দেরি
-প্রদীপ চক্রবর্তী
দুনিয়া চলে নিয়ম মেনেই
ভাগ্যের স্থান নেই,
নিজের উপর বিশ্বাস হারালে
ভয় চেপে বসবেই।
মানবধর্ম সেখায় যে প্রেম
তুমি-আমি একাকার,
যুক্তিবাদীরাই আসল ধার্মিক
দূর করে অনাচার।
আমরা সবাই হোমো স্যাপিয়েনস
রক্তের রং লাল,
আজকেই শোধরাও; করেছ যে ভুল
দেরি হয়ে যাবে কাল।
দুর্গা-কোরান
-অমিতাভ ভট্টাচার্য
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
রোজের জীবন এমনিতে জেরবার
"ধর্মতে হাত দিও না খবরদার ।"
পেট না ভরুক ধর্মরক্ষা হোক,
খরচা হবে খুচরো কিছু লোক ।
লাশের আবার জাতের বিচার চাই,
কে দুশমন কোনটা আমার ভাই?
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
রক্তখাকি ধর্মরা সব নাচে
ওপার তোমার, এপার আমার আছে ।
সীমান্ততে কঠিন কাঁটাতারে
ঘেন্নাকে কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে?
দুগ্গি ঠাকুর এবং আল্লা মিঞা--
কোনটা ক্রিয়া কোনটা প্রতিক্রিয়া?
আসুন, এবার সূক্ষ্মবিচার হোক
খরচা হলো খুচরো কিছু লোক ।
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে
-আখতারুজ্জামান আজাদ
"এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে;
বক্ষ ভাসাও, ফিলিস্তিনে খুনের খবর পেলে।
রোহিঙ্গাদের দুঃখে তুমি এমন কাঁদা কাঁদো;
ভাসাও পুরো আকাশ-পাতাল, ভাসাও তুমি চাঁদও!
অশ্রু তোমার তৈরি থাকে— স্বচ্ছ এবং তাজা;
হ্যাশের পরে লিখছ তুমি— বাঁচাও, বাঁচাও গাজা।
কোথায় থাকে অশ্রু তোমার— শুধোই নরম স্বরে,
তোমার-আমার বাংলাদেশে হিন্দু যখন মরে?
মালেক-খালেক মরলে পরে শক্ত তোমার চোয়াল;
যখন মরে নরেশ-পরেশ, শূন্য তোমার ওয়াল!
তখন তোমার ওয়ালজুড়ে পুষ্প এবং পাখি,
কেমন করে পারছ এমন— প্রশ্ন গেলাম রাখি।
তোমরা যারা দত্ত-কুমার, মৎস্য ঢাকো শাকে;
কবির লেখা পক্ষে গেলেই ভজন করো তাকে।
মুসলমানের নিন্দে করে লিখলে কোথাও কিছু;
তালির পরে দিচ্ছ তালি, নিচ্ছ কবির পিছু।
কিন্তু তোমার অশ্রু, আহা, কেবল তখন ঝরে;
বাংলাদেশের কোথাও কেবল হিন্দু যখন মরে!
পুড়লে তোমার মামার বাড়ি, জীবন গেলে কাকুর;
তখন তোমার কান্না শুনি— রক্ষে করো, ঠাকুর!
কালীর ডেরায় লাগলে আগুন তখন কেবল ডাকো,
রহিম-করিম মরলে তখন কোথায় তুমি থাকো?
বাংলাদেশে সুশীল তুমি, ভারতজুড়ে যম;
মুসলমানের মূল্য তখন গরুর চেয়ে কম!
বাংলাদেশের কস্তা-গোমেজ— যিশুর দলের লোক;
বোমায় ওড়ে গির্জা যখন, তখন কেবল শোক।
বস্তাভরা শোকের রঙে কস্তা তখন রাঙে,
যিশুর নামে মারলে মানুষ নিদ্রা কি আর ভাঙে!
মরণ হলে মুসলমানের, হয় না কাঁদার ইশু;
গভীর ঘুমে থাকেন তখন বাংলাদেশের যিশু!
খেলার ওপর চলছে খেলা— টমের সাথে জেরি;
বঙ্গদেশের সন্তানেরা এমন কেন, মেরি?
তোমরা যারা কস্তা-গোমেজ কিংবা রোজারিও;
মুখের ওপর মুখোশ খুলে জবাব এবার দিয়ো।
রোহিঙ্গাদের রক্তে যখন বার্মা মরণ-কূপ;
বাংলাদেশের বৌদ্ধ যারা, মড়ার মতোন চুপ!
ভিক্ষু যখন বলছে হেঁকে— রোহিঙ্গাদের কাটো;
তখন কেন, হে বড়ুয়া, ওষ্ঠে কুলুপ আঁটো?
এমন করেই মরছে মানুষ ধর্ম নামের ছলে;
বাংলাদেশের বৌদ্ধ কাঁদে, বুদ্ধ যখন জ্বলে।
যখন জ্বলে বৌদ্ধবিহার, যখন রামুর পাহাড়;
সব বড়ুয়ার জবানজুড়ে শান্তিবাণীর বাহার!
শান্তিবাণীর এমন বাহার তখন কোথায় থাকে,
রোহিঙ্গারা যখন মরে নাফের জলের বাঁকে?
পাগড়ি দেখি, পৈতা দেখি, আকাশজুড়ে ফানুশ;
চতুর্দিকে চতুষ্পদী, হচ্ছি কজন মানুষ!
জগৎজুড়ে সৈয়দ কত, কত্ত গোমেজ-বসু;
খতম কজন করতে পারি মনের মাঝের পশু!
মরণখেলায় হারছে কে বা, জিতছে আবার কে রে;
মরছে মানুষ, দিনের শেষে যাচ্ছে মানুষ হেরে।
হারার-জেতার কষতে হিশেব মগজ খানিক লাগে,
একটুখানি মানুষ হোয়ো কফিন হওয়ার আগে।
রক্তখেলা অনেক হলো, সময় এবার থামার;
বিভেদ ভুলে বলুক সবে— সকল মানুষ আমার।
বন্ধ ঘরের দরজা ভাঙো, অন্ধ দু-চোখ খোলো;
মরছে কেন আমার মানুষ— আওয়াজ এবার তোলো।"
জ্যোতিষ শাস্ত্র ও দেশসেবা
-নির্মল
[দুই বন্ধু, একজন আরেকজনকে দেখে ডাকছে]
১ম বন্ধু :এই বন্ধু শোননা শোন শোন,
কি হলো, পালাস কেন!
আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
২য় বন্ধু :তুই বড্ড পিছনে লাগিস,
অবান্তর প্রশ্ন করা তোর অসুখ।
১ম বন্ধু : যাব্বাবা! প্রশ্ন ছাড়া নতুন কিছু জানা যায় নাকি!
বিনা প্রশ্নে অন্ধের মতো মেনে নিলে,
জীবনটা তো হয়ে যাবে ফাঁকি।
২য় বন্ধু :এটাই তো তোর দোষ।
ছাড় ধুর!
শুনিস নি শাস্ত্রে বলা আছে,
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
সেই বিশ্বাসী তোর নাই।
১ম বন্ধু : তুই ঠিক বলেছিস ভাই,
অন্ধবিশ্বাস কিছুই আমার নাই।
শোননা, আজ নতুন কথা বলব।
প্রমিস করছি, পিছনে লাগবোনা তোর।
২য় বন্ধু : মনে থাকে যেন, করছিস প্রমিস।
১ম বন্ধু: একদম, আয় না একটু গল্প করি,
তোর জন্য একটা ভালো কথা আছে।
তোর সাথে দেখা হল ভাগ্যিস।
২য় : আমার জন্য ভালো কথা!
চল ওই গাছ তলাতেই বসি।
১ম: চল তাই চল।
[দুই বন্ধু গাছ তলাতে গিয়ে বসলো]
২য়: বল এবার কী বলবি বল?
১ ম: আমি এতদিন জ্যোতিষ নিয়ে তর্ক করে,
করেছি ভুল খুব
তুই আসলে সঠিক ছিলি,
আমিই বেয়াকুব।
তুই কি জানিস, বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের মত
জ্যোতিষশাস্ত্রও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে ;
জ্যোতিষ যদি ভুলিই হতো
সরকার কি এমন সিদ্ধান্ত নেয় তবে!
২য় : আবার তুই ঠাট্টা করছিস!
হেঁ হেঁ,
জ্যোতিষ শাস্ত্র সিলেবাসে -
ইম্পসিবল!
১ম : বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা,
পেপারে দিয়েছে দেখ তবে;
এইবার থেকে ইগনু বিশ্ববিদ্যালয়ে
জ্যোতিষ নিয়ে বছর দুয়ের
মাস্টার ডিগ্রি করা যাবে।
২য় : বলিস কি !
দেখি দেখি,
এমন হয় নাকি !
সে কি!
১ ম: এমনি হয়েছে বন্ধু আমার।
২য় : তাহলে,
খুব তো জ্ঞান মারতি আমায়,
আদিম কুসংস্কার।
স্বার্থপর মানুষ ব্যবসা
সব জ্যোতিসি ভন্ড বলে,
বল বল এবার।
১ম : বললাম তো,
অন্যায় হয়েছে সরি
দেখ না!
কান ধরেছি দেখ,
২য় : থাক আর অভিনয় করতে হবে না,
তোর বিশ্বাস ফিরেছে,
এটাই অনেক।
বল তাহলে এরপর?
১ম : মাথায় একটা প্ল্যান আছে জব্বর।
দেখ তুই আর আমি ছাত্র ভালো।
ডিগ্রি কি আছে কম!?
ভাগ্য খারাপ, তাই বেকার বসে
চেষ্টা চলছে হরদম।
চল বন্ধু,
এবার জ্যোতিষ পড়ি,
ভাগ্য যাবে বদলে।
দেশে সেবার এই তো সুযোগ
হারাবি পায়ে ঠেললে।
২য় : অ্যাঁ! কি বলছিস যা্তা!
দেশসেবার সঙ্গে জ্যোতিষ, কি সম্পর্ক?
গেছে নাকি তোর মাথা।
১ম: আরে পাগল, আমার মাথা ঠিকই আছে।
একটু ভাবনা চিন্তা কর।
জ্যোতিষ পড়াচ্ছে কি এমনি এমনি,
সরকারের কোন দরকার!
দু'বছর পর দেখবি, কর্মক্ষেত্রে বড় বড় বিজ্ঞাপন -
অমুক বিভাগে মাস্টার ডিগ্রি জ্যোতিষ চাই।
এসসি ৩০, এসটি ১০, জেনারেল ৫০
মোট নব্বই জন।
সচিবপদ বিলুপ্ত হবে।
জ্যোতিষ হবে পরামর্শদাতা।
আরে পৌরাণিক যুগে যেমন হত।
জ্যোতিষীই শেষ কথা।
২য় : বন্ধু তোর অনেক ট্যালেন্ট,
আমি তাতো জানি।
কিন্তু,
জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ার আগেই,
শুরু করে দিলি ভবিষ্যৎবাণী!
১ম : হ্যাঁ, তুইও শুরু কর প্র্যাকটিস।
২য় : আমায় ছাড়,
তুইই জ্যোতিষের চাকরি নিস।
১ম: সে তো নেবই,
তলার পর তলা হাঁকিয়ে বাড়ি বানাবো।
ইনকাম ট্যাক্সহীন কোটি কোটি টাকা কামাবো।
আর, বিদেশী সব গাড়ি তো আছেই,
নেতা মন্ত্রী পুলিশ উকিল সব পকেটে পুরে,
সারা জীবন কাটাব মহা রঙ্গে।
চিন্তা নেই প্রিয় বন্ধু।
প্রমিস করছি,
তোকেও নেব সঙ্গে।
২য় : ছাড়, ওসব ছ্যাবলামি ছাড়!
আসলে গল্পটা তোর খারাপ লাগছে না,
ওটাই শুধু বলনা ভালবেসে।
জ্যোতিষের সঙ্গে দেশসেবা
কোনখানেতে মেশে।
১ম : দেশসেবা!
শোন তবে,
জ্যোতিষের কিছু সাধারন ক্ষমতায় আসি।
ভুল যদি কিছু বলি
তবে তোকেই,
ধরিয়ে দিতে হবে।
২য় : ঠিক আছে বল তবে।
১ম : জ্যোতিষী তো আয়ু বলতে পারে
হাত দেখে বা কুষ্টি বিচার করে।
২য় : তাতো পারেই।
১ম: আবার দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগও
কাটিয়ে দেওয়া যায়।
পাথর শেকর বেঁধে,
আঙুল, বাহু, মাজায়।
২য় : হ্যাঁ, তাও হয়।
১ম: আবার দেখি বিজ্ঞাপনে,
জ্যোতিষীরা সিদ্ধহস্ত শত্রু দমনে।
বানমারা বিদ্যারও জ্ঞান রয়েছে,
পটু সব বশীকরণে।
২য় : এসব তো পারেই,
আসল কথায় আয় না -
১ম : বলতো প্রতিবছর আমার দেশে,
শহীদ হয় কত বীর সেনা।
কত মা সন্তান হারায়,
কত নারী স্বামী,
কত সন্তান পিতৃহারা হয়,
যারা আমাদের রক্ষা করে ;
তাদের জীবনটা এত কমদামী!
এদের জীবন রক্ষা করতে চাই,
জ্যোতিষের ক্ষমতা দিয়ে।
সরকারেরও হয়তো সেই ইচ্ছে
উন্নত জ্যোতিষী তৈরি করবে,
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে।
২য় : মানে কি?
১ম : মানে অতি সহজ কথা,
প্রথমত, সেনা রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে
থাকবে জ্যোতিষী পরামর্শদাতা।
হাত দেখে বা বিচার করে কুষ্টি
আয়ু তার কতদূর আছে দেখে,
তবেই নিযুক্ত করা হবে;
যদি জ্যোতিষীর হয় সন্তুষ্টি।
আয়ু যাদের কম আছে,
তারা প্রথমেই হবে রিজেক্ট,
মৃত্যুহার এমনিতেই কমবে,
রিক্রুটমেন্ট হবে পারফেক্ট।
২য় : কথায় তোর যুক্তি আছে,
বলে যা তারপর।
১ম : তারপর ধর যাদের আছে,
দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ,
অথবা যাদের উপর শনির দৃষ্টি,
ঘাড়ে চেপে রাহু কেতুর গুষ্টি,
তাদের ধরে -
নীলা গোমেদ ক্যাটসাই গুঁজে দেবে।
ব্যাস খেল খতম,
সবাই দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ থেকে রক্ষা পাবে।
শনি রাহু সব নিপাত যাবে,
শত্রু ছোড়া গুলি বোমা,
তখন অকেজো হবে।
বড়জোর থার্টি ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে,
কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
২য় : বাবা!
এরপরও কি আছে কোন প্ল্যান?
১ম: আর, শত্রু দমনের স্পেশালিষ্টদের,
বসিয়ে দেওয়া হবে বর্ডারের ধারে।
শত্রু সব বিনাশ করবে,
আধুনিক সব বাণ মেরে।
আর আনাচে-কানাচে যত আছে সব জঙ্গী,
যত আছে তাদের সঙ্গী,
এমন বশীকরণে বশ হবে সব যাতে;
ফ্রেন্ডশিপডে তে গোলাপ দেয় সব,
জনতার হাতে হাতে।
২য় :বন্ধু,
লজিক তোর পারফেক্ট আছে,
যতই করিস না ব্যাঙ্গার্থ।
জ্যোতিষের যখন এতই ক্ষমতা,
তখন এইসব তাদের পারা উচিত,
যাতে বাঁচবে জীবন, বাঁচবে দেশের অর্থ।
ধন্যবাদ বন্ধু,
এতদিন সত্যিই ছিলাম অন্ধ।
তোর লজিকেই কেটে গেল,
মনের সব দ্বন্দ্ব।
সত্যি, শিক্ষিত হলেই হয়না শুধু,
চাই যুক্তিবাদী মন,
যুক্তি দিয়ে বিচার করে
তবেই,
সত্যি-মিথ্যা করতে হয় গ্রহণ।
বুঝেছি এবার জ্যোতিষ শিক্ষা,
কেন চালু হল,
কি আসলে ওদের তাল,
দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে,
দেশটাকে লুটে পুটে খেয়ে,
পিছিয়ে দেবার চাল।
১ম : ধন্যবাদ তোকেও বন্ধু,
তুই এত সহজেই গ্রহণ করেছিস সত্যযুক্তি।
সমাজটাকে এগোতে চাই,
এই সমস্ত কুসংস্কার থেকে মুক্তি।
চল আজ ওঠা যাক তবে,
[হাতের আংটিগুলো খুলে বন্ধুর কাছে এগিয়ে দিয়ে]
২য় : সে নয় হল,
কিন্তু, এই সোনা বাঁধানো লালনীল পাথরগুলোর কি হবে,
এই বাঁধন গুলো বিক্রি করে চল,
কার্শিয়াং ঘুরতে যাই।
মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেব,
কুসংস্কারকে করে বাই বাই।
আইডিয়াটা কেমন বল ,
কি বলতে চাস?
১ম : চল তবে,
ডাকছে আকাশ ডাকছে বাতাস,
মুক্ত বাতাসে নেবই শ্বাস।