১ম - তুই ঈশ্বরে অবিশ্বাস করিস?
২য় -হ্যাঁ, অবশ্যই অবিশ্বাস করি, থাকলে সামনে আবির্ভূত হন বিশ্বাস করে নেব।
১ম - দেখ, ঈশ্বর ছাড়া এই মহাবিশ্বের কল্পনাও করা যায় না।
২য় - দেখ, একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না এটা কিভাবে যাচাই হবে? আমরা কিভাবে জানবো সে সময় একমাত্র ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন?
অথচ মহাবিশ্ব মহাকাশ কিছুই ছিল না?
হ্যাঁ এটা সত্য যে আজকের মহাবিশ্ব মহাকাশ সৌরমণ্ডল নীহারিকা তারকার সর্বদা অবস্থিতি ছিল না, মহাবিশ্ব এক্সপ্যান্ড করেছে যাকে সুপারনোভা বলছেন বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল।
১ম—দেখ, সে সব প্রমাণ না দেখাতে পারলেও বলবো ঈশ্বর ছিলেন আছেন।
২য় - ঈশ্বরের কি কাজ? কেন ঈশ্বর আছেন? তাঁর থাকাতে কার কার কি কি উন্নতি হয়েছে? আর না থাকাতে কার কার কি কি ক্ষতি ঘটেছে?
১ম - দেখ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ঈশ্বর তর্কের জিনিস নয় সম্পূর্ণ ভক্তিভরে বিশ্বাসের জিনিস।
২য় - আচ্ছা বলতো সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এখনও ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারায়নি, আমাদের গুটি কয়েক নাস্তিকের কথা বাদ দে। তাহলে ঐ কোটি কোটি ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষেরা চরম দুর্দশায় ভুগছে কেনো? তাঁদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান নেই, শিক্ষা স্বাস্থ্যর কথা বাদই দে। ঈশ্বর এইরকম এক চোখোমি করেন কেনো? তাহলে কি ধরে নেব সব ঈশ্বর ধনীদের গৃহেই অবস্থান করেন। সমাজে দরিদ্র অভুক্ত বস্ত্রহীন নিরাশ্রয় মানুষের জন্য এই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো ঈশ্বর নেই এই মহাবিশ্বে।
১ম - দেখ এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না, কিন্তু ঈশ্বর ছিলেন, আছেন আর থাকবেন এই বিশ্বাস আমার চিরকাল অটূট থাকবে।
দুই বন্ধুর কথপোকথনে একটা জিনিষ উঠে আসে সেটা হল বিশ্বাস শুধু বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ভাইরাস আমাদের সমাজকে হাজার হাজার বছর ধরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। একটু অন্যরকম কথা শুনলেই এদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং সমস্ত রকম অসভ্যতা নিয়ে দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ যুক্তিবাদীদের উপর। তখন সামান্য ভদ্রতার মুখোশটুকুও থাকে না।
ধর্মীয় পণ্ডিতদের বক্তব্যগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়ে। তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে যে, সৃষ্টিকর্তা দ্বারা সৃষ্টির আগে মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি শূন্য হতে সব কিছু তৈরি করেছেন। কিন্তু এই ধরণের দাবী অযাচাই যোগ্য, ঈশ্বর যে ছিলেন তার প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত আর পারবেনও না। আমরা কেমন করে জানবো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির আগে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন; অথচ মহাকাশ মহাবিশ্ব কিছুই ছিল না। এটা সত্যি যে আজকের এই মহাকাশ মহাবিশ্ব নীহারিকা তারকারাজির সর্বদা অবস্থিতি ছিল না। এগুলির সৃষ্টির কোনো উপাদান যদি মহাবিশ্বে বর্তমান না থাকতো তাহলে হঠাৎ করে ঈশ্বর কার থেকে এই গ্যালাক্সি নীহারিকা নক্ষত্রপুঞ্জ তৈরি করলেন? সুতারাং হঠাৎ করে এইসব ঈশ্বর দ্বারা তৈরি হয়েছে এই যুক্তি ধোপে টেকেনা। তার চেয়ে বরং পূর্ব থেকেই পরমাণুর অস্তিত্ব ছিল এটা মেনে নেওয়া সম্ভব। পরমাণুর সংযোগে সূর্যের ও অন্যান্য নক্ষত্রের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু এখনো পরমাণুর সংমিশ্রণ কেন ঘটে জানিনা। বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্ব গঠনের কারণ অনুসন্ধান করে সার্নের গবেষণাগারে বোস হিগিন কণার সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু এনার্জি কি করে ভরে রূপান্তরিত হয় তা এখনও জানতে পারেনি।তবে এই অনুকল্পের প্রমাণ দেখা যায় মহাকাশে অবিরাম তারকারাজির উদ্ভবে ও মৃত্যুতে।
তাই বলা যেতে পারে সৃষ্টির সূচনা পদার্থ থেকে নয় বরং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর। এই পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানো মুশকিল। আমরা যদি ধরে নিই যে, সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর সৃষ্টির পূর্বে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিলনা তাহলেও সমস্যা দেখা দেবে, সেই সমস্যা হচ্ছে -
১) মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ কি?
২) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আগে থেকে কেন ছিলনা?
৩) ঈশ্বর কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন?
এইরকম বিভ্রান্তির মাঝে আমাদের পার্থিব মনে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য জীবের সাথে একই শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে রজি নই। বহু পূর্ব থেকেই মানুষ প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে না পেরে ভয় থেকে বিশ্বাস করে আসছে এই বিশ্ব মহাবিশ্বে সবকিছু কেউ না কেউ একজন শুরু করছেন এবং তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন সকল শুভ ও অশুভ প্রভাব। এই ধারণার পক্ষে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বই লেখা হয়েছে, সঙ্গীত রচিত হয়েছে, কাল্পনিক কথাবার্তা উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব ঘটিয়েছে। আদিম বা প্রগতিশীল বর্তমান সমাজেও ধর্মের দারুণ প্রভাব বিরাজমান। আদিম সমাজে কুসংস্কার ও মোহ ছিল চূড়ান্তরূপে। আবার আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রভাবে সভ্য এবং ন্যায় সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। চিন্তাবিদরা আবির্ভূত হয়েছে আইন প্রণয়নকারী দার্শনিক, বিজ্ঞানী; সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারকের রূপে। যেমন হাম্বুরাবি, কনফুসিয়াস, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, ডিরোজিও শত শত মানুষের নাম করা যায়। আর মানুষ যে সমস্ত জিনিসে ভয় পেয়ে ঈশ্বর বা ধর্মের সৃষ্টি করেছেন তার অনেকটাই ব্যাখ্যাযোগ্য। এই মহাবিশ্বে সব ঘটনার একটা কার্য কারণ সম্পর্ক আছে, মানুষের পক্ষে হয়তো সব ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি, এটাইতো হবে আগামীতে, মানুষ চাইবেই প্রকৃতির এই জ্ঞান আহরণ করতে, তবেইতো সে অন্য জীবেদের থেকে পৃথক।
ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া শুনেছি গাছের পাতাও নড়েনা। সত্যিই যদি ঈশ্বর শক্তিমান সর্বজ্ঞ হোন, সমস্ত সৃষ্টির কর্তা হোন এবং চান যে তাঁর প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক বা সেমেটিকদের মতো ঈশ্বর প্রেরিত মেসেঞ্জার বা রসুল/নবীদের প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক এবং তার শিক্ষা গ্রহণ করুক তবে ঈশ্বরের সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে সবাইকে ভাল এবং বিশ্বাসী বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠানো। অন্যধারে উনিই যদি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠান তাহলে উনিই ভাল খারাপ মানুষ করে পাঠিয়েছেন এই পৃথবীতে; তাহলে সবজান্তা ঈশ্বরের মানুষকে পরীক্ষার জন্য বলাটা একটু হাস্যকর হচ্ছেনা কি? বা ঈশ্বর নিজে ঐ মেসেঞ্জারদেরকে মানুষের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিতে পারতেন তাহলে নবিকে ইসলাম গ্রহণের জন্য এতগুলি যুদ্ধ আর লোকক্ষয় করতে হতোনা; ক্রুসেডে এত লোক নিহত হতো না। দুর্যোধনকে ভাল সৎ করে তুললে শ্রীকৃষ্ণের ভোজবাজি বিশ্বরূপ অর্জুনকে দর্শন করাতে হতোনা; কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এতো লোকক্ষয় হত না বা কংসকে সৎ ভাল মনের করলে দেবকী বাসুদেব এত কষ্ট পেতেন না, মৃত সত্যবানকে সাবিত্রীর বাঁচিয়ে তুলতে হত না। এই কঠিন প্রক্রিয়ায় একজন মৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জীবিত করা বা কুমারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া বা নদীকে দুভাগ করা বা চাঁদকে দ্বি-খণ্ডিত করা বা মেরাজে করে সপ্ত স্বর্গ ভ্রমণ করানোর ক্ষমতার চাইতে অনেক সহজতর। তখন দেব দেবী বা ভগবানের দূত মুসা ঈশা আল্লাহর এই উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক কাজ করার প্রয়োজনই পড়ত না। সারা পৃথিবীর সবাই ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে যেত। তাহলে??