প্রশ্ন:
বামপন্থী ঘরানার ইতিহাসবিদ রা এখন একটু অন্যরকম বললেও চিরকাল ইসলামিক আগ্রাসন এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন এগুলোর সাথে ধর্মের যোগ নেই। কিন্তু ইসলামী ইতিহাসকার রাই বলেছেন যেমন তামীম আনসারী যে তুর্কী সুলতান নিজেদের বেশী মুসলিম প্রমান করার জন্য এত অত্যাচার করেছে। যেখানে আরব রা সেভাবে কোনো জাতির ওপর অকারণ আগ্রাসন চালায়নি। বামপন্থীরা এই ক্ষেত্রে সিলেক্টিভ কেন? আমি বলে রাখি আমি বামপন্থার অনেক বিষয়ের সাথে একমত কিন্তু ইসলামী আগ্রাসন নিয়ে নীরবতায় রাজি হতে পারিনা। আবার চীন যখন উইঘুর দের ওপর অত্যাচার করে সে নিয়েও চুপ(except CPIML Liberation). এই প্যারাডক্স বুঝতে পারিনা।
অভিজিৎ ভট্টাচার্য
বৈদ্যবাটি, হুগলি
উত্তর:
“আপনার প্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গের দিকে আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন। মার্কসবাদী চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে এর উত্তর দেওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে বামপন্থী ঘরানা একটা বেশ বড় স্পেকট্রাম। সেই কারণে এই ঘরানার ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিভঙ্গিও বিভিন্ন রকমের, সেটা ভারতের প্রসঙ্গেই হোক বা বিশ্ব প্রসঙ্গে। বামপন্থী ইতিহাসবিদরা কতটা সিলেকটিভ বা কতটা নয় সেই প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি রেখে আসুন বরং ভাবা যাক ইসলামিক আগ্রাসনের সাথে ধর্মের কোনো যোগ আছে কিনা। ইসলামিক আগ্রাসন এক প্রকার ধর্মীয় মৌলবাদ। যে কারণে ধর্মীয় মৌলবাদ আর ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়, ঠিক সেই কারণেই ইসলামিক আগ্রাসন আর ইসলাম ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় বলেই মনে হয়। ধর্ম একটা অযৌক্তিক ধারণা বলে একজন নিপাট সাদামাটা ধার্মিক মানুষের সাথে হিংস্রতায় পরিপূর্ন রক্তপিপাসু মৌলবাদীদের একই পর্যায়ভুক্ত হিসাবে বিবেচনা করাটা মার্ক্সবাদ অনুযায়ী অনুচিত বলেই মনে হয়।
মার্ক্সবাদ একটা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন। প্রতিটা সমস্যার আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ না করে সেটাকে হঠাৎ আবির্ভূত হিসাবে দেখাটা আর যাই হোক মার্ক্সবাদ সম্মত নয়। ধর্ম একটা ভাববাদী ধারণা। সমাজে শ্রেণীবিভাগের উৎপত্তির সাথে সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, সেই শ্রেণী বিভাগকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে। নিতান্তই প্রতিক্রিয়াশীল একটা ধারণা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্ক্স স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে এ হলো সর্বহারা শ্রেণীর দীর্ঘশ্বাস, কারণ ধর্ম ছাড়া তার কাছে আকড়ে ধরার জন্য আর কিছু নেই। তাই মার্ক্সবাদ অনুযায়ী অর্থনীতি হলো ভিত্তি, আর ধর্ম হলো উপরিকাঠামো। শোষক শোষিতের ভিতরকার অর্থনীতিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক বদল না ঘটিয়ে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সংস্কার ঘটতে পারে মাত্র। এখানে বিপরীতে তথাকথিত নাস্তিকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ধর্মের ভিত্তিটাকে অগ্রাহ্য করে ধর্ম ও ধার্মিক দুইয়ের বিরোধিতা করে যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই এতে যে তারা আরো বেশি জন বিচ্ছিন্ন হন সেটা তারা বুঝতে চান না। নিজেদের ধর্মবিরোধী আধুনিক হিসাবে দেখিয়ে তারা কিছু সুখ অনুভব করতে পারেন মাত্র। সমাজ বদলের লড়াইতে সেই সুখ খুব একটা কাজে আসে না।
এবার আসা যাক মৌলবাদের কথায়। একটা নির্দিষ্ট আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক মৌলবাদের উদ্ভব। যে ইসলামিক আগ্রাসন দিয়ে কথা শুরু হয়েছিল সেখানে ফেরত আসা যাক। এই আগ্রাসন আসলে যত না ধর্মীয় তার থেকে বেশি বরং সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে কাজ করা একটা শক্তি, যার সাথে সাধারণ ছা-পোষা মানুষের রোজকার ধর্মচর্চার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। যে সম্পর্কটা আছে সেটা হলো ক্রমাগত ধর্মীয় উসকানি মারফত একটা সাধারণ মানুষকে তার মৌলিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্ত করে দেওয়া, যাতে সে কোনোভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বা পুঁজিবাদের বিরোধিতার জায়গায় না চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারকে প্রথম থেকে কারা তোষামোদ করেছিল? - আমেরিকান ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা। কোন উদ্দেশ্যে? - কমিউনিজম-এর "সংক্রমণ" যেন তাদের ভূখণ্ডে না চলে আসে! একইভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা মধ্য এশিয়ায় ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিকে তৈরি ও লালন করেছিল কোন উদ্দেশ্যে? - রাশিয়াকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে। যদিও রাশিয়াও তখন আরেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত। ইসলামি মৌলবাদ বলতে আজকে আমরা যা বুঝি সেটা আসলে এই দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বন্দ্বের একটা প্রোডাক্ট। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ন্যারেটিভ অনুযায়ী লাদেন তখন গণতন্ত্রপ্রেমী জাতীয়তাবাদী, যে রাশিয়ান আগ্রাসনের মোকাবিলা করছে। কয়েক দশক পরে সেই ন্যারেটিভটাই আবার চেঞ্জ হয়ে গেল নতুন চাওয়া পাওয়ার হিসাবে। পৃথিবীতে তখন একটাই সুপার পাওয়ার। ইসলামি আগ্রাসন নিয়ে আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ ধারণা আসলে এই পোস্ট-২০০১ ন্যারেটিভ থেকেই তৈরি হয়েছে, যেখানে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ"-র নামে গোটা বিশ্ববাসীর চোখে ঠুলি পড়িয়ে একতরফা সন্ত্রাস চালিয়ে গেছে কিছু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। পাশাপাশি মৌলবাদী সন্ত্রাসকেও ইন্ধন যুগিয়ে গেছে। কারণ অস্ত্র বিক্রির জন্য চাই যুদ্ধ। শত্রু ছাড়া যুদ্ধ হয় না। আর শত্রু না থাকলে শত্রু তৈরি করে নিতে হয়!
আজকের দিনে চিন-ও একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের স্বার্থে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের উপর অত্যাচার করে। যে মার্ক্সবাদী দর্শন সমস্ত জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে সেই দর্শন অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের প্রতি এই অত্যাচার নিন্দনীয়। কিন্তু মার্ক্সবাদকে ধর্মমতে পরিণত করে ফেলা অনেক বামপন্থীদের হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। তাদের কেউ কেউ বর্তমান চিনকে সাম্যবাদী মনে করেন, তাই সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারের বিষয়টা চেপে যান। অনেকে এমনকি বর্তমান রাশিয়াকেও সাম্যবাদী মনে করেন, এবং ফলত রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণকে সমর্থন করে ফেলেন অদ্ভুত কিছু অজুহাতে। প্রসঙ্গত বলতে ইচ্ছা করছে, একদা মার্ক্সকেও তিতিবিরক্ত হয়ে বলতে হয়েছিল যে - এই যদি মার্ক্সবাদ হয় তাহলে আমি মার্ক্সবাদী নই। আজ বেঁচে থাকলে উনি নিঃসন্দেহে আবার এই কথাই বলতেন।
সুতরাং, ইসলামি আগ্রাসন/মৌলবাদ বা অন্য যেকোনো ধর্মের মৌলবাদ, বা তুর্কি কর্তৃক আগ্রাসন, বা কোনো আরব জাতির নিরপেক্ষ অবস্থান - আজকের দিনে সবই আসলে সেই স্থানের ভৌগলিক-রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ, যায় সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ, সেটা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ-ও হতে পারে, আবার এক কালের সমাজতন্ত্রী, কিন্তু পরে পুঁজিবাদী প্রত্যাবর্তন হওয়া রাশিয়া চিনের সাম্রাজ্যবাদ-ও হতে পারে। একথা একেবারেই ঠিক যে বামপন্থীরা মাঝে মাঝে নিজেদের ক্যাম্প অনুযায়ী সিলেকটিভ হয়ে পড়েন, সেটা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয় এবং সেটা মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণও নয়। তবে হ্যাঁ, এককথায় আমিও মনে করি যে ইসলামি আগ্রাসনের সাথে ধর্মের যোগ নেই, বরং সাম্রাজ্যবাদীদের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মার্ক্সবাদীদের উচিত আরও বেশি করে সেই যোগটাকে প্রকাশ্যে আনা এবং সেটার আলোকে ইসলামি আগ্রাসন বা যেকোনো রকম মৌলবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতা করা।
ধন্যবাদ। উত্তর একটু বড় হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। আপনার মতামত জানাবেন।”
উত্তরটি দিয়েছেন
কিনোক্ষ্যাপা