বিস্মৃতির অন্তরালে: অক্ষয়কুমার দত্ত
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 20, 2024 | | views :890 | like:2 | share: 1 | comments :0
গভীর রাত। এক তিনতলা বাড়ির ছাদে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছে। তবে তা নিচু গলায়। স্বামী ভদ্রলোকটির কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। যুবকটির ‘অপরাধ’, তিনি স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী নন। এই গভীর রাতে বাড়ির ছাদে বসে তিনি এক 'খগোল' যন্ত্র নিয়ে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছেন। জ্যোর্তিবিজ্ঞান তাঁর প্রাণের বিষয়। আকাশ জুড়ে সারা রাত যে মহাজাগতিক বিস্ময়ের ঘটনা চলতে থাকে, সে সবের সাক্ষী থাকতে হলে যে রাত ছাড়া উপায় নেই! বিরক্ত, ক্ষুব্ধ স্ত্রী ছাদে উঠে এসেছেন আজ। এমন লোক কে দেখেছে, যে দুই প্রহর-আড়াই প্রহর রাতে স্ত্রীর শয্যা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে! এ তো সামান্য বিড়ম্বনা নয়! উত্তরে যুবকটি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এমন লোকের স্ত্রী এরূপ কথা বলে, তা যে আরও বড় বিড়ম্বনার।”
খগোল-যন্ত্র হল 'দূরবিন'। পারিভাষিক শব্দ 'দূরবীক্ষণ'। এই নামটি দিয়েছেন রাত-জাগা ওই যুবক - অক্ষয়কুমার দত্ত। বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের ক্ষেত্রে আরও অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন তিনি। যেমন, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি। এগুলি নমুনা মাত্র। তালিকাটি দীর্ঘ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে পথ দেখিয়েছিল এই পরিভাষা।
আধুনিককালের প্রগতি ভাবনা সম্পর্কে আমাদের সবারই কমবেশি ধারণা রয়েছে। কাজেই বিস্তারিত আলােচনার প্রয়ােজন নেই। রাজা রামমােহন রায়ই ঊনিশ শতকের গােড়ায় গােটা ভারতে নতুন যুগের প্রবর্তক, প্রথম প্রগতিবাদী মানুষ। তার ব্যক্তিত্ত্ব ও বৈষয়িক জীবনে নানা অসংগতি থাকলেও বিদ্যায়-বিত্তে-জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় তিনি তাঁর সমকালের প্রথম সারির যে কোনাে প্রাগ্রসর চিন্তাসম্পন্ন ইউরোপীয় নাগরিকের সমকক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবযুগের উদ্গাতা, দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাবিদ। প্রগতিশীল যুক্তিবাদের আরও প্রসার ঘটে লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রভাবে ও প্রচারে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। শাস্ত্রিক সামাজিক লৌকিক বিধাসসংস্কার থেকে মুক্তি ছিল তাদের জীবনে নবলব্ধ যুক্তিবাদের অবদান। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রগতিশীলতা আমরা খুব একটা স্বীকার করি না বটে, কিন্তু তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন যে, সাহিত্য বিনোদনের বস্তু নয়, জাতীয় জীবনবিকাশের ভিত্তি ও অবলম্বনও। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তিনির্ভর জ্ঞানমনস্কতা, যা তাঁর প্রগতিশীলতার এবং পাশ্চাত্য প্রভাবিত প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনারই উজ্জ্বল নিদর্শন। বিদ্যাসাগরেরই সমবয়সী অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন আর একজন জিজ্ঞাসুদ্রোহী।
অক্ষয়কুমার দত্ত একাধারে গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, বাংলা গদ্যের রূপকার, দার্শনিক, ফলিত বিজ্ঞান গবেষক, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, ধৰ্মীয় ছুঁতমার্গহীন মানুষ। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক,তত্ত্বানুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমান মানুষ। সমকালীন বিশ্ব মানসিকতা তাঁর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। অগস্ত্যত কোঁৎ-এর প্রত্যক্ষবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা, এমনকি হারবার্ট স্পেন্সারের সংশয় বা অজ্ঞেয়তা পর্যন্ত তাঁর চিত্তে প্রতিফলিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠোর নীতি পরায়ণ, বিনয়ী এবং দরিদ্রের প্রতি দয়াশীল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন, “তিনিই বাঙালির সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক।” মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র রূপে তাঁর অকৃত্রিম দানেই গড়ে উঠেছিল আজকের 'ইন্ডিয়ান আ্যসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স'। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ। তাঁর শয়নশিখরে থাকত ডারউইন ও নিউটনের প্রতিকৃতি, ঘরের দেওয়ালে থাকত জ্যোতিষ্ক-লেখা গগনপট, নরকঙ্কাল, এবং পশুপঞ্জর (জাস্টিস সদাচরণ মিত্রের ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শনে প্রদত্ত বিবরণ)।
বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলেন অক্ষয়কুমার। পিতা পীতাম্বর দত্ত এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার। তাঁর পিতা কোলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র্য-দশার ভিতর প্রতিপালিত হয়েছেন। এরপর তিনি অর্থোপার্জনে উদ্যোগী হন। কিন্তু পাশাপাশি অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।
ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। তখনও বিদ্যাসাগরের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই সেই ভাষার নমুনা: ‘পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।’
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আগস্ট ১৬, ১৮৪৩ তারিখে তাঁর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। রচনাসম্ভারে ও পরিচালনার গুণে পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, ভূগোল, ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার, বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-বিধবাদের বিবাহের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখাও এতে প্রকাশিত হত। সচিত্র প্রবন্ধও থাকত। নীলকর সাহেব ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি এই পত্রিকায় নির্ভীকভাবে লেখনী চালনা করেন। দীর্ঘ বারো বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
হিন্দু বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, ‘ছন্দের জাদুকর’ পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’
‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান ও ভূগোলের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুব রেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, পরিমিতি, জড়, জোয়ার, রামধনু, ধ্রুবতারা, গ্রহণ, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, সৌরজগত, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয় দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনও বহমান।
অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ২১ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম। অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরোপাসনার তিনি অন্যতম প্রবর্তক। পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন। ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য, প্রচলিত পথের বাইরে হাঁটার জন্য তৎকালীন সমাজপতিরা তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা করেন ও কিছুক্ষেত্রে সফলও হন।
হিন্দু হোস্টেলের এক দল ছাত্র অক্ষরকুমারকে ঈশ্বর-প্রার্থনার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করল। তিনি বীজগণিতের সমীকরণ দিয়ে দেখালেন: পরিশ্রম=শস্য। পরিশ্রম+প্রার্থনা=শস্য। অতএব, প্রার্থনা=শূন্য। ছাত্ররা এই উপস্থাপনার নাটকীয়তায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। তাদের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এই সমীকরণ। শিক্ষিত মহলেও আলোড়ন উঠল। এই ঘটনার দু’দিন পর মেডিকেল কলেজের ‘ডিমনস্ট্রেটর’ বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের দেখা, নীলমাধববাবু হাসতে হাসতে বলিলেন, ‘‘আপনি ভাল এক সমীকরণ দিয়া শহরটা তোলপাড় করিয়া দিয়াছেন।”
অক্ষয়কুমারের একটি বইয়ের জন্য স্কুলে আগুন লাগাতে চেয়েছিল কিছু লোক। ঢাকার বিক্রমপুরের ঘটনা। ১৮৫১ সাল। সদ্য বেরিয়েছে ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ বইটি। বিক্রমপুরের কালীপাড়া স্কুলের এক দল ছাত্র বই পড়ে মুগ্ধ। দেড়শো বছরেরও আগে সেই বইয়ে অক্ষয়কুমার লিখছেন: "বিবাহের আগে হবু দম্পতি পরস্পরের সঙ্গে ভাল ভাবে আলাপ-পরিচয় করে নেবে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য যেন বেশি না থাকে। সংসারে নারী ও পুরুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব সমান। যদি স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং সমাধানের কোনও পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ কাম্য।"
তোলপাড় পড়ে গেল সর্বত্র। কালীপাড়া স্কুলের কিছু ছাত্র সভা করে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করলেন: ‘আমরা এই পুস্তকে লিখিত বিবাহাদির নিয়মসকল অবলম্বন করিব।’ ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মহলে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলবাড়িটাই পুড়িয়ে দেবেন। তবে এই হুমকিতে অগ্রণী ছাত্রদের প্রতিহত করা যায়নি। অনেকেই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন সে দিন। অক্ষয়-জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন: “উপস্থিত বৃত্তান্তটি সঞ্জীবনী-পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি ঐ সময়ে ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন।” দ্বারকানাথের উপরেও এর প্রভাব পড়েছিল। তাঁরা কুলীন ছিলেন, পরিবারে প্রায় সবাই বংশানুক্রমে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে বিবাহ করতেন। দ্বারকানাথ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জানিয়েছিলেন, “আমি এক বই দুই বিবাহ করিব না।”
অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। দেড়শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন, ‘কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনুকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যাখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।’
তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানচর্চা সুগম হবে মাতৃভাষায়। সাবলীল হবে অভ্যাস। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরেই বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। এমনকি বাংলাভাষাকে তিনি বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী, দর্শনচর্চার এতটা উপযোগী করেছিলেন যে অনেক সময় মনে হয় বিদ্যাসাগরের চেয়েও তিনি কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। পাশ্চাত্যী বেকনীয় দর্শনের অন্যতম গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। তিনিই প্রথম অফিস-আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনি প্রথা ভেঙে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত বিশেষ করে আমাদের যে ঐতিহ্য সেটা নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন সবটাই আমাদের ধর্মের ঐতিহ্য নয়। আমাদের দেশে যুক্তিবাদের ঐতিহ্য ছিল, নিরীশ্বরবাদের ঐতিহ্য ছিল। যেটাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলছি তারমধ্যেই একটা বড়ো অংশ অনিশ্বরবাদ নিয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন যেগুলি খোলাখুলি ঈশ্বরবিরোধী ছিল।
‘তত্ত্ববোধিনী’ সম্পাদনার অমানুষিক শ্রম থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিলেন। একটা মাস-মাইনে তো প্রয়োজন। কিন্তু এই কাজটাও করতে পারলেন না। বছর না ঘুরতে ছেড়ে দিলেন অধ্যক্ষের চাকরি। অসুস্থতার খবর পেয়ে জার্মানি থেকে ম্যাক্সমুলার চিঠি লিখেছেন অক্ষয়কুমারকে। ১৮৮৩ সালের ৩১ অগস্ট লেখা চিঠিতে উদ্বেগ: ‘আপনার অসুস্থতার খবর শুনে খুব দুঃখিত। আশা করি আপনি অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারবেন।’
অসুস্থতা নিয়েই করেছেন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটির কাজ। হিন্দু ধর্মের নানা শাখাপ্রশাখা, নানান সম্প্রদায়, বিচিত্র আচরণ। অন্যান্য ধর্মও খুব ব্যতিক্রম নয়। এমনই ১৮২টা সম্প্রদায়কে নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি প্রকাশ্যে ভাববাদী চিন্তাকে আক্রমণ করেছেন। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণকে মানসিক রোগ বলতেও ছাড়েননি। সব থেকে বড় কথা, এই বইয়ের অনেকটাই তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। রোগ-অসুখ তাঁর নিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এক দিন গাড়িতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পথে এক ধাঙড়কে দেখতে পেয়ে অক্ষয়কুমার গাড়ি থামাতে বললেন। মানুষটি তাঁর পূর্বপরিচিত। ইতিমধ্যে আরও কয়েক জন ধাঙড় সেখানে এসে উপস্থিত। গাড়ি থামিয়ে তাঁদের কাছ থেকে অক্ষয়কুমার শুনলেন ধাঙড় সমাজের রীতিনীতি, দেবদেবীর পূজার্চনার বৃত্তান্ত। এ কথা-সে কথায় অম্বিকাবাবুও দু-একটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ধাঙড়রা তাঁকে উত্তর দেবে না। অক্ষয়বাবুকে এত খাতির কেন? এক ধাঙড়ের উত্তর: “উনি আমাদের দেশে গিয়াছিলেন, উনি আমাদের (জাতের) ভেদ মারিয়াছেন।”
ক্ষমাপ্রার্থনা করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। আলাদা আলাদা সময়ে তিনটি পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়: ১২৯০ বঙ্গাব্দের ১১ বৈশাখ ‘সোমপ্রকাশ’-এ, ১২৯১-এর ৮ বৈশাখ ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় এবং ১৮৮৫-র ১০ জুন ‘নিউজ় অব দ্য ডে’ সংবাদপত্রে। অনুরাগীরা তাঁকে নানান বিষয়ে চিঠি লিখতেন, তিনি অসুস্থতার জন্য উত্তর দিতে পারতেন না। মনে মনে গ্লানি বোধ করতেন। তাই এই ক্ষমাপ্রার্থনা। আর একটি ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ অবশ্য বেশ মজার। “আমার এক ভৃত্য গত শুক্রবার প্রাতঃকালে স্বর্ণালঙ্কারে ও নগদে প্রায় আড়াইশত টাকা হরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। যে ব্যক্তি তাহাকে বমাল সহিত ধরিয়া দিতে পারিবে তাহাকে উচিতমত পারিতোষিক প্রদান করা যাইবেক।” ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এ ১২৬০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে গয়নার বিবরণে আছে: হেলে হার ১ ছড়া, কণ্ঠমালা ১ ছড়া, বাজু ২ খানা, বালা ৪ গাছা।
অক্ষয়কুমার দত্ত শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারতেন না। ফলে তাঁর সামাজিকভাবে উপস্থিতি ক্রমশ কমে আসছিল। সেটা অবশ্য সাপে বর হয়েছিল। প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকরি করা থেকে বিরত হন। কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইছিলেন। ১৮৫০ এর দশকে তিনি বালিতে জায়গা দেখে বাড়ি করে থাকতে শুরু করলেন। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটি বছর (১৮৫৬-১৮৮৬) তিনি বালিতে কাটান। আজ দেওয়ান গাজী তালায় যেটি ‘হরমিলার ডক’ বলে পরিচিত, সেটি তাঁর শেষ জীবনের বসতবাড়ি। লাগোয়া জমিতে তৈরি করলেন ‘শোভনোদ্যান’- উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্র। অক্ষয়কুমার রচিত তিন খণ্ড ‘চারুপাঠ’ ছাত্রমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তাই বিদ্যাসাগর এই উদ্যানের নাম দিয়েছিলেন ‘চারুপাঠ চতুর্থ ভাগ’। বাড়ির ভিতরেও তৈরি করেছিলেন একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। সেখানে ছিল বিভিন্ন যুগের প্রস্তরখণ্ডের নমুনা, ফসিল, প্রবাল প্রভৃতি। শরীর সঙ্গ দিত না, তবু কলকাতা জাদুঘরে বা শিবপুর বোটানিক্যাল উদ্যানে যেতেন নিয়মিত। জাদুঘরে লাঠি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বলে সঙ্গীর কাঁধে ভর রেখে চলতে হত। সঙ্গীর হাতে থাকত বই। সেখানে ছাপা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু।
৩৮ রকমের বৃক্ষ, ১৫ রকমের ফুল বা সুদৃশ্য নানা গাছ, ১৬ রকমের মশলাজাতীয় গাছের কথা পাওয়া যায় নানা জনের বিবরণে। নিরিবিলি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বালির বাড়িতে বসে নিরলস গবেষণার ভিত্তিতে আমৃত্যু যে কাজগুলো করে গেছেন সেগুলো আমাদের অক্ষয় ঐতিহ্য, অমূল্য ঐতিহ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা তাঁকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিইনি, আজও দিচ্ছি না। তিনি যে সময় কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তখন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না এইসব কাজ করার।
বালির বাড়িতেই একা, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন ‘ধর্ম্মনীতি’র লেখক। পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও রামচন্দ্র রায় তাঁর দেখাশোনা করতেন। ১৮৮৬ সালের ১৮ মে জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্ত ছেষট্টি বছর বয়সে যখন প্রয়াত হন, তখন তাঁর পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চার বছর বয়স। এই সত্যেন্দ্রনাথই পরে বাংলা কবিতায় ‘ছন্দের জাদুকর’ বলে খ্যাত। পিতামহকে ‘হোমশিখা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘বঙ্গীয় গদ্যের গৌরবস্থল/ আমার পূজ্যপাদ পিতামহ…।’
চিনি, ময়দা, সুতার কল, কাগজের কল, টাঁকশালে যেতেন অক্ষয়কুমার, যন্ত্রবিজ্ঞান কী ভাবে কাজ করে দেখবেন বলে। সমুদ্রভ্রমণে গিয়ে দূরবিন চোখে পৃথিবীর গোলাকৃতির পরীক্ষা করতেন, জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করতেন নানা দেশ নিয়ে। ইচ্ছে করে বারবেলা, কালবেলা, কালরাত্রি, অশ্লেষা, মঘা, ত্র্যহস্পর্শ প্রভৃতি ‘অশুভ’ দিনক্ষণ দেখে ভ্রমণে বেরোতেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা’র শরিক হতেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও জানতেন সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, ফরাসি ভাষা। বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা ছাড়াও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান, বিবর্তনতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ভারতের পুরাতত্ত্বের চর্চা করেছেন।
নিরিবিলিতে বালির বাড়িতেই রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন এই অসাধারণ বইটির জন্য অক্ষয়কুমার দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বইয়ের দুটি খণ্ড এই বাড়িতে বসেই তিনি লেখেন। প্রথম খণ্ড ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয় খণ্ড তেরো বছর পর ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়।
অক্ষয় দত্তের এই একখানা মাত্র বই কালের অবলেপন এবং উত্তরসূরিদের অবহেলার কবল থেকে বেঁচে গেছে। আমাদের কাছে তাঁর প্রদত্ত ‘অক্ষয়’ সম্পদ হয়ে টিকে থেকেছে। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস মানে তো ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ইতিবৃত্ত বর্ণন। মনে হয়, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় শব্দটি বাদ দিয়ে উপাসক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত খুব কম নয়। তিনি হাত দিলেন একশ বিরাশিটি সম্প্রদায়ের কাহিনিতে। পুরোটাই তিনি একা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে করে সম্পন্ন করেছেন। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে অনেক রকম তথ্য পেয়েছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন, বুঝেছেন। তবে লিখেছেন। এই কারণেই ভারতীয় সমাজ তথা ধর্মীয় সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাপেক্ষে বইটির আজও একটি আকর গ্রন্থমূল্য আছে।
আরও লক্ষণীয়, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানলেখক অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম বইটিতে ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র ধর্মসংস্কৃতি বিশিষ্ট মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের পরিশ্রমজাত ও বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দ্বিতীয় বইতে তিনি তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বিচার, ভারতীয় চিন্তাশীলদের বিভিন্ন দার্শনিক মতের পরিচয়, পারস্পরিক তর্কবিতর্ক খণ্ডন-বিখণ্ডন, ভারতীয় প্রাচীন মনন-ঐতিহ্যে নিরীশ্বরবাদ এবং বস্তুবাদের নানা শাখার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভারত গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ভাষা তথা অন্য নানা বিষয়ে সাদৃশ্য, ইত্যাদি বহু চিত্তাকর্ষক বৌদ্ধিক উপকরণ তুলে ধরেছেন। এখানে আছে শুধু যুক্তিবাদী বিচারধারা নয়, যুক্তিবাদের মননশীল ফসল। এতে পাওয়া যায় শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আবাহনী নয়, আগমনি নয়, তার পাশাপাশি আমরা পাই সমাজ সংস্কৃতি ভাষা দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অখণ্ড বিজ্ঞানমানস প্রয়োগের ফলস্বরূপ এক উৎকৃষ্ট বিচারপদ্ধতি ও অভাবিতপূর্ব সিদ্ধান্তরাশি। প্রথম বই শেখায়, কোনো একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে কীভাবে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয় বই থেকে শেখা যায়, কোনো একটা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘপ্রচলিত বিভ্রান্তিগুলিকে কীভাবে কাটানো যায়। বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন ও মুক্তমন অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন এইভাবে: “এখন বেদপ্রাণ হিন্দুমণ্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদমন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।” ম্যাক্সমুলার এই বইটি সম্বন্ধে জেনে অক্ষয়কুমার দত্তকে প্রসংসাসূচক চিঠি লেখেন।
আসলে অক্ষয়কুমার আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন বিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ, জীবন এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি, তার নিগুঢ় তত্ত্বগুলি। তার জীবনী এবং রচনা সংগ্রহের সংকলক এবং ‘অক্ষয়-সুধা’ (১৯২৪) নামের পুস্তকের রচয়িতা শিবরতন মিত্র যা বলেছেন, বােধহয় সেটাই অক্ষয়কুমার সম্পর্কে এবং তার বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা। তিনি উপরােক্ত পুস্তকের ‘অক্ষয়কুমার দত্ত ও বঙ্গসাহিত্য’ শিরােনামে লিখেছেন, “অক্ষয়কুমার প্রধানত বৈজ্ঞানিক। আজ ইংরেজ জাতি, জৰ্ম্মাণ জাতি, ফরাসী ও মার্কিণ জাতি বৈজ্ঞানিকতায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকতার প্রতিভা একদিনে হয় নাই। বৈজ্ঞানিকী বুদ্ধির অনুশীলনে, ইংরাজ জাতিকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য মনীষী বেকন হইতে জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত মনীষীগণ কি কঠোর তপস্যা এবং কি ভীষণ সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। ...এই মানুষকে প্রত্যক্ষ্য স্কুল ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ব্যাপার সমূহ পর্যবেক্ষণ করাইয়া অধ্যবসায় সহকারে সেই সমুদায় বিষয়ের শ্রেণীবিভাগ করিবার সহিষ্ণুতায় দীক্ষিত করিতে বেকনকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। আজ ইংরাজ যে গৌরবান্বিত, তাহার কারণ এই বৈজ্ঞানিকতা। অক্ষয়কুমার আমাদের দেশে এই বৈজ্ঞানিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য তপস্যা করিয়াছিলেন এবং সেই কঠোর তপস্যায় আত্মবিসৰ্জন করিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিকের যাবতীয় লক্ষণ অক্ষয়কুমারের চরিত্রে পরিদৃষ্ট হয়।”
'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' প্রাপক গবেষক আশীষ লাহিড়ী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি যদি ইংরেজিতে তর্জমা করা যেত তবে প্রমাণ করা যেত তাঁর চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্য অন্যদের থেকে কতযুগ এগিয়ে ছিল। সেটা সামাজিক দিক থেকে, দার্শনিক দিক থেকে, ইতিহাসের দিক থেকে এমনকি সাহিত্যগত দিক থেকে। বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অক্ষয়কুমার দত্ত গবেষক সাইফুল ইসলামের কথায়, 'আমরা যা কিছু আত্মসাৎ করতে পারি না তা ভস্মসাৎ করার চেষ্টা করি। ওনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ওনার পাণ্ডিত্য, অকাট্য যুক্তির জন্য তৎকালীন বঙ্গসমাজ ওনাকে আত্মসাৎ করতে পারেনি।'
৩৬৭, জিটি রোড, বালি, হাওড়ায় তাঁর সাধের শোভনোদ্যান বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়, অন্তিম দশা। আজ অবধি কোনো দেখভাল, সংরক্ষণ হয়নি। যদিও ২০০৬ সালে তদানীন্তন রাজ্য সরকার ‘হেরিটেজ’ -এর একটি ফলক লাগিয়েই তার দায়িত্ব সম্পাদন করেছে। বর্তমান সরকারও উদাসীন। এখন বাড়িটির অবস্থা করুণ। অতিসত্বর আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বহু স্মৃতিবিজড়িত বর্তমানে জরাজীর্ণ বাড়িটিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে অক্ষয়কুমার দত্তের কাজের উপর একটা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীরই উপকার হবে।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক। অর্থাৎ তাঁরও দুশো বছর পূর্ণ হল। ২০২০ সালের, ১৫ জুলাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ ও প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সকল কারণে আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন ঠিক একই কারণে বা তার চেয়েও বেশি কারণে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু এই মহান মনীষীর আদর্শ, চিন্তাধারা, অক্ষয় কাজ কোন কিছুই আমরা সঠিক মূল্যায়ন করিনি। আজও করছি না।
বাঙালি তাঁকে খুব যে মনে রেখেছে, বলা যাবে না। অবশ্য ঘটা করে প্রতি বছর তাঁর ছবিতে ফুলচন্দন দিলে বা পঞ্চধাতুর মূর্তি স্থাপন করলেও খুব কিছু এসে যেত না। বেঁচে থাকতেই ভাববাদের উল্টো পথের এই একলা পথিক লিখেছিলেন: ‘যদি বা আমার কীর্ত্তি স্থায়ী হয়, কিন্তু আমি তো চিরস্থায়ী নই।… মৃত্যুর পরে আমি সে কীর্ত্তি ঘোষণা শুনিতে আসিব না।’
ধর্মতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞান পর্যন্ত যে দীর্ঘপ্রকার জ্ঞানভূমির মধ্যে ছিল তাঁর অনায়াস পদচারণা, বাঙালি পাঠককে হাত ধরে সেই জ্ঞানজগতের সিংহদ্বারে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাছে আধুনিক ভারতবাসীর ঋণ অপরিশোধ্য। মাতৃভূমি থেকে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কদাচার ও দুর্বলতা দূর করাই ছিল অক্ষয়কুমার দত্তের ব্রত। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন ভারতের যুক্তিবাদীরা এযাবৎ অক্ষয়কুমার দত্তকে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে সামনে তুলে আনার প্রয়াস করলেন না? বিনয় ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখর ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এত ভালো ভালো কাজ আছে, অথচ তাতে অক্ষয়কুমার দত্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেলেন না কেন, “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” বইটি কোন জায়গা আদায় করতে পারল না কেন - মনে জাগে বিস্ময় প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে বাঙালিদের চিন্তা জগত থেকে তিনি কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অক্ষয়কুমার দত্তের আদর্শ ও দর্শন খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধবিশ্বাসের যাঁতাকলে অনেকক্ষেত্রে আমরা আলোর থেকে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছি। এটা যদি ঠেকাতে হয় তবে সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার আমাদের কাছে অক্ষয়কুমার দত্ত।
★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, দীপক সাহা - আপনপাঠ ওয়েবজিন, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (১ম খণ্ড), গবেষক আশীষ লাহিড়ী, গবেষক ও শিক্ষক অর্ণব চ্যাটার্জি, শিবপ্রসাদ মিত্র, শিক্ষক অনু বর্মন, সাহিত্যিক কুশল মৈত্র, সুকুমার সেন - 'বাংলার সাহিত্য ইতিহাস', সাহিত্য অ্যাকাদেমি, নতুন (পৃঃ ১৬৭), আমিনুল ইসলাম - নবজাগরণ ডট কম, সংবাদ ডট নেট ডট বিডি।