কেন এদেশে হিন্দুরা বিপদে?

রাহুল রায়


Nov. 24, 2024 | | views :285 | like:0 | share: 0 | comments :0

আমরা প্রায়ই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি অভিযোগ পাই যে বিরোধী দল বা দলের নেতারা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশাচ্ছেন। এই দুইয়ের মিশ্রণে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তীতে অবশ্য এই নেতাদেরই মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় দেখা যায়। একাংশকে তো আবার এর মধ্যে সবগুলোতেই দেখা যায়, তাও আবার ভঙ্গিমা বদল করে প্রার্থনারত অবস্থায়। অন্যের ক্ষেত্রে যত নিন্দাই করুক না কেন নিজের বেলায় গর্হিত এই কাজকে তখন দিব্যি জনসংযোগ বলে এঁরা চালিয়ে দেন। যে যাই বলুন না কেন বাস্তবে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এদেশে আদি কাল থেকে চলে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতন থেকে শুরু করে মোঘল, ব্রিটিশ পর্ব পরিষ্কার বলে দেয় যে এখানে ধর্ম ও রাজনীতি ওতপ্রোত ভাবে একে ওপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই দুইয়ের কাণ্ডারীদের কাজ করার ধরণেও দারুণ মিল আছে। ধর্মের অভিভাবকরা যাদের আমরা পুরোহিত বলে চিনে থাকি, সাধারণ মানুষকে বশে রাখতে কখনো স্বর্গের লোভনীয় স্বপ্ন দেখান তো কখনও নরকের ভয় দেখান। আবার রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখা যায় মানুষকে পাশে রাখতে একই কাজ করেন। কখনও প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দেন তো কখনো মারাত্মক শাস্তির ভয় দেখান। অর্থাৎ লোভ আর ভয়ের অস্ত্রেই এই দুই পক্ষ নিজেদের মত করে ব্যবহার করে নিজেদের কাজ হাসিল করেন।


আজকের দিনের নিরিখে দেখতে গেলে 'আচ্ছে দিন', 'অমৃত কাল', ‘রামরাজ্য’কে সেদিক থেকে জনগণকে পাশে রাখতে দেখানো 'স্বর্গীয় লোভ' বলতে হবে। পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন স্বর্গ নামক জায়গাটিকে দেখেনি, অথচ পুরোহিতরা যুগ যুগ ধরে সেই কল্পনা থেকেও নাকি সুন্দর জায়গার টোপ দিয়েই যাচ্ছেন। ‘ধর্মের পথের’ পথিক হলে পুরোহিতদের আশীর্বাদে স্বর্গপ্রাপ্তি অবধারিত। স্বর্গের অবস্থান, আকার, অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসছে যে যেহেতু মৃত্যুর পরই সেখানে মানুষ যেতে পারে তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বর্গকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। অতীতে পুরোহিতরা ‘বিশেষ ক্ষমতাবলে’ সেই জায়গা সম্পর্কে জেনেছেন এবং সেই জ্ঞানই স্বর্গের ধারণার মূল। এই ধারণা সকল প্রশ্নের উর্দ্ধে। আজকের রাজনৈতিক কাণ্ডারীরা একই রকম। ‘আচ্ছে দিন’ এর সংজ্ঞা, ‘অমৃতকাল’ এর অর্থ বা ‘রামরাজ্যের’ ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তর আসে না। তার বদলে উঠে আছে একগাদা অভিযোগ, অনেকটাই স্বর্গ নিয়ে প্রশ্ন করলে পুরোহিতের উত্তরের মতো। সেখানে প্রশ্নের উত্তর আসে না, উল্টে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন আসে এবং সর্বোপরি অবিশ্বাসী বা নাস্তিক নামকরণ হয়।

 রাষ্ট্র পরিচালকরা কিছু দিন পর পর তাদের পরিচালিত ব্যবস্থাকে বিভিন্ন নাম দিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। আবার তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুচ্ছকেও একই ভাবে তারা নামকরণ করে থাকেন। ‘আচ্ছে দিন’, ‘অমৃতকাল’, ‘রামরাজ্য’ এগুলো সেরকমই নামকরণ। ‘রামরাজ্যে’র উল্লেখ সর্বাগ্রে এদেশের মানুষ মহাত্মা গান্ধীর কাছে পেয়েছিলেন। গান্ধী সুশাসনকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই সুশাসনের সংজ্ঞা তিনি দিয়ে যাননি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো বাস্তববাদী তিনি অবশ্য কোনোদিনই ছিলেন না। সেদিক থেকে বিচার করলে 'রামরাজ্য' নিয়ে তাঁর নিজের ধারণাই বা কতটুকু পরিষ্কার ছিল তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যায়। যাই হোক মহাত্মা গান্ধীর সেই রামরাজ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, সামাজিক অবস্থা কি রকম হবে তা নিয়ে আমাদের কিছুই জানা নেই। এমনকি যার থেকে এর সৃষ্টি সেই কাব্যগ্রন্থ রামায়ণে উল্লেখিত  রামচন্দ্রের রাজ্যই বা কিরকম পরিচালিত হতো তারও বিশদ বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সেদিক থেকে একান্তই ধর্মীয় আবেগ পরিচালিত এবং একই সঙ্গে চরম ধোঁয়াশাপূর্ণ। এদিকে স্বাধীনতা লাভের পর ৭৫-টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। শাসক দলের কাছে কিছুদিন পর পর ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার কথা শোনা যায়। সেটা স্বাভাবিক, নিজের ঢাক পেটাতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের অবস্থা কোথায়?  ৭৫-বছরে কতটুকু আমরা এগোতে পেরেছি। এই বছর বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিষয়ের ওপর তৈরি সুচিতে ভারতের অবস্থান নিম্নরূপ –



বিষয় সূচক

ভারতের অবস্থান

 উদ্বাবনী সূচক

৪০

পরিবেশরক্ষা সূচক

১৮০

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক

১৫০

গণতন্ত্র সূচক

৪৬

দুর্নীতি সূচক

85

স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচক

৬৬

উৎকোচ সূচক

৮২

খাদ্য সুরক্ষা সূচক

৭১

 অবসরকালীন ভাতা সূচক

৪০

ক্ষুধা সূচক

১০৭

যুব উন্নয়ন সূচক

১২২

শান্তি সূচক

১৩৫

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক

১২১

মানব স্বাধীনতা সূচক

১৩১

মানবসম্পদ সূচক

১১৬

অসাম্য সূচক

১৪৭

শিশু অধিকার সূচক

১১৭


দেশ যে এগোচ্ছে না এই কথা দেশের চরম শত্রুও বলতে পারবে না। ‘সাপ খেলানো মানুষের দেশ’ আজ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির অধিকারী। শিক্ষার হার, গড় আয়ু গত সাড়ে সাত দশকে অনেকটাই বেড়েছে। আজ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দুই জন ব্যক্তি এই দেশেরই মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশচর্চায় এদেশের উন্নতি রীতিমতো ঈর্ষনীয়। কিন্তু এই চোখ ধাঁধানো উন্নতির পেছনের অন্ধকারটা অত্যন্ত গাঢ়। এদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অভুক্ত, অশিক্ষিত মানুষ থাকেন। এদেশে স্কুল ড্রপ আউটের হিসাব আফ্রিকার দেশগুলোকেও পেছনে ফেলে দেয়। এদেশ আজও বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শিশুশ্রমিকের সংখ্যায় আমরা সবচেয়ে উপরে আছি। এখানে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও ধর্মীয় তাবেদারদের সৌজন্যেও আজ মাটির প্রতিমাতে প্রণাম করার জন্য রক্তমাংসের মানুষকে মরতে হয়। ধর্মীয় হানাহানির মধ্যে দিয়ে এদেশে রাজনীতি পরিচালিত হয়। যুবপ্রজন্মের জয়গান  এদেশে সারাদিন নেতাদের মুখে থাকলেও এদের অশিক্ষা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। এখানে ছেলেমেয়েদের হাতে শিল্পোৎপাদনের যন্ত্রপাতি তুলে দেওয়া না হলেও ধর্মের বা বর্ণের ধ্বজা কিন্তু সময় মতো দিয়ে দেওয়া হয়। শাসকদের স্বার্থরক্ষা বলে কথা। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই তালিকা দীর্ঘ,  সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রাপ্তির সোনালী থলিটা যেদিকে গেছে সেদিকে মানুষ জনসংখ্যার নিরিখে অত্যন্ত কম বললেও কম বলা হবে আর অপ্রাপ্তির শতছিদ্র থলিটা যেদিকে রয়েছে সেদিকে মানুষ গুণে শেষ করাটা অসহনীয় হবে। 

ইতিহাস বলে যুগ যুগ থেকে পুরোহিতবর্গ ও শাসনে থাকা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে ভয় আর লোভের অস্ত্রে পরাভূত করে রেখেছে। হাস্যকর হলেও সত্যিটা হল এই অলীক লোভ ও ভয় কাটিয়ে উঠে মানুষ খুব কম বারই এই অত্যাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পেরেছে। সাধারণত, সে ধর্মের মোড়কে বাঁধা এই কল্পনাকে কাঁধে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। দেশের বর্তমান শাসকরাও একই পথের পথিক হয়েছে। নিজেদের বিফলতা ঢাকতে কখনো দান তো কখনও শাস্তির অস্ত্র ব্যবহার করেন। এদিকে চলে নিজেদের কাজের রাতদিন প্রচার আর আগাম দিনের জন্য মানুষের মধ্যে স্বপ্নের ফুলঝুরি ছড়ানো। পরিশেষে পরিবেশিত হয় অতি পরিচিত কিন্তু মোক্ষম অস্ত্র-বিদ্বেষাস্ত্র। নির্বাচন আসলেই শোনা যায় - হিন্দুরা বিপদে আছে (হিন্দু খতরে মে হে)।  এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখলেই হিন্দুরা রক্ষা পাবে। বাস্তবটা হলো হিন্দুরা বিপদেই আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা আলাদা হলেও শ্রেণীগত দিক দিয়ে দেশের ৮০% মেহনতী জনগণের সমস্যাগুলো কিন্তু এক - বেকারত্বের জ্বালায় সকলেই জ্বলছে; চাহিদাও এক - নিরাপদ বর্তমান,  সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও শান্তি সমৃদ্ধিতে সবার বাঁচা চাই, যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান মৌলিক অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যেভাবে দেশে একের পর এক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, দেশের মানুষ প্রশ্ন ও যুক্তিহীন হচ্ছেন তাতে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ কিন্তু সর্বাবস্থাতেই – ‘খতরে মে হে’।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929