গাছেদের কথা

রাজু দত্ত


May 19, 2025 | | views :12 | like:0 | share: 0 | comments :0

সেই তেঁতুল গাছটার কথা মনে হলে আমি এখনও প্রিয়জন হারানোর শোক অনুভব করি। ছেলেবেলায় সেই গাছটা ছিল আমাদের একান্ত আপন। 

গাছের নীচে সুশীতল ছায়ায় আমরা বেঁধেছিলাম একটা মাচা। এই মাচাটাই ছিল আমাদের ছেলেবেলার প্রখর গরমের দিনে একমাত্র আশ্রয়। আমরা সেই মাচায় বসে কত আড্ডা দিতাম। Rank card খেলতাম, গল্প গুজব করতাম। কখনও বা মাচায় শুয়ে ঘুমাতাম অঘোরে। স্কুল ছুটি থাকলে তেঁতুল গাছের নীচে বাঁধা এই মাচাতেই আমরা দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতাম। 


গাছটা মারা গেলো। তাকে মেরে ফেলা হলো নির্মমভাবে। মালিকের আরও বাড়ি বানানোর প্রয়োজনে মেরে ফেলা হলো আমাদের প্রিয় তেঁতুল গাছটাকে। তেঁতুল গাছটার কত প্রতিবেশী ছিল। একে একে নিহত হলো অনেকেই। নিহত সেই গাছের স্থান দখল করলো ছোটো বড়ো রঙীন সুসজ্জিত বাড়ি ও অট্টালিকারা। পাকা ও চওড়া হলো রাস্তাঘাট। তৈরি হলো কত অফিস, স্কুল কলেজ, সেতু, সুইমিং পুল,,,,,। 


একসময় এ তল্লাট জুড়ে ছিল দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত। ক্ষেতজুড়ে মহানন্দে নৃত্য করত ধান আর মরশুমি সবজির গাছেরা। ছিল আরও কত গাছ। বট, বাবলা, ক্ষিরিশ, তাল, গাছেদের নামে এখানে কত পাড়ার নাম জানো। 


তখন আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিলনা। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের দিনে, আমরা বসতাম গিয়ে  গাছেদের কাছে। তারা প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকতো হাসিমুখে। ডাকতো আমাদের। বলত, কৈ রে গরমে কষ্ট পাস বুঝি! আয় আয় একটু বোস দিকিনি আমাদের কাছে। আয়.....”।


 জল পিপাসা পেত ওদেরও। ওরা ইশারায় বলত সে কথা। আমরা  বালতি করে জল ভরে নিয়ে ভিজিয়ে দিতাম ওদের শিকড়। ওরা আনন্দে নেচে উঠতো। ডালপালা নেড়ে ওদের সে কি নাচ্। আমরা ওদের নাচ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম। 


শুধু কি দিনের বেলা? রাতেও ছুটে যেতাম আমরা আমাদের গাছেদের সাথে দেখা করতে। ওদের পাশে বসে আমরা কত গল্প করতাম, গান গাইতাম, দুষ্টুমি করতাম। মাঝেমাঝে আরামে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়ির বড়োরা এসে ডেকে নিয়ে যেতো। কেউ বলত “হ্যাঁ রে তোদের ঘরবাড়ি নেই? গাছতলায় শুয়ে আছিস!” আমরা হাসতাম। 


আমরা ঢিল ছুঁড়ে যখন গাছেদের ডাল থেকে ফল পেড়ে খেতাম, গাছেদের আঘাত লাগতো, ওরা কোনও প্রতিবাদ করত না। ওরা নীরবে সহ্য করত সে আঘাতের যন্ত্রণা। প্রতিবাদ করত মালিক। গাছেদের মালিক বকা দিত আমাদের। আমরা ফল খেতাম খিদে মেটাতে। আর সেই মালিকেরা  অট্টালিকা বানানোর জন্য, উন্নত শহর বানানোর জন্য কি নির্মমভাবে হত্যা করলো গাছগুলোকে। আমরা প্রতিবাদ করিনি। 


গাছেরা যাবার সময় বলে যেতো, “তোরা তো আমাদের বন্ধু, আমাদের ওরা এভাবে মেরে ফেলছে, তোরা নীরবে দেখে গেলি! কিছু বললি না! বাধা দিলি না! আমরা বলতাম, “আমরা তো মালিক নই।” গাছেরা বলত, “বাহ্ রে স্বার্থপরের দল! আমাদের কাছে এসে যখন শীতল ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকতিস, যখন আমাদের ডাল পালায় আঘাতের পর আঘাত করে ফল পেড়ে খেতিস, তখন তো আমি বলিনি, “যা যা আমি মালিককে ফল দেবো, ছায়া দেবো, তোরা দূর হ। বুঝবি যেদিন থাকবোনা, সেদিন বুঝবি তোরা‌।”


বলতে বলতেই তাদের ওপর নেমে আসতো তীক্ষ্ণ কুঠারাঘাত। যন্ত্রণায় অস্ফুটে চিৎকার করত গাছগুলো। আমরা তখন উন্নত শহরের জন্ম দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। ঝা চকচকে একটা শহর। যেখানে থাকবে বিশাল বিশাল রঙীন অট্টালিকা, চওড়া রাস্তাঘাট, সেতু, সুইমিং পুল, দোকানপাট, অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ,,,,,। হুস্ হুস করে সারাদিন ছুটে যাবে অজস্র গাড়ি। উফফ কি অসম্ভব সুখ পেতাম আমরা এটা ভেবেই। যেন স্বপ্ন মনে হতো। রঙীন স্বপ্ন!


আজ আমাদের গ্রামগুলি বদলে গেছে শহরে। আমাদের স্বপ্নের শহর। আমরা কত আধুনিক হয়েছি। এখনও গাছেরা আছে। তবে অধিকাংশ ফুলের গাছ। ফ্ল্যাটের জানালায়, বাড়ির ছাদে তাদের দেখা যায় এখন। বৃক্ষদের ভিড় তেমন আর চোখে পড়েনা আগের মতো। তাও সেইসব বৃক্ষরাজির কাছে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সর্বত্র। কোথাও সেই নির্দেশ কোনও ব্যক্তির, কোথাও বা সরকারের।‌ যে যেখানে মালিক আর কি!  


কিন্তু কোথায় যেন একটা কষ্ট হচ্ছে। কিসের কষ্ট এটা? এ কি! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে কেন! অক্সিজেন কি কমে গেলো নাকি পৃথিবীতে? এত গরম লাগছে কেন আমার? কি অসহ্য উষ্ণ বাতাস আমার চোখেমুখে অবিরাম আঘাত করে চলেছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে? 


আমায় একটু ছায়া দাও, একটু শীতল বাতাস করো আমায়। কেউ শুনতে পাচ্ছো? কেউ নেই! সবাই গেলো কোথায়! কৈ কেউ শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো হ্যালো,,,,আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এসি টা চালাও,,,,, অক্সিজেন সিলিন্ডারটা একটু,,,,, হ্যালো,,,,কেউ আছো.....হ্যালো....

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929