গল্পের ফাঁকফোঁকর : বিভীষনকে চিরঞ্জিবী হবার বর দিয়ে রামচন্দ্র বুদ্ধির পরিচয় দেননি।

Guitar K Kanungo


Dec. 26, 2024 | | views :60 | like:2 | share: 3 | comments :0

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, সাতজন চিরঞ্জীবী আছেন, অর্থাৎ এরা মৃত্যুকে জয় করেছেন। পুরাকালে অনেক অসুর এটাই চেয়েছিলেন, অবশ্য সঙ্গে কিছুটা শক্তিও, কিন্তু বিধাতা পুরুষ তাদের একজনকেও চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে দেননি। তিন বিধাতার মধ্যে যিনি সবচাইতে ভোলাভালা বলে পরিচিত, সেই ভোলানাথকেও অসুরেরা ভোলাতে পারেনি। অথচ এমন নয় যে তপস্যার জোর এদের কিছু কম ছিল।

ঈশ্বরের কাছে সব সৃষ্টিই সমান—সুর কিংবা অসুর। তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে 'ডিস্ক্রিমিনেট' করবেন, এমন ভাবার সুযোগ নেই। তাই ধরে নিতে হবে, অসুরদের চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে না দেবার পেছনে একটা শক্ত কোনো কারণ রয়েছে। যে সমস্ত অসুর অমরত্বের বর পেয়েও মৃত্যুকে এড়াতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বরের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারা সম্ভব না হলেও, আমরা কারণটা অনুমান করতে পারি। এটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ; জন্মিলে মরিতে হইবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। স্বয়ং ঈশ্বরও এই নিয়মের অধীন।

যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বর পরশুরাম, বিভীষণ, ব্যাস, বালী এবং হনুমানের ক্ষেত্রে প্রকৃতির এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে দিলেন কেন, যেখানে তিনি নিজেই বলছেন তিনি প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ? কিংবা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা অথবা আচার্য কৃপের ক্ষেত্রে? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এবং সেই প্রশ্ন আমি তুলতে চাইছি এখানে, কারণ এই প্রশ্ন তোলার একটা অত্যন্ত গুরুতর কারণও আছে—আর সেটা হচ্ছে মোক্ষলাভের প্রসঙ্গ। প্রতিটি মানুষের মোক্ষলাভের অধিকার হিন্দু ধর্মে স্বীকৃত।

দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) চিরঞ্জীবী হতে চাননি। শাস্তি হিসাবে তাদের এই দুর্ভাগ্যকে বরণ করতে হয়েছে। অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছিলেন। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রথমে পাণ্ডবদের পাঁচ সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, যে সন্তানটি তখনো অনাগত, অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভের সেই সন্তানটিকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই অপরাধ অত্যন্ত গর্হিত এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য।

অভিশাপ কুড়োবার মতোই অপরাধ ছিল। বাসুদেব কৃষ্ণ, যিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তিনি অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) কে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে তারা অনন্তকাল ধরে এই অপকর্মের অপরাধবোধ বয়ে বেড়াবে। শুধু তাই নয়, তারা অসহনীয় দুঃখ এবং কষ্টের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াবে। তাদের ঘৃণ্য অপরাধের কথা সবাই মনে রাখবে, এবং সেইজন্যই তারা কোথাও কারো কাছে দু'দণ্ড আশ্রয় পাবে না। দুঃখ, কষ্ট আর একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুকে হাজার ডাকলেও, মৃত্যু তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে না। মোক্ষ লাভের প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। 

এটুকু পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন, এবং সেই শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করেছেন; তিনি সেটা করতেই পারেন, যেহেতু তিনি স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। গোলমালটা বাঁধে যখন আমরা হনুমান (এবং বিভীষণ) কে চিরঞ্জীবী হতে দেখি। একই প্রশ্ন বালী এবং পরশুরামের ক্ষেত্রেও উঠবে, কিন্তু তাঁরা যেহেতু ঈশ্বরেরই অবতার, এই আলোচনা থেকে তাঁদেরকে বাদ দিলাম, কারণ অনেকেই হয়তো বলবেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য তাঁদের সর্বকালীন উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। যদিও তাঁদের সেরকম কোনো উপস্থিতি কোথাও ঠিক চোখে পড়ছে না, অথচ পৃথিবীতে অনাচার, অবিচার অবিরাম ঘটেই চলেছে।

কিন্তু হনুমান এবং বিভীষণের চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার কী প্রয়োজন ছিল বা এখনো আছে, সেই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। দুজনেই ভগবান বিষ্ণুর আরেক অবতার শ্রীরামচন্দ্রের কাছ থেকে অমরত্বের বর পেয়েছেন। এটা যেহেতু বর, এবং অশ্বত্থামার মতো তাঁদের মনে কোনো অপরাধবোধও নেই, অনুমান করা যেতে পারে যে তাঁরা তাঁদের পছন্দমাফিক জায়গায় অবস্থান করছেন, এবং জরা-ব্যাধি এসবের কোনো কিছুই তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি।

এরপরেও কি তাঁরা ভালো আছেন? একাকীত্বের বোঝা তাঁরা ঠিকঠাক বইতে পারছেন তো?  ওয়াশিংটনের আরভিঙের রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের গল্পটা  এখানে প্রাসঙ্গিক। অদ্ভুদ কিছু মানুষের পাল্লায় পড়ে, তাদের দেয়া পানীয় থেকে কয়েক যুগ ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে যখন রিপ ভ্যান উইঙ্কেল বাড়িতে ফিরে এলেন, ততদিনে তাঁর গ্রামের সবকিছু বদলে গেছে। ভাগ্যিস তাঁর ছোট্ট মেয়েটা যে কিনা ততদিনে অনেকে বড় হয়ে গেছে, সে রিপকে চিনতে পেরেছিল। ভাগ্যিস চিনতে পেরেছিল ! বাকী জীবনটা রিপ ভ্যান উইংকেল নাতি-নাতিনীদের গল্প শুনিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। কী ঘটছে হনূমান আর বিভীষণের বেলায় ? হনুমান তবু দুচারটে মন্দিরে পূজিত হন, এর কোন একটায় গিয়ে আশ্রয় নিলে দুচারজন ভক্তের কথাবার্তা তিনি হয়তো শুনতে পান, তাঁর অসীম একাকীত্বের কিছুটা হলেও কেটে যায়। কিন্তু বিভীষণ কী করছেন? এখন তো সেই রামও নেই, সেই লঙ্কাও নেই!

বর নামে চালানো হলেও গোটা ব্যাপারটা তাঁদের জন্য এক অর্থে অভিশাপ হয়ে গেল না? কী মূল্য আছে এই অর্থহীন বেঁচে থাকার? বিশেষ করে যদি বিভীষণের কথা বলি। লঙ্কার যে অবস্থা—কেউ বলে আজকের শ্রীলঙ্কা, আবার কেউ বলে আজকের মালদ্বীপ—রাবণের শ্রীলঙ্কা ! দুটি দেশের কোনো একটি বিশেষ ভালো অবস্থায় নেই। শ্রীলঙ্কা মাত্র কিছুদিন আগে অনেক কষ্টে দেউলিয়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে, মালদ্বীপের লোকজন মাছ ধরেই দিন কাটায়। সেটাও কতদিন করতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে—এই দ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেকোনো সময় পানির নিচে চলে যেতে পারে। আমার তো ধারণা, সুযোগ থাকলে অন্তত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এবং বিভীষণ এতদিনে মানুষের আদালতে ইচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করতেন।

শ্রীরামচন্দ্র যে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছেন, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, আসলে শ্রীরামচন্দ্র দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণে প্রকারান্তরে বিভীষণকে শাস্তিই দিয়েছেন, অশ্বত্থামার আদলে? দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছোট কোনো অপরাধ নয়। বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই অনেক মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে। সোনার লঙ্কা ট্রয় নগরীর মতো ধ্বংস হয়ে গেছে। হতে পারে, কিন্তু হনুমান এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের ক্ষেত্রে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার কারণটা কী ? এদের দুজন মোটাদাগে কোন অপরাধ করছেন, এমন কথা তো কোথাও চোখে পড়ে নি, অন্তত হনুমানের ক্ষেত্রে তো নয়ই ! নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদন করতে গিয়ে ব্যস, যদি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখি, তাহলে কিছুটা যৌন-বিকৃতির পরিচয় দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করা চলে না। তাহলে? চিরঞ্জীবিদের  চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার এই গোটা ব্যাপরটাই আসলে কেমন যেন গোলমেলে   


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929