিপলেকে। রিপলে বিষয়টা নিয়ে লেখেন সালিম আলিকে। 

তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্বাধীনতার পর যখন রাজস্থানে ভরতপুরের মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজনন ঋতুতে শিকারে নিষেধাজ্ঞা পড়ে, পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে যেতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। অবশ্য শুধু আবেগের বশে এ কাজে লিপ্ত হননি সালিম, তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে অনেককিছু দেয়-গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বুঝে সরকার পাস করে ভরতপুরের অরণ্য এবং জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত। ভরতপুরকে ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম। এই আগ্রহর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন দাবি যেমন, গবাদি পশু প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। কিন্তু সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা যায় গবাদি পশু ঢুকতে না দিলে আগাছার সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে যা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেটস ফিশিং অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড ১৯৮০ সালে ভারতে আসেন এই সমীক্ষা তদারকি করতে। তিনি গবাদি পশুর অবাধ বিচরণের পক্ষে রায় দেন। প্রায় এক দশক ধরে চলা বিতর্কের পর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় সোসাইটির প্রতিবেদন। তখন সালিম এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ক্রমেই গবাদি পশুর জন্য ভরতপুরের পাখিদের দৈন্যদশা প্রকট হতে শুরু করেছে।

১৯০৬/০৭ বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি।...’

নয়-দশ বছর বয়সে এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছিলেন সেলিম আলি! উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয়দের কাছে ‘পক্ষী সংরক্ষণ’ ব্যাপারটা ছিল কল্পনাতীত। বরং পশুপাখি শিকারে যে যত কামাল দেখাতে পারবে সে তত বড় পুরুষসিংহ। শিকার-শিকার খেলতে খেলতেই সেলিম হয়েছিলেন বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া।

মাত্র তিন বছর বয়সে সেলিম মা-বাবাকে হারান। অনাথ হয়েও পাঁচ ভাই ও চার বোনের সঙ্গে সেলিম নিঃসন্তান মামা-মামির কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মামা আমিরউদ্দিন ছিলেন বড় শিকারি। সাহেবরা তাঁকে নেকনজরে দেখতেন। নয় বছরের ছোট্ট সেলিমকে তিনি একটি এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই মাসে ২ টাকা হাতখরচ পেতেন সেলিম। সেই টাকা জমিয়ে মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের পাখির বাজার থেকে নানা ধরনের পাখি কিনে, তারের জাল ও প্যাকিং বাক্স জুড়ে খাঁচা বানিয়ে তাতে পাখিগুলিকে রাখতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে মেহমানদের জন্য বস্তাবন্দি তিতির বা বটের পাখি এসেছে। সে সব সুস্বাদু পদ হওয়ার আগেই বস্তা খুলে জ্যান্ত পাখি চুপিসারে সরিয়ে ফেলতেন। সেই সব পাখিদের জায়গা হত খাঁচায়। 

বড়দের অলক্ষে খুদেদের এই সব কাজে সাহায্য করত বাড়ির পুরনো ভৃত্য নান্নু। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে সেলিম লিখেছেন, তিনি বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না খাঁচার বন্দি পাখিগুলিকে। তার পরেই হাতে আসে এয়ারগান। সেলিমের বাড়ির ভিতরে ছাদে বারান্দায় ছিল অগুনতি চড়াইয়ের বসবাস। চোখের সামনে এত চড়াই ছিল প্রশিক্ষণের জন্য মোক্ষম। তিনি জেনে নিয়েছিলেন, মুসলমান সন্তান হিসেবে চড়াইয়ের মাংস গ্রহণে পাপ নেই। কিন্তু তা উপযুক্ত হালাল হওয়া চাই। মৃত চড়াইকে হালাল করার পদ্ধতি, কী ভাবে তেল মশলা দিয়ে এদের সদগতি করতে হবে, সবই শিখেছিলেন নান্নুর কাছেই! 

এমনই এক দিন, শিকারের পর এক চড়াইপাখি হালাল করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল পাখির গলায়। এ তো ঠিক পরিচিত চড়াইয়ের গলার মেটে দাগ নয়। তা হলে? মৃত পাখিটির গলায় ঝোল পড়ার দাগের মতো হলদে ছাপ। হালাল না করে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গেলেন মামার কাছে। মামাও এর বিহিত করতে না পারায় একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন অবৈতনিক সেক্রেটারি ডব্লু এস মিলার্ড-এর কাছে। সোসাইটির ভিতরে দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো কেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেওয়ালে টাঙানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি... প্রথম বার এই সব দেখে সেলিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সেলিমের জীবন বদলে দিয়েছিল। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এটা নিশ্চয় ১৯০৮ সালের কোনও একটা সময়ে ঘটে থাকবে। বি এন এইচ এস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’

পাখি ও প্রকৃতির বাইরে সেলিম আলি পাগল ছিলেন আর একটি ব্যাপারে। সেটি হল মোটরসাইকেল! কাজের সূত্রে মায়ানমারে গিয়ে প্রথম তাঁর হাতে আসে মোটরসাইকেল, ‘জেনিথ’। ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’ এবং ‘মেক’... সেরা কোম্পানিগুলির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল বিএমডব্লু-র মোটরসাইকেল ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বলে! বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরবাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নাল আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। নতুন মোটরসাইকেল হাতে এলেই, তিনি তার ইঞ্জিন খুলে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোম্পানি নতুন কী যন্ত্রপাতি তাতে দিল এবং কেন দিল। সপ্তাহান্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন মোটরসাইকেলের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে।

১৯৫০-এ সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেস-এ তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাইক ‘সানবিম’। একটাই উদেশ্য, ওই বাইকে করে গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ানো। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।

সালিম আলি সারা জীবন নিজেকে দেখেছেন একজন শখের বা অ্যামেচার পক্ষীবিদ হিসাবে। অথচ তিনিই তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন পেশাদারিত্বের সুউচ্চ মান। বিজ্ঞানী মাধব গ্যাডগিল-এর মতে তাঁর পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা। 

হয়ত আবেগের বশে কোথাও-কোথাও তিনি কিঞ্চিৎ সরে গিয়েছেন যুক্তির নিগড় থেকে। তবে তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় ছিল পাখিদের সংরক্ষণ। কেবল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি নয়, নিখাদ অর্থনৈতিক মূল্যে পাখি যে কত দামী তা বুঝতেন তিনি, বুঝিয়ে গিয়েছেন আমাদের।

ঝুলি ভর্তি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও ঝুলি ভরে গেছিল সম্মানে। ১৯৫৩ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল কর্তৃক প্রদত্ত জয় গোবিন্দ গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে দিল্লি ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৭৮ সালে অন্ধ্র ইউনিভার্সিটিও তাঁকে একই সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৬৭ সালে তিনিই হন প্রথম অব্রিটিশ মানুষ, যিনি ব্রিটিশ অর্নিথলজিস্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। সেই বছরই তিনি জ্য পল ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশনের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ডলারের পুরস্কার পান, যা তিনি নিজের নামের একটি বার্ড কনজারভেশন ফান্ডকে দান করে দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জন সি ফিলিম মেমোরিয়াল মডেল পান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনজারভেশন অফ নেচার অ্যান্ড নেচার রিসোর্সের পক্ষ থেকে। ইউএসএসআর অ্যাক্যাডেমি অফ মেডিক্যাল সায়েন্স তাঁকে প্যাভলস্কি সেন্টিনারি মেমোরিয়াল মেডেলে ভূষিত করে। সেই বছরই তিনি কমান্ডার অফ নেদারল্যান্ডস সম্মানে ভূষিত হন, সেই দেশের যুবরাজ বার্নার্ডের দ্বারা। ভারত সরকার তাকে হাজার ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি রাজ্যসভার সাম্মানিক সদস্য রূপেও মনোনীত হন।


সালিম মূলত উইভার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। লেখালেখির কাজ করার জন্য তিনি বেছে নেন তাঁর শ্বশুরবাড়িকেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল মুম্বইয়ের একটি ছোট্ট গ্রাম কিহিমে। গাছপালায় ঢাকা শান্ত পরিবেশের সেই গ্রামে একমনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন সালিম। ১৯৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন উইভার গোত্রের পাখিদের বৈশিষ্ট্য এবং কার্য পদ্ধতি নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম আর্টিকেল। এই আর্টিকেল তাঁকে পক্ষীবিশারদ মহলে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে দেয়। এই সময়ের পর থেকেই সালিম ঘরে বসে গবেষণার বদলে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে পাখিদের সম্পর্কে সার্ভে এবং বিশদ গবেষণা চালাতে শুরু করেন। দশ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস।’ এরপরে তিনি অপর এক বিখ্যাত পক্ষীবিদ এস ডিলন রিপ্লের সঙ্গে যৌথভাবে ১০ খণ্ডের ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ প্রকাশ করেন। যেটা করতে তিনি প্রায় ১০ বছর সময় নিয়েছিলেন। এখানে তিনি আরও গভীরভাবে উপমহাদেশীয় পাখিদের গঠন, চালচলন, বাসস্থান, প্রজনন, পরিগমন ইত্যাদি নানান ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘কমন বার্ডস’ এবং ১৯৮৫ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ স্প্যারো।’

সালিম আলি পক্ষী পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর এবং জাহাঙ্গিরের মতোই - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ বজায় রাখা। যেকোনও শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চে। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষী চর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলি নির্ভরযোগ্য ছিল না। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু করেন বাবর। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সালিম বলছেন, “চালু ধারণাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন সম্রাট বাবর একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে পথে এদের দল যদি কোনও আঙুর ক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে সেখানেই।” বাবর লিখেছেন, ”এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু। ‘ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনার যে সেগুলোকে কোনও স্থান দেননি, এটাই তার দৃষ্টান্ত। তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে তিনি হলেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যদি সম্রাট না হয়ে কোনও ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন, তাহলে হয়তো অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তাঁর পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুরকে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। 

বিখ্যাত পক্ষীবিশারদ ছাড়াও তিনি ছিলেন এক বাইক পাগল মানুষ। তাঁর জীবনের প্রথম গাড়ি ছিল ৩.৫ এইচ পি এনএসইউ। পরবর্তীকালে একটি সানবিম এবং তিনটি আলাদা আলাদা মডেলের হার্লে ডেভিডসন, একটি ডগলাস, একটি স্কট একটি নিউহাডসন এবং একটি জেনিথ তাই বাইকের সংগ্রহশালাকে শোভান্বিত করেছিল।

১৯৯০ সালের ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে কোয়েম্বাটুরে সালিম আলি সেন্টার ফর অর্নিথলজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটিতে স্থাপন করা হয় সালিম আলি স্কুল অফ ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স। গোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করেন সালিম আলিবার্ড স্যাংচুয়ারি এবং এবং কেরালাতে ভেম্বানাদের কাছাকাছি এক জায়গায় তাঁর সম্মানে সূচনা ঘটে থাট্টাকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি। ১৯৭২ সালে কিট্টি থংলঙ্গা একটি বিরল প্রজাতির বাদুড়ের স্পিসিজ আবিষ্কার করেন যার নাম রাখা হয় Latidens salimalii. এছাড়াও রক বুস কোয়েলের একটি সাব স্পিসিসকেও তাঁর নামেই Perdicula argoondah salimalii পরিচিতি দেওয়া হয়। এছাড়াও ফিন-এর উইভারের একটি প্রাচ্যীয় সাব স্পিসিসকেও নাম রাখা হয় তাঁরই নামে Ploceus megarhynchus salimalii. ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেম ব্যাক উডপেকারের একটি সাব স্পিসিসকে নাম রাখা হয় তাঁর স্ত্রীর নামে (তেহমিনা) Dinlopium benghalenese tehmainae.

১৯৮৭ সালের ২০ জুন প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর ৯০ বছর বয়সে তিনি জীবনযুদ্ধে হার মানেন এবং আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দেন। এরকম মানুষের শুরু তো আছে, কিন্তু তার যেন শেষ নেই। তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, তা যেন কম পড়ে যায়। 

ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে তাঁর খুব প্রিয় ছিল মোটরসাইকেল। এই নভেম্বরে তাঁর ১২৬-তম জন্মদিবস। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।


★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- (১) ডঃ মানস প্রতিম দাস, অনুষ্ঠান কার্যনির্বাহক, আকাশবাণী কলকাতা, আকাশবাণী ভবন, (২) বিজ্ঞান ডট ওআরজি ডট ইন, (৩) ঊর্মি নাথ, (৪) আনন্দবাজার পত্রিকা, (৫) বিজ্ঞান পত্রিকা - কিছু ইতিহাস-কিছু বিজ্ঞান, ১৩ নভেম্বর ২০১৫, (৬) পক্ষীবিশারদ সালিম আলি - রেজা খান। (৭) ফেমাস সাইন্টিস্টস - সালিম আলি ১৮৯৬-১৯৮৭, (৮) ফল অফ স্প্যারো - সালিম আলি, (৯) দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস - সালিম আলি, (১০) দ্য হিন্দু - হাইড অ্যান্ড সিক উইথ সালিম আলি, ১১ নভেম্বর ২০১৭, (১২) ইন্ডিয়া টুডে - রিমেম্বারিং সালিম আলি : দ্য বার্ড ম্যান অফ ইন্ডিয়া, (১১) মাই সেপিক ডট কম ও (১৩) উইকিপিডিয়া।

★ পাখী সংক্রান্ত কয়েকটি সুন্দর ওয়েবসাইট :- Bird Count India, eBird, eBird India, Cornell Lab of Ornithology, Audubon Society.

বৈজ্ঞানিক মেজাজ এবং দাভেলকার -তন্ময়
Nov. 24, 2024 | জীবনী | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দ্রুম, দ্রুম। দু’খানা গুলি। একটা মাথার পেছন দিক থেকে আর আরেকটা পড়ে যাওয়ার পর ডান চোখে। নরেন্দ্র দাভেলকারকে এইভাবেই গুলি করে হত্যা করেছিলেন হিন্দুত্ববাদীরা।

সমাজে বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরীর প্রক্রিয়ায় ডঃ নরেন্দ্র দাভেলকারের অদম্য সাহসী ভূমিকায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন মৌলবাদী শক্তি। বিজ্ঞান আন্দোলনের একজন অগ্রণী সৈনিককে খুন করে সমগ্র বিজ্ঞান আন্দোলনকে হারিয়ে দেওয়ার উগ্র বাসনায় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হিন্দুত্ববাদী ‘সনাতন প্রভাত’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। “one gets what one deserves.” অর্থাৎ, “তার যা পাওনা ছিল সেটাই তিনি পেয়েছেন।” এটাই ছিল পত্রিকা গোষ্ঠীর মনোভাব। ওরা জানেন না যে মস্তিষ্ককে কারাগারে বন্দী করে বা মস্তিষ্কে গুলি করে একটা মানুষকে আটকানো যেতে পারে কিন্তু তার চিন্তাধারাকে আটকানো যায় না। তা আরও ছড়িয়ে পড়ে। 

রাষ্ট্র শক্তি সর্বদা মানুষের চেতনা ও মানসিকতাকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত করতে অত্যন্ত সক্রিয়। একমাত্র শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ব্যাপকতা আর সক্রিয়তা পারে রাষ্ট্র শক্তির এই আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিহত করতে। সেই লক্ষ্যেই তিনি কুসংস্কার মুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক সমাজগড়ার জন্য বিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজে বহমান নানাবিধ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। তবে শুধু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হতেন না বরং মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতেন। 

জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দলিতদের সমানাধিকারের পক্ষে, মারাঠা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকারের নামাঙ্কিত করতে যেমন দাভেলকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তেমনি প্রতিটি গ্রামে একটি করে পানীয় জলের কুপের দাবিতে, প্রান্তিক মানুষদের মদ্যপানের আসক্তি দূর করতে, সশক্তিকরণ ও আত্মমর্যাদা জাগ্রত করার লক্ষ্যে, জলদূষণ রুখতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

ব্যক্তিজীবন বা সামাজিক জীবন সার্বিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়াস জারি রাখতে প্রকৃতি ও সমাজের প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা খুব জরুরী। আর এইজন্য চাই প্রশ্ন করার আর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার বৈজ্ঞানিক মেজাজ। ততটুকুই গ্রহণীয় যতটুকুর সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, এই বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরী করার কাজটা সুচারুভাবে করেছিলেন তিনি।

মানুষের সাথে বন্ধুর মত মিশে, মানুষের জীবনসংগ্রামের সাথী হয়ে, মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সামিল করার প্রয়াস প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাজ। আর এই কাজে ঔদ্ধত্য নয়, সাহসী এবং বিনয়ী হতে হবে। সেই বিনয় আর সাহস সঙ্গী করে দাভেলকার গড়ে তুলেছিলেন মহারাষ্ট্র অনিস অর্থাৎ মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি। ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনে আপাদমস্তক কুসংস্কার বর্জন করা মানুষটি সমাজ জীবনেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চালিয়ে গিয়েছিলেন আপোষহীন লড়াই। বেশ কয়েকজন কুসংস্কারের প্রচারক গুরুবাবাজিদের ভন্ডামি ফাঁস করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। চলমান বিজ্ঞান ভ্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসারের অনন্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সর্বোপরি তৈরী করেছিলেন কুসংস্কার ও জাদুবিদ্যা বিরোধী আইনের সেই ঐতিহাসিক খসড়া যা সারা ভারতে যুক্তিবাদী মানুষের সংগ্রামের পাথেয়। 

 যুগে যুগে কোনো যুক্তিশীল চিন্তাধারার মানুষদের কাজ কখনও সহজ হয়নি। ওনার কাছেও এই কাজ সহজ ছিল না। বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বক্তৃতা বন্ধের চক্রান্ত, ম্যাগাজিন বিক্রি না করার ফতোয়া এমনকি প্রাণনাশের হুমকি নিয়েই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অকুতোভয় মানুষটির পুলিশি সুরক্ষাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

যদিও শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা হয়নি। দাভেলকার এবং তারপরও আরও কয়েকজন যুক্তিবাদী প্রগতিশীল মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী থেকে সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক। বিজ্ঞানীরা সোচ্চারে বলেছিলেন, “we, scientists now join our voices to Theirs (the writers) to assert that the Indian people will not accept Such attacks on reason, science and our plural culture. we reject the destructive narrow view of India that seeks to dictate what people will wear, think, eat and who they will love. we appeal to all other sections of society to raise their voice against the assault on reasons and scientific temper we are witnessing in India today.”

ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি দাভেলকারদের এই ‘Scientific temper’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরির প্রক্রিয়া আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। তাই এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আমরা এই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।


আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম ‘সবই ব্যাদে আছে’ -মেঘনাদ সাহা
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:482 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অনেক পাঠক আমি আমার প্রথম প্রবন্ধে 'সবই ব্যাদে আছে' এইরূপ লেখায় একটু অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে আমি 'বেদের' প্রতি অযথা অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এই বাক্যটির প্রয়োগ সম্বন্ধে একটু ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে। প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা, যাহা Theory of lonisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। 

তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, 

‘এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।’ আমি দুই-একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কী?'

 তিনি বলিলেন, ‘আমি ত কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।’ অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।


বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্ৰগ্ৰহ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন-তন্ন করিয়া খুঁজিয়া 

আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে।

 সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়নবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নূতন কী করিয়াছে। কিন্তু এই সমস্ত 'অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী' শ্রেণির তার্কিকগণ


ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহসূর্যের চতুর্দিকে ভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই। যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ-কক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রিক বা আরবি পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বৈ কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাঁহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।


এই শ্রেণির লোক যে এখনও বিরল নয় তাহার প্রমাণ সমালোচক অনিলবরণ রায়। তিনিও সবই ব্যাদে আছে এই পর্যায়ভুক্ত, তবে সম্ভবত তিনি 'বেদ' মূলে না হউক, অনুবাদে পড়িয়াছেন। সুতরাং তাঁহার পক্ষে সবই বেদে আছে এইরূপ অপজ্ঞান আরও জোর গলায় প্রচার করা সম্ভবপর হইয়াছে। আমি 'সবই ব্যাদে আছে' এই উক্তিতে বেদের প্রতি কোনও রূপ অবজ্ঞা প্রকাশ করি নাই। অনিলবরণ রায় মহাশয়ের মত মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আমার মনোভাব প্রকাশ করিয়াছি মাত্র।


বেদে কী আছে?

এই ঘটনার সময়, অর্থাৎ আঠারো বৎসর পূর্বে আমার বেদ পড়া ছিল না। বলা বাহুল্য, বেদ বলিতে এস্থানে আমি ঋগ্বেদই বুঝিয়াছি। পরে ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদে 'ঋগ্বেদ-সংহিতা' পড়িয়াছি, কারন মূল বৈদিক সংস্কৃতে পড়ার সাধ্য নাই। সমালোচক অনিলবরণ রায়ও বোধহয় মূল বৈদিক সংস্কৃত' বেদ পড়েন নাই, আর মূলে পড়িলেও তাহা বিশেষ কোনো কাজে আসিবে না, কারন ঋগ্বেদ পাণিনির সময়েই (খ্রিঃপূঃ ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতাব্দীতে) দুর্বোধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। সায়নাচার্য খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে উহার অর্থ বুঝিতে প্রয়াস পান (সায়নভাষ্য)। কিন্তু প্রধানত য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণই সম্পূর্ণ বেদ সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করেন এবং বিবিধ উপায়ে উহার দুর্বোধ্য অংশসমূহের অর্থ বুঝিতে চেষ্টা . করেন।

 কিন্তু তাঁহাদের চেষ্টা সত্ত্বেও অধিকাংশ স্থলে অর্থ সুস্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হয় না। তাহার কারন অনেক—একটি প্রধান কারন' এই যে, বেদের বিভিন্ন অংশ অতি প্রাচীনকালে রচিত হয় এবং যে সময়ে যে দেশে অথবা যে সমস্ত অবস্থার মধ্যে যে শ্রেণির লোক দিয়া রচিত হইয়াছিল, পরবর্তী যুগে লোকে তাহা সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়া গিয়াছিল। এই সমস্ত বিষয়ের জ্ঞানের back ground না থাকিলে প্রকৃত অর্থবোধ হওয়া দুঃসাধ্য এবং পরবর্তীদিগকে কষ্টকল্পনার সাহায্য লইতে হয়। প্রথম জানা দরকার, 'বেদ কোন সময়ে রচিত হইয়াছিল!' বেদে অনেক জ্যোতিষিক ঘটনার উল্লেখ আছে। এই সমস্ত ঘটনার সময়নির্ণয় করা দুঃসাধ্য নয়। অধ্যাপক জেকোবি, শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত, বাল গঙ্গাধর তিলক, শ্রীযুক্ত প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ইত্যাদি দেশি ও বিদেশি পণ্ডিতগণ এই সমস্ত জ্যোতিষিক উল্লেখের বিজ্ঞানসঙ্গত পর্যালোচনা করিয়া 'বেদের উপরোক্ত অংশের সময় নির্ণয়ে প্রয়াস পাইয়াছেন। শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি বর্তমান লেখকের সমালোচকগণ, 

যাঁহারা এককালে গণিতশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তাহারা অনর্থক বাগাড়ম্বর বিস্তার না করিয়া এই সমস্ত প্রবন্ধ পড়িলে নিজেদের মানসিক জড়তা (mental inertia) দূর করিতে পারিবেন।

 এই সমস্ত প্রবন্ধে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বেদোক্ত জ্যোতিষিক ঘটনাগুলির কোনটিকেই খ্রিস্টীয় অঙ্গের চারি সহস্র বৎসর পূর্বে ফেলা যায় না। অনেকে মনে করেন যে, বাস্তবিক পক্ষে খ্রিঃ-পূঃ ২৫০০ অব্দ হইতে ৮০০ অব্দের মধ্যে বেদের বিভিন্ন অংশ সংকলিত বা রচিত হইয়াছিল, যেখানে ইহা হইতে প্রাচীনতর ঘটনার উল্লেখ আছে, তাহা 'শ্ৰুতি মাত্র'। যেমন বর্তমানে এদেশে প্রচলিত পঞ্জিকাতে অশ্বিনী নক্ষত্রকে নক্ষত্রপুঞ্জের আদি ধরা হয়। ইহা বর্তমানে শ্রুতি মাত্র, কারন বাস্তবিক পক্ষে অশ্বিনী নক্ষত্র আদি নক্ষত্র ছিল খ্রিঃ ৫০৫ অব্দে, ১৯৩৯ অব্দে নয়। বর্তমান পঞ্জিকাকারগণ 'মানসিক জড়তা' বশত ১৪৩৪ বৎসর পূর্বের জ্যোতিষিক ঘটনাকে বর্তমানকালীয় বলিয়া প্রচার করিতেছেন। বেদের প্রাচীনতম অংশও অনেক সুবিজ্ঞ লেখকের মতে বাস্তবিক সংকলন কালের প্রায় সহস্র বৎসর পূর্বের ঘটনার শ্রুতি মাত্র বহন করিতেছে। যাহা হউক, বেদের প্রাচীনতম অংশকেও খ্রিঃ অব্দের ২৫০০ বৎসর পূর্বে ফেলিতে য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণেরও বিশেষ আপত্তি নাই।


সুতরাং পৌরাণিক সত্যযুগের কথা 'যাহা ১৭,২৮,০০০ বৎসর স্থায়ী এবং 

বর্তমান সময়ের ২১,৬৫,০৪০ বৎসর পূর্বে শেষ হইয়াছিল বলিয়া প্রচার করা হয়, তাহা সম্পূর্ণ অলীক ও ভ্রান্ত।

খ্রিঃ-পূঃ ২৫০০ অব্দে পৃথিবীতে নানা স্থানে অনেক বড়ো বড়ো সভ্যতার উৎপত্তি হইয়াছিল। মিশরীয় সভ্যতাকে খ্রিঃ পূঃ ৪২০০ অব্দ পর্যন্ত টানিয়া আনা যায়। আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ ২৭০০ অব্দে মিশরে পিরামিড ইত্যাদি নির্মিত হইয়াছিল। খ্রিঃপূঃ ২৬০০ অব্দে ইরাক্ দেশে সুমেরীয় জাতি সভ্যতার উচ্চ শীর্ষে আরূঢ় ছিল। সম্ভবত খ্রিঃপূঃ ১৯০০ অব্দে প্রাচীন সভ্য জগতের কেন্দ্রস্বরূপ বেবিলান নগরী ইরাকের রাজধানিত্ব লাভ করে। নানাবিধ প্রমাণ প্রয়োগে স্থির হইয়াছে যে, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে যে প্রাগৈদিক্‌ ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে, তাহাকে খ্রিঃপূঃ ২৫০০ অব্দের দুই-এক শতাব্দীর এদিকে বা ওদিকে টানিয়া আনা যায়।


এখন জিজ্ঞাস্য যে, ‘বৈদিক সভ্যতা' এই সময়ে কোন্ দেশে প্রচলিত ছিল এবং প্রাচীন মিশরীয়, সুমেরীয় ও প্রাথমিক ভারতীয় সভ্যতার সহিত উহার কোন আদানপ্রদান ছিল কিনা? — বৈদিক সভ্যতার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৫০ পূঃ-খ্রিঃ অদের মিটানীয় রাজাদের উৎকীর্ণ লিপিতে। এই রাজগণ আধুনিক মোসা (Masul) নগরীর উত্তর পশ্চিম অংশে বাস করিতেন এবং তাঁহারা যেরূপ সম্ভ্রমের সহিত মিশরীয় ও ব্যাবিলোনীয় সভ্যতার উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা হইতে ধারণা হয় যে নিজেদের সভ্যতাকে উক্ত দুই সভ্যতার সমপর্যায়ভুক্ত মনে করিতেন না। আর একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, যদিও প্রাচীন মিটানীয়গণ, ইরানিয়ান অর্থাৎ পারস্য দেশবাসী আর্যগণ ও ভারতীয় বৈদিক আর্যগণ — সকলে প্রায় এক ভাষাভাষি ছিলেন, কিন্তু এতবত কাল পর্যন্ত তাহাদের নিজস্ব কোন লিপি ছিল বলিয়া কোনও অবিসম্বাদিত প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। বরঞ্চ প্রমাণ পাওয়া

যায় যে, পরবর্তীকালের তুর্কীদের বা মধ্য-এশিয়াবাসীদের মত তাহারা যখন যে-দেশে গিয়াছেন সেই দেশের লিপিই গ্রহণ করিয়াছিলেন। যেমন, পারস্যের এথিমিনীয় বংশীয় রাজগণ, বিশেষত ডেরিয়াস (পরায়াকুস্) ও তাহার পরবর্তী সম্রাটগণ ৫০০ পূঃ-খ্রিঃ আছে তাঁহাদের অনুশাসন পর্বত-গাত্রে উৎকীর্ণ করিয়া গিয়াছেন। এই অনুশাসনের ভাষা প্রায় বৈদিক ভাষা, কিন্তু লিপি প্রাচীন বেবিলোন প্রচলিত কীলক-লিপি এবং সাম্রাজ্যের অংশবিশেষে বিশেষত সিরিয়া দেশ প্রচলিত Aramaic লিপি। ১৪৫০ পূঃ-খ্রিঃ অব্দে মিটানীয়গণ তাহাদের অনুশাসনে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, নাসত্যাদি বৈদিক দেবতার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এখানেও বেবিলোন প্রচলিত কীলক (cuneform) লিপি ব্যবহৃত হইয়াছে। ভারতীয় আর্যগণ ৫০৩ খ্রিঃ পূঃ অব্দের পূর্বে কী লিপিতে লিখিতেন এখনও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। ২৫০ খ্রিঃ পূঃ অব্দের অশোক রাজার অনুশাসন সমস্তই ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা, হয়ত এই লিপির উৎপত্তি ইহার অনেক পূর্বেই হইয়াছিল। কি করিয়া এই লিপির উৎপত্তি হইল এখনও তাহার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় নাই।

এই সমস্ত ঘটনা হইতে বোধহয় ধরিয়া লওয়া অসঙ্গত হইবে না যে, প্রাচীন আর্যগণের কোনো নিজস্ব বিশিষ্ট লিপি ছিল না। তাঁহারা বিজেতা হিসাবে যে দেশে গিয়াছেন, সেই দেশের লিপিই গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের নিজস্ব কোনো লিপি (script) থাকিলে তাঁহারা কখনও বিদেশিয় লিপিতে নিজেদের ভাষা উৎকীর্ণ করিতেন না। ইংরেজ ভারতবর্ষে বা চিনে আসিয়া কি নিজেদের লিপি পরিবর্তন করিয়াছে? মধ্যযুগের আর্যগণ অনেক সুসভ্য দেশ নিজেদের অধিকারে আনে, কিন্তু সর্বত্রই অধিবাসীদিগকে আরবিলিপি গ্রহণে বাধা করিয়াছেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ার তুর্কী বা হুন বিজেতা হইয়াও চিনে চিন লিপি, পারসো ফারসি লিপি এবং রুশিয়াতে Cyritira লিপি গ্রহণ করিয়াছিল, কারন তাঁহাদের নিজেদের কোন লিপি ছিল না।


সুতরাং আশা করি, সমালোচকগণ স্বীকার করিবেন যে, ঋগ্বেদ সংহিতা খ্রিঃ পূঃ ২৫০০ অব্দ হইতে রচিত হইতে আরম্ভ হয় এবং ইহা সেরূপ সমাজের বা সভ্যতার চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে, সেই সমাজ ও সভ্যতা হইতে উন্নততর সমাজ ও সভ্যতা পৃথিবীর অন্যানা অংশে (ইজিপ্ট, ইরাক) এবং সম্ভবত এই ভারতবর্ষেও বর্তমান ছিল। ঋগ্বেদের মঙ্গনদারির উল্লেখের পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে বর্তমান পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বর্তমান আফগানিস্তানের পূর্বাংশ প্রাচীনতম আর্য্যগণের বাসভূমি ছিল এবং তাহারা প্রায়ই সভ্যতর সিন্ধুনদবাসীদিগকে উৎপীড়ন করিতেন।

ঋগ্বেদ সংহিতার সমসাময়িক সুমেরীয় বা মিশরীর সভ্যতার কোনো উল্লেখ আছে কি? এ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনও আবিষ্কার হয় নাই বটে, কিন্তু পরলোকগত লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখান যে, অথর্ববেদের কতকগুলি দুর্বোধ্য শব্দ ও শ্লোক, যাহাদের কোনওরূপ সুস্পষ্ট অর্থ করা কখনও সম্ভবপর হয় নাই, সম্পূর্ণ স্পষ্ট হইয়া যায়—যদি ধরা যায় যে ঐ সমস্ত শব্দ বেবিলান দেশে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনি হইতে গৃহীত হইয়াছে। যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে অর্থব বেদ ১৫০০-১৬০০ খ্রিঃপূঃ অব্দে রচিত হইয়াছিল, তাহা হইলে তিলকের প্রবন্ধ হইতে প্রমাণ হয় যে এই সময়ে ভারত ও বেবিলানের ভিতর যোগাযোগ ছিল। হয়ত ঋগ্বেদের অনেক দুরূহ অংশেরও এইভাবে মীমাংসা হইতে পারে।


ঋগ্বেদে নানা পরিবারস্থ বা গোত্রভুক্ত কবিগণ কর্তৃক সূর্য বা সবিতা, চন্দ্ৰ বা সোম ইত্যাদি প্রাকৃতিক দেবতা এবং ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে রচিত স্তোত্রাবলির সমষ্টি মাত্র।

 অনেকের মতে মিত্র, বরুণ, বিষ্ণু ইত্যাদি দেবতাও সূর্যেরই প্রতীক মাত্র। কিন্তু গ্রহনক্ষত্রাদি ও প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতারূপে কল্পনা করিয়া তাহাদের স্তবস্তুতি করা বৈদিক আর্যদের মৌলিক আবিষ্কার বা একচেটিয়া ব্যবসায় ছিল না। বৈদিক সভ্যতার সমসাময়িক মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতাতে এবং প্রায়শ সর্বত্রই প্রাচীন সভ্যতার স্তরবিশেষে সর্বজাতির মধ্যে এই মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরীয়গণ সূর্য বা 'রা' দেবতাকে প্রধান দেবতা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া মনে করিতেন। Suins তারকা বা লুব্ধক নক্ষত্র, যাহা আকাশে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর শ্রেষ্ঠস্থানীয়, তাহাকে তাহারা তাহাদের Isis দেবীর প্রতীক মনে করিতেন। প্রাচীন সুমেরীয়গণের অধিকাংশ দেবতাই ছিল গ্রহনক্ষত্রাদিমূলক। যেমন-

An or Ann আকাশ বা দৌ, Shamash বা Babbar –সূর্য, ন্যায় ও আইনের দেবতা : Sin বা Nannar— চন্দ্র, Istar — সৌন্দর্যের ও প্রেমের দেবী, Venus বা শুক্র গ্রহকে ইহার প্রতীক মনে করা হইত; Marduk দেবতাদের রাজা, ইনি ছিলেন বৃহস্পতি বা Jupiter গ্রহ; Nabu দেবতাদের লেখক, ইনি আমাদের Saturn বা মঙ্গল গ্রহ : Nergal যুদ্ধের দেবতা, আমাদের Mars বা মঙ্গলগ্রহ। এই সমস্ত দেবতা এবং অন্যান্য সমুদ্র, নদী বা পর্বতাত্মক দেবতাদি সম্বন্ধে প্রাচীন সুমেরীয় কবি বা ঋষিগণ যে সমস্ত স্তোত্র রচনা করিয়াছিলেন, তাহার কতকাংশ বর্তমান সময়ে আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং British Musium-এর সুমেরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যক্ষ গ্যাড় কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ সহ প্রকাশিত হইয়াছে। ইজিপ্ট দেবতাদের উদ্দেশে রচিত স্তোত্রাবলী ও Egyptian Book of the Dead নামক গ্রন্থে সংকলিত হইয়াছে। কিছুদিন পূর্বে পরলোকগত সুপ্রসিদ্ধ আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক ব্রেস্টড্ তাঁহার Dawn of Conscience in the World এই গ্রন্থে প্রমাণ করিয়াছেন যে, খ্রিস্টীয় বাইবেল-এ যে সমস্ত আধ্যাত্মিকতার বাণীকে যিশু খ্রিস্টের মুখনিসৃত বলিয়া বর্ণনা করা হয়, তাহার অধিকাংশই ভাব তো নয়, এমন কি, অক্ষরও প্রাচীন ব্যাবিলোনীয় ও মিশরীয় শাস্ত্রাদি হইতে ধার করা। অর্থাৎ বাস্তবিকপক্ষে ৪০০০ পূঃ -খ্রিঃ অব্দ হইতে ৬০০ খ্রিঃ পূঃ অব্দ পর্যন্ত দুইটি সুপ্রাচীন সভ্যজাতি তাহাদের বহু সহস্র বৎসরের অভিজ্ঞতার ফলে যে সমস্ত আধ্যাত্মিকতার তত্ত্ব (Altruistic Philosophy) আবিষ্কার করিয়াছিলেন, পরবর্তীকালে তাহাই খ্রিস্টীয় ধর্মের আধ্যাত্মিকতা'র ভিত্তি গঠন করিয়াছে। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে এবং আরও অপরাপর ধর্মে গ্রহনক্ষত্র ও নদী-পর্বতাত্মক 'দেবতাসমূহ' নিষ্প্রয়োজনীয় বলিয়া পরিত্যক্ত হইয়াছে। পরবর্তী দুই সহস্র বৎসরের ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি গঠনের জন্য বহুদেবতার উপাসনার কোনো প্রয়োজন নাই। 


বেদ ও বেদ-পরবর্তী শাস্ত্রাদি পর্যালোচনা করিলেও একবিধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। মহোজোদারোর সময় (খ্রিঃপূঃ ২৫০০ অব্দ) এবং অশোকের সময়ের (পূঃ-খ্রিঃ ৩০০ অব্দ) মধ্যবর্তী যুগের ইতিহাস লিখিবার উপাদান এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় ধর্ম ও সত্যতার সমস্ত মূলসূত্র আবিষ্কৃত ও গঠিত হয়। বৈদিক সভ্যতার ও প্রাথৈদিক ভারতীয় সভ্যতার দুইটি ও তিনটি বিভিন্ন ধারার সঙ্গমের ফলেই ভারতীয় ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা গঠিত হয়, পরবর্তী যুগের (অর্থাৎ খ্রিঃপূঃ ৩০০ অব্দের পরবর্তীকালের) লিখিত মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ ইত্যাদিতে এই ১২০ বৎসরের ঘটনাবলীর অস্পষ্ট শ্রুতিমাত্র পাওয়া যায়। বৈদিক আর্যগণ যখন ভারতবর্ষে আসেন পরবর্তীকালে। আনুমানিক বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তির কয়েক শতাব্দী পূর্ব হইতেই) বৈদিক যাগযজ্ঞের কার্যকারিতা সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন ওঠে। তখন নিশ্চয়ই ঘটা করিয়া যাগযজ্ঞাদি করিতেন, কিন্তু উপনিষদের 'আধ্যাত্মিকতা' ব্রহ্মবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, উহাতে বৈদিক দেবতাদি পরিত্যক্ত হইয়াছে। 

বৌদ্ধ ও জৈনগণ 'বেদকে' সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া নিজেদের ধর্মমত গঠন করেন। কিন্তু যে সমস্ত শাস্ত্র বা দর্শন খাঁটি সনাতনী বলিয়া প্রচলিত, মূলত তাহাদের অনেকাংশই বেদ বিরোধী।

 যেমন ধরা যাউক সাংখ্যদর্শন; ইহার বিস্তৃত সমালোচনা করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছেন 'বেদের সংজ্ঞা সাংখ্যে কোথাও নাই, বরং বৈদিকতার আড়ম্বর অনেক। কিন্তু সাংখ্যপ্রবচনকার বেদের দোহাই দিয়া শেষে বেদের মূলোচ্ছেদ করিয়াছেন।'


বেদের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিবিধ হিন্দুশাস্ত্রের সমস্ত মত বঙ্কিমচন্দ্র বিবিধ প্রবন্ধের পঞ্চম পরিচ্ছেদে উদ্ধৃত করিয়াছেন। কৌতূহলী পাঠক পড়িয়া দেখিতে পারেন। এই সমস্ত 'মত' অনুধাবন করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বেদ অপৌরুষেয় ও অভ্রান্ত এই মত অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে অর্থাৎ পুরাণাদি রচনার সময় প্রচলিত হইয়াছে। প্রাচীনকালের শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে বেদের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানারূপ অদ্ভূত ও অস্পষ্ট মত প্রচলিত আছে, কিন্তু কোন মতই বেদকে 'অপৌরুষেয় ও অভ্রান্ত প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করে নাই।

একটা কথা উঠিতে পারে, বেদের এতটা প্রতিপত্তির কারন কী? যাঁহারা বেদমতবিরোধী তাঁহারাও বেদের দোহাই দেন কেন? একথার উত্তর আর একটি ধর্ম হইতে দেওয়া যাইতে পারে। তাহা হইতেছে ইসলামধর্ম— যাহা কোরাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। হজরত মোহম্মদ 'ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ' শুনিয়া যাহা বলিয়া যাইতেন তাঁহার শিষ্যগণ তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া ফেলিতেন, এই সংগ্রহই হইল কোরাণ। কিন্তু হজরত মোহম্মদের মৃত্যুর কুড়ি বৎসরের মধ্যেই নানা কারণে বিশাল ইস্লাম জগতের বিভিন্ন অংশে কোরাণের নানারূপ পাঠ ও অনুলিপি প্রচলিত হয়। তখন খলিফা বা ইস্‌লাম জগতের অধিনায়ক ছিলেন ওমান। খলিফা ওমান দেখিলেন যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের কোরাণের প্রচলন হইতে থাকিলে শীঘ্রই ইসলাম ধর্মে অনৈক্য দেখা দিবে, ইস্লাম-জগৎ শতধা বিভক্ত হইবে। ইহার প্রতিকার-কল্পে তিনি এক অভিনব উপায় উদ্ভাবন করিলেন। তিনি তৎকালে হজরত মোহম্মদের যে সমস্ত শিষ্য ও কর্মসঙ্গী জীবিত ছিলেন তাহাদিগের একটি বৃহতী সভা আহ্বান করিলেন এবং বিভিন্ন দেশে প্রচলিত কোরাণের রচনাবলি বাস্তবিকই হজরতের মুখনিসৃত কি-না তদ্বিষয়ে তাঁহাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করিতে লাগিলেন। বহু দিন এইরূপ পরীক্ষার পর যে সমস্ত রচনা প্রকৃতপক্ষে হজরতের মুখনিসৃত বলিয়া প্রতিপন্ন হইল, সেই সমস্ত লিপিবদ্ধ করিয়া প্রকৃত 'কোরাণের' পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন করিলেন এবং নিয়ন বাঁধিয়া ছিলেন যে, যদি উবিষ্যতে কোরাণের কোনও অনুলিপিতে কিছুমাত্র ভুল থাকে, তাহা অশুদ্ধ বলিয়া বিবেচনা করিতে হইবে। এই কড়া নিয়মের জন্য বিগত চতুর্দশ শতাব্দী ধরিয়া বিশাল ইস্লাম-জগতের কোথাও কোরাণের পাঠ পরিবর্তন সম্ভবপর হয় নাই। ইসলাম-জগতে সর্বত্রই কোরাণ এক।

কিন্তু এইরূপ কড়াকড়ি সত্ত্বেও ইসলামধর্মে নানারূপ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। অধ্যাপক তারাচাঁদের মতে বর্তমানে ইসলামে ৭২টি বিভিন্ন সম্প্রদায় আছে। সকল সম্প্রদায়ই বাহ্যত কোরাণকে অভ্রান্ত ও অপৌরুষেয় (অর্থাৎ হজরত মোহম্মদের মুখনিসৃত ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ) বলিয়া স্বীকার করেন। 

কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এই সমস্ত সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস আচার ব্যবহার অনেক সময় আকাশ-পাতাল তফাৎ, গোঁড়া মুসলমানদের মতে 'কোরাণসঙ্গত' নয়।

 এই সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোরতর যুক্তিবাদী মোতাজিল সম্প্রদায় হইতে (যাঁহারা বাস্তবিকপক্ষে সক্রেটিস, প্লেটো, আরিস্টট্স প্রভৃতি প্রাচীন যুক্তিবাদী গ্রিক দার্শনিকদের মতবাদে বিশ্বাসবান ছিলেন) আগাখানী সম্প্রদায় পর্যন্ত (যাঁহারা অবতার, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি ভারতবর্ষীয় মতে বিশ্বাসবান) সমস্ত পর্যায়ের ধর্মবিশ্বাসীই আছেন। তাহার কারন, ইস্লামধর্ম অতি অল্পকাল মধ্যেই সিরিয়া, পারস্য, ইরাক্, মধ্য এশিয়া ইত্যাদি নানাদেশে প্রচারিত হয় এবং এই সমস্ত দেশের অধিবাসীগণ ইস্লাম ধর্মে দীক্ষিত হইলেও বাস্তবিক স্বদেশপ্রচলিত ধর্মবিশ্বাস একেবারে ছাড়িতে পারে নাই। অনেকস্থলে প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় ধর্মদর্শনতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলেও ইসলামীয় ধর্মমতে শ্রদ্ধাবান হইতে পারেন নাই। কিন্তু রাজশক্তি ইসলামধর্মাবলম্বী, তাঁহাদের বিরুদ্ধে কথা বলিবার মত সাহসও তাহাদের ছিল না। সুতরাং বাহ্যত কোরাণের দোহাই দিয়া, তাঁহারা বাস্তবিক পক্ষে গোঁড়া মুসলমানদের মতে কোরাণবিরুদ্ধ ধর্মমত পোষণ করেন।

'বেদের অভ্রান্ততা'র সম্বন্ধেও এই বক্তব্য চলে। বৈদিক আর্যগণ যখন ২৫০০ খ্রিঃ পূঃ অব্দের কিছু পূর্বে বা পরে উত্তর ভারতের সর্বত্র নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেন, তখন তাহাদের নেতা পুরোহিত (ঋষি) ও রাজগণ খুব আড়ম্বর করিয়া যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেন। 

এই যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে তাঁহারা তাহাদের উপাস্য দেবদেবীর উদ্দেশে স্তোত্র গান করিতেন এবং পশু বলি প্রদান করিতেন।

 পাণিনির পূর্বেই এই সমস্ত স্তোত্রাদি সংকলিত, গণিত ও মণ্ডলাদিতে বিভক্ত হয়। কিন্তু উপনিষদের যুগ হইতেই চিন্তাশীল ঋষিগণ বৈদিক যাগযজ্ঞের আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে সন্দিগ্ধচিত্ত হইতে থাকেন। এদিকে প্রাথৈদিক ভারতীয় সভ্যতায় যে সমস্ত লোকের ধর্মবিশ্বাস ছিল (সম্ভবত পাশুপতধর্ম বা নারায়ণীয় ধর্ম) তাহারাও ক্রমে অন্য প্রকারে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে চেষ্টা করিতে থাকে। দেশের রাজশক্তি ও পুরোহিতশক্তি বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডে প্রগাঢ় বিশ্বাসবান সুতরাং তাহাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিজেদের মতবাদ প্রচার করার সাহস প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসীদের ছিল না, সুতরাং তাহারা বেদের অস্পষ্ট সূক্তাদির দোহাই দিয়া নিজেদের ধর্মমতাদির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন। এইজন্য প্রাথৈদিক 'শিব পশুপতি' বেদের অমঙ্গলের দেবতা রুদ্রের সহিত এক হইয়া গেলেন এবং 'বেদের' সৌরদেবতা বিষ্ণুর সহিত নারায়ণীয় ধর্মের নারায়ণের একত্ব সম্পাদনের প্রয়াস হইল। পাশুপত ও নারায়ণীয় মতাবলম্বীগণ এইরূপে বেদের দোহাই দিয়া অবৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড বা ধর্মবিশ্বাসকে 'জাতে' উঠাইয়া লইলেন, যদিও অনেকস্থলে গোঁড়া বেদবিশ্বাসীগণ তাহাতে সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই; কিন্তু জৈন বা বৌদ্ধেরা ঐ পথে মোটেই গেলেন না, তাঁহারা সরাসরিভাবে বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করিলেন এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডকে নিরর্থক বলিয়া ঘোষণা করিলেন।

বর্তমান লেখক বৈজ্ঞানিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহাতে অবজ্ঞা বা অবহেলার কোনো কথা উঠিতে পারে না। তাহার বিশ্বাস যে, 

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য (world-phenomena), ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহাদের উপর বর্তমান যুগের উপযোগী 'আধ্যাত্মিকতা' প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না।

 কিরূপে 'বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির ভিত্তিতে নবযুগের উপযোগী 'আধ্যাত্মিকতা'র প্রতিষ্ঠা হইতে পারে, প্রবন্ধাত্তরে তাহার সবিশেষ আলোচনা করা যাইবে।

কবিতাগুচ্ছ ২০ -কবিরা
Nov. 23, 2024 | কবিতা | views:292 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দেশের কথা

-জা মা ল  আ ন সা রী


সততার কোনো মূল্য নেই মিথ্যের কারাগারে

নির্দয়ে সে একটু একটু করে গলা টিপে মারে।


দুর্নীতি যেখানে আকাশচুম্বী,চোর ডাকাতে ভরা

সুবিচারের আশা, সে যে শুধুই কষ্টকল্পনা করা।

কল- কারখানায়, হাটে- বাজারে যেখানেই যান

দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, মস্তানদের ইয়া― সন্মান।


নীতি-আদর্শ অক্ষুন্ন রেখে চলা বড়ই কঠিন কাজ

দেশ হাঁটছে অন্ধকারে, নেতা গুলোও  দূর্নীতিবাজ।

কি আর বলল দেশের কথা? লিখে শেষ হবে নাই

বড় ফুল আর ছোট ফুল চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।








নষ্ট ধর্ম

স জ ল  কা ন্তি  টি কা দা র


ভগবান বলে নাইতো কিছুই

কর্মে জগৎ চলে---

তবে কেন তাকে পাবার আশায়

ভাসছো চোখের জলে?

মন্দির মসজিদ গীর্জাতে গিয়ে

অঢেল টাকা ঢালি

ভাবছো তোমার পূন্য হয়েছে

সেই গুড়েতে বালি!

সেইসব টাকা খায় পুরোহিত

খায় বামুনের দল;

পূজোআচ্চা সব লোক দেখানো

পৈতেধারীর ছল।

তোমার টাকাতে পান্ডারা সব

করছে গাড়ী বাড়ী

তবু কি তুমি বোকার মতন

ছুটবে পিছন তারই?

অং বং চং মন্ত্র তাদের

বোঝা যায়না কিছু!

ভন্ড এসব ধর্মের কাছে

কোরোনা মাথা নীচু।


যতটাকা তুমি খরচা কর

ধর্মের নাম নিয়ে

সিঁকি ভাগ তার দাও যদি

ফুটপাতেতে গিয়ে

দেখবে তাদের মুখেতে হাসি

চোখেতে খুশীর আলো

ওরা তোমাকে আপন ভেবে

বাসবে কতই ভালো।

ফুটপাতেতে থাকে যারা সব

পেটেতে আগুন জ্বলে

এসব দেখেও কেন গো তুমি

মিশছো ভন্ড দলে?


মানুষের রক্ত থাকে যদি তোমার

গায়েতে একটু খানি---

মানুষ হয়ে কোরো নাগো আর

সত্যের মান হানি!

ধর্মের এই নোংরামি দেখে

বেঁধোনা কাপড় চোখে---

বজ্রের মতো কঠিন হয়ে

দাঁড়াও এবার রুখে---





বৃথা

প্র দী প  চ ক্র ব র্তী


দেশের একটা আইন আছে

সেটাই দেবে বিধান,

দেশপ্রেমিক হতে চাইলে

পড়ো সংবিধান।


গাছ কাটলে পস্তাতে হবে

সবুজ হবে ক্ষয়,

সত্যি কথা জোর দিয়ে বলো

দূর করো সব ভয়।


মানুষ আগে? নাকি ধর্ম আগে?

কে বলতে পারে?

যুক্তিবাদের ঔষধেতে

ধর্ম রোগ সারে।


বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে

সবকিছু করো যাচাই,

নইলে পরে কাঁদতে হবে

জীবনটা যাবে বৃথাই।

কুযুক্তি বহুল প্রচলিত কুযুক্তি বা হেত্বাভাস -মুক্তমনা
Nov. 23, 2024 | যুক্তিবাদ | views:6884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভূমিকা: 

গণিত বিষয়ক জ্ঞান যেমন প্রত্যেকের থাকা উচিত, তেমনি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানও প্রত্যেকের থাকা উচিত। ৫ + ২ = ৭ এটি সব সুস্থ মানুষই মেনে নেয়। সম্পূর্ণ বা আংশিক অসুস্থ অথবা ভন্ড মানুষ যারা তারা হয়ত মানে না যে, ৫ + ২ = ৭ হয়। অথবা তারা অপ্রয়োজনীয় এমন কথাবার্তা (ত্যানাবাজী) করে যে, বোঝা যায় না – তারা কি এটা মেনে নিল নাকি মানল না? কুযুক্তিগুলোকে কুযুক্তি হিসাবে না মানলে তাকেও সুস্থ মানুষ বলা হয় না। ইন্টারনেট বা অনলাইনে গুগল সার্চের মাধ্যমে বা অন্য সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে “কুযুক্তি” বা “Logical Fallacy” সম্পর্কে সহজেই জানা যায়। আবার www. google translate.com ব্যবহার করে সহজেই যেকোনো ভাষা থেকে অন্য যেকোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায়। 


যুক্তি ও প্রমাণ মানুষের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের ন্যায় বিচারক হওয়ার জন্য বা আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য Logical fallacy (কুযুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস) বিষয়ক ধারনা আবশ্যক। শুরুতেই কুযুক্তি/কুতর্ক/হেত্বাভাস  Logical fallacy কাকে বলে, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এর মানে হচ্ছে, প্রতারণামূলক কিছু, কুতর্ বা কুযুক্তি অথবা ন্যায় কর্মে ফাঁকি দেয়া। যুক্তিবিদ্যায় প্রচলিত কিছু অনর্থক কথার মারপ্যাঁচ কিংবা ভুলযুক্তি/কুযুক্তি/অপযুক্তি বা কুতর্ক জুড়ে দেয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যণীয় ছিল, এবং এগুলো সবই যে কুযুক্তি তা দ্বিধাহীনভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিতর্ক বা একাডেমিক আলোচনার সময় নির্ধারিত কিছু কিছু যুক্তিকে কুযুক্তি বা হেত্বাভাস বা logical fallacy হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

সভ্য মানুষ হতে হলে অবশ্যই জানতে হবে, কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি কাকে বলে, ইহা কত প্রকার এবং কী কী। এই আলোচনা সম্পূর্ণটুকুই আন্তর্জাতিক যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক নানা বই থেকে সংগৃহীত। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের প্রায় সকল যুক্তিবাদী মানুষই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত। অনুন্নত, অসভ্য এবং অশিক্ষিত সমাজে যদিও এই কুযুক্তিগুলোই এখনো যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু এগুলোর কোনটাই আসলে যুক্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সহজভাবে বলতে গেলে, এই ধরণের কুযুক্তিগুলোর সবই যুক্তিবিদ্যার শুরুতেই বাতিল করে দেয়া হয়। সেগুলো আলোচনাতে আসবার যোগ্যতাই রাখে না। সভ্য মানুষ হওয়ার জন্য আপনি যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকলে, এই লেখাটি সবার আগে মন দিয়ে পড়ে নেয়া জরুরি। কারন, হয়তো আপনি নিজেই মনের অজান্তে মানুষকে নানা ধরণের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি দিয়ে যাচ্ছেন।

কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি হচ্ছে যুক্তির ভান করে আপনাকে মিথ্যা বা অযৌক্তিক কিছু বোঝাবার কৌশল। যুক্তি প্রদানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত, সততার সাথে যুক্তি দেয়া এবং আপনার যুক্তি ভুল হয়ে থাকলে অন্যের শুদ্ধটি দ্বারা তা শুধরে নেয়া। মূর্খের মতো অসৎভাবে যারা যুক্তি প্রদান করে বা চালাকিপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরে, তাদের থেকে সাবধান থাকা প্রত্যেক সভ্য মানুষের জন্য খুবই জরুরি। কারন, তারা আপনাকে অযৌক্তিক বা চালাকিপূর্ণ যুক্তি দেখিয়ে আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবে। এই ধরণের প্রতারণামূলক যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে, সেগুলো বাতিল করে সঠিকভাবে গঠনমূলক যুক্তি কিভাবে প্রদান করতে হয় তা শিখতে হলে কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি সম্পর্কে সবারই অবশ্যই জানা থাকা উচিত। আলোচনায় উল্লেখিত উদাহরণগুলোর মধ্যে প্রায় সকল উদাহরণ এমন ধর্মীয় উদাহরণ হিসাবে দেয়া হয়েছে যাতে তা সাধাারণ মানুষের সহজে বোধগম্য হয়।


১. চক্রাকার কুযুক্তি (Circular Logic Fallacy) : 

প্রশ্ন- ১: হিন্দু ধর্মের বই বেদ যে সত্য তার প্রমাণ কী?

কুযুক্তি দাবী -১: বেদ সত্য কারন ভগবান বলেছেন বেদ সত্য।

প্রশ্ন-২: ভগবান যে সত্য তার প্রমাণ কী?

কুযুক্তি দাবী -২: ভগবান সত্য কারন বেদে লেখা আছে ভগবান সত্য।

উপরের দাবী দুটো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি দাবী আরেকটি দাবীকে সত্য প্রমাণ করতে চাচ্ছে। এই দাবী দুটো একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এর কোনটাই প্রমাণিত নয়, তবে একটি আরেকটি দাবীর প্রমাণ হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছে। যুক্তিবিদ্যায় একে বলে চক্রাকার যুক্তি বা সার্কুলার লজিক। এটি একটি কুযুক্তি।


২. অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি (Burden of Proof Fallacy) :

ঘটনা- ১

দাবী: ইউরেনাস গ্রহে আমার দাদার একটি দোতলা দালান আছে।

প্রশ্নঃ ইউরেনাস গ্রহে তোমার দাদার একটি দোতলা দালান আছে, তার প্রমাণ কী?

কুযুক্তিঃ ইউরেনাস গ্রহে আমার দাদার একটি দোতলা দালান নেই, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?

ঘটনা-২

দাবী: স্যুপারম্যানের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়।

প্রশ্নঃ স্যুপারম্যান যে আছে তার প্রমাণ কী?

কুযুক্তিঃ স্যুপারম্যান নেই, তা প্রমাণ করতে পারবে?

উপরের প্রতিটি দাবী এবং দাবীর সপক্ষে কুযুক্তিগুলো লক্ষ্য করুন। দাবীকারী নিজ দাবীর সপক্ষে কোন প্রমাণ উপস্থাপন না করে বরং প্রশ্নকর্তাকেই তার দাবীটি অপ্রমাণের দাবী জানাচ্ছে। অর্থাৎ, তার কাছে তার দাবী প্রমাণের যথেষ্ট যুক্তি না থাকায় প্রশ্নকর্তার ওপরেই সে তার দাবী অপ্রমাণের বোঝা চাপাতে চাচ্ছে। যুক্তিবিদ্যায় একে বলা হয় অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি। উল্লেখ্য, প্রমাণ বা যুক্তি উপস্থাপনের দায় তারই, যিনি দাবী উত্থাপন করেন। অন্য কারও তা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার দায় নেই। অন্য কেউ কারো দাবী অপ্রমাণ না করলেও, কারো দাবী প্রমাণের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপাতে চাইলে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ও যুক্তির অভাবে তার দাবীটিই খারিজ বা বাতিল হয়ে যাবে।

৩. অজ্ঞতার কুযুক্তি (Argument from Ignorance Fallacy) :

দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, আমার মাথায় কতগুলো চুল আছে; তাই হিন্দু ধর্মের দেবতা ব্রহ্ম হলেন সৃষ্টিকর্তা।

দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, মিশরের পিরামিডগুলো কোনটি কয়টি পাথর দিয়ে বানানো; তাই যৌন সম্পর্ক ছাড়াই যিশু খ্রিস্টের মা ম্যারীর গর্ভে সন্তান হয়েছে।

দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, মহাবিশ্বে কতগুলো গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যাদি আছে; তাই মুহাম্মদ ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে কয়েক মিনিটেই আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।

দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, প্রশান্ত মহাসাগরে কত লিটার পানি আছে; তাই হনুমান এক লাফে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা পৌঁছে গেছে।

দাবী: যেহেতু কেউ জানে না, আমার ভাইয়ের খুনী কে; তাই হারুন মিয়াই আমার ভাইকে খুন করেছে।

উপরের দাবীগুলো অজ্ঞতার কুযুক্তির কিছু উদাহরণ। ধরুন, কেউ দাবী করলো, তিনিই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন; এবং যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলো, এই দাবীটি কেউ অপ্রমাণ করতে পারবে না, এবং আরও প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করলো মানুষের অজ্ঞতাকে। যেহেতু পৃথিবীর মানুষ কিছু বিষয় সম্পর্কে এখনও জানে না; বা দাবী উপস্থাপনকারীর ঐ কথাটি এখনও কেউ ভুল প্রমাণ করেনি; সেহেতু তার দাবীটিই সঠিক, এমন যুক্তি দেখানো হলো একটি কুযুক্তি। এটাকে অজ্ঞতার কুযুক্তি বলে।

আগুন সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ প্রাচীনকালে আগুনের পূজা করত। পরবর্তীতে আগুন সম্পর্কে জানার কারণে আগুনকে ভয় করে পূজা করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের এখনও কিছু কিছু বিষয় অজানা আছে। মানুষ অজানাকে জানার চেষ্টা করতে পারে। ধীরে ধীরে জানাও সম্ভব হচ্ছে। তথ্য প্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের কোন অজানা বিষয় থাকার অর্থ এই নয় যে, অমুকের দাবীটি সঠিক। যেকোন অজানা বিষয়কে জানার পদ্ধতি হচ্ছে, তা নিয়ে পড়ালেখা করা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিয়ে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। অমুকে সৃষ্টি করেছে বা তমুকে এমনটি ঘটিয়েছে তা ধরে নেয়া নয়। কোনো অজানা বিষয় অপ্রমাণিত কোনো কিছুর সপক্ষের যুক্তি বা প্রমাণ হতে পারে না। এটাকে অজ্ঞতার কুযুক্তি বলে।


৪. প্রকৃতিগত কুযুক্তি (Appeal to Nature Fallacy):

এই কুযুক্তিটির গতানুগতিক ব্যবহারটি লক্ষ্য করা যায় যখন “ভাল” এর সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করা হয়। দার্শনিক জি. ই. মুর (১৮৭৩-১৯৫৮) যুক্তি দেন, কোন কিছু প্রাকৃতিক বলে একে “ভাল” বা “নৈতিক” বলে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে। এই হেত্বাভাসে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ভাল মন্দের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয় বলেই এর নাম “ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি”।

উদাহরণ:

প্রস্তাবঃ প্রাকৃতিকভাবে যেহেতু নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য  আলাদা তাই নারী পুরুষকে সমান মনে করা বা সমান অধিকাট দেয়া খারাপ।

কিন্তু, প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে কোন কিছুকে যদি নৈতিক বা ভাল মনে করা হয়, তাহলে একই যুক্তিতে প্রকৃতি মানুষকে অসুখবিসুখ এবং রোগব্যাধি দেয়। তাই একই যুক্তিতে ধরে নিতে হয়, অসুখ বিসুখ যেহেতু প্রাকৃতিক তাই নৈতিক এবং ভাল। এবং ঔষধের দ্বারা প্রকৃতির কাজে বাঁধা দেয়া এবং অসুস্থের চিকিৎসা করা নৈতিকভাবে ভুল। তাই বোঝা যাচ্ছে, প্রাকৃতক বা স্বাভাবিক বলেই কোন কিছু নৈতিক এবং ভাল, তা বলা যায় না।

আবার ধরুন, রাস্তাঘাট নির্মান, বিমান গাড়ি চালানো, এগুলো কোনটাই প্রাকৃতিক নয়। বরঞ্চ প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই রাস্তাঘাট বানাতে হয়, বিমান গাড়ি ইত্যাদি চালাতে হয়। তাই প্রাকৃতিক তাই ভাল বা নৈতিক, এমনটা দাবী করা একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি।


৫. স্বাভাবিক করার আবেদন (Appeal to Normality Fallacy) :

অর্থাৎ, প্রথা / অধিকাংশ মানুষ করতো বা করে এই দোহাই দিয়ে কোন অপরাধকে স্বাভাবিক  করার চেষ্টা। এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয় যখন কী স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক নয়, কী হয়ে আসছে, কী কখনও হয় নি, এর উপর ভিত্তি করে যখন কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত টানা হয়, কোনোটাকে ভাল, কোনোটাকে মন্দ বলা হয়। অন্যভাবে বললে, সচরাচর ঘটে কিংবা সচরাচর ঘটে না, সবাই করে কিংবা সবাই করে না, এর ওপর ভিত্তি করে যদি কোন কাজকে নৈতিক/ভাল বা অনৈতিক/মন্দ কাজ বলে সিদ্ধান্ত টানা হয়, তাহলে তাকে আপিল টু নরমালিটি ফ্যালাসি বলা হবে।

উদাহরণ:

১। 

দাবী: “১৪০০ বছর আগে পরাজিত বাহিনীর লোকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের তুলে এনে গনিমতের মাল নাম দিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করাটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই এই কাজকে খারাপ বলা যাবে না।“

কিন্তু ১৪০০ বছর আগে কোনো কাজ খুবই স্বাভাবিক ছিল, সকলেই করতো, সেই কারণেই তা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।

২।

 দাবী: “বাংলাদেশে বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিই ঘুষ খায়। তাই ঘুষ খাওয়ায় খারাপ কিছু নেই।“

কিন্তু বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি ঘুষ খেলেই, দুর্নীতি করলেই দুর্নীতি করা বৈধ বা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।


৩। 

দাবী: “বাংলাদেশে তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করেন নাই। তার আগেও দুর্নীতি হতো। তারেক জিয়ার আগে আওয়ামী লীগও দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতিই বাংলাদেশের মত দেশে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক বিষয়। সবাই করে। পুলিশ, আমলা, কর্মচারী, কর্মকর্তা সকলেই। তাহলে তারেক জিয়া করে কী অপরাধ করেছে?“

কিন্তু তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করে নি, তার আগেও দুর্নীতি হতো, সকলেই করতো, সেটাই সেই সময়ে স্বাভাবিক ছিল, এগুলো কোনটাই দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দান করে না। দুর্নীতি করা, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করা খারাপ এবং সকলে করলেও সেটা খারাপই থাকে। সকলেই করতো – এই দোহাই দিয়ে কাজটিকে ভাল কাজ বলে প্রমাণ করা যায় না।


৪। 

দাবী: “হযরত মুহাম্মদ ৬ বছরের আয়শাকে বিয়ে করে ৯ বছরে বৈবাহিক যৌনজীবন শুরু করেন। ঐ সময়ে এটাই ছিল স্বাভাবিক। সকলেই করতো। আওয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগেও এটির প্রচলন ছিল। তাই নবী মুহাম্মদ কোন খারাপ কাজ করেন নি।”

কিন্তু ঐ সময়ে সকলে করে থাকলেও, সকলের কাজই খারাপ কাজ বলে গণ্য হবে। সকলে করতো তাই একজনার কোন অসভ্য খারাপ কাজকে ভাল কাজ আমরা বলতে পারি না। সকলে করলেও একটি খারাপ কাজ খারাপই থাকে। এক্ষেত্রে মুহাম্মদকে সর্বকালের অনুসরণীয় আদর্শ মানব বলা একটি কুযুক্তি।

৫। 

দাবী: “আমাদের গ্রামে অধিকাংশ নারীরই বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা এখানে একটা নরমাল ব্যাপার, সুতরাং এটায় ক্ষতির কিছু নেই।“

উপরের একই কারণে এটি কুযুক্তি।


৬. সহিহ (খাঁটি) স্কটসম্যান নহেন কুযুক্তি (No True Scotsman Fallacy):

এটি আরেকটি বহুল প্রচলিত কুযুক্তি। কোনো বিপদ দেখলেই উনি সত্যিকারের স্কটসম্যান নহেন, অর্থাৎ সহিহ বা খাঁটি নহেন, ইত্যাদি বলতে থাকাকে যুক্তিবিদ্যায় সহিহ (খাঁটি) স্কটসম্যান নহেন কুযুক্তি বলা হয়। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ্য করুন –


১।

দাবী: জামাতে ইসলামির একজন নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।

কুযুক্তিঃ উনি সত্যিকারের জামাতি নহেন।


২ ।

দাবী: আওয়ামী লীগের এক নেতা দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।

কুযুক্তিঃ উনি সহিহ (খাঁটি) আওয়ামী লীগার নহেন।


৩। 

দাবী: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বার্মিজরা অত্যাচার চালাচ্ছে।

কুযুক্তিঃ যারা অত্যাচার করছে তারা সহিহ (খাঁটি) বার্মিজ নহেন।


৪। 

দাবী: প্যালেস্টাইনে ইসরাইল আবারো আক্রমণ করেছে।

কুযুক্তিঃ ওরা সহিহ (খাঁটি) ইসরাইলী নহেন।


৫। 

দাবী: আই.এস. (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিরা অনেক মানুষকে হত্যা করছে।

কুযুক্তি: যারা আই.এস. তারা সহিহ (খাঁটি) মুসলমান নহেন। এটা ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র।


৭. ভণ্ডামি আশ্রিত কুযুক্তি (Appeal to Hypocrisy Fallacy):


১। 

ধরুন, আওয়ামী লীগ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপি নেতা তারেক জিয়াকে বললো, তুমি একজন দুর্নীতিবাজ।

উত্তরে তারেক জিয়া বললো, তুমিও তো দুর্নীতি করো, বা ডোনাল্ড ট্রাম্পও তো দুর্নীতি করে বা এরশাদও তো দুর্নীতি করেছিল।



২। 

প্রস্তাব – ইসলামে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা অসম্মানজনক।

কুযুক্তি – হিন্দু ধর্মে নারীর মর্যাদা কতটুকু? সেখানেও তো অসম্মানজনক।

এই ধরণের উত্তর একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি, যাকে বলা হয় অ্যাপিল টু হিপোক্রেসি বা ট্যু ক্যুও-ক্যুই। মানে হচ্ছে, ইউ ট্যু বা তুমিও। কিন্তু অন্য আরেকজন দুর্নীতি করলেই প্রথম জনের দুর্নীতির দাবীটি মিথ্যা হয়ে যায় না। বা হিন্দু ধর্মে নারী অসম্মানজনক অবস্থানে থাকলেই ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান সম্মানজনক তা প্রমাণ হয় না। এই কুযুক্তিটি ধার্মিক সমাজে বহুল প্রচলিত এবং এই যুক্তি দ্বারাই সাধারণত বিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ইসলামি জঙ্গিবাদের সমালোচনার সময় তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের উদাহরণ তুলে আনেন, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হয়ে থাকলে ইসলামি জঙ্গিবাদ তাতে গ্রহণযোগ্য হয় না। আরেকটি অন্যায়ের উদাহরণ প্রথম অন্যায়টিকে ন্যায় বানাতে পারে না।


৮. ঈশ্বরের দোহাই দেয়া বা আপিল টু হ্যাভেন কুযুক্তি (Appeal to Heaven Fallacy):

যখন কোন দাবীকে এই যুক্তিতে গ্রহণ করতে বলা হয় যে, “ঈশ্বর এটাই চেয়েছেন” বা “এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা” বা “তিনি ঈশ্বর তাই তিনি এটা করতে পারেন”, তাহলে এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয়। এই কুযুক্তিটিকে ঈশ্বরের দোহাই বা অ্যাপিল টু হেভেন বলে।

উদাহরণ:


১। 

বিচারক: কেন তুমি ওদেরকে হত্যা করেছ?

অভিযুক্ত: কারন ঈশ্বর আমাকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন।

আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, কারন আধুনিক বিচারব্যবস্থা এভাবে কাজ করে না। কিন্তু মুশকিল হল মানব-চিন্তা অনেক সময়ই এভাবে কাজ করে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এই ভেবে কোন কাজ করছে যে ঈশ্বর তাই চান, ঈশ্বর এতে খুশি হবেন, এসব কাজ করলে কোন সমস্যা নেই কারন এটাই ঈশ্বরের বিধান। আর এরকম চিন্তার কারণে অনেকে অন্যের ক্ষতিও করে ফেলেন। আধুনিক বিচারব্যবস্থা এসবের তোয়াক্কা করেনা বলেই হয়তো অন্যের ক্ষতি করার পেছনে এরকম যুক্তি আর খাটে না, অপরাধ তো অপরাধই থাকে।


২। 

কেন ইব্রাহীম ও ইসমাইলের গল্পটিকে একটি “অসাধারণ” ইসলাম ধর্মের কাহিনী হিসেবে পড়ানো হয়? লোকটা তো তার জীবিত সন্তানকে প্রায় জবাই করে ফেলেছিল!

কুযুক্তি: কারন ইব্রাহীম আল্লাহর ইচ্ছারই অনুসরণ করছিল। এটা ইব্রাহীমের জন্য অনেক কষ্টকর হলেও সে আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণে এটা করতে যাচ্ছিল। এটা কি অসাধারণ শিক্ষনীয় ঘটনা নয়?

এখানে বোঝাই যাচ্ছে যে, নিজের সন্তানকে জবাই করতে যাওয়ার গল্প ততক্ষণ পর্যন্তই “অসাধারণ” যতক্ষণ পর্যন্ত এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের ভক্তির জন্য সন্তান হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করলেই সন্তান হত্যা করার চেষ্টা ভাল কাজ হয়ে যায় না, তাতে যতই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ পাক। আর তাই এই গল্পটিও “অসাধারণ” হয় না। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরকম ঈশ্বরের ইচ্ছার ব্যাপারটি আনার অর্থ হলো যুক্তিকে ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই প্রধান হয়ে যায়, আর সেজন্য কারও ক্ষতি করার ব্যাপারটি নৈতিকতার ঊর্ধ্বেও চলে যেতে পারে। যেমনটা গল্পে ইব্রাহীমের ক্ষেত্রে হয়েছিল, আর তাই এরকম কুযুক্তি বিপজ্জনকও হতে পারে।

৩।

দাবী: নিজের ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মের লোকজন অধস্তন বা নিকৃষ্টতম প্রাণী – এই কথা কোন মানুষ বলেনি, ধর্মগ্রন্থে স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন। এরকম কথা মানুষ বললে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সবার সৃষ্টিকর্তা, তাই তিনি এই কথা বলতেই পারেন।

এখানে মানুষের সাথে ঈশ্বরের একটি পার্থক্য সূচিত করে বলা হচ্ছে যে মানুষ এরকম কথা বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে, কিন্তু ঈশ্বর এরকম বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে না। ঈশ্বর এই কথাটি বলছে বলেই এটা সাম্প্রদায়িক হবে না, এটা সত্য এবং সঠিক হয়ে যাবে। এই কথাগুলোতেও যুক্তি ত্যাগ করা হয়, এবং এটি অ্যাপিল টু হ্যাভেন নামক কুযুক্তি। এছাড়া ঈশ্বরের এই কথাটি মানুষের উদ্দেশ্যেই বলা, মানুষকে জানানোর জন্য ঈশ্বর যেসব আদেশ দেন তাই ধর্মগ্রন্থে লেখা হয়। যেহেতু ঈশ্বরের ধর্মগ্রন্থে এরকম বিধান দেয়া হয়েছে তাই ঈশ্বরের কথা ভেবে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে, আর ঈশ্বর এভাবে বলেছেন বলে অন্য ধর্মের লোকেরা অধস্তন, লেস হিউম্যান বা ঊনমানব এরকম দাবী করাকে ঈশ্বরের দোহাই দেয়া কুযুক্তি বলে।

যেমন ধরুন, হিটলার দাবী করতে পারে, ঈশ্বরের নির্দেশেই সে ৬০ লক্ষাধিক ইহুদি নিধন করেছে। বা মাওলানা মওদুদি যখন আহমদীয়াদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণের উষ্কানি দিয়েছে, সেও একই দাবী করতে পারে যে, এটি ছিল আল্লাহর আদেশ। তারা বলতেই পারে, ঈশ্বর ভাল বোঝেন বলেই এই কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন। এভাবে আসলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজকে ন্যায্যতা প্রদান করতে পারে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। সেই কারণে এই যুক্তি কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। এই লজিক্যাল ফ্যালাসি বা কুযুক্তিটি শুধু কুযুক্তিই নয়, বিপজ্জনক ধারণাও বটে।

এই প্রসঙ্গে কথিত ঈশ্বরের আদেশে Deanna Laney murders, Sharon Dalson, আল্লাহর আদেশে রেজওয়ানা হত্যাকাণ্ড, ঈশ্বরের নির্দেশে Samuel Warren Shaffer এর ৮ বছরের বালিকা বিবাহ উল্লেখযোগ্য। এরকম হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে যারা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করেছে।


৯. অপ্রাসঙ্গিক তর্কের কুযুক্তি (Red Herring Fallacy):

দাবী: আমার মনে হয় ভুত আছে।

প্রশ্ন: ভুত যে আছে, তার প্রমাণ কী?

দাবী: এই যে আমরা জন্মেছি, মারা যাচ্ছি, এগুলো তো সত্য, তাই না? মারা যে যাচ্ছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

উপরের দাবীটি লক্ষ্য করুন। দাবীকারী প্রথমে বললো ভুত আছে। প্রমাণ চাওয়া মাত্রই তিনি আলোচনা ভিন্ন একদিকে নিয়ে গেলেন, যেই আলোচনায় তার কথাগুলো আপাত দৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও, তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবেই আসলে জন্ম মৃত্যুর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। যার সাথে ভুত থাকা না থাকা সম্পর্কহীন। পরের ধাপে তিনি যতই যৌক্তিক কথা বলুন না কেন, তার সকল যুক্তিই কুযুক্তি বলে বিবেচিত হবে। কারন তিনি মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন।


১০. মিথ্যা উভয়সঙ্কট কুযুক্তি (False Dilemma Fallacy):

ধরুন, কেউ সমাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে বাক স্বাধীনতা নেই, সেখানে ধর্ম পালনের অধিকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হয় ইত্যাদি। এবং কঠোর সমালোচনার ফলাফল হিসেবে নিয়ে আসছে ইসলামী শরিয়া আইনকে। বোঝাতে চাচ্ছে, যেহেতু সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা হরণ করে, তাই দেশে শরিয়া আইনের কোন বিকল্প নেই। যেন মানুষের সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন, এই দুইয়ের মধ্যেই পছন্দ করতে হবে। আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা খর্ব করলে শরীয়া আইন তার শতগুণ বেশি করে। মানুষের কাছে সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন ছাড়াও অনেকগুলো অপশন রয়েছে। যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। এরকম আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই সবগুলো পছন্দ সামনে না আনাকে ফলস ডিলেম্মা বা মিথ্যা উভয়সঙ্কট কুযুক্তি বলা হয়। যুক্তিবিদ্যায় এই চালাকিপূর্ণ কুযুক্তিকে খারিজ করে দেয়া হয়।


১১. খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি (Straw Man Fallacy):

একজন ব্যক্তি আসলে যা বলেনই নি, সেরকম কিছু তিনি বলেছেন দাবী করে সেই বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে পরাজিত করার যুক্তিকে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি বা খড়ের মানুষ বানিয়ে তার সাথে যুদ্ধ করার কুযুক্তি বলে। ধরুন –

বক্তা ১ বলেছেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।

বক্তা ২ বলছেন, বক্তা ১ আসলে ফ্রি সেক্স করার জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। ফ্রি সেক্স খুব খারাপ। ফ্রি সেক্সে অনেক সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। (এরপরে তিনি দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ফ্রি সেক্সের ভাল খারাপ বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিয়ে গেলেন। অথচ বক্তা ১ ফ্রি সেক্স বিষয়ক কিছু উল্লেখই করেন নি।)

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, বক্তা ২ হয়তো ফ্রি সেক্সের ভাল খারাপ বিষয়ে কিছু বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করতে চাচ্ছিলেন, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা না করে উনি নিজেই বিপক্ষের বক্তার একটি বানানো আর্গুমেন্ট তৈরি করলেন, এবং সেটাকে হারিয়ে দিলেন। একজন যেমন খড় দিয়ে মানুষ বানিয়ে তার সাথে মল্লযুদ্ধ করে যুদ্ধ জয় করার ভান ধরে, খুব বীরত্ব দেখানো হয়েছে বলে সবাইকে বোঝাতে চায়, ঠিক তেমনি, বক্তা ১ যা আসলে বলেনই নি, সেই আর্গুমেন্ট বানিয়ে বক্তা ২ নিজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে বসলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের সাথে ফ্রি সেক্স অথবা কোন ধরণের সেক্সই প্রাসঙ্গিক নয়। এরকম যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টাকে খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি বলা হয়।


১২. পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিত কুযুক্তি Confirmation Bias Fallacy:

যেহেতু আপনি হিন্দু পরিবারে জন্মেছেন এবং ছোটবেলা থেকে হিন্দু ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাই আপনার দাবী হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৪২০০ টি ধর্মের মধ্যে একমাত্র আপনার ধর্মটিই সত্য এবং সঠিক। বাদবাকি ৪১৯৯ টি ধর্মের সবই ভুয়া এবং বিকৃত। আপনি বাংলাদেশের কোন মুসলিম পরিবারে জন্মালে ঠিক একইভাবে একই যুক্তিতে ইসলাম ধর্মটিই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে তখন আপনার মনে হতো। যেহেতু কোন ধর্মটি সঠিক তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে যাচাই বাছাই না করে শুরুতেই আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার ধর্মটিই একমাত্র সঠিক, তাই আপনার দাবী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। আর আপনার এই যুক্তিটি একটি কুযুক্তি। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই মনে করেন, তিনি যেই পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ধর্মটিই একমাত্র সত্য। তিনি তার ধর্মের সপক্ষে যেসকল যুক্তি আছে, সেগুলো খুঁজে বের করেন, এবং সেইগুলোই প্রচার করেন। তার ধর্মের বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে তিনি এড়িয়ে যান বা বাতিল করে দেন।


১৩। এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল)

Appeal to Motive Fallacy:

কোন যুক্তির পেছনে যুক্তিদানকারীর স্বার্থ রয়েছে, এমনটা দেখিয়ে যুক্তি বা দাবীকে ভুল বললে বা নাকোচ করলে এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয়। এখানে যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি নয়, যুক্তিদানকারী কী উদ্দেশ্যে যুক্তি দিচ্ছে, সেই নিয়েই আলোচনা চলে।

উদাহরণ:


১।

 ধরা যাক, ইসলাম ধর্মের শিশু বিবাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরকম অবস্থায় একজন বললো, আপনি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই আপনি ইহুদী খ্রিস্টানদের থেকে টাকা পয়সা নিচ্ছেন।

– এখানে, ইসলামের পক্ষে যিনি বলছেন, তিনি শিশু বিবাহের ভাল খারাপ দিক নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা না করে কী উদ্দেশ্যে কেউ এই যুক্তি দিচ্ছে, কার থেকে টাকা পয়সা পাচ্ছে, তার দিকে নির্দেশ করছেন। যুক্তিবিদ্যায় একে এড হোমিনেম ফ্যালাসি বা কুযুক্তি বলে। উল্লেখ্য, ইহুদী খ্রিস্টানদের থেকে যদি কেউ টাকা নিয়েও থাকে, তাতেও শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে যিনি উপযুক্ত যুক্তি দিচ্ছেন, সেই যুক্তিটি ভুল প্রমাণিত হয় না।


১৪. প্রাধিকারের কুযুক্তি Argument from Authority Fallacy:

দাবী: অমুক বিজ্ঞানী ভাগ্য পরিবর্তনের আংটি পরতো, তাই আংটি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

দাবী: অমুক দর্শনের পণ্ডিত পীরবাবার পানিপড়া খেতো, অতএব পানিপড়া খেলে অসুখ সারে।

দাবী: অমুক বিখ্যাত ডাক্তার ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিল, অর্থাৎ ওঝা রোগ সারাতে পারে।

উপরের দাবীগুলোকে প্রাধিকারের কুযুক্তি বলে। কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এক ধরণের কর্তৃত্ব আরোপ করা, এবং তার নামকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করাকে কুযুক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ধরণের ঘটনা কোনকিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে না। কোন বিখ্যাত মানুষ কী বলেছেন বা করেছেন বা শুনেছেন, তার ওপর যুক্তি নির্ভরশীল নয়। যেমন, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর নাস্তিক হওয়া নাস্তিক্যবাদের যথার্থতার কোন প্রমাণ নয়। আবার একইভাবে, নিউটনের আস্তিক থাকাটিও ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের প্রমাণ নয়। ঈশ্বর আছে কী নেই, তা স্টিফেন হকিং বা আইজ্যাক নিউটনের ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপর নয়, ঈশ্বরের সপক্ষে কতটুকু যুক্তি রয়েছে তার ওপর নির্ভরশীল। তা ব্যক্তির বিশ্বাস অবিশ্বাস নিরপেক্ষ। কে কত বড় বিখ্যাত বা অখ্যাত বা পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ, তার উল্লেখ করে তাদের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকে প্রমাণ করা যায় না। তবে, স্টিফেন হকিং বা আইজ্যাক নিউটন যেসমস্ত যুক্তি বা প্রমাণ ব্যবহার করেছেন, সেগুলো যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু যুক্তিহীনভাবে বিখ্যাত কারও নাম উল্লেখ করে কোন দাবী করলে সেই দাবীকে প্রাধিকারের কুযুক্তি বলা হয়।


১৫. জনপ্রিয়তার কুযুক্তি:

Argument From Popularity/ Argumentum ad Populum Fallacy

দাবী: ইসলাম ধর্ম যদি সত্য নাই হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান কেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে?

দাবী: বিবর্তনবাদ যদি সত্য হয়েই থাকে, তাহলে পৃথিবীর সব আব্রাহামিক ধর্মের ধার্মিক মানুষ কেন তা অবিশ্বাস করে?

জনসংখ্যার কত অংশ কী বিশ্বাস করে, বা কোন মতবাদটি কতটুকু জনপ্রিয়, যুক্তি তার ওপর নির্ভর করে না। যুক্তি বা বিজ্ঞান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় যে, কত মানুষ তা মানলো সেটার ওপর নির্ভর করবে। যুক্তি শুধু তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তির যথার্থতার ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর সকল মানুষও যদি অযৌক্তিক কিছু বলে, শুধু একজন যদি যৌক্তিক কথা বলে, তাহলে ঐ একজন ব্যক্তিই সঠিক। যেমন, পৃথিবীর প্রায় দুইশত কোটি মানুষ ইসলামে বিশ্বাস করলে সেটা যেমন কোন যুক্তি নয়, ঠিক একইভাবে, পৃথিবীর বাকি প্রায় ছয়শত কোটি মানুষ যেহেতু ইসলামে বিশ্বাসী নয়, সেহেতু ইসলাম মিথ্যা, সেটাও ভুল যুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস বা লজিক্যাল ফ্যালাসি। কোন দাবীর সত্যতা সেই দাবীটির তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তির ওপর নির্ভরশীল, তা কতজন বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করে তার ওপর নয়। 


১৬. ভুল উপমার কুযুক্তি False Analogy Fallacy: 

এই ফ্যালাসিটি তখনই হয় যখন কেউ দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে তুলনা করে তাদের মধ্যকার একটি সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে আরেকটি সাদৃশ্য অনুমান করে। দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মিল আছে মানে এটা নয় যে, তাদের মধ্যে অপর আরেকটি ক্ষেত্রে অবশ্যই মিল থাকবে। একটি মোবাইল ফোন আর একটি জীবদেহ উভয়ই অত্যন্ত জটিল মানে এটা নয় যে, মোবাইল ফোনটি কোনো কারিগরের অবদান বলে জীবদেহটিও কোনো কারিগরের অবদান হবে। এই যুক্তি অনুসারে আমরা দাবি করতে পারিঃ

 ছাগল স্তন্যপায়ী প্রাণী,

ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়।

মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী,

 অতএব, মানুষও কাঁঠাল পাতা খায়।

অবশ্যই, ছাগল এবং মানুষ উভয়ই স্তন্যপায়ী প্রাণী মানে এটা নয় যে, ‘ছাগল এবং মানুষ উভয়ই কাঁঠাল পাতা খায়।’

দাবী : “ঘড়ি খুব জটিল একটি বস্তু, সেকারণে একটি ঘড়ি দেখে আমরা বুঝতে পারি, এটি কোনোভাবেই আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং কোনো কারিগর তৈরি করেছেন। যেহেতু জীবদেহ বা আমাদের এই মহাবিশ্বও অত্যন্ত জটিল, সেহেতু জীবদেহ বা আমাদের এই মহাবিশ্বও আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং কোনো কারিগর তৈরি করেছেন। একটি ঘড়ির জন্য যেমন একজন কারিগর প্রয়োজন, তেমনি জীবজগৎ বা মহাবিশ্বের জন্যও একজন ঈশ্বর প্রয়োজন।” 

 একটি ঘড়ি দেখে বোঝা যায়, এটি কোনোভাবেই আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং একজন কারিগর তৈরি করেছেন। তার কারন, আমরা আগে থেকেই জানি, একটি ঘড়ি আপনা-আপনি তৈরি হয়না, একজন কারিগর তৈরি করলেই তৈরি হয়।

একজন কারিগর দ্বারা একটি ঘড়ি তৈরি হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও, একজন কারিগর ছাড়া আপনা-আপনি একটি ঘড়ি তৈরি হওয়ার একটিও উদাহরণ নেই। অপরদিকে, প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জীবদেহ জন্ম নেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও, একজন কারিগর দ্বারা জীবদেহ তৈরি হওয়ার একটিও উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই না।

একটি ঘড়ির জন্য অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন আর তার কারন, একটি ঘড়ি প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জন্ম নিতে পারেনা, একটি অপর একটিকে জন্ম দিতে পারেনা। তাই, একটি ঘড়ি একজন কারিগর তৈরি করলেই তৈরি হয়। অপরদিকে, প্রাণী, উদ্ভিদ কিংবা প্রকৃতিতে বিদ্যমান সবকিছুই আমরা প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জন্ম নিতে দেখি আর এই জন্ম নেওয়ার ঘটনায় কোনো কারিগরের উপস্থিতি খুঁজে পাই না। অর্থ্যাৎ, একটি ঘড়ির জন্য অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন মানে এটা নয় যে, জীবজগৎ কিংবা মহাবিশ্বের জন্যও অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন।

অর্থ্যাৎ, ঘড়ি, মোবাইল ফোন, যানবাহন, রোবট ইত্যাদি মানবসৃষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে কারিগরের প্রয়োজনীয়তা একটি বাস্তবতা হলেও জীবজগৎ, গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কারিগরের প্রয়োজনীয়তা কেবলই একটি অনুমান। আপনি কেবল অনুমান করে নিতে পারেন জীবজগৎ বা মহাবিশ্বের পেছনে একজন কারিগরের অবদান আছে। আর এই অনুমানের অর্থ, জীবজগৎ বা গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা মহাবিশ্বের জন্মরহস্য আপনি জানেন না এবং সেই অজানা স্থান পূরণ করতেই একজন কারিগর বা ঈশ্বর অনুমান করে নিয়েছেন।

তাছাড়া, একজন ঘড়ি-নির্মাতা শূন্য থেকে ঘড়ির জন্ম দেন না। একটি ঘড়ি তৈরিতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপাদানসমূহই ব্যবহৃত হয়। আর প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপাদানসমূহ অবশ্যই একজন ঘড়ি-নির্মাতার সৃষ্টি নয়।


১৭. কুপ্রশ্নের কুযুক্তি Begging the question:

দাবী: আপনি কেন খুন করেছেন? (উনি খুন করেছেন কিনা তা প্রমাণের আগেই) 

দাবী: আপনি আগে যেমন চুরি করতেন এখনো কী করেন?

দাবী: আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা লেখা থাকবে কেন?

দাবী :  হনুমান না থাকলে এতো হনুমানের মন্দির আছে কেন?

উপরের দাবী প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি প্রশ্ন করেছেন, তিনি শুরুতেই ধরে নিয়েছেন, যাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি খুনি, বা তিনি চোর। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রশ্ন করেছেন, যেই প্রশ্নটিই ভুল। যদি আগে থেকেই শ্রোতা খুনি বা চোর প্রমাণিত না হয়ে থাকে, তাহলে এই ধরণের যুক্তিকে কুযুক্তি হিসেবেই গণ্য করা হয়।

তৃতীয় দাবীতে, উনি ধরে নিয়েছেন কোরানে যা লেখা তা সত্য, এবং আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা কেন লেখা থাকবে? যুক্তিবিদ্যায় এরকম যুক্তি প্রদানকে কুযুক্তি বা ফ্যালাসি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 


১৮. তালগাছ আমার কুযুক্তি Argument from final Consequences:

উপস্থাপিত যুক্তি তথ্য প্রমাণ যাই হোক না কেন, যুক্তিতর্কের ফলাফল আপনি আগেই নির্ধারণ করে সেই বিশ্বাসে স্থির থাকলে তাকে আমরা বলি আর্গুমেন্ট ফরম ফাইনাল কন্সিকুয়েন্সেস। ধরুন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। আপনি বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করতে আসলেন, এবং বিবর্তনের সপক্ষে সমস্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি শোনার পরেও, তার বিপরীতে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও আপনি বলতে থাকলেন, যত যাই হোক, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। কারন আপনার আস্থা যুক্তি বা প্রমাণে নয়, আপনার আস্থা বিশ্বাসে। এরকম অবস্থায় আপনার অবস্থানকে তালগাছবাদী কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলা হবে।


১৯.পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিত কুযুক্তি Confirmation Bias Fallacy:

যেহেতু আপনি মুসলিম পরিবারে জন্মেছেন এবং ছোটবেলা থেকে ইসলাম ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাই আপনার দাবী হচ্ছে, পৃথিবীর ৪২০০ টি ধর্মের মধ্যে আপনার ধর্মটিই একমাত্র সত্য এবং সঠিক। বাদবাকি সবই ভুয়া এবং বিকৃত। আপনি ভারতের কোন হিন্দু পরিবারে জন্মালে ঠিক একইভাবে একই যুক্তিতে হিন্দু ধর্মটিই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে তখন আপনার মনে হতো। যেহেতু আপনি কোন ধর্মটি সঠিক তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে যাচাই বাছাই না করে শুরুতেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার ধর্মটিই একমাত্র সঠিক, তাই আপনার দাবী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। তাই এই যুক্তিটি একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই মনে করেন, তিনি যেই পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ধর্মটিই একমাত্র সত্য। তিনি তার ধর্মের সপক্ষে যেসকল যুক্তি আছে, সেগুলো খুঁজে বের করেন, এবং সেইগুলোই প্রচার করেন। তার ধর্মের বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে তিনি এড়িয়ে যান বা বাতিল করে দেন।


২০. স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি Special Pleading Fallacy:

আপনার দাবী: সব কিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। স্রষ্টা ছাড়া কোনকিছু এমনি এমনি হওয়া সম্ভব না।

প্রশ্নঃ তাহলে স্রষ্টার সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে? কে করেছে? তিনি কী এমনি এমনি হয়েছেন?

দাবী: হ্যাঁ তিনি এমনি এমনিই হয়েছেন। তার কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বয়ংসম্পূর্ণ।

প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি কিছুক্ষণ আগেই তো বললেন, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। সেই একই যুক্তিতে, স্রষ্টার স্রষ্টা না থাকাটা আপনার যুক্তির বরখেলাপ হয়ে গেল না?

দাবী: আল্লাহ একটি স্পেশাল ক্যারেকটার। উনি সৃষ্টির উর্ধ্বে। উনার স্রষ্টার প্রয়োজন নেই।

উপরের দাবী অনুসারে, প্রথমে তিনি একটি প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকা অত্যাবশ্যক। পরে তিনি নিজেই আবার আল্লাহ বা ঈশ্বরকে সেই প্রস্তাবের বাইরে কিছু স্পেশাল সুবিধা দেয়ার দাবী জানিয়েছেন, এই বলে যে, উনি এই প্রস্তাব বা নিয়মের উর্ধ্বে। এটি একটি কুযুক্তি। একে বলা হয় স্পেশাল প্লিয়েডিং ফ্যালাসি। যখন কারও দেয়া সূত্র বা প্রস্তাব বা রুল সে বা অন্য কেউ ভঙ্গ করে, এবং সেই ভঙ্গ করাকে তিনিই স্পেশাল কিছু সুবিধা বলে চালিয়ে দিতে চান, তাকে আমরা স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলতে পারি।

২১. ব্যাখ্যা ও অজুহাত বা ন্যায্যতা প্রতিপাদনকে গুলিয়ে ফেলা  Confusing an explanation with an excuse:

কোন ঘটনার ব্যাখ্যা (explanation), অজুহাত (excuse) এবং ন্যায্যতা প্রদান(justification) তিনটি আলাদা বিষয়। কোন ঘটনার ব্যাখ্যাকে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন বা অজুহাত হিসেবে মনে করলে এই হেত্বাভাস হয়। অনেক মানুষই নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তথাকথিত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে, যা আসলে ব্যাখ্যা নয়, এক ধরণের অজুহাত। কোনটি ন্যায্যতা প্রতিপাদন, ব্যাখ্যা আর কোনটি অজুহাত, তা গুলিয়ে ফেলা অনেক মানুষেরই স্বভাব।

উদাহরণ :

১।

বক্তা ১ – পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল।

বক্তা ২ – আপনার এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে হবে। পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে! সেসব না বুঝে আপনি এই কথা বলতে পারেন না।

বক্তা ১ – গণহত্যার আপনি কী ব্যাখ্যা দিতে পারেন?

বক্তা ২ – ঐ সময় খুব কঠিন সময় ছিল। ভারতের দালালরা পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল পাকিস্তানের ক্ষতি করতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন হয়েছিল জানেন? সেই সময়ে কিছু বাঙালি দুর্বৃত্ত পাকিস্তানের সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। সেই সময়ে দেশপ্রেমিক পাক সেনাবাহিনী কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে।

লক্ষ্য করে দেখুন, একটি গণহত্যাকে ন্যায্যতা প্রদান(Justification) করতে বক্তা ২ নানা রকম অজুহাত তৈরি করছেন। গণহত্যার সপক্ষে তিনি অজুহাত তৈরি করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা মনে করছেন। কিন্তু ন্যায্যতা প্রদান, ব্যাখ্যা এবং অজুহাত একদমই আলাদা বিষয়। এই দুটো গুলিয়ে ফেলাকে Confusing an explanation with an excuse বলা হয়। উল্লেখ্য, গণহত্যা বা জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায় ধরে নিধন চালানো কোন ব্যাখ্যাতেই বৈধ বলে গণ্য হয় না। কোন অবস্থাতেই ন্যায্যতা পায় না।


২।

– ভাবি, আপনার ছেলে কিন্তু আমাকে মোটেও সম্মান করেনা।

– কারন সে মনে করে আপনার “আপনার চেহারা ডাইনির মত, যে বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না”।

– কিন্তু এটা কোন অজুহাত হতে পারে না।

– না, এখানে অজুহাতের কিছু নেই, এটা কেবলই তার আপনাকে পছন্দ না করার কারন।

এখানে বাচ্চাটি মহিলাটিকে কেন সম্মান করে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু বাচ্চাটি যে ঠিকই ভাবছে বা ব্যায্য কাজটি করছে বা বাচ্চার ভাবনাটাই যে ঠিক বা ন্যায্য সেটা বলা হয় নি, যা মহিলাটি ধরে নিয়েছিলেন।


৩।

– তুমি কেন বিগফুটকে মানুষ ও বানরের মধ্যকার মিসিং লিংক বলে মনে করছ?

– কারন বিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় দুটো প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতিকেই মিসিং লিংক বলে।

এখানে মিসিং লিংক কাকে বলে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, মানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেন সে বিগফুটকেই মিসিং লিংক বলে মনে করে এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি।


৪।

– ধর্ষণের পিছনে বিবর্তনগত কারন রয়েছে। জীববিজ্ঞানী থর্নহিল ও এনথ্রোপলজিস্ট পালমার বলেন, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হারেম-বিল্ডিং স্ট্রাগলের কারণে লুজাররা ধর্ষণকে বিকল্প জিন প্রমোটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায়, আর এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে আসায় পুরুষেরা ধর্ষণের প্রবণতা লাভ করেছে।

– এভাবে বলে তুমি ধর্ষণকে জাস্টিফাই(Justification) করছ, যেন ধর্ষণ খুব ন্যাচারাল, এটা হতেই পারে!

ধর্ষণের ইভোল্যুশনারি এক্সপ্লানেশন ধর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, অর্থাৎ মানুষ কেন ধর্ষণপ্রবণ হয় তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। কিন্ত এই ব্যাখ্যা কখনই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে না, বা ন্যায্যতা প্রদান করে না। অর্থাৎ ধর্ষণের পেছনে প্রাকৃতিক কারনও রয়েছে বলেই এটা নৈতিক এমন কিছু বলে না। আর সেই সাথে ইভোল্যুশন থেকে আসা প্রবণতা ধর্ষণের জন্য কোন এক্সকিউজ বা অজুহাতও হতে পারে না। এটা তাই অপরাধই থাকবে, কারন মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা থাকলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার অপশন আছে। বিবর্তনের দ্বারা মানুষ নৈতিকতা ও সামাজিকতার বৈশিষ্ট্যই লাভ করেছে। এছাড়া মানুষের আচরণ কেবল জিনই নয়, পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া অপরাধ অর্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ, আর অপরাধী অর্থ যে এই ক্ষতিকর কাজটি করেছে।

রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের বিধান অনুসারে অপরাধী যাতে অপরাধ থেকে নিবৃত হয় তাই শাস্তির প্রয়োজন, যেখানে শাস্তি অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করবার একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কেন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এখন অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মুখ্য, তাই এক্সকিউজ বা এক্সপ্লানেশনে কিছু আসছে যাচ্ছে না।

তবে বৈজ্ঞানিক কারন অনুসন্ধানে এবং মানুষের চরিত্র বুঝবার জন্য স্বাধীনভাবে বিবর্তনগত কারন অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যেখানে নৈতিক সিদ্ধান্ত আরোপনের মাধ্যমে এটা ঠিক কি ভুল- এই বিষয়ক মন্তব্য করার কিছু নেই, বরং এই অনুসন্ধান অপরাধ নিবৃতির কাজে সহায়তা করতে পারে, যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

উপরের উদাহরণে একটি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান এবং সেই ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য ব্যাখ্যা প্রদানকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি।তাহলে আমরা ব্যাখ্যা প্রদান এবং অজিহাতের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করবো?

অজুহাত > ধরুন, যখন কেউ বলবে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, এখানে মেয়েটিরই দোষ ছিল। মেয়েটাই হয়তো কম কাপড় পরেছে, ছেলেটিকে উত্তেজিত করেছে, মেয়েটারই চরিত্রে দোষ আছে ইত্যাদি।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা > লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ধর্ষণের ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয় বলে গবেষনায় দেখা গেছে। বিবর্তনের ধাপে ধাপে যেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটছে, সেখানে শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একজন পুরুষ, যারা সাধারণত অন্য পুরুষের সাথে লড়াইতে কুলিয়ে ওঠে নি, তারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সেখান থেকে হওয়া বাচ্চারা সেইসব জিন বহন করেছে। সেই সাথে পারিপার্শ্বিক ঘটনা, সামাজিক নিয়মকানুন এবং শিক্ষা সেই সব বাচ্চাদের ভেতরে সেই সব জিন সচল করতে সাহায্য করেছে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যখন দেয়া হচ্ছে, সেটি কাজটির ন্যায্যতা প্রদান নয়। এখানে কোনভাবেই কাজটি নৈতিক নাকি অনৈতিক, সেই সিদ্ধান্তে যাওয়া হয় না। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যও তা নয়। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য এইসব ঘটনার পেছনে কারন অনুসন্ধান করা। যখন কারনগুলো সঠিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে, সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে তার উপায়ও মিলতে থাকবে।


২৩. চেরি পিকিং কুযুক্তি  Cherry picking fallacy:

যখন আমরা কোন বিষয়ে বিভিন্ন রকম এভিডেন্স, ডেটা বা সম্ভাবনা থেকে আমাদের অনুকূলে যায় এরকম ডেটা বা এভিডেন্সকেই বা সম্ভাবনাকেই গ্রহণ করি তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

উদাহরণ:


১।

দাবী: কোরানে বলা হয়েছে, পৃথিবী এবং আকাশ(মহাবিশ্ব) এক সময় একসাথে ছিল। আল্লাহ পাক তা আলাদা করেন যা বিগ ব্যাং তত্ত্বের দিকেই নির্দেশ করে।

প্রশ্নঃ বিগ ব্যাং তত্ত্বে কোথাও বলা হয় নি, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব এক সময় একই বিন্দুতে ছিল। আমাদের অবজারভেবল মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। এবং পৃথিবীর বয়স ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ, পৃথিবী নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরের ঘটনা। তাহলে, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব একসাথে ছিল, এরকম বলার পেছনে যুক্তি কী?

এছাড়াও, কোরান অনুসারে পৃথিবীকে আগে সৃষ্টি করা হয়েছে(সুরা ফুসসিলাত আয়াত ৯-১২), এরপরে আল্লাহ আকাশের দিকে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ আকাশে আমরা যা দেখতে পাই, কোরান অনুসারে সে সবের বয়স পৃথিবী থেকে কম। অথচ, আমাদের কাছে এরকম তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্র পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরনো, অনেক প্রাচীন। তাহলে, কোরানের দাবীগুলো সত্য কীভাবে?

> লক্ষ্য করুন, প্রথম কথাটির দাবীদার চেরি পিকিং করছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তথ্যের সাথে যতটুকু মিলছে, ততটুকুই উনি বলছেন। অন্যান্য বিষয়াদি উহ্য রেখে। তাই এটি একটি ফ্যালাসি, যাকে আমরা বলি চেরি পিকিং।


২।

আমাদের পলিটিকাল ক্যান্ডিডেট তার আয়ের ১০% অভাবীদেরকে দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চে যান, এবং সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। তিনি একজন সৎ ও যোগ্য ক্যান্ডিডেট।

এখানে যে বিশেষগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোই যে তার সকল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করবে এমন কোন কথা নেই। হতে পারে তিনি অভাবী সেক্স ওয়ার্কারকে নিজের লাভের বিনিময়ে অর্থ দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চ থেকে বেরিয়ে পাশের স্ট্রিপক্লাবে যান, আর প্রতি সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে যাবার কারন সেখানে ড্রাগ ডিলারদের ঠেক বসে।


৩।

– আপনার সিভিতে লেখা যে আপনি খুব হার্ড ওয়ার্কার, সব কিছুতে আপনার অনেক মনোযোগ, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে আপনার কোন সমস্যাই নেই।

– ইয়েস স্যার।

– আমি আপনার আগের অফিসের বসের সাথে কথা বলেছি। তিনি বললেন, আপনি বারবার বিভিন্ন জিনিস পরিবর্তন করেন যা পরিবর্তন করা উচিৎ নয়, আপনি অন্যের প্রাইভেসি নিয়ে খুব একটা কেয়ার করেন না, আর কাস্টোমার রিলেশনের ক্ষেত্রে আপনার স্কোর খুবই খারাপ।

– ইয়েস স্যার। এগুলোও সত্যি।

– খুব ভাল। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া টিমে তোমাকে স্বাগতম!

সিভি, রেজিউম এসব চেরি পিকিং ইনফরমেশনের ক্লাসিক উদাহরণ। একটি রেজিউমে কেবল এই লেখা থাকে যে কেন আপনি পদটির জন্য যোগ্য। তবে বেশিরভাগ নিয়োগদাতাই বোঝেন যে এগুলো একপাক্ষিক, তাই তারা আরও বেশি এভিডেন্সের জন্য ইন্টারভিউ ও রিকমেন্ডেশন এর দ্বারস্থ হন।


৪। 

লোকটি ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে লিখছেন, নিশ্চই তিনি ধর্ষণ সমর্থন করেন ও তাদের প্রতি তার সমবেদনা কাজ করে।

ধর্ষকদের প্রতি সমবেদনা কাজ করা, ধর্ষকদের প্রতি সমর্থন থাকে, এসব ধর্ষকদেরকে গণপিটুনি দেবার বিরোধিতার কারন হতেই পারে, কিন্তু এটাই এর একমাত্র কারন নয়। মব জাস্টিস সমর্থন না করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকা, অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে বিশ্বাস করা ইত্যাদি অনেক কারন থাকতে পারে এটা নিয়ে লেখার। কিন্তু এদের মধ্যে নিজের অনুকূলে কাজ করে এমন একটি সম্ভাবনা নিয়েই যদি দাবী করা হয় তাহলে চেরি পিকিং কুযুক্তি ঘটবে।


লেখাটির উৎস:

Chintar Mukti - চিন্তার মুক্তি

সংশয় ডট কম

বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম শিল্পস্বাধীনতা! -লোকনাথ
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনী আইনে ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত হয় ১০টি নাগরিক মৌলিক কর্তব্য (পার্ট IV-A, আর্টিকল 51A) এবং পরবর্তীকালে আরো ১টি। এই মৌলিক কর্তব্য পালন আবশ্যক নয়, এই কর্তব্য পালনে নাগরিককে বাধ্য করার আইনি ক্ষমতার সংস্থান ভারতীয় সংবিধানে নেই। মৌলিক কর্তব্যগুলি মূলত নাগরিকের নৈতিক শিক্ষা এবং মননের গঠনের উদ্দেশ্যে সংযোজিত হয়েছে। এই মৌলিক কর্তব্যগুলির মধ্যে অষ্টম কর্তব্যটি হল "Develope Scientific temper, humanism and the spirit of inquiry and reform". ভারতবর্ষের মত ধর্মপ্রবল দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির লড়াই অত্যন্ত কঠিন। আর এই কঠিন লড়াই লড়ে চলেছেন বিভিন্ন মঞ্চ, সংস্থার সাথে যুক্ত বিজ্ঞানকর্মী এবং সমাজকর্মীরা। বছরের পর বছর ধরে তারা নিজেদের জীবন নিয়োজিত করেছেন সমাজে বিজ্ঞানচেতনা তৈরির কাজে। আর ঠিক এর বিপরীত চলেছে অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের চাষ। রাজনৈতিক, সামাজিক আধিপত্য অটুট রাখার জন্য কিছু ধান্দাবাজ, ক্ষমতালোভী মানুষ নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানবিমুখ প্রগতিশীলতা বিরোধী আন্দোলন। খুব স্পষ্ট উদাহরণ হিসাবে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর দিকে তাকানো যায়। কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাসের প্রচারে নির্মিত হয়ে চলেছে একের পর এক সিনেমা। এই প্রবণতা আরো বেড়েছে যখন আধুনিক VFX প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করে দিয়েছে এই ধরনের সিনেমাগুলোর দৃশ্যায়ন। ক্ষমতাসীন শক্তিগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বেশি এই ধরনের সিনেমা তৈরির উদ্যোগ বেড়েছে। দুঃখের বিষয় এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক আগ্রহকে আমরা এখনও সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করিনি। 

পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞানকর্মীদের বহুবছরের আন্দোলনে কার্যত জল ঢেলে দিয়েছিল ১৯৭৭ সালে নির্মিত “বাবা তারকনাথ” সিনেমাটি।

 সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে সাপ বিষ ফেরত নিচ্ছে(!), তাও আবার দৈবিক নির্দেশে! অপবিজ্ঞান, কুশিক্ষা, বিজ্ঞানবিমুখতার সর্বোচ্চস্তর এই সিনেমাটি। এই চুড়ান্ত মিথ্যে, ভ্রান্ত অপপ্রচার গ্রামবাংলার কত মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং কত মানুষের অকালমৃত্যুর কারন হয়েছে তার হিসেব কেউ জানে না। 

এখনও আমরা সংবাদপত্রের পাতায় খবর দেখি যে, ওঝা বা গুনিনের কাছে নিয়ে যাওয়ার কারণে সাপের কামড়ে বিষ ছড়িয়ে মৃত্যু। 

সাপের কামড়ের ১০০ মিনিট (প্রায় দেড়ঘণ্টা) সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু আটকানো যায়,

 বিজ্ঞানের এই সাফল্যের উপকার থেকে লাভবান হতে পারেন না বহু অভাগা মানুষ ও পরিবার। কারন শিক্ষার অভাব এবং অপশিক্ষার প্রচার। সম্পূর্ন অবৈজ্ঞানিক প্রাণঘাতী এই ফালতু সিনেমাটি পরবর্তীকালে একাধিকবার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মুক্তি পায় বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং বহু মানুষের কাছে পৌঁছে তাদেরকে প্রভাবিত করে। সাধারণত দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তিগুলি এই ধরনের পশ্চাদপসারী অপশিক্ষা প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের সিনেমা তৈরি এবং রিলিজ হওয়া আটকানো যায়নি। 

এই ধরনের অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারমূলক সিনেমার বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে তীব্র সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন ছিল, তা গড়ে ওঠেনি। প্রশাসনিকভাবে আটকানো সম্ভব না হওয়ার কারন সম্ভবত সংবিধানের আর্টিকেল ১৯ এবং ২৫। এই দুটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে প্রথমটি বাকস্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়টি যেকোনো ধর্মমত প্রচার, প্রসারের স্বাধীনতা। শিল্প এবং শিল্পীর স্বাধীনতার নামে সমাজকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়াকে আটকানোর জন্য কোনো আইনের সংস্থান ভারতীয় সংবিধানে নেই। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল সমাজগঠনের জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞানসচেতন মানুষের কাছে একমাত্র হাতিয়ার প্রচার আন্দোলন। 

যতদিন পর্যন্ত এই ধরনের অপবিজ্ঞান কুশিক্ষার প্রচার রোধে সুসংবদ্ধ আইন তৈরি না হচ্ছে, দেশের বিজ্ঞানকর্মী এবং সমাজকর্মীদের কাছে এই লড়াই খুবই কঠিন এবং দীর্ঘ।

 বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক স্বার্থে অপবিজ্ঞান প্রচারকে আটকানো না গেলে গণেশের দুধ খাওয়া, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা গণেশের ছবি টাকায় দিয়ে অর্থনীতি উদ্ধারের মত অপবিজ্ঞানবোধ আমাদের আরো কয়েকশত বছর পিছিয়ে দেবে।

লোকনাথ, Durgapur

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য: মেঘনাদ সাহা -জয়ন্ত ঘোষ
Nov. 23, 2024 | জীবনী | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর মেঘনাদ সাহার জন্ম হয় ঢাকার অদূরে শ্যাওড়াতলী নামক গ্রামে। পিতা জগন্নাথ সাহার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের পর মেঘনাদ সাহা ছিলেন পঞ্চম সন্তান। মেঘনাদ সাহার জন্মের রাত ছিল ঝড় আর দুর্যোগের। তখনকার সময়ে আঁতুড় ঘরটি থাকতো মূল বাড়ী থেকে একটু দূরে। সেদিন বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঘনঘটার মধ্যে দমকা হাওয়ায় আঁতুড় ঘরের চাল উড়ে গেল। ঝড়-বৃষ্টির বিরাম নেই দেখে বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য শিশুর ঠাকুমা তার নাম রাখলেন মেঘনাথ। পরে এটি হয়ে যায় মেঘনাদ। (শান্তিময় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫৯)

বিজ্ঞানসাধক মেঘনাদ সাহার ব্যক্তিবিশেষের ঊর্দ্ধে গিয়ে নিজেই একজন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বিরাজমান। আজ তাঁর জন্মদিনে এখানে আমি মেঘনাদ সাহার প্রতিষ্ঠান স্থাপনা, রাজনৈতিক জীবন এবং অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন নিয়ে তার মতাদর্শ আলোচনা করবো।  

(১) কলকাতায় ফেরা ও এক নতুন প্রতিষ্ঠানের শুভারম্ভ:

এলাহাবাদ ছেড়ে ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ডঃ মেঘনাদ সাহা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, ক্যালকাটাতে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পালিত অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। তখন সাহার কাছে দুটি প্রস্তাব এসেছিল – একটি কলকাতার পালিত অধ্যাপকপদ, অন্যটি বথের রয়াল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর অধ্যক্ষ পদ। তিনি বেছে নিলেন প্রথমটি। কলকাতা ফিরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ানোর প্রস্তাব দেন এবং নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে একটি বিশেষ পেপার চালু করেন। পাশাপাশি কলকাতায় একটি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর প্রতিষ্ঠান বানানোর পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি দেশের আরো অনেক প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সাথে ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা-র বিভিন্ন গবেষণাগার ভ্রমণ করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি যান রাশিয়াতে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের একটি অনুষ্ঠানে। এর আগে ১৯৩৬ সালের জুন মাসে তিনি যান ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ যোগ দিতে। 

সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাঊলি, হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন, ওপেনহাইমার, নীলস বোর, হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী।

ভেবে দেখুন তখনকার দিনে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বানানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। প্রয়োজন ফান্ডিং। তখন ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ এর মধ্যে তিনি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির মিটিং-এর সূত্রে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সময় ডঃ সাহা নেহেরুকে নিউক্লিয়ার শক্তির গুরুত্ব ও এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকেন। প্রাথমিক সফলতা পেলেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। জওহরলাল নেহেরুর উদ্যোগে তিনি ১৯৪১ সালে স্যার ডোরাব টাটা ট্রাস্ট থেকে ৬০ হাজার টাকা, ১৯৪২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬০ হাজার টাকা, ১৯৪৩ সালে জি. ডি. বিড়লার কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য ১২ হাজার টাকা করে গবেষণার জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। ডঃ সাহা তাঁর ছাত্র বি. ডি. নাগচৌধুরীকে ১৯৩৮ সালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়াতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তিন বছর পর নাগচৌধুরী দেশে ফিরলে তাঁকে যোগ্য সহকারী হিসেবে পাশে নিয়ে দেশের প্রথম সাইক্লোট্রন বানানোর কাজে ব্রতী হন ডঃ সাহা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁর কাজের জন্য বিদেশ থেকে অনেক যন্ত্রাংশ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠলো।

এরপর ১৯৪৭ সালে তিনি তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে জওহরলাল নেহেরু মাধ্যমে অনুদান হিসেবে পান ৭০,০০০ টাকা, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান ২ লাখ টাকা। শেষমেশ ১৯৪৮ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের। ১৯৫০ সালের ১১ই জানুয়ারী ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিল্ডিংয়ের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জোলিয়েট ক্যুরি (মাদাম ক্যুরি-র কন্যা)। (Pramod V. Naik, 2017)

(২) ডঃ মেঘনাদ সাহা ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন:

১৯৪৮ সালের ১৫ই এপ্রিল নবগঠিত ভারত সরকার “The Atomic Energy Act XXIX” লাগু করেন। সে বছরেরই ৯ই অগাস্ট গঠিত হয় “The Atomic Energy Commission”, যার চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন, ডঃ কে. এস. কৃষ্ণণ, ডঃ শান্তিস্বরূপ। অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাক্টে বলা হল: এই কমিশন সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে কাজ করবে এবং কমিশনের চেয়ারম্যান “answerable directly to the Prime Minister.”

সম্ভবত এই সময়ে অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাক্টের তীব্র সমালোচনা করেন ডঃ সাহা। পরবর্তীকালে একটি পত্রে তিনি জওহরলাল নেহেরুকে লেখেন: “I have been put to one humiliation after another. I have been asked to take orders from Bhatnagar, whom I consider a very poor scientist, and from Bhabha, who though a good scientist, but [he] is 18 years my junior and the conferment of enormous power on him has made him extremely bumptious. They would have throttled my scientific activities completely, but probably in your calmer moments, you think that I am not so bad as they represent me to you. So I have been given doles from time to time in order that my scientific efforts may not be completely throttled.” (Abha Sur, 2002)

জওহরলাল নেহেরু সাহার এই সমালোচনাকে “not only unjustified but completely lacking in objectivity and therefore most unscientific” বলে উড়িয়ে দেন। এর সঙ্গে জওহরলাল নেহেরু কটূক্তির সুরে বলেন: “If you attack the Government, surely you do not expect them to remain silent.” (Abha Sur, 2002)

ডঃ সাহা ও ডঃ ভাবার মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, গবেষণাক্ষেত্রে একে অন্যকে সাহায্যই করেছেন। ১৯৫৪ সালে ডঃ ভাবা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের বাজেট থেকে ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণাখাতে ৫০ লাখ টাকা দেবার প্রস্তাব রাখেন ডঃ সাহার কাছে। ডঃ সাহা সেই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। (Pramod V. Naik, 2017)

(৩) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডঃ মেঘনাদ সাহা:

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে ডঃ মেঘনাদ সাহার সুসম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে নেতাজীর দাদা শরৎচন্দ্র বোসের পরিচয় হয় ডঃ মেঘনাদ সাহার সাথে। শরৎচন্দ্র বোস ১৯৪৬ সালে প্রথম অন্তর্বর্তী ভারত সরকারের একজন সদস্য ছিলেন। তিনিই ডঃ মেঘনাদ সাহাকে পার্লামেন্টে যোগ দেবার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন। ডঃ মেঘনাদ সাহা ন্যাশনাল প্ল্যানিং, রিভার ভ্যালি ডেভলেপমেন্ট, শিল্পের আধুনিকীকরণ, শিক্ষার আধুনিকীকরণ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক ধারণা দিয়েছিলেন, তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে তাঁর পার্লামেন্টে যোগ দেওয়াটা আবশ্যিক বলে মনে করতেন শরৎচন্দ্র বোস। (Pramod V. Naik, 2017)

১৯৫২ সাল। দেশের প্রথম সাধারণ লোকসভা নির্বাচন। শরৎচন্দ্র বোস ততোদিনে পরলোকগমন করেছেন। শরৎচন্দ্র বোসের পত্নী বিভাবতী বোসের পরামর্শে উত্তর-পশ্চিম কোলকাতা থেকে বাম সমর্থিত নির্দলীয় প্রার্থী হলেন ডঃ সাহা। 

যদিও ডঃ সাহা কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাস করতেন কিন্তু কখনো কোনো বামপন্থী সংগঠনের সদস্য হননি। বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি।

 ১৯৫২ থেকে আমৃত্যু ১৯৫৬ পর্যন্ত লোকসভার সদস্য ছিলেন তিনি।

লোকসভায় বেশ সক্রিয় এবং জনপ্রিয় বক্তা ছিলেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নদীপ্লাবণ ও বাঁধ পরিকল্পনা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নিউক্লিয়ার শক্তি প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভায় আলোচনা করেছেন তিনি।

নিউক্লিয়ার শক্তি সংক্রান্ত প্রথম আলোচনা তিনি লোকসভায় করেন ১৯৫৪ সালের ১০ই মে। আলোচনার বিষয় “Peaceful uses of Atomic Energy.”। এই সংক্রান্ত পরবর্তী বিতর্কসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী।

১০ই মে-র বক্তব্যে ডঃ সাহা বলেন: “Any scientist, however great he might be, cannot do this work alone. In scientific work, sometimes we find that it is not an Einstein or a Newton who can solve any problem. 

Sometimes the problem was solved by a man who may be a back-bencher. Scientific work was the result of co-operation of a large number of brains.

Sometimes, a suggestion or a method of work comes from persons who were considered not very prominent or very able. In the development of atomic energy work in America, we find, suggestions have been made by persons whose names we do not know, we have not known till the other day. The most prominent scientists who were there had made absolutely no contribution. I want our government to take all these matters into consideration and lay down a sound policy for the development of atomic energy in this country.” (Pramod V. Naik, 2017)

এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন: “…An eminent Member of the other side, who used to be a great scientist, Prof. Meghnad Saha, but who drifted from the fields of science and has found no foothold elsewhere yet, told us many things, most of which I think are completely wrong. I have seldom come across a less scientific approach to a problem than that of Prof. Meghnad Saha, in fact, a less factual approach. I can only express my deep regret that such an eminent scientist should have fallen into such evil ways of thinking…” (Pramod V. Naik, 2017)

প্রত্যুত্তরে ডঃ সাহা কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেই বিদ্রূপের ঢঙে বলেন: ‘…I may add that I have done very little in science, but my name would be remembered for some hundreds of years while some politicians here will go to unregretted oblivion in a few years’. (Pramod V. Naik, 2017)

অর্থাৎ, ডঃ মেঘনাদ সাহা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন বা ডঃ ভাবার বিরোধী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন অ্যাটমিক এনার্জি গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো, আরো উন্নত ও মেধাবী গবেষক, মানবকল্যাণে এর ব্যবহার। তিনি সমালোচক ছিলেন চটজলদি সরকারী নীতি প্রণয়নের। তার মৃত্যু নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, কারন মেঘনাদ সাহার মতো ব্যক্তিত্ত্বের মৃত্যু হয়না, তারা চির অমলিন থাকেন আমাদের হৃদয়ে। আসলে মেঘনাদ সাহা এক আন্দোলনের নাম, মেঘনাদ সাহা এক আধুনিক মতাদর্শ তথা ভাবধারার নাম, মেঘনাদ সাহা এক স্বতন্ত্র ভারতীয় বিজ্ঞানচেতনার প্রতীক।

© জয়ন্ত ঘোষ, ভূ-পদার্থবিদ্, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।

তথ্যসূত্র:

(১) মেঘনাদ সাহা, শান্তিময় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৫৯।

(২) Meghnad Saha: His Life in Science and Politics, Pramod V. Naik, Springer, 2017.

(৩) Scientism and social justice: Meghnad Saha's critique of the state of science in India, Abha Sur, Historical Studies in the Physical and Biological Sciences, Vol. 33, No. 1 (2002), pp. 87-105.

(৪) Meghnad Saha: His Science and Persona through Selected Letters and Writings, Jibamitra Ganguly with Reminiscences of a Daughter Chitra Roy, Indian National Science Academy, 2019.

পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না -কৃষ্ণপদ ভৌমিক
Nov. 23, 2024 | জীবনী | views:810 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রচণ্ড দারিদ্রতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম প্রজন্মের ছাত্র হিসেবে কলকাতায় পড়তে গিয়ে প্রচণ্ড সমস্যার মুখোমুখি হই। ইংরেজি অনার্স পড়বার আগে ভেবে রোমাঞ্চিত হতাম যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের খুঁটিনাটি কতো কিছু জানতে পারব। ইংরেজিটা একেবারে মাতৃভাষার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি যাবতীয় আকর্ষণ শেষ করে দেওয়ার পক্ষে ইংরেজি অনার্স কোর্সটিই যথেষ্ট। ইংরেজির তেমন কিছু জানতে হবে না,শুধু নোটস কিনে মুখস্ত করতে হবে। সেই নোটসের মধ্যে নানা জনের লেখা থেকে টুকে বড় বড় কোটেশন দিয়ে নানা রকমের বিশেষণ ব্যাবহার করে বোঝানো আছে লেখক কিংবা কবি কতো ভালো লিখেছেন, কিংবা টাইটেল টা খুব সুন্দর হয়েছে ইত্যাদি! একই কথার চর্বিতচর্বণ করে, একটু এদিক ওদিক করে বিচ্ছিরি হাতের লেখায় সব বড় বড় এক গাদা নোটস। আমার নিজের থাকা খাওয়ার জন্য টাকা নাই। তার ওপর নোটস জোগাড় করতে অনেক টাকা দিয়ে টিউশন পড়তে হবে। অসম্ভব ব্যাপার। আমি বরাবরের অন্তর্মুখী। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতাম না। তাই ক্লাসে যে স্যারের পড়া খুব ভালো লাগে, সেই স্যারকেই সমস্যার কথা জানিয়ে কলেজের ঠিকানায় একখানা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু দিন পরে দেখি আমার গ্রামের বাড়িতে একটা চিঠি আসে। আমাদের প্রিয় অধ্যাপক শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা চিঠি। চিঠিতে তিনি আমাকে পূজার ছুটির পর কলেজ খুললে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। চিঠি পেয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। 



দেখা করে বললাম, স্যার গ্রামে থাকার সময় নিজে নিজে পড়াশুনা করেছি, এইভাবে  টিউশন পড়তাম না। বইপত্র সব বাঙলায় হওয়ায় কোনও সমস্যা হয় নি এতোদিন। কিন্তু এখন খুব সমস্যা হচ্ছে। সবচেয়ে সমস্যা হলো আমার মুখস্ত মনে থাকে না। আর না বুঝে মুখস্ত করতেও পারি না। আমাদের প্রিয় RKB Sir বললেন Self-Study হলো শিক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়। তিনি আমার হতাশ মনে সাহস দিয়ে বললেন টেক্সট গুলো আগে ভালো করে পড়। তারপর নিজে থেকে এক একটা প্রশ্নের উত্তর লিখে ফেল। তারপর যা লিখবি আমাকে দিয়ে চেক করিয়ে নিবি। বাড়ির ঠিকানাটাও দিলেন। সেই শুরু। যখন বললাম স্যার কোটেশন কি দিতেই হবে? কোটেশন হুবহু মনে থাকে না যে। তিনি বললেন কোথায় কে কী বলেছেন সেটা মুখস্ত করতে পারলি কিনা পরীক্ষায় তা জানতে চাওয়া হয় না। ইউনিভার্সিটি জানতে চায় তুই নিজে কী বুঝেছিস। আমার সুবিধার জন্য তিনি অনেক বইও দিতেন। 

এরপর নিয়মিত যাতায়াত, বইপত্র, সমাজ ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করতাম। পরবর্তীতে, আমার এম. এ. পড়ার সময়ও যাবতীয়  জিজ্ঞাসার সমাধান খুঁজতে আমি এই স্যারের কাছেই যেতাম।

 আমি বুঝতে পারি RKB এমন একজন প্রকৃত শিক্ষক যাঁর কাছে সিলেবাস নির্ভর পড়াশুনার বাইরে,জ্ঞান সমুদ্রের অগাধ মণিমুক্তোর সন্ধান আছে, যেগুলি আমার খুব প্রয়োজন। 

তিনি বস্তুবাদী দার্শনিক, চার্বাকের ওপর তাঁর অনেক গবেষণা। তিনি যুক্তিবাদী ও নাস্তিক মানুষ।

 এই জায়গায় আমার চিন্তা ভাবনার সঙ্গে বিরাট মিল খুঁজে পাই।
















পর্ব - ২

অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই জ্ঞানের উপাসক। তিনি সংসার করেননি, শ্যামবাজারের মোহনলাল স্ট্রিটের পুরনো লাল বাড়িটির টপ ফ্লোরটিতে ছিল তাঁর অন্য রকমের এক সংসার। দুটো ঘর ভর্তি নানা রকমের বই আর বই, সঙ্গে তাঁর নিজস্ব গবেষণালব্ধ বিভিন্ন বই ও লেখা পত্র এবং একটা কম্পিউটার। যখনই যেতাম দেখতাম কোনও না কোনও প্রকাশক, গবেষক, বিখ্যাত ম্যাগাজিন এবং লিট্ল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা প্রত্যাশী লোকজন এসেছেন কথা বলতে। অত্যন্ত সময়ানুবর্তী মানুষটির খাওয়া, লাইব্রেরিতে যাওয়া, পড়াশুনা, লেখালেখি সবই নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী হতো। প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। 

তাঁর গবেষণালব্ধ বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, যে অন্য কোনও গবেষকের তথ্যকে যাচাই না করে তিনি গ্রহণ করতেন না বা কোনও সিদ্ধান্তে আসতেন না। বিদ্যাসাগরের ওপর তাঁর "বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ" বইটি অতুলনীয়, যেখানে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তোলা বিভিন্ন প্রশ্নের তথ্য প্রমাণ সহ আলোচনা আছে। এছাড়াও তিনি Aristotle এর Poetics, এবং Sophocles এর King Oedipus র ওপরও গবেষণা করেছেন। তিনি তাঁর লেখা গুলি প্রকাশ করেছেন এক অতি সুন্দর, সহজবোধ্য নিজস্ব গদ্য রীতিতে। 

রামকৃষ্ণ বাবু ছিলেন দলীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত মার্ক্সবাদ চর্চার একজন কাণ্ডারী।

 ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের যে  বিকাশ লাভ হয়েছিল, তারই গর্ভে জন্ম নিয়েছিল মার্ক্সবাদ। এখন মার্ক্সবাদের আলোকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে হলে দরকার মানুষের মধ্যে চেতনার গুণগত মানোন্নয়ন, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞান তথা বস্তুবাদী দর্শনের প্রসার। অধ্যাপক ভট্টাচার্য ঠিক এই জায়গাটাতে হাত দিয়েছিলেন। বিখ্যাত সব ম্যাগাজিনের পাশাপাশি অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন, পাক্ষীক, ছোট ছোট বই, বিভিন্ন গণসংগঠন, সমাজ সচেতন সহকর্মী, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অধ্যাপক, শিক্ষক, পাঠক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক ও ছাত্র ছাত্রীরা মিলে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল জনপরিসর, যার মধ্যমণি আমাদের 

RKB যাঁর লক্ষ্য ছিল এদের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে জনমানসে বিজ্ঞান ভিত্তিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার।

এজন্য তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে কর্পোরেট মিডিয়ার আকর্ষণীয় প্রস্তাব ও আত্মপ্রচারকে দুরে ঠেলে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে আমি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, স্যার, আমরা আপনাকে নিয়ে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাই। এ জন্য একাধিক সম্পাদক মুখিয়ে আছেন। তিনি বললেন কখ্খনো না, আমি বেঁচে থাকতে তো হবেই না, আমি মারা যাওয়ার পরও যেন না হয়। তিনি চান ব্যাক্তির প্রচার নয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রচার হোক। বর্তমানে আত্মপ্রচার সর্বস্ব বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা যেখানে একদিকে জনগণের জন্য 'দুঃখে' কুম্ভীরাশ্রু ফেলছে, আর অন্যদিকে ক্ষমতার পিঠ চাপড়ে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য হামলে পড়ছে অর্থাৎ ঠকবাজীতে অকুতোভয়, সেখানে নীরবে নিভৃতে থাকা RKB র মতো মানুষ  আমাদের কাছে যেন বটবৃক্ষের নীচে এক শান্ত ছায়াতল।।


পর্ব-৩


স্যারের রসবোধটিও ছিল অসাধারণ। একবার স্যারের টেবিলে গিয়ে ভগবান ভীত সংবাদপত্রটি দেখে বলি স্যার নাস্তিক মানুষের কাছে এই কাগজ কেন? স্যার হেসে বলেন, এই কাগজটা দেখে তুই আমাকে ছোটলোক ভেবে বসলি! একবার বাংলাদেশের এক গবেষক কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। RKB র সঙ্গে কিছু আলোচনা করতে আসেন। কিছুক্ষণ পর তার কথাবার্তা মুজিবর রহমানের দিকে ঘুরে যায়। তিনি নানাভাবে বোঝাতে থাকেন মুজিবর রহমান এক সাংঘাতিক খারাপ লোক, আর তার দলটিও ততোধিক খারাপ। এই বোঝানোর প্রক্রিয়ায় মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে অনেকটা সময় নষ্ট করেন। তিনি চলে গেলে স্যার আমাদের বলেন মুজিব তো আরও একবার নিহত হলেনই, সঙ্গে আমার আজকের বিকেলটাও মারা পড়ল। 

প্রতিটি ছাত্রকে তিনি এক অদ্ভুত অনুপ্রেরণা দিতে পারতেন। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে বলতাম স্যার প্রগতিশীলতার পক্ষে সমাজের কোনও পরিবর্তন তো দেখতে পাচ্ছি না। এতো শিক্ষক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ইত্যাদি যাইহোক না কেন, তাদের বেশিরভাগই তো সাংঘাতিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ, গতানুগতিক এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। তিনি বলতেন সভ্যতার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের চলমান প্রক্রিয়া। আর একটা মানুষের জীবন ষাট সত্তর বছরের জীবন। এই এত অল্প সময়ে সবকিছু ভালো দেখে যেতে পারব ভাবলে চলে না। একটু একটু করে পরিবর্তন অবশ্যই হয়। আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে  এই প্রগতিশীলতার ধারাটিকে যতটা পারি রক্ষা ও বেগবান করার চেষ্টা করে যেতে হবে। তিনি ক্লান্তিহীন উৎসাহদাতা। 

নাস্তিকরাই ধর্মটাকে ভালো বোঝে, রবিঠাকুরের এই কথাটা RKB Sir এর কাছে এলে বেশ মালুম হয়। ধর্ম তত্ত্ব নিয়ে তাঁর ব্যপক পড়াশুনা ও গবেষণা।

 তাই ঈশ্বর বা ঠাকুর দেবতা নিয়ে বিন্দুমাত্র মোহ নাই তাঁর। তিনি বস্তুবাদের পক্ষে যেখানে যা উপাদান পেয়েছেন, তাই সংগ্রহ করেছেন। "উপনিষদে বস্তুবাদ" তাঁর একটি অনবদ্য প্রবন্ধ। তাঁর জীবনই আমাদের কাছে একটা শিক্ষণীয় বিষয়। তাঁর কাছে গেলে তিনি কখনও তাঁর একটা বই কিনতে বলেন নি। ফুলের প্রতি সবাই যেমন আকৃষ্ট হয়, আমরাও আকৃষ্ট হয়ে যেতাম তাঁর কাছে। 

যখনই যেতাম তিনি আমার বাড়ির খবর, আত্মীয় স্বজনদের খবর, গ্রামের খবর, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের খবরাখবর নিতেন। কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে ছিলাম, গত ২৬শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের  জন্ম দিনে শেষবারের মতো হাসপাতালে গিয়ে Sir কে দেখলাম,  তিনি কিছু বললেন, কিন্তু কী বললেন কিছু বুঝতে পারলাম না। আর কোনো দিন তিনি কথা বলবেন না, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর বইপত্র চিরকাল আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি সর্বত্যাগী, মানবতাবাদী। গত ২ রা অক্টোবর, ২০২২ রবিবার তিনি প্রয়াত হলে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার দেহ এন আর এস হাসপাতালে দান করা হয়। তারপর, তারপর কোনও শ্রাদ্ধ নয়, শান্তি নয়, নয় কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

কিছু রাজনৈতিক কথা -বিতান সানা
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:294 | likes:2 | share: 2 | comments:0

Bhakti in religion may be a road to the salvation of the soul. But in politics, Bhakti or hero-worship is a sure road to degradation and to eventual dictatorship.

বি আর আম্বেদকর Constituent Assembly এর শেষ দিন অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৫ শে নভেম্বর তাঁর বক্তৃতায় মধ্যে এই কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, কেন বলেছিলেন?

আমরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। কংগ্রেসের একটা বিক্ষুব্ধ অংশ যারা মূলত রাজনীতিকে ইনকাম করার রাস্তা হিসেবে দেখতো, তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি বিজেপি আর আরএসএসের সহায়তায় তৃণমূল কংগ্রেস নামের একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে। পরের বছরই ১৯৯৯ সালেই তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুপ্রেরণায় বিজেপির এনডিএর শরীক হয়েছিলো। এরপর ২০০৩ সালের আরএসএসের একটি অনুষ্ঠানে তারাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'দুর্গা' বলে অভিহিত করেন। মমতা প্রত্যুত্তরে জানান তাদের সাহায্য পেলে তিনি রাজ্য থেকে সিপিআইএমকে তাড়াতে পারবেন। অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট যে তৃণমূল কংগ্রেস কাদের সহায়তার দল গড়েছিলো। 

এবার কথা হলো এই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতি-আদর্শ আসলে কী ছিলো? আদৌ ছিলো কী? আজ্ঞে না। এটি একজন কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল, দিল্লি-পাঞ্জাবের আপ পার্টির মতো।

 এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেন সেটাই শেষ কথা। দলের ক্ষেত্রেও তাই, সরকারের ক্ষেত্রেও তাই। কেন, আমরা দেখিনি শিক্ষাবিষয়ক নানান ঘোষণা তিনি করছেন? এই দলের একটাই নীতি ছিলো। সেটা সিপিআইএম বিরোধিতা। এটা কোনো কথা বলুন? একটা দলের নীতি যখন শুধু সিপিআইএম তাড়ানো তাহলে বাংলার মানুষ কিভাবে এই দলকে বা দলের নেত্রীকে বিশ্বাস করলেন? বাংলার জনগণ একটুও জানতে চাইলেন না এই দল ক্ষমতায় আসলে কী নীতিতে রাজ্যের অর্থনীতি চালাবে? পলিসি ঠিক কী হবে? এই দলের ন্যাশনাল ইস্যুতে স্ট্যান্ড কী? দলের রাজনৈতিক স্ট্যান্ড কী? লেফ্ট না রাইট? নাকি সেন্টার? আমরা কেউ জানিনা। তারাও জানাননি আজ অব্দি কারন বাংলার মানুষের সে’সবে যায় আসে না। এই রাজ্যে বা এই দেশে মুখ দেখে ভোট হয়। সেই মুখ খুব ভালো বিরোধী নেতা বা নেত্রী হতেই পারেন।

কিন্তু, তিনি যে ভালো মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে নাও পারেন সেটা এই রাজ্যের বা এই দেশের মানুষ ঠিক মানতে চান না।

 সবাই মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। রাজ্যের হাল দেখেছেন নিশ্চয়ই। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনীতির জন্মলগ্ন থেকেই বুঝে গেছিলেন যে মিথ্যে কথা বারবার বললে সেটা একসময় সত্যি মনে হয়। নিশ্চয়ই হিটলারের ডানহাত গোয়বেলসের থেকে শিখেছিলেন এটা। তিনি মানুষকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন যে সিপিআইএম খারাপ, তৃণমূল কংগ্রেস ভালো। এর চেয়েও বড়ো কথা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি একজন সৎ নেত্রী। তার স্লোগান থাকতো মা মাটি মানুষ। ভুয়ো ডক্টরেট ডিগ্রি হোক বা নামের আগে কুমারী বসানো, মানুষ সবই দেখেছে, ভুলেও গেছে। কোনো প্রশ্ন করেনি। সিঙ্গুর বলুন বা নন্দীগ্রাম! তিনি এই দুটো জায়গায় সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সিপিআইএম আসলে কৃষকবিরোধী। কিন্তু, তিনি কৃষকদের পক্ষে। মানুষ এটা বিশ্বাস করেছিলেন। বিশ্বাস করবে নাই কেন? ২০১৬ সালে সিঙ্গুরের চাষের অযোগ্য জমি কৃষকদের হাতে পুনরায় ফেরত দিয়েছিলেন। তার সেই দক্ষতা ছিলো। পরবর্তীকালে দীপক ঘোষের বইগুলো পড়েই আমরা আসল তথ্যগুলো জানতে পেরেছি। তার মিথ্যেকথা বলা শুরু তার জন্মসাল থেকেই। যাইহোক, সেদিকে আর যাচ্ছিনা।


আপনাদের সবার মনে থাকবে, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষকে এটাই বলেছিলেন যে তাকে দেখেই যেন ভোট দেয় বাংলার মানুষ। ২৯৪ টি আসনে তিনিই প্রার্থী। বাংলার মানুষ সেটা বিশ্বাস করেছিলেন। কারন তারা তখনও মনে করতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই সৎ এবং মানবিক একজন মুখ্যমন্ত্রী। আপনি যদি ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৮ এর পর থেকে ২০১১ এবং তারপর 

২০১১ থেকে ২০২২ এর নানান ঘটনাগুলো দেখেন, আপনি বুঝবেন যে রাজনীতিতে একজনকে অন্ধভক্তি করলে ঠিক কী পর্যায়ে ক্ষতি হতে পারে।

 যেমন ধরুন তৃণমূল কংগ্রেস বাইরে বিজেপি বিরোধিতা করলেও, লোকসভার ভেতর বিগত ১১ বছরে বিজেপির আনা বিলগুলির বিপক্ষে একটিবারও ভোট দেয়নি। হয় পক্ষে ভোট দিয়েছে বা বিরত থেকেছে। এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন যে বাইরে বিরোধিতা করলে আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে 'ক্যা ক্যা ছি ছি' করলেই বাংলার জনগণ বলবে, 'দেখেছো, আমাদের নেত্রী সিএএ এর বিরোধিতা করছে'। কিন্তু, লোকসভায় যে সেই বিলের বিপক্ষে তৃণমূলের ২২জন এমপি ভোট না দিয়ে বিরত থাকলেন, সেটা খুব একটা সাধারণ মানুষ জানতে পারলেন না। এটাই ম্যাজিক। এই রাজ্যের মিডিয়া সেটাই ফলাও করে দেখাবে যেটা এই রাজ্যে হচ্ছে কিন্তু, ন্যাশনাল ইস্যুতে তাদের অবস্থান অতটা মিডিয়া দেখাবে না, প্রিন্ট মিডিয়া দেখালেও রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ খবরের কাগজ পড়েন না। পড়লেও সব খবর পড়েন না। আর এইভাবেই অন্ধভক্তি দ্বিচারিতাকেও হার মানিয়ে দেয়। তৃণমূল কংগ্রেস একটা রাজনৈতিক দল তো বটেই, কিন্তু এদের কোনো রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নেই, এরা মূলত 'পপুলিজম' নামক একটি নীতিতে বিশ্বাসী যার অর্থ মানুষকে নানান স্কিমের মাধ্যমে শুধু বিলিয়ে যাও, কোষাগারের টাকা অবাধে খরচ করো। এই নীতি অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, দিল্লি সরকারও অনুসরণ করে। এরা সবাই রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতিহীন দল। এগুলো করার কারন যাতে তারা মূল ইস্যু নিয়ে মাথা না ঘামায়। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প এরমই একটি 'পপুলিস্টিক' নীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে গ্রামবাংলার লাখ লাখ মহিলারা অন্ধভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রীকে ভোট দিয়ে থাকেন, তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন। ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে গ্রামে গ্রামে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা রাতের বেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বুঝিয়েও এসেছিলেন পুনরায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় না আনলে, লক্ষ্মীভান্ডারে টাকা পাবেন না তারা। অগত্যা!


২০১১ থেকে ধারাবাহিকভাবে গোটা রাজ্যে সবকিছু নীল সাদা রঙে মুড়ে দেওয়া, ঝাঁ চকচকে করে দেওয়াটাও এর অংশ। এর ফলে মানুষ এটা দেখতে চাইবেন না যে ভেতরে কী আছে, এটা কতটা টেকসই, বা এটা আসলে কে তৈরি করেছে আর কে নতুন রং করে নিজের নামে চালাচ্ছে? বাইরের সৌন্দর্য দেখেই তারা ভাববেন এটাই উন্নয়ন। আপনিই বলুন বাড়িঘরের বাইরে রং করলে, সেটাকে পরিষ্কার রাখলে দেখতে ভালো লাগেনা? রঙিন-উজ্জ্বল কিছুতে আমাদের চোখ আটকে যায়। 

যেমন ধরুন, সরকারি হাসপাতাল। সেটাকে ভালো করে রং করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলেই যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ এটাতেই খুশি।

 তারা জানতে চাইবেন না সেখানে কী কী সরঞ্জাম আছে, কতজন এমডি ডাক্তার আছেন, এমার্জেন্সিতে কতজন থাকেন, কতজন ট্রেইন্ড নার্স আছেন, বেড কতগুলো আছে, দরকারে বেড পাওয়া যাবে কিনা? অনেকটা তৃণমূলের নেতারা যেইভাবে উডবার্ন ওয়ার্ডে বেড পান। হাসপাতালে নানান অপারেশনের সুবিধে কতটা আছে, রেফার করার প্রবণতা নেই তো? ওষুধের সহজলোভ্যতা কতটা আছে, কোনো সিন্ডিকেট চলছে কিনা ইত্যাদি। কারন এগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। কী বলেন? যেমন ধরুন, সল্টলেক স্টেডিয়াম। ১৯৮৪ সালে তৈরি করলো বামফ্রন্ট সরকার, কিন্তু, ২০১৭ সালে অনুর্দ্ধ ১৭ পুরুষ ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য সেটাকে পুনঃসংস্কার করার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করে নিজের নামে সেখানে ফলক বসিয়ে দিয়েছেন। কেউ প্রশ্ন করেছে? দুয়ারে রেশন এরমই আরও একটি উদাহরণ। রেশন নেওয়া সাধারণ মানুষ জানতেও পারছেন না এই দুয়ারে বা বলা ভালো পাড়ার মোড়ে/ ক্লাবের সামনে রেশন দেওয়ার ফলে সরকারের অতিরিক্ত কত টাকা খরচ হচ্ছে যা আমাদের করের টাকা। তারা ভাবছেন তারা সুবিধে পাচ্ছেন, এই সরকার মমতাময়ী, মানবিক কিন্তু রেশনের দোকানে নিজেরা গেলে সরকারের কত টাকা সাশ্রয় হতো সেটা তারা জানেনও না। 


এখানে বলে রাখা ভালো যে হাইকোর্ট এটাকে বেআইনি বললেও খাদ্য দপ্তরের উচ্চপদস্থ অফিসারদের ধমকের চোটে রেশন ডিলাররা এখনও এই বেআইনি প্রকল্পটি চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। একইভাবে সরকারের করের টাকায় প্রায় প্রতিদিন সমস্ত প্রিন্ট মিডিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন করাটাও এর অংশ। কেউ প্রশ্ন করেননা যে কেন এত ফালতু টাকা খরচ করা হচ্ছে? রাস্তার গর্তগুলো অন্ততঃ এই টাকায় ভরাট করা যেত। কিছুদিন আগে তৃণমূলেরই এক নেতার ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেলন। কিন্তু, ওই যে সাধারণ মানুষ মনে করেন দুর্ঘটনা তো ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকারের এক্ষেত্রে কোনো দায় নেই। রাজনীতিতে একজনের প্রতি অন্ধভক্তি আসলে সত্যিই সবকিছু ভুলিয়ে রাখে। প্রশ্ন করতেই শেখায় না। আপনি সেই দলে নেই তো?

তথ্যসূত্র:

Anandabazar Patrika 

The Print

The Hindu

The Tribune

লক্ষী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী-র ভবিষ্যত -রাহুল কর্মকার
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:883 | likes:1 | share: 0 | comments:0

প্রথমে সবাইকে দুর্গাপুজোর আন্তরিক ও হার্দিক শুভেচ্ছা। পুজোর এই কটা দিন একটু অন্যরকম আমাদের সবার কাছে। দৈনন্দিন অফিসের কাজের চাপ নেই, পরিবারের সকলের সাথে পূর্ণাঙ্গ সময় বিচরণ। তারই একটি ছোট্ট অংশ হল মন্ডপে মন্ডপে প্রতিমা দর্শন।

এই প্রতিবেদনের উৎপত্তি সেরকমই এক সন্ধিক্ষণে। সেজে-গুজে চোখে চশমা এটে দিব্যি সুন্দর এই মন্ডপ থেকে ওই মন্ডপে ঘুরছি। সাথে বৌ আর একমাত্র পুত্র।

প্রবাদ আছে খালি মাথা শয়তানের বাসা, যেহেতু অফিসের কচকচানি নেই, তো মাথা মোটামুটি খালি, আর বৌ সঙ্গে থাকলে তো মাথা খালি রাখতেই হয় (অরন্যের প্রাচীন প্রবাদ)। তো, অতিরিক্ত ফাঁকা মাথা পেয়ে সেই শয়তান ভর করলো।

কোনোও এক মন্ডপে হঠাৎ চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল, দুর্গার মুখটা পালটে বৌ এর মুখ হয়ে গেল। আমি তারাতাড়ি নিজের আইডেন্টিটি জোগার করতে শিব খুঁজতে লাগলাম। ভবিত-ভব, উনাকে যে এই দূর্বল মুহুর্তে দেখার ক্ষমতা হারাব সেই বোধগম্যতাও আমার খালি মাথা থেকে উধাও। ইতি-উতি তাকাতেই অসুর ব্যাটার দিকে চোখ গেল। ওমা, কি সুন্দর আমার মুখমন্ডলের প্রতিচ্ছবি।  তৎক্ষনাৎ আকাশবাণী ভেসে এল মূর্খ, মেয়েরা বিয়ের আগে আমার মত বর চায়, কিন্তু বিয়ের পরে অসুর বধ করতেই ভালোবাসে। আমি আকাশপানে চাইতেই দেখি জটাধারী মিটমিট করে হাসছেন। কি আর করা যাবে, ঐশ্বরিক বাণী তো মাথা পেতে বরণ করে নিতেই হয়। অগত্যা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। দেখা যাক আর কাকে কাকে দেখতে পাই। জৈবিক সুত্র মেনেই যে কার্তিকের মধ্যে সন্তানকে দেখতে পাব সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এতক্ষন যা বললাম তা আসলে সৌজন্যমূলুক ভূমিকা, মূল প্রতিবেদনের সাথে সাজুজ্য খোঁজা বাতুলতা হবে। আসলে আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত বাবার মত আমিও সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে কিছুটা চিন্তিত তো বটেই।

গোদের উপর বিষ ফোঁড়া অর্থনৈতিক বেহালতা আর নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফীতি। একদম সরল ঐকিক নিয়মের সুত্র মেনে চললে আমরা প্রতিনিয়ত গরিব হচ্ছি।

 গত পাঁচ বছরের গড়পড়তা মুদ্রাস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশ ছিল, আমাদের (মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী) আয় কি সমহারে বেড়েছে? উত্তরটা না এবং না। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির সাথে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সোজাসাপ্টা আমাদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে, মানে প্রতিনিয়ত গরিব হয়েছি, হচ্ছি এবং হব। একটু অংকের হিসেবে আসা যাক, অর্থনীতির মানদণ্ডে সঞ্চয় ও ব্যয়ের অনুপাত ৭০:৩০ হলে তা সচ্ছল আয় হিসাবে ধরা হয়।

 অর্থাৎ ১ লক্ষ টাকা আয় হলে ৩০ হাজার টাকা সাংসারিক জীবনে খরচ করা যেতে পারে। এবার নিজের নিজের যোগবিয়োগ করে দেখুন কি ফলাফল আসছে (যৌথ পরিবারে এক ভাই সবজি বাজার, অন্য ভাই মুদিখানার টাকা দেয় বা বাবার পেনশনের থেকে ইলেক্ট্রিক বিল টা মিটে যায়- এজাতীয় গুলো দয়াকরে হিসাব বহির্ভূত ভাববেন না)।


হিউম্যান লেবার জাতীয় কাজের পরিসর ক্ষুদ্র হচ্ছে টেক্নোলজির কল্যানে এবং এটা অবশ্যম্ভাবী। সাউথ কোরিয়া গভমেন্ট রোবোট-ট্যাক্স এর প্রচলন করেছে। যেসব ইন্ডাস্ট্রি ম্যানুফ্যাকচারিং বা সার্ভিস রিলেটেড কাজ মানুষের বদলে রোবোট দিয়ে করাচ্ছে তারা এই ট্যাক্স দেবে। 

মোদ্দা কথা নিকট ভবিষ্যতে তথাকথিত ক্লারিক্যাল কাজের দায়ভার মানুষের হাতে থাকবে না। একদম বোধগম্য উদাহরণ দিচ্ছি।

 ডিজিটাল ক্যামেরা আসাতে রিলের ক্যামেরা জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। কোডাক নামটাই ইতিহাস হয়ে গেছে যেকিনা একদা ছবির জগতে মুকুটহীন সম্রাট ছিল। মোবাইলের ক্যামেরায় এ-আই এতটাই উন্নত যে এখন আর ফটোসপের দোকানে গিয়ে বলতে হয়না মুখটা আরেকটু ফর্সা করে দাও বা পেছেনের টা ব্লার করে দাও ইত্যাদি। কি মনে হয় আগামি পাঁচ বছর পরে ফটোসপের দোকানের কোনো গুরুত্ব থাকবে? 

আগে মোবাইলের দোকান গুলো গান ডাউনলোড বা রিচার্জ কুপন বিক্রি করেও মুনাফা করত, এখন তারা হয় ব্যবসা পাল্টেছে নয় মাছি তাড়াচ্ছে।

 কোন কোন পরিসরে কতটা করে কাজ হ্রাস পাবে তার পুংখানুপুংখ বিবরণ না পেলেও এটুকু অনুধাবন করতে পারি বিশ্বের সমগ্র কাজের ৫০% এর বেশি কাজ মানুষকে বাদ দিয়েই সম্পন্ন হবে। এবং সেটা তোমরা যতটা ভাবতে পারছো তার থেকে একটু বেশিই। আমরা কি করতে পারি? আন্দোলন!! মানুষকে কর্মহীন করার বিজ্ঞানের অমানবিক পদক্ষেপকে থামানোর আন্দোলন। অনেকদিন আগে এই বংগেই এমন আন্দোলন হয়েছিল, দশ বছর পরে ঘুম ভাংগে মানুষের। তাই আমরা আজও বেংগালুরু হয়ে উঠলাম না সমস্ত পোটেনশিয়ালস থাকা সত্ত্বেও। বিজ্ঞানের চাকা রুদ্ধ করে উন্নতি হয় না, উন্নতির ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের উপর।

তাহলে? বাকি যেটুকু কাজের পরিসর আছে সেখানে আমার সন্তান ফিট বসবে কিভাবে? লেটস গো ফর বেস্ট স্কুল, বেস্ট এডুকেশন, বেস্ট ব্লা ব্লা... সত্যিই কি তাই? যদি ধরেও নিই তাই তাহলেও কি আমাদের আয় সেটার সংগতি দেবে?


এবার আরেকটু আর্থসামাজিক জটিলতায় ঢুকব। পৃথীবির সমস্ত দেশের পরিচলন পদ্ধতিকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক-পুঁজিবাদি গনতন্ত্র, দুই-মুখোশে ঢাকা একনায়কতন্ত্র।

সত্যি বলতে কি এর বাইরে আর যা কিছু বলা হয় সেগুলো শুধুমাত্র প্রচার স্বার্থে। ভারত নির্দিধায় প্রথম ক্যাটেগরিতে আসে। পুঁজিবাদি গনতন্ত্রের চালিকাশক্তি বৃহৎ পুঁজিপতিরাই, তাতে যতই জনগনের সরকার বলে ঢক্কানিনাদ করা হোক। তোমার আমার ট্যাক্সের টাকা থেকেই করপোরেট সাবসিটি দেওয়া হয় যার বাজারি নাম এনকারেজ ফর ইন্ডাস্ট্রিয়ালাজেশন। ক্রনি-ক্যাপিটালিসমের সদব্যবহারে ধনকুবের আরও ধনবান হবে, গরিব আরও গরিব হবে।

কাজেই আদানি বিশ্বের ৩য় ধনকুবের হলেও গড় মাথাপিছু আয় নিম্নগামী রেখাতেই ধাবমান হতে থাকবে। কিন্তু এখানেও একটা টুইস্ট আছে। 

আমরা যদি এতই গরিব হয়ে যায় যে বাড়ি বানানোর সিমেন্ট কেনার পয়সাও নেই, তাহলে আদানির ব্যবসা কিভাবে হবে?


বা এত গরিব হয়ে গেলাম যে ফোন রিচার্জ করাটাও নেসেসারি খরচের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হলাম, তাহলে আম্বানি-বিড়লা দের ব্যবসা দেবে কে? কাজেই একটা ব্যালেন্সের প্রয়োজন। যাতে ধনকুবেরদের মুনাফায় টান না পরে, আবার জনগনের ক্রয় ক্ষমতাতেও টান না ধরে। টেক্নোলজি যে গতিতে ধাবমান তাতে এই ব্যালেন্সটা নষ্ট হয়ে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মতামত। এর প্রতিরোধে বিভিন্ন থিয়োরি উঠে আসছে যা নোবেল পেতে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে কতটা উপযোগী তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অন্তরায়। 

যেটুকু বোধগম্য হয়েছে তা হল - আগামি ২০ বছরে প্রযুক্তি যে সুনামি নিয়ে আসছে তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মে তারাই ভেসে থাকবে যারা বিষয়ভিত্তিক সৃজনশীল দৃঢ়চেতা।

 বাকি খড়কুটোর মতই ওলোট-পালোট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমরা অনেকেই আছি যারা জীবনের জোয়ার-ভাঁটা দেখেছি, অভিজ্ঞতা দিয়ে তা সামলাতেও শিখেছি। কিন্তু ওটা সুনামি, ওখানে আমাদের অভিজ্ঞতার সার্থক প্রয়োগ হতে পারে এমন নিদর্শন এযাবৎ অব্দি পাইনি।

উপসংহার: চেতনা ফিরল বৌ এর ধাক্কাতে - কিগো ক্যাবলাচো হয়ে মূর্তির দিকে তাকিয়ে কেন? আশেপাশে সুন্দরী গুলোকে আড়চোখে দেখলে বুঝতাম সুস্থ-সবল-সচরিত্রে আছো। বৈরাগ্যতে ধরল নাকি? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম না, আজ রাতে একটু লুডোই খেলব।

বাইবেল ও কোরানে মহাবিশ্বের সৃষ্টি -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 23, 2024 | যুক্তিবাদ | views:283 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন যা সাবাতের দিন নামে খ্যাত। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এই কথা প্রচন্ড ধার্মিক  ঈশ্বর বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন। যেহেতু সৃষ্টির আগে সূর্যের অস্তিত্ব ছিলনা তাই বোধহয় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হতো না। আর পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির সময়কে দিন (ছয় দিন) ধরে হিসাব করা স্পষ্টত অসম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে - কেন ঈশ্বর মানুষের আবিষ্কার  করা সময়ের মাপদণ্ড দিয়ে তার সৃষ্টির সময়কে হিসাব করবেন? কেন তিনি পৃথিবী নামক গ্রহের সময়কে একক ধরে হিসেব করবেন? অন্যান্য দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস বা নেপচুনের সময়কে একক হিসেবে ধরবেন না? ঈশ্বর সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগের সময়ে দিন ও রাত কিভাবে সংঘটিত হতো?

          মহাবিশ্বকে ছয়দিনে সৃষ্টি করার কথা কোরানে কমপক্ষে আটবার আছে। এছাড়া আরবী শব্দ আরশ কথাটির অর্থ রাজসিংহাসন বিভিন্ন আয়াতে (৭:৫৪/২৫:৫৯/১১:৭/২৩: ৮৬-৮৭, ১১৬/৩২:৪) আল্লাহর আরশে বসার কথা বলা হয়েছে। 



প্রশ্ন হচ্ছে – নিরাকার আল্লাহ কি করে আরশে বসেন? নিরাকার জীব আল্লাহকে কেন আরশে বসতে হব? কোরানে স্পষ্ট বলা হয়েছে আল্লাহর আরশ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানির ওপর ছিল। তাহলে পৌত্তলিক আরবীয়ানদের আল্লাহই কি নবির আল্লাহ? নবির বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর দাস এবং আবু লাহাবের নাম ছিল আব্দুল ওজ্জা যার অর্থ ওজ্জা দেবীর দাস। আর আকাশ পৃথিবী সৃষ্টির  আগেই আল্লাহর আরশ পানির ওপরে ছিল মানে কি? (সুরা ইউনুস – আয়াত ৩ ও সুরা আরাফের আয়াত ৪৪)। পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানি আসে কোথা থেকে?  এটা সম্ভবত বাইবেলের কপি পেস্ট। এদিকে আল্লাহ নিজেই বলেছেন – আমি আকাশ পৃথিবী এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী সব ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি। ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি (সুরা কাফ –আয়াত ৩৮)। তাহলে সর্বশক্তিমান আল্লাহরও নিশ্চয় ক্লান্তি আসে? এই আয়াতটি সত্যি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বাইবেলে সপ্তম দিন অবশ্য বিশ্রামের দিন বলা হয়েছে।  নীচে মহাবিশ্ব সৃষ্টি সংক্রান্ত সুরা ও আয়াতের কিছু কিছু তুলে দিলাম যা বর্তমান কালে শুধুই হাসির উদ্রেক করবে।


১) তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। সুরা ইউনিস, আয়াত - ৭)

২) যখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল তখন তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। (সুরা হুদ - ৭)

মনে প্রশ্ন জাগে - আকাশ জমিন সৃষ্টির আগেই সিং হাসন ও পানি কি করে ছিল?

৩) আমি আকাশ পৃথিবী এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি, ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি (সুরা কাফ - ৩৮)

এই আয়াতটি বিস্ময়কর ছেলে-মানুষি, সর্বশক্তিমান নিরাকার আল্লাহকে এ ধরণের বালখিল্লের মতো পরিচয়জ্ঞাপন বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

৪) বল তোমরা কি তাকে অস্বীকার করবে, যিনি দুদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; আর তোমরা তার সমকক্ষ দাঁড় করাবে।(সুরা হামিম সিজিদা-৯)

৫) তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন ও সেখানে কল্যাণ রেখেছেন-(৪১:১০)

৬) তারপর তিনি আকাশের দিকে মন দিলেন, আর তা ছিল ধোঁয়ার মত। তারপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন তোমরা কি স্বেচ্ছায় আসবে না অনিচ্ছায় - (৪১:১১)

৬) তারপর তিনি আকাশকে সাত আকাশে পরিণত করলেন আর প্রত্যেক আকাশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলেন(৪১:১২)। এই আয়াতে অতিরিক্ত দুটি দিনের কথা বলা হয়েছে যা আকাশকে সজ্জিত করার জন্য ব্যয় হয়েছে।

- এই আয়াত কোরানের ছয় দিনের সাথে সাংঘর্ষিক। এত বিশৃঙ্খলা সবজান্তা আল্লাহর কাছে আশা করা যায় না। সুরা তওবার দিনপঞ্জি সংক্রান্ত আয়াতটিও বড্ড গোলমেলে

আবার একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে – অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশেছিল? তারপর আমি উভয়কে পৃথক করলাম (সুরা আম্বিয়া ৩০) একে অনেক ইছলামিক পণ্ডিত বিগ ব্যাং থিওরী বলে চালাতে চায়। এরা জানেনা যে বিগ ব্যাং এর হাজার কোটি বছর পরে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে।

সব ধর্মগ্রন্থেই এইরকম গ্যাজাখুড়ি আছে। তবে ধর্ম মোহে আক্রান্ত   কিছু ধীমান  মানুষের গোল গোল ব্যাখ্যা আজ আর সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।

 এই গোঁজামিল থাকাই স্বাভাবিক, কারন তখনকার দিনের লোকদের হাতে উন্নত টেলিস্কোপ ছিলনা আর মহাকাশ বিজ্ঞানের এত প্রসার ঘটেনি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঘটনাতেও এই জলের কথা বলা আছে সেটা অনেকদিন আগেই আমি পোস্ট দিয়েছিলাম। আর কোরানের বাক্যগুলি এমনই যে কোনটা কে বলেছে সেটা না বুঝতে পারার মতো নয়।  নবি হজরত মুহাম্মদ এই ব্যালেন্সটা রাখতে পারেননি। বেশ কিছু আয়াতে তিনি ধরা পড়ে গেছেন যে এগুলি ওনারই বক্তব্য।

অন্ধদের হাতি দর্শনে হাতি গালগল্প? -মুজিব রহমান
Nov. 23, 2024 | যুক্তিবাদ | views:291 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা পাঁচ অন্ধের হাতি দর্শনের গল্পটি জানি৷ পাঁচ অন্ধকে হাতি দেখতে গেল৷ যার হাতে যা ঠেকলো সে সেটাকে ভালমতো উপলব্ধি করলো৷ সবাই নিশ্চিত হয়েই বলল আরে হাতি হল—

যে হাতির পা ধরেছিল সে বলল, ঠিক খাম্বার মতো৷ যে লেজ ধরেছিল সে বলল, ঠিক রশির মতো৷ যে শূঁড় ধরেছিল সে বলল, ঠিক সাপের মতো৷ যে পেট ধরেছিল সে বলল, ঠিক দেয়ালের মতো৷ যে কান ধরেছিল সে বলল, ঠিক কূলার মতো৷ সবাই নিজের দর্শনে অনড়৷ আলাদা অঙ্গ না ধরলে এই পাঁচটি উপাদান মিলালেও হাতি আসবে না৷

কমপক্ষে হাজার বছর আগের ধর্মগ্রন্থগুলোতে একেকটি বিষয়ের বর্ণনা অনেকটাই এরকমই৷ পৃথিবী, আকাশ, মানুষ, আত্মা. ইত্যাদি বহু বিষয়ের ব্যাখ্যাগুলো অন্ধের হাতি দর্শনের মতোই৷

তখন বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের মানুষও মনে করতো তারাই পৃথিবী, তারাই একমাত্র জনগোষ্ঠী৷ সে মোতাবেকই আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এমনকি জাপানের আদি বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল৷ মানুষ ব্যাখ্যা তৈরি করতে নিয়ে এসেছে পেট-বানানো গল্প৷ সেই গল্পগুলোর বিবর্তনও ঘটেছে কালক্রমে৷


একটা বিষয় নিশ্চিত যে তারা মনে করতো প্রাণীর দুটো উপাদান৷ একটি নশ্বর শরীর আরেকটি অবিনশ্বর আত্মা৷ আত্মার বিশ্লেষণ করতে হলে শরীর কিভাবে সচল থাকে সেটা উপলব্ধির দরকার ছিল৷ কিন্তু ওই সময় এটা মানুষ বুঝতে শিখেনি৷ তাই আত্মা নিয়ে একেক গ্রন্থে একেক রকম ধারণা দেয়া হয়েছে৷ সেমিটিক ধর্মে বলা হয়, 'স্রষ্টা আগেই আত্মা সৃষ্টি করে রাখে৷ জন্মের আগে ঢুকিয়ে দেয় গর্ভের শিশুর মধ্যে৷ স্রষ্টা আত্মা ছিনিয়ে নিলেই মৃত্যু৷ কবে কখন ও কিভাবে ছিনিয়ে নিবে সেটাও নির্ধারিত৷ পৃথিবী ধ্বংসের পরে পুনর্জিবীত আত্মার বিচার সভা বসবে'৷ বৈদিক তথা হিন্দু ধর্মে বলা হয়, 'আত্মা ভাল মন্দের কর্মের জন্য পরের জন্মে কোথায় জন্ম নিবে তা কর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয়৷ বৌদ্ধ ধর্মে আবার আত্মা ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন প্রাণির মধ্যেও৷ সৎ কর্ম করলে বা বৌদ্ধ ভিক্ষু হলে আত্মা মুক্তি পায় এবং বিলীন হয়ে যায় যাকে বলে নির্বাণ হওয়া৷ 

আর আজ বিজ্ঞান দেখাচ্ছে কিভাবে জীবন সচল থাকে এবং সেখানে আত্মা অপ্রয়োজনীয়৷

অন্তত এক হাজার বছর আগের মানুষ নিজেদের ভূখণ্ডগুলোকেই ভাবত দুনিয়া৷ জাপানের দ্বীপগুলো যাকে তারা দলতো নিপ্পন বা সূর্যোদয়ের ভূখণ্ড৷ তারা খবর রাখতো না কোরিয়া বা চীনের৷ অথচ বহু বছর আছে তারাও ছিল একই ভূখণ্ডে৷ ফলে শিন্টো ধর্মের পৃথিবী হল ওই নিপ্পন দ্বীপমালা! দেবতারা থাকতো সমুদ্রে৷ তারা কাদাকেলি করতে করতে সমুদ্রে বিভিন্ন দ্বীপ তৈরি করে৷ সেটাই পৃথিবী৷ এমন একটা বিশ্বাসও দেখি না যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবী গোলাকার এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে৷

সেমিটিক গ্রন্থে স্রষ্টা ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করে৷ বাইবেলে একদিন বিশ্রামের কথা আছে৷ আমরা আজ সপ্তাহে যে একদিন ছুটি পাই সেটা ওখান থেকেই আসা৷ স্রষ্টা সমতল পৃথিবীকে শক্ত রাখার জন্য পেরেক মেরেছে পাহাড়গুলো দিয়ে৷ পৃথিবীর উপর সাতটি আসমান দিয়েছে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান খুঁটি দিয়ে৷ দুনিয়া সৃষ্টির হাজারো রকমের ধর্মীয় ব্যাখ্যার একটিও মিলে না আজ৷

মানুষ সৃষ্টি নিয়েও হাজারো ব্যাখ্যা৷ হিন্দু ধর্মের সেই বিরাট পুরুষের কথা জানি যিনি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে সব কিছু তৈরি করেছেন৷ তার মাথা থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, বুক থেকে বৈশ্য, পা থেকে শূদ্র তৈরি হয়েছে৷ নাড়িভূড়ি থেকে অন্যসব প্রাণি-উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়৷ সেমিটিক ধর্ম বলে স্রষ্টা নিজে একজন পুরুষ ও একজন নারী সৃষ্টি করেন৷ স্রষ্টার কথা না শোনায় তিদের স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পাঠায়৷ বাকি ধর্মগুলোতে একেকটায় একেক রকম বিশ্বাস৷ কোনটায় বলা হয়েছে এক দানবের বগলের দুই তলা থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারী সৃষ্টি হয়৷ ওয়াক! কোথাও বলা হয়েছে, দেবতারা দাস তৈরি করতেই মানুষ তৈরি করেন৷ হাজারো ব্যাখ্যা৷ আবার মিলগুলোর মধ্যেও প্রভেদ অনেক৷ আদম-হাওয়া, এডাম-ইভ বা মনু-শতরূপা পুরোপুরি মিলবে না৷ অথচ বিজ্ঞান বলছে মানুষ এসেছে বিবর্তনের পথ ধরে৷

৪৩০০ টি ধর্ম বিশ্বাসের কোনটিতেই সঠিক ব্যাখ্যা মিলে না৷ আবার ব্যাখ্যাগুলোকে একত্রিত করলেও মিলে না৷ বিশ্বাসে পাওয়া তথ্যগুলো বিজ্ঞানের চোখে নিছকই গালগল্প!

রসায়ন নোবেল পুরস্কার ২০২২ -শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলঘরে বসে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিচ্ছে। আপনি পরীক্ষা-নিয়ামক। নিয়ম অনুযায়ী, উপস্থিত প্রতিটি পরীক্ষার্থীর স‌ই নিয়ে রাখতে হবে নির্দিষ্ট কাগজে। এবং এই কাজটা করতে হবে পরীক্ষা চলাকালীন‌ই আর ওদের পরীক্ষাকে কোনোভাবে বিঘ্নিত না করে। প্রয়োজন যেহেতু আছে, তাই আপনার এই কাজটা চলবে পরীক্ষা-ব্যবস্থার সঙ্গে এক‌ই সাথে, কিন্তু সমান্তরালে নয়। সমান্তরালে চলছে, এমন বললে এটা আলাদা কোনো পরীক্ষা বলে বোঝাতে পারে। আর তাই বিজ্ঞানের ভাষায়, যা মূলপদ্ধতির সঙ্গে সমান্তরালে চলছে না, তার চলাচল মূল পদ্ধতির সঙ্গে অভিলম্ব বরাবর, নব্ব‌ই ডিগ্রি কোণ করে। গ্রীকভাষা থেকে গৃহীত শব্দানুযায়ী, এমন দুটো পদ্ধতিকে একে অপরের 'অর্থোগোনাল' (orthogonal) বলা হয়। 

এখন এই দুই অর্থোগোনাল পদ্ধতির সঙ্গে আমরা রসায়নের কিছু বিক্রিয়ার তুলনা করব। কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া মানুষ নিজের ইচ্ছায় ল্যাবরেটরিতে ঘটাতে পারে। বিরাট সংখ্যক রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে কোষে কোষে ঘটিয়ে চলেছে প্রকৃতি আপন-খেয়ালে। কখনো কখনো সভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থে আমরা সেইসব কোষীয় বিক্রিয়ার ফলাফলের সুযোগ নিই। এই যেমন ধরুন ইস্ট দিয়ে ফার্মেন্টেশন ঘটানো, প্রাকৃতিক উৎসেচকের সাহায্যে ওষুধ তৈরির কয়েকটা ধাপ এগিয়ে নেওয়া, এইরকম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোষের মধ্যে থাকা মালমশলার যদি সামান্য একটু পরিবর্তন ঘটানো যায় তবে তার ফলাফলটা বেশ ভালো করে কাজে লাগানো যাচ্ছে। প্রাকৃতিক উপায়ে বিক্রিয়া চালালে হয়ত যতটা জিনিস আমাদের চাই, যেভাবে চাই, ততটা সেভাবে পেতাম না। তখন দরকার প্রাকৃতিক মালমশলার উপরে এঞ্জিনিয়ারিং করার। তার জন্য ল্যাবরেটরিতে ফ্লাস্কের মধ্যে আমরা তেমন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে দেখি, তেমনটা ঘটাতে হবে জ্যান্ত কোষের মধ্যে, তার সবরকম জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া চলাকালীন। 

এখন প্রথম অনুচ্ছেদে আরেকবার ঘুরে আসুন। মূল পরীক্ষার জায়গায় আপনি যদি আমাদের কোষে ঘটে চলা জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া রাখেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ঐ স‌ই করার পদ্ধতির বদলে ল্যাবরেটরিতে ফ্লাস্কে ঘটানো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার পদ্ধতিকে চিন্তা করেন, তবেই ঐ এঞ্জিনিয়ারিং, যাকে বলে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং, সেইটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করানো যাবে।

অর্থাৎ কোষের বিক্রিয়া আর মানুষের ঘটানো বিক্রিয়া একে অন্যের অর্থোগোনাল হ‌ওয়া চাই। দুটোই যেন স্বাধীনভাবে ঘটানো যায়, কেউ কাউকে প্রভাবিত না করে। জীবন্ত কোষে ঘটানো এই এঞ্জিনিয়ারিং বিক্রিয়াটার‌ই আরেকটা নাম, বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়া।

তার মানে ছাত্রছাত্রীরা যখন পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন তাদের দিয়ে স‌ই করানোর পদ্ধতিটা হতে হবে এক ধাপের, এক পাতার, একটা স‌ইয়ের। বারবার বিভিন্ন পাতায় বিভিন্ন স্থানে যদি তাদের স্বাক্ষর নিতে যাই, তবে তাদের মনঃসংযোগ নষ্ট হতে পারে। এক‌ই ব্যাপার খাটে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে। জীবন্ত কোষে যখন নিজস্ব জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া চলছে, তখন মানুষ সেই কোষের মধ্যে থাকা একটা জৈব যৌগের বিরাট অণুর কিছু গঠনগত পরিবর্তন ঘটাতে চায়। যেমন, তার দরকার বিরাট একটা কোষীয় অণুকে আরেকটা উজ্জ্বল রঙের বাইরের কোনো অণু দিয়ে যুক্ত করা (যাকে ফেসবুকে বলে 'ট্যাগ করা' tagging)। কেন? না, সেরকম করলে সেই অণুটাকে উপযুক্ত মাইক্রোস্কোপ দিয়ে চোখে চোখে রাখার সুবিধা হয়। দেখা যায় যে ব্যাটা কোষ থেকে কোষে কোন রাস্তা ধরে ছোটে। আর এই থেকে অণুটার কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বলিষ্ঠ ধারণা মেলে। সেইরকম ট্যাগ করার কায়দাটা হতে হবে এক ধাপের, যাতে ষাঁড়ের মত বড় অণুটা প্রায় বুঝতেই না‌ পারে যে তার গায়ে শালিক পাখির মত ছোট কোনো অণু আটকানো হয়েছে! আর এইখানেই চলে আসে "ক + খ = গ + ঘ" -মার্কা রাসায়নিক বিক্রিয়ার গুরুত্ব।

আমাদের ছোটোবেলার ব‌ইতে তীরচিহ্ন দিয়ে যত‌ই লেখা থাক যে 'ক'-এর সঙ্গে 'খ'-এর বিক্রিয়া ঘটালে 'গ' আর 'ঘ' তৈরি হয়, বাস্তবে ল্যাবরেটরিতে ঘটা বিক্রিয়াগুলো এত সহজ হয় না। এক-একটা তীরচিহ্নের খোঁচার পিছনে অন্তত হাজারখানেক রসায়নবিদের সারা জীবনের ঘাম-ঝরানো খাটনি লুকিয়ে থাকে। রসায়নবিদ্যার শুরু থেকে আজ অবধি মানুষ তার নিজের কাজের প্রয়োজনে যত রাসায়নিক বিক্রিয়া আবিষ্কার করেছে, তার সিংহভাগের ফলাফল‌ই নির্ভর করে বিক্রিয়ার সময়ে উপস্থিত গুচ্ছের শর্তের উপর। চটপট লাল রঙের তরল আর নীল রঙের কঠিন বিক্রিয়া করে সবুজ রঙের গ্যাস আর হলুদ রঙের কঠিন হয়ে গেল, আর কোথাও কোনো গণ্ডগোল হল না; সব জিনিস যত পরিমাণে যেমনটা চাই ঠিক তেমনটা পেলাম, এমন ভাগ্য কদাচিৎ হয়, এমনটা লিখলেও বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে! আগে থেকে বলা মুশকিল কোন্ অবস্থায় কিসের বাড়তি বা খামতিতে কি ফলাফল দেবে। অনেক পর্যবেক্ষণের পরে একটা গড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে এই এই পরিস্থিতিতে এই এই ফল আসে, আর সেটাই বিক্রিয়াটার প্রতিষ্ঠিত প্রোটোকল-রূপে বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। 

একমাত্র এক শ্রেণীর বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানুষ একটু নিশ্চিন্তে ফলাফল কী হবে তার ঘোষণা আগ বাড়িয়ে করতে পারে। সেটার কারন মানুষের এতদিনের পরমাণু এবং অণু, তাদের রাসায়নিক বন্ধন-সংক্রান্ত গণিত-নির্ভর বিশদ গবেষণা। এই ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণুর, বিশেষতঃ কিছু জৈব অণুর বাইরের কাঠামো জুড়ে, অণু-গঠনকারী পরমাণুগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনের চলাচলের দিক আগে থেকে বলা সম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা অণু থেকে আরেকটা অণুতে, বা একটা অণুর মধ্যে, এই ইলেকট্রনের চলাচল যেন গাড়ির একটা চাকার মত বলে মনে হয় - দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, কিন্তু 'যাবে না ফিরে' নয়, ফিরে যাবে। 

আর জন্ম নেবে দুটো অণুর সংযোগে নতুন একটা অণু, অথবা একটা অণু বদলিয়ে আরেকটা অণু। এই শ্রেণীর বিক্রিয়ার সাধারণ নাম পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়া।

 'পেরি', অর্থাৎ কিনা, 'পেরিফেরি' (periphery) বা পরিসীমা, যা বরাবর চাকার মত, অর্থাৎ cyclically, ইলেকট্রনের যাতায়াত ঘটে। এইসব পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়ার মজা হচ্ছে, এক ধাপে যা ঘটনা ঘটার ঘটে যায়। তাছাড়া এও দেখা যায় যে এক‌ই অণুতে তাপ দিলে ইলেকট্রনের চলাচল যেমন হয়, আলো ফেললে চলাচল ঠিক তার উল্টো রাস্তায় ঘটে। এই পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়াগুলোর‌ই বিশেষ একটা রকমফের হচ্ছে ক্লিক রিয়্যাকশন, যেন মাউসের এক ক্লিকে একখানা বিক্রিয়া ঘটানো যায় (অথবা, এখন এও বলা চলে যে সব পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়াই আসলে ক্লিক বিক্রিয়া)। ক্লিক বিক্রিয়ায় যেন অণু বা অণুগুলো প্রস্তুত থাকে আগেভাগেই, তারপর নির্দেশ পাওয়া মাত্র 'জো হুজুর ' বলে সেলাম ঠুকে নিজেদের সাজিয়ে নতুনভাবে পেশ করে আমাদের সামনে। 

সুতরাং এ বোঝাই যাচ্ছে, বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়া যদি জীবন্ত কোষে ঘটাতেই হয়, তবে তার জন্য ক্লিক-বিক্রিয়া ব্যতীত ভালো বিকল্প আর কিছু নেই। শার্পলেস আর মেল্ডাল বহু বছর ধরে গবেষণা করে এই ক্লিক-রসায়নের ভিত্তি মজবুত করেছেন। 'ক্লিক-কেমিস্ট্রি' নামটা শার্পলেসের‌ই 'শার্প ব্রেন' থেকে বেরিয়েছিল বাইশ বছর আগে। আর বার্তোজ্জি এই বিক্রিয়াকে 'বায়ো-অর্থোগোনাল' বিক্রিয়ারূপে জ্যান্ত কোষে কাজে লাগিয়েছেন। 'বায়ো-অর্থোগোনাল' শব্দটা আবার বার্তোজ্জিই প্রথম ব্যবহার করেন। জীবকোষের মধ্যে বিক্রিয়া চালাতে গেলে ল্যাবরেটরির ফ্লাস্কের মত নিয়ম খাটালে তো আর চলবে না। তাই বার্তোজ্জিকেও বহু বছর খেটেখুটে বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়ার শর্তগুলো নির্বাচন করতে হয়েছে। 

এখন এবং ভবিষ্যতেও এই শ্রেণীর বিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন জৈব-যৌগ নির্মাণ, শরীরের মধ্যে অনেক অণুর ইমেজিং পদ্ধতি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করা সম্ভব হচ্ছে এবং হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একুশ বছর আগে এই শার্পলেস‌ই অ্যাসিমেট্রিক সিনথেসিস (বিশুদ্ধ জৈব-যৌগ নির্মাণের একপ্রকার পদ্ধতি) আবিষ্কার করে রসায়নে নোবেলজয়ী হয়েছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ২০২২ -সরোজ নাগ
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র জগৎ সত্যিই রহস্যময়। আমরা জানি যে সেখানে কণাদের অস্তিত্ব রয়েছে। যখন সেই কণাগুলোকে পরিমাপ করা হয় তখন কণাগুলির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে একটি কোয়ান্টাম দশা (quantum state) পরিমাপ করতে গেলে তাদের আপনি যা পরিমাপ করবেন তা মৌলিকভাবে পরিবর্তিত (alter) বা নির্ধারিত (determine) হতে পারে। এমনকি দুটি কোয়ান্টাকে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করানোর ফলেও একই ঘটনা ঘটে। একজন পর্যবেক্ষকের ক্রিয়াকলাপ ছাড়া সেই অবজেক্টিভ বাস্তবতা কোনো মৌলিক উপায়ে বিদ্যমান বলে মনে হয় না। 

কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রকৃতি কোনো নিয়ম মেনে চলে না। এই নিয়মগুলি বিদ্যমান, যদি সেগুলি আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন এবং সাধারণ জ্ঞানের বিপরীতে (counterintuitive) হয়, তবুও সেগুলো রয়েছে। এমনকি দুটি এন্ট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম দশাকে অবশ্যই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। 

এভাবেই কোয়ান্টাম জগতে এক নতুন বৈপ্লবিক ধারণার বিকাশ ঘটছে যার নাম quantum information science.

এই কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সিস্টেম, এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা ফোটন আর বেলের অসমতা লঙ্ঘনের (violation of Bell’s inequalities) অগ্রণী গবেষণার জন্য 2022 সালের পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তিনজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী জন ক্লজার (John F. Clauser), অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট (Alain Aspect) এবং অ্যান্টন জেইলিংগারকে (Anton Zeilinger) এই অতি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

আমাদের কোয়ান্টাম বাস্তবতার অনির্দিষ্ট প্রকৃতিকে প্রকাশ করে এমন অনেক ধরণের পরীক্ষা আমরা করতে পারি। যেমন -

 একটি উপযুক্ত বাক্সে বেশ কয়েকটি তেজস্ক্রিয় পরমাণু রাখুন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেই সময় পরে গড়ে কতগুলি পরমাণু থাকবে আর কতগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, আপনি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন। কিন্তু কোন পরমাণু টিকে থাকবে এবং থাকবে না তা আগে থেকে বলার কোনো উপায় আপনার কাছে নেই। আমরা শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনা খুঁজে পেতে পারি।


 বিখ্যাত double slit পরীক্ষায় সংকীর্ণ ব্যবধানযুক্ত দুটো ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে পরপর অনেকগুলো কণা নিক্ষেপ করলে পিছনে পর্দায় কী ধরণের interference প্যাটার্ন তৈরি হবে তা অনুমান করতে আপনি সক্ষম হবেন। প্রতিটি পৃথক কণার জন্য, এমনকি যখন একবারে একটি কণাকে স্লিটের মাধ্যমে পাঠানো হয়, আপনি কিছুতেই আগে থেকে নির্দিষ্ট করতে পারবেন না যে এটি কোথায় কোন ছিদ্র দিয়ে গিয়ে পর্দায় আঘাত করবে।


কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার কিছু দিক সম্পূর্ণ র‍্যান্ডম বলে মনে হয়। কিন্তু এগুলি কি সত্যিই র‍্যান্ডম, নাকি এই সিস্টেমগুলি সম্পর্কে আমাদের তথ্য সীমিত থাকার জন্য এগুলিকে কেবল র‍্যান্ডম দেখায়?

 আমাদের কাছে থাকা সেই তথ্যগুলো কি একটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতা প্রকাশ করার জন্য অপর্যাপ্ত? কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূচনা থেকেই আইনস্টাইন থেকে বোর এবং তার পরেও বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে তর্ক করেছেন।

কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে বিজ্ঞানীরা কেবল যুক্তিতর্কের উপর ভিত্তি করে নয় বরং পরীক্ষানিরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বিষয়গুলি নির্ধারণ করেন। আমরা যদি কোয়ান্টাম সিস্টেমের বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন নিয়মগুলি জানতে পারি তাহলে আমরা সেই সিস্টেমের প্রত্যাশিত, সম্ভাব্য আচরণটি নির্ণয় করতে পারি। এরপর পর্যাপ্ত পরিমাপে সেটআপ এবং যন্ত্রপাতি দেওয়া হলে, আমরা পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের ভবিষ্যৎবাণী পরীক্ষা করতে পারি এবং আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমরা সম্ভব হলে এমন একটি পরীক্ষাও ডিজাইন করতে পারি যা বাস্তবতা সম্পর্কে অত্যন্ত গভীর ধারণা পরীক্ষা করতে পারে। যেমন কোয়ান্টাম সিস্টেমের জন্য যতক্ষণ না তাদের পরিমাপ করা হয় তখন সেই সিস্টেমে কোনো মৌলিক অনিশ্চয়তা আছে কিনা অথবা আমাদের বাস্তবতার অন্তর্নিহিত কিছু "লুকানো ভেরিয়েবল" বা “hidden variable” আছে কি না যা পরিমাপ করার আগেই ফলাফল কী হতে চলেছে তা পূর্ব-নির্ধারণ করে।


এই ধরনের প্রশ্নগুলোর একটা সমাধান পাওয়া যেতে পারে একটি বিশেষ ধরনের কোয়ান্টাম সিস্টেমে, তা হলো একটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম সিস্টেম। আপনাকে যা করতে হবে তা হল কণার একটি entangled জোড়া তৈরি করা, যেখানে একটি কণার কোয়ান্টাম দশা অন্যটির কোয়ান্টাম দশার সাথে সম্পর্কযুক্ত (correlated)। যদিও স্বতন্ত্রভাবে দেখলে, উভয়েরই সম্পূর্ণরূপে র‍্যান্ডম এবং অনির্দিষ্ট কোয়ান্টাম দশা রয়েছে, কিন্তু একসাথে হিসেবে নেওয়া হলে উভয় কোয়ান্টার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা উচিত।

এমনকি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্যও এই বিষয়টি অদ্ভুত বলে মনে হয়। সাধারণত আমরা জানি যে কোনো সংকেত তার তথ্য সমেত শূন্যস্থানে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যেতে পারে না। কিন্তু আপনি যদি -

একটি কণার একটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কণা তৈরী করেন

এবং তারপর তাদের খুব বেশি দূরত্বে পৃথক করে রাখেন

এবং তারপর তাদের একটির কোয়ান্টাম অবস্থা পরিমাপ করেন

তখন অন্যটির কোয়ান্টাম অবস্থা হঠাৎ করে নির্ধারিত হয়

আর সেই নির্ধারিত হওয়া আলোর গতিতে নয়, বরং তাৎক্ষণিকভাবে হয়!

এর আগে বিজ্ঞানীরা 33 কিমি দূরে অবস্থিত রুবিডিয়াম-87 পরমাণুর এনট্যাঙ্গল জোড়া তৈরী করে পরীক্ষা করেছিলেন। [তথ্যসূত্র - 1 দ্রষ্টব্য] এবং তাঁরা দেখেছিলেন যে এনট্যাঙ্গল ঘটনাটি সত্যিই সঙ্গে সঙ্গে ঘটে। তবে কি এই ঘটনা বিজ্ঞানের একটা মূলগত ধারণাকে নস্যাৎ করে? না। যদিও কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট দীর্ঘ দূরত্বে কণাগুলিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব পড়তে পারে, আমরা আলোর গতির চেয়ে দ্রুত তথ্য পরিবহন করতে এটিকে ব্যবহার করতে পারি না। শুধু এনট্যাঙ্গলমেন্ট নিজেই তথ্য পাঠানোর জন্য যথেষ্ট নয়। যেমন কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন দীর্ঘ দূরত্ব জুড়ে কোয়ান্টাম দশাকে স্থানান্তর করতে এনট্যাঙ্গলমেন্ট ব্যবহার করতে সক্ষম। এই টেলিপোর্টেশনের জন্য entangled qubits ছাড়াও একটি ক্লাসিক্যাল বিট পাঠানোর প্রয়োজন হয়। সুতরাং, এনট্যাঙ্গলমেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে, কিন্তু তথ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া ক্লাসিক্যাল ইনফরমেশনের গতি দ্বারা সীমিত, যা আলোর গতিতে এগিয়ে চলে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। [তথ্যসূত্র - 2 দ্রষ্টব্য]

যাইহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আমরা সাধারণ ভাবে যতটা ভাবি বাস্তবে অতোটাও সহজ নয়। যেমন যদি একটি কণাকে "স্পিন আপ" হিসাবে পরিমাপ করা হয়, তবে এর অর্থ এই নয় যে অন্যটি 100% সময়েই "স্পিন ডাউন" হবে। তার মানে হলো যে অন্যটি হয় "স্পিন আপ" বা "স্পিন ডাউন" হওয়ার সম্ভাবনা কিছু পরিসংখ্যানগত নির্ভুলতার সাথে ভবিষ্যৎ বাণী করা যেতে পারে। এটা নির্ভর করবে আপনার পরীক্ষার সেটআপের উপর। সেই সেটআপের উপর নির্ভর করে এনট্যাঙ্গলমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা দাঁড়াবে 50% এর বেশি, কিন্তু 100% এর কম।

এই অনিশ্চয়তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 1960-এর দশকে জন স্টুয়ার্ট বেল এই ঘটনার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন। এবং তা থেকেই নির্ণয় করেছিলেন বিখ্যাত Bell’s inequality বা বেলের অসমতা। এই অসমতা নিশ্চিত করে যে দুটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কণার পরিমাপকৃত দশার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক (correlations) কখনই একটি নির্দিষ্ট মান অতিক্রম করতে পারে না। অথবা তা এভাবেও বলা যায় "local hidden variables" উপস্থিত থাকলে এই এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা দশার মধ্যে পরিমাপ করা পারস্পরিক সম্পর্ক কখনই একটি নির্দিষ্ট মান অতিক্রম করবে না।


এই ক্ষেত্রে "স্থানীয়" বা "local" বলতে স্থানীয়তার নীতি (principle of locality) বোঝায়। এই নীতি অনুযায়ী একটি কণা শুধুমাত্র তার ঠিক আশেপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এবং তার সাথে ফিজিক্যাল ক্ষেত্রের (fields) মাধ্যমে করা মিথস্ক্রিয়া (interactions) আলোর গতির চেয়ে বেশি দ্রুত গতিতে ঘটতে পারে না। আর Hidden variables হল কোয়ান্টাম কণা দ্বারা আবিষ্ট (possessed) কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য, এমন বৈশিষ্ট্য যা সনাক্ত করা যায় না কিন্তু তবুও পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানী বেল বলেছিলেন "যদি (একটি লুকানো ভেরিয়েবল তত্ত্ব) লোকাল হয় তবে এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে একমত হবে না, এবং যদি এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে একমত হয় তবে এটি লোকাল হবে না।"


তবে স্ট্যন্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোনো hidden variables ছাড়াই এই বেলের অসমতা লঙ্ঘন করবে। যার ফলে সঠিক পরিস্থিতিতে বা সেট আপে সেই পারস্পরিক সম্পর্ক (correlations) আশাতীত ভাবে শক্তিশালী হবে। তার মানে এনট্যাঙ্গলমেন্টের শতকরা পরিমান অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানী বেল এই ভবিষ্যৎ বাণীই করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা অস্থায়ী (untestable) ছিলো।

এবং সেখানেই এই বছরের পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ীদের অসাধারণ অগ্রগতির প্রসঙ্গ আসে।

প্রথমে আসে জন ক্লজারের গবেষণা। ক্লজার যে ধরনের কাজ করেছিলেন তা তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা প্রায়শই খুব কম মূল্যায়ন করেন। তিনি বেলের গভীর কিন্তু অব্যবহারিক কাজগুলি নিয়েছিলেন এবং সেগুলিকে উন্নত করেছিলেন যাতে তাদের একটি ব্যবহারিক পরীক্ষা তৈরি করা যায়। তিনি কাজ করেছিলেন CHSH inequality নিয়ে যেখানে C অক্ষরটি তাঁরই নামানুসারে। এই অসমতা নিয়ে বিশদে না বললেও এটুকু বলা যায় এখানে একজন পর্যবেক্ষকের কাছে একজোড়া এনট্যাঙ্গল কণা থাকে। তাঁর কাছে দুটি আলাদা লম্ব দিকের একটিতে তাদের কণার স্পিন পরিমাপ করার চয়েস থাকে। 

যদি বাস্তবতা (reality) পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভর না করে, তাহলে প্রতিটি পৃথক পরিমাপকে অবশ্যই অসমতা (inequality) মেনে চলতে হবে। যদি তা না হয় (যেমন স্ট্যান্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স), সেই অসমতা লঙ্ঘন করা যেতে পারে।

ক্লজার তাঁর ছাত্র স্টুয়ার্ট ফ্রিডম্যানের সাথে পরীক্ষাটির ডিজাইন ও সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি নির্ধারণ করেছিলেন যে এটি আসলে বেলের (এবং CHSH) অসমতা লঙ্ঘন করেছে। স্থানীয় লুকানো পরিবর্তনশীল তত্ত্বগুলি (Local hidden variable), আমাদের মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম বাস্তবতার সাথে দ্বন্দ্ব দেখায়। এবং এটা সত্যিই একটি নোবেল-যোগ্য কৃতিত্ব!

কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন অবিরাম, অবিরত। কোনো পরীক্ষার অন্তর্গত কেবলমাত্র সেই অনুমানগুলি ছাড়া আর কি কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়? এখনো কি কিছু বিশেষ ধরনের লুকানো পরিবর্তনশীল থাকা সম্ভব যা এখনও বিজ্ঞানী ক্লজারের পরিমাপ করা ফলাফলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে?

এই বছরের নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে দ্বিতীয় বিজ্ঞানী অ্যালাইন অ্যাসপেক্টের কাজটি এখানেই আসে৷ অ্যাসপেক্ট বুঝেছিলেন যে যদি দুটি পর্যবেক্ষক একে অপরের সাথে কার্যকারন যোগাযোগে (causal contact) থাকেন [অর্থাৎ, যদি তাঁদের একজন অন্যজনকে তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে আলোর গতিতে তথ্য পাঠাতে পারেন এবং অন্য পর্যবেক্ষক তাঁর ফলাফল পরিমাপ করার আগে সেই ফলাফলটি পেতে পারেন] তাহলে একজন পর্যবেক্ষকের পরিমাপের "পছন্দ" (choice) অন্যটির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

1980 এর দশকের গোড়ার দিকে, সহযোগী ফিলিপ গ্রেঞ্জিয়ার, জেরার্ড রজার এবং জিন ডালিবার্ডের সাথে অ্যাসপেক্ট বেশ কয়েকটি গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন যা অনেক ক্ষেত্রেই ক্লজারের কাজকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। তিনি বেলের অসমতার লঙ্ঘনকে অনেক বেশি পরিমাপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি আগের আগের পরীক্ষাগুলিতে সর্বোচ্চ 55%-এর সীমায় বেলের অসমতার লঙ্ঘনের চেয়ে তাত্ত্বিক মতের 83% মাত্রার লঙ্ঘিত হওয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর পরীক্ষার সেটআপে ব্যবহৃত প্রতিটি ফোটনের পোলারাইজারের orientation কে দ্রুত ও ক্রমাগত র‍্যান্ডম পরিবর্তন করে তিনি দেখিয়েছেন যে দুজন পর্যবেক্ষকের মধ্যে যেকোনও “stealth communication” আলোর গতির চেয়ে অনেক বেশি গতিতে ঘটা সম্ভব। [তথ্যসূত্র - 3 দ্রষ্টব্য]

সেই শেষ কৃতিত্বটি ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, পরীক্ষাটি এখন বিজ্ঞানীমহলে third Aspect experiment হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানী অ্যাসপেক্ট যদি অন্য কিছু না-ও করতেন তবে শুধু এই লোকাল, বাস্তব লুকানো ভেরিয়েবলের (real hidden variables) সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অসঙ্গতি প্রদর্শন করার পরীক্ষাটিই তাঁকে খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

কিন্তু তবুও বিজ্ঞানীরা আরও নিখুঁত লুপহোল বিহীন পরীক্ষা চেয়েছিলেন। এই সমবর্তন সেটিংস (polarization settings) কি সত্যিই র‍্যান্ডম বা এলোমেলোভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল নাকি সেগুলো pseudorandom ও হতে পারে? যেখানে হয়তো দুজন পর্যবেক্ষকের মধ্যে প্রেরিত কিছু অদেখা সংকেত আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে পারে যা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে (correlations) ব্যাখ্যা করে। 

সেই শেষোক্ত লুপ হোলকে সত্যিকার অর্থে বন্ধ করার একমাত্র উপায় হল দুটি এনট্যাঙ্গল হওয়া কণা তৈরি করা, তাদের জোড় বজায় রেখে খুব বড় দূরত্বে আলাদা করা এবং তারপরে একই সাথে যতটা সম্ভব কাছাকাছি তুলনামূলক পরিমাপ করা। এই ঘটনাটি বিখ্যাত আলোক শঙ্কুর (light-cones) বাইরে দুজন পৃথক পর্যবেক্ষককে রাখে। এর ফলে নিশ্চিত হয় যে দুটো আলাদা পরিমাপ কখনোই একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না।

শুধুমাত্র যদি প্রতিটি পর্যবেক্ষকের পরিমাপ তাদের মধ্যে যোগাযোগের কোন সম্ভাবনা ছাড়াই (উপরে উল্লেখিত অদেখা সংকেত সহ) একে অপরের থেকে সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারে তখনই বিজ্ঞানীরা লোকাল, বাস্তব লুকানো ভেরিয়েবলের চূড়ান্ত লুপ হোলটি বন্ধ করতে পারবেন। সেখানেই এই বছরের তৃতীয় নোবেল প্রাপক, অ্যান্টন জেইলিংগারের কাজটি কার্যকর হয়। [তথ্যসূত্র 4 দ্রষ্টব্য]

জেইলিংগার এবং তাঁর সহযোগীরা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করেন। 

প্রথমত, তারা লেজারের আলোর সাথে একটি ডাউন-কনভার্সন ক্রিস্টাল পাম্প করে এক জোড়া এনট্যাঙ্গল হওয়া ফোটন তৈরি করেছিলেন।

 তারপরে, তারা ফোটন জোড়ার প্রতিটি সদস্যকে একটি পৃথক অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম দশাকে সংরক্ষণ করে প্রেরণ করেছিলেন।

 এর পরে, তারা দুটি ফোটনকে প্রাথমিকভাবে প্রায় 400 মিটার ব্যবধানে রেখেছিলেন। পরে তাদের আরও এমন দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে তাদের মধ্যে আলোর ভ্রমণের সময় এক মাইক্রোসেকেন্ডের চেয়ে দীর্ঘ হয়।

 এবং অবশেষে, তাঁরা প্রতিটি পরিমাপের মধ্যে দশ ন্যানোসেকেন্ডের ক্রম অনুসারে (দশ, একশো, এক হাজার এইভাবে) সময়ের পার্থক্য সহ পরীক্ষাটি সম্পাদনা করেছিলেন।

তাঁরা এই পরীক্ষাটি 10,000 বারের বেশি সম্পাদন করেছিলেন। তার ফলে এতো বেশি শক্তিশালী পরিসংখ্যান তৈরী হয়েছে যাতে সেই "অদৃশ্য সংকেত" (unseeable signal) টির লুপ হোল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এর পরবর্তী অন্য পরীক্ষাগুলি দুটো এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা ফোটনের দূরত্বকে কয়েকশত কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের প্রযুক্তি এতো বেশি উন্নত হয়ে উঠছে যে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া একটা পরীক্ষাতে এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা একটি ফোটন ভূপৃষ্ঠে এবং অন্য ফোটনটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মহাকাশে থেকে আমাদের চারিদিকে পাক খাচ্ছে! [তথ্যসূত্র 5 দ্রষ্টব্য]

বিজ্ঞানী জেইলিংগার আরও একটি বিখ্যাত পরীক্ষার সম্পাদনা করেছিলেন যাতে তিনি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে অদ্ভুত কোয়ান্টাম ঘটনাগুলির একটিকে সক্ষম করেছিল, তা হলো কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। একটি বিখ্যাত কোয়ান্টাম নো-ক্লোনিং উপপাদ্য (quantum no-cloning theorem) রয়েছে, যা নির্দেশ করে যে আপনি মূল কোয়ান্টাম দশাকে ধ্বংস না করে একটি নির্বিচারে (arbitrary) কোয়ান্টাম দশার একটি অনুলিপি তৈরি করতে পারবেন না।

 বিজ্ঞানী Francesco De Martini এর গ্রুপের সাথে জেইলিংগারের গ্রুপ মিলেমিশে এনট্যাঙ্গেলমেন্ট অদলবদল করার একটি ঘটনা পরীক্ষামূলকভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই পরীক্ষাতে দেখা যায় একটি কণার সঙ্গে এনট্যাঙ্গেলমেন্টে জড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও অন্য একটি দ্বিতীয় কণার কোয়ান্টাম দশা কার্যকরভাবে একটি ভিন্ন তৃতীয় কণার মধ্যে "সরানো" যেতে পারে। যেখানে তৃতীয় কণাটির সাথে প্রথম কণাটির কোনো ভাবেই সরাসরি যোগাযোগ নেই! [তথ্যসূত্র - 6 দ্রষ্টব্য]

বস্তুত কোয়ান্টাম ক্লোনিং এখনও অসম্ভব, কারন মূল কণার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে সেই পরীক্ষাতে একটি কোয়ান্টাম সংস্করণ নিশ্চিতভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। যা অবশ্যই অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা নোবেল পাওয়ার যোগ্য।

এই বছরের নোবেল পুরস্কার কেবল একটি ফিজিক্যাল কৌতূহল নয়, যা আমাদের কোয়ান্টাম বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু গভীর সত্য উন্মোচন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। Clauser, Aspect, এবং Zeilinger-এর গবেষণার কারণে আমরা এখন বুঝতে পারি যে এনট্যাঙ্গলমেন্ট কণাগুলি কোয়ান্টাম রিসোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যা সেটিকে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যবহারিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহার করতে সক্ষম করে।

কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট অনেক বড় দূরত্বের উপর ঘটতে পারে, যা যথেষ্ট বড় দূরত্বে কোয়ান্টাম তথ্যের মাধ্যমে যোগাযোগের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। Quantum repeaters, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক উভয়ই এখন সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারে। এছাড়াও বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত (controlled) এনট্যাঙ্গলমেন্ট কেবল দুটি কণার মধ্যে নয়, অনেকগুলো কণার মধ্যে সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে condensed matter এবং multi-particle systems এর কথা বলা যায়। এবং এই প্রক্রিয়াগুলি চলবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভবিষ্যৎবাণীগুলির সাথে সঙ্গতি রেখে, লুকানো পরিবর্তনশীল তত্ত্বগুলির সাথে নয়। অবশেষে উল্লেখ করা যায় একটি বেল-অসমতা লঙ্ঘনকারী পরীক্ষা দ্বারা সংঘটিত কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির কথা, যা জেইলিঙ্গার নিজেই পরীক্ষাটি করেছিলেন।


2022 সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী জন ক্লজার, অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট এবং অ্যান্টন জেইলিংগারকে জানাই শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক অভিনন্দন। 

তাঁদের জন্যই কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আর কেবল একটি তাত্ত্বিক কৌতূহল নয়, বরং একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা আজকের প্রযুক্তির অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সরোজ নাগ 

চিত্র পরিচিতি -

চিত্র 1ঃ পদার্থবিজ্ঞানে 2022 সালের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী ত্রয়। বাম দিকে Anton Zeilinger, মাঝে John F. Clauser এবং ডান দিকে Alain Aspect. সৌজন্যে  CNN

তথ্য সূত্র --

1) van Leent, T., Bock, M., Fertig, F. et al. Entangling single atoms over 33 km telecom fibre. Nature 607, 69–73 (2022). https://doi.org/10.1038/s41586-022-04764-4

2) Basic Theory of Quantum Entanglement and the Possibility of Passing on Information Faster than the Speed of Light, Yihe Xue 2021 IOP Conf. Ser.: Earth Environ. Sci. 658 012001 https://iopscience.iop.org/.../10.../1755-1315/658/1/012001

3) Experimental Test of Bell's Inequalities Using Time-Varying Analyzers 

Alain Aspect, Jean Dalibard, and Gérard Roger, Phys. Rev. Lett. 49, 1804 – Published 20 December 1982 DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.49.1804

4) Violation of Bell's Inequality under Strict Einstein Locality Conditions

Gregor Weihs, Thomas Jennewein, Christoph Simon, Harald Weinfurter, and Anton Zeilinger, Phys. Rev. Lett. 81, 5039 – Published 7 December 1998

DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.81.5039

5) Entanglement demonstration on board a nano-satellite, Optica Vol. 7, Issue 7, pp. 734-737 (2020)

https://doi.org/10.1364/OPTICA.387306

6) Experimental Entanglement Swapping: Entangling Photons That Never Interacted, Jian-Wei Pan, Dik Bouwmeester, Harald Weinfurter, and Anton Zeilinger, Phys. Rev. Lett. 80, 3891 – Published 4 May 1998

DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.80.3891 

যুক্তিবাদীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরুদ্ধে কেন? -চিত্রদীপ সোম
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:284 | likes:2 | share: 2 | comments:0

ঈদ বা এই জাতীয় উৎসব আসলে অনেক নাস্তিক বা মুক্তমনাই ধর্মীয় উৎসবে পশুবলিদানের বিরোধিতা করেন। এই নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ টিটকিরিও সহ্য করতে হয় তাদের। অনেকেরই ধারণা যুক্তিবাদীরা ধর্ম মানেন না বলে নিজেরা অন্য সময় কবজি ডুবিয়ে মাংস খেলেও শুধুমাত্র অন্ধ ধর্ম বিরোধিতার কারণেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরোধিতা করেন। এটা তাদের ভণ্ডামো ও স্ববিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়। ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম এক বিপ্লবী এই মর্মে একটি দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন দেখলাম। 

আসল সমস্যাটা হচ্ছে মূল বিষয়টা ধরতে না পারার ক্ষেত্রে। প্রশ্নটা পশু হত্যা বন্ধের নয়, প্রশ্নটা প্রকাশ্যে অমানবিকভাবে পশু হত্যা নিয়ে। প্রকাশ্যে এইভাবে অমানবিক পদ্ধতিতে পশুহত্যা করলে যারা দর্শক হয় তাদের মনের উপর দীর্ঘস্থায়ী খারাপ প্রভাব পড়ে। 

বিশেষ করে কোমলমতি বাচ্চাদের মনের উপর। পরবর্তীকালে তাদের নিষ্ঠুর ও অপরাধপ্রবণ হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 এই কারণে যুক্তিবাদীরা বরাবরই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরোধিতা করে, কারন তা করা হয় হাজার হাজার লোকের চোখের সামনে। খাদ্যের কারণে পশুহত্যার বিরোধিতা কখনও যুক্তিবাদীরা করে না। এবং জেনে রাখুন ধর্মের নামে পশুবলিদানের বিরোধিতা শুধুমাত্র যুক্তিবাদীরাই করেন তা নয়, ভারতীয় আইন অনুসারেও ধর্মীয় উৎসবে পশুবলিদান সম্পুর্ন বেআইনী। 

The Prevention of Cruelty to Animals Act 1960 অনুসারে প্রকাশ্যে ধর্মের নামে পশুবলি দেওয়া রীতিমত দন্ডনীয় অপরাধ।

আইনভঙ্গকারীর জন্য ধার্য আছে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা (একইভাবে মাংসের দোকানগুলিতে যেভাবে প্রকাশ্যে মুরগীকে মারা হয় বা খাসীর দোকানে মৃত ছাল ছাড়ানো খাসী উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় বেআইনী সেটাও। আইন অনুযায়ী প্রতিটি স্লটার হাউসে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রানীহত্যা করে খরিদ্দারকে তার চাহিদা অনুযায়ী মাংস প্যাকেটে ভরে দিতে হবে। এজন্য প্রতিটি স্লটার হাউসে উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকা আবশ্যক)। কিন্তু এদেশে আর কবে আইন মেনে সবকিছু করা হয়। তাই আরো হাজার হাজার আইনের মতো এটাও এদেশে মানা হয় না যথারীতি। এবং আমরাও উদাসীন। বরং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা আশেপাশের মাংসের দোকানে ছোটবেলা থেকে আইন না মেনে পশুহত্যা দেখতে দেখতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে দিব্যি গা সওয়া হয়ে গিয়েছে আমাদের এসব। বাড়ির শিশুদেরও তাই নির্দ্বিধায় নিয়ে যাই মাংসের দোকানে। 

এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলে রাখা ভালো, ইসলাম ধর্মে পশুকে আড়াই প্যাঁচে যেভাবে হত্যা করা হয় সেটাও অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক। খাদ্যের জন্য পশুহত্যা করতে হলে উচিত পশুকে এক কোপে কাটা, যাতে যতদূর সম্ভব কম যন্ত্রণা দেওয়া হয়। আরো ভালো হয় হত্যার আগে অজ্ঞান করে নিলে।

আশা করা যায় বোঝাতে পেরেছি কেন কিছু মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান আসলেই পশুবলিদানের বিরোধিতা করে হইচই করেন। এরপরেও কেউ আপত্তি করলে বুঝতে হবে ধর্ম তাদের বাস্তববোধ ও সংবেদনশীলতার ভিতকে নষ্ট করে তাকে করে তুলেছে অন্ধ ধর্মীয় অনুগামীমাত্র, যাদের কাছে ধর্মের নামে সবকিছুই করা 'জায়েজ'।

শব্দ দূষণ -দিবাকর মন্ডল
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:25 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রতি বছরই রুটিন মাফিক মনসা পুজো থেকে শুরু করে দুর্গাপুজা, কালীপুজা এবং আরো অন্যান্য সমস্ত রকম ধর্মীয় পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠানে (কখনো পারিবারিক কখনোবা সার্বজনীন) যেভাবে মাইক এবং বক্সের শব্দতাণ্ডব চালানো হয় তার থেকে কেউ রেহাই পায় না! ঐসব দিনগুলিতে দিনভর মণ্ডপ ও তার আশেপাশে মাইক বাজানো হয়। এ ছাড়াও ভাসানে মাত্রাতিরিক্ত জোরে সাউন্ড বক্স বাজানো ও শব্দ বাজি ফাটানো হয়। প্রকাশ্য রাস্তায় একটি ভ্যানে ১০ থেকে ১২টি সাউন্ড বক্স ও আট-দশটি চোঙা মাইক, সাথে জেনারেটর একসঙ্গে তুলে তারস্বরে বাজিয়ে উদ্দাম নাচতে নাচতে ভাসানে যাওয়াটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক ডেসিবেল (ডিবি)। শব্দের মাত্রা ৪৫ ডিবি হলেই সাধারণত মানুষ ঘুমাতে পারে না। ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়।


বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি তিন বছরের কম বয়স্ক শিশু কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ১০০ ডিবি মাত্রার শব্দ শোনে, তাহলে সে তার শ্রবণ ক্ষমতা হারাতে পারে। মানুষ সাধারণত ১৫ থেকে ২০ কিলোহার্টজ (KHZB) স্পন্দনের শব্দ শোনে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতানুসারে, সাধারণত ৬০ ডিবি শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে এবং ১০০ ডিবি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজি এবং ডিজের আওয়াজে মানুষের শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। হৃদ্‌রোগীদের পক্ষেও জোর শব্দ ভীষণ ভাবে ক্ষতিকারক। তাই শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক।


 আজ আমার রক্ত গরম, আমার বাড়িতে বয়স্ক কোন লোক নেই, বাচ্চা নেই, বক্স এবং মাইকের মুখ আমার বাড়ির দিকে নয়, তাই আমি গায়ের জোরে উচ্চস্বরে মাইক বক্স চালালে অন্যের ক্ষতি হবে, তাতে আমার কি! এই মানসিকতা নিয়ে যারা রয়েছেন তাদের বলব আগামী দিনে আপনিও বয়স্ক হবেন, আপনার বাড়ি তো একদিন না একদিন ছোট শিশু জন্মাবে! তখন যদি আগামী প্রজন্ম তাদের রক্তের গরমে চোখ দেখিয়ে আপনার বাড়ির দিকে মাইক বক্স করে উচ্চশব্দে গান-বাজনা চালায় তখন আপনি সহ্য করতে পারবেন তো? 


মানবিকতার নামে দানবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের আনন্দের জন্য যাঁরা আইন ভেঙে সাধারণ মানুষকে সমস্যায় ফেলেন, তাঁদের জন্য আইনের সহায়তা নেয়া একমাত্র উপায়।

তাই বলব সার্বজনীন শুভ অনুষ্ঠান মানবিকতার দিক বজায় রেখেই করুন। আপনাদের অনুষ্ঠানের অর্থ যদি হয়ে থাকে সকলের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী এবং ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রাখা, অন্যের ক্ষতিসাধন না করা, সকলের মুখে হাসি ফোটানো, তাহলে আশা করব আপনারা শব্দ দূষণকে নীরব ঘাতক হিসেবে ব্যবহার করবেন না। নির্ধারিত নিয়ন্ত্রিত মাত্রা বজায় রেখে অনুষ্ঠান করুন তাতে সকলেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে,  সকলের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।


জাফরপুর, প্রামানিক পাড়া 

 ফলতা, দক্ষিণ 24 পরগনা 

বস্তুর চেতনাসঞ্চার -তন্ময়
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বস্তু থেকে চেতনার সৃষ্টি না চেতনা থেকে বস্তুর - এই নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। লোকায়ত মতে চেতনা দেহেরই গুন,দেহের বাইরে চেতনার অস্তিত্ব নেই। ভাববাদীরা এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলেছেন চেতনা যদি দেহেরই গুন হয় তবে মৃত দেহও তো দেহ তাহলে সেই দেহে তো চেতনা নেই অতএব চেতনা দেহের গুণ নয়, চেতনা দেহাতিরিক্ত শক্তি যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় থেকেই ছিল এবং এই চেতনা থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে চেতনা থেকে বস্তু সৃষ্টির ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। 

চেতনা যদি বস্তুর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ভিন্ন সত্তা না হয় তবে তো চৈতন্যময় ঈশ্বরের ধারনাই অমূলক হয়ে যায়।

কিন্তু চেতনা থেকে যদি সকলপ্রকার বস্তুর সৃষ্টি হয় তবে তো মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি বা বস্তুর মধ্যেই চেতনার অস্তিত্ব থাকবে, সেই চেতনা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন? মাটি থেকে কোনও কিছুর সৃষ্টি হলে মাটির সামান্যতম উপস্থিতি থাকবে না? সেটা কি সম্ভব? না,সম্ভব নয়। সৃষ্টির মূল উপাদানকরণ থেকে সৃষ্ট প্রত্যেকটির বস্তুর মধ্যেই সেই প্রাথমিক উপাদান পরিলক্ষিত হবে, এটাই বাস্তব। সৃষ্টির আদিতে চৈতন্যের উপস্থিতি অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ চরম বা পরম সত্তার অনুসারীরা বলেন, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই চেতনা বর্তমান। সেই চেতনা ব্যক্ত হয়নি, অব্যক্ত অবস্থায় আছে।এই চেতনার মান শূন্য। এই শূন্য কোনও সংখ্যাহীনতা নয়, তাই চেতনাহীন নয়।


 অদ্ভুত এই দাবী। চেতনার মান যদিই শূন্যই হয় তবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? শূন্য এককভাবে কোনও কিছুর অস্তিত্বহীনতাই বোঝায়। আরবি শব্দ “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের পরিবর্তিত রূপ হল ইংরেজির “শূন্য”। “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের অর্থ “সেখানে কিছু ছিল না”। সংস্কৃত শব্দ “শুণ্যেয়া”র অর্থ “খালি” বা “ফাঁকা”। তাহলে কি দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে চেতনার মান শূন্য কথাটার অর্থ চেতনার অস্তিত্বহীনতা।


 বস্তুবাদী মতানুসারে দেহ গঠনের মূল উপাদানগুলির মধ্যে চেতনার অস্তিত্ব থাকে না। উপাদানগুলির প্রত্যেকটাই নিস্প্রান, জড় অর্থাৎ অচেতন। কিন্তু এই জড় পদার্থের যখন বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় তখন এক নতুন গুণ বা ধর্মের উদ্ভব হয়, ইহাই চেতনা। উদাহরণ হিসেবে বস্তুবাদীরা মদশক্তির কথা উল্লেখ করেন। যে সকল দ্রব্যের মিশ্রণে মদ তৈরি হয়, সেইসকল দ্রব্যের একটির মধ্যেও স্বতন্ত্রভাবে সেই শক্তি নেই নেই যে শক্তি মদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ মদ পান করলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেই উত্তেজনা মদ তৈরির উপকরণগুলি পৃথক পৃথকভাবে বা একত্রে খেলেও সৃষ্টি হবে না। কিন্তু সেই উপকরণগুলিকে যখন বিশেষ তাপমাত্রায় বিশেষভাবে (অর্থাৎ উপকরণগুলির পরিমাণের বিজ্ঞানসম্মত অনুপাতে) মিশ্রিত করা হয় তখন যে তরল পানীয়ের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে এক নতুন গুণের সৃষ্টি হয়, সেটাই মদশক্তি।


এই মদশক্তিকে উদাহরণ ধরেই বলা যায়, যে সকল জড়বস্তুর সমন্বয়ে শরীরের গড়ে ওঠা সেইসকল জড়বস্তুর মধ্যে স্বতন্ত্র বা মিলিত অবস্থায় চেতনার কোন লক্ষ্মণ না থাকলেও সেগুলিরই কোন এক বিশেষ পরিবর্তনের ফলস্বরুপ উদ্ভব ঘটেছে চেতনা নামক এক সম্পূর্ণ নতুন গুণের। 

এই গুণের অস্তিত্ব দেহ বা শরীর ছাড়া সম্ভব নয়। বস্তু ও চেতনা গুনগতভাবে বিপরীত ধর্মী, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

 তাই বিপরীত ধর্মী হলেও বস্তু ও চেতনার মধ্যে একটা ঐক্যও বর্তমান। এটাই বৈপীরিত্যের ঐক্য।


 এখানে একটা প্রশ্ন জাগে যে বস্তু ও চেতনার মধ্যে ঐক্য থাকলে তো সকল বস্তুর মধ্যে চেতনা বর্তমানের ধারণাটা মান্যতা পেয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হবে যে বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিন্তু অবশ্যই চেতনার অস্তিত্ব ব্যতীত বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে। তাহলে আর ঐক্য হল কোথায়? এখানে বস্তু বলতে সকল প্রকার বস্তুর কথা ভেবে নিলে অযৌক্তিক হবে। এখানে বস্তু বলতে ক্রম সমন্বয়ী বস্তুর ভিত্তিতে গড়া দেহ বা শরীরের কথা ধরতে হবে। 

 

এত আলোচনা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠতে পারে, চেতনা যদি শুধুমাত্র দেহের গুণ হয় তাহলে মৃতদেহে চৈতন্য বর্তমান থাকে না কেন? ভাববাদীরা দেহ বলতে জড়দেহ ভেবে নিয়েছেন। মৃতদেহ যেহেতু জড়দেহ তাই সেই দেহতে স্বাভাবিকভাবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেহ মাত্রেই অনুভব বা চিন্তা করতে সক্ষম নয়। যেহেতু জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চেতনার উদ্ভব হয়েছে সেহেতু কেবলমাত্র জৈবিক জীবিত দেহই এই গুণসম্পন্ন হয়। যে দেহে প্রাণ বর্তমান সেই দেহ জীবিত, মৃতদেহে প্রাণ বর্তমান থাকে না তাই মৃতদেহে চেতনার অস্তিত্ব খোঁজা অবাস্তব।


প্রশ্ন উঠতে পারে, উদ্ভিদেরও তো প্রান আছে, তাহলে কি উদ্ভিদেরও চেতনা আছে? হ্যা,আছে তবে উদ্ভিদের চেতনা আর প্রাণীর চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য হল অনুভূতি ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ার সাথে চিন্তার পার্থক্য।উদ্ভিদের চেতনা হরমোন দ্বারা নির্ধারিত হয় বলে উদ্ভিদ শুধুমাত্র অনুভূতির মাধ্যমে ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সাড়া দিতে পারে কিন্তু যেহেতু উদ্ভিদের স্নায়ুকোষ নেই তাই চিন্তা করতে পারে না।   

বিবর্তনের ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুগত বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভবের কার্যকারন সম্পর্কের ব্যাখ্যা অবৈজ্ঞানিক। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা হল বস্তুর ধর্ম। অনুন্নত থেকে উন্নত, সরল থেকে জটিল ক্রমে বিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়েই বস্তুর রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত পরিমান স্বরূপ চেতনার উদ্ভব। বস্তুর বিকাশ ব্যতীত চেতনার সৃষ্টির দাবী অযৌক্তিক। 


চেতনার উৎস সম্পর্কে চেতনা বিষয়ক এবং জীব বিজ্ঞানীদের কয়েকটি ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক, “All three media-genetic evolution, phenotypic plasticity and memetic evolution-have contributed to the design at human consciousness, each in turn, and at increasing rates of speed”. (ডেন্নেট,আমেরিকার চেতনা বিষয়ক বিজ্ঞানী)  

 “Convert attention is the virtual movement of deep processing from one item o another. The cortex needs to control that virtual movement … is does so by constructing an attention schema- a constantly updated set of information that describes what convert attention is doing moment by moment-by moment and what its consequences are”. (বিজ্ঞানী গ্রাজিয়ান)

“It is quite certain that human consciousness did not arise fullfledged with the human species, but is only the most highly evolved end point of a long evolutionary history”. (আরনেস্ট মেয়ার, জার্মান জীববিদ)। 


বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাসমুহের (সাম্য ও বিপর্যয়) থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অভিযোজিত বা সৃষ্টি সম্বন্ধীয় পরিব্যক্তির মাধ্যমে চেতনার সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেন, বিবর্তনের দীর্ঘ পরিক্রমায় উপজাত বস্তু (বাই প্রোডাক্ট অফ এভলিউশন) রূপে চেতনাকে পাওয়া যায়।   


সকল আলোচনা বিশ্লেষণ করে আমরা বস্তু থেকে চেতনার উৎপত্তির যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটি হাজির করতে পারি তা হল, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বস্তুজগতের গুনের পরিমানগত বৃদ্ধি গুণাত্মক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকাশের স্তরের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এক নতুন গুণসম্পন্ন বস্তুর সৃষ্টি করে যার মধ্যে চেতনা পরিলক্ষিত হয়।এরূপ ক্ষেত্রে অজড় বস্তুতে উত্তরণের মধ্য দিয়ে জড় বস্তুটির নিরাকরণ ঘটে।


বিখ্যাত দার্শনিক এঙ্গেলসের উক্তি দিয়ে এই অধ্যায়ের শেষ করি, তিনি বলেছেন - “আমরা যে প্রত্যক্ষ বস্তুজগতের অন্তর্গত তাই একমাত্র বাস্তব। আমাদের চিন্তা বা চেতনাকে যতই ইন্দ্রিয়াতীত বলে মনে হোক না কেন, তাহা আসলে একটি বস্তুময় দৈহিক অঙ্গ মস্তিষ্কেরই উপপাদ। বস্তু চেতনার উপপাদ নয়, চেতনা নিজেই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপপাদমাত্র”।

কৃপাদৃষ্টি -সুমন কর্মকার
Nov. 23, 2024 | গল্প | views:1011 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বেলা আন্দাজ দুপুর বারোটা। রাজ্যের শাসক দলের এক মন্ত্রীর অফিস। মন্ত্রী নেই। তার জেলারই আরেক বিধায়কের অফিসে তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। এই মিটিংয়ের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে বেশ কিছু কন্ট্র‍্যাক্টচ্যুয়াল কাজের প্রার্থীদের তালিকা। হাজার হাজার প্রার্থীদের মধ্যে থেকে যোগ্য মানুষদের খুঁজে নেওয়াই এই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। যোগ্যতার যেসব মাপকাঠি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল টাকা। তাই দরদাম চলছে। ঠিক কত লাখ টাকায় ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ লিখে দেওয়া যায় তার খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা মিটিং করুক। আমরা বরং ফিরে আসি মন্ত্রীর অফিসে। মন্ত্রী নেই। তাই মন্ত্রীর চেয়ার আলো করে বসে আছেন মন্ত্রীর পতিদেব। সাথে রয়েছেন মন্ত্রীর বিশ্বস্ত পিএ। ইনি স্বামী স্ত্রী দুজনেরই অত্যন্ত অনুগত। হঠাৎ 'দাদা আসছি' বলে কেবিনে প্রবেশ করলেন পার্টির একজন বিশিষ্ট কর্মী। এই কেবিনে সবার আসার অনুমতি নেই। বেশীরভাগ পার্টি কর্মীই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেবিনের বাইরেই বসে থাকেন। দাদা বা বৌদি ডাকলে ভেতরে যান। তবে এনার ব্যপারটা আলাদা। এর হাত ধরে কেও এসেছেন অথচ চাকরি হয়নি, এমন উদাহরণ বিরল। ইনি ঠিক 'যোগ্য' চাকরিপ্রার্থীদেরই বাছাই করে নিয়ে আসেন। যারা সবদিক থেকে 'যোগ্য'। তাই মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর স্বামীর কৃপাদৃষ্টি রয়েছে এনার ওপর। 

দাদা- হ্যাঁ বল, কেমন আছ? আজকাল তো দেখাই পাওয়া যায়না তোমার।

বিশিষ্ট কর্মী- আরে দাদা কি যে বলেন? এই আপনাদের আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে আর কি। আজ দাদা আমাদের এলাকার দুজন মহিলা কর্মীকে এনেছি। দারুণ কাজ করে দাদা। এলাকায় সংগঠন এদের হাত ধরে অনেক মজবুত হয়েছে। ওই আইসিডিএস না কিসে কয়েকটা চাকরি বেরিয়েছে না? তো সে খবর পেয়েই এরা আমার কাছে এসেছিল। আমি বললাম আমাকে বলে কি হবে? মাথার ওপর দাদা আছেন। ওনাকেই সরাসরি বল। আমি টাকা-পয়সার কথা সব বলে দিয়েছি দাদা। আপনি বাকি কথা বলে নিন।

দাদা- ওহ এতোদিন কাজ করছ এখনও তোমায় শেখাতে পারলাম না। এসব কথা এতো চেঁচিয়ে বলার কি আছে? বাইরে কতজন এই এক আবেদন নিয়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে জানো? কয়েকজন তো সেই নোটিস বেরোনোর দিন থেকে আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। বসো। একটু থিতু হও। এই তোমরাও বসো। 

মহিলা দুজন বসলেন। এদের একজনের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। ছেলের বয়স ছয় বছর। স্বামী কাজকর্ম তেমন কিছুই করতেন না। তাই বিচ্ছেদের সময় ক্লেম করেও কোনোরকম খোরপোষ পাওয়া যায়নি। বাড়ির অবস্থা মাঝারি। তাই একটা চাকরি পাওয়ার আশায় ভিড়েছেন শাসকদলে। দ্বিতীয়জনের বাড়ির অবস্থা একেবারেই খারাপ। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। বাবা মায়ের অনেক আশা মেয়ে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। বাড়ির দুঃখ ঘোচাবে। মেয়ে জানতো চাকরির বাজারের অবস্থা তাই কলেজে পড়তে পড়তেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠন করত। গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে তিন তিনটে বছর এলাকার নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে। সবশেষে আজ একটা সুযোগ এসেছে। 

দাদা এবার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখো জগন্নাথ যখন তোমাদের এনেছে তখন নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।

অবিবাহিতা মেয়েটি খানিক লাজুক প্রকৃতির। সে চুপ করেই রইলো। 

তুলনায় ডিভোর্সি মহিলা খানিক সাহসী। তিনি বললেন, 'দাদা, বারো হাজার টাকার কাজের জন্য পাঁচ লাখ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?'

দাদা একটু হেসে বললেন, 'আরে! তুমি বেতনটা দেখছ কেন? ওতে তো তোমায় হাতই দিতে হবেনা। ষাট বছর অবধি চাকরি করবে। দুহাতে কামাবে। উপরি যা পাবে, তাতেই তোমার চলে যাবে। আর তুমি কি ভাবছ ওই টাকা আমি একা নেব? আরও কত জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে জানো? জগন্নাথ আমাদের নিজেদের লোক। তাই তোমাদের এতো কথা বলছি। নাহলে টাকা দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। যাই হোক টাকা নিয়ে রবিবার বিকেল নাগাদ আমার বাগানবাড়িতে পৌঁছে যাবে। তারপর বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকিয়ে বললেন একসাথেই আবার দুজন চলে এসোনা যেন। এই সপ্তাহে তুমি এসো। সামনের সপ্তাহে ওকে পাঠিয়ে দিও।' 

ইঙ্গিত বুঝতে পেরে দুজনের মুখ ততক্ষণে লাল হয়ে উঠেছে। ডিভোর্সি মহিলাটিই প্রথমে মুখ খুললেন, 'এ কি বলছেন দাদা? আমরা কোথাও যেতে পারব না। টাকা আমরা জগন্নাথদার হাতে দিয়ে দেব। সেরকমই তো উনি বললেন। দাদার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। জগন্নাথকে আর তুমি তুমি না করে সরাসরি তুইয়ে নেমে এলেন, 'কি রে তুই এদের বলে আনিসনি? শুধু টাকা দিলে চাকরি হয়?' জগন্নাথের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, 'না মানে স্যার লাস্ট দু'বার তো আপনি ছিলেন না। ম্যাডাম ডিল করেছিলেন, তাই ব্যপারটা মাথায় ছিল না আরকি’।

দাদা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, 'তোমরা এখন এসো। পরে কথা হবে।' 

এর ঠিক বছরখানেক পরের কথা। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন পাশের গ্রামের একমাত্র ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। পেশেন্টদের লম্বা লাইন। হঠাৎ সেই লাইনে দেখতে পেলেন সেই অবিবাহিতা মেয়েটিকে, 'আরে তুমি! কতদিন পরে দেখলাম তোমায়। কেমন আছ? এখানে কেন? শরীর খারাপ নাকি? ' অবিবাহিতা মেয়েটি স্মিত হেসে বললেন, ‘এই দেখো না কাশিটা সারছেই না। তার সাথে আবার গলাব্যথা। তুমি কেমন আছ? কি করছ এখন?’

ডিভোর্সি মহিলা- এই চলে যাচ্ছে ভাই। করব আর কি? এই ছেলে মানুষ করছি। আর মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসি। তুমি কি এখনও পরীক্ষা দিচ্ছ?

অবিবাহিতা- দিচ্ছিলাম, শেষে ওই আইসিডিএস এর কাজটা পেলাম। গত মাসেই জয়েন করেছি।

ডিভোর্সি মহিলা- ওই কাজটা? কিন্তু কিভাবে? আমি তো জানতাম ওই অসভ্য ছোটোলোকটার হাত ছাড়া ওই চাকরি কোনোভাবেই হতে পারে না। 

অবিবাহিতা- আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করনা, দিদি। আমি বলতে পারবনা। শুধু বলব তোমার মতো সাহস সবার থাকেনা গো। কাওকে কাওকে আপোষ করতে হয়। তবে জানোতো সেদিন ওই জানোয়ারটার অফিসে থুথু ছিটিয়ে আমিও বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সাহস ধরে রাখতে পারলাম কৈ? আমি হেরে গেলাম দিদি। তাই আমায় আপোষ করে যেতে হবে বাকিটা জীবন। চাকরিটা ছেড়ে দিলেও আমার নিস্তার নেই। তুমি ভাল আছো দিদি, ভালো থেকো।

এই অবধি বলে ডিভোর্সি মহিলাটির অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে মেয়েটা ডাক্তার না দেখিয়েই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়লো। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরলেন। 

বিজ্ঞানের বিকাশ ও শোষণের প্রক্রিয়া বদল -প্রবীর ব্যানার্জি
Nov. 23, 2024 | রাজনীতি | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো পাল্টে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবর্তনে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে পঞ্চদশ - ষোড়শ শতকে নবজাগরণ (রেনেসাঁস) এবং ধর্মসংস্কার (রিফরমেশন) আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী রূপান্তরের এই পর্বে পুঁজিবাদ সহায়তা করেছিল বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান পুঁজিবাদকে। সমাজ বলতে এখানে আর্থসামাজিক অবস্থাকে ধরা হচ্ছে।

কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেল এবং আগেকার স্থানীয় চাহিদা নির্ভর যে উৎপাদন ব্যবস্থা  তা বদলে গিয়ে কৃষিতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হলো। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন কেন্দ্র করে সামুদ্রিক বাণিজ্য বিকাশ ঘটলো। অবশ্যই নৌ-পরিবহনে তা উদ্দীপনা প্রদান করলো। অর্থাৎ আগেকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদল হবার জন্যই হাত পাততে হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে। কম্পাসের উদ্ভাবন নাবিকদের অকূল সমুদ্রে দিকনির্দেশ করতে সহায়তা করলো। আবিষ্কৃত হলো অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্র, যার সাহায্যে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চর্চা আর্থসামাজিক প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। জলপথে সড়কপথের তুলনায় কম খরচে ও কম সময়ে অন্যত্র পৌঁছানোর সম্ভব হলো। ধাতু এবং কাঠ ব্যবহার করে জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে উন্নত করতে দ্বারস্থ হতে হলো আবার বিজ্ঞানের। সামাজিক প্রয়োজনে বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটল। আবার অন্য ভাবে বললে বিজ্ঞানের বিকাশ সামাজিক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল।

নৌবাহিনীতে শক্তিনালী দেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য দেশ হলো স্পেন ও পর্তুগাল, পরবর্তীতে ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড। ফান্স ও জার্মানি তাদের আগের ক্ষমতা হারাতে থাকে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছে।

আবার যুদ্ধে বারুদের ব্যবহার নির্ণায়ক হয়ে উঠলো। উদাহরণ - ১৪৮৫ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বসওয়ার্থের যুদ্ধ। বারুদের সাহায্যে যুদ্ধ জয়ের পর টিউডর রাজতন্ত্র সূচনা হয়। মাত্র আটত্রিশ বছর পর ১৫২৬ এ পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন।

আবার এই বারুদ ও গুলির ক্ষত নিরাময়ের জন্যও বিজ্ঞানের ডাক পড়ল। অ্যামবোয়াজ পারে (Ambuois Pare) শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে অস্ত্রপচারের কৌশল দেখালেন। এর পাশাপাশি বিকাশ ঘটল শারীরতত্ত্ব (ফিজিওলজি) এবং বিকারতত্ত্ব (প্যাথোলজি)। শল্য চিকিৎসার বিকাশের স্বার্থে শরীরসংস্থানবিদ্যা (অ্যানাটমি)-র বিকাশের প্রয়োজন ছিল। উল্লেখযোগ্য নাম এই বিষয়ে বেলিলিয়াস, যিনি লিখলেন মানব শরীরের গঠন (De Humani  Corpoloris Fabrica)। 

জাঁ ফার্নের প্যাথোলজি সম্বন্ধে চর্চা করলেন। একইসঙ্গে রোগ নিরাময়ে এবং শিল্পকলা চর্চাকে এই জ্ঞান  ভীষণ ভাবে সহায়তা করলো।

অ্যানাটমি রেনেসাঁস শিল্পীদের প্রভাবিত করে। শিল্পীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তির বিকাশ ঘটে। এর জন্য শিল্পীরা আলবের্তীর কাছে ঋণী। যিনি বলেছিলেন মানবদেহের স্তরভেদে আঁকা উচিত; অর্থাৎ প্রথমে অস্থির কাঠামো আর শেষে চর্ম আবরণ, মাঝে পেশিকলা, শিরা-ধমনী ইত্যাদি। এই বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটার ফলে সমৃদ্ধ হলো শিল্প। আর্নল্ড হসারের লেখা বই Social History of art এ প্রকাশ পায়, জ্যামিতি, গণিত, বলবিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান ইত্যাদি হলো এই শিল্পকলার নানান উপাদান।

রেনেসাঁস শিল্পীরা একাধারে শিল্পী আরেক দিকে কেউ কেউ বিজ্ঞানেও বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আলোকবিদ্যা, শরীরসংস্থানবিদ্যা, প্রাণীকূল, গাছপালা, শিলাপাহাড় প্রভৃতি নানা বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছিলেন এ যুগের এক সার্থক প্রতিনিধি।


আরেকটা মাইলফলক বিজ্ঞানের পক্ষে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র। বই ও কাগজপত্রের মাধ্যমে ছাপার অক্ষরে জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও বিস্তার লাভ ঘটল। বুর্জোয়াদের আগ্রহ বাড়ল শিল্পকলা, ভ্রমণ ও ভূগোল বিষয়ক লেখাপত্তরে। 

এতদিনের ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার বদলে চর্চা শুরু হলো মানবতাবাদী শিক্ষার যার হাত ধরে উঠে এলো নতুন চিন্তক  শ্রেনী, যাদের বলা হতো মানবতাবাদী বা হিউম্যানিস্ট।

 এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ। বিনা প্রশ্নের মেনে নেওয়ার বদলে জন্ম হলো জিজ্ঞাসার।

ক্যাথলিক চার্চের বাইবেল ছিল সাধারণের দুর্বোধ্য (আমাদের সংস্কৃতের মতো) ল্যাটিন ভাষায়। মার্টিন লুথার জার্মান ভাষায় এর অনুবাদ ছাপালেন। বাইবেল আর সাধারণের নাগালের বাইরে রইলো না। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের ভাষায় এর অনুবাদ ছাপালেন। চার্চের কর্তৃত্ব খর্ব হতে লাগল।অর্থাৎ  বলা যায় যে বিজ্ঞান  বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন (রিফরমেশন) বিকাশকে সম্ভব করে তুলল।


এবার বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত অন্য বিষয়ে শুরু হলো। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কিভাবে গঠিত এই বিষয়ে প্রাচীন ধারণার  সাথে নব্য আধারিত জ্ঞানের। টলেমি এবং অ্যারিস্টটলের ভূ-কেন্দ্রীয় মতবাদ  বনাম ব্রুনো/কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ। ততদিনে জ্যোতির্বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়ে গেছে।নিকোলো কোপার্নিকাশ দেখালেন পৃথিবী তার নিজ অক্ষকে ঘিরে সূর্যের চারপাশে পাক খাচ্ছে। চার্চের মত ছিল ঈশ্বর পৃথিবীর জন্মদাতা, তাই পৃথিবী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে আসীন। তাকে কেন্দ্র করে গ্রহ ও নক্ষত্র ঘুরছে।বিতর্ক শুরু হলো। যদিও কোপার্নিকাশ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। সেগুলো সমাধান করলেন কেপলার, টইকো ব্রাহে, গ্যালিলিও প্রমুখেরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই মতবাদ আসলে চার্চ আর বাইবেলের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।এককথায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান স্পৃহা সামাজিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করলো।


আবার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে বিজ্ঞানের বিকাশ অনেকাংশে সাহায্য করল।পুঁজিবাদের বিকাশ বিজ্ঞানের হাত ধরে উঠে এলো। খনি শিল্প, ধাতুবিদ্যায় এবং রাসায়নিক শিল্পের ক্রোমোন্নতি, পুঁজি বিনিয়োগ ও বিকাশের সহায়ক হয়ে উঠলো। খনিজ গবেষণা রসায়নের বিকাশকে ত্বরান্বিত করলো। রসায়নের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ডে রে মেটালিকা(De Re Metallica)। নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কার হলো।অর্থাৎ বিজ্ঞান চর্চার লক্ষ্য হলো সামাজিক চাহিদা পূরণ।


সামরিক প্রযুক্তি, মুদ্রণ ব্যবস্থা, ভৌগলিক অভিযানের সহায়ক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন  যেমন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অনেকাংশে পরিবর্তিত করেছিল, তেমনি বিশ্ববীক্ষণকেও বদলে ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান  ইত্যাদির অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করেছিল। এই পুরো বিষয়টি ছিল দ্বিমুখী। একদিকে যেমন বিজ্ঞান সমাজকে প্রভাবিত করেছিল, অন্যদিকে আবার সামাজিক প্রয়োজনেই বিজ্ঞানের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। আর এই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান  ব্যবহৃত হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির বিকাশে এবং পুঁজিবাদের উত্থানে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞান

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়

সুজিত রাজবংশী

প্রসঙ্গ: বিজ্ঞানমনস্কতা -রাজু দত্ত
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:809 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে আমি বুঝি, মনকে বিজ্ঞান নির্ভর করে তোলার প্রয়োজনে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠা।

বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে, তাকে‌ প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞানের কোনো একটি বা একাধিক শাখায় পান্ডিত্য থাকতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি তিনি যদি প্রথাগত শিক্ষায় বিশেষভাবে শিক্ষিত নাও হয়ে থাকেন, তাতেও তিনি বিজ্ঞানমনস্ক হবার ক্ষেত্রে অযোগ্য নন। বিজ্ঞানমনস্ক প্রথাগত শিক্ষা নির্ভর নয়। 

কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং অর্জিত শিক্ষা তিনি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেন, তবে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যেতে পারে।

 অন্যদিকে, বিজ্ঞানের এক বা একাধিক শাখায় প্রথাগত শিক্ষার এক বা একাধিক ডিগ্রি অর্জন করা সত্ত্বেও কেউ যদি, তার অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করেন, তবে তাকে কখনোই বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না। কাজেই বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে, কোনো ব্যক্তিকে প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অথবা প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষকতা করতেই হবে, এমন‌ কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। 


তাহলে কি বিজ্ঞানমনস্ক হবার ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষার কোনো‌ গুরুত্বই নেই? অবশ্যই আছে। তবে তা উল্লেখিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্ধারিত মুল্যয়নে নম্বর প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে অর্জিত বিজ্ঞান শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের উপর। প্রথাগত শিক্ষায় বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করলে, একজন ব্যক্তির বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার পথ সুগম হয়। অন্যদিকে নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিষয়টা অপেক্ষাকৃত কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত প্রত্যকে ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে নির্ধারিত বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। তিনি সেইটুকু শিক্ষার ভিত্তিতে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে  পারেন। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান বিষয় উচ্চশিক্ষা লাভ না করেও। 


একজন ব্যক্তির বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে।

 এই সকল পরিবেশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসী হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শৈশব থেকেই সেই সকল চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন। তখন তার বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। তার মানে এই নয় যে সেই ব্যক্তির পক্ষে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা অসম্ভব। 


ভুলে গেলে চলবে না ইউরোপে রেনেসাঁ বা ভারতে নবজাগরণের পথিকৃৎ মহামানবেরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজেই বেড়ে উঠেছেন। সেই সমাজের মধ্যে থেকেই তাঁরা আমাদের প্রগতিশীলতার পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের লড়াই আজকের তুলনায় সহস্রগুণ কঠিন ছিল। তবুও মানব কল্যানে তাঁরা আমৃত্যু আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁরাই তো আমাদের প্রেরণা। তাঁরা যদি তীব্র প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন, তবে আজ এত অনুকুল পরিবেশে আমরা কেন নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার লড়াই, সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার লড়াইটা লড়তে পারবো না? 


আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে হবে। বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে সেই শিক্ষা। ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের অর্জিত শিক্ষা অপরের মধ্যে। তবেই আমরা পারবো কুসংস্কার মুক্ত এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে। যেখানে মানুষ বাঁচবে 'মানুষ' হয়ে। 

উর্দু ভাষার ট্র্যাজেডি এবং হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ -অনুজ বিশ্বাস
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:876 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এবিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে, উর্দু ভাষার জন্ম ও বিকাশ এই ভারতবর্ষের মাটিতেই হয়েছে। উর্দু আর হিন্দি ভাষা সংস্কৃতের যমজ উত্তরাধিকারী। ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম রাজ্য সুরসেন, তথা দিল্লী থেকে মথুরা পর্যন্ত যমুনার তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সৌরসেনী প্রাকৃত অপভ্রংশের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। অনেকগুলি কথ্য ভাষার মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে তা হল কৌরবী উপভাষা। এই কৌরবী উপভাষা থেকেই কালক্রমে উর্দু ও হিন্দি ভাষার জন্ম। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালের মধ্যে সৌরসেনী কৌরবী প্রাকৃত এর সাথে হরিনাভী, অবধী, ব্রজবুলি, ভোজপুরি, বুলেন্দী এবং নবাগত আরবী, ফার্সি ও তুর্কী ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় হিন্দুস্তানী ভাষা। এটি একটি মিশ্র ভাষা, আর্য্যাবর্তের মিশ্র রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক সঙ্করায়নের ফসল। হিন্দুস্তানী ভাষার নিজস্ব কোন সর্বজনগ্রাহ্য বর্ণমালা নেই, এটি একান্তভাবেই হিন্দুস্তানের কথ্য ভাষা, মধ্যযুগীয় উত্তর ভারতের নতুন সংস্কৃতি। 

হিন্দুস্তানী ভাষার প্রধান দুইটি লিখিত রূপ, একটি হল দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দী এবং অপরটি নাসতালিক হরফে লিখিত উর্দু।

 হিন্দী আর উর্দু যমজ ভাষা, তাই এদের শব্দভাণ্ডারের অর্ধেক শব্দই এক ও সমার্থক।

              উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতায় সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে গণ্য হলেও, সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সরকারের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি চালু হওয়ার সাথে সাথে উর্দু ভাষার জীবনে দুর্দশা নেমে আসে। হিন্দু-মুসলিম আলাদা করার সাথে সাথে সরকার বাহাদুর খুব সুনিপুণ ভাবে দ্বি-জাতি ও দ্বি- ভাষা তত্ত্ব (Two Nations and Two Languages Theory) একত্রে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। ১৮৫৮ সালের মহারাণীর ঘোষণা পত্রের মধ্যে অবধারিত দেশভাগের সাথে সাথে উর্দু ভাষার মৃত্যু পরোয়ানাও যে লুকিয়ে আছে তা বোধ করি স্বয়ং মির্জা গালিবও সেদিন বুঝতে পারেননি। ব্রিটিশ সরকার সমাজের উচ্চস্তরে এজেন্ট নিয়োগ করে। হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং উর্দুভাষী এলিট মুসলিম সমাজকে নিয়োগ করা হয় ভাষা পরিশোধনের কাজে। কুলীন ব্রাহ্মণদের হিন্দি ভাষার সংস্কৃতায়নের কাজে লাগিয়ে, হিন্দি ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এটিকে কেবল হিন্দুদের ভাষা হিসাবে তুলে ধরা হয়। এ’থেকেই হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান তত্ত্বের জন্ম এবং তার অনিবার্য ফলশ্রুতি আজকের হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ। অপরদিকে উর্দু ভাষাকে স্থানীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভাষার মধ্যে আরবী ও ফারসি শব্দ ভান্ডার ও বাকধারার প্রয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এলিট মুসলিম সমাজকে ইংরেজরা যথেষ্ট তোল্লাই দেয়। সরকারী পৃষঠপোষকতায় সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন ও পরবর্তীকালে খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

উর্দু ভাষা শোধন করতে গিয়ে তার সমাধির পথ প্রশস্ত হয়।

 আরবী ও সংস্কৃত ভাষাকে খুড়োর কল বানিয়ে জাতিদাঙ্গা বাধিয়ে শুধু কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষ খুন করাই নয়, এর সাথে হিন্দুস্তানী ভাষা ও সংস্কৃতিকেও খুন করেছে ইংরেজ সরকার, আর সেগুলোর সৎকার করে চলেছি আমরা, দেশের সাধারণ মানুষ।

            

  ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের সাফল্য বা ব্যর্থতা একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ভবিষ্যতে দেশভাগ অনিবার্য, নিদেনপক্ষে বাংলা আর আসাম প্রদেশের পুনর্বিভাজন অবধারিত। এরপরেই আসরে নেমে পড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। 

একে একে গঠিত হয় মুসলীম লীগ ও হিন্দু মহাসভা। দুইদল হাতে হাত মিলিয়ে খাল কেটে কুমির আনতে বেশী সময় নেয়নি।

দুই জাতির সাথে দুই ভাষাও সম্মুখ সমরে নেমে পড়ে। হিন্দু মহাসভার সাথে যোগ দেয় সঙ্ঘ পরিবার। হিন্দু রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের আড়ালে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি প্রস্তর হয়। মহাসভার নেতারা হিন্দি ভাষার প্রতি এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে তারা তাদের মাতৃভাষাকে অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা বোধ করেন না। আশ্চর্যজনকভাবে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান তত্ত্বের যারা প্রবক্তা এবং ধারক ও বাহক, তাদের কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়। সাভারকরের মাতৃভাষা মারাঠী, মদনমোহন মালব্যের মালয়ী উপভাষা (ওনারা মধ্যভারতের মালয় অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, মালয়- মালয়ী- মালভী- মালব্য)। লাজপত রাইয়ের মাতৃভাষা গুরুমুখী পাঞ্জাবি, তার বাবা ছিলেন উর্দুর শিক্ষক। 

এছাড়া শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বা ডা. হেডগেওয়ার কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়, যথাক্রমে বাংলা ও মারাঠী। শুধু হিন্দুত্বের স্বার্থে তারা হিন্দি ভাষার দালালী করেছেন।

 উল্টোদিকে পাকিস্তানের ধ্বজাধারী মুসলীম লীগ উর্দু ভাষাকে হাতিয়ার করে দুর্বার গতিতে এগোতে থাকে। এখানেও অদ্ভুত সমাপতন। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের কারও মাতৃভাষা উর্দু নয়। জিন্নার মাতৃভাষা গুজরাটি আর তৃতীয় আগা খানের পারসি। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার নামে মাতৃভাষার এমন নির্লজ্জ বলিদান ভারতবর্ষ আগে কখনও দেখেনি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি যেন তেন প্রকারে আমাদের উপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। আমরা মানে ভারতবর্ষের সেই সত্তর ভাগ, প্রায় আশি কোটি মানুষ যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয়। চল্লিশ কোটি মানুষের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হল আশি কোটি মানুষের উপর। বর্তমানে শুধু চাপিয়ে দেওয়াই নয়, নাগপুরের গোপন এজেন্ডা অনুযায়ী একদেশ একজাতি একভাষা নীতি কার্যকরী করার জন্য হিন্দী বাধ্যতামূলক করতে চায় দিল্লির সরকার। ২৬/১১ পরবর্তী সময়ে ইসলামোফোবিয়ায় ভুগতে থাকা ভারতে উর্দু ভাষার গায়ে সুনিপুন ভাবে সন্ত্রাসবাদী দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে। শাহীনবাগ আন্দোলনের পর উর্দু ভাষা আর টুকরো টুকরো গ্যাং সমার্থক বলে পার্লামেন্টে আওয়াজ তুলেছেন আমাদের মন্ত্রীবর। এরসাথে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা জারি আছে। হিন্দি ভাষার ধ্বজাধারীরা ভুলে গেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা সাহিত্যের যা ভূমিকা, উর্দু কবিতা আর শায়ারীর ভূমিকা তারচেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এমনকি যে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান ব্রিটিশের মেরুদণ্ডে কম্পন ধরিয়ে দেয় সেটির উদ্গাতা ছিলেন উর্দু কবি মওলানা হাসরত মোহানি। এখানেও লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, বর্তমান ভারতে যে দুইজন মানুষ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের পোস্টার বয়, তাদের কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়, তারা দুজনেই গুজরাটি বানিয়া।

      ভারতে মত পাকিস্তানেও উর্দু ভাষার অবস্থা শোচনীয়। ১৯৪৮ সালে উর্দু ভাষাকে সেদেশের জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সাথে সাথে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% উর্দুভাষী, আর সেই ভাষাকেই দেশের জাতীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হল। উর্দু কোনোভাবেই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হতে পারে না, এটি ছিল মুসলীম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের একটা হাতিয়ার মাত্র। পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, খাইবার প্রদেশ এবং সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে উর্দু ভাষার লেশ মাত্র নেই। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের ৩০% মানুষ ছিল বাঙালী। বাকি ৬০% দখল করে আছে পাঞ্জাবি, পোস্তু, সিন্ধি এবং মুলতানি। পাকিস্তানে উর্দুভাষী মানুষের তুলনায় ভারতে উর্দুভাষী মানুষের সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেশি। বর্তমানে সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন। পাকিস্তানের মানুষ উর্দু ভাষাকে আজও হিন্দুস্তানের ভাষা মনে করে, তেমনি ভারতের কাছে পাকিস্তানি জঙ্গীদের ভাষা হল উর্দূ। ১৯৪৮ সালে বাঙলা ভাষা কে কেন্দ্র করে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয় তা সারা বিশ্বে ভাষা আন্দোলনের বিগ্রহ নড়িয়ে দেয়। বাঙলা আর উর্দু ভাষার সংঘাত চরমে ওঠে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। রক্ত দিয়ে রচিত হয় মাতৃভাষার বিজয়গাথা এবং বাঙালির আন্তর্জাতিক পরিচয় যার অনিবার্য পরিণতি হল ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক মেরুকরণের খেলায় ধর্ম যদি তুরুপের তাস হয় তবে ভাষা হল ইস্কাবনের টেক্কা যাকে ধর্ম দিয়েও ওভার ট্রাম্প করা যায় না। তাই মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি উর্দু ভাষা ও নাসতালিক বর্ণমালার বিন্দু বিসর্গও জানেন না এবং লাল লাজপতরাই দেবনাগরী বর্ণমালা ও হিন্দী ভাষা সম্পর্কে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন না করেও শুধু নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মীয় রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করতে উর্দু আর হিন্দি ভাষার হয়ে ওকালতি শুরু করেন।

একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে, সরকারী মদতে যেমন কোনও ভাষার বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি রাষ্ট্রের চরম বিরোধীতা সত্ত্বেও কোনও ভাষা হারিয়ে যায়নি।

 পাকিস্তানে উর্দু ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য করার মত ফাঁকা মাঠ থাকলেও আজ অবধি সমস্ত রকম সরকারী বদান্যতা সত্ত্বেও সেদেশে উর্দু ভাষার দুরবস্থা বেড়েছে বৈ কমেনি। আজ অবধি দ্বিতীয় কোনও গালিব, প্রেমচাঁদ, ইকবাল বা মন্টো কেউ উঠে আসেনি। 

তেমনি ভারতের মাটিতে বিশুদ্ধ হিন্দী ভাষা ক্রমশ লুপ্তপ্রায়। পরিবর্তে হিন্দী আর ইংরেজি ভাষার অবৈধ সহবাসের ফলে হিংলিশ নামক এক বর্ণসঙ্কর খিচুড়ি ভাষার সৃষ্টি হয়েছে।

 রাষ্ট্রশক্তি যখন কোনও ভাষার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে তখন সমাজ নিজ দায়িত্বে সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলে। ১৯৪৮ সালে জিন্না পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠা করার নিদান দেন, যার ফলশ্রুতি হিসাবে পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে গোটা পূর্ব পাকিস্তান লাহোরের হাতছাড়া হয়ে যায়। পারস্য দেশে ইসলামী শাসন চালু হওয়ার পর লাগাতার চারশত বছর ধরে আরব খলিফারা বুলডোজার চালিয়েও ইরানে আরবী ভাষায় প্রচলন ঘটাতে পারেনি। ইরানীরা আরবী ভাষায় কোরআন পাঠ করতে সম্মত হলেও দৈনন্দিন জীবনে এবং ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পারসি ভাষা ছাড়া এক চুলও নড়েনি, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তারা কোনও আপোস করেনি। এটি বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অন্যতম উদাহরণ। বর্তমান ইরাকের কুর্দ জনজাতি হাজার অত্যাচার সহ্য করেও কুর্দিশ ভাষা ছাড়েনি, এমনকি স্বয়ং সাদ্দাম হোসেন কয়েক লক্ষ কুর্দ জনজাতি হত্যা করেও তাদের মধ্যে আরবী ভাষার প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

      ১৯৪৮ সালে জিন্না পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে একদেশ একভাষা নীতির পক্ষে সওয়াল করেন, যার মারাত্মক ফলাফল প্রত্যক্ষ করে পাকিস্তান আর কখনও ভাষা নিয়ে মাতব্বরি দেখানোর সাহস পায়নি। 

ভাষা আন্দোলনের সামনে পাকিস্তান চরম শিক্ষা লাভ করলেও, ভারতবর্ষ এথেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি।


সাংবিধানিক ভাবে ভারতের জাতীয় ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও, সংবিধানের ৩৪৩ ধারায় হিন্দি আর ইংরেজি ভাষাকে একত্রে শুধুমাত্র সরকারী কাজ চালানোর ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও, হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে দ্রাবিড়ভূমে প্রথম গণ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ ভাষা আন্দোলনে নতুন দিশা দেখিয়েছে। দিল্লীর হিন্দি শাসক পরাজয় স্বীকার করে ফিরে গেছে। ভারতবর্ষ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ। এখানে একদেশ একভাষা নীতি কখনই চলতে পারে না। 

বারংবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও দিল্লির শাসক এই সহজ সত্যটিকে অস্বীকার করে এসেছে। হিন্দী কখনই ভারতের জাতীয় ভাষা হয়ে উঠতে পারে না।

 সমগ্র দাক্ষিণাত্য ও উত্তরপূর্বে হিন্দী চলেনা। ভারতে প্রচলিত ২২৫টি দেশীয় ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসাবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক, অন্তত পঁচাত্তর কোটি মানুষ আজকের দিনে কমবেশি ইংরেজী জানেন। অর্থাৎ, অভিন্ন ন্যুনতম জ্ঞান বা Common Minimum Knowledge এর সূচকে মাপলে ভারতের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ভাষা জানেন সেটি হল ইংরেজি। একমাত্র ইংরেজি হওয়া উচিত ভারতের Lingua Franca, কিন্তু তা হওয়ার নয়। আর্য্যাবর্ত, পশ্চিম ভারত জয় করে হিন্দি ধ্বজাধারী দের চোখ পড়ল বাংলার দিকে। বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা করে, গোবলয় থেকে হাজারে হাজারে হিন্দিভাষী মানুষকে বাঙলায় নিতে এসে, হিন্দু মুসলিমে আড়াআড়ি বিভাজন ঘটিয়ে, উত্তর প্রদেশ মডেলের সোনার পাথরবাটি দেখিয়েও হিন্দী বর্গীর দল বঙ্গদূর্গের দরজা খুলতে পারলো না। বাংলার মানুষ রাজনৈতিক ভাবে হিন্দী অসুরের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিল। এরাজ্যের মানুষ জানে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা কতখানি। বাঙালী মাতৃশক্তির পূজারী, পুরুষতান্ত্রিক অবতার তত্ত্বের পরোয়া করে না। বাঙলার কৃষ্টি সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে রাম-আল্লাহ-যীশু কেউ বাঁচাতে আসবে না, বাঙালী নিজেই নিজেদের বাঁচাবে। হিন্দী আগ্রাসন গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিহত হয়েছে, এখন সময় হিন্দি ভাইরাস আর ইউপি মডেল থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার। বাংলার মানুষ একদিন বিলাতী পণ্য বয়কট করেছে, এবারে হিন্দী প্রলোভন বয়কট করবে।।


অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক বিভাগে কর্মরত।

সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি -ধীরাজ দন্ডপাট
Nov. 23, 2024 | যুক্তি | views:990 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মানব প্রকৃতির মধ্যে মন্দভাবটা ঐতিহ্য ও শিক্ষার দ্বারা পরিমার্জন ঘটিয়ে যথার্থ মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটানোকে স্বাভাবিক ভাবে সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। এতদ্ব্যতীত যে স্থুলতা অবিকৃত তাকে তাহাই অপসংস্কৃতি। পুরোণ পুঁথি পত্রে নর নারীর যথেচ্ছ নাচগান, মেলামেশা ও যৌন সম্পর্ক ও পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে কাহিনীর ছড়াছড়ি। এমনকি মধ্যযুগেও এমন অবারিত মেলামেশার সুযোগ ছিল। 

তারপর ধীরে ধীরে সমাজব্যবস্থায় বিধি নিষেধ কঠোর হলেও গোপনে মেলামেশার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।


বৈদিক যুগে নারী নিজেই নিজের বন্ধু বা সঙ্গীকে পছন্দ করার সুযোগ পেয়েছিল। এখনও এদেশের আদিবাসীদের মধ্যে সেই ধারা প্রচলিত আছে।


     বিগত পাঁচ ছয় শতাব্দী জুড়ে সমাজে নরনারীর অবাধ মেলামেশা নিয়ে কঠোর বিধি নিষেধ বলবৎ থাকলেও,  বর্তমান সমাজে এই প্রাচীন বিধি নিষেধ কে অগ্রাহ্য করার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। আসলে মধ্যযুগে যে বিধি নিষেধ আরোপিত ছিল,  অর্থাৎ রক্ষণশীল সমাজের রীতি নীতিকে তুড়ি মেরে একটা স্বাভাবিক প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটছে। কালের তালে আগত আবহের সাথে রক্ষণশীল সমাজ যদি সহিষ্ণুতা দেখায় তবে নরনারীর বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা হয়তো শোভনতা প্রাপ্ত হবে। উচ্ছৃংখলতা শব্দের অর্থ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

    স্বাভাবিক ভাবে দেখা যাচ্ছে, অবাধ মেলামেশা,  মানসিক বা জৈবিক টানে যুগ যুগ ধরেই ছিল। যেটা সমসাময়িক সমাজে অনুমোদিত নয়। সেটাই গোপন অভিসার হিসেবে প্রচলিত। প্রকৃত পক্ষে জৈবিক প্রেরণা, বা অনেকটা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৌতুহল বা আকর্ষণের নিরীখে। আসলে জৈবিক টানকে প্রতিহত করার তাগিদে সোজা পথের সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় গোপন পথে জৈবিক প্রকৃতি চরিতার্থ করা। এটাকে পুরোপুরি অপসংস্কৃতির দোহাই না দিয়ে জীবের স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাটাকেও কিছুটা মান্যতা দেওয়া যেতে পারে।


পর্ব- ২

বেদ হলো আর্য্য গোষ্ঠীর জীবন বোধ সংক্রান্ত চিন্তাধারার প্রথম প্রকাশ। যার দ্বারা আধিপত্য কায়েমেরও চেষ্টা হয়েছে, ওই গোষ্ঠীর দ্বারা। লোকায়ত হলো এদেশিয় আদিম অধিবাসীদের জীবন বোধের  চিন্তাধারা। কালক্রমে আর্য্য অনার্যর মিলনে যে শঙ্কর জাতের সৃষ্টি হয়, তাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে বাঁধাই ছিল বৈদিক দর্শন। আর্য্যরা তাই আদিবাসীদের লোকায়ত দর্শনকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।

গান বাজনা, নাচ গান, পোশাক আশাক, ইত্যাদি  যুব সম্প্রদায়ের আবেগের পরিস্ফুটন। ফলে সমাজে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

 কারন যুব সম্প্রদায়ের রুচির সাথে তথাকথিত সমাজের ধারক ও বাহক বয়স্কদের মিল খায় না। শুরু হয় সামাজিক সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির সংঘাত।

    তারুণ্যের প্রভাব ও রুচি কতটা পরিমান প্রাধান্য পাবে বা কালক্রমে এই ধারা ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তাতে ভবিষ্যত সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির নিরিখে কেমন রূপ ধারণ করবে, এটা একটা প্রশ্নই বটে।

     সংস্কৃতিকে কোন গণ্ডির মধ্যে বাঁধা যায় না। প্রাকৃতিক ভাবে তা সতত পরিবর্তনশীল। বর্তমান যুবসমাজই বহন করে নিয়ে যাবে পর্যায়ক্রমে আগত প্রজন্মের জন্য। তাই সংস্কৃতির প্রশ্নে সামাজিক সহিষ্ণুতার প্রশ্ন বার বার উঠেছে, উঠবে।

     অস্বাভাবিক আতিশয্যের ফলে কিছুটা বাড়াবাড়ি হতে পারে, কারন রুচির পরিবর্তন তো কালানুক্রমিক। পরিবর্তন যুগকে প্রতিভাত করলেও সবটা বজায় রাখা কঠিন। সুরুচি, শোভনতা, সুন্দরতার রূপান্তর ঘটে, যদি উন্মাদনায় পৌঁছায় ধৈর্যশীল হতে হবে। আতিশয্য, উন্মাদনা স্থায়িত্ব পেতে পারে না, সংস্কৃতি নিজেই নিজের রূপ ধারণ করে।

    আতিশয্যের প্রকাশই রুচিকে পীড়িত করে। আতিশয্য ছাড়া ফুর্তি নাকি পূর্ণতা পায় না। নারীর পোশাক-আশাক, ধূমপান, চুলছাঁটা, ছেলেদের লম্বা চুল রাখা এগুলো নাকি অপসংস্কৃতির লক্ষণ। কেন? ধূমপান তো মোঘল আমলেও প্রচলিত ছিল। নিকট অতীতে দু-দশক পূর্বেই এদেশে মেমসাহেবদের ধূমপান করতে দেখা গেছে। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপূর্ণ বাড়িতে নারী গড়গড়াও টানতো। সেখানে প্রান্তিক গরীব শ্রমিক শ্রেণী হুঁকো বা বিঁরি টানতো। উপর তলার নরনারী বিদেশী মদে, আর নীচের তলা শস্তার মদে ডুবে থাকে। আঙ্গুল ওঠে শুধু মধ্যবিত্ত সমাজের বেলায়।

     উনিশ শতকে এসে মদ্যনিবারণী সভা রাশ টানার চেষ্টা করেছে। যে কারনে আজকাল মধ্যবিত্ত সমাজেই নারীদের অভ্যাস বশতঃ মদ্যপান ও ধূমপানে অপরাধবোধ কাজ করে।

তাই বলা যায় রুচির আতিশয্য যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা সীমা অতিক্রম করে, ততক্ষণ আতঙ্ক বা আপত্তি থাকা উচিৎ নয়। 

যদিও অতিরিক্ত  ধূমপান ও মদ্যপান নরনারী উভয়ের ক্ষেত্রেই স্বাস্থহানিকর।  তাই মাত্রার নিরীখে মদ্যপান ও ধূমপান যদি সাময়িক আরাম বা আনন্দের কারন হয় আপত্তি থাকা উচিৎ কি?


পর্ব - ৩

     বিগত শতাব্দীতে কিশোর ও যুবসম্প্রদায় ছিল তৎকালীন সমাজের একান্নবর্তী পরিবারের আওতায়। মানসিক মুক্তি ইচ্ছানুরূপ ছিল না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সবাই ছিল বাল্য অবস্থা থেকে  বিশেষ পরিচিত বা আত্মীয়। ফলে ভয় ব্যপারটা মনের মধ্যে সদা জাগ্রত থেকে একটা অলিখিত চাপ প্রয়োগ করতো। ব্যতিক্রমী হওয়ার সাহস সবার সব ক্ষেত্রে কঠিন ছিল। ব্যতিক্রম চোখে পড়লেই গুরুজনরা আঁতকে উঠতেন, গেল গেল রব উঠতো। বোধগম্য হতোনা কতদূর পর্যন্ত নির্দোষ হৈ-হুল্লোড় অনুমোদিত না হলে এ প্রজন্মের রোষানলে পড়া যায়। চলতো প্রথা লঙ্ঘনের, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা নিরবধি।

     বর্তমানে ব্যতিক্রমী পথটা শহরই দেখিয়েছে। যেহেতু নানা ভাষাভাষি, নানা মত, নানা সংস্কৃতির একত্র বসত, এক মিশ্রিত সমাজ। তাই সামাজিক গণ্ডিটা লঙ্ঘন সহজ। গুরুজনের তীক্ষ্ণ নজরকে এড়িয়ে চলার অফুরাণ সুযোগ। এ সবের বিরুদ্ধতা, প্রতিস্পর্ধার বাসনাটাকে উসকে দেওয়ার ফল মোটেই আশাপ্রদ হবে না। এই গণ্ডি অতিক্রম বিগত শতাব্দীর বশংবদতার প্রতিবাদ। বর্তমান প্রজন্মের স্বতন্ত্র জীবনীশক্তির প্রভাবে স্বাভাবিকতার প্রকাশই এমন প্রতিবাদী হওয়ার কারন। এরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর,  নবযৌবন দূত, তাই ছেড়ে দিতে হবে স্থান।

বন্ধনহীন মেলামেশায় কখনোও থাকে ভালোবাসা,  কখনোও বা ভালোবাসার অভিনয়ের মাধ্যমে উন্মাদনা লাভ। কারন অনেকেরই ভবিষ্যৎ অস্বচ্ছ।

 গ্রামাঞ্চলে চাষবাসের উপর নির্ভরশীল প্রজন্মের পর প্রজন্ম  আস্থাশীল। কিন্তু শহরাঞ্চলে কাজ কর্মের কোন স্থিরতা না থাকায় দিশাহীন ভবিষ্যত।  যে কারনে সংসার বাঁধার ইচ্ছে  রূপায়নের স্থিরতা না থাকায় উন্মাদনার মাধ্যমে সমাজে কর্মহীন বেকার যুবক-যুবতীরা ক্ষণিক উত্তেজনার মাধ্যমে প্রেমের ক্ষতিপূরণ করে নেয়। যারা সচ্ছল পরিবারের সন্তান সংসার বাঁধার আগেই যতটা সম্ভব দেদার অর্থ বিলিয়ে, পছন্দমত বহু সঙ্গিনীর সান্নিধ্য লাভ করে, ফুর্তির স্বাদ গ্রহণ করে নিতে চায়।

    এই মুক্তমন নারী পুরুষের সখ্যতা সময় বিশেষে শোভনতার মাত্রা অতিক্রম করে, তবুও আতিশয্যটা বাদ গেলে অবশিষ্টাংশ সেই সহজ, মুক্ত, সখ্য, সমাজের পক্ষে হয়তো ভালো হবে।

     বর্তমান সমাজের ছেলেমেয়েদের এই অত্যধিক অনর্গল উদ্দাম মেলামেশাকে অপসংস্কৃতি হিসেবে  আখ্যায়িত করলেও, ওরা হাজার উদাহরণ হাজির করছে মধ্যযুগ বা প্রাক ‘অশোক’ যুগ বা তারও আগের সংস্কৃতিকে উদাহরণ হিসেবে।  এমন কি পুরাণ বা মহাকাব্যে ছড়িয়ে থাকা ভুরিভুরি উদাহরণকে।

দশমীর দুপুরের অলস চিন্তা -রাহুল রায়
Nov. 23, 2024 | সচেতনতা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

লেখাটি লিখছি ৫ই অক্টোবর, এই বছর দিনটি বিজয়া দশমীর। শহরে বিশাল আয়োজনে ভাসান  চলছে। আরো পাঁচটি বাঙালি অধ্যুষিত জায়গার মতোই আসাম রাজ্যের এই শহরটিতেও দিনটি প্রতি বারের মতো এবারেও সাড়ম্বরে উদযাপন করা হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তার ছবি, আবেগস্ফীত বার্তায় ভরে উঠেছে। আর হবেই বা না কেন। মোটের ওপর ধর্মভীরু এই শহরের জনসংখ্যা তো আর কম নয়। আবার সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতির দিক থেকেও এই শহরের মানুষ পিছিয়ে নয়। এই শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব। প্রচলিত বিশ্বাস মতে ঘরের মেয়ে বছরের এই সময়ে ঘরে ফিরে আসে।  দশমীর দিনে সেই মেয়ে পতিগ্রহে পতিগৃহে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই দিনটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের বিশেষ আবেগ থাকে। চিরাচরিত এই আবেগের গণ্ডীর বাইরে গিয়ে ভাবলে দেখা যায় যে মাটির প্রতিমা তৈরি করে চারদিন সাড়ম্ভরে পুজো করে বিসর্জন, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই জ্ঞানের অভাবে গড়ে ওঠা প্রাচীন বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসকে তুষ্ট করার আয়োজন মাত্র। তবে লক্ষণীয় যে এই আয়োজনের সঙ্গে ‘ঘরের মেয়ে’, ‘গৃহ’, ‘শুভ শক্তি’র মতো  শব্দগুলো ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে।

এই তো গেল একটা দিক। এই দিকে 'ঘরের মেয়ে', 'ঘর', 'অশুভশক্তির ওপর শুভশক্তির জয়’ আছে। আছে আত্মীয়তার মাধুর্য। আছে বুকভরা আবেগ। এবার দেখা যাক  অন্য একটি দিকে। এই দিকটি আগেরটার মতো এক পক্ষের মাত্র ক’দিনের সাড়ম্বর স্থায়ীত্ব নিয়ে থাকে না। এর স্থায়ীত্ব কোনো অলৌকিক শক্তিকে কল্পনা করে নয়। এই স্থায়িত্ব বছরজুড়ে, এর উপস্থিতি অনাড়ম্বর সাধারণ মানুষের জীবনে, মননে। এদিকে আমরা দেখি  একদল লোভী মানুষ, তাদের অঙ্গুলহেলনে অঙ্গুলিহেলনে সরকার ও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের কর্তাদের সামনে ফি বছর মানুষের নিরুপায় অবস্থা। আমরা দেখি কিভাবে এদের পায়ে দলে দলে  মহিলারা পড়ে নিজেদের ঘর রক্ষার জন্য ভিক্ষা করে, কোলের শিশুকে এগিয়ে দিয়েও এই লোভীদের পথরোধ হয় না। না, এই দৃশ্য খুব বেশি দূরের নয়, সময় ও ভৌগোলিক,  কোনোদিকেই। আজ যে শহরে শারদীয় দুর্গোৎসব নিয়ে এতো জাঁকজমক,  তার থেকে মাইল পনেরোর দূরত্বের মধ্যেই আছে ডলু চা বাগান। সবুজে ঘেরা, হ্রদের ধারে পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলা ছবির মতো সুন্দর একটি বাগান। ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল এই বাগানের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। গত মে মাসে শ্রমিকদের প্রবল আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এই চা বাগানে রাজ্য সরকার বিমানবন্দর বানানোর নামে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল। যদিও কিছুদিন পরেই জানা যায় এই ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের কিছুই জানা ছিল না, অনুমোদন দেওয়া তো দূরের কথা। কথা হল সেদিন বিশাল পুলিশ বাহিনীর সামনে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাও নারী ছিলেন, এই বাগানটিই বংশপরম্পরায় এঁদের ঘর ছিল। কল্পকথার কৈলাশ পর্বত না হলেও কয়েক পুরুষ ধরে নিজেদের ঘাম, রক্তের বিনিময়ে তৈরী সেই ঘরের মাহাত্ম্যই বা কম কিসে।

আজকে ‘ঘরের মেয়ে’ ঘর শূন্য করে চলে যাচ্ছেন বলে যারা পাতার পর পাতা লিখছেন, সেদিন যে কেন অবাক নিস্তব্ধতায় তাঁরা এই রক্ত মাংসের মেয়েদের ঘরছাড়া করাকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরাই জানেন।

 শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোড়ে জোরে মাটির তৈরি প্রতিমা 'ঘরের মেয়ে'র স্থান পেয়ে যায় আর এই রক্তমাংসের মানুষগুলোর কপালে জোটে একরাশ বঞ্চনা ও অবহেলা।


এই পরিচিত্র কিন্তু শুধু এই শারদীয় দুর্গোৎসব বা দেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাসকারী মানুষের মধ্যেই সীমিত তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাট, কেরালা থেকে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, মানুষ ভিন্ন, আরাধ্য দেব-দেবী ভিন্ন কিন্তু কল্পকথার সেই আরাধ্য দেব-দেবীকে নিয়ে আবেগের যেমন শেষ হয় না, তেমনি রক্তমাংসের অসহায় মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনার প্রতি নির্বিকার, বীতস্পৃহ মনোভাবেরও বদল হয় না।   কোথাও বাঁধ, কোথাও মূর্তি, কোথাও খনি আবার কোথাও রেলপথের নামে এভাবেই শতসহস্র উমা, পার্বতীরা তাদের কৈলাশ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। পুজোর মণ্ডপে দেবী দুর্গার হাতে অসুরের মৃত্যু আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্য। পৌরাণিক কাহিনি মতে দেবী দুর্গা এখানে একাধারে নারীশক্তি ও শুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে অসুর অশুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। তবে ধর্মের ইতিহাস অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে। উজ্জ্বল বর্ণের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতা দুর্গা এখানে আক্রমণকারী, রণকৌশলী আর্য ও কৃষ্ণবর্ণের অসুর এখানে আদি ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আজকের সময়ের নিরিখে বিজয়া দশমীতে সেই পৌরাণিক কাহিনিকে পাথেয় করে 'অশুভশক্তির' ওপর 'শুভশক্তির' জয় উদযাপন করা হয়। অথচ তথাকথিত এই দেবীপক্ষ নিয়ে আমাদের বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে অনুষ্ঠানাদির বাইরে গিয়ে যদি দেখি, সেখানে কিন্তু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ধর্মীয় ইতিহাসের বারংবার পুনরাবৃত্তি।

সেখানে আজও ভূমিপুত্র, অনুন্নত, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা সমাজে ক্ষমতাবানদের আগ্রাসন লোভের  কাছে এভাবেই পরাভুত হন।

 তাদের কথা শোনার, তাদের দুঃখ বোঝার ইচ্ছা কারোর নেই। জায়গা বদলায়, সময় বদলায়, দৃশ্য বদলায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে এই অবিচারের কি কোনো প্রতিবাদ হয় না?  সাধারণ মানুষ বা অন্ততঃপক্ষে যারা দিনের পর দিন ধরে এভাবে অত্যাচারীত হয়ে আসছেন তারা কেন প্রতিবাদ করেন না। দেশে থানা আছে, আদালত আছে।  প্রশ্নের উত্তরটা হল সমসাময়িক সভ্যতা থেকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকা এই মানুষদের প্রতিবাদের 'অস্ত্র' বা 'রণকৌশল' সবই সেকেলে। 

তাদের কাছে থানা, আদালত কোনো কিছুই বিচার,  ভরসা দিতে পারে না। সংবাদমাধ্যমের কাছে এরা খুব বেশি মাত্রায় অচ্ছুৎ।

 

যদিও বা কোনোদিন, কোনোভাবে এই প্রান্তিকরা একান্ত নিরুপায় হয়ে তাদের প্রতি হয়ে আসা এই অবিচারের প্রতিবাদ করেন তখন  তাদের অবস্থা হয় অসুরের মতোই। মরতে তো তাদের হয়ই, উপরন্তু সমাজের সামনে সভ্যতার নিখাদ শত্রুর পরিচয়ও পেতে হয়। সংবাদমাধ্যম যেমন তাদের রাতারাতি জঙ্গি বানিয়ে দেয়, সরকার মাওবাদী তকমা দিয়ে দেয়। ধর্মীয় ইতিহাসের ভূমিপুত্র সেই অসুর প্রচারের ঠেলায় পৌরাণিক কাহিনীর সভ্যতা বিরোধী, নারীর অপমানকারী অসুর হয়ে যায়। আর যারা চরম স্বার্থপরতার প্রমাণ দিয়ে এই চরম অমানবিক কাজটি করে এরাই হয়ে ওঠে সমাজের কাছে সভ্যতার ধ্বজা বহনকারী অগ্রদূত। জ্ঞান ও চেতনার অভাবে আমরা, সাধারণ মানুষ এই অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের ওপর তাদের এই জয়কেই সভ্যতার জয় বলে মেনে নিই, সাড়ম্বরে উদযাপন করে আত্মতুষ্টি লাভ করি। 

রাহুল রায়, শিলচর।

অচলায়তন -মহম্মদ মহসীন
Nov. 23, 2024 | সমাজ | views:811 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সম্পর্কে না হলেও মেলামেশায় খুব কাছের আত্মীয়। আমার অবশ্য তার বাড়ি যাওয়া হয় না বহুদিন। তবে ওরা মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়ি  আসার ফুরসত পায়। আমার অনেক উপকারও করে দেয়।

 আসতে তাদের বেশ দেরি হলো। দেরি হওয়ার কারন হিসাবে পুজোর ভীড় বলতেই সে শোনালো এক কাহিনী। আমাদের জানা কাহিনী, কিন্তু সে বললে তার মনের মাধুরী মিলিয়ে মিশিয়ে পল্লবে পল্লবে জড়িয়ে, আপন রঙ ছিটিয়ে, ছড়িয়ে।

  দুর্গা কাহিনী। দুর্গা হল এক বারাঙ্গনা। আর্যরা ভারতবর্ষ দখল করতে এসে যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসাবে এদেশের আদি বাসিন্দাদের সম্মুখীন হলো। তাদের সাথে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারলো না।  কিন্তু এদের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু ব্যাপার স্যাপার জেনে গেল। এরা কোনো নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করে না। কাজেই তারা দুর্গাকে যুদ্ধে এগিয়ে দিয়ে নানান অস্ত্রের যোগান দিয়ে গেল। যারা সুরা পান করে তারা হলো সুর। আর যারা সুরা পান করেনা তারা হলো অসুর।

 মহিষী মানে রাণী, এ আমরা অনেকেই জানি, যেমন রাজমহিষী।

মহিষ মানে রাজা। অসুরদের রাজা হলো মহিষাসুর।

  তো সেই মহিষাসুরকে যখন মারতে এলো দুর্গা। রাজা তার সাথে যুদ্ধই করলো না, বীরের মৃত্যু বরণ করলো। 

 এই লজ্জার বিজয়কে কাপুরুষ জয়ীরা আজও এমন একটা প্রতিমা বানিয়ে উল্লাস করে। 

  এই প্রতিমার মূল কথা হলো যুদ্ধ জয়। 

 

তার কাহিনী শুনলাম। ভাবলাম, এই ব্যক্তিটি প্রতিদিন নামাজ পড়তে পারে, রমজানে সারামাস উপবাস করতে পারে, কিন্তু এর মাঝেও আছে কিছু যুক্তিশীল ধ্যানধারণা। কাজেই এর কাছে মুখ খোলা যেতে পারে। 

 আসলে বুঝিনি, ধার্মিক মানেই ধর্মান্ধ। সে বুঝবে যুক্তি?

  তাকে বললাম, দেখো ধর্ম ব্যাপারটাই এমন, ধার্মিকেরা তোমার মতো এতটা গভীর-গভীর বিষয়ের খোঁজই রাখে না। 

 এই আমাদের হজরত মোহাম্মদের কথাই ধরো না। একদিন ভোরবেলা বলে দিলেন গাধার চেয়ে একটু বড়, খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট প্রাণী বোরাকে চড়ে আকাশে উড়ে আল আকসা মসজিদে যান, মহাকাশ ভ্রমণ করেন, আকাশের ১নং গেট, ২নং গেট এইসব খুলে আল্লাহের সাথে দেখা করেন।

আগ্রহী পাঠকের জন্য,  মেরাজের গাল গল্পটি একটু বিশদে জানার জন্য  নিচে লিংক দেওয়া হল:-

রেফারেন্স : link

আবার  দেখো উইকিপিডিয়া বলছে, এক হাদিস মতে

ঐ রাতে তিনি উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন, আবার অন্য হাদিস মতে তিনি কাবা মসজিদে ঘুমাচ্ছিলেন।

 এখন দেখো দুই রকম কথা হচ্ছে, কাজেই এখানে দুটোই সত্য হতে পারে না, এর একটি তো অবশ্যই মিথ্যা। আর বোরাকের কথা তো মিথ্যাই। কারন প্রাণীবিজ্ঞানে এমন কোনো প্রাণীর কথা নেই যেটি মহাকাশে উড়তে পারে। পাখী ওড়ে বাতাসে। মহাকাশে সম্ভব নয়। এটা তো মোহাম্মদ স্পষ্টত মিথ্যাচার করেছেন।

কথা তখনও শেষ হয়নি। আমার সেই আত্মীয় তেড়ে এলো আমার দিকে, বললে, আর একটা কথা বলবেন না। তাহলে আমি কিন্তু কোনো রেয়াত করবো না।

আমার নবীজীর সম্বন্ধে যে কু-ইঙ্গিত করবে, মিথ্যাচারী বলবে তার ব্যবস্থা  করতে আমার এতটুকু আফসোস হবে না।

আমি প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, পরে  উপলব্ধি করতে পারলাম, এটিই স্বাভাবিক।

এরা প্রকৃতই অন্ধভক্ত।   যুক্তি বোঝে না। অন্য ধর্মের অলৌকিকতায় সমালোচনার সাইক্লোন বইয়ে দেয়, নিজ ধর্মের কথা এলেই অন্ধত্বের কুৎসিত নখ দাঁত বেরিয়ে আসে। 


  তবু শান্ত স্বরেই বললাম, সে নাহয় তুমি মারধোর করবে, কিন্তু কথাটা হলো,  হাতের কাছেই তো আছে, উইকিপিডিয়া,  দেখে নিতে পারো।   সে এসব দেখে ইমান অর্থাৎ মোহাম্মদের উপর বিশ্বাস নষ্ট করতে চায় না। আমাদের যাদের ইমান নষ্টের আশঙ্কা নেই, আমরা দেখে নিতে পারি তো। (লিঙ্ক: link….)  

 

 আমার আত্মীয় অবশ্য এসব দেখতেই চাইল না। তার বক্তব্য কাফেররা এসব লিখেছে। তারা শয়তানের অনুসারী। যারা মোহাম্মদের কথা বিশ্বাস করতো না, তাদের কাফের অর্থাৎ অবিশ্বাসী বলা হত। মোহাম্মদের এক কাকা আবু লাহাবও তার কথা বিশ্বাস করত না। আমার আত্মীয়টি বলে, এসব মিথ্যা হলে কোটি-কোটি লোক চুপ থাকতো? বললাম, মোহাম্মদকে উম্মেহানি এ কাহিনী বলতে নিষেধ করেছিল। আর কাফেররা তো শুনেই তৎক্ষণাৎ মিথ্যা বলেছিল। এমনকি মোহাম্মদের স্ত্রী আয়েশাও  মোহাম্মদ সশরীরে মহাকাশে যাওয়ার ঘটনাকে সত্য বলে মেনে নেন নি। উৎস: উইকি।

 “সারা পৃথিবী যখন সত্য বলে মেনে নেয়, সেখানে কয়েকজন কাফের মিথ্যা বললে কী যায় আসে?”

তাকে বোঝালাম, সত্য বলার জন্য লোকসংখ্যা নির্ভর করে না। হাজার লক্ষ কোটি লোকে সত্য সত্য বলে চিৎকার করলেও মিথ্যাটা সত্য হয়ে যায় না। সত্যটা হাজার লোকে বললেও সত্য, একজন বললেও সত্য।

  আর এ জগতে এক ধর্মের লোকের অন্য ধর্মে বিশ্বাস নেই। কাজেই কোরাণে তথা আল্লাহে বা মোহাম্মদে বিশ্বাসীর সংখ্যার চেয়ে অবিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশী। সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই এটি বলা যায়। কাজেই এই বিশ্বে অবিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশি, যদিও সংখ্যার উপর সত্য নির্ভর করে না। 

আরেকটি ঘটনার কথা বলি। 

 আমার এক দাদা আছেন। তিনি একটু বেশি রকমেরই ঠাকুরভক্ত। পেশায় তিনি ডাক্তার। এম.বি.বি.এস। 

 আমার সেই আত্মীয়ের গল্পটি, অর্থাৎ দুর্গার কাহিনী তার গ্রুপে পোষ্ট করলাম। আমার লেখাটি বেশ সাবধানতা নিয়েই লেখা। তাতে আমার নিজের কোনো কথা ছিল না। ছিল আনন্দবাজারে প্রকাশিত দাশাই পরব নিয়ে লেখা। এই পোষ্টটি করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রুপ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া  হয়। এটা তারা সহ্য করতে পারলেন না। বাজারে দেখা হলে বেশ উষ্মা সহ তক্কো (তর্ক বা বিতর্ক নয়)  করতে লাগলেন। শেষে আমার নামে রটালেন, আমি না কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর উস্কানি দিচ্ছি। 

 এই যে উগ্রতা, তার ভিত্তি হল অন্ধ ভক্তি, অন্ধবিশ্বাস। এখানে লেখাপড়ার কোনো প্রভাবই নেই। 

ধার্মিক মাত্রেই ধর্মে অন্ধ। সামজে একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।

  এক ধর্মের লোকের বুদ্ধিতে অন্য ধর্মের অবাস্তবতা,  অলৌকিকতা খুব সহজেই ধরা দেয়। ভক্তিতে অন্ধ হয়ে যান নিজ ধর্মের বিষয় এলেই। তখন একবার বাস্তবে আসেন, আবার পরক্ষণেই ভাব জগতে চলে যান।  নিজের অন্ধবিশ্বাস পোক্ত করার জন্য যেসব যুক্তির অবতারণা করেন, তা আসলে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যই, নিজেরা যে একেবারেই অন্ধ সেটাই জাহির করার জন্য।

  

    যাই হোক, এখানে এই সব কথা অবতারণার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হলো, এই সব ধার্মিক তথা ধর্মান্ধদের মধ্যে যুক্তিশীল মানসিকতা আনার কাজটা খুব-খুব কঠিন। এই দুরূহ কাজ তবু করে যেতে হবে। অন্ধকার কেটে একদিন আলো ফুটবেই। এ আশা, এ প্রত্যয় নিয়েই তো চলেছি আমরা।

ধৰ্ম, ঈশ্বর এবং নৈতিকতা -জাহিদ রুদ্র
Nov. 23, 2024 | যুক্তিবাদ | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধৰ্ম এবং ঈশ্বর বিশ্বাস প্রতিটা মানুষের একটা ব্যক্তিগত বিষয়৷ ধৰ্ম এবং ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস যে কেউ রাখতেই পারে অথবা না রাখতেও পারে, সেটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়৷ কিন্তু কথা হলো ধৰ্ম এবং ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি নয়! সহজাত কথাটা বলতে জন্মগতভাবে লাভ করা মানুষের বৈশিষ্ট্যকেই বোঝায়৷ উদাহরণ স্বরূপ: ক্ষুধা, রাগ, যৌন অভিলাষ ইত্যাদি প্ৰবৃত্তিগুলো সকলেরই থাকে৷ প্ৰাবল্য অথবা নিয়ন্ত্ৰণ কম বেশি হলেও এই সহজাত প্ৰবৃত্তিগুলো সকল সুস্থ মানুষের মধ্যে দেখা যায়৷ কিন্তু ঈশ্বরের বিশ্বাস করে না অথবা ঈশ্বরের চেতনার মধ্যে 

উপাসনা, ধৰ্মের উপর বিশ্বাস রাখাটা মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি নয়৷ মনোবিজ্ঞানের দিক থেকেও ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি রূপে গণ্য করা হয় না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঈশ্বর বিশ্বাসীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, এর মানে এটা নয় যে মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তিও কমে যাচ্ছে৷ যদি ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি নয় তবে এই ধারণা আসে কোথা থেকে?


একটা শিশুর জন্ম হয় নাস্তিক হিসেবে৷ সদ্যজাত শিশুটি এটুকুও বুঝতে পারে না যে তার ধৰ্ম কি আর ঈশ্বরও বা কি বস্তু? ঘরের পরিবেশ এবং সমাজ ব্যবস্থাই একটা শিশুকে ধৰ্মীয়করণ বা ঈশ্বর বিশ্বাসী হিসেবে বানিয়ে নিতে সহায়তা করে৷ তার ইচ্ছা, চাহিদা কে উপেক্ষা করে অৰ্থাৎ বাধ্য করানো হয়৷ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিশ্বাস নিয়ে ছোটবেলা থেকেই একটা পরিবেশের সৃষ্টি করা হয় যে শিশু অবস্থা থেকে মনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্ৰতি এমন একটা দৃঢ় ধারণা আঁকড়ে ধরে যা পরবর্তী সময়ে বহু কম সংখ্যকই এই বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে পারে৷ প্ৰতিটা শিশুই জন্মলগ্নে অনুসন্ধিৎসু হয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু তাদের অনুসন্ধিৎসু মনকে ধ্বংস করা হয় এভাবে -

ছোট্ট একটা শিশু তার বাবাকে যদি প্ৰশ্ন করে ‘বাবা, আমাদের পৃথিবী, মানুষ এসব কে সৃষ্টি করেছেন?

বাবার সহজ উত্তর: “সবকিছু, ঈশ্বরই”।

সে আবার জিজ্ঞেস করে “বাবা, এই ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন?”

বাবা, বিরক্তিকর উত্তর: “কেন একটার পেছনে লেগে আছিস’? বুঝবে না বাবা, এগুলো বলতে নেই, ঈশ্বর খারাপ ভাবেন ৷”


মন্দিরে প্ৰণাম- প্ৰাৰ্থনা, মসজিদে নামাজ, জিকির বা চার্চে গডের সম্মুখে প্রে করতেই হবে।

ঈশ্বর-আল্লাহ-গডের গুণকীৰ্তনের মধ্য দিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর নামের কাল্পনিক ধারণা বিভিন্ন ভাবে মানুষের মনে এভাবে মিশিয়ে দেয়া হয় যে জীবনের পরবর্তী সময়ে এর থেকে মুক্ত হওয়ার প্ৰবণতা ক্ষীণ হয়ে পড়ে৷

 এভাবেই মানুষের মনে ঈশ্বরের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রবেশ করে ঈশ্বর এবং ধৰ্মের ভয় দেখিয়ে ভালো হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। ধৰ্ম এবং ঈশ্বর বিশ্বাসের ভয় মানুষকে সৎ পথে আনার হাজার বছরের যে বৌদ্ধিক প্ৰক্ৰিয়া, সেই প্ৰক্ৰিয়ায় যে ব্যৰ্থতা রয়েছে তা বহু সময়ে বহু ভাবে আমাদের উপলব্ধি ও প্রমাণিত হয়েছে৷ এই ধরনের প্ৰক্ৰিয়ার বিফলতাই সৃষ্টি করেছিল ‘রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের নামে হত্যা আর হিংসা। এইধরনের প্ৰক্ৰিয়ার বিফলতার জন্যই ধৰ্মীয় ধারণার বিপরীতে কথা বলা জিওৰ্দানো ব্ৰুনোকে জ্বালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল৷ এই প্ৰক্ৰিয়ার বিফলতাই সৃষ্টি করেছে ইসলামিক মৌলবাদের, আফগানিস্তান,ইরান, সহ মুসলিম বিশ্বে চলছে ধর্মযুদ্ধ,নারী নির্যাতন, অশান্তি৷ এতসব ঐতিহাসিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও, যারা ধর্মে নৈতিকতা এবং ঈশ্বরের ভয় শেখায়, তারা কি সন্ত্রাসীদের ঈশ্বর এবং ধার্মিকদের ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে?


ধৰ্ম এবং ঈশ্বরের নামেই তো চারিদিকে চলছে হত্যা-হিংসা, সন্ত্ৰাস৷ একটা ধৰ্মের উপর অন্য একটা ধৰ্মের আক্ৰমণ, হুংকার৷ এই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠেছে আধুনিক চাঁদাবাজি সংস্কৃতিরও৷ ধৰ্মের রোষানলে উঠে পড়ে লেগেছে রাজনীতির বিষবাষ্প! ধৰ্ম রক্ষার নামে অলি-গলিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান৷ তথাপিও কমছে কি হত্যা-হিংসার জেনোসাইড? ধাৰ্মিক হওয়ার প্ৰতিযোগিতায় কোনো ধাৰ্মিক ঘুষখোর বা অসৎ উপায়ে পাওয়া টাকা দিয়ে সমাজে প্ৰতিপত্তিশীল দেখাবার জন্য দান খয়রাত করছে মন্দির, মসজিদে৷ আর ঐশী আবেগ বা অনুভূতিতে আল্লাহর নামে আত্মঘাতী বোমারু নিয়ে হচ্ছে অগ্রসর৷ ধৰ্ম, ঈশ্বর এবং আধ্যাত্মিকতাতেই এইসকল মানুষকে কেন নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয়না? সন্ত্ৰাসবাদী এবং বিভিন্ন কেলেংকারীতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা এই মানুষগুলোকে জিজ্ঞাসা করা হলে ঠিকই বলবে ঈশ্বরের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। কোনো ধাৰ্মিক বা 

ধৰ্ম প্ৰচারক হয়তো বলবেন ঈশ্বরের প্ৰতি আস্থা না থাকার দরুণ এহেন অপকৰ্মে হয়তো লিপ্ত হয়েছে৷ কিন্তু তার প্ৰমাণ কি করতে পারবেন?

এখানে বিগত দিনের ‘দ্যা টেলিগ্ৰাফ’ পত্রিকায় প্ৰকাশিত খবরের কথা মনে পড়ে গেল৷ ইংল্যাণ্ড থেকে প্ৰকাশিত বিখ্যাত ‘দ্যা টেলিগ্ৰাফ‌’ (২২ মাৰ্চ, ২০১৬) পত্রিকায় প্ৰকাশিত খবর অনুযায়ী নেদারল্যান্ডে অপরাধের মাত্ৰা এতোই হ্ৰাস পেয়েছিল সেদেশে পাঁচটা জেলখানায় ১৩,০০০ টা কোঠা শূণ্য হয়ে পড়েছিল। সেইজন্য এই পাঁচটা কারাগার বন্ধ হয়ে থাকাটাও স্বাভাবিক। যার ফলে কারাগারে কর্মচারীদের চাকরির স্থায়িত্ব সংক্ৰান্তে প্ৰশ্নবোধক চিহ্নে এসে ছিল৷ আকৰ্ষণীয় কথা হলো দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮৩% মানুষই নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী৷ কেবল মাত্ৰ ১৭% মানুষ ধৰ্ম কিম্বা ঈশ্বর-বিশ্বাসী। অন্যদিকে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্ৰের মোট জনসংখ্যার ৯০% মানুষ আস্তিক; ধৰ্ম এবং ঈশ্বরের উপর তাদের অটল আস্থা। কিন্তু বি.বি.সি.-র দেয়া তথ্য অনুসারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্ৰে মোট জেলবন্দীর সংখ্যা প্ৰায় বিশ লক্ষেরও অধিক৷ এদিকে নেদারল্যাণ্ডে অপরাধীর অভাবে কারাগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল৷ অপরদিকে সমস্ত আমেরিকার কারাগারের প্ৰায় একশো শতাংশ কোঠাই অপরাধীদের দ্বারা পূৰ্ণ হয়ে আছে। সেইজন্য নাস্তিকের সংখ্যাধিক্য থাকা দেশ থেকে, ধৰ্ম এবং ঈশ্বরের প্রতি আস্থাশীল লোকের গিজগিজ করতে থাকা আমেরিকাতে অপরাধের মাত্ৰা বেশি!

বিজ্ঞানের বলে আমরা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে নতুন দৃষ্টিভংগীতে দেখতে সক্ষম হয়েছি৷ কিন্তু বিজ্ঞান কখনও জিজ্ঞেস করে নাই যে ঈশ্বর আছেন না নাই! বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই প্ৰশ্ন গুরুত্বহীন৷ আদিম কাল থেকেই মানব সভ্যতা দুটা বড় প্ৰশ্নের মুখামুখি হয়ে আসছে৷ একটা হলো ‘কিভাবে’ এবং অন্যটি ’কেন’৷ যে ’কিভাবে’ এই প্ৰশ্নের উত্তর সন্ধানে লাগলো তাঁরা বিজ্ঞান জগতে প্রবেশ করলো আর যে ’কেন’ প্ৰশ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো, তাঁদের একটা সময়ে স্তব্ধ হতে হলো৷ যেখানে তথ্যের অভাব ছিল অৰ্থাৎ মানুষের সীমাবদ্ধতা বা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছিল৷ যার ফলে ঈশ্বরের নামে অলৌকিক শক্তির ধারণাটি এসে দাঁড়ালো৷ সেইজন্য ঈশ্বরের বিপক্ষে আর কোনো প্ৰশ্নের স্থান নেই৷ আর জিজ্ঞাসা বা অনুসন্ধান সেখানে স্তব্ধ হয়ে পড়লো।


ঈশ্বর হচ্ছে মানুষের মনের সৃষ্টি৷ প্ৰাকৃতিক পৰ্যবেক্ষণের পর কল্পনায় কিছু কথা সংযোজন করলেই ‘ঈশ্বর’র মতো কোন এক ধারণার সৃষ্টি হয়৷

 ভারতের অৰ্থাৎ সিন্ধু উপত্যকার ঈশ্বরসমূহের কাল্পনিক রূপসমূহ যদি দেখা যায় তবে লক্ষণীয় যে তাদের সাদৃশ্য ভারতীয়দের সঙ্গে রিলেটেড ৷ অৰ্থাৎ দেবী দূৰ্গার কাল্পনিক রূপটিতে যেভাবে আলঙ্কারিক সৌন্দৰ্যে আৰ্য দেবী হিসেবে অঙ্কন করা হয়েছে ঠিক সেইভাবে বাঘের ছাল, অৰ্ধ উলংগ একজন অনাৰ্য দেবতা হিসেবে শিবের চিত্ৰরূপ দেয়া হয়েছে৷ ঠিক সেইভাবে আফ্ৰিকা বা গ্ৰীসে দেবতাদের যদি দেখা হয় সেই কাল্পনিক রূপ সমূহ আফ্ৰিকা বা গ্ৰীসের মানুষের সঙ্গে মিল দেখা যায়৷ এই কাল্পনিক ঈশ্বরকে কেন্দ্ৰ করে পৃথিবীর সৰ্বাধিক ধৰ্মের সৃষ্টি হয়েছে৷ যেগুলো ধৰ্ম বেশি প্ৰাচীন সেখানে ঈশ্বরের বিভাগের কথা বলার বিপরীতে তুলনামূলকভাবে নতুন ধৰ্ম (খ্ৰীষ্টান, ইসলাম, প্রমুখ) এবং পুরানো ধৰ্মের সংশোধনী হিসেবে একজন ঈশ্বরের ধারণা দেয়া হয়েছে।


দেখা যায় একজন বিজ্ঞানী আস্তিক হলে, এই বিজ্ঞানী বহু আস্তিকের উদাহরণ হয়ে উঠেন ৷ ঈশ্বর, ধৰ্ম বিশ্বাসের কথা আসলে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রীধারী বা প্ৰফেশনাল ডিগ্ৰীধারী মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে প্ৰতিষ্ঠা করতে দেখা যায়৷ কিন্তু কথা হলো প্ৰফেশনাল ডিগ্ৰীর সাথে একজনের চিন্তাধারার মানসিকতা সর্বদা সমানুপাতিক নাও হতে পারে৷ অৰ্থাৎ একজন ভালো উচ্চ-শিক্ষিত মানুষের চিন্তাধারার থেকেও কখনও একজন অশিক্ষিত মানুষের ভালো চিন্তা, ভালো আদৰ্শ হতে পারে৷ তদুপরি বহুজনের প্ৰশ্ন বা যুক্তি, যদি ঈশ্বর অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীতে তবে কেন বেশি ঈশ্বর বিশ্বাসী? এই প্ৰশ্নের উত্তর একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়ে কিছু উপলব্ধি করতে পারি৷ আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেছিল যে পৃথিবী স্থির অৰ্থাৎ সূৰ্যই পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে৷ সেইমতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাও দেয়া হয়েছিল৷ হাজার হাজার বছর ধরে সেই ধারণা মানুষের মধ্যে প্ৰচলিত ছিল৷ কিন্তু সেইসময়ত জিওনাৰ্ড ব্ৰুনো, কোপাৰ্নিকাস, গেলিলিওকে মুখ্য করে যুক্তিবাদী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এই ধারণার বিরোধিতা করেছিল৷ যার জন্য তাদেরকে বিভিন্নভাবে শাস্তি প্ৰদান করা হয়েছিল৷ কিন্তু বৰ্তমান সময়ে পূৰ্বের ধারণার বিপরীতে সূৰ্যকেন্দ্ৰিক ধারণার বৈজ্ঞানিক সত্য রূপ মেনে নিয়েছি! সেইজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিশ্বাস মানেই বৈজ্ঞানিক প্ৰমাণ নাও হতে পারে। আস্তিকের সংখ্যা থেকে নাস্তিক, নিরশ্বরবাদী বা অজ্ঞেয়বাদীর সংখ্যা পৃথিবীতে বহু পরিমাণে কম যদিও বিগত দশক থেকে বহু দেশে নাস্তিক বা মুক্তমনা মানুষের সংখ্যা দ্ৰুত বৃদ্ধির বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্ৰতিবেদন দেখা গেছে৷


কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করেন যে একজন ব্যক্তি যে ঈশ্বর বা ধর্মকে মানে না সে “বিশৃঙ্খল, অহংকারী, অনৈতিক, অমানবিক।নৈতিকতা এবং ধর্ম-বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করা অনেকের মনে জাগা এটি স্বাভাবিক প্রশ্ন ৷

কিন্তু ঈশ্বর বা ধৰ্মের ভয় দেখিয়ে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া একটা অবৈজ্ঞানিক ধারণা।

নৈতিকতা মানে শুধু ঈশ্বরের বিশ্বাস নয় অথবা ঈশ্বরকে কেন্দ্ৰ করে তৈরি করা কোনো ধৰ্মাচরণও নয়৷ নৈতিকতা মানে সকাল-বিকেল ঈশ্বরের গুণকীৰ্তন করা নয়৷ নৈতিকতা মানে কোনো ধৰ্মের ধর্মীয় রীতিনীতির উপর আস্থা রেখে ভক্তিভাব নয়৷ নৈতিকতা হল সাধারণ নিয়ম ও প্রবিধানের সমষ্টি যা কারো ক্ষতি না করে নিজের এবং সমাজের উপকার করা৷ উচ্চ-নীচ, হিন্দু মুসলমান সকল জাতি-ধৰ্মের মানুষ সমান মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার মানসিকতাই হচ্ছে নৈতিকতা৷ নৈতিকতা হল এই ধারণা যে ঘুষ না নিয়ে কিছু সঠিক কাজ করা ৷ নৈতিকতা হল হৃদয়ে উপলব্ধি করা যে আমার নিজের স্বার্থে সমাজে অন্যদের ক্ষতি না করা৷ কারো কোন ক্ষতি না করা, চুরি না করা এবং সবার সাথে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখতে কোন ধর্মের প্রয়োজন নেই৷ এই ন্যূনতম নৈতিকতা পশুর মধ্যে ও দেখা যায়৷ নৈতিকতা এবং ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়৷ নৈতিকতা এসেছে মানুষের সমাজের জন্য নিজে তৈরী করে নেয়া কিছু সমাজনীতি থেকে৷ সেইজন্য নৈতিকতা সমাজে নীতির সঙ্গে জড়িত শব্দ৷ সমাজ ছাড়া অন্য প্রাণীদের কোনো কৃত্রিম নৈতিকতা নেই৷ নৈতিকতা যেহেতু সমাজ নীতির সঙ্গে জড়িত শব্দ, অনেকেই ঈশ্বর বিশ্বাস, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতাকে সমাজনীতির অংশে নৈতিকতার অধীনে নিয়ে আসেন ৷ কিন্তু ধৰ্ম, ঈশ্বর এবং আধ্যাত্মিকতাকে সমাজনীতির অধীনে এনে নৈতিকতার মৰ্যাদা দিলে কখনো কখনো এর পরিণতি হয় ভয়াবহ৷ এই ধরনের নীতি থেকে উদ্ভূত নৈতিকতা মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণ বা মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের পক্ষে। এই ধরনের নীতি থেকে সৃষ্ট নৈতিকতা আবার রাম রহিমের মতো ধর্মীয় নেতাদের জন্ম দিতে পারে।


ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস (World Happiness Report) রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রসংঘ দ্বারা পরিচালিত একটি বার্ষিক জরিপে দেখায় যে ধর্ম এবং ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। দেশসমূহের জরিপে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, মানবাধিকার এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সহ আরও অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের ১৫৬টি দেশের জরিপ অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং নরওয়ে এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, ভারত 140 তম স্থানে রয়েছে৷মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ ধর্মীয় দেশ রয়েছে ৫০ এর নীচে৷ ঠিক সেইভাবে Institute for Economics and Peace (IEP)র তত্ত্বাবধানে সমীক্ষা চালিয়ে ২০১৮ সনের Global Peace Indexর প্ৰতিবেদনে ভারতের সুখী সূচকে একটি বিভ্রান্তিকর জায়গায়! 

মজার ব্যাপার হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর জোর দেয় এমন লোকে ভরা একটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সুখের সম্পর্ক বিপরীত। এর মানে হল যে দেশগুলিতে বেশি সংখ্যক মানুষ যারা ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করে তাদের সুখের স্তর নিম্নতর হয়,

 যেখানে কম সংখ্যক মানুষ যারা ঈশ্বর এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের সুখের স্তর বেশি। প্রতিবেদনে শীর্ষ পাঁচটি দেশে স্বঘোষিত নাস্তিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষে পরিপূর্ণ দেশগুলোতে মানুষের মধ্যে খুন-হানাহানি বেশি হওয়া উচিত ছিল বলে প্রচলিত ধারণা! কিন্তু কেন এমন দেশগুলো বেশি সুখী? যদিও পরিসংখ্যান একটি সম্পূর্ণ উপসংহার টানতে পারেনি যে ঈশ্বর বা ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে অপরাধ করতে প্ররোচিত করে, আমরা এই ধরনের পরিসংখ্যান থেকে একটি যৌক্তিক উপসংহার টানতে পারি যে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস অপরাধ থেকে মানুষের সিংহভাগকে দূরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে! 

‘মেঘনাথ’ থেকে ‘মেঘনাদ’ -পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 23, 2024 | জীবনী | views:9741 | likes:3 | share: 2 | comments:0

হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি বিদ্বেষে নিজের নাম বদলে ফেলেছিলেন মেঘনাদ সাহা।

আজ ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার পথিকৃত মেঘনাদ সাহার ১২৯ তম জন্ম বার্ষিকী। তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ‘তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত ‘সাহা আয়নীভবন সমীকরণ’ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয় - সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে ক’জন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর - অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম।

 ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার ‘তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ’ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। নরওয়ের বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত ‘থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোফিজিক্স’ বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এ’কথা। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে - সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্স সহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সাথে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সাথে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য।

গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান - সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাশ করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয় - ক্রমশঃ পৌঁছে গেছেন এই বিষয়ের শিখরে। 

উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয় মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও থেমে থাকেননি  তিনি।

 সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, সে-বছরও পাঁজিতে ছিল অক্টোবরের আকাশ জুড়ে মেঘ, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। এই ৬ অক্টোবর ঢাকার বংশাই নদীর ধারে শ্যাওড়াতলি গ্রামে জগন্নাথ সাহার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হল। জগন্নাথ সাহা মুদির দোকানি ও হাঁটুরে ব্যবসায়ী, অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। তবুও কিন্তু এই প্রথম তাঁর সন্তান হচ্ছে না, এর আগে স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দুই ছেলে, দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। এদিন প্রসববেদনা উঠতেই গ্রামের ধাই এসে হাজির, সেকালে বসতঘরের বাইরে আলাদা করে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আঁতুড়ঘর তৈরি করা হতো, তো, সেই ঘরে ভুবনেশ্বরীকে আনা হল। আর তখনই আকাশ উথালপাথাল করে বজ্রবিদ্যুৎ গায়ে মেখে শুরু হল ঝড়। ঝড়ের দাপটে উড়ে গেল আঁতুড়ঘরের খড়ের চাল। সেই বজ্রনির্ঘোষ ঘনঘটার মধ্যেই জন্ম হল ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার। ঝড়-বাদলা-মেঘ নিয়ে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাকুমা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মেঘনাথ’। কিন্তু পরে স্কুলের খাতায় তাঁর এই নাম ঠিক করে রাখা হয় ‘মেঘনাদ’। পরবর্তীকালে মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর সব চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল নায়ক ‘মেঘনাদ’। এই প্রিয় হয়ে ওঠাটা শুধু নামের মিলের জন্য নয়, নায়ক মেঘনাদের জেদ, অনমনীয়তা ও বীরত্বের জন্য।

বাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না, বলা ভালো জীবনে যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা প্রয়োজন আছে এমন কোন ভাবনাই ছিল না জগন্নাথের। মুদির ছেলে মুদি হবে, তিনি বুড়ো হলে ছেলেরা তাঁর মতো ব্যবসা সামলাবে, এটাই তো ভবিতব্য, এর আর ভাবাভাবির কী আছে! কাজেই বড়ছেলে জয়নাথের মেট্রিকের গণ্ডি আর পেরনো হল না। ঢাকায় ছুটতে হল ব্যবসায়ীর গদিতে ব্যবসার কাজ শিখতে আর খিদমত খাটতে। মেঘনাদের কপালে এই ভবিতব্যই নাচছিল। পরিবেশে, পরিবারে কোথাও পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল না, উৎসাহ দেওয়ারও কেউ ছিল না, তবু পড়ুয়ার স্বভাব নিয়ে কেমন করে যেন জন্ম নিয়েছিলেন মেঘনাদ। পড়তে না পেলে তিনি কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। পড়ার জন্য খুব ভোরে উঠতেন। এসময় ভোররাত্তিরে জোরে জোরে পড়তে গিয়ে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মারও খেয়েছেন অনেকবার। তবুও, পড়াশোনা থেকে কেউ তাঁর মুখ ফেরাতে পারেনি। এই রকম একটি পরিবেশ থেকেই শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেশক্তির প্রবলতায় উঠে এসেছিলেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা।

বাবা জগন্নাথ সাহা ও মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান ছিলেন মেঘনাদ। জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি। ছোটবেলা থেকেই তাই রীতিমতো আর্থিক অনটেনর মধ্যে তাকে মানুষ হতে হয়েছিল। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়। গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনও সুযোগ ছিল না৷ কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় তা সফল হয়।

ছোটবেলায় গ্রামের সরস্বতী পুজোয় তিনি দেবীর কাছাকাছি চলে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে এক নির্বোধ গোঁড়া পুরুতের কাছে চরম অপমানিত হয়েছিলেন।

 নিম্নজাতের ধুয়ো তুলে তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে সমস্ত দেবদেবীর পুজোর ওপর তিনি শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন, এমনকি বিদ্যার দেবীর ওপরেও, কিন্তু বিদ্যার ওপরে নয়।

কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গিয়েছিল সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। মেঘনাদের ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের ভাবগতিক এমনই ছিল। এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল মেঘনাদের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে। 

সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বৈদিক ধর্মের প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা সামাজিক বিভেদের প্রতি বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে তিনি পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন।

 ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা জানিয়েছিলেন, যে দিন তাঁর বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

তিনি নাস্তিক হলেও, সেই নাস্তিকতা শুধুই অপমান থেকে আসেনি, এসেছিল জ্ঞান থেকে। তিনি সমস্ত ধর্মের বই আত্মস্থ করে তারপর বিজ্ঞানের স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছেন, ধর্মের পরস্পরবিরোধী দর্শন নিয়ে নয়।

 তাই আমাদের দীর্ঘদিনের পঞ্জিকার অনুমানমূলক জ্যোতিষগণনার পরিবর্তে তাতে জ্যোতির্বিদ্যার প্রবেশ ঘটিয়ে পঞ্জিকা সংস্কার করেন। বিশ্ববিজ্ঞানের সব কিছুই বেদে আছে, এই কথা যে বেদবাদীরা বলেন, তাঁদের বিরোধীতা করায় চরম প্রতিবাদের মুখে পড়েন মেঘনাদ, কিন্তু তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিজ্ঞান আর দর্শন কখনই এক নয়, হতে পারে না। মাইকেলের কাব্যের নায়ক মেঘনাদের মতই কোনদিনই কোন চাপের কাছে, কোন বিরুদ্ধতার কাছে মাথা নত করেননি তিনি।

এরপর তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায়। সে সময় মাসিক ৪ টাকার সরকারি বৃত্তি পান, বৃত্তির টাকা ও জয়নাথের পাঠানো পাঁচ টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ভর্তি হন। এরপর বৈশ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তিও তিনি লাভ করেন।

এদিকে সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার আসবেন শুনে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তার সম্মুখে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল করবে নির্ধারণ করে। সে মিছিলে মেঘনাদও যোগ দেন। ফলে পরদিন তাকে স্বদেশী আন্দোলন এ জড়িত থাকার জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পাশাপাশি তার সরকারী বৃত্তিও বাতিল করা হয়।


পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে মেঘনাদকে তাদের স্কুলে ভর্তি বিনাবেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন।

সহপাঠি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও উপরের শ্রেণির প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ, আচার্য হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন।

১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি করেন এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন।

মেঘনাদ তার সমস্ত গবেষণা ফলাফল গুলো একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রি প্রদান করে। একইবছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার সুযোগ পান।

১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কলেজ চালু করার পর সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ উভয়েই গণিত বিভাগের যোগ দিতে বলেন দেন। যদিও পরবর্তী কালে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে পরবর্তীতে যোগ দেন। এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লণ্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। দুইবছর ধরে দেশের বাইরে গবেষণা করার পর মেঘমাদ সাহা ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ সেসময় না থাকায় তিনি ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতবিদ অমিয় চরন ব্যানার্জি এর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৫ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। এরপর তিনি মারা যাবার আগে অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে দ্বায়িত্বপালন করেছেন।

১৯১৭ সাল। ব্রিটিশশাসিত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড চেম্সফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন স্থাপন করলেন। কমিশনের প্রধান হিসেবে বসানো হল এম ই স্যাডলারকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন কেমন চলছে তার রিপোর্ট তৈরি করাই স্যাডলারের দায়িত্ব। যদিও কমিশনের আসল উদ্দেশ্য অন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে নজর রাখা। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রিটিশ সরকারের চোখে বিপ্লবী তৈরির আখড়া। স্যাডলার একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট ৬৭১ জনকে বিলি করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আরও দাবিদাওয়া আলাদা করে লিখে জানানো যাবে। স্যাডলার জানতেন, উত্তরপত্রে কড়া নজর থাকবে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের।

উত্তরদাতাদের মধ্যে একজনের উত্তরপত্র ছিল বেশ দীর্ঘ। পঠনপাঠনের সমস্যা ছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যময় পরিবেশের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। উত্তরপত্রে লেখা ছিল, “যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় তা হলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণির (আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণি বলে অভিহিত করছি, যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বলা হয়) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্রেরা। কোনও গণতান্ত্রিক শ্রেণির ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র এক ঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয়।” উত্তরদাতা বছর কুড়ির এক লেকচারার মেঘনাদ সাহা। মাত্র দু’বছর আগে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন এবং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছেন।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টে মেঘনাদ সাহার মতোই পিছিয়ে পড়া বা ‘নিচু জাত’-এর ছাত্রদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। কিন্তু তাঁর ও মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদি পার্থক্য ছিল, যা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর রিপোর্টে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্য আলাদা আর্থিক তহবিল গড়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। 

শীলের রিপোর্টে যুগ্গি, বারিক, সুবর্ণবণিক, নমঃশূদ্র, সাহাদের ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ বা কোথাও ‘লোয়ার কাস্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

 সেখানে মেঘনাদের রিপোর্টে এরা প্রত্যেকেই এক ছাতার তলায়, গণতান্ত্রিক শ্রেণি। নিজের রিপোর্টে পৃথক তহবিল গড়ে তোলাকে একদমই প্রশ্রয় দেননি মেঘনাদ। তিনি সবার সমান অধিকারের প3ক্ষে। মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বর্তমান ভর্তুকিপুষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সরাসরি বিপক্ষে। তিনি সেই সময়েই বুঝেছিলেন, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভেদ টেনে এবং ভর্তুকি দিয়ে কোনও এক বিশেষ শ্রেণির উন্নতির সম্ভাবনাকে মেরে ফেলায় দেশের সত্যিকারের উন্নতি সম্ভব নয়। 

২৮ বছর পরে, দেশভাগের সময়েও মেঘনাদ সাহার গলায় ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টেরই সুর। তখন তিনি আর ২০ বছরের লেকচারার নন। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। কিন্তু ল্যাবরেটরির বাইরে এসেও তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর সাম্যের গান। স্বাধীনতার বছর দুই আগে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকায় মেঘনাদ লেখেন, “দেশভাগের ফলে ভারতে থাকা মুসলমানরা হিন্দুরাজের পদদলিত হয়ে থাকবে এবং সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত হবে বলেই মনে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকেও একটা কড়া জাতীয়তাবাদের রেখা দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হবে, যা সংখ্যালঘু শ্রেণির মধ্যে ডেকে আনবে সীমাহীন দারিদ্র্য।” পরের বছর ফের একই পত্রিকায় লেখেন, 

“সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে, অশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে হলে, রোগ-জরা-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।”

 ‘আওয়ার ন্যাশনাল ক্রাইসিস’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে মেঘনাদের মূল বক্তব্য ছিল, সবাইকে কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না। 

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি' নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে।

এই ভুল সংশোধন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু। তাদের এই অনূদিত প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।

১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেন।

নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি “আবিষ্কার” নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।

 মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারও মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে৷

তিনি ভারতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে আধুনিক গবেষণার জন্য ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য ১৯২৭ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটি তাকে এফআরএস নির্বাচিত করে।


তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে 'তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব' প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত 'সাহা আয়নীভবন সমীকরণ' নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

তিনি ও তার সহপাঠী এবং সহকর্মী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের 'স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' জার্মান থেকে ইংরাজি অনুবাদ করেন যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ভারতের নদী নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ভারতে পদার্থবিদ্যার বিকাশ ও প্রসারের জন্য ১৯৩১ সালে 'ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া' প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও ১৯৩৪ সালে ভারতে পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন 'ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি'ও প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগেই ভারতে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব সায়েন্স' এর সূচনা হয়, যা বর্তমানে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি' (আই. আই. টি.) নামে বর্তমানে পরিচিত।

১৯৫২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে ভারতীয় লোকসভার কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র (বর্তমানে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র) হতে নির্বাচিত সাংসদ হন।

কিন্তু কেমন ছিলেন ব্যক্তি মেঘনাদ? তাঁর ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায়, স্পষ্টবক্তা হিসেবে ‘কুখ্যাতি’ ছিল মেঘনাদের। আসলে কাজের জায়গায় কোনও রকম কুঁড়েমি তিনি পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা তাঁকে ভয় পেত। 

কিন্তু কড়া শিক্ষকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এক ছাত্রদরদি নরম মনের মানুষ। ব্রজেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়,

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় জাপানি বোমাতঙ্ক ছড়িয়েছে, অধ্যাপক সাহার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। সকালে চা খেয়ে পড়াশোনা, গবেষণার কাজ শুরু করায় অভ্যস্ত ছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। কিন্তু অধ্যাপক সাহার বাড়ির রান্নার লোক অনেকটাই দেরি করে আসতেন। ছাত্রের অসুবিধের কথা ভেবে নিজে হাতে চা তৈরি করে খাওয়াতেন তিনি। তবে হঠাৎ করে রেগে যাওয়াও ছিল মেঘনাদের স্বভাবের একটি অঙ্গ। আসলে, অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী মানুষটি সারা জীবনই বঞ্চনা ও গঞ্জনার শিকার - যা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর স্বভাবেও। এমনকি নিজের বিবাহেও সহ্য করতে হয়েছিল গঞ্জনা। 

মেঘনাদ সাহার বউমা বিশ্ববাণী সাহার লেখা থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালে রাধারাণী রায়ের সঙ্গে বিবাহ হয় মেঘনাদের। বিয়েতে তাঁর পাঞ্জাবির তলা দিয়ে ছেঁড়া গেঞ্জি দেখা যাচ্ছিল। পাত্রের দুর্দশা দেখে বিয়েতে প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন রাধারাণীর ঠাকুমা। আসলে গবেষণায় মগ্ন মানুষটি তখনও জীবনে বিশেষ টাকাকড়ি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বিদ্যাচর্চায় খামতি থাকেনি। গবেষণাগার থেকে ফিরেও বইয়ের জগতে ডুবে যেতেই পছন্দ করতেন। বাড়িতে ছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। 

মেঘনাদ সাহার তৃতীয় কন্যা চিত্রা রায় জানিয়েছেন, অধ্যাপক সাহা যখন গবেষণার কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতেন, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’ থেকে পড়ে শোনাতে হত তাঁকে। অধ্যাপক সাহার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে জায়গা পেয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের বিশাল সম্ভার - যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাক্সিম গোর্কি, নুট হামসুন, লিয়ো টলস্টয়ের লেখা বইপত্র। অধ্যাপক সাহার এই সাহিত্যপ্রেম দানা বেঁধেছিল ইলাহাবাদে থাকাকালীন। ইলাহাবাদে সেই সময়ে একটা বাংলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যমণি ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছিলেন যোগেনচন্দ্র গুপ্ত। এঁদের সান্নিধ্য অধ্যাপক সাহার কাছে ছিল বিজ্ঞান ও রাজনীতির বাইরে এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতো। সাহিত্য পাঠ ও চর্চা ছাড়াও দেশবিদেশের পত্রিকা সংগ্রহে তাঁর উৎসাহ ছিল। বাড়ির ছোটদের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ম্যাগাজ়িন থেকে বিভিন্ন ছবি দেখাতেন, অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি পড়ে শোনাতেন। ছোটদের জন্য কলমও ধরেছিলেন কয়েক বার, যা প্রকাশিত হয় যোগেনচন্দ্র গুপ্তের ‘শিশুভারতী’ পত্রিকায়। সাহিত্য ছাড়াও অধ্যাপক সাহা উৎসাহী ছিলেন ভাষাতত্ত্ব চর্চায়। বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আকর্ষণের সূত্রপাত ঢাকার স্কুল থেকে। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশন আয়োজিত এক পরীক্ষায় তিনি সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে জার্মান ভাষার সঙ্গে পরিচয়। এর পরে সারা জীবনই যখন সুযোগ পেয়েছেন বিভিন্ন ভাষা চর্চা করে গিয়েছেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজা শঙ্কর গুহর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাষা চর্চা করতেন নিয়মিত। সেই বিষয়ে একাধিক বই সংগ্রহ করাটাও তাঁর নেশা ছিল। 

‘দেশ’ পত্রিকাকে (১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিত ডেভিড ডিভরকিন জানিয়েছিলেন, মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ়ের জন্য মনোনীত করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯২৭-এর পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটন। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় ভাটা পড়ার কারণেই হোক বা দেশীয় বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায়, নোবেল প্রাইজ় তিনি পাননি। তাঁর জীবনযাপনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষীও ছিলেন না তিনি। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে জাতিভেদ, অসাম্যকে জয় করা এবং তথাকথিত উঁচু তলার মানুষদের তৈরি করা বিভাজন রেখাকে মুছে ফেলা। আমৃত্যু সেই কাজটাই করে গিয়েছেন মেঘনাদ নিষ্ঠার সঙ্গে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞান সংগঠক মেঘনাদকে না পেলে ভারত বিজ্ঞান গবেষণায় সাবালক হয়ে উঠত না।

কংগ্রেসের চরকা কাটার নীতির বিরোধিতার কারণে দেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না, যা বাধা সৃষ্টি করেছিল মেঘনাদ সাহার কর্মকাণ্ডে। স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকারের পারমাণবিক শক্তি কমিশনেও তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংগঠক হিসেবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করা, প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরিও তাঁর সাহসী পদক্ষেপের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়াও দেশীয় উপাদানে নিজের বিটা স্পেকট্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক সাহা, যার সাহায্যে ভারতীয় খনিজ পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা জরিপ করা, এ দেশে জীববিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্রিক বিজ্ঞান বা নিউক্লিয়ার সায়েন্সের প্রয়োগ তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়। 

১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আচমকাই মৃত্যু এসে থামিয়ে দিয়েছিল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোরের লেখায় আছে, ‘ড. জ্ঞান ঘোষের ফোনে অধ্যাপক সাহার অসুস্থতার খবর পাই। ওয়েলিংটন নার্সিংহোমে পৌঁছে জানতে পারি সব শেষ।’ 


বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, তিনি সময়ের আগে জন্মেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত হয়ে উঠতেই পারেনি তৎকালীন ভারত। তাই বিজ্ঞান বা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, ভারতীয় বিজ্ঞানের তিন নক্ষত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আচার্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মেঘনাদ সাহা আজও শুধুই অধ্যাপক সাহা। এ ক্ষেত্রেও তিনি ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের ‘পিছিয়ে পড়া’ বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

বিপ্লবী পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা - প্রতিবাদের এক শক্তিশেলের নাম। বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ সাহা স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। ছয়বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। সারাজীবন লড়াই করেছেন জাতপাত, দারিদ্রের বিরুদ্ধে। আজ মেঘনাদ সাহার জন্মদিবস। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, চ‍্যানেল হিন্দুস্তান, কোলকাতা ২৪×৭ ডট কম, ব্লগ ডট মুক্তমনা ডট কম, উইকিপিডিয়া, ড. চিত্রা রায়, ‘ডিসপার্সড রেডিয়েন্স, কাস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স ইন ইন্ডিয়া’ : আভা শূর, ‘মেঘনাদ সাহা : দ্য সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড দ্য ইনস্টিটিউট বিল্ডার’: শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স - ২৯ (১), ১৯৯৪, দেশ পত্রিকা - ১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা।

নিয়মের রাজত্ব -রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2627 | likes:18 | share: 6 | comments:0

বিশ্বজগৎ নিয়মের রাজ্য, এইরূপ একটা বাক্য আজকাল সৰ্ব্বদাই শুনিতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্পৃক্ত যে-কোন গ্রন্থ হাতে করিলেই দেখা যাইবে যে, লেখা রহিয়াছে, প্রকৃতির রাজ্যে অনিয়মের অস্তিত্ব নাই; সৰ্ব্বত্রই নিয়ম, সর্ব্বত্রই শৃঙ্খলা। ভূতপূর্ব্ব আর্গাইলের ডিউক নিয়মের রাজত্ব সম্পর্কে একখানা বৃহৎ কেতাবই লিখিয়া গিয়াছেন। মনুষ্যের রাজ্যে আইন আছে বটে, এবং সেই আইন ভঙ্গ করিলে শান্তিরও ব্যকথা আছে; কিন্তু অনেকেই আইনকে ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভ করে। কিন্তু বিশ্বজগতে অর্থাৎ প্রকৃতির রাজ্যে যে সকল আইনের বিধান বর্ত্তমান, তাহার একটাকেও ফাঁকি দিবার যো নাই। কোথাও ব্যভিচার নাই, কোথাও ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভের উপায় নাই। কোথাও ব্যভিচার নাই, কোথাও ফাঁকি দিয়া অব্যাহতি লাভের উপায় নাই। কাজেই প্রাকৃতিক নিয়মের জয়গান করিতে গিয়া অনেকে পুলকিত হন ভাবাবেশে গদগদ কণ্ঠ হইয়া থাকেন; তাঁহাদের দেহে বিবিধ সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব হয়।

যাঁহারা মিরাকল বা অতিপ্রাকৃত মানেন, তাঁহারা সকল সময় নিয়মের অব্যভিচারিতা স্বীকার করেন না, অথবা প্রকৃতিতে নিয়মের রাজত্ব স্বীকার করিলেও অতিপ্রাকৃত শক্তি সময়ে সময়ে সেই নিয়ম লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হয়, এইরূপ স্বীকার করেন। যাহারা মিরাকল মানিতে চাহেন না, তাঁহারা প্রতিপক্ষকে মিথ্যাবাদী নির্ব্বোধ পাগল ইত্যাদি মধুর সম্বোধনে আপ্যায়িত করেন। কখনও বা উভয় পক্ষে বাগ্যুদ্ধের পরিবর্তে বাহুযুদ্ধের অবতারণা হয়। বর্ত্তমান অবস্থায় প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে নূতন করিয়া গম্ভীরভাবে একটা সন্দর্ভ লিখিবার সময় গিয়াছে, এরূপ না মনে করিলেও চলিতে পারে। 

প্রাকৃতিক নিয়ম কাহাকে বলে? দুই একটা দৃষ্টান্ত দ্বারা স্পষ্ট করা যাইতে পারে। গাছ হইতে ফল চিরকালই ভূমিপৃষ্ঠে পতিত হয়। এ পর্যন্ত যত গাছ দেখা গিয়াছে ও যত ফল দেখা গিয়াছে, সর্ব্বত্রই এই নিয়ম।

যে দিন লোষ্ট্রপাতিত আম্র ভূ-পৃষ্ঠ অন্বেষণ না করিয়া আকাশমার্গে ধাবিত হইবে, সেই ভয়াবহ দিন মনুষ্যের ইতিহাসে বিলম্বিত হউক।

ফলে আম বল, জাম বল, নারিকেল বল, সকলেই অধোমুখে ভূমিতে পড়ে, কেহই ঊর্ধ্বমুখে আকাশপথে চলে না। কেবল আম জাম নারিকেল কেন, যে কোন দ্রব্য উর্দ্ধে উৎক্ষেপ কর না, তাহাই কিছুক্ষণ পরে ভূমিতে নামিয়া আসে। এই সাধারণ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম এ পর্যন্ত দেখা যায় নাই। অতএব ইহা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। পার্থিব দ্রব্য মাত্রই ভূকেন্দ্রাভিমুখে গমন করিতে চাহে। এই নিয়মের নাম

ভৌম আকর্ষণ বা মাধ্যাকর্ষণ। প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মভঙ্গ হয় না; কাজেই যদি কেহ আসিয়া বলে, দেখিয়া আসিলাম, অমুকের গাছের নারিকেল আজ বৃত্তচ্যুত হইবা মাত্র ক্রমেই বেলুনের মত উপরে উঠিতে লাগিল, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সেই হতভাগ্য ব্যক্তির উপর বিবিধ নিন্দাবাদ বর্ষিত হইতে থাকিবে। কেহ বলিবে — লোকটা মিথ্যাবাদী; কেহ বলিবে — লোকটা পাগল; কেহ বলিবে—লোকটা গুলি খায়; এবং যিনি সম্প্রতি রসায়ন নামক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া বিজ্ঞ হইয়াছেন, তিনি হয়ত বলিবেন, হইতেও বা পারে, বুঝি ঐ নারিকেলটার ভিতরে জলের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ছিল। কেহ না, তাঁহার ধ্রুব বিশ্বাস যে, নারিকেল, – খাঁটি নারিকেল, যাহার ভিতরে জল আছে, হাইড্রোজেন নাই, এ-হেন নারিকেল কখনই প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গে অপরাধী হইতে পারে না। খাঁটি নারিকেল নিয়ম ভঙ্গ করে না বটে, তবে হাইড্রোজেনপূর্ণ বোম্বাই নারিকেল নিয়ম ভঙ্গ করিতে পারে; আম ভূমিতে পড়ে, কিন্তু মেঘ বায়ুতে ভাসে; প্যারাশূট-বিলম্বিত আরোহী নীচে নামে বটে, কিন্তু বেলুনটা উপরে উঠে। তবে এইখানে বুঝি নিয়ম ভঙ্গ হইল। পূর্ব্বে এক নিঃশ্বাসে নিয়ম বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, পার্থিব দ্রব্য মাত্রেই নিম্নগামী হয়; কিন্তু এখানে দেখিতেছি, নিয়মের ব্যভিচার আছে; যথা মেঘ, বেলুন ও হাইড্রোজেন-পোরা বোম্বাই নারিকেল। লোহা জলে ডুবে, কিন্তু শোলা জলে ভাসে। কাজেই প্রকৃতির নিয়মে এইখানে ব্যভিচার।

অপর পক্ষ হঠিবার নহেন; তাঁহারা বলিবেন, তা কেন, নিয়ম ঠিক আছে, পার্থিব দ্রব্য মাত্রেই নীচে নামে, এরূপ নিয়ম নহে। দ্রব্যমধ্যে জাতিভেদ আছে।

গুরু দ্রব্য নীচে নামে, লঘু দ্রব্য উপরে উঠে, ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। লোহা গুরু দ্রব্য, তাই জলে ডুবে; শোলা লঘু দ্রব্য, তাই জলে ভাসে; ডুবাইয়া দিলেও উপরে উঠে।

 নারিকেল গুরু দ্রব্য; উহা নামে। কিন্তু বেলুন লঘু দ্রব্য; উহা উঠে।

এই নিয়মের ব্যতিক্রম খুঁজিয়া বাহির করা বস্তুতই কঠিন। কার সাধ্য ঠকায়। ঐ জিনিষটা উপরে উঠিতেছে কেন? উত্তর, এটা যে লঘু। ঐ জিনিষটা নামিতেছে কেন? উত্তর, ওটা যে গুরু। যাহা লঘু, তাহা ত উঠিবেই; যাহা গুরু, তাহা ত নামিবেই; ইহাই ত প্রকৃতির নিয়ম।

সোজা পথে আর উত্তর দিতে পারা যায় না; বাঁকা পথে যাইতে হয়। লোহা গুরু দ্রব্য; কিন্তু খানিকটা পারার মধ্যে ফেলিলে লোহা ডুবে না। ভাসিতে থাকে। শোলা লঘু দ্রব্য; কিনতু জল উইতে তুলিয়া ঊর্ধ্বমুখে নিক্ষেপ করিলে ঘুরিয়া ভূতলগামী হয়। তবেই ত প্রাকৃতিক নিয়মের ভঙ্গ হইল। উত্তর—আরে মূর্খ, গুরু লঘু শব্দের অর্থ বুঝিলে না। গুরু মানে এখানে পাঠশালার গুরুমহাশয় নহে বা মন্ত্রদাতা গুরুও নহে; গুরু অর্থে অমুক পদার্থ অপেক্ষা গুরু অর্থাৎ ভারী। লোহা গুরু, তার অর্থ এই যে, লোহা বায়ু অপেক্ষা গুরু, জল অপেক্ষা গুরু; কাজেই বায়ুমধ্যে, কি জলমধ্যে রাখিলে লোহা না ভাসিয়া ডুবিয়া যায়। আর লোহা পারার অপেক্ষা লঘু; সমান আয়তনের লোহা ও পারা নিন্ডিতে ওজন করিলেই দেখিবে, কে লঘু, কে গুরু। পারা অপেক্ষা লোহা লঘু, সে জন্য লোহা পারায় ভাসে। প্রাকৃতিক নিয়মটার অর্থই বুঝিলে না, কেবল তর্ক করিতে আসিতেছ। এ পক্ষ বলিতে পারেন, আপনার বাক্যের অর্থ যদি বুঝিতে না পারি, সে ত আমার বুদ্ধির দোষ নহে, আপনার ভাষার দোষ। গুরু দ্রব্য নামে, লঘু দ্রব্য উঠে, বলিবার পূর্ব্বে গুরু লঘু কাহাকে বলে, আমাকে বুঝাইয়া দেওয়া উচিত ছিল। আপনার আইনের ভাষা যোজনায় দোষ ঘটিয়াছে; উহার সংশোধন আবশ্যক।

ভাষা সংশোধনের পর প্রাকৃতিক আইনের সংশোধিত ধারাটা দাঁড়াইবে এই রকম:

ধারা।— কোন দ্রব্য অপর তরল বা বায়বীয় দ্রব্যমধ্যে রাখিলে প্রথম দ্রব্য যদি দ্বিতীয় দ্রব্য অপেক্ষা গুরু হয়, তাহা হইলে নিম্নগামী হইবে, আর যদি লঘু হয়, তাহা হইলে ঊর্দ্ধগামী হইবে। 

ব্যাখ্যা।- এক দ্রব্য অন্য দ্রব্য অপেক্ষা গুরু কি লঘু, তাহা উভয়ের সমান আয়তন লইয়া নিত্তিতে ওজন করিয়া দেখিতে হইবে। 

উদাহরণ।—রাম প্রথম দ্রব্য, শ্যাম দ্বিতীয় দ্রব্য। রামকে শ্যামের আয়তন মত ছাঁটিয়া লইয়া তুলাদন্ডে ওজন করিয়া দেখ, রাম যদি শ্যাম অপেক্ষা গুরু হয়, তাহা হইলে শ্যামের মধ্যে রামকে রাখিলে রাম নিম্নগামী হইবে। শ্যামকে তরল পদার্থ মনে করিতে আপত্তি করিও না। সংশোধনের পর আইনের ভাষা অত্যন্ত সুবোধ্য হইয়া দাঁড়াইল, সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নাই।

এখন দেখা যাউক, কত দূর দাঁড়াইল। পার্থিব দ্রব্য মাত্রই ভূমি স্পর্শ করিতে চাহে, নিম্নগামী হয়; ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম নহে। 

সুতরাং উহার ব্যভিতার দেখিলে বিস্মিত হইবার হেতু নাই; পার্থিব দ্রব্য অবস্থাবিশেষে, অর্থাৎ অন্য পার্থিব বস্তুর সন্নিধানে, কখনও বা উপরে উঠে, কখনও বা নীচে নামে। যখন অন্য কোন বস্তুর সন্নিধানে থাকে না, তখন সকল পার্থিব দ্রব্য নীচে নামে।

যেমন শূন্য প্রদেশে, পাম্পযোগে কোন প্রদেশকে জলশূন্য ও বায়ুশূন্য করিয়া সেখানে যে-কোন দ্রব্য রাখিবে, তাহাই নিম্নগামী হইবে। আর বায়ুমধ্যে, জলমধ্যে, তেলের মধ্যে, পারদ মধ্যে কোন জিনিষ রাখিলে তখন লঘু-গুরু বিচার করিতে হইবে। ফলে ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম; ইহার ব্যাভিচার নাই। এই অর্থে প্রকৃতির নিয়ম অলঙ্ঘ্য। তবে যত দোষ এই জলের আর তেলের আর পারার আর বাতাসের। উহাদের সন্নিধিই এই বিষম সংশয়।

উৎপাদনের হেতু হইয়াছিল। ভাগ্যে মনুষ্য বুদ্ধিজীবী, তাই প্রকৃত দোষীর সন্ধান করিতে পারিয়াছে; নতুবা প্রকৃতিতে নিয়মের প্রভুত্বটা গিয়াছিল আর কি! বাস্তবিকই দোষ এই তরল পদার্থের ও বায়বীয় পদার্থের। বেলুন উপরে উঠে, বায়ু আছে বলিয়া; শোলা জলে বাসে, জল আছে বলিয়া; লোহা পারায় ভাসে, পারা আছে বলিয়া ; নতুবা সকলেই ডুবিত, কেহই ভাসিত না; সকলেই নামিত, কেহই উঠিত না।

অর্থাৎ কি না, পৃথিবী যেমন সকল দ্রব্যকেই কেন্দ্রমুখে আনিতে চায়, তরল ও বায়বীয় পদার্থ মাত্রেই তেমনই মগ্ন দ্রব্য মাত্রকেই উপরে তুলিতে চায়। প্রথম ব্যাপারের নাম দিয়াছি মাধ্যাকর্ষণ; দ্বিতীয় ব্যাপারের নাম দাও চাপ। মাধ্যাকর্ষণে নামায়, চাপে ঠেলিয়া উঠায়। যেখানে উভয় বর্তমান, সেখানে উভয়ই কার্যা করে। যার যত জোর। যেখানে আকর্ষণ চাপ অপেক্ষা প্রবল, সেখানে মোটের উপর নামিতে হয়; যেখানে চাপ আকর্ষণ অপেক্ষা প্রবল, সেখানে মোটের উপর উঠিতে হয়। যেখানে উভয়ই সমান, সেখানে “ন যযৌ ন তখো”।

এখন এ পক্ষ স্পর্ধা করিয়া বলিবেন, — দেখিলে, প্রাকৃতিক নিয়মের আর ব্যতিক্রম আছে কি? আমাদের প্রকৃতির রাজ্যে কি কেবল একটা নিয়ম; কেবলই কি একটা আইন? অনেক নিয়ম ও অনেক আইন, অথবা একই আইনের অনেক ধারা। যথা—


১ নং ধারা—পার্থিব আকর্ষণে বস্তু মাত্রই নিম্নগামী হয়। 

২ নং ধারা—তরল ও বায়বীয় পদার্থের চাপে বস্তু মাত্রই ঊর্ধ্বগামী হয়।

৩ নং ধারা—আকর্ষণ ও চাপ উভয়ই যুগপৎ কাজ করে। আকর্ষণ প্রবল হইলে নামায়, চাপ প্রবল হইলে উঠায়। কাহার সাধ্য, এখন বলে যে, প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যভিচার আছে? উঠিলেও নিয়ম, নামিলেও নিয়ম, স্থির থাকিলেও নিয়ম; নিয়ম কাটাইবার যো নাই। প্রকৃতির রাজ্য বস্তুতই নিয়মের রাজ্য। নারিকেল-ফল যে নিয়ম লঙ্ঘন করে না, তাহা যে দিন হইতে নারিকেল-ফল মনুষ্যের ভক্ষা হইয়াছে, তদবধি সকলেই জানে। বেলুন যে ঊর্ধ্বগামী। হইয়াও নিয়ম লঙ্ঘন করিতে পারিল না, তাহাও দেখা গেল। কেন না, পৃথিবীর আকর্ষণ উভয় স্থলেই বিদ্যমান। পার্থিব দ্রব্য ব্যতীত অপার্থিব দ্রব্যও যে পৃথিবীর দিকে আসিতে চায়, তাহা কিন্তু সকলে জানিত না। দুই শত


বৎসরের অধিক হইল, এক জন লোক পৃথিবীতে জানান, অয়ি মাতঃ, তোমার আকর্ষণ কেবল নারিকেল-ফলেই ও আতা ফলেই আবদ্ধ নহে; তোমার আকর্ষণ বহুদূরব্যাপী। তোমার অধম সন্তানেরা তাহা জানিয়াও জানে না। এই ব্যক্তির নাম সার আইজাক নিউটন।


তিনি জানাইলেন দূরস্থ চন্দ্রদের পর্যন্ত পৃথিবী মুখে নামিতেছেন, ক্রমাগত ভূমিস্পর্শের চেষ্টা করিতেছেন, কেবল স্পর্শলাভটি ঘটিতেছে না। কেবল তাহাই কি? স্বয়ং দিবাকর, তাঁহার পার্ষদবর্গ সমভিব্যাহারে পৃথিবী মুখে আসিবার চেষ্টায় আছেন। কেবল তাহাই কি? পৃথিবীও তাহাদের প্রত্যেকের নিকট যাইতে চেষ্টা করিতেছেন। অর্থাৎ সকলের দিকে যাইতে চাহিতেছেন; স্বস্থানে স্থির থাকিতে কাহারও চেষ্টা নাই; সকলেই সকলের দিকে ধাবমান।


ধাবমান বটে, কিন্তু নির্দ্দিষ্ট বিধানে; পৃথিবী সূৰ্য্য হইতে এত দূরে আছেন; আচ্ছা, পৃথিবী এইটুকু জোরে সূর্য্যের অভিমুখে চলিতে থাকুন। চন্দ্ৰ পৃথিবী হইতে এতটা দূরে আছেন; বেশ, চন্দ্র প্রতি মিনিটে এত ফুট করিয়া পৃথিবী মুখে অগ্রসর হউন। পৃথিবী নিজেও চন্দ্ৰ হইতে এত দূরে আছেন, তিনিও মিনিটে চন্দ্রের দিকে এত ফুট চলুন। তবে তাঁহার কলেবর কিছু গুরুভার, তাঁহাকে এত ফুট হিসাবে চলিলেই হইবে; চন্দ্র পৃথিবীর তুলনায় লঘুশরীর; তাঁহাকে এত ফুট হিসাবে না চলিলে হইবে না। তুমি বৃহস্পতি, বিশাল কায় লইয়া বলহু দূরে থাকিয়া পার পাইবে মনে করিও না। তোমার অপেক্ষা বহুগুণে বিশালকায় সূর্য্যদেব বর্ত্তমান; তুমি তাহার অভিমুখে এই নির্দ্দিষ্ট বিধানে চলিতে বাধ্য; আর বুধ-কুজাদি ক্ষুদ্র গ্রহগণকেও একেবারে অবজ্ঞা করিলে তোমার চলিবে না, তাহাদের দিক্ দিয়াও একটু ঘুরিয়া চগিলতে হইবে। আর শনৈশ্চর, কোটি কোটি লোষ্ট্রখণ্ডের মালা পরিয়া গৰ্ব্ব করিও না; এই ক্ষুদ্র লোষ্ট্রখণ্ডকে উপহাস করিবার তোমার ক্ষমতা নাই। নেপচুন, তুমি বহু দূরে থাকিয়া এত কাল লুকাইয়াছিলে; বন্ধু উরেনসকে টান দিতে গিয়া স্বয়ং ধরা পড়িলে।


আবিষ্কৃত হইল বিশ্বজগতে একটা মহানিয়ম, একটা কঠোর আইন; এই আইন ভঙ্গ করিয়া এড়াইবার উপায় কাহারও নাই। সূর্য্য হইতে বালুকণা পর্যন্ত সকলেই পরস্পরের মুখ চাহিয়া চলিতেছে, নির্দ্দিষ্ট বিধানে নির্দিষ্ট পথে চলিতেছে। খড়ি পাতিয়া বলিয়া দিতে পারি, ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল মধ্যাহ্নকালে কোন্ গ্রহ কোথায় থাকিবেন। এই যে কঠোর আইন প্রকৃতির সাম্রাজ্যে প্রচলিত আছে, ইহার এলাকা কত দূর বিস্তৃত? সমস্ত বিশ্ব-সাম্রাজ্যে কি এই নিয়ম চলিতেছে? বলা কঠিন। সৌরজগতের মধ্যে ত আইন প্রচলিত দেখিতেই পাইতেছি। সৌরজগতের বাহিরে খবর কি? বাহিরের খবর পাওয়া দুষ্কর। খগোলমধ্যে স্থানে স্থানে এক এক যোড়া তারা দেখা যায়; তারকাযুগলের মধ্যে একে অন্যকে বেষ্টন করিয়া ঘুরিতেছে। যেমন চন্দ্র ও পৃথিবী এক যোড়া বা পৃথিবী সূর্যা আর এক ঘোড়া, কতকটা তেমনই। পরস্পর বেষ্টন করিয়া ঘুরিবার চেষ্টা দেখিয়াই বুঝা যায়, সৌরজগতের বাহিরেও এই আইন। বলবৎ। কিন্তু সৰ্ব্বত্র বলবৎ কি না, বলা যায় না। কেন না, সংবাদের অভাব। দূরের তারাগুলি পরস্পর হইতে এত দূরে আছে যে, পরস্পর আকর্ষণ থাকিলেও তাহার ফল এত সামান্য যে, তাহা আমাদের গণনাতেও আসে না, আমাদের প্রত্যক্ষগোচরও হয় না।

সম্ভবতঃ এই আইনের এলাকা বহুদূর বিস্তৃত। সমস্ত খগোলমধ্যে সকলেই সম্ভবতঃ এই আইনের অধীন। কিন্তু যদি কোন দিন আবিষ্কৃত হয় যে, কোন একটা তারা বা কোন একটা প্রদেশের তারকাগণ এই আইন মানিতেছেনা, তাহা হইবে কি হইবে? যদি বিশ্ব-সাম্রাজ্যের কোন প্রদেশের মধ্যে এই আইন না চলে, তবে কি ব্রমান্ডকে নিয়মতন্ত্র রাজ্য বলিয়া গণ্য করিব না?


মনে কর, নিউটন সৌরজগতের মধ্যে যে নিয়মের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, দেখা গেল, বিশ্ব-জগতের অন্য কোন প্রদেশে সেই নিয়ম চলে না, সেখানে গতিবিধি অন্য নিয়মে ঘটে; তখন কি বলিব? তখন নিউটনের নিয়মকে সংশোধন করিয়া লইয়া বলিব, বিশ্ব-জগতের এই প্রদেশে এই নিয়ম; অমুক প্রদেশে কিন্তু অন্য নিয়ম। এই প্রদেশে এই নিয়মের ব্যভিচার নাই, ঐ প্রদেশে ঐ নিয়েমর ব্যভিচার নাই। কিন্তু সর্ব্বত্রই নিয়মের বন্ধন – জগৎ নিয়মের রাজ্য। নিউটনের আবিষ্কৃত নিয়ম সর্ব্বত্র চলে না বটে, কিন্তু কোন-না-কোন নিয়ম চলে।

ইহার উপর আর নিয়মের রাজত্বে সংশয় স্থাপনের কোন উপায় থাকিতেছে না। কোন একটা নিয়ম আবিষ্কার করিলাম: যত দিন তাহার ব্যভিচারের দৃষ্টান্ত দেখিলাম না, বলিলাম—এই নিয়ম অনিবার্য্য, ইহার ব্যভিচার নাই। যে দিন দেখিলাম, অমুক স্থানে আর সে নিয়ম চলিতেছে না, অমনি সংশোধনের ব্যথা। তখনই ভাষা বদলাইয়া নিয়ম সংশোধিত ভাবে প্রকাশ করিলাম। বলিলাম—অহো, এত দিন আমার ভুল হইয়াছিল; ঐ স্থানে ঐ নিয়ম, আর এই স্থানে এই নিয়ম। আগে যাহা নিয়ম বলিতেছিলাম, তাহা নিয়ম নহে; এখন যাহা দেখিতেছি, তাহাই নিয়ম। প্রাকৃতিক নিয়মগুলি যেন ব্যাকরণের নিয়ম - যেন ব্যাকরণের সূত্র। ইকারাম্ভ পুংলিঙ্গ শব্দের রূপ সৰ্ব্বত্র মুনি শব্দের মত, পতি শব্দ ও সখি শব্দ, এই দুইটি বাদ দিয়া। এখানে সাবেক নিয়মের যে ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম দেখিতেছ, উহা প্রকৃত ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম নহে, উহা একটা নবাবিষ্কৃত অজ্ঞাতপূর্ব্ব নিয়ম, এরূপ স্থানে এইরূপ ব্যভিচারই নিয়ম। ইহার উপর আর কথা নাই।

অর্থাৎ কি না, নিয়মের যতই ব্যভিচার দেখ না কেন, নিয়ম ভাঙ্গিয়াছে বলিবার উপায় নাই। জলে শোলা ভাসিতেছে, ইহাতে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম ভাঙ্গিল কি? কখনও না; এখানে মাধ্যাকর্ষণ বর্তমান আছে, তবে জলের চাপে শোলাকে ডুবিতে দিতেছে না, এ স্থানে ইহাই নিয়ম। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে আমাদের দেশে বর্ষা হয়। এ বৎসর বর্ষা ভাল হইল না; তাহাতে নিয়ম ভাঙ্গিল কি? কখনই না। এ বৎসর হিমালয়ে যথেষ্ট হিমপাত ঘটিয়াছে; অথবা আফ্রিকার উপকূলে এবার অতিবৃষ্টি ঘটিয়াছে; এবার ত এ দেশে বর্ষা না হইবারই কথা; ঠিক ত নিয়মমত কাজই হইয়াছে।


 

নিয়ম দেখা গেল, চুম্বকের কাঁটা উত্তরমুখে থাকে। পরেই দেখা গেল, ঠিক উত্তর মুখে থাকে না; একটু হেলিয়া থাকে। আচ্ছা, উহাই ত নিয়ম।

আবার কলিকাতায় যতটা হেলিয়া আছে, লন্ডন শহরে ততটা হেলিয়া নাই, না থাকিবারই কথা; ইহাই ত নিয়ম। আবার কলিকাতায় এ বৎসর যতটা হেলিয়া আছে, ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে ততটা হেলিয়া ছিল না। কি পাপ, উহাই ত নিয়ম? চুম্বকের কাঁটা চিরকালই এক মুখে থাকিবে, এমন কি কথা আছে? উহা একটু একটু করিয়া প্রতি বৎসর সরিয়া যায়; দুই শত বৎসর বরাবরই দেখিতেছি, ঐরূপ সরিয়া যাইতেছে; উহাই ত নিয়ম। কাঁটা আবার থাকিয়া থাকিয়া নাচে, কাঁপে, স্পন্দিত হয়। ঠিকই ত। সময়ে সময়ে নাচাই ত নিয়ম। প্রতি এগার বৎসর একবার উহার এইরূপ নর্ত্তনপ্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে। আবার সূর্য্যবিঙ্গে যখন কলঙ্কসংখ্যার বৃদ্ধি হয়, যখন মেরুপ্রদেশে উদীচী ঊষার দীপ্তি প্রকাশ পায়, তখনও এই নৰ্ত্তনপ্রবৃত্তি বাড়ে। বাড়িবেই ত, ইহাই ত নিয়ম।

একটা নিয়ম আছে, আলোকের রশ্মি সরল রেখাক্রমে ঋজু পথে যায়। যতক্ষণ একই পদার্থের মধ্য দিয়া চলে, ততক্ষণ বরাবর একই মুখে চলে। জানালা দিয়া রৌদ্র আসিলে সম্মুখের দেওয়ালে আলো পড়ে। ছিদ্রের ভিতর দিয়া চাহিয়া সম্মুখের জিনিষ দেখা যায়, আশ-পাশের জিনিষ দেখা যায় না। কাজেই বলিতে হইবে —আলোক ঋজু পথে চলে। নতুবা ছায়া পড়িত না; চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ ঘটিত না। অতএব আলোকের সোজা পথে যাওয়াই নিয়ম। কিন্তু সৰ্ব্বত্রই কি এই নিয়ম? অতি সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভিতর দিয়া আলো গেলে দেখা যায়, আলোক ঠিক সোজা পথে না গিয়া আশে-পাশে কিছু দূর পর্যন্ত যায়। শব্দ যেমন জানালার পথে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে চলে ও আশে-পাশে চলে, সেইরূপ আলোকরশ্মিত সূক্ষ্ম ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে চলে ও আশে-পাশে যাওয়াই নিয়ম। বস্তুতঃ এ স্থলেও প্রাকৃতিক নিয়মের কোন লঙ্ঘন হয় নাই।


শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় এই। যাহা দেখিব, তাহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাহা এ পর্যন্ত দেখি নাই, তাহা নিয়ম নহে বলিয়া নিশ্চিত্ত থাকিতে পারি; কিন্তু যে-কোন সময়ে একটা অজ্ঞাতপূর্ব্ব ঘটনা ঘটিয়া আমার নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়মকে বিপর্যস্ত করিয়া দিতে পারে। কাজেই এটা প্রাকৃতিক নিয়ম, ওটা নিয়ম নহে, ইহা পূরা সাহসে বলাই দায়।

অথবা যাহা দেখিব, তাহাই যখন নিয়ম, তখন নিয়মলঙ্ঘনের সম্ভাবনা কোথায়? চিরকাল সূর্য পূর্ব্বে উঠে, দেখিয়া আসিতেছি; উহাই প্রাকৃতিক নিয়ম মনে করিয়া বসিয়া আছি; কেহ পশ্চিমে সূর্যোদয় বর্ণনা করিলে তাহাকে পাগল বলি। কিন্তু কাল প্রাতে যদি দুনিয়ার লোকে দেখিতে পায়, সূর্য্যদেব পশ্চিমেই উঠিলেন আর পূর্ব্বমুখে চলিতে লাগিলেন, তখন সে দিন হইতে উহাকেই প্রাকৃতিক নিয়ম বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। অবশ্য এরূপ ঘটনার সম্ভাবনা অত্যন্ত অল্প। কিন্তু যদি ঘটে, পৃথিবীর সমস্ত বৈজ্ঞানিক একযোট হইয়া তাহার প্রতিবিধান করিতে পারিবেন কি?


প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মটা কিরূপ, তাহা কতক বোঝা গেল। তুমি সোজা চলিতেছ, ভাল, উহাই নিয়ম; বাঁকা চলিতেছ, বেশ কথা, উহাই নিয়ম। তুমি হাসিতেছ, ঠিক নিয়মানুযায়ী; কাঁদিতেছ, তাহাতেও নিয়মের বাতিক্রম নাই। যাহা ঘটে, তাহাই যখন নিয়ম, তখন নিয়মের ব্যভিচারের আর অবকাশ থাকিল কোথায়? কোন নিয়ম সোজা; কোন নিয়ম বা খুব জটিল। কোনটাতে বা ব্যভিচার দেখি না; কোনটাতে বা ব্যভিচার দেখি; কিন্তু বলি, ঐখানে ঐ ব্যাভিচার থাকাই নিয়ম। কাজেই নিয়মের রাজ্য ছাড়িয়া যাইবার উপায় নাই।

ফলে জাগতিক ঘটনাপরম্পরার মধ্যে কতকগুলা সম্বন্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। ঘটনাগুলা একেবারে অসম্বন্ধ বা শৃঙ্খলাশূন্য নহে। মানুষ যত দেখে, যত সূক্ষ্ম ভাবে দেখে, যত বিচার করিয়া দেখে, ততই বিবিধ সম্বন্ধের আবিষ্কার করিয়া থাকে। বহুকাল হইতে মানুষে দেখিয়া আসিতেছে, সূর্য পূর্ব্বে উঠে, নারিকেল ভূমিতে পড়ে কাষ্ঠরূপী ইন্দ্রনযোগে প্রাকৃত অগ্নি উদ্দীপিত হয়, আর অন্নরূপী ইন্দ্রনযোগে জঠরাগ্নি নির্ব্বাপিত হয়। এই সকল ঘটনার পরস্পর সম্বন্ধ মনুষ্য বহুকাল হইতে জানে। আলোক ও তাড়িত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির সম্পর্কে নানা তথ্য, বিবিধ ঘটনার পরস্পর সম্বন্ধ, মনুষ্য অল্প দিন মাত্র জানিয়াছে। যত দেখে, ততই শেখে, ততই জানে: যতক্ষণ তাহা অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। ইন্দ্রিয়গোচর হইলেই তৎসম্পর্কে একটা নূতন তথ্যের আবিষ্কার হয়। কিন্তু পূৰ্ব্ব হইতে কে বলিতে পারে, কালি কোন নূতন নিয়মের আবিষ্কার হইবে? বিংশ শতাব্দীর শেষে মনুষ্যের জ্ঞানের সীমানা কোথায় পৌঁছিবে, আজ তাহা কে বলিতে পারে?

যাহা দেখিতেছি, যে সকল ঘটনা দেখিতেছি, তাহাদিগকে মিলাইয়া তাহাদের সাহচর্য্যাগত ও পরম্পরাগত সম্পর্ক যাহা নিরূপণ করিতেছি, তাহাই যখন প্রাকৃতিক নিয়ম, তখন প্রকৃতিতে অনিয়মের সম্ভাবনা কোথায়? যাহা কিছু ঘটে, তাহা যতই অজ্ঞাতপূৰ্ব্ব হউক না কেন, তাহা যতই অভিনব হউক না, তাহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। কোন স্থলে কোন নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিলে সেই ব্যতিক্রমকেই সেখানে নিয়ম বলিতে হয়। কাজেই ব্রহ্মান্ড নিয়মের রাজ্য। ইহাতে আবার বিস্ময়ের কথা কি? ইহাতে আনন্দে গদগদ হইবারই বা হেতু কি? আর নিয়মের শাসনে জগদযন্ত্র চলিতেছে মনে করিয়া একজন সৃষ্টিছাড়া নিয়ন্তার কল্পনা করিবারই বা অধিকার কোথায়? জগতে কিছু না কিছু ঘটিতেছে, এটার পর ওটা ঘটিতেছে, যাহা যেরূপে ঘটিতেছে, তাহাই নিয়ম, প্রাকৃতিক নিয়মের আর কোন তাৎপর্য নাই। এই নিয়ম দেখিয়া বিস্ময়ের কোন হেতু নাই। এই ঘটনাটাই বরং আশ্চর্য্য—একটা কিছু যে ঘটিতেছে, ইহাই বিস্ময়ের বিষয়। জগৎ-ঘটনাটার প্রয়োজন কি ছিল, ইহা ঘটেই বা কেন, ইহাই বিস্ময়ের বিষয়। ইহার উত্তরে অজ্ঞানবাদী বলেন, জানি। না; ভক্ত বলেন, ইহা কোন অঘটন-ঘটনা-পটুর লীলা; বৈদান্তিক বলেন, আমিই সেই অঘটন-ঘটনায় পটু—আমার ইহাতে আনন্দ; বৌদ্ধ একেবারে ঢুকাইয়া দেন ও বলেন, কিছুই ঘটে নাই।

কবিতাগুচ্ছ ১৯ -কবিরা
Nov. 21, 2024 | কবিতা | views:63 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আশ্চর্য ভাতের গন্ধ

-বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


আশ্চর্য ভাতের গন্ধ

রাত্রির আকাশে

কারা যেন আজো ভাত রাঁধে

ভাত বাড়ে, ভাত খায়।

আর আমরা

সারা রাত জেগে থাকি

আশ্চর্য ভাতের গন্ধে

প্রার্থনায়, সারা রাত


শাশ্বত

-অনার্য

ঊষার আলোর আহ্বানে নতুনের জাগরণ,

তৃণের শীশে শোভিত জীবন ক্ষণিকে স্খলন।

মায়ার পৃথিবী ভুলে যায় মায়া। একাকিনী জননী

খুঁজে ফেরে তার নয়ন মনি দিবস- যামিনী।

ভগবান, সকলই করিয়া থাকো মঙ্গল সাধনে!

পরম যতনে কাছে টেনে লও অমৃত বন্ধনে।

দয়ার সাগর প্রেমের আধার পুরুষোত্তম সত্য,

সকলই তোমার অধিন যবে তুমিই নিয়ন্তা নিত্য,

তবে কোন দোষে, কোন আক্রোশে সাঁজা দাও নির্দোষে?

আসলে তুমি, তুমি বলে কিছু নাই, চরম সর্বনেশে।

তবু ভিখ্ মাগে শতবার যত নির্বোধ দুর্বল,

সর্বজনীন কুসংস্কারে ভরসা অবিচল।।


এখানে সৃজন জীবন-প্রেম, মানুষ ও মনন,

এখানেই সব আনন্দ- হাসি রিক্তের বেদন।

সব দিয়ে সব কেড়ে লয় এই জগৎ-ঈশ্বর,

এই শাশ্বত-সত্য জানি তুমি-আমি- আর আর!




হৃদকুণ্ড

-মিঞোরেগা


ভীষণ ভারী পাদুকায় হাটছি

আপন মনে—পৃথিবীর বুকে,

শক্ত হাতে আঁকা তুফানের বর-পরঙ গল্পের পেইন্টিংয়ের মত

দুঃখগুলোকে অবশেষে রেখে।


ব্যস্ত রাস্তায় অবরোধ করে আছে

ট্রাফিক পুলিশের মত—আমার হৃদকুণ্ড

সাজের বৃষ্টিজলে, দূরে ঠিকানা ঘোলাতে

এই সবুজ যথাকালে, ঠিকানা সিদ্ধান্ত করে

সে বসে থাকত নীরবে, ভাবুক অথচ কী যেন খুঁজছে—।

এই দশকে বেশি আর হয়তো এগোনো যাবে না

আলো বিষণ্ণতায় মিশে গেছে

নাগরদোলার গানগুলো আঁধারে ভাসে

গাইতে গিয়ে ক্লান্তি চলে আসে

চেষ্টা করেও হয় না, হৃদকুণ্ড কম্প তৈরি করে

এ যাত্রা এভাবে থেমে যাবে।

রেঙ্গুন, মিয়ানমার



ওঠরে ওঠ দলিত সমাজ

-সজল কান্তি টিকাদার

ছোট্টো শিশুর প্রাণ যে গেলো

বর্ণবাদের বিষ নজরে

নয়নে এবার বহ্নি জ্বালা

থাকিসনা আর চুপটি করে।

ওঠরে ওঠ দলিত সমাজ

পুড়িয়ে দে সব মনুর বিধান

নইলে কিন্তু এই আগুনেই

যাবে আরো শিশুর প্রাণ।

যতই বলুক বামুনরা সব

আমরা সবাই সমান মানুষ

আসলে ওসব লোক দেখানো

ওসব কথা মিথ্যে ফানুস।

মানবিকতা নাইকো ওদের

জাতকে রাখে সবার আগে

কত যে দলিত প্রাণ হারালো

সেসব খবর কে আর রাখে?

ভুলিসনেরে ওদের কথায়

দেব দেবী সব ফেলনা ছুড়ে

দেওয়ালে পিঠ  ঠেকেই গেছে

লড়াই কর এবার ঘুরে।

জল ছুঁলে যে প্রাণ নিয়ে নেয়

এমন ধর্ম চাইনা আর

বর্ণবাদের মধুর কথায়

ভুলিসনে আর খবরদার।

বাঁচার মতই বাঁচরে তোরা

পায়ের তলায় থাকিসনে

এই ভারতেই জন্ম তোদের

ভয়টা মনে রাখিসনে।

অথ ধর্মকথা - এক সাঁওতালের উপলব্ধি -বিশ্বনাথ মুরমু
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:2613 | likes:2 | share: 2 | comments:0

জ্ঞান হবার পর থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে মানুষে মানুষে অনেক তফাৎ আছে। প্রথম তফাৎটা আমরা বুঝতে পারি ভাষায়। যেমন কারও ভাষা সাঁওতালি, কারও ভাষা মুন্ডারি, কারও ভাষা বাংলা, কারও ভাষা হিন্দি, কারও ভাষা পাঞ্জাবি, কারও ভাষা অসমীয়া, কারও ভাষা গুজরাটি, ইত্যাদি (ভারতে অষ্টম তপশীলভুক্ত সর্বমোট ভাষার সংখ্যাই ২২টি। এর বাইরে আরও অজস্র ভাষা আছে)। দ্বিতীয় তফাৎটা হল জাতির। যেমন মুসলমান, পাঞ্জাবি, ওঁরাও, সাঁওতাল, বাঙালি, তামিল, ওড়িয়া, নেপালি, ইত্যাদি (এও আছে অজস্র)। তৃতীয় তফাৎ খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যাভ্যাসে। চতুর্থ তফাৎ পরনের কাপড়ে ও পদ্ধতিতে। পঞ্চম তফাৎ ধর্মাচরণে। দৈনন্দিন জীবনে যে যার গৃহকোনে কেমন ধর্মাচরণ করি, কোন ঠাকুরকে নাম করি, প্রণাম করি, তা হয়ত অন্যের কাছে অনেকটাই অজানা থাকে। কিন্তু সামাজিক জীবনে ধর্মীয় আচরণে যা চোখে পড়ে (জাহের থান, মন্দির, চার্চ, মসজিদ, ইত্যাদি), তা সত্যি করেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দেয়, যে এই বিষয়ে তফাৎটা ঠিক কোথায়, কতখানি। ধর্মাচরণ নিয়েই বিশদ কথাবার্তা বলতে বসেছি। ধর্মাচরণ মানেই উপরের দিকে আঙুল তুলে কোনও এক মহা শক্তিধরের ধারণা পোষণ (ভিন্ন ভিন্ন নামে) এবং তার টুকরো টুকরো কিছু অবতারের তোষণ। এই আচরণের ক্ষেত্রে, কেউ কেউ কোথাও যায় না (আদিবাসীরা), ঠাকুর আছে কিন্তু কোন মূর্তি নেই, তাই ঘরে বাইরে মূর্তি রাখবার কোন দেবালয়ও নেই, তবে দেবস্থান আছে। তাদের মনে মনে জপ করে নিলেই হল। দেবস্থান আছে কোন গাছের গোড়ায়, খোলামেলা জায়গায়, আর সেখানে তারা যায় বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ  বিশেষ পূজার আয়োজনে। একদল মানুষ বাড়িতে এক বা একাধিক ফটো, মূর্তি রেখে সকালে সন্ধ্যায় ধূপ, দীপে, অবোধ্য/দুর্বোধ্য মন্ত্র (মাতৃভাষায় নয়) আউড়ে পূজার্চনা করে। কারও আবার আলাদা একটা ঠাকুর ঘর বলেই থাকে। একদল মানুষ ঠাকুর প্রণাম করতে যায় মন্দিরে। কেউ রোজ যায়, কেউ আবার বিশেষ কোন তিথিতে, বিশেষ কোন পূজার দিনে। এখানেও আবার কথা আছে। সব মন্দিরে কিন্তু একই মূর্তি বা ঠাকুর থাকে না। বিশেষ বিশেষ মন্দিরে বিশেষ কোন ঠাকুর থাকলেও, কোন কোন ঠাকুরের আবার সচরাচর মন্দির দেখা যায় না। কোথাও আবার একই মন্দিরে সব ঠাকুরকে অর্থাৎ ঠাকুরের ফটো বা মূর্তিকে রাখা হয়। কোন কোন জায়গার ঠাকুরকে জাগ্রত বলা হয়(তাহলে ধরে নিতে হবে যে বাকি সব জায়গার ঠাকুর নিদ্রিত)। একই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে আর একদল মানুষ যায় মসজিদে। আবার, হিন্দি, বাংলা, সাঁওতালি, মারাঠি, ইংরেজি বা আরও অন্য ভাষায় কথা বললেও, এবং জাতিতে আলাদা আলাদা হলেও, আর একদল মানুষ যায় চার্চে, যীশুখ্রীষ্টের কাছে প্রার্থনা করতে, যারা ধর্মে খ্রীষ্টান। আমাদের সাধারণ ধারনায় আমরা জানি যে, জাতি, ভাষা ও ধর্ম যেন একটা পারস্পরিক সম্পৃক্ত ব্যাপার। কিন্তু, এতে বোঝা গেল যে জাতি, ভাষা আর ধর্ম বিষয়টা সম্পৃক্ত নয়। 

জাতি, ভাষা একই থাকলেও, ধর্মটা যেন আলাদা আলাদা নামাবলীর মত গায়ে চাপানোর ব্যাপার। এবং এই আলাদা নামাবলীর অন্ধত্বে মানুষ একে অন্যের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে।

ইদানিং, জাতি আর ভাষার অন্ধ বিরোধের সাথে যোগ হয়েছে ধর্মের। কারণটা এটাই যে, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যে আচরণ করে, তা বেশির ভাগটাই তার ধর্মীয় শিক্ষা থেকেই করে। ফলে, এক ধর্মীয় আচরণের মানুষের সাথে অন্য ধর্মীয় মানুষের আচরণের পার্থক্যের জন্য কখনও কখনও বেধে যায় সংঘাত। এর মধ্যে অসহিষ্ণুতা আছে, অজ্ঞতা আছে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা আছে, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু হবার কারণ আছে, এবং এখন নতুন সংযোজন হয়েছে রাজনৈতিক রং। আর এমনিতেই আমরা জানি, নিত্যদিন দেখে চলেছি রাজনৈতিক বিভেদ কতটা হীন, কদর্য হতে পারে। এতে আপনার, আমার, আমাদের যে অসুবিধা বা বিপদ, ধর্ম ও রাজনীতি এই দুই ধ্বজাধারীদের সেটাই সুবিধা। রাজনৈতিক বিভেদের কারণে, একই ধর্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল হলে, রাজনৈতিক ফায়দার কারনে, অনায়াসে তাতে ধর্মীয় রং চড়ানো হয়। আবার, ভিন্ন ধর্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যের গোলমালকে (কখনও এক ধর্মীয়, কিন্তু দুই ভিন্ন মতাবলম্বী গোষ্ঠীর মধ্যের গোলমালকেও), ধর্মীয় লাভের কারণে রাজনৈতিক বিভেদকেই দায়ী করা হয়(অন্তত সেরকম বোঝানোর একটা প্রচেষ্টা চলে)। এতে করে, এই দুই ব্যবসায়ী অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবসায়ী এবং ধর্মীয় ব্যবসায়ীরা প্রভূত লাভবান হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্ম এবং রাজনীতি, এই দুটোই ব্যবসার জিনিস, তা যদি না হয়, তবে এই দুটোকেই অন্তত ব্যবসা হিসাবে ব্যবহার করা যায়। আদিতে, ধর্ম হয়ত মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে মানুষ অন্যায় না করে সুখী হতে পারে। তেমনই রাজার রাজ্য শাসনের নীতি নির্ধারন হয়েছিল কল্যাণমূলক যাতে দেশের ও দশের কল্যাণ হয়। এখন রাজার জায়গা নিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ।  অতীতে এই দুটোর প্রবর্তক ও প্রবক্তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল, তার বর্তমান অবস্থা দেখলে তাঁরা হয়তো বা বুক কি কপাল চাপড়েই আত্মহত্যা করতেন, পরিণতি দেখবার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না। কি ভীষণ "উল্টা বুঝলি রাম" অবস্থা।

পর্ব ২

বাংলায় বলা হয় যে ধর্ম নাকি এমন কিছু যা মানুষকে ধারণ করে থাকে। শব্দ বা উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যই যদি কোন অর্থ প্রকাশ করে, তাহলে ধর্মের ইংরেজি যা হবে বা আরও অন্য ভাষায় যা হবে, তা কি সেই ভাষার মানুষকে ধারণ করবে না? নাকি সেই সব মানুষকে ধারণ করতে অসমর্থ হবে? কারণ ইংরেজীতে তো ধর্মকে বলা হচ্ছে Religion. অবশ্য, এখন এমন অনেক তার্কিক পন্ডিত আছেন যারা আপনাকে আমাকে শব্দের মায়াজালে ঠিক বুঝিয়ে দেবে, যে তাতে ঠিক কি বোঝায়। তারা ঠিক ডিকশনারি ঘেঁটে ঘেঁটে r, e, l, i, g, i, o, n, সব কটা ওয়ার্ড এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলবে যে এইজন্যই কথাটাকে বলা হয়েছে রিলিজিয়ন। সে যাক। সাধারণ ভাবে আমরা ধর্ম বলতে যা বুঝি(আকাশের বুকে সর্বশক্তিমান কিছু থাকুক কি না থাকুক) তা হলো, সৎভাবে জীবন যাপন করা, অন্যায় না করা, মিথ্যা আচরণ না করা, লোভ না করা, বিবেকের নির্দেশ মেনেচলা, এইসব। এর বিপরীত ক্রিয়াকলাপই হলো অধর্ম বা পাপ। আর পাপের বেতন যে মৃত্যু সেও আমরা সবাই জানি। তবে কেন এত রকমের ধর্ম দেখা দিয়েছে? আর ধর্মে ধর্মে বিভেদই বা কেন? ধর্মে ধর্মে বিভেদও না হয় বুঝলাম। কোন কোন ধর্মের তো আবার নিজের মধ্যেই বিভাজন আছে। তারাও যে একে অন্যকে পছন্দ করে না বা এড়িয়ে চলে। যেমন, খ্রীষ্টানের রোমান ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট। ইসলামের সিয়া আর সুন্নি। বৌদ্ধধর্মের হীনযান আর মহাযান। জৈনের শ্বেতাম্বর আর দিগম্বর, ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে কোথাও একটা উদাহরণ পেয়েছিলাম এইরকম:-

- আপনি কি হিন্দু? 

- হ, হিন্দু।

- আমিও হিন্দু। আপনি বৈষ্ণব, নাকি শাক্ত?

- বৈষ্ণব।

- হরে কৃষ্ণ আমিও বৈষ্ণব। আপনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নাকি চৈতন্য বৈষ্ণব?

- চৈতন্য বৈষ্ণব।

- হরে কৃষ্ণ। আমিও চৈতন্য বৈষ্ণব।

- তো আপনি কি ইস্কনে নাকি শ্রী গুরু?

- ইস্কনে।

- হরে কৃষ্ণ, আমাদের দেশি ইস্কন নাকি বিদেশি ইস্কন?

- দেশি। 

- হরে কৃষ্ণ, আমিও দেশি।

এই উদাহরনে শেষ পর্যন্তই দুজনের মধ্যে মিল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, যদি দেখা যেত যে, তফাৎ হয়েই চলেছে হয়েই চলেছে, তাহলে কি আর তারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারত? পারত না। মারামারি কাটাকাটি না লাগলেও, তারা পরস্পরের থেকে দুরে সরে যেত। কেননা, তারা জন্মসূত্রেই এই পারস্পরিক দূরত্বটা পেয়েছে, যে দূরত্বের উদ্ভাবক তাদের পূর্বসুরীরা।

কোনও কোনও ধর্মের আবার গ্রন্থ বা বই আছে। যেমন, ইসলামের আছে কোরান, বৌদ্ধের আছে ত্রিপিটক, খ্রীষ্টানের আছে বাইবেল, এইসব। অনেক ধর্মমতের তো কোন বইই নেই, তবুও তাদের জীবন ধারনে কোথাও কোন অসুবিধা আছে বলে তো মনে হয় না। বেশ কেটে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। আদিবাসীরা লেখাপড়ার ধারই ধারতো না, লিপিও ছিল না। তাই তাদের লিখিত সাহিত্য, বিঞ্জান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদিই নেই, ধর্মগ্রন্থতো দুরের কথা। 

তবে বর্তমানে দৃষ্টিবিভ্রমে সাঁওতালদের অবস্থাও অন্যদের মত হতে চলেছে। সাঁওতাল এখন প্রতিভার অধিকারী হয়ে আর কিছু হতে না পারুক, বেশ কিছু 'গুরু' বেরিয়ে পড়েছে, তাদের চেলাও তৈরি হয়ে গেছে।


জৈনধর্মের কোন গ্রন্থ নেই। জাপানী শিন্টোধর্মেরও কোন গ্রন্থ নেই। ধর্মের উৎপত্তি কেন হলো, কেমন করে হলো? এর ধারণাই বা মানুষ করলো কেমন করে? একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা মনে হয় কিছু ধরা বোঝা অসম্ভব নয়। অতীতের কথা যতটা যা জানা গেছে যে তাতে মানুষ নাকি একদা দলবদ্ধ, শিকারজীবি, যাযাবর জীবনযাপন করতো। কৃষির যুগ তখনও আসতে দেরী আছে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ যখন যেরকম প্রকৃতির রুপ দেখেছে, তখন তাকে সেইভাবেই কল্পনা করে নিয়েছে। কখনও ভক্তিতে, কখনও ভয়ে রুপকল্পনা করে (নারী, পুরুষ, শান্ত, বদরাগী, কল্যাণকারী, অনিষ্টকারী, ইত্যাদি) তাকে নানারকম উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে এসেছে। তার আগের পর্যায় পন্ডিতরা যা বলেছেন, একেবারে গোড়ায় পুরাতন প্রস্তর যুগ, তারপরে নুতন প্রস্তর যুগ, তারপর লৌহযুগ, এইসব। একেবারে গোড়ার দিকের দলবদ্ধ শিকারজীবি মানুষ, শিকার করা পশুমাংস প্রত্যেকে সমানভাবে ভাগ করে কাঁচা চিবিয়ে খেত। আগুনের ব্যবহার শিখবার পর তারা তাতে ঝলসিয়ে বা পুড়িয়ে খেতে শিখল। এতে করে তারা দেখল যে পোড়া মাংস খেতে সুস্বাদু এবং সহজপাচ্য। তারপর ক্রমবিকাশের হাত ধরে মানুষ পরিবার বাঁধল এবং একসময় কৃষিজীবি হল। এবারেই সাম্যবাদী খোলস ছেড়ে মানুষ অসাম্যের জীবনে এসে পড়ল। শুরু হল তোমার, তোমাদের, আমার, আমাদের জীবন। আর তখন কোন কোন মানুষের ইচ্ছে জাগল যে, জাগতিক যা কিছু কাজের জিনিস, তা যেন 'তোমার' চেয়ে 'আমার' বেশি বেশি থাকে। অর্থাৎ লোভের সূত্রপাত। এবং এর ফলে একে অন্যকে ফাঁকি দিয়ে একটু বেশি সরিয়ে নেওয়া, অথবা ওকে কায়দা করে বেশি খাটিয়ে নিজে একটু আরাম করা (স্বার্থপরতা), এইসব এলো। জেনে বুঝে নিজের বিবেক লঙ্ঘন করে মানুষ শুরু করল পাপের প্রক্রিয়া (যার অবধারিত ফল হল দুঃখ)। যে একজন পাপ করলো, অন্য একজন হয়ত তা জেনেবুঝেও চেপে গেল, প্রতিবাদ করল না, বা প্রতিকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে অন্য কারুকে জানালো না। তখন সেও কিন্তু হয়ে পড়ল পাপের ভাগিদার। এখন, সবকালেই কিছু কিছু মানুষ চিন্তায় ও কাজে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে যে বা যাদের মনটা ভালো এবং চায় যে সবার ভালো হোক বলে। সেরকম মানুষ কিন্তু উপলব্ধি করবে যে লোভের বশবর্তী হয়ে যারা অন্যায়, অর্থাৎ পাপ করছে, তার ফলেই কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে জাগতিক দুঃখ ও কষ্ট। তাই, তিনি হয়ত তাদের ভালোর জন্যই, মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজাবার প্রয়াস করলেন। তিনি মানুষের ভয় আর ভক্তিতে সৃষ্ট কাল্পনিক দেব অথবা দেবীকে দিয়ে কাজ হাসিল করবার চেষ্টা করলেন। তাঁর প্রয়াসে কিছুটা চিড়ে হয়ত ভিজল, কিন্তু সবটা নয়। অর্থাৎ লোভের বশবর্তী হয়ে যারা অন্যায়ের পথে পা বাড়িয়েছিল, কিছু হয়ত সংযত হল কিন্তু সবাই নয়। এবারে সেই যার মনটা ভালো, মানুষের ভালো চান, পরবর্তীতে তিনি কি করবেন? আগের মিষ্টি কথার বদলে, একটু একটু করে যষ্টি প্রয়োগ করবেন। কিছু নরম, কিছু গরম বাণীর সাথে সাথে বাধ্যতামূলক আচার অনুষ্ঠানের বিধান দিলেন। এবার দেখা গেল, ফল হল আগের চেয়ে ভালো। দেখা গেল যে অন্যায় কাজ অনেক কমে গেল, ফলে মানুষও অনেক ভালোভাবে জীবনযাপন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু কথায় আছে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। পাপের পথে যে একবার পা বাড়ায়, পাপ তাকে নিত্য হাতছানি দেয় (পাপের পথ মসৃন)। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই যথা পূর্বম তথা পরং। অর্থাৎ, আবার অন্যায়ের মাথাচাড়া দেওয়া এবং জাগতিক দুঃখকষ্টের বৃদ্ধি হওয়া। ফলে, আবারও আরো কোন একজন মানবহিতৈষী(ততদিনে আগেরজন হয়ত মারা গেছেন) মানব উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালালেন। তবে আগের জনের চেয়ে হয়ত আরও পৃথক বাণীতে, পৃথক পদ্ধতিতে। এখন সর্বকালেই আমরা বেশকিছু হুজুগে মানুষের দেখা পাই, যারা নতুন কিছু পেলেই হা রে রে রে করে মেতে ওঠে। নতুন মানবদরদীকে পেয়ে তাদের গুরু, গুরু রব ছাড়তে দেরি হল না। তারা জোর কদমে প্রচারের কাজ চালাতে লাগল। তারা একটা নামও দিয়ে দিল, ফলে উদ্ভব হলো নতুন এক ধর্মের। নামকরন হল, হয় গুরুর নামে নয়তো অন্য কোনো কিছু। তারা চাইলো অন্য সবাইকে এই গুরুর ছত্রছায়ায় আনতে, নিজেদের দলভারি করতে। কেউ আসতে রাজী হল, কেউবা হল না। যারা এল তারা অতি উৎসাহীর হাত থেকে বেঁচে গেল, যারা এলনা, তারা দুয়ো পেতে লাগল। এতে করে, একে অন্যকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা এল। ক্রমে ক্রমে এই এড়িয়ে চলা গিয়ে দাঁড়ালো বিরোধে এবং এই বিরোধ একদিন গিয়ে দাঁড়ালো প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে। এইভাবে যত গুরুর সংখ্যা বেড়েছে, মানুষে মানুষে বিভাজনও বেড়েছে। দাঁড়ালো গিয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণের বাণীতে যা 'যত মত তত পথ'  এর মতো। অর্থাৎ সেই 'উল্টা বুঝলি রাম।' 

পর্ব ৩

মানুষের ভালো করতে গিয়ে হলো মন্দ। এবং এতে ইন্ধন যোগানোর কারিগর সব হলেন গুরুর চ্যালাচামুন্ডাগণ। তাঁরা চিরকালই সেই বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। এই প্রক্রিয়া যে কোনও একটা জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেই চলেছিল সেরকম নয়, ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও চলেছিল। ফলে দিকু বা হিন্দুর ধর্মচেতনা একভাবে বয়ে চলেছিল, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, আরও অন্যান্যদের অন্য অন্যভাবে বয়ে চলেছিল। ফলাফল, বিভিন্ন নদীর তাদের শাখানদী, উপনদী নিয়ে একই সমুদ্র অভিমুখে, কিন্তু আলাদা আলাদা পথে বয়ে চলার মত। অন্তিমে নাকি সবারই স্বর্গপ্রাপ্তি। ইতিমধ্যে পূর্ববর্তী কোনও ধর্মমতের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় গুরু বা তারও পরের গুরুদের আবির্ভাব হয়ে গেছে। ফল, আবারও বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার আরও একটা কারণ হলো, জাতি ও ভাষাসত্তা। এক জাতির যখন কোন গুরুর উৎপত্তি হলো, স্বাভাবিক জাতিসত্তার প্রবণতায় অন্য কোন জাতি হয়ত তাতে উদ্বুদ্ধ হলো না। এবং একসময় দেখা গেল, কোন এক সুন্দর সকালে তাদেরও নিজস্ব গুরুর আবির্ভাব হয়ে গেছে। অতএব, ষোলকলা পূর্ণ।

ধর্মীয় বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে বা বিশেষ কোন দেবালয়ের বা পূজারীদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে, বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল(ব্যাক্তিবিশেষও হতে পারে) ভোটব্যাঙ্কের ফায়দা তোলে, তুলতে পারে। কিন্তু, যেদেশে সরকার অথবা সরকারে থেকে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এইরকম কাজ হাতে নেয় এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে, বুঝতে হবে সেদেশের হাল কতটা দয়নীয় (অ-শিক্ষা, কু-শিক্ষা)। তাই দেখা যায়, দেশ গড়ার স্বার্থে এদেশে যেখানে অলি গলিতে লাইব্রেরি হওয়া দরকার, স্কুল হওয়া দরকার, শরীর গঠনের ক্লাব হওয়া দরকার, তার বদলে সরকারের তরফে না হলেও সরকারে থাকা কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের তরফে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য মন্দির, মসজিদ বা চার্চ বানাবার অথবা সংস্কার করবার কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে।

তাই মনে হয়, কার্ল মার্কস বাধ্য হয়েছিলেন বলতে যে ধর্ম হল জনগণের কাছে আফিমের মত, যার নেশায় তারা আচ্ছন্ন থাকে বা শাসক দ্বারা শাসন ও শোষনের স্বার্থে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়।

বলা হয় যে বর্তমান জীবনে যে যা হয়েছে, তা হয়েছে তার বা তাদের পূর্বপুরুষদের পূর্বজন্মের পাপ বা পূণ্যের কল্যাণে। প্রচার করা হয় যে মাথার উপরে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর/আল্লা/গড আছেন, যিনি সবার ভাগ্য নির্ধারন করেন। ফলে, মানুষের কোনও কারিকুরি সেখানে চলে না। মাথা পেতে ঈশ্বরের/আল্লার/গডের(প্রকারান্তরে রাজার। মর্ত্যভূমে তিনিই নাকি ঈশ্বরের অবতার) নির্দেশকে বিনা প্রশ্নে, সীমাহীন আনুগত্যে, বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে জীবনধারণ করতে হয়। কিছু স্বঘোষিত, ঈশ্বরের ঠিকাদারের দেখা পাওয়া যায় যারা ধনিক শ্রেণীর দালালি করে, গরিব শ্রেণীর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বেশ আয়েসে জীবন কাটায়। যুগে যুগে, দেশে দেশে, এই তন্ত্র বা সিস্টেম, এমন করেই প্রভুত্ব করে এসেছে যাকে রাজতন্ত্র বলে থাকি। 

এটা যদি সত্য না হয়ে থাকে, তবে যুগে যুগে, দেশে দেশে গণ আন্দোলন বা বিপ্লব বারেবারেই কেন দেখা দিয়েছে? ব্যাপারটা হলো প্রশ্ন করার, প্রশ্ন তোলার হিম্মতের, জবাব পাবার অধিকারের। এইখানেই শাসক শ্রেণী আর তার তাঁবেদারদের কৃতিত্ব যে তারা, কি কি পদ্ধতিতে কেমনভাবে এই মুক্তচিন্তার প্রশ্নের গলা টিপে ধরতে পারে বা পেরেছে। আজকে ভাষাবিদ্যার প্রয়োগে মিষ্টি মোড়কে যাই নাম দেওয়া হোক না কেন, সারা পৃথিবীতেই একই মানসিকতার, একই জিনিসই চলছে। হ্যাঁ, যুগের সাথে ভাবনার একটু রদ বদল তো অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে, শাসকের শীর্ষনেতাকে রাজার বদলে কোথাও প্রধানমন্ত্রী বলা হয়, কোথাও বা প্রেসিডেন্ট বলা হয়। আর, এখন একা খাওয়ার বদলে পাঁচ পাঁচ বছর করে একদল লোককে যথেচ্ছ জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়া হয়, ধনাঢ্য করে তোলা হয়(পোষাকী নাম মন্ত্রীসভা)। তারা নাকি শর্তসাপেক্ষে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত(নির্বাচনের আগে ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দেয়)। কিন্তু জনগণ যখন শর্তের কথা তোলে, তখন তাদের উপর বর্ষিত হয় লাথি, ঝাঁটা, কিল, চড় নয়ত গিলি গিলি ফুঃ, হাপ্পিশ। এই সিস্টেমের পোষাকী নাম নিশ্চয় বলতে লাগবে না যে এ হল গণতন্ত্র। সে যাক। কথা হচ্ছে ধর্মের। পাঠক, চিন্তা করুন ধর্মের উদ্দেশ্য নাকি মানুষের আত্মিক উন্নতির। সেখানে গেরুয়া পরে, কি সাদা কাপড় পরে, কি লাল কাপড় পরে, কি হলুদ কাপড় পরে, কি কাপড় না পরেই(উলঙ্গ থেকে), কি পাগড়ি পরে, কি দাড়ি না কেটে, কি পূর্বদিকে প্রণাম করে, কি পশ্চিমদিকে প্রণাম করে, কি আত্মিক উন্নতি হয়, বোঝা দুস্কর। এ তো ব্যবধানই সৃষ্টি করা হলো। হিংসা না করা, লোভ না করা, অন্যায় না করা, অন্যায় সমর্থন না করা(তেমনই অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও), মিথ্যা না বলা, কু চিন্তা না করা, ইত্যাদি সৎ কর্মের জন্য কোন উপচারের প্রয়োজন আছে কি? আসলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় চেলারা, তাদের কেউ কেউ আবার ততদিনে প্রমোশন হয়ে নিজেরাই গুরু বনে গেছে, তারা দেখেছে যে যত উপচার, তত টু পাইস প্রফিট(দুগ্ধে, ঘৃতে, চর্বচোষ্যে এলাহাবাদ কান্ড)। করতে করতে আজ শিশু চারাগাছ মহীরুহ, এমনকি মহীরুহ ছড়িয়ে পড়েছে শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও। তেমনই, বিদেশের বিভিন্ন ধর্মমত সেখানকার মাটিতে আটকে না থেকে (ধর্মের তেজ বলে কথা) এদেশেও মহীরুহ হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের কি রমরমা, চিন্তা করা যায় না, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যে যে ধর্মগুরুরা বিভিন্ন কেস খেয়ে ফেঁসে আছেন (নজরবন্দী বা জেলে আছেন), তাদের কর্মকান্ড নিয়ে একটু খবর নিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন (যারা ফাঁসেন নি তাদেরও  বুঝতে পারবেন)। তারা আপনাকে, আমাকে বলে ত্যাগের কথা, তারা আমাদের শেখায় মায়াবাদ। 

পর্ব ৪

কথা হলো, এর থেকে বেরিয়ে আসার কি কোন উপায় নেই? (বেরোতে দিলে তো বেরোবে? বেড়াজাল বিছানো আছে চতুর্দিকে)। বেরোবার উপায় থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই যে বলে, লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে? অধিকাংশ মানুষই চায়, যেমন আছে চলতে দাও, কোন পরিবর্তনের দরকার নেই। হ্যাঁ, এটা বা এরকম চলতে পারে ততক্ষণ, যতক্ষণ না বিশেষ কোন ক্ষমতাবান মানুষ বা সম্প্রদায়কে আঘাত করছে বা তাদের ক্ষতি করছে। যদি ক্ষমতাবান শাসকদের বা তাদের আপনজনদের ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায়, তবে অচিরেই দেখা যাবে পরিবর্তন এসে গেছে। অ্যাট এনি কস্ট, সামহাও তারা পরিবর্তন আনবেই। কিন্তু অর্থনৈতিক, শিক্ষানৈতিকভাবে দুর্বল, ভীরু, শতধা বিভাজিত, শাসিত আর শোষিতের বেলায়? দেখা যায়, প্রসঙ্গটা কে তুলবে, সেই লোকেরই দেখা পাওয়া না। জনমত, আন্দোলন, বিপ্লব তো বহুত দুর কি বাত। তাই মানুষের ধর্মবিশ্বাসে লাভবান শ্রেণী, কোনদিন কখনও চায়নি এবং এখনও চায় না যে এই গোলকধাঁধা থেকে মানুষ বেরোক। ধর্মকে শিরদাঁড়া বানিয়ে চলছে বিশ্বব্যাপী বিশাল বাণিজ্য লহরী। একটা উদাহরন দিই। ধরেনিন কোনও একটা মন্দির/প্যাগোডা/মসজিদ/চার্চ/গুরুদ্বারা, ইত্যাদি। কেউ ভক্তিতে প্রণাম করতে গেলে প্রণামি দিতে লাগে (যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এসব জায়গায় প্রণাম করলে পূণ্য অর্জন করা যায়। পূণ্য করবো কেন? না, আমাদের জন্মই হয়েছে পাপের মধ্যে দিয়ে। আমরা জন্মপাপী। তাই আমাদের পূণ্য অর্জন করতে হবে, দান ধ্যান, পূজো ব্রত, ইত্যাদি কাজের মধ্যে দিয়ে)।এতে বিশেষ প্রতিষ্ঠানের যে সেবক/সেবকেরা নিয়োজিত/লিপ্ত আছে তার/তাদের সরাসরি লাভ বা উপার্জন। শুধু প্রণামি দিয়ে প্রণাম সারলে আবার চলবে না। একটা মোমবাতি অথবা কটা ধূপকাঠি জ্বালাতে লাগবে। সে সব সাজিয়ে কাছেপিঠেই বসে আছে সেবকের ভাই বিরাদারেরা। তাদেরও টু পাইস লাভ। হতে পারে, তাদের বিক্রির একটা অংশ কমিশন হিসেবে সেবককে/সেবকদের দিতে লাগে। তেমনই, কোথাও আছে ফুলের, মালার, চন্দনের দোকান, কোথাও বাতাসা নকুলদানার দোকান, আরও আছে চাদরের দোকান, মোমবাতির দোকান, কলা, আপেল, আঙুর, নারকেল, ধূপ-ধুনো, ইত্যাদি যথাবিহিত উপচার। অর্থাৎ, পুরোপুরি একটা সাজানো গোছানো বাজার। এখন কেউ যদি চক্রবৎ চলতে থাকা এই বাজারটা ভাঙতে যায়, সে কি রেহাই পাবে এর পৃষ্ঠপোষকদের হাত থেকে? এভাবেই শুরু হয়েছিল এবং চলে আসছে ভাগ্যবাদীদের নিয়ে প্রবাল, গোমেদ, চুনী, পান্নার রঙীন পাথরের ব্যাবসা। এভাবেই চলছে কবচ বা তাবিজের ব্যাবসা। ইদানিং এসেছে লাকি বাম্বু (কার জন্য লাকি? জনসাধারণের পেছনে আনলাকি বাম্বু), লাফিং বুদ্ধ (জনগন বুদ্ধু), জাম্পিং ফ্রগ, ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অর্থনৈতিক পরাধীন, চিন্তাচেতনায় পরাধীন মানুষ, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোতেই বিশ্বাস করে। বর্তমান জগত, বিশ্বাসের জগত, যে বিশ্বাস কমছে না বরং বেড়েই চলেছে, যুক্তি যেখানে কাজ করে না, কাজ করতে দেওয়া হয় না।  এই বিষয়টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব সুন্দর করে বলে গেছেন তাঁর একটা কবিতায়। শোনা যাক:-সর্বহারা অবিশ্বাসী

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী, বেশ সেজেগুজে এসেছে/

কিন্তু আমাদের সঙ্গে খেতে বসবে না/

আজ তার নীলষষ্ঠী/

যৌবন বয়সে এই নিয়ে কত না চটুল রঙ্গ/ করতাম/

এখন শুধু একটা পাতলা হাসি,/ অন্যের বিশ্বাসে নাকি আঘাত দিতে নেই/ আর এক বন্ধু, যে প্রথম আমায় ছাত্র/ রাজনীতিতে টেনেছিল/ তার আঙুলে দেখি একটা নতুন পাথর-বসানো/ আংটি/ আমার কুঞ্চিত ভুরু দেখে সে দুর্বল গলায় বলল/ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না,/ তাই শাশুড়ি এটা পরতে বললেন, মুনস্টোন/ না বলা যায় না/ আমার মনে হল, এ যেন আমারই নিজস্ব পরাজয়!/ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের বাড়ি, মাঝে মাঝে যাই তাঁর/ আলাপচারী শুনতে/ এখনও কত কিছু শেখার আছে/ আজই প্রথম দেখলাম, তাঁর দরজায় পেছন/ দিকে,/ গণেশের মূর্তি আটকানো/ প্রশ্ন করিনি, তিনি নিজেই জানালেন,/ দক্ষিণ ভারত থেকে ছেলে এনেছে, কী দারুণ/ কাজ না?/ সুন্দর মূর্তির স্থান শো-কেশের বদলে দরজার/ ওপরে কেন/ বলিনি সেকথা, সেই ফক্কুড়ির বয়েস আর নেই/ বয়েস হয়েছে তাই হেরে যাচ্ছি, অনবরত হেরে/ যাচ্ছি/  অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই, অন্যের/ বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই/ চতুর্দিকে এত বিশ্বাস, দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে কত/ রকম বিশ্বাস/ যে গেরুয়াবাদী ঠিক করেছে, পরধর্মের শিশুর/ রক্ত/ গড়াবে মাটিতে, চাটবে কুকুরে/ সেটাও তার দৃঢ় বিশ্বাস/ ধর্মের যে ধ্বজাধারী মনে করে, মেয়েরা গান/ গাইলে গলার নলি/ কেটে দেওয়া হবে/ টেনিস খেলতে চাইলেও পরতে হবে বোরখা/ সেটাও তার দৃঢ় বিশ্বাস/  যে পেটে বোমা বেঁধে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে/ যে পেশি ফুলিয়ে, দেঁতো হাসি হেসে/ পদানত করতে চাইছে গোটা বিশ্বকে/ এরা সবাই তো বিশ্বাসীর দল/ সবাই বিশ্বাসী, বিশ্বাসী, বিশ্বাসী.../ এক একবার ভাঙা গলায় বলতে ইচ্ছে করে/ অবিশ্বাসীর দল জাগো/ দুনিয়ার সর্বহারা অবিশ্বাসীরা এক হও!


তবুও, পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবর্তনও হয়েছে (তবে উপযুক্ত মূল্য দিতে হয়েছে)। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস, ভারতের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, নিজেদের ইতিহাস পড়বে কে? যাদের পড়া দরকার, যাদের পরিবর্তন দরকার, তাদের কতজন লিখতে পড়তে পারে, কতজন নিরক্ষর তারা নিজেরা কি সে খোঁজ রাখে? ইতিহাস বলে যা পাই, পড়ি, তা কি প্রকৃত ইতিহাস? যাইহোক, ভারতে ইংরাজের প্রভুত্বকালে ইংরাজ মিশনারীগন জ্যাকপট লাভ করে সাঁওতাল বা সাঁওতালদের মত নিরীহ, গোবেচারা আদিবাসীদের পেয়ে (অন্যান্য ভারতীয় জাতিও ছিল)। ফলে, সাঁওতালদের নন্ খ্রীষ্টান আর খ্রীষ্টানের মধ্যে এল বৈরিতা, সন্দেহ, এইসব এবং তা এখনও প্রবহমান (এমনিতেও সাঁওতালদের মধ্যে সারিধরম আর সারনাধরম বলে, দুই ধর্মমতের প্রবাহ অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে)। ইংরাজ মিশনারি বলে কথা, তাদের ব্যাবস্থা একেবারে নিখুঁত(গীর্জা প্রথা)। কেউ বেরোতে চাইলেও পারবে না, বরং আড়কাঠি হয়ে তারা চেষ্টা করে নতুন নতুন সাঁওতালদের (অন্য আদিবাসীরা অন্য স্ব-জাতীয়দের) নিজেদের দলে ঢোকাতে। ইদানিং আবার শোনা যাচ্ছে যে সাঁওতালি যে পরব, গান বাজনা তারা একদা ত্যাগ করেছিল, বাদ্যযন্ত্র সহকারে সাড়ম্বরে তাই তারা অনুষ্ঠিত করছে (এরমধ্যে নতুন কি চাল আছে কি নেই, কে বলতে পারে? আমি তো বলতে পারব না। সাঁওতাল খ্রীষ্টান কি কম পড়িয়াছে? বিশ্বের খ্রীষ্ট সমাজ সুদুর ভ্যাটিকান থেকে পরিচালিত হয়, আপনি আমি কোন মহাজন যে তা বুঝতে পারব?) তবে,

পৃথিবীতে এখন মানুষেরই বড় অভাব। পৃথিবী ভরে গেছে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পারসী, জৈন, সারিধরম, সারনাধরম, ইত্যাদি  ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীতে। আর এই তথাকথিত ধার্মিকরা, একদা মহান ও সুন্দর পৃথিবীতে হানাহানি, রক্তপাত, খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নি সংযোগ, ভেদাভেদ আর হিংসারই আমদানি করেছে। পৃথিবী তাই আর সুস্থভাবে বাসযোগ্য নেই। সেটা করতে হলে, যুক্তি মনস্ক, বিজ্ঞান মনস্ক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, বিবেকবান, মানবিক মূল্যবোধের লোক চাই, স্বাভাবিক জীবন যাপনে যারা মানুষ হয়ে উঠবে এবং অন্যদের করে তুলবে।


পর্ব ৫

যুক্তিবাদী হওয়া সত্বেও, ব্যাক্তিজীবনে অনেকেই কিন্তু প্রকৃতই দ্বিচারি জীব(আমিও তাই)। মুখে বলে ঠাকুর দেবতা মানি না, ধর্ম মানি না, ভাগ্য মানি না, জ্যোতিষ মানি না, লাল সূতো, কবচ তাবিজ, পাথর - শিকড় মুর্দাবাদ, কিন্তু সেই তারাই হয়ত রাত জেগে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরে, ঈদে বা দশমীতে কোলাকুলি করে, প্রণাম করে। সাঁওতালের 'আবগে বঙ্গা'য় গ্রামের লোকের সাথে বাৎসরিক পিকনিক করে, মারাংবুরুর নামে জাহের থানে মুরগি মানত করে, আরও কিছু করে (আমিও)। আসলে, তারা এ সবের বিকল্প এখনও খুঁজে পায়নি, যা সফলভাবে এক জাতির সব মানুষকে, অথবা যে কোন জাতিরই প্রতিটি মানুষকে মেলাতে পারে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে। ততদিন যুক্তিবাদী হয়েও ঐসব সহ্য করে চলেছে, মেনে চলেছে নেহাৎ নিরুপায় হয়েই। কারণ, এখনও পর্যন্ত তারা এমন কিছু ভেল্কি আবিস্কার করতে পারেনি, যা আবালবৃদ্ধবনিতা, আপামর জনসাধারনকে ভুলিয়ে, আনন্দ দিয়ে একত্র রাখতে পারে। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত তারা খুবই  সংখ্যালঘুও বটে। অন্যদিকে, যে কোন মনুষ্য সমাজেই, শিশুর জন্মের সময় থেকেই তাকে  দেবদেবী, কবচ তাবিজ, শিকড় পাথর, অলৌকিক, অতিলৌকিক, ভৌতিক, দৈবী ইত্যাদির বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেফেলা হয়। যুক্তিবাদী হতে কোন একটা মানুষের কমপক্ষে অন্তত ২৪/২৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যেতে পারে। কানে শুনে বিশ্বাস করার পরিবর্তে, গুরুদেব বলেছেন বলে বিশ্বাস করার পরিবর্তে, যুক্তির উত্তর চাইলেই নাস্তিক, পাখন্ডী, ইত্যাদি কথা শুনতে হয়। স্বাভাবিক কৌতূহলেও কেউ যুক্তির কথা জানতে চাইলেও রে রে করে চতর্দিক থেকে আক্রমণ ধেয়ে আসে (মা, বাবা, ভাই, বোন, ঠাকুমা, দাদু, পিসি, মাসী, মামি, কাকিমা, জেঠিমা, পাড়ার দাদু, কাকু, জেঠা, ইত্যাদি ইত্যাদি)। তবুও বলবো, মানুষের যুক্তিবোধ সংখ্যায় কম হলেও বেড়ে চলেছে, বাড়তেই থাকবে যদি না তারা বাধ্য হয় এবং ধান্দাবাজদের খপ্পরে বা ফাঁদে পড়ে। বহু যুক্তিবাদীদের ক্ষেত্রে তো লাইফ থ্রেটনিং পর্যন্ত  হয়ে গেছে। কেউ বা শহীদও হয়ে গেছেন। তবুও, সুখের অন্তত একটা বিষয় হয়েছে যে কয়েক বছর যাবৎ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ধর্মের কলামে বিভিন্ন ধর্ম উল্লেখের সাথে সাথে 'মানবতা' কেও উল্লেখ করে চলেছে, অনেকের মতেই একমাত্র যেটা হওয়া উচিৎ। ধর্ম যদি আড়ম্বর সর্বস্বই কিছু হয়, তবে বলবো, রজনীশই একমাত্র সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন, আর তা হলো ভোগের মধ্যে দিয়ে ত্যাগের রাজ্যে উত্তরণ। তাঁর মতে, যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সে আবার কি ধর্ম করবে? ধর্ম করতে হলে বা ধর্ম পালন করতে হলে ধন থাকা চাই। তবেই না কেউ ভোগ করতে করতে একসময়  ত্যাগের রাজ্যে পৌঁছবে! যার মনে সবসময় কামনা রয়েছে, বাসনা রয়েছে, জাগতিক সামগ্রীর জন্য লালসা রয়েছে, তার পক্ষে ত্যাগী হয়ে মোক্ষলাভ একান্তই অলীক ব্যাপার। ভালোভাবে ধর্ম পালন করতে হলে তো আড়ম্বরও তদনুরুপ হতে হবে। জপতপের ভালো জায়গা চাই (উত্তম ইট, বালি, সিমেন্ট, মার্বেল, টাইলস্ এর ইমারত), একটা মূর্তি চাই বা মূর্তি না হলে লোকের চোখে ধাঁধা লাগানোর মত অনুরুপ একটা উপাদান চাই, ঢাক চাই, কাঁসি চাই(কখনও খাসিও চাই), উত্তম বস্ত্র চাই, আসন চাই, ধুপধূনো, কোশাকুশি চাই, ফুল চাই, মালা চাই, আতপ চাল ধান দূর্বা চাই, আপেল কলা (সব কলা আবার ঠাকুরের পেটে সহ্য হয় না), নকুল দানা, বাতাসা, ঢাক ঢোলের আওয়াজ, মাইক বক্সে তাকে দশগুন বাড়িয়ে পরীক্ষার্থী, হার্ট পেশেন্টদের অসুবিধা করে আড়ম্বর করা চাই। অর্থাৎ কিনা ধমাকেদার দেখনদারি চাই (ব্যবসা চলবে না কেন বলুন?)। সত্যিই তো, গরীবের দম কোথায় এমনভাবে কোনও ঠাকুরের (বা ভগবানের) সেবা করার, ধর্ম পালন করায়? রজনীশ তো তাহলে ঠিকই বলেছেন। তা সত্বেও বলছি, মন্দির, মসজিদ, চার্চ, প্যাগোডা, অবতার, ঠাকুর, এসব যদি সত্যি হত, প্রসাদ কি চরণামৃত খেয়ে কখনও ভক্তদের ভেদবমি হত না, হাসপাতালের চিকিৎসায় তাদের ভালো হতে হত না। কখনও চোর বাবাজীরা মন্দিরের সামগ্রী, মূর্তির গায়ের সোনারুপোর অলঙ্কার চুরি করে, কখনও হয়ত বহুমূল্য মূর্তিটাকেই চুরি করে নিয়ে যায়, অথচ কোন ঠাকুরের ক্ষমতা হয় না তাদের আটকাতে। ঠাকুরের অভিশাপে না হয় তাদের প্যারালিসিস কি ওলাওঠা, না হয় তাদের ভেদবমি (এই কারনেই যুক্তিবাদীরা অন্তর থেকেই অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী নয়, শুধুমাত্র উৎসবে বিশ্বাসী যা মানুষে মানুষে মিলন আনে, বিভেদ ঘটায় না)। 

এতসব বুঝেও, তা সত্বেও সাড়ম্বরে ঠাকুর পূজো করতে হবে, ধর্মস্থান বানাতে হবে, লক্ষ লক্ষ থেকে কোটি টাকার বাজেট রাখতে হবে, নতুন নতুন দেবস্থান গড়তে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার চাঁদা তুলতে হবে, চাঁদা না দিলে পেটে লাথি মারবো, হাত ভেঙে কোলে তুলে দেব, ইত্যাদি।

 A জাতি ধর্মের সামাজিক, দৈবিক কাজে যদি B দল আপত্তি করে, বাধা দেয়, হুকুম মত চাঁদা দিতে না চায়, ওদের মহল্লায় রাতে পেটো ঝাড়বো, কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেবো, ইত্যাদি। আমাদের চেনো না তো বাছাধন, বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বো। আমরা পরম ধার্মিক বলে কথা(অহিংসা পরমো ধর্ম)। কাজেই আর বেশী বক্তব্য রেখে লাভ কি? অর্থনীতিবিদরা দোহাই দেবেন, কি দরকার, চলতে দিন না মশাই যেমন চলছে। দেখছেন না কি, অন্ধবিশ্বাস কি বিশাল একটা শিল্প ও বাণিজ্য। এইসব পুরোহিত, বাবাজী, গুরুজী, ধর্ম, ঠাকুর, মূর্তি, ভাগ্য, পাথর আছে বলেই না সারা রাজ্যে কি সারাদেশে ধনী থেকে গরীব কেমন করেকম্মে খাচ্ছে। দেখুন কেমন খড় শিল্প বেঁচে আছে, বাঁশ শিল্প বেঁচে আছে, মাটি শিল্প বেঁচে আছে, রং শিল্প বেঁচে আছে, শোলা শিল্প বেঁচে আছে, ফুল শিল্প ফল শিল্প বেঁচে আছে, দূর্বা ঘাস- বেলপাতা শিল্প আছে, বাতাসা নকুলদানা শিল্প বেঁচে আছে, সন্দেশ মিষ্টি শিল্প বেঁচে আছে, ছাগল-গোরু-উট শিল্প (বলি দেবার জন্য) বেঁচে আছে, লাল শালু শিল্প গামছা শিল্প ধুতি শাড়ী শিল্প বেঁচে আছে, ঢাক শিল্প (শিল্পীও) বেঁচে আছে, শ্যামা সঙ্গীত শিল্প বা ঠাকুর বন্দনা শিল্প বেঁচে আছে(সঙ্গে হারমোনিয়াম, তবলা শিল্প আছে, গীতিকার সুরকার আছে), নৃত্য শিল্প আছে, ঠাকুরের ছবি আঁকা শিল্প আছে, ঠাকুরের মালা- লকেট শিল্প আছে, নাটক-সিনেমা আছে, কাব্য সাহিত্য আছে, ঠাকুরের গানের কলার টিউন আছে, ইত্যাদি। এখনকার থিম পূজোর জন্য কোন শিল্পটা যে বাদ আছে,  এমন হয়ত খুঁজেই পাওয়া  যাবে না। রঙীন বেলুন হতে পারে, কাঁচের বোতল হতে পারে, কোল্ড ড্রিংসের বোতল হতে পারে, তালা চাবি, কলম, লন্ঠন, করাত কাটারি, চুলের কাঁটা বা ফিতেও হতে পারে। কখন যে কোনটা থিম হবে আপনি আমি পাত্তাই পাবো না। 

অন্যদিকে কট্টর  যুক্তিবাদীরাও কে যে কখন সুবিধাবাদী হয়ে প্ল্যাটফর্ম বদল করতে পারে, তাই বা কে বলতে পারে? চোখের সামনে যখন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের সই করা রাশি রাশি সার্টিফিকেটের হাতছানি আসবে, তখন যে কেউই এই যুক্তিই দেখাতে পারে যে, যুক্তিবাদ মে ক্যা রক্খা হ্যায় য়ার! মওকা মিলা হ্যায় আও, কামালো কামালো। আর কারও সামনে যদি বারো ইঞ্চি মাপের স্টিলের চকচকে ফলা তুলে ধরা হয়? যারজন্য প্রতিবাদী চরিত্ররা চিরকাল সলমন রুশদী হয়ে খোলামঞ্চে ছুরি খেয়ে যাবে, এতে আর অবাক হবার কি আছে? তা সত্বেও জোর গলায় বলা চলে, ধর্ম ব্যাবসায়ী, ভাগ্যবাদী অথবা জাতপাতের বিভেদকামীদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, মানবতা ধর্মের ডক্টর দাভোলকরদের হত্যা করা গেলেও, তাদের আদর্শকে কোনভাবেই হত্যা করা যায় না, যাবে না।

অ্যালোপ্যাথি বনাম গেলোপ্যাথি (পার্ট-২) -প্রবীর ব্যানার্জী
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:290 | likes:0 | share: 2 | comments:0

আলোচনা যত এগোচ্ছে তত একটা ব্যাপার উঠে আসছে যে আপনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সেবার বিরুদ্ধে যতই লিখুন আমি কিন্তু এই চিকিৎসা করিয়ে ফল পেয়েছি। কেউ বলছে আঁচিল সেরে গেছে, কেউ বলছে অর্শ নিরাময় হয়েছে এসব। আজকে তাহলে রোগ সারা না সারা এবং তাতে ঔষধ এর অবদান কখন আসছে সেটা নিয়ে আলোচনা করি।

আসলে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও সব রোগ নিরাময় করা যায় না, নিরাময় যোগ্য সব রোগও সবসময় সারে না। কিছু কড়া ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ ভীত আর বিরক্ত - প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারদের অনেকেরই দরদের অভাব, দায়িত্বহীনতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার পরিচয়ে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসকদের সীমাবদ্ধতার ফলেই মানুষের হোমিও প্রীতি ঘুচছে না। আর আছে ফল পাওয়ার প্রশ্ন। অনেক অসুখই এমনকি মারাত্মক হলেও প্রকৃতির নিয়মেই আপনি সেরে যায় বা কমে আসে। আবার কখনো কখনো রোগ সারার মূলে থাকে রোগীর মনের বিশ্বাস। হোমিওপ্যাথি  তখন পাশাপাশি চিকিৎসা হিসাবে চললে ঐ ঝড়ে বক মরার নিয়মে পসার বাড়ে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এর  ফল ঘটতে পারে অভিভাব- স্বাভিভাবের জন্য(Suggestion and auto suggestion). হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহৃত পদ্ধতি ও ওষুধ কে চিকিৎসা কেন্দ্রে যাচাই করার বহু প্রচেষ্টা থেকে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় নি। (Great Soviet Encyclopedia, 3rd edition,1970)

ভারতবর্ষে একদিকে বাড়ছে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর অনাহার। অপরদিকে আধুনিক চিকিৎসকদের মানসিকতা সেবার নয়; না হলে সুশিক্ষিত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা হাজারে হাজারে ধনবান ইংল্যান্ড আমেরিকাবাসীর চিকিৎসা করাতে সাগর পার করতেন না। দুঃস্থ, রুগ্ন মানুষ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসতেই পারে না বা খরচে কুলিয়ে উঠতে পারে না। ভারতে তাই হোমিওপ্যাথের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

ভারতবাসীকে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা যোগানোর দায় থেকে ভারতের শাসকরাও যেন কিছুটা হালকা হতে চেয়েছিলেন। তাই কি ১৯৭৩ সালে পাশ হয়েছে হোমিওপ্যাথিক কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আইন আর ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হোমিওপ্যাথিক কেন্দ্রীয় কাউন্সিল? ভারতে যার বয়স সওয়া-শ বছর সেই হোমিওপ্যাথিকে দেশীয় চিকিৎসার মর্যাদা দেওয়া হলো। বলা বাহুল্য হোমিও ঔষধ এর বিশুদ্ধতা বা গুনমানের যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই।


ভারতবর্ষ মন্ত্র, তন্ত্র, তাবিজ কবচ, জ্যোতিষ, হাত দেখার দেশ। মানুষের শরীর ও জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এখানে অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু আই.এম.এ. র মতো সংস্থাগুলো জনচিকিৎসার ডিপ্লোমা কোর্স চালু করার বিরুদ্ধে সরব হলেও চলতি ভূয়া চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর ব্যাপারে নীরব কেন?

বিজ্ঞানে সত্যানুসন্ধানে আলোচনা ও সমালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণ বিশেষ করে বিজ্ঞানকর্মীরা-হোমিওপ্যাথি কতটা বিজ্ঞানসম্মত তার নিজেরাই বিচার করতে পারেন। অ্যালোপ্যাথি হাসপাতালের জনপ্রিয়তা, উক্ত চিকিৎসা তে ভালো ছাত্র ছাত্রীদের আকর্ষণ ও লোকের দায়ে পড়ে অবশেষে অ্যালোপ্যাথের শরণাপন্ন হওয়া তার প্রমাণ বলে মনে হয়। নানা রকম ম্যাজিকিওর গল্প ছাড়া এবিষয়ে বিজ্ঞান সম্মত সুসংবদ্ধ তথ্য কোথায়? বহুক্ষেত্রে হোমিও চিকিৎসার নামে রোগী বিনা চিকিৎসায় থাকে এবং বহু অসুস্থ শিশু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যথাযথ চিকিৎসা সময় মতো পায় না। ফলে বহু শিশু মারাত্মক ভাবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। হোমিও চিকিৎসা তে কত লোকের কত ক্ষতি হয়েছে তার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করতে পারলেও তা কম ভয়াবহ হবে না।

এবার আসি মূল কথায়।যারা বলছেন কি একটা ফুজা না ভুজা খেয়ে আঁচিল সেরে গেছে তাদের কথায়। আলোচনার শুরুতে ঠিক করে নিতে হবে হোমিওপ্যাথি কে কিভাবে দেখবেন:

১। যেভাবে এর ব্যবহার বা প্রয়োগ হচ্ছে সেভাবে না 

২। এর তাত্ত্বিক ভিত্তি ও দর্শন নিয়ে?

কোনো কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি কে হোমিও বলে চেনা যাবে কি ভাবে?

যেভাবে এর প্রয়োগ হচ্ছে তা দেখলে কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাবে না। কেউ কেউ গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে রোগী আকৃষ্ট করেন, কেউ আবার নানা উপসর্গে হোমিও ওষুধ এর নামে অ্যাসপিরিন, এন্টেরোকুইনল, অ্যান্টিবয়োটিক স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেন। হোমিও ঔষধ এ কি আছে যাচাই করা দুষ্কর, কারণ হ্যানিম্যানের উপদেশ মতো বেশিরভাগ হোমিও চিকিৎসক নিজেদের ঔষধ নিজেরা তৈরি করেন না, এমনকি কোন উদ্ভিদ, কোন্ প্রাণী, কোন্ ধাতব যৌগ ঔষধ এর উৎস, তাদের এক খটমট ল্যাটিন নাম ছাড়া বস্তুর সাথে পরিচিত নন। তাই হোমিওপ্যাথি অনুজ্ঞসূচক সদৃশ বিধান যেখানে প্রয়োগ হচ্ছে তাকেই হোমিওপ্যাথি বলতে হবে। হোমিওপ্যাথির বাইবেল অর্গানন অফ মেডিসিন এর ভিত্তিতেই আলোচনা করতে হবে। এই হিসেবে কিন্তু ঐ থুজা হোমিও ঔষধ ক্যাটাগরিতে পড়ল না।


Double blind trial test কি?

এতে  নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত বেশ কিছু রোগী কে সমান দুটি দলে ভাগ করা হয়।একদল কে প্রস্তাবিত ঔষধ দেওয়া হয়, অন্যদল পায় একই রকম স্বাদ গন্ধ যুক্ত ঔষধ গুন হীন পদার্থ বা নকল ওষুধ(placebo)। কে কোন টি পেল তার রোগী ও পরীক্ষকের কাছে অজ্ঞাত থাকে, এই কারণে একে ডাবল ব্লাইন্ড টেষ্ট বা জোড়া অন্ধের পরীক্ষা বলা হয়। কেবলমাত্র কিছু নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, যারা পরীক্ষা শেষে তথ্যবিশ্লেষনের কাজে যুক্ত হবেন, তাঁরা এটি জানবেন। নির্দিষ্ট সময় পর পর রোগীদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও নথিভুক্ত করা হয়। পরীক্ষা শেষে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় দলটির তুলনায় প্রথম দলটির রোগীদের শারীরিক অবস্থার তুল্যমূল্য বিচার করা হয়। যা থেকে রাসায়নিক ঔষধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় দলটি কন্ট্রোল গ্রুপ। ঔষধ বিজ্ঞানে একটি কথা আছে - disease can be cured with medicine, with out medicine,inspite of medicine.তাই চিকিৎসা ও রোগ সারার ভেতরকার সম্পর্ক সত্যিই জটিল। রোগ আক্রমণ প্রতিহত করা ও অসুস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পেছনে যেমন immunity  বা অনাক্রম্যতা কাজ করে তেমনি অনেক রোগ আবার স্ব-নিয়ন্ত্রিত (self limiting diseases) নির্দিষ্ট সময় পর এমনিতেই সেরে যায়। অধিকাংশ ভাইরাস ঘটিত রোগের ক্ষেত্রে যা সত্য।

তাই আধুনিক চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে প্রস্তাবিত প্রতিটি রাসায়নিকে প্ল্যাসিবো নিয়ন্ত্রিত জোড়া অন্ধের (placebo controlled double blind trial) পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হতে হয়। 

বিকল্প চিকিৎসা যেমন এই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সেসব দায় নেই, কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই দিব্যি চলছে। এখানে যে কথাটি স্পষ্ট করে বল দরকার সেটা হলো কতজন ব্যবহার করেছে না বা বিশ্বের কটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা দিয়ে কোনো ঔষধ বা চিকিৎসার কার্যকারিতা যাচাই করা যায় না। এটি কেবল করা যায় কতকগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে। জোড়া অন্ধের পরীক্ষা তেমন একটা পদ্ধতি।

বিশ শতকের শেষ দিকে হোমিওপ্যাথি যাচাই করে দেখার মতো বেশ কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা জমা হয়ে ছিল। যেগুলো তে হোমিও কার্যকারিতা আছে বলে মনে হয়েছে তার বেশিরভাগই পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম কানুন মানা দরকার তাই মানা হয়নি এবং প্রবন্ধ প্রকাশনার ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষতা ছিল না।খালি সাফল্য গুলো নথিভুক্ত করা হয়, একে বলে publication bias.

এরপর বহুবার পরীক্ষা করা হয় বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ভাবে। তাতে যেটা উঠে এসেছে তাহলো, গবেষকরা হোমিওপ্যাথি তে রোগসারানোর পেছনে প্ল্যাসিবো ছাড়া অন্য কিছুর ভূমিকা দেখতে পাননি।

আজ যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না,কাল তার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে, অথবা ব্যাখ্যা না পেলেই কোনো কিছু বর্জনীয় হয়ে যায় না এই সঠিক বক্তব্য থেকে,আজ যার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না সেরকম সব কিছু কে স্বীকৃতি দেওয়াটাও আবার বিপরীত ধরনের ভ্রান্ত মানসিকতা।

‌পর্ব- ৬

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে অনেক আলোচনা হলো।এবার আসি আরেকটি চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেটা হোমিওপ্যাথির মতো য়ুরোপে শুরু হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তার নাম নেচারোপ্যাথি।

তবে হোমিওপ্যাথির মতো এর একক জন্মদাতা নেই। এবিদ্যা নিজের খেয়ালে বেড়েছে। এই বিদ্যার মূল মন্ত্রটি হলো প্রকৃতি অসুখ সারিয়ে দেয়।

এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভেষজ ও শল্য ব্যবহৃত হয় না।কেবল শতাধিক বিচিত্র অভিনব নিরাময় পদ্ধতি বলা হয়েছে। এই বিচিত্র বিস্তারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বগত কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায় না প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিদ্যা বা নেচারোপ্যাথিতে।

প্রথম যুগের প্রকৃতি চিকিৎসকরা ছিলেন অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর য়ুরোপীয় ডাক্তাররা। ভিনসেন্ট প্রিনসিজ্ আর ফাদার সেবাস্টিয়ান নেইপ ছিলেন জল চিকিৎসার প্রবর্তক(Hydrotherapy)। অ্যাডলফ্ জাস্ট এর 'রিটার্ন টু নেচার’ বইতে বলা আছে - খালি জমির উপর শুয়ে,খালি পায়ে ভেজা ঘাস বা বালির উপর হেঁটে এবং কাদার প্রলেপ গায়ে মেখে কিভাবে বিভিন্ন অসুখ সারানো যায়। এই ধরনের আরেকটি বইতে লুই খুনের লেখা, সব ধরনের ওষুধের বিরোধিতা করা হয়েছে। তার পরিবর্তে অনুমোদন করা হয়েছে বাষ্প - স্নান, অবাধ সূর্যালোক, নিরামিষ খাবার এবং শুধুমাত্র গমের রুটি। চিকিৎসক অ্যানটোইন বেশ্যাম্প এর দৃঢ় অভিমত ছিল, রোগ হলেই কেবল রোগ জীবাণু জন্মায়,অন্য কোন ভাবে জীবানু আসতে পারে না। শেষে বলতে হয় বেনেডিক্ট লাস্ট এর কথা,ফাদার নেইপের শিষ্য,যাকে আমেরিকান নেচারোপ্যথি জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রবর্তী ব্যাক্তিত্ব বলে চিহ্নিত করা হয়। তিনি নিউইয়র্কে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও এবং নিউ জার্সি ও ফ্লোরিডায় নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। অনেক বইও লিখেছেন ও পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তার মধ্যে  নেচারস প্যাথ, উল্লেখযোগ্য। এবং প্রায় ষোল বার গ্রেপ্তার বরণ করেছেন ওষুধ বিশ্বাসীদের সাথে সংগ্রাম চালাতে গিয়ে।

এছাড়া ম্যাকফোডেনের পাঁচ ভল্যুমের সুবিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিজিক্যাল কালচার (১৯১২) অপচিকিৎসার পরিধিতে বৃহত্তম কর্মযজ্ঞ। চার নম্বর ভল্যুমের ৫৭২ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অসুখের কথা তেমন পোলিও, ক্যানসার ইত্যাদির চিকিৎসা সহ ম্যাকফাডেনের নিজস্ব গৃহ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বিশেষ খাবার,ব্যায়াম এবং জলচিকিৎসা। তেমন, ক্যানসারের নিরাময়ের জন্য প্রথমে উপবাস, তারপর কয়েকটি ব্যায়াম, শেষে সঞ্জীবনী কারক কিছু পথ্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। রোগী কে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয় নি। বরং বইতে ঐ অধ্যায়ে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে যে রোগ নিরাময়ে কোনো ঔষধ নেওয়া চলবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন ক্যানসার কেবলমাত্র আঙ্গুরের পথ্য দিয়ে সারানো যাবে। এমনকি তিনি ঘোষণা করেন যে,যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে আঙ্গুর খাইয়ে ক্যানসার ভালো করা সম্ভব নয় তাহলে তিনি দশহাজার ডলার দিতে প্রস্তুত আছেন। প্রসঙ্গত য়ুরোপের আঙ্গুর উৎপাদন কারী অঞ্চলে আঙুরের সর্বরোগহর গুনের কথা সবার জানা, ঠিক তেমন ছাগলের দুধের গুনাবলী, সেরকমই।

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এখানে ওখানে ব্যাঙের ছাতার মত নেচারোপ্যাথি স্কুল গজিয়ে ওঠে। বেশিরভাগ স্কুলেই গুটিকয়েক অগোছালো ঘর, রাতে ক্লাস এবং অল্প কয়েকটি লেকচারের পর জবরদস্ত ডিপ্লোমা। ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে এই সার্টিফিকেট গুলো একজন গ্র্যাজুয়েটের ঘরের দেয়াল চমৎকার অলংকৃত করত। এইসব স্কুলগুলোর নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য বা সমঝোতা ছিল না। প্রায়শই কিছু অপচিকিৎসক তাদের উন্মাদ ভাবনাকে প্রয়োগ করতে এক একটি আজব পদ্ধতি চালু করত। তেমন, একটা উদাহরণ হলো, চোখের আইরিস (Iris) সারাতে বিচিত্র পদ্ধতি (Iridiagnosis) যা অবৈজ্ঞানিক শুধু নয় বিপজ্জনকও বটে।

অনুরূপ চরিত্রের আরেকটি প্রকৃতি চিকিৎসা পদ্ধতির সন্তান হলো Zone therapy. হাতে কিংবা পায়ের আঙ্গুলে চাপ প্রয়োগ করে অথবা দেহের অন্য কোনো আক্রান্ত অংশে বা জোনে চাপ দিয়ে শারীরিক বেদনার উপশম পদ্ধতি। আবিষ্কারক ছিলেন ডাক্তার উইলিয়াম এইচ ফিটজেরাল্ড, যিনি বেশ কয়েক বছর সেন্ট ফ্র্যান্সিস হাসপাতালের নাক ও গলার উচ্চ পর্যায়ের সার্জেন ছিলেন। অনেক রোগ উপশমে তাদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব দাওয়াই ছিল। তেমন, চুল পড়ে যাওয়ার দাওয়াইয়ে রয়েছে বিচিত্র নিরাময় ব্যবস্থা -  দুহাতের নখ আড়াআড়ি ভাবে দ্রুত ঘষতে হবে একটানা তিন চার মিনিট। কিছুক্ষণ পর এই ঘর্ষণ চালাতে হবে সারাদিন ধরে। এতে শরীরের সবকটি জোনের পুষ্টি বৃদ্ধি হবে এবং গোটা শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে, মাথার খুলিতেও সেই উত্তম রক্ত সঞ্চালনের প্রতিফলন দেখা যাবে।

এ-ধরণের আজব চিকিৎসা কাউকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম কিনা এই প্রশ্ন থেকে যায়। অথচ শতশত প্রকৃতি চিকিৎসক একে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। ভাবতে পারেন মেয়েদের মাসিকের গোলমাল সারবে জিভের কয়েকটি অংশে চাপ দিলে, মাথা ব্যাথা সারাতে চাপ দিতে হবে মুখের ভিতর টাকরায়। অথচ এই থেরাপির চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তারা বহু দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি দিয়েছেন মানুষ কে।

নেচারোপ্যাথির মূল বিষয় প্রাচীন মত কে ধরে রাখা হয়েছে। যেমন - ব্যাধি কখনো বাইরে থেকে আসা রোগ জীবাণু দ্বারা হয় না, হয় দেহের ভেতর প্রাকৃতিক নিয়ম অবমাননার কারণে। এই চিকিৎসা জগতে সকলেই মনে করেন ঔষধ মাত্রই ক্ষতিকারক, ঔষধ সেবন করা উচিত নয়।

একজন নেচারোপ্যাথ কখনো ঔষধ ব্যবহার করেন না পরিবর্তে নির্ভর করে ভিটামিন, খনিজ, শাকসবজি,ফলের রস, গরুর কাঁচা দুধ আর সুষম খাবার এর উপর। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তাররা অসুখ চেপে দেয়, নিরাময় করে না। এহেন পরিস্থিতিতে ভারতে নেচারোপ্যাথি শিক্ষার জন্য ১০টি কলেজ আর ২৪টি হাসপাতাল রয়েছে। (Ministry of AYUSH, 2010)


অন্তিম পর্ব

আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি, নেচারোপ্যাথি নিয়ে আলোচনা হলো। আরও কিছু জনপ্রিয় বিকল্প চিকিৎসা আছে। যার মধ্যে অন্যতম আকুপাংচার। আলোচনা তো চলতেই থাকবে। আর যার যে প্যাথিতে আস্থা সে তার পক্ষে বলতে থাকবে। এ বলার মধ্যে মূল বিষয়বস্তু আমি ওমুক কে সারতে দেখেছি তাই ওটা বিজ্ঞান। আমার এক বন্ধু একদিন বলছে আমি আমার বৃদ্ধ মায়ের জন্য অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কাজ দিয়েছে রামদেবের তেল। শুধু তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাজারে যে সমস্ত স্বাস্থ্যের ম্যাগাজিন আছে তারাও এসব অবৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশন করে। ধরুন পেটের গোলমাল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল প্রথম দিকে যে কথা বলছেন সেগুলো যুক্তিপূর্ণ যেমন পায়খানার বা কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীরা একটু শাক জাতীয় খাবার যার মধ্যে ফাইবার আছে সেগুলো খান, যাদের অম্বলের রোগ তারা একটু সময়মতো খাওয়া দাওয়া করুন, রাত করবেন না,জল বেশি খান, এগুলো বলার পর আলোচনা শেষ করছেন এই ভাবে - এতেও কাজ না হলে নিকটবর্তী কোনো হোমিওপ্যাথ বা যোগ কেন্দ্র তে গিয়ে যোগাযোগ করুন। শুধু তাই নয় অনেক স্বাস্থ্যের ম্যাগাজিন জ্যোতিষ বইয়ের রেফারেন্স দেন।

মূল কথা হলো আপনি কিছু খেলেন আর কিছু নিরাময় হলো এই দুটি ঘটনার মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ নেই আপনি তর্ক শাস্ত্রের যেকোনো বইতেই এটা পেয়ে যাবেন।কাজেই এত তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে আসবেন না। ডক্টর কভ্যুরের মত চলুন, উনি যখন হসপিটালে তখন ঔষুধ খাওয়ার পর খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একজন যাজক এসে তাকে বললেন যীশুর আশির্বাদ মিশ্রিত জল বা চরণামৃত খেতে। ডাক্তার কভ্যুর তাকে নিরস্ত্র করলেন এই বলে যে দাঁড়ান এখুনি ঔষধ খেলাম এখন যদি চরণামৃত সেবন করি তাহলে কার কারনে ভালো হলাম সেটাই বুঝতে পারব না।

দেখুন তাদের বেশি সময় নেই পড়ার জন্য তাদের জন্য খুবই সংক্ষিপ্ত একটা লাইনে এবার বিকল্প চিকিৎসাটি কেন অবৈজ্ঞানিক লিখে দেওয়া যাক।

আয়ুর্বেদ - ত্রিদোষ তত্ত্ব:

- শারীরস্থানগত ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

হোমিওপ্যাথি - লঘুকরণের নিয়ম:

- রসায়নের মূলগত ধারণা অ্যাভোগাড্রো প্রকল্পের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

আকুপাংচার - ছুঁচ ফুটিয়ে রোগের উপশম:

- শারীরবিদ্যার মূল ধারণার সাথে বিরোধ।

য়ুনানি – রসতত্ত্ব:

- শারীরস্থানগত ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

মূত্র চিকিৎসা - মূত্র সেবনে রোগ মুক্তি:

- শরীরের বিভিন্ন বিপাকীয় ক্রিয়ায় উৎপন্ন অপ্রয়োজনীয় ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলি মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।

অক্সিজেন থেরাপি - শরীরের ভেতর প্রয়োজনের অতিরিক্ত অক্সিজেন ও ওজোন গ্যাস ঢোকানো।

- শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর, ওজোন গ্যাসের মারাত্মক বিষক্রিয়া।

মোদ্দা কথা হলো যে খোদার উপর খোদকারি না করে অর্থাৎ প্রকৃতির উপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ না করে প্রকৃতির সাহায্য নিয়ে রোগ সারিয়ে তোলা। অথবা যা কিছু অবিকৃত, তার প্রকৃত যা কিছু মানুষের হাতে পরিবর্তিত তা ক্ষতিকর। 

- এইরকম একটা অবৈজ্ঞানিক ধারণা বিকল্প চিকিৎসা ও চিকিৎসকের পূঁজি। তারা শুধু মানুষের নয় একই সঙ্গে তাঁর আত্মার ও চিকিৎসা করেন।

আধুনিক চিকিৎসা কি ত্রুটি মুক্ত?

সেই মাধ্যমিকের রচনা লেখা। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? স্পটত: ক্ষমতাধরের হাতে আধুনিক চিকিৎসা। রাষ্ট্র চেষ্টা করে, সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করতে। কিন্তু সেখানে পরিকল্পনা ও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা তো গলাকাটা চিকিৎসা। সেখানে ভুড়িভুড়ি অভিযোগ। অযৌক্তিক বিল,স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা সত্ত্বেও অহেতুক আই.সি.ইউ.তে থাকার বিল, কোভিড এর মতো রোগের জন্য আঠারো লাখ টাকা বিল, মৃত পেশেন্টের ভেন্টিলেশনে রাখার বিল, টাকা না পেলে বডি না ছাড়া, একই টেষ্ট বারবার করিয়ে  ক্লিনিক্যাল ল্যাবের পকেট শক্তিশালী করা ও কমিশন ভোগ, এই হয়রানি মানুষের নিত্য সঙ্গী।

অপরদিকে সরকারি হাসপাতালে বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অপ্রতুল চিকিৎসক, রোগীর জন্য কম সময় ও দরদ কম দিয়ে রোগী দেখা, ফলে ঠিক ঠাক রোগ নির্ণয় না হওয়া, হাসপাতালে ভর্তি করতে সমস্যা, অপ্রতুল বেড, নার্সিং স্টাফেদের দূর্ব্যবহার, দালালচক্র, ঔষধ না পাওয়া ইত্যাদি কারণে অনেকেই আধুনিক চিকিৎসা বিরূপ হয়ে পড়েছেন। তাই গ্রামেগঞ্জে য়ুনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি, জলপোড়া, তেলপোড়া, রামদেব, আকুপাংচার বা পাথর (জ্যোতিষ) জনিত চিকিৎসার রমরমা। এই পরিস্থিতিতে সরকার ও যেহেতু আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে অপারগ তাই বিকল্প চিকিৎসা সেবাকেই সরকারি অনুমোদন দিতে ব্যস্ত। এতে সাপ মরেনা লাঠিও ভাঙে না। অথচ চিকিৎসা সবার অধিকার এবং সেটা আধুনিক চিকিৎসা সেবা। এক কোভিড এসে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কঙ্কাল দেখিয়ে দিল।

তবু কিছু কথা বলতে হচ্ছে:

আধুনিক চিকিৎসার বিরুদ্ধে একটা নেগেটিভ ক্যাম্পেন সবসময় চলছে। যেটা আবার অবৈজ্ঞানিক।

১। অধিকাংশ বিকল্প চিকিৎসা নানাভাবে অস্ত্রচিকিৎসার (অপারেশন বা সার্জারির) বিরুদ্ধাচরণ করে। আবার আধুনিক ওষুধের নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অস্ত্রচিকিৎসা বিষয়ক সত্যিকারের ঝুঁকি ও অমূলক ভয় অনেক মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।এ নিয়ে অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য এবং চিন্তাচেতনায় বাসা বেঁধে থাকা অজ্ঞতার কারণেই অনেকের কাছে আধুনিক চিকিৎসা ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। অপরপক্ষে বিকল্প চিকিৎসা সেবা তে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বলে দাবি করা হয়। হোমিওপ্যাথির মতো মিথস্ক্রিয়াহীন চিকিৎসার ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বিভিন্ন দেশের বিকল্প চিকিৎসার সরবরাহকারীরা টিকা দেবার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ভয়ংকর চেষ্টা চালাচ্ছে। ডাক্তার সার্জারির পরামর্শ দিয়েছেন অথচ তা না করে অনেকেই বিকল্প চিকিৎসার দ্বারস্থ হচ্ছেন।

২। আধুনিক চিকিৎসক কখনো কখনো রোগের কারণ খুঁজতে ব্যর্থ হন এবং রোগীর রোগ যন্ত্রনার অবসান ঘটাতে পারেন না। এই অবস্থায় সরাসরি রোগী কে তারা মতামত জানিয়ে দেন। অথচ বিকল্প চিকিৎসার কারবারিরা কখনো হাল ছাড়েন না কারণ এই রোগী তার মূলধন।

৩। এই মুহূর্তে এইডস্,ক্যান্সার রোগীর জীবনকাল হয়তো দীর্ঘায়িত করতে পারে আবার আর্থ্রাইটিস  বা অন্যান্য বয়সজনিত সমস্যা সাময়িক ভাবে ভালো করে তুলতে পারে কিন্তু তাকে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আধুনিক চিকিৎসক এক্ষেত্রে সত্যিই অসহায়। আধুনিক চিকিৎসার অসম্পূর্ণতা আছে ঠিকই, সময়ের সাথে সাথেই তার ত্রুটি মুক্ত হয়ে উঠবে। অপরদিকে বিকল্প চিকিৎসা যে কোনো রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় দাবি করে। এখানে ভরসাহীনতার কোনো জায়গা নেই।সারা পৃথিবীতে এমন অনেক ক্যান্সার পেশেন্ট পাওয়া যাবে যারা রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি বাতিল করে নানা ধরনের অপ্রমাণিত ও অপরীক্ষিত চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে গেছেন।

৪। পিছিয়ে পড়া দেশে বিশেষত আফ্রিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে দেশজ চিকিৎসা খুব কম খরচে পাওয়া যায়। আমদের দেশে স্ব-প্রশিক্ষিত কবরেজ বা হোমিওপ্যাথ নামমাত্র দক্ষিণায় রোগী দেখেন। কিন্তু তুলনায় আধুনিক চিকিৎসকদের ভিজিট অনেক বেশি। আবার য়ুরোপ ও আমেরিকায় লাইফস্টাইল ট্রিটমেন্ট (বিকল্প চিকিৎসা) নিতে হলে রীতিমত ভালো রকমের গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে।

৫। তবে বিকল্প চিকিৎসকদের অধিকাংশ পেশার কারণে নব্বই শতাংশ আধুনিক চিকিৎসার ঔষধ ব্যবহার করেন।

পরিশেষে যে কথা বলে বিদায় নেব। মোটের উপর বিকল্প পদ্ধতিগুলোর কার্যকারিতার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বিকল্প চিকিৎসার কোনো পদ্ধতিকরণ যদি কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সেটি বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা হয়ে উঠবে আর ‘বিকল্প’ থাকবে না।

চিকিৎসার বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে রোগী কে পরিষেবা দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে তার প্রতারণার নামান্তর। বিকল্প চিকিৎসা যে ভাবে রোগীর চিকিৎসা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে বলে গলা ফাটায় তাতে স্বাধীনতা শব্দটির অপব্যবহারই হয়। অর্থহীন অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা বেছে নেওয়ার তাৎপর্য কি?

বিকল্প চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি রোগীর শরীরে সাংঘাতিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। কিরোপ্রাকটিক থেরাপিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর উপর এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়। অবাঞ্ছিত এই বিকিরণ বিশেষত: শিশুদের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কখনো কখনো বিকল্প চিকিৎসা দাবি করে জৈব রাসায়নিক বাস্তবায়ন না থাকলেও শুধুমাত্র প্ল্যাসিবো চিকিৎসা হিসাবে এদের কৃতিত্ব কে স্বীকার করা উচিত। উত্তর হলো সঠিক বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা সেবা থাকা সত্ত্বেও তা পাওয়ার অধিকার থেকে রোগীকে বঞ্চিত করে উপরন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করে কার্যকারিতা হীন বিকল্প চিকিৎসা নেবার কোনো মানে আছে? জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য দিয়ে শেষ করছি। There is no alternative medicine. There is only scientifically proven, evidence- based medicine supported by solid data or unproven medicine, for which scientific evidence is lacking.

সূত্র:

বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমরেন্দ্র নাথ সেন, ১ম খন্ড।

Medical Encyclopedia, Collins,1978

Encyclopedia Britannica, 15th Ed

বিজ্ঞান কে মুখোশ করে, মার্টিন গার্ডনার.

বিকল্প চিকিৎসা চিকিৎসার বিকল্প, মুক্তচিন্তা পাবলিকেশন, সুব্রত রায়।

Organon of medicine, 5th, Ed, S Hahnemann

যুক্তিবাদীর চোখে গীতা শ্রীমদ্ভাগবত-পুরাণ সমীক্ষা -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:998 | likes:2 | share: 3 | comments:0

আমি দেখছি। অনেকেই গীতাকে একটি দর্শনের বই ধর্ম গ্রন্থ কেউবা সাম্প্রদায়িক বলে থাকে। কিন্ত ভাগবত পুরাণ ছাড়া গীতার মাহাত্ম্য বোঝা যায়। আমরা অনেকেই শ্রীমদ্ভাগবদগীতা পড়েছি! কিন্ত বিশেষ করে যখন যুক্তিবাদীরা গীতা পড়ে 9/32 নিয়ে, যখন সমালোচনা করে তখন শুধুমাত্র একটি শ্লোক ধরেই করে। কিন্ত কিছু মানুষ এখানেও গীতার শ্লোক নিয়ে অপপ্রচার করে। সেখানেই অন্যতম হলো গীতার 9/32 শ্লোক যেখানে নারীকে বেশ্যা পাপযোনি তার থেকে শূদ্র সন্তান বলা হয়। তখন সেটা আরো চরম ভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠে এখানেই কিছু মানুষের মিথ্যাচার চলে। তারা বলে গীতা বোঝা কি অত সহজ তাহলে গীতার 9/32 কি বোঝাতে চাইছে আমরা জানার চেষ্টা করবো এখন..

মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ |

স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যাস্তি পরাং গতিম্ || ৩২


এখানে মূলত যে সংস্কৃত শ্লোক গুলি গুরুত্বপূর্ণ 

পাপযোনয়ঃ = বলতে নীচকুল জাত [তাহলে জাতিভেদ ও চলে আসছে, তার সাথে নীচ কুলজাত এই নীচ কুল বলতে কি এর জন্য ¹(গীতা 1/41) পড়তে হবে সেখানে বলা আছে যে বর্ণসংঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। ] এবার [ বর্ণসংঙ্কর কি? তার জবাব হলো ¹(গীতা 1/40) সেটা হলো ! ব্রাহ্মণ কন্যা যদি ব্রাহ্মণকুল ছেড়ে অন্য বৈশ্য শূদ্র কুলে বিবাহ কে বর্ণসংঙ্কর বলে। তার সাথে সেই কুলস্ত্রীগণকে অসৎ চরিত্র ব্যভিচারী বলেছে আর যদি সেই ব্রাহ্মণ কন্যা শূদ্র পুরুষ কে বিবাহ করে তার দ্বারা যদি কোনো সন্তান কে জন্ম দেয়! সেখানেই গীতা বলছে অবাঞ্ছিত প্রজাতি, ভাবা যায়! আমরা গীতা থেকে এক নতুন বিবর্তনবাদ এর অনুসন্ধান পেলাম আর সেইসব প্রজাতির নাম জানলে অবাক হবেন? আইন শাস্ত্র যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, সেই প্রজাতির নাম বলেছে।

যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার ১ ম অধ্যায়ের ( ৯১-৯৫ )² নং শ্লোকে দেয়া আছে 

১ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + ব্রাহ্মণ কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান ব্রাহ্মণ

২ ) ব্রাহ্মণ পুত্র + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান মুৰ্দ্ধাবিষিক্ত ৩ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + বৈশ্য কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান অম্বষ্ঠ 

৪ ) ব্রাহ্মণ পুত্ৰ + শূদ্র কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান নিষাদ / পারশব 

১ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + ব্রাহ্মণ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান সূত 

২ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান ক্ষত্রিয় 

৩ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + বৈশ্য কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান মাহিষ্য

৪ ) ক্ষত্রিয় পুত্র + শূদ্র কন্যা ---- উৎপন্ন সন্তান উগ্র 

১ ) বৈশ্য পুত্র + ব্রাহ্মণ্ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান বৈদেহক 

২ ) বৈশ্য পুত্ৰ + ক্ষত্রিয় কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান মাগধ 

৩ ) বৈশ্য পুত্র + বৈশ্য কন্যা -- উৎপন্ন সন্তান বৈশ্য 

৪ ) বৈশ্য পুত্র + শূদ্ৰ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান করণ 

১ ) শূদ্ৰ পুত্ৰ + ব্রাহ্মণ কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান চন্ডাল 

২ ) শূদ্র পুত্র + শূদ্র কন্যা --- উৎপন্ন সন্তান শূদ্র

তাহলে আমরা পৃথিবীর সব থেকে আজব প্রজাতির নাম জানতে পারলাম। যে বর্ণসংঙ্কর ফলে উৎপাদন করা অবাঞ্ছিত প্রজাতি গুলি কি! এবং যত বেশি নিজ কুল ছেড়ে নীচু কুলে বিবাহ করবে ততবেশি পাপী হবে। এবং নরকে যাবে।¹

এবং এই প্রশ্ন ¹(গীতা 1/42) শেষ করে দেয়। সেখানে বলা [ যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং তার ফলে অবাঞ্ছিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুলর্মজনিত দোষে ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায় ] বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছে গীতা আরো পরিষ্কার এই 42 শ্লোক সংস্কৃত (জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বত) অনেক বলে না? {সনাতন) ধর্ম বলতে পুরাতন যা ছিল তাই থেকে যাবে! সেটা হলো জাতিভেদ সেখানে বলা হচ্ছে। জন্ম থেকে জাতি জন্ম থেকে বর্ণ জন্ম থেকে কর্ম আর এইসব যারা মানে না। তারা বিভিন্ন পাপযোনয়ঃ = জন্ম নিয়ে নীচকুল জাত হয়। 

বৈশ্যাস্তথা = বলতে অনেকেই ( বৈশ্য ) এর কথা বলে। কিন্ত আসলেই কি তাই? আসলে না। ¹(গীতা 9/32) সেখানে [ বৈশ্যা ] বলতে আসলে হলো { বেশ্যা } এর উত্তর আপনি ¹(গীতা 18/41) ¹(গীতা 18/44) দুটির সংস্কৃত শ্লোক চেক করতে পারেন।  যে সেখানে বৈশ্য শব্দ কেমন এসেছে। চাইলে আপনি শঙ্কর ভাষ্য চেক করতে পারেন। সেখানে বৈশ্য নয়। বেশ্যা আছে তাহলে পরিষ্কার হয়ে গেলাম বৈশ্য শব্দ নয় বেশ্যা আছে সেখানে।

শূদ্রাস্তেহপি = বলতে শূদ্র। সেখানে আর আলাদা আলাদা অনুবাদ আর দেখতে হবে না। সবাই এখানে আর গোজামিল করেনি। তাহলে পুরো শ্লোক এর অনুবাদ হবে এমন 


মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ |

স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যাস্তি পরাং গতিম্ || ৩২

হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী,বৈশ্যা,শূদ্র আদি নীচকুল জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করবে।¹

তার মানে এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলতে চাইছে! যে যদি কৃষ্ণকে না মানে তাহলে ( বেশ্যা শূদ্র আদি নীচ জাত ) থাকবে। আশ্রয় করলে মুক্তি পাবে। কিন্ত শ্রীমদ্ভাগবত-পুরাণ কি বলছে। ¹(গীতা 9/32) কে ধরে। 

³আভীরঙ্কা যবনাঃ খসাদয়ঃ |

যেহন্যে চ পাপ যদুপাশ্রয়াশ্রয়াঃ 

শুদ্ধ্যন্তি তস্মৈ প্রভবিষ্ণবে নমঃ || ২৷৪৷১৮

কিরাত, হূণ, আন্ধ্র, পুলিন্দ, পুল্কস, আভীর, কঙ্ক, যবন ও খস প্রভৃতি নীচজাতিগণ ও অন্যান্য মহাপাপাসক্ত ব্যক্তিগণ যাঁর (ভগবানের) আশ্রিত ভক্তগণের শরণ গ্রহণ করলেই পবিত্র হয়ে যায় সেই সর্বশক্তিমান ভগবানকে বাব বাব প্রমাণ। 

তাহলে এখানে যে সব নীচ জাতি সম্পর্কে জানতে পারলাম। সেখানে বলছে যে ভগবানের আশ্রিত ভক্তগণের শরণ গ্রহণ করলেই পবিত্র হয়ে যায়।

 না করলেই সে ডাইরেক্ট নীচ মহাপাপী। এবং এখানেই শেষ নয়। সেই ভগবান আবার সর্বশক্তিমান তাহলে কেন এই জাত ব্যবস্থা জন্ম থেকে? এবং কোনো শূদ্র জ্ঞানী হলেও সে তার শূদ্র ধর্ম ত্যাগ করতে মানা করেছে। ¹(গীতা 3/35) ¹(গীতা 18/47'48) এখন যদি শূদ্র অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে বিদ্যাণ হয়ে! ধর্মীয় শাস্ত্রের ভুল এর সমালোচনা করে আর সেই ইশ্বর কি বলেছে তা আপনার চিন্তার বাইরে। ¹(গীতা 4/40) কি বলেছে।

অজ্ঞশ্বাশ্রদ্দধানশ্ব সংশয়াত্মা বিনশ্যতি |

নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্ননঃ || ৪০

অজ্ঞ ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনই ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না। সন্দিগ্ধ চিত্ত ব্যক্তি ইহলোকে সুখভোগ করতে পারে না এবং পরোলোকেও সুখভোগ করতে পারে না।

তার মানে কেউ শাস্ত্রের ভুল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে পারবে না ! যদি করে তাহলে ইহলোকে এবং পরোলোকে ভয়ঙ্কর দুঃখে থাকবে কোনো সুখে থাকবে না। এর মধ্যে যদি সেই ব্যক্তি ইহলোকে ইশ্বরের নিন্দা করে তাহলে তো খবর আছে।

³কর্ণৌ পিধায় নিরয়াদ্যদকল্প ঈশে

ধর্মাবিতর্যসৃণিভিরস্যমানে |

ছিন্দ্যাৎ প্রসহ্য রুশতীমসতীং প্রভুশ্চে-

জ্জিহ্বামসূনপি ততো বিসৃজেৎ স ধর্মঃ || ৪৷৪৷১৭

যদি যথেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা ধর্মরক্ষাকারী পূজনীয় প্রভুর নিন্দাবাদ করে তবে নিজের ক্ষমতায় তাদের দণ্ড দেওয়া সম্ভব না হলে কান বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যাবে, আর যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে বলপ্রয়োগে সেই অমঙ্গল - শব্দ - উচ্চারণকারীর জিহ্বাকে ছেদন করে ফেলবে। এই ধরনের পাপের প্রতিকারকল্পে নিজের প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করবে — এই - ই ধৰ্ম 

হালে পরিষ্কার হলো গীতার ও ভাগবত পুরাণ এর অনুসন্ধান  গীতার একটি শ্লোক ¹(9/32) এর মানে কত বড়ো  এখন কি বলছেন।  সেই সর্বশক্তিমান ইশ্বরের নিন্দা করলে ভক্তগণ আপনাকে জিহ্বাকে কেটে হত্যা করবে। তাহলে কেন স্ত্রী বেশ্যা শূদ্র ইশ্বরের দাসত্ব বহন করবে। এখানেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। যে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। আসা করি জানার কোনো শেষ থাকলো না। শুধু নিজেই রেফারেন্স চেক করে নেবেন বই থেকে....

রেফারেন্স :

1) শ্রীমদ্ভাগবদীতা যথাযথ- শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী / ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট 

2) যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার- সুমিতা বসু ন্যায়তীর্থ / কলকাতা সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার ২০০৭

3) শ্রীমদ্ভাগবত-মহাপুরাণ- গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর

বেমানান -সুমন কর্মকার
Nov. 21, 2024 | গল্প | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় সৌরকে দেখতে পাওয়া যায় স্টেইন্ড গ্লাস পাবের বাঁদিকের একদম কোনার টেবিলে। ও কখনোই ডান্সফ্লোরে আসে না। কার্লসবার্গের দুটো ক্যান আর চারটে ক্লাসিক ওর কোটা। কখনোই এর কম-বেশি হয়না। নিজের চেয়ারে বসে নৃত্যরত মানুষগুলোকে দেখা, ওদের দিক থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথা, হাসির শব্দ শুনতে ওর বেশ লাগে। আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে একটা ঝিমুনি অনুভূত হয়। তারপর কোটা পূরণ হয়ে গেলেই বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের একলা ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। এভাবেই এক শনিবারের সন্ধ্যেয় সৌর দেখতে পেল একদল প্রাণোচ্ছল যুবক-যুবতীকে। দলে আছে তিনটে ছেলে আর দুটো মেয়ে। দেখেই বোঝা আছে দুটো কাপল গ্রুপ আর তাদেরই এক বন্ধু। হাই সাউন্ডের মাঝে একে অন্যের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে কিছু কথা বলছে আর মাঝেমাঝে হেসে উঠছে। ওরা পাঁচটে চেয়ারের একটা টেবিলে বসে বিয়ার অর্ডার করল। এই অবধি দেখে সৌর টেবিল ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম গেল। ফিরে এসে দেখল এর মধ্যেই গ্রুপটা ডান্সফ্লোরে চলে গিয়েছে এবং গোল হয়ে ঘিরে চলছে নাচ। রোজকার চিত্র। নতুন কিছু নয়। সৌর নিজের কোটা পূরণে মনোনিবেশ করল। কোটা যখন প্রায় শেষের মুখে হঠাৎ একটা গোলমালের আওয়াজ সৌরর দৃষ্টি আকর্ষন করল। একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ডিজে গান থামিয়ে দিয়েছে। বাউন্সাররা নিজেদের কর্তব্যপালনে নেমে পড়েছে। সৌর উঠে পড়ল। জায়গাটায় যেয়ে যা বুঝল, ওই পাঁচজনের গ্রুপের একটি মেয়েকে নাচতে নাচতে অন্য একটি যুবক নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল, সাথে সাথেই মেয়েটি যুবকটিকে একটি সপাটে চড় মেরেছে। তাতেই তৈরি হয়েছে এই বিপত্তি। যুবকটি এই গ্রুপের কারোরই পরিচিত নয়। 

লম্বায় প্রায় ছফুট, ফর্সা গালটাতে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে, এলকোহলের প্রভাবে চোখদুটো খানিক রক্তাভ।

পাশে আস্তিন গুটিয়ে রাগী-রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি খুব সম্ভবত যুবতীটির বয়ফ্রেন্ড। গ্রুপের বাকিদের মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে তারাও অসভ্য ছেলেটাকে একহাত বুঝে নিতে চায় কিন্তু বাউন্সারদের জন্য সেই সুযোগ পাচ্ছে না। একটু পরেই একজন বাউন্সার ছেলেটাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলার সাথে সাথেই ছেলেটা মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল। ওর থমথমে মুখটা দেখে সৌরর বেশ ভালোই লাগলো। ঠিক হয়েছে। নেশাগ্রস্ত মেয়ের সুযোগ নিতে যাওয়ার যোগ্য জবাব পেয়েছে। ভাবলো মেয়েটাকে একটু সাবাসি দিয়ে আসবে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো ওদের দলটাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ছে। এইধরণের উটকো ঝামেলার পর নাচের আগ্রহ হারানোটা স্বাভাবিক। সৌরও নিজের টেবিলে ফিরে এলো। অর্ধেকটা বিয়ার এখনো পড়ে আছে। গরম হয়ে গিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে সৌর বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। 

এরপরের শনিবার পাবে ঢুকতে সৌরর খানিক দেরিই হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়েই বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে বেরোয়নি। ক্যাব অবধি আসতে আসতেই অল্প ভিজে গেল। এই সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের জায়গায় জায়গায় জল জমে গেছে। স্টেইন্ড গ্লাস ওর অফিস থেকে ক্যাবে পঞ্চাশ মিনিটের রাস্তা। আজ জ্যামের জন্য সেই রাস্তাই পেরোতে সময় লাগলো এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পাবে ঢুকেই ও ওর কোনার টেবিলে চলে এলো। রেগুলার কাস্টমার। তাই আলাদা করে অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। ওয়েটার ক্যানগুলো আনতে আনতে সৌর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো। ডিজে হাল্কা সাউন্ডে একটা রোমান্টিক গান বাজাচ্ছে। কাপলরা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে জড়িয়ে নাচ করছে। সিঙ্গেলরা কেও কেও নিজেদের টেবিলে বসে লালায়িত দৃষ্টিতে দৃশ্যটা উপভোগ করছে, আবার কেও কেও বিরক্তি প্রকাশ করছে ডিজের ওপর। হঠাৎ একটা কাপলের ওপর সৌরর চোখ আটকে গেল। আরে! এ তো সেই সাহসী মেয়েটাই। আগের দিন অসভ্যতা করার জন্য যে চড় মেরেছিল। আশেপাশে ওদের গ্রুপের আর কেও চোখে পড়ল না যদিও। সাথে নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটার খালি পেছন দিকটাই দেখা যাচ্ছে। বেশ লম্বা। ব্ল্যাক গ্লসি শার্টের সাথে ডেনিম জিন্স। এই তো ওরা ঘুরছে। ধীরে ধীরে ছেলেটার মুখটা সৌরর দৃষ্টিগোচর হলো। আর সাথে সাথেই ও চমকে উঠলো। এটা তো সেই চড় খাওয়া ছেলেটাই। ছেলেটার একটা গালে মেয়েটার হাত। ধীরে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। বেশ আবেগঘন মুহুর্ত। বোধহয় ওরা কিস করতে চলেছে। একসপ্তাহ আগেও ছেলেটার গালে মেয়েটার হাত পড়েছিল। তবে আজকের সাথে তার তুলনা চলেনা। সৌর মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিয়ারটা কি আজ একটু বেশিই তেতো লাগছে? মুখটা বিস্বাদ ঠেকছে কেন?  কয়েকদিন আগে কি একটা প্রসঙ্গে অফিসের বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড গৌরদা বলছিলেন, "বুঝলে সৌর, যুগ পাল্টাচ্ছে। সময়টা ভীষণ তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। পুরনো সবকিছু বেমানান হয়ে পড়ছে। একটা গোটা জেনারেশন নিজেদের শেষ করার জন্য কেমন উঠে পড়ে লেগেছে দেখছ তো?" সৌরর মনে পড়ে গেলো। ও উঠে পড়ল। আজ আর বিয়ার খাওয়া হবে না। পাব থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সৌরর চোখে পড়ল বিল কাউন্টারের এক পাশে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটাকে। একেই আগের দিন মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড বলে মনে হয়েছিল। সৌর আর দাঁড়ালো না। পাবের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ডিজে নতুন গান চালিয়েছে, 'ফলক তক চল সাথ মেরে, ফলক তক চল সাথ চল....'। নিজেকে হঠাৎই বড্ড বেমানান মনে হল সৌরর।

উঁচু জাত-নিচু জাত -জামাল আনসারী
Nov. 21, 2024 | অনুগল্প | views:992 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“কতবার তোকে বলেছি না, নিচু জাতের ছেলের সাথে খেলবি না। নিচু জাতের ছেলেকে ঘরে ঢুকাবি না। কোন কথায় তোর কানে ঢোকে না। এরপর যদি কোনদিন তোকে ওর সাথে খেলতে দেখেছি তো তোকে মেরে ফেলবো।”―ছেলেকে মারতে মারতে এক নিশ্বাসে এত কথা বলে ফেলল শ্রীদেবী।

 ছেলেটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,আমি ভুল করেছি মা। আর কোনদিন নিচু জাতের ছেলের সাথে খেলবো না। এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও।

ঠিক আছে। ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু কথাটা যেন তোর মনে থাকে।―শ্রীদেবী ধমকের সুরে জানিয়ে দেয়।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ছেলেটি স্কুলে চলে যায়। নিচু জাতের ছেলেটিও সেই স্কুলে পড়ে। তারই অন্তরঙ্গ সহপাঠী। প্রতিদিন তারা একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে।স্কুলে পরস্পর পরস্পরের সাথে দেখা হয় কিন্তু উঁচু জাতের ছেলেটি তাঁর মায়ের কাছে তুচ্ছ অজুহাতে মার খাওয়ার ভয়ে আর কথা বলে না।কিছু কিছু বাবা মা শিশুদের সহজ সরল নিষ্কলঙ্ক মনে বিদ্বেষ, ঘৃণার বিষ মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুচারুভাবে বপন করে দেয়।

 কিছুক্ষণ পরে ক্লাসে ইতিহাসে শিক্ষক পড়ায়, "জাতিভেদ প্রথা সমাজের কলঙ্ক ।কোন জাতিই নিচু নয়,আবার জাতিই উঁচু নয়।― সব সমান। আমরা সবাই মানুষ। কোন জাতিকে ছোটজাত বলে অপমান করা সামাজিক অপরাধ। আমরা কেউই আজ থেকে আর জাতিভেদ মানবো না। সবাইকে মানুষ বলে মানবো।"

 ঢং ঢং করে ঘন্টার আওয়াজ জানিয়ে দেয় ইতিহাস ক্লাসের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।...

নাস্তিকতাও একটি ধর্ম (কিংবা বিশ্বাস) হলে -অভিজিৎ রায়
Nov. 21, 2024 | মুক্তমনা | views:8572 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভাবছি দর্শন শাস্ত্রের প্রচলিত কিছু শব্দার্থ বিশ্লেষণ করে গুটি কয় হাল্কা ধরনের পোস্ট দেব সামনে। আমি দেখছি মুক্তমনায় লেখেন অথচ দর্শনের প্রান্তিক কিছু ব্যাপারে খুব অস্পষ্ট ধারনা রাখেন আমাদের অনেকেই। অনেকেই জানেন না আদি কারণ সম্বন্ধে, অক্কামের ক্ষুর কিংবা প্যাস্কালের ওয়েজার সম্বন্ধে, কিংবা গুলিয়ে ফেলেন নাস্তিকতাও একটি ধর্ম কিনা এ বিষয়ে। আমি এর আগে মেসবাহউদ্দিন জওহের নামে এক ভদ্রলোকের সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে এগুলো নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লিখেছিলাম। ভাবছি ছোট আকারে দু চারটি লেখায় বিষয়গুলো আবারো তুলে আনবো। মুক্তমনা ব্লগে বিষয়গুলোর আলাদা উপস্থিতি দাবী করে বলে আমার ধারণা।

আমি দেখেছি অনেকেই বুঝে হোক, না বুঝে হোক, এই ব্যাপারটি মাঝে মধ্যে এভাবেই আউরে দেন যে, আস্তিক্যবাদের মত নাস্তিক্যবাদও একধরনের বিশ্বাস। আস্তিকরা যেমন ‘ঈশ্বর আছে’ এই মতবাদে বিশ্বাস করে, তেমন নাস্তিকরা বিশ্বাস করে ‘ঈশ্বর নেই’ – এই মতবাদে। দুটোই নাকি বিশ্বাস। যেমন, এই ব্লগে শামীম সাহেব রায়হানকে উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন –"নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে যে “ঈশ্বর নেই”। কিন্তু “ঈশ্বর নেই” এটি প্রমানিত সত্য নয়। শুধু যুক্তি দিয়েই বুঝানো সম্ভন “ঈশ্বর নেই” বিবৃতিটি আসলে ফাকিবাজি।"

নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী, কিংবা নাস্তিকতাবাদও একটি বিশ্বাস – এগুলো ঢালাওভাবে আউরে দিয়ে নাস্তিক্যবাদকেও এক ধরনের ‘ধর্ম’ হিসেবে হাজির করার চেষ্টাটি আমি বহু মহলেই দেখেছি। নাস্তিকদের এভাবে সংজ্ঞায়ন সঠিক কি ভুল, তা বুঝবার আগে ‘নাস্তিক’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থটি আমাদের জানা প্রয়োজন। ‘নাস্তিক’ শব্দটি ভাংগলে দাঁড়ায়, নাস্তিক + কন বা নাস্তি+ক। ‘নাস্তি’ শব্দের অর্থ হল নাই, অবিদ্যমান। ‘নাস্তি’ শব্দটি মূল সংস্কৃত হতে বাংলায় এসে ‘ক’ বা ‘কন’ প্রত্যয় যোগে নাস্তিক হয়েছে যা তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত। ন আস্তিক = নাস্তিক – যা ন ঞ তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ এবং আস্তিকের বিপরীত শব্দ। আরো সহজ করে বাংলায় বললে বলা যায়, না + আস্তিক = নাস্তিক। খুবই পরিস্কার যে, সঙ্গত কারণেই আস্তিকের আগে ‘না’ প্রত্যয় যোগ করে নাস্তিক শব্দটি তৈরী করা হয়েছে। আস্তিকরা যে ঈশ্বর/আল্লাহ/খোদা ইত্যাদি পরম সত্ত্বায় বিশ্বাস করে এ তো সবারই জানা। কাজেই নাস্তিক হচ্ছে তারাই, যারা এই ধরণের বিশ্বাস হতে মুক্ত। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নাস্তিকতা কোন বিশ্বাস নয়, বরং ‘বিশ্বাস হতে মুক্তি’ বা ‘বিশ্বাসহীনতা’। 

ইংরেজীতে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Atheist’। সেখানেও আমরা দেখছি theist শব্দটির আগে ‘a’ প্রিফিক্সটি জুড়ে দিয়ে Atheist শব্দটি তৈরী করা হয়েছে।


 নাস্তিকতা এবং মুক্তচিন্তার উপর বহুল প্রচারিত গবেষণাধর্মী একটি ওয়েব সাইটে শব্দটির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এভাবে –

Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of gods. This absence of belief generally comes about either through deliberate choice, or from an inherent inability to believe religious teachings which seem literally incredible. It is not a lack of belief born out of simple ignorance of religious teachings.

সহজেই অনুমেয় যে, ‘absence of belief’ শব্দমালা চয়ন করা হয়েছে ‘বিশ্বাস হীনতা’কে তুলে ধরতেই, উলটোটি বোঝাতে নয়। Gordon Stein তাঁর বিখ্যাত ‘An Anthology of Atheism and Rationalism’ বইয়ে নাস্তিকতার (Atheism) সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘When we examine the components of the word ‘atheism,’ we can see this distinction more clearly. The word is made up of ‘a-‘ and ‘-theism.’ Theism, we will all agree, is a belief in a God or gods. The prefix ‘a-‘ can mean ‘not’ (or ‘no’)  or ‘without’. If it means ‘not,’ then we have as an atheist someone who is not a theist (i.e., someone who does not have a belief in a God or gods). If it means ‘without,’ then an atheist is someone without theism, or without a belief in God’. (Atheism and Rationalism, p. 3. Prometheus, 1980)

আমরা যদি atheist শব্দটির আরো গভীরে যাই তবে দেখব যে, এটি আসলে উদ্ভুত হয়েছে গ্রীক শব্দ ‘a’ এবং ‘theos’ হতে। গ্রীক ভাষায় ‘theos’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে, আর ‘a’ বলতে বোঝায় অবিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে। সেজন্যই Michael Martin তাঁর ‘Atheism: A Philosophical Justification’ বইয়ে বলেন, ‘According to its Greek roots, then, atheism is a negative view, characterized by the absence of belief in God.’ (Atheism: A Philosophical Justification”, p. 463.,Temple University Press, 1990)।

আসলে নাস্তিকদের  বিশ্বসী দলভুক্ত করার ব্যাপারটি খুবই অবিবেচনাপ্রসুত। ব্যাপারটাকে আরেকটু পরিস্কার করা যাক। ধরা যাক, এক মুক্ত-মনা যুক্তিবাদী ব্যক্তি ভুতে বিশ্বাস করেন না। তবে কি সেজন্য তিনি ‘না-ভুতে’ বিশ্বাসী হয়ে গেলেন? শামীম সাহেবদের যুক্তি অনুযায়ী তাই হবার কথা। এভাবে দেখলে, প্রতিটি অপ-বিশ্বাস বিরোধিতাই তাহলে উলটোভাবে ‘বিশ্বাস’ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তা সে ভুতই হোক, পঙ্খিরাজ ঘোড়াই হোক, অথবা ঘোড়ার ডিমই হোক। যিনি পঙ্খিরাজ ঘোড়া বা চাঁদের চড়কা-বুড়ীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তিনি আসলে তাঁর সংশয় এবং অবিশ্বাস থেকেই তা করেন না, তার ‘না-বিশ্বাসে’ বিশ্বাসী হবার কারণে নয়। যদি ওই ব্যক্তিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন ওগুলোতে তিনি বিশাস করেন না, তিনি হয়ত জবাবে বলবেন, ওগুলোতে বিশ্বাস করার মত যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি বলে। কিংবা হয়ত বলতে পারেন, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওগুলো সত্ত্বার বাস্তব অস্তিত্ব কেউ প্রমাণ করতে পারেন নি, তাই ওসবে বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠে না। এটি পরিস্কার যে, এই বক্তব্য থেকে তার মনের সংশয় আর অবিশ্বাসের ছবিটিই আমাদের সামনে মুর্ত হয়ে ওঠে, বিশ্বাসপ্রবণতাটি নয়। ঈশ্বরে অবিশ্বাসের ব্যাপারটিও কিন্তু তেমনি। নাস্তিকেরা তাদের সংশয় আর অবিশ্বাস থেকেই ‘নাস্তিক’ হন, ‘না-ঈশ্বরে’ বিশ্বাস থেকে নয়। সে জন্যই মুক্ত-মনা Dan Barker তাঁর বিখ্যাত ‘Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist’ গ্রন্থে পরিস্কার করেই বলেছেন – ‘Basic atheism is not a belief. It is the lack of belief.’ (পৃঃ ৯৯)। আসলে সত্যি বলতে কি, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটিই দাড়িয়ে আছে একটি ‘অপ-বিশ্বাসমূলক’ প্রক্রিয়ার উপর। আমি একবার একজনের সাথে বিতর্কের সময় ড. হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকার থেকে একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি উদ্ধৃত করেছিলাম। উক্তিটি এখানেও খুব প্রাসঙ্গিক। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

‘যে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই, যার কোন অস্তিত্ব নেই যা প্রমাণ করা যায় না, তাতেমানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ ভুতে বিশ্বাস করে, পরীতে বিশ্বাস করে বা ভগবানে, ঈশ্বরে বা আল্লায় বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস সত্য নয়, এগুলোর কোন বাস্তব রূপ নেই। মানুষ বলে না, আমি গ্লাসে বিশ্বস করি বা পানিতে বিশ্বাস করি, মেঘে বিশ্বাস করি। যেগুলো নেই সেগুলোই মানুষ বিশ্বাস করে। বিশ্বাস একটি অপবিশ্বাসমূলক ক্রিয়া। যা সত্য, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; যা মিথ্যে তাতে বিশ্বাস করতে হয়। তাই মানুষের সব বিশ্বাস ভুল বা ভ্রান্ত, তা অপবিশ্বাস।’

নাস্তিকেরা সঙ্গত কারণেই এই সমস্ত প্রথাগত অপবিশ্বাসের বাইরে। “ঈশ্বর নেই” বিবৃতিটি যদি শামীম সাহেবের কথামত ‘ফাঁকিবাজি’ হয়, তবে অশ্বত্থামা, ট্যাশ গরু, বকচ্ছপ, থর জিউস, জলপরী, ফ্লাইং স্পেগেটি মন্সটার – এগুলো নেই বলাও একধরণের ‘ফাঁকিবাজি’। নয়?

যা হোক শেষ করি ধর্মকারী সাইটে বর্ণিত একজন নিধর্মীর কিছু অমৃত বচন উল্লেখ করে –

নাস্তিক্যবাদকে ধর্মের সঙ্গে যারা তুলনা করে থাকে, তাদের বলতে ইচ্ছে করে:

১. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে “অফ” বাটনকে টিভি চ্যানেল বলতে হয়।

২. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে টাককে বলতে হয় চুলের রং।

৩. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে স্ট্যাম্প না জমানোকে হবি বলতে হয়।

৪. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে বাগান না করাও একটি শখ, ক্রিকেট না খেলাও একটি ক্রীড়া, কোকেইন সেবন না করাও একটি নেশা।

এই চমৎকার উপমাগুলোর পাশাপাশি আমিও অনুরূপ কয়েকটি উল্লেখ করে তালিকার শ্রীবৃদ্ধি করি –

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে বোবা লোককে ‘ভাষাবিদ’ হিসেবে ডাকতে হয়।

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে দন্তহীন ব্যক্তিকে ‘দাঁতাল’ আখ্যা দিতে হয়।

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে উপোস থাকাকেও এক ধরনের ‘খাদ্যগ্রহণ’ বলতে হয়।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস কিংবা ধর্ম হলে চাকরী না করাটাও একটি পেশা।

নাস্তিকতা একটি ধর্ম হলে বই না পড়াকেও বলতে হয় ‘পাঠাভ্যাস’।

নাস্তিকতা বিশ্বাস হলে পোষাক খুলে ফেলাটাও এক ধরনের পোষাক পরিধান।

নাস্তিকতা ধর্ম হলে চশমা না পরাটাও এক ধরনের সানগ্লাসের ফ্যাশান।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস হলে চিরকৌমার্যও বিবেচিত হওয়া উচিৎ এক ধরনের ‘বিবাহ’ হিসেবে।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস হলে নির্লোভী থাকার চেষ্টাকেও এক ধরনের ‘লোভ’ বলতে হয়।

নাস্তিকতা একটি ধর্ম হলে নিরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়াটাও এক ধরনের রোগ!

পাঠকেরা কি বলেন?

অন্ধকারের উপাসনা -মহম্মদ মহসীন
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:823 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দুই বন্ধুই নামকরা  চিকিৎসক, অর্থাৎ সমাজের দৃষ্টিতে বেশ লেখাপড়া করা শিক্ষিত লোক।

   তাঁদের একজনের সমস্যা, তিনি কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারছেন না, অথচ খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন, সিগারেট না ছাড়লেই নয়। অন্যজন মদ্যাসক্ত ছিলেন, এখন ছেড়ে দিয়েছেন। না, সিগারেটের নেশা তাঁর নেই। তিনি  নিজেকে দেখিয়ে বন্ধুকে বলেন, আমি মদ ছেড়ে দিতে পারলাম, আর তুই সিগারেট ছাড়তে পারছিস না। অন্য জনের যুক্তি, মদ তো খেতিস একবার শুধু সন্ধ্যে বেলায়।  ও ছাড়া এমন কি আর কেরামতি। আমি সিগারেট খাই দিনরাত, সব সময়, দিনে অন্তত দশবার। সেটি ছাড়া কি মুখের কথা। তবে আমি চেষ্টা চালাচ্ছি। একেবারে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, একটা করে কমাচ্ছি। এই যেমন সামনের মাস থেকে প্রতিদিন গুনে গুনে নয়টির বেশি খাবো না। 


  আমাদের ধর্মের নেশাটিও ঠিক এমনটাই। ভোর থেকে দুপুর রাত, এমনকি রাত্রির মধ্যেও, জীবনের প্রতিটি কাজেই ধর্মের অনুষঙ্গ। নেশা যাতে কেউ ছাড়তে না পারে তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা।


 দুটি লোকের দেখা হচ্ছে, “আসসালামু আলায়কুম, ওয়ালেকুম আসসালাম, ওয়া বরকাতুহু,  আল্লাহ তোমার কে আশির্বাদ করুক, তোমার ধনবৃদ্ধি ঘটুক”, গুরুর জয়, রামকৃষ্ণের জয়, সারদার জয়, শ্রীরামের জয়, বাবার জয়, মাতার জয়। এর মূল লক্ষ্য আপনার নেশাকে প্রতিক্ষণে জাগিয়ে রাখার কৌশল। এগুলি হলো নেশা চাগিয়ে তোলার  মন্ত্র। অন্ধকারের উপাসনা।

 এই উপাসনা মানুষকে করে তোলে নির্বোধ। করে তোলে স্বার্থপর। শেখায়, তুমি একা। এসেছ একা, যাবে (কোথায়?) একা। এরা ভিক্ষা দেয় স্বর্গের লোভে, অপরের পাশে দাঁড়ায় স্বর্গের লোভে। এরা জানে এটা তার নিজের ধর্ম। এটা আছে বিপদে। অতএব  মনের মাঝে পুষে থাকে এক ঘৃণা।  প্রতিনিয়ত চলে এই কু-শিক্ষা।

 মহালয়া। তর্পন করে। পিতৃপুরুষের আত্মাকে তিল জল খেতে দেয়। জিজ্ঞেস করি, তাহলে যে শুনেছিলাম আত্মা কিছু খায় না। আর আমায় কিছু খেতে দাও, খাওয়ার পর, দেখ প্লেট খালি। 

তোমরা যে খেতে দাও আত্মাকে, খাবার কি চোখের সামনে ভ্যানিশ হয়?

তাহলে আত্মা খাচ্ছে কিভাবে বুঝলে?

 আত্মা খাচ্ছে না, কারণ আত্মা নেইই। 

 আর যদি থাকেই, সে আত্মারও জাত সম্প্রদায় আছে। হিন্দু আত্মার পূনর্জন্ম হয়। মুসলিম, খৃষ্টান,  ইহুদি আত্মার পূনর্জন্ম হয় না।

 আত্মা অন্য জন্ম নেয়, এই যদি আপনার বিশ্বাস হয় তাহলে, তাহলে সে কিভাবে সে আপনার তর্পনে সাড়া দেবে? সে তো ইতোমধ্যেই জন্ম নিয়ে বড় হয়ে হয়তো সেও এক মৌলানা অথবা চারর এর ফাদার। ও হিন্দু আত্মা শুধু হিন্দুই হয়। তাহলে হয়তো সে বড় হয়ে আজ তার নতুন বাবার তর্পন করছে। তাহলে আপনি কেন তার তর্পন করছেন?

 অর্থাৎ একই সাথে দুই বিপরীত কাজ করে বোঝাচ্ছেন, ধর্ম আপনার যুক্তিবাদী মানুষকে অন্ধ করে দিয়েছে। 

 ধর্মে কোনো যুক্তি চলে না।

একজন মুসলিম বিশ্বাস করে হজরত মোহাম্মদ গাধায় চড়ে মাহাকাশ ভ্রমণ করেছিল। আমাদের মহাপুরুষেরা ধর্মের এজেন্ট। প্রতিটি মুহূর্তে তারা মানুষকে অন্ধকারের উপাসনার শিক্ষা দিয়ে চলে। সমাজে তা প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছে।

 এ জগদ্দল পাথর সরানো একদিনের কর্ম নয়, জেনেই যুক্তিবাদীরা আলো আনার প্রচেষ্টা করে চলেছেন। নিরন্তর। নিরলস।

প্রণাম বনাম সম্মান -অভিজিৎ ব্যানার্জী
Nov. 21, 2024 | যুক্তি | views:25 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ছোটো থেকেই শুনে আসছি বড়োদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে নাকি প্রণাম করতে হয়। বেশ খুব ভালো কথা। তবে ধরুন কারোর প্রণাম করতে ভালো লাগে না বা তাড়াহুড়ো এর মধ্যে করা হলো না তার মানে কী তিনি মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে না। 

ধরুন বাড়িতে কোনো আত্মীয় এলো আপনি ওনাকে আসা মাত্রই প্রণাম করলেন এবং মনে মনে ভাবলেন না বলে চলে এলো, কতোদিন থাকবে কে জানে, চলে গেলে ভালো হয়। এক গ্লাস জলও দিলেন না, যতক্ষণ না পর্যন্ত না বললেন উনি।

অন্যদিকে, ধরুন বাড়িতে কোনো আত্মীয় এলো আপনি ওনাকে আসা মাত্রই প্রণাম করলেন না কিন্তু ওনাকে দেখে খুব খুশি হলেন, বসতে বললেন, গল্প করলেন, নিজের হাতে জল খাবারের ব্যবস্থা করলেন। কোনটা দরকার প্রথম নাকি দ্বিতীয়টা? নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টা।  অনেকে বলবেন দুটোই দরকার। কিন্তু কেনো দরকার দ্বিতীয়টাতেই যখন উপযুক্ত সম্মান জানানো হয়ে যায় তখন প্রণামের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়। ধরুন  কেউ কোনো বড়ো মানুষের সাথে দেখা হবার পর প্রণাম জানাতে ভুলে গেলো কাজের চাপে, তার মানে কি তিনি মানুষকে সম্মান জানাতে জানে না? সম্মান ও শ্রদ্ধা আসে মন থেকে, সম্মান ও শ্রদ্ধা বিবেচনা করুন মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার দেখে, প্রণাম তো লোক দেখানোও করা যায়, মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার মাপকাঠি কখনো প্রণাম হতে পারে না, সম্মান ও শ্রদ্ধা বোঝা যায় মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার দেখে। মানুষকে ভালোবাসুন, যত্ন করুন ও মানবিকতা বজায় রাখুন। ধন্যবাদ।

মৃত্যু যখন জীবনদায়ক -অমলকান্তি
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:2612 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মৃত্যু এক চিরন্তন সত্য, যা গ্রহণ করা অত্যন্তই কঠিন। যে কোনো মৃত্যু মাত্রই তার নিকটস্থের কাছে তা শোকবিহ্বল। এই মৃত্যু যদি অকালে হানা দেয় দেহে, তবে তা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। এক গভীর শূণ্যতা সৃষ্টি করে দিয়ে যায় মৃত্যু। 

এই মৃত্যু ঘটে দুইভাবে। এক, সাধারণ মৃত্যু যাকে বলা হয় কার্ডিও রেসপিটরি ফেলিয়র যা ঘটে কোন অসুখের কারণে। দুই, ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্ক কান্ডের মৃত্যু যা ঘটে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণের ফলে।

কিন্তু, মৃত্যু যেমন এক কঠিন সত্য; তেমনি এই মৃত্যুই পারে অন্য কোনো মৃত্যু পথগামীর জীবনে জীবনের আলো বয়ে আনতে। মৃত্যু হয়ে উঠতে পারে জীবনদায়ক। স্বাভাবিকভাবেই, আমরা দেখে থাকি মানুষেরা মারা গেলে তাদের নিজস্ব ধর্মানুসারে হয় পুড়িয়ে ফেলে, দাফন্ করে, বা আরও অন্যান্য ভাবে মৃতদেহকে নষ্ট করা হয়। তাদের কাছে মৃতদেহ যেনো একটা সামাজিক আবর্জনা স্বরূপ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৃতদেহ একটি সম্পদ চিকিৎসাশাস্ত্রে। মৃতের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ(Organs)ও কলা (tissues) সংগ্রহ করে মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানবদেহের মধ্যে তা প্রতিস্থাপন করা যায়।

একমাত্র মৃত ব্যক্তির সক্রিয় ও উপযুক্ত অঙ্গ সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক’রা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দাতা অরগ্যান বা টিস্যু সংগ্রহ সম্ভব কিনা যাচাই করে নেবেন।

মৃতদাতার ক্ষেত্রে যে বয়স সীমা মেনে চলা হয় তা হলো, কিডনি, লিভার: ৭০ বছর পর্যন্ত। হার্ট, ফুসফুস: ৫০বছর পর্যন্ত। প্যানক্রিরিয়া, অন্ত্র: ৬০-৬৫ বছর পর্যন্ত। কর্ণিয়া, ত্বক: ১০০ বছর পর্যন্ত। হার্ট ভালভ: ৫০ বছর পর্যন্ত। অবহাড়: ৭০ বছর পর্যন্ত। অবশ্যই কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে। এর পরবর্তী প্রশ্ন আসবে মৃত দাতার থেকে গৃহীত প্রত্যঙ্গগুলি কত তাড়াতাড়ি প্রতিস্থাপন করা উচিত? 

হার্ট ও হার্ট ভালভ (৪ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে)। ফুসফুস (৪ থেকে ৮ ঘন্টার মধ্যে)। ইনটেন্সটাইন (৬ থেকে ১০ ঘন্টার মধ্যে)। লিভার (১২ থেকে ১৫ ঘন্টার মধ্যে)। প্যানক্রিয়াস (১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে)। কিডনি (২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে)। এই বিস্তারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার যে মৃত্যুর আমাদের মরদেহ হয়ে উঠতে পারে নব জীবনদানের আধার। জীবিতকালে আমরা নিজের নির্বাচিত কোন ব্যাক্তিকে আমার নিজের কিছুটা লিভার, একটি কিডনী এবং রক্ত দিতে পারি। অন্যকিছু নয়। কিন্তু মরণোত্তর কলা বা প্রত্যঙ্গদানের ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচিত কোন ব্যাক্তিকে তা পারিনা।

এক্ষেত্রে আমাদের একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার রক্ত বা কলা কিংবা প্রত্যঙ্গ কোনভাবেই কেনা বা বেচা যাবে না। যা আইনবিরুদ্ধ। এই মর্মে, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতিকল্পে গত ১৪ই আগস্ট, ২০২২ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ (উদয়নারায়ণপুর বিজ্ঞান কেন্দ্র), উদয়নারায়ণপুর ব্লকের ডিহিভূরসুট অঞ্চলে একটি মরণোত্তর চক্ষুদান-দেহদান শিবির আয়োজন করে। এই শিবিরে ৫২জন চক্ষুদান করেন ও ৬ জন করেন দেহদান। এই প্রগতিশীল দাতা'রা জন্মান্তরবাদের মিথ্যা ধারণাকে নস্যাৎ করে এগিয়ে এসেছেন এই কর্মকাণ্ডে। তাঁরা বুঝেছেন জন্মান্তরের কথা আসলে ভন্ড জ্যোতিষী - তান্ত্রিক দ্বারা অর্থ-লুটের কৌশল। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছেন, যদি জন্মান্তরবাদ সত্য হয় তাহলে যারা হিরোশিমা, নাগাসাকি' তে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারা গেছেন, যাদের দেহের নামমাত্র চিহ্নটুকুও মেলেনি তাহলে তারা আবার জন্ম নিলে কোন অঙ্গ নিয়ে জন্ম নেবে? একই সময়, একই জায়গায় ঐ যে লাখ লাখ মানুষ মারা গেলেন তবে কী তাদের সবাইয়েরই পূর্বজন্মের কর্মফল এক ছিলো? ঐ লাখ লাখ মানুষ কী একই দিনে, একই তিথি-নক্ষত্র অনুসারে জন্মগ্রহণ করেছিলো? তাহলে ঐ বিস্ফোরণে যারা মারা গেছিলেন তারা সবাই একই বয়সের? 

জানি প্রশ্নগুলোর উত্তর যুক্তিগত ভাবে খুব সহজ তাই তার বিশ্লেষণও সহজ। এই সমস্ত কুসংস্কারের অন্ধকারকে নস্যাৎ করে দিয়ে, কোনো দৃষ্টিহীন বা কোনো মৃত্যু পথগামীর জীবনে জীবনের আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে উঠুন। মরণোত্তর চক্ষুদান-দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।

ত্রিবিধ -চয়ন আচার্য্য
Nov. 21, 2024 | সমাজ | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম:

পরিবেশ বান্ধব সবুজ আতশ বাজি কতটা পরিবেশ বান্ধব?

মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পরিবেশ বান্ধব সবুজ আতশবাজি ব্যবহারের নিদান দিয়েছে রাজ্য সরকার। সবুজ আতশবাজি ঠিক কতটা পরিবেশ বান্ধব? একটু খতিয়ে দেখা যাক। আতশবাজি বলতে সাধারনত আমরা বুঝি যে বাজি আকাশে উঠে ফাটে এবং রংবেরং এর ফুলকি ছড়ায়। এই বাজি গুলিতে থাকে বেরিয়াম নাইট্রেট,(সবুজ আলোর জন্য) পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম পাউডার(রুপোলী ফুলকির জন্য), পটাশিয়াম ক্লোরেট (চলতি ভাষায় কলেরা পটাশ) এবং সালফার। অধম লেখক বাল্যকালে তুবড়ী বানানোয় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নিবেদন করছে এই রাসায়নিক পদার্থ পুড়লে যে ক্ষতিকারক ধোঁয়া উৎপন্ন হয় (বিশেষ করে সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বণ মনোক্সাইড) পরিবেশের সমগ্র জীবকূলের জন্য প্রাণঘাতী ও ক্ষতিকারক। সবুজ রং হলেই যে তা প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব এরকম মন্তব্য রীতিমতো অর্বাচীনসুলভ। ভিক্টোরিয়ান ইংলন্ডে 'শিলোজ গ্রীণ' নামের সবুজ রং বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হত যা ওয়ালপেপারে ব্যবহার করা হত। প্রচুর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই রং কারণ আর্সেনিক ছিল এর একটি অন্যতম উপাদান। পরিশেষে বলতে চাই, পরিবেশবান্ধব বাজি আর ঝগড়াবান্ধব স্ত্রী হল কবির কল্পনা। বাস্তবে ইহার অস্তিত্ব নাই। আর প্রকৃতিমাতার ধ্বংসসাধন করে মাতৃপূজা আমাদের মত হিপোক্রিটরা আমরণ চালিয়ে যাবে। সুতরাং এত লম্বা লেখা বৃথা পন্ডশ্রম।

দ্বিতীয়:

রথযাত্রা: একটি বাল্য স্মৃতি ও উপলব্ধি

  যখন খুবই ছোট বয়স হয়তো নয় বা দশ তখন রথের দিন মানে একটা উৎসবের দিন। শুরু হয়েছিল একতলা একটা কাঠের রথ থেকে, একই রথ বছর দুয়েক চালানোর পর প্রমোশন পেলাম। দুতলা কাঠের রথ জুটলো। রঙিন কাইট পেপার দিয়ে রথ সাজানো, ফুলের মালা দিয়ে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তিগুলিকে সাজানো, সেকি উত্তেজনা! যখন একতলা রথ ছিল তখন একটাই মূর্তি ব্যবহার করতাম যেটার দুপাশে জগন্নাথ বলরাম আর মাঝে সুভদ্রা। যখন দু তলা রথ পেলাম তখন আলাদা আলাদা মূর্তি ওপর তলায় জগন্নাথ নিচের তলায় বলরাম সুভদ্রা। অনেক পরে প্রমোশন হয়ে তিন তলা রথ জুটে ছিল, যেখানে তিনজনকে আলাদা আলাদা ফ্লোরে একোমোডেশন দেওয়া গেল। তার আগে অবধি বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক লাগতো দুতলা রথের উপরতলায় কে থাকবে? জগন্নাথ নাকি তার বড়ভাই বলরাম!এদের মধ্যে কে বড়? শ্রীজগন্নাথ! যিনি শ্রীহরি বিষ্ণুরই রূপ হিসেবে আরাধ্য নাকি তার বড় ভাই শেষনাগের অবতার বলভদ্রদেব!

 যাইহোক, একবার রথের বিকেল বেলা রথ সাজিয়ে বের হয়েছি প্রসাদ হিসেবে বাটিতে রেখেছি কিছু নকুল দানা যাকেই সামনে পাচ্ছি হাতে একটা করে নকুল দানা দিচ্ছি আর বদলে এক টাকা, দু টাকা, ৫০ পয়সা এরকম করে প্রনামী পাচ্ছি। সন্ধে ছটার সময় দেখলাম ৭ টাকা মত হয়েছে। সেখান থেকে আবার দু টাকা ইনভেস্ট করে দুটো মোমবাতি আর নকুল দানা কিনে অন্য পাড়ার দিকে এগোলাম, হাতে ঘড়ি পড়তাম না ঘুরছি তো ঘুরছি, সময়জ্ঞান আর নেই, যাকে পাচ্ছি হাতে একটা করে নকুল দানা দিচ্ছি আর প্রণামী নিচ্ছি। যখন হুশ হলো তখন বেশ রাত। গুনে গেঁথে দেখি প্রায় ৫০ টাকার কাছাকাছি খুচরো পেয়েছি। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে আত্মা দেহ ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়! তড়িৎগতিতে গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে পিঠে প্রথম চপ্পল এর বাড়িটা পড়ল। তারপর বলাবাহুল্য প্রচুর মারধর জুটলো। এখনো মনে আছে বাবার শাসন বাণী, ঘন্টা নাড়বে? পুরুতগিরি করবে বড় হয়ে?

 বর্তমানে মনে প্রশ্ন জাগে বাবা এখনকার ধর্মগুরু স্পিরিচুয়াল মোটিভেটরদের আশ্রম, বাড়ি, গাড়ি, হেলিকপ্টার এবং সেমিনার দেখলে কি ভাবতেন? সেই বাল্য বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম প্রায় বিনা ইনভেস্টমেন্টে ধর্মব্যবসায় কিরকম ভয়ংকর প্রফিট। যত দিন যাচ্ছে আশেপাশের পরিচিত মানুষজনগুলিকে যুক্তি,বোধ, বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কিরকম পাগলের মত আচরণ করতে দেখছি, ধর্মের নামে গলা কেটে ফেলা রাজনীতি,পরমতঅসহিষ্ণুতা গ্রাস করে ফেলছে এই উপমহাদেশকে।

তৃতীয়:

কাঁচা বাদাম:

 সোসাল মিডিয়ায় বীরভূমের দূবরাজপুরের ভূবন বাদ্যকরের বাদাম ফেরী করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হওয়ার মূল কারণ হলো ভুবনের একটি গান,যে গানটি গেয়ে সে বাদাম ফেরি করত।

গানটির কথা গুলি হল- মোবাইলের বডি ভাঙ্গা, পায়ের তোড়া, হাতের বালা থাকে যদি সিটি গোল্ডের চেন /দিয়ে যাবেন/ তাতে সমান সমান বাদাম পাবেন।/বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম।/আমার কাছে নাইকো কোনো ভাজা বাদাম।

 -গানটি যে ভিডিও থেকে ভাইরাল হয়, তার অডিও ক্লিপ টা নিয়ে তার সাথে কিবোর্ড স্যাম্পলিং করে, ডিজে বিট যোগ করে একটা ধামাকাদার গান ইন্টারনেটে ছেড়েছে কিছু ক্রিয়েটিভ মিউজিশিয়ান। এই গানটির একাধিক ভার্শন এখন ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়ার সাইটগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরিদ্র বাদামওয়ালার মুখের গান শুনছে বিশ্ববাসী। কিন্তু প্রশ্ন এটা যে এই অদ্ভুত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে যে বাদাম ব্যবসা তাতে ভুবন বাদ্যকরের লাভটা কোথায়? দুঃখের বিষয় আমি দর্শকবৃন্দকে এই গানটি নিয়ে টিক টকে কোমর দোলাতে দেখেছি। কিন্তু এই প্রশ্নটা কাউকেই করতে শুনিনি। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ই বর্জ্য সংক্রান্ত একটি প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করায় আমার কাছে এর একটি সম্ভাব্য উত্তর আছে। ভারতে খুব জনপ্রিয় না হলেও অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে অর্থ উপার্জনের একটি নতুন অল্টারনেটিভ পেশা হিসেবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আরবান গোল্ড মাইনিং‌। শহরে তো সোনার খনি নেই! তাহলে সোনা উত্তোলন করা হচ্ছে কোথা থেকে? এর উত্তর হলো বিভিন্ন পুরোনো ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যের মধ্যে সোনার ব্যবহার খুবই প্রচলিত‌। কম্পিউটারের মাদারবোর্ডের, প্রসেসরের, মোবাইলের পিসিবি'র অনেক যন্ত্রাংশই সোনার তৈরি বা গোল্ড প্লেটেড। তবে এই ই-বর্জ্য থেকে সোনা সংগ্রহ সহজ নয়। ব্যবহার করা হয় নাইট্রিক অ্যাসিড সায়ানাইড এর মত ভয়ঙ্কর রাসায়নিক। সম্ভবত ভুবন বাদ্যকর ও হয়তো নিজে অথবা অন্য কারো সহায়তায় আরবান গোল্ড মাইনিং এর কাজটি করে চলেছে। মনের ইচ্ছা কাঁচা বাদাম গানটির মত যেন এই পেশা টিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং এই পেশার হাত ধরে কিছু অংশ হলেও ই-বর্জ্যের রিসাইকেলিং যেন সম্পন্ন হয়।

চয়ন আচার্য্য

L.L.B (final year) Burdwan University.

M.A Film Studies, Jadavpur University.

ধর্ম কেন ব্যবসা? -রাজেশ মন্ডল
Nov. 21, 2024 | নাস্তিকতা | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আজকের ভারতবর্ষে মানুষ অসহায় যুক্তিহীন হয়ে পড়েছে বেশি বেশি করে। তার একটি প্রধান কারণ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। তারা চায় মানুষ ধর্ম নিয়ে মেতে থাকুক। তার জন্য যা যা করার দরকার সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত সমস্ত ব্যবস্থা তারা করে রেখেছে। এই অন্ধ বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা ‘মানুষ’কে মানুষ হয়ে ওঠার উপাদান দিতে পারুক আর না পারুক ধর্মীয়  অমানুষ করার কাজে তাঁদের ছাপ স্পষ্ট। কার্যত এখন ভারত বিভক্ত কে বড় হিন্দু, আর কে বড় মুসলমান এই প্রমাণে। এই খেলা তৈরিতে সরকারও ১০০% সফল। আর এই খেলা চালানোর জন্য পুঁজির কখন অভাব হয় না, সে দূর্গাপূজায় ৬০,০০০ করে দেওয়া থেকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ধর্মীয় শিক্ষালয় মাদ্রাসা সরকার দ্বারা পরিচালনা করে। পৃথিবীতে এমন একটি দেশ কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি যেখানে খিদের তাড়নায় মানুষ মারা যায় প্রতিনিয়ত, সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরকারের খরচ কয়েক হাজার কোটি। গরিব মানুষ সব থেকে বেশি কায়িক পরিশ্রম করে এবং দিনরাত ভগবান করে, এই পরিস্থিতি থেকে সে মুক্তি পেতে চায় কিন্তু কোনও উপবাস ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেয় না বরং জোতিষী মশাই শনির দৃষ্টি পড়েছে বা বৃহস্পতির দৃষ্টি নেই বলে পাথর দিয়ে টাকা কামানোর ব্যাবস্থা করেছে মানুষ দিব্যি তা গ্রহণ করে দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে।


এরপর এই সমস্ত করে যখন কোন কূল কিনারা পায় না তখন সেই গুরু মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। গুরু তাকে ভাল করে ভগবান দর্শনের পথ বলে দেয়। যা বলে তাই দৈববাণী অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে থাকে। এই অবধি সব ঠিক ছিল, গুরু আবার নিজের ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য তাতে অতি চালাকের সাথে শিষ্যকে দিয়ে তাঁর খ্যাতি প্রচার করতে থাকে। এই গুরুরা ভালো করেই জানে ‘যত শিষ্য তত টাকা’, কিন্তু আপনি মুক্ত মনের মানুষ হয়ে শিষ্যের কাছে জিজ্ঞাসা করবে গুরু সম্পর্কে। শিষ্য যা বিবরণ দেবে তা হল এই তার গুরু খুব সরল ভালমানুষ, নিরামিষ আমিষ, মরা বাড়ি যাওয়া কোন কিছুতেই তার গুরু কোন টাকা পয়সা চায় না। কিন্তু একটু ঠিক খবর নিলে জানা যাবে। গুরু হওয়ার আগে সে হকার কিংবা 420 জাতীয় লোক ছিল। টাকাপয়সা ছিল না, গুরু হওয়ার পর সে কোটিপতি কিছু লাখপতিও আছে। তারা শিষ্য বাড়িয়ে কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছে। শিষ্যরা মোটে বুঝতে চায় না গুরুপ্রীত রাম রহিমের ও তাঁদের মতো 2 কোটি শিষ্য ছিল। 


এই ভণ্ড বাবা দের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে একমাত্র যুক্তিবাদী মন। যুক্তিবাদী মনের একজন করে প্রতিটা গ্রামে গ্রামে তৈরি হলে এই কুযুক্তির অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্তির আলো দেখাতে পারবে। যুক্তিবাদ যখন প্রতিটা ঘরে পৌঁছবে ভন্ড রাজনীতি শেষ হবে। সাথে পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ তার অধিকার বুঝতে শিখবে। 

দুই-পত্র -দিবাকর মন্ডল
Nov. 21, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এখনও গ্রাম বাংলার মানুষ থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলে অনেক মানুষই আছেন, যারা ম্যাজিসিয়ানের জাদু দেখানোটাকে তন্ত্র, মন্ত্র ঈশ্বরের শক্তি এবং ভুতের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাস করেন। অনেকেই মনে করেন ম্যাজিসিয়ানের হাতে থাকা কালো ছোটো লাঠি বা দন্ডটাই তার জাদুবিদ্যার উৎস। আসলে ম্যাজিক কোন তন্ত্র - মন্ত্র, ঈশ্বর বা ভূত-প্রেতের কারিগরি শিক্ষা বা কৌশল নয়; ম্যাজিক হল বিজ্ঞানের কলাকৌশল। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ানদের মধ্যে একজন পিসি সরকারের (জুনিয়র) সামান্য একটু তথ্য তুলে ধরলাম বোঝানোর সুবিধার্থে। পি. সি. সরকার জাদুবিদ্যায় কল্পনা, উদ্ভাবনীর ক্ষমতা, প্রদর্শনভঙ্গি, পরিবেশনের মুর্ছনা, জাঁক-জমকপূর্ণ পোশাক, থিয়েটারের কায়দায় দৃশ্যপট, স্বদেশি কায়দায় বাজনা-সহ অভিনয়ে দক্ষ সুন্দর-সুন্দরী সহকারী-সহকারিনীর সঙ্গে আল্ট্রাভায়োলেট আলোর ব্যবহার করতেন। তিনিই প্রথম এসবের প্রবর্তক।

পি.সি.সরকাররের সেরা ম্যাজিক, বড় আকারের বস্তুগুলি অদৃশ্য করা। তাজমহল এবং ইন্দোর-অমৃতসর এক্সপ্রেস অদৃশ্য করেন। ৪ নভেম্বর ২০০০ সাল, তিনি আগ্রার কাখপুরাতে দুই মিনিটের জন্য তাজমহল "অদৃশ্য" করেন। তিনি কলকাতার ৩০০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটি অদৃশ্য করেন। এবং ১৯৯২ সালে ভারতে বর্ধমান জংশনে এক বিশাল জনসাধারণের সামনে যাত্রীদের পূর্ণ ট্রেন অদৃশ্য করেছেন। তিনি লন্ডনের ট্রফ্লাগার স্কয়ার থেকে, চোখ বেঁধে উচ্চ গতিতে সাইকেল চালান এবং একটি রেকর্ড তৈরি করেন।

 পিসি সরকার যতবার ইন্টারভিউ দিতে সামনে এসেছেন ততবারই উনি বলেছেন যে জাদু কোন অলৌকিক ক্ষমতা নয়, শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে এমন ভাবে প্রয়োগ করা যাতে তা মানুষের চোখে আশ্চর্য লাগে। এককথায় মানুষের Attention Divert করার কৌশলের অপর নামই জাদু। উনি সবসময়ই বলেন জাদুবিদ্যায় কোনও অলৌকিকত্ব নেই। সবটাই বিজ্ঞান আর কঠোর অনুশীলন। যা ঘটছে সবই দর্শকদের চোখের সামনে, কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। এছাড়া মঞ্চ, আলো, জাদুকরের মুখে অনর্গল কথা, বাজনা... সবকিছুই দর্শকের সামনে এক camouflage তৈরি করে যেটা জাদুকরকে দর্শকের মন divert করতে সাহায্য করে।

বর্তমানে "ট্রিক বিহাইন্ড ম্যাজিক", “ফাইনালি ম্যাজিক'স সিক্রেট রিভিউ”  বলে দুটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে কিভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, কারসাজি এবং কৌশলের মাধ্যমে ম্যাজিক প্রদর্শন করে সেগুলো তুলে ধরা হয়। এছাড়াও ফেসবুক এবং ইউটিউব এ প্রচুর ভিডিও পাবেন যেখানে ম্যাজিশিয়ান কিভাবে ম্যাজিক দেখান তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।

অবশেষে এটাই বলতে পারি যে যত ভালোভাবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং কলাকৌশল কে কাজে লাগাতে পারে সে তত বড় ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিক বা জাদু কোন দৈবিক বিদ্যা, মন্ত্র, ভূতাত্মা, কোন মানুষের হাড় বা বিড়ালের হাড় (ম্যাজিশিয়ান এর হাতে থাকা ঐ কালো লাঠিটি যা অনেকে ভাবে) প্রভৃতির মাধ্যমে মোটেই হয় না। এগুলো একটা সম্প্রদায়ের নিজেদের ব্যবসা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কল্পনার মাধ্যমে মানুষের মগজের ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তার সঙ্গে বিশ্বাস শব্দটা যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত ভন্ড এবং ভন্ডামির থেকে দূরে থাকবেন।

জেনে রাখুন ম্যাজিক এবং ম্যাজিশিয়ান দুটোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; কোনটাই অস্বাভাবিক বা অলৌকিক নয়।

দুই:

আজ অফিস যাওয়ার পথে একটা বিচারকের গাড়ির দিকে চোখ যায়। আমি বরাবরই উৎসুক থাকি নেতা মন্ত্রী, অফিসার, বিচারক, ডাক্তার এদের মুখটা, এদের চেহারাটা দেখার। স্বাভাবিকভাবে ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছিলাম ভদ্রলোককে কেমন দেখতে, কেমন তার চেহারা, কেমন গঠন। বিচারক বলে কথা! কিন্তু যে জায়গায় গিয়ে আমার চোখ আটকে গেল সেটা হল- আমি দেখলাম ভদ্রলোকের ডান হাতের তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকা তিনটিতেই পাথর বিশিষ্ট আংটি। দুটি পাথর বেশ বুঝতে পারছিলাম একটি মুক্তা এবং অপরটি নিলা কিন্তু তৃতীয় পাথরটির রং ভালোভাবে বুঝতে পারিনি।

যাইহোক এখানেই আমার প্রশ্ন দেশের বিচারক যদি কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়, তিনি কীভাবে অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবেন? যদি কোন অপরাধি বলেন, "আমার মাথায় শনি ভর করেছিল তাই আমি খুন/ ধর্ষন করে ফেলেছি।" তাহলে কি বিচারক তাকে নীলা পরার পরামর্শ দেবেন? যদি কোন অপরাধি বলে তার মাথা এমনিতেই গরম তাই উল্টোপাল্টা কাজ করেছেন। তাহলে কি তাকে মুক্ত পরার উপদেশ দেবেন?

 আজ যে শুধু বিচারককে দেখেছি বলেই বিষয়টা আমার মাথায় লেগেছে তা নয়, এর আগেও আমি বহু শিক্ষককে দেখেছি, আমাদের অফিসের অফিসার কেও দেখেছি এবং অনেক উচ্চশিক্ষিত, পদমর্যাদার লোককেও দেখেছি এই ধরনের কুসংস্কার কে মান্যতা দিতে।

 যে দেশের বিচারক, আইন রক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষক, ডাক্তার এদের মত সমাজের আদর্শবান মানুষেরাই কুসংস্কার মানেন, ভুত-প্রেত, জিন, দেব-দেবীতে (আকার এবং নিরাকার) বিশ্বাস রাখেন, তন্ত্র মন্ত্রে আস্থা রাখেন, হাতে - গলায় মাদুলি ঝোলানো থেকে শুরু করে তাবিজ বা আংটি পরা, মানত করা, রোজা, নামাজ, যাগ-যজ্ঞ করা, বলি দেওয়া প্রভৃতি কুসংস্কার মেনে থাকেন। সেই দেশের জনগণ সুবিচার পাবে কিসের আশায় বলতে পারেন? যে মানুষটা বিশেষ একটা ধর্মীয় রীতিনীতিকে মান্যতা দেয়, সেই মানুষটার থেকে আপনি নিরপেক্ষ বিচার পাবেন, এটা কি সম্ভব?

যে দেশের উচ্চ শিক্ষিত মানুষেররা, যারা জাতির মেরুদন্ড, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ, যাদেরকে আমরা ছোটবেলা থেকে জীবনের লক্ষ্য বলে মনে করি তারাই যদি এমন আচরণ করে থাকেন। সেই দেশের গ্রাম্য, খেটে খাওয়া, অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষদের আপনি কিভাবে কুসংস্কারমুক্ত করবেন বলতে পারেন?


শিক্ষক ও ধর্ম -অনিক সরকার
Nov. 21, 2024 | ধর্ম | views:280 | likes:0 | share: 0 | comments:0

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম নিরপেক্ষতার গুরুত্ব-বিদ্যাসাগর মহাশয় বলতেন- আমাদের দেশে এমন শিক্ষক চাই,যারা বাংলা ভাষা জানেন, ইংরেজি জানেন.আর চাই ধর্মীয় সংস্কার মুক্ত শিক্ষক। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষা দান করবেন এর সাথে ধর্মীয় সংস্কার এর কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে, এবং তা যথেষ্ট গভীর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর পাঠ্যক্রম  বিজ্ঞান নির্ভর, আর ধর্ম  বিশ্বাস(পড়ুন অন্ধবিশ্বাস) নির্ভর। পরস্পরের সাথে চরম ভাবে সাংঘর্ষিক। এবার ধরুন এক বাংলার শিক্ষক ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস যখন পড়াবেন, তখন ওনাকে আদিম গুহা মানব এর দেয়াল এ আঁচড় কেটে চিহ্ন আঁকিবুকি থেকেই শুরু করতে হবে সে বলতে পারবে না দেবী সরস্বতী  স্বয়ং এসে বিদ্যা দান করে গেছেন। সমস্যাটা এখানেই। প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কতটা আত্মবিশ্বাস এর সাথে এগুলো শিক্ষার্থীদের ব্যাখ্যা করবেন এটা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। কারণ যে মুহূর্তে বলবেন আমাদের পূর্বপুরুষ গুহা মানব ভাষার সৃষ্টিকর্তা তিনি নিজের ধর্মের সাথে বেইমানি করবেন।  যেটা ধার্মিকরা খুব সহজে করতে চায় না। আবার ধরে নিলাম উনি ধর্মকে সাইড-এ রেখে এটাই পড়ালেন, এবার উনি বাড়ি গিয়ে যখন  আবার দেবী সরস্বতীর চরণে লুটিয়ে পড়বেন তখন কিন্তু নিজের শিক্ষা, পেশা সব কিছুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে কারণ কোনো বৈজ্ঞানিক শিক্ষা কাল্পনিক দেব দেবীকে মেনে নেয় না। উনি ইতিহাস পড়িয়ে ধর্মের সাথে বেইমানী করলেন, আবার ধর্ম পালন করে নিজের পেশার সাথে বেইমানী করলেন। এরকম দু নৌকায় পা দিয়ে চলা  শিক্ষক সমাজের জন্য কতটা নিরাপদ সেটা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। 

ধর্ম আর বিজ্ঞান একে  অপরের পরিপূরক এই কথাটা ডাহা মিথ্যা।

হাতে গ্রহের দোষ কাটানোর রত্ন পড়া শিক্ষক কোন যুক্তিতে শিক্ষার্থীদের গ্রহণ এর কারণ বোঝাবেন সেটাই বোধগম্য হয় না। অথবা ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বিশ্বাস করা ব্যক্তি কোন যুক্তিতে বিবর্তন পড়াবেন। পড়ালেও তা পারিশ্রমিক এর লোভের বশবর্তী হয়ে, জ্ঞান চর্চার জন্য তো মোটেও নয় শিক্ষা বেছে নিলে ধর্ম অবমাননা হয়, ধর্ম বেছে নিলে শিক্ষা অবমাননা হওয়া আবশ্যক। যারা ধর্ম আর বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহাবস্থান করাতে চায় তারা হয় চরম লেভেল এর নির্বোধ অথবা চরম ধুরন্ধর। 

ঈশ্বরের মহানতা -মহঃ সামিম
Nov. 21, 2024 | গল্প | views:981 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(একটি ছোট্ট কাহিনী)

ইউরোপের নরওয়ে দেশের মধ্যে একটি সুন্দর গ্রাম ছিল। গ্রামটির নাম ‘God's Land’(ভগবানপুর)। সেখানে রাস্তাঘাট ছিল অতি সুন্দর, পুকুর ছিল মাছে ভর্তি, মাঠ ছিল ফসলে ভর্তি, স্বাস্থ্য সেবা অসাধারণ। গ্রামের জনসংখ্যা খুবই অল্প, প্রায় 20 জনের একটি গ্রাম। এককথায় অসাধারণ সুন্দর একটি গ্রাম যা শুধু কল্পনার জগতেই শোনা যায়।

সেখানে মানুষদের সুরক্ষার জন্য একজন সেনাপতি ছিল, তার নাম ছিল এলোহিম। সেই গ্রামের সব মানুষ তাকে ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করতো এবং তাকে বিভিন্ন দামী দামী উপদৌকন এবং খাবার দিয়ে যেত। এলোহিমের সাথে তার আরও 4 জন সৈনিক থাকত। তারাও আনন্দের সাথে সেই সব গ্রহণ করত। গ্রামবাসীর এই সব কর্মের পিছনে একটা বিশ্বাস ছিল যে কোনো বিপদ আসলে এলোহিম্ এবং তার সৈনিকটা তাদের বাঁচাবে।

এই রকম ভাবেই তাদের জীবন চলছিল। হঠাৎ একদিন 5 জনের একটি ডাকাতের দল তাদের গ্রামে হামলা করল। তারা প্রাণের ভয়ে এলোহিমের কাছে ছুটে গিয়ে তাদের রক্ষা করার আবেদন জানাল। কিন্তু আশ্চর্য রকম ভাবে  এলোহিম তাদের জানাল, “আমি তোমাদের কিচ্ছু সাহায্য করতে পারবো না।” এই কথা শুনে গ্রামবাসীরা কাকুতি মিনতি করতে লাগল তাদের বাঁচানোর জন্য। এলোহীমের কাছে তার পায়ে পড়ে নিজেদের প্রাণের ভিক্ষা চাইতে লাগলো। কিন্তু সেই সব কিছুই এলোহিমকে তার স্থান থেকে সরাতে পারলো না। তখন তারা গ্রামের শিশুদের এগিয়ে দিয়ে বললো, “আমাদের না হয় ছেড়ে দিন, এই ছোট্ট শিশুদের তো বাঁচান”। কিন্তু এলোহিমের কঠোর মন কিছুতেই শুনলো না। শেষে এলোহিম বলল, “আমি আসলে ঈশ্বর, আমার এটাই কাজ, আমি শুধু দেখি”।

তারপরে ডাকাতের দল গ্রামের সমস্ত মানুষকে এক এক করে হত্যা করল। এলোহিম শুধু চুপ চাপ দেখে গেলো। আর বললো, “এটাই তোদের ভাগ্যে ছিল”। 

আস্তিকতায় পেট ভরে না, রোগ সারে না -সায়ক সরকার
Nov. 21, 2024 | নাস্তিকতা | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যখন খুব খিদের পরে গরম ভাতের গন্ধটা নাকে আসে, তখন মনে হয় এটাই স্বর্গ কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষ এই স্বর্গ সুখ ঠিকমত পায় না, তারা তাদের দুঃখের কথা বললে কোনো ধার্মিক গুরু বলবে এখন এতো কষ্ট করছ, দেখবে মৃত্যুর পরে তুমি সুখ পাবে, আসলে এসব বলে একটি মানুষ কে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। যখন করোনা হলো তখন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, NGO, রেড ভলান্টিয়ার্স (ভারত)-দের আমাদের ফ্যারিস্তা বলে মনে হয়েছিল। এই কিছুদিন আগে বাংলাদেশে যখন বন্যা হলো, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের ধর্মীয় গুরু, ইউটিউবার-রা, তাদের অর্থ বল জুগিয়েছিল সাধারণ মানুষ। তাহলে সব তো আমরাই করলাম। তাহলে অদৃশ্যমান ঈশ্বর কোথায়? যেই গরম ভাতের গন্ধ আমাকে সুখ দিয়েছিলো সেই ভাতের ধান কৃষকরা বানায়, বানানোর সময় নজর রাখে সারের বৈজ্ঞানিক উপাদান, জলবায়ুর প্রকৃতি, মাটির উর্বরতার উপর, সোজা কোথায় তারা একটা অঙ্ক করে ফেলে, তারপরে নিজেদের উত্তর বের করে, এই অঙ্ক করতে লাগছে যুক্তি, তাহলে হঠাৎ করে কিছু হলো না।

অনেক লোক যেমন অনেক রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করেছে, ঠিক সেইভাবে অনেক ভাবে ধর্ম প্রচার করেছে, তাতে যে যা ভেবেছে সেটা বলে গেছে, তারাও আমাদের মতো এই পৃথিবীতে এসেছিলো, তাদের ও হাত-পা ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন ছিল না, ছিল না বিজ্ঞানের দুর্দান্ত আবিষ্কার, সময় বদলে গেছে আমাদের সেই ধর্মীয় চিন্তাকে প্রশ্ন করতে হবে।


আজকে চিকেন পক্স হলে আমাদের ডাক্তার দেখাতে হবে, একটা সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত ছিল না, তাই মানুষ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো, নিরামিষ খেত।

আজকেও অনেকে করে এটা, করে কি লাভ? ত্বকের উপরে ছোপ দাগ থেকে যায়, ওষুধ খেলে খুব তাড়াতাড়ি সেরে যায়, না তো সেই ভোগাবে। আবার প্রশ্ন করছি ঈশ্বর কোথায়? দিন রাত এক করে আমরা ওষুধ আবিষ্কার করেছি।

আজও কোনো জটিল অপারেশন হলে রোগীর বাড়ির লোক নামাজ পরে, প্রার্থনা করে, কিন্তু কাজ করছে ডাক্তারদের একটা দল, তারা কতটা কি পারছে তার উপরে জীবন নির্ভর করছে, অতএব সেই ডাক্তার রাই তখন ভগবান তুল্য।

বাংলাদেশে আজ একটা পোশাক নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়েছে, ছোট পোশাক পড়া অশালীন, পুরো চেহারা জুড়ে পোশাক পড়া শালীন। না বললেও আমরা জানি এটা একটা ধর্মীয় বেড়াজালের থেকে কোনো অংশে কম না, আসলে ধর্মের অজুহাতে মেয়েদের একটা খাঁচার মধ্যে রাখার চেষ্টা চলেছে, যেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ মানুষের নিজের মতো বেঁচে থাকার অধিকার কে মূল্য দেয় না, আমি তার পক্ষে কেন থাকবো?


যেই মন্দিরে বসে আমরা পুজো করছি, যেই মসজিদে বসে আমরা নামাজ পড়ছি, সেই মন্দির মসজিদ বানিয়েছে শ্রমিকরা, সেই বাড়ি বানানোর  পরিকল্পনা কেমন হবে, সেটা করেছে আর্কিটেক্ট-রা, ভগবানের উপাসনা করতে গিয়ে অসুস্থ হলে আপনাকে দেখবে ডাক্তাররা। অতএব চারদিকে স্বর্গের রূপে যা আছে সেটা বাড়ি হোক বা ডাক্তারখানা বা এম্বুলেন্স, সবটা করেছে মানুষের শ্রম আর উদ্ভাবনী শক্তি।

লিখতে লিখতে বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক ব্যক্তির কথা মনে পড়লো, কমরেড জসিমুদ্দিন।

সোজা ভাষায় কথা বলতেন উনি, ওনার অঙ্ক খুব সোজা ছিল, উনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন, সেটা হলেই সমাজের সকল মানুষ নারী-পুরুষ- তৃতীয় লিঙ্গ এর মানুষ সকলে নির্দ্ধিধায় শিল্পকলা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, উঁচু ইমারত গর্বে, তখন বুঝতে পারবে যা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি, সবই মানুষের শ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তির জন্যে।

করণীয় কি? হিন্দু মুসলিমের মধ্যে এত মিল এত বিভেদ? -মুজিব রহমান
Nov. 21, 2024 | মুক্তমনা | views:289 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এ অঞ্চলের মুসলিমদের সামান্যই বাইরে থেকে আসা। অধিকাংশই হিন্দু বা বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। আবার আর্যরাও বাহির থেকেই এসেছে৷ আর্যদের ধর্মীয় চেতনা স্থানীয় ধর্মের চেতনার সাথে মিলেই আজকের বৈদিক ধর্ম তৈরি হয়। আমাদের ইউনিয়নে দেবনাথ সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। দেশের সমস্ত নাথ ও দেবনাথরাই নাথ ধর্মের লোক ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মও আলাদা ধর্ম ছিল। শৈবরাও ছিলেন আলাদা ধর্মের। এক বৈষ্ণবদের মধ্যেও বহু মত-পথ রয়েছে। মুসলিম আগমনই হয়তো তাদের এক ধর্মে নিয়ে এসেছে। অথচ এখনো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের হিন্দুরা ভিন্ন-ভিন্ন দেবতার পূজা করে। বাংলার দুর্গা দেবীর অস্তিত্ব দক্ষিণ ভারতে নেই।  বাংলাভাষী অধিকাংশ মানুষই একইরকম দেখতে,  মূলত অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জিন রয়েছে। এজন্য তাদের শংকরজাতিও বলা হয়। আবার দুই ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে বেশ কিছু মিলও পাবেন৷ মুসলিমদের আদি পুরুষ আদম-হাওয়ার মতোই হিন্দুদের রয়েছে মনু-শতরূপা! সাধারণভাবে কে হিন্দু ও কে মুসলিম ধরার কোন পথ নেই। অথচ শুধুমাত্র ধর্মের কারণে তাদের মধ্যে বিরাজ করে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা।

আগের ধর্ম সংস্কার করেই নতুন নতুন ধর্ম এসেছে। ইহুদী-খৃস্টান-মুসলিম এর বিবর্তন আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। বৈষ্ণব ধর্ম থেকে শ্রীচৈতন্য হয়ে আজকের ইশকনের মধ্যেও একটি ধারাবাহিকতা হিসাব করতে পারি। অথবা সাংখ্য, শৈব, বৈষ্ণব ধর্ম থেকে আজকের হিন্দু ধর্ম নিয়েও পর্যবেক্ষণ করতে পারি। ধর্মগুলো শুধু স্রষ্টা বা দেবতার আরাধনাই নির্দেশ করে দেয়নি তারা একেকটা দর্শনও ঠিক করে দিয়েছে। যে দর্শন একসময় প্রাধান্য বিস্তার করতো তাদের অনুসন্ধিৎসার জবাব কিন্তু বিজ্ঞান খুঁজে নিয়েছে। বিজ্ঞানই সত্যের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। এতে দর্শনের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, উন্নত দেশে ধর্মের প্রভাবও কমেছে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার উন্নতি কমই হয়েছে। দারিদ্রতার মতো অন্ধতাও দূর হয়নি৷

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তানের দায়িত্ব নেন দুজন প্রগতিশীল ও ধর্মের প্রতি বিশ্বাসহীন মানুষ। জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসই ছিল না।

 তারা দুজনই ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তখন একটা ধারণা অনেকে করতেন যে আগামী ৫০ বছরে দক্ষিণ এশিয়াও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষে ভরে উঠবে। কিন্তু তা হয়নি। এখন দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই ধর্মান্ধতার অন্ধকার নেমে এসেছে। ১৯০৬ সালে বাংলা ভাগ হলে মুসলিমরা খুশি হয় এবং হিন্দুরা আন্দোলন করে ভারত ভাগের বিরুদ্ধে। এর একটি কারণ ছিল যে, পূর্ববঙ্গে অনেক হিন্দুর জমিদারি ছিল এবং তারা বাস করতো কলকাতায়। বাংলা ভাগ হলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পাবে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জমিদারি ছিল। যখন তাদের আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ রদ হল তখন হিন্দুরা ভিন্ন সংকট সামনে দেখতে পেল। ১৯৩১ সালের আদমশুমারী দেখেই অনেকে আৎকে উঠেন। তারা বিস্ময়করভাবে পরিসংখ্যান দেখেন যে, দুই বাংলায় মুসলিমের সংখ্যা হিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলও পান পরবর্তী নির্বাচনে। বাংলার পরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রীই হন মুসলিম- শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমউদ্দিন- যাদের নিয়ে ঢাকার দোয়েল চত্বরে তিন নেতার মাজার রয়েছে। কলকাতার হিন্দু বাবুরা বুঝে গেলেন- রাজনীতিতে যত বড় নেতাই তারা হন না কেন ভোটের দৌড়ে কখনোই তারা আর পেরে উঠবেন না। সিআর দাশের মতো মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যও কেউ নেই৷ ধর্মটাই সামনে চলে আসে, চলে আসে বিদ্বেষটাও যা নতুনও নয়। দেশভাগের পরে জমিদারি প্রথা বাতিল হয়। তাতেও হিন্দুদের প্রভাব আরেক ধাক্কায় কমে যায় কারণ অধিকাংশ জমিদারই ছিলেন হিন্দু। পূর্ব বঙ্গ থেকে হিন্দুরা চলে যেতে থাকে পশ্চিমবঙ্গে আর পশ্চিম বঙ্গ থেকে মুসলিমরা আসতে থাকে পূর্ব বঙ্গে। হিন্দুদের দেশান্তরের সংখ্যাটা অনেক বেশি। এতেও হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পূর্ববঙ্গে থাকা বহু সম্পদই তারা হয় নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে যায় নতুবা স্রেফ ফেলে রেখে যায়। পূর্ববঙ্গে হিন্দুর সংখ্যা অনেক কম থাকা সত্ত্বেও জমিদারি ও উচ্চ শিক্ষার কারণে তাদের হাতেই ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষমতা। বাংলাদেশে থেকে যায় সাধারণত দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা হিন্দুরা। আমাদের গ্রামেও একসময় ভট্টাচার্য, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, সেন ও রায় পরিবার ছিল। ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যানে আমার ভাগ্যকুল গ্রামে ৫১% হিন্দু ছিল। এখন সংখ্যায় কমে আসলেও হিন্দু ভোটার ৩৫-৪০% এর কমবেশি। এরমধ্যে একজনও ভট্টাচার্য, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, সেন ও রায় নাই। রয়েছেন কয়েক ঘর সাহা ও পোদ্দার আর অধিক সংখ্যক মাল ও রাজবংশী যারা জেলে সম্প্রদায়ের। দেশ ভাগের কারণে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা ক্ষমতায় যায়। সেখানে এখন ৯ কোটি মানুষের মধ্যে আড়াই কোটি মুসলিম। আবার বাংলাদেশে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দেড় কোটি হিন্দু (৮%)। দুই বাংলা মিলিয়ে দেখুন এখনো ২৫ কোটি বাঙ্গালির মধ্যে আট কোটি হিন্দু আর প্রায় তার দ্বিগুণের বেশি মুসলিম। হিন্দুদের ক্ষমতা হ্রাস ও মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য- এই পরিসংখ্যানই হয়তো দ্বন্দ্বের ও ঘৃণার প্রধান কারণ হয়ে উঠে। তবে মুসলিমদের মধ্যে থাকা প্রকট ধর্মান্ধতা, জিহাদী চেতনা ও সুশিক্ষা বিমুখতা পারস্পরিক ঘৃণাকে বাড়িয়ে দিয়েছে৷

ভারত ভাগের পরেও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিতরেও একটি প্রগতিশীল চেতনা জেগে উঠতে। বিশেষ করে বাম রাজনীতির প্রভাবে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তৈরি হচ্ছিল। সেখানে ধর্ম-অনুরাগহীন একটা শ্রেণিও ছিল যারা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতো। কমিউনিস্ট পার্টিতে যারা নেতৃত্বে ছিল তারা অধিকাংশই হিন্দু নেতা। তারা  বস্তুবাদের চর্চাই করতেন। সেখানে যারা মুসলিম ছিলেন তারাও বস্তুবাদী চেতনাধারী ছিলেন। ফলে হিন্দু মুসলিম নেতারা কাধে কাধ মিলিয়ে আনন্দের সাথেই রাজনীতি করতে পেরেছেন। হিন্দু-মুসলিম চেতনা তাদের স্পর্শ করতো না। কিন্তু বাম দলগুলোতে হঠাৎই একটি পরিবর্তন চলে আসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পরে।  বস্তুবাদের পরিবর্তে আসে ধর্ম-কর্ম সমাজতন্ত্রের কথা। মাওলানা ভাসানী আন্দোলনে নিয়ে আসে নামাজ ও মোনাজাত যা ইসলাম ধর্মীয় বিষয়। হিন্দুদের আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা সেই ধারাটাই এখনো দেখছি। মঞ্জুরুল আহসান খান মাজারপন্থী সুফিবাদী দর্শনের মানুষ যা বস্তুবাদ পরিপন্থী। তিনি আবার হজ্বব্রত পালন করে শরিয়তপন্থীও হয়ে গেলেন। এমনটা আরো অনেকের মধ্যেই দেখা গেল। ইনু-মেননও হজ্বব্রত পালন করে হাজিসাব হয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে প্রগতিশীল হিন্দুরাও ছাড়তে থাকেন বাম রাজনীতি এবং তারা আশ্রয় নেন মূলত আওয়ামী লীগের পতাকা তলে। প্রগতি চর্চার জায়গাগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। তৈরি হয় ধর্মীয় আবহ ও বিদ্বেষ। বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিল তারা ওখানে গিয়ে করতো সিপিএম। এতে সিপিএমের শক্তিও অনেক বেশি ছিল। মুসলিমরাও সিপিএম করতো। ফলে পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রগতিশীল সমাজ তৈরি হয়েছিল। হিন্দু মুসলিমরা একসাথেই ধর্মের প্রতি উদাসীন থেকেই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড করতেন। সেই জায়গাটাও হারিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গে বিস্ময়করভাবে সিপিএম ও সিপিআইর সমর্থকরা বিজেপিতে যোগ দিতে লাগল। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুরা প্রায় সকলেই বিজেপির সমর্থক বনে গেল। তারা হঠাৎ করেই কি প্রগতিশীল থেকে ধর্মান্ধ হয়ে উঠল! মুসলিমরাও যোগ দিল তৃণমূল কংগ্রেসে। কেন এমনটা হল? ভারত ও বাংলাদেশে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। পরস্পরের প্রতি বেড়েছে অবিশ্বাস ও ঘৃণা।

আমার মনে হয়েছে পারস্পরিক আস্থাহীনতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকেই এটা হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ আমার ভালভাবেই পড়া আছে। হিন্দু ধর্ম নিয়মিত পড়ে এমন একজনের কাছে জানতে চাইলাম- কোন ধর্মগ্রন্থে গরুকে দেবতা বলা হয়েছে? আমরা একমত হলাম যে, কোন ধর্মগ্রন্থেই এমনটা বলা নেই। তবে গরু দিয়ে হালচাষ করা হয় এবং গাভী দুধ দেয় তাই ভারতে যখন গরুর সংখ্যা কমে গেল তখনই গরু খাওয়ার বিরুদ্ধে রাজারা ব্রাহ্মণদের দিয়ে বিভিন্ন কথা বলা শুরু করাল। 

গরু দুধ দেয় ও হালচাষে কাজে লাগে বলেই তাকে মায়ের সাথে তুলনা করে বলা হয় গো-মাতা। আর তাতে গরু না খাওয়ার একটি ভাবাদর্শ তৈরি হল। মহাভারতে যজ্ঞে গোবৎস (বালক গরু) খাওয়ার কথা বলা আছে।

 যজ্ঞে হাজার হাজার গরু কাটা হতো বলেই গরুর সংকট তৈরি হতো। কিন্তু ভারত ভাগের সময়তো গরুর অমন সংকট ছিল না। তাহলে সেই গরু না খাওয়ার তীব্রতা কিভাবে বহাল থাকলো? এখানে কি মুসলিমদের কোরবানী ও গরু খাওয়ার বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে? মুসলিমরা ধর্মীয় উৎসবে গরু ব্যবহার করে ও খায় বলে হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে সেই প্রথা আরো জোরদার করেছে সম্ভবত(?)।

ইংরেজরা একটা চেষ্টা করেছিল ভারতীয় বৈদিক ধর্মে একেশ্বরবাদী চেতনা জাগ্রত করতে। তারা বুঝেছিল যদি এমনটা করা না যায় আর খৃস্টান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে এতো বৈপরত্য থাকে তাহলে সংঘাত আসবেই। ইংরেজরা ব্রাহ্ম ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। রাজা রামমোহন রায়, কেশব সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচেষ্টা চালান। ভারতে শংকরাচার্যও একেশ্বরবাদের একটি ধারণা দিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্ম ধনিক শ্রেণির মাঝে জনপ্রিয়তা পেলেও সাধারণ হিন্দুরা তা গ্রহণ করেনি প্রচণ্ড রাষ্ট্রীয় চাপ না থাকায়। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা সেটার দিকেই মনোযোগ দিয়েছে। ভারতে মুসলিম শাসনামলে ধর্মপ্রচারকগণ সুবিধা নিয়ে প্রচুর হিন্দু/বৌদ্ধকে মুসলিম বানিয়েছে। তবে রাষ্ট্র নিজে এজন্য কঠোর ছিল না। আবার তারা হিন্দু ধর্মকে একেশ্বরবাদী ধর্ম বানানোর দূরদর্শি চিন্তা করতেও পারেনি। এরমধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় নেতারা সুবিধা নেয়ার জন্য হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মীয় দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষটা চরমভাবে জাগিয়ে রেখেছে। পৃথিবীতে ধর্মগুলোকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একটা সেমিটিক একেশ্বরবাদী আরেকটি পৌত্তলিক প্যাগান। দুটি ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে মিল কমই। তারমধ্যে আবার বিভেদ বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা সবাই চালিয়েছে। বিপরীতে প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার মানুষ তৈরির চেষ্টা কোন সরকারই কোনকালে করেনি। ফলে বিভেদও দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এই আধুনিক ও সভ্য যুগে রাষ্ট্রের পক্ষে আর সম্ভব নয় মানুষের ধর্মবিশ্বাস বদলে দিয়ে আরেক ধর্মের দিকে ঠেলে নেয়া। তাহলে এই বিভেদ থেকে রক্ষার পথ কি? পথ একটাই আর তাহল বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠন করা। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছেই ধর্মটা পরিস্কার হয়ে উঠে। নেতাদের কারসাজি ও প্রতারণা টের পায়। ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের আহবান তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এজন্য রাষ্ট্র ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে বিরত থাকবে। ধর্ম হবে ব্যক্তিগত অনুশীলনের জায়গা। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যবই হবে বিজ্ঞাননির্ভর অর্থাৎ বিজ্ঞান সমর্থন করে না এমন কিছ পড়ানো যাবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে করতে হবে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে। তাহলেই ধর্মব্যবসায়ী ও নেতাদের এবিষয়ে আগ্রহ কমে আসবে। মানুষের মধ্যে ঘৃণাকে জাগিয়ে রাখতে তারা আর অর্থ ব্যয় করবে না। রাষ্ট্র এগিয়ে না আসলে অনেক সময় লেগে যাবে। আর এজন্য প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে প্রচুর কথা বলতে হবে এসব নিয়ে।

কর্পোরেট রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা -তন্ময়
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যে রাষ্ট্র কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং কর্পোরেট পুঁজিকে নিরাপত্তা প্রদান করে সেই রাষ্ট্রের অপর নাম কর্পোরেট রাষ্ট্র। ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি কর্পোরেট রাষ্ট্রেরই সমর্থক তা তাদের দেশ চালনার অর্থনৈতিক নীতির অভিমুখ দেখলেই বোঝা যায়। সরকারি ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত করার সাথে সাথে ঢালাও বেসরকারিকরণ সেই নীতিরই অংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় প্রাইভেট উদ্যোগের পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যেই প্রনয়ণ জাতীয় শিক্ষানীতির। 

জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের আগামী পরিকল্পনা হচ্ছে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় গুটিয়ে আনার জন্য ধীরে ধীরে সরকারি বিদ্যালয় থেকে হাত তুলে নেওয়া।

গত ১৬ ই এপ্রিল আসামের মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে ফাঁস করেছিলেন এই সত্যটা। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে আগামী এক দশক পর আর সরকারি বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ ফেলো কড়ি, মাখো তেল। টাকা দাও, পন্য (শিক্ষা) নাও। যাদের যথেষ্ট পয়সা নেই তাদের শিক্ষার অধিকারও নেই।

“ইউনাইটেড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন” বিভাগ থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সারা দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মোট ৫১০০০ সরকারি বিদ্যালয়(৪.৭৮ শতাংশ)। ওই বছরে বেসরকারি বিদ্যালয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১১৭৩৯ টি।

মৌলিক অধিকার “শিক্ষা” আজ বাজারের পণ্য। 

টাইমস অফ ইন্ডিয়া, রাইজিং কাশ্মীর, হিন্দুস্থান টাইমস, কাউন্টার ভিউ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী উত্তরাখণ্ডে মোট ১৫০০ কাশ্মীরে ১২০০ গুজরাটে ৫০০ ওড়িশায় ১২০০ হরিয়ানায় ২৫০০ ত্রিপুরায় ৯০০ উত্তরপ্রদেশে ২৬০৭৪ মধ্যপ্রদেশে ২২৯০৪ টি বিদ্যালয় একত্রীকরণ এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও কয়েক হাজার বিদ্যালয়। এর মধ্যে ওড়িশায় আরও ১৪০০০টি এবং মধ্যপ্রদেশে আরও১০০০টি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলিকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের একত্রীকরনের মাধ্যমে স্কুলের সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। একই সঙ্গে খবরে প্রকাশ স্কুল একত্রীকরণ ও বন্ধ করে দেওয়ার পর অবশিষ্ট স্কুলের অর্ধেক পরিচালিত হবে "Mission School of Excellence" নামে একটি প্রকল্পের অধীনে। 'বিশ্ব ব্যাঙ্ক' এবং 'এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের' যৌথ নিবেশের মাধ্যমে চলবে এই প্রকল্প।

এর থেকেই স্পষ্ট হয়, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে হাত তুলে নিচ্ছে সরকার। উৎসাহ পাচ্ছে বেসরকারী সংস্থাগুলো। 

২০২১ এর ৭ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া উন্নত করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরকারী স্কুলগুলোকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পিপিপি মডেল অনুসরণ করার কথা বলেন।

ব্যাতিক্রম হতে পারল না কেরালার বামপন্থী সরকার। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের খসড়া পরিকল্পনা পেশ করেন পার্টির রাজ্য সম্মেলনে। এই বিষয়ে একটি প্রশ্নের জবাবে পার্টির রাজ্য সম্পাদক বালাকৃষ্ণান জানান সিপিএম বেসরকারিকরণের বিরোধী নয়, যদি সেটা সরকারি নিয়ন্ত্রণে হয়। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, গেরুয়া সব রঙ আজ একাকার কর্পোরেটের নির্দেশিত পথে পা মেলাতে।

শিক্ষার চৌকাঠে পা আটকে শুধু অগণিত নিম্নবিত্ত মানুষদের।

অলৌকিক বলে কিছু হয় না -অশোক সরকার
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:978 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা সময় যুক্তিবাদী মানুষরা যীশুখ্রীষ্টের জীবন ও জীবনী সম্বলিত ধর্ম কাহিনীর উচ্চতর সমালোচনা শুরু ক'রেন। ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত বাইবেলের ঈশ্বরকে অস্বীকার ক'রে ঈশ্বরতত্ত্বকে একটি যুক্তিবাদী দর্শনের সমস্যা রূপে চিহ্নিত করেন। যীশুর সব মিরাকেল বা অলৌকিক কার্যকলাপ তিনি যুক্তি বিরুদ্ধ বলে উড়িয়ে দেন।

 তিনি বলেন: “ঈশ্বরকে বাইবেলের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র যুক্তিপূর্ণ দার্শনিক মনের মধ্যেই তাকে সন্ধান করতে হবে। এইভাবে মানুষ যখন মননের মাধ্যমে ঈশ্বর সম্বন্ধে সত্য উপলব্ধি করতে পারবে, তখন তারা বাইবেলকে বর্জন করবে।”

ডাচ দার্শনিক স্পিনোজা বলেন: “বাইবেলের সঙ্গে যুক্তি ও দর্শনের কোন মিল নেই, তারা দুটি আলাদা জগতের বিষয়। তাছাড়া বাইবেল, কে বা কারা লিখেছিলেন, কবে লিখেছিল, কেন লিখেছিল? কে বা কারা সবগুলো কাহিনী একসঙ্গে সংকলিত করেছিল, ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে তিনি বিশ্বাসী দের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেন। প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্পিনোজা বলেন যে, সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিই ঈশ্বর। জীবজগৎ সহ  মহাবিশ্বের সর্বত্র শুধু প্রকৃতি নামক একটি বস্তু বিভিন্ন  রূপে বর্তমান, এবং এই প্রকৃতিই ঈশ্বর।” (এখানে একটা কথা বলে রাখি, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একমাত্র স্পিনোজার দর্শনকেই বিশ্বাস করতেন। স্পিনোজা কে নিয়ে আমার একটা লেখা আছে। আবার করার ইচ্ছা রইল।) আর এইসব বক্তব্যের জন্য একবার ১৬৫৬ সালে এবং আরেকবার তার মৃত্যুর পরে ১৬৭৮ সালে তাকে ইহুদি ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়।

 

সপ্তদশ শতাব্দীতে আর যাদের রচনা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বাইবেলে বিশ্বাসের উপর আঘাত হেনেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন টমাস হবস, জন লক এবং জন মিল্টন।

 ১৮ শতকে ইউরোপে বিশেষকরে ফ্রান্সে, যে জ্ঞানবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, দিদেরো, হেলভেশিয়াস, ভলতেয়ার প্রমূখ সেই আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতারা বাইবেল তথা খ্রিস্ট ধর্মকে যুক্তি এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সাহায্যে নস্যাৎ করবার চেষ্টা করেন। তাছাড়া ইংল্যান্ডের ডেভিড হিউম তাঁর যুক্তিবাদ ও প্রয়োগবাদের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় খ্রিস্টধর্মের ভিত নাড়িয়ে দেন।  জার্মানিতে ইমানুয়েল কান্ট তাঁর Critigue of pure reason গ্রন্থে দেখান যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ নেই।

 এইসব যুক্তিবাদী প্রবাহের ফলে উনিশ শতকে যীশুর জীবন কাহিনীকে “নিউ টেস্টামেন্ট” এ আগের বর্ণিত সমস্ত অলৌকিকতা থেকে মুক্ত করে, একজন আদর্শ লৌকিক মানুষের জীবন হিসাবে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে।

 পলাশ (Paulus) ১৮২৮ সালে একটি যিশুচরিত রচনা করেন। যাতে তিনি যীশুর অলৌকিক জন্ম, জীবনের সমস্ত অলৌকিক কার্যকলাপ এবং পুনরুজ্জীবিত হয়ে কবর থেকে উঠে আসার কাহিনী কে অসত্য এবং অবিশ্বাস্য বলে ঘোষণা করেন। 

আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ রেনান বা রঁন্যার তাঁর life of Jesus বইতে, তিনি একইভাবে সমস্ত অলৌকিকতা বর্জন করে, জিশুকে একজন সাধারন কিন্তু আদর্শ মানুষ হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন।

এভাবেই খ্রিস্টধর্ম তাদের অলৌকিকতা বর্জিত ধর্মকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মে এটা মনে হয় কোনদিন সম্ভব নয়।

কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে এক বিরাট অলৌকিকতার মাধ্যমে যা কোনদিন সম্ভব নয়। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীরা তা অন্ধের মত বিশ্বাস করে। অবশ্য বিশ্বাস না করে কোনো উপায়ও নেই। অলৌকিকতায় অবিশ্বাস করলে, কৃষ্ণকে নিয়ে লেখা সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী গুলি যে কল্পকাহিনী তা প্রমাণ হয়ে যায়।

ধর্মীয় মৌলবাদ আসলে কতটা ধর্মীয়? -শ্রীকুমার মন্ডল‌
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:284 | likes:2 | share: 2 | comments:0

না মানে আমরা যদি ইতিহাস দেখি তাহলে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী যেই সময় বেড়ে উঠছে ঠিক তার কাছাকাছি প্রায় একই সময়ে হিন্দু মৌলবাদ বা হিন্দুত্ববাদ বড় হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে। খ্রিস্টান মৌলবাদ আবার সেদিকে আমেরিকায় তৈরি হয়ে গেছে আগেই। আর ধর্ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু মৌলবাদের কনসেপ্টগুলো একই, “আমাদের ধর্ম বিপদে পড়েছে আর তাই আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের ধর্ম রক্ষা করতে হবে।” তাহলে কি ধর্মীয় মৌলবাদ কি সত্যি ধর্মীয় না কি মৌলবাদের পেছনে অন্য কোনো মৌলিক কারন আছে যা সমস্ত ধর্মকে ব্যবহার করে মৌলবাদের মাধ্যমে নিজের কার্য সিদ্ধি করছে?

মৌলবাদ সাধারণত ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ বা religious revivalism এর কারনে ঘটে থাকে, যেটা বিজ্ঞান বিরুদ্ধ। অর্থাৎ যখন সমাজ থেকে প্রিডোমিনেন্ট ধর্মীয় প্রভাব ও বিশ্বাস ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করে হয় আধুনিকতা বা নতুন ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণে বা অন্য কোনো কারণে, তখন 


ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মীয় ঠিকাদার, ধর্ম রাজারা আবার সেই পুরোনো ধর্মকে ফিরিয়ে আনতে সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে আশা প্রগতিশীলতার পথে বাধা দিতে চায়।


 ভারতীয় সংস্কৃতির ঠিকাদার, আমেরিকান সংস্কৃতির ঠিকাদার, আরব সংস্কৃতির ঠিকাদার টাইপের যেকোনো সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলরাই আসল মৌলবাদী। অর্থাৎ কেউ যদি বলে যে এটা আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি, তাই আমাদের পালন করে চলা উচিত, তাহলে চোখ বন্ধ করে বুঝে নিতে হবে সে মৌলবাদী। তাহলে ধর্মীয় মৌলবাদ এখন জাতীয়তাবাদী মৌলবাদের রূপ নিয়েছে। আমরা আবার দেখলাম যে মৌলবাদ আলাদা ধর্মের মধ্যেও হয়, আবার এমনকি জাতীয়তাবাদী মৌলবাদও হয়। এখন সমধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করার বহু প্রচেষ্টা হয়েছে, যেখানে মেজরিটি ধর্ম বিশ্বাসীরা মাইনরিটি ধর্মীয় বিশ্বাসীদের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মতো অত্যাচার করে তাই জাতীয়তাবাদী মৌলবাদ পুরোটাই ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে জড়িত যদি না সেই জাতি বা রাষ্ট্র পুরোপুরি স্যাকুলার রাষ্ট্র হয়। এই যেমন ভারতীয় সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি ছাড়া আসলে কিছু না। যদিও ভারতে মুসলিমের সংখ্যা কম নয়, তবুও মুসলিম দের সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলেনা। মুসলিম দের সংস্কৃতি কে আরবীয় সংস্কৃতি বলে, তা সে হোক না ভারতীয় মুসলিম। ঠিক একই ভাবে আমেরিকায় চলে খ্রিশ্চিয়ান মেজরিটি সংস্কৃতি। 

অর্থাৎ পরিষ্কার ভাষায় মেজরিটি যার ক্ষমতা তার, সংস্কৃতি তার, মৌলবাদও তার। তাহলে মৌলবাদ কি ধর্মের ওপর নির্ভর করছে না কি ক্ষমতার ওপর?


তাহলে আমরা আমেরিকায় যেখানে মৌলবাদের জন্ম তার ইতিহাসটা একবার যদি দেখি তাহলে আমরা দেখবো ঊনবিংশ শতকে যখন বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আমেরিকা যাচ্ছে, তখন সেখানকার কনজারভেটিভ খ্রিশ্চিয়ান ইউরোপিয়ান আমেরিকানরা (যারা নিজেরাই অবৈধ বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী) দেখলো যে বিভিন্ন কালচারের মিশ্রনের ফলে খ্রিস্টান মেজরিটি কালচার বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে তারা খ্রিস্টান ধর্মের 5টি অবশ্য করণীয় ডক্ট্রাইন (Doctrine) ওপর একটি লেখা প্রকাশিত করে, যার নাম দেয় "fundamentals"। আর এইখান থেকেই জন্ম হয় fundamentalism বা মৌলবাদের। 

এই ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম যে খ্রিস্টান চার্চ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্যই এত কলাকুশলী করেছিল। যদিও তাদের ফুটসোলজাররা মনে করতো যে তারা এইসব পসলন করে আর জোর করে অন্যদের পালন করিয়ে নিজেদের ধর্ম রক্ষা করছে। কিন্তু আসলে তারা কনজারভেটিভদের ক্ষমতা আর পজিশানকে রক্ষা করছে। যদিও এর বিনিময়ে ফুট সোলজাররা কিছুই পায়না, দিনের শেষে রক্ত ঝরিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। কিন্তু তবুও ওরা নিজেদের শোষকদের হয়েই কাজ করে। তাহলে মৌলবাদ যতটা না ধর্মীয় তার থেকে অনেক বেশি সমাজের প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ দের ক্ষমতা ও নিজেদের আগের অবস্থানে টিকে রাখার প্রতিক্রিয়াশীল দ্বন্দ্ব। অবশ্য সমাজে ধর্ম আর ধর্মান্ধতা না থাকলে এই প্রতিক্রিয়াশীল বাধা সৃষ্টি করা সহজ হতো না। ফুট সোলজার জোগাড় করা মুশকিল হতো, অর্থাৎ ধর্ম  মৌলবাদের জন্য সবথেকে বড় সহায়ক হলেও মৌলবাদের কারন নয়, মৌলবাদের কারন হলো ক্ষমতায় টিকে থাকার স্ট্রাটেজিক যুদ্ধ। হিন্দু মৌলবাদ ও একই কারণে উঠে এসেছিল আমেরিকার পরে পরেই। যখন ভারতীয়রা (বিশেষ করে so called লোয়ার কাস্ট হিন্দুরা) হিন্দু ধর্মীয় গোঁড়া আর বার্নবাদী সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি চরম নারকীয় ভয়াবহতা থেকে রাম মোহন, বিদ্যাসাগরেরা যখন মানুষকে নবজাগরণের দিকে মুখ ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে ঠিক সেই সময়ে 




বিবেকানন্দ/সভারকর দের মতো কনজারভেটিভ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় বাবারা হিন্দু মৌলবাদের মাটি তৈরি করতে শুরু করে, যেগুলোকে আজ আমরা RSS, হিন্দু মহাসভা, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দুপরিষদ ইত্যাদি রূপে দেখতে পাই।

 হ্যাঁ এদের গোড়া পত্তন করেছে বিবেকানন্দ, সভারকররা। কিন্তু এরা একা একা কিছু করেনি। এরা করেছে আমেরিকার শিকাগোর আয়োজন করা ধর্মীয় সভায় নিজেদের মার্কেটিং এর মাধ্যমে, হ্যাঁ সেই থেকে শুরু। কি অদ্ভুত সমাপতন, এদিকে আমেরিকা নিজেদের খ্রিশ্চিয়ান মৌলবাদ গড়ে নিয়েছে, সেদিকে ব্রিটিশ কলোনি ভারতে খ্রিশ্চিয়ান দের প্রাদুর্ভাব কম দেখে হিন্দু ধর্মকেই ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী কান্ডকারখানা চালানোর জন্য। এদিকে সভারকর আবার এডলফ হিটলারের ফ্যানবয় ছিল। ন্যাৎসিজম এর ভারতীয় সংস্করণ হিন্দুত্ববাদ এর স্রষ্টা ছিল স্বয়ং সভারকর, যা ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি চালাতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এবং ইংরেজ দের উত্তর সুরি কংগ্রেস আর BJP আজপর্যন্ত তাই করে যাচ্ছে।  আবার 1400 বছর আগে ইসলামের জন্ম হলেও মুসলিম জঙ্গী গোষ্ঠী গুলোর আবির্ভাবও আমরা  দেখেছি এই ঊনবিংশ শতকে কোল্ড ওয়ারের সময়ে। যখন ওই মুসলিম কান্ট্রি গুলো আমেরিকা আর USSR এর ওয়ার বেস হয়ে উঠেছিল, হ্যাঁ এখানেও আমেরিকা। তাহলে আমরা দেখলাম মৌলবাদ আসলে যতটা না ধর্মীয়, তার থেকে অনেক বেশি সমাজের স্বাভাবিক প্রগতিশীলতাকে বাধা দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য একটা প্রতিক্রিয়াশীল অপচেষ্টা। এখন এই অপচেষ্টার নাম হলো ফ্যাসিবাদ, কারন ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় কনজারভেটিভ ক্যাপিট্যালিস্ট সাম্রাজ্যবাদীরা। আর পুঁজিবাদ নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে যা যা করে, তাকে বলে ফ্যাসিবাদ।

এবার দেখবো এই মৌলবাদ কখন জঙ্গিবাদ বা টেরোরিজম হয় আর কখন হয়না। হ্যাঁ মৌলবাদ আর টেরোরিজম এর মধ্যে পার্থক্য আছে। মৌলবাদীরা যতক্ষন ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার হয়ে লড়বে ততদিন তাকে জঙ্গি বা টেরোরিস্ট বলা হয় না (সাবঅল্টারন ভাবে যাকে বলে দেশদ্রোহী)। কিন্তু পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদের তৈরি সেই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরাই যদি কোনো ভাবে তাদের সৃষ্টিকর্তার (ক্ষমতার) বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়, তখন তাকে জঙ্গী বা টেরোরিস্ট বা দেশদ্রোহী বলা যাবে। আরেক ভাবে বললে এটাও বলা যেতে পারে যে সংখ্যা গুরুর মৌলবাদ হলো ভালো মৌলবাদ কিন্তু সংখ্যা লঘুর মৌলবাদ হলো জঙ্গীবাদ/টেররিজম/দেশদ্রোহীতা। আরেক ভাবে বললে এ ও বলাযায় যে ফ্যাসিবাদি মৌল বাদীরা ভালো মৌলবাদী কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিরোধী মৌলবাদীরা জঙ্গী/টেরোরিস্ট/দেশদ্রোহী।

এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো, জয় শ্রী রাম বলে খুন করলে তাকে জঙ্গি বলা হবে না কিন্তু আল্লাহু আকবর বলে খুন করলেই তাকে বলা হবে জঙ্গি। কারন জয় শ্রীরাম বলে খুন করা হলো এই দেশে সংখ্যাগুরু মৌলবাদ, এবং এই দেশের পুঁজিবাদী ফ্যাসিস্ট দের স্লোগান ও হলো জয় শ্রীরাম। কিন্তু আল্লা হু আকবরের ক্ষেত্রে তা নয়, সেটা কোনো না কোনোভাবে জেনে হোক বা তাদেরই অজান্তে সংখ্যা গরিষ্ঠ ও ফ্যাসিবাদের সরাসরি পক্ষে নয়। যদিও পরোক্ষ ভাবে ফ্যাসিবাদ এদের ও ব্যবহার করে। এদের কাগুজে বাঘ বানিয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ মৌলবাদী রিএক্সনিস্ট দের ভয় দেখিয়ে ভেড়ার পাল কে নিজের খোঁয়াড়ে ঢোকানোর জন্য। 


ঠিক একই ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ যখন সংখ্যা লঘুদের খুন করে মাটিতে পুঁতে তার ওপর ফুলকফি চাষ করে সেটাকে জঙ্গিবাদ বা টেররিজম বলে না।

 কিন্তু এই কাজ যখন সংখ্যা লঘু বা ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বিরোধীরা (পরোক্ষ ভাবে যদিও ক্ষমতারই লাভ হয়) করে তখন সেটা জঙ্গিবাদ হয়ে যায়। ঠিক একই ভাবে ডাব খাওয়ার নাম করে সংখ্যা গরিষ্ঠ ক্ষমতার দালালরা যখন ঘরে ঘরে অস্ত্র জমানোর আহ্বান দেয় তখন সেটা আর জঙ্গীবাদ থাকে না। কিন্তু সংখ্যালঘুরা করলেই সেটা হয়ে যায় জঙ্গীবাদ। এর আরো ভালো উদাহরণ হলো তালিবান, আলকায়েদা নামক জঙ্গী গোষ্ঠী গুলো যতদিন আমেরিকা ও পুঁজিবাদের হয়ে লড়েছিল তখন এরা জঙ্গী গোষ্ঠী নামে পরিচিত হয়নি। যেই এরা আমেরিকার বিরুদ্ধে গেল, তবে থেকেই এরা জঙ্গী নামে খ্যাত হলো। আর খ্রিস্টান মৌলবাদীরা কোনোদিন ক্ষমতার বিরুদ্ধে যায়নি, বরং এরা সবসময় ক্ষমতার পক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাই খ্রিস্টান মৌলবাদীরা আজও ‘জঙ্গী’ উপাধি পায়নি। 

আমি জঙ্গীবাদ কে জাস্টিফাই করছি না। বরং আমি বলতে চাইছি যে জঙ্গীর জন্ম একসময় সাম্রাজ্যবাদী ক্যাপিট্যালিস্ট ফ্যাসিস্টদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল, কিন্তু আজ ওরা কোনো ভাবে নিজেদের অজান্তেই প্রত্যক্ষ বিরোধী হয়ে উঠেছে, যদিও পরোক্ষ ভাবে ওরা ওই ফ্যাসিবাদের আগুনেই তেল দিয়ে চলেছে। আমি শুধু বলছি যে মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের জন্ম দেয় ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। অবশ্য ধর্ম এর জন্য খুব ভালো মিডিয়াম। ধর্ম না থাকলে ফ্যাসিস্ট দের কাছে এই ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ব্যবহার করা সহজ হতোনা। কিন্তু মৌলবাদের বড় কারন ধর্ম নয়, এর বড় কারণ হল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ বা আরেক ভাষায় কনজারভেটিভ ক্ষমতাশালীরা।

আমাদের ন্যায়পালিকা: তিস্তা থেকে বিলকিস -জাহিদ রুদ্র
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:2568 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা রাষ্ট্ৰের জাতীয় দিবস তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর এর মধ্যে যদি স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষ উদযাপন হয় তো এর মাহাত্ম্য কতটুকু হতে পারে বোঝতেও পারছেন। এরমানে দেশ কতটা এগোচ্ছে এর একটা প্রমাণ আমরা ওয়াকিবহাল। নিৰ্দিষ্ট শ্ৰেণীর কয়েকজন কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয়া কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ভারতীয় আইনে এই ধরনের ব্যবস্থা আছে। গৃহ বিভাগ সচিব, আইন বিভাগের সচিব এবং কারাগার বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিদ্বয়ের প্ৰস্তুত করা তালিকা মন্ত্রীসভাতে অনুমোদিত হওয়ার পর রাজ্যপালের কাছে প্রেরণ করা হয়। সেই তালিকাতে রাজ্যপাল সন্মতি জানালে তবেই তালিকাভুক্ত সকল কারাবন্দী মুক্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। এই তালিকাতে ভয়ংকর অপরাধীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না এবং নির্বাচিত সকল কারাবন্দীদের সেলে থাকা সময়ের আচার-আচরণ (বিশেষভাবে বিগত তিন বছরের) সন্তোষজনক হতে হব। উল্লেখিত সময়ে অসদাচরণের জন্য তাদেরকে আলাদা কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে এমন নয়।


এইবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহ বিভাগ এমনি এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজ্য সরকারের কাছে আবশ্যকীয় নির্দেশিকা প্রেরণ করে। বন্দীমুক্তির এই ব্যবস্থা চলতি বছরের ১৫ আগষ্ট, আগামী বছরের ২৬ জানুয়ারি এবং ১৫ আগস্টের ভিতরে কাৰ্যকরি করতে হবে বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, গৃহ বিভাগের নির্দেশাবলীতে মুক্তির জন্য নির্বাচিত কারাবন্দীদের মধ্যে হত্যাকারী এবং ধর্ষণকারী থাকতে পারবে না বলেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।


কিন্তু এই নিৰ্দেশাবলীর অহেতুক সুবিধা নিয়ে গুজরাট সরকার প্রথম খেউয়ে যে ১১জন লোককে মুক্তি করে দেয়, সমগ্র দেশবাসীর চোখ কপালে তুলতে তারা সফল হয়। পিএম মোদী স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে আহ্বান জানানোর কিছু সময়ের পরই এই গুরুতর কয়েকটি অপরাধীদের মুক্তি করে দেয়া হয়। তার থেকেও বিস্ময়কর এবং উদ্বেগজনক কথাটা হ'ল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মকর্তারা তাদেরকে কারাগারের সম্মুখে মিষ্টিমুখ করিয়ে দেয়, তিলক লাগানো হয়, পা স্পর্শ করে সম্মান জানানো হয়। কথাটা বিস্ময়কর এবং উদ্বেগজনক বলে একারণেই বলছি যে


সেই সকল কারাবন্দীরা কোনো রাজনৈতিক বন্দী ছিল না, দেশ তথা জনতার হিতে সংগ্রাম করে দণ্ডিত করা হয় নি। তারা ছিলেন হত্যাকারী এবং ধৰ্ষণকারী


 অথচ গৃহ বিভাগের নির্দেশাবলীতে উল্লেখ আছে, হত্যাকারী এবং ধর্ষণকারীকে মুক্তির তালিকায় সন্নিবিষ্ট করতে দেয়া হবে না। ২০০২ সনের গুজরাটের সাম্প্রদায়িক সংঘৰ্ষে সেই ১১জন বেকসুর খালাসীরা বিলকিস বানো নামের ইসলাম ধর্মীয় পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা এক মহিলাকে দলবদ্ধভাবে ধৰ্ষণ করেছিল। কেবল বিলকিস কে ধৰ্ষণ করাতে এরা থেমে থাকেনি, তার চোখের সম্মুখেই তার তিন বছরের কন্যা সন্তান সালেহা কে হত্যা করার পরও পরিবারের আরও সাতজন লোকের হত্যা করা হয়েছিল। এরা যে কতটা ভয়ংকর অপরাধী, তা বলে জানানোর আবশ্যকতা নাই। 

যাইহোক, কেন্দ্ৰের গৃহবিভাগ সমগ্র দেশের জন্য জারি করা নীতি গুজরাট সরকার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পদদলিত করে উক্ত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের সসম্মানে মুক্ত আকাশের নিচে বাহির করে আনার সাহস করলো কিভাবে? উল্লেখ্য যে এই ১১জন কারাবন্দীর মধ্যে একজন বন্দী, যে ইতিমধ্যে ১৫ বছর কারাবাসের সাজা কাটাচ্ছিল, তা লাগব করার উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে আবেদন দাখিল করেছিল। সেই আবেদনের ভিত্তিতে ন্যায়ালয় গুজরাট সরকারকে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির বিষয়টি বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সেই নির্দেশের উপর আমল করে গুজরাটের বিজেপি সরকার বাকী ১০জন লোককে মুক্তি দিয়ে দেয়।

ইতিহাসের পাতায় গুজরাট সরকারের এহেন কার্য নিশ্চয় কোনো সোনালী অক্ষরে লিখা থাকবে না বরং স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব বৰ্ষে এই ঘটনা কলংকিত করে রাখবে। কলংকিত করে রাখবে, কারন রাজ্য সরকারের এই কু-কার্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ সমর্থন আছে বিজ্ঞ মহলে চর্চিত। সমর্থন আছে এজন্যই কেন্দ্রের জারি করা নীতি উলংঘন করে রাজ্য সরকার যে কার্য সংঘটিত করেছে, কেন্দ্রীয় সরকার তার বিরুদ্ধে একটা কিছু লিখিত বা অন্তত একটা কথাও আজ পর্যন্ত বলে নাই দেশবাসীর প্রতি সম্বোধন করে। দেশের অগণিত মানুষ গুজরাট সরকারের এইকাজের প্ৰতিবাদে সবর হয়ে উঠেছে দেখেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও নির্বিকার হয়ে আছেন৷ উনাদের মৌনতা এই কথার স্পষ্ট আভাস দেয় যে বিলকিস বানো তথা তার পরিবারের মধ্যে আসতে পারে সম্ভাব্য দুশ্চিন্তা এবং বিপদ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একদমই উদ্বিগ্ন নয়, বরং আম আদমি পার্টির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে৷ একজন সোসিয়াল এক্টিভিস্ট বলেন 'সম্ভবত গোধরা বিধায়ক সি কে রাহুলের .. they are Brahmins. Anyway, the sanskar of Brahmins is very good." এই মন্তব্য আপ্তবাক্য রূপে মোদী-শাহ অন্তস্থল থেকে বিশ্বাস করেন। উল্লেখযোগ্য যে, সাজা লাগব করা পর্যালোচনা সমিতিতে রাহুল জি'র ছাড়াও আরও একজন মহিলা বিধায়িকা সুমন চৌহান ও ছিলেন !'

সম্প্রতিকালে ভারতের ন্যায়ব্যবস্থা নিয়ে যে সকল অবাঞ্ছিত প্ৰশ্নের অবতরণ হয়েছে, বিলকিস বানোর ঘটনাই সব 'দুধ কা দুধ, পানি কা পানি' হয়ে গেছে। এর আগে তিস্তা সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারকে নিয়ে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে দেয়া রায়ের বিষয়ে বিভিন্ন লোক ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তুলেছেন। অবশ্য দুই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ন্যায় ব্যবস্থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের ন্যায়লয়ের উপর আমার আস্থা আছে এবং তা রাখতে হবে। যদিও কয়েকটি রায় ন্যায়ালয়ের মর্যাদা অবনমিত করেছে বলে অনেক লোকের মন্তব্য। এমনকি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রাক্তন বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠ আধিকারিকের কাছ থেকেও মন্তব্য শোনা যায়। তিস্তা সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারের বিষয়টি আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববরণ্য কিছু ভালো মানুষ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে অনুরোধ জানিয়ে এইবলে আবেদন দাখিল করেছে যে স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগ নিয়ে ন্যায়ালয়ে সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারের কেইস দুটো তাৎক্ষণিকভাবে রফা-দফা করতে হবে। এই আবেদনে সকল স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন—— ব্ৰিটিশ সাংসদ এবং রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ভিখু পারেথ, ভাষাতত্ত্ববিদ তথা স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি, ভারতীয় মূলত আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অর্জুন আপ্পাডুরাই, মার্কিন রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ওয়েণ্ডি ব্রাউন, ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃত পণ্ডিত শেল্ডন পল ক., অর্থনীতিবিদ রবাৰ্ট পলিন, দার্শনিক কেওল বরেন, চাৰ্লস টেইলব, মার্কা নুসবাউম, আকিল বিলগ্রামী আরও অন্যান্য। এর দ্বারা দুটো কথা স্পষ্ট হয়। এক, এতো দিন ধরে আমাদের সরকারের — “ভারতের ন্যায়পালিকা স্বতস্ফূর্ত'— কথাগুলোর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। দুই, ন্যায়পালিকাকে প্রহসনমূলক করার ক্ষেত্ৰে বিজেপি সরকারের ভূমিকা সুস্পষ্ট।জরুরীকালীন অবস্থায় ইন্দিনা গান্ধী ন্যায়পালিকাকে নিজ স্বাৰ্থে ব্যবহার করেন নি, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ন্যায়পালিকার গতি-বিধি জরুরী কালীন অবস্থা কে তুচ্ছ করে তোলেছে।

এখনও আমাদের দেশে জরুরিকালীন অবস্থা জারি করা হয়নি। যদিও এর আবশ্যকতাও নেই৷ কারণ ফ্যাসিবাদ ঘোষণার মাধ্যমে ইহা আসে না, এটা আসে হস্তক্ষেপে একজনে দুজনের ভাগ আত্মসাৎ করার জন্য। ইতিমধ্যে আমার ঘটি, লোটা, বাটি আমার বহু বস্তু নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি অন্ন যোজনা, অরুণোদয়, সোনা রূপার মোহে বন্দী, আজমল মুখ্যমন্ত্ৰী হওয়ার আতংকে আক্রান্ত। একটা সময়ে আনোয়ারা তাইমুরও মুখ্যমন্ত্ৰী হয়েছিলেন। আমরা এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছি যে পরনের কাপড়টা যেদিন হারাবো, সেইদিন আর রাজার বিরুদ্ধে বাহিরে এসে প্রতিবাদ করতে পারবো না। ইতিমধ্যে আমরা 'বইলিং ফ্রগ সিমড্রমে' আক্রান্ত হয়েছি।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধর্ম কী? -পার্থ প্রতিম পাল
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্ম একটি মানবীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এটি মানুষের কিছু জীবন জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যা সে অন্য কোন স্থান থেকে পায়নি বা পাবার চেষ্টা করেনি। এই জগৎ অতিপ্রাকৃতের জগতের উপর নির্ভরশীল না হলেও, মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা ও কাজ প্রতিক্ষেত্রে না হলেও অনেকক্ষেত্রেই অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস, বস্তু বা চিন্তার উপর নির্ভরশীল। 

অতিপ্রাকৃতের এই প্রভাব আদিম বা বর্তমানকালের মানুষের জীবনযাত্রায় এমনিভাবে জড়িয়ে আছে যে কোথায় এর শুরু, কোথায় শেষ, কোথায় তা প্রকৃতিকে অতিক্রম করে অতিপ্রাকৃতে পৌঁছে গেছে তা নির্ধারণ করা কঠিন।


 এটি মানুষের সমাজজীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে সমাজকে ছেড়ে ধর্ম ও ধর্মকে ছেড়ে সমাজকে অনুধাবন করা যায় না। ধর্মের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেক গভীর। সমাজবিজ্ঞান তাই ধর্ম কী, ধর্মের উদ্ভব কিভাবে হয়েছে, ধর্মের ফাংশন কী, বর্তমান সমাজে ধর্মের ভূমিকা কী, মানব জীবনে এর ভূমিকা কী এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে। তবে সেইসব প্রশ্নে যাবার আগে সমাজবিজ্ঞানের চোখে ধর্ম কী, ধর্মের দিকগুলো কী, ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো কী তা জানা দরকার।

মূল তালিকা—ধর্মের সংজ্ঞাধর্মের ৭টি ডাইমেনশন বা দিকধর্মগুলোর মধ্যকার সাধারণ বৈশিষ্ট্যতথ্যসূত্র

ধর্মের সংজ্ঞা—

শব্দের ব্যুৎপত্তি – ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ religion, যা ল্যাতিন থেকে এসেছে, যা ব্যক্তিজীবনের তথা জাতীয় জীবনের সমার্থ সংগতি আনে তাই ধর্ম। ধৃ ধাতুর সাথে মন প্রত্যয় যোগে সংস্কৃতিতে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। আদিম সমাজের নিয়ান্ডার্থাল মানুষ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত সর্বত্র একটি অন্যতম মৌল সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্ম তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। ধর্ম একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, কোন ধর্ম একেশ্বরবাদী, কোনটা বহুঈশ্বরবাদী, আবার কোনটায় ঈশ্বর অনুপস্থিত, কোনটা আত্মায় বিশ্বাসী। তাই ধর্মের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর বলেন, ধর্ম হল অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস। ইয়ঙ্গার (Yinger) বলেন, ধর্ম হল আবেগ, বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার ও অভ্যাসের এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একদল লোক মানব জীবনের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। ফ্রেজার তার The Golden Bough গ্রন্থে বলেন, ক্ষমতা বা শক্তির আকাঙ্ক্ষা, মানুষের চেয়ে মহৎ যা মানুষের জীবনকে প্রকৃতির অভিশাপ থেকে রক্ষা করে তাই ধর্ম। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম তার The Elementary form of Social Life গ্রন্থে বলেন, ধর্ম হচ্ছে পবিত্র জিনিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত আচার-ব্যবহার ও বিশ্বাসের একটি সমন্বিত পদ্ধতি। নৃবিজ্ঞানী লৌঈ (Lowie) তার Primitive Religion গ্রন্থে ধর্মকে অসাধারণ ভীতিপ্রদ সত্তার প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন। তিনি তার সংজ্ঞায় অতিপ্রাকৃতের সাথে মানব মনের বিশেষ প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন। এম রেভাইলের মতে, ধর্ম হচ্ছে রহস্যাবৃত মনের সাথে মানব মনের সম্পর্ক সৃষ্টির ভাবানুভূতিগত বন্ধনের নির্ধারণী।

বিশ্ব ও ব্যক্তির উপর উক্ত শক্তির প্রভাবকে ব্যক্তি স্বীকার করে নেয় ও সে মহাত্মার সাথে নিজের সম্পর্কের কথা ভেবে ব্যক্তিমন পুলকিত হয়। কার্ল মার্ক্স বলেন, ধর্ম জনগণকে তন্দ্রাবিষ্ট করে রাখে। মানে এখানে ধর্ম মানুষেরই সৃষ্টি, কিন্তু আসলে এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি যা ব্যবহৃত হয় মানুষকে মোহগ্রস্ত ও নিয়ন্ত্রণের জন্য। সমাজবিজ্ঞানী গেলেস (Gelles) তার An Introduction to Sociology গ্রন্থে বলেন, ধর্ম হল এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস ও চর্চা যা জীবনের নির্দিষ্ট অর্থের সাথে সম্পর্কিত। ধর্ম ঐশ্বরিক, অতিপ্রাকৃত ও অর্থপূর্ণ নীতিমালার উপর ভিত্তি করে সামাজিক আচরণের জন্য একটি নকশা তৈরি করে। মানুষ কেন ধর্ম বিশ্বাস করে তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক আছে। নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্লাউ ম্যালিনস্কির মতে, ধর্ম হল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও যোগ্যতার মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণের প্রক্রিয়া। জগতের ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মত মানুষের ক্ষমতা সীমিত। অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে, অদৃশ্য একধরণের শক্তি মানুষ, মাটি, বায়ু, জল সবকিছুকে ধ্বংস করছে।

মানুষের তৈরি ও আবিষ্কৃত কোন প্রযুক্তি আবহাওয়া, জলবায়ু, ভূমিকম্প নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, অকালমৃত্যু থামাতে পারছে না। ধর্ম মূলত এসব জীবন-অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির সাথে মানুষকে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ তৈরি করতে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যু দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স (১৯৫২) এর মতে, ধর্ম হল সামাজিক প্রত্যাশাসমূহের সাথে অভিজ্ঞতার শূন্যস্থান পূরণের একটি প্রক্রিয়া। প্রতিটি সমাজে কম বেশি দেখা যায়, সামাজিক প্রত্যাশাগুলো প্রায় সময়ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, দুঃখ ও বঞ্চনা অযাচিতভাবে প্রসারিত হচ্ছে, মাঝেমাঝে নীতি বহির্ভূত কাজ বা নৈতিক মূল্যবোধ লঙ্ঘনকারী গোষ্ঠী বা প্রক্রিয়া পুরস্কৃত হয় ও অসাধারণ অর্জনগুলো ব্যক্তিগত প্রবঞ্চনা বা হার ও পরাজয়ের কারণে অবসান হয়। ধর্ম এসব দুঃখকষ্ট ও অনৈতিক কাজগুলোকে ঐশ্বরিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিকল্পনা বা অংশ হিসেবে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা প্রদান করে। নৃবিজ্ঞানী ক্লিফর্ড গিরটজ এর মতে (১৯৬৫), মানুষ যখন তার বিশ্লেষণমূলক ও নৈতিক দূরদৃষ্টি দ্বারা কোন ঘটনাকে বা ঘটনাসমূহকে বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়না, তখন সে সীমাবদ্ধতা ও টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টির উপর নির্ভর করে তা হল ধর্ম। তিনি বলেন, মানুষকে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে হবে যে, বিশ্ব একটি যৌক্তিক কাঠামো বা প্রক্রিয়া। এখানে প্রতিটি ঘটনার পিছনে এক বা একাধিক কারণ আছে। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, ধর্ম ‘অর্থের সমস্যাসমূহ’ নিয়ে কাজ করে ও এক্ষেত্রে একটি প্রেষণাদায়ী হিসেবে কাজ করে। ধর্মাচরণের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শনের বিষয়ে জানতে হলে আমাদেরকে ৫০০০ বছর পেছনে যেতে হবে। ইউরোপ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়া, নেদারল্যান্ডস এর মানুষেরা কোন মৃতদেহ কবরস্থ করলে সাথে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে দিত। তারা বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পর আরেকটি জগৎ আছে যেখানে এগুলোর দরকার পড়বে। ঐতিহাসিক রেকর্ড ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, বিশ্বের প্রতিটি গোষ্ঠী, ব্যক্তি, মানুষের বিভিন্ন ধর্ম আছে। আর এই ধর্ম বিশ্বাস ও চর্চা একে অন্য থেকে স্বতন্ত্র ও আলাদা।

কোন ধর্ম বিশ্বাস পূর্বপুরুষকেন্দ্রিক, কোনটি আবার অতিপ্রাকৃত শক্তি, কোনটি দেব-দেবী ও অসংখ্য দেবতাকে ও কোনটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছন্দময়তাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। এভাবে ধর্মবিশ্বাস স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়।

ধর্মের ৭টি ডাইমেনশন বা দিক—

স্কটিশ লেখক ও সেক্যুলার রিলিজিয়াস স্টাডিজের অগ্রদূত নিনিয়ান স্মার্ট ধর্মের ৭টি দিক বা ডাইমেনশনের কথা উল্লেখ করেন, যা প্রত্যেকটি ধর্মের মধ্যেই দেখা যায় –

১। Practical and ritual dimension: 

ধর্মের মধ্যে আরাধনা, প্রার্থন্যা এসব রিচুয়াল ডাইমেনশন বা আচারগত দিক আছে। ধর্ম থাকলে ধর্মীয় আচার থাকবে, কারও বা কোনকিছুর উদ্দেশ্যে প্রার্থনার ব্যাপারও থাকবে।

২। Experiential and emotional dimension: 

এইসব আচার ও প্রার্থনার পেছনে থাকে মানসিক চাঞ্চল্য উদ্রেককারী উপাদান, যা হল ধর্মের এক্সপেইয়েনশিয়াল ও ইমোশনাল ডাইমেনশন, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক বা আবেগগত দিক। ধর্ম মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও আবেগের সাথে সম্পর্কিত হয়। মানুষ ধর্মীয় বিষয়গুলোকে যেমন ঈশ্বরকে অনুভব করার জন্য তার ভেতরের অভিজ্ঞতা ও আবেগকে ব্যবহার করে।

৩। Narrative and mythic dimension: 

ধর্মের একটি ন্যারেটিভ বা মিথিক ডাইমেনশন আছে, মানে একটি আখ্যানগত বা পৌরাণিক দিক আছে। যেমন ইহুদিধর্মে নোয়াহ এর বন্যার কাহিনী, খ্রিস্টধর্মের ইডেনের কাহিনী ইত্যাদি। ধর্ম বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে যার জন্য এইসব আখ্যান বা পুরাণের আবির্ভাব হয়। আবার অনেক পূর্বে তৈরি হওয়া কোন কাহিনী, ঘটনা কালক্রমে বিভিন্ন ধর্ম নিজেদের মধ্যে এডপ্ট করে নেয় ও তা নিজের কাজে লাগায়। ধর্মগুলোর অনেক আচারেই এইসব আখ্যানের প্রতিফলন দেখা যায়।

৪। Doctrinal and philosophical dimension: 

ধর্মে একটি ডক্ট্রিনাল এন্ড ফিলোসফিকাল ডাইমেনশন অর্থাৎ তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দিক আছে। ধর্মগুলোকে জগতের পরমসত্তা কী, ঈশ্বরের স্বরূপ কী, আত্মা কী, চেতনা কী, মানুষের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ কী – এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়, আর তা খুঁজতে গিয়ে এগুলোকে ধর্মদর্শন তৈরি করতে হয়, অথবা ইতিমধ্যে কারও দর্শনচিন্তাকে এডপ্ট করে নিতে হয়।

৫। Ethical and legal dimension:

ধর্মগুলো মানব নৈতিকতার ধারক ও বাহক হতে চায়। এটি মানুষের নৈতিক ও আইনি ধারণায় এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে মানুষ মনে করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণীই হল নৈতিক, আর যা যা এই প্রতিষ্ঠানের বাইরে যায় তাই অনৈতিক। ধর্ম তার নিজের মত করে মানুষের মধ্যে বিশেষ মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে চায়। আইন ও নৈতিকতার সাহায্যে এটি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে সম্পর্কিত করে কোন কাজকে জাস্টিফাইড বা আনজাস্টিফাইড বলে দাবি করে। এগুল হল ধর্মের নৈতিক ও আইনি দিক।

৬। Social and institutional dimension: 

ধর্ম সমাজেরই একটি অংশ, মানুষও সমাজের অংশ যাকে ধর্ম প্রভাব ফেলতে চায়। ছোট থেকে বড় হতে মানুষের যে সামাজিকীকরণ বা সোশ্যালাইজেশনের প্রয়োজন হয় সেখানে ধর্মের ভূমিকা থাকে। মানুষের যে সামাজিক চাহিদাগুলো আছে সেগুলো ধর্ম পুরণ করে থাকে। চার্চ, মসজিদ, মন্দিরের মত স্থানে সোশ্যাল গ্যাদারিং এর ব্যবস্থা করে এটি মানুষের সামাজিকতার চাহিদা মেটায়, কোন সামাজিক সংকটের কালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে তাদের স্ট্রেস কমাতে ও কোন দিক নির্দেশনা দিতে, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মগুলো মানুষের বিনোদনের চাহিদাও পুরণ করে। এছাড়া ধর্ম মানুষকে একরকম সেন্স অফ আইডেন্টিটি দান করে।

এই বিশেষ আইডেন্টিটির জন্য মানুষ নিজের মানুষ পরিচয়ের আগে নিজেকে একজন হিন্দু, একজন মুসলিম, একজন খ্রিস্টান হিসেবে চেনে। ধর্ম এই আইডেন্টিটি দানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় আইডেন্টিটির সাথে মিলে যায় এমন মানুষকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়, তাদেরকে আপন ভাবতে শেখায়, আর যাদের ধর্মীয় আইডেন্টিটি তার আইডেন্টিটির সাথে ম্যাচ করে না তাদেরকে পর ভাবতে শেখায়। এগুলো ধর্মের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক।

৭। Material dimension: 

ধর্মের মেটারিয়াল বা বস্তুগত দিকও আছে। ধর্মগুলো কোন নির্দিষ্ট বিল্ডিংকে পবিত্র বিল্ডিং বা দালান বানিয়ে রাখে, যেমন মন্দির-মসজিদ। এটি কোন শিল্পকে পবিত্র শিল্প বানিয়ে রাখে, কোন কোন চিহ্নকে বানিয়ে রাখে পবিত্র চিহ্ন, কোন কোন গ্রন্থকে বানিয়ে রাখে পবিত্র গ্রন্থ। এইসব বিষয়ে ধর্ম পবিত্রতা আরোপ করে অন্যান্য বিষয়ের সাথে, জনসাধারণের সাধারণ বিষয়গুলোর সাথে বিচ্ছিন্ন করে রাখে যা সেই পবিত্রতার উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনেরই শর্ত হিসেবে কাজ করে। আর এইসব পবিত্র বস্তুগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ব্যক্তিত্বের সাথেও জুড়ে যায় পবিত্রতা, তাদের বাণীও হয়ে ওঠে পবিত্র। এগুলো হচ্ছে ধর্মের বস্তুগত দিক বা মেটারিয়াল ডাইমেনশন।

ধর্মগুলোর মধ্যকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য—

নিয়েলস নিয়েলসেন তার রিলিজিয়ন্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে ধর্মগুলোর মধ্যকার ১৩টি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন- 

১। অধিকাংশ ধর্ম অতিপ্রকৃতিকে (spirits, gods, God) বিশ্বাসএর অন্তুর্ভূক্ত করে বা কিছু বাস্তবতার আড়ালের কোন শক্তিকে বিশ্বাস করে যা মানব জ্ঞানের ও অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে, কিন্তু মানুষ এগুলোর সাথে একরকম সম্পর্ক অনুভব করে।

ক) হিন্দুরা ৩৩ কোটি দেবদেবীতে বিশ্বাস করে, কিন্তু আবার তারা পরম ব্রহ্ম নামে এক চূড়ান্ত সত্তা বা আল্টিমেট রিয়ালিটিতেও বিশ্বাস করে।

খ) খ্রিস্টানরা একেশ্বরে বিশ্বাস করলেও ত্রিত্ব বা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করে, আবার মুসলিমরা একেশ্বরবাদী হলেও তাদের মধ্যে ত্রিত্বে বিশ্বাস নেই, কারণ তারা একে বহুঈশ্বরবাদের ঝুঁকিসম্পন্ন বলে ভেবে থাকে।

২। ধর্ম সময়, স্থান, বস্তু ও মানুষের প্রেক্ষিতে পার্থিব বা সাধারণ বস্তু ও পবিত্র বস্তুর মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি

ক) মুসলিমদের কাছে মক্কার গুরুত্ব আর মিলওয়াইকী (আমেরিকার একটি শহর যা বিয়ার ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিখ্যাত) শহরের গুরুত্ব এক নয়।

খ) খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে ক্রিসমাস আর ইস্টার অন্যান্য দিনের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

৩। ধর্মের জন্য অনুমোদিত আচারিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হয়, যা ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশ্বাসের সাথে পালন করে।

ক) এই আচার মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও জীবনচক্রের সাথে জড়িত, যা সব ধর্মেই দেখা যায়।

খ) অধিকাংশ ধর্ম পবিত্র কিছু কাহিনী বা ঘটনাকে তুলে ধরে বাৎসরিকভাবে উৎসবের সাথে সেগুলো পালন করে।

৪। ধর্ম সাধারণভাবে একটি নৈতিক বিধিবিধান বা নৈতিক নীতিমালা প্রদান করে যা ব্যক্তি বা সমাজ বাধ্যবাধকতার সাথে মেনে চলে।

ক) বাইবেলের ক্ষেত্রে টেন কমান্ডমেন্টস, ইসলামের ক্ষেত্রে শরিয়ত আইন এর উদাহরণ।

খ) বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধের পথ অনুসরণ করে।

৫। ধর্মীয় জীবন একটি সাধারণ আবেগগত ও অন্তর্জ্ঞানলব্ধ আনবিক অনুভূতি প্রদান করে।

ক) এই অনুভূতির মধ্যে আছে আশ্চর্যবোধের অনুভূতি, রহস্যময়তার অনুভূতি, আনন্দের অনুভূতি, অপরাধবোধের অনুভূতি, সম্প্রদায়গত বন্ধনের অনুভূতি।

খ) ধর্মীয় প্রার্থনাগুলোতে প্রায়ই অনুসারীদেরকে অপরাধবোধের জন্য ও ক্ষমা ভিক্ষা করতে বলা হয়, একই সাথে আনন্দ ভোগ করতে ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করতেও বলা হয়।

৬। ধর্ম মানুষের সাথে ঐশ্বরিকতার যোগাযোগকে উৎসাহিত করে, আর এই যোগাযোগের জন্য অনুসারীকে পথপ্রদর্শন করে।

ক) ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে একক ও সমন্বিত প্রার্থনা লক্ষ্য করা যায়।

খ) হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে এই ঐশ্বরিকতা প্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন রকমের ধ্যানের উপায় বলা হয়েছে।

৭। পবিত্র কাহিনীর মাধ্যমে ধর্মগুলো একরকম সঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের চেষ্টা করে।

ক) বিভিন্ন রকম ক্রিয়েশন মিথ বা সৃষ্টিপূরাণ তৈরি করে বিশ্বজগৎ কিভাবে তৈরি হল, মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীদের উদ্ভব কিভাবে হল এগুলোর ‘যৌক্তিক’ উত্তর দেবার চেষ্টা করা হয়।

খ) অনুসারীদেরকে ধর্মীয় নেতাদের জীবনী পড়ানো বা শেখানো হয়, আর তার মাধ্যমে তাদেরকে ‘সঠিক’, ‘কল্যানকর’ ও ‘পরিপূর্ণ’ জীবনযাপনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়।

৮। ধর্ম এর অনুসারীদের জীবনকে অরগানাইজ বা সংগঠিত করে বা করতে চায়, যার মাধ্যমে মানুষের উপর আরোপ করে পোশাক পরার বিধিবিধান, খাদ্যাভাসের বিধিবিধান, পেশাবিষয়ক বিধিবিধান, ও সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার বিধিবিধান।

ক) একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে গেরুয়া রঙ এর পোশাক পরতে হয়, মাথা নেড়া বা মস্তকমুণ্ডন করতে হয়।

খ) মুসলিম নারীদের উপর হিজাব পরা বা পর্দা অনুসরণ করার বিধান আছে।

৯। ধর্মের প্রয়োজন হয় সামাজিক সংগঠনের ও প্রাতিষ্ঠানিক আকারগুলোর যার সাহায্যে এটি প্রার্থনার জন্য, ক্ষমতার জন্য, জনসাধারণের মধ্যে ধর্মশিক্ষা প্রদানের জন্য, ধর্মীয় আচারগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে।

ক) প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের পোপ নেই, সুন্নি মুসলিমদের নেই আয়াতুল্লাহ খোমেনির মত সুপ্রিম রিলিজিয়াস লিডার (যা শিয়াদের আছে)।

খ) কিন্তু সব সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় কার্যক্রম আছে, ও আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।

১০। জীবনে উত্থানপতন থাকলেও ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে একরকম অন্তঃস্থ শান্তি (Inner peace), সামঞ্জস্যতা বা সমন্বয়ের (Harmony) প্রতিশ্রুতি দেয়।

ক) বস্তুগত অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে অবস্থিত এমন কোন অর্থ খুঁজে পেয়ে অনেক সময় বিশ্বাসীরা তাদের জীবনের বিভিন্ন রোগ, শোক, অবিচার প্রভৃতি বাধাকে জয় করে।

খ) যেসব ধর্ম অনেক বছর ধরে শত শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে আছে সেগুলো তার অনুসারীদেরকে আশা ও জীবনের বিশেষ রকমের অর্থ প্রদান করে।

১১। কষ্টভোগ (suffering) ও দয়া (compassion) বেশিরভাগ ধর্মের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

১২। ধর্ম নতুন যুগের বা পরকালের মাধ্যমে ভবিষ্যতের একটি আশা প্রদান করে।

ক) বেশিরভাগ ধর্ম মানুষকে আশা দেয় যে ভবিষ্যতে কোন ঐশ্বরিক ব্যক্তি আসতে চলেছেন যিনি মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটিয়ে একটি শান্তির নতুন যুগে নিয়ে যাবে – যেমন ইহুদি ধর্মে মেসিহা, যিশুর দ্বিতীয়বার ফিরে আসা, বিষ্ণুর অবতার কল্কির আগমন, বুদ্ধের শেষ প্রকাশ ইত্যাদি।

খ) অনুসারীদেরকে স্বর্গ বা নতুন পৃথিবী, বা শারীরিক অস্তিত্বের ঊর্ধ্বর কোন অবস্থা যেমন মোক্ষ লাভের মধ্য দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের আশা প্রদান করা হয়।

১৩। ধর্মগুলোকে ধর্মের মধ্যে নতুন নতুন সদস্যের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ও বিশ্বাসীদের মধ্যে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে এর প্রসারকে নিশ্চিত করতে হয়।

ক) বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম হল বিশ্বের মূল তিন মিশনারি ধর্ম যেগুলো অন্য ধর্মের লোকেদেরকে তাদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করে।

খ) বেশিরভাগ ধর্ম তাদের অনুসারীদের মধ্যে সন্তান উৎপাদনকে উৎসাহিত করে যা সেই ধর্মের নতুন সদস্যদের আগমনের প্রাথমিক উৎস্য। 

JWST, ধর্ম ও আমার ঈশ্বর -সময়
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

 “Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.” - Karl Heinrich Marx

 সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস চোখ দিয়ে মানুষ মহাবিশ্বের প্রাচীনতম ছবি দেখতে সক্ষম হয়েছে। হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরি এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি গত 25 ডিসেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিলো। সৃষ্টির জন্মলগ্নে ব্রম্ভান্ডের গতি-প্রকৃতি এবং তার অভ্যন্তরীন গ্যালাক্সি সমূহকে বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যেই এই প্রজেক্টটি গ্রহণ করা হয়েছিলো। অবশেষে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে JWST প্রায় 1300 কোটি বছর আগের মহাবিশ্বের রূপকে আমাদের সামনে প্রকাশিত করেছে! 

 সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে প্রায় 8 মিনিট 20 সেকেন্ড সময় লাগে। মানে এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা যেই সূর্যকে দেখি সেটি 8 মিনিট 20 সেকেন্ড আগের সূর্য। একই রকম, নক্ষত্রপুঞ্জগুলি থেকে অবলোহিত তরঙ্গ প্রায় 1300 কোটি বছর ধরে পথ ভ্রমন করে JWST তে ধরা পড়েছে এবং এভাবেই চিত্রগুলি আমাদের সামনে ফুঁটে উঠেছে।

 ছবিতে আমরা অজস্র উজ্জ্বল ছায়াপথ, নক্ষত্রপুঞ্জকে দেখতে পারছি। কোনো শিল্পীর প্যালেটের মত শত বর্ণে রঞ্জিত। ক্যালাইডোস্কোপের রঙিন ফর্ম গুলির মতো প্রতিটি ছায়াপথে লুকিয়ে আছে চেতনাতীত রহস্য, কল্পনার মেঘকেও ছাড়িয়ে যাওয়া রূপকথার জেটপ্লেন কিংবা, শুধুমাত্রই মহাজাগতিক ধূলিকণা আর কিছু গ্যাসের মিশ্রণ।

 কিন্তু, এখানে ঈশ্বর কোথায়? কোথায়-ই বা স্বর্গ-দোজখের ঠিকানা? ওমনি ঠিক কেউ রে রে করে তেড়ে আসবে এই বলে যে মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষের মাঝেই ঈশ্বর। খুবই সত্যি কথা। কিন্তু, তাহলে সেই ঈশ্বরের ই আবাসস্থল নিয়ে এই এতো মারামারি-কাঁটাকাটি কেন? এই সব নীতিকথা ঈশ্বপের গল্পের শেষ লাইনেই আবদ্ধ, বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষ এ সবের ধার ধরেনা। পাহাড় প্রমান ডিগ্রি ধারী তথাকথিত শিক্ষিত বিজ্ঞানের অধ্যাপক যখন দশ আঙুলে দশটি রত্ন পরিধান করে কোনো এক পেটমোটা ধর্মগুরুর পায়ে মাথা নোয়ায়, এর থেকে ঘৃণ্য কাজ আর কিছু হতে পারেনা।

 কেউ যদি ব্যক্তিগত ভাবে কোনো কাল্পনিক সত্ত্বার প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাহলে আমার কিংবা সমাজের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সে তো পাশের বাড়ির পাঁচ বছরের প্যাঙলাও তো স্পাইডারম্যান কে তার আইডল মনে মরে, ও বিপদে পড়লে নাকি 'স্পাইডি' এসে তাকে উদ্ধার করবে।

কিন্তু, সমস্যাটা তখন হয়, যখন এই ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস দাসসুলভ দূর্বলতায় পরিণত হয়। ব্যাপারটা বোঝার জন্য টাইম মেশিনের পিঠে চেপে, সমাজ গঠনের আদি পর্বে চলে যেতে হয়। সেই আদিম যুগে মানুষ বুঝতে পেরেছিলো যে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বসবাস করলে হিংস্র পশু কিংবা কোনো দূর্যোগ থেকে নিরাপদে থাকা যায়। কর্মক্ষম নারী-পুরুষেরা খাদ্য সংগ্ৰহ করে আনতো এবং পরে তা সকলের মধ্যে বন্টন করা হতো। খাদ্য সংগ্রহে যার ভূমিকা বেশি থাকতো, স্বাভাবিক ভাবেই খাবারে তার অগ্রাধিকার থাকতো। কিন্তু, বাদ বাকি সবাই ও ন্যায্য পরিমানে খাবার পেতো। এই ভাবে আদিম সমাজের সূত্রপাত ঘটে।

লিঙ্গ বৈষম্যহীন সেই সমাজে, যে যেই কাজে দক্ষ ছিলো, সে সেই কাজই করতো। শ্রেণীহীন, বর্নহীন সেই সমাজে সবার সমান অধিকার ছিলো। ক্রমে, এই সকল সমাজে ক্ষমতার জোরে কিছু ব্যক্তিবর্গ নিজ প্রভাব বিস্তার করে। কিছু মানুষকে অনুগত সৈন্যে পরিণত করে তারা নিজেদের একাধিপত্য গঠন করে। 


খাদ্য ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই শাসকেরা সাধারণ মানুষের সাথে এক অলিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করে। রুশো একে "Social Contract" বলে অভিহিত করেছেন।

এর পরিবর্তে সাধারণ মানুষ শাসক কে কর দিয়ে সাহায্য করে এবং তাকে সিংহাসনে উপবিষ্ট হতে সাহায্য করে। এই ভাবেই এক রাষ্ট্র জন্ম নেয়।

 বলে রাখা ভালো, এর অনেক আগেই মানুষ বহু প্রাকৃতিক ঘটনাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে না পেরে দৈব বলে মনে করে, ভয়-ভক্তির বশে পূজা-প্রার্থনায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু, শাসক ও কিছু স্বার্থান্বেষী জনগোষ্ঠী (পুরোহিত ও মহাজন)  এই ঈশ্বরে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে শোষণের কাজ চালাতে শুরু করে। প্রথমে তারা দৈববানীর নামে রাষ্ট্রের শীর্ষে উপবিষ্ট হয়, এরপর তাদের অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য 'ঈশ্বর'-এর, যথেচ্ছ ব্যবহার করা শুরু করে। খেটে খাওয়া মানুষ গুলোকে প্রথমে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তারপর এই বলে স্বান্তনা দেয় যে এই পৃথিবী তো মায়া, তোমাদের দুরাবস্থার জন্য পূর্ব জন্মের কর্মফলই দায়ী। তাই, এই জন্ম ঈশ্বরের নাম জপ করে আর ধর্মগুরুর পদলেহন করে নির্বাহ করো, মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে অপ্সরা-হুরেরা সুরা-কুসুমদাম দিয়ে তোমায় বরণ করে নেবে। আর, প্রতিবাদ করলেই নরকের আগুনে জ্বলে-পুড়ে শেষ।

 ধর্ম আর কিছুই নয়, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমজীবী, সাধারণ মানুষকে শোষণ করার এক যন্ত্র মাত্র। ঘোড়ার চোখের ঠুলির মতো ভাবতে পারেন, আসল সমস্যা থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে ফোকাস করতে সাহায্য করবে। তাই তো দেশের অর্থনীতি ডুবিয়মান, তা যাক না ডুবে, আসল সমস্যা হলো – “মন্দির/মসজিদ ওয়াহি বানায়েঙ্গে …..”। 

এতো গেলো ধর্ম নিয়ে অনেক কথা। এবার একটু কলমের খোঁচা দেওয়া যাক। আস্তিক-নাস্তিক শব্দ দ্বয় মূলত '√অস্' ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যার অর্থ - থাকা। কোনো শক্তি বা বস্তুর অস্তিত্বের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাসকেই অস্তিক্যবাদ বলা হয়। নাস্তিক শব্দটি সম্পূর্ণ এর বিপরীত অর্থ ধারণ করে। আমি কোনো দৈব কিংবা অতি-প্রাকৃতিক সত্ত্বায় বিশ্বাস রাখিনা, যে কিনা আমার ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে অথবা যার পায়ে মাথা নোয়ালে, আমার জীবন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো বদলে যাবে।

  আমি এমন কোনো পাড়ার মোরাল জেঠিমা টাইপের ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা যে কিনা বলে দেবে যে এটা করা সঠিক, আর এটা করা বেঠিক। আর এই স্যাডিস্টিক ঈশ্বরের কথা না শুনলে, সে আবার নরকের আগুনের পোঁড়াবার ভয় দেখায়।

এবার, আপনি বলতে পারেন যে সমাজে নৈতিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনেই ঈশ্বর নামক মোরাল ফিগার কে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেম ও এই কথায় বলেছেন। কিন্তু, এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার যে নৈতিকতা বিষয়টা অত্যন্ত আপেক্ষিক। একটা সমাজের কাছে কোনো কিছু নৈতিক মনে হলেও, অন্য সমাজের কাছে তা অনৈতিক মনে হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ - হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষদের মধ্যে গো-মাংস ভক্ষণ অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ(কেন তা আমি জানিনা)। আবার, ইসলাম ধর্ম মেনে চলা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার গরু খাওয়ার চল আছে। এই একটি বিষয় নৈতিক না অনৈতিক তা নিয়ে দুই ধর্মালম্বী সমাজের মধ্যে সংঘর্ষ বর্তমান। এথিকসের সংজ্ঞায় একে কালচারাল রিলেটিভিসিম বলে। অর্থাৎ, বিভিন্ন সমাজের মধ্যে নৈতিকতা-অনৈতিকতার ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। তাই, আবার ব্যক্তি বিশেষের মধ্যেও নৈতিকতার ধারণার বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। এথিকাল এবসোলিউটিসম-এর ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বত্র কিছু নৈতিকতার স্থির ধারণা বর্তমান। যেমন- ব্যক্তি, সমাজ কিংবা ধর্ম নির্বিশেষে হত্যা একটি গর্হিত অপরাধ। সব ধর্ম এই বিষয়ে এক মত পোষণ করে যে মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটলে, সে হত্যার মতন এমন ঘৃণ্য কর্মে লিপ্ত হতে পারে। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন তো ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীরা যখন ব্রিটিশদের গাড়িতে বোমা মেরেছে কিংবা সাদা চামড়ার শোষকদের নির্বিচারে গুলি করেছে, সেটাও কিন্তু হত্যাই। তখন দেশ কে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে মুক্ত করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে যাওয়ার কারণে, নর হত্যা কে আমাদের অনৈতিক বলে মনে হচ্ছেনা। এর থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ব্যক্তি কিংবা পরিস্থিতি বিশেষে নৈতিকতার ধারণার পরিবর্তন ঘটে। তাই, মেঘের ওপর থেকে কোনো ব্যক্তির এথিকসের ছড়ি ঘুরিয়ে জ্যাঠামো কে আমি সম্পুর্ন রূপে অবজ্ঞা করি।

 আমার ঈশ্বর জাত-বর্ন-লিঙ্গ-পদবী মানে না। আমার ঈশ্বর বড়লোকের ম্যানসনে কিংবা মধ্যবিত্তের শো-কেসে থমকে নেই। নাম না জানা প্রান্তিক কোনো গ্রাম যেখানে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছতে পারেনি, সেখানেও আমার ঈশ্বর বিরাজমান। মেঘাচ্ছন্ন বিকেল, এক কাপ চা আর রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা ফিফথ্ সিম্পফনিতে আমার ঈশ্বর বেঁচে থাকে, ভ্যান গগের রঙে সে প্রতি মুহূর্তে প্রাণ ফিরে পায়। আবার, এলিমেন্টরি পার্টিকেলের স্ট্যান্ডার্ড মডেলই আমার ঈশ্বর, বোসন আর ফার্মিয়ন কণা দিয়ে সে তৈরি হয়েছে। মেহনতি মানুষের হাতুড়িতে, প্রতিবাদী মানুষের কন্ঠস্বরে আমার ঈশ্বর স্থান পেয়েছে।

আমার ঈশ্বর প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রতিবাদ করতে শেখায়। ব্রুনোকে যেদিন ধর্মের পিশাচেরা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, সেদিন আমি আমার ঈশ্বরকে পুড়তে দেখেছিলাম, চে র গুলি বিদ্ধ ছিন্ন-ভিন্ন নিথর দেহে আমি আমার ঈশ্বরের মৃত্যু দেখেছিলাম। কিন্তু, আমার ঈশ্বর রক্তবীজ। একটা প্রতিবাদী স্ফুলিঙ্গ থেকে সে নব রূপে উজ্জীবিত হয়। আমার ঈশ্বর ধর্মের মাকড়সার জালে আটকে থাকতে শেখায় না, সে চিন্তার মুক্ত আকাশে যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার করতে শেখায়। আমার ঈশ্বর শ্রেণীহীন, রাষ্ট্রহীন, ধর্মহীন সমাজের প্রতীক। 

আমি আস্তিক, আমি আমার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। আমার ঈশ্বর, আমার চেতনা।

মনের ফাঁদে -রাজর্ষি রীত
Nov. 21, 2024 | মনস্তত্ত্ব | views:873 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(মনস্তাত্বিক ভ্রম সম্পর্কে একটি ছোটো প্রবন্ধ)

আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে সেই তথ্যগুলিকে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি ঘটনাটি কী, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, আবার এক তথ্য থেকে অন্য তথ্যে উপনীত হই। এই বিশ্লেষণ এর কাজটিকেই বলা হয় যুক্তি বা লজিক। 

আবার এই মস্তিষ্কই কখনো কখনো তথ্যপ্রমাণের ভুল উপস্থাপনা করে, যার ফলে সঠিক বা বাস্তব তথ্য আমাদের সামনে বর্তমান থাকলেও আমরা অন্যকিছু বুঝি বা অন্যকিছু অনুভব করি বা অন্যকিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হই। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই বিভ্রান্তিগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, বিভ্রান্তিগুলিকে চিনতে শেখা এবং এড়িয়ে চলার যতটা সম্ভব চেষ্টা করা জরুরি।  

বিভ্রান্তিগুলি বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন আমাদের স্মৃতি, শিক্ষা, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা ইত্যাদিও প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, যুক্তির উপরে। আবার জন্মগতভাবে আমরা (যেকোনো মানব মস্তিষ্ক) কিছু কিছু বাঁধাধরা চিন্তাপদ্ধতির শিকার যার ফলে এইপ্রকার ত্রুটির উদ্ভব হয়। আজকের আলোচনায় রোগজনিত বা প্যাথলজিক্যাল বিভ্রম গুলিকে বাদ রাখছি। বিভ্রম বা ভ্রান্তি গুলিকে মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। 

১. ফ্যালাসি (fallacy), বা যুক্তির ফাঁকি । 

২. বায়াস (bias), বা কোনও ঘটনায় একটি ব্যাখ্যা বা একটি সম্ভাবনার উপরে প্রকৃত ব্যাখ্যার চেয়ে একটি ভুল ব্যাখ্যাকে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হওয়া।

৩. ইলিউশন (illusion),  বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির ত্রুটি। 

৪. প্যারাডক্স (paradox), বা এমন ঘটনা যা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তির বিপক্ষে যায় বা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না, কিন্তু গভীরভাবে তদন্ত করলে এটি যুক্তিগ্রাহ্য ঘটনা। (আবার অনেকসময় পরস্পরবিরোধী যুক্তি কেও প্যারাডক্স বলা হয়) ইত্যাদি। 

কোনও কোনও ত্রুটি এদের মধ্যে একাধিক শ্রেণীতে পড়তে পারে। এরা আবার মূলতঃ যুক্তির ভুলের কারণেই হতে পারে (লজিকাল এরর) অথবা এর পিছনে কোনো মনস্তাত্বিক কারণ থাকতে পারে (সাইকোলজিক্যাল এরর, সাইকোলজিক্যাল বায়াস)  আমরা এদের মধ্যে অল্প কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবো। মনে রাখতে হবে, সাইকোলজিক্যাল এরর, লজিকাল এরর এর মতই গুরুত্বপূর্ণ; বিচারপতি থেকে নীতিপ্রণেতা, গরীব ভোটার বা মধ্যবিত্ত খরিদ্দার, যে কেউ এইসব বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন। আবার রাজনীতিক বা ধর্মপ্রণেতা, সাধারণ জনগণ কে প্রভাবিত করতে নানা মনস্তাত্বিক কৌশল এর সাহায্য নিতে পারেন যা থেকে সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। 

যুক্তির ভুল

বিশুদ্ধ যুক্তির ভুল বলে হয়ত কিছু হয়না, কারণ যুক্তি আমাদের মন এবং মস্তিষ্কের ই অংশ। তবুও সাধারণভাবে যুক্তি বা কার্যকারণ সম্পর্ক বা অন্য শ্রেনীবিভক্তকরণে ভুল হলে সেগুলিকে যুক্তির ফাঁকি বা যুক্তির ভুল (লজিকাল ফ্যালাসি) বলা হয়। ধরা যাক নিম্নলিখিত কয়েকটি তথ্য বা বক্তব্য। 

১. কুকুরের একটি লেজ

২. গরুর একটি লেজ

অতএব কুকুর হল একটি গরু।

কিংবা 

১. মানুষের পাঁচটি আঙ্গুল

২. রামবাবুর চারটি আঙ্গুল

অতএব রামবাবু মানুষ নয়।

এগুলি কিছু যুক্তির ভুল যা সহজেই ধরা পড়ে। তবে মনস্তাত্বিক বিভিন্ন  কারণে অনেকসময় এই ভুলগুলোই সত্যি মনে হয়। অর্থাৎ ভ্রমাত্মক বিশ্লেষণের প্রতি বায়াস সৃষ্টি করে।  উপরের উদাহরণগুলোই সামান্য পরিবর্তিত করে ব্যাপারটা দেখাচ্ছি। 

১. রামবাবু রাজনৈতিক দল ‘ক’ এর সমর্থক ও ধর্ম ১ বিশ্বাসী।

২. শ্যামবাবুও ধর্ম ১ বিশ্বাসী

অতএব শ্যামবাবু নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দল ‘ক’ এর সমর্থক হয়ে থাকবেন।

কিংবা 

১. মানুষের মান-সম্মান বোধ থাকতে হবে।

২. বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদু মান-সম্মান বলে আর কিছু অবশিষ্ট  রাখলো না।

অতএব যদু মানুষের পর্যায়ে গণ্য নয়।

এখানে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিকোণ (পারসেপশন) বা বিশ্বাস (বিলিফ সিস্টেম); সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বিচার এ উপনীত করায়।  

এবার আসি বিভিন্ন মনস্তাত্বিক ভ্রম এর উদাহরণ এ।

এগুলিকে কগনিটিভ বায়াস বা বুদ্ধিগত বিভ্রম ও বলা হয়। এর অজস্র প্রকারভেদ রয়েছে। তবে আমাদের স্বল্প পরিসরে এর কয়েকটি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।  


 অ্যাপোফেনিয়া (Apophenia) – 

সম্পূর্ণ এলোমেলো (random) নয়েজের মধ্যে কোনও অবাস্তব সঙ্কেত দেখতে পাওয়া (যেমন ধরুন অজস্র রেডিও সিগন্যাল এর মধ্যে কোনওটিকে যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই  ভূত বা ভিনগ্রহী বলে দাবি করা, কিছু লোকজনের শারীরিক গঠন দেখে তাকে খারাপ বা ভালো লোক বলে দাবি করা, এগুলি  অ্যাপোফেনিয়া র উদাহরণ)। 


প্যারেইডোলিয়া (Pareidolia) – 

অ্যাপোফেনিয়া-র দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ হল প্যারেইডোলিয়া। এতে আমরা কোনও হিজিবিজি জ্যামিতিক আকৃতির মধ্যে ভ্রমাত্মক অর্থবহ কিছু আকৃতি বা লেখা খুঁজে পাই। প্যারেইডোলিয়া যে সবসময় ক্ষতিকর তা নয় (যেমন মেঘের মধ্যে মানুষের মুখ বা আকাশের তারা র মধ্যে কন্সটিলেশন খুঁজে বার করতে ভালো লাগে বা তার কিছু ব্যাবহারিক উপযোগিতাও রয়েছে), কিন্তু প্যারেইডোলিয়া কে বুঝতে পারলে আমরা এটাও বুঝতে পারি মানুষ কেন কোনো প্রাকৃতিক গঠন এর মধ্যে দৈবী বার্তা খুঁজে পায়। যেমন কেউ হয়ত পাহাড়ের পাথরে কোন মুখাবয়ব দেখতে পেয়ে ভাবতে শুরু করলো কোনো দৈব শক্তি ওই পাথরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। আবার প্রাচীন কালে মানুষ যা কিছু নক্ষত্র দেখেছে তার প্রায় প্রত্যেক-কটা কে কোনো না কোনো কন্সটিলেশন (নক্ষত্র মণ্ডলী) র মধ্যে ঢুকিয়েছে। তারা হয়ত ভেবেছে এইসব আকৃতি কোনো দৈবী শক্তির পরিচয় বহন করছে ও আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু আমরা এখন জানি সম্পূর্ণ এলোমেলো হিজিবিজির মধ্যেও আমাদের মস্তিষ্ক কোনো না কোনো নকশা খুঁজে পায়। এটা প্যারেইডোলিয়া, কোনো অলৌকিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ নয়। 

বার্নাম এফেক্ট (Barnum effect) –  

জ্যোতিষী, ভাগ্যগণক, প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ, কোনও অপরিচিত ব্যক্তির ভাগ্য, অতীত, ব্যক্তিত্বও, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে এমন বক্তব্য রাখে, যা প্রায় যেকোনো কারুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ওই ভবিষ্যতবাণী সম্পূর্ণ অর্থহীন। কিন্তু ক্লায়েন্টের মগজ শুধু লক্ষ্য করে তাঁর নিজের সাথে ওই ভবিষ্যতবাণী মিললো। তার ফলে ভ্রমাত্মক ভাবে ওই ক্লায়েন্ট মনে করে ভাগ্যগণনা সঠিক হয়েছে। 

প্ল্যাসিবো এফেক্ট (Placebo effect) এবং নোসিবো এফেক্ট (Nocebo effect) – 

সম্পূর্ণ অকার্যকরী ওষুধ খেয়ে বা কোনো বস্তু ধারণ করে যখন মনে হয় রোগযন্ত্রণার উপশম হয়েছে তখন তাকে প্ল্যাসিবো এফেক্ট বলে। এর ঠিক বিপরীত ঘটনা কে বলা হয় নোসিবো এফেক্ট যেখানে কোনো অকার্যকর দ্রব্য বিষক্রিয়া বা অশুভ প্রভাব ছড়াচ্ছে বলে মনে হয়। 

কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation bias) – 

আগে থেকেই যে ঘটনা বা ব্যাখ্যা জানা আছে, একগাদা তথ্যের ভিড়ে সেই তথ্য বা সেই ব্যাখ্যা ই প্রমাণিত হচ্ছে বলে মনে হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে তথ্যগুলি হয়ত এমন কোনও ব্যাখ্যা কে নির্দেশ করেনা অথবা অন্য কোনো ব্যাখ্যা কে নির্দেশ করে। এটা কিছুটা অ্যাপোফেনিয়া বা প্যারেইডোলিয়া-র ই মতন কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, একটি প্যাটার্ন আপনি আগে থেকে জানেন, কাজেই আপনার মস্তিষ্ক অযাচিত ভাবে ওই প্যাটার্নটি সবকিছুতে খুঁজে পাচ্ছে। এর উদাহরণ হল, ধরুন একটি প্রবাদ বলছে অমুক জাতের লোক যদি কালো রঙের হয় তাহলে তারা বদমাইশ হবে। এক্ষেত্রে তদন্তকারী ব্যক্তি যদি ১০০০ মানুষ কে পর্যবেক্ষণ করে মনে করবার চেষ্টা করেন, তখন, কতবার অমুক জাতের কালো লোকরা বদমাইশি করেছে সেটাই মনে পড়বে। কতবার ওই জাতের সাদা লোক বদমাইশি করেছে আর কতবার ওই জাতের বাইরে অন্য জাতের কালো লোক বদমাইশি করেছে তা মনে করা কষ্টসাধ্য হবে। 

কনফরমিটি বায়াস (Conformity bias) – যখন একই তথ্য বা পরিমাপ বা ব্যাখ্যা বা যুক্তি অনেক অনেক লোকজন দাবি করতে থাকে, তখন সংখ্যাগুরুর যুক্তিকেই অধিকতর সঠিক বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হতে থাকে। আবার অধিক মান্যতাপ্রাপ্ত কোনো অথরিটি যদি ভুল কথাকে সঠিক বলে আশ্বাস দেন তখনও এইপ্রকার ভ্রম হয়। একে অথরিটি বায়াস বলে। 

ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট (Dunning Kruger effect) – 

যখন কোনো বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জন করার পরই মনে হতে থাকে অনেক জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে। আবার এর উল্টোটাও হয়, যাকে ইমপোস্টার সিনড্রোম বলা হয় - যখন অত্যন্ত জ্ঞানী বা যোগ্য কেউ নিজেকে অযোগ্য ভাবতে থাকেন। 

সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি (self fulfilling prophecy) 

এটি হল একটি সামাজিক ঘটনা যেখানে কোনো ভবিষ্যৎবাণী বা অলৌকিক আদেশ (আশীর্বাদ অভিশাপ ইত্যাদি) বা অদ্ভুত কোনো দাবী নিজেই নিজেকে সত্যি করে তোলে। অর্থাৎ এটি একটি কগনিটিভ বায়াস এবং তার পরিণতি দুই মিলিয়ে এই ঘটনা ঘটে। ধরা যাক একটি ছাত্র পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কেউ বলল যদি আজ ডিম খাস তাহলে পরীক্ষায় গেল করবি। ছাত্রটি ডিম খেয়ে ফেলার পর নার্ভাস হয়ে পড়ল এবং মনে করলো সে বোধহয় সত্যই ফেল করবে। এর ফলে সে পড়াশোনা করে যাওয়া সত্বেও কিছু লিখতে পারলোনা, ফেল করল। এটি নসিবো এফেক্টের সাথে তুলনীয়। এতে করে দাবির ফলাফল মিলেগেলেও দাবির  অলৌকিকতার সত্যতা প্রমাণিত হয়না।  

সারভাইভারশিপ বায়াস (Survivorship bias) – 

আমরা সর্বদা সফল লোকের কথা শুনি, সফল ছাত্রের মতামত কে অধিক গুরুত্ব দিই। এর ফলে আমরা অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ভুল ব্যাখ্যায় উপনীত হই। একে সারভাইভারশিপ বায়াস বলে। এর একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাটি থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাতপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমান। দেখা যাচ্ছিলো, যেসব বিমান যুদ্ধ করে ফিরে আসছে তাদের ডানা ও লেজে অপেক্ষাকৃত বেশি গোলার দাগ। তখন সিদ্ধান্ত করা হল যে বিমানের ডানা ও লেজের  ওইসব স্থানেই হয়ত বেশি গোলা লাগার সম্ভাবনা। অতএব সেনাকর্তারা বললেন ওইসব স্থান অধিক মজবুত করে তৈরী করা হোক। কিন্তু গণিতজ্ঞ আব্রাহাম ওয়াল্ড বললেন ঠিক উল্টো কথা। যে স্থানগুলিতে একেবারেই গোলা লাগছে না, আসলে মজবুত করতে হবে সেই জায়গাগুলি। কেন? তার কারণ যে বিমানগুলি আর ফিরে আসেনি, তারা সেই সমস্ত স্থানেও গোলা খেয়েছে। সেই জায়গাগুলিতে ছিল বিমানের ইঞ্জিন ও পেট্রোল ট্যাংকার। যে বিমানগুলি ফিরে এসেছে তারা ওই স্থানগুলিতে গোলা না খাওয়ার ফলেই ফিরে আসতে সমর্থ হয়েছিলো। ঠিক এইরকম ভ্রম হয় যখন মনে করা হয় বিড়াল উঁচু  থেকে পড়লেও কখনই মারা যায়না। আসলে মৃত বিড়ালকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে আসে না, কাজেই মৃত বিড়াল পরিসংখ্যান থেকে বাদ যায়। আবার, কোনো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কত ভালো তা জানতে সাধারণতঃ সফল অ্যালামনি দের মতামত চাওয়া হয়। ড্রপআউট দের সাথে কী কী ঘটেছিলো তা কেউ জানতে পারে না। আবার অনেক সফল ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে বলা হয় উনি চেষ্টা করেছেন তাই পেরেছেন। কিন্তু যারা চেষ্টা করেও পারলো না, তাদের তথ্য হারিয়ে যায়। যারা পারলো না, বিফল হল, তাদের প্রচেষ্টা ছিলোনা বলেই আপাতদৃষ্টি তে মনে হয়। 

নরম্যালসি বায়াস (Normalcy bias)  – 

বহুল প্রচলিত রীতি বা ধারণার সাথে মেলে না এমন তথ্যপ্রমাণ সামনে আসলে নতুন করে সত্যিটাকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমনকি মানসিক দোলাচলগত যন্ত্রণা (কগনিটিভ ডিসোন্যান্স) তৈরি হয়। ফেলে আসা মিথ্যাটাকেই অধিক সত্য বলে মনে হয়। একে নরম্যালসি বায়াস বলে।  

পরিশেষে আবারও বলছি, ফ্যালাসি বায়াস ইলিউশন এগুলি কোনো অপরাধ নয়। এগুলি মানব মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা বলা যেতে পারে। কিন্তু যুক্তি ও আত্মঃসমীক্ষার মাধ্যমে এইসব বিভ্রান্তির থেকে প্রকৃত তথ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কোন প্রচলিত বিশ্বাস বা চিন্তাপদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে নিজের মনকে যেকোনো দিকে চিন্তা করার স্বাধীনতা দিতে হবে। অর্থাৎ মনকে মুক্ত রাখতে হবে। তবেই সত্যিটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। 

তথ্যসূত্রঃ 

১. Series – ‘Brain Games’ : National Geographic Channel

২. Wikipedia – List of Cognitive bias 

৩. Michael Stevens (Vsauce) youtube channel.  

আপনি কি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চান? -প্রিন্স ফার্দিনান্দ
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ওকে ফাইন, হে নবীন পথিক৷ মুক্তচিন্তার জগতে আপনাকে স্বাগতম। শুরুতেই বলে নিচ্ছি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হলে অর্থাৎ মুক্তচিন্তক বা মুক্তমনা হতে হলে আপনাকে অবশ্যই সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। মুক্তচিন্তা মুক্তমনা  মানেই হল আপনার চিন্তার জগত, আপনার কল্পনা, আপনার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই হবে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। বদ্ধ সিস্টেমের ভেতরে থেকে এটা সম্ভব নয়। 

চলেন বিষয়টি নিয়ে সায়েন্স ও ফিলোসোফির আলোকে একটু আলোচনা করি। 

বিজ্ঞানের আলোকে আমরা জানি যে, ইউনিভার্সের কোন কিছুই সুশৃঙ্খলভাবে চলছে না। এখানের সবকিছুই বিশৃঙ্খল। তবে এই বিশৃঙ্খল জগতের সকল পদার্থ ও শক্তির প্রকৃতি  ব্যাখ্যা করা যায় যেসব বৈজ্ঞানিক সূত্র দিয়ে তা কখনো পরিবর্তন হবে না। এই যেমন শক্তির নিত্যতা সূত্র, থার্মোডাইনামিক্সের 

সূত্রসমূহ এসব কখনও পরিবর্তন হবে না। এই সূত্রসমূহ যেকোনো সিস্টেমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন কোন সিস্টেম বা ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই ইউনিভার্সাল সূত্রসমূহের ব্যত্যয় ঘটবে। এই সিস্টেম হতে পারে  আমাদের পুরো মহাবিশ্ব কিংবা একটি নক্ষত্র অথবা আমাদের পৃথিবী বা অন্য কোন গ্রহ। আবার এই সিস্টেম হতে পারে আমাদের পৃথিবীর অন্তর্গত যেকোন কিছু, পৃথিবীর সাগর মহাসাগর, নদ-নদী, খাল, বিল,পাহাড় পর্বত,বাতাস ইত্যাদি। 


আপনার খাবার টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি, চুলোয় বসানো গরম পানিভর্তি পাতিল, পার্টিতে  কিনে আনা এক বোতল মদ, কিংবা কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান সবই একেকটা সিস্টেমের আওতাধীন।

এতো গেল শুধু ম্যাক্রো লেভেলের উদাহরণ। এবার সিস্টেমের কিছু মাইক্রো লেভেলের উদাহরণ দেখে নেয়া যাক। পদার্থকে ভাঙলে যে অণু পরমাণু পাওয়া যায় সেগুলো ও একটা সিস্টেম। আবার পরমাণুকে আরও ভাঙতে থাকলে যে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন,ও অন্যান্য Particles পাওয়া যায় সেগুলোও  একটা সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। আবার আরেকটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা, রাস্ট্র, সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান -মসজিদ,মন্দির,গীর্জা,প্যাগোডা, বিভিন্ন শিল্পকারখানা, যানবাহন, ক্রীড়া ও চিত্রজগত ইত্যাদির সবকিছুই কোন না সিস্টেমের অধীন। কাজেই এক কথায় বলা যায় ইউনিভার্সের সবকিছুই একটা সিস্টেমের আওতাধীন।

 এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সিস্টেম আসলে কি?  সিস্টেমের সংজ্ঞাই বা কি? ওকে ফাইন, উত্তরটা আমি জানিয়ে দিচ্ছি। 

সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে  “সিস্টেম হলো এমন একটি সজ্জিত  নিয়ম বা পদ্ধতি বা গঠনতন্ত্র বা বস্তুর সন্নিবেশ যা একটি নির্দিষ্ট কৌশল বা পরস্পর আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ক এর অংশ হিসেবে কাজ করে।  যেমনঃ রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে সিস্টেম, মোবাইল নেটওয়ার্ক সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম বা ইন্টারনেট, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি আবার পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় সিস্টেমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে -

পরীক্ষা নীরিক্ষা করার সময় জড়জগতের যে অংশ বিবেচনা করা হয় তাকে সিস্টেম বলে। এই সিস্টেম ৩ ধরনের হতে পারে। যথা- বদ্ধ সিস্টেম, মুক্ত সিস্টেম ও বিচ্ছিন্ন সিস্টেম। মুক্ত সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে পদার্থ ও শক্তির বিনিময় হয়। যেমন, গরম পানিযুক্ত উন্মুক্ত চায়ের কেটলি বা এক কাপ গরম চা বা কফি হল মুক্ত সিস্টেমের উদাহরণ। আবার বদ্ধ সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে শুধুমাত্র শক্তির বিনিময় হয় কিন্তু পদার্থ বা ভরের বিনিময় হয় না। যেমন, ঢাকনা  দিয়ে আটকানো গরম পানি ধারণ কারী চায়ের কেটলি। অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন সিস্টেমের ক্ষেত্রে পরিবেশের সাথে পদার্থ ও শক্তি কোনটারই বিনিময় হয় না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ইউনিভার্সের কোথাও কোন বিচ্ছিন্ন সিস্টেম বলে কিছুই নেই। এটা জাস্ট একটা কাল্পনিক ধারণা। 

যাইহোক, এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে। কিন্তু আমার এই আলোচনায় আমি জাস্ট মূল থিমের আলোকে আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি এতক্ষণে আপনি সিস্টেম সম্পর্কে অনেকখানি অবগত হয়েছেন। আপনি যদি সিস্টেম সম্পর্কে বুঝেই থাকেন তাহলে আপনাকে এখন বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। প্রশ্নগুলো আসতে পারে কোন অল্পশিক্ষিত চতুর ধূর্ত মোল্লার কাছ থেকে। ধূর্ত মোল্লা আপনাকে বলতে পারে যে, "পুরো মহাবিশ্বই যেহেতু একটা সিস্টেম, তাহলে এই সিস্টেম তৈরি করলো কে? এই সিস্টেম নিশ্চয়  'ভুগিভুগি' তৈরি করেছেন এবং তিনিই ইহা চালাচ্ছেন তার নিজের খেয়ালে।”

ধূর্ত মোল্লার এমন প্রশ্ন ও উত্তর শুনে যদি আপনি এখানেই থেমে যান তাহলে আপনি কোনদিন গন্ডীর বাহিরে চিন্তা করতে পারবেন না। আপনি জগতের সৃষ্টি রহস্যের আগামাথা কিছুই জানতে পারবেন না। আপনার পক্ষে কখনো  মুক্তচিন্তক ও প্রগতিশীল হওয়া সম্ভব না। কাজেই আপনাকে থেমে গেলে চলবে না। ওই পয়েন্টটাই আপনার মুক্তচিন্তক হয়ে উঠার পেছনে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে যদি আপনি তাকে পালটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে পারেন।

 

আপনি তাকে প্রশ্ন ছুড়ে মারুন যে পৃথিবীতে ৪০০০+ ধর্ম আছে। কোন ধর্মের কোন 'ভুগিভুগি' এই সিস্টেম তৈরি করেছেন?

এই সিস্টেম তিনি কেন তৈরি করেছেন, কিভাবে তৈরি করেছেন? ভুগিভুগির তৈরি করা সিস্টেমে কোন শৃঙ্খলা নেই কেন? কেন পৃথিবীতে এক প্রাণী খাচ্ছে আরেক প্রাণীকে? 

কেন মহাবিশ্বে সবসময় মহা কুরুক্ষেত্র লেগেই আছে? কেন কোন কিছুই সুক্ষ্ণভাবে চলছে না? কেন  নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠোকাঠুকি লাগে? কেন  নক্ষত্র  collapsed  হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত  হয়ে সে Constellation এর সকল তারাগুলোকে গিলে ফেলে  

কিংবা Neutron নক্ষত্র হয়ে মারাত্মক শক্তিশালী  Gamma ray বিকিরণ করে আশেপাশের সব তারাকে ধংস করে দেয়? কেন বড় Galaxy ছোটো  Glaxy কে গিলে খেয়ে আপন আকৃতিকে

বিশাল করে ফেলে? কেন মহাবিশ্বে এই অহরহ তান্ডবের লীলাখেলা চলছেই যার কোন নিয়ম কানুন নাই? 

 Why there is no plan or rule in the Cosmos? কেন যে যার খেয়ালে চলছে, ধ্বংস হচ্ছে আবার নতুন রূপে আবির্ভাব হচ্ছে? এভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে পারলে আপনি অতি দ্রুতই চিন্তায় ও মননে হাজারগুণে এগিয়ে যাবেন। 

পরিশেষে বলি মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করতে হলে আপনাকে আগে সিস্টেমের বাহিরে আসতে হবে। সিস্টেমের ভেতরে থেকে আপনি কখনোই সিস্টেমকে জানতে বা বুঝতে পারবেন না। সিস্টেমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে সিস্টেমকে observe করতে হবে। একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে বুঝাই-

আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের কথাই ধরুন। এই কাওমি মাদ্রাসা হল একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমের ভেতরে যেসব ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে তারা সাধারণত বাহিরের জগত উন্নত বিশ্বের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আধুনিকতা সম্পর্কে অবগত থাকে না। তারা সিস্টেমের আওতাধীন হুজুরদের মুখে যা শুনে সেটাকেই মনে করে পুরো পৃথিবী। তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কেও অনেক পিছিয়ে থাকে। এর কারণ কওমি মাদ্রাসার সিস্টেম অনুযায়ী সেখানে তাদেরকে সাধারণত ধর্মীয় বই পুস্তকই বেশি বেশি পড়ানো হয়। তাদেরকে বিখ্যাত লেখকদের বই পড়ার সুযোগ দেয়া হয় না। উন্নত বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা খুব একটা ওয়াকিবহাল থাকে না। কাজেই কওমি সিস্টেমের ভেতরে থেকে পড়াশোনা করা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে মুক্তচিন্তক হয়ে উঠা খুবই কম সম্ভব।

কিছু তেতো সত্য -সুদীপ্ত বিশ্বাস
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:785 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে কেউ মুসলমান ছিল না। আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কেউ হিন্দু ছিল না। তার আগেও বহুকাল ধরে মানুষ ছিল। মানুষের সাথে মানুষের বিবাদ বা বিভেদ যেটুকু ছিল তা ছিল খাদ্য ও বাসস্থানের। এরপর এল কিছু সুবিধাবাদী চালাক মানুষ। তারাই ধর্ম সৃষ্টি করল। পুঁতে দিল বিভেদের বীজ। তারপর মানুষ মানুষের থেকে এভাবে আলাদা হয়ে গেল যে আজ এতযুগ পেরিয়ে এসেও, এই স্মার্ট ফোনের যুগেও মানুষ এক হতে পারেনি। বরং ধর্মের বিষগাছটি শাখা প্রশাখা বিস্তার করে মানুষের রক্ত মজ্জায় ঢুকে গেছে। মানুষ হয়ে পড়েছে ধর্মান্ধ। শিক্ষা মানুষের জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন ঘটায় কিন্তু ধর্মের অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে না। মানুষের জীবন, রাজনীতি, চিন্তাভাবনা সব কিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই অতীতকালে কিছু চালাক মানুষের তৈরি 'ধর্ম'।

মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিল না ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। ধর্ম কোনো কাজেই আসে না, শুধু যুদ্ধ বাধায়, রক্ত ঝরায়,মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়। প্রতিটি ধর্মই সমান খারাপ। মানুষের সর্বনাশ করেছে, করছে এবং করবে এই ধর্ম। আজ এই করোনা সঙ্কটে কোন ধর্ম কোন কাজে লাগছে? শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলছে। হ্যাঁ,পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ধার্মিক।বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন তাদের নিজের নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য সব ধর্ম অতি নিকৃষ্ট। কিন্তু তাতেও কিছুই এসে যায় না। বিশিষ্ট আমেরিকান শিক্ষাবিদ Booker T. Washington এর কথায় "A lie doesn't become truth, wrong doesn't become right, and evil doesn't become good, just because it's accepted by a majority." মেজরিটি সবসময় সঠিক কথা বলে না। বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত হলে তারা অশিক্ষিত মানুষকেই তাদের নেতা হিসাবে পছন্দ করবেন। যেটা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের সবকটি দেশেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি।

পদবি/জাত/পৈতে থাকলে জাতের নামে বজ্জাতিও থাকবে। সংরক্ষণ উঠিয়ে দেব, আর আমি ব্রাহ্মণ, আমি শ্রেষ্ঠ, আমি উচ্চ,এইসব মিথ্যে ধারণা নিয়ে অন্যকে ছোট করব, তা হয় না। ঠিক এই কারণেই আজও সংরক্ষণ চলছে, চলবেও। পৈতে একগাছা সুতো মাত্র, ইচ্ছে হলে একজন অব্রাহ্মণও পৈতে পরবে, ইচ্ছে হলে একজন ব্রাহ্মণ সন্তান ফালতু সুতো মনে করে পৈতে পরবে না, এই ধারণাতে যতদিন সমস্ত ব্রাহ্মণ বিশ্বাস না করবে, ততদিন সংরক্ষণ তুলে দেবার কথা তাদের মুখে মানায় না। পদবি থাকলে ওই পদবি ধরেই আবার কাউকে উঁচু কাউকে নিচু ভাবা হবে। আপনি সাহা, আপনাকে ব্যানার্জি ভুরু কুঁচকাবে, আপনিও মীনা/সরেন/মুন্ডাকে নীচু ভাবার সুযোগ পাবেন। এই রিলিজিয়াস শোভিনিজম থেকে মুক্তি পেতে পদবি হতে হবে ব্যক্তির ইচ্ছেমতো। যার যা খুশি, সে তাই পদবি নিক।অন্ধ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ধরা যাক আপনার পদবি 'সাহা'। এক্ষেত্রে আপনার নামটা 'সাহা' দিয়েই শেষ হবে, আপনার ছেলের নামের শেষে ওই সাহা’ই থাকবে, এই ধারণা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে সংরক্ষণ তুলে দেবার মত বড় কথা আপনার ভাবা মানায় কী? বরং পদবি থাকবে কিন্তু সংরক্ষণ থাকবে না, এটাই ১০০% আঁতেলের মত কথা।

 পদবি রাখলেই তার হাত ধরে সংরক্ষণও থাকবে। পদবিটা বংশধারা অনুযায়ী হলেই সমস্যা। পদবি নামের পরে একটা শব্দ মাত্র। নাম হতেই পারে দুই বা তিন শব্দের বা সংখ্যারও। যেমন “রাতুল রাহুল” নাম নিতে পারেন কেউ, যেখানে তার বাবার নাম হয়তো ছিল রাজীব মীনা। যাতে করে আর পদবি ধরে মানুষের জাত চেনা না যায়। এমনটা একটা দুটো প্রজন্ম করতে পারলেই কেল্লাফতে। কে উঁচু জাত ছিল, কে ছিল নীচু জাত, তা চেনাই যাবে না আর। 


পদবি ছাড়াই দু অক্ষরে খুব সুন্দর সুন্দর 

নাম দেওয়া যেতে পারে, আর সেখানে নামকরণের স্বাধীনতা অনেক বেড়ে যায়। যেমন, কারো নাম হতে পারে ‘সুদীপ্ত সুন্দর’ বা ‘সুদীপ্ত আলোকবর্ষ’ অথবা ‘নক্ষত্রজাতক সুদীপ্ত’। সুদীপ্ত বিশ্বাস/সুদীপ্ত দাস/সুদীপ্ত ব্যানার্জি/সুদীপ্ত ঘোষের চেয়ে এগুলো অনেক অর্থবহ এবং সুন্দরও।

পদবি বিহীন, জাতপাত মুক্ত, ধর্ম মুক্ত পৃথিবী আমরা ইচ্ছে করলেই তৈরি করতে পারি। Frederick Douglass সঠিকভাবেই বলেছেন “If there is no struggle, there is no progress.”  আমরা কেউ কি স্ট্রাগল করেছি? সবাই তো হাত পা গুটিয়ে থেকে শুধু পাকা ফলটি খাবার জন্য বসে আছি। ভুলে গেছি, ‘মা ফলেষু কদাচন’ প্রবাদটিকে। 

মহাপুরুষ/প্রফেট যাদের বলা হচ্ছে তারা কেউ-ই মহান নন। বেশিরভাগ অন্ধকার এরাই ছড়িয়েছেন। এদের মুখোশ খুলে দেওয়া দরকার। এরা আসলে ভণ্ড, অন্ধবিশ্বাসী। প্রফেটরা কুসংস্কারই ছড়িয়েছেন। বিভিন্নভাবে স্ববিরোধী বক্তৃতা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার, দলবাজি আর অন্ধ পুজো-আচ্চার প্রচার। ওদিকে মুখে আবার বড় বড় যুক্তিবাদী ডাইলগ। আসলে যুক্তির য-ও নেই তাদের জীবনে। এরা ভণ্ড। মহাপুরুষ কখনোই নন। বিজ্ঞানীরাই আসল মহাপুরুষ। বিজ্ঞানীদের জন্যই আমরা এত সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি।

Voltaire বলেছেন, “Prejudice is an opinion without judgment.” কিন্তু মানুষ আসলে অন্ধকারের পূজারি। আলোর চেয়ে অন্ধকার তার চিরকালের প্রিয়। তাই চিরকাল বিজ্ঞানীর চেয়ে প্রফেট, পুরোহিত বা পাদ্রির মূল্য অনেক বেশি তার কাছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের বইয়ের চেয়ে ধর্মগ্রন্থের মূল্য অনেক বেশি মানুষের কাছে। বিজ্ঞানের বই পায়ে ঠেলে ধর্মগ্রন্থ মাথায় করে রাখে সমস্ত মানবসমাজ। অনেকে আবার ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজে পান! বিজ্ঞানের কাজ হল আলো ছড়ানো আর ধর্মগ্রন্থের কাজ হল অন্ধ মানুষকে আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখা। তাই ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞান একে অন্যের পরিপূরক নয়। আলোর সাথে অন্ধকারের যা সম্পর্ক  এদের সাথেও সেই একই সম্পর্ক। বিজ্ঞান নতুনের পূজারি। নতুন উন্নত চিন্তাভাবনা এলেই পুরানো ধারণাকে বাতিল করে দেয় সে। ওদিকে ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারটা পুরো উল্টো। যত পুরানো হয়, ততই তার মান্যতা বাড়ে। পুরানো বস্তাপচা ধর্মগ্রন্থের সাথে যদি বিজ্ঞানের কোনো ধারণার খুব সামান্য মিল পাওয়া যায়, তাহলে আর কথাই নেই, সব মানুষ ধর্মগ্রন্থ মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দেয়। আলোর চেয়ে অন্ধকার মানুষের বড় প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের ছিঁটেফোঁটা সম্মানও পাননা নোবেলজয়ী  সি. ভি. রমন বা চন্দ্রশেখরেরা। অথচ তাদের আবিষ্কার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মেধার পরিচায়ক ও শ্রমসাধ্য।


আগুনে বিশ্বাস করে হাত দিলে হাত পোড়ে।আগুনকে অবিশ্বাস করে হাত দিলেও হাত পোড়ে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে আগুনের চরিত্র বদলায় না। সাঁতার না জেনে জলকে বিশ্বাস করে অথৈজলে নামলে ডুবে মরতে হয়। জলকে অবিশ্বাস করে অথৈজলে নামলেও ডুবে মরতে হয়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে জলের চরিত্র বদলায় না। 


ঈশ্বরকে বিশ্বাস করলে তিনি খুবই খুশি হন। ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করলেই তিনি ক্ষেপে যান। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে ঈশ্বরের  চরিত্র বদলায়। যার চরিত্র সামান্য বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে বদলায়, তাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়?


ঈশ্বর নামক জুজুর ভয় থেকে মুক্ত হয়ে বিপদের সময় আত্মবিশ্বাসী হতে শেখার নাম প্রকৃত শিক্ষা। ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বিজ্ঞানের বইগুলো অনেক বেশি মূল্যবান, এটা বুঝতে পারার  নাম প্রকৃত শিক্ষা। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার সাহস অর্জন করার নাম প্রকৃত শিক্ষা। মিথ্যে বললে আখের গুছিয়ে নেওয়া যাবে জেনেও, সত্যকে আঁকড়ে থাকার নাম প্রকৃত শিক্ষা। প্রচলিত কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসগুলোকে লাথি মেরে গুঁড়িয়ে ফেলে যুক্তিবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী হতে শেখার নাম প্রকৃত শিক্ষা।

অসময়ে কাজে আসেনি কোনও মন্দির-মসজিদ-গীর্জা। এগুলোকে ভেঙে হাসপাতাল করা যায় না?

শুধু ডেভলপমেন্ট নয়, সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট আমাদের দরকার। শুধু মানুষকে নয়, গাছপালা, পশুপাখি সব্বাইকে ভালোবেসে বাঁচো এবং বাঁচতে দাও। বিশিষ্ট ভিক্টোরিয়ান কবি Matthew Arnold সঠিকভাবেই বলেছেন, “The free thinking of one age is the common sense of the next.” আমাদের আজকের এই মুক্ত চিন্তার কথাগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে অতি সাধারণ বলেই একদিন মনে হবে। কুসংস্কার ও অন্ধকারের গভীর থেকে তারা একদিন ঠিক আলোর দিশা খুঁজে পাবে।

Sudipta Biswas, (WBCS Exe.)

Nokari Uttar Para, Ranaghat

প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞে কি ফললাভ হয়? -চিত্রদীপ সোম
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:611 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞ জাতীয় জিনিসগুলি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত সমস্ত উপাসনা ধর্মগুলিরই একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। বলা যেতে পারে উপাসনা ধর্মগুলি টিকেই আছে যে সমস্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো এইসব প্রার্থনা। বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা পদ্ধতি বিভিন্ন। অমিলও প্রচুর। তবে একটা বিষয়ে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই একমত, ঠিকমত প্রার্থনা করলে ফললাভ অবশ্যম্ভাবী। হাতে গোনা কয়েকটি ধর্ম বাদ দিলে প্রায় সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যাকে প্রার্থনায় তুষ্ট করতে পারলে তিনি মানুষের কামনা পূরণ করেন। যাগযজ্ঞ, মানত করা, ইত্যাদি এরই রকমফের।

কিন্তু ধর্মীয় প্রার্থনায় কি আদৌ ফললাভ হয়? বিশ্বাসীরা বলবেন অবশ্যই হয়। অবিশ্বাসীরা বলবেন ‘সব ঝুট’। এইসব তর্কের মীমাংসা হওয়া দুঃসাধ্য৷ তাই তর্কে না গিয়ে খোলামনে একটু দেখে নেওয়া যাক প্রার্থনায় আদৌ ফললাভ হয় কিনা।

সুরেশবাবু ব্যাংকের কর্মী৷ প্রথম সন্তান মেয়ে হবার বছর দুই পরে আবার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মিনতিদেবী। সুরেশবাবুর একান্ত ইচ্ছা এবার একটি ছেলের মুখ দেখার। পাড়ার এক বয়স্কা মহিলার পরামর্শ মতো এক 'জাগ্রত' কালীর থানে মানত করলেন সুরেশবাবু পুত্রসন্তানের জন্য। এর কয়েকমাস পরেই স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলো। মিনতিদেবীর কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। মায়ের কৃপায় বিগলিত সুরেশবাবু সেই সপ্তাহেই ছুটলেন মানত পূর্ণ করতে।

মাঝবয়সী বিজনবাবু ইদানীং খুব গ্যাস অম্বলে ভুগছেন। ওষুধ খেয়েও বিশেষ কিছু কাজ হচ্ছে না৷ অফিসের দত্তদার পরামর্শ অনুযায়ী হুগলীর এক বিখ্যাত ঠাকুরের চরণামৃত পরপর তিনদিন সকালে খালিপেটে খেলেন বিজনবাবু। আর তারপরেই ম্যাজিক। গ্যাস অম্বল যেন মন্ত্রবলে অনেকটাই কমে গেলো!  ঠাকুরের এহেন কৃপায় বিজনবাবু একটি ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন ঠাকুরঘরে।নিত্য এখন সেই ছবিতে ফুলমালা দেন তিনি।

প্রদীপ বছর ছাব্বিশের এক বেকার যুবক। অনেক চাকরির পরীক্ষায় বসেছে। কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। বাড়ির লোক অনেকবার বলেছে ভালো দেখে একটা পুজো দিতে ঠাকুরের কাছে। কিন্তু যুবক প্রদীপ রক্তের জোরে সে সবকে এতদিন উপহাসই করে এসেছে। অবশেষে একদিন বাড়ির পীড়াপীড়িতে ঠাকুরের কাছে পুজো দিয়ে বুক পকেটে প্রসাদি ফুল বেলপাতানিয়ে চাকরির পরীক্ষায় বসলো প্রদীপ। আর এবারেই বাজিমাত! লিষ্ট বেরোতে দেখা গেলো জ্বলজ্বল করছে প্রদীপের নাম।

উপরের ঘটনাগুলির মতো ঘটনা অহরহ হয়ে চলেছে আমাদের চারপাশে। আর এগুলোকে হাতিয়ার করেই দৈব বিশ্বাসীরা প্রশ্ন তুলে দেন যুক্তিবাদীদের দিকে। প্রার্থনায় যদি ফললাভ নাই হবে তাহলে উপরের ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা কি? আছে এসবের কোনো উত্তর অবিশ্বাসী নাস্তিকদের কাছে?

বিষয়টিকে ভালোভাবে বুঝতে উপরের ঘটনাগুলির কাটাছেঁড়ায় আসা যাক এবার। কিভাবে পূরণ হয়েছিলো উপরের প্রার্থনাগুলি? আসলে প্রার্থনায় সেইসব চাহিদাই পূরণ হয় যেগুলো এমনিতেও পূরণ হওয়া সম্ভবপর ছিলো। মাঝখান থেকে নাম হয় প্রার্থনার। 


আপনি যদি উপরের দিকে একটা কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড পড়ার তাহলে প্রার্থনায় ফল লাভের সম্ভাবনা ৫০%। প্রার্থনা না করলেও হেড পড়ার চান্স ছিলো ওই ৫০%-ই

কিন্তু প্রার্থনা করায় নাম হয়েছে প্রার্থনার। কিন্তু আপনি যদি কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড ও টেল উভয়ই একইসাথে পড়ার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%, সে আপনি যতই ভক্তিভরে আপনার ঈশ্বরকে ডাকুন না কেন৷ কারণ বাস্তবত হেড ও টেল একইসাথে পড়া সম্ভব নয়৷ একইভাবে আপনি যদি ভারত পাকিস্তান খেলার সময় আপনার ভগবানকে ডাকেন আপনার দেশকে জেতানোর জন্য, যাগযজ্ঞ করেন এই উদ্দেশ্যে, তাহলেও আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ৫০%। কিন্তু আপনি যদি প্রার্থনা করেন দুটো দেশই জেতার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%।  কারণ দুটো দেশের একসাথে জেতা বাস্তবে সম্ভব নয়।

উপরের উদাহরণগুলিতেও তাই হয়েছে। সুরেশবাবু মানত না করলেও তার পুত্রসন্তান হতে পারত। মানত করায় নাম হয়েছে মানতের৷ বিজনবাবু একইসাথে চরণামৃতও খেয়েছেন আবার ওষুধও খেয়েছেন। রোগ সারায় নাম হয়েছে চরণামৃতের। শুধু বিজনবাবু নন, অধিকাংশ রোগীই এটা করেন। আধুনিক চিকিৎসা ও দৈব পদ্ধতি উভয়েরই সাহায্য গ্রহন করেন। রোগ সারলে নাম হয় দেবতার। আর না সারলে 'ডাক্তারের ব্যর্থতা'।  

আজ অবধি কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষকেই দেখিনি ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর ভরসা করে চিকিৎসা না করিয়ে কেবল প্রার্থনা বা চরণামৃত বা মাদুলি তাবিজের ভরসায় পড়ে থাকতে। এটাই এদের ভন্ডামি।

অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধ না খেয়ে কেবল চরণামৃত খেয়েও রোগ সারতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত কারণও আছে তার। যে কোনো চিকিৎসক মাত্রেই জানেন আমাদের দেহের অনেক রোগই সারানো যায় কোনো ওষুধ ছাড়াই কেবল মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে। যাকে placebo effect বলেন চিকিৎসকরা। আজকের আলোচনায় এনিয়ে বিস্তারিত কথা বলার অবকাশ নেই, পরে কোনোদিন সুযোগ হলে বলব। আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখুন কেবলমাত্র মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই গ্যাস, অম্বল, হাঁপানি, নানা স্থানে ব্যাথা ইত্যাদি নানাপ্রকার রোগেরনিরাময় বা প্রশমণ সম্ভব৷ বহুক্ষেত্রে সাইকো-সোম্যাটিক রোগ(মন জনিত দেহের রোগ) সারাতে প্ল্যাসিবো এফেক্টের ব্যবহারও করেন ডাক্তারবাবুরা। আসলে চরণামৃতের ঔষধিগুন নয়, এক্ষেত্রে চরণামৃতের প্রতি রোগীর বিশ্বাসই তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেছে। প্রদীপের ঘটনাটির ব্যাখ্যাও একই। ফুল বেলপাতা ছাড়াও প্রদীপের সফল হবার সম্ভাবনা ছিলোই। কিন্তু সফল হওয়ায় নাম হয়েছে ঠাকুরের কৃপার।

তাহলে কিভাবে 'মিথ্যা' প্রমান করা যাবে প্রার্থনার শক্তিকে? খুব সোজা। এমন কিছু প্রার্থনা করুন যেগুলো এমনিতেই সফল হবার সম্ভাবনা 'শূন্য'। তাহলেই দেখবেন ঈশ্বর আর সাড়া দিচ্ছেন না প্রার্থনায়। তা সে যত 'জাগ্রত' দেবতাই হোক। যেমন আপনি আপনার মনোমত যে কোনো দেবতার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশী পদক লাভ করে। দেখবেন প্রার্থনায় আর কোনো ফল হচ্ছে না৷ ভারত পদকতালিকায় পড়ে থাকছে সবার শেষেই। কিম্বা প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী দশ বছরের মধ্যে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতে। দেখবেন কালী বা আল্লা বা গড কোনো ঈশ্বরই আর প্রার্থনা পূরণ করছেন না৷ কিম্বা প্রার্থনা করুন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যেন ভারত থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার ও বেকারীত্ব দূর হয়ে যায়। এবারও দেখবেন কোনো ঈশ্বরই আর সাড়া দিচ্ছেন না আপনার প্রার্থনায়। কারণ এই দাবীগুলো বাস্তবে মেটা সম্ভব নয়। ওই হেড আর টেল একসাথে পড়ার মতই। আর তাই এখানে প্রার্থনার শক্তিও 'ফেল' করে যায়। এটাই বাস্তব।

অর্থাৎ এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত প্রার্থনায় ফলে কেবল সেইসব দাবীগুলোই যেগুলো এমনিতেও ফলার সম্ভাবনা ছিলো। প্রার্থনার ভূমিকা তাই বাস্তবে শুন্য।

এরপরও যদি কেউ প্রার্থনার শক্তিনিয়ে কুতর্ক করতে আসেন তাহলে তার কাছে উদাত্ত আহ্বান থাকবে প্রার্থনার সাহায্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতকে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতানোর বা প্রার্থনার সাহায্যে পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার, বেকারত্ব দূর করতে পারার। যদি পারেন, তাহলে যে কোনো কট্টর নাস্তিকও মেনে নেবে ধর্মীয় প্রার্থনায় সত্যিই ফললাভ হয়। আর যদি না পারেন তাহলে মেনে নিন প্রার্থনা কেবল মনের শান্তি বিশেষ। বাস্তব কোনো ফলপ্রদান সম্ভব নয়। কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ চাইলেই এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নাস্তিকদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে পারেন। খোলা আহ্বান রইলো সমস্ত ঈশ্বরবিশ্বাসী, প্রার্থনার শক্তিতে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে।

অঙ্গদান ও মামা-ভাগ্নে বিসংবাদ -নাফিস সাদিক শাতিল
Nov. 21, 2024 | সচেতনতা | views:764 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভাগ্নে বললো, “মামা চলো মরণোত্তর দেহ দানের ব্যাপারে কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেলি।” আমি আতংকিত হয়ে বললাম, “এসব কি বলিস? এই শরীর, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মালিক কি তুই? যে চাইলেই দান করে দিবি?” ভাগ্নে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আমার শরীর, আমার অঙ্গের মালিক আমি নই? তাহলে কে?”

“কে আবার? যিনি তোকে সৃষ্টি করেছেন সেই মহান স্রষ্টা। তিনি তোকে সৃষ্টি করে তোর বডিটা তোকে কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছেন। তাই তোর শরীরের কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করা ঠিক না। তুই ইচ্ছা করলেই তোর কোন অঙ্গ দান করে দিতে পারিস না। এই অধিকার তোকে দেয়া হয়নাই।”

“ও আচ্ছা। তাহলে এই একই লজিকে কোন ধরণের অপারেশনও তো করা যাবেনা। ধরো কারো এপেন্ডিক্স অপসারণের প্রয়োজন পড়লো, তাহলে সে কি করবে? অথবা কারো একটা দাঁত তোলার প্রয়োজন পড়লো, তাহলে সে কি করবে? এসব করলে তো দেহের পরিবর্তন হয়ে যাবে।” ভাগ্নে বললো।

“তুই আসলে বেশি বুঝিস। রোগব্যাধির বিষয়টা আলাদা। আর স্বেচ্ছায় দান করার বিষয়টা আলাদা। তোদের নাস্তিকদের মাথায় আসলে কিচ্ছু নাই। আসল ব্যাপার হলো মানুষকে তার ভাগ্যলিপি অনুসারে বানানো হয়েছে। যার ভাগ্যে কোন নির্দিষ্ট অর্গান ফেইলিওর লেখা আছে, সে কেন আরেকজনের অর্গান নিয়ে বেঁচে থাকবে? ভাগ্যলিপিকে পরিবর্তনের চেষ্টা করাটা অন্যায়।” আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।

“সেই একই যুক্তিতে তো আমাদের সকল ওষুধ পত্র, এন্টিবায়োটিক, ভ্যাক্সিন, অপারেশন, ট্রিটমেন্ট সবই বয়কট করে দিতে হবে। কারণ যার ভাগ্যে রোগব্যাধিতে মৃত্যু লেখা আছে তার তো কোন অধিকার নেই ভ্যাক্সিন, এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করে মৃত্যুকে বিলম্বিত করার।” ভাগ্নে পাল্টা উত্তর দিলো।

“আসলে তোদের মত স্বল্পবুদ্ধির গ*বেটরা কিছুই বুঝতে চাস না। তোর যদি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস থাকতো, তাহলে এই চিন্তা কখনোই মাথায় আসতো না। মৃত্যুর পর আমাদের আবার জীবন্ত করা হবে। তোর বডি দান করে দিলে তুই কি নিয়ে দাড়াবি?”

“মামা, দাড়াতে গেলে গ্র‍্যাভিটি লাগে। তুমি কি শিওর সেখানে মহাকর্ষ কাজ করবে? তাছাড়া সেসময় কিডনি লিভার পাকস্থলি হার্ট লাংস এগুলোর কাজই বা কি হবে? এগুলো দান করে দিলে সমস্যা কি? শুনেছি সেখানে মানুষের ক্ষুধা লাগবেনা, হাগু লাগবে না। তাহলে পরিপাকতন্ত্রের কাজ কি? সেখানে কি বায়ুমন্ডল থাকবে? বায়ুমন্ডলে কি অক্সিজেন থাকবে? না থাকলে লাংসের কাজ কি? তখনও কি বেঁচে থাকতে অক্সিজেনের উপর ভরসা করা লাগবে? তখনো কি শ্বেত রক্তকণিকা রোগ প্রতিরোধ করবে? হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন পরিবহণ করে নিয়ে যাবে কোষে কোষে? তখনও কি অনুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করবে? এগুলোর কাজ কি সে সময়?"

এই টাইপের মূর্খের সাথে তর্কের কোন মানেই হয়না ভেবে আমি আর কোন কথা না বলেই উঠে চলে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে ভাগ্নে বললো, “মামা, আত্মঘাতী বো মা মারতে গিয়ে যাদের বিশেষ অঙ্গ উড়ে যায়, তারা কী নিয়ে দাঁড়াবে?”

পেরিয়ার রামাস্বামী – বিরল এক ব্যক্তিত্ব -কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:979 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সাল ২০২২, তারিখ – ১৭-ই সেপ্টেম্বর, স্থান – কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এক টেকনোলজি ইন্সটিটিউট, যা আবার An Institute of National Importance-এর তালিকাভুক্তও বটে, সময় – সকাল ১০-টা। শুরু হয়ে গেল কাঁসর-ঘন্টার শব্দ আর সংস্কৃত মন্ত্র সহযোগে বিশ্বকর্মা পুজো। একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। সাথে হিন্দুত্ববাদীদের আস্ফালন তো আছেই। কিন্তু মন শান্ত করে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম এ-তো নতুন কিছুই নয়। এই সাংস্কৃতিক আবহেই তো আমরা – উচ্চবর্ণের হিন্দুরা – বড় হয়ে উঠেছি। আজ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নিয়ে আমরা অনেকে বহু আপত্তি প্রকাশ করছি বটে, কিন্তু তিল তিল করে এই হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে আমরা, আমাদের পূর্বপুরুষরাই তো ইন্ধন জুগিয়েছি। সত্যিটা তো এটাই যে এই ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-র বীজটা সেদিনই সংবিধানের মধ্যে পোঁতা হয়ে গিয়েছিল যেদিন স্বয়ং নেহরু-র নেতৃত্বে পরিচালিত উপদেষ্টা কমিটি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তটা প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবং উল্টে সকল ধর্মকে সমান হিসাবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। Secular শব্দটা ভারতে সেদিনই ‘Sickular’ হয়ে গিয়েছে। যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি স্বাধীনতার পরে জন্ম নিয়েছিল তাতে যে ভারত রাষ্ট্র বাস্তবে উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর ইচ্ছার কাছে, তাঁদের ধর্মের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে সেদিন একথা উপলব্ধি করা হয়নি, বা হয়তো জেনেবুঝেই সবটা করা হয়েছে। স্কুলে-কলেজে পুজো-অর্চনা সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে। সেই ঐতিহ্যের হাত ধরেই ১৭-ই সেপ্টেম্বর তারিখটা ভারতীয় সংস্কৃতি (পড়ুন হিন্দু সংস্কৃতি) অনুযায়ী বিশ্বকর্মা পুজো হিসাবে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে, পেরিয়ার ই. ভি. রামাস্বামী-র (১৮৭৯-১৯৭৩) জন্মদিন হিসাবে উদ্‌যাপিত হয় না। তবে এখনও আমরা এই ভেবে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করতে পারি যে এই দিনটা বর্তমান ভারতে বিশ্বকর্মা-র অবতার, ‘Make in India’-র জনক, নরেন্দ্র মোদী-র জন্মদিন হিসাবে তো আর পালন হচ্ছে না! অবশ্য আগামী প্রজন্ম এতটা সৌভাগ্যবান না-ও হতে পারে। তাই তাদের সম্ভাব্য দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচাতে আসুন পেরিয়ার রামাস্বামী-কে নিয়ে একটু সংক্ষেপে চর্চা করা যাক।

এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে ১৮৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন পেরিয়ার রামাস্বামী। দশ বছর বয়সেই প্রথাগত স্কুলশিক্ষা পরিত্যাগ, তরুণ বয়সে স্বল্পকালের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ, শীঘ্রই ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে বিশ্বাস হারিয়ে কংগ্রেসে যোগদান মারফৎ সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ, সেখানেও মোহভঙ্গ ও শেষে কংগ্রেসের সাথেও বিচ্ছেদ, তারপর আজীবন সমস্ত রকম নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা – যেন স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার জন্যই তিনি জন্মেছিলেন। ১৯২৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে, যখন ব্যাঙ্গালোর-এ গান্ধী-র সাথে সাক্ষাৎকারের পর তিনি বুঝতে পারেন যে গান্ধী নিজেই অন্তর থেকে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতি ভীষণভাবে বিশ্বাসী। যদিও ইতিমধ্যে ১৯২৫ সাল থেকেই তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন “আত্মসম্মান আন্দোলন” [Self-Respect Movement], যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে জাতিভেদ আর তার রক্ষক ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে নারীদের দমিয়ে রাখার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচার চালানো ও পদক্ষেপ নেওয়া। সমকালীন জাতীয়তাবাদীরা যেমন ‘স্বরাজ’-কে একটা জন্মগত অধিকার হিসাবে দেখেছিলেন, তেমন পেরিয়ার-এর কাছে সেই জন্মগত অধিকারটা ছিল ‘আত্মসম্মান’। ‘এক মানুষ এক ভোট’-এর রাজনৈতিক গণতন্ত্র যদি ‘এক মানুষ এক মূল্য’-র ভাবনাটাকেই না সুনিশ্চিত করতে পারে তাহলে সেই গণতন্ত্র যে কখনই ভারতের নারী ও পুরুষের স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব আর সাম্যকে সুনিশ্চিত করতে পারবে না সেই কথাটা পেরিয়ার এবং তাঁর-মত জাতিব্যবস্থা-বিরোধীরা গোড়াতেই উপলব্ধি করেছিলেন। পেরিয়ার মনে করতেন ভারতীয় জনজীবনের প্রতিটা দিকই বেদ, স্মৃতি, শাস্ত্র ও পুরাণ মারফৎ পরিপুষ্ট মনুর নিয়ম এবং বর্ণাশ্রমধর্ম দ্বারা পরিচালিত, যা মতাদর্শগতভাবেই ‘এক মানুষ এক মূল্য’ – এই চিন্তাভাবনার পরিপন্থী।

ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ, বর্ণাশ্রমধর্ম, এবং হিন্দুধর্মকেই জাতিব্যবস্থার মূল মতাদর্শ হিসাবে, এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও অ-ব্রাক্ষ্মণ শূদ্রদের মুক্তিকে জাতিব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য অপরিহার্য হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন পেরিয়ার।

যাঁরা অস্পৃশ্য তাঁরা প্রথমে ও সর্বাগ্রে মেহনতী জনগণ। এই মেহনতী জনগণকে দাসত্ব এবং ভয় থেকে মুক্ত না করলে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আর আত্ম-নির্ভরতার সমস্ত কথাবার্তাই আসলে ফাঁকা আওয়াজ। ‘আত্ম-নির্ভর’ ভারতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যতোই ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসভ’ উদ্‌যাপন চলুক না কেন, এই বাস্তব সত্য আজও আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

ধর্মের প্রতি, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের প্রতি পেরিয়ার-এর সমালোচনার তীব্রতা ছিল মারাত্মক। জনগণ কি খাবে, কিভাবে পোশাক পড়বে, কাদের বিয়ে করবে, পেশা নির্বাচন, পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রকাশ্য ব্যবহার, রাজনৈতিক পছন্দ, আরাধনার উপায় – সংক্ষেপে, হিন্দুদের প্রতিটা কাজেই একটা ধর্মীয় সংবেদনশীলতা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়, আর এই কর্তৃত্ববাদের দূর্গেই কামান দেগেছিলেন তিনি। তাঁর কথায় জাতিভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল ভিত্তিই ছিল এই ধর্ম। একইভাবে সতীত্ব বজায় রাখা, সন্তানের জন্মদানে সক্ষমতা প্রমাণ করা ইত্যাদি ব্যাপারে নারীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার চিরাচরিত ধর্ম-কেন্দ্রিক ধারণাগুলোকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি কখনও ভাবেননি যে পুরুষের শরীর নারীর শরীরের থেকে আলাদা বলে পুরুষ আর নারী বৈশিষ্ট্য আর মেজাজের নিরীখে আলাদা। এছাড়া, নারীরা যাতে সৌন্দর্য্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁরা যাতে নিছক গয়না ঝুলিয়ে রাখার খুঁটিতে পরিণত না হয়ে যান সেই আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি। পেরিয়ার-এর কাছে বিয়ের সম্পর্ক ছিল ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী মূল্যবোধের একটা ব্যবস্থা। তাঁর কথায় – “যেমনভাবে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ মেহনতী জনগণের একটা বিরাট অংশকে শূদ্র হিসাবে নিন্দা করেছে, ঠিক তেমনভাবে এই মতাদর্শ নারীদেরও বিবাহের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করেছে। .. একজন নারী যতই সতীসাবিত্রী ও আদর্শ স্ত্রী-এর আদবকায়দা মেনে থাকবে ততই সে নিজের দাসত্বকে স্ফূর্তির সাথে মেনে নেবে।”

ব্রাক্ষ্মণ-পারাইয়া, পুরুষ-নারী, ও ধনী-গরীবদের মধ্যেকার বিভেদ, যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীগুলো প্রথম শ্রেণী দ্বারা নিপীড়িত – সমাজের এই তিনটে বিভেদকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একটা সমানতার আদর্শ ‘সমধর্ম’-র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পেরিয়ার ও তাঁর আত্মসম্মান আন্দোলনের সহকর্মীরা। চাকরিক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুপাতিক ভিত্তিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব; বিভিন্ন জায়গা, পবিত্র স্থান, সম্পত্তি, চাকরি ইত্যাদির উপর সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা; আত্মসম্মান আন্দোলনের সদস্যদের বিবাহের ক্ষেত্রে আইনি বৈধতা নিশ্চিত করা; জাতি বা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে মন্দিরে পুরোহিত নিয়োগের মতো কাজকে সম্ভব করা ইত্যাদিকে ‘সমধর্ম’ আদর্শের বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাষায় – “সকল জাতির উচিত শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ও সংস্কৃতিতে উন্নতি করা, এবং একে অন্যের সাথে সমতা অর্জন করা। ... সকল জাতির উচিত সরকারী পদগুলোকে সমান ভাগে অর্জন করা ... সকল জাতির উচিত একে অন্যের কাছাকাছি আসা এবং সংস্কৃতির একটা সাধারণ স্তর, একটা সাধারণ শিক্ষাগত মর্যাদা অর্জন করা, একটা সাধারণ নৈতিকতার অভিজ্ঞতা লাভ করা।” জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্র যখন ‘secularism’ শব্দটার অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে ‘সব ধর্ম সমান’-এ পরিবর্তিত করে সেই মুখোশের আড়ালে একটা নির্দ্দিষ্ট ধর্মের (ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম) পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে, তখন পেরিয়ার-এর এই ‘সমধর্ম’-র আদর্শকে চর্চা করাটা নিঃসন্দেহে সময়ের একটা দাবি।

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থারও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন পেরিয়ার। তাঁর কাছে শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ধর্ম, শাস্ত্র ইত্যাদির উপর অন্ধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং তার সাথে পড়ুয়াদের নিজ বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সচেতনভাবে ও স্বেচ্ছাকৃতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করা। তাঁর মতে জনগণ ও দেশের জন্য পড়ুয়াদের মনে আত্মসম্মান, দৃঢ়তা, সাম্য, প্রেম ইত্যাদি বোধগুলোর সঞ্চার ঘটানোই শিক্ষকদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করা পড়ুয়ারা স্কুলে না যাওয়া অশিক্ষিত জনগণের থেকে যেকোনো দিক থেকে অনেক ভালো – এই ধারণাটা পেরিয়ার কোনওদিনও গ্রহণ করেননি। তাঁর কথায় – “যেমন একজন ধোপা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় জানেন না, ঠিক তেমনই বি.এ. ডিগ্রীধারীরাও জানেন না যে কিভাবে ধোপাদের মতো কাপড় কাচতে হয়; একজন মুচি যেমন ব্যাকরণ এবং সাহিত্য জানেন না, ঠিক তেমনই বিদ্বান এবং শাস্ত্রজ্ঞরা জানেন না যে কিভাবে পায়ের জুতো তৈরী করতে হয়... সুতরাং, যাঁরা বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেছেন সেই বিদ্বান আর শাস্ত্রজ্ঞরা কোনওভাবেই ধোপা, নাপিত আর মুচি বা জাগতিক বিষয়ে আরও প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের থেকে বেশী শ্রেষ্ঠ নন। শিক্ষিত ব্যক্তিরা যেটা শিখেছেন সেটা হল একটা নির্দ্দিষ্ট দক্ষতার কোনও একটা কৌশল, কোনও জ্ঞান নয়। এই শিক্ষিতরা বোকা হতে পারেন, স্বার্থপর হতে পারেন, তাঁদের আত্মসম্মান বোধ নাও থাকতে পারে, কিন্তু আবার বিপরীতে স্কুলে না যাওয়া জনগণ উদার, বুদ্ধিমান, এবং আত্মসম্মান বোধ-সম্পন্ন হতে পারেন।” যে শিক্ষাব্যবস্থা নিছক মুখস্থ করে শেখার প্রবণতা তৈরী করে এবং পড়ুয়াদের মধ্যে অনুসন্ধানের মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরী করেনা, সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘৃণা করতেন পেরিয়ার। এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা যুব সম্প্রদায়ের মনের মধ্যে পারস্পরিক ভালো ব্যবহার এবং নৈতিকতা বোধের জন্ম দিতে পারে না।

পেরিয়ার কে ছিলেন? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন – “একটা আকারে বড় দেশ যদি একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো দেশের উপর নিপীড়ন চালায়, তাহলে সেই ছোটো দেশটার পাশে দাঁড়াবো। সেই ছোটো দেশটায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম যদি সংখ্যালঘুদের ধর্মের উপর নিপীড়ন চালায় তাহলে আমি সেই সংখ্যালঘু ধর্মের পাশে দাঁড়াবো। যদি সেই সংখ্যালঘু ধর্মে জাতপাতের বিভেদ থাকে এবং একটা জাতি যদি আরেকটা জাতির উপর নিপীড়ন চালায় তাহলে আমি নিপীড়িত জাতিটার পাশে দাঁড়াবো। সেই নিপীড়িত জতির কোনো একজন মালিক যদি তাঁর কোনো কর্মীকে নিপীড়ন করেন তাহলে আমি সেই নিপীড়িত কর্মীর পাশে দাঁড়াবো। সেই নিপীড়িত কর্মী যদি বাড়ি ফিরে তাঁর স্ত্রী-কে নিপীড়ন করেন তাহলে আমি সেই নিপীড়িত মহিলার পাশে দাঁড়াবো। সামগ্রিকভাবে নিপীড়ন হলো আমার শত্রু।” 

তাই, একটা আদ্যন্ত নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে এহেন একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব, তাঁর আদর্শ ইত্যাদিকে ভুলিয়ে দিয়ে চাইবে সেকথা বলাই বাহুল্য।

তাই আসুন, রাষ্ট্রের সেই চক্রান্তকে ব্যহত করে দেওয়া যাক, অন্ততপক্ষে প্রতি বছর ১৭-ই সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁকে স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে, এছাড়াও বছরের অন্য যেকোনো সময়ে সুযোগ পেলেই, বা সুযোগ না পেলে সুযোগ তৈরি করে নিয়ে পেরিয়ার রামাস্বামী ও তাঁর কাজকর্মকে নিয়ে আরও বেশী করে চর্চার মাধ্যমে।

বার্ডেন অব প্রুফ -আমিনুল ইসলাম ইমন
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:576 | likes:0 | share: 0 | comments:0

Burden of Proof নামের একটা বিশেষ কনসেপ্ট আছে যেটার সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে অশিক্ষিত মানুষ তো নয়ই খুব কম শিক্ষিত মানুষ পরিচিত। অথচ এই কনসেপ্ট ক্লিয়ার না থাকলে মানুষ কখনো যৌক্তিক বা বিজ্ঞানমনষ্ক হবে না।

এই কনেসেপ্ট এর মূল কথা হল,

 

“যে ব্যাক্তি কোন বিষয়ে কোন পজিটিভ ক্লেইম করবে তার স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করার দায় শুধুই তার”

 যেমন, কেউ যদি দাবি করে তার বাসায় একটা হরিণ আছে, এটা অন্যকে বিশ্বাস করাতে চাইলে তাকেই প্রমাণ করে দিতে হবে যে হরিণটা আসলেই তার বাসায় আছে। অনেক ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব। তার মধ্যে কোন না ভাবে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ তাকে করতেই হবে। না হলে তার কথাটা বিশ্বাস না করার দায় অন্যকে দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজ, সে মানুষ জনকে বাসায় নিয়ে হরিণটা দেখাইলেই হবে। আবার অন্যান্ন বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্বশরীরে  না নিয়ে গিয়েও প্রমাণ  করতে পারে।

সমস্যা আরেকটু জটিল হবে যখন কেউ দাবি করবে যে তার বাসায় একটা হরিণ আছে যেটা শুধু রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে বাসায় হাজির হয়। সে নিজে দেখে কিন্তু অন্য কাউকে দেখাতে গেলে পালিয়ে যায়, কোনভাবেই সে হরিণটাকে প্রমাণ করতে পারছে না। কিন্তু সে সত্যি সত্যিই প্রতিদিন তাকে দেখে। তখন তার কথা অন্যদের বিশ্বাস করা উচিত, নাকি উচিত না?  হয়ত লোকটা বাকি সব বিষয়ে সত্যবাদী, সুতরাং এই একটা বিষয়ে মিথ্যা বলেব কেন? আবার এমন ও হতে পারে এইই লোকটা সত্যবাদী হলেও সে এইএকটা বিষয়ে কোন কারণে মিথ্যা বলছে। তাই ভেবে  তাকে মিথ্যাবাদী ভেবে নেওয়াই বা কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে তো আর এমন কোন প্রমাণ তো নেই যে,  মধ্য রাতে তার বাসায় হরিণটা সত্যিই আসে না। আসতেও তো পারে। বিশেষ করে তার বাসা বন জঙ্গলের কাছে হলে তো হরিণ আসা অসম্ভব কিছু না।

তাহলে আমাদের করনীয় কী? একজন যুক্তিবাদী মানুষ এক্ষেত্রে কি করবে? একজন বিজ্ঞানী কি করবে? একজন সুশিক্ষিত মানুষ এখানে কি করবে? উত্তর হচ্ছে, তাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই করবে না। তারা তাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবে।

এ আবার কেমন কথা!  আমরা কি তাইলে এরকম হাজারো দাবীর বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবো? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। এরকম সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে থাকাটাই হচ্ছে আসল শিক্ষা।

আমরা আমাদের জগত সম্পর্কে খুব অল্প কিছু কিছুই জানি, বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর জানি না।

কেউ যদি জিজ্ঞ্যেস করে, আসলে কি এলিয়েন আছে, ভূত আছে, মারমাইড আছে, সান্টা ক্লজ আছে, ড্রাকুলা আছে, আমাদের উত্তর হবে জানা নাই। কিন্তু কেউ যদি দাবি করে এর কোন একটা  আছে, তখন তাকেই চেপে ধরতে হবে, মামা এই বার তো Burden of proof তোমার ঘাড়ে এসে পড়ল। প্রমান করে দেখাও দেখি? আমরাও ব্যাপারটা বুঝে নেই। তার পাল্টা উত্তর এটা দিলে চলবে না যে, তুমি বা  তোমাদের বিজ্ঞান কি প্রমাণ করে দিয়েছে যে  ভূত নেই, মারমেইড, সান্টাক্লোজ বা ড্রাকুলা নেই? তার এ কথাই প্রমাণ করে যে সে প্রমাণ করা করার প্রসেসটাই বোঝে না। অর্থাৎ Burden of proof কনসেপ্টটা বোঝে না। সে আমাদের দেশের বেশাইরভাগ মানুষের মতই  সাধারণ একজন। অথচ এরকম অসংখ্য দাবি নিয়েই আমাদের মানব জীবনে বসবাস।

এই যেমন ঔষধ জগতে, কেউ বলে খেজুর খেলে রোগ ঠিক হয়, কেউ বলে গোমূত্র। কেউ বলে তুলসী, কেউ বলে জলপাই, কেউ বলে কুয়ার পানি, কেউ বলে নদীর জল। কেউ বলে ঝাড় ফুক, কেউ বলে তন্ত্র মন্ত্র। কেউ হোমিও কেউ এলো। কত ছাল বাকল, কত শিকড় বাকড়, কত পাতা, কত বিচি, লক্ষ কোটি গাছ পালা, পোকা মাকড়,  কে জানে কার মধ্যে কী উপকার বা অপকার আছে, তাই না? এই সব ক্ষেত্রে উত্তর হবে, আমরা জানি না। যে দাবি করবে তাকেই চেপে ধরতে হবে, বলতে হবে ব্রাদার proof টা দেখাও না please.

আমরা যতক্ষণ এই লেখাটি পড়ছি ঠিক তখন বিশেষ ধরনের কিছু মানুষ (লাখ লাখ তো হবেই) ঠিক এই মুহুর্তে  নিবিষ্ট মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে এসবের মধ্যে আসলেই কোনটা কতটা উপকারী বা কোনটা ক্ষতিকর। কেউ খুঁজে পেলেই মহা উতসাহে অন্যদের জানাচ্ছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ প্রাপ্তিই  অন্যরা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে কোন না কোন ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছে। তারা সবাই মিলে পরেরদিন থেকে আরও সতর্ক হয়ে খুঁজছে। মোটামুটি ভাল কিছু পাওয়া মাত্র সেটা নানা পেপার বা জার্নালে লিখে ফেলে কোটি মানুষের সামনে সেটার বিচারের ভার তুলে দিচ্ছে। তাদের প্রতিদিন এর প্রাপ্তির যোগফলকেই  আমরা বিজ্ঞান বলি, এঁর ওই বিশেষ  মানুষগুলোকে আমরা বিজ্ঞানী বলি।

এই বিজ্ঞানীরা আবার অন্য সাধারণ মানুষদের মত, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না।  তারা নিজেদের গোত্রের একে অন্যকে তেল মেরে বা মুখ রক্ষা করে চলে না। তাদের কোন নেতা নাই, তারা কারো ভক্ত না।  বরং তারা  সারাক্ষণ একে অপরের ভুল ধরার চেষ্টায় থাকে, ভুল ধরে, ভুল শুধরে ঐষধটার নতুন আপডেট বা রিপ্লেসমেন্ট বের করে। তাদের সম্মিলিত এই সব কর্মকান্ডে  বিজ্ঞান প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে একটু বদলে যায়, আরেকটু উন্নত হয়। ঠিক যেভাবে আমাদের হ্যাতের মোবাইল গুলো আপডেট হয়।

এই যে পজিটিভ ক্লেইম এর নিজ Burden বুঝে দ্বায়িত্বে নিজ কাঁধে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা, প্রমাণ খুঁজে বের করার চেষ্টা, অন্যদের প্রমাণে সন্দেহ করা, ভুল খেজে বেরার করার চেষ্টা এবং দিন শেষে খানিকটা আপডেট হওয়া, "জ্বী এটাই সায়েন্স"। 

এটা সত্যি কথা যে এই প্রক্রিয়া খুব স্লো। এর চেয়ে কোন একটা কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া অনেক স্বস্তির। এত চিন্তা করলে জীবন অতীষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া এই বিজ্ঞান প্রক্রিয়ায় আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের মনে মধ্যে লুকিয়ে থাকা লক্ষ কোটি প্রশ্নের মধ্যে খুব কম প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। হয়ত কিছু প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান কোনদিনই দিতে পারবে না। কিন্তু সত্য কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আমোদের বলতে হবে ‘আমাদের জানা নাই’।  

আমাদের জানা নাই বলার মধ্যে কোন মূর্খতা বা অজ্ঞতা নাই, কোন চতুরতা বা মিথ্যা নাই। কোন ভ্রান্তি বিলাস বা মানসিক প্রশান্তি নাই। তবে সততা আছে। নির্ভেজাল সততা আছে। 

আমাদের জানা নাই বলাটা আমাদের ইশকুল, মাদ্রাসা, ও  নানা বইয়ের পাতায় পাতায় লিখে লিখে পরবর্তী প্রজন্মের  মগজে ঢোকাতে হবে। তাইলে তারা আরও জানতে চাইতে, শিখতে চাইবে। মুখস্ত বাদ দিয়ে খুঁজে বের করতে চাইবে।  প্রতিটা পজিটিভ ক্লেইমকে চ্যালেঞ্জ করে Burden of proof কনসেপ্ট টা দেশের ঘরে ঘরে  ছড়িয়ে দেবে। তখন,  পীর, ফকির, তান্ত্রিক, ওঝা, কবিরাজ, হোমিও যে যাই বলুক তাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের লটারিতে না ফেলে, নিজেরা সারা জীবন দোটানায় না থেকে Burden of proof এর নিয়ম মেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

"what may be asserted without evidence, may be dismissed without evidence." Carl Sagan

স্রোতের বিরুদ্ধে চলা বিস্মৃত এক বিশ্বমানব -রাহুল রায়
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:976 | likes:0 | share: 0 | comments:0

হিন্দুরা সমুদ্র অতিক্রম করতে পারবে না। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের সৌজন্যে দীর্ঘদিন সমুদ্র ভ্রমণের ওপর সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কারন বা ইতিহাস কী সেটা তৎকালীন সমাজপতিরাই বলতে পারেন। কিন্তু এর ফলে শুধু হিন্দুরা নয়, সমগ্র মানবজাতিরই বিশাল ক্ষতি হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কথা বাদ দিলে সুদীর্ঘকাল ভারতের বিশাল অংশের মানুষ সামাজিক কারণে সমুদ্র পেরোতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসনে এদেশে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য জ্ঞানধারার বিস্তারের মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রতি সমুদ্রের অন্যদিকের সভ্যতার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। একদিকে যুগের পর যুগ থেকে চলে আসা সামাজিক শোষণ যেমন তাঁদের প্রচলিত নিয়ম নীতির প্রতি বিতৃষ্ণ ও নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল তেমনি দেশের শাসকদের চোখ ধাঁধানো উন্নতি তাঁদের মন-মস্তিষ্ককে বিশাল ভাবে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এই উন্নতির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভাবে জানতে, নিজেদের চোখে দেখতে জানতে সমুদ্র পেরোতে হতো। বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তার ক্ষমতাই বা আর কত। অন্তহীন, উচ্ছল জলরাশির সমুদ্রের দিকে তখন নব্যশিক্ষিতের দল আর সামাজিক ভ্রূকুটিকে মাথায় নিয়ে অসহায় ভাবে দেখার চেয়ে বর্হিবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হিসাবে উৎসাহ ভরা চোখে দেখতে শুরু করল। অবশেষে সামাজিক বন্ধন, দীর্ঘদিনের সব সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে একদিন একজন সমুদ্রের ওপারের অংশের দিকে এগিয়ে চলল। পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে, আত্মীয়তা করতে সে এগিয়ে চলেছিল, পেছনে পড়ে রয়েছিল একদল কুপমণ্ডুপ ও তাঁদের তৈরী চরম বিরক্তিকর কিছু নিয়ম নীতি। 

ব্রিস্টল, ব্রিটেনের একটি সুন্দর নগর। সেই নগরে গত ১৮৫ বছর ধরে প্রতিবছর একজন ভারতীয় মনীষীর স্মৃতিতে তৈরী মন্দিরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি সেখানে বাসরত প্রবাসী ভারতীয়রা করেন না। নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটি যথাযথ মর্যাদা সহকারে আয়োজন করা হয় এবং সেই শহরের মেয়র সহ গন্যমান্য ব্যক্তিরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ব্রিস্টল শহরে সেই মনীষীর নামে একটি রাস্তাও আছে। ১৯৩০ সনে এই মনীষী যখন ব্রিটেন এসে পৌঁছান তখন তাঁকে দেখতে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী ছাড়া ব্রিটেনে কোনো ভারতীয়র জন্য তা হয়নি। এমনকি ১৯৯৩ সনে আমেরিকার চিকাগো শহরে ধর্মসভার পর স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও সম্ভবতঃ সেরকম উন্মাদনা সৃষ্টি হয়নি। উল্লেখযোগ্য সেই ব্যক্তিই প্রথম ভারতীয় যিনি সমুদ্র পার করে বিদেশ গিয়েছিলেন। ১৮৩০ সনের ১৯ নভেম্বর, কলকাতা থেকে ‘ফবর্স’ জাহাজে চেপে তিনি ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। বাংলার নবজাগরণের জনক হিসাবে পরিচিত সেই মনীষী ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায়।

বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। রামমোহন রায় ব্রিটেনে কিন্তু গিয়েছিলেন বিজয়ী হয়েই। তাঁকে নিয়ে সেখানকার মানুষের উন্মাদনার শেষ ছিল না। সতীদাহ নিয়ে বিরোধীতা এদেশে নতুন নয়, তৃতীয় শিখ গুরু অমর দাস থেকে শুরু করে উনিশ শতকের গোঁড়ায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এই তালিকা কিন্তু খুব একটা ছোটো নয়। কিন্তু সতী দাহ প্রথাকে আইন করে বন্ধ করার পেছনে রামমোহনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। 


মহিলাদের এই সামাজিক কুপ্রথা থেকে মুক্ত করার জন্য ব্রিটেনের কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে রামমোহনের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কারণটা অনুধাবন করা দুষ্কর নয়।

 এই শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক কুপ্রথার থেকে এই মুক্তির সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাঙ্খিত মুক্তির মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। ১৮২০-২২ এর দিকে তখন ব্রিটেনে দেশে প্রচলিত দাসপ্রথা ও ভারতের সতীদাহ প্রথা বাতিল করার ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি সেদিন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে মারাত্মক রকম উৎসাহ দিয়েছিল। রামমোহন রায়ের ছবি ও সইয়ের তখন বিশাল কদর সর্বত্র। দোকানে দোকানে সেই ছবি ও সই লাগিয়ে রাখা হতো। তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজের অভিজাতরা দূর থাকতে পারেননি। ডিউক অফ সাসেক্স রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর একটি ছবি লাইব্রেরীতে লাগিয়ে রেখেছিলেন। পত্রিকার স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর আপোষহীন ভূমিকা দেশের বাইরেও তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে ১৮২৩ সনে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষ থেকে ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর শাসকদের এই হস্তক্ষেপ রামমোহন রায় মেনে নিতে পারেননি। তীব্র প্রতিবাদ করে ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে তিনি একটি ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। পরবর্তীতে সরকার তাঁর আবেদনে সাড়া না দিলে প্রতিবাদে তিনি তাঁর ফার্সী পত্রিকা ‘মিরাত-উল-আখবার’ বন্ধ করে দেন। সমসাময়িক যুগে ইংল্যাণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে এই ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও প্রেরণাদায়ক। ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলোতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে তাই সেই ভূমিকার কথা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। 

জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্বমানবতার তর্ক নতুন নয়। একদলের যুক্তি যেখানে আগে ঘর তো পরে পর, অন্যদলের যুক্তি সেখানে পাশের ঘরে আগুন লাগলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিজের ঘরও বেশিসময় বাঁচানো যায় না। রামমোহন রায় দ্বিতীয় দলের লোক ছিলেন।  কখনোই নিজেকে জাতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাননি। অস্ট্রিয় সেনারা পরাধীনতা বরণ করতে বাধ্য হলে ব্যথিত রামমোহন রায় সাংবাদিক বন্ধু বাকিংহামকে জানান যে ‘I am afraid I must be under the necessity of denying myself the pleasure of your society this evening; more specially as my mind depressed by the late news from Europe. I consider the cause of Neapolitans as my own and their enemies as ours. Enemies to liberty and friends of despotism have never been and never will be ultimately successful’। আবার স্পেনের স্বেচ্ছাচার থেকে দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর মুক্তি তাঁকে উৎফুল্ল করে তুলেছিল। সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে ইউরোপীয় বন্ধুদের নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডে নির্বাচনে শ্রমিক দলের জয়লাভ বা ফ্রান্সে উদারপন্থীরা ক্ষমতা দখল তাঁকে উৎসাহী করে তুলতো। বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স নিয়ে তাঁর অনুভূতি সবসময় ছিল বিশেষ। ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্স যেতে উদ্যোগীও হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা, উদারবাদের দেশ ফ্রান্সে যেতে পাসপোর্ট লাগে শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি কোনোমতেই স্বাধীনতার সেই দেশে কারোর অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবেন না। ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে চিঠি লিখলেন ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রীকে, ‘All mankind are one great family of which numerous nations and tribes existing are only various branches’। চিঠি পৌঁছায় ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের কাছে। রাজা সাদরের আমন্ত্রণ জানান আরেক রাজাকে। সেই ঘটনার সাত বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৪ সন থেকেই রামমোহন রায় সেই দেশের এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ফ্রান্সবাসীরা রামমোহন রায়কে সাদরে গ্রহণ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইউরোপের এই সুসভ্য দেশটির সঙ্গে রামমোহন রায়ের সুমধুর আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। ইউরোপে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেই সময়ে স্পেনের নতুন প্রণীত সংবিধানটি রামমোহন রায়কে উৎসর্গ করা হয়। 

   এই বছর রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের ২৫০ বছর পালন করা হচ্ছে। বলতে বাধা নেই রামমোহন রায়কে ভারতীয় নবজাগরণের জনক বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। নিজের সময়ের তুলনায়  শতাধিক বছর আধুনিক চিন্তার এই মানুষটি একটি আধুনিক ভারতীয় তথা মানব সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। অবিচার, অনাচার, অত্যাচার মুক্ত একটি সমাজ। 


ধর্মীয় অনাচার সহ্য করতে না পেরে পৃথক ধর্মের চিন্তা করলেন, জন্ম হয় ‘ব্রাহ্মসমাজের’, সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে নেমেছিলেন।


 ভবিষ্যত সমাজের উদারীকরণে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনীকরণের গুরুত্ব বুঝতে পেরে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ্চাত্য শিক্ষার আমদানীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আধুনিক যুগে অনেকের কাছেই তাঁর ব্রিটিশের সাহচর্য দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সেই জায়গা থেকে ধারণা তৈরী করার আগে সেই সময়টাকে ভাবতে হবে। এবং পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রামমোহন রায় ব্রিটিশের তৈরী নীতির প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিলেন। সেই মানুষটিও আজ আমাদের সমাজে প্রায় বিস্মৃত। কেন্দ্র বা তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবাংলা সহ কোনো রাজ্য সরকারই তাঁর জন্মের ২৫০-তম বর্ষ পালনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে করার কারণও নেই। আজকে যারা ধর্মের নামে, জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে রাজনীতি করে তাঁদের কাছে রামমোহন রায়ের মতো মনীষীদের যে গুরুত্ব থাকবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। এই মানুষটি যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই সমাজে এরকম রাজনীতি যে খুবই অচল। তারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার্থে সমাজকে রামমোহন রায়ের প্রদর্শিত পথের ঠিক বিপরীতে নিয়ে যেতে চায়। এবার মানুষ তথা সমাজকেই ঠিক করতে হবে যে তাঁরা কোন পথের পথিক হবেন।


রাহুল রায়

স্বামীজী রোড, শিলচর

ভারতের মিসিং উইমেন -অনুজ বিশ্বাস
Nov. 21, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:613 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রাচীন ভারতে নদীমাতৃক-মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার হাত ধরে সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। প্রাক বৈদিক যুগ থেকেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করলেও পরবর্তীতে পেশীশক্তির দ্বারা রচিত "বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা" মতবাদ এর হাত ধরে ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা শুরু হয়। এরপর এল মনুসংহিতা, মাতৃতন্ত্রের সর্বনাশ হয়ে গেল, মাতৃজাতি বারবনিতায় পরিণত হল। বর্তমান যুগে শিক্ষিত উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে সামান্য বেশি। আধুনিক মানুষ তথা হোমো-স্যাপিয়েন্স এর মধ্যে টিকে থাকার ক্ষমতা বা Survival Ability সাধারনত মহিলাদের বেশি, তাই মহিলাদের গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি হয়। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একাধিক বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বহু কোটি মানুষের মৃত্যু হয় যার অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পর সারা বিশ্বের সামগ্রিক জনসংখ্যা বিচার করলে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে নারী পুরুষের অনুপাত ছিল প্রায় ১ : ০.৯৪৫, অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জন মহিলা প্রতি পুরুষের সংখ্যা ৯৪৫ জন প্রায়।

এই অব্দি সবকিছু দিব্যি ঠিকঠাক ছিল। গন্ডগোল বাঁধলো গত শতকের আশির দশকে। একজন দেশদ্রোহী, দেশত্যাগী বাঙালী গবেষক লক্ষ্য করলেন এক আশ্চর্য জিনিস....ভারতের মেয়েরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বহু রাজ্যে মেয়েদের সংখ্যা শোচনীয় ভাবে কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে উপদ্রুত রাজ্য গুলি হল বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও মধ্য প্রদেশ; তথাকথিত “আর্য্যাবর্ত”। সাবিত্রী সীতার দেশ থেকে মেয়েদের হরণ করছে কোনও এক অজানা রাক্ষসের দল। আরও গবেষণায় দেখা গেল এটা শুধু ভারতের ছবি নয়, চীন -মধ্যপ্রাচ্য -উত্তর আফ্রিকা- দক্ষিণ এশিয়া সর্বত্র এক চিত্র। দেখাগেল সারা পৃথিবীতে যা থাকা উচিৎ তার চেয়ে ১০কোটি মহিলা কম, যার মধ্যে শুধু ভারতেই সংখ্যাটা প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। এরাই Missing Women..কোথায় গেলেন তাঁরা? হঠাৎ করে উবে গেল এতগুলো মানুষ? কিন্তু কিভাবে?

গবেষণায় বেরিয়ে এল এক ভয়াবহ, গা ঘিনঘিন করা জান্তব সত্য....আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা আল্ট্রাসাউন্ড। আল্ট্রা সাউন্ড করে খুঁজে বার করা হচ্ছে কন্যাভ্রূণ এবং শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে তাদের মাতৃগর্ভেই খুন করা হচ্ছে। সারাবিশ্বে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কারণটা নীচের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট –

রাষ্ট্রপুঞ্জের World Population Prospectus ২০১৯ অনুসারে বর্তমান ভারতে প্রতি ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা মাত্র ৯৪৩ জন। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতে ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল এযাবৎ কালের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৯৭২ জন। এরপর সংখ্যাটা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ১৯১১ সালে ৯৬৪; ১৯২১ সালে ৯৫৫; ১৯৩১ সালে ৯৫০ হয়ে ১৯৮১ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯২৭ জন, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ভারতে বাণিজ্যিক ভাবে আল্ট্রাসাউন্ড এর ব্যবহার শুরু হয়। তারপর থেকেই লক্ষ্যণীয় ভাবে মেয়েদের সংখ্যার কমতে থাকে। ১৯৮৫-৯০ সালের মধ্যে অবস্থা চরমে ওঠে।

দেশব্যাপী ছড়াতে থাকা এই সামাজিক ক্যান্সার দেশের একশো কোটি মানুষের চোখ এড়িয়ে গেলেও সেই দেশত্যাগী বাঙালী গবেষকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। যদিও বাঙালী গবেষক তখন দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে হার্ভার্ডের ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। সব দেখেশুনে তিনি আর থাকতে পারলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর দেশের মানুষকে ভালো করেই চেনেন। তিনি জানেন, এই পোড়া দেশে কেউ তাঁর কথা গ্রাহ্য করবেনা। তাই যেখানে বললে কাজ হতে পারে সেখানেই তিনি কলম ধরলেন। এই বাঙালী অর্থনীতিবিদ প্রথমে নিউ ইয়র্কের বুক রিভিউ তে এ’বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরবর্তীকালে British Medical Journal (Vol. 304, Issue 6827 dtd 7th March, 1992, Pp 587-588) এ একটা বিস্ফোরক গবেষণাপত্র হিসাবে বেরোয় "Missing Women: Social Inequality Outweighs Women's Survival Advantage in Asia and North Africa" নামে। 

সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে চলতে থাকা এক সুপরিকল্পিত নারকীয় গনহত্যার নৃশংস কাহিনী বে-আব্রু হয়ে পড়ে।

 দেশে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। ভারত সরকার বাধ্য হয় ব্যবস্থা নিতে। ১৯৯৪ সালে জারি হয় Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (PCPNDT) Act বা Prohibition of Sex Selection আইন। এর ফলে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং দেশের সমস্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ বন্ধ করার নোটিশ টাঙানো বাধ্যতমূলক করা হয়।

যদিও এই আইন প্রণয়নের ফলে লাভের লাভ আজও বিশেষ হয়নি তবুও যেটুকু হয়েছে তাই বা কম কি? আজ ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষের লিঙ্গ অনুপাত আগের তুলনায় অনেক ভালো। জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ অপরাধ ঘোষিত হয়েছে। কোটি কোটি মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন এই যুগন্ধর বাঙালী, যাঁর নাম অমর্ত্য সেন। জন্ম জন্মান্তরের জন্য ভারতবর্ষ তাঁর কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবে।

আমরা এই সর্বভারতীয় লজ্জার কথা জানি না, আর জানলেও তাকে কর্পোরেট আর গণতন্ত্রের কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকি। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে গেঁথে যাওয়া মনুবাদী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এই কন্যা ভ্রূণ হত্যা। এরা মৃণ্ময়ী রূপে আদ্যাশক্তির আরাধনা করে আর গর্ভের দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দেয়না। এমনকি দেশের সরকারও ভ্রূণ হত্যাকে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়ে নিজের মত ন্যারেটিভ তৈরি করে। ২০১৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শ্রীমতী মানেকা গান্ধী গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ বাধ্যতমূলক করার পক্ষে সওয়াল করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে All India Regional Editors' Conference এ তিনি বলেন ".... the women should be compulsorily told that whether it is a boy or a girl child whom she is going to give birth"... প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এমন প্রস্তাব লোভনীয় কিন্তু ভারতের জন্য কখনোই নয়। অন্তঃস্বত্তা মহিলা নাহয় জানলেন তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ ছেলে না মেয়ে, কিন্তু যদি মেয়ে হয় তখন সেই মেয়েটিকে সমাজের হায়েনা দের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা হবে সেবিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়া একটি কথাও খরচ করলেন না। তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন আমাদের আজন্ম লালিত মনুবাদী মানসিকতা। পুত্র সন্তানের লোভে আমরা মাতোয়ারা হতে গিয়ে আমাদের মনে এমন এক কদর্য আত্মশ্লাঘা তৈরী হয়েছে যে নিজের অজান্তেই আমরা সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছি। আর্য্যাবর্তের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এখানে মেয়েরা সামাজিক ব্যবসার পণ্য। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বৌদ্ধিক মানদণ্ডের কোন জায়গা নেই, অর্থই শেষ কথা বলে।

স্বাধীনতার পরে মনুবাদী চিন্তাধারা কে প্রসারিত করার দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ গুরু গোলবলকার তাঁর Bunch of Thoughts বইতে ভারতীয় নারীর আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাধারা কে নস্যাৎ করে, সংস্কারের দোহাই দিয়ে তাদের পরিষ্কার ভাবে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপন করে ব্রাহ্মণ্যবাদী দের জন্য সমাজের সর্বস্তরের নারীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন এক পবিত্র কর্তব্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন উত্তর ভারতীয় উন্নত ব্রাহ্মণের ঔরসে দক্ষিণ ভারতীয়, তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মহিলার গর্ভে যে সঙ্কর প্রজাতির সন্তান জন্ম নেবে তার মাধ্যমেই নিম্ন বর্ণের জিনগত উন্নতি সম্ভব। এর ফলে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে কন্যাভীতি তৈরি হয়। উচ্চবর্ণের লম্পটদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারার অপারগতা থেকেই সমাজের নিম্নবর্ণের মধ্যেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা করার প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যদিকে মনুসংহিতা অনুসারে উচ্চবর্ণের বিবাহে পণ দেওয়া আবশ্যিক। এখানেও কন্যাসন্তান ক্রমশ পিতার বোঝা হয়ে ওঠে। এপ্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই.কে. সভারওয়াল মন্তব্য করেন, "Investing in a daughter, They say, is like 'watering your neighbour's lawn' "... আর্য্যাবর্তের মানুষ ভাবে “পুরুষ হল উৎপাদক, মহিলা হল উপভোক্তা”। এমন মধ্যযুগীয় মানসিকতা আজও আমাদের জাতীয় লজ্জা।

আজ উঠতে বসতে অমর্ত্য সেন কে গালিগালাজ করা, তাঁকে দেশদ্রোহী, শহুরে নকশাল বলাটা আমাদের নতুন রাজনৈতিক প্রোপাগন্ডা। উনি নোবেল পেয়েছেন বটে, কিন্তু 'ভারতের জন্য কী করেছেন?' এই প্রশ্নে একজন নতুন ভোটারও নিজের ফেসবুক ওয়াল ভরিয়ে ফেলে। সেদিন অমর্ত্য সেন ওই প্রবন্ধ না লিখলে আজকের অনেক অষ্টাদশী যুবতী হয়তো পৃথিবীর আলোই দেখতে পেত না। যে মানুষের ঋণ সারা বিশ্ব জন্ম জন্মান্তরেও শোধ করতে পারবে না সেই মানুষের যোগ্যতা নিয়ে আজকের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির অশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা প্রশ্ন করে, অনেকাংশেই রাষ্ট্রীয় মদতে। এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব।।

তথ্যসূত্র:

১. অমর্ত্য সেনের মূল প্রবন্ধের ওয়েবলিঙ্ক: https://www.bmj.com/content/304/6827/587

২. MS Golwalkar, Bunch of Thoughts, Ch. Call to the Motherhood, Pp. 283-287., The Organizer, January 2, 1961, Pp. 5, 16.

৩. অন্যান্য সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

অভিজিৎ রায় ও তাঁর লেখালেখি -রতন কুমার সমাদ্দার
Nov. 21, 2024 | মুক্তমনা | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অনলাইনে অভিজিৎ রায়ের সর্বশেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, যেদিন তাকে হত্যা করা হয়েছিলো সেদিন। বিডিনিউজে প্রকাশিত লেখাটির শিরোনাম ‘কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? (Why there is something rather than nothing?)’। অতীতে বিজ্ঞানের কাছে এই প্রশ্নটির কোন উত্তর ছিলো না; এটি ছিলো ধর্ম ও দর্শনের এখতিয়ারে। ধর্মবেত্তারা এই সুযোগে তাদের নিজ নিজ ধর্মের উদ্ভট ব্যাখ্যাকেই কেবল মানুষের কাছে অখণ্ডনীয় (irrefutable) সত্যরূপে প্রচার করে ক্ষান্ত হননি, তারা এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে বিজ্ঞানকে খাটো করতে চেয়েছেন।

অভিজিৎ রায় তাঁর সর্বশেষ নিবন্ধটিতে তুলে ধরেছেন কিভাবে আধুনিক বিজ্ঞান নিত্য নতুন গবেষণার মাধ্যমে এই প্রশ্নটিকেও আজ নিজের করে নিয়েছে এবং ধর্মবেত্তাদের মুখ থামিয়ে দিয়েছে। প্রবন্ধটি অভিজিৎ রায়ের সর্বশেষ বই ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইয়ের নির্যাস হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে, এই শিরোনামটি যেন তিনি আমাদের উদ্দেশ্যেই রেখে গিয়েছেন, যেন তিনি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন, ‘দেখো, কেন আজকের প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চা একেবারেই না-থাকার বদলে কিছু হলেও আছে’।

হ্যাঁ, অভিজিৎ রায়ই সেই ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশী তরুণদের নিকট বিজ্ঞান সাহিত্যকে জনপ্রিয় করেছেন, তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে জাগিয়ে তুলেছেন। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন তথ্য ও তত্ত্বকে বাংলা ভাষায় সহজ ও সাবলীল রূপে তুলে ধরে তাকে জনপ্রিয় করার দাবীদার একমাত্র তিনিই। তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি সমকামিতার বৈজ্ঞানিক দিকগুলো তুলে ধরে বাংলা ভাষায় একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছেন যা হাজারো বাঙালির সমকাম বিষয়ে পূর্বেকার ধারণা আমূল পাল্টে দিয়েছে। তাঁর ‘ভালবাসা কারে কয়’ সম্ভবত বাংলা ভাষায় একমাত্র বই যেটি প্রেম ও যৌনতার বিবর্তনীয় মনোবৈজ্ঞানিক দিকটিকে অনেকটা গল্পের আলোকে তুলে ধরেছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত তাঁর আরেকটি বই ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো– এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিভিন্ন সময়ে আসা নারীদের বিষয়টি যেভাবে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, তা একেবারেই অভিনব।

অভিজিৎ রায় ছিলেন একজন আপাদমস্তক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অভিজিৎ রায়ের বড় পরিচয় নাস্তিক হলেও তাঁর নাস্তিকতা ছিলো আসলে বিজ্ঞানমনস্কতার ফল। হ্যাঁ, নাস্তিকতা নিয়ে তিনি প্রচুর লিখেছেন। ব্লগে লেখা তার বহু প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁর দুটি বই– রায়হান আবিরের সাথে যৌথভাবে লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এবং তাঁর একার লেখা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’– প্রায় পুরোটাই নাস্তিকতার ওপরে লেখা হলেও প্রতিটা প্রবন্ধের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বিজ্ঞান দিয়েই ধর্মকে খণ্ডন (refute) করেছেন। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে যে, অভিজিৎ রায় প্রচলিত 


ধর্মগুলোর বিরুদ্ধে যে লিখতেন তা নাস্তিকতা প্রচারের জন্য নয়, বরং ধর্মগুলো যে বিজ্ঞান চর্চার পথে অন্তরায় এবং বিশ্বাস ও কুসংস্কারের মাধ্যমে মানুষকে হত্যা ও শোষণ করে তার জন্যে।

 অভিজিৎ রায় মনে করতেন বাঙালি সমাজের অশিক্ষা-কুশিক্ষার পিছনে দায়ী প্রধানত ধর্ম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি যুক্তি-নির্ভর মুক্ত সমাজ, যা সত্যিকারার্থেই ধর্মকে এড়িয়ে গিয়ে গড়া সম্ভব নয়। আর তাই বিজ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর লেখার অন্যতম বিষয় ছিলো ধর্ম ও ধর্মীয় সমাজের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা।

এই আলোচনায় অভিজিৎ রায়ের পরিচয় তুলে ধরার তেমন কোন আবশ্যকতা রয়েছে বলে মনে করি না, বরং তার সৃষ্টি ও দর্শন বিষয়ে আলোকপাত করাই যথার্থ হবে বলে মনে করি। চিন্তায় তিনি ছিলেন যুগের চেয়ে অগ্রগামী। সেই ২০০১ সালে তিনি যখন বাংলাভাষীদের জন্য মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করার লক্ষ্যে ইয়াহু গ্রুপে মুক্তমনার যাত্রা শুরু করেন, বেশিরভাগ মানুষই তখন ইয়াহুতে যেতো মূলত বিনোদনমূলক চ্যাট করতে। ওয়েবসাইট হিসেবে মুক্তমনা যাত্রা শুরু করেছিলো ২০০২ সালে। মুক্তমনার এই দীর্ঘ পরিক্রমায় ওয়েবসাইটটি তথা ব্লগটি যে হাজারো বাঙালির চিন্তা-চেতনার জগতকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালি তরুণদের ওপর মুক্তমনার প্রভাব সম্ভবত অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি।

অভিজিৎ রায় কেবল লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রেরণাদায়ী মানুষও। অন্য অনেককেই তিনি লেখক বানিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন লিখতে। তিনি জানতেন ও মানতেন যে, শিক্ষা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা সমাজের তেমন কোন উপকারে আসে না, জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমেই কেবল মানুষের চিন্তা-চেতনাকে পরিবর্তন সম্ভব। মুক্তমনাতে আইডি নেই কিন্তু যৌক্তিক মন্তব্য করছেন, এমন কাউকে পেলেই তিনি তার নামে আইডি খুলে ইমেইল করতেন। কেবল মুক্তমনাতেই নয়, ফেসবুকের লেখা পড়েও তিনি অনেককে মুক্তমনায় লেখায় উৎসাহিত করতেন। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, লেখক খোঁজায় তাঁর উদ্দেশ্য কেবল মুক্তমনাতে লেখানোতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি জানতেন যে, কেউ মুক্তমনায় লিখতে চাইলে তাকে পড়তে হবে, জানতে হবে, লেখক হবার সাথে সাথে তাকে হতে হবে পাঠকও। লেখক ও পাঠক দুটো তৈরিতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

অভিজিৎ রায়ের মতো বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী লোক বাংলা ব্লগে খুব কমই ছিলেন বা আছেন। বিরুদ্ধমতের প্রতি তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের উদার। আমরা দেখতে পাই, ব্লগারদের অনেকেই সমালোচনা সইতে পারেন না, বিরুদ্ধমতে রেগে যান। কিন্তু অভিজিৎ রায় এদিক দিয়ে ছিলেন খুব বেশিরকম সহনশীল। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুক্তিসহকারে তর্ক করতেন; ব্লগের কোন পোস্টে তাকে রেগে যেতে দেখেছি, এমনটা মনে পড়ে না। আমি অবাক হতাম তিনি তাঁর দৈনন্দিন রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে এতোটা সময় কী করে বের করতেন। বাংলা ব্লগে তাঁর চেয়ে বেশি রেফারেন্সসহ লেখা কারো আছে বলে মনে হয় না; তাঁর মতো এতো বিচিত্র বিষয় নিয়েও কেউ সম্ভবত লেখেননি। তার মানে তাঁকে প্রচুর পড়তে হতো। আবার মুক্তমনাতে প্রকাশিত যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টও তিনি পড়তেন এবং মন্তব্য করতেন। সবার ওপর নিজের পোস্ট ও বই লেখা তো ছিলোই; লিখতেন পত্রিকাতেও। যোগাযোগ রাখতেন দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সাথে। একজন মানুষ সংসারে বাস করে কিভাবে এতোটা সময় বের করতেন ভাবতে আশ্চর্যই হতে হয়। আমার তো মনে হয়, বন্যা আহমেদের মতো একজন স্ত্রী পেয়েছিলেন বলেই তিনি আজকের অভিজিৎ রায় হয়ে উঠেছিলেন, নইলে সংসারের যাঁতাকলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।

অভিজিৎ রায় ছিলেন বাংলাদেশের ব্লগারদের দুর্দিনের কাণ্ডারি। ২০১৩ সালে যখন চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হলো, অভিজিৎ রায় বুঝতে পারলেন যে কেবল আভ্যন্তরীণ লবিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে বাংলাদেশের ওপর। তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে লিখতে শুরু করলেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। সব ব্লগাররাই মুক্ত হয়েছিলেন এবং আজ মুক্তভাবে জীবনযাপন করছেন। 

২০১৫ তথা পরবর্তীতে বাংলাদেশী নাস্তিক ব্লগাররা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অভিজিৎ রায় বেঁচে থাকলে তিনি যে ব্লগারদের এমন দুর্দিনে কাণ্ডারি হিসেবে অবতীর্ণ হতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অভিজিৎ রায়ের লেখায় আরেকটি বিষয় যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো তা হলো তাঁর কাব্যিক রসবোধ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি অনেকসময়ই কবিতাকে টেনে আনতেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, ওমর খৈয়াম থেকে শুরু করে বহু বিদেশী কবির উদ্ধৃতি পাওয়া যায় তার বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলোতে। ফেসবুকে অভিজিৎ রায় আমার কোন পোস্টে প্রথম মন্তব্যও করেছিলেন সম্ভবত একরকম একটি লেখার সূত্র ধরে। আমি বিজ্ঞান বক্তা আসিফের লেখা বই ‘কার্ল সাগান– এক মহাজাগতিক পথিক’ নিয়ে লিখতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ বা রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। অভিজিৎ রায় সেখানে লিখেছিলেন যে, তিনিও আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইয়ে ঐ বিষয়ে একই তুলনা দিয়েছেন। তাঁর দুটি বই– আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী ও ভালবাসা কারে কয়– রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতা থেকে নেয়া। নিরস বিজ্ঞানকে যিনি এমন কাব্যরসময়তায় টেনে আনতে পারেন, তিনি তো মানুষের কাছে জনপ্রিয় হবেনই।

অভিজিৎ রায়ের কাব্য রসবোধ নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর লেখা ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো– একজন রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটির কথা বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের একজন প্রেমিকা কেন একজন বিজ্ঞান লেখককে টানবে? কেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে তিনি পুরো একটা বই লিখতে গেলেন? আর্জেন্টিনা ভ্রমণে গিয়ে অভিজিৎ রায় দেখলেন যে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে আমরা যেভাবে চিনি, সেটা আসলে ওকাম্পোর খুবই খণ্ডিত একটি রূপ। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর্জেন্টিনা তথা ল্যাটিন আমেরিকার একজন প্রভাবশালী নারীবাদী লেখক যার সাথে ঐ সময়কার ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের সাথেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিলো। এটাও তাঁকে নিয়ে বই লেখার কোন যৌক্তিক কারণ ছিলো না। আরও খুঁজতে গিয়ে অভিজিৎ রায় পেলেন যে, ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের জীবনে কেবল একজন নারীই ছিলেন না, তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে ও জীবনে বেশ কিছু নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে পরিচয়ের পূর্বে নারী বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো সেকেলে। ঠাকুর পরিবারে কন্যাদের শিশুবিবাহ প্রচলিত ছিলো এবং রবীন্দ্রনাথ এতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাঁর তিন কন্যাকেই অল্প বয়সে পাত্রস্থ করেছিলেন। এছাড়া নারীবাদকে তিনি বহুবার আক্রমণ করেছেন বিভিন্ন প্রবন্ধে ও গল্পে (প্রগতিসংহার)। এমনকি নারীবাদ বিষয়ক সাহিত্যকেও আক্রমণ করেছেন- এক্ষেত্রে নরওয়েজিয়ান লেখক হেনরিক ইবসেনের লেখা নাটক ‘একটি পুতুলের ঘর’-এর সমালোচনা উল্লেখ্য। কিন্তু ওকাম্পোর সাথে পরিচয়ের পরে রবীন্দ্রনাথের সেই সেকেলে ধারণা অনেকটাই পাল্টে যায়।

নারী বিষয়ক চিন্তার পরিবর্তন ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবনে আরও অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তাঁর গৃহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতার আঁকাআঁকি দেখে ওকাম্পোই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে বুঝান যে, তাঁর মধ্যে এক চিত্রশিল্পী সত্তা আছে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছরে কয়েক হাজার ছবি আঁকেন। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করে দেন ওকাম্পো, যা বিশ্ববাসীর কাছে রবীন্দ্রনাথের এক নতুন পরিচয় তুলে ধরে। এরপর একে একে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয় লন্ডনসহ ইউরোপের বহু শহরে।

ওকাম্পোর সাথে রোমান্টিক সম্পর্কটি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নিয়ে আসে এক নতুন রোমান্টিকতা যা সংকলিত হয় পূরবী কাব্যগ্রন্থে। পূরবী কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন বিজয়াকে। এই বিজয়া আর কেউ না, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিজয়া নামেই ডাকতেন।

রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসে লাবণ্য চরিত্রের দৃঢ়তা আসলে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চারিত্রিক দৃঢ়তাই। উপন্যাসটির শেষের দিকে যে কবিতাটি রয়েছে, তার দুটি লাইন ‘তোমায় যা দিয়েছিনু তা তোমারই দান— গ্রহণ করেছো যতো ঋণী তত করেছো আমায়।’ আসলে রবীন্দ্রনাথকে লেখা ওকাম্পোর চিঠির লাইনের প্রায় হুবহু অনুবাদ। অভিজিৎ রায় এই বইটিতে এসব তুলে ধরেছেন প্রমাণসহ। আর রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী নিয়ে তিনি যে বিবর্তনীয় মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সে বিষয়ে প্রথমেই বলেছি।

এবারে অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলছি। তাঁর সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিলো। ২০১২ সালের বইমেলায়। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি যেহেতু ফেসবুক বা ব্লগে কোন ছবি দেননি, তিনি দেখতে কেমন হবেন সেটা ছিলো একেবারেই অনুমাননির্ভর। প্রথম দেখায় একটু অবাকই হয়েছিলাম, কারণ সে অনুমানের সাথে কিছুই মেলেনি। দেখলাম আমার মতো তাঁরও বেশ খানিকটা বাঙালি-ভুড়ি আছে। আমি মুক্তমনার ব্লগার ছিলাম না; তবুও তিনি আমাকে দেখেই কাছে টেনে নিলেন। চটপটি খেতে খেতে নিজের ভুরি নিয়ে রসিকতাও করলেন। বিশ্বাস ও বিজ্ঞান বইটিতে অটোগ্রাফ দিলেন এবং প্রথম দেখার নিদর্শন হিসেবে আমাকে ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি উপহার দিলেন।

অভিজিৎ রায়ের হত্যা বাঙালিদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা যতোই বলি যে, একজন অভিজিতের মৃত্যুতে হাজারো অভিজিতের সৃষ্টি হবে, এটা কেবলই কথার কথা; পরবর্তী একশ বছরেও অভিজিৎ রায়ের মতো কেউ আসবেন, এমনটা আমি মনে করি না। হয়তো কেউ অভিজিৎ রায়ের লেখার চেয়ে উন্নত মান নিয়ে আসতে পারেন, কিংবা আরও বেশি কর্মঠ কেউ আসতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাকে কেউ ছুঁতে পারবেন এমনটা ভাবা আমার পক্ষে কঠিন। ২০১৫ সালের এই দিনটির কথা মনে পড়ে। সেদিন তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে শুভ্র আর আমি ফোনে খুব কাঁদছিলাম। শুভ্র কী জন্য কেঁদেছিলো জানি না, তবে আমার সেই কান্না কোন ব্যক্তি অভিজিৎ রায়ের জন্য ছিলো না, আমার কান্না ছিলো অভিজিৎ রায়ের অনুপস্থিতিতে আমরা কতো বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হলাম, বা অভিজিৎ রায় যদি আরও ২০টি বছরও বাঁচতেন তাহলে আমাদেরকে তথা পৃথিবীর মানুষকে আরও কত কী দেয়ার ছিলো, তা ভেবে। হয়তো ভাবছেন, আমার কান্নাতে স্বার্থপরতা ছিলো। জানি না, হয় তো তাই-ই হবে। 

(লেখাটি সিলেট টুডে ২৪-তে প্রকাশিত)

রেনেসাঁসের অন্যতম প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:890 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের কাজ ছেড়ে দিলেন সম্পাদক রসময় দত্তের সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্য। রসময় দত্ত আড়ালে বলতে লাগলেন, বিদ্যাসাগর যে চাকুরিটা ছেড়ে দিলে, খাবে কি? 

এই কথা বিদ্যাসাগরের কানে পৌঁছুলে তিনি বললেন, রসময়বাবুকে বলো তিনি আলু পটল বেচে খাবেন। জীবিকার জন্য যেকোন স্বাধীন বৃত্তি তিনি নিতে পারতেন। স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল তাঁর আত্মমর্যাদা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড। সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করা বিদ্যাসাগরের আলু পটল বেচতেও কোনো অসুবিধা হতো না। 

তখন তাঁর বাসায় আশ্রিতের সংখ্যা অনেক। অসহায় দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের প্রায় কুড়িটি ছেলের খাওয়া পড়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে; এছাড়াও অনেক দায়িত্ব তিনি মাথায় নিয়ে চলতেন। কিন্তু স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জোনের পথ কোথায়? আলু পটলের ব্যবসা করার মতোও তাঁর নিজস্ব কোনো মূলধন ছিল না। বিদ্যাসাগরের মূলধন ছিল বিদ্যা, বিদ্যাই তাঁর স্বোপার্জিত মূলধন এবং তিনি ছিলেন বিদ্যার ব্যাপারী। কিন্তু বিত্তের সাথে বিদ্যার সাদৃশ্য কোথায়? বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে? বিত্ত দান করলে কমে, কিন্তু বিদ্যা দান করলে বাড়ে। স্বাধীন বাণিজ্যবৃত্তির দৃষ্টান্ত তাঁর পূর্বে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও কয়েকজন শাস্ত্রজ্ঞ বাঙালি পণ্ডিতদের মধ্যেও এটা দেখা গিয়েছিল। অনেক ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা এই স্বাধীন ব্যবসার পথে দেখিয়ে গেছেন। এটা রেনেসাঁসের একটা অন্যতম লক্ষণ। বিদ্যাসাগরও নিজের বিদ্যাকে মূলধন করে তারই যুগোপযোগী বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, সেদিক থেকে তিনিই বাংলাদেশে ও ভারতে এই ব্যবসায়ের অন্যতম পথপ্রদর্শক। 

এতদিন পর্যন্ত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ছিল পাতালের অন্ধকারে শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসের মতো। মুদ্রণযন্ত্র তাকে মুক্তি দিল যেদিন এবং সেদিন জ্ঞানের আলোক চারিদিকে পরিব্যপ্ত হল এবং অজ্ঞানের অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। পুরোহিত যাজক ইমামমদের পুঁথিগত জ্ঞান হাতেলেখা পাণ্ডুলিপির কারাজীবন থেকে মুক্ত হয়ে সকল মামুষের আয়ত্তের মধ্যে এল ছাপার অক্ষরে। কুসংস্কার ও কূপম্পন্ডুকতার কারাগার থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যে স্বপ্ন বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন, তা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সাহায্যে সম্ভব নয়। মূদ্রিত বইয়ের ভূমিকা অন্য কিছুই পুরণ করতে পারেনা সেই সময়ে। মুদ্রনযন্ত্র তাই নবযুগের জ্ঞান বিদ্যার প্রমিথিউস। গুরুগৃহের জীর্ণ-সংকীর্ণ দেয়াল ভেঙে জনসমাজের মুক্তাঙ্গনে জ্ঞানবিদ্যার আলোকবর্তিকা বহন করে নিয়ে আসার প্রচন্ড শক্তি যে মূদ্রণযন্ত্র ধারণ করে, সে এযুগের প্রমিথিউস বৈ কি? নবযুগের জ্ঞান তথাকথিত কল্পিত স্বর্গের অপহৃত প্রমিথিউসের অগ্নির মতো। 

এই মুদ্রিত বই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের মুক্তির প্রতীক। সংস্কৃত কলেজ ছাড়ার আগেই তিনি সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 


মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগরের সমান অংশীদ্বারিত্বে এই প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। এই দুই বন্ধু ছিলেন একই বৃন্তে দুটি ফুলের মত। শিক্ষা প্রসার ও সামাজিক কুসংস্কার নিবারণের জন্য ওনারা দুই বন্ধু লেখা শুরু করেছিলেন।

 এনাদের বন্ধু বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধার করে দুজনে এই পুরানো প্রেস ক্রয় করেন। বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ইংরেজ সিভিলিয়ন ছাত্রদের বাংলা শিক্ষার জন্য অন্নদামঙ্গল কাব্য কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে এনে ছাপিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ৬০০ টাকা পেয়েছিলেন। সেই অর্থে নীলমাধব বাবুর ধার পরিশোধ হয়। এই অন্নদামঙ্গল কাব্যই প্রথম বই যা ওনাদের প্রেস থেকে বেরোয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য আরো অনেক বই ছাপান। এর পর যে সমস্ত পুঁথি মুদ্রিত ছিলনা সেগুলি ছাপাতে শুরু করেন। সংস্কৃত কলেজে ও অন্যান্য লোকেদের কাছে সেগুলি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেন। বিদ্যার দুর্ভেদ্য গর্ভগৃহ থেকে পুথিবন্দি সাহিত্য দর্শন ইত্যাদির জ্ঞানভাণ্ডার মুদ্রিত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। 

বাণিজ্যক্ষেত্রে সে যুগে মুদ্রক প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। মুদ্রিত বইয়ের জন্য প্রকাশকদের তখনও পৃথক দোকান খুলে বিক্রির প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিন্তু এদেশে ছাপা বইয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছিল পাঠকমহলে। তখন কলকাতার চীনা বাজারই ছিল সব থেকে বড় বইয়ের ব্যবসার কেন্দ্র। অন্যেরা ক্যানভাসারদের দিয়ে বই বিক্রি করতেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর কলেজষ্ট্রীটে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি নাম দিয়ে প্রথম বইয়ের দোকান করলেন এবং নিজের লেখা ও ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রকাশিত বই ছাড়াও অন্য লেখকদের বইও বিক্রি করতে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগরই সম্ভবত এই অঞ্চলের প্রথম গ্রন্থ ব্যবসায়ী এবং যা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মুদ্রণের টেকনিক্যাল ব্যাপারেও উনি কতটা আগ্রহী ছিলেন তা ওনার অক্ষর বিন্যাস দেখেই বোঝা যায়। এরপর গিরিশচন্দ্র নিজের নামে একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। 

বাংলাদেশের জমিদার ও পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ মুদ্রণের প্রসার কামনা করতেন না। পণ্ডিত পুরোহিতদের কুক্ষিগত শাস্ত্রবিদ্যা গ্রন্থাকারে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হুলে তাদের বংশগত শাস্ত্রবিদ্যার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয়। 

মুদ্রণের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝেই বিদ্যাসাগর অন্য কোনো স্বাধীন বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হননি। কারণ আর্থিক আত্মনির্ভরতাই তাঁর একমাত্র কাম্য ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল, জীবনের স্বাধীন বৃত্তিকে জীবনের ব্রতের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ করে তোলা। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার যার জীবনের ব্রত, স্বাধীন মুদ্রক প্রকাশক ও গ্রন্থাকারের বৃত্তিই তার শ্রেষ্ট উপযোগী বৃত্তি। বাংলা তথা ভারতে জ্ঞানকে কারাগারের অন্ধকার মুক্ত করে আলোতে নিয়ে আসার প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কে? 

বিদ্যাসাগরের জন্ম মাসে ওঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

স্যাটানিক ভার্সেস -পৃথিবী
Nov. 21, 2024 | মুক্তমনা | views:5899 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অনেকের মত আমি সালমান রুশদিকে শুধুই একজন “ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রী” হিসেবে চিনতাম। ইসলাম ধ্বংস করার জন্য যেই কথিত লৌকিক-পারলৌকিক শক্তিগুলা অহোরাত্রি খাটা-খাটুনি করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে সালমান রুশদির নামটা অবধারিতভাবেই ঢুকে যায়। অন্তত মসজিদের ইমাম আর আশেপাশের মুরুব্বিদের মত “গণ্যমান্য” হিশেবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্বদের বয়ান থেকে তাই শিখেছিলাম। যেই বইটা পুড়িয়ে ও যাকে কেন্দ্র করে ফতোয়াবাজি করে ইসলামিস্টরা গোটা বিশ্বের সামনে তাদের কদাকার চেহারা তুলে ধরেছিল, স্বভাবতঃই সেই বইটার প্রতি আমার কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। সাহিত্যের আনাড়ি পাঠক হওয়ার কারণে সব কনটেক্সট-সাবটেক্সট গলাধঃকরণ করতে পেরেছি বলে মনে হয় না, তবে অন্তত এটুকু বুঝেছি যে ইসলামিস্টরা বইটির সম্পূর্ণ ভুল চিত্র তুলে ধরেছে, বইটি নিয়ে ভীষণ নোংরা রাজনীতি হয়েছে। বইটি নিয়ে রুশদির “In Good Faith” প্রবন্ধটি অনুবাদ করার ইচ্ছা ছিল, তবে আমার অনুবাদপ্রচেষ্টায় লেখকের কন্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে শেষমেষ নিজের মত করেই প্রবন্ধটা লিখে ফেললাম।

The Satanic Verses বইটা আসলে কী, এই প্রশ্ন একেকজনের কাছে করলে একেকরকম উত্তর পাবেন। কেউ বলে ভ্রান্ত ইতিহাস, কেউ বলে ধর্মবিরোধী পুস্তিকা, কেউ মনে করে একটি পুঁজিবাদী-ইহুদি চক্রান্ত, কারও কারও কাছে এই বইটা হলোকস্টের চেয়ে কোন অংশে কম জেনোসাইডাল নয়। রুশদির কাছে এটি কেবলই একটি উপন্যাস, একজন লেখকের কল্পনার সৃষ্টি। উপন্যাসকে অবশ্য হেলাফেলা করার কিছু নেই। পাঠের যোগ্য উপন্যাস মাত্রই ভাষা, রুপ ও ভাবনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে, ইংরেজি novel শব্দটি যেন জগতকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার উপরই গুরুত্ব আরোপ করে। রুশদি তাঁর সমগ্র লেখক জীবনে সাহিত্যের একটি ভাষা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, সাহিত্যের এমন একটি রুপ যার মাধ্যমে প্রাক্তন উপনিবেশের বাসিন্দারা পূর্নরুপে আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হবে। স্যাটানিক ভার্সেস যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে সেটি হল একজন পরিযায়কের জগতদর্শন, রুশদির ভাষায় a migrant’s-eye view of the world। মূলোৎপাটন, বিচ্ছেদ, রুপান্তর- অভিপ্রয়াণের এই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই রুশদি উপন্যাসটি লিখেছিলেন। সবাই হয়ত সশরীরে পাসপোর্ট হাতে বর্ডার পার হয় না, তবে ব্যক্তি জীবনে কোন না কোন বর্ডার কমবেশি সবাইকেই অতিক্রম করতে হয়। যৌবন অতিক্রমে করে মধ্যবয়সে পৌছুনোর বেদনাদায়ক যাত্রায় সবাইকেই অংশ নিতে হয়। অভিপ্রয়াণ একটা খুবই লোভনীয় উপমা, যেকোন প্রসঙ্গে যেকোন ব্যক্তির উপর একে প্রয়োগ করা যায়।

উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলো ব্রিটিশ মুসলমান, তবে ধার্মিক মুসলমান না। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে সঙ্করীকরণের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তারা পুরাতন ও নুতনের দ্বন্দ্বে ধরাশায়ী হয়। উপন্যাসটির কট্টর সমালোচকরা মনে করেন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে মেলামেশা নিজের সংস্কৃতি ধ্বংসেরই নামান্তর। অন্যদিকে স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করতা, তথাকথিত আপজাত্য, সংমিশ্রণ, এবং এসব কিছু থেকে উদ্ভূত নতুন সংস্কৃতি, রাজনীতি, চেতনা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতকে উদযাপন করে। বইটা সঙ্করীকরণকে উপভোগ করে, পরমকে ভয় করে। এখান থেকে কিছু আর ওখান থেকে কিছু নিয়েই তো দুনিয়াতে নতুন কিছু একটা আসে। রুশদি গণঅভিপ্রয়াণের মাধ্যমে উত্থাপিত এই সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করেন। স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, বইটি সব সঙ্করদের প্রতি নিবেদিত একটি প্রেমগীতি। সব প্রশ্নের উত্তর জানার দাবিদার পরমের শিষ্যরা সঙ্কর জনসাধারণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, অস্বীকার করতে চেয়েছে এই সহজ সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষ ইতিহাসের জারজ সন্তান। সাদা, কালো, বাদামি একজন আরেকজনের ভেতর প্রবিষ্ট হচ্ছে, যেভাবে নানা পদের মশলা মিশে সৃজন হয় নতুন কোন অমৃত। রুশদি মনে করেন- খাঁটি আর ভেজালের এই প্রাচীন বিরোধ অব্যাহত থাকুক। মানুষ সবসময় নিজেকে এভাবেই বুঝেছে- কোন মানুষ, মূর্তি বা ভাবমূর্তির সামনে প্রণত হয়ে নয়।

রুশদি চেষ্টা করেছিলেন একটি প্রতিবাদী কর্ম সৃষ্টি করতে, যা পাঠকের পূর্বনির্মিত জগতচিত্রকে সংস্কার করবে। এই বইয়ে এমন কিছু নেই যার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। মোল্লারা যেই বই নিয়ে বিলাপ করেছিল, ওই বইয়ের অস্তিত্ব নাই। এই বইটা নিয়ে যে ক্যাচাল হয়েছে, সেই ক্যাচালকে রুশদি প্রাচ্য আর পশ্চিমের স্বাধীনতার সংঘাত বলে মনে করেন না(যেমনটা অনেকে পরবর্তীতে দাবি করেছেন), কারন তার পরিযায়ী অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন যে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই স্বাধীনতার প্রতি সমানভাবে আসক্ত। নিজেকে স্বাধীন ধরে নিয়েই তিনি স্যাটানিক ভার্সেস লিখতে বসেছিলেন।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটা আসলে কী? এটা যাই হোক, আঘাত করার স্বাধীনতা না থাকলে এর কোন অস্তিত্বই নাই। সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় নৈষ্ঠিকতাকে ব্যঙ্গ করতে না পারলে আর্ট টিকবে না, আর্ট না টিকলে নিজেদেরকে “মানুষ” মনে করার একটা যুক্তি গায়েব হয়ে যাবে। স্যাটানিক ভার্সেসের একাংশ একজন ধর্মহীন ব্যক্তির সাথে ধর্মবিশ্বাসের মোলাকাতকে তুলে ধরে। বইটি সর্বাঙ্গে বিশ্বাসের প্রতি বৈরী নয়। এই বইয়েরই একটি ভারতীয় চরিত্র প্রশ্ন করছে, “আমরা যদি প্রথমেই কোন বিশ্বাসকে ভুল ধরে লেখালেখি করি, তবে কি আমরা উন্নাসিকতার দোষে দুষ্ট নই? আমরা কি সাধারণের উপর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দিচ্ছি না?”। তবে উপন্যাসটিতে কিছু সংশয়ও আছে, উপন্যাসটি কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে যা ধার্মিকদের পছন্দ হবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা খোদ ইসলামী সাহিত্যেই প্রাচীন আমল থেকে প্রচলিত আছে, স্যাটানিক ভার্সেস এদিক দিয়ে অভিনব না।

উপন্যাসটা কিসের প্রতিবাদ করছে? ধর্মবিশ্বাসের অধিকার তো নয়ই। এই গল্প সব ধরণের নৈষ্ঠিকতা ও পরম দাবির বিরোধী। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দরকার নাই, বিমান উড়িয়ে দেওয়া শিখ সন্ত্রাসেরও দরকার নাই, হাস্যকর খৃষ্টীয় সৃষ্টিবাদের দরকার নাই, ইসলামের সংকীর্ণ সংজ্ঞারও কোন দরকার নাই। এই প্রতিবাদ আর যাই হোক, খিস্তিখেউড় না। মুসলমানদের এসবে সমস্যা নেই, তাদের সমস্যা হল “রুশদি নবী মোহাম্মদকে সমকামী কইছে”, “রুশদি বলছে যে নবীজি আল্লাহর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাইছে”, “রুশদি নবীজির স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলছে”, “রুশদি কোরানকে শয়তানের কর্ম বলছে” প্রভৃতি দাবি। এই দাবিগুলার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হল যে এই দাবিগুলো বারবার পুনরাবৃত্তির কারণে সত্যের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বইটা না পড়েই বই আর বইয়ের লেখককে গালাগালি করেছে এবং করছে।

স্যাটানিক ভার্সেস দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার গল্প। একটি সত্ত্বা হল সালাদিন চামচা, তার ক্ষেত্রে বিভাজনটা সেকুলার ও সামাজিক; সালাদিন বোম্বে ও লন্ডন, প্রাচ্য ও পশ্চিমের টানাপোড়েনের শিকার। অন্যদিকে জিব্রিল ফারিশতার ক্ষেত্রে বিভাজনটি আধ্যাত্মিক; বিশ্বাস হারিয়েও জিব্রিল বিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু বিশ্বাস তাকে দেখা দেয় না। এই দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার দ্বান্দ্বিকতা ও একাগ্রতা অর্জনের অভিযাত্রাই এই উপন্যাসের আধেয়।

কেন “জিব্রিল ফারিশতা”? “আসল” জিব্রিল ফেরেস্তাকে হেয় করার জন্যই কি এই নাম বেছে নেওয়া হয়েছে?

নাহ। উপন্যাসের জিব্রিল একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। আর দশটা কুশীলব ও ফেরেস্তার মতই উপন্যাসের জিব্রিল আমপাবলিকের মাথার উপরে বসবাস করে, সে অর্ধেক দেবতা আর অর্ধেক মানুষ, সে জীবনের চেয়েও বড়। এই চরিত্রকে একজন ফেরেস্তার নাম দেওয়ার মানে হল তাকে ফেরেস্তাদের আধা-ঐশ্বরিকতার সেকুলার প্রতিমূর্তি প্রদান করা। তবে জিব্রিল যখন বিশ্বাস হারায়, এই নাম তখন তাকে তাড়া করে বেড়ায়।

এই গল্পে চামচা টিকে থাকে। সে প্রেম ও মরণের মত শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়, সে পরিশেষে তার শেকড়ে ফিরে এসে একাগ্রতা অর্জন করে। জিব্রিল টিকতে পারে না। সে ইশ্বরের প্রতি ভালবাসা ফিরে পায় না, ইশ্বরপ্রেমকে সে ঐহিক প্রেম দিয়েও প্রতিস্থাপন করতে পারে না, জিব্রিল নির্ধারিত সময়ের আগেই তার জীবনের উপসংহার লিখে ফেলতে বাধ্য হয়।

জিব্রিলের যাতনাগুলো তার কাছে স্বপ্নের রূপে আবির্ভুত হয়। এই স্বপ্নগুলোতে সে নিজেকে সত্যকারের জিব্রিল ফেরেস্তার রুপে আবিস্কার করে, বিভিন্ন ধর্মীয় ন্যারেটিভের সে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্মী হয় এবং সেগুলোতে সে অনিচ্ছায় অংশগ্রহনও করে। এই স্বপ্নগুলো অবশ্য পুরোপুরি সংশয়ী মনোভাবের না। একটা স্বপ্নে সে নিজেকে মির্জা সাইদ আকবর নামক এক জমিদারের দেহে আবিস্কার করে। এই জমিদারের গ্রামে হঠাত একদিন একটি রহসময়ী বালিকা আবির্ভূত হয়, সে গ্রামবাসীকে তার সাথে পদব্রজে মক্কায় যাত্রা করার আহবান জানায়, তাদের জন্য আরব সাগর পথ ছেড়ে দাঁড়াবে। পুরো গ্রামবাসী মেয়েটির পেছনে যাত্রা শুরু করে, তাদের সাথে যোগ দেয় জমিদারের ধর্মপরায়ণ, প্রিয়তমা স্ত্রী। জমিদার এই কাফেলার পিছু নেন। তিনি এসব অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না, নিজের চোখেই তিনি দেখেন তাঁর স্ত্রীসহ গোটা গ্রাম আরব সাগরে ডুবে যাচ্ছে। তবে বহুকাল পরে তিনি বিশ্বাস ফিরে পান। মরণের আগ মুহুর্তে ইশ্বর তাঁকে দেখান যে সেদিন আরব সাগর ঠিকই দু’ভাগ হয়েছিল, তার স্ত্রী ঠিকই সেদিন ইশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল, সংশয়ের পর্দা ভেদ করে মির্জা সাইদ আকবর এই অলৌকিক পরিণতি অবলোকন করতে পারেননি। জিব্রিলের সবগুলো স্বপ্নই বিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরে।

জিব্রিলের যে স্বপ্নগুলো নিয়ে গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সেই স্বপ্নগুলো জিব্রিলের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল। স্বপ্নগুলোতে জিব্রিল “জাহিলিয়া” নামক এক মায়াবী বালুকা নগরীতে “সাবমিশন” নামক এক ধর্মের উত্থান পর্যবেক্ষণ করে। স্যাটানিক ভার্সেস বইটা নিয়ে যাবতীয় কুৎসা ও আপত্তি এই স্বপ্নগুলোর অধ্যায় থেকেই নেওয়া হয়েছে।

এই স্বপ্নগুলো স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য ভয়াবহরকম বেদনাদায়ক ছিল। প্রতিটি রাতে এই স্বপ্নগুলো তাকে তার বিশ্বাসহীনতার জন্য শাস্তি দিত, বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার মাঝে তার উপরে সংশয়ের গুরুবোঝা চাপিয়ে দিত। ঘুমের মধ্যে জিব্রিল প্রাণপণে চেষ্টা করত স্বপ্নগুলো হতে মুক্ত হওয়ার জন্য, কিন্তু স্বপ্নগুলো এক সময় সজাগ দুনিয়াতেও জিব্রিলকে গ্রাস করল, জিব্রিল বদ্ধোন্মাদ হয়ে গেল। মক্কা শরিফকে ভেংচি কাটার জন্য এই স্বপ্নের শহরকে “জাহিলিয়া” নাম দেওয়া হয়নি, বরং জিব্রিলকে ওই শহরে জোরপূর্বক পাঠিয়ে তার মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্যই এই নাম ব্যবহার করা। স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মানবজীবনের উপর ইশ্বরহীনতার বিপর্যয়কর প্রভাবকে তুলে ধরা, ইসলামকে “ভুল” প্রমাণ করা নয়।

এই দৃষ্টিতে “আপত্তিকর” অধ্যায়গুলো দেখলে বাকি জিনিসগুলো নিজ থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। বইটির শিরোনাম “স্যাটানিক ভার্সেস” ইসলামের ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায়কে ইঙ্গিত করে। বলা হয়ে থাকে যে মোহাম্মদ মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতাদের সাথে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিলেন যে মোহাম্মদ কুরাইশদের তিনটি নারী দেবতাকে স্বীকৃতি দিয়ে কোরানের আয়াত নাযিল করালে কুরাইশরা মোহাম্মদের আল্লাহর উপাসনা করবে এবং মুসলমানদের সাথে মক্কায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। কিন্তু কুরাইশরা তাদের কথা রাখেনি, তাই মোহাম্মদ পরে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দাবি করে ওই আয়াতগুলোকে কোরান থেকে বাতিল করে দেন, এর জন্য এর নাম “স্যাটানিক ভার্সেস”। জিব্রিলের সবচেয়ে পীড়াদায়ক স্বপ্নগুলার জন্য রুশদি এই ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন কারন বিশ্বাস ও সংশয়ের দ্বন্দ্বের চরম পরিণতি লেখকের পক্ষে এই ঘটনাটার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। জিব্রিলের স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোতে পাঠক মোহাম্মদের চরিত্রে “মাহুন্ড”(Mahound) নামক এক চরিত্রকে দেখতে পান, উল্লেখ্য যে সেই সময়কার খৃষ্টানরা অবমাননার উদ্দেশ্যে মোহাম্মদকে এই নামে অভিহিত করত। মাহুন্ডের কর্মকান্ডের প্রতি সংশয় প্রকাশ করে “সালমান দ্যা পারসিয়ান” নামক এক চরিত্র, যার দায়িত্ব ছিল মাহুন্ডের উপর নাযিলকৃত আয়াতগুলো নথিভুক্ত করা। এই চরিত্রটি সাহাবী সালমান-আল ফারিসিকে হেয় করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বরং উপন্যাসে রুশদির সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। রুশদি স্বীকার করছেন যে এই সালমানের মুখ দিয়ে বের হওয়া কথাগুলো অনেক পাঠকের কাছেই কর্কশ মনে হবে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যেই জিব্রিলের স্বপ্নে এই দুর্মুখ ব্যক্তি আবির্ভূত হয়েছে, সেই জিব্রিল নিজেও একজন দুর্মুখ ব্যক্তি, মনযোগী পাঠক মাত্রই তা খেয়াল করবেন। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে জিব্রিল তার উন্মাদনার শেষ পর্যায়ে এই স্বপ্নগুলো দেখছে যখন তার জীবনের নিশ্চয়তাগুলো সব একে একে ভেঙে পড়েছে। এই স্বপ্নগুলো তার বাতুলতাকে পরিপূর্ণ করেছে।

তবে রুশদি স্বীকার করেন যে মক্কাবাসীর ওই তিন নারী দেবতাকে মাহুন্ড দ্বারা প্রত্যাখিত হওয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি ইসলামের মনোভাবকেও তিনি খোঁটা দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো কোরানে এখনও আছে,

‘Have ye seen Lat and ‘Uzza,

And another, the third (goddess), Manat?

What! for you the male sex, and for Him, the female?

Behold, such would be indeed a division most unfair!” [Qur’an 53:19-22]

সূরা আন-নাজম শুরু থেকে পড়লে প্রেক্ষাপটটা বুঝতে সুবিধা হবে।

আবার জিব্রিলের স্বপ্নের মধ্যেই সালমান দ্যা পারসিয়ান “সাবমিশন” ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন যে এই ধর্মটা মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি অংশের উপর নিজের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে,

“At the oasis of Yathrib the followers of the new faith of Submission found themselves landless, and therefore poor. For many years they financed themselves by acts of brigandage, attacking the rich camel-trains on their way to and from Jahilia. Mahound had no time for scruples, Salman told Baal, no qualms about ends and means. The faithful lived by lawlessness, but in those years Mahound – or should one say the Archangel Gibreel? – should one say Al-Lah? – became obsessed by law. Amid the palm-trees of the oasis Gibreel appeared to the Prophet and found himself spouting rules, rules, rules, until the faithful could scarcely bear the prospect of any more revelation, Salman said, rules about every damn thing, if a man farts let him turn his face to the wind, a rule about which hand to use for the purpose of cleaning one’s behind. It was as if no aspect of human existence was to be left unregulated, free. The revelation – the recitation – told the faithful how much to eat, how deeply they should sleep, and which sexual positions had received divine sanction, so that they learned that sodomy and the missionary position were approved of by the archangel, whereas the forbidden postures included all those in which the female was on top. Gibreel further listed the permitted and forbidden subjects of conversation, and earmarked the parts of the body which could not be scratched no matter how unbearably they might itch. He vetoed the consumption of prawns, those bizarre other-worldly creatures which no member of the faithful had ever seen, and required animals to be killed slowly, by bleeding, so that by experiencing their deaths to the full they might arrive at an understanding of the meaning of their lives, for it is only at the moment of death that living creatures understand that life has been real, and not a sort of dream. And Gibreel the archangel specified the manner in which a man should be buried, and how his property should be divided, so that Salman the Persian got to wondering what manner of God this was that sounded so much like a businessman. This was when he had the idea that destroyed his faith, because he recalled that of course Mahound himself had been a businessman, and a damned successful one at that, a person to whom organization and rules came naturally, so how excessively convenient it was that he should have come up with such a very businesslike archangel, who handed down the management decisions of this highly corporate, if non-corporeal, God”

সালমান এখানে কেবল জিব্রিলকে অত্যাচার করছে না, একই সাথে পাঠককেও খোঁচা দিচ্ছে। এটা একটা ভ্যালিড সমালোচনা, বিদ্বেষ না। কারও কাছে যদি মনে হয় উপরে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তবে তিনি “বিদ্বেষ” না ছড়িয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করার একটা ছহিহ তরিকা বাতলে দিলে সংসারের সকল দুষ্টু লেখকদের সুবিধা হত। যারা এরুপ সমালোচনার জন্য রুশদিকে হত্যা করার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, তাদের প্রতি রুশদির প্রশ্ন- ধর্মের বিধান কেন সমালোচনার উর্ধ্বে থাকবে? সমালোচনাই যদি করতে না পারবে, তবে লেখক আর বুদ্ধিজীবিদের কাজটা কী?

তাছাড়া এমন তো না যে মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে বিতর্ক হয় না। মুসলিম ধর্মপতিরা তাদের সুড়সুড়ি বন্ধ করার জন্য নারীদের উপর বোরকা-হিজাব চাপিয়ে দিতে চাইলে অনেক মুসলিম নারী তার প্রতিবাদ করছে, ইসলাম নারীদের সন্তান পালনের উপর গুরত্ব আরোপ করলেও মুসলিম বিশ্বের নারীরা এখন স্বেচ্ছায় কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে। মুসলিম সমাজ যেহেতু প্রতিদিনই নিজেদের বিধি-বিধান নিয়ে প্রশ্ন করছে, তাহলে ওই একই কাজ করার জন্য একজন ঔপন্যাসিকের কল্লা দাবি করতে হবে কেন?

যাই হোক, টেক্সটে ফেরা যাক। আরেকটা প্রচলিত অভিযোগ হল রুশদি নবীর সাহাবীদেরকে গালাগাল করেছেন। স্বপ্নের যেই দৃশ্যে নবীর সঙ্গীদের “scum” এবং “bums” বলা হচ্ছে, সেগুলো কাফিরদের মুখ নিঃসৃত, লেখকের নয়। জালিমের জুলুমকে বিশদে বর্ণনা না করে কি নিপীড়নকে ফুটিয়ে তোলা যায়? সংশয়ীদের প্রশ্নকে উত্থাপিত না করে কিভাবে আপনি আপনার উপন্যাসে সংশয়কে তুলে ধরবেন?

নবীর স্ত্রীদের নিয়ে করা অভিযোগটাও বিশেষভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জিব্রিলের স্বপ্নের শেষের দিকের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে যে জাহিলিয়াতে সাবমিশন ধর্ম পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাহিলিয়াবাসীর জীবনের প্রায় প্রত্যেকটি অংশ ধর্মপুলিশের পর্যবেক্ষণে চলে আসে(এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এক প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি হয়), একে একে প্রত্যেকটি ধর্মবিরোধী উপাদানকে নির্মূল করা হয়। রয়ে যায় শুধু একটি পতিতালয়। এমনিতেই উন্মুক্ত যৌনতায় অভ্যস্ত জাহিলিয়াবাসীর উপর জেন্ডার সেগ্রেগেশন চাপিয়ে দেওয়ায় তাদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ ছিল, তার উপর জাহিলিয়ার পুরুষদের দীর্ঘ দিনের প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করলে তাদের অবদমিত অস্থিরতা বিষ্ফোরিত হতে পারে, এই ভয়ে এই পতিতালয়কে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য জাহিলিয়াতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পতিতালয়ের পতিতারা পুরুষদের উত্তেজিত করার জন্য মাহুন্ডের স্ত্রীদের নাম নেয়, এবং এটাকে ভিত্তি করেই সমালোচকরা ছড়িয়ে দেয় যে রুশদি মোহাম্মদের স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলেছেন। অথচ উপন্যাসে পরিস্কার করেই বলা আছে যে মাহুন্ডের প্রকৃত স্ত্রীরা ঠিকই তাঁর হারেমে “শুদ্ধ” জীবনযাপন করছে, পতিতালয়ের পতিতারা তাঁদের নাম নিয়েছে শুধুই আগত পুরুষদের ফ্যান্টাসিকে তোষণ করার জন্য। এই প্রোভোকেটিভ চিত্রের মাধ্যমে দু’টো বিষয় তুলে ধরা হয়েছে- ১) শাসকদের বিলাসী জীবন নিয়ে শোষিতদের ফ্যান্টাসি ২) পবিত্র আর অপবিত্রতার দ্বন্দ্ব। হারেম আর পতিতালয়- এই দু’টো জায়গাতেই নারীদেরকে ব্যক্তিগত পুঁজি বা সম্পত্তির মত আলাদা করে রাখা হয়, পার্থক্যটা হল যে হারেমে মালিক থাকে স্থায়ীভাবে একজন আর পতিতালয়ে টাকার বিনিময়ে সাময়ীকভাবে প্রভুত্ব কিনে নেওয়া যায়। এই পতিতালয়ে বা’ল নামক এক কবি আশ্রয় নিয়েছিল, কুরাইশদের আমলে মাহুন্ডকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লেখার জন্য মাহুন্ড তার উপর ক্ষেপে ছিলেন। একদিকে পতিতালয়ের মত অপবিত্র জায়গায় নবীর পবিত্র হারেমকে সিমুলেট করা, আরেকদিকে এই একই পতিতালয়ে নবীর সমালোচনাকারী এক অপবিত্র কবিকে আশ্রয় দেওয়া- পবিত্র আর অপবিত্রতার মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরাই এখানে রুশদির উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত্য পবিত্রতা অপবিত্রতাকে ধ্বংস করে, মাহুন্ড সবার সামনে পতিতা আর কবির মুন্ডু কর্তন করেন।

‘In the old days you mocked the Recitation,’ Mahound said in the hush. ‘Then, too, these people enjoyed your mockery. Now you return to dishonour my house, and it seems that once again you succeed in bringing the worst out of the people.’

Baal said, ‘I’ve finished. Do what you want.’

So he was sentenced to be beheaded, within the hour, and as soldiers manhandled him out of the tent towards the killing ground, he shouted over his shoulder: ‘Whores and writers, Mahound. We are the people you can’t forgive.’

Mahound replied, ‘Writers and whores. I see no difference here.’

পবিত্রতা আর অপবিত্রতার দ্বান্দ্বিকতা সালাদিন চামচা ও জিব্রিল ফারিশতার গল্পেও দেখা যায়। স্যাটানিক ভার্সেস ক্যাচাল নিয়ে লেখা From Fatwa to Jihad বইয়ে লেখক কিনান মালিক বলছেন,

Angels and devils. Myths and monsters. These are at the heart of The Satanic Verses. The struggle of Saladin Chamcha and Gibreel Farishta, with themselves and with each other, is a struggle of the human imagination against the constraints placed upon it. One is a devil, the other an angel, yet they continually betray their own natures. When Saladin is arrested, Gibreel, the angel, refuses to help him. When the two meet up again in riot-torn east London, Gibreel appears as Azraeel, the most terrible of angels, wreaking fire and destruction. But even as he is hunted down by Gibreel, the demonic Saladin risks his life to save a family trapped in a burning house.

What Rushdie wants us to see is that the distinction between devil and angel lies less in their inner selves than in the roles that humans ascribe to them. If religion creates the divine and the Satanic in the image of man, secular society equally makes men in the image of devils and angels. Both religious faiths and secular societies deploy their angels and demons to justify their otherwise unjustifiable actions, to create boundaries that cannot be transgressed.

পতিতালয়ের দৃশ্যটা মোটেই নবীর স্ত্রীদের হেয় করার জন্য নির্মাণ করা হয়নি, বরং নৈতিকতা ও যৌনতা সম্পর্কিত কিছু ভাবনাকে নাটকীয় রুপ দেওয়া হয়েছে। পতিতালয়টির নাম “হিজাব”- একটা আয়রনি, কারন এই অপবিত্র গৃহে পবিত্রতাকে সিমুলেট করা হয়। এখানে অবশ্য আমি আরেকটা আয়রনি দেখতে পাই যেটা রুশদি নিজের অজান্তেই তুলে ধরেছেন। মেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে ঘুম হারাম করা, মেয়েদের “পবিত্রতা” নিশ্চিত করার গুরুভার বহন করা লোকগুলা নিঃসংকোচেই স্বীকার করে যে তাদের উপর তাদের মস্তিস্কের চেয়ে শিশ্নের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে শিশ্নই তাদের ঘিলু। জাকির নায়েক যখন দাবি করেন যে মেয়েরা “সংযত” জামা না পড়লে তারা “পাবলিক প্রপার্টি” হয়ে যাবে, তখন তিনি পবিত্রতার ঝান্ডাধারিদের অবচেতন ফেটিশগুলাকে নাঙ্গা করে দেন, তথাকথিত পবিত্রতার ধারণাটার মাঝে অপবিত্রতার প্রতিবিম্ব উদ্ভাসিত করেন- যেই ভাবটা এই গল্পে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এরপরও আপনি আশ্বস্ত না হলে ফেসবুকের ওড়না পেজগুলো ঘুরে আসতে পারেন। যাই হোক, রুশদির উদ্দেশ্য ছিল যৌন সম্পর্কের মধ্যে পরিপৃক্ত ক্ষমতার লড়াইটাকে তুলে ধরা; এই পতিতালয়ে ক্ষমতাহীন পুরুষরা যেন রানীকে অধিকার করার পুলক লাভ করে।


এই পর্যন্ত্য পড়ার পর পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা জাগে- এরকম উত্তেজক ইমেজারি ব্যবহার করার কী দরকার? “মাহুন্ড” নামটা যে মুসলমানদের খেপিয়ে দিবে এটা তো জানা কথা। আসলে এখানে টেক্সটকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসের ভেতরেই সরাসরি এই প্রেক্ষাপটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বই না পড়েই চিল্লাচিল্লি করার কারণে প্রতিবাদকারীরা যেটা বুঝতে পারেনি,

To turn insults into strengths, whigs, tories, Blacks all chose to wear with pride the names they were given in scorn; likewise, our mountain-climbing, prophet-motivated solitary is to be the medieval babyfrightener, the Devil’s synonym: Mahound

উপন্যাসটির একটি কেন্দ্রিয় থিম হল বর্ণবাদী ইংল্যান্ডে অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা। এই উপাখ্যানের একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হল শত্রুর মুখ থেকে তার ভাষা কেড়ে নেওয়া, অপবাদকে শক্তিতে রুপান্তর করা। “মাহুন্ড” নামটা ব্যবহার করার পেছনে এটা একটা কারন- যারা একসময় মাহুন্ডকে পাগল বলে অপবাদ দিত এবং মাহুন্ডের ব্যর্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল, তারাই একসময় মাহুন্ডের পদতলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করার উপমাটিকে রুশদি অনেক দূর নিয়ে গিয়েছেন। লন্ডনে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই সালাদিন চামচা আবিস্কার করে যে তার শিং গজিয়েছে, তার শরীর ক্রমশঃ জানোয়ারের মত হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাক্রমে সে অভিবাসন পুলিশের হাতে মার খেয়ে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। পাশের বিছানাগুলোতে সে অনেকগুলো জানোয়ার দেখতে পায়, অকল্পনীয় সব দৈত্য-দানব। এরা কারা? এরা দাবি করছে যে এরা সব অভিবাসী, এলিয়েন। তদের আশ্রিত দেশ তাদেরকে যে রুপ দিয়েছে, তারা সেই রুপটাই ধারণ করে আছে।

They have the power of description, and we succumb to the pictures they construct.

অভিবাসীদেরকে শয়তান আখ্যা দিলেই তারা শয়তান হয়ে যায় না, আর শয়তান যদি আসলেই শয়তান না হয় তবে ফেরেস্তারাও নিশ্চয়ই আসলে ফেরেস্তা নন? এখান থেকেই রুশদি নৈতিকতার এক্সপ্লোরেশন শুরু করেন যেখানে নৈতিকতা পরম কিছু নয়, সদা পরিবর্তনশীল।

উপন্যাসের শিরোনামটাই পুনরুদ্ধারের দাবি চিৎকার করে জানান দিচ্ছে। “তোমরা আমাদের শয়তান মনে কর তো? ঠিক আছে, তোমাদের দুনিয়া সম্পর্কে শয়তানের ভাষ্যটা একটু শুনো”- একারণেই এই বইটি “স্যাটানিক ভার্সেস” বা “শয়তানের ভাষ্য”। যাদেরকে তাদের otherness এর কারণে তাদের আশ্রিত সমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে, এই বইটা তাদেরই ভাষ্য। এই উপন্যাসের এশীয় শিশুরা সগর্বে শয়তানের শিং পরিধান করে ছুটোছুটি করে। তাদের উপর আরোপিত লেবেলটাকে তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে নিয়েছে। এই উপন্যাসে কোরানকে শয়তানের রচনা বলা হয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে “ব্ল্যাক” শব্দটা যে প্রক্রিয়ায় বর্ণবাদী অপবাদ হতে সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রকাশমাধ্যমে রুপান্তরিত হয়েছিল, এই বইটা সেই প্রক্রিয়ারই স্বাক্ষী।

বইটির মূল বক্তব্যকে এত জঘন্যভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে রুশদি আক্ষেপ করে বলছেন যে তাঁর এই সাহিত্যকর্মটি হয়ত চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেল। মৌলবাদী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাই যেন বইটির অর্থোদ্ধার করার ইজারা নিয়েছেন। সঙ্করীকরণ যেহেতু এই উপন্যাসটির নির্মাণের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা, তাই বলাই বাহুল্য যে ইসলাম ছাড়াও আরও অনেক উৎস থেকে উপাদান নেওয়া হয়েছে। প্রাক-খৃষ্টিয় যুগে ইশ্বর আর শয়তানকে একই সত্ত্বা বিশ্বাস করা হত,

It isn’t until the Book of Chronicles, merely fourth century BC, that the word Satan is used to mean a being, and not only an attribute of God.

বইটির পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে যে দু’টো বই কাজ করেছে তার কোনটার সাথেই ইসলামের সম্পর্ক নেই- উইলিয়াম ব্লেইকের Marriage of Heaven and Hell এবং মিখাইল বুলগাকভের The Master and Margarita। বুলগাকভকে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে নিপীড়িত হতে হয়েছিল, তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া সালমান রুশদিকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। অনুপ্রেরণা হিসেবে আরও কাজ করেছে মহানগরীর প্রতি তাঁর অনুরাগ। একসময় বোম্বে এবং পরে লন্ডনে বসবাসের অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসে একটু হলেও ঢুকে পড়েছে,

The modern city is the locus classicus of incompatible realities. As long as they pass in the night, it’s not so bad. But if they meet! It’s uranium and plutonium, each makes the other decompose, boom.

আধুনিক যুগের একজন শহুরে পুরুষ হিসেবে রুশদির কাছে অনিশ্চয়তাই একমাত্র ধ্রুবক। তরুণ বয়সেই ইশ্বরকে হারালেও তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক চাহিদা আছে, এই চাহিদাগুলো তিনি কোন আদি কারণের শরণাপন্ন না হয়েই তুষ্ট করতে আগ্রহী। সারা জীবন নির্ধার্মিক থাকার পরও যখন তাকে “মুরতাদ” ঘোষণা করা হয় তখন তিনি বিচলিত হন, যেই ভাষার সাথে তাঁর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই সেই ভাষায় তিনি বর্ণিত হতে চান না। তাঁকে যখন মুরতাদ আখ্যা দেওয়া হয়, তখন তাঁর জন্য যেন একটি মিথ্যা পরিচয় সৃষ্টি করা হয়; বস্তুকে পেছনে ঠেলে যেন ছায়াকে সামনে টেনে আনা হল। মিথ্যা পরিচয় তৈরীর প্রতিযোগীতায় তাঁর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর উপর ক্ষেপে থাকা ব্রিটিশ মিডিয়াও কম যায় না, অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁকে ইগোম্যানিয়াক, লোভী, ভন্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা এও প্রচার করেছে যে সালমান রুশদি তাঁর ওরিয়েন্টাল নামের জন্য লজ্জিত, তিনি Simon Rushton হিসেবে পরিচিত হতে ইচ্ছুক। আর যেহেতু সালমান রুশদি একজন “উন্মাদ”, তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলে সেটি তার মিথ্যা প্রতিবিম্বকেই বৈধতা দিবে। তাঁর এই মিথ্যা প্রতিবিম্ব তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম সহিংসতাকে সহায়তা করেছে। মুসলমান বিশ্বে অনেক পত্রিকাতে তাঁকে পশ্চিমপ্রেমী, মেরুদন্ডহীন, লোভী ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে যে টাকার বস্তার বিপরীতে ইসলাম ধ্বংস করতে বসেছে। হর্হে লুইস বর্হেস, গ্রাহাম গ্রিনের মত লেখকরা লিখেছিলেন যে তাঁদেরই নাম নিয়ে তাঁদের একটি “other” পৃথিবীতে হেটে বেড়াচ্ছে। রুশদি আশংকা করেন যে তাঁর other হয়ত তাঁকেই নির্মূল করে দিবে।


১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী আয়াতোল্লাহ খোমেনি রুশদির কল্লা চেয়ে ফতোয়া দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মাথায় সাংসদ Keith Vaz রুশদিকে ফোন করে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর তিনি রুশদির মৃত্যু দাবি করা লোক সমাগমের সামনে বক্তৃতা প্রদান করে স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। তার এক বছর আগে গার্ডিয়ানের কলামিস্ট হুগো ইয়াং ব্রিটিশ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে এক অমর বাণী ছেড়েছিলেন, “If not Dagenham, why not Tehran?”, মানে হল “এই দেশ ভাল না লাগলে ফুটো”। ওই একই লোক এক বছর পর মৌলবাদীদের সাথে গলা মিলিয়ে রুশদিকে দোষারোপ করেছিলেন। লর্ড Dacre ঘোষণা করেছিলেন যে রুশদিকে কেউ চিপায় নিয়ে পেটালে তাঁর কিচ্ছু যায় আসবে না। রানা কাব্বানি স্তালিনবাদী ঢংয়ে লিখেছিলেন যে সব লেখককে সমাজের কাছে “জবাবদিহি” করতে হবে। লেখক ব্রায়ান ক্লার্ক Who Killed Salman Rushdie? নামক একটি নাটক লিখে রুশদিকে পড়ার জন্য পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, রুশদির ভাগ্য ভাল সেই নাটক আলোর মুখ দেখেনি। টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রুশদির বেঁচে থাকা উচিত কিনা, এমনকি এটা ন্যাশনাল ওপিনিওন পোল পর্যন্ত্য গড়িয়েছিল। খৃষ্টান পাদ্রীরাও ইসলামী মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিল, এক John le Carre দাবি করেছিলেন যে রুশদি সবকিছু “জেনে শুনেই” এই কাজ করেছেন। রুশদি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করেন- Osip Mandelstam স্তালিনকে নিয়ে কবিতা লেখার সময় কি জানতেন না যে তাঁকে এর জন্য খুন করা হবে? তাহলে কি তাঁকে খুন করা জায়েজ হয়ে গেল? শিক্ষার্থীরা তো সব জেনে শুনেই তিয়েনআমেন স্কোয়ারে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, তাদের খুন করা কি তাহলে হালাল হয়ে গেল?

রুশদি মনে করেন- বই তার লেখককে নির্বাচন করে, বই সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি সচেতন হয় না। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে বিশ্বাসের ক্ষমতা ও গ্রন্থ নাযিলের প্রকৃতি নিয়ে ধ্যান করতে চেয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অতি অবশ্যই একটি জেনুইন অভিজ্ঞতা। একজন পয়গম্বর যদি সত্যই কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং পারলৌকিক জগত বলে যদি কিছু না থেকে থাকে, তবে আসলে ঘটছেটা কী? একজন অবিশ্বাসীর জন্য এটা একটা জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা মাথায় রেখেই তিনি মাহুন্ডের গল্পটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি জানতেন স্যাটানিক ভার্সেসের ঘটনাটা বিতর্কিত, যে মোহাম্মদ নিজেকে একজন সাধারন বার্তা-বাহক দাবি করা সত্ত্বেও তাঁর জীবনচরিতের প্রতি মুসলমানদের সংবেদনশীলতা একটু বেশিই, কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি যে পাঠক জিব্রিলের স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর কাঠামো থেকে লেখকের বক্তব্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হবেন। অবশ্য পাঠোদ্ধার করার জন্য তো আগে পাঠ করতে হবে, অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা লোকজনের পাঠ করার ধৈর্য কই!

জাহিলিয়া একই সাথে মক্কা হয়, এবং মক্কা নয়। জাহিলিয়া নির্মাণের জন্য রুশদি কিছু ঐতিহাসিক দলিলের সাহায্য নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একই সাথে এই শহরে একটি ভারতীয় নগরীর ছায়াও রয়েছে। জিব্রিল যখন লন্ডনে যায়, জাহিলিয়া তখন লন্ডনেরও কিছু অংশ শুষে নেয়। ফিকশন ফ্যাক্ট থেকে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু ফিকশন মাত্রই ফ্যাক্ট নয়।

রুশদি আসলে কী কী জানতেন? তিনি জানতেন যে মোহাম্মদ একজন রক্ত মাংসের মানুষ, আর দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মত তাঁরও নারীপ্রীতি ছিল, মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি আরও জানতেন যে ইসলাম কোন মতেই সমসত্ত্ব নয়। ইসলামে যেমন কবি ইকবাল, খৈয়াম, ইমাম গাজ্জালির দার্শনিকতা আছে(গাজ্জালিকে অবশ্য ইকবাল, খৈয়ামদের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না, আমার তাঁকে কট্টর বৈ কিছু মনে হয়নি), তেমনই ব্র্যাডফোর্ড মসজিদ কাউন্সিলের শাব্বির আখতার কিংবা ইরানপন্থী মুসলিম ইন্সটিটিউটের পরিচালক কলিম সিদ্দিকির সঙ্কীর্ণতাও আছে। জমিদার মির্জা সাইদ আকবর ও গ্রামবাসীর আরব সাগরে ডুব দেওয়ার মুল ঘটনাটাও তিনি জানতেন। এই বিশেষ গল্পটা লেখার সময় রুশদি চেষ্টা করেছিলেন ওই মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্বাসের ক্ষমতাকে অনুভব করতে, কেন কিছু মানুষ স্রেফ বিশ্বাসের জন্য নিঃচিন্তে আত্মহুতি দিতে পারে। রুশদি যদি তাঁর ভবিষ্যত দেখতে পেতেন, তবে কি তিনি উপন্যাসটির কাহিনী বদলে ফেলতেন?

না। Friedrich Durrenmatt তাঁর The Physicists গ্রন্থে লিখেছিলেন, What has once been thought cannot be unthought


স্যাটানিক ভার্সেসের ক্যাচালটাকে একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখতে হবে, শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখলে হবে না। ভারতে মৌলবাদী সাংসদ সৈয়দ শাহাবুদ্দিন এই ক্যাচালকে পুঁজি করে রাজিব গান্ধীর পতনোন্মুখ সরকারকে এক হাত দেখে নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ভোটারদের ক্ষমতা প্রদর্শন করা। কংগ্রেস সবসময়ই মুসলিম ভোটের উপর নির্ভরশীল ছিল। বইটি নিষিদ্ধ করার পরও কংগ্রেসের সেই যাত্রা রক্ষা হয়নি, শাহাবুদ্দিনদের একারণে বিশ্বাস করতে নেই। এই ক্যাচাল দক্ষিণ আফ্রিকার এপার্থিড বিরোধী ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুসলিম ও অমুসলিম সদস্যদের মাঝে বিভেদ গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানে নির্বাচনে মাইর খাওয়ার পর স্যাটানিক ভার্সেসকে আঁকড়ে ধরে ইসলামিস্টরা খেলায় ফিরে আসার পায়তারা করেছিল। বইটা পাকিস্তানে প্রকাশিত হবার আগেই নিষিদ্ধ করার পরও পাকিস্তানের জামায়াত ইসলাম আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্র ভাঙচুর করেছিল, রুশদির সাথে আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্রের সম্পর্ক কী সেটা তারাই বলতে পারবে। ওই মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়েছিল, হুদা কামে কম পক্ষে পাঁচজন মানুষ মারা গিয়েছিল। ইরানে খোমেনির ফতোয়া সদ্য সমাপ্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের লাখ লাখ ইরানী লাশের থেকে মনযোগ সড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। ব্রিটেনে অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্বের অধিকারের জন্য সেকুলার সংগঠনের সাথে ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিযোগীতায় ইন্ডিয়ান ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশনের মত সেকুলার সংগঠন এগিয়ে ছিল, কিন্তু এই ক্যাচাল মসজিদগুলোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। মসজিদগুলো একারণেই আন্দোলনের ইতি টানতে চায়নি, যদিও অনেক সাধারণ মুসলমানের কাছে প্রতিবাদের ধরণটা বিব্রতকর হয়ে পড়েছিল।

স্যাটানিক ভার্সেসের সাহিত্য মান নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, অনেক রিভিউতে দেখলাম বোদ্ধা পাঠকদের কাছেও বইটা দুর্বোধ্য লেগেছে। বক্তব্যের দিক দিয়ে বইটি দলিত অভিবাসী কমিউনিটির পক্ষে একটি শক্ত দলিল হতে পারত, কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্যাজুয়ালটি হয়ে বইটি ওই একই কমিউনিটির কাছে এখন স্রেফ একটি চপেটাঘাত ছাড়া কিছু না। মোল্লাদের মুঠোবন্দি পাঠকরা একটি সম্পূর্ণ নিরীহ ও হিতার্থী টেক্সটকে টুটি চেপে ধরে বধ করেছেন। একজন লেখকের জন্য তাঁর সৃষ্ট কর্মের এই পরিণতি বোধ করি মৃত্যু পরোয়ানার চেয়েও বড় শাস্তি।

(মুক্তমনা বাংলা ব্লগ)

দুটি কবিতা পর্ব ১৮ -কবিরা
Nov. 21, 2024 | কবিতা | views:731 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ও হে শিক্ষিত সমাজ

-সোমনাথ সেন


ও হে বঙ্গ "সমাজ" কাকে বলে?

সবই নাকি সমাজের দোষ।


আমাদের নিয়েই সমাজ গড়া, আর আমরাই নির্বোধ !

মোড়ে মোড়ে নেশার দ্রব্য কলো পট্টি পরা চোখে,

প্রকাশ্যে গিলছি আমরা একে-অপরের স্বচক্ষে;


ও হে বঙ্গ সমাজ

সব কিছুই লোক দেখানো সবার ভালো চাই,

ভেবে দেখেছো আমাদের ভবিষ্যতটা কোথায়?

দামী-দামী পোশাক গায়ে হাতে সবার বিজ্ঞান,

মেতেছে সবাই আধুনিকতায় বেড়েছে মানবিকতাহীন জ্ঞান।

"মা-বাবাকে বাসবো ভালো" শিক্ষক দেন শিক্ষা;


আমাদের ভুল-ত্রুটি সব শুধরে গেল,

কিন্তু এই শিক্ষিত সমাজে মা-বাবা ই করেন ভিক্ষা?

সমাজ সমাজ বলি আমরা আমরাই সমাজের মুখ,

এই সুশিক্ষিত সমাজে সমালোচনায় মানুষের সুখ


অন্যের সফলতা দেখে বাড়ে নিজের দ্বেষ,

এই শিক্ষিত সমাজেই বেঁচে আছি বেশ ৷৷

মানবশক্তি

-প্রদীপ চক্রবর্তী


আমার ধর্ম  মানবতা,

তোমার ও কি তাই?

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কাছে,

কিছুই মিলবে না; ভাই।


উঁচু জাত; নিচু জাত,

সাম্রাজ্যবাদের লম্বা হাত।

যুক্তিবাদের শক্ত দাঁত,

করবে যে আজ কিস্তিমাত।


ধর্ম স্থানে লাগলে আগুন,

নেভাতে আসে দমকল।

সর্বশক্তিমানের দেখা নেই,

মানবতাই সম্বল।


ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান,

এতেই আছে সব নিদান।

চাষের জমি; খনির খাদান,

মনুষ্যত্বের গাও সবে গান।

বিক্রমপুর কেন অগ্রসর? -মজিব রহমান
Nov. 21, 2024 | সচেতনতা | views:2570 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অগ্রসর এলাকা হিসেবে বিক্রমপুরের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। লর্ড কারমাইকেলের চোখে বিক্রমপুর ছিল স্কটল্যান্ডের মতো। লর্ড কার্জন বিক্রমপুরবাসীর কর্মদক্ষতা সম্পর্কে বেশ অবগত ছিলেন বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেছিলেন, এডিনবরা যেমন ইউরোপের মধ্যে তেমনি বিক্রমপুর ভারতবর্ষের মধ্যে সেরা। ইংল্যান্ডের এডিনবারর সাথে বিক্রমপুরের তুলনা হতো দক্ষ প্রশাসকসহ খ্যাতিমান মানুষদের জন্মস্থান হিসেবেই। কিন্তু কোন কোন মানুষদের কারণে এগিয়ে গিয়েছিল বিক্রমপুর? সেই অনুসন্ধান করে বিস্মিতই হয়েছি। মূলত বিক্রমপুরের মানুষেরা ছিল বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তায় অগ্রসর। আমার মনে হয়েছে ভারতের যে কোন অঞ্চলের চেয়ে বিক্রমপুরের মানুষ প্রগতিশীল। শুধু এ কারণেই বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় মৌলবাদীরা একযোগে বোমা হামলা করতে পারলেও একমাত্র মুন্সিগঞ্জে পারেনি। কলকাতা কেন্দ্রিক যে নবজাগরণ তৈরি হচ্ছিল তার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বিক্রমপুরের মানুষেরাই। যখন ব্রাহ্ম ধর্ম তৈরি হল তার নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে৷

জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী রাঢ়ীখালের স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কোন ধর্মীয় অনুরাগ ছিল না। তাঁর স্ত্রী তেলিরবাগ গ্রামের অবলা বসু ছিলেন কলকাতার অন্যতম সেরা সমাজসংস্কারকদের একজন। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণে অবলা বসু ও তাঁর ভাই বাংলার এটর্নি জেনারেল সতীশরঞ্জন দাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সতীশরঞ্জন দাশ গলার টনসিল অপারেশনের জন্য ১২ বছর বয়সে বিলেত গিয়ে সেখানেই পড়াশোনা করে ব্যারিস্টার হয়ে আরো ১২ বছর পরে দেশে ফিরেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা আইনজীবী। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হাঁসাড়া গ্রামের সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পিতা ব্যারিস্টার সুধীর রায় ছিলেন তাঁর জুনিয়র। তিনি ইংরেজদের ধাচে জীবন যাপন করতেন। তিনি বৃটিশদের ধাঁচে ভারতে দ্য দুন আবাসিক পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনো ভারতের অন্যতম সেরা স্কুল। এই দুন স্কুলে বিক্রমপুরের অবদান নিয়েই একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করা যায়। ভারতের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতিতে এই স্কুলের প্রাক্তণ ছাত্রদের বিশেষ অবদান রয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. রাজীব গান্ধীও ছিলেন দুন স্কুলের ছাত্র। এমনকি তার প্রশাসনে এই স্কুলের ছাত্রদের প্রাধান্য থাকায় একে ‘দুন মন্ত্রিপরিষদ’ও বলা হতো। ভারতের প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুজন সাহিত্যিক বিক্রম শেঠ ও অভিতাভ ঘোষ, প্রখ্যাত শিল্পী অনিশ কাপুরসহ অসংখ্য কৃতীসন্তান রয়েছেন এ স্কুলের ছাত্র। সতীশরঞ্জনের এক নাতি শমী দাশও এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁর বোন সরলা রায় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর স্বামী দার্শনিক প্রসন্নকুমার রায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় প্রিন্সিপাল ছিলেন।


এই পরিবারটির অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে কলকাতা বিনির্মাণে। সতীশরঞ্জন দাশের পিতার নাম দুর্গামোহন দাস।  তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। যদিও তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। দুর্গামোহন স্ত্রীর মৃত্যুর পরে বিখ্যাত সঙ্গীতস্রষ্টা অতুলপ্রসাদ সেনের বিধবা মা হেমন্তশী সেনকে বিবাহ করেন। তখন ভারতে হিন্দু বিধবাদের বিবাহের জন্য প্রচেষ্টা চলছিল। তিনি আরেকটি বৈপ্লবিক কাজ করেন যা কলকাতায় আলোড়ন তুলে; তা হল- নিজের অল্পবয়স্কা বিধবা সৎমার বিবাহ দেন। এসব আলোচিত ঘটনা ঘটানো সহজ ছিল না। এই পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি সতীশরঞ্জন দাসের কাকা ভুবন মোহন দাশের ছেলে। ভারতের মুসলিমদের পিছিয়ে পড়া ও সমস্যা নিয়ে তিনিই চিন্তা করেছিলেন। মুসলিমদেরও প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আবুল কালাম আজাদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘দেশবন্ধু অকালে মারা না গেলে দেশে নতুন অবস্থা সৃষ্টি করতেন’। তিনি মৃত্যুবরণ না করলে ভারত বিভক্তি রদ হতো বলেও অনেকে মনে করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকার্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।

 

পর্ব ২


চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবার শিক্ষিত প্রগতিশীল হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। তাঁর পিতা কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নী ছাড়াও ‘ব্রাহ্ম জনমত’ পত্রিকার সম্পাদক হওয়ায় কলকাতার সাংবাদিক জগতেও সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতামহও ছিলেন সরকারি আইনজীবী। তাদের পরিবারে তিনজন ছিলেন জজ ও বেশ কয়েকজন আইনজীবী ছিলেন। এই পরিবারের ব্যাপ্তী খুবই ব্যাপক। বিক্রমপুরের সেরা দুটি পরিবারের একটি দাশ পরিবার। সরলা দাশের নাতি রেণুকা রায় কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভারতের মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ভাই সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম প্রধান মার্শাল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বোন ও জাতিসংঘের প্রথম নারী সভাপতি বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিতের ভাগ্নি শারদা মুখার্জীকে বিয়ে করেন। সে হিসেবে পরিবারটি নেহেরু/গান্ধী পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ভাই প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতীয় রেল বোর্ডের চেয়ারপারসন। তিনি কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি ভায়োলেটকে বিয়ে করেছিলেন। তার ছোটবোন নীতা সেনের মেয়ে গীতি সেন খ্যাতনামা শিল্প ইতিহাসবিদ। গীতি সেন বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত বলিউড চলচ্চিত্র পরিচালক মোজাফফর আলীকে।

ভারতের প্রধান বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশও তাদের পরিবারের একজন। তাঁর পুত্র সুরঞ্জন দাশ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। ভারতের কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী সোনারং গ্রামের অশোক কুমার সেন তাঁর কন্যা অঞ্জনা দাশের স্বামী। অশোক কুমার সেনকে ছাড়া দীর্ঘকাল ভারতের আইনমন্ত্রীর পদে অন্য কাউকে ভাবাই যেতো না। অশোক সেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আসনটি ধরে রেখেছিলেন। পরে তিনি রাজ্যসভার সদস্যও হন। নেহেরু মন্ত্রী সভায় তিনি ১৯৫৭-৬৬ এবং রাজিব গান্ধীর মন্ত্রী সভায় ১৯৮৪-৮৭ আইন ও বিচার মন্ত্রী হন। এ ছাড়া তিনি যোগাযোগ, ইস্পাত ও খনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লোকসভার আসন জয়ের রেকর্ড রয়েছে এবং তিনি সাত প্রধানমন্ত্রীর সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশনেরও সভাপতি ছিলেন। তারই ভাই সুকুমার সেন ১৯২১ সালে আইসিএস কর্মকর্তা ও ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যসচিব হন। এ পদে থাকা অবস্থাতেই প্রেষণে ১৯৫০ সালে তাঁকে স্বাধীন ভারতের প্রথম ‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার’ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি অসামান্য দক্ষতার সাথে বিশাল ভারতের প্রথম দুটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৮ পর্যন্ত (চাকরিকাল) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইলেকশন কমিশনের সভাপতিরূপে সুদান ও নেপালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালন করে অভূতপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাদের আরেক ভাই অমীয় কুমার সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগী, চিকিৎসক ও শ্রুতি লেখক ছিলেন। তাদের পিতা অক্ষয় কুমার সেনও ছিলেন ভারতের আইসিএস কর্মকর্তা ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

সোনারং এর সেন পারিবারও ভারতব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। এই পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রসর পরিবার। এ পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুরুষ হলেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জে কিন্তু অমর্ত্য সেনের জন্ম শান্তিনিকেতনে মাতামহ সোনারং গ্রামের ক্ষিতিমোহন সেনের ‘পর্ণকুটীরে’। অমর্ত্য সেনের পিতা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ক্ষিতিমোহন ছিলেন তিনি চম্বা রাজ্যের শিক্ষা সচিব। রবীন্দ্রনাথের আহবানে তিনি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগদান করেন এবং বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ রূপে কর্মজীবন শেষ করেন। কিছুদিন তিনি বিশ্বভারতীর অস্থায়ী উপাচার্যের পদেও আসীন ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে বেশ কয়েকবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে ও ১৯২৪ সালে চীন ভ্রমণে সফরসঙ্গী হয়েছেন। তিনি মধ্যযুগের সন্তদের বাণী, বাউল সঙ্গীত ও সাধনতত্ত¡ নিয়ে গবেষণা ও সংগ্রহে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরের চেষ্টায় সংগৃহীত বিষয়সমূহ কয়েকটি গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তিনি বিশ্বভারতী নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের প্রধান উৎসাহদাতা ও সচিব ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রপ্রতিভার সম্যক রসজ্ঞ ও টীকাকার। তাঁর স্ত্রী কিরণবালা সেন শান্তি নিকেতন থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা শ্রেয়শী’র সম্পাদক ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র ক্ষেমেন্দ্র মোহন সেন রবীন্দ্র সংস্কৃতির প্রচারক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা অমিতা সেনের পুত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের কন্যা লেখক ও অভিনেত্রী নন্দনা সেনের স্বামী প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইনের চেয়ারম্যান ও সিইও জন ম্যাকিনসন। অমর্ত্য সেনের স্ত্রী নবনীতা দেবসেন পদ্মশ্রী প্রাপ্ত ভারতের একজন কবি, লেখক ও শিক্ষাবিদ।  উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা লেখক সত্যেন সেন ও রাষ্ট্রদূত বিনয় রঞ্জন সেনও এই পরিবারের সন্তান। বিনয় রঞ্জন সেন ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এশিয়ার প্রথম মহা পরিচালক। সত্যেন সেন সাংবাদিক ও লেখক হিসেবেও খ্যাতিমান। তাঁর পিতা প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করতেন এবং এ বিষয়ে পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর ঠাকুরদা ডাক্তার ভুবনমোহন সেন এর ছেলে ক্ষিতিমোহন সেন। সত্যেন সেনের ছোট ঠাকুরদা সংস্কৃতের শিক্ষক ও সংস্কৃত ভাষার কবি ছিলেন। আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশু সাহিত্যিক।


পর্ব ৩


চিত্তরঞ্জন দাশ জাত-পাত বৈষম্য মানতেন না৷ বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ পছন্দ না করে, নারীমুক্তি সমর্থন করে, নারীশিক্ষা ও বিধবাদের পুনর্বিবাহকে উৎসাহিত করতেন৷ শুধু মুখে নয়, তিনি অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে থেকে নিজ কন্যাদের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারে বিবাহ দিয়েছেন৷

ব্যারিস্ট্রার সুধীর রায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জুনিয়র হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনিও দেশবন্ধুর সাথে কংগ্রেসের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী একজন সদস্য। দেশবন্ধুর চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। তাদেরই পুত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। এই রায় বংশের চন্দ্রশেখর রায়ের নামেই শেখরনগরের নামকরণ। এই পরিবারের রায়বাহাদুর শ্রীনাথ রায়ের নামে ওখানে একটি হাইস্কুল রয়েছে। তাঁরই আমন্ত্রণে ১৯১৫ সালে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এসে শেখরনগর ও হাঁসাড়ায় দুটি দাতব্য চিকিৎসালয় উদ্বোধন করেন। বিক্রমপুরের দাশ, সেন ও রায় পরিবারের মধ্যে একটি আত্মীয়তার বন্ধনও তৈরি হয়েছিল। বিক্রমপুরের অধ্যাপক শাহজাহান মিয়ার পরিবার আরেকটি অগ্রসর পরিবার৷ এ পরিবারের সুসন্তানরা খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ ও হিন্দু পরিবারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷

বিক্রমপুরের আরেকটি বিখ্যাত পরিবার মালখানগরের বসু পরিবার। এই পরিবারের সন্তান ত্রিশ দশকের বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসু। তাঁর কবিতায় বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এসেছে বারবারই৷ তাঁর কবিতায় রয়েছে— প্রেমের শরীরী সৌন্দর্যতা ও কামনার মুক্তি লাভের ব্যাকুলতা৷ তিনি বিয়ে করেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও ঔপন্যাসিক হাঁসাড়া গ্রামের রানু সোম (প্রতিভা বসু) কে। বিক্রমপুর জুড়ে অনেক বসু পরিবার ছিল। তারমধ্যে শ্রীনগরের লালা কীর্ত্তিনারায়ন বসু শ্রীনগরের জমিদার ও মীর কাশিমের গভর্নর ছিলেন। রাজানগরের সমরেশ বসু ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনিও তীব্র প্রগতিশীল ও মুক্তমনা ছিলেন৷ মাত্র ১৮ বছর বয়েসে প্রেম করে বিয়ে করেন বন্ধুর স্বামী পরিত্যাক্তা ২২ বছরের বোনকে৷ তাঁর রচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামহা হয়েছিল৷ লেখক খ্যাতি রয়েছে হালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী পূরবী বসুরও। পূরবী বসুর স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছোটগল্পকার। পুরবী বসু স্বামীর 'দত্ত' পদবী গ্রহণ করেননি৷ মুন্সিগঞ্জ শহরের পূরবী বসুদের প্রতিবেশি বিমান বসু পশ্চিমবঙ্গ বাম ফ্রন্টের চেয়ারম্যান। তাঁর ভাই তুষারকান্তি বসু ছত্রিশগড় থেকে প্রকাশিত দণ্ডকারণ্য সমাচার নামে একটি দৈনিক হিন্দি পত্রিকা প্রকাশ করে এর প্রধান সম্পাদক হন। কবি ও শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল বসুর পরিবারটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুকোমল বসু ও বোন মঞ্জুলিকার পুত্র সুসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। বুদ্ধদের গুহর বাবলি উপন্যাসের বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল৷ সাহিত্যিক-সাংবাদিক গিরিশচন্দ্র বসু তাঁর পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন তাঁর মাতামহ। গিরিশচন্দ্র বসু নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দারোগাগিরিরি অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেন ‘সেকালের দারোগা কাহিনী’। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্র জগতের অগ্রদূত ছিলেন। ১৮৪৬ সালে সাপ্তাহিক হিন্দু ইন্টেইলজেন্সার পত্রিকা প্রকাশ করেন। বঙ্গদেশে এটা ছিল সর্বপ্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র এবং এটিতেই সবার আগে রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনা হয়েছিল। বিচারপতি চন্দ্র মাধব ঘোষ, ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ ও ব্যারিস্টার লালমোহন ঘোষ তাঁর মামাতো ভাই।

চন্দ্র মাধব ঘোষ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম বাঙালি বিচারপতি এবং পরবর্তীতে তিনি প্রধান বিচারপতিও হন। চন্দ্র মাধব ঘোষের পিতা ছিলেন বাংলার ডেপুটি কালেক্টরদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেন। চন্দ্র মাধবের বড় পুত্র এডভোকেট যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ রায়বাহাদুর হয়েছিলেন। চন্দ্র মাধব ঘোষের আরেক পুত্র সতীশচন্দ্র ঘোষও ছিলেন নামকরা উকিল। তাঁর ছেলে অরুণকুমার ঘোষও বার-অ্যাট ল। চন্দ্রমাধবের এক দৌহিত্র অশোককুমার রায়ও ছিলেন ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের পিতা রামলোচন ঘোষ প্রথম ব্যাচের ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষিত কর্মকর্তা ও সমাজ-সংস্কারক, কৃষ্ণনগরের সদর-অলা, ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ও মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। মনোমোহনই প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার হিসেবে ১৮৬৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে প্রচুর ভূমিকা রাখেন। বেথুন কলেজের সুপারিনটেন্ডেন্ট রূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী ও ঘণিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর ছোটভাই অসাধারণ বাগ্মী লালমোহন ঘোষ ১৮৮০ সালে ব্যারিস্টার হন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য ইংরেজি অনুবাদ করেন, ১৯০৫ সালে তিনি জাতীয় মহা সমিতির সভাপতি হন এবং তিনিই কংগ্রেস নেতা হিসেবে সর্বপ্রথম বাঙ্গালিকে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ঘোষ পদবীধারীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বিদ্যাসাগরখ্যাত কালীপ্রসন্ন ঘোষ লেখক, সম্পাদক ও ভাওয়াল রাজার দেওয়ান হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কুমারভোগ গ্রামের বিখ্যাত বিপ্লবী মার্ক্সশিস্ট জিতেন ঘোষ লেখক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বহর গ্রামের সুবোধ ঘোষও লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। শ্রীনগরের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সিনেমা নির্মাতা ও ওষুধ ব্যবসায়ী। তারা সকলেই প্রগতিশীল মানুষ৷


পর্ব ৪


কনকসার গ্রামের সরোজিনী নাইডুর পরিবারও বিখ্যাত পরিবার। তাঁর পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ— ছিলেন হায়দরাবাদের নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। সরোজিনীর মা ছিলেন বাংলা ভাষার একজন অগ্রগণ্য কবি। তাঁর ভাইদের মধ্যে বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিন কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং হিন্দু-জার্মান যড়যন্ত্রের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব যাকে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ হত্যা করে। সরোজিনীর ছোট বোন মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অধ্যয়ন করেন স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন ও ট্রাইপস লাভ করেন। মৃণালিনীও একমাত্র ভারতীয় নারী হিসেবে জার্মানিতে গিয়ে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন৷  তাঁর অপর ভাই হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা। সরোজিনী ব্রাহ্মণ কন্যা হলেও মাত্র ১৭ বছর বয়সে অব্রাহ্মণ ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে অসবর্ণ বিয়ে করে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে এক কন্যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী পদ্মজা নাইডু পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছিলেন।

শ্যামসিদ্ধি গ্রামের হরি আনন্দ বাড়রীও হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল ছিলেন। তিনি অবশ্য ভারতের গোয়েন্দা পুলিশ প্রধানও ছিলেন। তাঁর কন্যা রাধারানীর স্বামী কনকসার গ্রামের পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং পরবর্তী কালে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হন। বর্তমানে তিনি ভারতের বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো। বিক্রমপুরের আরো অনেকেই রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। আমিনুর রহমান শামসুদ দোহা যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, ইরান ও তুরস্কর রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর পিতা শরিষাবন গ্রামের আবু হামিদ মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা প্রথম ভারতীয় হিসেবে ডেপুটি কমিশনার হন। ভারত ভাগের পরে প্রথম মুসলিম হিসেবে ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ পুলিশের আইজি হন। এরপর আইয়ুব খান সরকারের কেন্দ্রীয় খাদ্য, কৃষি ও পূর্ব দপ্তরের মন্ত্রী হন। সিদ্ধার্থ শংকর রায়ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও বাহমার হাইকমিশনার ছিলেন। ষোলঘরের কামরুদ্দিন আহমদ বার্মার রাষ্ট্রদূত এবং কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। সোনারং গ্রামের বিনয় রঞ্জন সেন আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রথম ভারতীয় মহাপরিচালক ছিলেন। বিএনপির মন্ত্রী এম. শামসুল ইসলাম ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরা সকলেই মননে ও চেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল।

সিরাজদিখানের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলায় শীর্ষস্থানীয়। তিনি আন্তর্জাতিক ফ্যামে কাজ করার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তীব্রভাবেই মার্ক্সশিস্ট ও বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর লেখাতেও সাধারণ মানুষের জীবন উঠে এসেছে। তীব্র প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন শ্রীনগরের ড. হুমায়ুন আজাদও। আহমদ শরীফের পরে তিনিই প্রগতিশীলতার পক্ষে লিখছিলেন জোরালোভাবেই। কিন্তু মৌলবাদী অপশক্তি তাকে হত্যা করে। তবে শ্রীনগরের লেখক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরেকজন দেশবরেণ্য প্রগতিশীল লেখক। লৌহজং এর ইমদাদুল হক মিলনও ঔপন্যাসিক হিসেবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সিলেটে মৌলবাদীদের হাতে নিহত নুরজাহানকে তুলে আনেন বিক্রমপুরের প্রেক্ষিতে এবং মৌলবাদীদের অপরাধের একটি দলিল রচনা করেন। শ্রীনগরের ফয়েজ আহমেদ প্রসিদ্ধ ছড়াকার হলেও তিনি পত্রিকায় কলাম লিখেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রগতিশীল আন্দোলনের সারাদেশেরই শীর্ষস্থানীয় একজন। তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের আওতায় আনার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন এবং তাদের একটি নমুনা বিচারের তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন। লৌহজং এর নূহ-উল-আলম লেনিন প্রগতিশীল রাজনীতি করে এসেছেন। তিনিও গবেষক ও লেখক হিসেবে প্রগতির পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে গবেষণাও করেছেন।


পর্ব ৫


সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাধারণত প্রগতিশীল মানুষই থাকেন। দেশবরেণ্য দুজন নৃত্যশিল্পীর দুজনেরই বাড়ি বিক্রমপুরে। সিরাজদিখানের গওহর জামিল যিনি রওশন জামিলকে বিয়ে করার জন্য গণেশ নাগ থেকে ধর্মান্তরিত হলেও তিনি কখনোই প্রগতিশীলতা ছাড়েননি। তিনি বাংলাদেশের নৃত্য শিল্পের একজন পথিকৃৎ। দেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা যেমন আব্দুল জব্বার খান, শিশুশিল্পী তাঁরই পুত্র মাস্টার জুলু তেমনি প্রথম নৃত্য পরিচালকও বিক্রমপুরের— গওহর জামিল৷ সেই পথ ধরেই টঙ্গিবাড়ির লায়লা হাসান রোজি হয়ে উঠেন নৃত্যশিল্পের আরেক দিকপাল। তাঁর স্বামী হাসান ইমামও একজন বরেণ্য সাংস্কৃতিক কর্মী যিনি পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চা বন্ধের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। চারণ কবি মুকুন্দু দাশ, ‘একবার যেতে দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পড়বে ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এ গান ব্রিটিশদের বুক কাঁপিয়ে দিতো৷ হালে শাহ আলম সরকার বাউল শিল্পী হিসেবে দেশবরেণ্য হয়ে উঠেন। তাঁর পালাগান সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে ভূমিকা রাখে। তাঁর গান গেয়েই শিল্পী মমতাজ খ্যাতি লাভ করেন। সংগীত শিল্পী হিসেবে ভারতজোড়ে খ্যাতি লাভ করেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও হালের শ্রেয়া ঘোষাল। শ্রীনগরের শিমুল ইউসুফ ও তাঁর স্বামী নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। শিমুল ইউসুফ গান ও অভিনয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন।

সব ধরনের সঙ্গীতেই বিক্রমপুরের মানুষের বিশেষ অবদান রয়েছে। লোক সংগীত, পালাগান, আধুনিক গান সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান অনেক। বাউল শিল্পীদের মধ্যে আরো ছিলেন আবুল সরকার,  যিনি সারাদেশেই খ্যাতি অর্জন করেন। মুকুন্দু দাস ও কালাচাঁদ দাস কুন্ডু কীর্তন পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। শ্যামসিদ্ধি গ্রামের নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সব ধরনের গান করলেও কীর্তনীয়া হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি প্লে-ব্যাক সিঙ্গারও ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখেছেন সংগীত শিল্পী মালখানগরের উমা বসু ও হাঁসাড়ার প্রতিভা বসু। প্রতিভা বসু নজরুলেও ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মাহাত্মা গান্ধী উমাকে নাইটিংগেল উপাধি দেন। সীমান্ত গান্ধী খ্যাত খান আব্দুল গফফার খান ও সুভাষচন্দ্র বসু উমার গানের ভক্ত ছিলেন।  সন্তোষ সেনগুপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ভারত সরকারের গীতশ্রী উপাধী প্রাপ্ত সাবিত্রী ঘোষ বহু সিনেমাতেও কণ্ঠ দিয়েছেন। লৌহজং এর বাহেরক গ্রামের মেয়ে কলকাতার আধুনিক গানের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি’, ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’ এর মতো গান তিনি গেয়েছেন। টঙ্গিবাড়ির মুজিব পরদেশি ও মুন্সিগঞ্জ সদরের জহির আহমেদ সারাদেশব্যাপীই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন৷ তাদের গান এখনো সংগীতপিপাসুরা পছন্দ করেন৷ শিমুল ইউসুফ শুরুতে খ্যাতি অর্জন করেন গান গেয়েই। পরবর্তীতে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেই খ্যাতি পান। অভিনয় জগতে সবচেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন নায়িকা হিসেবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে টেলি সামাদ ও নারায়ণ চক্রবর্তী খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া নাজমা আনোয়ার, আব্দুল জব্বার খান, দোয়েল, আব্দুল কাদের খ্যাতিমান ছিলেন। পপ সংগীতের অন্যতম গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ নায়ক হিসেবেও অভিনয় করেন। তাঁর পুত্র হাবিব ওয়াহিদও খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। এ সময়ের বালাম ও তাহসানও বিক্রমপুরের। তাহসান অভিনয় করেও খ্যাতি অর্জন করেন। সিনেমা পরিচালনাতেও আলোচিতদের কয়েকজন হলেন আব্দুল জব্বার খান, চাষী নজরুল ইসলাম, আলমগীর কুমকুম, শফী বিক্রমপুর, নুর হোসেন বলাই। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন আলাউদ্দিন আলী ও সরদার আলাউদ্দিন আহমেদ।

চলচ্চিত্র অঙ্গনেও বিক্রমপুরের মানুষের বিপুল অবদান রয়েছে। আবদুল জব্বার খানকে বাংলা চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। তিনি মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ঢাকায় এর দুয়ার খুলে দেন। স্বাধীনতার পরে পরিচালক হিসেবে আসেন চাষী নজরুল ইসলাম। তাঁর ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। আলমগীর কুমকুম ও নুর হোসেন বলাইসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক বিক্রমপুরের। অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ জনপ্রিয় অভিনেত্রী৷ উত্তম কুমারের সাথে তাঁর জুটি বহু হিট সিনেমা উপহার দিয়েছে৷  আলাউদ্দিন আলী ও শাহ আলম সরকার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ নামের সিনেমা করে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবদান রাখেন। প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও ভূমিকা রাখেন।

চিত্র শিল্পে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন সারদা উকিল, বরোদা উকিল, রণদা উকিল, শান্তনু উকিল, মুকুল দে, আব্দুল হাই, অতুল চন্দ্র বসু, কাজী আব্দুল বাসেতসহ অনেকে। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনটাও বিক্রমপুরের মানুষ আলোকিত করে রেখেছেন৷ তাদের প্রগতিশীলতার আলোয় আলোকিত হয়েছে ঢাকা থেকে কলকাতা তথা সারা বাংলা!

অলৌকিক চিকিৎসা শিবিরের বুজরুকি ফাঁস --সন্তোষ শর্মা
Nov. 21, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমাদের দেশ ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমশঃ উন্নতি করে চলেছে। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিত্যদিন নব্যনতুন অনুসন্ধান ও আবিষ্কার হচ্ছে। একদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে। মানুষকে মস্তিস্ককোষ থেকে অনেক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কর সময়ের সঙ্গে দূর হয়ে চলেছে। কিন্তু এটি তো দেশের একাংশের চিত্র। কারণ আজও অনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-প্রেত, ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, অলৌকিক ও কাল্পনিক গুলগল্পে এবং অন্ধবিশ্বাসে ডুবে রয়েছে। এই সব অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর প্রতারক অর্থাৎ ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বাবাজী, মাতাজির মতন বুজরুকদের লোক ঠকানো ও বুজরুকি ব্যবসা ফুলেফেঁপে আছে। আজও অনেক বুজরুকরা অলৌকিক ক্ষমতা, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে যে কোনও রোগের চিকিৎসা করার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তন্ত্রমন্ত্র, অলৌকিক উপায়ে যে কোনও রোগের চিকিৎসার দাবি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এর পরেও আজও এই পশ্চিমবঙ্গে  আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে,  হেঁকেডেকে রীতিমতো অলৌকিক স্বাস্থ্য শিবির খুলে  বুজরুকি ব্যবসা চলছে। সাধারণ এবং গরীব  লোকেদের অন্ধবিশ্বাস, দারিদ্র ও  অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ফুলেফেঁপে চলেছে অলৌকিক ও বুজরুকি ব্যবসা। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সব কিছু জানা সত্ত্বেও পুলিশ ও প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। 

 অন্য দিকে  আমরা যুক্তিবাদীরাই এই বুজরুকি ব্যবসা বন্ধের জন্য সব সময় সক্রিয়। যেখানেই বুজরুকি, সেখানেই যুক্তিবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বুজরুকি মুখ থুবড়ে পড়ে। আজ এমনই একটি সত্যি ঘটনা লিখছি যা যুক্তিবাদী আন্দোলনকারীকে বুজরুকি ফাঁসের জন্য উৎসাহিত করবে। 


মঙ্গলবার ১০ এপ্রিল ২০১২

গ্রামের মাঝে একটি খোলা মাঠ। বিচালির ছাউনি দেওয়া দু-একটি কুঁড়ে ঘর। আশে-পাশে কয়েকটি গাছ। তার ছায়ার নীচে ছয় থেকে ৬০ বয়সের ছেলে, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ বসে আছেন। এঁরা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসেছেন নিজের জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসা করাতে। খোলা মাঠে গাছের ছায়ায় নিচে রীতিমতো স্বাস্থ্য শিবির চলছে। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন এই স্বাস্থ্য শিবিরে কোনও চিকিৎসক নেই। দু’জন সহকর্মীর সহায়তায় একজন ব্যক্তি তাঁর ‘অলৌকিক ক্ষমতা’র সাহায্যে শুধুমাত্র রুগীর কানে, মুখে, চোঁখে ‘ফুঁ’ দিয়ে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ‘হাত বুলিয়ে’ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করছেন। মধ্য বয়স্ক এই অলৌকিক চিকিৎসকের (?) নাম পঞ্চানন মাইতি। তিনি দাসপুরের গোসকপোতা গ্রামের নিবাসী।  তাঁর দুই সহযোগী অরুণ গোস্বামী এবং সুকুমার সামন্ত। এঁরা রামদেবপুরের বাসিন্দা।  প্রতি মঙ্গলবার  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার পালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় এই স্বাস্থ্য শিবির বসে। খোলা মাঠের এই শিবিরে এলেই প্রথমে প্রতিটি রুগীর পরিজনকে ১০ টাকায় বিনিময়ে একটা পুস্তিকা কিনতে হয়। পুস্তিকা বললে ভুল হবে কারণ এক টাকা দামের ছোট পাতলা খাতায় পেন দিয়ে কয়েকটি মন্ত্র লেখা থাকে। এর  পর পঞ্চাননের দুই সহযোগী অরুন এবং সুকুমার মাঠে বসে থাকা প্রতিটি  রুগীর কাছে গিয়ে তাঁর নাম, ঠিকানা, বয়স, রোগ ইত্যাদি একটি খাতায় লিখে রাখেন।

ফুলপ্যান্ট ও হাফ শার্ট পরিধানে পঞ্চানন মাইতি তাঁর এই শিবিরে চিকিৎসার জন্য আসা রুগীর এবং তাঁদের পরিজনদের উদ্দেশ্যে জোরে-জোরে বলতে শুরুর করেন, “আপনারা চিকিৎসার জন্য বড়-বড় হাসপাতালে ঘুরে-ঘুরে অনেক টাকা, পয়সা ও সময় নষ্ট করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। শেষ আশার আলো দেখতে আজ আমার ‘অলৌকিক শিবিরে’ এসেছেন। কথা দিচ্ছি এখান থেকে কেউ নিরাশ হয়ে ফিরে যাবেন না। আমার ফুঁ ও হাতের স্পর্শ পেয়ে বোবা কথা বলে। জন্মান্ধ দু’চোখ খুলে জগৎ দেখে। কানে কালাও সব কথা শুনতে পায়। ল্যাংড়া, খোঁড়াও ঘোড়ার মতন দৌড়তে শুরু করে। যে যেখান বসে আছেন, সেখানেই একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আমি নিজেই আপনাদের কাছে এসে রোগমুক্তি করব। কেউ নিরাশ হয়ে ফিরবেন না। অবশ্যই ফল পাবেন।”


 রোগীদের কাছে বিক্রি করা একটি পুস্তিকা নিজের হাতে নিয়ে পঞ্চানন বললেন, “এই পুস্তিকাতে রোগ মারণ মন্ত্রের শ্লোক লেখা আছে। আমি এই শ্লোকগুলি পাঠ করছি। আমরা সঙ্গে-সঙ্গে আপনারাও সব্বাই একসাথে শ্লোকগুলো পাঠ করুন।”

এরপর পঞ্চানন সহ অন্যান্য লোকেরা একযোগে মন্ত্র ও শ্লোক পাঠ করলেন। সব্বাইকে থামিয়ে দিয়ে রুগীদের অলৌকিক চিকিৎসা শুরু করলেন পঞ্চানন বাবাজী।  দূর গ্রাম থেকে নিজের মা-বাবার সঙ্গে এসেছে এক নাবালিকা। সে জন্ম থেকেই বোবা। মেয়ে যদি কথা বলতে পারে এই আশা নিয়ে এসেছেন তাঁরা। পঞ্চানন বাবাজী বোবা মেয়ের কাছে গেলেন। তার মায়ের দিকে তাকিয়ে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “চিন্তা করিস না মা। আমার চিকিৎসায় তোর মেয়ে কথা বলবে। মুখে কথার ফুলঝুরি ফুটবে।” 

নাবালিকার মাথায় হাত রেখে পঞ্চানন বাবাজী বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন এবং দু-তিনবার ফুঁ দিলেন। মাথার পর শরীরের বিভিন্ন স্থান হাত বুলিয়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। পঞ্চানন বাবাজী অশ্লীল ভাবে গায়ে হাত বোলাচ্ছিল  তাতে মেয়েটি অসস্তি বোধ করে। এরপর বাবাজী মেয়েকে মুখ হাঁ করতে বলেন। বোবা মুখ হাঁ করলো। পঞ্চানন বাবাজী তার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে জিভ ধরে টেনে ধরলেন। নিজের জিভ নাবালিকার জিভে স্পর্শ করলেন। কিছুক্ষন পরে ওর মুখে দু’বার ফুঁ দিয়ে পঞ্চানন বাবাজী আদেশের সুরে বললেন, “বলো মা। বলো বাবা, আব্বা। কিরে বলছিস না কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলো, মা বাবা, আব্বা।”


বেচারি বোবা মেয়েটি চিকিৎসার নামে পাঞ্চনন বাবাজির অশ্লীল আচরণে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। জন্ম থেকে বোবা মেয়েটি হয়তো কিছু বলার জন্য দু-দু বার মুখ হাঁ করলো। কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দ বেরোলো না। সে ফ্যাল-ফ্যাল দৃষ্টিতে বোবার মত তাকিয়ে রইল এবং তার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “দুঃখ করিস না খুকি। তুই কথা কইবি। আমার গুরুর আশীর্বাদে তোর মুখে কথা ফুঁটবে।”


 নাবালিকার মাকে বাবজিকে বললেন, “তোর মাইয়া কথা কইবে। ওকে আগামী মঙ্গলবার আবার এই শিবির নিয়ে আসবি। আরও তিন বার চিকিৎসা করতে হবে ওকে। তারপর মাইয়ার মুখে বুলি আসবে। দেখবি বোবা মামা, বাবা, আব্বা বলে  বলে ডাকবে।” কিছু দূরে একটি গাছের নিচে এক মহিলা তার অন্ধ ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন। পঞ্চানন বাবাজী তাঁদের কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেলে কবে থেকে চোখে দেখতে পায় না?”

মহিলা বললেন, “জন্মান্ধ।”

“চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার কাছে এসেছি। এ ছেলে আমার হাতের স্পর্শে দু’চোখ খুলে সব দেখবেই।” বাবাজী বলেন।

অন্ধ ছেলের দু’চোখে নিজের দু’হাতের বৃষ্ঠাঙ্গুল চেঁপে ধরলেন। আঙ্গুল সরিয়ে দু-বার ফুঁ দিলেন। এবং বাবাজী বললেন, “খোকা চোখ খুলে দেখ। তোর সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে।”

ছেলেটি দু’হাত বাড়িয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘোরাতে লাগল। না ও কিছুই দেখতে পারছে না।

এই দেখে পঞ্চানন বাবাজী বললেন, “খোকা জন্ম থেকে অন্ধ। তাই তোর চোখে আলো ফিরতে একটু সময় লাগবে। আমার কাছে আরও কয়েকবার আসবি। আমার মন্ত্র শক্তিতে তুই দু’চোখ ভরে দুনিয়া দেখবি।”


 এক যুবতী। কানে কালা। ছোটো বেলায় শুনতে পেত। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পাবার পর থেকে সে শুনতে পায় না। সে তাঁর  মায়ের সঙ্গে এসেছে এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবিরে। 

যুবতীর মাথায় হাত রেখে পঞ্চানন বাবাজী মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। এরপর দু’হাতে তাঁর দু’কান ধরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে দু’কান দু-দু বার ফুঁ দিলেন। ঝাড়ফুঁক করার পর বাবাজী জিজ্ঞেস করলেন, “মাইয়া তোর নাম কি?”

মেয়েটি চুপ করে তাকিয়ে রইল। পাশে বসে মা বললেন, “মনে হচ্ছে মেয়ে এখনো শুনতে পাচ্ছে না।”

একটু জোরে আবার পঞ্চানন বাবাজী জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কি তোর?” না। মেয়ে কিছুই শুনতে পাইনি। এবং সে বললো, “আমি কোনো কথা শুনতে পারছি না।” 

পঞ্চাননের সহযোগী একটি  ছোট্ট শিশি মেয়ের মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “এতে মন্ত্রপুত জল আছে। রোজ সকালে দু’ফোঁটা করে কানে দিবে। কানে শুনতে পাবে। আগামী মঙ্গলবার মেয়েকে আবার নিয়ে আসবি পঞ্চানন বাবাজীর কাছে।”


এই ভাবে জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও রোগগ্রস্তের অলৌকিক চিকিৎসা চলতে লাগলো। মাঝে-মাঝে পঞ্চাননের দুই সহযোগী অরুন ও সুকুমার মাঠে অলৌকিক চিকিৎসা শিবিরে আগত রুগীদের এবং তাঁদের পরিজনদের এই কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, “আজ যারা পঞ্চানন বাবাজীর এই অলৌকিক শিবিরে দূর-দূরান্ত থেকে আরোগ্য লাভের আশায় এসেছেন। কেই বাবাজির কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন না। সবার উপর বাবাজীর আশীর্বাদ সূর্য্যের আলোর মত ঝরে পড়বে। বাবার আশীর্বাদে নিজেকে ধন্য করতে দু’হাতে দান বাক্সে দান করতে ভুলবেন না। যে যত বেশি টাকা পয়সা দান করবেন, বাবাজীর কৃপা ও আশীর্বাদ তাঁদের পরিবারের উপর তত বেশি করে ঝরে পড়বে। একশো, হাজার যার যেমন ইচ্ছা দান করুন।” 


প্রতি মঙ্গলবার এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবির খোলা মাঠে চলে। রোগী এলেই প্রথমে তাকে ১০ টাকার বিনিময়ে একটা পুস্তিকা কিনতে হয়। পরে একটি বাক্সে রোগীকে ইচ্ছে মতো টাকা দিতে বলা হয়। এ ভাবে প্রতি মঙ্গলবার ৮-১০ হাজার টাকা রোজগার হচ্ছে। ইতিমধ্যে পঞ্চানন বাবাজীর এই  অলৌকিক শিবিরে এসে অনেক রোগীর মাথা ব্যাথা, হাটু, কোমর, গাঁটে ব্যাথা, অনিদ্রা ইত্যাদি দূর হয়ে গেছে।  আমরা লেখা এইটুকু অংশ পড়ার পর হয়তো কেউ ভাবতে পারেন, “সত্যিই কি এভাবে খেলা মাঠের মাঝে পঞ্চানন বাবাজী তাঁর দুই সহযোগী অরুন  এবং সুকুমারের সাহায্যে নিয়ে শুধুমাত্র কানে ফুঁ দিয়ে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত বুলিয়ে নানা রোগ সারানোর কারবার ফেঁদেছেন?”  

হ্যাঁ। সত্যিই। শুধুমাত্র ফুঁ দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে নানা রোগ সারানোর কারবার ফেঁদেছেন এই তিন প্রতারক। জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও অসুখ সারিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন এই তিন প্রতারক। প্রকাশ্যে এই প্রতারণা চলছে। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন?  এই প্রশ্ন নিয়ে ‘ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার কর্মকর্তা  দেবব্রত আমাকে ফোন করলো এবং বললো, “সন্তোষ দা, তুমি সাংবাদিক। এই অলৌকিক চিকিৎসা শিবির এবং পঞ্চানন বাবাজীর বুজরুকি বন্ধ করতে সংবাদ মাধ্যমের সাহায্য প্রয়োজন।”  

আমি বললাম, “তুই জানিস আমিও যুক্তিবাদী সমিতি’র সংযুক্ত সম্পাদক। তাই জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, থেকে মাথার যন্ত্রণা, যৌনরোগ, বাত, আলসার-সহ যে কোনও অসুখ সারিয়ে দেওয়ার দাবি করা এই পঞ্চানন বাবাজী এবং তাঁর বুজরুকি শিবিরের বিরুদ্ধে সব রকম পদক্ষেপ নিতে আমিও তৈরি আছি। কিন্তু এর জন্য সবার আগে প্রমাণ জোগাড় করে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।”


“কিসের প্রমাণ?” দেবব্রত জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, “এই বুজরুকি বন্ধের জন্য অভিযোগ করার আগে প্রমাণ লাগবে। পুলিশের কাছে মুখে বললে হবে না। একটা কাজ কর। তুই পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরে একজন রুগী সেজে চলে যা। পারলে তোকে যখন ফুঁ, স্পর্শ ইত্যাদি করে চিকিৎসা করবে, সেই সময় তোর কোনও বন্ধুকে বলে গোপনে ছবি তুলে নিবি। এর পর তুই নিজে একজন রুগি হিসাবে থানাতে ওই প্রমাণ ছবি সহ অভিযোগ দায়ের করবি। বাকি আমি সাংবাদিক হিসাবে বুজরুকি বন্ধের জন্য পুলিশের সঙ্গে কথা কথা বলব।” 

আমরা কথা শুনেই দেবব্রত ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “রুগি সেজে গেলে যদি পঞ্চাননের লোকেরা ধরে ফেলে তাহলে বিপদ হতে পারে।”

আমি বললাম, “তুই কেন বিপদে পড়বি? যারা বুজরুকি ব্যবসা করছে তাঁরা বিপদে পড়বে। তোর দ্বারা যদি এইটুকু না হয় তাহলে ছেড়ে দে। কিছু করতে হবে না।”

“ঠিক আছে যাচ্ছি।” কয়েক ঘন্টা পরে খবর পেলাম যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখা থেকে কয়েকজন সদস্য  দাসপুরের গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় গিয়ে গোটা ঘটনা গোপনে ভিডিও ক্যামেরাবন্দি এবং ছবি তোলা। এই খবর পাওয়ার পর আমি দেব্রতকে ফোন করে বললাম, “তুই আজই এই প্রমাণের ভিত্তিতে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্তিবাদী সমিতি’র প্যাডে লিখিত অভিযোগ দায়ের কর এবং ওই চিঠি আমার কলকাতার পত্রিকা অফিস ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র’-এ ইমেল বা ফ্যাক্স করে পাঠা।” চিঠিতে কি কি লিখতে হবে সেই বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিলাম। যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার তরফ থেকে ঘাটাল মহকুমা শাসককে  গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন মাইতির বুজরুকির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে চিঠি পাঠান হয়। নিচে পুরো চিঠিটি তুলে দিলাম।


প্রতি                                  ১০/৪/২০১২

মাননীয়

মহকমা শাসক মহাশয়

ঘাটাল

মহাশয়,

“...আমরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার পক্ষ থেকে আপনার কাছে একটি দাবি রাখতে চাই। আমরা দেখলাম গোপালপুর গ্রাম (জানাপাড়া, গ্রাম গোপালপুর, থানা- দাসপুর, জেলা- প: মেদিনীপুর ) -এ ‘ ফুঁ’ দিয়ে রোগ সরানোর’ নামে একটি অবৈজ্ঞানিক, বেআইনি এবং প্রতারণা মূলক ব্যবসা গত দ’সপ্তাহ ধরে চলে এসেছে। ‘ ড্রাগ এন্ড কমমেটিকস অ্যাক্ট,১৯৪০ অনুসারে এই ধরনের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে বে-আইনি এবং উক্ত প্রতারক ও এরূপ প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগণ দোষী বলে অভিযুক্ত হবে এবং তদানুসারে দণ্ডপ্রাপ্ত হবে। এরুপ প্রতারকদের থেকে সমাজকে বাচাঁতে আপনার কাছে আমাদের দাবি মানুষের অজ্ঞাতাকে নিয়ে এই বে-আইনি ব্যবসাটির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আমরা ‘ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছি।” 

ধন্যবাদ

দেবব্রত


 এই চিঠি পাঠানোর পর দেব্রত জানাল সে আগামী কাল কলকাতায় আসছে। আমার সঙ্গে দেখা করবে। ভালো কথা। 


বুধবার ১১ এপ্রিল ২০১২   

অলৌকিক চিকিৎসার নামে পঞ্চানন বাবাজী  জন্মান্ধ, মূক-বধির, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে শুধু প্রতারণাই নয়, তাঁদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করছে। এই পতারককে জেলে পাঠান উচিৎ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যুক্তিবাদী সমিতি’র অভিযোগের পরেও পুলিশ অভিযুক্ত পঞ্চানন বাবাজী এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। এই দেখে সন্দেহ হতেই পারে গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় বুজরুকি ব্যবসায় পুলিশের অপ্রত্ক্ষ সহযোগিতা থাকতে পারে। কারণ, দিনের আলোতে,  খোলা মাঠে অলৌকিক শিবির দিনের পরদিন চলছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার পরও পুলিস চুপ মেরে কেন আছে? এই গন্ধটা সন্দেহজনক!  

বিকেলে দেব্রত তার স্ত্রীরির সঙ্গে কলকাতার তালতলায় আমার পত্রিকা ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র’  -এর অফিসে এলো। ঘাটালের  গোপালপুর গ্রামের  জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর  অলৌকিক শিবির নিয়ে অনেকে কথা হল। আমি নিজের নোটপ্যাডে জরুরী তথ্য লিখে রাখলাম। এবং বললাম, “আমি কালকেই বলেছিলাম তুই রুগী সেজে পঞ্চাননের শিবিরে যা। তারপর নিজে একজন রুগী হিসাবে অভিযোগ দায়ের কর। কিন্তু তুইতো  আমার কথায় কান দিলি না।”

সে বলল, “বিপদ হতে পারে ভেবে রুগী সেজে ওখানে গেলাম না।”

“কেন? কিসের বিপদ?” জিজ্ঞেস করলাম।

সে বলল, “তোমার কথা মত যুক্তিবাদী সমিতি’র ঘাটাল শাখা থেকে আমি, সুরজিৎ, মানস ও সঞ্জয়  চারজনে গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরে যাই। গিয়ে দেখি, সম্পূর্ণভাবে অবৈজ্ঞানিক ও বে-আইনিভাবে ফুঁ দিয়ে, রুগীরদের শরীরে অশ্লীলভাবে হাত বুলিয়ে চিকিৎসার নামে দিন-দুপুরে বুজরুকি ব্যবসা চলছে। প্রতারণার এই ব্যবসায় শুধুমাত্র পঞ্চানন এবং তাঁর দুই সহযোগীই নয়, আরও অনেক সমাজবিরোধীরাও যুক্ত আছেন। এই অবস্থায় আমরা যদি পঞ্চাননের বুজরুকি ব্যবসার সরাসরি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি তাহলে বিপদ হতে পারে। পঞ্চাননের লোকেরা আমাদের উপর হামলা করতে পারে। তাই আমরা তোমার কথা মত শুধু গোপনে কিছু ছবি তুলতে পেরেছি। যদি আমার কাছে প্রেস কার্ড থাকতো তাহলে পঞ্চাননকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বুজরুকি ফাঁস করে দিতাম। আমার জন্য একটি প্রেস কার্ডের বানিয়ে দাও।”


 আমি বললাম, “রুগী সেজে পঞ্চানন বাবাজীর কাছে যেতে তোর ভয় করছে। বিপদ হতে পারে। তাহলে প্রেস কার্ড নিয়ে তাকে কোন সাহসে চ্যালেঞ্জ জানাবি? প্রেস কার্ড পাওয়া এত সহজ কথা নয়। তুই যদি ঠিক মতন কাজ করিস, মিডিয়ার খবরে তোর নাম উঠে আসবে। এবং আমি তো তোর সাংবাদিক বন্ধু। ভেবে বল, পঞ্চানন বাবজীকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার করার জন্য কী কী করতে হবে?” 

না। ও কোনও উত্তর দিতে পারলো না। ভেবেছিল আমার কাছ থেকে প্রেস কার্ড পাওয়া যাবে। কিন্তু না শুনে ওর ভালো লাগেনি। তাই হতাশ হয়ে ফিরে গেল। এরপর পত্রিকা অফিসে থেকে যুক্তিবাদী সমিতি’র সভাপতি প্রবীর ঘোষকে ফোন করে সব কথা বলল। শুনেই প্রবীর বাবু রেগে গিয়ে বললেন, “ও একটা কাজ দিতে ঠিক মতন করতে পারে না। আবার প্রেস কার্ড নিয়ে ওকি ঘোড়ার ডিম করবে? তুমি ওর সম্পর্কে আমাকে কিছু বললে না। একটি প্লান বানিয়ে ওকে বোঝাও কি করে পঞ্চাননকে জালে ফাঁসান যায়। কারণ তুমিও যুক্তিবাদী সমিতি’র একজন পদাধিকারী। তুমিও আমার সঙ্গে অনেক অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের বুজরুকি ফাঁস করছো। আমি দেখতে চাই তোমার নেতৃত্বে পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবিরের বুজরুকি ফাঁস হোক। সংবাদ মাধ্যমের শক্তি প্রয়োগ করে এই অভিযুক্ত প্রতারকদের পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করে দেখাও।”


 আমি বললাম, “ঠিক আছে। প্লান বানিয়ে কাজ শুরু করছি। গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় পঞ্চানন বাবাজীর অলৌকিক শিবির নিয়ে যে তথ্য ও অভিযোগ পেয়েছি তার ভিত্তিতে একটি খবর আমার পত্রিকায় লিখে দিচ্ছি। তার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করব।”

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় দাসপুরের গোপালপুর গ্রামের জানাপাড়ায় অলৌকিক শিবিরে ফুঁ দিয়ে, স্পর্শ করে রোগের চিকিৎসা নামে বুজরুকি চলছে। অন্যদিকে, খড়গপুরের বাঁশপতির গ্রামে যুগল মাহাত নামক এক বাবাজী নিজের মাথার ঘাম দিয়ে যে কোনও অসাধ্য রোগের চিকিৎসা করে রুগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। কিন্তু এই প্রতারকের বিরুদ্ধে পুলিশ বা প্রশাসন কোনও ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। 


শুক্রবার ১৩ এপ্রিল ২০১২ 

আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় কোথায় বা ফুঁ দিয়ে তো কোথাও মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুজি চিকিৎসা চলছে। এই বুজরুকদের খপ্পড়ে পরে অনেক অসহায় রুগী  ও মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। কিন্তু জানিনা কোন  সম্মোহনে পুলিশ ও প্রশাসন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে? কিন্তু আমরা সাংবাদিক কলম দিয়ে আঘাত করে এঁদের ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করে চলেছি। তাই আজ আমার পত্রিকা ‘ দৈনিক বিশ্বমিত্র ’-তে  গোপালপুর গ্রামে পঞ্চানন বাবাজীর ফুঁ দিয়ে এবং খড়গপুরে যুগল মহাতোর মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুকি চিকিৎসার খবর চার কলম জুড়ে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ কোথাও বা ফুঁ দিয়ে তো কোথাও মাথার ঘাম দিয়ে চিকিৎসার ব্যবসা ’ এই শিরোনামে আমার লেখা খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের সামনে এই খবরের একাংশ তুলে ধরছি। 


 পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ এপ্রিল (নি.প্ৰ.)। আজ এই বাংলা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বিকশিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ে নিত্যদিন নতুন-নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। রাজ্য বাসীদের মধ্যে যেমন বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে,  সেখানে অনেক অন্ধবিশ্বাস জনগনের মন-মস্তিস্ক থেকে দূর হয়ে চলেছে। এটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের ছবি। অন্য অংশের ছবিটি হল, আজও অনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-পেত্নি, ওঝা- তান্ত্রিক, অলৌকিক, গুলগল্পে বিশ্বাস করেন। এবং এই সবের সুযোগ নিয়ে এই বাংলায় ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, ওঝা-তান্ত্রিকের বুজরুজি ব্যবসা ফুলেফেঁপে রয়েছে। আজও তথাকথিত ওঝা, তান্ত্রিক, বাবাজী-মাতাজী ঝাড়ফুঁক করে যে কোনও রোগের চিকিৎসা করার দাবি জানাচ্ছেন। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে  পশ্চিম মেদিনীপুরে বিভিন্ন স্থানে ফুঁ বা মাথার ঘাম দিয়ে বুজরুজি চিকিৎসা চলছে।

দেশপ্রেম ও কিছু কথা -জামাল আনসারী
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:734 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বর্তমানে আমাদের দেশে দেশপ্রেমেরের জোয়ার বইছে। অভুক্ত শরীরেও দেশপ্রেম টগবগ করে ফুটছে।

কিন্তু দেশপ্রেম কি?

তা হইতো অনেকেই জানেন না।দেশপ্রেম বলতে শুধুই দেশের প্রতি প্রেম বোঝায় না,  দেশের মানুষের প্রতি প্রেমও বোঝায়।

 দেশ যদি ভালোবাসার মতো কাজ করে, তবে দেশের মানুষ আপনা আপনি দেশকে ভালোবাসবে। কাউকে জোর করে বলার দরকার নেই,  দেশকে ভালোবাসো, দেশকে ভালোবাসো।

কিন্তু ভারত সরকার থুড়ি মোদীর সরকার দেশের জনগনকে এখন ঘাড় ধরে দেশপ্রেমের পাঠ শেখাতে নেমেছে। আর এখানেই দেশের বহুত্ববাদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধছে। মোদীর সরকার যা বলছে তা ভুল হলেও ঠিক বলে চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে,  নইলে আপনাকে দেশদ্রোহী,  বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে ছাপ মেরে দেবে।তারপর যা ঘটে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

 ভারত সরকার ও মোদী সরকার এখন সমার্থক হয়ে উঠেছে। সরকার  দেশপ্রেমের নামে উগ্র হিন্দু তালিবানী শাসন চালু করতে চাইছে। যা ভারতের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় বটে।তাই সাধারণ শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের এখনই এই স্বৈরাচারী শাসনের উপরে প্রতিবাদ না জানালে, আগামী দিনে হয়তো চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকবে না।

 

দেশ জুড়ে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের চাপে ও গৈরিক বাহিনীর ভয়ে দেশের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে সামরিক সাঁজোয়া গাড়ি  মোতায়েন থাকবে, যা দেখে ছাত্র ছাত্রীদের মনের মধ্যে দেশপ্রেমেরের বাতাবরণ তৈরি হবে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। যেহেতু জোর করে মানুষের মনে দেশপ্রেম কখনও জাগানো যায় না।

 মাদ্রাজ হাই কোর্টের মহামান্য বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন যে,  দেশের স্কুল, কলেজ, অফিসে এখন থেকে "বন্দে মাতরম" গানটি বাধ্যতামূলক ভাবে গাইতে হবে। কিন্তু এর ফলে কি দেশপ্রেম বাড়বে? তা হইতো আগামী দিনে বোঝা যাবে।তবে দেশের শাসন বিভাগের নির্দেশে বিচার বিভাগ অতি সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ফলে জন সাধাণের চিন্তা বাড়ছে বলে মনে হয়।

 

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতো মানুষকে যেভাবে দেশের সরকার পদে পদে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে, অপমান করছে।সেটা মোটেই ভালো লক্ষণ নই। দেশ এক ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

 দেশের এক ভণ্ড যোগগুরু তো প্রকাশ্য সমাবেশে হুমকি দিচ্ছে, "ভারত মাতা কি জয়" না বললে মুণ্ডু কেটে নেওয়া হবে।এটাই কি দেশপ্রেম এর স্বরূপ? এগুলো কি মেনে নেওয়া যায়?

এখন তো আবার একটি নিরীহ পশুকে নিয়ে দেশের সরকার যেভাবে মেতে উঠেছে, তা দেশের মানুষের কাছে যথেষ্ট চিন্তার বিষয়ই বটে। মোদী রাজে  যেখানে সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনা বেড়েই চলেছে।মানুষের জীবনের চেয়ে এই পশুটি এখন মহা মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এই পশুটিই বর্তমানে মোদী সরকারের রাজনৈতিক প্রানী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরুর জন্য মানুষকে প্রতিনিয়ত খুন বা গনধোলাই এর শিকার হতে হচ্ছে। এরকম দেশপ্রেম আমরা চাই না।যে দেশপ্রেম মানুষের থেকে পশুকে মূল্যবান মনে করে।

এই মেকি দেশপ্রেমেরের প্রতিবাদ চাই। তাই দেশের শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের কাছে অনুরোধ করবো,  দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষ কে বাঁচাতে, দেশের গনতন্ত্র কে প্রতিষ্ঠা করতে, দেশের বহুত্ববাদকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে।

মেকআপ -রূপসা রায়
Nov. 21, 2024 | সমাজ | views:282 | likes:0 | share: 0 | comments:0

 প্রথম - 

বাড়ি ফিরেই তাড়াতাড়ি মেকআপ তুলতে থাকে শীর্ষা, রবিন জানতে পারলে কি হবে ভেবে উঠতে পারেনা সে। গত তিন বছর ধরে এই মেকআপ তার ভরসা। তিন বছর আগে হঠাৎই গাড়ি এক্সিডেন্টে রবিনের শরীর প্যারালাইসিস হয়ে যায়, সেই থেকে চলছে। চারিদিকে শকুনের চোখ আর চাকরির অভাবের বাজারে 'call girl' এর পেশাই তার একমাত্র ভরসা। দুঃখ, কষ্ট সব লুকিয়ে রেখেছে এই মেকআপের আড়ালে।

এই পেশায় সুন্দরী সাজতে হয় তাকে নাহলে যে শরীর পছন্দ হবেনা বাবুদের, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে তার।

রবিন কথা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে, তাই লোকানোর চেষ্টা! মেকআপ ধুয়ে এসে সোফায় বসতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শীর্ষা।

  

দ্বিতীয় -

 - "ইস! অনেক বুড়ি লাগছে তো! "

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলে রণিতা। বয়স তার বিয়াল্লিশ কিন্তু স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে বয়স কমানোর চেষ্টায় তিনিও পিছপা হননি।

প্রায় এক ঘন্টা মেকআপ করে উঠে ব্যাগ টা নিয়ে বেরিয়ে পরে শপিংয়ে। আজ সব ত্রিশ বছর বয়সী মহিলারা একসাথে শপিং করবে। মেকআপের আড়ালে ঢাকা পড়েছে বয়সটা।

 

 

তৃতীয় -

 যন্ত্রনায় কেঁপে ওঠে তার শরীরটা। আগের রাতের অত্যাচার আর মারে সারা মুখে কালশিটের দাগ পড়েছে স্নেহার। এদিকে অফিসের সময় আগত।

তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ করে মেকআপ করতে বসে সে। অফিসের সবার সামনে 'Happy family' এর 'show off' এর অভিনয়টা সে ভীষণ সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। এতো তাড়াতাড়ি হারলে চলবেনা বাচ্চাটা যে বড্ডো ভালোবাসে বাবাকে!

  

চতুর্থ -

 - "মেয়ে যে এতো কালো সে কথা তো আগে বলেননি? নানা, এই বিয়ে হবেনা।"

এবার আর এই কথা শুনতে হয়নি প্রিয়াকে। প্রতিবার এভাবেই তার বিয়ে ভেঙে যায়। তাই এবার সে পার্লার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে মেকআপ দিয়ে ঢেকে নিয়েছে তার আসল রূপ, ফুটিয়ে তুলেছে এক নকল ফর্সা চেহারা।

পাত্রপক্ষ বেরিয়ে গেলে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে সে, ঘষে ঘষে মেকআপ তুলতে থাকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সে - "কালো হওয়া কি পাপ ভগবান?"

  

পঞ্চম -

বাড়ি এসে নকল মেকআপ আর নকল পরচুলা টা খুলে ফেলে তৃষা। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, নিজের পরিচয় লোকানোর চেষ্টায় আজ জয়ী হলেও নিজের কাছে হেরে গেছে তৃষা।

 

চার বছর ধরে সে এই নকল 'আলিয়া' হয়ে জীবনযাপন করছে। চার বছর আগের করা অপরাধ কাঁদাচ্ছে তাকে আজ।

চার বছর আগে -

তৃষা - "স্যার, সব কটাকে খুন করে ফেলেছি এবার আমার টাকা টা দিন স্যার। আমার বাবাকে বাঁচাতে পারবোনা নাহলে, প্লিজ স্যার।"

বাবার অপারেশনের টাকা যোগাড় করতে পাঁচটা খুন করতে বাধ্য হয় সে। আর তার পরেই সারা পৃথিবীর কাছে তৃষা মল্লিক মৃত। রাতারাতি দেশ ছেড়ে বিদেশে অন্য নাম অন্য পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছে সে। প্লাস্টিক সার্জারি করেও মুখের কিছুটা আদল একই রয়ে গেছে সেটাই মেকআপ আর পরচুলা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা চলবে সারাজীবন।

ভারতীয় আস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদ (নাস্তিক্যবাদ) -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 21, 2024 | নাস্তিকতা | views:732 | likes:2 | share: 2 | comments:0

ভূমিকা: আপনাকে মনে রাখতে হবে। এই লেখা" ভারতীয় বস্তুগত সংস্কৃতি তাই এই লেখার সাথে' বর্তমান ভাষা সাহিত্য মিল কম। নাস্তিক শব্দ মানে ! বেদ বিরোধী ভারতীয় দর্শন মতে, এই নাস্তিক শব্দ বাংলাতে বলে = অনীশ্বরবাদী ইংলিশে Atheist বলা হয়। আমরা সবাই কম বেশি জানি। আর ভারতে কিছু নাস্তিকও নাস্তিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত পড়ালেখার অভাবের কারণে এই ভুলটি বলে থাকেন। ভারতবর্ষে উদ্ভূত দর্শনসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় আস্তিক ও নাস্তিক। যে দর্শন বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে তা আস্তিক। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত এই ছয়টি আস্তিক দর্শন এবং এগুলিকেই একত্রে বলা হয় ষড়দর্শন।

 

আর চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন বেদে বিশ্বাসী নয় বলে এগুলি নাস্তিক দর্শন হিসেবে পরিচিত। উলে­খ্য যে, আস্তিক-নাস্তিকের ক্ষেত্রে ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনো কারণ নয়, যেমন ষড়দর্শনের মধ্যে সাংখ্য ও মীমাংসা জগতের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, অথচ উভয়ই বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে। বৈশেষিক দর্শনেও সরাসরি ঈশ্বরের কথা নেই। সাংখ্য ও যোগ জগতের স্রষ্টা হিসেবে পুরুষ ও প্রকৃতিকে স্বীকার করলেও যোগ ঈশ্বরের স্বতন্ত্র সত্তায় বিশ্বাসী। ন্যায় আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও জগতের স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করে এবং বেদান্ত ঈশ্বর (সগুণ ব্রহ্ম) তথা ব্রহ্মে (নির্গুণ) বিশ্বাসী; বেদান্তমতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, আর সব মিথ্যা। ফলে দেখা যায় যে, একই উৎস থেকে জন্ম হলেও আস্তিক দর্শনগুলির মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে অমিল রয়েছে এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সেগুলি ভিন্ন ভিন্ন মতামত পোষণ করে।

 

চার্বাক দর্শন নাস্তিক দর্শন জড়বাদী। চার্বাক বা নাস্তিক দর্শন যে অতি প্রাচীন। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ ও সাহিত্যে,মহাভারতে এই মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। জড়বাদী দর্শন ঘোরতর বেদ-বিরোধী এবং বেদ নিন্দুক তাই [১] মনুস্মৃতি তে ঋষি মনু বলেছেন "নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ"-অর্থাৎ যে বেদ নিন্দা করে (অপমান, ত্যাগ করে অথবা বিরূদ্ধাচরণ করে তাহলে কাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করো )। কেউ যদি চেতন-সত্ত্বা কে অস্বীকার করে জড়বাদী হয়, তা তার বুদ্ধি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

 

চার্বাক মতে, পাপ নেই, পুণ্য নেই। পাপ-পুন্যের কর্মফল ভোগও নেই। অতিপ্রাকৃত কিছুই নেই। ঐহিক ইন্দ্রিয় সুখই একমাত্র সুখ। দেহের মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকে না। ইন্দ্রিয়লিপ্সু সাধারণ মানুষের কাছে চার্বাক নিতি খুবই হৃদয়গ্রাহী বা মনোরম, সহজ কথায় বেদ, উপনিষদ, ব্রাহ্মনগ্রন্থ, আয়ুর্বেদ..ভারতীয় দর্শনের মূল চিন্তাভাবনা থেকে চার্বাক, নাস্তিকতা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। এই দর্শনের কথা হল-কামের (ইন্দ্রিয়-সুখ) চরিতার্থই মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বা পরমপুরুষার্থ যা অন্যান্য দর্শন ও বৈদিক শাস্ত্রে ত্রিবিধ দোষ থেকে মুক্তির উপায় বা মোক্ষ প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। এই দর্শন বলে-যতদিন বাঁচবে ভোগ-সুখে বেঁচে থাক, প্রয়োজন হলে ঋণ করেও ঘি খাও। জীবনে খাও-দাও ফূর্ত্তি কর, কেননা আগামীকালই তোমার মৃত্যু হতে পারে। ভবিষ্যতের না-পাওয়া সুখের মিথ্যা ছলনায় বর্ত্তমানকে ত্যাগ করো না। বাকি কিছু বৈদিক মান্যতা গ্রহণ করে তাঁরা এটা মানে সুখই স্বর্গ, দুঃখই নরক কিন্তু সুখের পরিভাষা তাঁদের আলাদা।

 

এই মতে দেহাতিরিক্ত আত্মা নেই, দেহের সুখই আত্মার সুখ। কোন কারণেই নিজেকে ইহলৌকিক সুখ থেকে বঞ্চিত করো না। সাধারণ লোকের কাছে এই ধরনের কতা শ্রুতিমধুর বা চারুবাক্ বলে এই দর্শনের নাম "চার্বাক" হয়েছে। তবে অনেক পন্ডিতের মতভেদ আছে "চার্বাক" নামের উৎপত্তি বিষয়ে।

 

যেমনঃ "চর্ব"-ধাতুর অর্থ হল "খাওয়া দাওয়া করা বা চর্বণ করা"। এই দর্শনের খাওয়া দাওয়াকে, ইন্দ্রিয়-সুখকে, জীবনের পরমপুরুষার্থ বা কাম্যবস্তুরূপে মনে করে বলে এর নামকরণ "চার্বাক" হয়েছে। চার্বাকের একটি নীতিবাক্য হল "যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ"। আবার অনেকের মতে এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা দেবগুরু বৃহস্পতি। চারু শব্দের একটা অর্থও বৃহস্পতি। তাহলে "চারুর্ বাক্" অর্থাৎ "বৃহস্পতির কথা"। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই দর্শন অনুসরণ করে অসুরকুল যাতে সমূলে ধ্বংস হয় তার আয়োজন। এই দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায় আছে যথাঃ বৈতন্ডিক, ধূর্ত, সুশিক্ষিত।

 

এই জ্ঞানতত্ত্বের সার কথা হলঃ (ক) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ [প্রত্যক্ষমেকৈব্-Perception is the only source of Knowledge], চার্বাকের এই মত মানলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান না করলে চলে না। লোকযাত্রা নির্বাহের জন্য তাই প্রত্যক্ষ-অতিরিক্ত অনুমানকেও স্বীকার করতে হয়। (খ) অনুমান প্রমাণ নয়, (গ) আগম বা শব্দ প্রমাণ নয়, (ঘ) বেদবাক্য, শ্রুতিবাক্য প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য় নয় কোন বিজ্ঞানীর শ্রুতি বাক্য বা অনুমান তাঁর মান্যতাদেয়। প্রত্যক্ষের অর্থ প্রথমত অনুভব {ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ(যোগ) জনিত অনুভব}, দ্বিতীয় প্রত্যক্ষ অপরোক্ষ অনুভব [টেবিল দেখে টেবিলের যে জ্ঞান তা অন্য কোন জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না],তৃতীয় প্রত্যক্ষ সম্যক অনুভব [সম্যক অর্থে সংশয়শূন্য ও বিপর্যয়শূন্য। অনিশ্চিত জ্ঞান হচ্ছে সংশয়। যেমন- ঐ বস্তুটি মূর্ত্তি, না মানুষ? মিথ্যা জ্ঞানকে বলে "বিপর্যয়"-আকাশে দুটি চাঁদের জ্ঞান]। প্রত্যক্ষ দ্বিবিধ-বাহ্যপ্রত্যক্ষ [চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-এই পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাইরের জগতের যে সাক্ষাৎ] ও মানসপ্রত্যক্ষ [মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার সাক্ষাৎ]।

 

ন্যায় দর্শন বা বৈশেষিক দর্শনের সমস্ত প্রামাণ কে চার্বাক দর্শন গ্রহন করে না, বৈদিক দর্শন শাস্ত্রে "প্রত্যক্ষ" শব্দটি-কে যেমন যথার্ত জ্ঞান লাভের উপায় অর্থে ব্যবহার করা হয় তেমনি আবার 'যথার্থজ্ঞান' অর্থেরও ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ "প্রত্যক্ষ" শব্দটি একই সঙ্গে "প্রমাণ" এবং "প্রমা" অর্থে ব্যবহার করা হয়।

 

চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ আবার সবিকল্প অথবা নির্বিকল্প হতে পারে[যেমন- আমি "একটা কিছু" দেখেছি, কিন্তু সেটা কি বস্তু, সে জ্ঞান একনও হয়নি]। যাই হোক অন্যান্য দর্শন শাস্ত্রে প্রত্যক্ষকে প্রমাণরূপে স্বীকার করলেও একমাত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করেন না। চার্বাক মতে পরোক্ষ জ্ঞান অস্পষ্ট ও অযথার্থ, এই যুক্তি তে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেও অযথার্থ বলতে হয়, কেননা প্রত্যক্ষজ্ঞানও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইন্দ্রিয়-নির্ভর, তাই তা পরোক্ষ তা অযথার্থই।

 

আবার দেখুন নাস্তিক চার্বাক মতে "সকল ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ"-সকল ক্ষেত্রেই বলতে বর্তমান,অতীত ও ভবিষ্যতের প্রত্যক্ষ-জ্ঞান বোঝায়, যা প্রত্য়ক্ষের দ্বারা যাচাই করা যায় না। তাহলে মানতে হয় যে, চার্বাকরা প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমানকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেছেন। চার্বাক মতে, 'অনুমান ও শব্দ" প্রমাণ নয়, যেখানে ঋষি বাক্যও বৈদিক সংস্কৃতিতে শব্দ প্রমাণ মানা হয়। চার্বাক মতে অনুমান ও শব্দ-প্রমাণ অনেক সময় ভ্রান্ত জ্ঞান দেয়। একই যুক্তিতে প্রত্যক্ষেও প্রমাণরূপে প্রহণ করা যায় না, কেননা প্রত্যক্ষজ্ঞানও অনেক সময় ভ্রান্ত হয়। রুজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, শুক্তিতে (মুক্তো) রজত (রৌপ)-ভ্রম হয়। চার্বাক মতে অনুমান প্রমাণ নয়, কেননা অনুমানের দ্বারা "প্রমা" অর্থাৎ নিঃসন্দিগ্ধ জ্ঞানলাভ হয় না। ধূম দেখে বহ্নির যে জ্ঞান তা অনুমানলব্ধ জ্ঞান। এ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের মতে কখনই নিঃসন্দগ্ধ হতে পারে না। অনুমান ব্যাপ্তিজ্ঞানের ওপর নির্বর করে। ব্যপ্তি হল হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত সহচর-সম্বন্ধ। দূরের পাহাড়ে ধূম দেখে যখন "সেখানে আগুন আছে" বহা হয়, তখন তা হল অনুমান। এখানে অনুমান প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপঃ

 

ঐ প্রর্বতটি ধূমযুক্ত যে যে বস্তু ধূমযুক্ত সেই সেই বস্তু বহ্নিযুক্ত পর্বতটি বহ্নিযুক্ত।

 

প্রতিটি অনুমানের ক্ষেত্রে তিনটি পদার্থ থাকে-পক্ষ, হেতু ও সাধ্য (যা অনুমিত হয় তা সাধ্য)। এখানে 'বহ্নি" হচ্ছে সাধ্য, কেননা বহ্নি অনুমিত হয়েছে। যার সম্বন্ধে অনুমিত হয় তা পক্ষ। এখানে "পর্বত" সম্বন্ধে অনুমিত হয়েছে। তাই পর্বত হচ্ছে "পক্ষ"। যার সাহায্যে বা য়ার ওপর নির্বর করে অনুমিত হয় তা হেতু। এখানে ধূম হচ্ছে "হেতু", কেননা ধূম-প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে পর্বতে বহ্নি অনুমিত হয়েছে।হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সহচর-সম্বন্ধ হল ব্যপ্তি। হেতু ও সাধ্যের 'নিয়ত সম্বন্ধ" বলতে বোঝায়- যেখানে হেতু সেকানে সাধ্য এবং এমন কোন ক্ষেত্রে নেই যে, হেতু আছে কিন্তু সাধ্য নেই। উল্লিখিত উদাহরণে ধূম (হেতু) ও বহ্নি (সাধ্য) মধ্যে নিয়ত সাহচর্য বা ব্যপ্তি-সম্বন্ধ আছে। যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে এবং এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেকানে ধূম আছে কিন্তু বহ্নি (আগুন) নেই। 

 

নাস্তিক দর্শনগুলি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না; সেগুলি অনাত্মবাদী ও জড়বাদী। চার্বাকদের মতে প্রত্যক্ষই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় এবং যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষযোগ্য নন, সেহেতু তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই। বৌদ্ধদর্শনের আলোচ্য বিষয় মানবজীবন; মানুষের দুঃখমোচনই এ দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। বৌদ্ধমতে জগতের সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তনই জগতের একমাত্র সত্য; যেহেতু কোনো কিছুই শাশ্বত নয়, সেহেতু নিত্য আত্মা বলতেও কিছু থাকতে পারে না। জৈনরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। এ দর্শনে দ্রব্যসমূহকে ‘অস্তিকায়’ ও ‘নাস্তিকায়’ নামে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যার বিস্তৃতি ও কায় (দেহ) আছে তা অস্তিকায়, যথা জীব ও অজীব (জড়) এবং যার বিস্তৃতি ও কায় নেই তা নাস্তিকায়, যথা কাল (time)। বঙ্গদেশে উপরিউক্ত দর্শনসমূহের প্রত্যেকটিরই কম-বেশি চর্চা হয়েছে এবং এখনও গুরুপরম্পরা ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হচ্ছে; তবে ন্যায়, বিশেষত নব্যন্যায়ের চর্চার জন্য এক সময় এদেশ সমগ্র ভারতে বিখ্যাত ছিল।

 

নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। ইংরেজি ‘এইথিজম’(Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্য বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ (ἄθεος) শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাস কে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪% থেকে ৬৫% নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ৬% (ইতালী) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পরলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা কোন বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সকলে বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে যে কেউ, যে কোন মতাদর্শে সমর্থক হতে পারে,নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে অবিশ্বাস করা।

 

ইংরেজিতে Believe, Trust, Faith এই তিনটি শব্দের অর্থ আগে জেনে নেয়া যাক।

 Believe (অনুমান, বিশ্বাস, বিশেষভাবে প্রমাণ ছাড়াই মেনে নেয়া)

1. accept that (something) is true, especially without proof.

2. hold (something) as an opinion; think.

যেমন, ভুতে বিশ্বাস করা। এলিয়েনে বিশ্বাস করা। অথবা, বিশ্বাস করা যে, অতীতে আমাদের পুর্বপুরুষ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল। যার সপক্ষে এই বিশ্বাসী মানুষটি কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও তা তিনি বিশ্বাস করেন। 


Trust (আস্থা)

1. firm belief in the reliability, truth, or ability of someone or something.

কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ধারণার আলোকে কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা করা। যেমন আমি আমার অমুক বন্ধু সম্পর্কে আস্থাশীল যে, সে টাকা ধার নিলে আমাকে ফেরত দেবে। বা ধরুন, অমুক পত্রিকাটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছাপে বলে আপনি মনে করেন। কারণ, অমুক পত্রিকাটি কয়েকবছর ধরে পড়ার কারণে পত্রিকাটির প্রতি আপনার আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে, আপনার এই আস্থার পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে আপনার পুর্ব অভিজ্ঞতা।

 

তথ্যসূত্র 

1 || মনুস্মৃতি 2/11

2 || চার্বাক দর্শন- হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়

3 || লোকায়ত দর্শন- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

4 || সত্যার্থ প্রকাশ- দয়ানন্দ সরস্বতী

5 || ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

6 || Sutta Nipata - Khuddaka Nikaya

7 || Materialism in Indian Thought - K.K. MITTAL

ইনকিলাব জিন্দাবাদ -সুমন কর্মকার
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:722 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা গরিব লোক ছিল। গরিব মানে এক্কেবারে গরিব, যাকে বলে হতদরিদ্র। চাল-চুলো কিচ্ছু ছিল না। লোকটা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো আর টুকটাক কাজ করত। এই কারও বাড়িতে মিস্ত্রী লেগেছে ও লেগে যেতো বালি চালা অথবা ইঁট বওয়ার কাজে, কারও অনুষ্ঠান বাড়ি হচ্ছে, ও লেগে যেতো পাত পরিষ্কার করতে, যখন কিছুই জুটতো না তখন শাসকদলের মিছিলে পা মেলাতো, সেদিনের মতো রাতের খাওয়া দাওয়া তো জুটতোই, স্থানীয় নেতার মন ভালো থাকলে থাকলে কখনো সখনো বিশ পঞ্চাশ টাকা নগদও মিলে যেতো। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো। গরিব লোকটার কোনো দুঃখ ছিল না। মনে করতো এই বেশ ভালো আছি।

তা একদিন ওই গরিবটা এরকমই একটা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে গেলো এক বিশাল সভায়। দেখলো চারদিকে লোকে লোকারণ্য, ওর পাড়া থেকেও বহু মানুষ এসেছে এবং কাতারে কাতারে এসেই চলেছে। কোন দূর দেশ থেকে নাকি বিশাল বড় মাপের এক নেত্রী এসেছেন হেলিকপ্টারে চড়ে। তারই বক্তব্য শোনানোর জন্য সব পাড়া থেকে লোক নিয়ে আসা হয়েছে। সেই সকাল থেকে জমায়েত শুরু হয়েছে। দুপুর নাগাদ ওকে নগদ দুশো টাকা দিয়ে দিলেই ও ফেরার পথ ধরবে। পাড়ার নেতার সাথে সেরকমই কথা হয়ে আছে। বড় নেতা, মাঝারি নেতা, ছোটো নেতার বক্তব্য শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেলো। ভিড়ের মাঝে সেই পাড়ার নেতার দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। মঞ্চের সবাই চলে গেলে বিকেল নাগাদ দেখা মিললো নেতার। একগাল হেসে গরিবকে দুশোটা টাকা ধরিয়ে দিলো। ওর মতো আরও অনেকেই টাকা পাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। নেতা সবাইকে হেসে হেসে পয়সা দিতে থাকলো। গরিব টাকা নিয়ে ফেরার পথ ধরতেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলো ওদেরই পাড়ার একটা বৌয়ের সাথে পাড়ার নেতাটার একটা ঝগড়ামতো হচ্ছে। বৌটাকে গরিবটা চেনে। গেল বছর ওর বরটা রেলে কাটা পড়েছে, এখন দু তিনটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে খায়। বৌটা এসেছে ওর তিনটে মেয়েকে নিয়ে। তার মধ্যে একটা আবার কোলে, সেটা সমানে কেঁদেই চলেছে। আর বাকিদুটো এতোই ধুঁকছে, মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে। বৌটার অবস্থাও তেমনই। নেতা বলছে দুশো টাকার বেশি এক পয়সা দিতে পারব না। আর বৌটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে চলেছে, না বাবু আমরা তো চারজন আছি। কম করে তিনশোটা টাকা দাও। আস্তে আস্তে নেতার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। এতোগুলো লোককে পয়সা দিতে হবে, পাড়ার ক্লাবে রাতের ফিস্টের সব আয়োজন করতে হবে। আজ আবার ছেলেগুলো বাংলা ছেড়ে ইংলিশ খাবার বায়না ধরেছে। তার মধ্যে আবার এই। কাঁহাতক সহ্য হয়? বৌটাও নাছোড়বান্দা। নাকি সুরে একই কথা বারবার বলে চলেছে। নেতা আর পারলো না। হাতটা খানিক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একবার ওপরে উঠে আবার নীচে নেমে এলো। সপাটে একটা চড়। বৌটা বাচ্চা সমেত ধপ করে পড়ে গেলো। বাকি দুটো মেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নেতা একটু মুচকি হেসে নোটের গোছা হাতে পরেরজনের দিকে এগিয়ে গেলো। The show must go on. 

কিন্তু না, শো টা চালু রইলো না। নেতা হঠাৎ মাথা চেপে বসে পড়লো। কোন ফাঁকে গরিবটা একগাছা ইঁট তুলে নেতার একেবারে ব্রম্ভতালুতে সজোরে বসিয়ে দিয়েছে। পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় আশেপাশের লোকজন খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারই মধ্যে নেতার চ্যালাদের একজন চিল চিৎকার করে উঠলো, 'মেরে ফেললো রে, পাগলাটা কেষ্টদাকে বোধহয় মেরেই ফেললো'। পুলিশ এলো। গরিবটা পালানোর চেষ্টা করলো না। পুলিশ টানতে টানতে ওকে জিপে তুললো। জিপে ওঠার থেকেই শুরু হলো অকথ্য মার। ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের নেতাকে 'attempt to murder' বলে কথা। খাঁকি নিজের প্রভুভক্তি প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করল না। চলল বুট, লাঠির যথেচ্ছ ব্যবহার। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে পুলিশগুলোর একজন বলে উঠলো, 'স্যার! একে খামোখা থানায় নিয়ে গিয়ে ফ্রির খাবার খাওয়ানোর কি মানে হয়? বলেন তো এখানেই ঠুকে দিই?' স্যারের কথাটা বেশ পছন্দ হলোনা। বললেন, 'আরে ধ্যাত! সারাজীবন রাজা উজির মেরে রিটায়ারমেন্টের আগে এসে কি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব? নিয়ে চল থানায়। রাতে পার্টির লোকজন এলে ওদের হাতেই তুলে দেবো। ওরাই যা পারে করুকগে যাক।' তাই হলো। রাতের অপেক্ষায় গরিবটা আধমরা অবস্থায় গারদে পড়ে রইলো। সন্ধ্যে পেরিয়ে একসময় রাত হলো। পার্টির লোকও এলো। বিলিতি মদের গন্ধে থানাটা ম ম করতে লাগলো। গারদ থেকে টেনে হিঁচড়ে গরিবটাকে বের করে নিয়ে আসা হলো। থানা থেকে বেরিয়ে সোজা যাওয়া হবে নেতার ফার্ম হাউসে। সেখানেই গরিবটাকে খালাস করা হবে। শালার বড্ড বাড় বেড়েছে। কিন্তু এ কি! এতো আওয়াজ কিসের? এতো আলোই বা আসছে কোথা থেকে? একটা হাবিলদার স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো, 'হুজুর লাল পার্টির লোক এসেছে। হাতে মশাল নিয়ে থানা ঘেরাও করে বসে আছে। বলছে ওরা নাকি গরিবটার নিঃশর্ত মুক্তি চায়।' গরিবটা মেঝেতে পড়ে পড়ে এসব শুনে অবাক হয়ে গেলো। ওকে বাঁচাতে এত্তো লোক এসেছে? এরা কারা? শুনতে শুনতে একসময় ও পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়লো। যেটুকু চেতনা ছিল তাতেই বুঝত পারলো পুলিশগুলো ওকে বের করে নিয়ে আসছে। চারদিক থেকে গগনভেদী কান ফাটানো আওয়াজ আসছে, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে ও দেখলো কয়েকজন ওর মতোই হতদরিদ্র মানুষ ওকে বুকে জাপটে জড়িয়ে ধরছে আর বলে চলেছে কয়েকটা অদ্ভুত শব্দ। 'লাল সেলাম, কমরেড'।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: বিজ্ঞানী থেকে সমাজকর্মী -পার্থ সারথী চন্দ্র
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:680 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই খুঁজে বের করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

আপনি ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ এর ওষুধের নাম জানেন? এ কালের অনেকেই হয়তো বলবেন, ওসব বেঙ্গল-ফেঙ্গল এখন চলে না। মডার্ন মেডিসিনের যুগ। 'ভারতীয় রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় স্থপয়িতা', 'বেঙ্গল কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড' ও তার প্রতিষ্ঠাতা রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম হয়তো এখন খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই জানেন।

স্বাদেশিকতা বোধ তো দূর অস্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল প্রফুল্ল রায়ের জন্মদিনটা ২ আগষ্ট কি না কনফার্ম হবার জন্য তিনটে বাংলা ক্যালেন্ডার ও দুটো ইংরেজি ক্যালেন্ডার দেখতে গিয়ে অবাক হলাম কোথাও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জন্মদিনের উল্লেখ না দেখে। অথচ কত বাবা, ক্ষ্যাপা প্রমুখের জন্মদিন, ছটপুজো, কৌমুদী পুর্নিমা এ সবেরই উল্লেখ আছে। নেই শুধু স্যার পি সি রায়ের নাম।

বাঙালির এই অধঃপতিত অবস্থার কথা শতবর্ষাধিক আগেই লিখে গেছেন তাঁর 'অন্ন সমস্যা ও বাঙ্গালীর নিশ্চেষ্টতা' প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ১৮৬১ সালে জন্মেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালির মনন থেকে মুছে গেছেন। অথচ তিনি বার বার 'ডিগ্রিপ্রিয়,চাকরি প্রিয় বাঙালিকে' 'বিলাসের আরামশয্যা' থেকে জাগাবার চেস্টা করে গেছেন, তাদের দোষ ত্রুটি শুধরে নিতে পথনির্দেশ করেছেন। বাঙালি 'আলস্যের নিদ্রায় সুখের স্বপ্ন দেখে', 'বুদ্ধির অহংকারে অন্ধ হইয়া' জীবন সংগ্রামে ফাঁকি দেয়। ফলে 'বাঙালি সকল দিকের সকল ক্ষেত্র হইতে পরাজিত হইয়া পশ্চাদপদ হইতেছে'।

তিনি কেবল একজন অসামান্য বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও কবিও ছিলেন। শুধুই নীরস বিজ্ঞানশিক্ষা নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে বিজ্ঞানমনস্ক তথা বিজ্ঞানচেতনা সম্পন্ন করে তোলাই ছিল প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আজীবনের সাধনা। বই থেকে পড়া বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিবর্তে ব্যবহারিক এবং ফলিত বিজ্ঞানের প্রসারে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রকল্পে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ব্যবসা-বিমুখ বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা বাঙালিকে স্বাবলম্বী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

হরিশ্চন্দ্র রায়। ভদ্রলোকের জমিদারি তখন পড়তির দিকে। বাড়িতে পাওনাদারদের নিয়মিত কড়া নাড়া। স্ত্রী ভুবনমোহিনীদেবী অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের গয়নার টাকায় কেনা জমিদারির তালুক বিক্রির কাগজে সই করছেন। তাঁদের কলকাতার বাসা উঠে গেল। ফিরলেন খুলনার গাঁয়ে। ছেলেরা উঠলেন হস্টেলে। সেজো ছেলের জীবনে এই দৃশ্যটি মনে থেকে গেল। কিছু দিন পরে সেই ছেলেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতের পথে রওনা দিতে উদ্যোগী হলেন। যাওয়ার আগে মা’কে বললেন, ‘জীবনে সাফল্য লাভ করলে, প্রথমেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও বাড়ির সংস্কার করব।’

সে কাজ বেশ কিছুটা করেওছিলেন। কিন্তু বাড়ির তুলনায় বাইরের জগৎ তাঁকে যে বেশি টানে। সেই টান আর দেশের কাজের জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আচার্য’। তিনিই প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু একটি বিষয়ই বলা যেতে পারে, তা হল - মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারকে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হলেও যৌগটির ‘অস্তিত্ব’ এখনও অধরা, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব, ‘জৈব নাইট্রাইট, গন্ধকযুক্ত বিবিধ জৈব যৌগ এবং ধাতব লবণের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়া, জৈব হ্যালোজেন যৌগ বিশেষত ফ্লোরিনযুক্ত এবং পারদের ধাতু যুক্ত জৈব যৌগ - এ সবের প্রস্তুতি ও পরীক্ষণের সূচনা’ করা। কিন্তু এ বিষয়গুলি বহুল চর্চিত। তাই জীবনভর নানা কাজ, জেদের মধ্য দিয়ে কী ভাবে প্রফুল্ল-চরিত্র তৈরি হয়েছিল, তা সন্ধানেরই চেষ্টা করব আমরা।

রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় রইল না।

রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলার মন্ত্রটিও প্রবেশ করিয়ে দিতেন তিনি। যত টুকু দরকার, তার বাইরে কতটুকুই বা পড়ার আগ্রহ আছে আমাদের বইবিমুখ আগামীর? অথচ, বই পড়ার আগ্রহ থেকেই জন্ম হয়েছিল এই বাঙালি মনীষীর। নিজের সফলতাকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সার্থকতার শিখরে। 

১৮৬১, ২ অগস্ট অবিভক্ত বাংলাদেশের রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রপিতামহ মানিকলাল রায় ছিলেন নদিয়া (কৃষ্ণনগরের) ও যশোরের কালেক্টরের দেওয়ান। পিতামহ আনন্দলাল রায় ছিলেন যশোরের সেরেস্তাদার। পিতা হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। বাবা মায়ের আদরের সেই ছোট্ট ফুলু পরবর্তীতে  হয়ে ওঠেন ‘মাস্টার অফ নাইট্রাইটস’ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কেমন ছিল তাঁর এই জীবন পথ?

নিজ গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই তাঁর শিক্ষার সূচনা। পিতা পুত্রের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। বই পড়া অপেক্ষা পিতার সঙ্গে কথা বলে অনেক বিষয় বেশি করে শিখতেন। ১৮৪৬ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসনের  লেখা ‘ব্রিটিশ কবিগণের জীবনী’ বইটি তিনি পান তাঁর পিতার কাছ থেকে। এটাই ছিল তাঁর অমূল্য পৈতৃক সম্পদ।

১৮৭০ সালে সপরিবার চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। রাত জেগে পড়াশোনা করার ফলে হজমের সমস্যা ও রক্ত আমাশয় হলে তিনি ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। এই অসুস্থতাই ছিল তাঁর জীবনে ছদ্মবেশী-আশীর্বাদ। কারণ গ্রামে এসে তিনি অনেকখানি সময় কাটাতেন পিতার তৈরি লাইব্রেরিতে। বাঁধাধরা বইয়ের বাইরে, শেক্সপিয়ার, এমার্সন, কার্লাইল, ডিকেন্সের রচনা, নিউটন, গ্যালিলিও, ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী, বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি ইচ্ছেখুশি বই পড়ার আনন্দে মেতে উঠলেন তিনি। স্যর উইলিয়াম জোন্সের প্রশ্নের উত্তরে জোন্সের মায়ের উক্তি ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’ কথাটি প্রফুল্লচন্দ্রের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে।

সুস্থ হয়ে ১৮৭৩ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। এরপর এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হন মেট্রোপলিটনে। কারণ বিদ্যাসাগরের এই কলেজটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেটি তাঁর ‘নিজের’ বলে মনে হত। ভারতে  প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটিই উচ্চশিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার মতো সুলভ করার সাহসী প্রচেষ্টা দেখায়। এফএ পড়ার সময় থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজে 'বাইরের ছাত্র' হিসেবে অধ্যাপকদের রসায়ন বিষয়ে বক্তৃতা শুনতেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইংরাজি সাহিত্যানুরাগী প্রফুল্লচন্দ্র বিজ্ঞানের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। রসায়ন নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। এখানে তিনি বিখ্যাত প্রফেসর আলেকজান্ডার পেডলারের সান্নিধ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ গৃহেই ছোট্ট গবেষণাগার গড়ে গবেষণা শুরু করেন। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির 'গিলক্রাইস্ট বৃত্তি' পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হন। ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।

এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৮৮৪ সালে বি. এস. সি. ডিগ্রি পান। এখানে 'ইন্ডিয়ান বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য মিউটিনি’ বিষয়ে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সত্যের সাধক ছিলেন বলেই ভারতে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাব সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন তাঁর সেই লেখায়। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধটি পুরস্কৃত না হলেও প্রশংসিত হয়েছিল। এডিনবার্গ থেকেই ১৮৮৭ সালে ডি. এস. সি. ডিগ্রির সঙ্গে সঙ্গে ‘হোপ প্রাইজ’ বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮৮-তে তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়।

দেশে ফিরে কার্যত ১১ মাস কর্মহীন ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র! এই পর্বে বিশেষ ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন জগদীশচন্দ্র বসু ও বন্ধুরা। শেষমেশ ১৮৮৯-র মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সি কলেজে আড়াইশো টাকা বেতনের ‘সহকারী অধ্যাপক’-এর কাজ জুটল প্রফুল্লচন্দ্রের। তত দিনে তাঁর যোগ্যতার প্রতি সরকার অবিচার করেছে, ক্রফট সাহেবের কাছে সে কথা বলতে অপমানও হজম করতে হল তাঁকে। ক্রফট উদ্ধত ভাবে তাঁকে বললেন, ‘আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেউ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করছে না!’ পাশাপাশি, বাংলার শাসনকর্তা চার্লস ইলিয়ট ‘ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে’ ভারতীয়দের নিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দিলেন।

প্রেসিডেন্সিতে বিখ্যাত অধ্যাপক স্যার আলেকজাণ্ডার পেডলারের সান্নিধ্যে নিজের ঘরেই একটি ছোটোখাটো গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, সেখানেই চলতে থাকে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিরলস জ্ঞানচর্চা। প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারটি হয়ে উঠল প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মার সঙ্গী। ভারতীয় নানা খাদ্যদ্রব্য ও তার ভেজাল নিয়ে এই পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণটি করলেন তিনি।

পাশাপাশি, তাঁর অধ্যাপক-সত্তাও ক্রমে বিকশিত হতে শুরু করল। ১৯০৯ সাল ভারতের রসায়ন তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, রসিকলাল দত্ত-সহ একঝাঁক কৃতী ছাত্র পেল প্রেসিডেন্সি। ছাত্রেরা পেলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পরবর্তী সময়ে তৈরি হবে ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি’

তিনি। তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি ও রসবোধ দিয়ে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে রসায়নের পাঠ ছাত্রদের কাছে সহজবোধ্য ও মনোগ্রাহী করে তুলতেন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সফলতার জীবন কাহিনি গল্পের ছলে তুলে ধরতেন ছাত্রদের কাছে। অল্প সময়েই শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর গবেষণা।

আসলে ছাত্র-রত্নদের চিনতে পারাটাই মাস্টারমশাইয়ের আসল কৃতিত্ব। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কথা বলতে হয়। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি। কিন্তু ‘ব্যবহারিক রসায়ন’-এ তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষাগারে কিছু দিন কাজ করেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে নিজের গবেষণা কাজে সহায়তার জন্যও ডেকে নিলেন। কালক্রমে, জিতেন্দ্রনাথ সরকারি আফিম বিভাগে বিশ্লেষকের চাকরি পান।

প্রেসিডেন্সির পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ১৯১৬-এ সায়েন্স কলেজে যোগ দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের দানে তৈরি এই কলেজ। কিন্তু সরকার এই কলেজ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। দ্বিধাহীন ভাবে বিলেতের মাটিতে দাঁড়িয়েই প্রফুল্লচন্দ্র বললেন, তাঁরা কলেজের জন্য অনুদান চাইলেই সরকার বলে ‘অর্থাভাব’। উল্টো দিকে, দেশের ধনী ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে মুখ ফিরিয়ে থাকারও সমালোচনা করলেন।

অথচ নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দশ হাজার টাকা দান, মাদ্রাজ, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাপ্য অর্থ সেখানেই দিয়ে আসা, কলকাতার সিটি কলেজ, এমনকি গ্রামে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির পাশে দাঁড়ানো - এমন নানা কাজ আজীবন করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র।

আসলে শিক্ষার জগতে প্রফুল্লচন্দ্র একটি ‘লেগাসি’। বিষয়টি তাঁর ছাত্র নয়, বরং তাঁর ‘ছাত্রের ছাত্র’র মুখে শোনা যাক। এই ছাত্রটি বলছেন, ‘আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছি যে, স্যার পি সি রায়ের ছাত্র হতে পারিনি। সে জন্য হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করেননি।...আমি তাঁর রাসায়নিক ‘প্রশিষ্য’ হয়েছি। পি সি রায়ের ছাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে আমি রসায়ন শিখেছি।’ বক্তব্যটি, ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার যাঁর নামে, সেই শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের!

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস তাঁর 'প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানে অগ্রগতি' প্রবন্ধে লিখেছেন :-

"আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিদেশে রসায়নে কৃতবিদ্য হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দেশে ফিরে এলেন। এদিকে যেমন ভাবছেন কি ভাবে দেশে রাসায়নিক শিল্পের পুনরুজ্জীবন করা যায় অন্যদিকে অন্বেষণ শুরু করলেন প্রাচীন কালের পুঁথিতে রসায়নের উল্লেখের।

আচার্য রায় নিজের অধ্যাপনা আর গবেষণার কাজের বাইরের সময়টায় বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে তার থেকে বিভিন্ন তথ্য আবিস্কার করতেন। তিনি জেনেছিলেন যে পুরাকাল থেকেই ভারতবর্ষীয়রা ক্ষার (Alkali) ও অম্লকের (Acid) প্রস্তুত প্রণালী আবিস্কার করেছিলেন। লোহা‚ শিসা‚ তামা‚ টিন‚ পারদ ইত্যাদি ধাতুদের বিশেষ অবস্থায় আনতে পারতেন।  নানা শোধনক্রিয়া তাঁরা অনুসরণ করতেন। ধাতুভস্ম প্রস্তুত করার অনেক উন্নত প্রণালী তাঁদের জানা ছিল। রাসায়নিক নানা প্রক্রিয়ার জন্য তাঁরা নানা যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছিলেন। পুঁথির অনেকগুলিতে পারদের নানা রূপান্তর বর্ণনা পান তিনি। গন্ধকের সাথে নানা ধাতুর যৌগিক পদার্থ অনেকগুলি ভারতবর্ষীয়দের আবিষ্কার বলে জেনেছিলেন আচার্য। বহু বছর পরিশ্রম করে ভারতবাসীদের বিজ্ঞানচর্চার এক নতুন অধ্যায়ের খবর দিয়ে বিশ্বের পণ্ডিত মহলে এক বরেণ্য স্থান অধিকার করলেন আচার্য রায়। 

এ দেশ থেকে গণিতের অনেক আবিস্কার যে আরবজাতির মাধ্যমে পাশ্চাত্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তা কোলব্রুক সাহেব আগেই দেখিয়েছিলেন। কোলব্রুক সাহেব এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে খৃস্টাব্দ পঞ্চম শতাব্দীর আশেপাশে আর্যভট্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। আর্যভট্ট নাকি শিক্ষা দিতেন যে পৃথিবী দৈনিক তার অক্ষের চারদিকে ঘুরছে। তিনি সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ সঠিক বার করে নাকি বলেছিলেন‚ চন্দ্র কি গ্রহরা কেউই নিজে আলোক বিকিরণ করে না। তাদের উদ্ভাসিত করে সূর্যের আলো। আর্যভট্টের বইয়ে নাকি পৃথিবীর ব্যাস ১০৫০ যোজন ও তার থেকে পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত ২২/৭ (pi) ধরে পৃথিবীর পরিধি ৩৩০০ যোজন দাঁড়ায়। এই নির্ধারণ সত্য পরিমাপের খুব কাছাকাছি - যোজনকে চার ক্রোশের সমান ধরলে আর এক ক্রোশের মান ১.৯ মাইল ধরলে পৃথিবীর পরিধি দাঁড়াবে ২৫০৮০ মাইল যা বাস্তবের মাপের (24901 Miles) খুব কাছাকাছি। কোলব্রুক সাহেব আরও দেখিয়েছেন যে ভারতবর্ষীয়রা গণিতশাস্ত্রে Surd-এর ব্যবহার জানতেন। ঋণাত্মক সংখ্যার (Negetive Number) ব্যবহার করতেন তাঁদের বিশ্লেষণে। দ্বিঘাত সমীকরণ (Quadratic Equation) বা আরো জটিল সমীকরণের সমাধান তাঁরা জানতেন। 

আচার্য রায় সেই একই ব্যাপার দেখালেন রসায়নের ব্যাপারে। চরক ও সুশ্রুতের অনুবাদের সঙ্গে রাসায়নিক অনেক ভারতীয় প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। 

মহেঞ্জোদাড়োর উৎখননের থেকে আমরা জেনেছি এ দেশেই প্রথম নানা রঙের কাচ প্রস্তুত হত। ব্রোঞ্জ আর কাঁসার ধাতুর নানান উপকরণ আমরা পেয়েছি। এ দেশেই যে বিশুদ্ধ লোহা প্রস্তুত ও রপ্তানি হত সেই খবর আমরা পেয়েছি। ইস্পাত তৈরির রহস্যও ভারতের আবিস্কার। বিখ্যাত দামাস্কাস আর টলেডোর তরবারি নির্মাণে ভারতীয় ইস্পাতই ব্যবহার হত।"

এক দিন  হঠাৎই  তিনি আবিষ্কার করলেন রসায়নের এক অতি বিষম বস্তু' মারকিউরাস নাইট্রাইট'। রসায়নের ইতিহাসে এক চরম আশ্চর্যজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এই আবিষ্কার। পারদের সংস্পর্শে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিড রাখলে এই অস্থায়ী যৌগ উৎপন্ন হয়। প্রায় সমস্ত ধাতুরই নাইট্রাইট যৌগ আবিষ্কার করা সেসময় সম্ভব হলেও অত্যন্ত ভঙ্গুর ও অস্থায়ী এই বিশেষ যৌগটি কেউই তৈরি করতে পারেননি। এই গবেষণাপত্রটি প্রথম প্রকাশ পায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’-এর জার্নালে এবং একইসঙ্গে ১৮৯৬ সালের ২৮ মে লণ্ডনের ‘নেচার’ পত্রিকায়। এছাড়াও সালফাইডস ও হাইপোনাইট্রাইট বিষয়েও প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি।  প্রফুল্লচন্দ্র সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ ও ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। প্ল্যাটিনাম, ইরিডিয়াম ইত্যাদি ধাতুর বিষয়েও তাঁর গবেষণাপত্র রয়েছে। ১৮৮৭ সালে তাঁর ডি. এস. সি. ডিগ্রির গবেষণাপত্রটি জমা দেন তিনি যার বিষয় ছিল ‘অন পিরিয়ডিক ক্ল্যাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস্‌’ (On Periodic Classification of Elements)। এছাড়া তাঁর অন্যান্য গবেষণাপত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - ‘অন অ্যানালিসিস অফ ডাবল সালফেট্‌স অ্যাণ্ড দেয়ার ক্রিস্টালস্‌’ এবং ‘হাইপোনাইট্রাইটস অফ মার্কারি’। এগুলি ছাড়াও প্রফুল্লচন্দ্র সিলভার নাইট্রাইট থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট কিংবা মারক্যাপ্টাইল মূলকও আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১০৭টি।

ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ তাঁকে 'মাস্টার অব নাইট্রাইটস' আখ্যায় ভূষিত করেন। পরনে ধুতি, কালো কোট, চুল অবিন্যস্ত, তাঁর এমন উদাসীন বেশভূষায় আবৃত ছিল এক দূরদর্শী কর্মচঞ্চল প্রাণ। তিনি বুঝেছিলেন, ‘‘একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস'। মূলধন বলতে ছিল, মাত্র আটশো টাকা আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস। ৯১ নম্বর, আপার সার্কুলার রোডে আচার্যের ভাড়াবাড়িটিই এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আঁতুড়ঘর। এর নেপথ্যে ছিল বিদেশ থেকে নানা দ্রব্যের আমদানিতে লাগাম পরানো এবং বাঙালি তথা ভারতীয়কে কেরানি থেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ইচ্ছে।

এ ছাড়াও ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এডিনবার্গে থাকাকালীন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য রূপে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা পরিদর্শন করে রাসায়নিক কারখানা তৈরির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই খুঁজে বের করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ধাতু সঙ্কর তৈরিতে ভারত যে পিছিয়ে ছিল না, চরক সংহিতা-সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মাগ্র যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট তার প্রমাণ। ইস্পাত আবিস্কারের প্রথম কৃতিত্বও প্রাচীন ভারতের। প্রাচীন রসায়নে শুধু ইজিপ্ট, সিরিয়া, চিন বা আরব নয় প্রাচীন ভাতরবর্ষও যে কতটা এগিয়ে ছিল,তা তুলে ধরতেই তিনি লিখলেন ‘দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’। এ বিষয়ে প্যারিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্সিলিন বের্তেলোর সান্নিধ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এই কাজের জন্য সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিখেছিলেন।

প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞান ভাবনা যা-ই হোক না কেন, তাঁর সব কিছু জুড়ে ছিল দেশ আর দেশের প্রকৃতি। তাই ১৮৯০-এ তৈরি করেন ‘নেচার ক্লাব’। নীলরতন সরকার, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, রামব্রহ্ম সান্যাল, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, বিপিনবিহারী সরকার ছিলেন এর সদস্য। পাশাপাশি, ‘কলকাতার ফুসফুস’ ময়দানে ঘুরতে যাওয়া, তা-ও করেছেন সমান ভাবে।

আসলে প্রকৃতির উপরে মানুষের কেরদানিটা সহ্য হয়নি প্রফুল্লচন্দ্রের। তাই রবীন্দ্র সরোবরে ছট করতে চাওয়া, জলাভূমি বুজিয়ে ইমারত তৈরি করার বর্তমান দেশে প্রফুল্লচন্দ্রের একটা কথা বিশেষ ভাবে মনে করা যায় - ‘‘পশ্চিমবঙ্গে পুকুর বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লীধ্বংসের কাহিনী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।’’ এই জন-বিজ্ঞানকে বোঝাতে বাংলা ভাষায় সাধারণের উপযোগী বইও লিখেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। আদতে তিনি চেয়েছিলেন স্থিতিশীল উন্নয়ন।

লেখক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র সারাজীবনব্যাপী বহু নিবন্ধ-প্রবন্ধ এবং কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী ছাত্র-পাঠ্য বইপত্র লিখেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ‘নব্যরসায়নী বিদ্যা ও তাহার উৎপত্তি’ (১৯০৬), ‘বাঙালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’ (১৯১০), ‘চা পান ও দেশের সর্বনাশ’ (১৯৩২) ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে ১৯৩৭ সালে লেখা ‘আত্মচরিত’ এবং সুবিখ্যাত ‘দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল কেমিস্ট্রি’ (১৯০২ ও ১৯০৯) বই দুটি প্রধান। এই দ্বিতীয় বইটিতেই তিনি প্রমাণ করে দেখান যে ভারতের রসায়নচর্চার ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই চরক-সুশ্রুতের সমকালীন ভারতের রসায়নচর্চার মাহাত্ম্য তিনি এই বইতে প্রমাণ করেন। তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হল - ‘জাতি গঠনে বাধা - ভিতরের ও বাহিরের’ এবং ‘জাতীয় সম্পদের মূলে বিজ্ঞানের শক্তি’। ১৯০৩-এ প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর বাবার নামে স্থাপন করেন আর. কে. বি. কে হরিশচন্দ্র স্কুল’ এবং ১৯০৯ সালে তাঁর নিজের জন্মভূমিতে তিনি একটি সমবায় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে ‘পি. সি. কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০৮ সালে।

ব্যতিক্রমী এবং আমরণ উদার মহৎ কার্যের জন্য বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইটহুড’ উপাধি পান। তার আগে ১৯১১-তে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯১৯-এ মহীশূর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টরেট’ সম্মান জ্ঞাপন করে।

সালটা ১৯২১। বিলেত থেকে ঘুরে খুলনার গ্রামে বেড়াতে এলেন এক অধ্যাপক। কলকাতায় নামী কলেজে পড়াতেন তিনি। সারা ভারতে তাঁর নাম। এত বড়ো মানুষ, অথচ মনটা যে মাটির সঙ্গেই জুড়ে আছে। গ্রামে আসবেন না, তা কি হয়! কিন্তু এসে যা দেখলেন, সেটার কথা হয়ত কল্পনাও করেননি ওই অধ্যাপক। নিজের জন্মস্থান, খুলনার দিকে দিকে তখন হাহাকার। লোকজন মরে আছে ঘরে। জল, হাওয়া, খাবার - সবই যেন দূষিত। দুর্ভিক্ষ যেন গোটা জায়গাটিকে শ্মশান করে রেখেছে। তার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে ম্যালেরিয়া। কিন্তু খুলনার জেলা প্রশাসন থেকে কিছুই স্বীকার করা হচ্ছে না। এরম অবস্থাতেই এগিয়ে এলেন ওই মহান অধ্যাপক। গঠন করেন রিলিফ কমিটির। জোর কদমে চলতে লাগল কাজ। আগে মানুষ, তার জীবন, তারপরে বাকি সব। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আসল মন্ত্র তো ছিল এটাই।

তখনই তৈরি হল 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি। খুলনার মারাত্মক দুর্ভিক্ষে নেমে পড়েছিল এই দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন একজন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ঋষিতুল্য এই মানুষটির পরিচয় একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী হিসেবেই থেমে থাকে না। দেশীয় শিল্পেও যেমন দিশা দেখিয়েছিলেন, তেমনই মানুষের বিপদের সময় সমস্ত রকম ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। খুলনা দুর্ভিক্ষই একমাত্র নয়। একইরকম বিপদের মধ্যে পড়ে উত্তরবঙ্গ। তবে সেটার কারণ ছিল অন্য।

খুলনার দুর্ভিক্ষ পেরিয়েছে সবে এক বছর হল। ১৯২২ সালে আবারও একটা আবর্তে পড়ল বাংলা। সেপ্টেম্বরের প্রবল বৃষ্টিপাতে উত্তরবঙ্গের আত্রাই নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। অন্যান্য নদীও থেমে থাকল না। দেখা দিল প্রবল বন্যা। ব্রহ্মপুত্রের জল আত্রাই নদী হয়ে ভাসিয়ে দিল সব জায়গা। কিন্তু কলকাতায় এই খবর একটু দেরিতেই পৌঁছয়। কারণটি সহজেই অনুমেয়। তখনকার দিনে এত আধুনিক আয়োজন ছিল না। তার ওপর যে মেল ট্রেন দার্জিলিং থেকে ছেড়েছিল, তা পার্বতীপুরে এসে থেমে আছে। আগে লাইন ভেঙে গেছে। এখন উপায়? কোনোমতে সেখানকার রেল কর্মীদের বুদ্ধিতে একটি রাস্তা খুঁজে পেয়ে তাঁরা চলে আসেন কলকাতা। তখন প্রথম খবরে ছাপল এই ভয়ংকর দুর্যোগের কথা।

ভারত সভা হলে আয়োজিত হল জনসভা। তৈরি হল বন্যা সাহায্য কমিটি। কাজে নামল বেঙ্গল রিলিফ কমিটিও। প্রফুল্লচন্দ্র এবার আর দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। পরোক্ষে থেকে সমস্ত নজরে রাখবেন, এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু সেটা হল না। কমিটির সভাপতি’র আসনে বসলেন তিনি। অবশ্য এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও একজন। এই ব্যক্তিটি জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। বয়সে তরুণ, কিন্তু অদ্ভুত তেজ আছে। তিনি এবার মাঠে নামলেন সবার সঙ্গে। যুবকটির নাম? সুভাষচন্দ্র বসু!

বিজ্ঞান কলেজে বন্যা সমিতির অফিস তৈরি করা হল। স্বেচ্ছাসেবক, সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক - সবার উপস্থিতিতে ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। সব জায়গায় সাহায্যের জন্য আবেদন করা হল। দেশের মানুষের কাছে তো বটেই, বিদেশেও। সুভাষচন্দ্র বসু নিজে চলে গেলেন উত্তরবঙ্গে। সংবাদের ভিত্তিতে নয়, সরেজমিনে নিজের চোখে দেখতে চান ব্যাপারটা। সেখানেও সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ই উঠে এল ক্ষতির পরিমাণের প্রসঙ্গও। সবাই বুঝতে পারলেন, সরকার থেকে যে অঙ্কটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা আসলে কিছুই না। আসল পরিস্থিতি তার থেকেও গুরুতর। একে তো রেললাইন, চাষের জমি সমস্ত ডুবে যায়। তৎকালীন স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী, শুধু বগুড়া জেলায় ক্ষতির পরিমাণ এক কোটির ওপরে! তালোরা গ্রামে যে ২০০টি বাড়ি ছিল, তার ৭টি মাত্র অবশিষ্ট আছে। পাবনা আর রাজশাহী জেলার মিলিত ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ কোটির ওপর। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ভেবেই আতঙ্ক আসে আজ!

সুভাষচন্দ্র বসুর পর ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ বসুও এই কাজে এসেছিলেন। নিজে থেকেই অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটা তো আসলে মানুষকে, দেশকে বাঁচানোর লড়াই। ঠিক যে কাজটি এক বছর আগে খুলনাতে করেছেন সবাই। সুভাষচন্দ্র বসুও সমস্তটা দিয়ে লড়েছিলেন এই সময়। পরে এই বন্যার সমস্যার জন্য সরকারকেও দায়ী করেন অনেকে। অভিযোগ, উত্তরের ছোটো রেললাইনকে বড়ো করার ফলে নিকাশি ব্যবস্থায় আঘাত পড়ে। সেইজন্য আগেও বন্যা হয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেখানকার কর্মীরা সরকারকে বলেও; কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন তাতে বিন্দুমাত্র সাড়া দেননি। আর সেই সময়, বন্যা বা দুর্ভিক্ষ হলে, রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যেত। ভয় ছিল সেটারও। অথচ সরকার তথ্য চাপছে। আগেও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু সেসব দূরে রেখে, রিলিফ কমিটি ও বন্যা সাহায্য কমিটি যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, তা এক কথায় ছিল অভূতপূর্ব। আর এই সবকিছুর মূলে ছিলেন একজন মানুষ - আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আজকের এমন অবস্থাতেও তিনি নিশ্চয়ই থেমে থাকতেন না!

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি বলেন, ‘‘দেয়ার আর অকেশনস্ দ্যাট ডিমানডেড দ্যাট আই সুড লিভ দ্য টেস্ট টিউব টু অ্যাটেন্ড টু দ্য কল অফ দ্য কান্ট্রি। সায়েন্স ক্যান ওয়েট, স্বরাজ কান্ট।’’ তাঁর অর্জিত আয়ের প্রায় সবটুকুই দেশহিতার্থে দান করে গিয়েছেন। ত্যাগেই ছিল তাঁর তৃপ্তির আনন্দ। ১৯২২ সালে রসায়নে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাঁর দানের টাকা থেকে চালু করেন ‘নাগার্জুন পুরস্কার’।

১৯৪৪, ১৬ জুন। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অকৃতদার বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পরে, এমনকি তাঁর জীবিত অবস্থাতেও বাঙালি, ভারতীয়রা কতটা রক্ষা করতে পেরেছে প্রফুল্ল-ঐতিহ্য? জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয় মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে। কিন্তু এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন। আর প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে সমসময়ে তাঁর সাধের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে! তাঁকে আমরা কতটা মনে রেখেছি? আমাদের অভ্যস্ত জীবনের চক্রবূহ্যে আত্মতৃপ্তি কোথায়? আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে আমরা ক্রমশ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছি না তো?

শিল্প স্বনির্ভর ভারত গড়ার লক্ষ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল আজ বিলগ্নিকরণের পথে। ২০১৬ সালে এই সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। জল গড়ায় কোর্টে। সংস্থার আধিকারিক মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও কর্মীদের চেষ্টায় বিগত তিন অর্থবর্ষেই লাভের মুখ দেখেছে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। গত অর্থবর্ষে এর মুনাফা হয় সর্বাধিক - প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সংস্থার পানিহাটির ২৭ একর জমিতে রয়েছে ফিনাইল ও ন্যাপথলিন তৈরির কারখানা। এখানকার অতিরিক্ত ২৫ একর জমিও (যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪০০ কোটি টাকা) বিক্রির  সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। এছাড়াও মানিকতলার ১৪ একর জমিতে রয়েছে ওষুধ তৈরির কারখানা। কানপুরে ৩ একর ও মুম্বাইতে একটি বাড়ি সহ দেড় একর জমি রয়েছে।

এখানকার বহু পণ্য যেমন ফিনাইল, কালমেঘ, ক্যান্থারাইডিন অয়েল, ন্যাপথালিন, ইথুরিয়া অয়েনমেন্ট, অ্যাকুয়াটাইকোটিস সহ নানা ওষুধ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সংস্থাটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে প্রায় চারশো কর্মীর পরিবার। সেই সঙ্গে জুড়ে আছে জাতীয়তাবাদী বাঙালির গৌরবগাঁথা।

স্বাভাবিক ভাবেই এমন ঐতিহাসিক এবং বর্তমানে লাভে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালস বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত সবাইকেই বিস্মিত করেছে। কেন্দ্রের এই বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচিত হোক। আগামী দিনে ঋণমুক্ত হয়ে মিনিরত্ন (মহারত্ন, নবরত্ন, মিনিরত্ন ১, মিনিরত্ন ২) ক্যাটাগরির তকমা আদায় করে নিক বেঙ্গল কেমিক্যালস।

প্রফুল্লচন্দ্র বাঙ্গালি জাতকে চিনেছিলেন যথাযথ ভাবেই। তা না হলে লিখতে পারেন অত দিন আগেই এই সাংঘাতিক সত্য কথাটা - “আমাদের জীবনটা যেন দিনগত পাপক্ষয়। শুধু আলস্যের আরাম শয্যায় শয়ন করিয়া আমরা পদে পদে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা করিতেছি। আজ বাঙালির পরাজয় পদে পদে।” যতই কবি লিখে যান - "বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙ্গালী দিয়েছে বিয়া।" আজকের বাঙালি প্রজন্মের কাছে তার কোন মূল্যই নেই। এবার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রদর্শিত পথই হোক আমাদের লক্ষ্য। তাঁর জীবনালোকে দূরীভূত হোক আত্মবিস্মৃতির আঁধার।

আজ এই মহান বিজ্ঞানীর ১৬১তম জন্মদিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।


★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- শুভ্রদেব বল, আনন্দবাজার পত্রিকা, 'আত্মচরিত' : প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র’ : রবীন মজুমদার, ‘অন্বেষা’ (প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশেষ সংখ্যা), ‘প্রফুল্লচন্দ্র রে’ : জে সেনগুপ্ত, ‘জার্নাল অব দি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’, প্রহর, এই সময়, সব বাংলায়, উইকিপিডিয়া।

সাপ কি দুধ-কলা খায়?‌ -অদিতি প্রকৃতি কন্যা
Nov. 21, 2024 | পরিবেশ | views:279 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আজ অনেকেই হয়তো সাপের জন্য দুধকলা দিতে যাবেন মন্দিরে বা সাপুড়ের বাড়িতে, আপনার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই! কিন্তু সত্যি কি সাপ দুধকলা খায়? সেই নিয়েই কয়েকটি কথা বলছি।

প্রথমত বলে রাখি, সাপ সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত শীতল রক্তের মাংসাশী প্রাণী, তার খাদ্য হল পোকামাকড়, টিকটিকি, ব্যাঙ,পাখি, ছোট ও মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী, এবং অন্যান্য সাপ। আর যেহেতু এরা  স্তন্যপায়ী নয় জন্মথেকেই মায়ের দুধ খেয়ে এরা বড়ো হয় না তাই এদের জন্মের পর থেকেই শিকার করে বেঁচে থাকতে হয়। তাছাড়া সাপ ল্যাকটেজ ইনটলারেন্ট। ল্যাকটেজ কি? সাধারণ ভাবে বললে এই উৎসেচক শরীরে না থাকলে দুগ্ধজাতীয় খাবার হজম হয় না। সাপের পক্ষে দুধ হজম করা অসম্ভব! দুধ সাপের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর! দুধ খেলে সাপের শরীরে নানা সমস্যা থেকে শুরু করে সাপের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। 

বিশেষ করে গ্রামের দিকে অনেকে দাবি করেন নাকি নিজে চোখে দেখেছেন, সাপ গরুর পা পেঁচিয়ে গরুর ওলান এ মুখ লাগিয়ে দুধ চুষে খাচ্ছে! গরুর ওলান থেকে দুধ টেনে চুষে খেতে হলে একটি শক্ত জিভ থাকা দরকার। সাপের জিভ দুর্বল ও দু-ভাগে বিভক্ত যার ফলে সাপের দুধ খাওয়া অসম্ভব।


আচ্ছা তাহলে গরুর পা পেঁচিয়ে ধরে কেন? অনেক সময় সাপ ইঁদুরের খোঁজে গোয়াল ঘরে ঢুকে পরে তা দেখে গরু ভয় পেয়ে লাফালাফি করে এবং সেই দেখে সাপও ভয় পেয়ে পা জড়িয়ে ধরতে পারে। এই ঘটনা খুবই কম চোখে পরে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাপ ভয়ে পালিয়ে যায়। তাহলে গরুর ওলান ফুলে থাকে কেন? বা শক্ত হয়ে  কি করে? আমরা তো ভাবি সাপ দুধ খেয়েছে তাই ওরকম হয়!

আপনার ভাবার স্বাধীনতা আছে আপনি যা খুশি ভেবে নিতে পারেন তাতে সত্য পরিবর্তন হয় না। ওটা গরুর একটা রোগ যার নাম  ম্যাস্টাইটিস বা ওলান ফোলা স্থানীয় ভাবে ওলান পাকা রোগ বলে। কেন এই রোগ হয়? আমি পশু চিকিৎসক নই, আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া আপনার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। তবে সাধারণ বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে বলতে পারি বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, মাইকোপ্লাজমা ও ভাইরাস এর জন্য হয়।


আচ্ছা, নিজের চোখে নাগপঞ্চমীতে দেখলাম যে সাপ বাটি থেকে দুধ পান করছে! তাহলে সেটা কি? প্রথমেই বলেছি সাপ দুধ খায় না। সাপুরেরা নাগ পঞ্চমীর একসপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে সাপকে জল খেতে দেন না ফলে সাপ তৃষ্ণার্ত হয়ে পরে। নাগ পঞ্চমীতে সাপ বের করে সামনে দুধের বাটি ধরা হয় তৃষ্ণার্ত সাপ তৃষ্ণা মেটাতে সেই দুধ পান করে নেয়! সে সময় দুধের বদলে কোকোকলা রাখলেও সাপ তৃষ্ণার জন্য খেতে বাধ্য হবে। তাহলে সাপুড়ে রা এই কাজ করে কেন? সাপ ইঁদুর বা ডিম খায় বললে সাপুড়েকে কেউ দক্ষিনা দেবে না। ধর্মীয় বিশ্বাস কে হাতিয়ার করেই এই অমানবিক ধান্দাবাজি বহুকাল থেকে চলে আসছে। তাহলে কি  সাপ জল পান করে না? হ্যা সাপ বেঁচে থাকার জন্য জল পান করে।

এখুনি যে বললেন সাপ চুষে কিছু খেতে পারে না! হ্যাঁ, সাপ গরুর ওলান থেকে দুধ চুষে খেতে পারে না। জলও চুষে পান করতে পারে না। জল চিবিয়ে পান করে। আর কলা? কলাও খায় না! কলা খেলে গাছে একটাও কলা থাকতো না সব সাপেরা খেয়ে নিতো। সাপেরা ফল খায় না ওরা মাংসাশী! এইবার আপনি বলুন অবলা প্রাণীদের উপর অত্যাচার আর কতদিন করবেন? সাপ মাটির হলে পুজো করেন আর জ্যান্ত হলে পুড়িয়ে মারেন কেন?


তাই বলছি, এই কুসংস্কারগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। চোখের সামনে সাপুড়েদের এইসব অমানবিক কাজ দেখলে তাতে বাধা দিন। বন দফতর বা লোকাল থানায় খবর দিন। 

আস্তিক-নাস্তিক: কিছু প্রশ্নোত্তর -দিবাকর মন্ডল
Nov. 21, 2024 | নাস্তিকতা | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষদের আস্তিক বা ঈশ্বরশ্বরবাদী দাবি করতে দেখেছো?

উত্তরঃ হ্যাঁ

আস্তিকরা কি বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং প্রযুক্তি কে অস্বীকার করে?

উত্তরঃ হ্যাঁ (ওদের দাবি সব আদিশক্তি বা ভগবান করেছেন )

আস্তিকরা কি কোন তথ্য মানুষকে বিশ্বাস করে নিতে বলে?

উত্তরঃ হ্যাঁ

আস্তিকরা কি কোন কাল্পনিক ঘটনার তথ্য  বিবরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে?

উত্তর - না।

আস্তিক দেশগুলো কি উন্নত?

উত্তরঃ না(কিছু অনুন্নত এবং কিছু উন্নয়নশীল )

ঈশ্বর বা ভুত কি আস্তিকদের  ক্ষতি করতে পারে?

উত্তরঃ হ্যাঁ।

আস্তিকরা কি ধর্মগ্রন্থ গুলি পড়াশোনা করে?

উত্তরঃ বেশিরভাগই ধর্মগ্রন্থ পড়াশোনা করে না অন্যের ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে মাতামাতি করে। পড়াশোনা না করে, শিক্ষিত না হয়ে, বিজ্ঞান মনস্ক না হয়ে কি আস্তিক হওয়া সম্ভব?

উত্তরঃ হ্যাঁ।

আস্তিকদের ক্রিয়া-কলাপ এর ফলে কি সমাজের সকল শ্রেণীর উন্নতি হয়?

উত্তরঃ না। একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের উন্নতি হয়।

আস্তিকদের কর্মকান্ডের ফলে কি মানুষের জীবনহানি ঘটেছে?

উত্তর হ্যাঁ। নরবলি, সতীদাহ প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, এবং ডাইনি প্রথার মত বহু ঘটনায় বহু মানুষের জীবন গিয়েছে।

আস্তিকদের যাগ-যজ্ঞ,পূজা এসবের ফলে দেশের জনগণের, খেলাধুলার শিক্ষা,  স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক দিক গুলিতে দেশের কি উন্নতি হয়েছে?

উত্তর- না।

সকল আস্তিকের ঈশ্বর কি এক?

উত্তর- না।

সকল আস্তিক দের রীতিনীতি কি এক?

উত্তর- না।

আস্তিকদের মতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর সকল প্রকার মানুষকে কি সমানাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়?

উত্তর- না।

অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষদের নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী দাবি করতে দেখেছো?

উত্তর - না।


পার্ট-২

নাস্তিকরা কি বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং প্রযুক্তি কে অস্বীকার করে?

উত্তর - না।

নাস্তিকরা কি কোন তথ্য মানুষকে বিশ্বাস করে নিতে বলে?

উত্তর - না।

নাস্তিকরা কি কোন কাল্পনিক ঘটনার তথ্য  বিবরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে?

উত্তর - হ্যাঁ।

পৃথিবীতে নাস্তিকদের সংখ্যা কত শতাংশ?

৭% সমগ্র পৃথিবীতে

যার মধ্যে China - 91%

Japan - 87%

Sweden - 78%

Czech Republic - 76%

United Kingdom - 73%

Belgium - 72%

Estonia - 72%

Norway - 70%

Australia - 69%

Denmark - 68% মানুষ নাস্তিক এবং নিরীশ্বরবাদী।

সরকারি ভাবে প্রথম নাস্তিকদের দেশ কোনটি?

উত্তর - আলবেনিয়া (১৯৭৬)

নাস্তিক দেশগুলো কি উন্নত?

উত্তরঃ হ্যাঁ

ঈশ্বর বা ভুত কি নাস্তিকদের  ক্ষতি করতে পারে?

উত্তরঃ না।

নাস্তিকরা কি ধর্মগ্রন্থ গুলি পড়াশোনা করে?

উত্তরঃ হ্যাঁ

পড়াশোনা না করে, শিক্ষিত না হয়ে, বিজ্ঞান মনস্ক না হয়ে কি নাস্তিক হওয়া সম্ভব?

উত্তরঃ না।

নাস্তিকদের ক্রিয়া-কলাপ এর ফলে কি সমাজের সকল শ্রেণীর উন্নতি হয়?

উত্তরঃ হ্যাঁ। মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক এবং বাস্তববাদী করে তোলা হয়।

নাস্তিকদের কর্মকান্ডের ফলে কি মানুষের জীবনহানি ঘটেছে?

উত্তর - না। উল্টে আস্তিকদের হাতে অনেকেই আহত এবং নিহত হয়েছেন।

নাস্তিকদের মতামতের ফলে দেশের জনগণের, খেলাধুলার শিক্ষা,  স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক দিক গুলিতে দেশের কি উন্নতি হয়েছে?

উত্তর- হ্যাঁ।

সকল নাস্তিক দের রীতিনীতি কি এক?

উত্তর- হ্যাঁ সকলেই তথ্য প্রমাণ ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণে বিশ্বাসী।

নাস্তিকদের মতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর সকল প্রকার মানুষকে কি সমানাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়?

উত্তর- হ্যাঁ।

 lt. Nabin ch. Mondal

Pramanik para, Falta.. S 24 pgs

গুরুত্ব বুঝেই বিদ্যাসাগর সক্রিয় নাট্যকর্মী হয়েছিলেন -তপন চক্রবর্তী
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:390 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিদ্যাসাগর মানেই বর্ণপরিচয়, বিধবাবিবাহ, নারী শিক্ষা, দয়ার সাগর। কিন্তু বিদ্যাসাগর মানে সেকালের রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার একথা সর্বজন বিদিত নয়। আসলে থিয়েটারের ক্ষেত্রে সব সময়েই সব দেশেই একটি ব্যাপার খুবই স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে, সেটি হল একজন উচ্চমানের অভিনয় শিল্পী বা নাট্যকার যে পরিমান জনপ্রিয়তা আর পরিচিতি আদায় করেছেন, যত সহজে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদগ্ধ পণ্ডিতজনের এক ব্যাপক অংশের ভাবনা চিন্তায় আগ্রহের সৃষ্টি করেছেন, নিজেকেই একজন সংগঠক মধ্য আলো আঙ্গিক শিল্পীর পক্ষে অতটা সম্ভব হয়নি।


আজ আমরা পরপর দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে গণ প্রতিরোধের সম্পূরক নাট্য আন্দোলনের কার্যকর প্রভাবের কথা জেনেছি। কিন্তু সেই উনিশ শতকের গোড়ায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পর্বেই। বিদ্যাসাগর নিজেরই বিধবা বিবাহ প্রচলনের ও বহুবিবাহ রোধের আন্দোলনকে বঙ্গরঙ্গ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত করার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতে আশ্চর্য লাগে, ভালও লাগে। তিনিও কি সেই রোপনপর্বে বার্ডোন্ট রেট বা গার্সিয়া সোরকার মত অনুভব করেছিলেন “দেশের মানস গঠনে থিয়েটার এক অত্যন্ত উপযোগী ও অভিব্যক্তিক অস্ত্র, যার পরিমাপে দেশের উত্থান বা পতনের বার্তা পাওয়া যায়" বা যে জাতি তার থিয়েটারকে সাহায্য করে না, তার মেরুদন্ড সোজা হয়না" ঠিক যেমন "যে থিয়েটার তার সমাজ স্পন্দন, তার ইতিহাসের স্নায়ুস্পন্দন অনুভব করেনা, তার থিয়েটার নামের মুখ থাকে না।" আমরা জানি, বাংলা থিয়েটার ১৮৫৭-৭৬ সালের নাট্য নিয়ন্ত্রন বিধি চালু করেছিল। তখন থিয়েটার হলে ঢুকে ব্রিটিশ আমলা পুলিশ অমৃতলাল ও উপেন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরেছিল। নাট্যাভিনয়ের জন্য শিল্পী নাট্যকারদের কারাবরণ এই প্রথম এবং ঐতিহাসিক ঘটনা।


অতঃপর বাংলা থিয়েটার চলে গেল। যুক্তিবাদী বা র‍্যাশনাল সমাজসেবীদের হাত থেকে ভক্তিবাদী হিন্দু পৌরানিক পুনরুজ্জীবনকামীদের হাতে। এল বঙ্কিমচন্দ্র গিরিশচন্দ্রের হিন্দু জাতীয়তাবাদের যুগ। ঠিক এই সময়েই রামকৃষ্ণ স্টারে চৈতন্যলীলা দেখতে এসে বলেছিলেন “তোদের চৈতনা হোক, থ্যাটারে লোক শিক্ষে হয়রে।" অথচ বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন, মানুষের মনে ঐহিক জীবনবাদী যুক্তিবোধের উন্মেষ হোক থিয়েটারের মাধ্যমে। সমকালের ঐতিহাসিক ঘটনা নীল বিদ্রোহ-প্রসুত দীনবন্ধুর "নীলদর্পণ" যা বাংলা থিয়েটারের প্রথম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি নাটক, যাকে উৎসাহিত করতে বিদ্যাসাগর সক্রিয়ভাবে নাট্যকার্যে যুক্ত হয়েছিলেন। তার সময়ে ইংরেজ শাসনের হাত ধরে এসেছে পাশ্চাত্য শিল্প-বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্কুল-কলেজ, এসেছে সেক্সপিয়ার, ভোলতেয়ার, লক, বেকন প্রমুখ আলোকপ্রাপ্ত স্রষ্টা ও দার্শনিকদের ভাবাদর্শ, যা আমাদের জাতীয় জীবনকে যুগসঞ্চিত ধর্মীয় শাস্ত্রবিধির বন্ধন থেকে মধ্যযুগ অন্ধকার থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাতে পারে। সঙ্গে পেয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, শিयা রামনারায়ণ তর্করত্নকে যাঁরা মূলত নাটককার। তখনকার অক্ষম অনুকরনে বানানো থিয়েটারের মাধ্যমে তাদের লিখিত শ্ৰব্য রচনাকে অভি বা সামনে নীত করতে, অর্থাৎ নাটকে সমস্যা ও বার্তা মানুষের কাছে পৌছাতে, কলোনী প্রসাসন, শ্রেণীকক্ষ, শাস্ত্র দিয়েই শাসকার মণ্ডলের বিচার বিতর্কের মধ্যেই তিনি ছুটেছেন নাট্য সংগঠনে, নাটকের মহড়া কক্ষে। তখনকার নাগরিকদের মান এই নতুন বস্তুবাদী ভাবাদর্শ সঞ্চার করার তাগিদ নিয়ে। তখনকার সামাজিক সমস্যা ও থিয়েটারের পারস্পরিক প্রভাব প্রতিফলনের উপযোগিতা বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন। থিয়েটার সমাজ প্রগতি সহ্যাক শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম শুধু বিশ্বাস নয়, কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই উন্নত মনন প্রয়াস বিস্ময়কর।


যে বছর মহাবিদ্রোহ ঘটল, সেই ১৮৫৭ সালেই কোলকাতার রামজয় বসাকের বাড়িতে রামনারায়ণ তর্করত্নের 'কুলীন কুল সর্বস্ব' এর মত বিস্ফোরক সমাজ চেতনার নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। রামনারায়ন ছিলেন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের ছাত্র। বিধবা-বিবাহ, বহু বিবাহ বিষয়ক যুক্তি তর্কে গুরুর শাস্ত্র দিলেনই, শাকুকে নাকচ করার তীক্ষ্ণ পুনর্মূল্যায়নে উৎসাহিত হয়ে, এমনকি সংলাপে সেই সব যুক্তিকে নাট্যরসে চুবিয়ে রামনারায়ন কৌলিন্য প্রথার বর্বরতা ও মুখোশ উন্মোচিত করেন তাঁর প্রহসন নাটকে। গৌরদাস বসাকের স্মৃতিকথাতে ও সংবাদ প্রভাকরের প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই অভিনয়ের ব্যাপারে বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত ভাবে সাহায্য করেছেন এবং অভিনয় দখেছেন। একই সময় কালে বেলগাছিয়ার জমিদার প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ প্রাসাদ প্রাঙ্গনে যে নাট্যশালা তৈরী করে ছিলেন, তাতে মঞ্চস্থ হওয়ার আগে রামনারায়নের অনুদিত 'রত্নাবলীর মহড়ায় বিদ্যাসাগর পরিচালনার ব্যাপারে অংশগ্রহণ করেছিলেন।


বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল উমেশচন্দ্র মিত্রের 'বিধবা-বিবাহ' নাটক (১৮৫৭)। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল চিৎপুরের রামগোপাল মল্লিকের বাড়ীতে তৈরী মেট্রোপলিটান থিয়েটারে। এই ঘটনাতে কেশবচন্দ্র সেনের সাথে বিদ্যাসাগরও সহযোগী ছিলেন। এই নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণের ভাষা অনেকটাই বিদ্যাসাগরের নাট্য ভাবনার প্রভাব পড়েছে। পরে উমেশচন্দ্র সীতার বনবাস' অবলম্বনে নাটক লেখেন। বোঝা যায় দুজনার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। “বিধাব বিবাহ"। নাটকের চতুর্থ সংস্করণে ভদ্র চরিত্রের সংলাপে ক্রিয়ার সাধুরূপ বাদ দিয়ে। বিদ্যাসাগরের পরামর্শে হয়েছিল করতেছেন, বলতেছেন ইত্যাদি।


লক্ষ্যকরার মতো, তখনকার ধনী জমিদারদের প্রসাদে মঞ্চের সেই সেই নাটকাভিনয়ের প্রতি বিদ্যাসাগরের আকর্ষণ ও দায়বদ্ধতা ছিল, যেগুলিতে প্রধানত মধুসুদন, দীনবন্ধু, রামনারায়ণের মত সেকালের প্রেক্ষিতে প্রগতিশীল সাহসী নাটককারের রচনা মঞ্চস্থ হয়েছিল। রাজা যতীন্দ্রমোহনের পাথুরায়া ঘাটার নাট্যমঞ্চ পরিচালনার জন্য যে কমিটি হয়েছিল, তাতে কবি নাটককার মধুসুদন অভিনেতা কেশব গাঙ্গুলীর সঙ্গে বিদ্যাসাগরও স্বাগত হয়ে ছিলেন। রাজবাড়ীর মঞ্চ টানাটানি নেই। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত হলেও ধনী ছিলেন না। তাই এটাই ঘটনা, নাটক নির্বাচনে, পরিমার্জনায় এবং চরিত্রানুগ অভিনেতা নির্বাচনে তিনি কেবল উৎসাহী ছিলেন বলে কমিটি সদস্য করা হয়নি, যোগাও ছিলেন। বিদ্যাসাগর সমকালের সামাজিক নাটক ও থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর আন্দোলনকে


কতটা মেলাতে পেরছিলেন বোঝা যায়, তখনকার বহু বিবাহ বিষ্যাক নাটকগুলির প্রযোজনার। তিনি যে যুক্তিপূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করে রক্ষণশীল সমাজকে নাড়িয়ে দিতেন সেই সমনোর নাট্য সংলাপ তার প্রয়োগ হয়েছে, "বিশ্ববা সুখের দশা' নাটকে যিনি দর্শকাসনে বসে শুনেছেন “সত্যি দিদি শুনে এলুন, চ আমারো বাবাকে বলে তাই করি। আমি সব কথা শুনে এসেছি। কলকাতায় নাকি কে একজন বিধবার বের পাঁজিপুতি করেছেন।" কৌলিন্য প্রধার ছোবলে বাল্য বিবাহ, বুড়ো মরতে দুই বোন বাবার ঘরে চলে এসেছে বিধবা হয়ে। এবার আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে তাদের যৌবনে স্বপ্নে। দীনবন্ধুর "বিয়ে পাগলা বুড়ো" নাটকের অভিনয় দেখতে গিয়ে গৌরমনির সংলাপে শুনলেন “দিদি, ভাল খেতে ভাল করে সংসার ধম্ম করে কার না সাধ যায়? মা বাপ যদি একাদশীর জ্বালা বুঝতেন, তাহলে এতদিনে বিধবা-বিবাহ চলতো। দেখ দিদি, এসব পরমেশ্বর করেননি, মানুষে করেছে। তিনি যদি করেন, তবে আমাদের ক্ষুধা, পিপাসা, আশা, বাসনা স্বামীর সঙ্গে ভস্ম হয়ে যেত। বিদ্যাসাগর এই সময়েই জোড়াসাঁকো নাটা শালার পরিচালন কমিটির এবং পরবর্তী কালে বেঙ্গল থিয়েটারের উপদেষ্টা পর্যদের সদস্য হয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে “ইন্ডিয়ান মিরার" পত্রিকায় কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দেন। গ্রামে জমিদারদের অত্যাচার বিষয়ে শ্রেষ্ঠ নাটক লেখককে ২০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, যার অন্যতম বিচারক ছিলেন বিদ্যাসাগর।


বিদ্যাসাগরের অভিনব সৃষ্টি কালিদাস, ভবভূতি এবং সেক্সপিয়ারের কমেডি অবলম্বনে গদ্য ভাষায় নাট্যধর্মী আখ্যান রচনা, কালিদাসের শকুন্তলা (১৮৫০), ভবভূতির উত্তর রামচরিত অবলম্বনে সীতার বনবাস (১৮৬০) এবং সেক্সপিয়ারের কমেডি অব এররস্ অবলম্বনে ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) রচনাগুলি যেন তাঁর নাটাবোধের পরীক্ষাগার, বিশেষ করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আখ্যানবর্ণিত চরিত্রগুলির সংলাপ, পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যকারদের কাছে দৃষ্টান্তমূলক বলা যেতেই পারে, তাছাড়া ঘটনার ঘনঘটা বা বহিরঙ্গ থেকে নাট্য চরিত্রকে অন্তলোকে সংঘাতময় করে তোলার প্রতি তার মনোযোগ, বিভিন্ন মুড সৃষ্টিতে ও আবরনে নিয়ন্ত্রনে সেকালের প্রেক্ষিতে তাঁর পরিমিত বোধ অবাক করার মত।


একটি কথা স্মরণে রাখা দরকার। তা হল, সামাজিক আন্দোলন যেমন নাটকে ও মঞ্চে এসেছিল, তেমনি নাটক ও তার অভিনয় ও যে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে, তার নজির রামনারায়নের কৌলিন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহ বিরোধী নাটকাভিনয়। কারন তাঁর নাটকের জন্ম কোন পূর্ব ঘটিত আন্দোলনের নাড়া খেয়ে জানি। গুরুর শাস্ত্র দিয়েই শান্ত বিচারের মুক্তি তর্কের প্রেরনায় এবং গরুরই প্রত্যক্ষ সহচর্যে তৈরী হয়েছিল সেই অভূতপূর্ব বাংলা প্রহসন নাটক, রংপুরের জমিদার কালীচরণ চৌধুরি সম্বাদ ভাস্কর বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন "কৌলিদাপ্রথার কারণে নিঃবেশিত বঙ্গীয় কামিনীদের দুর্দশা নিয়ে যিনি শ্রেষ্ঠ নাটক রচনা করিবেন, তিনি ৫০ টাকা পুরস্কার পাইবেন, রামনারায়নের "কুলীন সর্বস্ব" নাটকই হয়েছিল প্রথম। এবং বিদ্যাসাগরের ব্যবস্থাপনায় কলকাতায় ও চুঁচুড়ায় পরপর অভিনয় হয়েছিল। রাজা রামমোহন রায় থেকেই এদেশের রেনেসাস আন্দোলনের শুরু বলা চলে, ইউরোপের বুর্জোয়া মানবতাবাদী ধ্যান ধারনা ও চিন্তা ভাবনাগুলিকে ধর্মের মূল সুরটির সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথেই তিনি এদেশে রেনেসাঁস আন্দোলনের জন্ম দেন। ফলে এদেশের রেনেসাঁস আন্দোলন রিলিজিয়াস ল এর (ধর্মীয় সংস্কার) পথ ধরে ধরে এগোতে থাকে। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অভ্যুত্থান রেনেসাঁস আন্দোলনে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা এবং যতদূর মনে হয় বিদ্যাসাগরই প্রথম ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় সংস্কারের পথে রেনেসাস আন্দোলনের মধ্যে একটা ব্রেক ঘটালেন। তিনিই প্রথম এদেশে যতদূর সম্ভব মানবতাবাদী আন্দোলন কে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চাইলেন। বিদ্বজনেরা তাই একমত যে তিনিই তদানীন্তন ভারতীয় সমাজ পরিবেশে একজন খাঁটি হিউম্যানিষ্ট, অত্যন্ত আধুনিক মানুষ, এবং ভারতবর্ষের নবজাগরনের অগ্রদূত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে অনেক গবেষণা আলাপ আলোচনা হয়েছে হচ্ছে। কিন্তু তিনি সম্যক গুরুত্ব উপলব্ধি করেই এক জন যথার্থ ও সক্রিয় নাট্যকর্মী হয়ে বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, একথা সর্বজনবিদিত নয়। এ দায় আমাদের নাট্য কর্মীদেরই নিতে হবে। বাংলা থিয়েটারে তাঁর অমরকীর্তি স্মরণ করে, থিয়েটারের গুরুত্ব বুঝে, থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হতে হবে।

অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এর জাঁতাকল বাড়ছে -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 21, 2024 | সমাজ | views:285 | likes:2 | share: 2 | comments:0

দুর্গা দুর্গা, সাবধানে যেও, এইরে পল্টুর মা এই সময়ই তোমার হাঁচি পেলো! একটু দাঁড়িয়ে যা বাবা। রিন্টু বাবা  চিন্তা করিসনা তোর বাবা ঠিক সেরে উঠবেন, যে ধন্বন্তরী ডাক্তার অস্ত্রোপচার করবে তাঁর হাতে আমাদের এখানে অনেক রোগী সুস্থ হয়েছে। সত্য সত্য সত্য, দেখ টিকটিকি টক টক করে সত্য ঘোষণা করলো।  বোনপো রিন্টু আর ওর যুক্তিবাদী বন্ধু এসেছে বর্ধমান দুর্গাপুর থেকে। চিনার পার্কে মাসি বাড়িতে উঠেছে বাবাকে নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে  চিকিৎসা করাতে। মাসির কথা শুনে বেরোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো। কিরে, থেমে গেলি কেনো? ঐযে মাসি দেখনা এক শালিক, দাঁড়াও আর একটা শালিক আসুক তারপর বেরবো। একটু পরেই আরো তিনটে শালিক একসাথে এল। ছেলেটি বেরোবে এমন সময় মাসি বললো, বাবা ভুলে গিয়েছিলাম একদম, গতকাল ঠাকুর বাড়ি গিয়ে এই ফুল বেলপাতা আর মাদুলিটা নিয়ে এসেছিলাম, এটা জামাইবাবুর হাতে বেঁধে দিস। রিন্টুর  বন্ধুর মুখ সারাক্ষণ  ভার হয়ে আছে এইসব  দেখে; রিন্টুও বুঝছে সেটা। কিন্তু কিছুই  করার ছিলনা বলে এই যুক্তিবাদী পরপোকারি বন্ধুকে নিয়ে। মাসি কি বলছো?অস্ত্রোপচারের আগে দেহের সব কিছু খুলে নেবে না হলে ইনফেকশন হতে পারে। তাহলে  বাবা, আচ্ছা জামাইবাবুর মাথায় ঠেকিয়ে জামাইবাবুর বিছানার নীচে রেখে দিস। এই তোর পায়ের কালো কারটা ঠিক মতো বাঁধ, খুলে যাবে যে। আচ্ছা মাসি, এবার চলি দেরী হয়ে যাবে। নিজেদের গাড়িতেই এসেছে এবং গাড়িতে উঠেই পায়ের কালো কার ঠিক করে নিল, গাড়ি নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ করে একটা জোরে ব্রেক কষলো, একটা কালো  বেড়াল দ্রুত গতিতে রাস্তা পার হলো। আর একটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটতো। রিন্টু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল; তারপর গাড়ি  থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। রিন্টুরা ধনী মানুষ, রিন্টুর হাতের আটটা আঙুলেই জ্যোতিষের দেওয়া  নিলা, পলা, গোমেদ, রুবি প্রভৃতির আঙটি। বুড়ো আঙ্গুলে পরা যায়না তাই পরেনি।  ওর বন্ধুর মুখের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে বসল।

    এদিকে ওর হাসপাতালে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেছে, ওর বাবাকে অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানা স্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে, একটু পরেই  অপারেশন  রুমে নিয়ে যাবে। রিন্টু বাবার মাথায় মাদুলি –ফুল দুর্বা ঠেকিয়ে বিছানার নীচে রেখে দিল। এমন সময় ডাক্তারবাবু  ও স্টাফেরা এলেন  পেশেন্ট কে অপারেশন  রুমে  নিয়ে  যাওয়ার  জন্য। রিন্টু ডাক্তারবাবুকে দেখে  বাবার অবস্থার খোঁজ নিয়ে ডাক্তারবাবুকে শুধলো, বাবা সেরে উঠবেনতো? ডাক্তারবাবু বললেন, দেখুন  আমরাতো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি, বাকিটা  ওপরওয়ালার হাত। ঈশ্বরকে ডাকুন তিনিই আপনার বাবাকে সুস্থ রাখবেন। বন্ধুটি বলে উঠল আমরা পেশেন্ট কে আপনাদের ভরসায় এনেছি, ওপরওয়ালার ভরসায় নয়। রিন্টু বলল কি আজেবাজে বকছিস। বন্ধুটি বলল ওপরওয়ালার  ভরসায় এতদূর এত দামী হাসপাতালে আনার দরকার  কি?  তোদের কথাতে ওপরওয়ালা সর্বত্র  বিরাজমান ; দুর্গাপুরেও নিশ্চিত  ওপরওয়ালা আছে?  ডাক্তারবাবু বোধহয় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন; তারপর  যুক্তিবাদী বন্ধুর দিকে এমন একটা তীর্যক দৃষ্টি হেনে  অপারেশন রুমে চলে গেলেন। রিন্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য ঈশ্বরকে প্রণাম জানিয়ে বন্ধুকে নিয়ে  রিসিপশানে এসে বসলো। সেখানে বিশাল টি ভী তে সাঁই বাবার বিভূতি দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। এখন প্রতি হাসপাতালেই দেবদেবীর থানে ভরা।  রিন্টুর বন্ধু এসব দেখে বলল এবার হাসপাতালে না নিয়ে  মন্দির মসজিদ গির্জাতে নিয়েই চিকিৎসা করালে হয়। দুজনে নানান কথা আলোচনা করছিল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে। মাঝে একবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে চা পান করে এসেছে। হঠাৎ রিন্টুর নামে ঘোষণা হলো, রিন্টুকে কর্তৃপক্ষের সাথে  দেখা করতে বলছে। রিন্টু ওর বন্ধু  ভয়ে ভয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারবাবু ওদের বসতে বললেন  এবং  বললেন, আপনার বাবার অবস্থা খুব ক্রিটিকাল, ভেন্টিলেশানে দেওয়া হয়েছে, ওনার  কোভিড হয়ে গেছে ----আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টাই করছি, তবে বলতে পারছি না। এখন বাঁচা মরা সব ওপরওয়ালার হাতে।

     আপনি বলতেই পারেন সোস্যাল মিডিয়া, ফেসবুকে যা খুশী লেখা যায় বলে আপনি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কারে খোঁচাখুঁচি করছেন। আর এইসব সংস্কার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখলেই কি মানুষ কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের গহ্বর থেকে উঠে আসবে?  শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বা মৃত্যুভোজ তুলে দেবে, সমস্ত অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বর্জন করবে, জ্যোতিষবিদ্যা, গ্রহরত্ন, হস্তরেখা বিচার, মাদুলি কবচ  জলপড়া ইত্যাদির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমবে? না, আমরা এসব এক্কেবারেই ভাবিনা যে আমার ফেসবুকের লেখা দেখে সবাই কাল থেকে পূর্বজন্ম, পরলোক, হাঁচি, দু’শালিক, বেড়ালের রাস্তা কাটা, কবচ মাদুলি, কালো কার লাল সুতো সম্পর্কে আমার ফেসবুকের বন্ধুরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। তবুও প্রচন্ড জলস্রোতের বিপক্ষে মাছেরা সাঁতার কাটে, জিওনার্দো ব্রুনোরা শয়তানদের আগুনে জ্যান্তো পোড়েন, চার্বাকেরা নির্মূল হয়ে যান ব্রাহ্মণ  পুরোহিতদের রোষে; গ্যালিলিওরা কারাগারে অবরুদ্ধ হয়ে জীবন দেন, সক্রেটিসেরা হেমলকে জীবন দেন। 

    সমাজের সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সংবেদনশীলতা একদিনে তৈরী হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভয় ভীতি অসহায়তা আদিম মানুষের মনোজগতে ধীরে ধীরে নানা অলৌকিক অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি করেছে। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বার্থান্বেষী ধীমান মানুষের প্রশ্রয়ে শাখা প্রশাখা শিকড় বাকড় ছড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে মানুষের কোশে কোশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধমনীতে ধমনীতে, অর্জন করেছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এবং মানুষের বেঁচে থাকার বাধাগুলির বিরুদ্ধে মানুষের অন্ধ আবেগ, ক্রোধ, ঘৃণা, আক্রোশকে প্রশমিত করতে কিছু মানুষ এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে পুঁজি করে অবিজ্ঞানকে সচেতন ভাবে বিস্তার করে গেছে। তাই অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের অধ্যাপক ক্লাশে সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ ছাত্রদের পড়িয়ে গ্রহণের দিন নিরম্বু উপবাস করে গ্রহণের পরে কীর্ত্তনীয়াদের সাথে গঙ্গায় স্নানে যায় পবিত্র হতে, ডাক্তারবাবু নিজের দায়িত্ব কমিয়ে ঈশ্বরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দেন, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ণের অধ্যাপকেরা মারকিউরাস ক্লোরাইড, অ্যালুমিনিয়ামের পাতের সংযোগে উৎপন্ন  আতর মেশানো ছাই বা বিভূতি নেওয়ার জন্য সাঁই বাবার আশ্রমে হুমড়ি খান।

    

আমাদের দেশের সুপ্রাচীন লোকায়ত বেদে বলা আছে --- “কায় শরীর  অঞ্চতি রক্ষতি কবচ “---- অর্থাৎ শরীরকে যে রক্ষা করে সেই কবচ। যেমন শীতবস্ত্র শীতের কবচ। পরবর্তী শ্রেণি বিভক্ত জাতপাতে বিভক্ত সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ধীমান শাসক পুরোহিত শ্রেণি সমাজকে অনশবিশ্বাস, কুসংস্কার ও বিভিন্ন আচারে মুড়িয়ে দেয়। কবচের অন্য অর্থ  করে  ----  ধাতুর খোলে দেবদেবীর নাম লেখা কাগজ এবং ফুল দুর্বা ঢুকিয়ে ধারণ করাকেই কবচ বলেন, এই কবচের মধ্যেকার বীজমন্ত্র জীবনকে রক্ষা করবে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তাহীন, রোগ শোক, দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত মানুষের দুর্বল মানসিকতাকে সাইকোথেরাপির সাহায্যে মোহাবিষ্ট করে ঐসব কবচ মাদুলি রত্ন বিকিকিনি করে লাভবান হন জ্যোতিষ বা রত্ন ব্যবসায়ীর মতো  সমাজের গুটিকয় মানুষ আর সর্বসান্ত হয় অধিকাংশ দুর্বল মানুষ। জ্যোতিষেরা অপরের ভাগ্য ফেরান আর নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে বিজ্ঞাপন দেন খবরের কাগজে দূরদর্শনে। সমাজে নানান বাবাদের প্রাদুর্ভাভাব  আগের তুলনায় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মানুষ  যন্ত্রের প্রভাবে  ক্রমশ নি:সঙ্গ একা  হয়ে যাচ্ছে। টলমল সমাজে মানুষ সংঘবদ্ধতা থেকে একাকী হয়ে গেলে  জ্যোতিষ  ওঝা এবং বিভিন্ন বাবাদের মায়েদের প্রাদুর্ভাব  আরো বাড়বে আগামীতে।  চতুর শিল্পপতি ও ধনীরা দূরদর্শনে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বামাখ্যাপা রামপ্রসাদ লোকনাথ  রাসমণির মতো  সিরিয়াল দূরদর্শনে আরও বাড়িয়ে দেবেন। এফএম এ কালী কথা কৃষ্ণ কথা শিব মাহাত্ম্য র প্রোগ্রাম আরও বাড়াবে। এগুলো ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

  

   আমার খাবারের থালায় প্রতিদিন একমুঠো করে ভাত কমে যাচ্ছে, বাবার  কারখানা অফিস বন্ধ ছাঁটাই চলছে, অর্ধশিক্ষিত ভাইটা কর্মহীনতার অন্ধকারে নিভিয়ে ফেলছে উদ্ধত আলোক শিখার মতো যৌবনশক্তির মহা উত্তাপ, আমার যুবতী বোনটার নাকের কাছে রুমাল দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শয়তান অন্ধকারের দেশে, আমার সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা, স্ত্রীর রক্তহীন পান্ডুর মুখ, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত অসুস্থ পিতা মাতার দীর্ঘশ্বাস এবং নিরুচ্চারিত অস্তিত্ব, মুখের সামনে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা, ইংরাজীতে এম এ এবং বি এড পাশ সোনার পুরের শান্তনু মিস্ত্রির আত্মহত্যার খবরে, পিএসসি, এসএসসি তুলে দেওয়ার খবরে বা রাজ্যের সমস্ত চাকুরি  20-30 লক্ষ টাকাতে বিক্রির খবরে ক্রমে ক্রমে নিভে আসছে বিবর্ণ পৃথিবীর অপসৃয়মান আলো। -  কী  সীমাহীন অন্ধকার আর ক্রোধ, আমার ভালো অথবা খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী নিয়ন্ত্রকগুলির ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সম্পূর্ণ অনিশ্চিয়তার জীবনের জন্য আমি কাকে দায়ী করবো? 


সারাদিন টিভির পর্দায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, বামাখ্যাপা, সাইবাবা, সারদামণি, শ্রীরাম এবং জ্যোতিষেরা বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে সব আয়ত্তে এনে দেবে, হনুমান চল্লিশা ব্রেসলেটের বিজ্ঞাপন মানুষকে দাবিয়ে রেখেছে। ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার আর অজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করে বিশাল দুঃখ আর ক্ষোভকে তাবিজ-কবজ, রত্ন, পাথর আর অদৃষ্টবাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে দিতে চায় --- আমি কি তাদের কাজের প্রতিবাদ করবো না?

সালমান রুসদি ও পেশিশক্তির আস্ফালন -গৌতম চক্রবর্তী
Nov. 21, 2024 | ধর্ম | views:274 | likes:0 | share: 0 | comments:0

স্যাটানিক ভার্সেস পড়িনি। পড়ার মত বিদ্যাও নেই আমার। যে রুশদিকে ছুরি মেরেছে, তারও পড়া নয় এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কলমের জবাব যখন পেশী শক্তি হয়, তখন বোঝা যায় যৌক্তিক অবস্থানের বিরুদ্ধে হেরে গিয়ে পেশী শক্তি দিয়ে তা থামানোর চেষ্টা। যা আরও বেশী করে সেই মতবাদকে প্রশ্নের মুখে দাড় করায়। কাল থেকে স্যাটানিক ভার্সেস নিশ্চিত ভাবে আরও অনেক মানুষ কিনেছেন। আরও বেশী মানুষ পিডিএফ ডাউনলোড করেছেন। আরও বেশী মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে বইটি। 

ইসলামিক মৌলবাদ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু অমুসলিমদের কাছে নয়, মুসলমান পরিবার থেকে উঠে আসা নিরীহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আতঙ্কিত। তাঁরা না পারছেন এর দায় নিতে, ধর্মীয় ভাবে না পারছেন এড়াতে। সম্ভবত সব থেকে বিব্রত আজ তাঁরা। তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, বিশ্বাসের অলীক ইমারত যুক্তির স্রোতে বিপন্ন হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। দুনিয়ায় কোন মতবাদ বাইরের আক্রমণে বিলুপ্ত হয়না। বরং বিরুদ্ধ মতবাদ একজোট করে মানুষকে। মতবাদ বিলুপ্ত হয় ভিতর থেকে, ভিতরের বিরোধিতার কারনে। ইসলামিক মৌলবাদে সব থেকে বেশী বিপন্ন ইসলাম নিজেই।  

প্রথাগত ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে কয়টি ধর্ম আছে, ইসলাম সম্ভবত তাঁদের মধ্যে সবার আগে বিলুপ্ত হবে তার এই পেশীশক্তি প্রয়োগ করে মানুষের মুখ বন্ধ করার তাগিদের জন্য। আজকের দুনিয়ায় কেউ প্রশ্নের উপরে নয়, না কোন মানুষ না কোন মতবাদ। মানুষ সমালোচনা করবে, প্রশ্ন তুলবে বারবার; কিন্তু জোর করে মুখ বন্ধের চেষ্টা আদপে সেই প্রশ্নটাকেই বার বার তুলে আনবে।

সালনাম রুশদির উপর আক্রমনের তীব্র প্রতিবাদ রইল। যে মতবাদ কলমের উপর চাপাতিকে স্থান দেয়, তাদের আশু বিলুপ্তি কামনা করি। তীব্র ঘৃণা করি কলম থামানোর জন্য এই হিংস্র আক্রমণকে। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন রুশদি। সমস্ত ধর্মীয় আগ্রাসন প্রশ্নবিদ্ধ হোক, মানুষের বাক স্বাধীনতার উপর যে কোন আক্রমণ তীব্র ভাবে নিন্দিত হোক গোটা বিশ্বে। কলম চলুক সকল অসহিষ্ণু মতবাদের বিরুদ্ধে।

অ্যালোপ্যাথি বনাম গেলোপ্যাথি -প্রবীর ব্যানার্জি
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:2571 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম পর্ব।

শুনুন বন্ধু। আমি ডাক্তার নই। তাই বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই বলতে পারব না এমন নয়। আমি যেমন জ্যোতিষী নই, তাই বলে জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না এটা হতে পারে না। ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি রান্না করতে পারেন না বলে তাতে নুন, ঝাল, মিষ্টি ঠিক আছে কিনা এটা বলার অধিকার নেই? বিরাট কোহলি আউট হয়েছে কিনা এটা বলার জন্য আম্পায়ার কে শচীনের সমান ব্যাটসম্যান হতে হবে নাকি? আশাকরি সবাই বুঝতে পারলেন আমি কি বলতে চাইছি।

অর্থাৎ আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি, আকুপাংচার, য়ুনানি, নেচারোপ্যাথি এরা আদবেই চিকিৎসার যোগ্যতা অর্জন করেছে কিনা সেটা বোঝার জন্য ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বলে আমি মনে করি না। আর অ্যালোপ্যাথি বলে কোনো চিকিৎসা নেই। হোমিওপ্যাথির প্রবক্তাই এরকম একটি নামকরণ করেছেন।আসল কথা হলো উন্নত ও বিকশিত যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান তাকেই অ্যালোপ্যাথি বলে। তাহলে আলোচনায় সুবিধার জন্য অ্যালোপ্যাথি বলতে বিজ্ঞান সম্মত উন্নত চিকিৎসাকেই বুঝব। আর গেলোপ্যাথি বলতে বিকল্প চিকিৎসা সেবা কে বুঝব। এই দলটি কিন্তু অনেক বড়ো। আসুন সবাই কে চিনিয়ে দিই। তালিকা বেশ বড়সড়।


বিকল্প চিকিৎসা:

আয়ুর্বেদ (ভারত), হোমিওপ্যাথি(জার্মানি), আকুপাংচার(চীন), য়ুনানি(গ্রিস), নেচারোপ্যাথি(ইউরোপ), অ্যারোমাথেরাপি, রেইকি, সম্মোহন চিকিৎসা, যোগ, সংযোগ স্থাপন করা সঙ্গীত চিকিৎসা, ফেইথ হিলিং, অর্থোমলিকিউলার থেরাপি, ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট, মূত্র চিকিৎসা, বায়োফিডব্যাক, অস্টিয়োপ্যাথি, কিরোপ্রাকটিক, আকুপ্রেসার, আলেকজান্ডার টেকনিক, রলফিং, সিয়াৎসু, রিফ্লেকশোলজি, বিভিন্ন ধরনের ম্যাসাজ, থেরাপিউটিক টাচ, কি গং, চুম্বক চিকিৎসা, ফেং শ্যুই, তাই কি, নানা ধরনের তড়িৎচুম্বকিয় ব্যবহার, সেলুলার থেরাপি (আইসোপ্যাথি থেকে), চিলেশন থেরাপি, অক্সিজেন থেরাপি, নানা ধরনের অপরীক্ষিত ক্যান্সার চিকিৎসা,অ্যানথ্রপোসফিক মেডিসিন,বায়োকেমিক, ফ্লাওয়ার রেমিডিজ, ইলেকট্রো হোমিওপ্যাথি, আইসোপ্যাথি, লিথোথেরাপি, কালার ও লেসার আকুপাংচার,জল চিকিৎসা (হাইড্রো থেরাপি), থ্যালাসোথেরাপি, ইরিডোলজি, ডাউসিং, সাইয়োনিক চিকিৎসা, বায়োরেসোন্যান্স, কিনেসিওলজি, কিরলিয়ান ফটোগ্রাফি, ভেগা টেষ্ট, ফ্রেনোলজি। বুঝতে পারলাম। বেশ হাঁপিয়ে গেছেন। সেই জন্য সব নাম দিলাম না। আরো আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এতো চিকিৎসা কেন? মানুষ কে পূর্ণ সুস্থতা দেওয়ার দায়িত্ব কার। রাষ্ট্রের না ব্যক্তির নিজের? এরকম প্রশ্ন উঠেছে।

সবকটা বিকল্প চিকিৎসা আলোচনা সম্ভব নয়। আসুন কয়েকটি বেছে নিই।


আয়ুর্বেদ:

আয়ুর্বেদ বলতে আমরা আজকে যেটাকে জানি,সেটা শুধুমাত্র কতকগুলো গাছগাছড়া আর দেশীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি একটা চিকিৎসা পদ্ধতি। সেই সঙ্গে রয়েছে নিদান--মানে অসুখটাকে কিভাবে নির্ণয় করবে, তা নিয়ে কিছু কথাবার্তা। আসল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রের মতো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র 'এনটিটি'। এটা হোলিস্টিকা। এতেও আছে এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, প্রিভেন্টিভ এন্ড স্যোসাল মেডিসিন, আছে 'আই', 'ইএনটি', সার্জারি বিভাগ। কিন্তু আয়ুর্বেদে উপযুক্ত লোক ছিল না। তাই আস্তে আস্তে অনেক ধারা লুপ্ত হয়ে যায়। কিছুটা সুশ্রুতের সার্জারিতে আর কিছু চরকের বইতে থাকে। তাকে বারবার সম্পাদনা করা হয়েছে। এটা আয়ুর্বেদের পূর্ণ পরিচয় নয়।

খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে ভারতের সমস্ত বিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করে ছিল এই আয়ুর্বেদ। প্রথমে এটি ছিল চরম বস্তুবাদী বিজ্ঞান। এখানে দৈবের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় নি। ফলে এই মতবাদ প্রচারে এলে দৈবমহিমা কে মূলধন করে যারা ব্যবসা করেন, তাদের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা ‌ছিল। কায়েমী স্বার্থবাদী লোক তাই এদের উপর চরম অত্যাচার নিপীড়ন নামিয়ে আনে। এদের নিগৃহীত করে, হত্যা করে, পুঁথিপত্র ধ্বংস করে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চলে। এরপরে যা কিছু বইপত্র ছিল তাদের একত্র করে তার মধ্যে দৈবের সংযুক্তি ঘটিয়ে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করে একদল গবেষক। চরক-সুশ্রুত সংহিতার কথা আগেই বলেছি। তারফলে বিজ্ঞান ভিত্তিক একটা দর্শন ধ্বংস হয়ে ঈশ্বর ভিত্তিক একটি চিকিৎসা শাস্ত্রের দর্শন চালু হয়। সৃষ্টি হয় ত্রিদোষ তত্ত্বের(বায়ু, পিত্ত, কফ)। মানবশরীর পঞ্চভূতের সমাহার। যা আসলে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর অসুখের ব্যাখ্যা ছিল পঞ্চভূতে ভারসাম্যহীনতা। চিকিৎসকের কাজ ছিল এই পঞ্চভূতের ভারসাম্য রক্ষা। এখানে স্পষ্ট করে বলা ছিল রোগ সৃষ্টি ও নিরাময়ে দৈবের কোনো ভূমিকা নেই কিন্তু পরিবর্তিত তত্ত্বে এলো বায়ু, পিত্ত, কফ ভিত্তিক ত্রিদোষ তত্ত্ব। এখনো পর্যন্ত এই তত্ত্ব চালু আছে। যদিও তার কিছু রূপান্তর হয়েছে। এটাই কবিরাজি বলে পরিচিত। ও হিন্দি তে vaid.


দ্বিতীয় পর্ব।

ভেবেছিলাম পরে আলোচনা করবো। কিন্তু যে হারে প্রশ্ন আসছে তাতে বিষয়টাকে আগেই বলে নিচ্ছি।একটা কথা গেলোপ্যাথির লোকজন প্রায় আলোচনা করেন যে অ্যালোপ্যাথিতে বড্ড বেশি সাইড এফেক্ট আছে। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সেবা তে এসব নেই।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র মনে পড়ে। মহাশয়, যাহার ক্রিয়াই নেই তাহার কিরুপ প্রতিক্রিয়া থাকিবে? যাইহোক আপনার/আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে অত নিশ্চিন্তে আয়ুর্বেদিক ওষুধ খেয়ে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঢেকুর তোলার আগে জেনে নিন,২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন(JAMA) ও ২০০৫ সালে হেলথ কানাডা তে প্রকাশিত গবেষণা পত্র থেকে আয়ুর্বেদিক ওষুধ এর নমুনায় আর্সেনিক, সীসা, পারদ ও দস্তার মতো শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতির কথা জানা গেছে।হেলথ কানাডা ১২টি আয়ুর্বেদিক ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে( Health Canada warns consumers not to use certain Ayurvedic medicine products,2005)।  JAMA তে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রস্তুত ৭০টি পরীক্ষিত আয়ুর্বেদিক নমুনার মধ্যে ১৪টিতে বিপজ্জনক সীসা, পারদ ও আর্সেনিকের উপস্থিতির খবর প্রকাশিত হয়েছে (Saper et Al 2004:2868-73)। ২০০৮ সালে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণায় রক্তাল্পতা,স্নায়ুতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের নানান সমস্যার পিছনে এইসব পন্য কে দায়ী করা হয়েছে (Dargan et Al 2008:463-74)।

আরেকটি অভিযোগ রয়েছে। আমি/আমরা নাকি পুঁজিবাদী সমাজের পেইড ব্লগার। এইসব বিরুদ্ধাচারণের জন্য আমাদের পয়সা দেওয়া হয়।এই প্রসঙ্গটি একদম শেষে আসব। এখন আলোচনা করলে ছন্দপতন ঘটে যাবে।

তো মূল প্রসঙ্গে যাই। আমাদের আলোচনা চলছিল আয়ুর্বেদ নিয়ে।

আগে যে অর্থে বায়ু বা পিত্ত বলা হতো, এখন সেটা পিত্ত বা বায়ু নাও হতে পারে। তিন হাজার বছর আগে পিত্তের মানে আজকে উদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ সেই ট্রাডিশন অনুযায়ী আগামী তে কাজ হচ্ছে না। দুঃখের বিষয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতে আপডেটিং টা হয়নি। মূল আলোচনার বিষয় হচ্ছে method.কোন method এ কি চর্চা হয়েছে সেটাই আসল। method মেনে চলেছে বলেই আধুনিক চিকিৎসা একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে আর মেথড মানেনি বলেই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা এক জায়গায় এসে থমকে গেছে। আজকে আমরা যেটা দেখছি এটা একটা অপভ্রংশ।

এই যে বিভিন্ন ধাতু আয়ুর্বেদিক ওষুধ এ পেলাম এটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আসলে আয়ুর্বেদে এমন ঔষধ প্রয়োগ করা হতো অ্যাকিউট কেসে যেগুলো ভস্ম কিংবা ধাতু। ভস্ম হচ্ছে কয়েকটি টক্সিক ধাতু যেমন পারা, সোনা, রূপা। এগুলো কে জারিত করা হতো। যেমন আর্সেনিক জারিত করলে বিষ নয়। কিন্তু বিজারিত রূপ বিষাক্ত।

আয়ুর্বেদ কিন্তু প্রথম চিন্তা করে যে শরীর মনকে সুস্থ রাখতে গেলে তার পরিবেশ,তার জীবন যাপন, তার আচার আচরণ এগুলো কেও যুক্তিশীল হতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা যেটা আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে।

তথ্য যখন আমার হাতে কম, তখন আমি যতই তত্ত্ব বানাই ততই ভুল হবে। সেই ভুলটাই আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রে হয়েছে প্রথম দিকে। আধুনিক যুগেও হচ্ছে‌।

আয়ুর্বেদের বর্তমান চেহারা এক কথায় লজ্জাজনক। আমাদের দেশে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার গুণমান নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঁচখানা ল্যাবরেটরী ও রাজ্য সরকারের একটি করে ল্যাব রয়েছে। হয়তো সেখানে NMR নেই। কিন্তু  AAS আছে HPLC, GC প্রত্যেক ল্যাবে আছে।এবার যদি আমি মনে করি, এক কোটি টাকা ব্যয়ে শুধুমাত্র কুমড়ো পাতা ও মূলোপাতা দিয়ে একটা বড়ি বানাবো এবং পাশে ১০৮টা গাছের নাম লিখে দেব, তাহলে সারা পৃথিবীর কোথাও কেউ বলবে না যে এতে কুমড়ো আর মূলা পাতা আছে বাকিগুলো নেই।

এই যে সমান্তরাল ভাবে আয়ুর্বেদিক ওষুধ এর ব্যবসা চলছে আর দাবি উঠছে রোগ সারছে এটা মারাত্মক খারাপ প্রবণতা।

ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা তে ব্যবহৃত সিঙ্কোনা গাছ  থেকে কুইনাইন, উচ্চরক্তচাপে সর্পগন্ধা থেকে রেসারপিন,আফিম থেকে ব্যথার ওষুধ মরফিন আধুনিক চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু আয়ুর্বেদিক নিয়মমেনে গাছের অবিকৃত নির্যাস ব্যবহার আজকের দিনে হয় না। কারণ উদ্ভিদের প্রাপ্ত নির্যাসে একাধিক উপাদান উপস্থিত থাকে যার একটি বা দুটি উপাদান কার্যকরী বাকি অপ্রয়োজনীয়। আয়ুর্বেদ এই কোন ভেষজের কোন উপাদানের কতখানি কোন রোগের জন্য ফলদায়ী তা সুনির্দিষ্ট ভাবে খতিয়ে দেখারও কোনো সিস্টেম নেই। এই সমস্ত কারণে এই প্রাচীন চিকিৎসা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।


তৃতীয় পর্ব।

হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে কিছু বলা অত সহজ নয়। না একতরফা বিরোধিতা ভালো নয়। একথা অনস্বীকার্য যে অ্যালোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি বিতর্ক বহুদিন ধরে চললেও মানুষের মধ্যে থেকে হোমিও চিকিৎসার প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে চিড় ধরানো যায় নি। ১৯৮৪ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে এদেশে ২.৭ লক্ষ আধুনিক চিকিৎসক, কবিরাজ ২ ৪ লক্ষ, হোমিওপ্যাথ, ১.১২ লক্ষ, ইউনানি ২৯ হাজার আর সিদ্ধা ১৮ হাজার। সাঁইত্রিশ বছর পর এই চিত্রটি কোথায় পৌঁছে গেছে সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন উঠবে এদের জীবন ও জীবিকারও। সেই হিসাবে এদেশে বর্তমানে জ্যোতিষ পেশায় যুক্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দশ কোটি দাঁড়িয়েছে। কাজেই স্বীকৃতি দিতে গেলে তাঁরাও বঞ্চনার অভিযোগ তুলবে।

প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটিসের মত ছিল অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে প্রকৃতিকে সাহায্য করাই চিকিৎসকের কাজ। রোমান আমলের চিকিৎসক গ্যালেনের মত ছিল উল্টো -- প্রকৃতিকে জয় করাই কাজ।গ্যালেনের শিষ্যরা গড়ে তুললেন অ্যালোপ্যাথি ব্যবস্থা। অ্যালোর অর্থ ভিন্ন বা উল্টো, গ্রিক 'পেথস্' অর্থে দুঃখ, কষ্ট থেকে প্যাথি।

এটা ঠিক প্রথম দিকে অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে লিডেনের চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক হারমান বোরহাভ (১৬৬৮-১৭৩৮) বলতে বাধ্য হলেন যে একেবারে কোনো চিকিৎসা না থাকলেই মানব সমাজের কল্যাণ হত।

এমন সময়ে হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩) হ্যোমিপ্যাথি শুরু করলেন।'হোমো',হোমিওর অর্থ সদৃশ, like, similar)। এবং তিনিই সনাতনী চিকিৎসার নাম দিলেন অ্যালোপ্যাথি। ওনার সম্পূর্ণ নাম স্যামুয়েল ক্রিশ্চান হ্যানিমেন।ইনি তাঁর বিরাট সৃষ্টি The Organon প্রকাশ করেন ১৮১০ সালে। তাঁর মূল চিন্তা  like cures like; Law of Similia: Similia similibus curantor। তাঁর মতে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তি (spiritual life force)  ব্যাহত হলে প্রকাশ পায় রোগ লক্ষণ।অসুখ হবার কারণ হলো আত্মার মতো যে জীবনীশক্তি মানুষ কে (সুস্থতা-অসুস্থতায়) সঞ্জীবিত রাখে সেই ভাইটাল ফোর্সের গতিময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টতে।

Organ of medicine কি বলছে।

When a person fall ill,it is only this spiritual self-acting automatic vital force, everywhere present in his organism, that is primarily deranged by the dynamic influence upon it by a morbific agent inimical to life;

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ অকল্পনীয় ক্ষুদ্রমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। হ্যানিম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী ঔষুধের মাত্রা যত কম হবে তার শক্তি ও কার্যকারিতা তত বেশি হবে। এরকম অচিন্তনীয় লঘুকরণকে(dilution) বোঝা যাবে এভাবে --- একফোঁটা ঔষধ প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলে ভালোভাবে মিশিয়ে তার থেকে এক চামচ তুলে নিতে হবে। হ্যানিম্যান এর বিশ্বাস ছিল, ওষুধের বস্তুগত পরিমাণ যত কম হবে তার আধ্যাত্মিক নিরাময় শক্তি তত বেশি হবে। এবং তাঁর পরামর্শ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লঘুকরণ বাড়াতে বাড়াতে এমনস্তরে নামিয়ে আনা উচিত যাতে দ্রবণের মধ্যে মূল পদার্থের পরিমাণ শূন্য হয়ে যায়। এটা নাকি নিরাময় ক্ষমতা কে চরম মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এই ধরনের ঔষধ খেয়ে ফলাফল পেতে পঞ্চাশ দিন ও লাগতে পারে।

তবে অচিরেই এই নিয়ে হোমিওপ্যাথি সমাজে ভাঙন ধরল। একদল বিশুদ্ধতাবাদী গোষ্ঠী, তাঁরা হ্যানিম্যান সাহেবকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ করলেন কিন্তু আরেকদল নিম্ন কার্যকরী গোষ্ঠী যারা মনে করতে শুরু করলেন যে ঔষধ এর লঘুদ্রবনে মূল পদার্থের সামান্যতম উপস্থিতি দরকার।

এবারে হোমিওপ্যাথি ওষুধগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক। ল্যাক্রিমা ফিলিয়া (ইদানিং অব্যবহৃত) তৈরি হয় ক্রন্দনরত বালিকার অশ্রুর থেকে, ভোদোরের ঘাম থেকে মেফিটিস,জ্যান্ত ছারপোকা চটকে সাইমেক্স লেকচুলারিয়াস, মানুষের প্রস্রাব বা সাপের মল থেকে অ্যাসিডাম ইউরিকিম, অ্যাস্টেরিয়াস রুবেনস (গুঁড়ো করা তারামাছ), এমনকি ঘা বা খোষপাজরার রস থেকে ও অনেক ওষুধ তৈরি করা হয়।


এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা একটি মন্তব্য করেছে যে অনাক্রম্যকরণের অভিজ্ঞতাবাদী অনুশীলনের সঙ্গে ওপর ওপর মিল দেখা গেলেও হোমিওপ্যাথির যথার্থতার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আবার এটাও শোনা যায় লঘুকরণ করতে করতে  না কি ওষুধের পদার্থ বিলুপ্ত হয়ে পড়ে থাকে  এক রহস্যময় রশ্মি,  যা রোগ সারায়। সেন্টেসিম্যাল স্কেলে হ্যানিম্যান ৩০ ডাইলিউশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। নব্যপন্থীরা অবশ্য লঘুকরণের উপর জোর কমালেন। ৩ থেকে ৬ ডাইলিউশনের বেশি আজকাল প্রায় কেউই ব্যবহার করেন না।

(চলবে)


তথ্য সূত্র:

বিজ্ঞান কে মুখোশ করে, মার্টিন গার্ডনার।

(উৎস মানুষ)

বিকল্প চিকিৎসা চিকিৎসার বিকল্প? সুব্রত রায়

(মুক্তচিন্তা পাবলিকেশন্)

আয়ুর্বেদ ও বিজ্ঞান,উৎস মানুষ।

হোমিওপ্যাথি বনাম বিজ্ঞান, উৎস মানুষ ‌

Alternative medicine (2000), Encyclopedia of pseudo science.

বার্নাম এফেক্ট -পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:293 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমি শুনতে চাই তাকে,

মস্তিষ্ক মিল পায় যাকে।

আমাদের মস্তিস্ক বিভিন্ন ঘটনার মিল খুঁজতে পারদর্শী। যে কোনো ধরণের বক্তব্য বা কথা আমরা নিজেদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে যাই। নিজেদের অহংবোধ আর মস্তিস্কের মিল খোঁজার প্রবণতা মিলে আমরা যে কোনো গল্পে নিজেদের খুঁজে পাই, তবে শুধু মিল গুলো! অমিলগুলো যেন নিজে থেকে নিভে যায়।

জ্যোতিষ, রাশিফল,বাবাজী, মাতাজী, সাধুবাবা কথায় বা অতীত বা ভবিষ্যৎবানীতে আমরা এভাবে মিলটাই খুঁজে নিই। কিন্তু একবার ভাবুন অন্য যারা একই রাশিফল পড়ছে তারাও আপনার মতই মিল খুঁজে পাচ্ছে- যদিও তাদের জীবন আপনার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।

এ’যেন কিছুটা এমন -

ধরুন, আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা একটি মেয়ে/ছেলে স্ট্যাটাস দিয়েছে, “আমি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা একটি ছেলেকে/মেয়েকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছি না।কি ভাবে বলি বলুন তো?”

আপনি এই স্টাটাস দেখে তৎক্ষণাৎ ভাবতে পারেন, স্ট্যাটাসটি হয়তো আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে।


মজার বিষয় হলো, ঠিক একইভাবে আরো কয়েকজন ফেসবুক ফ্রেন্ড একই কথা ভাববেন যে, মেয়েটি/ছেলেটি হয়তো তাদের উদ্দেশ্যেই কথাটি বলেছেন।  এটাই বার্নাম ইফেক্ট। এই ধরনের বাক্যগুলোতে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয় না। একটা কথা বলা হয়, যা সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে কিন্তু সবাই মনে করে কথাটি কেবল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।


"বার্নাম এফেক্ট" হলো মস্তিষ্কের এমন এক অনুভূতি যখন কোনও সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে নিজের মতামত শুনে বা কোনও রাশিফল পড়ে, আপনি মনে করেন: “এটি অবশ্যই আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ আমার জীবনের কথা"। "আমিতো এমন"। হাঁ আমার জীবনেই তো এমন ঘটেছে"। "আমার সঙ্গেই তো এমনটা ঘটে"। "হাঁ, আমার জীবনে এগুলো ঘটতে পারে"!


১৯৪৮ সালে মনোবিজ্ঞানী বার্ট্রাম ফোরার একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে একটা পার্সোনালিটি টেস্ট করেছিলেন। তিনি সকল ছাত্রদের পৃথক ভাবে ডেকে একটি পত্রিকায় যেমন রাশিফল দেয় তেমন  লেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাদের সঙ্গে কতটা মেলে তা পয়েন্ট দিয়ে জানাতে। সব মিলে গেলে ১০ পয়েন্ট। শিক্ষক একই কথা লেখা কাগজ প্রত্যেকের হাতে তুলে বলেছিলেন দেখো তোমার কথা লেখা আছে কি না। তবে লেখাটি নির্দিষ্ট করে কারোর জন্য ছিল না। তবুও বেশীরভাগ ছাত্র পয়েন্ট দিয়ে জানিয়েছিল তার কথাই লেখা হয়েছে।


কী লেখা ছিল সেই কাগজে? "তুমি সবাইকে আপন ভাবো, ভালোবাসো, কিন্তু সবাই তোমাকে ভালোবাসে না। তোমার কথার সবাই সমালোচনা করে কিন্তু পরে দেখা যায় তোমার কথাই ঠিক ছিল। তোমার কিছু ব্যক্তিগত দুর্বলতা থাকলেও তুমি সেগুলো কাটিয়ে ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে।কারণ তোমার মধ্যে যা প্রতিভা লুকানো আছে তা অনেকের নেই।তোমার শৃঙ্খলাবোধ, দায়বদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস তোমার সম্পদ। সেগুলোই অন্যদের ঈর্ষার কারণ। তবে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে বা সঠিক কাজটি করেছো কিনা তা নিয়ে মাঝে মাঝে তোমার সন্দেহ হয়।তুমি কিছু বৈচিত্র্য, বিশালতা, আর নিজস্বতা পছন্দ করো।কিন্তু তা পাওনা বলে মাঝে মাঝে অস্থির লাগে। তুমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করো; আবার উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া সবকিছু বিশ্বাস করো না। তুমি জেনে গেছো যে অন্য লোকের সাথে খুব খোলামেলা হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই কখনও কখনও তুমি অন্তর্মুখী, সতর্ক আর মিতভাষী।তাই বলে উচিত কথা বলতে তুমি পিছপা হয় না। তবে তোমার কিছু আকাঙ্ক্ষা অবাস্তব।সেটা তুমিও জানো। তবু তুমি স্বপ্ন দেখো। যাইহোক তোমার মধ্যে যা পজিটিভিটি আছে তা দ্বারা অনেক কষ্টের মধ্যেও তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে"।


আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, শিক্ষক মহাশয় অত্যন্ত চতুরতার সাথে এই লেখা লিখেছেন, যাতে বেশিরভাগ ছাত্রের মনের সাথে তা মিলে যায়। প্রত্যেকে যাতে প্রত্যেকের নিজের মতো বিবরণ খুঁজে পেতে পারে। 

এবার আসুন। জ্যোতিষীরা যেভাবে আপনার ভাগ্য বলে দেয়, আমিও সেভাবে আপনার অব্যর্থ ভাগ্যগনণা করে দিই। দেখুন তো এর মধ্যে কয়টি আপনার সঙ্গে মিলে যায়! 


১। আপনার যা Quality সেই পরিমাণ সাফল্য আপনি পান নি।

২। আপনি সবার জন্য করবেন, কিন্তু নাম পাবেন না।

৩। আপনি মুখ ফুটে নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না।

৪। আপনার নিকটজনই কিন্তু আপনার সবথেকে বড় শত্রু।

৫। আপনার প্রতি শণি বিরূপ। বৃহস্পতি ও সদয় নয়। এদের সন্তুষ্ট করতে হবে। নইলে বিপদ। 

৬। বছরের প্রথম দিকে অর্থভাব খুব শুভ হলেও, বছরের মাঝখানে আর্থিক দিকে একটু সমস্যা দেখা দেবে। তবে সেটা সামলে ওঠার ক্ষমতা আপনার আছে।অর্থের ব্যাপারে সতর্ক থাকলে সঞ্চয় ভাল হবে। অর্থ ভাগ্য খুব ভাল হবে এই বছর।

৭। বায়ুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে ও সংসারের সকলের ভালো করতে গিয়ে টেনশন বাড়বে। হার্ট দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা। 

৮। সন্তানরা একটু অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে।

৯। বিভিন্ন ছোটখাটো কারণে আপনার  স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ চলবে। 

১০। অনেক দিনের পুরনো কোনও সম্পর্কে কোনও প্রকার চিড় ধরতে পারে। 

১১। নিজের প্রচেষ্টায়  কিছু আয় বাড়তে পারে।তার জন্য আপনার কলিগদের ঈর্শাভাজন হবেন।

১২। বছরের শেষে ভ্রমণের যোগ আছে।

১৩। প্রেমের বিষয়ে কোনও গোলমাল সামনে এলে, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

১৪।  সম্পত্তির জন্য ভাই ভাই বিবাদ হতে পারে। তার জন্য মানসিক চাপ বাড়তে পারে।

১৫। সামনে আপনাকে অনেকে ভালোবাসলেও প্রকৃত ভালোবাসা আপনি পাবেন না।

১৬। আপনি ভালো মানুষ। সবাইকে খুব সহজে  আপনি বিশ্বাস করেন। সেই সুযোগে তারা আপনাকে ঠকায়।সবাই তো আর আপনার মতো সরল মানুষ না।

১৭। আপনি সবসময় ঠিক কথাই বলেন। প্রথমে সেই কথার গুরুত্ব কেউ দেয় না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আপনার কথাই সত্যি হয়।

১৮। আপনি অপরের বিপদে সবসময় এগিয়ে আসেন। কিন্তু নিজের কোনো বিপদে কাউকে তেমন পাশে পান না।

১৯। সামনে একটা ফাঁড়া আসছে। সাবধানে থাকবেন। ভগবানকে ডাকবেন। বিপদে তিনি আপনাকে রক্ষা করবেন। 

২০। আগামী দু মাস আপনার জন্য অশুভ। 


এই সাধারণ কথাগুলো অনেকের সঙ্গে মিলে যাবে।আর আগেই বলেছি আপনার মস্তিষ্ক তো মিলটাই খুঁজে নেবে।যেটা মিলবে না সেটার কথা ভুলেও ভাববে না! বার্নাম এফেক্ট বা ফোরার এফেক্ট!

জ্যোতিষীরা আপনাকে দেখে এই কথাগুলো তাদের মতো করে আপনাকে বলে।তারা পেশেন্ট/ক্লায়েন্ট ঘেঁটে-ঘেঁটে প্রচুর অভিজ্ঞ। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের হিসেব নিকেষ যেমন ঠিকুজি, কুষ্টি, হস্তরেখা বিচার, কপাল বিচার, বাস্তুশাস্ত্র এইসব ভড়ং বা নাটক করে আপনার বিশ্বাস অর্জন করে। এরপর তারা আপনার মন বুঝে এমন সব কথা বলে যে আপনি সহজেই বিশ্বাস করে নেন যে এগুলো আপনার ভাগ্যে আছে। এই বিশ্বাসের সুযোগ তারা কেন হাতছাড়া করবে! তারা ধান্দাবাজ, চিটিংবাজ  বৈ তো কিছু নয়!!

দেশপ্রেম: একটি উপযুক্ত সংজ্ঞার খোঁজে -চিত্রদীপ সোম
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:281 | likes:2 | share: 2 | comments:0

হয়ত বড় অসময়ে এ লেখায় হাত দিয়েছি। বা হয়ত এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সবে পনেরই আগষ্ট গেল। দেশপ্রেমের ঝড় প্রত্যক্ষ করেছি দু’দিন আগেই। বাইকে, গাড়িতে, বাড়ির মাথায় পতাকায় পতাকায় ছয়লাপ। মাইকে  দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। টিভিতে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ গানের সাথে ভারী বুটের কুচকাওয়াজ আর আকাশে যুদ্ধ বিমান থেকে পুস্পবৃষ্টি। দেখতে দেখতে ভারী আরাম বোধ করি। অনুভব করি এই তো আমার দেশ। ওই যে সার দিয়ে যাওয়া ট্যাঙ্কের সারি, ওই যে কম্যাণ্ডের তালে তালে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ, ওই যে মিলিটারি গাড়ির মাথায় রাখা স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপনাস্ত্র, এটাই তো আমার দেশ। ওই যে টিভিতে দেখাচ্ছে দেশের সেনা একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছে শত্রুসৈন্যকে খতম করে দেবার, আর তারপর এগিয়ে যাচ্ছে রণক্ষেত্রে, এটাই তো আমার দেশ। ওই যে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে পতপত করে উড়তে থাকা তেরঙা পতাকা, ওটাই আমার দেশ।

কে দেশপ্রেমিক নয় আজকের দিনে? সাতে পাঁচে না থাকা হরিপদ কেরানী শ্যামলবাবু, দু’নম্বরি ওষুধের ব্যবসায়ী রমেশবাবু, আয়কর দপ্তরে কাজ করা দু’হাতে ঘুষ নেওয়া অনিলবাবু, স্থানীয় মস্তানদের থেকে তোলা আদায়কারী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পদলেহনকারী পুলিশ অফিসার সুনীলবাবু, পণের দায়ে বউকে ধরে পেটানো স্বরূপবাবু, বাড়ির ইলেকট্রিক মিটারে কারচুপি করে রাখা সুব্রতবাবু, বাড়ির শিশু গৃহশ্রমিককে খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া অনিতা দেবী, সবাই সবাই দেশপ্রেমিক আজ। দেশপ্রেম আজ এতটাই সস্তা, এতটাই সহজলভ্য। দেশপ্রেমিক হবার জন্য আজ আর দেশের জন্য কিছু না করলেও চলে। দেশের মানুষের জন্য জীবনপাত না করলেও চলে। কেবল বুকে বা বাইকে পতাকার স্টিকার লাগিয়ে ঘোরা, টিভিতে মিলিটারি বুটের আওয়াজ বা মাইকে ‘অ্যায় মেরে বতন কে’ শুনে বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠা আর দুপুরে টিভিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খান দুই গরম গরম সিনেমা দেখলেই দেশপ্রেমিক হবার কোটা সম্পুর্ন। আর তাই দেশপ্রেমিক হবার এই সহজ প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে নেই আজ।


আর দেশপ্রেমের এত বিচিত্র আয়োজনে গুলিয়ে যায় একটা সোজা প্রশ্ন, কাকে বলবো দেশ, কাকে বলবো দেশের প্রতি প্রেম।

দেশ কী? তা কি শুধুই কাঁটাতারে ঘেরা একটা ভূখন্ড? শাসকের মগজধোলাইয়ের শিকার অধিকাংশ মানুষের কাছে দেশ মানে তাই-ই৷  কাঁটাতারে ঘেরা এক ভৌগলিক এক সীমানা মাত্র। এক রঙিন মানচিত্র। আর সেই ভৌগলিক সীমানাকে অখন্ড রাখতে চাওয়াই দেশপ্রেমের একমাত্র সংজ্ঞা আজ মানুষের কাছে৷ এবং এর জন্য সাধারণ মানুষকে একটুও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ বহু ঢক্কা নিনাদে, বহু ব্যায় করে মিডিয়া, স্কুল পাঠ্যপুস্তক থেকে পোষ্য নানা বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে সরকার জনগনের মাথার মধ্যে দেশপ্রেমের এই সংজ্ঞাই ঢুকিয়ে দিতে চায়। বোঝাতে চায় দেশ মানে কেবল কাঁটাতারে একটা ভূখন্ডমাত্র। আর সেই ভূখন্ডের রক্ষকরাই দেশের আসল সেবক। দেশের সীমানাকে যেনতেন প্রকারে অক্ষুন্ন রাখাই একমাত্র দেশপ্রেমের মাপকাঠি।

কিন্তু কেউ যদি শাসকের মগজধোলাইয়ের শিকার না হন, যদি সেই বিরল কিছু মানুষের মধ্যে পড়েন যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে অনুধাবন করবেন শুধু সীমানা দিয়ে দেশের ব্যখ্যা হয় না৷ দেশ মানে সেই সীমানার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত জনগোষ্ঠী, সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রানী, সবকিছুই। আর তাই দেশপ্রেম মানে কেবল দেশের মাটি বা সীমানার প্রতি প্রেম নয়, “দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি প্রেমও”। মানুষ ছাড়া দেশ অর্থহীন। মানুষই তৈরী করে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সীমানা। পৃথিবীতে যখন মানুষ আসেনি, প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসররা যখন ঘুরে বেড়াত পৃথিবীর বুকে, তখন কোনটা ছিলো ভারত, কোনটা ছিলো পাকিস্তান, কোনটাই বা ছিলো রাশিয়া? আবার হঠাৎ করে যদি মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায় দুনিয়া থেকে তখন কে বলে দেবে কোনটা ভারত আর কোনটা পাকিস্তান? এই যে কাঁটাতারে ঘেরা এই পৃথক পৃথক ভূখন্ডের ধারণা, এটা তো মানুষেরই সৃষ্টি। সেই মানুষই  যদি না থাকে তাহলে কী হবে সেই দেশ নিয়ে?

অথচ আজ শাসকগোষ্ঠী দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা আমাদের মাথায় ঢোকাতে চাইছে তাতে দেশের সীমানার কথা আছে, সীমান্তরক্ষাকারী প্রহরীদের কথা আছে, নেই কেবল দেশের মানুষের কথা। নেই রামা কৈবর্ত্য আর হাসিম শেখদের কথা। দেশপ্রেমিক বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সীমান্ত রক্ষাকারী সৈন্যদের কথা, কিন্তু ভেসে ওঠে না রামা কৈবর্ত্য  বা হাসিম শেখদের কথা, যারা রোদ ঝড় মাথায় নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়। ভেসে ওঠে না হাবিব মোল্লা বা কালু প্রামাণিকদের কথা, যারা কারখানায় হাতুড়ি পিটিয়ে সচল রেখেছে এ দেশের অর্থনীতিকে।


সৈন্যদের পেশার প্রতি আবেগে গদগদ ভাবকে কিছুক্ষনের জন্য ছুটি দিয়ে ভাবুন তো, দেশকে সচল রাখতে কার অবদান বেশী, একজন সৈন্যের, না একজন কৃষকের? একজন সৈন্যের, না একজন শ্রমিকের? আজ সারা পৃথিবী থেকে সৈন্যবাহিনী তুলে দিলেও পৃথিবী যেমন চলছে তেমনই চলবে। কিন্তু আজ যদি সারা পৃথিবীর কৃষকরা চাষ করা বন্ধ করে দেয়? যদি সারা পৃথিবীর শ্রমিকরা সমস্ত কারখানা বন্ধ করে দেয়? যদি সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিষেবা দেওয়া থামিয়ে দেয়? ভাবতে পারছেন কী হবে তারপরে?  চলবে তো তারপর পৃথিবী স্বাভাবিকভাবে? নাকি এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াবে তা? দেশকে সচল রাখতে কে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাহলে?


তাহলে টিভিতে, মিডিয়ায় কেন দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসাবে ঠাঁই পায় শুধু উর্দিধারী সীমান্তরক্ষীরা? কেন রামা কৈবর্ত্য বা হাবিব মোল্লারা নয়? কেন তারা সিনেমায়, গানে, কুচকাওয়াজে, কাব্যে সর্বত্র উপেক্ষিত? কেন সীমান্তে মৃত সেনারা শহীদের সন্মান পায়, কিন্তু চাষ করতে গিয়ে বজ্রপাতে বা সর্পাঘাতে মৃত কৃষকরা থেকে যায় উপেক্ষিত? কেন সৈন্য মারা গেলে আবেগে ছলছল করে ওঠে আমাদের চোখ, কিন্তু দেনার দায়ে গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ কৃষক মৃত্যুর খবর বিন্দুমাত্র ঝড় তোলে না আমাদের হৃদয়ে? কেন এদেশে সীমান্ত রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকার অস্ত্র আসে, বিদেশ থেকে যুদ্ধ বিমান কেনা হয়,  কিন্তু রামা কৈবর্ত্য বা হাসিম শেখরা যাতে ভালো থাকে, তাদের পেটে যাতে দুবেলা খাবার জোটে, তার ব্যবস্থা করা হয় না? কেন আজ ভারত পৃথিবীর অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও আজও ভারতের হাজার হাজার গ্রাম বিদ্যুতহীন? কেন আজ ভারতের কাছে রাফায়েল কেনার টাকা থাকে, কিন্তু থাকে না প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে নূন্যতম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার টাকা? কেন ভারতের পরমানু বোমা পরীক্ষার টাকা থাকে, অথচ থাকে না প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার টাকা? মানুষের মুখে খাবার না দিয়ে, মানুষের নুন্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে, মানুষের শিক্ষার ব্যবস্থা না করে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র কেনে, যারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ কমাতে কমাতে ১% এর কাছাকাছি নিয়ে আসে, যারা নোট বাতিল, জিএসটি সহ নানা উদ্ভট পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে ৪০% ছোট ব্যবসাকে ধ্বংস করে অসংখ্য পরিবারকে ঠেলে দেয় বিপদের মুখে, যারা একের পর এক সরকারী সংস্থাগুলিতে তুলে দেয় বেসরকারি হাতে, যারা ছাঁটাইয়ের খাড়া নামিয়ে এনে হাজার হাজার পরিবারকে ঠেলে দেয় ধ্বংসের পথে, এভাবে দেশের মানুষের জীবনকে যারা করে তোলে সঙ্গীন, তারা যে আদৌ 'দেশপ্রেমিক' নয় বরং 'দেশের শত্রু' এটা কবে বুঝবো আমরা? কবে কাটবে আমাদের চিন্তাধারার এই অস্পষ্টতা? দেশের শত্রু মানে কি কেবল পাকিস্তান? যাদের জন্য আজ দেশের মানুষের এই চরম দুরবস্থা তারা দেশের শত্রু নয়? আর যদি তাই হয় তাহলে তাদের বিরোধিতা করাটা, তাদের মুখোশ উন্মোচন করাটা কেন দেশপ্রেম নয়? এদের বিরুদ্ধে মানুষকে তাদের অধিকার বুঝে নেবার লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করাটা কেন দেশপ্রেম নয়?

দেশপ্রেম মানে শুধু সীমান্ত পাহাড়া দেওয়া নয়, মানুষকে তার অধিকার আদায়ের লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করাটা, রাষ্ট্রীয় মগজ ধোলাইয়ের কুহেলিকা থেকে মানুষকে  বের করে এনে মুক্ত মনে চিন্তা করতে শেখানোটাও দেশপ্রেম, দেশের মানুষের জন্য ক্ষেতে ফসল ফলানোটাও দেশপ্রেম, কারখানায় হাতুড়ি পেটানোটাও দেশপ্রেম, হাসপাতালে রাত জেগে মুহুর্ষু রোগীর সেবা করাটাও দেশপ্রেম। দেশ শুধু সীমান্তের কাঁটাতার আর সৈন্য দিয়ে তৈরী নয়, দেশ আরো অসংখ্য সাধারণ মানুষ দিয়েও তৈরী। সেইসব মানুষের সেবা করাটা, তাদের জাগতিক ও মানসিক উন্নতির চেষ্টা করাটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। আর সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ করটাই দেশদ্রোহীতা। এই সহজ সরল উপলব্ধিটা যতক্ষন না হবে ততক্ষন রাষ্ট্রীয় মগজধোলাইয়ের পুতুলই থেকে যাবেন আপনি।

বর্তমানে দেশপ্রেমিক হবার আর এক সহজ পথ পাকিস্তানকে তেড়ে গাল দেওয়া। আমরা ভুলে যাই নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রমান করার রাস্তা পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মা-কে তেড়ে গাল পাড়া নয়। আপনি নিজের মা-কে ভালোবাসেন সেটা তখনই প্রমানিত হবে যখন আপনি আপনার রোজগারের টাকা দিয়ে মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনে আনবেন, তার জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন, তার জন্য ভালো জামা কাপড় কিনে আনবেন। তখনই কেবল আপনাকে মায়ের সুসন্তান বলা যাবে। মায়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা তখনই একমাত্র পরীক্ষার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে। তার বদলে আপনার রোজগারের টাকায় যদি আপনি মায়ের জন্য খাবার না কিনে, তার অত্যাবশ্যক ওষুধ না কিনে, সেই টাকায় চকচকে ভোজালি কেনেন পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মা কে খুন করার জন্য, তাহলে সেটা আর যাই হোক মার্তৃপ্রেম বা মাতৃভক্তি নয়। নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রমানিত হয় না তাতে। বদলে এইটুকু প্রমানিত হয় কোনো কারণে পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মাকে ঘৃণা করেন মাত্র। ব্যাস।

ঠিক একইভাবে শুধু পাকিস্তানকে ঘৃণা করলেই বা দেশের সেনার প্রতি ভক্তিতে গদগদ হলেই আদৌ আপনি দেশপ্রেমিক হচ্ছেন না বা দেশের প্রতি আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। নিজের দেশের মানুষের প্রতি ইতিবাচক কিছু করার দায়িত্বও একইভাবে থেকে যাচ্ছে। সেটা যতক্ষন না সুষ্ঠুভাবে করছেন ততক্ষন বুকে বা বাইকে যতই তেরঙা স্টিকার লাগান, আর মাইকে অ্যায় মেরে বতন কি লোগো শুনে রক্ত গরম হোক, ওটা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।


শাসকের শেখানো ছদ্ম দেশপ্রেমের মগজধোলাইয়ের হাত থেকে তাই মুক্ত হই আসুন। আবেগ বিবর্জিতভাবে শিখে নিই কাকে বলে দেশ, কাকে বলে দেশপ্রেম। বুঝে নিই দেশ মানে শুধু দেশের মাটি নয়, দেশের মানুষও। দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু সীমান্ত আর সেনাকে ভালোবাসা নয়, দেশকে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ দেশের মানুষকে ভালোবাসা, তার জীবনসংগ্রামে পাশে থাকা, তার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সহযোদ্ধা হওয়া৷

এই বোধ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায় দেশপ্রেম।

স্বাধীনতার অমৃত -মহম্মদ মহসীন
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:289 | likes:0 | share: 0 | comments:0

স্বাধীনতার অমৃত, তার উৎসব,  মহোৎসব মানে মচ্ছব।  ১৯৪৭ এর এই রকম এক আগস্টের ১৫ তারিখে,  ভারত লাভ করেছিল স্বাধীনতা। কী পেয়েছিল তাতে আম জনতা? তার আগে দেখি আমাদের নেতারা কী পেয়েছিল। তারা পেল দুটো দেশ। একটা ভেঙে দুটো। তাই দুটো রাজা, দুটো মন্ত্রী, দুটো সেনাপতি, মন্ত্রী সান্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল, সব দুটো দুটো করে। যথার্থ স্বাধীনতা পেল এরাই। স্বাধীনতার প্রভুত্ব চালাবে এরাই প্রজাদের উপরে। দিন-মাস- বছরের একক, দশক, শতক ধরে।

এ নাহয় গেল নেতাদের কথা। এখন বলি তাহাদের কথা, মানে আম, জাম, আতা-জাতীয় জনতার কথা। তারা পেল সদ্য স্বাধীনতার অভিশম্পাত। দেশ ভাগ। নিজ দেশে পরভূম। রাতারাতি জানলো, এই দেশটা ওদের, তোমাদের দেশ তো ওপারে। যথেচ্ছ লুঠতরাজ, খুনখারাপি, দাঙ্গা। অনেক লড়াইয়ের শেষে, নিজের দেশে এসে, জুটলো তাদের ক্যাম্প নামক নরক। সেখানে পেল তারা নতুন নামঃ রিফিউজি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে এসে নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে করতে তারা ভাবলো, এর নাম তাহলে স্বাধীনতা? কেন এমন হলো। কে দায়ী এই যন্ত্রণার দেশভাগে?

 দায়ী তো আমরাই। হ্যাঁ আমরাই। কিভাবে? সেটাই আজ বলি। ছোট থেকে বাবা, মা, পরিবার, সমাজ, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মহা মহাজ্ঞানীদের শিক্ষায়, বলা ভাল কুশিক্ষায়, অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়েছি চোখ বুজে। ধর্মের পথে চলেছি। ধর্মের প্রতি ভক্তিতে ভক্তিতে খুইয়েছি মানবিকতার পাঠ, মনুষ্যত্বের ভাষা। ধর্ম বুনে দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ধর্ম করে দিয়েছে অন্ধ। তাই দেশভাগে নেতারা বোঝালে, তুমি হিন্দু, কাজেই ঐ দেখ হিন্দুস্থান, ওটাই তোমার দেশ, ওটাই তোমার আবাসস্থান। ওখানে তোমার ধর্ম সুরক্ষিত। নাহলে তোমার ধর্ম আছে খতরে মে।

  ধর্মের কাজই তো অন্ধত্বের চাষ। এই চাষে লগ্নী করে ধনীরা, বেনিয়ারা। তারাই বানায় ধর্মের নেতা, রাজনীতির নেতা। এদের চাকরি হলো তোমায় বোঝানো। তুমি মুসলমান, ধর্ম তোমার খতরে মে। ধর্ম করে দিয়েছে অন্ধ। তাই দেশভাগে নেতারা বোঝালে, তুমি মুসলমান,  ঐ দেখ পাকিস্তান, ওটাই তোমার দেশ, ওটাই তোমার আবাসস্থান। ওখানে তোমার ধর্ম সুরক্ষিত। ওখানে গড়তে পারবে তোমার ধর্মের রাষ্ট্র। 

 দেশ হলো স্বাধীন। যারা স্বাধীন হলো, তারাই খেতে পেলে অমৃত। সেই শুরু। সেই স্বাধীনতার অমৃত খেয়ে চলেছে দেশের দু আনা লোক, দেশের চৌদ্দ আনা সম্পদের অধিকারী তারা। আর বাকি চৌদ্দ আনা লোক, পেল দু আনা সম্পদ, দেশভাগের যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িকতার গরল। কারণ দেশভাগের বীজ তো তোমার মজ্জাতেই, তোমার ধর্মবিশ্বাসে, তোমার জীবন বোধে। তোমার জীবন দর্শণে।


 তাই যখন মুক্ত চিন্তা করতে দেখলেই রে রে করে তেড়ে আসি, তাড়িয়ে তাদের ঘর ছাড়া করি, দেশছাড়া করি, মারি, ধরি, খুন করি, তখন কি ভেবে দেখবে না, কে দায়ী এর জন্য? একবার তোমায়, ভেবে দেখার আর্জি জানাই, তোমার এই বদ্ধ চিন্তন, এই অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, এমনি ভাবেই লুট-পাটের পথ প্রশস্ত করবে ঐ ধনীদের, বেনিয়াদের, নেতাদের, ধর্মগুরুদের। যখনি ধার্মিক তথা ধর্মান্ধের দল, সামনে "কুকুর বেড়াল মেরো না, নাস্তিক পেলে ছেড়ো না" লেখা ফেস্টুন সাজিয়ে মিছিল করে, মুক্তমনাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করে, তাদেরকে অত্যাচার করার নানান আইন বানায়, তাদের উপর নানান ফন্দি ফিকিরি কানুন চাপায়, তখন স্মরণ করিয়ে দিই, গায়ের জোরে ধর্ম প্রবর্তকদের অন্যায়, অনীতি,  অনাচারের ইতিহাস চাপা দেওয়া যায় না, তাদের প্রণীত ধর্ম গ্রন্থের অন্যায়গুলিকে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, ভুল গুলিকে সঠিক বলে  প্রচলিত করা যায় না, মিথ্যাগুলিকে সত্য বলেও চালানো যায় না। মুক্তমনে শিখলে, জানলে, পড়লে, ভাবলে সে সব মিথ্যা স্পষ্ট হয়ে যায়, ধর্মের ফানুশ ফেটে কোথায়  যে ভ্যানিশ হয়ে যায়, তার চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। 

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কত শত ধর্ম, যারা দাবী করেছিল, তাদেরটাই একমাত্র সত্য ধর্ম, ঠিক তোমরা যেমন দাবী করে থাকো, কালের কবলে কোথায় যে হারিয়েছে তার ইয়ত্তা পাওয়া যায় না, নাম ঠিকানা হারিয়ে আজ সে সব সত্য ধর্ম মানবজাতির স্মৃতির অতল  থেকেও বেপাত্তা। তাহলে বোঝা গেল তো, কেমন স্বাধীনতা। কেন দেশভাগের যন্ত্রণা, কে দায়ী তার জন্য?

এই দেশভাগের বীজ আমাদের ধর্ম বিশ্বাস। সে বীজের অঙ্কুর বেরোনোয় দরকারী বাতাস দিয়েছে আমাদের ভক্তি-নিঃশ্বাস। চারার বৃদ্ধিতে  জলসেচ দিয়েছে আমাদের অন্ধ বিশ্বাস। সে বিষবৃক্ষ এখনো বেড়ে চলেছে।


কাজেই বন্ধু এখনো যদি না জাগো, এখনো যদি না চিন্তা করো মুক্তভাবে, এখনো যদি না পরিত্যাগ করতে পারো আজন্ম লালিত অযৌক্তিক জীবনাচরণ, যাকে তুমি ভেবেছো তোমার জীবনের আদর্শ, এখনো যদি না ত্যাগ করতে পারো তোমার হিন্দু-সত্তা, মুসলিম-সত্তা, তাহলে স্বাধীনতার অমৃত খেয়ে যাবে ওরাই। যুগ যুগ ধরে। তোমার জন্য উপহার অশিক্ষা, শিক্ষার নামে ধর্মশিক্ষা, কুশিক্ষা; আধুনিক চিকিৎসার নামে হোমিওপ্যাথীর চুষিকাঠি, মান্ধাতার আয়ুর্বেদ, চিকিৎসার নামে অভ্যাসের শৈলী যোগ,  স্বাস্থ্য কাঠামোর উন্নতির নামে আরো শোষণ। তোমার জন্য উপহার বেকারত্ব, চাকুরির নামে শোষণ। শোষণ, শোষণ আর শোষণ। রাষ্ট্র ক্ষমতা কায়েম করে শুধু শোষণ আর শোষণ। 

নির্বিবাদে এই শোষণ চালানোর জন্য মুক্তমনের চিন্তনকে দমন করা, চাপা দেওয়া জরুরি। তাই রাষ্ট্র মুক্ত চিন্তনের বিরুদ্ধে। ধর্ম বিশ্বাস প্রচলিত রাখতে লগ্নী করে বিভিন্ন দিক দিয়ে। ধর্ম বিশ্বাসরূপ অন্ধবিশ্বাসকে সুশিক্ষা বলে চালাতে সমর্থন যোগায় সকল দিক দিয়ে। 


কিন্তু ফাঁপা ঢেঁকির শব্দ আচকিত করে মাঝে মাঝেই। ধর্ম বিশ্বাস ফোঁড়া ফেটে পুঁজ বেরোয় হর হামেশাই। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এইসব স্বাধীনোত্তর দেশের সংখ্যালঘুরা, দলিতেরা  নিপীড়িত হয় ধর্মবিশ্বাসের "সুশিক্ষার গুণে"। দেশের সেই '৪৭ এর ১৫ই আগস্টে কিংবা আবার পরে '৭১ এর  ২৬ শে মার্চে স্বাধীনতা পাওয়া প্রভুরা, রাজারা, মন্ত্রীরা তাদের মহারাজ বেনিয়াদের দেওয়া চাকুরির দায়িত্ব পালন করে চলে অন্ধবিশ্বাস চাষের কর্তব্যে। ব্রেন ওয়াশড ধর্মগুরুগুলিও পুরোদস্তুর ময়দানে নেমে দায়িত্ব পালন করে চলে আরো আরো ব্রেইন ওয়াশ করার "শুভ কর্মপথে"। 

 আর ব্রেন ওয়াশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। আজকাল বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় অমুক ধর্ম গুরু স্বাধীনতা আন্দোলনে হ্যান করেছিল, ত্যান করেছিল। ধর্মগুরুর বৌটিও না কি স্বাধীনতা সং গ্রামে  প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কত কি সাহায্য করেছিল। স্বাধীনতা সং গ্রামের বিপ্লবী, জীবনের প্রথম দিকে অনেক কাজই করেছেন, কিন্তু পরে ধর্মের আঁধার আশ্রয়ে গিয়েছেন। ধর্মের লোকেরা কিন্তু তার আলোকিত জীবন নিয়ে যত না আন্দোলিত, তার অন্ধকারময় কাপুরুষকার জীবনকে আলোকিত বলে বলে শতগুণ উচ্ছ্বসিত, অন্ধকারময় কাপুরুষিক জীবনকে, তার জীবনের মিথ্যাকে, সত্য দর্শণ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সহস্রমুখে গোয়েবেলসীয় প্রচারে উৎসর্গীকৃত। হায়, বিশ্বকে বিপথে চালিত করতে ধর্মবিশ্বাসের জুড়ি নাই। তাই এই পথকেই নির্দ্বিধায় বেছে নেয় রাজা তৈরির মালিকেরা। দেশের সব শোষণের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখে এভাবেই।

  স্বাধীনতার লড়াই লড়েছিল ভগৎ সিং। স্বাধীনতার জন্য। মুক্তির জন্য। বলেছিল, মুক্তি মানে সকলের জন্য খাদ্য, সকলের জন্য আবাস, সকলের জন্য সুশিক্ষা, সকলের জন্য কাজ, সকলের জন্য নিরাপত্তা, সকলের জন্য বাঁচার অধিকার। মুক্তি মানে শোষণহীন সমাজ। মুক্তি মানে অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর কাজ।  অন্ধবিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস তাই সমাজের ক্যানসার। এর সঠিক চিকিৎসা হলো মুক্ত মননের পরিচর্চা, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পাঠদান, যুক্তিশীল মানসিকতা গঠনের পরিসর নির্মাণ।


কিভাবে হবে সেই নির্মাণ?

ধার্মিকেরা যেমন যুক্তিবাদীদের মারে, ধরে, হত্যা করে, যুক্তিবাদীরা কি পাল্টা মার দেবে? খুন করবে? ধার্মিকেরা যেমন যুক্তিবাদ দমনের জন্য ব্লাসফেমি আইন বানায়, এই আইনের বলে মুক্তচিন্তনশীল লোকেদের উপর অত্যাচার চালায়, যুক্তিবাদীরাও কি পাল্টা এসব করবে?

মোটেই না। যুক্তিবাদীদের মূল শক্তি হল তাদের যুক্তি, তাদের যুক্তিশীল মানসিকতা, তাদের সত্যকে সত্যরূপে বোঝার ক্ষমতা। 


 ধার্মিকদের ধর্মগ্রন্থের অসারতা,  অন্যায়, অনৈতিকতা যুক্তিনীষ্ঠভাবে দেখিয়ে দেওয়াই যুক্তিবাদী আন্দোলনের মূল কাঠামো।

মানুষ কিন্তু ভিত্তিগতভাবেই র‍্যাশানাল। তাকে বোঝানো আদৌ কঠিন নয় যে গাধা আকাশে উড়তে পারে না। ঢেকিও না। সূর্য কোনো ছোট্ট নরম কবোষ্ণ রুটি নয় যে বানর, হনুমানে তা বগলে পুরে নেবে। বানরে উড়তেও পারবে মন্ত্রবলে, এ বিশ্বাসে তাদের মনে দ্বিধাই মেশায়। চাঁদ কোনো খেলনা নয় যে তাকে কেউ দ্বিখণ্ডিত করার পর সেটি পৃথিবীতে নেমে এলেও পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় না তো বটেই, সেটিকে আবার আঙুলের ইশারায় জুড়েও দেওয়া যায়। এসব যে আষাঢ়ে গল্প তা বুঝতে কারুর বিন্দ্যমাত্র কষ্ট হয় না। এই রকম ধর্মগ্রন্থ দিয়েই তাদের অন্ধবিশ্বাস ভাঙতে হবে।       

বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতা -পার্থপ্রতিম পাল
Nov. 21, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:49 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বর্তমান সময়ের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে লেগে আছে বিজ্ঞানের পরশ। বিজ্ঞানের ছোঁয়াতে এখন মানুষ পরিহার করেছে নানা রকম কুসংস্কার, গ্রহন করেছে নানা রকম টেকনোলোজি ও তত্ত্ব। তার পরেও মনে প্রশ্ন জাগে এই বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ কি বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে নাকি শুধুই বিজ্ঞানের দানগুলো নিচ্ছে? নাকি শুধুই শিখছে বিজ্ঞান আবিষ্কৃত তত্ত্ব ও টেকনোলোজির ব্যবহার। ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’ ও ‘বিজ্ঞান-মনষ্কতা’ শব্দ দুটো স্বাভাবিক ভাবে একই মনে হলেও এদের ভেতর বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। এ দুয়ের পার্থক্য জানার আগে জানা উচিত বিজ্ঞান কি? সহজ ভাষায় বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান, যে কোন জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হয়। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, “বিজ্ঞান হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালদ্ধ পদ্ধতি যা জ্ঞানকে তৈরিপূর্বক সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। ল্যাটিন শব্দ সায়েন্টিয়া থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। আবার বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর সাথে দর্শনেরও যোগসূত্র পাওয়া যায়। এদিক থেকে “বিজ্ঞান হচ্ছে একটা দর্শন, যে দর্শনের মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে প্রশ্ন করা, কার্যকারন অনুসন্ধান করা।” 


বর্তমানে কর্পোরেট সমাজে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত কর্পোরেশনকেন্দ্রিক। এখানে আছে কর্পোরেশনের প্রয়োজন অনুসারে সিলেবাস। এর মাধ্যমে তাদের গোলামির জন্য যা যা লাগবে তা শেখানো এবং দক্ষ গোলামে পরিণত করা। বলা যায় “শিক্ষাব্যবস্থা এখন Two M সিনড্রোমে ভুগছে- marks and money। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এখানে ভালো রেজাল্ট করে বের হয়ে কোনো কর্পোরেশনে চাকুরী করা এবং টাকা উপার্জন করা। আর এ’জন্য বিজ্ঞান শিক্ষাকেই সবাই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করলে করে খাওয়ার অভাব হবে না তার কারন বুঝি এই। এভাবে সেই সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞান সিদ্ধ হয় (এই হচ্ছে কর্পোরেশনের লক্ষ্য সত্যি, কিন্তু তাদের বিজ্ঞানমনস্কতার উৎকর্ষ সাধিত হয় কি? কারন “বিজ্ঞান-মনস্কতা মানে নিছক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সচেতনতা নয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা বা সপ্রতিভতা নয়। বিজ্ঞান-মনস্কতা মানে হল বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি, যুক্তিশীল মননচর্চা, বৈচারিক চিন্তাকৌশল।” প্রশ্ন করে জানার স্পৃহা হচ্ছে বিজ্ঞান-মনষ্কতা৷ কোনো বিষয়ের এক কথায় সহমত প্রকাশ না করে বরং সংশয় প্রকাশ করা এবং যৌক্তিক ভাবে তার বিশ্লেষণ করা। মুলত “বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে সেই দুটি বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় যা বিজ্ঞানকে ধারণ করতে অপরিহার্য। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো – প্রশ্ন করার প্রবণতা এবং কার্যকরণ অনুসন্ধানের প্রবণতা। সুতরাং, যে ব্যক্তি অন্তরে উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করবেন তিনিই বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর এমন বিজ্ঞানমনষ্ক হতে হলে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু প্রশ্ন করে, যৌক্তিক ভাবে বিশ্লেষণ করে জানার স্পৃহা। যেমন, “আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদ, কেউই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। দর্শন ও সাহিত্যের ছাত্র হয়েও তাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তেমনি স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। তিনিও স্বেচ্ছায় প্রশ্ন ও কার্যকরণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রমাণ রেখেছেন। একই কথা প্রযোজ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেলায়ও। তিনিও বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। কিন্তু, তিনি গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন শিশুদের। শিখিয়েছেন আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির কার্যকরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ ছিলেন।


কবি রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনকে তাঁর যুক্তি-তর্ক দিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সত্য সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন যা কবির আধুনিক যুক্তিবাদী মন ও বিজ্ঞানমস্কতাকে প্রকাশ করে। আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন না যে মানুষের পর্যবেক্ষণের ওপরই নির্ভর করে আছে মহাবিশ্বের বাস্তব সত্য।বোরের কোয়াণ্টাম থিয়োরিতে কোপেনহেগের ব্যাখ্যার সাথে এখানেই ছিল তাঁর বিরোধ। সেই আলোকেই তাদের আলাপচারিতা হয়েছিল, হয়েছিল যুক্তি তর্ক। সমাজ নানা রকম অন্ধ ধ্যান ধারণাতে পূর্ণ। কিছুদিন আগেও বিশ্বাস করা হতো ডাইরিয়া, কলেরা, কুষ্ঠ রোগ গুলো নানা রকম খারাপ জ্বীনের আছড়। এমনকি এখনও মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বর, আল্লাহ, গড, জ্বীন, ভুত, বিভিন্ন অশরীরী আত্মা। এবং এদের থেকে বাঁচার জন্য গ্রহণ করে তাবিজ, কবচ, পানিপড়া। এখনও অনেক মানুষ বাচ্চা না হওয়া জন্য স্মরাণাপন্ন হয় বিভিন্ন কবিরাজ বা তান্ত্রিকের। শুধু অশিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ না; শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও। যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে বাচ্চা হওয়ার সাথে ক্রোমোজম, ডিম্বাণু, শুক্রানুর সম্পর্ক। অনেক সময় শোনা যায় অনেক ডাক্তারও নাকে কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে রুগীকে পরামর্শ দেন কবিরাজের কাছে যেতে। অর্থাৎ তারা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছেন না। বিজ্ঞানের তত্ত্ব, থিয়োরি জানছেন কিন্তু অন্তরে তা ধারণ করতে পারছেন না। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়,ধর্মিয় নানাবিধ কারন তাদের বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এখানে বিজ্ঞান শিক্ষাটাকে হেয় করছি না বরং বলতে চাচ্ছি বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে চাই বিজ্ঞান মানসিকতা। প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। অনেকে বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান আহরণ করেছে কিন্তু উদ্ভাবনী মানসিকতা নেই, আঁকড়ে ধরে আছে সমাজের নানা রকম প্রচলিত বা প্রাচীন ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস করছে নানা রকম কুসংস্কার। এরূপ শিক্ষা ব্যক্তিকে শুধু দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলবে। টাকার চাহিদা এখানে মুখ্য। এইরকম মানসিকতা থেকে বিজ্ঞানকে শুধু চর্চা করাই হয়, নিজেকে শুধু কর্পোরেট জগতের জন্য প্রস্তুত করাই হয় কিন্তু, প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার ফলে মস্তিষ্কে যে যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতার অনুরণন ঘটার কথা, তা আর ঘটার সুযোগ পায় না। কুসংস্কার, অপশিক্ষা আর রাষ্ট্রীয় দৈন্যের ফলে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায় এইদেশের বেশীরভাগ শিক্ষার্থীর বিজ্ঞানমনস্কতা; বিজ্ঞান আটকে যায় সীমিত পরিসরের মধ্যে। আবার বিজ্ঞানমনস্কতা শুধু বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যই প্রয়োজন না বরং ইতিহাস, ভূগোল সহ সকল বিষয় এমনকি জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে প্রয়োজন। সকলেরই জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা বিষয় বিশ্লেষণ করা উচিৎ, প্রশ্ন করা এবং সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে বের করা উচিৎ। 


মোট কথা বিজ্ঞানমনস্কতা চাই সবার জন্য। আমাদের বিজ্ঞানমনষ্কতার পেছনে অন্যতম বাধা হয়ে আছে কর্পোরেট সমাজ, রাষ্ট ও ধর্ম। কর্পোরেট সমাজ চায় তার জন্য দক্ষ কর্মী। সে জন্য নিজের প্রয়োজন মতে বেঁধে দিয়েছে সিলেবাস। কর্পোরেশনের জন্য যতটুকু দক্ষতা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করে দিয়েছে সিলেবাসের মাধ্যমে। যার ভালো দক্ষতা থাকবে, কর্পোরেশনের কাছে তার গুরুত্ব তত বেশী হবে। আর এজন্য মাইনেও পাবে বেশি। তাই কর্পোরেশনে চাকুরী করার জন্যই বর্তমানে শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে সকল প্রকার শিক্ষাই এমন। এভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক হতে বাধা সৃষ্টি করছে কর্পোরেশন। রাষ্ট্রের স্বভাবই খবরদারি করা, বল প্রয়োগ করা। আর বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি মাত্রই স্বাধীন চিন্তার অধিকারী। তাই রাষ্ট্র এবং বিজ্ঞানমনস্কতা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক একটা ব্যাপার। পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম নানা রকম ধ্যান, ধারণা, কুসংস্কারচ্ছন্নতা। বহুযুগ পুর্বের সৃষ্ট এ ধর্মগুলো শুধুই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে টিকে আছে। আর এ বিশ্বাস ছোটবেলা থেকে একটা মানুষের ভেতরে অবস্থান করতে করতে এমন একটা শক্ত অবস্থানের সৃষ্টি করে যা ভাঙ্গা যায় না। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে শেখা তত্ত্ব গুলো এখানে খাটে না। যদিও তা প্রমাণিত। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে চাই সমাজের সুষ্ঠ পরিবেশ। চাই চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। চাই ভাবনার সময়। চাই বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত প্রকাশের জন্য নির্ভীক পরিবেশ। সেই প্রকাশিত সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন তত্ত্ব উপস্থাপনের ব্যবস্থা। যৌক্তিকতার মাধ্যমে গ্রহণ করার মানসিকতা। এসবই তো বিজ্ঞানমনস্কতা।

নরেন্দ্র দাভোলকর -অনিমেষ দত্ত‌
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:877 | likes:0 | share: 0 | comments:0

২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট। মহারাষ্ট্রের পুণের বাসিন্দা ৬৭ বছরের এক বৃদ্ধ অভ্যাসমত সেদিনও প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি সেদিন তাঁর। মাথায় গুলি করে খুন করা হল তাঁকে। ৬৭ বছরের সেই বৃদ্ধের নাম নরেন্দ্র দাভোলকর। ঘটনার তদন্তভার নেয় সিবিআই। ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে নালাসোপারার একটি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে শরদ কলসকরকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্র সন্ত্রাস দমন শাখা। কলসকরের বয়ানের ভিত্তিতেই খুনের মূল চক্রী বীরেন্দ্র তাউড়েকেও গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতেই খুনের কথা স্বীকার করে লিখিত বয়ান দেয় কলসকর। সেই বয়ানের ভিত্তিতেই কলসকরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিবিআই। ধৃত মূল অভিযুক্ত শরদ কলসকর লিখিত বয়ানে বলেছিল, ‘‘খুব কাছ থেকে পর পর দু’বার গুলি চালিয়েছিলাম। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরই এলাকা ছাড়ি।’’ এছাড়া কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, নেপথ্যে কারা ছিলেন, ঘটনার দিন ঠিক কী ঘটেছিল, ১৪ পাতার স্বীকারোক্তিতে সেই বর্ণনাও দিয়েছিল কলসকর। খুনের মূল চক্রী কারা? সেই বিষয়েও স্পষ্ট বলেছিল কলসকর, ‘‘একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্য বীরেন্দ্র তাউড়ে আমার মগজ ধোলাই করেন। তাঁদের সংগঠনের আদর্শের পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি চলতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও। তার পর এক দিন বলা হয়, কয়েক জন যুক্তিবাদীকে খুন করতে হবে। সেই তালিকায় আমার দায়িত্ব পড়েছিল দাভোলকরকে খুন করার। আমার উপর নির্দেশ ছিল, মাথায় গুলি করতে হবে, যাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’’

এতক্ষণ যে ঘটনাটার কথা বললাম সেটা কোনো বলিউডের কাঁচা স্ক্রিপ্ট নয়, জলজ্যান্ত একটা খুন! কে এই নরেন্দ্র দাভোলকর? কেন তাঁকে খুন হতে হল? হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কেন তাঁকে খুন করল?


১৯৪৫ সালের ১লা নভেম্বর জন্ম হয় নরেন্দ্র দাভোলকরের। বাবা অচ্যুত দাভোলকার। মায়ের নাম তারাবাঈ দাভোলকার। সাত ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন নরেন্দ্র। সাতারা শহরের নিউ ইংলিশ স্কুলে পড়েছেন। তারপর তিনি সংলির উইলিংডন কলেজে ভর্তি হন। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করে নরেন্দ্র সিরাজ মেডিকেল কালেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন। সবচেয়ে বড়ভাই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদ দেবদত্ত দাভোলকার ছিলেন উইলিংডন কলেজের অধ্যাপক। স্বাধীনতার পর মহারাষ্ট্রের অনেক সামাজিক আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। নরেন্দ্রর জীবনে দাদা দেবদত্তের গভীর প্রভাব ছিল। ডাক্তারিতে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি শায়লা নাম্নী একজন ডাক্তারকে বিয়ে করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে হামিদ। মেয়ে মুক্তা দাভোলকার।

এরপর ডাক্তারি পাস করে ডাঃ নরেন্দ্র দাভোলকর শুধু ডাক্তারিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেন না। আশির দশক থেকেই তিনি অনুভব করেন, ডাক্তারি ছাড়াও তাঁকে আরো বড় কাজ করতে হবে। দেশকে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই প্রায় ১২ বছর পর একদিন ডাক্তারি ছেড়ে যোগ দিলেন বিজ্ঞান আন্দোলনে। তিনি 'অখিল ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি'-তে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে দাভোলকর 'মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন ও তার সভাপতি হন। মহারাষ্ট্রে তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞান আন্দোলনের জোয়ার এতটাই ছিল যে একজন ডাক্তারকে উদ্বুদ্ধ করল সেই লক্ষ্যে পাড়ি দেওয়ায়।


ভারতে বিজ্ঞান আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা আছে। কিন্তু প্রত্যেকটা ধারার মধ্যে কমন নেচার বা লক্ষ্য কিছু থেকে থাকলে সেটা হল বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ, বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশের চেষ্টা এবং বিজ্ঞানের প্রযুক্তিকে জনকল্যাণে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চালানো। মহারাষ্ট্রও তার ব্যতিক্রম নয়। আশির দশক থেকেই মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠতে লাগলো একাধিক বিজ্ঞান সংগঠন, পত্রিকা গোষ্ঠী। ১৯৮২ সালে লোকবিজ্ঞান সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল 'মহারাষ্ট্র বিজ্ঞান যাত্রা'। নাটক, গান, ছবি, মডেল, স্লাইড, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে জণগণের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার চলল। ১৯৮৯ সালে সেই ধারাবাহিকতায় কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হল সংগঠন 'অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি'। যার মাধ্যমে আসরে এলেন নরেন্দ্র দাভোলকর। এই সমিতি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারে। সেসময় মহারাষ্ট্রে অলৌকিকতার ছড়াছড়ি। অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানো, অলৌকিক উপায়ে জীবনে শান্তি ফেরানো ইত্যাদি দাবি নিয়ে একদল ভণ্ড সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে চলেছে। চলছে লাখ লাখ টাকা রোজগার। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা না করে তাদের 'অশুভ আত্মায় ভর করেছে' এই দাবি দিয়ে চালানো হচ্ছে শারীরিক অত্যাচার। একই সাথে সাপের কামড়ে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা না করে চলত 'বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন পাথর' বিক্রির ব্যবসা। এই সমস্ত অযৌক্তিক অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সোচ্চার হন দাভোলকরেরা। মারাঠী 'সাধন' পত্রিকার মাধ্যমে যুক্তিবাদী বক্তব্য প্রকাশ করা শুরু করেন একই সাথে। অলৌকিক বলে দাবি করা ঘটনাগুলো আসলে যে অলৌকিক নয়, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ শুরু হয় প্রচার। আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা হৃদযন্ত্র বন্ধ রাখার মধ্যে কোনো অলৌকিকতা নেই, তা হাতে কলমে করে দেখিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ চলতে থাকে জোরকদমে। আরও আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দীর্ঘমেয়াদি প্রচার আন্দোলন এর লক্ষ্যে দাভোলকর শুরু করেন 'বিবেক জাগরণ' প্রকল্প। আলোচনা এবং পথনাটক এর মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়া যার উদ্দেশ্য। এই কাজে দাভোলকরকে সাহায্য করেন তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী ডাঃ শ্রীরাম।


কুসংস্কার দূরীকরণ এর পাশাপাশি মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে 'পরিবর্তন' নামের একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করতেন তিনি। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের জন্য 'বিবেক বাহিনী' তৈরি করেন। কলেজ ও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সেখানে আসতেন। দাভোলকর যুক্তিবাদী সনাল এডামারাকু এবং বিশিষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারকিলকার-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এছাড়াও তিনি 'ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান রেশনালিস্ট এসোসিয়েশন'-এর সহসভাপতিও ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ২০১০-এর মাঝে দাভোলকর দলিত সমাজের মর্যাদা এবং ভারতীয় জাতিব্যবস্থার অবসানের লক্ষ্যেও আন্দোলন জারি রাখেন।


১৯৫৪ সালে ভারতে লাগু হয়েছিল 'দ্য ড্রাগ অ্যাণ্ড ম্যাজিক রেমেডিজ অ্যাক্ট' (Objectionable Advertisements)। কিন্তু তা দিয়েও যাদুটোনা, তুকতাক ইত্যাদির মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ২০১০ সাল থেকেই অন্ধবিশ্বাস (যাদুটোনা) বিরোধী বিল পাস করানোর জন্য মহারাষ্ট্র সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন দাভোলকর। সেই লক্ষ্যেই শুরু হল আন্দোলন। এখানেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সাথে সাক্ষাৎ সংঘাত শুরু হল তাঁর। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং শিবসেনার মত রাজনৈতিক দল তাঁর বিরোধিতা করে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তাঁর প্রস্তাবিত খসড়া বিলকে 'হিন্দু সংস্কৃতি'র বিরোধী বলে ঘোষণা করে। চলতে থাকে মতাদর্শগত সংগ্রাম। তারপরের ঘটনা ওই ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট।


দাভোলকরের খুনের একদিন পর অর্থাৎ ২১শে আগস্ট মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার ও তুকতাক বিরোধী অর্ডিন্যান্স জারি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে তুকতাক, ঝাড়ফুঁক এর মত বুজরুকির জন্য ৭ বছরের জেল হবে। ডাঃ দাভলকার গত ১০ বছর ধরে কুসংস্কার ও তুকতাক বিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হত্যার পর মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান এই অর্ডিন্যান্স জারি করার পদক্ষেপ নেন!


দাভোলকরের মতোই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির হাতে খুন হয়েছেন গোবিন্দ পানসারে, এম. এম. কালবুর্গীর মতো যুক্তিবাদী মানুষেরা। কিছু বছর আগেই আমরা দেখেছি সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সাংবাদিকতা করার জন্য খুন হতে হয়েছে। আসলে নরেন্দ্র দাভোলকর এবং বাকিরা একই পথের পথিক। আমরা জানি ইতিহাসে বরাবরই বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরা নিজেদের সময়ে আক্রমণের মুখে পড়েছেন। কারন তাঁরা প্রত্যেকেই সঙ্গী করেছেন বিজ্ঞানকে। না, শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ্যবইয়ের বিজ্ঞান নয়, যুক্তিনির্ভর হাতে কলমে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রগতিশীল দর্শনকে সমাজের প্রত্যেকটা স্তরে নিয়ে যাওয়া, বিজ্ঞানকে পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না রেখে তা মানুষের ব্যবহারিক জীবনে পৌঁছে দেবার কাজ নরেন্দ্র দাভোলকরেরা করে গেছেন। তাই হত্যার পরেও আজ নরেন্দ্র দাভোলকর আমাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। শুধুমাত্র শ্রদ্ধা নয়, বরং আমাদের আগামীদিনে পথচলার আদর্শও বটে। আজকেও আমরা অপবিজ্ঞান এর বীজ বুনতে দেখছি প্রত্যহ, কোথাও সরাসরি সরকারি মদতে আবার কোথাও পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দ্বারা। আমাদের লক্ষ্য কোনদিকে? যুক্তিনির্ভর প্রগতিশীল সমাজের দিকে? যদি তাই হয়, তবে নরেন্দ্র দাভোলকর আমাদের পথপ্রদর্শক। তাই তাঁকে হত্যার দিনটায় তাঁকে স্মরণ করাটা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় না আটকে রেখে তাঁর আদর্শকে পাথেয় করে এগোলেই তাঁর স্বপ্ন সফল হবে।

সান্তা -রামকৃষ্ণ সাহা
Nov. 20, 2024 | category | views:49 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কাল পঁচিশে ডিসেম্বর। স্কুলের বাচ্চারা খুব খুশি। কিন্তু রোহন একটু মনমরা। রোহনের বয়স ছয় বছর। স্কুলের অন্য বন্ধুরা গল্প করছে, গতবার পঁচিশে ডিসেম্বর রাতে ওদের বাড়িতে সান্তা এসেছিল। কাউকে খেলনা, কাউকে চকোলেট, কাউকে রং পেনসিল, কাউকে ক্যাডবেরি দিয়ে গেছে। কিন্তু রোহনতো কিছু পায়নি। ওর কাছে তো সান্তা আসেনি। 


- তুই দুষ্টু, পচা। তাই সান্তা তোর কাছে আসেনি। পচা... পচা ...


রোহন আরও কুঁকড়ে গেল। ঐ তো ওর বাবা আজ ওকে নিতে এসেছে। রোহন দৌড়ে ওর বাবার কাছে চলে গেল।  বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। 


- কি হয়েছে বাবা? 


রোহন কোনো উত্তর না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।


- কি হয়েছে বাবা? ম্যাম বকেছে? 


- না। বাবা, আমি পচা?...   আমার কাছে সান্তা কেন আসে না? ....


রাহুল বুঝতে পারছে না কি বলবে। রোহনকে আদর করতে করতে বললো না, না তুমি খুব ভালো। বলে জড়িয়ে ধরলো। রাহুলেরও চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো। 


- বন্ধুরা সান্তার থেকে কতো গিফ্ট পায়....


রাহুল বুঝতে পারছে না কি করবে। রাহুল চেয়েছিল রোহনকে কুসংস্কার মুক্ত বাস্তববাদী চিন্তা ভাবনায় গড়ে তুলবে। তারপর বড়ো হয়ে ও যেটা ভালো বুঝবে। এই ছোটো বয়সে ওকে যুক্তি বোঝাতে গেলে, এখন থেকেই ওকে প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হবে। না, না সেটা উচিত হবে না। আবার যদি ওর বন্ধুদের মতো সান্তা রাতে গিফ্ট রেখে যায়, তাহলে রোহন হয়তো খুশি হবে, কিন্তু ওর শিশুমনে অদৃশ্য কাল্পনিক শক্তির অস্তিত্ব সৃষ্টি হবে। রাহুল এখন কি করবে? কিছু ভাবতে পারছে না। 


- ও মা। বাবা, বাবা এই দেখো .., সান্তা আমার প্রার্থনা শুনেছে।


- কি হয়েছে বাবা? 


- এই দেখো রাতে সান্তা এসেছিল। দেখো কতো গিফ্ট। এবার আমিও বন্ধুদের বলবো, "আমি পচা না, আমাকেও কতো গিফ্ট দিয়ে গেছে। সান্তা Thank you. Thank you Santa." 


ছেলের খুশি দেখে বাবা মায়ের চোখে জল চলে এলো। দুজন ছেলেকে খুব আদর করলো। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। 


রাহুল সংশয়ে। ও কি ঠিক করলো? ওর হাত ধরেই আজ জন্ম নিলো কাল্পনিক শক্তির অস্তিত্ব। এবার রোহনও বিশ্বাস করতে শুরু করবে কাল্পনিক শক্তিকে। রাহুল কি ঠিক করলো??


গল্প নয় সত্যি -সুমন কর্মকার
Nov. 20, 2024 | গল্প | views:100 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আজ একটা ঘটনা শুনলাম। সাদামাটা হলেও 'রসালো' বটে। ভাবলাম আপনাদেরও শোনাই। এই বাদলা রাতে জমবে ভালো। 

আমাদের জেলারই আশেপাশের এক গ্রামের ঘটনা। একটা বৌ ছিল। একদম সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ। বরটা কোনো এক সরকারি দফতরে  চুক্তিভিত্তিক ঠিকে কেরানীগিরির কাজ করতো। শ্বশুর শাশুড়ি বিয়ের কয়েক বছর আগেই গত হয়েছিলেন। তাই স্বামী স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে তিনজনের ছোট্ট সংসার। তো একদিন হল কি, বলা নেই, কওয়া নেই  শ্বশুর বাড়ি থেকে সপরিবারে ফেরার পথে বৌ আর আঠেরো বছরের ছেলেকে ফেলে রেখে বরটা হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। হঠাৎ মানে হঠাৎই। হাসপাতাল অবধি নিয়ে যেতেও হলো না। জ্বর জ্বালা নেই, কষ্ট পাওয়া নেই, একদম শান্তির মরণ। 

তো বরটা শান্তিতে পটল তুললেও বৌ আর ছেলেটা কিন্তু খুব একটা শান্তিতে থাকতে পারল না। কন্ট্র‍্যাকচুয়েল কাজের বেতন তো আপনারা জানেনই। রোজকার সংসার খরচ আর ছেলের পড়াশুনো চালাতেই বেশিরভাগটা বেরিয়ে যেতো। যেটুকু জমানো ছিল তাতে মাস খানেকের বেশি চালানো সম্ভব ছিলনা। তাই অন্যকোনো উপায় না দেখে বিধবা বৌটা ছেলেকে নিয়ে চলল মৃত স্বামীর অফিসে। অফিসে ঢোকামাত্রই সহানুভূতির বন্যা বয়ে গেল। 'আপনার হাজব্যান্ড দারুণ কাজের মানুষ ছিলেন', 'অমুক দাকে আমরা কক্ষণো ভুলতে পারব না' এসব আর কি। কিন্তু যেই না বৌটা বলল মৃত স্বামীর জায়গায় ছেলেকে যদি কোনোভাবে কাজে রাখা যায়, সবার ভীষণ তাড়া পড়ে গেল। 'আজ না আমার টেবিলে অনেকগুলো ফাইল পড়ে গেছে। কাজের ভীষণ চাপ। আপনি বরং অমুক বাবুর কাছে যান। উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন' বলে বাবুরা একে একে নিজেদের গা বাঁচিয়ে সটকে পড়তে লাগলেন। আপনারা আবার বাবুদের জাজ করবেন না যেন। আজকের বাজারে কেই বা এসব উটকো ঝামেলা যেচে মাথায় নিতে চায় বলুন তো? আপনি নিজেই নিতেন কি? যাই হোক, অমুকবাবু তমুকবাবু্র টেবিল ঘুরে বৌটা শেষ অবধি পৌঁছালো বড়বাবুর কেবিনে। দেখা গেলো বড়বাবু মানুষটা কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের। পরিচয় পাওয়া মাত্র প্রাক্তন সহকর্মীর স্ত্রীকে যথোচিত খাতির করে বসালেন এবং সব শুনে একটা তারিখ দিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতে বললেন। উনি আগে থেকেই অফিসারকে সবটা বলে রাখবেন। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। বৌটা একরাশ আশা নিয়ে দেবতুল্য মানুষটার মঙ্গল কামনা করতে করতে উজ্জ্বল মুখে বাড়ি ফিরে এলো। নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে নিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতেও গেল। বড়বাবু সত্যিই এক কথার মানুষ। অফিসার দেখামাত্র সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। ছেলের কাজ হয়ে গেল। মা খুশি, ছেলেও খুশি। কিন্তু বৌটার কপালে সুখ মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার নয়। একদিন বিকেলবেলা, ছেলে তখনও অফিস থেকে ফেরেনি, 'দেবতুল্য' বড়বাবুর পেয়ারের আর্দালি এসে পান চিবোতে চিবোতে বৌটাকে বলল, 'বড়বাবু আজ সন্ধ্যের দিকে আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। ওই সাতটা নাগাদ গেলেই হবে।' ব্যপারটা প্রথমে বোধগম্য না হলেও আর্দালি যখন বেরোতে বেরোতে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হেসে বলল, 'বৌদি বাপেরবাড়ি গেছেন তো তাই আর কি...' বৌটার বুঝতে কিছুই বাকি রইলো না। হতবাক হয়ে আর্দালির চলে যাওয়া দেখতে কখন যে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল বুঝতেই পারল না। যথাসময়ে ছেলে ফিরে এলো। ছেলেকে খেতে দিতে দিতে বৌ টা বলল, 'বাবু, তুই বরং একটা অন্য কাজ দ্যাখ। এটা বোধহয় আর থাকবে না।' মায়ের কথা শুনে ছেলে যতোটা না আশ্চর্য হল, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হল যখন দেখল পরেরদিনই মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়ে একটা সামান্য ভুলের জন্য বড়বাবু দারুণ অপমান করে সত্যিই অফিস থেকে তাড়িয়ে দিলেন।' 

কাজ্টা চলে যাওয়ার পর মা-ব্যাটা পড়ল অকুল পাথারে। ঘোর বর্ষাকাল। বাড়ির টালি ফেটে ঝরঝর করে জল পড়ছে।  থালা বাটিগুলো পাতার সাথে সাথে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। ছেলের এই মাসের বেতন  ঢুকলে মিস্ত্রী লাগানোর কথা। মিস্ত্রীকে বলাও আছে সেরকম। কিন্তু সব কেমন ভেস্তে গেল। বর্ষাটাও আগেভাগে চলে এলো, চাকরিটাও আর রইলো না। যাই হোক, সারা রাত ধরে জল বাঁচিয়ে বিছানা পত্তর এদিক ওদিক করে সকাল হতেই ত্রিপল যোগাড় করতে পঞ্চায়েত অফিস ছুটলো বৌটা। প্রধান নেই। অফিসে ঢুকে ত্রিপলের কথা বলামাত্র উপপ্রধান জানালেন 'ত্রিপল শেষ। পরের লট আসলে খোঁজ নিয়ে যাবে।' পরের লট কবে আসবে জিজ্ঞেস করাতে ব্যস্ত উপপ্রধান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে জানালেন তার জানা নেই। অফিস থেকে বেরোতেই প্রধানের এক চ্যালা 'ও বৌদি ও বৌদি' বলে দাঁড় করিয়ে বৌটাকে আগাপাশতলা মেপে নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল, 'আরে, যাচ্ছেন কোথায়? আপনাদের বাড়ি তো আমি দেখেছি। আজ রাতে বৃষ্টি এলে একদম ভেসে যাবেন। ত্রিপল তো লাগবেই।' তারপর গলাটা অল্প নামিয়ে বলল, 'আসলে জানেনই তো আমাদের উপপ্রধানের এখনও বিয়ে হয়নি। ঘর সংসার নেই। রক্ত গরম। তাই মাঝে মাঝে মেজাজটা একটু খিঁচড়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন একেবারে মাটির মানুষ।' চ্যালার লোলুপ চাওনিই বলে দিচ্ছিল আলোচনাটা আস্তে আস্তে কোন দিকে যাচ্ছে। এরপর ছেলেটা যখন ভুরু নাচিয়ে সরাসরি বলল, 'শুধু ত্রিপল কেন? দাদাকে খুশি করে দিতে পারলে আরও অনেককিছুই পাবেন’ তখন ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। নিজের ছেলের বয়সী একজনের কাছে এহেন 'দারুণ' প্রস্তাব পেয়ে বৌটার চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠলো। উদভ্রান্তের মতো অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ছেলেটা তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে 'ও বৌদি রাগ করলেন নাকি? শরীর তো আর বয়স মানেনা বুঝলেন কিনা'। বৌটা বাড়ির পথ ধরলো।

গল্প হলে এটা এখানেই শেষ হয়ে যেতো। আপনারাও পটাপট হাততালি দিতেন। বলতেন এই তো চাই। একটা সৎ মানুষের আপোষহীন লড়াইয়ের গল্প। দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমি নিরুপায়। এটা তো গল্প নয়, ঘটনা। তাই শেষটা এভাবে হলো না। আজকের মতোই কোনো এক বৃষ্টিভেজা রাতে পাড়ার মাতব্বররা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে গ্রামের উপপ্রধানের বাড়ি থেকে আলুথালু বেশে বৌটাকে বেরিয়ে আসতে দেখলেন। তাদের বিশেষ কিছু বলার ছিল না। কারণ পঞ্চায়েত অফিস থেকে বেরিয়ে বৌটা যখন উপপ্রধানের 'ইন্টারেস্টিং' প্রস্তাবের কথা এনাদের জানিয়েছিল, এনারা ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'কি জানি বাপু! গ্রামে তো তুমিই একা মেয়েমানুষ নও। তোমার চাইতে ঢের বেশি দেখতে শুনতে ভালো আরও অনেকেই আছে। কই তাদের তো কখনও এমন বলতে শুনিনি। দেখে দেখে তোমাকেই তার মনে ধরল?' 

আজ বৌটার বাড়ির পাকা ছাদ। ছেলেটাও শুনলাম পঞ্চায়েতেই কি একটা কাজ করছে। দুহাতে কামাচ্ছে। আজ আর ওদের কোনো অসুবিধে নেই। কে বলে মন দিয়ে পূজো করলে 'ভগবান' সন্তুষ্ট হন না? শুধু সঠিক মন্ত্রটা জেনে নিতে হবে।

আমিও হাত দেখতে পারতাম! -মুজিব রহমান
Nov. 20, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:885 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ছাত্রজীবনে হাত দেখা শিখেছিলাম। একবার এক সন্তানসম্ভবা তরুণীবধূর হাত দেখে বললাম, আপনার ছেলে হবে; তবে সাধবানে থাকবেন ফাঁড়া আছে। আপনার মেয়ে হবে এটা কখনো কাউকে বলতাম না, বিশেষ করে প্রথম সন্তান মেয়ে হবে এটা অধিকাংশেরই প্রত্যাশা থাকে না বলেই মনে হতো। তরুণীবধূর পুত্রসন্তান হয়ে মারা যায়। অর্থাৎ ঝড়ে বগ মারা গেল কিন্তু ওই পরিবারের বিশ্বাসের মাত্রাটা ছিল অনেক বেশি। আবারো সন্তানসম্ভবা হলে আমাকে বারবার তার বাসায় দাওয়াত দিতে থাকেন। আমি থাকি হলে আর ওই মহিলা থাকে সূত্রাপুর। যাওয়া কঠিনই। ওনার স্বামী কয়েকবার আসলেন আমি তালবাহানা করি। একদিন এসে ধরে নিয়ে গেলেন। আবারো হাত দেখে বললাম এবারো ছেলে হবে এবং কোন ফাঁড়া নাই, সুস্থ সন্তান হবে। কাকতালীয়ভাবে মিলে গিয়েছিল। 


আমি একাধিক বইতে দেখেছি একই রেখার ভিন্ন ব্যাখ্যা, উল্টো ব্যাখ্যা। আসলে কথাচ্ছলে কিছু বিষয় জেনে নিয়ে সেই তথ্যই উপস্থাপন করা, যার হাত দেখবো তার সম্পর্কে কিছু তথ্য আগে থেকেই জেনে নেয়া এবং মানুষের চেহারা দেখেও কিছু অনুমান করেই হাত দেখা হয়। ওই মহিলার আত্মীয়া ছিল আমার সহপাঠী বান্ধবী। ওর কাছ থেকে কিছু তথ্য আগেই জেনেছিলাম।


আমিতো সৌখিন ছিলাম। কিন্তু এটাকে ব্যবসা হিসাবে নিয়ে প্রতারণা করছে অনেকে। এই সব প্রতারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোন প্রচারণা নেই। তবে ভারতে রয়েছে। ভারতের যুক্তিবাদী সমিতি ঘোষণা দিয়েছিল, যদি হাত দেখে কেউ পঞ্চাশ ভাগ সত্য বলতে পারবে তবে তাকে দেয়া হবে ১০ লক্ষ টাকা (এখন সম্ভবত ৫০ লক্ষ)। তো একজন হস্তরেখাবিদ আসলেন।


১। তাকে দেয়া হয় একটি বানরের হাতের ছাপ। জ্যোতিষি বললেন, এই শিশুটি ৮০ বছর বাঁচবেন, ২৫ বছরে বিয়ে করবেন আর উচ্চ শিক্ষা লাভ করবেন।


২। এরপর তার সামনে আনা হয় একজন সফল মানুষকে যিনি দেখতে কদাকার ও রুগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাকে দেখে জ্যোতিষি বলল, নিদারুণ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। পারিবারিক অশান্তি রয়েছে। সন্তানকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছেন।


৩। একজন খুবই সুদর্শন দরিদ্র মানুষকে ভাল পোষাক পরিয়ে তার কাছে আনা। এবার জ্যোতিষি শুধুই সফলতার কথা বললেন।


হস্তরেখা ব্যবসা একটি প্রতারণামূলক ব্যবসা। এখন এই ব্যবসার অবস্থা পৃথিবীজুড়েই বেশি ভাল না। তবুও বাংলাদেশে জ্যোতিষসম্রাটরা প্রতারণা ফাঁদ পেতে বসে আছে। বিক্রমুপুরের লিটন দেওয়ান একসময় বাসের হেল্পার ছিল এখন জ্যোতিষ সম্রাট!  মূর্খ নায়ক-নায়িকা ও নেতাদের হাত দেখার ভিডিও বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিনেতাদের মহাজ্ঞানী ভেবে কিছু অর্বাচিনও জ্যোতিষিদের স্মরণাপন্ন হচ্ছে। লিটন দেওয়ান একজন বড় মাপের প্রতারক। দেশের বহু নায়ক-নায়িকারাই তাকে হাত দেখান। রাষ্ট্রপতি আ. হামিদসহ বহু মানুষ তাকে হাত দেখিয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষ সহজেই প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। লিটন দেওয়ান বিভিন্ন রকম অপকর্ম করে এখন মুক্তিদাতার আসন গেড়ে বসেছেন।


মুঠু ভাজ করার কারণেই হাতে রেখা তৈরি হয়৷ এখানে ভাগ্য লেখা থাকে না৷ বাস্তবিক ভাগ্য বলেও কিছু নেই এবং তা হাত বা কপালসহ কোথাও লেখা থাকে না৷

ধর্মানুভূতির উপকথা -হুমায়ুন আজাদ
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:7559 | likes:1 | share: 0 | comments:0

একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় আজকাল, কথাটি হচ্ছে ‘ধর্মানুভূতি’। কথাটি সাধারণত একলা উচ্চারিত হয় না, সাথে জড়িয়ে থাকে ‘আহত’ ও ‘আঘাত’ কথা দুটি; শোনা যায় ‘ধর্মানুভূতি আহত’ হওয়ার বা ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ লাগার কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষের একটি অসাধারণ অনুভূতি, যার নাম ধর্মানুভূতি । মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি; স্বর্গচ্যুত মানুষেরা বাস করছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন; তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভূতি যে প্রতিমুহূর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভূতি আহত হবে না, ফুলের টোকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভূতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভূতি- এটা খুবই বেদনার কথা; এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান প্রাণী মহাবিশ্বে, শুধু এ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য; আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় রয়েছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে তার ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতরে বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত ক’রে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে জেগে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে চিৎকার ক’রে ওঠে এবং বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটা শিল্পানুভূতির মতো দুর্বল অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হ’লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।


আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া সুখকর অনুভূতি নয়; শরীরে আঘাত পেলে আমরা চিৎকার ক’রে উঠি। শরীরের থেকেও মনোরম যে-সব ইন্দ্রিয় আছে আমাদের, সেগুলো আহত হ’লেও চিৎকার ক’রে ওঠার কথা; তবে সেগুলোর চিৎকারের স্বর আমরা শুনতে পাই না।


আমার অজস্র অনুভূতি দিনরাত আহত হয়; পত্রপত্রিকায় গ্রন্থে গ্রন্থে নিকৃষ্ট শিল্পকলাহীন কবিতার মতো ছোটো বড়ো পংক্তির প্রাচুর্য দেখে আহত হয় আমার কাব্যানুভূতি, নিকৃষ্ট লঘু অপন্যাসের লোকপ্রিয়তা দেখে আঘাত পায় আমার উপন্যাসানুভূতি; রাজনীতিবিদদের অসততা ভণ্ডামোতে আহত হয় আমার রাজনীতিকানুভূতি; এবং আমার এমন অজস্র অনুভূতি নিরন্তর আহত রক্তাক্ত হয়, আমি ওগুলোর কোনো চিকিৎসা জানি না, ওগুলো নিয়ে আমি কোন জঙ্গলে কোন রাস্তায় চিৎকার করবো, তাও জানি না। রাষ্ট্র এগুলোকে অনাহত রাখার কোনো ব্যবস্থা করে নি, রাষ্ট্রের মনেই পড়ে নি এগুলোর কথা।


রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নয় আমার এসব অমূল্য অনুভূতিকে অনাহত রাখার সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেয়া? সবাই বলবে এটা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে তাকে খুলতে হবে একটি বিকট ‘অনুভূতি মন্ত্রণালয়’, যার কাজ হবে কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি অনুভূতির হিশেব নেয়া, সেগুলোর আহত হওয়ার সূত্র বের করা, এবং সেগুলোকে সব ধরনের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা। আমার শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি রাজনীতিকানুভূতি কাব্যানুভূতি প্রভৃতি পাহারা দেয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু এখন রাষ্ট্র এক উদ্ভট দায়িত্ব নিয়েছে, মনে করছে ধর্মানুভূতি পাহারা দেয়া তার কাজ; তাই রাষ্ট্র দেখে চলছে কোথায় আহত হচ্ছে কার ধর্মানুভূতি।


আমার শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি রাজনীতিকানুভূতি কাব্যানুভূতিকে কেনো রাষ্ট্র পাহারা দিচ্ছে না, কেনো আইন তৈরি করছে না এগুলোকে অনাহত রাখার? তার কারণ রাষ্ট্র শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি প্রভৃতিতে বিশ্বাস করে না, শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি হাস্যকর রাষ্ট্রের কাছে, বা রাষ্ট্র মনে করে শিল্পানুভূতি সৌন্দর্যানুভূতি ব্যক্তিগত ব্যাপার, তা যতোই আহত বা নিহত হোক, রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই। কিন্তু ধর্মানুভূতি এমন তুচ্ছ হাস্যকর ব্যাপার নয়, তা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ; রাষ্ট্র এতে বিশ্বাস করে, তাই রাষ্ট্র একে অক্ষত রাখার জন্যে ব্যগ্র।


কিন্তু ধর্মানুভূতি কী বস্তু, যাকে অনাহত অক্ষত রাখার জন্যে রাষ্ট্র এতো তৎপর? বিজ্ঞান, গত কয়েক শতাব্দীতে, এগিয়েছে অনেক, এবং মহাবিশ্বের রূপ এখন আমরা জানি বৈজ্ঞানিকভাবে, যাতে কোনো অলৌকিক পুরাণ নেই; তবু আজো পৃথিবীকে আবৃত ক’রে আছে পৌরাণিক সংস্কৃতি। আমরা মানসিকভাবে আজো বাস করছি পৌরাণিক বিশ্বেই, যে-বিশ্ব প্লাতো, আরিস্ততল, টলেমি ও বিভিন্ন পৌরাণিক বইয়ের। মহাবিশ্বের পৌরাণিক রূপ বদলে দিয়েছেন কোপারনিকাস কেপলার গ্যালিলিও নিউটন আইনস্টাইন, যার সাথে কোনো মিল নেই পৌরাণিক বইগুলোর বিশ্বের, তবে আমাদের কল্পজগতে তার কোনো স্থান নেই, আমাদের কল্পজগত জুড়ে আছে পৌরাণিক বিশ্ব। ওই বিশ্ব চলে পৌরাণিক বিশ্বাসের নিয়মে, যদিও তা সম্পূর্ণ অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক বা ভুল ব’লে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের কল্পজগত ও বাস্তব জগতের মধ্যে চলছে বিরোধ; মানুষ এখন বাস করছে পুরাণ ও বিজ্ঞানের নিরন্তর বিরোধিতার মধ্যে। ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিলো পৌরাণিক মানুষের বিস্ময়বোধ, ভয়, ও লোভ থেকে; তারা কল্পনা করেছিলো বহু দেবতা, বহু বিধাতা, এক সময় অসংখ্য দেবতায় তারা ভ’রে ফেলেছিলো আকাশমণ্ডলকে। ওই সব দেবতাকে তারা ধ্রুব ব’লে মনে করতো, যারা মানতো না ওই সব দেবতা, তাদের পীড়ন করা হতো। তারপর মানুষ উদ্ভাবন করতে থাকে নতুন নতুন দেবতা বা বিধাতা, আগের দেবতা বা বিধাতাদের অসত্য ব’লে বাতিল ক’রে দেয়, যদিও এক সময় তারাই পূজিত হতো চরম সত্য ব’লে। দেবতা বা বিধাতায় বিশ্বাস, তার পুজো-আরাধনা ধর্মের একটি বড়ো ব্যাপার; তারচেয়েও বড়ো ব্যাপার হচ্ছে ওই সব বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিতার মধ্য দিয়ে বিশেষ ধরনের সমাজকাঠামো তৈরি করা। তবে বিশেষ কোনো ধর্ম কোনো অবিনশ্বর ব্যাপার নয়; গত পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবীতে কয়েক হাজার ধর্ম প্রস্তাবিত হয়েছে, অনেক ধর্ম কয়েক হাজার বছর ধ’রে প্রচলিত থেকে নতুন ধর্মের আক্রমণে লুপ্ত হয়ে গেছে।


ধর্ম কি যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যর্পূন? ধার্মিকেরাই স্বীকার করেন যে যুক্তি দিয়ে ধর্ম চলে না, ধর্ম চলে যুক্তিরহিত অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে; ধর্মে কোনো প্রশ্ন নেই, নতুন কোনো উত্তর নেই; সব প্রশেড়বর উত্তর দেয়া হয়ে গেছে পুরোনো বইগুলোতে, সব সত্যের আকর হচ্ছে ওই বইগুলো।


তবে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের বইয়ে বিশ্বাস করে না, সাধারণত প্রচণ্ড বিরোধিতা করে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে ধর্মহীন ব’লেই গণ্য করে; আর সব ধর্মের মানুষই মনে করে ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার, সেখানে যুক্তি অচল। পৃথিবীতে সব কিছুই চলে যুক্তির সাহায্যে : গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতি থেকে শরু ক’রে সব কিছুই চলে যুক্তির সাহায্যে, কোনো জ্ঞানই যুক্তি ছাড়া সম্ভব নয়, কোনো সত্যই যুক্তি ছাড়া উদ্ঘাটন করা যায় না। অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে আমরা ধান উৎপাদন করতে পারি না, বিশ্বাস দিয়ে আমরা গাড়ি চালাতে পারি না, বা খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকোও তৈরি করতে পারি না; কিন্তু বিশ্বাস দিয়ে আমরা একটি অসামান্য কাজ করতে পারি;- মৃত্যুর পর যেতে পারি চিরসুখের জগতে।


মানুষের শুধু একটি এলাকাই আছে, যেখানে যুক্তি চলে না; সেটি খুবই ভিন্ন রকম এলাকা, সেখানকার সব সত্য লাভ করা যায় অযুক্তি আর অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে। মানুষের এই অন্ধ বিশ্বাসই অভিহিত হয়ে থাকে ধর্মানুভূতি নামে।


মানুষের ধর্মানুভূতিগুলো অভিন্ন নয়, যেহেতু ধর্ম একটি নয়; অজস্র ধর্মবিশ্বাসে পৃথিবী বিব্রত। একেক ধর্মের মানুষের ধর্মানুভূতি একেক রকম, আবার একই ধর্মের ভেতরে রয়েছে বহু উপগোত্র, এবং বিভিন্ন উপগোত্রের ধর্মানুভূতি বিভিন্ন। প্রতিটি ধর্মেই দেখা যায় সাধারণ বিশ্বাসীরা ধর্মের মূলকথাগুলো ঠিকমতো জানে না, তারা ধর্মে সংযোজিত করে নানা নতুন বিশ্বাস, যেগুলোর সাথে ধর্মের মূল বিশ্বাসগুলোর সম্পর্ক নেই। অজস্র ব্যাপার জড়ো হয়ে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় এক ধরনের যুক্তিরহিত বোধ, যাকে বলা হয় ধর্মানুভূতি। এই ধর্মানুভূতিই আহত হয়, এর গায়েই সাধারণত আঘাত লাগে।


ধর্মানুভূতিতে যে আঘাত লেগেছে, তা যে আহত হয়েছে, তা বোঝার ও পরিমাপ করার কোনো উপায় নেই। অযৌক্তিক ব্যাপারকে যুক্তির সাহায্যে পরিমাপ করা যায় না। বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্র এখন যেভাবে চলছে, তাতে প্রতিটি ধার্মিকের ধর্মানুভূতি প্রতিমুহূর্তেই আহত হ’তে পারে, এবং হচ্ছে ।


পৃথিবীতে সম্ভবত এখন বিশুদ্ধ ধার্মিক নেই, থাকলে তাদের ধর্মানুভূতি খুবই আহত হতো। যেমন, মন্দির দেখে আহত হ’তে পারে একজন ধার্মিক মুসলমানের ধর্মানুভূতি, কেননা তার বিশ্বাসের জগতে মন্দির থাকতে পারে না; আবার মসজিদ দেখে আহত হ’তে পারে একজন ধার্মিক হিন্দুর ধর্মানুভূতি, কেননা তার বিশ্বাসে মসজিদ অবাঞ্ছিত। একজন খাঁটি মুসলমান যদি দাবি করে যে মন্দির দেখে তার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে, তাই মন্দিরটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে, তখন রাষ্ট্র কী করবে; একজন খাঁটি হিন্দু যদি দাবি করে যে মসজিদ দেখে তার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে, তখন কী করবে রাষ্ট্র? খাঁটি ধার্মিকের কোমল ধর্মানুভূতি আহত হ’তে পারে প্রতিমুহূর্তেই; টেলিভিশন, সিনেমা, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের, সংসদে নারীদের দেখে আহত হ’তে পারে তার ধর্মানুভূতি, এবং সে এসব নিষিদ্ধ করার জন্যে আবেদন জানাতে পারে। পৃথিবী ও গ্রহগুলো ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র ক’রে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাগর্জনের ফলে, সেটি হঠাৎ সৃষ্টি হয় নি, হয়েছে আজ থেকে এক হাজার থেকে পনেরশ কোটি বছর আগে, তারপর থেকে সম্প্রসারিত হয়ে চলছে, সূর্য আর গ্রহগুলো উদ্ভূত হয়েছে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, মানুষ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসেসনি, বিবর্তনের ফলে বিকশিত হয়েছে বিশ থেকে চলি−শ লক্ষ বছর আগে, পাহাড়গুলো পেরেক নয় ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক সত্য বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়;- এগুলোতে প্রচণ্ডভাবে আহত হ’তে পারে ধার্মিকদের ধর্মানুভূতি, তারা এগুলো নিষিদ্ধ করার জন্যে দাবি জানাতে পারে। তখন রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র কি নিষিদ্ধ করবে বিজ্ঞান? তারপর ধর্মানুভূতি যেহেতু সম্পটর্ণরূপে অযৌক্তিক, তাই তা কতোটা আহত হলো, তা পরিমাপ করার উপায় নেই। যুক্তি দিয়ে অযুক্তিকে মাপা যায় না।


কোনো পৌরাণিক বিশ্বাস বা ভাবাদর্শ পোষণ, লালন, সংরক্ষণ কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব? রাষ্ট্র যদি কোনো ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেয় তার অধিবাসীদের ওপর, তাহলে তা হবে ভাবাদর্শগত স্বৈরাচার। সব ধরনের ভাবাদর্শই সন্দেহজনক ও পীড়নমূলক, আর পৌরাণিক ভাবাদর্শগুলো শুধু পীড়নমূলকই নয়, সেগুলো মানুষকে ক’রে রাখে অন্ধ, তার মননশীলতাকে ব্যাহত ক’রে তাকে বিকশিত হ’তে দেয় না। জ্ঞানের যে-বিকাশ ঘটেছে গত কয়েক শো বছরে, তা সহজে ঘটে নি; পৌরাণিক ভাবাদর্শগুলো পদেপদে বাধা দিয়েছে জ্ঞানের বিকাশে; বহু জ্ঞানীকে পীড়ন করেছে, পৌরাণিক ভাবাদর্শবাদীরা হত্যা করেছে বহু জ্ঞানীকে। পরে দেখা গেছে জ্ঞানীরাই ছিলেন ঠিক পথে, ভুল ছিলো পৌরাণিক ভাবাদর্শ, কিন্তু তা ছিলো শক্তিমান ও নির্মম। পৌরণিক ভাবাদর্শের যদিও কোনোই বাস্তব ভূমিকা নেই মানুষের জীবনে, তবু তা আজো শক্তিমান হয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর পাহারায়। জ্ঞানীর জ্ঞানের থেকে রাষ্ট্রের কাছে বেশি মূল্যবান হয়ে আছে অন্ধের ভুল বিশ্বাস। আজকের বিজ্ঞানের যুগেও পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোকে প্রবল ক’রে তোলা হচ্ছে, মাতিয়ে তোলা হচ্ছে মানুষকে পৌরাণিক বিশ্বাস দিয়ে; এবং পরিহাসের বিষয় হচ্ছে অসামান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোই ব্যবহৃত হচ্ছে পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোর প্রচারে। পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোর পক্ষে যে-কোনো অসত্য প্রচার করা যায়, এবং প্রচার করা হচ্ছে নিয়মিত, কিন্তু চরম সত্যও বলা যায় না, যা বিৎ›দ্ধে যায় পৌরাণিক বিশ্বাসের। আজকাল বই, পত্রপত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনে নিরন্তর প্রচারিত হচ্ছে পৌরাণিক বিশ্বাস, যার কোনো যুক্তিগত ভিত্তি নেই, যেগুলোর অধিকাংশই হাস্যকর নিরর্থক কথা; কিন্তু পৌরাণিক বিশ্বাসের বিপক্ষে একটি কথাও বলা যায় না বেতার ও টেলিভিশনে।


জ্ঞানের বিকাশের অর্থই হচ্ছে পুরোনো পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোকে আহত করা, শুধু আহত নয় সেগুলোকে সম্পূর্ণ বাতিল করা; কিন্তু রাষ্ট্রগুলো জ্ঞানের সুবিধাগুলো নিচ্ছে, কিন্তু পরিহার করছে তার চেতনাকে, এবং পোষণ ও পালন ক’রে চলছে পৌরাণিক বিশ্বাস।


মানুষ কোনো ধর্ম বা ধর্মানুভূতি নিয়ে জন্ম নেয় না; কিন্তু জন্মের পরই তার ওপর সক্রিয় হয়ে ওঠে পরিবারের ধর্ম বা ধর্মানুভূতি, এবং সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় পরিবারের ধর্মগোষ্ঠিতে। মাবাবা, আত্মীয়স্বজন, এলাকা, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠ্যপুস্তক, পত্রপত্রিকা, রাষ্ট্রযন্ত্র তার ভেতরে ঢোকাতে থাকে ধর্ম ও ধর্মানুভূতি, পুলিশের মতো পাহারা দিতে থাকে তাকে, এবং তার মননশীলতাকে নষ্ট ক’রে সেখানে বিকাশ ঘটাতে থাকে যুক্তিহীনতা। সে যে-ধর্মের সদস্য সেটি যদি হয় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষিত ধর্ম, তাহলে তার ধর্মানুভূতি উগ্র থেকে উগ্র হয়ে উঠতে থাকে। একটি প্রশ্ন ওঠে মাঝেমাঝেই যে যারা শিক্ষিত, জ্ঞানের বিভিন্ন এলাকায় যাদের অনেকেই অর্জন করেছে সাফল্য, তারা কেনো ধর্মের মতো অযৌক্তিক বিশ্বাস পোষণ করে? তারা যে ধর্মবিশ্বাস পোষণ করে, এটাকেই মনে কর হয় ধর্মের সঠিকত্বের প্রমাণ। কিন্তু এটা কোনো প্রমাণ নয়। এ-ধরনের শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাও জন্ম নেয় বিশেষ পরিবারে, বাল্যকালে তাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ভয় ও লোভ, তা থেকে তারা কখনো মুক্ত হ’তে পারে না; তারা যুক্তি ও অযুক্তির বিরোধিতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে। তারা বিরোধিতাটা বুঝতেও পারে না, কেননা মানুষ এমন অদ্ভুত প্রাণী, যে একই সাথে পোষণ করতে পারে পরষ্পরবিরোধী চেতনা। ধর্ম যে শুধু পারলৌকিক অনন্ত সুখের লোভ দেখায়, তাই নয়; বাস্তব জগতেও নানা সুবিধা দেয়। প্রথা মেনে নিলে সুবিধা অনেক, না মানলে বিপদ অনেক। তাই সে ইহজাগতিক ও পরজাগতিক দু-রকম সুবিধার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাই শিক্ষিত, এমনকি বিখ্যাত মানুষদের ধর্মানুরাগও ধর্মের অভ্রান্ততার প্রমাণ নয়। ধর্ম যেহেতু ভালো ব’লে স্বীকৃত, তাই আশা করতে পারি যে ধার্মিক মানুষেরা সৎ মানুষ হবে; কিন্তু আমরা কি নিয়মিত দেখি না ধার্মিকদের শোচনীয় অসততা?


বাঙলাদেশ এখন একটি প্রবল ধার্মিক দেশ; প্রার্থনালয়ে দেশ ছেয়ে গেছে, চারপাশ উপচে পড়ছে ধার্মিকে, উদ্দাম নাচগানের মধ্যে টেলিভিশন ব্যস্ত থাকছে ধর্মপ্রচারে, নেতানেত্রীরা তীর্থযাত্রার পর তীর্থযাত্রা করছেন, দিকে দিকে চলছে ধর্মের অলৌকিক উদ্দীপনা; তাই বাঙলাদেশ ভ’রে ওঠার কথা সততায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাপক অসততা, অতুলনীয় দুর্নীতি, সীমাহীন ধর্ষণপীড়ন। ধর্ম ও সততা হওয়া উচিত ছিলো সমানুপাতিক; কিন্তু দেখা যচ্ছে ধর্ম, ও অসততা, দুর্নীতি, ধর্ষণপীড়ন হয়ে উঠেছে সমানুপাতিক। তাহলে ধর্মানুভূতি কী দিচ্ছে আমাদের শুধু একরাশ অযৌক্তিক বিশ্বাস ছাড়া?


ধর্মানুভূতি কোনো নীরিহ ব্যাপার নয়, তা বেশ উগ্র; এবং এর শিকার অসৎ কপট দুর্নীতিপরায়ণ মানুষেরা নয়, এর শিকার সৎ ও জ্ঞানীরা; এর শিকার হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধ চলছে কয়েক সহস্রক ধ’রে, উৎপীড়িত হ’তে হ’তে জয়ী হচ্ছে জ্ঞান, বদলে দিচ্ছে পৃথিবীকে; তবু আজো পৗরাণিক বিশ্বাসগুলো আধিপত্য করছে, পীড়ন ক’রে চলছে জ্ঞানকে। ধর্মানুভূতির আধিপত্যের জন্যে কোনো গুণ বা যুক্তির দরকার পড়ে না, প্রথা ও পুরোনো বই যোগায় তার শক্তি, আর ওই শক্তিকে সে প্রয়োগ করতে পারে নিরঙ্কুশভাবে। উগ্র অন্ধ ধর্মানুভূতি বিস্তারের পেছনে কাজ করে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, দুর্নীতি ও রাজনীতি। দরিদ্রের শিক্ষালাভের সুযোগ নেই, তাই জ্ঞানের সব এলাকাই তার অজানা; তার জ্ঞানহীন মনের ভেতর প্রতিবেশ সহজেই সংক্রামিত করে অযুক্তি ও অপবিশ্বাস; আর তাতে সে খুঁজে পায় শান্তি ও শক্তি। তার কিছু নেই ব’লে তার সাথে থাকে এক অলৌকিক মহাশক্তি, যা তাকে বাস্তবে কিছু দেয় না, কিন্তু মানসিকভাবে সবল ক’রে রাখে। দুর্নীতি ধর্মের পক্ষে কাজ করে; দুর্নীতিপরায়ণ মানুষেরা নিজেদের অপরাধ ঢেকে রাখার জন্যে জাগিয়ে তোলে ধর্মীয় উগ্রতা। তাই সমাজে যতো দুর্নীতি বাড়ে ততো বাড়ে ধর্ম। রাজনীতিবিদেরাও ব্যবহার করে ধর্মকে; তারা দেখতে পায় ক্ষমতায় যাওয়ার সহজ উপায় ধর্মের উদ্দীপনা সৃষ্টি; তাদের কল্যাণ করতে হয় না মানুষের, বিকাশ ঘটাতে হয় না সমাজের- এগুলো কঠিন কাজ; সবচেয়ে সহজ হচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার ক’রে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা। কিন্তু এতে সমাজ নষ্ট থেকে নষ্টতর হ’তে থাকে, যা এখন ঘটছে বাঙলাদেশে। রাষ্ট্রকে মুক্ত হওয়া দরকার পৌরাণিক আবেগ থেকে, কেননা পৌরাণিক আবেগ গত কয়েক সহস্রকে মানুষের কল্যাণ বিশেষ করে নি, ক্ষতিই করেছে বেশি; এবং আজো ক্ষতি ক’রে চলছে।"

দেশভাগ - আমার অনুভূতি -নিশাত বিজয়
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:28 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমার জন্ম যশোর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শিমুলিয়ায়। আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এই গ্রামে। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার প্রাইমারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান যাকে আমার সেকেন্ড স্যার ডাকতাম তিনি একদিন ক্লাসে বললেন, "রবি ঠাকুরের বদলে নজরুলের নোবেল পাওয়ার কথা ছিল।"

এজন্য রবী ঠাকুর নজরুলকে বোবা(বাকশক্তিহীন) করতে বিষ খাইয়ে দেই, ফলে নোবেল জিতে রবী ঠাকুর। হিন্দুরা হল লাল পিপড়া যেটা কামড়ালে মুসলমানরা কষ্ট পাই আর মুসলিমরা হল কালো পিপড়া যেটা কামড়ালেও কেউ কষ্ট পাই না, রবী ঠাকুর হল লাল পিপড়া এজন্য নজরুলের এভাবে ক্ষতি করেছে।

এই ঘটনার আগে আমি হিন্দু-মুসলিম যে আলাদা এমন কিছু জানতাম না। আমাদের গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সবাই ছিল, আমার সব বাড়িতেই যাতায়াত ছিল কিন্তু আমি এসব বিভেদ জানতাম না। এই ঘটনা আমাকে বেশ ধাক্কা দেই, আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার পিতাই। আমি আব্বুকে বললাম, আব্বু সেকেন্ড স্যার তো আজ এই ঘটনা বললো। তখন প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িত আমার আব্বু বললো স্যার ভুল কথা বলেছেন, হিন্দু-মুসলিম উভয়ের ভিতরে যেমন ভাল মানুষ আছে তেমনি উভয়ের ভিতরেই খারাপ মানুষ আছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন কবি নজরুল তখনও কবিতা লিখতে শুরু করেননি। আমার মাথায় তারপর থেকেই ঘুরতে লাগলো কেন স্যার আমাকে মিথ্যা তথ্য দিলেন।

ছোটবেলার আরেকটি স্মৃতি আমাকে দারুণভাবে রোমাঞ্চিত করে। ঈদে আর দূূূর্গাপূজায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সোনাই নদীতে নৌকা বাইচ হতো। নৌকা বাইচে দেখতে আব্বুর সাথে মোটরসাইকেলে যেতাম সোনাই নদীতে, বাংলাদেশের এপারের জায়গাটির নাম সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার ভাদলি আর সীমান্তের ওপারে ভারতের হাকিমপুর বাজার। নৌকা বাইচের সময় সীমান্ত খুলে দিতো কয়েক ঘন্টার জন্যে, আমরা ওপাওে যেতাম, ওখানে যাত্রাপালাও দেখেছি কয়েকবার। শুনেছি এখন আর নৌকা বাইচ’ই হয় না।

ধীরে ধীরে চিন্তাজগতে এসব প্রভাব ফেলতে শুরু করলো দুইপারের ভাষা এক, তারপরও কেন আমরা ওখানে সবসময় যেতে পারি না, হিন্দু-মুসলিমের ভাষা একই, আচার-ব্যবহার একই তারপরও এসব বিদ্বেষ কেন! একে একে পড়তে শুরু করলাম ট্রেন টু পাকিস্তান, জয়া চ্যাটার্জিও ‘ভারত কেন ভাগ হল’, বুঝতে শুরু করলাম এই আচারণের মনস্তত্ত¡। বঙ্গভঙ্গ, ভারত ভাগ, ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাব, নোয়াখালী গণহত্যা, কলকাতা দাঙ্গা সম্পর্কে যখন পড়তে শুরু করলাম তখন অনেককিছুই বুঝতে সুবিধা হল।

বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে রামু, নাসিরনগর, ভোলা, মালোপাড়ায় হিন্দু-বৌদ্ধদের উপরে যে হামলা করেছে সংঘবদ্ধ মৌলবাদী চক্র সেটার পিছনে আছে ভারত ভাগের সময় তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত¡। তারা চাই এদেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সব চলে যাক, এই দেশ কেবল মুসলমানের দেশ। এই মৌলবাদীদের জন্যে প্রধান বাধা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই দেশ পাকিস্তানী শত্রু মুক্ত করেছিল।

সাম্প্রদায়িক এই আচারণ দেখে মনে হয়, দেশভাগই হচ্ছে এই উপমহাদেশে চলা চলমান বিদ্বেষের মূল কারণ। কাঁটাতারের দেওয়াল তুলে কখনো বিদ্বেষ দূর করে কোন দেশ শান্তিতে থাকতে পারে না। ভারতে গরু খাওয়া নিয়ে মুসলিম পিটিয়ে মারা আর বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে হিন্দু-বৌদ্ধদের উপর হামলার উপর হামলা চলছে অথচ সাতচল্লিশে ভাবা হয়েছিল যে, দেশ বিভক্ত করলেই বোধহয় সকল সমস্যার সমাধান হবে, সেই ধারণা যে কতবড় ভুল সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সময়ে ঘটা এই ঘটনাবলীসমূহ। আর এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের দেওয়াল তোলার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জাতিও বাঙালী জাতি, তারপরও আমাদের বোধদয় এখনও হয়নি যে সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে কখনো শান্তি আনা যায় না সমাজে। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যা, তিস্তা চুক্তি নিয়ে সংকট নিয়ে কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হয়েছে। অথচ এইসব সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান কিংবা প্রতিবাদ জারী না রেখে বাংলাদেশে চলে হিন্দু বিদ্বেষী প্রচারণা। সাম্প্রদায়িকতার কারণে পানি ঘোলা হয় কেবল কিন্তু সমাধান আসেনা। দেশের কোন উপকার না হলেও হিন্দুদের উপর নিপীড়ন জায়েজ করা হয় এটার মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িকতা কেবল আমাদেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, কোন সমাধানের পথ তৈরি করতে সক্ষম নয়।

রিচার্ড ডকিন্সের একটি ইন্টারভিউ -সম্পাদক
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:782 | likes:2 | share: 2 | comments:0

রেডিও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক: ঈশ্বর তো অপ্রমাণিত হননি। তাহলে কোন যুক্তিতে "ঈশ্বর নেই বলছেন"।

রিচার্ড ডকিন্স: সে তো পরী বা ইউনিকর্ন কিছুই অপ্রমাণিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করার স্বপক্ষে কোনও কারণও দেখছি না, তাই বিশ্বাস করি না।

['ইউনিকর্ন' পক্ষীরাজের মত এক কাল্পনিক এক শিংওয়ালা ঘোড়া] 

সঞ্চালক: সম্ভবনার কথা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে আপনি নিজেকে অ্যাগনোস্টিক বা অজ্ঞেয়বাদী বলেন না কেন?

ডকিন্স: ওরকম অদ্ভুত কথা বলতে যাব কেন? তাহলে তো বলতে হয় পক্ষীরাজ ঘোড়া বা হুরী-পরীও সত্যি আছে কিনা আমি জানি না। সম্ভবনার কথা যদি বলেন, তাহলে ঈশ্বর নামক কেউ (কোনও মহিলা, পুরুষ বা বস্তু) আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভবনা এতই কম, যে শতকরা হিসেবে একেরও নীচে, শূন্যই বলা যায়। তাই অজ্ঞেয়বাদ-টাদ না বলে, নিরীশ্বরবাদ-ই সঠিক বলে মনে করি।

টেলিফোনে এক দর্শক: ধর্ম সমাজের উপকার করে, একথা তো মানেন?

ডকিন্স: ধর্মবিশ্বাস সমাজ প্রচুর ক্ষতি, প্রচুর রক্তপাত ঘটিয়েছে। সমাজের উপকার করেছে কোনও সময়, একথা মানলে প্রমাণ হয় না যে ঈশ্বর বলে কিছু আছে। বরং ধর্মের নামে অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা তো দেখাই যাচ্ছে।

দর্শক: নাস্তিকরা সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে। যেমন হিটলার, স্ট্যালিন। কত হত্যা করেছে।

ডকিন্স: স্ট্যালিন যা করেছেন, তা নাস্তিকতার নামে করেননি। তিনি এক রাজনৈতিক মতাদর্শের বশবর্তী হয়ে করেছিলেন। আর হিটলার তো রোমান ক্যাথলিক ছিলেন, নাস্তিক আবার কোথায়? তিনি 'এথেনিক ক্লেনজিং' বা জাতিগতভাবে হত্যা করে একটি জাতিকে নির্মূল করাতে বিশ্বাসী ছিলেন।

এরপর বেশ মজা হল। ডকিন্স যেই বলতে লাগলেন হিটলারের কথা, বিশদভাবে ওঁর ইহুদিদের প্রতি জাতিঘৃণা, একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি গোঁড়া মনোভাবের কথা, টেলিফোনের বক্তা বলে উঠলেন — "যাই হোক, একজন হিটলার তো কিছু প্রমাণ করে না। কত ধার্মিক মানুষ আছেন যারা সৎ...."

তখন ডকিন্স হাসতে হাসতে বললেন — 'হিটলারের কথা তো আপনিই তুলেছিলেন, আমি না। আমিও তো বলছি কোনও বিশেষ নাস্তিক মানুষ যদি অন্যায় কাজ করেও থাকেন, তাতে প্রমাণ হয় না, নাস্তিকতা ভ্রান্ত বিশ্বাস। বরং ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি বহু ধার্মিক বন্ধু আছেন, যাঁরা আদ্যোপান্ত ভালো মানুষ। এতেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।

এরপর মধ্যপ্রাচ্যের একজন মহিলা ফোনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। ডকিন্স সাহেবের বইকে এবং ওঁর নাস্তিকতা প্রচারকে আপত্তিজনক বললেন। তাতে ডকিন্সের প্রতিক্রিয়া —

ডকিন্স: আপনি কি মনে করেন কারোর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই?

মহিলা: না, তা নয়।

ডকিন্স: আপনি যেমন আপনার মতে চলেন ও আপনার বিশ্বাস প্রচার করেন, আমিও আমার বিশ্বাস প্রচার করতে পারি তো?

মহিলা: হ্যাঁ, কিন্তু আপনার 'ঈশ্বর নেই' এসব বলাতে আমার ঘোর আপত্তি, আপনি এটা করতে পারেন না। আমি আপনার কথা মানি না (উত্তেজিত)

ডকিন্স: আপনি আমার বইটা পড়েছেন? (দ্য গড ডিল্যুশন)

মহিলা: না।

ডকিন্স: তাহলে আপনার কী করা উচিৎ? বইটা পড়ে আমাকে বলুন — 'এই জায়গাটা আমার ভালো লাগেনি', 'এটা আপনি ভুল লিখেছেন' ...ইত্যাদি। না পড়েই শুধু মানি না, মানি না বলে চেঁচালে হবে?

মহিলা: চুপ।

এরপর আরেকজন (সম্ভবত পাদ্রী) বললেন, 'আমি শুনেছি যে, আপনি নাকি বলেছেন শিশুদের ধর্মাচারণ করানো শিশুদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার? এমনকি তা নাকি 'শিশু নির্যাতন' - এর পর্যায়ে পড়ে?

ডকিন্স: না, ভুল শুনেছেন। আমি বলেছি শিশুদের বোঝবার বয়স হবার আগেই ধর্মীয়-ছাপ্পা মেরে দেওয়া, তাদের কোনও বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া ভুল। অবশ্যই শিশুদের সমস্ত ধর্ম সম্পর্কে জানা উচিৎ। ধর্মের ইতিহাস তো মানব সভ্যতারই ইতিহাস। সমস্ত ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে জেনে বুঝে বড় হয়ে ইচ্ছে হলে সে একটি বিশেষ ধর্মকে বেছে নেবে বা কোন ধর্মই নেবে না। আর একটা কথা, ধর্মের নামে ভয় দেখানোটা অবশ্যই 'শিশু নির্যাতনের' মধ্যে পড়ে। আমার অনুরোধ শিশুদের কখনোই পাপ, নরক, নরকের অগ্নিকুন্ড ইত্যাদির ভয় দেখাবেন না। এটা অন্যায়।

এরপর সঞ্চালক জিজ্ঞেস করলেন, ধর্ম ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে? তা কি কখনও আসবে?

ডকিন্স: নিশ্চয়ই আসবে। ধীরে ধীরে মানুষ সত্যিটা বুঝতে পারলে ক্রমশ ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। সৎ হতে হলে, ভালো মানুষ হতে হলে ধার্মিক বা ধর্মবিশ্বাসী হতে হয় না। তবে ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশোনা করা দরকার। মানব সভ্যতার ইতিহাস আর ধর্মগুলো অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। এগুলো না জানলে ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদির রসগ্রহণ করা যাবে না শেক্সপিয়ার কি বোঝা সম্ভব, ধর্মের ইতিহাস না জেনে?

"তুলনামূলক ধর্মশিক্ষা তাই ইতিহাসের অংশ"।

শেষে একজন ফোনে জিজ্ঞেস করলেন — যদি কখনও ঈশ্বরের দেখা পান, তখন কি করবেন? 'সরি' বলবেন? বলবেন 'আমার ভুল হয়েছিল?'

ডকিন্স: কার কথা বলছেন? কোন ঈশ্বর? জিউস?  আল্লা? হিন্দুদের শিব? কার দেখা পাবো? হাসতে হাসতে বললেন 'ঐ যে বললাম, এরকম হওয়ার সম্ভবনা এতই কম যে হিসাবের মধ্যেই আসে না'।

প্রশ্নকর্তা: এই সৃষ্টি! এর তো একটা সৃষ্টিকর্তা আছে। সব কিছুরই একটা রূপকার বা স্রষ্টা থাকে।

ডকিন্স: 'সে প্রশ্ন এতদিন ছিল। এখন ডারউইন এর "ন্যাচারাল সিলেকশন" থিওরিতে তো পরিস্কার হয়ে গেছে সৃষ্টির আদি রহস্য। যদি স্রষ্টা থাকে, তাহলে তো স্রষ্টারও স্রষ্টা আছে। তিনি কে? এর তো কোনও শেষ নেই। তর্কের খাতিরে যদি 'ঈশ্বরের' দেখা পাই আপনার কথামত, তাঁর কাছে জানতে চাইব বিজ্ঞানের এখনও অজানা কিছু তত্ত্ব ও তথ্য। আশাকরি তিনি (সেই মহিলা বা পুরুষ বা বস্তু) বলতে পারবেন তার উত্তর।

এটি ছিল একটি রেডিও অনুষ্ঠানে রিচার্ড ডকিন্সের প্রশ্নোত্তর পর্ব।

রিচার্ড ডকিন্স হলেন পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত নিরীশ্বরবাদী এবং ডারউইনের যোগ্য উত্তরসূরি। ওঁর দলে আরও আছেন — ক্রিষ্টোফার হিচেন্স সাহেব, যিনি মাদার টেরিজাকে নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

রিচার্ড ডকিন্স অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিষয়: "জনমানসে বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চার / Public Understanding of Science"। ধার্মিক রোমান ক্যাথলিক, মুসলিম সমাজ ও সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের বিরক্তি, ঠাট্টা ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। পশ্চিমী মিডিয়া তাঁকে 'ডারউইনের পোষা হিংস্র কুকুর' অবধি বলতে কসুর করেনি।

রিচার্ড ডকিন্স জন্মেছেন কেনিয়ায়। নয় বছর বয়সে খেয়াল করেন পৃথিবীর সবাই খ্রিস্টান নয়। আরও নানারকম ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান আছে। প্রতেকে নিজের বিশ্বাসটাকেই সঠিক এবং চরম সত্য মনে করে। এটা বুঝতে বুঝতে বছর পনের যখন বয়স, তখন উপলব্ধি করেন যে, 'ব্যক্তিগত ধর্ম একটা অ্যাক্সিডেন্ট' বা কাকতালীয় ব্যাপার। উনি খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই খ্রিস্টান। নয়ত অন্য কিছু হতেন। ঈশ্বরের চেহারা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন রকম। অতএব তা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।


ভাষান্তর- সুমিত্রা পদ্মনাভন

প্রতিটা মানুষই স্বভাবগতভাবে কম বেশি নাস্তিক -শোভন নস্কর
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:769 | likes:0 | share: 1 | comments:0

প্রতিটা মানুষই স্বভাবগতভাবে কম বেশি নাস্তিক। পুরোপুরি আস্তিক মানে সে বদ্ধপাগল।   কি হলো কানে হাত চেপে মনে হচ্ছে, ইসস কি শুনলাম! আমি নাস্তিক হলাম কিভাবে!  হ্যাঁ, মন্দিরে ঘন্টা বাজানো পুরোহিত থেকে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত সবাই নাস্তিক!  কিন্তু তাহলে নিজেদের নাস্তিক না বলে ঘোর ঈশ্বর বিশ্বাসী বলে কেন?  আসলে সমাজের চাপানো ক্রমাগত মিথ্যার আস্তরণের চাদর ভেদ করে উঠতে পারেনা৷ প্রতিটা মানুষ নিজেকে বোঝায় সে আস্তিক, যদিও সে না৷ জীবনের বহু এমন ক্ষণিকের সিচুয়েশন তৈরি হয় যেখানে সে ইশ্বরকে অবিশ্বাস করে ফেলে!  

  একজন সাধারণ মানুষকে কিভাবে নাস্তিক প্রমাণ করবেন?  খুব সোজা, কিছু টাকা ধার নিয়ে বলুন, পরকালে টাকা শোধ করে দেবো। কারোর ক্ষতি করে বলুন, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দেবে, আপনি দয়া করে পুলিশে যাবেন না!   কারোর মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে বলুন, চলুন মন্দিরের ভীড়ে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। মুসলমানদের সভায় বড় বড় করোনা তাড়ানো হুজুররাও জানে করোনার সময় মক্কা বন্ধ রাখতে হয়। কোটি কোটি মানুষের প্রবলেম চুটকিতে সলভ করে দেওয়া তিরুপতি মন্দিরও বন্ধ হয়ে যায়৷ তাহলে কি ওই ইমাম বা পুরোহিতগুলো ঈশ্বরের ভরসায় ওগুলো কি খুলে রাখতে পারতো না? হু হু বাওবা!  খেল তো ওখানেই৷ প্রতিটা মানুষ জানে গীতা বা কোরানের কোন নিয়মই বর্তমান জীবনে মেনে চলা সম্ভব নয়। 'যাহা গেছে তাহা যাবে ', 'যা হয় সবই ভালোর জন্য' ঘোর ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছ থেকে এক লাখটাকা চুরি করে এইসব ডায়লগ ঝেড়ে আসুন তো!  পিটিয়ে সোজা করে দেবে।  

  হাজার হাজার কট্টর ধর্মবিশ্বাসী যারা অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করে না, বিপদে পড়লে সুড় সুড় করে বেজাতের ডাক্তার দেখাতে দ্বিধাবোধ করবে না। মন্দির মসজিদে পড়ে থাকার থেকে বেজাতের ডাক্তারকে তখন শ্রেয় মনে করে।  

  এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষ যদি নাস্তিকই হয় তাহলে আস্তিকতার মুখোশ পরে থাকে কি করে?  কারণটা খুবই সোজা। মানুষ দলবদ্ধপ্রানী৷ প্রাচীনকাল থেকে নানা গোষ্ঠী তৈরি করে গেছে। তার থেকে হয়েছে গোষ্ঠী দন্দ্ব। ক্রমাগত একে অপরের থেকে উঁচু, এটা বোঝাতে নিজেদের গোষ্ঠীকে বড় করে গেছে। সেটা এখনো করে যাচ্ছে এবং যেটা করার দায়িত্ব নিয়েছে ধর্মগুরু, বলা যেতে পারে ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা ঘোষিত নাস্তিকের থেকেও বড় নাস্তিক। কাল্পনিক ঈশ্বর এবং তার গুনকীর্তন করে গোষ্ঠীবৃদ্ধিই তার কাজ।

মরণোত্তর দেহদানের প্রথম প্রচারক -শ্যামল
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:778 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এই মানুষটির কথা জানতে গেলে ইতিহাসের পাতা ওলটাতে হবে। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দতে লন্ডন এবং তার আশেপাশে বেসরকারি মেডিকেল স্কুলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এসব স্কুলের জনপ্রিয়তার কারণ ছিল মূলত সত্যিকার মানবদেহ ব্যবচ্ছেদের সুযোগ। কিন্তু সমস্যা হলো সে সময় সবার মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের অনুমতি ছিল না। কেবল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের দেহই সরকারি মেডিকেল স্কুলগুলোতে দেয়া হতো। কিন্তু  তা খুব সহজ ছিল না। সেইখানেও নানা ধরণের বাধা বিপত্তি ছিল। ১৭৬৫ থেকে ১৮৮৪ পর্যন্ত ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ওপর প্রায় ২৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা থেকে বাদ যায়নি মেরিল্যান্ড কিংবা ইয়েলের মতো নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। ফলে বাধ্য হয়েই এনাটমির শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা বেছে নেন এক অবৈধ পথ। সেই সঙ্গে রচিত হয় অন্ধকার জগতের নতুন অধ্যায়, শব বাণিজ্য। শুরু হয় কবর থেকে চুরি। ১৭৭০ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক জন ওয়ারেন "Spunkers" নামে একটি গুপ্ত এনাটমি সোসাইটি তৈরি করেন, যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করে ব্যবচ্ছেদ করতেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতেও অবস্থার সামাল দেওয়া যায় নি। চুরি করা মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা ছিল বেআইনি। এই অপরাধে ১৮২৪ সালে ডা. চার্লস নলটন (Charles Knowlton) অবৈধ ব্যবচ্ছেদের দায়ে গ্রেফতার হন। দু'মাস পর ছাড়া পেয়ে তিনি জনগণের মধ্যে মরণোত্তর দেহদানের বিষয়ে কুসংস্কার দূর করার জন্য ডাক্তারদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এই চার্লস নলটনই (নাউলটন) ছিলেন প্রথম মরণোত্তর দেহদানের প্রচারক। কিন্তু এই প্রচারে কোন সাড়াই মেলে নি। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। জেলে থাকাকালীন তার কিছু উপলব্ধি হয় এবং তিনি মরণোত্তর দেহদানে যে কুসংস্কার তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি বই লেখেন

“Elements of Modern Materialism”। যা ১৮২৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৮৩২ সালে মরণোত্তর দেহদানের আইন ইংল্যাণ্ডে প্রবর্তন হয়। এই সালেই ইংল্যাণ্ডের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ জেরেমি বেন্থামের মৃতদেহ দান দিয়েই মরণোত্তর দেহদানের যাত্রা শুরু।

পরিশেষে জানাই, চার্লস নলটন (নাউলটন) ছিলেন আমেরিকান। ১৮০০ সালের ১০ ইউনাইটেড স্টেটের ম্যাসাচুসেটসের টেম্পেল্টনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৫০ সালে ম্যাসাচুসেটসের উইনচেনডনে মারা যান।

মুফতি সাহেবের সাথে যুক্তি-তর্ক -আব্দুল হালিম বিশ্বাস
Nov. 20, 2024 | মুক্তমনা | views:765 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গত রবিবার একটি পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম। সেমিনার শেষে দেখলাম ঐ মঞ্চে একজন নববধূ ও একজন সাংবাদিক অতি সহজে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করলেন। অতি সহজে কথাটি এই কারণে ব্যবহার করলাম, যে সমাজে আমি বড়ো হয়েছি সেখানে মরণোত্তর দেহদান শুধু কঠিনই নয় প্রায় অসম্ভব।

মরণোত্তর দেহদানের উপকারিতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি মনের মধ্যে অনুরণন হচ্ছিল। পরদিন সকালেই একজন মুফতি সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তিনি স্থানীয় একটি খারিজি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকও।

আমি: মুফতি সাহেব, ইসলামে মরণোত্তর দেহদান প্রসঙ্গে বক্তব্য কি?

মুফতি সাহেব: না, একদম জায়েজ নয়।

আমি: কেন নয়, ধরুন আমি মৃত্যুর পর চক্ষু দান করব। তাতে তো একজনের অন্ধত্ব দূর হতে পারে।

মুফতি সাহেব: দান করুন। জীবিত অবস্থায় করুন। কোনো বাধা নাই। অনেকেই তো কিডনি দান করে।

আমি: জীবিত অবস্থায় আমি দুচক্ষু ব্যবহার করলাম। মৃত্যুর পরে কর্ণিয়া দান করলাম। তাতে তো আমার ক্ষতি নাই, বরং অপর একজনের উপকার আছে।

মুফতি সাহেব: এত ইচ্ছে হলে এখনই করুন। মৃত্যুর পরে অনুমতি নাই।

আমি: কিন্তু কারণটা কি? কেন দিতে পারব না?

মুফতি সাহেব: মৃত্যুর পর লাশের কাটাছেঁড়া করলে লাশের অসম্মান হয়। কাটাছেঁড়া করা যাবে না।

আমি: আমার তো মনে হয় তাতে লাশের সম্মান বাড়ে। জীবিত অবস্থায় যা পারলাম করলাম। মৃত্যুর পরে অন্তত একজনের জীবনে উপকার করতে পারলাম।

মুফতি সাহেব: এটা বোঝার ভুল। ইহকালের থেকে পরকালই দীর্ঘস্থায়ী না?

বস্তুতঃ মুসলিম সমাজ তথা ইসলামিক বিশ্বের এটাই গোড়ার কথা। অর্থাৎ মৌলবী মৌলানা সাহেবদের ভাষায় ইহকাল হলো "দুদিনের দুনিয়াদারি"। একজন একনিষ্ঠ মুসলমানের ভাবনা চিন্তা কর্ম শ্রম সবই পরকালের জন্য। আরও ঠিক ঠিক বলতে গেলে জান্নাত হুর গেলেমান প্রভৃতির জন্য। সেখানে এই পৃথিবীর সুখ শান্তি আনন্দ বেদনা সবই তুচ্ছ। আর তাই, পৃথিবীতে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রযুক্তি উদ্ভাবনা প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়েছে।

আমি: তাছাড়া, মুফতি সাহেব, মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ছাড়াও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যানাটমি বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের অধ্যায়ন ও হাতে কলমে শিক্ষার জন্য মৃত দেহ প্রয়োজন। তার জন্য আমাদের মরণোত্তর দেহদান করা উচিত।

মুফতি সাহেব: জীবিত অবস্থায় মানুষের হাড়গোড় ভাঙাচোরা করলে যেমন কষ্ট পায়, কাটাছেঁড়া করলে লাশও কষ্ট পায়। ওটা করা যাবে না।

আমি: তাহলে দেশে ইসলামিক বিধান চালু হলে কোনো ছাত্রছাত্রী হাতেনাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবে না। বড়ো মানের সার্জেন দেশে তৈরি হবে না। এইভাবে ইসলামিক বিধিনিষেধের কারণেই কি ইসলামিক দেশগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে পিছিয়ে যাবে না?

মুফতি সাহেব: কি হবে তাতে? সবচেয়ে বড় সার্জেন তো আল্লা স্বয়ং। ইসলামের দলিল তো পাল্টানো যায় না।

মরণোত্তর দেহদানে ইসলামিক প্রতিবন্ধকতার প্রতিফলন আরব ভুখন্ডে লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবের প্রায় সকল হাসপাতালে নামী ডাক্তার বা সার্জেন বলতেই ভারতীয় অথবা ইউরোপীয়। আরব সন্তানদের বড়ো একটা দেখা যায় না। কয়েকজন ডাক্তারের যে নাম পাওয়া যায় প্রত্যেকেই ইউরোপ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত।

তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশরের মতো মুসলমান প্রধান দেশগুলো মরণোত্তর দেহদানকে উৎসাহিত করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানও প্রভূত উন্নত। এবং উন্নতির জয়যাত্রায় ধর্মের বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

কয়েক বছর আগে দিল্লির একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরণোত্তর দেহদানের প্রচার চালালে অঙ্গীকারবদ্ধদের তালিকায় দেখা যায় একশো শতাংশ দাতাই অমুসলিম। এবং অতি আশ্চর্যের, ঐ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপর একটি রিপোর্টে দেখা যায়, পূর্বে প্রতিস্থাপিত অঙ্গ গ্রহীতার পঁয়তাল্লিশ শতাংশই মুসলিম।

অর্থাৎ লাশের অঙ্গ, জীবনের জন্য গ্রহণ করা যায়। কিন্তু ধর্মের বিধিনিষেধে দান করা যায় না। এই স্বার্থপরতা বড়ো একমুখী, দৃষ্টিকটু। ভারতবর্ষের মতো বহুধর্মের দেশে বড্ড বেমানান। দান সকল সমাজেই শ্রেষ্ঠ, সে দেহ হোক বা ধনসম্পদ হোক। আমাদের মনের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করতে হবে। তাতে ধর্মের বেড়া ভেঙে গেলে যাক।

হেরোফিলোস ও ইরাসসিস্ট্রাস -শ্যামল
Nov. 20, 2024 | সমাজ | views:24 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মরণোত্তর দেহদানের কথা জানতে গেলে হেরোফিলাস ও ইরাসসিস্ট্রাস এই দুই জনের কথা জানতেই হবে। ইরাসিস্ট্রেটাস এবং হেরোফিলাস এই দুই জনই একমাত্র চিকিত্সক যারা রেনেসাঁর আগে নিয়মিতভাবে মানবদেহে ব্যবচ্ছেদ করতেন। এই সবই শুরু হয়েছিল ৩য় শতাব্দীর প্রাচীন গ্রীসে কালসিডনের হেরোফিলাস এবং সিওসের ইরাসিস্ট্রেটাস নামের দুই চিকিৎসকের হাত ধরে। 

হিরোফিলোস প্রথম বিজ্ঞানী যিনি নিয়মিতভাবে শবদেহের বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন।  তিনি মানব দেহকে বিচ্ছিন্ন করে এবং মস্তিষ্কে স্নায়ুর কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং রক্তের বাহন, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, চোখ ইত্যাদি বর্ণনা করেন, পদ্ধতিগত শারীরিক গঠন শুরু হয়। এছাড়াও তিনি চোখ, লিভার, লালা গ্রন্থি, অগ্ন্যাশয় এবং উভয় লিঙ্গের যৌনাঙ্গে অঙ্গগুলির যত্ন সহকারে বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বইয়ে মিডওয়াইফারি, তিনি পর্যায়ক্রমে এবং গর্ভাবস্থার সময়কালের পাশাপাশি অসুবিধাজনিত প্রসবের কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই কাজের উদ্দেশ্য হ'ল ধাত্রী এবং সেই সময়ের অন্যান্য ডাক্তারদের জন্মানো এবং গর্ভাবস্থার প্রক্রিয়া আরও পুরোপুরি বুঝতে। এটি আবিষ্কারের জন্যও কৃতিত্বপ্রাপ্ত ডিম্বাশয় এবং পরে যাকে বলা হবে তার বৈজ্ঞানিক বিবরণ দিয়েছিলেন স্কিনের গ্রন্থি। ২০০১ সালে এর নামকরণ করা হয় মহিলা প্রোস্টেট। হিরোফিলাস তাঁর গবেষণা নিয়ে কমপক্ষে নয়টি রচনা লিখেছেন। ৩৩৫ খ্রীষ্ট্র পূর্বাব্দে হেরোফিলোস জন্মগ্রহণ করেছিলেন এশিয়া মাইনরের চালসিডন শহরে (এখন কাদিক্য, তুরস্ক)। তিনি তার স্কুল জীবন শুরু করার জন্য মোটামুটি অল্প বয়সে আলেকজান্দ্রিয়ায় চলে এসেছিলেন বলে তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।

এবার জানা যাক ইরাসিস্ট্রেটাসের কথায়। ইরসিস্ট্রাটাস তাঁর সমসাময়িক ছিলেন যিনি হেরোফিলাসের সাথে যৌথভাবে এই শবদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজ করেছেন। একসাথে তারা আলেকজান্দ্রিয়াতে একটি মেডিকেল স্কুলে কাজ করেছিলেন। তাঁরা এখানে  মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ অনুশীলন করতেন এবং যা ছিল শারীরবিদ্যা শেখার প্রধান মাধ্যম। ইরাসিস্ট্রেটাস হৃৎপিণ্ডের ভালভের বর্ণনার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, এবং তিনি আরও উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে হৃদয় সংবেদনের কেন্দ্র ছিল না, বরং এটি একটি পাম্প হিসাবে কাজ করে। ইরাসিস্ট্রেটাস  শিরা এবং ধমনীর মধ্যে পার্থক্যকারী প্রথম ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন। ইরাসিস্ট্রাটাসকে হেরোফিলাসের পাশাপাশি রেকর্ডকৃত ব্যবচ্ছেদ এবং সম্ভাব্য ভাইভিসেকশন পরিচালনা করা প্রথম চিকিৎসক/ বিজ্ঞানীদের একজন হিসাবে দেখা হয়। ভাইভিসেকশন হল কোন জীবন্ত প্রাণীর উপর পরীক্ষামূলক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অস্ত্রোপচার, সাধারণত একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রাণী, জীবিত অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে।  এই দুই জনের মৃত্যুর পর শারীরবিদ্যা সম্পর্কিত ব্যবচ্ছেদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু না হওয়ার আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় থাকে। ১২ শতকের পূর্বে এটি আর পুনরুজ্জীবিত হয়নি।  

এইখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করতেই হচ্ছে।  ১২শ শতকের দিকে মানুষের মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ আবারও শুরু হয়েছিল। এবারও ব্যবচ্ছেদকে অসম্মানের চোখে দেখা হয়েছিল, তবে এটাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয় নি। তার পরিবর্তে, নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমের  ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং এগুলোর অনুমতির ব্যাপার গির্জা নির্দিষ্ট কয়েকটি ফরমান সামনে নিয়ে আসে। এই ফরমানগুলোর একটি যা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্য স্মারকরূপে গণ্য হয়েছিল তা হচ্ছে পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক  কর্তৃক ১২৩১ সালে জারিকৃত একটি ফরমান। এই ডিক্রিতে বলা হয়েছিল যে, শারীরবৃত্তীয় অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে প্রতি পাঁচ বছরে একটি মানবদেহ একবার ব্যবচ্ছেদ করা হবে এবং যারা চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অথবা ঐ সময়ে এই বিষয় দুটি নিয়ে অনুশীলন করছেন তাদের সকলের উপস্থিতি প্রয়োজন। ১৭ শতকে এটি উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তখন থেকে আজও এর ব্যবহার করা হয়ে চলেছে।

পেরিয়ার ঈশ্বর নিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন করেছেন -সম্পাদক
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:38 | likes:2 | share: 2 | comments:0

স্বাধীনতার পরে এবং তার আগেও দক্ষিণ ভারতের রাজ্য বিশেষ করে তামিলনাডু তে পেরিয়ারের খুবই গভীর প্রভাব থাকতে দেখা যায়। 

দক্ষিণ ভারতের লোক ওনাকে খুবই সম্মান করেন পেরিয়ারের নামে চলচিত ই, বি, রামাস্বামির না শুধু সাংস্কৃতিক তবে তামিলনাড়ুর সামাজিক এবং রাজনীতি দিক থেকে ও প্রভাব এত গভীর যে কমিউনিস্ট হোক অথবা দলিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত লোক সব ওনার থেকে প্রভাবিত হয়েছে। 


তামিল রাষ্ট্রভুক্ত থেকে ধরে নাস্তিক তর্কবাদী নারীবাদী দেখে আন্দোলন করা লোক সবাই উনার সম্মান করেন উনার বিচার এবং কাজের সাক্ষী দেন এবং ওনাকে একজন মার্গ দর্শক রূপে গণ্য করেন। তর্কবাদী নাস্তিক এবং পিছিয়ে পড়া দের পক্ষে কাজ করার কারণে উনার সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে অনেক উচ নিচ দেখা যায়

পেরিয়ার ই, বি, রামাস্বামী (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯-/ ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩) বিশ শতাব্দীর তামিলনাড়ুর একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং লোক প্রিয় রাজনেতা ছিলেন ওনাকে পেরিয়ার নামে ডাকা হয় আসলে তামিলে সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য এই শব্দ ব্যবহার করা হয়

উনি হিন্দুত্বের প্রবল বিরোধী ছিলেন জাস্টিস পার্টি গঠনের সময় হিন্দুত্বের বিরোধ ছিল উত্তর ভারতের হিন্দি পশ্চিম ভারতের বাংলা এলাকায় যদিও ওনার লোকপ্রিয়তা কম কিন্তু আস্তে আস্তে বাড়তেই চলেছে এখন 


ভারতীয় বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় সমাজের পিছিয়ে পড়া শোষিত লোকেদের অবস্থা বদলানোর এবং একটি তর্কশীল সংস্কৃতিক আন্দোলন চালানোতে উনার নাম সবচেয়ে উপরে আছে

পেরিয়ারের মূর্তির নিচে লেখা ছিল - ঈশ্বর নেই এবং ঈশ্বর একদম নেই যে ঈশ্বরকে বানিয়েছে ও বোকা যে ঈশ্বরের প্রচার করে ও দুষ্ট আর জে ঈশ্বরের পূজা করে ও একজন বব্বর। 


এই ধরনের করা শব্দ ব্যবহার করে প্রশ্ন করার কারণে পেরিয়ার কে ভারতীয় হিন্দুত্ব সমাজ সব সময় দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু যখন আজকে ভারতে নাস্তিকতা এবং তর্কশীল আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সব জায়গায় ছড়াচ্ছে আর নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়ছে লোক খুব বড় সংখ্যায় উনার যুক্তি সিদ্ধান্ত প্রশ্ন ইত্যাদি প্রচারিত করছেন। 


আসেন দেখি মহান তর্কশীল নাস্তিক এবং সমাজ কল্যাণী পেরিয়ার ঈশ্বরকে কি কি প্রশ্ন করেছেন তবে এ প্রশ্নগুলো বলতে গেলে তো সামাজিক কুসংস্কার গুলোকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। 


১) তুমি কি ভীতু যে সবসময় লুকিয়ে থাকো কখনো কারো সামনে আসো না

2. আপনি কি একজন সুখী ব্যক্তি যিনি মানুষকে দিনরাত ইবাদত ও প্রার্থনা করতে বাধ্য করেন? 

৩) আপনি কি সবসময় ক্ষুধার্ত যারা মানুষের কাছ থেকে মিষ্টি, দুধ, ঘি ইত্যাদি নিয়ে থাকেন? 

৪) আপনি কি একজন আমিষভোজী যিনি মানুষকে দুর্বল পশু বলি দিতে বলেন? ৫) আপনি কি একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী যিনি লক্ষ লক্ষ টন সোনা পুঁতে রেখে মন্দিরে বসে আছেন?

৬)  তুমি কি ব্যভিচারিণী যে মন্দিরে দেবদাসী রাখে?  

৭)  আপনি কি দুর্বল যারা প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বন্ধ করতে পারে না?  

৮)  তুমি কি বোকা, যারা পৃথিবীর দেশে তেল না খেয়ে নদীতে দুধ-ঘি ফেলে দেয়?  

৯)  আপনি কি বধির যারা নিরপরাধ মানুষদের ধর্ষিত, অকারণে মারা যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পান না?  ১০)  আপনি কি অন্ধ যে প্রতিদিন অপরাধ ঘটছে তা দেখতে পাচ্ছেন না?  

১১) আপনি কি সেই সন্ত্রাসীদের সংস্পর্শে আছেন যারা প্রতিদিন ধর্মের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে? 

১২) আপনি কি একজন সন্ত্রাসী যিনি চান যে লোকেরা আপনাকে ভয় পায়? 

১৩) আপনি কি বোবা যিনি একটি শব্দও বলতে পারেন না কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ আপনাকে লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন করে? 

১৪) আপনি কি সেই দুর্নীতিবাজ যারা গরীবকে কখনও কিছু দেন না যখন গরীবরা আপনার উপর পশুর মত কাজ করে অর্জিত সমস্ত অর্থ ত্যাগ করে? 

১৫) তুমি কি বোকা যে আমাদের মত নাস্তিক সৃষ্টি করেছ যারা তোমাকে মিথ্যা বলে এবং তোমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে?


ভাষান্তর -অরিজিৎ।

ভারতীয় ইতিহাসের আরব্যকরণ এবং রাজনীতি -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 20, 2024 | রাজনীতি | views:484 | likes:3 | share: 2 | comments:0

একটি মিথ্যা ও ভ্রান্ত ইতিহাস বর্তমানের social media তে দেখা যায়। [1] ভারতকে স্বাধীন করতে যদি দশজন হিন্দু প্রাণ দিয়ে থাকে তাহলে ৯০ জন মু সলমান প্রাণ দিয়েছিলো। এই ইতিহাস নাকি বিজেপি আরএসএস মুছে ফেলেছে! অথচ মুসলিম লীগের অন্যতম লিডার, সাংবাদিক, লেখক আবুল মনসুর আহমদ তার বিখ্যাত বই [ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ ] বইতে লিখেছেন, [2] মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা চায়নি। তাদের মূল আগ্রহ ছিলো তুর্কী খিলাফত নিয়ে। সেই খিলাফত ও তার খলিফাকে রক্ষার জন্যই তারা মহাত্মা গান্ধির সমর্থন পাওয়ার আশ্বাসে অসহোযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। পরে খিলাফত বিলুপ্ত হয়ে গেলে সেই ভাবে মুসলিমদের আর আগ্রহ দেখা যায়নি ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে...।

আবুল মনসুর আহমদ আত্মসমালোচনা করে এই স্বীকারোক্তি করেছিলেন যে, মুসলিম লীগের একজনও তারা ভারতের স্বাধীনতা চায়নি! আজকের বুর্জোয়া কমিউনিস্টরাই ‘ওহাবী আন্দোলনের’ নাম দিয়েছিলো ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’! তীতুমীরের মত একটা ইসলামিক মৌলবাদী কে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত করতে চেয়েছে। কিন্ত কাল মার্ক্স তার বই - [3] [ MARX NOTES ON INDIAN HISTORY] তে লিখেছেন -Also, formidable disturbance at Barasat, near Calcutta, where bloody fight broke out between Moslem fanatics under Titu Mir and Hindus. British regiment put the rioters down (p.129) এর পরেও আজকের বুর্জোয়া রা কাল মার্ক্সকে চাড্ডি বলতে দুই পা পিছু হবে না।

হাজি শরীয়তুল্লাহ-তীতুমীর-দুদুমিয়ারা এই বঙ্গে হিন্দুয়ানী বিরোধী আন্দোলন করে বাঙালি মুসলমানকে তাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করে ফেলে। হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যতা তৈরির আন্দোলন ছিলো ওহাবী আন্দোলন। আজকে যাদের সালাফি বা আহলে হাদিস হিসেবে চেনে তীতুমীর-শরীয়তুল্লাহ ছিলেন সেই মতবাদের আদিপুরুষ। তাদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে আমাদের সামনে পরিচিত করেছে এই বুর্জোয়া বামগুলি। তাদের ছানাপোনারা যখন আমাদের ইসলাম শেখাতে আসে, ইতিহাস শেখাতে আসে, বিজেপি আরএসএসের ইতিহাস বলে সত্যকে মুছে ফেলে তখন ভারতের হিন্দুদের কপালে দুঃখ আছে বলতেই হবে! 

এইসব বামদের কাছে প্রশ্ন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ কেন করেছিলেন যদি হিন্দু মুসলমান একই বৃন্তের দুটি কুসুম হয়ে থাকবে? নিরোদ সি চৌধুরী দেখিয়েছেন ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার ইতিহাস অনেক পুরোনো। সাতশো বছরের মুসলিম শাসনে স্থানীয় হিন্দুদের উপর মুসলিমদের একেশ্ববাদ, তাদের কালচার, শাসক হিসেবে, ধর্মগুরু হিসেবে যে আধিপত্য চলেছে সেখানে কি করে সুসম্পর্ক তৈরি হবে? যে মুসলমানরা মনে করত ইংরেজ তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে সেই ক্ষমতা নিজের হাতে শাসক হিসেবে বুঝে পাওয়াই লক্ষ্য সেই জনগোষ্ঠি কি করে হিন্দুদের ভাই মনে করবে? এরা তো হিন্দুদের প্রজাই মনে করবে। হিন্দু কমিউনিস্টদের মুখে ঝামা ঘষে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন।

[5] মুসলমানরা নিজেদের জন্য পদ পদবী পাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী ছিলো। বেঙ্গল প্যাক্ট করতে তাদের আগ্রহ ছিলো বিপুল কারণ এখানে রাজনীতি ও সরকারী চাকরিতে লোভনীয় কোঠা সুবিধার চুক্তির কথা বলা হয়। সেই মোতাবেক দেশবন্ধু যখন কোলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন তখন তার ডেপুটি করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। বেঙ্গল প্যাক্ট আদৌ হিন্দু মু সলমান ঐক্য নয় বরং বিবাদমান দুটি শত্রুর মাঝে শান্তি চুক্তি হচ্ছে বলেই মনে হয়। বস্তুত এরকম চুক্তি করে কখনোই ঐক্য করা সম্ভব নয়। বেঙ্গল প্যাক্টের চুক্তির এই ধারাগুলির দিকে একটু তাকান-

রাজনীতির পঞ্চাশ বছর - বই থেকে একটি পেজ পুরোটাই তুলে দিলাম। (p.162,163)

[6] কমরেড এম. এন. রায়ের প্রভাব জিন্না - সুভাষ মোলাকাত ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও তার একটা ছাপ আমার মনে স্থায়ী হইয়াছিল। আমি নয়া ধারায় চিন্তা করিতে শুরু করি। এই চিন্তায় কমরেড এম. এন. রায়ের সাহচর্য আমাকে অনেক দূর আগাইয়া নিয়া যায়। ১৯৩৮ সালে দিল্লী কংগ্রেস কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে কমরেড রায়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তার আগে কমরেড রায়ের প্রতি আমার ভক্তি - শ্রদ্ধা ছিল নিতান্ত রোমান্টিক। বিশ্ব কমিউনিয়মের অন্যতম নেতা স্ট্যালিনের সহকর্মী হিসাবে তিনি ছিলেন আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে এক মনীষী। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর আমার ভক্তির রোমান্টিক দিকটার অবসান হইলেও শ্রদ্ধা - ভক্তি এতটুকু কমে নাই। বরঞ্চ বাড়িয়াছে। বাস্তব রাজনীতিতে অবশ্য তাঁর মতবাদ ও উপদেশ নির্ভরযোগ্য মনে করিতাম না। সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর মত ধৈর্য ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় প্রথম দিকে তিনি আমাকে কৃষক - প্রজা পার্টি ভাংগিয়া সমস্ত কর্মীদের লইয়া সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিবার পরামর্শ দেন। তাঁর উপদেশ অগ্রাহ্য করার পর তিনি নিজেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং আমরা কৃষক - প্রজা কর্মীরা কংগ্রেসে না যাওয়ায় আমাদের প্রশংসা করেন। কলিকাতার মুসলিম ছাত্রদের উদ্যোগে আহুত মুসলিম ইনস্টিটিউটের এক সভায় তিনি কংগ্রেসকে ' নিমজ্জমান নৌকা ' বলেন এবং উহা হইতে সাঁতরাইয়া পার হওয়ার জন্য দেশ - প্রেমিকদের অনুরোধ করেন। কিন্তু আদর্শগত দিক হইতে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত আমাকে বিস্মিত ও মোহিত করিয়াছিল। কংগ্রেস - মুসলিম লীগ - কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক প্রজা পার্টির প্রভাবে ভারতের সকল গণ - প্রতিষ্ঠান যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলিতেছিলেন, তখন কমরেড রায় একাই ফ্যাসি - নাযিবাদকে মানবতার শত্রু ও সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে বড় দুশমন প্রমাণ করেন এবং এই যুদ্ধকে গণযুদ্ধ বা ' পিপলস ওয়ার ' আখ্যা দেন। বিশ্বের একমাত্র সমাজবাদী রাষ্ট্র রাশিয়া হিটলারের সমর্থন করায় আমরা কমরেড রায়ের কথায় তখন বিশ্বাস করি নাই। তাঁর উপদেশ মানি নাই। পরে ১৯৪১ সালের জুন মাসে যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ায়, তখন কমরেড রায়ের কথার সত্যতায় এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় আমার শ্রদ্ধা আকাশচুনী হইয়া গেল। 

১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষক - প্রজা সমিতির সেক্রেটারি ও আইন পরিষদে কৃষক - প্রজা পার্টির লীডার বন্ধুবর শামসুদ্দিন পদত্যাগ করার পর হক মন্ত্রিসভার সহিত কৃষক - প্রজা সমিতির সম্পর্ক আগের চেয়েও তিক্ত হইয়া পড়িল। ফলে আমার পক্ষে হক সাহেবের সহিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যাতায়াত রক্ষা করাও আর সম্ভব রহিল না। ১৯৩৯ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর ইউরোপে মহাযুদ্ধ বাধিয়া গেল। ভারতবাসীর বিনা অনুমতিতে ভারতবর্ষকে ইউরোপীয় যুদ্ধে জড়ানোর প্রতিবাদে সাতটি কংগ্রেসী প্রদেশ হইতেই কংগ্রেসী মন্ত্রী - সভারা ২২ শে ডিসেম্বর পদত্যাগ করিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৩৮ সালে মুসলিম লীগ পীরপুর রিপোর্ট নামে একটি রিপোর্টে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা সমূহের মুসলমানদের উপর যুলুমের ফিরিস্তি প্রচার করিয়াছিল। কংগ্রেসী মন্ত্রীদের পদত্যাগকে মুসলিম লীগ কংগ্রেসী যুলুম হইতে মুসলমানদের নাজাত ঘৈাষণা করিয়া ২৩ শে ডিসেম্বর সারা ভারতে ‘ নাজাত দিবস ' পালন করে। এতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে এবং হিন্দু - মুসলিম সম্পর্ক আরও তিক্ত হইয়া পড়ে। এমন সাম্প্রদায়িক তিক্ততার মধ্যে কৃষক - প্রজা সমিতির অসাম্প্রদায়িক অর্থনীতিক রাজনীতি পরিচালন মুসলমান জনসাধারণ্যে খুবই কঠিন হইয়া পড়িল। তার উপর ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ' পাকিস্তান প্রস্তাব ' গৃহীত হওয়ায় এবং স্বয়ং হক সাহেবই সেই প্রস্তাব উত্থাপন ও তার সমর্থনে মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করায় বাংলার মুসলমানদের মধ্যেও পাকিস্তান দাবির ও মুসলিম লীগের শক্তি শতগুণে বাড়িয়া গেল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সভা - সমিতি ও প্রচার - প্রচারণা অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়সাধ্য হইয়া পড়ায় কৃষক - প্রজা সমিতির মত গরিব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সভা সম্মিলন করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। ফলে কৃষক - প্রজা সমিতির দাবিদাওয়া এবং হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রচার - প্রচারণা কেবল মাত্র সমিতির দৈনিক মুখপত্র ’ ‘ কৃষকে’র পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ হইল।

এখানেই শেষ নয়। ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও ডঃ আম্বেদকর। বই (p.65) সেই সময় হিন্দুদের নিয়ে মুসলিম লীগ কি চিন্তা করছে ভালো করে পড়ুন। আজ অব্দি পাকিস্তানের রাজনীতিতে হিন্দুদের কোনো স্থান নেই। এর পরেও ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার চলে।

[7] “ পাকিস্তান হওয়ার বরং যুক্তি আছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বর্ণ হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা - সাম্যের সুযোগ দেওয়া মোটেও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আর অন্যান্য সংখ্যালঘুদের একত্রে চারটি আসনে সীমাবদ্ধ রাখাও আদৌ যুক্তিসংগত নয়। কারণ এঁদের ( হিন্দুদের ) মধ্যে একটি সম্প্রদায় হল তফসিলী যারা মুসলমানদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অনেক বেশি কাষ্ট হিন্দুদের সঙ্গে তুলনায় মুসলমানদের সমান দাবি যদি যুক্তিযুক্ত হয় তবে তফসিলীদের পক্ষে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত প্রতিনিধিত্বের অন্ততঃ ৫০ ভাগ দাবি করা তো আরও যুক্তিযুক্ত। ” 

[8] শুধু ভারত নয় সমগ্র পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সেদিন ডঃ আম্বেদকরকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সাধুবাদ জানাতে পারেনি লীগ, মিঃ জিন্নাহ্ এবং তাদের বন্ধু মিঃ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। মিঃ জিন্নাহ্ বলেছিলেন, ' আমরা পাকিস্তানের দাবি থেকে এক ইঞ্চিও সরছি না। ' শুধু তা - ই নয়, ঐ সময়ে এক ব্যক্তিগত আলোচনা প্রসঙ্গে আকালি নেতা সর্দার বলদেব সিংহকে সঙ্গে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মিঃ জিন্নাহ্। তাঁকে বলেছিলেন: “বলদেব সিং, এই দেশলাই বাক্সটি দেখছেন তো! এই আকারের পাকিস্তানও যদি আমাকে দেওয়া হয়, আমি তা সানন্দে স্বীকার করে নেব। কিন্তু আমি আপনার সহায়তা - প্রার্থী। আপনি যদি শিখদের মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজী করাতে পারেন তাহলে আমরা এমন এক গৌরবজনক পাকিস্তান পাব যার দেউড়ি খাস দিল্লীতে যদি নাও হয় অন্ততঃ দিল্লীর কাছাকাছি হবে। ”  শিখরা সেদিন মিঃ জিন্নাহ্র প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখান করেছিলেন তা ব্যাখা করার প্রয়োজন নেই। মিঃ জিন্নাহ্ যতদিন কংগ্রেসে ছিলেন ততদিন ধর্ম - বর্ণ - নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর নেতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু যেদিন থেকে ইসলাম ভিত্তিক মুসলিম লীগে যোগদান করলেন যেদিন থেকে তাঁর চিন্তা - চেতনা ও নেতৃত্বের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে গেল। তিনি হলেন কেবল মাত্র লীগপন্থী মুসলমানদের নেতা। (p.66,67)

ভারত ভাগ ছিল একপক্ষ হিন্দুরা যতোটা ভারত ভাগের পক্ষে ছিল। তার থেকেও বেশি ছিল। সেই সময়ের মুসলিম সমাজ তারা গণতান্ত্রিক নয়। মনে মনে ইসলামিক রাষ্ট্রের কল্পনাই করেছিল। সেই বিষয় আর তথ্য প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বর্তমানে সেই দেশে দলিত দের অবস্থা দেখছেন। আর তথ্য দরকার হলে ডঃ আম্বেদকর পাকিস্তান নিয়ে বইটা পড়তে পারেন। সেখানে ডঃ আম্বেদকর লিখেছেন- 

[9] What a Hindu is to a Muslim! To the Muslims a Hindu is a Kaffir. A Kaffir is not worthy of respect. He is low - born and without status. That is why a country which is ruled by a Kaffir is Dar - ul - Harb to a Musalman. Given this, no further evidence seems to be necessary to prove that the Muslims will not obey a Hindu government. The basic feelings of deference and sympathy, which predispose persons to obey the authority of government, do not simply exist. (Pakistan Or The Partition Of India) 

এবং এটা শেষ নয়। ডঃ আম্বেদকর তার বিভিন্ন বইতে লিখেছেন। যে আমি যখন ভারতের দলিত ও অছুত মাহার সমাজ কে এমন একটি ধম্ম কথা বলেছি। তখন মূলনিবাসী মুসলিমরা এর বিরোধ করেছে। তারা বলেছে। আমরা ইসলাম ত্যাগ কে করে অন্য কোনো মতবাদ কে সমর্থন করতে পারবো না। আপনি আমাদের কাছে জীবন চাইলে দিতে পারি। কিন্ত ধর্ম ছাড়তে পারবো না। যতই আমরা লাঞ্ছিত হই না কেন। [ তারপর আমরা জানি ডঃ আম্বেদকর ইতিহাসে সব থেকে বড়ো ধর্মান্তরিত সভা করে। ডঃ আম্বেদকর বৌদ্ধ  ধম্মের এক নতুন শাখা করে তার নাম নববৌদ্ধ যেখানে সবার সমান অধিকার আছে। তাই বলে এই লেখাতে আমি বৌদ্ধ ধম্ম সমর্থন করি না। এবং সংবিধানের সময়ও এটা দেখলো ভারতের মুসলিম সমাজ কতটা কুসংস্কার তথা ধর্মান্ধ।  ডঃ আম্বেদকর লিখেছেন- ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচার হাজার বছরের তার পরেও মুসলিম সমাজ শরিয়ার মতো আঘাতমূলক আইনের চিন্তা করে। যতটা না মনুস্মৃতি আমাদের বঞ্চিত করেছে। তেমনি শরিয়া আইন ও মুসলিমদের আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ডঃ আম্বেদকর আর লিখেছেন। ভারতের মুসলিমরা কোনোদিন ভারত কে ভালো বাসতে পারে না। তার কারণ ইসলাম এর অধিক দেয় না। ভারতের মূলনিবাসী ধর্মের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত তাহলেই ভারতের দলিতরা ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে বিচ্যুত হবে। (Pakistan Or The Partition Of India )

ইতিহাস কোনোদিন শেষ হবে না। ভারতের হিন্দুরা দেখেছেন তারা কি ভাবে বারবার আক্রান্ত হয়েছে। আর Rss এখানেই সেই সময়ের ইতিহাস কে  ব্যবহার করে। নিজেদের অস্তিত্ব শক্ত করেছে। সেই সময়ের ভুল গুলি আজকের Rss ফায়দা দিচ্ছে। আপনারা যতবেশি অসাম্প্রদায়িকতার নামে ইতিহাস কে আলু কে ভাগ করবেন।  Rss সেই আলু দিয়ে ইতিহাসের তরবারি করবে। আমরাই এক ভাবে ভুল ভাবে Rss কে শক্তিশালী করেছে। ভারতে যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদের ফলে মানুষ সাম্প্রদায়িক ও অর্থনৈতিক ভাবে আক্রান্ত তেমনি ইসলামের জন্য বারবার মানুষ আক্রান্ত আর আপনাদের নীরবতা Rss কে শক্ত করে দেয়। মুসলিমদের হাতে অনার কিলিং হলে আপনারা চুপ থাকেন।  আর উচ্ছ বর্ণ হিন্দুদের হাতে দলিত মরলে আপনারা মিছিল করেন। দিনের পর দিন একটি ধর্মীয় সমাজ ভুলের উপর ভুল করলে আপনারা চুপ থাকেন। এখনো চুপ থাকেন। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করেন। যে কাজ Rss এর সেই কাজ আপনারা করে চলেছেন।  ইতিহাস কে আর কত বিকৃত করবেন।  সময় এসেছে সত্য ইতিহাসের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আরব্য সাম্রাজ্যবাদ কে দমানোর....

তথ্যসূত্র 

1 || আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর - আবুল মনসুর আহমদ

2 || MARX NOTES ON INDIAN HISTORY

3 || ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও ডঃ আম্বেদকর - শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস 

4 || Pakistan or The Partition Of India - B.R Ambedkar 

পূজা প্রার্থনা বা নামাজ পড়ে দেশের উন্নতি হয়েছে? -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:814 | likes:2 | share: 2 | comments:0

পূজা প্রার্থনা বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কি পৃথিবীর কোন ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দেশের উন্নতি হয়েছে?  এর প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবে? অনেককে দেখেছি সারা জীবন ভক্তিভরে নিয়ম মেনে পূজা আর্চা করার পর শেষ জীবনে প্রায় ছয় মাস কোমাতে থেকে মারা যেতে। আবার একজন মুসলিম ভদ্রলোককে দেখতাম নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর একদিন ট্রাক চাপা পড়ে হাসপাতালে দুর্বিসহ অবস্থায় কদিন কাটিয়ে মারা গেছেন। তার ছেলে কলকাতার হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে ভিড় ট্রেনের থেকে পড়ে মারা যায়। তাহলে প্রার্থনার ফল কি?

   আমাদের ছোটবেলায় মা বাড়িতে বিপদতাড়িনি ও বিপিনাশিনীর পুজো করতেন প্রতি আষাঢ় মাসে, এছাড়াও নানান ব্রত করতেন। কিন্তু মা মাত্র ৬৬ বছর বয়সে প্রচুর রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন।পুজো করে কি আদৌ কোন ফল হয় বা হয়েছে?  কোনো বিপদ কেটেছে?  আসলে ভগবান থাকেন  ধনীদের গৃহে; সেখানে ধনীর সম্পদ বাড়ান  গুনিতক হারে। আদানি আম্বানি বিড়লা --------- প্রভৃতিদের দেখুন। ওরা পুজো নামাজ প্রেয়ারে  সাধারণ মানুষকে  ডুবিয়ে রাখতে চায়। এতে ওদের দুদিক  থেকেই লাভ  হয়। একদিকে নিজের দ্রব্য বিক্রি আর একদিকে শ্রমিকদের  মধ্যেই ধর্মীয় বিভেদ তৈরী করে  শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার  আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য।  গরিব মধ্যবিত্তরা পুজো ঈদ  বড়দিন বা অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎসবে    যা  খরচ করে তার সিংহ ভাগ ধনীদের কাছেই যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।  নোয়াখালী দাঙ্গার  পরেই ভয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের  মিরসরাই  থেকে  কলকাতায় সেটেল হয়ে   আমাদের এতগুলি ভাইবোনকে মানুষ করতে করতে মা  প্রচণ্ড লড়াই করে ক্ষয়ে গেছেন।  দেশভাগে বিপর্যস্ত উদ্বাস্তু  পরিবারকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে মা অনেকটা দায়িত্ব  নিজের কাঁধে  বয়ে নিয়ে গেছেন। উদ্বাস্তু না হলে উদ্বাস্তু শব্দের  অর্থ  পরিস্ফুট হয়না।  আমাদের জীবনে যা কিছু হয়েছে মায়ের অবদান তাতে সিংহভাগ; বাবা সেই অর্থে সংসার সন্যাসী, সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন  এবং ঠাকুর দেবতা নিয়ে বেশ একটু নির্বিকারই ছিলেন । মা সংসার নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ফলে চরম অনিযম করে  মা মাঝে মাঝে অসুস্থ হতেন, হাসপাতালে ভর্তি হতেন।  কোনোদিন পুরো সুস্থ ছিলেন না। কিন্তু প্রতি আষাঢ় মাসের মঙ্গল ও শনিবার পুরোহিত ডেকে পুজো করতেন ভক্তিভরে  এবং লাল কালো তাগাতে হাত ভরে থাকতো, শুধু তাই নয় বাড়িতে মনসা লক্ষ্মী কার্তিক সরস্বতী  সূর্য পূজা এবং আরো অনেক ব্রত হতো। তাবিজ কবজ  মাদুলিও কম করেননি। কিন্তু মায়ের কোন বিপদ কাটেনি বা  বিপদ নাশ হয়নি। আবার  অসুস্থ হলে মন্দিরেও  হত্যে দিতে যাননি, বারেবার  হাসপাতালেই গিয়েছিলেন।  এইসব দেখে ছোটবেলা থেকেই আমার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছিল। মা আবার  দেওয়ানগাজি  এলাকার পীরের থানেও প্রদীপ জ্বালাতেন, ফল কি?   শূন্য  ঋণাত্মক। আমি বলতাম কবজ তাবিজ মাদুলি বিপদতাড়িনীর তাগা পরেও তোমার বিপদ কাটছেনা; ওসব ছেড়ে দাও। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে অবশ্য সব পূজা আর্চা কবজ মাদুলি তাগা  বাদ দিয়েছিলেন এবং আমাদের বাড়ি সর্বধর্মের  বন্ধুদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আসলে এই রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এবং ভয় অনিশ্চয়  ও  সংশয়ে ভরা।  সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষের নিদারুণ  অসহায় অবস্থা মানুষকে দুর্বল করে দেয় ফলে বিশ্বাস ভয়  মাথায় চড়ে বসে এবং সেই ভয় থেকেই ভক্তি তৈরি হয় এবং তারপর ঐ  ভক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু  হয় পূজার নামাজের  ব্যবসা।গড়ে ওঠে মন্দির মসজিদ গির্জা, তৈরি হয় পুরুত ইমাম  পাদ্রী। আসে রাজনীতি এবং ধর্ম ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে  যায়, মানুষের জীবনকে করে তোলে দুর্বিসহ।  

                             প্রতিটি ধর্ম তৈরির সময় সমাজ ছিল অস্থির অভাবে ভরা এবং মানুষের জ্ঞানও ছিল একদম আদিম স্তরে। প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভয় থেকেই চিন্তা করতে পারা একমাত্র জীব মানুষের ধর্ম জন্ম নিয়েছে । প্রকৃতির আর কোন জীব ধর্মপালন করেনা; সুন্দরবনে হিন্দু বাঘ বা মুসলিম শুয়োর বা খ্রিস্টান হাতি দেখেছেন??। ধর্ম আবিষ্কারের পরেই এটাকে নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা । সবাই নিজের লোক বাড়াতে চেয়েছে ভয় অথবে অস্ত্রের জোরে। মুহাম্মদের মদিনার জীবনী রাজনীতি ছাড়া কি??  রাজানুগ্রহ না পেলে কোনো ধর্মই এমনভাবে প্রসারিত হতোনা । সম্রাট অশোকের সহায়তা না পেলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ হতোনা। গুপ্ত রাজাদের সহায়তা না পেলে হিন্দু ধর্মও পুন:প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল ছিল। সব ধর্মের ইতিহাসই প্রায় এক এবং ধর্মগ্রন্থগুলি  রূপকথা  ভয় লোভ দেখানো ঘৃণা হিংসায় ভরা  রক্তাক্ত। আমিই    ঘোর  নাস্তিক  বোধহয় ভারতের প্রায় সব রাজ্যের অধিকাংশ বড় বড় তীর্থস্থানে ঘুরেছি একফোটা ধর্ম বিশ্বাস না নিয়ে । তবে  ভারতের নামী তীর্থস্থান গুলি প্রকৃতির অপূর্ব জায়গায় স্থাপিত; অমরনাথ কেদার বদ্রী গঙ্গোত্রী  মণিমহেশ হেমকুণ্ড  গোয়ার কিছু গির্জা বা কাশ্মীরের  হজরতবাল মসজিদ  ---সবের পথের শোভা অসাধারণ। সেই পথের  সৌন্দর্যের টানেই ছুটে যাই; দেব দেবীর টানে নয় । কোনো মন্দির মসজিদ গির্জায় বিশেষ স্থাপত্য না থাকলে সাধারণত ঢুকিনা।  যারা প্রচুর পূজা আর্চা করে তাদের অধিকাংশই  গ্রাম ছেড়ে বেরোতে  পারেননি।যারা বেশী  পূজা করে বেশী  নামাজ পড়ে  তাদের দেখেছি অধিকাংশই অসৎ । আবার পাড়ায় অনেককে দেখেছি যারা সারা জীবন ধরে পুজো আর্চা নিয়ে আছে এবং সৎ জীবনযাপন করে তারা গরীব খেতে পায়না  এবং তারা কোনোদিন গ্রামের বাইরে বেরোতে পারেনি। তাহলে এই পূজা প্রার্থনার নীটফল কি শূন্য নয়??

                   কোন ধর্ম পালন না করেও মানুষ সৎ ভাবে বাচতে পারে । অনেক লোককে দেখেছি ধর্মের ধ ও মাথায় না তারা ভীষণ সৎ। আমি কোন ধর্মেই বিশ্বাস করিনা এবং ধার্মিকদের সঙ্গ এড়াই ও পারলে বিরোধীতা করি। বাষট্টি বছর পর্যন্ত লড়াই করে বেঁচে আছি  এবং ভালোই বেঁচেছি, অন্যদের থেকে খুব একটা খারাপও নেই। রোগের কথা যদি বলেন  তবে বলব যারা প্রচুরপূজা আর্চা করে তাদের ঘরে  টিভি ক্যান্সার হয় কেন??। প্রকৃতির সৃষ্ট  মানুষ  আমি প্রকৃতি প্রদত্ত হাত পা মগজ দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে বেঁচে থাকার  চেষ্টা করছি।  চেষ্টা করি সবার পাশে থাকার আর কি? এভাবে চলে গেলেই হয়।

হাজার বছর আগে ইসলামের জন্ম হয়নি -পঙ্কজ কুমার ভাদুড়ী
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:765 | likes:0 | share: 0 | comments:0

৫ হাজার বছর আগে, পৃথিবীতে একটাও মুসলমান ছিলো না। মাত্র দেড় হাজার বছর আগেই, পৃথিবীতে একজনও মুসলমান ছিলো না। অর্থাৎ পাঁচ হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষেও, কোনো মুসলমান ছিলো না। স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু পাঁচ হাজার বছর আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা হয়েছিলো। কাদের মধ্যে হয়েছিলো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ? কৃষ্ণের সময়, দ্বাপর যুগের শেষে, সনাতন ধর্মাবলম্বী একই পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত ভাইয়ে-ভাইয়ে যে যুদ্ধ হয়েছিলো, যে নারকীয় আত্মীয় নিধন, নির্বিচারে আসমুদ্রহিমাচলের মানুষের চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছিলো, তারই নাম কুরুক্ষেত্র। ইগোর লড়াই, ক্ষমতার লড়াই, কুৎসা, ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখলের রাজনীতি, প্রেম, যৌন ঈর্ষা, ব্যভিচার, বহুগামীতা, হত্যাযজ্ঞ- মহাভারত এই, বা হয়তো তার থেকে অনেক, অনেক বেশি কিছু। কিন্তু যাইইহোক, যে রক্তগঙ্গা বয়েছিলো, তাতে মুসলিমদের কোনো হাত ছিলো না।

রাম। আজ যে নামটাকে জপমালা বানিয়ে, ভারতবর্ষ ক্রমশঃ সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠছে- সেই রামের সময়, রামায়ণের সময়ও, ভারতবর্ষে একজনও মুসলমান ছিলো না। প্রায় ৭০০০ বছর আগে, রামের জীবনে কোনো মুসলমান না থাকা সত্ত্বেও, রামকে প্রাসাদ রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের পরিবারকে ফেলে, রাজসুখ ফেলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। একে বলে Palace Ordeals. পৃথিবীতে একজন মুসলমান না থাকা সত্ত্বেও, রামকে স্বধর্ম-স্বজাতির মানুষের হাতে হেনস্থা হয়ে, বনবাসে গিয়ে পর্ণ- কুটিরে থেকে, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, হিংস্র জন্তুজানোয়ারদের মাঝখানে সীতাসহ বসবাস করতে হয়েছিলো। রাজা দশরথ মুসলমান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর তিনজন রানী ছিলেন। এবং তিনি তার লিবিডোর কারনে বলুন, হৃদয়ের দুর্বলতার কারনে বলুন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলুন- সন্তানকে সাপ-শ্বাপদের মধ্যে, দৈত্য-দানো, রাক্ষসখোক্ষসের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন। 

পার্টিসানের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মিলে, তৈরি হলো একটা রাষ্ট্র। দুটো দেশই তৈরি হলো মুসলমানদের জন্য। ভারতের মূল ভূখণ্ড হিন্দুদের। পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মুসলমানদের। কিন্তু ধর্মের মিল কী তাদের এক দেশ, এক জাতি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো? পারলো না। ধর্মীয় ঐক্য বলে আদৌ যদি কিছু থাকে, তা একটা প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিয়ে কিছুকাল বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রতিপক্ষ সরে যাওয়ার পর, ধর্মীয় ঐক্য ভূলুন্ঠিত হতে দশ মাস সময় লাগে না। ইতিহাস কি দেখাচ্ছে আমাদের? মুসলমানকে মুসলমানের হাতে তুলে দিয়ে, কি হলো তার পরিণতি? ৩০ লক্ষ হত্যা। ৭ লক্ষ নারী ধর্ষণ। একটা এমন মুক্তিযুদ্ধ, যার স্মৃতি এখনো গোটা বাংলাদেশকে তাড়া করে বেড়ায়। মুসলমান মানেই তার মানে, মুসলমানের রক্ষাকর্তা নয়! মুসলমান মানেই তার মানে, মুসলমানের মান-সম্মান, ধন-প্রাণের জিম্মি নয়! মুসলমানও মুসলমানের দুঃস্বপ্নের কারন হতে পারে। 

নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, শরীর-মন জড়িয়েমড়িয়ে কি যে একটা ব্যাপার হয়। কিন্তু আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায় কেমন। হিন্দু ছেলে, হিন্দু মেয়ে। তাও ডিভোর্স হয় কেনো? মুসলিম ছেলে, মুসলিম মেয়ে। তাও তালাক হয় কেনো? তার মানে হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই, এক সঙ্গে থেকে যাওয়ার একমাত্র ক্রাইটেরিয়া নয়? হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই, সম্পর্কে টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা নয়? ধর্ম এক হওয়ার পরও, এতো বিরোধ তৈরি হয়? ধর্ম এক হয়েও, এতো বিশ্বাসঘাতকতা করে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে? এতো ক্ষতি করে? এতো আঘাত দেয়? দেয়। কারন ধর্মের মিল আসলে একটা মিথ্যে মিল। সাজানো ব্যাপার। ধর্মের মিল বলে আসলে কিছুই হয় না। ধর্মের মিল মনের মিল তৈরি করতে পারে না। 

একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, সমস্ত জীবনে যতোবার অপমানিত হয়েছি, যতোবার প্রবঞ্চিত হয়েছি, যতোবার আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেছে, যতোবার আমার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যতো অন্যায় হয়েছে আমার সঙ্গে, অফিসে, কলেজে, কোর্ট-কাছারিতে, বাসে-ট্রামে, পুলিশ স্টেশনে, পরিবারের ভেতরে-বাইরে, সমস্ত খারাপ ব্যবহার, যাবতীয় অসভ্যতা, কূটকচালি, নোংরা সম্ভাষণ - যা যা সহ্য করতে করতে আমাকে পথ চলতে হয়েছে, সব কিছুই কি আমার কাছে মুসলিমদের কাছ থেকেই এসেছিলো? তাই কি আসে? নাহ! মুসলমানরাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, এই একই প্রশ্ন করুন নিজেকে। দেখবেন উত্তর হবে একই। না। না। আর না। দেখবেন আপনার চারপাশের যে মানুষগুলোর ব্যবহারে কান্না গলায় এসে আটকে গেছে, তারা সবাইই হিন্দু নয়।

৭০০০ বছর আগেও ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিলো না। আজও নেই। পরেও থাকবে না। ক্ষমতা, অর্থ, ধনসম্পত্তি, নারী- এসব নিয়ে মানুষে মানুষে ক্ষমতা দখলের প্রলয় চলবেই। তারপরও শুধু রাজনীতি পয়েন্ট আউট করে দেবে, Hindu's enemy Muslim, Muslim's enemy Hindu। 


আজ একজন ধার্মিক মানুষের জীবন নিয়ে কিছু বলবো আমি। তিনি শুধু একজন ধার্মিকই নন, তিনি এই সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। লাহোরের ফজল মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন তিনি। মসজিদের ঈমাম সাহেব লক্ষ্য করতেন তিনি খুতবার সময়টিতে প্রায়শই কি যেনো লিখছেন তাঁর একটা নোটবইয়ে। ঈমাম সাহেব পরে জেনেছিলেন, তিনি আসলে সেই নোট বুকে খুতবা থেকে পাওয়া ইসলামী বয়ান লিখতেন না, তিনি লিখতেন ফিজিক্স এর সম্ভাব্য এক্সপেরিমেন্টস গুলো যা তাঁর মাথায় আসতো, যেনো ভুলে না যান তাই লিখে রাখতেন।

তাঁর ঘরে সব সময় থাকতো একটি কুরআন, কয়েক হাজার গানের লং প্লে রেকর্ড আর তার চাইতেও বেশী সংখ্যক বই।

ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা কে "ষ্টুপিড আইডিয়া" বলতেন তিনি। কেননা দুটি সম্পূর্ণ দুই মাত্রার বোঝাপড়ার বিষয়। একটি পদ্ধতিগত আরেকটি নিছক ব্যক্তি মানুষের। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত নিয়ে চিন্তা করার চাইতেও তাঁকে পিড়িত করতো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় একশো বছরেও কেনো একজন গনিতের পিএইচডি তৈরী করতে পারলোনা সেই অপমানজনক গ্লানি।

তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন - পারটিকল ফিজিক্স এর "ক্ল্যাসিক্যাল মাইন্ড"দের একজন। তিনি নোবেল পুরুস্কার জিতেছিলেন। তিনি তাঁর নোবেল পুরষ্কার টি দান করেছিলেন শিক্ষা খাতে। তাঁর সাথে আরও দুজন নোবেল পেয়েছিলেন তাঁদের একজন প্রফেসর ওয়েইনবারগ বলেছিলেন - "আমি কখনই তা করবোনা, আমারটা আমি রেখেছি ব্যাংকে"। ভারতে তাঁর অসুস্থ ও শয্যাগত শিক্ষকের হাতে নোবেল মেডেলটি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, গুরুজি এই নোবেল আসলে আপনার পাওনা, কেননা আপনিই আমাকে গনিত শিখিয়েছিলেন।

এই স্কলারের ব্যক্তি জীবন কে তছনছ করে দিয়েছে পাকিস্তানের সুন্নী মুসলমানেরা, জামাতে ইসলামী, জুলফিকার আলী ভুট্টো আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এর শাসনকাল। সংগঠিত ধর্ম কতটা অন্ধ, ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার নজির হচ্ছে এই ধার্মিক মানুষটির পাকিস্তান ত্যাগ আর হাজার হাজার কাদিয়ানীদের উপরে নেমে আসা সুন্নী নিপীড়নের ইতিহাস। সূন্নী মুসলমানেরা তাঁর কবরের এফিটাফ থেকে "মুসলিম" শব্দটিকেও হাতুড়ী দিয়ে ভেঙ্গে মুছে দিয়েছে।

অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষ কতো বিচিত্র ভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মোকাবিলা করে তার হাজারটা উদাহরনের একটি হচ্ছে এই মানুষটির পেশাদার জীবন।

এই লেখাটির সময় মাথার ভেতরে ঘুরছিলো বুয়েটের ছাত্রটিকে নিয়ে করা তসলিমা নাসরিনের মন্তব্যগুলো......... ছিঃ ছিঃ বুয়েটে পড়ে "নামাজ পড়ে" তাহলে সেকি "বিজ্ঞান মনস্ক"? পরে নিজেকেই বোঝালাম ... কিসের মধ্যে কি নিয়ে আসছি আমি... বরং এই মহান মানুষটিকে নিয়েই ভাবি।

কেইমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট জন হলের লম্বা করিডোরের মাঝে মুখোমুখি আছেন - কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ ও এই মানুষটি, যাঁর নাম প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুস সালাম। সব কিছু ছাপিয়ে এটাই হয়ে থাকবে ইতিহাস।

না শুধু ছবি নয়, আরেকটি বিরাট প্রতিষ্ঠান সালামের "বিউটিফুল মাইন্ড" কে বয়ে নিয়ে যাবে ইতিহাসে, সেটা হচ্ছে ইতালীর ত্রিয়েস্ত শহরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিটিপি (ICTP)।

তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিলো অনগ্রসর দেশগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের উন্নত বিশ্বের গবেষণার সাথে যুক্ত করা।

তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রধান উন্নত দেশ বলে দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেইন এই প্রত্যেকটি দেশ এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলো। এদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো একটি "অপ্রয়োজনীয়" উদ্যোগ।

সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশিকতা কেবল দেশ দখল করেই হয়না, আরও অসংখ্য উপায়ে হয়। বোঝার জন্যে শুধু দরকার আমাদের বোধ আর কিছু তথ্য।

মানুষ অমর হন তাঁর কাজ দিয়ে। ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। মানুষ "বিচার" করা উচিত তাঁর কাজ দিয়ে, ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। কেননা এই মানুষটি ও জিয়াউল হক দুজনেরই ধর্ম বিশ্বাস ইসলাম।

বিস্মৃতির অন্তরালে: অক্ষয়কুমার দত্ত -পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:889 | likes:2 | share: 1 | comments:0

গভীর রাত। এক তিনতলা বাড়ির ছাদে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছে। তবে তা নিচু গলায়। স্বামী ভদ্রলোকটির কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। যুবকটির ‘অপরাধ’, তিনি স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী নন। এই গভীর রাতে বাড়ির ছাদে বসে তিনি এক 'খগোল' যন্ত্র নিয়ে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছেন। জ্যোর্তিবিজ্ঞান তাঁর প্রাণের বিষয়। আকাশ জুড়ে সারা রাত যে মহাজাগতিক বিস্ময়ের ঘটনা চলতে থাকে, সে সবের সাক্ষী থাকতে হলে যে রাত ছাড়া উপায় নেই! বিরক্ত, ক্ষুব্ধ স্ত্রী ছাদে উঠে এসেছেন আজ। এমন লোক কে দেখেছে, যে দুই প্রহর-আড়াই প্রহর রাতে স্ত্রীর শয্যা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে! এ তো সামান্য বিড়ম্বনা নয়! উত্তরে যুবকটি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এমন লোকের স্ত্রী এরূপ কথা বলে, তা যে আরও বড় বিড়ম্বনার।”


খগোল-যন্ত্র হল 'দূরবিন'। পারিভাষিক শব্দ 'দূরবীক্ষণ'। এই নামটি দিয়েছেন রাত-জাগা ওই যুবক - অক্ষয়কুমার দত্ত। বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের ক্ষেত্রে আরও অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন তিনি। যেমন, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি। এগুলি নমুনা মাত্র। তালিকাটি দীর্ঘ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে পথ দেখিয়েছিল এই পরিভাষা।


আধুনিককালের প্রগতি ভাবনা সম্পর্কে আমাদের সবারই কমবেশি ধারণা রয়েছে। কাজেই বিস্তারিত আলােচনার প্রয়ােজন নেই। রাজা রামমােহন রায়ই ঊনিশ শতকের গােড়ায় গােটা ভারতে নতুন যুগের প্রবর্তক, প্রথম প্রগতিবাদী মানুষ। তার ব্যক্তিত্ত্ব ও বৈষয়িক জীবনে নানা অসংগতি থাকলেও বিদ্যায়-বিত্তে-জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় তিনি তাঁর সমকালের প্রথম সারির যে কোনাে প্রাগ্রসর চিন্তাসম্পন্ন ইউরোপীয় নাগরিকের সমকক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবযুগের উদ্গাতা, দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাবিদ। প্রগতিশীল যুক্তিবাদের আরও প্রসার ঘটে লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রভাবে ও প্রচারে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। শাস্ত্রিক সামাজিক লৌকিক বিধাসসংস্কার থেকে মুক্তি ছিল তাদের জীবনে নবলব্ধ যুক্তিবাদের অবদান। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রগতিশীলতা আমরা খুব একটা স্বীকার করি না বটে, কিন্তু তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন যে, সাহিত্য বিনোদনের বস্তু নয়, জাতীয় জীবনবিকাশের ভিত্তি ও অবলম্বনও। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তিনির্ভর জ্ঞানমনস্কতা, যা তাঁর প্রগতিশীলতার এবং পাশ্চাত্য প্রভাবিত প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনারই উজ্জ্বল নিদর্শন। বিদ্যাসাগরেরই সমবয়সী অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন আর একজন জিজ্ঞাসুদ্রোহী।


অক্ষয়কুমার দত্ত একাধারে গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, বাংলা গদ্যের রূপকার, দার্শনিক, ফলিত বিজ্ঞান গবেষক, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, ধৰ্মীয় ছুঁতমার্গহীন মানুষ। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক,তত্ত্বানুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমান মানুষ। সমকালীন বিশ্ব মানসিকতা তাঁর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। অগস্ত্যত কোঁৎ-এর প্রত্যক্ষবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা, এমনকি হারবার্ট স্পেন্সারের সংশয় বা অজ্ঞেয়তা পর্যন্ত তাঁর চিত্তে প্রতিফলিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠোর নীতি পরায়ণ, বিনয়ী এবং দরিদ্রের প্রতি দয়াশীল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন, “তিনিই বাঙালির সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক।” মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র রূপে তাঁর অকৃত্রিম দানেই গড়ে উঠেছিল আজকের 'ইন্ডিয়ান আ্যসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স'। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ। তাঁর শয়নশিখরে থাকত ডারউইন ও নিউটনের প্রতিকৃতি, ঘরের দেওয়ালে থাকত জ্যোতিষ্ক-লেখা গগনপট, নরকঙ্কাল, এবং পশুপঞ্জর (জাস্টিস সদাচরণ মিত্রের ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শনে প্রদত্ত বিবরণ)। 


বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলেন অক্ষয়কুমার। পিতা পীতাম্বর দত্ত এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার। তাঁর পিতা কোলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র্য-দশার ভিতর প্রতিপালিত হয়েছেন। এরপর তিনি অর্থোপার্জনে উদ্যোগী হন। কিন্তু পাশাপাশি অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।


ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। তখনও বিদ্যাসাগরের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই সেই ভাষার নমুনা: ‘পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।’ 


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আগস্ট ১৬, ১৮৪৩ তারিখে তাঁর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। রচনাসম্ভারে ও পরিচালনার গুণে পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, ভূগোল,  ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার, বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-বিধবাদের বিবাহের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখাও এতে প্রকাশিত হত। সচিত্র প্রবন্ধও থাকত। নীলকর সাহেব ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি এই পত্রিকায় নির্ভীকভাবে লেখনী চালনা করেন। দীর্ঘ বারো বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।


হিন্দু বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, ‘ছন্দের জাদুকর’ পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’


‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান ও ভূগোলের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুব রেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, পরিমিতি, জড়, জোয়ার, রামধনু, ধ্রুবতারা, গ্রহণ, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, সৌরজগত, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয় দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনও বহমান। 


অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ২১ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম। অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরোপাসনার তিনি অন্যতম প্রবর্তক। পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন। ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য, প্রচলিত পথের বাইরে হাঁটার জন্য তৎকালীন সমাজপতিরা  তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা করেন ও কিছুক্ষেত্রে সফলও হন। 


হিন্দু হোস্টেলের এক দল ছাত্র অক্ষরকুমারকে ঈশ্বর-প্রার্থনার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করল। তিনি বীজগণিতের সমীকরণ দিয়ে দেখালেন: পরিশ্রম=শস্য। পরিশ্রম+প্রার্থনা=শস্য। অতএব, প্রার্থনা=শূন্য। ছাত্ররা এই উপস্থাপনার নাটকীয়তায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। তাদের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এই সমীকরণ। শিক্ষিত মহলেও আলোড়ন উঠল। এই ঘটনার দু’দিন পর মেডিকেল কলেজের ‘ডিমনস্ট্রেটর’ বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের দেখা, নীলমাধববাবু হাসতে হাসতে বলিলেন, ‘‘আপনি ভাল এক সমীকরণ দিয়া শহরটা তোলপাড় করিয়া দিয়াছেন।”


অক্ষয়কুমারের একটি বইয়ের জন্য স্কুলে আগুন লাগাতে চেয়েছিল কিছু লোক। ঢাকার বিক্রমপুরের ঘটনা। ১৮৫১ সাল। সদ্য বেরিয়েছে ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ বইটি। বিক্রমপুরের কালীপাড়া স্কুলের এক দল ছাত্র বই পড়ে মুগ্ধ। দেড়শো বছরেরও আগে সেই বইয়ে অক্ষয়কুমার লিখছেন: "বিবাহের আগে হবু দম্পতি পরস্পরের সঙ্গে ভাল ভাবে আলাপ-পরিচয় করে নেবে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য যেন বেশি না থাকে। সংসারে নারী ও পুরুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব সমান। যদি স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং সমাধানের কোনও পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ কাম্য।"


তোলপাড় পড়ে গেল সর্বত্র। কালীপাড়া স্কুলের কিছু ছাত্র সভা করে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করলেন: ‘আমরা এই পুস্তকে লিখিত বিবাহাদির নিয়মসকল অবলম্বন করিব।’ ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মহলে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলবাড়িটাই পুড়িয়ে দেবেন। তবে এই হুমকিতে অগ্রণী ছাত্রদের প্রতিহত করা যায়নি। অনেকেই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন সে দিন। অক্ষয়-জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন: “উপস্থিত বৃত্তান্তটি সঞ্জীবনী-পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি ঐ সময়ে ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন।” দ্বারকানাথের উপরেও এর প্রভাব পড়েছিল। তাঁরা কুলীন ছিলেন, পরিবারে প্রায় সবাই বংশানুক্রমে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে বিবাহ করতেন। দ্বারকানাথ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জানিয়েছিলেন, “আমি এক বই দুই বিবাহ করিব না।”


অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। দেড়শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন, ‘কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনুকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যাখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।’


তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানচর্চা সুগম হবে মাতৃভাষায়। সাবলীল হবে অভ্যাস। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরেই বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। এমনকি বাংলাভাষাকে তিনি  বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী, দর্শনচর্চার এতটা  উপযোগী করেছিলেন যে অনেক সময় মনে হয় বিদ্যাসাগরের চেয়েও তিনি কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। পাশ্চাত্যী বেকনীয় দর্শনের অন্যতম গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। তিনিই প্রথম  অফিস-আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনি প্রথা ভেঙে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। 


অক্ষয়কুমার দত্ত বিশেষ করে আমাদের যে ঐতিহ্য সেটা নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন সবটাই আমাদের ধর্মের ঐতিহ্য নয়। আমাদের দেশে যুক্তিবাদের ঐতিহ্য ছিল, নিরীশ্বরবাদের ঐতিহ্য ছিল। যেটাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলছি তারমধ্যেই একটা বড়ো অংশ অনিশ্বরবাদ নিয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন যেগুলি খোলাখুলি ঈশ্বরবিরোধী ছিল।


‘তত্ত্ববোধিনী’ সম্পাদনার অমানুষিক শ্রম থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিলেন। একটা মাস-মাইনে তো প্রয়োজন। কিন্তু এই কাজটাও করতে পারলেন না। বছর না ঘুরতে ছেড়ে দিলেন অধ্যক্ষের চাকরি। অসুস্থতার খবর পেয়ে জার্মানি থেকে ম্যাক্সমুলার চিঠি লিখেছেন অক্ষয়কুমারকে। ১৮৮৩ সালের ৩১ অগস্ট লেখা চিঠিতে উদ্বেগ: ‘আপনার অসুস্থতার খবর শুনে খুব দুঃখিত। আশা করি আপনি অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারবেন।’


অসুস্থতা নিয়েই করেছেন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটির কাজ। হিন্দু ধর্মের নানা শাখাপ্রশাখা, নানান সম্প্রদায়, বিচিত্র আচরণ। অন্যান্য ধর্মও খুব ব্যতিক্রম নয়। এমনই ১৮২টা সম্প্রদায়কে নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি প্রকাশ্যে ভাববাদী চিন্তাকে আক্রমণ করেছেন। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণকে মানসিক রোগ বলতেও ছাড়েননি। সব থেকে বড় কথা, এই বইয়ের অনেকটাই তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। রোগ-অসুখ তাঁর নিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এক দিন গাড়িতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পথে এক ধাঙড়কে দেখতে পেয়ে অক্ষয়কুমার গাড়ি থামাতে বললেন। মানুষটি তাঁর পূর্বপরিচিত। ইতিমধ্যে আরও কয়েক জন ধাঙড় সেখানে এসে উপস্থিত। গাড়ি থামিয়ে তাঁদের কাছ থেকে অক্ষয়কুমার শুনলেন ধাঙড় সমাজের রীতিনীতি, দেবদেবীর পূজার্চনার বৃত্তান্ত। এ কথা-সে কথায় অম্বিকাবাবুও দু-একটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ধাঙড়রা তাঁকে উত্তর দেবে না। অক্ষয়বাবুকে এত খাতির কেন? এক ধাঙড়ের উত্তর: “উনি আমাদের দেশে গিয়াছিলেন, উনি আমাদের (জাতের) ভেদ মারিয়াছেন।”


ক্ষমাপ্রার্থনা করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। আলাদা আলাদা সময়ে তিনটি পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়: ১২৯০ বঙ্গাব্দের ১১ বৈশাখ ‘সোমপ্রকাশ’-এ, ১২৯১-এর ৮ বৈশাখ ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় এবং ১৮৮৫-র ১০ জুন ‘নিউজ় অব দ্য ডে’ সংবাদপত্রে। অনুরাগীরা তাঁকে নানান বিষয়ে চিঠি লিখতেন, তিনি অসুস্থতার জন্য উত্তর দিতে পারতেন না। মনে মনে গ্লানি বোধ করতেন। তাই এই ক্ষমাপ্রার্থনা। আর একটি ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ অবশ্য বেশ মজার। “আমার এক ভৃত্য গত শুক্রবার প্রাতঃকালে স্বর্ণালঙ্কারে ও নগদে প্রায় আড়াইশত টাকা হরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। যে ব্যক্তি তাহাকে বমাল সহিত ধরিয়া দিতে পারিবে তাহাকে উচিতমত পারিতোষিক প্রদান করা যাইবেক।” ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এ ১২৬০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে গয়নার বিবরণে আছে: হেলে হার ১ ছড়া, কণ্ঠমালা ১ ছড়া, বাজু ২ খানা, বালা ৪ গাছা।


অক্ষয়কুমার দত্ত শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারতেন না। ফলে তাঁর সামাজিকভাবে উপস্থিতি ক্রমশ কমে আসছিল। সেটা অবশ্য সাপে বর হয়েছিল। প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকরি করা থেকে বিরত হন। কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইছিলেন। ১৮৫০ এর দশকে তিনি বালিতে জায়গা দেখে বাড়ি করে থাকতে শুরু করলেন। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটি বছর (১৮৫৬-১৮৮৬) তিনি বালিতে কাটান। আজ দেওয়ান গাজী তালায় যেটি ‘হরমিলার ডক’ বলে পরিচিত, সেটি তাঁর শেষ জীবনের বসতবাড়ি। লাগোয়া জমিতে তৈরি করলেন ‘শোভনোদ্যান’- উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্র। অক্ষয়কুমার রচিত তিন খণ্ড ‘চারুপাঠ’ ছাত্রমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তাই বিদ্যাসাগর এই উদ্যানের নাম দিয়েছিলেন ‘চারুপাঠ চতুর্থ ভাগ’। বাড়ির ভিতরেও তৈরি করেছিলেন একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। সেখানে ছিল বিভিন্ন যুগের প্রস্তরখণ্ডের নমুনা, ফসিল, প্রবাল প্রভৃতি। শরীর সঙ্গ দিত না, তবু কলকাতা জাদুঘরে বা শিবপুর বোটানিক্যাল উদ্যানে যেতেন নিয়মিত। জাদুঘরে লাঠি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বলে সঙ্গীর কাঁধে ভর রেখে চলতে হত। সঙ্গীর হাতে থাকত বই। সেখানে ছাপা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু।


৩৮ রকমের বৃক্ষ, ১৫ রকমের ফুল বা সুদৃশ্য নানা গাছ, ১৬ রকমের মশলাজাতীয় গাছের কথা পাওয়া যায় নানা জনের বিবরণে। নিরিবিলি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বালির বাড়িতে বসে নিরলস গবেষণার ভিত্তিতে আমৃত্যু যে কাজগুলো করে গেছেন সেগুলো আমাদের অক্ষয় ঐতিহ্য, অমূল্য ঐতিহ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা তাঁকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিইনি, আজও দিচ্ছি না। তিনি যে সময় কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তখন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না এইসব কাজ করার।


বালির বাড়িতেই একা, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন ‘ধর্ম্মনীতি’র লেখক। পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও রামচন্দ্র রায় তাঁর দেখাশোনা করতেন। ১৮৮৬ সালের ১৮ মে জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্ত ছেষট্টি বছর বয়সে যখন প্রয়াত হন, তখন তাঁর পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চার বছর বয়স। এই সত্যেন্দ্রনাথই পরে বাংলা কবিতায় ‘ছন্দের জাদুকর’ বলে খ্যাত। পিতামহকে ‘হোমশিখা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘বঙ্গীয় গদ্যের গৌরবস্থল/ আমার পূজ্যপাদ পিতামহ…।’


চিনি, ময়দা, সুতার কল, কাগজের কল, টাঁকশালে যেতেন অক্ষয়কুমার, যন্ত্রবিজ্ঞান কী ভাবে কাজ করে দেখবেন বলে। সমুদ্রভ্রমণে গিয়ে দূরবিন চোখে পৃথিবীর গোলাকৃতির পরীক্ষা করতেন, জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করতেন নানা দেশ নিয়ে। ইচ্ছে করে বারবেলা, কালবেলা, কালরাত্রি, অশ্লেষা, মঘা, ত্র্যহস্পর্শ প্রভৃতি ‘অশুভ’ দিনক্ষণ দেখে ভ্রমণে বেরোতেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা’র শরিক হতেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও জানতেন সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, ফরাসি ভাষা। বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা ছাড়াও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান, বিবর্তনতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ভারতের পুরাতত্ত্বের চর্চা করেছেন।


নিরিবিলিতে বালির বাড়িতেই রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন এই অসাধারণ বইটির জন্য অক্ষয়কুমার দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বইয়ের দুটি খণ্ড এই বাড়িতে বসেই তিনি লেখেন। প্রথম খণ্ড ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয় খণ্ড তেরো বছর পর ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। 


অক্ষয় দত্তের এই একখানা মাত্র বই কালের অবলেপন এবং উত্তরসূরিদের অবহেলার কবল থেকে বেঁচে গেছে। আমাদের কাছে তাঁর প্রদত্ত ‘অক্ষয়’ সম্পদ হয়ে টিকে থেকেছে। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস মানে তো ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ইতিবৃত্ত বর্ণন। মনে হয়, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় শব্দটি বাদ দিয়ে উপাসক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত খুব কম নয়। তিনি হাত দিলেন একশ বিরাশিটি সম্প্রদায়ের কাহিনিতে। পুরোটাই তিনি একা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে করে সম্পন্ন করেছেন। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে অনেক রকম তথ্য পেয়েছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন, বুঝেছেন। তবে লিখেছেন। এই কারণেই ভারতীয় সমাজ তথা ধর্মীয় সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাপেক্ষে বইটির আজও একটি আকর গ্রন্থমূল্য আছে। 


আরও লক্ষণীয়, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানলেখক অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম বইটিতে ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র ধর্মসংস্কৃতি বিশিষ্ট মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের পরিশ্রমজাত ও বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দ্বিতীয় বইতে তিনি তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বিচার, ভারতীয় চিন্তাশীলদের বিভিন্ন দার্শনিক মতের পরিচয়, পারস্পরিক তর্কবিতর্ক খণ্ডন-বিখণ্ডন, ভারতীয় প্রাচীন মনন-ঐতিহ্যে নিরীশ্বরবাদ এবং বস্তুবাদের নানা শাখার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভারত গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ভাষা তথা অন্য নানা বিষয়ে সাদৃশ্য, ইত্যাদি বহু চিত্তাকর্ষক বৌদ্ধিক উপকরণ তুলে ধরেছেন। এখানে আছে শুধু যুক্তিবাদী বিচারধারা নয়, যুক্তিবাদের মননশীল ফসল। এতে পাওয়া যায় শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আবাহনী নয়, আগমনি নয়, তার পাশাপাশি আমরা পাই সমাজ সংস্কৃতি ভাষা দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অখণ্ড বিজ্ঞানমানস প্রয়োগের ফলস্বরূপ এক উৎকৃষ্ট বিচারপদ্ধতি ও অভাবিতপূর্ব সিদ্ধান্তরাশি। প্রথম বই শেখায়, কোনো একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে কীভাবে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয় বই থেকে শেখা যায়, কোনো একটা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘপ্রচলিত বিভ্রান্তিগুলিকে কীভাবে কাটানো যায়। বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন ও মুক্তমন অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন এইভাবে: “এখন বেদপ্রাণ হিন্দুমণ্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদমন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।” ম্যাক্সমুলার এই বইটি সম্বন্ধে জেনে অক্ষয়কুমার দত্তকে প্রসংসাসূচক চিঠি লেখেন। 


আসলে অক্ষয়কুমার আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন বিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ, জীবন এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি, তার নিগুঢ় তত্ত্বগুলি। তার জীবনী এবং রচনা সংগ্রহের সংকলক এবং ‘অক্ষয়-সুধা’ (১৯২৪) নামের পুস্তকের রচয়িতা শিবরতন মিত্র যা বলেছেন, বােধহয় সেটাই অক্ষয়কুমার সম্পর্কে এবং তার বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা। তিনি উপরােক্ত পুস্তকের ‘অক্ষয়কুমার দত্ত ও বঙ্গসাহিত্য’ শিরােনামে লিখেছেন, “অক্ষয়কুমার প্রধানত বৈজ্ঞানিক। আজ ইংরেজ জাতি, জৰ্ম্মাণ জাতি, ফরাসী ও মার্কিণ জাতি বৈজ্ঞানিকতায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকতার প্রতিভা একদিনে হয় নাই। বৈজ্ঞানিকী বুদ্ধির অনুশীলনে, ইংরাজ জাতিকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য মনীষী বেকন হইতে জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত মনীষীগণ কি কঠোর তপস্যা এবং কি ভীষণ সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। ...এই মানুষকে প্রত্যক্ষ্য স্কুল ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ব্যাপার সমূহ পর্যবেক্ষণ করাইয়া অধ্যবসায় সহকারে সেই সমুদায় বিষয়ের শ্রেণীবিভাগ করিবার সহিষ্ণুতায় দীক্ষিত করিতে বেকনকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। আজ ইংরাজ যে গৌরবান্বিত, তাহার কারণ এই বৈজ্ঞানিকতা। অক্ষয়কুমার আমাদের দেশে এই বৈজ্ঞানিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য তপস্যা করিয়াছিলেন এবং সেই কঠোর তপস্যায় আত্মবিসৰ্জন করিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিকের যাবতীয় লক্ষণ অক্ষয়কুমারের চরিত্রে পরিদৃষ্ট হয়।”


'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' প্রাপক গবেষক আশীষ লাহিড়ী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি যদি ইংরেজিতে তর্জমা করা যেত তবে প্রমাণ করা যেত তাঁর চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্য অন্যদের থেকে কতযুগ এগিয়ে ছিল। সেটা সামাজিক দিক থেকে, দার্শনিক দিক থেকে, ইতিহাসের দিক থেকে এমনকি সাহিত্যগত দিক থেকে। বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অক্ষয়কুমার দত্ত গবেষক সাইফুল ইসলামের কথায়, 'আমরা যা কিছু আত্মসাৎ করতে পারি না তা ভস্মসাৎ করার চেষ্টা করি। ওনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ওনার পাণ্ডিত্য, অকাট্য যুক্তির জন্য তৎকালীন বঙ্গসমাজ ওনাকে আত্মসাৎ করতে পারেনি।'


৩৬৭, জিটি রোড, বালি, হাওড়ায় তাঁর সাধের শোভনোদ্যান বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়, অন্তিম দশা। আজ অবধি কোনো দেখভাল, সংরক্ষণ হয়নি। যদিও ২০০৬ সালে তদানীন্তন রাজ্য সরকার ‘হেরিটেজ’ -এর একটি ফলক লাগিয়েই তার দায়িত্ব সম্পাদন করেছে। বর্তমান সরকারও উদাসীন। এখন বাড়িটির অবস্থা করুণ। অতিসত্বর আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বহু স্মৃতিবিজড়িত বর্তমানে জরাজীর্ণ বাড়িটিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে অক্ষয়কুমার দত্তের কাজের উপর একটা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীরই উপকার হবে।


বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক। অর্থাৎ তাঁরও দুশো বছর পূর্ণ হল। ২০২০ সালের, ১৫ জুলাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ ও প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সকল কারণে আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন ঠিক একই কারণে বা তার চেয়েও বেশি কারণে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু এই মহান মনীষীর আদর্শ, চিন্তাধারা, অক্ষয় কাজ কোন কিছুই আমরা সঠিক মূল্যায়ন করিনি। আজও করছি না।


বাঙালি তাঁকে খুব যে মনে রেখেছে, বলা যাবে না। অবশ্য ঘটা করে প্রতি বছর তাঁর ছবিতে ফুলচন্দন দিলে বা পঞ্চধাতুর মূর্তি স্থাপন করলেও খুব কিছু এসে যেত না। বেঁচে থাকতেই ভাববাদের উল্টো পথের এই একলা পথিক লিখেছিলেন: ‘যদি বা আমার কীর্ত্তি স্থায়ী হয়, কিন্তু আমি তো চিরস্থায়ী নই।… মৃত্যুর পরে আমি সে কীর্ত্তি ঘোষণা শুনিতে আসিব না।’


ধর্মতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞান পর্যন্ত যে দীর্ঘপ্রকার জ্ঞানভূমির মধ্যে ছিল তাঁর অনায়াস পদচারণা, বাঙালি পাঠককে হাত ধরে সেই জ্ঞানজগতের সিংহদ্বারে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাছে আধুনিক ভারতবাসীর ঋণ অপরিশোধ্য। মাতৃভূমি থেকে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কদাচার ও দুর্বলতা দূর করাই ছিল অক্ষয়কুমার দত্তের ব্রত। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন ভারতের যুক্তিবাদীরা এযাবৎ অক্ষয়কুমার দত্তকে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে সামনে তুলে আনার প্রয়াস করলেন না? বিনয় ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখর ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এত ভালো ভালো কাজ আছে, অথচ তাতে অক্ষয়কুমার দত্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেলেন না কেন, “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” বইটি কোন জায়গা আদায় করতে পারল না কেন - মনে জাগে বিস্ময় প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে বাঙালিদের চিন্তা জগত থেকে তিনি কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অক্ষয়কুমার দত্তের আদর্শ ও দর্শন খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধবিশ্বাসের যাঁতাকলে অনেকক্ষেত্রে আমরা আলোর থেকে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছি। এটা যদি ঠেকাতে হয় তবে সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার আমাদের কাছে অক্ষয়কুমার দত্ত।           


★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, দীপক সাহা - আপনপাঠ ওয়েবজিন, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (১ম খণ্ড), গবেষক আশীষ লাহিড়ী, গবেষক ও শিক্ষক অর্ণব চ্যাটার্জি, শিবপ্রসাদ মিত্র, শিক্ষক অনু বর্মন, সাহিত্যিক কুশল মৈত্র, সুকুমার সেন - 'বাংলার সাহিত্য ইতিহাস', সাহিত্য অ্যাকাদেমি, নতুন (পৃঃ ১৬৭), আমিনুল ইসলাম - নবজাগরণ ডট কম, সংবাদ ডট নেট ডট বিডি।

বাংলায় বিজ্ঞান অক্ষয় -সমূদ্র সেনগুপ্ত
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:878 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিদ্যাসাগর তাঁর লেখা "জীবনচরিত" বইটার পরিশিষ্ট অংশে "দুরুহ ও সঙ্কলিত নুতন শব্দের অর্থ" শিরোনামে একটি তালিকা দিলেন। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা যেমন আছে, তেমনই অন্যান্য শব্দও আছে। দু চারটে নমুনা পেশ করা যাক। Botany (উদ্ভিদবিদ্যা), Optics (দৃষ্টিবিজ্ঞান), Telescope (দূরবীক্ষণ), Satelite (পারিপার্শ্বিক, উপগ্রহ) ইত্যাদি। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, বঙ্কিম কথিত "টেক্সট বুক রাইটার" বিদ্যাসাগর মশাই কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় বিজ্ঞান পাঠ প্রচারের জন্য এসব লেখেন নি, তার মূল লক্ষ্য কিন্তু সেই শিশু শিক্ষা। [সূত্র: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য সম্পাদিত বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী]

অক্ষয়কুমার দত্ত (যিনি ইংরেজিতে নিজের নাম লিখতেন Ukkhoy Coomar Dutt)-কে নিয়ে লিখতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের নাম টেনে আনার কারণ হল ওনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার। "পদার্থবিদ্যা: জড়ের গুণ ও গতির নিয়ম" বলে যে বইটি উনি লিখলেন শকাব্দ ১৭৭৮ সালে সেই বইয়ের মুখবন্ধে (বিজ্ঞাপন) উনি লিখছেন, "এই পুস্তক মুদ্রিত হইবার সময়ে শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অমৃতলাল মিত্র মহাশয়েরা অনুগ্রহ পূর্বক দেখিয়া দিয়াছেন।" 

অক্ষয়কুমারের ভাষার ওপর বিদ্যাসাগরের প্রভাব সম্পর্কে যে জনশ্রুতি চালু আছে সেটি খন্ডন করতে গিয়ে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলেছেন, "অক্ষয় দত্তের বাংলা রচনাতে ঈশ্বর গুপ্তর নিকট হাতে খড়ি হয়। তবে অক্ষয় দত্ত যে বরাবর গুরুর রচনা পদ্ধতি নকল করিয়াছিলেন তাহা নহে। তিনি খানিকটা বিদ্যাসাগরি রীতির দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা বলিয়া বিদ্যাসাগরের ও মাছি মারা গোছের নকল করেন নাই। অক্ষয় দত্ত যে রূপ প্রতিভা সম্পন্ন ছিলেন, তিনি যে কাহারও নকলে চলিবেন, ইহা কোনোমতেই সম্ভবপর ছিল না। তাঁহার রচনায় ঔদার্য, অকপট আন্তরিকতা এবং মনের ভাব অকাতরে ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা বাঙ্গালার অতি অল্প লেখকই প্রদর্শন করিয়াছেন" [সূত্র: পুরাতন প্রসঙ্গ]।

পদার্থবিদ্যা প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইংরেজি ভাষায় রচিত বিভিন্ন বই অবলম্বনে রচিত এই পুস্তিকাটি লেখার সময় অক্ষয় কুমার সেকালের রীতি অনুযায়ী সাধুভাষাতেই লিখলেন কিন্তু তাতে বামুনের ঘরের চাল কাঁচকলা সৈন্ধব লবণের গন্ধ প্রায় নেই বললেই চলে। একটু খানি পড়া যাক, "জড় পদার্থের যে গুণ থাকাতে, কোন দ্রব্য নষ্ট হয় না, তাহার নাম অনশ্বরত্ব। সকল বস্তুকেই পুনঃ পুনঃ বিভাগ করিয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহার কনামাত্রও কোন ক্রমে ধংস হয় না। জল, পারদ প্রভৃতি বস্তু বাষ্প হইয়া আমাদের অদৃশ্য হয় কিন্তু তাহার অণুমাত্রও একেবারে নষ্ট হইয়া যায় না। বাষ্প, জল ও বরফ এ তিনই এক পদার্থ; বরফ দ্রব হইয়া জল হয়, এবং জল উষ্ণ হইয়া বাষ্প হয়। বরফে যতগুলি পরমাণু থাকে, তাহা বাষ্প রূপে  পরিণত হইলে,সে বাষ্পে ও ততগুলি থাকে, তাহার একটি পরমাণুর ও ধ্বংস হয় না।"

আজ যদি আমরা লিখতে বসি, তাহলে এই অনুচ্ছেদের ক্রিয়াপদগুলোকে চলিত ভাষায় আর বড়জোর ওই "দ্রব" শব্দটা কে গলে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু পাল্টাতে পারবো না, এতটাই ঝরঝরে ছিল অক্ষয়কুমারের ভাষা, এতটাই আধুনিক। মলিকিউল আর এটম এর পরিভাষা হিসেবে অনায়াসে অণু আর পরমাণু ব্যবহার করছেন উনি। বইয়ের অন্যত্র স্বর্ণ, রৌপ্য লিখলেও প্লাটিনামকে "প্লাটিনম" লিখছেন, কোনো উদ্ভট অপ্রচলিত পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। 

পরিভাষা নিয়ে তাঁর এই অবদান কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখছেন, "স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত ও ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সময় হইতে বাঙ্গালা ভাষায় বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লিখিবার চেষ্টা হইতেছে। এ বিষয়ে উক্ত মহাত্মাদ্বয়ই প্রথম পথপ্রদর্শক।" [সূত্র: শক্তিব্রত ভৌমিক সম্পাদিত: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচনা সংকলন]। 

ওই প্ল্যাটিনম এ একটিবার ফেরত আসা যাক। এবিষয়ে দত্ত মশাই এর উত্তরসুরি রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দ বিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে উঠে, মুলে যেটা অসঙ্গত, অভ্যাসে সেটা সঙ্গতি লাভ করে" [সূত্র: মানস প্রতিম দাস: বাংলায় বিজ্ঞানের পরিভাষা ও অক্ষয় কুমার দত্ত]। রাজশেখর বসুও এই কৃত্রিম পরিভাষা আমদানির বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর মত অনুযায়ী অক্সিজেন এর বদলে অম্লজান লিখলে ভাষা মোটেও পুষ্ট হবে না। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)দের ধারা ধরে দুঃখিনী বাংলা মায়ের বাংলা ভাষায় আমরা যারাই একটু আধটু বিজ্ঞান চর্চার চেষ্টা করি তাদের কাছে আজকের দিনটা'র একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ পিউরিট্যান ছিলেন, মদ্যপানের বিরুদ্ধে ও আমিষ ভক্ষণের বিরুদ্ধে লিখে গেছিলেন, কিন্তু বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় ওনার অবদান সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। 

বিশেষ জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখে, মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে একটা জাতির কোনোদিন উন্নতি হতে পারে না, তাকে সর্ব সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে মাতৃ ভাষায় চর্চা করতে হবেই। লিখতে বসে পরিভাষা খুঁজতে গিয়ে যখন বিরক্তি আসে, মনে হয় ধুত্তর এত খেটে কি হবে, ইংরেজি/ল্যাটিন/গ্রীক শব্দগুলো বাংলা হরফে লিখে দিলেই তো গোল মিটে যায় তখনই দত্তকুলোদ্ভব এই মেধাবী মানুষটি যিনি সারাটা জীবন মস্তিকের চর্চা করলেন, দুঃখজনকভাবে শেষ বয়সে যিনি সেই মস্তিষ্কের অসুখেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন, নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন, আশেপাশের লোক তাঁকে পাগল বলে আখ্যা দিল, সেই মানুষটার নাম স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অন্যেরা দেখে, হাসে আর বলে, "যতসব পাগলের কান্ড"। 

অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে আসুন, সব পাগল আমরা আজ ওঁর জন্মদিনে একজোট হই।

‘ঈশ্বরের’ নিবাস বাংলার অন্যতম তীর্থস্থান -সুদিন চট্টোপাধ্যায়
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:776 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মধ্য কলকাতায় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিজস্ব বাসভবন।

বিদ্যাসাগর প্রথম জীবনে নিজে কোনও বাড়ি না তৈরি করলেও শেষ বয়সে তাঁর বিপুল গ্রন্থসম্ভার রাখার জন্যেই ১৮৭৬ সালে মধ্য কলকাতার ২৫ বৃন্দাবন মল্লিক লেনে (এখনকার ঠিকানা ৩৬ বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ) এক টুকরো জমি কিনে একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। জীবনের শেষ চোদ্দ বছর তিনি কাটিয়েছেন এই বাড়িতেই। এই বাড়িতেই ‘সাগর দর্শন’ করতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বহু জ্ঞাণীগুণী মানুষের নিত্য যাতায়াত ছিল এই বাড়িটিতে।  রাত দুটো আঠারাে মিনিটে, ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে জুলাই, বঙ্গাব্দ ১২৯৮ সনের ১৩ ই শ্রাবণ এখানেই জীবনাবসান হয়  বিদ্যাসাগরের। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘বিদ্যাসাগর এস্টেট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠিত হলেও তা এক সময়ে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ে। সেই সময়ে বিদ্যাসাগরের মহামূল্য গ্রন্থ সংগ্রহ লালগোলার মহারাজ নিলামে কিনে নেন।  এই বাড়ি থেকেই বিদ্যাসাগরের সযত্ন সঞ্চিত গ্রন্থরাজি বাক্সবন্দি হয়ে চলে যায়। পরে অবশ্য বইগুলোর অধিকাংশই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ফিরে এসেছে। অল্প কিছু বই বিদ্যাসাগর কলেজে রয়েছে। গ্রন্থ সংগ্রহ রক্ষা পেলেও, বিদ্যাসাগরের ওই বাসভবনটি কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়ে এবং এক সময়ে সেটি দুষ্কৃতীদের আড্ডায় পরিণত হয়। দীর্ঘ কাল ওই অবস্থায় থাকার পরে পশ্চিম বঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার আইনের লড়াইয়ে জয়ী হয়ে বাড়িটি দখলে আনেন এবং সংরক্ষিত ঘোষণা করেন।বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িগুলির মধ্যে একমাত্র রক্ষা পেয়েছে এই বাড়িটিই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইচ্ছানুসারে, বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজের তত্ত্বাবধানে বিদ্যাসাগরের এই বসত বাড়িটিতে নারী শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নের নানা প্রকল্প চালু হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ও পোড়ামাটির কাজে সাজানো একটি মুক্ত মঞ্চও তৈরি হয়েছিল। আন্তরিকতার সঙ্গে বিদ্যাসাগর জন্মবার্ষিকী পালন করতো কলেজের ছাত্রীরা। বর্তমান সরকার এসব স্থগিত করে ভবনটি সরাসরি নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন, সুসজ্জিত স্মৃতি সংগ্ৰহশালা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। জানি না সে কাজ কতদূর এগিয়েছে। আজ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণবার্ষিকী [২৯ জুলাই ১৮৯১], জানি না এ ভবন-দ্বার  আজকের দিনে সর্বসাধারণের জন্যে অবারিত কিনা? গৃহটি এখন "ঐতিহ্য ভবন" হিসেবে চিহ্নিত।

একদা, 'ঈশ্বরের' নিবাস, বাংলার অন্যতম তীর্থস্থান।

কবিতাগুচ্ছ ১৬ -কবিরা
Nov. 20, 2024 | কবিতা | views:457 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আরোগ্য

-প্রদীপ চক্রবর্তী


ধর্ম নিয়ে অনেক লড়াই

ধর্ম নিয়ে অনেক ভাষণ,

ধর্ম ধর্ম  কর কেন ?

ধর্ম  মানেই চরম শোষণ।


প্রকৃতির রোষাণলে

যখন আসে বিপর্যয়,

ধর্ম খায় গড়াগড়ি

ধার্মিকরা পায় যে ভয়।


বিজ্ঞানকে মেনে চল

পাবে মনে অনেক আরাম,

যুক্তিবাদী হলে পরেই

সেরে যাবে ধর্ম ব্যারাম।







যেমন কর্ম তেমন ফল

-জামাল আনসারী


কি যে বইল্যব ভাই, গরিবলকের জন্মটাই বৃথা,

সকাল থ্যেইকা বেলাডুবা তক্কো বাবুঘরে খাইটে খাইটে

কমর-কাখ্যাল ধরাই দিলে কপালে জুইটবেক সাতকুড়ি টাকা।

ত,এই টুকু টাকায় কি হবেক? নুন-তেল-চাল-ডাল! কিনতেই কুলাই নাই

ইদিকে নুনুর মাই, মুখটা ফুঁল্যাই আছে, ছুটু বিটিটারও দমে রাগ...

কালী পূজায় নুতন শাড়ি চাই।নতুন জামা কাপড় চাই।


টাকা পয়সা তো হাতে নাই,তাও নুনুর মাই-কে বলি,আর দিনা দুয়েক সবুর কর!

বাবুঘরের টাকাটা একবারে হাতে পালেই সবই কিনে দিব।টুকু ধর্য্য ধর।

ই জামানায় লিখাপড়ার কানাকড়িও দাম নাই হে।যতই ডিগ্রি থাকুক।

দাম আছে ঐ ন্যেতা-মন্ত্রী গুল্যানের।আর দাম আছে বাবাজি- মাতাজিদের।

শালা সব ভন্ডের এক রা। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।সে যতই লকে দেখুক।

ন্যেতা গুল্যানের লাজ-লজ্জা, হাইয়া-শরম কিছুই না। সব শেষ।


কেউ কেউ আবার বলে, "যেমন কর্ম তেমন ফল।"

ত, বলছি ফলটা কি শুধু ন্যেতা-মন্ত্রীদের ঘরেই ধরে? গরিব লকের ঘরে নাই কেনো?

নেতামন্ত্রীরা মিনিটে মিনিটে পেঁদা কথা বল্যে, দেশের লকগুল্যানকে ভুল বুঝায়।

সেই জন্যই কি উহারা কোটি কোটি টাকার মালিক? গাড়ি বাড়ি, টাকা কড়ির পাহাড় জমায়।

আর গরীব লক সকাল থ্যেইকা বেলাডুবা তক্কো বাবুঘরে খাইটে খাইটে

মাথার ঘাম পায়ে ফেইল্যে, কমর-কাখ্যাল ধরাই দিলেও ফল নাই।

গরিব গরিবেই থাকে।কুনু পরিবর্তন নাই।খাইটে খাই আর  ছিঁড়া খাইতে ঘুমায়।

কর্মের কি পরিহাস! তাথেও ধর্মের সেই এক কথা, , "যেমন কর্ম তেমন ফল !"


হবে তোমার সর্বনাশ

-রবিন তালুকদার


মেয়ের বাবা চিন্তায় আছে,

নুতন জামাই তার মাস্টার!

জামাইয়ের চাকরিটা থাকবে,

কোর্টের দেখছি যা'হাবভাব !!

পুরুত মশাই চিন্তায় আছেন,

এবার বিয়ের বাজার মন্দা!

হাইকোর্টের অর্ডার গুলো আসুক,

বিয়ের মরসুমের বাদ'টা !!

মুদির দোকানদার হিসেব কষছে,

কজন মাস্টারকে দিয়েছে ধার!

গাড়ির শোরুমে নোটিস ঝুলিয়েছে,

'বঙ্গের চাকুরে' লোনের থেকে বাদ !!

শশুর মশাই হিসেব কষছেন,

জামাইয়ের চাকরির বয়স কতো!

শাশুড়ি বলে শুধু দেখো জামাইয়ের,

চাকরি 'মমতার সরকারের' নয়তো !!

আগের জামাইরা বেচে যাবে,

তবে নুতন জামাইদের হবে কি!

জমি বেচে-বন্দক দিয়ে-লোন করে,

"পার্থর" থেতে চাকরি কিনেছি !!

খাটলো জামাই গতর দিয়ে,

এবার চাকরিটা যাওয়ার পালা!

তারসাথে আবার ফেরাতে হবে-

"বেতন" নয়তো জেলে ভাত খাওয়া !

হে বঙ্গরানী তুমি করলে কতনা কি,

সারদা-নারদা-সরকারি চাকরি!

সাথে টাটানেনো'কে ঝুলালে ফাঁস,

এবার তোমার হবেই সর্বনাশ !!

আমাদের ভদ্র হতে হবে

-শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়


গায়ে পরার মত কাপড় না জুটলেও

শব্দের গায়ে কাপড় পরানো চাই,

আমাদের ভদ্র হতে হবে।

আমাদের শালীনতা বজায় রাখতে হবে।

খেতে না পেলেও, খিদে পেয়েছে বলা চলবে না।

খিদেয় গা পাকিয়ে উঠুক, বেরিয়ে যাক নাড়ি ও ভুঁড়ি,

তবু আমাদের শব্দ যেন ন্যাংটো না হয়।

হ্যাঁ, প্রয়োজনে অনুস্বারের মাথায় দিতে হবে মাত্রা,

বর্ণনির্বিশেষে ঘোমটা পরিয়ে রাখতে হবে,

চন্দ্রবিন্দু লেখা পর্যন্ত।

আমাদের ভদ্র হতে হবে।

আমাদের সভ্য হতে হবে।

সভ্যসমাজে কেউ এমনি এমনি কাপড় খোলে না।

যাকে দেখে মনে হচ্ছে, উলঙ্গ, নির্লজ্জ,

কে জানে হয়তো সে জন-সমুদ্রের সৈকতে

স্বর্ণালী রৌদ্রস্নানে ব্যস্ত আছে!

তাকে 'ন্যাংটো' তো বলাই যায় না,

বড়জোর একটু ভালো শব্দ ব্যবহার করে বলতে পারেন,

উলঙ্গ।

কিন্তু তাহলেও ভদ্রতাবোধে,

বাতানুকূল কামরার যাত্রীদের মত,

খুব আস্তে করে বলতে হয়।

এখানে কেন্দ্রীয় বাতানুকূল‌ তন্ত্রে,

একটিও প্রতিকূল কথা বলবার জো নেই।

আমাদের ভদ্র হতে হবে।

আমাদের মৌন হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের বুদ্ধি উলঙ্গ করে,

তার কোমরে দড়ি পরিয়ে,

লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে,

দাস কেনাবেচার হাটে বেচে দেয়ার মধ্যে

কোনো অশ্লীলতা নেই।

শুধু আমাদের বিনয়ী হতে হবে।

আমাদের ভদ্র হতে হবে।

কারণ, ভদ্রলোক দুটো কথা শোনাতে পারে না।

তাদের তো একটাই কথা,

আমাদের ভদ্র হতে হবে।

আমাদের সহ্যশক্তি বাড়াতে হবে।

উপার্জনের সব রাস্তা এক এক করে বন্ধ হয়ে গেলেও,

আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে,

নিষ্পলকে তাকিয়ে থেকে দেখতে হবে বিক্রি হ‌ওয়া।

লোকাল ট্রেনে সামুদ্রিক মাছের মত,

একদিন শেষ প্যাসেঞ্জারটার‌ও কশেরুকা বেচা হয়ে যাবে।

আমাদের সহ্য করা শিখতে হবে।

কারণ আমাদের টিকে থাকতে হবে,

সূর্য যতক্ষণ না পৃথিবী গিলে খাচ্ছে,

ঠিক ততদিন পরিপূর্ণ মমি হয়ে।

আমাদের ভদ্র হতে হবে।





হুল দিবস

- সুমন বিশ্বাস


সিধু কানু চাদ ভৈরব শক্তি দিয়ো আজ।

লাচতে যাবক হুল দিবসে গুছিয়ে ঘরের কাজ।

মাথায় নিয়ে কলসী ঘটি রংবেরং-এর ফুল;

মাদল তালে লাচতে যেন হয়না মোদের ভুল।

এদিনটোতে বাপ ঠাকুরদারা ভগনাডিহিতে;

দাঁড়িয়ে ছিল তীর ধনুক আর বল্লম নিয়ে হাতে।

ভয় পেয়ে যায় কামান গোলাও যদি বাঁধা যায় জোট।

মারাংবুরুর শক্তিতে আজ আবার জেগে ওঠ।

জেগে উঠল সিংভুম আর সান্তাল পরগনা।

সেদিনটোকে ভুলতে যে মোরা পারবোক না।

মহাজন, জোতদার দিখু আর ইংরেজ;

সবাই সেদিন দেখে ছিল সাঁওতালদের তেজ।

কামান গোলায় প্রাণ দিয়েছি - দিইনি মোদের মান।

হারিয়ে গেছে সর্বস্ব - হারায়নি সম্মান।

শিখিয়েছিল সিধু কানু প্রতিবাদের ভাষা।

সেটাই মোদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশা।

ঘরে কোন এসিড রাখলে সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? -তলাশ মাহমুদ বিশ্বাস
Nov. 20, 2024 | সচেতনতা | views:782 | likes:1 | share: 1 | comments:0

কোন এসিডেই সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।


কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ পালায়?

সাপের ঘ্রাণ শক্তিই এত দূর্বল যে ফুলের গন্ধেও আসে না, তাহলে কার্বলিকে সাপ পালাবে কে বলল আপনাকে?

এসব সেইফটি এককালে প্রচলিত ছিল। এখন ব্যর্থ টোটকা।


সাপ সম্পর্কিত কিছু প্রচলিত ভুল তথ্য , কিছু সাবধানতা এবং সাপে কাটার চিকিতসাঃ

বীন বাজালে সিনেমায় সাপ নাচে। বাস্তবে নাচে না। সাপের কান নাই। শোনার জন্য ঘনঘন জিহ্বা বের করতে হয়।

সাপ আপনাকে আক্রমণ করবে না। আপনি যদি শব্দ করে হাঁটেন, সে বুঝতে পারে। সাপের বুকের তলায় খোলসের রঙ আলাদা। সেখানে বিশেষ স্নায়ুতন্তু থাকে। মাটির কম্পন বুঝতে পারে। আপনি কতদুরে আছেন, আপনি সাইজে কতবড়, সে বুঝতে পারে। পালিয়ে যায়।


বেলি, হাস্নাহেনার গন্ধে কখনো সাপ আসে না। কেউকেউ জীবদ্দশায় বেলি, হাস্নাহেনা গন্ধরাজের তলায় সাপ দেখেছেন হয়তো। মনে রাখবেন, সাপের ঘ্রাণশক্তি খুবই দূর্বল। সে গন্ধ পায় না।


সুগন্ধি ফুলে পোকামাকড় আকৃষ্ট হয় বেশি। পোকা খেতে ব্যাঙ আসে। ব্যাঙ খেতে মাঝেমাঝে সাপ আসতে পারে। খাবার পর মানুষের মত সাপও ক্লান্ত হয়। মানুষ খাবারের পর যেমন আয়েশ করে ঘুমায় তেমনই সাপও বেলি-হাস্নাহেনার তলায় ঘুমুতে পারে। তবে এসব গাছ যদি বাড়ির ভেতর থাকে তবে সাপ কম আসে। কারণ মানুষের উপস্থিতি তারা ভয় পায়। তবে বাড়ির সাইডে, ঝোপঝাড়ে এমন গাছ থাকলে সাপ আসা স্বাভাবিক।


একটা সাপকে মারলে তার জোড়া সঙ্গী কখনোই আপনাকে খুঁজে দংশন করতে আসবে না। সাপের স্মৃতিশক্তি খুবই দূর্বল। সাপ বাংলা সিনেমার স্বর্পরাজ শাকিব খান কিংবা নাগিন মুনমুন নয়। যে সঙ্গীহারার প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসবে। সাপ নিম্নজাতের প্রাণি। এদের মধ্যে রিভেঞ্জ বলে কিছু নাই।


কিন্তু একটা সাপ মারার পর আরেকটা সাপ প্রায়ই একই স্থানে দেখা যায়, কারণ কী?সিম্পল। মেটিং এর সময় তাদের পার্টনার আশেপাশে থাকতেই পারে কিংবা আশেপাশে গর্ত থাকলে তার বাচ্চাকাচ্চা কিংবা আরো সাপ উঠে আসতেই পারে। সে প্রতিশোধ নিতে আসেনি বরং ভুল করে গর্ত থেকে চলে এসেছে।


ছোট সাপের বিষ নাই। কথাটা ভুল। সাপের বাচ্চাও সাপ। কেঁচোর সমান একটা কেউটের কামড়ে আমার চোখের সামনে এক রোগীকে টানা ২৪ ঘণ্টা জীবনের সাথে ফাইট করতে হয়েছে। আইসিইউতে আমরা তিন ডাক্তার তার পাশে ২৪ ঘন্টা লড়েছিলাম। আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশন থেকে শুরু করে একাধিকবার অ্যান্টি-ভেনম দিয়েছি। সে সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে। যাবার আগে আমাদের গালিগালাজ করে গেছে। আমরা নাকি তাকে অনেক দামী ঔষুধ দিয়েছি। সে জানে না, একডোজ অ্যান্টিভেনমের দাম ১০ হাজার টাকা। লজিক্যালি লোকটার দোষ নেই। সে ছিল জেলে। দিনে হয়তো এক দেড়শ টাকা তার ইনকাম।


রাতে যারা বাজার থেকে অন্ধকারে ঘরে ফেরে তাদের এবং জেলেদের সাপ বেশি কাটে। জেলেরা বর্ষায় রাতে আইল বরশি ফেলে, জাল ফেলে মাছ ধরে। নদী বা নালায় মাঝ ধরে। সাপ শুকনো ভেবে সেখানে থাকে। কামড় দেয়।

সিনেমা বলে, সাপ দুধ খায়। গরুর দুধ খেতে গোলাঘরে হানা দেয়। ভুল কথা। এসব সাপ ক্ষেতের ব্যাঙ- পোকামাকড় খায়। কালো রঙ্গের দাড়াশ সাপ দেখি, এরা আমাদের উপকার করে। ফসল বাঁচায়। এদের না মারা উত্তম।


সাপে কাটলে ব্লেড দিয়ে কেটে দিলে বিষ বের হয়ে যায়। কথাটা ভুল। ভুলেও এই কাজ করবেন না। ব্লেড দিয়ে কাটলেন তো বিষকে রক্তের সাথে নিজহাতে মিশিয়ে দিলেন।


দংশন করা সাপকে উল্টো কামড় দিলে বিষ ফেরত চলে যায় সাপের ভেতরে। কথাটা ভুল। পায়ে কাটলে বিষ সেখানে। আপনার মুখের দাঁতে তো বিষ নাই। কীভাবে ফেরত দিবেন?


সাপের বিষ তার দাঁতে থাকে না। সে যখন কামড় দেয় তার মুখের পেশিগুলো টানটান হয়ে যায়। দাঁতের কাছেই থাকে বিষধর। সেখান থেকে বিষ দাঁত বেয়ে আপনার শরীরে প্রবেশ করে। শক্ত করে বাঁধলে বিষ ছড়াতে পারে না এমন ধারনা ভুলে যান। আপনি নিজেও নিশ্চিত না সাপটা বিষধর ছিল কি না, তাহলে শক্ত করে বাঁধবেন কেন?


অনেক ডাক্তার সাপে কাটার পর বাঁধতে নিষেধও করেন। কারণ এতে হিতে বিপরীত হয়। ফুটবলের অ্যাংলেট পায়ে দিলে যেমন আটসাট হয়ে থাকে এমন ভাবে গামছা বা শার্ট বা শাড়ি দিয়ে দংশনের কিছু উপরে পেঁচিয়ে নিতে পারেন। বাঁধন অবশ্যই ঢিলা রাখবেন। দুট আঙ্গুল ঢোকে এমনভাবে ঢিলা করবেন। আবার খুব ঢিলাও না। ২০ মিনিট পরপর খুলে আবার লাগাতে পারেন। ভুলেও লোহার তার, সুতলি, কারেন্টের তার বা অন্য সরু জিনিস দিয়ে বাঁধবেন না। বাঁধলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হাতে-পায়ে পঁচন শুরু হবে। চিরতরে হাত বা পা খোয়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো আপনাকে বিষধর সাপ কাটেই নি অথচ আপনি ভয়ে গিট্টু দিয়ে হাত পা পঁচিয়ে পঙ্গু হয়ে গেলেন। কেমন হবে?


সাপ কাটলে কিন্তু আংটি, চুড়ি, ব্রেসলেট খুলে ফেলবেন। কিছু সাপের বিষে আপনার আঙ্গুল, হাত বা পা ফুলে যেতে পারে। আংটি বা চুড়ি থাকলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে পঁচন ঘটতে পারে।


সাপ কখন দংশন করে?

১। যদি ভুলে আপনার মুখোমুখি হয় সে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে নিজে ভয় পেলে হিংস্র হয়। সব প্রাণিই এমন। মুরগীরও মাঝেমাঝে মানুষকে ঠোকর দেয়। সামনে সাপ পড়লে তাকে চলে যেতে দিন।

২। বর্ষাকাল মানেই হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী। বর্ষায় গর্তে পানি উঠে যায়। ফলে সাপ ডাঙ্গায়, শুকনো জায়গায় উঠে আসে। সেটা ক্ষেতের আইল, রাস্তা কিংবা আপনার ঘরের তোশকের তলা, বালিশের তলা, আলনার ভেতর, কাঠের স্তুপ যেকোন জায়গাতেই আসতে পারে।

৩। অন্ধকারে সাপের শরীরে পা পড়লে। জঙ্গলায় ভুলে তার শরীরে পা পড়লে কামড় দেয়।

৪। ইদুরের গর্তে সাপ থাকলে সেখানে পা রাখলে বা বসে থাকলে কামড় দিতে পারে। বাচ্চা ছেলেরা মাঝেমাঝে বসে গর্তের মুখে প্রস্রাব করে। সন্তানকে শিক্ষা দিন। এই কাজ যেন না করে।


সব সাপ বিষাক্ত?

বাংলাদেশে ৮০ ধরণের সাপ আছে। মাত্র ২৭ তা বিষাক্ত। অধিকাংশই সামুদ্রিক। মাত্র ৫/৬ প্রজাতি স্থলে আছে যারা বিষধর।

আপনার চোখের সামনে নিয়মিত যাদের ঘোরাফেরা দেখেন, তারা বিষাক্ত নয়। পানির সাপ অধিকাংশই বিষাক্ত নয়। তবে সামুদ্রিক সাপ সবাই বিষাক্ত।

যদি চেনেন তবে বলি গোখরা, কালকেউটে, শঙ্খচূড়, চন্দ্রবোড়া বিষাক্ত।


সাপে কাটলে বুঝবেন কীভাবে?

দংশন করেছে এমন মনে হবার পর যদি সরাসরি সাপ দেখেন, তাহলে ভাবতে পারেন সে আপনাকে দংশন করেছে।

একবার এক ছেলে হাসপাতালে আসল। মাটির ঘরে অন্ধকারে হেলান দিয়ে ছিল। পিঠে সাপ কেটেছে। সারাদিন হাসপাতালে আমাদের অবজারভেশনে ছিল। রাতে রিলিজের আগে খবর আসল, যেখানে হেলান দিয়ে ছিল, সেখানে কে যেন তারকাটা পুতে রেখেছিল। পিঠে লেগে তারকাটা দেয়ালে ঢুকে যায়। খোচা লাগাকে সাপে কাটা ভেবে সে হাসপাতালে আসে। ২৪ ঘণ্টা ভয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফেরে সুস্থ অবস্থায়।

বিষাক্ত সাপে কাটলে বোঝা বেশ সহজ।

১। শিকারি পশুর মত সাপের দুটো দাঁত বড় থাকে। বাঁকানো। দংশন করলে গভীর ক্ষত হয়। দুঁটো দাঁতের অস্তিত্ব থাকলে ধরে নিতে পারেন, আপনাকে বিষাক্ত সাপ দংশন করেছে।

২। যদি অনেকগুলো দাঁত থাকে, সেখানে মাংস তুলে নিলেও ভেবে নিতে পারেন এটা ছাগলের মত। অনেক দাঁত কিন্তু বিষদাঁত নাই। আপনার কিছু হবে না।

৩। সাপের বিষ কয়েক ধরণের। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে নিউরোটক্সিন রিলিজ করা সাপের কামড়ে। এক্ষেত্রে ঝিমঝিম লাগবে। চোখে ঝাঁপসা দেখবে। চোখের উপরের পাতা নেমে চোখ অংশিক বন্ধ হয়ে যাবে। মাথা ঝুলে যাবে। জিহ্বা ও শ্বাসনালী ফুলে যাবে। শ্বাস নিতে পারবে না। মুখে লালা ঝরবে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। বমি করতে পারে।

আরো নানাবিধ লক্ষণ আছে।

চন্দ্রবোড়া কামড় দিলে লোহিত রক্তকনিকা ভেঙ্গে যায়। ফলে রক্তবমি, রক্তপায়খানা হতে পারে। কামরের জায়গায় রক্ত ঝরতে পারে। ফুলে যেতে পারে, লাল হতে পারে। ফোস্কা পড়তে পারে। কালোও হতে পারে।

কিছু সাপের কামড়ে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারাও যেতে পারে।

মাঝেমাঝে নির্বিষ সাপ কামড়েও মানুষ মারা যায়।কেন ?

ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করে।

সাপে কামড়ে সিনেমায় গড়াগড়ি দেখেন, বিষের কারণে চেঁচামেচি দেখেন। এগুলো অভিনয়। সাপের বিষ নিয়ে একটা প্রবাদ আছে, কেমন ব্যাথা বুঝিবে সে কীসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে... এইসব ভুলে যান। সাপে কাটা মানুষ খুব স্বাভাবিক থাকে শুরুতে। কোন ব্যাথা নাও থাকতে পারে। এমনকী মৃত্যু ঘটার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোন ব্যাথা নাও বুঝতে পারে।


চিকিৎসা এবং সতর্কতা:

একদম ঘাবড়াবেন না। বেশি ঘাবড়ালেই বিষ বেশি ছড়াবে।

সাপেকাটা জায়গা ধুয়ে ফেলুন সাবান দিয়ে।

কাটবেন না ব্লেডে।

চুষে রক্ত বের করবেন, এমন চিন্তা ভুলে যান।

যেখানে কামড়াবে সেখানকার নাড়াচাড়া বন্ধ। হাতে কামড়ালে হাত নাড়ালে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে যায়। হাত একদম নাড়াবেন না। পায়ে কামড়ালে হাঁটবেন না।

সাপেকাটা স্থানে ভুলেও অ্যাসিড ঢালবেন না। মরিচের গুড়ো দিবেন না। কার্বলিক অ্যাসিডে ঝলসাবেন না। কোন ফলের বীজ, সর্পরাজ তেল, গুটি, আটি, বড়ি, তাবিজ কিছুই লাগাবেন না।

সাপটাকে পারলে চিনে রাখুন। ডাক্তারকে বললে চিকিৎসা পেতে সুবিধা হবে। তবে ধরে যাবেন না। মেরেও ফেলার দরকার নাই।

মৃত সাপকে ধরতে যাওয়াও নিরাপদ নয়। এরা মৃত্যুর ভান করে শুয়ে থাকতে পারে।

জীবিত ধরে ওঝার কাছে যাবেন, এমন চিন্তা থাকলেও ঝেড়ে ফেলুন। ওঝা সাপের বিষ নামাতে পারে না।

ওঝারা অনেক রোগী ভালো করে। যেগুলো আসলেই বিষাক্ত সাপের কামড় ছিল না। বিষাক্ত হলে একটা সময় বুঝতে পারে তখন নানা অজুহাত নাগ-নাগিনির কথা বলে এরা হাসপাতালে রোগী রেফার করে। আমরা হাসপাতালে অনেক পাই যারা একেবারে শেষ মুহুর্তে আসে। ওঝার কাছে গিয়ে জীবন খুইয়ে ফেলার পরিস্থিতি তৈরি করে আসে।

বিষাক্ত সাপে কাটলে আপনি বাঁচতে পারেন একটামাত্র পথন অনুসরণ করলে। সেটা হল- দুনিয়ার কারো মতামত নিবেন না। সরাসরি হাসপাতাল যাবেন।

সাপে কাটলে এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সরকারি বড় হাসপাতালে যান। রাসেল ভাইপারভ বাদে সব সাপেরই বিষের অ্যান্টিভেনম আছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যেই চিকিৎসা শেষে ফিরে আসবেন। [রাসেল ভাইপার বাংলাদেশে বিলুপ্ত সাপ। তবে রাজশাহীতে কয়েকবার নতুন করে পাওয়া গেছে। ফরিদপুরে পাওয়া গেছে কিছুদিন আগে। বন্যার জল-স্রোতে এরা আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে দেশময়]


যদি বুঝে ফেলেন, সাপটাবিষধর নয়, তাহলে কী করবেন?

তবুও হাসপাতালে যাবেন। ভর্তি হয়ে প্রয়োজনে বিছানায় ২৪ ঘন্টা বসে থাকবেন। তবুও হাসপাতালে যাবেন।

অধিকাংশ সাপই নির্বিষ। সাপ মারবেন না। সাপ বাস্তুতন্ত্রের অংশ। ঘরে সাপ পাওয়া গেলে স্নেক রেস্কিউয়ারকে জানাতে পারেন। ওঝাদের জানিয়ে পরিবেশ থেকে এসব সাপ বিলুপ্ত করবেন না। ওঝারা সাপ মেরে পুড়িয়ে তেল বানায়। সেই তেল বাত ব্যাথা- সাপের বিষ নামানো, হারানো যৌবন পুনরুত্থান নামক নানাকিসিমের মিথ্যা চিকিৎসায় ব্যবহার করে। তাদের এই কাজ করতে দিবেন না। কারণ দিনশেষে সেই সাপের তেল হয়তো আপনার আত্মীয়ই কিনে নিয়ে ব্যবহার করছে।

বাড়িতে খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তুপ থাকলে আপনার মা বা স্ত্রীকে সতর্ক করে দিন। খড় বা লাকড়ি নেবার আগে সেখানে লাঠি দিয়ে কিছুক্ষণ শব্দ করুন। সাপ থাকলে চলে যাবে।

রাতে বিছানা এমনকী বালিশের তলাও চেক করবেন। আলনার ভেতরে থাকতে পারে। শব্দ করে কাপড় নিতে যাবেন।

বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড় থাকলে কেটে ফেলুন। ঈদুরের গর্ত থাকলে ভরাট করে ফেলুন।

অনেকেই বলেন, মরিচপড়া দিয়ে ইদুরের গর্তের মুখে ধরলে সাপ চলে যায়। এ ব্যাপারে আমার জানা নাই। অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে পারেন।

বর্ষাকাল এসেছে। এখন সাপ আপনার বাড়িতে-ঘরে আশ্রয় নিতে আসতেই পারে। সাবধান থাকুন। অন্যদের সতর্ক করে রাখুন। গ্রামের আপন মানুষদের (বাবা-মা, বউ-বাচ্চা-বন্ধু) সাপের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে রাখুন।

সতর্ক থাকবেন-ভয় পাবেন না-অবহেলা করবেন না।


ধন্যবাদান্তেঃ ডা. রাজীব হোসাইন সরকার 

ঈশ্বর Hypothesis -এরিখ ডি
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:744 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সবচেয়ে পছন্দের দাবি হলো এই যে ঈশ্বরই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।তিনিই সর্বশক্তিমান এবং তার অসাধ্য কিছু নেই।আসুন সেই ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন তুলি।

১) ঈশ্বর তৈরী করার আগে যদি সময়ের অস্তিত্ব না থেকে থাকে,তাহলে ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করলেন কোন সময়ে?

২)আমরা জানি কোনোকিছু তৈরী করতে স্থান/space এর প্রয়োজন হয়।ঈশ্বর ই যদি সেটা সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তিনি সেটা কোন স্থানে বসে সৃষ্টি করলেন?

৩)ঈশ্বর কি এমন কাউকে তৈরী করতে পারেন, যে তার চেয়ে শক্তিশালী? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন আর উত্তর যদি না হয় তাহলে তিনি সবকিছু তৈরী করতে পারেননা।

৪)প্রচলিত ধর্মমতগুলোর বয়স খুব বেশি হলেও ৫ থেকে ৬ হাজার বছর,এদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন পৃথিবীতে প্রানের আবির্ভাব ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে আর পৃথিবীর জন্ম তারচেয়েও অনেক আগে।সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? 

৫)ঈশ্বর কি ন্যায়পরায়ণ না দয়ালু? একটি বিচারসভায় দুইপক্ষই যদি ঈশ্বর এর কাছে প্রার্থনা করে থাকেন,তাহলে তিনি দুটো একসাথে হতে পারেননা। অর্থাৎ বিভিন্ন তীর্থভ্রমনে গিয়ে পাপস্খলন আদৌ সম্ভব নয়।

জেমস রান্ডি: এক বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর। -জাহিরুল ইসলাম
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:7876 | likes:0 | share: 75 | comments:0

জেমস রান্ডির আসল নাম Randall James Hamilton Zwinge। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্টেজ ম্যাজিশিয়ান হিসেবে। লেখাপড়া খুব বেশি করেন নি। কলেজ থেকে ক্লাস পালিয়েছেন। তারপর থেকে বিভিন্ন সার্কাস দলে এবং নাইট ক্লাবে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়িয়েছেন জীবনের প্রথম কয়েক বছর। স্টেজে নিজেকে The Amazing Randy বলে পরিচয় দিতেন। 

তারপর তিনি একসময়য় দেখলেন, ম্যাজিককে 'অলৌকিক ক্ষমতা' দাবি করে অনেক মানুষ বিভিন্নভাবে আমজনতাকে প্রতারিত করছে। তিনি তখন এদের ভন্ডামি দেখিয়ে দেওয়া শুরু করলেন। 

( https://en.wikipedia.org/wiki/James_Randi )

আপনারা হয়তো AXN চ্যানেলের Breaking the magician's code: Magics Biggest secret finally revealed সিরিয়ালটা দেখেছেন। ( আগে না  দেখলেও এখন দেখতে পারেন। ইউটিউবে, টরেন্টে দেখে নিন ) 

এই সিরিজে ভ্যাল ভ্যালেন্টিনো নামের একজন আমেরিকান ম্যাজিশিয়ান বিভিন্ন ম্যাজিক দেখায় প্রথমে, তারপর সেই ম্যাজিক কিভাবে করল সেই ট্রিকটাও দেখিয়ে দেয়।

কিভাবে আইফেল টাওয়ার গায়েব করা যায়, কিভাবে নায়িকার শরীর দুই ভাগ করে কেটে আবার জোড়া লাগানো যায়, কিভাবে পানির উপর হাটা যায়, কিভাবে আকাশে ভেসে বেড়ানো যায় , কিভাবে টুপির মধ্যে থেকে খরগোশ বের করা যায় বা অদৃশ্য করা যায় --এইরকম কয়েক শো ম্যাজিকের ট্রিক দেখানো হয়েছে এই সিরিয়ালে। 

https://www.youtube.com/channel/UCkozSCYe1posLlfjUhaJOkw 

 নিজের নিরাপত্তার  জন্য ভ্যাল ভ্যালেন্টিনো কোনো কথা বলেন না, একটা মুখোশ পরে শো করেন। ( এ কারনে তাকে মাস্কড ম্যাজিশিয়ান ও বলা হয়!!) 

গুজব শুনেছিলাম, পেশাদার ম্যাজিশিয়ানদের সব ট্রিক ফাঁস করে দেওয়ার কারনে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা নাকি ভ্যাল ভ্যালেন্টিনোকে খুন করার চেষ্টা করেছিল।  

যাই হোক , জেমস রান্ডির প্রসঙ্গে  ফিরে আসি। জেমস রান্ডিও এইরকম ভাবে তার শেখা বিভিন্ন যাদুর ট্রিক দিয়ে মানুষদের সাহায্য করা শুরু করলেন। 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকায় প্রচুর 'প্যারানর্মাল রিসার্চার' এর আবির্ভাব ঘটল। তারা বিভিন্ন জায়গায় অনেক প্যারানর্মাল ঘটনা দেখাতেন মানুষদেরকে। এসব থেকে বাচার জন্য মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সাও নিত।  

জেমস রান্ডি এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করলেন। নিজের সংগঠন , জেমস রান্ডি এডুকেশনাল  ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করলেন।  এই সংগঠনে যুক্ত হলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জ্যোতির্বিদ,মনোবিদ সহ বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞরা। তারা বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, সবই ভুয়া। সবই নরমাল ঘটনা, কোনো প্যারানর্মাল কিছু নাই। 

গুজব এবং ভুয়া প্যারানর্মাল তথ্যের বিস্তার ঠেকাতে জেমস রান্ডি  এডুকেশনাল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ওপেন চ্যালেঞ্জ ঘোষনা করা হয়েছিল। কেউ যদি কোনো প্যারানর্মাল ঘটনা না ব্ল্যাক ম্যাজিকের ক্ষমতা দেখাতে পারে, তাহলে তাকে ১ মিলিয়ন পাউন্ড ( বাংলাদেশি ৮ কোটি টাকা) দেওয়া হবে। আর যদি এমন কোনো ঘটনা দেখাতে না পারে, তাহলে তার ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। 

বলা বাহুল্য , কেউ সে চ্যালেঞ্জ জিততে পারেনি। অনেকে এসেছিল  অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতে, কিন্তু ধরা খেয়ে সবাই ফিরে গেছে। 

২. 

রান্ডির জীবনের কয়েকটা বিখ্যাত কান্ড কীর্তির কথা শোনাই। 

১।  ইউরি গেলার নামের এক লোক দাবি করলেন, তিনি 'সাইকিক পাওয়ার এর অধিকারী। এই সাইকিক পাওয়ার বা মানসিক শক্তি দিয়ে তিনি চামচ বা স্টিলের রড বাকিয়ে ফেলতে পারেন। 

জেমস রান্ডি ইউরি গেলারের ম্যাজিক ট্রিক ধরে ফেললেন খুব সহজে। তিনি দেখালেন, সাইকিক পাওয়ার বা টেলিকাইনেসিস নামে কিছু নাই। মনের শক্তি দিয়ে ,হাতে টাচ না করে কোনো কাজ করা সম্ভব না। কাজ করতে হলে অবশ্যই বল প্রয়োগ করতে হবে। 

ইউরি গেলারের ম্যাজিকে , চামচের বিশেষ অংশ নরম থাকত। ওই অংশে হাত দিয়ে অল্প চাপ দিলেই বেকে যেত সেটা। 

জেমস রান্ডির কাছ থেকে ধরা খাওয়ার পর ইউরি গেলার আবার নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এলেন। কয়েক ঘন্টা একটা স্টেজের উপরে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন চামচের দিকে। এক সময় দেখা গেল, চামচ বেকে গেছে।

জেমস রান্ডি এটার ও রহস্য বের করে দিলেন। চামচটা দুইটা আলাদা ধাতু দিয়ে বানানো হত (লোহা আর নিকেল এর দুইটা পাত থাকত ভিতরে, উপরে গ্যালভাইনাইজড করে সুন্দর ফিনিশিং দেওয়া হত। বোঝার কোনো উপায় নেই যে ভিতরে আলাদা দুইটা পাত)।

এরপর  উজ্জ্বল আলো ফেলা হত চামচের উপর। ফলে লোহা আর নিকেল , দুইটাই দৈর্ঘ্যে অল্প অল্প করে বৃদ্ধি পেত। লোহা যতটুকু লম্বা হত, নিকেল তত লম্বা হত না।  ফলে ,অসম দৈর্ঘ্য প্রসারনের জন্য চামচটা এক সময় বাকা হয়ে যেত।

ফিজিক্সের এই ঘটনা দর্শকদের সামনে লুকিয়ে রেখে ইউরি গেলার বলতেন, আমি সাইকিক পাওয়ার দিয়ে চামচ বাকিয়ে ফেলছি। জেমস রান্ডি তার ধান্দাবাজি ফাঁস  করে দিয়েছিলেন।   The truth about uri geller নামে একটা বইও লিখেছিলেন তখন তিনি 

(https://en.wikipedia.org/wiki/The_Truth_About_Uri_Geller) 

২। হোমিওপ্যাথি যে ভুয়া, এর ওষুধের মধ্যে পানি আর চিনি ছাড়া আর কোনো কেমিকাল নাই, সেটা প্রমান করার জন্য তিনি নিজের শরীরের উপরেই পরীক্ষা করেছিলেন।

তিনি গেলেন একটা হোমিওপ্যাথির দোকানে। ৬ মাসের ঘুমের ওষুধ কিনলেন। তারপর সেই ৬ মাসের ওষুধ একসাথে খেয়ে ফেললেন। 

এত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরেও তার একটুও ঘুম এল না। তিনি হেটে চলে বেড়ালেন ঠিকমত। 

পরবর্তীতে তিনি টেড টকেও দর্শকদের সামনে লাইভ হোমিওপ্যাথি খেয়ে দেখিয়েছেন, এর কোনো ইফেক্ট নাই। 

https://www.ted.com/.../james_randi.../transcript... 

৩। পিটার পপফ ( Peter popoff) নামে এক Faith healer ধান্দাবাজি ব্যবসা করছিলেন  আমেরিকায়। শত শত মানুষ তার  সেশনে আসে অডিটোরিয়াম ভর্তি করে। পপফ দর্শক সারি থেকে একেকজনকে র‍্যান্ডমলি দাড় করান। তারপর তার নাম, বাপের নাম, বাসার ঠিকানা, বয়স, হবি,অসুখ বিসুখ  সহ ১৪ গুষ্টির কথা বলে দিয়ে চমকে দেন তাকে। দাবি করে, ঈশ্বর তাকে এইসব তথ্য জানিয়ে দিচ্ছেন, কোনো এক অলৌকিক উপায়ে। 

তারপর দর্শককে স্টেজে এনে বিশেষ পদ্ধতিতে ( মন্ত্র পড়ে, হাত পা নাড়ানাড়ি করে) ওই রোগীর দেহ থেকে শয়তান বের করে দেন। রোগী সর্বরোগ থেকে সূস্থ হয়ে ওঠেন।

জেমস রান্ডি দেখালেন, পপফের কানে খুব ছোট একটা হেডফোন লাগানো থাকে। এই হেডফোন দিয়ে তার এ্যাসিস্ট্যান্ট রা বলে দেয় , কোন লোকের নাম কি, কার বয়স কত,কার কি অসুখ। অডিটোরিয়াম এ ঢোকার সময়েই সবাই যে রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম ফিল আপ করে,  সেখান থেকেই এই তথ্যগুলা পাওয়া যায়। 

৪। ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ল্যাবরেটরি থেকে একবার র‍্যান্ডির কাছে ফোন আসে। তাঁরা এক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন যিনি তাঁর হাতের উল্টো পিঠে রাখা ম্যাচের বাক্সকে “মনের শক্তি” তাঁর কথামত দাঁড় করাচ্ছে এবং শোয়াচ্ছে! কী আজব ব্যাপার স্যাপার! তাঁরা র‍্যান্ডিকে ফোন করলেন, বিষয়টি জানালেন। 

র‍্যান্ডি ব্যাখ্যা দিলেন -- 

“এই যাদুটি করা খুব সহজ, ম্যাচের বাক্স হাতের উপর রাখার সময় বাক্সটি একটু খুলে হাতের একটু চামড়া বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। মাংসপেশী সম্প্রসারণ আর সঙ্কুচনের প্রভাবে এমনিতেই ম্যাচের বাক্সটি দাঁড়াবে এবং শুয়ে পড়বে।” 

https://bigganjatra.org/the_amazing_randi/

৫। জেমস হাইড্রিক নামের এক ধান্দাবাজ দাবি করলেন,  তিনি হাত দিয়ে টাছ না করেই বইয়ের পাতা উল্টাতে পারেন। রান্ডি তাকে চ্যালেঞ্জ করলেন। তার বইয়ের পাতায় কিছু পাতলা ফোম আর বাদাম রেখে দিলেন। 

 টেবলে বই রেখে, সে কয়েক পা দুর থেকে হেটে এসে টেবিলের কাছাকাছি বসত। হেটে এসে ও টেবিলের সামনের বসাতে, তার বডির সম্মুখমুখী মুভমেন্টের কারনে সম্মুখমুখী একটা এয়ার কারেন্ট তৈরি হত। এই এয়ার কারেন্ট বইয়ের পাতাতে গিয়ে ধাক্কা লাগত, সে শুধু টাইমিং করে হাত উচু করত, মনে হত সাইকিক পাওয়ার। 

রান্ডি বইয়ের চারপাশে পাতলা ফোম ছিটিয়ে রাখার পরে হাইড্রিক ওই ট্রিক খাটাতে পারেনি। ধরা পড়ে যায় সে। 

https://m.youtube.com/watch?feature=youtu.be&v=7CASghTzNhc

এই ধরনের অনেক ধান্ধাবাজের গল্প, এবং তাদের জারিজুরি ফাস করে দেওয়ার কাহিনী তিনি লিখেছেন তার ১০ টা বইতে। Conjuring এবং The Faith healers তার সবচেয়ে জনপ্রিয় বই

 (জানামতে, তার কোনো বই এখনো বাংলায় অনুবাদ হয়নি। আগ্রহী কোনো অনুবাদক কি এগিয়ে আসবেন প্লিজ?) 

৬।   শুধু রিয়েল লাইফে নয়, তিনি প্রচুর লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন। হিন্দি পিকে সিনেমায় পিকে আর গুরুজী যেমন লাইভ বিতর্কে বসেছিল,  সেইরকম ভাবে জেমস রান্ডি অনেক টিভিতে লাইভ বিতর্ক করেছেন। Exploring psychic powers এইরকম একটা টিভি শো ছিল। 

টিভি পর্দায় অভিনেতা হিসেবেও দেখা গেছে তাকে অনেক জায়গায়। অতি সাম্প্রতিক - নেটফ্লিক্স এর    The Messiah তার উদাহরণ।  এই টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়, পায়াম গোলশিরি নামক এক লোক সিরিয়ার মরুভূমি থেকে উঠে এসে নিজেকে ইমাম মাহদি / দি মেসায়া/ ত্রানকর্তা হিসেবে দাবি করছে। ঘটনাচক্রে সে নিউইয়র্কে পৌছায়, ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল লেকে পানির উপর দিয়ে হেটে হেটে লোকজনকে মুগ্ধ করে। 

টিভিতে তখন জেমস রান্ডি পায়াম গোলশিরিকে চ্যালেঞ্জ করে, আমার সামনে,  টিভি ক্যামেরার সামনে , সকল চেকিং এর মধ্যে দিয়ে মেসায়া আবার এসে পানির উপর দিয়ে হেটে দেখাক। ট্রিক বাদে তার যদি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকে, সে অবশ্যই আবার হাটতে পারবে। 

মেসায়া পায়াম গোলশিরি সেই চ্যালেঞ্জ নেয় নাই।

সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ টা সিনেমা বা টিভি শোতে জেমস রান্ডি অভিনয় করেছেন। অধিকাংশ জায়গায় তিনি নিজের পেশাগত পরিচয়েই অভিনয় করেছেন। 

৩. 

নিজের জেমস রান্ডি ফাউন্ডেশন বাদেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন Committee for Skeptical Inquiry যেটা বিশ্বের অনেকগুলা স্কেপটিক সংগঠনের একটা আমব্রেলা। কার্ল স্যাগান, আইজ্যাক আজিমভ সহ অনেক বিজ্ঞানী এমনকি নোবেল লরিয়েট এই সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলেন।

 বিশ্বব্যাপীই একটা নতুন আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি, যেটা Skeptic Movement নামে পরিচিত। বিভিন্ন দেশের অজ্ঞতা, কুসংস্কার,গুজব দূর করে, মানুষকে শিক্ষিত সচেতন করে তুলতে এই স্কেপটিক মুভমেন্ট ( সংশয়বাদী আন্দোল)  অনেক ভূমিকা রেখেছে 

https://en.wikipedia.org/.../Committee_for_Skeptical_Inquiry

জেমস রান্ডির দেখানো পথে পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনেক স্কেপটিক সংগঠন এর জন্ম হয়েছে। উইকিপিডিয়ার এই লিস্টে কমপক্ষে ২৬ টা এমন সংগঠন এবং চ্যালেঞ্জের কথা পাওয়া যায়। 

https://en.m.wikipedia.org/.../List_of_prizes_for...

আমাদের প্রতিবেশী ,ভারতের কোলকাতাতেই 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিত'' নামে একটা সংগঠন আছে। তারা যেকোনো অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারলে ৫০ লক্ষ রুপি দিবে। এই দলের মূল কর্নধারের নাম প্রবীর ঘোষ। তার লেখা 'অলৌকিক নয় ,লৌকিক' বইটা  খুব জনপ্রিয়। 

বাংলাদেশে এমন কোনো সংগঠন নাই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে চেষ্টা করছেন। যেমন- 

১। জুয়েল আইচ একবার চ্যালেঞ্জ দিয়েচিলেন, কেউ যদি চীন থেকে আমদানি করা নকল ডিম দেখাতে পারে, তাহলে তাকে এক লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এখনো কেউ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেনি। কিন্তু ডিম সংক্রান্ত  গুজব চলছে সমানে 

https://www.facebook.com/photo/?fbid=2325420754184561&set=a.651782084881778

সাভারের বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আতাউল গনি রব্বানি ও একই চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন।  কোনো দাবিদার পাননি তিনিও

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1843265902354464&id=100000132163030

২। খুলনায় ALO - Antisuperstition Learning Organization নামে একটি সংগঠনের কথা জানা যায়, যারা এমন অলৌকিক ঘটনা প্রমাণে এক লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল 

 https://www.facebook.com/Alo.AntisuperstitionLearningOrganization

৩। Baba Exposed নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ বিভিন্ন ফকির/কবিরাজ/ঘোস্ট হান্টার/প্যারানরমাল রিসার্চার এর ভন্ডামি উন্মোচন করে দেয়। এদের সবচেয়ে বড় সাফল্য- এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফ এম এর 'ডর' নামক অনুষ্ঠান বন্ধ করা। 

আরজে কিবরিয়া আর রাদবি রেজার পরিচালনায়  এই রেডিও শো তে লাইভ প্লানচেট করা হত, জিন নামানো হত, আংটি পাথর আতর বিক্রি করা হত। সোশাল মিডিয়ায় এদের ভন্ডামি প্রকাশ করার পরে পুলিশ একশন নেয়। আরজে রেজা কে পুলিশ এরেস্ট করে। এবিসি রেডিও অথরিটি ডর অনুষ্ঠানটা বন্ধ করে দেয় এবং আরজে কিবরিয়া কে এবিসি রেডিও থেকে বহিষ্কার করে। 

https://www.facebook.com/babaxposed/

৪। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ তালাশ, খোজ,ইনভেস্টিগেশন ২৪,সার্চ লাইট  জাতীয় বিভিন্ন অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান দেখায় এখন। এরা বিভিন্ন অপবিজ্ঞান না ধান্দাবাজির ব্যবসা এক্সপোজ করে নিয়মিত। 

যেমন-  ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির তালাশের এই এপিসোডে দেখা যাচ্ছে, যশোর এলাকায় এক কবিরাজ জিনের সাহায্যে করোনার চিকিতসা করাত। তালাশের ক্যামেরা-সাংবাদিক দেখে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। ক্যামেরার সামনে কনফেস করেছে যে এইভাবে করোনা নিরাময় সম্ভব নয়। 

https://youtu.be/K4SV0KTKGaY

৫। জনপ্রিয় লেখক ও অনুবাদক মুহম্মদ নাজিম উদ্দিন এর 'পেন্ডুলাম' নামক বইয়ের নায়ক চারু আহসান কে দেখা যায় একটি কাল্পনিক স্কেপটিক সংগঠন চালাতে। এটা পুরোপুরি কাল্পনিক চরিত্র ,নাকি মুহম্মদ নাজিম উদ্দিনের পরিচত কেউ এমন কার্যকরম চালাচ্ছেন , এবং তাকে দেখে তিনি এই বই লিখতে ইনস্পায়ার্ড হয়েছেন, সেটা জানা যায়নি।

https://m.facebook.com/groups/383271456026783?view=permalink&id=383273889359873

৪.

আমরা, বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি গুজব শুনি, গুজব শুনে কাজ করি। 

জেমস রান্ডির মত বিচার বিশ্লেষণ করিনা, চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই দৌড় মারি চিলের পেছনে।

 পদ্মাসেতুতে কল্লা লাগবে শুনেই ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ মা কে পিটিয়ে মেরে ফেলি। 

চাদের গায়ে রাজনৈতিক নেতার ছবি দেখা গেছে শুনেই রাস্তায় নেমে ভাংচুর শুরু করি। 

থানকুনি পাতা খেলে করোনা সেরে যাবে শুনে গভীর রাতে থানকুনি পাতা খুজি। 

বিভিন্ন রোগে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে অন্যান্য অপচিকিতসক দের কাছে ছুটি, এবং নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনি। 

জেমস রান্ডির মত বিশ্লেষণী ক্ষমতার লোক আমাদের  ঘরে ঘরে দরকার। ৯২ বছরের দীর্ঘ জীবনে রান্ডি পৃথিবীবাসীকে সচেতন করার যে কাজ শুরু করেছিলেন  , সেই ধারা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন আপনার,আমার,প্রত্যেক সচেতন মানুষের।

ভারতের মুসলমান সমাজ ও তাদের জিনোম -মধুশ্রী বন্দ্যেপাধ্যায়
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারতীয় মুসলমানরা কি এদেশীয় নাকি তারা দেশের বাইরে থেকে এসেছেন - এই নিয়ে আজও বিতর্ক চলেছে। অথচ এই বিষয়ে জিনবিদ্যার গবেষণা অন্তত ১৫ বছর ধরে চলেছে এবং সকলে প্রায় একই সিদ্ধান্তে এসেছেন।

পুরুষদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ ডেটা থেকে ১৫ বছর আগে একদল বিজ্ঞানী সিদ্ধান্তে আসেন যে, পিতৃক্রমের দিক দিয়ে ভারতীয় মুসলমানরা মূলতঃ আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত। তবে ভারতীয় শিয়াদের মধ্যে আফ্রিকান ও মধ্য প্রাচ্যের ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’-র এক বিশেষ মিউটেশনের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ পুরুষের শুক্রাণুতে পাওয়া যায়। শিয়াদের এই মার্কার প্রমাণ করে, সম্ভবত একটা জিন প্রবাহ অর্থাৎ মাইগ্রেশন হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে। এটি সুন্নিদের মধ্যে অনুপস্থিত।

২০১০ সালে আবার গবেষণা করে দেখা যায় যে, ভারতীয় মুসলিমদের জিনোমিক প্রোফাইল ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী অমুসলিমদের সঙ্গেই মেলে। তবে সামান্য পরিমাণে আফ্রিকা, আরব ও পশ্চিম এশিয়া থেকে জিন প্রবাহ এসেছে। শেষ পর্যন্ত এখানেও একই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে যে, ভারতবর্ষে ইসলাম কোন ব্যাপক বহিরাগত জিন প্রবাহ নিয়ে প্রবেশ করেনি। সামান্য মানুষ ওই অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।

প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জোনমিং ঝাও ও তার সহকর্মীরা। ওরা দেশীয় শিয়াদের মধ্যে সনাক্ত করেন এক বিশেষ ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ। এটি সুন্নিদের মধ্যে পাওয়া যায় না। শিয়াদের মধ্যে এই ডিএনএ-র উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মুসলিমদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু জিনগত পার্থক্য আছে।

আবার বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভারতীয় মুসলিমরা মাতৃক্রমের দিক দিয়ে দেশের বাইরের লোকদের সঙ্গে নয় বরং অন্যান্য ভারতীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনীয়। তারা মাতৃক্রমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। 

সত্যি কথা বলতে, ভারতবর্ষের যে কোন ধর্ম, বর্ণের মানুষের সংখ্যাগুরু অংশ মাতৃক্রমে সেই ৬৫ হাজার বছর আগের আফ্রিকা থেকে আগত নারীদের বংশধর। 

অর্থাৎ পরে যে মূল মাইগ্রেশনগুলো হয়েছিল, যেমন ইরানের শিকারি-সংগ্রাহক, বা ইন্দো ইউরোপীয় বা অস্ট্রো-এশিয়াটিক - তাদের মধ্যে নারী ছিল কম। অস্ট্রো-এশিয়াটিক মাইগ্রেশনের সময়ে ওদের মধ্যে নারী প্রায় অনুপস্থিত ছিল। একমাত্র তিব্বতি-বর্মীদের মধ্যে কিন্তু নারী পুরুষ প্রায় সমান হারে এসেছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ভারতীয় মুসলমানরা যদিও হিন্দু বর্ণপ্রথা অনুসরণ করেন না তবে তারাও নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিয়ে সীমাবদ্ধ রাখেন। অর্থাৎ সুন্নি এবং শিয়ারা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিয়ে করতে পছন্দ করেন। 

দেশজুড়ে মুসলমানদের নিয়ে একাধিক গবেষণায় জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ভারতে ইসলামের বিস্তার মূলতঃ একটি সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ, মুসলিম বিশ্ব থেকে জিন প্রবাহের প্রমাণ তেমন পাওয়া যায় না। ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষত্রী, কুর্মি, ব্রাহ্মণ এবং ঠাকুরদের মতোই ভারতীয়।

মুসলিমরা ততটাই ভারতীয় যতটা হিন্দুরা। 

বাঙালি মুসলিমরা ততটাই ভারতীয় যতটা বাঙালি  হিন্দুরা। 

বাঙালি মুসলমানের এই দেশ, এই ভাষা, এই খাবার, এই নদী, এই পাহাড়, এই আকাশ, এই বাতাসের ওপরে ততটাই অধিকার ও দায়িত্ব থাকে যতটা আছে পাশের হিন্দুদের। 

এই তথ্য আশা করি মুসলমানদের মধ্যে প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। মুসলমানদের দেশের প্রতি অধিকার ও কর্তব্য তার পাশের হিন্দুদের থেকে একবিন্দু কম নয়।

অবশ্য যদি তারা সকলে বাইরে থেকে আসতেন তবুও কিন্তু অধিকার ও কর্তব্য কমত না। কারণ তারা এই দেশটাকে নিজের বাসস্থান করে নিয়েছেন। যেমন নিয়েছিল ৩৫০০ বছর আগে স্তেপভূমির ইন্দো-ইউরোপীয়রা বা ৫০০০ বছর আগে অস্ট্রো-এশিয়াটিকরা।

কিন্তু ব্রিটিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসিরা তা নেয়নি। তারা রাজ্য শাসনের অবসান হতেই পোটলা গুটিয়ে চলে গেছে। 

এটা তাদের দেশ নয়।

একটু লজ্জা পাওয়ার জন্য -শ্যামল চ্যাটার্জী
Nov. 20, 2024 | সচেতনতা | views:683 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সালটা ১৯৯৮।

৩০ সেপ্টেম্বর আসানসোল থেকে পাঁচ বছরের অসুস্থ শৌভিক চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসে। বাবার কাছে আবদার করে সে আর আসানসোলে ফিরে যাবে না, এই শহর কলকাতাতেই থাকবে।  ওর বাবা-মা ওকে একা ফেলে রেখে আসানসোলে চলে যায়। হ্যাঁ, তারপর থেকে শৌভিক একাই এখনও এই শহর কলকাতাতেই আছে।

নিশ্চয় আপনার কৌতুহলি মনে প্রশ্ন জাগছে যে শৌভিক কোথায় আছে? কেনইবা আর আসানসোলে ফেরত গেল না? কী রকম বাবা-মা? আরো অনেক অনেক প্রশ্ন।

ব্যাপারটা খোলসা করি।

এস এস কে এম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শৌভিকের চিকিৎসকেরা জানালেন খুব দ্রুত শৌভিকের জন্য রক্ত লাগবে। সেই দিনটা ছিল ২৯ অক্টোবর। শৌভিকের বাবা মনিময়, একজন পরিচিত জুনিয়র ডাক্তারকে সঙ্গে কলকাতার সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক ঘুরলেন। সব ব্লাড ব্যাঙ্কের ঝাঁপ বন্ধ। কারণ, তখন বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব চলছে। আনন্দে সবাই মাতোয়ারা। রক্ত পাওয়া গেল না। দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল শৌভিকের হৃদস্পন্দন। না, শোকে বিহ্বল হলেন না মনিময়বাবু। শৌভিকের কলকাতায় থাকার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করলেন পাঁচ বছরে পুত্র শৌভিকের মৃতদেহ দান করার মধ্য দিয়ে। নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগ মনিময়বাবুর উদ্যোগকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে শৌভিকের পাকাপাকি কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করেন। সত্যি আজও নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে শৌভিক  আছে। লেকচার রুমে কাঁচের বাক্সের মধ্যে ওর কঙ্কালটা আছে। 

অমানবিকতার বিরুদ্ধে শৌভিক দৃষ্টান্ত হিসেবে আজও বর্তমান।

কত সংগঠন কত জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের স্মরণে রক্তদান শিবির করেন। সেই সব সংগঠনগুলির প্রতি আবেদন 'শৌভিক স্মরণে' রক্তদান শিবিরের আয়োজন করুন। কোন রকম সাহায্যের প্রয়োজন হলে সাথে আছি।

হৃদয়চন্দ্র মন্ডলের গ্রেফতার ও বিজ্ঞানচর্চায় কিছু প্রশ্ন -ড. রূপম প্রামাণিক
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:767 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মন্ডলের গ্রেফতার হওয়া এবং ১৯দিন জেলহাজতের পর জামিনে মুক্ত হওয়া সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।  তাঁর অপরাধ; তিনি বিজ্ঞানকে ধর্মের থেকে পৃথক করে, বলা ভাল বিজ্ঞানকে ধর্মের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। অথচ ধর্ম অবমাননার দায়ে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। একজন ছাত্র বিজ্ঞানের ক্লাসে তাঁর বক্তব্য রেকর্ডিং করে ছড়িয়ে দেয়। তারপর কিছু ছাত্র-ছাত্রী এবং এক শ্রেণীর মৌলবাদী মানুষ তাঁকে গ্রেফতারির দাবি তোলে। যথারীতি গ্রেফতার হন হৃদয় মন্ডল। কোর্টও তাঁর ২ বার জামিন নাকচ করে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে  হৃদয় মন্ডলের মুক্তির দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগ চত্ত্বর থেকে ঢেউ আছড়ে পড়ে বুদ্ধিজীবি সমাজে। হৃদয় মন্ডলকে নিয়ে গান লেখেন প্রিন্স মাহমুদ। সেই গান বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের কন্ঠে ধ্বনিত হয়, ইউটিউবে কোটিবার দেখা হয়। অবশেষে নাগরিক সমাজের চাপে জামিন পান হৃদয় মন্ডল। ইউটিউব থেকে যে অডিও রেকর্ডিং আমারা শুনেছি তাতে বোঝা যাচ্ছে হৃদয় মন্ডল ছাত্রটির প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন যে, বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের প্রশ্নকে ধর্মের আদল দেওয়া ঠিক নয়। প্রসঙ্গত হিন্দু ধর্মে বর্ণিত হনুমানের কানের ভেতরে সূর্যের অবস্থানকেও তিনি অস্বীকার করছিলেন। অথচ কোরান অবমাননার দ্বায়ে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন - পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্মস্থান প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে। বিদ্যালয়কে ধর্মস্থানের রূপ দিতে চাইলে ঠিক হবে না। বিদ্যালয়ে যুক্তিবাদীতাই এবং মুক্তবুদ্ধি স্থান পাবে। এটা আসলে প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার সুচারু পরিকল্পনা। ভারতবর্ষ, পাকিস্তানে ধর্মগুরুদের বাড়বাড়ন্ত দেখে এর অন্যথা মনে হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন গণেশের শুঁড় আসলে প্রাচীন ভারতের প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন মহাভারতে সঞ্জয়ের আখ্যান আসলে প্রাচীন ভারতের ইন্টারনেট ব্যবস্থার উদাহরণ, তখন আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কেন দেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। আমাদের মনে পড়বে 'দাদাগিরি'তে 'সুপার ন্যাচারাল' শক্তির প্রসঙ্গে কয়েকটি ডিভাইস দেখিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া একটি দলের কথা। যখন তাদের কাছে 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র চ্যালেঞ্জ যায় তাদের বক্তব্য প্রমাণের, তাদের আর পাত্তা পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ডারউইনকে দিয়ে কোরানের ব্যাখ্যা মূর্খতার অন্যতম নজির, যা নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হচ্ছে। আচ্ছা ভেবে দেখুনতো ক্রোমোজম থেকে শুরু করে পরমাণু পর্যন্ত - এসবের ব্যাখ্যা ধর্মগ্রন্থে কোথায়? বর্তমানে এই উপমহাদেশে ধর্ম অবমাননার বহু অভিযোগ ওঠে। আচ্ছা, ধর্মের কথা বলতে গিয়ে যে প্রতিদিন বিজ্ঞানের অবমাননা হচ্ছে, তার কি শাস্তি হবে? আমরা যেভাবে ভূত বা ভগবানের গল্পকে সত্যি বলে দেগে দিই, ফলত শিশুমনে ভূতকে নিয়ে ভয় এবং ভগবানে ভক্তি তৈরি হয়। এভাবে যে আমরা শিশুদের চিন্তার স্থবিরতা তৈরি করছি, তার শাস্তিই বা কি হবে? শিশুদের আর দোষ কোথায়!  বিজ্ঞানের শিক্ষক যদি তাবিজ-কবজ-রত্ন ধারণ করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে যান, তখন বুঝে নিতে হয়, তিনি চাকরি পাওয়ার জন্য বিজ্ঞান পড়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পারেননি। যে অভাগা দেশে বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধন হয় নারকেল ভেঙে বা বিজ্ঞান কংগ্রেসের শিশু অধিবেশনে শিশুদের বোঝানো হয় বিজ্ঞান ও পুরাণ অভিন্ন, সে দেশের আর কিইবা হতে পারে? বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কিছু মানে না। যার প্রমাণ নেই তা দর্শন হতে পারে, সাহিত্য হতে পারে, অলৌকিক মায়াজালের কল্পনা হতে পারে; বিজ্ঞান হতে পারে না। তাই বিজ্ঞানচর্চা করতে গেলে ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার বিসর্জন দিতে হবে, মানবতাকে মুক্ত করতে হবে।

"সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে -- এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে। "

বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার (সংক্ষেপিত) -আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
Nov. 20, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:811 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মিলনীর অভিভাষণে এক স্থলে বলিয়াছিলাম যে, ‘প্রায় সহস্র বৎসর যাবৎ হিন্দুজাতি একপ্রকার মৃতপ্রায় হইয়া রহিয়াছে। যেমন ধনীর সন্তান পৈতৃক বিভব হারাইয়া নিঃস্বভাবে কালাতিপাত করেন, অথচ পূর্বপুরুষগণের ঐশ্বর্যের দোহাই দিয়া গর্বে স্ফীত হন। আমাদেরও দশা সেইরূপ। লেকী বলেন যে, খৃঃ অঃ দ্বাদশ শতাব্দী হইতে ইউরোপ খণ্ডে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রথম প্রবাহিত হয়। প্রায় সেই সময় হইতেই ভারতগগন তিমিরাচ্ছন্ন হইল। অধ্যাপক বেবর (Weber) যথার্থই বলিয়াছেন যে, ভাস্করাচার্য ভারতগগনের শেষ নক্ষত্র। সত্য বটে, আমরা নব্য স্মৃতি ও নব্য ন্যায়ের দোহাই দিয়া বাঙালি মস্তিষ্কের প্রখরতার শ্লাঘা করিয়া থাকি, কিন্তু ইহা আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে সময় স্মার্ত ভট্টাচার্য মহাশয় মনু, যাজ্ঞবল্ক, পরাশর প্রভৃতি মন্থন ও আলোড়ন করিয়া নবম বর্ষীয়া বিধবা নির্জলা উপবাস না করিলে তাহার পিতৃ ও মাতৃকুলের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কয় পুরুষ নিরয়গামী হইবেন, ইত্যাকার গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন, যে সময়ে রঘুনাথ, গদাধর ও জগদীশ প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায়গণ বিবিধ জটিল টীকা-টিপ্পনী রচনা করিয়া টোলের ছাত্রদিগের আতঙ্ক উৎপাদন করিতেছিলেন, যে সময়ে এখানকার জ্যোতির্বিদগণ প্রাতে দুই দণ্ড দশপল গতে নৈঋত কোণে বায়স কা কা রব করিলে সে দিন কী প্রকারে যাইবে ইত্যাদি বিষয় নির্ণয়পূর্বক কাকচরিত্র রচনা করিতেছিলেন, যে সময়ে এ দেশের অধ্যাপকমণ্ডলী ‘তাল পড়িয়া ঢিপ করে, কি ঢিপ করিয়া তাল পড়ে’ ইত্যাকার তর্কের মীমাংসায় সভাস্থলে ভীতি উৎপাদন করিয়া সমবেত জনগণের অন্তরে শান্তিভঙ্গের আয়োজন করিতেছিলেন, সেই সময়ে ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন প্রমুখ মনস্বীগণ উদীয়মান প্রকৃতির নূতন নূতন তত্ত্ব উদ্ঘাটন পূর্বক জ্ঞান জগতে যুগান্তর উপস্থিত করিতেছিলেন ও মানবজীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতেছিলেন। 

উপরে যে মন্তব্য প্রকটিত হইল, তাহা একবার বিশেষভাবে আলোচনা করিয়া দেখা যাউক। বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্র এক স্থলে স্মরণীয় বাঙালির মধ্যে উল্লিখিত মহাত্মাগণ ও কুল্লুকভট্টের নাম করিয়া বলিয়াছেন, ‘অবনতাবস্থায়ও বঙ্গমাতা রত্নপ্রসবিণী'। এখন বিবেচনার বিষয় এই যে, আজ বর্তমান জগতের ভীষণ জীবনসংঘর্ষের দিনে আপনাদের জাতীয় অস্তিত্ব বজায় রাখিতে হইলে রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টোলে প্রবেশ লাভ করিয়া পুনরায় ন্যায় সাংখ্যের গবেষণায় নিযুক্ত হইতে হইবে, কি বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান ও প্রতিভার রশ্মি লক্ষ্য করিয়া ধাবিত হইতে হইবে? আমরা আজ কালবারিধিতীরে দাঁড়াইয়া শুধু কি উত্তাল তরঙ্গমালা গনিয়া হতাশ মনে গৃহে ফিরিব? ক্ষুদ্র জলাশয়ে আবদ্ধ হইয়া ভাবিব, আমরা বেশ আছি? অথবা নিরাশার তীব্র দংশনের ক্ষোভ মিটাইবার নিমিত্ত ভাবিব, বর্তমান জগতের শিক্ষা ও দীক্ষা ভ্রান্তিমূলক, উহা মানব হৃদয়ে জ্বালাময়ী তৃষ্ণা জনন করিয়া সুখ, শাস্তি ও আধ্যাত্মিক চিন্তাশীলতার পথে কণ্টকসমাকীর্ণ করে?

কোনো জাতির গৌরব ও মহত্ব নিরূপণ করিতে হইলে, কী কী উপাদানে এই মহত্ব গঠিত সর্বাগ্রে তাহারই পর্যালোচনা করিতে হইবে। আমার বোধ হয়, ভূদেব ও বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত অভিমতের উপর নির্ভর করিয়া যাঁহারা বাঙালির, এমনকী হিন্দু জাতির অতীত গৌরবের শ্লাঘা করিয়া থাকেন, তাঁহারা অজ্ঞাতসারে ভ্রান্ত অভিমত পোষণ করেন মাত্র। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টীকা-টিপ্পনী শ্লাঘার বিষয় জ্ঞান করিয়া, যদি উহারই আদেশ অভ্রান্ত সত্য মানিয়া, সেই অতীতপ্রায় কূটশিক্ষায় মনোনিবেশ আমাদের গৌরবের বিষয় বলিয়া অনুমিত হয়, আর বর্তমানের নূতন আশা, নুতন উদ্দীপন ঠেলিয়া ফেলিয়া প্রাচীনের প্রচলন স্থির ধীর কর্ম বলিয়া আদৃত হয়, জানি না এ মৃতপ্রায় জাতি নূতনের প্রবল অসহনীয় সংঘর্ষে আর কতদিন বাঁচিতে সক্ষম হইবে। স্বাধীন চিন্তা জাতীয় জীবননদের উৎস। এই উৎস যেদিন হইতে শুকাইতে আরম্ভ করিয়াছে, সেই দিন হইতে মৌলিকতা ও অনুসন্ধিৎসা তিরোহিত হইয়াছে, সেই দিন হইতে বাঙালি জাতির অধোগতির সূত্রপাত হইয়াছে। আজ সহস্র বৎসরকাল এই স্বাধীন চিন্তার স্রোত আলস্য এবং অন্ধবিশ্বাসরূপ গভীর কর্দমে আবদ্ধ হইয়া জাতীয় জীবনের প্রস্রবণকে বদ্ধ করিয়াছে। যখনই স্বাধীন চিন্তা, বিচার শক্তি ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আইসে, চরিত্র মধ্যে যখন স্বীয় অভিমত পোষণ করিবার সাহস চলিয়া যায়, তখন পরের গ্রাসে আহার করিবার প্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে। ফলত এরূপ জীবন ইতর প্রাণীর জীবনাপেক্ষা অল্পমাত্রই বিভিন্ন, কেন না, প্রাকৃতিক আদেশ প্রতিপালনই মানুষের একমাত্র লক্ষ্যের বিষয় নহে। গাভী প্রত্যুষ হইতে প্রদোষ পর্যন্ত ঘাস খায়, ক্লান্ত হইয়া রাত্রে বিশ্রাম করে, দিবসভুক্ত নবতৃণাঙ্কুর উদ্গীরণ ও রোমন্থন করে— স্বীয় বৎসকে স্তন্য দেয় ও যথাসম্ভব তাহাকে মানুষের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার প্রয়াস পায়; পরম স্নেহাস্পদ বৎসটির গাত্র স্নেহনিদর্শনস্বরূপ অবলেহন করে। এই প্রকার জীবনযাত্রা নির্বাহ করাই কি মানবের উদ্দেশ্য? আহার-বিহার-নিদ্রাই কি ঈশ্বরসৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীবের কেবল একমাত্র কর্তব্য? আপনার গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ থাকিয়া নিষ্ফল সস্বার্থ- গবেষণায় কালাতিপাত করা, জাত্যাভিমান পাণ্ডিত্যাভিমানে স্ফীত হইয়া উচ্চ-নীচের কল্পিত ভেদাভেদকে গভীরতর করা, আর মানবজাতির সাধারণ সম্পত্তি স্বাধীন চিন্তাকে বিসর্জন দিয়া, দুর্বোধ শ্রুতি ও স্মৃতির টীকাকরণে মস্তিস্কের প্রখরতা ক্ষয় করা কি বিধাতার অভিপ্রেত? পরম করুণাময় পরমেশ্বর কি মানুষকে জ্ঞান, ধৃতি, ক্ষমা ইত্যাদি দুর্লভ গুণালংকৃত করিয়াও এতদপেক্ষা মহত্তর চরিত্র ও অনুষ্ঠান দাবি করেন না?

ভারতবর্ষীয় প্রাচীন গৌরবের কথা আমি ভুলি নাই; পূর্বপুরুষগণের পবিত্র স্মৃতির প্রতিও আমি কাহাকেও সম্ভ্রমহীন হইতে বলি না। কিন্তু যাঁহারা সেই স্মৃতির প্রতি সম্ভ্রমযুক্ত হইতে গিয়া তাঁহাদিগের ভুলগুলিকেও অলংকার-বিভূষিত করিতে চাহেন— সে গুলির অনুকরণ করিতে চাহেন, তাঁহাদিগের জন্যই আমার "বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার" প্রবন্ধের অবতারণা।

কুল্লুকভট্ট ও রঘুনন্দনের অপূর্ব পাণ্ডিত্যের প্রশংসা শুনিয়াই যাঁহারা দেশে সেই প্রাচীন টোলের শিক্ষাপ্রণালী সংস্থাপন করিতে চাহেন, নূতনকে একেবারে তাড়াইয়া পুরাতনকে তাহার স্থানে আনিতে চাহেন, তাঁহাদিগের সহিত আমি কখনও একমত হইতে পারি না। নূতন ভারতবর্ষীয় জাতি, নূতন ও পুরাতন উভয়ের সম্মিলনে গঠিত হইবে। অন্ধবিশ্বাস জাতীয় উন্নতির মূল হইতে পারে না। প্রাচীন হিন্দু জাতির মহান আদর্শ ভুলিলে আমাদের চলিবে না, কিন্তু সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে উক্ত আদর্শের অনুকরণ কতটা সম্ভব তাহাও আমাদিগকে ভাবিতে হইবে।

উপেক্ষিত ও বিস্মৃত বিজ্ঞানসাধক মেঘনাদ সাহা -অরিন্দম
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:7885 | likes:3 | share: 2 | comments:0

   Scientists are often accused of living in the “Ivory Tower” and not troubling their mind with realities and apart from my association with political movements in my juvenile years, I had lived in ivory tower up to 1930. But science and technology are as important for administration now-a-days as law and order. I have gradually glided into politics because I wanted to be of some use to the country in my own humble way.

    —Meghnad 

মেঘনাদ সাহা। কি নামটা চেনা চেনা ঠেকছে? ঠিক ধরেছেন। হ্যাঁ উনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। কিসের বিজ্ঞানী ছিলেন বলুন তো? আটকে গেলেন তো! বলুন তো কী করতে মনে রাখবেন? লোকটা কী এমন করেছে? রাজা মহারাজাদের থেকে পয়সা নিয়ে বিদেশে গিয়ে ধর্মসভায় বক্তৃতা দিয়ে দেশের নাম বাড়িয়েছে? না। কাজের খোঁজে ভগবানের কাছে দয়াভিক্ষা করেননি, কোনও ঠাকুরের শিষ্যও ছিলেন না। কোনও ধর্মীয় মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে? না। এমনকি সবজায়গায় খাপে খাপ মিলে যায় এমন কোনও বক্তৃতা দেননি, উদ্ধৃতিও পাওয়া যায় না। এমনকি কলকাতাতেও জন্মাননি। নামদার বাপ-মাও ছিল না। বিশ্বাস করুন আমিও নামটুকুই জানতাম। বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন আর সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স— ওইটুকুই। কিন্তু বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক আশিস লাহিড়ীর মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে বক্তব্য শুনে আর একটু পড়াশুনো করে আমি অভিভূত ও শ্রদ্ধাবনত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র, বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সতীর্থ ও বন্ধু, কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন এই সাহা। একবগগা কাঠখোট্টা বিজ্ঞানসাধক, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, ছাত্রদরদী শিক্ষক, এক নিখুঁত বিজ্ঞানপ্রসারক ও পরিকল্পক। জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে বিজ্ঞানে ইউরোপীয় আমেরিকানদের একচেটিয়া দখলদারিত্বে ভাগ বসিয়েছেন শুধু নয়, ভেঙে দিয়েছেন। আধুনিক ভারতের এই যতটুকু বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয়েছে তার অন্যতম মূল পরিকল্পক শুধু নন তার খুঁতটুকু নিয়েও উচ্চকিত। শুধু তাই নয় গান্ধির খাদি, চরকা ও শিল্পনীতির ঘোর বিরোধী, জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক, বয়সে ছোট সুভাষ বসু সম্পর্কে প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন মেঘনাদ সাহা। বারবার তীক্ষ্ণ যুক্তিতে ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পাণ্ডিত্যে সনাতন ভারতের ফাঁপা ধর্মীয় গর্ববোধকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছেন। কিন্তু ছোট করেননি। যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে বাঙালির মনে জায়গা করে নিতে গেলে যে দক্ষতা ও চতুরতা লাগে সেটা ছিল না তাঁর। আসলে লোকটার মধ্যে নায়ক হয়ে ওঠার কোনও গুণই ছিল না। আর আমরা ভুলে যেতে খুব দক্ষ অবশ্যই নির্বাচিতভাবে। তবুও জাতির এই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্কটে মেঘনাদ সাহা বিশ্ব, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে বার বার উঠে আসবে। অত্রি মুখোপাধ্যায় মেঘনাদ সাহার জীবনী লিখতে গিয়ে সঠিকভাবেই ‘অবিনাশ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। মেঘনাদের বন্ধুরা তাকে বলতেন ‘আইগেনসাফটেন’। একটা জার্মান শব্দ। ইংরাজিতে বলা যায় ‘ইনভিন্সিবল’।

আসুন সেই ‘অবিনাশ’ মানুষটাকে নিয়ে একটু আলোচনা করি। আমার এই ধৃষ্টতা আপনারা ক্ষমা করে দেবেন বলেই আমি মনে করি।

জীবনের প্রথমভাগ

ঢাকা শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে শেওড়াতলি গ্রাম। এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ খুবই গরীব। তার উপর আবার অন্ত্যজ শ্রেণির পরিবার। অর্থাৎ নিচু জাত। যদিও মেঘনাদের বক্তব্য অনুযায়ী গ্রামে পড়াশুনোর চল ছিল কিন্তু তা কাজচালানো গোছের। এটা কিন্তু ওই সময়ের একটি দিকনির্দেশ দেয়। গ্রামের মুদি দোকানি জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ঘরে ১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর মেঘনাদের জন্ম। ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। পরে স্কুলে যাবার সময় নাম বদলে মেঘনাদ করা হয়। আট ভাই-বোনের মধ্যে মেঘনাদ পঞ্চম। ছয় বছর বয়সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানোর পাশাপাশি মেঘনাদকে দোকানে নিজের পাশে বসিয়ে কাজও শেখাতে শুরু করলেন বাবা জগন্নাথ সাহা। বাবার মনে হয়েছিল পড়াশুনো শিখে কী হবে। তার চেয়ে দোকানে বসলে রোজগারে সহায়তা হবে। বড় ছেলে জয়নাথকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মাধ্যমিকই পাশ করতে পারল না ছেলেটা। সে এখন জুট মিলে কাজ করে মাসে বিশ টাকা পায়। পড়ে সংসারের কী লাভ? জগন্নাথ সাহা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন— মেঘনাদকে আর পড়াবেন না। কিন্তু শিক্ষকেরা রত্ন চিনতে ভুল করেননি। বলেকয়ে মেঘনাদের বাবাকে রাজি করালেন। মেঘনাদ ভর্তি হলেন ১০ কিমি দূরের সিমুলিয়া জুনিয়র হাইস্কুলে। এইখানেই ওনার মনে গণিতের বীজ বপন করেছিলেন শিক্ষক প্রসন্নকুমার চক্রবর্তী। এই বিজ্ঞানচেতনাই বোধহয় তাকে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহিত করেছিল।

এখানে বলে রাখি, আমি এই লেখাটি লিখছি তাঁর জীবনের ঘটনার দিনক্ষণ জানানোর জন্য নয়। তার জন্য বহু বই আছে। আসলে আমার ইচ্ছে ইতিহাসে সাহাদের যে স্থান নির্দিষ্ট সেখানে অনধিকার চর্চা করা। আবার বলছি ঢাকার থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁয়ের নিচু জাতের একটি ছেলে। অন্যের বাড়িতে থেকে গরু চরিয়ে, নিচু জাতের অপমান সহ্য করে, গোটা পূর্ববঙ্গে সাহিত্যে প্রথম স্থান অধিকার করবার পর সিভিল সার্ভিসে না ঢুকে, উকিল না হয়ে কেন কেঠো বিজ্ঞানচর্চায় ঢুকলেন? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর আছে— আশীষ লাহিড়ী বলছেন— রামমোহন রায়ের হাত ধরে পরবর্তীতে বিজ্ঞানচর্চা অক্ষয় কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর হয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ও জগদীশ বসুর হাত ধরে বাংলার প্রত্যন্ত জীবনেও বিজ্ঞানচর্চার ছাপ ফেলতে যে সমর্থ হয়েছিল প্রমাণ হচ্ছে সাহার প্রথম জীবনের শিক্ষক প্রসন্নকুমার চক্রবর্তী। তারই ফসল মেঘনাদ সাহা। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার এই অংশটি বেশিরভাগ সময়ই উহ্য থেকে যায়। এর সঙ্গে রয়েছে পরাধীন দেশের এবং নিচু জাতের মানুষ হিসেবে মেঘনাদের নিজেকে, দেশকে প্রতিষ্ঠা করবার ইচ্ছে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় অংশগ্রহণের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও পড়াশুনোর লড়াই ছাড়েননি। চিন্তা করুন ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান পড়তে ঢুকলেন। পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, রসায়নের অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সহপাঠীদের মধ্যে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আছেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন ধর, নিখিলরঞ্জন সেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছিলেন মেঘনাদের এক বছর সিনিয়র। এদের সঙ্গে পড়লেও মেঘনাদের লড়াইটা আলাদা। ছোট জাতের অসম্মান নিয়ে বিজ্ঞানসাধনা চালিয়ে যাওয়ার লড়াই। থাকেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা আলাদা থাকা ও খাবার ব্যবস্থা। হোস্টেলের সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে গেলে কিছু ব্রাহ্মণসন্তান মেঘনাদকে অপমান করে মণ্ডপ থেকে বের করে দেয়। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় মেঘনাদ সাহা প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন, আর প্রথম হলেন সত্যেন বসু। মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন বসু দুই প্রিয় বন্ধু ভারতীয় বিজ্ঞানে ঊজ্জলতম জ্যোতিষ্ক। কিন্তু আজ বোঝা যায় নিচু জাতের হিন্দু হিসেবে সাহার লড়াই স্বচ্ছল, উঁচু জাতের বসুর চেয়ে কত কঠিন ছিল। এর থেকেই বোঝা যায় এই এই হিন্দুধর্ম ও তার জাত প্রথা, তার অত্যাচার এই উপমহাদেশের বিজ্ঞানসাধনার হাজার বছরের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। গত দুই হাজার বছরে কত শত মেঘনাদ সাহা হারিয়ে গেছে হিন্দু গর্বের জাতের করাল অন্ধকারে। এটাই তো ইতিহাসের কাজ। পরতে পরতে লেগে থাকা ঘটনাগুলিকে আলাদা করা। ব্যাখ্যা খোঁজা।

ইডেন হস্টেলে জাতের বজ্জাতির বিরুদ্ধে সহপাঠী ও আবাসিক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও নীলরতন ধর তীব্র আপত্তি করলেন এবং তিনজন হস্টেল ছেড়ে দিলেন। চলে এলেন মেসে। সেই বিখ্যাত মেস— ১১০, কলেজ স্ট্রিট। সেখানেই তার আলাপ হয় বিপ্লবী বাঘাযতীন, ভূপেন দত্ত (বিবেকানন্দর ভাই) সহ আরও অনেকের সঙ্গে। ভূপেন দত্ত এই ব্যপারে ‘বিপ্লবের পদচিহ্ন’ বইতে আলোকপাত করেছেন। এমনকি ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার সময়েও তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা দফতরের রিপোর্ট যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বলশেভিক কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সাহায্য করবার। বলশেভিক সাহিত্য পড়বার। তার মেয়ে চিত্রা রায় লিখছেন যে তার শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিকেলবেলায় কলকাতার গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাওয়ার সময়ে সাহা সহ তার প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে দীক্ষিত করতেন। এ এক হারিয়ে যাওয়া সময়। এক দিকে পরাধীনতার গ্লানি। অন্যদিকে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের, বিদ্রোহের প্রস্তুতি। মেঘনাদ সাহা তার এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান মাত্র।

অদ্ভুত এক লড়াকু মানুষ এই মেঘনাদ সাহা। ছিলেন গণিতের ছাত্র। উনি জানতেন স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার কল্যাণে উচ্চপদস্থ সরকারি কাজ তার জুটবে না। ১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে সাহা ও বসু দুই বন্ধুই যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। কিন্তু পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক নেই। তাছাড়া নতুন বিভাগ— পরিকাঠামো নেই, তৈরি করতে হবে। এবং এটার জন্য জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাগবে। সাহার আগেই জার্মান ভাষা কিছুটা জানা ছিল। কুছ পরোয়া নেই। লড়াকু সাহা ও তার বন্ধু সত্যেন বসু লেগে পড়লেন। গভীরভাবে জার্মান শিখলেন। পরিচিত হলেন আইনস্টাইন সহ অন্যান্য জার্মান পদার্থবিদদের কাজের সঙ্গে। সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাপ ও তাপগতিবিদ্যা পড়াতেন। এবং এই বিষয়টি পড়ানোর জন্য জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে তাকে অর্জন করতে হয়েছিল। এর মধ্যেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে সাহা এবং বসু নিজেদের নাম চিরস্থায়ী করে ফেললেন ১৯১৫ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব’-এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করলেন। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর বলেন, এটি একটি চমকপ্রদ ঘটনা। আগে সবাই জানত যে আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব’-এর প্রথম অনুবাদ হয় জাপানি ভাষায়। তা ঠিক নয়। প্রথম অনুবাদক হচ্ছেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু। সাহা ও বসুর ১৯১৯ সালের অনুবাদ এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে রাখা আছে। এই অনুবাদের মাধ্যমেই আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয় সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের।

১৯১৭-১৮ সালের মধ্যে ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় সাহার। তার ভিত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি লাভ করেন। আর পরের বছরই পৃথিবীর জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে সাহার যুগান্তকারী আবিষ্কারের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’ নামে পরিচিত Ionization of the Solar Atmoshphere নামের এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে ফিলজফিক্যাল পত্রিকায়। মেঘনাদ সাহার বয়স তখন মাত্র ২৭ বছর। যদিও মেঘনাদ শক্তির বিকিরণের চাপ (radiation pressure) সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা শুরু করেছিলেন ১৯১৭ সালেই। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে ‘সিলেকটিভ রেডিয়েশান প্রেশার’ শিরোনামে গবেষণাপত্র রচনা করেন তিনি। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশের জন্য গবেষণাপত্রটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জার্নালের সম্পাদক জানালেন গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পক্ষে বড় দীর্ঘ হয়ে গেছে। তবে প্রকাশ করা যেতে পারে একটি শর্তে। প্রকাশনার খরচ যদি মেঘনাদ সাহা দিতে পারেন তবে। সেই ১৯১৭ সালে মেঘনাদের পক্ষে শতাধিক ডলার দেওয়া কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। ফলে প্রকাশ হয়নি। কিন্তু হতাশ হওয়ার মানুষ তিনি নন। তার তিন বছরের মধ্যে তাঁর গবেষণা জ্যোতির্বিদ্যার ভবিষ্যতের গবেষণার ধারাকেই পরিবর্তন করে দিল। না তাঁর গবেষণার ফলে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জগতে যে ভয়ানক পরিবর্তন এল তার বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার ইচ্ছে বা যোগ্যতা কোনওটাই আমার নেই। খালি জানাই ১৯২৭ সালে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে স্যার আর্থার এডিংটন লিখছেন ১৫৯৬ সাল থেকে ‘তারা’ সম্পর্কিত যত গবেষনা তার মধ্যে সেরা বারোটার মধ্যে সাহার গবেষণা অন্যতম। ১৯৩৬ সালে শ্যেন রোসেল্যান্ড লিখছেন “যদিও বোরকে জ্যোতির্বিদ্যার পথিকৃৎ বলে ধরা হয়, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যার প্রথম নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব আবিষ্কার করেন ভারতীয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। … ভবিষ্যতের সমস্ত আবিষ্কারই সাহার তত্ত্বকে ধরেই এগিয়েছে।”

সাতবার মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরস্কারের জন্য অনুমোদন পান। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। একমাত্র রয়্যাল সোসাইটির সভ্যপদ ব্যতিরেকে দেশি বিদেশি আর কোনও সম্মান জোটেনি। অনেকে অবাক হন, আমি হই না। যে দেশ বা জাতির অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীরা শিকাগোর ধর্মসভায় দেওয়া একটি ধর্মীয় বক্তৃতাকে দেশের পরিচয় বলে মনে করেন, তার শতবর্ষ উদযাপন করেন, তাঁরা যুক্তিবোধ বা বিজ্ঞানবোধকে যে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখবেন এ আর আশ্চর্য কি! আর এই বছর যে মেঘনাদ সাহার যুগান্তকারী আবিষ্কারের শতবর্ষ তা কে মনে রেখেছে? অনেকে বলতে পারেন এই তুলনাটা কি ঠিক হল? আমি বলব আলবাত ঠিক। কেন নয়? মানুষের জীবন, চেতনা বা বিজ্ঞানবোধের মানোন্নয়নে ভারতের অবদান হিসেবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? মেঘনাদ সাহার আবিষ্কার, না শিকাগোর কারখানা-মালিকদের পয়সায় ফি বছর উদযাপিত হওয়া ধর্মসভার বক্তৃতা?

সাংগঠনিক কাজকর্ম

আগেই লিখেছি একসময় পয়সার অভাবে সাহা উনি গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেননি। সেই থেকেই বোধহয় বিজ্ঞান গবেষণার সাংগঠনিক দিকটা নিয়ে উনি ভাবতে শুরু করেন। উনি গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার কথা ভাবতে শুরু করেন। ১৯২৩ সালে মাইনে বৃদ্ধি ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অভাবের কারণে উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যোগ দেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকৃতপক্ষে সাহার কাজের পূর্ণ বিচ্ছুরণ ঘটে এই সময়। তার গভীর বিজ্ঞানবোধ ও এগিয়ে থাকা চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৫ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতির ভাষণে। সেখানে ৩২ বছরের যুবক জ্ঞানবৃদ্ধ মেঘনাদ বলেন “ভারতে প্রাচীন শাস্ত্রের পূজা করা পাণ্ডিত্যের পরাকাষ্ঠা হয়ে পড়েছে। এককালে ইউরোপও এরকম ছিল। বাইবেল, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের পুজো করাই পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক ছিল। কিন্তু গ্যালিলেও, কেপলার, ব্রুনোর মতন বিজ্ঞানীরা নিজের জীবন ও রক্ত দিয়ে ইউরোপকে সেই ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভারতে বিজ্ঞান জগতে এরকম শহীদ তো নেই।” ওনার এই বক্তব্য যে কতটা সঠিক তা আজকে প্রমাণিত। সাহার এই বিপ্লবী যুক্তিবাদী মতামতই তাঁকে ভারতে বিস্মৃতির অতলে নিক্ষেপ করেছে। একদিকে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, তিলক প্রভৃতির নেতৃত্বে প্রবল হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান, অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধিতায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলবার জন্য নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদে অতীতকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো— এখানে মেঘনাদ, সত্যেন বসুদের স্থান কোথায়? তবুও সেই সময় এর বিপরীতে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল। যার অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন সাহা। আমাদের ইতিহাসে সচেতনভাবেই এই দিকগুলি অনালোচিত।

এই সময়ই প্রকৃতপক্ষে সাহা নিজের উদ্যোগে ও পরিচিতিকে ব্যবহার করে ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউপি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’, যা ভবিষ্যতে হবে ‘ন্যাশনাল অ্যাকাদেমি অব সায়েন্সেস’। ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আলাদা একটি সংগঠন।

১৯৩৩ সালে মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে কলকাতায় গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি’। ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’।

১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের ‘নেচার’ সাময়িকী এবং আমেরিকার ‘সায়েন্স’ সাময়িকীর আদলে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান’ গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে নিয়মিত ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি এই জার্নালে নিয়মিতভাবে লিখে গেছেন (মেঘনাদ সাহা – জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অগ্রদূত— প্রদীপ দেব)।

ভারতে পরমাণু পদার্থবিদ্যা গবেষণার জনকও মেঘনাদ সাহা। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স যা পরে হবে সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স। ভারতে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপন করেন। এবং ১৯৪৪ সালে সাহা আমেরিকা ও ইংল্যান্ড গেলে সেখানকার গোয়েন্দারা সারাক্ষণ সাহাকে নজরে রাখতেন পাছে সাহা তাদের পরমাণুবিজ্ঞানের পরিকল্পনা জেনে যান। আন্তর্জাতিক স্তরে বিশাল মাপের স্বীকৃত বিজ্ঞানী হলে কী হবে এখানে ভারতে পরমাণুবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে সাহার ভূমিকার কোনও স্বীকৃতিই নেই। যা পেয়েছেন হোমি ভাবা, ভাটনগর, সারাভাইরা। পরমাণু কমিশনে সাহাকে কাজ করতে হয়েছে তার চেয়ে আঠারো বছরের ছোট ভাবা এবং ভাটনগরের অধীনে। কেন? অবশ্যই কারণ আছে। যা পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং মেঘনাদ সাহার স্পষ্টবাদিতাও এর জন্য দায়ী।

পরাধীন ভারতে ১৯৩৬ সালে সাহা সুভাষ বসু ও নেহেরুকে বুঝিয়ে মেঘনাদ সাহা জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রস্তাব গ্রহণ করান।

১৯৪৬-এর জুলাইতে বিজ্ঞানকর্মীদের একটি সম্মেলন ব্রিটেনে হয় সাহা যাতে অংশগ্রহণ করেন। সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে তিনি লেখেন “… এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জাতীয় জীবনে শিক্ষা ও গণক্ষেত্রে বিজ্ঞানের পূর্ণ ব্যবহার…।” ভারতে এই সংগঠনের শাখা তৈরি হয় ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই।

১৯৩৪ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে বম্বেতে উনি ভারতের বন্যার ভয়ঙ্কর বিপদ সম্পর্কে বলেন। ১৯৩৮ সালে আবার সাহা নদীবিষয়ক পৃথক গবেষণাগার তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ১৯৪৮ সালে সাহার প্রস্তাব ও পরিকল্পনামাফিক দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তৈরি হয়। ছাত্রজীবন থেকেই বন্যাত্রাণে অংশগ্রহণ করেছেন, বন্যার্তদের দুর্দশা দেখেছেন। ওনার বহুধাবিস্তৃত গবেষণার মধ্যে নদীপরিকল্পনা একটি। ডিভিসি তাঁর পরিকল্পনামাফিক হলেও তাঁর সতর্কবাণী উপেক্ষিত থেকে গেছে।

সাহা পরাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির পরিকল্পক ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেও কংগ্রেসের গান্ধিবাদী শিল্পনীতি উনি কোনওদিন মেনে নিতে পারেননি। উনি তাঁর প্রবন্ধে এর সমালোচনা করেছেন। ফলে সাহাকে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কখনওই কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্বে রাখা হয়নি। (LIFE WITH FATHER–Chitra Roy née Saha, A Commemorative Volume on Saha’s 125th Birth Anniversary,Indian National Science Academy)।

ভারতের প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সাহার প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। ভারত সরকার ওনাকে ১৯৫২ সালে পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটির চেয়ারম্যান করেন। প্রায় তিরিশটি পঞ্জিকা পর্যালোচনা করে সাহার কমিটির দেওয়া পরামর্শ মোতাবেক সরকার প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ পঞ্জিকা প্রকাশ করে।

সেইসময় মেঘনাদ সাহার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৫১ সালে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সমর্থনে বিপুল ভোটে উত্তর পশ্চিম কলকাতা লোকসভা আসন থেকে জয়লাভ করেন।

আমার এই স্বল্পজ্ঞানে আর কোনও ভারতীয় বিজ্ঞানসাধকের সামাজিক ও জ্ঞানের জগতে এত বৈচিত্রময় কর্মকাণ্ড ও অবদান আছে বলে মনে করতে পারছি না।

মেঘনাদ সাহা, বিজ্ঞান ও ধর্ম

আমি আগেই বলেছি মেঘনাদ সাহা হিন্দু পুনরুত্থানবাদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। একদিকে প্রাচ্যবিদদের তুমুল প্রচার যে ভারতের যা কিছু গর্ব তা লুকিয়ে আছে প্রাচীন সনাতন হিন্দু ভারতে, অন্যদিকে সাহা-বসুদের আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই। সুতরাং সাহা, বসুদের তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ে সামিল হতে গিয়ে অতীতের ফাঁপানো গর্ববোধকে নস্যাৎ করতেই হত। কিন্তু নস্যাৎ করতে গিয়ে তাঁরা অতীতকে কখনও খাটো করেননি।

এবং মেঘনাদ সাহা জানতেন এই লড়াইটা কত কঠিন। এই লড়াইতে উনি রবীন্দ্রনাথকেও পাশে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মদিনে সাহা অভিযোগ করছেন, আমাদের কবি এত সম্মান এনে দিয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে এত নিঃস্পৃহ কেন? জার্মান কবি গ্যেটে বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে পারলে আমাদের কবি কেন পারবেন না? বিজ্ঞানের এই অনন্ত বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্রমপরিবর্তন কি কবির মনে রোমাঞ্চ জাগায় না? কবিরা কেন এক ধরনের ধর্মীয় আগড়ে বাঁধা পড়ে থাকবেন! আশিষ লাহিড়ী এই প্রসঙ্গে সাহার একটি কথাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। সেটি হল— “প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি প্রার্থনা (Worship to the inner spirit of Nature)’’। সাহা নাস্তিক কাঠখোট্টা মানুষ ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতিকে উনি যান্ত্রিক বিজ্ঞানবাদের দৃষ্টিতে দেখেননি।

নদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও উনি বারবার প্রকৃতিকে বোঝার উপর জোর দিয়েছেন। যাকে ভুলে গিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে, নদীকে ধবংস করছে। সুতরাং উনি বিজ্ঞানের হাত ধরে প্রকৃতিকে জয় করতে চাননি। প্রকৃতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাঁটতে চেয়েছিলেন। এখানেই উনি মিলে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তার কিছুদিন পরেই লেখেন ‘বিশ্বপরিচয়’ সত্যেন বসুকে উৎসর্গ করে।

ওনার একটি লেখা নিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ওনাকে চরম আক্রমণ করেছিল। সেটি হল “সব আছে ব্যাদে”।

এই প্রসঙ্গের বিতর্ক ঘাঁটলে দেখা যাবে অতীত ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে মেঘনাদ সাহার যথেষ্ট পড়াশুনো ছিল। দুঃখের কথা হলেও সত্যি আজ ভারতে “সব আছে ব্যাদে” জাতীয় লোকের সংখ্যা বেশি ও তারা সমাজে মান্যতাপ্রাপ্ত। প্রধানমন্ত্রী মোদিসাহেব মনে করেন গণেশের মাথা প্লাস্টিক সার্জারির উদাহারণ। বিজ্ঞান কংগ্রেসে বলা হয় স্টিফেন হকিং যা বলেছেন সব বেদে আছে। সুতরাং এখন আরও প্রয়োজন মেঘনাদ সাহার মতন বিজ্ঞানপ্রচারকের। সাহা একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘এক নতুন জীবনদর্শন’ নামে। সেখানে প্রাচ্যের আধ্ম্যাত্মিক চিন্তা কীভাবে বিজ্ঞান প্রসারের অন্তরায় হচ্ছে তা আলোচনা করেছিলেন। তখন অরবিন্দ আশ্রমের তৎকালীন সম্পাদক অনিলবরণ রায় সাহাকে তীব্র আক্রমণ করেন এবং তাঁর বেদ নিয়ে আলোচনার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন তিনি ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম’ নামে একটি প্রবন্ধে তার সমুচিত জবাব দেন। এই বিতর্কটি “সব ব্যাদে আছে” বলে বিখ্যাত। সেই লেখা থেকে আমি তিনটি দীর্ঘ মন্তব্য তুলে দিতে চাই যারা প্রাচীন ভারতের কোলে মুখ লুকিয়ে বর্তমানকে আলোকিত করতে চান তাঁদের জন্য। এই প্রবন্ধে সাহা শুরু করেছেন—

    …অনেক পাঠক আমার প্রথম প্রবন্ধে ‘সব ব্যাদে আছে’ এইরূপ লিখায় একটু অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে আমি ‘বেদের’ প্রতি অযথা অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এই বাক্যটির প্রয়োগ সম্বন্ধে একটু ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে। প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা যাহা Theory of Ionisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নূতন কী হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুই-একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, “মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?” তিনি বলিলেন, “আমি তো কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।” অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। ………… বাস্তবিকপক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যাবসায় প্রসূত।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন:

    একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন, আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহসূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (Elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণকক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনও হিন্দু গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত, কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহু পূর্বেই মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিস্কার করেছেন এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞানপ্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।

    এই শ্রেণীর লোক যে এখনও বিরল নয় তাহার প্রমাণ সমালোচক অনিলবরণ রায়। তিনিও ‘সবই ব্যাদে আছে’ এই পর্যায়ভুক্ত, তবে তিনি ‘বেদ’ মূলে না হউক, অনুবাদে পড়িয়াছেন। সুতরাং তাহার পক্ষে সবই বেদে আছে এইরূপ অজ্ঞান আরও জোর গলায় প্রচার করা সম্ভবপর হইয়াছে। অনিলবরণ রায় মহাশয়ের মতন মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আমার মনোভাব প্রকাশ করিয়াছি মাত্র।

সুতরাং এই মানুষটিকে মনে রাখবার কোনও কারণ বিজ্ঞানের কাছে থাকলেও শাসক রাষ্ট্রের কাছে ছিল না। আর আমাদের তথাকথিত লিবারেল বুদ্ধিজীবীরাও আসলে হিন্দু বুদ্ধিজীবী। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাও সাহাকথিত জ্ঞানের গজদন্তমিনারে অধিষ্ঠান করছেন। সমাজ-সচেতনতা তাদের কাছে বাহুল্য মাত্র। তাই আমাদের বার বার মেঘনাদ সাহার কাছে ফিরতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আইনস্টাইন বাদ দিলে সমাজের, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে তাঁর মতন বিচরণ আর কারও মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় না। মেঘনাদ সাহার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার করতে হবে। ইউরো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতাকে জ্ঞানের জগতে কোনও ধর্মসভার বক্তৃতা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চাকে বিশ্বমেধার জগতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু, পি সি রায়, শিশির মিত্র, জ্ঞান ঘোষ, নীলরতন ধর প্রমুখ।

তাই এই অকিঞ্চিৎকর লেখাটি মেঘনাদ সাহার ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’-এর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তার উদ্ভাবকের প্রতি ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তথ্যসূত্র:

    1. ইংরাজি পত্রিকা “বিজ্ঞান প্রসার”-এর নভেম্বর, ২০০২ ৫ম মাসিকপত্র।

    2. MEGHNAD SAHA A GREAT SCIENTIST AND VISIONARY-LECTURES DELIVERED AT 125TH BIRTH ANNIVERSARY CELEBRATION OF PROFESSOR MEGHNAD SAHA– A Publication of The National Academy of Sciences India (NASI)

    3. মেঘনাদ সাহা— জীবন ও সাধনা, সুখেন্দু বিকাশ কর মহাপাত্র

    4. Meghnad Saha— His Science and Personathrough Selected Letters and Writings— A Commemorative Volume on Saha’s 125th Birth Anniversary— Edited and Coordinated by Ashok Kumar Singhvi, Indian National Science Academy

    5. মেঘনাদ সাহা – জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অগ্রদূত, প্রদীপ দেব

    6. বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিপত্র

পরিবার ও সমাজের চাপেই মানুষ ধর্মে প্রবেশ করে -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | সচেতনতা | views:814 | likes:2 | share: 2 | comments:0

নাসিরুদ্দিন শা অনুপম খের এর অভিনীত বিখ্যাত এ ওয়েডনেসডে চলচ্চিত্রে পরিচালক নাসিরুদ্দিনের মুখ দিয়ে তোতলামো করিয়ে বলিয়েছিলেন “ WE ARE RELIGIOUS BY FORCE “।কারণ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা ধর্মের সুড়সুড়ি ক্রমশ বাড়ছিল। এখনতো একথা বললে সিনেমার সেট পুড়িয়ে দেওয়া হবে। কোন ইসলামিক দেশে এর আসেপাশে কোন কথা বললে তার মুন্ডুর দাম দশ লক্ষ ডলার ধার্য হবে।মহম্মদের ছবি আঁকার জন্য যদি কয়েকশ প্রাণ নিতে পারে ইসলাম ; বিনা কারণেই ব্লাশফেমি চার্জ এনে বধ্যভূমিতে হাজির করবে। 

পরিবার সমাজ বাধ্য না করলে আমরা অনেকেই ধার্মিক হতাম না , আর বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম পালন করলে লোকে পাগল বলতো ----- এটা কি মিথ্যা ? শিশুর জন্মের পরেই পরিবার ও সমাজ কি বাধ্য করেনা ধর্মাচারণ করতে ? আমরা ছোটবেলা থেকেই বাবা –মা বা অন্য পরিজনেরা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে মাথা ধরে ঠুকে বলে নম করো বা মসজিদ গির্জায় নিয়ে গিয়ে আল্লা যীশুর নামে প্রেয়ার করায় না কি ? এবং শিশুর মনও পরিবারের সেই ধর্মের আদলে গঠিত হতে থাকে ধর্মে ঢোকানোর জন্য ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও শাসক বরাবর সক্রিয়। ফলে প্রচুর ধর্মানুষ্ঠান আর আচারের নিগড়ে বাঁধা প্রতিটি মানুষকে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রচার ও ধর্ম প্রসারের সহায়ক। নাস্তিকদের চ্যানেলের অনুমতী কি সরকার দেবে ?

। নিজে থেকে কোন মানুষ ধর্মে প্রবেশ করেনা। একমাত্র বুদ্ধিমান মানুষই ধর্মাচারণ করে , অন্য কোন প্রাণী এই গ্রহে ধর্মাচারণ করেনা। সুন্দরবনে হিন্দু বাঘ বা মুসলমান বাঘ নেই কিন্তু হিন্দু মুসলমান মানুষ আছে।এবং আমাদের বৈদিক ধর্মের এক করুণ পরিণতি মানুষের বর্ণ বিভাগ। সুন্দরবনে ব্রাহ্মণ বাঘ বা চারাল বাঘের সন্ধানও কেউ পায়নি। বৃত্তি বিভাজনকে চালাকি করে বর্ণ বিভাজনে পরিণত করে ধর্মের মোড়কে হাজার হাজার বছর ধরে শোষণ করার করুণ পরিণতি আমাদের দেশেই ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বৃত্তি বিভাজন হয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদেই , ইংল্যান্ডেও পটার( কুমোর) , বুচার( কষাই) , স্মিথ (কামার) বারবার ,মিলার প্রভৃতি পদবি আছে। এরা ধর্মতত্ত্ব( থিওলজি বিষয়ের পাঠ্য ) পাস করলেই গির্জার যাজক হতে পারে , কিন্তু ব্রাহ্মণের বাইরে কেউ পুরোহিত হতে পারে এই দেশে ? এখন ধর্মান্তরকরণ ও আন্দোলনের ঠেলার ভয়ে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। নারীরাও পুজো করছে কলকাতায়। কিন্তু পুরোহিত দর্পণের শূদ্রাচমন আর নারী বিরোধী কথাগুলিতো এখনো গমগমিয়ে চলছে।পুরোহিত দর্পণের শূদ্র ও নারীদের এই অপমানগুলিকে বাদ দেবেন কি করে ?? ব্রাহ্মণ ও ধর্ম বিরোধী আন্দোলন আরো ব্যাপৃত হলে হয়তো ধর্ম ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এগুলিকেও এক সময় বাদ দিতে হবে। এবং আশ্চর্যের বিষয় যাদের এগুলি দ্বারা অপমান করা হয়ে থাকে তারা অর্থাৎ শূদ্র ওনারীরাই এই ধর্মকে আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরে সমাজে সঞ্চালিত করে। 

আমি এটা লেখার তাগিদ অনুভব করেছি এক মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়া ও দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে। আমার পর্যবেক্ষণ এই যে, গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস একজন মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ও বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। তাই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সত্য অসত্য প্রবন্ধে লিখেছিলেন একজন অধ্যাপক ক্লাশে সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের কারণ পড়িয়ে সারাদিন নিরম্বু উপবাস থেকে সন্ধ্যায় গ্রহণ ছাড়লে কীর্তনের দলের সাথে গঙ্গায় ডুব দিয়ে পবিত্র হয়ে আসেন। আমরা জানি শিশুকালে সামাজিকীকরণের সময় আমাদের মনে যেসব ধারণা প্রবিষ্ট করানো হয় তা পরবর্তীতে সবসময় আমাদের চিন্তার পটভূমিতে থাকে। ফলে যেকোন অযৌক্তিক ভাবনা চিন্তা যদি আমাদের মনে আসে তবে আমাদের শিশুকালে লব্ধ ভাবধারণার সাথে মিলিয়ে তার বৈধতা দিতে চাই।স্বল্প কিছু বিরল ব্যক্তি ছাড়া অনেক বিদ্বান অধ্যাপক বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারও এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারেননা। অযৌক্তিকতা ও কাল্পনিক ভাবনাকে বাস্তব বলে গ্রহণের জন্য প্রায়শই তাঁরা সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেননা অথবা করলেও তখনই করেন যখন তা তাঁদের মনে প্রোথিত ধারণার সাথে খাপ খেয়ে যায়। আর তাই ধর্মপ্রাণ টলেমি পৃথিবী সূর্য চারদিকে ঘোরে বুঝেও নিজের মধ্যেই চেপে রেখে দিলেন বা আমাদের ইসরোর ডিরেক্টর ডঃঃ শ্রীনিবাস চন্দ্রযান উৎক্ষেপণের আগের দিন তিরুপতি মন্দিরে পূজা দিয়ে আসেন এবং চন্দ্রযান ছড়ার আগে নারকেল ফাটিয়ে পূজা করেন , কোপার্নিকাস তাঁর তত্বপ্রকাশ করেননি খ্রিস্টান যাজকদের ভয়ে বা এই বিশ্বাস থেকেই। এই বিশ্বাস এক ভাইরাসের মতো তা সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। বিপরীত দিক দিয়ে বলা যায় এই মানবজাতিই পর্যবেক্ষণ এবং নায্য বিচার বিবেচনার অধিকারী। মানুষ তার এই জ্ঞানের জন্য নানা ধরণের বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং ভয় ঠেলে সত্য প্রকাশ করতে পারে এবং তাই আমরা পাই গ্যালিলিও ও তাঁর অনুসারীদের। কিন্তু যখন ধর্ম ও রাজনীতির মিশেল সামনে আসে তখন মানুষ তার বিচার-বুদ্ধি , বিশ্লেষণী চিন্তা এবং যৌক্তিকতাকে পদ দলিত করে ফেলে ভয়ে বা অন্ধ ভক্তিতে। 

যুক্তি বিজ্ঞান এবং গণিত অনুযায়ী এই ব্রহাণ্ডের প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক সামাজিক ---- প্রতিটি ঘটনার পেছনেই কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। তবে সমাজবিজ্ঞান ভৌত বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করলেও ভৌতবিজ্ঞানের রিজিড নিয়ম ধরে চলেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে নবীনতম প্রাণী মানুষের বয়স কম এবং জ্ঞান বুদ্ধি সেই পর্যায়ে না যাওয়ার জন্য সমস্ত ঘটনা তারা বিশ্লেষণ করতে এখনও সক্ষম নয়।তবে জ্ঞানের প্রসার অনেক দূর গেছে সেটা বুঝতেই পারা যায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রভূত অগ্রগতি দেখে। অনেক সময় এই কারণ প্রতীয়মান হয় দ্রুত আবার অনেক সময় তা দীর্ঘকাল নেয়।যেমন ক্যানসারের এখনো ঔষধ বা চিকিৎসা সেভাবে হয়না। তাই প্রতিটি মানুষকে আমরা যুক্তিবাদী হতে বলি বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা কুঁড়ে কুড়ে খায় সমজ ও ব্যক্তি জীবনকে।এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষ কষ্টভোগ করে।

সাম্প্রদায়িকতা : একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা -অনাবিল সেনগুপ্ত
Nov. 20, 2024 | সাম্প্রদায়িকতা | views:815 | likes:2 | share: 2 | comments:0

"যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।"

১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের গণপরিষদের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিম লিগ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় নেতৃবর্গের হাতে ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। এই প্রস্তাবে একটি নতুন ভারত অধিরাজ্য ও তার সরকার গঠনেরও প্রস্তাব জানানো হয়। এর অব্যবহিত পরে, একটি বিকল্প প্রস্তাবে হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলমানপ্রধান পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কংগ্রেস বিকল্প প্রস্তাবটি সম্পূর্ণত প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এবং একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিম লিগ ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট একটি সাধারণ ধর্মঘটের (হরতাল) ডাক দেয়। এই প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই কলকাতায় এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম হয়। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরে চার হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান ও এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন [গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ১৯৪৬]। কলকাতার দেখাদেখি দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, যুক্তপ্রদেশ (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও। তবে সর্বাপেক্ষা ভীতিপ্রদ দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল কলকাতা ও নোয়াখালীতে (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে)। কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা, আহত, ধর্ষণ, গৃহহারা করে। ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে দুই ধর্মের নিরীহ সাধারণ মানুষের পরস্পরের মনে অবিশ্বাস আর শত্রুতার বীজরোপণ হয়ে গিয়েছিল। আর এই ঘটনাই ভারত বিভাগের বীজ বপন করেছিল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন ধর্মীয় দাঙ্গাফাসাদের জড় রূপে দেখা গেছে।

সাম্প্রদায়িকতা বা সাম্প্রদায়িকতা (ইংরেজি: Communalism) হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্পদায়।ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ আছে সম্পদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি।

কথা হচ্ছে, একটা বহুত্ববাদী দেশ ভারতে এই ধরণের অসহিষ্ণুতার ঘটনা নতুন নয়৷ ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এই রকম অ-সহনশীলতা আগেও ছিল, এখনও আছে৷ অযোধ্যায় রামজন্মভূমির ওপরে বাবরি মসজিত নির্মাণ, হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে তার ধ্বংস কিংবা দেশের বিভিন্ন ভাগে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিখধর্মের অপমানের বদলা নিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা, ১৯৯৩ সালে মুম্বই দাঙ্গা, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরা গণহত্যা, অতি সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গোমাংস নিয়ে গণপিটুনিতে মহম্মদ আখলাকের মৃত্যু, যুক্তিবাদী লেখক কালবুর্গির খুন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে, যে দলই সরকারে থাকুক না কেন৷ পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রচার পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাসীদের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটসহ বিস্তীর্ণ অংশ ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখেছে গত বছরেই। হিংসা দেখেছে হাওড়া, হিংসা দেখেছে উত্তরবঙ্গের ধুলাগড়সহ নানা এলাকা। বর্তমানে কাকিনাড়া, পুরুলিয়া, রানিগঞ্জ আসানসোলের একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীর মিছিলকে (অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক আস্ফালন) কেন্দ্র করে সংঘর্ষ যা দাঙ্গার রূপ নেয়। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা (সমগ্র দেশের মত) দখলে সাম্প্রদায়িকতা ইস্যু করে তুলতে চাইছে ক্ষমতালোভীর দল। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, পুঁজিপতিদের ধনে বলিয়ান হয়ে বিরোধী আদর্শকে গুড়িয়ে (বর্তমানে লেনিনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মূর্তি ভাঙ্গা হল) দিতে পিছপা নয় ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতারা।

ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালেই মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে লন্ডনে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে দাবি করা হয়েছে দুটো ক্ষেত্রে ভারতের পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। "সাম্প্রদায়িকতা এবং বাক স্বাধীনতা।" অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, গত এক বছরে ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার শত শত ঘটনা ঘটেছে যা প্রশাসন রুখতে পারেনি। বরং কোনও কোনও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতার সরাসরি হিংসায় প্ররোচনা দিয়েই বক্তৃতা দিয়েছেন।

গরু পাচার বা গরুর মাংস খাওয়া হচ্ছে, শুধু এই সন্দেহের বশে মুসলিমকে জনতা পিটিয়ে মেরেছে। মুজফফরনগরে ২০১৩র দাঙ্গায় অভিযোগের আঙুল উঠেছে ক্ষমতাসীন রাজনীতিক ও পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের দিকেই। অ্যামনেস্টির রিপোর্টে জানাচ্ছে , ‘‘এটা স্পষ্ট যে ভারতে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত ও ধর্মীয় হিংসার ঘটনা বাড়ছে। যদিও ভারতে এই ধরনের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটে আসছে, এখন যেটা দেখা যাচ্ছে যে শুধু একজন মানুষকে তার ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।’’ আরও উল্লেখ্য , ‘‘কীভাবে মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মণিপুরে আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সবচেয়ে যেটা উদ্বেগের কথা, ধর্মের কারণে এই বৈষম্য করার জন্য কাউকে কিন্তু বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।’’

শুধু সাম্প্রদায়িকতা নয় – অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরব হয়েছে ভারতে ইদানীং বাক স্বাধীনতার অধিকার যেভাবে খর্ব হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও। সরকার ভারতে ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। ‘‘শুধু আপনার মতের বিপক্ষে কথা বললেই যেভাবে তাকে দেশ বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে – তাতে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদের বিরুদ্ধে চরম অ-সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে”। 

২০১৪র নির্বাচনের পর থেকেই ভারতে যে কোনও ইস্যুকে একটা সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ‘‘ক্ষমতাসীন দলই হোক বা আরএসএসের মতো তাদের সহযোগী সংগঠন – এরা তখন থেকেই প্রতিটা বিষয়কে একটা ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে।’’ ‘‘কখনও হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিয়েকে লাভ জিহাদ তকমা দিয়ে, কখনও গরুর মাংস নিষিদ্ধ দাবি করার দাবি তুলে, কখনও বা যোগাসন বাধ্যতামূলক করতে চেয়ে পুরো পরিবেশটাকে বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে। আশঙ্কা, ২০১৯য়ে দেশে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’’

দেশে-বিদেশে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়কে সেজন্য কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে এবং হবে সন্দেহ নেই৷ সবথেকে বড় কথা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে ধান্দা বন্ধ করতে হবে৷ প্রতিবাদ এক কথা আর রাজনৈতিক ফায়দা লোটা অন্য জিনিস৷ ধর্মীয় অসহনশীলতা, জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্য কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি দাড়িপাল্লায় মাপা যায়, তাহলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সত্যিই কি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে? এটা কি একটা সাময়িক প্রতিক্রিয়া? এটা কি যথাসময়ে থিতিয়ে যাবে?

অপরাধ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, জাতিসত্তা, আঞ্চলিকতা, আধিপত্য, প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে বৃহত্তর সমাজে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হতে পারে। এ অসিষ্ণুতা শুধু সমাজেই নয়, রাষ্ট্রের গোষ্ঠী, ধর্ম, জাতিসত্তার প্রতি অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হতে পারে। হিটলারের আমলে জার্মানি ইহুদি জাতির প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত, নির্যাতন ও হত্যা করেছিল। তবে সাধারণত সরকারের ঔদাসীন্য বা নেপথ্য উস্কানির কারণে এমন ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে যাতে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে নির্মূল করার অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। এটি হচ্ছে ঘৃণাজাত অপরাধ। ঘৃণাজাত অপরাধের সবচেয়ে বড় প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অপরকে নির্মূল করার প্রবণতা। এ অপরাধ এখন একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। অপরাধ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা বা শ্রেষ্ঠতর রাখার জন্য হিংসা, দাঙ্গা, হামলা, হত্যাকান্ড, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক বিনষ্টিকরণ প্রভৃতি হলো এ প্রকার ঘৃণারই ফল।

সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে বর্ণিত হয়েছে। ভারতের আইন ও বিচার ব্যবস্থাও উক্ত সংবিধানের প্রস্তাবনা গুলিকে সুরক্ষিত করে। রাজনৈতিক দল গুলো উক্ত প্রস্তাবনাকে সুরক্ষিত রাখবে, সেই অঙ্গীকারে "দ্য রিপ্রেজেন্টেসন অফ পিপলস অ্যাক্ট ১৯৫১ (অ্যামেনমেন্ট ১৯৮৯) এর ২৯ক ধারায়" দায়বদ্ধ হয়। কার্যক্ষেত্র নির্বাচন কমিশন "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" এর দশা হতে পারে। এটাও প্রশ্ন আইনের প্রয়োগের অভাবে ভারতে রাজনৈতিক দল গুলোর এই বাড়বাড়ন্ত। 

৩রা জানুয়ারি, ২০১৭, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও প্রচার করা যাবে না। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। কিন্তু রায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেক বিশ্লেষকগণ। তাঁদের কথায়, ‘‘ধর্ম, জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাইলে প্রার্থিপদ বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বড়জোর আদালতে যেতে পারে।’’ এই বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হলে আইন করে কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে ভয় পায় সব দলই। কারণ ধর্ম, জাতপাতের অঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের নেই।

রাজ্যের বা দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। আসানসোল-রানিগঞ্জ যেমন হিংসা চায় না, বসিরহাট বা ধুলাগড়ও তেমনই চায় না। চায় না উত্তরপ্রদেশের দাদরি বা মুজাফফরনগর, চায় না গুজরাতের গোধরা , চায় না বিহার। সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান, জীবনধারণের অধিকার চান। তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা নিয়ে মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।

পরিবেশ দিবসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। -জয়র্ষি ভট্টাচার্য
Nov. 20, 2024 | পরিবেশ | views:780 | likes:1 | share: 1 | comments:0

পৃথিবীর প্রথম ১০০টি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পগোষ্ঠী বিশ্বের মোট দূষণের ৭০% এর বেশী দূষণ ঘটায়। অপরদিকে সারা পৃথিবীর প্লাস্টিক স্ট্র ব্যবহারের ফলে ঘটা দূষণের পরিমাণ ১% এরও সামান্য কম। তবুও দূষণ রোধে জনপ্রিয় শ্লোগান প্লাস্টিক স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করতে বলা।

একইরকমভাবে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনে সর্বাধিক জীবাশ্ম জ্বালানি খরচ করলেও তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮.১ টনের কাছাকাছি, যেখানে গোটা বিশ্বে একদিনে জ্বালানিজনিত দূষণের পরিমাণ ৩৩০০ কোটি মেট্রিক টন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে কোনো ব্যক্তির এসি, ফ্রিজ, গাড়ির ব্যবহারের ফলে হওয়া দূষণ পরিবেশে সামান্যতম প্রভাবটুকুও ফেলে না। 

পরিবেশ রক্ষায় সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্লোগান, 'গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান'। অথচ, স্রেফ আমেরিকাই এখনো অবধি হওয়া জঙ্গল ধ্বংসের ৭৫% এর ভাগিদার। আমাজ়ন জঙ্গলকে গত ৫০ বছরে ১৭% ছাঁটা হয়েছে। প্রতিটাই করেছে রাষ্ট্রের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো না কোনো বৃহৎ কর্পোরেট। ফলে আমি আপনি আজকে একটি করে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ১% উন্নতিও করতে পারবো না। তাছাড়া একটি পুরনো গাছের সাথে একটি বৃহৎ বাস্তুতন্ত্র জুড়ে থাকে। নতুন গাছ লাগিয়ে সেই পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। বিখ্যাত পরিবেশবিদ জঁ বেলেমি ফস্টার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বে বর্তমানে যত জীবাশ্ম জ্বালানি আছে, তার প্রায় সাড়ে তিনগুণ গাছ লাগালেও পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য যথোপযুক্ত অরণ্য সৃষ্টি সম্ভব না। তিনি অঙ্ক কষে আরও দেখিয়েছেন, একটি প্রযুক্তির দূষণ রোধে আনা আরেকটি প্রযুক্তি গুণোত্তর প্রগতিতে দূষণ বৃদ্ধিই করবে যতক্ষণ না পুঁজির স্বার্থে প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে। ফলে গাছ লাগানোর চেয়ে অনেক অনেক বেশী জরুরি গাছ বাঁচানো। আর যেসব রাষ্ট্র এই অরণ্য ধ্বংস করে চলেছে বিশ্ব জুড়ে, তারাই এমন পরিবেশ দিবসের দিন বেছে গাছ লাগানো বা স্ট্র বন্ধের বিজ্ঞাপন দেয়, অথচ পুঁজিপতি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অগ্নিবর্ষণ করে না।

আদতে বিষয়টা খুব সহজেই বোধগম্য। বিশ্বে সেসব প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হয় যা লাভজনক। বিজ্ঞানী ও প্রাযুক্তিকেরা বাঁধ নির্মাণ বা সবুজ বিপ্লবের মতো প্রযুক্তির বারংবার বিরোধিতা করে গেলেও আর্থিক লাভের স্বার্থে রাষ্ট্র ও তাকে অর্থ যোগান দেওয়া ব্যবসায়ীরা বারবার এসব প্রযুক্তি চালু করতে চেয়েছে। সেই স্বার্থে কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতির আসল বন্ধু আদিবাসীদের। গঙ্গা, যমুনা দূষিত করে বেড়েছে মিনারেল ওয়াটারের ব্যবহার। মুনাফা করতে তারা শুষে নিয়েছে মাটির জল। অথচ, প্রাকৃতিক জল খেয়ে বেঁচে থাকা আদিবাসিন্দারারা পড়েছেন সঙ্কটে। জঙ্গলজীবীরা নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই জঙ্গল বাঁচায়। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে স্বামী হারানো স্ত্রীয়েরাও বাঘ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, বাঘ আছে তাই তাঁরা আছেন। বাঘ না থাকলে তাঁরাও থাকবেন না। প্রকৃতি নিয়ে এই বোধ যাঁদের আছে, তাঁদের থেকে জঙ্গল কেড়ে নিচ্ছে আদানি-আম্বানিরা। চিপকো আন্দোলনের মতো সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তাও জঙ্গল বাঁচিয়ে চলেছেন তাঁরা। একমাত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁদের শক্তিশালী প্রতিরোধই জঙ্গল ও প্রকৃতি বাঁচাতে পারে। পরিবেশ দিবসে পরিবেশ বাঁচানোর যথার্থ সদিচ্ছা থাকলে তাই পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে জঙ্গলজীবীদের সাথে গলা মিলিয়ে বলুন,

"গাঁও ছোড়াব নেহি, জঙ্গল ছোড়াব নেহি

মাহে-মাটি ছোড়াব নেহি, লড়াই ছোড়াব নেহি"

ওয়াশিকুর বাবুকে নিয়ে কিছু কথা -বিহঙ্গ
Nov. 20, 2024 | মুক্তমনা | views:810 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া দুই হামলা কারীর মধ্যে একজন ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র 'জিকরুল্লাহ'। অন্যজন ছিলেন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র 'আরিফুল'।


পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে খুনী জিকরুল্লাহ বলেছিলেন--

"ব্লগ কী বুঝি না। আর তার (বাবু) লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন, সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। ইমানি দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।"

এর থেকে স্পষ্ট যে, নেপথ্যের সেই হুজুররা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাবুকে হত্যা করতে মাদ্রাসা ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছিলো। কেন? কী লিখেছিলেন ওয়াশিকুর বাবু? ওয়াশিকুর রহমান বাবু ছিলেন স্পষ্টবাদী, প্রতিবাদী।

তিনি ধর্মের অসাড়তা, ভন্ডামী, গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। লিখেছিলেন কিছু 'ফাল দিয়ে ওঠা কথা।'


তাঁর কিছু লেখা তুলে ধরা হলো ----

১। এক সময় সবাই মানুষ ছিল। তারপর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল; মানুষ হয়ে গেল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ।

২। যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি।

৩। এমন কোন ভালো কাজ নাই, যার জন্যে ধর্ম আবশ্যক। কিন্তু এমন অনেক অপরাধ আছে, যা ধর্ম ছাড়া সম্ভব হতো না।

৪। কোন ধর্মই নারীকে কথিত সম্মানটুকুও দেয়নি। তারা সম্মান দিয়েছে মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে। যারা নিজেদেরকে এইসব পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছে- তারা সতী আর যারা মানুষ হতে চেয়েছে, তাদেরকে বেশ্যা উপাধি দিয়েছে ধর্মীয় সমাজ।

৫। ধর্মানুভূতি দিয়ে চাষাবাদ হয় না, উৎপাদন হয় না, শিক্ষা হয় না, গবেষণা হয় না, শিল্প-সাহিত্য হয় না। ধর্মানুভূতি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হয়, দাঙ্গা হয়, লুটপাট হয়, ধর্ষণ হয়, নোংরা রাজনীতি হয়।

৬। মানব রচিত সবচেয়ে আগ্রাসী কল্পনা হচ্ছে ধর্ম; যা মানুষের কল্পনা শক্তিকে গ্রাস করে। নিজের মত করে একটি স্বর্গ কল্পনা করতেও ধার্মিকেরা অক্ষম।

১৯৮৮ সালে জন্ম নেয়া অল্পবয়সী এই সাহসী মানুষটা মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ধর্মীয় সন্ত্রাসীসের হাতে নিহত হন। বাসার গলির মুখে ওঁত পেতে থাকা তিনজন ধার্মিক সন্ত্রাসী তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তেই বাবুর ঘাড়, ও মাথা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়।

মহান সাঁওতাল হুল ও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন -সুপ্রিয় ব্যানার্জি
Nov. 20, 2024 | সংগ্রাম | views:823 | likes:0 | share: 1 | comments:0

সাঁওতাল হুল বা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ৩০ শে জুন, ১৮৫৫। ব্রিটিশ শাসন ও তাদের সাদা চামড়ার  তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে  সচেতন আদিবাসীরা  (ভারতবাসী) সংগঠিত সশস্ত্র আঘাত এনেছিলেন।  যদিও অ্যাকাডেমিক মূল্যায়নে এক অশিক্ষিত সংগ্রামশীল জনজাতি (Tribe বলা হয় তাঁদের, কেন তাঁরা জাতি (Nation), নৃগোষ্ঠী (Ethnic group)  বলে বিবেচিত হন না জানা নেই আমার)। বলে দেওয়া ভালো এরাই ভারতবর্ষ নামক ভূখন্ডে বন জঙ্গল কেটে বৃহত্তর ছোটনাগপুর মালভূমিতে বাসস্থান ও কৃষির উপযোগী ভূমি তৈরি করেছিলেন। জঙ্গল পাহাড়ের পূর্বে  সমতলেই ছিল তাদের বসবাস। আর্যরাসহ অন্যান্য গোষ্ঠী  এই অঞ্চলে প্রবেশ করলে কখনো  ছলে কখনো বলপ্রয়োগে  জঙ্গলে ঠেলে দেয় তাদের। 

কিন্তু মাত্র এক দুই হাজার বছর পিছনে গেলেই দেখা যাবে চরম স্বাধীনতাবাদী এই জাতি ১৮৫৫ এর হুলের বহু আগে আর্য জাতিকে হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিরোধ করেছিলো জঙ্গলে থেকেই। সাদা চামড়াকে তারা "দিকু" বা বহিরাগত শয়তান নামে চিহ্নিত ও ঘৃণা করতো। ঋগবেদে আদিবাসীদের নিষাদ প্রজা, রাক্ষস, অসুর, কিরাত   বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চিন্তা চেতনায় এরা প্রকৃতিকে আরাধ্য মেনেই এক উন্নত সমাজ ও পরিবার পরিচালনা পদ্ধতির জন্ম  দিয়েছিল এই ভূখন্ডে। জন্ম দিয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির।

 ১৮৫১ সালে ঐতিহাসিক সেরওয়েল এঁদের "এক স্বাধীন সুশৃঙ্খল জাতি"  হিসেবে বর্ণনা  করেছিলেন।  তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহই  প্রথম শ্রমজীবী মানুষের মনে পরাধীনতার শিক্ষা ও  স্বাধীনতার আকাঙ্খার বীজ রোপণ করেছিল বললে  ভুল হয় না।

সাঁওতাল হুল ছিল ব্রিটিশ, তাঁদের পা চাটা বাঙালি, উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত মহাজন, সুদখোর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে এক সার্বিক লড়াই। যার মূলে ছিল স্বাধীন সাঁওতাল রাষ্ট্রের দাবি এবং পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি তথা ভারতীয় বিশেষ আর্য সামন্তবাদী শোষণের  বিরুদ্ধতা এবং তাকে বদলে ফেলার চেষ্টা। অর্থাৎ মুক্তি। 

বিদ্রোহী রঘুনাথ এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরে ১৭৭৪ সালে বীর বিদ্রোহী  তিলকা মাঝির  নেতৃত্বে সশস্ত্র হুল সংগঠিত হয়। সাথে সাথে  চলতে থাকে অসংখ্য ভূমিজ বিদ্রোহ।  পরে ১৮৫৫ সালে সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরৌ-ফুলো-ঝানো মুর্মুর নেতৃত্বে  গ্রাম ভগনাডিহিতে চারশো গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করেন  এবং খুব দ্রুত তা গণবিদ্রোহের আকার নেয়। 

কির্তা মাঝি, ভাদু মাঝি, সুন্নো মাঝির নেতৃত্বে বিভিন্ন কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট দের কাছে অত্যাচার অবসান ও জাতিগত স্বাধীনতার দাবি  জানিয়ে তাঁরা স্মারকলিপি দাখিল করেন। ইংরেজ শাসক এই দাবিপত্র পড়ে ভীত ও বিস্মিত হয়। কোনো ভারতীয় জাতি এমন স্বাধিকার সচেতন হতে পারে,  ইংরেজদের কল্পনারও অতীত ছিল তা।  যদিও আদিবাসী জনতার দাবি  মানতে অস্বীকার করে ও অচিরেই একে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। 

ইতিমধ্যে কয়েকজন সাঁওতাল বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করায় প্রথমেই আন্দোলনকারীরা প্রকাশ্যে হত্যা করে  কুখ্যাত দারোগা মহেশলাল দত্ত ও তার সিপাহী সঙ্গীদের। বিদ্রোহী আদিবাসীরা  ঘোষণা  করেন- "রাজা মহারাজাদের খতম করো, দিকুদের গঙ্গা পার করিয়া দাও, সমস্ত শাসনভার আমাদের চাই"। সম্ভবত এত স্পষ্ট রাজনীতির নলেজ তৎপূর্বে ভারতীয় সাদা 'শিক্ষিত' তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় ভদ্রদেরও ছিল না।  আসলে তাঁরা  (উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা) তখনও পর্যন্ত (একাংশ পরেও) ছিলেন ব্রিটিশদের দালাল।

হুল শুরু হলে আন্দোলনকারীরা ইংরেজ অফিসার বারোজের বিশাল সৈনবাহিনীকে তাঁরা হত্যা করে ও পাকুর,অম্বর পরগনার রাজবাড়ি  লুঠ করে।অবিভক্ত বিহার বাংলার বিস্তির্ণ অঞ্চল বিদ্রোহীদের প্রায় মুক্তাঙ্গন হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য সাঁওতাল  বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধ রীতির সফল  প্রয়োগ ঘটান এই অসম যুদ্ধে। এরপর বিদ্রোহীরা ডাক দেন কলকাতা অভিযানের। ঠিক যেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার মাওপন্থি লাইন! জানা যায়, মাত্র পনের দিনের মধ্যে অর্ধেক বাংলা ও বিহারে ইংরেজ শাসন বলে কিছু ছিল না-প্রায় মুক্তাঞ্চল। হতাশ ইংরেজ বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে যাতে বিদ্রোহীরা খাবার না পায়। এক ব্রিটিশ অফিসারের কথায় – ‘আমরা বিদ্রোহ দমনের নামে গণহত্যা করিয়াছিলাম।’

২০০৮ সালে পুনরায় দেখা দিল আবার এক-হুল।এবারও বিদ্রোহীরা চাইলো খাদ্য, সেচ,স্বাস্থ্য, নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় দিকু ও সরকারী পুলিশ-মিলিটারির অত্যাচার থেকে মুক্তি। তারা চাইলো মর্যাদা তথা প্রকৃত  স্বাধীনতা। কারণ ভারতরাষ্ট্র আদিবাসীদের কোনোরকম স্বাধীনতা, অধিকার তাদের দিতে পারেনি।

১৮৫৫তে বিদ্রোহীদের মেরে ফেলেছিল  ইংরেজ ও তাদের তাবেদার  সামন্তচক্র। এবারও হত্যা করে গ্রেপ্তার করে আদিবাসী আন্দোলনকে পিষে দিল ভারতরাষ্ট্র।  এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে  আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে,চলছে  ধর্মান্তকরণ কৌশলে হিন্দু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে তাদের।  সেই সঙ্গে চলছে তাদের অনাহার অর্ধাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু। এবং প্রায়ই সন্ত্রাসবাদী দমনের নামে তাদের উপর অত্যাচার চলছে গণহত্যা চলছে। জল জঙ্গল জমি দখলের জন্য তাদের উৎখাত চলছে নানান অছিলায়। চলছে ভারতীয় সংবিধানকে সামনে রেখেই। সেবার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব বীর সিধুর বিচার হয়েছিলো কিন্তু এখন স্বাধীন ভারতে আদিবাসীদের হত্যা করা হচ্ছে বিনা বিচারে। চলছে প্রায় প্রতিদিন। 

প্রশ্ন হল, আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও  যখন  আদিবাসীরা শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন,  অমর্যাদা থেকে মুক্ত হননি,  তখন আদিবাসী হত্যাকারী  রাষ্ট্র  হুল দিবস (উৎসব) পালন করে চলেছে কীভাবে, কোন অধিকারে ?? সাঁওতাল  বিদ্রোহকে উৎসব বা পরব বলার অধিকার সরকারকে কে দিয়েছে?  

আজও হুল এক ধারাবাহিক গতিতে এগিয়ে চলেছে বলেই কী সরকার তাকে উৎসবে পরিণত করে প্রকৃত ইতিহাস থেকে জনগণকে দূরে রাখতে চায় ? আদিবাসীদের হিন্দু বানিয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ভারতের তামাম আদিবাসী জনতাকে। তাহলেই  হুল দিবসের যথার্থ অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে, আলো দেবে সমগ্র সমাজকে। 

দেশের সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহ জিন্দাবাদ। 

রঘুনাথ, তিলকা, সিধু-কানু-বিরসা জিন্দাবাদ।

আত্মা-কথা -সৌরভ কুমার মান্না
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:481 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আত্মা- এই শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত।আত্মা নিয়ে প্রচলিত ধারনা এই যে,আত্মা এমন কিছু যেটা জীবিত অবস্থায় শরীরে থাকে কিন্তু মৃত্যুর পরে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।আত্মা বিষয়ে বিশ্বাসী শিক্ষিত মানুষেরা নিজেদের আত্মার অস্তিত্বের দাবিতে অনড় থাকতে "Conservation of Energy " থিওরি এর আশ্রয় নেন।এই থিওরি মতে Energy neither be created, nor be destroyed. It can only transform one form to another। তারা বলতে চান জীবিত অবস্থায় আমাদের মধ্যে যে এনার্জি, মৃত্যুর পর সেটা কোথায় যায়? আসুন এই দাবিকে কয়েকটা প্রশ্ন করি।

*ধরুন আপনাকে কেউ একটা মাঠে দশপাক দৌড়োতে বলল। দৌড়ানোর আগে আপনার যা এনার্জি লেভেল ছিলো, দৌড়ানোর পর সেই লেভেল খানিকটা কমতে বাধ্য। দাবি অনুযায়ী আপনার আত্মার সাইজ খানিকটা কমে যায়।

*মানুষের আত্মা থাকলে পশু-পাখি,ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন,জুপ্ল্যাঙ্কটন,জেলিফিশ,বাঁদর, সাপ, ছাগল এদেরও আত্মা থাকতে বাধ্য।এবার প্রশ্ন হলো মানুষের মতো এদের তো শ্রাদ্ধজাতীয় কাজ করা হয়না,এদের আত্মাও কি সবাইকে ভয় দেখাতে পারে,এদের আত্মাদের ও কি মুখে পোড়া ডিমভাজা লাগানোর মতো ভয়ংকর দেখতে?

*২০০০ সালে পৃথিবীর যা জনসংখ্যা ছিলো, ২০২২ এ তা অনেকটাই বেড়েছে।বেঁচে থাকতে গেলে যদি আত্মা compulsory হয়,তাহলে প্রশ্ন হলো এই এক্সট্রা আত্মাগুলো এলো কোত্থেকে?

অবশেষে বলা যাক,আত্মা বলে আদতেই কোনোদিন কিছু ছিলোনা এবং কোনোদিন থাকবেও না।এনার্জির বিভিন্ন form হয়। বিজ্ঞান পড়লে তা জানা যায়।শরীরে iron এর কমতি হলে যেমন iron rod এর ওপর শুয়ে থেকে কোনো লাভ হয়না, Energy এর ও সেরকমই আলাদা আলাদা form আছে। যেটা কল্পিত আত্মা কোনোদিনই নয়।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও হিগস বোসন কণা

- মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়

সেই ষাটের দশক থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্টান্ডার্ড  মডেলের একটা জোরালো অনুমিতি ছিল যে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্ব হিগস-কণাদের সমন্বয়ে গঠিত হিগস-ক্ষেত্রের (Higgs field) এক অথই সমুদ্রে ভাসছে। এই অথই সমুদ্রে চলতে গিয়েই নাকি উপ-পারমাণবিক বস্তুকণারা সব ভর অর্জন করে। যদি হিগস-ক্ষেত্র বলে কিছু না থাকত, তাহলে কোনো বস্তুকণারই ভর বলে কিছু থাকত না– তা সে রোগাপটকা ইলেকট্রনই হোক, আর হোঁৎকামুখো হিপোপটেমাস, মানে টপ-কোয়ার্কই হোক।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কেবলমাত্র হিগস-ফিল্ড বলে কিছু একটা আছে বলেই এসব কণা ভর অর্জন করতে পারছে, যা আবার ফলশ্রুতিতে তৈরি করতে পারছে আমাদের গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথসহ সবকিছুই।

চিন্তা করে দেখুন, আমরা ফোটনের মতো ভরহীন কণার কথা জানি যারা ছোটে আলোর বেগে। আলোর বেগে ছুটতে পারে, কারণ এরা হিগস-ফিল্ডের সঙ্গে কোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না। হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় না জড়ানোর কারণে তারা থেকে যায় ভরহীন। আর ভর-টরের ঝামেলা নেই বলেই তারা অমনি বেগে হু হু করে ছুটতে পারে।

কিন্তু ওভাবে ছুটলে কী হবে, তারা জোট বাঁধতে পারে না কারও সঙ্গেই। জোট বাঁধতে হলে ভর থাকা চাই। এই যে আমাদের চারপাশে এত বস্তুকণার সমারোহ দেখি, দেখি পাহাড় পর্বত, নদীনালা, গাছপালা আর মানুষ-– সবারই অল্পবিস্তর ভর রয়েছে। ভর জিনিসটা তাই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত বলে আমরা মনে করি।

তাই কোনো কণা যদি পাওয়া যায় যেটা মহাবিশ্বের শুরুর মুহূর্তে সবাইকে ভর প্রদান করছে, করছে অস্তিত্বহীনকে অস্তিমান, তার গুরুত্ব হয়ে দাঁড়ায় অপরিসীম। বহু বছর আগে ১৯৬৪ সালের দিকে পিটার হিগস নামে এক বিজ্ঞানী ধারণা করেছিলেন এই ধরনের এক ‘হাইপোথিটিক্যাল কণা’র।

যদিও ধারণাটির পিছনে কেবল পিটার হিগসের একার অবদানই ছিল তা নয়, এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্টের মত বিজ্ঞানীরাও; তারপরেও এক ধরনের কণা দিয়ে তৈরি ফিল্ডের ব্যাপারটা হিগসের মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়েছিল বলে অনেকে ভেবেছিলেন। তাই তার নামানুসারেই এই অনুকল্প-কণাটির নাম দেওয়া হয় হিগস-কণা।

যদি এ নামকরণ থেকে কেউ ধরে নেন যে, হিগস-কণার অনুকল্প যাদের মাথা থেকে এসেছে সেসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে পিটার হিগসের অবদানই ছিল সর্বাধিক, তাই তার নামে কণাটির নামকরণ করা হয়েছে– তাহলে কিন্তু ভুল উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া হবে।

আসলে ১৯৬৪ সালে হিগসের ধারণাসূচক যে তিনটি মহামূল্যবান পেপার প্রকাশের কথা বলা হয়, তার মধ্যে হিগসের পেপারটি ছিল দ্বিতীয়। হিগসের আগে বেলজীয় পদার্থবিদ রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্টের একটি পেপার প্রকাশিত হয়। আর হিগসের পেপারটির পরে জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন এবং টমকিব্বল-এর আরও একটি পেপার প্রকাশিত হয়।

প্রতিসাম্যতার ভাঙনের জন্য দায়ী ‘হিগস-প্রক্রিয়া’ হিসেবে যে প্রক্রিয়াটিকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেটার পেছনে এদের সবারই কমবেশি অবদান আছে। এমনকি তাদের কাজের আগে জাপানি-আমেরিকান পদার্থবিদ ইয়োইচিরো নামবু এবং ভূতপূর্ব বেল ল্যাবের ফিলিপ অ্যান্ডারসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের উত্তরসূরীদের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দেয়।

এদের সকলের অবদানই উল্লেখযোগ্য। তারপরেও কেবল পিটার হিগসের নামেই কেন হিগস-কণা, হিগস-ক্ষেত্র, হিগস-প্রক্রিয়া সবকিছুর নামকরণ হল এটা একটা মূর্তিমান রহস্য। পিটার হিগস নিজেই নিজের নামে কণাটির নামকরণ করেননি এটা নিশ্চিত।

অনেকেই এই নামের জন্য আঙুল তুলেন মেধাবী কোরিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিদ বেঞ্জামিন লীর প্রতি, যিনি ১৯৭৭ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে, হিগসের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং এই আলাপ থেকে তিনি প্রতিসাম্যতার ভাঙনের মাধ্যমে কীভাবে কণারা ভরপ্রাপ্ত হয়, সে সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করেন।

এই সূত্র ধরে উৎসাহী লী বেশ কিছু সেমিনারে সেটাকে ‘হিগস-মেকানিজম’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়াও নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গের ১৯৬৭ সালের গুরুত্বপূর্ণ একটি পেপারে ভুলক্রমে রেফারেন্সে পিটার হিগসের নাম অন্যদের আগে চলে যায়। এটাও একটা কারণ হতে পারে।

এগুলোর বাইরে ‘হিগস-বোসন’ শব্দটির দ্যোতনা শ্রুতিমধুর, উচ্চারণও সহজ। এসব কিছুই এই নামের পক্ষে গেছে।

কিন্তু নাম দিলে কী হবে, সে কণার কোনো পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ বিজ্ঞানীরা কখনওই দিতে পারেননি, অন্তত ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত।

২০১২ সালে এই হারানো টুকরা খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা তাদের বিশাল ব্যয়বহুল কণা ত্বরক লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার থেকে পাওয়া প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার এক বিশাল যন্ত্রদানব।


দানবাকৃতির লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার দিয়ে প্রমাণ হল হিগসের অস্তিত্ব

আমাদের কোনো ধারণাতেও আসবে না কতটা বিশাল।  জেনেভার সীমান্তে জুরা পাহাড় বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে নানা কায়দা-কসরত করে মাটির পঞ্চাশ থেকে একশ পঞ্চাশ মিটার (মানে প্রায় ১৬৫ ফুট থেকে পাঁচশ ফুট) নিচে ২৭ কিলোমিটার (মানে প্রায় সাড়ে সতের মাইল) পরিধির ধাতব এক টিউব বসানো হয়েছে। সেখানেই এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা।

বলাবাহুল্য, এই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার নামের দানবটা শুধু সুইজারল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার নিচ দিয়ে চলে গেছে একেবারে ফ্রান্স অব্দি। সেখানেই বিজ্ঞানীরা পেলেন হিগস কণার অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ।

কীভাবে তারা এই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করলেন, এ নিয়ে সাদামাটা ভাষায় কিছু বলা যাক।

আমাদের মহাবিশ্ব যদি হিগসের অথই সমুদ্রে ভাসমান থাকে আর সেই সমুদ্র যদি হিগস-কণাদের দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিলে সেখান থেকে কিছু কণা বেরিয়ে আসতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে প্রচণ্ড গতিতে দুটো সাবমেরিনের সংঘর্ষ হলে যেমন কিছু জল ছিটকে চলে আসে উপরে, আর তা দেখে আমরা বুঝি নিশ্চয়ই জলের র নিচে কিছু একটা ঘটেছে।

ঠিক তেমনি ব্যাপার হবে হিগস-মহাসাগরের ক্ষেত্রেও। হিগস-কণা পেতে হলে প্রচণ্ড গতিতে হিগসের-সমুদ্রকে ধাক্কা দিতে হবে। এমন জোরে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার ছাড়া আর কারও নেই। সেখানে প্রোটনকে আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯৯ শতাংশ গতিতে ত্বরান্বিত করা হয়। আর এভাবে দুদিক থেকে প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোর মাধ্যমে মৌলিক কণা তৈরি করা হয়।

সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করলেন বিজ্ঞানীরা। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে সংঘর্ষের মাধ্যমে ১৪ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের শক্তি উৎপন্ন হয়, আর সেই শক্তির ধাক্কায় উপ-পারমাণবিক কণিকারা (subatomic particles) দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে থাকে যত্রতত্র। সেগুলো আবার ধরা পরে যন্ত্রদানবের ডিটেক্টরগুলোতে। এভাবেই আটলাস আর সিএমএস ডিটেক্টরে ধরা পড়ল মহামান্যবর হিগসের অস্তিত্ব।

হিগসের শক্তি অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে হিসেব করা হয়েছিল অনেক আগেই। বিজ্ঞানীরা জানতেন হিগস-কণা যদি থেকে থাকে তবে সেটার ভর থাকবে ১১৪ থেকে ১৩১ বিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট (যেটাকে নতুন এককে গিগা-ভোল্ট বলা হয়) এর মাঝামাঝি জায়গায়।

বিজ্ঞানীদের অনুমান মিথ্যে হয়নি। প্রোটন নিয়ে গুঁতোগুঁতির ফলাফল শনাক্ত করতে গিয়ে এমন একটা কণা পাওয়া গেল যার শক্তি ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি। হিগস-কণার যা যা বৈশিষ্ট্য থাকার কথা তা এই ফলাফলের সঙ্গে মিলে যায়। আজ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, নিচের ছবিতে ১২৫ জিইভি-র কাছাকাছি যে ঢিপি চোখে পড়ছে সেটা হিগস-কণার জন্যই হয়েছে।

হিগসের প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ

এটাই ছিল হিগসের প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ। ফ্যাবিওলা জায়ানোত্তির নেতৃত্বে এক দল (আটলাস) এবং জো ইনকানডেলার নেতৃত্ব আরেক দল (সিএমএস) পৃথক পৃথকভাবে এই কণার খোঁজ পেয়ে তাদের উপর মহলে সার্ন গবেষণাগারের সার্নের মহাপরিচালক রলফ হয়ারের কাছে রিপোর্ট করেন। পৃথক দুই দলের পৃথক গবেষণা থেকে যখন একই ফলাফল বেরিয়ে এল তখনই রলফ হয়ার বুঝতে পারলেন সত্য সত্যই হিগসের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারপরেও নিঃসন্দেহ হবার জন্য তারা বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে ফলাফলগুলো পুনঃপরীক্ষা করলেন।

অবশেষে সবাই হলেন নিঃসন্দেহ। শেষমেশ ২০১২ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হাই এনার্জি ফিজিক্সের একটি দ্বিবার্ষিক কনফারেন্সে হিগসের প্রাপ্তির খবর জানানো হয়। জেনেভার সার্ন থেকে সরাসরি রিলে করা হয় তাদের ঘোষণাটি। গবেষণাগারের মহাপরিচালক রলফ হয়ার যখন এই আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন, তখন উল্লাস আর করতালিতে ফেটে পড়লেন সমবেত শতাধিক বিজ্ঞানী।

হিগসপ্রাপ্তির বৃহৎ ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে ফ্যাবিওলা জায়ানোত্তি, রলফ হয়ার এবং জো ইনকানডেলা

হিগসপ্রাপ্তির বৃহৎ ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে ফ্যাবিওলা জায়ানোত্তি, রলফ হয়ার এবং জো ইনকানডেলা

বিজ্ঞানীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পিটার হিগস স্বয়ং। ৮৩ বছর বয়স্ক এ বিজ্ঞানী ঘোষণার সময় হয়ে উঠলেন আবেগে অশ্রুসজল। বললেন, ‘‘আমি ভাবতেই পারিনি ব্যাপারটা আমার জীবদ্দশাতেই ঘটবে।’’

তবে হিগস-বোসনকে মিডিয়ায় যথেচ্ছভাবে সব বস্তুকণাদের ‘ভর সৃষ্টির পেছনে মুখ্য কণা’ বা সরাসরি ঈশ্বরকণা হিসেবে তুলে ধরা হলেও, বাস্তবতা হল– মহাবিশ্বের বস্তুকণার তাবৎ ভর কিন্তু হিগস থেকে আসেনি। বরং সত্যি বলতে কি তাবৎ ভরের খুব নগণ্য ছোট্ট একটা অংশই কেবল হিগস থেকে এসেছে।

তারপরেও হিগস-কণার গুরুত্ব যে ম্লান হয়নি। হিগস না থাকলে কণা পদার্থবিদদের সাধের ‘প্রমিত মডেল’-এর বোধহয় সলিল সমাধি ঘটত। কণাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য বলে কিছু থাকত না, সবার চেহারাই হত হুবহু অনুরূপ। ফার্মিয়নেরা সব থাকত ভরহীন হয়ে। আমরা কণাদের যে রসায়নের সঙ্গে পরিচিত, সেই রসায়ন বলেই কিছু থাকত না। কণাদের রসায়ন না থাকলে জীবনের রসায়নও থাকত অনুপস্থিত।

সে হিসেবে আমরা বলতে পারি, হিগস-বোসন হচ্ছে এমন এক মূল্যবান কণা যা কিনা মহাবিশ্বে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়েছে।মিডিয়ায় যে ‘ঈশ্বর কণা’ হিসেবে হিগসকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেটা হয়তো এসব গুরুত্ব উপলব্ধি করেই।

হিগস না থাকলে মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেমন হত, প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনাই বা কতটুকু থাকত তা নিয়ে নানা ধরনের দার্শনিক আলোচনায় জড়ানো যায়; কিন্তু বাস্তবতা হল, মহাবিশ্বে উদ্ভবের পর থেকেই এই কণার একটা বড়সড় ভূমিকা ছিল। হিগসের অথই সমুদ্রের কথা যে আমরা বলছি, যেটাকে বলা হয় হিগসের ক্ষেত্র বা হিগস-ফিল্ড; বিগ ব্যাং-এর পর হিগস-ক্ষেত্র তৈরি হবার আগ পর্যন্ত কণাদের ভর বলে কিছু ছিল না।

মহা-উত্তপ্ত অবস্থা থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যখন মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, তারপর সেটা কিছুটা কমে যখন মিলিয়ন বিলিয়ন ডিগ্রিতে (দশের পিঠে পনেরটা শূন্য চাপালে যে তাপমাত্রা পাব সেটা) পৌঁছেছিল, তখন হিগস বেচারাদের এতই ঠাণ্ডা লাগা শুরু করল যে তারা সব ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে এক ধরনের করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যাকে জ্যোতির্পদার্থবিদেরা বলেন ‘কসমোলজিক্যাল ফেজ ট্রান্সিশন’।

এর আগ পর্যন্ত মহাবিশ্বে কণারা লাল ঝাণ্ডা তুলে সাম্যবাদের গান গাইত। কোনো কণারই ভর বলে কিছু ছিল না, পদার্থ-প্রতিপদার্থের সংখ্যা ছিল সমান ইত্যাদি। কিন্তু যে মুহূর্তে হিগস বাবাজির ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল, অমনি সাম্য-টাম্য সব ভেঙে পড়তে শুরু করল। রাতারাতি কণাদের ভর গজাতে শুরু করল; কারও কম কারও বেশি।

কেউ চিকনা পটকা হালকা হয়ে রইল, আর কেউ-বা হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে বেশি করে মিথস্ক্রিয়ায় গিয়ে আর রসদ খেয়ে হয়ে উঠল হোঁদল কুতকুত। যেমন ইলেকট্রন বাবাজি কিংবা লেপ্টন গ্রুপের সদস্যরা হালকা-পাতলা থেকে গেলেও আপ-কোয়ার্ক কিংবা W বা Z কণারা হয়ে উঠল গায়েগতরে হাতির মতন (যেমন আপ-কোয়ার্ক কণাটা আয়তনে ইলেকট্রনের সমান হলেও ওজনে ইলেকট্রনের চেয়ে ৩৫০ হাজার গুণ ভারী)।

সাম্যাবস্থা ভেঙে এই যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় যাওয়ার ব্যাপারটাকেই কেতাবি ভাষায় বিজ্ঞানীরা বলেন ‘সিমেট্রি ব্রেকিং’, বাংলা করলে আমরা বলতে পারি ‘প্রতিসাম্যের ভাঙন’। তবে এই অসাম্য আর বৈষম্য নিয়ে আমরা যতই অসন্তুষ্ট হই না কেন, হিগস-কণার কল্যাণে প্রতিসাম্যের ভাঙন ব্যাপারটা না ঘটলে পরবর্তীতে তৈরি হত না কোনো অণু কিংবা পদার্থ কিংবা সৌরজগত, নীহারিকা, সূর্য আর পৃথিবীর মতো গ্রহ।

এই প্রতিসাম্যের ভাঙন কীভাবে ঘটতে পারে সেটাই ১৯৬৪ সালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পেপারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিলেন ছজন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী– পিটার হিগস, জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন, টম কিব্বল, রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট– যাদের কথা আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতেই জেনেছি।

এদের মধ্যে রবার্ট ব্রাউট মারা গিয়েছেন ২০১১ সালে। নোবেল পুরষ্কার মরণোত্তর হিসেবে দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই; তাই রবার্ট ব্রাউট মনোনীত হতে পারেননি। বাকি তিনজন– গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন, টম কিব্বলের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় সবার শেষে।

কাজেই গুরুত্ব বিচারে তারাও ছাকুনির জাল ভেদ করে উপর উঠতে পারেননি। জয়মাল্য গিয়েছে ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট এবং পিটার হিগসের গলাতে।

২০১৩ সালে  পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট। পারমাণবিক এবং উপ-পারমাণবিক কণার ভরের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যে ‘হিগস-বোসন’ কণার ধারণা করেছিলেন, ২০১২ সালে সার্নের পরীক্ষায় তা সফলভাবে প্রমাণিত হয়। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে  নোবেল পেয়েছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। 

ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালে, অধ্যাপনা করছেন ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি একটি যুগান্তকারী গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার সহকর্মী রবার্ট ব্রাউটের (অধুনা পরলোকগত) সঙ্গে মিলে যা হিগস-কণার কাজ বুঝতে সহায়ক হয়েছিল।

আর ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী পিটার হিগস এমনিতেই পাদপ্রদীপের আলোতে সবসময়ই ছিলেন, বিখ্যাত কণাটির সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত থাকায়। তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে এখনও কাজ করছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নোবেল কমিটির বলেছেন  ‘‘একটি প্রক্রিয়ার তাত্ত্বিক আবিস্কারের জন্য, যে প্রক্রিয়া উপ-পারমাণবিক কণাদের ভরের উদ্ভব বুঝতে সহায়তা করে এবং যেটি সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের আটলাস এবং সিএমস-এর পরীক্ষায় নিশ্চিত করা গেছে।’’ 

বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি নিয়ে আজও প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা হিন্দুদের -রূপায়ণ ভট্টাচার্য
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:812 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সন্ধ্যেয় মাথার ওপর মশারা গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করা না পর্যন্ত খেলা চলত আমাদের। দুই ক্লাসমেট হাসানুল্লা আর তফিকুল ফুটবল ম্যাচে এক টিমে থাকলে বড় ভরসা ছিল। বাবা স্টেশন যাতায়াত করত পাশের মুসলমান পাড়ার খয়রুল বা গোলাপের রিক্সায়। পাশের বাড়িতে কাজ করত মকবুল। ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে উঠলে ঘুরে বেড়াতাম হাটে, বাগানে। যতদূর মনে পড়ে, মকবুলের বিয়ে হয়েছিল আমাদের প্রাইমারি স্কুলের এক ক্লাসমেটের সঙ্গে। আমার কলেজ পড়ুয়া দিদি ছুটিতে গ্রামে এলে তাঁকে পড়াতে আসতেন শের মহম্মদ মাস্টারমশাই।

ছোটবেলায় শোনা সবচেয়ে খারাপ কথাটি ছিল, ‘ও কি বাঙালি, না মুসলমান?’ নজরুলের জন্মদিনের সপ্তাহে নজরুল পক্ষে এসে খেয়াল করি, সেই খারাপ কথাটির মৃত্যু ঘটেনি। এখনও সেই আজব কথা বলার মতো শিক্ষিত লোক অনেক। এখনও অনেকে সবিস্ময় হাততালি দিতে থাকে, বাঙালি মুসলিম পরিবারে রবীন্দ্র চর্চা হয় শুনে। এখনও যেন ওই আমলে পড়ে রয়েছি। যেখানে শৈশবের মতো হ্যাজাক-লণ্ঠন-ল্যাম্পই জ্বলে। মাঝে মাঝে আলো চলে যায়। অনেকে চেঁচিযে বলে, ‘জ্যোতিবাবু গেলেন।’ 

কে এঁদের বোঝাবে, হিন্দুদের মতো বাঙালি মুসলমানও কিশলয়-বর্ণপরিচয় পড়ে বড় হয়েছে। তারাও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক। পাড়ায় বীরপুরুষ বা লিচু চোর আবৃত্তি করেছে। স্কুলে অমল বা দইওযালা সেজেছে ডাকঘর নাটকে। বড়দের বিসর্জন, কালমৃগয়া দেখে শুনে নাটক বা গীতিনাট্য মুখস্থ করেছে। পঁচিশে বৈশাখে প্রভাতফেরিতে গলা মিলিয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে। আমাদের স্কুলে আবার শুক্রবার টিফিন ছিল এক ঘণ্টার--নমাজ পরার জন্য। অক্সফোর্ডের গবেষক, কালিয়াচকের ছেলে শাহনওয়াজ আলি রায়হান সেদিন লন্ডন থেকে ফোনে হাসল, ‘তুই বাঙালি না মুসলমান, প্রশ্নটা মালদা-মুর্শিদাবাদে কোনওদিন শুনতে হয়নি। শুনেছি বড় হযে কলকাতা গিয়ে।’

সেই কলকাতা---রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর এলাকায় উর্দুভাষী মুসলিম অনেক বেশি। বিহার, উত্তরপ্রদেশের মুসলিমরা বেশি সেখানে। তাই কলকাত্তাইয়াদের বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ধারণা কম। কলকাতা আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতির চাবুক হাতে ঘুরে বেড়ায়, জেলা শহরগুলো বিদ্রোহ না করে তার হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে রাখে কেন? তাই ‘সংস্কৃতিবান’ কলকাতা থেকে ভুল ধারণা ছড়াতে থাকে বাঙালি মুসলিম-হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে। সব পার্টির নেতারাও দায়িত্ব নেন। বরং জেলাগুলোয় এই সমস্যা কম। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়ে, একই ক্লাবে খেলে পরস্পরের জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা স্পষ্ট। শাহনওয়াজের স্ত্রী ইংল্যান্ডে ডাক্তারি করেন। তাঁরা ছোটবেলায় ছুটিতে হুগলি থেকে দল বেঁধে যেতেন শান্তিনিকেতন ঘুরতে। তাই মুসলিম ছেলের মুখে রবি ঠাকুর আবৃত্তি শুনলে জেলার হিন্দুরা বিস্মযে হাঁ হয়ে যায় না। অনেক মুসলিম শিক্ষক বাংলা পড়ান স্কুলে-কলেজে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, জীবনানন্দ তো তাঁদের বুকের মধ্যে গাঁথা। এপারে পত্রিকায় ঈদ সংখ্যা হয় না বলে, তীব্র অভিমান আছে। তবু পুজো সংখ্যা নিযে টানাটানি করেন। পুরোনো পুজোর গানে আজও ঘোর।

বাঙালির মৃতপ্রায় ঐতিহ্য ফুটবল আইসিইউতে অক্সিজেন পাচ্ছে বাঙালি মুসলিমদের সৌজন্যে। মইদুল-নাসির-নাজিমুল থেকে মেহতাব-নবি, রফিক-রহিম আলি-ফারদিন আলি মোল্লা। ঘাটালের দাশপুরের ছেলে মইদুল প্রথম বাঙালি মুসলিম তারকা ফুটবলার। তাঁর বাড়িতেই অনেক হিন্দু-মুসলিম বিযে হয়েছে। স্ত্রীও হিন্দু। মইদুল সহাস্য, ‘আমরা তো ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের মধ্যে বড় হয়েছি। এক পাড়ায় বাড়ি ছিল। ওদের বাড়িতে গিয়ে খেতাম।’ অথচ আজ, কলকাতায় এখনও বাঙালি মুসলিমের ঘর ভাড়া পাওয়া কঠিন। শিলিগুড়িতেও।

গ্রামবাংলায় বড় হওয়া বাঙালি মুসলিমরা বিরিযানির কথা শোনেননি অনেকদিন। ফিরনির কথাও। হালিম এখনও অপরিচিত খাবার উত্তরবঙ্গে। শাহি টুকরাও। তাঁরা তো একেবারে হিন্দুদের মতোই মাছ-ভাত-ডাল-তরকারি-ছ্যাঁচড়া-দই-বোঁদে-রসগোল্লা খেযে বড় হয়েছেন। বিযোড়িতে হত ঘি ভাত, লোকে বলত পোলাও। সংস্কৃতি থেকে জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস থেকে পোশাক-সব ব্যাপারেই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম এক। ব্যাপারটা বুঝতে আজও অনেকের ভুল হয়। মালদার দিকে এখনও শের শাহের সৈন্যদের বংশধররা রয়েছেন, শের শাহ বাদিযা বলে তাঁদের। মুর্শিদাবাদে পাবেন মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সঙ্গে আসা আফগান সেনার উত্তরসূরিদের। দুপক্ষেরই বাংলা সংস্কৃতিতে বড় হওযা। মালদার সুলতাননগরে মুসলিম গ্রামে এখনও রয়েছে শিবনাথ শাস্ত্রীর নামে লাইব্রেরি।

বসিরহাট ও একবালপুরে বড় হওয়া, বিশিষ্ট গায়ক কাজি কামাল নাসের গান বেঁধেছিলেন, ‘যে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, আজও সেখানেই দাঁড়িযে আছি/ প্রতিবেশী হযে দুজন কেন এলাম না কাছাকাছি।’ মেদিনীপুরের মইদুল, মালদার শাহনওযাজের মতো তাঁরও এক অভিজ্ঞতা। জেলার তুলনায় কলকাতাতেই এই বিভেদমূলক কথাবার্তা বেশি। এখনও একটা স্মৃতি ভোলেননি কামাল। বাসে যাচ্ছেন ববি হাকিম কলকাতার মেয়র হওযার দিন। এক সহযাত্রী আরেকজনকে বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত মুসলমানকে কলকাতার মেয়র করে দিল।’ ডালহৌসীর অফিসে পাশের সহকর্মী কাগজে পাকিস্তানের খারাপ খবর বেরোলেই গোল দাগ দিয়ে আড়চোখে তাকাতেন কামালের দিকে। 

এপার বাংলার হিন্দু-মুসলিমদের আর একটা বড় মিল দেখতে পাই পড়শি বাংলাদেশের দিকে তাকালে। কোথাও কি আমরা দুপক্ষই একটু ঘরকুনো, নিজস্ব বৃত্তে স্বচ্ছন্দ, বেহিসেবি ছক ভাঙায় অবিশ্বাসী মানুষ? একটু ভীরু, একটু নরম ও কম পরিশ্রমী?

বাংলাদেশিরা ক্রমাগত বিদেশ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। বেআইনি পথে, আইনি পথে। সমুদ্রে জাহাজের খোলে লুকিযে ইউরোপ যেতে গিযে অনেকে যেমন চিরকালের জন্য হারিযে গিয়েছেন, তেমনই পর্তুগাল-স্পেনের এক একটা জায়গায় বিশাল সম্পত্তি কিনে ওপারের বাঙালিরা বানিয়ে ফেলছেন ছোটখাটো উপনিবেশ। লন্ডন-নিউ ইয়র্কের বাজার তাঁদের জন্যই ভরে উঠেছে বাঙালি খাবারে। বিশ্বে এমন ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা, অজস্র বিদেশি মুদ্রা আসছে দেশে। বাংলাদেশের  রেমিট্যান্স অর্থনীতি পৌঁছে যাচ্ছে অন্য উচ্চতায়। ১৯৯০-৯১ সালে বছরে ৭৬৩.৯১ মিলিয়ন ডলার অর্থ এসেছিল সে দেশে। ২০১৯-২০ সালে অঙ্কটা ১৮২০৫.০১ মিলিয়ন।

পদ্মাপারের বাঙালি কোনও দেশে আস্তানা পেলে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে চেনা আত্মীয় বন্ধুদের। যা মনে করায় মালযালি, তামিল বা পাঞ্জাবিদের। কেরল যেমন আরবের সোনায় ফুলে ফেঁপে উঠছে, বাংলাদেশও তাই। সৌদি আরব ও আমিরশাহি থেকে সবচেযে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে ঢাকায়। তারপর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কাতার থেকে। আমাদের এখানে বাঙালি মুসলিমরাও ঘর ছাড়েন চাকরির খোঁজে। গন্তব্য ভিনরাজ্য। অধিকাংশই শ্রমিকের কাজ। এখনও কিন্তু তাঁদের মাথায় বিদেশ নেই। কী জানি, মনে হয়, গঙ্গা পারের তুলনায় পদ্মাপারের হাওযায় সাহস শব্দটা বেশি ওড়ে। হয়তো যুদ্ধ এবং নতুন দেশের প্রাথমিক চরম দারিদ্র‌্য, অনিশ্চয়তা ওপারের বাঙালি মুসলিমের মনের মরিযা ভাবকে আরও আগুন দিয়েছে।

দক্ষিণবঙ্গে বড় হযে উত্তরবঙ্গে কাজে আসা এক বাঙালি মুসলিম তরুণ বলছিলেন, ‘পাড়ায় বড় হওযা আর মহল্লায় বড় হওযার মধ্যে মনোভাবের ফারাক হয়।’ কথাটা নির্মম সত্যি। পাড়ায় সবার সঙ্গে বড় হলে উদারতা জন্মায় সব পক্ষেরই। প্রত্যেক গোষ্ঠীর আলাদা মহল্লা হলে বিচ্ছিন্নতার দড়িটা বেড়ে যেতে থাকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে। উত্তরবঙ্গেই একটা সময় জাঁদরেল মুসলিম নেতা ছিলেন, যাঁরা পুরো বঙ্গে পরিচিত। মালদায় গণি খান, দিনাজপুরে জয়নাল আবেদিন, কোচবিহারে ফজলে হক। গঙ্গা পেরোলে মুর্শিদাবাদে আবদুস সাত্তার। তাঁরা হিন্দু না মুসলিম, গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বাঙালি পরিচয়ই ছিল আসল। ফজলে ছাড়া সবাই প্রযাত। ছয় বছর আগে বাংলার মুসলিমদের সামগ্রিক দুরবস্থার যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন অমর্ত্য সেন, তা এই নেতাদের লজ্জায় ফেলার মতো। তথ্য বলছিল, বাংলায় যেখানে এক লাখ লোক পিছু ১০. ৬ পিছু মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, সেখানে মুসলমান প্রধান মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরে এই হার ৭.২, ৮.৫, ৬.২।

এখন শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সাধারণ মুসলিম য়খন বাংলা পড়াতে মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠান, অনেক নেতা তখন সন্তানদের পাঠান মাদ্রাসায়। জেনে মাথায় ঘোরে আর একটা তথ্য। ওপারের বাঙালি মুসলিম এখনও অক্সফোর্ডে পড়তে গেলেও নিজেরা বাংলায় কথা বলে, বাংলাভাষা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। এ পারের বাঙালির কোনও পক্ষই সেটা করে না। এখানে হিন্দু-মুসলিম, কলকাতা-জেলার খুব মিল।

আমাদের স্কুলে পণ্ডিত মশাই ছিলেন, ছিলেন মৌলভী মাস্টার মশাইও। সংস্কৃত পড়াতেন একজন, অন্যজন আরবি। স্কুল ছুটির পর শুধু উড়নি গায়ে পণ্ডিত মশাই বাড়ি ফিরতেন হাঁটতে হাঁটতে। পাশে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর যেতেন পাজামা, ফেজ টুপি পরা মৌলভী মাস্টারমশাই। শুধু বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান জানাতে। সেই দৃশ্যটা আজও চোখে ভাসে। যাবতীয় সব যন্ত্রণা মুছে যায় তখন।"

যুক্তির ফাঁদে সর্বশক্তিমান -সময়
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:810 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কয়েকদিন আগে ইন্টারনেটে পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। হটাৎ, একটা পোস্টে চোখ আটকে গেলো। বিজ্ঞান দিয়ে ঈশ্বরকে নয়, বরং ঈশ্বরকে দিয়ে বিজ্ঞানকে বিচার করুন। কারণ, বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল, কিন্তু ঈশ্বর সর্বদা সত্য। সত্যিই বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। প্রায়শই নতুন ধারণা পূর্ব ধারণার স্থান দখল করে।

আসলে বিজ্ঞান আমাদের প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে দেখায়নি। বিজ্ঞান আমাদের আর্গুমেন্ট এবং কাউন্টার-আর্গুমেন্টের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। বিজ্ঞান সত্যিই পরিবর্তনশীল, সে আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর, ঈশ্বরকে দিয়ে বিজ্ঞানকে বিচার করতে বলেছেন। তা, আপনাদের ঈশ্বর তো নিজেই বিজ্ঞান ও যুক্তির নিয়মে বন্দি! কীভাবে?

আচ্ছা, প্রায় সকল ধর্মেই ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তাকে সর্বশক্তিমান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। God is almighty…..। তা, এই সর্বশক্তিমান ব্যক্তিটি কি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারে, যা তিনি নিজেই তুলতে পারবেননা?


যদি উত্তরটা হ্যাঁ হয়, তাহলে জগতে এমন কাজ তৈরি হবে, যা স্বয়ং ঈশ্বর ও করতে পারবেননা। আর, উত্তরটা যদি না হয়, তাহলেও বিশ্বে এমন কাজ থাকবে, যা স্বয়ং ঈশ্বর ও করতে পারবেননা। তাহলে, ঈশ্বর কি আদৌ সর্বশক্তিমান থাকলেন? এই প্রশ্নের মাধ্যমেই জন্ম হয় The Omnipotence Paradox নামের পৃথিবী বিখ্যাত (অথবা, ধর্মান্ধদের কাছে কুখ্যাত) কূটাভাসের। এই সাধারণ একটি প্রশ্ন, কোনো সর্বশক্তিমান স্বতার অস্ত্বিত্ব সম্পর্কিত ধারণার ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। তাহলে এর

দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে ঈশ্বর আদপে সর্বশক্তিমান নন। যৌক্তিক ভাবে যেই সকল কাজ করা সম্ভব হবে, শুধুমাত্র সেই সব কাজ করতেই তিনি সক্ষম। যুক্তির খন্ডন কেউ করতে পারেনা।

সুতরাং, আমাদের মতন সাধারণ মানুষদের ন্যায় ঈশ্বর নিজেও যুক্তির বাঁধনে বন্দি, গণিতের নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এবার তাহলে বলবেন যে গণিত তো আসলে ঈশ্বরেরই অংশ। পয়েন্টে আসুন। তার মানে আপনি স্বীকার করছেন যে বিজ্ঞানকে দিয়ে ঈশ্বরকে নয়, বরং ঈশ্বরকে দিয়ে বিজ্ঞানকে বিচার করুন - এই সব কথা বোগাস! গণিত ও বিজ্ঞান যদি ঈশ্বরেরই অংশ হয় তাহলে বৈজ্ঞানিক তত্ব ছেড়ে অন্ধবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছেন কেন?

ধর্মের আফিমে আচ্ছন্ন না থেকে যুক্তির আলোয় প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করুন। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ধর্মের মাধ্যমে আমরা-ওরার বিভাজন তৈরি করার চেষ্টায় আছে, বলা যায় আংশিক সফল। কিন্তু বিজ্ঞানের আলোর তলায় আমরা সবাই এক। তাই, যুক্তির মাধ্যমে প্রচলিত কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে খন্ডন করে চোখের ঠুলিটা খুলুন, দেখবেন জ্ঞানের আলোয় জগৎ কতটা উজ্জ্বল…

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও জাতপাত লুপ্ত হল না কেন? -জামাল আনসারি
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:815 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশ পদার্পণ করলেও সমাজের বুকে এখনও জাতপাত  স্বমহিমায় বিরাজমান! কেন! কারা এই অপমানজনক প্রথাকে টিকিয়ে রেখেছে? অনেকেই হয়তো বলবেন যে,জাতপাতের যা কিছু ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত  আছে তা গ্রামাঞ্চলেই বিদ্যমান। শহরের দিকে এটা নেই বললেই চলে।এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমার এক বন্ধু কর্মসূত্রে শহরের এক শিক্ষিত তথাকথিত উঁচুজাতের বাড়িতে ঘরভাড়া নিয়ে থাকত। একটি ঘর সাথে একটি বারান্দা। বাকি অংশে ঘর মালিকের পরিবার থাকত।শীতকালের দিন, স্নান করে,বারান্দায় চেয়ারে বসে বসে রৌদ্রের তাপ গায়ে মেখে তারপর সে বন্ধুটি প্রতিদিনই অফিসে যায়। একদিন শরীর ভালো না থাকায় সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সেদিন আর অফিসে যাবে না। তাই ঘরের ভিতরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ঘরমালিক বুঝতেই পারে নাই। কিছুক্ষন পর ঘরমালিকের বউ জল দিয়ে বারান্দাটি শুদ্ধ করতে নেমে পড়ে। বন্ধুটি ভিতরে থেকে ঘরমালিক এর কথা স্পষ্ট শুনে পায় ―" স্নান করে তো একেবারেই অফিসে গেলেই হত।সে নাই, একবার এখানে বসবেক।একবার ওখানে বসবেক। উচুজতের ছ্যালা হলেও সোভা পাইত। সে নাই,নিচুজাতের ছ্যালা! প্রত্যেক দিন পরিস্কার কর, শুদ্ধ কর, তারপর আমরা টুকু বারান্দায় বসতে পারব। আজ আসুক অমুকের বাবা তারপর দেখাচ্ছি।পরিষ্কার আমি বলে দিব, বাড়িভাড়া দিতে হলে উঁচুজাতের লোককে দাও। এমন নীচু জাতের লোককে দিও না। আমি রোজ রোজ জল দিয়ে বারান্দা শুদ্ধ করতে পারব নাই।"

দুই দিন পর বন্ধুটি আমাকে ফোন জানায়, সে নতুন জায়গায় ঘরভাড়া নিয়েছে।

সত্যিই ভাবা যায়,এই আমাদের গর্বের ভারত! আর কতদিন এই অমানবিক,অপমানজনক জাতপাত প্রথা  আমাদের দেশে ঠিকে থাকবে?

সতীদাহ প্রথা -ডি. মন্ডল
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:483 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিধবাকে তার মৃত স্বামীর সাথে পুড়িয়ে মারার প্রথাটি হল সতীদাহ প্রথা। এরিস্টোবুলুস লেখা থেকে বোঝা যায়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিষ্টাব্দ ৪০০) আগে থেকেই এ প্রথার প্রচলন ছিল। প্রাচীন অথর্ববেদে এবং বিষ্ণু স্মৃতিতে প্রতীকী সতীদাহের উল্লেখ থাকলেও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ গুলিতে সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

এই প্রথা বৃদ্ধি পায়, ১৬৮০-১৮৩০ সালের মধ্যে, কারণ বিধবাদের উত্তরাধিকারের অধিকার ছিল সেজন্য পরোক্ষভাবে মৃত্যুর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তাদেরকে পরজন্মের সুফল এবং এই মানুষটিকে স্বামী রুপে পেতে পারে এমন সব কিছু বোঝানো হতো। এছাড়া মুসলিম শাসনের অধীনে দাসত্বের কারণে দারিদ্র্যতা এবং চরম লজ্জাজনক পরিণতির পরিবর্তে সম্মানজনক সমাধান হিসাবে অনেকেই সতীদাহ বেছে নেয়।

১৯ শতকের প্রথম দিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই প্রথাটির বিরুদ্ধে কলকাতায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তা সত্ত্বেও ১৮০৩ সালে রাজধানীর  ৩০ মাইলের মধ্যে ৪৩৮টি সতীদাহ হয়। এবং ১৮১৫  এবং ১৮১৮  সালের মধ্যে, বাংলায় সতীদাহের ঘটনার সংখ্যা ৩৭৭ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৮৩৯-এ এসে  দাঁড়ায়। অবশেষে কেরির মতো ধর্ম প্রচারক এবং রাম মোহন রায়ের মতো হিন্দু সংস্কারকদের মতামতকে সমর্থন করে  ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়ামের বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালে হিন্দু বিধবাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রথাকে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক শাস্তিযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

ব্রাহ্মণদের সতীদাহ প্রথা চালু রাখার পেছনে কিছু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল যেমন..

১) মৃত ব্যক্তির বহু বিধবার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব না নেওয়ার নোংরা মানসিকতা।

২) সে সময়ে বিধবাদের সম্পত্তি সমাজের নিয়ন্ত্রকগন অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা ভোগ করতে পারত।

৩)  জীবন্ত দগ্ধ হওয়া সহ্য করা, সতীমাতার মর্যাদা অর্জন করা।

ভবিষ্যতে ওই গ্রামে ওই সতী মাতার নামে কোন মানুষ ঐ সতীমাতার কাছে প্রার্থনা করলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে এমন ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করেছিল ব্রাহ্মণরাই।

কিন্তু দেখা যেত অনেকেই অল্প বয়সে বিধবা হত, ফলে তারা আরো কিছুদিনের জন্য বেঁচে থাকতে চাইত। এমন সব নারীরা চিতায় ওঠার আগে বেঁকে বসতো। আসলে খুব কম নারীই ছিল যারা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে পরলোকের মোহে পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেত। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদত, ছেড়ে দিতে বলত। এই আওয়াজ যেন কেউ না শোনে তাই শবযাত্রীরা ঢোল, মাদল, বাঁশির আওয়াজে ভরিয়ে তুলত। অনিচ্ছুক মেয়েদের খাওয়ানো হত আফিম জাতীয় ওষুধ, যেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাউকে মাথার পেছন দিকে আঘাত করে অজ্ঞান করা হত। আর বোঝানো হত এই স্ত্রী পরবর্তী জন্মে উঁচু বংশে জন্মাবে, হতে পারবে এই স্বামীরই স্ত্রী।

পরের জন্মের নামে এভাবে ১৫০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে কয়েক হাজার নারীকে জীবিত পুড়িয়ে মারা হয়।

 এবার কি বলবেন সতীদাহ প্রথা ছিল স্বেচ্ছামৃত্যু?

না, এটা কোন স্বেচ্ছামৃত্যু ছিলনা এটা ছিল মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হিংস মানসিকতার পরিচয়।

যা সীমাবদ্ধ ছিল: উত্তরে- গাঙ্গেয় উপত্যকা, পাঞ্জাব এবং রাজস্থান;  পশ্চিমে- দক্ষিণ কোঙ্কন অঞ্চলে;  এবং দক্ষিণে- মাদুরাই ও বিজয়নগরে। ধন্যবাদ জানাই রাজা রামমোহন রায় কে যিনি আমাদের এই হিংস্র পশুদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

Hate Politics বলে কিছু হয়না, নিরপেক্ষ বলে কিছু হয়না -সন্ধ্যা মুখার্জী
Nov. 20, 2024 | রাজনীতি | views:809 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মাস গেলে মোটা বেতন, শহরের বুকে ৩ বি এইচ কে ফ্ল্যাটে অত্যাধুনিক ফার্নিচার, দামি গাড়ি চেপে স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে কে নিয়ে সপ্তাহান্তে অন্তত একবার আইনক্স তে সিনেমা দেখে ফেরার পথে ম্যাকডোনাল্ড তে ঢুঁ মারা আর বাড়ি ফিরে এসে হালকা করে এসি টা ছেড়ে দিয়ে দামি সোফায় বসে বিশাল বড় এলসিডি টিভির সামনে বসে বনধ, ধর্মঘট, রাস্তায় মিটিং মিছিল এর সমালোচনা করে গুষ্টি উদ্ধার করা। এই তো জীবন কালিদা। 

কিন্তু জীবনের কি নিষ্ঠূর পরিহাস দেখুন এই সেদিন পর্যন্ত বনধ, ধর্মঘট, রাস্তায় মিটিং মিছিল এর সমালোচনা করা মানুষ গুলো আজ নিজেরাই রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। কিছুদিন আগে রাতারাতি চাকরি খুইয়ে ছিলেন জেট এয়ারওয়েজ এর প্রায় ১৭০০০ কর্মী। এক রাতের মধ্যে শহরের বুকে ৩ বি এইচ কে ফ্ল্যাটে র ওই নিশ্চিত জীবন থেকে রাস্তায় মিটিং মিছিল এর ওই অচেনা ময়দানে নামিয়ে দিয়েছিলো ওনাদের। হয়তো ওঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে একটু একটু করে বুঝেছেন রাস্তায় নেমে এইসব আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাটা কতটা, হয়তো বা ওঁরা বুঝছেন ওঁদের ভাষায় সমাজের ওই ছোটোলোক মানুষ গুলো শখ করে পথে নামেন না,পথে নামেন একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই তে।

দেশের গাড়ি শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে, ফেডারেশন অফ অটোমোবাইল ডিলার্স এসোসিয়েশন এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত কয়েক মাসে ৩ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন আগামীদিনে আরো ১০ লক্ষ মানুষ কাজ হারাবেন, টেক্সটাইল সেক্টর এর অবস্থা আরো ভয়াভব গত একবছরে ৩৫℅ উৎপাদন কমেছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ রুজিরোজগার হারিয়েছেন গত একবছরে, দেশের ৩০ টি ইস্পাত কারখানা বন্ধের মুখে, স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীনস্থ এন এইচ এম এবং আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের ১৩১৮ জন কে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে, ৩ লক্ষ কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছে রেলতেও, বিস্কুট প্রস্তুতকারী সংস্থা পার্লে এই আর্থিক মন্দার জেরে তাদের ১০ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করতে চলেছে। আই টি সেক্টর এর অবস্থাও খুব একটা আশানরুপ নয়, ২০১৮ সালে যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা খাতে ব্যায় বৃদ্ধি পেয়েছিলো ৬.৭ হারে এবছর সেটি হ্রাস পেয়ে ৩.৮ হওয়ার সম্ভাবনা। 

চাকরি থেকে ছাঁটাই হওয়া এই কয়েক লক্ষ কর্মীর প্রায় অধিকাংশই এই সেদিন পর্যন্ত বনধ, ধর্মঘট, রাস্তায় মিটিং মিছিল এর সমালোচনা করে পাড়া মাথাতে তুলতেন। 

কিন্তু জীবনের কি নিষ্ঠূর পরিহাস দেখুন ওই নিশ্চিত জীবনের ড্রয়িং রুম ছেড়ে ছোটলোকদের ওই আন্দোলনে আজকে ওনারা  পা মেলাতে বাধ্য হয়েছেন, খুব কিউট ব্যাপার না?

রেল, বি এস এন এল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো (PSU) কেউ আর সুরক্ষিত নয়। একের পর এক সব শিল্পপতিদের হাতে  বেচে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি চাকরিটাও আর মানুষের কাছে সুরক্ষিত নয়। 

- তাই ফেসবুক স্টেটাস তে নামের পাশে আপনিI Hate Politics লিখতেই পারেন, সারাদিন সেক্স, পরনিন্দা -পরচর্চা নিয়ে আলোচনা করতে ভালো লাগলেও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে ওসব নোংরা জিনিস বলে আপনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে ই পারেন, মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইতে পথে নেমে সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে আপনি ডিসগাস্টিং বলে ছোটলোকদের নোংরামি বলে দাগিয়ে দিতেই পারেন, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গিন্নির হাতের ইলিশ ভাপা খেয়ে হাত চাটতে চাটতে আমি রাজনীতি করিনা কথাটা ১০৮ বার আপনি বলতেই পারেন, কলেজ পাস করার পরও বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই স্কুল সার্ভিস এক্সাম টা দিতে না পেরে পেট চালানোর দায়ে কলকারখানায় কাজ করার পরও আমি রাজনীতি করিনা কথা টা আপনি বলতেই পারেন কিন্তু জেনে রাখুন মশাই এই নিরপেক্ষতার ভনিতা আপনাকে বেশি দিন বাঁচাবে না। 

ছোটবেলায় রাখালের বাঘ পড়ার গল্পটা কমবেশি তো সবাই পড়েছিলেন, এই ঘুণ ধরে পচে গলে যাওয়া সমাজের আজকের রাখাল যদি জেট এয়ারওয়েজ এর ওই  কর্মীরা হয় কালকের রাখাল যদি বিএসএনএলের কর্মী  রা হয় তাহলে জেনে রাখুন আগামীদিনের রাখাল কিন্তু আপনি। তাই আজ না হয় কাল বাঁচতে গেলে পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে, এই নিরপেক্ষতার ভনিতা আপনাকে বেশি দিন বাঁচাবে না। আর পক্ষ বলতে তো ২ টো, একদিকে যা কিছু অন্যায়, যা কিছু মিথ্যে যা কিছু অত্যাচার তার সব কিছু নিরপেক্ষতার ভনিতা করে নিজের শিরদাঁড়া বেচে দিয়ে মেনে নেওয়া আর একদিকে সমাজের ওই উঁচু শ্রেণীর ভাষায় ছোটলোকদের ওই শেষ বিন্দু পর্যন্ত শিরদাঁড়া সোজা রেখে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে নিজের মতো করে, নিজের সামর্থ অনুযায়ী যা কিছু অন্যায়, যা কিছু মিথ্যে যা কিছু অত্যাচার তার বিরোধিতা করা। তাই বাঁচতে গেলে পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে কারণI Hate Politics বলে কিছু হয়না, নিরপেক্ষ বলে কিছু হয়না।

আত্মার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? ভূত কি বাস্তব? নাকি পুরোটাই কুসংস্কার? -চিত্রদীপ সোম
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:817 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আত্মা নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই৷ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই অনন্ত রহস্যের আধার এই বিষয়টি। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে আত্মার। তাছাড়াও আছে প্রচলিত ও লোকায়ত নানা বিশ্বাস। আসুন আজ এসব নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক মুক্ত মনের আলোয়। 

আত্মা কী?  

সংক্ষেপে বলা যায় মানুষ ও অনান্য প্রানীর শরীরে থাকা যে অতিপ্রাকৃত শক্তি মানুষ তথা অন্য প্রানীর জীবিত থাকার জন্য দায়ী, তাই-ই হলো আত্মা। একটা জীবিত প্রানী নড়তে পারে, শব্দ করতে পারে, স্থানান্তরিত হতে পারে, যা একটা জড়বস্তু বা একটা মৃতদেহ পারে না৷ আস্তিকরা একেই নাম দিয়েছেন আত্মা। এমনকি উদ্ভিদের মধ্যেও আত্মা আছে, যদিও তাদের মধ্যে প্রানীর লক্ষনগুলো দেখা যায় না। 

আত্মার অস্তিত্ব সত্যি আছে কিনা বা আত্মা সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো কী বলেছে তা নিয়ে আলোচনায় ঢুকবার আগে একটু দেখে নি আত্মার উৎপত্তি মনুষ্যসমাজে কবে থেকে।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে আত্মার ধারণা সংগঠিত ধর্মগুলির চেয়ে অনেক প্রাচীন। এমনকি তা ঈশ্বরবাদের আবির্ভাবের চেয়েও প্রাচীন৷ ঈশ্বরবিশ্বাস মানুষের মধ্যে অস্পষ্ট রূপে প্রথম আসতে শুরু করে নিয়ান্ডারথাল মানবের সময় থেকে, যা প্রায় পাঁচলক্ষ বছরের পুরানো৷ কিন্তু আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস আরো আগে। কত আগে? সে বিষয়ে সঠিক তথ্য আমরা কেউই জানি না৷ তবে পন্ডিতেরা বলছেন অন্তর তারো দশ হাজার বছরের পুরানো তো হবেই (এগুলো নিয়ে যদিও বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী তথ্য ও তত্ত্ব আছে)। সম্ভবত আদিম প্রাইমেট থেকে যখন 'বুদ্ধিমান' বিভিন্ন আদিম মানব প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিলো, আত্মার কল্পনাও তখন থেকেই মানবসমাজে (যদি সেটাকে 'সমাজ' নাম দেওয়া যায়) শুরু হয়। 

কোন ঘটনা মানুষকে সাহায্য করেছিলো আত্মার অস্তিত্বের কথা ভাবতে? 

এ’ব্যাপারে দুটো জিনিসের কথা পন্ডিতরা তুলে ধরেছেন। এক, আদিম মানুষ লক্ষ করেছিলো জীবন্ত প্রানীর সাথে মৃত প্রানীর বা জড়বস্তুর পার্থক্য আছে। কিন্তু সেই পার্থক্য কিসের কারণে সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করার মতো উপায় তাদের মধ্যে ছিলো ন। ফলে তারা ধারণা করে নেয় 'অলৌকিক' কোনো শক্তিই এর পিছনে দায়ী৷ আর দ্বিতীয় কারণটি হলো স্বপ্ন৷ স্বপ্নে আদিম মানুষরা দেখতো তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন কাজ করছে যেগুলো তারা কখনো করে নি। ফলে তাদের ধারণা হয় দেহের মধ্যে কোনো শক্তিই এগুলোর জন্য দায়ী। ঘুমন্ত অবস্থায় সেই শক্তি শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে এসব কাজ করে আবার ঘুম ভাঙার আগে ফিরে আসে। এটাই হলো আত্মা প্রাথমিক ধারনা৷ কোনো কোনো পন্ডিত এর সাথে জুড়ে দিচ্ছেন রোগের ধারণাকেও। কেন বিভিন্ন রোগ হচ্ছে তা ব্যখ্যা করার উপায় আদিম মানুষের কাছে ছিলো না। ফলে তাদের ধারণা হয় বহিরাগত কোনো খারাপ শক্তি এসে তাদের শরীরের মধ্যের শক্তিটাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এইবকারণেই রোগবাগ হয়৷ রোগ সারাতে ওঝা ডাকার প্রচলন এই সময় থেকেই শুরু হয় আদিম মানুষের মধ্যে। আদিম বিভিন্ন গুহাচিত্রে অদ্ভুতুড়ে পোষাক পরে নৃত্যর‍ত যেসব মানুষগুলোকে দেখেন, তারাই মানবসমাজের প্রথম ওঝা। ধর্ম বা পুরোহিতের আগমন তখনও হয় নি সমাজে।

 আরো একটা কৌতুহলকর বিষয়, মানুষ এইসময় মনে করতো গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়পর্বত, সূর্য চাঁদ প্রত্যেকেরই প্রান অর্থাৎ আত্মা আছে। তাই এসব প্রাকৃতিক শক্তিতে তুষ্ট করার জন্য, অর্থাৎ তাদের আত্মাকে তুষ্ট করার জন্য তারা এসব প্রাকৃতিক শক্তির পুজো করতো৷ মনে রাখবেন, হিন্দুদের প্রকৃতিবাদের সাথে এই বিশ্বাসের পার্থক্য আছে। হিন্দুরা বায়ুর দেবতা বলে মনে করে পবনদেবকে। জলের দেবতা বলে মনে করে বরুনকে। তাই হিন্দুরা ঠিক বায়ু বা জলকে পুজো করে না, করে এইসব প্রাকৃতিক শক্তি গুলোর দায়িত্বে থাকা দেবতাদের, অর্থাৎ পবন বা বরুণকে৷ কিন্তু আদিমমানুষেরা তা করত না। তারা সরাসরি এসব বায়ু বা জলকেই জীবন্ত প্রানী হিসাবে পুজো করতো (সম্ভব হলে ধর্ম ও জাদুবিশ্বাসের বিবর্তন নিয়ে পরে একদিন কলম ধরবো)।

এই গেলো আত্মার উদ্ভবের ইতিহাস৷ এবার আশা যাক আত্মা সম্পর্কে কোন ধর্মমত কী বলেছে।এবং এখান থেকেই গ্যাঁড়াকলের শুরু। কারো বর্ণনার সাথে কারো বর্ণনা মেলে না, অথচ সবাই মনে করে তার ধর্মের ব্যখ্যাটাই সঠিক। কেন সঠিক তার অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই বিশ্বাসীদের কাছে। সঠিক, ব্যাস।

প্রথমে গীতার কথাতেই আসা যাক। গীতায় বলা হয়েছে


বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়।

নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা।

ন্যন্যনি সংযাতি নবানি দেহি।।

নৈনং শস্ত্রাণি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।

ন চৈনং ক্লেদায়মত্যাপো ন শোসষয়তি মারুতঃ।।

অচ্ছেদ্যহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশপষ্য এব চ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থানুরলচোহয়ং সনাতনঃ।।

অব্যক্তহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমহর্সি।।

(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, ২/২২-২৫)

মানেটা কী দাঁড়ালো? 

মানুষ যেমন ছিন্ন বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরে, আত্মা তেমমই পুরানো শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে।  এই আত্মাকে কোনো অস্ত্র দ্বারা কাটা যায় না, আগুন তাকে পোড়াতে পারে না, জল ভেজাতে পারে না, বাতাস শুকাতে পারে না। এ হলো শাশ্বত, স্থির ও সনাতন।

 মৃত্যুর পর আত্মা তাহলে কোথায় যায়?  প্রাচীন হিন্দুরা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর ভালো আত্মার স্থান হয় ব্রহ্মলোকে, অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মার রাজ্যে। আর খারাপ আত্মার স্থান হয় নরকে। পরবর্তীকালে হিন্দুদের মধ্যে এলো কর্মফল তত্ত্ব। হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করলো মানুষের এ জীবনের কর্মফল অনুযায়ী পরবর্তী জন্ম নির্ধারিত হবে তার। অর্থাৎ ভালো কাজ করলে ব্রাহ্মণ জন্ম, খারাপ কাজ করলে বৈশ্য বা শূদ্র জন্ম, এবং আরো খারাপ কাজ করলে কীটপতঙ্গের জন্ম। প্রথমদিকে সমাজের অনুশাসন বজায় রাখতে, গোষ্ঠী জীবনের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই কর্মফলবাদের উদ্ভব হয়৷ পরবর্তীকালে তাই হয়ে দাঁড়ায় শ্রেনী শোষনের অস্ত্র৷ জাতিভেদ প্রথা টিকিয়ে রাখার অস্ত্র। সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত শূদ্রদের মাথায় ঢোকানো হয় এ জীবনে তাদের উপর এত অত্যাচার, এত শোষণ নিপীড়নের কারণ তাদের পূর্বজন্মের কর্মফল। পূর্বজন্মে তারা অনেক পাপ করেছিলো, তারই শাস্তি হিসাবে এজন্মে শূদ্র হয়ে জন্মানো, এই অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়া৷ অতএব শূদ্রদের মাথায় ঢোকানো হলো হে শূদ্ররা, তোমরা তোমাদের উপর এই অমানবিক শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করো না৷ কারণ এই শোষন, এই অত্যাচার পূর্বনির্দষ্ট। তোমাদের গতজন্মের কর্মফল। এর প্রতিবাদ করলে তোমাদের ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করা হবে।  ফলত পরের জন্মে আরো অবনতি হবে তোমাদের। কাজেই কোনো প্রতিবাদ না করে মেনে নাও এই অত্যাচার। তাতে পরের জন্মে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ব্রাহ্মন বা ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেবে তুমি। ভোগ করবে অসীম সুখ ও ঐশ্বর্য (শূদ্রদের উপর অমানবিক অত্যাচারের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিধান নিয়ে পরে একদিন লিখবো নাহয়)।

এভাবেই কর্মান্তরবাদ এদেশে জল ঢেলেছিলো বিদ্রোহের আগুনে। শোষিত শ্রেনীর প্রতিবাদের বর্শার অভিমুখ থেকে নিরাপদ রেখেছিলো শোষক সমাজকে। আর এইকারণেই পৃথিবীর অনান্য দেশে দাসবিদ্রোহ ঘটলেও আধ্যাত্মিকতার পূন্যভুমি এই ভারতে কোনোদিন ঘটে নি কোনো শূদ্র বিদ্রোহ৷ নিশ্চিন্ত নিরাপদে পাঁচ হাজার বছর ধরে অত্যাচার চালিয়ে গেছে উচ্চবর্ণের লোকেরা।

হিন্দুদের উপনিষদ বারোটি। মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৪০০ অব্দে রচনা হয় এগুলি৷ ভগবদ গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে যেসমস্ত উপদেশ দিয়েছিলেন তার অনেকগুলিই কঠ উপনিষদ থেকে নেওয়া৷ কারণ গীতা অনেক পরের রচনা৷ কঠ উপনিষদে আছে যম ও নচিকেতার কাহিনী। নচিকেতা যমের কাছে আত্মার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষন অরাজী থাকার পর যম নচিকেতাকে আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ে জ্ঞান দেন। রথের উদাহরণ দিয়ে সেখানে আত্মার বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়েছে শরীর রথ, আত্মা রথী, ইন্দ্রিয়গুলি অশ্ব, মন রশি, বুদ্ধি তার সারথি৷ 

বৃহদারণ্য উপনিষদে বলা হয়েছে 'মনো বৈ ব্রহ্মোতি অমনসো হি কি সাৎ?' (৪/১/৬), অর্থাৎ মনই ব্রহ্মা, মন হীনের কি সিদ্ধ হতে পারে? 

মৈত্রী উপনিষদে বলা হয়েছে 'যিনি শুদ্ধ...শান্ত...শাশ্বত, অজাত...তার দ্বারাই এই শরীর চেতন রূপে থাকে। অর্থাৎ আত্মার শুধু শাশ্বতই নয়, আত্মার দ্বারাই চেতনার উৎপত্তি।

ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের আটান্ন সুক্তে আছে

যত্তে যমং বৈবস্বতং মনো জগাম দূরকম।

তত্ত আ বর্তয়ামসী হ ক্ষয়ায় জীবসে।।

যত্তে দিবং যৎ পৃথিবীং মনো জগাম দূরকম।

তত্ত্ব আ বর্তমায়সী ক্ষয়ায় জোবসে।।

অর্থাৎ, তোমার যে মন অতিদূরে বিবস্বনের পুত্র যমের নিকট তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি। জীবিত হয়ে ইহলোকে বাস করো।

তোমার যে মন অতিদূরে স্বর্গে অথবা পৃথিবীতে চলে গিয়েছে, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি। তুমি জীবিত হয়ে ইহলোকে বাস করো।

বলাই বাহুল্য, এখানে মন ও আত্মা সমার্থক। 

সাংখ্যমতে 'আত্মা চৈতন্যস্বরূপ' (সাংখ্যসূত্র ৫/৬৯ ও সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য ২/৪২/৪৭)।

আচার্য শংকর তার ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন 'মন হলো আত্মার উপাধিস্বরূপ। 

শ্রীভাষ্যকার রামানুজের মতে 'আত্মা চৈতন্যস্বরূপ'।

শাক্ত দর্শনে বলা হয়েছে 'মন অন্য নয়, আত্মাই মন' (ত্রিপুরারহস্যতন্ত্র ১৭/১১৭, ৪৭)

যোগবাশিষ্ঠরামায়নে বলা হয়েছে 'স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই যখন মননশক্তি ধারণ করে, তখন মন বলে অবহিত হয়', অর্থাৎ চৈতন্য বা মনই আত্মা (যোগবাশিষ্ঠ রায়ন, উৎপত্তিপ্রকরণ, ১০০/১৪)। 

স্বামী বিবেকানন্দের মতে 'চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা' (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখন্ড সং- প্রকাশক নবপত্র, পৃষ্ঠা ১৬২)।

কি মাথা ঘুরছে এতরকম মতবাদ পড়ে? দাঁড়ান বন্ধু। এ তো সবে কলির সন্ধ্যা৷ শুধু তো হিন্দুধর্মে আত্মার বর্ণনা দিতেই কেটে গেলো এতটা সময়৷ এরপর আসবে মুসলিম, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও অনান্য আদিবাসী ধর্মের আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা। দেখবেন একের সাথে অন্যের কেমন আকাশ পাতাল পার্থক্য। কারো সাথে কারো বক্তব্য মেলে না। এ যায় ডানদিকে তো ও যায় বামে। অথচ অদ্ভুতভাবে সবাই বিশ্বাস করে তার ধর্মের বক্তব্যই একমাত্র সঠিক, বাকি সব মিথ্যা৷ কেন মিথ্যা, কিভাবে মিথ্যা,  কিভাবে জানা গেলো আপনার ধর্মের আত্মার বর্ণনাটাই ঠিক, অনান্য গুলো মিথ্যা, প্রমান করতে পারবেন অনান্য ধর্মের আত্মার বর্ণনা ভুল, ঠিক শুধু। আপনারটি?  ইত্যাদি প্রশ্ন করবেন না৷ কারণ এর কোনো উত্তর ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে নেই। অথচ এতরকম মতবাদ একইসাথে সত্য হতে পারে না। হয় যেকোনো একটি সত্যি, আর নয়তো সবগুলিই মিথ্যা৷ কোনটা সত্যি তা প্রমান করার দায় তো আস্তিক ও ধর্মগুরুদের। আমরা শুধু মজা দেখবো।  যাই হোক, হিন্দুধর্মের আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা তো পড়লেন। এবার একটু যাওয়া যাক অন্য দিকে। দেখা যাক বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় ও অনান্য বিভিন্ন ধর্মে আত্মার বিষয়ে কী বলা হয়েছে। প্রথমেই আসি আদিবাসীদের আত্মা সম্পর্কিত বিশ্বাসে। এখানেও বারো গেরস্তর তেরো হাঁড়ি। অর্থাৎ কারো ধারণার সাথে কারো ধারণা মেলে না। অথচ প্রত্যেকেই আবার মনে করে তার ধর্মের বা তার কমিউনিটির বিশ্বাসটাই একমাত্র সত্য, বাকি সব মিথ্যা 

ছোটনাগপুর ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের ধারণা মানুষের ছায়াই হলো তার আত্মা।

কুকি ও মণিপুরের পুরুম সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি করে আত্মা।

বীরহোররা মনে করে প্রতিটি মানুষের মধ্যে আছে তিনটি করে আত্মা। তার মিধ্যে একটাকে প্রায়ই দেখা যায়, তা হলো মানুষের ছায়া।

নীলগিরির টোডা সম্প্রদায়ের মানুষের মতে মানুষের আত্মা ঠিক তার মতই দেখতে।

মালয়ের মানুষের বিশ্বাস আত্মার রঙ লাল। আয়তনে তা ভুট্টার দানার মতো।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর ধারণা আত্মা তরল।

অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা বিশ্বাস করে আত্মা থাকে বুকের বামদিকে। আয়তনে খুব ছোট্ট।

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো প্রতিটি মানুষের মধ্যে হাত পা ও অনান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে একটা ছোট্ট মানুষ বাস করে৷ এটাই হলো তার আত্মা।

জাপানীরা বিশ্বাস করে আত্মার রঙ কালো।

চলুন এবার যাই বিদেশের দিকে বা অনান্য ধর্মগুলির দিকে। ইহুদীরা মনে করে প্রাণই আত্মা, আত্মাই প্রাণ৷ তারা বিশ্বাস করে জিহোবা মানুষের নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণময় আত্মার সঞ্চার করেছিলেন। তাদের বিশ্বাস আত্মা থাকে হৃদপিন্ডে।  সেখান থেকেই শক্তি সঞ্চারিত হয় সারাদেহে৷  হৃদপিন্ডই থেকেই উৎসারিত হয় চিন্তা, চেতনা, প্রেম,  আনন্দ ইত্যাদি (বাস্তবে রক্তসঞ্চালন করা ছাড়া হৃদপিন্ডের কোনো ভূমিকা নেই। চিন্তা চেতনা উৎসারিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। এসব গাঁজাখুরি তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন না)।

হোমারের সময় ও তার পরবর্তীকালে গ্রীকরা বিশ্বাস করতো শ্বাসই আত্মা। মারা গেলে শ্বাস দেহ থেকে বিচ্যুত হয়৷ তবে মৃতদেহ যতক্ষন রক্ষিত থাকবে ততক্ষন আত্মা থাকবে মৃতদেহেই। মৃতদেহের সৎকার করার পর আত্মা বাতাসের সাথে মিশে যাবে।

ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মে আত্মার বর্ণনা মোটামুটি একই। আত্মা এখানে দেহাতীত একটি স্বত্তা। এবং মৃত্যুর পরে আত্মা বেহেস্তে (স্বর্গ)  বা দোজখে (নরকে) যায় এবং শেষ বিচারের দিন অবধি সেখানে অনন্ত সুখ বা অনন্ত দুঃখ ভোগ করে। হিন্দুধর্মের মতো পুনর্জন্মের তত্ত্বে বিশ্বাসী নয় এই দুই ধর্ম। খ্রীষ্টানরা আবার ভালো আত্মা  ও দুষ্ট আত্মা এই দুইপ্রকার আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। 

আত্মা নিয়ে বিভিন্ন ধর্ম ও উপজাতির পরস্পরবিরোধী মতামতগুলো দেখলেন। এবার দেখা যাক সত্যিই আত্মার অস্তিত্ব আছে কিনা সেই প্রশ্নে। 

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে আত্মা বলতে তাকেই বলা হয়েছে, যে শক্তি আমাদের দেহকে পরিচালনা করে, যা মৃতদেহ বা জড়বস্তু থেকে জীবিত প্রানীকে পৃথক করে। ধর্মগ্রন্থের মতে আমাদের চিন্তা চেতনার উৎস হলো আত্মা। আত্মার কারণেই আমরা চিন্তা করতে পারি, কোনো বিষয়ে ভাবতে পারি, শরীরের নানা মুভমেন্ট, চলন, গমন, বাক নির্গমন করতে পারি ইত্যাদি। অর্থাৎ খুব সোজা কথায় বললে, মনই হলো আত্মা। এখন মন কী? মানুষের শরীর কুচিকুচি করে কাটলেও কিন্তু 'মন' বলে কোনো অঙ্গ দেখা যাবে না। তাহলে আমরা চিন্তাভাবনা করছি কী করে?  কী করেই বা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নানা নির্দেশ দিচ্ছি? আসলে পুরোটাই পরিচালিত হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের অত্যন্ত জটিল বিভিন্ন কার্যপ্রনালী, অসংখ্য স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ককোষের জটিল সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সুসংহত সিস্টেম আমাদের সাহায্য করছে কোনো বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নানা নির্দেশ দিতে৷ কিন্তু প্রাচীন মানুষের কাছে আজকের বিজ্ঞানের এই গবেষনালব্ধ জ্ঞানগুলি ছিলো অজানা। মানবশরীরের বিভিন্ন রহস্যও তাদের জানা ছিলো না৷ জানা ছিলো না স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্ক কোষের অস্তিত্বের কথা, যার সাহায্যে আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি। প্রান ছিলো তাই তাদের কাছে রহস্যময় একটি বিষয়। ফলে তারা মনে করতো আমাদের শরীরে নিশ্চয়ই এমন কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা আছে যার ফলে  আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি, নানারকম অঙ্গসঞ্চালন করতে পারি। কিন্তু আজ আমরা জানি এরকম কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব নয়, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের নানা জটিল ক্রিয়াকলাপই আমাদের চিন্তা চেতনা ও অনান্য ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়ী। জড়বস্তুর মধ্যে এই মস্তিষ্ক বলে বিষয়টি নেই, নেই অনান্য ক্রিয়াকর্মের উপযোগী অঙ্গপ্রত্যঙ্গও৷  তাই জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণের লক্ষনও দেখা যায় না। এটাই মূল ব্যাপার। কোনো অতিপ্রাকৃত স্বত্তাকে এর মধ্যে টেনে আনার দরকার নেই। আবার প্রানীদেহের মৃত্যুর সাথে সাথে তার মধ্যে প্রানের বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরও মৃত্যু ঘটে৷ তারপর তা পোড়ানো হয় আগুনে বা কবর দেওয়া হয় মাটিতে। অর্থাৎ তথাকথিত 'মন'কে হয় আগুনে পোড়ানো হয়, নয় মাটির সাথে মেশানো হয়। এরপর মনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। মনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয় মানে সম্ভব নয় আত্মার অস্তিত্ব থাকাও।

প্রশ্ন উঠবে তাহলে মৃত মানুষের মধ্যে প্রাণের লক্ষন দেখা যায় না কেন৷ তারও তো সমস্ত স্নায়ুকোষ, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। সোজা উত্তর, শুধু বিভিন্ন অর্গানগুলি থাকলেই হবে না, সেগুলিকে সচল রাখার শক্তি থাকতে হবে৷ নয়তো প্রাণের লক্ষণ তার মধ্যে থাকবে না৷  ঠিক যেমন একটা ফ্যানের সমস্ত পার্টস ঠিকঠাক থাকলেও ইলেকট্রিসিটি না থাকলে ফ্যান চলবে না ঠিক তেমনই।

প্রশ্ন উঠবে ফ্যানের ঘুর্ননের জন্য যে শক্তি দরকার তা আসে ইলেকট্রিসিটি থেকে৷ কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রানের এই শক্তি আসে কোথা থেকে? মৃত্যুর পরেই বা সেই শক্তি কোথায় যায়? উত্তর কোথাও থেকে আসে না। আবার মৃত্যুর পরেও কোথাও যায় না। এটা প্রানেরই নিজস্ব ধর্ম। আগুনের ধর্ম যেমন সমস্ত কিছুকে পোড়ানো, অ্যাসিডের ধর্ম যেমন ধাতুকে গলানো, তেমনই। অ্যাসিডের এই যে ধাতুকে গলানোর ক্ষমতা, এই ক্ষমতা কোথা থেকে আসে?  উত্তর এটা কোথাও থেকে আসার বা কোথাও যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই এর মধ্যে। এটা অ্যাসিডেরই নিজস্ব ধর্ম। আগুনের এই যে সমস্ত কিছুকে পোড়ানোর যে শক্তি, সেই শক্তি কোথা থেকে আসে? আবার আগুন নিভিয়ে দিলেই বা সেই শক্তি যায় কোথায়? উত্তর কোথা থেকে আসেও না, কোথাও যায়ও না৷ পোড়ানোটাই আগুনের সহজাত ধর্ম৷ ঠিক তেমনি প্রাণেরও সহজাত ধর্মই হলো প্রাণের বিভিন্ন লক্ষন যথা চিন্তাভাবনা করা বা বিভিন্ন শারীরবৃত্তিয় কাজ পরিচালনা করা ইত্যাদি। প্রশ্ন উঠতে পারে সম্পুর্ন জড় উপাদান দিয়ে তৈরী প্রানীদেহে জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্য বহির্ভূত প্রানের লক্ষন আসে কোথা থেকে?  উত্তর, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন কোনোটার মধ্যেই যেমন জলের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষ অনুপাতে দুটিকে মেশালে তা থেকে জল তৈরী হয়, যার বৈশিষ্ট্য হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ন পৃথক, ঠিক তেমনি জড় উপাদান দিয়ে প্রাণ তৈরী হলেও তার বৈশিষ্ট্য জড় উপাদান থেকে পৃথক।

বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দ পঞহোতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নাগসেনের সাথে রাজা মিলিন্দের কথোপকথনের একটি বর্ণনা আছে, যাতে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে আত্মার অবিনশ্বর তত্ত্বের অসাড়তাকে।

মিলিন্দ- মৃত্যুর পরে আত্মা কোথায় যায়? 

নাগসেন- কোথাও যায় না রাজন। দেহের সাথে সাথে তারও মৃত্যু ঘটে৷

রাজা মিলিন্দ সন্ধিগ্ন। সন্তুষ্ট নন এই উত্তরে।

নাগসেন বুঝতে পারেন রাজার মনোভাব। বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেন- মহারাজ, বলতে পারেন, প্রদীপ নেভানোর পর আগুনের শিখা কোথায় যায়?

এবার রাজা মিলিন্দের ভুল ভাঙে। বুঝতে পারেন নাগসেনের তত্ত্বের যথার্থতা। 


এরপরেও যারা গাঁইগুঁই করবেন আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে, তাদের জন্য রইলো সরাসরি কিছু প্রশ্ন-

১) বিভিন্ন ধর্মে আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে৷ এতটাই পরষ্পরবিরোধী সেগুলি যে তার একটাকে মানতে গেলে বাতিল করতে হয় অন্যগুলো। এখন পৃথিবীর ৪২০০টা ধর্মের ৪২০০ রকম পৃথক পৃথক আত্মার বর্ণনার মধ্যে আপনি ঠিক কোনটিকে মানবেন ও কেন মানবেন? কিসের ভিত্তিতে মানবেন যে আপনার পছন্দের ওই ধর্মের বর্ণনাটাই ঠিক, বাকি সব ভুয়ো? কিভাবে প্রমান করবেন একমাত্র আপনার পছন্দের ধর্মের আত্মার বর্ণনাটাই ঠিক, বাকি সব ভুল? 'অন্ধবিশ্বাস' ছাড়া আর কোনো পথ আছে কি আপনার কাছে? না নেই। এবং মনে রাখবেন, বিজ্ঞানের কাছে কিন্তু কোনো বিশ্বাস বা কোনো তত্ত্বের বিন্দুমাত্র দাম নেই, যতক্ষন না সেই বিশ্বাসটি বা সেই তত্ত্বটির যথার্থতা 'প্রমানিত' হচ্ছে। 'প্রমান' বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের কাছে। বিজ্ঞান বিশ্বাস করে যুক্তি ও প্রমানে। যুক্তি ও প্রমান ছাড়া বিজ্ঞানের দরবারে কোনো তত্ত্ব গ্রহনযোগ্য নয়, তার পিছনে যতবেশী মানুষেরই সমর্থন থাকুক না কেন বা যত বেশীদিন ধরেই সেই বিশ্বাসটি জনমানসে চলে আসুক না কেন।


২) যখন পৃথিবী তথা সৌরমন্ডলের জন্ম হয় নি, তখন আত্মাগুলি কী করছিলো?  কোথায় ছিলো? যখন ব্রহ্মান্ডেরই জন্ম হয় নি, বিগ ব্যাং যখন সংগঠিত হয় নি, তখন কোথায় থাকতো আত্মারা? কী করতো তারা তখন? 


৩) সৃষ্টির প্রথমে ছিলো মাত্র একটি প্রাণ৷ অর্থাৎ তার মধ্যে ছিলো মাত্র একটি আত্মা। অথচ আজ পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যাই সাতশো কোটি৷ অনান্য প্রানী ও উদ্ভিদের কথা তো বাদই দিলাম। তাহলে এত প্রানীর মধ্যে এত আত্মা আসলো কোথা থেকে? ওই একটি আত্মা কী ভাগ হয়ে এতগুলো আত্মা হলো? কিন্তু ধর্মগ্রন্থ তো বলছে আত্মাকে কাটা যায় না। আবার আত্মা নাকি নতুন করে জন্মায়ও না বা তার মৃত্যুও হয় না৷ তাহলে এত জনসংখ্যা ও অনান্য প্রানীসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কী?  


৪) হিন্দুধর্ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণী নাকি তার পূর্বজন্মের কর্মফলে এ জন্মে পৃথিবীতে জন্মায়। অর্থাৎ পূর্বজন্মে ভালো কাজ করলে এ জন্মে ব্রাহ্মন বা পূর্বজন্মে খারাপ কাজ করলে এ জন্মে শূদ্র বা পোকামাকড় হয়ে জন্মায় ইত্যাদি। তা পুর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পিছাতে পিছাতে পৃথিবীতে প্রথম যে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি তার কোন পূর্বজন্মের কর্মফলে পৃথিবীতে এসেছিলো? 


৫) পৃথিবীতে যখন প্রাণের উদ্ভব হয় নি, তখন আত্মাগুলো কোথায় স্তূপাকারে রাখা ছিলো? এই সৌরমন্ডলের মধ্যেই, না বাইরে কোথাও? সৌরমন্ডলের মধ্যে রাখা থাকলে ঠিক কোন জায়গায় রাখা ছিলো? বৃহস্পতি আর শনির মাঝে, নাকি মঙ্গল  আর শুক্রের মাঝে? নাকি গ্রহানুপুঞ্জের মধ্যে? নাকি অন্য কোথাও? কিভাবে জানলেন ঠিক সেখানেই রাখা ছিলো? 

৬) স্বর্গ ও নরক জায়গাগুলি ঠিক কোথায়? সেটি কি সৌরমন্ডলের মধ্যেই, নাকি বাইরে কোথাও? সৌরমন্ডলের মধ্যে হলে ঠিক কোন জায়গায়? বুধ আর মঙ্গলের মাঝখানে, নাকি ইউরেনাস আর নেপচুনের মাঝখানে? নাকি অন্য কোথাও?  কারণ বিজ্ঞানীরা সৌরমন্ডলের মধ্যে এরকম কোনো জায়গার খোঁজ পান নি। সৌরমন্ডলের বাইরে হলেই বা ঠিক কোন জায়গায়? কিভাবে জানলেন ঠিক সেই জায়গাতেই স্বর্গ বা নরক আছে? গিয়ে দেখেছেন? শক্তিশালী দূরবীনের সাহায্যে আমরা এখন সৌরমন্ডলের বাইরেও কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের জিনিস দেখতে পাই। কিন্তু এখনও অবধি বিজ্ঞানীরা এরকম কোনো জায়গার খোঁজ পান নি যেটা ধর্মগ্রন্থ বর্ণিত স্বর্গ বা নরক হতে পারে, যেখানে আত্মারা সব কিলবিল করছে। তাহলে স্বর্গ নরক জায়গাগুলি ঠিক কোথায়? 

 

৭) হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে আত্মাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, অস্ত্রে বিদ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না, আবার এদিকে অনান্য ধর্মের মতো হিন্দুধর্মেও নরকে আত্মার শাস্তির বিভিন্ন উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। একটু ভেবে দেখুন তো, যাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, অস্ত্রে বিদ্ধ করা যায় না, তাকে আদৌ কোনো শাস্তি দেওয়া সম্ভব কিনা? এগুলো তো সম্পুর্ন স্ববিরোধী কথাবার্তা। কাজেই যদি আপনি গীতায় বর্ণিত আত্মাকে আগুনে না পোড়াতে পারার, অস্ত্রে বিদ্ধ না করতে পারার তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনাকে নরকে আত্মাকে শাস্তি দেবার তত্ত্বে অবিশ্বাস করতে হবে, আবার নরকে আত্মার শাস্তির তত্ত্বে বিশ্বাস করলে গীতায় দেওয়া আত্মার তত্ত্বে অবিশ্বাস করতে হবে। দুটো একসাথে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়৷ অথচ মুশকিল হলো হিন্দুধর্মে এই দুই পরস্পরবিরোধী কথা একইসাথে বলা হয়েছে।


কাজেই, এই দীর্ঘ আলোচনার শেষে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি আত্মা শুধুমাত্র একটি কুসংস্কার বিশেষ৷ দেহাতীত আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ আর আত্মার অস্তিত্ব নেই মানেই অস্তিত্ব নেই ভূতেরও।

রাজা রামমোহন রায়ের কবিতা এবং এক মহান যোগসূত্র -মলয় দাস
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:484 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রাজা রামমোহন রায় এক যুগপুরুষl তাঁর কর্মজীবন এবং জীবনবোধের গভীরতা অবাক করেl কুসংস্কারের ঘন কুয়াশায় আবৃত সনাতন ভারতীয় চিন্তা নতুন প্রাণস্পর্শে জেগে ওঠে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমেl পন্ডিতপ্রবর কেশবচন্দ্র সেন মহাশয় রামমোহন সম্পর্কে বলছেন,

উপনিষৎ পুরাণ হইতে চারি সহস্র বৎসর পূর্বে যে ব্রহ্মমন্ত্র উচ্চারিত হইয়াছিল, সেই ওঁকার পুনঃসংস্থাপন করিলেনl আমাদিগের দেশীয় শাস্ত্রে যে বড় বড় কথা মহারণ্যের মধ্যে পড়িয়া ছিল, তৎসমুদয় উদ্ধার করিলেনl সমুদয় বিরুদ্ধবাদীগণকে নিরস্ত্র করিয়া সত্য উদ্ধার করিলেন, দেশীয় ভ্রাতাদিগকে সৎপথ দেখাইলেনl (পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা, পৃ : ৬)

রামমোহনের আধ্যাত্মিক ভাবনা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বেদবেদান্তের বিবিধ রচনায়, তেমনই বাসা বেঁধেছে তাঁর কবিতায়। তিনি লিখছেন, 

একদিন যদি হবে অবশ্য মরণ।

এত আশা বৃদ্ধি কেন এত দ্বন্দ্ব কি কারণ।

এই যে মার্জিত দেহ,

যাতে এত কর স্নেহ,

ধূলি সার হবে তার মস্তক চরণ।

যত্নে তৃণ কাষ্ঠখান,

রহে যুগ পরিমাণ,

কিন্তু যত্নে দেহ নাশ না হয় বারণ।

অতএব আদি অন্ত,

আপনার সদা চিন্ত,

দয়া কর জীবে লও সত্যের শরণ।(ঐ, পৃ : ৪৩)

প্রশ্ন হল, কি সেই সত্য, কোন সত্যকে আঁকড়ে ধরতে বলছেন রাজা রামমোহন, কোন সত্যের জন্য সবকিছু মানুষ তৃণজ্ঞান করতে পারে? উত্তর অন্বেষণে চলতে চলতে, এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াই। একজন বলছেন, 

অনেকে মনে করেন যে, suffering ( দুঃখ) এর মধ্যে বুঝি শুধু কষ্টই আছে, কিন্তু একথা সত্য নয়। suffering এর মধ্যে কষ্ট যেমন আছে  - তেমনি একটা অপার আনন্দও আছে। এই আনন্দবোধ যার হয়নি তার কাছে কষ্ট শুধু কষ্টই ; সে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের  নিষ্পেষণে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের ভিতর একটা অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদ পেয়েছে - তার কাছে suffering একটা গৌরবের জিনিষ, সে দুঃখ কষ্টের চাপে মুমূর্ষু না হয়ে আরও শক্তিমান ও মহীয়ান হয়ে ওঠে।

সে গাইছে রবিঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে, 

যত দেব প্রাণ       বহে যাবে প্রাণ

       ফুরাবে না আর প্রাণ।

এত কথা আছে       এত গান আছে

       এত প্রাণ আছে মোর,

এত সুখ আছে        এত সাধ আছে

         প্রাণ হয়ে আছে ভোর।

সেই একজন আর কেউ নন, স্বয়ং সুভাষচন্দ্র, আমাদের নেতাজি। ( তরুণের স্বপ্ন, পৃ : ৮, ১৫) দুঃখের মধ্যে সত্য-শিব-সুন্দর -কে উপলব্ধির মহান সনাতন আধ্যাত্মিক চেতনা তমসাচ্ছন্ন পথে আলো দেখিয়েছে তাঁকে। এই সেই সত্য, রামমোহনের ভাবনায় যা ধরা পড়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হতে স্বামী বিবেকানন্দ কর্মবীর মানুষগণ সকলেই এই মহত্তম ভাবে মশগুল। 

রামমোহন লিখছেন,

অনিত্য বিষয় কর সর্ব্বদা চিন্তন।

ভ্রমেও না ভাব হবে নিশ্চয় মরণ।

বিষয় ভাবিবে যত,

বাসনা বেড়িবে তত,

ক্ষণে হাস্য ক্ষণে খেদ, তুষ্টি রুষ্টি প্রতিক্ষণ।

অশ্রু পড়ে বাসনার,

দম্ভ করে হাহাকার,

মৃত্যুর স্মরণে কাঁপে কাম ক্রোধ রিপুগণ।

অতএব চিন্ত শেষ,

ভাব সত্য নির্বিশেষ,

মরণসময়ে বন্ধু, একমাত্র তিনি হন।

ভজ অকাল নির্ভয়ে।

পবন তপন শশী ভ্রমে যাঁর ভয়ে।

সর্ব্বকাল বিদ্যমান,

সর্ব্বভূতে যে সমান,

সেই সত্য তাঁরে নিত্য ভাবিবে হৃদয়ে।

'সেই সত্য তাঁরে নিত্য ভাবিবে হৃদয়ে ' - ভারী সুন্দর এই কথাখানি। বারবার শুনতে ইচ্ছা করে।  সৎ-চিৎ -আনন্দ তথা সচ্চিদানন্দের উপলব্ধি ধরা পড়েছে রামমোহনের এই লেখায়। সত্য -শিব -সুন্দর ভাস্বর হয়ে উঠে তাঁর প্রকাশ ও ভাবনায়। শঙ্করাচার্যের 'ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ কবিতা হয়ে ধরা পড়ে তাঁর বর্ণনায়। জগৎ তথা পার্থিবতা অনিত্য ( মিথ্যা তথা প্রতিভাসিক সত্তা ), একে অতিক্রম করে আমাদের যেতে হবে সেই পরমসত্যের দিকে অর্থাৎ 'ক্ষণে হাস্য ক্ষণে খেদ, তুষ্টি রুষ্টি প্রতিক্ষণ' ছেড়ে চলো যাই নিজ নিকেতনে সত্যশিবসুন্দরের দ্বারে। ঋষি শ্রী অরবিন্দের ভাষায় '... towards a Divine।ife'. ঋষি বাক্যে, 'স্ব অহম্', ঐতরেয় উপনিষদের ভাষায়,  'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম', আর সাধক রামপ্রসাদের গানে,

        আপনাতে আপনি থেকো মন

        তুমি যেও না কো কারো ঘরে,

        যা চাবি তা বসে পাবি

        শুধু খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে।

সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্ যেমন পরমসত্তার তিনটি অভিন্ন প্রকাশ;  জ্ঞান -কর্ম -ভক্তি তেমনই অভিন্ন কেবল আঙ্গিকের তফাৎ। যে রাজা রামমোহন রায় চূড়ান্ত কর্মযোগী, তিনিই আবার তাঁর কবিতায় ধরা পড়েন জ্ঞানযোগী ও ভক্তিযোগী রূপে। যোগ একই তফাৎ কেবল আঙ্গিকে। সুভাষচন্দ্রের নেতাজি হয়ে ওঠা তাঁর জ্ঞান ও ভক্তিযোগেরই এক পরম প্রকাশ, অন্যরূপে অন্যভাবে। রাজা রামমোহন হতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র সবাই একই যোগসূত্রে গাঁথা, তফাৎ কেবল আঙ্গিকে, ভাবে, প্রকাশে। কূপমণ্ডকতা, ধর্মীয় বিকৃতির চোরা বালিতে তলিয়ে যেতে বসা সনাতন হিন্দুজাতিকে টেনে তুলেছিলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এবং একই পথের পথিকগণ। তাঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা আমাদের কল্পনারও অতীত। সবকিছু হারানোর মধ্যে পেয়েছিলেন সবটুকু আনন্দ। অসীমের পানে চেয়েছিলেন বলে অনায়াসে ডিঙিয়ে ছিলেন সসীমতাকে। উপনিষদীয় সত্য সাকার হয়েছিল তাঁদের জীবনচরিতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলছেন- গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়: পরোধর্ম ভায়াবহ:"। আমি এই উক্তিতে বিশ্বাস করি। (তরুণের স্বপ্ন, পৃ: ১১) 

তিনি বলছেন, ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে - কিন্তু মৃত্যুর পর  পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারন এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বাণী আছে যেটা জগৎসভায় শুনাতে হবে;  ভারতের শিক্ষার ( culture) মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না। শুধু তাই নয়, - বিজ্ঞান, শিল্প, কলা, সাহিত্য, ব্যবসায়, বাণিজ্য - এ সব ক্ষেত্রেও আমাদের জাতি জগৎকে কিছু দেবে ও কিছু শেখাবে। তাই ভারতের মণিষীগণ কত তমোময় যুগের মধ্যেও নির্নিমেষ নয়নে ভারতের জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সন্তুতি আমরা, আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য সফল না ক'রে কি মরতে পারি? (ঐ: ১৪)

এরপর লেখা বাহুল্য, আমার আঙ্গুলগুলি আপনা হতেই থেমে যায়...

তথ্যসূত্র : 

১. পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা, তথ্যসংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ

২. শ্রী অরবিন্দের দর্শন মন্থনে - সুনীল রায়

৩. রামকৃষ্ণ কথামৃত

৪. তরুণের স্বপ্ন : সুভাষচন্দ্র বসু

বিদ্যাসাগর পরবর্তী যুক্তিবাদী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ল কেনো? -শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:488 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাংলাদেশে ধর্মের বিবর্তন বারবার ঘটেছে। প্রথমে আর্য আগ্রাসন এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার।  শশাঙ্কের নির্মম  হাত ধরে আবার হিন্দু ধর্মের উত্থান, শৈব  শশাঙ্ক অধিকাংশ  বৌদ্ধ মঠ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।পাল রাজাদের সময়ে আবার বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার, কিন্তু সেন রাজাদের হাতে পুনরায় হিন্দু ধর্মের উত্থান বাংলা দেখেছে। হিন্দু বৌদ্ধ বৈষ্ণব ইসলাম  খ্রিস্টান ধর্মের জাতাকলে বাংলায় রক্ষণশীল ধর্ম মতের জয়জয়কার ঘটেছে।      

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন আন্দোলনের প্রাথমিকভাবে নেতৃত্বে থাকে মধ্যবিত্তেরা। ইংরেজ আগমনের পরে  উনবিংশ শতকে বাংলার সামন্তযুগের ভাঙন ও নতুন ধনতান্ত্রিক শিল্প বাণিজ্যের অভ্যুদয়কালে কাঁচামালের উৎপাদকের সাথে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে  শ্রমবিভাগের ফলে বিচ্ছেদ ঘটে এবং নগরে শহরে শিল্পবাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। তার ফলে সমাজে এক সুসংবদ্ধ মধ্যবিত্ত জনস্তরের বিকাশ হয়। এই মধ্যবর্তী জনস্তরে ধীরে ধীরে যখন নাগরিকতার বিকাশ হয়, তখন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অধিকারের চেতনাও তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। এই মধ্যবর্তী শ্রেণি থেকেই রামমোহন ডিরোজিও বিদ্যাসাগরেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলার নবজাগরণের। রামমোহনের সতীপ্রথা রদ ও ইংরাজীর মাধ্যমে  পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা সেই সময় বাংলায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে  বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলনের  রূপ নেয় এবং পরবর্তীকালে বাল্য বিবাহ রদ, বহুবিবাহ বন্ধ, নারী শিক্ষা বিস্তার সহ সামগ্রিক শিক্ষার বিস্তার, কলেজ প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক রচনা, বাংলা ভাষা ও গদ্যে প্রাণ সঞ্চার, বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা,  পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মিলনের শিক্ষা বিস্তার  করা সহ সমস্ত কাজ সমাজে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। রামমোহন দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত  ব্রাহ্ম্যদের একেশ্বরবাদের আন্দোলন ও পাশ্চাত্য ভাবধারার বিস্তারও সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু রামমোহনের পরবর্তীকালে ব্রাহ্মরা সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এই ধর্মকে রেখে দিলেন, সাধারণ বঙ্গ সমাজে এর বিস্তার ঘটালেন না। নারী শিক্ষার ব্যাপারেও তারা ছিলেন সংকীর্ণমনা, নিজেদের বাড়ীর মহিলাদের শিক্ষার জন্য অন্তঃপুরের  অবরোধের বাইরে বার করেননি। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধেও এরা গেলেননা । এই ব্রাহ্মরা যেন ফিসফাস করে সংস্কারের কাজ করতে উৎসাহী, সেভাবে কেউ এগিয়ে এলেননা। ফলে এই ব্রাহ্মধর্ম সাধারণের মধ্যে প্রসার পেলোনা। 

    হেনরী লুই ভিভিয়ান  ডিরোজিও ছিলেন  ঝড়ের পাখির মতো, স্বল্প কালের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং বাংলার সমাজ জীবনে ঝড়ের পাখির মতো উত্থান হয়েছিল তাঁর আবার ঝড়ের পাখির মতো মিলিয়ে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে। এই স্বল্প কালে  ইয়ং বেঙ্গলের মাধ্যমে শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে নতুন ভাবনা বঙ্গের যুবকদের  মাথায় গুঁজে দিয়েছিলেন।এর ফসল ইয়ং বেঙ্গল এবং তাদের মাধ্যমে সংস্কার।

  নবযুগের বাংলায় সমাজ জীবনের স্রোত দুটি স্বতন্ত্রমুখী খাতে প্রবাহিত হয়।একটি সম্মুখগামী উদারপন্থী  উন্নতিশীল ধারা, আর একটি পশ্চাদগামী হিন্দুভাবধারী রক্ষণশীল ধারা। এবং আশ্চর্যের বিষয় জীবন  এই স্রোতের দুটি ধারার মধ্যে ব্রিটিশের চাটুকার  শোভাবাজার রাজবাড়ীর নেতৃত্বে চরম রক্ষণশীল পশ্চাদগামী ধারা সব সময়ই বাংলাদেশে অতীব শক্তিশালী ছিল। এই বাড়ি থেকেই সমস্ত অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার সীলমোহর পেত। ১৮৭০ সালের পর থেকে জাতীয়তাবোধের প্রথম উদ্বোধনকালে তারা অত্যন্ত উগ্রভাবে ঐতিহ্যবাদী হয়ে ওঠেন। এইসব কারণেই এই সময় প্রাচীন আদর্শ ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার – আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে, এবং স্বভাবতই তা মধ্যে মধ্যে বাঁধ ভাঙার উপক্রম করে। বৈদেশিক পরাধীনতার জন্য বাংলাদেশে ধনতন্ত্রের যুগসম্মত স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু ধনতন্ত্রের  এই অসমবিকাশের মধ্যে অর্থনৈতিক  বাস্তব ভিত্তি  রচিত না হওয়ার ফলে চিত্তবিকার ও বিভ্রমই বৃহত্তর সত্য হয়ে উঠেছে এবং নবযুগের নবজাগরণ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের উত্থানে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন, কার্ল মার্ক্স ও অন্যান্য মনীষীদের উত্থানে ইউরোপীয় চিন্তাধারাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে তোলে। সে সময় প্রথম পর্বে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্ব সমাজকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী পর্বে ১৮৬০-৬১ থেকে ১৮৭০-৭২ পর্যন্ত নেতৃত্বে ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন।  

           কেশব চন্দ্র সেন বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় চিৎপুরের গোপাল মল্লিকের বাড়িতে নিজের প্রযোজনায় বিধবা বিবাহ নাটক মঞ্চস্থ করেন  এবং বিদ্যাসাগর তা দেখতেও যান। যে সময় বাংলার গৃহবধূরা অবরোধে কড়া প্রহরায় অন্তরীণ থাকতো সেসময় কেশবচন্দ্র সেন কোলকাতার রাস্তায় সস্ত্রীক এসে দাঁড়ালেন এবং দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মের  আচার্য পদে অভিষেক দেখতে জোড়াসাঁকো গেলেন। এটাকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজে এক বিপ্লব বলেই চিহ্নিত করা হয়। এটা বন্ধ করার জন্য কেশব সেনের আত্মীয় ও সমাজের রক্ষণশীল নেতারা তাঁর বাড়িতে গুণ্ডা পর্যন্ত পাঠায়, কেশব সেন সেগুলিকে উপেক্ষা করেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জোড়াসাঁকো যান। এই ঘটনার পরে ব্রাহ্ম্যরা তাদের স্ত্রীর সাথে বেরোতে শুরু করেন এবং পরে তা হিন্দু  সমাজেও তা প্রচলিত হয়। কেশবচন্দ্রের উত্থানকে বাংলার ব্রাহ্ম্য সমাজের নবোত্থানের যুগ বলে উল্লেখ করা হয়। কেশবচন্দ্র ব্রহ্ম্যবিদ্যালয়, সঙ্গতসভা, কলিকাতা কলেজ  প্রতিষ্ঠা করে বাংলার শিক্ষিত তরুণ সমাজকে ব্রাহ্ম্য ধর্মের দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। এই সময় তিনি সুবক্তা,পুস্তিকা লেখক, সংস্কারকর্মী, ধর্ম প্রচারক ও মানবহিতৈষী বলে সমাজে খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৬০  --১৮৭২ সাল পর্যন্ত কেশব সেনের জন্য বাংলার সমাজ জীবন প্রব; আলোড়িত হয়। কেশব সেন বিদ্যাসাগরের একান্ত অনুগামী। তাঁর জন্যই ব্রাহ্ম্যধর্মের আচার্যদের ব্রাহ্মণ্যত্বের সনাতন প্রতীক উপবীত বা পৈতা  ত্যাগের কথা বললেন। দেবেন্দ্রনাথ অনিচ্ছা সত্বেও তরুণদের এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। ব্রাহ্ম্যধর্মে অসবর্ণ বিবাহ শুরু হলো ১৮৬২ সালে। দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ মনে মনে স্বীকার করতেননা। ব্রহ্মোপাসনার সময় পুরুষদের সাথে মেয়েদেরও যোগ দেওয়ার অধিকার থাকবে। এইসব সংস্কার প্রাচীনপন্থী দেবেন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেননি, ফলে ব্রাহ্ম্য সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ১৮৭০ এর ফেব্রুয়ারীতে কেশবচন্দ্র ইংল্যান্ড যাত্রা করেন র প্রতিভায় ও বাগ্মিতায় ইংরেজ সমাজ মুগ্ধ হয়ে গেল। সেখানে জনসাধারণের আত্মোন্নতির ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য আগ্রহ এবং শ্রমিক শ্রেণির সচেতন আন্দোলন তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।১৮৭০ এর শেষে কলকাতায় ফিরে এসে ভারত সংস্কার সভা, স্থাপন করেন। এদের কর্মসূচী ছিল সুলভ সাহিত্য প্রকাশ,সুরাপান নিবারণ, শ্রমজীবী বিদ্যালয় স্থাপন, স্ত্রী-শিক্ষা প্রসার, দান-দাতব্য সভা।

              কিন্তু ক্রমে ক্রমে কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারা ও কাজকর্মে নানারকমের অসঙ্গতি দেখা যায়। তিনি গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই তিনিই এর বিরোধীতা শুরু করলেন।অল্পদিনের মধ্যেই ঈশ্বরপ্রেরিত মনুষ্যাবতার সম্বন্ধে তাঁর গভীর বিশ্বাস জন্মালো, সে বিষয়েও তিনি আবেগময়ী বক্তব্য রাখা শুরু করলেন এবং নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। কেবল অবতারবাদ নয়, বৈষ্ণব ভক্তিবাদও তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান শেষ পর্যন্ত খোল-করতাল সহ নগরকীর্তনে বেরোতে শুরু করলেন। নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। ১৮৭৬ সালে রামকৃষ্ণর সাথে দেখা হতে তিনি মাতৃভাবে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লেন এবং ব্রাহ্ম্যধর্ম হিন্দু ধর্মের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেল। ১৮৭২ সালে তিনি নিজের নাবালিকা কন্যা সুনীতিদেবীর কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনাথের সাথে হিন্দুমতে বিবাহ দিলেন। যত তাড়াতাড়ি প্রদীপ শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তত দ্রুত প্রদীপ নিভে গিয়েছিল। কেশবচন্দ্র ও অনেকটাই দায়ী বাংলার যুক্তিবাদী আন্দোলন বিস্তার না হওয়ার। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা সব দক্ষিণেশ্বরে দৌড়তে শুরু করলো এবং ব্রাহ্ম্য ধর্মকে হিন্দু ধর্মের সাথে মিলিয়ে দিল। এই সময় তরুণ ব্রাহ্ম্যরা সমাজ থেকে বেরিয়ে  সমদর্শী নামে একটি দল গঠন করেন। শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু,দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এদের নেতা, তিনি পুনরায় ব্রাহ্ম্যসমাজকে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ ব্রাহ্ম্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

সূত্রঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ - বিনয় ঘোষ

ঈশ্বরকণা ঈশ্বরের জিয়নকাঠি না মৃত্যুবাণ -সাধন কুমার ঘোষ
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:7812 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১ম পর্ব

      নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মিওন লিওন লেডারম্যান (M.।.Lederman) সম্প্রতি (03.10.18) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর (বিজ্ঞান লেখক ডিক টেরেসির সঙ্গে যৌথভাবে) লেখা সাড়া জাগানো বই 'ঈশ্বর কণা' (ইংরেজীতে The God Particle: If the Universe is the answer, what is the question? 1993)। লেডারম্যান নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে, সাব অ্যাটমিক পার্টিকল নিউট্রিনো আবিস্কারের জন্য, এ তথ্য হয়ত খুব কম লোকই জানেন, কিন্তু তাঁর লেখা 'ঈশ্বর কণা' বইটির নাম শোনেননি এমন মানুষ কমই আছেন। বইটির অসম্ভব জনপ্রিয়তার জন্য এর নামের সঙ্গে 'God' শব্দটি অনেকাংশেই কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। এ নামটির মধ্যে দিয়েই যেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান বইটিতে  পাওয়া গেছে, তাই এত শোরগোল। স্বীকার করতেই হবে God শব্দটি জুড়ে দিয়ে প্রকাশক যথেষ্ট ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। আর স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর লেখা বই-এর নামে God বা ঈশ্বর জুড়ে যাওয়া ঈশ্বর বিশ্বাসীদের কাছে আত্মশ্লাঘার বিষয় বইকি। আসলে বিজ্ঞানচর্চা মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে যতটা প্রসারিত করেছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের রহস্য তত তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে, আর এর ফলে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের স্থান ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়েই চলেছে। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসীরাও হাল ছাড়েননি, বিজ্ঞান যেমন ঈশ্বরের জগতে থাবা বসিয়ে চলেছে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরাও যেন খোদ বিজ্ঞানকেই (আসলে বিজ্ঞানের ছোঁয়া) ততবেশী আঁকড়ে ধরতে চাইছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে, কারন বিজ্ঞানের একটু ছোঁয়া থাকলে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, এটাই তাঁদের ধারনা, যতই তাঁরা বিজ্ঞানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকুন না কেন।

        'ঈশ্বরকণা' কি তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সুক্ষতম রূপ? এটাই কি ছিল বইটির প্রামাণ্য বিষয়? এ আলোচনায় যাওয়ার আগে সাধারন ভাবে আমরা পদার্থ বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। বিদ্যালয় স্তরের ছাত্ররা জানে সমস্ত পদার্থ অতি ক্ষুদ্র অনু দিয়ে গঠিত, আবার সমস্ত অনু মৌল কণা পরমানু' (প্রায় ১০০টি) দ্বারা গঠিত। কিন্ত পরমানুগুলিও গঠিত হয় আরও সুক্ষ কণা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দ্বারা। আর পদার্থ বিজ্ঞানের যে শাখায় এসমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় সেটা হল পার্টিকল ফিসিক্স। এখানে আলোচিত প্রাথমিক কণাগুলি (Elementary বা fundamental particle) হচ্ছে সাব অ্যাটমিক পার্টিকল যাদের কোনো সাব স্ট্রাকচার এখনও পর্যন্ত জানা নেই। দেখা যাচ্ছে এরূপ প্রাথমিক কণার সংখ্যাও প্রায় একশত। আলোচ্য 'ঈশ্বর কণা' আসলে এরকম একটি এলিমেন্টারি সাব অ্যাটমিক পার্টিকল, যার কিছু বৈশিষ্টের জন্য একে দিয়েছে অনন্যতা। যাইহোক পদার্থ বিজ্ঞানে এইসব প্রাথমিক কণাই হল পদার্থ আর শক্তির (যারা একে অপরটিতে পরিবর্তিত হতে পারে) ক্ষুদ্রতম একক। পার্টিকল ফিসিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে সব প্রাথমিক (elementary) কণাগুলিকে প্রধান দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, 

১) ফান্ডামেন্টাল ফার্মিয়ন, এদের স্পিন হল অর্ধপূর্ণ সংখ্যা

২) ফান্ডামেন্টাল বোসন, এদের স্পিন হল পূর্ণ সংখ্যা। 

এখনও পর্যন্ত জানা তথ্য অনুসারে ফার্মিয়নগুলি (আপ ডাউন চার্ম ইত্যাদী কোয়ার্ক, অ্যান্টি কোয়ার্ক, লেপ্টন, অ্যান্টি লেপ্টন গুলি) পদার্থের বিল্ডিং ব্লক, আর বোসনকণা গুলিকে (গেজ বোসন, হিগস বোসন গ্রাভিটন ইত্যাদী) বলা যায় বল বাহী কণা বা ফোর্স পার্টিকল। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও আলবার্ট আইনস্টাইন মিলে গত শতকের বিশের দশকে যে কোয়ান্টাম সাংখ্যায়ন (বোস-আইনস্টাইন সাংখ্যায়ন) প্রবর্তন করেছিলেন সেটা মেনে চলা মৌল কণা গুলিকেই বোসন শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। আলোচ্য ঈশ্বর কণা আদতে হল একটি বোসন কণা; বৈজ্ঞানিক মহলে এর স্বীকৃত নাম 'হিগস-বোসন'; কোন 'ঈশ্বর কণা' নয়। আবার একাধিক এলিমেন্টারী পার্টিকল দিয়ে তৈরী হতে পারে কম্পোজিট পার্টিকল। কোয়ান্টাম তত্বানুসারে এলিমেন্টারী পার্টিকল আপ ও ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে কম্পোজিট পার্টিকল গঠিত হয় যেমন প্রোটন, নিউট্রন গঠিত। এখন ফোর্স পার্টিকলগুলি যেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বাহক অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যে চারটি ফান্ডামেন্টাল বলের (weak force, electromagnetic force, strong force, gravitation) কথা বলা হয়েছে তাদের বাহক, যেমন ফোটন হল তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রের বাহক, আমাদের আলোচ্য হিগস বোসন কণা হিগস ক্ষেত্রের বাহক, তেমনি অভিকর্ষ ক্ষেত্রের বাহক ভাবা হয় গ্রাভিটন কণাকে যদিও আমরা এর প্রমাণ পাইনি, যেটা সম্প্রতি পাওয়া গেছে হিগস-বোসন এর ক্ষেত্রে। এই বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের আরও কিছু বিষয় বুঝে নিতে হবে।

       হিগস ক্ষেত্র ও হিগস মেকানিজম : বিজ্ঞানী পিটার হিগস প্রস্তাবিত একটি শক্তি ক্ষেত্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বত্র বিরাজ করছে আর এই ক্ষেত্রের সঙ্গে বিভিন্ন মৌল কণার মিথষ্ক্রিয়ার (interaction) ফলেই কণা গুলি ভর অর্জন করে। এই ক্ষেত্রের নাম হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসন হল এই ক্ষেত্রের বাহক কণা (quanta)। যে প্রক্রিয়ায় হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে মৌলকণারা মিথস্ক্রিয়া করে সেটাই হল হিগস মেকানিজম। গত শতকের ষাটের দশকে ভরহীন মৌল কণাদের ভর প্রদান করে এমন একটি কণা বা ক্ষেত্রের তাত্বিক সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী পিটার হিগস, ইংল্যান্ডের ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলাট সহ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও ১৯৬৪ সালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষনা পত্র প্রকাশিত হয়, এই কণাটিই হিগসের নামে হিগস কণা ও ক্ষেত্রের নামকরন করা হয় হিগস ক্ষেত্র। এখন মিথস্ক্রিয়ার মাত্রার উপর ভর নির্ভর করে, বেশী ভরের কণা অর্থাৎ হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা বেশী, কম ভরের ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা কম। এই যে হিগস ক্ষেত্র বা কণা প্রাথমিক কণা গুলিকে ভর দেয় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন কণাগুলি ভর পেলেই তবে তাদের উপর মহাকর্ষ বল কাজ করতে পারে তারা একত্রিত হয়ে জোট বাঁধতে পারে, ফলে অনু-পরমানু, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছু তৈরী হতে পারে। যদিও মহাকর্ষের সঙ্গে হিগস ক্ষেত্রের সম্পর্ক এখনও পরিস্কার নয়। আবার হিগস ক্ষেত্র সব কণাকে ভর দেয় না, সবটা ভরও দেয় না। হিগস মিথস্ক্রিয়ায় শুধু অন্তর্নিহিত ভর পায়, কিন্তু মহাকর্ষ বস্তুর সমগ্র শক্তির উপর কাজ করে, শুধু ভরের উপর নয়। তাই ফোটনের জাড্য ভর শূন্য হলেও মহাকর্ষ কাজ করে কারন ফোটনের শক্তি আছে। আবার প্রোটনের সমস্ত ভর শুধু হিগস মিথস্ক্রিয়া থেকে আসে না, প্রোটন মধ্যস্থ কোয়ার্ক কণাদের বিনিময়কারী গ্লুয়ন কণার গতিশক্তি থেকেও আসে। এই বিষয়গুলির জটিলতার মধ্যে আমরা যাব না, কিন্তু আমরা হিগস বোসন তথা হিগস ক্ষেত্রের গুরুত্ব সহজেই বুঝতে পারলাম কারণ হিগসের জন্যই কণারা ভর পায় বলেই মহাকর্ষ কাজ করে ও সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ হিগস কণা না থাকলে অন্যান্য মৌলকণা গুলি ভরহীনভাবে আলোর বেগে এখনও  ছুটে বেড়াত, কিছুই সৃষ্টি হত না। এবার আমরা আসব সার্ন গবেষনাগারে হিগস কণার পরীক্ষালব্ধ প্রমাণে যা তোলপাড় করে দিয়েছিল সারা পৃথিবী।


২য় পর্ব

          কণা পদার্থবিদ্যার অনেক অমিমাংসিত বিষয়, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ফান্ডামেন্টাল কণাসমূহের যে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাহায্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তাতে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। এ জন্য প্রায় অর্ধশতক আগে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে স্থান পাওয়া হিগস কণার তাত্বিক সম্ভাবনার প্রমাণও হয়ে উঠছিল অত্যন্ত জরুরী। এই মিসিং লিংক পূরণ করার জন্য প্রয়োজন এক্সপেরিমেন্টাল ডেটা। তত্ত্বানুসারে আলোর গতিতে মুখোমুখি প্রচন্ড শক্তির প্রোটন কণাদের সংঘর্ষ ঘটাতে পারলে অন্যান্য কণার সঙ্গে হিগস কণাও পাওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন আধুনিকতম ব্যবস্থা যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী কণা ত্বরণযন্ত্রে এই সংঘর্ষ ঘটিয়ে পরীক্ষাগারে মিনি বিগ ব্যাং এর মত অবস্থা সৃষ্টি করা যায়। সার্ন (ইউরোপিয়ান অরগানাইজেশান ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ-CERN) এর গবেষানাগারে পরিকল্পনা করা হল এরকম একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সার্ন গবেষনাগারটি সুইজারল্যান্ডের সুইস-ফ্রান্স সিমান্তে ১৯৫৪ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এই সার্নের তত্বাবধানেই গড়ে তোলা হল এযাবৎকালের বিশ্বের সর্ববৃহৎ যান্ত্রিক ব্যবস্থা, ১২ ফুট ব্যাসের রিং আকৃতির ২৭ কিমি দীর্ঘ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC),স্থাপন করা হল মাটির প্রায় ১৭৫ মিটার নিচে। এটি একটি হ্যাড্রন কোলাইডার অর্থাৎ যে যন্ত্রে নিউট্রন, প্রোটন এর মত হ্যাড্রন কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এই বিশালাকৃতি টিউবটিকে সর্বক্ষণ - ২৭১.৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বজায় রাখতে ব্যবহার করা হয় তরল হিলিয়াম প্রবাহ। দশ বছর ধরে নির্মিত এই যন্ত্রে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ১০০ দেশের দশ হাজার বিজ্ঞানী যার মধ্যে কলকাতার কয়েকজন বিজ্ঞানীও ছিলেন।

         এই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের দুটি  পৃথক টিউবের মধ্যে প্রায় আলোর গতিতে বিপরিত মুখি দুটি অতি উচ্চ শক্তির প্রোটন বিম নির্দিষ্ট  অভিমুখে চালনা করা হয়, গাইড করানোর জন্য ব্যবহার করা হয় প্রায় দশ হাজার ম্যাগনেট। এল.এইচ.সি-র ভিতরে চারটি স্থানে প্রোটন বিমের সংঘর্ষ ঘটানোর ব্যবস্থা ও সার্ন এর কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করা হয়। বিপরীত মুখি ধাবমান বিম দুটিকে অত্যন্ত সঙ্কুচিত করে সূচের চেয়েও সুক্ষ করা হলে, অতি ক্ষুদ্র জায়গায় সংঘর্ষের ফলে প্রচন্ড তাপ ও চাপে আকাঙ্খিত ফল অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর সময়কার পরিস্থিতি সৃষ্টি সম্ভব। এরকম হাজার হাজার কোটি সংঘর্ষে কোটি কোটি কণা উৎপন্ন হলে, প্রতি এক হাজার কোটি সংঘর্ষে একটি হিগস কণা তৈরী হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়, তবে প্রাপ্ত কণার স্থায়িত্ব  হবে সেকেন্ডের কোটি ভগ্নাংশেরও কম। বিগ ব্যাং এর সময়ের অবস্থা পরীক্ষাগারে সৃষ্টি করা হলে তার প্রথম মাইক্রো সেকেন্ডে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থের অবস্থা পর্যবেক্ষনলব্ধ তথ্য  থেকে ধারণা করা যেতে পারে কিভাবে দৃশ্যমান পদার্থের উৎপত্তি তথা ভর জেনারেট হয়। এল.এইচ.সিতে সংঘর্ষের ফলে যে মিনি বিগ ব্যাং হয় তাতে প্রোটন কণা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যে সমস্ত কণা উৎপন্ন হয় সেগুলি পার্টিকল ডিটেক্টরে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়। প্রাপ্ত  বিপুল তথ্য বিশ্লেষন করে জানা যাবে অতি স্বল্পায়ু হিগস কণার অস্তিত্ব। কি বিপুল পরিমান তথ্য বিশ্লেষন করতে হয়েছিল সেটা বোঝা যায় দুটি ডিটেক্টরে প্রতি সেকেন্ডে গৃহিত তথ্য সংরক্ষন করতে প্রয়োজনীয় সিডির সংখ্যা থেকে, সেই সংখ্যাটি হল দু লক্ষ।

        সার্ন এর।HC চালু করার পর প্রোটন বিম এর সংঘর্ষ ঘটিয়ে প্রাপ্ত তথ্যবিশ্লেষণের কাজ চলতে থাকে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হাজার হাজার বিজ্ঞানীর অনলস প্রচেষ্টায়।HC-র ATLAS ও CMS  পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে 126 Gev ভর বিশিষ্ট একটি কণা সনাক্ত করা গেলে সার্ন কতৃপক্ষ ৪-ঠা জুলাই ২০১২, এই পর্যবেক্ষনের কথা জানান ও এটি একটি হিগস কণার অস্তিত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ বলে ঘোষণা করেন। এরপরও দীর্ঘ নয় মাস ধরে প্রাপ্ত তথ্য থেকে কণা ও তার ধর্মাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন চালিয়ে ১৪ই মার্চ, ২০১৩ প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফৎ পর্যবেক্ষনলব্ধ কণাকে শতকরা একশত ভাগ হিগস বোসন (Standard model।ike Higgs-Boson) কণা রূপে সনাক্ত করার কথা জানান। সার্ন কতৃপক্ষ আরও জানান হিগস কণার আরও তথ্য বা অন্যান্য প্রকারের হিগস কণার অনুসন্ধান কার্য চালিয়ে যাওয়া হবে। এই আবিস্কারের পরে নোবেল কতৃপক্ষ এই কণার তাত্বিক প্রবর্তক রূপে বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বিজ্ঞানী ইংলার্টকে যৌথভাবে ২০১৩ সালের নোবেল পুরষ্কার প্রদান করেন। পরীক্ষাগারে হিগস বোসন কণার অস্তিত্বের প্রমাণ বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেই হিগস বোসন কণাকে 'ঈশ্বর কণা' নামে অভিহিত করে তাতে ঈশ্বরত্ব আরোপের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানচেতনাকে আচ্ছন্ন করার অপচেষ্টা ছাড়া যে কিছু নয়, এবারে সে প্রসঙ্গে আমরা কিছু বলার চেষ্টা করব।


৩য় পর্ব

              বিজ্ঞান মহলে প্রচলিত পদ্ধতি প্রকরণ মেনে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক, গবেষকদের অবদান ও  পারিপার্শ্বিকতা স্মরণে রেখে সাধারনত বিজ্ঞানের আবিস্কৃত বিষয়গুলির নামকরণ করা হয়ে থাকে। এই ভাবেই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বহু আকাঙ্খিত কণাটি দীর্ঘদিন ধরে তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে 'হিগস বোসন' কণা নামে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। নামকরণের মধ্য দিয়ে যেমন বৈজ্ঞানিকদের কৃতিত্বের স্বীকৃতির স্বাক্ষর মেলে, একইভাবে বিজ্ঞান গবেষণার ধারাবাহিক ইতিহাসেরও কিছুটা প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজের দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের পর যখন হিগস কণার অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে প্রমানিত হল ততদিনে কণাটি 'ঈশ্বর কণা' রূপে জনমানসে এক অদ্ভুদ আলো আঁধারীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের পথে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না হয়ে বিষয়টি সাধারণের মধ্যে যেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া রূপে প্রতিপন্ন হল। ঈশ্বর বিশ্বাসীর কাছে 'ঈশ্বর এক বিশ্বাসের ব্যাপার' কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এতে সব সন্দেহের নিরসন হয় না, বরং বিজ্ঞানের একটা সিলমোহর পেলে সেটা অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। তাই লেডারম্যানের বইটির 'ঈশ্বরকণা' নামকরন তাদের কাছে, হাতে একটা তুরুপের তাস হয়ে দেখা দিল। তারপর পরীক্ষাগারে 'হিগস বোসনের' অস্তিত্বের প্রমাণ মিডিয়ার কল্যাণে ঈশ্বরের সুক্ষতম অস্তিত্বের  প্রমাণরূপে জনমানসকে প্রভাবিত করল। অথচ লেডারম্যান কিন্তু বইটির নাম দিতে চেয়েছিলেন #গডড্যাম_পার্টিকল (#Goddamn_Particle)। আসলে দীর্ঘদিন ধরে কণাটির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় বিজ্ঞানী পিটার হিগস বিরক্ত হয়ে একে গডড্যাম পার্টিকল বলতে শুরু করেছিলেন ও বৈজ্ঞানিক মহলে সেটাই মুখে মুখে গডড্যাম পার্টিকল (Goddamn particle অর্থাৎ হতচ্ছাড়া, পাঁজি) বলে প্রচলিত হয়েছিল। শোনা যায় প্রকাশক বইটির নাম গডড্যাম থেকে ড্যাম কেটে দিলেন, বইটির নাম হয়ে গেল 'গড পার্টিকল' স্বভাবতই বইটি পেল অভাবনীয় ব্যাবসায়িক সাফল্য।

'হিগস বোসনের' ঈশ্বরপ্রাপ্তি:

'ঈশ্বরকণা' (The God Particle) বইটির দৌলতে 'হিগস বোসন কণা' নামটি সাধারণ্যে 'ঈশ্বরকণা' নামে প্রচলিত হয়ে গেল। বিষয়টি অনেকেরই ভালো লাগে নি, জানা যায় স্বয়ং পিটার হিগস এতে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, এই অর্থে তাঁকে নাস্তিক বলা যায়। যাইহোক 'হিগস বোসন কণা'র নাম মানুষ না জানলেও 'ঈশ্বর কণা'র নাম বেশ পরিচিতি পেয়ে গেল। তারপর এল সার্ন-এর ঘোষনায় হিগস কণার অস্তিত্বের প্রমাণের মুহূর্ত, প্রচার মাধ্যম ঈশ্বর কণার আবিস্কারের কাহিনী ফলাও করে প্রচার করল। টিভি, খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকায় হিগস কণা প্রতিভাত হল ঈশ্বরকণারূপে। এ যেন বিজ্ঞান গবেষনার এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য নয়, এ হল ঈশ্বর সাধনার বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি। কষ্টার্জিত হিগস বোসন নামটি চাপা পড়ে গেল ঈশ্বরকণার নীচে, রীতিমত হাইজ্যাক বলা যায় আর কি! অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, নামে কি এসে যায়, অন্তর্নিহিত সত্যটাই তো আসল, হিগস বোসন কণার নাম 'ঈশ্বর কণা' হলে ক্ষতি কি, কণাটির চরিত্র ধর্ম তো পাল্টে যাচ্ছে না। সংগত প্রশ্ন মনে হতে পারে, কিন্তু প্রশ্নকর্তার কেন মনে হচ্ছে না কণাটির প্রচলিত নামটিতে তারা সন্তুষ্ট নন কেন, সত্যেন্দ্র নাথ বসু থেকে পিটার হিগস পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রা পথে কণাটি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি বহন করা নাম কেন তাঁরা অন্য নামে ডাকবেন? আসলে কণাটির 'ঈশ্বর কণা' নাম দেওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কোন কারণ নেই। কণাটির চরিত্র ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমান হয়নি। কিন্তু ঈশ্বরবিশ্বাসীদের সৌজন্যে 'কণা'টির ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে গেছে! এখানেই তাদের সুক্ষ কৌশল, একটি প্রাকৃতিক বিষয়কে অতিপ্রাকৃতিক, অলৌকিকতার মোড়কে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে মানুষের যুক্তিবাদী মানসিকতাকে পঙ্গু করে রাখার চেষ্টা, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ রুদ্ধ করার অপচেষ্টা। যে চেষ্টা প্রচলিত ধর্মমত গুলি অনবরত করে চলে, সেই চেষ্টাকে বিজ্ঞানের জগতে এনে ফেলা, তাকে কলুষিত করা। অর্থাৎ আমরা দেখতে পেলাম ক্ষেত্র বিশেষে নামেও অনেক কিছু এসে যায়। সব থেকে দুঃখের বিষয় বিজ্ঞানক্ষেত্রে যুক্ত কিছুলোক ঈশ্বরকণা নামটির যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছেন যা মানুষের বিজ্ঞান চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখতেই সাহায্য করে।

         বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষনলব্ধ ফলাফল যৌক্তিক পদ্ধতিতে বিচার বিবেচনা বিশ্লেষন অনুধাবন করে যে বিশেষিকৃত জ্ঞান আমরা অর্জন করি সেটুকুই আমরা জেনেছি বলে দাবি করতে পারি, তার বেশীও নয় কমও নয়। এখানে আত্মগতভাবে কোন আরোপিত ধারণা পোষন প্রকৃতিকে তার সৃষ্টি, বিকাশ, ক্রিয়া পদ্ধতি সব কিছু জানার বোঝার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, আমাদের যুক্তিবোধ প্রগতিমুখি চিন্তাভাবনা সমগ্র প্রকৃতির প্রতিটি রহস্য সন্ধানে উৎসুক হতে ও প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে, ফলস্বরূপ আমরা অজ্ঞনতার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হই।

বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত ঘটনা প্রবাহ, কার্য-কারণ সম্পর্ক সব কিছু জানার আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র স্বচ্ছ স্বাধীন সক্রিয় কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে, কোন অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরতা থেকে নিশ্চেষ্ট হয়ে তার কাছে আত্মসমর্পন করে নয়। 'ঈশ্বরকণা' সেরকমই একটা মোহ বিস্তারকারী শব্দ যা বিশ্ব প্রকৃতির অপার রহস্য জানার চিরন্তন কৌতুহলী মানুষের মনে কিংবদন্তির সৃষ্টি করেছে যা বিজ্ঞান জগতে নিতান্ত বেমানান। পক্ষান্তরে শব্দটির অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার হিগস ক্ষেত্রের ক্রিয়ারও যথাযথ মূল্যায়ণ করে না। হিগস কণার আবিস্কার মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের পথে, মহাবিশ্বকে বোঝার পথের  উল্লেখযোগ্য মাইলফলক, সব রহস্য সমাধানের যাদুদন্ড নয়।

                 বিজ্ঞানী লেডারম্যান ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কথা বলেন নি, সম্ভবত তিনি অজ্ঞেয়বাদী, তাঁর বইয়ে বর্ণিত ঈশ্বরকণা পদার্থ বিজ্ঞানের একটি টার্মের অতিরিক্ত কিছু নয়, তবু এধরণের শব্দের ব্যবহার অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে, তাতে লেখক যা বলতে চাননি সেটাও তাঁর বক্তব্য বলে অনেক সময় ধারনা জন্মায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কোথাও প্রচলিত ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা বলেছেন বলে জানা নেই। তিনি ঘোষিত নাস্তিকও সম্ভবত নন, কিন্তু তিনি ঈশ্বর শব্দটির প্রয়োগ করায় কেউ কেউ তাঁকে পরোক্ষে ঈশ্বর বিশ্বাসী বলার সুযোগ পেয়েছেন। 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম' বইটিতে স্টিফেন হকিং "ঈশ্বরের মন বুঝতে পারব" বলায় ভুল বোঝার অবকাশ থাকতে পারে ভেবেই সম্ভবত আবারও বলেছেন, "ঈশ্বরের মন বোঝা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, যদি কোন ঈশ্বর থাকে যা আসলে নেই, তাহলে সেই ঈশ্বরের যা যা জানার সম্ভাবনা,আমরাও তাই জানতে পারব।আমি নাস্তিক।" অর্থাৎ ঈশ্বর শব্দটির অসতর্ক ব্যবহার ভুল বোঝানোর সুযোগ করে দেয় এ বিষয়ে তিনি পূর্ণ মাত্রায় সচেতন ছিলেন। অর্থাৎ মানুষ যা জানতে পারে ঈশ্বরের জানার দৌড় ততটুকুই, তাহলে 'ঈশ্বর' আর ঈশ্বর থাকলেন কোথায়? "মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই" হকিং এর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায় 'হিগস বোসনের' আবিস্কারে ঈশ্বর বিশ্বাসীদের উল্লসিত হবার কোন কারণ নেই, বরং অনন্যসাধারণ এই কণাটির আবিস্কারের মধ্য দিয়ে কণা পদার্থ বিজ্ঞান এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে যা হয়ত হকিং বর্ণিত বহু আকাঙ্খিত "থিয়োরি অফ এভরিথিং" মানুষের আয়ত্বে এনে দেবে, সেদিন হয়ত হিগস কণা ঈশ্বরের জীয়নকাঠি না হয়ে ঈশ্বরের মৃত্যুবাণ রূপে চিহ্নিত হবে।

কবিতাগুচ্ছ ১৪ -কবিরা
Nov. 20, 2024 | কবিতা | views:87 | likes:2 | share: 1 | comments:0

চোরের মায়ের বড় গলা

-সুকমল সরকার।


পচামাল আছে আমার দোকানে,

তবুও খদ্দেরে যদি নেয় কিনে,

তবে আমার দোষ কোনখানে?

আমার দোকানে যদি গু বিক্রি করি,

খদ্দেরে কিনে যদি করে কাড়াকাড়ি!

আমার দাপট তো চলবেই বাড়াবাড়ি।

যে গুরু রা, সবাইকে দেয় দীক্ষা,

তাদের নিজেদেরই নাই সুশিক্ষা,

কেউকেউ তো দেখি করে ভিক্ষা,

তবুও সবাই তাকে খুব সযতনে,

ঘটা করে বাড়িতে ডেকে এনে,

দীক্ষা নিয়ে লুটিয়ে পড়ে চরণে,

পা চেটেপুটে খায় ধার্মিক গনে,

পিতার চেয়েও তাকে বড় মানে,

গৌরবে বলে আমি দীক্ষিত এখনে,

আমার বেশি দুঃখ সেইখানে।

এরচেয়েও বেশি যাবেনা বলা,

কারণ চোরের মায়ের বড় গলা।

লেখক

-জামাল আনসারী


এই তো কিছু দিন আগের ঘটনা―

চোখ রাঙিয়ে পাঁচ পয়সার রাজনৈতিক নেতাটিও

তর্জনী উঁচিয়ে বলে গেল―

"এই লেখক!রাজনীতি নিয়ে কিচ্ছুটি লিখবি না!লিখলে ভাল হবে না!"

―ঠিক আছে! তাই হবে।তাই হবে।


এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে,

দুদিন পর, ধর্মের বর্জ্য পদার্থস্বরূপ ধর্মগুরু নামধারী,

আপাদমস্তক ভন্ড,লোভী লোকটিও

সর্বাঙ্গে নামাবলি জড়িয়ে কর্কশ ভাবে বলেছিল―

"এই লেখক !ভালো করে শুন ! ধর্মের কথা!

ধর্ম নিয়ে,জাতপাতের ভেদাভেদ নিয়ে একটিও শব্দ লিখবি না!  লিখলে কিন্তু ভালো হবে না।"

―আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা,লিখব না। ...লিখব না।


পাড়ার জেলখাটা মস্তান  দলবল নিয়ে এসে,খিস্তি মেরে,

হুমকি দিয়ে এইমাত্র চলে গেল।

ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে জানিয়ে দিল―

"এই লেখক! কান খাড়া করে শুন! অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালাবি না।

ভুল করেও যদি কলমে হাত দিস,ঐ হাত কেটে জগন্নাথ বানিয়ে দেবো।"

ঠিক আছে বাবা। তাই হবে ।আর লিখব না।


সেদিন পাশের গ্রামের কোটিপতি দেশ বিদেশ খ্যাত বিচারপতিটিও কানে কানে বলে গেল...

"ভারতের বিচার ব্যবস্থার দিকে প্রশ্ন তুলবি না।আর ধর্মনিরপেক্ষতা,গণতন্ত্র নিয়ে কিছু বলবি না।

আর যদি প্রশ্ন করিস,তার ফল কিন্তু মারাত্মক হতে পারে।"

―আচ্ছা, ঠিক আছে। প্রশ্ন করব না।


যার গোপ-দাড়ি এখনও গজায় নি,তবুও পাড়ায় সমাজ-বিপ্লবী বলে পরিচিত,সেই কমিউনিস্ট ছেলেটি বড় বড় চোখ পাকিয়ে প্রকাশ্য রাস্তার মোড়ে জানিয়ে দিল―

"এই লেখক। কি সব লিখছিস?  সমাজের অসাম্য নিয়ে কিচ্ছুটি লেখবি না।কথাটা মনে থাকে যেন!নইলে...

সমাজের সর্ব স্তরের কাছ থেকে হুমকি, ধমকি, চোখ রাঙানি

সহ্য করতে করতে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া লেখকটি মুখের উপর প্রশ্ন ছুড়ে মারে, কেন? কেন লিখব না??

কমিউনিস্ট ছেলেটি ভুরু কুঁচকে বলে, "সমাজ বিপ্লব করা লেখকের কাজ নয়। "

―ও আচ্ছা।ঠিক আছে। লিখব না।


কেন লিখব? কাদের জন্য লিখব?

রাস্তার ফুটপাতের উপরে বসে থাকা ভদ্রলোকটির থেকে উত্তর এলো―"কলম থামাবে না।লিখে যাও। আমাদের জন্য লিখো।"

সাইকেল চালিয়ে যে শ্রমিকটি রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল, সেই শ্রমিকটি জানিয়ে দিয়ে গেল― "আমাদের জন্য লিখো।"

রাস্তার পাশ থেকে সাফাইওয়ালা দাদু বলে ওঠে―

"লিখে যাও লেখক।আমরা তো আছি।আমাদের জন্য লিখো।"

স্কুলব্যাগ পিঠে নিয়ে ছাত্র ছাত্রীরা হেঁটে হেঁটে স্কুল যেতে যেতে বলে গেল, ―কাকু ভয় পেয়ো না।আমরা আছি।আমাদের জন্য লিখো।''




সঠিক

-প্রদীপ চক্রবর্তী


কুষ্ঠী দিয়ে মানুষ বিচার

পাথর দিয়ে ভাগ্য,

কালো চামড়া,সাদা চামড়া

কে বেশী যোগ্য?


ধর্ম গ্রন্থে আছে সব-ই

শুধু খুঁজে নাও,

রোগ হলে ধর্ম কোথায়?

হাসপাতালে যাও।


বন্যা-ভূকম্পে সম্পত্তি ক্ষয়

যতই ডাকো ভগবান,

প্রকৃতিকে ভালবাসো

সে যে মাতৃসমান।


মুক্ত মনের মানুষেরা

সদাই সুখী হয়,

কুসংস্কারকে বিদায় করার

এটাই সঠিক সময়।


ওর চোখ নাই নাক নাই

-মোহাম্মদ আল্লারাখা


যে দেশে রাজনৈতিক নেতা

অন্য জাতের মেয়েদেরকে

ধর্ষণ করতে উৎসাহ দেয়

কবর থেকে অন্য জাতের

মেয়েদের মৃতদেহ তুলে ধর্ষণ করতে বলে

যে দেশে ঈশ্বরের উপাসনালয়ে

অন্য জাতের নেহাত এক বালিকাকে

আটকে রেখে সাতদিন ধরে ধর্ষণ করা হয়

মৃতপ্রায় মেয়েটিকে অসহ্য যন্ত্র‌ণা দিয়ে নরপশুর দল ধর্ষণ করতে করতে একটি মাংসের পিণ্ডে পরিণত করে মেরে ফেলে

যে দেশে ধর্ষকদের সমর্থনে জাতীয় পতাকা হাতে

মিটিং মিছিল হয়, বিক্ষোভ দেখানো হয়

যে দেশে দাঙ্গার সময় মেয়েদেরকে ধরে ধরে

ধর্ষণ করা হয় ঘরে বাইরে রাস্তা ঘাটে পার্কে

সে সব দৃশ্য আবার ভিডিও করে ছাড়া হয়

যারা দাঙ্গার ধর্ষণে অংশ নিতে পারেনি

তারা দাঙ্গার ধর্ষণের ভিডিও দেখে উপভোগ করে।

এসব নেতা মন্ত্রী জজ ব্যারিস্টার প্রশাসন বুদ্ধিজীবিদের সামনে ঘটে, সবাই দেখে, সবাই শোনে, সবাই নির্বিকার।

যে দেশে কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে তার দু পা টেনে দেহ চিরে ফেলা হয়, যেখানে অপরাধীদের বিচারের দাবীর চেয়ে শাসক ও বিরোধীদের রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে, কে কতো ফায়দা তুলতে পারবে ঘটনা থেকে।

যে দেশে রাজনৈতিক নেতা সভার মাঝে ঘোষনা করে অন্য রাজনীতির লোকদের ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার, তাদের মেয়েদেরকে ধর্ষণ করার

যে দেশে ধর্ষণে বাধা দিলে হাত পা হাড়গোড় ভেঙে দেওয়া হয়, জিভ কেটে নেওয়া হয়, গলায় দড়ি ওড়না পেঁচিয়ে মেরে মৃতদেহকেই ধর্ষণ করা হয়

তারপর ধর্ষক ঘটনা স্থলেই দেহ জ্বালিয়ে দেয়

কখনো পুলিশ গিয়ে রাতের আঁধারে জ্বালিয়ে দেয়।

যে দেশে নিম্ন শ্রেনির নারীদেহ মানেই উচ্চ শ্রেণির

লোকদের মুফতে ভোগের অধিকার ভাবা হয়।

যে দেশে নারীকে মানুষ নয় কেবল সন্তান উৎপাদনের পালিত প্রাণী ও ভোগের বস্তু ভাবা হয়।

যে দেশে ধর্ষকদের নয়, ধর্ষিতা নারী ও তার পরিবারের লোকদের সাজা হয়।

যে দেশে ধর্ষকদের জাত দেখে রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী মিডিয়া পুলিশ এমনকি নেটিজেনরাও সরব নীরব হয়।

যে দেশে ধর্ষকদের সমর্থনে কলেজ ছাত্র ছাত্রীরাও

মিছিল করে, উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দেওয়ার সাহস পায়!


সে দেশে ধর্ষণ হবে না তো কোথায় হবে?

সে দেশে মানুষ নয়, সব মনুষ্যরূপী পশু বাস করে

তুই তোরা কি মনে করিস ধর্ষণকারীদের উৎসাহ দেবো অপছন্দের জাতের, অপছন্দের লোকদের মেয়েদের দেহের উপর ধর্ষণ চালাতে?

আর সব তোদের ঘরের মেয়েরা নিরাপদে থাকবে?

ওরে! লিঙ্গের চোখ নাই নাক নাই

ওটা চোখে দেখে না গন্ধ শুঁকে না

নারী দেহের মধ্যাংশের ওই ছেঁদা টুকু পেলেই এঁফোড় ওঁফোড় করে দেয়।

পৃথিবীর চরম পরম সেরা আনন্দময় আদরের বস্তুকে

আজ যারা ঘৃণা বিদ্বেষ হিংসা দিয়ে জাগাচ্ছিস

পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে

অন্যদের নারীদেহ ধর্ষণ করতে

সে কালই তোর, তারই নিজের মা বোন স্ত্রীকে

পশুর চোখ নিয়েই এঁফোড় ওঁফোড় করবে।

ওর চোখ নাই নাক নাই

ওটা চোখে দেখে না গন্ধ শুঁকে না

বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা - মিথ-মিথ্যার মিশেল -দেবোত্তম চক্রবর্তী
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:874 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অলস, কল্পনাপ্রবণ বাঙালি যা জানে তা হল শিকাগোয় ১৮৯৩এ এক ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে বিবেকানন্দ ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স’ বলে ভাষণ শুরু করে পেয়েছিলেন জগৎজোড়া খ্যাতি। অথচ এর চাইতে হাস্যকর দাবি আর কিছুই হতে পারে না। বাঙালি সেই সম্মেলনে অন্য ভারতীয় বা বাঙালি প্রতিনিধিদের নাম জানে না, বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা পড়ে দেখার পরিশ্রম করে না এবং সমস্ত তথ্য যাচাই করে নেওয়ার সময় নষ্টও করে না।

 

শিকাগোতে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন বলে যেটি প্রচার করা হয় আদতে সেটি ছিল কলম্বাসের মৃত্যুর চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশ্বমেলা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় কুড়িটি সভা বা সম্মেলনের। অধ্যাপক নিমাইসাধন বসু ‘বিবেকানন্দ: প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন ধর্ম মহাসম্মেলন যে হচ্ছে এই সংবাদই অনেকে জানত না, এমনকি কলম্বিয়ান প্রদর্শনী দেখতে গিয়েও ধর্ম মহাসম্মেলনের কথা কেউ জানতে পারেনি। আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ ধর্ম মহাসম্মেলন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানত না বা শোনেনি।

 

১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসভার প্রথম দিনের অধিবেশনে অভ্যর্থনার উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন “সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর হইয়া আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি”। অর্থাৎ বহু ধর্মাবলম্বীদের দেশ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে নয়, হিন্দুধর্মের একজন হিসেবেই নিজেকে প্রচার করেছিলেন তিনি।

 

ওইদিন একই বক্তৃতায় স্বামীজী বলেন, “যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি”। কিন্তু এই সম্মেলনেই আমরা দেখতে পাই তিনি অবলীলাক্রমে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, বেদসমূহকে ‘অনাদি ও অনন্ত’ বলেছেন, এমনকি পূর্বজন্মের ওপরও আস্থা প্রদর্শন করেছেন। এই কি ‘সর্বধর্মসমন্বয়’-এর রূপ? 

 

প্রকৃতপক্ষে শিকাগো ধর্মসভার প্রথম বক্তৃতাটিতে স্বামী বিবেকানন্দ ঝড় তুলে দিয়েছিলেন বলে যে ধারণা আমাদের মধ্যে সুপ্রচলিত, তার অন্যতম ভিত্তি হল বিবেকানন্দ স্বয়ং এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রকাশিত বিবেকানন্দের জীবনী গ্রন্থগুলি। 

১৮৯৩ সালের ২ নভেম্বর আলাসিঙ্গা পেরুমলকে বিবেকানন্দ লেখেন, "মজুমদার বেশ বলিলেন, চক্রবর্তী আরও সুন্দর বলিলেন। খুব করতালিধ্বনি হইতে লাগিল। তাঁহারা সকলেই বক্তৃতা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন। আমি নির্বোধ, কিছুই প্রস্তুত করি নাই। দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করিয়া অগ্রসর হইলাম। ডক্টর ব্যারোজ আমার পরিচয় দিলেন। আমার গৈরিক বসনে শ্রোতৃবৃন্দের চিত্ত কিছু আকৃষ্ট হইয়াছিল, আমেরিকাবাসীদিগকে ধন্যবাদ দিয়া এবং আরও দু-এক কথা বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিলাম। যখন আমি ‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ বলিয়া সভাকে সম্বোধন করিলাম, তখন দুই মিনিট ধরিয়া এমন করতালিধ্বনি হইতে লাগিল যে, কানে যেন তালা ধরিয়া যায়। তারপর আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম; যখন আমার বলা শেষ হইল,তখন হৃদয়ের আবেগে একেবারে যেন অবশ হইয়া বসিয়া পড়িলাম" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পত্রাবলী, ৭৪ সংখ্যক পত্র, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৯)। সেই গ্রন্থগুলিতে আমরা এও পড়ি যে, ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স’ বলে তিনি বক্তৃতা শুরু করলে শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ও করতালিতে বিপুল অভিনন্দন জানায় বলে ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড’-এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। 

কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে শিকাগোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ Chicago Daily Tribune, Chicago Herald বা Chicago Inter Ocean-এ এমন কোনও কথা ছাপাই হয়নি। এমনকি আমেরিকার চারটি বিখ্যাত সংবাদপত্র New York Times, New York Herald, New York Daily Tribune ও Boston Evening Transcript-এ ১২ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে অনেক খবর থাকলেও বিবেকানন্দের নামও উল্লেখ করা হয়নি, বক্তৃতার লিপি তো দূরের কথা। 

১৮৯৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘দ্য নিউইয়র্ক হেরাল্ড’-এ ‘The doctrine of the Swami’ শীর্ষক বিবেকানন্দ সম্পর্কিত একমাত্র সংবাদেও এমন কিছু বলা হয়নি। শুধু আলাসিঙ্গা পেরুমলকে ভ্রান্ত তথ্য দিয়েই বিবেকানন্দ ক্ষান্ত হননি, সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ নিউইয়র্ক হেরাল্ড’-এর ‘কাল্পনিক’ ভূয়সী প্রশংসার সেই খবর ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৩ চিঠির আকারে ছাপেন এবং তারপর থেকেই শুরু হয় মিথ ও মিথ্যার এই সুপরিকল্পিত নির্মাণ।

লরেন যে লরেনকে চিনবে এতে আর প্রশ্ন কেন!

হিন্দুত্ববাদের ধারণা বনাম ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদ -মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
Nov. 20, 2024 | রাজনীতি | views:900 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এম এস গোলওয়ালকর ও তার হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনা 

এক দেশ- হিন্দুস্তান। তাতে আছে এক জাতি (রেস)- হিন্দু জাতি। সেই জাতি ধারণা সম্পূর্ণতা পায় হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ভাষার মাধ্যমে। এই হিন্দু ভাষা হল সংস্কৃত ও তার থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলি। এক জাতি, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি, এক ভাষা মিলে তৈরি হয়েছে এক নেশন- হিন্দুস্তান। 


১৯৩৯ সালে নাগপুর থেকে প্রকাশিত ভারত পাবলিকেশন্সের ‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইণ্ড’ গ্রন্থে নেশন নিয়ে দীর্ঘ আলাপের শেষে এম এস গোলওয়ালকর আলোচনার নিস্পত্তি করেছেন হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার মাধ্যমে। নেশনের এই ধারণার বাইরে যারা আছেন, অর্থাৎ যারা হিন্দু জাতি নন, বা হিন্দু ধর্মে আস্থা নেই, অথবা হিন্দু সংস্কৃতির থেকে দূরে অবস্থান করেন বা হিন্দুভাষী নন, সেই সব মানুষ হিন্দুস্তানে নিছক থাকতে পারেন তবে তাদের জাতীয় জীবনে কোন স্থান থাকতে পারে না। একমাত্র যদি তারা হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু ভাষা ও হিন্দু জাতি-র অংশ হয়ে যেতে পারেন তবেই তাদের জাতীয় জীবনে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া যায়। এই একশৈলিক নেশন হল এম এস গোলওয়ালকরের ভবিষ্যতের ‘হিন্দুস্তানের’ রূপরেখা।


এম এস গোলওয়ালকর ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রধান। তাঁর এই লেখা এখনও আরএসএসের মূল  মতাদর্শ।


গ্রন্থটিতে তিনি রেস বা জাতি, তার সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রেস বলতে তিনি এমন এক জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়েছেন যাদের অভিন্ন রীতিনীতি আছে, যারা এক ভাষায় কথা বলে, যাদের সংস্কৃতিও অভিন্ন। অতীত থেকে যেসব রীতি, আচারানুষ্ঠান, প্রথা, দর্শন ও ধর্ম অনুসরণ করা হচ্ছে তার একত্রিত প্রভাবে তৈরি হয় জাতির সংস্কৃতি। তিনি বলেছেন, ধর্ম ও সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। ধর্মের ওপরে ভিত্তি করেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সংস্কৃতির আরেক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল ভাষা। প্রতিটি জাতির নিজের দেশে নিজস্ব ভাষা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়। 


তিনি বিশ্বাস করেন, দেশ ও জাতির শিরদাঁড়া গড়ে ওঠে তার ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে। সুতরাং, জাতি ধারণায় তার উপাদানগুলোকে আলাদা করা যায় না। আসমুদ্রহিমাচল সকলের সাধারণ ভাষা হল সংস্কৃত। আর সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত আধুনিক ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি প্রায় সকলে বুঝতে পারে এবং বিভিন্ন রাজ্যে এটিই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দু জাতি হিন্দুস্তানে বসবাস করে। এদের উৎস, সংস্কৃতি এক। এক হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই দেশে বিশুদ্ধ, খাঁটি দেশজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষা ছিল। শেষ এক হাজার বছর ধরে মুসলমান ও ব্রিটিশদের সাথে সংস্পর্শে এলেও এই সংস্কৃতি এখনও পৃথিবীর মহত্তম।  


গোলওয়ালকরের হিন্দুস্তানে বিভিন্ন ধরনের ধর্ম, ভাষা বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্থান কোথায়? যে জনগোষ্ঠীগুলি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দুস্তানে বসবাস করে না, যারা ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন আচার নিয়ে হিন্দুস্তানে এসেছে তারা ভারতের জনজীবনে কীভাবে অংশ গ্রহণ করবে? 


যদি ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন আচার নিয়ে কোন জনগোষ্ঠী হিন্দুস্তানে আসে, তাদের সামনে দুটি বিকল্প থাকবে। 


এক, তারা হিন্দু নেশনের অংশীদার হবার জন্য নিজের ভাষা, জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতি ও ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুস্তানের মূল প্রবাহে সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের আলাদা কোন সত্ত্বা থাকবে না। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক জীবনে নয়; ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষায় মাতৃভূমির প্রধানতম জাতির (অর্থাৎ হিন্দু জাতি) মধ্যে তাদের লীন হতে হবে। 

দুই, যদি সেই ভিনদেশি জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের ভিন্ন সত্ত্বা নিয়ে অবস্থান করে তবে তারা দেশে থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় জীবনের অংশীদার হতে পারবে না। 


এম এস গোলওয়ালকর তার কল্পনামাফিক হিন্দুস্তানের ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় প্রথমে আলোচনা করা দরকার কবে থেকে এই দেশে মানুষ বসবাস করছে। সেই মানুষ কারা? যেমন গোলওয়ালকার দাবি করেছেন, সত্যি কি এই দেশে ৮-১০ হাজার বছর আগে থেকে হিন্দুরা বসবাস করেছে? হিন্দু কারা?

কীভাবে ভারতে এতগুলি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এল? কেন আমি বা আপনি দক্ষিণ ভারতের ভাষা বুঝতে পারি না? আন্দামানের ওঙ্গেদের সাথে পঞ্জাবের মানুষের চেহারা তুলনীয় নয়, পরিধান বা খাদ্যেরও কোন সাদৃশ্য নেই, আর তাদের ভাষাও একেবারে ভিন্ন। অথবা একজন নাগা বা মিজোর সাথে দক্ষিণ ভারতীয় তামিলের কীবা সাদৃশ্য? কোন অভিন্নতা আছে এক বাঙালি উচ্চবর্ণের মানুষের সাথে সাঁওতাল পুরুষের? বাঙালি উচ্চবর্ণের খাদ্য কেন উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ খায় না? ভারতবর্ষে এত ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের মানুষ কেন আছে?

কোথায় আমাদের মিল? কোথায় আমাদের অমিল?


ভারতবর্ষে বিভিন্ন পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন:


এম এস গোলওয়ালকর যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব জার্মানির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একমাত্রিক স্বাধীন নেশনের কল্পনা করছেন, সেই একই সময়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস। প্রথমে তারা পুরাবস্তু, দেহাবশেষ ইত্যাদি খুঁজে বার করে, পরীক্ষা করে তার ইতিহাস লিখেছেন। আবার এই শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্সের সাহায্যে আরও সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারা যাচ্ছে কিছু চিরন্তন প্রশ্নের। কোথায় মানুষের সৃষ্টি? কবে ভারতে মানুষ এল?


ভারতবর্ষে প্রথম পরিযান ও তার পরম্পরা:


প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বারবার পরিযান করেছে। জিনবিদ্যার সাহায্যে শরীরের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীর খোঁজ পাওয়া যায়। প্রমাণ করা যায়, মানুষের উদ্ভব আফ্রিকাতে। তারপর আজ থেকে ৭০-৭২ হাজার বছর আগে খাদ্যের অন্বেষণে একদল মানুষ শুষ্ক শীতল পূর্ব-আফ্রিকা ছেড়ে শুরু করে প্রব্রজন। সেই ছোট্ট গোষ্ঠীর সন্ততিরাই আজ আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মানুষের পূর্বজ। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে যত মানুষ আজ এশিয়া, ইউরোপ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে আছে, তাদের সকলের পূর্বজরা ছিল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা সেই গোষ্ঠীতে।


আফ্রিকা থেকে বহির্গত সেই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ করে অন্তত ৬৫ হাজার বছর আগে। ওরা ছিল শিকারী ও সংগ্রাহক। ওরাই আদি ভারতীয়। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর নিকটতম প্রতিনিধি। এমনকি আজকের সমগ্র ভারতের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ মাতৃক্রমের (maternal lineage) দিক দিয়ে সেই আফ্রিকা-আগত মায়ের সরাসরি বংশধর। অর্থাৎ ওই সময়ে যে নারীরা সোজাসুজি এদেশে এসেছিলেন আজকের ভারতের অধিকাংশ নরনারী মাতৃক্রমে সরাসরি তাদের উত্তরসূরি।


পিতৃক্রমের (paternal lineage) হিসেবটা ভিন্ন। সেই যে ৬৫ হাজার বছর বা তার আগে ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ এসেছে তার পরেও এই দেশে আরও কিছু পরিযান হয়েছে। তারা পূর্বোক্ত জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী পরিযানগুলিতে পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে যে জনগোষ্ঠীগুলি ভারতবর্ষে এসেছে তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের জিনগত ছাপ ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে অধিক মাত্রায় রয়ে গেছে। 


ভারতবর্ষে ইরান থেকে দ্বিতীয় পরিযান ও হরপ্পীয় সভ্যতা:


সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষে হরিয়ানার রাখিগর্হিতে হরপ্পীয় মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই সময়কালের আরও কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।  

এই দেহাবশেষগুলির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, আফ্রিকা থেকে প্রথম পরিযানের অনেক পরে, মাত্র ১২ হাজার বছর আগে, পূর্ব ইরানের দিক থেকে ভারত অভিমুখে এক জনগোষ্ঠীর পরিযান শুরু হয়। এদের সাথে আদি আফ্রিকাজাত শিকারি-সংগ্রাহকদের মিশ্রণের ফলে এক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে এদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে তারাই হরপ্পীয় সভ্যতা গড়ে তোলে। 


সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পীয় সভ্যতা এক বিস্ময়। এই সভ্যতা উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। 

আবহাওয়ার পরিবর্তন ও তজ্জনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে আজ থেকে ৩.৯ হাজার বছর আগে হরপ্পীয় সভ্যতা ভেঙে পড়ে। তখন সিন্ধু তীরের সেই মিশ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যের আশায় সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। এরা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে এসে আবার ওখানকার প্রাচীন আফ্রিকা-আগত শিকারী-সংগ্রাহকদের সাথে আরও একবার মিশ্রিত হয়। আর সেই মিশ্র মানুষ সমগ্র ভারতে জাতিগোষ্ঠী গঠনে পরবর্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।


আজও ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষাপরিবার হল দ্রাবিড় ভাষাপরিবার, এতে প্রায় ১৯.৬৪% ভারতীয় কথা বলে। আজ থেকে চার হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষা ছিল না, সেই সময়ের মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ইন্দো-ইউরোপীয় জিনও পাওয়া যায়নি। ইন্দো-ইউরোপীয় জিন কাকে বলে? কবে এই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এল? কী করে বুঝব ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষ থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়নি, বরং বিপরীতে বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছে? এবার সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।


হরপ্পীয় সভ্যতার লিপিগুলির পাঠোদ্ধার করা যায়নি। তবে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য বেদ নিয়ে ভাষাতত্ত্ববিদরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। কারা বেদ লিখেছিল? তারা কবে ভারতবর্ষে এল?


ভারতবর্ষে ইন্দো-ইয়োরোপীয় আগমন:


বেদ রচয়িতা বৈদিক-সংস্কৃতভাষীদের উৎপত্তি ও তাদের সময়কাল জানতে একত্রিতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, শব্দতাত্ত্বিক ও জিনবিদদের চর্চার প্রয়োজন। কারণ উত্তর ভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এক অভিন্নতা অনেকদিন ধরেই ভাষাতত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় সংস্কৃত ভাষা ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষা, যেমন গ্রিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অথচ তুলনামূলকভাবে উত্তরপ্রদেশের অনেক কাছে তামিলনাড়ু অবস্থিত। 


এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে অতীতে এদের মধ্যে কোন এক সংযোগ ছিল। সমগ্র ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে এক আদি ভাষার খোঁজ চলে। শেষ পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্যে এই ভাষাগুলিকে নিয়ে এক ভাষাবৃক্ষ তৈরী করা হয়। তার চূড়ায় যে আদি ভাষা আছে তার নাম দেওয়া হয় ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’। সেই আদি ভাষা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন শাখাপ্রশাখাগুলিকে প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। আজকে অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে পন্টিক-স্তেপ অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক দল পশুপালক ওই ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’ ভাষায় কথা বলত। এদের সাথেই ওই ভাষা ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উপভাষা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকে ও পরবর্তীকালে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে।   


আজকে ভারতবর্ষে প্রায় ৭৮.০৫% ভারতীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে কথা বলে। 

বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে যারা কথা বলে তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশের পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ (যা পুরুষরা পিতার কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পায়) রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপীয় পুরুষের ওই ডিএনএ-র এক বিশেষ উপশাখার অনুরূপ। প্রায় ৪.৭ হাজার বছর আগের সেন্ট্রাল এশিয়াতে সেই বিশেষ উপশাখার প্রাচীনতম রূপটি এক প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আমাদের উত্তর ভারতের কিছু মানুষের মধ্যে যে ডিএনএ-উপশাখা আছে তার সবচাইতে প্রাচীন রূপটি পাওয়া যায় সেন্ট্রাল এশিয়াতে। ভারতবর্ষে নয়।


দ্বিতীয়ত, মধ্য এশিয়ার সেই প্রাচীন দেহাবশেষে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আফ্রিকাজাত শিকারী-সংগ্রাহক বা ইরান থেকে আগত জনগোষ্ঠীর ডিএনএ পাওয়া যায়নি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ওই অঞ্চল পরিযানের ফলে সেন্ট্রাল এশিয়াতে এই ডিএনএ-উপশাখার বিস্তার সম্ভব নয়; বরং এ থেকে এর উল্টোটাই, অর্থাৎ স্তেপভূমির মানুষের এইদেশে প্রবেশ প্রমাণিত হয়।


স্তেপের পশুপালকরা ইউরোপেও গিয়েছিল। চার হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় বৈদিক সংস্কৃতভাষী স্তেপ পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। হরপ্পীয় সভ্যতার মানুষ তখন দেশের দক্ষিণ দিকে চলেছে। যত দক্ষিণে যাচ্ছে তত মিশ্রিত হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় শিকারি-সংগ্রাহকদের সাথে। ইতিমধ্যে,যে হরপ্পীয় মানুষ উত্তর ভারতে থেকে গেছে স্তেপের পশুপালকদের সাথে তারা মিশে যাচ্ছে। এই মিশ্রণের প্রয়োজন হয়েছিল নারীর জন্য। ইন্দো-ইউরোপীয়দের মধ্যে নারী ছিল কম।

 

ভুলে গেলে চলবে না যে, যদিও ক্ষীয়মান তবুও এই দেশে তখনও যে সংস্কৃতি ছিল সেটা উপাদানগত বিচারে বৈদিক আর্যদের থেকে ছিল শ্রেষ্ঠতর। গুণগতভাবে এই শ্রেষ্ঠতর সংস্কৃতি পশুপালক বৈদিক আর্যদের উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার জন্যই বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিকে এক মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। আর প্রাচীন বৈদিক আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে দেশজ প্রাগার্য ধর্মীয় চিন্তা।তবে এই মিশ্রণ সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ছিল না। দেশের অঞ্চল, ভাষা ও বর্ণভেদে মানুষের মধ্যে মিশ্রণের আনুপাতিক পরিমাণ ছিল ভিন্ন। 


সংস্কৃতভাষী জনগোষ্ঠীর ভারতে প্রবেশের আগে অন্তত দুটি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ভিন্ন অঞ্চল থেকে এই দেশে এসেছে। তাদের বংশ পরম্পরা আজও চলেছে। এমনকি স্তেপভূমির সেই হালকা বর্ণের মানুষ এই দেশে এসে নারীর প্রয়োজনে ক্রমাগত মিশ্রিত হয়েছে আগে আসা জনগোষ্ঠীর সাথে। আবার পরে যখন নারীর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তখন ওরা বর্ণপ্রথা দৃঢ়ভাবে প্রচলন করেছে।


পূর্বভারতে কয়েকটি পরিযান:


এতো গেল উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে তিন মূল জনগোষ্ঠীর ভারতবর্ষে প্রবেশও মিশ্রণের ইতিহাস।


এছাড়াও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে কয়েকটি জনগোষ্ঠী পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেছে।


পূর্ব ও মধ্য ভারতে দেখা যায় মুণ্ডা, হো, বিরহোর, সাঁওতাল, খাসি ইত্যাদিদের। এরা কারা? 

এই জনগোষ্ঠীগুলি এক বিশেষ ভাষাপরিবারের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তাকে বলে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাপরিবার। 


মূলতঃ মধ্য, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ১.১ কোটি অস্ট্রো-এশিয়াটিকভাষী মানুষ বাস করেন। আজকে অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পিতৃক্রমের বিচারে ওদের পুরুষরা বহন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ডিএনএ। সম্ভবত লাওস থেকে ৫ হাজার বছর আগে বিভিন্ন দলে ওরা ভারতে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ ওরা ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতে প্রব্রজনের আগেই এই দেশে এসেছে। 


এছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে কিছু আদিবাসীগোষ্ঠী আছে যারা বিভিন্ন তিব্বতী-বর্মী ভাষাতে কথা বলেন। ত্রিপুরার ত্রিপুরী, জামাতিয়া, উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা, মণিপুরি বা মেইতেই, মিজো, বাংলাদেশের চাকমা, মারমা এই শ্রেণীভুক্ত। প্রায় ০.৭% ভারতীয় তিব্বতী-বর্মী ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে খুব সম্প্রতি ,২.৫-১ হাজার বছর আগে,‘প্রাচীন তিব্বতী-বর্মী’ জনগোষ্ঠীএই দেশে আসে। ওরা মূলতঃ দুই বাংলার পূর্ব সীমান্ত ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাস করে। 


এক জাতি, এক ভাষা,এক ধর্ম, এক সংস্কৃতিঃ


হিন্দু জাতি- ভারতবর্ষে কোন একটি রেস্ বা জাতি নেই। একটি জনগোষ্ঠী এই দেশ তৈরি করেনি। অন্তত ৫টি পৃথক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে। এদের উৎস এক নয়। তবে প্রথম তিনটি জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মিশ্রিত হয়েছে। আর তাই ভিলদের মধ্যেও পাওয়া যায় উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণের ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএ। অবশ্য দেশের অঞ্চল, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদে মিশ্রণের তারতম্য আছে। এদের সার্বজনীন কোন রীতি নেই। এরা এক ভাষায় কথা বলেন না।

মুণ্ডারি ও দ্রাবিড়দের আত্মগৌরব তুলনীয় নয়।


আজকে প্রমাণিত প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে যদি কোন তিনটি জিন সর্বব্যাপী হয় সে তিনটি হল আন্দামানের ওঙ্গে জনজাতির জিন (মাতৃক্রমে) এবং হরপ্পীয় ও স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকদের জিন (পিতৃক্রমে)।


হিন্দু ভাষা- সংস্কৃত ও তার থেকে উদ্ভূত ভাষাপরিবারের বাইরে এই দেশের ২২% মানুষ কথা বলেন। তামিল ভারতের প্রথম আইন স্বীকৃত শাস্ত্রীয় ভাষা। কোন অজুহাতেই হিন্দির জন্য তামিলরা তাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দেবে না। এই প্রসঙ্গে বলি, ভারতবর্ষে আছে ২২টি মূল ভাষা। তবে ছোট বড় মিলিয়ে ১৯,৫০০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। এই বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে শেষ ৫ হাজার বছর ধরে।


হিন্দু ধর্ম-হরপ্পীয় মানুষ সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতিপূজারী ছিল। সম্ভবত ওরা শিশ্নপূজা অর্থাৎ লিঙ্গপূজা করত। মৃত্যুর পরে দেহ মাটি চাপা দিত। ওখানে ধর্মীয় উত্সর্গীকরণ যেমন মহিষ-বলি, শোভাযাত্রা, স্বস্তিকা চিহ্নর ছবি পাওয়া গেছে। 

ভারতে আগত ইন্দো-ইউরোপীয়রা মূর্তিপূজক ছিল না। ওরা ঘৃণা করত শিশ্নপূজাকে। অগ্নিসংস্কার ও যজ্ঞে রাখত আস্থা, আস্থা ছিল বেদের মহত্বে। মনে করত মানুষ নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর। 

 

তারপর বহু শতাব্দী ধরে হরপ্পীয় ও বৈদিক সংস্কৃতভাষী মানুষের মিশ্রণ হয়েছে। আর ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্ম আজকের রূপ নিয়েছে। এবার ভাবুন হিন্দুদের প্রধান জীবনচর্যা ও সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান প্রণালীর কথা। হিন্দু ধর্মের বৈবাহিক ও শ্রাদ্ধ ক্রিয়ার মূলে আছে অগ্নিসংস্কার, যজ্ঞ। এছাড়াও বিবাহে আছে আরও অনেক স্ত্রী-আচার যেগুলি মূলতঃ হাজার হাজার বছরের দেশজ প্রথা। মৃতদেহ সৎকার হয় বৈদিক প্রথায়। মূর্তিপূজা, শিশ্নপূজা, ধর্মে বৃক্ষ ও পশুর গুরুত্ব এসেছে হরপ্পীয় সভ্যতা থেকে। তার সঙ্গে স্থানীয় নানা ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর নানা আচার হিন্দুধর্মের নানান স্থানীয় রূপভেদের মধ্যে এসে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচারসমগ্র এক ধর্মের রূপ নেয়। তবু আজও খাদ্যাভ্যাস, বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরির নিয়মবিধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। 


ভারত সরকারের ‘এনথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’-র ‘পিপল অফ ইন্ডিয়া’ প্রজেক্ট দেশের ৪৬৩৫ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করে বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, গোত্র, বংশনাম নিয়ে এক তালিকা প্রস্তুত করে। প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে এই সমস্ত তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। নিরীক্ষণ করা জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বর্তমানে হিন্দু ধর্মে ৩৫৩৯টি আলাদা সম্প্রদায় আছে, মুসলিমদের মধ্যে আছে ৫৮৪টি সম্প্রদায়, খৃস্টানদের মধ্যে ৩৩৯টি, শিখদের মধ্যে ১৩০টি, জৈনদের মধ্যে ১০০টি আর বৌদ্ধদের মধ্যে ৯৩টি সম্প্রদায়। এছাড়াও আছে পার্সি, ইহুদি এবং আরও ৪১১টি ট্রাইবাল সম্প্রদায়। অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মতো আছেই, সেই ধর্মগুলির মধ্যেও আছে আলাদা সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়গুলি তাদের বিভিন্নতা ধরে রাখতে আগ্রহী।


হিন্দু সংস্কৃতি- সংস্কৃতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক থাকে। তবে তার বাইরেও সংস্কৃতির একটা বিরাট পরিসর আছে। খাদ্য, বস্ত্র, আচার এবং অনুষ্ঠান, উৎসব, ঐতিহ্য ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে তৈরি হয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি।


সময়ের সাথে সাথে ভারতবর্ষে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। আবার একই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভ্যাস হয়েছে ভিন্ন। বিগত ১০০ বছর ধরে হরপ্পীয় সভ্যতার বিভিন্ন সাইটগুলিতে পাওয়া গেছে প্রভূত পরিমাণে গবাদি পশু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, পাখি, শূকর ইত্যাদির কঙ্কাল। প্রাচীনকালের মাটির বাসনে অনেক সময়ে লেগে থাকে পশু চর্বিজাত লিপিড। ওরা লিপিড বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, সেই সময়ে হরপ্পীয় জনগোষ্ঠী শূকর, ভেড়া এবং গরু, মহিষের মাংস প্রভূত পরিমাণে খেত।

আবার পরবর্তীকালে স্তেপভূমির আর্যভাষীদের মূল খাদ্য ছিল ফল, দুধ, ক্ষীর এবং আগুনে ঝলসানো গো ও অন্যান্য মাংস। পরবতীকালে এরা প্রাগার্যদের থেকে কৃষিকাজ শেখে। তবে উপনিষদের যুগে খাদ্যাভাব রুখতে গরু ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা আসে। 


মনুর সময়ে বর্ণবিভক্ত সমাজে বর্ণবিশেষে খাদ্যও হয়ে যায় ভিন্ন। মনুর বিধান ছিল ব্রাহ্মণের খাদ্য হবে সাত্ত্বিক। সে খাবে ফল, দুধ, মধু, অন্ন। ক্ষত্রিয়র খাদ্য ছিল রাজসিক- শিকার করা মাংস। ময়ূর বা হরিণের মাংস রাজসিক গুণসম্পন্ন বলে ধরা হত। অধিকাংশ শূদ্র মাংস খেত। তবে দরিদ্র মানুষ কোনকালেই খাদ্যবিচার করে না। সেই বৈদিক যুগেও চণ্ডালরা অনেক সময়ে খেয়েছে কুকুরের মাংস, কারণ একমাত্র এই মাংসই বিনা পয়সায় পাওয়া যেত।

এই খাদ্যবিভাজন দেশের বিভিন্ন অংশে সমান ভাবে বাস্তবায়িত হত না। খাদ্যবিধির মূল কারণ হল আর্থ-সামাজিক। বাংলা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্রভূমি থেকে দূরে অবস্থিত ছিল। তাই বাঙালির খাদ্যবিধান উত্তরপ্রদেশের মনুর বিধান অনুযায়ী পুরোপুরি চলেনি। 


শুধু তো খাদ্য নয়। বাঙালি হিন্দুর বিবাহ অনুষ্ঠান হয় রাতে, দক্ষিণ ভারতে দিনে। উত্তর ভারতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে মামা-ভাগ্নি বা মামাতো, পিসতুতো ভাই-বোনে বিবাহ কাম্য। 


বাৎসরিক মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। বাঙালির দুর্গাপূজা, মারাঠির গণেশ চতুর্থী, উত্তর ভারতের বৈষ্ণবদের গোবর্ধনপূজা। ঐতিহাসিককালে ভারতবর্ষ একই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একত্রিতভাবে দীর্ঘদিন থাকেনি। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক রীতিনীতি, প্রথা, খাদ্যাভ্যাস।

এই বিভিন্নতা আমাদের সংস্কৃতি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।


পরিশিষ্ট:


পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তাই প্রাগিতিহাস বা ইতিহাসের দীর্ঘ সময়কাল ধরে ভারতবর্ষ বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধারণ করেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন মিশ্রিত হয়েছে, তখন অন্যের থেকে কিছু শিখেছে, কিছু নিজেরা উদ্ভাবন করেছে। আবার মানুষের আঞ্চলিক মিউটেশন সাহায্য করেছে প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে, বেঁচে থাকতে, উন্নততর প্রজন্মের জন্ম দিতে। 


গোলওয়ালকর ইতিহাসকে স্বনির্মাণ করেছেন। আজ থেকে ৯০ বছর আগেও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে তাঁর তত্ত্বের ত্রুটি দেখানো সম্ভব ছিল। কিন্তু এদেশের প্রকৃত প্রাগিতিহাস তখনও অনেকটা অজানা ছিল। আজ সেটা বিশদভাবে, নিশ্চিতরূপে জানা গিয়েছে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের কোথাও বিশুদ্ধ জাতি বা ‘রেস’ নেই। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণের দেহেও আছে আফ্রিকান শিকারী-সংগ্রাহক আর প্রাচীন ইরানীয় শিকারী-সংগ্রাহকের জিন। আছে ইন্দো-ইউরোপীয় রক্ত। একমাত্র আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে বা অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা হল খাঁটি অবিমিশ্র জনগোষ্ঠী। আদি অধিবাসীরা এখনও শিকারী ও সংগ্রাহকের জীবন যাপন করে।


সভ্যতার বীজ রয়েছে জনগোষ্ঠীর মেলামেশায়, জ্ঞানের আদান প্রদানে। ভারতবর্ষ এর ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তারা এই দেশকে নিজভূমি করে নিয়েছে। আমার আপনার পূর্বজ পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই আসুক আজ আমরা সবাই ভারতবাসী।


প্রধান কয়েকটি তথ্যসূত্র:

১) M. S. Golwalkar, “We or Our Nationhood Defined”, Bharat Publications, Nagpur, 1939

২) Stephen Oppenheimer, “Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: tracing uniparental gene trees across the map,” Phil. Trans. R. Soc, B367770–784, (2012) 

৩) V. M. Narasimhan et al., “The formation of human populations in South and Central Asia,” Science, 365(6457), (2019)

৪) Priya Moorjani et al., “Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India,” Am Journal of Human Genetics, 93(3), (2013)

৫) Iain Mathieson et al., “Genome-wide patterns of selection in 230 ancient Eurasians,” Nature, 528, (2015): 499–503

নীল দিন পালন করা বর্জন করুন -রাজর্ষি
Nov. 20, 2024 | সচেতনতা | views:280 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সম্প্রতি কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে “বিশ্ব অটিজম সতর্কতা দিবস” পালন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি  প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নীল বাতি জ্বালাচ্ছেন, রিবন ব্যাজ পরছেন, পাজল চিহ্ন পোস্ট করছেন। কিন্তু জানেন কি, এই অনুষ্ঠান কোন বার্তা দেয়? 


আমি নিজে অটিস্টিক । অনেকের ধারণা অটিস্টিক ব্যাক্তি মাত্রই কথা বলতে লিখতে বা পড়তে অক্ষম, তাঁদের  জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি ঐ তিনটি কাজই আমি যথেষ্ট ভালভাবে করতে পারি। আমার নিজের বক্তব্য আমি তুলে ধরতে পারি, আর যেসমস্ত অটিস্টিক ব্যাক্তি এই তিন মাধ্যমে সংযোগ করতে পারেন না, তাঁদের প্রকৃত অনুভূতি ঠিক কিরকম, সেটা বলার মতো কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি রাখি; যেটা   “পেশাদার” বিশেষজ্ঞরাও বুঝতে পারেন না।   


অটিজম বিষয়ে লাগাতার প্রচারাভিযানের ফলে আজকাল অটিজম শব্দটি সবাই জানেন। অথচ অটিজম কী, সে বিষয়ে প্রায় কেউই ঠিকঠাক জানেন না । অটিজম কথার আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মমগ্নতা’, ডাক্তারি পরিভাষায় কোনো বিশেষ আকর্ষণের প্রতি প্রবল একাগ্রতা এবং একই কাজ বারবার করে যাওয়া, সামাজিক বোধ এর অভাব। 


এখন, ভাবার বিষয় হল, ‘আত্মমগ্নতা’ কে  আদৌ ‘ব্যাধি’ বলা উচিত কিনা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিক্ত সত্য এই, যে, যেসমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তি আত্মমগ্নতা কে ‘ব্যাধি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন সরাসরি নাৎসি গণহত্যাকারী সুপ্রজননবাদী। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যাক্তিদের, অর্থাৎ যাদের “educability” কম থাকতো, যাদের ‘ডিসিপ্লিনড’ করা যেতনা, তাদের হত্যা করা হত।  ফলে ‘আত্মমগ্নতা’ যাকে এখন ব্যাধি বলে গণ্য করা হয়, সেটি কতটুকু ব্যাধি, আর কতটুকু সমাজযন্ত্রের শিকার, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। 


এখন, কথা উঠতে পারে, যে অটিস্টিক ব্যাক্তি কি সমস্যার সম্মুখীন হন না? অবশ্যই সমস্যার সম্মুখীন হন, এবং তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষের চাইতে অনেক, অনেক, অনেক বেশি। কিন্তু একটু ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অবশ্যই দেখা যায় ‘আত্মমগ্নতা’ সমস্যাগুলির কারণ নয় বরং সমাজই সমস্যাগুলির উৎস।  ধরুন, কোনো ব্যাক্তি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না।  তাহলে তাঁর কর্মস্থলের সহকর্মী, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাঁর ‘পিছনে লাগবেন’, তাঁর ‘ঘণ্টি বাজিয়ে’ দিয়ে চলে যাবেন। যেন অটিস্টিক ব্যাক্তি টি কোনও গুরুতর অপরাধ করেছেন। ডাক্তারবাবুরা হয়ত জ্ঞান দেবেন, আরও চেষ্টা করুন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবার। প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টায় হারায় আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমরা কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছি, প্রকৃত বক্তব্য পেশ করার সাথে চোখের দিকে তাকানোর  আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? শুধুমাত্র এরকম অগুনতি ছোটো-ছোটো সামাজিক নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে ফেলায় মানুষকে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস আর হয়রানি র শিকার হওয়া টা একরকম অবধারিত। 

এবার আসি, তাঁদের কথায়, যাঁরা কথা বলার মাধ্যমে সংযোগ রাখতে পারেন না। বাড়িতে হাহাকার পড়ে যায় কথা বলা শেখানোর জন্য। শেষমেশ আমরা ভেবে নিই বাচ্চাটির কোনও বোধ-বুদ্ধি নেই । অথচ আমরা কেউই হয়ত জানি না, যে, চিন্তাভাবনা করার জন্য শব্দ বা বাক্যই একমাত্র ভাষা নয়। ছবির ভাষা, অলটারনেটিভ অগমেন্টেটিভ কমিউনিকেশন, সাইন ল্যাংগুয়েজ, ব্রেইল, আরো বহুরূপ ভাষা আছে পৃথিবীতে। অনেকেই আছেন যাঁরা কথা বলতে পারেন না, কিন্তু টাইপ করতে পারেন এমনকি বাইরের দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। (সন্দেহ থাকলে গুগল করুন হরি শ্রীনিবাসন সম্পর্কে, যিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই।)  তাহলে সমাজ যদি ভেবে নেয় কথা বলার ভাষা ই একমাত্র ভাষা, আর যারা যারা সেই ভাষায় কথা বলতে পারবেনা, তাদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারেনা, তাহলে সমস্যাটা আত্মনিমগ্ন ব্যক্তির নয়। সমস্যাটা সমাজের। 


“তোমার অটিজম কে তুমি পরাস্ত করেছ” – সমাজের এই অদ্ভুত কথাবার্তা আমাদের অনুপ্রাণিত করেনা। তার কারণ অটিস্টিক ব্যক্তি এবং অটিজম পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। চঞ্চলতা চঞ্চল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, শান্তভাব শান্ত ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, চামড়ার কালো রঙ কালো মানুষের বৈশিষ্ট্য, গাণিতিক চিন্তা গণিতবিদের বৈশিষ্ট্য। ঠিক সেরকম ‘অটিজম’ অটিস্টিক ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যও। অটিজম কে অস্বীকার করতে বলা মানে অটিস্টিক ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। 


দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, সমাজটা তথাকথিত সামাজিক লোকজন নিয়ে তৈরী। (অটিস্টিক রা সংখ্যালঘু এবং বিচ্ছিন্নও )  ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশ,  এমনকি বিজ্ঞানী, পণ্ডিত, এমনকি প্রায়শই অটিস্টিক ব্যক্তির তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ বাবা-মা ও ঠাহর করতে পারেন না, সমস্যাটা আদতে ‘অটিজম’ নয়। কিন্তু যাবতীয় বইপত্র, ‘চিকিৎসা পদ্ধতি’ (?), সতর্কতা অভিযান তৈরি হয়েছে এমন ব্যাক্তিদের দ্বারা, যাদের এই অন্তর্দৃষ্টি ছিল না। ফলে তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন অটিজম এর  “মেডিক্যাল মডেল”, যেখানে অটিজম কেই মূল সমস্যা বলে মনে করা হয়। আর আগেই বলেছি, অটিজম কে অস্বীকার করা আর  অটিস্টিক ব্যক্তি কে অস্বীকার করা একই ব্যাপার।  কদর্য এবিএ চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক ইভার লোভাস মনে করতেন অটিস্টিক ব্যক্তিরা মানুষের মধ্যে গণ্য নয়। আজও, ব্যায়বহুল এইসব কদর্য চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে আচরণের অবদমন শেখানো হয়। যার ফলে আপাতদৃষ্টিতে অটিস্টিক ব্যক্তিকে ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। কিন্তু পরিবর্তে সে হারিয়ে ফেলে তার নিজের যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। ভুলে যায় তার নিজের ও কিছু বলার থাকতে পারে, যেটা হয়ত বাকি পৃথিবীর সাথে মিলবে না। এই পণ্ডশ্রম অটিস্টিক ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে নিজের মতো করে খেলা থেকে, নিজের মতো করে বাঁচতে শেখা থেকে। 


নীল দিন কেন নয়? 

কোটিপতি ব্যবসায়ী সংগঠন “অটিজম স্পিকস” মনে করে অটিজম কোনও ঘৃণ্য অভিশাপ। এরা অটিজম সম্পর্কে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। এরা বারংবার এইডস ক্যান্সার প্রভৃতি মারণব্যাধির সাথে আত্মমগ্নতা কে এক শ্রেণিতে ফেলাটা একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করে তোলে । । ২০০৯ সালে  “আই অ্যাম অটিজম” বিজ্ঞাপন এ এরা মানুষজন কে প্রবল ভাবে ভয়ার্ত করে তুলেছিল।  প্রচার করছিল অটিজম বাবা-মা র embarassment (লজ্জা) র কারণ।  প্রকৃতপক্ষে সমাজই লজ্জার কারণ। প্রভাবশালী এই সংস্থা গোটা পৃথিবী থেকে কোটি-কোটি টাকা ডোনেশান তোলে, যার সিংহভাগ যায় অটিজম কে পৃথিবী থেকে তাড়ানোর গবেষণায়, (অটিজম দূর করা আর অটিস্টিক ব্যাক্তি কে দূর করা একই ব্যাপার আগেই বলেছি)। অটিস্টিক ব্যক্তির জীবন সহজসাধ্য করে তোলার কোনো কাজে তাৎপর্যপূর্ণ কোনমাত্র অংশ নেয় না সংস্থাটি। সংস্থাটিতে ক্ষমতাসীন পদে কোন অটিস্টিক ব্যাক্তি নেই। 

এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মহল কে সহজেই প্রভাবিত করে। আমেরিকার সরকার ও ‘ওয়ার অন অটিজম’ (আত্মমগ্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ) অভিযান করছিলো।   এবং এপ্রিল ফুলস ডে- র পরদিন অর্থাৎ ২রা এপ্রিল  কে নীল দিন অর্থাৎ বিষণ্ণ দিন ঘোষণা করা হয়। 


অটিজম মোটেও হুহু করে বাড়ছেনা। প্রাচীন কালের মুনি ঋষি দার্শনিক দের কথা পড়লে তাঁদেরকে অটিস্টিক বলেই মনে হয়।  আমাদের সমাজে অটিস্টিক মানুষ আরও অনেক বেশি বেশি দরকার। যারা সমাজের সংখ্যাগুরুর ভুল গুলিকে ধরিয়ে দিতে সমর্থ।  


তাই অটিজম এর বিরুদ্ধে সতর্কতা নয়, বরং সমাজকে সংশোধন করার জন্য অভিযান করুন, যাতে অটিস্টিক ব্যক্তির জীবন সহজসাধ্য হতে পারে, যাতে সমাজ অটিস্টিক ব্যক্তির কথা সম্মানের বিনিময়ে গ্রহণ করতে পারে।   

আরও পড়ুনঃ 

Chown, Nick. "Who benefits from autism research? And to what extent is it participatory and/or emancipatory?: A brief follow-up to Pellicano, Dinsmore and Charman (2014)." Autism Policy and Practice 2, no. 1 (2019): 93-95.


Armstrong T. The myth of the normal brain: embracing neurodiversity. AMA J Ethics. 2015 Apr 1;17(4):348-52. doi: 10.1001/journalofethics.2015.17.4.msoc1-1504. PMID: 25901703. 


Czech, Herwig. "Hans Asperger, national socialism, and “race hygiene” in Nazi-era Vienna." Molecular autism 9, no. 1 (2018): 1-43. 


Long-term ABA therapy is abusive: A response to Gorycki, Ruppel, and Zane; by A. H. Sandoval Norton, Gary Shkedy, Dalia Shkedy; Advances in Neurodevelopmental disorders (2015) 5:126-134


How much complience is too much complience: Is long term ABA abuse? by A. H. Sandoval-Norton and Gary Shkedy, Cogent Psychology (2019), 6:1, 1641258.


Ethical concerns with Applied Behaviour Analysis for Autism Spectrum “Disorder”. by Daniel A Wilkenfeld, Allison M. McCarthy; Kennedy Institute of Ethics Journal, Volume 30, Number 1, March 2020, pp. 31-69 (article). 


Thibault, R. (2014). Can autistics redefine autism? The cultural politics of autistic activism. Trans-Scripts, 4, 57-88. 


Waltz, M. M. "Getting from 'you can’t speak for my child' to ‘nothing about us without us' :: A brief history of diagnostic denial, misuse and misunderstanding in autism." Lancaster Centre for Disability Studies (CeDR) Conference, UK. 2018

দেহদান মানবতার এক অঙ্গীকার -পৃথ্বীশ ঘোষ
Nov. 20, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:9721 | likes:454 | share: 523 | comments:0

দেহদান ও চক্ষু দান এর কথা মনে পড়তেই প্রথম যে বাধার সম্মুখীন হই আমরা তা হল আজন্ম লালিত কিছু ধর্মীয় কুসংস্কার। যদি কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দান করি পুনর্জন্ম ( rebirth) হলে সেই অঙ্গ ছাড়াই প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মাতে পারে। তাছাড়া ধর্মীয় বাধা সামাজিক বাধা এগুলো এক এক করে আসে। যদি এসব বাধা  কাটিয়ে কেউ ইচ্ছে করলেই অনায়াসে এই মহৎ দানে ব্রতী হতে পারে। মরণোত্তর দেহদান হল মৃত্যুর পর শবদেহ ধর্মীয় প্রথাসিদ্ধ মতে সৎকার না করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে দান করা।

যাঁর মৃতদেহ তিনি কিন্তু নিজে এই দান করতে পারে না, সেটাই স্বাভাবিক। কারন মৃত্যুর পর তিনি দান করবেন কি করে? কোন ব্যক্তি জীবিতকালে শুধুমাত্র তাঁর এই ইচ্ছার কথা অঙ্গীকারের মাধ্যমে জানিয়ে রাখতে পারেন শুধু। তাঁর ইচ্ছাপূরণের দায়টা কিন্তু নিকটজনের। আর এই ইচ্ছাপুরণটা যাতে হয় সেক্ষত্রে অঙ্গীকারকের একটা ভূমিকা আছে। তা হল এই অঙ্গীকারের বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। যা দিয়ে সে নিকটজনকে মোটিভেটেড করতে পারবে।

আমি 2010 সালেই গণদর্পন এর মাধ্যমে এই অঙ্গীকার করেছিলাম। আপনার প্রিয়জন যার ইতিমধ্যেই ব্রেন ডেথ হয়েছে তার সুস্থ সবল অঙ্গ দিয়ে অন্য আর একজন ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। বলতে গেলে তিনি অন্য একজনের মধ্যেই স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবেন। আপনার প্রিয়জনের দুটি চোখ দুজন অন্ধ মানুষ কে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে । তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণায় নানাবিধ সাহায্য হয়ে থাকে।  যদি ইতিহাসের পাতায় ফিরে যাই পৃথিবীর প্রথম মরণোত্তর দেহদান হয় 1832 সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত চিন্তাবিদ জেরমে বেন্থাম এর। ভারতে 1956 সালে পুনের শিক্ষাবিদ পান্ডুরঙ শ্রীধর আপ্তে। পশ্চিমবঙ্গে 1990 সালের 18 ই জানুয়ারি সুকুমার হোমচৌধুরী।  পূর্ব অঙ্গীকার মতো সুকুমার হোমচৌধুরীর মরদেহ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে দান করা হয়।

1905 সালের 7 ডিসেম্বর প্রত্যঙ্গদানে ঘটে যুগান্তকারী ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে চেকশ্লোভাকিয়ায় চক্ষু চিকিৎসক এডোয়ার্ড কনরাড জার্ম (Eduard conarad Zirm) হাত ধরে। 45 বছরের অ্যালোস গ্লোগা (Alois Gloga) কর্ণিয়াজনিত কারণে দুটি চোখেই দৃষ্টিহীন। তখন এডোয়ার্ড কনরাড জার্ম 11 বছরের কার্ল ব্রুয়ের ( Karl Brauer) একটি চোখের কর্ণিয়া নিয়ে অ্যালোস গ্লোগার চোখে প্রতিস্থাপন করেন। হ্যাঁ, এই কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন ছিল জীবিত মানুষের থেকে নিয়ে। আর এই ছিল একমাত্র প্রথম ও শেষ জীবিত কারো থেকে কর্ণিয়া সংগ্রহ করে কর্ণিয়াজনিত কারনে কোন ব্যাক্তিকে কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন। দক্ষিণ ভারতের বিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ আব্রাহাম কোভুর ও আক্কা কোভুর। তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের মৃত্যুর পর তাদের মরদেহও চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে ব্যবহৃত হয়। ঘটনাটি ঘটে 1970 সালে। 1987 সালে শ্রীলঙ্কায় এল টি টি ই-র নেতা দিলীপ থেলাপ্পান অনশন চলাকালীন মারা যান। উনার অঙ্গীকার অনুযায়ী উনার মৃতদেহ জাফনা মেডিক্যাল কলেজে দান করা হয়। 

কোভিড মহামারীর মধ্যেই গনদর্পন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও দেহদান আন্দোলনের পথিকৃৎ ব্রজ রায়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর (13,may,2021) পর প্যাথলজিক্যাল অটোপসি করা হয়। এই প্রথম পূর্ব ভারতে কোনও কোভিডে মৃত ব্যক্তির প্যাথোলজিক্যাল অটোপসি হয় বলে আরজি কর হাসপাতাল সূত্রে দাবি। মৃত্যুর সঠিক কারণ কী, কোভিডের কারণে মৃতের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, প্যাথলজিক্যাল অটোপসির মাধ্যমে তা জানা সম্ভব।

1994 সালে ভারত সরকার ‘দ্য ট্রান্সপ্লানটেশন অব হিউম্যান অরগ্যান অ্যাক্ট – 1994’ আইন চালু করেন। এই আইনের ফলেই সাধারণ মৃত্যুর পাশাপাশি মস্তিষ্কের মৃত্যুও স্বীকৃতি পায়। এরফলে যান্ত্রিকভাবে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ চালু রেখে মৃতের দেহ থেকে প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে রাস্তা সুগম হয়। 1995 সালে আমাদের রাজ্য এই আইন গ্রহণ করে। কিন্তু 2010 সাল পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে শুধুমাত্র কর্ণিয়া ছাড়া মৃতদেহ থেকে অন্যকোন অরগ্যান সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় নি। ২০১০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী এস এস কে এম হাসপাতালে জয়দেব পালের মৃতদেহ থেকে লিভার সংগ্রহ করে সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত জয়তী চট্টোপাধ্যায়ের দেহ প্রতিস্থাপিত হয়। নদীয়ার দীনেশচন্দ্র মোদক হঠাৎই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। তখন উনার একমাত্র কন্যা বন্দনা মোদকও বিকল দুটি কিডনী নিয়ে মৃত্যুর দিনের অপেক্ষায়। তখন চিকিৎসারত চিকিৎসক ডাঃ এম সি শীল মৃত দীনেশচন্দ মোদকের স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীকে জানান যে উনার স্বামীকে ফিরে পাবেন না কিন্তু আপনি আপনার মেয়েকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারেন যদি দীনেশবাবুর মৃতদেহ থেকে কিডনী বন্দনার দেহে প্রতিস্থাপনের অনুমতি দেন। লক্ষ্মীদেবী অনুমতি দেন। বন্দনা আজো বেঁচে আছে আমার আপনার মতই। 


সাধারণ মৃত্যুর পর যেসব অরগ্যান নেওয়া সম্ভব


১) চোখ (গ্লুকোমা, ক্যানসার, হেপাটাইটিস, এইচ আই ভি বা সেপটোসেমিয়া থাকলে সম্ভব নয়) (একমাত্র কর্ণিয়া জনিত কারনেই দৃষ্টিহীন হলেই তাকে দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব) (যদি কেউ কর্ণিয়াজনিত কারণ ছাড়া অন্যকারনে দৃষ্টিহীন হয় তবে সেই দৃষ্টিহীন ব্যাক্তিও চোখ দান করতে পারেন)। আমাদের দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী ৪ ঘন্টার মধ্যে।

২) ৪ ঘন্টার মধ্যে অস্থি, ত্বক, ইয়ারড্রাম ও ইয়ার বোন।

৩) ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে কিডনী।


কিছু অরগ্যান যা রক্ত সঞ্চালন অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়।


সেগুলো হচ্ছে ১) কিডনী, ২) হার্ট ও হার্ট ভালভ, ৩) প্যাঙক্রিয়াস, ৪) অস্থিমজ্জা, ৫) রক্ত ও অনান্য সব।


এবার চক্ষুদান নিয়ে কিছু কথা বলি আপনার চোখে দৃষ্টি পাবে দৃষ্টিহীন কেউ। এই মহত কাজটি অনেকেই মৃত্যুর আগে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু অনেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে। কিন্তু ওই যে নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আর হয়ে ওঠেনা।

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে চোখ দানের

প্রয়জনীয়তা রয়েছে। তবে পাশাপাশি, আসল প্রক্রিয়া, উপকারিতা, কল্পনা, মিথ এবং ঘটনাগুলি সম্পর্কে ভুলধারণা রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে ভারতে আনুমানিক ১৫ মিলিয়ন মানুষ দৃষ্টিহীন এবং ৩০ মিলিয়ন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে লড়ে চলেছে।  ডাক্তার হর্ষবর্ধন ঘোড়পাদে বলেছেন  ভারতে চোখের দান সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার হয়না। কারণ এর চারপাশে বহু মিথ ও কুসংস্কার রয়েছে; চোখ দান সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন করা উচিত। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাব গুলি । সেই সঙ্গে আমরা যতটা রক্তদানে আগ্রহী তার সিকিভাগ যদি এই ব্যাপারে উৎসাহী হই তাহলে সমাজের পক্ষেই মঙ্গল হবে । এখন তো বিভিন্ন ক্লাব তাদের রক্তদান কর্মসূচির মধ্যেই দেহদান ও চক্ষুদান কে অন্তর্ভুক্ত করছে আমি বলাগড়ে ব্লকে দেখেছি ।


●চোখ দানের পিছনে যে ভুল ধারণা রয়েছে দেশেজুড়ে তা হল -

◆চোখের দান করলে পরের জন্মে চোখ হবে না। মুখের আদল নষ্ট হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরও যে জন্ম হয়, তার নিশ্চিত পরীক্ষামূলক তথ্য নেই। তাছাড়া বিভিন্ন কারনে অনেক সময় জীনগত কারনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।

◆সঠিক তথ্য- চক্ষু দান করলে মুখের চেহারা নষ্ট হয় না। কর্নিয়া নেওয়া হয়। যখন চোখ বন্ধ থাকে , তখন স্বাভাবিকই থাকবে।

●কোনও ব্যক্তি জীবিত থাকাকালীন তাদের চোখ দান করতে পারে।

◆সঠিক তথ্য: না। কিডনি বা যকৃতের কিছু অংশ জীবিত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তিকে দান করা যেতে পারে, তবে মৃত্যুর পরে চোখ দান করা হয়। আপনি জীবিত থাকাকালীন আপনার চোখ দান করার শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে অঙ্গীকার করতে পারেন।

● চক্ষু দান সমস্ত অন্ধ মানুষকে সাহায্য করতে পারে।

◆সঠিক তথ্য: শুধুমাত্র কর্নিয়ার অস্বচ্ছ ব্যক্তিরাই উপকৃত হতে পারে, অন্যদিকে রেটিনা বা অপটিক নার্ভের জন্য অন্ধত্ব এলে তারা চোখ দান থেকে উপকৃত হবে না।

● আপনি যদি রেটিনার রোগে ভোগেন বা আপনার চোখে শল্যচিকিৎসা হয়ে থাকে, আপনি দাতা হতে পারবেন না।

◆সঠিক তথ্য:  রেটিনা বা অপটিক নার্ভ সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের পর চোখ দান করা যায়।

● চোখ মৃত্যুর পরে যে কোনও সময় দান করা যায়।


◆সঠিক তথ্য: মৃত্যুর ৬ ঘন্টার মধ্যে কোনও দাতার কাছ থেকে চোখ সংগ্রহ করা দরকার। দাতার দেহকে শীতল পরিবেশে রাখা উচিত।   চোখ বন্ধ করা, আর্দ্র সুতির কাপড় চোখের উপরে রাখা এবং মাথার নীচে দুটি বালিশ রাখতে হবে। কারণ, স্থানীয় চক্ষু সংগ্রহ কেন্দ্র (হাসপাতাল) বা চক্ষু ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সময় প্রয়োজন। আর সেই সময় যাতে চোখ ঠিক থাকে তার জন্যই এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।

●চোখ দান করে বিক্রি করা হয়।  

◆সঠিক তথ্য: যে কোনও মানব অঙ্গ বিক্রি ও ক্রয় করা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ; এটি একটি মহৎ কাজ এবং অনুমোদিত সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

শেষ করব বাংলাদেশের মুক্তমনা আরজ আলী মাতুব্বর দেহদান সম্পর্কে কি লিখেছেন আসুন জেনে নিই -


আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০–১৯৮৫)

আমাদের মত শিক্ষিত বলে কথিত সুশীলদের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিয়েছেন আরজ আলী মাতুব্বর। শুধু জীবিত অবস্থায় নিজেকে আর অন্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেননি, তিনি তার মৃত্যুর  সময়েও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যে সাহস এর আগে কোন শিক্ষিত সুশীলেরা করে দেখাতে পারেনি। পাঠক মনে রাখবেন বাংলাদেশ এর প্রেক্ষাপট ও তৎকালীন সময়ে মৌলবাদীদের অত্যাচার ।

তিনি তার মৃতদেহ কবরে দাফন না করে মানব কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা  ‘কেন আমার মৃতদেহ মেডিকেলে দান করেছি’ শীর্ষক  প্রবন্ধে তিনি বলেন –


‘…আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানব-কল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা।’


মাতুব্বরের মৃতদেহ দানপত্রটি হুবহ তুলে দিলাম –  যা এখনো আমাদের মতো মানবতাবাদীদের জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস –


অধ্যাপক আহমদ শরীফ ( 1921 - 1999)

মাতুব্বরের মতো বাংলার বিবেক, অধ্যাপক আহমদ শরীফও তার মৃতদেহকে  মেডিকেল মানব কল্যাণে দান করে গেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরের মৃতদেহ দানপত্রের মতো আহমদ শরীফের সম্পাদিত ( মৃত্যুর চার-পাঁচ বছর আগে)  তার ‘অছিয়তনামা’ আর ‘মরদেহ হস্তান্তরের দলিল’ দুটিও বাংলা আর বাঙালির মুক্তবুদ্ধির ইতিহাসে অনন্য কীর্তি।


অছিয়তনামায়  তিনি লিখেছিলেন –


“আমি সুস্থ শারীরিক এবং সুস্থ মানসিক অবস্থায় আমার দৃঢ় সঙ্কল্প বা অঙ্গীকার স্থির সিদ্ধান্ত-রূপে এখানে পরিব্যক্ত করছি।


আমার মৃত্যুর পরে আমার মৃতদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের  অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বেসরকারী মেডিকেল কলেজে অর্পণ করতে চাই। … চক্ষুদান এবং রক্তদান তো চালুই হয়েছে। চোখ শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।”


জ্যোতি বসু (১৯১৪ – ২০১০)


২০১০ সালের ১০ই জানুয়ারি কলকাতার সল্ট লেকের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার পর কিছু সময় পরেই তাঁর চোখের কর্নিয়া অপসারণ করেন চিকিৎসকরা, তারপর তার দেহ ছাত্র ছাত্রীদের গবেষণার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।   জ্যোতি বসু জীবিত অবস্থাতেই বলে গিয়েছিলেন  এভাবে –


“জানিনা আমার অশক্ত শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কারো কাজে আসবে কিনা! কিন্তু আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা যে আমার মরদেহ যেন অন্তত গবেষণার কাজে লাগানো হয়।একজন কমিউনিস্ট হিসেবে জানতাম জীবিতকালে মানুষের সেবা করতে পারব। মৃত্যুর পরেও যে মানবতার কাজে লাগা যাবে, এটা জেনে প্রফুল্ল বোধ করছি।”


প্রথমেই জানাই আপনি যদি মরণোত্তর দেহদান ও প্রত্যঙ্গদানের জন্য অঙ্গীকার করতে চান তবে যোগাযোগ করতে পারেন।


1- গণদর্পণ

৪, ডি এল খান রোড, কর্পোরেশন ব্লিডিং, কলকাতা – ৭০০ ০২৫

দূরভাষ – (০৩৩) ২৪৫৪ ০৮৯১ / ২৪১৯ ১১৬৫

http://www.ganadarpanindia.in/index.php

ওয়েবসাইট এ গিয়ে প্লেজ ফর্ম পাবেন ডাউনলোড করে নিন পছন্দ মত ভাষায়। ফিলাপ করে ওদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে ওরাই আপনাকে একটি কার্ড পাঠিয়ে দেবে। গণদর্পণ কোন চক্ষু বা মৃতদেহ সংগ্রহ করে না। একমাত্র প্রত্যঙ্গদানের ক্ষেত্রে সহয়তা করে।

চাইলে অনলাইনের মাধ্যমেও এই কাজটা করতে পারেন। https://www.notto.gov.in

2- বাংলাদেশে যারা মরণোত্তর দেহদানে আগ্রহীঃ

জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন

১০৮ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

বাংলামটর, ঢাকা

ফোন: ০১৫৫২৩৫৮০১৮

ইমেইল:

janabigganfoundation@gmail.com

ayubhoss@yahoo.com

3- Department of Anatomy, N.R.S. Medical College, 138, A.J.C. Bose Road, Kolkata - 700 014 Phone No. (033) 2265-3214 (EXTN.- 383)।

কলকাতার এন.আর.এস মেডিক্যাল কলেজ-এর Department of Anatomy থেকেও এই Pledge Formটি (একই ফর্মের দুটি কপি) সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারেন।


4- চক্ষু দান এর জন্য

RIO Calcutta Medical College & Hospital Eye Bank.

9433085756 / 9007064831 / 033-22123767 / 033-22413853


5- বর্ধমান

Durgapur Blind Relief Society

C/o: SDO Office

City centre, Pin – 713 216

(0343) 2572698 / 9732066165


6- জলপাইগুড়ি

Alipurduar Lions Eye Hospital

Chowpathi. P.O – Alipurduar Dist- Jalpaiguri Pin – 736 121

(03224) 255938


7- হুগলি

Doyen Dishani

37, Hanseswari Road, Banshberia, Hooghly, Pin – (033) 26344555 / 26527555 / 9433084563 / 9433052503


8- দার্জিলিং

Siliguri Lions Eye Bank

Hillcart Road, P.O – Shiliguri, Dist – Darjeeling

2511004 / 2519793


কলকাতা থেকে দূরে যাঁরা থাকেন তাঁদের অনুরোধ করব মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আপনাদের নিকটবর্তী সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।


সূত্র-

1-সংশয় ডট কম/ মৃত্যুই শেষ কথা নয় ।

2- ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ফেসবুক পেজ ।

3- 13/05/2021 এর আনন্দবাজার পত্রিকা ।

4- মুক্তমনা ব্লগ।

বাঙালির, অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যৎ -অভিষেক দে
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:817 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দিনকয়েক আগেকার কথা। কিছু প্রয়োজনীয় কাজে গিয়েছিলাম আসানসোলে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা একটা চিরকুটে কয়েকটা জিনিসের নাম লিখে দিয়ে বলেছিল সময় পেলে আসানসোল বাজারে ঢুকে জিনিসগুলো কিনে আনতে। কাজ সেরে বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ বাজারে ঢুকে উক্ত জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ( অবশ্য এই অভিজ্ঞতা আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে)। এইখানে জানিয়ে রাখি আমার জন্ম এবং বেড়েওঠা আসানসোলে। বর্তমানে দুর্গাপুর শহরে আপাতত স্থায়ী ঠিকানা হলেও, জীবনের ২৯ টা বছর কাটিয়েছি এখানে। শহরটাকে হাতের তালুর মতন চিনি। এখানে অনেকেই আমাকে যেমন বেশ ভালোরকম চেনেন তেমন ভালোওবাসেন। 


যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আসানসোলে বাজারে একটা বহুপুরোনো মাড়োয়ারি ব্যক্তির দোকান রয়েছে। দোকানে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে বানানো বিভিন্ন পাঁপর, চিপস, বিউলিডাল বড়ি ইত্যাদি পাইকারি দরে বিক্রি হয়। দোকানে একজনই কর্মচারী, বাঙালি ( বয়স আন্দাজ প্রায় ২৪)। দোকানে কিছুটা ভীড় থাকায় দাঁড়াতেই হলো। মাড়োয়ারি ব্যক্তিটি তার কর্মচারীকে বারেবারে তাড়া দিচ্ছিল কারন আমাকে বাদ দিলে বাকি সবাই চরম ব্যস্ত যে। দোকানদার, বাঙালি ছেলেটির উদ্দ্যেশ্যে বলছে -"আরে বিট্টু, থোড়া হাত জলদি চালাও। আজ কুছ খায়াপিয়া নেহি ক্যায়া। ইতনা ঢিলা কাম করনে সে তুম মেরা দুকান মে হি তালা লগবা দোগে"। 


খুব খারাপ লাগছিল ছেলেটির এই দুর্দশা দেখে। খোঁজ নিলাম, মাত্র ৪৫০০ টাকা (যা আজকের মুদ্রাস্ফীতির বাজারে অপ্রতুল বলাই যায়) র জন্যে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ( মানে ১২ ঘন্টা) পরিশ্রম করছে এই বাঙালি ছেলে, বিট্টু। না, আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াই নি। যা কিনতে গিয়েছিলাম সেসব না কিনেই এগিয়েছি অন্য দোকানে। 


আজ এই প্রশ্নটা উঠে আসা খুবই প্রয়োজন যে, বাঙালিরা কি অথবা কেন ব্যাবসায় বিমুখ? বাঙালিদের ব্যাবসা প্রসঙ্গে, কবিগুরুর সমসাময়িক ১৮৬১ সালে জন্মেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাঙালিদের বুঝতে একটুও ভুল করেননি। তাই হয়তো “ অন্ন সমস্যা ও বাঙালির নিশ্চেষ্টতা ” প্রবন্ধ সমেত নিজের অনেক লেখাতেই সেই সুর স্পষ্ট শোনা গেছে। উনি লিখেছেন- 

“আলস্যের নিদ্রায় সুখের স্বপ্ন” দেখে, "বুদ্ধির অহংকারে অন্ধ হইয়া” জীবন সংগ্রামে ফাঁকি দেয়। ফলে “বাঙালি সকল দিকের সকল ক্ষেত্র হইতে পরাজিত হইয়া পশ্চাদপদ হইতেছে। মাড়োয়ারি, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা ব্যবসাবাণিজ্যের সকল ক্ষেত্র করতলগত করিতেছে, আর আমরা বাঙালিরা তাদের হিসাব লিখিয়া মাসমাহিনা লইয়া পরমানন্দে কলম পিষিতেছি। বাঙালি শ্রমজীবির দশাও কিছু ভাল নহে।” হিন্দু কেমিস্ট্রির লেখক, বাঙালিদের উদ্দ্যেশ্যে লিখেছেন- “আমাদের জীবনটা যেন দিনগত পাপক্ষয়। শুধু আলস্যের আরাম শয্যায় শয়ন করিয়া আমরা পদে পদে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা করিতেছি। আজ বাঙালির পরাজয় পদে পদে।” 


প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১০০ বছর আগে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তেমনই উনি লিখে গেছেন। তবে ওনার বক্তব্য নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালিদের বলেছেন অলস, কুঁড়ে কথাটা কিছুটা ঠিক আবার খানিকটা ভূলও। মাছেভাতে বাঙালিদের একটা বড় অংশ কিন্তু সত্যিই ব্যাবসা বিমুখ। তারা সরকারি (অথবা বে-সরকারি) চাকরিজীবী হয়েই বেঁচে থাকায় অপরিসীম আনন্দ পায়। একটা উদাহরণ দিই। সেটা ২০০৩ সালের ঘটনা। আমার পরিচিত একজন দিদির শ্বশুরের দোকান ছিল আসানসোল বাজারে একেবারে রাস্তার ওপর। দিদির জীবনসঙ্গীর একবার বেশকিছু টাকার প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক লোনের জন্য ঘুরেঘুরে নাজেহাল হয়ে শেষে দোতলা দোকানটাই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। আমার বাবা সেই জামাইবাবুকে অনেক বুঝিয়েছিল, দোকান বিক্রি না করে গোডাউন হিসবে ভাড়া দিতে ( দোকানটি ছিল শাড়ি, অন্তর্বাসের। ব্যাবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তো পুঁজি প্রয়োজন। আবার পুঁজি থাকলেও যে ব্যাবসা দারুন ভাবে এগিয়ে যাবে এটাও ভুল। লাভ-ক্ষতি নিয়েই ব্যাবসা। তাছাড়া জামাইবাবুদের দোকান সেভাবে চলছিলও না)। কিন্তু একদিন চুপিচুপি সেই দোকানটি একজন হিন্দিভাষী ব্যক্তির কাছে ২২ লক্ষ টাকাতে বিক্রি হয়ে গেলো। প্রিয় পাঠকবন্ধুরা, এখন একটিবার ভাবুন, ২০০৩ সালে যেটা ২২ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছিল আজ ২০২২ সালে সেই দোকানের দাম কতটা বৃদ্ধি পেতো? দোকানটি বিক্রি করে সেইটাকা জামাইবাবু কি কাজে ব্যবহার করেছিলেন জানা নেই, তবে বর্তমানে উনি একটি বে-সরকারি সংস্থার অফিসে সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ০৬টা পর্যন্ত কাজ করেন ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে। এইকারনেই কি প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন- “আমরা দোকান করিয়া ফেল মারি। কারণ সর্বপ্রকার কষ্ট সহ্য করিয়া কৃতিত্ব অর্জনের প্রয়াস আমাদের যুবক গণের মধ্যে দেখা যায় না।” 


"বাঙালি ব্যাবসায় বিমুখ অথবা বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হবে না" কথাগুলো আমি অন্তত মানিনা। আসলে এগুলো একপ্রকার অপপ্রচার এবং খুব সুকৌশলে আমাদের মননে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চালানো হয়েছে এবং হচ্ছেও। একসময় কলকাতা শহরজুড়ে বাঙালিদের দোকান ছিল চোখে পরার মতন। তাদের ব্যবসাও ছিল রমরমা। কিন্তু আজ সেসব অতীত। এখন পশ্চিমবঙ্গে মাড়োয়ারি, গুজরাটি কিংবা বিহার, উত্তরপ্রদশ থেকে আগত 'বেওসায়ীরা' তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করে ফুলেফেঁপে উঠলেও বাঙালিরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আটকে রয়েছে। বাঙালিদের একটা বড় অংশের আজ নিজের মাতৃভাষার বদলে হিন্দিপ্রীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধিও পাচ্ছে। ভারতীয় সংবিধান কোনো রাষ্ট্রভাষা না থাকলেও খুব কৌশলে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা বানানোর কাজ চলছে, চলবেও। দুঃখের বিষয় বাঙালিরাও এটা একপ্রকার প্রচার চালাচ্ছেন। আজ উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবার তাদের সন্তানদের নামীদামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তী করিয়ে অত্যাধুনিক বানানোর একটা প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে কারন " আমার সন্তানের বাংলাটা ঠিক আসেনা " জাতীয় কু-যুক্তিও শোনানো হচ্ছে। 


আরেকটি গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তরুণতুর্কী বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন হাতে অস্ত্র তুলে লড়াইয়ের ময়দানে, তখন কিছু বেইমান বাঙালি ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করতে ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসেব বলা যায়, মাস্টারদা সূর্যসেনের মাথার দাম যখন ব্রিটিশেরা ১০০০ টাকা ধার্য করে তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ব্রিটিশদের দেওয়া ৬০ টাকার চাকরি করতেন এবং মাস্টারদা কে ধরিয়ে দিতে বিশেষ ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যখন অসংখ্য তরুণ প্রাণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকালে ঝড়ে যাচ্ছিল তখন একদল বেনিয়ারা ব্রিটিশদের পদলেহন করে সুদের টাকা গুনে মুনাফা কামানোর দিকে বেশি নজর ছিল। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে অসহায় জনগণ যখন সামান্য ভাতের ফ্যানের জন্য হাহাকার করছে তখনও এই বেনিয়াদের দল অগুনতি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চালের কালোবাজারি করেছে এবং বলে গেছে 'বাঙালি লোগো সে বেওসা নেহি হোগা। উ লোগ মাছলিভাত খাকে গেহেরি নিন্দ মে যানে ওয়ালা বড়াহি আলসি কিসম কা জাতি হায়'।


পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের সুদিন কি সত্যিই ফিরেছে? ফিরলে আজ সেই বিট্টু অন্যের দোকানে ৪৫০০ টাকা রোজগারের জন্য এতো পরিশ্রম না করে হয়তো নিজস্ব দোকানে কোনো ব্যবসা করতো, নিদেনপক্ষে মুদিখানা। 


কয়েকমাস আগে বন্ধু সুপ্রিয়র সাথে হাওড়া গিয়েছিলাম দিল্লিগামী ট্রেন ধরবো বলে। হাওড়া ব্রিজের (রবীন্দ্রসেতু) ওপর দাঁড়িয়ে বন্ধুটি বলছিল - "ব্রিটিশদের আমরা যতই গাল পারি তাদের উগ্রতা ও ফ্যাসিস্ট আচরণের জন্য, কিন্তু এটা মানতেই হবে তারা নিজেদের প্রয়োজনে দেশটাকে খোলনলচে বদলেছিল অনেকটাই। এই যেমন হাওড়া ব্রিজের কথাই ধরা যাক। অসংখ্যা গাড়ি যানবাহনের ভার নিয়েও ব্রিজটা আজও কেমন সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ বর্তমানে কোনো ব্রিজের টেন্ডার ডাকা হলে সেটা অন্যরাজ্যের লোকেরা এসে বানাচ্ছে। এই বানানোতেও কোটিকোটি টাকার দুর্নীতি আর ব্রিজটাও তেমন টেকসই হয়না।উদাহরণ, বিবেকানন্দ সেতু।" 


বন্ধু সুপ্রিয়র কথাগুলো খুব ভুল নয়। আজ দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। এই রাজ্যের শ্রমিকেরা নিজেদের সংসারে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয় অথচ অন্যে রাজ্যের শ্রমিকেরা এখানে সুন্দর ভাবে কাজ করে অন্নসংস্থান করছে ( মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলের অনেক হিন্দু বাঙালি বা বাঙালি মুসলিমরা কাজের জন্যে ভীন রাজ্যে যায় না এটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না)। আজ কলকাতার বড়বাজার থেকে হাওড়া, ডানকুনি, রানিগঞ্জ, আসানসোল প্রায় সর্বত্র মাড়োয়ারি, গুজরাটি দের রমরমা ব্যাবসা এবং সেখান থেকে কোটিকোটি আয়। 


দিনেরশেষে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় যে, বাঙালিরা কি পারবে সেই হারানো দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে? অলস, কুঁড়ে ইত্যাদির তকমা পাওয়া মাছেভাতে বাঙালিরা কি পারবে ব্যাবসায়ী রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে? মাড়োয়ারি, গুজরাটিরা যেভাবে এই রাজ্যে শেকড়গেঁড়ে বসে কোটিকোটি টাকা ব্যাঙ্কে ভরছে, ঠিক তেমন কিছু কি বাঙালিরাও পারবে? 


লেখাটি শেষ করবো দেশের ডাক বইএ তরুণের স্বপ্ন প্রবন্ধে (পৃ. ৬-১০) সুভাষচন্দ্র বসুর একটি দারুন উক্তি দিয়ে যা উনি ১৯৩৮ সালে লিখেছিলেন। " অনেকে দুঃখ করে থাকেন, বাঙ্গালী মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া হলো না কেন? আমি কিন্তু প্রার্থনা করি, বাঙ্গালী যেন চিরকাল বাঙ্গালীই থাকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম্ম ভয়াবহঃ”। আমি এই উক্তিতে বিশ্বাস করি। বাঙ্গালীর পক্ষে স্বধর্ম্ম ত্যাগ করা আত্মহত্যার তুল্য পাপ।"

জানা-অজানা বিজ্ঞান -দেবব্রত দাস
Nov. 20, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:551 | likes:1 | share: 0 | comments:0

জানো কি বেনীমাধব? সাদা কাপড় ওয়াশ করার পর কেন নীল রঙ বা উজালা ব্যবহার করা? কাপড় কাচার পর ডিটারজেন্ট (প্রায় সব প্রকার ডিটারজেন্ট এ সালফেটেড কোকোনাট অয়েল মনোগ্লিসারাইড (Sulphated Coconut oil Monoglyceride-৩১.৫% অ্যানহাইড্রাস সোডিয়াম সালফেট (Anhydrous Sodium Sulphate - 65.৯%) এ সালফার (S)এবং জলে আইরন লবন (FeSO4) থাকার জন্য জামাকাপড়ে একটু হলদে ভাব তৈরি হয়ে থাকে, নীল হলো হলুদ বর্ণের পরিপূরক, দুটি বর্ণ মিশে সাদা বর্ণের সৃষ্টি হয় এবং উজ্জ্বলতা বাড়ে। এই কারণে উজালা বা ব্লু মেশানো হয়,


জানো কি বেণীমাধব, উচ্ছে বা করলা কেনো তেতো লাগে? করলা উচ্ছে এগুলো ফল জাতীয় সবজি। পাকলেও এর সব তেতো। কারণ এটা momordician গ্রুপের ফল, এই গ্রুপের আপেল, তরমুজ, স্কোয়াশ সব ই তেতো। কারণ এতে মোমোরডিসিন এবং কিউকারবিটাসিন biochemical থাকে, তার জন্য এই স্বাদ। তবে এলার্জি, শ্বাসকষ্ট, বাত ও ডায়াবেটিস নিরাময়ে momordicin দারুন কাজ করে।


মুলো খেলে পাদ হয় এই কথাটি কতটুকু সত্যি?

মূলার পাশাপাশি বাঁধাকপি পরিবারের সব সদস্যই অতিরিক্ত বাতকর্মের উদ্রেক করে। কারণ এগুলোতে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার থাকে যা মানুষের পরিপাকতন্ত্রে হজম হওয়া কষ্টসাধ্য । প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার পেটে গেলে বৃহদন্ত্র পর্যন্ত হজম না হয়ে চলে যায়। বৃহদন্ত্রে ফাইবারের হজম প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রচুর গ্যাস উৎপন্ন হয় । ফাইবার ছাড়াও মূলায় ফ্রুকট্যান নামক শুগার থাকে । এই শুগারকে হজম করতে উৎসেচক (Enzyme) লাগে সেটা মানুষের পাকস্থলিতে নেই । এটাকে হজম করতে গিয়ে যে কর্মযজ্ঞ হয় তা হজম না হলেও প্রচুর গ্যাস তৈরি করে । এই জন্য মূলা খেলে অতিরিক্ত বাতকর্ম হয় ।


 পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন?

পেঁয়াজে সালফারযুক্ত বিভিন্ন ধরণের যৌগ থাকে, এর মধ্যে একটি হল অ্যামিনো এসিড সালফোক্সাইড (amino acid sulfoxide)। পেঁয়াজ কাটলে এর কোষের ভেতরের অ্যালিনেজ (allinase) নামক এনজাইম বের হয়ে আসে, যা amino acid sulfoxides যৌগগুলোকে উদ্বায়ী সালফোনিক এসিড (sulfenic acid) এ পরিণত করে; যা চোখের জলের সংস্পর্শে আসামাত্র syn-propanethial-S-oxide নামক যৌগ তৈরী করে, এটিই চোখে জল আনার জন্য দায়ী। সহজ কথায়, চোখের জলের সংস্পর্শে মৃদু সালফিউরিক এসিড তৈরী হয়, তাই চোখ জ্বালাপোড়া করে।


এখানে উল্লেখ্য যে, জ্বালাপোড়া এর অনুভূতি কর্ণিয়ার উপরে থাকা free nerve ending (যেখানে অনেকগুলো স্নায়ু একত্রে এসে মিলিত হয়) এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক সনাক্ত করে থাকে, তারপর সিলিয়ারি নার্ড (cilliary (nerve) দিয়ে এই অনুভূতি বাহিত হয়ে প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভ (parasympathetic nerves) হয়ে ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড (lacrimal gland)-কে উত্তেজিত করে। ফলে চোখ দিয়ে জল পড়ে।


দুধ গরম হওয়ার পরে উপচে পড়ে যায় কেন?

দুধের উপাদানগুলো হলোঃ

> জল ( ৮৭% )

> প্রোটিন (৪%)

ল্যাক্টোজ বা দুধের চিনি(৫%)

> মিনারেল ও অন্যান্য উপাদান।

যখন দুধ গরম করা হয় তখন মিনারেল, প্রোটিন, ফ্যাট উচ্চ তাপে ভেঙে আলাদা হয়ে যায়। এগুলো দুধের চেয়ে হালকা, তাই উপরে ভেসে ওঠে। একেই আমরা দুধের সর বা ক্রিম বলি।

তো উচ্চ তাপে কিছু পরিমাণ জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। কিন্তু কিছু সময় পরে উপরে যে ক্রিমের আস্তরণ আছে সেটা ভেদ করে আর বাষ্প বের হতে পারে না। কারণ এ ক্রিমের ফ্যাট,মিনারেলের স্ফুটনাংক জল অপেক্ষা বেশি। তাই ওগুলো জলের মতো ফুটতে শুরু করে না। সুতরাং, দুধের জলীয় বাষ্প তার উপরের স্তর ভেদ করতে না পারায় আটকে যায়।যতই তাপ দেয়া হয় ততই জলীয় বাষ্প উপরে উঠে আর এ বাষ্পীভূত বুদবুদ উপরে চাপ দেয়।আরও গরম করা হয় তখন জলীয় বাষ্প দুধের উপরের স্তরকে ঠেলে উপরে তুলে দেয়। এর কারণে দুধের সর ও কিছু দুধ উপচে পড়ে যায়।

আক্রান্ত মুক্তচিন্তকরা -অভিষেক দে
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:8789 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ফ্ল্যাশব্যাক ১) দিনটা ছিল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই ফেব্রুয়ারী।মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালো দিন হিসেব আজও যা চিহ্নিত। এই দিনে জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল ধর্মের ধ্বজাধারী রক্ষকরা। বড় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় তাকে। শেষ কথা বলার সুযোগই তাঁকে দেওয়া হয়নি। একটা দন্ডের সাথে পেছনে হাত বেঁধে, জিহ্বায় একটা পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে ব্রুনো কোনোরকম শব্দ করতে না পারে। তারপর তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত‍্যা করেছিলো সেসময়ের ধর্ম যাজকরা। মৃত্যুর আগে কারাগারে আট বছর তাঁর উপর চলেছিল নির্মম অত্যাচার। ব্রুনোর অপরাধ, তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তাকারী। অন্ধের মতন কোনোকিছু না মেনে সবেতেই প্রশ্ন তুলতে ভালোবাসতেন। ১৫৯১ সালে তিনি ইতালি ফিরে আসার কিছুদিন পর জিওভাননি মচেনিগো নামক একজন ব্যক্তি ব্রুনোর বিরুদ্ধে ধর্ম ও ঈশ্বর বিরোধীতার অভিযোগ আনেন। ১৫৯২ সালের ২২ মে ব্রুনোকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে ভেনিশিয়ান ইনকুইজিশনের মুখোমুখি করা হয় (ইনকুইজিশন হলো রোমান ক্যাথলিক গির্জার একটি বিচার ব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম অবমাননাকারীদের বিচার করা হতো)। ব্রুনো খুবই দক্ষতার সাথে তাঁর বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন ও তাঁর বিরোধীতাকারীদের যুক্তি খণ্ডন করেন। বেশ কয়েক মাস ধরে জেরা চলার পর ১৫৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রুনোকে রোমে পাঠানো হয়। সাত বছর ধরে রোমে ব্রুনোর বিচারপর্ব চলতে থাকে। এসময়ে তাঁকে নোনা টাওয়ারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সেই মহা ঐতিহাসিক বিচারকাজের গুরত্বপূর্ণ কিছু নথি হারিয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগই সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল এবং ১৯৪০ সালে বিচারকাজের সেসময়ের একটি সার-সংক্ষেপ পাওয়া যায়। এতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলো ছিল- (১) ক্যাথোলিক ধর্মমত ও ধর্মীয় গুরুদের মতের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ (২) খ্রিস্টীয় ধর্মমত অনুসারে স্রষ্টার ত্রি-তত্ত্ববাদ, যীশুর মৃত্যু ও পরে আবার শিষ্যদের কাছে দেখা দেয়ার বিষয়গুলো বিশ্বাস না করা (৩) যীশু ও তাঁর মা মেরিকে যথাযথ সম্মান না করা (৪) এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়- এই ধারণা পোষণ করা। 


সেদিনের ধর্মযাজক আজ নেই। নেই সেখানে উপস্থিত সেইসব জনতারাও যারা ব্রুনোকে হত্যার সময় উল্লাসিত হয়েছিল। ব্রুনোকে তারা খুন করেছিল ঠিকই কিন্তু ব্রুনো মারা গিয়ে এই প্রশ্নটা রেখে গেলো যে, "মুক্তচিন্তকদের হত্যা করেও কি মুক্তচিন্তার গতিকে রোধ করা কি আদৌ সম্ভব?"


ফ্ল্যাশব্যাক ২) " সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক, প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানহীন, সেখান কোনো ধর্মগুরুর জীবনীপাঠও বন্ধ হোক। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্জন করুক, বৃদ্ধি পাক তাদের জ্ঞানের উন্মেষ, তারা হয়ে উঠুক মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানবতাবাদী "। 


ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ( Science and Rationalists’ Association of India)  দীর্ঘবছর ধরে ওপরের দাবীগুলোতে সরব। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব নয়। সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন- "স্বাধীনতা কেউ দেয় না, ছিনিয়ে নিতে হয়"। অনেকটা সেইরকম ব্যপার। 

স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তিবাদী সমিতির এই দাবীদাওয়া আজও মেনে নিতে পারেনি শিক্ষকসমাজের একাংশ এবং বেশকয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন। ২০০১ সাল থেকে যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে সরস্বতী পুজো ও নবী দিবস পালনকরা বন্ধ হোক। এইকাজ করতে গিয়ে প্রতিপদে বাঁধা এসেছে, মধুসূদন মাহাতোকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ফোনও এসেছে তবুও যুক্তিবাদী সমিতির সহযোদ্ধারা নিজেদের দাবী এবং লক্ষ্যে আজও অবিচল। সুভাষচন্দ্র বসুর একটি উক্তি এখনে স্মরণ করা যাক। উনি বলেছিলেন- "জীবনে সংগ্রাম আর ঝুঁকি না থাকলে জীবনে বেঁচে থাকাটাই ফিকে হয়ে যায়"। 


গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সামান্যতম হলেও আলোর দেখা পাওয়া গেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে "এইসময়" পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম- "বিশ্ববিদ্যালয় 'ধর্মনিরপেক্ষ', মিলল না সরস্বতী পুজো করার অনুমতি"। সরস্বতী পুজো আয়োজনের অনুমতি দিল না কেরালার এক বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীরা পুজো করতে চাওয়ায় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মনিরপেক্ষ, সেখানে পুজোর অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এরই পাশাপাশি বেশকয়েকটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে এসেছে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্তরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো বন্ধ করার খবর দিল্লির মোট ১০/১৫ টি খবরেরকাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রইলো কিছু লিংক -1) http://www.sabguru.com/yukthivadi-samiti-demands-to-stay-on-saraswati-puja-in-govt-schools/

2) http://www.matnews.in/national/11330


ফ্ল্যাশব্যাক ৩) ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ দিনটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলো একটি সংবিধানে উল্লেখিত 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে'। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ত্রিপুরার কমলপুর শাখার অন্যতম সংগঠক সহযোদ্ধা দুলাল ঘোষ, মদ্ভাগবদগীতা থেকে রেফারেন্স তুলে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। খুব স্বাভাবিকভাবে এটি ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি কট্টর ধার্মীক বা ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। তাই উন্মত্ত ধার্মীকদের দল চড়াও হয় দুলাল বাবুর বাড়ি। আসবাবপত্র ভাঙচুর থেকে দুলাল বাবু এবং তার পরিবারেকে হেনস্তা ও শারীরিক নিগ্রহ করে। এরপরে দুলাল ঘোষের পরিবার কমলপুর থানার অফিসার ইনিচার্জকে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ জানিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়, SDM- Kamalpur Dhalai, SDPO -Kamalpur Dhalai, DM-Dhalai Ambassa, SP- Dhalai Ambassa সহ বেশকয়েকটি যায়গায় ও মিডিয়ায়। উক্ত ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, ত্রিপুরা যুক্তিবাদ বিকাশ মঞ্চ, ত্রিপুরা বিজ্ঞান মঞ্চ সমেত অনেকগুলো সংগঠন। শোনা গেছে, পুলিশ প্রশাসনের অপদার্থতায় অপরাধীরা নাকি এখনও বুক ফুলিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। 


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন - (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার ( সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে এবং অবশ্যই উগ্রতাবিহীন) (৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, (৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। এবং ১৯৭৬-সালের ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে ' Secular ' শব্দটা যুক্ত হয়। ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধের ( Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে ' ধর্মনিরপেক্ষ ' ( Secular) শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে - "We The People Of India, having solemnly resolved to costitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;" অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি। আবার সংবিধান জানাচ্ছে, প্রতিটি নাগরিকদের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"। দুলাল বাবু সংবিধানকে সম্মানে করেন বলেই আর্টিকেল ৫১ এ(এইচ) পার্ট-৪এ কে স্মরণে রেখেই মদ্ভাগবদগীতা থেকে শুধু প্রশ্ন তুলেছিলেন যেটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কারন, একমাত্র মুক্তমনারা কোনোরকম অন্ধবিশ্বাসে বশ না হয়ে প্রশ্ন তোলেন, সঠিক প্রমাণভিত্তিক যুক্তি খোঁজেন অন্যদিকে সবকিছু বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়া ধার্মীকদের স্বভাব।  


সেদিন দুলাল ঘোষ সমেত অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, "চমকে,ধমকে, অস্ত্র দেখিয়ে কিংবা কোপ মেরে কি মুক্তচিন্তকদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা যায়?"


ফ্ল্যাশব্যাক ৪) সম্ভবত ২ ফেব্রুয়ারী ২০২২ থেকে হিন্দুধর্মের শাস্ত্র-গ্রন্থ থেকে তথ্য তুলে ধরে সরস্বতীপুজো সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন গবেষক, সুলেখক এবং দলিতদের ন্যায্য অধিকারের দাবীদাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী শরদিন্দু বিশ্বাস ওরফে শরদিন্দু উদ্দিপণ। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি র মতন উনিও দাবী জানিয়েছিলেন সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক ধর্মমুক্ত সেখানে সমস্তরকম  ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মগুরুদের জীবনী পাঠ বন্ধ হোক। এতে ধর্মানুভূতী আক্রান্ত হয় ধার্মীকদের। শাস্ত্রগ্রন্থর সত্য ( যা ধর্মবেত্তা কিংবা ব্রাহ্মণরা জানাতে চায় না) প্রকাশ পাওয়া দেখে ভীত হয়ে তারা কলকাতা সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চে অভিযোগ জানায় এবং নরেন্দ্রপুর থানায় এফআইআর করে। এরফলে ০৩/০২/২০২২ সকাল সাড়ে বারোটা নাগাদ নরেন্দ্রপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সুশোভন সরকারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ শরদিন্দু বাবুর বাড়ির দরজায় গিয়ে ডাকেন এবং দরজা খুলে দিলে শরদিন্দু বাবুকে ধাক্কা মেরে বিনা নোটিশে ওনার ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নেয় এবং ল্যাপটপ, বইপত্র ইত্যাদি ঘাটতে শুরু করেন। অবশেষে জোরপূর্বক তাঁকে নরেন্দ্রপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। 


ঐদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শরদিন্দু বাবুর অনুগামীরা ও শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুরা নরেন্দ্রপুর থানায় ধিরে লধিরে জড়ো হতে থাকেন এবং কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বড়বড় উকিল এসে থানার বড়বাবুকে প্রশ্ন করা শুরুকরলে অবশেষে ৬ ঘন্টা পর শরদিন্দু বাবুকে এফআইআর এর কপিতে সই করিয়ে থানা থেকে ছাড়া হয়। ওনার নামে আইপিসি ৫০৪, ৫০৫ ধারায় মামলা রুজু হয়। গত ০৭/০২/২০২২ তারিখে তিনি কোর্টে উঠলে তাঁকে জামিন দেয়া হয়। 


গত ০৮/০২/২০২২- এ, AISA, APDR, AIPWA, CPI(ML) লিবারেশন সহ বেশকয়েকটি গণসংগঠনের সদস্যরা নরেন্দ্রপুর থানায় গিয়েছিলো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে ওই অন্যায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে। কিন্তু 

কর্তব্যরত পুলিশ অফিসাররা বিক্ষোভকারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। শোনা গেছে ছাত্র সংগঠন AISA-র মহিলা কর্মীদের ওপর পুরুষ পুলিশরা অত্যাচারও নাকি করেছেন ( যেটা আআইনত দণ্ডনীয় অপরাধ)। এছাড়া সেদিনই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন দলের রাজ্য কমিটির নেতা মলয় তেওয়ারীসহ ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। এই ঘটনাগুলো প্রামাণ করে মুক্তচিন্তকদের ওপর এভাবেই আঘাত চলছে, চলবেও। 


খ্রিস্টজন্মের ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু, সিমেন্ডের মতো গ্রীক অনুসন্ধিৎসু পণ্ডিতেরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ, সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো ঘুরছে। এইকথাগুলো বলবার বিনিময়ে ধর্ম- বিরোধী, ঈশ্বর- বিরোধী, নাস্তিক মতবাদ প্রকাশের অপরাধে এঁদের বরণ করতে হয়েছিল অচিন্তনীয় নির্যাতন, সত্যের ওপর অসত্যের নির্যাতন, ধর্মের নির্যাতন। 

উক্ত মতকে ২০০০ বছর পরে পুস্তকাকারে তুলে ধরলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস। তাঁরই উত্তরসূরি হিসেবে এলেন জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি সহ অনেকেই। প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে — "সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীসহ গ্রহগুলো"।


বিগত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি মুক্তচিন্তকদের ওপর কট্টর ধার্মীকদের আক্রমণ। আমরা হারিয়েছি- অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নীলয় নীল), অনন্ত বিজয় দাস, ফয়সাল আফেরিন দীপন,

নাজিমুদ্দিন সামাদ, রাজিব হায়দার,শাফিউল ইসলাম, শাহজাহান বাচ্চু, রেজাউল করিম সিদ্দিকি, জুলহাজ মান্নান, মাহবুব রাব্বি তনয়, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মীর সানাউর রহমান, গোবিন্দ পানসারে, এম.এম.কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভলকার সহ অনেকে। কিন্তু এতো হত্যা করেও কি মুক্তচিন্তকদের অগ্রগমন রোধ করা গেছে কি? কট্টরপন্থী ধার্মীক বা মৌলবাদীদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম। 


পরিশেষে জানাই, যুক্তির বা সত্যের পথে অনেক কাঁটা বিছানো। তবুও আমরা চলেছি সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করেই। আজ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিচারে নাস্তিক /অধার্মিক / যুক্তিবাদীরা তৃতীয় স্থানে ( সূত্র- মনোরমা ইয়ারবুক ২০১৯। যাকে মান্যতা দেয় ওয়ার্ল্ড অ্যালম্যানাকও)। ২০১২ সালের 'উইন গ্যালপ গ্লোবাল ইনডেক্স অফ রিলিজিয়ন রিপোর্ট' অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছিল ঘোষিত নাস্তিক। এই হিসেবে ১৩০ কোটির ভারতে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষের জয় নিশ্চিত। তাদের দুর্বার গতিকে আটকানোর সাধ্য নেই কারোরই।

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নোত্তর


[হৃদয় মন্ডলকে এই প্রশ্নোত্তরের ভিডিওটির জন্য গ্রেফতার করা হয়, পরবর্তীতে মুক্তচিন্তকদের চাপে জামিন দিতে বাধ্য হয়]

মুন্সিগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের সাথে তাদের বিজ্ঞানের সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নোত্তরের একটি ভিডিও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে।  প্রায় ১৩ মিনিটের এই টেপটি ওই ক্লাসের ছাত্রদেরই রেকর্ড করা, যেটা পরে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। শিক্ষক ও ছাত্রের প্রশ্নোত্তরের পুরো ট্রান্সক্রিপটি আজ পড়লাম। এইটা যদি উদ্যেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে স্বপ্রনোদিত হয়ে জানার আগ্রহ থেকে হতো তাহলে এইটা হতে পারতো একটা উদাহরণীয় ছাত্র শিক্ষকের প্রশ্নোত্তর। 

আমি অনেকটা নিশ্চিত  করে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষকও এতটা ধৈর্যের সাথে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে এমনভাবে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না। আমি আরো হলপ করে বলতে পারি বাংলাদেশের খুব কম শিক্ষার্থীদের কপালেই এমন অসাধারণ বিজ্ঞানের শিক্ষক জুটেছে। কিন্তু এইখানে এমন ঘটনা ঘটেছে যা কোন সভ্য দেশে কল্পনাতীত। এমনকি ১০-২০ বছর আগের বাংলাদেশেও কল্পনাতীত। এখানে নতুন একটি ঘটনা ঘটে। দশম শ্রেণীর সেই ক্লাসের কোন এক ছাত্র গোপনে হৃদয় বণিকের এই বক্তব্য রেকর্ড করে। চিন্তা করে দেখুন কেমন মানের ছাত্র আমরা এখন পয়দা করছি যে আপন শিক্ষককে বিপদে ফেলতে ইচ্ছে করে শিক্ষককে প্রশ্ন করা হয় এবং উদ্যেশপ্রণোদিত ভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর রেকর্ড করা হয়। 

হৃদয় মন্ডলের সাথে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর পড়ে আমার মনে হয়েছে এই শিক্ষককে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষক হিসাবে ঘোষণা করা উচিত। অথচ যেই কারণে তার সেরা শিক্ষক হওয়ার কথা সেই কারণে সে নিগৃহীত হচ্ছে। নিচে প্রশ্নোত্তরের কথোপকোটনটি কাট & পেস্ট করলাম। যেটি পড়লে জানবেন যে শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে "প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ"  বই পড়তে উপদেশ দিচ্ছে। এই বইই আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। এই বই পড়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিজ্ঞান বিমুখ হচ্ছে। অথচ এই বইকে আমাদের বিজ্ঞানের বড় বড় শিক্ষকরাও প্রমোট করছে। এরা নিজেরাতো কূপমণ্ডূকতায় ভুগছেই সাথে আমাদের আগামী প্রজন্মকে অন্ধকারে ধাবিত করছে। 

"[00:00]

স্যার: কেউ দেখেছে? কোন কিছুইতো কেউ দেখেনি। এটা তারা বিশ্বাসের উপর রেখেছে। তোমরা যখন বিজ্ঞান আরো পড়বে তখন দেখবে বিজ্ঞানে আরো কতকিছু আসছে। আসলে আমরা বুঝে উঠতে পারি না বা চাই না সত্য জানতে। দেখো উন্নত বিশ্ব ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে। আর আমরা ধর্মান্ধ হচ্ছি।

[00:35]

ছাত্র: বহু ধরনের কথা ও থিওরিতো ধর্ম থেকেই এসেছে। বিজ্ঞানীরা ধর্ম থেকে এসব আবিস্কার খুঁজে পেয়েছেন।

স্যার: কোন কথা ধর্ম থেকে নেয়া হয়নি। কোনভাবেই না। বরং বিজ্ঞান থেকে নিয়ে ধর্ম চলছে, ধর্ম বানানো হয়েছে।

[01:10]

ছাত্র: আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) বহু বিজ্ঞানের সকল উৎস দিয়ে গেছেন। সাড়ে চার হাজার বছর আগে আমাদের হযরত মোহাম্মদ (স:) এসব বিজ্ঞানের কথা বলে গেছেন।

স্যার: সাড়ে চার হাজার বছর আগে কীভাবে? হযরত মোহাম্মদ তো ছিলেন সাড়ে  চৌদ্দশো বছর আগে। বিজ্ঞানীরা আবিস্কার শুরু করেছেন বহু আগে থেকে। মানে হযরত মোহাম্মদের আমল থেকেই বিজ্ঞান শুরু হয়েছে এমনটা তো নয়। 

[01:30]

ছাত্র: হ্যাঁ স্যার, হযরত মোহাম্মদ (স:) এর পূর্বে যারা বলে গিয়েছেন তাদেরটায় কোন যুক্তি পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) যা বলে গেছেন তা সব যুক্তিপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে৷

স্যার: হযরত মোহাম্মদ এমন কী  বলে গেছেন যার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা তার কাছ থেকেই পেয়েছেন? এমন কোন আবিস্কার ছিলো যা বিজ্ঞানীরা আগে করতে পারেননি?

এটা বিজ্ঞানের ক্লাস, ধর্মের ক্লাস নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। আর ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস।

[02:00]

ছাত্র: স্যার আছে, অনেক প্রমাণ আছে যে ধর্মই বিজ্ঞানসম্মত।

স্যার: ধর্মের কোন প্রমাণ নেই। শেষমেশ ধর্মের ব্যখ্যা কোথায় যায় জানো? শেষমেশ ওই ঈশ্বর দেখে, ঈশ্বর সমাধান দেবেন, পরকালে বিচার হবে। এসব বিশ্বাসের বিষয়। কোন প্রমাণ নেই৷

[02:15]

ছাত্র: একটি বই আছে, পড়বেন। নাম হচ্ছে ‘থিওরি অব এভরিথিং’। পাবেন ডিমের ভেতর কুসুম কীভাবে আছে তা আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছে৷ 

স্যার: আমি সব পড়েছি। না পড়লে কি বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষক এমনিই হয়েছি? এগুলো সব গোঁজামিল দাবী। ওই বইয়ে এমন কিছুই লেখা নেই। বস্তুত ধর্ম মানুষের লেখা৷ সব ধর্ম মানুষের লেখা।

[02:45]

ছাত্র: স্যার বিজ্ঞানও তো মানুষের লেখা৷ 

স্যার: হ্যাঁ বিজ্ঞান অবশ্যই মানুষের লেখা। 

[02:55]

ছাত্র: স্যার, ধর্মের প্রমাণ আছে।

স্যার: ধর্মের কী প্রমাণ আছে আমাকে দেখাও।  

[02:04]

ছাত্র: কী যে বলেন স্যার! সারা বিশ্বে মুসলিমদের নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সবাই দেখে ইসলামই সত্য। এটাই সত্য ধর্ম আর বাকি সব মিথ্যা। এটা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে।

স্যার: কোরআন যদি বিজ্ঞানের উৎস হয়ে থাকে তবে দেখাও কোরআন পড়ে কতজন বিজ্ঞানী হয়েছেন? পৃথিবীর ৯০% বিজ্ঞানী খ্রিষ্টান বা খ্রিষ্টান পরিবার থেকে আসা। 

[03:24]

ছাত্র: স্যার আমরা যেটাকে ধর্ম বলছি, এটাকে যদি আমরা [বিজ্ঞানের] দিকে নিয়ে যাই তবে সেটাই বিজ্ঞান। আর যদি বিজ্ঞানকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাই তবে ওটাই বিজ্ঞান। মূল কথা হচ্ছে দুটোই এক জিনিস।

স্যার: এই যে খ্রিষ্টানরা এতোকিছু আবিস্কার করে, তাদের ধর্মের নিয়ম সেভাবে কেউই মানে না। তারা কি ধর্ম ব্যবসা করতে পারে না? অবশ্যই পারে। তারা ধর্ম ব্যবসা করছে কি? তারা ধর্মের ধারেকাছেও নেই। তারা আছে আবিস্কার নিয়ে৷ এই মুসলমানরা এগিয়ে যেতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকতে হবে৷ ধর্মান্ধতা বাড়লে সেটা সম্ভব নয়৷ এই চৌদ্দ শত বছর আগে ইসলাম এসেছে। বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ বছরে৷ তাহলে এতোদিন হুজুররা কী করেছেন? কী আবিস্কার করেছেন তারা? 

[04:40]

ছাত্র: শুরু থেকেই হুজুররা যা বলতেন তাই বিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেয়া হতো। 

স্যার: তোমাদের হুজুররা বিজ্ঞানের কী পড়েছেন? কী জানেন? তারাতো বিজ্ঞান পড়েইনি সে অর্থে। এই যে ডারউইনের কথা বললাম, ডারউইন কি ধর্ম পড়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন? 

[05:08]

ছাত্র: স্যার, ডারউইন যে ধর্ম পুস্তক পড়েনি তার প্রমাণ কী স্যার? 

স্যার: আরেহ ধর্ম পুস্তক পড়েই না ওরা বেশিরভাগ।

[05:10]

ছাত্র: স্যার, নাস্তিক ঠিক আছে। কিন্তু ওরা ধর্মের পুস্তক পড়েই এসব আবিস্কার করেছে। ধর্মের প্রমাণ পেয়েছে ওরা। 

স্যার: আরেহ আবিস্কারগুলো ধর্ম পুস্তক থেকে আসেইনি। কোন সুরা কোন হাদিসে আছে আবিস্কারের কথা? আবিস্কারের সূত্র? ধর্মটাতো কাল্পনিক বিশ্বাস। বাস্তবতার সাথে ওর সম্পর্ক কী? হ্যাঁ স্রষ্টা আছেই। স্রষ্টা না থাকলে গাছপালা কোথা থেকে এলো? এই গাছপালাগুলো তো মানুষ সৃষ্টি করেনি। মাটি মানুষ তৈরি করতে পারে না। মায়ের পেটে বাচ্চা মানুষ তৈরি করতে পারে না, ডিম থেকে বাচ্চা হওয়া। পাওয়ারতো থাকতে পারে। পাওয়ার থাকলে সেটা কার? সেটাই আল্লাহ, সেটাই ঈশ্বর। এই যে হযরত মোহাম্মদ। এরা কী? এরা হইলো মহাপুরুষ। এরা কেউ ঈশ্বর নন। 

[06:15]

ছাত্র: এরা আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন।

স্যার: নৈতিক জ্ঞান হয়ত। ধর্ম মানুষকে জীবনযাপন এর কিছু নিয়ম বলে দেয়। মানুষ সেটা পালন করে। এর বাহিরে কি কিছু নেই? অবশ্যই ধর্ম পুস্তকের বাহিরে অনেক কিছুই আছে৷ ধর্ম এসেছেই মানুষকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য। আর কোন কিছুর জন্য নয়।

এই যে স্রষ্টা আছে বলা হয়, আমরাতো দেখিনি। যে জিনিস দেখিনি সে জিনিস নিয়ে মারামারি কাটাকাটির কোন মানে আছে? তোমার বিশ্বাস তোমার বিশ্বাসের জায়গাতেই রাখো। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ সাপেক্ষ। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়৷ আর ধর্মে অন্ধ হলে যা হয়, এই গরমে জোব্বা পরে থাকে। এটাতো বিজ্ঞানসম্মত নয়৷

এই যে তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাস হয়ে বাতি জ্বলে এটা বিজ্ঞান। এই যে A+B হোলস্কয়ারের সূত্র, এগুলো হিসেব করে মেলানো। এটাই বিজ্ঞান যা প্রমাণ সাপেক্ষ। এগুলো কি ধর্মগ্রন্থে আছে? আমরা অনেক সময় বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে মিলাই যা ঠিক নয়। হ্যাঁ ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল রাখে। বিজ্ঞান আলাদা কথা। বিজ্ঞান বিজ্ঞানই।

[08:27]

ছাত্র: ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ বইটা পইড়েন স্যার। গুগল প্লে স্টোরে পাবেন।

স্যার: আমি পড়েছি। প্রতিনিয়ত আমি বিজ্ঞানের বই পড়ি। এসব গোঁজামিলের বইও আমার পড়া আছে। ওই  বই থেকে বিজ্ঞান শিখতে হবেনা আমার৷ এই যে মুসলমানরা মুসলমানের মত ধর্ম প্রচার করে, হিন্দুরা হিন্দুদের মত আর খ্রিষ্টানরা তাদের মত করেই ধর্মের ব্যখ্যা করে। এই জাত আর ধর্ম নিয়েই দ্বন্দ্ব। 

[09:00]

ছাত্র: আমরা যদি বলি, ধর্মের বিভিন্ন জিনিস যুক্ত করে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ক্রেডিট নিচ্ছে?

স্যার: আরেহ বিজ্ঞান তো প্রমাণ দিয়েই আসছে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কী? নেয়া দেয়ার প্রয়োজন কেন আসবে? বিজ্ঞান তো কোন বিশ্বাস নয়।

[09:12]

ছাত্র: আমরা যদি ১৪০০ বছর পেছনে যেতে পারতাম তবে তো আমরা দেখতেই পেতাম আমদের সামনে সব প্রমাণ চলে আসতো।

স্যার: ধর্ম পুস্তক ১৪০০ বছর আগের লেখা৷ তার আগে কোথায় ছিলো? এর আগে মানুষ ছিল না? সভ্যতা ছিল না? তবে?

[09:26]

ছাত্র: কোরানের আগেও ৩ টি বই ছিলো। 

স্যার: যবুর ছিলো, ইঞ্জিল তো ২৫০০ বছর আগের। আর বৌদ্ধদের ছিলো। আমাদের হিন্দু ধর্মের বেদ ছিলো বড়জোর সাত হাজার বছর আগের। তাতে লাভ কী ? মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে। তখন এসব পুস্তক কোথায় ছিলো? তাহলে? এখন আমরা যতটুকু পাই সেটুকু নিয়েই ধর্মের কথা বলি৷ আমরা এখন ধর্ম নিয়ে গ্যাঞ্জাম করি! কেন করি? আমরা গ্যাঞ্জাম করব না। শিখব, জানব। কোনপ্রকার ঝামেলা করব না ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন মানে নেই। জিনিসটা হচ্ছে তোমরা বুঝে কাজ করবে৷ ধর্ম একটা কথা বললেই ঝাঁপিয়ে পড়বে না। ধর্ম বলল কান নিয়েছে চিলে আর চিলের পেছনে দৌড়াতে হবে ব্যপারটা এমন নয়। 

হনুমান নাকি সূর্যটাকে কানের ভেতর রেখেছে। আমাদের হিন্দু ধর্মের যারা বয়স্ক তারা খুব বিশ্বাস করে যে এই হনুমানের কানের মধ্যে সূর্য থাকে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে হনুমান যদি কানের ভেতর সূর্য রাখে তবে পৃথিবীর ১৩ লক্ষ গুন বড় হচ্ছে সূর্য। এই পৃথিবী সূর্যের ১৩ লক্ষ গুন ছোট! এই ছোট পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে হনুমান কিভাবে তার কানের ভেতর সূর্য রাখে?

এই রকম গাঁজাখুরি গল্প যারা করে তাদের গল্প বিশ্বাস করতেই হবে? কেন আমরা এসব বিশ্বাস করব? কমবেশি সব ধর্মের মধ্যেই এরকম গাঁজাখুরি গল্প আছে। আমরা সচেতন থাকবো। এসব বলতে গেলেই বিতর্ক। যাক তোমাদের পড়ানো শুরু করি। এসব বিতর্কে যেয়ে লাভ নেই।

ধর্মের ভালো দিকও আছে খারাপ দিকও আছে। ভালো না থাকলে খারাপ এলো কোথা থেকে? এই যে দিন দেখতে পাচ্ছো, এই দিন কীভাবে এলো? রাত আছে বলেই তো আমরা দিন বলতে পারি।

এই যে কালো ব্যাগ, এটা কালো তুমি বুঝলে কীভাবে? এই যে লাল ব্যাগ, তোমরা সবাই কেন লাল দেখতে পাচ্ছো?

এই যে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এরকমই স্পষ্ট বিষয়। বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তবতা।

এই গাঁজাখুরি গল্প করে, এসব কারা করে? খারাপ মানুষেরা করে।

এই গাঁজাখুরি গল্প খারাপ মানুষগুলো করে তাদের ব্যবসা টেকানোর জন্য।

এই যে হনুমানের গল্প, হিন্দুদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করে তারা কিন্তু এসব বিশ্বাস করে না। যারা মূর্খ লোক আছে তারাই এসব বিশ্বাস করে। কিছু লোক আছে ঘুরেফিরে খায়। সারাদিন কাজ করে না। এরে ওরে এটা সেটা বলে বাটপারি করে অন্ন যোগায়। ওরাই এই মূর্খদের শিষ্য বানায়। এরপর বসে বসে খায়। তারাই বলে হনুমানের কানে সূর্য আছে আর এসব শুনে মূর্খ লোকেরা তাদের টাকাপয়সা দেয়।

এই যে তোমরা লেখাপড়া শিখেছো, তোমরা ধর্মের পুস্তক পড়বে। অন্যের কথা শুনে লাফাবে কেন? তোমরা তো মূর্খ নও।

[12:50]

ছাত্র: স্যার আমরা তো কোরআন পড়েই এসব পাচ্ছি। তাছাড়া ওয়াজ শুনি, ওয়াজ শুনেও অনেক কিছুই শিখছি।

স্যার: ওয়াজ যে শোন, ওয়াজে কত ধরনের কথাই বকে, ভেবে দেখেছো? মানুষকে হত্যা করতে বলে, বাজে কথা বলে। হিংসা ছড়ানো হয় খেয়াল করেছো? শুনে ধর্ম মানতে হবে কেন? নিজে পড়েই ধর্ম মানো।"

বাবা রামদেব:‌ আসলে এক ধান্দাবাজ গণশত্রু -প্রিয়াম সেনগুপ্ত
Nov. 20, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:283 | likes:0 | share: 1 | comments:0

‘আমাকে কারও বাবা গ্রেফতার করতে পারবে না’।‌

উপরের উক্তিটি আইন–আদালত রয়েছে, এমন একটি দেশের নাগরিকের। দেশটির নাম ভারতবর্ষ। নাগরিকটির নাম বাবা রামদেব। সত্যিই কি কোনও নাগরিক, যিনি দিনের পর দিন নানা অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেও, নুইসেন্স ছড়িয়েও গ্রেফতারি এড়াতে পারেন? আইন বলছে পারে না। বাস্তব কিন্তু বলছে অন্য কথা। বাবা রামদেব এটা করেছেন এবং কোনও দিন গ্রেফতারও হননি। কারণ রাজনীতিকদের সঙ্গে রামদেবের যোগাযোগ গভীর। কীভাবে? সেই উদাহরণ একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে, কেন এই লোকটাকে নিয়ে একটু মাথা ঘামানো দরকার হয়ে পড়ল, সেটা বলি।

করোনার সেকেন্ড ওয়েভেও জান কবুল করে লড়ছেন আমাদের দেশের চিকিৎসকরা। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের নাগাড়ে ‘‌মক’‌ করে চলেছেন এই ভণ্ড বাবাজিটি। কয়েকদিন আগে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে ‘‌স্টুপিড সায়েন্স’‌ বলা এই বাবাজিটির দাবি, তাঁর কোনও প্রথাগত ডিগ্রি নেই। কিন্তু চিকিৎসক হতে গেলে নাকি তাঁর মতো চিকিৎসকই হওয়া উচিৎ। কোভিডের বিরুদ্ধে ‘‌ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র’‌ হিসেবে লড়তে গিয়ে আমাদের দেশে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় শ’‌চারেক চিকিৎসক। তাঁদের মৃত্যুকে বিদ্রুপ করে রামদেব বলেছেন, যাঁরা অ্যালোপ্যাথির চর্চা করেও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারেন না, তাঁরা অন্যের প্রাণ কী বাঁচাবেন?

এই কঠিন সময়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাণপাত করে লড়ছেন। সেই সময়ে বাবা রামদেবের এই মন্তব্যে চিকিৎসক সমাজের রুষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। খুব প্রত্যাশিতভাবেই তাঁরা রামদেবের গ্রেফতারির দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরে রামদেব বলেছেন, ‘আমাকে কারও বাবা গ্রেফতার করতে পারবে না’।

এই প্রথম নয়, এর আগেও এই লোকটা নাগাড়ে আজেবাজে কথা বলে গেছে। তবু রাজনৈতিক নেতানেত্রী দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরে পার পেয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার উদাহরণ পরে দেবো। আগে লোকটার আজেবাজে কথার কয়েকটার নমুনা দিই।

১) কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভে যখন অক্সিজেনের সংকটে একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছেন, তখন বাবা রামদেবের উক্তি, ‘অক্সিজেনের তো কোনও কমতি নেই। ভগবান তো সারা ব্রহ্মাণ্ডে অক্সিজেন ভরে দিয়েছেন।’‌

২)‌ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের রাক্ষস বলেছিলেন রামদেব। 

 এবং

কেন অ্যালোপ্যাথির ওপরে বাবা রামদেবের এই তাচ্ছিল্য? কারণ, উনি স্পষ্টতই অ্যালোপ্যাথিক ওষুধকে নিজের ব্যবসার কম্পিটিটর মনে করেন। জানিয়ে রাখা যাক, পতঞ্জলিকে সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ দেয় ঘি। দু’‌নম্বরে আছে আয়ুর্বেদিক ওষুধ। যে প্রোডাক্টের জন্য আপনার কোম্পানি বিখ্যাত হল, সেটা যদি রেভিনিউ জেনারেট করার লিস্টে দু’‌নম্বরে থাকে— তাহলে কারই বা ভাল লাগবে বলুন?

৩) ঠিক সেই কারণেই বাবা রামদেবের আর একটা দাবি হল, করোনায় অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার জন্যই নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন।

৪)‌ স্কুপহুপের প্রতিবেদন অনুসারে, বাবা রামদেব বলেছিলেন, ‘বাচ্চে পয়দে করনা বহোত বাহাদুরি কা কাম হ্যায়’‌। শুধু তাই নয়, তিনি দাবি করেছিলেন, এমন ওষুধ তিনি বানিয়েছেন, যা শুধু পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে। ড্রাগ্‌স অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ অ্যাক্ট (‌১৯৫৪)‌–এ রামদেবের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়েছে কিংবা তাঁকে কোনও শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। 

৫)‌ আমিষ খাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ। মলও পায়ু থেকে বেরয়, ডিমও মুরগির পায়ু থেকে বেরয়। তাই ডিম হল মুরগির মল।

‌৬)‌ লোকটা সাধু–ফাধু নয়। নিখাদ ব্যবসায়ী। জরিবুটির থেকে জিন্‌স— সব বিক্রি করেছে মার্কেটের হাওয়া বুঝে। কয়েকদিন আগে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী মহিলারা কেন ফাটা জিন্‌স পরবেন বলে আপত্তি তুলেছিলেন। বাবা রামদেব তারও আগে বাজারে নিয়ে এসেছিলে ‘‌সংস্কারী জিন্‌স’‌। 

এবং

শুধু তাই নয়, প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যবসাও রামদেব করেন।

৭)‌ মেহুল চোকসির মতো বাবা রামদেবও ঋণ নিয়ে ব্যাঙ্কের টাকা ফেরত দেননি এখনও। আরটিআই কর্মী সাকেত গোখলের করা একটি আরটিআই–তে একথা জানিয়েছিল খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক‌!‌ অথচ আজও লোকটা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

৮)‌ আজ তককে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে বাবা রামদেব দাবি করেছিলেন, যে ব্যক্তি ১ মিনিট নিজের শ্বাস আটকে রাখতে পারে, ধরে নিতে হবে, তার শরীরে করোনা ভাইরাস নেই। শুধু তাই নয়, নাকে সর্ষের তেল ঢাললে নাকি করোনা আক্রমণ করতে পারে না। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি?

৯)‌ কেউ যোগব্যায়াম করলে তার মধ্যে সন্ত্রাসবাদী হওয়ার ইচ্ছা জাগবে না। সিরিয়াসলি?

১০)‌ রামদেবের অন্তত ২৫টি বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিজ্ঞাপনী বিধি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে। তারপরেও রমরমিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন রামদেব।

১১)‌ বাবা রামদেবের বিরুদ্ধে এর আগেও এফআইআর হয়েছিল। কেন? বেঙ্গালুরু মিরর জানাচ্ছে, ‘Ramdev, who had said that he would have beheaded lakhs of people for not chanting 'Bharat Mata ki Jai’।

১২)‌ সমকামিতাকে বাবা রামদেব একটা রোগ বলে মনে করেন। এবং এটাও দাবি করেন, তাঁর কাছে যোগভ্যাস করলে সমকামিতা ‘‌সেরে’‌ যায়। 

১৩)‌ বাবা রামদেব মনে করেন, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ বলেই তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি।


এত ভাট, অনৈতিক কাজ, অবৈজ্ঞানিক দাবিক পরেও আজ অবধি রামদেবের একটি চুলও কেউ ছিঁড়তে পেরেছে বলে জানা নেই। এতকিছুর পরেও রামদেব সগর্বে হুংকার দিতে পারেন, ‘কারও বাবা আমাকে গ্রেফতার করতে পারবে না।’‌ কেন? উত্তরটা খুব সহজ। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গা মাখামাখি। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সঙ্গে রামদের সখ্য কতটা? এক এক করে দেখা যাক।

১৪)‌ বেঙ্গালুরু পুলিস রামদেবের বিতর্কিত মন্তব্যের পর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ অমিত শাহ। বলেছিলেন, নিজের মনের কথা বলার অধিকার বাবা রামদেবের আছে। এবার বুঝতে পারছেন, কেন রামদেব হুংকার দিতে পারেন, কারও বাবা আমাকে গ্রেফতার করতে পারবে না।

১৫)‌ রামদেবও অকৃতজ্ঞ নন। তিনিও অমিত শাহের সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন

১৬)‌ অমিত শাহ মাখন পাবেন আর নরেন্দ্র মোদি বঞ্চিত হবেন, তা তো আর হয় না। সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদি ‘‌রাষ্ট্রঋষি’‌ উপাধি দেয় রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হাতে রাখতে পারলে কার বুকের পাটা আছে রামদেবকে গ্রেফতার করবে?

১৭)‌ দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নিতিন গড়কড়ি এবং হর্ষবর্ধন (‌যিনি কি না খোদ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী)‌ উপস্থিতিতে রামদেব দাবি করেছিলেন, তাঁর বানানো ওষুধ ‘‌করোনিল’‌ নাকি ডব্লিউএইচও–র ছাড়পত্র পেয়েছে। সত্যিটা হল, ‘করোনিল’‌ কোনও দিন এই ছাড়পত্র পায়নি।

এবং 

দাবি করেছিলেন, করোনা সারাতে ১০০ শতাংশ কার্যকরী তাঁর ‘‌করোনিল’‌।

১৮)‌ পরে অবশ্য ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে রামদেব দাবি করেছিলেন, তিনি নাকি কোনওদিন করোনিলকে করোনা সারাতে পারে বলে দাবিই করেননি।

১৯)‌ তারপরেও সম্প্রতি হরিয়ানা সরকার সে রাজ্যের করোনা রোগীদের ‘‌করোনিল’‌ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ‘‌ওষুধ’‌ রোগীদের দেওয়া হবে নিখরচায়। দাম দেবে হরিয়ানা সরকার। দামের টাকা আসবে রাজ্যবাসীর ট্যাক্সের টাকায়। অর্থাৎ, যে ওষুধকে প্রস্তুতকারকরাই রোগের ওষুধ বলে স্বীকার করছেন না, সেটা সরকার দিয়ে দিচ্ছে। পকেট ভরবে রামদেবের। কাটমানির লোভ ছাড়া এই প্রস্তাব পাস হয়? আঁতাতটা বুঝতে পারছেন?

এবং 

এই হরিয়ানা সরকারই রামদেবকে ‘‌ক্যাবিনেট স্টেটাস’‌ দিতে চেয়েছিল।

২০)‌ শুধু হরিয়ানা নয়। আঁতাত রয়েছে মধ্যপ্রদেশেও। ২০১৭ সালে মধ্যপ্রদেশে যখন কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল, মন্দসৌরে পাঁচ কৃষক মারা যান পুলিসের গুলিতে। সেই সময় মধ্যপ্রদেশের কৃষিমন্ত্রী এবং ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় সহসভাপতি রাধামোহন সিং ব্যস্ত ছিলেন বাবা রামদেবের সঙ্গে মঞ্চে যোগব্যায়াম সভা আয়োজন করতে। সাংবাদিকরা কৃষকের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন করায় রাধামোহনের জবাব ছিল, ‘যোগব্যায়াম করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’‌

২১)‌ মহারাষ্ট্রে বাজারের দরের হাফ দরে ৪০০ একর জমি পেয়েছিলেন রামদেব। মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় তখন ফড়নবিশের বিজেপি সরকার। শুধু কম দামে জমি? আর কী কী দেওয়া হয়েছিল রামদেবকে? নিউজক্লিকের প্রতিবেদন কয়েকটা বিস্ফোরক তথ্য জানাচ্ছে।

ক)‌ These concessions include waiving stamp duty, recompensing the GST that Patanjali would have to pay, and reducing Rs 1 per unit in electricity charges, as the project comes under the MSME category.

খ)‌ Since Bharatiya Janata Party came to power, Ramdev's company has received discounts worth more than $46 million for land acquisitions in states controlled by the BJP, according to Reuters. It has also gained access to a few pieces of land free of charge, says the report.

২২)‌ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আয়ুর্বেদের ওপরে মানুষের যে আস্থা, সেটাকে মূলধন করে রামদেবের মতো মানুষদের ব্যবসা কতটা লাভজনক? ২০১৭ সালের একটা রিপোর্ট অনুসারে, বাবা রামদেবের পতঞ্জলি ভারতের ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং এফএমসিজি হয়ে উঠেছে।

ব্যবসা করুন। তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু যে চিকিৎসকরা এই কোভিডের সময়ে প্রাণপাত করে লড়ছেন, তাঁদের কেন রাক্ষস বলে অসম্মান করতে হবে। কেন অ্যালোপ্যাথিকে ‘‌স্টুপিড সায়েন্স’‌ বলতে হবে? কেন বিভ্রান্ত করে দেশের সাধারণ মানুষকে ঠেলে দেওয়া হবে মৃত্যুর দিকে?

এতগুলো প্রশ্নের একটাই উত্তর— ‘‌গন্দা হ্যায় পর ধান্দা হ্যায় ইয়ে।’‌ আর এই ধান্দার শরিক আমাদের রাজনীতিকরাও, যাঁদের স্নেহের হাত মাথার ওপরে আছে বলেই রামদেবের মতো লোক দেশের আইন–আদালতকে ফুৎকারে উড়িয়ে বলতে পারে, ‘কারও বাবা আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারবে না।’‌

সেই হিসেবে রামদেব নামক লোকটা নির্লজ্জ ধান্দাবাজ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।যিনি এই ছবির মতোই আমাদের দেশের আইন–আদালতের দিকে তাকিয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে বিদ্রুপের হাসি হেসে যাচ্ছেন,


সাপোর্টিং লিংক (‌উদাহরণের ক্রম অনুসারে)‌

১) ‌https://in.mashable.com/culture/22191/watch-ramdev-baba-make-light-of-covid-19-patients-struggle-for-oxygen-and-try-not-to-slap-the-screen

২)‌ https://www.newindianexpress.com/nation/2021/may/27/up-bjp-mlabacks-ramdev-over-remarks-on-allopathic-medicine-calls-doctors-rakshas-2308391.html

এবং

https://www.scoopwhoop.com/these-5-products-are-patanjalis-most-popular-contribute-the-maximum-to-its-revenue/?ref=?ref=page_search

৩)‌ https://www.thequint.com/news/webqoof/baba-ramdev-covid-misinformation-vaccine-coronavirus


৪) https://www.scoopwhoop.com/news/opposition-rajya-sabha-baba-ramdev-male-child/?ref=?ref=page_search


৫) https://www.oneindia.com/2008/02/02/non-veg-food-is-injurious-to-health-baba-ramdev-1202057971.html


৬) https://www.youtube.com/watch?v=nQGgZ-D7n7Y


এবং

https://www.scoopwhoop.com/now-baba-ramdev-launches-his-own-private-security-firm/?ref=?ref=page_search


৭) https://www.businessinsider.in/india/news/indian-banks-might-never-recover-68607-crore-of-bad-loans-says-rti-data/articleshow/75419516.cms

৮) https://www.indiatoday.in/india/story/e-agenda-aajtak-yoga-guru-ramdev-coronavirus-patient-hold-breath-pandemic-1670920-2020-04-25

৯)‌ https://zeenews.india.com/delhi/do-yoga-to-cure-the-urge-of-becoming-terrorist-says-ramdev-2032893.html

‌১০)‌ https://www.scoopwhoop.com/Baba-Ramdevs-Patanjali-Faces-Government-Flak-For-Ads-Violating-The-Advertising-Code-Of-India/?ref=?ref=page_search

১১) https://bangaloremirror.indiatimes.com/news/india/yoga-guru-ramdev-who-had-said-that-he-would-have-beheaded-laksh-of-people-for-not-chanting-bharat-mata-ki-jai-slogan-was-booked-by-the-hyderabad-police-today-/articleshow/51825339.cms?utm_source=contentofinterest&utm_medium=text&utm_campaign=cppst

        

১২)‌ https://www.deccanchronicle.com/131211/news-current-affairs/article/homosexuality-disease-yoga-can-cure-it-ramdev

১৩)‌ https://www.indiatoday.in/india/story/ramdev-says-denied-nobel-prize-because-he-is-black-twitter-goes-berserk-271947-2015-11-07

১৪)‌ https://www.scoopwhoop.com/Amit-Shah-Defends-Baba-Ramdevs-Statement-About-Beheading-People-Not-Saying-Bharat-Mata-Ki-Jai/?ref=?ref=page_search

১৫)‌ https://www.youtube.com/watch?v=URWtBZTkjEE

১৬)‌ https://ndtv.in/videos/baba-ramdev-calls-pm-narendra-modi-rashtra-rishi-456167

১৭)‌ https://www.thequint.com/news/webqoof/baba-ramdev-covid-misinformation-vaccine-coronavirus#read-more

১৮) https://www.scoopwhoop.com/news/baba-ramdev-unveils-coronil-ayurvedic-medicine-to-treat-coronavirus/?ref=page_search

এবং

https://www.scoopwhoop.com/news/never-said-coronil-can-cure-corona-patanjali-takes-u-turn-on-claims-of-treating-virus/?ref=page_search

১৯)‌  https://www.thequint.com/news/india/haryana-government-anil-vij-coronil-baba-ramdev-free-covid-patients

২০)‌ https://www.scoopwhoop.com/as-mp-burns-agriculture-minister-does-yoga-with-ramdev-asks-farmers-to-do-the-same/?ref=?ref=page_search

২১)‌ https://bangaloremirror.indiatimes.com/bangalore/cover-story/bhelsmaharashtra-land-will-produce-soybean-for-baba-ramdev-instead/articleshow/70236822.cms

এবং 

https://www.newsclick.in/cronyism-maharashtra-govt-offers-patanjali-group-400-acres-land-50-per-concession

২২)‌ https://www.ndtv.com/india-news/yoga-guru-ramdev-gets-cabinet-minister-status-in-haryana-754600

২৩)‌  https://in.finance.yahoo.com/news/patanjali-journey-india-apos-fastest-193807621.html#:~:text=Twelve%20years%20ago%2C%20Baba%20Ramdev,3L%20crore-worth%20FMCG%20sector

মন ও মনোবিজ্ঞান : ফ্রয়েডিয় অবৈজ্ঞানিক উদ্ভট তত্ত্ব -সুদীপ নাথ
Nov. 20, 2024 | যৌনতা | views:9645 | likes:1 | share: 26 | comments:0

অনেকেই বলেন, আমাদের মন নাকি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। উনবিংশ শতাব্দি অব্দি অনেকেই মনে করতেন, মন বলতে যা কিছু বোঝায়, তার সব কিছুই জন্মসূত্রে পাওয়া বিষয়। তখন তারা ধারণা করতেন, মনের কোন বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তখনকার ধারণাগুলো সবই ছিল অনুমান নির্ভর। যুগে যুগে বহু মনিষী, মনের অস্তিত্ব ও তার কার্যকলাপ নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা করেছেন। কিন্তু শারীর বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, মানব মনের হদিশ করতে তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের সাথে মানব মনের সম্পর্ক খুঁজে পেতে হয়রান হয়েছেন। বিশেষত প্রাণীর ঘিলু তথা মস্তিষ্কের জটিল ক্রিয়াকলাপ, তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের করায়ত্ত না থাকার ফলে, শরীর ও মস্তিষ্ক ভিত্তিক মনোবিদ্যা তখনো গড়ে উঠতে পারেনি। তখনও মনোবিদ্যা আলাদা কোন বিষয় হিসেবে গণ্য হত না। দর্শন শাস্ত্রেরই একটা উপশাখা হিসেবে গণ্য হত। সেই কারণে মনোবিদ্যার বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিলনা। দর্শন শাস্ত্রের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকার কারণে, মানুষের মন নিয়ে সকলেই, যার যার নিজের মত করে, যা খুশি বলার রাস্তা খোলা ছিলো। 


তখন পর্যন্ত সকলেই, নিজের মন দিয়েই অন্যের মন বোঝার চেষ্টা করতেন । তখন দর্শন শাস্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বোঝা ও ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা। কবি সাহিত্যিকেরা, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই মনের দ্বন্দ্ব খুঁজে বেড়াতেন। তখন জার্মান দেশই ছিল মনোবিদ্যা চর্চার প্রাণকেন্দ্র।


এদিকে, ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Frayed), The Interpretation of Dreams এবং Psychopathology of Everyday Life নামে দুটি বই লিখে পরিচিত হন। এই বই দুটি থেকে জানা যায় যে তিনি মানসিক রোগগ্রস্ত মনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিক মনের ঠিকানা খুঁজতে প্রয়াসী হয়েছেন। ১৯০৫ সালে ফ্রয়েড যৌনমানস সম্পর্কে এক বইয়ে যৌনতার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কিত এক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বের মূল কথাটি ছিল সর্বরতিবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে শৈশবের সবকিছু ইচ্ছা এবং আচরণই যৌনতা ভিত্তিক। ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব লিবিডো তত্ত্ব নামে পরিচিত। তিনি আরও একটা তত্ত্ব খাড়া করে তার নাম দিয়েছিলেন ঈডিপাস কমপ্লেক্স। এই তত্ত্ব অনুসারে মাতার প্রতি পুত্রের মনে কামেচ্ছা জাগে এবং এই কামেচ্ছা নিবারনে পিতাকে সে তার পথের কাঁটা হিসেবে গন্য করে। একই ভাবে, কন্যারাও মাতাকে তাদের পথের অন্তরায় ভাবে। ফ্রয়েড ধারণা করেন এই সমস্ত তত্ত্ব দিয়েই সমাজ ও মানুষের জীবনের সমস্তকিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তখন দার্শনিকদের বেশিরভাগই আমাদের মননক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে ভাববাদের আশ্রয় নিতেন, কল্পনার আশ্রয় নিতেন। ফ্রয়েড কিন্তু সেদিক থেকে একধাপ এগিয়ে নৃবিদ্যা, পৌরাণিক কাহিনী ইত্যাদির আশ্রয় নিয়েছেন। ফ্রয়েড প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সাহায্য নেন নি। অথচ তখনই প্রকৃতি বিজ্ঞান অনেক কিছুই আবিষ্কার করে ফেলেছে। ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষ সহজাত হিংস্র প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মায় এবং তা সভ্যতার চাপে অবদমিত হয়ে থাকে। সময় সুযোগ মত তা মানুষকে হিংসাশ্রয়ী ধ্বংসাত্মক কাজ করতে উৎসাহিত করে। 


তিনি আনস্টাইনকে এক চিঠিতে, এই তত্ত্ব জানিয়ে এক বিশাল চিঠি লিখেছিলেন । তিনি ঐ চিঠিতে আনস্টাইনকে লিখেছিলেন, এই তত্ত্ব অনুসারে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, যুদ্ধ হবেই। এই তত্ত্ব, সাম্রাজ্যবাদীদের খুব মনপছন্দ্‌ হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর ব্যক্তি চেতনার প্রসারে, সাম্রাজ্যবাদ যখন বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনায় কোণঠাসা, ঠিক তখনই ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে তারা লুফে নিয়েছিল। যুদ্ধ উদ্দেশ্য মাত্রই বাজার দখল – এই ধারণা থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করে, সাম্রাজ্যবাদীরা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে উর্ধ্বে তুলে ধরে, তার জয়গান শুরু করে দিল। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তত্ত্বকে চাপিয়ে দেয়া হল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতে এই তত্ত্ব বাধ্যতামূলক করে টেক্সট্‌ বইয়ে অন্তর্ভূক্ত করে নিল। 


এখনো ভারতের সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এই তত্ত্ব বয়ে নিয়ে চলছে। কোনও বুদ্ধিজীবী টু শব্দটিও করছেন না, যা ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ ঐ সময়ের আগেই এই আজগুবি তত্ত্ব বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই হয়ে বিজ্ঞানী মহল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এই তত্ত্বের উপর আর নির্ভর করে না। 


ক্ষুদ্র পরিসরে এখানে ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের অসারত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। মোটকথা, ফ্রয়েড যৌনতাকে আশ্রয় করে তত্ত্ব বানিয়েছিলেন, অথচ যৌনতার উৎস খুঁজতে সামান্যতম চেষ্টাও করেননি। যৌনতার এনাটমি ও ফিজিওলজি নিয়ে চিন্তাও করেননি। যৌনতাকে মনন ক্রিয়ার পশ্চাৎপট (back ground) বিষয় হিসেবেই ধরে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। মানসিক ক্রিয়ার অধঃস্তর (material substratum) অর্থাৎ মস্তিষ্ককেই বাদ দিয়ে, মনকে বুঝতে চেষ্টা করে গেছেন ফ্রয়েড সাহেব। ফ্রয়েডের কয়েকজন উত্তরসূরি, এই তত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও, বিশেষ কোন নূতন দিক নির্দেশ করতে পারেননি। 


এদিকে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই জারের সহায়তায়, রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানী, গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে, কালজয়ী শর্তাধীন পরাবর্ত তত্ত্ব (Theory of Conditioned Reflex) আবিষ্কার করেন। এই বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন নোবেন জয়ী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ। ল্যাবরেটরিতে, হাতে কলমে পরিক্ষার পর পরীক্ষা চালিয়ে যান। শর্তাধীন পরাবর্ত ভিত্তিক মনোবিদ্যার শুরু তখন থেকেই। তারপর পাভলভের নেতৃত্বে একের পর এক, অজানা তথ্য আবিষ্কার হতে থাকে। 


সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, স্মৃতি, চিন্তা, স্বপ্ন, প্রক্ষোভ(emotion), ঐচ্ছিক নির্বাচন ইত্যাদি মনন ক্রিয়ার, বস্তুনির্ভর অধঃস্তরের (material substratum) সন্ধান এইসব গবেষণা থেকেই পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গ ও জৈব রসায়নের, যেমন হরমোন ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান আবিষ্কার, পাভলভের এই তত্ত্বকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। অনুমান নির্ভর অন্তর্দর্শন ভিত্তিক মনস্তত্ত্বের দিন, তখনই ফুরিয়ে যায়। 


পাভলভই মনোবিদ্যাকে দর্শনের গণ্ডির বাইরে বের করে এনে, বিজ্ঞান নির্ভর মনোবিদ্যা চর্চার সোপানটি স্থাপন করেন। পাভলভের এই তত্ত্ব নির্ভর করে, প্রমাণিত হয়েছে মানুষের সবকিছু ধ্যানধারণার উদ্ভব ঘটে, মস্তিষ্কে বাইরের জগতের ঘটনা এবং বস্তুর ধর্ম ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলন থেকে। আর চেতনা হচ্ছে অতীব জটিল বস্তু-মস্তিস্কের বিশেষ প্রক্রিয়া। বাস্তব বহির্জগতের প্রতিফলনই, বাস্তব মস্তিষ্কে চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। 


বহির্বাস্তবের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে [পাঁচটি ইন্দ্রিয় হচ্ছে, শ্রবণেন্দ্রিয় (কান), দর্শনেন্দ্রিয় (চোখ), ঘ্রাণেন্দ্রিয় (নাক), স্বাদেন্দ্রিয় (জিভ) আর স্পর্শেন্দ্রিয় (চামড়া)], সম্পর্ক রক্ষার কাজই হচ্ছে স্বজ্ঞান প্রক্রিয়া বা চেতনা । চেতনা সংবেদনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে বহির্বাস্তবের প্রতিফলন। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী ‘প্রতিফলন তত্ত্ব’ যা The Theory of Reflection নামে সমাদৃত। 


এই প্রতিফলন তত্ত্বের (Theory of Reflection) উপর নির্ভর করেই বিজ্ঞানীরা কয়েকটি মৌলিক সূত্রও উপস্থাপিত করেন। মানুষ যখন প্রথম সামাজিক জীবে রূপান্তরিত হয়, তখন মানুষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটেছিল। সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে, মানব মনে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। সামাজিক ক্রিয়া-কান্ডের সাথে মানুষের মনেরও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। এখানেই ফ্রয়েডের মনগড়া তত্ত্ব দূরে হঠে গেছে। ফ্রয়েড ভেবেও দেখেননি যে, পরিবার প্রথার বিবর্তনের ধাপগুলো কিভাবে ঘটেছে। এ পর্যন্ত কয়েক ধরণের পরিবারের রূপ আমরা দেখেছি। আর তিনি বর্তমানের অতি প্রকট, এক-পতিপত্নী পারিবারিক রূপটির বাইরে কিছুই জানতেন না, বা দেখতে চেষ্টাও করেন নি। আর বর্তমানের এই এক পতিপত্নী পারিবারিক রূপটিও যে ইতিমধ্যেই ভাঙ্গতে শুরু করেছে, এটা সকলে দেখতেই পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে পিতার খোঁজ থাকবে কিনা কে বলতে পারে। আর যে পুত্রের পিতা, বর্তমান সমাজে বাইরে থাকে, পুত্রের জন্মের সময় থেকে, সেই পুত্র যখন কেবল মাত্র মা অথবা, মা ও প্রতিপালিকার সংস্পর্শে বড় হয়, কিংবা শুধুমাত্র প্রতিপালিকার সংস্পর্শে বা হোস্টেলে বড় হয়, তাদের ক্ষেত্রে লিবিডো তত্ত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আর যে শিশুর মা জন্মক্ষণে মারা যান বা পিতা সন্তানকে গর্ভে রেখে মারা যান, সেই শিশুদের কি হবে? অথবা এইসব শিশুরা, যখন তাদের দাদু দিদিমারা প্রতিপালকের স্থানে থাকেন, তাদেরই বা লিবিডো তত্ত্বের কি ঘটবে? সমাজের পরিবর্তন ফ্রয়েড সাহেব দেখেন নি। তিনি মনে করতেন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা আগেও ছিল, এবং তা সনাতন। 


বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষণ থেকে মানুষ ভাবনাচিন্তার বিষয় (content) যোগাড় করে। এসব প্রকৃতি আর সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আর আমাদের ক্ষেত্রে, সমস্ত প্রত্যক্ষণের সহায়তায় নূতন নূতন সংকেতের উপর একটা বিমূর্ত রূপ অনুভূত হতে থাকে। এইভাবেই গড়ে উঠে ধারণা। আর তাকে সাধারণীকরণ করার মাধ্যমে তা হয়ে উঠে বিমূর্ত। মস্তিস্ক, বাইরের পরিবর্তনের সাথে সক্রিয় এবং পরিবর্তনশীল সম্পর্ক স্থাপন করে, প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযোজনে সাহায্য করছে। তারই নাম স্বজ্ঞান ক্রিয়া। 


অতীতের কোন প্রত্যক্ষণ যখন আমাদের মস্তিষ্কে অনুভুতি জাগায়, তখন তাকে বলা হয় চিন্তা। তা যুক্ত হতে পারে চলমান প্রত্যক্ষণের সাথেও। অতীতের অনেকগুলো ধারণা থেকেও আমরা নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে পারি। এই পুরনো ধারণার উপর নির্ভর করে, নূতন ধারণা সৃষ্টি করাকে বলা হয় কল্পনা। 


মনের মধ্যে একবার ধারণা তৈরি হয়ে গেলে, খুশিমতো একটার সঙ্গে একটা জুড়ে দিয়ে কিম্ভূত কিমাকার অনেক ধারণা তৈরি করাও সম্ভব। জীন, পরী, দৈত্য, এমনকি ঈশ্বরও আমাদের মনে এভাবেই সৃষ্টি হয়, সম্পূর্ণ কল্পনার উপর দাঁড়িয়েই। উচ্চমার্গের মননক্রিয়া তথা ধারণা এবং চিন্তা (concept and thought) যেমন ভ্রান্তি দূর করতে পারে, ঠিক তেমনই আবার ভ্রান্তি তৈরিও করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসবের মূলে আছে বস্তু। 


প্রত্যক্ষণ, ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থেকেই জন্মায়। আবার অতীতের ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং জীবনক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে এবং সর্বোপরি জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করে। 


মনস্তত্ত্ব শুধুমাত্র জীববিদ্যার বিষয় নয়। তা সামজিক-ঐতিহাসিক বিদ্যার সাথেও সম্পর্কিত। মানবমন গুণগতভাবে পশুমন থেকে স্বতন্ত্র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধুমাত্র আমাদের মানসিকতারই বিবর্তন ঘটে না, মনন ক্রিয়ার নিয়মেরও পরিবর্তন ঘটে চলে এবং তা সর্বদা একটা চলমান প্রক্রিয়া। 


শর্তাধীন পরাবর্ত তথা Conditioned Reflex-এর দৌলতেই আমরা আমাদের চৈতন্যের উন্মেষ ঘটাতে পেরেছি। এই শর্তাধীন পরাবর্ত আবার শর্তহীন পরাবর্ত অর্থাৎ জন্মগত রিফ্লেক্সের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠে। নূতন নূতন শর্তাধীন পরাবর্ত যেমন গড়ে উঠে, আবার সেগুলো ভেঙ্গেও যেতে পারে। এই ভাঙ্গা গড়া সবসময় চলতে থাকে। 


তাই বলে, মানুষের আচরণের মূলে, নির্জ্ঞান বা ছোট বেলার অবদমিত কামনা বাসনার কোনও ভূমিকাই নেই। চেতনা অপরিস্ফুট থাকতে পারে, তার ব্যাপ্তি ও বিস্তার সম্বন্ধে সবকিছু জ্ঞান আমাদের না থাকতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রত্যক্ষনের সাহচর্যে, প্রয়োজনীয় চৈতন্যের সম্যক উন্মেষ ঘটানো সম্ভব। 

ডিরোজিও ও বাঙলায় যুক্তিবাদের প্রসার -রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যুক্তিবাদ বলতে দর্শনের ছাত্রছাত্রীরা প্রথমেই মনে করেন সতেরো শতকের ইওরোপে প্রত্যক্ষবাদ (এম্পিরিসিজম) বনাম যুক্তিবাদ (র‍্যাশনালিজম)-এর কথা। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ থেকেই র‍্যাশনালিজম  শব্দটি অন্য এক অর্থে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেটি হল: মতামত বা কাজকর্মর ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস বা আবেগের ওপর ভরসা না করে যুক্তি ও জ্ঞানের ভিত্তিতে আচার-আচরণ ও নীতি ঠিক করা। এর জন্য খুব বড় অভিধান দেখার দরকার নেই; কনসাইজ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি, দ্বাদশ সংস্করণ, ২০১১ দেখলেই চলবে।


হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন এই ধরণের যুক্তিবাদী। ভগবান আছেন না নেই এই নিয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট মত দিতেন না, প্রচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু তাঁকে নাস্তিক বলে দাগা মেরে হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিরোজিও কিন্তু তাঁর ছাত্রদের একটা কথাই বলতেন: কোনো বিষয়ে মত স্থির করার আগে তার পক্ষে ও বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সেগুলো জেনে বুঝে বিচার করে তবে নিজের মত ঠিক করবে। এই শিক্ষাই ডিরোজিওর স্বল্পায়ু জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি। কারুর কথা শুনে বা আবেগের বশে কোনো মতের প্রতি পক্ষপাত দেখানো উচিত নয়; বরং নিজের বোধবুদ্ধির ওপর ভরসা রেখে পক্ষে-বিপক্ষে যা বলার আছে সেগুলো নিক্তিতে ওজন করে ঠিক করো: কার পাল্লা ভারী। ছাত্রদের তাই যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক করতে উৎসাহ দিতেন তিনি। নিজেরা মাথা খাটিয়ে, দরকার মতো পড়াশুনো করে তারা যেন ঠিক-ভুল পরখ করতে শেখে।


উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ডিরোজিওর ছাত্ররা দেখা দিয়েছিলেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতবিদ্য ও কৃতী মানুষ হিসেবে। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ সিকদার, রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ — এঁদের নাম বাঙলার ইতিহাসে, বিশেষত শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সদাস্মরণীয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এঁদের কয়েকজনের নাম অক্ষয় হয়ে আছে। বাড়ির মেয়েদের পড়ার জন্য মাসিক পত্রিকা বের করা কম গৌরবের বিষয় নয়। তার সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ সিকদার ও প্যারীচাঁদ মিত্র। বাঙলা সাহিত্যিক গদ্যর বিকাশে তাঁদের অবদান এখনও বোধহয় ঠিকমতো বোঝা হয়নি। টেকচাঁদি ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে বিদ্যাসাগরি আর হুতোমি ভাষার ঠিক মাঝখানে। উঁচু আর নিচু রীতির মধ্যে মাঝারি রীতি। একেও বলা যেতে পারে ডিরোজিওর পরোক্ষ প্রভাব।


হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭)-র আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে বোঝাত: একজন সায়েব (বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান)-এর কাছে কাজ চালানোর মতো ইংরিজি শেখা। অন্য কিছু স্কুলে (বাঙালি-পরিচালিত) একই ধরণের ইংরিজি শিক্ষা হতো: ছড়া কেটে ইংরিজি শব্দ ও তার বাঙলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করানো। তার পরেও, আরও উঁচু ক্লাসে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু তথ্য মনের মধ্যে গেদে দেওয়া হতো।

ফরাসি লেখক আনাতোল ফ্রাঁস চেয়েছিলেন: আমাদের শিক্ষণ ভরা হোক ভাবনায়। এতকাল এটি শুধু তথ্য দিয়ে ঠাসা হয়েছে’ (Let our teaching be full of ideas. Hitherto it has been stuffed only with facts)। অবশ্যই এ এক নতুন শিক্ষাদর্শ। এখনও পর্যন্ত বাস্তবে তার নমুনা চোখে পড়ে না। কোনো কোনো মনীষী এর জন্যে নিজেরাই আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel)-এর কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির ভেতরে থেকে, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও ডিরোজিও চেয়েছিলেন কিশোর ছাত্রদের মনে অন্ধবিশ্বাসের জায়গায় পক্ষপাতহীন যুক্তিবুদ্ধির বীজ রোপণ করতে। তার জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছিল। কুৎসা রটনা ছাড়াও তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। হিন্দু কলেজের পরিচালকরা রীতিমতো কোমর বেঁধে, প্যাঁচ কষে ডিরোজিওকে তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে সরালেন।


এর থেকে একটা জিনিস বোঝার আছে: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র আর যুক্তিবুদ্ধির সহাবস্থান অসম্ভব। মুক্তচিন্তা আর পাঠক্রম মেনে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা ও তার ফল – দুটো একযোগে চলে না। ডিরোজিও-ও সে কথা বুঝতেন। তাই হিন্দু কলেজের বাইরে, নিজের বাড়িতে ও মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-র বাগানবাড়ির ঘরে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে মুক্ত চিন্তা বিকাশের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন: ‘The young lions of the Academy roared out, week after week, “Down with Hinduism! Down with orthodoxy!’’’


হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি সমাজে তথ্যর পাশাপাশি ভাবনাচিন্তার একটা জায়গা হলো। যত সঙ্কীর্ণই হোক তার সীমা, বাঙালি সমাজের ওপরের স্তরে তার থেকেই একটা কাঁপন ধরল। তার উদ্যোক্তা সব ক্ষেত্রেই ডিরোজিয়ান বা ইয়ং বেঙ্গলরা নন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন বেশ কিছু মানুষ, তাঁদের সকলেই অবশ্য ইংরিজি শিক্ষিত, ঢাকঢোল না-পিটিয়েই, শাঁখ-ঘণ্টা না বাজিয়েই একটি একটি করে প্রথাবিরোধী কাজ শুরু করলেন। এগুলোর সাথে ডিরোজিও কেন, কোনো ডিরোজিয়ানেরও সাক্ষাৎ যোগ ছিল না। তবু কলকাতা ও মফস্বলে যুক্তিবুদ্ধির প্রসার এইভাবেই হয়েছে। এঁরাও ডিরোজিওর–ই সন্ততি।


রামমোহন রায় যখন সতীদাহ-র বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম পুস্তিকাটি লিখলেন (১৮১৮) সেখানেও বিষয়টি উপস্থিত করা হয়েছিল তর্ক-র আকারে: প্রবর্তক (যিনি সতীদাহ চান) আর নিবর্তক (যিনি তা বন্ধ করতে চান) এমন দুজন কাল্পনিক ব্যক্তির ‘সম্বাদ’ বা ডায়ালগ (ঠিকমতো বললে: ডুওলোগ) হিসাবে। এখানেও সেই দুটি পরস্পর-বিরোধী মতের দ্বন্দ্ব। রামমোহন নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দেন নি, সে-বরাত পাঠকের ওপরে।


বাঙলা তথা ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাটিও চিরস্মরণীয়। তক্কাতক্কি তো ভারতের লোকে বহুকাল ধরেই করে আসছেন। কিন্তু সে হলো শখের তক্ক। তার মীমাংসার ওপর জগৎ-জীবনের কিছুই নির্ভর করে না। অমর্ত্য সেন যাদের ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ (আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান) বলেছেন, তাদের সঙ্গে রামমোহনের সময় থেকে যে সব তক্কাতক্কি শুরু হলো, তার তফাত অনেক। সতীদাহ থাকবে না বন্ধ হবে, বিধবার আবার বিয়ে দেওয়া যাবে, না যাবে না; একজন লোকের অনেক বউ থাকা উচিত না অনুচিত — এই ধরণের বিষয়ে তক্কাতক্কির একটা ব্যাবহারিক গুরুত্ব আছে। এগুলো শুধুই ‘সুখপাঠ্য লাঠালাঠি’ নয়, এগুলোর মীমাংসার ওপরে মেয়েদের — সব জাতের, সব অবস্থার মেয়েদের — বাঁচা-মরা জড়িয়ে আছে।


দুঃখের বিষয়, রামমোহন রায়ের সঙ্গে ডিরোজিওর পরিচয় হয়নি। অনেক বছরই তাঁরা এক শহরে বাস করেছেন। কিন্তু ফিরিঙ্গি সমাজ আর বাঙালি সমাজের মধ্যে তেমন যোগ ছিল না, বরং বিয়োগই ছিল বলা যায়। বোধহয় সেই কারণেই ডিরোজিওর শিক্ষক ড্রামন্ড বা তাঁর কোনো ছাত্রের সঙ্গে রামমোহন রায়ের পরিচয় হয় নি।


সতীদাহ বন্ধ করার আইন, ১৮২৯-এর ১৭ নং রেগুলেশন জারি হলো। রামমোহন অবশ্যই তাতে খুবই খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সমর্থনে খুব অল্প লোকই ছিলেন, এগিয়ে এসেছিলেন আরও কম লোক। গণভোট নিলে সতীদাহ সমর্থকরাই বিপুল ভোটে জয়ী হতেন। (বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রেও কথাটি সমানভাবে সত্যি; প্রগতিশীলরাই এখানে সংখ্যালঘু, রক্ষণশীলরাই সংখ্যাগুরু)। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি জায়গা থেকে সতীদাহ বন্ধ করার সমর্থন এসেছিল। ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল (ডিসেম্বর ১৮২৯)-এ একটি কবিতা বেরোল; ‘অন দ্য অ্যাবলিশন অব সতী’। কবির নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন; ‘বিষয়টি কবিরই যোগ্য; আর কবি দেখিয়েছেন যে তিনিও এই বিষয়ে (কবিতা রচনায়) অনুপযুক্ত নন।’


সমাজ সংস্কারের মতো চিন্তাসংস্কারও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বাঙলায় পরবর্তীকালে যাঁরা সেই কাজে হাত দিয়েছেন তাঁদের সবাই ডিরোজিওর কাছে — আর তার সঙ্গে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের কাছেও — প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী। ডিরোজিওর সাক্ষাৎ ছাত্ররা তাঁর যুক্তিবাদের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যান নি। দিলীপকুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন একজন ডিরোজিয়ানও ‘উত্তর জীবনে নাস্তিকতা প্রচার করেন নি।’ কথাটি ঠিক। ডিরোজিয়ান তথা ইয়ং বেঙ্গল-এর মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রিস্টান হয়েছিলেন, হরচন্দ্র ঘোষ নিষ্ঠাবান হিন্দু-ই থেকে যান, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর দেব, শিবচন্দ্র দেব ব্রাহ্ম হন, প্যারীচাঁদ মিত্র ব্রহ্মবিদ্যা বা থিওজফি আন্দোলনে যোগ দেন, আর রসিককৃষ্ণ মল্লিক এক সর্বজনীন ধর্ম-য় বিশ্বাস করতেন।


বরং নাস্তিকতার ধারাটি প্রচার হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্ত মারফত। ধ্রুববাদী (পজিটিভিস্ট) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলেই নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। বিশেষ করে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর নাম করা যায়। এঁরা কেউই সরাসরি ডিরোজিও-প্রভাবিত ছিলেন না। তবু বাঙলায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়েছিল ডিরোজিওর কাছে — এই সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না। বাঙলা সাহিত্যে ধ্রুববাদী আন্দোলনের দিকচিহ্ন ধরা আছে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ-য়। জ্যাঠামশায় এক আশ্চর্য চরিত্র। ইতিহাসের ধারায় দেখলে তিনিও কিন্তু ডিরোজিও-রই উত্তরসূরি।


আর একটি কথা বলে আলোচনা শেষ করি। ডিরোজিওকে লোকে চেনেন অ-সাধারণ শিক্ষক আর কবি বলে। এখানে তুলনায় কম পরিচিত একটি কবিতা উদ্ধৃত করা হলো:

ক্রীতদাসের মুক্তি

গোলামির পালা শেষ। কি এক বিচিত্র অনুভূতি!

মুক্তি পেয়ে সমুদ্বেল বুক ভরে গর্বের স্পন্দনে

সহসা ভাস্বর হল অন্তরের মহৎ প্রস্তুতি

নতজানু-দাসত্বের ক্রান্তির ঘোষণা সেই ক্ষণে:

নিজেকে চিনেছে দাস মানুষের আত্মার সম্মানে,

আকাশে তাকিয়ে নেয় নন্দনের বাতাসে জীবন,

বুনোপাখিদের ঝাঁক উড়ে যায়, দেখে ঊর্ধ্বপানে,

মৃদু হাসি মুখে মেখে নিজেকেই জানায় বন্দন!

ওদিকেতে চেয়ে দেখে কলস্বরে ঝর্ণা চলে নেচে,

বাতাস — পাখিরা — ঝর্ণা দেখে ভাবে কি খানিক

“আমিও ওদের মতো মুক্ত হয়ে রয়েছি ত বেঁচে!”

সহসা চেঁচিয়ে ওঠে অতঃপর ভুলে দিগ্বিদিক।

মুক্তি! নাম থেকে ঝরে সুনিবিড় মাধুর্য তোমার,

হৃদয়ের বেদীতটে জ্বেলেছ যে শিখা অনির্বাণ,

স্বদেশের মুক্তিযজ্ঞে উদ্ভাসিত খোলা তলোয়ার

শোণিতের পুণ্য-অর্ঘ্যে এনেছ কি মুক্তির সম্মান!

ধন্য হোক সেই হাত যে-হাত করেছে খান খান

শোষণের শিকলকে; ধন্য হোক সে-আত্মপ্রসাদ

নিপীড়িত মানবাত্মা যার বলে হল বলীয়ান

ক্রীতদাস পেল যাতে অবশেষে মুক্তির আস্বাদ।

ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭

অনুবাদ : পল্লব সেনগুপ্ত

(ডিরোজিও: সময়ের এ্যালবাম, শক্তি সাধন মুখোপাধ্যায় ও অধীর কুমার সংকলিত, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি, পাত্র’জ পাবলিকেশন, ২০০৩)

ডিরোজিওর অন্য একটি পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। তিনি যে সাংবাদিকও ছিলেন, অনেককটি পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগ ছিল — এই কথাটি খেয়াল করা হয় না। অথচ বাঙলা তথা ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ডিরোজিও-র নাম রেডিয়ামের অক্ষরে লিখে রাখার কথা। কটি কাগজের তিনি সহ-সম্পাদক বা সম্পাদক ছিলেন সে নিয়ে বিতর্ক আছে। এমনকি দ ক্যালাইডোস্কোপ, যে মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘আমার ছাত্রদের প্রতি’ (টু মাই পিউপিলস) কবিতাটি বেরিয়েছিল, তাতেও স্বাক্ষর ছিল: এইচ সি।


হিন্দু কলেজের ছাত্রদের জন্য সনেট


ফুলের তরুণ কলি যেভাবে ছড়ায় পাপড়ি তার

সেইমতো দেখি মৃদু খুলে যায় তোমাদের মন,

আর কী মধুর খোলে সেই সব সম্মোহন ভার

বেঁধে রেখেছিল যারা তোমাদের সমর্থ মনন,

যে মনন করে দেয় তার সব ডানা প্রসারণ

(গ্রীষ্মের প্রহরে যেমন পাখির শাবক) উড়বার

শক্তির পরখ করে। অভিঘাত কত না হাওয়ার,

প্রথম জ্ঞানের কত বৈশাখের নবীন বর্ষণ।

অগণ্য নতুন কত বোধ — সবই চিহ্ন রেখে যায়

তোমরা নিরত থাকো সর্বশক্তি সত্যের পূজায়।

কত যে আনন্দধারা আমার উপরে পড়ে ঝুরে

যখন তাকিয়ে দেখি যশোদেবী ভবিষ্যমুকুরে

গেঁথে চলেছেন মালা কখনও যা পাবে তোমরা, তাই

সে-সময়ে মনে হয় এ জীবনে বাঁচিনি বৃথাই।


অনুবাদ : শঙ্খ ঘোষ

(ভারত-বীণা ও অন্যান্য সনেট-কবিতা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০২)


কোনো কোনো শিক্ষককে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা পদ্যর কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়, কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশে শিক্ষকের লেখা কবিতা — তায় আবার এমন চমৎকার কবিতা — বিরল। কবিতাটি যে ডিরোজিওর — তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তারও কোনো প্রমাণ নেই। হারিয়ে যাওয়া পত্রিকাটি আগাগোড়া ছেপে বার করেন প্রয়াত অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকার যে নীতি-বিষয়ক বিবৃতি, তার সঙ্গে ডিরোজিও-র নিজের মতামতের কোনো মিল নেই। সুরেশচন্দ্র মৈত্র তাই সঙ্গত কারণেই আপত্তি তুলেছেন ডিরোজিও আদৌ ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কিনা।


কিন্তু ডিরোজিও যে দ ইস্ট ইন্ডিয়ান নামক পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই পত্রিকায় অনেক বকধার্মিকের মুখোশ খুলে দেওয়া হতো। যেমন, অগাস্ট ১৮৩১-এ ভাদ্রোৎসব উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে পণ্ডিত বিদায়-এর ব্যবস্থা হয়েছিল। দুশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও তাঁদের ছেলেদের দু’টাকা থেকে ষোল টাকা হারে দক্ষিণা দেওয়া হয় (১৮৫ বছর আগে টাকার অঙ্কটা তুচ্ছ নয়)। দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এ লেখা হয়েছিল: ‘ব্রাহ্মসভা কি ব্রাহ্মণদের ভেলকিবাজির মঞ্চ? আমরা তো জানতাম, তা নয়। কারণ এই সভার প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামমোহন রায়। তিনি মানবপ্রেমের পূজারী, ঈশ্বরোপাসনাকে শুদ্ধতম নীতির উপর স্থাপন করেছিলেন।’ তারপর পণ্ডিত বিদায়-এর খবরটি দিয়ে ঐ পত্রিকায় লেখা হয়: ‘শুনতে পেলাম সমাজের পরিচালকেরা এমন কাজ নাকি হামেশাই করে থাকেন। দয়াধর্ম প্রশংসনীয় কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা: একই সময়ে কাউকে উঁচুতে তোলা আর নিচুতে নামানোর কী অর্থ আছে? আসলে এ হল সম্পূর্ণ আজগুবি কাণ্ড!’


ঐ পত্রিকাতেই হিন্দুসমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল: রক্ষণশীল, আধা উদারপন্থী আর উদারপন্থী।


শুধু সাংবাদিকতা নয়, কথায় ও কাজের মিল না থাকলে তার সমালোচনা করাও ছিল দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এর অন্যতম কাজ। তার সম্পাদক সমীপেষু অংশে এমন চিঠি ছাপা হতো। বড়লোকের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় বড়লাট, ছোটোলাট থেকে প্রধান বিশপ ও অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উপস্থিতি নিয়ে এমন একটি চিঠি ছাপা হয়েছিল। সাংবাদিকতার এই ঐতিহ্য, ডিরোজিওকে বিশিষ্ট ও স্মরণীয় করে রেখেছে।

ভারতের সরকারি ভাষা প্রসঙ্গে আইন -ঈশান
Nov. 19, 2024 | সমাজ | views:55 | likes:0 | share: 0 | comments:0

"বাউল থেকে চর্যাপদ, ভাষা আমার প্রান,

একুশ মানে সেই ভাষাতেই রক্তঝরার গান।

সম্প্রতি চলে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রথমেই শ্রদ্ধা জানাই, ভাষা আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সেইসব মানুষদেরকে।

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১-শে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলতে পারি।"


আমাদের প্রত্যেকেরই মাতৃভাষা আছে, কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা নেই। হ্যাঁ সত্যিই নেই। সম্ভবত ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারীর ঠিক দিন দুয়েক আগে থেকে কিছু অতিবোদ্ধারা (যাদের মধ্যে একশ্রেণীর বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ) নানানরকম বিকৃত তথ্যসহ প্রমাণে মরিয়া থাকেন যে - (১) হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা, (২) আরবী বা উর্দু নয় বাংলা চাই।


এই অতিবোদ্ধা, জ্ঞানপাপী প্রচারকারীদের এটা জানিয়ে দেওয়া খুবই প্রয়োজন যে, National  Language এবং Official Language দুটো সম্পূর্ণ কিন্তু আলাদা বিষয়। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। ভারতের সংবিধান ও ১৯৬৩ সালের 'Official Language Act' দ্বারা যা সুচিহ্নিত। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারা অনুযায়ী, কেন্দ্র সরকারের দাপ্তরিক ভাষা (Official Language) ইংরেজি ও হিন্দি। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ এবং ৩০ এ এই নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

আরার ১২০ নং অনুচ্ছেদে সংসদে কি ভাষায় কাজকর্ম চলবে, তারও বর্ণনা রয়েছে।


সংবিধানের ৩৪৩ (১) ধারায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে "The Official Language of the Union government shall be Hindi in Devanagari script.", অর্থাৎ দেবনাগরী হরফে হিন্দি হল ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের (যাকে আমরা কেন্দ্রীয় সরকার বলে থাকি) সরকারি ভাষা। হিন্দিতে সংবিধানের ৩৪৩ (১) ধারার রূপান্তর হয়েছে এই রকম - "देवनागरी लिपि में लिखित हिंदी संघ की राजभाषा होगा।" হিন্দির প্রচলিত রূপ অনুযায়ী শব্দটা হওয়া উচিৎ ছিল "সরকারি ভাষা"। কিন্তু প্রচলিত রূপ থেকে আদর্শ হিন্দিকে প্রায় সংস্কৃত বানিয়ে তোলার তাগিদেই এমন একটা অপ্রচলিত শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর ধ্বনির সাযুজ্য এবং বিশেষ তাগিদে সেটাকেই কেউ কেউ বানিয়ে ফেলেছেন রাষ্ট্রভাষা।


সংবিধানের  ৩৪৩(২) ধারায় বলা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত হিন্দির পাশাপাশি ইংরাজিও একই উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হবে। আবার ৩৪৩(৩) ধারায় বলা হল, "Notwithstanding anything in this article, Parliament may by law provide for the use, after the said period of fifteen years, of

(a) the English language, or

(b) the Devanagari form of numerals, for such purposes as may be specified in the law."


সংবিধানের ৩৪৩ (৩) ধারার ভিত্তিতেই ১৯৬৩ সালের "Official Language Act" - এর মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ২৬ শে জানুয়ারির পরেও ইংরাজির ব্যবহার অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী কী ক্ষেত্রে? দেখে নেওয়া যাক। section 3- তে বলা হয়েছে "Continuation of English Language for official purposes of the Union and for use in Parliament-

(1) Notwithstanding the expiration of the period of fifteen years from the

commencement of the Constitution, the English language may, as from the appointed day, continue to be used in addition to Hindi,


(a) for all the official purposes of the Union for which it was being used (a) for all the official purposes of the Union for which it was being used immediately

before that day;

and

(b) for the transaction of business in Parliament:

Provided that the English language shall be used for purposes of communication

between the Union and a State which has not adopted Hindi as its Official Language:


Provided further that where Hindi is used for purposes of communication between one State which has adopted Hindi as its official language and another State which has not

adopted Hindi as its Official Language, such communication in Hindi shall be accompanied by a translation of the same in the English language:


Provided also that nothing in this sub-section shall be construed as preventing a State which has not adopted Hindi as its official language from using Hindi for purposes of communication with the Union or with a State which has adopted Hindi as its official language, or by agreement with any other State, and in such a case, it shall not be obligatory to use the English language for purposes of communication with that State.


(2) Notwithstanding anything contained in sub-section (1) where Hindi or the English

Language is used for purposes of communication-

(i) between one Ministry or Department or office of the Central Government and

another;

(ii) between one Ministry or Department or office of the Central Government and any

corporation or company owned or controlled by the Central Government or any office thereof.;

(iii) between any corporation or company owned or controlled by the Central Government or any office thereof and another,

Translation of such communication in the English language or, as the case may be, in Hindi shall also be provided till such date as the staff of the concerned Ministry,

Department, office or the corporation or company aforesaid have acquired a working knowledge of Hindi.

(3) Notwithstanding anything contained in sub-section (1) both Hindi and the English

languages shall be used for-

(i) resolutions, general orders, rules, notifications administrative or other reports or press communiques issued or made by the Central Government or by a Ministry"।


প্রসঙ্গত জানাই, ২০১০ সালে একটি জনস্বার্থ মামলা হয় গুজরাট হাইকোর্টে।  মামলাকারীরা বলেন যে কোন পণ্যের গায়ে সেই পণ্যের তৈরির তারিখ, তার উপকরণ এবং দাম এগুলি হিন্দিতে লিখতে হবে কেননা ইতিমধ্যেই হিন্দি ভারতবর্ষের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এই তথ্যকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে হাইকোর্ট সেদিন রায় দানের সময় জানায়, আদৌ হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা রূপে স্বীকৃত নয়। সাথে এটাও জানানো হয়েছিল, হিন্দি, গুজরাটের মাটিতে বিদেশী ভাষা। ২০২০ সালে প্রাণোজিৎ কর্মকার একটি RTI করেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যার উত্তরে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, "ভারতের কোনো রাষ্ট্রীয় ভাষা নেই।"


সংবিধান অনুযায়ী, 'ক্যাটেগোরি সি' রাজ্যে জনপরিষেবার ক্ষেত্রে সেখানকার ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য কেন্দ্র সরকার। পশ্চিমবঙ্গ অর্থাৎ আমাদের রাজ্য বাংলায় 'ক্যাটেগোরি সি' রাজ্য। এখানে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আর রাজ্য সরকার তার নিজের ইচ্ছে মতন রাজ্যের সরকারি ভাষা ঠিক করতে পারে।


ভারতে স্বীকৃত ভাষার সংখ্যা ছিল ১,৬৫২টি৷ ২০০১ সালে এই ভাষার তালিকাকে আরেকটু অর্থবহ করে তোলা হয়েছে৷ দশ লক্ষ বা তার বেশি মানুষ কথা বলে এরকম ২৯টি ভাষাকে নির্বাচন করা হয়েছিল এবং দশ হাজার মানুষ কথা বলে এরকম ১২২ টি ভাষাকে আলাদা করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে অবশ্য স্বীকৃত ভাষার এই তালিকা ছোট করে ২২টি করা হয়েছে৷ তবে, এখন নাকি ওপর থেকে দাদারা চাপ দিয়েছে আরো অন্তত ৩৮টি ভাষাকে আনুষ্ঠানিক তালিকায় যোগ করতে চলছে তোড়জোড়।


এই ভাষাগুলির মধ্যে ১৪টি সংবিধানে প্রাথমিকভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২১তম সংবিধান সংশোধনীতে সিন্ধি ভাষাটি ১৯৬৭ সালে যোগ করা হয়েছিল। তারপরে ৭১তম সংবিধান সংশোধন আইন অনুসারে তিনটি ভাষা যেমন কোঙ্কনি, মণিপুরী ও নেপালীকে ১৯৯২ সালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ৯২তম সংবিধান সংশোধনী আইন অনুসারে ২০০৪ সালে বোডো, ডোগরি, মৈথিলি ও সাঁওতালি যোগ করা হয়েছিল।

সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত নিম্নলিখিত ২২ টি ভাষা হচ্ছে- (১) আসামি, (২) বাংলা (৩) গুজরাতি, (৪) হিন্দি, (৫) কন্নড়, (৬) কাশ্মিরি, (৭) কোঙ্কনি, (৮) মালয়ালাম, (৯) মণিপুরী, (১০) মারাঠি, (১১) নেপালি, (১২) ওড়িয়া, (১৩) পাঞ্জাবি, (১৪) সংস্কৃত, (১৫) সিন্ধি, (১৬) তামিল,

(১৭) তেলুগু, (১৮) উর্দু (১৯) বোডো (আসামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ভাষা শোনা যায়)

(২০) সাঁওতালি, (২১) মৈথিলি ও (২২) ডোগরি (জম্মু-কাশ্মীরে)।

আলোচনার সূত্রে জানিয়ে রাখি, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সংবিধান কমিটি গঠন ও কমিটি কর্তৃক খসড়া প্রণয়ন ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট “খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি” গঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "বাংলা ভাষা" বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা। প্রায় ৯৯% বাংলাদেশির মাতৃভাষা বাংলা। মোটেই উর্দু কিংবা আরবী নয়।


তাই আমরা উর্দু কিংবা আরবী যেমন চাই না ঠিক তেমনই জোরকরে চাপিয়ে দিতে চাওয়া হিন্দিও চাইনা।  বাংলার বাঙালি মায়েদের মুখনিঃসৃত ভাষা "বাংলা"। দুঃখের বিষয় এটাই, এই ভাষায় কথাবলতে অনেক বাঙালির আজ লজ্জা লাগে।

ডাইনির নামে হত্যাকান্ড ও সংবিধান কী বলে? -অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:732 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সময়টা ২০০১ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাস। বাঁকুড়ার একটি গ্রামে গিয়েছি বন্ধু কৌশিক এর মামাতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা গ্রামে পৌছে মেতে গেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরের দিন খুব ভোরে উঠে বন্ধুর একজন মামার সাথে বন্ধু  কৌশিক এবং আমি বেরিয়েছি শীতের সকালে গ্রাম ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এক যায়গায় দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ব্যাপার টা কি জানতে আমরা তিনজনে উক্ত স্থানে চলে আসি। দেখি কয়েকজন হোমড়াচোমড়া ব্যাক্তি খুব উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন কে যেন কড়াভাষায় কিছু বলছে এবং তাঁদের অনতিদূরে একজন ষাটোর্ধ মহিলা অসহায় ভাবে মাটিতে মাথা নীচু করে কাঁদছেন। বন্ধুর মামা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বিষয় টা জেনে এসে আমাদের জানালেন, উক্ত মহিলা নাকি ডাইনি। গ্রামের একজন কে দেখলাম উনি নাকি গুণিন, তিনিই নাকি জানিয়েছেন উক্ত মহিলাটি একজন ডাইনি এবং মহিলার পরিবার কে গ্রামের মাতব্বর দের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এর জন্য নইলে গ্রামে থাকা উক্ত পরিবারটির পক্ষে নাকি  অসম্ভব।


ডাইনির ব্যাপারে গল্পের বইতে আগে অনেক পড়েছি, কিন্ত এভাবে সরাসরি একজন ডাইনি কে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম বিষয়টা সেদিন ভালোভাবে না জানার দরুন। জানিনা, ডাইনি ঘোষিত সেই মহিলা এবং তাঁর পরিবারটি আদৌ অতগুলো  টাকা দিয়ে গ্রামে থাকতে পেরেছিলেন কিনা। অনেক পরে জেনেছি ডাইনি বা ডায়েন বলে বাস্তবে কিছুই হয় না,ওসব গল্পগাঁথাতেই সম্ভব। কিন্ত আমি বললেই বা লোকে মানবে কেন? বাড়ির চালে ফনফন করে লাউ গাছ বেড়ে উঠছিল,কড়াও পরেছিল রাশি রাশি। আচমকা গাছ শুকিয়ে মরে গেলো। কেউ কি তবে কু-নজর দিয়েছে গাছে? কে-সে? ডাইনি নয় তো? সদ্য প্রসুতির সন্তান ক্ষিদের জন্য কাঁদছে অথচ মায়ের স্তনে মুখ দিচ্ছে না, কেউ কি মায়ের স্তন ভেড়ে দিয়েছে? সে, ডাইনি নয় তো? ছটফটে শিশুটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে গেছে। এটা ডাইনির কু-নজর নয়তো? এই তো গতবছর হারাণ এর মা এর পায়ে ঘা হয়, মলম লাগিয়েও কাজ হয় নি শেষে গ্রামের একজন গুণিনের কাছে জানতে পারলো গ্রামেরই এক ডাইনি, সেই পা এর রোগ টা জিইয়ে রেখেছে। শেষে গুণিন কে দক্ষিণা দিয়ে কিসব শেকড়বাকড় পরে সুস্থ হলো।


শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, শিক্ষার সু্যোগ না পাওয়া কিংবা শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত শহুরে মানুষের একাংশও ডাইন বা ডাইনি বা ডায়েন এ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজে এই বিশ্বাস হচ্ছে সমুদ্র গভীর। কোনো গ্রামের কোনো গুনিন,জানগুরু, ওঝা,দিখলি, সৎসখা ইত্যাদিরা যদি কোনো মহিলাকে একবার ডাইনি ঘোষণা করে দেয় তাহলে সেই মহিলাকে বাঁচানো খুবই সমস্যার। গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর দের বিধান মতো ঘোষিত ডাইনির পরিবার কে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে তবে গ্রামে থাকতে হয়। কখনওবা ডাইনি বলে যাকে দেগে দেওয়া হয় তাঁকে প্রকাশ্যে নির্মম ভাবে হত্যাও হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই এমন খবর আমাদের চোখে পরে। বিভিন্ন দেশের নানান গল্পগাঁথায় ডাইনি নিয়ে প্রচুর কাহিনী রয়েছে এসব গল্পই ধিরে ধিরে আমজনতাকে ডাইনির প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে শেখাতে যে, ডায়েন বা ডাইনিদের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা আছে, এবং ডাইনিরা সমাজের ক্ষতিই করে থাকে। স্টার প্ল্যাস হিন্দি চ্যানেলে তো ডাইনির প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগাতে  ' নজর ' নামে একটা সিরিয়াল পর্যন্ত হয়েছে। এইধরনের সিরিয়াল বা সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অনেক। ডাইনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না জানি কত অসহায় মহিলারা সামাজের চোখে অপরাধী হয়ে অত্যাচারিত হবে, হচ্ছেও। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব চললেও কোনো প্রতিবাদ,প্রতিরোধ নেই। এই প্রসঙ্গে একটি লজ্জাজনক ও নৃশংশ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই।


রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ সালে পাঁচজন মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী।

উক্ত পাঁচজন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি " ডাইনি"। রাঁচির এই গ্রামে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনা, বরং গভীরে বিশ্বাস করে। ফলে যা হয় সেটা সত্যিই ভয়াবহ।

২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে  হত্যা করার পরে গ্রামের এক ওঝার নিদান মতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়।পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। পুলিশ আসায় গ্রামবাসীরা জানায়, খুন করে বেশ করেছি। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট ২০১৫)।


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে এই গ্রামে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে। আরেকটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে আরেকটি জঘন্য ঘটনার কথা শোনা যাক।


বাঁকুড়া সিমলাপাল অঞ্চলের চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার গত প্রায় দেড়বছর হল গ্রামে ফিরতে পারছেন না। কারণ তিনি নাকি ডাইন বা ডাইনি। গ্রামের একজন

জানগুরুর নির্দেশে, পরিবারটিকে জমিজমা বিক্রি করে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার নেই।

বর্তমানে একটা আদিবাসী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুগ্রহে পরজীবির মত বেঁচে আছেন ওনারা। অদ্ভুত এই অবস্থা। প্রশাসন সব জেনেও অন্ধ সেজে বসে আছে।

আশ্চর্য হলেও, রাগ হলেও এটাই আমাদের ভারত।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কান্ড ঘটলেও তারা নির্বিকার।


" ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি " র পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো, দীর্ঘবছর ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ জঙ্গলমহল এলাকায় যুক্তিবাদী বা  সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  বিশেষ ভাবে ডাইনি সমস্যা সহ আদিবাসী এলাকার আরেকটি সমস্যা নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ মধুসূদন মাহাতো সহ কয়েকজন মুক্তমনা সহযোদ্ধারা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, মধুসূদন মাহাতো, তথ্যের অধিকার আইনে রাজ্যে সরকারের স্টেট ক্রাইম ব্যুরোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কত মানুষকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে?

সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছে এবিষয়ে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাবা যায়! যেখানে তথ্যই নেই সেখানে প্রতিকার দুরাশা করাটা বোকামো।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েও সুবিচার পাননি চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার। এই অবস্থাই কি চলছে, চলবেও? প্রশাসন কি এভাবেই জেগে ঘুমাবে? কিছু আলোচনার সময়ে মধুসূদন মাহাতোর দাবী, কাউকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, যেই বছর কম বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির ফলে খরার প্রকোপ দেখা যায় সেবছরই ডাইনির ঘটনা বেশি শোনা যায়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতন যায়গায় এমনিতেই চাষাবাদ খুব কম হয় বৃষ্টি বা জলের অভাবে। তাই কয়েকজন ধূর্ত ব্যাক্তি এই বিষয় টাকে হাতিয়ার করে। তাঁরা বুজরুক, প্রতারক ওঝা,গুণিন, জানগুরু ইত্যদিদের সাথে মিলে কোনো মহিলা কে ডাইনি ঘোষণা করে দেয় এবং সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। স্বাভাবিক ভাবে অনেকেরই সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে চলে অত্যাচার এবং গ্রামে একঘরে করে রাখার বিধান। সোজা কথা, উদ্দ্যেশ্যে, কোনো মহিলাকে ডাইনি বলে দেগে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নোংরা চক্রান্ত। যেহেতু গ্রামগঞ্জে আজও ডাইনির ক্ষমতায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষের অভাব নেই তাই বিশ্বাসীরাও দল কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে যাকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের ওপরে ক্রমাগত চাপ দিতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য।


যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান আজকের মতন এতো উন্নত হয়নি সেসময় অজানা জ্বর বা রোগের প্রাদুর্ভাব কে অনেকে বোঙ্গা বা দেবতার অভিশাপ নয়তো ডাইনির কারসাজি ধরে নিতো। অবস্থা এখনো পালটায় নি। আজও প্রত্যন্ত গ্রামে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পরেও। আজও একশ্রেণীর মানুষের পরনে কাপড় নেই, হাতে রোজগার নেই, সু-চিকিৎসা নেই, পেটে খাদ্য দেওয়ার মতন অবস্থা নেই, পারিস্কার পানীয়জল নেই, বাসস্থান নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। এই নেই এর রাজ্যে আছে শুধু প্রতারণা, বুজরুকি, ধর্মের সুড়সুড়ি। গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশে নাগরিক অধিকার আজ খর্ব। আমজনতা তাঁদের সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে দেশে শুধুমাত্র ঘুষ দিয়ে কাজ করাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় সেদেশের জনতা সু-চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং সচেতনতার অভাবে এসব ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয় এবং ডাইনি ঘোষিত বলে অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত হয় প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মাথারা নারী কে কোনো দিনই ' মানুষ ' হিসেবে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। সর্বদাই ভেবেছে ভোগের সামগ্রী অথবা সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ করার একটা যন্ত্র।


প্রায় দুশো খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ডাইনিতত্ত্ব বা ডাকিনিতত্ত্বের রমরমা শুরু হয় এবং দ্রুত ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রেসিন্যান্ড স্কট নামক একজন ব্যাক্তি প্রকাশ করেন ' The Discovery of Witchcraft ' নামের গ্রন্থ টি। উক্ত বইটির মূল আলোচনা ছিল মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে ঘোষনা করে সমাজ মিথ্যেই তাঁদের ওপরে অত্যাচার করেছে। স্কট এর বইটি প্রায় সর্বত্রই ধিক্কৃত হয়েছিল সেসময়। এরও আগে ১৪৮৬ সালে খ্রিষ্টান ধর্মে পোপের নির্দেশে ' The Witche's Hammer ' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থেই বলা হয়েছিল ডাইনিরা সমাজের শত্রু, ওরা অশুভ শক্তি, তারা মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক জানে,সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি দের ক্ষতি করে, নানান অসুখ তৈরী করে, রক্ত শুষে নেয়। তাই পোপের নির্দেশ ছিলো, ওদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ওঁদেরকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হোক। 'The Witche's Hammer ' গ্রন্থটির সময় থেকে বহুযুগ ধরে প্রকাশ্যে মানসিক রোগিণী অর্থাৎ মহিলাদের উপর বারে বারে আঘাত এসেছে যা আজও ক্রমবর্ধমান। এখন হয়তো ডাইনি ঘোষিত কোনো মহিলাকে জীবন্ত জ্বলিয়ে দেওয়া হয়না, কিন্ত যা যা অত্যাচার হয় সেটা কোনো অংশেই কম নয়। রাঁচির মারাইটোলি গ্রামের ঘটনাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে।


National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত ও খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। এতো গেলো সরকারি হিসেবে।  কিন্তু বিভিন্ন মানবধিকার বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ  পর্যন্ত ডাইনি অপবাদে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৮০ হাজার মহিলাকে। এই জঘন্যতম কান্ড শুধু ইউরোপ নয়, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সহ অনেক দেশেই ছিল যথেষ্ট আকারে।


শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর। উনি দীর্ঘসময় ধরে আদিবাসী দের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবীতে প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ ভাবে ডাইনির ঘটনা নিয়ে। আরেকজন ব্যাক্তি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়। উনিও ডাইনি নামক একুশ শতকের লজ্জাজনক কান্ড নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু ওনার কিছু বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন শ্রী বাস্কের  একটি লেখা ' আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার ' এর এক যায়গায় উনি লিখেছেন- " এটাকে (ডাইনি) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের  কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ "। 

অর্থাৎ, শ্রীবাস্কের ধারণায়, ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। তাঁর মানে উনিও মনে করেন ডাইনি বা ডাইন বা ডায়েন বাস্তবে হয় এবং তাঁদের সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। গভীর দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি ডাইনির প্রতি এমন অন্ধবিশ্বাস থাকলে, যতই মিটিং মিছিল আন্দোলন কিংবা লেখালিখি হোক না কেন সমস্যাটা মোটেই দূর করা সম্ভব নয়। ডাইনির প্রতি গভীর বিশ্বাসও রাখবো আবার এর বিরুদ্ধে কলম চালাবো এটা সোজাসাপটা স্ববিরোধীতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরো দুঃখ পাই যখন ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েকজন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীরাও মনে করেন এই পৃথিবীতে সত্যিই ডাইনির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁরা নিজের ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একদা পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলা স্বঘোষিত ডাইনি ইপ্সিতা রায়চৌধুরী' র কথা। ১৯৮৮ সালে উনি সাড়াজাগিয়ে এসেছিলেন। সেসময় পত্রপত্রিকায় ওনাকে নিয়ে গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল। কয়েকটি পত্রিকাতো ওনাকে ভালো ডাইনি আখ্যা দিয়ে প্রশংসায় ভরা লেখা পর্যন্ত লিখেছে।  কিন্তু তারপরে যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা ওনার বুজরুকি ফাঁস হয়। আগষ্ট থেকে ডিসেম্ভর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্রিকায় উনার বুজরুকি ফাঁসের নানান মুখরোচক খবর প্রকাশিতও হয়।


কোনো ওঝা,জানগুরু,গুণিন, সৎসখা, দিখলি ইত্যাদিরা ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করলে বা ডাইনি বলে ঘোষণা করলে, তাঁদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপারে সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই এইসব প্রতারকদের জেলে ঢোকাতে পারেন অনায়াসেই।


" নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"।


" অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি "  র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেন্দ্র দাভোলকর, যাকে মৌলবাদী কট্টরপন্থীরা নৃশংশ ভাবে হত্যা করেছিল, তিনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " লাগু হয়। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 " এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


সাংসদ প্রবর্তিত The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954, আইনটি ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য।


The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনের ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..


" The Drugs And Cosmetics Act 1940 "  Amendment GSR 884 (E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন,১৯৫৫,১৯৫৭,১৯৬২,১৯৬৪,১৯৬৪ এবং শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় ২০০৯ সালে। ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের ' স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর '। এই আইনে এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।


কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। ইতিমধ্যে উনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


আইন আছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। গোদীলোভো কোনো রাজনৈতিক দলই চায়না আন্তরিক হতে, তাই তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই আমজনতার তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করতে নারাজ। নইলে সরকার চাইলে কড়া হাতে এইসব অমানবিক ও জঘন্য কাজ অনায়াসেই বন্ধ করতে পারে ব্যাপক আকারে সচেতনতার প্রচার ও প্রাসারের মাধ্যমে সঙ্গে ওঝা,জানগুরু ইত্যদিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যাবস্থা করে। এর সাথেই প্রয়োজন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজও বহু গ্রামগঞ্জে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ এবং ডাক্তার। তাই তো অজানা রোগ, জলবাহিত রোগ ইত্যাদিকে  ডাইনির প্রকোপ আখ্যা দিয়ে স্বার্থলোভী ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের প্রতারণা অবাধে চলছে।


ডাইনি বলে বাস্তবে কিছুই নেই ওসব গল্পের বই এবং সিনেমা সিরিয়ালেই সম্ভব। এইধারণা কে মনে গেঁথে নিলে এবং আন্তরিক হলে অবশ্যই বন্ধ করা যাবে এই ডাইনির ঘটনা গুলোকে। এর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নাটকের মাধ্যমে,  কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রচার মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে ডাইনির বিরুদ্ধে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে প্রশাসনের উচিৎ নজর রাখা কোনো গ্রামে কাউকে ডাইনি ঘোষণা হওয়ার খবর পেলেই দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া এবং যে বা যারাই কোনো মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে কড়া হাতে ব্যাবস্থা নেওয়া।


পর্ব-২।


গত ৫ জুলাই ২০২১ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এ ডাইনি সন্দেহে একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবী জানিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক কে ইমেল করেছি। খবর পেয়েছি সরকার এখনও নাকি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এই সূত্র ধরেই

কথা হচ্ছিল ফ্রিথিংকার এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিঃ দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার (Activist Dr Dibyajyoti Saikia) সাথে।

গত ১৪ আগষ্ট ২০১৫ সালে অসম বিধানসভায় পাশ হয়েছে ডাইনি হত্যা প্রতিরোধ আইন। " THE ASSAM WITCH HUNTING (PROHIBITION, PREVENTION AND  PROTECTION) ACT 2015 " অসম বিধানসভায় আলোচনার পর বিলটি গৃহীত হয় এবং ২৯ জুন ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইনে কোনো মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ডাইনি অপবাদে কাউকে অত্যাচার করা হলে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা জড়িত থাকলে সকলের কাছ থেকে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান থাকছে। ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় বিচার হবে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। তদন্তে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে ১০ হাজার টাকা। সরকারের দাবি, অসমের এই আইন বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের চেয়েও কড়া হবে। উল্লেখ্য, কিছু সময় আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির মাণ্ডরে ডাইনি অপবাদে পাঁচ মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়। অন্য রাজ্যগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে মাঝেমধ্যেই ডাইনি অপবাদে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে।

অসমে পাশ হওয়া আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার চালানো, একঘরে করা বা হত্যার ঘটনায় তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজার সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে উক্ত আইনে হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেআইনি অনুশীলন ও সালিশি সভা বন্ধেরও কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ডাইনি অপবাদে একঘরে হওয়া, জখম হওয়া, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মহিলা বা পুরুষকে ক্ষতিপূরণ এবং ডাইনি-শিকারের বলি হওয়া পরিবারের অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হবে।


এই আইনটি লাগু করার পেছনে দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার অবদান অনেক।

অসমে গত ৭ বছরে ডাইনি অপবাদে প্রায় ৭০ জনের বেশি খুন করা হয়েছে। এই ঘটনা বেশি ঘটেছে শোণিতপুর, লখিমপুর, মাজুলি, বড়ো ও সাঁওতাল অধ্যূষিত জেলাগুলিতে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে দেখেছে, অনেক ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। রাজ্য পুলিশ ডাইনি হত্যা রোধে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। পাশাপাশি বীরুবালা রাভা ও দিব্যজ্যোতি সাঁইকিয়া ডাইনি হত্যা রোধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু, তার পরও এই সব ঘটনা আটকানো যাচ্ছিল না।

দিব্যজ্যোতিবাবু জানান, প্রায় ছ’বছর ধরে তাঁরা ডাইনি হত্যা রোধে কড়া আইনের জন্য সুপারিশ করছিলেন। অসম সরকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া বিল তৈরি করে। মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘ছ’বছরের চেষ্টায় বিল পাশ হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু, ওঝাদের রমরমা বন্ধ করতে কোনও দল মুখ খুলল না। এটা খুবই মর্মান্তিক। অসম সরকারের হিসেবে, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৬ জন ও ২০১৪ সালে ডাইনি অপবাদে ৯ জনকে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে বিধানসভায় এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুল রহিম খান, অপরাধীদের জরিমানার টাকা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। অগপ বিধায়ক কেশব মহন্ত বলেন, ‘‘শাস্তি দিয়ে ডাইনি-হত্যার রাশ টানা যাবে না। স্কুলে স্কুলে অন্ধবিশ্বাস রোধে সচেতনতা শিবির ও এই বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’’


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রদদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"। " অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি " র প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র দাভলকর এর বিশেষ উদ্যোগে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " চালু হয়েছে। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


ভারতে এতোগুলো আইন থাকা সত্বেও ডাইনি বলে দেগে দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। অন্যান্য রাজ্যে আইন রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে না আছে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার কিংবা হত্যার কোনো তথ্য আর না কঠোর আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ।


কয়েকজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা মহারাষ্ট্রের ধাঁচে এই রাজ্যে একটা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। আইনটির নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


ডাইনি অপবাদে মাথা কেটে, পুড়িয়ে খুন, গ্রেফতার ১১

অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও রয়ে গিয়েছে ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা।

   

এই সময় ডিজিটাল ডেস্ক: অসমের কার্বি আংলঙে ডাইনি সন্দেহে মাথা কেটে, আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হল দু'জনকে, তার মধ্যে একজন মহিলা। রমাবতী হালুয়া এবং বিজয় গৌরের 'কালা জাদু'র জন্য গ্রামের মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এই অভিযোগ তুলে শুক্রবার দু'জনকে খুন করেন রোহিমপুর গ্রামের মানুষ। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়েই শুক্রবার ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার দেবজিৎ দেউরি। ধৃতদের মধ্যে দু'জন মহিলা, উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু অস্ত্র। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কুসংস্কারের বশে এ হেন নৃশংসতা অবাক করছে পুলিশ, প্রশাসনকেও।


দেবজিৎ জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রশ্মি গৌর নামে গ্রামের এক কিশোরী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, রশ্মি মৃত্যুর আগের দিন রমাবতী ও বিজয়ের নাম করে জানিয়েছিল, তাঁদের 'কালা জাদু'র জন্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। রশ্মির মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় গ্রামের আরও এক কিশোরী গ্রামপ্রধানের বাড়ি গিয়ে অসুস্থতার কথা জানায়। তারও দাবি, ওই দু'জনের কালা জাদুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে।


এর পরই গ্রামবাসীরা চড়াও হয়ে রমাবতী ও বিজয়কে পিটিয়ে মারে বলে অভিযোগ। কাছের পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে, রশ্মির কবরের খুব কাছে তাঁদের মাথা কেটে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসীরা। বৃহস্পতিবার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক এবং এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জিন্টু বোরা। সেখান থেকে পোড়া দেহাংশ ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মামলা দায়ের করে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।


অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা। গত আগস্ট মাসেও চিরাং জেলায় তিনজনকে ডাইনি সন্দেহে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে খুন করার চেষ্টা করে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁরা প্রাণে বাঁচেন। ডাইনি অপবাদে নৃশংস হত্যাকাণ্ড রুখতে রাজ্য সরকার আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও ঘোষণা করেছে। গ্রামবাসীদের সচেতন করতে নেওয়া হয়েছে 'প্রহরী' সামাজিক প্রকল্প। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তারই ফের প্রমাণ মিলল ডোকমোকায়। উল্লেখ্য, বছর দুয়েক আগে এই ডোকমোকাতেই দুই অসমীয়া যুবককে গ্রামবাসীরা ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে খুন করে।

https://eisamay.com/nation/2-brutally-killed-by-villagers-in-assam-in-suspected-witch-hunting-case/amp_articleshow/78453560.cms


ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবিতে চিঠি


সম্প্রতি, ডাইনি সন্দেহে এক প্রবীণাকে হত্যা করা হয়েছে ওডিশায়। তাঁর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। মৃতার নাম যমুনা হাঁসদা (৬২)। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আপাতত দুজনকে আটক করা হয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়ে বিজ্ঞানমনষ্ক বন্ধু রথীন মন্ডল সহ অনেকেই ইমেল করেছিল মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক মহাশয় কে। ইমেলের বয়ান-

প্রতি,

নবীন পট্টনায়ক সমীপেষু,

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী,

ওড়িশা সরকার।

বিষয় - ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবি।


মহাশয়,

গতকাল ' TheWire ' পত্রিকার মাধ্যমে পড়লাম, আপনার রাজ্যের ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় "জাদুবিদ্যা" অনুশীলনের অভিযোগ দিয়ে এক মহিলার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি বলিভোল গ্রামের বাসিন্দা, ৬২ বছর বয়সী যমুনা হংসদা। সূত্র- https://thewire.in/rights/odisha-elderly-tribal-woman-accused-of-witchcraft-beheaded


একজন বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মী হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

মহাশয়, এই একুশ শতকেও এমন নিন্দনীয় ঘটনা ভারতের বহু স্থানে প্রায়শই দেখা যায়।  National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত এবং খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। যদিও বে-সরকারি মতে সংখ্যাটা অনেক বেশি।

ডাইনি নামক কুসংস্কারের বিরূদ্ধে কিছু কঠিন আইন রয়েছে আমাদের দেশে। যেমন:- " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরােধ বিল -২০১১ " নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনাে মহিলাকে ডাইনি ঘােষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘােষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন -২০১১ ", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তােনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন- ১৯৯৯ "। এছাড়া, রয়েছে, " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 "। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 ", এবং " The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", IPC 307, IPC 302 এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।

আধুনিক সমাজে এমন কুসস্কারাচ্ছন্ন কর্মকাণ্ড মোটেই কাম্য নয়। আমি একজন বিজ্ঞানমনষ্ক ও সমাজকর্মী মানুষ হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

আশাকরছি আপনি এমন ঘটনার বিরূদ্ধে দ্রুত কড়া ব্যাবস্থা নেবেন এবং প্রকৃত অপরাধীদের কড়া শাস্তি দিয়ে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করন।

ধন্যবাদ সহ,

রথীন মণ্ডল,

পশ্চিম বর্ধমান, বাংলা। 



প্রসঙ্গ: এনআরসি, এনপিআর, সিএএ -সব্যসাচী মুখার্জি
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:54 | likes:0 | share: 0 | comments:0

(প্রথম পর্ব)

ভূমিকা

এনআরসি, এনপিআর, সিএএ- এই শব্দগুলি সম্ভবত বর্তমান ভারতবর্ষে সবথেকে বেশিবার উচ্চারিত শব্দ। আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি অর্থাৎ এনআরসি তালিকা থেকে ঊনিশ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ যাওয়ার পরে মানুষের মনে এনআরসি তথা নাগরিকত্ব হরণ নিয়ে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে গত এগারোই ডিসেম্বর সংসদে পাশ হয়ে যায় সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল-২০১৯. এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। ছাত্র, যুব, মহিলাদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে বিরল। এই বিক্ষোভ আন্দোলনের মাঝেই কেন্দ্রীয় সরকার এনপিআর তৈরির ছাড়পত্র দেয়। ফলে শুরু হয় আরেকদফা বিতর্ক। বারবার অভিযোগ উঠতে থাকে যে এই এনপিআর-ই হলো এনআরসি-র প্রথম ধাপ। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন ভোটার কার্ডও নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। ফলে মানুষেরই মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে। সঙ্গে ছড়াতে থাকে গুজব, ভুল তথ্য। সে কারণেই চেষ্টা করছি আপনাদের সামনে সরকারি নথিপত্র সহ সঠিক তথ্য তুলে ধরতে। তারপর ভালো মন্দ বিচারের সিদ্ধান্ত আপনাদের।


পর্ব এক: এনপিআর এবং এনআরসি


এনপিআর, এনআরসি এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব সম্বন্ধে  জানতে গেলে সময়রেখা ধরে একটু পিছনের দিকে যাওয়া দরকার। স্বাধীন ভারতের সংসদে ১৯৫৫ সালে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট পাশ হয়। এই আইন বলেই ভারতের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ভারতীয় নাগরিকত্বের বিষয়ে সমস্ত তথ্য এই আইনে রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী পাঁচভাবে ভারতের নাগরিক হওয়া যেতে পারে। বাই বার্থ অর্থাৎ জন্মগত ভাবে, বাই ডিসেন্ট অর্থাৎ বাবা মা ভারতবর্ষের নাগরিক হলে, বাই রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ আবেদনের ভিত্তিতে, বাই ন্যাচারালাইজেশন অর্থাৎ স্বাভাবীকরণের ভিত্তিতে এবং বাই ইনকোরপোরেশন অফ টেরিটরি অর্থাৎ কোনও এলাকা যেটা দেশের সীমানার মধ্যে আগে ছিলো না; পরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- সেই এলাকার প্রত্যেকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবে(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://indiacode.nic.in/bitstream/123456789/4210/1/Citizenship_Act_1955.pdf&ved=2ahUKEwivis37zJnoAhXAyDgGHbHRB9oQFjAYegQIBBAB&usg=AOvVaw0FzIFeLkTmCmbDkBnlGGVC&cshid=1584177656758 )। স্বাধীন ভারতের আইন অনুযায়ী ভারতের মাটিতে জন্মানো সব শিশুরা ভারতের নাগরিকত্ব পেতো। যে কোনও আধুনিক, সভ্য রাষ্ট্রে সেটাই হওয়া উচিৎ। ১৯৫৫ সালের এই নাগরিকত্ব আইন বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে। ধীরে ধীরে বারবার সংশোধনী এনে নাগরিকত্ব পাওয়ার রাস্তাকে সংকুচিত করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে সংশোধনী এনে বলা হয় ভারতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই অবধি। কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় ২০০৩ সালে; যখন কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ-র সরকার(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=http://164.100.47.4/billstexts/rsbilltexts/AsIntroduced/XXXIX_2003.pdf&ved=2ahUKEwiUs4j20ZnoAhWHzjgGHbNjDR8QFjASegQIAxAB&usg=AOvVaw2B_mzG4kTdFndT0AfduIfh)। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে(চিত্র: ১, চিত্র: ৩৮)। একইসঙ্গে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়েও বিস্তর পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী এই দেশে জন্মালেই একটি শিশু সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিক হয়ে যেতো; শিশুর বাবা মায়ের নাগরিকত্বের সঙ্গে শিশুটির নাগরিকত্বের কোনও সম্পর্ক ছিলো না। এই সংশোধনীতে বলা হয়- ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩ লাগু হওয়ার তারিখ(অর্থাৎ ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর) পর্যন্ত জন্ম হলে প্রমাণ করতে হবে যে বাবা অথবা মায়ের মধ্যে কেউ একজন ভারতীয় নাগরিক। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩ লাগু হওয়ার পর জন্মালে প্রমাণ করতে হবে যে বাবা অথবা মায়ের কেউ একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন(চিত্র:২)। একইসঙ্গে এই সংশোধনী ১৯৫৫ সালের সিটিজেনশিপ অ্যাক্টে ১৪এ ধারা যুক্ত করে যা সরকারকে গোটা দেশে এনআরআইসি করবার ক্ষমতা দেয়(চিত্র: ৩)। ১৪এ ধারায় লেখা আছে কেন্দ্র সরকার ভারতের প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্যতামূলক ভাবে পঞ্জিকরণ করতে পারে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করতে পারে। এই এনআরআইসি হলো ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস। আসামে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এনআরসি অর্থাৎ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস তৈরি হয়েছে। দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জি অর্থাৎ এনআরসি হলে তাকেই এনআরআইসি বলা হয়। দুটোর মধ্যে কোনও মূলগত তফাৎ নেই।

২০০৩ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সংসদে সর্বসম্মতিতে পাশ হয়। এই আইনে এনআরসি তৈরির বিষয়টিই কেবল আপত্তিজনক নয়; শিশুর নাগরিকত্বকে তার বাবা মায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়াও অত্যন্ত আপত্তিজনক। যারা অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছে বা যে সমস্ত মানুষরা "সিঙ্গেল পেরেন্ট"; তাঁদের সন্তানদের নাগরিকত্ব ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। সর্বোপরি ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাই থেকে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়া পর্যন্ত যারা জন্মেছিলো; তারা জন্মেই নাগরিক হয়ে গেছিলো। এই আইন পাশ করিয়ে পুনরায় তাদের নাগরিকত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হলো।

দেশের সংসদে যখন কোনও আইন তৈরি হয়; সেই আইন কীভাবে কার্যকর করা হবে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক একটি নিয়ম বা রুলস তৈরি করে। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পরেও এরকম একটি রুল তৈরি হয়; যার নাম- সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস-২০০৩. এই রুলসেই এনআরআইসি এবং এনপিআর তৈরির বিষয়ে লেখা আছে

(তথ্যসূত্র: https://drive.google.com/file/d/1GRr0YEJ5Ouj03GKJR5ZOR4ie9XoojHTq/view?usp=drivesdk)। ৩১ জুলাই, ২০১৯ এ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এনপিআরের গেজেট নোটিফিকেশন জারি করা হয়। সেই নোটিফিকেশনে লেখা রয়েছে সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস-২০০৩ এর রুল নম্বর ৩ এর সাব রুল ৪ অনুযায়ী সরকার এনপিআর করতে চাইছে(চিত্র: ৪)। কী লেখা আছে সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস-২০০৩ এর রুল নম্বর ৩ এর সাব রুল ৪ এ? ৩ নম্বর রুল হলো "ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস"; অর্থাৎ এনআরসি তৈরির রুল(চিত্র:৫)। সেই এনআরআইসি তৈরির রুলের ৪ নম্বর সাব রুলে লেখা রয়েছে- কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে; তার মধ্যে লোকাল রেজিস্টারের জুরিসডিকশনে বসবাসকারী ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে পপুলেশন রেজিস্টার তৈরি করতে পারে(চিত্র:৬)। ৫ নম্বর সাবরুলে লেখা আছে পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে লোকাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস তৈরি হবে(চিত্র:৭)।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; এনপিআরের গেজেট নোটিফিকেশনে বলা আছে যে আসামে এনপিআর হবে না। কেন? তার কারণ আসামে এনআরসি হয়ে গেছে। এনআরসি হয়ে গেলে আইনত আর এনপিআর করা যায় না।

সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ এর ৪ নম্বর রুলের ৩ এবং ৪ নম্বর সাবরুলে লেখা আছে- পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য লোকাল রেজিস্টার দ্বারা যাচাই করা হবে এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় সময়ে যাদের নাগরিকত্ব সন্দেহজনক মনে হবে; লোকাল রেজিস্টার সেই বিষয়টা পপুলেশন রেজিস্টারে উল্লেখ করবেন। সেই বিষয়ে তদন্ত হবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে সেটা জানানো হবে(চিত্র:৮)। এবারের এনপিআরে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আধার নম্বর এবং বাবা মায়ের তথ্য। বাবা, মা কবে কোথায় জন্মেছেন; সেটাও জানাতে হবে; যা অনেকেই জানেন না। ফলে তাঁরা উত্তর দিতে পারবেন না। মুশকিল হলো; সিটিজেনশিপ রুলস-২০০৩ এ কোথাও বলা নেই ঠিক কী কী তথ্য না দিলে সরকারি আধিকারিক কাউকে সন্দেহজনক নাগরিক ঘোষণা করতে পারেন। সবটাই সরকারি আধিকারিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সর্বোপরি; আধার নম্বর বাধ্যতামূলক করা অন্য একটি বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। আধার কার্ডের ওপর বড়ো করে লেখা আছে। এনপিআর হয় সিটিজেনশিপ অ্যাক্টি-১৯৫৫ এবং সিটিজেনশিপ রুলস-২০০৩ অনুযায়ী। এনপিআরের কাজ সন্দেহজনক নাগরিক চিহ্নিত করা। তাহলে এনপিআরে আধার নম্বর বাধ্যতামূলক কেন? নাগরিকত্বের সঙ্গে বায়োমেট্রিক্সের সম্পর্কটা কী? এনপিআরের সঙ্গে বায়োমেট্রিক্স যোগের কথা সরকার সরকার সংসদেও স্বীকার করে নিয়েছিল। বলা হয়েছিলো কিছু রাজ্যে বায়োমেট্রিক্স সংগ্রহ করবে এনপিআর, কিছু রাজ্যে আধার(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://mha.gov.in/MHA1/Par2017/pdfs/par2014-pdfs/rs-230714/229.pdf&ved=2ahUKEwiwhbLhkZzoAhVNzjgGHWTVCSoQFjABegQIBBAB&usg=AOvVaw3qeUa_w6TWIQNSZ8rGL1xE)। এখন সবার আধার কার্ড করিয়ে সেটাকে এনপিআরে সংযুক্ত করার কারণটা কী? ঠিক কোন খিচুড়িটা পাকানো হচ্ছে? আধারের সঙ্গে মোবাইল নম্বর,  আধারের সঙ্গে প্যান, প্যানের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট; এখন ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধার যোগ করতে চাইছে কেন্দ্র। আধারে বায়োমেট্রিক্সের মতো ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। তাহলে কি এটা প্রত্যেকটা মানুষকে ২৪*৭ রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে আনার চেষ্টা? পরবর্তীতে তো বিষয়টা এমনও হতে পারে যে আধার ধরে এক একটা মানুষকে জাস্ট নেই করে দেওয়া হবে। বায়োমেট্রিক্সের তথ্য সহ এনপিআর; এই বিশাল তথ্যভান্ডার যে আদৌ সুরক্ষিত থাকবে তার কী গ্যারান্টি আছে? আধারের সঙ্গে নাগরিকত্বকে জুড়ে দেওয়ার পর যদি এই বিপুল তথ্যভান্ডারে একজনের বায়োমেট্রিক্স অন্যজনের বায়োমেট্রিক্সের সঙ্গে মিলেমিশে যায় তখন কী হবে? তখন তো বহু মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। আধারে যে কী ভয়াবহ ভুলত্রুটি এবং গোলমাল হয় আমরা সবাই সেটা দেখেছি। বড়সড় সর্বনাশ হলে দায়টা কে নেবে?

এনপিআর এবং জনগণনা হবে একই সময়ে, একজনই সরকারি আধিকারিক দুটোরই তথ্য নেবেন। ফলে জনগণনা এবং এনপিআর-কে এক বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে। জনগণনার আইনি ভিত্তি সেন্সাস অ্যাক্ট-১৯৪৮(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=http://censusindia.gov.in/2011-Act%26Rules/notifications/Act%2520%26%2520Rules%2520corrected%252029-5-08_doc.pdf&ved=2ahUKEwix04fJ7pzoAhXUxzgGHf4gDikQFjAAegQIBBAB&usg=AOvVaw2sCgI8TQbbpFFtMavlcTtj) আর এনপিআরের আইনি ভিত্তি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-১৯৫৫ এবং সিটিজেনশিপ রুলস-২০০৩. এই দুটো বিষয়ের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং, এই বিষয়ে অন্তত কোনও সন্দেহের অবকাশই থাকে না যে এনপিআর এনআরসি-র প্রথম ধাপ। সঙ্গে যোগ হয়েছে আধার। অনেকে বলবেন এনপিআর তো আগেও হয়েছে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে আগেও এনপিআর হয়েছে। কিন্তু পূর্বের এনপিআরের সঙ্গে এ বারের এনপিআরের তফাৎ আছে। নতুন অনেক প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে। সর্বোপরি এনআরসি হলে তা ঠিক কতটা ভয়াবহ হতে পারে; সেটা আসাম আমাদের দেখিয়েছে। সেটা থেকে শিক্ষা নিয়েই এনআরসি-র প্রথম ধাপ এনপিআরের বিরোধিতা করা প্রয়োজন।২০১৮~১৯ সালের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টেও কথা লেখা আছে এনপিআর এনআরআইসি-র প্রথম ধাপ(চিত্র: ৯)। ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই রাজ্যসভাতেও সরকার জানিয়েছিলো যে তারা এনপিআরের তথ্য যাচাই করে এনআরআইসি করতে চায়(চিত্র: ১০)। সুতরাং এনআরসি আটকাতে গেলে এনপিআর আটকাতেই হবে।

আসামের এনআরসি-র একটা অন্য ইতিহাস রয়েছে। আসামে বিদেশীদের তাড়িয়ে দেওয়ার দাবীতে ১৯৭৯ সাল থেকে দীর্ঘকালীন আন্দোলন চলেছে। ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসাম আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়(তথ্যসূত্র: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Assam_Accord)। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন হোম সেক্রেটারি আর.ডি.প্রধান এবং চিফ সেক্রেটারি পি.পি.ত্রিবেদী। আন্দোলনকারীদের তরফে অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি পি.কে.মোহন্ত, সাধারণ সম্পাদক পি.কে.ফুকন এবং অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক বিরাজ শর্মা স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিই আসাম একর্ড নামে পরিচিত(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://peacemaker.un.org/sites/peacemaker.un.org/files/IN_850815_Assam%2520Accord.pdf&ved=2ahUKEwi5o5LM05noAhU6wzgGHf4qDg0QFjApegQICBAB&usg=AOvVaw2dQQvd-eiMoD13cMaOhXfD&cshid=1584178859564)। এই চুক্তির অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে প্রধান একটি বিষয় ছিলো বিদেশী চিহ্নিতকরণ এবং বিতাড়ন। অর্থাৎ বিদেশীদের চিহ্নিত করে আসাম থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। আসাম একর্ড স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে ১৯৮৫ সালে নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করা হয় এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ৬এ ধারা যুক্ত করা হয়; যা শুধুমাত্র আসামের জন্যই প্রযোজ্য(চিত্র: ১১)। যদিও আসাম একর্ডে এনআরসি তৈরির কথা বলা হয়নি।২০০৯ সালে "আসাম পাবলিক ওয়ার্কস" নামে একটি এনজিও সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি আপডেট করার আবেদন জানায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট এনআরসি আপডেট করার নির্দেশ দেয়(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/gulfnews.com/amp/world/asia/india/assam-nrc-timeline-through-the-years-1.66124831)। আসামে এনআরসি-র কাট অফ ডেট ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। অর্থাৎ; এনআরসিতে নাম তোলার জন্য আসামের প্রত্যেক মানুষকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাঁরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে থেকে ভারতবর্ষে আছেন। এই কাট অফ ডেট ঠিক হয় আসাম একর্ড অনুযায়ী; যার ভিত্তিতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ৬এ ধারা যুক্ত হয়(চিত্র: ১২)। গোটা দেশের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাট অফ ডেট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ভারতের সংবিধানের ৬ নম্বর ধারায় লেখা আছে- যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই থেকে তার পরবর্তীতে যাঁরা ভারতে এসেছেন; তাঁদের প্রত্যেককে আবেদন করে নাগরিকত্ব নিতে হবে(চিত্র: ১৩)। সুতরাং; সংবিধান মেনে ধরে নেওয়া যায় যে গোটা দেশে এনআরসি হলে তার কাট অফ ডেট হবে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই। কী কী লাগবে এনআরসিতে নাম তুলতে গেলে? আসামের এনআরসিতে নাম তোলার জন্য লিস্ট এ তে উল্লিখিত নিজের অথবা পূর্বপুরুষের ১৪ টি নথিকে গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে। সেগুলি হলো-

১৯৫১ সালের এনআরসি, ২৪ মার্চ; ১৯৭১ পর্যন্ত ভোটার লিস্ট, জমির দলিল, সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট, রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, এলআইসি, গভর্নমেন্টের ইস্যু করা লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট, গভর্নমেন্ট সার্ভিস/ এমপ্লয়মেন্ট সার্টিফিকেট, ব্যাঙ্ক/ পোস্ট অফিস অ্যাকাউন্ট, বার্থ সার্টিফিকেট, বোর্ড/ ইউনিভার্সিটির এডুকেশনাল সার্টিফিকেট, কোর্ট রেকর্ডস।

যদি লিস্ট এ অর্থাৎ উপরিউক্ত নথিগুলি পূর্বপুরুষের হয়; তাহলে লিস্ট বি তে উল্লিখিত নথিও জমা দিতে হবে। লিস্ট বি তে উল্লিখিত আটটি নথি হলো-

বার্থ সার্টিফিকেট, ল্যান্ড ডকুমেন্ট, বোর্ড/ ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট, ব্যাঙ্ক/এলআইসি, পোস্ট অফিস রেকর্ড, সার্কেল অফিসার বা জিপি সেক্রেটারির তরফ থেকে বিবাহিতা মহিলাদের দেওয়া সার্টিফিকেট, ভোটার লিস্ট, রেশন কার্ড অথবা আইনত গ্রাহ্য অন্য কোনও কাগজপত্র। (তথ্যসূত্র: http://www.nrcassam.nic.in/admin-documents.html)

মোদ্দা বিষয় হলো আসামের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি বা তাঁর পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে থেকে আসামের বসবাস করছেন। এই নথিপত্রের তালিকা বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষে এনআরসি হলে প্রত্যেককে সম্ভাব্য সাংবিধানিক কাট অফ ডেট অর্থাৎ ১৯ জুলাই, ১৯৪৮ সালের আগে থেকে নিজের অথবা তার পূর্বপুরুষের ভারতবর্ষে বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে।

এই পশ্চিমবঙ্গে বহু মানুষ স্বাধীনতার পর ওপার বাংলা থেকে এসেছেন। আসামের এনআরসি তালিকা দেখতে দেখা যাবে; এনআরসি ছুট ঊনিশ লক্ষ্য মানুষের মধ্যে চোদ্দ লক্ষ হিন্দু। সেটাই স্বাভাবিক; কারণ স্বাধীনতার পরে ওপার বাংলা থেকে মূলত হিন্দুরাই ভারতে এসেছেন। তাঁদের অনেকের কাছেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। বহু প্রান্তিক, গরীব মানুষের কাছে কাগজপত্র নেই। এই বাংলায় বন্যায় প্রতিবছর ঘরবাড়ি ভেসে যায়। কী করে মানুষজন কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করবেন নিজের নাগরিকত্ব? আসামের এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা। মহিলাদের বিয়ের পরে পদবী পাল্টে যায়, ঠিকানা পাল্টে যায়। ফলে নথিপত্র জমা দিতে গিয়ে তাঁরাই বিপদে পড়েছেন বেশি(তথ্যসূত্র: https://www.thecitizen.in/index.php/en/NewsDetail/index/7/17924/Women-Worst-Victims-of-NRC-Gendered-and-Discriminatory-Nature-of-the-Register-Revealed)। এনআরসি হলে বিপদে পড়বেন বাবা মায়ের পরিচয়হীন ব্যক্তিরা, যৌনকর্মী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। কারণ এঁদের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক থাকে না। আসামে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ডাক্তার, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী সহ অনেকে। বাদ গিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারও(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/www.indiatoday.in/amp/india/story/former-president-fakhruddin-ali-ahmed-family-again-left-out-of-nrc-list-1594188-2019-09-01)। সমস্ত নথি দেখিয়েও বাদ পড়েছেন অনেকে। ১৫ টি নথি দেখিয়েও এক মহিলা প্রমাণ করতে পারেননি যে তিনি ভারতের নাগরিক(তথ্যসূত্র: https://www.ndtv.com/india-news/declared-foreigner-assam-womans-story-predicts-citizenship-list-effect-2182212)। এনআরসি-তে যাঁরা বাদ পড়েছেন; তাঁদের ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ভারতের নাগরিক(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/www.thehindu.com/news/national/over-19-lakh-excluded-from-assams-final-nrc/article29307099.ece/amp/)। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে যেতে হাজার হাজার টাকাটা লাগে। সবথেকে বেশি বাদ পড়েছেন গরীব মানুষরা। কোর্ট কাছারি করতে করতে আজকে তাঁদের জীবন কার্যত নরকে পরিণত হয়েছে। কী করে প্রমাণ করবেন তাঁরা নিজেদের নাগরিকত্ব? মানুষের এই চূড়ান্ত কষ্ট এবং হয়রানির দায় কে নেবেন? নরেন্দ্র মোদী না অমিত শাহ? বারবার করে বিজেপির তরফে বলে যাওয়া হচ্ছে ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যামেরার সামনে বলেছেন যে ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়(তথ্যসূত্র: https://youtu.be/eNd792HSl_A)। অথচ ভারতের সংবিধানের ৩২৬ নম্বর ধারায় পরিষ্কার করে লেখা রয়েছে যে ভারতে কেউ ভোটার হতে গেলে তাকে আঠারো বছরের বেশি বয়স্ক হতে হবে এবং ভারতের নাগরিক হতে হবে(চিত্র: ১৪)। "দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপলস অ্যাক্ট-১৯৫০" এর ১৬(১) ধারায় বলা হয়েছে যে শুধু ভারতের নাগরিকদেরই ভোটার তালিকায় নাম থাকতে পারে(চিত্র: ১৫)। ২৩.০৪.২০১৫ তে সংসদের "Unstarred Question No- 4920" র উত্তরে এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী এফিডেভিট করে জানিয়েছেন যে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকায় কোনও বিদেশীর নাম নেই (তথ্যসূত্র: সংসদীয় যৌথ কমিটির রিপোর্ট, পৃষ্ঠা-১১০,১১১; চিত্র ১৬, ১৭)। তাই যাঁরা ভোটার; তাঁরা অবশ্যই ভারতের নাগরিক। সংবিধান সেটাই বলে। আর ভোটার কার্ড যদি বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণ না হয়; তবে অবৈধ নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত সরকারও অবৈধ বলে গণ্য হওয়া উচিৎ।

এনআরসি এবং তার প্রথম ধাপ এনপিআর করার কোনও বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা নেই। যতই মানুষের কানে কানে অবৈধ অনুপ্রবেশের গল্প শোনানো হোক না কেন; জনগণনা থেকে প্রাপ্ত কোনও তথ্য অনুপ্রবেশ তত্ত্বকে সমর্থন করে না। যদি সত্যিই বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে হু হু করে অনুপ্রবেশ ঘটতো; তাহলে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি হতো। কিন্তু জনগণনার তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক কম; শুধু তাই নয় গুজরাটের মতো রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে অনেক বেশি(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-editorial-on-citizenship-amendment-act/amp_articleshow/73981400.cms)। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আরা ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ১৭.৬৪%. বিহারের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৫.০৭%, ছত্তীসগড়ের ২২.৬০%, রাজস্থানের ২১.৪০%, উত্তরপ্রদেশের ২০.১০%, মধ্যপ্রদেশের ২০.৩০%। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ১৩.৯৩%, আসামে ১৬.৯০%. অর্থাৎ অনুপ্রবেশের তত্ত্ব শুধুই মাত্র হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ফরওয়ার্ড করা মেসেজ এবং আইটি সেলের ফেসবুক পোস্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর যদি তর্কের খাতিরে এও ধরে নেওয়া হয় যে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ভারতে ঢুকে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে; জনগণনার তথ্য সেই বক্তব্যকেও সমর্থন করে না। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবথেকে বেশি বাঙালি থাকে পাঁচটি রাজ্যে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক দিল্লী এবং উত্তরপ্রদেশ। এই চারটি রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বাঙালিদের অবদান যথাক্রমে ০.৩৯%, ০.৮৫%,০.৫৬%, ০.২৫% এবং ০.১৭%.(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/post-editorial-on-infiltration/amp_articleshow/74590772.cms) সর্বোপরি, এক দেশ থেকে অবৈধ ভাবে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিক। কাজের সন্ধানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যান। অর্থাৎ, অনুপ্রবেশের মূল কারণটা যে অর্থনৈতিক; এটা বুঝে নেওয়া দরকার। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কমেছে অনুপ্রবেশ।

সুতরাং, কোনও অঙ্কতেই বিপুল অনুপ্রবেশের তত্ত্ব মেলানো যায় না। এমনকি বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন কিছু এলাকায় বারবার মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। বিষয় হলো; যে সমস্ত জেলায় জনসংখ্যার হার বেশি; সেখানে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে জনসংখ্যার হার বেশি; যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম; সেখানে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে কম। (তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/www.anandabazar.com/amp/editorial/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25A8-%25E0%25A6%25AA-%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%25B6-%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%25A7-%25E0%25A6%25AA-%25E0%25A6%25AA-%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%259C-1.205663)। যতটুকু অনুপ্রবেশ হচ্ছে; সেটা আটকানোর জন্য বিএসএফ রয়েছে, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নিজের দেশে  ফেরৎ পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯২০, ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬ এর মতো শক্ত আইন রয়েছে। সেই সব কিছু থাকা সত্ত্বেও অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে এনআরসি করতে চাওয়া আসলে মানুষের মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে তাকে নাগরিকত্বের প্রশ্নে ব্যস্ত করে তোলা। ফিসফিস করে আরেকটা প্রচার চলে- মুসলিমরা বেশি অপরাধপ্রবণ হয়। এই কথারও কোনও বাস্তবিক ভিত্তি নেই।

আরও একটি প্রচার চলে। দলে দলে মুসলিমরা ঢুকে সব চাকরি বাকরি খেয়ে নিচ্ছে। অনুপ্রবেশের তত্ত্ব যে কতটা ভুয়ো; সেটা আগেই প্রমাণিত। কিন্তু মুসলিমরা সত্যিই প্রচুর চাকরি পাচ্ছে? ২০০৫ সালে গঠিত হওয়া উচ্চপর্যায়ের সাচার কমিটির রিপোর্ট ঠিক তার উল্টো কথা বলেছিলো(তথ্যসূত্র: https://drive.google.com/file/d/1KlbF64TQ9EfR2uO0LdZbmie_QQ2YBLMp/view?usp=drivesdk)। ওই রিপোর্টে দেখা গিয়েছিলো ভারতে মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা এসসি, এসটি-দের থেকেও খারাপ। সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে "রেগুলার ওয়ার্কার"দের মধ্যে জনসংখ্যার শতাংশের ভিত্তিতে মুসলিমদের যোগদান সবথেকে কম(চিত্র: ১৮)। "পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম তোষণ হয়"- এই কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। কী রকম তোষণ হয়? আসুন একটু জেনে নিই। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৭% মতো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি এবং বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিমদের যোগদান ২৭% এর আশেপাশে হওয়া উচিৎ। কিন্তু তথ্য কী বলছে? পশ্চিমবঙ্গে ৩৩১২৪৯ জন সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ১৮৯৯১ জন মুসলমান। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারী মধ্যে মুসলিমদের যোগদান ৫.৭৩%. সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীন গ্রুপ এ এবং গ্রুপ বি সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের যোগদান ছিলো ৪.৭%, গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি-র ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ২.১%(তথ্যসূত্র: https://www.google.com/amp/s/www.thehindu.com/news/cities/kolkata/Bengal-records-more-Muslims-in-govt.-jobs/article16439342.ece/amp/)। ভয়াবহ তোষণ হচ্ছে না? হিন্দুরা বিপদে তো এই তোষণের জন্য। এইজন্যই তো এনআরসি দরকার।

অনেকে বলবেন সরকারি কর্মচারীরা অনেকসময় দুর্নীতিপরায়ণ হন। ফলে অনেক সময়েই তাঁরা ঘুষ নিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেন। সত্যিই যদি তাই হয়; তবে তাঁদের কাছে প্রশ্ন- দেশজুড়ে এনআরসি প্রক্রিয়াটা কারা করবেন? সেই সমস্ত সরকারি কর্মচারীরাই করবেন। সরকারি কর্মচারীদের কথা যখন উঠলোই; তখন আসামের এনআরসি প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়ন হয়েছে সেটা বলা দরকার। ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অ্যাডভোকেট; যাঁদের "মেম্বার" বলা হয়; তাঁদের কাজের মূল্যায়ন হয় তাঁরা কতো মানুষকে বিদেশী ঘোষণা করেছেন তার ওপর। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে "মেম্বার" যত বেশি মানুষকে বিদেশী ঘোষণা করতে পেরেছেন; সেই "মেম্বারে"র কাজ সরকারি নথিতে তত বেশি প্রশংসিত হয়েছে(চিত্র: ১৯, ২০)। অর্থাৎ; বেশি বেশি সংখ্যায় মানুষকে রাষ্ট্রহীন করলেই কাজের জায়গায় তাঁদের সুনাম। আজ বাদে কাল কাজের জায়গায় সুনামের জন্য আমি বাঁ আপনি যে বাদ পড়ে যাবো না; এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন কি?

এবার আসা যাক এনআরসি-র অর্থনৈতিক প্রভাবের দিকে। আসামের মতো একটা মাঝারি মাপের রাজ্যে এনআরসি করতে খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি টাকা। গোটা ভারতে এনআরসি হলে মোটামুটি এর ৪০ গুণ খরচা হবে; অর্থাৎ আনুমানিক ৬৪০০০ কোটি টাকা খরচা হবে। জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে জনগণকে বিপদে ফেলার কারণ কী? নাগরিকত্বের অধিকার মূল অধিকার। কেউ নাগরিক হলে তবেই সে বাকি সাংবিধানিক অধিকার পাবে। গোটা দেশে যখন গণতন্ত্রের ওপর আঘাত নেমে আসছে; তখন খুব সচেতন ভাবে নাগরিক অধিকার হরণের লক্ষ্যেই এই এনআরসি, এনপিআরের অবতারণা। মানুষের সমস্ত অধিকার হরণ করে তাদের বিনা পয়সার মজুর বানানোর চক্রান্ত এই এনআরসি, এনপিআর। দেশের শ্রমিক, কৃষকদের ওপর যতই অত্যাচার হোক না কেন; শেষত তাঁরা নাগরিক। ফলে কোথাও গিয়ে রাষ্ট্রের একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়। সেই দায়বদ্ধতা থেকে হাত ধুয়ে ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্ব বিহীন বিনা পয়সার  মজুরে পরিণত করাই এনআরসি-র লক্ষ্য। একইসঙ্গে বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের মেরুকরণের রাজনীতির বিপুল সুবিধা হবে এই এনআরসিতে। একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি ছড়ানো ঘৃণার ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের রাজনীতি। সেই কারণেই এনপিআর, এনআরসি-র মানুষ মারা পদক্ষেপ গ্রহণ। আর ঠিক এই কারণেই যে কোনও মূল্যে এনপিআর, এনআরসি-কে প্রতিহত করা দরকার।



মেনে নিলাম -মধুসূদন মাহাতো
Nov. 19, 2024 | কবিতা | views:25 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মিঁত্রো - - -

এক দেশ এক আইন মেনে নিলাম৷


তর্কের খাতিরে—

এক দেশ এক ভাষা (হিন্দি) মেনে নিলাম!

এক দেশ এক ধর্ম (হিন্দু) মেনে নিলাম!

এক দেশ এক পোশাক(গেরুয়া) মেনে নিলাম!

এক দেশ এক খাদ্যও (নিরামিষ) মেনে নিলাম!

এক দেশ এক নাম হিন্দুস্তান (ভারত,ঈন্ডিয়া বাদ) মেনে নিলাম!

যেহেতু কাশ্মীরে এক দেশ এক আইন বলবৎ হচ্ছে, অতএব মহারাষ্ট্র, গুজরাট, আসাম, মনিপুর, অন্ধ্র, সিকিম, অরুণাচল, মিজোরাম থেকেও ৩৭১ ধারার উচ্ছেদ মেনে নিলাম!


এসটি/এসসি'দের সংরক্ষণ তুলে দেওয়া মেনে নিলাম!

ওদের জমি যে কেউ কিনতে পারে, মেনে নিলাম!

এই সবগুলি মেনে নেওয়ার পর ভারতের ৮০কোটি গরীবের কি কল্যাণ হবে?


আপনাকে বলতে হবে—

এক দেশ এক আইন, অথচ দেশটায় ধনী গরিব থাকবে কেন?

এক দেশ এক আইন, অথচ দেশের ৫১% সম্পদের মালিক কেন আম্বানি আদানীরা হবে?

এক দেশ এক আইন, অথচ ১শতাংশ ধনীর প্রতিদিনের আয় কেন ২২০০কোটি টাকা হবে?


মিঁত্রো—

দেশের আইন সবার জন্য সমান করতে পারছেন৷ ভালো কথা৷


পারবেন- - আপনার ঐ আইনে দেশের সব জমি গুলি দেশের সব মানুষের মধ্যে ভাগ করে দিতে?


পারবেন- - আপনার ঐ আইনে দেশের সব সম্পদগুলি দেশের সব মানুষের মধ্যে ভাগ করে দিতে?


হাঃ হাঃ মিঁত্রো!

আইন সকলের জন্য সমান করলেই হবে না, সম্পদ সকলের জন্য সমান করতে হবে৷ আর যেটা আপনি পারবেন না৷ কারণ আপনার টিকিটা তো বাঁধা আছে ঐ পুঁজিপতিদের কাছেই!


পুরুলিয়া,

০৫/০৮/২০১৯

দেশের আইন কি মাকড়সা জলের মতো?? -জামাল আনসারী
Nov. 19, 2024 | আইন | views:43 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয় মাকড়সা জাল দেখেছো। কি সুন্দর বুনন! তাই না। কিন্তু এই জাল হল ছোট ছোট পোকা- মাকড় ধরার ফাঁদ। জালের সংস্পর্শে কোনো ছোট পোকা এলেই সেই জালে জড়িয়ে পড়ে। আর যদি একবার জালে আটকে যায়, তাহলে  পোকার চৌদ্দ গুষ্টির সাধ্য নেই, সেই অতিসূক্ষ জালের তীব্র আকর্ষণ  ছিন্ন করে,পালিয়ে বাঁচে। তবে মজার ব্যাপার হলো এই যে, মাকড়সা জালে কখনও কোনো হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক, আটকে পড়ে না। কারন তাঁরা তাদের পেশী শক্তি দ্বারা অতি সহজেই জালের বন্ধন ছিন্ন করে,অবাধে,নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারে।


দেশের আইন হচ্ছে অনেকটা মাকড়সার জালের মতো।ছোট্ট কিছু পড়লে আটকে যায়, কিন্তু বড়ো কিছু জালে পড়লে জাল ছিঁড়ে ঠিকই বেরিয়ে আসে।তাই দেশের আইন দিয়ে খেটে খাওয়া, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত,গরীব মানুষ গুলোকে বিনা বিচারে, বিচারের নামে প্রহসনে দিনের পর দিন কারাগারে আটকে রাখা যায়।কিন্তু ললিত মোদি, নীরব মোদি,বিজয় মালিয়ার মতো  মহান দেশপ্রেমিক(!) মানুষরা সেই আইনের জাল ছিঁড়ে অনায়াসে বেরিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারে। দেশের আইন, আদালত, বিচার ব্যবস্থা,CBI সম্মিলিত ভাবে চেষ্টা করেও পালিয়ে যাওয়া  ধনকুবের, শিল্পপতিদের টিকি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেন না। কেন??একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই সহজেই বুঝতে পারবে, নেতা, মন্ত্রীরা হাজার অন্যায়- অত্যাচার, দুর্নীতি, খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি করলেও পেশী শক্তি দ্বারা  ওই আইন নামক মাকড়সা জাল ছিঁড়ে ঠিকই বেরিয়ে যায়। 


এক বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনের আগে একশো ত্রিশ কোটি মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সরকার গঠন করলে, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা দেশে নিয়ে এসে দেশের কোটি মানুষের উন্নয়ন করবে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি যে ক্রমশ রসাতলে যেতে বসেছে, তবুও বিদেশের একটিও কালো টাকা কি দেশে এসে পৌঁচেছে। না পৌঁছে নি। আর  কোনোদিনই ঐ কালো টাকা দেশে আনার কোনো ব্যবস্থায় নেওয়া হবে না। কারন সেই কালো টাকার মালিক তো আর গরিব নয়। সব  ধনকুবের, শিল্পপতি, নেতা, মন্ত্রীদের টাকা। সে হোক না কালো টাকা। তাতে কি! ঐ যে আগেই বলেছি।দেশের আইন নামক মাকড়সা জালে তারা কোনোদিনই আটকে পড়ে না। তারা আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 


দেশের আইন তাদের জন্য নয়। দেশের আইন গরিব মানুষের জন্য...গরিব মানুষদের মারার জন্য...

মিলিয়ে দেখবে কোনো গরিব চাষি ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া মাত্র হাজার দশের টাকা ঋণ পরিশোধ করতে না পারার জন্য জেল খাটতে বাধ্য হয়।কিন্তু ললিত মোদি, নীরব মোদি, বিজয় মালিয়া... এদের কত হাজার কোটি টাকা ভারতীয় ব্যাঙ্কে ঋণ আছে!! এখনও সেই টাকা কেউ পরিশোধ করে নি।তবুও তাদের জেল হয় না। কেন??

যারা হাজার কোটি টাকা চুরি করে আছে তাদের জেল হয় না, কিন্তু কোনো মানুষ না খেতে পেয়ে দোকানে সামান্য রুটি চুরি করার অপধধে জেল হয়।

আবার সবাই বলে দেশের আইন নাকি সবার জন্য সমান ! কোন মানদণ্ডে দেশের আইন সবার জন্য সমান তা আজও আমার মাথায় ঢোকে নি।

(বিঃ দ্র: আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আমার পূর্ন আস্থা আছে)

জ্যোতিষী, তান্ত্রিকগিরি প্রতারণা পেশা, হতে পারে জেলও। -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | আইন | views:293 | likes:2 | share: 1 | comments:0

জ্যোতিষী, তান্ত্রিক,ওঝা,জানগুরু,কাপালিক, অলৌকিক ক্ষমতাধর, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাধর, ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করা কোনো ব্যাক্তি, ইত্যাদিদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো আইন রয়েছে। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে  টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অবজ্ঞার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। কিন্তু তারা কানে তুলো গুঁজে বসে থাকে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপার সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে সমস্ত, চোর, চিটিংবাজদের জেলে ঢোকাতে পারেন, অনায়াসেই।


নরেন্দ্র দাভোলকর, যিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন, অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতির। উনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে "The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act, 2013 লাগু হয়। তাছাড়া Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954, The Drugs and Cosmetics Act 1940, IPC 420, IPC 302, IPC 303 এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


প্রসঙ্গত জানাই, সংসদ প্রবর্তিত এই আইন 30 th April 1954 সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং  1st May 1954 এ ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য।


The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় 1963 তে। এই আইনের 9(A) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..


আগে Drugs and Magic Remedies Act ভঙ্গকারীদের অপরাধ ছিলো Non-Cognizable অর্থাৎ এক বা একাধিক ব্যাক্তিকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হত। পুলিশ সরকারের তরফ থেকে অভিযোগকারীর পক্ষে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতেন। আদালত অভিযুক্তর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা বা ওয়ারেন্ট দায়ের করলে তবেই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন।

এই উল্লিখিত আইন ভাঙ্গাটা যেহেতু Non-Cognizable অপরাধ বলে 1963 সালে আইন সংযোজনের আগে পর্যন্ত গণ্য করা হত, তাই আদালত অভিযুক্তর বাসস্থল কিংবা ব্যাবসা/চাকরিস্থলে থানা মারফত অভিযুক্তকে সামনস পাঠাতেন। সামনস অর্থাৎ আদালতের নির্দেশ। যাতে লেখা থাকে কবে, কতটার সময়, কোনো আদালতে তাকে হাজিরা দিতে হবে। যেহেতু উল্লেখিত এই আইন ভাঙ্গাটা Criminal Offence বা ফৌজদারি অপরাধ তাই অভিযুক্তকে (পড়ুন জ্যোতিষী, তান্ত্রিককে)  আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে হত।


কোনো জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা,জানগুরু ইত্যাদি বুজরুক প্রতারকের বিরুদ্ধে  ' ম্যাজিক রেমেডিস 'আইন ভেঙ্গেছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পরও কোনোও বিশেষ কারণে পুলিশ নিরব দর্শক থাকতেই পারেন। তখন আপনি অভিযোগকারী হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করার প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে (যেমন ডাইরি নং অথবা লিখিত অভিযোগ গ্রহণের থানার সিলমোহর ও স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্র) আদালতে মামলা করা যায়। একে ' Complain Case ' বলে। এই মামলার ভিত্তিতে আদালত সামনস পাঠাবেন অভিযুক্তর কাছে। অভিযুক্ত আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেবেন।  সামনস অগ্রাহ্য করলে আদালত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ কে আদেশ দেবেন।


" The Drugs And Cosmetics Act 1940, Amendment GSR 884 (E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন,1955,1957,1962,1963,1964..শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় 2009 এ। 19th March 2009 তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের ' স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর '।  এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।


কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে সরব। ইতিমধ্যে ওনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill 2016 "..  আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে।


পরিশেষে জানাই, বৃত্তিকর চাপান হয় আইনসম্মত পেশার উপর। আইন সম্মত পেশার একটা তালিকা আছে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন, টেডস, কলিংস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯-এ। প্রফেশন ট্যাক্স বিষয়ক আইন ১৯৭৯ এর সেকশন ও (২) তে আইন-সম্মত পেশার পূর্ণ তালিকা দেওয়া আছে। তাতে কোথাও ‘জ্যোতিষ’ এর নাম নেই। কারন ‘জ্যোতিষ’ এর কোন আইনি স্বীকৃতি নেই। বরং এদেশের আইন অনুসারে জ্যোতিষ পেশা বে-আইনি, নিষিদ্ধ, অবাঞ্ছিত, অনৈতিক এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।


জ্যোতিষ শাস্ত্রটাই যখন বে-আইনি, প্রতারণা এবং চিটিংবাজি। তখন আজ নয়তো কাল জ্যোতিষী, তান্ত্রিকদের জেলে যাওয়া আটকানোর সাধ্য কারোর নেই। তবে আমার ব্যাক্তিগত মতে শুধুমাত্র কঠোর আইন এনে এদের দমানো যাবেনা। কারন টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতির সুবাদে এরা আইন কে পকেট বন্দি করে ছাড় পেয়ে যাবে। এদের একটাই ওষুধ। সেটা হচ্ছে বয়কট করা।

বুজরুকি, প্রতারণা ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনস্বার্থে প্রচারিত -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | আইন | views:297 | likes:2 | share: 2 | comments:0

"ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি" ১৯৮৫ সাল থেকেই প্রশাসনের কাছে প্রবল দাবী জানিয়ে আসছে আইনকে মলাট বন্দি না রেখে, সর্বত্র তার প্রয়োগ হোক। কিছু ভারতীয় আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেমন, Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954, Drug and Cosmetic Act 1940 (Amendment 2009), IPC 415, 420 (প্রতারণা), IPC 299 to 308 (অপরাধজনক নরহত্যা, অপরাধজনক নরহত্যা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ), IPC120 A&B (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র), IPC 319 to 338 (আঘাত, গুরুতর আঘাত), IPC 339 to 358 (অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ), IPC 268 (গন-উপদ্রপ), IPC 375 (ধর্ষণ), IPC 503 to 507 (অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন), IPC 508 (কোন ব্যক্তিকে সে দৈব আক্রোশ কবলিত হইবে বলিয়া বিশ্বাস করিবার জন্য প্ররোচিত করিয়া কোন কার্য সম্পাদন করা), IPC 447 (অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ), IPC 354, 509 (শ্লীলতাহানি) এবং IPC 367 (ধর্ষণের চেষ্টা), IPC 425(অনিষ্ট) ইত্যাদি।

আইন অনুযায়ী যেকোনো অলৌকিক(?) কর্মকাণ্ড এর নামে ধান্ধাবাজি, বুজরুকী, ঝাড়ফুঁকের নামে অত্যাচার, ব্যভিচার, প্রতারণা করে তার যেকোনো রকম প্রাসার, প্রচার এবং প্রয়োগ নিষিদ্ধ এবং নূন্যতম শাস্তি ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন বা ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে। জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বাবাজী, মাতাজী, ওঝা, গুণিন, জানগুরুদের  বিভিন্ন বুজরুকী বা পরিকল্পিত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ বহুবার জানানো হয়েছে।


"ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"ই  ভারতের একমাত্র সংগঠন, যারা ১৯৮৫ সাল (দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে) থেকেই উক্ত ভারতীয় আইনের প্রচার এবং তার প্রয়োগ করে চলেছে "জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বাবাজী, মাতাজী, ওঝা, গুণিন, জানগুরুদের " বিরুদ্ধে যাদের অনেকেই আজ শ্রীঘরে। "জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বাবাজী, মাতাজী, ওঝা, গুণিন, জানগুরুদের" উদ্দেশ্যে রইলো ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফে "৫০ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ", যে কেউ যেকোন রকম অলৌকিক (?) ঘটনা দেখাতে পারলেই উক্ত পুরস্কার সেই ব্যক্তির হাতে। এই চ্যালেঞ্জ এর সামনে আজপর্যন্ত ৭০০ ওপর অবতার, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক বুজরুকরা পরাজিত।

"ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি" র হাতে পরাজিতদের তালিকাটি বিশাল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন - তারাপীঠের তান্ত্রিক নির্মলানন্দ, গৌতম ভারতী, ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতা, পুনের মিঠাইবাবা, সাইবাবা, সাইদাবাদী, আমেরিকার মরিস সেরুলো, ফকির এস পি আলি, সত্যানন্দ, বাবা রামদেব, অলৌকিক মাতা জয়া গাঙ্গুলি, ক্লাইভ হ্যারিস, ভ্যাটিকানের পোপ (মাদার টেরিজার অলৌকিকতা!) প্রমুখ।

বুজরুক, অলৌকিক বাবাজী, মতাজী, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ঠগবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইন কি বলছে দেখা যাক:

"দ্যা ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশন্যাবল অ্যাডভারটাইজমেন্টস) অ্যাক্ট, ১৯৫৪"-সংসদে প্রবর্তিত এই আইন ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ তারিখে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১মে ১৯৫৪ তারিখে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত।


  ড্রাগ সম্পর্কিত কিছু বিজ্ঞাপন এবং যাদু বা মন্ত্রবলে রোগ প্রতিকার হিসেবে বর্ণিত বিজ্ঞাপন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এই আইন প্রবর্তিত। ১৯৬৩-তে আইনটি সংশোধন করা হয় এবং ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হল, এই আইন ভঙ্গকারীদের 'congnizable' অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হবে।


জ্যোতিষ,তান্ত্রিক,ম্যাগনেটোথেরাপি,ফেংশুই সহ সমস্ত রকম বাবাজী মাতাজীদের শায়েস্তা করতে "দ্যা ড্রাগস অ্যান্ড কস্মেটিকস অ্যাক্ট ১৯৪০" আইনটি আরও কড়া হল l 19 মার্চ 2009 ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান দপ্তর একটি নোটিশ জারি করে GSR 884 (E) The Drugs and Cosmetics Act (1940) Amendment. নোটিশে জানাল প্রতিটি ওষুধের ওজন, আয়তন, উপাদান সমূহের পরিমাণ ওষুধের লেবেলের গায়ে না সাঁটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে l ওষুধ সেবনের ফলে রোগীর মৃত্যু বা আশঙ্কাজনক ক্ষতি হলে ওষুধ প্রস্তুতকারকের শাস্তি আজীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে ও দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও হতে পারে l [উক্ত আইনে "cosmetics" দ্রব্যাদিও পড়ছে এবং যা "ISI Standard" এর মান দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার পর বাজারে বিক্রি করা যাবে। তাহলে দেখাই যাচ্ছে "ধনলক্ষী যন্ত্র বা সৌভাগ্য জেমস" এর নামে কিভাবে এক দুর্নীতির চক্র চলছে আমাদের আশেপাশে!]


ওষুধ বা 'ড্রাগ' বলতে শরীরে যাহা কাজ করে বলে দাবি করা হবে যেমন তাবিজ, মাদুলি, কবজ, যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই কিন্তু ড্রাগের মধ্যেই পরে 

সাধারণ মানুষের কী করণীয় এই ভন্ডামীর বিরুদ্ধে:

আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গবাসী হন, এবং কোনও তান্ত্রিক বা জ্যোতিষী যদি রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া আপনার কাছে কোনো তাবিজ,কবজ, মাদুলি বা ঐ ধরণের কিছু বিক্রয় করে থাকেন তবে আপনি আপনার অভিযোগ দায়ের করবেন এই ঠিকানায়--DIRECTORATE OF DRUGS CONTROL

P – 16, INDIA EXCHANGE PLACE EXTENSION, K.I.T. BUILDING – 5TH FLOOR, KOLKATA - 700 073, (+) 91 – (+) 33 – 2225 – 2214 / 9587 / 9610,TELE FAX: - 2225 – 2215, Email: psumana2021@gmail.com


অভিযোগ দায়ের করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, তান্ত্রিক-জ্যোতিষির রোগ সারাবার কোনো বিজ্ঞাপন পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকলে তার জেরক্স কপি অভিযোগ পত্রের সাথে যুক্ত করে দেবেন। মূল কাগজটি যত্ন করে রেখে দেবেন, মামলা চলাকালীন কাজে লাগবে l আপনার অভিযোগ পাওয়ার পর ড্রাগস কন্ট্রোল থেকে অভিযুক্তের কাছে জানতে চাইবে এই ধরণের তাবিজ কবজ (যা আইনের সংঞ্জায় ওষুধ বা ড্রাগস) তৈরির বৈধ লাইসেন্স তার কাছে আছে কিনা l ড্রাগস কন্ট্রোলের দেওয়া লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ বানানো বা বিক্রয়ের জন্য ওই জ্যোতিষী বা তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবে ড্রাগস কন্ট্রোল l মামলাটি হবে অভিযুক্ত তান্ত্রিক-জ্যোতিষি বনাম সরকারের।  আপনাকে বড়জোর সাক্ষী দেওয়া ছাড়া কিছুটি করতে হবে না। এবং সর্বোপরি  আপনার নিকটবর্তী পুলিশ থানা, বিডিও, এসডিও বা ডিএম অফিসে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে রাখুন।

তাহলে, আসুন আপনি আমি সহ সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বেআইনি এইসব পেশার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলি এবং নিথর প্রশাসনকে সচল করি, নচেৎ আইন বইয়ের মলাটে বন্দিই থাকবে অনন্তকাল অবধি।

তথ্যসহায়তায়: প্রবীর ঘোষ,অনাবিল সেনগুপ্ত, সন্তোষ শর্মা।

বাংলায় কুসংস্কার বিরোধী আইনের প্রস্তাবনা -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | আইন | views:62 | likes:1 | share: 1 | comments:0

প্রথমেই স্মরণ করা যাক পুনে- মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা, ডাক্তার নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরের (জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর)। ১৯৭০ সালে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি পান, তার পর থেকে ১৯৮২ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত একটি হাসপাতাল ও দু’টি ক্লিনিক চালাতেন। তার পর ১৯৮৩ সালে উনি হঠাৎই হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়ে গড়ে তোলেন "অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি"র। শুধু মহারাষ্ট্রেই ২৩০টি শাখা বর্তমানে। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।


মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক, কালাজাদু, কুসংস্কার, দৈব চিকিৎসা, অলৌকিক শক্তিধর, নিরিহ মহিলাদের ডাইনি বলে দেগে দেওয়া ইত্যাদি বুজরুকির বিরুদ্ধে দাভোলকর, একটি কঠোর আইন প্রণয়ণের জন্য কাজ করছিলেন। কিন্তু, ২০১৩ সালের ২০ অগস্ট ভোরবেলা পুনেতে তাঁর বাড়ির সামনেই প্রাতর্ভ্রমণের সময় দু’জন বন্দুকধারী আততায়ী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে চার রাউন্ড গুলি চালায় নরেন্দ্র দাভোলকরের উপর। দু’টি গুলি মাথায় লাগে। রক্তাক্ত অবস্থাতেই লুটিয়ে পড়েন তিনি এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।


দাভোলকর যে আইনের জন্য কাজ করছিলেন সেই বিলটি বিধানসভার অধিবেশনে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আলোচনার জন্য বিলটির কথা তোলাই হয়নি। দাভোলকর কিন্তু থামেননি। অধিবেশনে বিলটির প্রসঙ্গ এল সাত-সাত বার। এক বারও আলোচনার জন্য তোলা হল না। অবশেষে, জনগণের চাপে তাঁর হত্যার তিন দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৩ অগস্ট ২০১৩ বিলটি পাশ করানোর জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করেন মহারাষ্ট্র সরকার এবং শেষ পর্যন্ত ওই বছরই ১৮ ডিসেম্বর মহারাষ্ট্র বিধানসভায় পাশ হয়, " মহারাষ্ট্র প্রিভেনশন অ্যান্ড ইর‌্যাডিকেশন অব হিউম্যান স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড আদার ইনহিউম্যান ইভিল অ্যান্ড অঘোরী প্র্যাকটিসেস অ্যান্ড ব্ল্যাক ম্যাজিক বিল-২০১৩ (The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act, 2013)।


দাভোলকরের মৃত্যুর পর "ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান র‌্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন" এর সভাপতি নরেন্দ্র নায়ক বলেছিলেন -“প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যদি মনে করে থাকে আমাদের এক জনকে গুলি চালিয়ে খুন করে আন্দোলনকে স্তব্ধ করবে, তবে তারা ভুল করছে। অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই কখনওই থামে না, ব্যাটনটা হাতবদল হয় শুধু।"


কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে, মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। গত ৪ঠা এপ্রিল ২০১৭, কুসংস্কারবিরোধী আইন প্রস্তাবনা উদ্যোগ এর পক্ষে এই  রাজ্যে কুসংস্কারবিরোধী আইন লাগু করার জন্য একটা খসড়া প্রস্তাব জমা দিয়েছে, রাজ্য আইন কমিশন, রাজ্য বিধানসভার স্পিকারের দফতর এবং অন্যান্য জায়গায়। এনারা যে আইনটি আনতে চান তার নাম "The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill 2016"। আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


সেই খসড়া প্রস্তাবটির  সিডিউল ৩টে তেরোটা  আইন মোতাবেক আদালত গ্রাহ্য অপরাধ হিসেবে  গণ্য করার জন্য কুসংস্কারচর্চার একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। যেমন-

১) ভূত  অশুভ  আত্মা  প্রেতাত্মা  বা  ওই  ধরনের  কিছু  তাড়ানোর  অজুহাতে  কোনো  ব্যক্তিকে  দড়ি  শেকল  ইত্যাদি  দিয়ে  বাঁধা  ঝুলিয়ে  রাখা, তাকে  লাঠি  জুতো  ঝাঁটা  চাবুক  বা  ওই  ধরনের  কোনো  বস্তু  দিয়ে  মারা  চুল  ছিড়ে  নেওয়া  বা  কেটে  দেওয়া, গরম  লোহার  শিক  বা  ওই  ধরনের  কিছু  দিয়ে ছেঁকা  দেওয়া, যে কোনোভাবে  শারীরিক  ও মানসিক  নির্যাতন  করা, শুকনো  লঙ্কা জাতীয়  জিনিস  পুড়িয়ে  তার  গন্ধ  শোকানো, অত্যাচারের  ভয়  দেখিয়ে  নোংরা  জল  প্রস্রাব  বিষ্ঠা  বা  ওই  জাতীয়  কোনো  অখাদ্য  কুখাদ্য  খেতে  বাধ্য  করা, জুতো  মুখে  নিয়ে  দৌড়ে  যাওয়া, ওই  জাতীয়  সামাজিক  মর্যাদা  হানিকর  কোনো  কাজ  করতে  বাধ্য  করা, প্রকাশ্যে বা  অপ্রকাশ্য  যৌন  হেনস্থা   হয়রানি  করা, অন্য  যে  কোনো  মানসিক  বা  দৈহিকভাবে  অস্বাস্থ্যকর  কাজ  করতে  বাধ্য  করা  আইনত  দণ্ডনীয়  অপরাধ  হিসেবে  গণ্য  করতে  হবে। 

কাউকে  ভূতে  ধরেছে  বা  অশুভ  আত্মা  বা  অশুভ  শক্তি  ভর  করেছে  বলে  প্রচার  করাটাও  এই  আইনের  আওতায়  আসবে।

২) তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে এবং / অথবা প্রচার করে জনসাধারণের কাছ থেকে  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ জমি বাড়ি অলংকার  সম্পত্তি  ইত্যাদি আদায় /উপার্জন  করা, ভয়  দেখানো সন্ত্রস্ত করা প্রতারিত করা, শারীরিক  /মানসিকভাবে  ক্ষতিকর  কোনো  ক্রিয়া কলাপ  করা এবং / অথবা অন্যকে প্ররোচিত  করা  অপরাধ  হিসেবে  গণ্য  করতে  হবে। 

৩) অলৌকিক  শক্তি  বা  ক্ষমতার  অধিকারী  হতে  গিয়ে  বা  ওই  ধরনের  অতিপ্রাকৃত  কোনো   শক্তির  আশীর্বাদধন্য  হওয়ার  / করার  বাসনায়  এমন  কিছু  করার  বা  অন্যকে  প্ররোচিত  করা  যাতে  ব্যক্তির   শারীরিক  /  মানসিক  ক্ষতি  বা  জীবনহানির  আশঙ্কা  থাকে, অপরাধ  হবে  এসব কাজ ও।


৪) জলের  গোপন  উৎস, গুপ্তধন, সোনাদানা, হীরে, খনিজ সম্পদ  ইত্যাদি  অনুসন্ধানের  নামে  কোনো  অমানবিক  এবং  / অথবা  বৈজ্ঞানিকভাবে  অপরীক্ষীত   এবং  / অথবা  অস্বীকৃত  কোনো  কাজ  / যাদু -  করা  বা কাউকে  সেই  ধরনের  কাজ  করতে  প্ররোচিত  / প্রলুব্ধ  করা  এবং  সেই  ধরনের  কাজের  প্রচার  করা, যাতে  কোনো   ব্যক্তির  শারীরিক  /মানসিক  ক্ষতি   কিংবা   অঙ্গ/ জীবনহানি  হয়  বা  তার  আশঙ্কা  থাকে।


৫) কোনো  ব্যক্তির  অলৌকিক  বা  দৈবশক্তি  আছে  বা  ওই  ধরনের  কোনো  শক্তি  ভর  করেছে  বলে  প্রচার  করে  জনসাধারণকে  ভীত - সন্ত্রস্ত  করে  তোলা, এমন  প্রচারের  দ্বারা  মানুষকে  আকৃষ্ট  করে  অর্থ, সম্পত্তি  ইত্যাদি  আদায়  করা  বা  তার  চেষ্টা  করা  এই তথাকথিত  দৈবশক্তির  প্রতি  আনুগত্য  না  দেখালে  বা ঘোষিত  বিধান  না  মানলে  সমূহ  ক্ষতি  হওয়া  বা  ক্ষতি  করার  ভয়  দেখানো  দণ্ডনীয়  অপরাধ  বলে  আইনের  আওতায়  আনতে  হবে।


৬) কোনো  ব্যক্তি  তথাকথিত  ভূত  নামানো  প্রেত চর্চা  ডাকিনিবিদ্যা  চর্চা  করে  বা  তার  মাধ্যমে  সে অশুভ  শক্তিকে  নিয়ন্ত্রণ  করতে  পারে, কুনজর  কুদৃষ্টি  দিয়ে  বান  মেরে  মন্ত্রতন্ত্র  বা  অন্য  কোনো  ক্রিযকলাপের  মাধ্যমে  গবাদিপশুর  মড়ক  লাগানো, দুগ্ধবতী  দুধ  নিঃসরণ  বন্ধ  করা, অসুখবিসুখ  ঘটনো  থেকে  শুরু  করে  নানাবিধ  দুর্ভাগ্য  ডেকে  আনা  এবং  যেকোনো  ক্ষতিসাধন  করার  অশুভ  ক্ষমতা  আছে  বলে  প্রচার  করা,  এবং  ওই  ব্যক্তিকে  ডাইন  বা  ডাইনি  শয়তানের  অনুচর  /দূত  ইত্যাদি  তকমা  দিয়ে  প্রচার  করা, তার  ওপর  শারীরিক /মানসিক   অত্যাচার  চালানো, তাকে  একঘরে  করা, অর্থ  জমি  ইত্যাদি  আদায়  করা  বা  দখল  করা,  তাকে  এলাকা  থেকে  বিতাড়িত  করা, তার  ওপর  হামলা  এবং  /অথবা  তাকে  হত্যার  চেষ্টা। 


৭) কোনো  ব্যক্তিকে  ডাইন  বা  ডাইনি  বলে  দেগে  দিয়ে  তাকে  প্রকাশ্যে  /অপ্রকাশ্যে  নগ্ন  করে  হাঁকানো  এবং  তার  ওপর  যে  কোনো  ধরনের  শারীরিক / মানসিক  নির্যাতন  চালানো। 


৮) নখদর্পণ, থালা - বাটি  চালা, কন্ছি  চালা, আটার  গুলি  ইত্যাদির  সাহায্যে  চোর  ধরা, অপরাধী  শনাক্ত  করা  বা  করার  চেষ্টা  বা ওই  ধরনের  দাবি  / বিজ্ঞাপন  দেওয়া  বা  সেই  সূত্রে  কোনো  ব্যক্তির  ওপর  শারীরিক  /মানসিক  নির্যাতন  করা  বা তার  প্ররোচনা  দেওয়া। 


৯) সাস, কুকুর, বিছে  বা  যে  কোনো  প্রাণীর  কামড়ের  চিকিৎসার  ক্ষেত্রে  বৈজ্ঞানিকভাবে  প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত  ও  স্বীকৃত  পদ্ধতি  এড়িয়ে, রোগীকে  তা  নেওয়ার  ব্যাপারে  উৎসাহিত  / সাহায্য  না  করে  /নেওয়ার  ব্যাপারে বাধা  দিয়ে  ওঝাগুনিন, তান্ত্রিক  প্রমুখের  দ্বারস্থ  হওয়ার  প্ররোচনা  দেওয়া  এবং  / অথবা  ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র তন্ত্র, বিষপাথর  দিয়ে  বিষ  তোলা, ক্ষতস্হানে  মুরগির  পায়ু  ঘষা, শেকড়  বাকর  ইত্যাদি  দিয়ে /খাইয়ে  বিষ  নামানোর  চেষ্টা  ইত্যাদি। 


১০) আঙুল  বা  অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  দিয়ে  'রক্তপাতহীন'  অস্ত্রোপচার, গর্ভবতী  মহিলার  যৌনাঙ্গে  হাত  /  আঙ্গুল  ব্যবহার  করে  বা  অন্য  যে  কোনো  পদ্ধতিতে  গর্ভস্থ  ভ্রূণের  লিঙ্গ  নির্ধারণ  /পরিবর্তন  করার  দাবি  করা।


১১) সন্তানধারণে  ইচ্ছুক  মহিলাকে  ডিম, কলা  বা  অন্য  কোনো  বস্তু  খাইয়ে, তন্ত্রমন্ত্র- এর  সাহায্যে  বা  অন্য  কোনো  অবৈজ্ঞানিক  পদ্ধতি  অবলম্বন  করে  এবং  / অথবা  তথাকথিত  অলৌকিক  শক্তির  সাহায্য  নিয়ে  " সন্তানবতী"   করার  দাবি  করা  / চেষ্টা  করা। 

আলৌকিক  ক্ষমতার  সাহায্যে  কোনো  মহিলাকে  সন্তানবতী  করার  প্রতিশ্রুতি দিয়ে  এবং  বিশ্বাসের  সুযোগ  নিয়ে  তাকে  প্রতারণা  করা, যৌন সম্পর্ক স্থাপন  করা, যৌন নির্যাতন  চালানো।  তুকতাক  ঝাড়ফুঁক  মন্ত্রপূত  জলপড়া  তেলপড়া  তাবিজ  কবজ  মাদুলি  আংটি, তামা  বা  ওই  জাতীয়  ধাতু, পাথর, শিকড় বাকড়, মাটি  মন্ত্র  তন্ত্র,  বিশ্বাস, প্রার্থনা  ইত্যাদির  মাধ্যমে  শারীরিক  /মানসিক  চিকিৎসা  করা  /করার  চেষ্টা  করা  /  দাবি  করা। 


১২) কোনো  ব্যক্তির  শারীরিক  / মানসিক  বিকার, কোনো  ব্যক্তি, প্রাণী  বা  বস্তুর  ব্যতিক্রমী  জৈব  রূপ, সত্তা  বা  বাস্তবতার  বহিঃপ্রকাশকে  দৈব  ঘটনা, ঈশ্বরের  আবির্ভাব  ইত্যাদি  বলে  প্রচার  করা  কিংবা   সেই  ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণীকে  " দৈবশক্তি  সম্পন্ন  বলে  প্রচার  করা  এবং  তার  মাধ্যমে  জনসাধারণকে  বিভ্রান্ত  করা, অর্থ  আদায়  করা, সেই  ব্যক্তি, বস্ত  বা প্রাণীর  প্রতি  আনুগত্য  আদায়  করা, তার  ঘোষিত  বা  তার  নামে  ঘোষিত  বিধিবিধান, আদেশ, উপদেশ  জনসাধারণকে  মেনে  চলতে  প্ররোচিত  করা  বা  বাধ্য  করা।


১৩) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জমিজমা, চাকরি, ব্যবসা, প্রেম, বিয়ে, দাম্পত্য  কলহ, শত্রুদমন   জাতীয়  ব্যক্তিগত  /পারিবারিক   সমস্যার  নিষ্পত্তি  করতে  তন্ত্রমন্ত্র, বশীকরণ, মুঠিকরণ, বানমারা, তুকতাক  বা  ওই  ধরনের  যে কোনো  অবৈজ্ঞানিক  (অপরীক্ষিত  ও  অপ্রমাণিত)   পদ্ধতির  সাহায্য  দেওয়া, দাবি  ও  প্রচার  করা, বিজ্ঞাপন  দেওয়া।


অতিরিক্ত সংযোজন:-

(ক) ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.সি. প্যাটেল এবং বিচারপতি এ.কে. সিকরি র ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকার কে নোটিশ পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনো সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখালে জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশক প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন "The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954" অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়। সে খবরের সংক্ষেপসার ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।


(খ) ২২ জুন ২০০৩ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে - রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা যাঁরা করেন, তাঁরা নিজের নামের আগে ' ডাক্তার ' শব্দটা কোনো ভাবেই ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ এই চিকিৎসা পদ্ধতির কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রক স্পষ্ট করে এটাও জানিয়েছে যে, রেইকি সহ জেম থেরাপি, কালার থেরাপি, ম্যাগনেটোথেরাপি,আরোমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি ইত্যাদি তথাকথিত প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিই বে-আইনি এবং এইসব পদ্ধতি শেখানো কিংবা প্রয়োগকারী ব্যাক্তি কোনো ভাবেই নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটাকে ব্যবহার করতে পারবেন না। রইলো একটি খবরও।


State anti-superstition laws not enough. India needs a central law, focus on victim not crime

Cases of witch-hunting and human-sacrifices are part of systems of oppression that have been culturally and religiously legitimised for centuries.

ASTHA MADAN GROVER and SUSHOVAN PATNAIK

9 December, 2020 03:38 pm IST

India’s multi-ethnic identity makes it a nation of many superstitions. On November 15, a newspaper story reported how police rescued four minor boys in Assam suspected to be sacrificed in a ritual. Further, the National Crime Record Bureau (NCRB) data for 2019 revealed an overall rise in witch-hunting cases, with Chhattisgarh witnessing 22-witch-hunt related deaths in the past year.


In yet another instance in Odisha, in August 2020, a woman was killed after being impaled with a Trisul or a trident, a divine symbol in Hindusim, during a medical treatment by a self-proclaimed supernatural doctor. As a result in this case – JituMurumu @ SukulMurmu&Anr. v. State of Odisha – the Odisha High Court observed that existing state laws were inadequate to address the issue and emphasised on the urgent need for a central law instead.


Witch-hunting and broader superstition related crimes violate basic fundamental rights guaranteed under Article 14, 15, and 21 of the Indian Constitution. Such acts also violate several provisions of various International legislations to which India is a signatory, such as the ‘Universal Declaration of Human Rights, 1948’, ‘International Covenant on Civil and Political Rights, 1966’, and ‘Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women, 1979’.


Yet, despite constitutionally guaranteed fundamental rights and provisions in international legislations, the reality on the ground remains starkly different. A primary reason for this is the lacunae that exist in the Indian Penal Code (IPC).


For instance, the IPC only takes cognisance of human sacrifice after a murder is committed, and the physical torture that alleged ‘witches’ are subjected to is categorised as merely ‘simple hurt’. The accompanying mental trauma is completely ignored. Victims, therefore, find it hard to get justice and often withdraw their complaints due to societal pressure – letting perpetrators off the hook.


Given this context, several Indian states have recognised the need for special anti-witch-hunt laws since 1999. Yet, only a few have enacted them and the ones that have are wanting in implementation. This blog analyses the existing state laws and builds the case for a central law that takes reasons for the failure of implementation of state laws into account. It argues that for a central legislation to be effective, it must be grounded in the larger socio-cultural context, with adequate restorative measures for victims.

News Link- https://theprint.in/opinion/state-anti-superstition-laws-not-enough-india-needs-a-central-law-focus-on-victim-not-crime/563439/

কর্নাটকে চালু হল কুসংস্কার বিরোধী আইন -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | আইন | views:61 | likes:1 | share: 2 | comments:0

কর্নাটকে কুসংস্কার বিরোধী আইন চালু হল গত ৪ জানুয়ারি ২০২০ থেকে। ওইদিন রাজ্যপাল ভজুভাই ভালা আইনে সিলমোহর দেন। মজার ব্যাপার হল, বরাবর যে বিলের কট্টর বিরোধী ছিল বিজেপি তথা গেরুয়া শিবির, সেই তাদেরই জমানায় বিলটি কর্নাটকে পাস হল, দেশের দ্বিতীয় রাজ্য হিসেবে!

কুসংস্কারবিরোধী আইনের হয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন করেছে কর্নাটক। রাজ্যের মানবাধিকার ও বিজ্ঞানকর্মীদের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে একটি খসড়া পেশ করা হয়েছিল রাজ্য বিধানসভায়। আলাপ-আলোচনার পরে সেই বিলটি ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর বিধানসভায় পাস হয়। তখন রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়ার কংগ্রেস।


প্রত্যাশিতভাবে, এই বিলের বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। চিকমাগালুরের বিজেপি বিধায়ক সিটি রবি বিধানসভায় বলেছিলেন, "এই আইন চালু হলে রাজ্যের হিন্দু জনসমাজের বহু প্রথা, আচরণবিধি আইন ও আচার-অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, যা কখনো সরকারের করা উচিত নয়।" তাঁর বক্তব্য ছিল, এই আইন চালু হলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এইসব যুক্তি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। যুক্তি, তথ্য, বিজ্ঞান ও মানবিক আবেদনের কাছে হার হয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির।


"কর্নাটক অমানবিক ও ক্ষতিকারক চর্চা ও কালা জাদু প্রতিরোধ আইন, ২০১৬"(The Karnataka Prevention and Eradication of Inhuman Evil Practices and Black Magic Bill 2016) শীর্ষক এই আইনে এখন থেকে কী কী নিষিদ্ধ একবার দেখে নেওয়া যাক।

মাডে স্নান বা উচ্চবর্ণের অভুক্ত উচ্ছিষ্টের ওপর নিম্নবর্ণের মানুষের গড়াগড়ি খাওয়ার মতো প্রথা ও এই সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, কালো জাদু প্রদর্শনী বা চর্চা, অমানবিক ও ক্ষতিকর যেকোনো ধরনের চর্চা, আচার অনুষ্ঠান, ধনসম্পত্তি আহরণ বা প্রাপ্তির কথা বলে তন্ত্রচর্চা, শারীরিক মানসিক ও যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি, অংগপ্রত্যংগ কাটা বা বলি দেওয়া, আগুনে হাঁটা...এগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে। এছাড়া ধর্মের কারণে বা ধর্মের অজুহাত দিয়ে এখন থেকে আর কোনো মানুষকে নগ্ন করে ঘোরানো যাবে না। রোগ সারানোর নামে কারোর উপর কোনওরকম ভুতুড়ে, অপরীক্ষিত ও নির্যাতনমূলক ক্রিয়াকলাপ চালানো যাবে না। ধর্মের নামে মানুষকে ভুল তথ্য দেওয়া, ভূত বা অলৌকিক শক্তির কথা বলে এমন বলা বা করা যাবে না বা কাউকে প্ররোচিত করা যাবে না, যা মানুষ বা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক।

তবে এই আইনে পুজোপাঠ চর্চা, ধর্মানুষ্ঠান, পরিক্রমা, মিছিল, সমাবেশ, প্রাচীন ধর্মকথা, সাধুসন্ন্যাসীদের অলৌকিক গালগল্প, কান জিভ ফুটো করা, মাথা ন্যাড়া, জ্যোতিষ ও বাস্তুশাস্ত্রকে বর্জনীয় বলে মনে করা হয়নি। কেন করা হয়নি এটাই কোটিটাকার প্রশ্ন।


Karnataka's anti-superstition bill gets Governor's nod

The law came into effect on January 4, according to the government order.

NEWS POLICY WEDNESDAY, JANUARY 22, 2020 - 17:28

TNM Staff Follow @thenewsminute

Karnataka Governor Vajubhai Vala has given his assent to the Karnataka Prevention and Eradication of Inhuman Evil Practices and Black magic Act 2017.


Popularly known as the Anti-Superstition Act, the law was enacted in 2017 during the Siddaramaiah-led Congress government’s rule in Karnataka.

According to the government order issued earlier this month, the Act came into force from January 4, 2020. The Karnataka Prevention and Eradication of Inhuman Evil Practices and Black Magic Bill 2016 was passed in the state Assembly on November 17, 2017 amid opposition from BJP MLA from Chikkamagaluru, CT Ravi, who had argued that the state government could not curb certain practices of the Hindu community.


What is banned-

The act bans made snana, menstrual taboos, performing any black magic, inhumane act and evil practices in search of treasure or bounty, tantric acts which include physical and sexual assault.

Practices such as parading people naked, ostracising a person in the name of a ritual and encouraging inhumane acts during said rituals are also banned.


Rituals of exorcism, assaulting people under the pretext of exorcism, misinformation and creating a panic-like situation under the pretext of ghosts and black magic is also be banned. Other practices such as making claims of having healing power, propagating practices that involve self-mutilation and coercing people to perform fire-walking are banned.


The law also states that if any person is killed or injured due to superstitious practices, a case of murder or attempt to Murder can be registered by jurisdictional police. The law also mandates the appointment of one vigilance officer in every police station to keep tabs on such practices


What is not banned-

Any form of worship including pradakshine, yatra, parikrama at any religios shrine, harikatha, keerthana, pravachana, bhajans do not come under the purview of the act.

Providing knowledge of ancient arts and practices, speaking about miracles performed by deceased saints and literature on them offering prayers, upasana, religious rituals at places of worship or at people’s homes, religious celebrations, festivals, processions, piercing of ears and nose, shaving of head, astrology and vaastu are considered acceptable under the act.


link- https://www.thenewsminute.com/article/karnatakas-anti-superstition-bill-gets-governors-nod-116608

ভারতে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন: যা জানা প্রয়োজন। -ঋত্বিকা জৈন
Nov. 19, 2024 | আইন | views:1475 | likes:258 | share: 265 | comments:0

২০১৮ সালে থমসন রয়টর্স ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় ভারত মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বলে বিবেচিত হয়।

২০১৮ সালে, থমসন রয়টর্স ফাউন্ডেশন (টিআরএফ) পরিচালিত এক সমীক্ষায় ভারতকে মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বলে চিহ্নিত করেন মতদাতারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসার সম্ভাবনা এবং তাদের দাস শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করার প্রথা, এই দুই কারণ ভারতকে প্রথম স্থানে তুলে দেয়।

টিআরএফ-এর ২০১৮ সালের সমীক্ষায়, তাদেরই করা ২০১১ সালের সমীক্ষার ফলাফল আবারও ফুটে ওঠে। ২০১১ সালেও ভারত তালিকার প্রথম ১০টি দেশেরে মধ্যে ছিল। "ভারত মেয়েদের প্রতি চরম উপেক্ষা ও অবমাননা দেখিয়ে চলেছে...ধর্ষণ, দাম্পত্য ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ ও উৎপীড়ন এবং কন্যা ভ্রুণ হত্যা হয়েই চলেছে।" মঞ্জুনাথ গঙ্গাধর নামে কর্নাটকের এক সরকারি অধিকর্তার এই উক্তি উদ্ধৃত করা হয় রিপোর্টে।

গঙ্গাধরের মন্তব্যকে সমর্থন করে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনআরসিবি)প রিসংখ্যান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে ওই সংস্থা অপরাধের তথ্য সংগ্রহ করে ও সেগুলিকে বর্তমান আইনের আলোয় বিশ্লেষণ করে। সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হন ও প্রতিদিন ৮৮টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। ২০১৯ সালে, ৩২,০৩৩ ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে ১১% ঘটনায় অপরাধের শিকার হন পিছিয়ে-থাকা দলিত সম্প্রদায়ের মহিলারা।

উত্তরপ্রদেশের হাথরসে একটি ১৯ বছরের দলিত মেয়েকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ দেশের বিবেককে নাড়া দিয়েছে (ময়না তদন্তে বলা হয়েছে মেয়েটির বয়স ২২)। ২০১২ সালে দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনা, ২০১৫-য় মুম্বইয়ের গণধর্ষণ, উন্নাওয়ের ধর্ষণ, কাঠুয়া ধর্ষণ কাণ্ড এবং আরও পিছিয়ে গেলে, মথুরা ও ভাঁওরি দেবীর ধর্ষণ হল কয়েকটি মর্মান্তিক উদাহরণ।


ধর্ষণ কি? 

আভিধানিক সংজ্ঞায় অবৈধ যৌন মিলন বা সম্মতি ছাড়া, বলপূর্বক বা বলোপ্রয়োগ ছাড়াই, আক্রান্তের যোনি, মলদ্বার বা মুখে যৌনাঙ্গ, শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ বা বিজাতীয় বস্তুর প্রবেশকে ধর্ষণ বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের ভাষায়, একই বেআইনি কাজের বিভিন্ন মানে আছে।

ধর্ষণ ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি) ১৮৬০ বা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫–৩৭৭ ধারার আওতায় পড়ে। ওই ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণ হয় তখনই যখন কোনও পুরুষ তার লিঙ্গ, মুখ, শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ বা অন্য কোনও বস্তু কোনও মহিলার যোনি, মুখ, মলদ্বার বা মূত্রনালীতে প্রবেশ করায় অথবা কোনও মহিলাকে দিয়ে এগুলির মধ্যে যে কোনও একটি কাজ তার বা অন্য কারোর ওপর প্রয়োগ করায়। আর এ সব হতে হয় মহিলার ইচ্ছে ও সম্মতির বিরুদ্ধে; যখন কোনও মহিলা বা তাঁর প্রিয়জন শারীরিক আঘাত বা মৃত্যুর হুমকি অনুভব করেন; যখন কোনও পুরুষ মহিলাটির স্বামী সেজে তাঁর সম্মতি আদায় করে; মহিলা যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হন বা যদি তিনি কোনও মাদক দ্রব্যের প্রভাবে থাকেন; যদি তাঁর বয়স ১৬ বছরের কম হয় (১৪ বছরের কম মণিপুরে); এবং স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের কম হয় (১৩ বছর মণিপুরে)।

আইপিসি অনুযায়ী, সম্মতি মানে হল মহিলাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ও স্বেচ্ছায়, কথায়, ইঙ্গিতে, ভাষায় বা ভাষাহীন কোনও ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে জানাতে হবে যে তিনি যৌন ক্রিয়ায় অংশ নিতে ইচ্ছুক।


ধর্ষণের শাস্তি:

আইপিসির ৩৭৬ নং ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের শাস্তি দু' ভাবে ভাগ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিভাগে অন্তর্ভুক্ত নন এমন কোনও ব্যক্তি যদি ধর্ষণ করে থাকে, তাহলে তার জেলে থাকার মেয়াদ ১০ বছরের কম হবে না। এবং সেই শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। সেই সঙ্গে হতে পারে জরিমানাও।

দ্বিতীয় বিভাগে যারা পড়বে, তাদের ন্যুনতম সাজা হবে ১০ বছর জেল, এবং তা সারা জীবনের জন্যও (যত দিন সেই অপরাধী বেঁচে থাকবে) হতে পারে তাদের। একই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে তাদের। এই বিভাগে পড়বে যারা:

o একজন পুলিশ অফিসার যদি তাঁর পুলিশ স্টেশনের এলাকার মধ্যে ধর্ষণ করেন বা থানার মধ্যে, বা ধর্ষিত মহিলা যদি পুলিশ হাজতে থেকে থাকেন

o একজন সরকারি চাকুরে

o কেন্দ্রীয়/রাজ্য সরকার দ্বারা মোতায়েন করা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।

o যে সব হোম বা কোনও জায়গা যেখানে মহিলা ও শিশুদের সুরক্ষিত রাখার জন্য পাঠানো হয়, সেই সব প্রতিষ্ঠানের ম্যানজমেন্টের সদস্য বা কোনও কর্মী।

o কোনও হাসপাতাল কর্মী যদি সে কোনও রোগীকে ধর্ষণ করে।

o কোনও আত্মীয়, অবিভাবক, শিক্ষক ও আস্থাভাজন বা কর্তৃত্বের জায়াগায় থাকা কোনও ব্যক্তি যদি তাদের তত্বাবধানে থাকা কাউকে ধর্ষণ করে।

o সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠী হিংসার সময় যদি কেউ ধর্ষণ করে।

o একজন গর্ভবতী মহিলাকে যে ধর্ষণ করবে

o কেউ যদি একই মহিলাকে বার বার ধর্ষণ করে।

o সম্মতি জানাতে অক্ষম এমন কোনও মহিলাকে যদি ধর্ষণ করে কোনও ব্যক্তি।

o ক্ষমতাবান কোনও ব্যক্তি যদি ধর্ষণ করে।  

o মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন এমন কোনও মহিলার ধর্ষণকারী।

o ধর্ষণের সময় যদি ধর্ষণকারী মহিলার শারীরিক ক্ষতি করে বা তাঁকে পঙ্গু বা বিকৃত করে দেয় বা তাঁর জীবন সংশয় ঘটায়।


অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের ব্যবহার:

যুদ্ধের সময় ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০০৮ সলে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লক্ষ্য করে যে, "মহিলা ও শিশুরা বিশেষ করে যৌন হিংসার শিকার হচ্ছে। এমনকি "যুদ্ধের কৌশল হিসেবেও তা করা হচ্ছে।" এর পরিপ্রেক্ষিতে, পরিষদে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে বলা হয় "যুদ্ধরত সব দলকেই অসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সব রকম যৌন হিংসা বন্ধ করতে হবে।"

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে, জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সেখানকার অসামরিক নাগরিকরা ভারতীয় সেনা বাহিনীর জওয়ানদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ আনেন। তাঁরা বলেন, কাশ্মীরের প্রত্যন্ত কুপওয়ারা জেলার কুনান ও পোশপোরা গ্রামে সেনারা ৩০ জন মহিলাকে ধর্ষণ করে। ভিত্তিহীন বলে ভারত সরকার অভিযোগটি উড়িয়ে দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালে, সেনা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের ঘটনার স্বাধীন তদন্ত না করার অভিযোগ তুলে, রাষ্ট্রসংঘের হাইকমিশন ফর হিউম্যান রাইটস কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র নিন্দা করে।

কুনান-পোশপোরা সহ ১৩টি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জম্মু ও কাশ্মীরে যৌন অপরাধের প্রতি "রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা"র বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে আরও বলা হয় যে, "ন্যায়-বিচার পাওয়ার সব চেষ্টা ও পথকে বিভিন্ন স্তরে আটকে দেওয়া হয়েছে।"


২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার একটি তদন্তে, সিটিজেনস ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস দেখে যে, "পরিকল্পিত ভাবে অল্প বয়সী মেয়ে ও মহিলাদের ওপর যৌন হিংসা চালানো হয়"। ওই তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, "একটি সম্প্রদায়কে অপমান করতে ও বশে রাখতে ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেব ব্যবহার করা হয়।" তাতে আরও বলা হয়, "কয়েকটি বাদে, বেশিরভাগ ঘটনাতেই মহিলাদের উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়। তারপর গণধর্ষণ করা হয় তাদের। এবং অবশেষে তাদের দেহ চার টুকরো করে এমন ভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয় যে কাউকে আর চেনা যায় না।"


ধর্ষণ আইনের সংস্কার:

১৬০ বছর আগেকার আইপিসি ঔপনিবেশিক আইনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। আইপিসি-র কিছু খুচর রদবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনও সংস্কার হয়নি। ২০০০ সালে জাস্টিস মালিমাথ কমিটি অপরাধ বিচারের ধারা সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর সুপারিশগুলি বাতিল করে দেওয়া হয়।


এখন আরও একটি প্রচেষ্টা চলছে। পাঁচ সদস্যের 'কমিটি ফর ক্রিমিনাল রিফর্মস' গঠন করা হয়েছে যাতে কেবল পুরুষরাই রয়েছেন। কিন্তু মে মাসে গঠিত এই কমিটি ইতিমধ্যেই বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ, বলা হচ্ছে, সেটির গঠনে কোনও বৈচিত্র নেই; নির্দেশের শর্তগুলি জনসাধারণকে জানান হয়নি; কম সময় দেওয়া হয়েছে (ছ' মাসের মেয়াদ ধার্য করা হয়েছে, যা এ মাসেই শেষ হয়ে যা্বে); এবং পদ্ধতিগত ত্রুটি, যেমন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রশ্ন ঠিক করার বদলে কিছু পূর্বনির্ধারিত প্রশ্ন ছ'টি কিস্তিতে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।


১৯৭২ সালে মথুরা ধর্ষণ কাণ্ডের পর ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেওয়ার ফলে, ধর্ষণ আইন প্রথম সংশোধন করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৭২ তারিখে, মহারাষ্ট্রের এক আদিবাসী মহিলা কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ করেন। ট্রায়াল কোর্ট পুলিশদের নির্দোষ ঘোষণা করে এবং সেই রায় সুপ্রিম কোর্টও বহাল রাখে। কেবল মাত্র হাইকোর্টেই অভিযুক্ত পুলিশরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। পুলিশরা নিজেদের পক্ষে সওয়াল করার সময় বলে, ওই মহিলা 'লুজ' চরিত্রের। তাছাড়া তার সঙ্গে তার পুরুষ বন্ধু ছিল। তাই তাকে ধর্ষণ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৭৮ সালে, উচ্চতম আদালত তার রায়ে বলে, "কোনও ক্ষত চিহ্ন না থাকাটা এটাই ইঙ্গিত করছে যে, অভিযোগে যে যৌন মিলনের কথা বলা হয়েছে, তা শান্তিতেই হয়েছিল।"

১৯৭৮-এর ওই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিলে, আইনসভা 'ক্রিমিনাল ল (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৮৩' প্রণয়ন করে। তাতে বেশ কিছু নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। তার মধ্যে একটিতে ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করাটা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।

২০১২ সালে, দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ড, মহিলাদের অধিকার ও নিরাপত্তার আন্দোলনে একটি জলবিভাজিকার কাজ করে। তার ফলে 'ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৩, প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা যেমন আরও বিস্তৃত করা হয়, তেমনই শাস্তিও আরও কড়া করা হয়।


 অপরাধ বিচার প্রণালীর সমালোচনা ও ফাঁক:

ভারতীয় ধর্ষণ আইনের বৈশিষ্ট্য হল তার লিঙ্গ নিরপেক্ষতার অভাব। আইপিসি অনুযায়ী একজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাকে কেন্দ্র করে ভারতের আইন কমিশন যৌন মিলনের সংজ্ঞাকে আরও বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়েছে, যাতে তা আরও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হয়। ২০১৮ সালে, সম্মতির ভিত্তিতে সমকামীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে অপরাধ নয় বলে ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। এখন, ধর্ষণকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করে তোলাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে।


অন্যান্য ধারায় ধর্ষণের শাস্তি:

a) Section Section - 376A

Offence - Causing death or resulting in a persistent vegetative state of the victim

Minimum Punishment - 20 years

Maximum punishment - Life term or Death Penalty Fine - No


b) Section Section - 376AB

Offence - Rape of a girl under 12 years

Minimum Punishment - 20 years

Maximum punishment- Life term or Death Penalty Fine - Yes. Fine paid directly to the victim will be just & reasonable to meet medical expenses & rehabilitation costs


c) Section Section - 376DA

Offence - Gangrape of a woman under 16 years

Minimum Punishment - Life Term

Maximum punishment- Life Term

Fine- Yes. Fine paid directly to the victim will be just & reasonable to meet medical expenses & rehabilitation costs.


d) Section Section - 376DB

Offence - Gangrape of a girl under 12 years

Minimum Punishment - Life Term

Maximum punishment - Death Penalty

Fine- Yes. Fine paid directly to the victim will be just & reasonable to meet medical expenses & rehabilitation costs

link- https://bangla.boomlive.in/law/rape-laws-in-india-all-you-need-to-know-10232

ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সেকাল ও একাল -দ্বৈপায়ণ ঘোষ
Nov. 19, 2024 | বন্যপ্রাণ | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

Wildlife (Protection) Act, 1972 বা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ তর্কাতীত ভাবে এই পৃথিবীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণ আইন। এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ নামক ভৌগলিক ভূখণ্ডের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করলে প্রেক্ষিত বুঝতে খানিকটা সুবিধা হবে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, আর্যদের আগমন ইত্যাদির সময়ের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্য নিদর্শনে বন্যপ্রাণ ও গৃহপালিত প্রাণীদের সাথে মানুষের সম্পর্কের ও সহাবস্থানের প্রমাণ পাই। কিন্তু সেগুলোকে আইনের প্রামাণ্য দলিল বলা যায় না। আমরা প্রথম এই ধরণের নথিবদ্ধ আইন পাই মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়। এই সংরক্ষণের মূল কারণ অবশ্যই আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকেই ভারত ভূখণ্ডের একটা ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। সাথে সাথে তার সৈন্য বাহিনীও শক্তিশালী হতে থাকে। ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্রের সাথে সাথে এই সময় থেকে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার জনপ্রিয় হতে থাকে। হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই হাতিকে গৃহপালিত করার ব্যবস্থা চালু থাকলেও মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকেই যুদ্ধে হাতির ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর সেই বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তাই সাম্রাজ্যের জন্য হাতির নিরন্তর যোগান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এই যোগান অক্ষুণ্ণ রাখতেই অশোকের শাসনকালে হাতি ও হাতির জন্য সংরক্ষণের আইন প্রণীত হয়, যেখানে মৌর্য সাম্রাজ্যে আটটা সংরক্ষিত ও চিহ্নিত হস্তি-বন বা আধুনিক পরিভাষায় Elephant Sanctuaryর উল্লেখ ছিল। বন্য হাতির ক্ষতি করলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। এমনকি প্রাকৃতিক কারণে মৃত হাতিদের দাঁত সরকারের কাছে সমর্পণ করার আইনও ছিল, যা আধুনিক WPA, 1972 এরও বিধান। পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের কালে বন্যপ্রাণ নিয়ে মিশ্র সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। এই সময় শিকারকে বাদশাহি আদব কায়দার অংশ হিসেবে অনেক সময় প্রাধান্য দেওয়া হলেও বিশেষ বিশেষ সময় বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে শিকার নিষিদ্ধ করা হত।


মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথা ধরেই ব্রিটিশ ভারতের শুরুর থেকেই ব্রিটিশ ও দেশীয় শাসকদের মধ্যেও শিকার ছিল আভিজাত্যের আবশ্যিক প্রতীক। আজ ভারতের অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলই সেই সময়ের কোনো না কোনো দেশীয় শাসকের ব্যক্তিগত শিকার খেলার জায়গা, বান্ধবগড়ের জঙ্গল যেমন ছিল রেবার রাজপরিবারের শিকার ভূমি, গিরের জঙ্গল সেই রকমই জুনাগড়ের নবাবদের খেলার জায়গা। শিকার সেই সময় শাসক ও অভিজাতদের মধ্যে কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করে, তা বুঝতে আমাদের কয়েকটা তথ্যই যথেষ্ট। বিংশ শতকের গোরায় ভারতের জঙ্গলে আনুমানিক এক লাখ বাঘ ছিল, ১৯৭৩ সালে প্রজেক্ট টাইগার শুরু হওয়ার সময়ের গণনায় তা কমে দাঁড়িয়েছিল তিন হাজারের মত। শিকারের ব্যাপকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫, এই ৫০ বছরে শুধুমাত্র ভারতবর্ষে কম করে ৮০ হাজার বাঘ শিকার করা হয়। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ দশ দিনে ৩৯টি বাঘ শিকার করেন। কর্নেল জফ্রে নাইটিঙ্গল ভারতবর্ষে প্রায় ৩০০ বাঘ শিকার করেছিলেন। দেশীয় রাজ-পরিবারগুলোও বিদেশী শাসকদের থেকে এই প্রশ্নে পিছিয়ে ছিলনা। রেবার রাজা নিজে মধ্য ভারতে ১০৯টা বাঘ শিকারের নজির রেখেছেন। শুধু বাঘ নয়, শিকারের ফলে আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে শেষ টিকে থাকা সিংহের সংখ্যাও কমতে কমতে গিরের জঙ্গলে ২০টায় এসে দাঁড়ায়। সরকারি হিসেবে ১৮২০ থেকে ১৮৭০ এর মধ্যে গুজরাটে ১৫০০ এর বেশি সিংহ শিকার করা হয়। সেই অবস্থায় ভারতের শাসক ও অভিজাতদের একাংশ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তিত হয়। ১৮৭৯ সালের ১০ই মে জুনাগড়ের নবাব মহব্বত খানজি দ্বিতীয় গিরের জঙ্গলে সিংহের শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়, যা ছিল আধুনিক ভারতের প্রথম বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন। এর আগেও ১৮৫৫ সালের ভারীয় ফরেস্ট চার্টার, ১৮৬৫ সালের ভারতীয় বন আইন, ১৮৭৮ সালের ভারতীয় বন আইনও কখনোই সেই অর্থে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কথা বলা হয়নি। এরপর ১৯২৭ সালে ভারতীয় বন আইন প্রণীত হয়।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টায়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম বন-নীতি আসে। পর্যায়ক্রমে ১৯৭২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর পৃথিবীর সংরক্ষণের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইন, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ প্রণীত হয়। এই আইনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হল:

১) ভারতীয় সব রকম বন্যপ্রাণের শিকার ও তা নিয়ে ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়। এই ধরনের অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত হয়।

২) ভারতের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভাগ, সংরক্ষণের স্তর, সংজ্ঞা দেওয়া হয়।

ফলে ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের নতুন দিশা আসে, কয়েক'শ বছর ধরে ধ্বংস হতে থাকা ভারতের বন ও বন্যপ্রাণ আবার একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এর পরপর ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮৬ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভারতের সংরক্ষণকে আরো শক্তিশালী করে।

কিন্তু এই আইনগুলোর কথা বললেই সবটা বলা হয়না। আইনগুলোর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ঠিক যেখান থেকে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেখান থেকেই এই সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। সংরক্ষণ আইনগুলো Wildlife First নৈতিকতায় ভর করে তৈরি হওয়ায় তা ভারতের জঙ্গলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এখানের আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষের জীবন ও সংরক্ষণে তাদের ভূমিকাকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ের যে আইনের কথা আমরা শুরুতে আলোচনা করছিলাম, তাতেও বনবাসী উপজাতিদের সন্দেহজনক ও বন্যপ্রাণের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে করা হত। ব্রিটিশ ও স্বাধীন ভারতের আইনগুলোও সেই পরম্পরা মেনে বারবার সংরক্ষণের নামে বনবাসী উপজাতিদের তাদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং করেই চলেছে। বহু ক্ষেত্রেই উচ্ছেদ করা মানুষদের প্রাপ্য পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি। কখনো অভিজাতদের খেয়াল, কখনো পুঁজিবাদী দুনিয়ার মুনাফার লোভ পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণকে শত শত বছর ধরে ধ্বংস করে আসলেও আইনগুলো আদিবাসীদেরকে বারবার বন্যপ্রাণের ধ্বংসের জন্য দায়ী করে চলেছে। সংরক্ষণের নামে মানুষকে উচ্ছেদ করতে আইনগুলো যতটা আগ্রহী, ধ্বংসাত্মক উন্নয়নের হাত থেকে পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণকে রক্ষা করতে ততটা আগ্রহ দেখা যায়না।

পশুবলি ও অ্যানিমেল প্রটেকশান ল -অভিষেক দে।
Nov. 19, 2024 | আইন | views:286 | likes:0 | share: 0 | comments:0

"জীবে প্রেম করে যে জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর " - এটা কী শুধুই একটা বাণী না পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে শুধু পড়তে হয়? আমরা কালি পূজা,দূর্গা পূজা ও মনসা পূজা উপলক্ষে হাজার হাজার পাঠা, মোষ, হাস বলি দি প্রতি বছর। কুরবানীর ঈদে গরু,মোষ,দুম্বা,উট কুরবান দি নির্বিকার চিত্তে। শিশু বৃদ্ধ সবার চোখের সামনে ধারালো অস্ত্রের কোপে ধড় থেকে নিরিহ, অবলা প্রানীদের মাথাটাকে বিচ্ছিন্ন করা হয় সেটা নৃসংশতা ছাড়া আর কিছুই নয়।


শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ থেকে প্রানী হত্যা যা খুশি করা যায়।কেউ প্রতিবাদ তো করবেই না উলটে এই কাজ পূন্যের মনে করেন অনেকেই।আর কেউ যদি বাধা দেয় তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে উম্মত্ত একদল অমানুষ এর দ্বারা। যে দেশে মানুষই হৃদয়বিদারক অবস্থায় বসবাস করছে, সে দেশের প্রাণিদের দুর্দশার কথা চিন্তা করা কঠিন।


কিন্তু আমরা কিছু সময়ের জন্য আপনাদের এটাই বিবেচনা করার অনুরোধ করছি যে, উৎসর্গ হবার জন্য যে সমস্ত উট, ভেড়া, ছাগল,গরু রা অবলা প্রানী বলেই কি ইচ্ছা মত যা খুশি করা যায় তাদের সাথে??


ধর্মের ধ্বজাধারীরা প্রচার করে থাকেন, ধর্মীয় কারনে পশুবলি দিলে মানসিক শক্তির বিকাশ হয়। তারা যুক্তি রূপে টেনে আনেন তন্ত্রের বা কুরবানির কথা। অথচ পুজোর বা কুরবানির নামে এই নৃশংস প্রথা কোনো ভাবেই মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করেনা বরং দুর্বল এবং অবলা প্রানীদের যে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় এতে খুনী মানসিকতার জন্ম নেয়। বিশেষত শিশুমনে বলিপ্রথার কু প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ থেকে মানসিক রোগ, ভীতি, হিংস্রতা বৃদ্ধি, নিদ্রাহীনতা হতে পারে। সারা পৃ্থিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এমনটাই অভিমত।


ধর্মীয় কারনে পশুবলির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইন কি বলছে?

১) The prevention of cruelty to animals act, 1960 অনুসারে, প্রকাশ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ। কোন প্রত্যক্ষদর্শী ওই বলির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানালে মন্দিরের পূরোহিত সমেত পুজো কমিটির কর্মকর্তা ও বলি দানে অংশগ্রহনকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে।

২) Wild life protection act অনুসারে যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী প্রানী হত্যা দন্ডণীয় অপরাধ। জেল এবং জরিমানা দুটোই হতে পারে।

৩) Public nuisance act অনুসারে কোনো ব্যক্তির চোখের সামনে বলি দেওয়া নিষিদ্ধ।

৪) Arms Act অনুসারে লাইসেন্স ছাড়া বলি দেওয়ার অস্ত্র যেমন, খাঁড়া, চপার, কাটারি ইত্যাদি জিনিস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মজুদ রাখা বেআইনি  এবং শাস্তি যোগ্য অপরাধ।

৫) Cow Protection Act অনুসারে ধর্মের নামে পশুহত্যা নিষিদ্ধ হয়েছে। হাইকোর্টের নিষিদ্ধকরণের সাথে সুপ্রিম কোর্টও এই রায়ে অভিমত দেয়, বকরি ইদের সময় গরু কুরবানি দেওয়া মুসলিম ধর্মে প্রয়োজনীয় নয় এবং কুরবানি আইনত নিষিদ্ধ। এটিকে জনস্বার্থে নিষিদ্ধ করা উচিত। (মহম্মদ হানিফ কুরেশি বনাম বিহার সরকার, এ.আই.আর ১৯৮৫, এস.সি ৭৩১)

এছাড়াও পশু প্লেস নিবারণী আইন, দৃশ্য দূষণ আইন ইত্যাদি সবগুলি প্রযোয্য।


প্রসঙ্গত জানাই, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এবং ভারতের মানবতাবাদী সমিতি, বহুদিন ধরেই ধর্মের নামে প্রকাশ্যে এই পশুহত্যার বিরোধিতা করে আসছে। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিকাশ শ্রীধর শিরপুরকরের ডিভিশন বেঞ্চ যে শুধু রায় দিয়েছে,  কালীঘাট মন্দিরে প্রকাশ্যে বলি দেওয়া যাবে না। প্রকাশ্যে বলি দেওয়া বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বর্ধমানের জেলা শাসক সৌমিত্র মোহন মহাশয় সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পশুবলি বন্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় সেটি বন্ধ করা গেছে। সম্প্রতি, ধর্মের নামে নির্বিচারে পশুবলি রুখতে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির জনস্বার্থ মামলা আদালতে গৃহীত হয়েছে।

সূত্র- https://kolkata24x7.com/to-stop-thousands-of-animals-kill-in-the-name-of-sacrifice-in-several-mandir-in-purulia-pil-filed-calcutta-high-court.html

https://kolkata24x7.com/to-stop-thousands-of-animals-kill-in-the-name-of-sacrifice-in-several-mandir-in-purulia-pil-filed-calcutta-high-court.html


ভাবলে অবাক হতে হয়, পশুবলির বিরুদ্ধে এতগুলি জোরালো আইন থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে দুর্গা, কালি, মনসাপুজো, ইদের কুরবানীর সময় কত কত পাঁঠা, ভেড়া, গরু, উঁট নির্বিচারে বলি দেওয়া হচ্ছে। আর দেশের নির্লজ্জ সরকার এবং প্রশাসন ধর্মের দোহায় দিয়ে এইসব বে-আইনী প্রথাকে পশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় আইন ব্যবস্থাকে কদর্য রূপে প্রকাশ করছে। বিক্ষিপ্ত কিছু জায়গা বাদে (যেমন হিমাচল প্রদেশ, ঝারখণ্ড ইত্যাদি) সব জায়গাতেই প্রশাসন সূত্রে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়না।


কবিগুরুও তো বলিপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘বিসর্জন’ ও ‘রাজর্ষি’ নামক দুটি উপন্যাস ও নাটকের মাধ্যমে একশো বছর আগে ‘বলি’র বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধুমাত্র ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবনে গদগদ ভঙ্গিতে কবিতা পাঠেই তাঁকে সম্মান জানানোতে শেষ হয়ে যায়? তাঁর চিন্তা ধারাকে সম্মান জানাতে আমরা এটুকু করতে পারিনা? আমরা কী মানবিক হতে পারি না?

যাই হোক একটা কবিগানের কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে, একজন ফকিরী সাধক বলছিলেন-


''কুরবানি করিতে হুকুম প্রাণপ্রিয় ধন,

গরু-ছাগল হইল কি তোর এতোই প্রিয়জন?

নিজের থেইক্যা প্রিয় বস্তু আর যে কিছু নাই,

আত্মত্যাগই আসল কুরবান জেনে নিও ভাই।

দশ ইন্দ্রিয়, ছয়টি রিপু পারলে দমন কর গো,

প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর.....''


সংযোজন: "কুরবানির ঈদ"। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে এই দিনটির গুরুত্বই আলাদা। তারা তাঁদের আল্লাহতালার উদ্যেশ্যে কুরবানি দেয় অবলা প্রানী দের। উঠ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি কুরবানির তালিকায়। যে কোনো যুক্তিবাদী মানুষই ধর্মের নামে প্রানী হত্যার বিপক্ষে। অনেকেই উদ্ভট দাবী করে খাদ্যর সাথে পশুবলি কে এক করে দেন। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে, খাদ্যর প্রয়োজনে একটা দুটো প্রানী কে হত্য করা এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে অবলা প্রানী দের হত্যা এক বিষয় নয়। ব্যাপার টা এভাবে ভাবুন যে, স্নানের জন্য বাথরুমে উলঙ্গ হওয়া এবং প্রকাশ্যে উলঙ্গ হয়ে স্নান করার ভেতর যথেষ্ট পার্থক্য আছে।

সরকার চাইলেই ধর্মের নামে প্রানী হত্যা কে বন্ধ করতেই পারে কঠোর ভাবে। কিন্তু মাজা ভাঙ্গা খাঁজা সরকার এই উদ্যোগ নিতে চায়না অসংখ্য কুযুক্তি দেখিয়ে। আসলে ভোট ব্যাঙ্ক বড় বালাই। তাই ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে সরকার আন্তরিক হয়না এই জঘন্য প্রথা কে বন্ধ করতে।

প্রানীরা অবলা তাই ধর্মের নামে যা খুশী তাই করা যায় তাদের সাথে। আর প্রতিবাদ করার মতন বুকেরপাটা ক'জনের থাকে মশাই।


নীরিশ্বরবাদ দর্শন " চার্বাক" এ একটা অসম্ভব সত্যি কথা বলা হয়েছে যে- ভণ্ডরা চায় খেতে পশুর, মাংস তাই তারা দিয়েছে বলির বিধান।

বিশেষ বিবাহ আইন (Special Marriage Act- 1954) -ঈশান
Nov. 19, 2024 | আইন | views:110 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ফি রোববার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা প্রায়শই দেখে থাকি পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে তাদের ধর্ম,জাত ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। কিন্তু যারা কোনোরকম প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে (Religion) বিশ্বাসী নন অর্থাৎ আমরা যাদেরকে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক বলে অবহিত করে থাকি, তারা বিশেষ বিবাহ আইনের মাধ্যমে বিয়ে করতে পারেন। ১৮৭২ সালের এই আইন নতুনভাবে ৯ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে ভারতীয় সাংসদে পাশ হয় এবং ১ জানুয়ারী ১৯৫৫ সালে সমগ্র ভারতে লাগু হয়।  [ The Special Marriage act was passed in 9th October 1954. It was passed with an intention to regulate marriage between two individuals (of the opposite sex) irrespective of their caste or religion. It applies to the whole of India except for the states of Jammu and Kashmir.] 


১৮ মে, ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইন (Hindu Marriage Act - 1955)  অনুসারে পাত্র-পাত্রী উভয়কেই হিন্দু হতে হয় নতুবা  সেই বিয়ে অবৈধ ঘোষনা করা হয়। প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভালো, ভারতীয় সংসদের আইন দ্বারা গঠিত এই আইনে হিন্দু কোড বিলের (Hindu Code Bill - 1950) অংশ হিসাবে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয়েছিল। যেমন- হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (hindu inheritance act- 1956), হিন্দু সংখ্যালঘু ও অভিভাবকত্ব আইন (The Hindu Minority and Guardianship Act of 1956), হিন্দু দত্তক গ্রহণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আইন (The Hindu Adoptions and Maintenance Act - 1956)।


অন্যদিকে, মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম পাত্র কোনোও অমুসলিম পাত্রীকে বিয়ে বা নিকাহ করতে পারেন না (ব্যতিক্রম, সুন্নি মুসলমান পুরুষ একজন খ্রিস্টান বা ইহুদি নারীকে বিয়ে করতে পারেন) আবার বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে এই আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বিবাহ সম্পন্নের ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার পরও যদি কেউ এই আইন অমান্য করে তবে সেই ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩০০০/- টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড দিতে হতে পারে। ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো মুসলিম ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন।


বিয়ে যেহেতু দুটি হৃদয়ের বন্ধন তাই, বিশেষ বিবাহ আইনে পাত্র-পাত্রী ভিন ধর্মের বা অধার্মিক হলেও কোনো সমস্যা নেই। বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করতে হলে পাত্র-পাত্রীকে অবিবাহিত থাকতে হবে। বিয়ের সময় বিয়ের উভয় পক্ষগণের মধ্যে কারোরই কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকা চলবে না। পাত্রের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর এবং পাত্রীকে ১৮ বছর হতে হবে (গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ এ, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বেড়ে ২১ করার জন্য একটি বিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় পাশ হয়েছে। এর অর্থ ২১ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে)।


এই বিয়েতে প্রথমত পাত্রপাত্রী উভয়কেই (কোনো শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষকে) বিয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করে আদালত অথবা ম্যারেজ রেজেস্ট্রি অফিসে গিয়ে, ম্যারেজ রেজেস্ট্রি অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট আবেদনপত্র পুরন করতে হবে এক মাসের নোটিশ দিয়েই। নোটিশের একমাস কাল উত্তির্ণ হওয়ার পর পাত্রপাত্রী উভয়কেই আদালত অথবা ম্যারেজ রেজিস্টার অফিসে সরাসরি হাজির হয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসারের কাছে শপথগ্রহণ করে নির্দিষ্ট আবেদনপত্রে সাক্ষর করতে হবে। বিশেষ বিয়েতে নোটিশ প্রসঙ্গে একটি খবর জানিয়ে রাখা ভালো- 



 

বিশেষ বিবাহ আইনে নোটিশ প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়, রায় এলাহাবাদ হাইকোর্টের

বিশেষ বিবাহ আইন নিয়ে বড়সড় রায় ঘোষণা করল এলাহাবাদ হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বুধবার রায় দিয়েছে যে বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে বিবাহের নোটিশ প্রকাশের প্রয়োজন বাধ্যতামূলক হবে না, বরং তা দম্পতির পছন্দ সাপেক্ষে হবে।


এই রায় দেওয়া হয় একজন হেবিয়াস কর্পাসের আবেদনের ভিত্তিতে। আবেদনে বলা হয়েছে যে অন্য ধর্মের প্রেমিককে বিয়ে করার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে আটক করা হয়। ওই যুগল হাইকোর্টকে জানিয়েছেন যে ৩০ দিনের এই বাধ্যতামূলক নোটিশ তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ ও বিবাহ সম্পর্কিত স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা দেয়। হাইকোর্টের বিচারপতি বিবেক চৌধুরি জানিয়েছেন যে এই ধরনের নোটিশ প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার ফলে তা স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। একজন ব্যক্তি তাঁর গোটা জীবন কার সঙ্গে কাটাতে চান এটা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা। এছাড়াও আদালত জানিয়েছে যে বিয়ে করতে ইচ্ছুক যুগল বিবাহ আধিকারিককে ৩০ দিনের নোটিশ প্রকাশ করতে বা না করার অনুরোধ লিখিতভাবে জানাতে পারেন।


হাইকোর্ট এও জানিয়েছে যে যদি কোনও যুগল নোটিশ প্রকাশ করতে না চান তবে বিবাহ আধিকারিক নোটিশ প্রকাশ করবেন না এবং অন্য কারোর হস্তক্ষেপও তিনি বরদাস্ত করবেন না। তার বদলে বিয়ের অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে এগিয়ে যাবেন।


উত্তরপ্রদেশে লাভ জিহাদ বিরোধী আইন চালু হওয়ার পর থেকে বেশি করে এ ধরনের মামলা আদালতে আসছে। ২৮ নভেম্বর রাজ্যে লাভ জিহাদ বিরোধী আইন চালু হওয়ার পর থেকে ১৬টি মামলা পুলিশ দায়ের করেছে।

খবরটির লিংক- https://bengali.oneindia.com/news/india/the-notice-were-not-mandatory-under-the-special-marriage-act-said-allahabad-highcourt-121410.html


বিশেষ বিবাহ আইনে সাক্ষী হিসেবে তিনজন (যাদের একজন অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে) উপস্থিত থাকতে হবে এবং পাত্রপাত্রীর মতন তাদেরও পাসপোর্ট সাইজ ছবি, বয়সের এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র যেমন- আধার / ভোটার আইডি / প্যান ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে যা প্রয়োজন পরবে বিয়ের সময়ে। 


ভারত কিংবা বাংলাদেশের কোনো হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ইত্যাদি নন বা তাদের একজন যেকোনো একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে।

এই আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ধরা হবে যে, তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন। 


যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তকরা জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম (Religion) ত্যাগ করে মানবতাবাদী (Humanist / Humanism) ঘোষণা পত্র পেতে নোটারি পাবলিক কর্তৃক ‘নোটরাইজড’ করানো এফিডেফিট সংগ্রহে রাখুন বিশেষ বিবাহ আইনের ক্ষেত্রে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ডক্যুমেন্ট যা ম্যারেজ রেজেস্ট্রি অফিসে প্রয়োজন হবেই। 


লক্ষ্যনীয় বিষয় এটাই যে, বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে এবং নবদম্পতির সন্তান বেড়ে উঠছে একটি অন্যরকম পরিবেশে যেখানে কোনোরকম ধর্মাচরণ বা ধর্মপালন হয়না এবং উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় বহনও করছে না। এই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের জন্য কোনো আইন নেই। 



'বিয়ের জন্য ধর্ম পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়, বলল ইলাহাবাদ হাইকোর্ট'

কেবলমাত্র বিয়ের জন্য ধর্ম পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। একটি মামলার প্রেক্ষিতে আবেদনকারীকে শনিবার এ কথা জানাল ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। বিয়ের তিন মাস পর পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক দম্পতি। আদালত সেই আবেদনও খারিজ করে দিয়েছে।


জন্মসূত্রে এক মুসলিম মহিলা বিয়ের জন্য হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। আবেদনে ওই দম্পতি জানিয়েছেন যে তাঁরা চলতি বছরের জুলাই মাসেই বিয়ে করেন। এও অভিযোগ করেন, বিয়ের পরেও পাত্রীর বাবা তাঁদের জীবনে হস্তক্ষেপ করছেন। তার প্রেক্ষিতেই বিচারপতি মহেশ চন্দ্র ত্রিপাঠী এ দিন বলেন, ‘‘ওই মহিলা ২০২০ সালের ২৯ জুন নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেন এবং ৩১ জুলাই বিয়ে করেন। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় বিয়ের উদ্দেশ্যেই এই ধর্ম‌ পরিবর্তন’’।


বিচারপতি এও জানিয়েছেন, আদালত এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। এর আগে ২০১৪ সালে নূর জাহান বেগমের একটি আবেদনের ভিত্তিতেও একই রায় দিয়েছিল ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। এ দিন ওই রায়ের কথাও উল্লেখ করেছে আদালত।


খবরটির লিংক- https://www.anandabazar.com/india/conversion-for-the-sake-of-marriage-is-not-acceptable-said-allahabad-high-court-dgtl-1.1222498



বিশেষ বিবাহ আইনের কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য-

১) আবেদনকারী পাত্রপাত্রীকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসারের কাছে জমা দেওয়া যাবতীয় তথ্য (যেমন- বয়সের প্রমাণপত্র, নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র, প্রতিষ্ঠানিক ধর্মহীনতার প্রমাণপত্র, ঠিকানার প্রমাণপত্র ইত্যাদি) সঠিক দিতে হবে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসারের সেইসব কাগজপত্র দেখে যদি সন্দেহজনক মনে হয় কিংবা অফিসার যদি তথ্যবিকৃতি পান তাহলে তিনি বিবাহ বাতিল করে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেন।


২) বিশেষ বিবাহ আইনে পাত্রপাত্রীর মধ্যে যদি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে (যেমন মামাতো, কাকাতো ভাই বোন, দাদা বোন, ভাই দাদা কিংবা কাকা ভাইঝি, অথবা বিবাহবিচ্ছেদ না করে গোপনে কোনো পুরুষের সাথে নারীর বিয়ে) তাহলে এই বিয়ে অবৈধ ঘোষনা করা হয়। 

৩) পাত্র কিংবা পাত্রীর মধ্যে কোনো একজন মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী অথবা ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক বিয়েও এই আইনে অবৈধ। 

৪) কোনোরকম সমস্যাজনিত কারনে বিবাহবিচ্ছেদের প্রয়োজনে নূন্যতম বিয়ের তিন বছরের আগে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করা যাবেনা। এবং বিবাহবিচ্ছেদের একবছর পূর্ণ না হলে নতুন বিয়ে গ্রাহ্য হবে না। 


৫) বিশেষ বিবাহ আইন- ১৯৫৪ এবং হিন্দু বিবাহ আইন- ১৯৫৫ অনুযায়ী স্ত্রী বর্তমানে থাকা সত্ত্বেও অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ না হলে পাত্র তার প্রাক্তন স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে বর্তমানে বিবাহ করলেও এই বিয়ে আইনত অবৈধ। আইনের ফাঁক গলে যদি এই বিয়ে হয়েও যায় তাহলে বর্তমান স্ত্রী, বর্তমান ই থাকবেন। পত্নীর স্বীকৃতি পাবেন না এবং সেই প্রাক্তন স্ত্রী তার স্বামীর বর্তমান বিয়ের অভিযোগ নিয়ে আইনের দারস্থ হলে স্বামীর হাজতবাস সঙ্গে মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রয়েছে আইনে। 


৬) বিবাহবিচ্ছেদ না হয়েও যদি বিশেষ আইনে কেউ বিয়ে করেন তথ্যগোপন রেখে তাহলে বর্তমান স্ত্রী সাথে তার স্বামীর দৈহিক মিলনে জন্মনেওয়া সন্তানকে অবশ্য বৈধ ধরা হবে এবং তার জন্মদাত্রী সন্তানের ভরণপোষণ এর জন্য স্বামীর কাছে আর্থিক সাহায্যও পাবেন। তাছাড়া ভবিষ্যতে এই সন্তান (প্রাক্তন স্ত্রীর নয়, বর্তমান স্ত্রীর) তার জন্মদাতার সম্পত্তির অধিকার নিয়ে আদালতে মামলা করত পারবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর জানিয়ে লেখাটির ইতি টানা যাক- 

বিয়ের নামে ধর্মান্তরণ রুখতে অধ্যাদেশ যোগী সরকারের, ‘প্রমাণ’ হলে ১০ বছরের জেল ধর্ম পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিবাহের অভিযোগ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।

বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে ‘লভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে আইন আনার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। তার মধ্যেই বিবাহের নামে ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে অধ্যাদেশ জারি করল উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার। তাতে বলা হয়েছে, ছল-চাতুরি করে ধর্ম পরিবর্তন করানোর অভিযোগ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হবে।

মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অধ্যাদেশ জারি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যোগী নিজে এই বেআইনি ধর্মান্তরণ প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০২০-এ অনুমোদন দেন বলে জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। ওই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ধর্মান্তকরণের উদ্দেশে যদি কোনও মহিলাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা হয়, তা হলে আইনের চোখে সেই বিবাহ বৈধ নয়। তা বাতিল বলে ধরা হবে।

শুধু তাই নয়, নিজের ইচ্ছেয় যদি কোনও মহিলা ধর্ম পরিবর্তন করতে চান, সে ক্ষেত্রে বিয়ের ২ মাস আগে জেলাশাসকের কাছে সেই মর্মে আবেদন জমা দিতে হবে। অন্যথায় ৪ মাস থেকে ৩ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানা দিতে হতে পারে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকার।

জোর করে ধর্মান্তরণের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সাজা এবং ১৫ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা রয়েছে ওই অধ্যাদেশে। তবে তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের কোনও মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কের ধর্ম পরিবর্তন করা হলে, সে ক্ষেত্রে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে। জরিমানা দিতে হতে পারে ২৫ হাজার টাকা।


হিন্দু মেয়ে এবং মুসলিম ছেলের বিবাহকেই ‘লভ জিহাদ’ আখ্যা দিয়েছে গেরুয়া শিবির। তাদের অভিযোগ, ধর্ম পরিবর্তনের লক্ষ্যেই হিন্দু মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুসলিম ছেলেরা। বিজেপি নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে শুরু থেকে যোগী আদিত্যনাথই সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন। সম্প্রতি এই ‘লভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে আইন আনার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানায় মধ্যপ্রদেশ এবং হরিয়ানা সরকার। তার পর উত্তরপ্রদেশে এ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে এ নিয়ে আইন মন্ত্রকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। শেষমেশ এ দিন অধ্যাদেশ জারি করে যোগী সরকার।


গেরুয়া শিবিরে ‘লভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এর বিরুদ্ধে খুব শীঘ্র রাজ্যে আইন চালু হবে বলে শুক্রবারই জানিয়েছে সেখানকার স্বরাষ্ট্র দফতর। হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারও একই পথে হাঁটছে। তবে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম যুবকের বিয়েতেই যাবতীয় আপত্তি তাদের। মুসলিম মেয়ের হিন্দু পরিবারে বিয়েতে কোনও আপত্তি তোলেনি তারা।

তবে বিজেপি এবং গেরুয়া শিবিরের এই ‘লভ জিহাদ’ তত্ত্বের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন বিরোধী নেতারা। সাম্প্রদায়িক সংহতি নষ্ট করাই তাদের মূল লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেছেন অশোক গহলৌতের মতো অনেকেই। সোমবার একটি মামলার রায়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্টও জানিয়ে দেয়, নিজের পছন্দ মতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

খবরটির লিংক- https://www.anandabazar.com/india/uttar-pradesh-government-brings-ordinance-against-unlawful-religious-conversion-dgtl-1.1233735


বিদ্রঃ ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট, জম্মু ও কাশ্মীর থেকে প্রত্যাহার হয়েছিল ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ এ। মনে করা হচ্ছে এবারে জম্মু এবং কাশ্মীরের কোনো স্থায়ী নাগরিক বিশেক বিবাহ আইনে নিজদের দাম্পত্যজীবন শুরু করতে পারেন।

ঋণ স্বীকার: সদ্যপ্রয়াত আইনজীবি শ্রী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং আইনজীবী প্রবাল মিত্র। 

পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুভোজ নিবারণ আইন প্রণয়ণের দাবী -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | আইন | views:38 | likes:2 | share: 2 | comments:0

গত ২৮ জুলাই ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে "মৃত্যুভোজ (Death Feast) নিবারণ আইন" প্রণয়নের আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, আইন মন্ত্রী সহ সমস্ত বিধায়ক দের ইমেল করেছেন "ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক, মধুসূদন মাহাতো।

এখানে প্রশ্ন উঠবে কেন এই আইন প্রণয়ণের দাবী? মধুসূদন মাহাতো জানাচ্ছেন, কারও আত্মীয় মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দ্যেশ্যে আয়োজিত শ্রাদ্ধকে কেন্দ্র করে আমন্ত্রিত ব্যক্তি (বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ইত্যাদি) এবং আত্মীয় এবং ব্রাহ্মণদের যে ভোজ (Feast) খাওয়ানো হয়, সেটাই মৃত্যুভোজ (Death Feast)। 


অভিধানে আধ্যাত্মবাদ শব্দের অর্থ, আত্মা সম্পর্কিত বা সম্বন্ধীয় মতবাদ। বিজ্ঞান কিন্তু গডেশ্বরাল্লহ, আত্মা, অলৌকিক ইত্যাদির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। কারন, বিজ্ঞানের দরবারে কোনো কিছু তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সেটা বিজ্ঞানের- পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত এই তিন সহজ সরল ধাপে উপনিত হয় বা সাফল্য (পাশ) লাভ করে। এমনটা আগেও হয়েছে কল্পিত প্রস্তাবনা বা হাইপোথিসিস। অর্থাৎ কোনো ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে যদি মনে হয় (সন্দেহ জনক কিছু রয়েছে) গবেষণা চালানো প্রয়োজন, তাকেই বলা হয় হাইপোথিসিস। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করার পক্রিয়া শুরু হয়।


আত্মা নামক বিষয়টি এখনও পর্যন্ত হাইপোথিসিস এ নিজের পা টাই রাখতে পারেনি, বাকি তিন ধাপ তো অনেক দুরের কথা। এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি যা ইঙ্গিত করে আত্মার অস্তিত্বকে। এখনও সেই রকম কিছু ঘটেনি যার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখবে,তারপর আসবে একটা সিদ্ধান্তে। আত্মার কোনো কার্যপ্রলাপ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কে প্রভাবিত করতেই পারেনি তাই বিজ্ঞান আজও মাথা ঘামায়নি যে আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে, নাকি নেই। আত্মা শুধুমাত্র আমাদের মনোজগৎ এর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয় যেখানে জ্ঞানের আলো জ্বালালেই তেঁনারা ভ্যানিশ। 


যুক্তিবাদী সাজবার ভণ্ডামো হতে পারে কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো শাখায় কেউ পড়াশোনা করলে কিন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী হয়ে যায়না। এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার যেটা সবাই পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং জিজ্ঞাসু মন। তাই কোনো নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী অথবা কোনো ধর্মগুরুরা যতই প্রচার করুক, যতই তত্ত্বকথা শোনাক -"বিজ্ঞান, গডেশ্বরাল্লহ, অলৌকিক, আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নিয়েছে" তবুও কোনোদিনই এসব প্রমাণিত হবে না বিজ্ঞানের দরবারে। 


দেখা গেছে, অনেকসময় গ্রামবাসীদের একাংশের চাপে পরে মৃতের পরিবার এই ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে নিজেদের জমানো সম্পদ খুইয়ে কিংবা ফসলি জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায়।  এই অহেতুক খরচের ফলে পরিবারগুলি তাদের সদস্যদের সঠিক মতন চিকিৎসা ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেন না এমনকি তাদের বাড়িঘরও তৈরি করতে ব্যর্থ হন। তাই এই কুরীতি বা কুপ্রথা বন্ধ হওয়া একান্তই প্রয়োজন  এবং এরজন্য সারাদেশে আইন আনা ভীষণ জরুরী।

ভারতে প্রথম মৃত্যুভোজ নিবারণে আইন এনেছে রাজস্থান রাজ্য। আইনটির নাম - "রাজস্থান প্রিভেনশন অফ মৃত্যুভোজ অ্যাক্ট -১৯৬০" { (Rajasthan Prevention of Mrityu Bhoj Act, 1960)। Notification No. F(25)/LJ/A/59 dated .8.2.1960 (Published in Rajasthan Gazette Extraordinary Part 4 A Dated 10.2.1960) [Received the assent of the President on the 3rd day of February 1960] An act to provide for the prevention of Mrityu Bhoj }


এই আইনে মৃত্যুভোজ নিবারণে জেলা প্রশাসনকে অত্যাবশ্যক কার্যকরী ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে। এই অাইন অনুসারে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।


১) উক্ত আইনের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে - কেউ মৃত্যুভোজ আয়োজন করতে পারবে না এবং কেউ এই ভোজে যোগদানও করতে পারবে না। এই নিষেধ অমান্য করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। 

২) এই আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি মৃত্যুভোজে উৎসাহ দিলে বা কোনরূপ সহযোগিতা করলে ১ বছর কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। 

৩) ধারা ৫ অনুসারে, এলাকার জনপ্রতিনিরা মৃত্যুভোজের খবর জানলে তা নিকটবর্তী প্রশাসক বা পুলিশ আধিকারিক জানাবে এবং সেই অনুযায়ী প্রশাসক ও পুলিশ মৃত্যুভোজের আয়োজন বন্ধ করবে এবং আয়োজনের সমস্ত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করবে। তারপরও যদি মৃত্যুভোজ করে থাকে, তবে ধারা ৬ অনুসারে ১ বছর কারাবাস অথবা ১০০০টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডই দিতে পারে। 

৪) ধারা ৭ অনুসারে, কোন জনপ্রতিনিধি যদি মৃত্যুভোজের খবর জেনেও তা নিকটবর্তী প্রশাসক বা পুলিশ আধিকারিককে না জানিয়ে গোপণ করার চেষ্টা করে, তবে তাদেরও তিনমাস কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে। 

৫) ধারা ৮ অনুসারে, কোন ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মহাজন বা কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুভোজ করতে টাকা বা জিনিসপত্র ঋণ বা ধার দেয়, তবে আইন অনুসারে তা ফেরতযোগ্য বা পরিশোধযোগ্য হবে না। এমনকি তাদেরও ১ বছর কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা হবে।

উক্ত আইনে কয়েকটি ফাঁকফোকর, স্ববিরোধীতা (যেমন জরিমানার অঙ্ক এবং শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা সহ কয়েকটি বিষয়) থাকলেও আইনটির অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মধুসূদন মাহাতো আরো জানিয়েছেন- আত্মা-পরমাত্মা যেহেতু সব অলীক কল্পনা তাই, মৃত ব্যাক্তির কাল্পনিক আত্মার উদ্দ্যেশ্যে শ্রাদ্ধ একটি কুসংস্কার মাত্র। শ্রাদ্ধ হচ্ছে ব্রাহ্মণদের দ্বারা তাঁদের যজমান দের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার দারুন কুবুদ্ধি। সম্ভব হলে অঙ্গদান করার অঙ্গিকার করুন। শ্রাদ্ধের নামে ভুরিভোজ এ অর্থের অপচয় বন্ধ করে সেই টাকায় কোনো গরিবের বাড়িতে সারা মাসের রেশন টা পাঠিয়ে দিন। এতে আপনার পুণ্য জাতীয় কিছু হবে কিনা জানা নেই, তবে মনে একটা অনাবিল শান্তি পাবেন। একটা ভালো কাজ করার শান্তি, যা টাকা দিয়ে কিন্তু কেনা যায় না।

সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে -বাবাই
Nov. 19, 2024 | আইন | views:880 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারতবর্ষের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকর সংবিধান কিন্তু একা

লেখেননি। সর্বপ্রথমে উনি বেশকয়েকটি দেশবিদেশের সংবিধানগ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালোকরে পড়ে তারপরে সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ২৯৯ জনের মিলিত মতামতে জন্ম সংবিধানের। 


সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন,পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। ১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। প্রসঙ্গত জানাই, এই সংশোধনীর ফলে রাজ্যগুলি নিজেরাই নিজস্ব ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা প্রস্তুত করবে এবং তার জন্য ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস -এর অনুমতি লাগবে না। এর জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৪২-এ এবং ৩৪২ এ (৩) ধারা সংশোধন করা হয়েছে। 


সংবিধানের শুরুতে সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' বা 'Secular' শব্দটি ছিলোনা। মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রপতির ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া দিয়েছে (সংবিধানের ১৪-৩৫ নং ধারা)। যেমন -  (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার, (৫)সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, এবং (৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। 


ধর্মনিরপেক্ষতা' বা 'Secularism' শব্দটা নিয়ে আমজনতার মধ্যেই রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে তথ্যবিকৃতিও করা হয়েছে বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। ' Secularism' এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোনো অথবা কারোর পক্ষেই নয় থাকা নয়।তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে মোটেই সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ 'রাষ্ট্র' ('রাষ্ট্র' অর্থে এখানে একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, সাংসদ বিধায়ক, সরকারি আমলা থেকে পাড়ার কাউন্সিলর ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে) কোনো ধর্মের পক্ষেই থাকবেনা, সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। ঠিক যেমনটা একজন রেফারী ইষ্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের মধ্যে ফুটবল খেলায় অথবা ভারত বনাম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় আম্পেয়ার নিরপেক্ষ থেকে খেলা পরিচালনা করেন। 


নির্বাচনে দাঁড়ানো ডান-বাম-ওপর-নীচ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো উক্ত প্রস্তাবনাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকারে "The Representation of the People Act 1951" (Amendment 1989) এর 29(A) ধারায় দায়বদ্ধ। অবশ্য, কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" এর অবস্থা হতে পারে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক। আইনের প্রয়োগ এবং সদিচ্ছার অভাবে ভারতে গোদীলোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির অপব্যখ্যা ও অপপ্রচার করে, তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছে অনেক আগেই।


এইখানে একটি বিশেষ খবর জানিয়ে রাখা উচিত হবে যে, গত ৩রা জানুয়ারি ২০১৭ তে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও ভোটের প্রচার করা যাবে না। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। এখন প্রশ্ন এটাই, শীর্ষ আদালতের এই রায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ম- জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাইলে প্রার্থিপদ বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বড়জোর আদালতে যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হলে আইন করে কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে ভয় পায় সব দলই। কারণ ধর্ম, জাতপাতের অঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রর ঝাঁঝালো বক্তব্য রেখেই কিন্ত ২০১৩ সালে একটি রাজনৈতিক দল ভারতে কেন্দ্রসরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল।


ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় আমজনতার ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি রয়েছে, যা আবেগের নয় বরং যুক্তিপূর্ণ আলোচনার বিষয়।ভারতীয় সংবিধান  আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা, কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। অন্যদিকে, ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের কথাও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, প্রতি ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞান মনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"।


ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় অধিকার বা ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমজনতার মধ্যে রয়ে গেছে নানানরকম বিভ্রান্তি। অন্যদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের উচিৎ খুব ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতীয় আইনের বইপত্র ভালোকরে পড়ে দেখা। আমাদের সংবিধানে এমন বেশকিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো পরস্পরবিরোধী যার সংশোধনের প্রয়োজন আবশ্যক। আবার এমনও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


যেমন -১) সংবিধানে বর্ণিত একটি Secular, Democratic, Republic Country ভারতে লাগু রয়েছে শরীয়া আইন (The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act, 1937)। ভারতে এটি শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয় গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


২) ব্লাসফেমি অ্যাক্ট। কোনো বিশেষ ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে 'ব্লাসফেমি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের 'Commission on International Religious Freedom' এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 


বহুর মধ্যে একটা মর্মান্তিক শোনা যাক। সম্ভবত আগষ্ট ২০২১ এর ঘটনা, ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে আটক একটি হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী পরিবারের ৮ বছরের ছেলে মৃত্যদন্ডে দণ্ডিত। যে বয়সের শিশুরা জানেই না ধর্ম নামক জিনিসটা খায়, নাকি মাথায় মাখে সেই বয়সের একটি শিশু কিভাবে ধর্ম অবমাননা করতে পারে? সে কিভাবেই বা অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে? 


দন্ডবিধি ১৮৬০, অনুচ্ছেদ ১৫র ২৯৫ ধারা থেকে ২৯৮ ধারা (IPC-295-298) পর্যন্ত সংশোধন করা প্রয়োজন এবং এর মধ্যে ২৯৫-ক (IPC-295A) ধারাটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা খুবই প্রয়োজন। সংবিধান প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী এই আইন। আলোচনা, সমালোচনা, মতপ্রকাশ এবং  উস্কানি, বিদ্বেষ, ঘৃণাবাদ এক নয়  অন্যদিকে, দন্ডবিধি-১৮৬০ এর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ২৯৫-ক ধারাটিতে আলোচনা, সমালোচনা, বাক্ স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে।


৩) ভারতীয় সংবিধানের ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.'অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনোরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবেনা। আবার, ২৮(২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ব-বিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন। 

One way Rationalism, One way Humanism -সন্তোষ শর্মা
Nov. 19, 2024 | আইন | views:882 | likes:2 | share: 2 | comments:0

২০১৯ সালের ৩ জুন “ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো,  সিধু কানু বিরষা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Sidhu-kanho-Birsha University) ভাইস চ্যান্সেলর এবং রেজিস্টারকে তাদের বিভিন্ন ফর্ম (Form)-এ ধর্মীয় (Religion) কলামে মানবতাবাদ বা মানবধর্ম রাখার আবেদন জানান।

 স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে হয়তো ভাববেন, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ৪২০০টি প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম (Religion) থাকতে হটাৎ মানবধর্ম কেন বা কি প্রয়োজনে? অথবা, এই মানবধর্ম বিষয়টি আদতে ঠিক কি?

দেখা যাচ্ছে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানিক ধর্মেই নিজেদের কে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী জানায়। মানবতা এবং পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার লোকদেখানো প্রচারও করে থাকে কিন্ত সেটাই যদি সত্য হতো তাহলে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাতের খবর শোনাই যেতো না। ‘ধর্ম মানবতা শেখায়’ কথাটা আসলে সোনার পাথরবাটির মতন ব্যপার। এটি সর্বৈব মিথ্যে এবং অপপ্রচার।

প্রথম মানবধর্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৯ সালে নিউইয়র্কে। অর্থাৎ রাষ্ট্রসংঘের অধিকার ঘোষণার অনেক আগে। এই মানবধর্মীরা তখন ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ১৯২৯ সালে পাশ্চাত্যে “Humanism” নামে যে নতুন Ism বা মতবাদের জন্ম হয়েছিল সেটা ছিল ইহুদি- খ্রিস্টান কট্টর পন্থীদের অবিরাম সংঘর্ষের একটা ফলস্বরূপ। তখনকার গণ্যমান্যরাই ছিলেন এই দলে। এঁরা মানবধর্মকে অন্য সমস্ত প্রচলিত ধর্মের বিকল্প হিসেবে চেয়েছিলেন। এদের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন Albert Einstein, Will Durant, Thomas Mann, Julian Huxley  ইত্যাদি জ্ঞানী গুণী যোদ্ধারা। এদের পথপ্রদর্শক ছিল আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞান। তাদের আস্থা ছিল, প্রত্যয় ছিল কিন্তু ছিল না অন্ধবিশ্বাস। তাদের আস্থা ছিল গণতন্ত্রে, বিজ্ঞানে, সব মানুষের সমান অধিকারে।

এখন এই ধর্মীয় স্বাধীনতার যুগে অনেক বিশ্বাস বা Cult যা ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে উঠে এসেছে, তাঁরা আলাদা স্বীকৃতি চাইছেন। যেমন রামকৃষ্ণের ভক্তরা “Ramkrishnaite” হিসেবে আলাদা ধর্মীয় স্বীকৃতি চাইছিলেন বেশ কিছু বছর ধরেই। কিন্তু তাঁরা মূলত হিন্দু বলেই তাঁদের এই আবেদন বাতিল করে দেয় সরকার। অবাক লেগেছিল যখন একজন সফল আবেদনকারীর চাকরিতে ঢোকা নাকচ হয়ে যায় শুধুমাত্র “Religion”  কলামে “মানবতাবাদ” লেখার জন্য। যেন মানবিক হওয়াটা খুব গর্হিত অপরাধ।

সেটা ১৯৯২-৯৩ সাল। যুক্তিবাদী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই বাংলার ছেলে মেয়েরা সরকারি, বে-সরকারি সমস্ত আবেদনপত্রে “ধর্ম” কলাম তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। “ধর্মপালন বা ধর্মাচরণ কারোর ব্যক্তিগত ব্যপার, একটি ধর্মনিরপক্ষে রাষ্ট্রে ধর্মীয় পরিচয় জানানো জরুরি নয়। যাঁরা কোন প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম মানেন না তাঁদের form বাতিল করা হচ্ছে অসম্পূর্ণ বলে। এই সময় এগিয়ে আসে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সিস্টার কনসার্ন “Humanists Association of India” বা “ ভারতের মানবতাবাদী সমিতি” এবং সক্রিয় হয় মানবতাকে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

মানবতাবাদী সমিতি সরাসরি চিঠি পাঠায় রাষ্ট্রসংঘের অফিসে। উত্তরও আসে দেরি না করেই। UNO তাদের Human Rights এবং Religious Rights সংক্রান্ত যাবতীয় বই ও কাগজপত্র পাঠিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘১৯৮১-র জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করেছে প্রতিটি মানুষের যে কোনো ধর্মমত গ্রহণ করার ও চর্চা করার স্বাধীন অধিকার আছে।’ তারপরই এই আইনি লড়াইতে যৌথভাবে নেমে পড়ে মানবতাবাদী সমিতি ও যুক্তিবাদী সমিতি। একটা চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সাংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও বিদেশি দূতাবাসেও। তারপর মানবতাবাদী সমিতি’র সহায়তায় কোর্টে গিয়ে Affidavit করে দলে দলে  ছেলেমেয়ে Humanism-কে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৯৩ সালে ১০ ডিসেম্বর। ১৯৯৩ সালে ১০ ডিসেম্বর “বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে” প্রথম ৫৪ জন সদস্য-সদস্যা আইনিভাবে Humanist হন।

এই কঠিন লড়াইটা জেতার পর এখন আর কোন বাধা নেই– যে কোন রাষ্ট্রসংঘের সদস্য দেশে এই একই ভাবে যে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে HUMANIST ঘোষণা করতে পারেন সগর্বে।

প্রসঙ্গত জানাই, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি রায়ে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে, রাষ্ট্র কাউকে তার ধর্ম জানাতে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন বা কোনও ধর্ম পালন করেন না -- এই দাবী করার সাংবিধানিক অধিকার আছে প্রত্যেক নাগরিকের। (State can compel none to declare or specify his/her religion. Citizens have Constitutional Right to belong to 'No Religion'.----- Bombey H C Ruling.

এটি পড়ুন –

 No person in India can be compelled to declare his religion: HIGH COURTS

Bombay High Court: In a landmark judgment, a bench comprising of A.S. Oka and A.S. Chandurkar, JJ declared that by virtue of Article 25 of the Constitution, every individual has the right to claim that he does not practice or profess any religion and thereby directed the state that they cannot compel any individual to declare or specify his religion in any form or in any declaration.


In the present case the petitioners were members of a registered organization “Full Gospel Church of God”.  Though they believed in the existence of Lord Jesus Christ but they did not believe in any religion, much less Christianity. According to their belief, Lord Jesus Christ desired to have a kingdom of heaven and not to form any religion. Therefore, they wanted a gazette notification to be issued recording that they were not Christians and that they belong to ‘no religion’. This application was rejected by Government Printing Press against which they filed a public interest litigation in Court.


The Court took into consideration various judgments including Commissioner of Police v. Acharya Jagadishwarananda Avadhuta (2004) 12 SCC 770 where it was stated that ‘man’s relation to his God is no concern of the State’. The Bench also observed that Article 25 (1); of the Constitution is in two parts. The first part confers fundamental right to freedom of conscience whereas the second part confers a right on a citizen to freely profess, practice or propagate any religion. The Court clarified that as freedom of conscience confers a fundamental right to entertain a religious belief, it also confers a right on an individual to express an opinion that he does not belong to any religion. Therefore, no authority which is a state within the meaning of Article 12 or any of its agency or instrumentality can infringe the fundamental right to freedom of conscience and thereby, the Court set aside the order of the Government Printing Press. Dr. Ranjeet Suryakant Mohite vs. Union of India, Public Interest Litigation No. 139 of 2010, decided on 23.09.2014

News Link: https://www.scconline.com/blog/post/2014/09/26/no-person-in-india-can-be-compelled-to-declare-his-religion/

এখানে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবর তুলে ধরলাম।


“ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ ভারতে।”

ইনকিলাব ডেস্ক। প্রকাশের সময়: ১১ এপ্রিল, ২০২১

১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো নাগরিক তার ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে বলে সংবিধানে অধিকার দেয়া রয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার ভারতের উচ্চ আদালতে অশ্বিন উপাধ্যায় নামে আইনজীবীর আবেদনের প্রতিউত্তরে এমন মন্তব্য করেছেন। এছাড়া এ বিষয়ে ‘এরকম ক্ষতিকর’ পিটিশন করার জন্য নিন্দাও জানিয়েছে আদালত। অশ্বিনের আবেদন ছিল, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মান্তরকরণ বন্ধের জন্য সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোকে যেন নির্দেশ দেয়। সংবিধান বিরোধী এমন আবেদন করায় অশ্বিনের আইনজীবী গোপাল শঙ্কর নারায়ণকে নিন্দা জানিয়েছেন বিচারপতি আর এফ নরিম্যান, বি আর গাভাই ও ঋষিকেশ রায়কে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ। বিচারপতিরা বলেন, একজন সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার পরও সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারের বিষয়ে জানা নেই আপনার। যদি না জানেন তাহলে আবেদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করার আগে তা জেনে নিতে পারেন। এভাবে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আমরা আপনার এবং আপনার নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারি। সূত্র- দ্য হিন্দু।

 খবরটির লিংক - https://m.dailyinqilab.com/article/372707/%E0%A6%87%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%8B-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%A3-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87


আমজনতার বৃহৎ অংশ 'ধর্ম' বলতে উপাসনা / প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বলতে উপাসনাধর্ম বিষয়ক বই-পত্র কেই বোঝেন। অভিধানে ‘ধর্ম’ বা ‘ রিলিজিয়ন’ (Religion) শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে - (১) ধর্ম মানে - সাম্প্রদায়িক, ঈশ্বর উপাসনা, রীতি-নীতি, ঈশ্বর এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। যেমন -হিন্দু, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি ৪২০০ প্রকার। (২) Religion [ রিলি'জন ]n. ধর্ম:  human recognition of a personal God entitled to obedience.. আবার, (৩) ধর্ম মানে - গুণ (Property) বৈশিষ্ট (Characteristic)। যেমন - আগুনের ধর্ম বা গুণ দহন, জলের ধর্ম বা গুণ তরলতা, তরোয়াল এর ধর্ম বা গুণ তীক্ষ্ণতা ইত্যাদি। ধর্মবিশ্বাস ; any system of faith and worship বোঝায়।

বহু ব্যক্তিরা এই প্রশ্নটিও তোলেন যে, কি এই মানবতাবাদ অথবা HUMANISM? কেন মেনে নেবো একে? এর উত্তরটি বেশ সহজ। HUMANISM কে ভাঙ্গলে আমরা কি পাই দেখা যাক। HUMAN অর্থাৎ ‘মানব’ বা মানুষ এবং ism হচ্ছে ‘মতবাদ’। দুয়ে মিলে দাঁড়ায়, মানবের মতবাদ কিংবা একজন মানুষের নিজস্ব মতবাদ এবং একজন মানুষের নিজস্ব মতবাদ কখনওই জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম (Religion) যেমন- হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি পরিচয় হতে পারে না। কারন, একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে জানেই না তার ধর্মচিহ্ন বা ধর্মবিশ্বাস ঠিক কি। শিশুটি জানেই না, জাতপাত, ধর্মীয় আচার আচরণ, ধর্মীয় বিদ্বেষ কাকে বলে। শিশুটি শুধু জানে প্রাণখুলে খেলতে, আনন্দে বাঁচতে। একটি শিশুর মস্তিষ্ক মাটির তালের ন্যায়। কুমোর যেমন চরকায় মাটির তাল ফেলে ইচ্ছেমত আকার দেয় তেমনই পরিবারের শিশুদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন তাদের অভিভাবকেরা। কেউ, ছোট থেকেই শিশুদের ধর্মহীন, জাতপাতহীন মুক্তমনা গড়তে চেষ্টা করেন তো কেউ আবার ধার্মিক। মানবতাবাদ=নাস্তিকতাবাদ + মানবিক গুণ।


তাই যিনি নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী যুক্তিবাদী নন তিনি মানবতাবাদী হতে পারেননা, তিনি মানবিক গুনসম্পন্ন ব্যক্তি হতে পারেন কিন্তু মানবতাবাদী নন।

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, “বর্তমান যুগে যারা শুধু বিজ্ঞান ও বির্বতনকে বিশ্বাস করে তারা মানবধর্ম পালন করে। তারা স্বাধীন।তারা আধুনিক বিজ্ঞানকে আর্দশ মনে করে। মানব ধর্মে বিশ্বাসীগণ নাস্তিক নামেও পরিচিত,কারণ তারা আদিমকালের কোন ধর্মই বিশ্বাস করে না, পালন করে না। ৭৭১.৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মানবধর্মে বিশ্বাসী পুরো পৃথিবীতে ২০ কোটি প্রায়। মানব ধর্মের উল্লেখ, কবি ‘লালন শার্হ’ তার কবিতায় বলেছেন। তিনি চেয়েছেন ধর্ম, জাত, বর্ণের কোন ভেদাভেদ না রেখে সবাই মানবধর্মে মনোযোগ দেই, মানবধর্ম পালনে বিশ্বাসী হই।”

 এই প্রসঙ্গে জানাতে চাই, Humanitarianism আর Humanism এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। Humanism বা মানববাদ মানুষের বৌদ্ধিক চেতনা নিয়ে কথা বলে। অপরদিক Humanitarianism মানুষের মানবিক গুণাবলী  যেমন প্রেম ভালোবাসা, দয়া, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদির কথা বলে।

আজ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিচারে নাস্তিক /অধার্মিক / যুক্তিবাদীরা তৃতীয় স্থানে (সূত্র- মনোরমা ইয়ারবুক ২০১৯। যাকে মান্যতা দেয় ওয়ার্ল্ড অ্যালম্যানাকও)। ২০১২ সালের ‘উইন গ্যালপ গ্লোবাল ইনডেক্স অফ রিলিজিয়ন রিপোর্ট’ অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছিল ঘোষিত নাস্তিক। এই হিসেবে ১৩০ কোটির দেশ ভারতে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। অন্যদিকে, অনেকে দেশে এখন নাস্তিকরাই সংখ্যাগুরু, এ তথ্য ছাপা হয়েছে শারিয়াপন্থী দলগুলোর সমর্থক দৈনিক ‘আমার দেশ’ এ, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬, গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল জরিপ।


 

ইউরোপের অনেকে দেশে এখন নাস্তিকরাই সংখ্যাগুরু। চীনে ৬১ শতাংশ সরাসরি স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সুইডেনে ৮ শতাংশ উপাসনালয়ে ধর্মচর্চা করে, ৭৬ শতাংশ নাস্তিক।

চেক প্রজাতন্ত্রে ১২ শতাংশ গির্জায় ধর্মচর্চা করে, ৭৫ শতাংশ নাস্তিক। ব্রিটেনের ৫৩ শতাংশের ধর্মবিশ্বাস নেই। হংকংএর নাগরিকদের ৬২ শতাংশে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। জাপানে নাস্তিকের সংখ্যা ৬২ শতাংশ। জার্মানিতে ৫৯ শতাংশ নাস্তিক। স্পেনের নাগরিকদের বড় একটা অংশই নাস্তিক। অস্ট্রিয়ার নাগরিকদেরও বড় অংশ নাস্তিক। ফ্রান্সের নাগরিকদের বৃহত্তর অংশ নাস্তিক।

এসব তথ্য এটাই কি প্রমাণ করে না যে, নাস্তিক / অধার্মিক / যুক্তিবাদী / মানবতাবাদীদের বিশ্বজয় নিশ্চিত। যতই কট্টরপন্থী, মৌলবাদীরা অস্ত্রের প্রয়োগে মুক্তচিন্তকদের হত্যা করুক তবুও তাদের দুর্বার গতিকে আটকানোর নেই সাধ্য কারোরই। রইলো আরেকটি মন ভালোকরে দেওয়া খবর-


“কলেজে ভর্তির ফর্মে সবার উপরে মানবধর্ম”

ধর্মের নাম মানবতা। পড়ুয়াদের ভর্তির ফর্মে এ বার চাইলে এমনটাও লিখতে পারেন কোনও আবেদনকারী। এ বছর ভর্তির জন্য অনলাইনে ফর্মে পড়ুয়াদের জন্য এই সুযোগ করে দিচ্ছে কলকাতার বেথুন কলেজ এবং মেদিনীপুর কলেজ।

গত সোমবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে সেই রাত থেকেই অনলাইনে বিভিন্ন কলেজের ফর্ম পূরণ শুরু হয়েছে। আর সেখানেই বেথুন ও মেদিনীপুর কলেজের জন্য ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে আবেদনকারী ছাত্রীরা দেখতে পাচ্ছেন, ধর্মের কলামে তালিকার প্রথমেই রয়েছে মানবধর্ম। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্ট বা অন্য যে কোনও ধর্মকে বাদ দিয়ে মানবতাকে নিজের ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার সুযোগ পাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা।

কেন এই উদ্যোগ? বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা মমতা রায় জানাচ্ছেন, গত বছরও কলেজে ভর্তির অনলাইন ফর্ম থাকলেও তাতে মানবতাকে নিজের ধর্ম বলে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তিনি বলেন, “অনেক আবেদনকারী হয়তো কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। তিনি হয়তো শুধু মানবধর্মে বিশ্বাসী। এই আবেদনকারীরা ওই কলামে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান-সহ নানা ধর্মের মধ্যে ‘অন্যান্য’ বলে যেখানে উল্লেখ থাকত তা বেছে নিতেন। অনেকে আবার লিখে দিতেন ‘নন বিলিভার’। এবার থেকে তাঁরা নিজের মত আরও স্পষ্ট করে প্রকাশ করতে পারবেন।” অধ্যক্ষার মতে, মানবতা ছাড়া যে কোনও ধর্মই হয় না, সেই বার্তাও এর মাধ্যমে নবীন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। আর মেদিনীপুর কলেজের অধ্যক্ষ গোপালচন্দ্র বেরা বলছেন, ‘‘মানুষের প্রথম পরিচয় সে মানুষ। মানবতাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। তাই কলামটি এমন রাখা হয়েছে।’’


বেথুনের অধ্যক্ষা অবশ্য জানাচ্ছেন, সুষ্ঠু ভাবে ভর্তির মেধা-তালিকা বার করাটাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। তবে তার মধ্যেই ছোট ছোট বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এ বার অনলাইনে ভর্তির আবেদনপত্র প্রকাশের আগে কলেজে অ্যাডমিশন কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এ বারের আবেদনপত্রে ধর্মের তালিকায় স্থান পাবে মানবধর্ম।

বেথুন ও মেদিনীপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন আবেদনকারী ছাত্রী থেকে শুরু করে তাঁদের অভিভাবকদের অনেকেই। তাঁদের একাংশের মতে, এর ফলে অনেকেই নিজের মত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন।


তবে শুধু কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেই নয়। চাকরির আবেদন থেকে শুরু করে নানা জায়গায় ফর্ম ভর্তি করার সময়ে ধর্মের নাম লেখার একটি জায়গা থাকে, যা আবেদনকারীকে লিখতেই হয়। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের নামের সঙ্গে সঙ্গে ‘অন্যান্য’ বলেও লেখা থাকে। বেথুন কলেজের মতো এ বার সেই সব জায়গায় ধর্মের কলামে মানবতাকে রাখা যেতেই পারে বলে মনে করছেন অনেকে।


সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, সব ধর্মেরই মূল কথা মানবতা। এখন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক সময়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়। আসলে ধর্মে ধর্মে কিন্তু কোনও বিভেদ নেই। শীর্ষেন্দুবাবুর কথায়, “আজকাল অনেকেই ধর্মীয় পরিচয় দিতে চান না বা দিতে লজ্জা পান। সে ক্ষেত্রে মানবতাকে বেছে নেওয়ার এই সুযোগ থাকাটা ভাল। তাতে আবেদনকারীকে একটা স্বাধীনতাও দেওয়া হল।” সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই উদ্যোগ অনুসরণযোগ্য।”

https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/bethune-college-and-midnapore-college-included-humanities-in-their-religion-section-1.999637


জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্মপরিচয় ছেড়ে (যেমন- হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান ইত্যাদি) নিজেকে মানবতাবাদী বা Humanist ঘোষণা করতে চাইলে সেই ব্যক্তিকে এফিডেফিট (Affidavit) করাতে হবে নোটারী দ্বারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষর সহ পাকাপোক্ত একটি এফিডেফিট এর জন্য যাতে ভবিষ্যতে কোনোরকম সমস্যা না এসে দাঁড়ায় (In order to have that, a Religion Change affidavit has to be prepared mandatorily. The affidavit is a legal document that contains details like name, the new religion, old religion, and address. It must be made on stamp paper and notarized by a notary public.) আমি, সন্তোষ শর্মা একজন সাংবাদিক এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সংযুক্ত সম্পাদক এবং ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সদস্য, গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ –এ ব্যারাকপুর নোটারী থেকে এস দত্ত মারফৎ ১৬ জন মুক্তচিন্তকদের সাথে এফিডেফিট করিয়ে Religion কলামে Humanism লেখার আইনত অধিকার লাভ করেছি। এফিডেফিট এর বয়ানটি তুলে ধরলাম -

"We, members of Humanist Association feel and sincerely believe that the greatest religion of Man is 'Humanism' which is most suitable for the protection and achievement of human rights and for the fullest expression of human talents. We therefore declare 'Humanism' as our religion. This is in accordance to the declaration of the General Assembly of UNO, November, 1981.

The religion of 'Humanism' is a way of life separate and different from any other like Hinduism, Islam, Christianity, Judaism etc. 'Humanism' has its separate organization and separate philosophy aiming at the total well-being of mankind where coercion and repression hardly exist."

ভারতে কোনো শিশুর জন্মনেওয়ার পরে পৌরসভা থেকে যে জন্মসংশাপত্র বা Birth certificate প্রদান করা হয় তাতে (form 5) কিন্তু Religion column বলে কিছু নেই, ব্যতিক্রমী কিছু যায়গা ছাড়া। অনেকেই অভিন্ন দেওয়ান বিধি অর্থাৎ Uniform Civil Code চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছেন। কিন্তু যতদিন না Uniform Civil Code তৈরি হচ্ছে, আইনের চোখে আবার ধর্ম থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে Criminal Law আবার ধর্মের ধার ধারে না কিন্তু Personal Law (যেমন- Property, Marriage, Divorce, Inheritance ইত্যাদি) লাগু করতে হলে আমাদের দেশে এখনও ধর্ম ছাড়া গতি নেই। এমনকি কেউ যদি বিশেষ বিবাহ আইন বা Special Marriage Act এ বিয়ে করেও থাকেন, সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে গোলমাল বাধলে তার নিষ্পত্তি কোনও না কোনও ধর্মের Personal Law অনুযায়ী হবে। তবে, উইকিপিডিয়ার একটি তথ্য জানাচ্ছে-


Q: What is all about religion change in India?

Ans: As per Article 15 of the Indian Constitution, freedom of religion is one of the fundamental rights in India. India is a secular country and every Indian citizen has the right to practice and promote their own religion peacefully. This means changing religion (due to self-belief, marriage, or divorce) is legal in India provided the same is in good faith and not because of any coercion or application of force. অন্যদিকে, জনৈক দুর্গাদাস বাবু জানিয়েছেন – “আমার মেয়ের বয়স এখন 22, ওর Birth certificate এ কোনো পদবী বা টাইটেল নেই, এবং ধর্ম হিসাবে Humanism লিখেছিলাম। প্রথমে একটু ঝামেলা করলেও দমদম মিউনিসিপ্যালিটি থেকে Birth certificate বের করতে পেরেছিলাম। ধর্ম এবং পদবী ছাড়াই আমার মেয়ের সমস্ত রকম কার্ড, পাসপোর্ট, PAN, Aadhar, Driving license, Ration card, Voter card আছে।”


 


প্রিয় পাঠকবন্ধু, আপনি কি স্নেহা পার্থিবরাজকে চেনেন? উনি তামিলনাড়ুর তিরুপাত্তুর-এর বাসিন্দা এবং পেশায় আইনজীবি। কিছুসময় আগে তিনি একটি ব্যতিক্রমী কাণ্ড বা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছেন তাও আবার ভারতের মতো ধর্ম ও বর্ণে শতবিভক্ত একটি দেশে। তিনিই ভারতের সেই প্রথম মহিলা যাঁর কোনো ধর্ম নেই এবং বর্ণও নেই (No Religion, No casts) এই স্বীকৃতি তিনি আদায় করেছেন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর খোদ তামিলনাড়ু সরকারের কাছ থেকে। স্কুল জীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্তরে ধর্ম ও বর্ণের যায়গাটি ফাঁকা রাখতেন। ২০১০ সাল নাগাদ তিনি এর জন্যে আইনি লড়াই শুরু করেন। পাশে পেয়ে যান তাঁর জীবনসঙ্গী পার্থিবরাজকেও। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মিলছে স্বীকৃতি। স্বয়ং তামিলনাড়ু সরকার, স্নেহা পার্থিবরাজকে সনদ পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, এবার থেকে স্নেহা নিজেকে ধর্মহীন এবং বর্ণহীন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। সরকার একই সঙ্গে জানিয়ে দেয়, এখন থেকে স্নেহার একমাত্র পরিচয়,তিনি ভারতীয়।

স্নেহা পেরেছেন। কিন্তু বাকিরা? আরে মশাই আর কতদিন? আর কতদিন জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম কে আঁকড়ে ধরে বাঁচবেন? যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে আসুন। আনন্দ পাবেন। এমন এক অনাবিল আনন্দ যা টাকাপয়সা দিয়ে কেনা যায়না। অন্তত আগামীপ্রজন্মর স্বার্থেই এগিয়ে আসুন। গর্ব করে প্রচার করুন হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান ইত্যাদি নয়, মানুষের একমাত্র ধর্ম হচ্ছে “HUMANISM”।

স্নেহা পার্থিবরাজ। আপনাকে কুর্নিশ। লেখাটি শেষ করবো একটি অন্যরকম খবর জানিয়ে।


“চাকরির নথিতে ‘নাস্তিক’ লেখার দাবি, শিক্ষা দফতরে চিঠি শিক্ষিকার তা-ও যদি না-হয়, তবে ফর্মে ধর্মের জায়গা পূরণ ‘ঐচ্ছিক’ করতে হবে।”

পদবি ওঁর কাছে ‘ধর্মচিহ্ন’ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মেয়ের নামের সঙ্গে পদবি জোড়েননি দক্ষিণ ২৪ পরগনার উস্তির শেরপুর রামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শর্মিলা ঘোষ। এ বার তিনি শিক্ষা দফতরে চিঠি পাঠিয়ে তিনি দাবি করেছেন, চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথিতে ধর্মের জায়গায় ‘নো রিলিজিয়ন’ বা ‘না-ধার্মিক’ লেখার সুযোগ তাঁকে দিতে হবে। একান্তই তা সম্ভব না-হলে, ফর্মের ওই জায়গায় ‘নাস্তিক’ অথবা ‘মানবিকতা’ লেখার সংস্থান থাকতে হবে নথিতে। আর তা-ও যদি না-হয়, তবে ফর্মে ধর্মের জায়গা পূরণ ‘ঐচ্ছিক’ করতে হবে।

শর্মিলা বলেন, ‘‘এখন চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথি এবং ফর্মে ধর্মের জায়গায় আমাকে হিন্দু অথবা ‘আদার্স’ লিখতে হয়। এই ‘আদার্স’-এর অর্থও কোনও না কোনও ধর্ম। কিন্তু আমি কোনও ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ নই। তাই ফর্মের ওই জায়গায় আমাকে না-ধার্মিক, মানবিকতা অথবা নাস্তিক লেখার সুযোগ দিতে হবে। তা সম্ভব না হলে, ধর্মের জায়গা পূরণ করার বিষয়টি ঐচ্ছিক করতে হবে।’’ সঙ্গে যোগ করেন: ‘‘বছরের পরে বছর ধরে ওই ফর্মগুলিতে ধর্মের জায়গায় আমাকে হিন্দু অথবা আদার্স লিখে যেতে হচ্ছে। অথচ আমি প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ধর্মপালন করি না। আমি আপাদমস্তক নাস্তিক এবং না-ধার্মিক।”

শর্মিলা ওই মর্মে চিঠি পাঠিয়েছেন শিক্ষা দফতরের কমিশনার, দফতরের সচিব, এবং জেলা স্কুল পরিদর্শককে। চিঠি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং নিজের স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিউদ্দিন আহমেদকে। ঘটনাচক্রে রফিউদ্দিন আবার শর্মিলার স্বামী। রফিউদ্দিন বলেন, ‘‘উনি ধর্মাচরণ করেন না। আমিও করি না। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত। শিক্ষা দফতরে একই আবেদন আমিও জানাব বলে ভাবছি।’’জেলা স্কুল পরিদর্শক প্রদ্যোৎ সরকারের বক্তব্য, ‘‘আমি ওই শিক্ষিকার আবেদনপত্র ই-মেল মারফত পেয়েছি। কিন্তু এই বিষয়টি আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। তাই আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। এটি রাজ্য সরকারের বিষয়। যদি কিছু করার থাকে, রাজ্য সরকার বা শিক্ষা দফতর করতে পারে।’’

শর্মিলা বলেন, ‘‘বেতন-সহ নানা বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনলাইনে ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হয়। ফর্ম ছাড়াও শিক্ষা দফতরের পোর্টালেও চাকরি সংক্রান্ত অনেক বিষয় পাঠাতে হয়। সর্বত্রই ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে ধর্মের জায়গাটি পূরণ করতে হয়। অথচ আমি বাড়িতে বা অন্য কোথাও ধর্মাচরণ করি না। ধর্মীয় কোনও রীতিও মানি না। সেই কারণেই আমি ওই দাবির কথা জানিয়েছি দফতরকে।’’


নামের পাশে পদবির উল্লেখ নিয়েও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার। শর্মিলার সংযোজন: ‘‘কেউ মানুক বা না-মানুক, এটা বাস্তব যে, পদবি দেখে মানুষের ধর্ম চেনা যায়। পদবিকে তাই আমি ধর্মচিহ্ন বলেই মনে করি। এই কারণে আমি মেয়ের নামের পাশে কোনও পদবির উল্লেখ করিনি।’’ শর্মিলার মেয়ের নাম ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’। স্কুল-সহ সব নথিতে এটাই তার নাম।

খবরটির লিংক- https://www.anandabazar.com/west-bengal/24-parganas/woman-wrote-letter-to-education-department-to-permit-her-to-write-atheist-on-religion-coloumn-1.1193102

তথ্যসহায়তায়: সুমিত্রা পদ্মনাভন (প্রাক্তন সভাপতি, ভারতের মানবতাবাদী সমিতি) সদ্যপ্রয়াত আইনজীবী শ্রী গীতানাথ গাঙ্গুলী এবং নোটারী অফিসার দেবদুলাল সাহা।

কলেজে ফর্ম ফিলাপে Religion -সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | সচেতনতা | views:67 | likes:2 | share: 1 | comments:0

 কিছুসময় আগে একজন বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন, কলেজে ফর্ম ফিলাপের সময় এখনো Religion এর জায়গায় আমার অভিভাবকের ধর্ম (Religion) লিখতে হয়েছিল।

আমি একজন উকিল মারফৎ এফিডেফিড করার আবেদন করেছিলাম No Religion, No Cast এর জন্যে। কিন্তু সেই সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে। তাছাড়া, এখনো পর্যন্ত যে সমস্ত সরকারি কিংবা বে-সরকারি চাকরির ফর্ম বের হয় সেখানে কোথাও Humanity বা Humanism বলে আলাদা কিছুর উল্লেখই থাকেনা। আমার একজন বন্ধু এমনই একটি ফর্মে Humanism লেখায় সেটি বাতিল করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয়?

উত্তর - আমি সন্তোষ শর্মা, উক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর জানতে যোগাযোগ করেছিলাম,কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজীবীর সাথে। ওনারা জানিয়েছেন- “ভারতীয় নাগরিকদের জন্যে সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১২-৩৫ নং ধারায় ৬ টি মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে যার একটি হলো ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার। সংবিধানের ২৫ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, “প্রত‍্যেক ব‍্যক্তি নিজের বিবেক এবং বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোন ধর্মমত গ্রহন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও নিজধর্ম প্রচার করতে পারবেন।”

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে বোম্বে হাইকোর্ট তাদের একটি রায়ে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন যে, রাষ্ট্র কাওকে তার ধর্ম জানাতে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন বা কোনও ধর্ম পালন করেন না  এই দাবী করার সাংবিধানিক অধিকার আছে প্রত্যেক নাগরিকের। অন্যদিকে, এপ্রিল ২০২১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এফ নরিম্যান, বি আর গাভাই এবং ঋষিকেশ রায়কে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ জানিয়েছেন, ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো ভারতীয় নাগরিক তার ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবেন কারন সংবিধানে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে।”

তাই জন্মসূত্রে পাওয়া Religion চিহ্ন ছেড়ে যেকেউ নোটারী পাবলিক ও ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা এফিডেফিট করিয়ে No Religion বা HUMANISM সার্টিফিকেট বানাতে পারেন। তামিলনাড়ুর বাসিন্দা স্নেহা পার্থিবরাজ ভারতের প্রথম সেই মহিলা যিনি এমন সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। তাছাড়া ২০১৯ সালে হরিয়ানার বাসিন্দা রবি কুমার, No Casts, No, Religion, No God সার্টিফিকেট পেয়েছে যাতে সরকারি সীলমোহরও রয়েছে। কোনো নাগরিক সরকারি অথবা বে-সরকারি কোনোরকম ফর্মের Religion কলামে HUMANISM, ATHEISM অথবা No Religion ইত্যাদি লিখলে সেই ফর্ম বাতিল করা বে-আইনি। প্রয়োজনে আবেদনকারী এই সংক্রান্ত ব্যপারে আদালতের দারস্থও হতে পারেন নির্দিধায়।

ডিভোর্স ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি -সৌরাষ্ট্র দাশ
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:1018 | likes:2 | share: 2 | comments:0

(প্রথমেই বলতে চাই আমার এই লেখা বিবাহ-বিচ্ছেদ এর পক্ষেও নয়, বিপক্ষেও নয়। এই লেখার মাধ্যমে এটাই বোঝার চেষ্টা করবো যে Divorce-এর আইনি পদ্ধতি এবং ডিভোর্স পদ্ধতি নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করেছি।  এই লেখার মাধ্যমে কোনো ধর্ম-কে অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। লেখাটি সম্পূর্ণ তথ্য অনলাইন আইনগত ওয়েবসাইট তথা সংবাদ পত্রিকা ও YouTube থেকে প্রাপ্ত।)


বিবাহ-বিচ্ছেদ যে'কোনো দম্পতির জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। এর সাথে যোগ করার জন্য, বিবাহবিচ্ছেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে এটি ভারতে দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যয়বহুল ব্যাপার হতে পারে। এমনকি যে দম্পতিরা পারস্পরিকভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদে সম্মত হন, তাদের অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে আদালত তাদের আবেদন বিবেচনা করার আগে তারা এক বছরের জন্য আলাদা ছিল। এই বিষয় নিশ্চয়ই আপনারা অবগত।

ভারতে, বেশিরভাগ ব্যক্তিগত বিষয়গুলির মতো, বিবাহবিচ্ছেদের নিয়মগুলি ধর্মের সাথে যুক্ত। হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈনদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হিন্দু বিবাহ আইন, 1955 দ্বারা, মুসলমানদের মুসলিম বিবাহ আইন, 1939 দ্বারা, পার্সি বিবাহ এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন, 1936 দ্বারা এবং খ্রিস্টানদের ভারতীয় বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন, 1869 দ্বারা পরিচালিত হয়। সমস্ত নাগরিক এবং আন্তঃ-সম্প্রদায়িক বিবাহ বিশেষ বিবাহ আইন, 1956 দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিবাহবিচ্ছেদ আইন কিছু শর্তের সাথে কাজ করে এবং সমস্ত পরিস্থিতিতে নয়। [1]


একজন পত্নী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ করার আগে অন্য পত্নীকে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য আইনি নোটিশ দিতে শুরু করতে পারে। বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদনের ধরন রয়েছে এবং আপনি এতদ্বারা, ভারতে কীভাবে স্ত্রীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ পাবেন তার পদ্ধতিগুলি বুঝতে পারবেন। ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া, ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদের নিয়ম এবং ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আইনগুলি একটু জটিল। আপনি প্রয়োজন হলে উকিল বা আইন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন। 


Divorce পিটিশনের ধরন

একটি দম্পতি পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ পেতে পারে, অথবা স্বামী/স্ত্রী উভয়ের সম্মতি ছাড়াই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ফাইল করতে পারে।


পারস্পরিক সম্মতিতে Divorce: [2]

যখন স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই বিবাহ-বিচ্ছেদে সম্মত হন, তখন আদালত পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ বিবেচনা করবে। আবেদনটি গ্রহণ করার জন্য, তবে, দম্পতিকে এক বা দুই বছরের বেশি সময় ধরে আলাদা থাকতে হবে (প্রাসঙ্গিক আইন অনুসারে) এবং তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন যে তারা একসাথে থাকতে পারেনি। প্রায়ই, এমনকি যখন স্বামী বা স্ত্রী উভয়েই অনিচ্ছুক হন, তবুও তারা এই ধরনের বিবাহ-বিচ্ছেদে সম্মত হন কারণ এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো আঘাতমূলক নয়। শিশুদের হেফাজত, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সম্পত্তির অধিকারের মতো বিষয়গুলি পারস্পরিকভাবে সম্মত হতে পারে।

How Does Mutual Divorce Work? [3]

তিনটি দিক আছে যেগুলো নিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হয়। একটি হল ভরণপোষণ বা রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা। আইন অনুসারে, সমর্থনের সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ সীমা নেই। এটি যে কোনও চিত্র বা কোনও চিত্র হতে পারে। দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হল সন্তানের হেফাজত। এটি অবশ্যই পক্ষগুলির মধ্যে কাজ করা উচিত, কারণ এটি অবশ্যম্ভাবীভাবে পারস্পরিক সম্মতি ছাড়াই বিবাহ-বিচ্ছেদে সর্বাধিক সময়ের প্রয়োজন। পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদে সন্তানের হেফাজতও স্বামীদের বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করে ভাগ বা যৌথ বা একচেটিয়া হতে পারে। তৃতীয়টি হল সম্পত্তি। স্বামী-স্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কে সম্পত্তির কোন অংশ পাবে। এর মধ্যে স্থাবর এবং অস্থাবর উভয় সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ডানদিকে, সবকিছু ভাগ করা আবশ্যক। এটি ন্যায্য হওয়ার জন্য এটি প্রয়োজনীয় নয়, যতক্ষণ না এটি উভয় পক্ষের দ্বারা সম্মত হয়।


ধারা কী বলে?

আদালতের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে! পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের সময়কাল 6 থেকে 18 মাসের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত, আদালত পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদ শীঘ্রই শেষ করতে পছন্দ করে, বরং পরে। হিন্দু বিবাহ আইন, 1955 এর 13 বি এবং বিশেষ বিবাহ আইন, 1954 এর ধারা 28 অনুসারে, বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে দম্পতিকে কমপক্ষে এক বছরের জন্য আলাদাভাবে বসবাস করতে হবে। বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন, 1869-এর 10এ ধারায় অবশ্য দম্পতিকে কমপক্ষে দুই বছরের জন্য আলাদা থাকতে হবে। মনে রাখবেন যে আলাদাভাবে বসবাস করার অর্থ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা আবশ্যক নয়, দম্পতি শুধুমাত্র এই সময়ের মধ্যে স্বামী এবং স্ত্রী হিসাবে বসবাস করছেন না যে প্রদান করতে হবে।

মুম্বাই [4] এবং কলকাতা [5] পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ কীভাবে করা যায় তা জানুন।


পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ:

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে যার ভিত্তিতে আবেদন করা যেতে পারে। এটা এমন নয় যে একজন স্বামী বা স্ত্রী কোনো কারণ ছাড়াই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য জিজ্ঞাসা করতে পারেন। কারণগুলো নিম্নরূপ, যদিও কিছু

1. নিষ্ঠুরতা

নিষ্ঠুরতা শারীরিক বা মানসিক নিষ্ঠুরতা হতে পারে। ভারতের হিন্দু বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুসারে, যদি একজন পত্নীর মনে যুক্তিসঙ্গত আশংকা থাকে যে অন্য পত্নীর আচরণ ক্ষতিকারক বা ক্ষতিকারক হতে পারে, তাহলে স্বামী/স্ত্রীর দ্বারা নিষ্ঠুরতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়ার পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে৷

2. Adultery

ভারতে, একজন পুরুষ যে Adultery করে! (অর্থাৎ বিবাহের বাইরে সম্মতিক্রমে যৌন মিলন করেছে) তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে অভিযোগ আনা যেতে পারে না। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে ভারতে পরকীয়া অপরাধ নয়। [6] তবে স্ত্রী অবশ্যই দেওয়ানী প্রতিকার হিসেবে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অন্যদিকে, যদি একজন স্ত্রী Adultery করে, তবে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা যাবে না, এই আইন আগের থেকে ছিল। যেটা এখন দুইপক্ষ মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে।

3. পরিত্যাগ

একজন পত্নী যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই অন্যকে ত্যাগ করা (উদাহরণস্বরূপ নিষ্ঠুরতা) বিবাহ-বিচ্ছেদের একটি কারণ। তবে, যে পত্নী অপরকে পরিত্যাগ করবে তার মরুভূমিতে যেতে হবে এবং তার প্রমাণ থাকতে হবে। হিন্দু আইন অনুসারে, ত্যাগ কমপক্ষে দুই বছর স্থায়ী হওয়া উচিত ছিল। খ্রিস্টানরা অবশ্য শুধুমাত্র এই কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে না।

4. রূপান্তর

একজন স্বামী/স্ত্রী অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এই কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ দায়ের করার আগে কোন সময় অতিবাহিত করার প্রয়োজন হয় না। 

এই বিষয় পশ্চিমবঙ্গের গায়ক কবীর সুমনের ব্যক্তিগত জীবনের উপর নজর দিতে পারেন। তবে এই বার বার ধর্ম পরিবর্তন করে বিয়ে করা অপরাধ না হলেও শিক্ষিত তথা সভ্য সমাজের জন্য অসম্মান জনক" এবং এর ফলে যদি তাদের সন্তান থেকে তাকে তাহলে স্বামী/স্ত্রীর ভূমিকা কি? এটা নিয়েও প্রশ্ন হতে পারে। [7]

5. মানসিক ব্যাধি

যদি স্বামী/স্ত্রী মানসিক অসুস্থতার কারণে বিবাহে প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া যেতে পারে। মানসিক অসুস্থতা এতটাই বেড়ে যায় যে বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করা যায় না।

6. সংক্রামক রোগ

যদি পত্নী একটি সংক্রামক রোগে ভোগেন, যেমন এইচআইভি/এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া বা কুষ্ঠ রোগের একটি মারাত্মক এবং দুরারোগ্য রূপ, ভারতে হিন্দু বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন বলে যে অন্য পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদ পেতে পারে। স্বামীর জন্য কোনো নিয়ম নেই।

7. বিশ্বের ত্যাগ / বা সন্ন্যাস

যদি পত্নী তার বিবাহিত জীবন ত্যাগ করেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, তাহলে সংক্ষুব্ধ পত্নী বিবাহবিচ্ছেদ পেতে পারেন। 

8. মৃত্যুর অনুমান

যদি স্বামী/স্ত্রীকে কমপক্ষে সাত বছর ধরে জীবিত থাকার কথা শোনা না হয়, এমন ব্যক্তিদের দ্বারা যারা এই ধরনের পত্নীর সম্পর্কে শুনেছেন, যদি তিনি বা তিনি বেঁচে থাকেন, তাহলে যে পত্নী জীবিত আছেন তিনি একটি বিচারিক ডিক্রি পেতে পারেন। বিবাহ-বিচ্ছেদ

আপনি ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদের ধরন [8] ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের আইন, ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদের নিয়ম, ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদের নতুন নিয়ম [9] ভারতে মুসলিম বিবাহ আইন, [10] দিল্লি এবং কলকাতায় [11]  পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ [12] এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারেন।

বিবাহবিচ্ছেদের বিজ্ঞপ্তি:

কিছু করার আগে, আপনার পত্নীকে বিবাহ-বিচ্ছেদের নোটিশ দিতে আপনার সচেতন হওয়া উচিত। এটি আবেগগুলিকে স্পষ্ট করতে এবং সম্পর্কটি বন্ধ করার বিষয়ে আপনার চিন্তাভাবনা শুরু করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম। বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য একটি আইনি নোটিশ অন্য পত্নীকে ভবিষ্যতের সম্পর্কের বিষয়ে স্পষ্টতা এনে দেবে যা আপনি রাখতে চান।


একজন পত্নী বিবাহের সম্পর্ককে কভার করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তার/তার অভিপ্রায় জানাতে অন্য পত্নীকে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য একটি আইনি নোটিশ পাঠাতে পারেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ যা 'স্বামী এবং স্ত্রী' সংযোগ ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ।

যে উপাদানগুলি ভরণপোষণের সময়কাল এবং পরিমাণকে প্রভাবিত করে:

একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, ভরণপোষণ, তার পরিমাণ এবং মেয়াদ, বিবাহের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। বিবাহের এক দশক পরে বিবাহবিচ্ছেদ স্বামী/স্ত্রীকে আজীবন ভরণপোষণের অধিকারী করে। অন্যান্য অপরিহার্য কারণ হল:


1. পত্নীর বয়স (অথবা যে ব্যক্তিকে ভরণপোষণ পাওয়া উচিত)

2. অর্থনৈতিক অবস্থা বা যে ব্যক্তিকে ভরণপোষণ প্রদান করতে হবে তার উপার্জন

3. উভয় পত্নীর স্বাস্থ্য (ব্যর্থ স্বাস্থ্য বা চিকিৎসার অবস্থা স্বামী/স্ত্রীর মধ্যে একজন যে ভরণপোষণ পেতে চলেছেন তারা তার পক্ষে কাজ করতে পারেন। তারা তাদের স্বাস্থ্যহীনতার ভিত্তিতে একটি বড় ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন)।

4. যে পত্নী সন্তানের হেফাজতে রাখে সে হয় কম ভোক্তা প্রদান করবে বা শিশুটি নাবালক থাকাকালীন একটি বড় পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে।

সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় কিভাবে নিষ্পত্তি করবেন?

আপনি বা আপনার পত্নী সম্পত্তির মালিক কিনা তা খুব কমই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন - বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন দায়ের করা হয়েছে তা নির্বিশেষে - আপনার সম্পত্তি দখল করার অধিকার রয়েছে। আপনি যদি বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন তবে মামলাটি আরও শক্তিশালী। যদিও সম্পত্তিটি বিবাহ-বিচ্ছেদের নিষ্পত্তিতে একজন বা অন্য পত্নীকে মঞ্জুর করা যেতে পারে, যতক্ষণ না এটি করা হয়, উভয় পত্নীর সম্পত্তিতে থাকার অধিকার রয়েছে।


সন্তানের হেফাজত সম্পর্কে কি?

অনেকে ধরে নেন যে মা সবসময় তার সন্তানদের হেফাজত পান। এই ক্ষেত্রে না হয়. যদিও আদালত সাধারণত পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পিতামাতার সিদ্ধান্তে সম্মত হন, আদালত সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থের দিকে নজর দেবে। একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, আদালত সন্তানের পিতা বা মাতা হওয়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করবে, উদাহরণস্বরূপ। আপনি বিবেচনায় টাকা নিতে পারবেন না. সাধারণত, আদালত তাদের সন্তানদের হেফাজত করে অ-কর্মজীবী মায়েদের কাছে, তবে পিতারা আর্থিক সহায়তা প্রদান করবেন বলে আশা করা হয়।


বিবাহবিচ্ছেদ পেতে কত খরচ হয়?

বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আদালতের ফি কম, খরচ প্রধানত ফি আপনি আপনার আইনজীবী প্রদান! আদালতে হাজিরা এবং অন্য কোনো কাজ করার জন্য আইনজীবীদের ফি নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এটি কতটা নিবিড়ভাবে কাজ করে তার উপর নির্ভর করে, তাই এটির দাম কম হতে পারে দশ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত।


তথ্যসূত্রঃ 

1 || https://indiankanoon.org/search/?formInput=Marriage+and+Divorce

2 ||  https://youtu.be/Y6vIXZ-WpEs

3 || https://indiankanoon.org/search/?formInput=How+Does+Mutual+Divorce+Work%3F

4|| https://indiankanoon.org/search/?formInput=How+To+Get+A+Mutual+Consent+Divorce+In+Mumbai%3F

5 || https://indiankanoon.org/search/?formInput=How+To+Get+A+Mutual+Consent+Divorce+In+Kolkata+

6 || https://www.bbc.com/bengali/news-45667250

7 || https://bangla.asianetnews.com/west-bengal/how-many-times-kabir-suman-changed-religion-does-islam-accept-his-actions-r6h2ta

8 || https://www.legalserviceindia.com/article/l393-Divorce-under-Muslim-Law.html#:~:text=Under%20Muslim%20law%20the%20divorce,to%20the%20status%20of%20marriage.

9 || https://ca.practicallaw.thomsonreuters.com/6-581-5985?transitionType=Default&contextData=(sc.Default)#:~:text=The%20only%20requirement%20for%20divorce,a%20period%20of%20one%20year.

10 || https://indiankanoon.org/search/?formInput=Muslim+Marriage+Law+In+India%3A+Formalities%2C+Polygamy%2C+Divorce%2C+Remarriage

11 || https://lawrato.com/divorce-legal-advice/divorce-by-mutual-consent-in-kolkata-119765

12 || https://indiankanoon.org/search/?formInput=Divorce+Without+Mutual+Consent+In+Delhi

যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্মনিরপেক্ষতা -অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | আইন | views:918 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্মনিরপেক্ষতা' বা Secularism শব্দটা নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে হয়েছে বিকৃতিও। এই শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। 'Secularism'  এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের এবং অলৌকিকতার সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ অর্থাৎ কোনো অথবা কারোর পক্ষেই নয়। ধর্মনিরপেক্ষ মানে সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষেই  থাকবেনা, বরং সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না। কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। আবার উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- "The separation of religion and state is the foundation of secularism. It ensures religious groups don't interfere in affairs of state, and the state doesn't interfere in religious affairs." 


ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয় যার মূলে ছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকর মহাশয়। ১৯৭৬-সালের ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে 'Secular' শব্দটা যুক্ত করা হয় কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি- "With the Forty-second Amendment of the Constitution of India enacted in 1976, the Preamble to the Constitution asserted that India is a secular nation. However, the Supreme Court of India in the 1994 case S. R. Bommai v. Union of India established the fact that India was secular since the formation of the republic." 


ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে ' ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করে সে খানে লেখা হয়েছে - 

"We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens; "। অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি। আবার, প্রতিটি নাগরিকদের কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall be duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)"।


ভারত রাষ্টের সংবিধানের  তৃতীয় অংশে (Part- iii) ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানে নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights of Indian Constitution)

দেওয়া হয়েছে। যেমন - 

(১) সাম্যের অধিকার,

(২) স্বাধীনতার অধিকার, 

(৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার,

(৪) ধর্মীয় অধিকার, 

(৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, 

(৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।


আমজনতার বৃহৎ অংশ 'ধর্ম' বলতে উপাসনা / প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বলতে উপাসনাধর্ম বিষয়ক বই-পত্র কেই বোঝেন। অভিধানে 'ধর্ম' বা 'রিলিজিয়ন' (Religion) শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে – 

(১) ধর্ম মানে - সাম্প্রদায়িক, ঈশ্বর উপাসনা, রীতি-নীতি, ঈশ্বর এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। যেমন -হিন্দু, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি ৪২০০ প্রকার। 

(২) Religion [রিলি'জন]n. ধর্ম:  human recognition of a personal God entitled to obedience.. আবার। 

(৩) ধর্ম মানে - গুণ (Property) বৈশিষ্ট (Characteristic)। যেমন - আগুনের ধর্ম বা গুণ দহন, জলের ধর্ম বা গুণ তরলতা, তরোয়াল এর ধর্ম বা গুণ তীক্ষ্ণতা ইত্যাদি। ধর্মবিশ্বাস; any system of faith and worship বোঝায়।  


ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষানীতি হবে সম্পূর্ণ ধর্ম বর্জিত। রাষ্ট্রনায়কগণ কোনভাবেই প্রকাশ্যে ধর্ম-আচরণ করতে পারবেন না।  অনেকেই অনেকেই হয়তো জানেন না, এই শর্তকে লঙ্ঘন করলে অর্থাৎ রাজনীতি বা ভোটব্যঙ্কের স্বার্থে কোনো নেতামন্ত্রীরা প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ করে অ-ধর্মনিরপেক্ষ কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে থাকলে সংবিধানের "দ্য রিপ্রেজেন্টেসন অফ পিপলস অ্যাক্ট ১৯৫১" (অ্যামেন্ডমেন্ট ১৯৮৯) এর ২৯ক ধারায় ঐ নেতামন্ত্রী কিংবা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দলটির স্বীকৃতি খারিজ করার বিধান রয়েছে নির্বাচন কমিশনের হাতে। অন্যদিকে, ৩রা জানুয়ারি, ২০১৭ সালে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও প্রচার করা যাবে না। এছাড়া, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। 


ভারতীয় যেহেতু প্রতিটি মানুষকেই ধর্মীয় অধিকার দিয়েছে (২৫-২৮ ধারায়) তাই কেউ যেমন ব্যক্তিগত ধর্মচারণ করতে পারেন, তেমনই কেউ ধর্মহীন ভাবে জীবনে এগিয়ে চলতে পারেন (২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে বোম্বে হাইকোর্ট একটি রায় এ স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে, "State can compel none to declare or specify his/her religion. Citizens have Constitutional Right to belong to 'No Religion." অর্থাৎ, রাষ্ট্র কাউকে তার ধর্ম জানাতে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন বা কোনও ধর্ম পালন করেন না -- এই দাবী করার সাংবিধানিক অধিকার আছে প্রত্যেক নাগরিকের)। 


একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সাধারন মানুষ থেকে রাষ্ট্রনায়কগণ প্রকাশ্যে নয়, তবে ব্যাক্তিগত ভাবে ভাবে ধর্মাচরণ করতে পারেন। সংবিধানের এই কথাটা কে গ্রাহ্য করেন না কোনো রাষ্ট্রনেতাই। তাই তো,

ভোটনির্ভর বা গোদীলোভী রাজনৈতিক দল কেউই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার আসল চেহারাটা প্রকাশ করেন না নিজেদের রাজনীতির স্বার্থেই। ওরা ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে। ঝোলে- ঝালে- অম্বলে সবেতেই আছে। আসলে ভোটব্যাঙ্ক এর স্বার্থে কেউই আমজনতার তথাকথিত "ধর্মবিশ্বাস" কে আঘাত করতে চান না। ধর্ম শুধুমাত্র ঠিকে আছে শাষকগোষ্ঠি এবং তাঁদের চালিকাশক্তি পুঁজিপতিদের জন্যেই। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকারের দাবীর জন্য সংগ্রাম কিংবা ক্ষোভের আগুনে জল ঢ্লাতে আজ তাই "ধর্ম" হচ্ছে এক সুন্দর কার্যকর অস্ত্র। কারণ রাষ্ট্রশক্তি ভালো করেই জানেন ধর্ম নামক মারাত্বক আফিমের নেশায় ডুবে থাকা জনগণ কোনো প্রশ্নই তোলেন না, উলটে যুক্তি-বুদ্ধি সব বাক্সবন্দি করে রাষ্ট্রশক্তির হ্যাঁ তে 'হ্যাঁ' এবং না তে 'না' মেলায় শেখানো তোঁতাপাখির মতন। এইমূহুর্তে সেই গল্পটা মনে পরছে যেখানে পথচলতি একজন ব্যাক্তিকে একজন মাতাল প্রশ্ন করছে, "দাদা একটু ধর্ম হবে, বিড়ি জ্বালাবো? ব্যাক্তিটির অবাক হয়ে পালটা প্রশ্নের উত্তরে মাতাল টি জানায়, আরে দাদা ধর্ম দিয়ে তো দেশ জ্বলছে আর সামান্য একটা বিড়ি জ্বলবে না।" এটাই কিন্তু বাস্তব চিত্র। 


এক শ্রেণীর ধান্দাবাজ রাজনৈতিক ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মগজধোলাই এর কল্যাণে বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষবা Secular শব্দটির অর্থ - ধর্মের ক্ষেত্রে এক খাবলা নিরপেক্ষতা, দু-খাবলা পক্ষপাতিত্ব মিলিয়ে এক বিচিত্র স্ববিরোধীতার খিঁচুড়ি এবং সংবিধান রাস্তার পরে ধুলোয় খায় লুটোপুটি। 


 একটি রাষ্ট্রকে প্রকৃতঅর্থে  ধর্মনিরপেক্ষ বা Secular গড়ে তোলা খুব সহজও নয় আবার খুব যে কঠিন তেমনও নয়। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা। ভারতীয় জনতা পার্টির দাবী, পৃথিবীতে যদি ৫৫ টি মুসলিম রাষ্ট্র থাকতে পারে তাহলে ভারত কেন ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে? তাই, সংবিধানে সংশোধনী বিল এনে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে বাতিল করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতেই হবে। যারা এমন দাবী তোলেন তাঁরা এটা হয়তো ভুলে থাকতে চায়, একটি রাষ্ট্র, হিন্দু, ইসলাম কিংবা খ্রিষ্টান যাই হোক, সেখানে আমজনতা কি দারুন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছেন? বেকারত্ব কি মুছে গেছে কিংবা জাত-পাত বিভেদ কিংবা ধনী- গরিবের বিভেদ কি আদৌ দূর হয়েছে?


পাকিস্তানের কথাই ভাবুন। সেখানকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। শেখানে একশ্রেণীর মানুষ স্বাচ্ছন্দে থাকলেও একটা বড় অংশের মানুষই গরিব। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে আজপর্যন্ত কোনো নেতা-মন্ত্রী পারেন নি পাকিস্তান কে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিনত করতে এবং দেশের চিত্রটাকে আমূল বদলে দিতে। ১৯৭১ এর পর থেকে বাংলাদেশ কে ইসলামিক রাষ্ট্রে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে কৌশলে। সরকারেরও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় রয়েছে এই কাজে। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে ওপার বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে খুবই দুর্বল এবং বেকারত্বের হারও উর্ধমুখি। 


আজ থেকে বহুবছর আগে শ্রদ্ধেয় কবিগুরু তাঁর লেখার  মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন  - "দেশ মাটিতে নয়, মানুষে গড়ে ওঠে। দেশপ্রেম মানে দেশের মাটিকে ছুঁয়ে শপথ নেওয়া কিংবা একটা মানচিত্র কে ভালোবাসাও নয়। দেশপ্রেমের অর্থ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নিরন্ন, বিপন্ন মানুষের প্রতি প্রেম।" 


মোরা তোমাদেরই লোক, গরিবি হটাও ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে এইসব গরিবগুর্ব মানুষের প্রতি মিথ্যে প্রেম দেখিয়ে রাষ্ট্র কে ধর্মের মোড়কে মুড়ে ফেললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না, কোনদিনই হবে না, হতে পারেও না। একটি রাষ্ট্র কে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ গড়ে তুলতে গেলে যা করতে হবে তার একটা রুপরেখা তুলে ধরলাম। 


১- রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি, রাজনীতি ধর্মবর্জিত করতে হবে। সরকারি কিংবা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নেতার জীবনী পাঠ, ধর্মীয় শ্লোগান, পঠন-পাঠনে ধর্মীয় নেতাদের জীবনী এবং প্রতিষ্ঠানিক ধর্মচেতনা বৃদ্ধিকারী বিষয় অন্তর্ভুক্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। 

সংবিধানের ২৮ নং ধারায় ভারত রাষ্ট্রের "ধর্মনিরপেক্ষ"  চরিত্রের প্রতিফলন আছে। এতে বলা হয়েছে- 

ক) সম্পূর্ণভাবে সরকারী অর্থে পরিচালিত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া চলবে না।

খ) ১ নং উপধারায় বর্ণিত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্থাপিত হয়েও যদি সরকার দ্বারা পরিচালিত বা প্রশাসিত হয় তবে নিজস্ব মতে ধর্মশিক্ষা দিতে পারবে না।

গ) নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে কোন শিক্ষাপ্রার্থীকে সরকারী অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা বা নির্দেশনামা গ্রহনে বাধ্য করা যাবে না।

২- আমজনতার দেওয়া করের টাকায় হজ যাত্রা,ইমাম কিংবা পুরোহিত ভাতা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

৩- যেহেতু, সংবিধানগতভাবে শুধু পদাধিকারী নন, কোনও দলও প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচরণ করতে পারেন না সেইজন্য এ-বিষয়ে কঠোর ভাবে নজর রাখতে হবে।  

৪- Secularism শব্দটার বিকৃত নয়, বরং প্রকত অর্থ টা ঠিক কি সেটা আমজনতাকে বোঝাতে সর্বধর্মসমন্বয়ের গালগল্প ছেড়ে বাস্তব সংজ্ঞাটাকে গ্রহণ করতে হবে। 


৫- উৎসবের অযুহাত দেখিয়ে কোনো নেতা-মন্ত্রীর প্রকাশ্যে কোনো পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন, ইফতার পার্টি কিংবা অন্যকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ায় কঠোর হতে হবে। 

৬- ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরিহ পশুদের হত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে। কেউ প্রকাশ্যে পশুবলি বা কুরবানি দিচ্ছে জানতে পারলে সেই ব্যাক্তিকে "দ্য ক্রুয়েলটি টু এনিম্যাল অ্যাক্ট ১৯৬৯" অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে কিংবা এই বিষয়ে সচেতন করতে কোনো পন্থা গ্রহণ করতে হবে। 

৭- সরকারি অর্থ অর্থাৎ আমজনতার দেওয়া Tax এর টাকায়, সমস্ত প্রকার ধর্মীয় অনুষ্টান বন্ধ করতে হবে এবং পুলিশ লাইনে কোন উপাসনালয় তৈরী হওয়া আটকাতে হবে। দুরদর্শনের মতন সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। 

৮-  সরকারি অথবা বে-সরকারি আবেদনপত্রে কোনও ব্যাক্তির Religion এবং Cast জানতে চাওয়া চলবে না। যারা নাস্তিক অথবা ধর্মহীন তারা যেমন সরকারি বা বে-সরকারি ফর্মের Religion কলামে HUMANISM, ATHEISM ইত্যাদি লেখেন তেমন লিখতে পারার অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, এপ্রিল ২০২১ এ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে -"১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো ভারতীয় নাগরিক তার ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে বলে সংবিধানে অধিকার দেয়া রয়েছে"। 

৯- কোনো রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক কাজের সাথে জড়িত থাকলে অথবা  সাম্প্রদায়িক, বিদ্বেষমূলক, উস্কানিমূলক বক্তব্যে রাখলে ১৯৫১ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল (এমেন্ডমেন্ট ১৯৮৯) অ্যাক্ট এর ২৯ (এ) ধারা মতে সেই রাজনৈতিক নেতার কিংবা পুরো দলের স্বীকৃতি খারিজ করতে হবে।

১০- বিজ্ঞানের পঠন-পাঠন এর যায়গায়, বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে, স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্তপ্রকার ধর্মীয় আলোচনা, ধর্মগুরুদের জীবনীপাঠ এবং অবৈজ্ঞানিক বিষয়ের প্রচার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সংবিধান স্বীকৃত বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রচার এবং প্রসারে রাষ্ট্র যদি ব্যার্থ হয়,তাহলে কোনো ব্যাক্তি কিংবা সংগঠনের এই কাজে কোনরকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না রাষ্ট্র সেদিকে নজর দিতে হবে। 

প্রিয় পাঠক, একবার গভীরভাবে ভাবুন তো, ওপরের ১০ টি পয়েন্ট কি খুবই কঠিন নাকি খুবই সহজ? অপ্রিয় সত্যি এটাই যে, রাষ্ট্রশক্তি চাইলে  আমজনতাকে মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক গড়ে তুলতেই পারে। কিন্তু কেন করেনা জানেন, কারণ রাষ্ট্র বেশ ভালো মতই জানে যারা অন্ধবিশ্বাস, ভাববাদ, ঈশ্বরবাদ ইত্যাদিকে আকঁড়ে ধরে থাকেন তাঁরা কোনদিনই শোষণমুক্তির কথা চিন্তাতেই আনে না। সেবা দিয়ে যেমন শোষণমুক্তি ঘটানো সম্ভব নয়, তেমনই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ, নেতৃত্বহীন জনগণ কোন প্রশ্নই তোলে না। আর এভাবেই শাষণ -শোষণ- তোষণের রাজনীতি করে, আমজনতাকে ধর্মের নেশায় ডুবিয়ে রেখে বিদেশের সুইসব্যাঙ্ক ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। আমজনতার বৃহত্তর অংশ যদি নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে সরব হয় তাহলে শোষণ প্রক্রিয়াটাই ব্যাহত হয়। 

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে মন্দির-মসজিদ-গীর্জা - গুরুদ্বার -গুম্ফায় গিয়ে প্রকাশ্যে ধর্মচারণ এবং প্রচারমাধ্যমে সেসব ফলাও করে প্রচার করা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে প্রকাশ্য রাজপথে বিফ খেয়ে কতটা ধর্ম -নিরপেক্ষ প্রমাণ করাও নয়, এটা তখনই ভালো যখন দুই ধর্মের মানুষকে নিয়ে বিফ এবং পর্ক দুটোই একসাথে খাওয়া অথবা কে বিফ খেলো, কে পর্ক খেলো সেসব না দেখে, কে সারাদিন অভুক্ত রইলো সেদিকে বেশি নজর দেওয়া। সর্বধর্মসমন্বয়ের গল্পো শুনিয়ে ধর্মের নামে বিদ্বেষ,হিংসা টাও ভণ্ডামি, তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে দুদুও খাবো আবার তামুকও খাবো, কিংবা ধর্মে ও জিরাফে একত্রে সহাবস্থানও নয়। ধূলো জমে থাকা ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রয়োগ করতে আন্তরিক হলে ভণ্ডামো ছেড়ে এই শব্দটাকে সংবিধানের পাতা থেকে তুলে এনে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করতেই হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষর প্রকৃত সংজ্ঞাটা এসে যদি বিকৃত হওয়া সংজ্ঞাটা তার চরিত্র হারায় এবং কেউ আন্তরিকভাবে এর প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হন তাহলেই এই লেখা স্বার্থক।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও আইন -মধুসূদন মাহাত
Nov. 19, 2024 | আইন | views:4620 | likes:3 | share: 0 | comments:0

বাল্যবিবাহ কী:- পরিণত বয়সের আগেই বিবাহ করলে, তাকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। ভারতে কোন মেয়ে আঠারো বছরের নিচে এবং ছেলে একুশ বছরের নিচে বিয়ে করলে তাকে বাল্যবিবাহ হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে উভয়ের একুশের নিচে হলেই বাল্যবিবাহ বলে গণ্য হবে।

বাল্যবিবাহের পরিসংখ্যান:- বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার যেখানে 29 শতাংশ, সেখানে ভারতে 58 শতাংশ। ইউনিসেফ -এর সমীক্ষা অনুযায়ী 43 শতাংশের বিয়েই 18 বছরের আগে হয়েছে। প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন - তপশিলী জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসরদের ক্ষেত্রে 70% মেয়েদের বিয়ে হয় নাবালিকা বয়সেই। বাল্যবিবাহ যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি  তার মধ্যে 6 নম্বরে আছে ভারত।

বাল্যবিবাহের কারণ:- বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা,  ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং বিজ্ঞান সচেতনতার অভাব। বেশী বয়স পর্যন্ত মেয়েকে বাড়িতে রাখলে, মেয়ে কোন অযাচিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে বা অবিবাহিত বলেই তার উপর কোন আক্রমণ সংঘটিত হলে পারিবারিক বা সামাজিক সম্মাণ নষ্ট হতে পারে এই আশঙ্কায় মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরা হয়ে রয়েছে। আবার, বেশী বয়সে বিয়ে হলে, বিয়ের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়  দ্রুত বিয়ে অনেক পরিবার। এছাড়াও রয়েছে ধর্মীয় রীতি মেনে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার বিধি। ধর্মীয় রীতি মেনে চলতে ইসলামিক দেশগুলো বোধ হয় এগিয়ে। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে যে 5 টা দেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বোচ্চ তা হল - নাইজার (75%), চাদ (72%), মালি (71%), বাংলাদেশ (64%), গিনি (63%)। এবং এই পাঁচটা দেশের প্রত্যেকটি ইসলাম প্রধান রাষ্ট্র। সর্বোপরি, কম বয়সে বিয়ে দিলে, বিশেষ করে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির এবং তার সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির যে সম্ভাবনা রয়েছে তা সম্বন্ধে অজ্ঞতাই বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন:- বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ভারতে প্রথম বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন আনা হয় 1929 সালে - "Child Marriage Registry Act, 1929" বা  "বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন - 1929"। এই আইন অনুসারে পাত্র পাত্রীর বিয়ের বয়স যথাক্রমে 21 এবং 18 করা হয়েছিল । এর থেকে কম বয়সে বিয়ে দিলে, যারা এই বিয়ের উদ্যোক্তা অর্থাত্ বাবা -মা ছাড়াও বিয়েতে উপস্থিত আত্মীয় স্বজন ও পুরোহিতের, এমনকি যারা এই বিয়েতে কোনভাবে সাহায্য বা আর্থিক সাহায্য করে থাকে, তাদের শাস্তির বিধান রয়েছে। 1929 সালের এই আইনে শাস্তির বিধান ছিল জরিমানাসহ তিনমাসের কারাবাস। পরে 2006 সালের " The Prohibition of Child Marriage Act, 2006" তে এই শাস্তি বাড়িয়ে 2 বছর কারাবাস অথবা একলক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয়ই হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর এই আইন আরও সংশোধন করে মেয়ের বিয়ের বয়স ন্যুনতম 21 বছর করা হয় - "The Prohibition of Child Marriage (Amendment) Act, 2021 তে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কীভাবে করবেন:- বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের ও সরকারের সচেতনার কাজ সব সময় জারী রাখতে হবে। তবে এর বিরুদ্ধে কাজ করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখতে হবে এটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। কাজেই সাবধানতা খুব প্রয়োজন। 

 একজন নাবালিকা নিজে অভিযোগ করলে ভালো কথা এবং তা অন্যের কাজ করার বা তাকে সহযোগিতা করার পক্ষে সুবিধাজনক। কিন্তু, কোন প্রতিবেশী বা বাইরের কেউ কখনোই থানাতে এবং বিডিও অফিসে বিশেষ করে নিজের এলাকার বিডিও বা থানাকে জানাবেন না, কারণ এদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি, ফলে আপনার নাম ও ঠিকানা ফাঁস করে দিতে পারে। যারফলে অভিযুক্ত পরিবারের আক্রমণের শিকার হতে পারেন। অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি - জেলার সমাজ কল্যাণ আধিকারিক, মহকুমা শাসক এবং বর্তমানে চাইল্ড লাইন তথ্য গোপণ রেখে কাজ করে, তাই এদের জানানো বেশি নিরাপদ। এছাড়া আপনি যুক্তিবাদী সমিতিকে জানালেও তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া জেলা শাখা কয়েক বছরে গোপণে ও প্রকাশ্যে দুশোরও বেশি বাল্যবিবাহ বন্ধ করে সমাজে কড়াবার্তা দিতে পেরেছে, ফলে অনেক পরিবারকে বাল্যবিবাহ দিতে গিয়ে  পিছিয়ে আসতে হচ্ছে। তবে বাল্যবিবাহের কোন অভিযোগ থাকলে বিয়ের কিছুদিন আগেই জানান, তাতে করে পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতিটা এড়ানো যাবে এবং সফলতার হারটাও বেশি হবে।

 

পকসো আইন

শিশুদের প্রতি যাতে কোনও ধরণের যৌন অপরাধ না হয়, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে আইন, তাকেই "পকসো" (POCSO) বলা হয়। পুরো নাম, "দ্য প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট ২০১২"।  শুধু নিরাপত্তা দেওয়া নয়, কোনও শিশুর প্রতি কোনওপ্রকার যৌন অপরাধ ঘটলে কীভাবে বা কি পদ্ধতিতে তার বিচার হবে, কোন আদালতে তার বিচার হবে, কোন পদ্ধতিতে শিশুটির সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে, কোন পদ্ধতিতে তদন্ত হবে, শিশুটির চিকিৎসা কীভাবে হবে–ইত্যাদি বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে এই আইনে।


পকসো আইনে ১৮ বছরের নিচে বাচ্চাদেরই শুধু শিশু বলে গণ্য করা হবে। এখন দেখা যাক এই আইনে কী কী শাস্তির বিধান আছে।

1. যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৭ থেকে ১০ বছরের জেল ও জরিমানা। সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও জরিমানা।

2. যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা ৩ থেকে ৫ বছরের কারাবাস। সর্বোচ্চ সাজা ৫ থেকে ৭ বছরের কারাবাস ও জরিমানা।

3. অশ্লীল কাজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৫ বছর জেল ও জরিমানা। সর্বোচ্চ ৭ বছর জেল ও জরিমানা। এছাড়াও আইনে বলা হয়েছে

4. যৌন হয়রানির শিকার শিশুর জবানবন্দী নিতে হবে তার বাড়ি বা পছন্দমত স্থানে। এই মামলায় প্রাধান্য দিতে হবে মহিলা পুলিশ আধিকারিককে।

5. রাতে শিশুকে থানায় আনা যাবে না।

6. জবানবন্দির সময় পুলিশ ইউনিফর্ম পরে থাকা চলবে না।

7. শিশুর কথা শুনে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে হবে। শিশুর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নেওয়া যাবে না।

8. প্রয়োজনে জবানবন্দির সময় শিশুটির জন্য দোভাষীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

9. শারীরিকভাবে অক্ষম শিশুর জবানবন্দি নেওয়ার সময় পরিবারের লোকের সাহায্য নিতে হবে।

10. মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় শিশুর মা–বাবা কিংবা বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপস্থিতি দরকার।

11. নির্যাতিতা মহিলা হলে, মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় মহিলা চিকিৎসক থাকতে হবে।

12. বিচার চলাকালীন শিশুর বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে হবে।

13. কোনও উত্তেজনামূলক প্রশ্ন শিশুকে করা যাবে না।

14. নির্যাতিতা শিশুর নাম বিচারের সময় গোপন রাখতে হবে।

15. বিশেষ আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই খবর প্রকাশ করা যাবে না।

16. বিশেষ জুভেনাইল পুলিশ দল ২৪ ঘণ্টার ভিতরে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিকে পুরো ঘটনা জানাতে হবে। 

17. শিশুটির গুরুতর আঘাত বা ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ এর ব্যবস্থা করতে হবে।

18. অপরাধের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শিশুর কাছে যা প্রমাণ আছে, তা আদালতে নথিভুক্ত করতে হবে। সম্প্রতি এই আইনের বিশেষ সংশোধনী আনা হয়েছে। একটি সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পকসো আইনের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। নৃশংসতায় দোষীর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। পাশাপাশি, চাইল্ড পর্নোগ্রাফি রুখতেও পকসো আইনে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।


সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম-এর আওতায় কী কী পড়ে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি, ফেসবুক এখন সবার হাতের নাগালে। খুব কম খরচে ফেসবুক ব্যবহার করা যায় আমাদের দেশে এখন। প্রযুক্তির এই ছোঁয়ায় আমাদের দেশ বদলেছে অনেক। কিন্তু এই ফেসবুকের মাধ্যমে করা ক্রাইম এখন বেড়েই চলেছে। সহজলভ্য হয়ে পড়ায় ফেসবুকে সাইবার ক্রাইম এখন আমাদের দেশে অনেক বড় একটি সমস্যা। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সাইবার ক্রাইম আমাদের দেশে। আমাদের অজান্তেই আমরা সাইবার ক্রাইমেরর শিকার হয়ে যাচ্ছি। অনেকেই মুখ বুঝে সহ্য করেই যাচ্ছেন, কিন্তু জানেন না যে কিভাবে কি করতে হবে। আজকে আমি আসলে আপনাদের সাথে কথা বলবো কখন আর কিভাবে বুঝবেন যে আপনি ফেসবুকে বা সামাজিক গণমাধ্যমে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন বা কখন আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

১. সাইবার বুলিং-

কেউ যদি অনলাইনে আপনাকে অহেতুক জ্বালাতন করে এবং আপনার সম্মানহানি করার চেষ্টা করে অথবা অনলাইনে যেকোনো উপায়েই হোক কেউ যদি আপনাকে উত্যক্ত করে তাহলে তা সাইবার বুলিং হিসেবে স্বীকৃত। সেক্ষেত্রে তা যদি অনলাইনে হয় তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।


২. আইডি হ্যাক-

আপনার ফেসবুক আইডি কেউ যদি হ্যাক করে থাকে আর আপনার ব্যক্তিগত ছবি আর কথোপকথন অনলাইনে ছেড়ে দেবে বলে যদি হুমকি প্রদান করে, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য তার বিনিময়ে যদি সে আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সেক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।


৩. সেক্সুয়ালি এবিউজ-

কেউ যদি অনলাইনে আপনার ছবি দিয়ে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আইডি খুলে, আপনার ছবি ব্যবহার করে কোনো পোস্ট প্রদান করে। আপনার ছবির সাথে অন্য ছবি জোড়া লাগিয়ে বিতর্কিত কিছু বানোয়াট খবর প্রকাশ করে, আপনার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করে, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য তার বিনিময়ে যদি সে আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সেক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।


৪.হ্যাকিং-

অনলাইনে ডাটা বা তথ্য অনুমতিবিহীন চুরি, ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় হ্যাকিং। এতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ক্ষুন্ন হয়।

এ রকম আরো অনেক কিছুই রয়েছে। তবে এখন নাগাদ এই সমস্যাগুলোই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে ফেসবুকে সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়ার সংখ্যাই অনেক বেশি। এর বাইরেও অনেক রকমের সাইবার ক্রাইম রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে অনলাইন বা ইন্টারনেটে অনেক রকমের হয়রানি। নিচে অনলাইনের হয়রানির ধরনগুলো দেওয়া হলো:


• সামাজিক মাধ্যমে ফেক আইডি খুলে জ্বালাতন

• সামাজিক মাধ্যমের আইডি, ইমেইল অথবা ওয়েব সাইট হ্যাক

• সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ট্রল গ্রুপ বা পেজে ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়া

• বিভিন্ন পর্নো ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ধারণ করা ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া

• সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি

• ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান ও হয়রানি

• কাউকে মারধর করে তার ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া

• কোনো কিশোরী বা যুবতী বা নারীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে তার ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া

• অনলাইনে ইকমার্সের নামে ভুয়া পেজ খুলে খারাপ পণ্য বিক্রির নামে হয়রানি

• অনলাইনে পরিচিত হয়ে অনলাইন কারেন্সি ট্রাঞ্জেকশন করতে গিয়ে ফ্রডের শিকার

• ভুয়া বিকাশ নম্বর থেকে ফোন করে লটারির কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ

• ভুয়া বিকাশের এসএমএস দিয়ে গ্রাহককে দিয়েই অভিনব কায়দায় প্রতারণা

• অনলাইনে ব্যাংক একাউন্ট আর এটিএম কার্ডের ডিটেইলস চুরি করে অর্থ চুরি

• অনলাইনে স্প্যামিং এবং গণ রিপোর্ট

• অনলাইনে স্ক্যামিং

• অনলাইনে বিভিন্ন সেলেব্রেটি বা মানুষের নামে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বা খবর প্রচার


কোনও ব্যক্তি সরকারের বিরুদ্ধে ফেইসবুকের একটি অশ্লীল বিবৃতি পোস্ট করলে সেটি কি একটি অপরাধ হতে পারে?

-হ্যাঁ, অবশ্যই হতে পারে যদি সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ বিবৃতি হতাশা সৃষ্টি করে, সম্মান হানি ঘটায় এবং বিবৃতিটি যদি।ব্যক্তির বা সরকারের ক্ষতির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় তবে এটি সাইবার মানহানির আওতায় পড়ে এবং এটি IPC ধারা 499 এব‌‌্ তথ্য প্রযুক্তি আইন, 2000 এর ধারা 4 এর অধীনে দন্ডযোগ্য অপরাধ।


যদি একজন ব্যক্তি ফেসবুক, ইমেল বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির হয়রানির উদ্দেশ্যে অন্য ব্যক্তিকে অনুসরণ করে তবে তা কি অপরাধমূলক অপরাধ হতে পারে?

-হ্যাঁ, যদি ব্যক্তিটি হয়রানির উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তিকে অনুসরণকরে বা অপ্রত্যাশিত ফ্যাশনে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে তবে এটি সাইবার স্টকিংয়ের নামক একটি অপরাধ এবং সেকশন 503 আইপিসি অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

যদি কোন ব্যক্তিকে সোশ্যাল সাইট এর মাধ্যমে ধমকি, অশ্লীল কথাবার্তা, হ্যাকিং, এটিএম কার্ড জালিয়াতির শিকার হতে হয় তবে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে?

-যদি কোন ব্যক্তি কে সোশ্যাল সাইট এর প্রকোপে পড়ে তবে তিনি জেলার সাইবার ক্রাইম থানায় জানাতে পারেন অথবা তিনি স্থানীয় পুলিশ অফিসে গিয়ে পুলিশ কর্তা কে লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন।


Some General Legal Information regarding Cyber crime or Computer Crime:---

New technologies create new criminal opportunities but few new types of crime. The information and Communication technologies revolutionized with the invention of the computer and computer has been a boon to the human community, but the same computer is an instrument to aid criminals. Therefore, certain well known crimes like unauthorized access to information, damage to property, distribution of obscene and indecent material etc. have assumed different dimensions with the emergence of Internet. Most cybercrime is an attack on information about individuals, corporations, or governments. Although the attacks do not take place on a physical body, they do take place on the personal or corporate virtual body, which is the set of informational attributes that define people and institutions on the Internet. In other words, in the digital age our virtual identities are essential elements of everyday life: we are a bundle of numbers and identifiers in multiple computer databases owned by governments and corporations. Cybercrime highlights the centrality of networked computers in our lives, as well as the fragility of such seemingly solid facts as individual identity.


What is Cyber Crime or Computer Crime?

Cyber crime is an act of creating, distributing, altering, stealing, misusing and destroying information through the computer manipulation of cyberspace without the use of physical force against the will or the interests of the victim. Cyber crime include variety of criminal offences and unlawful activities related to or having connection to computer or a traditional crime which has been transformed by the use of a computer related crimes such as criminal threats, internet auction, hacking of bank accounts, cloning of ATM card, cyber stalking, cyber defamation, email spoofing, morphing, phishing etc.

 Whether posting a statement in facebook against any person or against the government is a crminal offence?

If the particular statement against the government is causing defamation and the statement is made with the intention of causing harm to the reputation of such person or government then it amounts to cyber defamation and it's a punishable offence under Section 499 of the Indian Penal Code read with section 4 of the Information Technology Act,2000.


If a person is following another person through facebook, email, or other social media with the intention of harassing the other person in unsolicited fashion then is it a criminal offence?

Yes, if the person is following te other person via internet with the intention of harassment or to contact another in an unsolicited fashion then it's a crime called as Cyber Stalking and is punishable under section 503 IPC


সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ সংক্রান্ত কিছু সাধারণ আইনি তথ্য:

-Sabnam & Associates Law Firm


বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। বিজ্ঞানের অবদানে এসেছে নানা নতুন প্রযুক্তি। আর এই প্রযুক্তিই নতুন অপরাধমূলক কার্যকলাপের ধারক ও বাহক। কম্পিউটার ও বিভিন্ন সোশ্যাল সাইট গুলো আবিষ্কারের সাথে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপুল বিপ্লব ঘটিয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের জন্য এটি যেমন আশীর্বাদ স্বরূপ ঠিক তেমন‌ই কিন্তু এই কম্পিউটার অপরাধীদের সহায়তা করার জন্য একটি যন্ত্র‌ও বটে। কম্পিউটার আবিষ্কারের সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে মানব সম্প্রদায়ের জন্য একটি আশীর্বাদ স্বরূপ, কিন্তু একই কম্পিউটার অপরাধীদের সহায়তা করার জন্য একটি যন্ত্র‌ও বটে। অতএব, নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য অননুমোদিত অ্যাক্সেস, সম্পত্তি ক্ষতি, অশ্লীল মেসেজ, ছবি বিতরণ ইত্যাদি সুপরিচিত অপরাধ ইন্টারনেটের উত্থানের সাথে বিভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করেছে। সর্বাধিক সাইবারক্রাইম ব্যক্তি, কর্পোরেশন, বা সরকার সম্পর্কে তথ্যর উপর একটি আক্রমণ যদিও কোনও শারীরিক শরীরের আক্রমণগুলি সংঘটিত হয় না, তবে এটি ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট ভার্চুয়াল শরীরের উপর সঞ্চালিত হয়, যা তথ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলির সেট যা ইন্টারনেটে মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংজ্ঞায়িত করে। অন্য কথায়, ডিজিটাল যুগে আমাদের ভার্চুয়াল পরিচয় দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য উপাদান: আমরা সরকার এবং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন একাধিক কম্পিউটার ডেটাবেসে সংখ্যা এবং সনাক্তকারীর একটি বান্ডিল। সাইবারক্রাইম আমাদের জীবনে নেটওয়ার্কে কম্পিউটারের কেন্দ্রিকতা তুলে ধরে, সেইসাথে স্বতন্ত্র পরিচয় হিসাবে যেমন আপাতদৃষ্টিতে কঠিন তথ্যগুলির তার বাস্তব রুপ।


সাইবার ক্রাইম বা কম্পিউটার অপরাধ কি?

সাইবার অপরাধটি মূলত শারীরিক শক্তির ব্যবহার না করে সাইবার স্পেসের সাহায্যে কম্পিউটার ম্যানিপুলেশন দ্বারা তথ্য তৈরি, বিতরণ, পরিবর্তন, চুরি, অপব্যবহার এবং ধ্বংসাত্মক মূলক কাজ। সাইবার অপরাধ বিভিন্ন ধরণের কম্পিউটারের সাথে সম্পর্কযুক্ত যেমন ইন্টারনেট নিলাম, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হ্যাকিং, এটিএম কার্ড ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে রূপান্তরিতকরণ, সাইবার স্টকিং, সাইবার ডিফাম্যামটেশন, ইমেইল স্পুফিং, মর্ফিং, ফাউজিং ইত্যাদি।


পণপ্রথা বিরোধী আইন নিয়ে কিছু আলোচনা।

পণ, যৌতুক অথবা দান যাই বলুন সবই এক। বিয়েতে পাত্রীর অভিভাবকের তরফে পাত্রকে যৌতুক দেওয়ার আচার বা রীতি বহুযুগ পুরোনো একটি প্রথা। আমার ওকালতির জীবনে বেশকয়েকটি বধূহত্যা এবং বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা চাক্ষুষ করেছি এবং আইনি লড়াইও লড়েছি যার প্রধান কারন, পাত্রপক্ষর দাবী বা ইচ্ছানুযায়ী পণ না দেওয়ার জন্যে পাত্রী বা বধূর ওপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। 

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- "যৌতুক বা পণ হল কন্যার বিবাহে পিতামাতার সম্পত্তির হস্তান্তর প্রক্রিয়া। 'যু' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন 'যুত' শব্দের অর্থ যুক্ত; বুৎপত্তিগত অর্থ হলো, পাত্র-পাত্রীর যুক্ত হওয়ার সময়ে অর্থাৎ বিয়ের সময় পাত্রীর জন্য যা কিছু মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হয়, তা যৌতুক।" 

উইকিপিডিয়া আরো জানাচ্ছে- "পণ মৃত্যু বলতে বোঝায়, যৌতুক বা পণ নিয়ে বিবাদের ফলে বিবাহিত মহিলার, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির ক্রমাগত হয়রানি ও অত্যাচারের স্বীকার হয়ে অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়ে মৃত্যু। ২০১০ সালে ভারতে সর্বোচ্চ ৮,৩৯১ টি পণ মৃত্যু সংঘটিত হয়েছিল, অর্থাৎ প্রতি ১০০,০০০ মহিলার মধ্যে ১.৪ জনের মৃত্যু। ভারতে প্রতি বছর নারী হত্যার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই পণ মৃত্যুর ঘটনা, যা ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটি স্থিতিশীল প্রবণতা হিসেবে দৃশ্যমান।" 


'দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর' তথ্য অনুযায়ী, ভারতে পণ মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১২ সালে সমগ্র ভারতে ১৮,২৩৩ টি পণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এর অর্থ প্রত্যেক ৯০ মিনিটে একজন বধূকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। 


ভারতীয় দণ্ডবিধির সেকশন ৩০৪বি এবং ৪৯৮এ ধারায় পণপ্রথাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে জেলও হতে পারে। তাই কোনও বিবাহিত মহিলা যদি মনে করেন তার শ্বশুরবাড়ি অকারণে পণ নিচ্ছেন বা পণের জন্য তাঁকে কোনওরকম শারীরিক কিংবা মানসিক অত্যাচার করছেন তাহলে তিনি নির্দ্বিধায় মামলা করতে পারেন। 


তবে জেনে রাখা ভালো, পণপ্রথা বিরোধী আইনের (The Dowry Prohibition Act, 1961) অপব্যবহার হচ্ছে। এমনও বেশকয়েকটি ঘটনা আমার জীবনে চাক্ষুষ হয়েছে যেখানে উচ্চবিত্ত পাত্রপক্ষ বধূহত্যা করেও শুধু টাকার জোরে আইনকে পকেটবন্দি করে বুকফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং প্রত্যন্ত গ্রামের কিংবা শহরের শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত অসংখ্য মহিলারা উক্ত আইনের বিষয়ে  অজ্ঞতার কারনে এবং আইনি পক্রিয়া চালানোর খরচের অভাবে নির্যাতন, লাঞ্ছনা, অপমান সহ্য করে বেঁচে থেকেছে। আবার এমনও অনেক পাত্র আছেন যারা বিয়েতে যৌতুক বা পণ নেওয়াকে তাচ্ছিল্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে নয়তো মাত্র এক টাকা কয়েন নিয়েছে দান হিসেবে। এটি কু নাকি সু-প্রথা সেই নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত। দুঃখ লাগে যখন দেখা যায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কোনো উচ্চশিক্ষিত পুত্র সন্তান নিজের বিয়েতে নির্লজ্জভাবে হাত পেতে মোটা অঙ্কের অর্থ থেকে দানসামগ্রী, যৌতুক হিসেবে নেয়। 

পরিশেষে, এটাই বলতে চাই নারীদের উচিৎ নিজেকে অবলা, দুর্বল না ভেবে নিজেদের চেনা এবং জানা। তাদের উচিৎ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা বিদ্যাসাগর, রামমোহনদের। এই দুজন অসামান্য ব্যক্তিত্বরা বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বিধবাবিবাহ প্রচলনের কারনে আজও বহু মহিলারা ডিভোর্সি তকমা ঘুচিয়ে ফের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্মানের সাথে সংসার করছেন। 

জেনে রাখুন কিছু আইন-

১) ভারতীয় রেলওয়ে আইন ১৯৮৯ অনুযায়ী, ১৩৭ ধারা-  বৈধ নথিপত্র বা পাস ছাড়া রেলভ্রমণ, ১৪১ ধারা- বিনা কারণে চেন টানা, ১৪৪ ধারা- পণ্য ফেরি করা, ১৪৫ ধারা- অশালীন আচরণ করা, ১৪৭ ধারা- অনধিকার প্রবেশ এবং তা থেকে বিরত থাকতে ব্যর্থ হওয়া, ১৫৭ ধারা- টিকিট বা রেলের পাস বিকৃত বা অবৈধ সংশোধন করা, ১৫৯ ধারা- রেলের এলাকায় চালকদের নির্দেশ অমান্য করা, ১৬২ ধারা- মহিলা কামরায় অবৈধ ভ্রমণ, ১৬৬ ধারা- আবর্জনা সৃষ্টি করা এবং ১৬৭ ধারা- যাত্রী এলাকায় ধূমপান করা ইত্যাদি রেলওয়ে আইনের মোট ১৬টি ধারা সংশোধনের পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। এছাড়া, বিনাটিকিটে রেলভ্রমণে শাস্তির তালিকা থেকে হাজতবাস তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা এবং তার বদলে শুধুমাত্র আর্থিক জরিমানা ধার্য করার রীতি চালু করতে উদ্যোগ নিতে চলেছে ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। 

সূত্র- ১৭ জুন ২০২০, হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা অনলাইন।


২) বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪৪ নং অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ধারা ৪৫ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উক্ত দুই ধারা অনুযায়ী বুজরুক জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, গুণিন, ওঝা ইত্যাদিদের জেল অবধারিত। কারন, প্রথমত বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা জনগণকে প্রলুব্ধ এবং বিভ্রান্ত করে প্রতারণা করেন এবং বিষাক্ত সাপের কামড়ের পরে নিজদের কেরামতি দেখানোর নামে অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।


৩) ২২ জুন ২০০৩ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে - রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা যাঁরা করেন, তাঁরা নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটা কোনো ভাবেই ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ এই চিকিৎসা পদ্ধতির কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রক স্পষ্ট করে এটাও জানিয়েছে যে, রেইকি সহ জেম থেরাপি, কালার থেরাপি, ম্যাগনেটোথেরাপি,আরোমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি ইত্যাদি তথাকথিত প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিই বে-আইনি এবং এইসব পদ্ধতি শেখানো কিংবা প্রয়োগকারী ব্যাক্তি কোনো ভাবেই নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটাকে ব্যবহার করতে পারবেন না। ভারতে দুটো জোরালো আইন আছে বুজরুকি চিকিৎসার বিরুদ্ধে। আইন দুটি হল " (1) The Drugs & Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 

এবং (2) The Drugs And Cosmetics Act (Amendment) 1940।" The Drugs And Cosmetics Act 1940, Amendment GSR 884 (E) এই মর্মে ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের 'স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর'।  এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।


৪) সাপের কামড়ে কোনও রোগীর যদি মৃত্যু ঘটে –মৃত ব্যক্তির পরিবার এককালীন ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। কোন রোগী মারা গেলে সরকারী হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার “মৃত্যুর কারণ যে সাপের কামড়” এই মর্মে শংসাপত্র প্রদান করবেন কারণ সাপে কামড়ে মৃত ব্যক্তির পরিবারের প্রাপ্য ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নয় এই শংসাপত্রই চলবে।(সরকারী অর্ডার নং- ১৫৬১(১৯)F.R/৪P-৩/০৪ date ১৯.৮.২০০৮)।


৫) কোনো মহিলাকে যদি তার স্বামী অকারণে মারধর, গালিগালাজ করেন, শ্বশুরবাড়িতেও প্রতিনিয়ত অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয় তবে অবশ্যই হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের ১৩ নং ধারা অনুযায়ী মামলা করতে পারেন অত্যাচারিত মহিলা। সেই সঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ নং ধারা অনুযায়ী মেয়েরা নিজের জন্য এবং সন্তানের জন্য খোরপোশ (financial maintenance) দাবি করতেই পারেন (স্বামীর রোজগার অনুযায়ী খোরপোশ নির্ধারণ করা হয়)। যদি একান্তই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে থাকে তাহলে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ১৪ নং ধারা এবং হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের ২৭ নং ধারা অনুযায়ী স্ত্রী, ডিভোর্সের পর নিজের যাবতীয় জিনিস ফেরত পাবেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে। গয়না, আসবাব, ফ্রিজ, টিভি-সহ যা কিছু তাঁর অভিভাবক যৌতুক হিসেব দিয়েছেন বিয়েতে সবেতেই অধিকার একমাত্র স্ত্রীর। এছাড়াও নিজের জিনিস ফেরত পেতে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট- এ মামলা করতে পারবেন।


৬) এই একুশ শতকে শুধু ভারতেই নয় পৃথিবীর বহু দেশে কন্যার জন্মকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। তাই আজও ভারতে কন্যাভ্রুণ (Female feticide) হত্যার ঘটনা যথেষ্ট পরিমাণে শোনা যায়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বা ইউএনএফপিএর জুন মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে ভারতে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ মেয়ে 'নিখোঁজ' হয়ে গেছে। প্রতি বছর দেশটিতে গর্ভপাত ঘটিয়ে ৪৬ লাখ কন্যা ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলা হয় এবং জন্মের পর কন্যা শিশুদের ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করার কারণে জন্মের পর কন্যা শিশুমৃত্যুর হার খুবই বেশি।


১৯৭৪ সালে দিল্লিতে যন্ত্রের সাহায্যে গর্ভাবস্থায় মাতৃগর্ভে কন্যা না পুত্রভ্রুণ আছে তা জেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং ৮-এর দশকের প্রথম দিকে কিছু পরীক্ষাগারে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ণয় করে কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হতে থাকে। ২০০৩ সালে PCPNDT Act (The Preconception and Prenatal Diagnostic Techniques Act) চালু করা হয়। এতে বলা হল, বিশেষ কিছু ব্যাপারে ছাড়া কখনই গর্ভাবস্থায় USG করা ও শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা যাবে না। এইভাবেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে কন্যাভ্রুণ হত্যা বন্ধ করার। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো, যদি কোনও নারী গর্ভপাত করাতে চান সেক্ষেত্রে তার জীবনসঙ্গী এবং শ্বশুরবাড়ির অনুমতি নিষ্প্রয়োজন। The Medical Termination of Pregnancy Act, 1971 অনুযায়ী ২৪ সপ্তাহের মধ্যে যে কোনও নারী স্ব-ইচ্ছায় গর্ভপাত করাতেই পারেন। তবে বিশেষ কোনও কারণ থাকলে ভারতে ২৪ সপ্তাহের পরও গর্ভপাতের অধিকার দিয়েছে আদালত। একদিকে নারীকে দেবীশক্তিরুপে পুজো, অন্যদিকে ধর্ষণ কিংবা কন্যাভ্রুণ হত্য। এই নাটক কতদিন চলবে জানা নেই।

৭) লিঙ্গ বৈষম্য নিরোধক আইন- 

দেব-দেবীর মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার না থাকায়, তার বিরুদ্ধে নারীবাদী সংগঠনগুলি সোচ্চার সর্বদাই৷ কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষের মন এতে টলেনি৷ ধর্মগুরুদের মতে, প্রাচীনকাল থেকেই মাসিকের সময় মেয়েদের ‘অশুচি’ বলে গণ্য করা হয়৷ তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে মুম্বই হাইকোর্ট মন্দির প্রবেশাধিকার আইন ১৯৪৭ অনুসারে রায় দেয় যে, মন্দিরে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না৷


৮) জাতিভেদ প্রথা অপরাধযোগ্য- 

জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আইনের ১৭নং ধারায় এই আইন লঙ্ঘনে ছ’মাসের জেল ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে৷ কারণ মানুষের ব্যক্তি অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ সামাজিক মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, ধর্মীয় স্থানে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নীচু জাত আর উঁচু জাতের মধ্যে বিভেদ করা অবৈধ৷ ১৯৭১ সালে আইনটি সংশোধন করে তার নাম দেওয়া হয় নাগরিক অধিকার সুরক্ষা আইন৷


৯) লিঙ্গ বৈষম্য নিরোধক আইন- 

দেব-দেবীর মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার না থাকায়, তার বিরুদ্ধে নারীবাদী সংগঠনগুলি সোচ্চার সর্বদাই৷ কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষের মন এতে টলেনি৷ ধর্মগুরুদের মতে, প্রাচীনকাল থেকেই মাসিকের সময় মেয়েদের ‘অশুচি’ বলে গণ্য করা হয়৷ তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে মুম্বই হাইকোর্ট মন্দির প্রবেশাধিকার আইন ১৯৪৭ অনুসারে রায় দেয় যে, মন্দিরে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না৷

১০) সম্পূর্ণ আইনটির নাম- Essential Services Maintenance Act 1968 সংক্ষেপ ESMA Act যা, ১৯৬৮ সালে তৈরী এবং ১৯৮১ সালে সংশোধন করা হয়। এই আইন লঙ্ঘন করলে ৬ মাসের জেল এবং কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে অথবা উৎসাহিত করলে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। চিকিৎসা, পরিবহণ, বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো জরুরি পরিষেবা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে বা বিপর্যস্ত বলে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় কর্মবিরতি, ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং প্রয়োজনে কর্মচারীদের ওভারটাইম করতে বাধ্য করতে পারে প্রশাসন। এমনই বলছে এসমা আইন। 

প্রসঙ্গত জানাই, Medical Council of India (Regulation 2002) এর 2 নং ধারা অনুযায়ী কোনো অবস্থাতেই কোনো মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত কয়েকটি মৌলিক অধিকার -বাবাই
Nov. 19, 2024 | আইন | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অনেকেই, বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর কে ভারতীয় সংবিধানের জনক হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। উনি ছিলেন সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান। সর্বপ্রথমে আম্বেদকর মহাশয় বেশকয়েকটি দেশের সংবিধানগ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালোকরে পড়ে তারপর সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ২৮৪ জন সাক্ষর করলে এটি গৃহীত হয়। এই দিনটি "জাতীয় আইন দিবস" হিসেবে পরিচিত। গণপরিষদ সংবিধান রচনা করতে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় নিয়েছিল। এই সময়কালের মধ্যে ১৬৬ দিন গণপরিষদের অধিবেশন বসে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার স্মৃতিতে ২৬ জানুয়ারি তারিখটি সংবিধান প্রবর্তনের জন্য গৃহীত হয়েছিল। 

১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন কার্যকরী হয়। এই আইনবলে ব্রিটিশ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়। স্থির হয়, সংবিধান প্রবর্তন পর্যন্ত এই দুই রাষ্ট্র কমনওয়েলথ অফ নেশনসের দুটি অধিরাজ্যের মর্যাদা পাবে। এই আইনবলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ভারত ও পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং উভয় রাষ্ট্রের উপর সংশ্লিষ্ট গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান প্রবর্তিত হলে পূর্বপ্রচলিত ১৯৩৫ সালের ভারতের শাসন আইনেরও অবসান ঘটে এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন প্রত্যাহৃত হয়। এরপরে ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির অধিরাজ্যের বদলে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা অর্জন করে। 

ভারতের সংবিধান, বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। ভারতের সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে মোট শব্দসংখ্যা ১১৭,৩৬৯।  দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়ার দরুন, ভারত সরকার প্রবর্তিত প্রতিটি আইনকে সংবিধান-অনুসারী হতে হয়।

সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন,পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। প্রথম সংশোধন হয়েছিল সংবিধান চালু হবার পরের বছরেই, অর্থাৎ ১৯৫১ সালে। প্রসঙ্গত জানাই, ভারতের সংবিধান সংশোধনের জন্য বিল একমাত্র সংসদেই উত্থাপন করা যায়। সংসদের যে-কোনও কক্ষেই এই বিল উত্থাপন করা যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কোনও বিল উত্থাপন করা যায় না। কেন্দ্রীয় সরকার বা সংসদের যে-কোনও কক্ষের যে-কোনও সাংসদ বিলের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন। সরকার যে বিল উত্থাপন করেন তা সরকারি বিল এবং কোনও সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে যে বিল উত্থাপন করেন তা বেসরকারি বিল হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, ভারতের সংবিধানের সকল অংশকে একই পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। গুরুত্ব অনুসারে বিভিন্ন অংশের সংশোধনীর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। 

১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্বারা স্বাক্ষরিত ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। 

সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।

এবারে দেখে নেওয়া যাক সংবিধান আমজনতাকে কিধরনের মৌলিক অধিকার দান করেছে। সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে মুল সংবিধানে ৭ টি মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ ছিল। সেগুলি হল- 

১) সাম‍্যের অধিকার (১৪-১৮ নং ধারা)

২) স্বাধীনতার অধিকার (১৯-২২ নং ধারা)

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩-২৪ নং ধারা) 

4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা)

৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার (২৯-৩০ নং ধারা)

৬) সম্পত্তির অধিকার (৩১ নং ধারা)

৭) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (৩২ নং ধারা) 

বর্তমানে মৌলিক অধিকারের সংখ্যা ৬ টি। (এইখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ১৯৭৮ সালে ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ‍্যমে সম্পত্তির অধিকার কে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে  বর্তমানে সম্পত্তির অধিকার ৩০০এ ধারায় সংযোযিত রয়েছে) যেমন- 

১) সাম‍্যের অধিকার:

(ক) সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আইন সবাইকে সমানভাবে রক্ষা করবে। 

(খ) সংবিধানের ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের সাথে ধর্ম, জাতি, বর্ন, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বেষম‍্যমুলক আচরন করতে পারবে না। 

(গ) সংবিধানের ১৬ নং ধারা অনুসারে সরকারি চাকুরি তে সব নাগরিকদের সমান সুযোগসুবিধা থাকবে।

(ঘ) সংবিধানের ১৭ নং ধারা অনুসারে অস্পৃতাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষনা করা হয়েছে।

(ঙ) সংবিধানের ১৮  নং ধারার সামরিক শিক্ষাক্ষেত্র ছারা সমস্ত ক্ষেত্রে উপাধি গ্রহন ও ব‍্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

২) স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ১৯ নং ধারায় নাগরিকদের ৬ প্রকার স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন- 

(ক) বাক স্বাধীনতার অধিকার

(খ) শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশ 

(গ) সঙ্ঘ ও সংবিধানের ২০ (১) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে কেবলমাত্র সেই আইন অনুসারেই শাস্তি প্রদান করতে হবে।

সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে এক‌ই অপরাধের জন‍্য একাধিকবার শাস্তি প্রদান করা যাবে না। 

সংবিধানের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে নিজের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ দিতে বাধ‍্য করা যাবে না।

সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে তার জীবন ও ব‍্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

২০০২ সালের ৮৬ তম সংবিধান সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার আইনটি (২১এ ধারা) সংবিধানে সংযোযিত হয়েছে। এই ধারায় সকল শিশুদের জন‍্য অবৈতনিক ও বাধ‍্যতামুলক শিক্ষার ব‍্যবস্থা করবে। 

২২ নং ধারা অনুসারে কোন ব‍্যক্তিকে যুক্তি সংগত কোন কারণ ছারা গ্রেফতার করা যাবেনা। 

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার: 

সংবিধানের ২৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, মানুষ নিয়ে ব‍্যবসা অর্থাৎ মানুষ ক্রয় বিক্রয়, বেগার খাটানো বা অনুরুপ ভাবে বলপূর্বক শ্রমদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সংবিধানের ২৪ নং ধারায় ১৪ বছ‍রের কম বয়সী শিশুদের খনি, কলকারখানা বা অন‍্য কোন বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

৪) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ২৫  নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত‍্যেক ব‍্যক্তি নিজের বিবেক এবং বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোন ধর্ম গ্রহন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও নিজ ধর্ম প্রচার করতে পারবে।

সংবিধানের ২৬  নং ধারায় বলা হয়েছে প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্ম প্রচারের জন‍্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষনাবেক্ষন ও পরিচালনা করতে পারবে।

সংবিধানের ২৭  নং ধারায় বলা হয়েছে কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির এবং রক্ষনাবেক্ষণের জন‍্য কোন ব‍্যক্তিকে কর বা চাঁদা দিতে বাধ‍্য করা যাবে না। 

সংবিধানের ২৮  নং ধারায় বলা হয়েছে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত সেগুলিতে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া যাবেনা। 


৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার: সংবিধানের ২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় ভুখন্ডের যেকোন অংশে বসবাসকারী নাগরিক নিজ নিজ ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি সংরক্ষনের অধিকার ভোগ করতে পারবে। 

সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ‍্যালঘু সহ সকল সংখ‍্যালঘুদের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। 


৬) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার: সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার টি কে, ড. বি আর আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

সংবিধানের ৩২নং ধারায় বলা হয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা যদি মনে করেন যে তাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বা খর্ব করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হতে পারেন। 


এছাড়া সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রপতি, ২০ এবং ২১ নং ধারা ব‍্যতীত সমস্ত মৌলিক অধিকার গুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। 

সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট, ২২৬ নং ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার গুলি রক্ষার জন‍্য পাঁচ ধরনের লেখ বা রিট জারি করতে পারেন। যেমন- 

(ক) বন্দী প্রত‍্যক্ষীকরন (Habeas Corpus): এর অর্থ হল To have the body অর্থাৎ "সশরীরে হাজির করা"। 

(খ) পরমাদেশ (Mandamus): এর অর্থ হল Command to. 

(গ) প্রতিষেদ (Prohibition): এর অর্থ হল "নিষেধ করা"। 

(ঘ) উৎপ্রেশন (Certiorari) এর অর্থ হল "বিশেষভাবে জ্ঞাত হ‌ওয়া"।

(ঙ) অধিকার পৃচ্ছা (Quo Warranto) এর অর্থ হল "কোন অধিকারে"।

হিন্দু কোড বিল কাকে বলে? -পার্থপ্রতিম পাল
Nov. 19, 2024 | আইন | views:448 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যাদের আগ্রহ আছে, তারা নিশ্চয়ই ভারতের “হিন্দু কোড বিল” বিষয়ে পড়েছেন। ভারত স্বাধীন হবার পরে পণ্ডিত নেহেরুর কেবিনেট এই বিলের মাধ্যমে হিন্দুসমাজ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ে, তালাক, নারী অধিকার, পৈত্রিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের মতো সংবেদনশীল বিষয় ছিলো এই বিলে। বিগত সময় ধরে চলে আসা সনাতনী কুসংস্কার, ধর্মের নামে অনাচার ও অধিকারহরণ বন্ধ করাই ছিলো এই বিলের উদ্দেশ্য। যুগোপযোগী এবং বাস্তবিক সিদ্ধান্তই ছিল এই বিলের সারকথা।

বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা পাওয়া, ইতিহাস ও শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ড. বি আর আম্বেদকার ওই কেবিনেটের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনিই এই বিলের প্রণেতা এবং প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সমর্থনেই তিনি বিলটি প্রস্তুত করে সংসদে উত্থাপন করেন।

যথারীতি মৌলবাদী হিন্দুরা এর বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে আসে। তারা বিভিন্ন শ্লোক দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, এটা হিন্দুধর্মের প্রতি সরাসরি আক্রমণ। তাই ধর্মরক্ষায় এই বিল বন্ধ করতে হবে। একজন হিন্দু হিসেবে, এই বিল বন্ধ করা ধর্মীয় দায়িত্ব। দীর্ঘদিন ধরে একে-অন্যকে-গালি-দেয়া হিন্দুবাদী সংগঠনগুলোও এই ইস্যুতে এক হয়ে যায়। তারা বলে, আমাদের ধর্ম ও সামাজিক আইন সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত বেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো মানুষের এই বিষয়ে আইন করার অধিকার নেই।

ড. আম্বেদকার উত্তর দেন, হিন্দুধর্মের সাথে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা আছে ভিন্ন জনের ভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন হিন্দুবাদীরা তাদের সুবিধামতো শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন সামাজিক কুকর্মের বৈধতা দেয়। তাই একটি স্পষ্ট আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে, অনাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এতে মৌলবাদীরা আরও ক্ষেপে গিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সরকারকে নাস্তিক আখ্যা দেয়। সরকার সেকুলারাইটিস রোগে আক্রান্ত বলে প্রচার করা হয়। ধর্মান্ধদের এরকম উন্মত্ততা দেখে কংগ্রেসের দুর্বল মানসিকতার লোকজন ঘাবড়ে যায়। তারাও আম্বেদকার ও নেহেরুকে বিলটি পাশ না করে ফেরত নেবার জন্য অনুরোধ করতে থাকে।

আম্বেদকার তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। পণ্ডিত নেহেরুও নৈতিকতার দায় থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি ঘোষণা দেন, এই বিলটি ফেরত নিলে তিনি ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারাবেন। তাই কোনোভাবেই তিনি বিল ফেরত নিতে চান না, বরং পুনরায় পাশ করার চেষ্টা করতে চান।

যারা সরাসরি মৌলবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন, কিন্তু মনে মনে মৌলবাদী, তারা এই বিলের একটু অন্যভাবে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, শুধু এক ধর্মের জন্য আইন বানানো কতোটুকু উচিত? একাধিক বিয়ে করা যদি হিন্দুদের জন্য নাজায়েজ হয়, তবে মুসলমানদের জন্য জায়েজ কেন? যাদের ভোটে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে আইন বানানো হলে, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য আইন বানানো হচ্ছে না কেন? সরকার কি মুসলিমদের ভয় পায়?

বিল পাশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন নেহেরু। সরকারের সময়ও শেষ হয়ে আসছিলো। এসময় আম্বেদকার নেহেরুকে আবেদন করেন যে তাঁর শরীর খারাপ হচ্ছে। তিনি বিল পাস হবার পরেই নিজেকে ডাক্তারের হাতে ছাড়তে চান, তার আগে না। নেহেরু আবার চেষ্টা করেন। আরও ভয়াবহ বিরোধিতা আসে।

বছরখানেকের মধ্যেই ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবার জন্য সময় দরকার ছিলো। তাই সব দিক বিবেচনা করে, পণ্ডিত নেহেরু বিল ফেরত নেবার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ঘোষণা দেন, কংগ্রেস যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তখন এই বিল পুনরায় উত্থাপন হবে। ওই সেশনে বিল পাশ না হওয়ায় ড. আম্বেদকার অভিমানে ইস্তফা দেন এবং চিরদিনের জন্য কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিলো সেই হিন্দু কোড বিল। এটাই মনে হচ্ছিলো জেতা-হারার ফ্যাক্টর। এটা ছিলো অনেকটা হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নেহেরু আর কংগ্রেসের নৈতিক যুদ্ধ। হিন্দুবাদীরা শুধু আইনের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নেহেরুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী দেয় এবং নির্বাচিত হলে এই বিল চিরকালের জন্য আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এলাহাবাদের ফুলপুর আসনে নেহেরুর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সে সময়ের বিখ্যাত ধর্মনেতা প্রভুদেব ব্রহ্মচারী।

হিন্দুবাদী নেতার জনপ্রিয়তা এবং প্রতিটি বক্তৃতায় নেহেরুর হিন্দু কোড বিলের পক্ষে বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল, নেহেরুর হার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু হিন্দুবাদীদের লম্ফঝম্প বেশি হলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে জয়লাভ করেন নেহেরু। তাঁর দল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে ফিরে আসে। ফিরে এসেই তিনি পুনরায় সেই বিল তোলেন। ১৯৫৬ সালের মধ্যে ৪টি আইনে ভাগ হয়ে বিলটি পাশ হয়।

অনেক বছর পার হয়ে গেছে। আজ সেসব ইতিহাস। ভারত ড. আম্বেদকারকে ভারতরত্ন ঘোষণা দিয়েছে, সংবিধান নির্মাতার সম্মান দিয়েছে, দলিতের ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবাদপুরুষ আখ্যা দিয়েছে। এমনকি আজকের বিজেপিও তাঁর সংস্কারকে সম্মান দেখায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ড. আম্বেদকারকে মরতে হয়েছিলো নাস্তিক, দেশবিরোধী, ছুপা মুসলিমসহ আরও বহু গালিময় আখ্যা নিয়ে।

সমসাময়িক ইতিহাস নিয়ে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেয়া দরকার। তবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা নেয়া দরকার আমাদের সাধারণ জনগণের। মনে রাখতে হবে, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা অন্য যেকোনো নামে উন্মাদনা যতো বেশিই হোক, শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়। উন্মাদনা দেখে ভুল পথে হাঁটলে হয়তো সাময়িক জয় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পরাজয় হয়েই দেখা দেয়।

ভারতীয় সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রসঙ্গে --শুভাশিস লাহা (সংবিধান বিশেষজ্ঞ)
Nov. 19, 2024 | আইন | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারতীয় সংবিধান হচ্ছে পৃথিবীর সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান যা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই কার্যকরী হয়। ভারতীয় সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। ভারতের সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে মোট শব্দসংখ্যা ১১৭,৩৬৯।  

১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্বারা স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। এরপরে সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -

"We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।

ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) বা ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে যার অভিধানিক অর্থ হচ্ছে- "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ, ধর্ম এবং অলৌকিকতার সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্যদিকে, নিরপেক্ষ শব্দটির অর্থ, কোনো অথবা কারোর পক্ষেই অবস্থান নয়। ধর্মনিরপেক্ষ মানে সর্বধর্মসমন্বয়ও নয়। এর অর্থ রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষেই  থাকবেনা বরং সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার বা রাষ্ট্র কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানও করবে না। জনগণকে ধর্ম পালনে বাধ্য করাও হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।


এইপ্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- "The separation of religion and state is the foundation of secularism. It ensures religious groups don't interfere in affairs of state, and the state doesn't interfere in religious affairs."

ভারতীয় সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights of Indian Constitution) যার মধ্যে একটি ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার যা সংবিধানের ২৫-২৮ নং ধারায় উল্লেখিত রয়েছে। সেগুলো যথাক্রমে- 

(১) ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা:

 সংবিধানের ২৫(১) নং ধারায় লেখা হয়েছে, বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্মস্বীকার, ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সব নাগরিকের রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য, জনশৃঙ্খলা বা সামাজিক নীতিবােধ এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ছাড়া কোনাে বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান কোনাে ধর্মের অঙ্গ কি না তা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে বলে সুপ্রিমকোর্ট ১৯৮৮ সালে হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য মামলায় রায় দেন।

২৫(২) (ক) নং ধারায় লেখা হয়েছে, ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে। তা ছাড়া সামাজিক কল্যাণসাধন ও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র প্রয়ােজনমতাে আইন প্রণয়ন করে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। 

২৫(২) (খ) নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সব হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত রাখতে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারবে। সংবিধানে হিন্দু শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

(২) ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা:

সংবিধানের ২৬ নং ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গােষ্ঠীকে কয়েকটি অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল-


(ক) ধর্ম বা দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, 

(খ) নিজেদের ধর্মীয় কার্যকলাপ নিজেরাই পরিচালনা করা, 

(গ) স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও ভােগদখল করা এবং 

(ঘ) আইন অনুযায়ী নিজস্ব সম্পত্তি পরিচালনা করা।

তবে রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার জন্য যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গােষ্ঠীর এই অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

(৩) কর আদায় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ: 

সংবিধানের ২৭ নং ধারায় লেখা হয়েছে, ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষপাবেক্ষণের জন্য কোনাে ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না।

(৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষার বিধিনিষেধ:

সংবিধানের ২৮ নং ধারায় বলা হয়েছে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরােপুরি সরকারি সাহায্যে পরিচালিত হয় সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা আংশিকভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্য ধর্মশিক্ষা নিষেধ করা হয়নি। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হলেও কোনাে দাতা বা অছির উইলে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষাদানের কথা উল্লিখিত থাকলে, সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে। 


প্রসঙ্গত জানাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। যেমন- সংবিধানের ২৮(১) ধারায় লেখা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.'অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনোরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবেনা। আবার, ২৮(২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ববিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন যুক্তিমনষ্ক মানুষেরা।

ঋণ স্বীকার: আমাদের সংবিধান, সুভাষ সি কাশ্যপ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট

গ্রেফতারি পরোয়ানা ও ভীতি -পৃথ্বীশ ঘোষ
Nov. 19, 2024 | আইন | views:8559 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গ্রেপ্তার কথাটা শুনলেই কেমন যেন বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে যায় তাই না। যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। সেটা যদি হয় আবার মাঝরাতে ভুক্তভোগী মাত্রই এর স্বাদ বুঝেছেন। ধরুন আপনি সামাজিক মাধ্যমে কিছু লিখলেন যার সূত্র ধরে রাতে আপনাকে পুলিশ তুলতে এল তখন অসহায় হয়ে সাহায্য প্রার্থনা ছাড়া কি বা করার আছে বলুন। আমরা অনেকেই আইনের মারপ্যাচ বুঝি না। যেহেতু আমরা আইন বিরুদ্ধ কাজ করি না তাই আইন বোঝার চেষ্টাও করি না। তবুও আমাদের অনেক সময়  নানান চক্রান্তে পুলিশি হেনস্থার শিকার হতে হয়।  সাধারণত আমরা জানি পুলিশ সন্দেহের বসে যেকোনও মানুষকে গ্রেফতার করে থানার লকআপে তার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে পারে এবং করেও থাকে।  কিন্তু বাস্তবটা অন্যরকম। পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে না 41CRPC নোটিশ না দিয়ে।

আমি নিজে ভুক্তভোগী আমাকেও এরকম তুলে নিয়ে গিয়ে পোস্ট ডিলিট করার জন্য চাপ দিয়েছিল আমার লোকাল থানার পুলিশ। রাজনীতি না করা স্বত্তেও একটা স্ট্রং রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করি। তাই কিছু শত্রু সবসময় সমস্যা তৈরি করে গেছে তাদেরই কেউ উস্কে ছিল আমি নাকি ফেসবুকে দাঙ্গা ছড়াচ্ছি। আদতে ছিল দাঙ্গা রোধ করা নিয়ে পোস্ট একটু খুঁটিয়ে পড়লেই ব্যাটারা বুঝতে পারত। মূল বিষয়ে আসি যদি আপনার সঙ্গে বা পরিচিত কারুর সঙ্গে এরকম কিছু হলে কি করবেন দেখেনিন চট করে।

হঠাৎ গ্রেফতার হলে করণীয়:

অনেক রাত!  হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খোলার সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে অথবা পোশাকে (সিভিক ও হতে পারে) একদল লোক আপনাকে বা আপনার পরিবারের কাউকে গ্রেফতার করে তাদের হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে-

কে গ্রেফতার করতে পারে?

একমাত্র পুলিশ অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেট, অথবা যার হাতে গ্রেফতার করার ওয়ারেন্ট আছে।

ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার:

কোনও সাধারণ ব্যক্তিকে পুলিশ একমাত্র তখনই  গ্রেফতার করতে পারে যখন সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিটি কোনও জামিন অযোগ্য অপরাধ করে থাকে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট (এক্সিকিউটিভ অথবা জুডিশিয়াল) কোন এরেস্ট ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন। কোনও অপরাধী সজ্ঞানে কোন অপরাধ করলে এরেস্ট ওয়ারেন্ট ছাড়াই অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারে।

বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। তবে, ওয়ারেন্ট বা বিনা ওয়ারেন্টে, কাউকে গ্রেপ্তার করতে গেলে অভিযুক্তকে অবশ্যই অ্যারেস্ট মেমো দিতে হবে। সেই অ্যারেস্ট মেমোতে দুই নিরপেক্ষ প্রাপ্ত বয়স্ক মানসিক ভারসাম্যযুক্ত নাগরিকের সই থাকতে হবে। অভিযুক্তকে বা যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাকে যে অ্যারেস্ট মেমো দেওয়া হচ্ছে তাতে কী কারণের জন্য গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তার কারণ ও ভারতীয় আইনের ধারা বা সেকশন অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি তার মেডিকেল চেকআপ করাতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতারের পর পুলিশি জেরায় সময় চুপ থাকতে পারে। এই আইনি অধিকার তার আছে Section 20(3) পুলিশ সরকারি কাজের প্রয়োজনে বা কোন কিছু অনুসন্ধানে যে কোন ব্যক্তিকে থানায় ডেকে পাঠাতেই পারে। তবে ডেকে পাঠানোর ক্ষেত্রে যাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে তাকে লিখিত কল মেমো দিতে হবে পুলিশকে, সেখানে ডেকে পাঠানোর কারণ লিখতে হবে বিশদ বিবরণ সহ। কল মেমো বা কোন উপযুক্ত কারন ছাড়াই যদি মাঝরাতে ডাকতে আসে আপনি যেতে বাধ্য নন। পরদিন সকালে অবশ্যই থানায় খোঁজ নেবেন।

কীভাবে গ্রেফতার করা হয়?

পুলিশ যদি কোনও অপরাধীকে ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার নিয়ে গ্রেফতার করতে আসে তাহলে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির হাতে হট করে হাতকড়া পড়াতে পারবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তির হাতে হাতকড়া পরানোর জন্য পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুমতি নিতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি গ্রেফতারের সময় কোনো সহযোগিতা না করে তাহলে পুলিশ যেন-তেন প্রকারেণ সেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারে।

এমন পরিস্থিতির শিকার হলে করনীয়:


একজন নাগরিক হিসেবে প্রথমেই আপনার জানার অধিকার রয়েছে কেন, কী কারণে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাই প্রথমেই জানতে চাইতে হবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি কী? আর তাদের সাথে গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো পরোয়ানা আছে কি না? মনে রাখবেন গ্রেফতারের কারন জানাতে আর প্রয়োজনে পরোয়ানা (যদি থাকে) দেখাতে পুলিশ বাধ্য। যদি তারা আপনাকে পরোয়ানা দেখাতে সক্ষম না হয় তাহলে বুঝতে হবে তারা আপনাকে বিনা পরোয়ানায় আটক করতে আসছে (ধারা ৫৪)। এই ক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের পরিচয় জানতে চাইবেন এবং তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইবেন।কোনও অভিযুক্তকে তখনই গ্রেপ্তার করা হয় যখন সেই অভিযুক্ত কোন অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত এবং উক্ত ব্যক্তির বিচারে উপস্থিতি প্রয়োজন। যতক্ষণ না আদালতে অপরাধীর দোষ প্রমাণ হচ্ছে ততক্ষণ অপরাধী র প্রতি কোনো খারাপ অমানবিক ব্যবহার করা চলবে না। অ্যারেস্ট  ওয়ারেন্টে অফিসারের সই থাকবে দেখে নিতে হবে কোর্টের সিল ও স্ট্যাম্প ডেট। যদি এগুলি না থাকে তাহলে বুঝতে হবে অ্যারেস্ট  ওয়ারেন্ট সঠিক নয়।একা একা কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিন। প্রয়োজনে আশপাশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের খবর দিন এবং যত পারা যায় লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করুন। অবশ্যই উকিলকে খবর দিন রাত হলেও।

পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে আপনি একা তাদের সঙ্গে যাবেন না বলে তাদের জানিয়ে দিন এবং পরিবারের দু-একজনকে সঙ্গে নেবেন বলে তাদের জানান। প্রয়োজনে নিকটস্থ থানায় ফোন করে আপনার গ্রেপ্তারের বিষয়টি কনফার্ম করুন কেননা আজকাল পুলিশের ড্রেস পরে আততায়ী পর্যন্ত আসে। এবং থানা এ সম্পর্কে অবগত অছে কি না, তা জানার চেষ্টা করুন।

গ্রেফতার পরবর্তী পদক্ষেপ:

গ্রেফতার পরবর্তী আপনার আপনজনের প্রথম কাজ হল আইনি সহায়তার জন্য কোনো আইনজীবীর শরণাপন্ন হওয়া।কারন একজন আইনজীবীই এই ক্ষেত্রে আপনাকে সব থেকে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।গ্রেপ্তার হলে গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চালান দেবেন। এই সময় আইনজীবী আটক কৃত ব্যক্তির পক্ষে জামিনের আবেদন করবেন।কোনো কারণে নিম্ন আদালতে জামিন না হলে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। তাই সব সময় আইনজীবীর ফোন নাম্বারটি বাড়িতে জানাবেন।

বর্তমানে সব থেকে চিন্তার বিষয় হল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে অপহরন এবং খুন।প্রথমেই বলে দি, সাদা পোশাকে ৫৪ ধারায় কাউকে আটক করা যাবে না। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন এবং কিছু গাইডলাইন দিয়েছেন, যা ১০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পূর্ণাঙ্গ রায় হিসেবে প্রকাশিত হয়। তাই আটককারী তার পরিচয়পত্র দেখাতে অস্বীকার করলে এক্ষেত্রে আপনি আত্নরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিনামূল্যে একজন উকিলবাবুর পরামর্শ পাবার অধিকার আছে।

জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে থানাতেই জামিনের ব্যাবস্থা সুনিশ্চিত করা আপনার অধিকার।


কোন ব্যক্তি নিখোঁজ থাকলে কি করবেন:

কোন ব্যক্তি নিখোঁজ থাকলে পার্শ্ববর্তী থানায় প্রথমে খোঁজ করতে হবে। যদি কোন সংবাদ পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে উচ্চ আদালত অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগে জরুরী ভিত্তিতে রীট করতে পারে। অবৈধ আটকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ হচ্ছে “হেবিয়াস কর্পাস” রীট করা। হেবিয়াস কর্পাসের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে “সশরীরে হাজির করা”।

যখনই আদালতে নিখোঁজ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আবেদন করা হয় যাকে সর্বশেষ পুলিশের হেফাজতে দেখা গেছে তখন আদালত পুলিশকে আটকৃত ব্যক্তিকে সশরীরে হাজির করার জন্য সমন জারি করে। এমনকি আটকাদেশ যদি অবৈধ প্রমাণিত হয় তাহলে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও নির্দেশ দিতে পারে উচ্চ আদালত।

সার্চ ওয়ারেন্ট:

আমরা অনেকেই কমবেশি জানি সার্চ ওয়ারেন্ট এর ব্যাপারে কিন্তু হঠাৎ করে আপনার বাড়ি, দোকান তল্লাশি বা সার্চ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে সার্চ ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে পুলিশকে অবশ্যই এবং যে ব্যক্তির বাড়ি, দোকান ঘর, গুদাম বা অফিস ইত্যাদি তল্লাশি বা  সার্চ করা হচ্ছে, তাকে সার্চ ওয়ারেন্টের  একটি কপি অবশ্যই দিতে হবে। এখানেও সিল স্ট্যাম্প ডেট সিগনেচার ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।


সার্চ ওয়ারেন্টের সময়সীমা:

এখানে উল্লেখ্য যে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যে কেউ সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারে না, তা করবে আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট। সেই সার্চ ওয়ারেন্ট যখন থেকে  ইস্যু করা  হবে সেই সময় ও দিন থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তল্লাশি অভিযান বা সার্চ অপারেশন শুরু করতে হবে পুলিশকে। ৪৮ ঘন্টা হয়ে গেলে, সেই পুরানো সার্চ ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে কোনো তল্লাশি অভিযান বা সার্চ অপারেশন করতে পারে না পুলিশ।

ডকুমেন্ট:

নথি সংগ্রহ করা একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য। গ্রেফতারের সময় আপনাকে কোন কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, গ্রেফতারকারী অফিসারের নাম, গ্রেফতারের সময় সম্পর্কিত লিখিত মেমো পুলিশ আপনাকে দিতে বাধ্য। মামলা আদালতে যদি বিষয় গড়ায় তবে মামলার ক্ষেত্রে এটির গুরুত্ব অপরিসীম।


থানার লকআপে হেনস্থা:

আপনাকে গ্রেফতার করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনাকে যে থানার পুলিশ গ্রেফতার করেছে সেই থানার অন্তর্গত বিচারাধীন ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে হাজির করতে বাধ্য। ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া আর একদিনও আপনাকে অতিরিক্ত আটকে রাখতে পারে না থানার লকআপে। যদি কোনও কারনে আদালতের কাজকর্ম বন্ধ থাকে বা ছুটি  থাকে,তাহলে সেক্ষেত্রে ম্যাজিষ্ট্রেটের বা বিচারকের সরকারি ঠিকানা বা  বাড়িতে আপনাকে হাজির করাতে হবে।


মহিলা পুলিশ:

মহিলা পুলিশ ছাড়া কোনওভাবেই কোনও মহিলাকে গ্রেফতার বা তল্লাশী চালানো যায় না।এক্ষেত্রে আপনি মহিলা হলে অবশ্যই মহিলা পুলিশ দিয়ে আপনাকে গ্রেফতার বা তল্লাশি করাতে হবে।একজন মহিলাকে শুধুমাত্র মহিলা পুলিশই  আটকাতে অথবা অ্যারেস্ট করতে পারেন, কোনো পুরুষ পুলিশ সেই কাজ করলে দণ্ডনীয় অপরাধ। CRPC ৫১(২) ধারা অনুসারে ধৃত মহিলার দেহ তল্লাশি করার অধিকারও নেই পুরুষ পুলিশের। এই কাজটি একমাত্র মহিলা পুলিশরাই করতে পারেন এবং সেটা যেন শোভনীয়তার মাত্রা না ছড়ায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে মহিলা পুলিশকে।


According to Section 46(4) of the Criminal Procedure Code, 1973 which governs the arrest of women, It is specifically mentioned that “Save in exceptional circumstances, no woman can be arrested after sunset and before sunrise, and where such exceptional circumstances exist, the woman police officer shall, by making a written report, obtain the prior permission of the Judicial Magistrate of the first class within whose local jurisdiction the offence is committed or the arrest is to be made.

আইন অনুযায়ী যতক্ষণ আপনি পুলিশ লকআপে থাকবেন,ততক্ষণ পুলিশ আপনাকে কোনওপ্রকার শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করতে পারে না। এমনকি চড় মারতেও পারে না গালাগালি তো দূরে থাক।


পুলিশ হয়রানি করলে কী করবেন?

সাধারণত সরকার বিরোধী কোনও মতামত পোষণ করলে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ বাক স্বাধীনতার অধিকার আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু পুলিশ মামলা দায়ের করে অন্য ধারায়। আপনি পুলিশী হয়রানির শিকার হতে পারেন যদি আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিম্নলিখিত অপরাধ করে থাকেন। আপনি যদি আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্টে অশ্লীল কোনও শব্দ ব্যবহার করেন যার ফলে অন্য কোন ব্যক্তি অপমানিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করে।

o প্রমাণ ছাড়া ভিত্তিহীন ভাবে কোনও ব্যক্তিকে অপমান বা তার অসম্মান করার চেষ্টা করলে।

o কোনও ব্যক্তির চরিত্রহনন করে অসম্মানজনক কিছু লিখে বা ছবি পোস্ট করলে।

o সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে এইরকম কিছু পোস্ট করলে।

o ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করে এমন কিছু পোস্ট করলে।

o সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্ণগ্রাফি কিছু পোস্ট করলে আপনি গ্রেফতার হতে পারেন।

তাই এই সমস্ত বিষয়গুলি এড়িয়ে চলুন একজন দায়িত্ববান সচেতন নাগরিক হিসাবে। আপনার নির্বুদ্ধিতামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। অবশ্যই কোনও  উকিল বন্ধু বা স্থানীয়  কোন মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী এবং মিডিয়ার ফোন নাম্বার রাখুন এবং প্রয়োজনে তাদের ফোন করুন।বাড়ির লোককেও নাম্বারগুলি দিয়ে বলে রাখুন আপনাকে পুলিশ তুলে দিয়ে গেলে এই নাম্বারগুলিতে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করতে।

CPDR এর কেন্দ্রীয় অফিস

Committee for the Protection of Democratic Rights

Contact Address: Adv Suresh Rajeshwar,

4th Floor, Poddar Chambers,

S. A. Brelvi Marg, Fort,

Mumbai – 400 001

Fax: +9193224045911

Email: cpdr2014@gmail.com


এবং


NHRC / National Human Rights Commission-এর পূর্বভারতীয় শাখার Special Rapporteur:

Shri Damodar Sarangi, IPS (Retd)

(M) 9777579400, 9040079404

sprep2.nhrc@nic.in

dssarangi@yahoo.com


অথবা

Head Office:

National Human Rights Commission, Manav Adhikar Bhawan Block-C, GPO Complex, INA, New Delhi – 110023

For Complaints: Tel. No. 24651330, 24663333. Fax No. 24651332


কোনও ব্যক্তি পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন জানতে পারা মাত্র তার পাশে দাঁড়ান। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে খবরটি ছড়িয়ে দিন।

মনে রাখবেন, আপনি যদি অন্যের পাশে না দাঁড়ান তাহলে আপনার বিপদে আপনার পাশেও কেউ দাঁড়াবে না।

সূত্র-

১- https://www.ainbisharod.com/

২-আইনি পরিষেবা ও আপনার অধিকার

৩-পুলিশের কর্তব্য

কবিতাগুচ্ছ ১২ -কবিরা
Nov. 19, 2024 | কবিতা | views:109 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রার্থনালয়

– হুমায়ুন আজাদ


ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম

তিরিশ বছর পর গিয়ে দেখি সেখানে একটি

মসজিদ উঠেছে।

আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে

কোথায়?

তারা বলে ছেলেরা এখন খেলে না, মসজিদে

পাঁচবেলা নামাজ পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুড়িগঙ্গার ধারে

বেড়াতে গিয়ে

যেখানে একঘন্টা পরস্পরের দিকে নিষ্পলক

তাকিয়ে ছিলাম আমি আর মরিয়ম,

গিয়ে দেখি সৌদি সাহায্যে সেখানে একটা লাল

ইটের মসজিদ উঠেছে।

কোথাও নিষ্পলক দৃষ্টি নেই চারদিকে

জোব্বা আর আলখাল্লা।

পঁচিশ বছর আগে বোম্বাই সমুদ্রপারে এক

সেমিনারে গিয়ে

যেখানে আমরা সারারাত নেচে ছিলাম আর পান

করেছিলাম আর নেচে ছিলাম,

১৯৯৫-এ গিয়ে দেখি সেখানে এক মস্ত মন্দির

উঠেছে।

দিকে দিকে নগ্ন সন্ন্যাসী, রাম আর সীতা,

সংখ্যাহীন হনুমান;

নাচ আর পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ফার্থ অফ ফোর্থের তীরের বনভূমিতে

যেখানে সুজ্যান আমাকে

জড়িয়ে ধ’রে বাড়িয়ে দিয়েছিলো লাল ঠোঁট,

সেখানে গিয়ে দেখি মাথা তুলেছে এক গগনভেদি

গির্জা।

বনভূমি ঢেকে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত

ঝুলছে এ ক্রুদ্ধ ক্রুশকাঠ।

আমি জিজ্ঞেস করি কেনো দিকে দিকে এতো

প্রার্থনালয়?

কেনো খেলার মাঠ নেই গ্রামে?

কেনো নদীর ধারে নিষ্পলক পরস্পরের দিকে

তাকিয়ে থাকার স্থান নেই?


কেনো জায়গা নেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধ’রে

চুম্বনের?

কেনো জায়গা নেই নাচ আর পানের?

তারা বলে পৃথিবী ভ’রে গেছে পাপে,

আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহ্'য়

তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধুই

প্রার্থনা।

চারদিকে তাকিয়ে আমি অজস্র শক্তিশালী

মুখমণ্ডল দেখতে পাই,

তখন আর এ কথা অস্বীকার করতে পারিনা।





রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র(?)

-জামাল আনসারী


করোনা অজুহাত আর তুমি দিও না।

শিক্ষাকে এভাবে আর ধ্বংস করো না।


মাথাটা ঠান্ডা রেখে একটু  ভেবে দেখো―

চোখ- কান খুলে তুমি একটু হলেও শেখো।


লেখা পড়া ছেড়ে শিক্ষার্থী করোনাতঙ্কে মরে!

করোনা-ভাইরাস কি শুধুই স্কুলে বাস করে?


চলছে মিটিং, চলছে মিছিল, করোনা তো নাই

চলছে বাস, চলছে ট্রেন, ভাইরাসের ভয় নাই―


হাটে- বাজারে ভিড়, খোলা আছে শপিংমল!

শুধু স্কুলে প্রবেশ নিষেধ! চলছে সিনেমা হল।


সব তো স্বাভাবিকই আছে। শুধু স্কুলটা ছাড়া,

তবুও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খোলার নেই কো তাড়া!


ভোটের পর ভোট আসছে, ঢেউ এর পর ঢেউ

কত যে ঢেউ আছে! বোঝেই না মানুষ কেউ।


করোনা ভাইরাস, তবে কি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র (?)

করোনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যবসার মূলমন্ত্র!


ঢেউ উঠলেই কেন বন্ধ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান?

যুব সমাজকে মূর্খ বানানো সরকারেরই ধ্যান।


শিক্ষা-ছাড়া ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার

শিক্ষার্থীর স্বার্থে স্কুল-কলেজ খোলা দরকার।



ছিল ব্রিটিশ যেমন

-রবীন্দ্র নারায়ণ তালুকদার


কতো বড়ো পাল্টি বাজ

একটু ভাবুন বসে

কতো বড়ো কালো হাত

হিসেব করুন দেখে!

মায়ের গয়না চুরি করেছে

১৮ বছর বয়সে

নিজের দাদাই বলে দিয়েছে

প্রচারসভায় এসে!

৩৫ বছর অবধি ভিখারী ছিল

নিজের মুখের কথা

কখন আবার পড়াশোনা করল

বসুক বিচারের সভা!

স্টেশন ছাড়া চায়ের দোকান

কলেজে লাগিয়েই পড়া

ডিজিটাল পিন্ট মেশিনের আগে

হয়েছে মানপত্র গড়া!

বহুরূপী সেজে বলেছিল

২ কোটি চাকরি দেবে

কেমন সুন্দর ঘুরে দাড়াল

চাকরি গেল জলে!

বাড়লো বেকারত্ব-ক্ষুধার্ত

কমল শিক্ষিতের হার

জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া

দেখ গরীবের দিনকাল!

কর্পোরেট কতো আয় বাড়ালো

আবার তাদেরই টাক্সে ছাড়

গরীবের কোনও সুবিধা নেই

শুধু ভিক্ষে নিয়ে খাও!

গরীবকে গরীব একেজো করছে

নানান কুপথের সড়যন্ত্রে

ভোটে ২০লক্ষ্য ইভিএম হারিয়ে

কতো সুন্দর মসনদে!

বিচার শুধু নামেই আছে

বিচারকের দায়িত্ব কম

সুন্দর ইশারায় দেশ চলছে

ছিল ব্রিটিশ যেমন!!



কফিনবন্দী

-প্রদীপ চক্রবর্তী


হিজাব পরবো ? নাকি গেরুয়া পরবো ? ------------

শপথ নাও হাতে হাত রেখে, শুধু বই পড়বো।

ধর্ম নিয়ে অনেক তো হল, এবার জীবনের কথা বলো,

যুক্তির ইন্ধন নিয়ে মনুষ্যত্বের পথে চলো।


জাতপাতের নির্লজ্জ ধ্বজা এবার নামিয়ে নাও,

ভয়কে জলাঞ্জলি দিয়ে; সামনে এগিয়ে যাও।

ভাগ্যিস ভাগ্যটা নেই; জ্যোতিষের দাবি মতো,

পাথরের আংটি রোগ সারালে; কী কাণ্ডটাই না হতো।


করোনা সারাতে কোন্ পাথর?

জ্যোতিষের দাবি মতো,

কফিনবন্দী করে ফেল তাই

অন্ধ কুসংস্কার যত।

একবিংশ শতকের নতুন আতঙ্ক সিএএ -পৃথ্বীশ ঘোষ
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:86 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ছোটবেলায় যখন লেখা পড়া শুরু করেছিলাম তখন বই খুললেই প্রথমে সংবিধান এর প্রস্তাবনা দেখে দেখে মুখস্ত হয়ে গেছিল। তাতে সমানাধিকার এর কথা থাকত। বর্তমান শাসক শ্রেণী ধর্মীয় মেরুকরণ ও জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে এই সমানাধিকার এর ব্যাপারটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে। যে রাষ্ট্রে সাক্ষরতার হার খুব সন্তোষজনক নয় তাদের কত শতাংশ মানুষ যে এটা বুঝবে সন্দেহ। আমাদের দেশে বিল (সি এ বি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) টি খুব কম লোকেই পড়েছে বেশিরভাগ লোকেই কিন্তু শাসক বিরোধী বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত এমন অবস্থায় 2019 সালের 11 ডিসেম্বর গভীর রাতে পাস হয়ে গেল। বিলের উদ্দেশ্য 1955 সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব  লাভের সুযোগ রয়েছে। মুসলিমদের জন্য এখানে কোন সুযোগ রাখা হয়নি। শাসকশ্রেণী বোঝাল এতে হিন্দুদের কোন অসুবিধা নেই খালি ঘুসপেটিয়া দের তাড়িয়ে দেওয়া হবে, ওহ কি মজা। বিধি বাম। 31 আগস্ট 2019 আসাম এনার্সির তালিকা থেকে দেখলাম 19 লক্ষ মানুষের নাম বাদ। পাঠক এতটুকু শুনেই অবাক হচ্ছেন আর একটা তথ্য পেশ করি তার মধ্যে 12 লক্ষ হিন্দু বাঙালির। আপনি ভাবলেন বিজেপি তো হিন্দু দের কিছু করবে না বেছে বেছে মুসলিম দের তাড়াবে, আজ্ঞে না এরকম কোন দিবাস্বপ্ন দেখলে এখুনি বেরিয়ে আসুন। বাংলার এক গো নেতা সেদিন বললেন এনার্সি হলে নাকি 2 কোটি লোকের নাম বাদ যাবে। এই আনন্দে রাম্ভক্ত হনু ভক্ত গো সন্তান রা যদি আনন্দে আমোদে ফেটে পড়ে কিছুদিন বাদে এনার্সি লাগু হলে তাদের কয়েকজন এর নাম বাদ যায় তাহলে কারা বাঁচাবে?? যেমন টা আসামে বিজেপি নেত্রী ববিতা পাল এর নাম বাদ গেছে। ইনি কিন্তু এনার্সি র পক্ষে জোরদার প্রচার চালিয়েছেন।


সিটিজেন আমেন্ডমেন্ট আইন চালু হলে কতজন বাঙালি নাগরিকত্ব পাবে ? মাত্র 31 হাজার 313 জন। এর ভেতরে আপনার নাম থাকবে তো? কিছুদিন আগেই টাকলুভাই বললেন যে আধার ভোটার নাকি নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। মানছি আধার শুধু পরিচয় কখনোই নাগরিকত্ব নয়। তাই বলে ভোটার কার্ড? উনি আরো বলেন অত্যাচারিত হয়ে যে এসেছে সে হিন্দু হলে তার হিন্দুত্বের প্রমান।  এরা কখন কি বলে মানুষ কে বিভ্রান্ত করে দেবে আপনি সেই বিভ্রান্তির মধ্যেই নিজ দেশে নিজেই বিদেশি হয়ে যাবেন ধরতে পারবেন না। খুব সুচতুর গেম প্ল্যান কষে এগোচ্ছে আরএসএস এন্ড কোং। মানুষের বেসিক চাওয়া শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান চাকরি এগুলো থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতেই পাকিস্তানএর সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, 370 ধারা, নাগরিকত্ব, দেশীয় সংস্থা বিক্রি আর বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিস্কার যেমন গরু র দুধে সোনা, মহাভারত এ ইন্টারনেট, হাস জলে অক্সিজেন ছাড়ে এরকম কত কি। যে নাগরিকদের বৈধ ভোট দিয়ে গেরুয়া বাহিনী কে ক্ষমতায় আনল আজ তারাই দাবী করছে আপনি নাগরিক নন। বাহ চমৎকার এই তো গোলওয়ালকর, সাভারকার দের শিক্ষা। দিল্লির নির্বাচনী ফলাফল পরিষ্কার মানুষ জাত পাত, ধর্মের রাজনীতি পছন্দ করছে না।  হেঁয়ালি ছেড়ে পরিষ্কার কথায় আসি ধরুন আপনার পরিবারের 4 জনের নাম বাদ গেছে এবার নিয়ম মতো আপনাকে কাগজপত্র নিয়ে 120 দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল এ আপীল করতে হবে নিজেদের ভারতীয় প্রমান করার জন্য।সেখানকার রায় আপনার বিপক্ষে গেলে হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিমকোর্ট। হাইকোর্ট এ আবেদন করতেই লাগবে 19 থেকে 20 হাজার টাকা জনপ্রতি। সুপ্রিমকোর্ট ছেড়েই দিলাম এবার বলুন তো দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে 4 জনের যদি এরকম অবস্থা হয় আপনার মৃত্যু ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে কি? রাতের ঘুম উড়িয়ে আপনাকে পুরে দেবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে আপনারা কেউ একসঙ্গে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ। যারা আসামের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয় নি তারা কি করে বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেবে? বিজেপির বাবার ও ক্ষমতা নেই দেবার আইনের নিয়ম অনুযায়ী। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় যে শরণার্থী ও নাগরিকত্ব এক জিনিস নয়। একজন নাগরিক সে যে যে সুবিধা পাবে একজন শরনার্থী সেগুলো পাবেনা। ভোটদান এর সুযোগ, শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান এগুলোর কোন দাবী একজন শরনার্থী করতে পারে না। রাষ্ট্রের দয়া ভিক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।  এখন প্রশ্ন এত মানুষ যে নাগরিকত্ব হারালো এরা যাবে কোথায়??? উত্তর খুব সহজ ডি ক্যাম্প। খুব সস্তা শ্রম এখন সারা বিশ্ব জুড়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পুঁজিবাদের কল্যানে। নাম মাত্র বা বিনামূল্যে হাড়ভাঙা খাটিয়ে নাম মাত্র খেতে চিকিৎসা দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। যে ক্যাম্প গুলো জার্মানি তে হিটলার শুরু করে গেছিলেন সেই একই কায়দায় নাম পাল্টে ডিটেনশন ক্যাম্প হয়ে ফিরে এসেছে। এখনো সময় আছে গর্জে না উঠলে সর্বনাশ। একনজরে দেখে নি আসাম এর বাদ পড়া জনজাতি গুলির পরিসংখ্যান-

বাঙালী হিন্দু 6.90 লাখ

পুর্ব বাংলা বংশোদ্ভূত মুসলিম 4.86 লাখ

 গোর্খা 85,000

অসমীয়া হিন্দু 60,000

কোচ রাজবংশী 58,000

গরিয়া মরিয়া দেশি 35,000 

বোরো 20,000

করবি 9,000

রাভা 8,000

হাজং 8,000

মিসিং 7,000

অহম 3,000

গারো 2,500

মাতাক 1,500

ডিমাসা 1,100

সোনোয়াল কাছারি 1,000

মারান 900

বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী 200

নাগা 125

হামার 75

কুকি 85

থাডো 50

বাইট 85

ভারতের নাগরিক তারাই যারা 1971 এর আগের দলিল ও ঠাকুর্দার ভোটার লিস্টে নাম দেখাতে পারবে। মোট দশটা প্রমাণপত্র। 76 এর বন্যায় অনেক মানুষের অনেক কাগজপত্রই নষ্ট হয়ে গেছে তারা পারবেন তো কাগজ দেখাতে? ওপার বাংলায় মুসলিম দের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন সেই FIR কপিও দেখাতে হবে। যারা এসে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন সেই সংখ্যা কত? 31 হাজার 313 জন। আর সারা ভারত জুড়ে কতজন বিদেশি নাগরিকত্ব পাবেন 31 হাজার সেই 313 জন। কি মজা না।

NRC আতঙ্ক গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে পড়ছে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চিত্রটা ভয়াবহ:

এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে NRC শহীদ ২২জন!

তথ্যসূত্র-  1- উইকিপিডিয়া ( এন আর সি)

          2- বিভিন্ন সময়ের এই সময় পত্রিকা।

          3- আ বা প - 1/9/19

          4-https://www.sabrangindia.in/article/over-7-lakh-hindus-among-those-excluded-nrc-leaked-data-suggests 

সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে -ঈশান দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:879 | likes:1 | share: 1 | comments:0

ভারতবর্ষের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকর সংবিধান কিন্তু একা

লেখেননি। সর্বপ্রথমে উনি বেশ কয়েকটি দেশবিদেশের সংবিধান গ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালো করে পড়ে তারপরে সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ২৯৯ জনের মিলিত মতামতে জন্ম সংবিধানের। 


সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। ১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। প্রসঙ্গত জানাই, এই সংশোধনীর ফলে রাজ্যগুলি নিজেরাই নিজস্ব ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা প্রস্তুত করবে এবং তার জন্য ন্যাশনাল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের অনুমতি লাগবে না। এর জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৪২-এ এবং ৩৪২ এ (৩) ধারা সংশোধন করা হয়েছে। 


সংবিধানের শুরুতে সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' বা 'Secular' শব্দটি ছিল না। মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রপতির ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া দিয়েছে (সংবিধানের ১৪-৩৫ নং ধারা)। যেমন - (১) সাম্যের অধিকার (২) স্বাধীনতার অধিকার (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার, (৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, এবং (৬) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। 


ধর্মনিরপেক্ষতা' বা 'Secularism' শব্দটা নিয়ে আমজনতার মধ্যেই রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে তথ্যবিকৃতিও করা হয়েছে বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। 'Secularism' এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে কোনও রূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোনও অথবা কারোর পক্ষেই নয় থাকা নয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে মোটেই সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ 'রাষ্ট্র' ('রাষ্ট্র' অর্থে এখানে একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, সাংসদ বিধায়ক, সরকারি আমলা থেকে পাড়ার কাউন্সিলর ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে) কোনও  ধর্মের পক্ষেই থাকবে না, সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। ঠিক যেমনটা একজন রেফারী ইষ্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের মধ্যে ফুটবল খেলায় অথবা ভারত বনাম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় আম্পেয়ার নিরপেক্ষ থেকে খেলা পরিচালনা করেন। 


নির্বাচনে দাঁড়ানো ডান-বাম-ওপর-নীচ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো উক্ত প্রস্তাবনাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকারে "The Representation of the People Act 1951" (Amendment 1989) এর 29(A) ধারায় দায়বদ্ধ। অবশ্য, কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" এর অবস্থা হতে পারে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক। আইনের প্রয়োগ এবং সদিচ্ছার অভাবে ভারতে গোদীলোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার করে, তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছে অনেক আগেই।


এইখানে একটি বিশেষ খবর জানিয়ে রাখা উচিত হবে যে, গত ৩ রা জানুয়ারি ২০১৭ তে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও ভোটের প্রচার করা যাবে না। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। এখন প্রশ্ন এটাই, শীর্ষ আদালতের এই রায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ম- জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাইলে প্রার্থী পদ বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বড়জোর আদালতে যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হলে আইন করে কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে ভয় পায় সব দলই। কারণ ধর্ম, জাতপাতের অঙ্ককে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রর ঝাঁঝালো বক্তব্য রেখেই কিন্ত ২০১৩ সালে একটি রাজনৈতিক দল ভারতে কেন্দ্র সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল।


ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় আমজনতার ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি রয়েছে, যা আবেগের নয় বরং যুক্তিপূর্ণ আলোচনার বিষয়। ভারতীয় সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা, কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। অন্যদিকে, ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের কথাও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, প্রতি ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"।


ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় অধিকার বা ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমজনতার মধ্যে রয়ে গেছে নানানরকম বিভ্রান্তি। অন্যদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের উচিৎ খুব ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় সংবিধান এবং ভারতীয় আইনের বইপত্র ভালো করে পড়ে দেখা। আমাদের সংবিধানে এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো পরস্পরবিরোধী যার সংশোধনের প্রয়োজন আবশ্যক। আবার এমনও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


যেমন -১) সংবিধানে বর্ণিত একটি Secular, Democratic, Republic Country ভারতে লাগু রয়েছে শরীয়া আইন (The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act,1937)। ভারতে এটি শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয়গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


২) ব্লাসফেমি অ্যাক্ট। কোনও বিশেষ ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে 'ব্লাসফেমি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের 'Commission on International Religious Freedom' এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১ টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনও  কোনও  ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 


বহু কিছুর মধ্যে একটা মর্মান্তিক শোনা যাক। সম্ভবত আগষ্ট ২০২১ এর ঘটনা, ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে আটক একটি হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী পরিবারের ৮ বছরের ছেলে মৃত্যদন্ডে দণ্ডিত। যে বয়সের শিশুরা জানেই না ধর্ম নামক জিনিসটা খায়, নাকি মাথায় মাখে? সেই বয়সের একটি শিশু কীভাবে ধর্ম অবমাননা করতে পারে? সে কীভাবেই বা অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে? 


দন্ডবিধি ১৮৬০, অনুচ্ছেদ ১৫র ২৯৫ ধারা থেকে ২৯৮ ধারা (IPC-295-298) পর্যন্ত সংশোধন করা প্রয়োজন এবং এর মধ্যে ২৯৫-ক (IPC-295A) ধারাটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা খুবই প্রয়োজন। সংবিধান প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী এই আইন। আলোচনা, সমালোচনা, মতপ্রকাশ এবং উস্কানি, বিদ্বেষ, ঘৃণাবাদ এক নয় অন্যদিকে, দন্ডবিধি-১৮৬০ এর পঞ্চদশ অধ্যায়ের ২৯৫-ক ধারাটিতে আলোচনা, সমালোচনা, বাক্ স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে।


৩) ভারতীয় সংবিধানের ২৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.' অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনওরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবে না। আবার, ২৮ (২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ববিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন।

হিজাব, একটি বিতর্ক এবং.. -অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:881 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর প্রথম সপ্তাহ থেকে হিজাব নিয়ে বিতর্কে সরগরম কর্ণাটক। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য সপ্তাহ খানেক আগে। কর্ণাটক রাজ্যের উদুপি জেলায় একটি সরকারি কলেজে ছয়জন ছাত্রীকে হিজাব পরে ক্লাস করতে বাধা দেওয়ায় শুরু হয় বিতর্ক। সেই ঘটনায় আদালতের দ্বারস্থ হন একজন ছাত্রী। পরে বিতর্কের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে আরও কয়েকটি কলেজে। অন্যদিকে গত ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ (বৃহস্পতিবার) ওই জেলার সৈকত-শহর কুন্দাপুরের একটি কলেজে হিজাব পরে আসা কয়েক জন জন ছাত্রীকে ক্লাস করতে বাধা দেওয়া হয়। ছয় ঘণ্টা ক্লাসের  বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা। শুক্রবারও একই ভাবে তাঁদের ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে চারটে ঘটনার ভিডিও। একটিতে দেখা গেছে, শ’খানেক ছাত্র গেরুয়া শাল পরে একজন বোরখা পরিহিত মুসলিম তরুণীকে "জয় শ্রীরাম" স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে এবং সেই তরুণীটি পাল্টা "আল্লাহ্‌ আকবর" স্লোগান দিচ্ছে। দ্বিতীয় ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে কর্নাটকের একটি স্কুলে গেরুয়া পতাকা উত্তলন করছে রামের নামে স্লোগান দেওয়া একজন তরুণ। তৃতীয় ভিডিওতে, একটি বন্ধ ক্লাসরুমের বাইরে বেশকয়েকজন উত্তেজিত যুবকেদের "জয় শ্রীরাম" স্লোগান ও দরজা খুলে দিলে তাদের হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ। চতুর্থ ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তা দিয়ে যাওয়া কয়েকজন বোরখা পরিহিত তরুণীদের উদ্দ্যেশ্যে একদল যুবকেরা জল ছুঁড়ে দিচ্ছে। 


এইমূহুর্তে অন্য কিছু আলোচনা কোথায় যেন হাওয়া। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, মাছবিক্রেতা মন্ডলদা থেকে বাড়ির পরিচারিকা মুন্নির এখন একটাই প্রধান ইস্যু -"হিজাব"। ওদিকে, সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকা এবং আতঙ্কে রাখা মিডিয়াতেও করোনাতঙ্ক ভ্যানিশ হয়ে হিজাব বিতর্কটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। শুরুতে যে ঘটনাটা উল্লেখ করেছি সেটা খুবই সাধারণ একটা ব্যপার, হটাৎই স্মরণে এলো বলেই লিখলাম। কিন্তু কোথাও যেন এই হিজাব বিতর্কের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। আমি কি পোশাক পরবো, কি বই পড়বো, কোথায় ঘুরবো, কি খাবো কিংবা কি দেখবো অথবা শুনবো সেটা সম্পূর্ণ আমার অথবা একজন ব্যক্তিনির্ভর ব্যপার। এতে কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারেনা অথবা জোর করে কিছু চাপিয়েও দিতে পারেনা। 


ইসলামধর্মাবলম্বী পরিবারের কোনো মহিলা যদি স্ব-ইচ্ছায় হিজাব কিংবা বোরখা পরিধান করতে চান তাহলে ব্যপারটা আলাদা কিন্তু কোনো মহিলাকে জোর করে উক্ত জিনিস দুটো পরিধান করানো কিন্তু অবশ্যই নিন্দনীয়। তাছাড়া একটা বাস্তব সত্যি হচ্ছে, বোরখা কিংবা হিজাব মধ্যযুগীয় কু-প্রথা এবং অবশ্যই কট্টর পুরুষতান্ত্রিক। আমার পরিচিত একজন দিদি সোশ্যাল মিডিয়াতে ঠিক এমনই কিছু লিখেছিলেন সম্প্রতি। দেখলাম, সেখানে একজন বাংলাদেশের মুমিন ব্যক্তি কমেন্টে লিখেছে - " ও হিন্দুম্যাডাম, এসব ডায়লগ নিজের বাড়িতে বসে ঝাড়ুন গে। আপনি বিকিনি পরে কিংবা উলঙ্গিনী হয়ে ঘুরতে ভালোবাসতে পারেন, তবে আমাদের ইসলাম একে মান্যতা দেয়না। শুধু চোখ দুটি ছাড়া নারীকে পর্দানশীন রাখা ইসলামের অঙ্গ। তাই না জেনে উল্টোপাল্টা লিখবেন না। আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার আপনি কে হে? "।


প্রিয় বন্ধুরা, লক্ষ্য করুন এই ব্যক্তির বক্তব্য যা অনেককিছুই স্পষ্ট করে দিচ্ছে। যারা নারীকে সম্মান জানতে পারেনা, যাদের কাছে একজন নারী শুধুমাত্র "মানুষ" না হয়ে, ভোগের সামগ্রী হয়ে ওঠে, যারা নারীকে শিক্ষার আলো থেকে শতহস্ত দূরে রেখে নিজেদের বানানো আইনে শৃঙখলাবৃত করে রাখতে পছন্দ করে তারা চাইবেই নারীকে সারাজীবন পর্দানশীন রাখতে। এইসব নারীলোভীদের এই প্রশ্নটা করলেই দেখবেন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে যে, "তাহলে কি এটাই মেনে নেবো যারা নারীকে পর্দানশিন রাখতে একপ্রকার ফতোয়া জারি করেছে তারা প্রত্যকেই ছিল নারীভোগী। তাই অন্য পুরুষের কু-নজর থেকে বাঁচতে এমন বিধান লিখেছিলেন?" মজাটা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির যুক্তি মানলে এটাই দাঁড়ায় পৃথিবীর সকল পুরষেরাই যেহেতু নারীলোভী তাই নারী নিজেকে সর্বদা পর্দানশিন রাখবে নিজেকে। সত্যি, হাস্যকর (কু)যুক্তি। এমন অদ্ভুত নিয়মকানুনের ফতোয়া যে ধর্ম দেয়, তাকে কি সহিষ্ণু, মানবিক বলা চলে? প্রত্যেক দেশেই রয়েছে নানানরকম ধর্মীয় নিয়মের বাঁধন তাই অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারছি যে, দেশে প্রতি দিন ৯১ টি ধর্ষণ ঘটনা ঘটে ( সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০২০, পৃ.৬)। কিছু অতিবোদ্ধারা ধর্ষণের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে দোষারোপ করে, বিশেষ করে তার সাজপোশাক কে। কিন্তু এইসব অতিবোদ্ধাদের কেউ এটা অবশ্যই জানিয়ে আসবেন যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে শুধু এবং শুধুমাত্র বিকৃত মানসিকতা, যৌন বিকার ইত্যাদি প্রধান দায়ী, সাজপোশাক নয়। এই মানসিক বিকারগ্রস্তদের কারনেই আসিফা, নির্ভয়া, পুতুল, হাথরস, উন্নাও, বিন্দুদের মতন ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে আকছার। সরকারের অপদার্থতায় এবং রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থের জোরে ধর্ষকদের মতন জঘন্যতম অপরাধীরা আইনকে পকেটে পুরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। জনগণের দেওয়া করের টাকায় এইসব অপরাধীদের জেলে বসিয়ে চারবেলা খাওয়ানোর কি প্রয়োজন জানা নেই। এদের জন্য একটাই শাস্তি - To be hang till death. (এখানে অনেকেই হয়তো বলতে পারেন ফাঁসি কেন? তাদের বলবো সভ্য দেশে ফাঁসি হয়না। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন ৯১ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেই দেশটাকে সভ্য দেশ কিভাবে বলবো?) 


যাইহোক মূল আলোচনা অর্থাৎ হিজাব নিয়ে যে বিতর্ক সেখানে ফেরা যাক। তার আগে একটি বিশেষ খবরের দিকে পাঠক বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। ঘটনাটি মার্চ ২০১৮ সালের। মহারাষ্ট্রর থানে জেলার ‘সাঁই হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ'এর একজন শিক্ষার্থীকে হিজাব পরবার অনুমতি দিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দেয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। 

তার পিটিশনে বলা হয়, তাকে হিজাব পরে তার কলেজে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হোক অথবা অন্য কোনো কলেজে তাকে স্থানান্তর করার অনুমতি দেওয়া হোক যেখানে কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুশীলন করতে পারেন।

এছাড়াও কারো ধর্ম বিশ্বাসের ওপর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে না পারে, সেজন্যও জন্য পিটিশনে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। 


সেই শিক্ষার্থীর আইনজীবী মিহির দেসাই জানিয়েছিলেন, হিজাব পরে লেকচারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি না দেয়ার কারণে তার মক্কেল ঠিকমত কলেজে উপস্থিত হতে পারেন নি। কলেজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দিন উপস্থিতি না থাকার কারণে তাকে গত বছরের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। মেডিকেল কলেজের ওই শিক্ষার্থী আদালতকে আরও জানায় যে, তিনি যখন কলেজে ভর্তি হন, তখন তিনি বোরখা ও পরতেন না। ওই সময় এই নিষেধাজ্ঞা কেবল বোরখাতেই ছিল।


বিচারপতি আর এম সাভান্ট ও সারাঙ্গ কোতওয়ালের একটি বেঞ্চে এই রিট আবেদনের শুনানি হয়।

আবেদনকারী তার আবেদনে বলেন, তিনি কেবল হিজাব এবং একটি লম্বা গাউন পরতে চান এবং অন্য ছাত্রীদের মতোই এর উপরে অ্যার্পন পরতে ইচ্ছুক। সব পক্ষের বক্তব্য শুনানির পরে আদালত শিক্ষার্থীদেরকে হিজাব এবং গাউন পরার অনুমতি দিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন। কলেজ থেকে স্থানান্তরের জন্য প্রার্থনার প্রয়োজন নেই সেটাও জানিয়ে আদালত পিটিশনটির নিষ্পত্তি করেন। 


তাহলে এখন এটা স্পষ্ট, এই হিজাব বিতর্ক আজকের নতুন কিছু নয়। বহুবছর ধরেই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থেকে গেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের একশ্রেণীর ব্যক্তিদের দাবী- "এটা আমাদের ইসলামে স্বীকৃত ব্যপার। আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা কি পোশাক পরে বাইরে বেরুবে সেটা নিয়ে যেচে কেউ যেন জ্ঞান না দেয় অথবা অন্যকেউ যেন এতে নিজেদের নাক না গলায়। আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত যেন না লাগে এটা সকলের দেখা বিশেষ প্রয়োজন "। 


সত্যিই, ধার্মীকরা বড়ই মিষ্টি। "আমার ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর সবেচেয়ে সুন্দর, মানবিক, সহিষ্ণু, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম" ইত্যাদি বলে প্রচার করলেও যখনই তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তখনই নিজদের ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা কুৎসিত মুখটা বের করে এনে উগ্রধর্মান্ধতার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে সেটা প্রকাশ করে ফেলে এরা (বহুর মধ্যে উদাহরণ, বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তমনা ব্লগার দের নৃশংশভাবে হত্যাকান্ড)। তখন, শান্তি-সম্প্রীতি, সহিষ্ণু মানবিক ইত্যাদি কথাগুলো কেমন যেন জেলো হয়ে যায়। এই ব্যপারটা পৃথিবীর প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের (Religion) অনুসারী ধার্মিকদের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য।


আজ এটা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট, একটি পুরোনো বিতর্কিত বিষয়কে ইচ্ছেকরেই প্রচারে আনা হচ্ছে এবং একটি রাজনৈতিক দল ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে বিষয়টাকে খুঁচিয়ে বের করে এনে বিতর্কের আগুন পোহাচ্ছে। আরেকটি কথা, যেসকল তরুণেরা গলায় গেরুয়া গামছা পরে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছে তাদের উস্কানিও এরাই দিচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। এইসব তরুণ যুবকরা "ধর্ম" নামক আফিমে এতোটাই আচ্ছন্ন যে, এরা জানেও না কোন মারণ ফাঁদের দিকে এরা নিজেদের পা বাড়াচ্ছে। নিজেদের রাজনীতির স্বার্থেই যারা এদেরকে ব্যবহার করছে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এইসব যুবকেরাও শেষ। এদের কি মনে হয় সরকার ওদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং তারপরে একটা ভালো স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করবে? তাহলে অনুরোধ, টিভিতে পোগো চ্যানেল এদের জন্য আদর্শ। (তবে "জয় শ্রীরাম" স্লোগানের সেইসব যুবকদের যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার  সেইসব হিন্দুবীর যুবমোর্চাকে গৈরিক শুভেচ্ছা জানাই। জনগণের পরিহিত কোনো পোশাক কিংবা যে কোনো চিহ্ন যেটা কোনো ধর্মীয় ইঙ্গিত বহন করে, সেটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। ওমুক যায়গায় তমুক লেখা রয়েছে তাই চলবে কিংবা দীর্ঘবছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে বলেই চলতে দেওয়া হবে এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারনা। সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে জিজ্ঞাস্য, চুরিবিদ্যাটা যুগযুগ ধরে চলে আসছে কিংবা ধর্ষণের মতন চরমতম অপরাধ যুগে যুগে ঘটে চলেছে বলে কি আপনি আজও এসব মেনে নেবেন? তবে আশা রাখবো, কোনো মহিলার হিজাব ব্যান করার আন্দোলনে নামার আগে নিজের কাঁধের গেরুয়া গামছা থেকে শুরু করে নিজের মা,বোন, দিদি, স্ত্রীর শাঁখা, সিঁদুর, ঘোমটা আর ব্রাহ্মণদের পৈতে, টিকি, তিলক অবশ্যই বাতিল করে তারপর যেন মুসলিম মহিলাদের হিজাব বাতিলের জন্য নামবে এই তরুণ শক্তিতে পরিপূর্ণ হিন্দুবীর যুবমোর্চা বাহিনী।)


বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বচ্চ বেকারত্ব কিন্তু একজন মন্ত্রীমশাইয়ের রাজত্বে। "চাকরি দেওয়ার দায় সরকারের নয়।" সংসদে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি এমনই বুঝিয়ে দিয়েছেন সেই মন্ত্রীমশাই। এছাড়া উনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, "দেশে বেকারত্বও নেই, মূল্যবৃদ্ধিও নেই।" ২০১৪ সালে যিনি বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি চাকরি দেওয়া হবে, সেই মন্ত্রীমশাই এটাও জানিয়ে দিয়েছেন - "কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের উপর ভরসা করে থাকার দিন শেষ হয়েছে। সবকিছু সরকার করে দেবে এই ভাবনা আর চলবে না। আগে মনে করা হতো, সরকারই ভাগ্যবিধাতা, সেই জীবিকার সব দায়িত্ব নেবে। কিন্তু এই ভাবনা ভুল। যুবসমাজ নিজে নিজেকেই গড়বে।" 


অন্যদিকে, দিনকয়েক আগে কেন্দ্রীয় বাজেট (Union Budget 2022) পেশ করতে গিয়ে ভারতের মাননীয়া অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন- "আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হবে।" অর্থাৎ প্রতি মিনিটে কি ২.২৮ জনের চাকরি? আরেকটি কথা, এই কেন্দ্রীয় বাজেটে বড়বড় শিল্পপতিদের ট্যাক্স ১৮% থেকে কমিয়ে ১৫% করা হলেও সাধারণ মানুষের ট্যাক্স একটাকাও কমানো হয়নি। 


১০ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে কর্ণাটক হাইকোর্ট অন্তবর্তী রায়ে জানিয়েছিল- " শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ধর্মীয় পোশাক নয়"। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছে সেইসকল তরুণীরা যারা দাবী জানাচ্ছে "হিজাব আমাদের সাংবিধানিক অধিকার "। 


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হিজাব পরার কী সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে? ভারতীয় সংবিধানে কিন্তু সরাসরি ভাবে হিজাব পরার কোনো উল্লেখ নেই,  আর্টিকেল ২৫ (১)- এ সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে “Freedom of conscience and the right to freely profess, practise, and propagate religion.” সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নিদান দিয়েছেন যে অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচরণ পালনে বাধা দেয়া যাবে না। ভারতীয় সংবিধানের ধারা-২৫ এর প্যারা নং ২ বেশ অন্যরকম। অবশ্য এগুলো যুক্তিবিদ্যার বিষয়। আবেগের নয়। কারন, আবেগ যুক্তির প্রধান শত্রু। অন্যদিকে সংবিধানে ১৫৩এ, ২৯৫,২৯৫এ ইত্যাদি ধারাগুলোও আছে। আসলে ভারতের সংবিধানে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা বিতর্কিত আবার এমনও অনেক কিছু রয়েছে যা যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন -  (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, (৫) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার এবং 

(৬) ধর্মীয় অধিকার। এই বিষয়ে সামান্য আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। 


পৃথিবীতে ৫৬ টি ইসলামিক রাষ্ট্রে হিজাব বা বোরখা পরিধান বাধ্যতামূলক। এরমধ্যে, আফগানিস্তান, ইরান, মৌরিতানিয়া, ব্রুনেই, মালদ্বীপ, সৌদি আরব অন্যতম। শরিয়া আইনে চলা রাষ্ট্রে একজন অমুসলিম মহিলাকেও পাবলিক প্লেসে মাথায় কাপড় দিতেই হয়। নয়তো শরিয়া আইন লংঘনের অভিযোগে শাস্তি দেয়া হয়। বিশেষ করে ইরানে বিষয়টি গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। 


অপরদিকে পৃথিবীর বেশকিছু ইসলামিক রাষ্ট্রে মুসলিম এবং অমুসলিম দেশে বোরখা বা হিজাব নিষিদ্ধ। যেমন, তাজিকিস্তান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া (এই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বা Secular সরকার হিজাবকে Fundamentalism আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। তাদের যুক্তি, Hijab is the tool of Political Islam and Oppression Against Women), কসোভো,আজারবাইজান, মিশর (এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকাব পড়া নিষিদ্ধ। ক্লাস চলাকালীন পুরো মুখ ঢেকে রাখা যাবে না। ২০১৫ সাল থেকে এই আইন বহাল আছে), তুর্কি (মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাবলিক প্লেসে যেকোনো ধরনের ধর্মীয় পোশাক পড়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। তা প্রায় ৮০ বছর বহাল ছিলো কিন্তু ২০১৩ সালে এরদোয়ান সেই আইনে পরিবর্তন এনেছেন), কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়াসহ আরো বেশ কিছু মুসলিম দেশে হিজাব বা বোরকার প্রতি বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া, অমুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, সুইজারল্যান্ড, গ্যাবন,চাদ, কঙ্গো,নেদারল্যান্ডস, চীন, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশ হিজাব বা বোরখা নিষিদ্ধ করেছে,


আসলে, কিছু দেশ পাবলিক প্লেসে হিজাব পড়লে শাস্তি দেয়। আবার কিছু দেশ পাবলিক প্লেসে হিজাব না পড়লে শাস্তি দেয়। ফলে এটি এখনও অত্যন্ত অদ্ভুত এবং বিতর্কিত। 


এই প্রশ্নটা এখন বেশি উঠে আসছে যে, সংবিধান বর্ণিত  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে কী হিজাব নিষিদ্ধ হবে? আসলে উত্তরটি জটিল। তবে দেখাযাচ্ছে ভারতে নির্বাচনী হাওয়া এলে এইরকম একটু আধটুক উস্কানি দেখতে হতে পারে। ঠিক যেমন ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই পুলওয়ামার নৃশংশ হত্যাকান্ড। এই কান্ডে আমরা দেখলাম অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। একদল উগ্রদেশপ্রেমীরা একপ্রকার মেরে ধরে আমাদের দেশপ্রেম শেখাতে নেমেছিল। যে অথবা যারাই এই হত্যাকান্ড নিয়ে বেশকয়েকটি প্রশ্ন তুলেছিলেন তারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন এই স্বঘোষিত দেশপ্রেমী দলের হাতে। ফিরি হিজাব প্রসঙ্গে, ভারতের কেন্দ্রশাসিত সরকার রাজ্য সরকারকে কোনো আইন মানতে বাধ্য করাতে পারে না। তাই একেক রাজ্য একেক পদ্ধতিতে হয় হিজাব বাতিল করবে নয়তো হিজাব পড়ার অনুমতি দিবে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিমকোর্ট।


যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী- "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং সমস্তরকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানবিহীন, সেখানে বিভিন্ন ধর্মগুরুদের জীবনীপাঠও বন্ধ হোক। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্জন করুক, বৃদ্ধি পাক তাদের জ্ঞানের উন্মেষ, তারা হয়ে উঠুক মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানবতাবাদী"। তাই শিক্ষাপ্রাঙ্গনে হিজাবই হোক কিংবা গেরুয়া গামছা দুটোই পরিধান বন্ধ হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অগ্রাসনের এই রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন। শিক্ষাপ্রাঙ্গনে জয় শ্রীরাম কিংবা আল্লাহ্‌ আকবর দুটো স্লোগানেরই বিরোধীতা করুন। 

হিজাব /বোরখা আমার চয়েস বলে অনেকেই গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে ওগুলোর কোনটাই কারোর 'চয়েস' নয়। ওগুলো ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন / রীতিনীতি। আমি, সমস্ত প্রতিষ্ঠানিকধর্ম (Religion) মুক্ত একটা সুন্দর শিক্ষাঙ্গন চাই। সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত। আর ধর্ম! সেটা না হয় থাকুক ব্যক্তিগত পরিসরে।


পরিশেষে বলতে চাই, একটা শিশু, সে যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাসী পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সেই শিশুটি জানেই না তার ধর্মবিশ্বাস কি। শিশুটি জানেই না কেন বহুসংখ্যক হিন্দু-মুসলিম দের মধ্যে কেন একটা ঠান্ডা গরম লড়াই চলছে কিংবা ভারত পাকিস্তান কেন ভাগ হলো ইত্যাদি। শিশুটি শুধুই জানে প্রাণখুলে আনন্দ করতে, খেলতে। শিশুর মন একটা মাটির তালের ন্যায়। আমি, আপনি সেই তাল কে যেভাবে গড়তে চাইবো সেভাবেই গড়ে উঠবে। তাই অনুরোধ, ধর্মান্ধ মস্তিষ্কে যুক্তির সন্ত্রাস গড়তে চাইলে, আপনার শিশুটিকে প্রাণখুলে আনন্দ করতে দিন। ওকে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করুন। কোনোরকম ধর্মীয় নিয়মকানুন ইত্যাদি ওর মননে গেঁথে দেবেন না। শিশুটি বড় হলে ওকেই এটা সিদ্ধান্ত নিতে দিন সে, সরকারি কিংবা বে-সরকারি ফর্মের Religion কলামে Hinduism, Islam, Christian, Buddhist, Jainism, Sikhism ইত্যাদি যে ৪২০০ ধরনের Religion রয়েছে তার মধ্যে আদৌ কোনটা বেছে নিতে ইচ্ছুক, নাকি অনেকের মতন জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করে Religion কলামে HUMANISM / ATHEISM / NON RELIGIOUS ইত্যাদি কিছু লিখতে চায়। সমস্ত অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, শৈশবে শিশুদের মননে ছ্যুত অছ্যুৎ, জাতপাত, ধর্মীয় নিয়মকানুন, বিদ্বেষ ইত্যাদি ঢুকিয়ে উগ্রধর্মান্ধ তৈরী হওয়ার দিকে ঠেলে দেবেন না। 


আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, ভারতের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকদের জন্য আশু কর্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে, "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform {Article 51A(h)Part iv A}" অর্থাৎ, বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। 


অতিরিক্ত সংযোজন : আজ ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২। গতকাল ছিল প্রেমের দিন। ভালোবাসার দিনেও হিজাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। হিজাব সংক্রান্ত 'এক্সক্লুসিভ খবর' নিয়ে খবরেরকাগজ গুলো লক্ষকোটি প্রিন্ট খরচ করতে যেমন ব্যস্ত, তেমনই অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। বহুর মধ্যে মাত্র ৬ টি খবর (বলতে পারেন টপ সিক্স) প্রিয় পাঠক বন্ধুদের জন্য তুলে ধরলাম। 


খবর ১) হিজাব ছোঁয়ার চেষ্টা করলে হাত কেটে ফেলব, এসপি নেত্রীর মন্তব্যে বিতর্ক তুঙ্গে। ১২/০২/২০২২। আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন পোর্টাল।


উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের মধ্যে হিজাব নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলেন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী রুবিনা খানম। অখিলেশের দলের নেত্রীর দাবি, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ মেয়েদের ঘোমটা এবং হিজাব। কিন্তু তা নিয়ে যে ভাবে রাজনৈতিকীকরণ করা হচ্ছে, তা ঘৃণ্য। এর পরই এসপি নেত্রীর হুঙ্কার, ‘‘যে হাত হিজাব ছোঁয়ার চেষ্টা করবে, সে হাত কেটে ফেলা হবে।’’

খবর ২) ‘শরিয়ত নয়, সংবিধান অনুযায়ী চলবে ভারত”, হিজাব বিতর্ক নিয়ে মুখ খুললেন যোগী আদিত্যনাথ।

১২/০২/২০২। বাংলা Hunt অনলাইন পোর্টাল।


কর্ণাটকে হিজাব বিতর্কের আলোচনা পুরোদমে। এদিকে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হিজাব বিতর্কে বলেছেন যে, দেশ শরিয়ত নয়, সংবিধান দিয়ে চলবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, দেশের ব্যবস্থা চলবে সংবিধান দিয়ে, শরিয়ত দিয়ে নয়। প্রতিটি সংস্থার নিজস্ব ড্রেস কোড প্রণয়নের অধিকার রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা চলবে।


খবর ৩) হিজাব বিতর্কের আগুন এবার পশ্চিমবঙ্গে, মুর্শিদাবাদে তালাবন্দি শিক্ষকরা। ১২/০২/২০২২। বাংলা Hunt অনলাইন পোর্টাল।


হিজাব বিতর্কের গনগনে আগুনে পুড়ছে গোটা দেশ। এবার সেই উত্তাপের আঁচ এসে লাগল বাংলাতেও। স্কুল ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখালেন অভিভাবকরা। আটকে রাখা হল শিক্ষকদেরও। কর্ণাটকের হিজাব বিতর্কের উত্তাপে কার্যতই অগ্নিগর্ভ মুর্শিদাবাদের সুতি।অভিযোগ, ছাত্রীদের স্কুলে কালো ওড়না পরে আসতে নিষেধ করেন সুতির বহুতালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই ঘটনা জানাজানি হতেই স্কুলে পৌঁছন পড়ুয়াদের অভিভাবকরা। কথা বলতে চাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। কিন্তু ততক্ষণে দাবানলের মতন বাড়তে শুরু করেছে উত্তেজনা। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পরে কয়েক মুহুর্তেই। স্কুল চত্ত্বরে এসে জড়ো হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকদের তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয় একটি ঘরে। চলে অবস্থান এবং বিক্ষোভও। ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। শেষ অবধি বহুক্ষণের চেষ্টায় উদ্ধার করা হয় আটক শিক্ষকদের।


খবর ৪) ‘হিজাব পরা মহিলাই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন’, চ্যালেঞ্জ ওয়েইসির।

১৩/০২/২০২২। সংবাদ প্রতিদিন অনলাইন পোর্টাল।  


হিজাব বিতর্কে (Hijab Row) নয়া মাত্রা যোগ করলেন AIMIM প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি। তাঁর কথায়, ভবিষ্যতে হিজাব পরিহিতা মহিলাই হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এহেন মন্তব্য ঘিরেই নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের হিজাব পরা উচিত নাকি অনুচিত, সেই বিতর্কের জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। এর মাঝেই উত্তরপ্রদেশের ভোটপ্রচারে হিজাব বিতর্ক টেনে আনলেন ওয়েইসি (AIMIM chief Asaduddin Owaisi)। এই ইস্যুতে বিজেপিকে তুলোধোনার পাশাপাশি মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়েও মুখ খুললেন তিনি।


খবর ৫) হিজাব না পরার জন্যই ভারতে ধর্ষণ সবচেয়ে বেশি, কংগ্রেস বিধায়কের মন্তব্যে বিতর্কের ঝড়।

১৪/০২/২০২২। সংবাদ প্রতিদিন অনলাইন পোর্টাল। 


কর্ণাটকের হিজাব বিতর্কে (Hijab Row) পক্ষে-বিপক্ষে উত্তপ্ত বাক্যবাণ অব্যাহত। গতকাল AIMIM প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি (Asaduddin Owaisi) বলেন, হিজাব পরা মহিলাই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আজ কর্নাটকের কংগ্রেস (Congress) বিধায়ক জমির আহমেদ (Zameer Ahmed) বিতর্ক আরও বাড়ালেন। বললেন, মহিলারা হিজাব পরেন না বলেই ভারতে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি। কংগ্রেসের বিধায়কের মন্তব্যে নিন্দার ঝড় উঠেছে নেট দুনিয়ায়।

রবিবার সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জমির আহমেদ বলেন,” ইসলাম ধর্মে হিজাব হল এক ধরনের পর্দা। একটা বয়সের পর মেয়েদের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখতে হিজাব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আজ ভারতে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। এর কারণ কী? এই জন্যই যেহেতু অনেক মহিলাই হিজাব পরেন না।” জমির আরও বলেন, হিজাব কখনই বাধ্যতামূলক নয়, তবে যাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চান, নিজের সৌন্দর্যকে সকলের সামনে প্রকাশ করতে চান না, তাঁরাই হিজাব পরেন। জমির দাবি করেন, “হিজাব পরার ব্যাপারটা নতুন না, বহুকাল ধরে এই রীতি প্রচলিত।”

খবর ৬) মেয়েটার নাম আরুশা পারভেজ (Aroosa Parvaiz) সমগ্র কাশ্মীরে ক্লাস ১২ এ প্রথম স্থানাধিকারী। সে ৪৯৯ নং পেয়েছে ৫০০ এর মধ্যে।কিন্তু তাঁর এই বিশাল সাফল্য তাঁকে অপমান, কটুক্তি, হুমকি থেকে বাঁচাতে পারেনি। কারন, কট্টরপন্থীরা একপ্রকার মেয়েটির হত্যার ফতোয়া জারি করেছে। কারন, মেয়েটার মাথায় হিজাব নেই। এটাই তার মস্তবড় অপরাধ। 

অবশ্য এই প্রতিভাবান মেয়েটি ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকেনি। কট্টরপন্থীদের যোগ্য জবাব সে দিয়েছে। আরুশার জানিয়েছে -"I don't need to wear hijab to prove a good muslim.These comments do not matter to me, but my parents are undergoing a trauma.My religion, my hijab and my Allah are my personal issues. What I should wear or not should not bother people if they believe in the greatness of my religion." অর্থাৎ, আরুশা জানিয়েছে, সে হিজাব পরবে কি পরবে না সেটা একান্তই তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না।  

খাদ্যে ভেজাল: সচেতন হোন, প্রতিরোধ করুন -অর্ণব
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:879 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সর্ষের তেল থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাকসবজি, সবেতেই ভেজালের রমরমা। বস্তুত ভেজাল এক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, পাশ্চাত্য হোক বা প্রাচ্য, প্রথম বিশ্ব হোক বা তৃতীয় বিশ্ব, সর্বত্র তার বিচরণ। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে জনসচেতনতা কম সেখানে খাদ্যে ভেজাল ধরা ও আটকানো এক কঠিন কাজ। যদিও এ ব্যাপারে দেশে আইনকানুনের কমতি নেই। ভারতবর্ষে প্রাথমিকভাবে ১৯৫৪ সালের খাদ্যে ভেজাল নিরোধক আইন (Prevention of Food Adulteration Act, 1954) দিয়ে ভেজালের মোকাবিলা করা হয়। এই আইন অনুযায়ি কোনও  খাদ্যবস্তুতে ভেজাল আছে বলা যায় তখনই যখন-


খাদ্যবস্তুটি যে গুণমানের বলে দাবি করা হচ্ছে সেই গুণমানের না হয়। খাদ্যবস্তুটির কোনও উপাদান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়।

খাদ্যবস্তুটি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক কোনও পাত্রে রাখা থাকে। খাদ্যবস্তুটিতে নিজস্ব উপাদানের বদলে নিম্নমানের বা সস্তার উপাদান মেশানো থাকে। খাদ্যবস্তুটিতে কোনও বিষাক্ত উপাদান থাকে। খাদ্যে আংশিকভাবে বা পুরোপুরিভাবে কোনও নোংরা, পচা, রোগযুক্ত প্রাণীজ বা উদ্ভিজ্জ উপাদান থাকে। ফলে খাদ্যবস্তুটি খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। খাদ্যবস্তুটিতে অনুমোদিত নয় এমন রঙ মেশানো থাকে। খাদ্যবস্তুটির শুদ্ধতা নির্দিষ্ট মানের নীচে থাকে। খাদ্যবস্তুটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হয় বা রাখা হয়। যার ফলে সেটি থেকে রোগ সংক্রমণের সম্ভবনা থাকে ইত্যাদি।


কৃত্তিম খাদ্য রঙের রমরমা কারবার খাবারে রঙ মেশানোর প্রথা আজকের নয়। এই প্রথার শুরু হয়েছিল সেই ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময় থেকেই। তবে আগেরকার দিনে খাবারে শুধুই প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হত। ১৮৫৬ সালে প্রথম কৃত্রিম খাদ্য রঙ আবিষ্কৃত হয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সারা পৃথিবীতে খাদ্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে কৃত্তিম রঙের ব্যবহার শুরু করেন। এর উদ্দেশ্যে ছিল ক্রেতাদের মন জয় করা।


বাজারে বা দোকানে ক্রেতারা খোঁজেন লাল টকটকে টমেটো, ঝকঝকে সবুজ শাকসবজি, লাল দই, রঙীন মিষ্টি, চকচকে মুগ বা মুসুরির ডাল। এখানেই ক্রেতাদের অসচেতনতার সুযোগ নেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আর কৃত্রিম রঙ মেশানো খাবার খেয়ে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ।


সাধারণভাবে বাড়িতে তৈরি খাবারদাবারে যে সব রঙ ব্যবহার করা হয় সেগুলো হল নিরাপদ প্রাকৃতিক রঙ। সেগুলো নিয়ে অত চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। বাড়িতে মূলত মশলাপাতি দিয়ে খাবারে রঙ আনা হয়। যেমন হলুদ দিয়ে হলদে রঙ, লংকা দিয়ে লাল রঙ। মশলা বিশুদ্ধ হলে এতে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বরং উপকার আছে। তাই বাড়ির রান্নায় ব্যবহৃত মশলাপাতি বিশুদ্ধ কিনা, সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করে নিতে হবে।


বাড়িতে রান্নার সময় খাবারে রঙ আনার আরেকটা উদাহরণ দিই। মাংস রান্নার সময় অনেকে আগে তেলে কিছুটা চিনি ভেজে নেন। এই চিনিটাকে একটু লালচে করে ভেজে নেওয়া হয়। তাতে ঝোলের রঙটা দেখতে আকর্ষণীয় হয়। বাড়ির রান্নাবান্নায় কৃত্রিম রঙ দেওয়ার চল নেই বললেই চলে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজান্তে কৃত্রিম রঙের পরোক্ষ ব্যবহার হয়ে যেতেই পারে। যেমন, বাজার থেকে কিনে আনা তৈরি খাবার আজকাল আমরা অনেকেই দেদার খাই। সেগুলোতে প্রায়শই কৃত্রিম রঙ প্রচুর পরিমানে মেশানো থাকে। আবার বাজার থেকে কেনা কাঁচা শাকসবজি, মশলাপাতি এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুতেও কৃত্রিম রঙের ব্যবহার থাকতে পারে। সেগুলার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।


অনুমোদিত খাদ্য রঙ

আমাদের দেশে ১৯৫৪ সালে খাদ্যে ভেজাল নিরোধক আইন তৈরি হওয়ার পর থেকে সরকার খাদ্যে কয়েকটি রাসায়নিক রঙ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আইন অনুযায়ী খাবারের রঙ নিয়ে পরিষ্কার গাইড লাইনও দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রধান দুটো বিচার্য বিষয় হলো:

১) খাবারে যে কৃত্তিম রঙ মেশানো হচ্ছে সেটা অনুমোদিত খাদ্য রঙ কিনা এবং

২) অনুমোদিত রঙ হলে সেটা নির্ধারিত মাত্রায় মেশানো হচ্ছে কিনা


খাদ্যে ভেজাল নিরোধক আইন কতোটা রক্ষিত হচ্ছে সেটা দেখার দায়িত্ব মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রকের। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশন সবাই মিলেই এই ব্যাপারটা পরিদর্শন করে। এজন্য সরকারের নানান কমিটি আছে। দরকার মতো সেই সব কমিটি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রাসায়নিক পরীক্ষা করিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় খাবারে কোন রঙ কতোটা ব্যবহার করা ঠিক, আর কতোটা ঠিক নয়।


বর্তমানে আমাদের দেশে বেশ কিছু রাসায়নিক রঙকে খাবারে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া আছে। এগুলোর মধ্যে আছে লালের জন্য পনকিউ ফোর আর (Ponceau-4 R), কারমোসিন (Carmosine) এবং এরিথ্রোসিন (Erythrosine)। হলুদের জন্য টারট্রাজাইন (Tartrazine) ও সানসেট ইয়েলো (Sunset Yellow)। নীলের জন্য ইনডিগো কারমাইন (Indigo Carmine), ব্রিলিয়ান্ট ব্লু এফ.সি.এফ. (Brilliant Blue FCF)। এছাড়া আছে সবুজের জন্য ফাস্ট গ্রিন এফ.সি.এফ. (Fast Green FCF)।


চাই ক্রেতাদের সচেতনতা

আইন অনুযায়ী খাদ্য বিক্রেতাদের কেবল অনুমোদিত খাদ্য রঙ ব্যবহার করলেই চলবে না, সেটাও করতে হবে নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে। যেমন মনে করুন, আইসক্রিম, বিস্কুট, পেস্ট্রি, কোল্ড ড্রিংক্স, ইত্যাদিতে কৃত্তিম রঙ ব্যবহার করা যেতে পারে প্রতি ১০ গ্রামে সর্বোচ্চ ১ মিলি গ্রাম। আবার মনে করুন, ফ্রুট সিরাপ, স্কোয়াশ, জ্যাম ও জেলি জাতীয় খাবারে প্রতি ১০ গ্রামে সর্বোচ্চ ২ মিলিগ্রাম রঙ দেওয়া যেতে পারে। এই সব খাদ্যবস্তুতে অনুমোদিত মাত্রার থেকে বেশি রঙ মেশানো ভেজালেরই সমার্থক। এর ফলে খাবার থেকে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভবনা থাকে।


অনুমোদিত খাদ্য রঙের বাইরে অন্য যে কোনও রাসায়নিক রঙ খাবারে ব্যবহার করা শুধু আইনবিরুদ্ধই নয়, স্বাস্থ্যের পক্ষে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। ক্রেতাদের কর্তব্য হল বাজার থেকে খাবার কেনার সময় খাবারের প্যাকেটটা খুঁটিয়ে দেখা। সাধারণত প্যাকেটের লেবেলে ব্যবহৃত খাদ্য রঙ সম্পর্কে উল্লেখ করা থাকে। এটা নিয়মের মধ্যেই পড়ে।


এছাড়া মিষ্টির দোকানে বা হোটেল-রেস্তোঁরায় খেতে গিয়ে যদি কারো রঙের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক কিছু মনে হয়, দোকানদার বা পরিবেশকের কাছে তাদের খাবারে ব্যবহৃত রঙ সম্পর্কে জানতে চাওয়াটা ক্রেতার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। ১৯৮৬ সালের ক্রেতা সুরক্ষা আইনে ক্রেতাদের এই অধিকার দেওয়া হয়েছে।


এখানে আরও একটা কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সরকারী ভাবে অনুমোদিত কৃত্তিম খাদ্য রঙগুলোও কিন্তু রাসায়নিক খাদ্য রঙ। দীর্ঘদিন ধরে এধরনের রাসায়নিক রঙ মেশানো খাবার বেশি বেশি খেলে শারীরিক ক্ষতির সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সবচেয়ে ভালো হল, রাসায়নিক রঙ মেশানো খাবার যথাসম্ভব না খাওয়া, কেবলমাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যরঙ যুক্ত খাবারই গ্রহণ করা।


খাদ্যবস্তুতে বিষের বিপদ

সুগন্ধ আনতে কিংবা পচন রোধ করতে কিংবা উৎপাদন বাড়াতে বাজারি খাবারদাবারে প্রায়শই নানান বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়, যেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে রীতিমতো বিপজ্জনক। কয়েকটা উদাহরণ দিতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

➤জ্যাম, জেলি, মাখন, চিজ, ইত্যাদিতে জীবাণু বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য বহু ক্ষেত্রে বেঞ্জোয়েট জাতীয় যৌগ ব্যবহার করা হয়। এ থেকে মাথা ও বুক ব্যাথা এবং ঘাড়ের যন্ত্রণা হতে পারে।

➤পচন রোধের উদ্দেশ্যে অনেকসময় বাজারের কাঁচা মাংসে সোডিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়। এ থেকে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, এমনকি পাকস্থলীর ক্যান্সারও হতে পারে।

➤কাটা ফল ও সবজিকে দীর্ঘসময় তাজা দেখানোর জন্য অনেক সময় সালফেট ও সালফাইড জাতীয় যৌগ ব্যবহার করা হয়। এ থেকে অ্যালার্জি হতে পারে।

➤আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয়, স্কোয়াশ, চকোলেট, ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় খাবারে প্রায়শই স্যাকারিন ও অ্যাসপারটেম ব্যবহার করা হয়। এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে দারুণ ক্ষতিকারক।

➤বাজারে প্রতিদিন যে টন টন ছানা আসছে মিষ্টি তৈরির জন্য, বহু ক্ষেত্রেই তা সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে কাটানো দুধ থেকে তৈরি করা। এই অ্যাসিড দিয়ে কাটানো দুধের ছানা বেশি সময় টাইট থাকে। মিষ্টির মাধ্যমে সালফিউরিক অ্যাসিড যুক্ত ছানা চলে যাচ্ছে খাদ্যরসিক ক্রেতাদের পেটে।


সরষের তেলে শিয়ালকাঁটার তেল ভেজাল দেওয়ার কাহিনী বেশ পুরোনো। এছাড়াও সর্ষের তেলে পেট্রোলিয়াম জাত খনিজ তেল ট্রাইক্রিসাইল ফসফেট ভেজাল দেওয়ার ঘটনা বহুবার শোনা গেছে। ১৯৮৮ সালে কলকাতার বেহালা অঞ্চলে যে ভেজাল সর্ষের তেল খেয়ে বহু মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছিলেন তাতে ট্রাইক্রিসাইল ফসফেট ভেজাল দেওয়া হয়েছিল।


নিষিদ্ধ রঙ হইতে সাবধান

বাজারে অনেক সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের ঠকাতে ছোলার ডাল, মুগ ও মুসুর ডাল, গুঁড়ো বা গোটা হলুদ, মিষ্টি ইত্যাদিতে মেটানিল ইয়েলো রঙ মিশিয়ে বিক্রি করে। আবার শুকনা লংকা, রাঙা আলু, জ্যাম, জেলি, সস, লজেন্স, চকোলেট, আইসক্রিম ইত্যাদিতে লাল রঙ আনতে অনেকে নিষিদ্ধ কঙ্গো রেড রঙ ব্যবহার করে। এইসব রঙের বিষক্রিয়ায় মস্তিষ্ক, মূত্রাশয় ও চোখে ক্ষত তৈরি হতে পারে।


খাদ্যবস্তুতে উজ্জ্বল লাল রঙ আনতে আরেকটি নিষিদ্ধ রঙের ব্যবহারও বাজারে চালু আছে। তার নাম রোডামাইন বি। রোডামাইন বি-এর কারণে মূত্রাশয়, যকৃত ও প্লীহাতে ক্ষত তৈরি হতে পারে। এমনকি ক্যানসার হওয়ারও সম্ভবনাও থাকে।


অবৈধ রঙের কারবার থেকে আমাদের চিরপরিচিত মুড়িও আর মুক্ত নয়। আজকাল মুড়ি ধবধবে সাদা এবং আকারে বড় করার জন্য বহু উৎপাদক দেদার ইউরিয়া মেশাচ্ছে। এমনিতে ইউরিয়া প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুড়ির সাথে বেশি মাত্রায় ইউরিয়া শরীরে গেলে নানা অসুবিধে তৈরি হতে পারে। কিডনির সমস্যা হতে পারে।


সবুজ শাকসবজি, যথা, পটল, ঢেঁড়শ, উচ্ছে, বিনস,মটরশুঁটি ইত্যাদিকে তরতাজা দেখাতে অনেক সময় অসাধু বিক্রেতারা নিষিদ্ধ ম্যালাকাইট গ্রিন রঙ ব্যবহার করে। এই রঙ-এর জন্য মূত্রাশয়, কিডনি, যকৃত ও প্লীহাতে বিভিন্ন রোগ, বিশেষ করে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


সবজিতে নিষিদ্ধ ম্যালাকাইট গ্রিন রঙ দেওয়া হয়েছে কিনা তা বোঝার একটা সহজ উপায় আছে। খানিকটা তুলো তরল প্যারাফিন বা নারকেল তেলে ভিজিয়ে তা দিয়ে সবজির খোসা কয়েকবার ঘষুন। যদি তুলোটা সবুজাভ হয়ে যায়, তাহলে বুঝবেন সবজিতে নিষিদ্ধ রঙ ব্যবহার করা হয়েছে।


এবারে চায়ের কথায় আসি। একটা ভেজা সাদা কাগজের ওপর বাজার থেকে কিনে আনা চা পাতা ছড়িয়ে দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজের ওপর লালচে ছোপ ফুটে উঠলে বুঝবেন আপনার চায়ে ভেজাল আছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা চা পাতায় প্রায়ই কোলটার ডাই মিশিয়ে থাকে। এটাও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।

ঠান্ডা জলে চা পাতা দিলে সাধারণত কোনও রঙ বেরোনোর কথা নয়। যদি বেরোয়, তাহলে আপনি সন্দেহ করতেই পারেন যে সেই চা পাতায় রঙ মেশানো আছে। এটা চা পাতা ভালো কি মন্দ, বোঝার একটা সহজ উপায়।


খাদ্যে নিষিদ্ধ রঙ ধরার কিছু সহজ পরীক্ষা

1. বাজারের শাকসবজি তরতাজা দেখানোর জন্য অনেকসময় বিক্রেতারা ম্যালাকাইটগ্রিন নামের নিষিদ্ধ রঙ ব্যবহার করে। এই রঙ ধরার সহজ উপায় হলো খানিকটা তুলো তরল প্যারাফিনে ভিজিয়ে তা দিয়ে সবজির খোসা ঘষতে হবে। যদি তুলোটা সবুজাভ হয়ে যায়, তাহলে বোঝা যাবে সবজিতে নিষিদ্ধ রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সবজির বোঁটার দিকটা লক্ষ্য করেও নিষিদ্ধ রঙের উপস্থিতি ধরা যায়। সাধারণভাবে সবজির বোঁটা হওয়া উচিত হালকা সবুজ বা ধূসর বর্ণের। কিন্তু রঙে চোবানো সবজির বোঁটাও হবে ঘন সবুজ। বাজার থেকে এধরনের সবজি কেনা উচিত নয়।


2. মিষ্টি, শুকনা লংকা, রাঙা আলু, জ্যাম, জেলি, সস, লজেন্স, চকোলেট, ইত্যাদিতে নিষিদ্ধ লাল রঙ কঙ্গো রেড ব্যবহার করা হয়েছে কিনা ধরার জন্য কাজে লাগাতে হবে মিউরিয়েটিক অ্যাসিড। সন্দেহজনক খাদ্যবস্তু জলে গুলে তার মধ্যে মিউরিয়েটিক অ্যাসিড যোগ করুন। কঙ্গো রেড থাকলে জলীয় দ্রবণের রঙ লাল থেকে নীল হয়ে যাবে। 


3. মাছের কানকোতেও নিষিদ্ধ কঙ্গো রেড রঙ ব্যবহার করার রীতি আছে। দেখে মনে হয় যেন রক্ত। সত্যিকারের রক্ত হলে বার বার জল দিয়ে ধুলে চলে যায়। কিন্তু কঙ্গো রেড হলে বারবার ধোয়ার পরেও লাল রঙ থেকে যায়।


4. সিরাপ, জ্যাম, জেলি, সস, করমচা, আইসক্রিম, লজেন্স, শুকনো লংকা বা রাঙা আলুতে লাল রঙ আনতে আরেকটা নিষিদ্ধ রঙের ব্যবহার চালু আছে যার নাম রোডামাইন বি। এই রঙ ধরার জন্য আগের মতো প্যারাফিন বা নারকেল তেলে তুলো ভিজিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন। তুলো লালাভ বর্ণ ধারণ করলে বুঝবেন খাদ্যে নিষিদ্ধ রোডামাইন বি রঙ আছে।


5. মুড়িতে ইউরিয়া আছে কিনা সেটাও আপনি ঘরোয়া রাসায়নিক পরীক্ষার সাহায্যে সহজেই ধরতে পারেন। খানিকটা মুড়ি নিয়ে অল্প জলে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। তারপর ছেঁকে জলটা সংগ্রহ করে তাতে কয়েক ফোঁটা ফিনলপথ্যালিন মেশান। জলীয় দ্রবণটা হালকা গোলাপী বর্ণ ধারণ করলে বুঝবেন মুড়িতে ইউরিয়া আছে। ফিনলপথ্যালিন না পেলে লাল লিটমাস পেপার দিয়েও এই পরীক্ষা করা যাবে। লাল লিটমাস ওই দ্রবণে ডোবালে যদি নীলাভ রঙ নেয়, তাহলে বুঝবেন আপনার মুড়িতে ইউরিয়া আছে।


6. খাদ্যে সুগন্ধ আনতে আমরা অনেকসময় যে হিং ব্যবহার করি তাতে ভেজাল হিসেবে গদ, রেজিন, এমনকি নিষিদ্ধ রঙও মেশানো হয়। হিং খাঁটি হলে একে জলে গুললে দুধের মতা সাদা মিশ্রণ তৈরি হবে। তাছাড়া খাঁটি হিং আগুনে দিলে উজ্জ্বল শিখায় জ্বলতে থাকে। এই দুটো ক্ষেত্রেই অন্যরকম কিছু ঘটলে বুঝবেন আপনার হিং-এ গন্ডোগোল আছে। ওই হিং খাবারে ব্যবহার করা নিরাপদ নাও হতে পারে।


দুধের ভেজাল ধরবেন কীভাবে?

আমাদের খাদ্য তালিকায় দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহের প্রায় সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানই দুধের মধ্যে রয়েছে। তাই দুধকে বলা হয় সুষম খাদ্য। দুধ থেকে প্রচুর পরিমানে দুগ্ধজাত খাদ্য তৈরি হয়। যেমন, পনির, ছানা, রসগোল্লা, সন্দেশসহ বহু ধরনের মিষ্টি, আইসক্রিম ইত্যাদি।


ইদানিং খোলা বাজারে এমন অনেক গুঁড়ো দুধ, প্যাকেটজাত দুধ, পনির, ছানা, খোয়া ক্ষীর বিক্রি হচ্ছে যেগুলোর FSSAI এর ছাড়পত্র নেই। এগুলোর অধিকাংশই নিম্নমানের। অবশ্য FSSAI ছাড়পত্র থাকলেই যে সেই দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য ভেজাল মুক্ত হবে চোখ বুঁজে এমন ধরে নেওয়ারও কোনও কারণ নেই।

বাজারে ভেজাল দুধ তৈরি করতে জলের সঙ্গে মেশানো হয় সাদা রঙের সস্তা ভোজ্য তেল, চিনি, ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট পাউডার, ইত্যাদি। আসুন আজ আমরা জেনে নিই, দুধের নানা ভেজাল কীভাবে হাতে কলমে পরীক্ষা করে সহজেই ধরে ফেলা যায়।


দুধে ইউরিয়া

এক কাপ দুধে ১ চামচ অড়হর ডালের গুঁড়ো মিশিয়ে কয়েক মিনিট রাখুন। এরপর তাতে লাল লিটমাস ডোবালে যদি রঙ নীলচে হয়ে যায় তবে বুঝবেন দুধে ইউরিয়া আছে।


দুধে চিনি

ভেজাল দুধে মিষ্টত্ব আনতে চিনি বা বাতাসা মেশানো হয়। ১০০ মিলি দুধে ৪০ মিলি ঘন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড সহ ১ গ্রাম রিসরসিনল মিশিয়ে গরম করুন। দ্রবণটির রঙ যদি লাল হয়ে যায় তাহলে বুঝবেন দুধে চিনি বা বাতাসা মেশানো হয়েছে।


দুধে নিষিদ্ধ রঙ

ভেজাল দুধে হলুদ রঙ আনতে অনেক সময় নিষিদ্ধ মেটানিল ইয়েলো রাসায়নিকটি মেশানো হয়। বিশেষ করে মোষের দুধে জল মিশিয়ে মেটানিল ইয়েলো প্রয়োগে হলদেটে ভাব তৈরি করে গরুর দুধ বলে বেচে দেওয়া হয়। শুধু দুধে নয়, দুগ্ধজাত খাদ্য, যেমন, রসগোল্লা, ছানা, সন্দেশ, বরফি বা খোয়াতেও প্রায়শই মেটানিল ইয়েলো মেশানো হয়।

এ ধরনের দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যে লঘু হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড যোগ করলে তার রঙ বদলে লালচে-বেগুনী হয়ে যাবে। মেটানিল ইয়েলো না থাকলে দুধের স্বাভাবিক রঙ বজায় থাকবে।


বিপদের নাম আজিনামোটো

আজিনামোটো এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ যার বৈজ্ঞানিক নাম মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। এটা হলো এক প্রকার গন্ধ-বর্ধক বা ফ্লেভার এনহ্যান্সার। অর্থাৎ, এর নিজের কোনও গন্ধ নেই কিন্তু এটা অন্য গন্ধকে বাড়াতে সাহায্য করে। চাইনিজ ও জাপানিজ খাবারে আজিনামোটো বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আজিনামোটো যুক্ত খাবার নিয়মিত বেশি পরিমানে খেলে পরিপাকের নানা সমস্যা দেখা দেয়। আজিনামোটোর কারণে ‘চাইনিজ রেস্তোরা সিনড্রোম’ নামের এক রকম রোগ হয়। যার ফলে প্রথম প্রথম গা-হাত-পা-ঘাড়ে ব্যথা হয়। পরের দিকে গায়ের চামড়া ঝুলে যায়। অল্প বয়েসেই বৃদ্ধদের মতো দেখতে লাগে।


আজিনামোটো যুক্ত খাবার সকলেরই পরিহার করা উচিত। বিশেষ করে, শিশুদের খাবারে আজিনামোটো দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। সন্তান সম্ভবা মহিলাদেরও আজিনামোটো এড়িয়ে চলা ভালো। আজিনামোটো মস্তিষ্কের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। আজিনামোটো তো বটেই, বাজারে চালু নুডলস মশলাও আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।


পরিচিত খাদ্যের প্রচলিত ভেজাল

ঘি-র ভেজাল

বনস্পতি বা ডালডায় কৃত্তিম গন্ধ যুক্ত করে 'ঘি' নামে বিক্রি করার গল্প খুবই পুরোনো। এধরনের নানান ভেজাল 'ঘি' দেশের বহু 'কারখানায়' প্রতিদিন হাজার হাজার কেজি তৈরি হচ্ছে। এই সব তথাকথিত 'ঘি' শুধু যে নিম্নমানের তাই নয়, এগুলো রীতিমতো বিপজ্জনক অর্থাৎ এগুলো খেলে যেকোনও  লোক অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। সৌভাগ্যক্রমে এমন কিছু সহজ পরীক্ষা আছে যেগুলোর মাধ্যমে আপনি বাজারি ঘি-র কয়েক রকম চালু ভেজাল ধরতে পারেন।


বাড়িতে একটা টেস্টটিউব জোগাড় করে কিছুটা ঘি (বা মাখন) নিন। তাতে ১ চামচ ঘন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl) অ্যাসিড ও সামান্য চিনি যোগ করে মিশ্রণটাকে সামান্য গরম করে ঝাঁকান। কিছু সময় পরে মিশ্রণের নীচের স্তর গাঢ় খয়েরি রঙ ধারণ করলে বুঝবেন আপনার ঘি-র নমুনায় ডালডা বা বনস্পতি মেশানো আছে।

ঘি গলিয়ে তার মধ্যে একটুখানি টিংচার আয়োডিন যোগ করুন। মিশ্রণটা নীলবর্ণ ধারণ করলে বুঝবেন ঐ ঘি-তে আলুসেদ্ধ মেশানো আছে।


ডাল ও জিরেতে ভেজাল

নকল ডাল ও জিরের কারবার বর্তমানে রমরম করে চলছে। এক্ষেত্রে প্রথমে মাটির সঙ্গে সিমেন্ট মিশিয়ে বড়ো বড়ো তাল তৈরি করা হয়। সেগুলোকে রোদে খানিকটা শুকিয়ে নিয়ে লোহার জালে ঘষা হয়। জালের ছিদ্র বিভিন্ন আকারের হয়। এই পদ্ধতিতে তৈরি হয় নকল মুসুর ডাল বা কালো জিরের দানা। সব শেষে সেগুলো সোনালি মেটানিল ইয়েলো রঙে ডুবিয়ে দিলেই হয়ে যায় মুসুরি ডাল। কিংবা পোড়া মোবিল মাখিয়ে তৈরি হয় কালো জিরে। সস্তায় ঐ নকল ডাল বা জিরে কিনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ি ভালো ডাল বা জিরের সাথে পাইল দিয়ে বিক্রি করে বিভিন্ন বাজারে। দেশের বহু জায়গায় এভাবেই ভেজাল চক্রের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে।


আলুতে রঙ

আলু বর্তমানে আমাদের সার্বজনীন খাবার। প্রায় সব রান্নাতেই আমাদের আলু চাই। আলু দিয়ে যে কতরকম স্পেশাল আইটেম হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। আলুর দম, আলু-চানা, আলু পোস্ত, আলু-মটর, আলু-কাবলি, আলু চোখা, আলু ভাজি, আরো কতো কি। দুঃখের বিষয় সেই আলুতেও মেশানো হচ্ছে নানান ভেজাল। আলুতে ইটের গুঁড়ো, এলা মাটি সহ নানান লাল ও হলুদ রঙ মেশানো এখন বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। এই সব ভেজাল ও রঙ যুক্ত আলু খেলে অ্যালার্জি তো হতে পারেই, উপরন্তু হতে পারে কিডনি ও পেটের রোগ সহ নানা ধরনের রোগ।


চকচকে সবজি ও ফলে রঙ

বাজারের চকচকে বেগুন মানেই যে টাটকা ভালো বেগুন তা নাও হতে পারে। পোড়া মোবিল মাখিয়ে যে ঐ বেগুনকে চকচকে করা হয়নি তা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। ইদানিং আপেল ও অন্যান্য ফলে এক ধরনের রঙ পালিশ করে চকচকে করা হচ্ছে। এই রঙ শরীরের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক। পটল, করলা ও অন্যান্য সবজিও তুঁতের জলে রঙ করা হয় উজ্জ্বল সবুজ রাখার জন্য।


নকল আমলকি ও চেরি

ট্রেনে, বাসে আমলকির প্যাকেট আজকাল দেদার বিক্রি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এইসব আমলকির কুচির রঙ হয় কুচকুচে কালো। কাঁচা আমলকি রোদে শুকালে তার রঙ এতোটা কালো হওয়ার কোনও কারণ নেই। আসলে অনেক সময়ই ডুমুরকে ফালি করে কেটে বীটলবণ ও সাইট্রিক অ্যাসিডে ভিজিয়ে রেখে, পরে শুকিয়ে আমলকি বলে বিক্রি করা হয়।

আবার বাজারে যে লাল টকটকে চেরির প্যাকেট বিক্রি হয় তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো আদৌ চেরিফল নয়। আসলে কাঁচা করমচা চিনির রস ও কৃত্তিম লাল রঙ রডোমিন-বি এর দ্রবণে চুবিয়ে রেখে চেরি বলে বিক্রি করা হয়।


খাবারে প্রিজারভেটিভ

খাদ্যবস্তুর শেল্ফ লাইফ বাড়ানোর জন্য তাতে যেসব পদার্থ মেশানো হয়, তাদের বলা হয় ফুড প্রিজারভেটিভ। এই ফুড প্রিজারভেটিভদের আবার দুটো শ্রেণী আছে। ক্লাস ওয়ান এবং ক্লাস টু। ক্লাস ওয়ান প্রিজারভেটিভের মধ্যে পড়ে সাধারণ চিনি, লবণ, গ্লুকোজ, ইত্যাদি। ক্লাস টু প্রিজারভেটিভের উদাহরণ, নানান রাসায়নিক পদার্থ, যেমন, সালফার ডাইঅক্সাইড, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম মেটাসালফাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেট, ইত্যাদি।


বিভিন্ন খাদ্য বস্তুর মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বাজারে শত শত প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। এর অনেকগুলোই প্যাকড ফুড বা টিনজাত খাবারে ব্যবহার করা হয়। বহু ক্ষেত্রেই এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়, বরং বেশ ক্ষতিকারক।

এমন একটা ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ হলো সোডিয়াম বেনজোয়েট। এটা ফলের রস, আচার, জ্যাম, এমনকি ওয়াইন ও বিয়ারেও ব্যবহার করা হয়। ভারতে এটা নিষিদ্ধ হলেও বাজারে এর ব্যবহার চালু আছে। কারও কারও ক্ষেত্রে, এটা অ্যালার্জির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রিজারভেটিভ যুক্ত খাবার খেয়ে অনেকের বমিভাব বা পেটে ব্যাথা দেখা দেয়। এই রাসায়নিকের প্রভাবে মাথা ব্যথা ও শ্বাসের সমস্যাও হতে পারে।


আর একটা প্রচলিত প্রিজারভেটিভ হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিড। এর ব্যবহার বাচ্চাদের পক্ষে বেশ ক্ষতিকর। পাঁউরুটি, কেক, বিস্কুট, পাস্তা, পেস্ট্রি, নুডলস, ইত্যাদিতে প্রোপিওনেট জাতীয় এক ধরনের প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, যার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে সামান্য তেতো-তেতো ভাব আসে। অতিরিক্ত প্রোপিওনেট যুক্ত খাবার খেলে কিডনির কার্যকলাপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া এ থেকে ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনাও বেড়ে যায়।


সাধারণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে খাদ্যে ক্ষতিকারক প্রিজারভেটিভদের উপস্থিতি ও পরিমান চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। অতএব প্রিজারভেটিভ যুক্ত প্যাকড ফুড বা বাজারি খাবার যথা সম্ভব কম খেয়ে ঘরে রান্না টাটকা খাবারদাবার বেশি বেশি খাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।


অস্বাস্থ্যকর ভেজাল খাবার খেলে কী হয়?

ভেজাল বা নিম্নমানের খাবার এক আধবার খেলে বা অল্প পরিমানে খেলে হয়তো তেমন বড়ো কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অবশ্য সেটাও খাবারের মধ্যে থাকা টক্সিসিটি বা বিষক্রিয়ার পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে। আসলে এই টক্সিসিটি দু ধরনের হয়। এক, অ্যাকিউট টক্সিসিটি বা তীব্র বিষক্রিয়া। এই ধরনের বিষক্রিয়ায় শরীরে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করার পর দ্রুত (২৪ ঘন্টার মধ্যে) শারীরিক ক্ষতি হতে দেখা যায়। যেমন, বমি, মাথাঘোরা, দ্রুত রক্তচাপ বৃদ্ধি, পঙ্গুত্ব, ইত্যাদি। দুই, ক্রনিক টক্সিসিটি বা দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া। এই ধরনের বিষক্রিয়ায় শরীরে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করার সাথে সাথে ক্ষতির লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যতদিন যেতে থাকে, ধীরে ধীরে এই বিষক্রিয়ার ফল প্রকাশ পায়। যেমন, ধীরে ধীরে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, চোখের দৃষ্টি কমে, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি হয়, হৃদরোগ দেখা দেয়, কিডনি বিকল হয়ে পড়ে, লিভারের ক্ষয় হয়, ইত্যাদি। ভেজাল ও রাসায়নিক বিষ-প্রভাবিত খাদ্য নিয়মিত খেলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব।


ভেজাল খাদ্য বন্ধে আমাদের কী করণীয়?

ভেজাল খাদ্যের রমরমা কারবার বন্ধ করতে দরকার সর্বাত্মক সামাজিক উদ্যোগ। প্রথমেই ভেজাল সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো দরকার। ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকেও তৎপর হতে হবে। প্রতিটি ব্লক ও পৌর এলাকায় খাবারের নমুনা দোকান থেকে সংগ্রহ করে উন্নত মানের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করতে হবে এবং দ্রুত রিপোর্ট প্রকাশ করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ভেজাল সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ভেজালদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এর জন্য দরকার হলে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।


প্রতিটা মানুষকে ভেজাল রোধে ব্যক্তিগত স্তরেও উদ্যোগী হতে হবে। এর জন্য রাসায়নিক সার ও বিষ বর্জিত, ভেজালমুক্ত খাদ্য সংগ্রহে জোর দিতে হবে। কৃত্তিম রং মেশানো খাবার, জাঙ্ক ফুড, প্যাকেজড ফুড, ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। স্বাস্থ্যই যে সবচেয়ে বড়ো সম্পদ, এবং ভেজালমুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যই যে সুস্বাস্থ্যের অন্যতম শর্ত, সেটা আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার।

হোমিওপ্যাথি - এক অপবিজ্ঞানের চর্চা -পরীক্ষিৎ চক্রবর্তী (আজিজুল শাহজি)
Nov. 19, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:986 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা মানে এই ভারত বাংলাদেশের (পাকিস্তানের বিষয়টা ঠিক জানি না তবে ওটা ঐদিকে ও থাকবে আশা করি) এমন কোনও নাগরিক বোধহয় নেই যে এই হোমিওপ্যাথির স্বাদ পাননি। ছোটবেলায় বাবার হোমিওপ্যাথির বাক্স থেকে আর্নিকা বা নাক্স অথবা অন্য ওষুধ প্রচুর খেয়েছি। তাপ-উত্তাপ কিছুই ছিল না কারণ ওটা আমাদের শৈশবের কোনও মাথা ব্যাথার বিষয় ছিল না। পরবর্তীতে মাথায় পোকা ঢোকায় এক প্রাতঃস্মরণীয় লেখক রাজশেখর বসু (পরশুরাম)। ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই কৈশোর থেকে যৌবন এবং সবচেয়ে বড় ধাক্কা এলো যখন আমার মা এর ক্যান্সার ধরা পড়লো। প্রথাগত চিকিৎসা করাতে দৌড়েছিলাম বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) তে টাটা মেমোরিয়ালে। ডাক্তারবাবু রায় দিয়েছিলেন সার্জারি এবং কেমো। না, প্রথাগত চিকিৎসার বদলে তার চিকিৎসা করেন বেশ খ্যাতিমান এক হোমিও চিকিৎসক যিনি আমার মাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখার আশ্বাস দেন। না, মা বাঁচেননি, বুঝিনি বাঁচার কথা ও ছিল না। যাই হোক, এই ব্যক্তিগত অবান্তর কথার থেকে আবার লাইনে আসি। 


হোমিওপ্যাথির ইতিহাস : 

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান বলে এক জার্মান ডাক্তার ১৭০০ সালের শেষের দিকে হোমিওপ্যাথির উপর কাজ শুরু করেন।  সে সময়কার প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে হিউমারিজম বলা হয়। হিউমারিজম “দাবি” করে যে শরীরের সমস্ত রোগ শরীরের চার প্রকার তরল: কালো, হলুদ, রক্ত এবং কফ -এর তারতম্যের কারনে ঘটে। বলাবাহুল্য, এই নীতিটির কোনও  বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং বর্জনীয়। মজার কথা হল এর বিরোধী ছিলেন হ্যানিম্যান। যে পদার্থের জন্য কোনও রোগের সূত্রপাত হয়েছে, সেই পদার্থের খুব অল্প পরিমান সেই রোগটিকে সারিয়ে তুলবে। অর্থাৎ হিউমারিজম যদি আপনার সর্দি কাশি লাগলে ওটা কমানোর কথা বলে, হানেম্যান তার উল্টো বলেন, আরও সোজা কথায় যা খেয়ে ওটা হয়েছে ওটার কম পরিমানে খেতে বলে। এই চিকিৎসাকে নাম দিলেন হোমিওপ্যাথি। এসেছে গ্রিক শব্দ হোমিওস (একই রকম) আর প্যাথোস (ব্যাধি) এই দুটোর সংমিশ্রণে। 


হ্যানম্যান এবং তার সহযোগীরা এই পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর বিবরণ তৈরী করেন। নানান খনিজ আর লতা পাতা ইত্যাদির নানান প্রয়োগ করেন সুস্থ এবং অসুস্থ মানুষের উপর এমনকি নিজেদের উপর আর তার উপর একটি বই প্রকাশ করেন মেটেরিয়া মেডিকা। প্রথম দিকে তার এই ওষুধ /টোটকা কম পরিমানে ব্যবহার আর পরে একটা থিওরি খাড়া করেন, ঔষধের মাত্রা যত কম হবে তার প্রভাব তত বেশী হবে। এই নিয়মটিকে আমরা ডাইলুটিং বা লঘু করার একটি পদক্ষেপ বলতে পারি। হাস্যকর হল বর্তমান বিজ্ঞান বিশেষতঃ মূল ধারার স্বীকৃত চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে প্রকৃতপক্ষে ঠিক এর উল্টোটা ঘটে। যেমন, আপনার নির্দিষ্ট মাত্রার ক্রোসিন /প্যারাসিটামল এ জ্বর না কমলে মাত্রা বাড়াতে হয়। 


মেটেরিয়া মেডিকার সর্বশেষ সংস্করণে প্রায় হাজারখানেক পদার্থকে হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহারের জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ কোন রোগ বা কোন অসুখের জন্য কোন পদার্থ ব্যবহার করতে হবে বইটিতে সে ব্যাপারে কোনও নির্দেশনা নেই। এক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক বা তথাকথিত হোমিও চিকিৎসকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ১৮ শতকে এটা কম রিস্কি হওয়ায় আর সহজ হওয়ায় অনেকেই এর প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৯ শতকে এই প্র্যাকটিশিয়ান ছিলেন প্রায় ১৪ হাজার আর ২২ টি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষার কেন্দ্র। মেডিক্যাল সাইন্স এর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর অতি দ্রুত পতন হয়। আজ ঐগুলো হয় বন্ধ অথবা আধুনিক মূল ধারার চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত হয়েছে। শেষ প্রতিষ্ঠানটি ১৯২০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। 


আসুন এই পদ্ধতি কী ভাবে ওষুধ তৈরী করে ওটা এবার দেখি : 

আমরা আগেই দেখেছি খনিজ, ভেষজ ইত্যাদির থেকে এই ওষুধের মূল পদার্থ নেওয়া হয়। এখন এই পদার্থকে এক ভাগের সাথে ৯৯ ভাগ অ্যালকোহল বা জলের সাথে মিশ্রিত করা হয়। দ্রবীভূত না হলে মিহি করে গুঁড়ো করে গুঁড়ো দুধ বা মিল্ক সুগারের সাথে মেশানো হয়। এই পদ্ধতির একটা ছবিও দেওয়া হল।


এইবার আসল খেলা, কেন এই চিকিৎসা নিছক একটি অবৈজ্ঞানিক! 

এই ডাইলুশন এর একটা কাটাছেঁড়া করি। এক ভাগ জল/পানির এই ডাইলুশন রোমান X এ প্রকাশ করার রীতি। এখন ১X হল ১/১০ ঘনত্ব। ৩X হল ১/১০^৩ মানে ১/১০০০ ঘনত্ব। আর ১০০ ভাগ ডাইলুশন প্রকাশ করার রীতি হলো C। তাহলে  ১C হচ্ছে ১/১০০ ঘনত্ব, ৩C হচ্ছে ১/১০০^৩ বা ১/১০০০,০০০ ঘনত্ব ইত্যাদি। বর্তমানে বাজারে পাওয়া হোমিও-টোটকাগুলো ৬X থেকে ৩০X মাত্রায় পাওয়া যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৩০C মাত্রার হোমিও-টোটকাও বাজারে বিক্রী হয়।


৩০X লঘুকরণের মানে হচ্ছে একভাগ মূল পদার্থকে ১০^৩০ অর্থাৎ ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগ লঘুকরণ করা হয়েছে। এক কিউবিক সেন্টিমিটার, বা একটি ছক্কার কাছাকাছি আকারের মধ্যে ১৫ ফোঁটা জল/ পানি ধরে এই হিসেবে এক ড্রপ হোমিওপ্যাথিক পদার্থকে মেশাতে পৃথিবীর ৫০ গুণ আকারের জল/পানিতে সেটাকে মেশাতে হবে। পৃথিবীর পঞ্চাশগুণ আকারের একটি জল/পানিভরা পাত্র কল্পনা করুন। তারপর তাতে একফোঁটা লাল রং ছেড়ে এমনভাবে গোলান যাতে সেটা জল/ পানিতে সমভাবে মিশে যায়। হোমিওপ্যাথির “লঘুকরণের সুত্র” অনুযায়ী এরকম একটি বিশাল পাত্র থেকে এক ফোঁটা রং মিশ্রনের পর যদি একফোঁটা জল/ পানি নেওয়া হয় তাহলে তাতে লাল রংটির "নির্যাস" পাওয়া যাবে। অথচ ব্যাপারটি অসম্ভব।


রবার্ট এল. পার্ক, পিএইচডি একজন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ এবং আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞান সোসাইটির নিবার্হী পরিচালক। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, একটি দ্রবণে দ্রাব্য পদার্থের ন্যুনতম একটি অনু বিদ্যমান থাকলেই কেবল পদার্থটি সেই দ্রবণে উপস্থিত সে দাবী করা যায়। এক অনু পদার্থ থাকতে তাই দরকার ১০^১৯ অনু জল/ পানির। হিসেব করে দেখা গেছে যে, মূল পদার্থের এক অনু পেতে চাইলে ৩০X মাত্রার হোমিও টোটকার দুই বিলিয়ন ল্যাকটোজ সুগারের দানা খেতে হবে। এই এক অনু মূল পদার্থের সাথে আপনার শরীরে যাচ্ছে প্রায় এক হাজার টন ল্যাকটোজ এবং তার মধ্যে থাকা ভেজাল ময়লাগুলো।

তাহলে ধরুন ৩০X ডাইলুশন হল মূল বস্তুর ১০^৩০ মানে ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগ ডাইলুশন। সহজ হিসাবে এই পদ্ধতিতে ওই মিশ্রনে আপনি কোনও মূল ওষুধের কিছুই পাবেন না। 


বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে হোমিওপ্যাথির উপকারিতা নিয়ে আগে বা এখনও আমরা লেখা পড়ি। রিডার্স ডাইজেস্ট একবার লিখলো পশুদের উপর হোমিওপ্যাথির ফলাফল পাওয়া যায়। না, একদম ভুল তা প্রমাণিত হয়েছে ২০০৫ সালে। এখন আমরা কেন এই নিয়ে সরব হই না? নিজেরাও তো দেখেছি মা, বাবাকে, দিদিমা-ঠাকুরমাকে, ছোট্ট ছোট্ট গুলি বা পুরিয়া খেয়ে দিব্যি সেরে উঠতে। কারুর জ্বর, সর্দি ভালো হয়েছে তো কারুর বাচ্চার তোতলামি সেরেছে। আঁচিলের মতো গুটি একেবারে মিলিয়ে গেছে। আমরা জানি না, ওষুধ না খেলে ওগুলো নিজে নিজে সারত কিনা। বা কেউ মিষ্টি গুলি ছাড়াও বাচ্চাকে কাশির সিরাপ, জ্বরের ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন কিনা। কিন্তু মজা হলো, প্রচন্ড জ্বরে, অ্যাকসিডেন্ট এ অথবা অন্য কোনওভাবে হাড় ভেঙে গেলে বা অন্য কোনও ইমার্জেন্সিতে কেউ হোমিওপ্যাথি করার কথা মুখেও আনেন না। 


রবার্ট এল. পিএইচডি একজন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ লক্ষ্য করেন যে একটি মিশ্রণে কোনও একটি পদার্থের নূন্যতম একটি অনু থাকলেই কেবল পদার্থটি সেই দ্রবণে উপস্থিত সে দাবী করা যায়। এক অনু পদার্থ থাকতে তাই দরকার ১০^১৯ অনু জল/পানি। এই অনুপাতে ধরুন আপনি যদি ওষুধ মানে ওই দ্রব্যের এক অনু পেতে চান তা হলে ৩০X এর মাত্রার হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে  দুই বিলিয়ন ল্যাকটোজ সুগারের দানা খেতে হবে। ভাবুন! 


রসায়নের সূত্র অনুযায়ী (পিনাকী এই বিষয়ে বলতে পারবে আরও ভালো) ডাইলুশনের একটি সীমা আছে, যার বেশী ডাইলুটেড  করা হলে দ্রবণে আসল পদার্থটি আর পাওয়া যাবে না। এই সীমাটি অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার সাথে সম্পর্কিত এবং ১২C বা ২৪X (১০^২৪ ভাগের এক ভাগ) হোমিওপ্যাথি মাত্রার সমতুল্য। হ্যানিম্যান নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এ ধরণের কাজ করলে ওই তরলে মূল পদার্থের ছিঁটেফোঁটা থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু তিনি “বিশ্বাস” করতেন যে প্রতি বার এই ডাইলুশনের সময় ওই মিশ্রনে মূল বস্তুর “আত্মার-মত” এক ধরণের নির্যাস থেকে যায়, যেটা যদিও ওটা পদার্থ হিসাবে পাওয়া যায় না তবু শরীরের 'প্রাণ শক্তি' আবার জাগিয়ে তোলে। কি সাংঘাতিক !!  


সাইলেসিয়া ২০০ খেলে নাকি গলায় ফুটে থাকা মাছের কাঁটা গলে যায়। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ সাইলেসিয়া ২০০ ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে কাঁচের প্লেটে সাইলেসিয়া ২০০ নিয়ে তাতে দিনের পর দিন মাছের একটা ছোট্ট কাঁটা ডুবিয়ে রেখে দেখেছিলেন- কাঁটা লাগা তো লাগা! কিছুই হয়নি।

 

বস্তুত হ্যানিম্যান এর পরে আর এই নিয়ে কোনও কাজ হয়নি আর করেও লাভ নেই তাই হ্যানিম্যান আজও পুনরায় জীবিত হয়ে নিজের বইয়ের উপর পরীক্ষা দিলে পাস্ করবেন কিন্তু ডারউইন হয়তো ফেল করে যাবেন কারণ পরবর্তীতে যা গবেষণা হয়েছে তার অধিকাংশ জিনিস ডারউইনের জানা নেই। বস্তুতঃ এই চিকিৎসা এক ধরণের প্ল্যাসিবো চিকিৎসা বা ফেইথ হিল মানে স্ব-ইচ্ছায় রোগের উপশম। 


তারপরেও এই হোমিওপ্যাথির কেন এখনও জনপ্রিয়তা? কেন লোকে যায়? কারন হল আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষ পিছু ডাক্তারের সংখ্যা অতীব কম, এর সাথে আছে ওই মূল ধারার ডাক্তারদের ওষুদের মাত্রা নিয়ে ভুল চিকিৎসা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধ না খেলে রোগী নিজেই সেরে যায়। আপনি হাম বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ বলে কিছু এন্টিবায়োটিক্স দিলে রোগীর উপর আফটার এফেক্ট আসতেই পারে। 


একটা কাউন্টার লজিক আসে যে এই হোমিওপ্যাথি এক ধরনের টিকা হিসাবে কাজ করে। না ওটাও ধোপে টিকবে না। কারণ টিকা রোগ ঠেকাতে ব্যবহার হয়, রোগ হওয়ার পরে না। আর টিকায় উপাদানের পরিমান অনেকগুন বেশী এবং হিসেব করে দেওয়া হয়। 


১৯৯৭ এ এই কারণে লন্ডন স্বাস্থ্য দফতর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ব্যয়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানান। তারা নির্দিষ্ট মানের উপর কোনও  সঠিক উত্তর পাননি ওই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের থেকে। হোমিওপ্যাথির ভক্তকুল অল্প কিছু পরীক্ষায় হোমিওপ্যাথির পক্ষে ফলাফল এলেই সেটা দেখিয়ে প্রমান করতে চায় হোমিওপ্যাথি কাজ করে। ক্রমাগত পরীক্ষায় একই ফলাফলের জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আবার বলছি, প্ল্যাসিবো মানে নকল ওষুধ খেলে কিন্তু বেশী শক্তিশালী হতে পারে। তবে নকল ঔষধ খেয়ে রোগ সারবার সম্ভবনাটার তুলনায় রোগটা না সারবার এবং বিশাল ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। সেই সাথে রয়েছে আর্থিক ক্ষতি এবং সময় অপচয়। শুরুতে যা বলেছিলাম, ক্যান্সারের মতো রোগ কিন্তু হঠাৎ করে জটিল হয়ে যেতে পারে, সময়মত ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নিলে। যারা হোমিওপ্যাথি খেয়ে উপকারের কথা বলেন, তারা সেটা না খেয়েও সুস্থ হয়ে যেতেন এমনটা হবার সম্ভাবনাই বেশী।


ভারতে বা বাংলাদেশে এই চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে সরকারের কাছে। কি আর বলবো ! যা মনে হয়েছে তা হল আধুনিক চিকিৎসক তৈরির খরচ আর ওই চিকিৎসালয় তৈরির বাজেট আমাদের দেশগুলোর নেই ফলে একটা জোড়াতালি ব্যবস্থা, চলছে চলুক! এছাড়াও আর একটা কারণ হল আমাদের সেই 'বিশ্বাস', আমরা বিশ্বাস করি গুরু /পীর অথবা রাজনৈতিক নেতাদের। আমরা ফুল বেলপাতা থেকে প্রাসাদে খুঁজি রোগের ওষুধ। আমরা ওই হোমিওপ্যাথি ওষুধ জার্মানি বা আমেরিকার থেকে তৈরী বলে তা অব্যর্থ ভাবি। তার উপর সরকারীভাবে দেশের মানুষের আয়করের টাকায় কলেজ স্থাপন হয় যখন, জাতীয় হোমিওপ্যাথিক বোর্ড গঠন করে যখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তখন আর সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়ার কিছু থাকে না।


আবার সেই ক্যান্সার রোগটির কথাই বিবেচনা করি। ক্যান্সার রোগটি ভয়াবহতার দিক দিয়ে এখন বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতি একটি রোগ। ক্যান্সার যত তাড়াতাড়ি ধরা যায় এবং চিকিৎসা শুরু করা যায়, ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা তত বাড়ে। ওহাইয়ো স্টেইট ইউনিভার্সিটির এক গবেষনায় দেখা গেছে জটিল ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার দু’মাসের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা শতকরা ৮৫ ভাগ। অ্যাপেল কোম্পানীর সিইও স্টিভ জবস জড়িবুটি এবং ব্যতিক্রমধর্মী ঔষধের সেবন করে তার রোগ সারাতে চেয়েছিলেন। নয় মাস এসব টোটকা সেবনের পর তার ক্যান্সার ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। জবসের শেষ পরিণতি তো আমাদের জানাই।


হোমিওপ্যাথির তেমন কোনও সর্বজনগৃহীত স্ট্যান্ডার্ড নেই, এটা কোনও মান নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির মধ্যে দিয়েও যেতে হয় না। তাই ভেষজ আর প্রাকৃতিক উপাদানের নামে আসলে কী দেওয়া হচ্ছে আপনাকে সেটা জেনে রাখাই ভালো। ১৭ শতকের হ্যানিম্যানের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এই আধুনিক যুগে তার আর কার্যকরিতা নেই। সময় এসেছে একটু কঠিন কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা। 



তথ্যসূত্র : 

১. http://www.quackwatch.org/01QuackeryRelatedTopics/homeo.html

২. https://blog.mukto-mona.com/2009/12/06/3561/

৩. http://www.hpus.com/

৪. http://news.bbc.co.uk/2/hi/health/8211925.stm

এবং সিধু জ্যাঠার ভার্চুয়াল রূপ : ইন্টারনেট

আদম চরিত -মুখফোড়
Nov. 19, 2024 | যুক্তি | views:110 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পোষাক নিয়ে আলোচনায় এই লেখাটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। লেখক কে জানি না, কেউ জানলে বলবেন -


ঈশ্বর গলা খাঁকরাইয়া কহিলেন, "ব্যাপার কী আদম, এই প্রাতঃকালে তোমার এইরূপ উত্থিত দশা কেন? চুরি করিয়া নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ কর নাই তো?"

আদম গোঁ গোঁ করিয়া কহিল, "ঈভের জামাকাপড় ঠিক নাই।"

ঈশ্বর কহিলেন, "তাই বলিয়া তুমি এইরূপে তোমার শ্রীলঙ্কাটিকে বাগাইয়া চলাফিরা করিবে?"

আদম কহিল, "কী করিব? ঈভ তাহার নিকটে ঘেঁষিতে দেয় না। তাহার সহিত কোনক্রমেই কোন কিছু ঘটিবার নহে। তাহাকে যতই তেলআবিব দেই না কেন, সে একটি জেরুজালেম!"

ঈশ্বর কহিলেন, "তোমাকে দুই দুইটি হস্ত নির্মাণ করিয়া দিলাম আদম, বিপদে আপদে কার্যে প্রয়োগ করিতে।"

আদম কহিল, "হস্ত পদ সকলই প্রয়োগ করিয়াছি প্রভু। উহাদিগের দিন শ্যাষ।"

ঈশ্বর কহিলেন, "এখন আমার দরবারে আসিয়াছ কী আবদার লইয়া?"

আদম কহিল, "আপনি ঈভকে পর্দা করিতে বলুন।"

ঈশ্বর কহিলেন, "ঈভ তো বস্ত্র আচ্ছাদন সকলই প্রয়োজনীয় পরিমাণে করে বলিয়া জানি।"

আদম কহিল, "উঁহু, তাহার বস্ত্র যথোচিত পরিমাণে নাই। খাটো কাঁচুলি পরিধান করিয়া সে তাহার তামিলনাড়ু দুটি ইচ্ছা করিয়াই প্রদর্শন করিয়া বেড়ায়। তাহার ঘাগড়াটিও তাহার বুন্দেলখণ্ডকে ঠিকমত আবৃত করে না।"

ঈশ্বর কাশিয়া কহিলেন, "আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ফরমান পাঠাইতেছি। ঈভ এক্ষণ হইতে তামিলনাড়ু ও বুন্দেলখণ্ড আবৃত করিয়া চলাফেরা করিবে।"


দুইদিন পর আদম পুনরায় ঈশ্বরের দরবারে হানা দিল।

ঈশ্বর আরশে বসিয়া অস্বস্তিভরে নড়িয়া চড়িয়া কহিলেন, "ব্যাপার কী আদম? তুমি তোমার এডিনবড়াটি পুনরায় এইরূপ বাগাইয়া আমার দরবারে আসিলে যে?"

আদম গোঁ গোঁ করিয়া কহিল, "ঈভের জামাকাপড় ঠিক নাই প্রভু।"

ঈশ্বর চক্ষু মুদিয়া কহিলেন, "আমি ঈভকে ফরমান পাঠাইয়া হুকুম দিয়াছি সে যেন তাহার তামিলনাড়ু ও বুন্দেলখন্ড ঢাকিয়া ঢুকিয়া চলাফেরা করে। গবাক্ষে উঁকি দিয়া আমি দেখিয়াছি, ঈভ আমার কথা মান্য করিতেছে। তাহার তামিলনাড়ু ও বুন্দেলখন্ড যথোচিত পরিমাণে আবৃত।"

আদম কহিল, "ঈভের নতুন বস্ত্রটি অত্যন্ত টাইট, জাঁহাপন! তাহার বস্ত্র তাহার তামিলনাড়ু ও বুন্দেলখণ্ডের উপর এমনরূপে আঁটিয়া থাকে যে আমি আমার নাগাসাকি নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিতেছি না, সে শুধু ফুকুশিমা হইবার উপক্রম করিতেছে।"

ঈশ্বর গলা খাঁকরাইয়া কহিলেন, "হস্ত পদের প্রয়োগে সুফল ঘটিতেছে না?"

আদম গম্ভীর কণ্ঠে কহিল, "না!"

ঈশ্বর কহিলেন, "এখন কী করিব? আবদারখানা কী তোমার?"

আদম কহিল, "ঈভ যেন এখন শিথিল ঢিলাঢালা বস্ত্রাদি পরিধান করে খোদাবন্দ!"

ঈশ্বর কহিলেন, "ঠিকাছে। আমি ফরমান পাঠাইতেছি। ঈভ এক্ষণ হইতে ঢোলা আলখাল্লা পরিয়া চলাফেরা করিবে।"


দুইদিন পর আদম আবার ঈশ্বরের দরবারের দ্বারে ঘা মারিল। তবে হস্ত বা পদ দিয়া নহে।

ঈশ্বর দরজা খুলিয়া আঁতকাইয়া উঠিয়া কহিলেন, "ছি ছি আদম, তুমি তোমার হণ্ডুরাসটি এইরূপে বাগাইয়া পুনর্বার আমার পবিত্র দরবারে আসিলে যে? দশজন দেখিলে কহিবে কী?"

আদম গোঁ গোঁ করিয়া কহিল, "ঈভের জামাকাপড় ঠিক নাই মহাত্মন!"

ঈশ্বর চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, "ঠিক নাই মানে কী? আমি তো অলিন্দ হইতে দেখিলাম, ফরমান পাইবা মাত্র সে একটি ঢোলা আলখাল্লা পরিয়া বাজারে বরবটি দরদাম করিতেছে!"

আদম কহিল, "উহার মুখ দেখা যায় জাঁহাপন।"

ঈশ্বর কহিলেন, "মুখ তো দেখা যাইবেই। মুখ দেখা না গেলে বুঝিবে কীরূপে যে এটি ঈভ?"

আদম কহিল, "জাঁহাপন, আপনি কি মনিকালিউয়িনস্কিলের ঘটনা সম্পর্কে অবগত?"

ঈশ্বর মাথা চুলকাইয়া কহিলেন, "উমমম, আচ্ছা, বটে?"

আদম কহিল, "হাঁ। কখনও কখনও মুখদর্শন করিলেও মোগাদিশু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হইয়া পড়ে।"

ঈশ্বর কহিলেন, "আচ্ছা আমি ঈভকে ফরমান পাঠাইতেছি, সে মুখ ঢাকিয়া চলাফেরা করিবে।"


দুইদিন পর আদম ঈশ্বরের দরবারে পুনরায় হানা দিল।

ঈশ্বর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে কহিলেন, "আদম, তোমার সমস্যা কী? তুমি আবার তোমার হাম্বানটোটা বাগাইয়া আমার দরবারে আসিলে যে?"

আদম গোঁ গোঁ করিয়া কহিল, "ঈভের জামাকাপড় ঠিক নাই প্রভু!"

ঈশ্বর হুঙ্কার দিয়া কহিলেন, "আবার কী সমস্যা তাহার জামাকাপড়ে? আমি তো দেখিলাম সে একটি বস্তায় ঢুকিয়া বুটের ডাল কিনিতে বাজারে আসিয়াছে!"

আদম কহিল, "নন্দন কানন বড় বাত্যাপ্রবাহময় অঞ্চল প্রভু। বাতাসে ঈভের বস্তাটি তাহার অঙ্গে এইরূপে মাখিয়া যায় যে তাহার মেদিনীপুর ও রাওলপিণ্ডি দুটি পরিষ্কার ঠাহর করা যায়।"

ঈশ্বর দন্ত কিড়মিড় করিয়া কহিলেন, "এখন কি নন্দন কাননে বাত্যাপ্রবাহ বন্ধ করিয়া দিবার আবদার লইয়া আসিয়াছ মর্কট?"

আদম গম্ভীর কণ্ঠে কহিল, "না। আপনি ঈভকে একটি ইস্পাতের সিন্দুকে ঢুকিয়া চলাফিরা করিতে আদেশ দিন।"

ঈশ্বর আরশের হেণ্ডুলে কীল মারিয়া কহিলেন, "ঠিকাছে! বলিতেছি! এইবার তোমার হনুলুলু নামাইয়া দূর হও!"


দুইদিন পর আদম পুনরায় ঈশ্বরের দরবারে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। উভয়ার্থেই।

ঈশ্বরের চোয়াল ঝুলিয়া পড়িল। তিনি বিস্ফারিত নেত্রে আদমের পানে চাহিয়া কহিলেন, "তুমি কী ভক্ষণ কর বল দেখি? আবার তুমি তোমার লিভারপুল বাগাইয়া আমার দরবারে হাজির হইয়াছ?"

আদম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, "ঈভের জামাকাপড় ... !"

ঈশ্বর হুহুঙ্কারে কহিলেন, "ঠিক নাই? ইস্পাতের নিরেট সিন্দুকে তাহাকে ঢুকাইয়াছি, দুইটি স্বর্গদূত ঠ্যালাগাড়িতে করিয়া সেই সিন্দুক লইয়া বাহির হয়, তারপরও ঠিক নাই?"

আদম গোঁ গোঁ করিয়া কহিল, "ইস্পাতের সিন্দুকটি বড় মনোহর!"

চেতনা বিকাশের হাতিয়ার -মহম্মদ মহসীন
Nov. 19, 2024 | যুক্তিবাদ | views:882 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা বেশ সাত্বিক সাত্বিক গন্ধ মাখা কথা আমাদের সমাজে বেশ চালু। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না। ধর্ম থাকুক ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি থাক রাজনীতির জায়গায়।


আসলে আমরা ধর্মের ইতিহাস অনেকে জানি না, অনেকে আবার জেনেও অজানাদের মতই অসচেতন। মানব জীবনে রাজনীতি এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার সাথে ধর্মীয় কিছু আবেগ মিশিয়ে দিতে পারলেই স্বার্থ সিদ্ধ হয়, সংগঠিত করার কাজ সহজ হয়। এ কথা বোধহয় আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে ধর্মীয় স্বার্থ আর রাজনৈতিক স্বার্থের সার্থক ককটেল একটা বাজারে ছাড়তে পারলেই, জনগণের মনের তৃষ্ণা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়ে সেই দলটির 'আমি তোমাদেরই লোক' ভাবটির যে ভাবে স্পষ্টকরণ সম্ভব; তা বোধহয় শত বক্তৃতা বা হাজার কাজের বাস্তবায়ণের মাধ্যমেও ফলপ্রসূ দেখি না।


মানুষ মূলগতভাবে প্রথমত একটি প্রাণী। সামাজিক প্রাণী। মানবেতর অন্যান্য প্রাণীর প্রায় খাড়া দ্বিপদ প্রাণী। তিনি মানুষ হয়ে উঠতে পারেন শুধুমাত্র তাঁর যুক্তিবাদী চেতনা গ'ড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে। এই চেতনা গ'ড়ে ওঠার পথে সহস্র প্রতিবন্ধকতা।


প্রথম থেকেই শিশুর শিখনকালে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কুশিক্ষা ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা জগৎ ব্যাপী বিস্তৃত। শিশুর মনে ভূত, প্রেত, ঈশ্বর বিশ্বাস প্রভৃতি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রবিষ্টকরণের কাজে অভিভাবক, প্রতিবেশী, শিক্ষক-শিক্ষালয় এক কথায় সমগ্র সমাজ যেমন উঠে পড়ে লাগে তাতে সেই শিশুটিকে কুসংস্কারাচ্ছান্ন করে গড়ে তোলার লব্ধ মিশন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সামান্যতম সুযোগ থাকে না। এই চক্রব্যুহ ভেদ করেও যাঁরা কেন, কী, কোথায়, কবে, কীভাবে , প্রশ্ন করতে শেখেন, চিন্তা করেন, চিন্তা করার সাহস পান, তাঁদের বলা যায় যুক্তিবাদের পথের পথিক, অর্থাৎ যুক্তিবাদ সম্পন্ন প্রাণী -মনুষ্য। যুক্তিবাদ বিবর্জিত প্রাণী মনুষ্য পদবাচ্য হতে পারে কি? 


অবশ্য আজ পর্যন্ত এমন কাউকে আমি দেখিনি, যিনি নিজেকে কুসংস্কারগ্রস্ত, নিজেকে অন্ধবিশ্বাসী মনে করেন। সকলেই নিজেকে যুক্তিবাদী মনে করেন। ধর্মের কুসংস্কার প্রচার করা যারা পেশা হিসাবে নিয়েছেন, তাদের নামের সামনে দেখি, যুক্তিবাদী বিশেষণ। হাসি পেলে হাসি চেপে চুপে থাকাই সেখানে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ দশচক্রে পাথরকেও ভগবান বানানো হয়। হাসি চেপে রাখতেই হয় যখন কাঠের তৈরী ঠাকুরের হেলথ চেক আপ করেন এম বি বি এস, এম ডি ডাক্তারে, কাঠের বুকে সত্যিকারের স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে। 


বন্ধু বলার কিছু নেই, এভাবেই কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে শিক্ষার বলি ঘটে প্রতি মুহুর্তে। 

 

রাজনীতি ছাড়া তো সমাজ চলে না। ধর্মকেও এতটাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ব্যক্তিক জীবনশৈলীর প্রতিটি ক্ষেত্র জুড়ে আছে ধর্ম, কুসংস্কার৷ অন্ধবিশ্বাস। যুক্তিবাদীদের নিয়েও মানসিক প্রমোদ লাভের মেনু উপভোগ করতে পারেন কবজি ডুবিয়ে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের খাদ্য ভক্ষণ থেকে পানীয় পান করে ঢেঁকুর তোলা পর্যন্ত। তারপর কুশিক্ষার পান চিবানোর পর্ব সম্পূর্ণও বাদ যাবে না।


ভূতে বিশ্বাসকে অনেকেই যুক্তিবাদের বিপরীত গোষ্ঠীভুক্ত করেন। খ্যাতনামা এক সাহিত্যিক, যিনি নিজেকে যুক্তিবাদ বিবর্জিত প্রাণী বলে আদৌ মনে করেন না বলেই জানি, তিনিও অকপটে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ভূত আছে, চতুর্দশীতে তেঁনাঁরাঁ এসেও থাকেন।

 

ভূতে অবিশ্বাসী যুক্তিবাদীরা আবার ভগবানে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন। 

আরও দেখবেন, ভগবানে অবিশ্বাসীরা আবার জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে চেঁচিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। বিজ্ঞান ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের হাতেও দশ আঙুলে দশাধিক স্টোন সমন্বিত আংটির শোভা দেখে মূর্ছা-ভাব কারুর অভিজ্ঞতায় থাকাটা স্বাভাবিকের থেকেও বাস্তব। 


আবার জ্যোতিষকে অবিজ্ঞান অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার বলে বুঝেছেন, তাঁদের মাঝেও অনেকের কাছে হোমিওপ্যাথি নিয়ে বলুন, সেই জ্যোতিষ বিরোধী যুক্তিবাদীমন্য লোকেও রে রে করে উঠবে। 


এ হ'ল যুক্তিবাদীদের এক ঝলকের পরিচয়।

খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যখন যুক্তিবাদীরা তাদের একজন গুরুকে খাড়া করে দেন। আবার সেই গুরুর দলে কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর যখন কলিকালাভ না হওয়াতে গুরুবিরোধিতার শক্তি অর্জন করতে ভূতান্বেষী বিজ্ঞানীদের ধরে ঝুলে পড়েন। 


এরা নিজেদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে এমনভাবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেন যে এ নিয়ে অলিম্পিকে ইভেণ্ট থাকলে নির্দ্বিধায় সর্ব জাজের সম্মতিক্রমে উভয়পক্ষকেই প্রথম স্থানাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করা যেতে পারতো।

যুক্তিবাদী আন্দোলনের কত বড় ক্ষতি এঁরা করে চলেছেন, তার তল পাওয়া দুস্কর।

তাহলে উপায়? সব ছেড়েছুড়ে হাত গুটিয়ে ব'সে থাকবো? 


না হাজার পথ খোলা। পথই পথ দেখাবে। 

পেশী শক্তির বিকল্প মসি শক্তি। 


কলম ধরতে হবে। ওটাই যুক্তিবাদী চেতনা বিকাশের হাতিয়ার।

দুটি কবিতা পর্ব ১১ -কবিরা
Nov. 19, 2024 | কবিতা | views:121 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিজ্ঞান কংগ্রেসের কমেডি শো

-জামাল আনসারী


দু হাজার ঊনিশ, ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেস সম্মেলন,

বিজ্ঞানীরা পৌরাণিক কাহিনীতে করলেন অবগাহন।।


বিজ্ঞান কংগ্রেসের বলছি সংক্ষেপে কিছু পন্ডিতের কথা,

তাদের মহামূল্যবান কথা শুনে অনেকের ধরবে মাথা।।


প্রজাপতি ব্রহ্মা করেছিল ডাইনোসরের আবিষ্কার,

মনু থেকে একে একে বিশ্বে মানুষের হল আবির্ভাব।।


ভারতের বিজ্ঞানীরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল বিবর্তনবাদ।

বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের আর থাকল না কোন বিবাদ।।


গণেশের হাতির মাথা প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ,

হাতির মুন্ডু চাপিয়ে দিলে হবেনা কেন তার মরন!


মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার অবশ্যই ছিল,

ঘরে বসে সঞ্জয়, যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর কিভাবে দিল!


নির্বিচারে বৃক্ষ ছেদন! ভারতের ক্ষতি নেই  তা-তে

পাতি হাঁসগুলিই তো, অক্সিজেন ছাড়ছে মাঠে ঘাটে।।


রামায়ণের যুগে শ্রীলঙ্কাতে অনেক বিমানবন্দর ছিল,

বিমানে(পুষ্পক রথ) করেই রাবন সীতাকে হরণ করিল।।


ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের আরো আছে অবদান,

জ্যোতিষীরা হাত দেখেই বলে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান।।


বিজ্ঞানীদের দাবি,আধুনিক প্রযুক্তির কিবা প্রয়োজন!

ভারতেই পারে গো মূত্রে মরণব্যাধি ক্যন্সার নিবারণ।।


বিশ্বে যা কিছু আবিষ্কার, সবই নাকি ভারতের অবদান!

বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র,আধুনিক মিসাইলের উৎকৃষ্ট প্রমাণ।।


বিজ্ঞান কংগ্রেসের কমেডি শো দেখে কি যে হাসি পায়!

বিদেশিরা বলে বিজ্ঞান কংগ্রেসে বিজ্ঞানেরই দেখা নাই।।


বিলাপ

-প্রদীপ চক্রবর্তী


ধর্ম নিয়ে বড়াই করো,

সত্যিকারের মানুষ নও।

জাতিভেদের ভাইরাস কে,

বলো সবাই;তফাত যাও।


আমি-তুমি মানুষ যখন,

ধর্ম হল মানবতা।

আমাদেরই হৃদয় পুষ্পে,

ভালবাসার মালা গাঁথা।


সূর্য যখন গগণ মাঝে,

পৃথিবীতে আলো ছড়ায়।

সাম্যবাদের ইস্কুলেতে,

যুক্তিবাদী পাঠ পড়ায়।


ধর্ম নিয়ে রাজনীতি,

বন্ধ হোক্ চিরতরে।

মানসিকতাটা সুস্থ হলেই,

ধর্মান্ধরা বিলাপ করে।

গোলটেবিলে সাফ জবাব, প্রসঙ্গে: স্বামী বিবেকানন্দ। -অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:485 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যদি প্রশ্ন করা হয় স্বামী বিবেকানন্দ কে ছিলেন, তাহলে এককথায় এর উত্তর হচ্ছে, উনি ছিলেন একজন স্ববিরোধী  সন্ন্যাসী। রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের মতন এমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ করেননি যার জন্যে স্বামীজির নামে আবেগাপ্লুত হতে হবে। কিন্ত অন্ধভক্তদের এসব বোঝানো কঠিন। স্বামীজি কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু সমালোচনামূলক লেখার চেষ্টা করলেই কিছু অন্ধভক্তরা হা রে রে  করে ছুটে আসবেই। তারপর শুরু হবে আক্রমণ। গালাগাল, হুমকি, খিস্তি কিছুই বাদ যাবেনা। 


কোনো মানুষ ই সমস্ত দোষ ক্রুটি মুক্ত নয়। কারন দোষ মুক্ত মানুষের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ ও এর বাইরে নয়। এমন অনেকেই আছেন যারা বিবেকানন্দ কে চেনেন কিছু ভালো ভালো বাণী সংকলিত ঐ ১০/২০ টাকা দামের বই পড়ে নয়তো অন্যের মুখ থেকে শোনা কথায়। 


আসলে  - "সত্য ঠিক ততটাই প্রকাশিত হয় যতটা আমরা জানতে চাই অথবা আমাদেরকে জানানো হয় "। লাগাতার প্রচারের ফলে বিবেকানন্দ কে মহাপুরুষ, বিজ্ঞানীদেরও বিজ্ঞানী, তরুণ প্রজন্মের আদর্শ, সৎ, প্রগতিশীল,  যুক্তিবাদী ইত্যাদি নামে চালানো হয়েই চলেছে। এর পেছনে একটা বড় উদ্দ্যেশ্য তো অবশ্যই আছে। স্বামী বিবেকানন্দ কে চিনতে, জানতে, বুঝতে  -


দশ খন্ডের বাণী ও রচনা, 

পত্রাবলি,

স্বামীজি কে যেরুপ দেখিয়াছি,

স্বামী শিষ্য সংবাদ, 

জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, 

বিবেকানন্দ ও বাঙালির বিবেক, 

সেকুলার বিবেকানন্দ, 

বিবেকানন্দ অন্য চোখে, 

ইত্যাদি বই গুলো বেশ ভালো ভাবে এবং পাতায় পাতায় নিজের যুক্তিবোধ দিয়ে পড়া খুবই প্রয়োজন। অনেকের বাড়িতেই বিবেকানন্দ রচনাবলী থাকতে দেখা যায়, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের প্রায় কেউই সেসব বই পুরো টা পড়েননি। অবশ্য না পড়ে না জেনে জ্ঞান দেওয়াও একটা বিরাট মাপের শিল্প। 

বিজ্ঞান বিরোধী, স্ববিরোধী বিবেকানন্দর পুর্নাঙ্গ জীবনী মন দিয়ে পড়লেই জানা যায় তিনি কেমন মানুষ। আজ একরকম বলছেন তো পরের দিন আরেক। 

যে কারনে রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগর মহাশয় কে শ্রদ্ধা করি, ঠিক তার বিপরীত মেরু তে অবস্থানকারী বিবেকানন্দকে সন্মান জানানো সম্ভব নয় কোনো মুক্তমনের যুক্তিবাদী মানুষের। তিনি, অনেক স্ববিরোধী কথা বলেছেন। জীবনে এমন কিছু করেছেন যা মানবতার বিরোধী। আবার যদি বলা হয় বিদ্যাসাগর, রামমোহন এনারা যা যা কাজ করেছেন আমরা জানি কিন্তু বিবেকানন্দ এমন কি করেছেন সমাজের জন্য? তখন আবার ব্যক্তি আক্রমণ ছাড়া কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাবেন না। আপনি মানুন অথবা না মানুন এটা সত্য যে, উনি অর্থাৎ স্বামীজি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতা, পশুবলি, সহমরণ প্রথা বাল্যবিবাহ  ইত্যাদি অনেক কিছুর পূর্ণরূপে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ, বিধবাদের বিবাহ থেকে নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে প্রমাণ করেছেন উনিও সেই পুরুষশাসিত সমাজের প্রাচীন পন্থী চিন্তাধারা থেকে মোটেই বেরিয়ে আসতে পারেন নি। 


অপ্রিয় সত্য এটাই যে, প্রগতিশীলতার মুখোশের আড়ালে ভন্ড সন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দই বলছেন "জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলে, চাষা চাষা"(স্বামী শিষ্য সংবাদ)। ভাবতে পারছেন কি পরিমাণ জাতিবিদ্বেষ ছিলো আবার বলেছেন "বিধর্মী জাতিদের ভেতরে আদান প্রদান হওয়ার কথা আমি বলি না।" (বাণী ও রচনা, নবম খন্ড)

একজন ব্যক্তি নারীদের প্রতি কেমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন তার ওপর ব্যক্তিত্ব বুঝতে পারি ইনি কি বলেছেন, "ভক্তের বাড়িতে স্ত্রী ভক্তের হাতের রান্না খেওনা এতে মন নিম্নমুখী হয়" আবার বলেছেন,"কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করাই স্ত্রী লোকের প্রধান কর্ম"। (শ্রীমতি ইন্দুমতী মিত্রর প্রতি পত্র)

এরকম একগাদা কথা পাতায় পাতায় ছড়িয়ে, কিন্তু না পড়লে জানবেন কিভাবে? 

যাদের মনে হবে ভুল বলেছি তাদেরকে অনুরোধ করবো পুর্নাঙ্গ বিবেকানন্দ কে পড়েই দেখুন এবং মিলিয়ে নিন আমার কথা। সত্য কিন্তু কখনো চাপা থাকেনা, একদিন সেটা ঠিকই প্রকাশ পাবেই।  সেদিন খুব দূরে নয় যখন মানুষ নিজেই চিনে নেবেন বিদ্যাসাগর না বিবেকানন্দ কাকে আদর্শ হিসেবে মেনে নেবে আগামী প্রজন্ম। 


যারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে সোচ্চারে দাবী করেন যে স্বামীজি একজন খাঁটি মানুষ বিজ্ঞানীদেরও বিজ্ঞানী তাদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য বলেই শেষ করি, বেশ মজাদার বক্তব্য। বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখন্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক -নবপত্র, পৃষ্ঠা - ২৬৪ থেকে - 


" একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথমে তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ - একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো,দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠেছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও,ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রুপান্তরিত হয়ে গেছে"।। 

একবার ভাবুন তো, স্বামীজি কতবড় বিজ্ঞানী দের ও বিজ্ঞানী!!  ইস্পাতের মাধ্যমে " মন " কেও যে তৈরি করা সম্ভব সেটা বিবেকানন্দই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। 

বাল্যবিবাহ সমর্থনকারী বিবেকানন্দ, নাকি এর বিরোধী বিদ্যাসাগর?বেদান্তবাদী বিবেকানন্দ, নাকি বেদান্তবিরোধী বিদ্যাসাগর? বিধবা বিবাহের বিরোধী বিবেকানন্দ, নাকি সমর্থক বিদ্যাসাগর? ভাববাদের মুখোশের আড়ালে অন্ধবিশ্বাস এবং কু-সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়া বিবেকানন্দ, নাকি মুক্তমনা  বিদ্যাসাগর? কাকে বেছে নেবে আগামীপ্রজন্ম সেটা অবশ্যই জোর গলায় বলতে হবে এবং স্পষ্টভাবে। 

তাই নিজে পড়ুন, জানুন, সত্য কে উপলব্ধি করতে শিখুন। আগামীপ্রজন্মের মাথায় ভাববাদ অন্ধগুরুবাদ, অন্ধভক্তি, অন্ধশ্রদ্ধা ইত্যাদি না ঢুকিয়ে তাঁদেরকে মুক্তমনে ভাবতে শেখান। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী গড়ে তুলুন আপনার আগামীপ্রজন্ম কে।

কিছু খবর:

১। বুজরুকির পর্দা ফাঁস বিজ্ঞান মঞ্চের


এই সময়, বনগাঁ: স্বয়ং কালীঠাকুর নাকি ভর করেন তাঁর উপর। প্রতি শনি-মঙ্গলে 'দরবার' বসত 'সাধক' রবীন দাসের। জ্বর-পেটখারাপ, চাকরি, বিয়ে, জমি বিবাদ সবেরই সমাধান বাতলে দেন রবীন। খবর পেয়ে বনগাঁয় রবীনের গ্রামে হানা দেন বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা। বিপদ বুঝে বুজরুকির কথা স্বীকার করে নেন রবীন।


সীমান্ত শহর বনগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম চাদার বিনয় কলোনিতে বাস রবীন দাসের। তাঁর বাড়িতেই রয়েছে কালীমন্দির। প্রতি মঙ্গল ও শনিবার ঠাকুর নাকি ভর করেন রবীনের উপর। এই দু'দিন মন্দিরের চাতালে বসেন রবীন। আর আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন এই শনি -মঙ্গলে ভিড় জমান রবীনের কালীমন্দির চত্বরে। এই ভরে পড়াটা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, শুধু রবীন নয়, তাঁর সঙ্গে আরও তিন মহিলাকেও কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতা ভর করে। রবীন ও তাঁর তিন মহিলা সঙ্গী এই ভরে থাকা অবস্থায় লোকজনের দুঃখ-কষ্ট শোনেন। সমাধানের পথ বাতলে দেন। কেউ বাতের ব্যথায় কাবু তো কেউ দেনায় ডুবে রয়েছেন। কারও বিয়ে টিকছে না তো কারও সন্তান হচ্ছে না। সবই মনযোগ দিয়ে শোনেন রবীনরা। তারপর ভক্তদের সমস্যা বুঝে কারও হাতে ফুল, কারও হাতে বেলপাতা অথবা মাটি, শিকড়, মাদুলি, তাবিজ দেন। এ সবই সমস্যার সমাধান।


অনেকেই নাকি রবীনের টোটকায় উপকার পেয়েছেন। তাই ভক্তের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। ভক্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীনের পরিচিতিও আশপাশের গ্রাম পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল। সেভাবেই রবীনের কথা জানতে পারেন বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা।


এ দিন মন্দির চত্বরে ভক্ত সেজে হাজির হন বিজ্ঞান মঞ্চের কয়েকজন সদস্য। কিন্তু কোনও ভাবে তা কানে ওঠে রবীনের। বিপদ আঁচ করে খানিক বাদে রবীন বলে ওঠেন আজ কেউ মাছ-মাংস খেয়ে এসেছেন। তাই মা আসছেন না। আপনারা আজ ফিরে যান। তখন বিজ্ঞান মঞ্চের একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এর আগেও মাংস খেয়ে এসেছি। তখন তো ঠাকুর আপনার উপর ভর করেছিলেন। আজ কেন হচ্ছে না? আপনি মাকে নিয়ে আসুন। আমরা অপেক্ষায় আছি।' এরপরই নিজেদের আসল পরিচয় দেন বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে গলা মেলান ভক্তদের আনেকেই। সুযোগ বুঝে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দোর এঁটে দেন রবীন। তাল বুঝে চম্পট দেয় রবীনের সঙ্গী তিন মহিলাও। মন্দির চত্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।


একটু পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন রবীন। বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা চেপে ধরলে বুজরুকির কথা স্বীকার করে নেন। করজোড়ে গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। ভবিষ্যতে কোনও দিন এ সব করবেন না বলে কথাও দেন। এরপর বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা গ্রামবাসীদের অন্ধ বিশ্বাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেন। বিজ্ঞান মঞ্চের কথায় সবচেয়ে বেশি সাড়া আসে মহিলাদের কাছ থেকেই।

https://eisamay.indiatimes.com/west-bengal-news/kolkata-news/buzruki-seen/articleshow/71070677.cms


২। ‘নাসা’ যাওয়ার ডাক পেল পুরুলিয়ার কিশোরী

" ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি " র সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত কে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। তার প্রচেষ্টায় ফাঁস হয়েছিল এক বিশাল বুজরুকি। বিস্তারিত জানতে পড়ুন..


আনন্দবাজার পত্রিকা : 

নিজস্ব সংবাদদাতা, পুরুলিয়া, ১৯ অগস্ট, ২০১৯


বড় হয়ে সে মহাকাশে যেতে চায়। তার আগেই, পুরুলিয়া শহরের কিশোরী অভিনন্দা ঘোষের হাতে যেন চাঁদ এসে হাজির। দিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থা আয়োজিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হয়ে সুযোগ মিলেছে ‘নাসা’-য় পাড়ি দেওয়ার।  নবম শ্রেণির ছাত্রীটি বলছে, ‘‘খবরটা পাওয়ার পরে আনন্দে কিছু ক্ষণ কথাই বলতে পারিনি। নাসায় যাওয়ার স্বপ্ন এত দ্রুত সফল হবে ভাবতেই পারছিলাম না।”


তেলকলপাড়ার বাসিন্দা অভিনন্দা পুরুলিয়া শহরের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। বাবা সজল ঘোষ ও মা সুস্মিতা রায়চৌধুরী শহরের দু’টি স্কুলে ইংরেজি পড়ান। চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে ‘ন্যাক’ ছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের কম্বলের। তবে সে গিয়েছিল ছাদে। জাঁদরেল মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে বিচ্ছু ছেলে ঘাপটি মেরেছিল চিলেকোঠার ঘরে। আর নাস্তানাবুদ হয়েছিল টেনিদারা। সজলবাবুরা জানাচ্ছেন, অভিনন্দার কিন্তু ছোট থেকে পড়াশোনাই ধ্যানজ্ঞান। চতুর্থ শ্রেণি থেকে প্রতি বছর অলিম্পিয়াডে বসছে। আলাদা ভাবে কোনও প্রশিক্ষণ নেয়নি। অভিনন্দার কথায়, ‘‘পরীক্ষা নিয়ে এখন আর ভয়ডর করে না। পরীক্ষাটা উপভোগই করেছি।” জানাচ্ছে, অল্প সময়ে অনেকগুলি উত্তরের মধ্যে থেকে ঠিকটা বেছে নিতে হয়েছিল পরীক্ষায়। আর প্রস্তুতিতে যাবতীয় সাহায্য করেছেন স্কুলের শিক্ষকেরাই।


কৃতী ছাত্রী হিসেবে স্কুলে তার নামডাক রয়েছে। গত নভেম্বরে দিল্লির বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে স্কুল স্তরের পরীক্ষায় বসেছিল অভিনন্দা। সফল হয়ে সেখান থেকে রাজ্যস্তরে। অগস্টের গোড়ায় দিল্লিতে ইসলামিক কালচার সেন্টারে সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষাটি হয়। 


অভিনন্দার স্কুলের শিক্ষক তথা ওই বেসরকারি সংস্থার পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর সুদীপচন্দ্র দাস জানান, সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় প্রায় ১৮ লক্ষ প্রতিযোগী ছিল। সফলদের শিক্ষামূলক ভ্রমণে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ (নাসা) ‘কেনেডি স্পেস সেন্টারে’ নিয়ে যাবে সংস্থা। দলে সুযোগ পেয়েছে অভিনন্দা। স্বাধীনতা দিবসে সংস্থার তরফে স্কুলে ফোন করে সেই খবর দেওয়া হয়। তবে, কবে রওনা হতে হবে সেই কথা এখনও জানানো হয়নি।


স্কুলের পড়াশোনার বাইরে নিয়ম করে পড়ে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধ। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘মিশন মঙ্গল’ নামে হিন্দি ছবি। মঙ্গল-অভিযানে একঝাঁক মহিলা বিজ্ঞানীর ভূমিকা তুলে ধরেছেন পরিচালক। ইচ্ছা থাকলেও পড়ার চাপে সেই ছবি দেখা হয়নি অভিনন্দার। তবে তাকে অনুপ্রানিত করেছে ‘চন্দ্রযান ২’ অভিযানে মহিলা বিজ্ঞানীদের ভূমিকা। মেধাবী ছাত্রীটি বলে, ‘‘খবরের কাগজে দেখেছি চন্দ্রযান অভিযানে কী ভাবে নিজেদের দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করেছেন মহিলা বিজ্ঞানীরা।” 


তারও স্বপ্ন, লাল মাটির দেশ থেকে এক দিন পাড়ি জমাবে লাল রঙের গ্রহে।

খবরের লিংক - https://www.anandabazar.com/district/purulia-birbhum-bankura/purulia-student-got-a-call-from-nasa-after-her-success-in-science-olympiad-1.1033409



৩। যে কোনও ভারতীয়র অধিকার রয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার’, রায় মাদ্রাজ হাইকোর্টের


সমাজ সংস্কারক পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর অনুগত এবং দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সদস্যদের সম্পূর্ণ মৌলিক অধিকার রয়েছে ঈশ্বর এবং ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার। ঠিক যেমন অন্যদের অধিকার আছে ঈশ্বর বিশ্বাসে। এই রায় ঘোষণা করল মাদ্রাজ হাই কোর্ট।


মাদ্রাজ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দানের সময়ে বলে, ‘মামলাকারীর যদি অধিকার থাকে ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী ঈশ্বারের অস্তিত্ব এবং ধর্ম সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশের, তাহলে সুপ্রিম কোর্টেক লালাই সিং যাদব মামলার উদাহরণ তুলে আমরাও বলছি পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর অনুগত এবং দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সদস্যদেরও ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছে ঈশ্বরকে অস্বীকার করার। ’ডিভিশন বেঞ্চে এদিন উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এস মণিকুমার এবং সুব্রামোনিয়াম প্রসাদ।


১৯৬৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সমাজ সংস্কারক পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী জীবিত থাকাকালীন ত্রিচিতে উন্মোচিত হয় তাঁর একটি মূর্তি। উদ্বোধন করেছিলেন তত্‍কালীন মুখ্যমন্ত্রী সি এন আন্নাদুরাই। উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে কামরাজও। তাঁর সেই মূর্তির নিচে লেখা হয়েছিল, ‘ঈশ্বর বলে কেউ নেই... ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্বই নেই। যে ঈশ্বরের জন্ম দিয়েছে সে ভীষণই বোকা। যে ঈশ্বরের প্রচার করেছে সে স্কাউনড্রেল এবং যে ঈশ্বরের আরাধনা করে সে বর্বর, আদিম।’

মামলাকারী এম দেইভানয়াগমের দাবি ছিল, এই ধরনের আক্রমণাত্বক এবং আপত্তিকর মন্তব্য পেরিয়ার কোনওদিনও করেননি এবং তাঁর মৃত্যুর পর এই সব কথা লেখা হয়েছিল মূর্তির নিচে। দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সভাপতি এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘থানথাই পেরিয়ার আগে থেকেই বুঝেছিলেন, তাঁর মূর্তির নিচে এই কথাগুলি লেখা না হলে কিছু বছর পর তাঁকেই ঈশ্বর জ্ঞানে মানুষ পুজো করা শুরু করবে। সেই জন্যেই এই কথাগুলি তিনি বলে গিয়েছিলেন।’

https://eisamay.indiatimes.com/nation/madras-high-court-declares-that-indian-constitution-has-given-right-to-its-citizens-to-deny-gods-existence/articleshow/71006042.cms

ওয়ার্ল্ড সিজোফ্রেনিক ডে -আদিত্য
Nov. 19, 2024 | সচেতনতা | views:987 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রতিবছর মে মাসের ২৪ তারিখে World Schizophrenia Day পালিত হয়। WHO এর মতে এখনও গোটা পৃথিবীতে প্রায় ২১ মিলিয়ন লোক এই সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত! মোটামুটি বিংশ-শতাব্দীর একটু আগে থেকে সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে প্রথম সিজোফ্রেনিয়া সচেতনতা দিবস পালিত হয়, মে মাসের ২০ থেকে ২৭!এইভাবে  সিজোফ্রেনিয়া দিবস পালনের  প্রধান কারণ হল- সাধারন মানুষকে সচেতন করা।Schizophrenia  এর সিম্পটোমগুলোর সাথে সাধারন মানুষদের পরিচয় করানো। চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা নিয়ে প্রচার করা! এই রোগ হলে তার পরিণতি কি হতে পারে ও কতো ভাগ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তা বোঝানো।এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  Schizophrenia  নিয়ে স্টিগমা এবং বৈষম্য বন্ধ করা। 


Schizophrenia  একটি মানসিক সমস্যা  যা মূলত এটা একটা মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ  গন্ডগোল হলে তৈরি হয় (Brain Disorder)!   Dr. Eugen Bleuler  এই Schizophrenia শব্দটি প্রথম  ব্যবহার করেন। 

Schizophrenia কে গোদা ভাবে ট্রান্সলেট করলে হয়- Splitting of the mind.  গ্রিক শব্দ   'schizein' (to split) আর 'phren' (mind) থেকে যার উৎপত্তি! তাই পপুলার কালচারে  Schizophrenia মানে কিন্তু 'Split Personality'  কে বোঝায় যা একেবারে ভুল!

এখানে Split মানে আমাদের মনের অনুভুতি(Emotion), চিন্তনের ধরন(Cognition) এবং ব্যবহার বা আচরণ(Behavioural) এই তিনটের মধ্যে যোগাযোগ

ভেঙ্গে যাওয়া বা আলাদা হয়ে যাওয়া বা Split হয়ে যাওয়াকে বোঝায়!অর্থাৎ মনের এই তিনটে ব্যবহারিক উপাদানের মধ্যে  কোন সু-সামঞ্জস্য না থাকা।   Bleuler এর আগে অবশ্য ১৮৫৩ সালে Benedict Morel এইরক রোগের নাম করেন Demence Precoe।তারপরে Kahlbaum (১৮৭১)আর তার ছাত্র Hecker(১৮৭৪) বর্ণনাতেও উঠে আসে এই রোগের এর কথা। প্রখ্যাত জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট Emil Kraeplin এই রোগের নাম করণ করেন  Dementia Praecox।শেষে ১৯০৮ সালের ২৪শে এপ্রিল  সুইস সাইকিয়াট্রিস্ট Dr. Eugen Bleuler বার্লিনে এক লেকচারে এই Schizophrenia শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে তার বর্ণনা করলেন চারটি "A"এর মাধ্যমে যাকে বলা হয়4A- Loosening of Associciations (সঙ্গতিহীন চিন্তা ভাবনা ও কাজ),Blunting of  Affect(কোনো  রকম অনুভুতি না থাকা), Autism( Self-absorbed একমাত্র নিজের মতো করে কাজ করা ) আর Ambivalence (সংশয় এর মধ্যে থাকা)। পরবর্তীতে  আর এক জার্মান ডাক্তার Kurt Schneider ১৯৩৯ সালে সিজোফ্রেনিয়া ডায়াগনোসিস এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিম্পটোম এর কথা বললেন -যা First Rank Symptoms (FRS ) নামে পরিচিত।

১৯৮৬ থেকেই National Schizophrenia Foundation ফ্রান্সের   Dr. Philippe Pinel (1745-1826) (যিনি মানসিক রোগ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, Dementia (ডিমেনসিয়া) শব্দটি উনিই প্রথম ব্যবহার করেন) তাকে সম্মান জানাতে ২৪ শে মে প্রতিবছর এই দিনটি  সিজোফ্রেনিয়া দিবস পালনের জন্যে বেছে নেয়! এই বছর ২৩শে মে থেকে ২৭ শে মে  Schizophrenia Awareness Week (SWA) সিজোফ্রেনিয়া সচেতনতা সপ্তাহ পালিত হচ্ছে-এইবারের থিম হল- “Discover Better Mental Health”. যেভাবে মানসিক রোগের স্টিগমা এবং বাছবিচারের জন্যে অনেকেই চিকিৎসা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন!বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও স্টিগমা এবং বৈষম্য এর জন্যে অনেকই শুরুতে চিকিৎসা করাতে চান না! এবং রোগ অনেকবেশি chronic আকার ধারন করে! আর যেহেতু Schizophrenia একটি ব্রেইন ডিসঅর্ডার তাই ওষুধ খেতেই হবে!এবং মনে রাখতে হবে এটা এমন এক অসুখ  যাকে সারানো যায়!  সমস্ত পপুলেশানের মধ্যে এর prevalence ১% এর একটু বেশি। 

NMHS (National Mental Health Survey 2015-16) অনুযায়ী এর prevalence ০.৪% অর্থাৎ ভারতের প্রায় ৫-৬ মিলিয়ন(৫০-৬০ লাখ)  লোক এই রোগ নিয়ে ভুগছেন!


Schizophrenia এর ডায়াগনোসিস হয় রোগীকে ক্লিনিকাল ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে! কোন মাথার স্ক্যান বা রক্তের পরীক্ষা নয়! DSM-5 অনুযায়ী Schizophrenia এর রোগীদের যে সিম্পটোম গুলি থাকে-

Delusion (একটা মিথ্যে অপরিবর্তনীয় স্থির বিশ্বাস যা রোগীর নিজস্ব সংস্কৃতি শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানের সাথে মিল খায় না)

Halluniaction (কোন রকম বাহ্যিক উদ্দীপনা ছাড়াই একটা বাস্তবিক অনুভুতি যা একদম সত্যিকারের মতো)

Disorganised Thought and Speech (চিন্তাভাবনার স্বাভাবিক বিন্যাস থেকে লাইনচ্যুত হওয়া বা অসংলগ্ন কথা বলা)

Grossly Disorganised  Behaviour (আচরনের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজে না পাওয়া এক অদ্ভুতরে ব্যাখাতীত আচরণ)

Negative Symptoms (অনুভুতির প্রকাশ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যাওয়া!)

সাধারণত ছয় মাসের বেশি এই সিম্পটোমে গুলির মধ্যে দুটি বা তার বেশি থাকলে এবং যদি রোগীর কাজের জায়গা, নিজের কেয়ার নেওয়া ও পারস্পরিক সম্পর্কগুলো অত্যাধিক মাত্রায় প্রভাবিত হয় তাহলে আমরা Schizophrenia এর কথা ভাবতে পারি!  আসলে সাইকিয়াট্রিস্ট দের কাছেও সিজোফ্রেনিয়া খুব চ্যালেঞ্জিং ও জটিল এক রোগ। সিম্পটোম এর দিক দিয়ে খুব Heterogenous(অসমসত্ত্ব) একটা অসুখ। তাই এক এক একজন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী এক একরমের হয়। কেউ হয়তো খুবই উত্তেজত, কেউ খুব আক্রমণাত্মক, কেউ বা হয়তো ঝিমিয়ে আছে, কেউ নিজের মতো হাসছে নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে, কেউ হয়তো নিজের যত্ন একেবারেই করতে পারছে না, খাওয়া দাওয়া করছে না, রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ বা সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তাই কোনো একরকম সিম্পটোমগুচ্ছো দিয়ে সিজোফ্রেনিয়াকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে ধরণের সিম্পটম দেখা যায় তা হল- 

কারও উপস্থিতি ছাড়াই তার আওয়াজ কানে পরিস্কার শুনতে পাওয়া (Auditory Hallucination) 

আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি ও আমাকে মারতে আসছে এই রকম বলে উত্তেজিত হয়ে ওঠা(Visual Hallucination) 

লোকজনকে সবসময় সন্দেহ করা(Paranoid Ideation ) 

সারাক্ষণ একটা ভয় ও ভীতি এর মধ্যে থাকা।(Fearful Episode) 

নিজেকে একদম আলাদা করে নেওয়া (Social Withdrawal ) 

নিজের অনুভূতির প্রকাশ একদম কমে যাওয়া(Emotional Blunting ) 

বেশিক্ষণ ধরে মনোযোগ না রাখতে পারে (Poor attention ) এবং ভুলে যাওয়া(Memory Disturbance ) 


সাধারত ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি ১৫-২৫ বছরের মধ্যেই শুরু হয়!মেয়েদের মধ্যে এই রোগের সূত্রপাত একটু দেরিতে হয় এবং  এর বাইমোডাল ডিস্ট্রিবিউশান(Bimodal onset Peak) দেখা যায় -

একদল ২৫-৩৫ বছর আর একদলের ৪৫ বছরের এর পরে গিয়ে রোগের শুরু হয়! অন্যদিকে বাচ্চাদের সিজোফ্রেনিয়া (Childhood Schizophrenia) শুরু হয় ১২-১৩ বছর এর একটু আগে থেকে!  

সিজোফ্রেনিয়াতে সেই রোগের পাশাপাশি অন্যান্য রোগও থাকতে পারে! বিশেষ করে Tobaco এবং Cigarettes এরা নিয়মিত ব্যবহার করেন !

অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যও ব্যবহার করে থাকতে পারেন।সাধারণ পপুলেশানের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায়  OCD(Obssesive Compulsive Diosrder ) সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের  থাকে!এছাড়া ডিপ্রেসিভ এপিসোডও থাকতে পারে!এদের মধ্যে ১৫-৩০ % সুইসাইড এর চেষ্টা করেন। ১০% মারা যান সুইসাইডে! আবার ১০-১৫ % Schizophrenia এর রোগীরা স্বাভাবিক সময়ের আগে মারা যান!


Schizophrenia কোনো একটা কারণে হয় না অনেক কারণ রয়েছে। Geentics, Immunological, Biochemical, Neurodevlopmental, Psychological থিওরি আছে! তাই বলা হয় Multifactorial Polygenic Brain Disorder।


চিকিৎসা পদ্ধতির প্রধান জায়গা হল- মেডিকেশানের উপর থাকা এই রোগের চিকিৎসার মূল জায়গা! বিশেষত Anti-Psychotic Drug এবং তাকে সাপোর্ট করার জন্যে বিভিন্ন ওষুধ ও তাদের কম্বিনেশান!

Psychoeducation,Family Therapy, Social Skill Training (SST) Token Economy এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ!


কতদিন ধরে ট্রিটমেন্ট চালবো??


এটা একটা খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যতটা একজন বাড়ির লোকের কাছে ততটাই একজন চিকিৎসকের কাছে! কতদিন চিকিৎসা চলবে তা নির্ভর করে বিভিন্ন বিশয়ের উপর-

(১)রোগটা কতদিন ধরে আছে এবং তার তীব্রতা কতোটা

(২)কতগুলো এপিসোড হয়েছে মানে বাড়াবাড়ি রকমের

(৩)কতবার Relapse(রোগ ফিরে ফিরে আসা) হয়েছে

(৪)বাড়িতে কারও এই ধরনের রোগ আছে কিনা!

(৫)ওষুধ খেয়ে রেসপন্স কেমন??

তবে ওষুধ বন্ধ করার আগে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলবেন! দেখা গেছে বার বার এটা যে রোগী ঠিক হয়ে যাবার পরে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং রোগ আবার নতুন চেহারানিয়ে ফিরে এসছে! IPS(Indian Psychiatric Society এর গাইডলাইন অনুযায়ী)সাধারণত প্রথম এপিসোডের ক্ষত্রে ১-২ বছর এবং অনেক কটা এপিসোড হলে মিনিমাম ৫  বছর ওষুধ চালানো উচিত! তবে কতদিন ধরে রোগ আছে, সুইসাইড করার প্রবণতা থাকলে অন্যকে ক্ষতি করার আচরণ থাকলে খুব অ্যাগ্রেসিভ হলে কিম্বা অন্য অসুখ থাকলেঅনেকদিন কখনো কখনো সারাজীবন  ওষুধ চলতে পারে!


Schizophrenia কিভাবে এগোবে এবং শেষ পরিনতি কি হবে তা একবাক্যে বলা যায় না! বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর এই Prognosis (আরোগ্য সম্ভাবনা) নির্ভর করে।সাধারণত যাদের রোগ জীবনের পরের ধাপে (৪০ বছর পরে) শুরু হয়,ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের,রোগ শুরুর আগে কোন বাহ্যিক কারণ থাকে, রোগ শুরুর আগে(Premorbid Personality) যারা খুব সুস্থ ছিলেন,  মস্তিষ্কের কোন গঠনগত জায়গা নষ্ট( Structural Damage of Brain) হয় নি নেই, যাদের সুইসাইড করার চিন্তা বা প্রবণতা কম,  যারা বিবাহিত, যাদের ফ্যামিলি সাপোর্ট ভালো, তাদের ক্ষেত্রে  Prognosis ভালো!

Manfred Bleuler (যিনি Eugen Bleuler এর ছেলে) বলেছিলেন এদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ করে ভালো হয়ে যায় যায়, এক তৃতীয়াংশ মোটামুটি কম-ভাল মিশিয়ে থাকে, আর এক তৃতীয়াংশ দীর্ঘদিনের (Chronic) রোগে পরিণত হয়! পরবর্তী কালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে-

এক দল,মোটামুটি ৩০-৪০% লোকজন একটা এপিসোড হয় এবং ১ বছর ওষুধ খেয়ে একদম ঠিক হয়ে যায়!সমস্ত কাজকর্ম করতে পারে কোন রকম ওষুধের দরকার পরে না!

আর একধরনের ৩০-৪০ % লোকের অনেক এপিসোড থাকা সত্ত্বেও ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকেন!

 তিন নাম্বার গ্রুপের লোকজন ১০-২০% ওষুধ খেয়ে সম্পূর্ণরুপে সুস্থ হয় না! ওষুধ খেয়ে পজিটিভ সিম্পটোম নিয়ন্ত্রনে চলে আসে কিন্তু ওষুধ বন্ধ করলেই বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যায়!

 বাকি ১০% প্রথম থেকেই ওষুধ খেয়ে কিছু হয় না! যাকে বলে Treatment Resistant Schizophrenia (TRS) তবে বিভিন্ন কারণে এর পারসেন্টেজ বেড়ে দাঁড়ায়! ২০-৩০% এর এসে কাছাকাছি! তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ওষুধ বিভিন্ন উপায়ে ড্রাগ কম্বিনেশানের মাধ্যমে সিম্পটোম নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করা হয়!


আমাদের সামনে কি কি চ্যালেঞ্জ ??


সবচেয়ে বড় সমস্যা হল স্টিগমা ও বৈষম্য! Schizophrenia এর ক্ষেত্রে তো বটেই যেকোনো মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেই এটা হয়! একজন হাই প্রেশার বা ডায়াবেটিস এর রোগী যতটা সহজে চিকিৎসা পান একজন Schizophrenia রোগী সেই সহজে চিকিৎসা পান না!

প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে চিকিৎসার সহজলভ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে! কতো সহজে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে কিনা!বাড়ির লোকেরাও প্রথম দিকে রোগীর সমস্যামূলক আচরণ শুরু হলেও নজর দেন না!

এই ট্রিটমেন্ট গ্যাপ ৭৫%। তারমানে ২৫% Schizophrenia রোগীরা শুধু চিকিৎসা পান! ভারতবর্ষে প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যা! তার মধ্যে-

 Psychiatrist এর সংখ্যা  ৯০০০ এর কাছাকাছি

 Clinical Psychologist ৩০০০ এর কাছাকাছি

Psychiatric Nursing (যারা M.Sc in Psychiatry Nursing  করেছেন) ২০০০ এর মতো

Psychiatric Social Worker ২০০০ এর মতো  

হিসেব করে দেখলে সাইকিয়াট্রিক বেড এর সংখ্যাও খুব অল্প! একটা হিসেব হচ্ছে ভারতে

মানসিক হাসপাতাল আছে ৪৩ টি মেডিকেল কলেজ ৫৪২ টি ডিসট্রিক্ট হাসপাতালের সংখ্যা ৭১৮ টি। সব মিলিয়ে আনুমানিক হিসেবে বেড এর সংখ্যা হবে ৩৭ হাজারের মতো সরকারি জায়গায়!

এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জায়গায় গুলোতে   Homeless People যাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই , যারা দীর্ঘকালীন ভাবে কোন রোগে ভুগছেন বাড়ির লোক নেই বলে কমিউনিটিতে ফিরে যাবার সম্ভাবনা কম তারাই থাকেন। 


আর একটা গুরুত্বপূর্ণ হল- Disability Certificate। প্র্যাক্টিকাল সমস্যা হল অন্য কোন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মতো Schizophrenia এর Disability (অক্ষমতা) তো বাইরে থেকে বোঝা যায় না!আর Schizophrenia এর রোগীদের Insight(নিজের রোগ আছে কি নেই তাকে বুঝতে পারার ক্ষমতা) খারাপ থাকে!মানসিক রোগ যে Disability তৈরি করতে পারে তা একটা সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষই মনে করনে না! বরঞ্চ তারা মনে করেন এইসব রোগীরা  ইচ্ছে করে করছে!

তাই  Disability Certificate পেতে খুব সমস্যা হয়!

অন্যদিকে পারিবারিক দিক থেকে  ডিভোর্সের সম্ভাবনা বাড়ে!ফ্যামিলি সাপোর্ট যেখানে সবচেয়ে জরুরি তা ভেঙ্গে পড়ে!বেকারত্ব এবং কাজে করতে পারায় তারা যেকোনো পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে ওঠেন!যেকোনো রকম চাকরি খুঁজতে গেলে তাঁরা সামাজিক ভাবে গ্রহনযোগ্যতা পান না। যদিও বা কেউ উচ্চশিক্ষিত হন  সহজে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন না!পরিবারের লোকেরাও ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে যান! Schizophrenia এর রোগীরা তাই আরও বেশি একা হতে শুরু করনে।


এই সমস্যা থেকে সমাধানের দিকে কি কি ভাবে আমরা এগোতে পারি??


এক, সবার আগে Mental Helath Care Act, 2017 এবং Right to the Persons with Disability Act (RPwD Act 2016)  যেখানে মানসিক রোগীদের ন্যায্য দাবির কথা বলা আছে !এই দুটো আইনই একটা landmark আইন!একে দেশের সব জায়াগায় সঠিক ভাবে লাগু করা !যেখানে রুগীদের মানবধিকার নিয়ে কথা বলা আছে!Mental Helath Care এখন একটা অধিকারের প্রশ্ন তাই!

দুই, সব জায়গায় ইনডোর সার্ভিস এবং আউটডোর সার্ভিস জোরদার করা। গুরুত্বপূর্ণ Psychotropics Drugs  এর জোগান দেওয়া! Rehabitilation সেন্টার গুলোকে আরও সক্রিয় করে তোলা!

যদি এই সার্ভিস গুলো সঠিক ভাবে  না থাকে  তাহলে যে কোন রোগী বা তার পরিবার Mental Helath Care Act, 2017 অনুযায়ী  সরকারকে এটা প্রশ্ন করতে পারে!

যে নিজের অধিকার তিনি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জানাতে পারে এবং স্টেট বা সরকার তা শুনতে বাধ্য!কোনও কিছুর অজুহাত না দেখিয়ে  স্টেট বা সরকারের দায়িত্ব হল- Mental Helath Care সেই রোগের পৌঁছে দেওয়া যা থেকে উনি বঞ্চিত হচ্ছেন!    

তিন, পরিবারের লোকজন এর সহযোগিতা এই রোগের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ! একজন Chronic Schizophrenia এর রোগীর সঠিক পরিচর্জার জন্যে একজন লোক কে সবসময় তেই থাকতে হয়!

 তাহলে সেই  Care Giver এর   একটা বড় সময় এখানে কেটে যায়!  তাই Care Giver Pension এখন চর্চিত একটা ইস্যু!যে বাবা বা মা নিজের ছেলে বা মেয়ের দেখ-ভাল করার জন্যে নিজের পুরো জীবন

দিয়ে দিলো স্টেট কে তার দায়িত্ব নিতে হবে! একে অবিলম্বে  লাগু করা উচিত!

চার,  একদম শেষতম প্রান্তিক লোকটির কাছেও আমাদের পৌঁছে যেতে হবে! একটা Welfare Society  তে সেটাই তো কাম্য! কখনো Proactive approach নিয়ে কমিউনিটিতে আমাদের উপস্থিতি বাড়াতে হবে। 

পাঁচ, আগেই বলেছি Schizophrenia এর রোগীদের  মেডিসিন চালিয়ে যাওয়া উচিত! এই মহামারির সময়ে কিভাবে ওষুধ এর জোগান দেওয়া হবে তা ঠিক করতে হবে! Tele-Psychiatry এবং Tele-Psychotherapy Servicies চালু করা করা আরও বেশি সহজলভ্য করে তোলা! শুর করা! এই কথা গুলো হয়তো খুব আইডিয়াল শুনতে খুব ভালো! কিম্বা  তাত্ত্বিক বা থিওরিটিকাল। বাস্তবে কতোটা রূপায়িত করা সম্ভব তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আসে মনে!

যদি  সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, যদি প্রশাসনিক দক্ষতা আর সঠিক ব্যবহারিক জিনিসপত্রের জোগান থাকে তবে সমস্ত কিছু করা সম্ভব।যেখান থেকে আমরা   ৬০-৭০% সমস্যার সমাধান করতে পারি। 

ভ্যাক্সিনেশানের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে যে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মানসিক রোগীরা অনেক বেশি বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন! এখন সময় এটাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার বয়স্কদের পাশাপাশি মানসিক রোগীদের বিশেষ করে ডিমেনসিয়া বা সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ভ্যাক্সিন দেওয়া উচিত! কার আধার কার্ড বা অন্য ID Card   আছে কি নেই তা দেখতে গেলে মুশকিল! অনেক দিন ধরে ভোগা বেশির ভাগ মানসিক রুগীদের কাছেই কোনো পরিচয় পত্র থাকে না!  অনেক জায়গাতেই এটা শুরু হয়েছে-বিশেষ করে কর্ণাটকে  আধার কার্ড বা অন্য ID Card ছাড়া মানসিক রোগীদের ভ্যক্সিন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে!


পৃথিবী বিখ্যাত লেখক Jonathan Harnisch একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন “I have schizophrenia. I am not schizophrenia. I am not my mental illness. My illness is a part of me.” অতএব কাউকে সিজোফ্রেনিক বলে সহজে চিহ্নিত বা স্টিগমাটাইস করে দেবো না।বর্নণা দেওয়া উচিত একজন মানুষ যার  সিজোফ্রেনিয়া আছে-এই ভাবে।  A person with mental illness. এইটা বলার মধ্যে দিয়ে শুরু করতে হবে!


সবশেষে  এটাই বলার যদি শুরু থেকে রোগীর লক্ষ্মণ বুঝে চিকিৎসা করা যায়! তাহলে Schizophrenia ভয়াবহ আকার নেওয়ার সম্ভাবনা কম! যেহেতু মানসিক রোগ কে নিয়ে ছুঁতমার্গ এবং স্টিগমা এর জন্যে প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয় না! আর ওষুধ অনেক সময়েই রোগীরা খেতে চান না! বা অনিহা থাকে( যাকে বলে Poor Adherence)!তখন  বাড়ির লোককে দায়িত্ব নিয়ে তখন ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়! (supervised medication )বার বার বলছি ওষুধ বন্ধ করা যাবে না- যদি কেউ মনে করে আমার রোগী ঠিক হয়ে গেছে ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে দেখি তাহলেই কিন্তু আবার ফিরে আসবে! মনে রাখবেন একটা বড়ো অংশের(৬০-৭০%) লোক কিন্তু Schizophrenia তে ওষুধ খেয়ে প্রায় সুস্থ থাকেন!

তাই সঠিক চিকিৎসার মধ্যে থাকা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেশাদার ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া ও পরিবারের পাশে থাকা, সুস্থ Rehabilitation প্রক্রিয়া সব মিলিয়ে সিজোফ্রেনিয়াকে আমরা জয় করতে পারি!

বাচ্চা মানুষ করার এককুড়ি টিপস -সৌম্যকান্তি পান্ডা (বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ)
Nov. 19, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:876 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১. শিশুর জন্মের পর প্রথম ৭-১০ দিনে জন্মের সময়ের ওজনের ৮-১০ শতাংশ ওজন কমে যায়। এটা একদম স্বাভাবিক। বিশেষত যে সব শিশু সঠিক সময়ের আগে (৩৭ গর্ভ-সপ্তাহের আগে) জন্মায় তাদের ক্ষেত্রে এই ওজন কমে যাওয়ার পরিমান বেশি হয়।


২. শিশুকে চড়া রোদের তলায় রাখবেন না। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।


৩. গর্ভাবস্থায় শরীরে প্রচুর জল জমে যায় ভেবে অনেকে মা'কে চড়া রোদে বসিয়ে আর জল কম খেতে দিয়ে শোকানোর চেষ্টা করেন। এটা করবেন না। জলের অভাবে বুকের দুধের পরিমান কমে যেতে পারে।


৪. নবজাতক মধু খেয়ে মিষ্টভাষী হয় না। বরং এতে পেটে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।


৫. পেচ্ছাব করার আগে কান্না মানেই মূত্রনালীর সংক্রমণ নয়। মূত্রথলি ভর্তি হয়ে গেলে বাচ্চা অস্বস্তির কারনে কাঁদতে পারে। পেচ্ছাব হয়ে গেলে এই কান্না ঠিক হয়ে যায়। পেচ্ছাব হওয়ার সময় কান্না নিয়ে বরং চিন্তা থাকে। বুঝতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


৬. শিশুকে জন্মের কয়েক ঘন্টা পর থেকেই তেল মাখানো যেতে পারে। কম ওজনের অপরিনত বাচ্চার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আটকাতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নিতে পারে। সুগন্ধীবিহীন নারকেল তেল দিয়েই হাল্কা মালিশ করতে পারেন।


৭. সরষের তেল মাখানো যাবে না। সরষের তেল রান্না করা-মাছ ভাজার জন্য। বাচ্চাকে মাখানোর জন্য নয়। "সরষের তেল দিয়ে বাচ্চার ঠান্ডা কম লাগে আর নারকেল তেল দিলে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শুরু হয়ে যায়"--ভুল ধারনা। বরং সরষের তেলের ইরিট্যান্ট থেকে বাচ্চার র‍্যাশ বেরোতে পারে।


৮. নাভীর নাড়ি খসে না পড়া অব্দি স্পঞ্জিং করুন।জন্মের ২৪ ঘন্টা পর থেকেই স্পঞ্জিং শুরু করা যায়। নাড়ি খসে গেলে স্নান করান। প্রথমে ২-৩ দিন ছাড়া করালেও ক্ষতি নেই। মাথায় সবার শেষে জল লাগাবেন।মুছে ফেলবেন সবার আগে। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে স্নান বন্ধ করবেন না। অপরিষ্কার ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে।


৯. পাউডার জাতীয় কিছু দেবেন না। বোরিক অ্যাসিড মেশানো কোনও কসমেটিকস দেওয়া নৈব নৈব চ। কাজল দেবেন না। চোখে তো নয়ই, মুখের কোথাওই দেওয়া ঠিক নয়। কাজল দিয়ে সব 'নজর' আটকে গেলে এত খরচ করে হাসপাতাল বানানোর দরকার পড়ত না।


১০. প্রথম ছ'মাসে শুধুই বুকের দুধ। 'পেট ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে,বাচ্চা খিদেয় শুকিয়ে যাচ্ছে, বুকে দুধ নেই' এগুলো অধিকাংশ সময় ভুল ধারনা। যে বাচ্চা দিনে ন্যূনতম ৬-৭ বার পেচ্ছাব করছে, দুধ খেয়ে ২-৩ ঘন্টা ঘুমোচ্ছে এবং ওজন বাড়ছে, তার বুকের দুধের খেতে সমস্যা হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বাইরের দুধ দেওয়া যাবে না। 


১১. দুধ তোলা মানেই বমি নয়। সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাও সারাদিনে ৮-১০ বার বা তারও বেশিবার দুধ তুলতে পারে। ওজন ঠিক থাকলে এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা না থাকলে দুধ তোলা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। প্রত্যেকবার দুধ খাওয়ার পরে ঢেকুর তোলান, মাথার দিক উঁচু করে শোওয়ান। বমির সাথে তফাত করতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন বলাই বাহুল্য। 


১২. দুধ খাওয়ার পরে পরেই অল্প অল্প করে সারাদিনে ১৫-২০ বার পায়খানা করাও অস্বাভাবিক নয়। এটা অনেকটা রাস্তার ট্রাফিকের মত। পাকস্থলীতে খাবার এলেই সংকেত যায় রাস্তা পরিষ্কার করার। ফলস্বরূপ বৃহদন্ত্রের মধ্যে জমে থাকা মল বেরিয়ে যায়। 

১৩. এবং গ্যাস! মাথায়ও ওঠে না, হাঁটুতেও নামে না।


১৪. দুগ্ধপোষ্য শিশুর অর্ধতরল পায়খানা লিভারের দোষে নয়। লিভার টনিক খাইয়ে লিভারকে শক্তিশালী করে ডাম্বেল তোলার উপযুক্ত করা যাবে ভাবলে ভুল করছেন। 


১৫. সামান্য কয়েকটি গুরুতর অসুখ ছাড়া বুকের দুধ কখনোই বন্ধ করার দরকার হয় না। মায়ের সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি এসবের জন্য তো নয়ই।


১৬. এক বছর বয়সের আগে গরুর দুধ না দেওয়াই ভালো। বাজারচলতি প্যাকেটের গুঁড়ো খাইয়ে টলার-স্ট্রংগার-শার্পার করা যায় না। মাথায় রাখুন, রবি ঠাকুর আর আইনস্টাইনের সময় এগুলো বাজারে ছিল না। 


১৭. কলা বা টক জাতীয় ফল খেয়ে ঠান্ডা লাগে না। বরং তার মধ্যে থাকা প্রচুর পরিমান খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে।


১৮. মোটা হওয়া মানে স্বাস্থ্য হওয়া নয়। মুটিয়ে যাওয়া কিংবা হাড় জিরজিরে হয়ে যাওয়া দুটিই অস্বাস্থ্য। দুনিয়ার যাবতীয় ফাস্ট ফুড আর প্যাকেটের খাওয়ার খাইয়ে শিশুকে জ্যান্ত ফুটবল বানাবেন না।


১৯. এক বছর বয়েসের পর স্বাভাবিকভাবেই শিশুর বৃদ্ধিহার কমে আসে। ওজন বাড়ছে না ভেবে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। এতে শিশুটি খাবার দেখেই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে।


২০. নিয়ম মেনে ভ্যাকসিন দিন। নিজে নিজে বা পাড়ার কোয়াকের পরামর্শে মুড়ি মুড়কির মত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াবেন না। মনে করিয়ে দিই, শুধু ভারতে বছরে ৫৮০০০ শিশু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়ার আক্রমণে মারা যায়। শিশুকে যত্ন করা মানে সারাদিন আঁচলে ঢেকে রাখা নয়। দুবার আছাড় খাক, তিনবার হাঁটু ছড়ুক, ধুলোমাটি একটু ঘাঁটুক.. প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠাটাও একটা শিক্ষা।

 https://thedoctorsdialogue.com/few-tips-of-child-parenting/

নাগমণি কি সত্যিই আছে? -পিন্টু হালদার
Nov. 19, 2024 | বন্যপ্রাণ | views:881 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কথায় বলে, সাত রাজার ধন নাগমণি অর্থাৎ সাত জন রাজার ধন সম্পত্তি একত্রিত করলে নাগ মণির মূল্যের হবে। নাগমণির উল্লেখ পুরান এমনকি সিনেমাতেও পেয়েছি সেই থেকে আমাদের ধারণা যে নাগমণি থাকলেও থাকতে পারে! সেই নিয়ে দু চার কথা খোলসা করে বলার চেষ্টা করছি।


প্রথমেই বলে রাখি নাগমণি মানুষের কল্পনা মাত্র অনেকটা স্পাইডার ম্যান বা এন্ডগেমের থানোস-এর  ইনফিনিটি স্টোনের মতো যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।


1. বলা হয় যে সাপ 100 থেকে 1000 বছর বাঁচবে সেই সাপ সাপেরদের রাজা হয়ে যাবে এবং মণি তার মাথায় ধারণ করবে :-  


 >কিন্তু কথা হলো সাপ ওতো দিন বাঁচে না। আলাদা আলাদা সাপের আয়ুষ্কাল আলাদা আলাদা! যেমন হেলে সাপ প্রায় 5 থেকে 6 বছর বাঁচে । দাঁড়াস, কেউটে, গোখরো বাঁচে  প্রায় 11 থেকে 12 বছর। ভারতীয় অজগর বাঁচে 34 থেকে 35 বছর। তাই কোনো সাপই 100 বছর বা তার বেশি বাঁচে না তাই মণির ধারণা সম্পূর্ণ ভারতীয় কুসংস্কার!


2 .যে সাপ কোনো দিন কামড়ায় নি সেই সাপের বিষ জমে শক্ত হয়ে পাথর হয়েযায় আর বিষের জন্য ঝলমল করে:- 


>বিষধর সাপ তার শিকার করতে তার বিষের প্রয়োগ করে। শিকার ছাড়া না খেয়ে সাপ বাঁচবে কি করে? 


3. সাপ বুড়ো হয়ে গেলে নাগমনির আলোর সাহায্যে শিকার করে:-


 >কিছু সাপ দিনে চলা ফেরা করে ও কিছু সাপ রাত্রে চলা ফেরা করে! যারা রাত্রে চলাফেরা করে সেই সাপেদের চোখ অনেকটা বিড়ালের চোখের মতো হয় যাতে অল্প আলোতেও দেখতে পায়। তাছাড়া সাপ যেহুতু চোখে ভালো দেখতে পায় না তাই জিভ ও রিসেপ্টর বা সংবেদনশীল অঙ্গ এর উপর ভরসা করে (কিভাবে জিভ ও সংবেদনশীল অঙ্গ দিয়ে সাপ বুঝতে পারে তা পরে আলোচনা করবো) তাই নাগমনির আলোর কোনো দরকার নেই সাপের।


4 . সে সাপের নাগমনি আছে তারা ইচ্ছাধারী হয়, মানে যা ইচ্ছে হতে পারবে:- 


 >এগুলো হিন্দি সিনেমা থেকে আমাদের মাথায় ঢুকেছে বাস্তবে কখনো হয় না। লেখক গুল্প রোমাঞ্চিত করার জন্য এরকম প্লট সৃষ্টি করেন। সেটা নিয়ে মজা না পেয়ে, মাথায় ঢুকিয়ে নিজের মস্তিষ্কে কুসংস্কারের সংক্রমণ ঘটানো বোকামি। বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই!


5. সাপুড়েরা চোখের সামনে সাপের মাথার থেকে মণি বের করে দেয়!আর তুমি বলছো কুসংস্কার?:-   


 >সাপুড়েরা সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ভাবে বোকা বানিয়ে টাকা লুট করে চম্পট দেয়! সাপের মাথার থেকে মণি বের করা টাও একটা ভেলকি সেটা হলো - একটা ফনাধর সাপ নিয়ে বিশেষ করে গোখরো! (আমরা ফনাধর সাপ দেখলে রোমাঞ্চিত হই কিনা! স্বয়ং শিব সেও গলায় রাখে এই সাপ কে!) যাক সে নিয়ে অন্যদিন বলা যাবে । আসল কথাতে ফিরে আসি! তো এই গোখরো সাপ নিয়ে সাপটির লেজের উপরে  ছোট্ট ফুটো করে সেখান থেকে  কালো ,লাল চকচকে পাথর বা কাঁচের স্ফটিক ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু তাকে তো লেজে রাখলে হবে না আমাদের বিশ্বাস সেটা সাপের মাথায় থাকে! তাই সাপুড়েরা সেটাকে টিউবের মতো চেপে চেপে ঠেলতে ঠেলতে মাথায় নিয়ে আসে। (অনেকটা দাদুর আন্ডার প্যান্টের মতো যেভাবে সেফটি পিন দিয়ে দড়ি ঢোকানো হয় তেমনি)

এবার সাপুড়েরা অপেক্ষায় থাকে কাকে বোকা বানানো যায়! আপনার বাড়িতে সাপ টা ছেড়ে দিয়ে বলবে আমি একটা সাপের গন্ধ পাচ্ছি! মনে হয় খুব পুরনো সাপ মণি থাকতে পারে! ব্যাস আপনিও বললেন খুঁজুন খুঁজুন!  সাপুড়েদের ওস্তাদ আপনাকে  সাপের ভয়ংকর কথা বলে ব্যস্ত রাখছে অন্যদিকে তার চ্যালারা একটু মাটি নিয়ে এসে বললো ওস্তাদ দেখুন তো (সাপেদের গায়ে সব সময় গন্ধ থাকে না মেটিং সিজিনে ফেরোমনের কটু গন্ধ থাকে কিন্তু সেটা মাটি শুকে বলা যায় না! মাটি শুকে যদি বলে দিতেই পারতেন ওনারা তাহলে ওনাদের দিয়ে ল্যান্ড মাইন খোজানো হয় না কেন!) ওস্তাদ গন্ধ নিয়ে বিজ্ঞের মতো বললো এটা এটা গোখরো ,ফনিমনসা বা শীষ নাগ (যেটা আগে থেকেই ছেড়ে রেখে ছিল) ব্যাস সাপ টা ধরে আনা হলো । এই বার সে  সাপেরমাথায় হাত দিয়ে বলবে এই অংশটা ফুলে আছে দেখুন মণি আছে! কেটে বের করে দিতে পারি 10000 বা 50000 টাকা লাগবে! (মুরগির বাড়ির সাইজের উপর ডিপেন্ড করে কতো টাকা চাইবে) আপনিও শুনেছেন সাত রাজার ধন সম্পতি একত্রিত করলে এই মণি সমান হয় আপনি কোটিপতি হয়ে যাবেন। ব্যাস সাপের মাথা কেটে একটা পাথর বের করা হলো (যেটা আগে থেকেই সাপুরেরা ঢুকিয়ে রেখেছিল) আপনিও আনন্দে গদগদ হয়ে টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। আপনাকে বলা হলো এখন সদ্য বের করা হয়েছে তো তাই আলো বের হচ্ছে না পুজো দেবেন আস্তে আস্তে আলো হবে আর আপনার ধন সম্পত্তিও বাড়বে। এই বলে সাপুড়েও চম্পট দিলো !আর ,পরে আলোও বের হবে না আর আপনার সম্পত্তিও বাড়বে না এই মণি থেকে। আপনি আস্ত মুরগি বনে গেলেন!


একবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন তো যদি মণি বলে কোনো জিনিস থাকতো বা মণির এমন ক্ষমতা থাকতো তাহলে সাপুড়েরা আপনাকে বিক্রি করবে কেন? ওরা নিজেরাইতো ধন সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত তাই না?


তারচেয়ে একটু জানার চেষ্টা করুন। কুসংস্কার গুলো মাথা থেকে টেনে ছুড়ে ফেলুন!   চোখের সামনের সাপুড়েদের এই অমানবিক কার্যকলাপ দেখলে তাতে বাধাদিন। পুলিশে খবর দিন। সাপ পোষা, সাপ নিয়ে খেলা দেখানো, ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই প্রাণী গুলিকে বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব।

   সুতরাং সাপুড়ের কাছে নিজে মুরগি হওয়ার চেয়ে মুরগি কিনে খাওয়া ভালো!

কেন আমি অজ্ঞেয়বাদী? -পরাগ সেন
Nov. 19, 2024 | যুক্তিবাদ | views:2392 | likes:25 | share: 0 | comments:0

ধর্ম, ভূতপ্রেত, আত্মা, আত্মার বিভক্ত হওয়া ও তার ট্রান্সফার এগুলো শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। তবে দুটো জিনিস আমাকে খুব অবাক করে, যার জন্য আমি অজ্ঞেয়বাদী, কিন্তু আস্তিক বা নাস্তিক কোনোটাই নই। একটি হল শক্তি, অপরটি হল জীবন/চেতনা/নিজের শরীরের মাধ্যমে নিজের বহিঃপ্রকাশ, নিজস্ব অনুভূতি বা আত্মপলব্ধি। এবার বলি, গন্ডগোলটা কোথায় কোথায়?


(১) পদার্থবিজ্ঞানে শক্তির কোনও মৌলিক সংজ্ঞা দেওয়া ভীষণ মুশকিল। ইন ফ্যাক্ট, নেই।

(২) মনে করা হয়, মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ (ধনাত্মক শক্তি বা ভর এবং ঋণাত্মক শক্তি বা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র কাটাকুটি করে) শুন্য। কিন্তু কিভাবে প্রথম শক্তির উপস্থিতি সম্ভব হল তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরমুহূর্তের (১০^-৩৬ সেকেন্ড অবধি) কথা জানা যায় না। গুথের ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং মডেল (যা বর্তমানে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য) বলে, "Just before the Big Bang, space was filled with an unstable form of energy, whose nature is NOT YET KNOWN. At some instant, this energy was transformed into the fundamental particles from which arose all the matter we observe today. The known laws of nature can in principle explain where the matter and energy in the universe came from, PROVIDED THERE WAS AT LEAST A TINY SEED OF ENERGY TO BEGIN WITH" (সূত্র: Harvard Smithsonian Center for Astrophysics).

এখন প্রশ্ন, এই শক্তি/ম্যাটার, স্থান, সময় কোথা থেকে ও কেন এল? স্ট্রিং থিওরি দিয়ে একে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। এই মত অনুযায়ী অন্য কোনও মহাবিশ্বের সাথে সংঘর্ষের ফলে আমাদের মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। সেখানেও প্রশ্ন উঠবে আগের মহাবিশ্বের উদ্ভব কিভাবে?


(৩) এলান গুথের তত্ত্ব অনুযায়ী "A small volume of space occupied by a virtual particle pair (due to quantum fluctuations) could have ballooned to become the vast universe we see today. Alan Guth, one of the main brains behind inflationary cosmology, thus described the universe as-the ultimate free lunch." এখানেও সেই একই প্রশ্ন এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্থানের আবির্ভাব কিভাবে? আর কেন স্থান 'নেই' না হয়ে 'আছে'?

তাছাড়া অবজার্ভবল ইউনিভার্সের বাইরের খবর জানা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, infeasible. মনে করা হয়, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত ও ত্বরান্বিত হচ্ছে। কিন্তু স্থানের আবির্ভাব ব্যাপারটাই বেশ অদ্ভুত। আবার অন্যদিকে স্থানহীনতা আমাদের কল্পনার বাইরে। একটা লিংক দিলাম। https://www.quora.com/What-caused-the-Big-Bang-6?

(৪) বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, 'ঈশ্বর থাকতে পারেন, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি রহস্য ব্যাখ্যার জন্য তাঁকে প্রয়োজন নেই'। কারণ হকিং মাল্টিভার্স থিওরিতে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর মতে অন্য মহাবিশ্বের সাথে সংঘর্ষের ফলে আমাদের মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে। কিন্তু মাল্টিভার্স থিওরি সম্পর্কে বিরোধিতা বা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কসমোলোজিস্ট পল ডেভিস বা নোবেলজয়ী ডেভিড গ্রসের মত পদার্থবিদরা। মাল্টিভার্স থিওরিতে প্রশ্ন উঠতে পারে আগের মহাবিশ্ব কিভাবে ও কেন আবির্ভাব হল! 'মাল্টিভার্স এমনিই আবহমান কাল ধরে আছে' এই বক্তব্যের সাথে 'ঈশ্বরকে কেউ তৈরী করেননি, ঈশ্বর (impersonified God) এমনিই আবহমান কাল আছেন'-এই বক্তব্যের মূলগত তফাৎ কোথায়!


(৫) মনে করা হয়, পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব হয় আনুমানিক ৩৫০ কোটি বছর পূর্বে মাইক্রোঅর্গানিসম-এর মাধ্যমে, সম্ভবত ধূমকেতুর থেকে। এর প্রমাণ মেলে সমুদ্রের তলদেশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের অবশেষ থেকে। RNA World Hypothesis থিওরিটা অনেকটা এইরকম। কেমিক্যাল স্যুপ (সমুদ্রের জল+ধূমকেতুর রাসায়নিক পদার্থ)---RNA---প্রোক্যারিওট (যেমন, ব্যাকটিরিয়া, আর্কিয়া)---বিভিন্ন ধরণের প্রোক্যারিওটের সহাবস্থানের ফলে (Endosymbiotic Theory) প্রোটিস্ট---দু'ধরণের প্রোটিস্ট প্রোটোজোয়া (সালোকসংশ্লেষে অক্ষম শুধু মাইটোকন্ড্রিয়া বিশিষ্ট) এবং প্রোটোফাইটা (সালোকসংশ্লেষে সক্ষম সবুজ প্লাস্টিড এবং মাইটোকন্ড্রিয়াবিশিষ্ট)---প্রাণী এবং উদ্ভিদ যথাক্রমে। এই হিসাবে দেখতে গেলে প্রাণী থেকেই উদ্ভিদের উদ্ভব হয়েছে। প্রাণী ও উদ্ভিদ উভয়েরই প্রাণ আছে। ল্যাবরেটরিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? প্রাণের সংজ্ঞাই বা কি?

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের জিনোম টেকনোলজি সেন্টারের ডিরেক্টর Dr. Adriana Heguy-র বক্তব্য অনুযায়ী ল্যাবরেটরিতে একদম স্ক্র্যাচ থেকে বা শুধুমাত্র জড়পদার্থ থেকে কোনও জীবিত কোষের সাহায্য ছাড়া প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এমনকি গবেষক Craig Venter-এর সিন্থেটিক ব্যাকটিরিয়া জিনোম সংক্রান্ত যুগান্তকারী গবেষণাটির (২০১০) ক্ষেত্রেও এই একই বক্তব্য প্রযোজ্য। নিচের তিনটি লিংক দেখা যেতে পারে।

1) https://www.quora.com/Have-any-of-the-experiments-to-create-life-been-successful

2) https://www.quora.com/Has-life-been-created-in-the-laboratory

3) https://www.quora.com/Who-was-the-scientist-who-recently-made-life-from-scratch-Can-anyone-provide-the-details-of-this-experiment

সাম্প্রতিককালে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশিত তমাল দাস ও তাঁর টিমের একটি গবেষণায় (২০১৯) উঠে এসেছে-"energetically feasible interactions between just two small molecules -- hydrogen cyanide and water -- could give rise to most of the important precursors of RNA and proteins." এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত করেছে, কিন্তু সেটি কৃত্তিম প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়।


(৬) প্রাণকে কি সংজ্ঞায়িত করা যায়? না, যায় না। প্রাণের কোনও মৌলিক সংজ্ঞা নেই। প্রাণের প্রধাণ এবং সাধারণ ধর্ম শারীরবৃত্তীয় কার্যসমূহ পরিচালনা করা বা উল্টোটা। অর্থাৎ শারীরবৃত্তীয় কার্যসমূহ পরিচালিত হয় বলে প্রাণ থাকে। মেশিনের মত। কিন্তু পুরোটা তাও নয়। উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া প্রাণের একটি বৈশিষ্ট্য হতে পারে। কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়। কোমায় চলে যাওয়া ব্যক্তি (গ্ল্যাসগো কোমা স্কোর খুব কম হলে) উত্তেজনায় সাড়া নাও দিতে পারে, কিন্তু তবু শারীরবৃত্তীয় কার্য চললে তাকে মৃত বলা যায় না। প্রাণের আরও একটি ধর্ম হল চেতনা অর্থাৎ নিজের মস্তিষ্ক তথা শরীরের মাধ্যমে নিজেকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা, নিজের অস্তিত্বকে বোঝা। কিন্তু সেটাও সর্বৈব নয়। ঘুমন্ত প্রাণীর (যে স্বপ্ন দেখছে না) চেতনা থাকে না, কিন্তু শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী চলায় তাকে মৃত বলা যায় না। আবার, স্পঞ্জের মত প্রাণী উচ্চ চেতনাসম্পন্ন নয়। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে প্রাণকে সংজ্ঞায়িত করা কত ঝামেলার ব্যাপার! প্রাণ নিছক মেশিনের সচলতার মত নয়, আবার ক্ষেত্রবিশেষে তাই-ও।


(৭) এবার অনুভূতি বা চেতনার প্রশ্নে আসি। প্রথমে সৌপর্ণ অধিকারীর এই লেখাটি পড়ে দেখা যেতে পারে। 

https://www.facebook.com/groups/2000118743332714/permalink/3678177875526784

সব অনুভূতির প্রমাণ সম্ভব নয়। অন্ধকে যতই বোঝানো হোক হাতি এইরকম চোখে না দেখলে হাতির ধারণা করা সম্ভব নয়। যে কোনওদিন রসগোল্লা খায়নি তাকে হাজার যুক্তি বিবৃতি দিয়েও বোঝানো সম্ভব নয় যে ওটার স্বাদ ঠিক কিরকম। যার কোনও দিন হাত পা কাটেনি তাকে ব্যাথা বোঝানো সম্ভব নয়, কারণ ব্যাথা মেসারমেন্টের না আছে কোনও যন্ত্র, না আছে কোনও ইউনিট (ডেল ইউনিট বাতিল হয়ে গেছে)। মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর জাগ্রত অবস্থা (চেতনা) নিয়ন্ত্রণ বা প্রমোট করে ওরেক্সিন বা হাইপোক্রেটিন নামক নিউরোপেপটাইড [short chains of amino acids linked by peptide (amide) bonds]। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০০০-২০০০০ ওরেক্সিন উৎপাদনকারী নিউরোন বা স্নায়ুকোষ থাকে। ভিন্ন ভিন্ন খাঁচায় (শারীরিক কাঠামোয়) গ্র্যাজুয়ালি ভিন্ন ভিন্ন চেতনার জন্ম হয়। গ্র্যাজুয়াল কেন? কারণ ঠিক কবে থেকে আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব বুঝতে পারি তা আমাদের নিজেদেরই অজানা। মোটামুটিভাবে যেটুকু বলা যায় তা নিচের লিঙ্কে পড়ে দেখা যেতে পারে।

https://www.scientificamerican.com/article/when-does-consciousness-arise/

এখন সমস্যা হচ্ছে কেন ওরিক্সিন চেতনার জন্ম দেয় বা একজনকে তার 'আমিত্ব' বুঝতে সাহায্য করে তা খুব একটা পরিষ্কার নয়। আমি আমার খাঁচায় শুধু 'আমিত্ব' অনুভব করি। যখন ঘুমাই (স্বপ্ন না দেখা অবস্থায়) বা অচেতন থাকি, তখন আমার খাঁচায় আমি কোনও 'আমিত্ব' উপলব্ধি করতে পারি না। যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হই, তখন আবার আমি আমার খাঁচায় 'আমিত্ব' উপলব্ধি করি, কিন্তু অন্যের খাঁচায় করি না। প্রতিটা খাঁচার 'আমিত্ব' চেতনা হলেও তারা স্বকীয় এবং ভিন্ন/আলাদা-আলাদা। সুতরাং জাগ্রত অবস্থার 'আমিত্ব' নিছক ওরিক্সিন কেন্দ্রিক চেতনার চাইতেও বেশি কিছু যা একই খাঁচায় বারংবার জাগ্রত হতে পারে, কিন্তু অন্য খাঁচায় ট্রান্সফার হতে পারে না।

সমস্যার জায়গা মূলতঃ দু'টো। প্রথমত, জড় পদার্থ থেকে প্রাণের আভির্ভাব, ব্যাপারটা অদ্ভুত। এই একই কাজ ল্যাবরেটরিতে একদম স্ক্র্যাচ থেকে করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, শারীরিক গঠন এবং শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী চেতনা তথা আমিত্বের জন্ম দিলেও আমিত্ব ব্যাপারটাই স্বকীয়। আমার 'আমিত্ব' অন্য খাঁচাতেও উপলব্ধি করতে পারতাম। কিন্তু কেন তা আমার খাঁচায়ই, অন্য খাঁচায় নয়, তা অজানা। অর্থাৎ, সহজ কথায় কেন আমি অন্য কেউ নই, তা অজ্ঞাত। শারীরিক গঠন ও শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলীর বিভিন্নতা ভিন্ন ভিন্ন চেতনা তথা আমিত্বের জন্ম দেয় কিনা উইল রিমেইন আননোন ফরএভার।


উপসংহার:

(১) অনেক মানুষের বক্তব্য বিজ্ঞান তো অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারে না। তাহলে কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে! না, এরকম কেউ মাথার দিব্যি দেয় নি যে 'ঈশ্বর' নামক বড়বাবুর অস্তিত্ব তাই বলে স্বীকার করতে হবে। কেউ যদি তাকে 'প্রকৃতি' বলে খুশি হন, হোন না, কে বারণ করেছে! কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু বক্তব্য আছে। বিজ্ঞান অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে না তো ঠিকই, ইন ফ্যাক্ট বেশির ভাগ সমস্যারই সমাধান করতে পারে না। এদের মধ্যে হয়তো কিছু সমস্যার সমাধান ভবিষ্যতে হবে, কোনও সমস্যার সমাধান হয়তো কোনও দিনই হবে না। কিন্ত এই সমস্যাগুলোর মধ্যেও চরিত্রগত দিক আছে। অধিকাংশ সমস্যারই মূল কারণ পরিমাপজনিত সমস্যা বা যথাযথ মডেল ডেভেলপমেন্টের অসুবিধা। বস্তুত এগুলো কোনও ফান্ডামেন্টাল প্রবলেম আদৌ নয়। কিন্তু আমরা আমাদের যত জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করব তত দেখব যে আমরা আসলে ফান্ডামেন্টালি প্রায় কিছুই জানি না, কিচ্ছুটি না। 

শক্তির সংজ্ঞা আমাদের অজানা, মহাকর্ষের প্রকৃতি আমাদের অজানা, সবচেয়ে বড় কথা কেন স্থান আদৌ আছে (নাও তো থাকতে পারত, স্পেসটাইমের অস্তিত্বই না থাকতে পারত) বা কেন সময় একইদিকে ধাবিত হয় (অন্যভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ড শুরুর ক্ষেত্রে এনট্রপি কেন ভীষণ কম ছিল) এই বেসিক প্রশ্নগুলোর উত্তরই আমাদের অজানা। একটা সফটওয়ার কিভাবে বানানো হয়েছে সেটা না জেনে সফটওয়্যারটা ব্যবহার করা যেরকম ব্যাপার এটা খানিকটা তেমনই। এর মানে বিজ্ঞানীদের আমি সমালোচনা করছিনা, তাঁদের প্রচেষ্টাকে সর্বদাই কুর্নিশ। কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে নাস্তিক বিজ্ঞানী যেমন আছেন, অজ্ঞেয়বাদী বিজ্ঞানীর সংখ্যাও প্রচুর। স্বয়ং আইনস্টাইন অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। 

মূল কথা এটাই যে এই ফান্ডামেন্টাল ইগনোরেন্স (যা কোনোদিনই জানা সম্ভব নয়, almost infeasible) আর পাঁচটা বিজ্ঞানের না জানার মত নয়। তাই এমন কিছু চিরকাল থাকবে যা সবসময়ই মানুষের মনে শুধু বিস্ময়েরই সৃষ্টি করবে না, অকল্পনীয়ই থাকবে।  


(২) এখানে একটা কথা বলা দরকার। পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বিজ্ঞানীই কিন্তু ধর্ম এবং ঈশ্বরচেতনাকে এক ও অভিন্ন দেখেন। তাই তাঁদের কাছে অজ্ঞেয়বাদ নাস্তিকতার অনেক নিকট। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আস্তিকতা এবং ধর্মের গালগল্পকে অস্বীকার করবেন। যেহেতু আস্তিকতা ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত তাই সেটাকেও অস্বীকার করবেন। কিন্তু আমাদের দেশের বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী ডঃ মণি ভৌমিকের মত মানুষেরা ঈশ্বরচেতনা ও ধর্মকে আলাদা করতে পারেন। কিছু পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীও পারেন। সামাজিকভাবে বা কমিউনিটিগত ভাবে অবশ্যই এর কোনও মানে হয় না, কারণ সামাজিক ক্ষেত্রে ঈশ্বর ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু ইন্ডিভিডুয়ালি তার মানে আছে বৈকি। এরকম মানুষ খুব কম সংখ্যায় হলেও সমাজে আছেন যাঁরা মনে করেন ঈশ্বরচেতনা ও ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক, ঈশ্বরচেতনাকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম নামক ভণ্ডামির উৎপত্তি হয়েছে। এই দলে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ আরনো এলান পেনসিয়াস থেকে শুরু করে হার্ভার্ড মেডিসিন স্কুল ও জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির নোবেলজয়ী রসায়নবিদ ক্রিস্টিয়ান এনফিনসেনের মত বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আছেন। এনফিনসেনের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল: 

“I think that only an idiot can be an atheist! We must admit that there exists an incomprehensible power or force with limitless foresight and knowledge that started the whole universe going in the first place.”


আমার ব্যক্তিগত মতামত আস্তিকতা ও নাস্তিকতা উভয়ই গোলমেলে। অজ্ঞেয়বাদ সুবিধাবাদী বা ডিপ্লোম্যাটিক হলেও অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য তার স্ট্রং স্টেটমেন্টের জন্য। অজ্ঞেয়বাদের বক্তব্য খুব সিম্পল-"We don't know and probably will never know how and WHY existence had come into existence in the first place. We don't know why 'I am ME'. Hence, mystery will remain forever." এবার এই রহস্যময়তাকে (যা আর পাঁচটা সাধারণ বিজ্ঞানের অজানার মত নয়) কেন্দ্র করে ঈশ্বর, প্রকৃতি, ভূতপ্রেত, ব্রহ্মদৈত্য যে যা খুশি বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারেন।

অজ্ঞানতার বিজ্ঞাপন -মহম্মদ মহসীন
Nov. 19, 2024 | যুক্তিবাদ | views:888 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্ম প্রকৃতই অন্তঃসারশূন্য। তবুও চারিদিকেই তার ব্যাপ্তি। এই বিস্তৃতির কারণ কী? মেজোরিটি ম্যাটারস। বিজ্ঞাপন আমাদের জীবনকে অনেকটাই  চালিত করে থাকে। নাস্তিকতা  মানুষকে অর্জন করতে হয়। ধর্মকে অর্জন করতে হয় না। জন্মের সাথে সাথেই তা ঘাড়ে চড়ে বসে।

মানুষ ধর্মকে অর্জন করে না গ্রহণও করে না। আবার বলতে গেলে বর্জনও করে না। বর্জন করতে চাই শিক্ষা।  ধর্ম হল  তার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া এক অন্ধবিশ্বাসের গুপ্তধন। যা নিয়ে সে বেশী নাড়াঘাঁটা করেও দেখে না। বরং ভক্তি ছেদ্দা করে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখে। তাই তার স্বরূপ বিশেষ বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না।

ছোট থেকেই তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট হতে থাকে ধর্মের নানান রিফ্লেক্স। অনুপ্রবিষ্ট হতে থাকে ধর্মাহংকার। তাই ধার্মিক মাত্রেই গর্বিত হিন্দু না হয় গর্বিত মুসলমান নাহয় গর্বিত অন্য কিছু। ধর্ম গর্বে গর্বিত। জীবনে আর সকল সমালোচনা স্বাগত হলেও, ধার্মিকের কাছে তার ধর্মের সমালোচনা মানেই এক নিষিদ্ধ বস্তু। ধর্মের সমালোচনায় ধার্মিক একেবারেই অসহিষ্ণু। ধর্মে প্রশ্ন নিষিদ্ধ। প্রশ্ন কোরো না।

শিশু এভাবেই বড় হতে থাকে। সে যত বড় হয়, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ে তার কুসংস্কার। তার অন্ধবিশ্বাস। জীবনশৈলীতে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে জড়িয়ে মানবিক যুক্তিশীলতার রস শুষে জীবনকে একটা দাসত্বের আধারে পরিণত করে। ধর্মের দাস হয়ে সে তখন গর্বিত ধার্মিক। কুসংস্কারাচ্ছন্নতার নির্বোধ প্রতিমুর্তি।

রাস্তার ধারে দেখবেন, হলুদ রঙের এক ধরণের লতা। কোনো গাছকে আশ্রয় করে বাড়ে। গাছটিকে ঢেকে ফেলে। গাছে রস খেয়ে তাকে ছিবড়ে করে দেয়। গাছটির নিজস্বতা আর থাকে না। বাইরে থেকে দেখতে সে যতই হোক না সোনার মতো লতা শোভিত। সোনার লতায় ঢেকে গিয়ে সে যায় লুকিয়ে।  তার কত না শোভা।

ধর্ম মানুষের যুক্তিশীল মনকে একেবারেই শেষ করে দেয়। ধর্মশৈলী প্রতিনিয়ত মানুষের যুক্তিশীলতার রস শুষে তাকে আর মানবিক ভাবনা ভাবানোর যোগ্যই রাখে না। 

একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। কোনো একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করলো, তাদের দলে যারা আসবে, তারা ক্ষমতা দখল করলে, খুন-ধর্ষণ-মদ-নারী বিলাসিতার ব্যবস্থা তারা করে দেবে। কী বলবেন? তাদের প্রতি আপনার মনোভাব কেমন হবে? এখন দেখবেন, ধর্মের ব্যাপারটাও তেমনই। দেখবেন, প্রায় প্রতিটি ধর্মে,  স্বর্গ,  স্বর্গে আমোদ প্রমোদ বিলাস ব্যসনের প্রলোভন দেখায়। মানুষকে প্রতিনিয়ত কুসংস্কারের অনুশীলনের মাধ্যমে তাতে বিশ্বস্তও করে তোলে।

  মানুষ নির্বোধ হলে নির্লজ্জও হয়ে থাকে।

দেখবেন, যারা হোমিওপ্যাথীর পক্ষে তারা জানেনই না যে উচ্চমাত্রার হোমিওতে এক বিন্দুও ওষুধ থাকে না। অথচ তারা ঔষধবিহীন চিকিৎসাতেও আগ্রহী নন। আসলে তাঁরা এই অজ্ঞানতা হেতু হোমিওতে আস্থা রাখেন। যাঁরা আঙুলে আংটি নিয়ে ঘোরেন, তাঁদের অজ্ঞানতার কারণেই এইসব স্টোন ধারণ করেন। ধারণ করেন, তবু লজ্জাও পান না।

এই নির্লজ্জতা গোটা সমাজে।

বহু কিছু পড়া শুনা করেছেন। ডিগ্রীও অর্জন করেছেন। এঁরা আত্মা মানেন, ভূত মানেন না!

যিনি আত্মা মানেন, ভগবান মানেন, ভূতও মানেন, তাকর মানামানির ব্যাপারটা বোঝা যায় যে নির্বুদ্ধিতার চূড়ায় থাকলে লজ্জার বালাই থাকেনা। নির্লজ্জভাবে আঙুলের আঙটি প্রদর্শনে এতটুকু কুণ্ঠিত নন। কিন্তু যিনি ভগবান মানেন, কিন্তু ভূত মানেন না, তাঁর লজিক বিশ্বাসসর্বস্ব লজিক।

ধার্মিকদের ভক্তি এক আজব বস্তু। ভক্তি যার স্কন্ধে ভর করে তাঁকে বলা হয় ভক্ত। প্রায়শ শিক্ষিত ধার্মিকে বলে থাকেন, তিনি সর্ব ধর্মের ভক্ত। নানা ধর্মে নানান বৈপরীত্য। কোনটি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, কোনটি বা বহু-ঈশ্বরে। সব ধর্মের ভক্ত অবশ্য  'এক = বহু'   ভাবতে সাগ্রহে অভ্যস্ত। একে নিছক মূর্খামি ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি?

  এবার এক নামকরা চিকিৎসকের কথা বলি। ইনি চিকিৎসাক্ষেত্রে এক অতি খ্যাতনামা ব্যক্তি। আমার সাথে কথায় কথায় জানালেন, উনি মকর স্নানে যাচ্ছেন। শুনে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, আমরা সাধারনত ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি শিক্ষকদেরও শিক্ষিত বলেই ভেবে থাকি।

এই চিকিৎসক ভদ্রলোকের কথাই বলি। ইনি বারো ক্লাসের পর থেকেই মেডিকেলে। ফিসিওলজি, অ্যানাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা, ডিসেকসন, ফার্মাকোলজি নিয়েই তাঁর জগৎ।

তিনি তাহলে শিক্ষিত হলেন আর কখন? অথচ দেখুন, তাঁকেই আমরা অনেকে বুদ্ধিজীবির দলে ফেলি।

যে ভদ্রলোক জীবন বোধের সিনেমা দেখেন, লাইব্রেরী থেকে বই এনে নিজের ছোট দোকানটিতে বসে বইটি পড়ে চলেন, দোকানে আসা লোকের সাথে সমাজ অর্থনীতি ধর্ম রাজনীতি নিয়ে নিজের মতামত উপস্থাপন করেন, তাঁর ডিগ্রী দেখে তাঁকে আমরা অনেকেই

শিক্ষিত বলতে আদৌ রাজী নই। এখানে নিহিত আছে ধর্ম ব্যাপ্তির সূত্র। অজ্ঞানতাই হ'ল ধর্ম ও ধার্মিকতার ভিত্তি।

গড্ডালিকাপ্রবাহে চিন্তাস্রোত অপরের ধারায় প্রবাহিত। এতে কখনই মনুষ্যত্বের বিকাশ হতে পারে না। অন্ধবিশ্বাস থাকে তাঁর মনে সারা জীবন। অশিক্ষা থেকেই যায়।  মূর্খামির জানান দেখা যায় ধর্মাচরণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত। তিনি নিজের মূর্খামির খবর জানতে পারেন না সারা জীবনেও।

   যে সকল ধার্মিক নিজেদের যুক্তিবাদী মনে করেন, তাঁরা চিন্তা করুন, আপনার ধর্ম কেন বাস্তব জমির উপর দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠীত করতে পারেনা। কেন তাকে অলীক অলৌকিক মিথ্যার শরণাপন্ন হতে হয়।

জন্ম যার মিথ্যাচার দিয়ে, সে জিনিস কিভাবে আপনাদের কাছে এত গ্রহণযোগ্যতা পায় কেন?

একটু ভাবুন। ভাববাদী কথা দিয়ে গোঁজামিল দিয়ে কখনই সত্যকে আশ্রয় করা যায় না।

কবিতাগুচ্ছ ১০ -কবিরা
Nov. 19, 2024 | কবিতা | views:884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

হায়, ধর্ম!

- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মাঠে মাঠে রবিশস্য বােনার কাজ চলছে সারাদিন নামলাে সন্ধ্যা

পাতলা অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়েছে দূরের পাহাড়

পাখিরা ফিরছে, বাতাস বইছে বিপরীত দিকে এখন ঘরে ফেরার সময়

যাদের ঘর নেই তারাও ফেরে

ওদের ক্লান্ত পা, গলায় গুনগুনে স্বর, মাথায় জড়ানাে গামছা

পাম্প হাউজে এসে টিউবওয়েলের জলে ধুয়ে নিল হাত মুখ

আঃ কী নির্মল, ঠাণ্ডা জল, ধরিত্রীর স্নেহ

জুড়িয়ে দেয় শরীর

একটা বিড়ির সুখটান, তারপর উনুন ধরাবার পালা কয়েকজন রুটি পাকাবে, দু-একজন রাঁধবে অড়হড় ডাল,

ভেণ্ডির সবজি

আর একজন না-সাধা গলায় গাইবে গান ;

"হােইহি সােই জো রাম রচি রাখা

কো করি তর্ক বঢ়াবৈ সাখা..."

যে গায় এবং যারা শােনে, তাদের এক ঝলক মনে পড়ে

সুদুর পূর্ণিয়া জেলার গ্রামের বাড়ি, ঘরওয়ালী ও

বাল-বাচ্চার মুখ ওরা এখন পঞ্জাবের ভাড়াটে চাষী

অন্যের জমিতে এক মৌসুমের ঠিকা

দিনভর সূর্য পােড়ায় মাথা, নিঙড়ে নেয় মজ্জা সন্ধেবেলা পেটের মধ্যেই জ্বলে উনুন, চোখ দিয়ে খাওয়া

ডাল-রুটি

তারপর খােলা আকাশের নীচে খাটিয়ায় চিৎপটাং বিড়িতে টান দিতে দিতে ঘুমােবার আগেই দেখা দু-একটা স্বপ্ন

জীবন এর চেয়ে বেশি কিছু দাবি করেনি...

রুটি সেঁকা হয়ে গেছে, ফুটন্ত ডালে যেই দেওয়া হলাে লঙ্কা

ফোড়ন

তখনই এলাে দুই আগন্তুক, হাতে সাব মেশিনগান ছদ্মবেশ ধরার কোনাে চেষ্টাই নেই, চোখে নেই দ্বিধা কেউ কারুকে চেনে না, এদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও শত্রুতা ছিল না

সেই দুই কাল্পনিক দেশপ্রেমিক ছেলেখেলার মতন চালিয়ে দিল গুলি

উল্টে গেল ডালের গামলা, ছড়িয়ে গেল বাসনা-নিশ্বাস লাগা

রুটি রাশি

জানলােই না কেন তারা মরছে , বুঝলােই না মৃত্যুর রূপ কেমন

পঁচিশজন সেখানেই শেষ, বাকিদের ছিন্নভিন্ন হাত-পা

এবার ছুটে আসবে শকুন-শেয়ালের পাল...


দুই আততায়ী অস্ত্রের নলে ফু দিয়ে ধীর পায়ে উঠে গেল জিপে

গ্রামের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা

কোনাে বাড়িতে শ্বেত শ্মশ্রু এক বৃদ্ধ পাঠ করছেন গ্রন্থসাহেব:

"সাধাে মন কা মান তিআগউ

কাম ক্রোধু সংগতি দুরজন কী তাতে অহিনিস ভাগউ..."

জমির ফসলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুবাতাস এই মাত্র চাঁদ উঠে ছড়িয়ে দিল জ্যোৎস্না


তুলসীদাসের দোঁহায় রামের গুণগান করছিল যে শ্রমিকটি

তার কণ্ঠ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে,

রামচন্দ্রজী, তােমার ভক্তদের তুমি রক্ষা করলে না? যারা অযােধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামমন্দির বানাবার জন্য উন্মত্ত

তারাও কেউ এইসব মানুষদের বাঁচাতে আসবে না কোনােদিন

গুরু নানক, আপনি দেখলেন আপনার রক্তপিপাসু ভক্তদের

এই লীলা

গুরুজী, গুরুজী, আপনার নামে ওরা জয়ধ্বনি দিয়ে গেল?


জম্মু থেকে এই শনিবারই একটা বাস ছাড়লো সকাল সাড়ে আটটায়, যাবে কাঠুয়া

ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, শােনা যাচ্ছে মিশ্র কলস্বর মায়েরা সামলাচ্ছে বাচ্চাদের, এক কিশােরীর হাতে

জিলিপির ঠোঙা জানলায় থুতনি-রাখা তার ছােট ভাইটির চোখে বিশ্বজোড়া বিস্ময়

আকাশ আজ প্রসন্ন নীল, উপত্যকায় উড়ছে কুসুম রেণু

যাত্রীরা কেউ ফিরছে গ্রামের বাড়িতে, একজন যাচ্ছে বিয়ে করতে

আপন মনে বাসটা যাচ্ছে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে

একটা বাঁক পেরুবার মুখেই বজ্রপাতের মতন বিস্ফোরণ

উড়ে গেল জিলিপির ঠোঙা ধরা কিশােরীর হাত বালকটির ছিঁড়ে যাওয়া মুণ্ডুতে চোখ দুটো নেই সন্তানকে বুকে জড়ানাে জননী আর্ত চিৎকারেরও সময় পেলেন না

কালাে বােরখা পরা আর একটি রমণীর নিস্পন্দ শরীর

এই প্রথম উন্মুক্ত হলাে প্রকাশ্যে বলশালী পুরুষদেরও শেষ হয়ে গেল সব নিশ্বাস মােট সতেরাে জন, বাকিরাও মৃত্যুর অতি কাছাকাছি দগ্ধ

কেউ একজন যেন কৌতুক করে রেখে গিয়েছিল একটা পেনসিল বােমা

সেই হত্যাকারী আল্লার সেবক, ধর্মের ঝাণ্ডা তোলার জন্য

রক্তনদী বইয়ে দিতেও দ্বিধা নেই যারা প্রাণ দিল তারাও আল্লার সন্ততি

পাঁচ ওয়ক্ত নিত্য নামাজ পড়া দুই প্রৌঢ়ও নিস্তার পায়নি

এক মৌলবী সাহেবের ডান পা অদৃশ্য হয়ে গেছে হায় আল্লা, হে খােদাতালা, হে খােদাতালা...

মনরােভিয়া, ডেট লাইন একত্রিশে অক্টোবর কোথায় গেল সেই পাঁচজন আমেরিকান নান? আজীবন ব্রতচারিণী, তারা শরীর-মন নিবেদন করেছিল যীশুকে

আর্তের সেবায় গিয়েছিল দেশ ছেড়ে অমন সুদূরে কোথায় তারা? না, হারিয়ে যায়নি, পাওয়া গেছে পাঁচটি শরীর

লাইবেরিয়ায় যুযুধান দু পক্ষের গােলাগুলির মাঝখানে পড়ে

ভূলুণ্ঠিত, বেআব্রু, রক্ত-কাদায় মাখামাখি

পরম করুণাময় যীশু কি সেই সময় চোখ বুজে ছিলেন?


বােসনিয়া-সারবিয়াতে শুরু হচ্ছে গ্যাস যুদ্ধ এতকালের প্রতিবেশী, শুধু ধর্মভেদের জন্য এত ঘৃণা?

পশুরাও তাে এমন ধর্মে বিশ্বাস করে না মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের পুড়িয়ে মারছে যে বর্ণগর্বী হিন্দুরা

তারাই বাড়িতে বসে শ্লোক আওড়ায়, সব মানুষেরই মধ্যে রয়েছেন নারায়ণ!


অন্য কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, কলম সরছে না আমার

না, কবিতা আসছে না, ইচ্ছে করছে না ছন্দ মেলাতে

খবরের কাগজে, বেতারে, দূরদর্শনে শুধু মৃত্যুর নির্লিপ্ত ধ্বনি

অসহায় বিরক্তিতে ছটফট করছে আমার সমস্ত শরীর

ধর্মশাস্ত্রগুলির মহান বাণী টুকরো টুকরো মনে পড়ে, তাতে আরও কষ্ট হয়

'হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর দণ্ড তব?'

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি, কয়েক পা গিয়েই মনে হয় কোথায় যাচ্ছি?

কেন উঠলাম, কেনই বা ফিরে গিয়ে বসবাে টেবিলে কবিতা হবে না, তবু লিখে যাচ্ছি এই পঙক্তিগুলি, না, ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকদের জন্য নয়, উন্মাদ জল্লাদদের জন্যও নয়।

শুধু আগামী শতাব্দীর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এই সামান্য দীর্ঘশ্বাস

মানুষকে ভালােবাসা ছাড়া মানুষের আর কোনাে ধর্মই থাকবে না

তখন, তাই না?

কাব্যগ্রন্থ

' রাত্রির রঁদেভু '


মহাধার্মিক

-জামাল আনসারী


আদা,রসুন আর পেঁয়াজ খেলে

তুমি অধার্মিক,জগতের মহাপাপী!

নরকেও তোমার হবে না ঠাঁই!

গরুর গু আর মুত সে যে  উৎকৃষ্ট খাদ্য !

খাও, আরো খাও হে মহাধার্মিক!

স্বর্গে হবে তোমার অনন্ত ঠাঁই।


এ দেশ, ধার্মিক শ্রেষ্ঠ দেশ ―

কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম

এখানে বিচার করে বলা বড় দায়.

রসুন খাওয়া পাপ, ঘুষ খাওয়া তো নয়!

নেতা, মন্ত্রী  থেকে আমলা - গামলা

কে আর সাধু ! কম বেশি সবাই ঘুষ খাই।



দলিত, অস্পৃশ্য বলে যাদের নেই অধিকার,

ধর্ম থেকে, কর্ম থেকে সমাজ থেকে তারে

যুগ যুগ ধরে নির্মম ভাবে করে যাও বহিষ্কার!

ধর্মের কি মহিমা! মানুষ বলে তারে করেনি স্বীকার,

তারা অস্পৃশ্য! কিন্তু ধর্ম মতে তাদের দেহ অস্পৃশ্য নয়।

তাই তুমি মহাধার্মিক!  সুযোগের করো সৎ ব্যবহার।

গাবলুর গাট্টা -মণীশ রায়চৌধুরী
Nov. 19, 2024 | রম্যরচনা | views:877 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সকালবেলা গাবলু আমার বাড়ি এসে হাজির। গাবলু আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড।

অনেকদিন পর সে আসায় ভারি খুশি হয়ে বললাম,  "তুই তো এখন বড়মানুষ। তোর কীর্তিকলাপ নিয়ে বই বেরিয়েছে দেখলাম।"

গাবলু হেসে বলল, "আরে সে তেমন কিছু নয়। লোকে অনেকদিন ধরে চাইছিল তাই একটা পাগলাটে লোক বই বের করেছে।"


"তা এতদিন পর যখন এসেছিস তখন আজ দুপুরে আমরা একসাথেই খাব। ঠিক সেই কলেজের মত আজকেও বিরিয়ানি হয়ে যাক?"

গাবলু হেসে বলল, "তুই তো জানিস বিরিয়ানি খেতে আমি কত ভালবাসি। আর পরের পয়সায় হলে তো কথাই নেই।"

"সে আর জানিনা, হাড়েহাড়ে চিনি তোকে। কলেজে  বেশিরভাগ সময়ে আমার পকেটটাই তো হালকা হত।"


গাবলু বলল, "তবে ভাবছি এবার ভাগ্যনগর বিরিয়ানিটাই ট্রাই করব।"

গাবলু মাঝেমাঝে এমন সব দুর্বোধ্য কথা বলে যে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা।

ঘন্টাখানেক 'মন কি বাত' শুনলে বা একবারে গোটা একটা 'কথাঞ্জলি' পড়ে ফেললে মাথার ভিতর যেমন ব্ল্যাকআউট হয়ে যায় ঠিক সেরকম মনে হয়।


"হ্যাঁ রে গাবলু, চিকেন-মাটন বিরিয়ানি ঢের শুনেছি, খেয়েছিও বিস্তর। এমন কি তোর পাল্লায় পড়ে বাড়িতে লুকিয়ে দুএকবার বিফ বিরিয়ানিও খেয়ে এসেছি।

কিন্তু, এই ভাগ্যনগর বিরিয়ানি আবার কি দিয়ে তৈরি হয়?

জলহস্তীটস্তির মাংস দিয়ে বানায় বুঝি?"


গাবলু একচাঁটি মেরে বলল, "এইজন্য তোর কোন উন্নতি হলনা। আরে বাবা মগজের ভিতর গ্রে ম্যাটার কিছু অবশিষ্ট আছে, নাকি সবই গোমূত্র খেয়ে লোপ পেয়েছে?

এই বিরিয়ানি শুধু আমি নয়, তুইও বহুবার খেয়েছিস।

আরে তুই তো বলতিস এই বিরিয়ানির কোন তুলনাই হয়না।"


গাবলুর কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লাম।

বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে করতে পারছিনা এমন অদ্ভুতুড়ে বিরিয়ানি ঠিক কবে খেয়েছি। 

গাবলু হযবরল'র বেড়ালের মত ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসে বলল, "কি হল পারলিনা তো? জানতাম পারবিনা। আচ্ছা তুই তো হায়দরাবাদি বিরিয়ানি খেতে ভালবাসিস?"

"হ্যাঁ বাসি। একশবার, হাজারবার বাসি। কিন্তু তারসাথে কোথাকার কি ভাগ্যনগরের কি সম্পর্ক?"


গাবলু আরেক চাঁটি কষিয়ে বলল, "প্রেমে পড়ার পর থেকে তোর ইন্টালিজেন্স ক্রমশ কমেই যাচ্ছে।

দেশের কোন খবরই আজকাল রাখিসনা।

যোগী আদিত্যনাথ বলেছে বিজেপিকে ভোট দিলে পরেরবার হায়দরাবাদ এর নাম পালটে ভাগ্যনগর রাখা হবে।

কারণ এতে নাকি ভারতীয় সংস্কৃতি রক্ষা পাবে।

তাহলে এবার থেকে হায়দরাবাদি বিরিয়ানির নাম তো ভাগ্যনগর বিরিয়ানিই হয়ে যাবে।"


বোঝ কান্ড, এই হল গাবলু।

কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যায়।

তবে আমিও গাবলুর ফ্রেন্ড।

আমি কি কম যাই নাকি?

গম্ভীর গলায় বললাম, "তাহলে ভাই তুই রাতেও থেকে যা। কষা মাংসের সাথে জমিয়ে দিনদয়াল উপাধ্যায় পরোটা খাওয়া যাবে।"

বেশ্যাবৃত্তি, PITA আইন এবং.. -অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | নারী | views:288 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল এ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম : " লকডাউন যাঁদের যৌনকর্মী বানাল, সন্ধ্যা-মালতি-শ্যামলীদের কথা "। লিংক- https://www.anandabazar.com/west-bengal/many-women-working-as-sex-worker-after-loosing-their-job-in-lockdown-dgtldx-1.1244911


এই রিপোর্ট টি বানিয়েছেন জনৈক সৈকত ঘোষ। এই প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। আশাকরছি সবাই ঠান্ডা মাথায় পড়বেন। এই রিপোর্ট টি নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তির বক্তব্য পড়েছি বা শুনেছি। যাদের মোদ্দা কথা " বেশ্যাবৃত্তি কি অপরাধ? আরে ওরা তো গতরটা খাটিয়ে রোজগার করছে। চুরিচামারি থোড়াই করছে নাকি? পেটে ক্ষিদে থাকলে নৈতিক - অনৈতিক তত্ত্বকথা এসব মাথায় থাকেনা। তাছাড়া কেউ যদি এটাকে পেশা বানাতে চায় স্বইচ্ছায় তাহলে আপত্তির কি আছে? সিগারেটের প্যাকেটে ধূমপান ক্যান্সারের কারন মার্কা ছবি দিয়েও তো দিব্যি বিক্রি হচ্ছে তাহলে বেশ্যাবৃত্তির বেলায় এতো প্রশ্ন কেন উঠবে? "


বাহঃ, চমৎকার। এই প্রসঙ্গ মনে পরছে " thehindu " অনলাইন পোর্টাল এ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ছিল - "Prostitution not a criminal offence : Bombay HC orders release of 3 sex workers "। অর্থাৎ বোম্বে হাইকোর্ট তার একটি রায়ে জানিয়েছে,

বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যাবসা আইনত অপরাধ নয়। খবরটির লিংক-

https://www.thehindu.com/news/cities/mumbai/prostitution-not-a-criminal-offence-bombay-hc-orders-release-of-3-sex-workers/article32701646.ece


 উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, 

" Prostitution is the business or practice of engaging in sexual activity in exchange for payment. Prostitution is sometimes described as sexual services, commercial sex or, colloquially, hooking. It is sometimes referred to euphemistically as "the world's oldest profession" in the English-speaking world. A person who works in this field is called a prostitute and is a type of sex worker ".


১৯৫০ সালের মে মাসে নিউইয়র্ক এ আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের ফল হিসেবে ভারতে " The Immoral Traffic (prevention) Act 1956 "  এর সূচনা হয়। এই " PITA " আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় পতিতাবৃত্তি নিয়ে যা বলা আছে, তাতে একজন সাধারন মানুষের ও বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, পতিতাব্যাবসা বা যৌনতা ব্যাবসা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বা Criminal Offence। 


আমাদের এই ভোগবাদী সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি, অনেক এনজিও আছে যারা মুখোশের আড়ালে দুর্দান্ত ভণ্ডামি করে খায়। এরা যেনতেন প্রকারে বেশ্যাবৃত্তি কে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। এই মুখোশধারীরা এটা ভুলে যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি ঠিকে আছে শুধুমাত্র ভোগবাদী গ্রাহকদের ওপর নির্ভর করে এবং এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় রয়েছে। 


কথাপ্রসঙ্গে একটা আলোচনায় সাংবাদিক এবং 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সংযুক্ত সম্পাদক সন্তোষ শর্মা জানাচ্ছেন, " উত্তর প্রদেশ একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল। National Crime Record Bureau এর রিপোর্ট অনুসারে,২০১৯ সালে ভারতে প্রতিদিন ৮৭ টা ধর্ষণ ঘটেছে যার বেশিরভাগই উত্তরপ্রদেশে। এই পরিস্থিতিতে বেশ্যাগিরিকে আইনের তমকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আমার কয়েকজনের মুখেও বেশ্যাবৃত্তি বা প্রস্টিটিউশনকে লাইসেন্স দেওয়ার কথা শুনেছি। তাঁদেরকে আমি কিছু কড়া কথা বলেছিলাম যেমন,  এই লকডাউনে এমন অনেকে আছেন যাঁরা কাজ হারিয়ে বাড়িয়ে বসে আছেন। বিশেষ করে মহিলারা। কোথাও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না?চিন্তা কেন করছেন হে পুরুষ, একবার ভেবে দেখুন আপনি বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে মৌজমস্তি করছেন আর অন্যদিকে আপনার স্ত্রী আপনার জন্য টাকা রোজগার করে চলেছেন। কিন্তু যদি আমাদের দেশে বেশ্যাগিরি আইনত হত তাহলে টুক করে আপনার স্ত্রীর নামে দেহবিক্রির লাইসেন্স নিয়ে ঘরেই বেশ্যালায় খুলে বসলেন। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত যখন খুশি আপানার বেশ্যালয়ে গ্রাহকদের আনাগোনা। যত বেশি স্ত্রী  গতর খাটাবে তত বেশি টাকা। এই সুযোগে পাড়ার যে সব ফালতু মদমাতাল আপনার স্ত্রীকে কে দেখে লালা ঝড়াতো তারা এই সুযোগে চেখে দেখার সুবর্ণ সুযোগও পেয়ে যাবে। থানা পুলিশ, পাড়ার মাস্তানের কোনও বালাই নেই। কারণ আপনার স্ত্রী লাইসেন্স ধারি বেশ্যা যে। এখানেও শেষ নয়। হয়তো বাড়িতে অবিবাহিতা বোন রয়েছে,  টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না। বোনের নামেও বেশ্যাগিরির লাইসেন্স নিয়ে নিন। স্ত্রী আর বোন দুজনের ডবল রোজগারে ঘরে টাকার বন্যা বইবে। কি! আমার এই কথা শুনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ? জানেন, আমারও রাগ হয়। যারা চাইছেন বেশ্যাগিরিকে আইনত করা হোক, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনি কি নিজের স্ত্রী বা বোনকে বেশ্যা বানাতে যদি চান, তাহলে এখনই স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলুন। কথা দিচ্ছি এই সাংবাদিক আপনাকে খবরের শীর্ষে নিয়ে  যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। 

আমি, সন্তোষ শর্মা বেশ্যাগিরিকে আইনত করার সবথেকে বড়ো বিরোধী। আমি চাই না দেশটা বেশ্যাখানায় পরিণত হোক। তাই মুক্তমনা যুক্তিবাদী বন্ধুদের কাছে একটি বিনীত  অনুরোধ, যে বা যারাই বেশ্যাগিরিকে আইনত করার দাবি তুলছে, তাদের প্রশ্ন করুন সবার আগে, তারা কি নিজের বাড়ির মা, স্ত্রী  বোনকেও বেশ্যা বানাতে রাজি আছেন কি? "


আসুন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক কি রয়েছে PITA আইনে। এই আইনের ২ নং ধারায় পতিতালয় বা Brothel এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে কোনও স্থান, বাড়ি, গাড়ি - সম্পূর্ণরূপে বা অংশকে বোঝাবে যেখানে বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যে, লাভের আশায় যৌনতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকেই পতিতালয় বা Brothel বলে চিহ্নিত করা হবে।

' Prostitute ' বলে সেইসব মানুষকে চিহ্নিত করা হবে, যারা বাণিজ্যিকভাবে নিজের যৌনতাকে লাভের আশায় ব্যবহার করে। পতিতাবৃত্তি বা Prostitution হল যৌনতাকে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহার।

শিশু বলতে তাদের বলা হয়েছে, যাদের বয়স ১৬ বছরের কম। এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের ' শিশুপতিতা ' হিসবে গণ্য করা হবে।

অপ্রাপ্তবয়স্ক তারাই, যাদের বয়স ১৬ বছরের ওপর কিন্তু ১৮ বছর অতিক্রম করেনি  এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাদের ' অপ্রাপ্তবয়স্ক পতিতা ' বলে গণ্য করা হবে। ১৮ বছর যারা পার করেছে, তারাই আইনের চোখে অপ্রাপ্তবয়স্ক।


PITA আইনের ৩ নং ধারায় পতিতালয় চালানোর বিরুদ্ধে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কোনও ব্যক্তি যদি মালিক হিসেবে, ভাড়াটিয়া হিসেবে অথবা লিজ হোল্ডার হিসেবে কোনো পতিতালয় চালায়, তবে তার প্রথম অপরাধের জন্য এক থেকে তিন বছরের জেল এবং দু হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। দ্বিতীয় বা পরবর্তী অপরাধের জন্য দুই থেকে পাঁচ বছরের জেল ও দু হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।


PITA আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে - কোনও পতিতার আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে দু বছরের জেল ও সঙ্গে এক হাজার টাকা জরিমানা। এছাড়া, কোনো শিশুকে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে সেই আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে সাত থেকে দশ বছরের জেল ও জরিমানা।


PITA আইনের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহিত করলে বা কাওকে পতিতা হিসবে নিয়োগ করলে সেই ব্যক্তির যাবজ্জীবন জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। 


এই আইনের ১৩ নং ধারায় পতিতাবৃত্তি নিবারণের উদ্দ্যেশ্যে বিশেষ পুলিশ অফিসার ' স্পেশাল পুলিশ অফিসার ' নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে বিশেষ পুলিশ অফিসার, পতিতাবৃত্তি চালানোর সন্দেহে যে কোনো স্থানে বিনা ওয়ারেন্টে প্রবেশ ও অনুসন্ধান করতে পারে।


১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনওভাবে খবর পান যে, কাওকে পতিতাবৃত্তিতে নামানোর উদ্দ্যেশ্যে আটক করা হয়েছে, তবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে আদেশ দিতে পারেন। ১৭(ক) ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ধার করা মানুষটিকে তার মা, বাবা অথবা অভিভাবকের হাতে তুলে দেবেন। তবে তার আগে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখবেন ওই মা, বাবা কিংবা অভিভাবক ওই উদ্ধার করা মানুষটির ভরণপোষণে সক্ষম কি না। ১৮ ধারামতে ম্যাজিস্ট্রেট খবর পাওয়ামাত্র পতিতাবৃত্তি চালানোর উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত যে কোনো স্থান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন ।


আইনের এতগুলো ধারাগুলি ভালোভাবে পড়লে যেকেউ বুঝবেন যে পতিতাবৃত্তি বে-আইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইফাঁকে আমরা জেনে নিই পতিতাবৃত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো বা হয়। যেমন, দেহপসারিনী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, গণিকা, বিজর্জরা, আসুগো ইত্যাদি। আবার কামসূত্র গ্রন্থর লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনিষ্টা, রুপজীবা, গণিকা ( সূত্র- চতুর্থ ভাগ, ষষ্ঠ অধ্যায় -২৪)। আবার ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে রয়েছে - " সুবন্ধবে যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা "। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ 'মরিস ভিন্টারনিৎস' এর মতে এখানে বিশ্যা শব্দটি থেকেই নাকি বেশ্যা কথাটির উৎপত্তি।  এছাড়া, George Ryley Scott তার " A history of prostitution from antiquity to the present day " বইতে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন- পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে। 


পরিশেষে বলাই যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি টিকে রয়েছে শরীর লোভী গ্রাহকদের চাহিদার ওপরে। সেইসব গ্রাহক যাদের কাছে নারী শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী, পায়ের জুতো এবং সন্তানের জন্মদেওয়ার যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ সর্বতোভাবে, কোনোরকম রাখঢাক না করেই। সুস্থ সমাজে বেশ্যাবৃত্তি অভিশাপের ন্যায়। একে সমূলে উৎপাটন করতে ব্যপক প্রচার ও প্রসার করতেই হবে।


বিশেষ সংযোজন : বিগত কয়েক বছরে অ্যামিটি,প্রত্যয়, উত্তরাপথ, স্বীকৃতি ইত্যাদি নামের কয়েকটি গোষ্ঠী ' মানস বাংলা ' নামক এক সংস্থার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠছে। এইসব গোষ্ঠীগুলোর কাজ HIV র বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, সমকামীদের সামাজিক স্বীকৃতির পক্ষে প্রশ্ন তোলা এবং সবচেয়ে যেটা বড় লক্ষ্য তা হলো গণিকাবৃত্তিকে আইনী করার লক্ষ্যে আন্দোলন করা ইত্যাদি। এদের ফান্ড আসে বিদেশ থেকে মোদ্দা কথায় ফান্ডেড এনজিওর আড়ালে এরা বেশ্যাবৃত্তিকে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। ' মানস বাংলা ' র চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনীশ রায়চৌধুরী তার জুলাই ২০০৯ এর হিসেব অনুযায়ী জানিয়েছিলেন এই সংস্থার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। ভাবা যায়!

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সাংবাদিকরা পরাধীন। -প্রবীর ঘোষ
Nov. 19, 2024 | যুক্তিবাদ | views:878 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এখনকার সংবাদপত্রগুলি অনেক প্রগতিশীল হয়েছে। সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকে রাজনৈতিক হানাহানি। দ্বিতীয় পাতাতে থাকে কলগার্ল ও কলবয়দের ঢালাও বিজ্ঞাপন। কোনও সৎ সাংবাদিক এগুলো সরানোর কথা চিন্তা করে না। তারা জানে এসমস্ত বিজ্ঞাপন সরাতে গেলে মালিক লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।


       এ’দেশের প্রতিটি বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র, জনপ্রিয় সাপ্তাহিক, টিভি মিডিয়ার পিছনে মূলধন হিসেবে খাটে কোটি কোটি টাকা। কোটিপতি মিডিয়া মালিকদের কাছে ‘মিডিয়া-ব্যবসা’ আর পাঁচটা ব্যবসার মতই ব্যবসা। উৎপাদন কর, খদ্দের ধর, বিক্রি কর। আর পাঁচটা ব্যবসার মতই এখানেও- যত বেশি উৎপাদন, যত বেশি বিক্রি, তত বেশি লাভ। অন্যান্য ব্যবসায় বড় ভাবে পুঁজি নিয়োগ করার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্পপতিরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে বুঝে নেন মার্কেটের অবস্থা। তারপরে নামেন উৎপাদনে। বৃহৎ মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সম্ভাব্য পুঁজি বিনিয়োগকারী বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষকরা কয়েক মাসব্যাপী সমীক্ষা চালান নানাভাবে, যার একটা বড় অংশ জনমত যাচাই। তারপর তাঁরা রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে মিডিয়ার চরিত্র কী কী ধরনের হলে সম্ভাব্য পাঠক ও দ্রশক কতটা হতে পারে, তার একটা হদিশ দেওয়া হয়। এই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে পুঁজিপতি ঠিক করেন তার মিডিয়ার চরিত্রের রূপরেখা, ঠিক করেন পলিসি। কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন সম্পাদক থেকে সাংবাদিককারও। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ ‘নিউজ চ্যানেলের স্বাধীনতা’ বলে শব্দ দুটি আমরা অহরহ শুনে থাকি। শব্দ দুটি নিয়ে ফি-বছর গোটা কয়েক সেমিনার হয় দেশের বড়-মেজ শহরগুলোতে। শব্দটি একটিই মাত্র অর্থ বহন করে আর তা হল মিডিয়া মালিকের মিডিয়া-চরিত্রকে বজায় রাখার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নামের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সব মিডিয়া মালিকদের সংগঠিত ভাবে আঘাত হানার স্বাধীনতা।


       সম্পাদক থেকে সাংবাদিকরা মালিকের কাছে ‘মিডিয়া পলিসি’ মেনে বলার ও লেখার অলিখিত চুক্তির বিনিময়েই চাকরিতে ঢোকেন। মিডিয়া পলিসিকে অমান্য করার মত ধৃষ্টতা কেউ দেখালে, পরের দিনই তার স্থান হবে মিডিয়া অফিসের পরিবর্তে রাস্তায়।


       সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের এই সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্টভাবে না জানা থাকার দরুন এবং পত্রিকা চরিত্র গড়ে ওঠার কাহিনি অজানা থাকার কারণে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে একটা বিপজ্জনক ধারণা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে- অমুক পত্রিকা প্রতিক্রিয়াশীল, তমুক পত্রিকা প্রগতিবাদী। ধারণাটা আগাপাশতলা ভুল।


       সমস্ত বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর ও নিউজ চ্যানেলের মালিকরাই এক একটি ধনকুবের, এবং সবারই মূল চরিত্র একই। সমাজ কাঠামোকে আঘাত না দিয়ে আমি আপনি যত খুশি লম্ফ-ঝম্ফ দিতে পারি। চাই কি, তার জন্য প্রচারও পেতে পারি। কিন্তু ‘সিস্টেম’কে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে ওরা প্রত্যাঘাত হানবে সর্বশক্তি দিয়ে।


       আর প্রচার মাধ্যমের সে শক্তি এতই বিশাল যে সাধারণের কল্পনাতীত। জনগণকে প্রভাবিত করার এই বিশাল শক্তিই তাকে দিয়েছে ‘সিস্টেম’-এর বনিয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ পিলারের ভূমিকা। কয়েক বছর হল সংবাদপত্রের পাশাপাশি নিউজ চ্যানেল নিয়েও এই ধরনের ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রচার মাধ্যমের অকল্পনীয় শক্তির প্রসঙ্গে পরে আসব, আপাতত প্রসঙ্গে ফিরি।


       বৃহৎ নিউজ মিডিয়াগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের খদ্দের ধরতে বহিরঙ্গকে সাজায় নানাভাবে। জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে তারই রাজনীতির ইমেজ বা সরকার বিরোধী ইমেজ তৈরি করে বিক্রি বাড়িয়ে চলে। এইসব মিডিয়ার সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের অবস্থান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের ফুটবল টিমের কোচ ও খেলোয়াড়দের মতোই- যখন যে দলে খেলবেন, সেই দলকে জয়ী করতেই সচেষ্ট থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা বলে যাকে আপনি গাল পাড়েন, তারই অতিক্ষমতা সম্পন্ন দুঁদে বার্তাসম্পাদক কিংবা ঝাণ্টু সাংবাদিক আপনার মনে হওয়া প্রগতিবাদী পত্রিকায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার স্বার্থে কলম থেকে ঝরাতে থাকেন বিপ্লবী আগুন। একই ভাবে বিপরীত ঘটনাও ক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল পত্রিকার বিপ্লবী কলমও টিম পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিপ্লবী কলম হয়ে ওঠে। এই জাতীয় উদাহরণ কিন্তু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত নয়, বরং সাবলীল গতিশীল। এইসব বিপ্লবী, প্রতিবাদী, প্রতিবিপ্লবী, বুর্জোয়া প্রভৃতি প্রতিটি বাণিজ্যিক মিডিয়ার মালিকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। একজনকে ধন-সম্পদে আর একজনের টপ্‌কে যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কোনও শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ওরা দারুণ রকম এককাট্টা।


       মিডিয়াগুলোর ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, প্রতিটি মিডিয়াই বর্তমান সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে জনমতকে পরিচালিত করে এবং বহিরঙ্গে এরা সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ছেপে সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার মূল ঝোঁককে আড়াল করে। এমন সব দুর্নীতির কথা ‘পাবলিক’ খায় বলেই মিডিয়াগুলো প্রচারে আনে। এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি যাদের হাতে, তারা জানে, এমন দু-চারটে দুর্নীতি ধরার লালিপপ্‌ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কীভাবে অত্যাচারিতের ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে হয়। তারা জানে, সিস্টেমের প্রেসার কুকারে নিপীড়িতদের ফুটন্ত ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার ‘সেফটি ভালভ’ হল মাঝে-মধ্যে দু-চারজনের দুর্নীতি ফাঁস। পরে অবশ্য দুর্নীতিগ্রস্তকে শাস্তি-টাস্তি না দিলে ক্ষতি নেই। জনগণের স্মৃতি খুবই দুর্বল। ভুলে যাবে প্রতিটি ঘটনা, যেভাবে ভুলেছে বর্ফস কেলেঙ্কারি, শেয়ার কেলেঙ্কারি। আর এর ফলে এক-আধটা রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ বা প্রশাসক যদি বধ হয়, তাতেও অবস্থা একটুও পাল্টাবে না। ফাঁকা জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না, থাকবে না। এক যায়, আর এক আসে।


       এইভাবে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্তরা আসে এবং বিদায়ও নেয়, কিন্তু দুর্নীতি টিকেই থাকে। এই দুর্নীতির সূত্রেই বাঁধা পড়ে থাকে ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তিগুলো।


       কখনও কখনও বাণিজ্য সাম্রাজ্যের অধিকারীরা রাজনীতিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের ক্ষমতা রক্ষা ও বর্ধিত করতে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল উদ্যোগী হয়। এখানেও কিন্তু বাণিজ্য-সম্রাটের পক্ষে মিডিয়ার বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। যে পত্রিকা বিক্রি হয় না, যে চ্যানেল লোকে দেখে না তাকে কেন রাজনীতিক দল পাত্তা দেবে?


       যে-সব সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, দুর্নীতির শিকল ভেঙ্গে সুসংস্কৃতির সমাজ গড়তে চান, তাঁদের পক্ষেও কলমকে মগজকে হাতিয়ার করে মিডিয়াকে রণভূমি করা সম্ভব হয় না। কারণ পত্রিকায় ব্যক্তি ইচ্ছে বা ব্যক্তি আবেগের স্থান সীমাবদ্ধ। মিডিয়ার পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একজন সাংবাদিককে চলতে হয়। কোনও সাংবাদিকের পক্ষে একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ততক্ষণই সহযোগিতা করা সম্ভব যতক্ষণ না পেপার পলিসি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে যায়।


       মিডিয়া পলিসি কাউকে ব্ল্যাক-আউট করতে চাইলে বা কারও বিপক্ষে গেলে তাকে প্রচারে আনা কোনও সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু মিডিয়া মালিক যদি দেখেন কাউকে ব্ল্যাক-আউট করার ফলে অথবা কারও বিপক্ষে লেখার ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে, তখন ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা পলিসি পালটে ফেলেন, ডিগবাজি খান। এই ডিগবাজি খাওয়াটাও ততক্ষণই সম্ভব, যতক্ষণ না ওই ব্যক্তি বা সংস্থা পত্রিকা মালিকের অস্তিত্বের পক্ষে চূড়ান্ত সংকট হিসেবে হাজির হচ্ছে।


       বাণিজ্যিক টিভি চ্যানেল পত্র-পত্রিকার বাস্তব কাঠামো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, ভুল বোঝার অবকাশ বেশি থাকে। আর এই ভুলই বহু সৎ ও গতিশীল আন্দোলনে ধস্‌ নামাতে পারে। সত্যিকারের আন্দোলনের পাল থেকে জনসমর্থনের হাওয়া কেড়ে নিতে মেকি আন্দোলনকারী খাড়া করে তথাকথিত প্রগতিশীল নিরপেক্ষ মিডিয়া যখন ময়দানে নামে, তখন ভ্রান্ত ধারণা বহু সমর্থককে, বহু আন্দোলন-কর্মীকে দূরে সরিয়ে দেয়।


       বিভিন্ন প্রচার-মাধ্যম বা পত্র-পত্রিকা যেমন বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্বকে ‘মিডিয়া পলিসি’র পক্ষে কাজে লাগায়। নিজস্ব ছাঁচের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ার পক্ষে কাজে লাগায়, তেমনই শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কেন পারবে না প্রচার-মাধ্যমগুলোকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগাতে? কাজে লাগানো সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ও সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব চেষ্টা করলে দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করে, প্রচার-মাধ্যম দ্বারা ব্যবহৃত না হয়ে প্রচার-মাধ্যমকেই ব্যবহার করতে পারেন।


       যে মিডিয়ার পাঠক ও দর্শক সংখ্যা যত বেশি, জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তার তত বেশি।


       পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কি তবে কোনও স্বাধীনতা নেই? ক্ষমতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। ওদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আছে, পেপার পলিসির সঙ্গে সংঘর্ষে না নামা কাউকে প্রচার দেওয়া, বা বিশেষ কোনও সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আইনি অধিকার বা বে-আইনি সুবিধে আদায়ে সহযোগিতা করা, অপছন্দের মানুষ বা সংস্থাকে কিঞ্চিৎ টাইট দেওয়া। এবং স্বভাবতই এই ক্ষমতা একটু বেশি পরিমাণে থাকে সম্পাদকের ও তাঁর প্রিয় সাংবাদিকদের। অনেক সময় ওদের কৃপায় অনেক ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, অনেক ‘মিথ্যে’ হয়ে ওঠে ‘সত্যি’, অনেক জোনাকি মিথ্যে প্রচারের আলোতে নক্ষত্র হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কিংবদন্তি।


আরও একটি প্রবল ক্ষমতা সংবাদ মাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিদের আছে। আর তা হল, কাউকে ‘ব্ল্যাক আউট’ করার ক্ষমতা।


       সংবাদ মাধ্যমগুলো বাস্তবিকই পারে ‘জোনাকি’কে ‘নক্ষত্র’ বানাতে, সত্যের সূর্য ঢাকতে পারে ‘ব্ল্যাক-আউট’-এর মেঘে।


       এই দুই ক্ষমতাই ‘নামী’ হতে চাওয়া, ‘জনপ্রিয়’ হতে চাওয়া, ‘দামি’ হতে চাওয়া, ‘পুরস্কৃত’ হতে চাওয়া, ‘সম্মানিত’ হতে চাওয়া বুদ্ধিজীবীদের (যাদের মধ্যে সাধারণভাবে ফেলা হয় সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক-সহ অধুনা ক্রীড়াবিদ্‌দের পর্যন্ত) সংবাদ মাধ্যমগুলো কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘নামী’ ‘দামি’ হওয়ার একটা পর্যায় অতিক্রম করে আরও ‘নামী’ ‘দামি’ হতে গেলে সাধারণভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে আপস করা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবীদের এই আপসকামিতাকে, কৃপাপ্রার্থী মানসিকতাকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগায় প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তি ধনকুবের পুঁজিপতিরাই।


*এই লেখাটি হিন্দি পত্রিকা " দৈনিক ভারতমিত্র " তে প্রকাশিত হয়েছে ১২ জুলাই ২০১৫ তে। সাংবাদিক সন্তোষ শর্মা, প্রবীর ঘোষের উক্ত লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 

শ্রাদ্ধকর্ম হল ব্রাহ্মণ্য ধান্দাবাজি

-প্রশান্তকুমার মন্ডল।


মৃত পিতামাতার শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ পুরোহিত আপনাকে দিয়ে যে মন্ত্রপাঠ  করায়  সে মন্ত্রের অর্থ জানেন কী ?

সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থে এরা মানুষকে জাতের নামে হীন, নীচ প্রতিপন্ন করেছে, শ্রাদ্ধকর্মে ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। শ্রাদ্ধের মন্ত্রের অর্থ না জেনে ব্রাহ্মণের কথায় বোকা যজমান কেমন নিজেকে এবং নিজের জন্মদাতা মৃত পিতা-মাতাকে গালাগালি করে দেখুন।


  “ পাপহম " পাপকর্মাহম পাপাত্মা পাপসম্ভবা

  " ত্রাহিমাম " কৃপাদেবা স্মরণাগতা বাৎসল্য

অর্থ হল..

পাপহম = আমি পাপী।

পাপকর্মাহম = আমি পাপ কর্মের ফল।

পাপাত্মা = আমার আত্মা পাপী।

পাপসম্ভবা = আমার দ্বারা পাপই সম্ভব। ত্রাহিমাম কৃপাদেবা স্মরণাগতা

বাৎসল্য = হে দেব কৃপা করে সন্তানসম স্মরণাগতকে  আশ্রয় দিন।


আপনি কেন পাপী ?

কোনো পাপ কাজ আপনি করেছেন কী ?

আপনার পিতা-মাতার পাপকর্মের ফলে আপনার জন্ম হয়েছে কী ?

সত্যি তাই কী ?

আপনি যদি কাল্পনিক আত্মায় বিশ্বাস করেন তাহলে সে আত্মা পাপী হল কিভাবে ? আপনার থেকে কী সব পাপই উৎপন্ন হবে ? 

শাস্ত্র অনুযায়ী দেবদেবী ব্রাহ্মণের মুখ দিয়ে খায়,ব্রাহ্মণের মুখ দিয়ে কথা বলে। সাধারন মানুষ ডাকলেও আসবে না, খাবেও না্,কথাও বলবে না। আবার শ্রাদ্ধ করলে মৃত পিতৃ পুরুষগন ব্রাহ্মণের কথায় ওঠাবসা করে। ব্রাহ্মণের কথায় তারা আসবে এবং ব্রাহ্মণের কথায় তারা উত্তর পুরষদের প্রচুর দান করবে। মানুষের এমন অন্ধবিশ্বাস এবং এমন " নির্লজ্জ পুরোহিত তন্ত্র " পৃথিবীর কোনো ধর্মে নেই।

ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট দেবদেবীরা ব্রাহ্মণের কথায় সাড়া দেয়, কেবল ব্রাহ্মণের সাথে কথা বলে, ব্রাহ্মণ খাদ্য চিবিয়ে দিলে তবে খায় এবং ব্রাহ্মণের কথায় যজমানকে সবকিছু দান করে। বিনিময়ে ব্রাহ্মণ যজমানের দেত্তয়া সামান্য কিছু নিয়ে সন্তুষ্ঠ হয়। এমন মহান হৃদয় ভারতীয় ব্রাহ্মন পুরোহিতদের। নিজের জন্য তবু দেবতাদের কাছে এরা কিছুই চায় না। বোকা যজমানদের এমন মিথ্যাবুলি শিখিয়েছে ব্রাহ্মন পুরোহিত। বোকা যজমানরা জানে না যে, ব্রাহ্মণের তৈরী জড় পদার্থের " পুতুল দেবদেবী " শুধুই তাদেরকে ঠকানোর জন্য। যজমানরা কি কোনো দিন ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছেন ? যে আপনারা শুধু আমাদের জন্য দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করেন কেন? আর আমাদের দেওয়া অল্প সম্পদে সন্তুষ্ট হন কেন ? আপনারা দেবদেবীর কাছে নিজেরা ইচ্ছামত চেয়ে নেন না কেন? দেবদেবীর কাছে চাইলে যদি সব পাওয়া যেত তাহলে তো আর আপনাদের অভাব থাকতো না। এমন সরল প্রশ্নটি যজমানরা কেন করেন না? বাবা, মায়ের মৃত্যূর পর তাঁদের আত্মা-প্রেতাত্মা ও ব্রাহ্মনের কথায় নাকি উঠবোস করেন, এমন দাবি ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের।দেবদেবীরা যেমন ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট খায় আত্মা-প্রেতাত্মারা ও নাকি ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট খেয়ে ধন্য হয়।

ভূ-দেবতা সেজে এরা জীবিত মানুষকে উচ্ছিষ্ট খাইয়েছে আর মৃত্যূর পর তার প্রেতাত্মাকেও উচ্ছিষ্ট খাওয়ায়।

কেন খাবে না ? সমস্ত দেবদেবী যদি ব্রাহ্মণ পুরোহিতের চিবিয়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে ধন্য হয়, মানুষ খাবে না কেন ?

এমন জঘণ্য বিশ্বাস হিন্দুদের।


সারা জীবন বাড়ীতে এসে হাজর বাজর মন্ত্র আউড়ে যে ব্রাহ্মণ দেবদেবীর কাছ থেকে একটা পয়সা আদায় করে দিতে পারেনি, সেই বাড়ীর ছেলে আবার ঐ ব্রাহ্মন পুরোহিতের কাছে ছুটছে মৃত বাবা/মাকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য। এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে।

বোকা যজমানারা আর কবে বুঝবে এসব দেবদেবী কাল্পনিক আর কর্মফল, আত্মা, প্রেতাত্মা, জন্মান্তরবাদ, স্বর্গ, নরক সব ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ধানদাবাজি।

শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মন্ত্রবলে মৃতের পূর্বপুরষরা দলে দলে আসবে আর প্রচুর ধনসম্পদ দান করবে মৃতের সন্তানদের।

এমন বিশ্বাস কী পৃথিবীর কোন ও সভ্য মানুষ করে?

চার্বাক পন্ডিত মাধবাচার্য বলেছেন-“ স্বর্গ-নরক " নেই,পারলৌকিক আত্মা নেই, বর্নাশ্রমাদির ক্রিয়া নিষ্ফল।

অগ্নিহোত্র তিনবেদ ( ঋক, সাম ও যজু ) ত্রিদন্ড, ছাইভস্ম লেপন, বুদ্ধিহীন ও পৌরুষহীন, নিষ্কর্মা মানুষের জীবিকার উপায় মাত্র।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন - “ মৃত্যূর পর মানুষ স্বর্গে যায় এটা কল্পনা মাত্র। সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যূর পর স্বর্গে গিয়ে অনন্ত সুখময় জীবন যাপন করে - এ ধারনা স্বপ্ন মাত্র। স্বর্গ ও নরক এসব আদিম ধারনা। ( বানী ও রচনা -দশম খন্ড -পৃষ্ঠা ১৫৯ )

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন.. পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। যেখানে পুরোহিত তন্ত্রের আবির্ভাব সেখানেই ধর্মের গ্লানি।( জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজ, স্বামী বিবেকানন্দ )

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন.. প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কবিহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। আগে তাদের নির্মূল করো। এস মানুষ হও। ( জাতি,সংস্কৃতি ও সমাজ, স্বাঃবি. পৃষ্ঠা - ২৮ )

স্বামী বিবেকানন্দ  “ আত্মা তো নিত্য মুক্ত।তার আবার মুক্তির চেষ্টা কি? (স্বাঃ বি. বানী ওরচনা - ৯ম/২১৬ পৃঃ )

শ্রীচৈতন্যদেব - পুরোহিতগনকে রাক্ষসদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ( চৈতন্য চরিতামৃতে )

ডঃআম্বেদকর -“ ধূর্ত ব্রাহ্মণ'রা " শাস্ত্র রচনা করে হিন্দুদেরকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে ( আঃ রঃ বঃ ১ম/২৫৬ পৃঃ )

স্বামী বিবেকানন্দ - “ যে শাস্ত্র বলছে.. তথাপি লোকাচার। অর্থাৎ তবুও মানুষ লোকাচারই অনুসরন করিবে্‌, সে সব শাস্ত্র-দূরে নিক্ষেপ করুন্‌, সেগুলি অর্থহীন ”। ( স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র. ৩/৩০০ পৃঃ )

 বাবাসাহেব ড.বি.আর. আম্বেদকর ..

মৃত্যূ উপলক্ষে অশৌচ পালন অপেক্ষা শোকদিবস পালন করাই যুক্তিযুক্ত। শ্রাদ্ধ নয়, শ্রদ্ধা প্রদর্শনই মৃতের  প্রতি যথার্থ  সম্মান জানানো।                   

পাগলচাঁদ.. 

“ শ্রাদ্ধ " হলো ব্রাহ্মণদের শোষনের কৌশল।মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই। জীবিত অবস্হায় পিতামাতার আশীর্বাদই সন্তানের সবচেয়ে বেশী কল্যান”।    


পন্ডিত দিগিন্দ্র নারায়ন ভট্টাচার্য..

তাঁর বই “ হিন্দুধর্মের ব্যাধি ও চিকিৎসা ” গ্রন্থের বঙ্গ বৈশ্য ক্ষত্রিয় নামক অধ্যায়ে  বলেছেন - হৃদয়হীন ব্রাহ্মণ পন্ডিতগনের আশা ত্যাগ করো। পাষানে নাস্তি কর্দম।শকুনের দৃষ্টি যেমন মরা গরুর মাংসের দিকে ইহাদের দৃষ্টি ও লক্ষ্যও তেমনি ভারতের মুমুর্ষু হিন্দু নর-নারীর দিকে।


 ব্রাহ্মণের ফাঁদে পা দিয়ে মৃত পিতা-মাতার জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা মানে বাড়িতে ব্রাহ্মণ ডেকে মৃত পিতা-মাতাকে গালাগালি করা, অসম্মান করা। তাই ব্রাহ্মণের কথায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নয়, " শ্রদ্ধা " অনুষ্ঠান করুন।অনাত্মীয় নাপিত, ব্রাহ্মণ নয়, নিজের আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে।

অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব -রণদীপম বসু
Nov. 19, 2024 | ব্রাহ্মণ্যবাদ | views:988 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কলঙ্ক

খুব বেশিকাল আগের কথা নয়, একসময় সাধারণ পৌর শহরগুলোতেই কিছু কিছু ভ্রাম্যমান নারী-পুরুষ দেখা যেত যাদের কোমরে অনিবার্যভাবে বাঁধা থাকতো একটি ঝাড়ু, আর গলায় বা কোমরে ঝুলানো থাকতো একটি টিনের মগ জাতিয় পাত্র। ঝাড়ুটি হলো তার পেশাগত প্রতীক বা পরিচয়। তাদের কাজ হচ্ছে লোকালয়ের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখা। পেশাগতভাবে এরা পৌর-কর্তৃপক্ষের শুধু যে বেতনভুক কর্মচারী তা-ই নয়, সম্প্রদায়গতভাবেও এদের পেশাটা তা-ই। সামাজিক শ্রমবিন্যাস অনুযায়ী তাদের জন্য অন্য পেশা বরাদ্দ ছিলো না। তাই জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এ পেশাই তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস।  আর সাথের মগটি ছিলো তাদের সামাজিক অবস্থানের এক ভয়াবহ অস্পৃশ্যতার প্রতীক। অর্থাৎ সব ধরনের ছোঁয়াছুয়ির উর্ধ্বে থেকে অন্য কাউকে যাতে কোনরূপ অশূচি হবার বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। পানির তেষ্টা পেলে কোন হোটেল বা চা-দোকানের বাইরে থেকে মগটা বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দোকানের কেউ হয়তো নিরাপদ অবস্থান থেকে ওই মগটিতে পানি ঢেলে দিতো। এমনকি কোন পাবলিক টিউবওয়েলে ছোঁয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এরা অপেক্ষায় থাকতো দয়া করে কেউ যদি টিউবওয়েল চেপে কিছুটা পানি ঐ মগে ঢেলে দেয়। কিংবা টাকা দিয়ে দোকান থেকে চা খেতে চাইলেও চায়ের কাপ স্পর্শ করার অধিকার নেই বলে গরম চা ওই মগেই ঢেলে দেয়া হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্য লোকজনের সাথে এক কাতারে বসার তো প্রশ্নই উঠে না! নিরাপদ দূরত্ব বাঁচিয়ে মাটিতে বসে পড়াটাই তাদের জন্য অনুমোদিত ব্যবস্থা। তারপরও তাদের ছোঁয়ায় ঐ স্থানটা নোংরা হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল থাকতো সবসময়। এরা হলো ধাঙড়, মেথর বা সুইপার। তাদের বসবাসের ব্যবস্থাও সেরকমই। ভদ্রপাড়া থেকে দূরে স্বতন্ত্র কোন বস্তি বা পল্লীতে এদের গোষ্ঠিগত বসবাস। এদের সংস্কৃতি ভিন্ন, জীবনধারা ভিন্ন, উৎসব-উদযাপন সবই ভিন্ন এবং অনিবার্যভাবে গোষ্ঠিগত।


এদেরই একটি অংশ আবার চর্মকার বলে পরিচিত, ভাষার অপভ্রংশতায় যাদেরকে চামার বলে ডাকা হয়। যারা মূলত মৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে জুতো বা চামড়া জাতিয় দ্রব্যাদি তৈরির সাথে জড়িত। এরা সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। সমাজের যে কোন সামাজিক কর্মকাণ্ডে এদের শ্রমের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার এদের নেই। এধরনের আরো বহু সম্প্রদায় রয়েছে আমাদের সমাজে একই রকম অস্পৃশ্য। স্বভাবতই অধিকতর সভ্য ও শিক্ষিত নাগরিকদের বাসস্থান শহরের চিত্র থেকে যদি আমাদের দৃষ্টিটাকে দূরবর্তী পল্লী অঞ্চলের দিকে নিয়ে যাই, তাহলে এই বাস্তবতাই আরো অনেক কঠিন ও তীব্র হয়ে দেখা দেবে। কেননা গ্রামের সামাজিক কাঠামোতে জীবিকার উৎস আরো অনেক বেশি সঙ্কুচিত বলে এসব অস্পৃষ্য সম্প্রদায়গুলোর মানবেতর জীবন-ধারণ খুবই শোচনীয় পর্যায়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের বসবাস থাকে গ্রামের বাইরের দিকে অত্যন্ত অবহেলিতভাবে অবস্থায়। দেখতে শুনতে চেহারায় আকারে অন্য বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মতো হয়েও কেন এরা সামাজিকভাবে এতো অস্পৃশ্য অপাঙক্তেয় ? যুগে যুগে এ প্রশ্নটা যে উত্থাপিত হয়নি তা নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এদের পেশার অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ইদানিং জীবিকার তাগিদে ভাগ বসালেও এই অস্পৃশ্যদের জন্য অন্য পেশায় জড়িত হওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়নি আজো। কারণ অস্পৃশ্যতা এদের গা থেকে মুছে যায়নি বা মুছা হয়নি। অথচ তাদের পেশায় ভাগ বসালেও অন্য সম্প্রদায়কে কিন্তু এই অস্পৃশ্যতার দায় বইতে হয় না। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সমাজ নিয়ন্ত্রিত এই অস্পৃশ্যতার দায় আসলে পেশা বা কর্মগত নয়, সম্পূর্ণই জন্মগত একটা অভিশাপ। কর্মদোষ নয়, জন্মদোষটাই এখানে একমাত্র উপাত্ত। কিন্তু সমাজ বা সামাজিক ব্যবস্থা কি চাইলেই কোন সম্প্রদায়কে অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য বানিয়ে দিতে পারে ? প্রশ্নটা যত সহজে করা যায়, উত্তরটা বোধ করি তত সহজ বা সাবলীল নয়। এর পেছনে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরিতে যে ধর্মীয় বর্ণাশ্রমগত নিপীড়নের ইতিহাস তথা  মানব-দলনের যে ঐতিহ্য বা কালো অধ্যায় মিশে আছে তার শিকড় এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, গোটা সামাজিক সত্তাটাই বুঝি এই বর্ণবাদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে। অর্থাৎ আচারে বিচারে জীবনে যাপনে সামাজিকতায় এই ধর্মীয় বর্ণবাদী ব্যবস্থা থেকে সমাজকে বা সমাজের কোন অংশকে পৃথক করা শরীর থেকে চামড়া আলগা করার মতোই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়ার কোথাও একটু টান পড়লে গোটা শরীরটাই আৎকে ওঠে, বিগড়ে যায়। তাই বলে কি এই সভ্য জগতের তথাকথিত সভ্য মানুষদেরকেও এভাবেই হাজার বছরের কলঙ্ক বয়ে বয়ে যেতে হবে ?


সভ্য মানুষরা তা বয়ে যাচ্ছে বৈ কি ! কেননা আজো যারা এই সমাজ সংসারের অধিকর্তা হিসেবে জন্মগতভাবে মহান উত্তরাধিকার বহন করছে, সেইসব ক্ষমতাসীন উচ্চবর্ণীয়দের অনুকূল এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে পাল্টানোর খায়েশ তাদের হবেই বা কেন !  কিন্তু সমাজের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও একটা আরোপিত ব্যবস্থায় কেবল জন্মগত কারণে নিম্নবর্ণীয় বা অস্পৃশ্য হবার অভিশাপে যাদের সমস্ত অর্জন কুক্ষিগত হয়ে চলে যায় অন্যের অধিকারে, তারা এটা মানবেন কেন ? আসলে এরা কখনোই মানেনি তা। ক্ষমতাহীন এই না-মানার প্রতিবাদ-বিদ্রোহকে তাই দমন করা হয়েছে বড় নিষ্ঠুরভাবে, নির্দয় প্রক্রিয়ায়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয় আমাদেরকে।


বৈদিক আধিপত্য

ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানতে পারি, মুঘলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর এই আক্রমণেই একদিন ধ্বংস হয়ে যায় এসব আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতাকেই কেউ কেউ হরপ্পা সভ্যতা বা দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিকে দাসে পরিণত করার লক্ষে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠলো মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকলো তার ভিত্তি এক আজব চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলো, এদেরকেই সুকৌশলে করা হলো অছ্যুৎ, দস্যু, সমাজচ্যুত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। চাতুর্যপূর্ণ চতুর্বর্ণের এই অসম সমাজ ব্যবস্থার কুফল সমাজে গভীরভাবে সংক্রমিত হতে থাকলে এই মাটির সন্তান শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। গৌতম বুদ্ধ (Buddha) এ দেশেরই আদিনিবাসী হওয়ায় তাঁর এই সামাজিক বিদ্রোহে আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠি তাঁকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়। ফলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এবং বুদ্ধের নির্বাণলাভ বা মৃত্যুর পর আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্ম। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্মের ডাক।


মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট মহামতি অশোকের (৩০৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্বকালকেই (২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। গৌরবময় আর্যসম্রাট হয়েও মহামতি অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ২৬১) ভয়াবহ রক্তপাত, আহত-নিহতের বিপুল সংখ্যাধিক্য ও যুদ্ধের বীভৎসতায় বিচলিত হয়ে যান। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এই যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি দেখে তিনি বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। প্রচলিত হিন্দুধর্মের মানবাধিকারহীন অসহিষ্ণুতা আর যুদ্ধের পথ ত্যাগ করে তিনি বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মকেই তাঁর আচরিত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর অশোক দেশে ও বিদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর প্রতিনিধিদের পাঠান। জানা যায় তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলংকা পাঠান। এছাড়া তিনি কাশ্মীর, গান্ধার, ভানাভাসী, কোংকন, মহারাষ্ট্র, ব্যকট্রিয়, নেপাল, থাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, লাক্ষাদ্বীপ প্রভৃতি স্থানেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করান।


সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপর নেমে আসে দলন-পীড়ন। ব্রাহ্মণ্যবাদের কালো থাবার নিচে প্রকৃতই চাপা পড়ে যায় আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠির উজ্জ্বল আগামী। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দীর্ঘকালব্যাপী ব্রাহ্মণ্যবাদের এই অত্যাচার নির্যাতন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের কোমরটাই ভেঙে দেয়। শেষপর্যন্ত যাঁরা বেঁচে গেলো তারাও এ দেশ থেকে বিতারিত হলো।



ইতিহাস গবেষক মনীন্দ্র মোহন বসু এ প্রসঙ্গে লিখেন-

‘অবশেষে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধমত তিব্বত, নেপাল প্রভৃতি দেশে যাইয়া আশ্রয়লাভ করিয়াছে। বৌদ্ধধর্মের এই পরাজয় এত সম্পূর্ণ হইয়াছিল যে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থসমূহও ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। থেরবাদী সম্প্রদায়ের গ্রন্থগুলো সিংহল ও ব্রহ্মদেশ হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। আর মহাযান মতের শাস্ত্রসমূহ পাওয়া গিয়াছে প্রধানত চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে। চর্যাপদের পুঁথি নেপালে আবিষ্কার হইয়াছিল। আর ইহার অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে তিব্বতী ভাষায়। এখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের সমাধির স্মৃতিচিহ্ন মাত্রই দৃষ্ট হইয়া থাকে।’


উল্লেখ্য হীনযান বা থেরবাদী মত ও মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধমত বৌদ্ধধর্মেরই দুটি শাখা।


অধ্যাপক হরলাল রায় চর্যাগীতি গ্রন্থে লিখেন-

‘ধর্ম কোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পালি সাহিত্যের সৃষ্টি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণেই বৌদ্ধধর্ম ভারত হতে বিতাড়িত হয়েছিল। … বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমি ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। যারা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল, তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে কুক্ষিগত করে। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা রিক্ত সর্বস্বান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ভারত থেকে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।’


অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি জাতিভেদমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদী চতুর্বর্ণ প্রথার নিগড়ে ভারতের মাটিবর্তি অহিংস বৌদ্ধধর্ম দীর্ঘকাল যাবৎ নিগৃহিত হতে হতে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পতিত হলো। যদিও চীন ও জাপান সহ অনেকগুলো দেশের কোটি কোটি মানুষ বুদ্ধের অহিংস ধর্ম গ্রহণ করে ততদিনে বৌদ্ধ হয়ে গেলেন, ভারতবর্ষ রয়ে গেলো এক বিদ্বেষপূর্ণ অমানবিক বর্ণবাদী বিষাক্ত দর্শনের নিরাপদ প্রজননভূমি হয়ে।


মনুসংহিতা ও  ব্রাহ্মণ্যবাদ

পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ (Manu-smriti) বা ‘মনুসংহিতা’ (Manu-samhita)। ব্রাহ্মণ্যবাদের (Hinduism) আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলো উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোন মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ ব্যাপারে কোন বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং মনুসংহিতা থেকে অনুবাদ ও ভাবার্থসহ কিছু শ্লোকের নমুনা-উদাহরণ টানলেই বিষয়গুলো আমাদের সামনে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।


উল্লেখ্য, মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। কথিত হয় যে মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এ সবকিছু রক্ষার জন্য তাঁর মানব সৃষ্টিও জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষও সৃষ্টি হলো। কিন্তু মানব সৃষ্টি ও পরিপালনের ক্ষেত্রে এসে ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বোধ করি নিজেকে আর সুমহান মর্যাদায় ধরে রাখতে পারেন নি। যে শ্রেণীবিদ্বেষপ্রসূত তীব্র অসমতাভিত্তিক বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেয়া হয়েছে তাতেই সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে যে এটা আদৌ কোন অতিলৌকিক পবিত্র বিধিবিধান কিনা। বরং ধর্মীয় মোড়কে এক ঘৃণ্য আর্থ-সমাজ-রাজনীতির অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক হীন প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। তার পেছনে যে এক অতীব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড প্রতারক গোষ্ঠির সূক্ষ্মতম কারসাজিই কার্যকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন পড়ে না। বিস্তৃত পরিসরে না গিয়ে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের নমুনা-উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারি। এক্ষেত্রে বঙ্গানুবাদসহ উদ্ধৃত শ্লোক ব্যবহারে সদেশ প্রকাশনী কলকাতা থেকে বইমেলা ১৪১২-এ প্রকাশিত মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মনুসংহিতা’ সুলভ সংস্করণ গ্রন্থটির সহায়তা নেয়া হয়েছে।


০১

এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে অতঃপর স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা কি আদতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, না কি কিছু বিভেদপূর্ণ বর্ণ (varnas) (জাতি) সৃষ্টি করলেন, মনুসংহিতা পাঠ করলে তা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়। তবে গোটা গ্রন্থে যেখানে যা কিছুই বলা হয়েছে জাতি হিসেবে ব্রহ্মাসৃষ্ট বর্ণগুলোকেই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-


সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।

মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। (১/৮৭)

বঙ্গানুবাদ: এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।


অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।

দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। (১/৮৮)

বঙ্গানুবাদ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।


প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।

বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। (১/৮৯)

বঙ্গানুবাদ: প্রজারণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।


পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।

বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। (১/৯০)

বঙ্গানুবাদ: পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল।


অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।

প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।। (১০/১)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।


এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।

এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। (১/৯১)

বঙ্গানুবাদ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, -তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।


উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই। তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ। সন্দেহ তীব্র হলে নিচের শ্লোকগুলো দেখা যেতে পারে-


উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।

সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।। (১/৯৩)

বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।


ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।। (১/৯৯)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।


সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।

শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।। (১/১০০)

বঙ্গানুবাদ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।


স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।

আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।। (১/১০১)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।


ন তং স্তেনা ন চামিত্রা হরন্তি ন চ নশ্যতি।

তস্মাদ্রাজ্ঞা নিধাতব্যো ব্রাহ্মণেষ্বক্ষয়ো নিধিঃ।। (৭/৮৩)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণকে যে ভূমি-অর্থ প্রভৃতি দান করা হয় তা এমনই নিধি (ন্যস্ত সম্পত্তি) যে, সেই নিধি চোরেরা অপহরণ করতে পারে না, শত্রুরা হরণ করতে পারে না, এবং তা নিজেও নষ্ট বা অদৃষ্ট হয় না। এই জন্য রাজার কর্তব্য হল, ব্রাহ্মণগণের কাছে এই অক্ষয় নিধি ন্যস্ত করা।


সমমব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণব্রুবে।

প্রাধীতে শতসাহস্রমনন্তং বেদপারগে।। (৭/৮৫)

বঙ্গানুবাদ: অব্রাহ্মণকে যে বস্তু দান করা হয় তার সমপরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার দ্বারা অতিরিক্ত ফল হয় না। ব্রাহ্মণব্রুবকে (অর্থাৎ যিনি জাতিমাত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণোচিত গুণসম্পন্ন নন) দান করলে পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ফল লাভ হয়। যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করেছেন, তাঁকে দান করলে লক্ষগুণ ফল লাভ হয়; এবং যিনি সমস্ত বেদশাখাধ্যেতা বেদপারগ ব্রাহ্মণ, তাঁকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়।


বুঝাই যাচ্ছে, কথিত ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ হতে সৃষ্ট বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই জগদীশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অতএব কাউকে কর দিয়ে ব্রাহ্মণের চলার কথা নয়। এবং তা-ই মনুসংহিতার পাতায় পাতায় খুব ভালোভাবে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

মনুশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য হিসেবে নিরাপদে রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজনেই প্রজাদের কাছ থেকে কর ধার্য্য ও গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে-



নোচ্ছিন্দ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাঞ্চাতিতৃষ্ণয়া।

উচ্ছিন্দন্ হ্যাত্মনো মূলমাত্মানং তাংশ্চ পীড়য়েৎ।। (৭/১৩৯)

বঙ্গানুবাদ: কর, শুল্ক প্রভৃতি গ্রহণ না করে রাজা নিজের মূলোচ্ছেদন করবেন না অর্থাৎ রাজকোষ শূন্য করবেন না; এবং অতিলোভবশতঃ বেশি কর নিয়ে প্রজাদেরও মূল নষ্ট করবেন না। কারণ, এইভাবে নিজের ও পরের মূলোচ্ছেদ ঘটালে নিজেকে এবং প্রজাবর্গকে উৎপীড়িত করা হয়।


অতএব কার কাছ থেকে কিভাবে কী পরিমাণ কর আদায় করা হবে তার বিস্তারিত শ্লোক-বয়ান মনুশাস্ত্রে উদ্ধৃত রয়েছে। তবে সাধারণসূত্রে বলা হচ্ছে-



যৎ কিঞ্চিদপি বর্ষস্য দাপয়েৎ করসংজ্ঞিতম্।

ব্যবহারেণ জীবন্তং রাজা রাষ্ট্রে পৃথগ্জনম্।। (৭/১৩৭)

বঙ্গানুবাদ: যে সব ‘পৃথগ্জন’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয় ছাড়া অন্য লোক কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি কোনও একটি ব্যবহার অর্থাৎ বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের কাছ থেকে রাজা বার্ষিক যৎ কিঞ্চিৎ হলেও কর গ্রহণ করবেন।


যে ব্রাহ্মণ কল্পশাস্ত্রের সাথে এক বেদ অথবা ব্যাকরণ প্রভৃতি ছয়টি বেদাঙ্গের সাথে বেদশাখা অধ্যয়ন করেন এবং বেদাধ্যয়নাদি কাজে নিরত থাকেন, তাঁকে ‘শ্রোত্রিয়’ বলা হয়। উপরোক্ত ৭/১৩৭ সংখ্যক শ্লোকে এই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয়ের কাছ থেকে কোনরূপ কর গ্রহণকে নিরস্ত করা হয়েছে। তবে মনুসংহিতার ১০/১২৯ সংখ্যক শ্লোকের দ্বারা (পরবর্তীতে নিচে বর্ণিত হয়েছে) শূদ্রের ধন-সম্পদ অর্জনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও শূদ্রের কাছ থেকে কর আদায় নিষিদ্ধ হয়নি। যেহেতু তার অর্জিত সম্পদ থাকার কথা নয়, তাই এই কর পরিশোধ হবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে-


কারুকান্ শিল্পিনশ্চৈব শূদ্রাংশ্চাত্মোপজীবিনঃ।

একৈকং কারয়েৎ কর্ম মাসি মাসি মহীপতিঃ।। (৭/১৩৮)

বঙ্গানুবাদ: পাচক, মোদক প্রভৃতি কারুক এবং কাংস্যকার, লৌহকার, শঙ্খকার প্রভৃতি শিল্পী ও কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকানির্বাহকারী শূদ্র- এদের দ্বারা রাজা প্রতি মাসে একদিন করে নিজের কাজ করিয়ে নেবেন।


কিন্তু পরধন অর্জনে মত্ত ব্রাহ্মণের কাছে কোনক্রমেই কর নেয়া যাবে না। অর্থাভাবে রাজা মরণাপন্ন হলেও ক্ষতি নেই, তবু কোন ব্রাহ্মণ যেন রাজার রাজ্যে ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন, এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে-



ম্রিয়মাণোহপ্যাদদীত ন রাজা শ্রোত্রিয়াৎ করম্।

ন চ ক্ষুধাহস্য সংসীদেচ্ছ্রোত্রিয়ো বিষয়ে বসন্।। (৭/১৩৩)

বঙ্গানুবাদ: রাজা ধনাভাবে মরণাপন্ন হলেও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনও যেন কর গ্রহণ না করেন। রাজার রাজ্যে বাস করতে থেকে কোনও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ যেন ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন।


মনুসংহিতার পরতে পরতে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা প্রদান আর নিম্নবর্ণ শূদ্রের নিচত্ব ও তাকে বঞ্চনা করার কৌশল বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, রাজকার্যে ও বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে সবাইকে উদ্ধারের নিমিত্তে ক্ষমতাসীন পরামর্শক ব্রাহ্মণের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। প্রয়োজনীয় গুণ ও যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক ব্রাহ্মণ হলেই হলো, এবং তা-ই হতে হবে। কিন্তু যত যোগ্যতা বা গুণের আধারই হোক শূদ্রকে কিছুতেই নিয়োগ মর্যাদা দেয়া যাবে না।


জাতিমাত্রোপজীবী বা কামং স্যাদ্ব্রাহ্মণব্রুবঃ।

ধর্মপ্রবক্তা নৃপতের্ন তু শূদ্রঃ কথঞ্চন।। (৮/২০)

বঙ্গানুবাদ: বিদ্যা ও গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণের অভাব হলে রাজা জাতিমাত্রোপজীবী অর্থাৎ জাতিসর্বস্ব ব্রাহ্মণকে অথবা ক্রিয়ানুষ্ঠানবিহীন ব্রাহ্মণব্রুবকেও (অর্থাৎ নামে মাত্র ব্রাহ্মণকেও) নিজের ধর্মপ্রবক্তার পদে (শাস্ত্রীয় আইন বিশ্লেষক) নিযুক্ত করবেন, কিন্তু শূদ্র যদি সর্বগুণসম্পন্ন, ধার্মিক এবং ব্যবহারজ্ঞও হয়, তবুও তাকে ঐ পদে নিয়োগ করতে পারবেন না।


শাস্ত্র বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্রাহ্মণকেই ধর্মপ্রবক্তা করার বিধান থাকায় বিদ্বান্ ব্রাহ্মণকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করতে হয়। কাজেই ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্য তিন বর্ণের লোককে ধর্ম নিরূপণের কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। তবুও এখানে শূদ্রকে ঐ কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করার তাৎপর্য হলো, ঐ কাজের জন্য উপযুক্ত বিদ্বান ব্রাহ্মণ পাওয়া না গেলে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যকে ঐ কাজে হয়তো নিয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই শূদ্রকে নয়। এই ব্রহ্মবিধি ভঙ্গ হলে কী পরিণতি হবে তাও মনুশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-



যস্য শূদ্রস্তু কুরুতে রাজ্ঞো ধর্মবিবেচনম্।

তস্য সীদতি তদ্রাষ্ট্রং পঙ্কে গৌরিব পশ্যতঃ।। (৮/২১)

বঙ্গানুবাদ: বিচারসভায় যে রাজার সাক্ষাতে শূদ্র ন্যায়-অন্যায় ধর্ম বিচার করে, সেই রাজার রাজ্য কাদায় নিমগ্ন গোরুর মতো দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়।


যদ্রাষ্ট্রং শূদ্রভূয়িষ্ঠং নাস্তিকাক্রান্তমদ্বিজম্।

বিনশ্যত্যাশু তৎ কৃৎস্নং দুর্ভিক্ষব্যাধিপীড়িতম্।। (৮/২২)

বঙ্গানুবাদ: যে রাজ্য ধর্মাধিকরণে (বিবাদ নিরূপণের ব্যাপারে-) শূদ্রের প্রাধান্য ও নাস্তিকদের প্রভুত্ব, এবং যেখানে দ্বিজগণের (ব্রাহ্মণদের) অভাব, সেই রাজ্য দুর্ভিক্ষ ও নানারকম রোগে পীড়িত হয়ে অতি শীঘ্রই বিনষ্ট হয়।


অপরাধ সংঘটন হলে রাজার বিচারে দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনুসংহিতার ৮/৩৭৯ সংখ্যক শ্লোক অনুযায়ী শাস্ত্রের বিধান হলো- প্রাণদণ্ডের যোগ্য অপরাধেও ব্রাহ্মণের এই দণ্ড বা অঙ্গচ্ছেদনাদি করা যাবে না। যদিও অন্যান্য বর্ণের পক্ষে বধাদি প্রাণদণ্ডই বিধেয়। এছাড়া মনুশাস্ত্রে আরো বলা হচ্ছে-



ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্থিতম্।

রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্।। (৮/৩৮০)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে কোনও পাপ বা অপরাধই করুক না কেন (যত কিছু অপরাধ আছে সে সবগুলি একসাথে অনুষ্ঠান করলেও) রাজা তাকে হত্যা করবেন না; পরন্তু সমস্ত ধনের সাথে অক্ষত শরীরে তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করবেন।


কারণ-

ন ব্রাহ্মণবধাদ্ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি।

তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ।। (৮/৩৮১)

বঙ্গানুবাদ: এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম (অর্থাৎ পাপ) আর কিছুই নেই। এই কারণে ব্রাহ্মণকে বধ (এবং অঙ্গচ্ছেদনাদি) করার কথা রাজা কখনও মনে মনেও চিন্তা করবেন না।


০২

মনুষ্য সমাজে সন্তান জন্ম নিলে তার একক পরিচিতির জন্যে একটি নামের প্রয়োজন হয়। অবশ্য পালনীয় বৈদিক বিধি মনুসংহিতায় তা অস্বীকার করা হয়নি। তবে বর্ণপ্রথার কঠিন নিগড় নামকরণ ব্যবস্থার মধ্যেও পরিয়ে দেয়া হয়েছে সুকৌশলে। বিধি অনুসারে এমনভাবে নামকরণ করতে হবে, নাম থেকেই যেন বুঝা যায় কে উচ্চবর্ণের প্রভুবংশীয় এবং কে নিম্নবর্গীয় দাসজাত শূদ্রবংশীয়।


মঙ্গল্যং ব্রাহ্মণস্য স্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য বলান্বিতম্।

বৈশ্যস্য ধনসংযুক্তং শূদ্রস্য তু জুগুপ্সিতম্।। (২/৩১)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক শব্দ (‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম’; সেই ধর্মের সাধক ‘মঙ্গল্য’; ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবতাবাচক শব্দ বা ঋষিবাচক শব্দ মঙ্গলের সাধন, তাই ‘মঙ্গল্য’; যেমন- ইন্দ্র, বায়ু, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি); ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলসূচক শব্দ (যেমন, প্রজাপাল, দুর্যোধন, নৃসিংহ প্রভৃতি); বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক অর্থাৎ পুষ্টিবৃদ্ধিসমন্বিত (যেমন ধনকর্মা, গোমান, ধনপতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নাম হবে জুগুপ্সিত (নিন্দা বা হীনতাবোধক, যেমন- কৃপণক, দীন, শবরক ইত্যাদি)।


শর্মবদ্বাহ্মণস্য স্যাদ্ রাজ্ঞো রক্ষাসমন্বিতম্।

বৈশ্যস্য পুষ্টিসংযুক্তং শূদ্রস্য প্রৈষ্যসংযুতম্।। (২/৩২)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নামের সাথে শর্মা এই উপপদ যুক্ত হবে (অর্থাৎ আগে মঙ্গলবাচক শব্দ তারপর ‘শর্মা’ এই উপপদ যুক্ত হবে; যেমন শুভশর্মা), ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে ‘বর্মা’ বা এইরকম কোনও রক্ষাবাচক উপাধি যুক্ত হবে; (যেমন বলবর্মা), বৈশ্যের নামের সাথে যুক্ত হবে ‘বৃদ্ধ, গুপ্ত, ভূতি’ প্রভৃতি পুষ্টিবোধক উপপদ (যেমন গোবৃদ্ধ, ধনগুপ্ত, বসুভূতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নামের উপাধি হবে প্রৈষ্য (দাস বা ভৃত্য) বাচক শব্দ (যেমন দীনদাস, ব্রাহ্মণদাস, দেবদাস প্রভৃতি)।


আর স্ত্রী-জাতির নামের ক্ষেত্রে ?

স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।

মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।। (২/৩৩)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)।


যাই হোক, পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক ক্ষেত্র বা আবহ তৈরি করে, বৈদিক ঈশ্বরের মনেও তা রেখাপাত করতে পেরেছে বলে মনে হয়। ভাবতে ভালোই লাগে, ঈশ্বর কি তাহলে পুরুষ সম্প্রদায়ের কেউ ? অবশ্য মনুসংহিতায় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ব্রহ্মা তো পুরুষগুণবাচকই। সেভাবেই তাঁকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যাবার আগে এই সংহিতা বা শাস্ত্র রচিত হবার শাস্ত্র-বর্ণিত ইতিহাস অতি সংপ্তিভাবে জেনে রাখলে শাস্ত্রবিধিগুলো অনুধাবনে সহায়তা হতে পারে।


স্বয়ম্ভু ভগবান কর্তৃক পূর্বে অপ্রকাশিত এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি ও সংহারের পর্যায়ক্রমিক বিশদ বর্ণনার এক পর্যায়ে এসে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে-

এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্।

সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।। (১/৫৭)

বঙ্গানুবাদ: এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন।


এরপরই আমরা পেয়ে যাই এই শাস্ত্র প্রস্তুতির উল্লেখ-

ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাসৌ মামেব স্বয়মাদিতঃ।

বিধিবদ্ গ্রাহয়ামাস মরীচ্যাদীংস্ত্বহং মুনীন্।। (১/৫৮)

বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে আমাকে যথাবিধি অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং আমি (মনু) মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করিয়েছি।


প্রখ্যাত শাস্ত্রভাষ্যকার মেধাতিথি মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৫৮ সংখ্যক শ্লোকের ভাষ্যে বলেন- “নারদশ্চ স্মরতি। শতসাহস্রো গ্রন্থঃ প্রজাপতিনা কৃতঃ স মন্বাদিভিঃ ক্রমেণ সংক্ষিপ্ত ইতি।” অর্থাৎ এখানে নারদ বলছেন- “এই গ্রন্থ শতসাহস্র বা লক্ষ সন্দর্ভাত্মক; প্রজাপতি (ব্রহ্মা) এটি রচনা করেছেন। তারপর ঐ লক্ষ সন্দর্ভটিকে ক্রমে ক্রমে মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ সংক্ষিপ্ত করেছেন।”



এই একই শ্লোকের টিকায় কুল্লুকভট্ট নারদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন- ব্রহ্মা প্রথমে স্মৃতিগ্রন্থটি প্রণয়ন করেন; তারপর মনু নিজ ভাষায় তার সারসংক্ষেপ করেন এবং সেই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটিই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন।


পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে। মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে (শ্লোক ৩২-৩৫) দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে বিরাট্ পুরুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং সেই বিরাট্ পুরুষ তপস্যার দ্বারা মনু-কে সৃষ্টি করেছিলেন। মনু আবার প্রজাসৃষ্টির অভিলাষে ক্লেশকর তপস্যা করে যে দশজন প্রজাপতি (এঁরা সকলেই মহর্ষি) সৃষ্টি করলেন তাঁরা হলেন- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু এবং নারদ। প্রথম অধ্যায়ের শ্লোক ৫৮-৫৯ অনুযায়ী বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা মনুসংহিতায় আলোচনীয় শাস্ত্র অর্থাৎ বিধিনিষেধসমূহ প্রস্তুত করে প্রথমে মনু-কে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং তারপর মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পড়িয়েছিলেন। ভৃগুমনি এই সম্পূর্ণশাস্ত্র মনুর কাছে অধ্যয়ন করলেন। চারটি বর্ণের ও সঙ্কর জাতিগণের ধর্মসমূহ জানার উদ্দেশ্যে মনু-সমীপে আগত মহর্ষিদের মনু জানালেন যে, তিনি এইসব শাস্ত্র ভৃগুকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই ভৃগুই ঐ শাস্ত্র আদ্যোপান্ত সকলকে শোনাবেন। মনুকর্তৃক এইভাবে আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি ভৃগু খুশি হয়ে সকল ঋষিকে তাঁদের জিজ্ঞাস্যের উত্তর দিতে লাগলেন- এভাবেই মনুসংহিতা ভৃগু কর্তৃক সংস্কার ও সংকলিত হয়ে প্রচারিত হলো। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের অন্তিম শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়-


ইত্যেতন্মানবং শাস্ত্রং ভৃগুপ্রোক্তং পঠন্ দ্বিজঃ।

ভবত্যাচারবান্নিত্যং যথেষ্টাং প্রাপ্লুয়াদ্ গতিম্।। (১২/১২৬)

বঙ্গানুবাদ: ভৃগুর দ্বারা কথিত এই মনু-সৃষ্ট-শাস্ত্র নিয়মিত পাঠ করতে থাকলে দ্বিজগণ সতত আচারনিষ্ঠ হন এবং যথাভিলষিত উৎকৃষ্ট গতি অর্থাৎ স্বর্গ লাভ করেন।

কিন্তু এ মুহূর্তে স্বর্গ লাভের বদলে আমাদের প্রয়োজন মনুসংহিতা গ্রন্থটি অলৌকিকতার মোড়কে লৌকিক বর্ণাশ্রমপ্রসূত কী ভয়ানক জাতি-বিভেদ ও বর্ণ-বিদ্বেষে দুষ্ট তা অনুধাবন করা। তাই প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ফিরে আসাই উত্তম।


০৩

মনুসংহিতায় নারীকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে তা মনুর শ্লোক থেকেই ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়-


ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।

ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।। (৯/৩৩)

বঙ্গানুবাদ: নারী শস্যক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি।



বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।

সর্বভূতপ্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।। (৯/৩৫)

বঙ্গানুবাদ: বীজ ও যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণযুক্ত হয়ে থাকে।

শাস্ত্রীয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত মনুশাস্ত্রে শস্যক্ষেত্ররূপী নারীর চেয়ে বীজরূপ পুরুষেরই শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে তা কি আর বলতে হয় ! তবে পবিত্র শাস্ত্র এটা প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি। নারী যে একটা নিকৃষ্ট কামজ সত্ত্বা তা প্রমাণেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে-


স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ্ দূষণম্।

অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।। (২/২১৩)

বঙ্গানুবাদ: ইহলোকে (শৃঙ্গার চেষ্টার দ্বারা মোহিত করে) পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব; এই কারণে পণ্ডিতেরা স্ত্রীলোকসম্বন্ধে কখনোই অনবধান হন না।


মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ।

বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।। (২/২১৫)

বঙ্গানুবাদ: মাতা, ভগিনী বা কন্যার সাথে কোনও পুরুষ নির্জন গৃহাদিতে বাস করবে না, কারণ ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান্ (চঞ্চল) যে, এরা (শাস্ত্রালোচনার দ্বারা আত্মসংযম অভ্যাস করতে পেরেছেন এমন) বিদ্বান্ ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে (অর্থাৎ কামক্রোধাদির বশবর্তী করে তোলে)।


অর্থাৎ তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও আসলে পুরুষ অভব্যই হয়, এবং তার দুরাচারকে সুকৌশলে ব্রহ্মবাক্য দিয়ে শেষপর্যন্ত নারীর উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। নারী যে আসলে মানুষ নয়, অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতোই পুরুষের ব্যবহারযোগ্য উপভোগের সামগ্রী মাত্র তা নিচের শ্লোক থেকে বুঝতে কি কোন সমস্যা হয় ?


স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।

বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।। (২/২৪০)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে।

মনুশাস্ত্রে আসলে নারীর স্বাধীনতা কখনোই স্বীকার করা হয়নি-


বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।

ন স্বাতস্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহেষ্বপি।। (৫/১৪৭)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বালিকাই হোক, যুবতীই হোক কিংবা বৃদ্ধাই হোক, সে গৃহমধ্যে থেকে কোনও কাজই স্বামী প্রভৃতির অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না।


বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পানিগ্রাহস্য যৌবনে।

পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্।। (৫/১৪৮)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায় পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনকালে পাণিগ্রহীতার অর্থাৎ স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রদের অধীনে থাকবে। (পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ড, স্বামীর সপিণ্ড না থাকলে পিতার সপিণ্ড এবং পিতার সপিণ্ড না থাকলে রাজার বশে থাকবে), কিন্তু কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না।


উল্লেখ্য যে, সপিণ্ড মানে যিনি মৃতব্যক্তির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পিণ্ড দানের যোগ্য। হিন্দুশাস্ত্রে পিণ্ডদানের ক্রমাধিকারের সাথে সম্পত্তির অধিকার অর্জনের বিষয়ও জড়িত।


পিত্রা ভর্ত্রা সুতৈর্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।

এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্যাদুভে কুলে।। (৫/১৪৯)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক কখনো পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না; কারণ, স্ত্রীলোক এদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে পিতৃকুল ও পতিকুল- উভয় কুলকেই কলঙ্কিত করে তোলে।


বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।

উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।। (৫/১৫৪)

বঙ্গানুবাদ: স্বামী বিশীল (অর্থাৎ জুয়াখেলা প্রভৃতিতে আসক্ত এবং সদাচারশূন্য), কামবৃত্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীতে অনুরক্ত) এবং শাস্ত্রাধ্যায়নাদি ও ধনদানাদি গুণবিহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রীর কর্তব্য হল স্বামীকে দেবতার মতো সেবা করা।


কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।

ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।। (৫/১৫৭)

বঙ্গানুবাদ: পতি মৃত হলে স্ত্রী বরং পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি অল্পাহারের দ্বারা জীবন ক্ষয় করবে, কিন্তু ব্যভিচারবুদ্ধিতে পরপুরুষের নামোচ্চারণও করবে না।


অর্থাৎ নারীর কোন জৈবিক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না। এই চাওয়া-পাওয়াকে পবিত্র মনুশাস্ত্রে স্বীকার করা হয়নি। তবে নারীর ক্ষেত্রে জৈবনিক চাহিদাকে স্বীকার করা না হলেও শাস্ত্রে পুরুষের কামচরিতার্থতার প্রয়োজনকে কিন্তু অস্বীকার করা হয়নি, বরং তা পূরণের জন্য পবিত্র বিধানও তৈরি করে দেয়া হয়েছে-


ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।

পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।। (৫/১৬৮)

বঙ্গানুবাদ: (সুশীলা-) ভার্যা স্বামীর পূর্বে মারা গেলে তার দাহাদি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে পুরুষ পুনরায় দারপরিগ্রহ ও অগ্ন্যাধ্যান করবে (যদি ধর্মানুষ্ঠান ও কামচরিতার্থতার প্রয়োজন থাকে, তবেই ঐ স্বামীর পুনরায় দারপরিগ্রহ করা উচিৎ। তা না হলে পত্নী নেই বলে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস অবলম্বন করতে পারে)।


যারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থে নারী-পুরুষের সমতা খুঁজে বেড়ান, তারা আসলে কী যে খুঁজেন বুঝা দায়। তবে  মনুশাস্ত্রে স্ত্রীর মর্যাদা কতটুকু তা এই শ্লোক থেকেও কিঞ্চিত অনুধাবন করা যেতে পারে-


ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ।

প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুলেন বা।। (৮/২৯৯)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদরভ্রাতা অপরাধ করলে সূক্ষ্ম দড়ির দ্বারা কিংবা বেতের দ্বারা শাসনের জন্য প্রহার করবে।

তবে প্রিয়জনকে প্রহার বলে কথা, তাই শাস্ত্র কি এতোটা নির্দয় হতে পারে ! প্রহারের নিয়মও বলে দেয়া হয়েছে-


পৃষ্ঠতস্তু শরীরস্য নোত্তমাঙ্গে কথঞ্চন।

অতোহন্যথা তু প্রহরন্ প্রাপ্তঃ স্যাচ্চৌরকিল্বিষম্।। (৮/৩০০)

বঙ্গানুবাদ: রজ্জু প্রভৃতির দ্বারা প্রহার যদি করতে হয়, তাহলে শরীরের পশ্চাদ্ভাগে প্রহার কর্তব্য; কখনো উত্তমাঙ্গে বা মাথায় যেন প্রহার করা না হয়; এই ব্যবস্থার অন্যথা করে অন্যত্র প্রহার করলে প্রহারকারী চোরের মতো অপরাধী ও দণ্ডনীয় হবে।


তারপরও এসব হচ্ছে শাস্ত্রবাক্য। আর শাস্ত্র কি উচিত কথা বলতে কার্পণ্য করতে পারে ? তাই বলা হচ্ছে-


ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।

যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।। (৮/৪১৬)

বঙ্গানুবাদ: স্মৃতিকারদের মতে ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পে অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে।


দাসী হোক বাঁদী হোক, তবু তো স্ত্রী, তাকে ছাড়া পুরুষের চলেও না। তাই মনুসংহিতায় পুরুষদেরকে স্ত্রী-স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞাত করা না হলে কি চলে !


শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জবম্।

দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।। (৯/১৭)

বঙ্গানুবাদ: বেশি নিদ্রা যাওয়া, কেবল বসে থাকার ইচ্ছা, শরীরকে অলংকৃত করা, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, নীচহৃদয়তা, অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কুচর্মা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা- স্ত্রীলোকদের এই সব স্বভাব মনু এদের সৃষ্টি-কালেই করে গিয়েছেন।


এরকম অদ্ভুত বক্তব্য মনুশাস্ত্রে নিতান্ত কম নয়। তাই বোধ করি শাস্ত্র অত্যন্ত সচেতনভাবেই স্ত্রী-রক্ষকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে-


ইমং হি সর্ববর্ণানাং পশ্যন্তো ধর্মমুত্তমম্।

যতন্তে রক্ষিতুং ভার্যাং ভর্তারো দুর্বলা অপি।। (৯/৬)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোককে রক্ষণরূপ-ধর্ম সকল বর্ণের পক্ষে শ্রেষ্ঠ ধর্ম- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। এই ব্যাপার বুঝে অন্ধ, পঙ্গু প্রভৃতি দুর্বল স্বামীরাও নিজ নিজ স্ত্রীকে রক্ষা করবার জন্য যত্ন করবে।


প্রশ্ন হতে পারে, স্ত্রী-রক্ষায় এতোটা গুরুত্ব দেয়া হলো কেন ? কারণ

স্বাং প্রসূতিং চরিত্রঞ্চ কুলমাত্মানমেব চ।

স্বঞ্চ ধর্মং প্রযত্নেন জায়াং রক্ষন্ হি রক্ষতি।। (৯/৭)

বঙ্গানুবাদ: যে লোক যত্নের সাথে নিজের স্ত্রীকে রক্ষ করে, তার দ্বারা নিজ সন্তান রক্ষিত হয়। কারণ, সাঙ্কর্যাদি দোষ না থাকলে বিশুদ্ধ সন্তান-সন্ততি জন্মে। স্ত্রীকে রক্ষার দ্বারা শিষ্টাচার রক্ষিত হয় এবং নিজের কুলমর্যাদা রক্ষিত হয়। স্ত্রীকে রক্ষা করলে নিজেকেও রক্ষা করা হয় এবং স্ত্রীকে রক্ষা করলে স্বামী তার নিজের ধর্মকেও রক্ষা করতে পারে।


তাই, কিভাবে স্ত্রীকে রক্ষা করতে হবে তার উপায়ও মনু বাতলে দিয়েছেন-

ন কশ্চিদ্যোষিতঃ শক্তঃ প্রসহ্য পরিরক্ষিতুম্।

এতৈরুপায়যোগৈস্তু শক্যাস্তাঃ পরিরক্ষিতুম্।। (৯/১০)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকসমূহকে কেউ বলপূর্বক বা সংরোধ বা তাড়নাদির দ্বারা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বক্ষ্যমাণ উপায়গুলি অবলম্বন করলে তাদের রক্ষা করা যায়।


কী উপায় ?

অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।

শৌচে ধর্মেহন্নপক্ত্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।। (৯/১১)

বঙ্গানুবাদ: টাকাকড়ি ঠিকমত হিসাব করে জমা রাখা এবং খরচ করা, গৃহ ও গৃহস্থালী শুদ্ধ রাখা, ধর্ম-কর্ম সমূহের আয়োজন করা, অন্নপাক করা এবং শয্যাসনাদির তত্ত্বাবধান করা- এই সব কাজে স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করে অন্যমনস্ক রাখবে।

মূলত মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে-


নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।

নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।। (৯/১৮)

বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ,  -এই হলো শাস্ত্রস্থিতি।


০৪

সম্পদ অর্জন এবং তা নিজের অধিকারে রাখার প্রচেষ্টা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এককালে ব্যক্তির উত্তরাধিকার তৈরি জরুরি হয়ে পড়ে। এবং এ কারণেই মানব সমাজে বিবাহপ্রথার সৃষ্টি হয় বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। বৈদিক সমাজে বিবাহকে অন্যতম ধর্মানুষ্টানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথার তীব্র উপস্থিতি। বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় শূদ্রনারীকে উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা ভোগ করার ব্যবস্থা পাকা করা হলেও শূদ্রদের জন্য কোন মর্যাদা বা সুযোগ না রেখে সর্বতোভাবে বঞ্চিত করার কূটকৌশলী প্রয়াস মনুসংহিতার বিবাহ ব্যবস্থায় তীব্রভাবে লক্ষ্যণীয়।


সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।

কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।। (৩/১২)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে বক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (পরবর্তী শ্লোকে তা বর্ণিত হয়েছে)


শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।

তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজম্মনঃ।। (৩/১৩)

বঙ্গানুবাদ: একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে।


অর্থাৎ এখানে ‘অনুলোম’ বিবাহের বিষয়টিকেই অনুমোদন করা হয়েছে। উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের কন্যার বিবাহকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিবাহের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিবাহ সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সাথে বিবাহই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এখানেও অন্য ভার্যায় সমস্যা নেই, শূদ্রা ভার্যার ক্ষেত্রেই যত বিপত্তি।


দৈবপিত্র্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।

নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।। (৩/১৮)

বঙ্গানুবাদ: শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ বা যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম যেমন শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়।)


অর্থাৎ শূদ্রা নারী ব্রাহ্মণের প্রথম পরবর্তী ভার্যা হয়ে ব্রহ্মভোগের বস্তু হলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীর কোনো মর্যাদাই তার প্রাপ্য হয় না। আর যদি সে প্রথম বিয়ে করা স্ত্রী হয় ?


শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।

জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।। (৩/১৭)

বঙ্গানুবাদ: সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন (অর্থাৎ সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়)।


এছাড়া ব্যভিচারের দণ্ডের ক্ষেত্রেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথা চোখে পড়ার মতো-

শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্।

অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।। (৮/৩৭৪)

বঙ্গানুবাদ: কোনও দ্বিজাতি-নারী (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ত্রিয় ও বৈশ্য নারী) স্বামীর দ্বারা রক্ষিত হোক্ বা না-ই হোক্, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে, আর যদি স্বামীর দ্বারা রক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ঐ শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে।


অথচ উচ্চবর্ণিয়দের ক্ষেত্রে একই অপরাধের জন্য বিবিধ বিধানের মাধ্যমে মনুশাস্ত্রে বর্ণক্রমানুসারে বিভিন্ন মাত্রার কিছু অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে মাত্র।

০৫

বৈদিক শাস্ত্র মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে যে, ব্রহ্মা তাঁর পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ শূদ্রের জন্ম নিজে নিজে বা তার ইচ্ছায় হয়নি বা এ প্রক্রিয়ায় তার কোন কর্মদোষও জড়িত নেই। জড়িত কেবল স্রষ্টা ব্রহ্মার তীব্র বৈষম্যমূলক দৃষ্টি। অথচ মনুসংহিতায় শূদ্রের প্রতি অন্য বর্ণকে যে অমানবিক আচরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা এককথায় ন্যাক্কারজনক।


ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবিষ্কৃতম্।

ন চাস্যোপদিশেদ্ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ।। (৪/৮০)

বঙ্গানুবাদ: শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না।


কেউ এ বিধান অমান্য করলে তার পরিণতি বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

যো হ্যস্য ধর্মমাচষ্টে যশ্চৈবাদিশতি ব্রতম্।

সোহসংবৃতং নাম তমঃ সহ তেনৈব মজ্জতি।। (৪/৮১)

বঙ্গানুবাদ: যে ব্যক্তি (কোন ব্রাহ্মণকে ব্যবধানে না রেখে) নিজে শূদ্রকে ধর্মোপদেশ দেন, বা প্রায়শ্চিত্তাদি ব্রতের অনুষ্ঠান করতে আদেশ দেন, তিনি সেই শূদ্রের সাথে অসংবৃত নামক গহন নরকে নিমগ্ন হন।


উল্লেখ্য যে, মনুশাস্ত্রে শূদ্রের কোনরূপ সম্পদ অর্জনকেও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।


শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।

শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।। (১০/১২৯)

বঙ্গানুবাদ: ‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷’


এই যখন অবস্থা- সম্পদ অর্জন নয়, কোনরূপ খাবার সরবরাহও নয়, তাহলে শূদ্রদের বেঁচে থাকার উপায় ? উপায় একটা রয়েছে বৈ কি। এক্ষেত্রে যেসব জন্মদাস শূদ্র ব্রাহ্মণ বা অন্য উচ্চবর্ণীয়দের সেবা শুশ্রূষায় কৃতপরায়ণ হবে তাদের প্রতি অবশ্য কিছুটা করুণা দেখানো হয়েছে। যেমন-


শূদ্রাণাং মাসিকং কার্যং বপনং ন্যায়বর্তিনাম্।

বৈশ্যবচ্ছৌচকল্পশ্চ দ্বিজোচ্ছিষ্টঞ্চ ভোজনম্।। (৫/১৪০)

বঙ্গানুবাদ: ন্যায়চরণকারী শূদ্রগণ (অর্থাৎ সে সব শূদ্র ব্রাহ্মণ-শুশ্রূষা পরায়ণ) মাসে মাসে কেশ বপন (অর্থাৎ কেশমুণ্ডন) করবে এবং জননশৌচে ও মরণাশৌচে বৈশ্যের মত অশৌচ পালনের পর শুদ্ধ হবে এবং ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট ভোজন করবে।


উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।

পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ।। (১০/১২৫)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ-পরিত্যক্ত বস্ত্র, ধানের পুলাক অর্থাৎ আগড়া (অসার ধান) এবং জীর্ণ পুরাতন ‘পরিচ্ছদ’ অর্থাৎ শয্যা-আসন প্রভৃতি আশ্রিত শূদ্রকে দেবেন।


মনুসংহিতায় বর্ণিত সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বর্ণবৈষম্যের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। অধমর্ণদের প্রতি উত্তমর্ণের খারাপ আচরণের দণ্ডের সাথে উত্তমর্ণের প্রতি অধমণের্র খারাপ আচরণের দণ্ডে যথেষ্ট ভেদ রয়েছে। কিন্তু নিম্নবর্ণ শূদ্র ও অন্ত্যজদের প্রতি দণ্ড প্রয়োগের বিধি একেবারেই অমানবিকতায় পর্যবসিত হতে দেখা যায়।


পঞ্চাশদ্ ব্রাহ্মণো দণ্ড্যঃ ত্রিয়স্যাভিশংসনে।

বৈশ্যে স্যাদর্দ্ধপঞ্চাশৎ শূদ্রে দ্বাদশকো দমঃ।। (৮/২৬৮)

বঙ্গানুবাদ: (উত্তমর্ণ) ব্রাহ্মণ যদি (অধমর্ণ অনুসারে) ক্ষত্রিয়ের প্রতি আক্রোশন বা গালিগালাজ করে তা হলে তার পঞ্চাশ দণ্ড হবে, বৈশ্যের প্রতি করলে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রের প্রতি করলে বারো পণ দণ্ড হবে।


শতং ব্রাহ্মণমাক্রুশ্য ক্ষত্রিয়ো দণ্ডমর্হতি।

বৈশ্যোহ প্যর্দ্ধশতং দ্বে বা শূদ্রস্তু বধমর্হতি।। (৮/২৬৭)

বঙ্গানুবাদ: ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে গালাগালি দেয় তা হলে তার এক শ পণ দণ্ড হবে। এই একই অপরাধে বৈশ্যের দণ্ড হবে দেড় শ কিংবা দুই শ পণ; আর শূদ্র শারীরিক দণ্ড প্রাপ্ত হবে (এই দণ্ড অপরাধের তীব্রতা অনুযায়ী বধ পর্যন্ত হতে পারে)।


এই শারীরিক দণ্ড কেমন হবে তাও বিশদ ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে-


যেন কেনচিদঙ্গেন হিংস্যাচ্চেৎ শ্রেষ্ঠমন্ত্যজঃ।

ছেত্তব্যং তত্তদেবাস্য তন্মনোরনুশাসনম্।। (৮/২৭৯)

বঙ্গানুবাদ: শূদ্র কিংবা অন্ত্যজ ব্যক্তি (শূদ্র থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত নিকৃষ্ট জাতি) দ্বিজাতিগণকে (ব্রাহ্মণ, ত্রিয়, বৈশ্য) যে অঙ্গের দ্বারা পীড়ন করবে তার সেই অঙ্গ ছেদন করে দেবে, এটি মনুর নির্দেশ।


মনুশাস্ত্র অনুযায়ী একজাতি শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এইসব দ্বিজাতিকে দারুণ কথা বলে গালি দেয় তা হলে তার জিহ্বাছেদন কর্তব্য (৮/২৭০), যদি নাম ও জাতি তুলে আক্রোশন করে তবে তার মুখের মধ্যে দশ-আঙুল পরিমাণ জ্বলন্ত লৌহময় কীলক প্রবেশ করিয়ে দেবে (৮/২৭১), যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণকে “তোমার এই ধর্ম অনুষ্ঠেয়, এখানে ধর্মানুষ্ঠানে তোমাকে এই সব কাজ করতে হবে” এইসব বলে ধর্মোপদেশ করে তা হলে রাজা তার মুখে ও কানে উত্তপ্ত তেল ঢেলে দেবেন (৮/২৭২), যদি হাত উঁচিয়ে কিংবা লাঠি উঁচিয়ে ক্রোধের সাথে উচ্চ জাতিকে প্রহার করে তবে তার হাত কেটে দেবে এবং পায়ের দ্বারা যদি ক্রোধের সাথে প্রহার করে তা হলে পা কেটে দেবে (৮/২৮০), ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু-গয়ের প্রভৃতি দিলে রাজা অপরাধীর ওষ্ঠদ্বয় কেটে দেবেন, মূত্রাদি ত্যাগ করলে পুরুষাঙ্গ এবং পায়ুবায়ু ত্যাগ করলে মলদ্বার কেটে দেবেন (৮/২৮২)। (অপমান করার অভিপ্রায়ে কোনও শূদ্র যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ) ব্রাহ্মণের চুল ধরে টানে, কিংবা পা, দাড়ি, গ্রীবা (গলা) কিংবা বৃষণ (অণ্ডকোষ) ধরে টানে তাহলে রাজা কোন রকম বিচার না করেই ঐ শূদ্রের দুটি হাতই কেটে দেবেন (৮/২৮৩)। শুধু তা-ই নয়-


ব্রাহ্মণান্ বাধমানন্তু কামাদবরবর্ণজম্।

হন্যাচ্চিত্রৈর্বধোপায়ৈরুদ্বেজনকরৈর্নৃপঃ।। (৯/২৪৮)

বঙ্গানুবাদ: যদি কোনও শূদ্র ইচ্ছাপূর্বক ব্রাহ্মণকে শারীরিক বা আর্থিক পীড়া দেয়, তাহলে অতি কষ্টপ্রদ নানা উদ্বেগজনক-উপায়ে (যেমন শূলে চড়িয়ে, মস্তক ছেদন করে দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে) সেই শূদ্রকে বধ করা উচিত।

তাছাড়া-


সহাসনমভিপ্রেপ্সু রুৎকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজঃ।

কট্যাং কৃতাঙ্কো নির্বাস্যঃ স্ফিচং বাহস্যাবকর্তয়েৎ।। (৮/২৮১)

বঙ্গানুবাদ: যদি কোন শূদ্রজাতীয় ব্যক্তি ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই আসনে বসে তা হলে তার কোমরে ছেঁকা লাগিয়ে দাগ দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে কিংবা তার পাছা খানিকটা কেটে দেবে।

শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-

শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।

দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।। (৮/৪১৩)

বঙ্গানুবাদ: ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।


ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।

নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।। (৮/৪১৪)

বঙ্গানুবাদ: প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ?


বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।

তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।। (৮/৪১৮)

বঙ্গানুবাদ: রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে।


অর্থাৎ শূদ্রকে তার নিজ কর্মের বাইরে বিকল্প জীবিকা গ্রহণের কোন সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ উচ্চবর্ণিয়দের জন্য প্রতিকুল সময়ে ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ এই মনুসংহিতায় বিশদভাবেই দেয়া হয়েছে।


০৬

ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হলো চতুবর্ণ প্রথা। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে কোন মানুষের উল্লেখ নাই বললেই চলে। অর্থাৎ মানুষ সম্পর্কিত ধারণা বা মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আরেকটি গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।


যেহেতু চারটি বর্ণ নিয়ে সমাজ, তাই এই অস্পৃশ্যরা বর্ণ-বিভাগেরও বাইরে। মনুসংহিতায় এদেরকে ‘সঙ্করজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে এরা কি এই বৈদিক সমাজ বা  সনাতন হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয় ? একটা অস্পষ্ট বিভ্রান্তি থেকে যায়-


ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।

চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।। (১০/৪)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি।


প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর। চারটি বর্ণের মধ্যে তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।


এবার বর্ণসঙ্কর বিষয়ে মনুর বৈদিক অভিজ্ঞানশ্রুতি থেকে কিঞ্চিৎ ধারণা নিতে পারি।


সর্ববর্ণেষু তুল্যাসু পত্নীষ্বক্ষতযোনিষু।

আনুলোম্যেন সম্ভূতা জাত্যা জ্ঞেয়াস্ত এব তে।। (১০/৫)

বঙ্গানুবাদ: সকল বর্ণের পক্ষেই স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি (অর্থাৎ প্রথমবিবাহিতা এবং যার সাথে আগে কোনও পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক হয় নি) সবর্ণ বা সমান জাতির নারীর গর্ভে সবর্ণ পতিকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান পিতামাতার জাতি থেকে অভিন্ন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণীতে ব্রাহ্মণকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান ‘ব্রাহ্মণ’হবে; ক্ষত্রিয়কর্তৃক এই রকম ক্ষত্রিয়া পত্নীর গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘ক্ষত্রিয়’ হবে; বৈশ্যকর্তৃক স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি বৈশ্যার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘বৈশ্য’ এবং শূদ্রকর্তৃক ঐ রকম শূদ্রার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘শূদ্র’ হবে। এসব ছাড়া অসবর্ণা স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন সন্তান জনকের সাথে সবর্ণ হয় না, নিশ্চয়ই জাত্যন্তর হবে।


স্ত্রীষ্বনন্তরজাতাসু দ্বিজৈরুৎপাদিতান্ সুতান্।

সদৃশানেব তানাহুর্মাতৃদোষবিগর্হিতান্।। (১০/৬)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ প্রভৃতি দ্বিজ বর্ণ-ত্রয়ের দ্বারা অনুলোমক্রমে অনন্তর অর্থাৎ অব্যবহিত পরবর্তী জাতীয়া নারীর গর্ভে জাত সন্তানেরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণকর্তৃক ক্ষত্রিয়াতে উৎপন্ন সন্তান এবং ক্ষত্রিয় কর্তৃক বৈশ্যানারীতে উৎপন্ন সন্তান এবং বৈশ্যকর্তৃক শূদ্রা নারীতে উৎপন্ন সন্তানগণ হীনজাতীয়া মাতার গর্ভে উৎপন্ন বলে পিতৃজাতি প্রাপ্ত হয় না, কিন্তু উৎপাদকের (পিতার) জাতির সদৃশ হয়। এই সন্তানেরাই মূর্ধাবসিক্ত, মাহিষ্য ও করণ নামে অভিহিত হয়। এরা মাতৃজাতির তুলনায় উৎকৃষ্ট কিন্তু পিতৃজাতির তুলনায় নিকৃষ্ট।


বিপ্রস্য ত্রিষু বর্ণেষু নৃপতের্বর্ণয়োর্দ্বয়োঃ।

বৈশ্যস্য বর্ণে চৈকস্মিন্ ষড়েতেহপসদাঃ স্মৃতাঃ।। (১০/১০)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের পক্ষে তিনটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ পরিণীতা ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) উৎপন্ন (মূর্দ্ধাবসিক্ত, অম্বষ্ঠ বা ভৃজ্যকণ্ঠ ও নিষাদ বা পারশব), ক্ষত্রিয় পুরুষের পক্ষে দুইটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (মাহিষ্য ও উগ্র), এবং বৈশ্য পুরুষের পক্ষে একটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (করণ)- এই ছয় জাতীয় অনুলোমজ সন্তান অপসদ নামে অভিহিত হয় (অপসদ মানে পুত্রের যে প্রয়োজন তা থেকে এরা অপসারিত; সমান জাতীয় পুত্রের তুলনায় এরা অপসদ অর্থাৎ অপকৃষ্ট); এই অনুলোম-সঙ্করজাতির কথা স্মৃতিমধ্যে বর্ণিত হয়েছে।


উল্লেখ্য, শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রের প্রয়োজন হয় পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি বা সদগতির লক্ষে (স্বর্গারোহণ) শ্রাদ্ধাদিতে পিণ্ডদান করার জন্য। পিণ্ডদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মূলত অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। বৈদিক শাস্ত্রে পুত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায় নিম্নোক্ত শ্লোকটি থেকে-



সংস্থিতস্যানপত্যস্য সগোত্রাৎ পুত্রমাহরেৎ।

তত্র যদ্ রিক্থজাতং স্যাত্তত্তস্মিন্ প্রতিপাদয়েৎ।। (৯/১৯০)

বঙ্গানুবাদ: কোনও ব্যক্তি যদি অপুত্র অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী গুরুজনদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সগোত্র পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করবে এবং মৃত ব্যক্তির যা কিছু ধনসম্পত্তি তা ঐ পুত্রকে অর্পণ করবে।


বৈদিক বিধান এমনই অলৌকিক শাস্ত্র যে সম্পদরক্ষায় পুত্রের প্রয়োজনে মনুসংহিতার ৫/১৫৭ সংখ্যক শ্লোকে (ইতঃপূর্বে উদ্ধৃত) বর্ণিত বিধবার কর্তব্যও সাময়িক রদ হয়ে যায়।


শাস্ত্র অনুযায়ী উপরোক্ত অনুলোমজ (উচ্চবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণ মাতার গর্ভজাত) সন্তানেরা সবর্ণ পুত্রের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও এরা বর্ণবহির্ভূত নয়। এরা মাতৃজাতির তুল্য অর্থাৎ মাতৃজাতির সংস্কারের যোগ্য হয়। কিন্তু প্রতিলোম-সঙ্করের (নিম্নবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্ণ মাতার গর্ভজাত সন্তানের) ক্ষেত্রেই যতসব শাস্ত্রীয় সমস্যা ও জটিলতার সূত্রপাত। এক্ষেত্রে সর্বজ্ঞ মনু একের পর এক প্রতিলোমজ সঙ্করের উৎপত্তি ও পর্যায়ক্রমিক যে বহুবিধ জাতি-তালিকা তৈরি করতে থাকেন, রীতিমতো বিভ্রান্ত হবার মতো। এবং একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে আমরা কতকগুলো স্পর্শাদি-অযোগ্য অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য জাতির সন্ধান পেতে থাকি। যেমন প্রাথমিকভাবে সূত, মাগধ, বৈদেহ, আয়োগব, ক্ষত্তা, চণ্ডাল নামের যে প্রতিলোমজ-সঙ্কর জাতি পাই, তাদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য। তবে আয়োগব ও ক্ষত্তা অস্পৃশ্য না হলেও এরা অপসদ  বা নরাধম, অর্থাৎ পুত্রকাজ করার অযোগ্য। কারণ এরা শূদ্র পিতার ঔরসে প্রতিলোমজ-সঙ্কর। এক্ষেত্রে মনুসংহিতায় সুকৌশলে তৈরি বিধিবদ্ধ সূত্রগুলো কিঞ্চিৎ অধ্যয়ন করে নেয়া যায়-


একান্তরে ত্বানুলোম্যাদম্বষ্ঠোগ্রৌ যথা স্মৃতৌ।

ক্ষত্ত্ববৈদেহকৌ তদ্বৎ প্রাতিলোম্যেহপি জন্মনি।। (১০/১৩)

বঙ্গানুবাদ: একান্তরে অর্থাৎ একটি মাত্র বর্ণের ব্যবধানে অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষের ঔরসে বৈশ্যজাতীয় নারীর গর্ভে জাত অম্বষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়পুরুষের ঔরসে শূদ্রানারীর গর্ভে জাত উগ্র- এইসব অনুলোমজ সন্তান যেমন স্পর্শাদিযোগ্য হয়, সেইরকম প্রতিলোমক্রমে একান্তরিত অর্থাৎ একজাতি-ব্যবধানে উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে জাত (যেমন, শূদ্রপুরুষ থেকে ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন ক্ষত্তা এবং বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন বৈদেহ) দুই জাতি স্পর্শাদিযোগ্য হবে। (তবে যজনাদিক্রিয়াতে এদের তুল্যতা নেই।)


এই সূত্রানুযায়ী প্রতিলোমজগণের মধ্যে দুই বর্ণ-ব্যবধানে (অর্থাৎ শূদ্র পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে) উৎপন্ন চণ্ডাল এই সূত্রে পড়ে না বলে শাস্ত্রানুযায়ী চণ্ডালই একমাত্র অস্পৃশ্য হয়ে যায়।


এখানে একটা সাধারণ সূত্র খেয়াল রাখতে হবে। চতুর্বর্ণ প্রথার মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এরা বর্ণক্রমে দ্বিজজাতি। অর্থাৎ তাদের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান থাকায় এরা উৎকৃষ্ট জাতি। তাই এই তিন বর্ণের নারীতে অনুলোমক্রমে উৎপাদিত সন্তানও দ্বিজ হয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া, ক্ষত্রিয়জাতীয়া ও বৈশ্যজাতীয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া ও বৈশ্যা স্ত্রীতে এবং বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক বৈশ্যনারীতে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হবে। আর বাহ্যক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রতিলোমক্রমে অনন্তরবর্তী উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে যেমন বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে যে সন্তান উৎপাদিত হয় সেও তাদের আত্মা অর্থাৎ দ্বিজ হয়। এককথায় দ্বিজদের মধ্যে আন্তসম্পর্কক্রমে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কররা দ্বিজজাতিই হবে।



কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও শূদ্র নারী বা পুরুষের আবির্ভাব ঘটলে। শাস্ত্রীয় বিধানে দাসজাতি শূদ্রবর্ণের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নাই বলে এরা একজাতি। তাই তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্ণসঙ্করাও দ্বিজ হয় না। এক্ষেত্রে অনুলোম প্রক্রিয়ায় শূদ্রা স্ত্রী উচ্চবর্ণভোগ্যা হওয়া তার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার বলে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হয় না বটে, তবে মাতৃজাতি শূদ্র থেকে কিঞ্চিৎ উৎকৃষ্ট হয়। কিন্তু শূদ্রবর্ণের পুরুষের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ প্রতিলোম প্রক্রিয়ায় উচ্চবর্ণের স্ত্রীভোগ গুরুতর সামাজিক অপরাধ বা দূষণ হিসেবেই চিহ্নিত। তাই এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর সন্তান তাদের পুত্র-অধিকার হারিয়ে নরাধম হয়ে যায়। আর এই অপরাধের মাত্রা বা দূষণপ্রক্রিয়া তীব্রতম হলে অর্থাৎ শূদ্রপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণা স্ত্রী দূষিত হলে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর অস্পৃশ্য চণ্ডাল হয়ে যায়।


অতএব, শূদ্র পুরুষ যেখানে বর্ণসঙ্করে জড়িত সেখানে কি সমস্যা না হয়ে পারে ?



আয়োগবশ্চ ক্ষত্তা চ চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্।

প্রাতিলোম্যেন জায়ন্তে শূদ্রাদপসদাস্ত্রয়ঃ।। (১০/১৬)

বঙ্গানুবাদ: শূদ্র পুরুষ থেকে প্রতিলোমক্রমে জাত অর্থাৎ শূদ্র পুরুষের ঔরসে বৈশ্যা স্ত্রীতে জাত আয়োগব, ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে জাত ক্ষত্তা এবং ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত চণ্ডাল- এই তিন জাতি পুত্রকাজ করার অযোগ্য। এই জন্য এরা অপসদ অর্থাৎ নরাধম বলে পরিগণিত হয়। এদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য।


চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।

অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।। (১০/৫১)

বঙ্গানুবাদ: চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র’ করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধনস্বরূপ। (অপপাত্র হলো যে পাত্রে ভোজন করলে তা আর সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করা চলবে না, তা পরিত্যাগই করতে হবে। অথবা তারা যে পাত্র স্পর্শ করে থাকবে তাতে অন্ন-শক্তু প্রভৃতি দেয়া চলবে না; কিন্তু পাত্রটি মাটির উপর রেখে দিলে কিংবা অন্য কোনও লোক তা হাতে করে ধরে থাকলে তার উপর ভাত-ছাতু প্রভৃতি দিয়ে মাটির উপর রেখে দিলে তারা ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে। অন্য অর্থে ভাঙা পাত্রকে অপপাত্র বলে।)


বাসাংসি মৃতচেলানি ভিন্নভাণ্ডেষু ভোজনম্।

কার্ষ্ণায়সমলঙ্কারঃ পরিব্রজ্যা চ নিত্যশঃ।। (১০/৫২)

বঙ্গানুবাদ: মৃত লোকের কাপড় এদের আচ্ছাদন (পোষাক) হবে; এরা ভাঙা পাত্রে ভোজন করবে; এদের অলঙ্কার হবে লৌহনির্মিত; এবং এরা সকল সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াবে। অর্থাৎ একই স্থানে বাস করবে না।


খুব সাধারণভাবে সঙ্কর জাতি থেকে সঙ্কর জাতিরই জন্ম হয়। আর শাস্ত্রানুযায়ী জন্মদোষ যেহেতু প্রজন্মক্রমেই স্থায়ী দোষ, যা থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই, তাই যেখানে নরাধম ও অস্পৃশ্যের ছোঁয়া পড়ে সেখানে পরবর্তী বংশ পরম্পরায় অস্পৃশ্য-সঙ্কর জাতিরই উৎপত্তি হতে থাকে। এভাবে ডাল-পালা বিস্তৃত করতে করতে সর্বজ্ঞ মনু তাঁর শঙ্করায়ন-শাস্ত্রকে এতোটাই জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে শেষপর্যন্ত শত শত অন্ত্যজ-অছ্যুৎ সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠির বিশাল এক জনগোষ্ঠিই সেখানে বাঁধা পড়ে যায়, যারা মূলত শ্রমজীবী। সমাজের গতিচক্রটিকে এরাই ধারণ করে অথচ এরাই হয়ে যায় বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্টি- অছ্যুৎ, অস্পৃশ্য, দলিত বা নির্যাতিতও। মনুসংহিতায় এই ব্রাত্যজনগোষ্ঠির উৎপত্তি নির্ধারণক্রমে সৃষ্ট  যে জালিকাবিন্যাস, এর সুদীর্ঘ তালিকা দেখলে রীতিমতো আঁৎকে ওঠতে হয় ! প্রাসঙ্গিক হিসেবে দুয়েকটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য, যেমন-


যথৈব শূদ্রো ব্রাহ্মণ্যাং বাহ্যং জন্তুং প্রসূয়তে।

তথা বাহ্যতরং বাহ্যশ্চাতু র্বর্ণ্যে প্রসূয়তে।। (১০/৩০)

বঙ্গানুবাদ: শূদ্র যেমন ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্ট চণ্ডাল নামক সন্তানের জন্ম দেয়, সেইরকম সূত (ক্ষত্রিয় পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত সন্তান সূত) প্রভতি অন্যান্য বাহ্যজাতি (বৈদেহক, চণ্ডাল, মাগধ, ক্ষত্তা এবং আয়োগব) অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় পুরুষ চারবর্ণের নারীতে আরও বেশি বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় সন্তান উৎপাদন করে।


নিষাদো মার্গবৎ সূতে দাশং নৌকর্মজীবিনম্।

কৈবর্তমিতি যং প্রাহুরার্য্যাবর্তনিবাসিনঃ।। (১০/৩৪)

বঙ্গানুবাদ: আয়োগবজাতীয় (শূদ্র পুরুষ থেকে বৈশ্যনারীর গর্ভজাত সন্তান হলো আয়োগব) নারীতে নিষাদজাতীয় পুরুষ (ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রা নারীতে জাত সন্তানকে নিষাদ বলে) ‘মার্গব’ নামক সঙ্কর সৃষ্টি করে থাকে। তাদের দাস বলা হয়; আর্যাবর্তনিবাসিগণ তাদের কৈবর্ত নামে অভিহিত করেন। তারা নৌকর্মের দ্বারা জীবিকার্জন করে। (নৌকর্ম হলো নৌকা চালান, তার দ্বারা জীবন ধারণ করা।)


কারাবরো নিষাদাত্তু চর্মকারঃ প্রসূয়তে।

বৈদেহিকাদন্ধ্রমেদৌ বহির্গ্রামপ্রতিশ্রয়ৌ।। (১০/৩৬)

বঙ্গানুবাদ: নিষাদ পুরুষ থেকে ‘বৈদেহী’ নারীতে (বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন সন্তানকে বৈদেহ বলে) ‘কারাবর’ জাতি জন্মে; এরা চামড়ার কাজ করে। কারাবর এবং নিষাদজাতীয়া নারীতে ‘বৈদেহিক’ পুরুষ থেকে ‘অন্ধ্র’ এবং ‘মেদ’ এই দুই বর্ণসঙ্কর সৃষ্ট হয়; গ্রামের বাইরে এদের বাসস্থান।


চাণ্ডালৎ পাণ্ডুসোপাকন্ত্বক্সারব্যবহারবান্।

আহিণ্ডিকো নিষাদেন বৈদেহ্যামেব জায়তে।। (১০/৩৭)

বঙ্গানুবাদ: চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে বৈদেহজাতীয় নারীতে ‘পাণ্ডুসোপাক’ নামক বণসঙ্করের উৎপত্তি; এরা বাঁশ থেকে ঝোড়া-চুব্ড়ী প্রভৃতি তৈয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নিষাদ পুরুষের ঔরসে ঐ ‘বৈদেহী’ নারীতেই ‘আহিণ্ডিক’ জাতির উৎপত্তি। (তাদেরও ঐ একই বৃত্তি।)


নিষাদস্ত্রী তু চাণ্ডালাৎ পুত্রমন্ত্যাবসায়িনম্।

শ্মশানগোচরং সূতে বাহ্যানামপি গর্হিতম্।। (১০/৩৯)

বঙ্গানুবাদ: নিষাদজাতীয়া নারী চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে ‘অন্ত্যাবসায়ী’ নামক সন্তান প্রসব করে; সে শ্মশানের কাজে নিযুক্ত হয়; সে নিকৃষ্টজাতিরও নিন্দিত।


অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠির উৎপাদনরহস্য নিয়ে এরকম ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত-শ্লোক মনুসংহিতায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। এই সঙ্করায়ন-প্রক্রিয়ায় অনন্তপ্রকার বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হতে পারে বলে খোদ শাস্ত্রকারই এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তাই বাস্তবে এই অছ্যুৎ বর্ণসঙ্কর চেনার উপায় বা প্রক্রিয়া কী হবে, এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে। হয়তো এসেছেও। নইলে পবিত্র মনুসংহিতায় এরকম শ্লোক আসতো কি?


সঙ্করে জাতয়স্ত্বেতাঃ পিতৃমাতৃপ্রদর্শিতাঃ।

প্রচ্ছন্না বা প্রকাশা বা বেদিতব্যাঃ স্বকর্মভিঃ।। (১০/৪০)

বঙ্গানুবাদ: পিতা-মাতার নাম নির্দেশপূর্বক এইসব হীন সঙ্করজাতির কথা বলা হলো; এছাড়া যাদের পিতা-মাতার নাম জানা যায় না, এমন যারা গুপ্তভাবে বা প্রকাশ্যভাবে বর্ণসঙ্কররূপে উৎপাদিত হয়, তাদের  জাতিপরিচয় তাদের ক্রিয়াকলাপ থেকে জানতে হবে।


কারণ-

পিত্র্যং বা ভজতে শীলং মাতুর্ব্বোভয়মেব বা।

ন কথঞ্চন দুর্যোনিঃ প্রকৃতিং স্বাং নিযচ্ছতি।। (১০/৫৯)

বঙ্গানুবাদ: জন্মগত দোষযুক্ত ব্যক্তি পিতার দুষ্ট স্বভাব অথবা মাতার নিন্দিত স্বভাব অথবা উভয়েরই স্বভাবের অনুবর্তী হয়। যে লোক দুর্যোনি অর্থাৎ বর্ণসঙ্করজাত নিন্দিত ব্যক্তি, সে কখনো নিজ জন্মের কারণ অর্থাৎ পিতামাতার স্বভাবকে গোপন করতে পারে না।


স্বার্থগৃধ্নুতায় ক্ষমতাদর্পী বৈদিক ব্রাহ্মণ তথা স্বঘোষিত উচ্চবর্ণধারী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিটা কী জঘণ্য বর্ণবিদ্বেষী হতে পারে মনুসংহিতায় উদ্ধৃত উপরোক্ত অবশ্য-পালনীয় শ্লোকগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এরকম শত-সহস্র বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক গোটা মনুসংহিতা জুড়ে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হলো, বৈদিক বা আর্য-সভ্যতার বাইরে আর কোন দেশে বা সভ্যতায় বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অস্তিত্ব মনুসংহিতায় স্বীকার করা হয়নি। হয়তো এটাই মনুকৃত একমাত্র সত্যবাদিতা বা বাস্তবতা স্বীকার। তবে  আর্য-সভ্যতার বাইরেও পৃথিবীতে যে আরো বহু দেশ রয়েছে বা থাকতে পারে তা হয়তো অস্বীকার করার উপায় ছিলো না। ফলে সেসব দেশেও শাসক সম্প্রদায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং তাদের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে এরা এতোই একদেশদর্শী ছিলো যে, মনুসংহিতা অনুযায়ী শাসকশ্রেণী ক্ষত্রিয় হলেও সেসব দেশের শাসককে উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয় বলে গ্রহণ করা সংগত বিবেচিত হয়নি। কারণ উপনয়নাদি-সংস্কার পালন না করা এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ওরা শূদ্র হয়ে গেছে। মনুশাস্ত্র অনুযায়ী-



পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদ্রবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ।

পারদা পহ্নবাশ্চীনাঃ কিরাতা দরদাঃ খশাঃ।। (১০/৪৪)

বঙ্গানুবাদ: পৌণ্ড্রক, উড্র, দ্রাবিড়, কাম্বোজ, যবন, শাক, পারদ, পহব, চীন, কিরাত, দরদ ও খশ- এই সব দেশোদ্ভব ক্ষত্রিয়গণ তাদের কর্মদোষে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।


কী তাদের কর্মদোষ ?

শনকৈস্তু ক্রিয়ালোপাদিমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ।

বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ।। (১০/৪৩)

বঙ্গানুবাদ: ওই সমস্ত ক্ষত্রিয়জাতিগণ পুরুষানুক্রমে উপনয়নাদি, নিত্যাগ্নিহোত্র ও সন্ধ্যাবন্দনা প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান না করায় এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করায় ক্রমে ক্রমে বৃষলত্ব অর্থাৎ শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।


০৭

ধর্মীয় মোড়কে সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদই পৃথিবীর প্রাচীনতম বর্ণবাদী দর্শন। এবং বেদ-নির্যাস হিসেবে স্বীকৃত মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা যদি এ দর্শনের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক ভিত্তিমূল হয় তাহলেই বলতেই হয়, এটা কেন সম্পূর্ণ মানবতা-বিরোধী একটা অসভ্য দর্শন হবে না ? একটা সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠিকে জঘণ্যতম বর্ণাশ্রমে বিভাজিত করা এবং একজন কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা’র নাম দিয়ে সমাজের উৎপাদনসংশ্লিষ্ট বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে ক্ষমতায় আসীন শাসক গোষ্ঠির প্রতিভূ বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ নামের এক স্বার্থান্বেষী পরভোজী শ্রেণীর সেবাদাস বানিয়ে ফেলা যে একটা চতুর রাজনীতি, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ রাজনীতির পেছনে যে গভীর ও সূক্ষ্ম কূটাভাষ লুকিয়ে আছে তা হলো নিকৃষ্টবর্ণ শূদ্রসংশ্লিষ্টতায় কতকগুলো বর্ণবহির্ভূত অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করে গোটা জনগোষ্ঠিকে প্রথমে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলা হলো- উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণী। ক্ষমতালিপ্সু শাসক বা ক্ষমতাসীনরা উৎকৃষ্ট বা উচ্চশ্রেণীভুক্ত আর্য, আর শ্রমজীবী শাসিতরা হলো নিকৃষ্ট বা নিম্নশ্রেণীর অনার্য শূদ্র। এই শ্রেণীবিভেদ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি এরা। যেহেতু শাসিতরাই সংখ্যাধিক্যে বিপুল, তাই সুকৌশলে এদের মধ্যে আবার তৈরি করা হলো বিষাক্ত বিভেদের এক ভয়ানক বিচ্ছিন্নতা। আজব এক সত্ত্বার জন্ম দেয়া হলো- যার নাম অস্পৃশ্য (Untouchable)। মারাঠি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘দলিত’, অর্থাৎ নির্যাতিত।


ধর্মের অলৌকিক মোড়কে ঘটানো এই রাজনৈতিক কূটচালে খুব স্বাভাবিকভাবে ধরাশায়ী হলো বিশাল এক জনগোষ্ঠি। লেখাপড়া বা শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে তাদেরকে চিরকালের অন্ধ বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রও খুব ভালোভাবেই নিষ্পন্ন হলো। একটা প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতার সামাজিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দুমড়েমুচড়ে তার জায়গায় ধীরে ধীরে কার্যকর করা হলো একটা তীব্র বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থা ব্র্রাহ্মণ্যবাদ। যার নাম বৈদিক বা আর্য সভ্যতা। এভাবেই প্রাচীন ভারতবর্ষে বহিরাগত লুণ্ঠনকারী আর্যদের চাপিয়ে দেয়া ট্র্যাজিক অবদান হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ। এরপর শত সহস্র বছর ধরে প্রতিপালিত এই বিষাক্ত বর্ণদর্শন মিশে গেলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর অবশ্যপালনীয় উপাচার ও সংস্কৃতির রক্তে। তা থেকে আর মুক্ত হতে পারেনি এই সমাজ। মুক্ত হওয়া এখনো যে সম্ভব হয়নি তার প্রমাণ বর্তমান বাংলা ও ভারতীয় হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলো। বিবাহে, প্রয়ানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে তথা সর্বক্ষেত্রে এই বর্ণাশ্রমের বিষাক্ত থাবা আজো আদিরূপেই বর্তমান। যদিও তা দৃশ্যমান স্বরূপে ততোটা আক্রমণাত্মক নয়, কিন্তু অন্তর্গত অবস্থানে কোনভাবেই কম ক্রিয়াশীল নয়।


ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তিমূল এই মনুসংহিতা অধ্যয়নে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলেই এর তীব্র ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায় খুব সহজেই। এমন মানববিদ্বেষী বিষাক্ত বিধান কোন স্রষ্টা নামীয় অলৌকিক মুখ থেকে নিঃসৃত হতে পারে কিনা তা সন্দেহ করা অযৌক্তিক হবে কি ? হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সমকালীন সামাজিক বাস্তবতা ও বিদ্বেষমূলক জীবনাচারের প্রয়োজনেই এর শ্লোকগুলো বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে হয়। ভূমি নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষিতে কিভাবে জমি ও বাসস্থানের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে, সীমানায় কী গাছ বা উদ্ভিদ রোপন করলে স্থানচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকবে না। কিংবা যে লোক আবদ্ধ জলস্রোতের বাঁধ ভেঙে দেয় তার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা মাথায় বস্ত্রাদি বেষ্টন করে বা চর্মপাদুকা পরে ভোজন করা হলে পরিণতি কী হবে; নতুবা কোন্ বস্তু উষ্ণ অবস্থায়, কোন্ বস্তু ঠাণ্ডা অবস্থায়, কোন্ দ্রব্য তিনদিন পরেও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, রসুন কারা খেতে পারবে, কখন লবণ বিক্রি করা যাবে না বা রাজা দেবতার প্রতিনিধি ইত্যাদি বিধান রচনায় কোন অলৌকিক উৎস থাকার দাবী একান্তই হাস্যকর মনে হয়। প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খুটিনাটি উপাচার ও কর্তব্য পালনের যে পৌনপুনিক অগুনতি বিধি রচিত হয়েছে তাতে এটা মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে মনুসংহিতার এক বা একাধিক শাস্ত্ররচয়িতারা আসলে চলমান পরিবেশ-প্রতিবেশেই লালিত-পালিত স্বেচ্ছা-অন্তরালবর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি।

তবু এটাই অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় সামাজিক আর্যবিধান হিসেবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। গৌতম বুদ্ধ এই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী হলেও এর পর সুদীর্ঘকাল এই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপক্ষে আর টু-শব্দটি করার মতো কেউ দাঁড়াতে যে পারে নি, তার কারণও যুগে যুগে এই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিভূ বর্ণবাদী নেতৃত্বের নির্লজ্জ আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুকঠিন সামাজিক দ্বৈত-কাঠামো। এ বড় শক্ত দূর্গ।এ সবকিছু বিবেচনায় নিলে এটা ভাবা কি খুব অযৌক্তিক হবে যে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বর্ণবাদী শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোন নির্যাতিত শূদ্র বা অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠি কখনোই তার সমকালীন সমাজকে দুষিত করেনি, বরং এক কাল্পনিক স্রষ্টা ব্রহ্মার নামে কোন চতুর স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠি কর্তৃক সৃষ্ট মানবতাবিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদই আমাদের এই প্রাচীন মানব সমাজকে ভয়ঙ্করভাবে দুষিত করে দিয়েছে ? যার বিষাক্ত নীল ছোবল পবিত্র মানবাত্মাকেই কলঙ্কিত করেছে।


অতঃপর আরেক বিদ্রোহীর উত্থান

শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধের প্রয়ানের দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পর তাঁর আর এক সার্থক বিপ্লবী অনুগামীর আবির্ভাব হলো এই ভারতবর্ষেই। যিনি মনু’র মানবতাবিরোধী শাস্ত্রধারী হিন্দুদের প্রচলিত জাত-পাতের ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন-

‘মনুসংহিতাকে হিন্দু ধর্মের আচরণবিধির পবিত্র গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়। মনুস্মৃতিকে ব্রাহ্মণ জগদীশ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, শূদ্রের সম্পদ অর্জনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়েছে। যে কোন বর্ণের নারী ব্রাহ্মণদের উপভোগের বস্তু। গ্রন্থটি ব্রাহ্মণ্যবাদের কালাকানুন এবং সভ্যসমাজের কলঙ্ক। কাজেই গ্রন্থটিকে অবিলম্বে ভষ্মীভূত করা প্রয়োজন।’


বর্ণবাদের অসভ্য উৎস হিন্দু সমাজের সংবিধান বলে খ্যাত মনুসংহিতা যে আদৌ কোন ধর্মগ্রন্থ হতে পারে না, কিছু কুচক্রী স্বার্থান্বেষী লোভী ভণ্ড প্রতারক মানুষের শোষণের হাতিয়ার কেবল, আম্বেদকরই প্রথম উচ্চারণ করলেন তা। এবং খুব স্পষ্টভাবে ইতিহাস ঘেটে ঘেটে যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে। এমন তীব্র ও স্পষ্ট বক্তব্য এর আগের সুদীর্ঘ অতীতে আর কারো মুখ থেকে উচ্চারিত হতে শুনা যায় নি। কিন্তু চলমান বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই তাঁর। তাই তিনি এও বলেন-



আমার কাছে আমার জীবন অপেক্ষা আমার দেশের স্বার্থ অনেক বড়। আমার অসহায় এবং নির্যাতিত দলিত সমাজের স্বার্থ তার চেয়ে বড়।

শিক্ষা সংহতি ও সংগ্রামী ঐক্যই শূদ্র, দলিত-শোষিত সমাজের মুক্তি আনতে পারে। তোমরা সংঘবদ্ধ হও অধিকার আদায় করে লও।


তিনি উপমহাদেশের কোটি কোটি লাঞ্ছিত, দলিত ও মানবিক অধিকারহীন জনগণের মুক্তিদাতা, সারা বিশ্বে মানবাধিকার যোদ্ধা নামে খ্যাত এক দলিত পুরুষ বাবা সাহেব ড. ভীম রাও রামজি আম্বেদকর (Baba Saheb D. Bhima Rao Ramji Ambedkar)। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য-


‘দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এ অঞ্চল থেকে বর্ণ-বৈষম্য শোষণ নির্মূল করা দরকার। …দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ বিকাশের শত্রু হল ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ।’


তাঁর এ কথা বলার নেপথ্যশক্তি তিনি প্রজাতন্ত্রী ভারতের সংবিধান প্রণেতা কিংবা ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও মনীষী বলে নয়। তিনিই ভারতের প্রথম দলিত (Dalit) গ্রাজুয়েট। যিনি তাঁর গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন দলিত জনগোষ্ঠির মুক্তির লক্ষে বর্ণবাদী অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি এই যুদ্ধ থেকে এক পা’ও পিছু হঠেননি। আদর্শের প্রশ্নে ছেড়ে কথা বলেননি ভারতের বর্ণবাদী হিন্দুদের কট্টর প্রতিনিধি মহাত্মা গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজিকেও। আম্বেদকর মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’ (harijan) শব্দটিকে বাতিল করে দেন এই যুক্তিতে যে, গান্ধীর (Gandhi) এই পদক্ষেপ নিতান্তই হঠকারী সমাজ-সংস্কারমূলক ফাঁকা বুলি মাত্র৷ গান্ধীর উদ্দেশ্য দলিতদের মুক্তি নয়, বরং সংগঠিত দলিতদের জোটবদ্ধ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কূট-রাজনীতি। উপমহাদেশের নিপীড়িত দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তি বিরোধী গান্ধীর এসব রাজনৈতিক কৌশলের সাথে কখনোই আপোষ করেননি আম্বেদকর। গোটা ভারত জুড়ে সর্বতোমুখি এক দলিত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান তিনি। তাঁর হাত দিয়েই দলিত সাহিত্য নামে এক মাটিবর্তি সাহিত্যের জন্ম হয়, যার মাধ্যমে তিনি হিন্দু বর্ণবাদের মুখোশ উন্মোচন করে দলিত আন্দোলনে তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শক্তি যুক্ত করে সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা হাজার বছরের নিগড় ভেঙে বর্ণ হিন্দুদের সংরক্ষিত চাভাকর লেক বা চৌদার পুকুর থেকে জলপান করেন, অসংখ্য দলিত অনুসারী নিয়ে তিনি ভারতীয় বর্ণবাদের আকরগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা‘ পুড়িয়ে এর মানবতাবিরোধী অবস্থানের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতীকী ও প্রত্যক্ষ অনাস্থা প্রকাশ করেন। দলিতদের শিক্ষার প্রতি ব্যাপক দৃষ্টি দিয়ে, যা এর আগে কল্পনাও করা যায় নি, তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯২৮ সালে গঠিত ‘ডিপ্রেসড কাশেস এডুকেশন সোসাইটি’র মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে বোম্বেতে সিদ্ধার্থ কলেজ ও ১৯৫১ সালে আওরঙ্গবাদে মিলিন্দ কলেজের প্রতিষ্ঠা তাঁর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফসল৷ তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে আম্বেদকরের এই বিপুল অবদান, যা সংক্ষেপে বলে শেষ হওয়ার নয়। আম্বেদকর আর দলিত আন্দোলন একই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত।


তাঁর উত্থানও এই হাজার বছরের অত্যাচারিত অছ্যুৎ দলিত সম্প্রদায় থেকেই। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর রক্তে মাংসে মনে মননে দলিত হবার কষ্টই বেজে গেছে আজীবন। কিন্তু হাজার হাজার বছরের গভীর শিকড়ে প্রোথিত পাহাড়ের মতো জেকে বসা এমন একটা অসম অটল ব্যবস্থার বিপরীতে তাঁর ছোট্ট জীবনের সর্বসত্ত্ব কতোটুকু আর ! গোটা দেশ জুড়ে তীব্র এক ঝড় উঠালেও টলাতে পারেননি তিনি এই অসম ব্যবস্থাকে। শেষপর্যন্ত বুদ্ধের মতোই বর্ণান্ধ হিন্দু সমাজ ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আরেকটি সামাজিক বিদ্রোহের সূচনার দিকেই এগিয়ে গেলেন, লক্ষ লক্ষ দলিত অনুসারী নিয়ে।


দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন-

“…নির্যাতিত শ্রেণীর মানুষদের হিন্দু হয়েও যদি সম অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, বিগত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন বা সংগ্রাম করেও তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র ন্যায়বোধের পরিচয় পাওয়া না যায় তাহলে নির্যাতিত সমাজকে ভাল করে ভেবে দেখতে হবে। তাই দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে আত্মসম্মান ও মানবিক অধিকার লাভ করতে হলে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। … আমার চরম দুর্ভাগ্য যে, অস্পৃশ্য সমাজে জন্মেছি বলে আমাকে আত্মসম্মানহীন অপমানজনক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।”


এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন-


“আমি অস্পৃশ্য হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও অস্পৃশ্য হয়ে মরবো না।”


অতঃপর দার্শনিক স্থিরতা দিয়ে মানুষের সাম্যের জায়গাটাকে খুঁজে গেছেন আজীবন।


মহারাষ্ট্রের অত্যন্ত গরীব ও একেবারে নিচু তলার এক দলিত মাহার (Mahar) বা চর্মকার পরিবারে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্ম আম্বেদকরের। মহারাষ্ট্রে অনেকগুলো দলিত সম্প্রদায়ের বাস হলেও এদের মধ্যে মাহাররাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু মাহারদের আলাদা কোন গ্রাম বা পল্লী ছিলো না। প্রতিটা হিন্দু গ্রামের উপান্তে বা প্রান্তসীমায় দু-চার ঘর মাহার থাকতো। গ্রামের প্রধান এলাকার বাইরে ঘর বেঁধে থাকতে হতো। তাদের কাজ ছিলো গ্রাম পাহারা দেয়া, গ্রামের মরা পশু অপসারণ করা, গ্রাম-প্রধান বা মোড়লদের হুকুম অনুযায়ী সমাজের সামষ্টিক কাজে বেগার খাটা, ময়লা পরিষ্কার করা ইত্যাদি।


মাহারদের অসংখ্য কর্তব্য থাকলেও কোন জীবিকার ব্যবস্থা ছিলো না। বর্ণ হিন্দুদের বাড়ির এঁটো কুড়িয়ে, কাটা ক্ষেতের পরিত্যক্ত ফসল কুড়িয়ে, মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করে, আর মরা পশুর মাংস খেয়ে জীবন কাটাতে হতো তাদের৷ এদের অস্পৃশ্যতা এতোটাই তীব্র ছিলো যে, তাদের ছোঁয়া লাগলে, এমনকি ছায়া মাড়ালেও উচ্চ শ্রেণীর স্পর্শদোষ ঘটত৷ বর্ণভিত্তিক সমাজে এরা শূদ্রেরও অধম। এক সময়ে তাদের গলায় মাটির পাত্র বাঁধতে বাধ্য করা হতো, যাতে তাদের থুতু মাটিতে পড়ে দূষণ সৃষ্টি না করে৷ আরেকটি বাধ্যবাধকতা ছিল, পেছন দিকে ঝাড়ু বেঁধে রাখা যাতে অন্যদের চোখে পড়ার আগে তাদের পায়ের ছাপ মুছে যায়৷ এরকম একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে ভবিষ্যৎ যে কোথায় নির্ধারিত হয়ে যায় তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু যে অছ্যুৎ জাতির জন্য একজন আম্বেদকরকে পেতে হবে তাদের প্রথম স্বপ্ন তৈরি হতে, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে, আত্মমুক্তি ঘটাতে, তাদের বৌদ্ধিক উত্তরণ ঘটাতে, তাদের জন্য একজন আম্বেদকরের জন্ম হয়ে যায় ঠিকই।


স্কুলজীবনের শুরুতেই হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার অভিশাপের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তাঁর শিশুমন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকে। ছাত্রজীবনের অপমানজনক দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার তাঁর সংবেদনশীল কোমল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করে। যা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর মনে প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করে। অস্পৃশ্যের সন্তান বলে স্কুলে বেঞ্চটুলের পরিবর্তে ক্লাশের একেবারে পেছনে ছালার চটে তাঁকে বসতে দেয়া হতো। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁর বইখাতা স্পর্শ করতেন না, থুথুর ছোঁয়ায় বাতাস দুষিত হবে বলে তাঁকে ক্লাশে কোন পড়া জিজ্ঞাসা করা হতো না, এমনকি খড়িমাটি অপবিত্র হয়ে যাবে এই শংকায় তাকে বোর্ডে পর্যন্ত লিখতে দেয়া হতো না। স্কুলে স্বহস্তে জল পান করতে পারতেন না। তাঁর মুখের উপর পাত্র উঁচু করে জল ঢেলে দেয়া হতো। উঁচু বর্ণের সহপাঠিদের টিফিন বক্সগুলোয় যাতে তাঁর কোনরূপ ছোঁয়া না লাগে সেজন্য সাবধানে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। এরকম বহু নির্মম ঘটনা তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছিলো অবশ্যই। কিন্তু এসবই একজন মুক্তিকামী আম্বেদকরের উন্মেষ ঘটায়। অস্পৃশ্যদের মুক্তির দিশারী দলিত আন্দোলনের বীজ হয়ে মানবতার খোঁজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে দেয় আম্বেদকরকে। পরবর্তীকালের প্রতিটা আন্দোলনের উৎস ও ফলাফল বিশ্লেষণ করলে একটাই প্রতিপাদ্য পেয়ে যাই আমরা, মানবতার সন্ধান। মানুষ হয়ে যে সমাজের মানুষদের মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই তাদের প্রতি ঘৃণায় ক্ষোভে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি খুঁজতে থাকেন মানবতার  সাম্যের অমিয়বাণীর উৎসটাকে।


‘তিনটি শব্দের মধ্যে আমার জীবন দর্শন খুঁজে পাই। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যদিও আমরা ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতিকে গ্রহণ করেছি বস্তুত আমাদের সমাজ জীবনে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমি বুদ্ধের বাণী থেকে গ্রহণ করেছি। হিন্দু ধর্মে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কোন স্থান নেই, তাই বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করলে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ পরস্পরের পরিপূরক হবে।’


‘কেন আমি বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি’ শীর্ষক প্রচারিত এক বক্তৃতায় বলেন-


‘আমি তিনটি নীতির জন্য বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি। প্রথমটি হলো প্রজ্ঞা (অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত জ্ঞান), দ্বিতীয়টি হলো করুণা (প্রেম অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা) এবং তৃতীয়টি হলো সাম্য (সমতা অর্থাৎ সমস্ত মানুষকে সমান মনে করা)।’


শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামী নিয়ে এই বৌদ্ধধর্মেই দীক্ষা নিয়ে অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক মুছে এক নবজন্ম নিয়েছিলেন, এবং দিয়েছিলেন অন্যদেরকেও। অস্পৃশ্য হয়ে জন্মালেও অস্পৃশ্য হয়ে মরেননি তিনি। বুদ্ধের পবিত্র আলো বুকে ধরে এক মহান পাহাড়ের সৌম্য স্থিরতা নিয়ে মহানির্বাণে প্রস্থান করলেন।


আজ আম্বেদকর নেই। রয়ে গেছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। অথচ বর্ণান্ধতার গোঁড়ামি থেকে হিন্দু সমাজ মুক্ত হতে পারলো না আজো। এ আমাদেরই নিরন্তর মূর্খতা, অনপনেয় কলঙ্ক। একজন আম্বেদকর কষ্টে, যাপনে, বিদ্রোহে, সাম্যে সারাটা জীবন পথ দেখিয়ে গেছেন ঠিকই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তারপরও যদি মহামূর্খ আমরা চোখ বন্ধ করেই থাকি, অধোগামিতার প্রলয় কি বন্ধ হবে আদৌ ?

মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণ, নারী ও শূদ্রের স্থান -সুধীররঞ্জন হালদার
Nov. 19, 2024 | হিন্দুধর্ম | views:8552 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভারতের সংবিধানে দেশের সমস্ত মানুষকে সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে একই অধিকার ভোগ করার সুবিধা প্রতিটি নাগরিকের। দেশের আইনও সেভাবেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই অধিকার ভোগ করা সংবিধান কার্যকর হবার পঁয়ষট্টি বছর পরেও অধিকাংশ লোকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এর কারণ হিন্দুদের সামাজিক এবং ধর্মীয় আইনকানুন। আমাদের সংবিধানে যাই থাকুক না কেন, হিন্দুরা অর্থাৎ বৈদিক ধর্মাবলম্বীরা সে সব বিধানের তোয়াক্কা না করে তাদের ধর্মীয় আইনকানুনকেই সামাজিক জীবনধারণে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এই ধর্মীয় আইনকানুন যেসব গ্রন্থে লেখা রয়েছে তার মধ্যে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতাই হল প্রধান গ্রন্থ। এক কথায় সমগ্র ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে নিয়মকানুন পালনের ক্ষেত্রে মনুসংহিতাকেই সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ভারতবর্ষে সর্বত্র বৈদিকধর্মীয়রা এই গ্রন্থের বিধান অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেই তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে থাকে।


এই মনুসংহিতা একখানি চরম বিভেদমূলক গ্রন্থ। মানুষকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- জন্মসূত্রে এই চারটি বর্ণে ভাগ করা, সংখ্যাগুরু শূদ্রসমপ্রদায়কে ভাগ করে হাজার হাজার জাতের সৃষ্টি করা এবং তাদের মধ্যে আবার কাউকে কাউকে অস্পৃশ্য হিসাবে নির্দেশ করাই এই বিভেদের মূল উৎস। মানুষে মানুষে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ সৃষ্টি করতে এই গ্রন্থ যে কেবল উৎসাহই দেয় তাই নয়, বরং এই বিভেদকে কঠোরভাবে পালন করার নির্দেশও দেয়। ফলে মানুষে মানুষে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে মানুষের অন্তরে ঘৃণা ও হিংসার বীজ ছড়িয়ে দেয়। ঠিক এই কারণেই ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মাহাদে বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে মনুস্মৃতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।  এই বহ্নুৎসবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয়, “মনুস্মৃতি শ্রদ্ধার উপযোগী নয় এবং একে পবিত্র গ্রন্থ বলা যায় না। এর প্রতি ঘৃণা দেখানোর জন্য এই সম্মেলন সভাশেষে এর এক প্রতিলিপি দাহ করতে মনস্হ করেছেন। কেননা এ ধর্মের বেশে সামাজিক অবিচার জিইয়ে রাখার প্রণালী বলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চায়। ”


কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজসংস্কারক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এ জন্য কোনো বিবেক জাগ্রত হয়নি। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী এই গ্রন্থকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত হলেও উচ্চবর্ণীয় শাসকগোষ্ঠী কিংবা বুদ্ধিজীবী বা সমাজসংস্কারকদের কেউই সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না, বরং সযত্নে ওই গ্রন্থটিকে লালন করে থাকেন।  ফলে গ্রন্থখানি বহুল প্রচারিত ও ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুদিত এই গ্রন্থের বর্তমান যুগেও প্রবল চাহিদা।  বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের কাছে প্রাণভোমরাস্বরূপ এই গ্রন্থ। যাঁরা এই গ্রন্থের অনুবাদ কিংবা সম্পাদনা করেন, তাঁরা বিভেদমূলক হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ ধর্মীয় আইন তথা নীতিগুলিকে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যার প্রলেপে বাস্তবসম্মত করে তোলার হীন প্রচেষ্টা করে থাকেন। বলাবাহুল্য এই গ্রন্থের প্রকাশ ও প্রচারকর্তারা সকলেই ব্রাহ্মণ। এই গ্রন্থের সমর্থনেই তাঁরা আজও সমাজের উচ্চশিখরে বাস করে দ্বিধাহীন চিত্তে মনুবাদী ভাবধারায় কালাতিপাত করে থাকেন।


মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ স্রষ্টা মনু কতৃক কথিত (রচিত) বলে ওই গ্রন্থে দাবি করা হয়। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে মনুর নাম বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে রচয়িতা হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্যই ওই নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য এটা একটা বিরাট ধাপ্পা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওই গ্রন্থের রচয়িতা হিসাবে স্বাক্ষর রয়েছে ভৃগুর পারিবারিক নামে। ওই গ্রন্থের প্রকৃত নাম ছিল ‘মনুর ধর্মশাস্ত্র‘। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে লেখা ‘ভৃগু কর্তৃক রচিত‘। কোথাও তাঁর আসল নাম লেখা নেই। তবে নারদস্মৃতির গ্রন্থকার তার নাম জানিয়ে দিয়েছে। তার প্রকৃত নাম ছিল সুমতি ভার্গব। সে ‘মনু‘ ছদ্মনাম নিয়ে এই গ্রন্থ রচনা করে।


পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ঐতিহাসিক পণ্ডিতব্যক্তিরাই এ বিষয়ে একমত যে, পুষ্যমিত্রের ব্রাহ্মণ্যবাদী বিপ্লব সংঘটিত হবার পরে সুমতি ভার্গব ১৭০-১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই গ্রন্থ রচনা করে। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠার অনেক পরে অশোকের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্ম করার ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের হীনাবস্থায় বহুকাল গত হলে ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে পুষ্যমিত্র কর্তৃক সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠার পরে এই গ্রন্থ রচিত হয়। প্রধানত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এবং পুরোনো ধর্মশাস্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে বর্ণব্যবস্থাকে জন্মগত করে ব্রাহ্মণকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে হাজারো জাতপাতের সৃষ্টি করে একেবারেই নতুন করে ব্রাহ্মণ্যধর্মী এই গ্রন্থ রচিত হয়। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল রাজহত্যাকারী ব্রাহ্মণ সেনাপতি স্বয়ং পুষ্যমিত্র যে তখন সিংহাসনে আসীন। অথচ এই গ্রন্থ স্বয়ম্ভূ মনু কর্তৃক রচিত বলে প্রাচীনত্বের ভণিতা করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয়।  বারোটি অধ্যায়ে রচিত এই গ্রন্থ ‘সৃষ্টি প্রকরণ‘ থেকে শুরু করে ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্ত আইনকানুন নিয়ম ইত্যাদি সবই যে সুচতুর ব্রাহ্মণদের কল্পনাপ্রসূত, নিজেদের সুখসুবিধা চরিতার্থ করার একখানি যন্ত্রবিশেষ হিসাবে লিখিত হয়েছে, এ কথা যুক্তি-বিজ্ঞানের আলোয় কারও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।


অশোক বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্ম করেছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র মানুষে মানুষে সমতা ফিরে আসায় সমাজে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আর ছিল না। ব্রাহ্মণ্যধর্মের লোকদের কাছে এটা ছিল একটা বিরাট ধাক্কা। ব্রাহ্মণেরা বর্ণশ্রেষ্ঠ- এই দাবির সুবাদে প্রাপ্ত সকল সুযোগসুবিধা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে সাম্রাজ্যের সকল ক্ষেত্রে গৌণ ও অবহেলিত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের মর্যাদার চেয়ে সমাজে তাদের আলাদা কোনো বিশেষ মর্যাদা ছিল না। এক কথায় ব্রাহ্মণ্যবাদকে দমন করা হয়েছিল। অশোক সব ধরণের পশুবলি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার ফলে পশুবলিদানের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের পাওনা মোটা রকমের দক্ষিণা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছিল, যা ছিল তাদের জীবনধারণের প্রধান উপায়। মৌর্যদের শাসনকাল ছিল ১৪০ বছর। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে ব্রাহ্মণেরা বলতে গেলে নিপীড়িত ও অবদমিত শ্রেণি হিসাবে বাস করতে বাধ্য হয়। ব্রাহ্মণদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ছিল বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। সামবেদী ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র সুঙ্গই সেই বিদ্রোহের ধ্বজা ধরে প্রথম এগিয়ে আসে।


পুষ্যমিত্র নিজে ব্রাহ্মণ এবং তাঁর নির্দেশে মনুস্মৃতি রচিত হয়েছে বলেই ব্রাহ্মণদের রাজারও ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। পুষ্যমিত্রের বিপ্লবের সময় পর্যন্ত আর্য আইনে বলা ছিলঃ-

১। রাজকার্য কেবলমাত্র ক্ষত্রিয়দের অধিকারভুক্ত একজন ব্রাহ্মণ কখনও রাজা হতে পারবে না।

২। কোনো ব্রাহ্মণ সৈনিকের কাজ করতে পারবে না। (আইনটি খুবই কঠোর ছিল। অপস্তম্ভ ধর্মসূত্র অনুযায়ী ‘একজন ব্রাহ্মণ শুধু পরীক্ষার জন্যও তার হাতে কখনও অস্ত্র ধারণ করবে না। ‘)

৩। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা পাপ।

পুষ্যমিত্র তিনটি আইনই লঙঘন করেছে। সে ব্রাহ্মণ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যা করেছে, সৈনিকের বৃত্তি অবলম্বন করেছে এবং রাজাও হয়েছে।  তার এই কলঙ্কপূর্ণ বলপূর্বক সিংহাসন দখল জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। সেই জন্যই আইন পরিবর্তন করে পুষ্যমিত্রের নির্দেশে নতুন করে মনুস্মৃতি লেখা হয়েছে।


                উপস্হমুদরং জিহ্বা হস্তৌ পাদৌ চ পঞ্চমম্‌।

                চক্ষুর্নাসা চ কর্ণৌ চ ধনং দেহস্তথৈব চ \


বঙ্গানুবাদ। উপস্হ (স্ত্রী বা পুরুষের জননেন্দ্রিয়), উদর, জিহ্বা হাত, পা, চোখ, নাক, কান, ধনসম্পত্তি এবং দেহ- এই দশটি দণ্ডস্থান।

মনুর নির্দেশ হল যে লোক যে অঙ্গের দ্বারা অপরাধ করবে তার সেই অঙ্গেই পীড়া দিতে হবে। যেমন কেউ যদি পরনারীর সাথে সঙ্গম করে তবে তার জননেন্দ্রিয়ে আঘাত দিয়ে শাস্তি দিতে হবে। চুরি করার অপরাধে উদরের শাস্তি অর্থাৎ আহার বন্ধ প্রভৃতি। গালাগালি এবং মারামারির অপরাধে যথাক্রমে জিহ্বা ও হাতের উপর দণ্ড হবে। পদাঘাতের অপরাধে দুই পায়ের উপর দণ্ড হবে। রাজপত্নী প্রভৃতিকে কুদৃষ্টিতে দেখলে চোখের উপর দণ্ড হবে। পরনারীর অনুলেপনের গন্ধগ্রহণ করলে নাকের উপর দণ্ড হবে। রাজার গোপন মন্ত্রণা লুকিয়ে শুনলে কানের উপর দণ্ড হবে। বিশেষ কোনো অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলে ধনের উপর দণ্ড। দেহের উপর দণ্ড হল মহাপাতকী ব্যক্তিকে হত্যা করা। 


কিন্তু ব্রাহ্মণ কোনো অপরাধ করলে এর কোনো দণ্ডই দেওয়া চলবে না। অক্ষত শরীরে সমগ্র ধনসম্পত্তিসহ তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে শুধু।

এমনি হাজারো নিয়মের বেড়াজালে জাতপাত সৃষ্টিকারী অমানবিক গ্রন্থ এই মনুসংহিতা, যেখানে জন্মগত কারণে ব্রাহ্মণ হলেই তার সমস্ত সুখভোেগর ব্যবস্থা এবং ক্রমনিচুবর্ণের জন্য যেসব বিধি, তার মধ্যে নারী ও শূদ্রের অবর্ণনীয় অসম্মান ও হীনতার বিভেদনীতির প্রধান প্রধান কয়েকটি বিষয় এই ছোট্ট পুস্তিকায় দেখানো হয়েছে। এর বাইরেও আরও বহু নিয়মকানুন, আইন, বিধান ইত্যাদি ব্রাহ্মণ, নারী ও শূদ্রের জন্য আলাদা আলাদা উল্লেখ আছে।

এই পুস্তকে মূল সংস্কৃত শ্লোকগুলি বাংলা হরফে লিখে দেওয়া হয়েছে, যাতে বিজ্ঞ পাঠক অনুবাদের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন। অনুবাদ পাঠ করেই পাঠকরা এর মর্মার্থ বুঝতে পারবেন বলে আলাদা করে আর বিশেষ টীকা বা আলোচনা করা হয়নি। সংস্কৃত শ্লোকে লুপ্ত ‘অ‘কার চিহ্নটি বর্তমানে কম্পিউটারের বাংলা হরফে নেই বলে বিশেষ চিহ্ন ‘ হ‘ দিয়ে বোঝানো হয়েছে।


প্রথম পরিচ্ছেদ


সৃষ্টি প্রকরণ


                মনুমেকাগ্রমাসীনমভিগম্য মহর্ষয়ঃ।

                প্রতিপূজ্য যথান্যায়মিদং বচনমব্রুবন্‌ \ ১ম, ১ \

                ভগবন্‌ সর্ববর্ণানাং যথাবদনুপূর্বশঃ।

                অন্তরপ্রভবাণাঞ্চ ধর্মান্‌ নো বক্তুমর্হসি \ ১ম, ২ \

বঙ্গানুবাদ। ভগবান মনু, ঈশ্বরে একান্ত মনঃসমাধান করিয়া সমাসীন রহিয়াছেন, এমন সময় জিজ্ঞাসু মহর্ষিগণ, তাঁহার সন্নিধানে সমাগত হইয়া, বিধিমত পূজা-বন্দনাদি করিয়া তাঁহাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ভগবন্‌ ! ব্রাহ্মণাদি বর্ণ সকলের ও অম্বষ্ঠকরণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অনুলোম প্রতিলোমজাত সংকর জাতির ধর্মসমূহ যথাযথভাবে এবং যথাক্রমে আমাদের বলুন।


                স তৈঃ পৃষ্টস্তথা সম্যগমিতৌজা মহাত্মভিঃ।

                প্রত্যুবাচার্চ্য তান্‌ সর্বান্‌ মহর্ষীন্‌ শ্রূয়তামিতি \ ১ম, ৪ \

বঙ্গানুবাদ। অসীম জ্ঞানশক্তি সম্পন্ন্‌ ভগবান মনু তাঁদের সাগ্রহে বলতে লাগলেন। 


                সোহভিধ্যায় শরীরাৎ স্বাৎ সিসৃক্ষুর্বিবিধাঃ প্রজাঃ।

                অপ এব সসর্জাদৌ তাসু বীজমবাসৃজৎ \ ১ম, ৮ \

বঙ্গানুবাদ। সেই সূক্ষ্মরূপী ভগবান নিজের দেহ থেকে বিবিধ প্রজা সৃষ্টি করার ইচ্ছায় ধ্যানযোগে প্রথমে জলের সৃষ্টি করলেন এবং তাতে আপনার বীজ (শক্তি) নিক্ষেপ করলেন। 


                তদণ্ডমভবদ্ধৈমং সহস্রাংশুসমপ্রভম্‌।

                তস্মিন্‌ জজ্ঞে স্বয়ং ব্রহ্মা সর্বলোকপিতমহঃ \ ১ম, ৯ \

বঙ্গানুবাদ।  সেই বীজ সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট সোনার বরন এক অণ্ডে (ডিম) পরিণত হল; সেই অণ্ডে তিনি স্বয়ংই সমস্ত লোকের পিতামহ ব্রহ্মারূপে জন্মগ্রহণ করলেন।


                তস্মিন্নণ্ডে স ভগবানুষিত্বা পরিবৎসরম্‌।

                স্বয়মেবাত্মনো ধ্যানাৎ তদণ্ডমকরোদ্‌দ্বিধা \ ১ম, ১২ \

বঙ্গানুবাদ। ভগবান ব্রহ্মা সেই অণ্ডে সংবৎসরকাল (ব্রহ্ম পরিমাণে) বাস করে নিজের ধ্যানবলে তাকে দুই ভাগে ভাগ করলেন।


                তাভ্যাং স শকলাভ্যাং চ দিবং ভূমিঞ্চ নির্মমে।

                মধ্যে ব্যোম দিশশ্চাষ্টাবপাংস্থানঞ্চ শাশ্বতম্‌ \ ১ম, ১৩ \

বঙ্গানুবাদ। তিনি দুই ভাগে বিভক্ত ঊর্ধ্বখণ্ডে স্বর্গলোক এবং নিম্নখণ্ডে ভূলোক নির্মাণ করলেন এবং মধ্যভাগে আকাশ, আট দিক এবং চিরস্থায়ী জলাধার (সমুদ্র প্রভৃতি) সৃষ্টি করলেন। (এতে বোঝা যায় যে সমুদ্র পৃথিবীতে নয়, শূন্যে অবস্হিত।)


                সর্বেষাং তু স নামানি কর্মাণি চ পৃথক্‌ পৃথক্‌।

                বেদশব্দেভ্য এবাদৌ পৃথক্‌সংস্থাশ্চ নির্মমে \ ১ম, ২১ \

বঙ্গানুবাদ।  সৃষ্টির সূচনায় এই পরমাত্মা বেদ শব্দ থেকে পূর্ব পূর্বকল্পে যার যেমন নামাদি ছিল তা জেনে নিয়ে সকলের পৃথক পৃথক নাম (যেমন মানুষ জাতির মানুষ, বানর জাতির বানর) পৃথক পৃথক কর্ম (যেমন ব্রাহ্মণ জাতির অধ্যয়ন, ক্ষত্রিয় জাতির প্রজাপালন) এবং পৃথক পৃথক বৃত্তি (যেমন ব্রাহ্মণের যাজন) নির্দেশ করে দিয়েছিলেন।


এই শ্লোক থেকে এ কথা পরিষ্কার প্রতীয়মান যে এই সৃষ্টিপ্রকরণের পূর্বেও ব্রহ্মাণ্ড ছিল এবং একটা মহাপ্রলয়ের ফলে তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল। পরে এই নতুন ব্রহ্মাণ্ড পুনরায় সৃষ্টি করা হয়েছিল। সৃষ্টির সূচনায় এই নতুন পরমাত্মা বেদ শব্দ থেকে সব জেনে নিয়ে পূর্বকল্প মত জাতি, কর্ম, বৃত্তি ইত্যাদির নামকরণ পুনঃপ্রবর্তিত করে দিলেন।


                যং তু কর্মণি যস্মিন্‌ স ন্যযুঙ্‌ক্ত প্রথমং প্রভুঃ।

                স তদেব স্বয়ং ভেজে সৃজ্যমানঃ পুনঃপুনঃ \ ১ম, ২৮ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রজাপতি (ব্রহ্মা) সৃষ্টির আদিতে যাকে যে কর্মে নিযুক্ত করলেন (যেমন ব্রাহ্মণ জাতিকে যাজন কর্মে এবং অধ্যাপনায়), সে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেও নিজের থেকেই সেই কর্ম করতে লাগল।


                হিংস্রাহিংস্রে মৃদুক্রূরে ধর্মাধর্মাবৃতানৃতে।

                যদ্‌যস্য সো ্হদধাৎ সর্গে তৎ তস্য স্বয়মাবিশৎ \ ১ম, ২৯ \

বঙ্গানুবাদ।  (সিংহ প্রভৃতির) হিংসা, (হরিণ প্রভৃতির) অহিংসা, (ব্রাহ্মণের) মৃদুতা, (ক্ষত্রিয়ের) ক্রূরতা, (ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মচর্য) ধর্ম, (মাংস সেবন মৈথুন প্রভৃতি) অধর্ম; (দেবগণের) সত্য, (নরগণের) মিথ্যা- যার যে গুণ তিনি সৃষ্টিকালে বিধান করলেন সেই গুণ তার মধ্যে আপনা আপনিই প্রবেশ করতে লাগল।


                যথর্তুলিঙ্গান্যৃতবঃ স্বয়মেবর্তুপর্যয়ে।

                স্বানি স্বান্যভিপদ্যন্তে তথা কর্মাণি দেহিনঃ \ ১ম, ৩০ \

বঙ্গানুবাদ।  বসন্ত প্রভৃতি ঋতু যেমন নিজের নিজের অধিকার বলে আম্রমুকুল প্রভৃতি ঋতুচিহ্ন ধারণ করে, তেমনি দেহধারী পুরুষেরাও নিজ নিজ কর্মের অধিকার পেয়ে থাকে।


                লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।

                ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ \ ১ম, ৩১ \

বঙ্গানুবাদ।  ভূলোক প্রভৃতির প্রজা বৃদ্ধির জন্য পরমেশ্বর আপনার মুখ, বাহু, ঊরু, এবং পা থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র- এই চারিটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন।


                দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ।

                অর্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু \ ১ম, ৩২ \

বঙ্গানুবাদ।  পরমেশ্বর আপনার দেহকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এক অর্ধেক নারী এবং এক অর্ধ্বে পুরুষ হলেন। সেই পুরুষ সেই নারীতে বিরাট নামক এক পুরুষকে উৎপাদন করলেন। 


                তপস্তপ্ত্বাসৃজৎ যং তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্‌।

                তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ \ ১ম, ৩৩ \

বঙ্গানুবাদ।  হে শ্রেষ্ঠ দ্বিজগণ! সেই বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করে যাকে সৃষ্টি করলেন আমিই সেই মনু, আমাকে এই সমস্ত জগতের স্রষ্টা বলে জেনো। 


এই শ্লোকে মনু নিজেকে সমস্ত জগতের স্রষ্টা অর্থাৎ নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে পরিচয় দিচ্ছেন। অথচ উপরের শ্লোকগুলিতে পরমাত্মা বা পরমেশ্বর অর্থাৎ ব্রহ্মাই সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন বলা হয়েছে। এমনকি ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টিও বলা হয়েছে। তথাপি মনুই আবার নিজেকে সমস্ত জগতের স্রষ্টা অর্থাৎ সর্বশক্তিমান বলছেন।  কারণ, এই গ্রন্থ যারা পড়বে তারাই অনুধাবন করবে যে এই মনুই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং তাঁর এই বচন সকলের শ্রদ্ধেয়- এইটি প্রতিষ্ঠা করাই রচয়িতার উদ্দেশ্য। মনু কথিত সমস্ত বিধান যে সৃষ্টিকর্তারই বিধান এই বিশ্বাসকে মেনে চলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই মনু হল ধূর্ত ব্রাহ্মণ সুমতি ভার্গব! আর এই হল তার রচিত ‘মনুসংহিতা‘য় সৃষ্টি প্রকরণ! বিজ্ঞ পাঠক নিজেই বিচার করুন কতখানি ধূর্ততার সাথে এবং কল্পনার দৌড়ে রচিত হয়েছে এইসব শ্লোকগুলি!


পরবর্তী শ্লোকগুলি অনুযায়ী- মনু দশজন প্রজাপতির (পুত্র) জন্ম দিলেন তপস্যার বলে, কোনো নারীর গর্ভে নয়। বিশেষত একটিও কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন না। সেই দশজন প্রজাপতি আবার সাতজন মনু (মনুষ্য) সৃষ্টি করলেন। কিন্তু এরা প্রজাপতিদের ঔরসজাত, না হাতে গড়া, তার কোনো উল্লেখ নেই। প্রতিমার মতো হাতে গড়া হলে দরকার ছিল তাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠার এবং ঔরসজাত হলে দরকার ছিল নারীর। কিন্তু কিছুরই উল্লেখ নেই। আদি মনুর পৌত্র সপ্তমনুর মধ্যে কারোই স্ত্রীর উল্লেখ নেই। অথচ তাদের বংশাবলিতে বর্তমান পৃথিবী ভরপুর!


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ব্রাহ্মণ


এই পরিচ্ছেদে আমরা দেখব মনুসংহিতায় কীভাবে ব্রাহ্মণকে সকলের ঊর্ধ্বে রেখে তাদের জন্য সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা ভোগ করার বিধান বানানো হয়েছে।


ব্রাহ্মণের অধিকারঃ-


                উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্‌ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।

                সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভু \ ১ম, ৯৩ \

বঙ্গানুবাদ।  যেহেতু ব্রাহ্মণগণ ব্রহ্মার মুখ থেকে উদ্ভূত, প্রথম জাত এবং বেদকে অবলম্বন করেন সে কারণে তাঁরা অধিকার বলে এই সৃষ্ট জগতের প্রভু।


                ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু প্রাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ

                বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ।  \ ১ম, ৯৬ \

বঙ্গানুবাদ।  সৃষ্টি মধ্যে সজীব প্রাণী শেষ্ঠ, জীবের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ।


                ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।

                ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে \ ১ম, ৯৯ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকে।


                সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্‌।

                শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণো  ্হর্হতি \ ১ম, ১০০ \

বঙ্গানুবাদ।  বিশ্বের যাবতীয় সবকিছুই ব্রাহ্মণের সম্পদ। তার জন্মসূত্রে শ্রেষ্ঠতার জন্য বস্তুত ব্রাহ্মণই এই সম্পদের অধিকারী।


                স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্‌ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।

                আনৃশংস্যাদ্‌ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ \ ১ম, ১০১ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ যে খাদ্য গ্রহণ করে, যে পরিধেয় বস্ত্র পরিধান করে, তা অন্যের দ্বারা প্রস্তুত হলেও, তা তার নিজের।  কারণ অন্য মরণশীলগণ ব্রাহ্মণদের অনুগ্রহে জীবন ধারণ করে।


                অবিদ্বাংশ্চৈব বিদ্বাংশ্চ ব্রাহ্মণো দৈবতং মহৎ।

                প্রণীতশ্চাপ্রণীতশ্চ যথাগ্নির্দৈবতং মহৎ \ ৯ম, ৩১৭ \

বঙ্গানুবাদ।  পবিত্র হোক বা অপবিত্র হোক, অগ্নি যেমন মহান দেবতা, তেমনি ব্রাহ্মণ বিদ্বান বা মূর্খ যাই হোক না কেন, সে দেবতাতুল্য।


                এবং যদ্যপ্যনিষ্টেষু বর্তন্তে সর্বকর্মসু।

                সর্বথা ব্রাহ্মণাঃ পূজ্যাঃ পরমং দৈবতং হি তৎ \ ৯ম, ৩১৯ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ সকল প্রকার নিন্দাজনক কাজে নিযুক্ত থাকলেও সকলের নিকট পূজ্য, যেহেতু ব্রাহ্মণ দেবতা-স্বরূপ।


                বৈশেষ্যাৎ প্রকৃতিশ্রৈষ্ঠ্যান্নিয়মস্য চ ধারণাৎ।

                সংস্কারস্য বিশেষাচ্চ বর্ণানাং ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ \ ১০ম, ৩ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রথম জাত হওয়ার কারণে, মৌলিক শ্রেষ্ঠতার কারণে, নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত আচরণে, সংস্কারের পবিত্রতার কারণে ব্রাহ্মণই সকল জাতির প্রভু।


                বিধাতা শাসিতা বক্তা মৈত্রী ব্রাহ্মণ উচ্যতে।

                তস্মৈ নাকুশলং ব্রূয়ান্ন শুষ্কা গিরিমীরয়েৎ \ ১১শ, ৩৫ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণকে সমসড় বিশ্বের স্রষ্টা, শাস্তিদাতা, শিক্ষক এবং সর্বপ্রকার সৃষ্ট প্রাণীর হিতৈষী বলে ঘোষণা করা হয়েছে।  অপ্রসন্ন হতে পারে এমন কোনো বাক্য অথবা কোনো অশালীন বাক্য তাকে কেউ বলবে না।


                বিস্রব্ধং ব্রাহ্মণঃ শূদ্রাদ্‌ দ্রব্যোপাদানমাচরেৎ।

                ন হি তস্যান্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ \ ৮ম, ৪১৭ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ নিঃসঙ্কোচে শূদ্রের জিনিস বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারে।  কারণ, শূদ্রের নিজের বলতে কোনো ধন নেই, সে প্রভুর জন্যই ধন আহরণ করে।

ব্রাহ্মণকে কখনও অসন্তুষ্ট করা যাবে না। এর বিরুদ্ধে মনুস্মৃতি নিম্নলিখিত শ্লোকে রাজাকে সতর্ক করে দিয়েছেন ঃ-


                পরামপ্যাপদং প্রাপ্তো ব্রাহ্মণান্‌ ন প্রকোপয়েৎ।

                তে হ্যেনং কুপিতা হন্যুঃ সবলবাহনম্‌ \ ৯ম, ৩১৩ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজা যতই বিপদে পড়ুক না কেন ব্রাহ্মণকে নিন্দা করে ক্রোধান্বিত করবে না। কেননা ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার সৈন্য এবং যানবাহনসহ তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।


                ন ব্রাহ্মণো বেদয়েত কিঞ্চিদ্‌ রাজনি ধর্মবিৎ।

                স্ববীর্যণৈব তান্‌ শিষ্যান্মানবানপকারিণঃ \ ১১শ, ৩১ \

বঙ্গানুবাদ।  ভাল করে আইন জানে এমন কোনো ব্রাহ্মণের কোনো ক্ষতির জন্য রাজার কাছে অভিযোগ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তার নিজের ক্ষমতাবলে সে অনিষ্টকারীকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে।


                স্ববীর্যাদ্রাজবীর্যাচ্চ স্ববীর্যং বলবত্তরম্‌।

                তস্মাৎ স্বেনৈব বীর্যেণ নিগৃহ্নীয়াদরীন্‌ দ্বিজঃ \ ১১শ, ৩২ \

বঙ্গানুবাদ।  নিজের (ব্রাহ্মণের) ক্ষমতা রাজার ক্ষমতা অপেক্ষা শক্তিশালী। অতএব একজন ব্রাহ্মণ তার নিজ শক্তি দ্বারা তার শত্রুকে দমন করতে পারে।


                সৈন্যাপত্যঞ্চ রাজ্যঞ্চশ দণ্ডনেতৃত্বমেব চ।

                সর্বলোকাধিপত্যঞ্চ বেদাশাস্ত্রবিদর্হতি \ ১২শ, ১০০ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজ্যের প্রধান সেনাধ্যক্ষের পদ, যা সরকারের সর্বোচ্চ পদ, এবং প্রত্যেকের উপর যার পূর্ণ আধিপত্য, তা একজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের প্রাপ্য।       


                হত্বা লোকানপীমাংস্ত্রীনশ্নন্নপি যতস্ততঃ।

                ঋগ্বেদং ধারয়ন্‌ বিপ্রো নৈনঃ প্রাপ্নোতি কিঞ্চন \ ১১শ, ২৬২ \

বঙ্গানুবাদ।  ঋগ্বেদধারী ব্রাহ্মণ ত্রিজগতের সকলকে হত্যা করলে এবং যত্রতত্র ভোজন করলেও কোনো পাপে লিপ্ত হয় না। 


                ঋক্‌সংহিতাং ত্রিরভ্যাস্য যজুযাং বা সমাহিতঃ।

                সাম্নাং বা সরহস্যানাং সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে \ ১১শ, ২৬৩ \

বঙ্গানুবাদ।  উপনিষদসহ ঋক্‌, যজু এবং সামবেদ তিনবার আবৃিত্ত করলে সকল পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। 


                শস্ত্রং দ্বিজাতিভির্গ্রাহ্যং ধর্মো যত্রোপরুধ্যতে।

                দ্বিজাতীনাঞ্চ বর্ণানাং বিপ্লবে কালকারিতে \ ৮ম, ৩৪৮ \

                আত্মনশ্চ পরিত্রাণে দক্ষিণানাং চ সঙ্গরে।

                স্ত্রীবিপ্রাভ্যুপপত্তৌ চ ধর্মেণ ঘ্নন্‌ ন দুষ্যতি \ ৮ম, ৩৪৯ \

বঙ্গানুবাদ।  ধর্মদ্বারা প্রতিষ্ঠিত ন্যায্য অধিকারে কোনো শক্তি বাধা প্রদান করলে এবং কোনো দুঃসময়ে দ্বিজ শ্রেণীর উপর কোনো আকস্মিক বিপদ নেমে এলে দ্বিজগণ অস্ত্র ধারণ করতে পারবে।


                ক্ষত্রস্যাতিপ্রবৃদ্ধস্য ব্রাহ্মণান্‌ প্রতি সর্বশঃ

                ব্রহ্মৈব সন্নিয়ন্ত্‌ স্যাৎ ক্ষত্রং হি ব্রহ্মসম্ভবম্‌ \ ৯ম, ৩২০ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্ষত্রিয়দের কেহ (সৈনিক বা রাজা) যদি ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করে তবে ব্রাহ্মণ নিজেই তাকে শাস্তি দেবে, কারণ সৈনিকবৃত্তি ব্রাহ্মণ থেকেই প্রথম শুরু হয়।


                যদা স্বয়ং ন কুর্যাত্তু নৃপতিঃ কার্যদর্শনম্‌।

                তদা নিযুঞ্জ্যাদ্বিদ্বাংসং ব্রাহ্মণং কার্যদর্শনে \ ৮ম, ৯ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজা যখন স্বয়ং সব কাজ (বিবাদ বিষয়ে) দেখাশোনা করতে পারবে না, তখন সেই সব কাজ দেখার জন্য বিদ্বান ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করবে।


                সোহস্য কার্যাণি সম্পশ্যেৎ সভ্যৈরেব ত্রিভির্বৃতঃ

                সভামেব প্রবিশ্যাগ্র্যামাসীনঃ স্হিত এব বা \ ৮ম, ১০ \

বঙ্গানুবাদ।  সেই বিদ্বান ব্রাহ্মণ আরও তিনজন সহকারীসহ রাজদরবারে বিচারের জন্য আগত সমস্ত বিষয়ে উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান থেকে সে সব বিষয় বিচার করবে।


                বিদ্বাংস্তু ব্রাহ্মণো দৃষ্ট্বা পূর্বোপনিহিতং নিধিম্‌।

                অশেষতোহপ্যাদদীত সর্বস্যাধিপতির্হি সঃ \ ৮ম, ৩৭ \

বঙ্গানুবাদ।  বেদবিদ বিদ্বান ব্রাহ্মণ পূর্বের কোনো ধন যদি ভূমিমধ্যে পায়, তবে সেই ধন সে নিজেই সম্পূর্ণ নিয়ে নেবে।  তার কোনো অংশ রাজাকে দেবার প্রয়োজন নেই; যেহেতু ব্রাহ্মণই ধনের প্রকৃত অধিকারী।


                যন্তু পশ্যেন্নিধিং রাজা পুরাণং নিহিতং ক্ষিতৌ।

                তস্মাদ্‌ দ্বিজেভ্যো দত্ত্বার্দ্ধমর্দ্ধং কোষে প্রবেশয়েৎ \ ৮ম, ৩৮ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজা যদি ভূমিমধ্যে কোনো ধন পায়, তবে তার অর্ধেক ব্রাহ্মণদের দান করে বাকি অর্ধাংশ রাজকোষে গ্রহণ করবে।


                দত্ত্বা ধনন্তু বিপ্রেভ্যঃ সর্বদণ্ডসমুত্থিম্‌।

                পুত্রে রাজ্যং সমাসৃজ্য কুর্বীত প্রায়ণং রণে \ ৯ম, ৩২৩ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি রাজা তার মৃত্যু সন্নিকট অনুভব করে, তবে সেই দণ্ড দ্বারা প্রাপ্ত সমস্ত ধন ব্রাহ্মণদের দান করে পুত্রের হাতে রাজ্যভার সমর্পণ করে যুদ্ধ কিংবা উপবাসাদি দ্বারা প্রাণত্যাগ করবে।


                সর্বেষামপ্যভাবে তু ব্রাহ্মণা রিক্‌থভাগিনঃ

                ত্রৈবিদ্যাঃ শুচয়ো দান্তাস্তথা ধর্মো ন হীয়তে \ ৯ম, ১৮৮ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি কোনো ব্যক্তির ধনের কোনো অধিকারী না পাওয়া যায়, তবে তা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ পাবে।  এর ফলে তার শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়ার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।


                অহার্যং ব্রাহ্মণদব্যং রাজ্ঞা নিত্যমিতি স্হিতিঃ।

                ইতরেষান্তু বর্ণানাং সর্বাভাবে হরেন্নৃপঃ \ ৯ম, ১৮৯ \

বঙ্গানুবাদ।  এটা হল শাশ্বত নিয়ম যে, রাজা কখনও ব্রাহ্মণের ধন গ্রহণ করতে পারবে না। তবে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী না থাকলে অন্য বর্ণের ব্যক্তিদের ধন রাজাই গ্রহণ করবে।


                অনাম্নাতেষু ধর্মেষু কথং স্যাদিতি চেদ্ভবেৎ।

                যং শিষ্টা ব্রাহ্মণা ব্রূয়ুঃ স ধর্ম স্যাদশঙ্কিতঃ \ ১২শ, ১০৮ \

বঙ্গানুবাদ।  এমন কোনো পরিস্হিতি বা বিষয়ের সম্মুখীন যদি হতে হয় যা সম্পর্কে কোনো বিধান দেওয়া নেই, তা হলে শিষ্ট ব্রাহ্মণেরা যা বলবে তাকেই অকাট্য বিধান বলে গ্রহণ করতে হবে।


ব্রাহ্মণের কর্মঃ-


ব্রাহ্মণের জীবিকা নির্বাহের জন্য মনু যেসব কর্মের বিধান দিয়েছেন।

                অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।

                দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ \ ১ম, ৮৮ \

বঙ্গানুবাদ।  শিক্ষা, বেদপাঠ, নিজের এবং অপরের কল্যাণের জন্য যজ্ঞানুষ্ঠান, ভিক্ষা দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা তিনি (ব্রহ্মা) ব্রাহ্মণের জন্য নির্দিষ্ট করে দিলেন।


                অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাং স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।

                প্রব্রূয়াদ্‌ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ \ ১০ম, ১ \

বঙ্গানুবাদ।  দ্বিজবর্ণ তিনটি অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য।  এই তিন বর্ণই ধর্মপরায়ণ হয়ে বেদ অধ্যয়ন করবে। কিন্তু এদের মধ্যে একমাত্র ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য দু’টি বর্ণ অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বেদের অধ্যাপনা করতে পারবে না।


                বৈশেষ্যাৎ প্রকৃতিশ্রৈষ্ঠ্যান্নিয়মস্য চ ধারণাৎ।

                সংস্কারস্য বিশেষাচ্চ বর্ণানাং ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ \ ১০ম, ৩ \

বঙ্গানুবাদ।  জন্মগত কারণে উৎকর্ষতা, বেদ অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও ব্যাখ্যানে, উপযুক্ত নিয়ম ধারণে যোগ্যতা এবং ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র অপেক্ষা সংস্কারের বিশিষ্টতাযুক্ত ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের শ্রেষ্ঠ।              


                অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।

                দানং প্রতিগ্রহশ্চৈব ষট্‌ কর্মাণ্যগ্রজন্মনঃ \ ১০ম, ৭৫ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণদের ছয়টি কর্ম হল- অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (দান গ্রহণ করা)।


                ষণ্নাস্তু কর্মণামস্য ত্রীণি কর্মাণি জীবিকা।

                যাজনাধ্যাপনে চৈব বিশুদ্ধচ্চ প্রতিগ্রহঃ \ ১০ম, ৭৬ \

বঙ্গানুবাদ।  এই ছয়টি কর্মের মধ্যে অধ্যাপনা, যাজন ও সৎপ্রতিগ্রহ- এই তিনটি ব্রাহ্মণদের জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট।


                ত্রয়ো ধর্মা নিবর্তন্তে ব্রাহ্মণাৎ ক্ষত্রিয়ং প্রতি।

                অধ্যাপনং যাজনঞ্চ তৃতীয়শ্চ প্রতিগ্রহঃ \ ১০, ৭৭ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্ষত্রিয়ের জীবিকার ক্ষেত্রে অধ্যাপনা, যাজন ও প্রতিগ্রহ- এই তিনটি নিষিদ্ধ।


                বৈশ্যং প্রতি তথৈবৈতে নিবর্তেরন্নিতি স্হিতিঃ।

                ন তৌ প্রতি হি তান্‌ ধর্মান্‌ মনুরাহ প্রজাপতিঃ \ ১০ম, ৭৮ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্ষত্রিয়ের ন্যায় বৈশ্যদের ক্ষেত্রেও মনু অধ্যাপনা, যাজন ও প্রতিগ্রহ- এই তিনটি কর্ম নিষিদ্ধ করেছেন। 

অর্থাৎ অধ্যাপনা, যাজন ও দান গ্রহণ করা ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার। ওই কাজে অন্য কেউ ভাগ বসাতে পারবে না।

                শাস্ত্রাস্ত্রভৃত্ত্বং ক্ষত্রস্য বণিক্‌পশুকৃষির্বিশঃ।

                আজীবনার্থং ধর্মস্তু দানমধ্যয়নং যজিঃ \ ১০ম, ৭৯ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রজারক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি। পশুপালন, কৃষি ও বাণিজ্য বৈশ্যের বৃত্তি। দান, যাগ ও অধ্যয়ন- এই তিনটি কর্ম ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের কর্তব্য বলে জানবে।


                বেদাভ্যাসো ব্রহ্মণস্য ক্ষত্রিয়স্য চ রক্ষণম্‌।

                বার্তাকর্মৈব বৈশ্যস্য বিশিষ্টানি স্বকর্মসু \ ১০ম, ৮০ \


বঙ্গানুবাদ।  জীবিকা অর্জনের জন্য যে সমস্ত উপায়ের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে ভাল হল ব্রাহ্মণের পক্ষে বেদ-অধ্যাপনা, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রজাপালন এবং বৈশ্যের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য।

                অজীবংস্তু যথোক্তেন ব্রাহ্মনঃ স্বেন কর্মণা।

                জীবেৎ ক্ষত্রিয়ধর্মেণ স হ্যস্য প্রত্যনন্তরঃ \ ১০, ৮১ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ যদি নিজ বৃত্তি দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে না পারে, তবে সে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা অর্জন করতে পারবে।

                উভাভ্যামপ্যজীবংস্তু কথং স্যাদিতি চেদ্ভবেৎ।

                কৃষিগোরক্ষমাস্থায় জীবৈদ্বৈশ্যস্র জীবিকাম্‌ \ ১০, ৮১২ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ যদি তার নিজের ও ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে না পারে তবে, সে বৈশ্যের বৃত্তি দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে পারবে।  অর্থাৎ ব্রাহ্মণ তার খুশি মত যে কোনো বৃত্তিই অবলম্বন করতে পারবে।


                বৈশ্যবৃত্ত্যাপি জীবংস্তু ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়োহপি বা।

                হিংসাপ্রায়াং পরাধীনাং কৃষিং যত্নেন বর্জয়েৎ \ ১০ম, ৮৩ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়কে যদি বৈশ্য বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা অর্জন করতে হয়, তবে তাদের হিংসামূলক কৃষিকার্য বর্জন করতে হবে।

                কৃষিং সাধ্বিতি মন্যন্তে সা বৃত্তিঃ সদ্বিগর্হিতা।

                ভূমিং ভূমিশয়াংশ্চৈব হন্তি কাষ্ঠময়োমুখম্‌ \ ১০ম, ৮৪ \

বঙ্গানুবাদ।  কৃষিকার্য উত্তম বৃত্তি হলেও সজ্জন ব্যক্তিরা তা নিন্দনীয় মনে করে; যেহেতু কৃষিকার্য করতে গেলে হল চালনাকালে মৃত্তিকাস্হিত বহু প্রাণী মারা যায়।

                ইদন্তু বৃত্তিবৈকল্যাত্ত্যজতো ধমনৈপুণম্‌।

                বিট্‌পণ্যমুদ্ধৃতোদ্ধারং বিক্রেয়ং বিত্তবর্ধনম্‌ \ ১০ম, ৮৫ \

বঙ্গানুবাদ।  ধর্মানুগ বৃত্তির দ্বারা জীবিকা অর্জন সম্ভবপর না হলে, তারা বৈশ্য বৃত্তির মধ্যে আপত্তিকর জীবিকা বাদ দিয়ে ধনবর্ধক অন্যান্য বৃত্তি গ্রহণ করবে।

                অদ্রোহেণৈব ভূতানামল্পদ্রোহেণ বা পুনঃ।

                যা বৃত্তিস্তাং সমাস্থায় বিপ্রো জীবেদনাপদি \ ৪র্থ, ২ \

বঙ্গানুবাদ।  আপৎকাল ব্যতীত অন্য সময়ে যাতে কোনো প্রাণীর কিছুমাত্র অনিষ্ট না হয়, অথবা স্বল্পমাত্র পীড়ন হয়, এরূপ বৃত্তি আশ্রয় করে ব্রাহ্মণ জীবিকা নির্বাহ করবে।

                যাত্রামাত্রণ্ডপ্রসিদ্ধ্যর্থং স্বৈঃ কর্মভিরগর্হিতৈঃ।

                অক্লেশেন শরীরস্য কুর্তীত ধনসঞ্চয়ম্‌ \ ৮র্থ, ৩ \

বঙ্গানুবাদ।  জীবন ধারণের জন্য শরীরকে কোনো রূপ ক্লেশ না দিয়ে ব্রাহ্মণ নিজের বর্ণবিহিত অনিন্দিত কর্মের দ্বারা ধন অর্জন করবে।


                ম্রিয়মাণোহপ্যাদদীত ন রাজা শ্রোত্রিয়াৎ করম্‌।

                ন চ ক্ষুধাহস্য সংসীদেচ্ছ্রোত্রিয়ো বিষয়ে বসন্‌ \ ৭ম, ১৩৩ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজা অর্থাভাবে বিপন্ন হলেও কোনো ব্রাহ্মণের নিকট থেকে কর গ্রহণ করতে পারবে না। অপরপক্ষে কোনো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পায় তার প্রতি রাজাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বাহ্‌ কী চমৎকার ব্যবস্থা! ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনও কর নেওয়া চলবে না, বরং ব্রাহ্মণ জীবিকা অর্জনে অসমর্থ হলে রাজা তার ভরণপোষণেরও ব্যবস্থা করবে!


ব্রাহ্মণের জন্য দণ্ডবিধানঃ-

বিভিন্ন রকম অপরাধে ব্রাহ্মণদের জন্য শাস্তি হিসাবে মনুর বিধান দেখুন।

                কৌটসাক্ষ্যং তু কুর্বাণাংস্ত্রীন্‌ বর্ণান্‌ ধার্মিকো নৃপঃ।

                প্রবাসয়েদ্‌ দণ্ডয়িত্বা ব্রাহ্মণং তু বিবাসয়েৎ \ ৮ম, ১২৩ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্ষত্রিয়াদি তিনটি বর্ণ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বিধান অনুসারে রাজা তাদের অর্থদণ্ডসহ দেশ থেকে বহিষ্কার করবে।  কিন্তু ব্রাহ্মণকে অর্থদণ্ড না করে কেবলমাত্র বহিষ্কার করবে।

                দশ স্থানানি দণ্ডস্য মনুঃ স্বায়ম্ভুবো ্হব্রবীৎ।

                ত্রিষু বর্ণেষু যানি স্যুরক্ষতো ব্রাহ্মণো ব্রজেৎ \ ৮ম, ১২৪ \

ঙ্গানুবাদ।  স্বায়ম্ভূব মনু দণ্ডদানের দশটি স্থানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এগুলি কেবলমাত্র ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য।  ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দৈহিক দণ্ড না দিয়ে কেবলমাত্র দেশ থেকে বহিষ্কার করতে হবে।


                ব্রাহ্মক্ষত্রিয়াভ্যাং তু দণ্ডঃ কার্যো বিজানতা।

                ব্রাহ্মণে সাহসঃ পূর্বঃ ক্ষত্রিয়ে ত্বেব মধ্যমঃ \ ৮ম, ২৭৬ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের মধ্যে পারস্পরিক নিন্দাবাদ হলে প্রত্যক্ষদর্শী রাজা ব্রাহ্মণকে সবচেয়ে কম (প্রথম সাহস) দণ্ড দেবে এবং ক্ষত্রিয়ের মাঝামাঝি মধ্যম সাহস) দণ্ড দেবে।

                মৌণ্ড্যং প্রাণান্তিকো দণ্ডো ব্রাহ্মণস্য বিধীয়তে।

                ইতরেষাং তু বর্ণানাং দণ্ডঃ প্রাণান্তিকো ভবেৎ \৮ম, ৩৭৯ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রাণদণ্ডের যোগ্য অপরাধে ব্রাহ্মণের দণ্ড হবে মস্তক মুণ্ডন। অন্যান্য বর্ণের প্রাণদণ্ডই করবে- এই হল শাস্ত্রের বিধান।

                ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্হিতম্‌।

                রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্‌ \ ৮ম, ৩৮০ \


বঙ্গানুবাদ।  সর্বপ্রকার পাপে পাপী হলেও ব্রাহ্মণকে কখনও বধ করবে না- বরং সমগ্র ধনের সঙ্গে তাকে অক্ষত দেহে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করবে।

                ন ব্রাহ্মণবধাদ্‌ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি।

                তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ \ ৮ম, ৩৮১ \


বঙ্গানুবাদ।  পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম (পাপ) কিছুই নেই। এই জন্য ব্রাহ্মণকে বধ, অঙ্গচ্ছেদনাদি করার কথা রাজা কখনও চিন্তাও করবে না।                 

           প্রাজাপত্যমদত্ত্বাশ্বমগ্ন্যাধেয়স্য দক্ষিণাম্‌।

                অনাহিতাগ্নির্ভবতি ব্রাহ্মণো বিভবে সতি \ ১১শ, ৩৮ \


বঙ্গানুবাদ।  সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যে ব্রাহ্মণকে এবং দেবতাকে অশ্ব দক্ষিণা না দেয়, সে অগ্নি আধানের ফলপ্রাপ্ত হয় না।

                পুণ্যান্যন্যানি কুর্বীত শ্রদ্দধানো জিতেন্দ্রিয়ঃ।

                ন ত্বল্পদক্ষিণৈর্যজেতেহ কথঞ্চন \ ১১শ, ৩৯ \


বঙ্গানুবাদ।  যজ্ঞের উপযুক্ত দক্ষিণা দিতে না পারলে সে অন্যান্য অনুষ্ঠান করবে; কিন্তু দক্ষিণার যে বিধান আছে তা দিতে সমর্থ না হলে কখনও যজ্ঞ করাবে না।

                ইন্দ্রিয়াণি যশঃ স্বর্গমায়ুঃ কীর্তিং প্রজাঃ পশূন্‌।

                হন্ত্যল্পদকিণো যজ্ঞস্তস্মান্নাল্পধনো যজেৎ \ ১১শ, ৪০ \


বঙ্গানুবাদ।  অল্প দক্ষিণা প্রদান করলে তার যশ, স্বর্গ, আয়ু, কীর্তি, প্রজা ও পশু সবই নষ্ট হবে। তাই স্বল্প সম্পদসম্পন্ন ব্যক্তি কখনও যজ্ঞ করবে না।

আত্মনশ্চ পরিত্রাণে দক্ষিণানাং চ সঙ্গরে।                                                                       স্ত্রীবিপ্রাভ্যুপপত্তৌ চ ধর্মেণ ঘ্নন্‌ ন দুষ্যতি \ ৮ম, ৩৪৯ \

বঙ্গানুবাদ।  আত্মরক্ষার্থে, দক্ষিণার অর্থ আদায়ে, নারী ও ব্রাহ্মণকে রক্ষার নিমিত্ত কাউকে হত্যা করলেও তা দোষাবহ নয়।

ব্রাহ্মণ পূজাপার্বণের দক্ষিণা আদায়ের জন্য কাউকে হত্যাও করতে পারে।

ব্রাহ্মণকে দানের ফলঃ-

ব্রাহ্মণ যাতে আবহমানকাল বংশপরম্পরায় আরাম আয়েসে কালাতিপাত করতে পারে সে জন্য নানাভাবে তাকে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন জিনিস দানে কী ফল লাভ হবে তাও বিস্তারিত বলা হয়েছে, যাতে সবাই দানে আগ্রহী হয়।  শুধু তাই নয়, এই দান কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ জন্য প্রায়শ্চিত্ত নামক পাপ খণ্ডনের এক বিধানও তৈরি করা হয়েছে।


                ভূমিদো ভূমিমাপ্নোতি দীর্ঘমায়ুর্হিরণ্যদঃ

                তিলপ্রদঃ প্রজামিষ্টাং দীপদশ্চক্ষুরুত্তমম্‌ \ ৪র্থ, ২৩০ \


বঙ্গানুবাদ।  ভূমি দান করলে অধিক ভূমির আধিপত্য লাভ হয়। স্বর্ণ দান করলে দীর্ঘ পরমায়ু প্রাপ্তি হয়, গৃহ দান করলে উত্তম অট্টালিকা লাভ হয়। রৌপ্য দান করলে উত্তম রূপ লাভ হয়।

                বাসোদশ্চন্দ্রসালোক্যমশ্বিসালোক্যমশ্বদঃ।

                অনডুদ্দঃ শ্রিয়ং পুষ্টাং গোদো ব্রধ্নস্য পিষ্টপম্‌ \ ৪র্থ, ২৩১ \


বঙ্গানুবাদ।  বস্ত্র দান করলে চন্দ্রের ন্যায় ঐশ্বর্য সম্পন্ন হয়ে চন্দ্রলোকে বসবাস করে। ঘোটক দান করলে অশ্বিলোকে যায়, বলীবর্দ (বলদ) দান করলে অতুল সম্পত্তি লাভ হয় এবং গাভী দান করলে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হয়।

                যজেত রাজা ক্রতুভির্বিবিধৈরাপ্তদক্ষিণৈঃ।

                ধর্মার্থঞ্চৈব বিপ্রেভ্যো দদ্যাদ্ভোগান্‌ ধনানি চ \ ৭ম, ৭৯ \


বঙ্গানুবাদ।  দক্ষিণাবিশিষ্ট নানাপ্রকার যজ্ঞানুষ্ঠান, ধর্মার্থে ব্রাহ্মণগণকে নানাপ্রকার ভোগ্যবস্তু ও স্বর্ণাদি প্রদান করা রাজার বিশেষ কর্তব্য।

                আবৃত্তানাং গুরুকুলাদ্বিপ্রাণাং পূজকো ভবেৎ।

                নৃপাণামক্ষয়ো হ্যেষ নিধির্ব্রাহ্মো ্হভিধীয়তে \ ৭ম, ৮২ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণপুত্র যখন গুরুগৃহ থেকে পাঠ সমাপন করে গৃহাশ্রমে ফিরবে, তখন তাকে রাজা ধনসম্পদ দ্বারা পূজা করবে। কারণ এরূপ পাত্রে দান করা রাজার পক্ষে অক্ষয় সম্পদ বলে গণ্য হবে।


                ন তং স্তেনা ন চামিত্রা হরন্তি ন চ নশ্যতি।

                তস্মাদ্রাজ্ঞা নিধাতব্যো ব্রাহ্মণেষ্বক্ষয়ো নিধিঃ \ ৭ম, ৮৩ \

বঙ্গানুবাদ।  এই সম্পদ চোর বা শত্রু হরণ করতে পারে না, বা এই সম্পদ কখনও বিনষ্ট হয় না। তাই রাজারা সর্বদাই এরূপ অক্ষয়নিধি ব্রাহ্মণকে অর্পণ করবে।

                সর্বরত্নানি রাজা তু যথার্হ প্রতিপাদয়েৎ।

                ব্রাহ্মণান্‌ বেদবিদুষো যজ্ঞার্থঞ্চৈব দক্ষিণাম্‌ \ ১১শ, ৪ \

বঙ্গানুবাদ।  যজ্ঞার্থী ও বেদবিদ ব্রাহ্মণকে রাজা সর্বদা বিভিন্ন প্রকার রত্ন ও দক্ষিণার জন্য উপযুক্ত অর্থ প্রদান করবে।

                সমমব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণব্রুবে।


                প্রাধীতে শতসাহস্রমনন্তং বেদপারগে \ ৭ম, ৮৫ \

বঙ্গানুবাদ।  অব্রাহ্মণ দ্বিজকে দান করলে যে ফল পাওয়া যায়, অবিদ্বান ব্রাহ্মণকে  দান করলে তার দ্বিগুণ ফললাভ হয়।  বেদাধ্যয়নকারী ব্রাহ্মণকে দান করলে লক্ষগুণ ফললাভ হয় এবং যিনি সর্ববেদ পারদর্শী তাকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়।


                পাত্রস্য হি বিশেষেণ শ্রদ্দধানতয়ৈব চ

                অল্পং বা বহু বা প্রেত্য দানস্যাবাপ্যতে ফলম্‌ \ ৭ম, ৮৬ \

বঙ্গানুবাদ।  স্বল্প হোক বা বেশি হোক বিশ্বাসযুক্ত ও শ্রদ্ধাবান হয়ে দান করলে দানপাত্রের গুণের তারতম্য অনুসারে দানের ফললাভ হয়ে থাকে।

                সান্তানিকং যক্ষ্যমাণমধ্বগং সর্ববেদসম্‌।

                গুর্বর্থং পিতৃমাত্রর্থং স্বাধ্যায়ার্থ্যুপতাপিনঃ \ ১১শ, ১ \

                নবৈতান্‌ স্নাতকান্‌ বিদ্যাদ্‌ ব্রাহ্মণান্‌ ধর্মভিক্ষুকান্‌।

                নিঃস্বেভ্যো দেয়মেতেভ্যো দানং বিদ্যাবিশেষতঃ \ ১১শ, ২ \

বঙ্গানুবাদ।  সন্তানের জন্য বিবাহে ইচ্ছুক, যজ্ঞ করতে ইচ্ছুক, পরিব্রাজক, যজ্ঞ করে যিনি নিঃস্ব হয়েছে, পিতার জন্য, মাতার জন্য ও গুরুর জন্য যার অর্থের প্রয়োজন, শিক্ষাথর্ী এবং রোগী এই নয়জন নিঃস্ব ব্রাহ্মণকে ধর্মভিক্ষুক বলে মনে করবে এবং তাদের বিদ্যাবত্তা অনুসারে দান করবে।

                এতেভ্যো হি দ্বিজাগ্রেভ্যো দেয়মন্নং সদক্ষিণম্‌।

                ইতরেভ্যো বহির্বেদি কৃতান্নং দেয়মুচ্যতে \ ১১শ, ৩ \

বঙ্গানুবাদ।  এইসব ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠদের যজ্ঞবেদীর মধ্যে বসিয়ে দক্ষিণাসহ খাদ্য দান করবে এবং যজ্ঞবেদীর বাইরের ভিক্ষুকদেরও অন্নদান করবে।

                ধনানি তু যথাশক্তি বিপ্রেষু প্রতিপাদয়েৎ।

                বেদবিৎসু বিবিক্তেষু প্রেত্য স্বর্গং সমশ্নুতে \ ১১শ, ৬ \

বঙ্গানুবাদ।  বেদজ্ঞ এবং সংসারত্যাগী ব্রাহ্মণদের যথাসাধ্য অর্থদান করবে। এদের দান করলে পরলোকে স্বর্গলাভ হয়ে থাকে।

পাপ কাজের জন্য ধর্মীয় আইনে সাজা হল প্রায়শ্চিত্ত করা।  আর প্রায়শ্চিত্ত মানেই হল ব্রাহ্মণকে অকাতরে প্রচুর দান করা।

                অকুর্বন্‌ বিহিতং কর্ম নিন্দিতঞ্চ সমাচরন্‌।

                প্রসজংশ্চেন্দ্রিয়ার্থেষু প্রায়শ্চিত্তীয়তে নরঃ \ ১১শ, ৪৪ \

বঙ্গানুবাদ।  শাস্ত্রবিহিত কাজ না করলে অথবা নিন্দিত কাজের আচরণ করলে এবং অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়াসক্ত হলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।


                অকামতঃ কৃতে পাপে প্রায়শ্চিত্তং বিদুর্বুধাঃ।

                কামকারকৃতেহপ্যাহুরেকে শ্রুতিনিদর্শনাৎ \ ১১শ, ৪৫ \

বঙ্গানুবাদ।  ঋষিগণ বলেছেন যে, অজ্ঞানতাবশত কোনো পাপ করলে তার প্রায়শ্চিত্ত আছে। আবার কেউ কেউ শাস্ত্রের প্রমাণ দেখিয়ে বলে থাকেন যে, সজ্ঞানে পাপ করলেও তার প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে।


                অকামতঃ কৃতে পাপং বেদাভ্যাসেন শুধ্যতি।

                কামতস্তু কৃতং মোহাৎ প্রায়শ্চিত্তৈঃ পৃথগ্বিধৈঃ \ ১১শ, ৪৬ \


 বঙ্গানুবাদ।  অজ্ঞানতাবশত যে পাপ হয় বেদপাঠ দ্বারা তার নিরসন ঘটে। কিন্তু সজ্ঞানে ইন্দ্রিয় তাড়নায় পাপের নিরসন প্রায়শ্চিত্ত ব্যতীত হয় না।


                চরিতব্যমতো নিত্যং প্রায়শ্চিত্তং বিশুদ্ধয়ে।


                নিন্দ্যৈর্হি লক্ষণৈর্যুক্তা জায়ন্তেহনিষ্কৃতৈনসঃ \ ১১শ, ৫৪ \

বঙ্গানুবাদ।  তাই পাপ করলে পাপ খণ্ডনের জন্য অবশ্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সে কারণে পাপ কার্যের জন্য সর্বদা প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। অর্থাৎ জেনেশুনে ইচ্ছে করে পাপকাজ করেও প্রায়শ্চিত্ত করলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কোনো কোনো প্রায়শ্চিত্ত শুধুমাত্র ব্রাহ্মণকে দান করেই করা যায়। আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেও করা হয়, সে ক্ষেত্রেও ব্রাহ্মণকে দান এবং দক্ষিণা অবশ্যই দিতে হবে।


ব্রাহ্মণের বিবাহবিধিঃ-


ব্রাহ্মণের বিবাহের বিধানে কী চমৎকার সুযোগসুবিধা রাখা হয়েছে দেখুন।

                সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।

                কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ \ ৩য়, ১২ \

বঙ্গানুবাদ।  দ্বিজবর্ণের প্রথম বিবাহ স্ববর্ণে হওয়াই প্রশস্ত। কিন্তু যারা কামলালসার দ্বারা পরিচালিত হয় তারা ক্রম-নিম্নবর্ণের কাউকে পত্নী হবার জন্য মনোনয়ন করতে পারে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ কামচরিথার্থ করার জন্য যে কোনো বর্ণের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। তাতে তার ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হবে না।

                শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।

                তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ \ ৩য়, ১৩ \


বঙ্গানুবাদ।  শূদ্রের পত্নী হবে শূদ্রানী, বৈশ্যের পত্নী হবে বৈশ্যা ও শূদ্রানী, ক্ষত্রিয়ের পত্নী হবে ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রানী এবং ব্রাহ্মণের পত্নী হবে ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা এবং শূদ্রানী।


                ন ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়য়োরাপদ্যপি হি তিষ্ঠতোঃ।

                কস্মিনংশ্চিদপি বৃত্তান্তে শূদ্রা ভার্যোপদিশ্যতে \ ৩য়, ১৪ \


বঙ্গানুবাদ।  বিপৎকালেও কোনো ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়কে প্রথম স্ত্রী হিসাবে শূদ্রাণীকে গ্রহণ করার উপদেশ দেওয়া হয়নি।

নিম্নলিখিত শ্লোকগুলিতে আবার বিপরীত কথা বলা হয়েছে।

                হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুদ্বহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।

                কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্রতাম্‌ \ ৩য়, ১৫ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি মোহবশত কোনো দ্বিজ হীনবর্ণের কোনো নারীকে বিবাহ করে, তবে তার পুত্র-কন্যাসহ সে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হবে।

                শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্‌।

                জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে \ ৩য়, ১৭ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্রা-গমন করলে ব্রাহ্মণের অধোগতি হয় এবং তাতে সন্তান উৎপাদন করলে তার ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়।

                দৈবপিত্র্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।

                নাশ্নন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি \ ৩য়, ১৮ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্রাণী স্ত্রীসহ যদি কোনো ব্রাহ্মণ পিতৃকর্ম বা দেবলোকের কার্য করে তবে সেই হব্য দেবতা বা পিতৃপুরুষ গ্রহণ করেন না এবং তদ্বারা তার স্বর্গলাভ ঘটে না।

                বৃষলীফেনপীতস্য নিঃশ্বাসোপহতস্য চ।

                তস্যাঞ্চৈব প্রসূতস্য নিষ্কৃতির্ন বিধীয়তে \ ৩য়, ১৯ \

বঙ্গানুবাদ।  যে ব্রাহ্মণ শূদ্রাণীর অধরসুধা পান অর্থাৎ চুম্বন করে ও সেই রমণীর নিশ্বাস তার শরীরে প্রবেশ করে এবং তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে তার মুক্তির কোনো পথ নেই।


ব্রাহ্মণের আহারঃ-


ব্রাহ্মণের অন্যান্য নিচবর্ণের অন্ন গ্রহণের ব্যাপারে কীভাবে ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে তা নিচের শ্লোকগুলিতে দেখুন।

                রাজান্নং তেজ আদত্তে শূদ্রান্নং ব্রহ্মবর্চসম্‌।

                আয়ুঃ সুবর্ণকারান্নং যশশ্চর্মাবকর্তিনঃ \ ৪থর্র্, ২১৮ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজার অন্ন গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণের তেজ নষ্ট হয়, শূদ্রের অন্ন ভোজন করলে ব্রহ্মজ্ঞান নষ্ট হয়, স্বর্ণকারের অন্ন ভোজন করলে আয়ু নষ্ট হয় এবং চর্মকারের অন্ন ভোজনে খ্যাতি লোপ পায়।

                কারুকান্নং প্রজাং হন্তি বলং নির্ণেজকস্য চ।

                গণান্নং গণিকান্নঞ্চ লোকেভ্যঃ পরিকৃন্ততি \ ৪র্থ, ২১৯ \

বঙ্গানুবাদ।  শিল্পকারের অন্ন ভোজনে সন্তান নষ্ট হয়, রজকের অন্ন গ্রহণে বলহানি ঘটে, হোটেলে বা বারবণিতার অন্ন ভোজনে পূণ্যার্জিত স্বর্গ থেকে ভ্রষ্ট হতে হয়।


                পূযং চিকিৎসকস্যান্নং পুংশ্চল্যাস্ত্বন্নমিন্দ্রিয়ম্‌।

                বিষ্ঠা বার্দ্ধুষিকস্যান্নং শস্ত্রবিক্রয়িণো মলম্‌ \ ৪র্থ, ২২০ \

বঙ্গানুবাদ।  চিকিৎসকের অন্নভোজন পূজভক্ষণের সমান, ব্যভিচারিণী স্ত্রীর অন্নভোজন ইন্দ্রিয় অর্থাৎ শুক্রভোজন তুল্য; কূসীদজীবীর অন্নভোজন বিষ্ঠা ভোজনের সমান; এবং শস্ত্রাদি লৌহবিক্রয়ীর অন্নভোজন শ্লেষ্মাদিভোজনের সমান।    


                ভুক্ত্বা ্হতো ্হন্যতমস্যান্নমমত্যা ক্ষপণং ত্র্যহম্‌।

                মত্যা ভুক্ত্বাচরেৎ কৃচ্ছ্রং রেতো বিণ্‌মূত্রমেব চ \ ৪র্থ, ২২২ \

বঙ্গানুবাদ।  অজ্ঞানতাবশত (নিষিদ্ধ অন্ন) ভোজন করলে তিনদিন উপবাস করতে হবে। আর সজ্ঞানে ভোজন করলে কৃচ্ছ্রব্রত পালন করতে হবে এবং রেত, বিষ্ঠা ও মূত্র ভোজনের দ্বারাও প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে।


                জীবিতাত্যয়মাপন্নো যো  ্হন্নমতি যতস্ততঃ।

                আকাশমিব পঙ্কেন ন স পাপেন লিপ্যতে \ ১০ম, ১০৪ \

বঙ্গানুবাদ।  যে ব্রাহ্মণ অন্নাভাবে জীবনসংশয়ে পতিত হয়েছে সে যত্রতত্র অন্নভোজন করলেও তার পাপ হয় না।

অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে সে সকলের অন্নই ভোজন করতে পারে!


                ন ব্রাহ্মণস্য ত্বতিথির্গৃহে রাজন্য উচ্যতে।

                বৈশ্যশূদ্রৌ সখা চৈব জ্ঞতয়ো গুরুরেব চ \ ৩য়, ১১০ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণের গৃহে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র এলে তারা অতিথি বলে গণ্য হবে না। এতদ্ব্যতীত বন্ধু, জ্ঞাতি বা গুরু এলেও অতিথি পদবাচ্য হতে পারে না।


                যদি ত্বতিথিধর্মেণ ক্ষত্রিয়ো গৃহমাব্রজেৎ।

                ভুক্তবৎসূক্তবিপ্রেষু কামং তমপি ভোজয়েৎ \ ৩য়, ১১১ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি ক্ষত্রিয় অতিথিরূপে ব্রাহ্মণের গৃহে আসে তবে ব্রাহ্মণ অতিথিগণের ভোজনের শেষে তাকে ভোজন করাবে।


                বৈশ্যশূদ্রাবপি প্রাপ্তৌ কুটুম্বে  ্হতিথিধর্মিণৌ।

                ভোজয়েৎ সহ ভৃত্যৈস্তাবানৃশংস্যং প্রযোজয়ন্‌ \ ৩য়, ১১২ \


বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণের গৃহে যদি বৈশ্য বা শূদ্র অতিথিরূপে আসে তবে গৃহকর্তা দয়াপরবশ হয়ে তাদের বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গে ভোজন করাবে।


তৃতীয় পরিচ্ছেদ


নারী

মনুর বিধানে নারীকে মিথ্যা এবং অপদার্থ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। নারীকে কোনোরকম স্বাধীনতাই মনু দেননি। নারীর কোনো ধর্মীয় সংস্কার নেই, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণেও তার অধিকার নেই। তার বিদ্যা শেখা, বেদপাঠ বা বেদশ্রবণেরও অধিকার নেই।


                অমন্ত্রিকা তু কার্যেয়ং স্ত্রীণামাবৃদশেষতঃ।

                সংস্কারার্থং শরীরস্য যথাকালং যতাক্রমম্‌ ।  ২য়, ৬৬ \


বঙ্গানুবাদ।  নারীদের দেহশুদ্ধির জন্য উপনয়ন বাদে সমস্ত সংস্কারই যথাসময়ে করা উচিত। তবে এ সমস্ত সংস্কারে মন্ত্র প্রয়োগ করা যাবে না।

                বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ।

                পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া \ ২য়, ৬৭ \

বঙ্গানুবাদ।  বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন ও পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্মই হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।

                স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম্‌।

                অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ \ ২য়, ২১৩ \

বঙ্গানুবাদ।  ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব। সুতরাং পণ্ডিত ব্যক্তিরা সর্বদা নারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।


                অবিদ্বাংসমলং লোকে বিদ্বাংসমপি বা পুনঃ।

                প্রমদা হু্যৎপথং নেতুং কামক্রোধবশানুগম্‌ \ ২য়, ২১৪ \


বঙ্গানুবাদ।  সংসারে সকলেই কাম ও ক্রোধের বশীভূত। তাই বিদ্বানই হোন বা মূর্খই হোন নারীগণ তাঁদের অনায়াসে বিপথগামী করতে পারে।

                মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ।

                বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি \ ২য়, ২১৫ \

বঙ্গানুবাদ।  মাতা, ভগিনী ও কন্যা প্রভৃতির সঙ্গেও নির্জন গৃহে একত্রে থাকা সমীচীন নয়। ইন্দ্রিয় সকল এত বলবান যে তারা জ্ঞানবান লোকেরও চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে।


                বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।

                ন স্বাতন্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ গৃহেষ্বপি \ ৫ম, ১৪৭ \

বঙ্গানুবাদ।  নারী বালিকাই হোক, যুবতীই হোক বা বৃদ্ধাই হোক- গৃহমধ্যে হলেও সে স্বাধীনভাবে কোনো কার্যই করতে পারবে না।

                বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে।

                পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্‌ \ ৫ম, ১৪৮ \


বঙ্গানুবাদ।  বাল্যকালে নারী পিতার অধীন থাকবে, বিবাহের পর সে স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রের অধীনে থাকবে। নারী কখনও স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে না।


                পিত্রা ভর্ত্রা সুতৈর্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।

                এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্যাদুভে কুলে \ ৫ম, ১৪৯ \

বঙ্গানুবাদ।  নারী কখনও তার পিতা বা স্বামী বা পুত্রের থেকে আলাদা থাকবে না। তা হলে সে তার পিতৃকুল ও পতিকুল উভয়কুলকেই কলঙ্কিত করে তুলবে।


                বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।

                উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ \ ৫ম, ১৫৪ \

বঙ্গানুবাদ।  পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতোই পূজা করবে।


                নাস্তি স্ত্রীণাং পৃথগ্‌ যজ্ঞো ন ব্রতং নাপ্যুপোষিতম্‌।

                পতিং শুশ্রূষতে যেন তেন স্বর্গে মহীয়তে \ ৫ম, ১৫৫ \

বঙ্গানুবাদ।  স্ত্রীর স্বামী ছাড়া পৃথক সত্তা নেই।  পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই। নারী স্বর্গে যেতে পারে একমাত্র স্বামীসেবার মাধ্যমেই।


                বন্ধ্যাষ্টমে  ্হধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।

                একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্ত্বপ্রিয়বাদিনী \ ৯ম, ৮১ \

বঙ্গানুবাদ।  স্ত্রী নিঃসন্তান হলে বিয়ের অষ্টম বৎসরে, মৃতবৎসা হলে দশম বৎসরে, শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্ম দিলে একাদশ বৎসরে এবং অপ্রিয়বাদিনী হলে সদ্য সদ্য তাকে ত্যাগ করে পুনরায় বিবাহ করা যায়। 

সন্তান জন্ম দেওয়ার অক্ষমতার জন্য স্বামীকে দোষারোপ বা ত্যাগ করার কোনো বিধান কিন্তু মনু দেননি।


                অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দিবানিশম্‌।

                বিষয়েষু চ সজ্জন্তঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে \ ৯ম, ২ \

বঙ্গানুবাদ।  স্বামী এবং পরিবারের পুরুষগণ স্ত্রীলোকদের দিবারাত্র কখনও স্বাধীনভাবে থাকতে দেবে না। সংগত ভোগের মাধ্যমে তাদের সর্বদা বশীভূত করে রাখবে।


                পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।

                রক্ষন্তি স্হবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি \ ৯ম, ৩ \

বঙ্গানুবাদ।  কুমারী অবস্থায় সে পিতার, যৌবনকালে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রগণের রক্ষণাবেক্ষণে থাকবে। নারী কখনও স্বাধীনভাবে থাকার যোগ্য নয়।


                সূক্ষ্মেভ্যোহপি প্রসঙ্গেভ্যঃ স্ত্রিয়ো রক্ষ্যা বিশেষতঃ।

                দ্বয়োর্হি কুলয়োঃ শোকমাবহেয়ুররক্ষিতাঃ \ ৯ম, ৫ \

বঙ্গানুবাদ।  যে কোনো ধরণের কুসঙ্গ থেকে নারীকে যত্নসহকারে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সে স্বামীর এবং পিতার উভয় কুলের দুঃখের কারণ হবে।

                উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ।


                অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাদ্‌ যথাবিধি \ ৯ম, ৮৮ \

বঙ্গানুবাদ।  বিবাহযোগ্য বয়স না হলেও সমজাতীয় উৎকৃষ্ট ও সুদর্শন বর পাওয়া গেলে কন্যার পিতা তার কন্যাকে যথাবিহিত ভাবে সমপ্রদান করবেন।


                নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্হিতিঃ।

                সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে \ ৯ম, ১৪ \

বঙ্গানুবাদ।  নারী রূপ বিচার করে না, বয়স সম্পর্কেও তাদের বাছবিচার নেই। সুরূপ বা কুরূপ, পুরুষ পেলেই নারী তাকে ভোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।


                পৌংশ্চলাচ্চলচিত্তাচ্চ নৈঃস্নেহ্যচ্চ স্বভাবতঃ।

                রক্ষিতা যত্নতোহপীহ ভর্তৃষ্বেতা বিকুর্বতে \ ৯ম, ১৫ \

বঙ্গানুবাদ।  পুরুষ দর্শনেই ভোগমত্ততা হেতু নারী চঞ্চলচিত্তা ও স্নেহশূন্যা। এজন্য স্বামী কর্তৃক সুরক্ষিতা হলেও তারা স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে থাকে।


                এবং স্বভাবং জ্ঞাত্বা স্বাং প্রজাপতিনিসর্গজম্‌।

                পরমং যত্নমাতিষ্ঠেৎ পুরুষো রক্ষণং প্রতি \ ৯ম, ১৬ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রজাপতি কর্তৃক নারীদের স্বভাব এরূপভাবে সৃষ্ট হয়েছে। এ কথা জেনে স্বামী তাকে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং তার প্রতি সদা সতর্ক থাকবে।


                শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জবম্‌।

                দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ \ ৯ম,১৭ \

বঙ্গানুবাদ।  সৃষ্টিকালেই মনু নারীর স্বভাবের মধ্যে শয্যা অর্থাৎ বেশি নিদ্রা যাওয়া, উপবেশন অর্থাৎ বসে থাকার ইচ্ছা, অলঙ্কারপ্রিয়, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙক্ষা, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা এবং কুচর্যা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা- এগুলির প্রতি দারুণ আসক্তি স্থাপন করেছেন।


                নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্হিতিঃ।

                নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্হিতিঃ \ ৯ম, ১৮ \

বঙ্গানুবাদ।  স্ত্রীলোকদের সংস্কার বেদমন্ত্র ব্যতীত সম্পন্ন হবে। এ জন্য তাদের চিত্তশুদ্ধি ঘটে না। তাদের কোনো শাস্ত্রজ্ঞান হবে না, যেহেতু তাদের বেদপাঠে অধিকার নেই। তারা মন্ত্রহীন, তাই তাদের দেহ পাপস্পর্শ থেকে কখনও মুক্ত হতে পারে না।  তাই তারা মিথ্যার মতই অপবিত্র।


                সদা প্রহূষ্টয়া ভাব্যং গৃহকার্যেষু দক্ষয়া।

                সুসংস্কৃতোপস্করয়া ব্যয়ে চামুক্তহস্তয়া \ ৫ম, ১৫০ \

বঙ্গানুবাদ।  নারী সর্বদাই হৃষ্টচিত্তে কালযাপন করবে, গৃহকার্যে দক্ষ হবে, সংসারের সমস্ত জিনিসপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং খরচের ব্যাপারে মিতব্যয়ী হবে।


                যস্মৈ দদ্যাৎ পিতা ত্বেনাং ভ্রাতা বানুমতে পিতুঃ।

                তং শুশ্রূষেত জীবন্তং সংস্হিতং চ ন লঙঘয়েৎ \ ৫ম, ১৫১ \

বঙ্গানুবাদ।  পিতা অথবা পিতার অনুমতিক্রমে ভ্রাতা যাকে দান করেছে সেই পতির জীবিতকাল পর্যন্ত তাকে সেবা করা এবং মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে অসম্মান না করা নারীর কর্তব্য।


                অনৃতাবৃতুকালে চ মন্ত্রসংস্কারকৃৎ পতিঃ।

                সুখস্য নিত্যং দাতেহ পররোকে চ যোষিতঃ \ ৫ম, ১৫৩ \

বঙ্গানুবাদ।  মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা বিবাহিত পতি তার পত্নীর ঋতুকালে বা ঋতুভিন্ন-কালে, ইহকালে বা পরকালে সর্বদাই পত্নীর একমাত্র সুখদাতা।


                পাণিগ্রাহস্য সাধ্বী স্ত্রী জীবতো বা মৃতস্য বা।

                পতিলোকমভীপ্সন্তী নাচরেৎ কিঞ্চিদপ্রিয়ম্‌ \ ৫ম, ১৫৬ \

বঙ্গানুবাদ।  সাধ্বী স্ত্রী যদি পতিলোক লাভ করতে ইচ্ছা করে তা হলে যে ব্যক্তি তার পাণিগ্রহণ করেছে তার জীবিতকালে বা মৃত্যুর পরে তার কোনো অপ্রিয় কাজ সে করবে না।


                কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।

                ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু \ ৫ম, ১৫৭ \

বঙ্গানুবাদ।  পতির মৃত্যুর পর বিধবা নারী পবিত্র ফুল, ফল ও মূল আহার করে দেহপাত করবে। কিন্তু কখনও অন্য পুরুষের কথা চিন্তাও করবে না।

                অপত্যলোভাদ্‌ যা তু স্ত্রী ভর্তারমতিবর্ততে।

                সেহ নিন্দামবাপ্নোতি পতিলোকাচ্চ হীয়তে \ ৫ম, ১৬১ \

বঙ্গানুবাদ।  যে বিধবা পুত্র লোভে অন্য পুরুষে ব্যভিচারিণী হয় সে ইহলোকে নিন্দনীয় হবে এবং পরকালে পতিলোক থেকে বঞ্চিতা হবে।


                নান্যোৎপন্না প্রজাস্তীহ ন চাপ্যন্যপরিগ্রহে।

                ন দ্বিতীয়শ্চ সাধ্বীনাং ক্কচিদ্ভর্তোপদিশ্যতে \ ৫ম, ১৬২ \

বঙ্গানুবাদ।  স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষ কর্তৃক উৎপাদিত পুত্র অথবা সহধর্মিনী ভিন্ন অপরের স্ত্রীতে উৎপাদিত পুত্রকে শাস্ত্রকারগণ পুত্র বলে স্বীকার করেন না।  সাধ্বী রমণীর দ্বিতীয় পতি গ্রহণের কোনো নির্দেশ নেই।


                ন নিষ্ক্রয়বিসর্গাভ্যাং ভর্তুর্ভার্যা বিমুচ্যতে।

                এবং ধর্মং বিজানীমঃ প্রাক্‌ প্রজাপতিনির্মিতম্‌ \ ৯ম, ৪৬ \

বঙ্গানুবাদ।  বিক্রয় বা ত্যাগ করলেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয় না। প্রজাপতি কর্তৃক এটাই ধর্ম বলে ঘোষিত হয়েছে।


                ত্রিংশদ্বর্ষোদ্বহেৎ কন্যাং হূদ্যাং দ্বাদশবার্ষিকীম্‌।

                ত্র্যষ্টবর্ষোহষ্টবর্ষাং বা ধর্মে সীদতি সত্বরঃ \ ৯ম, ৯৪ \

বঙ্গানুবাদ।  তিরিশ বৎসর বয়স্ক একজন পুরুষ পছন্দমত বারো বৎসর বয়স্কা বালিকাকে অথবা চতুর্বিংশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ অষ্টম বর্ষীয়া বালিকাকে বিবাহ করবে।


                ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ।

                প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুলেন বা \ ৮ম, ২৯৯ \

বঙ্গানুবাদ।  স্ত্রী, পুত্র, দাস, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদর ভ্রাতা অপরাধ করলে তাকে রজ্জু (চাবুক) অথবা বংশদণ্ড দ্বারা প্রহার হরতে হবে।


                অমন্ত্রিকা তু কার্যেয়ং স্ত্রীণামাবৃদশেষতঃ।

                সংস্কারার্থং শরীরস্য যথাকালং যথাক্রমম্‌ \ ২য়, ৬৬ \

বঙ্গানুবাদ।  উপনয়ন বাদে স্ত্রীলোকদের দেব-সংস্কারের নিমিত্ত জাত-কর্মাদির অনুষ্ঠান করা যাবে, তবে সে সব অনুষ্ঠানে কোনো রূপ বেদমন্ত্র পাঠ করা যাবে না।

                বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ।

                পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া \ ২য়, ৬৭ \


বঙ্গানুবাদ।  বিবাহণ্ডসংস্কারই স্ত্রীলোকদের বৈদিক সংস্কার, বিবাহের পর পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস, স্বামীর গৃহস্থালীর সমস্ত কাজই হল অগ্নিপরিচর্যা।

উপরোক্ত শ্লোকগুলি ছাড়াও আরও বিভিন্ন শ্লোকে নারীদের সম্পর্কে যেসব্ন বিধান দেওয়া হয়েছে সেগুলি হলঃ-

নারীর বেদপাঠে কোনো অধিকার নেই। নারীর কোনো সম্পত্তির অধিকার নেই। বেদ-কথিত দৈনিক যজ্ঞাহুতি মহিলারা দিতে পারবে না। এটা করলে সে নরকে যাবে। নারী প্রদত্ত যজ্ঞের খাদ্য ব্রাহ্মণ গ্রহণ করবে না। নারীর দেওয়া দান অশুদ্ধ, ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন না। স্বামী ছাড়া নারী কোনো আত্মত্যাগ, প্রতিজ্ঞা, অনশন পালন করবে না। মন্ত্রপাঠ করে নারীর প্রায়শ্চিত্ত করার অধিকারও নেই। স্ত্রী স্বামীর আজ্ঞাবহ থাকলে, সে স্বর্গে আরোহণ করবে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ


শূদ্র

           মঙ্গল্যং ব্রাহ্মণস্য স্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য বলান্বিতম্‌।

                বৈশ্যস্য ধনসংযুক্তং শূদ্রস্য তু জুগুপ্সিতম্‌ \ ২য়, ৩১ \

বঙ্গানুবাদ।  একজন ব্রাহ্মণের নাম শুভার্থক, ক্ষত্রিয়ের নাম শৌর্যার্থক, বৈশ্যের নাম সম্পদার্থক ও একজন শূদ্রের নাম ঘৃণার্হ হতে হবে।

                শর্মবদ্বাহ্মণস্য স্যাদ্‌ রাজ্ঞো রক্ষাসমন্বিতম্‌।

                বৈশ্যস্য পুষ্টিসংযুক্তং শূদ্রস্য প্রৈষ্যসংযুতম্‌ \ ২য়,৩২ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণের নামের সাথে (মঙ্গলবাচক) ‘শর্মা’, ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে (রক্ষাবাচক) ‘বর্মা’, বৈশ্যের নামের সাথে (পুষ্টিবাচক) ‘গুপ্ত’ এবং শূদ্রের নামের সাথে (প্রৈষ্য বা ভৃত্যবাচক) ‘দাস’ ইত্যাদি উপপদ যুক্ত হবে।


                একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।

                এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া \ ১ম, ৯১ \

বঙ্গানুবাদ।  প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন- তা হল কোনো অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে অন্য তিন বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) শুশ্রূষা অর্থাৎ সেবা করা।

                বাণিজ্যং কারয়েদ্বৈশ্যং কুসীদং কৃষিমেব চ।

                পশূনাং রক্ষণঞ্চৈব দাস্যং শূদ্রং দ্বিজন্মনাম্‌ \ ৮ম, ৪১০ \

বঙ্গানুবাদ।  রাজা বৈশ্যকে বাণিজ্য, কুসীদ, কৃষি ও পশুপালনের কাজে এবং শূদ্রকে উচ্চতর তিন বর্ণের সেবার কাজে নিযুক্ত করবে।

                শূদ্রং তু কারয়েদ্‌ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।          

                দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা \ ৮ম, ৪১৩ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্রীত বা অক্রীতই হোক শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবে। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

                বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।

                তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ \ ৮ম, ৪১৮ \


বঙ্গানুবাদ।  রাজা বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে বৈশ্য ও শূদ্রকে তাদের বর্ণোচিত কার্য করাবে। কারণ এর ব্যতিক্রম হলে সংসারে নানাপ্রকার বিশৃঙখলা দেখা দেবে।


               ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবিষ্কৃতম্‌।

                ন চাস্যোপদিশেদ্‌ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ \ ৪র্থ, ৮০ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্রকে কোনো উপদেশ দেবে না, অথবা যজ্ঞের খাদ্যাবশিষ্ট অথবা নিবেদিত মাখন দেবে না এবং তাকে কেউ আইন শেখাবে না। অথবা ধর্মীয় প্রকরণ তাকে দিয়ে করাবে না।


                যো হ্যস্য ধর্মমাচষ্টে যশ্চৈবাদিশতি ব্রতম্‌।

                সোহসংবৃতং নাম তমঃ সহ তেনৈব মজ্জতি \ ৪র্থ, ৮১ \

বঙ্গানুবাদ।  যে তাকে আইন শেখাবে অথবা তাকে দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করাবে সে সেই শূদ্রের সঙ্গে অসম্বৃত নামক নরকের অন্ধকারে ডুবে যাবে।

                শূদ্রাণাং মাসিকং কার্যং বপনং ন্যায়বর্তিনাম্‌।

                বৈশ্যবচ্ছৌচকল্পশ্চ দ্বিজোচ্ছিষ্টঞ্চ ভোজনম্‌ \ ৫ম, ১৪০ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ-শুশ্রূষাপরায়ণ শূদ্র মাসে মাসে মস্তক মুণ্ডন করবে। জনমে মরণে বৈশ্যের ন্যায় অশৌচ গ্রহণ করবে এবং ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট ভোজন করবে।

                যস্য শূদ্রস্তু কুরুতে রাজ্ঞো ধর্মবিবেচনম্‌।

                তস্য সীদতি তদ্রাষ্ট্রং পঙ্কে গৌরিব পশ্যতঃ \ ৮ম, ২১ \

বঙ্গানুবাদ।  বিচারসভায় যে রাজার সাক্ষাতে শূদ্র ন্যায়-অন্যায় ধর্ম বিচার করে, সেই রাজ্য কাদায় নিমগ্ন গোরুর মত দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়।


                শতং ব্রাহ্মণমাক্রুশ্য ক্ষত্রিয়ো দণ্ডমর্হতি।

                বৈশ্যোহপ্যর্দ্ধশতং দ্বে বা শূদ্রস্তু বধমর্হতি \ ৮ম, ২৬৭ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে রূঢ় ভাষায় গালাগালি দেয় তবে তার দণ্ড হবে একশত পণ, বৈশ্যের ক্ষেত্রে দণ্ড হবে দেড়শত পণ এবং শূদ্র হলে তাকে দৈহিক শাস্তি দিতে হবে।


                পঞ্চাশদ্‌ ব্রাহ্মণো দণ্ড্যঃ ক্ষত্রিয়স্যাভিশংসনে।

                বৈশ্যে স্যাদর্দ্ধপঞ্চাশৎ শূদ্রে দ্বাদশকো দমঃ \ ৮ম, ২৬৮ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়কে গালাগালি দেয় তবে তার শাস্তি হবে পঞ্চাশ পণ, বৈশ্যকে গালাগালি দিলে দণ্ড হবে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রকে দিলে দণ্ড হবে মাত্র বারো পণ।

                একজাতির্দ্বিজাতীংস্তু বাচা দারুণয়া ক্ষিপন্‌।

                জিহ্বায়াঃ প্রাপ্নুয়াচ্ছেদং জঘন্যপ্রভবো হি সঃ \ ৮ম, ২৭০ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি কোনো একজাতি অর্থাৎ শূদ্র দ্বিজবর্ণের কোনো লোককে কঠোর বাক্যের দ্বারা গালি দেয়, তাহলে তার জিহ্বা কেটে ফেলা উচিত, কারণ সে নিকৃষ্ট স্থান থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

                নামজাতিগ্রহং ত্বেষামভিদ্রোহেণ কুর্বতঃ।

                নিক্ষেপ্যোহুয়োময়ঃ শঙ্কুজর্বলন্নাস্যে দশাঙ্গুলঃ \ ৮ম, ২৭১ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি সে অপমানজনকভাবে তাদের নাম বা বর্ণের উচ্চারণ করে তা হলে দশ আঙুল লম্বা লাল উত্তপ্ত লৌহশলাকা তার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।

                ধর্মোপদেশং দর্পেণ বিপ্রাণামস্য কুর্বতঃ।

                তপ্তমাসেচয়েৎ তৈলং বক্ত্রে শ্রোত্রে চ পার্থিবঃ \ ৮ম, ২৭২ \


বঙ্গানুবাদ।  যদি ঔদ্ধত্যের বশে সে পুরোহিতদের তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দেয় তা হলে (রাজা) তার মুখের ও কানের ভিতর ফুটন্ত গরম তেল ঢেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

                যেন কেনচিদঙ্গেন হিংস্যাচ্চেৎ শ্রেষ্ঠমন্ত্যজঃ।

                ছেত্তব্য তত্তদেবাস্য তন্মনোরনুশাসনম্‌ \ ৮ম, ২৭৯ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্র যে অঙ্গের দ্বারা ব্রাহ্মণকে আঘাত করবে (রাজা) তার সেই অঙ্গ ছেদন করবে এটাই মনুর বিধান।


                পাণিমুদ্যম্য দণ্ডং বা পাণিচ্ছেদনমর্হতি।

                পাদেন প্রহরন্‌ কোপাং পাদরচ্ছদনমর্হতি \ ৮ম, ২৮০ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্র যদি দ্বিজবর্ণের কারও প্রতি আঘাত করার উদ্দেশ্যে হাত বা পা তোলে তবে রাজা যথাক্রমে তার হাত বা পা ছেদন করবে।

                সহাসনমভিপ্রেপ্সু রুৎকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজঃ।

                কট্যাং কৃতাঙ্কো নির্বাস্যঃ স্ফিচং বা  ্হস্যাবকর্তয়েৎ \ ৮ম, ২৮১ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি কোনো শূদ্র ব্যক্তি ব্রাহ্মণের সঙ্গে একই আসনে বসে তাহলে তার কোমরে ছেঁকা লাগিয়ে দাগ দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে কিংবা  তার পাছা খানিকটা কেটে দেবে।

                অবনিষ্ঠীবতো দর্পাদ্দ্বাবোষ্ঠৌ ছেদয়েন্নৃপঃ।

                অবমূত্রয়তো মেঢ্রমবশর্দ্ধয়তো গুদম্‌ \ ৮ম, ২৮২ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি ঔদ্ধত্যবশত সে (শূদ্র) ব্রাহ্মণকে থুথু দেয় তা হলে রাজা তার দু’টি ঠোঁট, যদি সে তার দেহের উপর প্রস্রাব করে তাহলে তার লিঙ্গ এবং যদি তার উপর পায়ুবায়ু ত্যাগ করে তা হলে তার গুহ্যদ্বার কেটে দেবে।

                কেশেষু গৃহ্নতো হস্তৌ ছেদয়েদবিচারয়ন্‌।

                পাদয়োর্দার্ঢ়িকায়াঞ্চ গ্রীবায়াং বৃষণেষু চ \ ৮ম, ২৮৩ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি কোনো শূদ্র ব্রাহ্মণের চুল ধরে টানে, কিংবা পা, দাড়ি, গ্রীবা কিংবা অণ্ডকোষ ধরে টানে, তাহলে রাজা তৎক্ষণাৎ তার দু’টি হাত কেটে ফেলার ব্যবস্থা করবে।

                ব্রাহ্মণান্‌ বাধমানন্তু কামাদবরবর্ণজম্‌।

                হন্যাচ্চিত্রৈর্বধোপায়ৈরুদ্বেজনকরৈর্নৃপঃ \ ৯ম, ২৪৮ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি কোনো শূদ্র ইচ্ছাপূর্বক ব্রাহ্মণকে শারীরিক ও আর্থিক পীড়া দেয়, তা হলে অতি কষ্টপ্রদ নানা উদ্বেগজনক উপায়ে (যেমন শূলে চড়িয়ে, মস্তক ছেদন করে দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে) সেই শূদ্রকে বধ করবে।

               

শূদ্রং তু কারয়েদ্‌ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।

                দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টো  ্হসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা \ ৮ম, ৪১৩ \

বঙ্গানুবাদ।  ক্রীত হোক বা অক্রীত হোক শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ সেবা করিয়ে নেবে। যেহেতু শূদ্রকে বিধাতা ব্রাহ্মণদের সেবা করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন।


                ন স্বামিনা নিসৃষ্টো ্হপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।

                নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি \ ৮ম, ৪১৪ ।

বঙ্গানুবাদ।  তার প্রভু যদি তাকে মুক্ত করেও দেয় তবুও সে সেবা করা থেকে মুক্তি পাবে না। কারণ, সেবা তার সহজাত ধর্ম। সুতরাং কে তাকে সেবা থেকে মুক্ত করতে পারে?


                শুচিরুৎকৃষ্টশুশ্রূষুর্মৃদুবাগনহঙ্কৃতঃ।

                ব্রাহ্মণাদ্যাশ্রয়ো নিত্যমুৎকৃষ্টাং জাতিমশ্নুতে \ ৯ম, ৩৩৫ \

বঙ্গানুবাদ।  যদি সে (শূদ্র) পবিত্র, উচ্চবর্ণের প্রতি অনুগত, মৃদুভাষী, নিরহঙ্কারী এবং সর্বদা ব্রাহ্মণের প্রতি বিনীত থাকে তাহলে সে পরজন্মে উচ্চবর্ণে জন্মগ্রহণ করে।


                শূদ্রস্তু বৃত্তিমাকাঙক্ষেৎ ক্ষত্রমারাধয়েদ্‌ যদি।

                ধনিনং বাপ্যুপারাধ্য বৈশ্যং শূদ্রো জিজীবিষেৎ \ ১০ম, ১২১ \

বঙ্গানুবাদ।  শূদ্র জীবিকার্জনের জন্য ক্ষত্রিয়ের সেবা করতে পারে। অথবা তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কোনো ধনী বৈশ্যের সেবা করতে পারে।


                স্বর্গার্থমুভয়ার্থং বা বিপ্রানারাধয়েত্তু সঃ।

                জাতব্রাহ্মণশব্দস্য সা হ্যস্য কৃতকৃত্যতা \ ১০ম, ১২২ \

বঙ্গানুবাদ।  কিন্তু সে কোনো ব্রাহ্মণের সেবা করবে শুধু স্বর্গলাভের জন্য অথবা স্বর্গলাভ এবং জীবন ধারণের জন্য। কারণ ব্রাহ্মণ শব্দ উচ্চারণের দ্বারাই সবকিছু লাভ হয় এবং ইহাই তার করা উচিত।


                বিপ্রসেবৈব শূদ্রস্য বিশিষ্টং কর্ম কীর্ত্যতে।

                যদতো  ্হন্যদ্ধি কুরুতে তদ্ভবত্যস্য নিষ্ফলম্‌ \ ১০ম, ১২৩ \

বঙ্গানুবাদ।  শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ সেবাই একজন শূদ্রের সবচেয়ে ভাল জীবিকা। কারণ, এ ছাড়া আর যা কিছু সে করে তা নিষ্ফল।


                উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।

                পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ \ ১০ম, ১২৫।

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন ও জীর্ণণ্ডপরিত্যক্ত বস্ত্র, ধানের পুলাক অর্থাৎ অসার ধান এবং পুরানো জীর্ণ পরিচ্ছদ অর্থাৎ আসবাবপত্র তাকে (শূদ্রকে) দেবে।


                ন ব্রাহ্মণস্য ত্বতিথির্গৃহে রাজন্য উচ্যতে।

                বৈশ্যশূদ্রৌ সখা চৈব জ্ঞাতয়ো গুরুরেব চ \ ৩য়, ১১০ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণের গৃহে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র এলে তারা অতিথি বলে গণ্য হবে না। এতদ্ব্যতীত বন্ধু, জ্ঞাতি বা গুরু এলেও অতিথি পদবাচ্য হতে পারে না।


                বৈশ্যশূদ্রাবপি প্রাপ্তৌ কুটুম্বেহতিথিধর্মিণৌ।

                ভোজয়েৎ সহ ভৃত্যৈস্তাবানৃশংস্যং প্রয়োজনম্‌ \ ৩য়, ১১২ \

বঙ্গানুবাদ।  ব্রাহ্মণের গৃহে যদি বৈশ্য বা শূদ্র অতিথিরূপে আসে তবে গৃহকর্তা দয়াপরবশ হয়ে তাদের বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গে ভোজন করাবে।


                উত্তমাং সেবমানস্তু জঘন্যো বধমর্হতি।

                শুল্কং দদ্যাৎ সেবমানঃ সমামিচ্ছেৎ পিতা যদি \ ৮ম, ৩৬৬ \

বঙ্গানুবাদ।  নিম্নবর্ণের পুরুষ যদি উচ্চবর্ণের নারীর সঙ্গে তার ইচ্ছা অনুসারেও সম্ভোগ করতে থাকে তা হলে সেই পুরুষের বধদণ্ড হবে। কিন্তু সমজাতীয় কন্যার সাথে ওই রকম করলে সে ওই কন্যার পিতাকে শুল্ক দেবে, যদি তার পিতা ওই শুল্ক নিতে ইচ্ছুক হয়।


                শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্‌।


                অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে \ ৮ম, ৩৭৪ \

বঙ্গানুবাদ।  কোনো শূদ্র যদি দ্বিজ-জাতির কোনো নারীর সঙ্গে বসবাস করে এবং সেই নারীর অভিভাবক থাক বা না থাক তাহলে তার নিম্নাঙ্গ কেটে ফেলা (লিঙ্গচ্ছেদন) হবে এবং তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে।


                বিস্রব্ধং ব্রাহ্মণঃ শূদ্রাদ্‌ দ্রব্যোপাদানমাচরেৎ

                ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ \ ৮ম, ৪১৭ \

বঙ্গানুবাদ।  একজন ব্রাহ্মণ নিশ্চিত মনে একজন শূদ্রের জিনিস নিয়ে নিতে পারে, কারণ শূদ্রের নিজস্ব বলে কিছু নেই, তার প্রভু তার সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে নিতে পারে।


                শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।

                শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে \ ১০ম, ১২৯ \

বঙ্গানুবাদ।  সক্ষম হলেও শূদ্র কোনো সম্পদ সঞ্চয় করবে না। কারণ, ধনগর্বে শূদ্র ব্রাহ্মণকে অপমান করতে পারে।

শূদ্র সম্পর্কে আরও বিধান দিয়েছেন মনু- শূদ্রের উপস্হিতিতে কখনও বেদ পাঠ করবে না। শূদ্রের ঈশ্বরের অনুগ্রহলাভের অধিকার নেই ইত্যাদি।


এই পুস্তিকা রচনায় যে যে বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছেঃ-

১।     বাবাসাহেব ড: আম্বেদকর রচনাসম্ভার, ৭ম খণ্ড,

        প্রকাশকঃ ড: আম্বেদকর ফাউণ্ডেশন,

        কল্যাণ মন্ত্রক, ভারত সরকার, নতুন দিল্লি - ১১০ ০০১।


২।     মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত মনুসংহিতা

 প্রকাশকঃ সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ৩৮, বিধান সরণী, কলকাতা - ৭০০ ০০৬।

কবিতাগুচ্ছ ৯ -কবিরা
Nov. 19, 2024 | কবিতা | views:884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিদ্রোহের দিন

-ঋতম সানা


বাতাসে ভাসছে আজ দেখি মুক্তির সুবাস

ভেঙে সকল বিভেদের শেকল, উঠছে গড়ে মানববন্ধন

জীবনের পঙক্তি যারা লিখবে নতুন করে

ছুয়েও যেতে পারে রামধনু আকা ঐ মুক্ত গগণ


যেই শোষকের শেষকথা ওদের নিকট ভাগ্যের পরিহাস

শুরু থেকে শেষ তাদেরই কব্জায় যখন বদ্ধ জীবন

মৌনতার ব্রত ভেঙে আজকে দেখি নিদ্রাহীন সব চোখ

প্রতিবাদের উন্মাদ সুরে নেচে উঠেছে দেখি সকল মন কেমন


আজ দূর থেকে দেখি পরিবর্তনের পদধ্বনী

একত্রিত সকল অস্তিত্বের নতুন করে লড়াইয়ে নামা

মিছিল স্লোগান প্রতিরোধের আহবান চারিপাশে

রণহুংকারী ঐ লাল চোখ, ভাঙা চোয়াল, শীর্ণ কলেবর, কীভাবে দিচ্ছে হানা

মানবে না বাধা, হাটাও সকল মন ভোলানো কথা

জ্বেলে স্পর্ধার মশাল, ছিড়ে গোলামির দড়ি

এগিয়ে আসে সংকল্প, ফেলে সকল বাহানা


রোজ রোজ দেখি ভাঙছে জীর্ণ সংস্কার

দুর্লভ রুটি অন্নও আজ দু’হাতে মেটাচ্ছে আহার

আজ চকিত ঐ সিংহাসন, ছিন্নভিন্ন রাজশাসন

কোথায় বড়বাবুদের সাহসী ভাষণ

আজ গুটিয়েছে পাত্তারি শোষনের কারবার



আজ নাকি বিদ্রোহের দিন, চলছে মহোতসব ক্লান্তিবিহীন

সকল ব্যর্থতা ভুলে এই সমাজের প্রকৃত মানে, আজ নতুন ছন্দে আসীন

জড়োসড়ো প্রথা, মিথ্যা রীতিনীতি ভুলে সকল নবীন

আজ মেটাবে বঞ্চিত সকল জঠরের ঋণ


চলে যাবো দেখে শেষ পরিণতি, এই শেষ রজনীর

শুনি বিদ্রোহীদের মহাভাষ্য, দেখি বিকৃত সভ্যতা ধ্বংসের কাহিনী

আমি দেখি এবার বদলের ইতিহাসে,

উঠবে নতুন ভোরের শপথে রাঙা সূর্য আগামীর



তখন প্রতিটা দিন শিশুদিবস প্রতিটা অসহায় শিশুর জন্য

ক্ষুধা, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা, দারিদ্রের মহামারী মুক্ত

সকল মাতৃক্রোড় হতে তখন, এক নতুন সভ্যতা নেবে জন্ম



দধীচির ন্যায় যে গরিবগুলোর জ্বলেছিল হাড়

আজ এই নতুন সমাজের শেকড়ে সাড়, ওদেরই ছাইভস্ম

শোনা যাবে শব্দ সকল ক্ষমতাধারীর আত্মসমর্পণ অতন্দ্র,

ঝোকাবে মাথা এদের সামনেই এই বিছিন্ন বিশ্বসমগ্র

আড়ি


-প্রদীপ চক্রবর্তী



কৃষকের লাঙ্গল-কাস্তে,

শ্রমিকের হাতুড়ি।

রাজমিস্তিরির হাতের কলায়

গড়ে ওঠে ঘরবাড়ি।



আমরা বসে মৌজ করি,

পাওনা গন্ডার হিসাব।

সভ্যতার মুখে ছড়াই,

অসভ্যতার তেজাব।



ওরা কাজ করে নগর প্রান্তরে,

আমরা খাচ্ছি মাখন,

চুনকালির দাগ তুলব বলে

মুখে ঘষছি বেসন।



সর্বহারা ঘোরায় চাকা,

আমরা চড়ি গাড়ি।

ভগবানের দোহাই দিয়ে

যুক্তির সঙ্গে আড়ি।

বইয়ের পাতার গন্ধ -দেবব্রত দাস
Nov. 19, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:477 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একেক মানুষ এই গন্ধটিকে একেকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। কারো কাছে এটি শুধুই পুরনো কাগজের গন্ধ। কারও কাছে এই গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে পুরনো স্মৃতি। কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে? এই সুগন্ধের পেছনে রয়েছে শত শত জৈবিক উদ্বায়ী (volatile organic compound, VOC) পদার্থ। বইয়ের কাগজ, কালি, আঠা সবকিছুর মাঝে থাকে এসব উদ্বায়ী পদার্থ | সময়ের সাথে সাথে এসব রাসায়নিক ভাংতে থাকে আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ সেই গন্ধ | নতুন বইয়ের মাঝেও কিন্তু এক ধরণের গন্ধ থাকে। বই কেনার পর এর পাতায় নাক ডুবিয়ে দেখতে পারেন। কিন্তু তার সাথে পুরনো বইয়ের গন্ধের বিস্তর ফারাক।


        বই তৈরিতে যদি ব্যবহৃত হয় বেনজালডিহাইড, তবে তার সুগন্ধটা হবে অনেকটা কাঠবাদামের মতো, ভ্যানিলিন ব্যবহার করলে হবে তানিলার মতো। মিষ্টি গন্ধ আসে টলুইন এবং ইথাইল বেনজিন থেকে, আর ২-ইথাইল হেক্সানল থেকে আসে ফুলের সুবাস। সময়ের সাথে সাথে এই যৌগগুলির সাথে অক্সিডেশন -এর ফলে এই রকম উদ্বায়ী গন্ধ তৈরি হয়।


          নিছক জানার জন্য জানা নয়, কী কারণে বইয়ের গন্ধ অন্যরকম হয় তা জেনে রাখার পেছনে কিন্তু উপকারিতাও আছে। গন্ধ থেকে বোঝা যেতে পারে, পুরনো বইটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবার কোনও ভয় আছে কিনা। একটি গবেষণায় জানা যায়, এমন ১৫টি  VOC আছে যাদের কারণে খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।


পুরানো বই এর পাতা হলুদ হয়ে যায় কেন?

পুরানো বই এর পাতা হলুদ হওয়ার কারন হল, লিগনিন ও সেলুলোজ অনু ভাঙনের ফলে। কাগজ সাধারনত লিগনিন ও সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। সেলুলোজের কাজ হল পাতার মধ্যে থাকা লিগনিন তন্তুকে ধরে রাখা। সময়ের সাথে সাথে কাগজের লিগনিন অক্সিজেন -এর সংস্পর্শে এসে বিক্রিয়া করে অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। এই অ্যাসিড সেলুলোজকে ভেঙ্গে ফেলে যার দ্বারা বইয়ের পাতা হলুদ হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে এই অ্যাসিডের হাইড্রলাইসিস বিক্রিয়া হয় এবং বিভিন্ন উদ্বায়ী জৈব যৌগ সৃষ্টি হয় যা পুরাতন বইতে গন্ধের সৃষ্টি করে।।


গুরুপ্রসাদী প্রথাঃ হিন্দুসমাজে নববধূ যখন গুরুদেবের প্রসাদ

- বিশ্ব ব্যাপারী

হিন্দু সমাজে একসময় এক ধরণের রীতি প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে সহবাস করার আগেই গুরুদেবের কাছে নিজের স্ত্রীকে নিবেদন করতে হত। গুরুর খাওয়া হয়ে গেলে তার প্রসাদ পেত শিষ্য, তাই এই প্রথার নাম হল গুরুপ্রসাদী।

       ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বইয়ে এই প্রথার মোটামুটি ভালো বিবরণ মেলে। কালিপ্রসন্ন তার বইয়ে গুরুপ্রসাদী প্রথার এরকম বিবরণ দিয়েছেন -


        পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রের গুরুপ্রসাদী প্রথা প্রচলিত ছিল। নতুন বিয়ে হলে গুরুসেবা না করে স্বামী-সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। বেতালপুরের রামেশ্বর চক্রবর্তী পাড়াগাঁ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট লোক ছিলেন। চক্রবর্তীর ছেলেপুলে কিছুই ছিল না, কেবল ছিল একটি মাত্র কন্যা। শহরের ব্রকভানু চক্রবর্তীর ছেলে হরহরি চক্রবর্তীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বর কনের বয়স ১০/৫ বছরের বেশি ছিল না। সুতরাং জামাই নিয়ে যাওয়া কী মেয়ে আনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। কেবল পাল পার্বণে, পিঠে সংক্রান্তি ও ষষ্ঠীর বাটায় তত্ত্ব তাবাস চলতো।

 

        যখন বরের বয়স প্রায় কুড়ি-একুশ হল তখন তার শ্বশুরমশাই তাকে নিয়ে গেলেন। শহুরে জামাইকে দেখার জন্য গ্রামের নানা দিক থেকে লোক আসতে লাগলো, সে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। এমন সময় মেয়ের বাড়ির লোকেদের মনে পড়লো গুরুপ্রসাদী প্রথার কথা। তাই পঞ্জিকাতে ভালো একটি দিন দেখে গোঁসাইগুরুকে খবর পাঠানো হল। গোঁসাইও খোল করতাল নিয়ে তার দলবলের সাথে আগমন করলেন।


         হরহরি গুরুপ্রসাদীর ব্যাপারে ব্যাপারে তেমন কিছু জানতেন না। কিন্তু তার স্ত্রীকে নতুন কাপড়, আর প্রচুর গয়না পড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে এবং শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত দেখে তার মনে সন্দেহ হল। তিনি এক ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “ কিহে, আজকে বাড়িতে কিসের এত আয়োজন?” ছেলেটি বললো, “ জামাইবাবু, তুমি জানো না, আজ আমাদের গুরুপ্রসাদী হবে। “


         গুরুপ্রসাদীর কথা শুনে বর হরহরি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কীভাবে এই গুরুপ্রসাদী হতে তার স্ত্রীকে রক্ষা করা যায় তিনি তার উপায় ভাবতে লাগলেন। আর এর মধ্যে গোঁসাই বরের মত সেজেগুজে জামাইবাবুর ঘরে গিয়ে শুলেন। এরপর গুরুপ্রসাদীর জন্য হরহরিবাবুর স্ত্রী নানারকমের অলঙ্কার পড়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন।


          হরহরিও গোঁসাইয়ের ঘরে ঢোকার আগেই বুদ্ধি করে একটি লাঠি নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। হরহরি দেখলেন, তার স্ত্রী গোঁসাইকে প্রণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। প্রভু অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে মেয়েটিকে বিছানায় নিয়ে গেলেন। আর মেয়েটিও বা কি করে, ‘বংশপরম্পরানুগত ধর্ম না মানা মহাপাপ’- এমন ধারণা তার মনে গেঁথে ছিল। তাই সেও আপত্তি করলো না। এবার গুরুদেব মেয়েটিকে স্পর্শ করে মেয়েটিকে বলতে বললেন, “আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ”। মেয়েটিও গুরুদেবের কথামতো বললো,““আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ”। মেয়েটি সবে তিনবার বলেছে, “আমি রাধা তুমি কৃষ্ণ” হরহরি বাবু আর থাকতে পারলেন না। খাটের নিচ থেকে উঠে এসে গুরুদেবের চরম ধোলাই করলেন। ধোলাই খেয়ে গুরুদেব সজোরে চিৎকার করতে থাকেন। গুরুপ্রসাদী করতে যাওয়ার আগে গুরুদেব তার শিষ্যদের বলে এসেছিলেন প্রসাদী সেড়ে উনি ‘হরিবোল’ বললে সবাই যেন খোল করতাল বাজায়। এখন গোঁসাইয়ের আর্তনাদকে ‘হরিবোল’ ভেবে শিষ্যরা খোল করতাল বাজাতে শুরু করলো, বাড়ির মেয়েরা উলু দিতে লাগলো। সবকিছুর শব্দে চারপাশে হুলস্থূল পড়ে গেল।

         হরহরিবাবু দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তাকে দেখে সবাই অবাক। সকলে ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে অচেতন, আহত অবস্থায় দেখতে পেলেন। আর হরহরি সোজা থানায় গেলেন।

         “সেই থেকে গুরুপ্রসাদী প্রথা বন্ধ হয়ে গেল, লোকের চৈতন্য হল, গুরুদেবরাও ভয় পেল।”

          এ বার আরেকটি কাহিনী বলা যাক। গুরুপ্রসাদী প্রথার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই, তবে গোঁসাইদের লীলাখেলার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে।


          একবার এক বাড়ির পুরুষেরা বাড়িতে ছিলেন না। এমন সময় গোঁসাই সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। প্রভুকে সমাদর করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। বাড়ির সকল মেয়েরা একজায়গায় হলে গোঁসাই চৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবত অনুসারে বেছে বেছে গোছালো গোছালো লীলা করতে শুরু করলেন। লীলা সেরে গোঁসাই বাড়ি ফিরছেন এমন সময় সেই বাড়ির ছোটোবাবুর সাথে তার দেখা। ছোটোবাবু একটু মেজাজি লোক। প্রভুকে দেখেই তার মাথা গরম হয়ে গেল। তিনি প্রভুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ভাগবতের মতে লীলা দেখানো কি শেষ হল?” প্রভু ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন – “আজ্ঞে, ইয়ে… মানে… বলছিলাম কী” ছোটোবাবুর একজন মোসায়েব ছিল। সে এর মাঝে বলে উঠলো, “ হুজুর! গোঁসাই সকল রকমের লীলা করে চললেন, কিন্তু গোবর্ধন পর্বতটাতো ধারণ করলেন না? আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে গোঁসাইকে গোবর্ধন পর্বতটাও ধারণ করানো যেত!” একথা শুনে ছোটোবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, “ হুম, একদম ঠিক বলেছ। গোঁসাই এত লীলা করলেন, এটাও বা বাকি থাকবে কেন? যাও ওনাকে গোবর্ধন ধারণ করাও।“ ছোটোবাবুর আদেশে দশ বারো মনের একটি পাথর গোঁসাই -এর ঘাড়ে চাপানো হল। পাথরের ভারে গোস্বামীর কোমর গেল ভেঙ্গে। এরপর থেকে প্রভুরা আর এই ধরণের জায়গায় লীলা করতে যেতেন না। প্রয়োজন হলে শিষ্যারা পালকি চড়ে গুরুদেবের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতেন।

তথ্যসূত্রঃ এই দুটি কাহিনীই কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বই থেকে উল্লেখ করা হয়েছে (পৃষ্টা ৬০ এর পর থেকে পাবেন)।

মনু কে? -অজিত কেশকম্বলী
Nov. 19, 2024 | হিন্দুধর্ম | views:876 | likes:1 | share: 0 | comments:0

সম্ভবত আপনারা অনেকেই মনুসংহিতার নাম শুনে থাকবেন। স্ত্রীদের প্রতি ঘৃণা, শূদ্রদের প্রতি অত্যাচার ও জাতিভেদের আকর গ্রন্থ এই মনুসংহিতা। সুচতর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সৃষ্ট এই শাস্ত্রে পদে পদে ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার দেখা যাবে, ব্রাহ্মণকে দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই মনুসংহিতা। মনুসংহিতার প্রণেতা হিসাবে ঋষি মনু্র নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বৈদিক সাহিত্য হতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সর্বত্রই মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি, সেটি হল কয়েক’শ বছর আগেও নিম্নবর্ণের মানুষেরা এই মনুর বিধান অনুসারেই অত্যাচারিত হতেন, এখনও প্রায়ই দলিতদের উপর অত্যাচারের খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। সুতরাং প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি মনুর আদর্শের ভুত হিন্দুদের পিছু ছাড়েনি।

বিখ্যাত লোকেদের পরিচয় যেমন জানার প্রয়োজন পড়ে, তেমনি কুখ্যাত লোকেদের পরিচয় না জেনেও উপায় থাকে না, মনুর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

  

               ১/হিন্দুদের আদিমতম গ্রন্থ বেদে অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

  “ হে অগ্নি! দেবগণ প্রথমে তোমাকে নহুষের মনুষ্যরূপধারী সেনাপতি করেছিলেন এবং ইহলোকে মনুর ধর্মোপদেষ্টা করেছিলেন। পুত্র যেন পিতৃতুল্য হয়।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১১)

   

         “হে বিশুদ্ধ অগ্নি! হে অঙ্গীরা! মনু ও অঙ্গীরা এবং যযাতি ও অন্যান্য পূর্বপুরুষের ন্যায় তুমি সম্মুখবর্তী হয়ে (যজ্ঞ) দেশে গমন কর, দেবসমূহকে আন ও কুশের উপর উপবেশন করাও এবং অভিষ্ট হব্যদান কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৩১/১৭)

   

         “হে অগ্নি! তুমি এ যজ্ঞে বসুদের, রুদ্রদের এবং আদিত্যদের অর্চনা কর এবং শোভনীয় যজ্ঞযুক্ত ও জলসেচনকারী মনুজাত জনকেও অর্চনা কর।“ (ঋগ্বেদ ১/৪৫/১)

  

              “আমাদের নতুন স্তুতি হৃদয়জাত ও মিষ্ট জিহ্ব অগ্নির সম্মুখে ব্যপ্ত হোক; মনুর সন্তান মানুষগণ যথাকালে যজ্ঞ সম্পাদন করে ও যজ্ঞান্ন প্রদান করে সে অগ্নিকে সংগ্রামকালে উৎপন্ন করে। (ঋগ্বেদ” ১/৬০/৩)

  

                 “হে অগ্নি! তুমি মনুর অপত্যগণের মধ্যে দেবগণের আহ্বানকারী রূপে অবস্থিতি কর; তুমিই তাদের ধনের স্বামী, তারা স্বীয় শরীরে পুত্র উৎপাদনার্থ শক্তি ইচ্ছা করেছিল এবং মোহত্যাগ করে পুত্রগণের সাথে চিরকাল জীবিত থাকে।“ (ঋগ্বেদ ১/৬৮/৪)

               “দেবগণের আহ্বানকারী, অতিশয় বিদ্বান এবং দেবগণের মধ্যে মেধাবী অগ্নিদেব,মনুর যজ্ঞের ন্যায় আমাদের যজ্ঞে উপবেশন করে দেবগণকে আমাদের হব্যের অভিমুখে শাস্ত্রানুসারে প্রেরণ করুন। হে দ্যাবাপৃথিবী! আমার বিষয় অবগত হও।“ (ঋগ্বেদ ১/১০৫/১৪)

   

          “আমরা যজ্ঞানুষ্ঠান ও আজ্যাদিবিশিষ্ট নমোস্কারোপলক্ষিত স্তোত্র দ্বারা বহু হব্য বিশিষ্ট এবং দেবযজ্ঞে যজ্ঞসাধক অগ্নিকে পরিতোষপূর্বক সেবা করি। সে অগ্নি আমাদের হব্যরূপ অন্য গ্রহণের জন্য ক্ষমবান হয়ে নাশপ্রাপ্ত হবেন না। মাতরিশ্বা মনুর জন্য দূর হতে অগ্নিকে এনে দীপ্ত করেছিলেন, সেরূপ দূর হতে আমাদের যজ্ঞশালায় তিনি আসুন।“ (ঋগ্বেদ ১/১২৮/২)

   

           “হে ইন্দ্র! তুমি সমুদ্রাভিমুখে যাবার জন্য নদীদের গমণশীল রথের ন্যায় অনায়াসে সৃজন করেছ। সংগ্রামকামীগণ যেরূপ রথ সৃজন করে সেরূপ তুমিও করেছ। মনুর জন্য ধেণুগণ যে সর্বার্থপ্রদ হয় এবং সমর্থ মানুষের জন্য ধেণুগণ যেরূপ ক্ষীরপ্রদ হয় সেরূপ অস্মদাভিমুখী নদী সকল একই প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করে।“ (ঋগ্বেদ ১/১৩০/৫) 

  

                 “স্বীয় তেজবলে শত্রুদের পরাভব করবার সময় হে অগ্নি! তুমি আমাদের সম্ভোগযোগ্য স্তুতি অবগত হও। তোমার আশ্রয় পেয়ে আমরা মনুর ন্যায় স্তব করি। সে অনুন মধুস্পর্শী ধনপ্রদ অগ্নিকে আমি জুহু ও স্তুতি দ্বারা আহ্বান করি।“ (ঋগ্বেদ ২/১০/৬)

  

                    হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (২.৩৩.১৩)।

 

                   (ঋগ্বেদ ৪/২৬/১) এ ইন্দ্র আপনার কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-

   “আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস রিষিকে অলঙ্কৃত করেছি, আমি কবি উশনা, আমাকে দর্শন কর।

   

           “হে অগ্নি! মনুর ন্যায় আমরা তোমাকে ধ্যান ও প্রজ্বলিত করছি; হে অঙ্গীরা! তুমি মনুর ন্যায় যজমানের জন্য দেবগণের পূজা কর।“ (ঋগ্বেদ ৫/২১/১) 

  

                   “মনুকৃত দেবযজ্ঞে তিনটি তেজের আবির্ভাব হয়; মরুৎগণ অন্তরিক্ষে সূর্য, বায়ু, অগ্নিরূপে তিনটি জ্যোতিষ্ক ধারণ করেন। হে ইন্দ্র! বিশুদ্ধ বলসম্পন্ন মরুৎগণ তোমার স্তব করেন, কারণ তুমি সুবুদ্ধিসম্পন্ন এবং এ সকল মরুৎ দর্শন করে।“ (ঋগ্বেদ ৫/২৯/১) 

  

                   “হে বন্ধুগণ! এস, আমরা সে স্তোত্র পাঠ করি, যা দিয়ে অপহৃত ধেণুগণের গোষ্ঠ উদ্ঘাটিত হয়েছিল, যা দিয়ে মনু বিশিশিপ্রকে জয় করেছিলেন যা দিয়ে বণিকের ন্যায় কক্ষীবান জলেচ্ছায় বনে গিয়ে জল লাভ করেছিল।“ (ঋগ্বেদ ৫/৪৫৬) 

                 “হে মহান ইন্দ্র! মনুর ন্যায় কুশ বিস্তারকারী যজমানের অন্নের জন্য এবং সুখের জন্য যে যজ্ঞ আরদ্ধ হয়, অদ্য তোমাদের জন্য ক্ষিপ্র সে যজ্ঞ ঋত্বিকগণের দ্বারা প্রবৃত্ত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৬/৬৮/১) 

   

              “হে অগ্নি! ঋত্বিকগণ দিবসে তিন বার হব্যদাতা মনুষ্যের জন্য তোমার মধ্যে হব্য প্রক্ষেপ করে। মনুর ন্যায় এ যজ্ঞে দূত হয়ে যাগ কর এবং আমাদের শত্রু হতে রক্ষা কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/১১/৩) 

  

                       “যজ্ঞার্হ দেবগণের ও যজনীয় মনুর, যজনীয় মরণরহিত সত্যজ্ঞ যে দেবগণ আছেন, তারা অদ্য আমাদের বহু কীর্তি যুক্ত পুত্র প্রদান করুন। তোমরা সর্বদা আমাদের স্বস্তি দ্বারা পালন কর।“ (ঋগ্বেদ ৭/৩৫/১৫)

 

                   “তুমি যজ্ঞশীল, কবিপুত্র,জাতবেদা,মনুর গৃহে উশবা তোমাকে হোতারূপে উপবেশন করিয়েছিলেন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৩/১৭)

   

               “হে বরুণ! আমরা মনুর ন্যায় সোম অভিষব করে ও অগ্নি সমিদ্ধ করে, ঘন ঘন হব্য স্থাপন ও বর্হি ছেদন করে তোমাদের আহ্বান করছি” (ঋগ্বেদ ৮/২৭/৭)

  

                      “সমান ক্রোধবিশিষ্ট বিশ্বদেবগণ মনুর উদ্দেশ্যে যুগপৎ দানে প্রবৃত্ত হোন, অদ্য এবং অপর দিনে এবং আমাদের পুত্রের জন্যেও ধনদাতা হোন।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৭/২০)

  

                           “হে শত্রু ভক্ষক, মনুর যজ্ঞারহ দেবগণ! তোমরা ত্রয়স্ত্রিংশ, তোমরা এ প্রকারে স্তুত হয়েছ।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/২)

  

                          “তোমরা আমাদের ত্রাণ কর,তোমরা রক্ষা কর, তোমরা আমাদের মিষ্ট কথা বল। হে দেবগণ! পিতা মনু হতে আগত পথ হতে আমাদের ভ্রষ্ট করো না, দূরবর্তী মার্গ হতেও ভ্রষ্ট করো না।“ (ঋগ্বেদ ৮/২৯/৩)

  

                          “হে ইন্দ্র! বিবস্বান মনুর সোম পূর্বে যেরূপ পান করেছ, ত্রিতের মন যেরূপ যুগিয়েছ, আয়ুর সাথে যেরূপ প্রমত্ত হয়েছে,-“ (ঋগ্বেদ ৮/৫২/১) 

  

                          “যে স্থানে সকল স্তুতিবাক্য রচয়িতারা স্তব করবার জন্য মিলিত হয়, সোমের সে সত্য স্বরূপ স্থান আমরা যেন প্রাপ্ত হই। সে সোম যার জ্যোতি দ্বারা আলোক উদয় হয়ে দিবসের আবির্ভাব করেছে। যার জ্যোতি মনু রক্ষা করেছে এবং দস্যুর দিকে প্রেরিত হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ৯/৯২/৫) 

   

                         “যে সকল দেবতা অতি দূরদেশ হতে এসে মনুষ্যদের সাথে বন্ধুত্ব করেন, যারা বিবস্বানের পুত্র মনুর সন্তানদের অতি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আশ্রয় দান করেন, যারা নহুষপুত্র যযাতির যজ্ঞে অধিষ্ঠান হন, তারা আমাদের মঙ্গল করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩/১) 

      “মনু অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে সাতজন হোতা নিয়ে যে সকল দেবতার উদ্দেশ্যে অতি উৎকৃষ্ট হোমের দ্রব্য উৎসর্গ করেছেন, সে সমস্ত দেবতাগণ আমাদের অভয় দান করুন এবং সুখী করুন, আমাদের সকল বিষয়ে সুবিধা করে দিন এবং কল্যাণ বিতরণ করুন।“ (ঋগ্বেদ ১০/৬৩৬/৭) 


      ইন্দ্রের কীর্তি সম্বন্ধে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে-


      “যজ্ঞানুষ্ঠানে নমুচিকে বধ করেছ। দাসজাতীয়কে ঋষির নিকট নিস্তেজ করে দিয়েছ। তুমি মনুকে সুবিস্তীর্ণ পথ সকল প্রস্তুত করে দিয়েছ, সেগুলি দেবলোকে যাবার অতি সরল পথ হয়েছে।“ (ঋগ্বেদ ১০/৭৩/৭)

  

           “যেমন পূর্বকালে মনুর যজ্ঞে সোমরস এসেছিল, সেরূপ এ প্রস্তরের দ্বারা নিষ্পীড়িত সোম জলে প্রবেশ করুন। গাভীদের জলে স্নান করাবার সময়ে এবং গৃহ নির্মাণ কারযে এবং ঘোটকদের স্নান করাবার সময় যজ্ঞকালে এ অবিনাশী সোমরসদের আশ্রয় লওয়া হয়। “ (ঋগ্বেদ ১০/৭৭/৩) 


         ঋগ্বেদে মনুর বারংবার উল্লেখ দেখে মনুকে একজন প্রভাবশালী স্বতন্ত্র মানুষ বলেই মনে হয়।

২/এছাড়াও, তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনুর নির্দেশকে ‘ভেষজ’ বলা হয়েছে- “যদ্বৈ কিং চ মনুরবদৎ তদ্ ভেষজম্।”

ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে “সর্বজ্ঞানময়ো বেদঃ সর্ববেদময়ো মনুঃ” উক্তিটির মাধ্যমে মনুর মধ্যে সমস্ত বেদের জ্ঞান নিহিত আছে বলে প্রশংসা করা হয়েছে।

 

                ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি বলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।”- “প্রজাপতি র্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যঃ” (৩.১১.৪)।

  তৈত্তিরিয় সংহিতায় মনু থেকেই প্রজা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।


           ৩/ রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রকর্তৃক আহত বানররাজ বালি রামচন্দ্রকে ভর্ৎসনা করলে রামচন্দ্র মনুসংহিতা থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করে নিজ দোষ ক্ষালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন-“রাজভিঃ ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।।শাননাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।রাজা ত্বশাসন্ পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।।” (১৮/৩১-৩২) অর্থাৎ, মানুষ পাপ করলে যদি রাজা তাকে দণ্ড দেন, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় স্বর্গে যায়; রাজার দ্বারা শাসিত হলে, অথবা বিচারের পর বিমুক্ত হলে, চোর চৌর্যপাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু রাজা চোরকে শাসন না করলে তিনি নিজেই ঐ চৌর্যপাপের দ্বারা লিপ্ত হন। রামায়ণে উদ্ধৃত এই শ্লোক দুটি মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩১৬ ও ৩১৮ সংখ্যক শ্লোকে প্রায় একইভাবে পাওয়া যায়।

   

           কোশল দেশে বিখ্যাত অযোধ্যা নগরীর স্রষ্টা হিসাবে রামায়ণে ‘মানবশ্রেষ্ঠ মনু’-র নাম পাওয়া যায়।

“অযোধ্যা নাম তত্রাসিৎ নগরী লোকবিশ্রুতা।

           মনুনা মানবেন্দ্রেণ পুরের পরিনির্মাতা।। (বালকাণ্ড ৫/৬)

           ৪/ মহাভারতেও অসংখ্যবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে কখনো ‘স্বায়ংভুব মনু’ এবং কখনো বা ‘প্রাচেতস মনু’র উক্তি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।

            মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৩৬.৩৮-৪৬) বর্ণিত হয়েছে-“পুরুষোত্তম ভগবান ধর্মবিষয়ক লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন, যার দ্বারা সমগ্র লোকসমাজের পালনীয় ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিলো (লোকতন্ত্রস্য কৃৎস্নস্য যস্মাদ্ ধর্মঃ প্রবর্ততে)। স্বায়ংভুব মনু নিজে ঐ ধর্মগুলি প্রচার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে উশনাঃ ও বৃহস্পতি মনু-স্বায়ংভুবের গ্রন্থ আশ্রয় করে নিজ নিজ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন।–“স্বায়ংভুবেষু ধর্মেষু শাস্ত্রে চৌশনসে কৃতে। বৃহস্পতিমতে চৈব লোকেষু প্রতিচারিতে।।”

                   মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে,

   “প্রজেনং স্বেষু দারেষু মার্দবং হ্রীরচাপলম।

  এবং ধর্মং প্রধানেষ্টং মনু স্বায়ম্ভুবোহব্রবিং।।“ (২১/১২)

  অর্থাৎ, স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন- নিজ স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন, ম্রিদুতা, লজ্জ্বা ও অচপলতা প্রভৃতি গুণগুলি অবলম্বন করাই হল শ্রেষ্ঠ ও অভিষ্ট ধর্ম।

                   রাজধর্ম বা রাজনীতিশাস্ত্রের রচয়িতা হিসাবে প্রাচেতস মনুর পরিচয়ও শান্তি পর্বে আছে-

   “প্রাচেতসেন মনুনা শ্লৌকৌ চেমৌ উদাহুতৌ।

  রাজধর্মেষু রাজেন্দ্র তাবিহৈকমনাঃ শৃণু ।।“ (৫৭/৪৩)


                   অর্থাৎ, মহাভারতের বনপরবে (৩৫/২১) মনুর দ্বারা মনুর দ্বারা রাজধর্ম বর্ণিত হওয়ার কথা এবং মনুর সৃষ্ট অর্থবিদ্যার প্রসঙ্গ দ্রোণপর্বে (৭/১) দেখা যায়।


            ৫/ গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন-

“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্ অহমব্যয়ম্।বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।” (৪.১)

অর্থাৎ আমি ঐ যোগ পুরাকালে বিবস্বানকে বলেছিলেন এবং বিবস্বান নিজপুত্র বৈবস্বত মনুকে বলেছিলাম । পরে বৈবস্বত মনু ঐ যোগ ইক্ষাকুকে বলেছিল।

           

            ৬/ তাছাড়াও, ৮০০ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবির্ভূত টীকাকার বিশ্বরূপ তাঁর যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার টীকায় মনুসংহিতা থেকে দুশটিরও বেশি শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে P.V. Kane দেখিয়েছেন।

  

                      সপ্তম শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদের জনক শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে প্রায়ই মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন (উল্লেখ্য, বর্তমানকালের প্রচলিত হিন্দু দর্শন শঙ্কারাচার্যের এই মায়াবাদের উপরই আশ্রিত বলা যায়)।

 

                       ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে মনুর একটি অনুশাসনের উল্লেখ রয়েছে এভাবে-

                “অয়ং হি পাতকী বিপ্রো ন বধ্যো মনুরব্রবীৎ। রাষ্ট্রাদস্মাত্তু নির্বাস্যো বিভবৈরক্ষতৈঃ সহ।।” অর্থাৎ, মনুর মতানুসারে পাপাচারী ব্রাহ্মণ বধ্য হবেন না, বরং এঁকে এঁর সমস্ত ধন-সম্পদের সাথে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করাই বিধি।

             

                   মহাকবি কালিদাস তার রঘুবংশের প্রথম সর্গে দিলিপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন- এই রাজার শাসন প্রভাবে মনুর সময় থেকে প্রচলিত চিরাচরিত আচারপদ্ধতি থেকে তার প্রজারা বিচলিত হননি।

   “রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্ণাদা মনো বর্ত্মনঃ পরম।

  ন ব্যতিয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তু র্নেমিবৃত্তয়ঃ” (রঘুবংশ ১/১৭)

  আবার চতুর্দশ সর্গে (৬৭ শ্লোক) কালিদাস বলছেন – রাজা যাতে বর্ণ ও আশ্রম সুরক্ষিত করতে

  পারেন, তার জন্য মনু কিছু ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

   “নৃপস্য বর্ণাশ্রমপালনং যৎস এব ধর্মো মনুনা প্রণীতঃ।”

  আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কয়েকবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

  

               আরেক স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহষ্পতির আবির্ভাবকাল ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে। তিনিও প্রয়োজনবোধে বহুস্থানে মনুবচন উদ্ধৃত করেছেন। আবার অপরার্ক, কুল্লুক ভট্ট প্রভৃতি ভাষ্যকারগণও নিজ নিজ মন্তব্যের সমর্থনে বৃহষ্পতির ঐ উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করেছেন।

 

                 যেমন, কুল্লুক ভট্ট মনুসংহিতার প্রথম শ্লোকের টীকায় মনুবচনের প্রশংসাসূচক বৃহষ্পতির দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-“বেদার্থোপনিবন্ধৃত্বাৎ প্রাধান্যং তু মনুস্মৃতৌ। মন্বর্থবিপরীতা যা স্মৃতিঃ সা ন প্রশস্যতে।।” বেদের অর্থ ঠিক ঠিক ভাবে উপস্থাপিত করার জন্যই মনুস্মৃতির প্রাধান্য। যে স্মৃতি মনুবচনের বিরুদ্ধ তা নিন্দনীয়। আবার-

   

           “তাবচ্ছাস্ত্রাণি শোভন্তে তর্কব্যাকরণানি চ। ধর্মার্থমোক্ষোপদেষ্টা মনুর্যাবন্ন দৃশ্যতে।।” তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই শোভা পায়, যতক্ষণ মনুস্মৃতি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। মনু হলেন ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের উপদেষ্টা। বোঝা যাচ্ছে, মনুবচনই বেদবাক্য হিসেবে শিরোধার্য্য হয়ে আছে।


            ৭/ পুরাণে পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে ১/৬১-৬৩ শ্লোকে।


            ৮/বিভিন্ন শিলালেখ থেকে মনুর সম্বন্ধে জানা যায়।


            ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে প্রচারিত কিছু অভিলেখে স্মৃতি শাস্ত্র রচয়িতা মনুর সশ্রদ্ধ উল্লেখ এবং তার দ্বারা অভিহিত বিধানের উল্লেখ আছে।

  

                   ৫৩৫ ও ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে বলভী থেকে প্রচারিত রাজা শ্রীধর সেনের অভিলেখে রাজাকে মনু ও অন্যান্যদের প্রণীত বিধি বিধান অনুসরণকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘মন্বাদি-প্রণীতবিধিবিধান-ধর্মা’

  ৮ম শতক ও তার পরবর্তী বহু তাম্রলিপিতে ‘উক্তঞ্চ মানবে ধর্মে’, ‘তত্র্য মনুগীতা ধর্মা শ্লোকা ভবন্তি’ প্রভৃতি সূচনা দিয়ে শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে।


              ৯/ অবশ্য মনুসংহিতা থেকেও মনু সম্বন্ধে জানা যায়।


                মনুসংহিতা মতে, বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করে মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। মনুকে সমুদয় জগতের দ্বিতীয় স্রষ্টা বলা হয়েছে। ১/৩৩

 

                      মনু তপস্যার মাধ্যমে দশজন প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন। তারা হল- মরীচি, অত্রি, অঙ্গীরা, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু ও নারদ। ১/৩৪-৩৫

  

                         মরীচি প্রভৃতি দশ প্রজাপতি আরও সাতজন মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন। ১/৩৬ তাদের নাম হল স্বরোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, মহাতেজা, চাক্ষুস ও বৈবস্বত। ১/৬১-৬২ অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন এই সাতজন মনু নিজ নিজ অধিকার বলে এই চরাচর বিশ্বসংসার সৃষ্টি করে প্রতিপালন করেন। ১/৬৩

  

                          মনুসংহিতা প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বর্ণিত আছে,

  মনুসংহিতায় বলা আছে, হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র (মনুসংহিতা) প্রস্তুত করে যথাবিধি অধ্যয়ণ করিয়েছিলেন এবং মনু মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পাঠ করিয়েছিলেন। ১/৫৮

  

                       মহর্ষি ভৃগু মনুর কাছে মনুসংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তিনিই মনুসংহিতা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। ১/৫৯


[লেখাটি সম্পূর্ণ করতে বিশেষভাবে ডাঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘মনুসংহিতা প্রাককথন’ লেখাটির সাহায্য নিয়েছেন লেখক অজিত কেশকম্বলী ।]


RSS একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠন 

- সৌতিক দাস

     

'আরএসএস'-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে৷ প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর 'আরএসএস'-এর পরিচালক হন৷ গোলওয়ালকর ১৯৪০ সালে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর 'আরএসএস'-এর পরিচালক এর দায়িত্ব সামলেছিলেন। 

       ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৬০, ডিসেম্বর ১৭; গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্ট-দের উদ্দেশে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন 'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর। সেখানে তিনি বলেন- "আজ ক্রস-ব্রিডিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল প্রাণীদের উপর করা হয়। কিন্তু মানুষের উপর এ জাতীয় পরীক্ষা করার সাহস আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানীও দেখাননি। ...যে কোনও শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।"

      পরবর্তীকালে 'আরএসএস'-এর মুখপত্র 'অর্গানাইজার' পত্রিকাতে ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারী ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল।  

       অর্থাৎ ওঁর ওই বক্তব্যের সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে, আপনি যদি মহিলা হন আর কোনও সন্তানের মা হতে চান তবে আপনার স্বামীর বদলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কোনও পুরুষের সাথে আপনাকে সেক্স করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না আপনি প্রেগন্যান্ট হচ্ছেন। তারপর সেই পুরুষের ঔরসজাত সন্তান আপনার গর্ভে আসার পর দ্বিতীয় সন্তান আপনি আপনার স্বামীর সাথে সেক্স করে নিতে পারেন। 

       ফ্ল্যাশব্যাক ২০১৩, জানুয়ারি ৬ ; 'আরএসএস'-এর প্রধান শ্রী মোহন ভাগবত ইন্দোরের একটি জনসভা থেকে বলে উঠলেন- "বিবাহ হল চুক্তি। ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাওয়ার জন্যে, আর মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার বিনিময়ে নিজেদের পেট চালানোর জন্য। এই চুক্তি মেয়েরা যদি পূরণ করতে না পারে তাহলে পুরুষদের ওদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।" 

       'আরএসএস'-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ-চালক গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ে ২৩৮ পৃষ্ঠায় গণপরিষদকে তুলোধোনা করে ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছিলেন, জাতীয় লক্ষ্য, জীবন দর্শনের কোনও পথনির্দেশই সংবিধানে নেই, কোনও নিজস্বতাও নেই, কারণ গণ পরিষদের পণ্ডিতরা 'মনুস্মৃতি'র মত প্রাচীন ভারতের নৈতিক ও কার্যকরী আইনকে সংবিধানে জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন বোধই করেননি। 

বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে 'আরএসএস' সেই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিলো যে, 'মনুস্মৃতি'র প্রতিটি পদে পদে নারী জাতির প্রতি চূড়ান্ত অসম্মানের, নারী বিদ্বেষের ইতিহাস লেখা আছে। 


      ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে 'মনুস্মৃতি' পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা আরও বেশি বেশি করে প্রমাণ করে, এই বইটির ছত্রে ছত্রে আছে শুধুই বিদ্বেষের সুর।

  

      'মনুস্মৃতি'তে মোট দু’হাজার সাতশো শ্লোক ও ১২ টি অধ্যায় আছে। এই মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নারীকে স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে।

       মনুশাস্ত্রে নারী হচ্ছে, পুরুষের ইচ্ছাধীন এক যন্ত্র যাতে পুরুষপ্রভু তার বীর্যরূপ বীজ বপন করে পুত্ররূপ শস্য হিসেবে যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের মাধ্যমে ধর্মরূপ পুরুষতন্ত্রের বহমান ধারাটিকে সচল রাখতে পারবে। এখানে নারী কেবলই এক পুরুষোপভোগ্য জৈবসত্তা। নারীর মনস্তত্ত্ব বা কোনওরূপ মানসিক সত্তাকে মনুশান্ত্রে স্বীকারই করা হয়নি। নারীর দেহসত্তাটিরই প্রাধান্য এখানে, যার মালিকানাও নারীর নিজের নয় অবশ্যই। এর মালিকানা শুধুই আধিপত্যকামী পুরুষ প্রভুর। পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছানুরূপ শারীরিক-মানসিক ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করতে পারবে। 


        'মনুস্মৃতি'র ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে থাকা এই নারী বিদ্বেষের কথার সাথে গোলওয়ালকর, মোহন ভাগবতদের সুর মিলে যাচ্ছে তো!

        

        সেই কারণেই সেদিন 'আরএসএস', বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত ভারতীয় সংবিধানের বদলে এই 'মনুস্মৃতি'কে ভারতের সংবিধান হিসেবে চেয়েছিল।

        আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে সারাজীবন এদের বিরোধীতা করে যাব। আমার আশেপাশের সাধারণ মানুষকে এভাবেই বার বার বুঝিয়ে যাব যে, 'আরএসএস' শুধু একটি দেশদ্রোহীদের সংগঠন না তার সাথে একটি তীব্র নারী বিদ্বেষী সংগঠনও। 


        সবাইকে ভালোবাসা যায় না, কাউকে কাউকে ঘৃণা করতেও জানতে হয়। আমি আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে এদেরকে ঘৃণা করতাম, ঘৃণা করি আর আজীবন করে যাব। 

        কথা দিলাম আপনিও যেদিন 'আরএসএসে'র পুরো ইতিহাস পড়ে ফেলবেন, জেনে ফেলবেন, বিশ্বাস করুন ঠিক সেদিন আপনিও ঘৃণাতে বমি করে ফেলবেন।

ওয়াক থুঃ!‌


লোক ঠকানোর ধান্দাবাজি: বাটি চালানোর মূল রহস্য!

-এস এ খান


বাটি চালানোতেই যদি কাজ হতো তবে পুলিশ, গোয়েন্দা, সি বি আই, সি আই ডি, “ডগ স্কোয়াড” না রেখে “বাটি চালানো স্কোয়াড” রাখা হতো! এর কোনও বৈজ্ঞানিক কৌশল নেই’ই এমনকি এমন ঘটার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। যেটা আছে সেটা হল ভাঁওতাবাজি এবং “সফল বাটি চালানোর” কেস স্টাডিতে পাওয়া যায় “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি” আর অপরাধীকে আড়াল করে কোনও "সজ্জন ব্যক্তিকে ফাঁসানোর" মারপ্যাঁচ ।


         প্রথমেই তথাকথিত “বাটি চালনো” পদ্ধতিটা জেনে নেওয়া যাক, যেটার কথা বলা হয়ে থাকে :

১. তান্ত্রিক সাধু লোক তার তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে বা আগে থেকে “পড়ে রাখা” বাটি রাখবে মাটিতে।

২. তথাকথিত “তুলা রাশির জাতক”কে সেটা হাত দিয়ে ধরতে হবে, কেউ কেউ বাটিতে হাত রাখতে বলে, কখনও হাতে লাঠি নিয়ে লাঠির মুক্তপ্রান্ত বাটির মধ্যে রাখতে বলা হয়।

৩. বাটি চলা শুরু করে ও কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে চলে যায় ধরে রাখা ব্যক্তিটাকে নিয়ে।


        প্রথমেই পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন করে বাটির নিজে নিজে চলা সম্ভব নয়। 


        কোনও বস্তুকে স্থির অবস্থা থেকে নাড়াতে চাইলে আপনাকে এর ওপর বল প্রয়োগ করতে হবে। বাটির ওপর যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; বাটি যদি লৌহজাতীয় ধাতুর তৈরি হয় সেক্ষেত্রে চৌম্বক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন; এমনকি রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যবহার করেও শক্তি উৎপন্ন করে কাজে লাগানো যায়। ধান্দাবাজদের বাটি চালানোর ক্ষেত্রে আসি। ইশারায় যদি কোনও বস্তুকে নাড়ানো হয়- তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ইশারা থেকে উৎপন্ন শক্তি বাটিকে নাড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটি যদি সত্যি ঘটে থাকে, তাহলে তা এসব ছোটখাট কাজে ব্যবহার না করে বড় কাজে ব্যবহার করা যায়।


        যেমন, যেসব ওঝা /তান্ত্রিক /বাবা ইশারায় বাটি নাড়ান তারা একত্র হয়ে একটি পরিবহন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এই সংস্থা কোনও জ্বালানি বা শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই বস্তু সরানোর কাজ করে দেবে। এতে পৃথিবীর জ্বালানি সমস্যা মিটে যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসও খুঁজতে হবে না। মহাকাশে যান পাঠাতে আর জ্বালানি লাগবে না, তাদের ইশারার মিলিত শক্তি সেগুলোকে অরবিটে পাঠিয়ে দেবে। বাস, ট্রাক, প্লেনে এইসব লোককে নিয়োগ করা যায়। তাদের ইশারা থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করে যানবাহন চলবে। পৃথিবীর শক্তি বিষয়ক যাবতীয় সমস্যা মিটে যাবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে শক্তি আত্মনির্ভর!


         যাই হোক, আসল কথা বলি- বাটি চালান দিয়ে কখনোই ইশারার মাধ্যমে বাটি নাড়ানো সম্ভব না। তা সম্ভব হলে পদার্থবিদ্যা সূত্রগুলো নতুন করে লিখতে হবে, আর এরা পাবেন নোবেল পুরষ্কার। এই জাতীয় ঘটনাগুলোয় সবসময়ই কোনও না কোনও কৌশল ব্যবহার করা হয়। ঠিক যেমন যাদুকরেরা তাদের কৌশল ব্যবহার করে আমাদের চোখে ধুলো দেয়। আর ওঝা / তান্ত্রিক/ হুজুর  / বাবাদের হাত থেকে যদি নিজের আত্মীয়পরিজনকে বাঁচাতে চান তাহলে তাদেরকে হয়- পদার্থবিজ্ঞান শেখাতে পারেন, নয়তো স্রেফ বলতে পারেন যে, ধর্মে যাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এটা কাজ করবে!


         এখন আসি ঘটনা বিশ্লেষণে। সে ক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি দুটো বিষয়:

১. এধরনের ঘটনায় বহুবার বাটি না নড়ার এবং বহুবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে না পৌঁছাবার ঘটনা ঘটে এবং প্রায়শই যাদের পরিবারে বাটি চালান পদ্ধতি প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকে তাদের ফলাফল না পাবার ঘটনা জানা থাকবার কথা। (তারপরেও আস্থা কীভাবে থাকে সেটা বোধগম্য নয়)


২. তান্ত্রিক/বাবা/ওঝা ব্যক্তি পইপই করে বলতে থাকে “আমার উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, আমার তন্ত্রের উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে সবার, নয়ত চালান কাজ করবে না।” এটা হল সেইফ জোনে যাওয়ার সেরা উপায়। কাজ না করলেই বলে ফেলা যায়। আপনাদের মধ্যে কেউ হয়ত আমাকে, আমার তন্ত্রকে বিশ্বাস করেননি। তাই হয়নি।


এবার দেখা যাক কী ঘটে? 

যখন তান্ত্রিক নিজেই “তুলা রাশির জাতক” সাপ্লায়ার তখন বলাই বাহুল্য সাপ্লায়ার নিজেই বাটি চালনার চালিকা শক্তির উৎস এবং নিজেই ঠেলে নিয়ে যায়। সম্ভাব্য কোনও স্থানে। মিলে গেলে কাকতালীয় বাহবা, আর না মিললে উপরে ২ নম্বর পয়েন্ট হড়বড় করে বলে দেওয়া।

যখন পরিবারের কেউ বা বাইরের কোনও ভলান্টিয়ারকে বাটিতে হাত রাখতে বলা হত তখন দুটো ঘটনা ঘটতে পারে।

১. যদি ভলান্টিয়ার নিজে বেশ গভীরভাবে মনে করে “বাটি চালান” কাজ করেই তবে সে হাত রাখার পরে অজান্তেই তার মনে হয় বাটি নড়ছে। এতে সে নিজেও ওইদিকে হাত নাড়ায় ফলে বাটি এগোতে থাকে। আর একবারে এগিয়ে গেলে সেটা আরও পেয়ে বসে ও কোনও একটা জায়গায় গিয়ে থামে। ভলান্টিয়ার বুঝতেও পারে না সে নিজেই নিয়ে যাচ্ছে বাটি। তার মনে হয় বাটিই তাকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণই মানসিকে চাপ ও সাব-কনশাস মাইন্ডের খেলা।


২. শুরুতে যে রাজনীতির কথা বলেছিলাম এখন সেটাই বলছি। এটা আমার নিজের ছোট সময়ের একটা ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত। ওদিনই বুঝে গিয়েছিলাম, বাটি চালান “বড়দের একটা পাতানো খেলা” মাত্র।


        সচরাচর যদি খুব দামী কিছু খোয়া যায় যেমন, স্বর্ণালংকার বা বড় অংকের টাকা বা ধরুন, এখন দামী মোবাইল এবং ধারণা করা হয় চুরি হয়ে বাইরে যায়নি তাহলে সেটা খুঁজতে “বাটি চালান” পদ্ধতি এখনও অনেকে অবলম্বন করে।

এক্ষেত্রে যদি অপরাধী সেখানে থেকেই থাকে এবং পরিবারে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কেউ হয় এবং সেও মনেপ্রাণে ধরে নেয় “বাটি চালান দিলে তো আমি ধরা পড়েছি”।


         তাহলে সম্মান বাঁচাতে যে ঘটনাটা ঘটে –

সে বাঁচতে স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নেয়, সবার সামনে ধরা পড়লে মান-সম্মান যাবে এই ভয়ে। তখন সে এমন কাউকে বলে যে তাকে মারবে না। তখন সে তেমনই একজন মুরুব্বির/মোড়ল/পাড়ার দাদার হাতে পায়ে ধরে নাকের জল চোখের জল এক করে মাফ চায় এবং জিনিস ফেরত দেয়।

মুরুব্বি/মোড়ল তাকে ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বাড়ির কোনও অন্ধকার ঘুপচিতে জিনিসটা লুকিয়ে রাখে। ঘরের “তুলা রাশির জাতক”কে সাইডে নিয়ে সেট আপ দেয়, পুরা ঘটনাটা বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কী করতে হবে মানরক্ষার্থে। যথাসময়ে সেই সেট আপ হওয়া তুলা রাশির জাতক বাটি সেই মুরুব্বির/মোড়লের পূর্ব লুকানো স্থানে নিয়ে যায়। জিনিস পাওয়া যায়, অপরাধী উলালা উলালা আর এইদিকে তান্ত্রিক রকস।

এটাই হচ্ছে বেশিরভাগ সফল বাটি চালানের “অভ্যন্তরীণ রাজনীতি”।

          এছাড়াও কাউকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতে বা অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে তার সম্পত্তি দখল নিতেও অনেকে তান্ত্রিক / ওঝার সঙ্গে জোট বাঁধে। আখের গুছোয়। 

আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ঈশ্বর নেই? -মারুফুর রহমান খান
Nov. 19, 2024 | নাস্তিকতা | views:44 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ঈশ্বর বিশ্বাসীগণ যখন বুঝতে পারেন যে, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারবেন না, তখন তারা অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।

       তারা এটা বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চেষ্টা করেন না যে, আমরা যদি ‘ঈশ্বর নেই’ প্রমাণ করতে না পারি, তাতে প্রমাণ হয় না ‘ঈশ্বর আছে’। আমি একটি দাবি করে বসলাম, আপনি আমার দাবিটি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলেন না, এতে আমার দাবিটি সত্য প্রমানিত হয়ে যায় না।

       আমি যদি বলি অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কোনও একটি নক্ষত্রের কোনও একটি গ্রহে ঠিক আপনার মতোই দেখতে একজন মানুষ বাস করে, স্বাভাবিকভাবেই আপনি আমার দাবিটি বিশ্বাস করবেন না, কেন না এমনটা বিশ্বাস করার কোনও যৌক্তিক কারণ আপনার কাছে নেই।

       এখন, আপনি যদি আমাকে আমার দাবিটি সত্য প্রমাণ করে দেখাতে বলেন এবং আমি তাতে ব্যর্থ হয়ে আপনাকেই আবার আমার দাবিটি মিথ্যা প্রমাণ করে দেখাতে বলি আর আপনি যদি তা না পারেন, তাতে কি প্রমাণিত হয়? তাতে কি প্রমাণিত হয় অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কোনও একটি নক্ষত্রের কোনও একটি গ্রহে ঠিক আপনার মতোই একজন মানুষ বাস করে? অবশ্যই না।

        ঈশ্বরের অনস্তিত্বের প্রমাণের অভাবকে যদি আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে সেটা একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি বা কুযুক্তি ছাড়া কিছু না। একে বলে Argument from ignorance fallacy.

        এই Argument from ignorance fallacy বা অজ্ঞতার কুযুক্তি অনুযায়ী, কোনওকিছু সত্য, কারণ তা এখন অব্দি মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, আবার, কোনওকিছু মিথ্যা, কারণ তা এখন অব্দি সত্য প্রমানিত হয়নি।

        কোনও দাবি মিথ্যা প্রমাণিত না হলেই দাবিটি সত্য প্রমানিত হয়ে যায় না। আবার, কোনও দাবি সত্য প্রমানিত না হলেই দাবিটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায় না। এছাড়াও, আপনি যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে বলে দাবি করেন, তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ আপনাকেই দিতে হবে। দাবি যার, প্রমাণের দায়িত্ব তার।

        আমি যদি শাঁকচুন্নির অস্বস্তি আছে দাবি করি, তাহলে শাঁকচুন্নির অস্বস্তি প্রমাণের দায়িত্ব আমার ওপরেই বর্তায়। নিজেই শাঁকচুন্নি বলে কিছু আছে দাবি করে অন্যকে 'পারলে শাঁকচুন্নি নেই প্রমাণ করে দেখাও' বলার কোনো অর্থ নেই। কারণ, কেউ শাঁকচুন্নি বলে কিছু প্রমাণ করতে না পারলেই শাঁকচুন্নি বলে কিছু আছে প্রমাণিত হয়ে যায় না!

        আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে বলে দাবি করলেন, আমি আপনার দাবির সপক্ষে প্রমাণ চাইলাম। আপনি বললেন, ঈশ্বর নেই তার প্রমাণ কী? আপনি এখানে Burden of proof fallacy প্রয়োগ করলেন।

        কিছু দাবি করে দাবিটি প্রমাণ করার পরিবর্তে অন্যের ওপর অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর মানেই Burden of proof fallacy.

নাস্তিক-আস্তিক কথোপকথন -আহমেদ তালট তাহজিব
Nov. 19, 2024 | নাস্তিকতা | views:552 | likes:0 | share: 0 | comments:0

নাস্তিক: স্রষ্টা কে?

ধার্মিক: যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই স্রষ্টা। 

নাস্তিক: তিনি কী কী সৃষ্টি করেছেন? 

ধার্মিক: সবকিছু।

নাস্তিক: সৃষ্টির আগে উনি কী করতেন?

ধার্মিক: সৃষ্টির আগে পরে বলে কোনও কথা নাই উনি সময়ের উর্দ্ধে।

নাস্তিক: তার মানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই ওঁর সৃষ্টি?

ধার্মিক: ঠিক ধরেছেন।

নাস্তিক: সবই যদি ওঁর সৃষ্টি হয় তাহলে আমার করণীয় কী?

ধার্মিক: আপনার করণীয় ওঁকে বিশ্বাস করতে হবে, ওঁর কথামতো চলতে হবে।

নাস্তিক: ওঁকে বিশ্বাস করা না করায় কি আসে যায় উনি তো আগে থেকেই ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে রেখেছেন?

ধার্মিক: তবুও আপনাকে আপনার কাজ করে যেতে হবে। কারণ আপনার কর্মফলের উপর ভিত্তি করেই উনি আপনাকে স্বর্গে অথবা নরকে দিবেন।

নাস্তিক: উনি যদি ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করেই থাকেন তাহলে আমার কর্মফল কিভাবে ওঁর সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনবে?

ধার্মিক: উনি আসলে আপনার জন্য ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে সেখানে অনেকগুলো ফলাফল দিয়ে রেখেছেন। আর আপনাকে জ্ঞান দিয়েছেন ভালো মন্দ বোঝার এবং ফ্রিউইল দিয়েছেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আপনার নেয়া সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আপনি ওঁর সৃষ্টি থেকে কোন ফল পাবেন।

নাস্তিক: আচ্ছা উনি কি জানেন ওঁর সৃষ্টির অনেক ফলাফলের মধ্যে আমি কোনটা পাবো?

ধার্মিক: অবশ্যই উনি সব জানেন।

নাস্তিক: কীভাবে?

ধার্মিক: যেহেতু উনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান তাই উনি সব জানেন।

নাস্তিক: যেহেতু আমি নাস্তিক তাই ধরে নিলাম মরার পরে আমার অবস্থান হবে নরকে এবং উনি ভবিষৎ দেখেই তা জানতে পারলেন। এই জানাটা ধরে নিয়েই আজ থেকে আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস স্থাপন করলাম আর স্রষ্টার দেখানো পথে চলা শুরু করলাম। আমার এই নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আমি ভবিষ্যতে স্বর্গে চলে গেলাম। তাহলে কি ওঁর পূর্বের জানাটা ভুল হয়ে গেল না?

ধার্মিক: এটাও উনি আগে থেকেই জানতেন যে আপনি পরিবর্তন হবেন।

নাস্তিক: উনি আসলে কোনটা জানতেন আগেরটা নাকি পরেরটা?

ধার্মিক: পরেরটা।

নাস্তিক: তাহলে আগের জানাটা ভুল ছিল।

ধার্মিক: না উনি আগেরটাই জানতেন।

নাস্তিক: তাহলে ওঁর পরের জানাটা ভুল।

ধার্মিক: না না পরেরটাই ঠিক।

নাস্তিক: আপনার মাথামুণ্ড ঠিক আছে তো?

ধার্মিক: আগেরটাই ঠিক।

নাস্তিক: ঠিক আছে আজকের মত এখানেই থাক আপনি বাড়ি যান।

ধার্মিক: না না পরেরটাই ঠিক। না না আগেরটাই ঠিক। না না পরেরটাই ঠিক। কোনটা যেন ঠিক? ওহ আগেরটা। না না পরেরটা।


বি. দ্র: ধার্মিক এখন পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর কিছুক্ষণ পর পর বলতে থাকে -না না পরেরটাই ঠিক। না না আগেরটাই ঠিক...

পিতৃতন্ত্রে দাম্পত্য, আধিপত্য ও টক্সিক ব্যবহার - কিছু ভাবনা -সম্রাট সেনগুপ্ত
Nov. 18, 2024 | পুরুষতান্ত্রিকতা | views:885 | likes:25 | share: 0 | comments:0

কিছুদিন আগে একটা বাংলা ছবিতে দেখছিলাম কর্মব্যস্ত স্বামী বার বার ফোন ধরছেন বলে স্ত্রী ফোনটা আছড়ে দিল। অতঃপর স্বামী গেল দোকানে ক্রুদ্ধ স্ত্রীকে খুশি করতে শাড়ি কিনতে। রোজ অজস্র দাম্পত্য জোকস ভেসে আসে মোবাইলে যার মূল কথা হল, স্ত্রীরা কলহপ্রবণ এবং কলহ মেনে জীবন কাটানো সংসারে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।

        সে এক সময় ছিল কিছুকাল আগে যখন স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর হেনস্থাকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হত। ওটা ছিল ভালোবাসারই আরেক রূপ - প্রকাশ। স্বামী ছিল সেই যে গালি দেয়, মারে, আবার সোহাগও করে। নিজের জন একটু খবরদারী তো করবেই আর কি। নারী নির্যাতন ও গৃহ হিংসা নিয়ে আমাদের সচেতনতা সেই বোধকে অন্তত শিক্ষিত ভদ্রলোক সমাজে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছে। 


        কিন্তু বারংবার বলে বলে যেন নারীর টক্সিক ব্যবহারকে, খবরদারী ও ঔদ্ধত্যকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। আসলে মূল পিতৃতান্ত্রিক পিতৃসুলভ নিয়ন্ত্রণের কাঠামোটি টিকেই থাকছে। নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো টিকে থাকলে যদি সেই নিয়ন্ত্রণ ও ঔদ্ধত্যের অধিকার নারীর কাছে যায় তবুও মূল আধিপত্যবাদী সিস্টেমটি টিকেই থাকে। অর্থাৎ নারী বা পুরুষের আদর্শ ব্যবহার ও যাপন কীরকম হবে তা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হতেই থাকে, সাথে চলে সম্পর্কের মধ্যে টক্সিক ব্যবহারকে স্বাভাবিক করে তোলার প্রক্রিয়া।

        এমতবস্থায় কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে টক্সিক ব্যবহারে অভ্যস্ত পুরুষ বা নারী কি ভালোবাসেন না। অবশ্যই বাসেন। তাদের ভালোবাসার ধারণার সাথে আসলে নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও ক্ষমতা প্রদর্শন যুক্ত। এক বিকৃত অধিকারবোধের পিতৃতান্ত্রিক ধারণা যেমন পুরুষকে দীর্ঘকাল প্রভাবিত করেছে, তা নারীকেও একভাবে চালিত করে। সমাজকে বদলাতে গেলে desire কেও বদলাতে হবে, ভালোবাসার ধারণাকেও বদলাতে হবে।


        অপরকে সম্মান দেওয়া এবং কাছের মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করা প্রতিটি মানুষের স্বীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সংসার তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে বিবাহ আমাদের সনাতন ভাবনা বলে যে যত যাই বলুক না কেন বিবাহ একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই ভাবনা থেকেই একজন পার্টনার আরেকজনের ওপর টক্সিক ব্যবহার ছুঁড়ে দেন। কারণ বিচ্ছেদের ভয় নেই। বরং অন্যজন মেনে না নিলে তার মধ্যেই যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করে। অর্থাৎ আপনার স্ত্রী আপনার মোবাইল ফোনটি আছড়ে ভাঙলে (তা সে যে কারণেই হোক না কেন) আপনার পক্ষে তা মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং উলটে আপনি সেই রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন আদর্শ স্বামী হিসেবে। 


         যে কোনও সামাজিক সম্পর্কে আমাদের অপর মানুষটি যেন ক্ষুব্ধ না হয় সেই চেষ্টা করে যেতে হয়। অফিসে, বাজারে, বন্ধুদের আড্ডায় আমাদের অন্য কারও ব্যবহার বা কাজ পছন্দ না হলেও নম্রভাবে তা ব্যক্ত করে বা তার ভিন্নতাকে সম্মান দিয়ে চুপ থাকি। এর কারণ সেখানে বিচ্ছেদের ভয় আছে। সোজা কথায় যার ওপরে আপনি খবরদারী করছেন, সে যদি আপনার ওপর নির্ভরশীল কর্মচারী না হন তা হলে সে আপনাকে এড়িয়ে চলবে, আপনার সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়বে। 


         অনেকে মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পর্কে সেই সম্ভাবনা নেই। মা বাবা তাই ছেলেমেয়ের ওপর যথেচ্ছ খবরদারী করেন, নিজের ধারণা অনুসারে তার ব্যক্তিত্ব ও যাপনকে চালিত করতে চান। একই কাজ দাম্পত্যে একে অপরের ক্ষেত্রে করতে থাকে স্বামী অথবা স্ত্রী। সেখানে হারানোর ভয় নেই, আছে সীমাহীন অধিকারবোধ ও আধিপত্য। সেখানে মানিয়ে চলা মানে একে অপরের টক্সিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিজের নিজস্বতাকে প্রকাশ না করা, দমিয়ে রাখা। মানিয়ে চলা মানে কখনোই অপরের ভিন্নতা ও ব্যক্তিত্বকে মেনে নিয়ে ও সম্মান করে একসাথে থাকা হয়ে ওঠে না। এই ideology of possession আসলে কোনও এক সময়ের মালিকানার ধারণার সাথে যুক্ত, যখন স্ত্রী অন্যান্য সম্পদের মতোই স্বামীর সম্পত্তির অংশ হতেন। এখন তা আমাদের আবেগ অনুভূতির সাথে মিশে গেছে।


        একটি পরিবারে সন্তান অপরের ভিন্নতাকে মর্যাদা দিতে শেখে না, শেখে না আপন ব্যক্তিত্বকে উদযাপন করতে। সে জানে বাবা মা তাকে যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রয়োজনে বকা মারা করতে পারে তার ভালোর জন্যেই। ভবিষ্যতে তার সমস্ত সম্পর্কের ধারণাই এই আধিপত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। অপরের ভালোর কথা ভাবতে গেলে তাকে বুঝতে হয় ও বোঝাতে হয় কারণ সে ভিন্ন মানুষ। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আপনার নেই। ছেলেবেলা থেকে এই প্রচেষ্টার অভাব দেখে মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক মনে করে। 

 

       আমি তোমার ভালো তোমার চেয়েও বেশি বুঝি তাই তুমি আমার কথা শুনে চলবে - এই ভাবনা হল paternalistic ধারণা। সেখানে একজন আরেকজনের কাছে বোদ্ধা এবং ক্ষমতাবান পিতা হিসেবে আবির্ভুত হয়। পুর্নবয়স্ক মানুষকেও তার পার্টনার এভাবেই paternalize করে। অপরের নিয়ন্ত্রণ কখনোই বিশুদ্ধ হয় না। কারণ সেও মানুষ। তারও ইচ্ছা অনিচ্ছা লিপ্সা আকাঙ্খা ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি আছে। অধিক নিয়ন্ত্রণবাদী পিতারা তাই অচিরেই খবরদারীতে অভ্যস্ত হয়ে পরে। মেয়ের ভালোর জন্য যেমন তারা মেয়েকে সন্ধ্যের পর বেরোতে দেয় না বা তার পোষাক নিয়ন্ত্রণ করে তেমনই একদিন মেয়ে কার সাথে মিশবে, কাকে বিয়ে করবে সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পিতা। অতঃপর পিতা স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের মতো হয়ে ওঠে। তার ভালোর ধারণা সন্তান মানতে না চাইলে তার পিতৃত্বের ইগো আহত হয়। তখন - 'তুমি আমার কথার অবাধ্য হচ্ছ' - টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন আর 'তোমার' ভালো নয়, জেগে ওঠে 'আমার' কথা, কারণ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, তোমার জন্য এত কিছু করে থাকি। 


       একই ঘটনা দাম্পত্যে অভিনিত হতে থাকে। স্বামী তো বটেই স্ত্রীরাও এখন স্বামীকে স্বীয় সন্তানের ন্যায় নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার ইচ্ছার বাইরে গেলে তাদের 'আমিত্ব' জেগে ওঠে। টক্সিক ব্যবহারকে তারা অধিকার মনে করে ও সেই অধিকারকে প্রশ্ন করলে তাতে ভালোবাসার অবমাননা হয়েছে মনে করে তারা। ইদানিং স্ত্রীর এই ভুমিকাকে গ্লোরিফাই না করা হলেও অন্তত স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে যেটুকু লিঙ্গ 



       চেতনা তৈরি হয়েছে তাতে পুরুষের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণকে, টক্সিক ব্যবহারকে সহজেই খারিজ করা চলে, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তা তেমন সহজ হয় না। তাই সর্বত্র হাসিঠাট্টার ছলে অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্যের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।

বিবেকানন্দ ও একটি বিভ্রান্তির জবাবে -অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:561 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বছরের পর বছর ধরে একটি মিথ্যেকে এমন ভাবে প্রচার করা হয়ে আসছে যেটাকে সত্য বলে ধরেই নিয়েছে আমজনতার একাংশ। মনোবিজ্ঞানে (Psychology) " Illusory Truth Effect " বলে একটা কথা আছে। এর মানে হচ্ছে একটি মিথ্যেকে ইচ্ছেকৃত ভাবে বারংবার বিকৃত করে জনগণের কাছে উপস্থাপন করলে জনগণ সেটাকেই সত্য বলে ধরে নেয়। এছাড়া অন্ধবিশ্বাসী, হুজুগ এবং গুজবপ্রিয় জনতা কোনওদিনই সত্যকে জানতে ভালো করে পড়াশোনা এবং পড়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে আর দশজনের সাথে আলোচনা করে ঠিক ভুলটা বেছে নেন না।

      গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার 'প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ' শীর্ষক প্রবন্ধে উভয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বিধান মুখোপাধ্যায় জাপানী কবি ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, "ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন - ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। " If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative'."১

      তথ্যসূত্র হিসেবে বিধানবাবু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' গ্রন্থের উল্লেখ করেছিলেন। এইখানেই রহস্য। 

    

       “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে...” দীর্ঘবছর যাবৎ এটি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বলে কোটেশনটির প্রচার চলেছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, কবিগুরুর নামে এই বক্তব্যটি প্রথমবার প্রকাশ পায় উদ্বোধন পত্রিকার ৪৩তম বর্ষের ভাদ্র ১৩৪৮ সংখ্যায়, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক পরে। তাতে লেখা হয়েছিল, "রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চরিতের জন্য রোমা রোলাঁ যখন উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন, সেই সময় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ সংঘের এক সন্ন্যাসীকে তাঁর ওই উক্তির কথা জানিয়েছিলেন।" উদ্বোধন পত্রিকারই আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যায় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ তাঁর একটি প্রবন্ধের পাদটীকায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে লিখেছিলেন, "স্বামী অভয়ানন্দ বলেছেন, রোলাঁ নিজেই এই তথ্য একসময় স্বামী অশোকানন্দকে জানিয়েছিলেন।" স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ অবশ্য কোনও চিঠির উল্লেখ করেননি। 

         উদ্বোধন পত্রিকার আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যায় 'রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ৫৮১ পৃষ্ঠার পাদটীকায় লেখক জানিয়েছেন, "শোনা যায় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রোলাঁর যখন প্রথম দেখা হয়, কবি তখন ঐ ফরাসী মনীষীকে বলেছিলেন : 'If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative', everything positive.' দুঃখের বিষয় রোলাঁর ডায়রিতে উক্ত সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ আছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঐ উক্তির কোনও উল্লেখ নেই। রোমা রোলাঁ অথবা রবীন্দ্রনাথ কারও কোনও প্রকাশিত রচনায় ঐ উক্তিটি পাওয়া যায় না। এর পর লেখক ভাদ্র ১৩৪৮ এবং আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যার প্রবন্ধ দুটির উল্লেখ করেছেন এবং অত্যন্ত আপশোসের সঙ্গে জানিয়েছেন, "দেখা যাচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের নির্ভর করতে হয় শ্রুতি আর স্মৃতির উপর।"

        ইতিমধ্যে প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরী ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর 'একত্রে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের অন্তর্গত 'কবি ও সন্ন্যাসী' প্রবন্ধের ৩২০ পৃষ্ঠায় আমাদের জানালেন, "জাপানী মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে, ভারতবর্ষকে জানতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন' ; If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative." মজার বিষয়, এই উদ্ধৃতির কোনও তথ্যসূত্র কিন্ত অমিতাভ বাবু দেননি, এমনকি রোলাঁ যে কী করে পালটে ওকাকুরা হয়ে গেলেন, সে হদিসও তিনি আমাদের জানাননি। এটাই বড় রহস্যের। 

        আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত যে নিবন্ধটির উল্লেখ করেছিলাম, তাতে আমরা দেখেছি লেখক ওখানেও ওকাকুরার নাম দিয়েছেন। এবার মজার কথা হল, তথ্যসূত্র হিসেবে লেখক যে বইটির উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' বইয়ের বাংলা অনুবাদের ৯৭৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে "যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই।" এবং তথ্যসূত্র হিসেবে ৯৭৪-৯৭৫ পৃষ্ঠার ফুটনোটে উল্লিখিত আছে, "এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোঁমা রোঁলাকে বলেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী অশোকানন্দকে লেখা একটি চিঠিতে রোঁমা রোঁলা এই তথ্যটি জানান। স্বামী অশোকানন্দের সূত্রে আমরা এই তথ্যটি জেনেছি।" জানিনা, আনন্দবাজার পত্রিকার উল্লিখিত প্রবন্ধের লেখক ওকাকুরার নাম কীভাবে পেলেন! মজার কথা হল, বিবেকানন্দ সম্পর্কে মিশনের সন্ন্যাসীরা এবং অসংখ্য বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্বামী অশোকানন্দকে লেখা রোঁমা রোঁলার ওই বিশেষ চিঠিটি আজ পর্যন্ত কেউ ছেপেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। 


আরও একটি মজার কথা হল, ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে রোঁমা রোঁলা একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম 'ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি : ১৯১৫-১৯৪৩'। অনুবাদক অবন্তীকুমার সান্যাল। প্রকাশকাল ১৯৬০। এরও ১৪ বছর আগে ১৯৪৬ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক থাকাকালীন সরোজ দত্ত অনুবাদ করেন রোমা রলাঁর পত্রপ্রবন্ধ 'I will not rest' এর। নাম দেন 'শিল্পীর নবজন্ম'। উভয় বইতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওই বহুচর্চিত বিশেষ মন্তব্যটি নেই। আমরা জানি, বিবেকানন্দের বেশ ভক্ত ছিলেন রোমা রোঁলা। ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। তাই অদ্ভুত লাগে রবীন্দ্রনাথের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য তিনি লিখতে ভুলে গেলেন কেন? হাইলি সাসপিসাস। 

দেখা যাচ্ছে, একই উক্তি রবীন্দ্রনাথের নামে চালানো হয়েছে অথচ পাত্র আলাদা। এমনটাও হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ রোলাঁ ও ওকাকুরা দুজন বিদেশীকেই এই উপদেশ দিয়েছিলেন। ওকাকুরার ক্ষেত্রে পুরোটাই শ্রুতি হলেও রোলাঁর ক্ষেত্রে একটি তথাকথিত চিঠি বর্তমান। এখান থেকেই ভক্তির চশমাটা খুলে যদি আপনি যুক্তিসম্মত ইতিহাসচর্চা করতে বসেন তাহলে কি কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসা কি স্বাভাবিক নয়?

 যেমন-

১- উদ্বোধন পত্রিকা ও চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ বইতে রোলাঁর নাম অথচ কবি ও সন্ন্যাসী বইতে ওকাকুরার নাম কেন? অর্থাৎ দুই ঘরাণার লেখকরা সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন কেন?

২- রোলাঁ সত্যিই যদি অশোকানন্দকে কোনও চিঠি লিখে রাখেন তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি মিশন আজ অবধি প্রকাশ করেনি কেন?

৩- রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় মিশন কোনওদিন রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যটি তাদের পত্রিকায় ছাপেনি কেন?

৪- রবীন্দ্রনাথ আসলে কাকে কথাটা বলেছিলেন অথবা আদৌ কী বলেছিলেন?

৫- এখানেই সন্দেহ জাগে যে, পুরোটাই কি অপপ্রচার মাত্র? বিবেকানন্দকে জাস্টিফাই করতে কি একজন রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো নামের প্রয়োজন পড়েছিল?

       পরিশেষে জানাই, যে কোনও চরিত্র বিশ্লেষণের আগে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে - আমরা কেউই শ্রেণীবদ্ধতা ও কালবদ্ধতার উর্ধ্বে নই। সমস্ত দোষমুক্ত মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রতিটি চরিত্রকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন তাঁদের দোষের পাল্লা ভারী, না গুণের। প্রিয় মুক্তমনা বন্ধুরা, রবীন্দ্রনাথের কোনও উক্তি ব্যবহার করার আগে সামান্য ভাববেন কিন্ত। যদিও এসব কারণে ওঁর মতন ব্যাক্তিত্বকে অসম্মান মোটেই জানানো উচিৎ নয়। কারণ আজ পর্যন্ত এমন প্রতিভাবান মানুষের কোনও সমকক্ষ কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

       

        কবিগুরুই বলেছিলেন - "তাঁহারাই ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃতির ধর্মসেতু নির্মাণ করিতেছিলেন। ভারতবর্ষ এখনই যে নিশ্চেষ্ট হইয়া আছে তাহা নহে— রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ, শিবনারায়ণ স্বামী ইঁহারাও অনৈক্যের মধ্যে এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন।" (এর সূত্র জানাবো না। আগ্রহী ব্যক্তিরা খুঁজে নেবেন)। 

       আবার দেখা যাচ্ছে, স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছিলেন - “মনে রেখো, ঐ পরিবারটি (ঠাকুর পরিবার) বাংলাকে যৌনতার বিষে প্লাবিত করেছে।“ সূত্র- ভগিনী নিবেদিতার পত্রাবলী, ১ম খন্ড, ১৯৬০:৮২ (ইং সংকলন)।

       স্বামী বিবেকানন্দকে সত্যিই জানতে এবং বুঝতে চাইলে দশ খন্ডের বাণী ও রচনা, পত্রাবলি, স্বামীজিকে যেরুপ দেখিয়াছি, স্বামী শিষ্য সংবাদ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, বিবেকানন্দ ও বাঙালির বিবেক, 



সেকুলার বিবেকানন্দ, বিবেকানন্দ অন্য চোখে ইত্যাদি বইগুলো এবং কবিগুরুর ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী হতে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী, স্বরবিতান, গীতবিতান, গীতাঞ্জলী ইত্যাদি বইগুলো বেশ ভালো ভাবে এবং পাতায় পাতায় নিজের যুক্তিবোধ দিয়ে পড়া খুবই প্রয়োজন যদি না আপনি অন্ধভক্তদের দলে পড়েন। 




কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শিবাশীস বসু, সুনীত দে, শমীন্দ্র ঘোষ, সপ্তর্ষি রায়। 

সূত্র১- https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/friendship-between-rabindranath-tagore-and-swami-vivekananda-1.1105588

মানুষ বড় না ধর্ম বড়? -জামাল আনসারী
Nov. 18, 2024 | ধর্ম | views:885 | likes:2 | share: 2 | comments:0

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের কুমিল্লায় একটি মন্দিরে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করা হয়েছে বলে কি ঘটনায় না ঘটল। হাজার হাজার উন্মুক্ত উগ্রবাদী মানুষ কয়েকদিন ধরে ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনি, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা চালাল, কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ এর ঘটনা ঘটল,এমনকি দাঙ্গায় কয়েকজন নিরহী মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা তো ছেড়েই দিলাম কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ছোট বড় মাঝারি নিউজ চ্যানেল এবং সংবাদপত্রের শিরোনামের কল্যানে গোটা বিশ্ববাসীর জানতে আর বাকি রইল না, যে কেন গোটা বাংলাদেশ জুড়ে এমন অভাবনীয় অনভিপ্রেত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

        এই সব কান্ডকারখানা দেখে শুনে আপনার কি মনে হয় না যে, মানুষ বড় না ধর্ম বড়? একজন ধর্মান্ধ গোঁড়া আপাদমস্তক ধর্ম ব্যবসায়ী ব্যক্তির নিকট অবশ্যই তার নিজের ধর্ম বড়। কিন্তু যারা শিক্ষিত, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, মানবদরদী, মানবতাবাদী, নাস্তিক, তারা কখনও ধর্মকে মানুষের উপরে স্থান দিতে পারে না। 


মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার জোরে প্রমান করেছে মানুষই এই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ জীব। সেই মানুষই মাঝে মধ্যে উগ্র হয়ে ওঠে, প্রচন্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। কারন মানুষ অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। 

আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে কবি বড়ু চণ্ডীদাস বলে গেছেন; মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী―

"সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। 

মধ্যযুগে বসে বাংলারই এক কবি সমগ্র বিশ্বের জাতিকে শুনিয়েছেন বিশ্ব মানবতার অমর কবিতা। যেখানে কোনো ঈশ্বর-আল্লা-গড-ভগবান নয়, মানুষেরই স্থান সবথেকে উপরে। মানুষই বড়। মানুষের থেকে কোনো কিছুই বড় হতে পারে না।

 

           আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কবিতায় সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এই ভাবে―"গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।"

নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। অন্তরে তিনি না ছিলেন হিন্দু না ছিলেন মুসলিম। ‘তিনি সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন মানবতার কবি। "জাতের বজ্জাতি" কবিতায় তিনি ধর্ম ব্যবসায়ীদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলছেন―

জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া,

ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।

হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি – ভাবলি এতেই জাতির জান,

তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান।

এখন দেখিস ভারত জোড়া পঁচে আছিস বাসি মড়া,

মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।


যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙবে সে ত,

যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।"

নজরুলের স্পষ্ট উক্তি জাত, ধর্ম লুপ্ত হয়ে গেলেও এই পৃথিবীর মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। হাজার খানেক জাত, হাজার খানেক ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। ধর্ম ছাড়াও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা যায়। দুঃখের বিষয় হলেও একথা সত্যি যে, আমাদের দেশে নজরুল ইসলামের লেখার যথাযথ মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত হয়নি।

       আমরা লেখাপড়া শিখি। বিদ্যা বুদ্ধি অর্জন করি। কিন্তু সেই অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগায় না। বিখ্যাত দার্শনিক ও রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন―"আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢাক, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।"

       আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উপলব্ধিতে কোনো ভুল ছিল না। আমরা ক্লাসে শিখি এক, আর প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করি আরেক। সেটাই হল বর্তমান শিক্ষিত যুব সমাজের অন্যতম দুর্বলতা। সেই দুর্বলতার সুযোগে ধর্মান্ধ উগ্রবাদ শুধু এপার বাংলা ওপার বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, গোটা বিশ্বের কোনায় কোনায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কবি কালিদাস তার কবিতায় মানুষেরই জয় ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন―

        "মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে করে দেবমহিমা নির্ভর। "কবি কালিদাস রাযের উক্তিকে বর্তমানের শিক্ষা দীক্ষা, সভ্যতায় এগিয়ে থাকা মানুষজন বোধহয় কেউই অযৌক্তিক বলে এড়িয়ে যেতে পারবে না। এমন কি বড় বড় ধর্মগুরুরা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, কবির উক্ত বক্তব্য অতিরঞ্জিত নয়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? হিংসার ঘটনাই বা ঘটছে কেন?

          ধর্ম নিয়ে কেন এতো টানাটানি? ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটি লড়াই ঝগড়ার অন্ত নেই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সংঘর্ষে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সিংহভাগ মৃত্যু হয়েছে ধর্মের কারনে। ধর্মকে যখনই মানুষের উপরের স্থানে বসানোর চেষ্টা হয়েছে তখনই বিশ্ব সাক্ষী থেকেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। ধর্মের কারনে কত গ্রাম, কত নগর, কত জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'গোরা’ উপন্যাসে ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছেন―"একটা বিড়াল পাতের কাছে এসে ভাত খেলে কোনও দোষ হয় না, অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়। মানুষের প্রতি মানুষের এমন অপমান এবং ঘৃনা যে জাতিভেদে জন্মায় সেটাকে অধর্ম না বলে কি বলব? মানুষকে যারা এমন অবজ্ঞা করতে পারে, তারা কখনোই পৃথীবিতে বড়ো হতে পারে না। অন্যের অবজ্ঞা তাদের সইতেই হবে।"

        এই পৃথিবীতে এমন মানুষেই সংখ্যায় বেশি যারা ধর্মের নামে অধর্মের কাজই বেশি করে। সে জ্ঞাত ভাবেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ধর্মমোহ' নামক অবিস্মরণীয় একটি কবিতায় সমগ্র মানব জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন যে―"ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন শুধু মারে আর মরে।"

রবি ঠাকুরের সেই অমর বাণীকে তোয়াক্কা না করে লক্ষ লক্ষ ধর্মান্ধ নিজের নিজের ধর্মকে রক্ষা করতে মারামারি কাটাকাটি করে গোটা বিশ্বের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত, বিষাক্ত করে তুলছে। কবে তারা বুঝবে মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ বড় হতে পারে না! কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ''মানুষ' কবিতায় লিখে গেছেন―

"মানুষেরে ঘৃণা করি’

ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি!

ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ’ নাও জোর ক’রে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্থ’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,

পূজিছে গ্রন্থ’ ভন্ডের দল! ―মূর্খরা সব শোনো,

মানুষ এনেছে গ্রন্থ’; ―গ্রন্থ’ আনেনি মানুষ কোনো।"

          পৃথিবীর সমগ্র মানুষ যেদিন বুঝতে পারবে কোনো ধর্ম নয়, ধর্ম থেকে মানুষ বড়। সেদিনই ধর্ম নিয়ে হানাহানি, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতি ঘটবে। সর্বকালের সেরা মানবদরদী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একটি উক্তি দিয়ে এই লেখা শেষ করছি― “সমস্ত ধর্মই মিথ্যা,―আদিম যুগের কুসংস্কার। বিশ্বমানবতার এতবড় পরম শত্রু আর নেই।”

কবিতাগুচ্ছ ৮ -কবিরা
Nov. 18, 2024 | কবিতা | views:484 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দেরি

-প্রদীপ চক্রবর্তী


দুনিয়া চলে নিয়ম মেনেই

ভাগ্যের স্থান নেই,

নিজের উপর বিশ্বাস হারালে

ভয় চেপে বসবেই।


মানবধর্ম সেখায় যে প্রেম

তুমি-আমি একাকার,

যুক্তিবাদীরাই আসল ধার্মিক

দূর করে অনাচার।


আমরা সবাই হোমো স্যাপিয়েনস

রক্তের রং লাল,

আজকেই শোধরাও; করেছ যে ভুল

দেরি হয়ে যাবে কাল।


দুর্গা-কোরান

-অমিতাভ ভট্টাচার্য


একটা পুতুল একটা আরবি বই

ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!

রোজের জীবন এমনিতে জেরবার

"ধর্মতে হাত দিও না খবরদার ।"

পেট না ভরুক ধর্মরক্ষা হোক,

খরচা হবে খুচরো কিছু লোক ।

লাশের আবার জাতের বিচার চাই,

কে দুশমন কোনটা আমার ভাই?


একটা পুতুল একটা আরবি বই

ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!


রক্তখাকি ধর্মরা সব নাচে

ওপার তোমার, এপার আমার আছে ।

সীমান্ততে কঠিন কাঁটাতারে

ঘেন্নাকে কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে?

দুগ্গি ঠাকুর এবং আল্লা মিঞা--

কোনটা ক্রিয়া কোনটা প্রতিক্রিয়া?

আসুন, এবার সূক্ষ্মবিচার হোক

খরচা হলো খুচরো কিছু লোক ।


একটা পুতুল একটা আরবি বই

ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!



এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে

-আখতারুজ্জামান আজাদ


"এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে;

বক্ষ ভাসাও, ফিলিস্তিনে খুনের খবর পেলে।

রোহিঙ্গাদের দুঃখে তুমি এমন কাঁদা কাঁদো;

ভাসাও পুরো আকাশ-পাতাল, ভাসাও তুমি চাঁদও!

অশ্রু তোমার তৈরি থাকে— স্বচ্ছ এবং তাজা;

হ্যাশের পরে লিখছ তুমি— বাঁচাও, বাঁচাও গাজা।

কোথায় থাকে অশ্রু তোমার— শুধোই নরম স্বরে,

তোমার-আমার বাংলাদেশে হিন্দু যখন মরে?

মালেক-খালেক মরলে পরে শক্ত তোমার চোয়াল;

যখন মরে নরেশ-পরেশ, শূন্য তোমার ওয়াল!

তখন তোমার ওয়ালজুড়ে পুষ্প এবং পাখি,

কেমন করে পারছ এমন— প্রশ্ন গেলাম রাখি।

তোমরা যারা দত্ত-কুমার, মৎস্য ঢাকো শাকে;

কবির লেখা পক্ষে গেলেই ভজন করো তাকে।

মুসলমানের নিন্দে করে লিখলে কোথাও কিছু;

তালির পরে দিচ্ছ তালি, নিচ্ছ কবির পিছু।

কিন্তু তোমার অশ্রু, আহা, কেবল তখন ঝরে;

বাংলাদেশের কোথাও কেবল হিন্দু যখন মরে!

পুড়লে তোমার মামার বাড়ি, জীবন গেলে কাকুর;

তখন তোমার কান্না শুনি— রক্ষে করো, ঠাকুর!

কালীর ডেরায় লাগলে আগুন তখন কেবল ডাকো,

রহিম-করিম মরলে তখন কোথায় তুমি থাকো?

বাংলাদেশে সুশীল তুমি, ভারতজুড়ে যম;

মুসলমানের মূল্য তখন গরুর চেয়ে কম!

বাংলাদেশের কস্তা-গোমেজ— যিশুর দলের লোক;

বোমায় ওড়ে গির্জা যখন, তখন কেবল শোক।

বস্তাভরা শোকের রঙে কস্তা তখন রাঙে,

যিশুর নামে মারলে মানুষ নিদ্রা কি আর ভাঙে!

মরণ হলে মুসলমানের, হয় না কাঁদার ইশু;

গভীর ঘুমে থাকেন তখন বাংলাদেশের যিশু!

খেলার ওপর চলছে খেলা— টমের সাথে জেরি;

বঙ্গদেশের সন্তানেরা এমন কেন, মেরি?

তোমরা যারা কস্তা-গোমেজ কিংবা রোজারিও;

মুখের ওপর মুখোশ খুলে জবাব এবার দিয়ো।

রোহিঙ্গাদের রক্তে যখন বার্মা মরণ-কূপ;

বাংলাদেশের বৌদ্ধ যারা, মড়ার মতোন চুপ!

ভিক্ষু যখন বলছে হেঁকে— রোহিঙ্গাদের কাটো;

তখন কেন, হে বড়ুয়া, ওষ্ঠে কুলুপ আঁটো?

এমন করেই মরছে মানুষ ধর্ম নামের ছলে;

বাংলাদেশের বৌদ্ধ কাঁদে, বুদ্ধ যখন জ্বলে।

যখন জ্বলে বৌদ্ধবিহার, যখন রামুর পাহাড়;

সব বড়ুয়ার জবানজুড়ে শান্তিবাণীর বাহার!

শান্তিবাণীর এমন বাহার তখন কোথায় থাকে,

রোহিঙ্গারা যখন মরে নাফের জলের বাঁকে?

পাগড়ি দেখি, পৈতা দেখি, আকাশজুড়ে ফানুশ;

চতুর্দিকে চতুষ্পদী, হচ্ছি কজন মানুষ!

জগৎজুড়ে সৈয়দ কত, কত্ত গোমেজ-বসু;

খতম কজন করতে পারি মনের মাঝের পশু!

মরণখেলায় হারছে কে বা, জিতছে আবার কে রে;

মরছে মানুষ, দিনের শেষে যাচ্ছে মানুষ হেরে।

হারার-জেতার কষতে হিশেব মগজ খানিক লাগে,

একটুখানি মানুষ হোয়ো কফিন হওয়ার আগে।

রক্তখেলা অনেক হলো, সময় এবার থামার;

বিভেদ ভুলে বলুক সবে— সকল মানুষ আমার।

বন্ধ ঘরের দরজা ভাঙো, অন্ধ দু-চোখ খোলো;

মরছে কেন আমার মানুষ— আওয়াজ এবার তোলো।"




জ্যোতিষ শাস্ত্র ও দেশসেবা

-নির্মল

[দুই বন্ধু, একজন আরেকজনকে দেখে ডাকছে]


১ম বন্ধু :এই বন্ধু শোননা শোন শোন,

কি হলো, পালাস কেন!

আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?


২য় বন্ধু :তুই বড্ড পিছনে লাগিস,

অবান্তর প্রশ্ন করা তোর অসুখ।


১ম বন্ধু : যাব্বাবা! প্রশ্ন ছাড়া নতুন কিছু জানা যায় নাকি!

বিনা প্রশ্নে অন্ধের মতো মেনে নিলে,

জীবনটা তো হয়ে যাবে ফাঁকি।


২য় বন্ধু :এটাই তো তোর দোষ।

ছাড় ধুর!

শুনিস নি শাস্ত্রে বলা আছে,

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

সেই বিশ্বাসী তোর নাই।


১ম বন্ধু : তুই ঠিক বলেছিস ভাই,

অন্ধবিশ্বাস কিছুই আমার নাই।

শোননা,  আজ নতুন কথা বলব।

প্রমিস করছি, পিছনে লাগবোনা তোর।


২য় বন্ধু : মনে থাকে যেন, করছিস প্রমিস।


১ম বন্ধু: একদম, আয় না একটু গল্প করি,

তোর জন্য একটা ভালো কথা আছে।

তোর সাথে দেখা হল ভাগ্যিস।


২য় : আমার জন্য ভালো কথা!

চল ওই গাছ তলাতেই বসি।


১ম: চল তাই চল।


[দুই বন্ধু গাছ তলাতে গিয়ে বসলো]


২য়: বল এবার কী বলবি বল?


১ ম: আমি এতদিন জ্যোতিষ নিয়ে তর্ক করে,

করেছি ভুল খুব

তুই আসলে সঠিক ছিলি,

আমিই বেয়াকুব।


তুই কি জানিস, বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের মত

জ্যোতিষশাস্ত্রও  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে ;

জ্যোতিষ যদি ভুলিই হতো

সরকার কি এমন সিদ্ধান্ত নেয় তবে!


২য় : আবার তুই ঠাট্টা করছিস!

হেঁ হেঁ,

জ্যোতিষ শাস্ত্র সিলেবাসে -

ইম্পসিবল!


১ম : বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা,

পেপারে দিয়েছে দেখ তবে;

এইবার থেকে ইগনু বিশ্ববিদ্যালয়ে

জ্যোতিষ নিয়ে বছর দুয়ের

মাস্টার ডিগ্রি করা যাবে।


২য় : বলিস কি !

দেখি দেখি,

এমন হয় নাকি !

সে কি!


১ ম: এমনি হয়েছে বন্ধু আমার।


২য় : তাহলে,

খুব তো জ্ঞান মারতি আমায়,

আদিম  কুসংস্কার।

স্বার্থপর মানুষ ব্যবসা

সব জ্যোতিসি ভন্ড বলে,

বল বল এবার।


১ম : বললাম তো,

অন্যায় হয়েছে সরি

দেখ না!

কান ধরেছি দেখ,


২য় : থাক আর অভিনয় করতে হবে না,

তোর বিশ্বাস ফিরেছে,

এটাই অনেক।


বল তাহলে এরপর?


১ম : মাথায় একটা প্ল্যান আছে জব্বর।


দেখ তুই আর আমি ছাত্র ভালো।

ডিগ্রি কি আছে কম!?

ভাগ্য খারাপ, তাই বেকার বসে

চেষ্টা চলছে হরদম।


চল বন্ধু,

এবার জ্যোতিষ পড়ি,

ভাগ্য যাবে বদলে।

দেশে সেবার এই তো সুযোগ

হারাবি পায়ে ঠেললে।


২য় : অ্যাঁ! কি বলছিস যা্তা!

দেশসেবার সঙ্গে জ্যোতিষ, কি সম্পর্ক?

গেছে নাকি তোর মাথা।


১ম: আরে পাগল, আমার মাথা ঠিকই আছে।

একটু ভাবনা চিন্তা কর।

জ্যোতিষ পড়াচ্ছে কি এমনি এমনি,

সরকারের কোন দরকার!


দু'বছর পর দেখবি, কর্মক্ষেত্রে বড় বড় বিজ্ঞাপন -

অমুক বিভাগে মাস্টার ডিগ্রি জ্যোতিষ চাই।

এসসি ৩০, এসটি ১০, জেনারেল ৫০

মোট নব্বই জন।


সচিবপদ বিলুপ্ত হবে।

জ্যোতিষ হবে পরামর্শদাতা।

আরে পৌরাণিক যুগে যেমন হত।

জ্যোতিষীই শেষ কথা।


২য় : বন্ধু তোর অনেক ট্যালেন্ট,

আমি তাতো জানি।

কিন্তু,

জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ার আগেই,

শুরু করে দিলি ভবিষ্যৎবাণী!


১ম : হ্যাঁ, তুইও শুরু কর প্র্যাকটিস।


২য় : আমায় ছাড়,

তুইই জ্যোতিষের চাকরি নিস।


১ম: সে তো নেবই,

তলার পর তলা হাঁকিয়ে বাড়ি বানাবো।

ইনকাম ট্যাক্সহীন কোটি কোটি টাকা কামাবো।

আর, বিদেশী সব গাড়ি তো আছেই,

নেতা মন্ত্রী পুলিশ উকিল সব পকেটে পুরে,

সারা জীবন কাটাব মহা রঙ্গে।

চিন্তা নেই প্রিয় বন্ধু।

প্রমিস করছি,

তোকেও নেব সঙ্গে।


২য় : ছাড়, ওসব ছ্যাবলামি ছাড়!

আসলে গল্পটা তোর খারাপ লাগছে না,

ওটাই শুধু বলনা ভালবেসে।

জ্যোতিষের সঙ্গে দেশসেবা

কোনখানেতে মেশে।


১ম : দেশসেবা!

শোন তবে,


জ্যোতিষের কিছু সাধারন ক্ষমতায় আসি।

ভুল যদি কিছু বলি

তবে তোকেই,

ধরিয়ে দিতে হবে।


২য় : ঠিক আছে বল তবে।


১ম : জ্যোতিষী তো আয়ু বলতে পারে

হাত দেখে বা কুষ্টি বিচার করে।


২য় : তাতো পারেই।


১ম: আবার দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগও

কাটিয়ে দেওয়া যায়।

পাথর শেকর বেঁধে,

আঙুল, বাহু, মাজায়।


২য় : হ্যাঁ, তাও হয়।


১ম: আবার দেখি  বিজ্ঞাপনে,

জ্যোতিষীরা সিদ্ধহস্ত শত্রু দমনে।

বানমারা বিদ্যারও জ্ঞান রয়েছে,

পটু সব বশীকরণে।


২য় : এসব তো পারেই,

আসল কথায় আয় না -


১ম : বলতো প্রতিবছর আমার দেশে,

শহীদ হয় কত বীর সেনা।

কত মা সন্তান হারায়,

কত নারী স্বামী,

কত সন্তান পিতৃহারা হয়,

যারা আমাদের রক্ষা করে ;

তাদের জীবনটা এত কমদামী!

এদের জীবন রক্ষা করতে চাই,

জ্যোতিষের ক্ষমতা দিয়ে।

সরকারেরও হয়তো সেই ইচ্ছে

উন্নত জ্যোতিষী তৈরি করবে,

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে।


২য় : মানে কি?


১ম : মানে অতি সহজ কথা,

প্রথমত, সেনা রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে

থাকবে জ্যোতিষী পরামর্শদাতা।

হাত দেখে বা বিচার করে কুষ্টি

আয়ু তার কতদূর আছে দেখে,

তবেই নিযুক্ত করা হবে;

যদি জ্যোতিষীর হয় সন্তুষ্টি।

আয়ু যাদের কম আছে,

তারা প্রথমেই হবে রিজেক্ট,

মৃত্যুহার এমনিতেই কমবে,

রিক্রুটমেন্ট হবে পারফেক্ট।


২য় : কথায় তোর যুক্তি আছে,

বলে যা তারপর।


১ম : তারপর ধর যাদের আছে,

দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ,

অথবা যাদের উপর শনির দৃষ্টি,

ঘাড়ে চেপে রাহু কেতুর গুষ্টি,

তাদের ধরে -

নীলা গোমেদ ক্যাটসাই গুঁজে দেবে।

ব্যাস খেল খতম,

সবাই দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ থেকে রক্ষা পাবে।

শনি রাহু সব নিপাত যাবে,

শত্রু ছোড়া গুলি বোমা,

তখন অকেজো হবে।

বড়জোর থার্টি ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে,

কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে।


২য় : বাবা!

এরপরও কি আছে কোন প্ল্যান?


১ম: আর, শত্রু দমনের স্পেশালিষ্টদের,

বসিয়ে দেওয়া হবে বর্ডারের ধারে।

শত্রু সব বিনাশ করবে,

আধুনিক সব বাণ মেরে।

আর আনাচে-কানাচে যত আছে সব জঙ্গী,

যত আছে তাদের সঙ্গী,

এমন বশীকরণে বশ হবে সব যাতে;

ফ্রেন্ডশিপডে তে গোলাপ দেয় সব,

জনতার হাতে হাতে।


২য় :বন্ধু,

লজিক তোর পারফেক্ট আছে,

যতই করিস না ব্যাঙ্গার্থ।

জ্যোতিষের যখন এতই ক্ষমতা,

তখন এইসব তাদের পারা উচিত,

যাতে বাঁচবে জীবন, বাঁচবে দেশের অর্থ।


ধন্যবাদ বন্ধু,

এতদিন সত্যিই ছিলাম অন্ধ।

তোর লজিকেই কেটে গেল,

মনের সব দ্বন্দ্ব।

সত্যি, শিক্ষিত হলেই হয়না শুধু,

চাই যুক্তিবাদী মন,

যুক্তি দিয়ে বিচার করে

তবেই,

সত্যি-মিথ্যা করতে হয় গ্রহণ।

বুঝেছি এবার জ্যোতিষ শিক্ষা,

কেন চালু হল,

কি আসলে ওদের তাল,

দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে,

দেশটাকে লুটে পুটে খেয়ে,

পিছিয়ে  দেবার চাল।


১ম : ধন্যবাদ তোকেও বন্ধু,

তুই এত সহজেই গ্রহণ করেছিস সত্যযুক্তি।

সমাজটাকে এগোতে চাই,

এই সমস্ত কুসংস্কার থেকে মুক্তি।

চল আজ ওঠা যাক তবে,


[হাতের আংটিগুলো খুলে বন্ধুর কাছে এগিয়ে দিয়ে]

২য় : সে নয় হল,

কিন্তু, এই সোনা বাঁধানো লালনীল পাথরগুলোর কি হবে,

এই বাঁধন গুলো বিক্রি করে চল,

কার্শিয়াং ঘুরতে যাই।

মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেব,

কুসংস্কারকে করে বাই বাই।

আইডিয়াটা কেমন বল ,

কি বলতে চাস?


১ম : চল তবে,

ডাকছে আকাশ ডাকছে বাতাস,

মুক্ত বাতাসে নেবই শ্বাস।

সংকটে নাগরিকত্ব! -স্বর্ণাভ ভট্টাচার্য
Nov. 18, 2024 | রাজনীতি | views:7566 | likes:0 | share: 0 | comments:0

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ও তৎজনিত পরিস্থিতি এবং লকডাউনের জন্য স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে আজও। করোনার খবর ছড়াবার আগে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল "নো এনআরসি মুভমেন্ট" বা এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, যা এখনো চলমান। ২০১৯ সালে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনের পর সক্রিয়ভাবে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী চালু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার সাথেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল প্রস্তাবিত হয়। একই সালে অসমে সংগঠিত এনআরসিতে প্রায় ১৯ লাখ মানুষের নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ গেছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণ সংগঠন, ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল এনআরসি এবং সিএএ-র বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছেন ; সর্বোপরি প্রতিবাদে সরব হয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এত আন্দোলন সত্ত্বেও ২০১৯ এর ১১ই ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয় এবং ১২ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ -এ পরিণত হয়। ইতিপূর্বেই সরকার ও বিরোধী বিভিন্ন দলগুলো নিজেদের স্বার্থে উক্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করেছে, যাতে সমস্যায় পরছেন সাধারণ মানুষ।


এবার স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এনআরসি কী? সিএএ কী? এবং এর বিরোধিতাই বা কেন করা হচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে অতীতে।


১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে দেশে সংবিধান কার্যকরী হয়। এর পর থেকে বারবার সংবিধানের মূল কাঠামো এক রেখে, অন্যান্য বিষয়ে সংযোজন, কাটছাট চলেছে বিভিন্ন আইনের। সেরকমই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা দেশের নাগরিকত্বকে সংজ্ঞায়িত করে, সেটাই হলো ১৯৫৫ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫ (সিএ ১৯৫৫)। এই আইন অনুসারে, পাঁচ ধরণের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ায় অসুবিধা নেই —

১) উক্ত ব্যক্তির জন্ম ভারতে হলে, ২) উক্ত ব্যক্তির বাবা মা দেশের নাগরিক হলে, ৩) নাগরিকত্বের আবেদন করলে, ৪) ন্যাচারালাইজেশন বা স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে (অর্থাৎ যাঁরা আইনত নাগরিক না হলেও, বহুবছর থাকার ফলে দেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমস্ত কিছুর সাথেই মিশে গেছেন), ৫) ইনকরপোরেশন অফ টেরিটরির মাধ্যমে, অর্থাৎ কোনো জায়গা পরবর্তীতে দেশে অন্তর্ভুক্ত হলে, সেই এলাকার প্রত্যেকে ভারতীয় নাগরিক হবে। অতএব, ১৯৫৫ এর নাগরিকত্ব আইন জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করছে।


পরে বিভিন্ন সরকারের আমলে অন্যান্য আইনের মত সিএ, ১৯৫৫ -এরও সংশোধনী আনা হয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেকবারই নাগরিকত্বের অবকাশ হয়েছে সংকীর্ণতর। ১৯৮৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই পর্যন্ত জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।


পরবর্তী সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত সংশোধনীটি হল ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩)। এখানেই প্রথম নাগরিকত্বের প্রশ্নে এনআরআইসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস)-র মাধ্যমে ইললিগ্যাল মাইগ্রেন্ট বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত এবং তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলে। বাতিল এই আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই থেকে সিএএ ২০০৩ কার্যকর হওয়ার দিন ২০০৪ সালের ৩ রা ডিসেম্বর পর্যন্ত জন্মানো ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে তার বাবা বা মায়ের একজন ভারতীয় নাগরিক ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। তাহলেই তিনি ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হবেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে,, যাদের সিঙ্গেল পারেন্ট বা যারা অনাথ আশ্রমে পালিত, তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? তাছাড়াও দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ বন্যা, ধস, দুর্যোগ কবলিত উপকূলীয়, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করেন, যেখানে প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে বাঁচা, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের উপযুক্ত কাগজ কীভাবে তাদের সংগ্রহে থাকবে? যাঁরা উদ্বাস্তু, তাঁরা কাগজ কোথায় পাবেন?

                                


সিএ ১৯৫৫ -এর এই সংশোধনীতে "১৪ক" ধারা যুক্ত করা হয়, যার দ্বারা সরকার দেশজুড়ে এনআরআইসি করার ক্ষমতা পায়। এর মাধ্যমে পূর্বোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করবে সরকারি আধিকারিকেরা। প্রসঙ্গত, এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ সিটিজেনস) এবং এনআরআইসি প্রায় একই ব্যাপার। পার্থক্য শুধুমাত্র, এনআরআইসি দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জী তৈরির প্রক্রিয়া ও এনআরসি হল একটি বিশেষ স্থানের নাগরিকপঞ্জীর তৈয়ারী (যেমন, ২০১৯ সালে অসমের ঘটনাটি)।


সিএএ ২০০৩ ছড়ায় সেই সম্বন্ধীয় বিভিন্ন নিয়মাবলী সংকলিত হয় সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস ২০০৩ -এ। এর ৩ নাম্বার রুলে হলো এনআরআইসি তৈরির নিয়ম রয়েছে। উক্ত রুলের (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এই (নাগরিক পঞ্জী) বিষয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে তার মধ্যে স্থানীয় রেজিস্টারের এক্তিয়ারে বসবাসকারী ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে "পপুলেশন রেজিস্টার" তৈরি করতে পারে। উক্ত রুলের (৫) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে "লোকাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস" অর্থাৎ স্থানীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হবে। এখানে চলে আসে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিষ্টার অথবা সংক্ষেপে এনপিআরের প্রসঙ্গ।


পূর্বে বলা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এর ৪ নাম্বার রুলের (৩) ও (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য স্থানীয় রেজিস্টার দ্বারা যাচাই করা হবে। যাচাইয়ের সময়ে যাদের "সন্দেহজনক নাগরিক" বলে মনে হবে, স্থানীয় রেজিস্টার তাদের বিষয়ে পপুলেশন রেজিস্টারে উল্লেখ করবেন। সেই বিষয়ে তদন্ত করা হবে ও সেই ব্যক্তিকে এব্যাপারে জানানো হবে।


এনপিআরে নথিভুক্ত করা হবে, আধার নাম্বার, বাবা মায়ের তথ্য, তাঁদের জন্মানোর স্থান- কাল জানাতে হবে। সমস্যার বিষয় হলো, "সন্দেহজনক নাগরিক" দাগানো এড়াতে কোন কোন তথ্য দেওয়া আবশ্যিক, তা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এ উল্লেখ নেই। অতএব, বোঝা যাচ্ছে এই "সন্দেহজনক" তকমার ব্যাপারটি একান্তই রেজিস্টার বা তৎস্থানীয় আধিকারিকের হাতে, যেখানে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় রয়েছে। আবার এদিকে, আধার কার্ডের সাথে আমাদের বায়োমেট্রিক্স অর্থাৎ আঙ্গুলের ছাপের তথ্য থাকে, যা এনপিআরে সংগ্রহ করা হবে। কেন্দ্রের উদ্যোগে প্যান কার্ড, মোবাইল সিম, ভোটার কার্ড প্রভৃতি সবকিছুর সাথেই আধারের সংযোগ করা হচ্ছে। এর ফলে যে কোনো ব্যক্তি চব্বিশ ঘন্টা রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।


জানা যাচ্ছে, এনপিআর ও জনগণনা একই সাথে করার কথা হয়েছে, যা একজন সরকারি আধিকারিক কর্তৃকই সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ, অজ্ঞাতসারেই একজন ব্যক্তি তাঁর তথ্য দিতে বাধ্য হবেন।


প্রসঙ্গত এনপিআর কিন্তু নতুন ব্যাপার নয়, সিএ ১৯৫৫ -তেও এর উল্লেখ আছে। যদিও এবারের এনপিআর আসলেই এনআরসির পূর্বধাপ।


উল্লেখ্য, ২০১৯ -এ অসমে ঘটা এনআরসির আগে এনপিআর করা হয়নি। "আসাম পাবলিক ওয়ার্কস" নামের সংস্থার পক্ষ থেকে ২০০৯ সালে আবেদন করা হয় আ অসমে নাগরিক পঞ্জী আপডেট করার, যার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট তা করতে অর্ডার দেয়। "আসাম অ্যাকর্ড" অনুযায়ী (যা, সিএ ১৯৫৫ -এর ৬ক ধারা হিসাবে যুক্ত করা হয়েছিল), অসমের কাট অফ ডেট ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ। অর্থাৎ অসমের মানুষদের প্রমাণ করতে হয়েছে, "কাট অফ ডেট" অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের আগে থেকেই তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষ ভারতের নাগরিক। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি নথিকে তালিকা ক -তে এবং ৮ টি নথিকে তালিকা খ -তে (যদি তালিকা ক'র নথিগুলি পূর্বপুরুষের হয়ে থাকে, তবে নিজের জন্য এই নথি প্রয়োজন) ভাগ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও, অসমে ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারায়, তাদের মধ্যে ১৪ লক্ষ হিন্দু।

                            


ধারণা করা হচ্ছে, সমগ্র ভারতে যদি এনআরআইসি করা হয়, সেক্ষেত্রে এই কাট অফ ডেট হবে ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাই। কারণ, সংবিধানের ৬ নাম্বার ধারায় বলা হচ্ছে, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের পরে ভারতে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে। আর এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশে নাগরিক পঞ্জী গঠনের কাজে এই তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।


এবার আসা যাক, সিএএ ২০১৯ প্রসঙ্গে। এই সিএএ ২০০৩ -এর পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত্ব আইন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব সংবাদপত্র "দি গেজেট অফ ইন্ডিয়া"তে এই আইনটি প্রকাশ করেছেন ভারত সরকারের সচিব ডাঃ জি. নারায়ণ রাজু। ১০ই জানুয়ারি, ২০২০ তারিখ থেকে এই আইন লাগু হয়েছে।


সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই সিএএ আসলে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, আক্ষরিকভাবে তা সত্যিও। সিএএ ২০১৯ আইনটিতে নাগরিকত্বের আবেদন করার ভিত্তিতে (অতএব এনআরসিতে যারা নাগরিকত্ব হারাবেন, তাদের আবেদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) কারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবে, সে বিষয়ক। এই আইনের নব্য সংশোধনীগুলি হলো—


১) এই আইনে সিএ ১৯৫৫-এর ২ নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে যুক্ত করা নিয়মটি হলো —

     "আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান মানুষ, যারা ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ -র আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন, এবং যাদেরকে কেন্দ্র সরকার দ্বারা বা পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন ১৯২০-র ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারায় (গ) শর্ত অনুযায়ী অথবা বিদেশী আইন ১৯৪৬ (ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬)-এর নিয়ম প্রযুক্ত করে বা এদের অন্তর্ভুক্ত কোন নিয়ম বা আদেশ জারি করে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে এই আইনের আওতায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না।"


২) এক্ষেত্রে মূল আইন সিএ ১৯৫৫-য় ৬খ ধারার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এতে বলা হয়, অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার উপজাতি অঞ্চল এবং বঙ্গীয় পূর্ব সীমান্ত বিধেয়ক ১৮৭৩-এ নির্দেশিত অন্তর্বর্তী সীমা অঞ্চল বাদে দেশের অন্য স্থানে যদি পূর্বোক্ত নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে উল্লিখিত ব্যক্তির নাগরিকত্বের আবেদন কেন্দ্র সরকার বা তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সমস্ত নিয়ম মেনে নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দিতে পারেন। সমস্ত শর্ত মেনে শংসাপত্র পাওয়ার দিন থেকেই সেই ব্যক্তি ভারতের প্রবেশের দিন থেকেই নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন এবং এই আইন জারির দিন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব বা অবৈধ অনুপ্রবেশ বিষয়ক যেকোনো মামলা মকুব হয়ে যাবে। কোনো ব্যক্তি উক্ত ধরণের মামলা চলার কারণে নাগরিকত্বের আবেদন করতে অক্ষম হবেন না এবং আবেদন করলেও (অর্থাৎ নিজের বর্তমান নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা) আগের সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা তিনি যেমন পেতেন তেমনি পাবেন। উল্লেখ্য, এখানে "অন্তর্বর্তী সীমা"(ইনার লাইন) বলতে বোঝায় ভারত সরকার দ্বারা বিশেষভাবে সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে, যেসব অঞ্চলে যেতে গেলে যে কোনো সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের "ইনার লাইন পারমিট" নামক বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন।


৩) এই আইনের ৭ঘ ধারার সংশোধনী অনুযায়ী, ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিদেশী নাগরিক ভারতের কোনো আইন লঙ্ঘন করলে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই আইন দ্বারা কোনো আদেশ জারি করা যাবে না। 


৪) আইনের ১৮ নাম্বার ধারার সংশোধনীতে, এই ধারার (২) নাম্বার উপধারায় (গগ) শর্তের পরে (গগঝ) শর্ত যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হচ্ছে, নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দেওয়ার শর্ত, বিধিনিষেধ ও উপায় ৬খ ধারার (১) নাম্বার উপধারা অনুসারে হবে।


৫) শেষত, আইনের তৃতীয় ভাগের (ঘ) শর্তে সংযুক্ত হওয়া নিয়মে বলা হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে, উক্ত শর্তের হিসেবে, ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্য  ভারতে বসবাসের বা চাকরির প্রামাণ্য মেয়াদ এগারো বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হলো। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি পাঁচ বছর (৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ -র আগে থেকে) দেশে রয়েছে বা চাকরির সাথে যুক্ত, তা প্রমাণ করতে হবে।


গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এনআরসি করার কথা বলা হয়েছে সিএএ ২০০৩ -এ, সিএএ ২০১৯ -এ নয়। সুতরাং, যারা এনআরসি ও সিএএ ২০১৯ -এর বিরোধিতা করছেন, তাদের উচিত সমভাবে সিএএ ২০০৩ -এরও বিরোধিতা, কারণ এনআরসির মূল এই আইনই।


ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সিএএ ২০১৯ -তে মাত্র ৩১৩১৩ জনই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। বাকিরা আবেদনও করতে পারবে না। সেই ৩১৩১৩ জনকে হতে হবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান — এই ৬টি ধর্মের মানুষ, যারা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা এদেশে এসে সে বিষয়ে সরকারকে না জানালে, তাদের সিএএ ২০১৯ দ্বারা নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যারা তাদের এদেশে আসার কথা জানাবেন, সেই ৩১৩১৩ জনকে "রেজিস্টার্ড রিফিউজি" বলা হচ্ছে। যদিও তাদের প্রত্যেকেই যে নাগরিকত্ব পাবেন, এমনটাও আশা করা যায় না। কারণটা বলি তাহলে।


কারোর এনআরসিতে নাম বাদ যাবার দিন থেকে (অর্থাৎ নাগরিক পঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে, যাতে সেই ব্যক্তির নাম নেই) ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিজেকে ভারতীয়ত্ব দাবি করতে হবে। এ জন্য তাকে দ্বারস্থ হতে হবে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে, যা একজন সাধারণের মানুষের জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য। প্রমাণ স্বরূপ তাকে পূর্বোক্ত ৬টি ধর্মের একটির অনুসারী হতে হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরু (মুসলিম) দ্বারা নির্যাতিত হয়ে যে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন তাদের ওই দেশের এফআইআরের কপি বা অন্য লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে, যে তাদের ওপর সংখ্যাগুরু দ্বারা অত্যাচার করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্যের যাচাই করবে আরএডব্লিউ (র), ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রভৃতি ইন্টেলিজেন্স। তারা নিজেদের কূটনৈতিক চর দ্বারা উক্ত দেশে গিয়ে যাচাই করবে, নাগরিকত্বের আবেদনকারী ব্যক্তির প্রদান করা তথ্য ও ঘটনার উল্লেখ সঠিক কি না! তারপর যদি প্রমাণিত হয় ব্যক্তির তথ্য সঠিক, তবে তিনি নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া।


এতক্ষণ আমরা দেখলাম, নাগরিকত্ব পাওয়ার লড়াইয়ের কথা। স্পষ্টত বোঝা গেল, সিএএ ২০১৯ আইনে সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্বের আবেদনের ব্যাপারটা বিশেষভাবে অনুল্লিখিত থাকলেও, বিপদে পরবেন সমস্ত ধর্মের মানুষ, যে বিষয়ে সতর্ক আমাদের প্রত্যেককেই হতে হবে। শুধু অসমে ১৯ লাখ মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ গেছে, সেখানে  দেশব্যাপী এনআরআইসি হলে অথবা কোনো রাজ্যে/জোনে এনআরসি হলে, কত মানুষের নাম বাদ যাবে তার একটা ধারণা করতেই পারি। আর সেই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে মুসলিম বাদে আবেদনই করতে পারবেন না ৩১৩১৩ জনের বেশি, যাদের আবার প্রত্যেকে নাগরিকত্ব পাবে কি না, যথেষ্ট সংশয়ের।


এবার, আইনের মারপ্যাঁচে যারা বাদ গেলেন বা যাবেন, তাদের ঠাঁই কী হবে? তাদের থাকতে হবে ডিটেনশন সেন্টারে, যতদিন না সেই ব্যক্তিকে কোনো দেশ নিজের অধিবাসী হিসাবে শংসাপত্র দিচ্ছে। আর এই বিশাল সংখ্যক মানুষ দায় কি অন্য দেশ নেবে? শেখ হাসিনা তো পরিষ্কার জানিয়েই দিয়েছেন, বাংলাদেশের কেউ ভারতে প্রবেশ করেনি, অর্থাৎ এত মানুষের দায় তারা নেবেইনা। তাহলে, তাদের কি সারাজীবনের জন্য ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?


ডিটেনশন সেন্টারের প্রসঙ্গ কেন এলো, তা আলোচনা করা যাক। কোনো নাগরিকত্ব আইনেই বলা নেই, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষের, যারা অবৈধ নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তাদের পরিণতি কী হবে! তাই ভারতীয় আইনসমূহের অন্য দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তা সেই আইন হচ্ছে, পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ এবং বিদেশী আইন, ১৯৪৬। পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ -এর ৫ নাম্বার ধারা অনুযায়ী, ভারতের নাগরিক নয় এমন কোনো ব্যক্তির যদি বৈধ পাসপোর্ট না থাকে, অথবা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে এবং তা পুনর্নবীকরণ করা না হয়ে থাকে, তবে সেই ব্যক্তি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। বিদেশী আইন, ১৯৪৬ -এর ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারার (ঙ) শর্তে বলছে, দেশে থাকা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তি নির্দিষ্ট স্থানে সরকার আরোপিত সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে আটক থাকতে বাধ্য হবে। তার সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, যেমন পরিচয়, স্বাক্ষর, আঙ্গুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক্স), ছবি ইত্যাদি সবকিছুই সরকারকে জানাতে বাধ্য থাকবে। সে সরকার কর্তৃক মেডিকেল পরীক্ষা করাতে বাধ্য হবে। সে সরকার নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা কাজ বা জিনিসের সাথে সংশ্রব না রাখতে বাধ্য থাকবে। পক্ষান্তরে, তার সমস্ত গতিবিধির ওপরই নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আর এখান থেকেই আসে ডিটেনশন সেন্টারের ধারণা, যা আসলে কিছু সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত বৃহৎ জেলখানা ছাড়া অন্য কিছু না।


যেহেতু, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষ নাগরিক বলে গণ্য হবে না, বরং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা জুটবে তাদের, তাই তাদের ঠিকানা হবে ডিটেনশন সেন্টার। ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে সরকারের তরফে জানানো হয়, অসমে গোলপাড়া, ডিব্রুগড়, শিলচর, তেজপুর, জোরহাট, কোকরাঝাড় — এই ৬টি জায়গার ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে ১০৪৩ জনকে। কেরালায় তৈরি হচ্ছে ডিটেনশন সেন্টার। আসলে কেন্দ্র যদি এনআরসি তৈরীর নির্দেশ দেয়, যে কোনো রাজ্য সরকারই তা মানতে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে কোনও রাজ্য কোনো প্রস্তাব নিয়ে এলে, তা হবে অসাংবিধানিক। স্বভাবতই বিভিন্ন রাজ্য ডিটেনশন সেন্টার বানাবার চেষ্টাতেই আছে। ফলে আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে, এনআরসি চালু হতে দেরি নাই। এত কিছুর মধ্যে সমস্যা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা এখনো বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়নি এবারের এনআরসিতে নাম তোলার জন্য কী কী তথ্য লাগবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সরকারি নির্দেশের। 


সুতরাং ক্রমানুযায়ী একবার রিপিট করা যাক লেখার বিষয়বস্তু। সিএএ ২০০৩ আইনে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর কথা রয়েছে। এনআরসির আগে এনআরপি বা জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন তৈরি হবে, যেখানে দেশের সমস্ত ব্যক্তির তথ্য নেওয়া হবে। তারপর সরকারি আধিকারিক দ্বারা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের নোটিশ পাঠানো হবে সরকার নির্দিষ্ট তথ্যাদি জমা করে প্রমাণ করতে হবে সেই ব্যক্তি অথবা তার পূর্বপুরুষ ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের আগে দেশে এসেছেন। এই সমস্ত নথি বিশ্লেষণ করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী প্রকাশ হবে। তাতে যাদের নাম বাদ যাবে, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে, যে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মের) এবং সেই দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে আসার লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে। এই আবেদন করতে পারবেন ৩১৩১৩ জন। প্রমাণসমুহ ইন্টেলিজেন্স দ্বারা সেদেশে গিয়ে যাচাই করা হবে। এর পরেও যারা নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন না, তাদের ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প।


প্রশ্ন আসে, এতকিছু করার কারণ কী? সরকারে থাকা লোকজন বলছে, "বহিরাগত", "অনুপ্রবেশকারী"দের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে নাকি এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে সুযোগ সুবিধা শুধু দেশের লোক পায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই কি তাই? এতদিনের যে নাগরিক কোনো কারণে নথি জোগাড় করতে পারেনি বা সব নথি দেওয়ার পরও যার নাম বাদ গেল এনআরসিতে, যাদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং ভবিষ্যতে যাদের এরকম ঘটবে, তাদের দায় কে নেবে? নাকি শুধু সবটাই কর্পোরেট স্বার্থে সস্তা শ্রমিক তৈরির প্রক্রিয়া? এনআরসি, সিএএ ২০০৩ ও সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করতে হবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে। যতদিন না এই জনবিরোধী আইনগুলো বাতিল হচ্ছে, ততদিন মানুষের মাথার ওপর নাগরিকত্ব হারানোর খাঁড়া খুলতেই থাকবে।


আশা করি, লেখাটি বিভ্রান্তি দূর করতে কাজে আসবে। লেখায় কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন। লিখতে গিয়ে সাহায্য নিয়েছি অভিষেক দে দা, মাসিদুর রহমান দা, সব্যসাচী মুখার্জি দা এবং আরও অনেকের কাছে, প্রত্যেককে অবশ্য ধন্যবাদ।


তথ্যসূত্রঃ–

১)CA 1955 https://www.tiss.edu/uploads/files/Citizenship_Act_1955.pdf&ved=2ahUKEwiuufLsjNbzAhXSyzgGHX3WCQsQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw0OSVMwxaKaKRw0wliF9gO3)

২) CAA 2003 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2004/E_7_2011_119.pdf&ved=2ahUKEwiUhMC6jNbzAhXGfX0KHXb2AiMQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw3HEMnIPp6gTHP7YPkdiSAP)

৩) CAA 2019 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2019/214646.pdf&ved=2ahUKEwjJjtWFjNbzAhVEb30KHXjoDBIQFnoECAMQAQ&usg=AOvVaw0NLqZ7NbWW-sXe1LSfFMBl)

৪) Citizenship Rules, 2003 (https://drive.google.com/file/d/1GRr0YEJ5Ouj03GKJR5ZOR4ie9XoojHTq/view)

৫) Foreigners Act, 1946 (https://legislative.gov.in/sites/default/files/A1946-31.pdf&ved=2ahUKEwik6Or0jtbzAhU3wjgGHRFxClYQFnoECAoQAQ&usg=AOvVaw0lIoWd8Cd4aAVryywGGuuO)

৬) The Passport (Entry Into India) Act, 1920 (https://www.mha.gov.in/PDF_Other/act1920_17042017.pdf&ved=2ahUKEwict6e5j9bzAhVKWysKHUqNAYUQFnoECAcQAQ&usg=AOvVaw3b-xdEGxqKmLHMWolpMTgi)

Email — swarnavabhattacharya9@gmail.com

সাম্প্রদায়িকতার বিষ -শীলা মোস্তাফা
Nov. 18, 2024 | সাম্প্রদায়িকতা | views:661 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন” আসলে পুরোনো শকুন বলে কিছু নেই। সেই শকুনেরা আমাদের মাঝেই বাস করে। আর সেই শকুনদের দুধকলা দিয়ে পোষেন সরকার। সেই শকুনদের হৃষ্টপুষ্ট রাখতে সরকারী টাকায় মসজিদ তৈরি হয়, তাদের আদর্শের ধারক বাহক তৈরির জন্য হাজার হাজার মাদ্রাসা তৈরি হয় যেখানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, নেই জাতীয় সঙ্গীত, নেই ধর্ম নিরপেক্ষতা, নেই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা।


বাংলার মাটিতে বাংলার মুসলমানরা বার বার প্রমাণ করেছে ইসলাম শান্তির ধর্ম নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অর্থ বোঝার মত শিক্ষায় শিক্ষিত নয় তারা। এরা যেই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত সেখানে মূলমন্ত্র “জেহাদ” “বিধর্মী” আর তার সাথে সমাধান “বেহেস্ত”। তাদের মগজ এই তিন শব্দের কাছে জিম্মি। তাই পৃথিবীর শান্তি, প্রতিবেশীর শান্তি, রক্তমাংসের মানুষের জীবন তাদের কাছে মূল্যবান নয় । ইসলাম যে অসহনশীল, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গির ধর্ম এটা বার বার প্রমাণ হয়েছে। ইসলামে শান্তির সংজ্ঞা হচ্ছে অন্য মত অন্য ধর্মের মানুষকে খুন, ধর্ষণ, হত্যা করা। আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা।


কোরান ত্রিপিটক, রামায়ণ, বেদ সে তো শুধু পুস্তক। তার অবমাননা হয় না, আকাশ উড়ালেও না, আগুনে পোড়ালে না। অবমাননা হয় তখন যখন ওই পুস্তকে যা লেখা সেটা তার অনুসারী ধার্মিক যদি ধারণ করতে না পারে। তুমি ধর্ম পালন করবে, নামাজ পড়ে কপালে দাগ করে ফেলবে কিন্তু মানুষ নামে রক্তেমাংসে গড়া মানুষকে অবমাননা করবে, তার বেলা…? আর কত চলবে এই অনাচার? আর কত চলবে হিন্দুর বাড়ীতে আগুন দিয়ে দখলদারি, আর কত চলবে পূজার মূর্তি ভাঙ্গা, কত হিন্দু শিশু ধর্ষিত হবে? আর কত চলবে ভয়ভীতি দিয়ে তৈরি করে বাংলাদেশকে বৃহত্তর পাকিস্তানি তালেবানী রাষ্ট্র তৈরি করা?

সরকারের কোন দায় নেই এর পেছনে? উন্নয়ন কি শুধু বড় বড় অট্টালিকা, ব্রিজ, পদ্মা সেতু? শুধু দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন হলেই কি দেশের উন্নয়ন হবে? কেন মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে না? কেন সরকারের টাকায় মসজিদ আর মাদ্রাসা তৈরি করে তাতে এইসব জঙ্গি লালন করা হচ্ছে? কেন কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না এই নপুংসকদের? এই সরকারের দরকার ভোট, না না কি বললাম ভোটের তো দরকার নেই। জনগণের জন্য ভাবার কোন দরকার নেই। যাদের দরকার তাদের তো কুক্ষিগত করা আছে, তারা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, সংবাদ মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম। হেফাজতের হেফাজতকারি সরকারের জন্য জনগণের প্রয়োজন নেই, মৌলবাদের প্রজনন চলুক। এই সরকারের মুখে মুখে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” অন্তরে “মদিনা সনদ”। এই নিয়ে দেশে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করা যাবে না।

তবুও মানুষ জাগবে

শুনে রাখো

তুমি তোমরা যতবার ধ্বংস করবে

আমরা ততবার সেই আগুন থেকে বেরিয়ে আসব,

যতবার গলা টিপে ধরবে ততবার

তারও অধিক চিৎকার হয়ে ফিরে আসব।

এ মাটিতে ঈদ মহরামের মত শারদীয় দুর্গোৎসব হবে,

বড়দিন পালন হবে, হবে মানবতা জয়গান।


মসজিদে আজান হবে, মন্দিরে ঘণ্টা বাজবে।

যদি অধিকার থাকে ঈদ মহরমের

অধিকার থাকবে পূজা পার্বণ কিংবা

শুধুই মানবতার।

কলকাতার জলাভূমি এবং এক পরিবেশবিদ। -সৌরদীপ চ্যাটার্জী
Nov. 18, 2024 | পরিবেশ | views:9715 | likes:56 | share: 253 | comments:0

আপাতত টিভি আর খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গ। দামোদর, অজয়, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ—রাঢ়বঙ্গের আপাত নিরীহ নদীগুলি রীতিমত ফুঁসছে! কলকাতায় কিছুদিন আগে অবধি বিভিন্ন জায়গায় জল জমে ছিল, সেই জল থেকে তড়িদাহত হয়ে দু’টি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটল। সবাই দেখছেন, হইহই করছেন, ফেসবুকে ‘দুয়ারে দীঘা’, ‘লন্ডন বানাতে গিয়ে ভেনিস’ ইত্যাদি ক্যাপশন জুড়ে দিচ্ছেন। কিছুদিন আগে আনন্দবাজারের ভেতরের পাতায় একটা ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল। “বেআইনি দখলদারির চোটে আন্তর্জাতিক মর্যাদা হারানোর আশঙ্কা পূর্ব কলকাতা জলাভূমির”। কেউ দেখেছিলেন এবং সেই নিয়ে হইচই করেছিলেন বলে মনে পড়ে না।

এইভাবেই সামনে আসে ফলাফল, পেছনে থেকে যায় কারণগুলো।

জলাভূমিতে ভৌতিক রহস্য বা আলেয়ার গল্প আমরা ছোটবেলায় অনেক শুনেছি! কিন্তু গোটা জলাভূমিটাই যদি হয়ে ওঠে এক রহস্য? এরকমই এক রহস্যময় জলাভূমি হল ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি’। যারা নলবন বা নুনের ভেড়িতে শীতকালে সামান্য উষ্ণতার খোঁজে পিকনিক করতে যান, তারা হয়ত জানেনই না, জায়গাটা একটি আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত ‘সাইট’; শুধু তাই নয়—বাংলা বা ভারতে নয়, সারা পৃথিবীরই একটি বিরল বিস্ময়! খুব সামান্য কয়েকজন হয়ত নামটা জানেন—‘রামসার সাইট!’ জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ আন্তর্জাতিক চুক্তি। ইরানের একেবারে উত্তরে, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে পাহাড়ে ঘেরা রুক্ষ ছোট্ট শহর রামসার, হাজার তিরিশ মত লোকের বসবাস। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে এখানেই বসেছিল জলাভূমি নিয়ে এক আন্তর্জাতিক বৈঠক। তখনও ইরান শাহের অধীনে। ইরান সরকার বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রাথমিকভাবে ঠিক ছিল বৈঠক হবে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অন্য এক শহরে—নাম বাবোলসার। কিন্তু ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে সিদ্ধান্ত বদলে বৈঠক সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ১৭৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, রামসারে। মাত্র ১৮ টি দেশ প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল, আশ্চর্যজনকভাবে, তাতে ছিল ভারতও। তখন রামসারে এয়ারপোর্টও ছিল না। তেহরানে সবাই জমায়েত হলেন, তারপর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হল প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে। সম্মেলন শুরু করলেন খোদ ইরানের রাজপুত্র, আবদুল রেজা পহলভী। ৩ ফেব্রুয়ারি সেই সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার স্বাক্ষরিত হল—যে শহরের নামও কেউ জানত না, সেই শহরের নামে তার নাম হয়ে গেল ‘রামসার কনভেনশন অফ ওয়েটল্যান্ডস’। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ১৭১, সদর দফতর সুইজারল্যান্ডে।

বর্তমান ভারতে রামসার সাইটের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। তালিকায় আছে চিলিকা হ্রদ, মণিপুরের লোকটাক হ্রদ, কোল্লেরু হ্রদ, লোনার ক্রেটার, ভিতরকণিকা, কাশ্মীরের উলার হ্রদ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আছে দু’টি। দ্বিতীয়টি আয়তনে ভারতের বৃহত্তম রামসার সাইট—সুন্দরবন। সুন্দরবন বহুল আলোচিত, চর্চিত এবং দর্শিতও। সারা বছর দেদার লোক বেড়াতে যান, পাঠ্যবইতে বাচ্চারাও পড়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রামসার সাইটটি আমাদের চোখের সামনেই যেন অদৃশ্য হয়ে রয়েছে।

অদৃশ্যই বটে। কারণ আজ থেকে মাত্র তিরিশ বছর আগেও পুরোটাই ছিল রহস্যে ঘেরা। কীরকম রহস্য? প্রকৃতির এক বিচিত্র রহস্য! ভৌগলিকভাবে কলকাতা ভারতের অন্যতম নিচু শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাপলে চার-পাঁচ মিটারও হবে কিনা সন্দেহ! কলকাতার পশ্চিমে গঙ্গা, অথচ শহরের ঢাল পুবে। প্রতিদিন শহরে প্রায় সাতশো মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে এই পরিমাণ বর্জ্যকে সাফাই করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিকাশি প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়। কলকাতায় এমন একটিও ‘প্ল্যান্ট’ নেই। ছিলও না কোনোকালে। শহরও অত্যন্ত নিচু অববাহিকায়। তারপরেও, নোংরা জলে সেরকম বিশাল মাপের দূষণের কোনও খবর আসে না। তাহলে ওই অতখানি নোংরা জল যায় কোথায়?

ওপরের পুরো প্রশ্নটা আসলে বর্তমানকালের নয়, হবে অতীতের হিসেবে। সময়টা আশির দশক। প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল একজন সরকারি অফিসারের মাথায়। তিনি ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। পেশায় রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র—ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশাপাশি রীতিমত ইকোলজি বা বাস্তুবিদ্যায় পিএইচডি। রাজ্যে তখন সদ্য এসেছে বামফ্রন্ট সরকার। তাদেরই নির্দেশে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমে পড়েছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। চারিদিকে অনুসন্ধান চালালেন। নিকাশি প্ল্যান্টের কার্যপদ্ধতি বুঝতে মুম্বইয়ের ‘দাদার সিউয়েজ প্ল্যান্ট’ ঘুরে দেখে এলেন। কিন্তু কোথাও কিছুই জানা গেল না। কলকাতার বর্জ্য জলের নিকাশি কোথায়, কলকাতার কেউ জানে না। সেই জল কোথায় যায়—তাও কেউ জানে না। অন্যান্য শহরে যে জলের নিকাশিতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, কলকাতায় যেন সেই জল ম্যাজিকের মত ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যায়। শেষে একদিন তিনি নেহাতই ঘটনাচক্রে নিকাশি নালা আর খাল ধরে এগনো শুরু করলেন। দেখতে চান, নালাগুলো যায় কোথায়! এই উত্তর খুঁজতে গিয়েই ধ্রুবজ্যোতিবাবু হাজির হলেন কলকাতার পুবপ্রান্তের এই জলাভূমিতে। আপাতভাবে দেখলে মনে হয় জলাজমি—আমাদের ভাষায়, ‘নুনের ভেড়ি’—কোনো কাজে আসে না। তখন ওইসব এলাকা একেবারেই অনুন্নত, সামান্য রাস্তাঘাটও নেই। কিন্তু সেখানেই ধ্রুবজ্যোতিবাবু পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো শুরু করলেন। ফলাফল দেখে রীতিমত ‘চক্ষু চড়কগাছ’ অবস্থা। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ধ্রুবজ্যোতিবাবু জলের মতই সহজ করে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। “বর্জ্যজল আসলে কিছুই না, ৯৫% জল এবং ৫% জীবাণু। এই বিশাল জলাভূমিতে ওই বর্জ্যজলের জীবাণু জলজ বাস্তুতন্ত্রে শৈবাল ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। ফলে স্রেফ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রেই সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পুরো জল পরিশুদ্ধ অবস্থায় চলে আসে, বিপুল মাছের ভাণ্ডার তৈরি করে—পুরোটাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে—বিন্দুমাত্রও শোধন করাতে হয় না!”

প্রায় একার চেষ্টায় ধ্রুবজ্যোতিবাবু কলম্বাসের মত নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন শহরের পুবপ্রান্তের এই বিশাল জলাভূমিকে। যদিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাঁকে। ততদিনে সেই অগভীর জলাভূমির বেশ খানিকটা ভরাট করে সল্টলেক তৈরি হয়ে গিয়েছে। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তবে জলাভূমির গুরুত্বটা তিনিও বুঝতে পারেননি। তবু গঙ্গা থেকে পলি তুলে সেই লবণ হ্রদের প্রায় অর্ধেকটা ভরাট হয়েছিল, বাকিটা ডাক্তার রায় ছেড়ে রেখে দেন। ডাচ সংস্থা নেডেকো ও একদল যুগোস্লাভ ইঞ্জিনিয়ার দুর্দান্ত পরিকল্পনা করে নগর ‘ডিজাইন’ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল সল্টলেকে, সভাপতি ছিলেন ভাবী রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল ছোট্ট একটি বাংলো, নাম দেওয়া হয় ‘ইন্দিরা ভবন’। কিন্তু সেই ইন্দিরা ভবনের পরবর্তী বাসিন্দা—মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু—ক্ষমতায় আসতেই গোলমাল শুরু হয়। ডাঃ রায় ইউরোপের ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে এলাকা পরীক্ষা করিয়েছিলেন, কিন্তু বিলেত-ফেরত জ্যোতিবাবুর অত ধৈর্য ছিল না। ফলে সল্টলেকের আকার বাড়তে শুরু করল, শুরু হয় অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ। তখন জোর যার মুলুক তার। প্রোমোটারি শক্তি পাখনা মেলছে। ১৯৯০ সাল নাগাদ জ্যোতিবাবুর সরকার ঘোষণা করেন—ওই জলাভূমি বুজিয়ে একটা বিশাল বড় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। রাজ্য সরকারের কর্মী ধ্রুবজ্যোতিবাবু চাইলেও তার বিরোধিতা করতে পারবেন না। অতএব তাঁর পরামর্শে হাইকোর্টে মামলা করল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'PUBLIC' (People United for Better Living in Calcutta)। ১৯৯২ সালে দেশের অন্যতম প্রথম পরিবেশবান্ধব রায়টি দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট—বিচারপতিরা ঘোষণা করলেন, ওই জলাভূমি বোজানো চলবে না, তাকে সংরক্ষণ করতে হবে।

ততদিনে জলাভূমি সংরক্ষণেই মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। সরকারকে বোঝানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন। সটান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দরবার শুরু করেন তিনি। একদিন মুখ্যমন্ত্রীকেই তিনি নিয়ে যান সেখানে। তারপর জলের গুরুত্ব ও প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই সেই তথাকথিত ভেড়ি বা নোংরা জলাভূমি থেকে এক গ্লাস জল তুলে ঢকঢক করে খেয়ে নেন। হাঁ হাঁ করে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। আশেপাশে যাওয়ার মত কোনও পায়খানাও নেই। পেটখারাপ অনিবার্য। কিন্তু কিছুই হল না। ধ্রুবজ্যোতিবাবু দেখিয়ে দেন, ওই জল খেলেও কিছুই হবে না। ওই জল প্রাকৃতিকভাবে পরিশুদ্ধ।

সম্ভবত—ওই জলাভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলশোধক! 

লেখালেখি করতে ভালবাসতেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। শুরু করেন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে লেখালেখি। তাঁরই প্রায় একক চেষ্টায় খবর পৌঁছয় সুইজারল্যান্ডে, আন্তর্জাতিক জলাভূমি সংরক্ষণ সংস্থার দফতরে। আসেন বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সকলেই। কারণ এরকম প্রাকৃতিক শোধন ভারত কেন, গোটা দুনিয়াতেও দ্বিতীয়টি নেই। নিজেদের জ্ঞাতে বা অজান্তেই ইংরেজরা এমন একটি জায়গাকে নিজেদের উপনিবেশের রাজধানী বানাতে বেছে নিয়েছিল, যার একদিকে গঙ্গার প্রবাহ, অন্যদিকে প্রাকৃতিক জলাভূমি। কলকাতা ময়দান যদি কলকাতার ফুসফুস হয়, তাহলে এই জলাভূমিই হবে তার কিডনি। অবশেষে ২০০২ সালে এল সেই সুখবর। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ‘রামসার সাইট’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হল এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি।

স্বীকৃতি এলেও ধ্বংসলীলা থামেনি, চলেছে বছরের পর বছর ধরে। প্রায় তিরিশ হাজার মানুষের জীবিকা সরাসরিভাবে জড়িত এই জলাভূমির সঙ্গে। আজও আমরা জানিই না, রোজ গরম গরম ভাতের সঙ্গে পাতে যে মাছের ঝোল বা ঝাল খাই, তার বেশিরভাগটাই আসে আসলে এই ভেড়ি থেকে। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ শাকসবজির জোগান দেয় এই এলাকা। স্রেফ এই কারণেই ভারতের সমস্ত মহানগরের মধ্যে বাজার খরচের ব্যাপারে সবচেয়ে সস্তা আমাদের কলকাতা। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ অক্সিজেনের জোগানও দেয় এই জলাভূমি। কার্যত একটি পয়সাও খরচ না করে দূষিত জল নিয়ে সে ফেরত দেয় টাটকা জল, মাছ, শাকসবজি, অক্সিজেন। 

এবং এর সবচেয়ে রহস্যময় ভূমিকা হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ। যে বিপুল পরিমাণ জলে প্রতিদিন ভেসে যেতে পারত কলকাতা, তার বেশিরভাগটাই টেনে নেয় এই জলাভূমি, তারপর অবশিষ্ট চলে যায় বিদ্যাধরী নদীতে। তাই অন্তত বছর দশেক আগে অবধি মুম্বই বা চেন্নাই নিয়মিত বন্যায় ভেসে গেলেও দিব্যি টিকে যেত কলকাতা। 

আজ ভেঙে পড়েছে পুরো ব্যবস্থাটাই। চলছে যথেচ্ছ প্রোমোটিং, জলাভূমি ভরাট, নগরায়ণ। চলছে দূষণ। ফলে নজিরবিহীন সংকটের মুখে পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমি। প্রকৃতি সামান্য রুষ্ট হলেই আজ ভেসে যাচ্ছে কলকাতা। জমা জলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, জলবাহিত ও মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। অজানা জ্বরে হাসপাতাল উপচে পড়ছে। ড্রেনগুলো অবরুদ্ধ। জলে তড়িদাহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রোজকার সান্ধ্য আড্ডায় উঠে আসে অনেক ভারি ভারি প্রসঙ্গ—লকগেট কখন খুলবে, কর্পোরেশন পাম্প চালাচ্ছে না কেন ইত্যাদি। অথচ এইগুলোর কোনোটাই যে স্থায়ী সমাধান নয়, তা আমজনতা বুঝতে চান না, রাজনীতিবিদরা বুঝতে দেন না। কারণ বুঝতে দিলে তাঁদের বিপদ। রাজনীতির নেতাদের ব্যবসাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই জলাভূমি ভরাটের ওপর। পূর্বতন বাম জমানায় যা ছিল, বর্তমান ঘাসফুল জমানায় তা তেড়েফুঁড়ে বেড়েছে। সরকারের হেলদোল নেই। সম্ভবত সরকার যারা চালান, তাঁদের এতটা গভীরে গিয়ে ভাবার মতও বিদ্যে নেই। বা বলা ভাল, ভাবার দরকারও নেই। এই পাম্প করে জল বের করা বা রাস্তা খুঁড়ে বছরের পর বছর পাইপ বসিয়ে চলা বা লকগেটের ওপর নির্ভর করা—এগুলি সবই আসলে ‘ডায়ালিসিস’ পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে রক্ত পরিশোধন করে কিডনির কাজ চালানো হয়। সকলের অলক্ষ্যে ক্রমশ পাঁক জমে, দূষিত ও বিষাক্ত রাসায়নিক জমে ও ভরাট হয়ে বিকল হয়ে পড়ছে কলকাতার আসল সেই ‘কিডনি’—এই জলাভূমি। 

জলাভূমি নিয়ে আন্দোলন আমৃত্যু চালিয়ে গিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। একাধিক বই লিখেছেন, তার মধ্যে ‘ইকোলজি অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল ওয়েটল্যান্ড প্র্যাকটিস’ বইটি কার্যত এই বিষয়ের ‘ইউজার ম্যানুয়াল’ হতে পারে। বইটি সম্ভবত আজ আর পাওয়া যায় না। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে জলাভূমি বা ‘ওয়েটল্যান্ড’-এর সংজ্ঞা, ব্যবহার, বিস্তার, প্রায়োগিক দিক ইত্যাদি সবই ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন ভারতের এক প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী। লিখেছিলেন—“...অমর্ত্য সেনের ‘ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স’-এর মতই ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের এই আন্দোলনের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘ওয়েলফেয়ার ইকোলজি’...”। লেখক—ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক প্রোফেসর এম এস স্বামীনাথন। 

দূর্ভাগ্য যে, তাঁর কথা অমান্য করার ফল কী হতে পারে, তা বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ আর দেখে যেতে পারলেন না। ২০১৮ সালেই তিনি বিস্মৃতলোকে গমন করেন।

বিয়ে করা কি উচিৎ না কি ভুল হবে? -চার্লস ডারউইন
Nov. 18, 2024 | সমাজ | views:290 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব ভাবছি। আশা করি, এমার তরফেও আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়েটা কি করা ঠিক হবে? করলেও এখনই কি করব না কি পরে? ভাবছেন বিয়ে করা নিয়ে কার এত ভয়, কার এত সংশয়, এত ধন্ধ? কার 'জয় করে তবু ভয় কেন যায়না'? আর কারো নয়, বিবর্তনবাদের জনক স্বয়ং চার্লস ডারুউইনের। যদিও ১৮৩৮ সালের 11 নভেম্বর ডারউইন তাঁর তুতো বোন এমা ওয়েডউডকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং এমা সম্মতি জানান। পরের বছর ২৯ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়। ডারউইন তাঁর বাগদানে পর্বের আগে এই দুটি নোটে বিয়ের উপকার ও অপকার নিয়ে নিজের সাথে প্রবল যুদ্ধ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে করাই ঠিক বলে মনে করেছেন। এরকম একজন মনীষী ও অবিস্মরণীয় প্রতিভারও সাধারণের মত বিবাহ নিয়ে সংশয় বেশ কৌতুক উদ্রেককারী।

প্রথম নোটঃ ১৮৩৮ ৭ এপ্রিলের পরের কোন সময়

যদি বিয়ে না করি- তবে ঘুরে বেড়াতে পারব। ইউরোপ? আমেরিকা ???? ভূতত্ত্বের যাদুঘর অ্যামেরিকায় যাবই। মেক্সিকো যাওয়াটা অবিশ্যি শরীর-স্বাস্থ্য, ক্ষমতা আর প্রাণিবিদ্যায় কতটা পটু হতে পারি, তা দেখে পরে না হয় ভাবা যাবে। আর ভ্রমণ না করলেও, বিভিন্ন প্রজাতি উদ্ভব, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ভূতত্ত্ব নিয়েও কাজ করা যেতে পারে। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করা যেতে পারে।

প্ল্যান বি- লন্ডনে রিজেন্টস পার্কের কাছে ছোট্ট একটা ঘরে থাকব। ঘোড়া থাকবে। গ্রীষ্মে ঘুরেঘুরে প্রাণিবিদ্যা আর ভূতত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করব।

কিন্তু বিয়ে করলে, বাঁধা মাইনের জন্য চাকরি করে যেতেই হবে। লন্ডনের একঘেয়ে জীবন, খালি সামাজিকতা আর সামাজিকতা। দেশ বেড়াতে পারবনা, প্রাণিবিদ্যার নমুনা সংগ্রহ করতে পারব না, বই কেনা হবেনা। ওই কোনক্রমে কেম্ব্রিজে ভূতত্ত্ব বা প্রাণিবিদ্যার প্রফেসারি করেই জীবন কাটাতে হবে। আর এসবগুলো যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে প্রাণিবিদ্যার গবেষণা সুষ্ঠু ভাবে করতেই পারবনা। দেশের মধ্যে এরকম শীতঘুমে জীবন কাটাবার চেয়ে আর একটু ভাল কি কিছু করা যায়না? লন্ডনের কাছাকাছি কোন গ্রামে বেশ রাজকীয় একটা বাড়িতে থাকা যেতে পারে অবশ্য। কিন্তু কিস্যু না করে, ঐ রকম কুঁড়েমি করে তো জীবন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। নাকি, তার চেয়ে লন্ডনেই বন্দিদশা কি মেনে নেব? যদি মোটামুটি টাকা পয়সা করতে পারি, তাহলে লন্ডনে বড়সড় একটা বাড়িতে থাকা যাবে। কিন্তু প্ল্যান বি অনুসারে পয়সা কড়ি হাতে না থাকলে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে কি সেরকম বাড়িতে থাকা যাবে না। সেক্ষেত্রে লন্ডনের কাছের কোন গ্রামই ভাল।কিন্তু গ্রামে থাকা রোজগার আর বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কেম্ব্রিজে থাকা ভাল এক্ষেত্রে, তবে হাতে পয়সা না থাকলে আর প্রফেসারি না করলে, সেখানে আবার অবস্থাটা দাঁড়াবে ঢাঙায় তোলা মাছের মত। নাঃ, কেম্ব্রিজের প্রফেসারিটাই সবচেয়ে ভাল এক্ষেত্রে। এটা করেই যা করার করতে হবে। ঘড়ি ধরে কাজ করব, আর যেটুকু সময় বাঁচবে গবেষণার কাজ করব। যা বুঝতে পারছি, হয় কেম্ব্রিজের প্রফেসার অথবা দারিদ্র এই আমার কপালের লিখন। তবে হ্যাঁ, লন্ডনের উপকণ্ঠে ছোট্ট একটা ঘরে গরীব হয়ে কাটালেও কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু আমার স্বাধীনতা থাকছে।

সরাসরি পর্য্যবেক্ষণের মত আনন্দ আমি অন্য কিছুতেই পাইনা, সেক্ষেত্রে লাইলের (বন্ধু) মত সেই পুরনো ট্রেনে নতুন তথ্য জোড়া আর ভুল শোধরানো কি আমার কিছুতেই ভাল লাগতে পারেনা। লন্ডনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলে একজন কি ভাবে এগোতে পারে, সেই পথটাই তো দেখতে পাচ্ছিনা ঠিকঠাক। এদিকে গ্রামে থাকলে থাকবে, নিম্নস্তরের প্রাণীদের ওপর নানা পর্য্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা নীরিক্ষার সুযোগ আর সময়।

দ্বিতীয় নোট, জুলাই ১৮৩৮

প্রশ্ন সেই একই- বিয়েটা কি করব?

বিয়ে করলে ঈশ্বর কৃপায় বাচ্চারা থাকবে – চিরকালের সঙ্গী আর বৃদ্ধ বয়সের এমন বন্ধু পাব – যার একজনের প্রতিই টান থাকবে – ভালবাসার ও খেলার সঙ্গী পাব — অন্তত কুকুরের চেয়ে তো ভাল। বাড়ি হবে। তার দেখভাল করার একজন লোক হবে। গান বাজনা হবে এবং বৌয়ের সাথে গল্প করা যাবে। এসব একজনের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল। কিন্তু মারাত্মক সময়ের অপচয়।  

হে ভগবান, ভাবা যাচ্ছেনা, যে একজন খালি শ্রমিক মৌমাছির মত সারাটা জীবন খালি কাজ আর কাজ করে অপচয় করবে, আর কিস্যু হবেনা তারপর। না, না , কেউ পারবেনা এরকম। ভাবতে পারা যায়, একজনকে সারাজীবন লন্ডনে ধোঁয়া ভর্তি একটা নোংরা ঘরে একাকী একা কাটিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি- একটু আগুনের উষ্ণতা, সোফায় বসে থাকা সুন্দরী নরম সরম স্ত্রী, কিছু বই আর গান বাজনা- এর উল্টোদিকে গ্রেট মার্লব্রো স্ট্রিটের ঘোলাটে বাস্তবতার কথা ভাবলেই-

না , না, না, বিয়ে করব, করব, করব- নান্য পন্থা

কিন্তু বিয়ে না করলে- যেখানে খুশি যাবার স্বাধীনতা- সমাজিকতার বালাই থাকবেনা- ক্লাবে বুদ্ধিমান লোকেদের সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে- আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে কেউ জোর জবরদস্তি করবে না- ছোটখাট অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে হবেনা - বাচ্চাদের পেছনে খরচ আর উৎকণ্ঠা থাকবেনা- বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে সময় নষ্ট হবেনা- সন্ধে বেলা নিজের মত পড়াশুনো নিয়ে থাকা যাবে- চর্বি বাড়বেনা বসে বসে- উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ব থেকে মুক্তি- তার মধ্যে এক গাদা বাচ্চা কাচ্চা হলে প্রতিটার খোরাকি জোগাড় করতেই সময় চলে যাবে- একজনের পক্ষে এত পরিশ্রম স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই খারাপ। হয়তো বৌয়ের লন্ডন ভালই লাগল না। তারপরের কথাই হল নির্বাসন, আর একজন নিষ্কর্মা মূর্খে পরিণত হওয়া। 


তবুও বিয়েটা করা দরকার। কিন্তু কখন? এখনি না পরে?

মহাজনে বলে বিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা উচিৎ। কম বয়সে লোকের চিন্তা ভাবনা অনেক নমনীয় থাকে, অনুভূতি তীব্র থাকে, তাই সে সময় তাড়াতাড়ি বিয়ে না সারলে, সেই অনাবিল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হবে।  

কিন্তু যদি কালকেই বিয়ে করি, সেক্ষেত্রে আমায় একটা সাজানো গোছানো ভদ্রস্থ বাড়ি পেতে একগাদা টাকা আর অনন্ত ঝামেলা পোয়াতে হবে - সামাজিকতা রক্ষার জন্য নিত্য অশান্তি- সকাল সকাল হাঁকডাক- বিশ্রী সব ব্যাপার স্যাপার- প্রতিদিন সময়ের অপচয়। (বৌ ছাড়া জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে আর পরিশ্রমী করে তোলে)। আমি আমার সব কাজকম্ম করব কিভাবে যদি বৌয়ের সাথে রোজ আমার হাঁটতে বেরোতে হয়? ধুস্‌!! আমি কোনদিন ফরাসীরা কেমন জানতেই পারবনা, এই মহাদেশ দেখতে পাবনা, অ্যামেরিকা যাওয়া পণ্ড- বেলুনে চড়ার বা বেশ একা একা জাহজে করে ওয়েলস যাওয়া বাতিল- ক্রীতদাসের জীবন মাইরি- বা তাদের চেয়েও খারাপ হয়তো- তার ওপর তীব্র দারিদ্র- (বৌ না থাকলে কিন্তু জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে সাথে প্রচুর টাকা)। নাঃ, বালক, এসব ভাবনা ছাড়- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত- এভাবে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন কেউ কাটাতে পারেনা, বিশেষত বৃদ্ধ হয়ে অসুস্থ অবস্থায়, বন্ধুহীন জীবন, ঠাণ্ডা, নিঃসন্তান অবস্থায় পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, যে মুখে এখনি বয়েস থাবা বসাতে শুরু করেছে। বাদ দাও এসব আজেবাজে ভাবনা, একটা সুযোগ দাও নিজেকে- চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখ- অনেক সুখী ক্রীতদাসও দুনিয়ায় চড়ে বেড়াচ্ছে

মূল পাণ্ডুলিপিগুলি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ডারউইন আর্কাইভে রয়েছে- DAR 210.8:2


অনুবাদকের কৈফিয়ত- ডারউইনের নোটদুটি ভাঙা ভাঙা বাক্যে, কখনো একটি দুটি শব্দে নিজের জন্য লেখা- সেভাবে লিখলে পড়ার সুখ থাকবেনা, তাই একদম আক্ষরিক অনুবাদ না করে, কিছু ক্রিয়াপদ বিশেষণ ইত্যাদি জুড়তে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন একটা দুটো শব্দে, সেটা বোঝাও একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আশা করি, যথাযথ বুঝে সেটা সঠিক ভাবে ভাবটা তুলে ধরতে পেরেছি। যদি কিছু ভুল পান, জানাবেন অবশ্যই। 


অনুবাদক- নির্মাল্য দাশগুপ্ত

মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কি অদাহ্য? -কৃষ্ণ ঘোষ
Nov. 18, 2024 | কুসংস্কার | views:929 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মানবদেহ অবিনশ্বর নয়। মারা যাওয়ার পর আমাদের দেহের সমগ্র অংশ মাটিতে বিলীন হয়ে যায়। বিলীন হয়ে যাওয়াটা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। কোনও দেহ পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়। আবার কোনও দেহ মাটিতে পচে গলে মিশে যায়। এসব তথ্য আমরা সবাই জানি। এসব জানার মাঝেও আমরা দু একটা তথ্য ভুল জানি। যেমন, মৃত মানুষের নাভিকুন্ড নাকি কখনওই পোড়ে না। এই নিয়ে বেশ কিছু মানুষের সাথে আলোচনা করে দেখেছি,কেউ কেউ মানলেও অনেকেই মানতে চান না মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে বলে। দিন কয়েক আগে ফেসবুকেও একজন এই বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেখানেও দেখলাম,অনেকেই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা পরিবেশন করে জানিয়েছেন, নাভিকুন্ড পোড়ে না। এমন কি ইলেকট্রিক চুল্লিতেও নাকি মৃত মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কথা প্রসঙ্গে আমাদের এক বন্ধু তো তার সারা জীবনে তিনি কত মরা পুড়িয়েছেন,সেই হিসেব দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না। কেউ যদি তার নিজের অবস্থানে অনড় অটল থাকে,তবে তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। বেশি কিছু বলতে গেলে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।

শ্মশানে মৃতদেহ পোড়ানো দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সকলেরই কমবেশি থাকলেও মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এই নিয়ে আমরা কেউই তেমন একটা ভেবে দেখিনি। মরা পোড়ানো হয়ে যাওয়ার পরে শ্মশানের ডোম 'অস্তি' হিসাবে গনগনে চিতা থেকে কিছু একটা পোড়া অংশ সদ্য প্রয়াত মানুষের নিকটজনের হাতে তুলে দেন। ওটাই নাকি মৃত মানুষটির নাভিকুন্ড। এমনটাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। এর মধ্যে বড় শহরগুলিসহ জেলায় জেলায় ইলেকট্রিক চুল্লির প্রচলন হলেও 'নাভিকুন্ড' পোড়ে না,এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার খুব একটা বদল ঘটেনি। কিন্তু কেন এমন ভ্রান্ত ধারণা আজকের দিনেও বিরাজমান মানুষের মনে ? এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

যেখানে আগুনের তাপে লোহা জলের মতো তরল হয়ে যায়,সেখানে নাকি মানুষ নামক প্রাণীর নাভিকুন্ডলি পোড়ে না ! এই রকম ধারণা পোষণ করার মধ্যে আছে আমাদের আজন্ম লালিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা। সুদূর অতীতে অল্প কিছু করেকম্মে খাওয়া স্বঘোষিত ব্রাহ্মণ তকমাধারী মানুষদের তৈরী করা সংস্কারকে অনুসরণ করে পোড়া কাঠ কয়লা মাখানো অর্ধদগ্ধ একটা টুকরোকে শ্মশানের ডোমেরা মৃতের পরিবারের হাতে তুলে দেয়। ওটা আদৌ নাভিকুন্ড, নাকি অন্য কোনও আধা পোড়া দেহাংশ,এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতো মানসিকতা মৃতের পরিবারের তো থাকেই না,অন্য কোনও মানুষের ইচ্ছে থাকলেও করতে পারেন না অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। তাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে এমন ভ্রান্ত ধারণা। মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না,এমন জল্পনা শ্মশানের চৌহুদ্দির মধ্যেই হয়। বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বোধহয় কখনও এমন গবেষণা হয়নি।


কিছু অতি সাধারণ বিষয় আছে,যা বুঝতে ও বোঝাতে কোনও বিরাট কিছু বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞান কিম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। এসব ক্ষেত্রে একেবারে সাধারণ কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এটা সেই রকমই একটা সাধারণ বিষয়।


ধরা যাক, কোনও একজন মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়,একটা লোহার টুকরো এবং এক টুকরো মাংস কোনও গনগনে জ্বলন্ত ফার্নেসের মধ্যে একসঙ্গে ছুঁড়ে দিলে কোনটা আগে পুড়ে যাবে ? এমন প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা প্রশ্নকর্তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাবে,এমন একটা উদ্ভট প্রশ্ন করার জন্য।


কিন্তু যদি 'এক টুকরো মাংসের' পরিবর্তে 'এক টুকরো মানুষের নাভিকুন্ড' কথাটা বসিয়ে প্রশ্ন করা হয় তবে তিনিও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। কারণ,তিনি যত বড় শিক্ষিত হোন না কেন, তিনি তার বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছেন,দেখে এসেছেন মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কেন পোড়ে না,এটা নিয়ে তেমন কেউই ভেবে দেখেনি বা দেখতে চান না। কারণ,এই নাভিকুন্ড নিয়ে অস্তি বিসর্জনের মতো একটা পারলৌকিক আচার ও সংস্কার আছে। তাই সংস্কারটির পিছনে আমাদের আজন্ম লালিত ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে।


উপযুক্ত তাপমাত্রায় এবং পর্যাপ্ত সময়ে যেখানে সবচেয়ে কঠিন ধাতু হীরের টুকরোও পুড়ে যায়,সেখানে সামান্য নাভিকুন্ড তো কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় নাভিকুন্ডে চর্বি জাতীয় পদার্থ অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। তাই পুড়তে কিছুটা সময় নেয়। কিন্তু পোড়ে। নাভিকুন্ড পোড়ে না,এমন ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। কাঠের চিতায় একটা মৃতদেহ পোড়াতে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই সময়ের মধ্যে সারা দেহের অন্যান্য অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও দেহের চর্বি জাতীয় অংশ ঠিক মতো পোড়ে না। এছাড়া অস্তি নেওয়ার মতো একটা সংস্কার কাজ করে। ফলে,খুব সহজেই নাভিকুন্ড 'অদাহ্য পদার্থ' হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যায়।


একটা খুব সহজ সরল উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক বিষয়টি। কিছুটা বদ্ধ জায়গায় একটা A4 সাইজের কাগজ হাতে নিয়ে কাগজটির যে কোনও একটা কোণায় আগুন লাগিয়ে মাটিতে রেখে দিন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখবেন,কাগজটার অধিকাংশ অংশ পুড়ে গেলেও মাটিতে লেগে থাকা কিছুটা অংশ পোড়েনি। এই ভাবে আপনি দশ বারোটা কাগজ একটা একটা করে পোড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখবেন, একেবারে সম্পূর্ণ কোনও কাগজই ঠিক মতো পুড়ছে না। কোনও না কোনও অংশ বাকি থেকে যাচ্ছে। অথচ ওই একই সাইজের কাগজ আপনি হাতে ধরে রেখে যদি পোড়াতে যান অথবা কোনও জ্বলন্ত উনুনে ছুঁড়ে দেন,তাহলে দেখবেন মুহূর্তের মধ্যে কাগজটা পুড়ে যাচ্ছে। এইবার ধরুন, কোনও ধর্মগুরু যদি আগুনের এই স্বাভাবিক নিয়মটিকে কাজে লাগিয়ে ঘোষণা করে যে,আমার মন্ত্রপূত কোনও কাগজই আগুনে সম্পূর্ণ পুড়বে না। দেখা যাবে বহু মানুষই ওই ধর্মগুরুর কথাকেই মেনে নেবেন,প্রকৃতির কার্যকারণের বিষয় ভেবে দেখবেন না। মানুষের নাভিকুন্ড না পোড়ার ব্যাপারটাও অনেকটা এই রকমের।

নাভিকুন্ডের মধ্যে একটা অতি অলৌকিক কিছু একটা ব্যাপার আছে,এই ধারণাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে এটাকে ঘিরে যে লৌকিক আচার কিম্বা সংস্কার আছে, সেগুলোও একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে। তাই এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণাকে নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকে না। রাষ্ট্র ও সরকারও এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। কারণ, তাহলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। আর আমরা সাধারণ মানুষেরাও এই নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেও রাজী হই না। তাই এই রকম বহু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। থাকবেও বহু কাল।

এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ -জামাল আনসারী
Nov. 18, 2024 | সচেতনতা | views:285 | likes:1 | share: 0 | comments:0

একটি শিশুর প্রথম লেখাপড়ার হাতেখড়ি বর্ণ পরিচয়। সাথে সাথে শিশুটি বিভিন্ন সংখ্যা গোনা শিখতে থাকে।এ গুলো শিশুর সহজ সরল কোমল মনে এবং বিশ্বাসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। এই বর্ণ পরিচয় ও বিভিন্ন সংখ্যা গোনার সময় থেকেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুর মনে কিছু আজগুবি, অবিশ্বাস্য, পৌরাণিক ধর্মীয় কুসংস্কারের ধ্যান ধারণা মস্তিষ্কের রন্ধে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আসুন আমরা খোলামেলা মনে সেগুলো আলোচনা দেখি-

১- এক- এ চন্দ্র।চন্দ্র মানে চাঁদ। আমরা সকলেই জানি আমাদের পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হল চাঁদ। তাহলে এক-এ চন্দ্র বলতে একটি চাঁদকে বোঝাচ্ছে। এটা ঠিক আছে। কোনো ভুল নেই।

২- দুই-এ পক্ষ। পক্ষ মানে এখানে কোনো বর পক্ষ বা কনে পক্ষের কথা বলা হয়নি,শত্রুপক্ষ, মিত্রপক্ষ নয় ।বাংলা অভিধানে পক্ষ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে “চাঁদের বৃদ্ধিকাল বা হ্রাসকাল (শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ); প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়; মাসার্ধ, পনেরো দিন (তিনি এক পক্ষকাল বিদেশে থাকবেন)।”

এখানে দুই-এ পক্ষ বলতে  মাসের দুটি (মাসার্ধ)পক্ষকে বোঝানো হয়েছে। এই পক্ষ দুটি হল কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষ।

৩-তিন-এ নেত্র। নেত্র শব্দের অর্থ সংসদ বাংলা অভিধানে লেখা আছে চক্ষু।

এখন তিন-এ নেত্র বলতে এখানে তিনটি চক্ষুর কথা বলা হয়েছে। সমস্যাটি এখানেই।গোটা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেও কোনো মানুষ তো দূরের কথা। গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী, কোনো পশু পাখির মধ্যে কারোও তিনটি চোখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে আজগুবি, অবিশ্বাস্য, গল্পের গরু গাছে চড়ে মার্কা পৌরাণিক গল্প গুলো টেনে আনা হয়েছে। পৌরাণিক গালগল্পে আছে পৃথিবীর যতসব আষাঢ়ে গল্প গুলোর আঁতুরকুড়। পুরানেই পাওয়া যায় কারো জন্ম মাথা থেকে তো কারো জন্ম পা থেকে। কেউ উরু থেকে, কেউ আবার বাহু থেকে জন্ম গ্রহন করে। যতসব হাস্যকর অবৈজ্ঞানিক কান্ডকারখানা! এমন কি চোখের জল থেকে; কান থেকেও মানুষের জন্ম হওয়ার কথা পুরানে লেখা আছে। সেই পৌরাণিক কাহিনীতে শিবের তিনটি চোখের কথা বলা আছে। তাছাড়া কিছু পুরানে দুর্গার তিনটি চোখের কথা বলা হয়েছে। এটা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। বির্তকিত বিষয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিশু মনে কেন এই অবৈজ্ঞানিক, বিতর্কিত বিষয় গুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এর উদ্দেশ্যই বা কি তা পাঠকদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।

৪- চার এ বেদ। আমরা জানি বৈদিক যুগে চারটি বেদ ছিল। এই চারটি বেদ হল- 1) ঋক 2) সাম 3) যজু 4) অথর্ব। ঘুরে ফিরে সেই পৌরাণিক বিষয়। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের কি এগুলো জানা খুব প্রয়োজন? পাঠকগণ একটু ভেবে দেখবেন। 

৫-পাঁচ এ পঞ্চবাণ। বাণ শব্দের অর্থ বাংলা অভিধানে লেখা আছে, ধনুক থেকে যে তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়, তির, শর। হিন্দু ধর্ম অনুসারে কামদেব অথবা মদন দেবের পাঁচটি বানের কথা বলা হয়ে থাকে। এই পাঁচটি বাণ হল- ১) সম্মোহন 2) তাপন 3) শোষণ 4) উন্মাদন 5) স্তম্ভন। এখানেও সেই সহজ সরল শিশুর মনে ও বিশ্বাসে ধর্মীয় বিষয় পরিকল্পনা মাফিক  ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঠ। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এযাবৎ পৃথিবীতে লড়াই ঝগড়া করে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার সংখ্যাধিক্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধর্মের কারনে। তাই ছোট্ট ছোট্ট সহজ সরল শিশুদের লেখাপড়ার হাতেখড়িতেই ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ কেন?

৬- ছয়-এ ঋতু। আমরা যারা ভূগোল বই পড়েছি,তারা সময় জানি যে, গোটা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। এই ছয়টি ঋতু হল- 1) গ্রীষ্ম 2) বর্ষা 3) শরৎ 4) হেমন্ত 5) শীত 6) বসন্ত। এটা সত্যি। এটা মানতে কারো অসুবিধা নেই।

৭- সাত-এ সমুদ্র। বাংলা অভিধানে সমুদ্র শব্দের অর্থ দেওয়া আছে-সাগর, অর্ণব, দরিয়া, জলধি, বারিধি, অম্বুনিধি, প্রচেতা, জলেন্দ্র, জলেশ্বর, জলারণ্য, জলধর, নীলাম্বু, মকরালয়, মকরাকর, নীরধি, পয়োধি, জলাধিপ,  বারিধর, বারিনিধি, বারীন্দ্র, বারীশ প্রভৃতি। 

এখানে সাত-এ সমুদ্র বলতে সাতটি সমুদ্র বা সাগরের কথা বলা হয়েছে। এই সাতটি সমুদ্র কোথায় অবস্থিত? বিভিন্ন দেশের ভূগোল বইয়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে। মহাসাগর আছে, সাগর আছে ,উপসাগর আছে। কিন্তু কোনোটিই সংখ্যায় সাতটি নয়।এই পৃথিবীতে সমুদ্র বা সাগরের সংখ্যা মোট সাতটি নয়। আরো বেশি। উইকিপিডিয়া অনুসন্ধান করলে অনেক সাগর বা সমুদ্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

লোহিত সাগর, বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, তিমুর সাগর, জাপান সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, জাভা সাগর, মৃত সাগর, বেরিং সাগর, কৃষ্ণ সাগর প্রভৃতি। কিন্তু সাত-এ সমুদ্র এগুলো নয়।


সাত-এ সমুদ্র হল,আমাদের দেশের পুরাণে বর্ণিত সাতটি সমুদ্রের নাম। এগুলি হল – লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, দধি, ক্ষীর ও মিষ্টি 

হ্যাঁ। এগুলিকেই সমুদ্র বলে মানতে হবে। শিখতে হবে। বাচ্চাদের শেখাতে হবে। আচ্ছা, শিশুদের  সংখ্যামালা  শেখার সাথে সাথে  এই ভুল ধ্যান ধারণা গুলি কেন শিখতে হবে? সচেতন পাঠকদের এটাও ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।


৮ - আটে অষ্টবসু। অষ্ট বসু মানে আট জন বসুর কথা বলা হয়েছে। মহাভারত অনুযায়ী দক্ষ রাজার কন্যা বসুর গর্ভজাত আটপুত্রকে বলা হয় অষ্টবসু। তাঁরা হলেন- 1) ধর 2) ধ্রুব 3) সোম 4) অহ 5) অনিল 6) অনল 7) প্রত্যুষ 8) প্রভাস বা দ্যু। বলা হয় এই অষ্টবসুরাই ইন্দ্রের সহকারী, পরবর্তীতে তারা বিষ্ণুর সহকারী হন।

অষ্টবসুর এক বসু প্রভাস বা দ্যু যিনি মাতা গঙ্গা ও শান্তনুর পুত্র রূপে দেবব্রত নামে মর্ত্যে জন্মগ্ৰহণ করেন। পরে তার ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে ভীষ্ম নামে পরিচিত হন‌।


বৃহদারন্যক পুরাণ অনুযায়ী অষ্ট বসু হচ্ছে- 1) পৃথিবী 2) অগ্নি 3) বায়ু 4)অন্তরীক্ষ 5) আদিত্য 6) চন্দ্রমা 7) নক্ষত্রাণি 8) দ্যু।

এখানেও সেই বির্তকিত বিষয়ের অবতারণা। একটার সাথে একটার কোনও মিল নেই! তবুও শিখতে হবে।পড়তে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে! কিন্তু কেন?

৯- নয়-এ নবগ্রহ। নবগ্রহ মানে নয়টি গ্রহ। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে নয়টিগ্রহের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু।

এখানে রবি অর্থাৎ সূর্যকে পুরানে গ্রহ বলা হয়েছে। কিন্তু রবি তো একটি নক্ষত্র। আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুদের ভুল শিক্ষা দিচ্ছি। তাছাড়া রাহু ও কেতু নামে  কোনো গ্রহের  অস্তিত্ব এই সৌরজগতে নেই। তবুও আমরা নয়টি গ্রহের মধ্যে রাহু কেতুকে রেখেছি। কারন পুরানে আছে। তাই রাহু, কেতু কে গ্রহ বলেই মানতে হবে। পড়তে হবে। শিখতে হবে।বাচ্চাদের শেখাতে হবে। কিন্তু কেন?

হিন্দু ধর্মের পুরাণ অনুসারে, "সমুদ্র মন্থনের সময় রাহু (স্বরভানু) নামক এক অসুর লুকিয়ে দিব্য অমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে। সূর্য্য ও চন্দ্রদেব তাকে চিনতে পেরে মোহিনী অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণুকে জানায়। তৎক্ষণাৎ, অমৃত গলাধঃকরণের পূর্বেই বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে রাহুর ধড় থেকে মুন্ড ছিন্ন করে দেন। অমৃত পানের জন্য মুন্ডটি অমরত্ব লাভ করে এবং এভাবেই রাহু গ্রহটির উৎপত্তি হয়; (এই ভাবে কি কোনো গ্রহের জন্ম হতে পারে?) বাকী মুন্ডহীন দেহটির নাম হয় কেতু। সূর্য্য ও চন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাহু এদেরকে গ্রাস (গ্রহণ) করে ফেলে। কিন্তু এই গ্রহণের পর সূর্য্য ও চন্দ্র রাহুর কাটা গ্রীবা থেকে আবার বেরিয়ে আসে। এই ভাবেই সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণ হয়” যা একটি অবৈজ্ঞানিক মতবাদ। 


আমরা ভূগোল বইয়ে পড়েছি সৌরমণ্ডলের কথা।সৌরমন্ডলে যে নয়টিগ্রহের নাম রয়েছে সেগুলি হল – বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। যদিও তার মধ্যে বর্তমানে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্লুটোকে বলা হয় বামন গ্রহ। ভেবে দেখুন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের  অভূতপূর্ব উন্নতির পরও আমরা কি পৌরাণিক গালগল্প গুলো মানব না বিজ্ঞান মানব! বাচ্চাদের স্বার্থে এ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার 

১০-দশ-এ দিক। দশটি দিকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দশটি নাম  হল পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, উর্ধ এবং অধঃ। এটা সত্যি। তাই এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। 

সময়ের সাথে বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় বুদ্ধিমানের কাজ। পরিশেষে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক কবিতার কয়েকটি লাইন নিম্নে উদ্ধৃতি করে এই লেখা শেষ করছি।

“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে

সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;

যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়

পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”


ঋণ স্বীকার:

সংসদ বাংলা অভিধান।

বাংলা অভিধান।

কয়েকটি পুরাণ গ্রন্থ।

উইকিপিডিয়া।

ভূত চতুর্দশী ও ব্যবসা -ক্রান্তিকারী শুভাশিষ
Nov. 18, 2024 | ভূত | views:279 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভূত চতুর্দশী। বাঙালির হ্যালোইন। কুমড়োর লণ্ঠন তৈরি, ঘর সাজানো, ছোট ছোট বাচ্চারা নানা বিচিত্র পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এইসব নানাবিধ কার্যকলাপের মাধ্যমে উৎসবের মেজাজে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে হ্যালোইন পালিত হলেও বাংলায় ভূত চতুর্দশী পালিত হয় যথেষ্ট নিষ্ঠাভরে। যদিও উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে এই উৎসব। বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষজনদের মতে দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কোজাগরী পূর্ণিমার পরবর্তী চতুর্দশী তিথির দিনটিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। ভূত চতুর্দশী নিয়ে নানা পৌরাণিক গল্প কথা থাকলেও মূল বিষয় হল এই দিন মৃত পূর্বপুরুষরা ধরাধামে নেমে আসে। তাই এত আয়োজনের ঘনঘটা। এই দিন দিনের বেলায় ১৪ রকমের শাক খেয়ে রাতে ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে নিষ্ঠাভরে পালন করার রেওয়াজ বঙ্গবাসীর দীর্ঘদিনের।


এ তো গেল বিশ্বাসের কথা। কিন্তু এই ভৌতিক বিশ্বাসকেই এক শ্রেণীর প্রচারমাধ্যম সুকৌশলে বিকিকিনির উপকরণে পরিণত করেছে। একটা সময় অবধি ভূত-প্রেত-আত্মা এই সমস্ত বিষয়গুলি নির্দিষ্ট কিছু উপন্যাস, গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে অবস্থাটা অন্যরকম আকার নিয়েছে। সংবিধানের 51A(h) ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একশ্রেণীর প্রচারমাধ্যম অধিক মুনাফার আশায় প্রতিবার এই সময়ে এমন কিছু সংবাদ পরিবেশন করে যা শুধু নিন্দনীয় নয়, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারে পরিপন্থী। গত বছরই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে "হদিস মিলল সাত রকম আত্মার, ভূত খুঁজতেই ঘাড় ধাক্কা।" সেই সাথে জুড়েছে কোনো প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান, বসতিহীন রাজবাড়ী, পরিত্যক্ত রেলস্টেশন গুলিকে 'Ghost Tourism' -এ রূপান্তরিত করার নতুন পন্থা। বেগুনকোদর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অনুঘটক হিসাবে উদয় হয়েছে একদল ভূত বিশেষজ্ঞ। যাদের পোশাকি নাম 'প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর'। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যন্ত্রপাতিকে সম্বল করে মানুষকে সুকৌশলে বোকা বানানোর চেষ্টা রীতিমতো উদ্বেগজনক। সেই সাথে রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের কৌতূহলকে পাথেয় করে কখনও কখনও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে এইসব প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটররা লাইভে আত্মার অস্তিত্ব দেখানোর চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে। আমরা এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছি বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পাওয়া জি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় টিভি শো দাদাগিরিতে; যা নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনো ঘটেনি। এই কাণ্ডকারখানা যুক্তিবাদীদের কাছে হাস্যকর মনে পারে, কিন্তু বিষয়টি ভাববার। তার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত বেড়ে চলা অপবিজ্ঞান চর্চা তো আছেই। রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ।


বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির অনিবার্য সংঘাত হিসাবে যুক্তিবাদীদেরকে এই বিষয়ে আরো বেশি অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কখনও কখনও দেখা যায় এই বিশ্বাসকে অপযুক্তির হাত ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করে, একটি ধারণা তৈরী করে। কিন্তু সেই অপচেষ্টাকে আমাদের যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতেই হবে। অনেকে ১৪ শাক খাওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেন, ঋতু পরিবর্তনের সময় ১৪ শাক খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, বিশেষ করে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে, কীভাবে একটি বিশেষ দিনে ১৪ রকমের শাক কিঞ্চিৎ পরিমাণ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিপুল পরিমাণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন উঠবে শুধুমাত্র ঐ দিনেই কেন? আগে বা পরে নয় কেন? প্রশ্ন ওঠা উচিত একইভাবে ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া যুক্তির। প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটরদের ব্যাপারে বলি, এই সমস্ত প্রতারকদের যতবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ডাকা হয়েছে তাদের টিকি পাওয়া যায়নি। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের সংবিধানের 51A(h) ধারার গুরুত্ব বুঝে এই সমস্ত মিথ্যা বিভ্রান্তিকর অপবিজ্ঞান সংবাদ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। সবজান্তা মধ্যবিত্ত মানসিকতা লোকজনদের পাত্তা না দিয়ে এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতার মশাল জ্বালতেই হবে।

চুপি পাখিরালয় -অজিত মিত্র
Nov. 18, 2024 | ভ্রমণ | views:882 | likes:74 | share: 0 | comments:0

  ঘরে বসে আছি,হটাৎ সৌরভের ফোন, দাদা যাবেন নাকি চুপিতে, আমিতো যাব বলে কথাটা লুফে নিলাম। সুশান্ত, আমার পরিচিত পাখি প্রেমী,ওকে বললাম, সাথে সোরভ কেও বললাম রাজি।

পরদিন ভোর ৬ টায় বিরাটি মোর এসে সৌরভের গাড়িতে চেপে বস্ লাম আমরা ৩ জনে, কল্যানী এক্সপ্রেস ওয়ে ধরলাম, কিছু বাদে সোদপুর মোড়, চা এর বিরতি। ডিসেম্বর মাস, বেশ ঠান্ডা লাগছে,চা খেয়ে গাড়ীতে উঠে পড়লাম,গাড়ী চলতে লাগল, দুপাশে দেখতে দেখতে চলা, সাম নেই রাস্তার ধারে বাজার, বহু মানুষ রাস্তা পারা পার করে বাজার করছে, গাড়ি থামাতে হল,  আবার চলা, কিছুটা যাবার পর বাদিকে ধান খেত, বেশ লাগছে দেখতে, একটু গিয়ে ডানদিকে ফুল কপি, পালংশাকের খেত, অনেকটা জুরে চাষ  করেছে, ফেরার সময় কিনব, যদি মনে থাকে।  এরই মধ্যে কালনা তে এলাম,কিছু খেয়েনিলাম। আমি ক্যামেরা নিয়ে এদিক ওদিক ছবি তুলছিলাম দেখে কয়েকজন উৎসুক হয়ে বলল আপনারা কি কাগজের লোক? আমি হেসে ফেলে বললাম না, আমরা পুরবস্থলিতে যাচ্ছি পাখি দেখতে, ওরা অবাক! পাখি দেখতে কলকাতা থেকে এতদুরে??দোকান দার ওদের কথায় বাধা দিয়ে বললেন যে ওখানে গংগা নদীতে বিরাট চড় আছে, সেখানে অনেক বিদেশী পাখি আসে, ওনারা ওইখানে যাচ্ছেন মনেহয়।হেসে বললাম ঠিক বলেছেন। চা খেয়ে ওখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম, কিছু পরে পারুলিয়া মোরে এলাম। যেখান থেকে পুরবস্থলি হয়ে আমাদের গন্তব্য স্থলে যাওয়া।এই চুপি পাখিরালয় দিনে দিনে বেস আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছ, ফলে বাড়ছে পরযটকদের ভির। বেশ কিছু আবাস গড়ে উঠেছে, মুড়ি গঙ্গার তীর বরাবর, আবাসের বারান্দা থেকে পরিযায়ী পাখিদের দেখতে পাওয়া যায়। একটা প্রজাপতি পারক গড়ে উঠছে। দেখলাম খুব বড় বড় আমবাগান,আবার বেস কিছুটা চাষের খেত। মাটির রাস্তা, দুপাশে মাটির বাড়ি,ভালোই লাগছিল। গাড়ি থেকে নামা মাত্রই নবি বক্স বাবু এগিয়ে এলেন তার ঔষধের দোকান থেকে,এখানে খুবই পরিচিত লোক, এখানে যারা আসে, সবাই ইনার সাথে যোগাযোগ করে আসে, পাখি প্রেমী। থাকা খাওয়, নৌকায় ঘোরা, সাথে গাইড, সব যোগাযোগ করে দেন, আমরা শুভেচছা বিনিময় করলাম, যেখানে থাকব, সেখানে নিয়ে গেলেন।আমরা তাড়াতাড়ি ব্যাগ পত্তর নামিয়ে সবাই ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সামনেই ছোট্ট একটা বাজার, সপ্তাহে একদিন হাট বসে, বেস কয়েকটা দোকান আছে, খাবারের দোকান, মিস্টির দোকান ও দেখলাম। নবি বাবু বললেন এখন এদিক ওদিক ঘুরে ছবি তুলুন, দুপুরে খাওয়ার পর গাইড আসবে, ১টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়ব। এখানে দুটো সেশন, সকাল ৬টা ---১১ টা, আবার ১টা ---৫ টা। তবে চাহিদানুযায়ী সময়ের পরিবর্তন হয়।যদিও সবটা নদিতে, অবশ্য ভ্রমন বা পাখি দেখা কিন্তু গংগা বক্ষে, একটা ব্যাপার, এখানেও দেখলাম সভ্যতার অসুখ, নদীর ধারে আম বাগানে বন ভোজন হচ্ছে, খুব জোরে ডি যে সহ গান, নাচ চলছে। রান্না বান্না চলছে কাঠ জ্বালিয়ে, বেস কয়কটি দল রয়েছে। আধপোড়া কাঠ এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং এঠো কাটা সহ খাবার, থারমকলের থালা, তরকারির চোকলা সমেত চারদিকে ছড়ানো, একটা আধা নরকের মত অবস্থা, বললাম এই অবস্থায় পাখি আসবে কি করে?  জানলাম এখানে একটা পক্ষি সমিতি আছে, নবি বাবুও যুক্ত, বলেন প্রশাসন কে বলেছিলাম, কিছুদিন বন্ধ  ছিল, আবার চালু হয়েছে,  কেউ কিছু বলার নেই। অবশ্য আশাকরি আগামী দিনে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে। এদিকে আমরা ১টার মধ্যে হাটের কাছে চলে এলাম, আমাদের সাথে পাখি ভাল চেনে যে, তার সাথে পরিচয় হল, নাম তপন। নদীর  পাড়ের  দিকে যেতে গিয়ে বেশ কিছু বাড়ি ঘড় দেখলাম, বেশিরভাগ ক্রিশি জীবি।নোউকা অপেক্ষা করছে, নদীর পাড় বেশ উঁচু  খাড়াই পথ, ঢাল বেয়ে নামতে হবে, এই বুঝি নদীতে পড়ে যাব,  নৌকায় ওঠার পর চালাতে  লাগলো বইঠা  সহকারে অবশ্য বড়ো লগিও আছে, আমরা  মুল নদীতে না গিয়ে,   নদীর পাশেই একটা বড়ো জলাশয়ে ঢুকে পড়লাম, কিছুটা কচুড়ি পানা আছে, আমরা কিছুটা দুরত্ব রেখে চললাম, কারন সাপের উপদ্রব আছে, অনেক বাশের কঞ্চি পোতা রয়েছ, দেখলাম মাছরাংয়া(বুক সাদা), প্যারেড কিংফিশার, ক্যাটেল ইগ্রেট, রাংয়া মুড়ি, ভারি সুন্দর দেখতে, মাথাটা লাল এবং গোলাপি ঠোঁট, ক্যামেরার খচাখচ আওয়াজে উড়ে যাচ্ছে, সৌরভ কেমন হল, মনের মতো হলনা অজিত দা, রাংয়া মুড়িটা কচুরিপানার উল্টা একদিকে গিয়ে বসলো।গাড়ী হলে ঘুড়িয়ে নেওয়া যেত, নোউকার সময় লাগবে, যেতে যেতে পালিয়ে যাচ্ছে।সাম নের দিকে কয়েকটি পারপেল সোয়ান হেন দেখলাম, রোগা লম্বাটে, কি সুন্দর জলে সাতার কাটছিলো পেখম তুলে।অদ্ভুত ধরনের পাখি, না দেখলে ভাবা যায়ন। জল ময়ুর  বলে, রাজারহাটে একটা জলাশয়ে দেখেছিলাম। বিকাল হল, এখানে শেষ করে ঘরে ফিড়ে এলাম। পরদিন সকাল ৬ টার আগে তৈরি হয়ে বাইর এসে চায়ের দোকান খোলা দেখে চা খেয়ে নিলাম, ভালো চা, নদীর পাড়ে গিয়ে নৌকাতে উঠলাম। মূল নদীতে প্রবেশ করলাম, বেস স্রোত। একটা শুশুক দেখলাম, উঠছে আর ডুব দিচ্ছে।অনেক দুর অব্দি আমাদের সাথে ছিলোএকটু ভয় পেয়েছিলাম, এতো কাছ দিয়ে যাচ্ছিল, বেস বড়। ভাবলাম নৌকা না উল্টিয়ে দেয়, মাঝি বলল কিছু হবে না।দুরে দেখতে পাচ্ছি নদীর মাঝখানে লম্বা ধরনের বিশাল দ্বীপের মত, ওরা বলল ওই টাই চড়। ওদিকে একঝাক রুডিশেল ডাক- সুদুর লাদাখ থেকে আসে, ভাবাযায়  কত শত মাইল পারি দিয়ে আসে, ওদের ডাক দুর থেকে শোন যাচ্ছে, কিছুটা ধারের দিকে এলাম, দেখলাম প্যারেড কিং ফিশার, সাথে লেসার হুইসেল ডাক ও গ্রে হেরন, ক্যাটেল ই গ্রেট, এবার চড়ের উপর উঠলাম, একটু হাল্কা হয়ে নিলাম সবাই, সাম নে দেখলাম দুটি লোক ঝগড়া করছে, কার কতটা জমি। আমি বললাম মিলে মিশে চাষ কর, কিছুদিন বাদেই ডুবে যাবে, তখন কি করবে হাসলো ওরা। চরে হাটছি, হটাত এক ঝাক পাখি উড়ে গেল, মাটির রঙের সাথে মিশেছিল, চড়াই পাখির মতন, বলল বাবুই বাটান, অত পাখি উড়ছে বসছে, বেশ লাগছে কমন কিং ফিশার দেখলাম, বেলা হয়ে এলো নৌকায় উঠলাম, স্রোতের উল্টা দিকে চলা, কিছুটা আড়া আড়ি ভাবে চলতে লাগলাম, কি ভাবে নদীরপাড় ভাংছিল ভয় লাগছিলো, ধপাস ধপাস করে জলে পরছিল মাটির চাক গুলি। একটা মজার ঘটনা চোখে পড়ল,একটা কিং ফিশার, বাটা ধরনের মাছ ধরেছে,ওর থেকে আকারে বর, মাছটা নড়ছে আর ও মাথা ঘুরিয়ে পাশের ডালে আছার মারছে একাধিক বার, দারুন লাগল। বেস হাশিও পেল খাওয়ার ধরন দেখে। মাছটা মড়বে,নরম হবে, তখন ও গিলবে।  এক সময় আমরা তীরে এসে গেলাম, গাইড মাঝি ওদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম, আমরা লজে এলাম, পরদিন ঠিক করেছিলাম, যে এই গ্রামটা শুধু পাখিরালয় নয়,মহা মনীষীদের জন্মভুমি, আমরা সেই ইতিহাস কে ছুয়ে যাব। এই চুপি গ্রামে জন্মেছিলেন অক্ষ্য়কুমার দত্ত ও তার নাতি কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত।গেছিলাম দেখতে, খুব পুরানো বাড়ি। আরেকজন ভারতীয় ভাষা, দরশন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে  মহা পন্ডিত শ্যামদাস বাচস্পতি এখানে জন্মেছিলেন১৮৪৯ সালে, বারির সামনে ফলকে লেখা।  কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে  বিখ্যাত উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, সারা পরে গেছিল দেশজুরে। এই গ্রামেই জন্ম। আরও অনেকেই আছেন। পাখিরালয় দেখার সাথে ওইতিহাসিক স্থানগুলি দেখে নিলে বেশ ভাল লাগবে। একটা কথা ওখানে ভাল পাটালিগুড় পাওয়া যায়, কিনতে কেউ ভুলবেন না।    

কবিতাগুচ্ছ ৭ -কবিরা
Nov. 18, 2024 | কবিতা | views:123 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অজ্ঞের রাজ

-প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল


কিছু মানুষ আজো বড়ো বেইমান,

হিংসা দ্বন্দ্বে প্রায় সকলেই সমান।


ধর্মের ধ্বজা করে যারা বহন,

তাদের‌ সবার হয় কলুষিত মন।


ধর্মের বিরোধিতায় মানুষ ব্যাজার,

সমাজটা তাই আজ  হলো ছারখার।


ধর্মের ধোঁয়ায় অন্ধকারে এই দেশ,

বক ধার্মিকরা করছে শুধু আয়েশ।


সত্যের গলায় পড়েছে দড়ির ফাঁস,

সত্যের তাই আজ হয়েছে বনবাস।


দেশে অন্ধ ভক্তের  ভীষণ ত্রাস,

মানবতা তাই এখন হচ্ছে হ্রাস।


অন্ধ বিশ্বাস মোদের মানতেই হবে,

সত্য বললে আজ জীবন নাহি রবে।


কবির কলম থেমে গেছে তাই,

অকারণে কে জেলে যেতে চাই।


অন্ধের কুশাসনে  অন্ধের এই দেশ,

অন্ধ ভক্তর ধরে শুধু সাধুর  বেস।


ধার্মিক ভণ্ড লাঠি হাতে খাড়া,

কুসংস্কার প্রচার করে তারা।


প্রতিবাদের ভাষা কণ্ঠেই যে রয়,

কলম ধরতে লাগে বড়ো ভয়।


অন্ধের দেশে শুধু ধর্মের বিকাশ,

এটাই হবে আগামীর ইতিহাস।


মহা অজ্ঞ যুক্তি যে মানে না,

অজ্ঞ কে দেখলেই যাবে চেনা।


অন্ধ পণ্ডিত অনেক আছে দেশে,

তারা রয় অন্ধ কে ভালো বেসে।


নির্বোধেরা মহাসুখে অন্ধের স্বর্গে,

যুক্তি প্রিয় না মরেও রয়  মর্গে।


সমাজ পতি সমাজের ঠিকাদার,

ধর্মানুভূতিতে ছাড়ে  হুংকার।


ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব আমি নাহি চাই?

দলিতরা পাক মানুষের বুকে ঠাঁই।


সকল ধর্মে যদি শান্তি খুব রয়,

ধর্ম নিয়ে লড়াই  কেন তবে হয়?


সৃষ্টির সেরা জীব পৃথিবীর মানুষ,

আজো তারা হয়ে আছে বেহুঁশ।


সকল কর্মের মাঝেই ধর্ম খুঁজি,

কর্ম‌ হয় যে সকল ধর্মের পুঁজি। 


শিক্ষক-বন্দনা

-শ্রেষ্ঠী দে

শিক্ষক মানে আলোর দিশারী,

জীবনের পথপ্রদর্শক।

শিক্ষার মহাসাগরে তিনি,

জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্জ্বলক।

শিক্ষক জাগান রুক্ষ পাহাড়ে,

সবুজ প্রাণের সাড়া।

তাঁরই স্পর্শে চূর্ণ হয়,

অজ্ঞানতার বদ্ধ কারা।

শিক্ষক মানে ধূসর মরুতেও ----

অমৃতের সন্ধান,

তাঁরই আশ্রয়ে বাঁচে অবহেলিত -

হাজারও কোমল প্রাণ।

শিক্ষক হলেন নৈতিকতা-আদর্শের

সমাহার,

তিনিই পার্থিব জগতে আজও

পরম জ্ঞানের আধার।

শিক্ষক মানে জীবনের পথে

সকল সমস্যার সমাধান,

আনেন জীর্ণ নদীর বুকেও

মিষ্টি মধুর কলতান।

শিক্ষক হলেন আলোর পথের

সত্য নির্ভীক যাত্রী,

তাঁরই নির্দেশিত জীবনাদর্শে চলেছে

সহস্র ছাত্রছাত্রী।

শিক্ষক মানে শ্রদ্ধার পাত্র

শিক্ষার অতি সুজন,

ভালোবাসার আবরণে করেছেন

উকিল-ডাক্তার সৃজন।

জন্ম থেকে মায়ের কাছে

শুরু শিশুর শিক্ষা,

জীবনে চলার পথে শিক্ষক দিলেন

সততার ব্রতে দীক্ষা।



সংক্রমণের কড়চা

-সাবিত্রী দাস

সকল বিপদ  করতে কাটান হাঁকেন তারা নিদান,

কবচ তাবিজ হোম-যজ্ঞের হরেক বিধি-বিধান।


বাক্ -সিদ্ধ,দিক-সিদ্ধ, সু-সিদ্ধের শঙ্কা,

ডুবলো এবার তরী নাকি বাজলো মৃত্যু-ডঙ্কা!


দিন ফুরিয়ে সিঁধেল আঁধার এবার বুঝি নামে,

নীরবতার ঢল নেমেছে গৌরবময় ধামে।


সত্যি নাকি অস্তাচলে সিদ্ধ রবি-শশী!

সেবা-যজ্ঞের দিব্যারতি, বচন এখন বাসি।


বিশ্বজোড়া মৃত্যু-মিছিল কাঁপছে জীবন-ছন্দ,

তাহলে কী সংক্রমণে ব্যবসা এবার বন্ধ!


অষ্টোত্তর শতনামের হরেক কিসিম বাবা,

জননীরাও কম যান না বেড়াল বগল দাবা!


আস্থা তবে শেষ হলো কী, চলছে গজব আড্ডায়।

পঞ্জিকাদির অর্থনীতি সংক্রমণের গাড্ডায়!


বাকসিদ্ধা  জননীদের কণ্ঠ এখন রুদ্ধ,

লক-ডাউনে তারাও নাকি বেজায় আছেন ক্রুদ্ধ।


যেতে যেতেও যায় নারে ভাই  এমন ইমপ্রেশন!

অতিমারির জাস্টিফাই এর দারুণ এক্সপ্রেশন!


পুরুষ্টু ঐ শিখার বাহার গায়ের নামাবলী

বিংশোত্তরী মতে এখন পাড়ছে তারা গালি।


কোন তরীতে মিলবে এখন কে কোন মোহনায়,

সংক্রমণেও  বিশ্বায়নের আকাশ ছুঁয়ে যায়।


নিতে হবে সাম্যের পাঠ

-প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল


দাম বাড়াতে ধর্ম গ্রন্থ

রাখো সবাই ঘরে;

দামী জীবন রক্ষা করো

বিজ্ঞানের বই পড়ে।


ধর্ম গ্রন্থে ডুবে থেকে

বড়ো হলো কেবা?

বিজ্ঞান পড়ে ডাক্তার হয়ে

জীবের করো সেবা।


ধর্ম গ্রন্থে ভেদাভেদি

লিখে নিজের মতো;

দ্বন্দ্ব সদাই লাগেই থাকে

হিংসা অবিরত।


বিজ্ঞান শেখায় সাম্যের নীতি

সব মানুষই সমান;

ভিন্ন জাতের এক‌ই রক্ত

বিজ্ঞান করলো প্রমান।


ধর্ম গ্রন্থ পড়ে মানুষ

যদি ভদ্র হতো;

ধর্মের নামে খুনোখুনি

এতো নাহি হতো।


ছোটো থেকে শিশুর মনে

জাগাও বিজ্ঞান কথা;

জীবন যুদ্ধে জয়ী হবে

কমবে মনের ব্যথা।


অন্ধ জনে ধর্ম গ্রন্থে

ডুবে সদা থাকে;

নিজের মতো ধর্মের বাণী

শুনায় যাকে তাকে।


মনে রেখো বিজ্ঞান পড়লে

সভ্য হয়ে যাবে;

সবার মাঝে থাকবে তুমি

পরম আদর পাবে।






















কত বিলাসিতার অভাব।

-ঋতম সাহা

ধর্ম হোক বা বিজ্ঞানের নাম, হোক কুসংস্কারের দাপট বা প্রযুক্তির খাম,

একলা মানুষ হোক বা গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, বাড়িয়েছে বারবার প্রকৃতির অভিমান,


করে ধ্বংশ, প্রকৃতি একাংশ, মেতেছে মানুষ একপ্রকার নিজেরই হত্যালীলায়,

এভাবেই চললে সংকটে ভবিষ্যত, জানিনা কীভাবে থাকবে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায়।


এই সৃষ্টির সৌন্দর্য্যের অনেক তত্ত্ব, আদি থেকে অভিনবত্ব,

কেও বিশ্বাসী যুক্তি তর্কে বিজ্ঞানী পন্থায়,

কারো মতে মানব সৃষ্টি নাকি আডাম ইভের ভালোবাসায়।

নানা মানুষের নানা মত, নানা বিশ্বাসের নানা পথ।


কোনোটা মিথ্যা, কোনোটা সত্য,

কোনোটা আগামী কোনোটা অতীত বৃত্তান্ত,

পরিবেশের সুস্থতাই শেষকথা এখন, নয়তো আগামীর অপেক্ষায় ভয়ংকর ভবিতব্য।


প্রকৃতির যে সকল সম্পদ দূষিত আজ,

আনতে হবে সেই  ক্ষতিপূরনের নতুন পথ,

হবে দূর প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে কলুষতার ভাঁজ,

সকলের সামনে এখন আগামীর নতুন শপথ।


আমাদের অভ্যাসে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, বন্য জীব বা পতঙ্গ ক্ষুদ্য,

করতে হবে সুরক্ষিত তাদের অস্তিত্ব,

সুস্থ বাস্তুতন্ত্রের কারিগর আমরা সকলে,

প্রত্যেকের জীবনের রয়েছে প্রকৃতির সমান গুরুত্ব।


ফেরাতে হবে ধোঁয়াশা মুক্ত আকাশে শুদ্ধ সমীরন, ফেরাতে হবে বর্জ্যমুক্ত স্নিগ্ধ শীতল নদীর জল,

ফেরাতে হবে দূষনমুক্ত শস্য শ্যামলা উর্বর ভূতল, ফেরাতে হবে মহীরূহে ঘেরা সবুজ সম্বল।

যুব সমাজ

-জামাল আনসারী


একবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজ মেরুদণ্ডহীন,দুর্বল,

প্রতিবাদহীনতায়,ভেঙেছে তাদের যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত মনোবল।

সাম্প্রদায়িক  বিষবাষ্পে,পৃথিবী  দিশাহারা,

দ্রুত থেকে দ্রুততম বেগে ধাবিত,

হিংসার লেলিহান শিখা।

বিশ্বের কেউই আজ আর সুরক্ষিত নয়,

ক্রমবর্ধমান বাক্ স্বাধীনতার কণ্ঠরোধে__

সবাই  ভীত, সন্ত্রস্ত,

ঘোষিত মানবতাবাদীরাও বর্তমানে বাক্ হারা।

প্রাণ চঞ্চল যুব সমাজ তবে কি নীরব দর্শক?

না, তা হয়তো নয়..

বহু দলে আজ তারা ছন্নছাড়া।


পৃথিবীর কোনায় কোনায় দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে

পৌঁছে গেছে উগ্রবাদের রণংদেহি হুংকার।

দৈনিক খবরের কাগজে,টিভির পর্দায়,

এখন চোখ রাখলেই শোনা যায়,

অসহায় মানুষের গগনস্পর্শী বুকফাটা  করুণ আর্তনাদ।


ধর্মের জন্য, কল্পিত প্যুণ্যফলের আশায়,

কত প্রানচঞ্চল, তরুণ তরুণী,

না বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে,

ধর্মের ষাঁড়েদের পাতা  ফাঁদে।

হাজার হাজার কুকর্ম করেও

তারা স্বর্গে যাওয়ার জন্য অঝোরে কাঁদে।

হায় রে দেশের যুব সমাজ!

অসীম নীল মত্ততার টানে,বিকৃতরুচির  উত্থানে,

ক্রমশ অবক্ষয়িত  যুব সমাজ।

যারা গোটা পৃথিবীকে উল্টে পাল্টে,

দেওয়ার অসীম ক্ষমতা রাখে,

তারা কেন আজ ভয়ে কাঁপে?

এই যুব সমাজের দুর্দশা  দেখে,

বসুন্ধরাও  আজ নীরবে কাঁদে।


এ যুব সসমাজের ঘুম ভাঙবে  আর কবে?

তারা খুলে ফেলবে কবে নিজের চোখের ঠুলি?

অদৃশ্য বিভেদের মায়াজাল  ছিন্ন করে,

মানুষের সাথে মানুষের হবে কি কোলাকুলি?

এ ধরাতে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই শ্রেষ্ঠ নয়,

আমরা সবাই মানুষ....

এটাই হোক আমাদের একমাত্র পরিচয়।












লকডাউন -৮

-জামাল আনসারী

করোনা এসে মানুষে মানুষে বাড়িয়ে দিল অবিশ্বাস,

মানবিকতা যতটুকু বেঁচে ছিল, সেটারও হবে বিনাশ।


মানুষের বিপদ হলে, মানুষ সাহায্যের জন্য যেত ছুটে,

প্রতিবেশীর দুঃচিন্তায়, অনেকের রাতের ঘুম যেত টুটে।


সেই সব সুখের দিন আর নেই। সব কিছু হয়েছে অতীত।

ভবিষ্যতে ধংসের দোরগোড়ায় মানুষ হয়েছে  উপনীত।


দয়া, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, বিশ্ব থেকে নিচ্ছে বিদায়।

পিতা মাতার করোনা, নিজের সন্তান এড়িয়ে যাচ্ছে  দায়।


এতো সুন্দর পৃথিবীটা ভর্তি হচ্ছে স্বার্থপর আর স্বার্থপরে।

করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ― পড়ে থাকছে অন্ধকার ঘরে।


যে সন্তানকে কুড়ি বছর ধরে লালন পালন করে মাতা,

সেই সন্তান অকৃতজ্ঞ, যে দায়িত্ব পালনে ধরে না ছাতা।


ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে মানবিকতার প্রশস্ত ডাল- পালা,

যারা ফুটপাটবাসী,যাদের  মাথা গোঁজারও নাই  চালা।


লকডাউনে ওরা কেমন আছে? খোঁজ নিচ্ছে না কেউ,

আবার শুনছি আসতে চলেছে, করোনার তৃতীয় ঢেউ।

কত মানুষ না খেয়ে মরছে দেশে? সঠিক হিসাব তার নাই,

করোনার মরছে কত? মিনিটে মিনিটে তার হিসাব পাই।


করোনায় মরুক আর না খেয়ে মরুক, দুটো মৃত্যুই সমান,

সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে, কমবেই  মৃত্যুর ব্যবধান।

কৃষি বিল কি, কেন ও কোথায় আপত্তি? -দীপঙ্কর মুলনিবাসী
Nov. 18, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:883 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম বিলটি কৃষি বাজার সংক্রান্ত। এই বিলে বলা হয়েছে

* এমন একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা রাজ্যের কৃষি পণ্য বাজার কমিটির আওতায় নিবন্ধিত কৃষিমান্ডিগুলির বাইরে খামারজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের স্বাধীনতা পাবেন।

* রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্য বাধামুক্ত হবে।

* বিপণন ও পরিবহন ব্যয় কমবে, যার ফলে কৃষকরা তাদের * উৎপাদিত পণ্যের আরও ভাল দাম পাবেন।

কৃষকদের ই-কমার্সের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিকাঠামোও সরবরাহ করবে এই বিল।

কৃষক ও আমাদের আপত্তি -

* এই ব্যবস্থার ফলে রাজ্যগুলির রাজস্ব সংগ্রহে বড় ক্ষতি হবে। কারণ, কৃষকরা নিবন্ধিত মান্ডিগুলির বাইরে তাদের উত্পাদিত পণ্য বিক্রয শুরু করলে রাজ্য 'ম্যান্ডি ফি' পাবে না।

* এছাড়া, যদি সম্পূর্ণ কৃষিবাণিজ্যই মান্ডির বাইরে চলে যায়, সেই ক্ষেত্রে রাজ্যের নিযুক্ত 'কমিশন এজেন্টদের' কী হবে?

* সেই সঙ্গে এই বিল শেষ পর্যন্ত এমএসপি-ভিত্তিক অর্থাৎ সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যুনতম সমর্থিত মূল্যের ক্রয় ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে।

* ই-এনএএম অর্থাৎ সরকারি কৃষিপণ্য বিক্রয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মতো বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থাগুলি কৃষি মান্ডিগুলির পরিকাঠামোই ব্যবহার করে। ব্যবসা বাণিজ্যের অভাবে যদি মান্ডিগুলিই ধ্বংস হয়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্মগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে?

২. কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০

২য় বিলটিতে বলা হয়েছে চুক্তিভিত্তিক চাষ সংক্রান্ত। 

* এতে বলা হয়ছেে, কৃষকরা ভবিষ্যতের কৃষি পণ্য বিক্রির জন্য কৃষিবাণিজ্য সংস্থা, প্রক্রিয়াকারক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক বা বড়মাপের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রাক-সম্মত মূল্যে চুক্তি করতে পারবেন।

* এই চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ হেক্টরের কম জমির মালিক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা লাভবান হবেন (ভারতের মোট কৃষকদের ৮৬ শতাংশই প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক)।

* এতে করে অপ্রত্যাশিত বাজারের ঝুঁকি কৃষকদের কাঁধ থেকে তাদের স্পনসর সংস্থাগুলির কাঁধে স্থানান্তরিত হবে।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকদের আরও ভাল তথ্য পেতে সক্ষম করবে।

* বিপণনের ব্যয় কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াবে।

* মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে কৃষকরা সরাসরি বিপণনে জড়িত থেকে সম্পূর্ণ দাম নিজেরাই পেতে পারবেন।

* প্রতিকারের সময়সীমা বেঁধে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকরী প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে।

কৃষক ও আমাদের আপত্তি -

* চুক্তি চাষের ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের ক্ষতিই হবে। কারণ তারা চুক্তির অন্য পক্ষের মতো দরাদরি করার বিষয়ে দক্ষ নন, তাই তাদের প্রয়োজনটা আদায় করতে পারবেন না।

* টুকরো টুকরো করে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করতে সম্ভবত স্পনসররা পছন্দ করবে না।

* বড় বেসরকারী সংস্থাগুলিই হোক কিংবা রফতানিকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী বা প্রক্রিয়াকারকরা, বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ছোট কৃষকদের থেকে তারা অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে।

৩. অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০

৩য় বিলটি পণ্য সম্পর্কিত। 

* অত্যাবশ্যকীয় পণ্য়ের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে এই বিলে। যুদ্ধের মতো কোনও 'অস্বাভাবিক পরিস্থিতি' বাদে এই জাতীয় পণ্যগুলি মজুতে সীমা আরোপ করা হবে না।

* এই বিধান বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দূর করবে। ফলে বেসরকারী ক্ষেত্র / বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কৃষিক্ষেত্রে আকৃষ্ট হবে। 

* এতে করে, কোল্ড স্টোরেজের মতো কৃষি পরিকাঠামো এবং খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলকে আধুনিকীকরণের জন্য বিনিয়োগ আসবে।

* দামে স্থিতিশীলতা এনে কৃষক এবং গ্রাহক উভয়ই সহায়তা করা হবে।

* প্রতিযোগিতামূলক বাজারের পরিবেশ তৈরি করে কৃষিপণ্যের অপচয় বন্ধ করা হবে।

কৃষক ও আমাদের আপত্তি -

* 'অস্বাভাবিক পরিস্থিতি'র যে উদাহরণ সরকার দিয়েছে সেই রকম চরম পরিস্থিতি সম্ভবত কখনই তৈরি হবে না।

* বড় সংস্থাগুলি পণ্য মজুদ করার স্বাধীনতা অর্জন করার অর্থ তারা কৃষকদের উপর শর্ত আরোপ করার সুযোগ পাবে। * যার ফলে চাষীরা কৃষিপণ্যের কম মূল্য পেতে পারেন।

* এই বিধান পেঁয়াজের রফতানি উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছে।

জলই জীবন? -অভিষেক দে।
Nov. 18, 2024 | পরিবেশ | views:884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে এসেছি জলের অপর নাম জীবন। কিন্ত আমরা এই জল নিয়েই এমন অনেক কিছু জানিনা যেগুলো আমাদের জেনে রাখা উচিৎ। 

আমাদের শরীর কে নিরোগ সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাদ্যের সাথেই পরিস্রুত পানীয়জল এর প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী। এই পরিস্রুত পানীয়জল নিয়েই সামান্য আলোচনা করবো। 

প্রথমেই আমাদের জেনে রাখা ভালো এই "পরিস্রুত পানীয়জল" এর নামে বাজারে যেসব বোতল ভর্তি মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করা হয় সেখানেই রয়েছে গপ্পো। কারন, এটি প্রায় ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ প্রতারণা। একমাত্র ঝরনার জল বা স্প্রিং ওয়াটার, যাতে নানান প্রাকৃতিক খনিজ লবন মিশে থাকে তাকেই বলে "মিনারেল ওয়াটার"। বিদেশে এই মিনারেল ওয়াটার বোতলে কোন পাহাড়ের কোন ঝরনার জল থেকে সংগৃহিত সেটা লেখা থাকে। কিন্ত দুর্নীতিতে প্রথম সারিতে থাকা আমাদের দেশ ভারতে এসব আশা করাই বৃথা। তাছাড়া বাজারজাত ১০/২০/৩০ টাকার পানীয়জল এর বোতলের জল কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেটা আমরা কতজন জানি? কিছুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যেখানে দেখেছিলাম, জনৈক ব্যাক্তি ২০ লিটারের জার এ সাধারণ কলের জল ছাঁকনির মধ্যে ছেঁকে ভর্তি করে বিক্রি করছিল আর সাধারণ কলের জলে যে কত প্রকার ব্যাকটেরিয়া আছে সেসব খোঁজ কতজন রাখেন। দুঃখ এটাই এইসব প্রতারণা দিনের পর দিন চলে আসছে কিন্তু প্রশাসনের নজরদারীর অভাবে এবং টাকার কুমির বনে বসে থাকা লোভী দের আন্ডারটেবিল ঘুষ দেওয়ার কারনে অনেক কিছুই ধামাচাপা পরে যায়। 

তথ্য বলছে গোটা পৃথিবীর মতন মানব শরীরও ৭০ ভাগ অংশ জল দ্বারা পূর্ণ এবং শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ এই জলের ওপরে নির্ভরশীল। শরীর থেকে দূষিত Toxin ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ বের করতে জলের গুরুত্ব অনেক। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আজ প্রায় প্রতিটি পরিবারে নানান রোগ যার সংখ্যাগরিষ্ঠই কিন্ত জলবাহিত রোগ। জলের গুণ মাপা হয় প্রধানত তিন ভাবে। ১) Cluster Size, ২) pH Value, ৩) ORP Value। বর্তমানে এই দ্রুতগতির জীবনে আমাদের শরীরে এতোটাই Acid Base জমা হয়ে গেছে যে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ সঠিক অক্সিজেন ও পুষ্টি পাচ্ছে না।  পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি শিশু যখন জন্মায় তখন থেকে শিশুটি যতদিন মায়ের দুধ পান করে ততদিন তার শরীরের pH থাকে 7.4 ( Neutral)। তারপর থকেই শুরু হয় নানান সমস্যা। ‌"No Disease Can Survive in An Alkaline Body" এই তথ্য দেওয়ার জন্য " Dr. Otto Heinrich Warburg " কে ১৯৩১ সালে " Nobel " পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।

যদি আপনি শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া স্টেশনের ভেতরের কলে জল পান করেছেন তাহলে নিশ্চই জানেন ঐ জলে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে যা আসলে পানীয়জল পারিস্কার করার জন্য ব্যবহৃত ক্লোরিন। ক্লোরিন যুক্ত পানীয়জল দীর্ঘসময় ধরে পান করাও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক লিটার পানীয়জলে আধ মিলিগ্রাম ক্লোরিন মিশিয়ে কমপক্ষে এক ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপরেই সেটা পানযোগ্য হয়। জলের সাথে ক্লোরিন বিক্রিয়া করে হাইপোক্লোরাইট অ্যাসিড ও হাইপোক্রোরাইট তৈরি করে। এই হাইপোক্লোরাইটই হল জীবাণুনাশক। বাজারে যে জিওলিন পাওয়া যায় তাতে থাকে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট। এক গ্লাস বা ২০০ মিলি.জলে ৩-৪ ফোঁটা জিওলিন মেশালেই চলে। ক্লোরিন কিন্ত সব ধরনের জলবাহিত জীবাণু কে ধ্বংস করতে পারে না এবং এটি দীর্ঘসময় ধরে শরীরে প্রবেশ করলে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

প্রচন্ড গরমে রঙ্গিন ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিয়ে গলা ভেজাতে কে না চায় কিন্ত এই ঠান্ডা পানীয়ই কিন্ত বিপদ বাড়ায় অনেক। সাল ২০০৩ এ C.S.E. সংস্থা ল্যাবোরেটারি তে বেশ কয়েকটি রঙ্গিন পানীয়র পরীক্ষা করে জানিয়েছিল এতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত কীটনাশক ( Pesticides, Insecticides) রয়েছে যা শরীরে বড় ধরনের রোগ সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ক্লোপাইরিপস্, হেপ্টাক্লোর, লিনডেন ইত্যাদি।

এই রিপোর্ট সামনে আসার পরেও যে অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তার প্রমাণ ২০০৬ সালে ফের C.S.E. সারা দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি নামী কোল্ড ড্রিংক বা সফট ড্রিংক এর স্যাম্পেল নিয়ে পরীক্ষা করে জানায় এসবে কত পরিমাণে বিষাক্ত জিনিস রয়েছে।

জল যদি আপনি ফুটিয়ে খেতে পারেন সেটা সবচেয়ে ভালো। কমপক্ষে ২০ মিনিট জল ফুটিয়ে সেটা ভালোকরে ছেঁকে তারপর ঠান্ডা করে পান করুন। এড়িয়ে চলুন ফ্রিজ রাখা পানীয়জল বের করেই পান করা এবং বরফ শীতল জল একেবারেই পান করবেন না। চেষ্টা করুন পানীয়জল এর অপচয় বন্ধ করার। মনে রাখবেন এই পৃথিবীতেই এমন অনেক স্থান আছে যেখানে মানুষেরা সামান্য জলের জন্য হাহাকার করেন।

একুশ শতকের লজ্জা ডাইনি -অভিষেক দে।
Nov. 18, 2024 | কুসংস্কার | views:888 | likes:25 | share: 0 | comments:0

গত ৫ জুলাই ২০২১ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এ ডাইনি সন্দেহে একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবী জানিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক কে ইমেল করেছি। খবর পেয়েছি সরকার এখনও নাকি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এই সূত্র ধরেই

কথা হচ্ছিল ফ্রিথিংকার এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিঃ দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার (Activist Dr Dibyajyoti Saikia) সাথে। 

গত ১৪ আগষ্ট ২০১৫ সালে অসম বিধানসভায় পাশ হয়েছে ডাইনি হত্যা প্রতিরোধ আইন। " THE ASSAM WITCH HUNTING ( PROHIBITION, PREVENTION AND  PROTECTION) ACT 2015 " অসম বিধানসভায় আলোচনার পর বিলটি গৃহীত হয় এবং ২৯ জুন ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইনে কোনো মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ডাইনি অপবাদে কাউকে অত্যাচার করা হলে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা জড়িত থাকলে সকলের কাছ থেকে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান থাকছে। ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় বিচার হবে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। তদন্তে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে ১০ হাজার টাকা। সরকারের দাবি, অসমের এই আইন বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের চেয়েও কড়া হবে। উল্লেখ্য, কিছু সময় আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির মাণ্ডরে ডাইনি অপবাদে পাঁচ মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়। অন্য রাজ্যগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে মাঝেমধ্যেই ডাইনি অপবাদে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে।

অসমে পাশ হওয়া আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার চালানো, একঘরে করা বা হত্যার ঘটনায় তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজার সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে উক্ত আইনে হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেআইনি অনুশীলন ও সালিশি সভা বন্ধেরও কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ডাইনি অপবাদে একঘরে হওয়া, জখম হওয়া, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মহিলা বা পুরুষকে ক্ষতিপূরণ এবং ডাইনি-শিকারের বলি হওয়া পরিবারের অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হবে।

এই আইনটি লাগু করার পেছনে দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার অবদান অনেক।  অসমে গত ৭ বছরে ডাইনি অপবাদে প্রায় ৭০ জনের বেশি খুন করা হয়েছে। এই ঘটনা বেশি ঘটেছে শোণিতপুর, লখিমপুর, মাজুলি, বড়ো ও সাঁওতাল অধ্যূষিত জেলাগুলিতে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে দেখেছে, অনেক ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। রাজ্য পুলিশ ডাইনি হত্যা রোধে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। পাশাপাশি বীরুবালা রাভা ও দিব্যজ্যোতি সাঁইকিয়া ডাইনি হত্যা রোধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু, তার পরও এই সব ঘটনা আটকানো যাচ্ছিল না।

দিব্যজ্যোতিবাবু জানান, প্রায় ছ’বছর ধরে তাঁরা ডাইনি হত্যা রোধে কড়া আইনের জন্য সুপারিশ করছিলেন। অসম সরকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া বিল তৈরি করে। মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘ছ’বছরের চেষ্টায় বিল পাশ হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু, ওঝাদের রমরমা বন্ধ করতে কোনও দল মুখ খুলল না। এটা খুবই মর্মান্তিক। অসম সরকারের হিসেবে, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৬ জন ও ২০১৪ সালে ডাইনি অপবাদে ৯ জনকে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে বিধানসভায় এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুল রহিম খান, অপরাধীদের জরিমানার টাকা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। অগপ বিধায়ক কেশব মহন্ত বলেন, ‘‘শাস্তি দিয়ে ডাইনি-হত্যার রাশ টানা যাবে না। স্কুলে স্কুলে অন্ধবিশ্বাস রোধে সচেতনতা শিবির ও এই বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’’

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রদদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"। " অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি " র প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র দাভলকর এর বিশেষ উদ্যোগে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " চালু হয়েছে। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies ( Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং 

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে। 

ভারতে এতোগুলো আইন থাকা সত্বেও ডাইনি বলে দেগে দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। অন্যান্য রাজ্যে আইন রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে না আছে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার কিংবা হত্যার কোনো তথ্য আর না কঠোর আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ। 

প্রসঙ্গত জানাই, গত ১৪ ই আগষ্ট ২০১৮ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কে একটা RTI করেন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি র পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি মধুসূদন মাহাতো। তথ্য জানার অধিকার আইন ২০০৫ এর মাধ্যমে মধুসূদন মাহাতো, সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ডাইনি সন্দেহে কতজন মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনার তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে।

৩০ আগষ্ট ২০১৮ তে স্টেট ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো থেকে উত্তর আসে যা সত্যিই অবাক করার মতন। সরকারের কাছে নাকি কোনো তথ্যই নেই! 

বাহঃ চমৎকার। 

কয়েকজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা মহারাষ্ট্রের ধাঁচে এই পশ্চিমবঙ্গে একটি কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। আইনটির নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill 2016। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।

দেশের শ্রদ্ধা প্রথম আধুনিক মানুষ -আকাশ সেনগুপ্ত
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:117 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন রাজা। বড় হতাশ লাগছে তাঁর। মানুষই যদি বিরোধিতা করে, তাহলে তিনি লড়বেন কাদের নিয়ে? আর করবেনই বা কাদের জন্য? ধুস, আর লড়াই করে লাভ নেই। এমন সময় দারোয়ান এসে বলল একজন গেঁয়ো ব্রাহ্মন দেখা করতে চাইছে। একটু বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, এখন আমার সময় নেই বলে দে।

দারোয়ান বলল, বলেছি। কিন্তু উনি যেতে চাইছেন না। তখন রাজা বললেন, পাঠিয়ে দে। এক ব্রাহ্মন ঘরে ঢুকলো। খাটো ধুতি, গায়ে নামাবলি, মাথায় টিকি। টিকি দেখলেই রাজার মাথাটা যায় গরম হয়ে। রুক্ষ স্বরে বললেন কী চাই? ব্রাহ্মন বলতে শুরু করলেন। আমি নদীয়ার মহাদেব ভট্টাচার্য।থামলেন একটু,বোধহয় গুছিয়ে নিলেন একটু। আবার শুরু করলেন। জানেন,সেদিন ছিল বৈশাখ মাস। টোল থেকে ফিরতেই অপর্ণা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে। জল দিলো, গামছা দিলো, বাতাস দিলো পাখা করে।আমার জন্য তার যতো চিন্তা।বাপে মেয়েতে আদর খাচ্ছি। তখন ওর মা ডাকলো ঘর থেকে। ভেতরে যেতে বলল, মেয়ের তো ৭ বছর বয়স হোল। আর কতদিন ঘরে বসিয়ে রাখবে? পাড়ায় যে কান পাতা দায়। আমি বললাম,পাত্র পাচ্ছি কই? যার কাছেই যাই। ১০০০ টাকার কমে পন নেবেনা কেউ। মন্দিরা ফিসফিস করে বলল, সবার তো কপাল সমান হয়না।

কিন্তু জাত ধর্ম তো রাখতে হবে। কাল নদীপথে একজন কুলীন ব্রাহ্মন এসেছেন। বয়সটা বেশি। ৭০ এর ঘরে। কিন্তু বংশ উঁচু। ৫০ টাকায় কন্যা উদ্ধার করেন তিনি। আমাদের অপুকে ওর হাতে গৌরি দান করো। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, না না এ হবেনা। কিন্তু সমাজের চাপতো বুঝি। বুঝি সংসারের চাপও। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে অপুর সাথে বিবাহ দিলাম। লাল চেলি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়েকে আমার দেবীর মতো লাগছিলো। সে যে কী রূপ কী বলবো!! বোধয় বাপের নজরটাই লেগেছিল সেদিন। পরদিনই মেয়েকে ছেড়ে জামাই বাবাজীবন আবার পাড়ি দিলেন নদীপথে। আরও কারোর কন্যা উদ্ধার করতে। বলে গেলেন আবার আসবো পরের বত্‍সর। আমাদের বাপ মেয়ের আনন্দের জীবন চলছিলো বেশ। সারাক্ষন আমার পিছনে। সব কাজ শিখে গেলো। পারতো না শুধু রান্না। একদিন হাতে ফোস্কা পড়ে কী অবস্থা। আমি ওর মা কে বলে দিলাম, ওকে রান্নার কাজে লাগাবেনা। আগুনে ওর কষ্ট হয়। কী খুশি সেদিন মেয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কতো আদর। আশ্বিন মাস গড়িয়ে যায়। পুজো আসছে, চারদিকে সাজো সাজো রব। আমি হাট থেকে মেয়ের জন্য লালটুকটুকে শাড়ি, আলতা সব নিয়ে এলাম। মেয়ে খুব খুশি। বলল ওঃ!! কখন যে পড়বো এইসব।বাবা, আমাকে রানীর মতো লাগবে, বলো? আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠলো। অভাবী সংসারে খুশি উপচে পড়লো। ঠিক তার পরের দিন, জানেন ঠিক পরের দিন। সকাল দশটা হবে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এলো পত্র নিয়ে। গতকাল নারায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় দেহ রেখেছেন। যথাবিহিত বিধি অনুসারে কন্যাকে সতী করার নির্দেশ দিয়েছেন তারা।

ভেবেছিলাম, পত্র ছিঁড়ে ফেলবো। কিন্তু পত্রবাহক গ্রামের মাতব্বরদের জানিয়েই এসেছেন আমার বাড়ি। কোন উপায় ছিল না। রাজা বলে উঠলেন তারপর??? তারপর মেয়েকে সাজালাম। নতুন লাল চেলির শাড়ি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়ে সেদিন অপরূপা। গ্রামে উত্‍সব, ঢাক বাজছে। এয়োরা সবাই ওর মাথার সিঁদুর,ওর আলতা নিচ্ছে। আর ও নিজে কী খুশি সেজেগুজে। ওর পছন্দের দধি মিষ্টান্ন এসেছে ঘর ভরে। জানেন, তার মধ্যেও ও সেসব আমাকে খাওয়াবে বলে ব্যস্ত। কথা বন্ধ হয়ে আসে ব্রাহ্মনের। চোখটা মুছে আবার শুরু করেন। খালি সে বুঝতে পারেনি উত্‍সবটা কিসের। এরপর খবর এলো নদীর তীরে চিতা সাজানো সমাপ্ত। সতীমাতাকে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন কুলীন সমাজ। মেয়েকে কোলে নিয়ে চললাম। কাঁদিনি একটুও। ওকে বুঝতে দিতে চাইনি কিছুই। চিতার পাশে সমস্ত আনুষ্ঠানিক কাজ মিটলো। মেয়ে অবাক হয়ে দেখছিল সব। আগুন দেওয়া হোল চিতায়। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো চিতা। মেয়ে বলল বাবা, বাড়ি চলো। আগুনে আমার বড় ভয়। আমি বললাম, আমার গলাটা একবার ছাড় মা। কচি হাত দুটো গলাটা ছাড়তেই ছুঁড়ে দিলাম অগ্নিকুণ্ডে। আগুনের মধ্যে থেকে একটা রিনরিনে গলা পাওয়া গেল, বাবা। সেই ডাক আমি ভুলতে পারিনি। তারপর থেকে একদিনও রাত্রে ঘুম হয়নি। উঠতে বসতে খেতে শুতে শুধু এক আওয়াজ। বাবা। আমি পারিনি তাকে বাঁচাতে। আপনি পারেন। পায়ে ধরি আপনার। মেয়েগুলাকে বাঁচান। কতো মেয়ে গ্রাম ঘরে আপনার মুখ চেয়ে আছে। আছি আমরা, মেয়ের বাপ মা রা। বলতে পারিনা সমাজের ভয়ে। কিন্তু আপনি পারবেন। উঠে দাঁড়ালেন রাজা রামমোহন রায়।

বললেন,আমায় আপনি শক্তি দিলেন। পারতে আমাকে হবেই। এখানে না হলে ব্রিটেন যাবো। প্রিভি কাউন্সিলে দরবার করবো। কথা দিলাম আপনাকে। বাকিটা ইতিহাস। সেই যুগে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই লড়াই কতোটা কঠিন ছিল বলে বোঝানো যাবেনা। কলকাতার রাজ পরিবার থেকে ভারতের পণ্ডিত সমাজ সকলে ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কম নিন্দা অপমানের ঝড় বয়নি তাঁর ওপর দিয়ে। কিন্তু বটবৃক্ষের মতো অটুট ছিলেন তিনি। রামমোহন রায়, ভারতের 'প্রথম আধুনিক মানুষ'। 

কলেজে শূদ্র ছাত্রদের প্রবেশাধিকার বিতর্কে বিদ্যাসাগর: একটি পর্যালোচনা -শিবাশিস বসু
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:885 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা দেখেছি, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনও বর্ণের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার ছিল না। অধ্যক্ষরূপে কর্মভার নেওয়ার পর বিদ্যাসাগর প্রথমে কায়স্থ এবং পরে যেকোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দু ছাত্রের প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করলেন সংস্কৃত কলেজে। 

তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের এই বাস্তববাদী পদক্ষেপটির যথাযথ মুল্যায়ন না করেই একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করতে বসে যান যে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিদ্যাসাগর শূদ্রদের শিক্ষার বিরোধী ছিলেন! বিনয় ঘোষ সরাসরিভাবে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ না আনলেও মন্তব্য করেছেন, "এক্ষেত্রেও দেশাচারের কাছে তিনি নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।" এই প্রসঙ্গে একই রকম মন্তব্য করেছেন অলোক রায়ও - “কিন্তু সেকালের সামাজিক রীতিনীতি-সংস্কার সম্পুর্ণ অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয় নি।"

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ১৮৫১-৫৮ মোট সাত বছরের মতো অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এই সময় তিনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও তাদের তাৎপর্য বিশাল। সে সময়ে পাঁজি-পুঁথি দেখে অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকতো। বিদ্যাসাগর কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সচিবকে লিখলেন, তিথি মেনে নয়, সপ্তাহান্তে রবিবার দিন ছুটি থাকবে। কলেজে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হত না। ফলে ছাত্ররা যখন খুশি ভর্তি হত, আবার যখন খুশি ছেড়ে যেত। তাছাড়া কলেজে আসারও কোনও সময় নির্দিষ্ট ছিল না। বিদ্যাসাগর প্রথমে প্রবেশ দক্ষিণা দুই টাকা ও মাসিক বেতন এক টাকা নির্দিষ্ট করলেন। ছাত্র-শিক্ষক সকলের জন্য কলেজে আসার সময় - সাড়ে দশটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। উপস্থিতির হিসাব রাখবারও ব্যবস্থা হল।

কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের যে আমূল সংস্কার করেন, কৃষ্ণকমল তাঁর 'পুরাতন প্রসঙ্গ' গ্রন্থে তার পরিচয় দিয়েছেন - ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনও বর্ণের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনি ব্যবস্থা করলেন, বর্ণনির্বিশেষে হিন্দু ছেলেমাত্রই কলেজে পড়তে পারবে। শিক্ষা সংসদের সচিব ডঃ মৌয়াটের চিঠির উত্তরে ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দের ২৮শে মার্চ তিনি লেখেন, "I see no objection to the admission of other castes than Brahmanas and Vaidyas or in other words, different orders of Shudras, to the Sanskrit College. But as a measure of expediency, I would suggest that at present Kayasthas only be admitted." এই যে দুই-পা এগোনোর জন্য এক-পা পিছিয়ে যাওয়া, এর কারণটিও বিদ্যাসাগর ব্যাখ্যা করলেন ওই চিঠির অষ্টম অনুচ্ছেদে, "The reason why I recommend the exclusion of the other orders of Shudras at present, is that they, as a body, are wanting in respectibility and stand lower in the scale of social considerations, their admission, therefore, would I fear, prejudice the interests of the Institution." একই কারণে ১৮৫৫ সালের ২১শে নভেম্বর তিনি সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের ছাত্রকে সংস্কৃত কলেজে পড়বার অনুমতি দেন নি, কারণ "Admission from that class will I am sure not only shock the prejudice of the orthodox Pandits of the Institution but materially injure to its popularity as well as respectability. Personally I have always been opposed to the exclusive system as will appear from my former reports to the late Council on the subject of admitting applicants if other castes than Brahmanas and Vaidyas, I would have been glad to admit the son of the memorialist" শেষ লাইনটার মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের মনোভাব ও অসহায়তা, বোধকরি দুটোই স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ নীতিগতভাবে শূদ্রদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার খুলে দেওয়ার তিনি সম্পুর্ণ সপক্ষে কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা করতে গেলে হিন্দু সমাজে প্রতিক্রিয়ার যে ঢেউ উঠবে তাতে শিক্ষা প্রসারের মুল প্রচেষ্টাটাই বানচাল হয়ে যাবে।

Causality, অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাপারটা আপনারা সবাই বোঝেন। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। কিন্তু কাজটা যেখানে হল, কারণটাকেও যে সেখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন তো কোনও কথা নেই, বরং প্রায়শই মনে হয় - হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে।

সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজ একই প্রাঙ্গনে অবস্থিত হলেও দুই বিদ্যায়তনের সামাজিক স্তরভেদ ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কয়েক যোজন তফাত। সংস্কৃত কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই ছিল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য এবং তুলনামুলকভাবে আর্থিক সঙ্গতিহীন। পক্ষান্তরে, হিন্দু কলেজে এবং মেডিকেল ছাত্ররা ছিল ধনী জমিদারদের সন্তান বা ইংরেজ আমলে আত্মপ্রকাশ করা নযা বেনিয়াদের সন্তান। হিন্দুকলেজ এবং সম্ভবত একই কারনে মেডিকেল কলেজেও জাতিভেদ ছিল না, "কুলকৌলিন্যের মানদণ্ড দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষাধিকার স্বীকৃত হত না।" এমনকি সংস্কৃত কলেজের রক্ষনশীল ধ্যানধারণার পণ্ডিতমশাইরা হিন্দু কলেজের পাশ্চাত্যভাবাপন্ন শিক্ষকদের সুনজরে দেখতেন না। অর্থাৎ পাশাপাশি অবস্থিত হলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুটি কলেজের পরিবেশে পঞ্চাশ বা একশো বছরের পার্থক্য ছিল।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আজ ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে একজন ব্রাহ্মণের ছেলে বা মেয়ে কোনো দলিতের মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করলে হয়তো প্রবল সমালোচনা হবে, হয়তো বা একঘরেও হতে পারে। কিন্তু একই কাজটা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান বা হরিয়ানাতে করলে অনার কিলিং হতে দেরি লাগবে না।

সতীদাহ রদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবার জন্য ১৮৩০ সালের ১৭ই জানুয়ারি কলিকাতায় যে ধর্মসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। কাজেই হিন্দু কলেজ বা মেডিকেল কলেজের ছাত্রশিক্ষকদের মাইন্ডসেট দিয়ে সংস্কৃত কলেজকে বোঝা যাবে না। ১৮৫১ সালে জাতিভেদের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি বিদ্যাসাগর শিক্ষাপরিষদের নজরে আনলে পরিষদ তাঁকে রিপোর্ট দিতে বলেন। ২০শে মার্চ বিদ্যাসাগর তাঁর রিপোর্ট দেন। "তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য, শূদ্রদের চেয়ে কোনও অংশে উচ্চস্তরের মানুষ নয়, অতএব সংস্কৃত কলেজে সব জাতির ছাত্রদের প্রবেশাধিকার না থাকবার কোনও কারণ থাকতে পারে না। তিনি এও অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে কলেজের পণ্ডিতরা প্রায় সবাই এই উদার সংস্কার বিধানের বিরোধী। পরিষদকে তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন যাতে প্রবেশাধিকার সম্বন্ধে কড়াকড়ি না করা হয় এবং শুরুতে অন্ততঃ কায়স্থ সন্তানদের ভর্তি করবার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে ধীরে ধীরে সমস্ত জাতিভেদগত নিষেধ দূর হতে পারে। কলেজের পণ্ডিতরা, যাঁরা বেশিরভাগই বিদ্যাসাগরের শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে লাগলেন। ... কলেজে সর্বজাতির ছাত্রদের প্রবেশাধিকার দিতে তিনি দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন এবং পণ্ডিতদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তাঁরাও যদি সমানে তাঁর বিরোধিতা করার প্রতিজ্ঞা করে থাকেন তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।" এই কথা অনেকেই বলেছেন যে, কায়স্থদের ভর্তি করবার সিদ্ধান্ত গৃহিত হতেই বেশ কয়েকজন অধ্যাপক লিখিত প্রতিবাদ করেন। বদরুদ্দীন উমর লিখছেব, "হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সকল বর্ণের ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তির প্রশ্ন যখন ওঠে তখন রক্ষণশীলরা ভয়ানকভাবে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতা এত প্রবল ছিল যে, ইচ্ছে সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকলের জন্য উন্মত্ত করার প্রস্তাব কতৃপক্ষের কাছে দিতে পারেন নি।" বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলালও বলেছেন, বিদ্যাসাগর শিক্ষা-সভায় আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে "কলেজের প্রধান প্রধান অধ্যাপকগণ ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন।" 

 ইতিহাস অচেতন এইসব তথাকথিত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের কে বোঝায় যে ভারতবর্ষের মতো ধর্মপ্রধান দেশে যেখানে রানী রাসমণি জাতে শুদ্র বলে মন্দির স্থাপন করার জন্যও হিন্দুদের কাছে জমি পান নি, এবং মন্দির তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করবার জন্য কোনো ব্রাহ্মণ পূজারী পাচ্ছিলেন না, সেখানে একই সময়ে বিদ্যাসাগর যদি শূদ্রদের পুরোপুরিভাবে জন্য সংস্কৃত কলেজের দরজাটা তখনই খুলে দিতেন, তা তো কার্যকর হতই না, এমনকি হয়তো সংস্কৃত কলেজটাই উঠে যেত ! এই প্রসঙ্গে পাঠকপাঠিকাদের মনে করিয়ে দিতে চাই ১৬ই আগস্ট, ১৯৯২ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী চুনি কোটালের আত্মহত্যার পর তাঁর জীবনসঙ্গী মন্মথ শবর পুলিশকে বলেছিলেন, "কী প্রবল উচ্চবর্ণীয় ঘৃণায় এক বাঙালী ব্রাহ্মণ অধ্যাপক চুনিকে প্রতি মুহূর্তে মনে করাতেন যে, স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াশোনার অধিকার কোনও লোধা মেয়ের থাকতে পারে না।" মনে করিয়ে দিতে চাই, কয়েকবছর আগেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সরস্বতী কারকেট্টার অবমাননার কথা। মনে করিয়ে দিতে চাই, অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মুর প্রতিদিনকার সংগ্রামের কথা। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে কেন তিনি সেই সময় শুধু কায়স্থদের ভর্তির সুপারিশ করেছিলেন তা তৎকালীন হিন্দু ধর্মের জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ির প্রাবল্য সম্পর্কে যাঁদের পরিস্কার ধারণা আছে, তাঁরাই বুঝতে পারবেন। ধীর প্রক্রিয়ায় সামাজিক বাধা কাটিয়ে সংস্কৃত কলেজে সকল জাতির ভর্তির ক্ষেত্রে কোনও আপত্তিই যে তাঁর ছিল না, চিঠিতে স্পষ্ট করেই তিনি তা ব্যক্ত করেছিলেন। এটাই বিদ্যাসাগরের প্রাজ্ঞতা। তিনি জানতেন সামাজিক বিপ্লব রাতারাতি হয় না - এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। তাই তিনি "১৮৫১, জুলাই মাসে প্রথমে কায়স্থ, পরে ১৮৫৪, ডিসেম্বর মাসে যে-কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দুকে সংস্কৃত কলেজে পড়ার অবাধ অনুমতি দিলেন।" এইভাবে সম্ভ্রান্ত ঘরের সমস্ত হিন্দু ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে পঠনপাঠনের অনুমতি দিয়ে বিদ্যাসাগর স্রেফ জাতিগত সংস্কারের বদ্ধ শিলাখণ্ডটিকে উৎপাটিত করে প্রগতির গাড়ির চাকাটা গড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পরবর্তী চালকদের আশায়। বলতে পারি অগ্রবর্তী যুগের পথ চলবার সোপান তৈরী করে গিয়েছিলেন তিনি। আমরা কি আজও তা পরিপূর্ণভাবে পেরেছি?

তথ্যসূত্র :

বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান

উনিশ শতকে নবজাগরণ: স্বরূপ সন্ধান, অলোক রায়, অক্ষর প্রকাশনী

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, প্রকাশনা বিভাগ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, চিরায়ত প্রকাশন

বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন

রোহিত, চুনি এবং একলব্যেরা, সুমন দে, এবেলা.ইন

বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স।

বিদ্যাসাগর: একালের নিরিখে -রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:876 | likes:0 | share: 0 | comments:0

লেখক প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শন বিশেষত চার্বাক/লোকায়ত দর্শন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

বড় মাপের মানুষদের সম্পর্কে অনেক গল্প চালু হয়। সেগুলোর সবই যে পুরো ঠিক তা নয়। কিন্তু কোনো-কোনোটির মধ্যে অন্তত কিছুটা সত্য থাকে। মা-য়ের ডাকে সাড়া দিতে বিদ্যাসাগর ঘোর বর্ষায় সাঁতরে দামোদর পেরিয়েছিলেন— এই গল্পটি পুরোপুরি বানানো। এর মধ্যে এক তিলও সত্য নেই, যদিও হাজার হাজার, হয়তো লক্ষ লক্ষ লোক আজও গল্পটি বিশ্বাস করেন। কিন্তু সে কথা থাক। মানুষের বিশ্বাস করার ক্ষমতা অসীম— যত অসম্ভব ততই যেন বিশ্বাস্য। আরও কম-জানা কিন্তু বিশ্বাস্য একটি গল্প দিয়ে শুরু করি।

উনিশ শতকের শেষে বাঙলায় হিন্দু ধর্মকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তার নেতা ছিলেন শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫২-১৯২৮)। তিনি থাকতেন কাশীতে; প্রচারের জন্যে তাঁকে কলকাতায় আনা হয়েছিল। তিনি একবার গেছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে৷ বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেন,

‘আপনাকে হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্য যাঁরা এনেছেন তাঁরা যে কেমন দরের হিন্দু তা তো আমি বেশই জানি, তবে আপনি এসেছেন, বক্তৃতা করুন। লোকে বলবে, বেশ বলেন ভালো। এমন একটা প্রশংসালাভ করবেন এইমাত্র।’ এর পরে তিনি যোগ করেন, ‘আমার স্কুলের [মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন-এর] ছেলেরা যে মুরগির মাংস খায়, আপনার বক্তৃতায় তাঁরা যে সে মাংস ছাড়বে আমি তা একেবারেই বিশ্বাস করি না।’

কথাগুলি শশধরও লিখে যাননি, বিদ্যাসাগরও না। একজন তৃতীয় ব্যক্তি, শশিভূষণ বসু ঘটনাটি লিখেছেন (‘বিদ্যাসাগর-স্মৃতি’, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪৩, পৃ.৫৪৯)। অবশেষে তাঁর মন্তব্য: ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় অতি উদারচেতা পুরুষ ছিলেন, ধর্ম্ম-বিষয়ে তাঁহার কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস প্রচলিত হিন্দু ধর্ম্মের অনেক উচ্চে তিনি বাস করিতেন।’ তাঁর মতে, ‘লোকের ধর্ম্ম-বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা বড় কঠিন বিষয়। তাই এখানে এ-বিষয়ে আর কিছু বলিলাম না।’

একালে মানুষের পরিচয় রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে। বিদ্যাসাগরের সময়ে অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। গণতন্ত্র শব্দটিও চালু ছিল না। তাঁর জীবন কেটেছে খানিকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে (১৮২০-১৮৫৮), বাকিটা মহারানি ভিকটোরিয়ার অধীনে (১৮৫৮-১৮৯১)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৫-তে৷ বিদ্যাসাগরের তাতে কোনো উৎসাহ ছিল না। এবিষয়ে তাঁর কোনো লিখিত মতামত পাওয়া যায় না। তবে নানা লোকের কথায় জানা যায়: বক্তৃতা করে ভারত উদ্ধারে তাঁর আস্থা ছিল না। একজন অন্তত বলেছেন, বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধুদের বলতেন: ‘তোমাদের আর উপায় নেই। জঙ্গলে গিয়ে পল্টন তৈরী করো।’ তিনি সময়ে সময়ে এত গরম ভাবে কথা বলতেন যে, বন্ধুরা তাঁর ঘরের কপাট বন্ধ করে দিতেন। বাঙলার অন্যতম প্রথম বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে একথা জানিয়েছিলেন মেদেনীপুরের একটি স্কুলের একজন অতি বৃদ্ধ পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই মানসিক প্রস্তুতির দ্বারাই এই অতিবৃদ্ধ পণ্ডিত আমাদের কর্মে [অর্থাৎ, বিপ্লবী কাজকর্মে] সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিলেন’ (ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম, নবভারত পাবলিশার্স ল, ১৯৮৩, পৃ. ৯৩)।

তার মানে, সরাসরি কোনো ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগ না থাকলেও, তাঁর একটি রাজনৈতিক মত ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল।

তবে এও ঘটনা যে, নিজের ধর্মবিশ্বাসের মতো রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও তিনি কারুর সঙ্গে আলোচনায় যেতেন না। তাঁর সমসময়ের সকলেই অবশ্য জানতেন: তিনি পরকালে বিশ্বাস করেন না, বরং সেই নিয়ে ঠাট্টা করেন (বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিদ্যাভারতী, ১৩৭৩ ব., পৃ.১৩১)।

ডিরোজিও আর ইয়াং বেঙ্গলের মারফত একই সঙ্গে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা আর যুক্তির যুগ-এর ধারণা এসেছিল বাঙলায়। বিদ্যাসাগরও তাঁর নিজস্ব রীতিতে আধুনিক পৃথিবীর সেইসব ধারণাকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন। এই দিকটিকে জোর দেওয়া হয় না, অথচ এর ওপরেই তাঁর গোটা জীবন-দর্শন দাঁড়িয়ে আছে। দীনেশচন্দ্র সেনকে একটি চিঠিতে (১৭ নভেম্বর ১৯০৫) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘… বোলপুরের বিদ্যালয় স্থাপন ও শিক্ষার ভার নিজের হাতে ও স্বদেশী ভাবে প্রবর্ত্তনের চেষ্টা’ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইনি বলেন, ‘এ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় অগ্রণী। তিনি ইংরেজি ধরণের বিদ্যালয় দেশীয় লোকের দ্বারা চালাইতে সুরু করেন— আমার চেষ্টা যাহাতে বিদ্যাশিক্ষার আদর্শ যথাসম্ভব স্বদেশী রকম হয়।’ (চিঠিপত্র, খণ্ড ১০, বিশ্বভারতী, ১৩৭৪, পৃ.৩৩)।

বিদ্যাসাগরের চরিত্রর অনেক দিকই দুর্জ্ঞেয়, শুধু সাধারণ লোকের পক্ষেই নয়, সকলের পক্ষেই। সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে বইটির উপসংহার-এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি বাক্য ছিল। কেন তিনি দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে সেটি বাদ দিলেন, তা সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায় না। তেমনি, বোধোদয়-এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ঈশ্বর ও ঈশ্বরসৃষ্ট পদার্থ’ অংশটি থাকলেও (সম্ভবত) পঞ্চম সংস্করণ থেকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ বাদ দিলেন, আবার ১০৫তম সংস্করণে কেনই বা প্রথমে ‘পদার্থ’ ও তার পরে ‘ঈশ্বর’ নামে দুটি আলাদা অংশ আনলেন— সে রহস্যও ভেদ করা যায় না।

বিদ্যাসাগরের স্বরূপ বোঝার পক্ষে তাঁর জীবনীকাররাও দুটি বড় বাধার সৃষ্টি করেন। এক তো হলো তাঁর মননশীলতার চেয়ে হৃদয়বত্তার ওপর বেশি জোর দেওয়া, আর দ্বিতীয় হলো জনদরদে তাঁকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। বিদ্যাসাগর কেন ১৮৫৯-এর সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলেন নি এই নিয়ে কোনো কোনো গবেষক কমবেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ অলডস হাক্সলি দুঃখ করেছিলেন যে ভারতে ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হচ্ছে কিন্তু জনশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। মুসোলিনির কারাগারে বন্দী, বিশিষ্ট মার্কসবাদী তত্ত্ববিদ, আন্তোনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭) বলেছিলেন, কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা সত্য আছে। কিন্তু দেশের ‘প্রথাগত বুদ্ধিজীবী’দের নিয়ে আগে উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত না করলে নিচের স্তরের ছেলেমেয়েদের শেখাবেন কারা? আর গোড়ার দিকের শিক্ষার সুযোগ তাই সকলে পাবেন না, বরং অল্প লোকই পাবেন (Antonio Gramsci, Selections from the Prison Notebooks, New York: International Publishers, 1971, pp.26-43; Further Selections from the Prison Notebooks, Minneapolis: University Minnesota Press, 1995, p.122)।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর : প্রাণদাতা ও জীবনদাতা -হুমায়ুন আজাদ
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:476 | likes:0 | share: 0 | comments:0

"রামমোহন তাঁর ‘সম্বাদ’ লিখেছেন নৈর্ব্যক্তিক রীতিতে; কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে তার সকাতর আবেগ। তাঁর প্রস্তাবগুলো অভিসন্দর্ভ হিসেবে অসামান্য, কিন্তু তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কেঁপেছেন আবেগে। তিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে, ওই পিতৃতন্ত্র তাঁর সাথে যে-নিষ্ঠুরতা করেছে, তা তিনি ভোলেন নি। তিনি নারীকে শুধু নিশ্বাসের অধিকার নয়, দিতে চেয়েছেন জীবনের অধিকার, তাই তাঁর লড়াই ছিলো আরো রক্তাক্ত। সহমরণ নৃশংস বলে তার নিবারণও সহজ, সহজেই মানুষ ও জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে নারীকে পোড়ানো নৃশংসতা। কিন্তু যাদের সংবেদনশীলতা আদিম, তাদের বোঝানো অত্যন্ত কঠিন যে ব্ৰহ্মচর্য পালন করে বেঁচে থাকা চিতায় ছাই হওয়ার থেকেও মর্মান্তিক। নারীর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা চাওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিলো না, তিনি তা চান নি; চেয়েছেন জীবনযাপনের অধিকার। তিনি নারীর দেহকে মূল্য দিয়ে, নারীর দেহকে স্বীকার ক’রে হয়ে উঠেছেন একজন আমূল নারীবাদী; এবং ঊনিশ শতকের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। একটি আদিম পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি একজন আধুনিক মানুষ দাঁড়ালে তাঁকে যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তার সবখানিই ভোগ করেছেন বিদ্যাসাগর; তাঁর বুকে ক্ষোভও জেগেছে অশেষ। হিন্দু পিতৃতন্ত্র তাঁকে সহ্য করে নি; অমূল্যচরণ বসু জানিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাঁহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভুক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে। কলিকাতার কোন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুৰ্বত্তেরা প্রভুর আজ্ঞা পালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদগণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ-প্ৰহারের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন’ (বিনয় /১৯৭৩,- ২৬৮)। এ হচ্ছে বিপন্ন পিতৃতন্ত্রের ইতির আচরণ। প্রিয় বালিকা প্রভাবতীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (প্ৰভাবতী সম্ভাষণ, ৪১৯) :

‘তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয়া, আমার বোধে অতি সুবোধের কার্য করিয়াছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয় ত, অদৃষ্টদ্বৈগুণ্যবশতঃ অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জীবনযাত্রা সমাধান করিতে পারিতে না।‘

বেঁচে থাকার চেয়ে ভারতে নারীর ম’রে যাওয়াও তার কাছে মনে হয়েছে ‘সুবোধের কাৰ্য’; বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব-এ (১৮৫৫খ, ৮৩৯) বলেছেন, ভারতবর্ষে যেনো ‘হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’, আর্তনাদ করেছেন, ‘হা অবলা গণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর।’ এ-ক্ষুব্ধ বিলাপ থেকেই বোঝা যায়। এ-মহৎ আমূল নারীবাদীকে কতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিলো নির্বোধ হিন্দু পিতৃতন্ত্র।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর সহমরণ নিবারণে, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণে বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের চেষ্টা করেন : শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে বাতিল ক’রে প্রবর্তন করেন নববিধান। তাঁরা কি বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে ? রামমোহন হয়তো কিছুটা করতেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ওই শাস্ত্রে বিশ্বাস ছিলো না বিন্দুমাত্র; কিন্তু তাঁরা জানতেন মধ্যযুগীয় এ-অঞ্চলে এটাই উপায়। যুক্তি এখানে মূল্যহীন, মূল্যবান এখানে পুরোনো শ্লোক। বিদ্যাসাগর ( ১৮৫৫ক, ৬৯৫-৬৯৬) বলেছেন, ‘যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এদেশে শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে।’ তাই তাঁরা দুজনেই ঘেঁটেছেন শাস্ত্র, শাস্ত্র থেকে নিয়েছেন সেইসব অংশ, যা তাঁদের পক্ষে। তাঁরা শাস্ত্রকে প্রমাণ হিসেবে নিয়েছেন এজন্যে নয় যে তাঁরা ওই শাস্ত্রের সাথে একমত, তাঁরা ওই শাস্ত্র নিয়েছেন কেননা ওই শাস্ত্র তাঁদের সাথে একমত। তাঁদের দুজনের জন্যে এটা ছিলো বিশেষ সুবিধাজনক; পাণ্ডিত্যে ও মেধায় তাঁরা তাঁদের প্রতিপক্ষের থেকে এতো শ্রেষ্ঠ ছিলেন যে তাঁদের পরাজিত করা ছিলো অসম্ভব। তাঁরা শাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন আইনে; তাই শাস্ত্র দিয়ে তাঁরা প্রথাগ্রস্ত দেশবাসীদের কাবু ক’রে প্রবর্তন করেন আইন। তাঁরা জানতেন আইন ছাড়া অসম্ভব হবে সহমরণ নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন; এবং এও জানতেন যদি তাঁদের দেশবাসী তাঁদের যুক্তি মেনে নেয়, কিন্তু আইন প্রণীত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আবার দেখা দিতে পারে সহমরণপ্রথা, নিষিদ্ধ হ’তে পারে বিধবাবিবাহ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যদি উনিশ শতকে ওই আইন পাশ না করাতেন, তাহলে বিশ শতকে গান্ধির ভারতবর্ষে ওই আইন কখনো প্রবর্তিত হতো না; কেননা বিধবা হতো দুষ্ট রাজনীতিকদের জন্যে চমৎকার রাজনীতি। বিদ্যাসাগর ( ১৮৭১, ৮৮৪-৮৮৫ ) কেনো আইন চেয়েছেন, তা শোনার মতো :

" কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন,... বহুবিবাহ সামাজিক দোষ ; সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য; সে বিষয়ে গবর্ণমেন্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া কোনও ক্রমে বিধেয় নহে। এই আপত্তি শুনিয়া আমি, আমি কিয়ৎ হাস্য সংবরণ করিতে পারি নাই। সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য, এ কথা শুনিতে আপাততঃ অত্যন্ত কর্ণসুখকর।...যাঁহারা এই আপত্তি করেন, তাঁহারা নব্যসম্প্রদায়ের লোক। নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁহারা অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ ও বহুদর্শী হইয়াছেন, তাঁহারা অর্বাচীনের ন্যায়, সহসা এরূপ অসার কথা মুখ হইতে বিনির্গত করেন না। ইহা যথার্থ বটে, তাঁহারাও এক কালে অনেক বিষয়ে অনেক আস্ফালন করিতেন;... কিন্তু এ সকল পঠদ্দশার ভাব। তাঁহারা পঠদ্দশা সমাপন করিয়া বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ক্রমে, পঠদ্দশার ভাবের তিরোভাব হইতে লাগিল। অবশেষে, সামাজিক দোষের সংশোধন দূরে থাকুক, স্বয়ং সেই সমস্ত দোষে সম্পূর্ণ লিপ্ত হইয়া, স্বচ্ছন্দ চিত্তে কালযাপন করিতেছেন। "

বাঙলা ও বাঙালি এখনো এমনই আছে; ছাত্রজীবনেই তারা প্রগতিশীল পরে প্রতিক্রিয়াশীল। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন এদের বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেছেন আইনে।.. "

ভূতান্বেষী ঈশিতার মিথ্যাচার ও সত্যানুসন্ধান -দেবরাজ দাস
Nov. 18, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:7555 | likes:85 | share: 25 | comments:0

১৬ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে জি বাংলা দাদাগিরি অনুষ্ঠানে সৌরভ গাঙ্গুলী ও ঈশিতা দাস নামে এক অতিথি ভূত ও ওই জাতীয় কোনো অলৌকিক শক্তির বাস্তব অস্তিত্বের প্রচার করেছেন ১৫ মিনিট ধরে, মোট সময় ছিল ১ ঘন্টা ১২ মিনিট। ঈশিতা দাস নিজেকে প্যারানরম্যাল ইনভেস্টিগেটর দাবী করে কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র উপস্থিত করেন, সাথে দুটি আলাদা ঘটনার বর্ণনা করেন। আমরা এখানে ওই ভদ্রমহিলার ভূতের অস্তিত্বের সপক্ষে বলা কিছু যুক্তি ও ওই সমস্ত পেশ করা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র গুলো দেখিয়ে উনি যে অলৌকিক শক্তির বাস্তব অস্তিত্বের দাবী করেন, আমরা সেই সমস্ত যুক্তির পাল্টা যুক্তি ও যন্ত্রের প্রকৃত ব্যাখা দেব। 

ঈশিতা দাস এর পেশ করা কিছু যুক্তির পাল্টা যুক্তি

১- আমাদের রোজকার জীবনে কোনো ঘটনার উত্তর খুঁজে না পেলে বা বহুদিন ধরে ঘটে চললে তা মনের ভূল বলে এড়িয়ে যাই, যদি মনের ভুল না হয়,  তা হলে কী। উনি বোঝাতে চেয়েছেন,  তা কোনো অলৌকিক শক্তি। 

প্রতিটি মানুষের জ্ঞান ও জানার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে,  এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, যা তার জানার বাইরে, তার মানে কী তাকে অলৌকিক ধরে নেব। গ্রামের দিকে কেউ যদি হঠাৎ বাঁশ বাগানের বা কোনো মাঠের মাঝখানে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠতে দেখে, সে সেটা ভূত বলে রটাতে শুরু করবে, কারণ সে সেই বিষয়ে কিছু জানে না, আসলে তা বিজ্ঞানের ভাষায় আলেয়া, একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা। এই ভাবে কেউ যদি কোনো ছায়া বা পায়ের শব্দ শুনতে পায়, তার অনেক কারণ থাকতে পারে, আমরা যুক্তিবাদী সমিতি এই ছায়া ও পায়ের শব্দ থেকে ভূতের রটনার অনেক রহস্য সন্ধান করেছি, কোথাও কোনো ভূত পাওয়া যায় নি, এর বিভিন্ন কারণ আমরা পেয়েছি, তাই কেউ কোনো ঘটনার ব্যাক্ষা পাচ্ছে না মানে, তা অলৌকিক শক্তির প্রমাণ নয়, তার জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব। 


২- বিজ্ঞান বলে এনার্জি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু তার রুপ পরিবর্তন সম্ভব, এটা বলে উনি বোঝাতে চান, আত্মা একটি শক্তি, যা মৃত্যুর পর একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বেঁচে থাকে। 

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় শক্তি বলতে কাজ করার সামর্থ্যকে বোঝায়। প্রধানত শক্তি হচ্ছে পদার্থের এমন একটি বৈশিষ্ট্য যার সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এক রূপ থেকে অন্য রূপ নিতে পারে এবং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে যেতে পারে। বিখ্যাত E=mc2 অনুযায়ী শক্তি পদার্থে নিহিত থাকতে পারে। বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত বেশ কয়েক ধরনের শক্তির রুপ আবিষ্কার করেছে, যেমন যান্ত্রিক শক্তি, আলোক শক্তি, শব্দ শক্তি, তাপ শক্তি, চৌম্বক শক্তি, তড়িৎ শক্তি ইত্যাদি। এর মধ্যে কোথাও অলৌকিক কোনো নেগেটিভ শক্তি নেই, মন বা যদি বলি আত্মা, তা আসলে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরোনের রসায়নিক ও জৈবিক ক্রিয়াকলাপ এর ফল, আর মানুষ মারা গেলে নিউরোন মারা যায়, সেই শরীর বিভিন্ন ভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয়, পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে দিয়ে, তাই নিউরোন এর আর অস্তিত্ব থাকে না, এবার নিউরোন যখন মারা গেল, তার ক্রিয়াকলাপ ও শেষ, তা হলে তা কী করে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হবে, এই বিষয়ে বলা

ভালো, আমরা একটি কোনো একটা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কথা জানি, কোনো একটা একদম মরণাপন্ন রোগীকে একটি সম্পূর্ণ বদ্ধ কাঁচের বাক্সে রাখা হয়, যখন সে মারা যায়, সেই বাক্স সাথে সাথে ফেটে যায়, মানে তার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যায়, এটাই নাকি আত্মার অমরত্বের প্রমাণ, আমরা যুক্তিবাদী সমিতি বহু বহু খোঁজার পরেও এরকম কোনো পরীক্ষার কোনো ঘটনা পাইনি। কাজেই আত্মা অমর বা মানুষ মৃত্যুর পর তা অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, এই জাতীয় দাবী চরম অবৈজ্ঞানিক । 


৩- যদি কোনো কারণে মানুষের ব্রেন খুব সক্রিয় থাকে আর এই অবস্থায় সেই ব্যক্তি মারা যায়, তা হলে তার সেই এত উত্তেজিত শক্তি কী নষ্ট হয়ে গেল, তখন সেই শক্তি খুব দ্রুত ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ পরিণত হতে থাকে, অসুখে মারা গেলে এটা হয় না, আর এই ম্যাগনেটিক ফিল্ডই নাকি স্পিরিট বা ওর এই অদ্ভুত যুক্তির পেছনে কারণ কি জানি না, কোনো মানুষের উত্তেজনা আসলে বিভিন্ন হরমোনের ক্ষরণ ও মস্তিষ্কের নিউরোনের বেশ কিছু জটিল ক্রিয়াকলাপ এর ফল, মানুষ মারা গেলে তার নিউরোন ও মারা যায়, আর সাথে সাথে সেই উত্তেজনা গুলোও শেষ, ওর দাবী, এই উত্তেজনাগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়। চৌম্বক ক্ষেত্র প্রথম ব্যাক্ষা করেন বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে, উনি এই সব শুনলে আত্মহত্যা করে নিতেন, এক কথায় বললে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ঘোরানো এবং প্রদক্ষিণ একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। মানুষের উত্তেজনা কী ভাবে নিউক্লিয়াসকে ঘোরায় ও পদক্ষিণ করে তা কেউ জানে না, উনি প্রথম আবিষ্কার করলেন এই অদ্ভুত যুক্তি। আর যদি ওর দাবী আমরা মেনেও নিই, তাহলে দেশের বীর সন্তান, শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য দেশবাসী জানতে চায়, উনি ওর দেখানো ECHO VOX"এর মাধ্যমে নেতাজির সাথে কথা বলে তার মৃত্যুর কারণ জেনে নিন, ওর মধ্যে কিন্তু এনার্জি কম ছিল না। তা হলেই মিটে গেল। আর উনি যদি তা না পারেন, তাহলে এটা ধরে নিতেই হবে উনি ভন্ড আর প্রতারক। 


৪- উনি অনুষ্ঠানে বলা দুটি ভৌতিক ঘটনার প্রথমটিতে একটি জঙ্গলের রোমহর্ষক ভৌতিক অভিজ্ঞতা শোনান, যাদে নাকি স্পিরিট এসে দলের একজন এর পিঠে কয়েকটি আঁচড় কেটে রক্ত বের করে দেয়। 

ম্যাডামের মতে আত্মা ম্যাগনেটিক ফিল্ড, তা তিনি বহুবার দাবী করেন, উনি বলেন, স্পিরিট একটা এনার্জি, আর যুক্তি অনুযায়ী এনার্জি বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর কোনো শরীর হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে শক্তি কী ভাবে আঁচড় দিতে পারে?এর কোনো উত্তর উনি দেবেন না, কারণ এর উত্তর নেই ওর কাছে, নিজের কথায় নিজেই স্ববিরোধী। 


৫- আত্মা যেখানে খুশি থাকতে পারে, স্পিরিচুয়াল কিছু ঘটলে সেখানে হট স্পট আর কোল্ড স্পট তৈরী হয়, মানে সেখানে আত্মা আছে। আর তা থার্মোমিটার এ মাপাও সম্ভব। 

এটিও অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি, একই জায়গায় একাধিক তাপমাত্রা হওয়া কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, এটি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা, যা ক্লাস এইট এর বইতেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে এই রকম হতে পারে, গাছের তলায় একরকম তাপমাত্রা, আবার ফাঁকা জায়গায় আলাদা, একটু উঁচুতে একরকম আবার কম উচ্চতায় একরকম, ঘরে এক রকম আর বাইরে একরকম, কোনো ফাঁকা জায়গায় হঠাৎ করে অনেক মানুষের সমাগম হলে, সেখানের তাপমাত্রাও ওই জায়গার স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, আরো অনেক কারণে একই জায়গায় তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, এর মানে এই নয় যে, তা আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ। এই কাজে বিভিন্ন রকম থার্মোমিটার ব্যবহার করে কী ভাবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ হয়, তা একমাত্র উনি নিজেই জানেন, ওর যুক্তি অনুযায়ী কারো জ্বর হলে তার শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়, তার মানে সেই ব্যক্তিকে ভূতে ধরেছে। এগুলো এবং আরো ছোটো কয়েকটি যুক্তি উনি ভূত বা অলৌকিক শক্তির প্রমাণে দিয়েছেন, যা আমরা খন্ডন করে বুঝিয়ে দিলাম, এগুলো আসলে যুক্তির নামে কুযুক্তি, মানুষকে বিজ্ঞানের নামে বিভ্রান্ত করার নোংরা চক্রান্ত। যাকে ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সৌরভ গাঙ্গুলী ও জি বাংলা কতৃপক্ষ ক্রমাগত সমর্থন করে গেছেন। 







ঈশিতা দাসের পেশ করা ৭ রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সঠিক পরিচিত ও তার অপব্যবহারের ব্যাখ্যা: 

১- Electromagnetic Field Detector :- বৈদ্যুতিন চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলি (ইএমএফ) পরিমাপের জন্য পোর্টেবল হ্যান্ডহেল্ড হল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড মিটার বা গাউস মিটার। এই ব্যবহারকারী বান্ধব ইএমএফ মিটার বৈদ্যুতিক বিদ্যুতের লাইন, গৃহ সরঞ্জাম এবং শিল্প যন্ত্রগুলি থেকে নির্গত বৈদ্যুতিন চৌম্বকীয় রেডিয়েশনের সংস্পর্শের সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকির মূল্যায়ন করার জন্য আদর্শ। এই মেশিনটি যে কোনো ধরনের ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে, বৈদ্যুতিন দেওয়ার অর্থ, সেখানে আত্মা বা ভূত আছে। এই রকম কুযুক্তি বিজ্ঞানের সঠিক জ্ঞানের অভাব আর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সাহায্য সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই না। 




২- ECHOVOX :- এই প্রসঙ্গে বন্ধু পিনাকি পাত্র-র একটি তদন্ত রিপোর্ট তুলে Box”যা তৈরি করেছে Big Beard Studios! আর সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানাতেই আমার এই লেখা। (Pic: 1, Pic: 2) দুটি ছবির প্রথমটিতে দেখতে পাচ্ছেন উনি এই মোবাইল অ্যাপস টার সাথে পরিচয় করাচ্ছেন এবং দ্বিতীয়তে সেটা কাজ করছে এমন একটি ফুটেজ। Play Store-এ অ্যাপস্ টা র দাম ১৬৫০ টাকা। আমি নেট থেকে সেটার ফ্রী ভার্সন ডাউনলোড করি (Pic: 4) এবং সেটার ফরেনসিক (অ্যাপস্ টা নিয়ে কাটা-ছেঁড়া আর কি!) করে তার মধ্যে কি আছে জানার চেষ্টা করি। (Pic: 5 ) -এ দেখতে পাবেন “ECHOVOX System v3.2.apk”(ডাউনলোডেড অ্যাপস্ টার নাম) এর পর কিছু ফোল্ডার রয়েছে “/res/raw”নামে।


 এই ফোল্ডার টির ভিতরে “an***.ogg”নামে কিছু ফাইল দেখতে পাবেন, যার মোট সংখ্যা ১৩, ৩৭০! (Pic: 6) যেগুলো আসলে এক ধরনের অডিও (specifically multimedia) ফরম্যাট বা কিছু ভয়েস রেকর্ড করা ফাইল কয়েক সেকেন্ডের। লক্ষ্য করুন প্রতিটা ফাইল এর নিচে সেটা কোন তারিখ এ তৈরি তা লেখা আছে (29 Jan 14 ) অর্থাৎ এর থেকে পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে যে অ্যাপস্-টিতে সেই জিনিস গুলিই চলে যেগুলো আগের থেকেই রেকর্ড করা, নতুন কোনো ভৌতিক শব্দ রেকর্ড হয় না, বা ভূত আপনার সাথে কথা বলতে চায় না। পুরোটাই ভাঁওতা। অ্যাপস্-টির কাজ করার পদ্ধতি এই রকম: Start বাটন এ ক্লিক করলে আপনার নিজের কথা এবং আশে-পাশের শব্দ রেকর্ড হবে, তারপর অ্যাপস্ এর ভিতরে থাকা শব্দ গুলি random order এ ওর সাথে যুক্ত হয়ে প্লে হবে। আপনি চাইলে নিজে এমন কোনো শব্দ আগে থেকে রেকর্ড করে সেটাও চালাতে পারেন অন্য শব্দের সাথে মিশিয়ে। এই রকম আরো কিছু ফিচার আছে, যেগুলো এই লেখায় প্রাসঙ্গিক নয়। অ্যাপস্ টা র ১ টা নতুন ভার্সন ও বেরিয়েছে “ECHOVOX System 3 Professional ITC Ghost Box”যাতে আবার হিন্দি তেও কিছু শব্দ রেকর্ড করা আছে! এরকম অজস্র অ্যাপস্ আপনি Play Store-এ পেয়ে যাবেন, যার বেশিরভাগের ই দাম কয়েক'শ থেকে কয়েক হাজার টাকা। (Pic: 7, Pic: 8, Pic: 9) আমার নিজের ফোনে ইনস্টল করার কিছু ছবি। 


৩-External thermometer :- কোনো জায়গার তাপমাত্রা মাপতে হলে, তার জন্য এই বিশেষ রকম থার্মোমিটার ব্যবহার হয়, ঈশিতার দাবী, হট স্পট আর কোল্ড স্পট নির্ণয় করতে এই যন্ত্র ব্যবহার হয়। একই জায়গায় একাধিক তাপমাত্রা হওয়া কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, এটি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা, যা ক্লাস এইট এর বইতেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে এই রকম হতে পারে, গাছের তলায় একরকম তাপমাত্রা, আবার ফাঁকা জায়গায় আলাদা, একটু উঁচুতে একরকম আবার কম উচ্চতায় একরকম, ঘরে এক রকম আর বাইরে একরকম, কোনো ফাঁকা জায়গায় হঠাৎ করে অনেক মানুষের সমাগম হলে, সেখানের তাপমাত্রাও ওই জায়গার স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, আরো অনেক কারণে একই জায়গায় তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, এর মানে এই নয় যে, তা আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ। আর এই থার্মোমিটার নানারকম কাজে ব্যবহার হয়, কেউ এই বিজ্ঞানের সুন্দর আবিষ্কার এই সব উল্টোপাল্টা কাজে, ব্যবহার করে, ভাবলেই খারাপ লাগে। ঈশিতা দাসের কাছে প্রশ্ন, আত্মা আসলে কী? একবার বলছেন চুম্বকীয় শক্তি, আর একবার বলছেন তাপশক্তি। 

8- Parabolic thermometer:- এই বিশেষ ধরনের থার্মোমিটারে লেজারের মাধ্যমে কোনো বিশেষ বস্তুর তাপমাত্রা মাপা হয়, এর থেকে বের হওয়া লেজার যে জায়গায় পয়েন্ট করা হবে, সেই বস্তুর তাপমাত্রা ধরা পড়বে এতে, ওর দাবী, একই ঘরের একাধিক দেওয়ালের ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রা মাপতে এটি ব্যবহার হয়, মানে উনি বোঝাতে চাইছেন, একই ঘরের আলাদা দেওয়ালে ভিন্ন তাপমাত্রা হলে, সেখানে স্পিরিট আছে। একই ঘরের দুটি দেওয়াল এর তাপমাত্রা আলাদা আলাদা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। একটি দেওয়ালের অপর প্রান্তে যদি বাথরুম থাকে আর অন্য দেওয়ালের অপর প্রান্তে রান্নাঘর থাকে, কিংবা কোনো দেওয়ালের এক প্রান্তের বাইরে খালি জায়গা আর অন্য দেওয়ালের অপর প্রান্তে আলাদা ঘর, তাহলেও দুটি ভিন্ন দেওয়ালের তাপমাত্রা ভিন্ন হবে, এবার ম্যাডামের যুক্তি অনুযায়ী, এরকম মানেই সেখানে স্পিরিট আছে , তা হলে তো প্রায় সব ঘরই ভূতের আস্তানা। এই বিশেষ আধুনিক থার্মোমিটার বহু জটিল কাজ সহজ করে দেয়, এই মেশিনটি উনি সম্পূর্ণ অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। 

৫- Laser grid :- এটি একটি অতি সাধারণ মেশিন, পেনের মত দেখতে, ভিতরে ব্যাটারি থাকে, আর লেজার বেরিয়ে আসে। ওর দাবী, এটি অন্ধকার ঘরে কোনো একটি দেওয়ালে পয়েন্ট করে ক্রমাগত ছবি তুলতে থাকেন, সেই লেজার আলো একটু বাধা পেলেই সেখানে “কিছু একটা “আছে । অন্ধকার ঘর, ওই লেজার আলোর মাঝে যা কিছু আসতে পারে, কোনো মশা, বা কোনো পতঙ্গ, যা কিছু, আর ঘরের বাইরে করলে তো তার সম্ভাবনা আরো বেশি, ম্যাডাম এর সাহায্যে কী ভাবে ভূত খুঁজে পান, তা কেউ জানেন না। 



৬ - light motion sensor :- এটি এক ধরণের বিশেষ লাইট লাগানো মেশিন, এর অনেক রকম ভাগ হয়, উনি যেটি ব্যবহার করেছেন, সেটি খুবই সাধারণ মানের, এটি ছোটো একটি বস্তু, যার মাথায় একটি লাইট লাগানো আছে, আশেপাশের পরিবেশে কোনো রকম নড়াচড় হলেই এই মেশিনে আলো জ্বলে উঠবে৷ অন্ধকারে কোনো ছোটো পতঙ্গ, বেড়াল, বা নিশাচর কোনো প্রাণী মানুষ এমন কী জোরে হাওয়া দিলেও এই লাইট জ্বলে উঠবে । এমনকি এই মেশিনটি যে টেবিল বা কোনো কিছুর উপরে রাখা আছে, সেটিও যদি নড়ে ওঠে, এই আলো জ্বলবে, কিন্তু ম্যাডামের দাবী ওই যে "কিছু একটা “ওটা তো চুম্বকীয় ক্ষেত্র, এই মেশিন তো কোনো সাধারণ বস্তুর উপস্থিতি ধরতে পারে, কোনো ভাবেই কোনো চুম্বকীয় ক্ষেত্র বা ছায়া ধরতে পারে না, তা হলে ওর দাবী কোনো ভাবেই খাটল না। এটিও একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের চরম অপব্যবহার। 

৭- Electronic voice phenomena recorder :- এটি একটি রেকর্ডার, যা বিভিন্ন রেডিও তরঙ্গ, বিভিন্ন ওয়ারলেস বার্তা পাঠানোর জন্য যে রেডিও তরঙ্গ পাঠানো হয়, ও এই জাতীয় সমস্ত ইলেট্রনিক মেশিন থেকে উৎপন্ন স্বল্প দৈর্ঘ্যের শব্দকে ধরে তা রেকর্ড করে। এই মেশিনটি একটি খুবই নিম্নমানের টেকনোলজি দিয়ে তৈরী, যা বর্তমানে আর খুব একটা ব্যবহার হয় না, পৃথিবী বিখ্যাত ওয়েবসাইট rationalwiki.org তে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। কিছু সেনাবাহিনী আজও এই জাতীয় মেশিন ব্যবহার করে, তবে এটি খুব একটা বিশ্বস্ত নয় । যেখানে বিজ্ঞান এই মেশিনটি বাতিল করছে ধীরে ধীরে, সেখানে কী ভাবে এর ব্যবহার করে ভূত বা ওই জাতীয় “কিছু একটা “পাওয়া সম্ভব?

উল্লেখ করা সমস্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্র কোনো না কোনো কাজে লাগে, কোনোটা ইঞ্জিনিয়ারদের কোনোটা সেনাবাহিনীর, কোনোটা আবার সাধারণ মানুষের, এটা খুবই লজ্জার যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে এই ভাবে অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব প্রমাণের নোংরা খেলা চলছে। 


ঈশিতা দাস অনুষ্ঠানে দুটি কেস স্টাডির কথা বলেন, একটি জঙ্গলের ও অন্যটি একটি ঘরের, আমরা এই আলোচনায় ওর দেওয়া দুটো গালগল্পের কোনোটাই ব্যাক্ষা করব না, কারণ কেউ যা খুশি কিছু বলে দিলেই, তা ব্যাক্ষা করা সম্ভব নয়, কেউ যদি বলে আমি চোখের সামনে একটি ছেলেকে প্রথমে একটি বিশাল ঈগল পাখিতে রূপান্তরিত হতে দেখলাম, তারপর তাকে আকাশে উড়ে যেতেও দেখলাম, এবার আপনারা দাবী করেন এই মহাবিশ্বে অলৌকিক কিছু নেই, কিন্তু এটা আমি নিজের চোখের সামনে দেখেছি, এটার কী যুক্তি দেবেন। এই অবাস্তব প্রশ্নের কোনো যুক্তি হয় না কাজেই কোনো দাবী যদি কেউ করেন, প্রমাণ করার দায়িত্ব তারই। 




‌কেস স্টাডির কিছু বিষয়ে আলোকপাত:

১- ইছাপুরের কেস স্টাডিতে ফ্লাটের জমি মালিকের জলে ডুবে মৃত্যুর পর ওই কমপ্লেক্স এ নাকি ওই মৃত ব্যক্তির আত্মা ঘুরে বেড়াতো। আর তারপর নাকি নানারকম সমস্যা শুরু হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় একে গণ হিস্টিরিয়া বলে, ওই আচমকা মৃত্যু আসলে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরী করে ওই কমপ্লেক্স এ, যার কারণে নানাভাবে নানারকম ছোটোবড়ো ঘটনাও অলৌকিক মনে হয়েছে সবার, আমরা যুক্তিবাদী সমিতি বহু তথাকথিত ভুতুড়ে জায়গার সত্যানুসন্ধানে গিয়ে এরকম বহু ঘটনা দেখেছি, এটি কোনো আত্মার অস্তিত্ত্বের প্রমাণ নয়। 

২- কোনো জায়গা কখনই ভৌতিক হয় না, তাকে বিভিন্ন কারণে ভৌতিক করে তোলা হয় এক শ্রেণীর মানুষের দ্বারা । এ প্রসঙ্গে ' বেগুনকোদর ' নামে পুরুলিয়ার একটি রেলস্টেশন এর কথা বলতে চাই, যেটি নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভৌতিক স্টেশন । এটি নিয়ে বহু বহু ভৌতিক ঘটনার কথা প্রায়ই রটে থাকে। আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা ওই জায়গায় রাত কাটিয়ে এসেছে, কোথাও কোনো ভূত পায়নি, বদলে পেয়েছে একাধিক বেআইনি কাজের প্রমাণ ও ধরা পড়েছে কিছু বেআইনি কাজের সাথে যুক্ত মানুষ। এরকম বহু পুরোনো বাড়িতে আমরা ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে বহু বেআইনি কাজের প্রমাণ পেয়েছি, কোথাও পেয়েছি মদের ঠেক, কোথাও গাঁজার ব্যবসা, কোথাও ড্রাগস এর চক্র। আবার কোনো বাড়ি কোনো প্রমোটার কমদামে কেনার জন্য ভূতের গল্প রটিয়ে দেয়। এরকম নানারকম কারণ পেয়েছি ভূতের গুজবের পিছনে, কিন্তু দুঃখের কথা, কোথাও একটি ও ভূত পেলাম না। 

ভূত, ভূতে ভর ও ভূতে ধরা কী - বিজ্ঞান বলছে ভূতে ধরা আসলে তিনটি রোগ বা প্রবণতা, সিজোফেনিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেশন ও গণ হিস্টিরিয়ার ফলাফল, এছাড়া আমাদের মস্তিষ্কের অবচেতন ও সচেতন মনের খেলা। 

সিজোফেনিয়া(Schizophrenia ) এটি এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা, যার ফলে অলীক শ্রবণ, অলীক দর্শন এরকমই কিছু অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়। সঠিক সময়ে এটি ধরা না পড়লে বেশ জটিল রুপ ধারণ করতে পারে। এর কারণ বিভিন্ন হতে পারে, মস্তিষ্কের রসায়নিক অবস্থার পরিবর্তন, আশপাশের পরিবেশ এর প্রভাব ও অবদমিত চাহিদা ইত্যাদি। এর ফলাফল আত্মহত্যার ইচ্ছা, নিজেকে আঘাত করার ইচ্ছা, আচমকা চিৎকার ও অদ্ভুত ব্যবহার করা, নিজের শরীরের প্রতি যত্ন না নেওয়া। তবে কারো এরকম হচ্ছে মানেই যে সে এই রোগে আক্রান্ত, এমন নয়। এর সেই ভাবে কোনো চিকিৎসা নেই, মানসিক ভাবে কাউন্সেলিং ও কিছু ঔষধ ছাড়া। যত তাড়াতাড়ি এটি ধরা পড়বে ততই ভালো। আমরা যুক্তিবাদী সমিতি এরকম বেশ কিছু সিজোফেনিয়ার রোগী দেখেছি। যাদের ভূতে ধরেছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে এবং ওঝা দিয়ে অত্যাচার করানো হয়েছে, সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এরকম ই অনেক ঘটনা যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর ঘোষের অতি বিখ্যাত বই অলৌকিক নয় লৌকিক সিরিজে আছে। 

ম্যানিয়াক ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার- এটিও একটি বিশেষ ধরণের মানসিক অসুস্থতা, সিজোফেনিয়ার থেকে একটু আলাদা এবং বেশ ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থা, এর ফলে রোগীর এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়, যা ভৌতিক বা ওই ধরণের বলেই রোগীরা দাবী করেন ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা বা শুনে আসা ভূতের গল্প, সিনেমা তার কল্পনার মাধ্যমে তাকে একটু একটু করে প্রভাবিত করতে করতে একসময় তা এমন অবস্থায় যায় যে রোগী সেই সমস্ত কিছু নিজের সাথে হতে দেখে। তবে এই রোগের কারণ যে শুধুই এটা, তা নয়। এছাড়া মস্তিষ্কের রসায়নিক ক্রিয়াকলাপের ভারসাম্যের তারতম্য ও বংশগত বিভিন্ন কারণেও হতে পারে। এর ফলে ভৌতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া হঠাৎ করে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক ব্যবহার করা, আত্মহত্যার প্রবণতা, অপরকে আঘাত করার ইচ্ছা ও আরো অনেক কিছু হতে পারে, তবে এগুলো হচ্ছে মানেই যে এই রোগ, এমন নয়। এর বেশ কিছু চিকিৎসা আছে। তবে যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে ততই ভালো। এইরকম আচরণের মানে কাউকে ভূতে ধরেছে তা নয়, এর মানে তিনি মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। ভূতে ধরার অর্থ, রোগী এই জাতীয় কোনো রোগে আক্রান্ত, এর কারণ কখনই অলৌকিক শক্তি বা “কিছু একটা “নয়। 

গণ হিস্টিরিয়া- এটি আসলে কোনো রোগ নয়, একটি প্রবণতা। হঠাৎ করে একইরকম চিন্তা ভাবনা যখন একাধিক মানে বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে আমরা গণ হিস্টিরিয়া বলতে পারি , একটু ভালো করে বিষয়টি বোঝা যাক। ধরে নিন কোনো জায়গায় কেউ আত্মহত্যা করেছে কোনো ব্যক্তিগত কারণে তারপর এই আচমকা মৃত্যু সাধারণ মানুষের মনে এক ভয় সৃষ্টি করে যা জন্ম থেকে শুনে আসা বিভিন্ন ভৌতিক গল্প ও ওই জাতীয় বিশ্বাসের সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত সামাজিক পরিবেশ তৈরী করে । এর ফলে একসাথে বহু লোক একটি মানসিকতায় চালিত হয়, সবার মনে ভূত ভূত চলতে থাকে। সেই জায়গায় কেউ রাত্রে বাইরে বের হয় না, চারিদিকে শুধু এই নিয়ে আলোচনা, এমন অবস্থায় যদি এই এলাকার কোনো একজন কোনো রাস্তার মোড়ে অন্ধকারে একটি কলা গাছ ও দেখে নেয়, পরের দিন সেই না দেখা কলাগাছকে কেউ ভূত ভেবে ভূত দেখার অভিজ্ঞতা চরম ভাবে ছড়িয়ে দেবে, অবস্থা এমন জায়গায় যাবে যে, ওই রাস্তার মোড়ে লোকের যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে। শেষে এই চরম অন্ধবিশ্বাসের ফলে একদিন দেখা যাবে রাস্তার মোড়ে ওঝা, তান্ত্রিক সমেত বিশাল যজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমরা যুক্তিবাদী সমিতি এরকম অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী। এছাড়া গণ হিস্টিরিয়া আরো অনেক রকম ভাবে দেখা যায়। 

এগুলো ছাড়া আরো বিভিন্ন কারণে ভূতে ধরা বা ভূত দেখার গুজব ছড়িয়ে পরে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ও দেখা গেছে, কেউ বিখ্যাত হওয়ার জন্য ভূত দেখেছি, এই দাবি করে বসেন। কিংবা কেউ কারো প্রতি বদলা নেওয়ার জন্য বা অন্য কোনো স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য বা একান্তই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কাউকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে দিল, তারপর তাকে গণ প্রহার, গণ হত্যা এছাড়া সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখল এরকম ঘটনা, ডাইনি সন্দেহে কাউকে মেরে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া, গ্রাম ছাড়া করার ঘটনার আমরা যুক্তিবাদী সমিতি প্রায়ই সম্মুখীন হয়ে থাকি, কোথাও কোনো ডাইনি অপবাদের ঘটনা শুনলেই আমরা সেখানে ছুটে যাই তাকে রক্ষা করতে ও ওই এলাকাবাসীদের বোঝাতে। 


ভারতীয় সংবিধানের ৫১ এ ধারা অনুযায়ী বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসার করা ও অনুসন্ধানী মেজাজ তৈরী করা ভারতের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। বিনোদন জগতের শিল্পী দের সাধারণ মানুষ অনুসরণ করে থাকে, তাই তাদের এই কর্তব্য আরো গুরুত্ব দিয়ে বজায় রাখতে হবে, দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও অধিনায়ক এবং বর্তমান বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট, এছাড়া

একজন জনপ্রিয় সেলিব্রিটি হিসেবে ভারতীয় সংবিধানের এই ধারার যথাযথ মর্যাদা রক্ষা সৌরভ গাঙ্গুলী র কী মৌলিক কর্তব্য নয়? ১৫ সেপ্টেম্বর একই অনুষ্ঠানে উনি এইরকমই অবৈজ্ঞানিক দাবী করেছিলেন। ভূত, প্রেত জাতীয় অলৌকিকত্বের প্রতি বিশ্বাস মানবজাতির বিজ্ঞানমনস্কতার হত্যা করে, যা সমাজের একটি জলন্ত সমস্যা৷ শিল্পী মহলের এই অবৈজ্ঞানিক দাবীতে আরো কঠিন হয়ে ওঠে। এই ঘটনা চরম হতাশা ও দুঃখের। উনাদের এইরূপ আচরণ সাধারণ মানুষের উপর কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে, তা ঠান্ডা ঘরে বসে ওদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। আমরা এবং আমাদের মত অসংখ্য বিজ্ঞান সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ, যারা গ্রামে শহরে পাড়ায় স্কুলে, কলেজে রোজ অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটু একটু করে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরী করছি, তা এক ঝটকায় ওদের এই আচরণে শেষ হয়ে যায়। ওরা শুধুমাত্র নিজেদের সস্তা জনপ্রিয়তা ও অন্য কোনো লোভে এই চরম নোংরা কাজ করে বসেন যার ফলাফলে জন্ম নেয় কুসংস্কার, বিজ্ঞান বিরোধিতা, অন্ধবিশ্বাস ও বিনা প্রশ্নে যে কোনো কিছু মেনে নেওয়ার মানসিকতা, ও শেষে এ থেকে সৃষ্টি হয় বিনা প্রশ্নে রাষ্ট্রশক্তির সমস্ত অন্যায় অত্যাচারকে এক অদ্ভুত নিরবতা, উনাদের এই আচরণ জন্ম দেয় শত শত ডাইনি তকমা দেওয়া মানুষ যারা দিনরাত লড়াই করছে এই সমাজের সাথে। 

আমরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি জি বাংলা, সৌরভ গাঙ্গুলী ও ঈশিতা দাস ও এইরকম সমস্ত মানুষের পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া এই অলৌকিকত্বের বিষের তীব্র নিন্দা করি, উনাদের প্রতি আমাদের একরাশ ধিক্কার। গত ৩৪ বছর ধরে আমরা ভূত ও অলৌকিক শক্তির দাবী করা বেশ কিছু ব্যক্তি ও ঘটনার সত্যানুসন্ধান করেছি, যার সংখ্যা প্রায় ১৬০০। আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো অলৌকিক শক্তির বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ পায়নি, এর বেশ কয়েকটি ঘটনার সত্যানুসন্ধান এর বিবরণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর ঘোষের অতি বিখ্যাত বই "অলৌকিক নয় লৌকিক “সিরিজ এ আছে। ভূত, প্রেত, আত্মার অমরত্ব, ডাইনি ও ওই জাতীয় কোনো অলৌকিক শক্তির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই, এই মহাবিশ্বে অলৌকিক বলে কিছু নেই, সবই লৌকিক। 


সৌরভ গাঙ্গুলী ও নিজেকে প্যারানরম্যাল ইনভেস্টিগেটর দাবী করা ঈশিতা দাস কে আমাদের

অনুরোধ, ‘ভারতীয় বিজ্ঞান যুক্তিবাদী সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রবীর ঘোষের ৫০ টাকার লক্ষ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন বিভিন্ন  বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের  অপব্যবহার করে ভূত ও ওই জাতীয় কোনো অলৌকিক শক্তির দাবী করেছেন সেই অলৌকিক শক্তির প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তিতে প্রমাণ দিন, প্রবীর ঘোষের তরফ থেকে যুক্তিবাদী সমিতির দেবে ৫০ লক্ষ টাকা ও যুক্তিবাদী সমিতি ভেঙে দেবে। প্রমাণ করতে না পারলে আমরা ধরে নেব, আপনারা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য এই অবৈজ্ঞানিক দাবী করেছেন। 

সবার প্রতি ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র একান্ত অনুরোধ, বিখ্যাতজনে কিছু দেখেছেন বা কেউ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র নিয়ে কিছু গালগল্প শুনিয়ে কিছু দাবী করেছেন মানেই, তাকে যুক্তি দিয়ে বিচার না করে, ভালো করে না জেনে গ্রহণ করবেন না, যুক্তি দিয়ে বিচার করে, তবেই সব কিছু গ্রহণ বা বর্জন করুন। 

*শর্তাবলি প্রযোজ্য।

(আমার এই লেখায় আমি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের থেকে পরামর্শ নিয়েছি। অনেক বন্ধুর থেকে ও যুক্তিবাদী সমিতির অনেক সদস্যের সাহায্য নিয়েছি, প্রায় ১০০টি বিভিন্ন ওয়েবসাইট দেখেছি। বহু বই, বিশেষ করে যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক “সিরিজ আমাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সমিতির সদস্য হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা লিখেছি।)

কবিতাগুচ্ছ ৬ -কবিরা
Nov. 18, 2024 | কবিতা | views:884 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বিধর্মীর ধর্মকথা

-ঋতম সাহা


অবিশ্বাসী আমি সেই সকল কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি,

করে নত মাথা যাদের পদতলে মানুষ ব্যস্ত জীবনের প্রতিটি নিশ্বাসে।

মিথ্যা বিশ্বাসের বিভেদে, মানুষের বানানো ধর্মের ভীড়ে,

মিথ্যা নিয়মের নীচে পড়ে চাপা যুক্তিতর্কের অস্তিত্ব, অদূরেই।


সংস্কারের আদর্শ যেখানে হয় বিক্রিত ধর্মের বাজারে,

সেখানেও পায়নি খুঁজে ঈশ্বরকে কোনোদিন, তার পথ চেয়ে থাকা আর্তের হাহাকারে।


অনেকে রাখে তুষ্ট ঈশ্বরকে মেটাতে বৃহত্তর স্বার্থের স্বাদ,

তো কেও চায় ঈশ্বরকে পাশে কাটাতে সংসারের সামান্য অভাব।


তবুও পাইনি খুঁজে তাকে,

পাইনি খুঁজে আত্মহত্যা করা চাষির পরিবারে,

পাইনি খুঁজে দিনমজুরি করা শ্রমিকের অভাবের সংসারে,

পাইনি তাকে কাতর স্বরে চাওয়া ধর্ষিতা মেয়ের শেষ বিচারে।

যুগ যুগ ধরে চলা রাষ্ট্রের হাতে প্রতারিতদের ভাগ্য লেখেনি সে,

পাইনি খুঁজে তাকে যখন একলা শিশু যখন করে ব্যয় শ্রম গোটা পরিবারের মুখ চেয়ে,

খুঁজে পাইনি তাকে বুড়ো ভিখারির ক্ষুধার জ্বালায় অনিশ্চিত জীবন সংশয়ে।


ঈশ্বর যদি সকল মানুষকে সন্তানসম সমান ভালোবাসে,

তাহলে কীভাবে হয় একশ্রেনী শোষক , আরেকশ্রেনী শোষিত ভাগ্যের পরিহাসে।


সবাই বলে চেঁচিয়ে নাকি তাদের ধর্মের শেখানো ভালোবাসা প্রধান,

তর্কে জড়ালে ধর্মের আড়ালে ,তারায় আবার বোঝায় মানুষের চেয়ে ধর্ম মহান।


করলে অপমান কোনো ধর্মবিশ্বাস, আসে তেড়ে সকলে নাকি ধর্মরক্ষায়,

এতই দুর্বল নাকি তাদের আস্থা,  এই সহজেই কি ভাঙার ভয়?

তাহলে কোনো মানুষ কীভাবে নেয় বেছে সেই বিশ্বাসে নিজের জীবনের আশ্রয়।


মন্দির মসজিদ গির্জা, ভাঙো কিমবা গড়ো, নেই তাতে আমার আগ্রহ,

কিন্তু যেদিন ধর্মের নামে করলে ধ্বংস নালন্দার মত হাজার শিক্ষাগৃহ,

সত্যই সেদিনে হয়েছিলো ঠুনকো তোমাদের আস্থার বিগ্রহ।


সকল ধর্মস্থান, ধর্মপ্রাণ আদর্শ হয়ে ওঠে অচেনা অপ্রয়োজনীয়,

যখন দেখি মানুষ মরে মানুষের হাতে,

সেখানে ঈশ্বরের নামের অস্তিত্ব হয়ে ওঠে সত্যই অসহনীয়।


কোনো ধর্মতেই শ্রেষ্ঠত্ব খুজিনা আমি, সবাই নিজের স্বার্থে বাঁচে,

যতই বলুক মহান নিজেদের, অপর ধর্মে ঠিক গাফিলতি খোঁজে।


কবি যখন লিখেছিলেন, ধর্মকারার প্রাচীরে হেনে আঘাত এই অভাগা দেশে জ্ঞ্যানের আলোক আনো,

ভাবেননি তিনি এই সত্য রয়ে যাবে কেবল কবিতায় গাঁথা, আসল আদর্শ অন্ধবিশ্বাসে চাপানো।


এ হৃদয়ে নেই ধর্মের ভয়, নেই জাতপাতের কোনো সংশয়,

বুঝি কেবল মানুষের ভালো অথবা খারাপ,

তাই বিশ্বাসের প্রতি প্রশ্ন হোক সকলের

গরিবের জীবনভর দুর্দশা ঠিক তার কত জনমের পাপ।


সে যদি নাই জানে তার পূর্বজন্মের স্মৃতি, কি করেছিলো সে ঠিক না ভুল,

তাহলে পাপপূণ্যের নামে কেন ঠকানো হয় তাদের,

কেন সারাজীবন ধরে গুনবে তারা বঞ্চিত অধিকারের মাশুল।


পৃথিবীতে হাজার ধর্মের নামে হাজার রকম প্রথা,

হাজার বিশ্বাসের ভীড়ে কেবল নিজেকেই তুষ্ট রাখার চেষ্টা।

যেখানে ধর্মের বেড়াজাল গড়েছে বারবার মানুষের সম্পর্কে বাধা,

সেখানে তবুও আমি দেখেছি , দেখতে চাই বারবার ,

মানুষ থাকুক মানুষের পাশে পেড়িয়ে হাজার ধর্মের মাথাব্যাথা।


ধর্ম খেয়ে ভরেনা পেট, জাত কি দেখা যায় চোখে,

ধর্মীয় রোষ গড়েছে প্রতিরোধ এক সুস্থ সমাজের সম্মুখে,

সঠিক শিক্ষা, সাথে যুক্তি ব্যয়

আনে জগত চেনার নতুন উপায়,

আঁধার হতে দেখো চেয়ে,  বিভিন্নতার  সৌন্দর্য্য কত এই ভেদাভেদ পেরিয়ে

হবে তৈরি এক নতুন সমাজ, চেতনায় গড়বো প্রতিরোধ সকল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে,

বিশ্বাস থাকুক নাহয় তোমার অন্তরে, স্থান দিওনা তাকে উগ্রতারে আড়ালে,

দেখো ফুটবে কত নতুন কুড়ি সকল বাধা পেরিয়ে, এই সুস্থ সমাজের অন্তরালেই।


রক্ষাকবচ

-প্রদীপ চক্রবর্তী


জীবনের কথা বলো

মৃত্যুর নয়,

যুক্তির সাথে থাকো

দুর করো ভয়।


ৠণী মোরা প্রকৃতির কাছে

কর তাই শোধ,

সোজা কথায় প্রকাশিত

নিজ মূল্যবোধ।


ঝড়-তূফান-বজ্রপাত

পশ্চাতে বিজ্ঞান,

পরিস্থিতির বিচারে

বাড়াও নিজ জ্ঞান।


নিজেই রক্ষা কর

নিজের-ই প্রাণ,

বিপদ থেকে বাঁচাতে

আসবে না ভগবান।


লকডাউন ৩

-জামাল আনসারী

মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে যমদূত দাঁড়িয়ে দুয়ারে

লকডাউন। আবালবৃদ্ধবনীতার গৃহবন্দী জীবন।

মাক্স, ছাড়া রাস্তা ঘাটে চলাফেরা নিরাপদ নয়,

অসাবধানে চলে যায় প্রাণ, কাঁদে আপনজন।


নিউজ চ্যানেলে, রেডিওতে এখন মুখ্য খবর

আতঙ্ক, উদ্বেগে জড়সড় ,বেলাগাম মৃত্যুহার ।

কর্মহীন দিন মজুরের হেঁসেলে পড়ছে টান―

করোনার উর্ধমুখী গ্রাফে পতন শেয়ার বাজার।


সোশ্যাল ডিসটেন্স। লাগু আদর্শ আচরণবিধি

অজ্ঞতার কারণে বাড়ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস।

সমাজতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সব দেশে

দাপিয়ে বেড়াছে শুধু প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস।


ঘরে ঘরে মৃত্যু ভয়, কড়া নাড়ছে করোনা ভাইরাস

কি হবে? কি খাবে মানুষ? তাড়া করছে আতঙ্ক ―

ডাক্তার ,নার্স বিজ্ঞানী দিন রাত এক করে ব্যস্ত

পরিষেবা দিতে, তবুও মিলছে না কোরোনার অঙ্ক।


হিংসা নয়, ঘৃণা নয়। চাই সবার একটু সহযোগিতা।

কোরোনাকে হারাতে হলে, মানুষের সচেতনতা চাই।

আসুন,সকলে মিলেমিশে একসাথে লড়াই করি ―

জিতব আমরা। হারবে কোরোনা। ভয় নাই,ভয় নাই।



লকডাউন ৫

-জামাল আনসারী


একুশটা রজনী  কবেই কেটে গেছে,দেশে লকডাউন চলছে..

বাবুইপাখির বাসার মত হৃদয়ের মণিকোঠায় অঙ্কিত স্বপ্নগুলি

আকুল পাথারে একে একে বিলীন...

কথা ছিল, একুশটা দিবানিশি অতিক্রম শেষে

আসমুদ্রহিমাচলে উঠে যাবে সোশ্যাল ডিস্ট্যান। লকডাউন।

নীল আকাশে উদিত হবে দুর্যোগ-মুক্ত প্রভাতের নবারুণ।

বদ্ধ ঘরের আগল ভেঙে মানুষ গুলি আবার পথে ঘাটে মাঠে...

রৌদ্র ঝলমলে ভিজে মাটির গন্ধ মেখে  স্বস্তির শ্বাস নেবে।

কিন্তু না। এই পোড়া দেশে আর মীরাক্কেল ঘটল না।

একুশটা রজনী কেটে গেলেও লকডাউন উঠল না।


পাড়ার দর্জি কাকু অমলের মতো জানালার খিড়কি খুলে

দুচোখ ভরা অনাবিল আশার নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন

আর দুই দিন। আর মাত্র দুই দিন আমাদের কষ্ট!!

তারপর। শহরের কোনায় ওই দর্জি দোকানটা খুলতে পারব।

জানিস, ঐ ছোট্ট দোকানটায় আমার সংসারের রেলগাড়ি।

অনেক কাজ। কাজের পাহাড় জমে আছে।

আর না খেয়ে অনাহারে মৃত্যু  যন্ত্রনা আর সইতে হবে না।

কিন্তু সেই দুই দিনও গুটি গুটি পায়ে বিদায় নিল।

দোকান খুলল না। লকডাউন । লকডাউন ।

চলছে গোটা দেশে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম।

বারংবার প্রশ্ন বানে বিদ্ধ হচ্ছি.. দর্জিকাকু এখন কি করছে?

বেঁচে আছে তো! যুদ্ধ শেষে কি আবার দেখা হবে??

না। দেখার কোনো উপায় নাই। ঘরবন্দি।

দেশে লকডাউন। রাস্তায় পা ফেললেই বিপদ।


ছোট কাকিমা, সেদিন হাস্য মুখেই সুখবরটা জানিয়েছিল..

এই লকডাউন শেষ হলেই আসবে ...

জ্যোৎস্না আর আকাশের চার হাত এক হবে।

মনে পড়ে, ঘড়ির কাঁটার ছন্দে পা মিলিয়ে চলতে পারলে


বহুদিন পূর্বেই সুখের সাগরে জলকেলিতে মগ্ন হত দুই তরী।

কিন্তু এখন লকডাউনের অদৃশ্য দেওয়াল হৃদয় জুড়ে

জ্যোৎস্না ও আকাশের সীমারেখা।

একুশটা রজনী কেটে গেল, দেশে  লকডাউন চলছে।

আরো কতদিন চলবে?? কারো নেই জানা।


কথা ছিল, করোনা যুদ্ধে একুশ দিনেই জয়ী হবে আমার দেশ।

অন্তর্দাহ সহ্য করে হাসিমুখে কোটি কোটি কৃষক শ্রমিক দিনমজুর

অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেছে সরকারি নির্দেশিকা...

একুশ দিনে কত প্রান্তিক মানুষ অভুক্ত থেকেছে?

লক্ষ লক্ষ কৃষক হয়তো পায়নি উৎপাদিত শস্যের ন্যায্য মূল্য

পরিবহনের অপ্রতুলতা, মাঠেই পচেছে তাজা ফসল।

তবুও দাঁতে দাঁত চেপে মেনেছে লকডাউন...জানে অন্তর্যামী।

অতীত পর্যালোচনা, করোনার ইতিহাসে চোখ মেলি...

কার দোষে? নভেল করোনা ভাইরাস উড়ে এল দেশে?

অচিরেই  মহামারীর শাখা প্রশাখা মেলেছে সারা ভারতজুড়ে?

এটা কি ভারত সরকারের নির্বুদ্ধিতা নয়?

প্রশ্ন অনেক। উত্তর পাওয়ার নাই অবকাশ।


তবুও আশার প্রদীপ হাতে নিয়ে দুচোখে  সুদিনের প্রত্যাশা দেখি

জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে মানুষ মিলিয়েছে কাঁধে কাঁধ

চলছে আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে তুমুল কোরোনা সংগ্রাম

আশা রাখি,জয়ী হবেই একদিন মানুষ। মৃত্যু ঘটবেই করোনার।




বন্দীর আশা

-শ্রেষ্ঠী দে


হোক আমার বদ্ধ জীবন

হই না আমি খাঁচার পাখি,

নতুন পথেই চলবে জীবন

এই আশাতেই কেবল বাঁচি।

বছর শেষে বছর ঘোরে

আসে দিনের শেষে রাত্রি,

সুখের পাশেই দুঃখ বাঁচে

জীবন তো নয় স্বপ্নপুরীর যাত্রী!


চোখ গুলো আজ ধাঁধিয়ে ওঠে

হাতছানি দেয়, রংবেরঙের স্বপ্ন,

পড়ন্ত বেলায় ঘুম ভেঙে যায়

দেখি জীবন শুধু হতাশাতেই মগ্ন।

আজ আকাশ ভরা কালো মেঘ

আর জীবন ভরা বিষাদ,

সঙ্গে দোসর মাতাল বাতাস

মানুষ কেবল ঠুটো জগন্নাথ।

সময় চলে নিজের তালে

হাপিয়ে ওঠে জীবন,

পায়ের শিকল ছিন্ন হবে

এই আশাতেই বাঁচে মন।।





অবক্ষয়

-তারা কয়াল


কোথায় শিক্ষা, কোথায় সমাজ

কোথায় বা আমাদের বিপ্লব!

আস্তরনে ঢাকা পড়ে গেছে,

অহংকারের কালো ছাপ।

স্বপ্নের ঘুমে তলিয়ে গেছে

বিশ্ব বাংলা জুড়ে।

নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সর্বক্ষণ

কল্পনার, আশার সমুদ্রে।

আসছে সেই গভীর জোয়ার,

তলিয়ে দিতে বিশ্বজুড়ে।


কোথায় শিক্ষা, কোথায় সমাজ

কোথায় বা আমাদের বিপ্লব!

ভাবনার জগতে মেতে আছি সবাই,

মধুর আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দে।

পরিবর্তনটা কি শব্দ?

ভুলে গেছি বহুদিন আগে।

মূর্খের মতো সান্তনা দিচ্ছি

বেশ!...দিব্যি!... চলে যাচ্ছে বলে।

ভবিষ্যত প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাচ্ছে

কি হবে তা চিন্তা করে!


কোথায় শিক্ষা, কোথায় সমাজ

কোথায় বা আমাদের বিপ্লব!

লজ্জা লাগে বলতে আমার

বাচ্ছি শিক্ষিত সমাজে?

যে মাটিতে বিপ্লবীরা

ডাক দিয়েছিল শিক্ষার ব্যাখ্যা তুলে।

ভুলে যাচ্ছে সবাই

কষ্টে গড়া সেই অধিকার।

কঠোর পরিশ্রম ও পরাজিত হচ্ছে

বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে।


কোথায় শিক্ষা, কোথায় সমাজ

কোথায় বা আমাদের বিপ্লব!

স্বার্থপর ওহে মানব সমাজ

লজ্জা কি আছে তোমাদের?

কষ্টে পাওয়া এই জগত

মূল্যহীন হয়েছে তোমাদের কাছে।

উল্টে দেখো পাঠ্যের পৃষ্ঠা

সংগ্রাম করেছে কতো।

শিক্ষার আলো তুলতে গিয়ে,

শহীদ হয়েছে কত-শত।

কোথায় শিক্ষা, কোথায় সমাজ

কোথায় বা আমাদের বিপ্লব!



গৌতমের প্রতি

-ঋতম সাহা

লিখতে বসেছি এক সন্ন্যাসীরাজার পরিচয়

জগতে এরূপ চরিত্রের হবেনা কোনোদিন বিকল্প,


সংসারের অমানিশায় সে এনেছিলো আলো

বোঝা তাকে সত্যিই জটিল, যেমন আমিও বুঝেছি তাকে অল্পস্বল্প।


দেয়া হয়েছিলো তাকে শৈশবেই রাজত্বের লক্ষ্য অব্যর্থ,

নামকরণে মুখর রাজমহল, পিতা দিলেন নাম সিদ্ধার্থ।


রাজা-রাজত্ব সকল বিলাসিতা হতেই সে ছিলো অধিক দূরত্বে

রাজকুমার হয়েও কিনা বারবার বলতেন কথা যুদ্ধ বিনা মনুষ্যত্বে।


শুরুর জীবনেই ঘটলো সমাপ্তি মা মহামায়ার জীবনী,

নামে জুড়লো গৌতম, গৌতমী হয়ে উঠলেন তার প্রকৃত জননী।


পিতা চেয়েছিলেন ফেরাতে বিশ্বাস বালকের রাজতন্ত্রে,

শৈশবেই দক্ষ বালক গনিত, বিজ্ঞ্যান আর বেদমন্ত্রে।


শিক্ষকরা পেলেন দায়িত্ব, হলো গৌতমের শিক্ষা শুরু,

শিশুরূপে আচার্য্য পেয়ে হলেন অবাক, ধন্য সকল গুরু।


দেখিয়েছিলে পশুপ্রেম, তীরবিদ্ধ হংস বাঁচিয়ে আপন জেদে,

করলে বিয়ে যশোধরাকে, ভালোবেসেও শেষে কিনা যুদ্ধ জিতে।


ভেবেছিলো পরিবার পুনরায় মহলে দেবে মন

ফিরবে তোমার সংসারে আস্থা,

তবুও তুমি সেই উদাসীনই, ছাড়লে সংসার,

অনুভবে জনজাতির দূরাবস্থা।


গুরু কালামা ও রামাপুত্তা হতে কঠোর যোগ তপস্যায় হলে পুরুষ সিদ্ধ,

ভাঙলে জীর্ন সন্ন্যাস চক্র, গড়লে নতুন তুমি, তুমিই বুদ্ধ।


জটিল রোগে বৃদ্ধ স্পর্শে, ভেঙেছিলে ভ্রান্ত ধারণার বিভীষিকা,

তুমিই করেছিলে চিহ্নিত সকল মানবজীবনের মরীচিকা।


তুমি উদ্ধারে জাগতিক সত্য,

শিখিয়েছিলে রাখতে বিশ্বাস অন্তর্হিত সত্যের অস্তিত্বে,


জীবনের ঝটিকাসফরে শিখেছি ভালোবাসা,

ভক্তিতে নিমজ্জিত কেবল আমি বোধিসত্ত্বে।


পতিতাকে দিলে স্নিগ্ধতা, বিশ্বাস তার মাতৃত্বে,

বিষন্ন মন এখনো পায় বিশ্বাস তোমার অস্তিত্বে।


সিদ্ধিলাভে চিনলো জগত তোমারে, আর্তপীড়িত হলে তোমা দ্বারে আগত,

তুমি হলে পরিত্রাতা তাদের, জীবন চেতনায় তোমাকে পেলাম তথাগত ।


নাস্তিকতায় বিশ্বাসীদেরও পছন্দের তুমি,

নিজের ধর্ম বাঁচাতে ব্যবসায়ীরা বানিয়েছে তোমাকেই দেবতা,

শিখিয়েছো ত্যাগিতে অন্ধবিশ্বাস, জীবনে যুক্তি প্রধান

জরাজীর্ন সকল ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে চলেছে তোমার যুদ্ধ সর্বদা।


শত শত আঘাতের পরেও, লক্ষ্যে অবিচল তোমার আদর্শে চলা শিষ্য,

তোমার দর্শনে অটূট তারা, এখনো বিঘ্নিত হতে দেয়নি তোমার উদ্দেশ্য।


কত রাজা ছাড়ে রাজত্ব, আপন করে তোমায় কাটিয়েছে যুদ্ধের কান্তি,

তোমার রাজত্বেই ফলেছে দেশমাটির সীমানা পেড়িয়ে  কেবল শান্তি।


শিখিয়েছো উপায়, দমাতে অশান্ত হৃদয় অন্তরের সকল যুদ্ধ,

অষ্টাংগিক মার্গ দিয়েছো আমাদের, কেবল এক এবম অদ্বিতীয় বুদ্ধ।

'মেয়েলি' আলতা! -রাজা দেবরায়
Nov. 18, 2024 | কুসংস্কার | views:972 | likes:2 | share: 2 | comments:0

মাঃ আয় সোনা মা আমার, পায়ে আলতা লাগিয়ে দিচ্ছি।


মেয়েঃ পায়ে আলতা লাগালে কী হবে মা?


মাঃ বলিস কী! আলতা লাগানো কত ভালো জানিস। আর কী সুন্দরও লাগে দেখতে। দ্যাখ্ দ্যাখ্ আমার পা দুটো কী সুন্দর লাগছে।


মেয়েঃ বেশ বুঝতে পারছি মা! আমাকে মেয়ে দেখাতে লাগবে সেটা পরিষ্কারভাবে বলো! তাই নয় কি? শুধু শুধু কেনো আলতার বাহানা দিচ্ছো!!?


সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি খবর

 ১. কুসংস্কার বিরোধী আইনের দাবি এবার এ রাজ্যেও

মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের পথ অনুসরণ করে এরাজ্যেও একই ধরনের আইন আনার দাবি তুলছেন বিজ্ঞানকর্মীরা। খুব শীঘ্রই একটা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করবে।

 কুসংস্কার বিরোধী আইন চালু করার দাবিতে পথে নামলেন এ রাজ্যের মানুষ। মহারাষ্ট্রে এই আইন ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। কুসংস্কার বিরোধী আইনের দাবি উঠেছে কেরল ও কর্নাটকেও। পশ্চিমবঙ্গও কিন্তু পিছিয়ে নেই। এবারের কলকাতা বইমেলায় 'কুসংস্কার, তন্ত্রমন্ত্র ও জ্যোতিষ বিরোধী আইন'-এর দাবি জানিয়ে মেলা পরিক্রমা করতে দেখা গিয়েছে শ’খানেক মানুষকে।

'কুসংস্কারবিরোধী আইন প্রস্তাবনা উদ্যোগ'-এর তরফে বিজ্ঞানকর্মী সুরেশ কুণ্ডু জানিয়েছেন, ''কুসংস্কারবিরোধী আইন লাগু করার ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে মহারাষ্ট্রের ''অন্ধ শ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি''। আমরা তাদের অনুসরণেই এ রাজ্যেও একই ধরনের আইন আনার দাবি তুলেছি। লিফলেট, পোস্টার ও গণস্বাক্ষর দিয়ে প্রচারের কাজ শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই একটা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব আমরা পেশ করব রাজ্য সরকারের কাছে। ওই প্রস্তাবে কুসংস্কারবিরোধী বিলের সম্ভাব্য রূপরেখা দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে মনে রেখেই এই আইনি খসড়া প্রস্তাবটি তৈরি করা হচ্ছে।''

উদ্যোগের পক্ষে সাধন বিশ্বাস বললেন, ''কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে গুরুজি, বাবাজি, মাতাজি, পীর, ফকির, ফাদার'রা প্রতারণার ফাঁদ পেতে রেখেছে। তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক তাগা তাবিজ জ্যোতিষ ইত্যাদি দিয়ে নানাভাবে ঠকানো হয় জনসাধারণকে। এমনকী তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও করা হয়। কুসংস্কারবিরোধী আইন চালু করতে পারলে ধর্ম ও কুসংস্কারের নামে আর্থিক প্রতারণা, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ, সামাজিক মর্যাদাহানি ইত্যাদি বন্ধ করা যাবে।''

তবে কুসংস্কার বিরোধী উদ্যোগের অন্যতম নেতা অরিন্দম মুন্সীর বক্তব্য, ''কুসংস্কার বিরোধী আইন চালু করলেই যে তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে লোক ঠকানো, ভূত ছাড়ানোর নামে ঠ্যাঙানো ও নোংরা খাওয়ানো কিংবা যৌন হয়রানি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন নয়। আইন একটা অস্ত্র যা হাতে থাকলে, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে, আমরা পুলিশ-প্রশাসন'কে চাপ দিতে পারব অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু কুসংস্কারজনিত শোষণ ও পীড়ন পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে গোটা ব্যবস্থা'কেই পালটাতে হবে।''


২. ভূত ভর করেছে ছাত্রীর উপর! আতঙ্ক এলাকায়, আজও কুসংস্কারে ডুবে।

কবর থেকে উঠে আসা ভূত নাকি চেপেছে বছর আটেকের বালিকার ঘাড়ে। তা নিয়েই পড়ে গেল হুলুস্থূল। এলাকাবাসীর দাবি ভূতে ধরেছে বলেই, ছাত্রী এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী চিৎকার-চেঁচামিচি করছে, কখনও মায়ের গলা টিপতে যাচ্ছে। এই ঘটনায় ভূতের আতঙ্ক তো ছড়িয়েছেই, তার থেকেও লজ্জার এ ঘটনা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের। প্রতীকী ছবি চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা ঘটেছে জলপাইগুড়ির পাহাড়পুরের বড় চৌধুরী পাড়ায়। হঠাৎ ওই বালিকার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সবাই-ই বলতে শুরু করে ওকে ভূত ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে নানা দাওয়াই শুরু হয়ে যায়। কেউ সুপারি গাছের পাতা হাতে দলে ওই বালিকার নাকে দেয়, কেউ কানে দেয় সরষের তেল। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

এরপরই আবির্ভূত হন মৌলবি। তিনি এবার শুরু করেন ঝাড়ফুঁক। চলতে থাকে তুকতাকও। ভূতের সঙ্গে কথোপকোথনও চলতে থাকে তাঁর। জানা যায়, কবরে ভূত খুব কষ্টে আছে। তাই সেই ভূত এসে ভর করেছে ছাত্রীর উপর। এই ঘটনায় প্রকট হয়ে পড়ে এখনও সামাজিক কুসংস্কারের শিকড় কতখানি গভীরে রয়েছে।

সম্প্রতি এক তরুণী আত্মঘাতী হন এলাকায়। তাঁকে কবর দেওয়া হয় পাড়াতেই। তার অতৃপ্ত আত্মাই ছাত্রীকে ভর করেছে। এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। ভূতের আতঙ্ক কাটাতে তাই সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করছে জেলা প্রশাসন। মেডিকেল টিম পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক।

লিংক- https://bengali.oneindia.com/news/west-bengal/ghost-panic-is-spread-jalpaiguri-a-girl-student-is-behaved-unnatural-044699.html

ভূত চতুর্দশী ও ব্যবসা -ক্রান্তিকারী শুভাশিষ
Nov. 18, 2024 | যুক্তিবাদ | views:879 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ভূত চতুর্দশী। বাঙালির হ্যালোইন। কুমড়োর লণ্ঠন তৈরি, ঘর সাজানো, ছোট ছোট বাচ্চারা নানা বিচিত্র পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এইসব নানাবিধ কার্যকলাপের মাধ্যমে উৎসবের মেজাজে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে হ্যালোইন পালিত হলেও বাংলায় ভূত চতুর্দশী পালিত হয় যথেষ্ট নিষ্ঠাভরে। যদিও উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে এই উৎসব। বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষজনদের মতে দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কোজাগরী পূর্ণিমার পরবর্তী চতুর্দশী তিথির দিনটিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। ভূত চতুর্দশী নিয়ে নানা পৌরাণিক গল্প কথা থাকলেও মূল বিষয় হল এই দিন মৃত পূর্বপুরুষরা ধরাধামে নেমে আসে। তাই এত আয়োজনের ঘনঘটা। এই দিন দিনের বেলায় ১৪ রকমের শাক খেয়ে রাতে ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে নিষ্ঠাভরে পালন করার রেওয়াজ বঙ্গবাসীর দীর্ঘদিনের।


এ তো গেল বিশ্বাসের কথা। কিন্তু এই ভৌতিক বিশ্বাসকেই এক শ্রেণীর প্রচারমাধ্যম সুকৌশলে বিকিকিনির উপকরণে পরিণত করেছে। একটা সময় অবধি ভূত-প্রেত-আত্মা এই সমস্ত বিষয়গুলি নির্দিষ্ট কিছু উপন্যাস, গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে অবস্থাটা অন্যরকম আকার নিয়েছে। সংবিধানের 51A(h) ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একশ্রেণীর প্রচারমাধ্যম অধিক মুনাফার আশায় প্রতিবার এই সময়ে এমন কিছু সংবাদ পরিবেশন করে যা শুধু নিন্দনীয় নয়, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারে পরিপন্থী। গত বছরই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে "হদিস মিলল সাত রকম আত্মার, ভূত খুঁজতেই ঘাড় ধাক্কা।”সেই সাথে জুড়েছে কোনো প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান, বসতিহীন রাজবাড়ী, পরিত্যক্ত রেলস্টেশন গুলিকে 'Ghost Tourism' -এ রূপান্তরিত করার নতুন পন্থা। বেগুনকোদর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অনুঘটক হিসাবে উদয় হয়েছে একদল ভূত বিশেষজ্ঞ। যাদের পোশাকি নাম 'প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর'। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যন্ত্রপাতিকে সম্বল করে মানুষকে সুকৌশলে বোকা বানানোর চেষ্টা রীতিমতো উদ্বেগজনক। সেই সাথে রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের কৌতূহলকে পাথেয় করে কখনও কখনও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে এইসব প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটররা লাইভে আত্মার অস্তিত্ব দেখানোর চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে। আমরা এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছি বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পাওয়া জি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় টিভি শো দাদাগিরিতে; যা নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনো ঘটেনি। এই কাণ্ডকারখানা যুক্তিবাদীদের কাছে হাস্যকর মনে পারে, কিন্তু বিষয়টি ভাববার। তার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত বেড়ে চলা অপবিজ্ঞান চর্চা তো আছেই। রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ।


বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির অনিবার্য সংঘাত হিসাবে যুক্তিবাদীদেরকে এই বিষয়ে আরো বেশি অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কখনও কখনও দেখা যায় এই বিশ্বাসকে অপযুক্তির হাত ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করে, একটি ধারণা তৈরী করে। কিন্তু সেই অপচেষ্টাকে আমাদের যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতেই হবে। অনেকে ১৪ শাক খাওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেন, ঋতু পরিবর্তনের সময় ১৪ শাক খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, বিশেষ করে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে, কীভাবে একটি বিশেষ দিনে ১৪ রকমের শাক কিঞ্চিৎ পরিমাণ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিপুল পরিমাণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন উঠবে শুধুমাত্র ঐ দিনেই কেন? আগে বা পরে নয় কেন? প্রশ্ন ওঠা উচিত একইভাবে ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া যুক্তির। প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটরদের ব্যাপারে বলি, এই সমস্ত প্রতারকদের যতবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ডাকা হয়েছে তাদের টিকি পাওয়া যায়নি। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের সংবিধানের 51A(h) ধারার গুরুত্ব বুঝে এই সমস্ত মিথ্যা বিভ্রান্তিকর অপবিজ্ঞান সংবাদ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। সবজান্তা মধ্যবিত্ত মানসিকতা লোকজনদের পাত্তা না দিয়ে এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতার মশাল জ্বালতেই হবে।

আত্মা, আধ্যাত্মবাদ এবং কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বই নিয়ে মুক্তমনে আলোচনা -অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:996 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মৃত্যুতেই কি সব কিছুর শেষ? আত্মা বা Soul বলে আদৌ কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এই বিশ্বে, নাকি সেটা নেহাৎই কল্পনা? পুনর্জন্ম অথবা জাতিস্মর কি আত্মার অস্তিত্ব কেই ইঙ্গিত করে? বিজ্ঞান কি আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করেছে? 

বহু মানুষের ধারনা মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন থাকে , একেই আত্মা বলা হয়। এর মধ্যে শিক্ষার সূযোগ পাওয়া না পাওয়া ব্যাক্তিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীজুড়ে যে ৪২০০ প্রকারের ধর্ম বর্তমান,  সেখানে আত্মা নিয়ে রয়েছে নানান মতামত, রয়েছে অনেক বিভ্রান্তিও। সেখান থেকেই উঠে আসে অসংখ্য প্রশ্ন। 

শ্রীমদ্ভাগবদ গীতায় আত্মা সংক্রান্ত অনেকগুলো শ্লোক আছে। দুটি শ্লোক, উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। ২ য় অধ্যায়ের ২২ তম শ্লোকে আছে - 

“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়। নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা। ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।। 

ঐ অধ্যায়ের ২৩ তম শ্লোকে আছে - 

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি  নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। 

এই দুটি শ্লোকের অর্থ করলে দাঁড়ায় , “মানুষেরা যেমন ছিন্ন বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মা তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে। এই আত্মাকে কোনো অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, আগুন একে দগ্ধ করতে পারে না, জল দ্বারা একে সিক্ত করা যায় না, বাতাস একে শুষ্ক করতে পারেনা। ইনি কোথা থেকে আসেনি এবং কোথাও যাবে না। তিনি অজেয়, নিত্য, শাশ্বত, সর্বজ্ঞ, স্থির, অচল ও সনাতন। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয়না "। 

আত্মার এই সংজ্ঞা কে মেনে নিলে একটা সমস্যা এসে প্রকট হয়। গীতার মতে আত্মা কে কাটা, ভেজানো, জ্বালানো ইত্যাদি নাকি যায়না। অথচ দেখুন  ব্রহ্মপুরাণ, গরুরপুরাণ, ইত্যাদিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ রয়েছে স্বর্গ- নরকের বর্ণনা। যদি আপনি হিন্দু হন এবং এই জীবনে ভালো কাজ করে যান তাহলে হিন্দু বিধান মতে আপনার আত্মা মৃত্যুর পরে যাবে স্বর্গে। সেখানে, রোগ- ব্যাধি নেই।শুধু আনন্দ হি কেবলম। কিন্তু আপনি যদি এই জীবনে সর্বদা পাপ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন  যেমন খুন,ধর্ষণ, চুরি, ঘুষ দেওয়া- নেওয়া ইত্যাদি , তাহলে মৃত্যুর পরে আপনার আত্মার জন্য রয়েছে বিভৎস শাস্তি বা অত্যাচারের উল্লেখ গরুরপুরাণে। যেমন গরম তেলে ভাঁজা, কাঁটার ওপর দিয়ে টেনে -হিচড়ে নিয়ে যাওয়া, মুগুর দিয়ে আড়ংধোলাই,তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা আঘাত, ইত্যাদি অনেক কিছুই যা আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না (একশ্রেণীর লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত,বেইমান, ধান্দাবাজ নেতা মন্ত্রীদের কি পরিণাম হবে ভেবেই শিউরে উঠছি)।


একদিকে গীতায় বলছে আত্মাকে কাটা যায় না, জ্বালানো যায়না এবং অন্যদিকে পুরাণে আত্মাকে জ্বলানো, কাটার নির্দেশ রয়েছে। এতো চরম স্ববিরোধীতা। জানিনা কতজন মানুষ এসব নিয়ে মুক্তমনে ভাবতে পছন্দ করেন। 


ইসলাম ধর্মেও রয়েছে বেহেশত এবং দোজখ এর বর্ণনা। খ্রিষ্টান ধর্মেও আছে হেভেন এবং হেল এর স্পষ্ট বর্ণনা। হিন্দুধর্মে আত্মাকে যেভাবে অত্যাচার করার উল্লেখ আছে, প্রায় একই কায়দায় ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্মেও রয়েছে শাস্তির উল্লেখ। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আজই খোলামনে পড়ুন - গীতা, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, মনুসংহিতা, বেদ,বাইবেল, কোরান,হাদিস ইত্যাদি সমস্ত গ্রন্থ গুলো কে যাকে আমজনতা ' ধর্মগ্রন্থ ' বলেই আখ্যা দেন। দেখবেন যা লিখছি সেসবই লেখা আছে। সঙ্গে রয়েছে প্রচুর স্ববিরোধী,বিজ্ঞানবিরোধী, ভুলেভরা, হাস্যকর কথাবার্তাও। 

আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে কথা উঠলেই একদল ব্যাক্তি প্রথমেই যে বই টির উল্লেখ করেন সেটি হল স্বামী অভেদানন্দজী মহারাজ রচিত  “মরনের পারে "। যার ইংরাজি অনুবাদ “Life Beyond Death ", প্রকাশক - শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। বইটি বেস্টসেলার তালিকায় দীর্ঘবছর ধরে স্থান করে রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, অভেদানন্দজি কি তবে সব ভুল লিখেছেন, তিনি কি মিথ্যেবাদী? আপনি পারবেন এই বইটিকে ভুল প্রামাণ করতে? ইত্যাদি।

উক্ত বইটির প্রথমেই লেখা আছে “মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)। কি রকমের বৈজ্ঞানিক আলোচনা, নাকি বিজ্ঞানবিরোধী আলোচনা আসুন দেখেনেওয়া যাক। 

' মরণের পারে ' বইটি বেশ ভালো ভাবে পড়লে বোঝা যায়,স্বামী অভেদানন্দ মনে করতেন যে- 

১- চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মনই হচ্ছে আত্মা। 

২- চিন্তা,চেতনা,চৈতন্য কিংবা মন আত্মারই কর্মফল।

অভেদানন্দজীর এই তত্ত্ব কে মেনে নিলে খুব মুশকিলে পড়তে হয়। কারণ আজ ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে  শিখছে (যদিও পরে সেসব বেমালুম ভুলে থেকে অন্ধবিশ্বাস কেই আঁকড়ে ধরছে) যে, একজন মানুষ চিন্তা করে নিজেদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ থেকেই। অর্থাৎ চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মন যাই বলা যাক সেসবের উৎপত্তি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকেই। একজন মানুষের মৃত্যু হলে হয় তাঁর দেহ হয় চিতায় জ্বালিয়ে দেওয়া হবে নয়তো মাটিতে পুঁতে দিলে পঁচে গলে সেই মাটিতেই মিশে যাবে, নয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে থাকলে চিল- শকুনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে, একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে-সাথেই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের ও মৃত্যু। মন কে আত্মা মানলে এটাও মানতে হচ্ছে আত্মা মরণশীল। আর আত্মা মরণশীল এটা প্রমাণিত হলে মিথ্যে হয়ে যায় ঈশ্বর, স্বর্গ- নরক,পুর্বজন্ম,আত্মা, জাতিস্মর ইত্যাদি অনেক কিছুই। 

'মরণের পারে' নামক বেস্টসেলার বই এর কিছু বৈজ্ঞানিক আলোচনা (পড়ুন বিজ্ঞানবিরোধী) র কিঞ্চিত নমুনা এখানে তুলে ধরছি, ত্রয়োদশ পুনমূর্দণ,বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ থেকে।

ত্মার স্বরুপ কেমন? এই বিষয়ে স্বামীজির  (লেখার সুবিধের জন্য স্বামীজি বলতে এখানে বিবেকানন্দ কে নয়, বরং অভেদানন্দজি কে বোঝানো হলো) মত “মেঘের মত, কুয়াশার মত (ঐ বইএর ২৮ পৃষ্ঠা)। তিনি এটাও জানিয়েছেন - 

 বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, ঐ  ‘বস্তুটির নাম দিয়েছেন 'এক্টোপ্লাজম' বা সূক্ষ্ম- বহিঃসত্তা, এটি বাষ্পময় বস্তু এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। একে দেখতে একখণ্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার নিতে পারে’।  (ঐ বইএর ২৮ - ২৯ পৃষ্ঠা) 


স্বামীজির এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিজ্ঞান কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে মোটেই স্বীকার করেনি। বিজ্ঞান এক্টোপ্লাজম বলতে মেঘের মত,কুয়াশার মত কোনও বস্তুকেই নির্দেশ করেনা। এক্টোপ্লাজম 

(Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা মানব দেহের শরীরের কোষ (Cell) এর অভ্যন্তরস্থিত সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) নামের একপ্রকার জেলির মতন বস্তুর বাইরের দিকের অংশকেই স্পষ্ট নির্দেশ দেয় (এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ে দেখুন ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর বিজ্ঞানের বই)। 


আত্মাকে দেখতে মেঘের মত,কুয়াশার মত ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত হননি স্বামীজি, এর সপক্ষে প্রামাণ হিসেবে একটা দারুণ উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যারা নিজের আত্মাকে স্বচক্ষে দেখতে চান তাঁরা সামান্য খরচ করে দাঁড়িয়ে পড়ুন একটা এক্সরে মেশিনের সামনে, এবং তুলে নিন নিজ শরীরের কোনো একটা অঙ্গের ছবি। এক্সরে ফটো হাতে পাওয়ার পরে দেখতে পাবেন নিজের আত্মাকে। জানেন কিভাবে? এইখানে স্বামী অভেদানন্দজি জানাচ্ছেন - "আমার দেহের কোনো অংশ যদি এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব- হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণায় পরিপূর্ণ,  চারিদিকে যেন তারা ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়,তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ"। (ঐ বই এরই ৩২ পৃষ্ঠা)।

ভাবা যায় কি মারাত্মক রকমের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা পড়া  মাত্রই অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়। একটা অপ্রিয় সত্যি বলতে বাধ্য হচ্ছি, স্বামীজির যদি শরীর বিদ্যার স্কুলের সামান্যতম জ্ঞানটুকুও থাকতো তাহলে নিশ্চই তিনি এটা জানতেন যে, শরীরের হাড়, মাংস, পেশি ইত্যাদির ঘনত্বের ভিন্নতার জন্যই এক্সরে ছবিতে সাদা-কালো রঙের গভীরতারও বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আর এই রঙের গভীরতার বিভিন্নতাকেই আত্মার কুয়াশারুপের প্রামাণ হিসেবে খাড়া করতে এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের মগজে ঢোকাতে চেয়েছেন স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ। 

স্বামীজি আবার আত্মার ওজন মাপার এক প্রকার যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন 'মরণের পারে' বইএর ২৮  পৃষ্ঠায়। তিনি জানাচ্ছেন - 

"বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যে বস্তুটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার ' ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ"। 

বাহ, চমৎকার তথ্য। শুনেই শিহরণ জাগছে শরীরের সর্বাঙ্গে। মজাটা হচ্ছে স্বামীজি এমন জব্বর তথ্য জানিয়েই খালাস। তিনি কিন্তু মোটেই জানাননি এমন দারুণ যন্ত্রটির নাম কি, কে, কতসালে, কোথায়, এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন। এই বিষয়ে অভেদানন্দজির অন্ধভক্তরা কিংবা উক্ত বইটির প্রকাশক ' শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ' যদি পথ দেখান তবে বিশেষ বাধিত হব। আত্মা কিংবা মরণের পারে গ্রন্থের পক্ষ  নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলবেন তাদেরকে অনুরোধ, দয়াকরে ভাববাদী শিবিরের ওপরে চাপ সৃষ্টি করুন যাতে তারা সর্বসমক্ষে এমন যন্ত্রটির ব্যপারে বিস্তারিত জানায়। চাপ পড়লেই দেখা যাবে যে তাদের বক্তব্য কতটা মিথ্যাচারে ভরা, কতটা বিজ্ঞানবিরোধী।

 আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যারাই সন্দিহান তাঁদের উদ্দ্যেশ্যে ভাববাদী শিবির থেকে একটা পরীক্ষার কথা প্রায়শই উল্লেখ করা হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানীরা নাকি একবার একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যাক্তিকে কাঁচের একটা বাক্সে রেখে পুরো সিল করে দিয়েছিল অক্সিজেন প্রবেশের সমস্ত পথ কে বন্ধ রেখেই। একসময় ঐ বাক্সবন্দি ব্যাক্তিটির মৃত্যু ঘটলে আচমকা নাকি কাঁচের বাক্সটি ফেটে যায়। এই কাঁচ আপনা থেকে ফেটে যাওয়াই নাকি আত্মার অস্তিত্বকে প্রামাণ করার জন্য যথেষ্ট।

এই (কু) যুক্তিটি বহু মানুষ আজও বিশ্বাস করেন। অথচ এটা পড়ার পরে অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসাই স্বাভাবিক যে, এই ঘটনাটা ঠিক কবে, কত সালে,কোন দেশের বিজ্ঞানীরা ঘটিয়েছে এমন অনেক কিছুই। না, স্বামীজিও কিন্ত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করেছেন। ভাববাদী শিবিরও কেন জানিনা নিশ্চুপ। প্রশ্নের উত্তর গুলো তোলা রইলো গুরু ভাই- বোনেদের উদ্দ্যেশ্যে  যাঁদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত হয়েও এমন বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন। ভাবখানা এমন যে, ' গুরু বাক্য অভ্রান্ত,তাই প্রশ্ন তোলার অর্থই হচ্ছে গুরুর প্রতি অবিশ্বাস। ছিঃ ছিঃ এতো মহাপাপ কাজ ' । যারা এই কাঁচ ফেটে আত্মা বের হওয়া তত্ত্বে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী তাঁদের প্রতি অনুরোধ, একটা পোকা কিংবা পিঁপড়ে নিন,এবার সেটাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই ভরে ফেলুন একটা ট্রান্সপারেন্ট কোনো কৌটো অথবা শিঁশি  তে। একসময় অক্সিজেনের অভাবে পোকা কিংবা পিঁপড়ে টি মারা যাবেই। আর আত্মার অস্তিত্ব যদি বাস্তবিকই থেকে থাকে তাহলে পিপড়ে কিংবা পোকাটির ও থাকা স্বাভাবিক। আচমকা কৌটো ফেটে গেলে বুঝবেন আত্মার অস্তিত্ব সত্যিই আছে এবং  অভেদানন্দজির আত্মা সংক্রান্ত সব লেখাই অভ্রান্ত। 

আত্মা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বামী বিবেকানন্দর নাম অবধারিত উঠে আসবেই। কারণ উনিও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবেকানন্দর পূর্নাঙ্গ জীবনী দশ খন্ডের ' বানী ও রচনা ' পড়লেই সেটা বোঝা যায়, জানা যায়। যাইহোক আত্মা নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দর ধারণা অবাক করার মতোই। স্বামী বিবেকানন্দও কিন্তু অভেদানন্দজির মতো মনে করতেন - ' চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য বা মনই হল আত্মা এবং চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন আত্মারই কাজ- কর্মের ফল '।  মন নিয়ে বিবেকানন্দর একটা বক্তব্য তুলে ধরছি, যা কৌতুহলোদ্দিপক এবং কৌতুক-উদ্দিপক।

বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক নবপত্র,পৃষ্ঠা ২৬৪ এবং “বেদান্ত কি এবং কেন?”দশম পুনর্মুদ্রণ - মাঘ ১৪০৮, পৃষ্ঠা- ৩৭ এ লেখা আছে- “মন জড়ে রুপান্তরিত হয় এবং জড়ও মনে রুপান্তরিত হয়,এটা শুধু কম্পনের তারতম্য। একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথমে তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ- একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি এক্কেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রুপান্তরিত হয়ে গেছে"।  

না, এরপরে মন্তব্য নিঃস্প্রয়োজন। কারন বলার ভাষা টাই যে হারিয়ে ফেলেছি ইস্পাতের দ্বারা মন তৈরির থিওরি শুনে। একটা বাস্তব সত্য হচ্ছে, কোনো কিছু জানতে, শিখতে হলে সবজান্তার ভণ্ডামি ছেড়ে আন্তরিক হতে হয়। হতে হয় মুক্তমনা এবং জিজ্ঞাসু মনের। কে কি বলে গেছেন অথবা লিখে গেছেন সেটকেই অভ্রান্ত বলে ধরে না নিয়ে নিজেই মুক্তমনে সত্যকে খুঁজে দেখা খুবই প্রয়োজন। কারণ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব তো ভন্ডরাই কষে থাকে।

বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় ভর্তি বেস্টসেলার বই “মরণের পারে “থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে এনে বোঝানে যায় যে আত্মা নিয়ে স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ যা যা লিখেগেছেন নিজের বইতে সেগুলো সম্পূর্ণ উনার নিজের মনেরই কথা। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরোটাই গপ্পো এবং আজগুবি তথ্যের জঞ্জাল। আরেকটি চমকপ্রদ উদাহরণ দিচ্ছি "মরণের পারে”বই থেকে। কিন্তু তার আগে জানিয়ে রাখা আবশ্যক যে, আত্মার কুয়াশামার্কা রুপের সরাসরি কিন্তু বিরোধীতা করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি - বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড,নবপত্র প্রকাশন,পৃষ্ঠা  ২৫৪  থেকে। বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন “আত্মার কোনও রুপই নেই। কোন অণু- পরমাণুর দ্বারা গঠিত নয় বলে আত্মা অবিনশ্বর... আত্মা কোনোরুপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয় ।

নিন এবার কাকে ছেড়ে কার তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীরা। একজনের কথা মানলে অপরজন কে অবিশ্বাস করতেই হবে। কাকে বিশ্বাস এবং কাকে অবিশ্বাস করবেন এটা আত্মায় বিশ্বাসী জনগণের হাতেই ছেড়ে দিলাম।  

অভেদানন্দজি নিজের বই এ কয়েকটি সাদা-কালো ছবি বা ফটো তুলে ধরেছেন যা কিনা প্রামাণ করে সেগুলো আত্মার ছবি।  ‘মরণের পারে’, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮ এ লেখা আছে "আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন তার ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়"। আচ্ছা কি ভাবে নেওয়া যায়? একটা সাধারন ক্যামেরাতে নিশ্চই নেওয়া যাবে। আমার কাছে কোডাক কোম্পানির রিল ভরা ক্যামেরা যেমন আছে তেমনই আমার এক আত্মীয়ের কাছে ' ডিএসএলআর ' নামক ক্যামেরাও আছে। এখন তো স্মার্টফোন বা এন্ড্রয়েড ফোনের যুগ। এই ফোনেই দিব্বি আত্মার ছবি নেওয়া যায়। গুগল ইমেজে সার্চ করলে এমন আত্মার অসংখ্য ছবি পাওয়া যাবে। সুপার ইমপোজ করা কিংবা কাঁচের রিফ্লেক্সন দ্বারাও এমন অনেক ছবি পাওয়া সম্ভব যেগুলো দেখে সয়ং অভেদানন্দজিও বিষ্ময়ে হতবাক হতেনই। কেউ চাইলে নিজেরাই চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ' মরণের পারে ' বই তে ছাপা সেসব ছবিগুলোর চেয়ে আরও চমকপ্রদ সব ছবি তোলা যাবে যেগুলো দেখে একজন আত্মায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী)  মানুষ হতবাক হবেই হবে। আমি স্বচক্ষে দেখে নিয়ে একটা আত্মার ছবি তুলতে চাই, কেউ যদি আন্তরিক ভাবে আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করেন তাহলে বিশেষ বাধিত হবো। 

কিছু মানুষ আছেন যারা লজিকের চেয়ে ম্যাজিকে বেশি বিশ্বাস করেন। অথচ তাঁরা এটাই ভুলে যান যে, মন্ত্র-তন্ত্র দ্বারা ম্যাজিক সম্ভব নয়। প্রতিটি ম্যাজিকের পেছনে থাকে একটা কৌশল, যা ছাড়া ম্যাজিক দেখানোই অসম্ভব। অভেদানন্দজির পরেই যার বই এর বিক্রি বেশ ভালো তিনি হলেন সাধনার শেষ স্তরে পৌছানো,আধ্যাত্মিক জগতের সাধু, অলৌকিক ও  অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী (এসব অবশ্য ভক্তদেরই কথা) স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি। তিনি আত্মা, পরলোক, জাতিস্মর, প্ল্যানচেট ইত্যাদির ওপরে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সেসব বই মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় নিগূঢ়ানন্দজি হলেন অভেদানন্দজির ও গুরুর গুরু। হাস্যকর, বিজ্ঞানবিরোধী লেখা ছেপে তিনি বিজ্ঞানের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে কিভাবে উদোর পিণ্ড বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে,  বিজ্ঞানের পিণ্ডি চটকে ছেড়েছেন। সেসব উদাহরণ উনার বইতেই ছাড়িয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে  “জাতিস্মর “বই এর দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৯, প্রকাশক -নবপত্র থেকে কিঞ্চিৎ নমুনা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই বইএর ১২ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, টেপরেকর্ডারে পরলোকগত আত্মার কণ্ঠস্বর ধরার কথা। আছে। এটা শোনা মাত্রই আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং গাইড ' শ্রীমান পটলা 'র আন্তরিক ইচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজি কিংবা উনার কোনো শিষ্যের  সাথে একটিবার দেখা করে কোনো বিদেহী আত্মার কণ্ঠস্বর দ্বারা জেনে নেওয়া কে সেই কালপ্রিট যে তার দোকানের টালি সড়িয়ে অনেক টাকার মাল পত্র চুরি করে সটকে পড়েছে। জানিনা নিগূঢ়ানন্দজি এটা শুনলে ঠিক কি করতেন। এই অতীন্দ্রিয় শক্তিধর লেখক মহাশয় তাঁর “আত্মার রহস্য সন্ধান “বইএর ৭৭-৭৮ পৃষ্ঠায়  যা লিখেছেন সেটার সংক্ষিপ্ত অর্থ হল- মানুষের দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারে নাকি এক চুম্বক ক্ষেত্র আছে। যোগ সাধনার বিশেষ শ্বাস -প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সেটাকে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে পারলেই কেল্লাফতে। মাথা নাকি ব্লাডারের মত ফুলে গিয়ে যেকেউ মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব কে তুড়িমেরে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে। 

আমার একান্ত ইচ্ছে এমন একজন সাচ্চা, নিখুঁত সাধুমহারাজ কিংবা  যোগগুরু এগিয়ে আসুন, এবং থিওরি ছেড়ে প্র‍্যাক্টিক্যালি কোনো কৌশল ছাড়াই শূন্যে ভেসে দেখান দয়াকরে (বাবা রামদেব চাইলে এগিয়ে আসতেই পারেন। উনাকে মন খুলে স্বাগতম জানাচ্ছি)। "আত্মার রহস্য সন্ধান”বই এর ১১১ পৃষ্ঠায় নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন উনার কাছে যোগ শিখছেন এমন অনেকেই নাকি ' সূক্ষ্ম দেহে ভিন্ন ব্যাক্তি বা স্থান দর্শনের বর্ণনাও তাঁরা দিতে পারেন। লেখকের ব্যাক্তিগত এমন অভিজ্ঞতা আছে "। এই গ্রন্থের  ১২৩ পৃষ্ঠায় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন, "আত্মার পক্ষে পার্থিব সূক্ষ্ম- স্তরগুলোর অভিকর্ষ এড়িয়ে ভিন্ন গ্রহে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়"। স্বামীজি ঐ পৃষ্ঠাতে আরও জানিয়েছেন "লেখক ভিন্নগ্রহে বিভিন্ন মাত্রায় জীব দর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন"। মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার,ইউরো,পাউন্ড খরচ না করে, গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনেহয় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজির সাহায্য নিলেই ভালো হবে। সময় এবং অর্থ দুইই বেঁচে যাবে আর আমরাও বিশ্ববাসী জানতে পারবো মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব আছে।

নিগূঢ়ানন্দজির মারাত্মক সব জ্ঞানের নজির উনার বইএর ছত্রেছত্রে সাজানো। যেমন তিনি 'জাতিস্মর' গ্রন্থের ৮৫  পৃষ্ঠাতে  লিখেছেন “পি.সি.সরকার সকলের ঘড়ির কাঁটার সময় কমিয়ে দিতে পারেন কী করে? এ-বিষয়ে তাঁকেই জিজ্ঞাস্য।অধিমনোবিজ্ঞানে একে বলে সম্মোহন বা Pk (Psycho Kinesis)"। সত্যি মানতেই হচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজির জ্ঞানের বড়োই অভাব। যার এত জ্ঞান, এত অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্তকিছুর খবরাখবর জেনে ফেলেছেন তিনি পি.সি.সরকারের ঘড়ির কাঁটার সময় পিছিয়ে দেওয়ার আষাঢ়ে গল্প কে সত্যি বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। কারন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া শুধুমাত্র গল্পতেই সম্ভব, বাস্তবে কেউই এমন কোনো দিন ঘটায়নি এবং ঘটাতেও পারবেন না। চ্যালেঞ্জ রইলো। আর Pk বা Psycho Kinesis হচ্ছে আরেকটা বিজ্ঞানবিরোধী থিওরি। বিজ্ঞানের মুখোশের আড়ালে থাকা প্যারাসাইকোলজিস্ট রা যতই সিক্সথ সেন্স, সাইকো কাইনেসিস, দে'জা ভূ, ই.এস.পি.র গপ্পো বাজারে ছড়ুক না কেন সেসব কোনোদিনই বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণিত হবেনা। 

না, এর বেশী লেখা মানেই স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি কে তোল্লাই দেওয়া। সত্য জানতে প্রিয় পাঠক বন্ধুরাই প্রয়োজনীয় বই পত্র গুলো পড়ে নিয়ে নিজের যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখুন। নিজেই বুঝবেন ' কুছ তো গড়বড় হ্যায় দয়া'।

আত্মা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেই  আধ্যাত্মবাদের কথা উঠে আসবে। অভিধান জানাচ্ছে আত্মা সংক্রান্ত কিংবা আত্মা সম্বন্ধীয় মতবাদ ই হলো - আধ্যাত্মবাদ কিংবা অধ্যাত্মবাদ। এমন অনেকেই আছেন যারা অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত এবং হয়তো বিজ্ঞানের কোনো শাখায় পড়াশোনাও করেছেন। সেইসব মানুষের ভেতর অনেকেই অন্ধবিশ্বাস এবং আজন্মলালিত বিশ্বাস কে আঁকড়ে ধরে আছেন আজও। এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন যে 'ধর্মের সাথে কিংবা আধ্যাত্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো দন্দ নেই'। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞান কি আদৌ ঈশ্বর,অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় আত্মা কিংবা  আধ্যাত্মবাদ কে সত্যিই মেনে নিয়েছে? এর এককথায় উত্তর হচ্ছে না, না এবং না। কারন,বিজ্ঞানের দরবারে কোনো কিছু তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সেটা বিজ্ঞানের  - পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত এই তিন সহজ - সরল ধাপে উপনিত হয় বা সাফল্য (পাশ) লাভ করে। এমনটা আগেও হয়েছে কল্পিত প্রস্তাবনা বা হাইপোথিসিস। অর্থাৎ কোনো ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে যদি মনে হয় (সন্দেহ জনক কিছু রয়েছে) গবেষণা চালানো প্রয়োজন, তাকেই বলা হয় ' হাইপোথিসিস'। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করার পক্রিয়া শুরু হয়। 

ঈশ্বর, আধ্যাত্মবাদ, অলৌকিক ইত্যাদি এখনও পর্যন্ত হাইপোথিসিস এ পা টাই রাখতে পারেনি, বাকি তিন ধাপ তো অনেক দুরের কথা। এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি যা ইঙ্গিত করে ঈশ্বর,অলৌকিক অথবা  আধ্যাত্মবাদ কে। এখনও সেই রকম কিছু ঘটেনি যার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখবে,তারপর আসবে একটা সিদ্ধান্তে। ঈশ্বর, অলৌকিক কিংবা আধ্যাত্মবাদের কোনো কার্যপ্রলাপ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কে প্রভাবিত করতেই পারেনি। তাই বিজ্ঞান আজও মাথা ঘামায়নি যে ঈশ্বর, অলৌকিক, অতীন্দ্রিয়,  আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে, নাকি নেই। ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি সবটাই শুধুমাত্র মনোজগৎ এর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। 

একদল ধর্মগুরু অথবা বিজ্ঞানী কিংবা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যাক্তিরা (বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কিন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক,যুক্তিবাদী হওয়া যায়না। যুক্তিবাদী সাজা যায় কিন্ত হওয়া যায় না কারণ, এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার। যেটা সবাই পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং জিজ্ঞাসু মন) যতই প্রচার করুক, যতই তত্ত্বকথা শোনাক না কেন “বিজ্ঞান ঈশ্বর, অলৌকিক, আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নিয়েছে “তবুও কোনোদিনই এটা প্রমাণিত হবে না বিজ্ঞানের দরবারে। 

প্রাচীন ভারতীয় দর্শন যে মূলত নিরীশ্বরবাদী দর্শন ছিলো সেটাই হয়তো জানেন না আমজনতার একাংশ। বুদ্ধ, চার্বাক, মিমাংসা, মাধ্যমিক, জৈন ইত্যাদি নিরীশ্বরবাদী দর্শন। আমজনতা কে মিথ্যের জালে ভুলিয়ে রাখার প্রয়াস চলছে,চলবে। আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বহুদিন আগেই সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলে কিংবা আক্রমণ করেছিল বুদ্ধ এবং চার্বাক দর্শন। এছাড়া দে'জ পাবিলিশিং থেকে প্রকাশিত, প্রবীর ঘোষ এর লেখা “অলৌকিক নয়, লৌকিক “৪র্থ খণ্ডেও আত্মা, আধ্যাত্মবাদ এবং জাতিস্মরের স্ববিরোধীতা, বুজরুকি এবং ভণ্ডামো উপযুক্ত তথ্যসহ তুলে ধরা আছে। চাইলে কেউ পড়ে দেখতেই পারেন। 

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী এবং অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী মানুষ। তাঁর মুল চারটি সিদ্ধান্ত জানলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বুদ্ধের মূল চারটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে - (১) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা, (২) আত্মাকে ' নিত্য ' স্বীকার না করা, (৩) কোনও গ্রন্থ কে স্বতঃ প্রামাণ স্বীকার না করা, (৪) জীবন প্রবাহ কে স্বীকার করা। গৌতম বুদ্ধর মৃত্যুর পরে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হীনজান এবং অপরটি মহাজান। দুঃখ এটাই, যে বুদ্ধ ছিলেন সম্পূর্ণরুপে নিরীশ্বরবাদী সেই বুদ্ধ কে আজ ঈশ্বর বানিয়ে বিষ্ণুর অবতার রুপে পূজো করা হচ্ছে। সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা পড়লেই সেটা লক্ষ্য করা যায়,কারণ বুদ্ধ কে ঈশ্বর বনিয়ে, নানা অলৌকিক ব্যাপারে উনাকে জড়িয়ে ক্রমাগত প্রচারের কাজটা এই পত্রিকা করেচলেছে। বুদ্ধ মনে করতেন -”চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান আর আত্মা একই বস্তু"।  তিনি এটাও জানালেন “আত্মা বা চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান যেহেতু শরীরেরই ধর্ম (এখানে ধর্ম অর্থে গুণ কেই বুঝিয়েছেন বুদ্ধ। যেমন আগুনের ধর্ম বা গুণ হচ্ছে দহন না জ্বলন) তাই শরীর বিনাশের সাথে সাথেই আত্মার ও বিনাশ ঘটে। দার্শনিক জগদীশ্বর সান্যাল তাঁর ' ভারতীয় দর্শন ' গ্রন্থে লিখেছেন - বুদ্ধদেব বলেছিলেন, জন্মান্তর বলতে চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ করা বোঝায় না। জন্মান্তর অর্থে একটি জীবন থেকে আর একটি জীবনের উদ্ভব বোঝায়। গৌতম বুদ্ধের মতে নির্বাণ মানে দুঃখের বিনাশ কেই বোঝায়। এই নির্বাণ লাভ করেই সিদ্ধার্থ গৌতম ' বুদ্ধ ' হয়েছিলেন। যারা গৌতম বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না পড়েই কিংবা বিকৃত জীবনী পড়েই চেঁচায় তাদের বোঝানো বেজায় মুশকিল। বুদ্ধকে বিকৃত করার খেলায় সামিল মনুবাদীদের একাংশ থেকে দার্শনিক বা চিন্তাবিদ ছাপ দেওয়া ব্যাক্তিরা। ওরা জানে এক এবং জানায় আরেক। একে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। মনুবাদীদের বা ব্রাহ্মণবাদীদের দ্বারা শুদ্র বা দলিত মানুষের অত্যাচার চলেছে বহুযুগ ধরে, এই ধারা আজও অব্যাহত। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক সংবিধানের প্রণেতা বাবা সাহেব আম্বেদকর এর। উনি শুদ্রদেরকে সমাজে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং কট্টরপন্থী হিন্ধুত্ববাদীদের হাত থেকে হিন্দুধর্ম কে সরিয়ে আনতে এবং মানবিক গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনড়,স্থবির হিন্ধুধর্ম নিজের স্থানে অটল থাকার কারণে ব্যার্থ হয়ে আম্বেদকর, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে নাগপুরে ৫ লক্ষ নিম্নবর্গীয় বা দলিতকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু উপাসনাধর্ম ত্যাগ করন এবং জাত-পাত হীন বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেন। 

'চার্বাক দর্শন' বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন- ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক, স্বর্গ- নরক, জন্মান্তর ইত্যাদি কে যুক্তির শানিত অস্ত্রের আঘাতে কেটে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছিল। তাই ভাববাদী দর্শনপন্থীরা সজত্নে এড়িয়ে চলতেন চার্বাক দর্শন কে। এই কারণেই হয়তো চার্বাক কে লোকায়ত দর্শন আখ্যা দিয়েছিল সেযুগের ভাববাদী শিবিরের তাত্ত্বিক নেতা থেকে ম্যাক্সমুলার বা শঙ্করাচার্য প্রমুখরা। এই বস্তুবাদী বা লোকায়ত দর্শনে ' আত্মা বা চেতনা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম ব্যাতিত অন্য কিছুই মনে করেনা। এই বস্তুবাদী দর্শন থেকে সামান্য কিছু নির্যাস তুলে ধরছি, মুল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। যেমন- - 

(১) চৈতন্য রুপে আত্মার পাকযন্ত্র কোথা? তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা। 

(২) ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত। এছাড়া  কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।

(৩) যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ। তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিৎ জ্বলন।।

শেষে একটা অপ্রিয় সত্য বলতে বাধ্য হচ্ছি। স্বামী অভেদানন্দ থেকে স্বামী নিগূঢ়ানন্দ'র মতন অনেকেই আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বই-পত্র লিখেছেন। স্বামী অভেদানন্দ কিংবা স্বামী নিগূঢ়ানন্দ আজ আমাদের ভেতর নেই। বহুদিন আগেই উনারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। একটা প্রশ্ন জেগেছে এইমূহুর্তে, এই দুজন বিখ্যাত স্বামীজির উচিৎ ছিল মৃত্যুর পরে যদি একটা জীবন  থেকেই থাকে তাহলে সেটা জানানোর জন্য নিজেরাই  বিদেহী আত্মা রুপে মর্তে এসে জানান দেওয়া। কিন্ত আজ পর্যন্ত ওনারা আত্মা রুপে মর্তে এসে কোনো রকমের প্রামাণ দেননি। দেননি ওপরে ঈশ্বর নামক কেউ সত্যিই আছে কিনা, তার স্বরুপ কি, নিরাকার নাকি সাকার ইত্যাদির "প্ল্যানচেটে আত্মাকে আনা সম্ভব”এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা,পরামনোবিজ্ঞানী, ভুত - প্রেতাত্মা গবেষক বা অনুসন্ধানকারীরা চেষ্টা করে একবার দেখতে পারেন, যদি অভেদানন্দজি কিংবা নিগূঢ়ানন্দজির বিদেহী আত্মাকে টেনে আনা সম্ভব হয়। তাহলে বিশ্বের তাবড় যুক্তিবাদী, ঈশ্বর এবং আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী মানুষের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে আধ্যাত্মবাদ কে এবং আত্মা বলে বাস্তবিকই কিছু আছে সেটাও প্রামাণ হয়ে যাবে এই ফাঁকে।  

পরিশেষে একটা মজার ঘটনা জানাই। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষের ক্রমাগত যুক্তির আঘাতে পেরে উঠতে না পেরে, স্বামী অভেদানন্দজি রচিত ‘মরণের পারে’ গ্রন্থের  আত্মা সংক্রান্ত অনেক আজগুবি, বিজ্ঞানবিরোধী তথ্য বা বক্তব্যে কে ছেঁটে ফেলে বর্তমানে বইটি প্রকাশ করছেন 'শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ'। হাতে গরম প্রমাণ পেতে উক্ত বইটি পড়ে মিলিয়ে দেখে নিতেই পারেন কেউ। এটা নিঃসন্দেহে বড় জয় যুক্তিবাদী মানুষের। জয় যুক্তিবাদ। 


ঋণ স্বীকার : প্রবীর ঘোষ, শিবাশীষ বসু, রামকৃষ্ণ মন্ডল, উইকিপিডিয়া, কিছু প্রয়োজনীয় পত্র-পত্রিকা।

মন্ত্রপূত লটারির টিকিট -সন্তোষ শর্মা
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:112 | likes:2 | share: 2 | comments:0

লটারি! অনেকে লটারির টিকিট কেটে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। মাঝে-মঝেই খবর আসে অমুক ব্যাক্তি লটারিতে কোটি টাকা পেয়েছে। এই খবরে উৎসাহিত হয়ে আরও বেশি বেশি করে লোক লটারির টিকিট কেটে নিজের রক্ত জল করে উপার্জিত টাকা পয়সা ধ্বংস করতে থাকেন। এখানেই শেষ নয়, অনেকে আবার কোনও জ্যোতিষ বা  তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে মন্ত্রপূত লটারির টিকিট কেটে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেনে। আমার মেজ মামা নির্মলের ছেলে রাজীব কোটিপতি হওয়ার জন্য এক তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা গাচ্ছা দেয়। শেষে প্রতারণার শিকার হয়ে মামাত ভাই রাজীব ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য আমরা হাত-পা ধরে। প্রতারক তান্ত্রিকের কাছ থেকে ভাইয়ের টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে সে কি ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম , তা এখানে লিখছি।

রাতে আমার পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মেজ মামা নির্মল, মামি এবং তাঁদের ছেলে রাজীব এসেছে। মামারা আমার মা মিথলেশ দেবীর সঙ্গে গল্প করতে মশগুল। এই মামাকে দেখেই মনের কোণে সন্দেহ দেখা দিলে, “আবার কোনও নতুন ফন্দি নিয়ে মামা, মামি ও ভাই এসেছে। এর আগেও যখনই মামার বাড়িতে পা রেখেছে, তখনই আমাদের কোনও ক্ষতি হয়েছে।  এই কারণেই আমি মামার বাড়ির কাউকে এক চোখেও দেখতে চাই না।”

আমাকে নিজের ঘরে ঢুকতেই মামা নির্মল বলে উঠলেন, “আমার সবথেকে প্রিয় ভাগ্না সন্তোষ। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করছে। শুনেছি ভাগ্না নাকি এখন ভূত-প্রেত, জ্যোতিষ, ওঝা- তান্ত্রিক, বাবাজীদেরকে জব্দ করে।”

মামার মুখে এমন কথা শুনে একটু আবাক হলাম। আমি ওঝা- তান্ত্রিককে জব্দ করি, এই কথা কি করে জানল? ওহ ! আমার ফেরার আসেই মায়ের সঙ্গে গল্পের ছলে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছে। একবার কি মামা কোনও ওঝা বা তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়েছে? এবং উদ্ধারের জন্য আমার কাছে ঘ্যান-ঘ্যান করবে?”

মামি মুখ ভার করে বললেন, “তোমার ভাই রাজীব খুব বোকা। এক তান্ত্রিকের চক্করে পড়ে বাড়িতে জমানো ২৫ হাজার টাকা খুইয়ে এসেছে। তুমি দেখো না, ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকাগুলি উদ্ধার করে দিয়ে পারো কি না।”

শুনেই আমার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। রেগে গিয়ে মামিকে মুখের উপর বলে ফেললাম, “রাজীব যখন অমুক তান্ত্রিককে কি কারণে অতো টাকা দিয়ে গিয়েছিল তা আমি জানি না। তান্ত্রিককে টাকা দেওয়ার আগে কি ভাই আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কি? এখন কেন আমাকে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য বলছ।

আমার হাত ধের মাম বললেন, “অমন করে রাগ করো না।  তুমি আমাদের সব থেকে প্রিয় ভাগ্না। বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। দেখো কিছু করতে পারো কি না?”

“আমি এই সবের মধ্যে নেই। যদি টাকা উদ্ধার করতে চাও তাহলে তোমার ঐ তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করো।”আমি বললাম।

মামি বললেন, “আমার মুখ্য-সুখ্য মানুষ। এক অক্ষর লেখাপড়া করিনি। পুলিশের নাম শুনলেই ভয় করে। থানায় অভিযোগ করতে জানলে কি শিক্ষিত ভাগ্নের কাছে ছুটে আসতাম?”


বললাম, “যাই বল।  ভাই যে বকামি করেছে, তার ভাগিদার আমি কেন হব?”

ভাই রাজীব বললেন, “সন্তোষ দা, আমি বুঝতে পারিনি। ভুল করেছি। এবার তো সাহায্য করবে না?”

ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক আছে। বল কি হয়েছিল? কেন তুই তান্ত্রিককে এতো টাকা দিতে গেলি?”

রাজীব জানল, “আমি কোটিপতি হওয়ার জন্য অনেক টাকার লাটারির টিকিট কেটেছি। কিন্তু  লাটারিতে এক টাকাও জিততে পারিনি। এক দিন বাহাদুর নামে একজন লোকের সঙ্গে বান্ধুত হল। সে  তোমার বাবার সঙ্গে ঘুরে-বেড়ায়। তাঁর বয়স প্রায় ৩৫ –এর কাছাকাছি।”

আমি লটারি কেটে কোটিপতি হতে চাই। এই কথা জানারা পর বাহাদুর বললে, “ধুর বোকা। ঐ ভেবে টিকিট কাটলে কেউ কোটিপতি হয় না। আমি এমন একজন তান্ত্রিক বাবাজীকে জানি তিনি তোর কপাল পাল্টে দিতে পারনে। তাঁর কাছে যেই গেছে,ল লাভবান হয়েছে। তুইও চল। ফল হাতেনাতে পাবি।”

বাহাদুরের কথা বিশ্বাস করে ওঁর হাত ধরে এক তান্ত্রিকের বাবাজীর কাছে গেছিলাম। আমার কথা শুনে বাবাজী বলল, “লটারির টিকিট কেটে কোটিপতি হওয়া মুখের কথা নয়। এটা কপালের ব্যাপার।  তোর কপালেই কোটিপতি লেখা আছে। কিন্তু পাথে বিশাল বাঁধা। সেটাকে পার করতে পাড়লেই কেল্লাফতে। তুই কি লাখপতি-কোটিপতি হতে চাস? “

মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, বাবাজী। আমি অনেক টাকা চাই।”

“তুই যদি লটারি কেটে কোটিপতি হতে চাস তাহলে তোর নামে একটা যজ্ঞ করে করতে হবে। যজ্ঞে একটি লটারির নাম্বার উঠবে। সেই নাম্বারেই কোটি টাকা উঠে আসবে।”

বোকার মত জিগ্যেস করলাম, “মানে যজ্ঞ করে নাম্বার উঠবে এবং তাতেই কোটিপতি হয়ে যাবো?”

“হ্যাঁ রে টাকার লোভী। হাত বাড়ালেই কি টাকা পাওয়া নারে বোকা। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়।”বাবাজী বললেন।

বাবাদুর বোঝাল, “দেখ রাজীব। তুই এতদিন লাটারির টিকিট কেটে কেটে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করেছি। বাবাজী যখন বলছেন, তাহলে আর একটু টাকা খরচা করতে আসুবিধে তো নেই। তাই বলছি, বাবাজীর যা বলছেন মন দিয়ে শোন। যখন কোটি টাকা পাবি তখন এই বাহাদুর কাকার কথা মনে পড়বে না।”

তান্ত্রিকের কথা শুনে দিনের বেলায় চোখের সামনে টাকার বান্ডিল দেখতে লাগলাম। ভাবছি সত্যি যদি লাটারির টিকিট কেটে কোটি টাকা জিততে পারি তাহলে একটা চার চাকার গাড়ি কিনবো।

তান্ত্রিক বললেন, “কিরে খোকা কি ভাবতে শুরু করেছিস। তোর সব স্বপ্ন পূর্ণ হবে রে।”

“বাবাজী বলুন, আমাকে কি করতে হবে?”আমি জিগ্যেস করলাম।

তান্ত্রিক বললেন, “একটি যজ্ঞ করতে হবে। এর জন্য ২৫ হাজার টাকা লাগবে। পারবি কি এতো টাকা দিতে?”

মাথা চুলকিয়ে বললাম, “বাবাজী এতো টাকা এখন কোথা থেকে পাবো?”

“দেখ এটা তোর ব্যাপার। তুই যদি পারিস তাহলেই যজ্ঞ করা সম্ভব। তুই যখন আমার চ্যালা বাহাদুরের সঙ্গে এসেছিস। তাই তোকে একসঙ্গে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে না। তুই এখন শুধু যজ্ঞের সামগ্রি এবং আগিম ৫ হাজার টাকা দে। তার পার বাকি কাজের জন্য টাকা দিবি। এবার বল?”বাবাজী বললেন।

“ভালো উপায় কথা বলেছেন বাবাজী। দেখ রাজীব আমার জন্য তোকে অনেক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভেবে দেখ এখন কি করবি? বাহাদুর বললেন।

বাহাদুরের উপর বিশ্বাস করে আমি তান্ত্রিককে যজ্ঞের সামগ্রী এবং অগ্রিম ৫ হাজার টাকা দিলাম।

এক অমবস্যার রাতে বাহাদুরে সঙ্গে ঐ তান্ত্রিকের আশ্রমে গেলাম। তান্ত্রিক যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ বেদী থেকে ছাইভস্ম তুলে আমার কপালে ঘষে দিলেন। এবং তান্ত্রিক বললেন, “আসছে পূর্ণিমাতে তুই লটারির এক বান্ডিল টিকিট কিনবি। তার মধ্যেই একটি টিকিটে কোটি টাকার পুরষ্কার উঠবে।”

তান্ত্রিকের কথামত আমি পাড়ার ফুটপাতের দোকান থেকে কয়েকশো টাকার লটারির টিকিট কিনে আনলাম। আনন্দে দিশেহারা। উফ আর কিছু দিন। লটারি খেলার ফল বেরোলেই কোটি টাকা পাবো।


দুদিন পর।

আমার সব টাকা মাটি হয়ে গেল। লটারি খেলার ফল প্রাকশিত হল। কিন্তু আমি এক টাকাও পেলাম না। সব টিকিট বেকার হয়ে গেল। আমি নিরশ হয়ে বাহাদুর কাকার কাছে ছুটে গেলাম। সব কথা বলে কাকা বলল, “চল তান্ত্রিকের কাছে।”

সব শুনে তান্ত্রিক বললেন, “আমার যজ্ঞ বিফলে যায় না। মনে হচ্ছে তুই আমার কথা মতো কাজ করিস নি। তুমি অবশ্যই কোনও ভুল করেছিস। আরে খোকা এটা তো প্রথম ধাপ। একবারেই কি ফল পাওয়া যায়রে।”

বললাম, “আপনার কথা মত সব টিকিট কেটেছি।”

“পূর্ণিমার সকালে লটারির টিকিট কাটতে যাওয়ার আগে কি তুই স্নান করে, মন্দিরে পূজা দিয়েছিলিস?”বাবাজী জিগ্যেস করেন।

মাথা নেড়ে বললাম, “না বাবাজী।”

“লটারির টিকিট কাটার সময় তুই অসুদ্ধ ছিলিশ। তাহলে তুই বল। আমরা যজ্ঞ কি করে ফল দেবে?”বাবাজী বললেন।

আমি জিজ্ঞেস কারলাম, “তাহলে কি আমার টাকা জলে গেলো?”

“না না। তোমার ছোট্ট ভুলের জন্য লটারির টিকিট কিনে টাকা হল। কিন্তু একটা উপায় আছে।”তান্ত্রিক বললেন।

“কি উপায় বাবাজী? আমি জিগ্যেস করলাম

তান্ত্রিক বললেন, “নতুন করে যজ্ঞ করতে হবে।”

“এর জন্য কি আবার টাকা দিতে হবে?”আমি জিগ্যেস করলাম।

“হ্যাঁ, না দিয়ে যজ্ঞ কি করে করবো। বিনা পয়সায় কিছু হয় না খোকা। এবার যজ্ঞ করার পর তুমাকে কোটিপতি হওয়ার থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু এবার পুরো ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। যদি ফল না পাও তাহলে টাকা ফেরত করে দেবো।”তান্ত্রিক বললেন।

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতো টাকা একসাথে কোথা থেকে পাবো।

বাবাজী জিগ্যেস করলেন, “এতো কিসের চিন্তা করছিস। তুই যখন লটারিতে কোটি টাকা পাবি, তখন সব চিন্তা ছুমন্তর হয়ে যাবে।”

বাবাজীর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তো কথায় নেই। এই ভেবে বললাম, “ঠিক আছে বাবাজী। আমি টাকা দিতে রাজি আছি।”

“বাহ। খোকা একটু সাবধান। টাকা আনর্থের কারণ। তাই আবার ভালো করে চিন্তা করে বলো। যজ্ঞের জন্য এতো টাকা দিতে পারবে তো?”তান্ত্রিক বললেন।

আমি জিগ্যেস , “বলুন যজ্ঞের জন্য কবে টাকা দিয়ে হবে?”

“যেদিন দিবি, সেদিনই যজ্ঞ হবে।”তান্ত্রিক হেঁসে বললেন।

এক সপ্তাহের পর ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাহাদুর কাকার সঙ্গে আবার ঐ তান্ত্রিক বাবাজীর আশ্রমে গেলাম। লটারির টিকিটে কোটি টাকা পাবো, এর জন্য তান্ত্রিক অনেক ক্ষণ ধরে যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ বেদী থেকে এক মুঠো ছাই নিয়ে আমার কপালে ঘষে দিয়ে তান্ত্রিক বললেন, “মন দিয়ে শোন। আসছে অমাবস্যার দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে চান করে। বাড়ির কাছে মন্দিরে পূজা দিবি। মায়ের কাছে মানত করবি, লটারিতে কোটি টাকা পেলে দু’জোড়া পাঠা বলি দেবো। আমি আগেও বলেছি, আমার যজ্ঞ বিফল যায় না। খেয়াল থাকে, এবার জেন কোনও ভুল না হয়। যা এবার। জয় মা কালী।”

তান্ত্রিকের কথা শুনে মনে হল এবার আমার নামে লটারি ফাসবেই। তাই তান্ত্রিকের কথা মত অমাবস্যার দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে চান করি। শ্যামনগর কালী মন্দিরে মায়ের  পূজা করি। সেখান থেকে বেড়িয়ে আবার সেই ফুটপাতের ঝুপড়ি মার্কা দোকান থেকে এবার বেশি সংখ্যক লটারির টিকিট কিনলাম। টিকিটের বান্ডিলগুলি মাথায় ঠেকিয়ে মা কালীর উদ্দ্যেশে মনে-মনে বললাম, “দে মা আমাকে কোটিপতি করে দে। আমার আমি তোর পুজাতে দু’জোড়া পাঠা দেবো।”


চারদিন পর।

কাগজে লটারির ফল প্রকাশ হল। কিন্তু একি ! আমার কাটা লটারির একটিও নাম্বারে এক টাকাও পেলাম না। এই দেখে আমি মনমরা হয়ে গেলাম। কোটিপতি হওয়ার জন্য ঐ তান্ত্রিকের পেছনে ২৫ হাজার থেকেও বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছি। তবুও এক টাকাও পেলাম না। তান্ত্রিক বলেছিল, “যদি ফল না পাও তাহলে টাকা ফেরত করে দেবো।”এই কথা মনে পড়তেই ছুটে গেলাম বাহাদুর কাকার বাড়িতে। কাকাকে বললাম, “তান্ত্রিকের কথা বিফলে গেছে। আমার টাকা ফেরত চাই।”

“টাকা? কিসের টাকা?”অবাক হয়ে বাহাদুর বললেন। 

“ঐ যে তান্ত্রিক যা কাছে তুমি আমাকে নিয়ে গেছিলে। আমার থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে  লটারির জন্য যজ্ঞ করেছিল। কিন্তু লটারিতে এক টাকাও পেলাম না। সব টাকা জলে গেল। কোনও  লাভ হয়নি। এখন আমার টাকা ফেরত চাই।”বললাম।

বাহাদুর বলল, “তুই কি আমাকে টাকা দিয়েছিলিস। যাকে টাকা দিয়েছেস তার কাছে যা।”

“তুমিও তো আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেছিলে। তোমার কথা শুনেই আমি ঐ তান্ত্রিককে টাকা দিয়েছি। এবার ঐ তান্ত্রিকের কাছে থেকে আমার টাকা আদায় করে দাও তুমি।”

বাহাদুর বললেন, “তুই লটারিরে কোটি টাকা পাবি বলে তান্ত্রিককে যজ্ঞের জন্য টাকা দিয়েছিল। তুই তান্ত্রিককে যে টাকা দিয়েছিলি  সেই টাকা যজ্ঞে স্বাহ হয়ে গেছে। তাই ঐ টাকা ফেরত হয় না।”

“তান্ত্রিক বলেছিল, যদি ফল না পাই তাহলে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে চল। আমি টাকা আদায় করে নেবো।”আমি বললাম।

এই শুনেই বাহাদুর ধমকের সুরে বললেন, “টাকা ফেরত পাওয়া এতো সোজা নয়। যজ্ঞে টাকা খরচ হয়ে গেলে। দেখ। সকাল সকাল ভ্যাট বকিস না। ভাগ এখান থেকে। আমার অনেক কাজ আছে।”

“এরপর আমি নিজে ঐ তান্ত্রিকের আশ্রম স্থলে ছুটে গেলাম। কিন্তু ওখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। বুঝতে পারলাম। লটারিরে কোটি টাকা পাওয়ার লোভে পড়ে ঐ বাহাদুরের কথায় বিশ্বাস করে এক তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছি। শেষ পর্যন্ত যুক্তিবাদী কাজ কর্মের কথা শুনে তোমার কাছে ছুটে এসেছি সন্তোষ দা। তুমিই বল একবার আমি কি করবো?”এই বলে রাজীব কেঁদে উঠল।


আমি বললাম, “তোদের মত লোভী মানুষই তান্ত্রিকের মতো প্রতারকের মেন  টার্গেট। এই সুযোগ নিয়ে তান্ত্রিকেরা বাহাদুরের মত চ্যালা পুষে রাখে। এই চ্যালারাই বলির পাঠা নিয়ে গিয়ে তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে যায়। এবং নিজের মত করে জবাই করে।”

“এই বাহাদুর কাকাকে ধরে টাকা আদায় করা যায় না?”ভাই বলল।

আমি বললাম, “ঐ তান্ত্রিকের কাছে যদি কোনও ধরণের অলৌকিক ক্ষমতা থাকত তাহলে সে নিজেই যজ্ঞ করে লাটার টিকিট কেটে কেন কোটিপতি হতে পারছে না? আসলে এই প্রতারক তান্ত্রিকরা ভালো করেই জানে অলৌকিক ক্ষমাটা বলে কিছু হয় না। যাজ্ঞ যজ্ঞ ইত্যাদি লোক ঠকানো ফন্দি মাত্র। আর এই বাহাদুরও একটা চিটিংবাজ। এক চক্করে তুই কি করে পড়লি?”

“বাহাদুর কাকা আমার পিসের সঙ্গে বাড়িতে প্রায় দিন আসত। সেই সূত্রে ওনার সঙ্গে পরিচয়।”রাজীব বলল।

আমি বললাম, “ঠিক আছে। দেখছি তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায় কি না। কিন্তু তার জন্য বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলি।”


কয়েক দিন পর।

বাবার সঙ্গে বাহাদুর আমার বাড়িতে এলো। সামনে পেয়ে তাঁকে বললেন, “আমার একটি সমস্যা আছে। ভাবছি কোনও তান্ত্রিকের কাছে যাবো। তোমার সঙ্গে কোনও তান্ত্রিকের যোগাযোগ আছে কি?”

আমার কথা শুনেই ভূত দেখার মত করে বলল, “তুমি তো যুক্তিবাদী। এই সব তান্ত্রিক – ওঝাতে বিশ্বাস করো না। তাহলে আবার তান্ত্রিকের কি দারকার?”

“তুমি তো রাজীবকে এক তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেছিলে না? তার কাছে আমাকেও নিয়ে চলো।”আমি বললাম।

আমার কথা শুনেই বাহাদূরের বুঝতে অসুবিধা হল না রাজীবের সব কথা আমি জেনে ফেলছি। এবং এবার সে বড় সামস্যায় পড়তে চলেছে। বড়বড় চোখ করে বাহাদুর বলল, “ও এবার বুঝেছি কেন তুমি তান্ত্রিকের কাছে যেতে চাইছ।”

বললাম, “রাজীব লটারির টিকিট কিনে কোটিপতি হতে চায়। এই লোভে পড়ে সে তোমার চক্করে পড়ে এক তান্ত্রিকের কাছে গাঁটের ২৫ হাজার টাকা গেঁড়িয়ে এসেছে। কিন্তু ঐ তান্ত্রিক বলেছে, কাজ না হলে টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়ে হবে। তাই বলছি আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে চলো। আমি টাকা আদায় করে নেবো।”

“তুমি কি বলতে চাইছো, রাজীবের টাকা আমি নিয়েছি?”বাহাদুর বলল।

আমি বললাম, “তুমি যদি রাজীবকে বুঝিয়ে বলতে লটারির টিকিট কাটিস না। তুমি যদি ভাইবে ঐ তান্ত্রিকের কাছে না নিয়ে যেতে তাহলে ও এভাবে এতো টাকা তান্ত্রিক, যজ্ঞের পেছেন খরচ করত না। সোজা কথায় তুমি ঐ তান্ত্রিকের চ্যালে হিসবে কাজ করে ভাইকে ঠকিয়েছ। তাই বলছি, হয় ভালো মানুষের মত ভাইয়ের টাকাগুলি ফেরত দিয়ে দাও। নাহলে তান্ত্রিক এবং তোমার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবো।”

“দেখছি কি করা যায়।”এই বলে বাহাদুর বাড়ি বেড়িয়ে গেলো।

রাতে পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই দেখি  মা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই মা বললেন, “তুই ভালো আছিস তো। তোর কিছু হয়নি তো?”

“আমি ভালো আছি। হটাৎ এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?”আমি বললাম।

বড় বোন বাসন্তি বললেন, “সাকালে বাহাদুর দা কে তুমি বলেছিলে যদি তান্ত্রিক টাকা ফেরত না দাও তাহলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবে। বিকেলে রাগে গজগজ করতে করতে বাহাদুর দা বাড়ির এসেছিল। তোমার নাম করে আমাকের হুমকি দিয়ে গেছে। বলেছে, তুমি যদি ওঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ করো তাহলে তোমাকে এই জগৎ থেকে গায়েব করে দেবে।”

মা বললেন, “বাহদুর এও বলেছে, তাঁর এক ভাগ্নে এখন জেলে বন্ধ আছে। ও একটি খুন করার অভিযোগে জেলে বন্ধ আছে। কিছুদিন পর ভাগ্নে জেল থেকে ছাড়া পাবে। তখন ভাগ্নে কে বলে তোকে  খুন করে দেবে। তুই রাতে যখন অফিস থেকে ট্রেনে করে ব্যারকপুর স্টেশনে নামবি। তখনই তোকে গুলি করে মেরে ফেলবে।”

বাহ বাহ। এখন বুঝতে পারছি ও বাবার হাত আমার ও মামার বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। ভাইয়ের টাকা লুট করছে। এখন টাকা চাইতেই সে নিজের আসল রং দেখাছে। পুলিশের নাম শুনেই বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছে। দাড়াও বাহাদুর তোমার সব বাহাদুরির শায়েস্তা করছি।

মাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “এবার বুঝতে পাড়লে তো মেজো মামা বাড়িতে এসে আমাদের সামস্যার মধ্যে ফেলে গেলো। এই জন্যই আমি এনাদের এড়িয়ে চলি। চিন্তার কোনও কারণ নেই। বাহাদুর আমার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। ও আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এবার ওঁকে শায়েস্তা করতেই হবে।”

পরের দিন দুপুরে অফিস যাওয়ার আগে বাহাদুরের বাড়িতে হাজরি হলাম। আমাকে দেখেই বাহাদুর চমকে উঠল। বললাম, “কাল বিকেলে তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে কি বলে এসেছ? তুমি আমাকে খুন করবে? আমি মারা গেলে তোমার কপালে ভোগান্তি আছে বুঝলে। বাড়িতে গিয়ে খুনের হুমকি দেওয়ার আগে ভেবেছ কি তুমি ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। তুমি আমার মাকে আমাকে খুন করার জন্য যে হুমিক দিয়ে এসেছ তাঁর জন্য তোমার বিরুদ্ধে এক্ষণই থানায় অভিযোগ করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার করিয়ে দেবো।”

কথার মাঝেই বাহাদুরের বউ আমরা হাতজোড় করে বললেন, “সন্তোষ এঁকে ক্ষমা করে দাও। এ কোনও কাজ করে না। আমার স্বামী জেলে গেলে আমরা বাচ্চা দুটির কি হবে।”

বললাম, “তোমার স্বামী রাজীবের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, সেটা ফিরিয়ে দিতে বল। না হলে সত্যিই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবো।”

“আমি তোমাকে সহজ সরল ছেলে ভাবতাম। কিন্তু তুমি যে এতো চালাক চতুর বুঝতে পারিনি। তোমাকে চিনতে ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। চেষ্টা করে দেখছি ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া যায় কি না।”বাহাদুর বলল।

এক মাস পর।

রাজীব এসে বললে, “সন্তোষ দা তোমার জন্য ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা ফেরত পেয়েছি।”

আমি বললাম, “এবার থেকে আর কোনও ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বাবাজী, মাতাজী-এর মতন বুজরুকদের চক্করে পরিস না। কারণ, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতারক।”

ভর। মানসিক রোগ, নাকি ভড়ং? -অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:485 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৩ জুন ২০০২, স্থান : বীরভূম জেলার নলহাটি। একজন চল্লিশোর্ধ মহিলা আচমকাই উন্মত্তের মতন আচরণ করেছিলেন। হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই ছুঁড়ে দিচ্ছেন। উপস্থিত জনতার সামনে কখনও নাকিসুরে কাঁদছিলেন তো কখনওবা পুরুষ কন্ঠের ন্যায় আবোলতাবোল বকেছিলেন। বিশ্বাসীদের দাবী এই মহিলাকে ভূতে বা জ্বীনে পেয়েছে বা ধরেছে।  অপরপক্ষের দাবী ইনি  মানসিক রোগী নয়তো শুধুই অভিনয় করছেন অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। শোনা গেছে এর পরে একজন ওঝা এসে নিজের কেরামতি দেখানোর পরেও সমস্যা না মেটায় মহিলার দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয় ওনাকে কলকাতার পাভলব মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান এবং ওখানেই উনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। 

এই ধরনের ঘটনা, হয়তো অনেকেই দেখেছেন নিজের জীবনে। দেখেছেন এর চেয়েও বেশি কিছু। যেমন ধরুন, কোনো ভূতে(!) ধরা কিংবা ভূতের ভরে পরা মহিলার উন্মত্ত আচরণ,জ্বলন্ত কয়লাকে হাতে তুলে নেওয়া, জলভর্তি কলসি দাঁতে তুলে লাফ দেওয়া ইত্যাদি বেশ কিছু। যেহেতু সেইসব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা দেখে আপনার মনে হয়েছে এর ব্যাখ্যা আপনার কাছে নেই তাই নিশ্চই এটা অলৌকিক কিংবা ভূতুড়ে ব্যাপার স্যাপার। অথচ প্রতিটি ঘটনার পেছনেই থাকে একটা কার্যকারন সম্পর্ক। কারন। এই পৃথিবীতে "অলৌকিক “নামক কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। সমস্ত তথাকথিত অলৌকিক, অদ্ভুতুড়ে ঘটনার পেছনে রয়েছে একটা “লৌকিক “বা বিজ্ঞানসম্মত কারণ। এই লৌকিক কারণ টাই অনেকের জানা না থাকায় বিষয় গুলো ভৌতিক, অলৌকিক ইত্যাদি ঠেকে। তাছাড়া এটাও সত্যি, অনেকেই অলৌকিক কিছুতে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী, সেই কারণে তাঁরা সবতেই দেবত্ব,অলৌকিক, ভৌতিক ইত্যাদির ধরে নেন। 

মনোবিজ্ঞান মতে এইসব ভূতের (!) ভরে পরা মহিলারা একপ্রকার মানসিক রোগ (Neurotic Disorder) এ আক্রান্ত। মনোবিজ্ঞান এমন ঘটনাকে প্রধানত তিনটে ভাগে ভাগ করেছে। যেমন - 

(১) Hysteria (হিস্টিরিয়া)। এরও আবার দুটিভাগ আছে। Dissociative Hysteria এবং Convertion Hysteria.

(২) Maniac Depressive (ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ)।

(৩) Schizophrenia (সিজোফ্রেনিয়া বা স্কিটসোফ্রেনিয়া)।

 হিস্টিরিয়া  কথাটির উৎপত্তি গ্রীকশব্দ 'Hysteron  থেকে, যার অর্থ জরায়ু। প্রাচীনকালে গ্রীসদেশের মানুষের ধারণা ছিলো জরায়ু খেপে গেলে হিস্টিরিয়া হয়। অথচ এই ধারনাটাই মিথ্যে। যেহেতু মহিলারাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন, তাই মনে করা হত যে জরায়ুর গোলমালের কারণেই এই রোগের সৃষ্টি। পরে প্রমাণিত হয়েছে, পুরুষেরাও এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। 

সাধারণত দুর্বল মস্তিষ্কের ব্যাক্তিরা অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা কম, অল্পেতেই ভেঙ্গে পড়েন, আবেগপ্রবণ, অন্ধবিশ্বাসী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষার সূযোগ সেভাবে না পাওয়া ব্যাক্তিরাই ভূতের (!) ভরে আক্রান্ত হন।

জল ভরা কলসি দাঁতে করে তোলা, লজ্জা ভুলে প্রচণ্ড লাফ দেওয়া কিংবা কোনও গাছের শক্ত ডাল ভেঙ্গে ফেলা হিস্টিরিয়া রোগীর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণভাবে এই ধরনের মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সহনশীলতা কম তারা একনাগাড়ে একই কথা শুনলে মস্তিষ্কের কিছু কোষ বারবার উত্তেজিত হয়ে থাকে। ফলে এর পরে অনেক সময় উত্তেজিত কোষগুলি অকেজো হয়ে পড়ে অন্য কোষের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্কের কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটে। এই রোগে আক্রান্তরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন তাঁদেরকে কোনো ভূতে বা জ্বীনে ধরেছে কিংবা ভর করেছে। আপাতদৃষ্টি তে এইধরনের অদ্ভুত আচরণ যতই অস্বাভাবিক লাগুক না কেন, আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কিছুসময়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে শরীরের চুড়ান্ত সহ্য শক্তিকে ব্যাবহার করেন, যেটা স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের পক্ষে অসাধ্য বা অসম্ভব। আসলে হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ, স্কিটসোফ্রেনিয়া ইত্যাদি রোগীদের রোগ সম্বন্ধে আমজনতার ভালো ভাবে জানা না থাকায় রোগীদের কাজকর্ম এবং নানান আচরণ আমজনতার কাছে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা হিসেবেই গ্রহণযোগ্যতা পায়।

গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬০- ৩৭৭) ই প্রথম বলেন, মানসিক রোগ আর পাঁচটা রোগের মতই একটা রোগ। এর সঙ্গে ভূত বা অশুভ শক্তির কোনও সম্পর্ক নেই। মস্তিষ্কের বিকারের ফলেই নানান মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়। প্রাচীনকালে এইধরনের ভরে পরা মানুষের সাথে চরম অমানবিক অত্যাচার করা হত। যার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ১৪৮৬ সালে খ্রীষ্টান ধর্মের পোপের নির্দেশ মত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “The Witche's Hammer "..গ্রন্থটিতে মানসিক রোগীদের 'ডাইনি ' ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই আজও কোনো মহিলাকে ডাইনি বা ডায়েন চিহ্নিত করে অত্যাচারের ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো উচিৎ হবে বলে মনে করি।

রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ তে পাঁচ মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী (তথ্যসূত্র : ABP, 23rd August 2015)। 

সেই পাঁচ জন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি “ডাইনি"। এখানে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ করেনা, একদম গভীর বিশ্বাস করে। 

২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলকে ডাইনি ঘোষণা করে হত্যা করার পরে গ্রামের ওঝার নিদান মত সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়। পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। 

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে।

ফিরি "ভর”নিয়ে। শুধুমাত্র কাল্পনিক অপদেবতা, ভূতপ্রেত, জ্বীন, আত্মা ইত্যাদিরই ভর নয়, কাল্পনিক ঈশ্বরের ভরের ঘটনাও প্রায়শই শোনা যায়। মূলত, কালী, দুর্গা, মহাদেব, শীতলা, ওলাবিবি, পাঁচুবাবা, পীর, বনবিবি, সন্তোষী, মনসা, সাঁঝলি মাঈ ইত্যদিদেরই ভরের ঘটনা শোনা যায়। এর ব্যাখ্যাও একই। কখনও মানসিক রোগ আবার কখনওবা শুধুই অভিনয়, ভর এদের কাছে ভড়ং, শুধু কিছু কামানোর চেষ্টায়। 

যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীরা এমন কয়েকশো ভরের ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করে দেখে স্পষ্ট বুঝেছেন শতকরা ৯০% ক্ষেত্রে এই ভর শুধুই ভড়ং। বাকিদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন  মানসিক রোগ থেকেই এই ভরের সৃষ্টি। মনোরোগ চিকিৎসক দের দাবী আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়, যেমন - চোখ, কান,নাক,জিভ, ত্বক ইত্যাদি আমাদের অনেক সময় প্রতারিত করে। মনে করুন মরুভূমির কথা, প্রখর রোদে উত্তপ্ত বালি কে দেখে অনেকেই জল ভেবে ছুটে যান, যাকে আমরা মরিচিকা বলি। আবার নাম সংকীর্তন  আসরে অনেকেই ভাবাবেগে ডুবে গিয়ে চেতনা হারিয়ে অদ্ভুত আচরণ করে বসেন। কেউ আবার অলীক কিছু দেখার, শোনার দাবী করেন। এর কারণ হচ্ছে- 

(১)  Illusion (ভ্রান্ত অনুভূতি), এরও পাঁচটি ভাগ আছে যেমন, Optical Illusion/Visual Illusion (দর্শানুভূতির ভ্রম), (খ) Auditory Illusion (শ্রবণাভূতির ভ্রম), Talctile Illusion(স্পর্শানুভূতির ভ্রম), Olfactory Illusion (ঘ্রাণানুভূতির ভ্রম) এবং Taste Illusion (জিহ্বানুভূতির ভ্রম)।

(২) Hallucination(অলীক বিশ্বাস) (৩) Paranoia (বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি) (৪) Delusion (মোহ / অন্ধ ভ্রান্ত ধারণা)।

একুশ শতকে বিজ্ঞানের গতি দুর্বার। এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের সমাধান বিজ্ঞান করে ফেলেছে। আগামীদিনে আরও অনেক রহস্যভেদ হবে। তবে এটাও সত্যি বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কের অনেক অদ্ভুত কার্যকলাপের রহস্যভেদ করে উঠতে সেভাবে পারেনি। তবে নিরন্তর গবেষণা চলছে পৃথিবীজুড়ে। আগামীদিনে সেই সব রহস্যেরও সমাধান হয়ে যাবে দ্রুত। 

এতটা লেখার মাধ্যমে আশাকরি এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, যাকে আমজনতা ভূতে বা জ্বীনে কিংবা ঈশ্বরের ভর বলে মনে করেন সেটা আসলেই একপ্রকার মনের বিকার কিংবা মানসিক রোগের ই কারণ। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকজন প্রতারক ভরের ভড়ংবাজী করেন টু পাইস রোজগারের ধান্দায়। 

ভর নিয়ে কিছু লিখতে গেলে দুটো প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক। যেমন, ভরে পরা অনেকেই আশীর্বাদী ফুল, জলপড়া, তেলপড়া দেন, তাতে সুস্থও হয়ে ওঠেন অনেকে। ভর যদি মানসিক রোগ কিংবা প্রতারণাই হবে তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব?

 এর উত্তরটা খুবই সোজা। এর জন্য সবার আগে জানতে হবে ' প্ল্যাসিবো ' কাকে বলে। প্ল্যাসিবো তে শুধু সেই সব রোগই সেরে উঠবে যা মানসিক কারণে সৃষ্টি (Psyscho Somatic Disorder)। নয়তো কোনো ভরে পড়া ব্যাক্তির ক্ষমতা নেই  ক্যান্সার টু এইডস রোগী কে সুস্থ করে তোলে। আসুন জেনে নিই' প্ল্যাসিবো ' আসলে কি বা কাকে বলে। 

আসলে, মানবদেহে যত প্রকার রোগ ব্যাধি হয়, তার একটা বড় অংশই কিন্তু মানসিক কারণে সৃষ্ট। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলে এটাই সত্যি। বুক ধড়ফড়, উচ্চ বা নিম্ন ব্লাডপ্রেশার, উচ্চ বা নিম্ন ব্লাডসুগার, হাঁপানি, মাথার যন্ত্রনা, শরীরের নানান স্থানে ব্যাথা, পুরুষত্বহীনতা, কামশীতলতা, পেটের গোলমাল, ক্লান্তি, অবসাদ, পেটে আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, কাশি, মহিলাদের ঋতুস্রাব-জনিত সমস্যা, বাত, শরীরের কোনো অংশের অবশতা ইত্যাদি অসুখ শারীরিক কারণ ছাড়াও মানসিক কারণেও হয়। অর্থাৎ, মানসিক প্রতিক্রিয়া বা মনের অত্যাল্প অসুস্থতা বা সাময়িক বিকৃতি মন ছেড়ে শরীরের আশ্রয় নেয় রোগীর অজান্তে। যদিও এভাবে মানসিক রোগ হওয়া বা বৃদ্ধি হওয়া আটকে যায়; এটাকে মনের "স্কেপগোট”বলে। কিন্তু শারীরিক অসুবিধা উপলব্ধ হয়; অথচ শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না মেডিকেল পরীক্ষায়। এসব রোগকেই "দেহ-মন-জনিত বিশৃঙ্খলা”বা "Psycho-Somatic Disorder”বলে। জলপড়া, তেলপড়া, চরণামৃত, স্পর্শ চিকিৎসা, ঔষধ-গুণহীন ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট অথবা ইঞ্জেকশন ইত্যাদির প্রয়োগ করে অনেক সময় এই Psycho-Somatic Disorder-এর রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতিকে বলে 'প্ল্যাসিবো' (Placebo)। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় 'আমি খুশি করবো কিংবা আমি সেরে উঠবো'। ইংরাজিতে একে বলা চলে ' I Will Please '। এখানে রোগীর বিশ্বাসবোধ-এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

কোনো Psycho Somatic Disorder-এর রোগী যদি জলপড়া, তেলপড়া, ঝাঁড়ফুক, স্পর্শ চিকিৎসা বা রেইকি, চরণামৃত, হোমিওপ্যাথি  ইত্যাদিতে গভীরভাবে আস্থা রাখে, তাহলে জলপড়া ইত্যাদি যা আগেই লিখেছি তাতে সুস্থ হতে পারবে অবশ্যই। এই সুস্থ হয়ে ওঠার পেছনে উক্ত জিনিসগুলোর কোনো ভূমিকাই নেই। একেবারেই শূন্য। এখানে রোগীর গভীর বিশ্বাসই একমাত্র Factor  বা গুণ। 

ইতিমধ্যে লেখাটা বেশ লম্বাচওড়া হয়েছে। পাঠক বন্ধুদের ধৈর্য্যচ্যুতি হতে পারে, তাই আপাতত এখানেই ইতি টানতে বাধ্য হলাম। মনোরোগ চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীদের মতে ভূতে ভর কিংবা ঈশ্বরের ভর ঠিক কি এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হলে অবশ্যই পড়ুন-

১- Modern Synopsis of Comprehensive Text Book of Psychiatrist, by-  Harold I.kaplon & Benjamin Sadock,3rd edition, Williams & Williams - London.

 ২- দেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত, প্রবীর ঘোষ এর লেখা অলৌকিক নয়, লৌকিক ২ য় খন্ড, মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ মেডিটেশন এবং আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা।

৩- অলৌকিক চিকিৎসায় কি রোগ সারে? রাজেশ দত্ত, র‍্যাডিক্যাল। 

৪)মনের বিকার ও প্রতিকার- ড: ধীরেন্দ্র নাথ  নন্দী - আনন্দ পাবলিশার্স।

পরিশেষে এই লেখকের বিনীত অনুরোধ, কোনো অন্ধবিশ্বাসে বশ হওয়া নয়। নিজের যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগ করুন, যেটা সত্য সেটাকেই গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন মানসিক রোগী মানেই কিন্তু সেই ব্যাক্তি উন্মাদ কিংবা পাগল নয়। সঠিক সময়ে সু-চিকিৎসা পেলে তাঁরা অবশ্যই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।আপনার আশেপাশে এমন কোনো ভারগ্রস্ত ব্যাক্তি কে দেখলে ভক্তি ছেড়ে যুক্তিতে মন দিন। ওঝা,গুনিন ইত্যদিদের বাড়ি যাবেন না, তথাকথিত ভূত বিশেষজ্ঞদেরও ডাকবেন না। রোগ লুকিয়ে না রেখে, রোগী কে অবদমিত করে না রেখে দ্রুত একজন ভালো মনোরোগ চিকিৎসক এর  

পরামর্শ নিন। কোনো অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলে অবশ্যই জানান। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো সমাধানের নয়তো ভাণ্ডাফোঁড় করার। The Drugs And Magic Remedies (Objectionable Advertisement ) Act 1954 অনুযায়ী কোনো ওঝা, জানগুরু, গুনিন, সৎসখা, দিখলি, অলৌকিক রোগের চিকিৎসক (!) ইত্যাদিরা মন্ত্র-তন্ত্র, তাবিজ-কবজ, জলপড়া, তেলপড়া ইত্যাদির দ্বারা রোগ মুক্ত করার দাবী জানালে কিংবা কাউকে ডাইনি ঘোষণা করে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করলে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে কড়া শাস্তির ব্যাবস্থা। জেল এবং জরিমানা দুটোই। 

মনে রাখবেন, এইসব ভূত, প্রেতাত্মা, অশরীরী, জ্বীন ইত্যাদি থাকে গল্পগাঁথায়, পত্রিকার পাতায় এবং আমাদের মনের অন্ধকার জগতে, সেখানে জ্ঞানের আলো জ্বলালেই তেনারা ভ্যানিশ। 

ছেলেদের অগ্রাধিকার -বিতান সানা
Nov. 18, 2024 | নারীবাদ | views:817 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আমাদের দেশ বা তার আশেপাশের দেশ যেরম বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ইত্যাদি দেশে বিয়ের রীতিনীতি গুলো প্রায় একই। অর্থাৎ, বিয়ের পর মেয়েকে তার বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়। খেয়াল করলে দেখবেন এই বাপেরবাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি শব্দদুটোর মধ্যেও কেমন পুরুষদের সম্পত্তি-অধিকারের ব্যাপারটা ফুঁটে ওঠে। অর্থাৎ, নারীদের নিজের বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বিয়ের আগে বাপের, বিয়ের পর স্বামীর বা শ্বশুরের। আমরা যদি পদবীর দিকটাও দেখি সেক্ষেত্রেও দেখবো বাবার সূত্রে পাওয়া পদবী বিয়ের পর পাল্টে স্বামীর সূত্রে পাওয়া পদবী হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তিত্ত্ব বা আইডেন্টিটি বলে মেয়েদের আসলেই কিছু নেই। সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেকটাই প্রগতিশীল। তবে সেটা মূলত বড়ো বড়ো শহর ও শহর সংলগ্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।

অনেকেই বলতে পারেন যে ছেলেরাও তো ঘরজামাই থাকে। অবশ্যই থাকে। তবে সেটা গোটা পুরুষসমাজের ঠিক কত অংশ বা যেই পুরুষরা মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করেন তারা কি আদৌ ঘর জামাই থাকেন? তারা কি এই ঘরজামাই থাকাকে অপমান হিসেবে দেখেন না? আশা করি আপনিও উত্তরটা জানেন।

ছোটবেলা থেকে যে বাবা মায়ের আদরে মেয়ে বড়ো হলো, যে পরিবেশে সে অভ্যস্ত, কম্ফোর্টেবল, যে বাড়ির প্রতি তার একটা মায়া রয়েছে, সেই সবকিছু ছেড়ে তাকে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা একটা পরিবেশে গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়। নতুন বাড়ি, নতুন সংসার। প্রধানত ছেলেদের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়না। বিয়ের পর মেয়েরা যখন তার স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায় অর্থাৎ, জামাই যখন তার শ্বশুরবাড়ি যায়, জামাই সেখানে যে আদরটা পায়, তাকে আপ্যায়ন করার যে ইলাহী আয়োজন করা হয় সেটা কি মেয়েরা বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়িতে পায়? ভেবে দেখুন তো। ছেলেরা বা মেয়েরা বাড়িতে যেই পরিবেশে বেড়ে ওঠে, বিয়ের পর ছেলেদের সেই জীবনের খুব একটা হেরফের নাহলেও মেয়েদের জীবন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায়।

যদি একটি ছেলে আর মেয়ে আত্মনির্ভর হয়ে বিয়ে করে, তবে বিয়ের পর সেই ছেলেটা সংসারে যতটা না কন্ট্রিবিউট করে থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কন্ট্রিবিউট করে থাকে মেয়েরা। তাকে বাইরের সাথে বাড়ির প্রায় সবকিছুই সামলাতে হয়। সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা গুলো আজও সমানভাবে বয়ে চলেছে আমাদের মানসিকতার মধ্যে দিয়ে। গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েট এমনকি পিএচডি হোল্ডার ছেলেরাও এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে বেরোতে পারেনি। আজও প্রায় সব মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেদের অন্যভাবে ও মেয়েদের অন্যভাবে মানুষ করা হয়। বাড়িতে ছেলেদের মূলত শেখানো হয় তাদের কাজ একটাই। অর্থ উপার্জন। বাড়িতে মেয়েদের এটা শিখিয়ে দেওয়া হয় তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ বরাদ্দ করেছে এই সমাজ। যেমন ঘরমোছা, জামাকাপড় কাচা, জামাকাপড় ইস্ত্রি করা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও ফিটফাট রাখা, রান্নাবান্না করা, বাসন মাজা এবং বিয়ের পর স্বামীর হুকুমের তামিল করা। বাড়ির বউ এইসবকিছু ঠিকঠাক ভাবে করলেই সে একজন ভালো বৌমা, ভালো স্ত্রী হতে পারবে। শ্বশুর শাশুড়ির বা স্বামীর প্রশংসা পেতে তাকে সব কাজেই নিপুণ হতে হবে। মফস্বলে বা পল্লীর দিকে গেলে এখনও এটাই মুখে মুখে ফেরে মানুষের। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এইখানে এই গুণের কথাই বলা হয়েছে। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে অর্থ উপার্জন করাটা গুণ নয়। তাইতো হিন্দুরীতিতে বিয়ের পর পাত্রকে বলতে হয় “আমি আমার স্ত্রীর ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম।”কথাটা কতটা পুরুষতান্ত্রিক আর নারীসমাজকে অপমান করছে এটা কজন ভেবে দেখেছেন? কিভাবে নারীসমাজকে শোষণ করা যায়, তাদের সাথে দাসীর মতো আচরণ করা যায় তার পুরো বন্দোবস্ত করে গেছে একটা বড়ো অংশের ব্রাহ্মণবাদী মানুষ। সমাজের মধ্যে এখনও একটা অংশের মানুষ নিজের ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে পড়াশুনা জানা, শিক্ষিতা কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয় এরম পাত্রী খোঁজেন। কারণ এরম পাত্রীদের শোষণ করা সহজ। তাকে দিয়ে বাড়ির প্রায় সব কাজ করানো যায়। সেই ছেলের বাড়ি এটাই চায় স্বামী, শ্বশুরশাশুড়ির সেবা করা বা বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করাই সেই মেয়েটার জীবনের মূল লক্ষ্য হবে।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এই চিন্তভাবনা থেকে আজ আমরা পুরোপুরিভাবে সবাই বেরিয়ে আসতে পারিনি। শহরঅঞ্চলে এখনও এই প্র্যাকটিস হয়ে চলেছে। আগামী ৫০-১০০ বছরেও সম্পূর্ণভাবে এই প্রাকটিস বন্ধ হবে কিনা, জানিনা। যেই পরিবারে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে আছে অথবা, যেই পরিবারে ছেলে আর তার বিবাহিত বউ আছে, সেই বাড়িতে কোনো না কোনোভাবে মেয়েরা শোষিত হচ্ছে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর সেটা এখনও হচ্ছে। একটি মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে নিজের বাড়ির মতোই আদর যত্ন পাওয়ার আশা করে, স্বপ্ন দেখে সেখানে ভুল কোথায়? একটি ছেলে তার শাশুড়িমার কাছ থেকে যে আদরটা পায়, সেই একই আদরযত্ন কি মেয়েটা তার শাশুড়িমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করতে পারেনা?

চিনে রাখা প্রয়োজন -সায়ন কর্মকার
Nov. 18, 2024 | যুক্তিবাদ | views:818 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আজ একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের বিজ্ঞান দুর্বার গতি লাভ করেছে। অভূতপূর্ব তার উন্নতি। আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানকে এবং বিজ্ঞানের দৌলতে পাওয়া কৃতকৌশল প্রযুক্তিবিদ্যাকে জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহার করেও আমরা অনেকেই বিজ্ঞান বিরোধী। তবু আজ জনমনে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অলৌকিকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে চাইছে। বিজ্ঞান বিরোধিতার স্থূল ও সূক্ষ্ম চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ডারউইন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা-র বই, প্রবন্ধ লক্ষ লক্ষ বিক্রি হয়েছে। পরমাণু জগৎ থেকে মহাকাশবিদ্যা, এমনকি মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা বৃদ্ধির ব্যাপক চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ অলৌকিক শক্তির প্রতি নিরর্থক প্রার্থনা ছেড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আরাধনায় রত হয়েছে। তবু কেন মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ছে না? 

        এমন হওয়ার কারণটি আমাদেরই সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর হুজুর দল ও তার মদত পুষ্ট ধান্দাবাজ গোষ্ঠীর ধর্মীয় নেতা, জ্যোতিষী-তান্ত্রিক-বাবাজি-মাতাজি, প্যারাসাইকোলজিস্ট-রা কখনোই চায় না সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার আলো প্রবেশ করুক। তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সাধারণ মানুষদের ডুবিয়ে রাখে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের সুগভীর সাগরে, টিকিয়ে রাখে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজটাকে।

সম্প্রতি এক ভূত গবেষিকা ঈশিতা দাস সান্যাল ও তার দল "ডিটেকটিভ অফ সুপারন্যাচারাল (DOS)”উদয় হয়েছে যারা বিভিন্ন বিতর্কিত অঞ্চল গুলোতে (তথাকথিত ভৌতিক, অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা) সত্যানুসন্ধানের নামে একটা অলৌকিক আবরণে আবৃত পরিবেশ গড়ে তোলে এবং তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ব্যাখ্যা ও ভয়ের সঞ্চার করে। বছর খানেক আগেও এই ঈশিতা দাস সান্যালকে 'দাদাগিরি'-র মতো একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি(?) শো তে এসেও অলৌকিক রহস্যময়তায় ঢাকা ভূতুরে গুলগপ্পের চচ্চড়ি রান্না করতে দেখা গিয়েছিল। ঈশিতা দাস সান্যাল ও তাঁর দলের মতো আরো অনেক ভূত অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন বিজ্ঞানবিরোধী ধ্যান-ধারণা সঞ্চার করে চলেছে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কে। বলা ভালো প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে। এই সকল প্যারাসাইকোলজিস্ট রা স্বভাবে ধুরন্ধর চালাক প্রকৃতির। তাঁরা নিজে থেকে তো বলবে না যে, আমরা মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাই! খুব চালাকির সাথে নিজেদের অবস্থানটা তৈরি করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে তারা বিজ্ঞানের পক্ষে। বলবে, আমরা জানতে চাই কী আছে? যেন এমন একটা ভাব যে – অজানাকে জানার ভীষণ চেষ্টা। তাঁরা এমন কিছু যুক্তি সামনে নিয়ে আসে যেগুলো উপর থেকে দেখলে মনে হয় ভীষণ ধারালো যুক্তি। তাঁরা উপস্থাপন করেন — বিজ্ঞানে আজও প্রমাণিত হয়নি বলে ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? —এর  সাপেক্ষে বলতে পারি যে ঘোড়ার ডিম আজও প্রমাণিত হয়নি বলে, ভবিষ্যতেও যে প্রমাণিত হবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? আবার এও শোনা যায়, "বিজ্ঞান আজও প্রমাণ করতে পারেনি যে ভূত, অলৌকিকতা নেই"। এর সাপেক্ষেও বলা যায় – হাঁসজারু, বকচ্ছপ, রামগরু ইত্যাদি আজও বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি যে এগুলো নেই। এই সকল যুক্তি দিয়ে যা খুশির অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়। আসলে এগুলো কোন যুক্তিই নয়। এগুলোকে বলা হয় লজিক্যাল ফ্যালাসি বা প্রতারণা মূলক যুক্তি।


প্যারাসাইকোলজিস্টদের তথাকথিত ভূত গবেষণার কাজে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেগুলোর সাহায্যে তাঁরা ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার অস্তিত্বের প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি গুলি ব্যবহার ক্ষেত্র বিজ্ঞানে। Electromagnetic field detector, External thermometer,  Parabolic Thermometer এই সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এগুলোর সাথে ভূত, আত্মা, অলৌকিক কোনও কিছুর অস্তিত্ব খোঁজার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। প্যারাসাইকোলজিস্ট ও জ্যোতিষীরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যায় অবৈজ্ঞানিক  প্যারাসাইকোলজি ও জ্যোতিষকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করতে। Extra -sensory perception (ESP) বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (Telepathy/দূরচিন্তা, Precognition/ ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, Clairvoyance/অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, Psycho-Kines (PK)/ জড় পদার্থে মানসিক শক্তি প্রয়োগ) -র মতো চমকদার অবান্তর বিষয়গুলির সাথে কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষা চয়ন করে আর উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে প্যারাসাইকোলজিস্টরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। তাঁরা বিজ্ঞানের মোড়কে বাঁধা এক রসালো অতিরঞ্জিত সাজানো গল্প মানুষের সামনে পরিবেশন করেন। আর তার সাথে মদত দেয় মেরুদণ্ডহীন সেলিব্রিটি ও তাবড় তাবড় মানুষেরা। যার ফলে সাধারণ মানুষ সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ফলে একটা কুপ্রভাব সমাজে বিস্তার করে। লজিক ছেড়ে ম্যাজিকে চালিত হয় মানুষ। সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষ ভালোবাসে অতিরঞ্জিত গল্প গুলো বিশ্বাস করতে, তার মধ্যে ডুবে থাকতে এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার লোভও সামলাতে পারে না। যার ফলে একটা গণ হিস্টিরিয়া তৈরি হয়। বিজ্ঞানের যুগেও মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মানুষদের সাথে প্রতারণা চালিয়ে এভাবেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছে প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় এখনো ডাইনি সন্দেহে হত্যা, ভূতে ভর এই সকল ঘটনা গুলি পরিলক্ষিত হয়। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যান এবং ঘটনাগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে মানুষের ভুল ধারণার অবসান ঘটানোর চেষ্টা চালান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই সকল বিজ্ঞানবিরোধী ভূত, আত্মা, অলৌকিকতার ধারণা মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে   প্যারাসাইকোলজিস্টরা ডাইনি সন্দেহ, ভূতে ভরের মতো কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস গুলিকে পরোক্ষ ভাবে মদত দিচ্ছে। এদের চিনে রাখা প্রয়োজন। 

 এ সমাজ ব্যবস্থা ততটাই এগোয় যতটা মানুষ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি বিজ্ঞানমনস্কতা। মানুষ যতদিন না অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে মুক্তমনে বিজ্ঞানের পথে না চলবে ততদিন অগ্রগতির চাকা স্তদ্ধ রয়ে যাবে। প্যারাসাইকোলজিস্ট থেকে শুরু করে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরা এ সমাজের শত্রু। তারা সমাজের অগ্রগতির চাকাকে বিপরীতে ঘোরাতে চাইছে।

আমরা, বিজ্ঞান প্রিয় তরুণ, দেখিয়ে দিতে চাই কারা সমাজের শত্রু, প্রকৃত দেশদ্রোহী ও দেশপ্রেমিককে। 

এই পরিস্থিতিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটা কথা খুব মনে পড়ে যায় — 

তখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ

উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি

এ যদি সমাজ হয়

তবে আমি সমাজবিরোধী।

আধুনিক যুগের পথিকৃৎ: কোপার্নিকাস -পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:485 | likes:45 | share: 0 | comments:0

সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেলের কথা এলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে নিকোলাস কোপার্নিকাসের নাম । কিন্তু কোপার্নিকাসের অনেক আগেই গ্রিক দার্শনিক সামোসের অ্যারিস্টার্কাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ।খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৭০ সালের দিকে তিনি প্রথমবার সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন।তার মতে পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে।কিন্তু সেই সময় গ্রিসে অ্যারিস্টটল ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এক দার্শনিক।তিনি এই তত্ত্ব নাকচ করেন বলে শোনা যায় । গ্রিসে তার তত্ত্বটি নাকি তেমন কারো সমর্থন পায়নি।এরপর প্রায় অনেক বছর সেই তত্ত্ব কেউ গ্রহণ করেন নি।

এদিকে আবার কোপার্নিকাসের প্রায় এক হাজার বছর আগে ভারতীয় দার্শনিক আর্যভট্ট সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন।তার মডেল অনুযায়ী, পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণনরত এবং গ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুর্ণনকাল ছিল সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে।

এদিকে মধ্যযুগে টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা লিখেছিলেন আরবের বিজ্ঞানী আল হাজেন (আল হাইসাম)।প্রায় ১০০০ সালের দিকে আবু রায়হান বিরুনি (আল বিরুনি) সৌরকেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বেশ জোড়ালো ভাবেই প্রচার করেছিলেন।তার প্রস্তাবনায় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনরত ছিল।সে সময় অন্যদের চরম বিরোধিতায় তিনি হঠাৎ করেই স্থির পৃথিবীর তত্ত্বে ফিরে আসেন।১৩০০ সালের দিকে নাজিদ আল দিন আল খাজইনি আল কাতিবিও সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন।তবে তিনিও শিগগিরিই তার মত পরিবর্তন করেন।

তবে এ বিষয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস ।১৫৪৩ সালে তিনি On the Revolutions of the Celestial Spheres নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।প্রমাণ আছে যে কোপার্নিকাস আরবের বিজ্ঞানী আল কাতিবির কাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।কারণ আল কাতিবির অনেক রেখাচিত্রের সাথে কোপার্নিকাসের রেখাচিত্রের মিল পাওয়া গেছে।এমনকি এসব রেখাচিত্র একই বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন কোপার্নিকাস।তবে অনেকেই মনে করে কোপার্নিকাস আল কাতিবির চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন ।তিনি সুস্পষ্টভাবে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছিলেন।তার যুক্তি ছিল, টলেমির ভূকেন্দ্রিক ব্যবস্থার চেয়ে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ আর যুক্তির সাথে একদম একদম খাপ খায়।আবার এর পাশাপাশি তিনি দার্শনিকগত কিছু ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন।এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল,পৃথিবী বা মানবজাতিই যে সবকিছুর কেন্দ্রে নয়, এ অভিনব ভাবনার প্রকাশ।অবশ্য এই অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করার জন্য তাকে ভুগতে হয়েছিল।খ্রিষ্টীয় গির্জা এই ধারণাকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত হিসেবে দেখেছিল।সে কারণে এ ধারণাকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল তারা।কারণ তাদের দৃষ্টিতে সৌরকেন্দ্রিক ধারণা ছিল বিপথগামিতার নামান্তর।

কোপার্নিকাসের এই বইটি ১৫৪৩ সালে যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।শোনা যায় যখন এই বইটি ছাপা অবস্থায় তার কাছে এসে পৌছালো তখন তিনি শুধুমাত্র বইটি দুইহাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরেই তার মৃত্যু হয়।

কোপার্নিকাস এই বইয়ের মাধ্যমে যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করলেন তার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন, আইনস্টাইন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

কোপার্নিকাস যে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, তিনি ইউরোপের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের মূলে তীব্র আঘাত হেনেছিলেন।তাই বিংশ শতাব্দীতে আইনস্টাইন বলেছিলেন, "বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসই হচ্ছেন আধুনিক যুগের পথিকৃৎ"

কোভিড মহামারীর সময় বিজ্ঞানমস্কতা -সৌরভ দেবনাথ
Nov. 18, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:500 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আমরা কি বিজ্ঞানমনস্ক? প্রথমেই এমন একটা বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে অনেকেই রেগে উঠতে পারেন, অনেকেই ভ্রু, নাক কুঁচকে ' অ্যাঁ' সূচক শব্দ করতে পারেন। অনেকে বলবেন আলবাত বিজ্ঞানমনস্ক। এই যে বিজ্ঞানের এত অবদান আমরা ভোগ করছি, যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছি সবই তো বিজ্ঞানের দান এবং সেগুলো গ্রহণ করেছি। এই যে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোলেই অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের ' সায়েন্স নিবি, সায়েন্স নিবি ' বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেন, এই যে ইঞ্জনিয়ারিং কলেজের ছড়াছড়ি। স্মার্টফোন, কম্পিউটারের মত জটিল যন্ত্রগুলো কত সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। 

                এখানে জানা দরকার বিজ্ঞান কি। আমরা যে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি এগুলোই কি বিজ্ঞান? আজ্ঞে না। এগুলো হলো বিজ্ঞানের ফল। বিজ্ঞান হলো প্রকৃতিকে তার নিয়মগুলি দিয়েই জানার পদ্ধতি। বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ' বিশেষ জ্ঞান' বললে কিছুই বলা হয়না। প্রকৃতি কি ভাবে চলছে তার পরীক্ষালব্ধ, যুক্তিসঙ্গত উত্তর খুঁজে বের করাই বিজ্ঞানের মূল কাজ। বিজ্ঞানের দৌলতেই প্রকৃতির উপাদান এবং তাদের পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। আর সেই নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন যন্ত্র বানাতে পারি। যেমন তাপগতিবিদ্যার সূত্র প্রথমে এসেছিল পদার্থবিদ ক্লডিয়াসের হাত ধরে। সেই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জেমস ওয়াট বানালেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আজকের মোটরগাড়ির ইঞ্জিন। কাজেই বলা যায় বিজ্ঞান হলো প্রযুক্তির ভিত। 

                তাহলে বিজ্ঞানমনস্কতা কি? বিজ্ঞানমনস্কতা হলো প্রশ্নহীন আনুগত্যের একশোআশি ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থান। সংশয়বাদী (skeptic) হ‌ওয়া। কোনো উত্তর খোঁজার আগে নিজের মনটাকে ফাঁকা শ্লেটের মত স্বচ্ছ রাখতে হবে। অর্থাৎ পূর্ব পরিকল্পিত উত্তর ভেবে সেটার পেছনে ধাওয়া করলে হবেনা। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে নভেম্বর ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে বিখ্যাত 'রয়াল সোসাইটি'। যাদের লক্ষ্য ছিল 'নুলিয়াস ইন্ ভার্বা'। এই ল্যাটিন শব্দত্রয়ের মানে হলো ' কারো কথায় নয়', অর্থাৎ কেউ বলেছে বলে নয়, সত্যিটা নিজেকে যাচাই করতে হবে। গত সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সংস্থাটি বিজ্ঞানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চাঁদের হাট হয়ে এসেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন, স্যার হামফ্রে ডেভি, চার্লস ডারউইন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মাইকেল ফ্যারাডে, স্টিফেন হকিং আরো অসংখ্য নাম। এনারা যত বিখ্যাত ব্যক্তিই হননা কেনো, তাঁদের বক্তব্যের সাপেক্ষে প্রমাণ দিতে হয়েছে। তাই তো বিজ্ঞানে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া হয়না সেই ব্যক্তি বিখ্যাত বলে। 

                বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার মাঝে একটি যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্র হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। কি এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি? এটি হলো মুক্তমনে অনুসন্ধান, জ্ঞানার্জন পূর্ব জ্ঞানের সংশোধন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণ সাধারণত আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয়ে থাকে।দ্বিতীয় ধাপে একটা হাইপোথিসিস কল্পনা করা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঘটনাটির সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তৃতীয় ধাপে ঘটনাটি পরীক্ষা করে দেখা হয় ব্যাখ্যার সাথে ফলাফল মিলছে কিনা। যদি না মেলে তখন পূর্ব হাইপোথিসিস বাতিল করে নতুন হাইপোথিসিসের অবতারণা করা হয়। সব শেষে আসে সিদ্ধান্ত। তবে এরও কিছু শর্ত আছে। যেমন ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্বে কোনো পরীক্ষা হয়েছে কিনা দেখতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত বর্তমান সিদ্ধান্তের সাথে মেলাতে হবে। যদি দেখা যায় বর্তমান তত্ত্বটি পূর্বতন তত্ত্বের থেকে উন্নত ও বেশি সংখ্যক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম তখন পুরাতন তত্ত্বটি বাতিল করা হয়। বিশ্লেষনটি হতে হবে যুক্তিসম্মত। কোনরকম অতিপ্রাকৃতিক হস্তক্ষেপ বিশ্লেষণে থাকবে না। পরীক্ষাটি বার বার করা যেতে পারে এমন হতে হবে। আরো যে বিশেষ বৈশিষ্ট বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বের থাকতে হবে তা হলো ফলসিফায়াবিলিটি। দার্শনিক কার্ল পপারের মতে আদর্শ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো যা কিনা মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে। এটাকেই বলা হয় পপারের ফলসিফয়াবিলিটি। যেমন নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। এখনো পর্যন্ত এটাই হয়ে এসেছে। এবার ভবিষ্যতে যদি কোনো ক্ষেত্রে এর অন্যথা দেখা দেয়। তবে নিউটনের এই সূত্র সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে। 

                এবার আসা যাক কোভিড প্রসঙ্গে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক মহামারী ও অতিমারীর পার্থক্য। মহামারী হলো যখন কোনো বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাব কোনো দেশের নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে যাকে ইংরাজিতে বলে ' Epidemic'। আর অতিমারী বা ' Pandemic'  হলো যখন সেই রোগ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে রোগটি যখন সদ্য প্রকাশ পায় তখন তাকে বলে ' Outbreak'। এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করতে  না পারলে ক্রমশ তা মহামারী এবং তা থেকে অতিমারীর আকার ধারণ করে। কোভিডের ক্ষেত্রে এর উৎস চিনের উহান অঞ্চলে। ডিসেম্বরের শেষদিকে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১১ ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করে। কোভিড বা ইংরাজিতে Covid হলো Corona virus disease এর সংক্ষিপ্ত নাম। আর ১৯ হলো ২০১৯ সালকে বোঝানো হয়েছে। করোনা শব্দের অর্থ মুকুট। ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের জন্য এইরকম নাম। এই রোগটি মূলত শ্বাস যন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। রোগটি যখন অতিমারীর তকমা পেল তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ল এটি নাকি চিনের চক্রান্ত। বিজ্ঞানমনস্কতাকে বিসর্জন দিয়ে কাতারে কাতারে ইন্টারনেট পোস্ট হতে লাগলো এই খবর। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বিভিন্ন মতামত উঠে এলো। মুসলিম সম্প্রদায়ের মুমিনগণ নির্দ্বিধায় প্রচার চালালো চীনের ওপর এ ' আল্লাহর গজব '। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে এবং জমজমের পানি, কালো জিরে খেলে করোনা হবে না। পরে অবশ্য মক্কা বন্ধ করে হজ স্থান জীবাণুমুক্ত করতে হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনে উক্ত ধারণা গুলো শেকড় গেঁথে গেছে। খ্রিস্টীয় যাজকরা প্রচার করল পবিত্র জল একমাত্র মুক্তির উপায়। এত কিছুর পরেও পোপের শহর ভ্যাটিকানে মানুষের মৃত্যু ঘটতে লাগলো। পোপ গৃহবন্দী হয়ে রইলেন। ভারতে তখনও করোনা আসেনি। আয়ুষ মন্ত্রক নির্দ্বিধায় কোনরকম বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই প্রচার করতে লাগলো হোমিওপ্যাথিক আর্সেনিক অ্যালবাম ৩০ সি খেলেই করোনা হবে না। বিখ্যাত যোগীগুরু 'বাবা রামদেব' বললেন নিয়মিত যোগব্যামই একমাত্র অবলম্বন করোনার থেকে বাঁচার। ' চির আধ্যাত্মবাদের(?)' দেশ ভারতবর্ষ। মাঝে  অনেক জায়গায় গোমূত্র পানেরও আয়োজন হলো। কিন্তু এতকিছু করেও ধীরে ধীরে মাস্কবদনের সংখ্যাও বেড়ে চললো। ধীরে ধীরে আক্রান্তের খবর আসতে লাগলো। ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হলো। ২২ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী বারো ঘন্টার জনতা কার্ফিউ জারি করলেন এবং সকলকে বিকেল পাঁচটায় হাততালি দেওয়ার এবং কাসর, ঘন্টা, শঙ্খ বাজানোর আহ্বান জানালেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল করোনার জীবাণু বারো ঘন্টা জীবিত থাকে। এরকম কোনো তথ্য প্রমাণ তখনো মেলেনি। এছাড়া হাততালি, শঙ্খ বাজানোর অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এলো এরকম যে পাঁচটার সময় রেবতী নামক নক্ষত্র চাঁদের কাছ থেকে যাবে, সম্মিলিত আওয়াজ দেহের রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখবে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে।  বিখ্যাত তারকা অমিতাভ বচ্চন টুইট করলেন ঐদিন অমাবস্যা থাকায় সমস্ত অশুভ শক্তি, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষমতা বেড়ে যাবে। সম্মিলিত শঙ্খনিনাদ করোনা ভাইরাস ধ্বংস করে দেবে। এত কিছুর পরেও লকডাউন ঘোষনা করতে হলো। এরপর প্রধানমন্ত্রী আপামর ভারতবাসীকে ৯ ই এপ্রিল রাত ৯ টায় বাড়ির সব আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে বললেন। এটার ওপরেও অনেক রকম ব্যাখ্যা এলো ইন্টারনেটে। কেউ বললেন একসাথে এতগুলি প্রদীপ জ্বালালে তার উত্তাপে ভাইরাস নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ বললেন এর ফলে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রভাবে ভাইরাস মারা যাবে। যুক্তিবাদীরা অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল প্রচণ্ড উত্তাপে মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না তা কি করে সম্ভব? এছাড়াও চীন মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে তবুও কোভিডের উৎপত্তি চীন কেনো? এছাড়াও শিলের ওপর নোড়া বসিয়ে তাকে শিবলিঙ্গ হিসেবে পূজো করা হতে লাগলো। যা নাকি কখনো হয়নি। এটি পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনেই যে হচ্ছে তা কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসী মানতে নারাজ। বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ধারণা যে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জতিক স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে তারও প্রমাণ মিলল যখন আমেরিকায় মানুষ লকডাউনকে কাঁচকলা দেখিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। সরকার নাকি চক্রান্ত করে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তাদের। প্রাক্তন ব্রিটিশ ফুটবলার 'ডেভিড আইক' তাঁর অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। তিনি এক টিভি শোতে বললেন ফাইভ জি প্রযুক্তি দেহের কোষের জন্য বিষাক্ত। শক্তিশালী তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র এর জন্য বিশেষ দায়ী। এই বক্তব্য অনেকের ওপরেই গভীর ক্ষোভ তৈরি করেছে ফাইভ জি প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। অনেক জায়গায় ফাইভ জি টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়েছে। অপবিজ্ঞান যে শুধু কুসংস্কারের ওপর নির্ভর হবে এমন নয়।হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সামান্য ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছিল কোভিডের ওপর। তবে তা পুরোপুরি ভাবে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর মধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়ে পাঠালেন ভারতের কাছ থেকে। সাধারণ মানুষ দোকানে গিয়ে মুড়ি মুড়কির মত কিনে খেতে লাগলো কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত না হয়েই। পরে দেখা গেলো তাতে ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশি। ২০২০ পেরিয়ে ২০২১ এ আমাদের ওপর আছড়ে পড়লো কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। প্রত্যক্ষ করলাম দিনে প্রায় চার লক্ষের কাছে সংক্রমণ। এক বছরের মাথায় ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার পরেও ভুল ধারণার জন্য অনেকে নিতে চাইছেন না। 

                কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার এত অভাব কেনো? এর উত্তর আমাদের দিতে পারে বিবর্তন তত্ত্ব। যখন মানুষ শিকারি সংগ্রাহক ছিল তখন প্রতি পদে পদে ছিল মৃত্যুর আশঙ্কা। ছিল হিংস্র প্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। তাই কোনো রকম অস্বাভাবিক কিছু দেখলে তারা তার কারণ জানতে যাওয়ার থেকে পালানো শ্রেয় মনে করতো। এই অভ্যেস তখন সত্যি কাজে লেগেছিল। তার জন্যই মানবসভ্যতা যোগ্যতমের উদ্বর্তন নিয়ম মেনে এগিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু এখন তা মানবসভ্যতার ক্ষতি ছাড়া কিছু করছে না। উপরের ঘটনাগুলি কোনোটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনা। যেমন ভাইরাসের জিনের সজ্জা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন এটি এসেছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারাই। এটি একটি আর এন এ জু নটিক ভাইরাস। তার মানে এটির জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হলো আর এন এ এবং এটি মানুষের সংস্পর্শে আসার আগে কোনো প্রাণীদেহে নিজের মিউটেশন ঘটিয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন নব্বই থেকে পঁচানব্বই শতাংশ জিনের সজ্জার মিল রয়েছে বাদুড়ের সাথে। অর্থাৎ এটি কোনরকম জৈব অস্ত্র নয়। এছাড়া যোগব্যাম, হোমিপ্যাথি, কালো জিরে, আল্লাহর গজব এগুলো কোনোটাই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমানিত নয়। এছাড়াও সম্মিলিত প্রদীপ জ্বালানো বা  হাততালির ওপর যে সকল অবৈজ্ঞানিক দাবি করা হয়েছে তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ যে বা যারা দাবি করছে তারা বলবে কোনো অলৌকিক উপায়ে হচ্ছে যা কিনা বিজ্ঞানের অজানা। এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। ফাইভ জি প্রযুক্তিতে যে মানবদেহে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। কিন্তু বিজ্ঞান চেতনাহীন মানুষ তা বিশ্বাস করে চলেছে। এই রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া। কারণ এই ভাইরাসের সংক্রমণ হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। আর হাত ধোয়ার কারণ হলো যে কোনো ভাইরাসের জেনেটিক বস্তুটি ক্যাপসিড নামক প্রোটিন বা ফ্যাটের স্তর দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। সাবান এই স্তরটি ধ্বংস করে দেয়, ফলে ভাইরাসটির বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। আর কোনরকম রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু ভুল তথ্যগুলোতে কেউ যদি বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকে এবং উপরোক্ত নিয়মগুলি মেনে না চলে তাহলে বিপদটা সেখানেই। যে কারণে বর্তমানে মুহুর্মুহু বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভুল খবর ছড়ানোকে নাম দিয়েছে 'Infodemic'। তাই প্রযুক্তির সাথে দরকার বিজ্ঞানমনস্কতা। লকডাউনের এই সময়টাকে কাজে লাগানো যেতে পারে নিজের বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখা যেতে পারে, বই পড়া যেতে পারে এর ওপর।

                মহামারী নতুন কোনো কিছু নয়। বন্য মানুষের সময়ও মহামারী ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই যারা অনাক্রম্যতা পেয়েছে তারা টিকে গেছে। মিশরের মমির দেহেও গুটি বসন্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কিন্তু এডওয়ার্ড জেনারের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর ছবিটা বদলে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে অন্য রোগেরও ভ্যাকসিন এলো। পোলিও ও গুটি বসন্ত এমন দুটি রোগ যা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের দৌলতে আজ বিলুপ্ত। আর এত কিছু সম্ভব হয়েছে মানবজাতির দুর্দমনীয় কৌতূহলের কারণে। যা জন্ম দিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের। কারণ বিজ্ঞানমনস্কতা বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর কোভিডও একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব এবং কুসংস্কার বা অপবিজ্ঞান বিশেষত অতিমারীর সময় ভয়াবহ একটি সংমিশ্রণ।

সেকালের ভূত, এ কালের বিজ্ঞান, আর আমাদের ভবিষ্যত। -মহম্মদ মহসীন
Nov. 18, 2024 | ভূত | views:1588 | likes:45 | share: 0 | comments:0

শিশুর মনে কিভাবে ভূতের অস্তিত্ব শিকড় বিস্তার করে, তা আমার নিজের শৈশব দিয়েই বিচার করি। অনেকের শৈশবের  ঘটনাও একই প্রকার।

   এক্কেবারে অজ পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায়, তা হ'ল আমাদের সেকালের গ্রামটি। গ্রামে ঢুকতে হলে শীতে ধুলো আর বর্ষায় কাদা মাখতেই হবে। গাছপালা, বাঁশবাগান এত ছিল যে দিনের বেলা বাঁশতলায় সুর্যের আলো নিচে আসতে পারতো না। তাতে দিনেই ভূতুড়ে ভূতুড়ে আবহাওয়া গড়ে উঠতো, রাত্রে তো ভূতেদেরই বাজত্ব।

সেকালে ভূতের ভয়ে গাঁ-গ্রাম ছিল তটস্থ। সন্ধ্যে হলেই ভূতের ভয়ে রাস্তা ঘাটে লোকজনের বিশেষ দেখা মিলতো না।

শিশু প্রথমত প্রাথমিক শিক্ষা পায় তার মায়ের কাছে। আমিও পেয়েছিলাম। মা বলতো, সে এক সন্ধ্যার ঘটনা। তোর বাবা ইলিশ আনলো যখন,  তখন ভর সন্ধ্যেবেলা।  হাট থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই মাছের গন্ধে সঙ্গ নিয়েছিল "তেনারা"।  বলতো এঁকটাঁ মাঁছ দেঁনা। এঁকটাঁ মাঁছ দেঁনা। দিদি গুটিসুটি মেরে কাছে এসে সন্দেহ প্রকাশ করতো,”সত্যি মা? “আমরা কিন্তু মায়ের কথা চোখ বুজে বিশ্বাস করতাম। কক্ষনো সন্দেহ করতাম না।

সেই মাছ বেছে যেই না পুকুর ঘাটে ধুতে যাবে, অমনি শাঁকচুন্নি একটা বাঁশ শুইয়ে ধরতো। সেটা পার হতে গেলেই সটাং করে তুলে ধরবে। মা তো ভীষণ রেগে বকা ঝকা দিত। সুরা ইয়াসিন পড়বো? বলে ভয় দেখাতো। শাঁকচুন্নিটা বিপদ বুঝে বাঁশবাজি বন্ধ করে পালাতো।

  ঘুমাবার সময় বাবাও বলতো তার নিজের জীবনের ঘটনা। আমাদের লাঙল  চালানোর নাঙলা ছিল মকর কাকা আর বুধন কাকা। বাবার ছিল ছোট্ট একটি বিড়ি কারখানা- কাম- বই- খাতা-মনিহারি-চাল-ডিম- তেলের পাঁচমিশেলি দোকান। সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে আসার সময় তিনজনে প্ল্যান করলো, পরের দিন ভোরে পুকুরের মোয়ানের খালে দু দিকে বাঁধ দিয়ে বালতি করে জল সেঁচে তুলে ফেলে দিয়ে জুলির পাঁকাল, ট্যাংরা, চ্যাঙ, ল্যাটা, মাগুর, সিঙি ধরবে।

রাত তখনও আছে, ভোর হয়তো হবে হবে করছে, বুধন কাকা এসে বাবাকে ডাকে, দাদা, ও দাদা, জল সেঁচতে যাবে না?

দুজনে গিয়ে প্রচুর মাছ পেল। বাবা হঠাৎ দেখল, বুধন কাকা বালতি থেকে তুলে তুলে কাঁচা মাছে খাচ্ছে। চোখের ভুল না কি? কিন্তু না, খানিক পরে একই কাণ্ড। বুধন কাকা আবার একটা কাঁচা মাছ খেল। বাবা বুঝতে পারল, এ তো বুধন নয়, নিশ্চয়ই  বুধনের বেশে মেছো ভূত।

পড়ি মড়ি করে ছুটে এসে বাড়িতে দেখে বুধনকাকা আর মকরকাকা এসেছে জল সেঁচে মাছ ধরার জন্য। তাহলে আগে কে এসেছিল? বুধনকাকাকে সব ঘটনা খুলে বলতেই আর মাছ ধরার জন্য খালে যেতে তাদের সাহসে কুলালো না। এইসব ঘটনা খোদ বাবার মুখে শোনা। কাজেই অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠেনা।

আমাদের ছিল শানের মেঝে, মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনি দেওয়া লম্বা দুয়ার ওয়ালা ঘর। ঘরের পিছনে একটি বহু বয়স্ক উঁচু নারকেল গাছ। আর সামনে উঠানের পরেই পাঁচিলের বাইরে একটি তালগাছ। তাতে এক বিশাল জীন বাস করতো। নিরুপদ্রবে। তার একটা পা ছিল নারকেল গাছে, অন্য পা বাড়ানো ছিল তালগাছে।  বাবা, মা দুজনেই  গভীর রাতে উঠে স্বচক্ষে দেখেছে বেশ কয়েকবার। কাজেই স্বচক্ষে দেখা জীনেও অবিশ্বাস করার কিছুই নেই।


এই রকম হাজারো ঘটনা আছে। সব বললে লেখাটির প্রায় ওজন হয়ে যাবে তিনমণ। বাবা মায়ের স্বচক্ষে দেখা এতগুলি ভূত কখনো মিথ্যা হতে পারে কি?

পরে দুই একবার আমরা নিজেরাও ভূতের দেখা পেতাম। সেবারে বেদের দল এলো দিঘীর পাড়ে। তাদের  কালো কালো রোগা-সোগা দুটি ছেলে মাদার গাছে উঠে মাদার পাড়ছিল। গ্রীষ্মের দুপুরে সব্বাই যখন ঘুমাচ্ছে, আমি দুটো করঞ্জা পাড়ার উদ্দেশ্যে বার হয়েছিলাম। এক লহমা ছেলেদুটিকে দেখলাম, পরক্ষণেই কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। কেন জানি না, একটা ভয় মনে জুড়ে বসলো। করঞ্জা না পেড়েই, দ্রুত ঘরে ফিরে এসে ঘুমন্ত মায়ের পাশটিতে আবার শুয়ে পড়তাম।  মনটা উসখুস করতে লাগলো।

রাত্তিরে মা কে ঘটনাটি বললাম। দিদি তো হেসেই খুন। মা খুব বকাবকি করলো। বললে, সবেতেই হাসিস না, ঐ দুটো ভূতের ছানাকে আমিও ক' বার দেখেছি। ইখলাস, ফালাক আর নাস তিনবার পড়ে আমাদের প্রত্যেকের মাথায় ফুঁ দিতে যেন আমার ধড়ে  প্রাণ ফিরে আসতো। সেই দুটো ভূতের ছানাকে আমরা স্কুলেও বকুলতলায় দেখেছি। সহপাঠীদের বলতেই অনেকে ভূত বলেই সাব্যস্ত করেছিল। অনেকে অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল ওরা বেদেদের ছেলে, চুরিটুরি করে বলে, পালাই পালাই করে। আমাদের কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, সে দুটো ভূতের বাচ্চাই ছিল। আমি তো নিজের চোখেই দেখেছিলাম। এই দেখছি মাদার গাছের ঝোপে। এক মুহূর্ত পরে দেখছি হাওয়া। চুরিই যদি করতে আসে, মায়ের বকুনিকে ভয় পায়, মা তো তখন ঘুমাচ্ছিলো। তাহলে বকবে কে? কাজেই বহু যুক্তি তর্কের পর বুঝেছিলাম ও দুটি বেদের ছেলে নয়, আদৌ নয়। বেদের ছেলের মতো দেখতেই নয়। কেমন যেন ভূতুড়ে ভূতুড়ে। কাজেই ওরা ভূতেরই ছানা। যে পারে ওদের মানুষ বলে বলুক, আমি অন্তত নাস্তিক হতে পারবো না, নিজের দুচোখকে অবিশ্বাস করতে পারবো না।  ভূত না থাকতে পারে, ভূতের ছানা আছেই। ওদুটো ভূতেরই ছানা। আমার স্বচক্ষে দেখা।

এভাবেই বাবা মা'র দেখা ভূত, নিজের দেখা ভূত,  পুকুরে নিজের চক্ষে দেখা জুজুবুড়ির চুল অবিশ্বাস করি কিভাবে?

সেবারে আমাদেরই পাড়ার নতুন এক বৌকে ভূতে না জিনে ধরলো। ভূত- জীন না থাকলে, ধরলো কে? যখন ওঝার সর্ষে পড়া,  ঝাঁটা পড়ায় ছেড়ে যাচ্ছে, তখন জলের ঘড়া খিড়কি দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল কে? ওসব মানুষের কম্ম?

স্কুলে গিয়ে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হল। কেউ কেউ নাস্তিকগিরি করে স্রেফ উড়িয়ে দিলে। এরা কোনো যুক্তিই মানে না। আমাদের দুক্লাস উঁচুর এক দাদা বললে, তার মামার বাড়িতেও এমন ভূত সে নিজের চোখে দেখেছে। ছেড়ে যাওয়ার সময় পুরো ভর্তি জল শুদ্ধু ঘড়া দাঁতে করে নিয়ে গেল। সাথে কাছের একটি উঁচু গাছের মগডালটিও কোত্থাও কিছু নেই,  হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার জোরে ভেঙে দিয়ে তবে গেল। আর সেই ওঝার ঝোলার বোতলে এমন কত আত্মা প্রেতাত্মা বন্দি করে রাখা। এসব যুক্তি অনেকেই মানলো না। গোঁয়ার্তুমি করে সব উড়িয়ে দিলে। আমি অবশ্য মগডাল ভাঙা দেখিনি, কিন্তু স্বচক্ষে ভূতে ধরা - ছাড়া,  কলসি বওয়া তো দেখেছি। তাই আমি তাদের দলে ছিলাম না। ভগবানের সাথে ভূতকেও সমান মর্যাদায় মান্য করে চলতাম।


এবার বলি, সুনীল গাঙ্গুলীর একটা কবিতা ।

এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল

কিছুতেই বড় হতে চায় না

এখনো বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে

চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়

মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই

ঈশ্বর নামে কোন বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না

ধর্মগুলো সব রূপকথা

যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে

তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না...

সুনীল গাঙ্গুলী বলেছেন,  মানুষ পরিণত হয় না। আমি বলি পরিণত হলেও স্বার্থান্বেষী কিছু ধড়িবাজ অপরিপক্কদের খরিদ্দার বানিয়ে ভূতের সান্রাজ্য চালানোর জন্য ছোটবেলায় দেখা বেদেদের ছেলেকে ভূতের ছানা বলে শেখা পণ্ডিতেও বড় হয়ে ছাদে বেড়ানো ছিঁচকে চোর ছেলেকে অথবা ভূতে ভীত ভৌতিক ভাবালুকে ভয় দেখাতে আসা অকুতোভয় ছেলেকেই ভূত ভূত বলে চেঁচায়। টিভিতে এসে  নিজের অপরিপক্কতার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়ায়। এই সব কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সেলিব্রটিরাই কুসংস্কারের পালে হাওয়া দেয়। এরাই ভূতের কারবারিদের সমর্থন করে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি করে চলে।

হায় ছেলেবেলার সেই ভূতগুলি আজ গেল কোথায়? ভূতেদের প্রধান শত্রু হ'ল ইলেক্ট্রিসিটি। দেশে ইলেক্ট্রিসিটি আসতেই বারো আনা পরিমান ভূত ম'রে হেজে গেল। যে সিকি ভাগ ভূত ছিল,  তারাও গাছ কাটার ফলে মুলুক ছেড়ে কোথায় যে গেল!

সব যে গেল তাও বলতে পারি না। খোদ কলকাতার বুকে ভূত দিদি, ভূতে বিশ্বাসী ক্রিকেটারের রক্তে এখনও ঘোরাফেরা করে ছোটবেলার সেইসব ভূতেরা।

ইলেক্ট্রিক আলোর থেকেও ভূতের আরো বড় শত্রু হ'ল জ্ঞানের আলো, বিজ্ঞানের আলো। যে সব লোকের জ্ঞানের জগতে আলোর প্রবেশ ঘটেনি, ভূতেরা সেখানে দিব্যি রাজত্ব করে চলেছে, এখনও। জ্যোতিষের মতো, ভূত নিয়েও চলছে বুজরুকি, জোচ্চুরি, ধান্দাবাজি, এক বিশাল কারবার। ধড়িবাজ কিছু ভণ্ড-পণ্ডিত, ধড়িবাজ কিছু খ্যাতিমান, ধড়িবাজ কিছু স্বার্থান্বেষী ক্রিকেটার, ধড়িবাজ কিছু ভূত- বিজ্ঞানী, -ধড়িবাজ কিছু গ্যাজেটধারী, ধড়িবাজ কিছু "যুক্তিবাদী”(যিনি আসলেই যুক্তিবাদীদের কলঙ্ক),  ধড়িবাজ কিছু ধর্মীয় নেতা হ' ল এই কারবারের সওদাগর। অ-বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মান্ধ, চিন্তারহিত বদ্ধমনা, কুযুক্তিবাদী অশিক্ষিত  হ'ল এই কারবারের খরিদ্দার।।

পৃথিবীতে যারা মিথ্যা গল্প বলে তারাও কারুর না কারুর বাবা মা। সূতরাং, যেহেতু

আমার বাবা, আমার মা  ভূত দেখার গল্প বলেছিল, কাজেই তা সত্যি, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। তা সেই বাবা,  সেই মা যত বড় ডিগ্রীধারী হোন না কেন, যতবড় ক্রিকেটার হোন না কেন, যতবড় "যুক্তিবাদী”হোন না কেন, যতবড় গ্যাজেটধারী বিজ্ঞানী বা যত বড় সুপার ন্যাচারাল অনুসন্ধানী ডিটেক্টিভ  হোন না কেন।  যতবড় ফিজিক্স-পড়া পণ্ডিত হোন না কেন। যত বড় আবিষ্কার করা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হোন না কেন।  যতবড় ডিটেক্টিভ অফ সুপারন্যচারাল হোন না কেন, মিথ্যেটা মিথ্যেই। নিজের চোখে দেখাটাও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখা নয়। প্রোথিত বিশ্বাসের আধারেই দেখা। যুক্তি গুলো আসলে কুযুক্তি। অন্ধবিশ্বাসের ভিতে গাঁথা সাবজেক্টিভ কাঠামোর কুযুক্তি।।

শৈশবের রিফ্লেক্স, শৈশবের অন্ধবিশ্বাস ছেড়ে মানুষ পরিণত হতে পারে না, বড় হতে পারে না। আজীবন শিশু, আমরণ অপরিণতই থেকে যায়। নিজে চিন্তা করতে পারে না। যুক্তিবোধ গড়ে ওঠে না। বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে ওঠার জন্য যে যুক্তিবাদী চেতনার প্রয়োজন তার অভাব থেকে যায় মননে।  চিন্তন- অনুশীলণ-রগিত-জীবনশৈলী তাদের জীবনের পাথেয়। এরা চিন্তা করে সীমানার ভিতরে। সীমানার বাইরে যেতে পারে না। ধর্মের গণ্ডী পার হতে পারে না। মুক্তচিন্তার অভাবে অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি আসে না কোনোদিনই। বরং অচিন্তন তাকে গ্রাস করে। অন্ধবিশ্বাস আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তার মানবিকতাকেও।  মুক্তির জন্য মানবিকতা মাথা কুটে মরে অন্ধবিশ্বাসের রুদ্ধ-পাষাণ-দ্বারে।  অহরহ মানবিকতার বলী চড়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, মেকি-শিক্ষা, ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে।

সব শেষে, কবিগুরুর লিপিকা থেকে একটু কপি পেষ্ট করি।

"দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, 'এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।''

"শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।"

"এই ভাবেই দিন চলত, ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারো মনে দ্বিধা জাগত না; চিরকালই গর্ব করতে পারত যে, এদের ভবিষ্যৎটা পোষা ভেড়ার মতো ভূতের খোঁটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যা'ও করে না, ম্যা'ও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে, যেন একেবারে চিরকালের মতো মাটি।"

"কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায় নি। তাই অন্য সব দেশে যত ঘানি ঘোরে তার থেকে তেল বেরোয় তাদের ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সচল করে রাখবার জন্যে, বুকের রক্ত পিষে ভূতের খর্পরে ঢেলে দেবার জন্যে নয়। কাজেই মানুষ সেখানে একেবারে জুড়িয়ে যায় নি। তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।"

কিন্তু আমাদের সমাজে,

"খিড়কির আনাচে- কানাচে ঘোরে ভূতের পেয়াদা, আর সদরের রাস্তায়- ঘাটে ঘোরে অভূতের পেয়াদা; ঘরে গেরস্তর টেঁকা দায়, ঘর থেকে বেরোবারও পথ নেই। এক দিক থেকে এ হাঁকে, 'খাজনা দাও।' আর- এক দিক থেকে ও হাঁকে, 'খাজনা দাও।' "

“শিরোমণি- চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, 'বেহুঁশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুঁশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।' "শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।"

কিন্তু ব্যাপারটা এতটাই সোজা নয়।

মানুষ পড়বে না, বুঝবে না, ভাববে না।

চিন্তনশীলতা তাদের ধাতে সয় না।

তাই ভূত থাকে চিরকাল। ভবিষ্যতের পথ আগলে।।

ব্যবসা হবিবুল্লাহ -মহম্মদ মহসীন
Nov. 16, 2024 | যুক্তিবাদ | views:499 | likes:50 | share: 5 | comments:0

কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, এ গল্পের শিরোনামের মানে কি? 

তাকে অকপটে জানাই, আমি জানি না।

তাহলে এ লেখার এমন নাম দিলাম কেন?

এর একটা ইতিহাস আছে।

ইতিহাসটি হলো আমার পাশের গ্রামেই থাকে এক যুবক। বেকার। হ্যাঁ, এটাই ওর কাছে ওর বড় পরিচয়। কিন্তু আমাদের কাছে ও একজন যুক্তিবাদী। নানান ক্রাইসিসে মানুষের মাঝে যুক্তিবাদের প্রসারে আত্মনিবেদনকৃত। সাপের কামড়ে ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সচেতনতায়। জ্যোতিষীকে চ্যালেঞ্জে। জণ্ডিস তোলা, ডাইনির কু নজর,  জ্বীন ভূতের দাবীদারকে পাবলিকলি এক্সপোজ করার সাহসিকতায়। ভণ্ড গুরু পীরবাবাদের ভণ্ডামি উন্মোচনে। সব সময় সাথে পাবে ওকে।

কিন্তু বড় দুঃখের কথা। তাকে আজ দেখলাম এক ভিন্ন রূপে। সম্পূর্ণ বদলে গেছে সে। অর্থের নেশায় উন্মত্ত। 


সে এখন এক জ্যোতিষী। ঠিক জ্যোতিষী নয়,  জ্যোতিষ শাস্ত্র পড়া, "বিজ্ঞানভিত্তিক" পথপ্রদর্শক,   আসলে স্টোন বিক্রেতা। ডায়ামণ্ড, রুবি,এমর‍্যাল্ড,সাফ্যায়ার, ব্লু, পিঙ্ক, ইয়োলো। একই কাটিংয়ের কত নাম। সব ব্যবসা। মাছের মত সাইজ বাড়লে রেট বাড়ে, এরও তেমন, সাইজ আর খদ্দেরের সামাজিক স্তর সমানুপাতে দাম। খদ্দের যত শাঁসালো, ফাঁড়া তত বেশি, বিজ্ঞানের কপচানির সাথে লাভের অঙ্কের উচ্চলম্ফন। নিশ্চিত এক আয়ের পথ। 

আমি আশ্চর্য্য হয়েছিলাম। 

বাম নেতার রামের দলের পতাকা নিয়ে তাদের মিছিলে জয়শ্রীরাম স্লোগান দিতে দেখেও এত অবাক হই নি।

আমাকে দেখে ও লজ্জা পেল না, ভয় পেল না, সংকুচিত হলো না, পালিয়ে গেল না।

কাজেই তার কাছে গেলাম। কথা বলবো। কিন্তু আমার আগে ও-ই প্রথম শুরু করলে, আগুন ঝরা লেখাগুলো এখনো লিখে যেতেও পারি। কিন্তু যুক্তিবাদী আন্দোলনে জ্যোতিষ নিয়ে যা পড়াশুনা, অভিজ্ঞতা আছে, অন্ধবিশ্বাসীগুলোকে মুরগী করে স্টোন বিক্রি করে যাবো। এটাই আমার ব্যবসার রেসিপি। ধর্মান্ধ, আকাঠ, গবেট, বি. এ,  এম.এ, ডক্টরেট, ডিগ্রীওয়ালা শাঁসালো মাস্টার, প্রফেসার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার ক্লায়েণ্টের বাড়ি গিয়ে জ্যোতিষের আফিং-এ আরো ডোজ বাড়িয়ে দু হাজারের স্টোন বিশ হাজারে বেচবো।

কারণ ব্যবসা হাবিবুল্লাহ।

এবার আমি সত্যি সত্যি কী বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। 

সে-ই আমাকে বোঝালে, আসলে হয়েছে কী, আমার যে শেঠ,  তিনি বম্বের এক বড় জহুরি। আবার তিনি এক বড় মৌলানা,  ওয়াজি হুজুরও বটে। তার বেশ শাঁসালো মুরিদানও ( শিষ্যও) আছে। সেখানে ঢঙ একটু আলাদা। জমজমের জলে শোধিত আসল জেমসের আল্লাহ লকেট, আলী লকেটা, আয়েষা সুরমা। অনেকটা ঠিক হনুমান যন্ত্র বা দেবতার  বিভূতি। মুরিদানের বাড়ি ওয়াজও করেন,  ব্যবসায়ের জমিও চাঢ করেন। জাকির নায়েক ঢঙে। মুখস্থ টুখস্থ ভালোই করেছে। আমি নিজেও কোরাণের আয়াত টায়াত, সুরা টুরা মুখস্থ করে একটা পার্ফর্ম্যান্স দেখিয়েছি। একটা সিজনেই পঁচিশ হাজার থেকে লাখ খানেক,  কখনও বা লাখ দুয়েক আয়। হুজুরের কমিশন 20% থেকে লাভ অনুযায়ী 30%।  বাকিটা আমার। বড় কথা হল আমার বসই ওয়াজে কায়দা করে বাজারি স্টোন, জ্যোতিষের বিরুদ্ধে কোরাণের কত আয়েত ঝাড়লো। অথচ সে আর মারাঠী ব্রাহ্মণ,  এক ধর্মগুরু, মণিলাল,  জহুরি বাজারে  স্টোন মার্চেণ্ট দুনিয়ায় রাজ করে।  ডাইরেক্ট শ্রীলঙ্কা বা মাদাগাস্কারের মাইন থেকে জেমস এনে এখানে কাটিং করে। এর এক টুকরোও বাদ যায় না। সবচেয়ে ধনীর ঘরে যায় সবচেয়ে বড়টা, গরীব গুর্বো, ছাপোষার ঘরে যায় নিচে পড়ে যাওয়া কুড়ানো চুনীগুলো। ঠিক যেমন বড় ইলিশ খায় বড় লোকে, চুনোপুঁটি খায় ছাপোষায়। কিন্তু আমার বস আর মণিলাল জুটি গুরুগিরিও করে, ব্যবসাও করে।

তাকে কেউ এ বিষয়টা তুললেই পরিষ্কার বলে দেয়- " ব্যবসা হাবিবুল্লাহ।" আমি জানি না, এর মানে কী।

বড় লোকের বিটি! গান শিখেছে, টিভিতে দুবার গান টান গেয়ে দুটো হাততালি পেয়েছিল, আর তাকে কেউ কেন ডাকে না! দেখাও হাত, নাও একটা স্টোন। বাপের বহুদিনের কারবার, ইদানিং আউটপুট তেমন দেখতে পাচ্ছে না, বিশ্বস্ত লোকের রেফারেন্স পেলে সেখানেও দশ আঙুলে দশটা স্টোন সাজানোর প্রজেক্ট অবশ্যই নেওয়া যায়।

ব্যর্থ প্রেমের কেস গুলো একটু সিমপ্যাথি থেরাপির সাথে স্টোন দিলে তো দরদামই করতে হয় না।  জ্যোতিষ দুনিয়ায় এমনই হাজার এপিসোড। আর গরীব গুর্বো মধ্যবিত্তের দৌড় ঐ চল্লিশ পঞ্চাশ তক। তবে তাদের বাড়ি ঝাড় ফুঁক দোয়া তাবিজ করে পাঁচ দশ হাজার হাতানো একেবারেই রুটিন জব।

মাসে পঞ্চাশ ষাট  মার্জিন তো আছেই। একা পারি না, বিভিন্ন শহরে সেলার বসিয়েছি। কোনো কোনো বৎসরে কোম্পানির টার্ন কোটি ছাপিয়ে যায়।

কুসংস্কারের চাষে জল সার দিয়েই আমার আয়।

আমার পেশার ক্লায়েণ্ট ঐসব অন্ধ গবেটগুলো। ওরাই আমার রিসোর্স। আজ আমার বাড়ি, গাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের ওরাই যোগানদার। 


এবার

আমি একটা গল্প শোনালাম,   আমার এই হঠাৎ ধনী বন্ধুটিকে।

আবদুল্লা আল মাসুদ। ঢাকায় একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন এই মুফতি। কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। জেনেছেন কোরাণ মিথ্যা।  মিথ্যার ভিতের উপর ধর্মের বিশাল ইমারত। জানালেন সে মিথ্যা। কিন্তু ধর্ম চিরকালই ভয় পায় আলোকে, সত্যকে। বরং বলা যায় সত্যের আলোয় তাদের অন্ধকার সাম্রাজ্য তছনছ হওয়ার ভয় সদা সর্বদা। তাই মস্তিষ্কবিহীন পাহারাদার সদা সর্বদা নিয়োজিত। সত্য যে বলতে চাইবে, ঘাড় থেকে তার মাথাটি কেটে নেওয়ার বিধান কার্যকর করার হাজার জেহাদি, হাজার মূর্খ, হাজার নীরবে-অন্যায়- সহ্য- করে- যাওয়া- জনগণ। এরা অভিজিৎকে মারে, বাবু ওয়াশিকুরকে মারে, অনন্ত বিজয়কে মারে, আরেফিন দীপনকে মারে, গৌরী লঙ্কেশকে মারে। হত্যা করে সাজাহান বাচ্চুকে, জাফর ইকবাল স্যারকে। হামলা করে আসিফ মহিউদ্দিনকে। হামলা করে রাফিদা আহমেদকে। হত্যা করে গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকার, এম এস কুলবার্গি, পাকিস্তানের খুররম আর কত নাম বলবো। সব তো জানিও না। নীলয় নীল কিংবা সাজাহান বাচ্চুকে তো দিনের আলোয় মারে। আসিফ মহিউদ্দিনকে দেশ ছাড়া করে। দেশছাড়া করে তসলিমাকে। 

কাজেই  সাজানো সংসার, সুখের সাম্রাজ্য ছেড়ে, মাতৃভুমি ছেড়ে পাড়ি দিতে হল মাসুদ ভাইকে অনিশ্চিত জীবনে পাশের দেশে। এলেন কলকাতায়। কী অসহনীয় একাকী নিরাপত্তাহীন জীবন। 

তবু তিনি বলে চলেন, " অদ্ভুত অন্ধকার চারিদিক। সেখানে এক ঝাঁক সাহসী তরুণ আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে চলেছে জোরকদমে। আমি তাদেরই একজন।"

এখানে সত্যকে পাথেয় করলে ধর্মান্ধরা খুনের চেষ্টায় থাকে।

তবুও তিনি অকপটে ঘোষণা করেন নিজের পরিচয়, আমি মানি না আল্লাহর অস্তিত্ব। জানালেন মিথ্যা কোরাণ, মুহাম্মদের মিথ্যাচার। আমি এক্স- মুসলিম। আমি ইসলামকে ত্যাগ করেছি, আমি মুরতাদ।

আর মুরতাদের জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে সমস্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধরা।

তবু তিনি তার পথে অবিচল। শিরদাঁড়া এতটুকু নোয়াবার নাম নেই। এত অসহায়তার মাঝেও তিনি আওড়াতে পারেন  ম্যাক্সিম গোর্কির বাণী, " ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকবে আক্রোশের আগুন, আর তার তেজে বাঁকা এ মেরুদণ্ড সোজা হয়ে ওঠে"।

তার একটি গল্প শোনাই। মিজানুর আজহারি নামের তার এক সহপাঠী ছিল। সে এখন জাকির নায়েকের শিষ্য। থাকে মালয়েশিয়ায়। কোটি কোটি টাকার মালিক।

মাসুদ ভাই যদি চাইতেন, এই একাকীত্বের নিরাপত্তাহীন অসহায়ত্বের জীবন না কাটিয়ে এই রকম কোটি কোটি টাকার মালিক হতেন, কারণ আজহারির থেকে ইসলামিক জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে মাসুদ ভাই অনেক উপরে। কিন্তু তিনি সুখের জীবন ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন সত্যের পথ, যে পথে প্রতি মুহুর্তে আছে

মৃত্যুকে আলিঙ্গন।। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসাই জীবন, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে। তাহলে আর ভয় কিসের? 


এ গল্পের শেষটায় কিন্তু আমি নিজে আরও আশ্চর্য্যান্বিত।

বন্ধুটির সাথে বহুদিন যোগাযোগ রাখতাম না। ও তখন থেকে পাকাপাকি বম্বের বাসিন্দা। হঠাৎ এই কদিন আগে, মানে গত বৎসর লকডাউনের আগে একবার বাড়ি এসেছিল। আমার সাথে দেখা করতে এলো। এটা সেটা কথার পর জানালো, জানো ওসব বুজরুকির কারবার ছেড়ে দিলাম। আগে আমার যুক্তি ছিল, আমি স্টোন সাপ্লাই না করলেও অন্য কেউ তো করবেই, কারণ এর বাজার আছে, অন্ধবিশ্বাসী খরিদ্দার আছে। 

এখন ভাবলাম, যে করে করুক, আমি জ্যোতিষীদের আর স্টোন সাপ্লাই করবো না। অন্তত এ ব্যবসায়ের একটা সাপ্লায়ার তো কমলো! আর উদ্যোগ থাকলে অনেক কিছুই করা যায়। কলকাতায় স্টোন-জুয়েলারি স্বর্ণ কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেছ? ওটার আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টার। হাওড়া সন্ধ্যাবাজার, বড়বাজারে কলাকার স্ট্রীট, জোড়াসাঁকোয়, ক্যামাক স্ট্রীটে আর কাকুড়গাছিতে শোরুম দিয়েছি। ডোমজুড়ে একটা কারখানাও করেছি। 


আজ আমায় পাবে একাডেমির সামনে গজিয়ে ওঠা দরগা ভাঙার আন্দোলনে, মুক্তমনা হত্যায় রাষ্ট্রের সমর্থনের বিরুদ্ধে রাজপথ অবরোধে, যুক্তিবাদী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতায়। 


ও তো বকবক করছিল। আমি দেখলাম একটা ছেলে ঠিক আলোর বৃত্তে ফিরে এসেছে।

আমি বললাম, কিন্তু ঐ যে বলছিলে, মনসুর হবিবুল্লা না কী যেন?

হো হো করে অট্টহাস্য দিয়ে বললে, মনসুর হবিবুল্লাহ নয়, ব্যবসা হবিবুল্লাহ। কিন্তু প্লিজ, এখনও মানে জিজ্ঞেস কোরোনা।

দুঃখিনী -জামাল আনসারী
Nov. 16, 2024 | অনুগল্প | views:498 | likes:5 | share: 5 | comments:0

আজন্ম দুঃখিনী সীতাদেবী তার একমাত্র গর্ভজাত পুত্র সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছে। কিন্তু লেখাপড়া শিখলেই তো আর  সকলেই শিক্ষিত হয়না! কেউ কেউ শিক্ষিত না হয়ে গর্দভও হয়। বিশ্বভুবন তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও বোধহয়  সিতাদেবীর একমাত্র ছেলে চিরঞ্জিতের মতো দ্বিতীয় গর্দভ এর  সন্ধান পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ?


ভালোবাসা মানুষকে যেমন আপন করে নেয়, তেমনি কখনও কখনও ভালোবাসা কাউকে কাউকে অন্ধ করেও দেয়। চিরঞ্জিত গ্রামেই এক সহপাঠীকে ভালোবেসে একদিন হঠাৎ বুড়ো মাকে একলা বাড়িতে ফেলে  নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।সেই দিন থেকে দীর্ঘ কুড়িটি বসন্ত সীতাদেবীর একমাত্র ছেলের পদশব্দটুকু একটিবারের মতো কান পেতে শোনায় জন্য অধীর আগ্রহে,প্রতিটি মুহূর্ত কাটে। অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো মাটির কুঁড়ে ঘরে পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু বসে বসে থাকলে তো আর দিন চলে না। যা কিছু বিষয় আশয় ছিল বিক্রি করে কোনও কর্মে দিনপাত চলে। তাছাড়া এতদিন ধরে গ্রামের পাড়া প্রতিবেশীরা দয়া বশত যথা সাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করেছে।এই পরনির্ভরশীল জীবন সীতাদেবীর আর ভালো লাগে না।তাই একদিন সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, আর গ্রামে থাকবে না। কিন্তু যাবে কোথায়? শরীরে আর তো সেই আগের মতো তেজ নেই। সে ভাবে,গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে ভিক্ষা করে খাবে! তবুও গ্রামে আর থাকবে না।


একদিন রাত্রে হঠাৎ পাড়া প্রতিবেশীকে না জানিয়েই পরনের শতছিন্ন শাড়িটি পরেই সত্তর বছরের রুগ্ন জীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে চুপিচুপি জন্মের মতো গৃহের মায়া ত্যাগ করে।গভীর রাত্রে খালি পায়ে হেঁটে এসে এক ষ্টেশনে একটি পেসেঞ্জার ট্রেনে ওঠে।সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখে এক বিরাট ঝাঁ চকচকে রেল স্টেশনে সে পড়ে আছে। জীবনে কোনোদিন এতবড় ষ্টেশন দেখার সৌভাগ্য সীতাদেবীর হয় নাই। কিন্তু ষ্টেশনটি যতই আধুনিক ঝাঁ চকচকে হোক না কেন, তাতে কি আর দুঃখিনির পেট ভরবে? অগত্যা ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পাশের দোকানগুলোতে ভিক্ষাবৃত্তি করতে লাগে।


একদিন একটি কাপড়ের দোকানে নতুন নতুন জামা কাপড় পরা পুতুলগুলিকে দেখে অবাক হয়ে ভাবে, যার প্রয়োজন তার দেহের লজ্জা নিবারনের কাপড়টুকু নাই,আর এই পুতুল গুলি? মুহূর্তে নজর পড়ে,দোকানে বিশাল আকারের ফ্লেক্সে বড়বড় অক্ষরে পরিস্কার বাংলায় লেখা" চিরঞ্জিত শাড়ি স্টোর।''  সিতাদেবী তার মলিন কাপড়ের আঁচলে অশ্রু মুছে, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমার ছেলের নাম চিরঞ্জিত!"

কবিতাগুচ্ছ ৫ -কবিরা
Nov. 16, 2024 | কবিতা | views:492 | likes:2 | share: 2 | comments:0

কফি কাপটা

-সুক্রোমণি


হ্রদে ভেসে থাকা জেলেরা আনন্দে খুশি

যেখানে ইচ্ছে ডুব দেয়,

উন্মত্ত হাওয়ায় তোমার চুলগুলো উড়তে থাকে

প্রত্যেকে কাউকে খুঁজে বেড়ায়

কিন্তু এখানে আমি একা

বেঞ্চে বসে জীবনের কথা ভাবছি

কেন কঠিন হয়ে কেটে যাচ্ছে আর দ্রুত

দেখতে দেখতে কফি কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।



নাচার

-প্রদীপ চক্রবর্তী


থালা - ঘটি - বাটি বাজাও

কিছু লাভ হবে না,

বিজ্ঞানের সাহায্যে

দূরে রাখ করোনা।


মূত্র পানে স্বাস্থ্য হানি

আমরা নাচার,

যুক্তির তেজেতে

বধ কুসংস্কার।


গ্রহ-তারা আকাশেতে

দেখেছি সবাই,

ভাগ্যের সাথে তার

যোগাযোগ নাই।


কর্মের হাত ধরে

আসে যে সুফল,

যুক্তিবাদী হলে পরে

হবেই সফল।



শুভ বুদ্ধির উদয় হোক

-জামাল আনসারী


ধর্মের উনুনে নিজেদের রুটি সেঁকে রাজনৈতিক দলের নেতা,

ইতিহাস একমাত্র নীরব সাক্ষী, গুজরাট, দিল্লির হিংসা দেখা।

ধর্ম খাই না মাথায় মাখে? জানে না দেশের প্রান্তিক লোকজন,

তবুও হিংসার লেলিহান শিখায়,পুড়ে তাদেরই আত্মীয় স্বজন।


ঝোপ বুঝে কোপ মারে শয়তান নেতা, বর্ণ চোরা আমের মতো

অরন্যের দাবালন সম  হিংসার বহি শিখা বাড়তে থাকে তত।

ধর্ম এক আফিম! মুহূর্তে গলাগলি পরিণত হয় গোলাগুলি তে,

মানুষ শ্রেষ্ঠ প্রাণী বিশ্বমাঝে! বিস্মৃত হয় এই কান্ড জ্ঞান দেখে।


মানুষকে নিঃস্বার্থ  ভালোবাসার চেয়ে মহান আর কিছু কর্ম নাই

দেখো  মানুষের বুকের রক্ত নিগড়ে, রাজনৈতিক নেতারা খাই।

ধর্ম আর পঙ্কিলময় সর্বনাশা রাজনীতির কূটচালে পড়ে  মানুষ,

আজ বন্ধক রেখেছে তাদের নিজ নিজ বিবেক বুদ্ধি মান- হুশ।


ধর্ম কি মানুষকে খেতে দেয়?পরতে দেয়?তবুও মোদের গর্ব কত?

ধর্মের ঠিকাদার খুলছে ব্যবসাকেন্দ্র দেখো--ব্যাঙের ছাতার মতো।

মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, ভারতে জ্ঞানের আলো আসুক।

ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে, মানুষ শুধু মানুষ পরিচয়ে  বাঁচুক।




ভারতবর্ষ আজও

-সঞ্চারী মজুমদার


আমার নীল হয়ে যাওয়া মৃতদেহের পাশে

বাঁচার উষ্ণতায় মাথা তুলেছে সবুজ দুটি পাতা।

চারিদিকের কলহ সত্বেও আমায় নিয়ে,

সবাই চুপ, রয়েছে শুধুই উদাস নীরবতা।

ভোটের যুদ্ধে শিতলকুচির মাটি, ভিজে উঠেছে

স্বজনহারাদের কান্নায়।

তাইতো এবার আওয়াজ ওঠাও

"বন্ধ শোষণ! আর নয়!!"

উপবাসী শিশুর চোখের জলে আজও

কোনো প্রতিশ্রুতি বাঁধ দিতে পারেনি ;

আজও বিচার পায়নি কত

ধর্ষিতা দলিত তরুণী।

ঘরে ঘরে  উঠুক জ্বলে

প্রতিবাদের আগুন আজ!

জনজাতি, গায়ে ওঠাও

যুদ্ধে যাওয়ার রণসাজ।।




রক্ত গোলাপ

-শুভায়ূ রুডান


তোমার অমানবিক শূন্য হৃদয়ে গোলাপ হয়ে ফোঁটার কথা ছিলো,

আমি সেই গোলাপ নিয়ে প্রত্যেকটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেওয়াল লিখন হয়ে উঠবো‌, কথা ছিলো।

তুমি শ্লোগান হবে, আমি চিৎকার

তুমি হাত রাখবে, আমি ব্যারিকেড

আমরা প্রতিবাদের তীব্রতা মেপে দেখবো শাসকের থার্মোমিটারে, কথা ছিলো।

একদিন ক্ষমতা, তার অহংকার ত্যাগ করতে বাধ্য হবে, হবেই

এই বিশ্বাসে ভর করেই এগোচ্ছিলাম আমরা, হার না মানা দূর্বার গতিতে।

কিন্তু একদিন পাল্টে গেলাম আমরা

আমরা ক্ষমতা হলাম

আমরাও অহংকারী হলাম

আমরা শাসক হয়ে উঠলাম

আমরাও শোষণ করলাম

আমরা বিক্রি হলাম, লোভের কাছে

আরো চাই এর নেশায় আলাদাও হলাম একদিন

আমাদের সৃষ্টিশীলতা আমাদের ত্যাগ করলো

ফলে মৃত হলাম, বোঝার আগেই।

কিন্তু জেনে রেখো প্রিয়তমা কেউ আবার গোলাপ হবে, দেওয়ালে লিখবে প্রতিরোধ

কেউ আবার রক্ত গোলাপ হবে,  নেবে সব অন্যায়ের প্রতিশোধ।

ক্ষমতা একদিন ঠিক ক্ষমতাহীন হবে, হবেই।

ক্ষমতা একদিন রাস্তার সস্তা ধুলোবালি হবে, হবেই।।

বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন -সন্তোষ শর্মা
Nov. 16, 2024 | জ্যোতিষ | views:842 | likes:49 | share: 17 | comments:0

ভারতীয় আইনে জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের কোনও স্বীকৃতি নেই। জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক কোনও আইন স্বীকৃত পেশা নয়। এমনকি, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার ‘দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট, ১৯৫৪’- অনুযায়ী নিষিদ্ধ। অর্থাৎ অ্যাক্ট ১৯৫৪ অনুযায়ী, জ্যোতিষ বা তন্ত্রমন্ত্র চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি এই পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি। দেশের যে কোনও স্থানে জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের সম্মেলনের আয়োজন করাও বেআইনি। কিন্তু আজও  জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের লোকঠকানো বে-আইনী ও বুজরুকির ব্যবসা আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে। জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের এই প্রতারক চক্র আবার সম্মেলনের আয়োজন করছে। এর পরেও ধান্ধাবাজ, প্রতারক এই জ্যোতিষী- তান্ত্রিকদের মনের মধ্যে একটি ভয় সব সময় লেগে থাকেই। সেই ভয়ের নাম ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। কারণ, এই যুক্তিবাদী সমিতি’র জন্য প্রতারক জ্যোতিষীদের ও তান্ত্রিকদের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। তাই এঁরা কোথাও সম্মেলন করার আগেও গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ, মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদিতে বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের উপর ভরসা রাখেন। আজ এমনই একটি ঘটনা লিখছি।   

সোমবার ১৩ জানুয়ারী ২০২০ 

পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রতি সোমবার ও  বৃস্পতিবার প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ –এ জ্যোতিষীদের সম্মেলনের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ১৩ জানুয়ারী প্রকাশিত ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ থেকে আমরা জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ -এ  জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। বিজ্ঞাপনটি এখানে তুলে ধরছি।

  অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন

 রবীন্দ্রকাডেমির অ্যানুয়াল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অ্যান্ড কনভোকেসন-২০২০ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ১৮ই জানুয়ারী ( শনিবার) নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। 

দেশ বিদেশের খ্যাতনামা জ্যোতিষী, বাস্তুবিদ, তান্ত্রিক, সাধু ও মহাপুরুষগণের উপস্থিতিতে এক বিরল অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে চলেছে পুরুলিয়া। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য প্রবেশপত্র  সংগ্রহ করুন।

 যোগাযোগ

 সাউথ কোলকাতা অ্যাসট্রলজি অ্যান্ড বাস্তু সায়েন্স একাডেমি

 পুরুলিয়া শাখা

জ্যোতিষ সম্মেলনের এই বিজ্ঞাপন দেখার পরেই আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ থেকে সিদ্ধান্ত নিই এই সম্মেলনের বিরুদ্ধে  পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার। কারণ, যে জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। সেই বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের এবং তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। তাই পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ-এ  জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আমরা যুক্তিবাদীরা অবশ্যই দাবি জানাব। 

 বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি ২০২০

১৩ জানুয়ারীর ‘পুরুলিয়া দর্পণ’–এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত জ্যোতিষ ও বাস্তুশাস্ত্রের সম্নেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ১৮ই জানুয়ারী নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। তাই যুক্তিবাদী সমিতি সিদ্ধান্ত নেয়, এই বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার। কেন এই অভিযোগ ? এর উত্তরে শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর, ২০০২-এ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর তুলে ধরছি।

   আনন্দবাজার পত্রিকা

 ২০ ডিসেম্বর, ২০০২

পেশাই নয় জ্যোতিষ, বৃত্তিকর দিতে গিয়ে জানলেন জ্যোতিষী

 অভিজিৎ ঘোষাল

 আইন মানা নাগরিক হিসাবে বৃত্তিকর দিতে গিয়ে তিনি জানলেন, জ্যোতিষচর্চা এই রাজ্যে পেশা হিসাবেই গণ্য নয়। হতবাক তিনি। কারণ, দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী মাত্র কিছুদিন জ্যোতিশাস্ত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের আওতায় এনেছেন। অথচ তাঁর কর দেওয়ার আবেদন নাচক করে বৃত্তিকর দফতর বলেছে, জ্যোতিষশাস্ত্রকে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই চর্চা দেশের আইন পরিপন্থী। ওই  ‘অপরাধ’-এর জন্য জেল ও জরিমানা দুই-ই হতে পারে।

দেশে মনুবাদের ক্রমশ জোরালো হাওয়া উপেক্ষা করে বৃত্তিকর আধিকারিক অশোককুমার দাস-এর নজিরবিহীন নির্দেশে যা বলা হয়েছে, তা বস্তুত জ্যোতিষচর্চা নিয়ে বিতর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। অশোক বাবু লিখেছেন,  বৃত্তিকর দেওয়ার আবেদন অনুমোদনের সময় সেটা সংশ্লিষ্ট সমাজে স্বীকৃত আইনসিদ্ধ কিনা সেটা প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য।

 তাঁর মতে এই পরীক্ষাতেই জ্যোতিষশাস্ত্র ডাহা ফেল।

 তাঁর নির্দেশে অশোকবাবু লিখেছেন, ভারতীয় আইনে জ্যোতিষশাস্ত্রের কোন স্বীকৃতি নেই। এমনকি, এর চর্চা ও প্রচার ১৯৫৪ সালের ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ফলে কনসালটেন্ট বা উপদেষ্টা হিসাবে আবেদন করলেও তাঁর পেশা আইনত গ্রাহ্য নয় - বলে ওই জ্যোতিষীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অশোক বাবু।

 যার বিরুদ্ধে এই রায়, বালিগঞ্জের সেই জ্যোতিষী মণিশংকর দাশগুপ্ত মুখ খুলে বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে নারাজ। তাঁর সাফ কথা, কর দিতে ইচ্ছুক নাগরিকের কাছ থেকে দেউলিয়া সরকার যদি কর নিতে না -চায়, তাহলে তাঁর কিছু বলার নেই। তবে যে-বৃত্তি তাঁকে আয়কর দিতে বাধা দেয় না,  সেই বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা দিতে রাজ্য সরকারের বাধা কোথায়? নির্দেশ হাতে পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের পরেও সেটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না। তবে তিনি স্বীকার করেছেন জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত উত্তর কলকাতা অ্যাস্ট্রলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্টের যে-সার্টিফিকেট তিনি বৃত্তিকর দফতরে পেশ করেছিলেন, তার আইনি স্বীকৃতি নেই বলে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন অশোকবাবু। মণিশংকরবাবুর বক্তব্য, তাঁদের পেশায় ‘লাইসেন্সসিয়েট সার্টিফিকেট’- এর প্রচলন নেই।

যে পেশার ওপর বহু শিক্ষিত মানুষের আস্থা আছে, সেই জ্যোতিষচর্চাকে কেন তিনি এভাবে নস্যাৎ করলেন ? গোটা বিষয়টি নিয়ে অশোকবাবু মুখে কুলুপ  আঁটলেও তাঁর নির্দেশেই পরিষ্কার তাঁর যুক্তি। ১৯৫৪ সালের ওই আইনে দেশের সর্বোচ্চ আইনসভার অর্থাৎ সংসদ এই পেশাকে এইভাবে বর্ণনা করেছে, পেশাটি অনৈতিক, অবাঞ্চিত, বেআইনি, মানুষের সুস্বাস্থ্যের ক্ষতিকারক ও মনুষ্য সভ্যতার পক্ষে হানিকারক।

 বছর পয়তাল্লিশের মণিশংকরবাবু ১০-১১ বছর ধরে মানুষের ভাগ্যগণনাকেই তাঁর জীবিকা করেছেন। মণিশংকরবাবু জানিয়েছেন, কোনও অলঙ্কার বা গ্রহরত্নের দোকানে বসে জ্যোতিষচর্চা করেন না তিনি। ফলে ভাগ্যগণনা ছাড়া অন্য কোনও স্বার্থ নেই তাঁর। কলকাতায় তো বটেই, দিল্লিতেও তাঁর বেশ ভাল পসার। বিদেশেও তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ আছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে দু’দিন টানা দেড় ঘণ্টা ধরে জ্যোতিষশাস্ত্র কী ও কেন, বৃত্তিকর আধিকারিকদের সেটা বোঝাতে যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। 

 এই খবর থেকে দিনের আলোর মত এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী করে একটি জ্যোতিষ সংগঠনকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামকে জ্যোতিষ সম্মেলন করার জন্য ভাড়া দেওয়া হল ? বেআইনী এই জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবিতে যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত, জেলা শাসক ও কলেজের প্রিন্সিপালকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

 




প্রতিলিপি  

প্রিন্সিপাল                                                                                    নিস্তারিণী মহিলা কলেজ

বিষয়ঃ জ্যোতিষ বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি।

 

 মহাশয়া,

 আমরা অর্থাৎ ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সদস্যরা সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’  ( তারিখ - ১৩ জানুয়ারী, ২০২০ ) থেকে জানতে পারি যে, আপনার কলেজের অডিটোরিয়ামে জ্যোতিষীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৮ জানুয়ারী, ২০২০, শনিবার।  তাই আপনার অবগতির জন্য জানাই যে, দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী, জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী ‘জ্যোতিষ’ পেশা হিসেবে গণ্য নয়, যেমন পেশাই নয় ‘খুন করা’ বা  ‘স্মাগলিং’। এছাড়া জ্যোতিষ শিক্ষার কোন বিধিবদ্ধ স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানও ভারতে নেই। জ্যোতিষ একটি অবিজ্ঞান বা বুজরুকি। তাই সরকারী অডিটোরিয়ামে বেআইনি পেশাদার বা বুজরুকদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি।

তাই আপনার প্রতি আমাদের তথা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ পুরুলিয়া জেলা শাখার সদস্যদের অনুরোধ দয়া করে জ্যোতিষের মত বেআইনি, নিষিদ্ধ, অবাঞ্ছিত, অনৈতিক এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক পেশাদার বা চর্চাকারীদের সম্মেলনের জন্য সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া বাতিল করে বাধিত করবেন।

 

 

 

বিনীত

 মধুসূদন মাহাত,

 সম্পাদক

 পুরুলিয়া জেলা শাখা

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি 

 প্রতিলিপি –

 ১) জেলাশাসক, পুরুলিয়া

 মধুসূদন মাহাত এই চিঠিটি আমাকেও ওয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর পর ফোন করে বললেন, “ সরকারী কলেজের অডিটরিয়ামে জ্যোতিষী নামক বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ঐ কলেজে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐদিন কলেজ বন্ধ থাকায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া যায়নি। কাল সকালে আবার যাবো। ” আমি বললাম, “ ঠিক আছে। নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানোর পর প্রিন্সিপালের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে আমাকে জানাও। আমি এই খবরটি মিডিয়াতে প্রকাশিত করার চেষ্টা করবো। ”

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

 আজ আবার মধুসূদন মাহাত ও যুক্তিবাদী সমিতি’র উপদেষ্টা জয়ন্ত দাস ঐ সরকারী কলেজে যান। এদিন কলেজ খোলা থাকলেও প্রিন্সিপাল ডঃ ইন্দ্রানী দেবকে কলেজ পাওয়া যায়নি। এরপর কলেজ থেকেই ফোন নং নিয়ে প্রিন্সিপালকে ফোনে ধরেন জয়ন্তবাবু। জয়ন্তবাবু বলেন, “ আপনার একটি চিঠি রয়েছে। কিন্তু রিসিভ করার কেউই নেই। একটু ফোন করে বলে দিন যেন চিঠিটা রিসিভ করে নিক। ”  এরপর প্রিন্সিপাল বলে দেওয়াতে চিঠিটা একজন রিসিভ করেন। 

এরপর যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে মধুসূদন নিজে কলেজের প্রিন্সিপালকে ফোন করে প্রশ্ন করলেন, “ যেখানে জ্যোতিষ পেশা বেআইনি, সেখানে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত জ্যোতিষীদের সরকারি কলেজের কলেজের অডিটোরিয়াম কী করে ভাড়া দেওয়া হল?  যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে ওই অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানো হচ্ছে। চিঠিতে আমরা জানিয়েছি, যেহেতু দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ অনুসারে জ্যোতিষ চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোফেসন এন্ড ট্যাক্স অনুযায়ী জ্যোতিষ পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটা বেআইনি। জ্যোতিষীদের সম্মেলন করতে দিলে আগামী দিনে হয়তো পতিতা, স্মাগলার, খুনিরাও সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া নেবে। ”

 এই শুনে প্রিন্সিপাল জানালেন, “ জ্যোতিষ পেশা বেআইনি নয়। জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হলে জ্যোতিষীরা চেম্বার খুলে বসে থাকতে পারতেন না। যদি জ্যোতিষ চর্চা বেআইনি হয়, তাহলে জ্যোতিষীদের পুলিশে ধরত। যদি জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হয়, তবে জ্যোতিষীদের এত রমরমা হত না। ” এদিকে তিনি নিজেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরোধী ব্যক্তি ও নিজেকে একজন বিজ্ঞান মঞ্চের সক্রিয়কর্মী দাবি করেন।

 বাহ কেয়া বাত! 

 এদিকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে যুক্তিবাদী সমিতি কলেজের প্রিন্সিপাল ও জেলাশাসককে পাঠানো চিঠির উপর ভিত্তি করে দৈনিক ‘একদিন’ পত্রিকার সাংবাদিক কৃশানু দে’কে দিলাম। এদিকে যুক্তিবাদী সমিতি’র চিঠির প্রতিলিপি সোশাল মিডিয়া ও ফেসবুকে পোস্ট করে দেওয়ায়, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়।

  শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 সকালে স্মার্ট ফোনের ইন্টারনেট অন করে আজ প্রকাশিত ‘একদিন’-এর ই-পেপারে সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি নিয়ে খবরটি পড়ছিলাম। খবরটি হল --

 

 একদিন

 ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 জ্যোতিষচর্চায় কলেজে বিতর্ক 

 নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ পুরুলিয়ার এক মহিলা কলেজের প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার আয়োজন করা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই অভিযোগে শুক্রবার কলেজ কর্তিপক্ষকে লিখিত অভিযোগ জানাল ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়া জেলা শাখা। আজ অর্থাৎ ওই প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। সমিতি প্রশ্ন তুলেছে, কলেজের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিভাবে জ্যোতিষ চর্চার মতো বেআইনি অনুষ্ঠান  হতে পারে। সংগঠনের জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র তরফে লিখিত এই আবেদন কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অবজেকসনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট আইন ১৯৫৪’ অনুয়ায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা এবং প্রচার করা বেআইনি।  

একটু পরে পুরুলিয়া থেকে মধুসূদন ফোন করে বললেন, “ সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে আমার লেখা চিঠির কথা জ্যোতিষীদের কানে পৌঁছে গেছে। সম্মেলন শুরু করার আগেই জ্যোতিষীরা আতঙ্কিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তার কারণ, আমরা যুক্তিবাদীরা ওই জ্যোতিষ সম্মেলনে হাঙ্গামা করতে পারি। যুক্তিবাদী সমিতি’র নেতার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লণ্ডভণ্ড করে না দেয়। এই ভয়ে জ্যোতিষীদের সংগঠক সম্ভবত পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি সঞ্জয়কুমার চক্রবর্তীর স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এরপরই পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি তাঁর সিভিক ভল্যান্টিয়ারের মাধ্যমে সকাল ১১ টার সময় জ্যোতিষ বিষয়ে আলোচনা এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করার তাগিদে থানায় ডেকে পাঠিয়েছে। ”

 

 মধুসূদনের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। হেসে বললাম, “ জ্যোতিষীদের একি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। যে জ্যোতিষী তাঁর গ্রাহকের যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে গ্রহ-রত্ন, পাথর, তাবিজ, কবজ, মাদুলি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। আর যখন যুক্তিবাদী সমিতি’র সংকট ঘাড়ে চেপে ধরে তখন আবার এই জ্যোতিষীরাই গ্রহ-রত্ন,পাথর, তাবিজ, কবজ ইত্যাদির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের সাহায্য চায়! যুক্তিবাদী সমিতি’কে আটকাতে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্য! হায় রে প্রতারক জ্যোতিষীরা। এই জনই আমার যুক্তিবাদীরা বুক ঠুকে বলে থাকি, “ যে যত বড় জ্যোতিষী সে ততো বড় প্রতারক। ”

 

মধুসূদন বললেন, “জ্যোতিষীরা কেউ-ই জ্যোতিষ শাস্ত্রে তিল-মাত্র বিশ্বাস করে না। জ্যোতিষীরা তাঁদের জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রহ-রত্ন ধারণ করে না। অসুখ হলে ডাক্তার দেখায়।  মামলা হলে উকিল রাখেন। এমনকি ভাগ্যের উপর নির্ভর না করে খদ্দের ধরতে পত্র- পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু লোক ঠকানোর জন্য বুজরুকি রূপ ধারণ করে থাকা এই জ্যোতিষীরা হাতের আঙ্গুলগুলিতে, গলায় গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ ইত্যাদি ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এইসব হিজিবিজি জিনিসে এই জ্যোতিষীদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। ”

 আমি বললাম, “জ্যোতিষ সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করার জন্য যখন থানার ওসি ডেকে পাঠিয়েছেন, তোমরা অবশই যাও। এটা আমাদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ। পুলিকেও এটা  বোঝানো যাবে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। পুলিশের সঙ্গে দেখা করার পর আমাকে সবকিছু জানাবে। ”

 এদিকে আমার দুষ্টুবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৩ জানুয়ারী ‘পুরুলিয়া দর্পণ’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে আজ পুরুলিয়ার নিস্তারিনী মহিলা কলেজে জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। তাই একটু খুঁচিয়ে দেখার জন্য ওই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সংগঠনের সভাপতি অভিজ্ঞান আচার্যকে ফোন করলাম। আমি প্রশ্ন করলাম, “ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে আপনাদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। সমিতি’র জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র দাবি, ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বে-আইনি। এরপরেও জ্যোতিষ সম্মেলন কি করে আয়োজিত হচ্ছে ? ”

 আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই আচার্যজী রেগে অগ্নিশর্মা।  “ জ্যোতিষ বেআইনি নয়। যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে আমাদের সম্মেলন বন্ধ করে দেখাক ওঁরা ? ” এই বলে উনি ফোন কেটে দিলেন।

 

প্রায় দু’ঘণ্টা পরে মধুসূদন আবার আমাকে ফোন করে বললেন, “ আমি ও জয়ন্তদা থানায় গিয়েছিলাম। ওসি জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনা করেন। ওসি কোনও সময়  জ্যোতিষের পক্ষে, কোনও সময় বিপক্ষে কথা বলেন। এরপর তিনি আমাদের কাছে জানতে চান ওই জ্যোতিষ সম্মলনে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতি’র কোনও বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে কি না ? আমরা জানাই, আমাদের কোন বিক্ষোভ কর্মসূচি নেই, ব্যাপারটা আমরা প্রশাসনের মধ্য দিয়েই করতে চাই। এরপরেই দেখলাম ওসি জ্যোতিষ সম্মেলনের আয়োজকদের ফোন করে আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের ভয়ের কিছু নেই, যুক্তিবাদীরা হাঙ্গামা করবে না। এর ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল জ্যোতিষীরা যুক্তিবাদী সমিতি’কে ভয় করেছিল। তাই ভাগ্য, কুষ্ঠি, গ্রহ-রত্ন,আংটি, মাদুলির ইত্যাদির উপর বিশ্বাস হারিয়ে, শেষ পর্যন্ত পুলিশের উপর ভরসা রেখেছিল। জেলাশাসক ওসিকে তদন্ত করতে বলেছেন, এই দাবিটা ওসি  আসলে মিথ্যা বলেছিলেন। আসল সত্যিটা হল, জ্যোতিষীরা সম্ভবত টাকার বিনিময়ে ওসিকে বশে এনেছিলেন নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই।”

 আমি বললাম, “ ভাবতে অবাক লাগছে, বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের সরকারি সভাগারে সম্মেলন বন্ধ করার পরিবর্তে পুলিশ যুক্তিবাদীদের থানায় ডেকে পাঠাচ্ছে। একই সঙ্গে শুধু মাত্র টাকার বিনিময়ে এক প্রিন্সিপাল জ্যোতিষকে আইনি বলে দাবি করেছে। এঁরা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত, তার জবাব সময় দেবে। কিন্তু জ্যোতিষীদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য আমরা যুক্তিবাদীরা যে বিশাল কাজ করেছি, তা নতুন প্রজন্মের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

 ‌ব্যারাকপুর, কলকাতা - ১২২

 মোবাইল : ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

প্রেম, যৌনতা এবং.. -অভিষেক দে
Nov. 16, 2024 | প্রেম | views:290 | likes:45 | share: 0 | comments:0

একজোড়া নারী- পুরুষের ভেতর প্রেম বা ভালোবাসা মোটেই অপরাধ,বে-আইনি  কিংবা নোংরামো নয়। বরং সুস্থ, স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রেমের কিছু পূর্ব-শর্ত আছে। যেমন বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা,মতাদর্শগত মিল এবং স্বনির্ভরতা।


দু-জন মানুষের ভেতর প্রেম, ভালোবাসা থাকলে যৌনতা কিংবা দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা সেই সম্পর্কে যাওয়া টা মোটেই অপরাধ কিংবা নোংরা মানসিকতার লক্ষণ নয়। কারণ,প্রেম থাকলে যৌনতাও থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেটা অবশ্যই হবে দু-জনের সম্মতিতে। কখনই জোর করে নয়। জোর করে দৈহিক সম্পর্কে যাওয়া ধর্ষণের সামিল। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর শাস্তি আজীবন জেল কিংবা সোজা ফাঁসি। যৌনতাকে বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন নোংরা, অতি-গোপনীয় কিছু। এটা অবশ্যই শূচিবাতিকগ্রস্ততা,যা একটা মানসিক রোগ।


তন্ময় এবং মেঘনা দ-ুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনষ্ক তরুণ-তরুণী। দু-জনেই চাকুরীজীবী। দু-জনের ভেতর প্রেম এবং সেখান থেকে একসময় বিয়ে। দু-জনের যৌনজীবন টাও স্বাভাবিক ছন্দেই চলছিল। এরই মধ্যে জন্ম নেয় মেঘনা এবং তন্ময়ের কন্যা সন্তান। বর্তমানে কন্যার বয়স পাঁচ। কয়েকবছর সব ঠিকঠাক থাকার পর আচমকা দু-জনের সম্পর্কে চিঁড় ধরে। সামান্য ছোট খাটো বিষয়েও প্রায়শই মনোমালিন্য এবং শেষে ঝগড়া। সব তো প্রথম থেকে সুন্দর ছন্দেই চলেছিল, তাহলে হটাৎ কি এমন হলো যাতে দু-জনের ভেতর আজ মতের এবং  মনের অমিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে? আসুন মুক্তমনে উত্তর খুঁজি।


মেঘনার বক্তব্য : " তন্ময়ের কোনো চয়েস বা পছন্দ বলে কিছু নেই। কিসব যে হিজিবিজি,উল্টোপাল্টা রঙের শাড়ি,কসমেটিক্স কিনে আনে। বাধ্য হয়ে ফের দোকানে ওকে পাঠাতেই হয় পালটে আনতে। আমি কি ধরনের শাড়ি কিনি,কী জুয়েলারি, কসমেটিক্স ব্যবহার করি সেসবের খবরও রাখেনা। সে কথা বললেই আবার বাবুর রাগ হয়।যত্তসব,হুঁ। মেয়েটা যে বড় হচ্ছে সেদিকে বাবুর যেন ধ্যান নেই। আজকাল হটাৎ করেই তেনার খিদে জেগে ওঠে। এই তো সেদিনের ঘটনা, রান্না করছি আর উনি পেছন থেকে এসে কোমড় জরিয়ে গালে একটা চুমু। দিয়েছি খুন্তি দিয়ে সলিড একটা। বুড়ো বয়সে ভিমরতি "।  


মেঘনার উদ্দেশ্যে বলা যায় : আপনার বর না হয় একটা উল্টোপাল্টা শাড়ি কিংবা কসমেটিক্স, জুয়েলারি কিনে এনেছেন, এবং সেটা হয়তো আপনার অপছন্দই হলো। কিন্তু সেটার জন্য আপনি তন্ময় বাবুকে যে কয়েকটা কড়া কথা শোনালেন সেটা কি ঠিক হলো? উনি কিন্তু আপনার জন্য খুশি মনেই শাড়ি ইত্যাদি কিনেছেন। আপনি যদি হেসে বলতেন ' খুব সুন্দর হয়েছে ' তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? না হয় উনাকে পরে একটু রসিকতার ছলেই বোঝাতেন যে সেটা আপনার ঠিক পছন্দ হয়নি। আপনি উনাকে সঙ্গে করে দোকানে গিয়ে না হয় কিনেই আনতেন আপনার পছন্দসই জিনিষ। এতে আপনার বর ও খুশি হতেন। দেখতেন আগামীদিনে উনি আপনার পছন্দসই জিনিষ ই ঠিক কিনে এনে দিতেন। একটা ছোট্ট কথা যেখানে ঝগড়ার পরিবর্তে খুশি আনতে পারে, সেখানে কি খুবই প্রয়োজন ঝগড়া করে নিজের এবং অপরের রক্তচাপ বাড়ানোর। মেঘনা, আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখুন তো সত্যি কি আপনি আগের চেয়ে বদলে যাননি? আপনি তন্ময় বাবুকে দুঃখ দিতে চান বলেই কি দুঃখ দিচ্ছেন? আর সেক্স। সেটা আপনিই ভালোই বুঝবেন। এই বিষয়ে কোনো সমস্যা হলে উনাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝান যে এভাবে মেয়ের সামনে এইসব দুষ্টুমি না করে রাতে বিছানায় করলে বরং ভালা হয়। অবশ্যই সেটা আপনার সম্মতিতেই, জোর করে নয়। মেঘনা, আপনি কি জানেন একজন সুস্থসবল মানুষ ৬০ বছর বয়সের পরেও যৌনতা কে উপভোগ করতে পারেন? নিশ্চই জানেন না। তাই যৌনতাকে (সেক্স) নোংরামো না ভেবে স্বাভাবিক ভাবে সেটাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করুন অথবা সরাসরি না বলে দিন বর কে। কিংবা আজ আপনার বরকে  পছন্দ না হলে সেটাও সরাসরি জানিয়ে দিন। মনে রাখবেন জোর করে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না।


আচ্ছা, মেঘনা আপনি নিশ্চই রান্নার নতুন রেসিপি টা ভালো হয়েছে কিনা বরকে জিজ্ঞেসা করেছেন। বর নিশ্চই আপনার রান্নার তারিফও করেছেন। অপছন্দ হলেও আপনাকে হয়তো খুশি করার জন্য রান্নার প্রশংসা করেছেন। উনি আপনাকে দুঃখ দিতে চাননা তাই মিথ্যেটুকু বলেছেন আর আপনিও পরে খেতে গিয়ে দেখেছেন রান্না ভালো হয়নি।ঝাল বেশি কিংবা নুনের পরিমাণ কম। 


তন্ময়ের বক্তব্য : " সেইদিন টা ফিরে পেতে চাই বড্ড বেশি করে যখন আমাদের বিয়ে হয়নি। মানে দু-জনে প্রেম করতাম, সেই কলেজের দিন গুলোতে। কিন্তু কেন? আসলে সেসব দিনে আমাদের ভেতর মনের অমিল ছিলোনা। ছিলোনা মতের অমিলও। কিন্তু আজ সেসব অতীত। মেঘনা আজকাল বড্ড বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে হয়ে গেছে। ভালো,খারাপ সবেতেই ঝগড়া করে। এই তো কয়েকদিন আগেকার ঘটনা, বউ কে বললাম অফিসের কয়েকজন কলিগ আসবে, একটা মিটিং করবো বাড়িতে বসে। কিছু স্ন্যাক্স বানিয়ে দাও। উনি মুখ ঝামটা দিলেন। অগত্যা একটা কফি শপে বসেই আলোচনা সারতে হলো। আজকাল উনাকে আদর টাদর করতে গেলেও যেন কোর্ট থেকে পারমিশন নিতে হবে, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে। আসলে সন্দেহ। বুঝলেন সন্দেহ। আমার অফিসের একজন মহিলা কলিগ একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন একটা পেন ড্রাইভে লোড করা কিছু জরুরি ডকুমেন্ট দিতে। তা আমার বউ এর কিভাবে যেন মনে হয়েছে যে ঐ মহিলার সাথে আমি নাকি ফষ্টিনষ্টি করে বেরাচ্ছি। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ যে ওর ভুল ধারনা সেটা বোঝানোই মুশকিল। ইদানীং ওর ঝগড়ুটে স্বভাবের কারনে আমিও পালটা ঝগড়া করি। ওকে জ্বালাই, আনন্দ পাই। মনে মনে বলি, দেখ কেমন লাগে "। 


তন্ময়ের উদ্দেশ্যে জানাবো : চোখের বদলা চোখ এবং রক্তের বদলা রক্ত এই নীতি নিয়ে চললে পৃথিবী একদিন মানবশূন্য হবেই।ভাবছেন কেন এমন বলছি? তাহলে শুনুন মশাই, বউ না হয় আপনার কথামতো, কারণে অকারণে ঝগড়া করছেন মানলাম কিন্তু আপনিও তো পালটা ঝগড়ার পথেই যাচ্ছেন। সেটা কি ঠিক কাজ ? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আজ আপনাদের ভেতর যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে তার পেছনে একটাই কারন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটা হলো আপনার সেই মহিলা অফিস কলিগ। বিশ্বাস বড়ই বেয়াড়া শব্দ। যা গড়তে সময় নেয় কিন্তু ভাঙ্গতে সময় বেশি নেয়না। আপনি নিজেদের সম্পর্ক কে আবার আগের মতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক হলে কয়েকটা কাজ করুন। উইকএন্ডে সপরিবার বাইরে ঘুরতে বেরান। লাঞ্চ অথবা ডিনার টাও বাইরেই সেরে নিন। আরেকটা দারুণ  কাজও করতে পারেন। আপনার কন্যাকে প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে দু-জন মিঞা বিবি মিলে বেরিয়ে পড়ুন কেনাকাটা করতে, সিনেমা দেখতে এবং অবশ্যই বাইরে খেতে। রোমান্টিকতা আনতে ক্যান্ডল লাইট ডিনার ও করতে পারেন। কারণবারি চাখতে চাইলে বউ এর অনুমতি নিয়েই চাখবেন সেখানে। বউ মানা করলে ভুলেও জেদ দেখাবেন না। যেদিন আপনি বাড়িতে থাকবেন, অর্থাৎ অফিসের ছুটি সেদিন অবশ্যই চেষ্টা করুন বাড়ির কাজে বউকে সাহায্য করতে ( বউ এর কোমড় জরিয়ে ধরার চিন্তা ছেড়ে দিয়ে )। সাথে যে মহিলা কে নিয়ে আপনাদের ভেতর অশান্তির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে সেটা নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করুন। বউকে সবটা জানান। সম্ভব হলে উনাকে সরাসরি বলুন যেন নিজেই গোয়েন্দাগিরি করে দেখে যে আপনি অন্য মহিলার সাথে কোনো রকমের গোপন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন কিনা।


মনে রাখবেন সুস্থ আলোচনার মাধ্যমেই কিন্ত অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলা সম্ভব। চাইলে কোনো মনোবিদ কিংবা মনোরোগ চিকিৎসক এর পরামর্শও নিতে পারেন। আখেরে লাভ আপনার। আর দৈহিক সম্পর্ক। সেটা নিয়েও বউ এর সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। উনার অপছন্দ হলে না হয় এড়িয়েই যান আপাতত। উনাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝান সেক্স কোনো নোংরামো নয়, বরং দু-জন সুস্থ সবল মানুষের ভেতর সেক্স হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। দেখবেন সব সুন্দর ভাবে মিটে যাবে। একদিন আপনারাই একে অপরকে বলবেন " হ্যাপি ম্যারেড লাইফ "।

মাউন্ট রাধানাথের খোঁজে -সুকৃতি দাস
Nov. 16, 2024 | ইতিহাস | views:825 | likes:48 | share: 3 | comments:0

সালটা ছিল ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ। দার্জিলিঙে তখন উত্তর- পূর্ব ভারতের পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। একদিন সকালবেলা কলোনেল অ্যান্দ্রিউ স্কটের অফিসে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন একজন ভারতীয় পরিগণক। তিনি প্রবেশ করা মাত্রই স্বউল্লাসে চেঁচিয়ে বললেন -” স্যার! আমি পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত খুঁজে পেয়েছি। " 

প্রথমে স্কট নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। কারণ তখন কাঞ্চনজঙ্ঘাই  ছিল পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত। তিনি ওই ভারতীয় পরিগণকের কাছে বিশদে এই বিষয়ে জানতে চাইলেন। তখন ওই ভারতীয় পরিগণক ওনার সামনে মেলে ধরলেন তার গণনার হিসাব। নিপুণ এই গণনা অনুযায়ী ওই উচ্চতম মাউন্টেনের উচ্চতা হল ২৯০০০ ফুট যা কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে অনেকবেশি। কিন্তু স্কট এই উচ্চতার সাথে আরও ২ ফুট যোগ করে প্রকাশ করলেন এই মানকে আরো বিশ্বাসযোগ্য বানানোর জন্য। 

১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হল এই পর্বতের কথা। স্কট এই পর্বতের নাম দিলেন তার পূর্বসূরি কলোনেল এভারেস্টের নাম অনুসারে মাউন্ট এভারেস্ট। সম্মান ঝাঁপিয়ে পড়ল স্কটের উপর। ওই বছরই  রয়্যাল জিওগ্র্যাফিকাল সোসাইটি তাকে ভূষিত করলেন স্বর্ণ পদক দিয়ে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্বাচিত হলেন রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হিসাবে। কিন্তু যিনি প্রথম এই পর্বতের উচ্চতা গণনা করেছিলেন। সেই ভারতীয় পরিগণকের নাম রয়ে গেল অন্ধকারে। 


কিন্তু কে ছিলেন এই ভারতীয় পরিগণক ? 


তিনি হলেন রাধানাথ শিকদার। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিতুরাম শিকদার এবং দেবকী শিকদারের কোল আলো করে জোড়াসাঁকোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই অসাধারণ মেধা ও বুদ্ধিযুক্ত গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার। 

যে কৈশোরে কিশোরদের হাতে শোভা পায় ডাঙ্গুলি আর ঘুড়ি। সেই সময়ে তিনি ডুবে থাকতেন  ইউক্লিডের জ্যামিতি, থমাস জেপ্সনের অ্যানালাইটিকাল জ্যামিতি, ওয়াইন্ডহাউসের অ্যাস্ট্রোনমি বইয়ের পাতায়। সেই বয়সেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন  দুটি বৃত্তের সাধারণ স্পর্শক আঁকার নয়া পদ্ধতি। 


কর্মক্ষেত্রের শুরু  


১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে কলোনেল জর্জ এভারেস্ট হন্যে খুঁজছিলেন এমন এক গণিতবিদকে যার কাছে স্ফেরিক্যাল ত্রিকোনামিতি একদম জলভাতের মতো পরিষ্কার। গ্রেট ট্রিগোনামেট্রিক সার্ভের দ্বারা ভারত ও ভারত সংলগ্ন অংশের নিপুণ পরিমাপ করার জন্য এমন গণিতবিদের বিশেষ প্রয়োজন পড়েছিল। অবশেষে অধ্যাপক জন টাইটেলার তাকে হদিস দিলেন তার ছাত্র রাধানাথ শিকদারের। এরপর তার পরামর্শ মতো রাধানাথকে পরিগণকের কাজে নিযুক্ত করলেন জর্জ এভারেস্ট। 

প্রথমে কাজের সূত্রে তাকে পাঠানো হল দেরাদুনে। সেখানে তিনি তার কাজের মাধ্যমে মুগ্ধ করে দিলেন সবাইকে। তিনি তার গণনার কাজে প্রথাগত গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করতেন না। তার নব্য আবিষ্কৃত গণনা পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি খুব দ্রুত আর নির্ভুলভাবে করে দিতেন সব গণনার কাজ। 

১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে জর্জ এভারেস্টের পরিবর্তে কাজে নিযুক্ত হলেন  অ্যান্দ্রিউ স্টার্ট।  ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে একজন ত্রিরিশ টাকা বেতনভোগী পরিগণক থেকে রাধানাথ শিকদারকে উন্নীত করা হল প্রধান পরিগণকের পদে। তিনি হলেন আবহাওয়া দপ্তরের অধীক্ষক। সেই সময় কলোনেল অ্যান্দ্রিউ স্টার্টের নির্দেশে তিনি পর্বতের উচ্চতা গণনার কাজ শুরু করলেন এবং তিনি গণনা করলেন উচ্চতম পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা। 


 অন্যান্য কর্মকাণ্ড 


রাধানাথ শিকদার শুধু একজন গণিতবিদ ছিলেন না। তার জনহিতকর কাজের বহু নিদর্শন রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। 

ম্যাজিস্ট্রেট ভ্যান্সিটারটের অত্যাচারে নিষ্পেষিত অসহায় সার্ভে শ্রমিকদের কষ্টে কেঁদে উঠেছিল তার মন। তিনি এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করেছিলেন স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। তার জন্য শাস্তিস্বরূপ তাকে দিতে হয়েছিল ২০০ টাকা জরিমানা। সেই সময় তার মাসিক রোজগার ছিল মাত্র ৩০ টাকা। 

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধু প্যারিচাঁদ মিত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে শুরু করেছিলেন মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি প্রচার করেছিলেন নারীশিক্ষার কথা। 


জীবনের শেষ দিনগুলো কাটি‍য়েছিলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশনের (বর্তমানে স্কটিশ চার্জ কলেজ) শিক্ষক হিসাবে। অবশেষে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলে গেলেন অমৃতলোকে। 

২০০৪ সালে তাঁর নামাঙ্কিত পোস্টাল ষ্ট্যাম্প ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। কিন্তু জীবিতকালে সেই অর্থে সম্মান পায়নি তার অবিস্মরণীয় প্রতিভা। 

হয়ত ভারতবর্ষ সেই সময়ে স্বাধীন থাকলে আজকে মাউন্ট এভারেস্টের নাম হত - মাউন্ট রাধানাথ। 


তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া

বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না -চিত্রদীপ সোম
Nov. 16, 2024 | বৌদ্ধধর্ম | views:817 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না। ছিলেন একান্তভাবেই দোষ গুন মিশিয়ে একজন মানুষ। বরঙ ছিলেন সেই ব্যতিক্রমী ধর্মপ্রচারকদের অন্যতম যিনি কোনো কাল্পনিক ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করেন নি মানুষের মধ্যে। মানুষ ও তার ইহজীবনই ছিলো তাঁর মতবাদের বিষয়বস্তু। এখানেই তিনি খ্রীষ্ট মহম্মদ বা শংকরাচার্য সহ অনান্য সমস্ত ধর্মপ্রচারক থেকে আলাদা৷ অথচ সেই বুদ্ধকেই আজ ভগবান হিসাবে পুজো করা হয়, নবম অবতার মনে করা হয়, এর চেয়ে হাস্যকর ও আপত্তিকর কিছুই হতে পারে না।


প্রসঙ্গতঃ বুদ্ধের যে ছবি বা মূর্তিগুলি দেখি আমরা তার কোনোটাই তাঁর আসল রূপকে তুলে ধরে না। বুদ্ধের আসল চেহারা আমাদের অজানা। কারণ বুদ্ধের জীবিতকালে তাঁর কোনো মূর্তি বা ছবি বানানো হয় নি। বুদ্ধের প্রথম মূর্তি বানানো বা ছবি আঁকা হয় তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পর। বলাবাহুল্য সেই শিল্পীরা কেউই চোখে দেখেন নি বুদ্ধকে। তাই কল্পনাই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা। গান্ধার শিল্পরীতিতে প্রস্তুত এইসব ছবি বা মূর্তিগুলি তাই বুদ্ধকে সঠিকভাবে তুলে ধরে না। বরঙ এই মূর্তি বা ছবিগুলোর সাথে অনেক বেশী মিল পাওয়া যায় গ্রীক দেবতাদের।


যে সময় আসমুদ্র হিমাচল ছিলো গোঁড়ামি, জাতপাত, আর কুসংস্কারে নিমজ্জিত, সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি বেদ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরলেন। দৃঢ়তার সাথে বেদের অপৌরুষেয়তাকে অস্বীকার করলেন৷ অস্বীকার করলেন স্বর্গ নরকের ছেলেভোলানো গালগল্পকে। অস্পৃশ্যতাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন সমাজ জীবন থেকে৷ আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যখন দেখি কোনো বিজ্ঞানের অধ্যাপকের হাতে গ্রহরত্নের আংটি, ডাক্তারকে দেখি অপারেশনের আগে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কী সাংঘাতিকভাবে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন এই মানুষটি। বুঝতে অসুবিধা হয় না আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের তমসাঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে দেবদ্বিজকে অস্বীকার করতে হলে কতটা কলজের জোর দরকার হয়েছিলো তাঁর।


বুদ্ধ সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। মানুষ হয়েছেন রাজ বৈভবের মধ্যে। পরবর্তীকালেও পেয়েছেন রাজঅনুগ্রহ৷ তাই মানুষের দুঃখকষ্টের বস্তুবাদী কারণ অনুসন্ধান তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। মানুষের দুঃখকষ্টের পিছনে যে সম্পদের অসম বন্টন লুকিয়ে আছে তা তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় নি। ইহজীবনের দুঃখের জন্য তিনি ভুলভাবে দায়ী করে গেছেন কামনা ও বাসনাকে। মনে করেছেন কামনা বাসনার অবসান হলেই দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। এটা বুদ্ধের সীমাবদ্ধতা। বুদ্ধের সময়ের সীমাবদ্ধতা। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিকাশের সময় সেটা ছিলো না৷ ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক রূপ তাই বুদ্ধের চোখে ধরা পড়ে নি। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেটুকু ইতিবাচক দর্শনের সূচনা তিনি করেছেন তাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হতেই হয়।


অহিংসা ছিলো তাঁর ধর্মের মূল কথা। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। জৈন ধর্মের মতো ইঁটকাঠ পাথরেও তিনি প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ান নি। উপরন্তু অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাংস খাওয়ারও বিধান দিয়েছেন৷ এ থেকে বোঝা যায় বাস্তবতাবর্জিত আদর্শবাদী তিনি ছিলেন না। বরঙ বাস্তবতাবোধ নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর নীতিবোধকে। ঘন ঘন যুদ্ধের রাজতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে গেছেন অহিংসার জয়গান, জীবনের জয়গান। যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো, যুদ্ধবন্দীনিদের যৌনদাসী বানানো, বিধর্মীদের উদ্দেশ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধে মদত দেওয়া, পরকালে সুন্দরী মহিলার লোভ দেখানো, ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে ছিলো না। ছিলেন একান্তভাবেই সত্য ও সুন্দরের উপাসক। আজ যখন যুদ্ধে দীর্ণ, ভাতৃঘাতী হানায় দীর্ন পৃথিবীকে দেখি, তখন অনুভব করি বুদ্ধের উপদেশ আজও কী পরম প্রাসঙ্গিক।


রোমিলা থাপার বলেছিলেন বিশ্বকে দেওয়া ভারতের শ্রেষ্ঠ উপহার গৌতম বুদ্ধ৷ আমার মতও তাই। শুধু ভারত নয়, এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। এই হিংসা, হানাহানিতে ভরা পৃথিবীর বুকে তাই জেগে থাকুন বুদ্ধ, জেগে থাকুক তাঁর বরাভয়ের মুদ্রা। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিক রাজকীয় বিলাসিতাকে হেলায় পরিত্যাগ করা এই ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসীকে।


ওঁং বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি।

রেড ভলান্টিয়ার্স -বিতান সানা
Nov. 16, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:495 | likes:5 | share: 5 | comments:0

এই তো সেদিন। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে স্নান সেরে বই নিয়ে বসেছি। সারাদিন একটুও বইমুখো হইনি। হইনি বলাটা ভুল হবে। হওয়ার সুযোগ হয়নি।

পড়তে পড়তে কখন রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেছে খেয়াল নেই। হুশ ফিরলো একটা ফোনে। অচেনা নম্বর। গত ১ মাসে এরম বহু অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। তাই বেশি না ভেবেই রিসিভ করলাম। 


রেড ভল্যান্টিয়ার্স?

হ্যাঁ বলছি।

আমি উৎপল সেনগুপ্ত। নবপল্লী ভদ্রবাড়ি থেকে বলছিলাম।

হ্যাঁ বলুন। আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?

দাদা, আমার মায়ের স্যাচুরেশন লেভেল অনেকটা নেমে গেছে। ৮০ চলছে। একটা Oxygen সিলিন্ডারের জোগাড় করে দিতে পারেন?

ঠিক আছে। আমরা ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছচ্ছি। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।


ফোনটা রেখেই কোনরকমে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। বেরোনোর আগে ফোন করলাম আমাদেরই আরেক রেডভল্যান্টিয়ারকে। বাবু বিশ্বাস। আমাদের পাড়াতেই থাকে। বয়সে আমার চেয়ে বড়ো। আমি তাকে দাদা বলেই ডাকি। ও আমাকে নানান বিষয়ে গাইড করে। যাইহোক, অফিস থেকে সিলিন্ডারটা বের করেই দুজনে রওনা হলাম। উৎপলবাবু বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন, সম্ভবত পায়চারী করছিলেন। আমাদের আসতে দেখে মনে হলো একটু দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন। অক্সিমিটারে যখন তার মায়ের স্যাচুরেশন লেভেলটা চেক করলাম, সেটা ৭৮-৭৯ এ আপডাউন করছে। তড়িঘড়ি সিলিন্ডার সেট করে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হলো। কিছুক্ষণ বাদে স্যাচুরেশন লেভেল বেড়ে দাঁড়ালো ৮৪-৮৫। উৎপলবাবুকে বললাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি পড়লে যেন নিঃসংকোচে জানান। মনে হলো উনি আমাদের ভরসা করলেন। আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালেন। সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১টা বেজে গেছিলো। পরেরদিন উৎপলবাবু নিজে থেকেই ফোন করে জানালেন ওনার মা এখন সুস্থ। শ্বাসকষ্ট আর হচ্ছেনা। অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ৯০-৯১ দেখাচ্ছে। 

গত ১ মাসে শয়ে শয়ে এরম ফোন কল রিসিভ করেছি। তাদের প্রায় অধিকাংশই অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। চেষ্টা করলেও সবাইকে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে পারিনি আমরা। ফোনেই বলতে বাধ্য হয়েছি। সরি। কারণ চাহিদামতো অক্সিজেনের যোগান সেদিন ছিলোনা। তাই অকালে চোখের সামনে অক্সিজেন না পেয়ে মারাও যেতে দেখেছি বহু মানুষকে। এপ্রিলের শেষদিকে আমাদেরই এক রেডভল্যান্টিয়ারের বাবা অক্সিজেন না পেয়ে মারা গেছেন। আবার এরমও হয়েছে যে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার পরেও স্যাচুরেশন লেভেল বাড়েনি, কমতে কমতে দম কেড়ে নিয়েছে রোগীর। বর্তমানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো। বারাসাতে অক্সিজেনের যোগান এখন কমবেশি আছে। তবে রক্তের আকালটা এখনো মেটেনি। গত ১ মাসে অনেককেই রেডভল্যান্টিয়ার্স রক্তের ব্যবস্থা করে দিলেও রক্তের জন্য রোগীর পরিবারকে এখনও এদিক থেকে সেদিক ছুটতে হচ্ছে। বারাসাত হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে গিয়েও রোগীর আত্মীয় রক্ত পাচ্ছেন না। ফোন করছেন আমাদের। আমাদের রেডভল্যান্টিয়ার্সরাই ছুটে যাচ্ছে রক্ত দিতে। আজ যখন এই প্রবন্ধটি লিখছি সেই মুহূর্তেও রোগীর আত্মীয় কোথাও রক্ত না পেয়ে রেডভল্যান্টিয়ার্সের কাছে A নেগেটিভ দু ইউনিট রক্ত জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করছেন।

খাবার পৌঁছে দেওয়া, ওষুধ কিনে দেওয়া বা কারও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা ; গত ১ মাসে সবকিছুই করার চেষ্টা করেছি আমরা। এখনও করছি। তবে সবটা পেরে উঠিনি। গত ১ মাসের হিসেব করলে মোট বারাসাতবাসীর নিরিখে আমাদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতা বেশি। তাও আমরা চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করতে তো আর ক্ষতি নেই।

কবিতাগুচ্ছ ৪ -কবিরা
Nov. 16, 2024 | কবিতা | views:608 | likes:23 | share: 2 | comments:0

ভোটের গ্রাসে

-দেশব্রত বিশ্বাস


ভোট আসে, ভোট যায়, গনতন্ত্রের পরবে

গনতান্ত্রিক গালিচা সাজে আমজনতার শবে।

লাল নেতা, সবুজ নেতা,গেরুয়া কিম্বা নীল

নেতাদের আয় বাড়তে থাকে, বন্ধ হয় মিল।

তোমার নেতা, আমার নেতা উৎসবে বাজে শ্লোগান,

ভোটপর্ব মিটে গেলেই নেতারা দেন পিঠটান।

কেউ বা জেতে, কেউ বা হারে, কেউ বা করে আপস

হেরো নেতার কিস্যু হয় না, সমর্থক পোহায় রোষ।

যেই মা আজ হারালো সন্তান, তার দুঃখ বুঝবে কে?

সব নেতারাই ঘুরে যাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

চারদিক জুড়ে মুষ্ঠিমেয়কে ক্ষমতায় আনার দায়ে

গনতন্ত্রের অজুহাতে কেন সাধারণ প্রান হারায়?

জনগনের সেবায় নাকি আকূল যাদের 'দিল'

কিস্যু কাজ না করেও তাদের বাড়ছে তহবিল।

গনতন্ত্র আসলে স্বৈরতন্ত্রই, মুখোসটাই কেবল ভিন্ন

নির্বাচন নামের নাটকের আড়ালে আমরা জরাজীর্ণ।

আর কত মা সন্তানহারা হলে ভোটদেব হবে তুমি শান্ত?

অনেক হয়েছে, আর না থামুক ভোটের বাঈজী নেত্য।


গণতন্ত্রের চাবিকাঠি

-জামাল আনসারী


রাস্তা কেটে ,পেরেক পুঁতে, ভাবছো তুমি কি?

ধমকে, চমকে, চোখ রাঙিয়ে, হবে না কিছু।

দেশ সবার। নয়, তোমাদের বাপের  সম্পত্তি।

কৃষকের দাবি না মানলে হটছে না দেশ পিছু।

অন্নদাতার বুকফাটা কান্না, হবে নাকো ব্যর্থ

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীরা,উত্তাল প্লাবন

বলছে সবাই, ফ্যাসিবাদী সরকার অপদার্থ।

কার সাথে যুদ্ধ?কৃষকরাই দেশের জনগন।

কৃষক আন্দোলনের পাশে ফেসবুক, টুইটার

কৃষকের সমর্থনে হাত তুলেছে গোটা দেশ ।

কান পেতে শুনে রাখো ফ্যাসিবাদী হিটলার,

বেশি দিন নেই তোমার জামানা হবেই শেষ।

কৃষক আন্দোলন লিখছে এক নতুন ইতিহাস

তুমি যদি কেড়ে নাও অন্ন দাতার ভাতের বাটি।

জেনে রেখো, অহঙ্কারই পতন। হবেই সর্বনাশ।

অন্নদাতার হাতেই আছে গণতন্ত্রের চাবিকাঠি।



চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

-জামাল আনসারী


এক সময় যারা চোর ছিল, এখন তারা সাধু

সুযোগে কাক কোকিল হয়,যদি থাকে জাদু।


উভচরের স্বভাব যেমন জলে- স্থলে বসবাস।

বর্ণচোরা আমগুলি যেন সোনার রাজহাঁস―


মরসুমী বিহঙ্গম যত প্রতি শীত কালে আসে

এই সময়েই ভোটের গন্ধ গ্রাম গঞ্জে ভাসে।


কালো টাকা, সাদা টাকা ― টাকার ছড়াছড়ি,

ভোট ভিখারি বাবুরা সব করে দৌড়াদৌড়ি।


গণতন্ত্র আর ধনতন্ত্রে নেইকো  বিশেষ ব্যবধান

মুখে গণতন্ত্র আর কাজে ধনতন্ত্রের জয়গান।


নীতি,আদর্শ, বলে রাজনীতিতে কিছুই নাই ঠাঁই

সবার উপরে ভোট সত্য, ভোট বড়োই বালাই ―


মারপিট, গোলাগুলি,দাঙ্গা,গণহত্যা― কিছুই নয়,

গণতন্ত্রের মহান উৎসব। তাই একটু আধটু হয় !


রাম,শ্যাম যদু মধু, রাজনীতিতে পার্থক্য নাই―

অদ্ভুত মিল। "চোরে চোরে মাসতুতো ভাই" ভাই।












শ্রাদ্ধে চুল ফেলা!

- রাজা দেবরায়


শ্রাদ্ধে ফেলতে হবে,

মাথার সব চুল!

চুল না ফেললে তবে,

সব শিক্ষা ভুল?

চুল ফেলে বোঝাতে হবে,

মনের অবস্থা!

না ফেললে সমাজ নেবে,

তোমার ব্যবস্থা!?










কেউ খোঁজ রাখেনি

-শুভায়ূ রুডান


এই পাড়ায় যখন মহাসমারোহে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হরিনাম সংকীর্তন চলছে

ঠিক সেই সময়ে ও পাড়ার রহমত বই খাতাকে বিদায় জানিয়ে কাজ নিয়েছে সবজির আড়তে

মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোতে একশো পেয়েছিল ছেলেটা।

প্রথম প্রথম অনেক সংবর্ধনা পেয়েছিল

তারপর কালের নিয়মে ভুলেছে সবাই

কেউ খোঁজ রাখেনি।


ও পাড়ায় যখন বিরাট আয়োজনে

চলছে বিশাল ঐতিহাসিক ইসলামীক জলসা

বিখ্যাত বক্তাদের বক্তব্যে ওয়াজ জমে উঠেছে।

ঠিক তখন এ পাড়ার অসীম হাতে তুলে নিয়েছে বেলচা,

একসময় হাতে থাকতো রংতুলি

এই এলাকার সেরা আঁকিয়ে,

নিজের দক্ষতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগও পেয়েছিল ছেলেটা।

তারপর যা হয়,পেটের টান তুলির টানকে হার মানাল,

কেউ খবর রাখেনি।

আগামী বছর ওরাও হয়তো বিশ পঞ্চাশ, যা পারবে চাঁদা দেবে,

কীর্তন হবে আরও জাঁকজমকপূর্ণ, জলসা হবে আরও বিশাল, ওয়াজ করতে আসবেন সেরা বক্তা।

এভাবেই চলবে,

যাদের অঙ্কের গবেষক হবার কথা ছিল, কথা ছিল যারা আর্টিস্ট হবে!

তারা সবাই অর্থের অভাবে আড়ালে রবে।


কেউ খোঁজ রাখেনি, কেউ খবর দেয়নি

কেউ খোঁজ নেবেনা, কেউ খবর দেবেনা।।


বিজ্ঞানের দিনরাত্রি

-প্রদীপ চক্রবর্তী।


বিজ্ঞানীসম্মত হলেও 'ধর্ম '

বিজ্ঞানসম্মত নয়,

ঈশ্বর বিশ্বাস এর মূলে আছে

অজ্ঞতা;লোভ;ভয়।


মঙ্গলেতে যান নেমেছে

তবু মুখ ভার,

দুর্দশার মূলে আছে

অন্ধ কুসংস্কার।


আঙুলেতে পলা-নীলা

মুখেতে ভাষণ,

সেই দেশে হবে নাকি

'আদিত্য মিশন' !


মানুষের জাত নাই

সবাই সমান,

মানুষই বানাতে পারে

দেশকে মহান।


বিজ্ঞানের  দরবারে লহ তাই শরণ,

সব ফলের পিছনেতে বৈজ্ঞানিক কারণ।










জালিয়ানওয়ালাবাগ

-রীতা বসু 


হে জালিয়ানওয়ালাবাগ!

এখনো  তোমার  দেহে তো দেখি কালো রক্ত  ও বুলেটেরদাগ!

১০৮ বছর  আগে, এই দিনে ই এক শান্তি পূর্ণ  সমাবেশে,

যোগ দান করে ছিলে ওই মাঠে,

একটা ই ছিল  প্রবেশের দ্বার,

কেউ  কোথাও নেই  আর,

হঠাৎ  উপস্থিত হল  দস্যু  আয়ার,

ঢুকে ই সে আদেশ করল, "ফায়ার "!

বাস্।১৬০০ রাউন্ড গুলি  চললো, শিশু থেকে  নারী  সবাই কে  ওরা  হত্যা করলো,

শতশত লোক  কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে  প্রাণ  বিসর্জন দিল।

পৃথিবীর  জঘন্যতম  গণহত্যা  ঘটে  গেল!

সারা  বিশ্ব হল স্তম্ভিত,

এত ভয়াবহ, এত উন্মত্ত,

রবিঠাকুর  ত্যাগ করলেন  " নাইট  উপাধি,

এন্ডরূজ বললেন, "a massacre, a butchery "......

এত পাশবিক, এত মর্মান্তিক,

বুক  জ্বলে যায়, বৃটিশ কে ধিক্।অফিসার  ডায়ার!আদেশ দিয়ে ছি লে যে ডায়ার,

কি শাস্তি  তুমি  পেলে,

এক পাঞ্জাবী বিদ্রোহী র এক গুলিতেই তো মাটিতে  লুটিয়ে  পড়লে!

এভাবে কি  অন্যের দেশ দখল করে  থাকা যায়?

তাই তো  বাধ্য  হলে এদেশের পাততাড়ি  গুটিয়ে  চলে  যেতে,

মরি হায় হায়!!!






মা , তোমার জন্য

- মৌমিতা দে


মা মানে পরম আদরের

অন্তহীন স্নেহ ,

সুখ দুঃখের সঙ্গী সাথী

ভালোবাসার মোহ।


মা মানে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে

দেখায় পথের দিশা,

সারাজীবন সকলকে

আগলে রাখার আশা।


মা মানে সব দুঃখ বুকে চেপে

সদাই হাসিমুখ,

সব কষ্ট মুছে দিয়ে

ভরিয়ে দেওয়া সুখ।


মা মানে সকল অন্যায় মেনে নিয়ে

বুকে দেয় স্হান

যার কোলেতে মাথা রেখে

স্বস্তি পাই প্রাণ।


অনাধুনিক

- উদয় নন্দী


সন্তানহারা অশ্রু শ্রাবণে ,

প্রস্তরীভূত মা।

অধরা, অন্ধ প্রেমে,

পাথুরে প্রতিধ্বনি ধনী ।

পৌরাণিক হলেও তবে

অনভিপ্রেত নয় ।

ফুল জমে জমে পাথর হওয়ার সুভাষিত ।

তেমনি সুন্দর-সত্য বুঝি , পাথরে যখন ফুল ফোটে ।

পাথরের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে জীবনানন্দ জল।


তবুও প্রশ্ন থেকে যায় ,

অজন্তা ইলোরায় কি মেলে

রক্তমাংসের উম ?

জুড়ায় বোশেক জ্বালা ?

যদি তাই হয় ,

তবে কেন বোবা হয়ে যায়

"অগ্নিবীণার”-এর কবি ?

কেন স্ফটিকজল ডাকতে ডাকতে

রাজকুমারের সামনে লুটিয়ে পরে স্কাইলার্কের মত ---

স্ব-সৃজন মাধুরীমূর্তির সামনে নিথর নিথর হয়তো কোনো রামকিঙ্কর ।

যুক্তিবাদ ও মানুষের মুক্তি -মহম্মদ মহসীন
Nov. 16, 2024 | যুক্তিবাদ | views:566 | likes:2 | share: 2 | comments:0

মানুষের উত্তরণের সুচক হলো, পৃথিবীর দরিদ্রতম থেকে দরিদ্রতর দেশে বসবাসকারী সাধারণ থেকেও অতি সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সর্বাধিক সুবিধা লাভের সুযোগের ব্যবস্থা করা গেছে কি না, কতটা করা গেছে।

কিভাবে এই ব্যবস্থা উপলব্ধ করা যেতে পারে বলে মনে হয়? সকলেই বলবেন প্রকৃতির রিসোর্সের উন্নততর বণ্টন ব্যবস্থা রূপায়নের জন্য পুঁজিবাদের খলনলচে পাল্টিয়ে দিয়ে সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা।  উত্তরটিকে অনেকেই বস্তাপচা বলে অভিহিত করেন। আমরা মনে করি,

এটা তো হল বিপ্লব। বহু বছর কেটে গেছে, বহু বিপ্লব ঘটেছে, কিন্তু স্বপ্নের সেই ব্যবস্থা আজও প্রণীত হয় নি। যতদিন সেই সাম্য প্রতীষ্ঠা না হচ্ছে, ততদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাঝেই তাই আমাদের পথ খুঁজতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সেই পথ হলো সংগ্রামের পথ। আন্দোলনের পথ। রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টির এটাই পথ।

পুঁজিবাদী কাঠামোয় রাষ্ট্র পুঁজিপতিদেরই স্বার্থে সব কিছু করবে। মেহনতি মানুষ সেখানে শ্রমের যোগানদার বই ভিন্ন কিছু নয়।

কিন্তু মেহনতি মানুষ তাদের শ্রম কেন পুঁজিবাদীর স্বার্থে যুগিয়েই যাবে যুগিয়েই যাবে অবিরাম?

কারণ তাদের ব্রেন এভাবেই প্রক্ষালিত।

যুক্তিবাদের প্রসারে এই মস্তিষ্ক প্রতিবন্ধিতা দূরীভুত হতে পারে, তারা রাষ্ট্রের এই পুঁজিবাদ সেবার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে। আন্দোলন জারি রাখতে পারে সার্বিক ক্ষেত্রে।

কুসংস্কারে আচ্ছন্ন লোকে মুক্তচিন্তায় আগ্রহী নয়। 

পুঁজিবাদ ছাড়াও ভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামো গড়া যেতে পারে, অন্তত পুঁজিবাদের লাভ দু আনা লোক না পেয়ে বারো আনা পরিমাণ লোকের স্বার্থে আসবে,  এমন ব্যবস্থাও যে গড়া সম্ভব, তা তারা মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

আমাদের সমস্ত শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান,  দর্শনের ফোকাসে থাকে এক বদ্ধমনা চেতনাঃ পুঁজিবাদের বিকল্প কাঠামো  রাষ্ট্র কোনোদিন আয়ত্ত করতে পারবে না। তাই বিপ্লব তো দূরের কথা সংগ্রাম আন্দোলনেই 'শিক্ষিতজন' এর সমর্থন পাওয়া দুরূহ। তারা বরং তাতে বাধা দেয়। এমনকি তাদের ব্রেন এমনভাবে প্রক্ষালিত যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রীকরণ অপেক্ষা বেসরকারীকরণেই তাদের উদ্দীপনা বেশি লক্ষিত হয়।

মানুষ ভিত্তিগতভাবে পশু। অনেক পশুর ন্যায় নিজ স্বার্থসিদ্ধিতেই বেশি আগ্রহী। আবার মানুষ শুধুই পশু নয়, র‍্যাশান্যাল পশু। তার মাঝে পশুত্ব যেমন থাকে,  তার মাঝে র‍্যশানালিটিও থাকে। কথা হচ্ছে কোন গুণটি কোন গুণটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মাঝে যখন র‍্যাশানাল ভাব বেশি থাকে তাহলে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা, অন্ধ অনুসরণেচ্ছা, সামগ্রিক মানবসমাজে থেকেও শুধুমাত্র সম্প্রদায়গত ঋণাত্মক চিন্তা ভাবনাগুলিও সমহারে কমতে থাকে। এটিই প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষায় সাম্প্রদায়িক চেতনার ঊর্দ্ধে ওঠা যায়, সামুদায়িক স্বার্থের জন্য কাজ করাকেই প্রকৃত কাজ ভাবা যায়, তার মাধ্যমে মানবিকতার বিকাশ ঘটানো যায়,  সেটিই প্রকৃত শিক্ষা।

যে যত ডিগ্রীর অধিকারী হোন না কেন, তিনি যদি বাস্তব থেকে অলৌকিকে বিচরণ করেন, তাঁকে শিক্ষিত বলা যায় না। বিকশিত মনুষ্যত্ব আধিদৈবিকতা, আধিভৌতিকতার পথ থেকে দূরত্ব বৃদ্ধির ত্বরণ জারি রাখে। মানুষকে বাস্তবিক মাটিতে বিচরণ করতে উদবুদ্ধ করে। 

যারা বাস্তব বোধের অধিকারী তারাই মানবমুক্তির পথনির্দেশ করতে পারেন। তার স্পষ্ট অর্থ হলো, ধর্মীয় দর্শণ কখনই মানুষের মুক্তির কথা বলতে পারে না। তারা প্রথমেই মানবমুক্তির ডেফিনিশন পাল্টে দেয়। তাদের মানব মুক্তির লক্ষ্যে থাকে বার বার জন্মগ্রহণ বা পাপ পূণ্য-জনিত উদ্ভট সমস্যার উদ্ভব করে তার মনগড়া সমাধান। মানবমুক্তির মূল অর্থ সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক  সুযোগ লাভের আনুপাতিক বিকাশ।

র‍্যাশান্যাল মানুষ প্রতিনিয়ত মানবমুক্তির মাইক্রো আন্দোলনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজেকে সাধ্যানুযায়ী নিয়োজিত রাখেন। 

মানুষের মুক্তির পথ সুগম করতে  যুক্তিবাদের প্রসার তাই অত্যন্ত জরুরী।

উত্তরণের পথে ধর্ম সদা সর্বদা প্রতিবন্ধক।

এই প্রতিবন্ধকতাকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারে কুসংস্কারমুক্ত মানুষ। ধর্মান্ধের দ্বারা তা আদৌ সম্ভব নয়।

যুক্তিবাদের সিঁড়ি বেয়েই মানব সমাজের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব।

মার্ক্সিজম ও গণচৈতন্য -অমিত দাস
Nov. 16, 2024 | মার্ক্স | views:268 | likes:23 | share: 0 | comments:0

 ''সমাজে যুক্তি অযুক্তিকে রেখেছে কিনারায়।''-- ফুকো 

 প্রকৃত গণজাগরণ কীভাবে সম্ভব? যেকোনো মুহূর্তে ঘটনাপ্রবাহের জনআন্দোলন রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে পারে একথা ঠিক, কিন্তু সাময়িক চমক তো একজনকে সচেতন সমকালীন বানায় না, তাই শক্তিশালী উত্তরাধুনিক গণচেতনার উদ্দেশ্যে আমাদের সামাজিক রাষ্ট্রীয় বা নানা অ-সরকারী ব্যক্তি বা সমষ্টির কর্মপ্রকৃতি ও ক্রিয়া  কীরকম হওয়া উচিত ?

                  আচ্ছা , এই যুক্তি-অযুক্তি ,কারণ-অকারণ , একমুখীনতা বহুমুখীনতা ,একককথন-দ্বিরালাপ সম্পর্কে যারা সচেতন তারা তো সত্যিকারেরই সমাজের কিনারায় থাকে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের নানা স্তরের মানুষ এক-এক পরিসরের জামা-জুতো পরা , সেখানে দুই একজন সচেতন মানুষ দেশীয় 'বোরোলিন' মাখলেও '৪৭ফ'রা তো 'ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি'র দলেই। আর রাজনৈতিকতন্ত্র পরিবর্তনে তাদের ভূমিকাই বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হল এবার কীভাবে ? মানুষ যে গাছের পাতা দেখে হাওয়ার অস্তিত্ব অনুভব করবে,সে ক্ষমতাও খুব কম মানুষের আছে।

                'আত্মা' শব্দটি নিঃসন্দেহে খুব ভালো শব্দ-- 'আত্ম' যা তা-কে  নির্দেশ করে,কিন্তু এখন দূষিত, তাই ব্যবহৃত হয় 'আমি'।জ্ঞানরাজ্যে 'ধর্ম' দূষিত, তাই শিল্পের ধর্ম হয়েছে 'ময়ূরাক্ষী' ,'সুবর্ণরেখা' ইত্যাদিরা। এরা নিরাপদ, কিন্তু একটা পার্টির মাথাকে জল দিয়ে স্নান করানো এবং আদর্শবীজগত 'ধুলোমাখা ' টোটেমগুলিকে নবায়ন একদিকে যেমন প্রয়োজন অন্যদিকে বিপদ। লক্ষ করি ,এই নতুন শব্দেচেতনার আকর্ষণেই  রাজনৈতিক মুখোশের  পতন-অভ্যুত্থান অথবা রূপান্তর হয়েছিল-হয়, হয়ত হবেও। কারণ শব্দ জ্যান্ত,শব্দ তার বহুমুখীশক্তি অনুযায়ী মানুষকে সচেতন করে। রোঁলা বার্থ-এর 'ডেথ অফ্ দা অথর' প্রয়োগ করলে এই তত্ত্ব ---সমাজের হৃদস্পন্দন যে সমষ্টি--এবং সেই সমষ্টির হৃদস্পন্দন যে কিছু বাণী ,তা প্রমাণিত হয় ।

                           এবার কীভাবে ? সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু ভেঙে গেছে ঠিক এই কারণেই--এ কথা মনে রেখেই--পোস্ট-মার্ক্সসিস্টরা বলে ,শোষণপোষাক পরিবর্তিত হয়েছে, আধেয় নয় ,উপেয় নয়।ফুকোর  সেই আধুনিক  'কারাগার-থিওরি'(†ছবি)-তো সেই কথাই বলে।তবে ?

                 মার্কসের বন্ধু এঙ্গেলস  ,'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে লিখেছিলেন--এক সময় নারীপুরুষ জঙ্গলে অনেকটা একই রকম কাজ করত পরবর্তী সময়ে এক ব্রাহ্ম-মুহূর্তে যখন নারী বুঝতে পারল তার পেটের এক অংশে কিছুটা ভারী হয়ে উঠছে এবং সে কোনো কাজ করতে পারছে না , তখন মন ও কর্মের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-মিথস্ক্রিয়ায় জন্ম নিল প্রথম সমাজ ব্যবস্থা। তারপর নানা তন্ত্র শেষে আজ 'এক' তন্ত্রে আমরা আছি। প্রশ্ন হল এই যে বিবর্তন ...তার উৎসেও বিমূর্ততা এসে দাঁড়াচ্ছে। যেখান থেকে অধিবিদ্যা যেখান থেকে অসংখ্য পাঠকৃতি তৈরি হচ্ছে--এদিকে সমষ্টিমানুষের জন্য প্রয়োজনের বস্তুধর্মিতা ছাড়া পথ নেই ---আবার যে উত্তরআধুনিক সমকাল তা দাবি করছে বিকেন্দ্রীভূত বহুমাত্রিকতা।

                   ক্ষমতার পিরামিডের সঙ্গে এই কনসাসনেস পিরামিডের উচ্চে (মানুষিক দৃষ্টিকোণে) অবস্থানকারী ব্যক্তিগণ লড়ে হেরে বা জিতে যে-ভাবেই হোক সমকালীন রাজনৈতিকশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারেনি--ধরা যাক কোনো এক পার্টির পূর্বের বা বর্তমানের শাসন ব্যবস্থা প্রকৃতই জনমুখী এবং জীবনমুখী সমাজতান্ত্রিক ছিল বা আছে-- যদি তাই হয় তাও তো 'ভালোর' ভালোকে স্বীকার করতে গিয়ে স্বহৃদয় সামাজিক মানুষটি ফেঁসে গেছে, কারণ উত্তরাধুনিকতা বলে ''হেগেলের চিন্তাও বায়াসডহীন নয়, কারণ হেগেল চিন্তা-চর্চা করার জন্য রাজনৈতিক সাহায্য পেয়েছিলেন।'' রাজনৈতিকবোধ ছাড়া কোন মানুষ আধুনিক বা উত্তরাধুনিক হতে পারে না--আবার সম্পূর্ণ রাজনৈতিকবোধে বা স্রোতের শক্তিতে প্রভাবিত হলেও  সত্য অনেক দূরে চলে যাবে.? অনেকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলবে কিন্তু বহুমুখীনতা স্বীকার করলে--পরস্পর বিপরীতমুখী  কর্মকাণ্ড হওয়া স্বাভাবিক , এবং তা প্রয়োজনও। এবার প্রশ্ন হল জনগণ কীভাবে তা গ্রহণ করবে? আবার জনগণ সমকালীন না হলে তাও আরেক সমস্যা? শাসকদলের দাসত্ব করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না‌ --যেমন এখন চলছে।

                    তাহলে এই গণমানসে প্রকৃত 'গণজাগরণ' কীভাবে সম্ভব? নাকি সেই সময়ের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আবার নতুন কোন ইজম এসে হাজির হবে?

ভোট-সার্কাস--গণতান্ত্রিক উৎসব? -অর্পণ
Nov. 16, 2024 | রাজনীতি | views:1365 | likes:67 | share: 23 | comments:0

"ভোট"-কথাটা শুনলেই কেমন যেন অকাল উৎসব, কোথাও আসন্ন ভীতি আবার কোথাওবা টি-আর-পি বাড়ানোর খেলার অনুভূতি জাগে। পৃথিবীর সবথেকে বড় গণতন্ত্র এই ভারত, আর সেই ভারতের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব এই নির্বাচন। সত্যিই কি তাই? গণতন্ত্রের প্রভাবকে অমলিন রাখতে কি সক্ষম এই ভোট? আলোচনা করা যাক...


    দেশের ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করুন গণতন্ত্র কী?খায় না মাথায় দেয়? ৯৯ জন অকপটে জানাবে "এই যে ভোট দিই আমরা"!, মানে এই ভোট দিয়েই তারা সন্তুষ্ট, ভোটের দিন ওই একদিনের রাজকীয় অনুভূতিতেই তারা খুশি, ঠিক এর বিপরীতে একটা ছবিও আছে, যেখানে ভোট আসছে শুনলে নিরীহ পাড়াটা তটস্থ হয়ে ওঠে আসন্ন খুনোখুনি, সন্ত্রাসের ভয়ে, বৃদ্ধা মাকে নিজের ছেলেকে হারানোর ভয় আঁকড়ে ধরে। এইসব নির্বাচনী হিংসার কোনটার পিছনে যে কে বা কারা থাকে  তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক তরজা আর মিডিয়ার প্রচারে সাধারণ মানুষের কাছে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মিডিয়াও নেমে পড়ে ঘটনাকে মশলা সহযোগে কে কত রোমাঞ্চকর ভাবে পরিবেশন করতে পারে তার খেলায়, যত রক্তপাত হবে, যত মায়ের কোল খালি হবে প্রাইমটাইমের টি আর পি তত বাড়বে, ফলত, তাদের কাছে এ এক দারুণ উৎসব, খেলা।

      ক্রিকেট মোটামুটি আমরা সবাই দেখি, আই পি এল নামের একটা ক্রোড়পতি লিগ কারোরই অজানা নয়, আমরা কী দেখি? কিছু দলের লড়াই চলছে ট্রফির আশায়, আর যেটা দেখি না সেটা হল প্রত্যেকটা দলের পিছনে বসে আছে কিছু ইনভেস্টর, যারা টাকা ঢেলেছে এক একটা দলের পিছনে। সেই দল ট্রফি জিতলে তার শেয়ার ভ্যালু, বিজ্ঞাপন ভ্যালু এটার থেকে বিপুল লাভ আসবে ইনভেস্টরের পকেটে, তাই আই পি এল যে কোনো মূল্যে করানো চাই-ই, তা সে করোনায় দেশবাসী যতই অনাহারে মরুক লকডাউনে। খেয়াল করলে দেখবেন, ভোটও তাই, করোনার গ্রাফ দৈনিক ৩ লাখ ছাড়ালো, কিন্তু ভোট স্থগিত? নৈব নৈব চ, এখানেও কারণটা খুব সহজ, রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগেরই শিল্পপতি ইনভেস্টর থাকে যারা বিপুল টাকা পার্টি ফান্ডে ঢালে, লক্ষ্য? ওই, ক্ষমতায় এলে তাদের সুবিধা করে দেওয়া। ভোট স্থগিত হলে, এত হাজার কোটির ইনভেস্টমেন্ট সব ভেস্তে যাবে যে!!

  ভোট যখন হচ্ছেই তখন জনগণের মগজধোলাই না হলে চলবে কীভাবে? অতএব সমাবেশ, মিটিং মিছিল সব চলবে....আর সেই সার্কাস দেখতে ভিড়ও হবে... প্রধানমন্ত্রী রাতে ভাষণ দেবেন সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মানার পরদিন সকালে সমাবেশে আসবেন হেলিকপ্টারে চড়ে, তবুও লোকজন বেশ খুশি, মুখিয়ে থাকবে শুনতে কোন নেতা কার নামে কী চটুল মন্তব্য করল...আর খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ঠাঁই পায় এই কাদা ছোড়াছুড়ি গুলোই। বিক্রি বাড়াতে হবে না??


আচ্ছা, উৎসব মানে আমরা কী বুঝি? পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, শালীনতার সীমায় থাকা। কিন্তু হায় এই উৎসবে যদি সেটা আশা করেন আপনি তবে সোনার পাথরবাটির আশায় আছেন।জাতপাত, ধর্ম, উন্নয়ন, সব কিছুই হয় প্রচারের হাতিয়ার। প্রত্যক্ষ গালিগালাজ থেকে শুরু করে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে লোকজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলায় সব দলের জুড়ি মেলা ভার,শীতলকুচিতেই দেখুন, কেউ বলে বাহিনীর দোষ, কেউ বলে মমতার উস্কানিতেই ঘটেছে, কারণ যাই হোক তৃণমূল বিজেপি কোনো পক্ষই কিন্তু মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করতে ছাড়েনি...,  একে অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে চাপা পড়ে গেছে বাবা হারা মেয়েটা, বা ছেলে হারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, হয়তো স্বামী হারা মেয়েটা টিভিতে দেখলো হেডলাইন, "শীতলকুচি নিয়ে কী বললেন বিজেপির মুখপাত্র, পাল্টা কী বললেন মমতা? জানতে হলে আজ রাত ৮ টায়"...টি আর পি কা খেল মশাই টি আর পি!!


    ভোটের দিনগুলোতে নেতাদের পারলে পা ধরে জড়িয়ে পরবে এমন ভাব থাকে, ফ্ল্যাটে থাকা স্বচ্ছল প্রার্থী নেমে এসেছে পথের ধুলোয়, মাথা নীচু করে ঝুপড়ি গুলোতে

ঝুঁকে পড়ছে, চকচকে পাঞ্জাবি ছেড়ে "আমি তোমাদেরই লোক" প্রমাণে নিজেদের পাঞ্জাবিতে পথের ধুলো লাগাতে ব্যস্ত। এও এক সার্কাসের অঙ্গ।


এমনি করে ভোট আসে ভোট যায়, সার্কাস,সন্ত্রাস, উৎসব একসাথে চলে, একদল ক্ষমতায় আসে আরেকদল বিদায় নেয়, কিন্তু ক্ষমতার মুখগুলো থেকে যায় একই, ঋতুবদল, দিনবদলের মতো দলবদলও এ সার্কাসের এক্স ফ্যাক্টর,

ফলে কী হয়, সার্কাসে জোকার গুলোর বেশভূষা পাল্টায়, আজ লাল জামা, কাল সবুজ তো পরশু গেরূয়া পোশাক.. কিন্তু জোকারের মুখগুলো থেকে যায় একই....তাই এ সার্কাসেও একই খেলা চলতে থাকে দিনের পর দিন।।

লকডাউনের নাটক ও আমরা -স্বর্ণাভ ভট্টাচার্য
Nov. 16, 2024 | সমাজ | views:281 | likes:0 | share: 0 | comments:0

লকডাউনে জনজীবন বিপন্ন হওয়ার ছবি আমরা সবাই দেখেছি, সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টায় মৃত্যুর স্মৃতি এখনো তাজা।


          দেখা যাক, রাজনীতি কীভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তার নমুনা। কীভাবে সংক্রামক রোগটিকে (যার মৃত্যুহার ভারতে ১.১৮%, পশ্চিমবঙ্গে ১.৫৯%, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা শ্রেয়) নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে ও হচ্ছে। সূত্র:  https://g.co/kgs/T3CrVZ


          হঠাৎ কেন করা হলো লকডাউন? ২০১৯ সালের শেষের দিকে CAA, NRC, NPR বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছিল। বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলি দিন রাত এক করে মিছিল, সমাবেশ করে জনমত সংগ্রহ করছিল, সরকার চাপে পরছিল। এই সময়ে সরকারের দরকার ছিল সবকিছু থামিয়ে দেওয়ার মতো ব্রহ্মাস্ত্র, এই ধারাবাহিক আন্দোলনের শৃঙ্খলটাকে ভেঙে দেওয়ার।


          নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে করোনায় আক্রান্তের খবর আসতে থাকে। ২৭ শে জানুয়ারি ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা জানাজানি হয় ( কেরলের ২০ বছর বয়সী একজন মহিলা)। তার আগে থেকেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, বা বলা যায় ছড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রোগ কিছুটা ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করা হয়েছে। তারপর হঠাৎ কোনোরকম পূর্ব অবগতি ছাড়াই ২৫ শে মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

          এর ফলে বাইরে বেরোনো সমস্যার হয়ে গেলো। যে মানুষটার 'দিন আনা দিন খাওয়া', যে মানুষটা দৈনিক মজুরী ভিত্তিক কাজ করে, তার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারখানাগুলোয় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় ন্যূনতম ভর্তুকি না দিয়ে। দেশের নানা প্রান্তের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা 'পরিযায়ী শ্রমিক'দের দুর্বিষহ জীবন। বাড়ি ফেরার পথে মৃত্যু, অনাহারে মৃত্যু, পুলিশের লাঠি।

          আর এসবের মূল লক্ষ্য, পরোক্ষভাবে NRC, CAA, NPR জাতীয় অপ-আইনের বিরোধীতামূলক আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে দমন করা। আর তা করা হয়েওছে। এই আন্দোলনহীন সময়ে (আন্দোলন হলেও লকডাউনের জন্য যা ডিজিটাল ভাবে হয়েছে, ব্যাপ্তি পায়নি বা আটকে দেওয়া হয়েছে) অনেকগুলো জনস্বার্থ বিরোধী বিল পাস করা হয়।

          এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP) ২৯ শে জুলাই, ২০২০ তে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদে পাস হয়। এই আইন চালু হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের পথে এগোবে। এরপর, আনলকে পুনরায় নিয়মমাফিক জীবনে অভ্যস্ত হতে মানুষের সময় লেগেছে। আর সেই সময়েই ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখ লোকসভা ও তার পরের দিন রাজ্যসভায় পাস হয়ে যায় The Industrial Relations Code, 2020. যার ফলে মালিক পক্ষের হাতে সরকার তুলে দেয়, ইচ্ছামত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অধিকার। যার জন্য কাজ হারায় অনেক শ্রমিক।


           এই সময় তিনটি কৃষি বিল উপস্থাপনা করা হয়, কর্পোরেট দালালদের সুবিধার্থে, কৃষকদের সাথে আলোচনা না করেই। যাদের গালভরা নাম —

     ১) The Essential Commodities (Amendment) Bill, 2020 ( চাল, ডাল, আটা, আলু, পিঁয়াজ প্রভৃতি ২০টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ গেল। এছাড়া, কোনো সংস্থার পক্ষে এই সমস্ত পণ্য মজুতির সর্বোচ্চ সীমা রইল না। ফলে যে কেউ অত্যধিকহারে উক্ত পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করতে পারে ও বেশি দামে তা বিক্রয় করতে পারে, এক্ষেত্রে সরকারকে জবাবদিহির বাধ্য থাকলো না সে বা তারা। )

     ২) The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020 ( নীলকর সাহেবদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া কৃষকদের দুর্গতির কথা আমরা সবাই জানি, এটা তারই আধুনিক রূপ। কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর, চুক্তি অনুযায়ী ফসল উৎপন্ন না হলে বা উৎপন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে না। ),

     ৩) The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020 ( ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নিজেরা সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল কিনতে পারবে। ফলে, পূর্বের স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকদের জন্য খরচের দেড় গুণ দামে বিক্রয়মূল্য সংক্রান্ত সুনিশ্চিতকরণের দায় সরকারের রইল না। )

          এই মারণ বিলের বিরোধিতায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা ৯ই আগস্ট, ২০২০ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের রাস্তা নেন। পরে অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা এতে যোগ দেন। তাঁরা দিল্লির সিংঘু ও টিকরী বর্ডারে বর্তমানে বিক্ষোভরত। কিন্তু লকডাউন ও তৎপরবর্তী আনলকের ফলে বেশিরভাগ অঞ্চলে এই আন্দোলন নৈতিক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি। এরই মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর ও ২০ শে সেপ্টেম্বর যথাক্রমে লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই জনবিরোধী বিল পাস হয়ে যায়। আন্দোলনকে 'অশান্তিকর' দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে ভুয়ো তথ্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের 'আন্দোলনজীবী' আখ্যা দিয়েছে।

          লকডাউনের শেষে নতুন খেলা শুরু হলো, আনলক। মানুষের মনে করোনার ভয় কমলেও, স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হলো। কিন্তু সিনেমা হল, শপিং মল সব কিছু খোলা রইল। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কী করোনা আসে? অনলাইনে ক্লাস হওয়াতে ৯১% ছাত্রছাত্রী, যাদের অনলাইনে পড়ার সুযোগ নাই, তারা বঞ্চিত হতে শুরু করলো। প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো ইন্টারনেট সহযোগিতা পৌঁছায়নি। তাছাড়া, সবার আধুনিক মোবাইল কেনার মত অর্থের অবস্থাও নাই। তাহলে তাদের কী হবে? অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা এই অনলাইন পড়াশোনার চাকায় পিষে লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, প্র্যাক্টিক্যাল বা হাতে কলমে শিক্ষা। অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিজে হাতে না শিখলে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাওয়া অসম্ভব। সেসব ক্ষেত্রে, যাদের অর্থ আছে, যারা বিত্তশালী, তারা বিভিন্ন অনলাইন এডুকেশনাল অ্যাপ থেকে শিখতে পারবে, বাড়িতে প্র্যাক্টিক্যালের সামগ্রী কিনে। কিন্তু যারা সেই প্রিভিলেজ পায় না, তারা কি করবে?

          ১২ই ফেব্রুয়ারি,২০২১ বাংলায় স্কুল খুললেও কলেজের কোনো কথাই নাই। আবার, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছে, ২০ শে এপ্রিল, ২০২১ থেকে স্কুল বন্ধ গরমের ছুটি হিসাবে। এদিকে কলেজ তো খোলেইনি। কিন্তু অফলাইনে যেমন ফিজ নিত, ঠিক তেমন হারেই ফিজ নিচ্ছে কলেজগুলো। তার মধ্যেও একটা ক্লাসও হয়তো ঠিকমতো হচ্ছে না। মানে, মোবাইলের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, নেটের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, আবার কলেজের অন্যায্য ফিজও আপনাকে দিতে হবে। এই আর্থিক প্রতিযোগিতায় কতজন পেরে উঠবে? এর মধ্যেই কখন নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়ে যাবে জানতে পারবেন না। শিক্ষা বেসরকারিকরণের সমস্ত ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে।

          আনলক-লকডাউন খেলার সুযোগে একের পর এক বিল এভাবেই পাস হয়েছে। বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারিকরণ হয়েছে একাধিক সরকারী সংস্থা ও ব্যাংকের। রেল, বিমান বেসরকারী হয়েছে। BPCL, NEEPCO, শিপিং কর্পোরেশন, Concor ইত্যাদি সংস্থাও বেচে দেবার উদ্যোগ চলছে।

          এর বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, মানুষ বুঝতে শুরু করেছে কেন্দ্র সরকারের কর্পোরেট দালালির স্বরূপ। পূর্বোক্ত আইন ও বিলগুলির বিপক্ষে প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, NRC-CAA-NPR এর ইস্যু নিয়ে আবার সবাই কথা বলতে শুরু করেছে। আর তাই শাসক ভয় পাচ্ছে। আবারও করোনা আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে। শীঘ্রই লকডাউন করার কথা ভাবা হচ্ছে। দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের তুলিয়ে দিতে পারে কেন্দ্র কোভিডের জুজু দেখিয়ে — এমনটাই আশঙ্কা করছেন অন্নদাতারা ( সূত্র — বর্তমান-২০/০৪/২০২১)। এটা বলাই যায়, তাঁদের আশঙ্কাই সত্য।

          ২০২০ সালের সেই ভয়াবহ দিনগুলো ফেরৎ আসতে চলেছে। দিল্লিতে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে, অন্য জায়গায় হতে দেরি নাই। বিভিন্ন জায়গায় থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁরা জানেননা, কীভাবে সংসার চলবে, কী খাবেন, খেতে পাবেন কিনা, তাই অনিশ্চিত।

কবিতাগুচ্ছ ৩ -কবিরা
Nov. 13, 2024 | কবিতা | views:300 | likes:5 | share: 5 | comments:0

সমঝোতা

- বিমুক্তি

দশ টাকার দুটো নোট হাতে নিয়ে বেরিয়েছি,

আজ একটা দফা-রফা করতেই হবে!

আজ দশ টাকার দুটো নোট নিয়ে আমি যাচ্ছি,

রাষ্ট্রের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে।


আমি একটা মস্ত বড়ো পাহাড় বেয়ে রাষ্ট্রের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম,

আমার হাতে থাকা দশ টাকার নোট দুটি দুমড়ে মুচড়ে গেছে ততক্ষণে,

সেই দুমড়ানো কাগজগুলো ছুঁড়ে মারলাম রাষ্ট্রের মুখে

রাষ্ট্রের নাকের সামনে ঘুষি বাগালাম,

চোখ দুটি বড় করে বললাম,

''জানো তুমি! জানো! গত তিনদিন ক্রমাগত ভাবতে ভাবতে

তোমার দুরবস্থা নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম।

আমার তিনদিনের পরিশ্রম তোমার কোনো পত্রিকা ছাপাতে চায় নি।

অতঃপর একটি অনলাইন ম্যাগাজিন বিনামূল্যে সেই গল্প ছাপালো।

একটা পয়সাও না নিয়ে, তিনদিনের ভালোবাসা দিলাম,

আর তোমার পুলিশ কি-না আমাকে জেলে পুরার কথা ভাবছে,

তোমারই দুরবস্থা নিয়ে গল্প লেখার কারণে!

তাই নিজের একমাত্র সম্বল দশ টাকার দুটো নোট নিয়ে এসেছিলাম,

তোমার মুখে ছুঁড়বো বলে!"


আমার হাতে মার খেয়ে রাষ্ট্র তখন পুরো নেতিয়ে পড়েছে,

ওর উপরের পাটির অগ্রদন্ত্য দুটি উড়ে গেছে আমার ঘুষিতে।

ফোকলা দাত নিয়ে হাসতে হাসতেই রাষ্ট্র বললো,

"আমি তো নিজে নিজেকে চালাই না।

আমার মানুষেরাও আমাকে চালায় না,

এবং লেখক তুমিও চালাও না।

আমাকে মেরে কি লাভ বলো?"


আমি কথা হারিয়ে রাগে দুঃখে,

দশ টাকার নোট দুটি ওর দাতের ফাঁকে গুজে দিয়ে দৌঁড় দিলাম।

পুলিশ আমাকে খোঁজছে।


মুখোশ খোলার শপথ

-শুভায়ূ রুডান

ক্লান্ত চোখে দিনের শেষে ফিরেছি যখন অবশেষে,

দেখেছি আমি চাপা কান্নারা অপেক্ষারত দিনের শেষে।

মুখগুলো সব মুখোশ পরা ভিড়ের মাঝে হাস্যরত,

মুখোশ খুললেই উলঙ্গ রাজা চরিত্রগুলো রাবারের মত।

এসেছে সময় মুখোশ খোলার হাসি গুলো সব মিলিয়ে যাক,

উলঙ্গ রাজা ছুটে পালাক কাপড় খুঁজুক ঢাকতে লাজ।

এবার যখন মিছিলে যাবে সময় নিয়ে দুটো প্রশ্ন কোরো,

তোমাকে যারা স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্নগুলো কি যাচাই করো?

এবার যখন মিছিলে যাবে সত্য মিথ্যার হিসেব নিও,

তোমাকে যারা শুধুই ঠকায় এবার তাদের চিনতে শেখো।

যেই মিটিংয়ে ভিড় বাড়াও, মঞ্চে খোঁজো তোমার তুমি,

সেই তুমি কি রেখেছে কথা? নিয়েছে তোমার খোঁজখবর।

সত্তর বছরে তোমার তুমিরা দিয়েছে শুধুই প্রতারণা,

যে দলেই তুমি আস্থা রেখেছ, জুটেছে শুধুই বিরম্বনা।

তাই এবার কোন দলের নয়,দাবী আদায়ের মিছিল হোক,

তাই এবার শেখানো স্লোগান নয়,দাবী গুলোই স্লোগান হোক।

তাই এবার শপথ রক্তে রাঙ্গা,তাই এবার যুদ্ধ হার না মানার,

তাই এবার মগজ দিয়ে মগজ ধোলাই,এবার যুদ্ধ পালটে দেওয়ার।









ফুলের রাজনীতি

-জামাল আনসারী


বঙ্গের ডাঙায় ফুটেছে দুটি ফুল, পদ্ম আর ঘাস।

দুই ফুলের সুগন্ধে আমজনতার উঠছে নাভিশ্বাস।।


কোন ফুল ছোট আবার কোনটা একটু বড়োসড়ো।

ফুলের রাজনীতিতে রাজ্যবাসী ভয়েই জড়োসড়ো।।


ছোট ফুলের নাম শুনলেই বড়ো ফুলের গাত্রজ্বালা হয়।

চোখ বন্ধ করলেও দেখছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে  আছে উন্নয়ন।


বড় ফুলটাও নাকি ভাল নয়, গায়ে তীব্র সাম্প্রদায়িক গন্ধ!

বাম-রাম- অতিবাম, ফুলের রাজনীতিতে লাগিয়েছে দ্বন্দ্ব।।


গণতন্ত্র উৎসব নয়, বাংলায় বসেছে গণতন্ত্রের নিলাম

কেউ বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকায়, কারো হাজার টাকা দাম।


কোথায় গেল বাঙালির তেজ, আত্মসন্মান, বিবেকবোধ?

বেনিয়াদের কাছে শিরদাঁড়া বেচে গড়ে তুলছে প্রতিরোধ।


ফুলে ফুলে মারামারি, কাটাকাটি চলছে দেশের সমাজসেবা,

রাজনীতিতে দারুন লাভ,ফুলে ফেঁপে উঠছে নেতাদের ব্যবসা।


রাজ্যের কোথাও চলছে গোলাগুলি,কোথাও পড়ছে লাশ।

দুই ফুল মিলেমিশেই  রাজ্যবাসীকে দিচ্ছে আচুলা বাঁশ।।





মাদুলি তাবিজ ঝাড়ফুঁক

-জামাল আনসারী

খুড়া ও খুড়া... টিনের আগুড় টা খুল ন চাঁড়ে কইরে,

খুড়া ও খুড়া... টিনের আগুড় টা খুল ন চাঁড়ে কইরে,

তোর ছুটু কাকী বিনা চিকিৎসাই যাবেক রে মইরে।

টিনের ঠকঠ্কানি আর ডাকা হাঁকার তরে

ধড়ফড়াইয়ে কাঁচা ঘুমেই চইখ কচল্যাই উঠে নিমাই ওঝা,

আগুড়ের ঠিনে আইসে গলার আওয়াজ আন্দাজ কইরে বলে―

এতো রাইতে কে কচ্চি রে আমার নাম ধইরে ডাকাহাকা??

আগুড়ের উল্টো দিকে হাঁপাতে হাঁপাতে  সে বলে,

আমি বঠি রে, নামোও কুহলির তোর মদনা কাকা।

খুল ন, কপাট টা একটু তাড়াতাড়ি,

তোর কাকী কেমন কেমন কইরছে রে,

চাঁড়ে চঅ ন,আমাদের বাড়ী।


মাদুলির ব্যাগটা বগলদাবা কইরে হন্ত দন্ত  হইয়ে ছুটে নিমাই ওঝা,

মদনকাকার বাড়িতে ঢুইকেই রোগীকে নাইড়ে চাইড়ে বিজ্ঞের মতো বলে,

মদনা কাকা, একে লতাপাতাই ছুঁইয়াছে,,

মুখের থ্যেইকে ফেনা বাইরাচ্ছে,,

আর পায়ের উপরে দুটি দাগ থ্যেইকে রক্ত বেইরাছে।

আর শুন, বলিস না কাউকেই এই লতাপাতার  কথা

আমি যখন আইসেছি তখন হবেই ঠিক ব্যবস্থা।


মদন কাকা ভইয়ে কাঠ,কপাট ধরেই থরথর কাঁপে

মাথায় দুই হাত নিয়ে বলে, কি হবে এবার !

ওঝা তড়িঘড়ি বলে ,ভাগ্যে যা আছে তাই হবে তুমার।

তবে চিন্তা করো না মদন কাকা―

আমি যখন আইসেছি,চেষ্টা কইরছি, ঝাড় ফুঁক কইরে,

"হে মনসা, হে কালী― কাকী যেন না যায় মইরে।

অং বং  চং ক্যং বকের ঠ্যাং এ নমো নমোও,

সাপের বিষ ঝটপট শরীর থ্যেকে নামো নামোও।"

মাদুলি, তাবিজ, জল পড়া, তেলপড়া কত কান্ড!

ঝাড়ফুঁক― শত মন্ত্রেও বিষ আর নামে না,

মুখের ফেনাটা কিছুই কমে না।

রোগীর অবস্থা যখন কাহিল, বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে,

মদন কাকা তখন কাকীকে নিয়ে হাসপাতালের পথে ঝড়ের গতিতে ছোটে।

ডাক্তার যখন দেইখল্য রোগীকে,নাড়িটা টিপে টিপে, হাই হাই....

পরীক্ষা কইরে ডাক্তার জানাইলো, রোগী আর বেঁচে নাই।

পুনশ্চ: বিষাক্ত সাপে কাটলে ওঝার`পরে ভরসা করো না।

তুক- তাক, ঝাড়- ফুঁক, করে আর রোগীকে মেরো না।


অভেদ

-প্রদীপ চক্রবর্তী।


জলের ধর্ম প্রবাহমানতা

মানুষের মানবতা,

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কলে

পিষ্ট আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।


হিন্দুর রক্ত লাল হলে

মুসলমানেরও তাই,

জগত জুড়িয়া মানব জাতি

কোনো ভেদাভেদ নাই।


কর্ম করলে ফলও মিলবে

বিজ্ঞান শেখায় তাই,

যুক্তিবাদী দার্শনিক মোরা

একে অপরের ভাই।


শোষনমুক্ত সমাজটা চাই

মাথা তুলে বাঁচতে,

শ্রমিকের হাতে হাতুড়ি নাচে

কৃষকের সাথে কাস্তে।

নারী নির্যাতনের সূত্রপাত! -রাজা দেবরায়
Nov. 13, 2024 | নারী | views:321 | likes:16 | share: 2 | comments:0

ছোটবেলা থেকেই লিঙ্গভেদের শিক্ষা দেওয়া হয় বাড়িতে এবং সমাজে!

মেয়ে হলেই চুড়ি, নূপুর পরানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখা যায় সমাজে। তাছাড়া লিঙ্গভেদে পোশাক পরানো, মেয়েদের ঘরে আটকে রাখা, ছেলেদের বাইরে যাবার ছুট দেওয়া, ছেলেদের ক্রিকেট, ফুটবল  ইত্যাদি আউটডোর গেম খেলতে দেওয়া কিন্তু মেয়েদের ইণ্ডোর গেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা কিংবা খুব বেশি হলে বাড়ির উঠোনে খেলতে দেওয়া ইত্যাদি আমাদের সমাজে দেখা যায়। যার ফলস্বরূপ ছোটবেলা থেকেই ছেলে এবং মেয়ে আলাদা, ছেলেরা শক্তিশালী বেশি, ছেলেদের বুদ্ধি বেশি ইত্যাদি কথা সবার মনে গেঁথে যায়। সবথেকে বড় কথা মেয়েদের থেকে ছেলেদের অধিকার বেশি সেই মানসিকতা চলে আসে, যার ফলে অনেক বাড়িতেই ছেলেদের জন্য বড় খাবারের টুকরো, ভালো খাবার, দামী পোশাক ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়।

পুরুষতান্ত্রিকতার নাগপাশে জড়িয়েই নারী নির্যাতনের সূচনা হয়! ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়ে আলাদা বোঝানোর সমাজের যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা সেটাই নারী নির্যাতনের সূত্রপাত বলে মনে হয়।।

প্রাইভেট টিউশন -বিতান সানা
Nov. 13, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:617 | likes:55 | share: 4 | comments:0

দীর্ঘদিনের হাজারো অভিযোগ, হাজারো নীতি-নির্দেশিকা সত্ত্বেও এক শ্রেণির স্কুলশিক্ষকের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করা যায়নি। করোনা অতিমারিতেও কেউ কেউ অনলাইনে পড়িয়েছেন। লকডাউন উঠলে ফিরে গেছেন সেই পুরোনো অভ্যেসে।

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আচরণবিধিতেই বলা আছে, স্কুলশিক্ষক-শিক্ষিকারা টিউশন করতে পারবেন না। কিন্তু সেই বিধি আছে বিধিতেই! গত ২-৩ বছরে নানান পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে নানান প্রতিবেদন বেরিয়েছে। নানান প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠন এই বিধিভঙ্গের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করেছেন। সেই স্কুল শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করা হলে কেউ বলেছেন তিনি এসব করেন না, বা কেউ বলেছেন আগে করতেন এখন ছেড়ে দিয়েছেন। আসলে এখনও তারা স্বমহিমায় টিউশন করিয়ে চলেছেন। নানান প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠনের শিক্ষকরা সেই অভিযুক্ত স্কুল শিক্ষকদের তালিকাও তুলে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের কাছে। উপরিমহল থেকে সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ফল শূন্য। আসলে কেউই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে চাননা। প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠন বলতে সেই শিক্ষকদের বোঝাচ্ছি যারা কোনো স্কুল বা কলেজের সাথে যুক্ত নন, কেবল টিউশন করিয়েই যাদের সংসার চলে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বারবার শিক্ষক শব্দটা ব্যবহার করছি কারণ প্রাইভেট টিউশনটা মূলত শিক্ষকরাই করে থাকেন। শিক্ষিকারা নন।

দীর্ঘদিন ধরেই এই ব্যবসা চলছে। বাম আমলেও এর রমরমা ছিলো, তৃণমূলের আমলেও কোনো পরিবর্তন নেই। আমার ধারণা আগামীতে যে সরকারই আসুক না কেন, এর পরিবর্তন হওয়ার নয়। আমি বারাসাত প্যারিচরণ সরকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। একসময় আমিও এই ব্যবসার অংশ ছিলাম। ব্যবসা বলছি কারণ যেই শিক্ষাটা দেওয়ার জন্য তারা সরকারের কাছ থেকে বেতন পান, সেই শিক্ষাটার কিছু অংশ তারা স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন আর স্কুলের বাইরে টাকার মাধ্যমে আসল শিক্ষাটা তারা প্রাইভেট টিউশনে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে থাকেন। আমাদের সময় কেউ কেউ পরীক্ষার প্রশ্নও বিলিয়ে দিতেন। স্কুলের ইউনিট টেস্টের বা ফাইনাল এক্সামের আগে প্রাইভেট টিউশনে যে প্রশ্নের ওপর পরীক্ষা নিতেন, হুবহু অনেক প্রশ্নই স্কুলের পরীক্ষায় চলে আসতো। এটা তখনই ঘটতো যখন সেই শিক্ষকই স্কুলের প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন। এই কারণে অনেক ছাত্ররাই নির্দিষ্ট শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে যেত। ছাত্রদের মা বাবাও চাইতেন তাদের ছেলে ভালো মার্কস পাক। আমার মা বাবার ক্ষেত্রেও এর বদল ঘটেনি, বাবা না চাইলেও মা প্রাইভেট টিউশনের পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের স্কুলের অনেক শিক্ষকরাই স্কুলের শেষে নানান ছাত্রের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন পড়াতেন। কেউ কেউ আবার নিজের বাড়িতেই প্রাইভেট টিউশন সেন্টার খুলে পড়াতেন। ২০১৪ এর দিকে নবম-দশম শ্রেণীর সপ্তাহে একদিন করে টিউশন থাকতো। মাসের রেটটা ছিল এরম: বাংলা ২০০-২৫০ টাকা, ইংরেজী ২৫০-৩০০ টাকা, বিজ্ঞানের প্রতিটা বিষয় ২৫০ টাকা, ইতিহাস ২০০-২৫০ টাকা, ভূগোল ২৫০ টাকা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের পড়া থাকতো সপ্তাহে দুদিন। রেটটা ছিলো বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিটা বিষয় ৬০০-৮০০ টাকা, ইংরেজি- বাংলা ৪০০ টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের জন্য মাসের রেট ছিলো ১০০০-১২০০ টাকা। প্রাইভেট টিউশন পড়তে গিয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে হিসেব করে দেখতাম একজন শিক্ষক মাসে কুড়ি-ত্রিশ হাজার বা কেউ কেউ চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম করছেন। কারণ তাদের অনেকেই অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাইভেট টিউশন পড়াতেন। প্রতিটা ক্লাসের অন্ততপক্ষে ২-৩টে ব্যাচ থাকতো।

স্কুলের প্রতিটা ক্লাস হতো ৪০ মিনিট করে, একজন শিক্ষক পড়িয়ে যাওয়ার পর আরেকজনের রুমে আসতে ৫-১০ মিনিট সময় লাগতো। ৩০-৩৫ মিনিটে আসলে সেইভাবে পড়া না হলেও, এমন অনেক শিক্ষকই ছিলেন যারা আন্তরিকতার সাথে ওই সময়টুকু পড়াতেন এবং তারা বাইরে প্রাইভেট টিউশনিও করতেন না।

কিছুদিন আগে আমার পাড়াত এক ভাইকে তার স্কুলের পড়া দেখাতে গিয়ে, আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়। সেদিন বুঝেতে পারি ওর স্কুলে আসলে পড়াশুনাটাই ঠিকমতো হয়না। বাংলা অক্ষরই সে ঠিকমতো চেনেনা। সহজ বাংলা রিডিং পড়তেই সে হিমশিম খাচ্ছে। বারাসাতেরই একটি বাংলা মিডিয়ামের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র সে। ওর সাথে কথা বলে জেনেছিলাম ওই ক্লাসে ওর মতো ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অনেক। কেবল গোনাকয়েক ছাত্রছাত্রীই প্রাইভেট টিউশনের দৌলতে ক্লাসে ভালো পারফর্ম করছে। আর্থিকভাবে সবল না হওয়ায় ওর সেই সুযোগটা হয়নি। তাই ক্লাস নাইনে এসেও বাংলা রিডিং পড়তেই সে হিমশিম খাচ্ছে।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোর প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীরাই প্রাইভেট টিউশন পড়তে যায়। তারাও জানে স্কুলে ঠিকমতো পড়ানো হয়না, আর সেটার ওপর ভরসা করে থাকলে পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়া মুশকিল। ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মাও তাই প্রাইভেট টিউশনিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করিয়ে দেন, কেবল মার্কসের লোভে পড়ে। শেষমেশ পরীক্ষায় নাম্বারটিই গুরুত্বপূর্ণ কিনা। কলেজের ক্ষেত্রেও তাই। নন-টেকনিক্যাল কলেজে সকল ছেলেমেয়েরাই প্রাইভেট টিউশন পড়ে। টিউশনের আশপাশের জেরক্সের দোকানে গেলেই নোটসএর ফটোকপির বান্ডিল দেখতে পাওয়া যায়। এমন কি যারা প্রাইভেট টিউশন পড়ান, তাদের মধ্যে অনেকেই নানান কলেজে বর্তমানে প্রফেসর পদে রয়েছেন। সরকারের বেতনও নিচ্ছেন, এদিকে বাইরে টাকার বিনিময়ে ছেলেমেয়েদের নোটসও বিলি করছেন।

বর্তমানে প্রাইভেট টিউশন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, অনেকের ধারণা প্রাইভেট টিউশন না পড়লে আসল শিক্ষা লাভ হয়না। স্কুল-কলেজের তেমন গুরুত্ব নেই। সরকার বা প্রাইভেট সংস্থার স্কুল/কলেজ তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই আসলে। স্কুল-কলেজ বর্তমানে শিক্ষার পরিবর্তে কেবল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টকার্ড আর ডিগ্রি সার্টিফিকেট নেওয়ার স্থান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। যদিও প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল এখনো গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান কারণ পয়সা খরচ করে শিক্ষা নেওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমার মনে হয় সরকারের নিজ উদ্যোগে প্রাইভেট কিছু টিউশন সেন্টার খুলে দেওয়া উচিৎ। ছেলেমেয়েদের আর কষ্ট করে স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা সেন্টারে গিয়ে টাকার বিনিময়ে আসল শিক্ষাটা নেবে। যাদের সেই অর্থটা নেই তারা শিক্ষাটা নেবেনা। সরকারও এটাই চায়। টাকা না থাকলে কিসের শিক্ষা? বেশিরভাগ শিক্ষকরা এই 'অর্থ যার, শিক্ষা তার' পরিবেশটাই তৈরি করেছেন। সেই শিক্ষকেরা যারা স্কুলে বা কলেজে শিক্ষকের বা প্রফেসরের দায়িত্বে থেকেও বাইরে প্রাইভেট টিউশন করে এক্সট্রা রোজগার করেন, তাদের বেতন না দিয়ে সরকারের একেবারে ছাত্রছাত্রীদের হাতেই টিউশনের টাকাটা তুলে দেওয়া উচিৎ। তারাই টিউশন পড়ার পর মাস শেষে সেই শিক্ষকদের টিউশনের টাকাটা বেতন হিসেবে তুলে দেবে।

স্কুলে ছাত্রহিসেবে আমরা অনেকেই এই ব্যবসার অংশ ছিলাম, কিন্তু, এরমটা চলতে থাকলে আগামীর প্রজন্ম এটাই শিখবে যে স্কুলে/কলেজ পড়াশুনা করার জায়গা নয়, কেবল গিয়ে হাজিরা দেওয়ার জায়গা। সরকার যদি বাজেটে শিক্ষাখাতে আরও বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চপ্রাথমিক, হাইস্কুলের শিক্ষার পরিকাঠামো আরও ভালো করে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের মধ্যেই উচ্চমানের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতো, তাদের প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়তো না। আজকাল আমরা অনেকেই ইউটিউবের নানান চ্যানেলে বিনামূল্যে আধুনিকভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকি। ছাত্রছাত্রীদেরকেও যদি সেই কায়দায় স্কুলে পড়ানো যেত, তাদের স্মৃতিতে আরো ভালোভাবে সেই বিষয়গুলো গেঁথে যেত বলে আমার মনে হয়। প্রাইভেট টিউশন পড়ার কোনো প্রয়োজন পড়তোনা। এছাড়া কলেজের ক্ষেত্রেও সিলেবাসে পরিবর্তন আনা বা এরম পরিকাঠামো বানানো দরকার যাতে কোনো ছাত্রছাত্রীকেই প্রাইভেট টিউশন না পড়তে হয়। স্কুল বা কলেজই হয়ে উঠবে প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণের একমাত্র স্থান। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে এরম একটা দিন আসবেই।

দেহের কোন অংশ সামান্য পুড়ে গেছে? টুথপেস্ট লাগিয়ে দিন। -Souvik Mukherjee
Nov. 10, 2024 | category | views:39 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এখন উৎসবের মরশুম চলছে, বাচ্চারা বাজি পোড়ানোর সময় আগুনের ছ্যাঁকা খাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে কোন বড় মানুষ Colgate বা Toothpaste লাগাতে বলছেন First Aid হিসাবে। এরকম অবিশ্যি আমরা দেখে থাকি কারোর সামান্য একটু পুড়ে গেলে Toothpaste ব্যবহার করেন। যেটা কখনওই উচিত নয়, যদি কারোর First degree burn অথবা Small Second Degree burn হয় তাহলে কখনওই সেই জায়গায় Toothpaste লাগানো উচিত নয়। পোড়ার পর Toothpaste লাগানো এতবড় myth যে Colgate company তার Website- এ নিয়ে research paper রেখেছে যাতে কখনওই এরকমভাবে Toothpaste কেউ ব্যবহার না করে। খুব সম্ভবত এই myth শুরু হয়েছিল টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজার সময় মুখের ভিতর ঠান্ডা অনুভব হয়, আগুনে পুড়লে সেই জায়গা গরম হয় তাই ঠান্ডা করার জন্য Toothpaste লাগালে কাজ হবে।  কিন্তু আসলে পোড়া জায়গায় টুথপেস্ট ব্যবহার করলে Toothpaste-এ থাকা কিছু ingredients-এর জন্য জায়গাটার আরও ক্ষতি হয়, পোড়া অংশের প্রদাহ বেড়ে যায় এবং infection-এর  ঝুঁকিও বেড়ে যায়। কোন কোন টুথপেস্টে sugar থাকে সেটা ব্যাকটেরিয়ার জন্য আরও উত্তম স্থান। Toothpaste home remedy আসলেই কোন কাজের নয় এতে বেশি ক্ষতি। First degree burn- এর জন্য বাড়িতে silver nitrate gel রাখুন First Aid হিসাবে কিন্তু সেই gel লাগানোর আগে পোড়া জায়গা জলে রাখুন কিংবা জলে ভেজানো ঠান্ডা পরিস্কার তোয়ালে ব্যবহার করতে পারেন। 

কবিতাগুচ্ছ ২ -সম্পাদক
Nov. 10, 2024 | কবিতা | views:625 | likes:27 | share: 2 | comments:0

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

জামাল আনসারী


আমার ভাই-এর তাজা রক্তে রাঙানো

স্বর্ণাক্ষরে লেখা নাম --অমর একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেই অমৃত নাম, আমি কি জীবনে- মরণে কখনো  ভুলিতে পারি?

না। তা আমি কখনো ভুলিতে পারিব না।

'নক্সীকাথাঁ বোনা রাতে স্বপ্নের প্রভায়' রঙিন

নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে,অমর ভাষা শহীদ --

আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, আব্দুস সালাম,

আব্দুল জাব্বার,এবং শফিউর রহমানের নাম।

বঙ্গ মাতার চির বীরসন্তানদের আত্ম বলিদানে

আমার মায়ের মুখের ভাষা, মাতৃভাষার

কৌস্তুভ মৃগসম সৌরভ পৌঁছে গেছে

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে ত্রিপুরা, আসাম,

দক্ষিনের কর্ণাটক, সুদূর দীপপুঞ্জ আন্দামান।

বাংলার রামধনু বিকেলের আকাশ জুড়ে,

বর্নে- গন্ধে ছড়িয়ে আছে একুশে ফেব্রুয়ারির নাম।


একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ক্যালেন্ডারের শুকনো পাতায় লেখা একটা দিন নয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি একটা বিপ্লবের নাম।

জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি  উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে

আপোষ হীন সংগ্রমের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃ প্রকাশ।

একুশে ফেব্রুয়ারির  হাত ধরে একবিংশ শতাব্দীর

ঝড়-ঝঞ্জা অতিক্রম করে দুরন্ত বেগে ধাবমান ষ্টীমার,

বিশ্বের বাইশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জয়গান।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো 'ফ্যাকাসে দেওয়ালের রাত্রিমাখা গন্ধে'

মর্মরিত সেকালের পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর

পৈশাচিক গোলা বারুদের উল্লাসী সন্ধ্যে।

রৌদ্রছায়া উল্কি আঁকা গ্রাম বাংলার নিকানো উঠানে,

কাঠের পিঁড়েতে বসে এখনো শোনা যায়....

ঐ দূর নীলচে আকাশে বেতারে ভেসে আসা,

সবুজ ধানের মাঠ,জ্যোৎস্না আলোকিত নদী বক্ষের

ভাটিয়াল, মুর্শিদি গানের চির পরিচিত সেই সুর।


আমার মায়ের সযত্নে লালিত যে ভাষা

সেই ভাষার অমৃতোপম নাম বাংলা ভাষা।

কি বৈচিত্র্যময় তার কথন শৈলী?

রাঢ়ী, বঙ্গালী, বরেন্দ্রী,ঝাড়খণ্ডী,রাজবংশী উপভাষা,

সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এই ভাষাতেই মিটে মনের আশা।

এই ভাষাতেই ধ্বনিত শিউলি ঝরা সকালে

"জনগনমন-অধিনায়ক জয় হে"

"আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি

"দুটি সার্বভৌম দেশের জাতীয় সংগীতের ঐক্যবোধে,

এপার বাংলা অপার বাংলা ভাই ভাই আজও পাশাপাশি।

আমি গর্বিত এই অমর বাংলা ভাষার তরে,

বাংলার বিজয় পতাকা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম,

পৌঁছে দিয়েছে প্রাচ্য -পাশ্চাত্যের দ্বারে দ্বারে।

ইউনেস্কো রেখেছে বাইশ কোটি বাংলা ভাষীর মান,

একুশে ফেব্রুয়ারি তাই পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান।

আমার মায়ের মুখের ভাষা,আমার মাতৃভাষা,

যাদের আত্মবলিদানে গৌরবান্বিত বাংলানাম,

সেই অমর বাংলা ভাষা শহীদরা অন্তরে পেয়েছে ঠাঁই

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানায় শহীদদের শত কোটি প্রনাম।



মাতৃভাষা

সাহেব ইসলাম


সব কিছুর চেয়েও দামি

মোদের বাংলা ভাষা

সেই ভাষাতেই আছে

মোদের সুখের আশা।

সবার উপর মাতৃভাষার

হয়রে ভাই ঠাই

দিনরাত মনের মাঝে

তাকে খুঁজে পাই।

জড়িয়ে আছে এই ভাষা

মোদের প্রশ্বাসে

মিশে আছে আনন্দে

আর উচ্ছাসে।

এই ভাষাতে আপন মাটির

গাইবো মোরা গান

শপথ নিচ্ছি সারা জীবন

রাখব তার মান।



মুক্ত

প্রদীপ চক্রবর্তী


মানুষ যখন আদিম ছিল

ছিলনা কোনো বারণ,

সবকিছুই ঘটত নাকি

ভগবানের কারণ।


ভূমিকম্প,অতিমারী

আসত যখন বন্যা,

ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে

মানুষ ধরত  কান্না।


আমরা আজকে আধুনিক

মনটা তো নয় পরিস্কার,

আধুনিকতার মোড়ক ঢেকে

পালন করছি কুসংস্কার।


যুক্তি দিয়েই দুনিয়া শুরু

যুক্তি দিয়েই শেষ?

সংস্কার মুক্ত সমাজ হলে

এগিয়ে যাবেই দেশ।



গ্রহণে সবকিছু করুন

রাজা দেবরায়


যেকোনো গ্রহণে খাওয়া যায়,

প্রতিদিনের কাজ করা যায়।

যদি ভাবেন গ্রহণে আলো কম,

তাই ক্ষতিকর জীবাণু দেখাবে দম!

তবে জেনে রাখুন সেটা আসল ভ্রম!

কারণ একটু বোঝার চেষ্টা করুন,

সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে একটু ভাবুন।

গ্রহণের আলো কি আসলে

রাত্রিবেলা থেকেও কম ?

রাতে যদি জীবাণুরা দেখাতে না পারে শক্তি,

কুসংস্কার মন নিয়ে কেনো করবো ভক্তি?

তাই গ্রহণে বিন্দাস সবকিছু করবেন,

আর অন্যদেরও এই কথাটা বোঝাবেন




ইনফিনিটি ক্রুসেড

শ্রীকুমার মন্ডল


জন্মের পর ক্ষনিকের মধ্যেই আমি আমার মনুষ্যত্ব হারিয়েছি।

কখন?

যখন, সদ্যজাত অবচেতন মস্তিষ্কে তোমরা ধর্ম ও কুসংস্কারের অসহনীয় বিষ প্রয়োগ করেছ।

জ্বালায় ছটফট করতে করতে কতনা যন্ত্রণা পেরিয়েছি।


একটুও মায়া হয়নি তোমাদের।

হওয়ার কথাও নয়।

কারণ, সেই বিষের জ্বালায় একই ভাবে তোমরাও জ্বলেছ,

তোমাদের সেইসব পূর্ব পুরুষদের সৌজন্যে,

ক্রুসেডের তরোয়াল পুরুষত্ব কেটে নিয়েছিল যাদের।


ঠিক যেমন আমি জ্বলে পুড়ে মরেছি তোমাদের জন্য।

এটাও যথেষ্ট নয়।

থমকে থাকবে না এ-অবধি,

কারণ আমিও তো মারব আমাদের সন্তান দের।

ঠিক তোমাদের মত।

সমস্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মরবে একই ভাবে।

হয়তো বা এই জ্বালা সহ্য করেও বাঁচবে কিছু মানুষ,

তবে তা খুবই সামান্য।


ধ্বংস হয়েছে এই প্রজন্মের ক্রিয়েটিভিটি।

সেই জ্বালায় বিনষ্ট হয়েছে আমাদের ছোট্টো হৃদয়ের সেনসিটিভিটি।

শিরায়, ধমনীতে গিয়ে শরীরের সমস্ত রক্তকে বিষিয়ে দিয়েছে সেই বিষ।

সেই বিষেরই chemical reaction এ যখন আমি আমার বিচার, বিবেক, জ্ঞানের তৃষ্ণা, কৌতূহল, উপলব্ধি, সচেতনতা সমস্ত হারিয়েছি সমূলে,

তখনই আমার ভেতরে থাকা সেই ধর্মীয় দানব জন্ম নিয়েছে,

ধ্বংস করেছে এই জীবনের মোটিভিটি।


আমি এখন এক সেন্স হীন জম্বী, মানুষের মত দেখতে এক শয়তান।

যেই শয়তান এখন ঈশ্বর নামক এক অলীক কল্প বস্তুর দাস।

ওই ঈশ্বর নাকি উপাসনা চায়, সেবা চায়।

ভেদাভেদ চায়, রক্ত চায়, দাঙ্গা চায়, হিংসা চায়, মাথা চায়,

চোখ বেরকরে থাকা বিভৎস কাটা মাথা,

শুধু নিজেকে করতে প্রমান।


ওই ঈশ্বর নাকি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে পরীক্ষা নেয়।

আর যে ওই পরীক্ষায় ফেল করে, সে নাকি মৃত্যুর পর নরকে যায়,

যাতে আরো হিংসা, আরো যন্ত্রণা, আরো কষ্ট দেখে দেখে পরীক্ষার জন্য আরো উপযুক্ত হয়।

ঠিক যেমন জেলে ক্রিমিনালদের সাথে থাকলে, নিরীহ মানুষও ক্রিমিনাল হয়ে ওঠে,

আর প্রতিদানে সমাজে আরো বহুগুন হিংস্রতা ফিরিয়ে দেয়।


ঈশ্বরই শয়তানদের কেন্দ্রীভূত প্রাণ।

আর আমি আজ ওই পরমেশ্বরের পদসেবায় নিযুক্ত।

হ্যাঁ আমি অপরাধী, আমি শয়তানের প্রাণকেন্দ্রের পূজারী।

কিন্তু তোমদের ওই বিষ।

সেই বিষে, আমি আমার সচেতনতা হারিয়েছি।

হারিয়েছি অপরাধ বোধ।

জানিনা, যে আমি নিজেই এক মস্ত শয়তান।


কোথায় সেই গুটি কয় মানুষ, যারা বিষের জ্বালা সহ্য করেও বেঁচেগেছে?

এক্সপোনেন্সিয়াল হারে বিস্তৃত হচ্ছে ঈশ্বরের সাম্রাজ্য।

ওই সামান্য কি পারবে, আমাদের মত অসংখ শয়তানের মাঝে মনুষ্যত্বকে টিকিয়ে রাখতে?

ওই সামান্য কি পারবে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে আমাদের অপরাধ?

ওরা কি পারবে, সেই সচেতনতাকে ফিরিয়ে আনতে,

যা ধর্মের পদতলে হারিয়েগেছে?

ফিচার: আমি কেন নাস্তিক হলাম -সম্পাদক
Nov. 10, 2024 | নাস্তিকতা | views:301 | likes:36 | share: 0 | comments:0

লিখেছেন- মোনালিসা

বাড়িতে নাস্তিকতা নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলে আমার সাথে মা বাবা সহ বাকিদের।

ছোটবেলায় বাড়ির সকলের ঠাকুর ভক্তি দেখে দেখে আমিও যন্ত্রের মত পুজো করতাম।কত কি চাইতাম।এখন সেইসব ভাবলে হাসি পায়।

আমার মতের পরিবর্তন হতে শুরু করে ২০১২ সাল নাগাদ। যে বছর পার্ক স্ট্রিট রেপ কেস টা ঘটে।এই ঘটনাটা আমার বিশ্বাসে প্রথম কুঠারাঘাত ঘটায়।তার পর দিল্লির ঘটনা ঘটলো। মেয়ে টাকে যখন সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হলো আমি মনে প্রাণে প্রার্থনা করেছিলাম পুজো করেছিলাম যে তোমরা ওকে বাঁচিয়ে দাও।

নাহ আমার কথা ঠাকুর শোনেনি। যার কান নেই যার প্রাণ নেই সে আর শুনবে কি করে।সেই দিন আমি প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছিলাম।আমি আর কখনও কোনোদিন কোনো পাথর খন্ডকে মানবো না।এবং বাড়ির লোককেও বলেছিলাম। যথারীতি তারা আমার মুখ বন্ধ করেছে,আমায় বকাঝকা করেছে।আমি আমার বিশ্বাস থেকে সরে আসিনি আজও।

আর যেহেতু বাড়িতে সবাই পুজো করে আমি একা এসব মানিনা।তাই  বাড়ির লোকের সাথে প্রায় অশান্তি লাগে।

বাট লাগে লাগুক।যেটা ভুল সেটাকে মেনে নিয়ে নিজের কাছে ছোট হওয়া সম্ভব নয়।

আর একটা ব্যাপার সালটা ছিল ২০১২।তার পরের বছর আমার উচ্চমাধ্যমিক ছিল।যেহেতু বাড়িতে নাস্তিকের মত কথা বলছি,যুক্তি দেখাচ্ছি সরস্বতী পূজায় অঞ্জলী দেবনা,উপোস করবো না বলছি বাড়ির লোক আমায় বলেছিল তুই এরম করছিস তো Hs ভালো হবে না। গ্রাজুয়েশনে ভালো ফল হবে না।এই সবও শুনতে হতো,পরীক্ষা খারাপ হ‌ওয়ার ভয় দেখাতো।আমি ওদের শুধু একটা কথাই বলি।তোমাদের ভগবান মেয়েটার জীবন শেষ করে দিল কি করে।তোমরা তো বলো তোমাদের ভগবান সবার মঙ্গল করে।তবে ওর ক্ষেত্রে এটা কি হলো।এইসব প্রশ্নের উত্তর নেই তাদের কাছে জানি।যাই হোক তারপর

আমি নিজের চেষ্টায় দেখিয়ে দিয়েছি ওদের, ভগবানের পায়ে মাথা না ঠেকিয়ে ও নিজের ইচ্ছাশক্তি,আত্মবিশ্বাসের জোরে সব কিছু সম্ভব।পাথরে না বিশ্বাস করে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাটা অনেক বেশি প্রয়োজন।


আমি কেন নাস্তিক হলাম

লিখেছেন- বিতান সানা

আমার নাস্তিক হওয়ায় পেছনে আমার বাবার অবদান আমি অস্বীকার করতে পারিনা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি বুঝিয়েছেন এই পৃথিবীর সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট গতিতে ঘটছে। কিভাবে সেটি ঘটছে, সেটা বিজ্ঞান ব্যাখা করেছে। বানর থেকে আদিম মানুষ আর তারপর আজকের এই আমরা, এটা সবটাই ঘটেছে বিবর্তনের ওপর ভর করে, অলৌকিক কিছুর জন্য নয়। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে নিরীশ্বরবাদের পরিবেশ ছিলো।

ছোটবেলায় আমার হাতে খড়ি হয়নি, এমন কি আমি সরস্বতী পুজোর আগেই কুল খাওয়া পছন্দ করতাম। বাড়িতে নিষেধ ছিলোনা, এমন কী সরস্বতী পুজোর দিন পড়াশুনাও করতাম। বাড়িতে কোনো ঠাকুরের ছবি ছিলো না, আজও নেই। বাবাকে মাকে কোনদিন বাড়িতে বা মন্দিরে গিয়ে পুজো করতেও দেখিনি। এই সবকিছুই আমার ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। একটু বড়ো হয়ে যখন মার্ক্সবাদ পড়েছি, গভীরে গেছি, জেনেছি ঈশ্বর, আল্লাহ সবই ক্ষমতাবান শ্রেণীর তৈরি, যা দিয়ে তারা দুর্বল শ্রেণীকে শোষণ করে। প্রতিটা ঘটনাই আমাকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে ঈশ্বর, আল্লাহ বলে আসলেই কিছু নেই, সবটাই আসলে কিছু মানুষ ক্ষমতার সিংহাসনে বসে কাঠি নাড়ছে। আমরা তাদের অঙ্গুলিহিলনে চলছি মাত্র।

একদিন বাবার বুক সেল্ফের পুরোনো বই ঘাটতে ঘাটতে প্রবীর ঘোষের বই পেয়েছিলাম, " অলৌকিক নয় লৌকিক ২য় খন্ড"। ব্যাস, এরপর সবকটি খন্ড জোগাড় করে গোগ্রাসে গিলেছি। " যে কটি doubt ছিলো, তাও ধুয়ে সাফ হয়ে গেল প্রবীর ঘোষকে পড়ে। সমস্ত কিছু বিচার করে বুঝলাম স্বর্গ, নরক, আশীর্বাদ, অভিশাপ, আগের জন্ম, পরের জন্ম সবই মানুষের বানানো ভ্রান্ত ধারণা। আমরা চাইলেই আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারি, তাও আবার গ্রহ, রত্নের পাথরের আংটি না পরেই। দরকার উপযুক্ত বিজ্ঞানমূলক, যুক্তিমূলক শিক্ষা, বিপরীত মতের সম্মান করার মানসিকতা আর সমাজের প্রচলিত সমস্ত সত্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার সাহস।


একুশ শতকের লজ্জা: ডাইনি -অভিষেক দে
Nov. 10, 2024 | কুসংস্কার | views:987 | likes:68 | share: 3 | comments:0

সময়টা ২০০১ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাস। বাঁকুড়ার একটি গ্রামে গিয়েছি বন্ধু কৌশিক এর মামাতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা গ্রামে পৌছে মেতে গেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরের দিন খুব ভোরে উঠে বন্ধুর একজন মামার সাথে বন্ধু  কৌশিক এবং আমি বেরিয়েছি শীতের সকালে গ্রাম ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এক যায়গায় দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ব্যাপার টা কি জানতে আমরা তিনজনে উক্ত স্থানে চলে আসি। দেখি কয়েকজন হোমড়াচোমড়া ব্যাক্তি খুব উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন কে যেন কড়াভাষায় কিছু বলছে এবং তাঁদের অনতিদূরে একজন ষাটোর্ধ মহিলা অসহায় ভাবে মাটিতে মাথা নীচু করে কাঁদছেন। বন্ধুর মামা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বিষয় টা জেনে এসে আমাদের জানালেন, উক্ত মহিলা নাকি ডাইনি। গ্রামের একজন কে দেখলাম উনি নাকি গুণিন, তিনিই নাকি জানিয়েছেন উক্ত মহিলাটি একজন ডাইনি এবং মহিলার পরিবার কে গ্রামের মাতব্বর দের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এর জন্য নইলে গ্রামে থাকা উক্ত পরিবারটির পক্ষে নাকি  অসম্ভব। 

ডাইনির ব্যাপারে গল্পের বইতে আগে অনেক পড়েছি, কিন্ত এভাবে সরাসরি একজন ডাইনি কে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম বিষয়টা সেদিন ভালোভাবে না জানার দরুন। জানিনা, ডাইনি ঘোষিত সেই মহিলা এবং তাঁর পরিবারটি আদৌ অতগুলো  টাকা দিয়ে গ্রামে থাকতে পেরেছিলেন কিনা। অনেক পরে জেনেছি ডাইনি বা ডায়েন বলে বাস্তবে কিছুই হয় না,ওসব গল্পগাঁথাতেই সম্ভব। কিন্ত আমি বললেই বা লোকে মানবে কেন? বাড়ির চালে ফনফন করে লাউ গাছ বেড়ে উঠছিল,কড়াও পরেছিল রাশি রাশি। আচমকা গাছ শুকিয়ে মরে গেলো। কেউ কি তবে কু-নজর দিয়েছে গাছে? কে-সে? ডাইনি নয় তো? সদ্য প্রসুতির সন্তান ক্ষিদের জন্য কাঁদছে অথচ মায়ের স্তনে মুখ দিচ্ছে না, কেউ কি মায়ের স্তন ভেড়ে দিয়েছে? সে, ডাইনি নয় তো? ছটফটে শিশুটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে গেছে। এটা ডাইনির কু-নজর নয়তো? এই তো গতবছর হারাণ এর মা এর পায়ে ঘা হয়, মলম লাগিয়েও কাজ হয় নি শেষে গ্রামের একজন গুণিনের কাছে জানতে পারলো গ্রামেরই এক ডাইনি, সেই পা এর রোগ টা জিইয়ে রেখেছে। শেষে গুণিন কে দক্ষিণা দিয়ে কিসব শেকড়বাকড় পরে সুস্থ হলো। 

শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, শিক্ষার সু্যোগ না পাওয়া কিংবা শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত শহুরে মানুষের একাংশও ডাইন বা ডাইনি বা ডায়েন এ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজে এই বিশ্বাস হচ্ছে সমুদ্র গভীর। কোনো গ্রামের কোনো গুনিন,জানগুরু, ওঝা,দিখলি, সৎসখা ইত্যাদিরা যদি কোনো মহিলাকে একবার ডাইনি ঘোষণা করে দেয় তাহলে সেই মহিলাকে বাঁচানো খুবই সমস্যার। গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর দের বিধান মতো ঘোষিত ডাইনির পরিবার কে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে তবে গ্রামে থাকতে হয়। কখনওবা ডাইনি বলে যাকে দেগে দেওয়া হয় তাঁকে প্রকাশ্যে নির্মম ভাবে হত্যাও হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই এমন খবর আমাদের চোখে পরে। বিভিন্ন দেশের নানান গল্পগাঁথায় ডাইনি নিয়ে প্রচুর কাহিনী রয়েছে এসব গল্পই ধিরে ধিরে আমজনতাকে ডাইনির প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে শেখাতে যে, ডায়েন বা ডাইনিদের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা আছে, এবং ডাইনিরা সমাজের ক্ষতিই করে থাকে। স্টার প্ল্যাস হিন্দি চ্যানেলে তো ডাইনির প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগাতে  ' নজর ' নামে একটা সিরিয়াল পর্যন্ত হয়েছে। এইধরনের সিরিয়াল বা সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অনেক। ডাইনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না জানি কত অসহায় মহিলারা সামাজের চোখে অপরাধী হয়ে অত্যাচারিত হবে, হচ্ছেও। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব চললেও কোনো প্রতিবাদ,প্রতিরোধ নেই। এই প্রসঙ্গে একটি লজ্জাজনক ও নৃশংশ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই। 

রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ সালে পাঁচজন মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী। 

উক্ত পাঁচজন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি " ডাইনি"। রাঁচির এই গ্রামে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনা, বরং গভীরে বিশ্বাস করে। ফলে যা হয় সেটা সত্যিই ভয়াবহ।  ২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে  হত্যা করার পরে গ্রামের এক ওঝার নিদান মতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়।পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। পুলিশ আসায় গ্রামবাসীরা জানায়, খুন করে বেশ করেছি। ( তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট ২০১৫ )। 


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে এই গ্রামে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে। আরেকটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে আরেকটি জঘন্য ঘটনার কথা শোনা যাক। 

বাঁকুড়া সিমলাপাল অঞ্চলের চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার গত প্রায় দেড়বছর হল গ্রামে ফিরতে পারছেন না। কারণ তিনি নাকি ডাইন বা ডাইনি। গ্রামের একজন 

জানগুরুর নির্দেশে, পরিবারটিকে জমিজমা বিক্রি করে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার নেই।  বর্তমানে একটা আদিবাসী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুগ্রহে পরজীবির মত বেঁচে আছেন ওনারা। অদ্ভুত এই অবস্থা। প্রশাসন সব জেনেও অন্ধ সেজে বসে আছে। 

আশ্চর্য হলেও, রাগ হলেও এটাই আমাদের ভারত।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কান্ড ঘটলেও তারা নির্বিকার। 

"ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"-র পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো, দীর্ঘবছর ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ জঙ্গলমহল এলাকায় যুক্তিবাদী বা  সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  বিশেষ ভাবে ডাইনি সমস্যা সহ আদিবাসী এলাকার আরেকটি সমস্যা নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ মধুসূদন মাহাতো সহ কয়েকজন মুক্তমনা সহযোদ্ধারা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, মধুসূদন মাহাতো, তথ্যের অধিকার আইনে রাজ্যে সরকারের স্টেট ক্রাইম ব্যুরোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কত মানুষকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে?  সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছে এবিষয়ে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাবা যায়! যেখানে তথ্যই নেই সেখানে প্রতিকার দুরাশা করাটা বোকামো।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েও সুবিচার পাননি চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার। এই অবস্থাই কি চলছে, চলবেও? প্রশাসন কি এভাবেই জেগে ঘুমাবে? কিছু আলোচনার সময়ে মধুসূদন মাহাতোর দাবী, কাউকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, যেই বছর কম বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির ফলে খরার প্রকোপ দেখা যায় সেবছরই ডাইনির ঘটনা বেশি শোনা যায়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতন যায়গায় এমনিতেই চাষাবাদ খুব কম হয় বৃষ্টি বা জলের অভাবে। তাই কয়েকজন ধূর্ত ব্যাক্তি এই বিষয় টাকে হাতিয়ার করে। তাঁরা বুজরুক, প্রতারক ওঝা,গুণিন, জানগুরু ইত্যদিদের সাথে মিলে কোনো মহিলা কে ডাইনি ঘোষণা করে দেয় এবং সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। স্বাভাবিক ভাবে অনেকেরই সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে চলে অত্যাচার এবং গ্রামে একঘরে করে রাখার বিধান। সোজা কথা, উদ্দ্যেশ্যে, কোনো মহিলাকে ডাইনি বলে দেগে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নোংরা চক্রান্ত। যেহেতু গ্রামগঞ্জে আজও ডাইনির ক্ষমতায় বিশ্বাসী ( পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষের অভাব নেই তাই বিশ্বাসীরাও দল কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে যাকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের ওপরে ক্রমাগত চাপ দিতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য। 


যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান আজকের মতন এতো উন্নত হয়নি সেসময় অজানা জ্বর বা রোগের প্রাদুর্ভাব কে অনেকে বোঙ্গা বা দেবতার অভিশাপ নয়তো ডাইনির কারসাজি ধরে নিতো। অবস্থা এখনো পালটায় নি। আজও প্রত্যন্ত গ্রামে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পরেও। আজও একশ্রেণীর মানুষের পরনে কাপড় নেই, হাতে রোজগার নেই, সু-চিকিৎসা নেই, পেটে খাদ্য দেওয়ার মতন অবস্থা নেই, পারিস্কার পানীয়জল নেই, বাসস্থান নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। এই নেই এর রাজ্যে আছে শুধু প্রতারণা, বুজরুকি, ধর্মের সুড়সুড়ি। গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশে নাগরিক অধিকার আজ খর্ব। আমজনতা তাঁদের সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে দেশে শুধুমাত্র ঘুষ দিয়ে কাজ করাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় সেদেশের জনতা সু-চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং সচেতনতার অভাবে এসব ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয় এবং ডাইনি ঘোষিত বলে অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত হয় প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মাথারা নারী কে কোনো দিনই ' মানুষ ' হিসেবে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। সর্বদাই ভেবেছে ভোগের সামগ্রী অথবা সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ করার একটা যন্ত্র। 

প্রায় দুশো খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ডাইনিতত্ত্ব বা ডাকিনিতত্ত্বের রমরমা শুরু হয় এবং দ্রুত ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রেসিন্যান্ড স্কট নামক একজন ব্যাক্তি প্রকাশ করেন ' The Discovery of Witchcraft ' নামের গ্রন্থ টি। উক্ত বইটির মূল আলোচনা ছিল মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে ঘোষনা করে সমাজ মিথ্যেই তাঁদের ওপরে অত্যাচার করেছে। স্কট এর বইটি প্রায় সর্বত্রই ধিক্কৃত হয়েছিল সেসময়। এরও আগে ১৪৮৬ সালে খ্রিষ্টান ধর্মে পোপের নির্দেশে ' The Witche's Hammer ' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থেই বলা হয়েছিল ডাইনিরা সমাজের শত্রু, ওরা অশুভ শক্তি, তারা মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক জানে,সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি দের ক্ষতি করে, নানান অসুখ তৈরী করে, রক্ত শুষে নেয়। তাই পোপের নির্দেশ ছিলো, ওদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ওঁদেরকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হোক। 'The Witche's Hammer ' গ্রন্থটির সময় থেকে বহুযুগ ধরে প্রকাশ্যে মানসিক রোগিণী অর্থাৎ মহিলাদের উপর বারে বারে আঘাত এসেছে যা আজও ক্রমবর্ধমান। এখন হয়তো ডাইনি ঘোষিত কোনো মহিলাকে জীবন্ত জ্বলিয়ে দেওয়া হয়না, কিন্ত যা যা অত্যাচার হয় সেটা কোনো অংশেই কম নয়। রাঁচির মারাইটোলি গ্রামের ঘটনাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে।

National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত ও খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। এতো গেলো সরকারি হিসেবে।  কিন্তু বিভিন্ন মানবধিকার বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ  পর্যন্ত ডাইনি অপবাদে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৮০ হাজার মহিলাকে। এই জঘন্যতম কান্ড শুধু ইউরোপ নয়, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সহ অনেক দেশেই ছিল যথেষ্ট আকারে।

শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর। উনি দীর্ঘসময় ধরে আদিবাসী দের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবীতে প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ ভাবে ডাইনির ঘটনা নিয়ে। আরেকজন ব্যাক্তি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়। উনিও ডাইনি নামক একুশ শতকের লজ্জাজনক কান্ড নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু ওনার কিছু বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন শ্রী বাস্কের  একটি লেখা ' আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার ' এর এক যায়গায় উনি লিখেছেন- "এটাকে ( ডাইনি) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের  কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ"।  

অর্থাৎ, শ্রীবাস্কের ধারণায়, ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। তাঁর মানে উনিও মনে করেন ডাইনি বা ডাইন বা ডায়েন বাস্তবে হয় এবং তাঁদের সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। গভীর দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি ডাইনির প্রতি এমন অন্ধবিশ্বাস থাকলে, যতই মিটিং মিছিল আন্দোলন কিংবা লেখালিখি হোক না কেন সমস্যাটা মোটেই দূর করা সম্ভব নয়। ডাইনির প্রতি গভীর বিশ্বাসও রাখবো আবার এর বিরুদ্ধে কলম চালাবো এটা সোজাসাপটা স্ববিরোধীতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরো দুঃখ পাই যখন ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েকজন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীরাও মনে করেন এই পৃথিবীতে সত্যিই ডাইনির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁরা নিজের ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একদা পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলা স্বঘোষিত ডাইনি ইপ্সিতা রায়চৌধুরী' র কথা। ১৯৮৮ সালে উনি সাড়াজাগিয়ে এসেছিলেন। সেসময় পত্রপত্রিকায় ওনাকে নিয়ে গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল। কয়েকটি পত্রিকাতো ওনাকে ভালো ডাইনি আখ্যা দিয়ে প্রশংসায় ভরা লেখা পর্যন্ত লিখেছে।  কিন্তু তারপরে যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা ওনার বুজরুকি ফাঁস হয়। আগষ্ট থেকে ডিসেম্ভর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্রিকায় উনার বুজরুকি ফাঁসের নানান মুখরোচক খবর প্রকাশিতও হয়। 

কোনো ওঝা,জানগুরু,গুণিন, সৎসখা, দিখলি ইত্যাদিরা ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করলে বা ডাইনি বলে ঘোষণা করলে, তাঁদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপারে সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই এইসব প্রতারকদের জেলে ঢোকাতে পারেন অনায়াসেই। 

"নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে "ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে "তোনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫", বিহার সরকার এনেছে  “ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"।

"অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি"  র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেন্দ্র দাভোলকর, যাকে মৌলবাদী কট্টরপন্থীরা নৃশংশ ভাবে হত্যা করেছিল, তিনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে "The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013" লাগু হয়। তাছাড়া "The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং 

"The Drugs and Cosmetics Act 1940" এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে। 

সাংসদ প্রবর্তিত The Drugs and Magic Remedies ( Objectionable Advertisement) Act 1954, আইনটি ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য। 

The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনের ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে ( Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..

"The Drugs And Cosmetics Act 1940"  Amendment GSR 884 ( E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৪ এবং শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় ২০০৯ সালে। ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের 'স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর'। এই আইনে এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।

কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। ইতিমধ্যে উনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম "The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬।" আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে। 

আইন আছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। গোদীলোভো কোনো রাজনৈতিক দলই চায়না আন্তরিক হতে, তাই তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই আমজনতার তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করতে নারাজ। নইলে সরকার চাইলে কড়া হাতে এইসব অমানবিক ও জঘন্য কাজ অনায়াসেই বন্ধ করতে পারে ব্যাপক আকারে সচেতনতার প্রচার ও প্রাসারের মাধ্যমে সঙ্গে ওঝা,জানগুরু ইত্যদিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে। এর সাথেই প্রয়োজন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজও বহু গ্রামগঞ্জে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ এবং ডাক্তার। তাই তো অজানা রোগ, জলবাহিত রোগ ইত্যাদিকে  ডাইনির প্রকোপ আখ্যা দিয়ে স্বার্থলোভী ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের প্রতারণা অবাধে চলছে। 

ডাইনি বলে বাস্তবে কিছুই নেই ওসব গল্পের বই এবং সিনেমা সিরিয়ালেই সম্ভব। এইধারণা কে মনে গেঁথে নিলে এবং আন্তরিক হলে অবশ্যই বন্ধ করা যাবে এই ডাইনির ঘটনা গুলোকে। এর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নাটকের মাধ্যমে,  কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রচার মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে ডাইনির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে প্রশাসনের উচিৎ নজর রাখা কোনো গ্রামে কাউকে ডাইনি ঘোষণা হওয়ার খবর পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং যে বা যারাই কোনো মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়া। 

দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান।


নারী শক্তি -মহম্মদ মহসীন
Nov. 9, 2024 | নারী | views:1043 | likes:1 | share: 1 | comments:0

ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখলাম। ট্রেনে এক দম্পতি চলেছেন। সামান্য মতান্তরে স্বামী চড় মারলেন স্ত্রীকে। প্রকাশ্যে। কোনোপ্রকার ইতস্তত না করে। যেন এ অত্যন্ত এক স্বাভাবিক ঘটনা। বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না এই প্রহার তার অভ্যাসবশত। সহযাত্রীরাও নির্বিকার। তারাও এটিকে স্বাভাবিক হিসাবেই নিয়েছেন। কোনো প্রতিবাদ নেই। নীরবে মার খাচ্ছেন এক নারী। এই নির্যাতন সমাজের গালে সপাটে এক চড়। অমানবিকতার ভিতে গড়া এই সমাজে বোধহয় এটি বিশেষ অকাম্য নয়। ধর্ম তাদের এই জীবন বিধান দিয়েছে। এতে তারা লজ্জা পায় না, গর্ব অনুভব করে।১ তাই আমরা নিয়োজিত হয়েছি এই সমাজের ধর্ম ভিতকে উৎপাটিত করে যুক্তি নির্ভর বাস্তব ভিত গড়ে নতুন সমাজ রচনার কাজে। স্ত্রীকে প্রহার। ধর্ম অনুমোদিত জীবন বিধান। নির্লজ্জ সগর্ব প্রকাশ্য ব্যবহার।

কোরাণে এই প্রহার বিষয়ে যা মত দিয়েছে তা নিয়ে কেউ জানতে চাইলে নিম্নের লিংকে যেতে পারেন।২ এখন ঘটনা হচ্ছে পুরুষ ধর্ম ধর্মগ্রন্থ রচনার মাধ্যমে নারীর উপর প্রভুত্ব খাটানোর প্রচেষ্টা করেই চললেও, ব্যতিক্রমী কিছু নারী আছেন, তারা পুরুষের এই নিয়ম মানেন না। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন। নিচের লিংকে দেখবেন স্ত্রী তার স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের প্রতিবাদে বাসেই স্বামীকে প্রহার করছে।৩

দুটি ছেলেমেয়ে বন্ধুরূপে মিশছে। কিন্তু সীমারেখা অতিক্রম, যেখানে বলপ্রয়োগের ঘটনাও দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে নারী আত্মসম্মানী, প্রতিবাদী। আমার বাড়ির কাছে রেল স্টেশনে বিকালে হাঁটতে যাই। একদিনের ঘটনা। দুটি ছেলে মেয়ে। কাছেই এক পলিটেকনিক কলেজ আছে। সেখানে কিছু খোঁজখবর নিতে এসেছিল। সেই সুত্রে দুজনের আলাপ পরিচয়। যাবেও একই ট্রেনে। প্লাটফর্মে বসেছিল। প্লাটফর্মে আলো খুবই অল্প। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। প্লাটফর্ম ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ দেখি মেয়েটি ছেলেটিকে মারছে। দ্রুত গেলাম তাদের কাছে কয়েকজন। জানা গেল, পরিচয়ের সুবাদে ছেলেটি কিছু খারাপ আচরণ করেছে। মেয়েটি তা হজম করে নেয় নি। তার পারিবারিক শিক্ষা, এসব ক্ষেত্রে কখনই আপোশ নয়, এভাবেই জবাব দিতে হয়। মেয়েটির স্বাভিমানকে সকলেই স্যালুট জানালো। একেই বলে নারীশক্তির জাগৃতি। অনেক পরিবারেই এই শিক্ষা দেওয়া হয়।

অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে কথা বলার শিক্ষা যে পরিবার দেয়, সমাজ গঠনে সেই পরিবার জমি প্রস্তুতির কাজটি করে দেয়।

অন্যায়কে মেনে নেওয়ার শিক্ষা কখনই সুশিক্ষা হতে পারে না। দেশ গঠনে নারি শক্তির ক্ষমতা যে কী অপরিসীম তা আজ দিল্লী সীমান্তে কৃষিবিরোধী পঞ্জাবের মেয়েরা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। সমাজে যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠায়, প্রসারে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি অর্থবহ। আংটি মাদুলির সগর্ব প্রকাশে অশিক্ষা কুশিক্ষায় ছেয়ে যাওয়া সমাজে বস্তুবাদী চিন্তনের বড় প্রয়োজন।

পুরুষতন্ত্র কায়েম করার জন্য দরকার হয় ধর্মের। নারীকে পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে চালাতে সকল ধর্মের নানান নিয়ম কানুন। পাখী যেমন খাঁচায় থাকতে থাকতে উড়তে ভুলে যায়, সমাজে পোষমানা নারীও তাই ভুলে গেছে তার মাঝের শক্তিকে। সে দেখেই নি নারী শক্তি। তাই কোনো নারী যখন এই জেগে উঠে এই পুরুতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন পুরুষতন্ত্রের ধারক- পুরুষের সাথে বহু বহু নারীও সোচ্চার হয় তার কণ্ঠ থামিয়ে দিতে। পুরুষতন্ত্র বিরোধী পুরুষদেরও ব্যাঙ্গ বিদ্রূপের শিকার হতে হয়।

ইসলামে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে তাদের পুনরায় ঘর সংসার করতে হলে স্ত্রীকে অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে ঘর করতে হয়, নতুন স্বামী তালাক দেয়, তারপর সে নিজ স্বামীর কাছে যেতে পারে। এই বিয়েকে বলা হয় হিল্লা বিবাহ।৪

নীচের লিংকে নারী বিষয়ক ৩. 0 এর মধ্যে ৩.১ নারী অবমাননা হিল্লা বিবাহ অংশ দেখতে পারেন।৫

মুর্শিদাবাদের আসমা বিবি এক খেটে খাওয়া নারী। তার স্বামী তিন তালাক দিলে, মোল্লারা তাকে হিল্লা বা মুতা বিবাহের ফতোয়া দিলে সে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে, আমার কি মান সম্মান নেই? পর পুরুষের সাথে আমি থাকবো না। কোরাণ হাদিসের এসব আইন আমি মানি না। মোল্লাদের সাথে মুসলিম মেয়েরাও তার বিরুদ্ধে যায়। প্রত্যাশিত ছিল অন্তত 'শিক্ষিত' মেয়েরা তাকে সমর্থন করে তার পাশে দাঁড়াবে। আসমা জানতো না তসলিমাকে বিতাড়িত করেছে বাঙলাদেশের মোল্লারা, বাঙলাদেশের সরকার, তসলিমাকে রাতের আঁধারে কলকাতা থেকে দিল্লীর ঘাড়ে ফেলে দিয়েছিল সি পি এম সরকার। প্রত্যাশা করেছিলাম মোল্লাদের থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা নেবে বামফ্রণ্ট সরকার।

পুরুষতন্ত্র কিভাবে তার শিকড় বিস্তার করেছে রাজনীতির সাম্রাজ্যে। রাজনীতি সেই আন্দোলনে সমর্থন দেবে না, যদি হও একলা। তাই আসমাকে সহ্য করতে হয় সমাজের নির্যাতন। তবু ভাঙে না। একেই বলে নারী শক্তি।


লিংকগুলি-

১) https://youtu.be/Jh6Q5LeAoTA

২) https://www.google.co.in/amp/s/www.shongshoy.com/archives/13370

৩) https://youtu.be/rJNCCoRLLpU

৪) https://www.google.co.in/amp/s/www.shongshoy.com/references/islam

৫) https://www.google.co.in/amp/s/www.shongshoy.com/references/islam (হিল্লা বিবাহ)


উই আর স্টার স্টাফ -সৌরভ দেবনাথ
Nov. 9, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:305 | likes:65 | share: 0 | comments:0

রাত ৯টা বেজে গেছে। ধানক্ষেতের মাঝখান থেকে একটা ঢালাই রাস্তা দুটো গ্রামের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে৷ সেই রাস্তা ধরে শঙ্খ আর কুশল ফিরছে তাদের বন্ধু পুষ্পকদের বাড়ি থেকে৷ গ্রাম বললেও এই গ্রামের প্রায় সব লোকের কাছেই স্মার্টফোন আছে৷ নেই শুধু বিজ্ঞানমনস্কতা৷ কুশল তার ফোনে টাইপ করে চলেছে কিছু একটা৷ সেই কিবোর্ডের টকাটক শব্দ শুনতে পাচ্ছে শঙ্খ৷ পুষ্পকদের বাড়িতে আজ বেজায় তর্ক হয়েছে পুষ্পকের সাথে৷ পুষ্পকের কোন দাদু নাকি জ্যোতিষি৷ ভদ্রলোক নাকি পুষ্পককে বুঝিয়েছেন যে ধর্ম আর বিজ্ঞানের কোনো তফাৎ নেই৷ প্রাচীন ঋষিরা অনেক কিছু জানতো বিজ্ঞানের ব্যাপারে৷ বিবেকানন্দ নিজেও সে কথা বলেছেন এমন যুক্তি টেনে বিজয়ী ভেবে নিল নিজেকে পুষ্পক৷ কুশল যথারীতি নিউট্রাল৷ সে মজা নিয়ে গেছে৷

       আকাশের দিকে তাকিয়ে শঙ্খ দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আজ অনেকগুলো তারা দেখা যাচ্ছে৷ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। কুশল এগিয়ে গেছিল মোবাইলে টাইপ করতে করতে৷ পেছন ফিরে দেখল শঙ্খ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কুশল শঙ্খের কাছে গিয়ে বলল "বাড়ি চল অনেক রাত হলো।" কুশল সে কথায় কান না দিয়ে "বললো আজকের দিনটা কি জানিস?"

-“১৭ ই ফেব্রুয়ারি।’’

-"হ্যাঁ। কিন্তু আজকের দিনটার বৈশিষ্ট্য কি?”

-“জানিনা ভাই।”

-"আজ হলো এমন একজন মানুষের মৃত্যুদিন যাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ বলা হয়। আজ জিয়র্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।"

-“এই জিয়র্দানো ব্রুনো কে?”

-“আমরা সবাই গ্যালিলিওর কথা জানি, কোপারনিকাসের কথা জানি৷ কিন্তু ব্রুনোর কথা আমরা শুনিনা৷ আজ যখন পুষ্পক তার দাদুর বলা বুলি আওড়ে বলল বিজ্ঞান আর 'ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ' তখনই বিজ্ঞানের জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের আত্মবলিদান নস্যাৎ করে দিল সে৷

-“আচ্ছা শঙ্খ একটা কথা তো মানবি যে স্পিরিচুয়ালিটি বলে কিছু হয়?”

-“আচ্ছা কুশল, তুই আমাকে স্পিরিচুয়লিটির সংজ্ঞাটা বল তো? ইউটিউবে যে বাবাজিরা সং সেজে স্পিরিচুয়লিটির কথা বলে সেটা? যারা অপবৈজ্ঞানিক কথা বলে তারা? যারা ব্যাকগ্রাউন্ডে ওম সাউন্ড চালিয়ে জ্যোতিষচর্চা করে তাদের স্পিরিচুয়ালিটি?”

-“তুই বলছিস বটে কিন্তু তাঁরা যদি ঠিক নাই হবে তাহলে তাঁদের এত ভক্ত কেনো হবে?”

-“শোন তবে একটা কথা বলি। প্রথমত আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি হলো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার যে অনুভূতি। যত দূরে তারা আমি দেখি তারা তত পুরনো। কার্ল সাগান যে বলে গেছেন 'উই আর স্টার স্টাফ' তার মানে আমার শরীরের প্রতিটা উপাদান তারাদের থেকে জন্ম নিয়েছে। আমার শরীরের প্রতিটা হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পরমাণুর বয়স মহাবিশ্বের বয়সের সমান। আমি রাতের আকাশের দিকে তাকালে এমন অনেক তারা দেখতে পাচ্ছি যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই যে অনুভূতিগুলো এটাই আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি।

     আর তুই যে বলছিস যে সেইসব স্পিরিচুয়াল বাবাজিদের এত ভক্ত কেনো, আমাকে বল তো যদি গণবিশ্বাস বিজ্ঞান হতো তাহলে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস এনারাও তো ভুল। আজও মহাবিশ্ব পৃথিবীকেন্দ্রিক হতো। তা তো নয়?"

-“হুম। ঠিকই বলেছিস তুই। আচ্ছা এই জিয়র্দানো ব্রুনোর ব্যাপারে তুই যা জানিস একটু বল তো”

-“ইউরোপের চার্চের কিরকম নিপীড়ন ছিল সে তো কিছু কিছু জানিস। ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি সবই একসাথে ছিল। চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই মৃত্যুদণ্ড। ষোলো শ শতকে কোপারনিকাস তাঁর বইতে লিখলেন মহাবিশ্ব সৌরকেন্দ্রিক। কিন্তু ধর্মের ষাঁড়গুলো কেনো মেনে নেবে? তাদের ধর্মের ওপর নাকি অপমান হয়েছে। কিন্তু একজন পাদ্রী ছিল যে কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের সমর্থন শুধু নয় তা প্রচারও করতো। এমনকি একধাপ এগিয়ে বলতে শুরু করলো মহাবিশ্ব অসীম। দূরের যে তারাগুলো তারাও এক একটা সূর্য। তাদের চারপাশে আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহ ঘুরছে। আমাদের সূর্য সেই তারাদের মতোই একটা তারা। তখনকার দিনের চার্চের নিষিদ্ধ বিজ্ঞানের বইও সে লুকিয়ে পড়ত।”

-“এখানে একটা কথা বলতে চাই যে তার কাছে তো কোনো প্রমাণ ছিলনা?”

-"না। কারণ টেলিস্কোপ তখনও আসেনি। অ্যাস্ট্রোনমাররা খালি চোখেই দেখতো ধৈর্য্য ধরে। ব্রুনোর সব কথা হয়তো ঠিক নয়। সে তার সময়ের ফসল। কিন্তু তার কৃতিত্ব এখানেই সে বৈপ্লবিক একটা ভাবনা ভেবেছিল। চার্চের ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে বেরোতে চেয়েছিল। চার্চের সেটা সহ্য হবার কথা নয়। হয়ওনি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেল। সেখানে গিয়ে নিজের ভাবনার সব উজাড় করে দিতে চাইল। কোপারনিকাসের সমর্থনে বলতে চাইল। কিন্তু সেখানেও তাঁকে অপমানিত হতে হলো। সবাই বলতে লাগলো সে হেরেটিক বা অধার্মিক। আট বছর তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। অকথ্য অত্যাচার করা হতো তাঁকে। বলা হতো যাতে মেনে নেয় সে যা বলেছে সব ভুল। কিন্তু সে ছিল ব্রুনো। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় অটল। ইনকুইজিশন নামক প্রহসন চললো। সেখানেও কার্ডিনাল তাকে ক্ষমা চাইতে বলল। কিন্তু ব্রুনো তার ভাবনা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াতে নারাজ। অবশেষে ষোল-শ খ্রিস্টাব্দে আজকের দিনেই রোমের ক্যাম্প্যে ডি ফিওরি স্কোয়ারে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয় ব্রুনোকে। রোমের জনগন সেদিন পুড়ে যেতে দেখেছিল এক অবিশ্বাসীকে। সবাই ভেবেছিল তাদের ধর্ম বুঝি রক্ষা পেল। কিন্তু তারপর আমরা সবাই জানি সত্যিটা কি। সবথেকে বড় কথা কি জানিস তো আমরা এতকিছু জানার পরেও বলব বিজ্ঞান আর ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। সত্যিই কি তাই? এখনকার দিন গুলোতে দেখ তো একবার বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান এনাদের পরিণতি। আমাদের দেশেই নরেন্দ্র দাভলকার যিনি চেয়েছিলেন কুসংস্কার বিরোধী আইন আনতে তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। এদেশে এখনও ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ খুন হয়। এত কিছুর পরেও যদি বলো বিজ্ঞান আর ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাহলে এই মানুষগুলোর অপমান।"

     এরকম একটা ঘটনা শুনে কুশলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে বলল "আচ্ছা আমাদের তবে কি করণীয়?”

-"আমরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারি, সবসময় যদি বিজ্ঞানের প্রচার করি, কুসস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে পারি তাহলেই তাঁদের বলিদান বিফলে যাবেনা। তুই, পুষ্পক তোরা যেদিন তোদের হাতের জ্যোতিষ রেকমেন্ডেড আংটিগুলো খুলে ফেলতে পারবি, যেদিন মনের সব ভয় দূর করে জাত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন থেকে বলতে পারবি 'উই আর স্টার স্টাফ' সেইদিন হয়তো সেই মানুষগুলো যথাযথ সম্মান পাবেন।"

     দুজনেই এরপর আবার হাঁটা শুরু করলো। শঙ্খ লক্ষ্য করলো কুশল আংটিগুলো খুলে নিজের পকেটে রাখলো। শঙ্খের দিকে তাকিয়ে বললো “চেষ্টা করবো এগুলো যাতে আর না পরতে হয়”

শঙ্খ শুনতে পেল কুশল মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে বলছে “উই আর স্টার স্টাফ।”


অনন্তের শহীদ -কুসুমকলি দে
Nov. 9, 2024 | যুক্তিবাদ | views:589 | likes:47 | share: 1 | comments:0

১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৬০০

সাত বছর কারারুদ্ধ থাকার পর আজ তাঁর চূড়ান্ত শাস্তি ভোগ করার দিন। ইতালির Campo De'Fiory স্কোয়ার। অগণিত মানুষের সমাগম হয়েছে আজ সেখানে। সকলের মধ্যে আজ উৎকণ্ঠা,কত বড় একজন আসামির সাজা হবে আজ! গির্জার ধর্মযাজকদের দয়ার শরীর, তারা নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম অপরাধীদের ও ক্ষমা করে দেন। চুরি,ডাকাতি,খুন খারাপি যাই করে থাকুক না কেন,সকল অপরাধই ক্ষমারযোগ্য শুধু যদি শেষে দোষীরা নিজেদের দোষ শিকার করে গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছে মাপ চেয়ে নেয়। কিন্তু এই তরুণ অসম্ভব জেদি, কিছুতেই তাকে নিজের অবস্থান থেকে টলানো গেল না। রোমান ইনকুইজিশনের ইনকুইজিটর কার্ডিনাল বেলারমাইন তাকে তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, কিন্তু সে অস্বীকার করে। ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট তাকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে তাকে আখ্যায়িত করেন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন। রায় শুনে আসামি বিচারকদের শাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা হয়তো আমার সাথে হেরে যাবার ভয়ে আমার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন। আমি এটি গ্রহণ করলাম।’’ তরুণটির নাম জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর অপরাধ রোমের ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধাচারণ করা। বাইবেলে বর্ণিত মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা মানতে অস্বীকার করেছিলেন। বাইবেলের বর্ণনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা সেই প্রথম ব্যাক্তিই ব্রুনো। তাঁর মত ছিল মহাবিশ্ব একাধিক ও তার কোনো কেন্দ্র নেই। নিষিদ্ধ করে দেওয়া কোপারনিকাসের মত-পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, সমর্থন করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন। তাই মৃত্যুদণ্ড। সকলের চোখের সামনে পিছমোড়া অবস্থায় প্রথমে তার জিভ কেটে ফেলে তারপরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল।

এই নৃশংসতার মাধ্যমে গির্জা কর্তৃপক্ষ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যারা যারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করবে, ধার্মিক মতাদর্শের বিরোধিতা করবে তাদের সকলের এমন ভাবে কন্ঠরোধ করে দেওয়া হবে। এমন এক রাজত্ব যেখানে একছত্র অধিপত্যে সম্ভব। অন্যায় ভাবে মানুষকে পেশীর বল, কখনও ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে উৎপীড়ন করা সম্ভব হবে।

কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্তব্ধ করা যায়নি বিজ্ঞানের গতিকে। এমন কোন কারাগার, কোন শাসকই তৈরি করতে পারেনি যা বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে, যুক্তিকে রুদ্ধ করতে পারে। ব্রুনোর মৃত্যুর পর তার কাজকে অনুসরণ করে এগিয়েছেন বহু অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলী মানুষ। সেই কৌতূহল,অদম্য সাহসই চালিত করেছে আমাদের এই বিশ্বের কত গোপন রহস্য উদঘাটন করতে। আজ বিজ্ঞানের কত সুবিধা আমরা উপভোগ করছি কিন্তু এই পথচলার শুরুটা ছিল এমনই কঠিন, প্রতিপদে বিরোধিতা। 


এবার প্রশ্ন আসে মনে এই একবিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনাগুলির তাৎপর্য ঠিক কী? আমরা হয়তো আজ আধুনিক হয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে আজ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা প্রচুর হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় আমরা কী সত্যিই একাত্ম হতে পেরেছি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের সাথে। সমাজের সর্বস্তরে কী পৌঁছতে পেড়েছে যুক্তির আলো? অনেক শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যেও চোখে পড়ে অন্ধবিশ্বাস, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা,কারণ সত্যেকে অনুধাবন করা অনেক কঠিন। সেই তুলনায় অন্য কারুর চিন্তাকে নিজের চিন্তা বলে চালানো সহজ।বিজ্ঞান অনেক বেশি নমনীয়।বিজ্ঞানের চোখে সকলে সমান। কোন ভুল ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নেওয়া হয়েছে। ধর্মমত আর রাজনীতিক মতের সত্যতা প্রমাণ করা অসাধ্য।প্রমাণের অভাবে আসে আক্রোশ আর উওেজনা, মতবিরোধের ফল হয় শত্রুতা। রাজশেখর বসু তাঁর 'বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি' রচনাটিতে লিখেছেন -"যদি বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সমাজের সকল মানুষ প্রয়োগ করতে শেখেন তবে কেবল ভ্রান্ত সংস্কার দূর হবে না, ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ও অবসান হবে।"

সেইদিন তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে পারব আমরা ব্রুনোকে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ব্রুনো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ।


সরষের তেলের ঝাঁঝ! -রাজা দেবরায়
Nov. 9, 2024 | অনুগল্প | views:559 | likes:69 | share: 1 | comments:0

মেয়েঃ মা, সেদ্ধ ভাতের সাথে ঘি দিও। সরষের তেলটা ভালো লাগে না, ঝাঁঝ লাগে। 

মাঃ বোকা মেয়ে। আরে সরষের তেলের ঝাঁঝটার জন্যই তো সবাই সরষের তেল খায়। আর সরষের তেলের ঝাঁঝ যত বেশি হবে ততই তেলটা ভালো হবে, বুঝেছিস?

মেয়েঃ আরে মা, তুমি জানো কেনো সরষের তেলে ঝাঁঝ বেশি হয়?

মাঃ কেনো আবার, বেশি হয় তো বেশি হয়!

মেয়েঃ কারণটা কী?

মাঃ অতশত বলতে পারবো না বাপু!

মেয়েঃ আসলে এই ঝাঁঝটা হয় সরষের তেলে এক ধরনের গন্ধকযুক্ত যৌগ গ্লাইকোসিনোলেট থাকার জন্য। 

মাঃ এটা আবার কী!

মেয়েঃ আরে শোনো না। খাদ্যনালি বা পাকস্থলিতে খাদ্য পরিপাকের সময় এই গ্লাইকোসিনোলেট ভেঙ্গে গিয়ে গ্লুকোজ, সালফেট আয়ন, থায়োসায়ানেট এবং আইসোথায়োসায়ানেট তৈরি হয়। এই থায়ো বা আইসোথায়োসায়ানেটের জন্যই বেশি পরিমাণে সরষে বা সরষের তেল খেলে গলা জ্বালা, বুক জ্বালা বা পেটের যন্ত্রণা হতে পারে। 

মাঃ কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না! তবে একটা কথা বল্, এই যে বললি সরষের তেল খেলে গলা জ্বালা করে, বুক জ্বালা করে, পেটের যন্ত্রণা হয়, আমরা তো কবে থেকেই খাচ্ছি, আমাদের তো কখনো এরকম হয় নি!

মেয়েঃ আমি বলেছি বেশি পরিমাণে খেলে। কম পরিমাণে সরষের তেল খেলে, যা সাধারণভাবে রান্নায় আমরা খাই, অসুবিধা নেই। বুঝলে?

মাঃ কী জানি বাপু! এরকম কথা আগে কখনো শুনিনি। তবে বেশ বুঝতে পারছি, সরষের তেলের ঝাঁঝ যাই হোক, তোর কথার ঝাঁঝ মোটেই কম নয়। 

মেয়েঃ হা হা হা। কী যে বলো মা। ঘি থাকলে একটু দাও তো। 

মাঃ আরে আমি আগেই আনিয়ে রেখেছি তোর বাবাকে দিয়ে। তোর যেরকম মতিগতি, ঠিক জানি যেকোন সময় ঘি চেয়ে বসবি। দিচ্ছি দাঁড়া। 

মেয়েঃ লাভ ইউ মা, লাভ ইউ!!


ভূত না ছাই... -মমতা দাস
Nov. 9, 2024 | অনুগল্প | views:680 | likes:70 | share: 1 | comments:0

বাঁধানো বটগাছটা যেন গ্রামটি অভিভাবক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ| রোজ সকালে আর বিকেলে তার চাতালের চারপাশে বসে থাকেগ্রামের মানুষজন ছেলেছোকরারা| কত গল্প কত কাহিনীবোনা হয় তাকে ঘিরে|

       গ্রামের নাপিত বলাই| এই বটগাছের একটা কোণে রোজদিন তার দোকান বসে| ছোট একটা টুল,একটা চেয়ার,আয়না,তার বাক্স সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে কাজে মন দেয় বলাই| একদিন দুপুরেবলাই প্রায় আধঘুম অবস্থায় বসে ছিল তা টুলের ওপর|এমন সময় হঠাৎ একটা আওয়াজ হওয়ায় চমকে ওঠে বলাই| দেখে তার সামনের আয়না দিয়ে দেখে তার সামনের আয়না দিয়ে একটা কালো কুচকুচে কোকড়ানো চুলে ঢাকা অস্পষ্ট মুখ| কেমন যেন ঝুলে আছে উল্টো ভাবে গাছ থেকে|চমকে উঠে বলাই|এক দৌড়ে সোজা গ্রামের ভেতর বাড়ির কাছে| এসেই হাঁপাতে শুরু করে| সেই সময় তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক স্কুল মাস্টার স্কুল মাস্টার| বলাইয়ের অবস্থা দেখে তিনি পুরোটা জানতে চান কী হয়েছে|বলাই আমতা-আমতা করে প্রায় পুরো বিষয়টাই জানায়|

       মাস্টার সমস্তটাই বুঝতে পারলেন| বলাই কে কিছু না বলে তিনি সোজা দুর্গা মন্ডপে হাজির হলেন|সেখানে তিনি বলেছিলেন আজ বিকেলে সভা আছে|সেটা হবে বাঁধানো বটগাছের নিচে|তিনি বলায় কেউ বললেন সেখানে আসতে| বলাই রাজি না হলেও তার স্ত্রী তাকে ভরসা দিল কোন অসুবিধা হবে না|

     বিকেল বেলা সবাই আসতে শুরু করেছে বট গাছের কাছে|বলাইয়ের খবরটা প্রায় গ্রামে চাউর হয়ে গিয়েছিল|তাও যারা ভয় পায়নি তারা পৌঁছে গেছে পৌঁছে গেছে বট গাছের কাছে|মাস্টারমশাই চলে এসেছে|শুরু হলো সভা|

       মাস্টারমশাই একটা বাচ্চা ছেলেকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে|মিনিট পাঁচেক পর তিনি সবার সামনে ছেলেটিকে আস্তে আস্তে বট গাছের মধ্যে উঠতে বললেন|ছেলেটি ছোট রোগাসোগা|তাই মুহুর্তের মধ্যে সে অনেকটাই উঠতে পারল|কিছুদিন ওঠার পরই সে দেখল গাছের একটা ডাল এর ভেতরে পুরের পুটলি খুব শক্তভাবে বাধা| আর তার পাশে একটা দড়ি বাঁধা| সেগুলো নিয়ে সে নিছে নেমে আসলো|

      এবার মাস্টারমশাই সবার সামনে পুটলি খুললেন|তার ভেতর একটা সিঁদকাঠি, আরেকটা ছোট তেলের বোতল|এবার আর বুঝতে হলো না বুঝতে দেরী হলো না কারোরই|সবাই বুঝতে পারলো যে চোর আশ্রয় নেয় এই বটগাছের ভেতরে দিনের বেলা রাতে চুরি করতে বেরায়|

     বলতে শুরু করলেন মাস্টারমশাই|''আমার এক ছাত্র গতকাল খবর দিয়েছিল সে নাকি কাউকে একটা উঠতে দেখেছিল বটগাছের ভেতরে|তারপর গতকাল রাতে খবর পাই রফিকের বাড়িতে ছোড়ে হানা দিয়েছে|আজ যখন বলাইয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন সব শুনে বুঝতে পারি পুরো ঘটনা|আর ও বুঝতে পারি যে বলাই আয়নাতে চোর কে দেখেছে যে কিনা তখন উল্টো ভাবে নামার চেষ্টা করছিল'' বলে বলার দিকে তাকালেন মাস্টারমশাই|

        বললেন ''বুঝলে তো বলাই ভূত নয় ঘুম থেকে উঠে তুমি চোরকে উল্টোভাবে ঝুলতে দেখেছো|''সবাই বার হো হো করে হেসে উঠলো| মাস্টারমশাই তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন ''সঠিক কিন্তু আগে চোরকে ধরার ব্যবস্থা সবাই করো''|


রক্তের রং ফ্যাকাসে -অরণ্য দাস
Nov. 9, 2024 | গল্প | views:292 | likes:2 | share: 2 | comments:0

--- হ্যালো অরুণ.......

--- হ্যাঁ বল ....

--- ভাই খুব বড়ো একটা বিপদ হয়ে গেছে। 

--- কেনো কি হলো রে? তুই অতো হাঁপাচ্ছিস কেন?

--- বাবা..... বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিল। আমি এখন হসপিটালে আছি। বাবার প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার বললো বাবাকে বাঁচাতে হলে প্রায় পাঁচ-ছয় বোতল রক্ত লাগবে। তুই একটু দেখ না যদি তোর চেনা জানা কারো O নেগেটিভ রক্ত থাকে। আমি ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম, সেখানে মাত্র দু বোতল রক্ত পেলাম। আর রক্ত না পেলে বাবাকে বাঁচাতে পারবো না। একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সৌমেন কেঁদে ফেললো। 

--- কাঁদিস না সৌমেন, আমি দেখছি কি করা যায়। তুই চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। 


ফোনে কথা বলা হয়ে যাবার পর সৌমেন উদ্বিগ্ন মুখে বাবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করল। 

--- ডাক্তারবাবু বাবা কেমন আছে?

--- আমাদের যতটা করার করছি। পেশেন্টের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। হার্ট খুবই দুর্বল। 

--- ডাক্তারবাবু বাবা বাঁচবে তো?

--- দেখুন পেশেন্ট-এর কন্ডিশন খুবই সিরিয়াস। এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। যদি রক্তটা জোগাড় করতে পারেন তাহলে একটা ক্ষীণ আশা আছে। এখন আপনি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। 

সৌমেন নিঃশব্দে বাইরে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। ভাবতে লাগল কি করবে সে এবার। 


আজ সকাল অবধিও সব কিছু ঠিকই ছিল। সৌমেন তার বাবার সঙ্গে প্রাতঃরাশ করতে করতে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছিল। বাড়িটাতে সৌমেন ও তার বাবা শ্যামলাল মিত্র মাত্র এই দুই প্রানীর বাস। সৌমেনের মা গত হয়েছেন বহুদিন। সৌমেন একটা সওদাগরী অফিসে কাজ করে। তার বাবার বয়স হয়েছে, প্রৌঢ়ত্বের গন্ডী পেরিয়ে তিনি এখন বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই বয়সেও তিনি এখনও একদম সুস্থ সবল আছেন। রোজ সকালে নিয়মিত প্রাতঃভ্রমন করেন। নিজের হাতে বাজার করেন। যৌবনে যে তিনি খুব কঠোর নিয়ম ও অনুশাসন মানতেন তা এখন দেখলেই বোঝা যায়। 


যদিও এর বাইরে তার আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্ৰামী। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেই সময় যে সব অনামী তরুণ বালক, যুবকেরা দেশের স্বার্থে প্রানপণ করেছিল তাদের মধ্যে তিনিও একজন। যখন থেকে তিনি বুঝতে পারেন ভারত পরাধীনতার শৃঙ্খলে বদ্ধ, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ব্রিটিশ শাসনের কাছে তখন থেকেই তিনি দেশের মুক্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। তিনি যোগ দেন একটি বিপ্লবী সংগঠনে। সেখানে নিয়মিত শরীরচর্চা,অস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি ব্রিটিশ বিরোধী বহু পুস্তক ও পত্র-পত্রিকার পাঠ চলতো। "পথের দাবী"র মতো পুস্তক পাঠ তার স্বাধীনতা চেতনাকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে তুলেছিল। সমস্ত রকম ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বহুবার তাকে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে কিন্তু প্রতিবারই তিনি পালাতে সক্ষম হতেন। শেষে একবার গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গভীর রাতে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্ৰেফতার করে। লকআপে তার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। অমানবিকভাবে তাকে পেটানো হয়,তার হাত পায়ের নখ উপড়ে নেওয়া হয়। তবুও পুলিশ তার কাছ থেকে বিপ্লবীদের কোন তথ্যই বার করতে পারেনি। তাকে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্যও লোভ দেখানো হয় কিন্তু তার অদম্য জেদ ও মনোবলের সামনে ব্রিটিশ পুলিশও হার মেনে যায়। শেষে তাকে আদালতে পেশ করা হয়। ব্রিটিশ আইনের চোখে দেশদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের হুকুম দেওয়া হয়। অবশেষে তার ঠাঁই হয় জেলে। কিন্তু ওদিকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ভারতীয়দের অসহযোগিতা ও বিদ্রোহের আঁচ তখন সুদূর ব্রিটেনের গায়েও লেগেছে। ব্রিটিশ সরকার ভালো করেই বুঝে গিয়েছে আর তারা বেশিদিন ভারতকে শাসন করতে পারবে না। তাদের এতদিনের উপনিবেশ এবার ত্যাগ করতে হবে। 

তারপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই বহু কাঙ্ক্ষিত দিন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাষ্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা চলে এল ভারতীয়দের হাতে। যদিও এর জন্য ভারতকে মূল্য চোকাতে হল। ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম হল মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের। ভারত ছেড়ে যাবার আগে ভারতের ঐক্যকে চিরদিনের জন্য দুর্বল করে দেবার জন্য ব্রিটিশ শাসকের কূটনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে হিন্দু-মুসলমান এর মধ্যে লেগে গেল সংঘর্ষ। সেই দাঙ্গায় অসংখ্য হিন্দু মুসলমান হত হল। বহু মুসলমান পাকিস্তানে চলে গেল। বহু হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এল। ইংরেজ এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে শেষ বারের মত ভারতের বুকে দিয়ে গেল পাকিস্তান নামক সুগভীর ক্ষত। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শৃঙ্খল ত্যাগ করে স্বাধীন হল ভারত‌। এই দিনটির জন্যই ক্ষুদিরাম,ভগৎ সিং সহ বহু ভারতীয় হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে জেল থেকে বহু স্বাধীনতা সংগ্ৰামীকে মুক্ত করে দিল ভারত সরকার। শ্যামলাল বাবুও ছাড়া পেলেন জেল থেকে। ইতিহাস বইয়ের পাতায় যেমন সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর কথা উল্লেখ থাকে না সেইরকম শ্যামলাল বাবুরও উল্লেখ নেই। তবুও তার এলাকার সকলেই এই সব কথা জানে ও তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। 


প্রাতঃরাশ পর্ব শেষ হবার পর শ্যামলালবাবু  ব্যাগ নিয়ে বের হন বাজারের উদ্দেশ্যে। যদিও সৌমেন বলেছিল, তোমাকে যেতে হবে না বাবা, আমি কয়েকটা কাজ সেরেই বাজারে যাব। সে কথায় আমল না দিয়ে শ্যামলালবাবু বলেন, তোকে যেতে হবে না, তুই বরং তোর অফিসের কাজগুলো শেষ কর। আমি তো সারাদিন বাড়িতে একাই থাকি, বাইরে বেরিয়ে বাজারে গেলে আমারও একটু ভালো লাগবে। এই বলে তিনি ব্যাগ নিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। 


রাস্তায় যেতে যেতে তিনি ভাবতে লাগলেন তার স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত কথা। সেই সময়ে তারা কত নিষ্ঠা নিয়ম মেনে সৎ পথে চলতেন, কিন্তু বর্তমান যুবসমাজের যেন কোনো দিশা নেই। তারা যেন হালবিহীন নৌকার মত মহাসমুদ্রে ভাসছে। ঢেউয়ের স্রোতের মত বর্তমান সমাজের অনৈতিক দোলাচলে তারা অভিমুখহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুবসমাজের দরকার নেতাজী সুভাষ বা বিবেকানন্দর মতো একজন পথপ্রদর্শকের। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে তিনি প্রায় বাজারের সামনে চলে এসেছিলেন। হঠাৎ একটা দ্রুতগামী লরি একটা ট্রেকারকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে শ্যামলালবাবুকে। দূরে ছিটকে পড়েন তিনি। তার মাথা ফেটে যায়, সারা শরীর থেকে গলগল করে বেরোতে থাকে প্রচুর রক্ত। সেই রক্তে রাঙা হয়ে যায় রাস্তা। ততক্ষণে আশেপাশের কিছু লোক জড়ো হয়ে যায়। বেগতিক দেখে লরিড্রাইভার খুব দ্রুত গতিতে লরি ছুটিয়ে চম্পট দেয়। জনতার মধ্য থেকেই একজন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে। মিনিট কুড়ির মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। ততক্ষণে শ্যামলালবাবুর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে। তার বুকপকেটের ডাইরি থেকে সৌমেনের ফোন নম্বর পায় পুলিশ। হসপিটাল থেকে বাবার খবর শুনে তড়িঘড়ি সেখানে উপস্থিত হয় সৌমেন। ডাক্তারের কাছ থেকে সে জানতে পারে বাবাকে বাঁচাতে প্রচুর রক্ত লাগবে। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে মাত্র দুই বোতল রক্ত পেয়েছে সে। এখনো তিন-চার বোতল রক্ত লাগবে। বন্ধু অরুণকে সে ফোন করেছে, দেখা যাক কোন রকম অন্য ব্যাবস্থা হয় কিনা। 


হাসপাতালের চেয়ারে বসে বসে এই সব চিন্তা করতে করতে একটু আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সৌমেন। হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে তার চটকা ভেঙে গেল। মোবাইলটা বার করে দেখল অরুণ ফোন করছে। ফোনটা রিসিভ করে সৌমেন বললো - হ্যালো অরুণ, কিছু ব্যাবস্থা হলো? ডাক্তারবাবু বলছে রক্ত না পেলে আর কোন আশাই থাকবে না। 

--- না রে সৌমেন কিছু করতে পারলাম না.....

--- তোর চেনা জানা কারও O নেগেটিভ রক্ত নেই? একজনেরও নেই? ব্লাড ব্যাঙ্কে তো দুটোর বেশি রক্তের বোতল পেলাম না। তুইই আমার শেষ ভরসা ছিলিস। 

--- আসলে তা নয়। চেনাশোনা দু-তিন জনের O নেগেটিভ রক্ত আছে। তাদেরকে ফোন করে বলেছিলাম কিন্তু তারা কেউই রক্ত দিতে রাজি নয়। 

--- কেন রাজী নয়? রক্ত দেওয়া তো কোন খারাপ কাজ নয়। তাঁরা রক্ত দিলে যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচে,তাও তাঁরা রক্ত দেবে না?

--- জানি না কেন তাঁরা রক্ত দিল না, তাদের অনেক করেই বললাম কিন্তু তারা সোজাসুজি বলে দিল তারা রক্ত দেওয়ার মধ্যে নেই। আমি কাকুর অবস্থার কথাও বললাম কিন্তু তাদের মত পরিবর্তন হল না। আমার যদি O নেগেটিভ রক্ত হতো আমি নিজেই দিতাম কিন্তু আমার B পজেটিভ রক্ত। হ্যালো, সৌমেন কথা বলছিস না কেন? কিরে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো....


খুট করে ফোন কাটার শব্দ হল। ফোনটা নামিয়ে পাথরের মত চেয়ারে বসে রইল সৌমেন। নাহ্,বাবাকে বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেল। সে দুঃখে বিস্ময়ে ভাবতে লাগলো তাদের কথা যাদের রক্ত O নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও রক্ত দিতে রাজি হলো না। এতটাই অমানবিক তারা। একটা মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে কিছুটা রক্ত বেশি দামী হয়ে গেল। হায় ঈশ্বর! যে মানুষটা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরাতে কোন কার্পণ্য করে নি, সেই কিনা আজ রক্ত না পেয়ে মারা যাচ্ছে। যাদের রক্তের ফোঁটায় ধরিত্রী সিক্ত হয়েছিল এক সময়ে তাদের এই করুন অবস্থা। দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে যারা নিজেদের উৎসর্গ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল, তাদের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে এখন কেউ এগিয়ে এলো না। এই অমানবিক হৃদ্যতাহীন ভারতবর্ষের জন্যই কি তাঁরা জীবন বাজী রেখে সংগ্ৰামের পথে হেঁটেছিল?


এই  সমস্ত প্রশ্ন রেখে গেল শ্যামলাল মিত্রের প্রায় রক্তশূন্য ফ্যাকাসে স্পন্দনহীন দেহ। এটা নিশ্চিত যে এই দেহে আর কোনদিন প্রানের স্পন্দন দেখা দেবে না। কিন্তু এই অমানবিক, বিবেকহীন ভারতবর্ষের বুকে কবে সৌহার্দ্য, মানবিকতার স্পন্দন দেখা যাবে সেই বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। হয়তো ঠিক এইভাবেই আগামীদিনেও রক্তের রং গাঢ় লাল থেকে হয়ে যাবে ফ্যাকাসে। 

কবিতাগুচ্ছ - ০১ -কবিতা
Nov. 9, 2024 | কবিতা | views:560 | likes:63 | share: 1 | comments:0

পোশাক

সেখ সাহিদ

স্বর্গদ্বারের বাইরে লাইন...নানারকম পোশাক পরে

আছে লোকজন,কেউ পরেছে গেরুয়া বস্ত্র,হাতে

রুদ্রাক্ষের মালা আর অন্য হাতে পথের দিশারী গীতা...কারোর মাথায় টুপি হাতে পবিত্র

কোরান...কারোর গলায় যীশুখৃষ্টের ক্রস,আর হাতে

রয়েছে বাইবেল!তারা সবাই একটা লাইনে দাঁড়িয়ে...

আর একটা লাইন আছে,সেখানে এখনো কেউ এসে

পৌঁছোয়নি...ফাঁকা লাইন নিয়ে সবার কৌতূহল!

তারপর কয়েকটা লোক মুখে একটা আলতো হাসি

নিয়ে সেই ফাঁকা লাইনে এসে দাঁড়ালো,তাদের গায়ে

কোনো পোশাক নেই,তারা সবাই উলঙ্গ...

অন্য লাইনের লোকজন শুরু করলো অট্টহাসি!

একটা আকাশবাণী শোনা গেলো,"জন্মের পর

ধর্মের নেশায় ডুবে ধর্মের পোশাক পরা ভীষণ সহজ,

কঠিন হলো মনুষ্যত্বের পোশাক পরে মানুষ হয়ে

ওঠা...ধর্মের নেশা বড়ো নেশা,এই মোহে আটকে

পড়লে নিজের অজান্তেই মনুষ্যত্ব লোপ পায়...তখন

আর যাইহোক না কেন মানুষ হয়ে ওঠা আর হয়না!

কিছুজন হয়তো পারে,তাদের ডাকনাম হাজারটা,শুধু

কেউ মানুষ বলেই তাদের ডাকেনা...ধর্মের পোশাক

পরতে বারণ করছি না,তবে পরাটা কী খুব জরুরি?

জন্ম নিলে মানুষ হয়ে তাহলে মানুষ হয়েই মরতে

ক্যানো পারোনা! মৃত্যুর পর কী হবে একমাত্র আমি

জানি তোমরা কেউ না,মানুষ হও আগে ধার্মিক না..."

অট্টহাসি থেমে গেল পোশাক পরা লোকজনের...পোশাক না পরে আসা উলঙ্গ লোকগুলোর মুখে তখনও আলতো হাসি লেগে

আছে,সেই প্রথমের মতোই...।

---------


মহান অন্তর

-স্বভাব কবি বৃন্দাবন ঘোষ

শুধু আফসোস আমার ই কি তোমার আফসোস নয়।

তুমি কি তেমন ই চিন্তা কর না হতাশা যাতে হয়।

আমি মনে করি লুকাও বিষয় কথা বলছি সঠিক

যদি এ না তুমি স্বীকার কর জানাব তোমায় ধিক।

স্বীকার না করে গোপনে অশ্রু ঝরিয়ে বল কি লাভ

তার থেকে বলি সাহস করে এস দুজনে জমাই ভাব।

ওটা বিরাট মহৎ কাজ হবে আমাদের দুজনের,

দুজনের বাসনা হবে পূরণ ভালো কাজ হবে ঢের।

আমার আফশোস থাকবে না তোমায় কাছে পেলে,

দুহাততুলে নৃত্য করব আমার বাড়িতেএলে।

তাই অযথা দেরি কেন সোনা তাড়াতাড়ি চলে এসো,

তোমার মহানঅন্তর দিয়ে আমায় ভালোবেসো।






সঠিক পথ

-তাপসী ভট্টাচার্য্য


অহংকারের দোলায় দুলে

দেখে‌ সবই আলো

সবার চেয়ে সব কিছুতে

দেখায় সবই ভালো


ভালোর চেয়ে অধিক ভালো

আরো অনেক আছে

যে বোঝেনা এ কথাটি

সে তো রবে পিছে


ছোটো থেকে অনেক ছোটো

বড়োর চেয়ে বড়ো

নিখুঁত চিন্তা সঠিক ভাবনা

চিন্তা সবাই করো


কেউ ছোট না, কেউ খারাপ না

ভাবনা থাকুক মুলে

রাগ হিংসা অহংকারের

ঝুলিটি দিয়ে ফেলে


মানব জীবনে সঠিক পথটি

যদি না নিই বুঝে

মানুষ,পশু হয়েই বিশ্বে

জীবন হবে মিছে।




অপমান

-মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র


অসংখ্য যোগ বিয়োগ--

হয়ে চলেছ অবিরাম!

ভগবান তুমি কবে নেবে খানিক বিশ্রাম?

অসংখ্য কলঙ্কের ক্ষত--

আজ যায় কেবল দেখা!

ভগবান, তুমি ছাড়বে কবে ভিক্ষা করা?

অপেক্ষারা হয়েছে আজ উপেক্ষিত--

ভুলেছি আজ সব অভিমান!

ভগবান, তুমি কবে বাড়াবে এই অপমানের ব্যবধান?

ভুলে যেতে চাই,

আজ সব ক্ষতের যন্ত্রনা!

ভগবান, তুমি পারবে কি মেটাতে, অপমানিত মনের সকল জ্বালা?







অমোঘ প্রেম

-সূরজ নন্দী


কালো মেঘের লাল আকাশের নিচে,

জলের ফেনা রসায় তীরের বালি।

লাল কাকড়ার গর্ত ওঠে ভরে..

ঝিনুক ছড়ায় দুঃস্বপ্নের মালি।

দূর নৌকার আবছা পালের ছায়া,

গর্জে সাগর বাতাস সোঁ সোঁ বয়।

সব নির্জন তবুও প্রাণস্পন্দে...

শূন্য থেকেও শূন্য কিছুই নয়।

শব্দ হারা গম্ভীর রূপে স্তব্ধ,

অবাক-পৃথিবী ক্ষিপ্ত ধ্যানের শিখায়।

ভিজা বালিটায়  ও-কার পদচিহ্ন?

করেছে প্রকাশ বেদনার লেখায়।

পরনের সাদা বসনের শেষ প্রান্ত,

সশব্দে ধায় দূর বাতাসের সঙ্গে,

ভাবলেষহীন মুখে ভেজা দুটি চোখ,

বিরহিত মন কাঁদে সাধারণ ভঙ্গে।

কী বিপুল এক প্রকৃতি প্রমাণ শোক,

তাপিত হৃদয় বয়ে ফেরে তার ভার,

এমন প্রেমেতে বাঁচা নয় খুব সোজা,

সত্তা শুন্য হেন প্রেম সম্ভার।

হঠাৎ সূর্য শেষের রাঙা প্রলেপে..

প্রেমের আগুনে ভরালো সিঁথির ক্ষয়।

মনে আছে প্রেম প্রেমে আছে প্রাণপ্রিয়

দেহ অবসানে প্রেম অবসান নয়।




বাহুবল

-প্রদীপ চক্রবর্তী।


ধর্ম নিয়ে নাচছি সবাই

দেখাচ্ছি যে বীরত্ব,

ভুলে  যাচ্ছি মানবতা

বাড়ছে কেবল দুরত্ব।


ভাগ্য গড়ে মানুষ নিজেই

যুক্তিবাদী গ্রহ,

নক্ষত্র কে পাক দিয়ে যায়

উপগ্রহ সহ।


বিজ্ঞান কে আপন করে

চল এগিয়ে যাই,

বাহুবল কে সাথী করে

সাফল্য টা পাই।



আদর্শবান হও, চরিত্রবান হও।

 -গোবিন্দ মোদক


বেড়িও  না  টই  টই! তার  বদলে  পড়ো  রে  বই!

মোবাইল গেম বাদ দাও। তার বদলে মাঠে যাও!

টিভি সিরিয়াল দেখো নাকো। তার বদলে পড়ায় থাকো!


ভিডিও গেম? বাদ দাও। তার বদলে হাঁটতে যাও!

বেলা  করে  উঠো  না। তার  বদলে  শরীরচর্চা!

বেশি রাত করে ঘুম নয়।  ভোরে ওঠা সহজ হয়!


ফাস্টফুড সামলে খাও।   জলখাবারে মন দাও!

চকলেট-আইসক্রিম কম খাও,শাক-সব্জিতে মন দাও!

হেডফোনে গান বাদ দিলে, মাথা ব্যথা হবে না ছেলে!


তোমরা দেশের ভবিষ্যত। তোমরা আনবে নতুন পথ!

তাই জীবনে আদর্শ চাই। চরিত্রটা গড়ো রে ভাই!

চরিত্রবান যারা-ই হয় --- তারা-ই করে জীবন জয়!!




জাতির গ্রহণ

 -শ্রীকুমার মন্ডল


সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ,

হাজার বছর পরেও জাতি বুঝলনা অবশেষ।

রাহু খায়নি, কেতু যায়নি,

চাঁদ এসেছিল মাঝে

পৃথিবীতে তাই দেখা যায়নি পুরো সূর্যের face,

জাতি বুঝলনা অবশেষ।

কে জানে এরা বোঝে কোন ভাষা,

কাটেনি এখনো অফিমের নেশা,

যুগ যুগ ধরে সেই চলে আসা জাত মূর্খের দেশ, জাতি বুঝলনা অবশেষ।

গ্রহণের কালে, খাইলে পরে,

ভাইরাস নাকি উথলে পড়ে,

অতিবেগুনির অপবিজ্ঞানও চলে বাজারে বেশ, জাতি বুঝলনা অবশেষ।

বিজ্ঞানকে মাড়িয়ে পায়ে

জ্যোতিষ এসে আগামী কয়।

বোঝেনা কি জাতি, বিজ্ঞান ছাড়া আগামীর আলো শেষ?

নাঃ, জাতি বুঝলনা অবশেষ।

বিজ্ঞান ফেলে জ্যোতিষ ভাঁটি

আম না খেয়ে চুষল আঁটি,

সাইন্সের ছেলে গোবর ঘাঁটি গর্ব ফলায় বেশ।

জাতি বুঝলনা অবশেষ।

সাইন্সে আমার পড়ছে ছেলে

গলায় মস্ত পৈতা ঝোলে

উপনয়ন আর বর্ণবাদও মাথায় ঢুকেছে বেশ

আর জাতিগত বিদ্বেষ।

পৈতা দিয়ে চিন্তা বাঁধা

বানিয়েছি এক আস্ত গাধা

শিক্ষিত ছেলে বয়ে নিয়ে চলে, মধ্যযুগের ক্লেশ।

অলীক অহংকারের ক্লেশ।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য বাদে

মন্দির, মজিদ ভাগ্যে মাতে

কে জানে এরা কাকে যে ডাকে, আসেনা তো এক লেশ!

তবু ভক্তরা মাতে বেশ।

চল গে সব হুজুগে মাতি

হুজুরেরা সব মারবে লাথি

মানুষের চেয়ে ম্যা ম্যা ডেকে হব একপাল মেষ

না না বুঝলনা অবশেষ।

গড্ডালিকার ছন্দ ধরে

অন্ধ হয়ে অন্ধকারে

অনুকরণের বিষোদগারে হবে জীবনের শেষ।

বাকি থাকবেনা অবশেষ।

চাঁদ সূর্যের সমাপতন,

হাজার বছর গেলেও মদন

বোঝেনা, তবু সখ করে বলে, হারাবেই চীন দেশ।

হাইস্যকর! হাইস্যকর!

জাতি তবু বুঝলনা অবশেষ।

দশ হাতে দশ আংটি পরে,

ভাগ্য গ্রহ ফেরাবে বলে,

জাতি তবু হবে আত্মনির্ভর, নাটকের এক শেষ।

জাতি বুঝলনা অবশেষ।

এই কি বিজ্ঞান মনস্কতা?

Sir এর মুখের কেতাবি ভাষা।

নিজেই তো sir মূর্তি দেখলে প্রনাম ঠোকেন বেশ।

জাতি বুঝলনা অবশেষ।

আই আই টি, আই আই এস

ডিগ্রিধারীর বিজ্ঞানী ভেশ

কুসংস্কার ছড়িয়ে বেড়ায় ISRO থেকে space,

সায়েন্স, ঘৃতাহুতিতেই শেষ

জাতি বুঝলনা অবশেষ।

বিবেকানন্দ, মঠ ও মিশন

মাদ্রাসারও প্রভাব ভীষণ

শিক্ষার সাথে অপবিজ্ঞানও, দেখে শিশু অনিমেষ।

এরা জাগবেনা অবশেষ।

গেরুয়া, সাদা নানান রঙে

বাবা গুলো সব সাজছে ঢং এ

লাইন দিয়ে চ্যালা বন্ধকী দেয় সেরিব্রাল কর্টেক্স।

ভক্ত বোঝেইনা অবশেষ।

কেউ তো আবার সাজে "নাস্তিক",

গড্ডালিকার ট্রেন্ডে ভাসতে।

নাস্তিকতা কী এতই সস্তা, ফ্যাশান মারার কেস?

আরে বিশেষ্য নয় বিশেষণ,

এটা বুঝলনা অবশেষ।

God, আল্লা, ঈশ্বর খেলা

সব খেলাতেই এই জাতি সেরা

খিদে পেট শিশু ধর্মই গেলে।

পলকের উন্মেষ?

সে ও ঘটবেনা পরিশেষ।

না না, সত্যিই সেলুকাস, গ্রহণ লেগেই আছে বেশ

আগামী হাজার বছরেও জাতি জাগবেনা অবশেষ,

এই জাতি বুঝবেনা অবশেষ।

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র "ভারত-বাদ" -ভাগবত ভট্টাচার্য
Nov. 9, 2024 | রাষ্ট্র | views:286 | likes:28 | share: 2 | comments:0

(1) আমরা ভারতবাসী। আমরা, আমাদের দেশকে মা বলি 'অর্থাৎ "ভারত-মাতা"। সেই অর্থে, আমরা সবাই ভারত-মাতার সন্তান। যে কোনো মায়ের কাছে, প্রতিটি সন্তানই যেমন, সমান গুরুত্ব পূর্ন,। ঠিক তেমনি, ভারতমাতার কাছেও তার প্রতিটি সন্তানই সমান গুরুত্বপূর্ন। সমান আদর। সমান সম্মান। সমান অধিকার। সমান মর্যাদা। খাদ্য পানীয় বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্ম বিনোদন ইত্যাদি সুখ ও সাচ্ছন্দ পাওয়ার সমান অধিকারী। আশাকরি এই বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। এখন প্রশ্ন হলো? আসল, বাস্তব সত্যটা কি? ভারত-মাতার সন্তান হিসেবে,আমরা তো প্রত্যেকেই পরস্পর পরষ্পরের ভাই অর্থাৎ এক জাতি। কিন্তু, আমরা কি সত্যিই তাই? সত্যিই কি আমরা একজাতি!একপ্রাণ! ভারতমাতার সন্তান?" আমরা! এবং আমাদের শাসকগোষ্ঠী এই ভারত-মাতা শব্দটা কি সত্যিই মানি? বা মানে? আমাদের সংবিধান! বাস্তবে কি, এই কথাটার আসল অর্থ মেনে লেখা হয়েছে? যদি,সত্যিকারের ভারতবাসীকে ভারত-মাতার সন্তান বিবেচনা করা হতো! তাহলে সংবিধান কখনোই "গণ-তন্ত্রের "নামে "দল-তন্ত্র" প্রতিষ্ঠা করার পথ সুগম করতো না। আমাদের সংবিধান আমাদের এক হতে দেয় নি। স্বাধীন গণতন্ত্রের নামে, বিভিন্ন দলে ভাগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ করে দিয়েছে। যেমন -A দল,B দল, C দল,D দল ইত্যাদি অসংখ্য দল। আর (অনস্বীকার্য বাস্তব সত্য) দল, মানেই গোষ্ঠী, বিভেদ। দল মানেই প্রতিস্পর্ধা। সমস্ত দেশবাসীকে যদি "ভারত-মাতার সন্তান" বিবেচনা করা হতো তাহলে দল শব্দটা সংবিধানে উল্লেখ করা হতো না। ভারতবর্ষ হতো "দলহীন "স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই দলহীন স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার কি ভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়?


  (2) স্বাধীনতা এই "স্বাধীনতা" শব্দটি প্রতিটি প্রাণী এবং প্রতিটি মানুষের কাছে, অত্যন্ত কাঙ্খিত শব্দ। এই স্বাধীনতা যুগ, যুগ ধরে প্রতিটি মানুষ এবং মানবজাতি কামনা করে আসছে! কিন্তু! বাস্তবে!, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে, আজ পর্যন্ত্য মানব-জাতির মধ্যে সাধারণ এবং অতি-সাধারণ শ্রেণীর মানুষ কখনো, কোনো দিনই এই কাঙ্খিত স্বাধীনতা পায় নি,আজও পায় না,পক্ষান্তরে আমরাও পাই নি। মানব সভ্যতা শুরুর আগে থেকেই সাধারণ মানুষ শক্তি ও শক্তিমানের কাছে স্বাধীনতা হারিয়ে শক্তিমানের দাসত্ব স্বীকার করেছে। সুদূর অতীতে, দৈহিক শক্তিতে, বলীয়ান্ ব্যক্তির, পরে দল বা গোষ্ঠী-দলপতির অধীন হয়েছে। তারপর, গোষ্ঠি থেকে,সৃষ্টি হয়েছে---- রাজা,মহারাজা,জমিদার। কালক্রমে এসেছে শক্,হুণ, মোগল, পাঠান, এসেছে ইংরেজ। এদের সবার শক্তির কাছেই আমরা,সাধারণ মানুষেরা অধীনতা স্বীকার করে, পরাধীন হয়েছি। তারপর একে, একে এবং সবার শেষে 1947 ইং সালে বিদেশী ইংরেজ তাড়িয়ে, আমাদের দেশ, তথা ভারত-মাতা স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমরা? সাধারণ মানুষরা? আমরা কি সত্যিই স্বাধীনতা পেয়েছি?? না। পাইনি। আমরা সাধারণ মানুষেরা, চিরদিনই গোলাম ছিলাম। আজও সেই গোলাম-ই আছি। চিরদিন-ই "স্বাধীনতা" ভোগ করেছে,এবং আজও করে চলেছে,সেই শক্তিমান দলপতি, সেই, শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের বশংবদেরা। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, - দলহীন গণতন্ত্রে কি, সবাই স্বাধীনতা পাবে? সেখানেও তো নেতা থাকবে, সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী থাকবে! হ্যাঁ। অবশ্যই থাকবে। আর দলহীন গণতন্ত্রে কি ভাবে প্রতিটি সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করবে?


  (3) দলহীন গণতন্ত্রের * রূপরেখা * দলহীন গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত কোনো "মালিকানা "থাকবে না। ভারতবর্ষের মাটিতে অবস্থিত,কল, কারখানা,জমি, বাড়ি ইত্যাদি,যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র মালিক হবেন -ভারত-মাতা। সংবিধানে "মন্ত্রী "শব্দ থাকবে না,থাকবে সেবক। যেমন : (1) কেন্দ্রে,প্রধান-সেবক! (2) রাজ্যে,মূখ্য-সেবক! (3) জেলা-সেবক! (4) মহকুমা-সেবক! (5) অঞ্চল-সেবক!ও (6) গ্রাম-সেবক! এই সংঙ্গে (1) কেন্দ্র (2) রাজ্য (3) জেলা (4) মহকুমা (5) ব্লক (6) অঞ্চল। এবং সর্বোপরি (7) গ্রাম। এই 7 টা স্তরেই গঠিত হবে, 7 টি সেবক-সরকার। , পুলিশের নাম বদল করে হবে,গৃহ-সেবক জেলা-গৃহ-সেবক! রাজ্য-গৃহ-সেবক! ও কেন্দ্রীয়-গৃহ-সেবক। এই সঙ্গে, প্রতিটা জেলা, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে, প্রতিটা মানুষের ঘর নির্মাণের জন্য থাকবে গৃহনির্মান-সেবক! কৃষির জন্য --কৃষি-সেবক খাদ্য সুনিশ্চিত করার জন্য,খাদ্য-সেবক এই ভাবে,শিক্ষা-সেবক, স্বাস্থ্য-সেবক! শ্রমিক-সেবক! বন-জঙ্গলের জন্য বন-সেবক। সেচের জন্য সেচ-সেবক। প্রতিটি নদী দূষণমূক্ত করার জন্য নদী-সেবক নদীর সঙ্গে নদীর সংযোজন,এবং সারা দেশে নতুন,নতুন খাল কাটার জন্য- উপনদী-সেবক বিনোদন-সেবক! ক্রীড়া-সেবক! মিলিটারি, শব্দের নাম বদল করে হবে মাতৃভূমি-রক্ষক। এনাদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যে থাকবে: কেন্দ্র-মাতৃভূমি-সেবক! এবং রাজ্য-মাতৃভূমি-সেবক!


  (4) প্রথমেই বলে রাখি সারা বিশ্বে কোথাও "গণতন্ত্র" নেই। যা আছে,তা গণতন্ত্রের নামে -প্রহসন। সব দলতন্ত্র। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনা করবেন রাজ্যের ক্ষেত্রে, রাজ্যের (২০) জন প্রধান বিচারপতি। গ্রাম-স্তর থেকে, সমস্ত নির্বাচনই হবে, সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে, সকলের চোখের সামনে। এই প্রসঙ্গে বলি : গোপনে ভোট দেওয়ার অর্থ স্বাধীনতার মৃত্যু। গণতন্ত্রে যদি প্রকাশ্যে স্বাধীন মতামত দেওয়ার অধিকার-ই না থাকে, তাহলে, কিসের গণতন্ত্র? কিসের স্বাধীনতা? -------- প্রসঙ্গত বলে রাখি- এই নির্বাচনের জন্য, নির্বাচন কমিশন তৈরী করে,কোটি কোটি টাকা অপচয় করার বিন্দু মাত্র প্রয়োজন নেই। 


 (5) কেন নির্বাচনে, কোটি কোটি টাকার "প্রয়োজন "নেই? প্রথমেই বলি,এই শতাব্দী বিজ্ঞানের, এই শতাব্দী প্রযুক্তির। এই যুগে, ভোট,অর্থাৎ প্রতিনিধি নির্বাচন হবে,মোবাইলের মাধ্যমে। প্রতিটি মোবাইল "আধার" কার্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এই,আধার নাম্বার-ই হবে ভোটার কার্ড। এক নাম্বারে, এক বার ভোট দেবার পর,সেই আধার নাম্বার লক্ হয়ে যাবে। ফলে,এক ব্যক্তি কখনোই দু,বার ভোট দিতে পারবে না। এই ভোট দানে ভোট দেওয়া "বাধ্যতামূলক"। যদি কেউ ভোট না দেয় সে দেশোদ্রোহী, হিসাবে, কঠোর শাস্তি পাবে। আর এই পদ্ধতিতে ভোট হলে,সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে,কে?ভোট দেয় নি। এবার নিশ্চয়ই ভাবছেন! সবাই, কোথায়! কি ভাবে মোবাইল পাবে? এর উত্তর (বর্তমান পদ্ধতিতে) সরকার গঠনের পর, স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের সরকারী-কার্যক্রম অংশে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন "ভোটে "কেনো কোটি,কোটি টাকার প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ। নির্বাচন কমিশন বলে একটা প্রতিষ্ঠান অবশ্যই থাকবে। আর তার প্রতিনিধি হবেন,দেশের সর্বোচ্চ আদালতের "প্রধান (২০ জন) বিচারপতি,  সঙ্গে থাকবে,  প্রধান গৃহ-সেবক এবং প্রধান দেশ-রক্ষক। মোট ২২জন। এনাদের কাজ হবে ২০ বছর বয়স হওয়া মাত্রই ভোটার তালিকাভুক্তি সুনিশ্চিত করা। এই সঙ্গে দেশের প্রতিটি ভোটের খবর রাখা। কোথাও কোনো রূপ ত্রুটি হলেই তার সমাধান করা। যদিও এই পদ্ধতিতে কোনো রূপ ভুল-ত্রুটি হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা,  গ্রাম-স্তর,  থেকে প্রতিটা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন একজন স্থানীয় বিচারক,  একজন স্থানীয় প্রধান গৃহসেবক,  এক জন স্থানীয় সক্ষম বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ এবং একজন মহিল। এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিনিধি হিসেবে অংশ গ্রহণ করবেন; অবশ্যই শিক্ষিত, বিজ্ঞান-মনষ্ক,  দেশ-প্রেমিক, কর্মক্ষম, মানব-দরদী। যে কোনো বিষয়ে বিশেষ গুণসম্পন্ন যেমন :- লেখাপড়া,খেলা আভিনয়*, কৃষি-কাজ, ডাক্তার,ইন্জিনিয়ার ইত্যাদি যে কোনো" মানব-হিতকারী" কর্মে নিযুক্ত "মানুষ " বিঃ দ্রঃ: -লিঙ্গ বিচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 


(6) আমার জন্ম 1947 ইং সাল। আমার জন্মের,, কয়েক মাস পরে,ইংরেজদের তাড়িয়ে ভারতমাতা "স্বাধীন" হন। অখণ্ড ভারতের, লক্ষ লক্ষ, সাধারণ,অতি সাধারণ শিশু, বৃদ্ধ, যুবা, নারী-পুরুষ,রক্তা-ঞ্জলী দিয়ে ভারতমাতাকে বরণ করেন। (ঐ মৃত্যু-মিছিলে আমিও থাকতে পারতাম।) তার পর যখন, সামান্য বোধবুদ্ধি হলো; দেখলাম স্বাধীন ভারতে "গণতন্ত্রের" নামে,বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা। অর্থাৎ,গণতন্ত্রের নামে, দলতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। আর এই, দলগঠিত হলো কিছু প্রভাবশালী মানুষের,ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং ধার করা মতবাদকে কেন্দ্র করে। এই দল অনিবার্য্য ভাবেই, তার কলেবর বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে বাধ্য হলো; সমাজের প্রভাবশালী অসামাজিক,চোর,গুণ্ডা, খুনী ইত্যাদিদের,শুরুতে (চুপিচুপি) সাহায্য এবং পরে "দলভুক্ত" করতে, যা আজ ও প্রবাহমান। প্রথমদিকে,দলীয়-নেতারা, এই সব অসামাজিক লোকদের সরাসরি অস্বীকার করলেও, নিজেদের,স্বার্থে গোপনে স্নেহ করতেন। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেই দেখলাম,এই সব খুনি, গুণ্ডাদের,সরাসরি দলীয় কর্মীর স্বীকৃতি, পেতে। এরা দলে এলো। দলের কলেবর বিস্তৃত হলো। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি হলো,সাধারণ মানুষের, উপর অত্যাচার, তোলাবাজি, ভয় দেখানো। শুরু হলো,বোম ইত্যাদি অস্ত্রের উন্মত্ততা। কালক্রমে প্রতিটা দল এবং শাসকগোষ্ঠী অস্তিত্ব রক্ষা ও বাঁচার তাগিদে, এদের একে, একে দলভুক্ত করে, এদেরই দলের,সম্পদ হিসেবে নেতা বানিয়ে ক্ষমতার আসনে বসালো। এই নেতারা, দলের মধ্যে নিজের,ব্যক্তিগত দল তৈরি করে, ক্রমাগত শক্তিশালী, হয়ে ইচ্ছা মতো দল-ত্যাগ,করার স্পর্ধা দেখাতেও,সক্ষম। এরা, সাধারণ মানুষের মনে,আতঙ্ক- সৃষ্টি-কারী জানা সত্বেও, এই গণতন্ত্র-হীন দল-তন্ত্রের বিচার ব্যবস্থা, অথর্ব-পঙ্গুর মতো নীরব দর্শক। কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে অক্ষম। এর অজস্র প্রমাণ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। আজ সারা ভারতে,এমন একটা দল ও নেতা নেই,যে,বা যারা,এই সমস্ত অভিযুক্ত- অপরাধী ও সমাজ-বিরোধীদের তাদের,কৃত-কর্মের জন্য, দল বা নেতৃত্ব থেকে, বহিষ্কার করে। যে দু'এক জন মাঝে,মাঝে বিভিন্ন দল থেকে, বহিষ্কৃত হয়! তার মূখ্য কারণ,দলীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের,সাথে মতবিরোধ এবং দন্দ্ব। গণতন্ত্রের নামে অশিক্ষিত, খুনী, স্বীকৃত ডাকাত, অনায়াসে শাসন ক্ষমতায় এসে,দেশের শিক্ষিত, জ্ঞানী,গুণী মানুষের উপর ছড়ি ঘোরাবার যে স্পর্ধা ওরা পেয়েছে,তার দায়, আমাদের বর্তমানে প্রচলিত "সংবিধান" এবং নির্বাচন পদ্ধতি অস্বীকার করতে পারে না। 


  (7) আমাদের দেশ ভারতের বর্তমান জন সংখ্যা 137 কোটি। এই 137 কোটি মানুষের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক 37 কোটি বাদ দিলে বৈধ ভোটার সংখ্যা (100 কোটি) সুষ্ঠু ভাবে দেশ পরিচালনা করার জন্য (100 কোটি ভোটার সংখ্যাকে) প্রতি রাজ্যে 5 কোটি হিসাবে,মোট 20 টি রাজ্যে বিভক্ত করতে হবে। অর্থাৎ সারা ভারতে থাকবে মোট 20 টা রাজ্য। এই 20 টা রাজ্যের প্রতিটি রাজ্যে থাকবে 10 টা করে জেলা। প্রতিটি জেলায় থাকবে : 5 করে মহকুমা প্রতিটি মহকুমায় থাকবে 10 করে ব্লক। প্রতিটি ব্লকে থাকবে 10 করে অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলে থাকবে 10 করে গ্রাম। প্রতিটি গ্রাম গঠিত হবে (1000) একহাজার ভোটার নিয়ে। এবার 1 টা জেলার হিসাব কোন স্তরে কতজন (ভোট প্রাপ্ত) জনসেবক থাকবে? প্রথমে : গ্রাম। পূর্বেই বলেছি, একটা গ্রাম গঠিত হবে (1,000) এক হাজার ভোটার নিয়ে। এই এক হাজার মানুষ তাদের গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত, বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ গুণসম্পন্ন যেমন কৃষিকাজ,বিজ্ঞান, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক,অভিনেতা, এবং অবশ্যই, মানবহিতকারী জনদরদী, সমাজসেবা ইত্যাদি গুণসম্পন্ন মানুষ দের মধ্যে থেকে (1) এক জন করে (মোট 4 জন) মানুষকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন (1000) এক হাজার মানুষ। (1 টা) ভোটও কম হলে হবে না। যে ভোট না দেবে সে দেশোদ্রহী হিসাবে চিহ্নিত হবে। এই নির্বাচনে একটা সমস্যা হতে পারে। সেটা একই গ্রামে বিভিন্ন গুন সম্পন্ন যেমন : একাধিক শিক্ষক, ডাক্তার, কৃষক, খেলোয়াড় ইত্যাদি আছেন। এ ক্ষেত্রে এদের মধ্যে থেকে,একজন মনোনীত কি ভাবে হবে? এক্ষেত্রে ঐ একই বিষয়ে 2,3 বা 4 জন সকলেই ভোট প্রার্থী হবে। এদের মধ্যে বিষয় অনুযায়ী যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে,সেই গ্রামসেবক নির্বাচিত হবে। প্রতি গ্রাম থেকে (4) জন। অর্থাৎ(250) জন ভোটার পিছু (1 জন) গ্রামসেবক নির্বাচিত হবে। এই খানে একটা কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন, এই গ্রাম-ই, হবে,ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্র তথা ভারত মাতার আঁতুড়ঘর। এই আঁতুড়-ঘরেই জন্ম নেবে দেশের সমস্ত সেবক যথা রাজ্যের মূখ্য সেবক (মুখ্যমন্ত্রী) সারা দেশের প্রধান সেবক (প্রধানমন্ত্রী) । এই গ্রামসেবক "নির্বাচনে সারা ভারতে (100) একশত কোটি মানুষের প্রতিটি মানুষকেই ভোট দিতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক। 

এই ভোট প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যানার,পোষ্টার,ব্যক্তিগত প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রথমে (পূর্ব-বর্ণীত নির্বাচন কমিশন) দেশের ২০ জন প্রধান বিচারপতি, একজন প্রধান গৃহসেবক,একজন প্রধান দেশ রক্ষক। মোট ২২ জন যৌথভাবে ভোটের তারিখ ঘোষণা করবেন। সারা দেশের সমস্ত পত্রিকা, টিভি ইত্যাদি যত রকম প্রচার মাধ্যম আছে, তার মাধ্যমে। দিন ঘোষণার 7 দিনের মধ্যে উল্লেখিত গুণসম্পন্ন (ভোটে দাঁড়াতে ইচ্ছুক) ব্যক্তিগণ,তাদের যোগতা ও গুণাবলী গ্রামে অবস্থিত,নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি অর্থাৎ এক জন বিচারপতি,একজন প্রধান গৃহসেবক,একজন গ্রামের সবচেয়ে,বয়স্ক কর্মক্ষম পুরুষ,এবং একজন মহিলা। এই 4 চারজনের কাছে জমা দেবে। তারপর এই চার জন সরেজমিনে যাচাই করে,অনুমোদন করার পর ভোটে দাঁড়াবার ছাড়পত্র পাবে। এই ছাড়পত্র পাবার পর 7 দিন সকাল দুপুর ও রাতে,স্থানীয় কেবল টিভির মাধ্যমে, প্রার্থীর নাম ও গুণাবলী দেশের পক্ষ থেকে বিনা পয়সায় প্রচার করা হবে 6 দিন। এবং ঠিক 7 দিনের দিন। গ্রামে বড় পর্দার টিভি লাগিয়ে,মোবাইলের মাধ্যমে গ্রামের 1000 জন ভোটার, প্রকাশ্যে ভোট দেবে। প্রতিটা ভোট দেবার সময়, ভোটদাতার ছবি সহ নাম এবং কাকে ভোট দিলেন সবাই পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাবে। এই ভোট গ্রহণ চলবে, সকাল 10 টা থেকে বৈকাল 4 টা। ফলাফল : ভোটদান শেষ হওয়া মাত্র,সবাই জানতে পারবেন,এবং ভোট শেষ হবার 10 মিনিটের মধ্যে গ্রামের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবেন। 


  (8) অঞ্চল গঠন এবং প্রধান অঞ্চল-সেবক নির্বাচন পদ্ধতি। এই আলোচনা করার পূর্বে,একটা বাস্তব সত্য তুলে ধরা বিশেষ প্রয়োজন। শুধু মাত্র,আমাদেরই নয়। সারা বিশ্বের,প্রতিটি দেশের হৃদপিণ্ড এবং শিরদাঁড়া, হচ্ছে গ্রাম। একবার ভেবে দেখুন,আমাদের বেঁচে থাকার প্রথম ও এক মাত্র শর্ত --খাদ্য। আর এই খাদ্য উৎপাদন করে শুধু মাত্র গ্রাম তথা গ্রামের কৃষক দাদা। সারা বিশ্বের এবং আমাদের দেশের দলতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী ও আমাদের সংবিধান দূর্ভ্যগ্যবশতঃ এই গ্রামকেই করেছে সবচেয়ে বেশি অবহেলা। গুরুত্ব দিয়েছে,শহরকে। যাবতীয় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য,বিনোদন ইত্যাদি, লোভনীয় জীবন যাপনের সুযোগ ও সুবিধা পেয়েছে শহর। যার অনিবার্য্য ফলশ্রুতি, মানুষ হয়ে উঠছে শহর-মুখি। এই বিষয়টা সেই মানুষটার সাথে তুলনীয় যার মুখ, প্লাস্টিক সার্জারি করে অতি সুন্দর করা হয়েছে। আপাদমস্তক মোড়া হয়েছে মূল্যবান রঙচঙে পোশাক দিয়ে। কিন্তু, পোষাকের নীচে? কংঙ্কালসার,হাড় জিরজিরে দেহ,হাত-পা সরু সরু,জরাজীর্ণ বুকের খাঁচা। এই দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহাশক্তিধর আত্মনীর্ভরশীল হওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও সম্ভব নয়। 137 কোটি সন্তানের জননী আমাদের ভারত-মাতা। এই বিশাল মহা-শক্তির অধিকারিণী, হওয়া সত্ত্বেও,আমাদের মাতা স্বয়ং-সম্পূর্ণা নন্। লজ্জাজনক ভাবে পর-মূখাপেক্ষি। এই বিপুল জন সংখ্যাকে প্রতিটি দলতান্ত্রিক- শাসকগোষ্ঠী শুধু মাত্র ভোটের যন্ত্র হিসেবে দেখেছে। সংবিধান,স্বাধীনতা, গণতন্ত্র,সমানাধিকার ইত্যাদি শব্দের মায়াজাল বুনে সাধারণ মানুষকে প্রকারান্তরে বোকা বানিয়ে শাসন ও শোষণের ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব। এটাই সত্য। আমি পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্লেষণ করবো,কি ভাবে এই 137 কোটি মানুষ, ভারতমাতার শ্রেষ্ঠতমো সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।  অঞ্চল গঠন এবং অঞ্চল সেবক নির্বাচন পদ্ধতি আলোচনার আগে আর একটা জরুরী বিষয় বলা প্রয়োজন। বর্তমান নিয়মে প্রতি 5 বছর পর পর নির্বাচন হয়। তার একটা মস্তবড়ো কারণ প্রতিটি নির্বাচনে বিপুল অর্থব্যয়। আর এই নির্বাচন পদ্ধতিতে শাসকগোষ্ঠী 5 বছর নিশ্চিন্ত মনে ক্ষমতায় থেকে,ইচ্ছামতো সাধারণ মানুষের উপর ছড়ি ঘোরাবার সুযোগ পায়। সাধারণ মানুষ সবকিছু দেখে,বুঝেও শুধু মাত্র অশহায়ের মতো চেয়ে,চেয়ে দেখে। তারপরেও দেখা যায় দলতন্ত্রের প্রভাবে ভোটের মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচনে জিতে, ক্ষমতায় আসে। অনিবার্য্য ভাবেই বিরক্ত হয়ে, সাধারণ মানুষের একাংশ ভোট বিমূখ হয়। যারা ভোট দান করেন,তাদের ভোট সংখ্যা অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে,এই প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিতে যেখানে সারাদেশের ভোটার সংখ্যার কমপক্ষে 50.1 শতাংশ ভোট নিয়ে, শাসন ক্ষমতায় আসার কথা, সেখানে 30 থেকে 40 শতাংশ অর্থাৎ সংখ্যালঘু হয়েও সংখ্যাগুরুর উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার পায়। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতান্ত্রিক নির্বাচন(5) বছর পর, পর নয়। নির্বাচন হবে (2) দুই বছর পর, পর। আর, এক ব্যক্তি,শুধু মাত্র (2) দুই বার নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন। এই দুই বার দাঁড়ানো,এবং 2 বছর পর,পর প্রতিটি স্তরেই, যথা গ্রাম-সেবক থেকে রাজ্যের মূখ্যসেবক (মুখ্যমন্ত্রী) দেশের প্রধান-সেবক (প্রধান মন্ত্রী) সবার ক্ষেত্রে ই প্রযোজ্য। আর এই নির্বাচনে দাঁড়াবার বয়স সীমা(২৫) পঁচিশ বছর থেকে (৫৫) বছর পর্যন্ত্য এবং কোনো ক্রমেই এই বয়স সীমা ৫৫ বছর অতিক্রম করবে না। অর্থাৎ (৫৫ বৎসর) বয়স হলেই সমস্ত কর্ম থেকে অবসর নেওয়া বাধ্যতামূলক। বিঃ দ্রঃ,শুধু মাত্র গ্রামসেবক "নির্বাচনেই সারাদেশের (100) কোটি ভোটার অংশগ্রহণ করবে। পরবর্তী পর্যায়ের কোনো নির্বাচনেই এই (100) একশত কোটি, মানুষ অংশ গ্রহণ করবে না। অর্থাৎ ভোট দেবে না। ভোট দেবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেমন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দেবে, শুধু মাত্র গ্রাম-সেবকরা। বিঃ দ্রঃ, সাম্যবাদী দল সহ সারা বিশ্বের,প্রতিটি দলের,গঠনতন্ত্রের সাথে ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গনতন্ত্রের,গঠনতন্ত্রের এটাই মূল তফাৎ,যা কখনোই,ব্যক্তি বিশেষকে আমৃত্যু,ইচ্ছা মতো ছড়ি ঘোরাতে দেবে না। 


  (9)গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করার আগে,আরো একটা কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী এক মাত্র রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার দেশ পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণ করার জন্যে বিভিন্ন বিষয়ের মন্ত্রী নিয়োগ করার অধিকারী। (শিক্ষা মন্ত্রী,অর্থ মন্ত্রী ইত্যাদি)। এই নিয়োগে মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন রাজ্যে-- মূখ্য-মন্ত্রী। কেন্দ্রে -প্রধান-মন্ত্রী। এই মন্ত্রিত্ব পাবার ক্ষেত্রে,(অধিকাংশ) যোগ্যতা নয়। দেখা হয়, কে কতবেশী মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুগত! এবং কতটা অর্থবান, বাহুবলী! ও প্রভাবশালী"! আর এটা ভারতমাতা স্বাধীন হবার পর দলতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকে, চলে আসছে। ফলস্বরুপ,যে ব্যক্তি,, কোনো দিন" চাষ" করেনি, সে হয় কৃষি-মন্ত্রী। খেলার মাঠের অখ্যাত খেলোয়াড় হয় ক্রীড়া-মন্ত্রী। অর্থ নীতির জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও হয় অর্থ-মন্ত্রী। শিক্ষা গত যোগ্যতা না থাকলেও শিক্ষা-মন্ত্রী ইত্যাদি হতে কোনো বাধা নেই। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন--- এই সমস্ত মন্ত্রীরা, সবাই মূলত,আমলা নির্ভর। এই আমলা-গন প্রায় সকলেই প্রচুর লেখাপড়া জানা- বিদ্বান, সু-চতুর, আত্ম-কেন্দ্রিক,দাস-মনোভাবাপন্ন,হয়ে থাকেন। এরাই নেপথ্যে থেকে,দল ও মন্ত্রীর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের নীতি নির্ধারণ,ভাষণ ইত্যাদি লিখে, মন্ত্রীদের কর্মপথ সুগম করার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই প্রচলিত পদ্ধতি পুরোটাই,দলতান্ত্রিক ব্যক্তি নির্ভর অ-গণতান্ত্রিক। নির্দ্বিধায় বলা যায় বাস্তব বোধ এবং অভিজ্ঞতা হীন ব্যক্তির (মন্ত্রী) ক্ষমতার আসনে, ঠাণ্ডা ঘরে বসে, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এই যে পদ্ধতি এটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক অনভিপ্রেত। বিঃ দ্রঃ-ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্র,এই পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কার্যকরী ও গুরুত্ব পূর্ন এবং শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন হবে গ্রামে, অঞ্চলে। (প্রচলিত নিয়ম মতো কেন্দ্রের লোকসভা এবং রাজ্যে বিধানসভায় নয়।) আমি ইতিপূর্বে বলেছি,এক হাজার জন,সংখ্যা বিশিষ্ট গ্রাম থেকে(4 চার) জন বিভিন্ন গুন সম্পন্ন গ্রামসেবক নির্বাচিত হবে। একটা অঞ্চল (10 টা) গ্রাম নিয়ে গঠিত হবার ফলে (10 টা) গ্রামের (4x10= 40 জন) নির্বাচিত সদস্য নিয়ে গঠিত হবে একটা অঞ্চল। এই (40 জন) সদস্যদের মধ্য থেকে বিশেষ, বিভিন্ন গুন সম্পন্ন(20) জনকে নিয়ে গঠিত হবে অঞ্চল সেবক (মন্ত্রী) সমিতি। এই (20) জন কে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, উক্ত (40) জন গ্রাম-সেবক। এই(20 জন) তাদের শিক্ষা, জ্ঞান, কর্মদক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুসারে,নিম্নোক্ত (20 টা) বিষয়ের সক্রিয় প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবেন। (1) খাদ্য। (2) পানীয় (বিশুদ্ধ) জল। (3) বস্ত্র। (4) বাসস্থান। (গৃহনির্মান) । (5) স্বাস্থ্য। (6) শিক্ষা। (7) বিদ্যুৎ ও জ্বালানী (8) খেলা। (9) বিনোদন। (10) রাস্তা। (11) জলাশয় (পুকুর, বিল। ) (12) নদী ও খাল। (13) বনভূমি (বনসৃজন) । (14) শিল্প (কল- কারখানা) । (15) পশু-পালন (যাবতীয় গৃহপালিত)। (16) ব্যবসা। (17) পরিবহন (স্থল- জল- আকাশ)। (18) অর্থ। (19) যান-বাহন। (20) গবেষণা। এই 20 টা একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ে(20 জন প্রতিনিধি) গ্রামের উন্নয়ন ও প্রগতির সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে,সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। 


  (10) প্রধান অঞ্চল সেবক নির্বাচন। প্রধান অঞ্চল সেবক নির্বাচিত হবেন উক্ত (20 জন) (মন্ত্রী) বিশেষ, গুণসম্পন্ন ব্যক্তিগণের মধ্যে থেকে যিনি অধিক শিক্ষিত এবং একাধিক গুণসম্পন্ন ধীর স্থির বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি উক্ত (20 জন) গ্রাম-সেবক, দ্বারা সর্ব-সম্মত। অথবা একাধিক সম গুণসম্পন্ন দাবীদার থাকলে,ভোটের মাধ্যমে প্রধান অঞ্চল সেবক নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি স্তরেই নির্বাচন হবে প্রকাশ্যে। ভোট পরিচালনা করবেন (1 বা 2 জন) বিচার-পতি স্থানীয় প্রধান গৃহসেবক (পুলিশ অফিসার) গ্রামের সবচেয়ে বয়ষ্ক কর্মক্ষম একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। ব্লক-সেবক নির্বাচন। আমি ইতিপূর্বে এক,একটা অঞ্চল থেকে (20 জন) অঞ্চল -সেবক পেয়েছি। মোট (10 টা) অঞ্চল নিয়ে গঠিত হবে ব্লক-সেবক সমিতি অর্থাৎ---- (20 মন্ত্রী x10=200) জনকে নিয়ে। এই (200 জনের) মধ্যে অঞ্চল সেবক নির্বাচনের পদ্ধতি অনুযায়ী (20 জন) উক্ত বিভিন্ন বিষয়ের শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে ব্লকসেবক সমিতি। এবং এই (20 জনের) মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হবেন,প্রধান ব্লক-সেবক। এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করে মহকুমা সেবক প্রতিনিধি নির্বাচন হবে (10 টা) ব্লকের (20 জন x 10) = (200 জন) সেবকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ(20 জনকে) নিয়ে এবং একই ভাবে, প্রধান মহকুমা সেবক নির্বাচিত হবেন। জেলা সেবক এবং প্রধান জেলা সেবক নির্বাচন হবে(5 টা) মহকুমা সেবকদের অর্থাৎ (5 x 20 = 100 জনের) মধ্যে শ্রেষ্ঠ (20 জন) কে নিয়ে এবং একই পদ্ধতিতে। একই ভাবে প্রধান জেলা সেবক নির্বাচিত হবেন। এবার রাজ্য সেবক নির্বাচন : রাজ্যসেবক নির্বাচন হবে(20 টা) জেলার প্রতিটি জেলার (20 জন x 20 = 400 জনকে) নিয়ে। এই (400 জনের) মধ্যে থেকে (20 জন) এবং সাথে আরও (20 জন) সহকারী নিয়ে রাজ্যসেবক সমিতি গঠন হবে। এবং এই (400 জনের) মধ্যে সর্বোত্তম,শিক্ষিত, জ্ঞানী গুণী, বিজ্ঞান-মনষ্ক মানব-দরদী ব্যক্তি, ঐ (400 জনের) সর্বসম্মতিক্রমে অথবা একাধিক প্রতিযোগী থাকলে (3 জন) বিচারপতি (1 জন) রাজ্যস্তরের গৃহসেবক(1 জন) (পুলিশ প্রধান) 1 জন রাজ্যস্তরের গৃহ রক্ষক (মিলিটারি) এই (5 জন) মিলে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। সব ক্ষেত্রেই ভোট হবে প্রকাশ্যে, সরাসরি প্রতিটি টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করবে। আশাকরি,সবাই বুঝতে পারছেন,এই জনপ্রতিনিধি নির্বচনে শুধু মাত্র শিক্ষা এবং গুণ-ই জনপ্রতিনিধি হবার একমাত্র মাপকাঠি। 


11)  কেন্দ্রীয় সেবক এবং কেন্দ্রীয় প্রধান সেবক নির্বাচন। ঠিক যে পদ্ধতিতে রাজ্যে মুখ্য সেবক (1 জন) সহ বিভিন্ন বিষয়ের (20 জন) সেবক এবং (20 জন) সহযোগী সেবক মোট (1+20+20=) 41 জন নির্বাচিত হয়েছেন ঠিক তেমনি,ভারত-মাতার (20টা) রাজ্যের,প্রতিটি রাজ্যের 1 জন রাজ্য মূখ্য-সেবক আর (40 জন) বিশেষজ্ঞ সেবক সর্বমোট 1 +40 =41 জন। অর্থাৎ কেন্দ্রে (41 x 20) =820 জন। এই (820 জনের) মধ্যে "সর্বোত্তম" আদর্শ-বান,শিক্ষিত, জ্ঞানী, গুণী এবং বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী,যোগ্যতম ব্যক্তি,নির্বাচিত হবেন, দেশের প্রধান সেবক (প্রধানমন্ত্রী) সর্বসম্মতিক্রমে। আর একাধিক প্রার্থীর ক্ষেত্রে উক্ত (820 জ) ভোট দিয়ে ভারত-মাতার প্রধান সেবক (প্রধান-মন্ত্রী) নির্বাচিত করবেন। এবং ঐ 820 জনের মধ্যে থেকে, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ,বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে কেন্দ্রীয় সেবক (মন্ত্রী) পরিষদ। এই গুণসম্পন্ন, যোগতম ব্যক্তি,বাছাই এর ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন,দেশের সর্বোচ্চ আদালতের (২০ জন) বিচারপতি। (৩ জন) প্রধান দেশরক্ষক (জল +স্থল+ বিমা) । সর্বোচ্চ (2 জন) কেন্দ্রীয় গৃহ-রক্ষক (পুলিশ ও গুপ্তচর বিভাগ) । মোট --(20+3+2) = 25 জন। এনারাই শিক্ষা,জ্ঞান কর্মদক্ষতা ও গুণের ভিত্তিতে, উল্লেখিত খাদ্য,পানীয়, শিক্ষা,স্বাস্থ্য ইত্যাদি (20 টা) এবং প্রয়োজন হলে "আরো কয়েকটা জনস্বার্থ, বিষয়ের কেন্দ্রীয় সেবক(মন্ত্রী) নির্বাচিত হবেন, হয় সর্বসম্মতিক্রমে না হয় ঐ (820 জনের) দেওয়া,প্রকাশ্য ভোটের মাধ্যমে। আশাকরি এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন,রাজ্যে, এবং কেন্দ্রে যে সকল মানুষ নিয়ে জন-সেবক (অধুনা প্রচলিত মন্ত্রী) নির্বাচিত হবেন তারা এক, এক জন দেশের,বাছাই করা "রত্ন "। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন,প্রচলিত দল তন্ত্রে,দল আগে, তারপর মানুষ। ঠিক, একই নিয়ম দেখতে পাওয়া যায়,মার্ক্সবাদি - সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রে। এই দল তন্ত্র কখনোই মানুষ কে তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা দেয় নি। দেয় না। যার অনিবার্য্য ফলশ্রুতি,রাশিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের, সাম্যবাদী সরকারের পতন। এই দলতান্ত্রিক দলের নেতৃবৃন্দ, ক্ষমতা পাবার আগে সাধারণ মানুষের দুঃখ,কষ্টের কথা বলে, তাদের সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থনে, ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতায় আসার পরেই,সেই জনগনের মাথার উপরেই নামিয়ে আনে শোষণ,অত্যাচার। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশের সাম্যবাদী প্রথম সারির নেতারা,ব্যক্তিগত চরিত্রে নির্লোভী,সৎ হলেও, দ্বিতীয়,তৃতীয়,এবং গ্রামস্থিত চতুর্থ শ্রেণীর নেতারা সাধারণ মানুষের উপর নামিয়ে আনে শোষণ, তোলাবাজি স্বজনপোষণ। ফলে,তৃণমূল স্তরের সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ সাম্যবাদী সমর্থক বীতশ্রদ্ধ হয়ে,সমাজতান্ত্রিক সরকারের অবসান ঘটাতে দ্বিধা করে না। সবচেয়ে আশ্চর্য জনক ঘটনা,প্রথম শ্রেনীর সাম্যবাদী নেতারা, মানুষের চেয়ে দলকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে সেই দলেরই আসল ভিত্ সাধারণ মানুষকে পাত্তা দেয় নি। পাত্তা দিয়েছে দুর্নীতি গ্রস্ত তৃতীয়,চতুর্থ শ্রেণীর নেতাদের! এর ভুরিভুরি প্রমাণ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আর এটাই, সারা বিশ্বের সমস্ত "দলতান্ত্রিক" দলের অন্তর্নিহিত বাস্তব সত্য। 


12)  তথাকথিত "গণতন্ত্রের" প্রতিষ্ঠাতা! আমাদের সংবিধানে, বড়ো,বড়ো অক্ষরে লিখেছেন: (1) সাধারণ মানুষের দ্বারা (2) সাধারণ মানুষের জন্য (3) সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র হ্যাঁ! (1 নং) কথাটা সঠিক। সাধারণ মানুষের দ্বারা অর্থাৎ,আমরা সাধারণ মানুষেরা,অসংখ্য দলের মধ্যে,একটা দলকে ভোট দিয়ে দলতান্ত্রিক সরকার গঠন করি। আর দলতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেই, সংবিধানে উল্লেখিত (2) সাধারণ মানুষের জন্য (3) সাধারণ মানুষের এই দুটো কথা, বেমালুম, ভুলে যায়। ক্ষমতায় টিঁকে থাকা এবং দলকে শক্তিশালী করার জন্য অতি সাধারণ ভোট দাতাদের চেয়ে, অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়,অসৎ, অসামাজিক,আর্থিক এবং পেশীশক্তিতে বলীয়ানদের। আর অনিবার্য্য ভাবেই সাধারণ মানুষ অন্ততঃ(5) বছরের জন্য হয়ে যায় গুরুত্বহীন দাস-দাসী। এই বিষয়টা আরো স্পষ্ট ভাবে বোঝানোর জন্য,একটা বাস্তব উদাহরণ :-- সঠিক গণতন্ত্র সেই --ছেলে,যে,আমৃত্যু মা-বাবার সাথে থাকে। মা ও বাবাকে, সবার চেয়ে,সবকিছুর চেয়ে,বেশি "গুরুত্ব" দেয়। তাদের,সেবা-যত্ন করে। কখনো,কোনো কারণেই মা-বাবার চোখে,বিন্দু মাত্র জল ঝরতে দেয় না। আর পক্ষান্তরে দলতন্ত্র?? দলতন্ত্র সেই ছেলেরা,যারা বাবা-মায়ের ঘাম ও রক্ত-জলে বড় হয়ে, তাদের দয়ায় লেখাপড়া শিখে,প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে,সেই মা ও বাবাকে পাঠায় বৃদ্ধাশ্রমে। মা-বাবার চোখের জল তাদের কাছে, ফালতু,সেন্টিমেন্ট। তবে হ্যাঁ। একেবারে ভুলে যায় না। দূর থেকে,মাঝে, মাঝে খবর নেয়, কখনো-কখনো দয়া দেখিয়ে,কিছু টাকা পাঠিয়ে,কর্তব্য পরায়ণতার নিদর্শনও রাখে। ঠিক,এই ভাবেই দলতন্ত্রের নেতারা" পাঁচ বছর,পরপর,সেই বৃদ্ধাশ্রমে (বাড়ি, বাড়ি) গিয়ে,হাত জোড় করে,ভালো-ভালো কথার ফুলঝুরি আর প্রতিশ্রুতির-বন্যা এমনকি,পায়ে হাত দিতেও দ্বিধা করে না। যেনতেন,প্রকারে চাই আশীর্বাদ, মানে,ভোট। সাথে কিছু ফল-মূলও থাকে। বেচারি বাবা-মা! হ্যাঁ। বেচারি!! দলতন্ত্র নামক সন্তানের মা ও বাবা অর্থাৎ জনগণ সত্যই বেচারা! আশাকরি "গণতন্ত্র "এবং "দলতন্ত্রের "তফাৎটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। ঠিক একই ভাবে ক্ষমতার শিখরে থাকা দলের নেতা-নেত্রীরা সাধারণ মানুষের দুঃখ,দুর্দশায় "কুম্ভীরাশ্রু" বিসর্জন করে, মানবদরদী হবার মহড়া দেন। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন, এই দলতান্ত্রিক প্রতিটি দলই নিজেদের দলের বিদ্রোহী এক বা দুজন মানুষকে, দল থেকে তাড়াবার সময় তাদের ভাষণে বলে থাকেন- ব্যক্তির অর্থাৎ, মানুষের চেয়ে, দল বড়। হ্যাঁ,দলতন্ত্রে এটাই,দস্তুর। দু'চার জন,ব্যক্তির ক্ষেত্রে, একথা দলের নেতা-নেত্রীরা বলতেই পারেন। কিন্তু, এই দলকে যারা বড় করে,সেই অতি-সাধারণ,অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা" হাড় জিরজিরে,খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষ!তাদেরও কি ঐ কথা বলা যায়? বলা যায়? তোমাদের চেয়ে দল বড়ো! আর একটা কথা, গণতন্ত্রে রাজ-নীতি মানে,রাজার নীতি শব্দের কোনো ঠাঁই নেই। রাজা,মন্ত্রী,শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে, "সামন্ত-তান্ত্রিক মানসিকতা। এরই, বাস্তব প্রতিফলন,আমরা দেখতে পাই,প্রতিষ্ঠিত দলতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্র হবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বিঃ দ্রঃ : আমি ইতিপূর্বে গ্রামসেবক সহ যাবতীয় সেবক-সংখ্যার যে হিসাব দিয়েছি হয়তো, পাটীগণিতের হিসাবে সংখ্যা গত ভুল থাকতে পারে। । কিন্তু, নির্বাচন -পদ্ধতিতে কোনো ভুল নেই


13) দলতন্ত্রে,দলের দলপতি অর্থাৎ সর্বোচ্চ নেতার কথাই,শেষ কথা। আমার প্রস্তাবিত গণতন্ত্রে কোনো একজন বা দু’জন (নির্বাচিত) ব্যক্তির কথা,কখনোই শেষ কথা হবে না। এই বার এদের কর্মপদ্ধতি এবং ক্ষমতা বিষয়ে আলোচনা করছি। গণতন্ত্রে ব্যাক্তি তথা"জনগনের " মূল্য সবার আগে। জনগণের, চাহিদা ও যথার্থ দাবী এবং অভিযোগ,প্রতিটি সেবক শুনতে,এবং প্রতিকার করতে বাধ্য। কোনো স্তরের-ই কোনো সেবক, কাউকেই আদেশ দিতে পারবে না। গণতন্ত্রে, সাধারণ, মানুষকে "আদেশ "দেবার অধিকার থাকবে-- বিচারকদের। আদেশ দিতে পারবে,দেশ-রক্ষক (মিলিটারি) ও গৃহসেবক (পুলিশ) তাদের বিভাগীয় ব্যক্তিদের,। শিক্ষাক্ষেত্রে,শিক্ষক। সংসারের ক্ষেত্রে বাবা-মা সহ বয়ষ্ক গুরুজন। এনারা ছাড়া,আর কেউই দেশের কোনো সাধারণ মানুষকে কোনো বিষয়ে আদেশ দিতে বা জোর করে কোনো কাজ বা কথা মেনে নিতে,বাধ্য করতে পারবে না। বিভিন্ন পর্য্যায়ের সেবকেরা (দেশের ও মানুষের,মঙ্গলের জন্য) প্রথমে,নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রধান সেবকেরা সেটা লিখিত আকারে প্রকাশ করবেন। বিঃ দ্রঃ-প্রতিস্তরের প্রধানদের (প্রধান অঞ্চল সেবক থেকে, রাজ্যের মূখ্যসেবক (মুখ্যমন্ত্রী) কেন্দ্রের প্রধান সেবক (প্রধানমন্ত্রী) মূল কাজ পরষ্পরের, সাথে "সমন্বয়" সাধন করা। এবং নিজের ব্যক্তিগত বক্তব্য সহ সেবকদের সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া সিদ্ধান্ত,"ঘোষক" হিসাবে জনসাধারণকে জানানো। যে কোনো ভাবেই হোক, সাধারণ মানুষের উপর,ব্যক্তিগত, সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ছড়ি ঘোরাবার চেষ্টা শাস্তি যোগ্য অপরাধ বিবেচিত হবে। এই খানেই "দলতন্ত্রের" সাথে "গণতন্ত্রের" মূল তফাৎ। দলতন্ত্র সমস্ত ক্ষমতা, দলপতি তথা নেতার হাতে দিয়ে হিটলার,গর্বাচভ ইত্যাদির জন্ম দেয়। আর এরই ফলশ্রুতি,(মুষ্টিমেয় কয়েকজনের সমর্থনে) ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রয়োগ করেই গর্বাচভ, রাশিয়াকে করেছে ছিন্নভিন্ন। চীন তার সাম্যবাদী চরিত্র হারিয়ে ধনতান্ত্রিক দেশের অনুকরণে দলেরই কিছু মানুষকে, যেমন,প্রচণ্ড ধনী (জ্যাক মা) হতে সাহায্য এবং অপর দিকে-- দুর্দশাগ্রস্ত, সাধারণ মানুষকে চুপ করিয়ে সাম্যবাদ কথাটাকেই অর্থহীন শব্দে পরিণত করেছে। আশাকরি গণতন্ত্রে কার? কি?এবং কতটা ক্ষমতা? সেটা বোঝাতে পেরেছি। 

14) আমাদের,সংবিধান সাধারণ মানুষকে,গণতন্ত্র দেয় নি। দেয় নি-- "স্বাধীনতা"। তার প্রথম প্রমাণ, --আমরা প্রকাশ্যে আমাদের মত জানাতে পারি না। আমাদের মত, তথা আমাদের ভোট গোপনে দিতে হয়। অর্থাৎ এই ভোট দানের মধ্য দিয়ে, আমাদের পরাধীনতার শুরু। আমাদের নেতা,নেত্রীরা সকলেই বলে থাকেন ভোট দান একটা পবিত্র কর্তব্য! এ কেমন,পবিত্র কর্তব্য! যা,গোপনে করতে হয়? সবাই জানেন-- মানুষ শুধুমাত্র অবৈধ এবং বেআইনী কাজ গোপনে করে। তাহলে কি বলতে,পারি না! এই গোপন ভোটদান পদ্ধতি আমাদের বেআইনী ও অবৈধ কাজ করতে বাধ্য করছে? এই (ভোট) মতদানের মধ্যেও,দলতান্ত্রিক দল ও দলের নেতারা,সাধারণ মানুষের ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন ঘটতে দেয় না। কখনো গায়ের জোরে,কখনো লোভ দেখিয়ে,আবার ইদানিং শোনা যায়-ই,ভি,এম মেশিনে গোলযোগ ঘটিয়ে আমাদের ইচ্ছার,এবং আমাদের স্বাধীনতার,অন্তর্জলি যাত্রা সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট। আর ও একটা কথা বলা প্রয়োজন,আমাদের আইনে,420 ধারা আছে! যে ধারায়, বলা আছে বিশ্বাস-ভঙ্গ প্রতারণা ধাপ্পাবাজি লোকঠকানো শাস্তি যোগ্য অপরাধ। অথচ আপনি!সেই বিশ্বাস করেই (ক বাবুকে) - (খ বাবুর) বিরুদ্ধে, ভোট দিয়ে ভোটে জেতালেন! আর(ক বাবু???) ভোটে জিতে হাসতে, হাসতে (খ বাবুর) সাথে হাত মিলিয়ে তার "কোলে" বসে পড়লেন! এটা কে, আপনি কি বলবেন? আপনি তো বিশ্বাস করে, ভোট দিয়ে (ক বাবুকে) জিতিয়েছেন! তাহলে এটা, কি আপনার সাথে,চিটিংবাজী!ধাপ্পাবাজি নয়? শুনেছেন কখনো? এই সব চিটারদের এক জনকেও,420 নং ধারায় অভিযুক্ত করে জেলে পাঠাতে??? না! কেউ শোনেন নি। আর কখনও শুনবেনও না। এই সঙ্গে আর একটা কথা মনে করিয়ে দেবো কিছু দিন আগে একটা আইন পাশ হয়েছে, যাতে বলা আছে, এই সব বিশ্বাস ঘাতকেরা,একজন, দু'জন দল-ত্যাগ করলে অপরাধ। কিন্তু, দলবেঁধে দল-ত্যাগ করা বৈধ। অর্থাৎ,দলবেঁধে চিটিং করা, অপরাধ নয়। আর,এ ক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি কানুন অন্ধ!!! দলতন্ত্রে, এই চিটিংবাজরাই দলের সম্পদ। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্রে এই লোক-ঠকানো দলের কোনো অস্তিত্ব-ই থাকবে না। থাকবে, মানুষ,থাকবে জনগণ। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্রে,নির্বাচিত সেবকেরা ভারতমাতার সন্তানদের জন্য কি, কি করবেন? প্রথমেই বলি : আমাদের ভারত-মাতা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে " বিত্তশালী" ধনবান ও শক্তিমান। হ্যাঁ আমি একদম সঠিক বলছি। আমাদের ভারত-মাতা সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশকে দয়া করার মতো সম্পদের মালিক। অনেকই হয়তো কথাটা শুনে হাসছেন। আমি বলবো না! হাসবেন না। আমি একে একে ভারত-মাতার' শক্তি এবং সম্পদের উল্লেখ করে তার,প্রমাণ দেবো। এই মূহুর্তে,ভারতমাতার সবচেয়ে বড় সম্পদ মাতার 137 কোটি সন্তান। এই 137 কোটি মানুষ দলতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীর কাছে,শুধু ভোট দেবার যন্ত্র। ভোটে জেতার পর,এই জনসংখ্যা তাদের কাছে জঞ্জাল এবং নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার একটা বাহানা। হ্যাঁ। 137 কোটি জনসংখ্যা, যে কোনো দেশের পক্ষেই বেশি,এবং এটা নিয়ন্ত্রণ করাটাও জরুরী। আমাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু, এই মুহূর্তে,দলতন্ত্রের কাছে যারা জঞ্জাল। ভারতবাদী গণতন্ত্রের কাছে ভারত-গঠনে তারাই, অমূল্য সম্পদ। 


15) স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এই দুটি বিষয়ে,দুই শ্রেণীর মতবাদ আছে। একশ্রেণীর মানুষের কাছে,স্বাধীনতা মানে : যা খুশি, তাই করা। (যেমন, ইচ্ছা মতো খুন করা,চুরি,ডাকাতি ইত্যাদি) যেটা যাবতীয় বন্য-প্রাণীদের মধ্যে বিদ্যমান। এটাকে বলে, পাশবিক-গণতান্ত্রিক-স্বাধীনতা। আর অপরটি হল মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য,মানুষের মানবিক গণতন্ত্র। যেটা শিক্ষিত মানুষের,চেতনা দ্বারা সৃষ্টি। এই গণতন্ত্র ইচ্ছা মতো যা খুশি, করতে শেখায় না। শেখায় মানবিকতা। শেখায় শিক্ষা,রুচি,শালীনতা সহ,পরস্পর পরষ্পরের প্রতি ভাতৃত্ববোধ। আমি ইতিপূর্বে বলেছি, সারা বিশ্বের মধ্যে সব থেকে "ধনবান "এবং "বলবান" আমাদের মাতা ভারত-মাতা। সারা বিশ্বের কোনো তথাকথিত, বাদা-শ্রিত দল বা দলতন্ত্র নয়। একমাত্র ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্র-ই পারে ভারত-মাতার এই মহাশক্তির বিকাশ ঘটাতে। এই বিকাশের মূল কারিগর ভারত-মাতার সন্তান, সাধারণ জনগন তথা জনশক্তি। এই শক্তির মূল চাহিদা,খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। সকলেই জানেন,উক্ত তিনটি শর্ত পুরন করার জন্য,আমাদের প্রতিটি মানুষেরই- চাই অর্থ অর্থাৎ টাকা। আর এই টাকার সম্পূর্ণ যোগান দেবে ভারতমাতা। শুধু,আমাদের নয় বিশ্বের প্রতিটি দলতন্ত্রের কাছে এই (137 কোটি) বিপুল জনসংখ্যা (শুধু মাত্র ভোটের সময় ছাড়া) অবাঞ্ছিত। আজ সারা বিশ্বের,প্রতিটি দলতান্ত্রিক সরকার যেখানে একে, একে জনতার কাজ (চাকরী) কেড়ে নিয়ে অনাহারে, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেখানে,ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন-গণতন্ত্রে আমাদের ভারত-মাতা দেশের এই (আনুমানিক) 100 কোটি মানুষের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে কাজ দেবে। বিঃ দ্রঃ- দেশে বিন্দুমাত্র কাজের অভাব নেই। ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্রে ২০ বছর বয়স হওয়া মাত্রই ছেলে এবং মেয়ে ভোট দেবার অধিকারী হবে। আর ভোটাধিকার, পাওয়ার দিন থেকে, তার ব্যঙ্কের খাতায় (আমৃত্যু) প্রতিমাসে, (10,000) দশ হাজার টাকা "ভাতা" হিসাবে জমা হবে। আর এই ভাতা পাওয়াটা, প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের আইন-সিদ্ধ- গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে ঘোষিত, হবে। তবে নগদ হিসাবে হাতে কোনো টাকা নয়। এই টাকা নাম অনুসারে, ভারত-মাতা প্রদত্ত ব্যাঙ্কের খাতায় জমা হবে। এবং প্রত্যেক ব্যক্তি টাকা,তোলা ও জমা শুধু মাত্র ATM এর মাধ্যমে করবেন। বাজারে কোনো কাগজের নোট বা ধাতব কয়েন থাকবে না। সারাবিশ্বে যতগুলি অপরাধ ঘটে বা আছে,তার 99.99% ভাগ অপরাধের সাথে,জড়িয়ে আছে অর্থ অর্থাৎ টাকা। বর্তমানে, আমরা সকলেই, টাকা রোজগার করি, শুধু মাত্র নিজে, এবং নিজের পরিবার-পরিজনদের (এক পুরুষের) জন্যে নয়। আগামী(14 পুরুষদের) জন্য। আর এই অপর্যাপ্ত সম্পদের লোভে,আমরা প্রতিনিয়ত টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে হারাচ্ছি,- বিবেক। হারাচ্ছি ---মনুষ্যত্ব। এই টাকা যদি কারো কাছে না থাকে এবং টাকা ছাড়াই যদি প্রতিটি মানুষ, তাদের যাবতীয় সুখ সাচ্ছন্দ ভোগ-বিলাস সহ, মানসিক চাহিদা পুরন করতে পারে,তাহলে নিশ্চয়ই তাদের নগদ টাকা বা অর্থের প্রয়োজন নেই। এবার স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে এই বিপুল অর্থ দেওয়া কি সম্ভব? তার উত্তর অবশ্যই সম্ভব। কারণ,,ভারতবাদী দলহীন স্বাধীন গণতন্ত্র গঠন হবার পর,সারা দেশের যাবতীয় ভূসম্পত্তি, কল-কারখানা ইত্যাদি স্থাবর,অ-স্থাবর সম্পত্তির এক মাত্র মালিক হবেন ভারতমাতা,। এবার নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না ভারতমাতার এই সমুদ্র সম সম্পদের দু'চার ঘড়া খরচ করলে, সমুদ্রের কিছুই যায় আসে না।

চলো,এগিয়ে চলি -সায়ন কর্মকার
Nov. 9, 2024 | যুক্তিবাদ | views:301 | likes:26 | share: 1 | comments:0

আমাদের সমাজব্যবস্থার মূল উপাদান হল মানুষ। আবার এই সমাজে মানুষ বৈচিত্র্যময়। আজ পর্যন্ত সভ্যতা যে এতদূর এগিয়ে এসেছে, সমাজ পাল্টেছে তা পুরোটাই যুক্তির উপর নির্ভর করে। সময় এগোচ্ছে, তার সাথে সাথে আমাদেরও উচিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা, সঠিক মূল্যবোধকে গ্রহণ করা। আর সেই অগ্রগতির ধারা হবে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারাকে ধারণ করে। আবেগে গা ভাসানো চলার স্রোতের প্রতিকূলে চিন্তাভাবনা করা কিছু মস্তিস্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাই আমাদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলে। গুটিকতক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাকে যখন আমরা, সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চায় তখন নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতা হয় যুগ যুগ ধরে আমাদের মস্তিষ্ক কোষে বাসা বেঁধে থাকা 'ধর্ম' নামক এক আফিমের নেশা, সামাজিক পরিবেশ, ভয়, লজ্জা ... ইত্যাদি ইত্যাদি। 

            যে সবকিছু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের আদর্শ ও মূল্যবোধে অবিচল থেকে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগে সফল হয়ে ওঠে একমাত্র সেই সাময়িক ভাবে সেই পরিস্থিতিতে সামাজিক পরিবেশের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলেও, ইতিহাসের পাতায় সে নায়ক রূপে বিদ্যমান থাকে। 

   সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগের এক গল্প আমি বলব। বলব আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। বলব 'ধর্ম' নামক এক নেশার ঘোর কাটিয়ে মরণোত্তর দেহদানের মধ্য দিয়ে এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ কৃতিত্বের গল্প।  

      

সাল ২০১৫, ৩০ ডিসেম্বর। 

তখন প্রায় দুপুর ২ টো। আমার ঠাকুমা, লীলাবতী কর্মকার নিজ বাড়িতে বয়সজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

         আমাদের পরিবার আগে থেকেই যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আদলে সংগঠিত। যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্দ্ধে আমাদের পরিবারের সদস্য। আমার বাবা, সঞ্জিৎ কর্মকার-এর হাত ধরেই আমাদের পরিবারে বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাপেক্ষে আমরা নাস্তিক হলেও, আমরা "মানবতাবাদী"। 

এই রকম একটি পারিবারিক পটভূমিকায় ঠাকুমার মৃত্যুর পর কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা ছিল আদর্শ, মূল্যবোধ থেকে সরে আসা, যা ছিল আমাদের পক্ষে লজ্জাজনক। আদর্শ ও নীতিবোধের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ঠাকুমার মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ মেডিকেল কলেজে দান (Donate) করা হবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই এবং ঠাকুমার ইচ্ছাতেই। 

        তবে সেদিন (৩০ ডিসেম্বর) আমাদের চিন্তাভাবনার বাস্তবিক প্রয়োগের পরীক্ষায় সফল হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। 

        যেহেতু ঠাকুমা বাড়িতে মারা গেছেন সেহেতু স্থানীয় হাসপাতাল থেকে থেকে ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। আবার অন্যদিকে মৃত্যু প্রমাণপত্র না পেলে মেডিকেল কলেজও বডি গ্রহণ করবে না। এই অবস্থায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় হাসপাতালের বি.এম.ও.এইচ., ড. দেবেশ নাথ। তাঁর পরামর্শে আমরা কালীগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে মৃত্যু শংসাপত্র প্রদানের দাবি জানাই। প্রধানের অনুপস্থিতিতে আমাদের উপপ্রধানের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। তিনি বলেন মৃতদেহ আগে দাহ করা হবে, তারপর মৃত্যু প্রমাণপত্র দেওয়া হবে, তার আগে নয়। শুরুতেই একটি ধাক্কা, তার উপর আমাদের পরিবার তথা আমাদের এলাকা থেকে প্রথম এমন একটি সমাজকল্যাণ মূলক কাজের জন্য একটি মাত্র কাগজের জোগাড় করার উপায় না পাওয়ায় পরিবারের মুখে এক অসহায়তার ছাপ ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায়, যোগাযোগ করা হয় যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে। প্রবীর দা বাবাকে বলেন, "তোমাকে ডেথ সার্টিফিকেট যে কোন প্রকারে জোগাড় করতেই হবে। সহজ রাস্তায় যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন লড়াই করো। লড়াই করে আদায় করতে হবে। " প্রবীর দা-র কথায় সাহস জুগিয়েছিল বাবাকে। এরপর বি. এম. ও. এইচ. ড. দেবেশ নাথ মারফৎ বি. ডি. ও. কে সব কিছু জানানো হয়। বি. ডি. ও.-র  সহযোগিতায় তখন গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মৃত্যু প্রমাণপত্র দিতে বাধ্য হয়। 


    তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইতিমধ্যে গোবড়াপোতা থেকে "শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান" নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উপস্থিত হয়, যেখানে ঠাকুমার চক্ষুদান করা হয়। অবশেষে মৃত্যু প্রমাণপত্র হাতে আসার পর শবদেহ নিয়ে রওনা হয়, কল্যাণীর "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" এর উদ্দেশ্যে। মেডিকেল কলেজে যখন মৃতদেহ নিয়ে হাজির, তখন সকাল। কোন সিনিয়র ডক্টর, প্রফেসর ছিলেন না। দেখা হয়েছিল এক জুনিয়র ডাক্তারের সাথে। তিনি মৃতদেহ পুরোপুরি ভাবে গ্রহণের কথা দিতে না পেরে বডি মেডিকেল কলেজে রেখেই, তিন দিন পর, ৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ তে আবার মেডিকেল কলেজে আসার কথা বলেন। যথারীতি যাওয়া হয় আবার। এবার সিনিয়র ডাক্তারকে দেখানো হয় মৃত্যু প্রমাণপত্র। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র সন্তুষ্ট করতে পারেনি ডাক্তারকে। সিনিয়র ডক্টর জানালেন কোন রেজিস্ট্রিকৃত ডাক্তার কর্তৃক অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্রই গ্রহণযোগ্য হবে এবং তখন বডি গ্রহণ করা হবে। কোন উপায় না দেখে, আমাদের গ্রামের এক প্র্যাকটিসিং হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, সুকদেব দত্ত- এর অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র নিয়ে আবার হাজির হতে হয় মেডিকেল কলেজে। এরপরও সেই সিনিয়র ডাক্তার হোমিওপ্যাথি-র অজুহাত দেখিয়ে মৃতদেহ গ্রহণ করতে নাকচ করে এবং মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেই সময় তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা। এই অবস্থায় ওই সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আমাদের বি. এম. ও. এইচ. এর ফোনে কথা বলানো হয়। শেষপর্যন্ত ঠাকুমার মৃতদেহ "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" স্বসম্মানে পুরোপুরি ভাবে গ্রহণ করে। 

      শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান মারফৎ কর্ণিয়া প্রদান করা হয় "প্রভা আই ব্যাঙ্ক" এ। সেদিন এক নৈতিক যুদ্ধ জয়লাভের স্বাদ গ্রহণ করেছিল আমাদের পরিবার। জয়ী হয়েছিল আমাদের আদর্শ। এক সাধারণ পরিবার, অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল সেদিন গ্রামবাসী তথা এই সমাজের কাছে। তাছাড়া আমাদের পরিবার কোন প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ- শান্তি অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি ভাবে বর্জন করেছিল। একজন যখন সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক কল্যাণমূলক কাজ করে তখন তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা হবেই জনমানসে। ঠাকুমার মরণোত্তর দেহদানের পর গ্রামবাসী দের মধ্যে এক বিস্তর সময় ধরে আলোচনা, সমালোচনা চলেছিল। অনেক মানুষের কাছে এক অভাবনীয় সাফল্য মনে হয়েছে,  আবার কিছু মানুষের কাছে ধর্মের আচার নস্যাৎ হওয়ায়  ভয়ে কুৎসাও রটিয়েছিল। যদিও কুৎসা রটানো লোকেদের বক্তব্য সেভাবে কারোর কাছে গুরুত্ব লাভ করেনি। 

সাল ২০১৯, ২০ জুলাই। 

আমার বড়ো জেঠু (বাবার বড়দা) , সনাতন কর্মকার প্রাণত্যাগ করেন। জেঠুর আগে থেকেই শারীরিক কিছু সমস্যা ছিল। রাত তখন ১০ টা হবে। জেঠুর শারীরিক অবস্থা শোচনীয় দেখে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। 

ঠাকুমার মতোই জেঠুর ও দেহদান করা হয়। জেঠুর সদিচ্ছাতেই করা হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে ঠাকুমার মতো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। হাসপাতালেই মারা যাওয়ার ফলে হাসপাতাল থেকেই মৃত্যু প্রমাণপত্র পাওয়া যায়।  কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা চক্ষুদান করতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও ওইসময় যোগাযোগ করা যায়নি চক্ষুদানের জন্য।  পরদিন জেঠুর মৃতদেহ দান করা হয় "মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে"। 


আমাদের পরিবার থেকে পরপর দুটি সফল মরণোত্তর দেহদানে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এক খুড়তুতো ঠাকুমারও চক্ষুদান করা হয়। ২০১৯ সালে ২৪ ডিসেম্বর আমার খুড়তুতো ঠাকুমা, দীপালি কর্মকার নিজ বাড়িতেই প্রাণত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে পূর্বে দেহদানের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শুধু চক্ষুদান করা হয়। এই কাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধু মঞ্জু কর্মকার। 

এই ঘটনাটি আমাদের পারিবারিক নয়। আমাদের এক সহযোদ্ধা, বাবার বন্ধু, শিবুরাম মন্ডল-এর লড়াই। তিনিও চেয়েছিলেন ধর্মের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে। 

সাল ২০২০,  ১০ অক্টোবর । 

রাত্রে নিজ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিবুরাম মন্ডল-এর মা, বীণা মন্ডল। গ্রামের এক ডাক্তার, সুদেব দাক্ষীৎ এর থেকে ডেথ সার্টিফিকেটও পাওয়া যায়। 

তবে COVID–19 এর মহামারীর প্রকোপে কোন মেডিকেল কলেজই শবদেহ গ্রহণ করেনি। চক্ষুদানও করা যায়নি। 

       এই পরিস্থিতিতে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুরে, গোরাবাজার শশ্মানে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ করা হয়। যেহেতু আমরা আত্মার অস্তিত্বকেই পুরোপুরি ভাবে নস্যাৎ করেছি, তাই সেক্ষেত্রে আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ শান্তি করাটাও বোকামির পরিচয়। সেকারণে মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে পুরোপুরিভাবে বর্জন করেছেন শিবুরাম মন্ডল। যদিও নিজে আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে শ্রাদ্ধ শান্তি থেকে বিরত থাকলেও নিজের ভাই বা দিদির ধর্মীয় কাজকর্মে কোন প্রকার বাধা দেননি। নিজের আদর্শ ও নীতিবোধের প্রতি অবিচল থেকেছেন শিবুরাম মন্ডল। 

  তবে গ্রামবাসীদের দাবি ছিল – শিবুরাম মন্ডল কেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টাও করা হয় শিবুরাম মন্ডল এর উপর। কিন্তু শিবুরাম মন্ডলের পাশে ছিল তার বাবা, নিত্যানন্দ মন্ডল। নিত্যানন্দ মন্ডল বলেন — "আমার ছেলে যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। পিতা-মাতার কর্তব্যের প্রতি তার কোন ত্রুটি আমি দেখিনি। সে তার আদর্শ থেকে সরে আসবে না। তার উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। " 

আমাদের সফলভাবে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়া, অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভয়, লজ্জা কাটিয়ে তারাও এই পথে এগিয়ে আসছে। বুঝতে শিখছে, দাহ বা কবর দেওয়ার থেকে মরণোত্তর দেহদান সমাজ কল্যাণের অগ্রগতির দিশারী। 


সৎকার-শ্রাদ্ধ বনাম দেহদান: প্রসঙ্গ যৌক্তিকতা -দেবস্মিতা
Nov. 9, 2024 | ব্রাহ্মণ্যবাদ | views:287 | likes:26 | share: 1 | comments:0

এইটুকু তো জীবন। চির অনিশ্চিত। কথায় আছে, আমরা মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।  জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা রবে! অথচ এই মাঝের সময়টুকু জুড়েই যত হল্লাহাটি। ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষ। সেই নিয়ে ব্যবসা করে চলে 'পুরোহিত' নামধারী একদল ব্যবসায়ী। বেঁচে থাকাকালীন ধর্মের পরকাষ্ঠায় মানুষকে ফাঁসিয়েই স্বস্তি নেই তাদের, মৃত্যুর পরেও জারি থাকে সে পরোয়ানা। জীবিত অবস্থায় ভগবান নামক এক পুতুলকে জ্যান্ত দেখিয়ে তার সেবা শুশ্রূষার মাধ্যমে লুঠ করা হয় সাধারণ মানুষের অর্থ। তার জন্য আছে হরেকরকম ফন্দি ফিকির। সারাজীবন ধরে 'পরকাল' নামক এক জুজুর ভয় দেখিয়ে চলে ব্রাহ্মণ সমাজ। ধর্মভীরু মানুষ বোকার মত মেনেও নেন সেসব। এ তো গেল জীবিত অবস্থার হুমকি। মৃত্যুর পরও রেহাই নেই কিন্তু। যখন কেউ মারা যাচ্ছে তখন তার পরিবারের ওপর দায় পড়ে সেই মৃত মানুষটিকে 'স্বর্গ' নামক এক ভ্রান্ত জায়গায় বসবাস করানোর। আর তার জন্য দরকার নাকি অনেক নিয়মের থুড়ি বেনিয়মের। যার গালভরা নাম 'পারলৌকিক ক্রিয়া'। এর লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষকে বোকা বানিয়ে আরও কিছু মোটা অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করা। মৃত মানুষ যাবেন নাকি স্বর্গে তাই তার জন্য খাবার দাবার, বিছানাপত্র, বাসনপত্র, পোশাক সমস্ত কিছু গুছিয়ে দিতে হবে। ধর্ম অনুযায়ী মানুষ নাকি এই মৃত্যুর পরবর্তী এই কয়েকদিন পৃথিবীতেই থাকে আর তারপর ব্রাহ্মণ নামক মধ্যস্থতাকারী আরও ভালো ভাষায় বললে দালালের সহায়তায় ঐসকল জিনিসপত্র সহযোগে স্বর্গবাসী হয়। যেদিন এসব হয় সেদিনকে বলা হয়  মৃত মানুষটির 'শ্রাদ্ধ'। আবার বেশ কিছু ব্রাহ্মণকে ভোজনও করানো হয় দক্ষিণা সহযোগে। সবচেয়ে যেটা হাস্যকর বাড়ির লোক মৃত মানুষের জন্য যেসব জিনিস দিলে তা গিয়ে শোভা পাচ্ছে ব্রাহ্মণদের ভিটেতে, কখনও তা দোকানে বিক্রি করে দিচ্ছে ব্রাক্ষণরা। তবে কি স্বর্গের ঠিকানা!?

এইসব নাটক শুরু হয় মানুষ মারা যাবার পরমুহূর্ত থেকেই। প্রথমে হয় তাকে পোড়ানো বা মুখে আগুন দেওয়া। এসব না করলে 'আত্মা' নামধারী একটি বস্তু যা নাকি মানুষের জীবিত শরীরে বিদ্যমান তার মুক্তি ঘটবে না। সে কুকুর, বিড়াল কিংবা কীট রূপে জন্ম নেবে পুনরায়। আর এই মুখে আগুন দিলে (যার পোশাকি নাম সৎকার) মৃতের আত্মার মুক্তি মিলবে। এ হচ্ছে মৃতের শরীরকে নিয়ে গল্প বানানোর প্রথম ধাপ কিংবা ঢপ। প্রথমে মুক্তি দিয়ে শুরু তারপর তাকে স্বর্গে পাঠানোর বন্দোবস্ত করানো। কতই না লাভের ব্যবসা!

            এবার প্রশ্ন হচ্ছে দুটো। এক, ধর্ম আমাদের বিপদে পড়লে বাঁচায়? করোনার পর কোনও ধর্মভীরু মানুষই আর জোর দিয়ে হ্যাঁ বলতে পারবেন না। কারণ ভগবান নিজেই করোনা থেকে বাঁচতে গৃহবন্দী। আর দুই, পরকাল ঠিক কি? কিছুই না। ব্রাহ্মণদের লোক ঠকিয়ে ব্যবসা করার এক রাস্তা। আবার প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই। তাহলে বিপদে পড়লে বাঁচায় কে? বিজ্ঞান। বর্তমানে হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। আমি, আপনি, আগামী প্রজন্ম সহ প্রতিটা মানুষ যাতে আরও বেশি সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে লড়তে পারে সেটার দেখভাল করে বিজ্ঞান। তাই যাতে চিকিৎসাবিজ্ঞান আরও উন্নত হতে পারে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে বৈকি এবং সেটা নিজেদেরই স্বার্থে। আমরা কম বেশি সকলেই জানি, মৃত্যুর পর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বিকল হয়ে যায় না। সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাহায্যে অন্য আরেকজন মানুষ নতুন জীবন পেতে পারে আবার সেই শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে হাতে-কলমে  শেখার মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে উন্নত জীবন দান করতে পারবে। বেশ কিছু সংস্থা আছে যারা দেহদান কিংবা অঙ্গদানের বিষয়টি দেখভাল করে। তাদের খবর দিলেই তারা সমস্ত বিষয়টির বন্দোবস্ত করে দেয়। তাছাড়া বেশিরভাগ শ্মশানেই দেখা যায় বি. আর. আম্বেদকরের দেহদান ও চক্ষুদান কেন্দ্র রয়েছে। এই মানুষটি সমাজের শ্রেনিবৈষম্য দূর করে বিজ্ঞানের পথে মানুষকে হাঁটাতে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু মানুষ বুঝলে তো! আজও অদ্ভুতভাবে শ্মশানে সেই সংস্থাগুলোর দফতর থাকে তালা দেওয়া। আর অন্যদিকে সেখানে পুরোহিতের মন্ত্রচ্চারণ, জাঁকজমক, ধোঁয়া সহযোগে মৃতদেহের 'সৎকার' থুড়ি ধর্মব্যবসা চলছে জোরকদমে। সমানতালে হচ্ছে পরিবেশদূষণও। কী না পরকালে পাঠানোর ব্যবস্থা! যার কোনও অস্তিত্বই নেই। 

        এবার ভাবুন, ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে মূর্খের মত এক শ্রেণীর মানুষের পকেট ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করবেন নাকি  বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে সামিল হবেন??


ইঞ্জিনিয়ারিং ইতিকথা -সৌরভ দেবনাথ
Nov. 9, 2024 | টেকনোলজি | views:302 | likes:28 | share: 1 | comments:0

ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রযুক্তিবিদ্যা বর্তমানে বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে এর সামান্য পার্থক্য আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ ভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় তেমন ছিলনা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আগে প্রযুক্তিবিদ্যা ছিল ঠেকে শেখার মত। প্রয়োজনের তাগিদ সবথেকে বড় তাগিদ। তাই গুহামানবদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে কারিগরিবিদ্যার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। চাকার ব্যবহার হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা মানবসভ্যতাকে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে দিয়েছে। এরপর আমরা দেখতে পাই প্রাচীনতম সভ্যতার কিছু নিদর্শন যা আমাদের বিস্মিত করে। মিশরের পিরামিড, পেরুর মাচুপিচু, ইস্টার দ্বীপের বৃহৎ সব মূর্তি, ভারতের চাঁদ বাওরি, রোমান স্থাপত্য, বন্যা রোধের জন্য মিশরের বাঁধ, রোমান জলাধার আরো অসংখ্য সব নিদর্শন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তাই এই সকল নিদর্শন যতই মানুষের দ্বারা অসম্ভব মনে হোক না কেনো (কিছু কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের মতে ভিনগ্রহীদের সাহায্যে এইসব বানানো হয়েছে) তা মানুষের কারিগরিবিদ্যার ফসল। 

              গ্যালিলিওকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের জনক। সবকিছু পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করার কথা তিনি বলতেন। তাঁর বানানো দূরবীন যখন তিনি রাতের আকাশের দিকে ফেরালেন সেটাই ছিল সম্ভবত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, গতির সূত্র এছাড়া আরো অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবির্ভাব হতে লাগলো। বিজ্ঞানকে বলা হতো প্রাকৃতিক দর্শন। এরপর থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনিয়ারিং গতি লাভ করে। ১৭৬০ এর সময় থেকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে ওঠে। তার সাথে প্রয়োজন হয়ে পড়ে দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানির। এছাড়া কম বিনিয়োগে বেশি লাভের আশা দেখতে শুরু করে কারখানার মালিকরা। প্রয়োজন হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। বাষ্পীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে থমাস নিউকোমেন বানালেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন। সেই ডিজাইন উন্নত করলেন জেমস ওয়াট। সেই শুরু ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে সভ্যতার অগ্রগতি। এরপর জর্জ স্টিফেনসন ও তাঁর পুত্র রবার্ট স্টিফেনসন যাত্রীবাহী রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। রকেট নামক লোকোমোটিভ ছিল তখনকার দ্রুততম যানবাহন। এগুলো সবই মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফল। এই ক্ষেত্রে যাঁদের কথা না বললেই নয় তাঁরা হলেন রুডলফ ডিজেলের ও নিকোলাস অটো। ডিজেল ইঞ্জিন ও পেট্রোল ইঞ্জিনের নাম আমরা সবাই মোটামুটি জানি। ডিজেল ও পেট্রোল ইঞ্জিনের উদ্ভাবক যথাক্রমে রুডলফ ডিজেল ও নিকোলাস অটো। এই দুই ইঞ্জিনকে বলা হয় ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন। অর্থাৎ জ্বালানী দহন করে তার দ্বারা উৎপন্ন গ্যাস পিস্টনকে ঠেলে দেয়। জার্মান উদ্ভাবক কার্ল বেঞ্জ ইঞ্জিনের ব্যবহার করে তৈরি করলেন প্রথম মোটরগাড়ি। 

              আমাদের বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। হৃৎপিণ্ড যেমন সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে এবং তা ব্যাহত হলে শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও যেন সেরকম। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জনজীবন থমকে যাবে। বর্তমানে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা হলো এ.সি. বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থারও একটা ইতিহাস আছে যা 'কারেন্ট ওয়ার ' নামে খ্যাত। সারা পৃথিবীতে এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁরা হলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদেরও একটা ইতিহাস আছে। প্রাচীন গ্রিকরা পশম ও অ্যাম্বার একে অপরের সাথে ঘষে দেখেছিল দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এটি ছিল স্থির তড়িৎ। এরপর প্রায় দুই হাজার বছর পর একই ঘটনা লক্ষ্য করেন রানী এলিজাবেথের ডাক্তার উইলিয়াম গিলবার্ট। এরপর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম তড়িৎকোষ বানালেন। সালফিউরিক অ্যাসিডে তামা ও দস্তার পাত দিয়ে বানালেন প্রথম ব্যাটারি যা ছিল রাসায়নিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর। এরপর মাইকেল ফ্যারাডে দেখলেন তার কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বক নিয়ে গেলে গ্যালভানোমিটারের কাঁটা নড়ে উঠছে। সেই ছিল বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরির প্রথম ধাপ। এছাড়াও বৈদ্যুতিক মোটরের ধারণাও তিনিই প্রথম দেন। এছাড়াও তড়িৎ ও চুম্বকত্ব একে অন্যের পরপূরক তা তিনিই প্রথম বলেন। কিন্তু রয়্যাল সোসাইটি প্রথমে মেনে নেয়নি। তার উদ্ধারকারী হিসেবে এলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। যিনি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে দেখালেন ফ্যারাডের তত্ত্বকে। ফ্যারাডের শিক্ষক স্যার হামফ্রে ডেভি ভোল্টাইক কোষ দিয়ে আর্ক ল্যাম্প বানানোর প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু তা ছিল প্রচুর উজ্জ্বল ও ক্ষণস্থায়ী। এরপর আমেরিকান উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতি বানালেন। তিনি কয়লাশক্তি পরিচালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও বানালেন। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল ডি.সি বা ডাইরেক্ট কারেন্ট। কিন্তু ডি.সি ব্যবস্থায় অসুবিধা হলো তড়িৎ পরিবাহীর প্রস্থছেদ অনেক বেশি হতে হবে এবং তা খুব বেশি দূর পর্যন্ত তড়িৎ পরিবহনে অক্ষম। সেই সময় মাঠে নামলেন আরেক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জর্জ ওয়েস্টিংহাউস। তিনি তার এ.সি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট ব্যবস্থা প্রসারে বদ্ধ পরিকর। পরবর্তীকালে তিনি পাশে পেয়েছিলেন এডিসনের জেনারেল ইলেকট্রিক ত্যাগ করা সাইবেরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার নিকোলা টেসলাকে। নিকোলা টেসলা তিন ফেজের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার জনক। তাছাড়া তিন ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর ও এক ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর উদ্ভাবন করেন। এই এ.সি বিদ্যুতের সুবিধা হলো উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বহু দূরে বিদ্যুৎ প্রেরণ করা যায় বিদ্যুৎ অপচয় কম করে ও স্বল্প প্রস্থের তার ব্যবহার করে। ট্রান্সফরমার যন্ত্রের সাহায্যে ইচ্ছে মত ভোল্টেজ বাড়ানো বা কমানো যায়। এই টেসলার  জন্যই ওয়েস্টিংহাউস কারেন্ট যুদ্ধে জিতে যান যার ফল স্বরূপ এখনো এ.সি ব্যবস্থাই আমরা দেখতে পাই। 

              ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দৌলতে আরেকটি বিভাগ একটু একটু করে বাড়তে থাকে যা হলো কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। বহুদূরে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল চিঠি আদান প্রদান। তারের মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবহনকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হলো টেলিগ্রাফ। চার্লস হুইটস্টোন প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ পেটেন্ট করান। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল উদ্ভাবন করলেন টেলিফোন। ম্যাক্সওয়েল লক্ষ্য করেছিলেন পরিবর্তনশীল তড়িৎক্ষেত্র ও পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র একে অপরের উৎপাদনের জন্য দায়ী। এই পরিবর্তন তরঙ্গের আকারে একটি নির্দিষ্ট গতিতে উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে যা আলোর গতির সমান। বিজ্ঞানের জগতে এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। বিজ্ঞানের আলাদা দুই তত্ত্বকে (আলো ও তড়িৎচুম্বকত্ব) এক সূত্রে গেঁথে দিলেন। একদিকে যেমন আপেক্ষিকতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করলেন অপরদিকে খুলে দিলেন যোগাযোগ ব্যবস্থার দুয়ার। প্রথমে তা গণিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ প্রথম খুঁজে পেলেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। মানব সভ্যতা আয়ত্ত করলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ গতি, আলোর গতি। মার্কনি অ্যান্টেনা বানিয়ে আটলান্টিকের পেরিয়ে রেডিও তরঙ্গ পাঠাতে সক্ষম হলেন। 

              বর্তমানে জটিল সব গাণিতিক সমাধান দ্রুত সম্ভব হচ্ছে ক্যালকুলেটরের দৌলতে। এছাড়া বিজ্ঞানের সকল গণনা, সিমুলেশন সব সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জন্য। এছাড়াও বর্তমান ল্যাপটপ, মোবাইলের শক্তিশালী প্রসেসরের বাহারী সব নাম আমরা শুনতে পাই সেই সবই সম্ভব হয়েছে ট্রানজিস্টর নামক যন্ত্রের আবিষ্কারের জন্য। এই ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের আগে যে যন্ত্র ব্যবহার হতো তা হলো ভ্যাকুম টিউব। এই ভ্যাকুম টিউবের আরেকটি ব্যবহার হলো বৈদ্যুতিক সংকেত বর্ধিত করা। কিন্তু তাতে প্রচুর বৈদ্যুতিক শক্তিক্ষয় হতো। ১৯৪৮ সালে জন বারডিন, উইলিয়াম শকলে ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেন আবিষ্কার করেন ট্রানজিস্টর। ১৯৫৬ সালে তিনজনই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর বৈদ্যুতিক বর্তনী অনেক ছোট এবং কম বৈদ্যুতিক ক্ষমতা সম্পন্ন বানানো সম্ভব হয়েছে। এরপর জ্যাক কিলবি তৈরি করেন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। ধীরে ধীরে ট্রানজিস্টরের আকার ছোট হতে থাকে। এরপর আমেরিকার ইনটেল কোম্পানি ১৯৭১ সালে বানায় তাদের প্রথম প্রসেসর ইনটেল ৪০০৪। এরপর আরো শক্তিশালী প্রসেসর তৈরি হতে থাকে যার ফসল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের অতি দ্রুত গণনক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ। 

              ১৯০৩ সালে রাইট ভাতৃদ্বয় প্রথম আকাশে ওড়েন। সেই ছিল প্রথম বিমান আবিষ্কার। এর মাত্র ৬৬ বছর পর ১৯৬৯ সালে নাসা প্রথম চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠাতে সক্ষম হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ত্বরণ প্রদান করেছিল। কিন্তু এতসব কিছুই সম্ভব ছিলনা ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। দৈনন্দিন আরামদায়ক জীবনের কথা বাদ দিলেও বর্তমানে বিজ্ঞানের গভীর কিছু প্রশ্ন যেমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি, মহাকাশ গবেষণা এইসব কোনো কিছুই ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৯০ তে নাসা মহাকাশে পাঠায় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এখনো পর্যন্ত এটা থেকে প্রায় ষোলো হাজার রিসার্চ পেপার বের হয়। ২০১৫ তে আবিষ্কার হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্ৰ্যাভিটেশনাল ওয়েভ যা প্রমাণ করল আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎবাণী, ২০১৯ সালে আমরা দেখতে পেলাম কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি, সার্নের কণা ত্বরণ যন্ত্র তো বিজ্ঞানের জগতে এক দুর্দান্ত আবিষ্কার যা বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় অনবদ্য অবদান রেখেছে। আর এই সবকিছুই অসম্ভব রয়ে যেত ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মূল ভিত্তিই হলো পরীক্ষার দ্বারা যাচাই করা। আর বিজ্ঞানীরা ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর পরীক্ষার যন্ত্রপাতির জন্য সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল। অপরদিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং অন্ধের যষ্ঠী ছাড়া পথ চলার মত। তাই বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং একে অন্যের পরিপূরক। একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। 

ঈশ্বর কি সর্বশক্তিমান? -পলাশ বাউরি
Nov. 9, 2024 | নাস্তিকতা | views:627 | likes:27 | share: 0 | comments:0

আমাদের বাড়ির পাশের চা দোকানে দুজন বৃদ্ধ কী বিষয়ে যেন তর্ক করছিল। কাছে গিয়ে মন দিয়ে শুনতেই বুঝলাম তাঁরা ঈশ্বর নিয়ে তর্ক করছে। একজন বৃদ্ধ বলছে যে ঈশ্বর নাকি সর্বশক্তিমান এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন। আরেকজন বৃদ্ধ বলছে যে এটা কোনো মতেই সম্ভব নয়, নিশ্চয়ই তার শক্তির কোন সীমা আছে, আর তা যদি নাই থাকত তাহলে তিনি কেন পৃথিবীর সব খারাপ লোকগুলোকে সরিয়ে ফেলছেন না। এভাবেই চলছিল তাদের যৌক্তিক অযৌক্তিক সম্বলিত তর্ক। আমি কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেই আমারও মনে প্রশ্ন জাগল, যদি সত্যিই ঈশ্বর বলে কিছু থাকে তাহলে সেই ঈশ্বর কি সর্বশক্তিমান যেমনটি ধর্মগ্রন্থগুলিতে দাবি করা হয়?

ইন্টারনেট পাড়ায় এবিষয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই খোঁজ পেলাম “সর্বশক্তিমান প্যারাডক্সের”, যা মনে হল আমাদের এই আলোচনাতে সাহায্য করবে। তবে শুরু করার আগে আমাদের এই লেখার খাতিরে ধরে নিতে হবে যে, ঈশ্বর বলে সত্যিই কিছু আছে (তাদেরর জন্য যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না) । তবে প্যারাডক্সটি বোঝার আগে,  ‘প্যারাডক্স’ আসলে কি সেটা জেনে নেওয়া উচিত। 

প্যারাডক্স (Paradox) বা বাংলা অর্থে কূটাভাস এককথায় হল একটি অসঙ্গতি। সাধারণত প্যারাডক্স বলা হয় সেই সব বাক্য বা উক্তিকে যা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। নিজের বক্তব্যের সাথে নিজেই সংঘর্ষ করে, এই হল প্যারাডক্স। একটা উদাহরণ দিলে ব্যপারটা আরেকটু সহজভাবে বোঝা যাবে - 

ধরো, আমি তোমাকে নিচের দুটি বাক্য লিখে দিলাম - 

১। নিচের লাইনটি সত্য। 

২। উপরের লাইনটি মিথ্যা।  

এবার বলতো উপরের কোন লাইনটি সত্য? প্রথম বাক্যটি সত্য হলে দ্বিতীয় বাক্যটি মিথ্যা;  আবার যদি দ্বিতীয় বাক্যটি সত্যি হয় তাহলে প্রথম বাক্যটি মিথ্যা। প্রথম দেখায় ব্যপারটা সহজ মনে হলেও, আসলে এগুলো একটা অন্তহীন চক্রের মতো। মাথায় একটু জোর দিয়ে ভাবলেই দেখবে একেবারে মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম হয়ে যাবে। অনেকে  প্যারাডক্সকে ধাঁধার সাথে তুলনা করে কিন্তু আমার মনে হয় এটাকে ঠিক ধাঁধা বলা চলে না। 


আশা করি, প্যারাডক্স কী সেটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, এবার চলো তাহলে আমাদের মুল আলোচনা সর্বশক্তিমান  প্যারাডক্সে ফেরা যাক। 

আমরা সব ধর্মগ্রন্থ এমনকি লোকমুখে শুনেও অভ্যস্থ যে ঈশ্বর বর্তমান এবং তিনি নাকি সর্বশক্তিমান, তিনি সবকিছুই করতে পারেন। আচ্ছা এটা যদি সত্যি হয় তাহলে ঈশ্বর কি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম? নিজেই ভেবে দেখো...

এটিই হল ঈশ্বর প্যারাডক্স বা গড প্যারাডক্স বা সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স। ভেবে দেখো যদি ঈশ্বর এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না, তাহলে এমন একটি কাজের সন্ধান পেলাম যেটা ঈশ্বর করতে পারেন না। 

আবার যদি তেমন একটি পাথর তৈরিতে তিনি অক্ষম হন তাহলে সহজভাবেই আমরা এমন আরেকটি কাজের সন্ধান পেলাম যেটা ঈশ্বর করতে পারেন না। 

পূর্বোক্ত একটি উক্তিও যদি সত্য হয় তাহলে বলা চলে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নয়। 

যুক্তিবিজ্ঞানে কোন জটিল সমস্যাকে সমাধানের জন্য সেটাকে অনেক ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা হয়, চলো আমরাও সেটাই চেষ্টা করি - 

সর্বশক্তিমান প্যারাডক্সের মুল প্রশ্নটি হল - যদি ঈশ্বর সবকিছু করতে সক্ষম হন তাহলে কি তিনি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম? 

প্রশ্নটিকে যদি আমরা একটি বাক্যে প্রকাশ করি তাহলে সেটা কিছুটা হবে এইরূপ – ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন, অর্থাৎ তিনি এমন একটি ভারি পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যেটা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম। 

বাক্যটিকে যদি কয়েকটি খণ্ডবাক্যে বিভক্ত করি - 

১। ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন। 

২। ঈশ্বর সবকিছু তুলতে পারেন। (কারণ ১ম বাক্য) 

৩। ঈশ্বর একটি ভারি পাথর তৈরি করতে পারেন যেটি তুলতে তিনি অক্ষম। (কারণ ১ম বাক্য) 

৪। ঈশ্বর তার তৈরি করা পাথর তুলতে পারবেন না। (কারণ তিনি এমন একটি ভারি পাথর তৈরি করেছেন যেটি তিনি তুলতে অক্ষম) 

১ম, ২য় এবং ৩য় বাক্যগুলিকে সর্বদা সত্যি হতে হবে। এবার আমাদের দেখতে হবে যে ৪র্থ বাক্যটি সত্য কিনা? 

যদি ৪র্থ বাক্যটি সত্য হয় তাহলে ২য় বাক্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে অর্থাৎ ১ম বাক্যটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে। 

৪র্থ বাক্যটি সত্যি হলে (যা ৩য় বাক্যটি সত্য হলে হবেই) ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান হওয়ার পথে মুল যুক্তি “ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন” মিথ্যা হয়ে যাবে। এখন স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ঈশ্বর কখনই দুটি পরস্পর বিরোধী কাজ করতে পারেন না, যথাক্রমে ২য় ও ৪র্থ বাক্য। অর্থাৎ ঈশ্বর সবকিছু করতে পারেন না অতএব ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নয়। 

আবার আস্তিকেরা বলবেন যে এইসবকিছু আলোচনা স্ট্রম্যান ফ্যালাসি দ্বারা আক্রান্ত, তাই আমাদের উচিত কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে আস্তিকদের যুক্তিগুলিও শোনা। 

প্রথমে আস্তিকেরা যেটা বলবে সেটা হল সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স নাস্তিকদের একটি কুযুক্তিমাত্র এবং এর প্রধান উক্তির প্রশ্নটিই ভুল প্রশ্ন। উদাহরণ হিসাবে তারা বলবে যে, কোন চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি কেন চুরি করেছো, বলো”। এবার এই প্রশ্নের উত্তরে ওই ব্যাক্তি যাই বলুক না কেন, সে চোর সাব্যস্ত হবেই। ওই ব্যাক্তি যদি দোষী না হয়ে থাকে তাহলে তার একমাত্র যুক্তিপূর্ণ উত্তর হতে পারে, প্রশ্নটির ত্রুটি প্রশ্নকর্তাকে ধরিয়ে দেওয়া। 

আস্তিকেরা আরও বলবেন যে, যখন তাঁরা বলেন যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তখন তাঁরা সেটির আক্ষরিক অর্থ বোঝান না বরং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও পরিচালনার জন্য যে অসীম ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, ঈশ্বর সেই অসীম শক্তিরই আধান মনে করা হয়। 

তারা বলেন যে ঈশ্বর ও শক্তি দুয়েই অসীম। তাকে কোনো বাঁধাধরা সীমারেখার মধ্যে ফেলা যায় না। যদি তিনি ইচ্ছা করেন যে এমন একটি ভারি পাথর তৈরি করবেন তাহলে তিনি সমান্তরালভাবে একইসাথে উত্তোলনযোগ্য শক্তিশালীও থাকবেন আবার অনুত্তোলনযোগ্য দুর্বলও থাকবেন। আস্তিকেরা বলেন যে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের শক্তি আমাদের মত সাধারণ মানুষের সীমিত বোধগম্যতার বাইরে, কারণ সাধারণ মানুষের যুক্তিবিচার অর্থাৎ যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌছানোর প্রক্রিয়া খোদ ঈশ্বরেরই সৃষ্টি। 

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স একেবারেই ত্রুটিহীন নয়। আবার আস্তিকদের যুক্তিহীন যুক্তিও মেনে নেওয়া যায় না। আস্তিকদের যুক্তি খণ্ডন করতে হলে আমাদের আগে ঈশ্বর আছে কি নেই তার সিদ্ধান্তে আসতে হবে, তবে সে বিষয় যুক্ত করে আমার এই আলোচনার আকার বৃদ্ধি করে আমার পাঠকদের আর কষ্ট দিতে চাই না। তাছাড়া এবিষয়ে ইন্টারনেট পাড়ায় বহু নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও বই ইতিমধ্যে বর্তমান আছে, যাদের মধ্যে প্রবীর ঘোষের ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা?’ বইটির কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। এই বইতে লেখক আস্তিকদের বিভিন্ন মতবাদকে যুক্তিপূর্ণভাবে খণ্ডন করেছেন। 

আবার যদি আমাদের মুল আলোচনার সিদ্ধান্তের কথায় আসি তবে আমাকে বাধ্য হয়ে বলতেই হয় শেষ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ  নির্ভর করছে তোমার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস ও মতবাদের উপর কারণ আস্তিকদের মতবাদ ও বিশ্বাস এবং নাস্তিকদের সর্বশক্তিমান প্যারাডক্স কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিহীন নয়। তোমার যদি বিশ্বাস হয় ঈশ্বরে তাহলে তোমার কাছে ঈশ্বর বর্তমান ও তিনিই সর্বশক্তিমান এবং তোমার যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তাহলে তোমার কাছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই তাই সর্বশক্তিমান হওয়ারও কোনো প্রশ্নই নেই। 

তবে আমার ব্যাক্তিগত মত যে কোনো বিশ্বাস বা মতবাদের পক্ষে কট্টরপন্থী হওয়া উচিত নয়। আমাদের বিজ্ঞানের মত নমনীয় বা ফ্লেক্সিবেল হওয়া উচিত। যেমন বিজ্ঞান কয়েকবছর আগে পর্যন্ত বলত যে অনুই পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ কিন্তু পরবর্তীকালে তা ভুল প্রমাণিত হলে বিজ্ঞান তার ভুল শুধরে নিতে একবারও দ্বিধাবোধ করেনি। আমাদেরও এমনি হওয়া উচিত। নিজের মতবাদ বা বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হলে সেটিকে শুধরে নিতে দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়, তবেই না গড়ে উঠবে এক সুন্দর সুস্থ পৃথিবী। 


চলো যাই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়ি -সন্তোষ শর্মা
Nov. 9, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:911 | likes:63 | share: 53 | comments:0

যে কোন ধরণের ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেওয়ার দৈব-চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মছলন্দপুরে ঘোষপুরের চারাবটতলা। শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের নাম ঐ অঞ্চলে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ নামে প্রসিদ্ধ। ইনি যে কোন ভাঙ্গা হাড় শুধুমাত্র দৈব-চিকিৎসার মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে থাকনে। এই খবর কানে আসার পর আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ-এর নেতৃতে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব-চিকিৎসার বুজরুকি ফাঁস করার জন্য একটি প্ল্যান তৈরি করলাম।  


শনিবার ২৮ অক্টোবর ২০০৬

সকালে আমাকে নিজের বাঁ হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধতে দেখে ছোট বোন শান্তি জিজ্ঞেস করল, “সন্তোষদা হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ বাঁধছো কেন?”

বললাম, “হাতে ছোট লেগেছে। ব্যাথা করছে। ডাক্তারের কাছে যাবো বলে ব্যান্ডেজ বাঁধছি। ”

একটু পরে প্রবীর বাবু ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, “যেভাবে বলেছিলাম, সেইভাবে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধেছ? চুলদাড়ি কাটনি তো?”

আমি বললাম,  “আপনার প্ল্যান মাফিক কাজ করছি। ”

তিনি বললেন, “শোন, কলকাতার মানিকতলা থেকে শংকর ভড়ও তোমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু তোমার দু’জনে আলাদ-আলাদভাবে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়িতে যাবে। এমনভাবে থাকেব, দেখে মনে হবে, তোমরা একে-অপরকে চেন না। ঠিক করে যাবে। যদি কোনও ধরণের বিপদ হলে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে ফোনে খবর দেবে। ”

বাঁ হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে, একটি মোটা সুতোর সঙ্গে হাত গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। এই অবস্থায় আমি বাড়ির কাছের বাসস্টপ কুন্ডুবাড়ি থেকে বাসে ধরে প্রথমে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত রেল স্টেশনে পৌছালাম। সেখান থেকে বনগাঁও লোকাল ট্রেন ধরে মছলন্দপুর স্টেশনে নামলাম। স্টেশনের বাইরে বেড়িয়ে দেখি ভ্যান চালকেরা হাঁক পারছে, “কেউ কি ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়িতে যাবেন। ”

কয়েকজন একসাথে ভ্যানে উঠে পরলাম। সহযাত্রীদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, এঁরাও দৈব চিকিৎসার জন্য ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র কাছে যাচ্ছেন। 

প্রায় ১০ মিনিট পর ঘোষপুরের চারাবটতলায় অবস্থিত ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র কাছে নামলাম। ভাড়া নেওয়ার সময় ভ্যান চালক বললেন, “ বুড়ি’মার কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার জন্য সরসে তেল ও কালো সুতো নিয়ে যাবেন। ”

বললাম, “আমি তো এই জিনিস তো আনিনি। তাহলে কি হবে?”

ভ্যান চালক বললেন, “চিন্তা করবেন না বাবু। ঐ যে ছোট্ট মুদির দোকান দেখতে পারছেন। ওখানেই তেল-সুত পাওয়া যায়। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। চার টাকা দিন আমি নিজেই কিনে এনে দিচ্ছি। ”


 

১০ টাকার একটি নোট বের করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ফিরে এসে আমার হাতে একটা ছোট তেলের শিশি এবং একহাত লম্বা কালো সুতো দিলেন। 

মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ল একটি কুঁড়েঘর। বাড়ির সামনে উঠেন প্রায় ৫০০ লোকের ভিড়। কেউ বাঁ ভ্যানে করে, কেউ বাঁ কোলে চড়ে, কেউ লাঠিতে ভর করে এসেছেন। একজন যুবক এগিয়ে এসে বলল, “আপনি কি ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ মার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছেন?”

বললাম, “হ্যাঁ, বাঁ হাতে সমস্যা। ”

 ‘সরিষা তেলের শিশি এনেছেন কি?’ সে জিজ্ঞেস করল। 

বললাম -হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি। 

যুবকটি বলল, “ঐ যে তেলের শিশির লাইন দেখছেন। ঐ লাইনে আপনার শিশিটি রেখে দিন। আপনাকে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে  হবে না। ” 

একটু পরে শংকরদা এলেন। তিনিও সরিষা তেলের শিশি লাইনে রেখে এক কোনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখি তাঁর ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা। 

এদিকে সূর্য মাথার উপরে উঠে গেছে। রুগীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। শিশির লাইন একটু-একটু করে বুড়ি’মার ঘরের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমার শিশি বুড়িমার সামনে পৌছাল। দেখলাম, প্রায় ৬০ বছর বয়স্ক এক মহিলা। তাঁর মাথায় সাড়ির আঁচাল দেওয়া। তাহলে ইনিই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’। আসল নাম লক্ষ্মী মণ্ডল। কিন্তু ঐ অঞ্চলে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ নামে প্রসিদ্ধ। ইনি হাড় ভাঙ্গার দৈব চিকিৎসা করে থাকেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বুড়ি’মার সামনে উবু হয়ে বসলাম। বুড়ি’মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি সমস্যা?”

আমি বললাম, “সাইকেল থেকে পরে বাঁ হাতে চোট পেয়েছি। এক্স-রে করিয়ে দেখেছি, হাড়ে চির ধরেছে। প্রচন্ড ব্যাথা। লোকমুখে শুনেছি, আপনি দৈব ক্ষমতায় ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেন। তাই চিকিৎসার আশায় হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে এতদূরে ছুটে এলাম। ”

আমার বাঁ হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে বুড়ি’মা বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। হাতে তিন বার ফুঁ দিলেন। ছোট তেলের শিশির ঢাকনা খুলে তাতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। শিশি থেকে একটু তেল নিয়ে আমার বাঁ হাতে মালিশ করলেন। এরপর আমার গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দেন। এবং বাকি সুতটি একটি হেসুয়া দিয়ে কেটে দিলেন। 

আমরা হাতে তেলের শিশিটি দিয়ে বুড়ি’মা বললেন, “এটা মত্রপুত তেল। এই তেল দিয়ে মালিশ করবেন। গরম সেঁক দেবেন। ”

আমি বললাম, “হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা। ব্যাথার ওষুধ খাচ্ছি। এই তেল ও শেকড় দিয়ে আমরা হাত ঠিক হয়ে যাবে তো?”

বুড়ি’মা মাথা নাড়িয়ে বললেন, “আমার দৈব ওষুধ বিফলে যাবে না। এখন থেকে আর কোন ওষুধ খেতে হবে না। গলায় ঝলানো এই শিকড় সব ব্যাথা শুষে নেবে। চিন্তা করো না। ”


জিজ্ঞেস করলাম, “এই চিকিৎসার জন্য কত টাকা দিয়ে হবে। ”

“আমি এই দৈব চিকিৎসার পরিবর্তে এক টাকা নিই না। আপনার যদি ইচ্ছে হয় তাহলে মায়ের দানবাক্সে কিছু দান কারুন। ” বুড়িমা বললেন। 

একটি ১০ টাকার নোট দানবাক্সে ফেলে বেড়িয়ে এলাম। দৈব চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মার বাড়িতে আজ প্রায় ৫০০ লোকের ভিড়। হিসেব করে দেখলাম, “আমার মত প্রত্যেকে যদি ১০ টাকা করে দেয়, তাহলে একদিনে বুড়ি’মার ৫০০০ টাকা আয় হবে! তাহলে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মিলিয়ে মাসে কত টাকা আয় হচ্ছে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মা সেটা পাঠকরাই হিসেব করুন। ”

এরপর শিশির লাইনে মধ্যমে শংকরদা এগিয়ে গেলেন। 

বুড়ি’মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”

বামপায়ের পায়জামাটা একটু উপরে তুলে শংকরদা বললেন, “কাল রাতে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পা পিছলে পড়ে যাই। এক্স-রে করিয়ে জানতে পারি হাড়ে চির ধরেছে। আমি পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে কোলকাতা থেকে আপনার কাছে দৌড়ে এসেছি মা। ”

বুড়ি’মা বললেন, “পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলুন। ”

বুড়ি’মা বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। তিন বার ফুঁ দিলেন। শিশির ঢাকনা খুলে তাতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দিলেন। বাকি সুতাটি একটি হেসুয়া দিয়ে কেটে দিলেন। 

শংকরদা হাতে শিশিটি দিয়ে বুড়িমা বললেন, “এই মন্ত্র পড়া তেল দিনে পায়ে মালিশ করবেন। গরম সেঁক দেবেন। কোন ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। হাড়ের চির জুড়ে যাবে। ”

এখনে উপস্থিত প্রত্যেক রোগীকেই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মা একই পদ্ধতিতে অলৌকিক চিকিৎসা করে চলেছেন। 

এদিকে আমি ও শংকরদা ভ্যানে করে মছলন্দপুর স্টেশনে ফিরে এলাম। এখান থেকে সিয়ালদাহগামী ট্রেনে উঠে বসলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে শিয়ালদহতে নেমে দু’জনে পায়ে হেঁটে ৩৩এ ক্রিক রো, মৌলালি, কলকাতায় অবস্থিত যুক্তিবাদী সমিতি’র স্টাডি ক্লাসে পৌছালাম। 

এই স্টাডি ক্লাসে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন প্রবীর বাবু। তিনি আমার ও শংকরদার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, “আজকের আলোচনার বিষয় -চলো যাই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়ি। 

আমি বললাম, “প্রবীর বাবুর নেতৃতে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব-চিকিৎসার বুজরুকি ফাঁস করার জন্য একটি প্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। তাই আমি ও শংকরদা দু’জনে নিজেকে হাড় ভাঙ্গা রোগী হিসাবে অলৌকিক চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়িমা’ অর্থাৎ  লক্ষ্মী মণ্ডলকে দেখাই। আমি বাঁ হাতে এবং শংকরদা বাঁ পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে বুড়ি’মার কাছে গিয়েছিলাম। মজার বিষয় হলে, বুড়ি’মা শুধুমাত্র হাতে বা পায়ে বাঁধা ব্যান্ডেজ খুলেই তাঁর ‘দিব্যদৃষ্টি’ দিয়ে দেখে নিচ্ছেন, হাড় ভেঙ্গেছে কি না। রুগীর হাড় জোড়া দিতে এই শিশির সরষে তেল ও গলায় এই শেকড় বেঁধে দিচ্ছেন। এখন থেকে আর ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। ”


 


শংকরদা বললেন, “প্রবীর বাবুর প্ল্যানমাফিক বাড়ি থেকেই আমি ও সন্তোষ দু’জনে পায়ে ও হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে গেছিলাম। আমাদের মুখের কথাতেই বুড়ি’মা ভাঙ্গা হাড় জোড়া দেওয়ার জন্য মন্ত্র পড়লেন, ফুঁ দিলেন। গলায় শিকড় বেঁধে দেলেন। আসলে ঐ বুড়ি’মার কাছে কোনও ‘দিব্যদৃষ্টি’ নেই। থাকলে বুঝতে পারতেন, আমাদের হাতে-পায়ের হাড়ে কোনও চির ধরেনি। পড়ে গিয়ে হাড়ে চিরটা একটি সাজানো গল্প। ”

আমাদের কাছে থেকে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বিস্তারিত ঘটনা শুনে প্রবীর বাবু বললেন, “এই প্রতারক দৈব চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে হবে। ”  


বৃহস্পতিবার ২ নভেম্বর ২০০৬

ভাবতে অবাক লাগে আজও আনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, তেলপড়া, শেকড়-বাকড়, দৈব ও অলৌকিক চিকিৎসায় বিশ্বাস করে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র মতন বুজরুকের কাছে প্রতারনার শিকার হচ্ছেন। এই সব বুজরুকদের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য আমরা যুক্তিবাদীরা সব সময় তৈরি আছি। এই বুজরুকদের শুধু মুখোশ খুলে দিলেই হবে না। চিকিৎসার নামে সাধারণ মানুষের জীবন নেই ছিনিমিনি খেলা এই বুজরুকের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানবার প্রয়োজন। 

ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুসারে, দৈব উপায়ে যে কোন রোগের চিকিৎসা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন অনুসারে, ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ ছাড়া যদি কেউ (‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র মত) তেলপড়া, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, শিকড় ইত্যাদি দিয়ে ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেওয়া অথবা যে কোন রোগের দৈব চিকিৎসা করার দাবি করেন তাহলে তাঁর জেল ও জরিমানা দুই হবে। 

আজও এই রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে সঠিক চিকিৎসা পরিসেবা মেলে না। আর্থিক এবং অন্ধবিশ্বাসে ডুবে থেকে মানুষ দৈব চিকিৎসার চক্করে পড়ে নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনেন। অন্য দিকে, প্রকাশ্যে বুজরুকি ব্যবসা চল্লেও পুলিশ ও প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ফলে, বুজরুকি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। এমন অবস্থায় দায়িত্ব বাড়ে আমরা যুক্তিবাদীদের। 

শেষ পর্যন্ত যুক্তিবাদী সমিতি’র নেতা শংকর ভড় একজন রুগী হিসাবে উঃ ২৪ পরগনা জেলার সুপারিটেডেন্ট অফ পুলিশ কাছে দৈব চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র অর্থাৎ শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বিরুদ্ধে লিখতি অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগ পত্রটি এখানে তুলে দিলাম-


মাননীয়,                                                                            তারিখ–২. ১১. ২০০৬

সুপারিটেডেন্ট অফ পুলিশ                          

উঃ ২৪ পরগনা, বারাসাত


 


আমি শংকর ভড়,  ১১ বি ভড়লেন, কোলকাতা-৬ –এর বাসিন্দা। আমি গত ২৮/১০/২০০৬ তারিখে বেলা ১২ তা ১০ নাগাদ উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মছলন্দপুরে ঘোষপুর, চারাবটতলায় অবস্থিত শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বাড়িতে যাই। শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের নাম ঐ অঞ্চলে হাড়ভাঙ্গা বুড়ি নামে প্রসিদ্ধ। ইনি হাড়ভাঙ্গার দৈব চিকিৎসক হিসাবে রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন। আমি যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করি, তখন সেখানে আনুমানিক প্রায় ৫০০ (পাঁচশত) জন মত রোগী ও তাঁদের আত্মীয় স্বজনের ভিড় দেখতে পাই। 

আমি নিজেকে একজন হাড়ভাঙ্গা রোগী হিসাবে অলৌকিক চিকিৎসক লক্ষ্মী মণ্ডলকে দেখাই। তখন বেলা প্রায় ১-১৫ মিনিট। তিনি আমাকে দেখেন ও আমার গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দেন ও একটা ছোট তেলের শিশিতে ফুঁ দিয়ে মন্ত্র পড়ে, ঐ মন্ত্র পড়া সরষের তেল দিনে মালিশ করবেন এবং গরম সেঁক দিতে বলেন। তিনি আমাকে আরও বলেন যে এখন থেকে আর কোন ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। 

এখানে উপস্থিত প্রত্যেক রোগীকেই তিনি আমার মত একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করছিলেন। 

আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে কোন ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ ছাড়াই প্রতি শনি ও মঙ্গলবার তিনি অসংখ্য মানুষকে এইভাবে অলৌকিক চিকিৎসা করে চলেছেন, যা আইনত সম্পূর্ণ বে-আইনি। 

আপনার কাছে আমি শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বিরুদ্ধে ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আবেদন করছি। 

আশাকরি জনস্বার্থে আপনি আমার আবেদন গ্রহণ করবেন বাধিত করবেন। 

                                                                           ধন্যবাদ

                                                                          শংকর ভড়

                                                                          কলকাতা-৬

এই অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ পদক্ষেপ নেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব চিকিৎসার নামে বুজরুকি ব্যবসা। 


সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

কলকাতা - ১২২

মোবাইল : ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

ইমেল : rationalist.santosh@gmail.com


তিমি শিকার -সংগীতা সাহা
Nov. 9, 2024 | বন্যপ্রাণ | views:490 | likes:258 | share: 36 | comments:0

তিমি মাছ খাওয়া কিন্তু বারণ। অন্তত বারণ না হোক আমরা বাঙালিরা ভেতো (পড়ুন মেছো বাঙালি) হলেও তিমি মাছের ঝোল আমরা খেয়েছি এমন কথা সচরাচর শোনা যায় না। অবশ্য তিনি মাছ শিকার হয় অনেক উন্নত উন্নত দেশগুলোতে। উন্নত দেশে হয় কারণ ওতো বড় মাছ শিকার করতে গেলেও যে পরিমাণ আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগে আর তার সঙ্গে যে পরিমাণ সাহস এবং শক্তি; উত্তাল সমুদ্রে গিয়ে লাফালাফি করে অতিকায় এবং স্থূলকায় তিমি মাছ কে মারার জন্য যে পরিমাণ উদ্যম লাগে শুটকি মাছ আর ইলিশ মাছ প্রিয় বাঙালির পক্ষে তা সম্ভব কিনা দেখতে হবে। ফলে তিমি মাছ আমরা খাইনা। 

    তাহলে প্রশ্ন করতে পারেন তিনি মাছ নিয়ে এত কথা বাড়াচ্ছে কেনো। আসলে তিনি যে শুধু একটা বিশাল বড় ভীষণাকায় ভয়ঙ্কর শিকারি মাছ তা নয়। না না, মানে সেটা তো বটেই তারও সঙ্গে ওর অনেক গুরুত্ব আছে। 

  ১৮৪৬ সাল থেকে  তিমি শিকার শুরু হয়েছিল। তিমি শিকার করা হতো কারণ তিনি মারলে বিশাল একটা জনসংখ্যাকে মাছে ভাতে থুরি মাছে পাউরুটিতে খাইয়ে দেওয়া যেত। তার সঙ্গে তিমি মাছের চামড়া দিয়ে শক্তপোক্ত জিনিসপত্র তৈরি হতো,এখনো হয়, তারপর তিমির ইন্টেসটাইন থেকে সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি হয় (বুঝুন অবস্থা সুগন্ধি দ্রব্য তাও নাকি আবার তিমির খাদ্য পাচনকারি অঙ্গ থেকে!) , সে না হয় হলো এছাড়াও তিমির দেহ থেকে যে তেল পাওয়া যেত তা দিয়ে সেকালের মানে আঠারোশো সালের ইউরোপের ঘরবাড়িতে বাতি জ্বলত। হ্যাঁ ওটা ইউরোপের বাড়ি নিশ্চিত কারণ আঠারোশো সালে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা ইউরোপের হাতে পড়ে তথৈবচ ছিল  আর তাদের লোকজনের বাড়িতে বাতি জ্বলার জন্য তিমি মাছের তেল ব্যবহৃত হতো না এটা নিশ্চিত। সে যাই হোক এত যে গুণ তিমির সেই তিমিকে শিকার করতে মানুষজন বেরিয়ে পরতো আর প্রচুর পরিমাণে তিমি মারার পরে নিয়ে এসে নানান কাজে লাগাত। 

  পরে ১৯৮৬ সালে তিমি শিকার নিষিদ্ধ হয় যদিও এখনো কোথাও কোথাও চলছে। এখন তিমি শিকার যে বন্ধ হল এটা কেন হল এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন ১৮৪৬ সালে তিমি শিকার শুরু না হলে আমাদের পৃথিবীতে নাকি কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রত্যেক বছর ১ লক্ষ ৬০ হাজার টন করে কম হতো।  তিমি কার্বণ-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে না বটে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে সে  অক্সিজেন টাই নেয়, কিন্তু তিমি জলে বসবাসের ফলে জলে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে ফলস্বরূপ প্লাংকটন সংখ্যা বাড়ে এই প্লাংকটন বাতাসে অক্সিজেন বাড়ায় আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায়। তিমি মাছ নিজেও তার দেহ কাঠামোর মধ্যে হাড়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা করে নিয়ে মৃত্যুর পর সমুদ্রের তলদেশে সলিল সমাধি ঘটায়। তিমি মাছের বর্জ্য পদার্থ জলের মধ্যে প্রয়োজনীয় উপাদান নাইট্রোজেন কার্বন সহ অন্যান্য মৌল উপাদান গুলির যোগান দেয় ফলে বিজ্ঞানীরা তিমি মাছের বর্জ্য পদার্থ নিয়ে খুব উৎসাহী। আর এই তিমি মাছ সমুদ্রের জলের ইকোসিস্টেমের খাদ্য খাদ্ক তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে তাদের সংখ্যা কমে গেলে পুরো সিস্টেমটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তিমি মাছ খাওয়া থেকে শুরু করে জুতোর সুকতলা হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। 

আমার এ লেখা বাঙ্গালীদের দোষারোপ করার জন্য নয়; কারণ আমরা বাঙালিরা পাতে শুটকি মাছ থেকে শুরু করে ইলিশ চিংড়ি রুই কাতলা যা খুশি তাই খেতে পারি তা বলে তিমি মাছের পেটি খাওয়ার আবদার করি না। এ লেখা আমাদের সকলের তিমি মাছের উপযোগিতা সেই সঙ্গে বৃহত্তর অর্থে মানুষ ছাড়াও পরিবেশের অন্যান্য জীব জন্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার জন্য লিখিত। 

 তথ্যসূত্র- ইন্টারনেট ও গুগল বাবাজি। 


গোপন কথা -কুসুমকলি দে
Nov. 9, 2024 | নারী | views:65 | likes:23 | share: 2 | comments:2

“ছি ছি, কি দিনকাল পড়ল বলুনতো! এও কি দেখা বাকি ছিল? “বাসে আমার পাশে বসা দুজন মধ্যবয়স্কা কাকিমা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। দুজনকে দেখেই মনে হল সম্ভ্রান্ত পরিবারের। “এত দোষে যেন কুলোচ্ছিল না, মেয়েরা আরও বেহায়া হয়ে গিয়েছে। একেবারে ঋতুস্রাব নিয়ে খোলাখুলি কথা, খোলাখুলি আলোচনা করছে! যা তোদের লুকিয়ে রাখার কথা, যে কথা শুনলে কান অবধি গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার কথা, সে বিষয়ে জিভ দিয়ে আলোচনা করছিস! জানিস না জিভে সরস্বতীর বাস” (তিনি দেবতা-মেয়ে, তাই বোধ হয় ঋতুমতী হন না) শুনতে পেলাম একজন বলছেন তাদের মধ্যে। “ঠাকুর ঠাকুর রক্ষা কর, এ ঘোর কলিকাল”,বলে করজোড়ে কপালে ঠেকালেন অন্যজন। 

২০১৯ সালে যখন ছোট ছবি ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স। ’ অস্কার জিতল, সারা দেশ জুড়ে ধন্য-ধন্য রব উঠল অস্কারবিজয়ী বলে কথা! একটু ধামাকা না হলে কি হয়? কিন্তু এই ধামাকা, তোপধ্বনি কি সত্যিই পৌঁছল সেইসব মানুষের কানে, যাদের কাছে ‘পিরিয়ড’ মানে অসুখ! ‘পিরিয়ড’ মানে অপবিত্রতা! ‘পিরিয়ড’-এর অর্থই যারা ঠিক মতো বোঝেন না। 'রজঃস্রাব' বা 'পিরিয়ড' ক্ষুধা-নিদ্রার মতোই স্বাভাবিক। আদৌ রোগ নয়— কিন্তু তার ডাকনাম ‘শরীর-খারাপ’। আড়ালের নাম ‘মাসিক’। স্যানিটরি ন্যাপকিন বাজারে আসা তো এই সেদিন, বড় জোর বছর পঞ্চাশ। আর মোটের উপর পরিচিত আর সুলভ হওয়া তো বড় জোর তিন দশক। খারাপ শরীর সামলানোর উপায় ছিল বাড়তি বাতিল কাপড়ের টুকরো। চলতি কথায় ‘ন্যাকড়া’। শুধু দিন-আনা দিন-খাওয়া হতদরিদ্র পরিবারগুলিতে নয়, মধ্যবিত্ত এমনকী উচ্চবিত্ত পরিবারেও মাসিকের জন্য ব্যবহৃত বস্ত্রখণ্ড এক বারের পর ফেলে দেওয়া যেত না, সেটিকে কেঁচে-শুকিয়ে পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করে নিতে হত। শুকোতে দিতে হত গোপনে, বড় বহরের ধুতি, শাড়ি বা চাদরের তলায়। একটা অস্বস্তি নিয়েই থাকতে হত মেয়েদের, রজঃস্বলাদের। অনেক কিছুর মতোই লাজ-লজ্জার জগতেও দ্রুত বদল শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে। বিপুল সংখ্যক নার্স এবং স্বেচ্ছা-সেবিকা হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সম্ভ্রান্ত মহিলাদের এত জবরজং উপকরণ ব্যবহারের উপায় রইল না। এই সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি আজকের ‘স্যানিটরি ন্যাপকিন’ নামে পরিচিত পণ্যটিকে বাজারে আনে। ন্যাপকিনের এইসব আদিরূপের মধ্যে একটি ছিল ‘SHAG-NA-KINS’ নামে একটি ব্র্যান্ড। 

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে পিরিয়ড কে নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো প্রাণঘাতীও বটে। যেমন নেপালে চৌপদী নামক একটি প্রথা আছে। মাসিকের সময় একটি আলাদা ছোট কুটিরে থাকতে হয়, মেয়েটিকে অপবিত্র মনে করা হয় তখন। অনেক সময় দমবন্ধ হয়ে অথবা অসম্ভব ঠান্ডায় অনেকে বলি হয়েছেন এই প্রথার। আমাদের সমাজেও সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বা কোন শুভানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অনেক পরিবারে। কেবল প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে নয় শহরেও মেয়েরা ঋতুকালীন পরিচ্ছনতার অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। আজ মহিলাদের আড়াল প্রায় নেই, তাঁরা অধিকাংশই আর অন্তঃপুরের নন। কিন্তু আড়ালের ওই শব্দগুলোর আব্রু যেন ঘুচতে গিয়েও ঘোচবার নয়। নারীর অনিবার্য শরীরধর্ম রজঃস্রাব ঘিরে রয়ে গিয়েছে আদিমতম কিছু নিষেধাজ্ঞা। কোষ্ঠ-কাঠিন্যের জন্য জোলাপ বিক্রি হয় প্রকাশ্যে, কিন্তু কন্ডোম আর স্যানিটরি ন্যাপকিন এখনও কাগজে জড়িয়ে নিতে হয় কাউন্টার থেকে। 

একটা প্রশ্ন প্রায়ই জাগে মনে। রনো কত স্মৃতি,কত সুঅভ্যাস সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলি আমরা। কিন্তু বস্তাপচা ধারণা,যুগের পর যুগ চলেই আসছে। কুসংস্কারের বীজ আর কতদিন আমরা বপন করে যাব এই সমাজের বুকে?হ্যাঁ মানছি, এখন অনেক প্রচার হয় এইসবের বিরুদ্ধে। টিভি,ইন্টারনেটে বড় বড় অনেক বিজ্ঞাপনই চোখে পড়ে। কিন্তু নিজের চারপাশে,নিজের পরিবারের মধ্যেই, একবার ভালো করে খেয়াল করবেন, খুব বেশি পরিবর্তন চোখে পড়বে না। আমরা পোশাক আর দৈনন্দিন জীবনে কেবল আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেই হবেনা নিজেদের চিন্তাভাবনাতেও আনা চাই স্বচ্ছতা,যৌক্তিকতা। কেবল এই একটি ক্ষেত্র নয়। জীবনকে অন্য কারুর নয় নিজের মতো করে বাঁচুন। নিজের যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে সব ঘটনাকে বিশ্লেষণ করুন। 

ধুমধাম করে আলাদা একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন না করে যদি সঠিক শারীরিক শিক্ষার পাঠ পড়াতে পারি এই সমাজকে তাহলে হয়তো নারী পুরুষ ভেদাভেদ দূর করে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সফল কান্ডারী হয়ে উঠতে পারব আমরা। 

ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তঃসারশূন্যতা -সায়নদীপ সরকার
Nov. 9, 2024 | যুক্তিবাদ | views:78 | likes:22 | share: 4 | comments:0

ইন্ডিভিজুয়াল সেকুলারিজমের কোন অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মানুষ নিজেকে সেকুলার বলে দাবি করতে পারে না। যদি এটা সে করে তাহলে সে আসলে ভন্ড ও মেকি। সে কোন বিশেষ সুবিধা পাওয়ার লোভে এটা করছে। একই ভাবে রাষ্ট্র তথা সংবিধানকে তাঁর রচনাকারেরা ধর্মনিরপেক্ষ আক্ষা দিয়ে থাকলে সেটা নিজের স্বার্থে দিয়েছে কারণ রাষ্ট্র বা কোন প্রতিষ্ঠান কোন জড় বস্তু নয়। দিনের শেষে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে কিছু সংগঠিত মানুষের দল যারা মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসছে। এখন রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার পিছনে আছে পাতি ভোটের অঙ্কের হিসেব যেটা আমরা সবাই খুব ভালো ভাবে অবগত। 

এখন আসা যাক ইন্ডিভিজুয়াল সেকুলারিজমের অন্তঃসারশূন্যতায়। কোন ব্যক্তি জন্মসূত্রে তার পিতা মাতার পরিচয়ে কোন বিশেষ ধর্মের মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়। সে না চাইলেও তাকে এটা হতে হয় কারণ না হলে বার্থ সারটিফিকেট ইস্যু হবে না এবং ভবিষ্যতে সেই ব্যক্তিকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এখন আমরা মনে করলাম সেই ব্যক্তি বড় হলো ও নিজের যুক্তি,বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে নিজেকে নাস্তিক আক্ষা দিলো। কিন্তু সে কখনোই নিজের ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করতে পারবেনা কারণ তার পদবীর সাথেই তার ধর্মীয় পরিচয় লেপ্টে আছে। সে তার নাম পালটে স্পাইডারম্যান, মিঃ বিন্ বা শক্তিমান  রাখতে পারবেনা। অর্থাৎ ধর্ম তার পিছু ছাড়ছে না টেকনিক্যালি কিন্তু তাও সে নিজের দার্শনিক দৃষ্টিতে নাস্তিকতা গ্রহণ করলো। এতে কোন সমস্যা নেই। কারণ পদবী পালটেও তাকে অন্য ধর্মের পরিচয় নিতে হবে যেটা সে চায়না এবং এতে তার কোন হাত নেই। এখন দর্শনের দিক দিয়ে নাস্তিক সেই ব্যক্তি যে কোন ধর্ম ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করতে এক মুহূর্ত ভাবেনা। নাস্তিক ব্যক্তি শুধুমাত্র গণিত,বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে জীবন ও প্রকৃতিকে বিচার করে। 

এবার আসা যাক সেকুলারদের কথায়। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি বা সেকুলার মানুষ বলে যারা নিজেদের আক্ষা দেয় এরাই আবার ঈদের দিন মুসলিম বন্ধুকে ঈদ মুবারক, হিন্দু বন্ধুকে শুভ জন্মাষ্টমী বা শুভবিজয়া এবং 25 শে ডিসেম্বরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে হ্যাপি খ্রিস্টমাস জানিয়ে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দের অর্থ হলো যে মানুষ কোন বিশেষ একটি ধর্মের নিয়মে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেনা বা বিশেষ কোন ধর্মের প্রভাব নিজের জীবনে পরতে দেয়না। অথচ সে প্রতিদিন একটি বিশেষ পদবী নিয়ে চলছে যেটা একটি বিশেষ ধর্মকে রিপ্রেজেন্ট করে। যে ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ কোন ধর্মের পক্ষ নেয়না কিন্তু আবার কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেই ব্যক্তিই বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানায় এটা সেল্ফ কনট্রাডিকটরি‌। সেকুলার শব্দের প্রকৃত অর্থ আসলে নাস্তিকতা। তাই যে সেকুলার হয় তার উচিৎ সমস্ত ধর্ম ও সেই ধর্মের অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে দূরে রাখা ও সেই বিশেষ দিনে ঐ বন্ধুকে শুভেচ্ছা না জানানো। কিন্তু সেকুলাররা সেটা করেনা কারণ রাষ্ট্রের মতোই সেও নিজের স্বার্থে বৃহত্তর মানুষকে নিজের হাতে রাখতে চায়। একজন নাস্তিকের সাথে একজন নামধারী "সেকুলার"এর মিল হলো দুজনেই জন্মসূত্রে ধার্মিক কিন্তু তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়। নাস্তিক বুক ঠুকে বলার সাহস রাখে আমি ঈশ্বর মানিনা আমি ধর্ম ও মানিনা যেটা "সেকুলার" কখনোই বলে না। সেকুলারেরা আসলে ভন্ড ও ধান্দাবাজ। 

এবার এই ইন্ডিভিজুয়াল সেকুলারিজম কে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক বলে বিবেচনা করতে গেলে নতুন একটি শব্দের অবতারণা করা যায় যেটা খুব কম লোক ব্যবহার করে থাকে- শব্দটা হলো অ্যাগনস্টিসিজম। শব্দটির অর্থ হলো অনেকটা এরকম--আমি ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করিনা আবার ঠিক বিশ্বাসটাও আসছে না কারণ আমি দেখতে পাচ্ছিনা তাঁকে, অবিশ্বাস ও করছিনা কারণ এত লোক বিশ্বাস করে‌। এটা হোল একজন অ্যাগনস্টিক্ মানুষের দর্শন। কোন "সেকুলার" ব্যক্তিকে যদি অ্যাগনস্টিক্ বলা যায় তাহলে তার ঐ সমস্ত কার্যকলাপ নীতিগত ভাবে কিছুটা সমর্থন করা যায় ও তাকে ক্ষমা করে দেওয়া চলে। কিন্তু সেকুলার হয়ে সে যদি সেকুলার শব্দের মানে জেনেও নিজেকে অ্যাগনস্টিক্ বলতে দ্বিধা করে ও প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে বেরায় তবে তাকে ধান্দাবাজ ও সুবিধাবাদী বলবো। 

সুতরাং বিশ্বাস ও যুক্তির লড়াইয়ে মূলত তিনটি শ্রেণীকে  মান্যতা দেওয়া যায়-

১.ধার্মিক

২.নাস্তিক

৩.অ্যাগনস্টিক্

এর বাইরে কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। সেকুলারেরা আসলে ভন্ড। কারণ একমাত্র প্রকৃত ধার্মিক মানুষই অপর একটি ধর্মাবলম্বী মানুষকে তার পার্বনের দিনে শুভেচ্ছা জানাতে পারে। যে প্রকৃত নাস্তিক সে কখনোই ধর্মের পক্ষ নেবেনা কারণ তার কাছে যুক্তি ও বিজ্ঞান আছে, সে কখনোই কোন বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাবেনা তার বন্ধুকে। বিশ্বাসের থেকে যুক্তি তার কাছে অনেক মহান। কিন্তু একজন সেকুলার এই দুই পথের কোনটায় হাঁটে না। সে স্বার্থপর,ভন্ড ও মেকি ঠিক ঐ সাজানো গোছানো রাষ্ট্রযন্ত্রের মতই। সে আসলে অন্তঃসারশূন্য। 


প্রাকৃতিক মানবধর্মের সাফকথা -মিলন সিংহ
Nov. 8, 2024 | যুক্তিবাদ | views:167 | likes:15 | share: 4 | comments:0

স্রষ্টা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি করলেন নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ। পৃথিবীকে সাজালেন প্রাণ সৃষ্টির উপযুক্ত করে। পৃথিবীতে বাতাস বইল, বৃষ্টি ঝড়ল, সূর্যের উত্তাপ পৌঁছাল। বাতাসে মিশল অক্সিজেন। তৈরী হল সমুদ্র, নদী, পাহাড়, ঝরণা। তারপর এককোষী প্রাণী। এককোষ ভেঙে বহুকোষ। উদ্ভিদ, জীব ও মানুষ। প্রত্যেকের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের সমাহার – খাদ্য,পানীয়। বংশবৃদ্ধির উপায় ও তাগিদ। কোটি কোটি বছর ধরে যখন সৃষ্টির আসল এই কর্মকাণ্ডগুলি চলছিল, যার অন্তিম ফলরূপে সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের তখন সৃষ্টির সেই কয়েক শতকোটি বছরে কতজন ফরিস্তা, দেবদূত, পয়গম্বর জন্মেছিল পৃথিবীতে? কোটি কোটি বছর উদ্ভিদ ও জীব এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকেছে, জীবন উপভোগ করেছে, বংশবৃদ্ধি ঘটিয়েছে সে কোন দেবদূত, ফরিস্তা বা পয়গম্বরের নির্দেশিত পথে? ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মহাযজ্ঞে কতজন পয়গম্বেরর সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা ঈগল্লার? লক্ষ লক্ষ বছর মানুষই বা দিব্যি বেঁচে-বর্তিয়ে থেকেছে কোন ধর্মপ্রবক্তার ধর্মে দীক্ষিত হয়ে?

চোখ, কান, নাক, হাত, পা, পাকস্থলী, যকৃত, হৃৎপিণ্ড - তোমার প্রয়োজনীয় প্রতিটি অঙ্গ তোমার শরীরে উপযুক্ত স্থানে স্থাপিত হোল।   ক্ষুধার খাদ্য, তৃষ্ণার বারি, ক্লান্তির নিদ্রা, মায়ের আদর কোন পয়গম্বর, কোন ফরিস্তা, কোন অবতার পৃথীবাতে আবির্ভূত হয়ে মানুষের জন্য বয়ে এনেছিল?   তারপর হঠাৎ গত মাত্রই হাজার দুই-আড়াই বছর ধরে স্রষ্টার কি এমন প্রয়োজন পড়ল যে তিনি পৃথিবীতে একের পর এক পয়গম্বর, অবতার, ফরিস্তা প্রেরণ করতে শুরু করলেন? স্রষ্টা কি জড়-বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন? সৃষ্টি কার্য রক্ষা করতে অক্ষম হয়েছেন? তাই তিনি সহকারী নিয়োগের বন্দোব্যস্ত করলেন? জন্ম-মৃত্যু রহিত ঈগল্লার বার্ধক্য? সর্বশক্তিমানের অক্ষমতা? সয়ম্ভুর সহকারী?

যিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ঠ থেকে সূর্য, তারকা থেকে শুরু করে পৃথিবী, প্রকৃতি উদ্ভিদ জীব ও মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন, আজও বৃহৎ এই ব্রহ্মাণ্ডকে পরিচালিত করতে পারেন একক ক্ষমতায়, সেই তিনি মানুষকে স্বয়ং পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়ে পয়গম্বর, দেবদূত, ফরিস্তাদের পাঠালেন মানুষের জন্য ধর্ম প্রচার করতে? তিনি স্বয়ং এইকাজের আর উপযুক্ত রইলেন না? মানুষের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ রাখতে তিনি কি অপারগ হয়ে পড়লেন? 

ব্যাঙাচির লেজ খসাতে ব্যাঙ-মাকে আজও কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অনুসরণ করতে হয় না, যেমন হয় খাতনা করতে। পুরুষের গোঁফ গজাতে কিংবা নারীর রজঃস্বলা হতে প্রয়োজন পড়ে না কোন মন্ত্রপাঠের, যেমন হয় বিবাহে। 

তাহলে এই এত এত পয়গম্বর, ফরিস্তা, দেবদূত এরা কারা? যারা প্রত্যেকে পৃথক পৃথক ধর্ম প্রচার করে মানুষকে নানা ধর্মে বিভক্ত করে মানুষের সর্বনাশ করতে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

এরপরও যারা স্বঘোষিত ফরিস্তা, পয়গম্বর, দেবদূতে বিশ্বাস করবে কর। প্রাকৃতিক মানবধর্মের কর্ণে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে সেই বাণী, “আমি কখনও কোন পয়গম্বর, ফরিস্তা বা দেবদূত প্রেরণ করি না। আমি সর্বশক্তিমান, আমি স্বয়ম সম্পূর্ণ। ” 

 অধর্ম করলে পাপ হয়। পাপে মৃত্যু। মহাপাপে সবংশে ধ্বংস। তাহলে ধর্ম কি, অধর্মই বা কি?

কেউ যদি গীতা না পড়ে, কোরাণ ছুঁড়ে ফেলে, বাইবেল পুড়িয়ে দেয় তাতে তার কোন কষ্টও হবে না, মৃত্যুও হবে না। কিন্তু কেউ যদি শ্বাসগ্রহণ না করে, খাদ্যগ্রহণ না করে, জলপান না করে? প্রথমে সে কষ্ট পাবে, তারপর তার মৃত্যু হবে। প্রথমক্ষেত্রে কষ্ট হয় না, মৃত্যু তো নয়ই। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে কেন কষ্ট ও তারপর মৃত্যু হয়? কেন না, প্রথম ক্ষেত্রে সে কোন পাপ করে না কিন্তু দ্বিতীয়ক্ষেত্রে সে পাপ করে। সেই পাপেই তার কষ্ট ও মৃত্যু হয়। প্রথমক্ষত্রে কোন পাপ হয় নাই, কারণ সেখানে কোন অধর্ম হয় নাই। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে অধর্ম হয়েছে তাই পাপ হয়েছে। অর্থাৎ শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ ও জলপান না করে সে অধর্ম করেছে। সেই অধর্মেই তার পাপ হয়েছে। অর্থাৎ, গীতা না পড়লে, কোরাণ ছুঁড়ে ফেললে কিংবা বাইবেল পুড়িয়ে দিলে কোন অধর্ম হয় না। তেমনি অধর্ম নয় মন্দির, মসজিদ, গীর্জা বা গুরুদ্বারায় না যাওয়াও। সারা জীবন মন্দিরে না গেলেও কেউ মরবে না। কিন্তু শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ কিংবা জলপান না করলে, বিষপান করলে অধর্ম হয়। 

অর্থাৎ মনু, শঙ্করাচার্য, হজরত, যীশুখ্রীষ্ট, বুদ্ধ স্বয়ং-স্রষ্টার বাণী বলে যা প্রচার করে গিয়েছেন তা ধর্ম নয়। 

 তাহলে ধর্ম কি?

শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ, জলপান, আত্মরক্ষা ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলা। প্রাকৃতিক হয়ে বাঁচা। যাকে বলি প্রাকৃতিক ধর্ম। প্রাকৃতিকধর্মেই  তুমি জন্মেছ, বেঁচে রয়েছ। প্রাকৃতিকধর্মের নিয়মেই তুমি মরবে। জন্ম-জীবনযাপন-মৃত্যু অর্থাৎ, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় – প্রাকৃতিকধর্মই এই তিনের কর্তা। 

এ তো গেল খুচরো পাপ। এবার আসি মহাপাপের কথায়। যে পাপে সবংশে ধ্বংস হতে হয়। কখন কেউ সবংশে ধ্বংস হয়? বিধবা আমিষ খেলে কিংবা তিন ওয়াক্ত নমাজ না পড়লে? মহাপাপ তো নয়ই, এতে খুচরো পাপও হয় না। মানুষ খুন করলেও কেউ সবংশে ধ্বংস হয় না। মানুষ খুন করাও মহাপাপ নয়। কিন্তু যখন কেউ প্রাকৃতিক দেহজ-কামকে ইন্দ্রিয় পরায়ণতা ও তাজ্য ভেবে ব্রহ্মচর্য্য পালন করে তখন সে মহাপাপে পাপী হয়। এই পাপে তার বংশরক্ষা হয় না, সে সবংশে ধ্বংস হয়। 

সুতরাং, কেউ যখন স্রষ্টার সংবিধান-স্বরূপ প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে অবহেলা করে বা ত্যাগ করে তখনই সে পাপ করে এবং যৌনপ্রবৃত্তি ত্যাগ করলে মহাপাপ করে। 

প্রাকৃতিক মানবধর্মে জৈবপ্রবৃত্তিগুলির যথাযথ পালন না করাকে পাপ ও প্রাকৃতিক দেহজ-কামবাসনাকে ঘৃণা করা মহাপাপ। 

ত্যাগবাদী বলেন – এই জগৎ অনন্ত দুঃখময়, ইহাতে প্রকৃত সুখের লেশও নাই। যাহা আছে তাহাও ক্ষণিক। সুতরাং সেই সুখ ও তাহার সাধন ত্যাগ করে কৃচ্ছ সাধন কর। ত্যাগে মোক্ষলাভ ও অনন্ত স্বর্গবাস হয়। 

      কিন্তু ওহে ত্যাগবাদী, তুমি যে ইহজগতকে দুঃখময় ও প্রপঞ্চময়, ইহজগতের সুখকে ক্ষণিক ও মায়া বলে সেই ভোগ-সুখে সময় নষ্ট না করে কৃচ্ছ সাধন কর সে কিসের জন্য? মোক্ষ ও স্বর্গলাভের জন্যই তো? অর্থাৎ, আরও বৃহৎ ও অনন্ত সুখলাভের লোভে। তাহলে ভোগলিপ্সা কার প্রবল? ইহজগতে ক্ষুদ্র জীবনকালে যেটুকু সুখ পাওয়া যায় তাই ভোগ করে যে তৃপ্ত হয় তার, না অনন্ত স্বর্গসুখের লোভে লালায়িত হয়ে যে ইহজগতে ত্যাগের মাধ্যমে কৃচ্ছসাধন করে তার? আসল ভোগবাদী তাহলে কে?


যুক্তিবাদ ও মননশীলতা -মহম্মদ মহসীন
Nov. 8, 2024 | যুক্তিবাদ | views:275 | likes:25 | share: 21 | comments:0

যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য বি.এ, এম.এ পাশের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। যাদের বাস্তব বোধ আছে তারাই হতে পারেন যুক্তিবাদী। যারা খোলা মনে অন্যের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করেন যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে তাদের মাঝে। বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গঠনের জন্য বিজ্ঞান পড়তে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বিজ্ঞানী হওয়ার তো কথাই আসে না। আমার জীবনের কয়েকটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা আজ সকলের কাছে রাখতে চাই। 

খুব ভোরে হাঁটা আমার বহু দিনের অভ্যাস। হেঁটে যেতাম বাড়ি থেকে দেড় কিমি দূরে রেল স্টেশনে। তার পাশে ধান জমি। অত ভোরেই একজন পাম্পসেট চালিয়ে সেচ দেবার যোগাড় যন্ত্র করছে। আমাকে দেখে ডাকলো। কৌতূহল নিয়ে কাছে গেলাম। “শুনেছেন কাল রাতে  নরেনকে (নাম পরিবর্তিত) সাপে কেটেছে। আর তাকে নিয়ে চলেছে বজরং (নাম পরিবর্তিত) ওঝার কাছে। আমি তো রেগে মেগে হুলুস্থুল করলাম, শেষে ওঝাবাড়ি বাদ দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ইনজেকশন দিয়েছিল, আজ ভালো আছে। আরেকটু দেরী হলে কলকাতা নিয়ে যেতে হতো, ডায়ালিসিস করতে হতো, তাও বলা যায় না, কী যে হতো বলা যায় না। ”

এই কৃষকটি প্রায় আশি ছুঁই-ছুঁই। জীবনে স্কুলের মুখ তো দেখেই নি। আর মুক্তমনা-যুক্তিবাদী এসব কথাও শোনে নি। কিন্তু তার মানসিকতা বৈজ্ঞানিক। অভিজ্ঞতার নিরিখে সে বুঝেছে, ওঝা নয়, সাপে কাটলে হাসপাতাল যেতে হয়। আমি অবাকই হয়েছিলাম। কারণ এখন অনেক ডিগ্রীওয়ালা শিক্ষিতকেও ওঝাবাড়ির শরণাপন্ন হতে দেখি আকছার। গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। মাঝে মাঝে কথার পিঠে কথায় তাদের যুক্তিবাদের বহিঃ প্রকাশ দেখতে পাই। ধর্ম প্রসঙ্গ আসে, বলি তোরা জানিস কোরাণ কে লিখেছে? একবাক্যে সবাই বলে মোহাম্মদ লিখেছে। অথচ তাবৎ বিশ্বের মুসলমানে বিশ্বাস করে ওটা মোহাম্মদ নয় স্বয়ং আল্লাহর রচনা। এই জলজ্যান্ত অবাস্তব কথাটি বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়। হায়! একটা নাইন টেনের ছেলে-মেয়ের বোধ বুদ্ধিও যদি তাদের থাকতো!

এক রেডিও মিস্ত্রি অর্শের যন্ত্রণায় ভুগছেন। তিনি দৈব, টোটকা এবং গাঁয়ে ঘরের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করান। রক্তপাত হয়ে হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার কথা, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, পাঁচশ' টাকা ফি দিয়ে হাজার হাজার টাকার ওষুধ খেয়ে শেষ হয়ে গেছি। আর খরচায় কুলিয়ে উঠতে পারছি না। ও আমার টোটকাই ভালো। তাতেও উপশম পাই না, সরকারী হাসপাতালে তো করোনা ছাড়া কারুর গুরুত্ব নেই। শুনছি জানুয়ারীতে ইমামবাড়া হাসপাতালে এক ডাক্তার আসছে, তাকেই দেখাবো। করোনা নাহলে ওয়ালসে অপারেশন হয়ে যেত। 

-তবে এখন যে দৈব খাচ্ছি, তাতে ভালো হয়ে যাবে বলছে। 

-ভালো হবে বলে কিছু বুঝছেন?

-এখন পর্যন্ত কোনো উপকার হয় নি, তবে যে আমাকে সন্ধান দিয়েছে তার ভালো হয়ে গেছে। 


আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়াটাও দৈব, টোটিকা, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি করার অন্যতম কারণ। স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারী উদ্যোগ যথেষ্ট হলে, ঘরে ঘরে আধুনিক চিকিৎসা পৌঁছে দিতে পারলে এইসব অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার রমরমা অনেকটাই কমে যেত। গ্রামের এক যুবক সর্পদষ্ট হয়। ওঝার বাড়িতে মরতে বসেছিল, কয়েকজন জানতে পারি। ধরে বেঁধে এন আর এস এ নিয়ে যাওয়া হয়। গিয়ে বেশ কয়েকবার ডায়ালিসিস করে এখন পুরো সুস্থ। কিন্তু রাস্তার ধারে একটি গাছের তলায় পাকা বেদী বানিয়ে নিয়মিত মনসা পুজো করে। তবে একটা কাজ সে করে, কাউকে কোনো সাপ মারতে দেয় না। আমার আরেক আত্মীয়কে সাপে কাটলে চুঁচুঁড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দেখি আরেক আত্মীয় জলপড়া নিয়ে গেছে। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসার সাথে সাথে দৈবও চালাচ্ছে। প্রতিটি হাসপাতালেই দেখবেন একটা করে ধর্মস্থান তৈরী করে রেখেছে, আয়ও তার চোখ টাটানোর পক্ষে যথেষ্ট। 

অন্যরকম যুক্তিবাদী মনের অশিক্ষিত, স্বল্প-শিক্ষিত লোককেও দেখেছি। আমাদের রেল স্টেশনে আছে একটি চায়ের দোকান। নীলমাধব। মাধ্যমিক দিয়েছে কি না জানি না। তবে একটা কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে, তাই দোকানের সাইন বোর্ড বেশ লম্বা। তাতে লিখেছেঃ নীল আকাশের নীচে, নীল মাধবের চা। একদিন সকালে দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। গান বাজছিল-

"শত জনমের কত সাধনায়

পেয়েছি এ মানব প্রাণ,

ওগো ভগবান ওগো দয়াময়

আমি যে তোমারি দান"। 

শুনলাম নীলমাধব তর্ক করছে, জন্মান্তর বলে কিছু হয় না। তাই অন্য জন্মের পূণ্যফলে মানব জন্ম হয়, এ মানা যায় না, এটা ঠিক নয়। তাছাড়া, জন্ম জন্মান্তরের সাধনায় যদি মানব জনম পাই, তাহলে আগের জন্মে নিশ্চয়ই মানব জনম পাই নি। আগে কি গরু ছাগল হয়ে সাধনা করছিলাম? সাধনা তো মানুষেই করে। তো আগের জন্মেই যদি মানুষ হয়েই সাধনা করে থাকি, তাহলে এ মানব জনম ভগবানের দান হয় কিভাবে? পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, এমন প্রশ্ন আর কেউ করে না কেন? অনেক ধর্মান্ধ লোকের মাঝেও মানুষের গুণ দেখেছি। এক সব্জি বিক্রেতা দেখা হলেই আমার শরীর ভালো আছে কি না, বাড়ির সকলে কে কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করে। আমাকে শুধু নয় সকলকেই এটা জিজ্ঞাসা করে। একদিন তারও দোকানে খদ্দের নেই, আমারও সময় কাটানোর কেউ নেই। তার সাথেই আড্ডা দেব ভাবলাম। বেশ দাড়ি রাখে। পাঁচবার নামাজও পড়ে। কথায় কথায় বললাম, কোরাণে কত বাজে কথা লেখা আছে জানো? লেখা আছে অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব করা, ওঠা বসা নিষিদ্ধ।  সে তো এর তীব্র প্রতিবাদ করলো। 

“কিছুতেই এটা থাকতে পারে না। কোরাণে নানান সুরা আছে, আয়াত আছে। এসব কেন লেখা থাকবে?”

আমিও ছেড়ে দেবার পাত্র নই, মোবাইলে কোরাণ খুলে দেখাই। সে বলে, মোবাইলের কোরাণ মানি না। ওটা কোরাণ নয়। বললাম, তাহলে বাড়ি গিয়ে তোমার কোরাণ খুলে দেখে নিও, না পেলে আমাকে ডেকো। 

সে কী বললো জানেন?  

-আমি তো লেখা পড়া জানি না। তবে আমার মনে হয় কোরাণে এসব বাজে কথা লেখা থাকতে পারে না। 

অতঃপর তাকে ধরলাম অন্য বিষয়ে। 

-এই যে বলে বুরাখ চেপে নবীজি সাত আকাশ উড়ে মেরাজ করেছিল, এটা মানো? 

সে বলে, ‘অবশ্যই মানি’। 

- তাহলে বলো কিভাবে বুরাক আকাশে উড়তে পারে? সেটি তো গাধা আর খচ্চরের মাঝামাঝি ডানাওলা এক প্রাণী। সে কখনও মহাকাশে যেতে পারে? 

সে বলে, ‘এই মেরাজটা তো বাস্তবিক সম্ভব নয়। আসলে এটার ভিতরে বিশাল অর্থ আছে। পুরো ব্যাপারটাই কল্পনা, আধ্যাত্মিক। বাস্তবিক নয়। ’ 

এরা ধর্ম বিশ্বাসী। তবু তাদের কথা বলছি কেন? কারণ তারা ধর্মগ্রন্থকেও পুরো বিশ্বাস করে না। অবাস্তব গুলোকে আধ্যাত্মিক বলে সন্তুষ্ট হতে চায়, কারণ তারাও বোঝে বাস্তবে তা হওয়া অসম্ভব। বাস্তববোধ তাদের আছে। তাই তাদের মাঝে কিছুটাও প্রশ্ন করার মানসিকতা জাগে। তাদের মাঝেও যুক্তিবাদের স্ফুরণ সম্ভব। মানুষ স্বভাবতই যুক্তিশীল। যুক্তিযুক্ত বিষয় তার মনে ধরে। বাস্তবজীবনে তার প্রয়োগও করে। তাই অতিবড় অযৌক্তিক বিষয়কেও কুযুক্তি দিয়ে যুক্তির ছদ্মবেশে বিজ্ঞানের মোড়কে খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় অলৌকিকতা নির্ভর ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86912