ইতিহাসের চাকা চলে আপন গতিতে

রাহুল রায়


Nov. 25, 2024 | | views :70 | like:0 | share: 0 | comments :0

আরও একটি ২৩শে জানুয়ারি দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রতিবারের মতো এবারও পাড়ায় পাড়ায় নেতাজী স্মরণ করা হবে। বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। নেতাজীর ছবি, তাঁর বাণী, তাঁর বীর গাঁথায় সাজানো ছবি, লেখা দিয়ে ভরে থাকবে সবক'টি অনুষ্ঠান মঞ্চ। সেদিন শাসক – বিরোধী - ছদ্ম বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সামাজিক মাধ্যমের প্রফাইলে নেতাজীর ছবি ও নামটি কিছু সময়ের জন্য জ্বলজ্বল করবে। এরপরেই শুরু হবে নেতাজীকে নিয়ে এদের তরজা। শাসক দল ১৯৪০ সনে কংগ্রেস থেকে তাঁর বহিষ্কার প্রশ্নে তাঁকে অকংগ্রেসী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে তুলে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। হয়তো এবারও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং নেতাজীর টুপি পড়ে এই মর্মে বক্ততা দেবেন। সংবাদমাধ্যম নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক রঙে নেতাজীকে রাঙানোর চেষ্টা করবে। যার অধিকাংশের রঙ আবার শাসক দলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এর বিপরীতে নেতাজীর অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী,  প্রগতিশীল মনন নিয়ে বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তবে এই সবই কিন্তু ওই একদিনের জন্যই। ২৩ জানুয়ারি যেতেই আবার সব যে যার জায়গায় চলে যাবে। পরের বছর আবার সেই একই চিত্র নতুন মোড়কে জনসমক্ষে পরিবেশিত হবে।

বলতে বাধা নেই এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাই করুক না কেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আপামর ভারতবাসী থেকে যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছেন সেটা তার আগে বা পরে কারোর কপালেই জুটেনি। হওয়ার কথাও নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনের সূযোগ যখন তার পাদদেশে অপেক্ষা করছিল তিনি তখন সেই সূযোগকে চরম অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেশ ও দেশের স্বাধীনতাকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও আপামর দেশবাসীর স্বাধীনতা। শুধু দেশ বা একটি ধর্মে বিশ্বাসী বা ভাষায় কথা বলা মানুষের স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। এখানে দেশের স্বাধীনতা ও দেশ ও দেশবাসী স্বাধীনতার পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া দরকার। উভয়ের মধ্যে শব্দের ব্যবধান বেশি না হলেও অর্থগত পার্থক্য বিরাট। প্রথমটিতে আমরা ফ্যাসিস্ট সুলভ চিন্তা পাই যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যই শেষ কথা, রাষ্ট্রই সর্বময়, মানুষ সেখানে রাষ্ট্রের নামে পরিচালকদের অনুগত প্রজাবৃন্দ, সেবক, তাদের প্রয়োজন, চাহিদা অনেকটাই গুরুত্বহীন। দ্বিতীয়টিতে পাই সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতার বার্তা। রাজনৈতিক ভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার মধ্যে থাকা একটি শিক্ষিত, রুচিশীল, প্রগতিশীল  অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন সমাজ। যেখানে প্রজার সর্বাঙ্গীন উন্নতিই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়। আজকের শাসকরা নেতাজীকে প্রথমটির সমর্থক হিসাবে তুলে ধরে নিজেদের পাশে আনতে চাইছেন। এজন্য অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে সব রকমের কূট কৌশল।  অথচ বাস্তবটা হল তিনি প্রথমটির অর্থাৎ অন্ধ জাতীয়তাবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এতটাই যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্যাসিস্ট সাহায্য নিয়েও হিটলারের বিরোধীতা করতে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বায় লাগাম পড়েনি। স্বাধীন ভারতে তিনি থাকলে আজকের রাজনীতি আর যাই হোক, বর্তমান অবস্থায় যে থাকতো না তা হলফ করে বলা যায়।


নেতাজীর জীবনে নিয়ে নিঃসন্দেহ  জনমানসে সবচেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক পর্ব সম্ভবত ১৯৪৫ সনের ১৮ আগষ্ট ও তার পরবর্তী অংশ। জাপানি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে ২১ আগষ্ট পৃথিবী জানতে পারে যে ১৮ আগষ্ট তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষের মৃত্যু হয়েছে। 


তবে এই খবরের মধ্যে এতোই ত্রুটি ও পরস্পর বিরোধীতা ছিল যে অচিরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ জাগতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু কেউই এই ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি। নেতাজী অনুরাগী দেশবাসীর কথা তো বলেই লাভ নেই৷ সময়ে সময়ে তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, মধ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে ধোঁয়াশাঘেরা করে রাখে। আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে নেতাজীর সমসাময়িক সব নেতাই প্রায় গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সরকারী নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ প্রায় কোনো রকম দৃঢ প্রমাণ ছাড়াই একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যুকে মেনে নেওয়া হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনানী শাহানুয়াজ খান কমিশন, বিচারক জি ডি খোসলা কমিটিও সরকারের বক্তব্যেই সায় দেয়৷ উল্লেখযোগ্য যে এরা কেইই তাইহোকুতে যাননি। অবশেষে ১৯৯৫ সনে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে  বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির নেতৃত্বে ঘটিত কমিশন তাইহোকু বা বর্তমান তাইওয়ান ঘুরে এসে জানায় যে যা তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে পরিষ্কার ১৮ আগষ্ট কোনো বিমান দুর্ঘটনা হয়নি এবং নেতাজী স্বাভাবিক ভাবেই তারপরেও বেঁচে ছিলেন। তখন দেশে  শাসনাধিষ্ঠিত কংগ্রেস সরকার। ২০০৬ সনে তারা মুখার্জী কমিশনের রিপোর্টকে সংসদে নাকচ করে দেয়। 


২০১৪ সনে দেশের শাসনে পরিবর্তন আসে। নেতাজী অনুরাগী সহ দেশবাসীর মনে একটি আশা জাগে যে এবার বোধহয় দেশনায়কের জীবনের ওপর থাকা রহস্যের আবরণ সরানো হবে। সরকারও এই ব্যাপারে তৎপর হয়ে নেতাজী সম্পর্কিত সব গোপন নথী জনগণের সামনে তুলে ধরবে বলে জানায়। কথামতো ফাইলগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলেও ধরা হয়। একই পথ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও৷ অর্থাৎ সরকারের কাছে এই মর্মে আজ আর কোনো নথী গোপন নেই৷ সমস্যা হল যা নথী বেরিয়ে আসল তাতে সেই রহস্যের ওপর থেকে এই মিলিমিটার আবরণও কিন্তু সরানো গেল না। নেতাজী ১৯৪৫ সনে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কি না রহস্যটি রহস্যই থেকে গেল। এমনকি কংগ্রেস সরকার বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির যে রিপোর্টটি নাকচ করে দেয় বর্তমান সরকার সেই রিপোর্টটি নিয়ে গত আট বছরে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিস্তম্ভটিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন কিন্তু তাঁর অধীনস্থ সরকার আজও দেশবাসীকে বলতে পারেনি যে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে আদ্য কতজন সেনানী ছিলেন, কতজনই বা শহীদ হোন, কেন আজও তাঁদের বীরত্বের ইতিহাসকে সেনাবাহিনীর ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পদে পদে ইতিহাস বদল করা হলেও এই ব্যাপারে সরকার জগন্নাথের ভূমিকাতেই স্বচ্ছন্দ। কিছুদিন আগে নেতাজীর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বাইক রেলীর অংশ হয়ে মৈরাঙ যাওয়া হয়েছিল। সেখানে জাপানী সেনানীদের সম্মানার্থে জাপান সরকার স্মৃতিসৌধ বানিয়ে রেখেছে, নাগাল্যান্ডের কোহিমা শহরে ব্রিটিশ সরকার একই কাজ করেছে।  অথচ এই দুই শহরেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের উদ্দেশ্যে কোনো সৌধ নেই৷ ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই করেনি। নাগাল্যাণ্ডের ফেক জেলার চেসেজু গ্রাম নেতাজীর স্মৃতি সগর্বে বহন করে চলেছে। ভারতের ভেতরে এই গ্রাম পর্যন্তই নেতাজী আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে আসতে পেরেছিলেন৷ সেখানে স্থানীয় মানুষ নেতাজী স্মৃতিতে একটি পাহাড়ের নামকরণ করেছিলেন। আজও প্রতিবছর শ্রদ্ধা, আবেগে এখন ঘটা করে নেতাজী স্মরণ করা হয়। তবে সরকারী সাহায্য, স্বীকৃতি ছাড়া সেখানের মানুষ কতদিন নেতাজী তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীর অমূল্য স্মৃতিচিহ্নগুলোকে কালের করাল থাবা থেকে রক্ষা করতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন।

নেতাজী সুভাষ জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস থেকে কোনোকালেই যোগ্য ব্যবহার পাননি। জওহরলাল নেহেরুর উত্তরসুরীরা একই পথ ধরে নেতাজী বিরোধিতা করে গেছেন। এতে অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু তা বলে নেতাজী ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদী বা অন্ধ জাতীয়তাবাদী ছিলেন বলে মেনে নেওয়া বা তার প্রচার করা নেতাজী তথা এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার নামান্তর হবে। সেরকমই কিছু বিশ্বাসঘাতক অহরহ প্রচার করে চলেন যে সমসাময়িক হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দেখানো পথেই নাকি নেতাজী সুভাষ ও মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানের মাটিতে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪০ সনের জুলাই মাসে হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের সঙ্গে নেতাজীর দেখা করার ঘটনাটির উল্লেখ তাঁরা এই মর্মে করে থাকেন। অথচ একই সময়ে নেতাজী মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহের সঙ্গেও দেখা করেন।  উভয়ের কাছে তাঁর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একই৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের সহযোগিতা চাওয়া। সেদিন উভয়ই নেতাজীকে ফিরিয়ে দেন। স্বরচিত The Indian Struggle পুস্তকে যার বিস্তারিত বিবরণী তিনি দিয়েছেন। নেতাজীর কাছে দেশের স্বাধীনতার থেকে বড় কোনো আদর্শ ছিল না, যার জন্য পরবর্তীতে তিনি কমিনিস্ট সোভিয়েত ও ফ্যাসিস্ট জার্মানীর কাছেও যান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে যুদ্ধে কমিনিস্ট রাশিয়া নেতাজীকে সমর্থন না করলেও তাঁর বিরুদ্ধাচারণও কোনোদিন করেনি। জার্মানি ও জাপান, দুই ফ্যাসিস্টবাদী দেশের সাহায্যই তিনি পেয়েছেন। এমনকি ইস্লামিক জাতীয়তাবাদী মুসলিম লিগ পরবর্তীতে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে আসলেও হিন্দু মহাসভা বা অন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো কিন্তু সুভাষ বিরোধীতার পথ থেকে কোনোদিন সরে আসেনি। আজ তাঁদের উত্তরসূরীরাই দেশের শাসনে এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এরা জওহরলাল নেহেরুর দৈন্য মানসিকতার সূযোগ নিয়ে নেতাজীকে নিজেদের শিবিরে আনতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতিহাসের শাস্তি বোধহয় একেই বলে, যাকে একদিন রিক্ত হস্তে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ তাঁকেই নিজেদের পাশে আনতে নিজেদেরই ইতিহাস ভূলে যেতে হচ্ছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হচ্ছে না । 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929