আমাদের ন্যায়পালিকা: তিস্তা থেকে বিলকিস

জাহিদ রুদ্র


Nov. 21, 2024 | | views :2569 | like:0 | share: 0 | comments :0

একটা রাষ্ট্ৰের জাতীয় দিবস তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর এর মধ্যে যদি স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষ উদযাপন হয় তো এর মাহাত্ম্য কতটুকু হতে পারে বোঝতেও পারছেন। এরমানে দেশ কতটা এগোচ্ছে এর একটা প্রমাণ আমরা ওয়াকিবহাল। নিৰ্দিষ্ট শ্ৰেণীর কয়েকজন কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয়া কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ভারতীয় আইনে এই ধরনের ব্যবস্থা আছে। গৃহ বিভাগ সচিব, আইন বিভাগের সচিব এবং কারাগার বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিদ্বয়ের প্ৰস্তুত করা তালিকা মন্ত্রীসভাতে অনুমোদিত হওয়ার পর রাজ্যপালের কাছে প্রেরণ করা হয়। সেই তালিকাতে রাজ্যপাল সন্মতি জানালে তবেই তালিকাভুক্ত সকল কারাবন্দী মুক্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। এই তালিকাতে ভয়ংকর অপরাধীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না এবং নির্বাচিত সকল কারাবন্দীদের সেলে থাকা সময়ের আচার-আচরণ (বিশেষভাবে বিগত তিন বছরের) সন্তোষজনক হতে হব। উল্লেখিত সময়ে অসদাচরণের জন্য তাদেরকে আলাদা কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে এমন নয়।


এইবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহ বিভাগ এমনি এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজ্য সরকারের কাছে আবশ্যকীয় নির্দেশিকা প্রেরণ করে। বন্দীমুক্তির এই ব্যবস্থা চলতি বছরের ১৫ আগষ্ট, আগামী বছরের ২৬ জানুয়ারি এবং ১৫ আগস্টের ভিতরে কাৰ্যকরি করতে হবে বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, গৃহ বিভাগের নির্দেশাবলীতে মুক্তির জন্য নির্বাচিত কারাবন্দীদের মধ্যে হত্যাকারী এবং ধর্ষণকারী থাকতে পারবে না বলেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।


কিন্তু এই নিৰ্দেশাবলীর অহেতুক সুবিধা নিয়ে গুজরাট সরকার প্রথম খেউয়ে যে ১১জন লোককে মুক্তি করে দেয়, সমগ্র দেশবাসীর চোখ কপালে তুলতে তারা সফল হয়। পিএম মোদী স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে আহ্বান জানানোর কিছু সময়ের পরই এই গুরুতর কয়েকটি অপরাধীদের মুক্তি করে দেয়া হয়। তার থেকেও বিস্ময়কর এবং উদ্বেগজনক কথাটা হ'ল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মকর্তারা তাদেরকে কারাগারের সম্মুখে মিষ্টিমুখ করিয়ে দেয়, তিলক লাগানো হয়, পা স্পর্শ করে সম্মান জানানো হয়। কথাটা বিস্ময়কর এবং উদ্বেগজনক বলে একারণেই বলছি যে


সেই সকল কারাবন্দীরা কোনো রাজনৈতিক বন্দী ছিল না, দেশ তথা জনতার হিতে সংগ্রাম করে দণ্ডিত করা হয় নি। তারা ছিলেন হত্যাকারী এবং ধৰ্ষণকারী


 অথচ গৃহ বিভাগের নির্দেশাবলীতে উল্লেখ আছে, হত্যাকারী এবং ধর্ষণকারীকে মুক্তির তালিকায় সন্নিবিষ্ট করতে দেয়া হবে না। ২০০২ সনের গুজরাটের সাম্প্রদায়িক সংঘৰ্ষে সেই ১১জন বেকসুর খালাসীরা বিলকিস বানো নামের ইসলাম ধর্মীয় পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা এক মহিলাকে দলবদ্ধভাবে ধৰ্ষণ করেছিল। কেবল বিলকিস কে ধৰ্ষণ করাতে এরা থেমে থাকেনি, তার চোখের সম্মুখেই তার তিন বছরের কন্যা সন্তান সালেহা কে হত্যা করার পরও পরিবারের আরও সাতজন লোকের হত্যা করা হয়েছিল। এরা যে কতটা ভয়ংকর অপরাধী, তা বলে জানানোর আবশ্যকতা নাই। 

যাইহোক, কেন্দ্ৰের গৃহবিভাগ সমগ্র দেশের জন্য জারি করা নীতি গুজরাট সরকার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পদদলিত করে উক্ত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের সসম্মানে মুক্ত আকাশের নিচে বাহির করে আনার সাহস করলো কিভাবে? উল্লেখ্য যে এই ১১জন কারাবন্দীর মধ্যে একজন বন্দী, যে ইতিমধ্যে ১৫ বছর কারাবাসের সাজা কাটাচ্ছিল, তা লাগব করার উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে আবেদন দাখিল করেছিল। সেই আবেদনের ভিত্তিতে ন্যায়ালয় গুজরাট সরকারকে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির বিষয়টি বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সেই নির্দেশের উপর আমল করে গুজরাটের বিজেপি সরকার বাকী ১০জন লোককে মুক্তি দিয়ে দেয়।

ইতিহাসের পাতায় গুজরাট সরকারের এহেন কার্য নিশ্চয় কোনো সোনালী অক্ষরে লিখা থাকবে না বরং স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব বৰ্ষে এই ঘটনা কলংকিত করে রাখবে। কলংকিত করে রাখবে, কারন রাজ্য সরকারের এই কু-কার্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ সমর্থন আছে বিজ্ঞ মহলে চর্চিত। সমর্থন আছে এজন্যই কেন্দ্রের জারি করা নীতি উলংঘন করে রাজ্য সরকার যে কার্য সংঘটিত করেছে, কেন্দ্রীয় সরকার তার বিরুদ্ধে একটা কিছু লিখিত বা অন্তত একটা কথাও আজ পর্যন্ত বলে নাই দেশবাসীর প্রতি সম্বোধন করে। দেশের অগণিত মানুষ গুজরাট সরকারের এইকাজের প্ৰতিবাদে সবর হয়ে উঠেছে দেখেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও নির্বিকার হয়ে আছেন৷ উনাদের মৌনতা এই কথার স্পষ্ট আভাস দেয় যে বিলকিস বানো তথা তার পরিবারের মধ্যে আসতে পারে সম্ভাব্য দুশ্চিন্তা এবং বিপদ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একদমই উদ্বিগ্ন নয়, বরং আম আদমি পার্টির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে৷ একজন সোসিয়াল এক্টিভিস্ট বলেন 'সম্ভবত গোধরা বিধায়ক সি কে রাহুলের .. they are Brahmins. Anyway, the sanskar of Brahmins is very good." এই মন্তব্য আপ্তবাক্য রূপে মোদী-শাহ অন্তস্থল থেকে বিশ্বাস করেন। উল্লেখযোগ্য যে, সাজা লাগব করা পর্যালোচনা সমিতিতে রাহুল জি'র ছাড়াও আরও একজন মহিলা বিধায়িকা সুমন চৌহান ও ছিলেন !'

সম্প্রতিকালে ভারতের ন্যায়ব্যবস্থা নিয়ে যে সকল অবাঞ্ছিত প্ৰশ্নের অবতরণ হয়েছে, বিলকিস বানোর ঘটনাই সব 'দুধ কা দুধ, পানি কা পানি' হয়ে গেছে। এর আগে তিস্তা সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারকে নিয়ে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে দেয়া রায়ের বিষয়ে বিভিন্ন লোক ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তুলেছেন। অবশ্য দুই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ন্যায় ব্যবস্থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের ন্যায়লয়ের উপর আমার আস্থা আছে এবং তা রাখতে হবে। যদিও কয়েকটি রায় ন্যায়ালয়ের মর্যাদা অবনমিত করেছে বলে অনেক লোকের মন্তব্য। এমনকি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রাক্তন বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠ আধিকারিকের কাছ থেকেও মন্তব্য শোনা যায়। তিস্তা সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারের বিষয়টি আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববরণ্য কিছু ভালো মানুষ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে অনুরোধ জানিয়ে এইবলে আবেদন দাখিল করেছে যে স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগ নিয়ে ন্যায়ালয়ে সিতালভাড় এবং শ্রীকুমারের কেইস দুটো তাৎক্ষণিকভাবে রফা-দফা করতে হবে। এই আবেদনে সকল স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন—— ব্ৰিটিশ সাংসদ এবং রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ভিখু পারেথ, ভাষাতত্ত্ববিদ তথা স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি, ভারতীয় মূলত আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অর্জুন আপ্পাডুরাই, মার্কিন রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ওয়েণ্ডি ব্রাউন, ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃত পণ্ডিত শেল্ডন পল ক., অর্থনীতিবিদ রবাৰ্ট পলিন, দার্শনিক কেওল বরেন, চাৰ্লস টেইলব, মার্কা নুসবাউম, আকিল বিলগ্রামী আরও অন্যান্য। এর দ্বারা দুটো কথা স্পষ্ট হয়। এক, এতো দিন ধরে আমাদের সরকারের — “ভারতের ন্যায়পালিকা স্বতস্ফূর্ত'— কথাগুলোর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। দুই, ন্যায়পালিকাকে প্রহসনমূলক করার ক্ষেত্ৰে বিজেপি সরকারের ভূমিকা সুস্পষ্ট।জরুরীকালীন অবস্থায় ইন্দিনা গান্ধী ন্যায়পালিকাকে নিজ স্বাৰ্থে ব্যবহার করেন নি, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ন্যায়পালিকার গতি-বিধি জরুরী কালীন অবস্থা কে তুচ্ছ করে তোলেছে।

এখনও আমাদের দেশে জরুরিকালীন অবস্থা জারি করা হয়নি। যদিও এর আবশ্যকতাও নেই৷ কারণ ফ্যাসিবাদ ঘোষণার মাধ্যমে ইহা আসে না, এটা আসে হস্তক্ষেপে একজনে দুজনের ভাগ আত্মসাৎ করার জন্য। ইতিমধ্যে আমার ঘটি, লোটা, বাটি আমার বহু বস্তু নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি অন্ন যোজনা, অরুণোদয়, সোনা রূপার মোহে বন্দী, আজমল মুখ্যমন্ত্ৰী হওয়ার আতংকে আক্রান্ত। একটা সময়ে আনোয়ারা তাইমুরও মুখ্যমন্ত্ৰী হয়েছিলেন। আমরা এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছি যে পরনের কাপড়টা যেদিন হারাবো, সেইদিন আর রাজার বিরুদ্ধে বাহিরে এসে প্রতিবাদ করতে পারবো না। ইতিমধ্যে আমরা 'বইলিং ফ্রগ সিমড্রমে' আক্রান্ত হয়েছি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929