বেশ্যাবৃত্তি, PITA আইন এবং..
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | | views :289 | like:0 | share: 0 | comments :0
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল এ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম : " লকডাউন যাঁদের যৌনকর্মী বানাল, সন্ধ্যা-মালতি-শ্যামলীদের কথা "। লিংক- https://www.anandabazar.com/west-bengal/many-women-working-as-sex-worker-after-loosing-their-job-in-lockdown-dgtldx-1.1244911
এই রিপোর্ট টি বানিয়েছেন জনৈক সৈকত ঘোষ। এই প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। আশাকরছি সবাই ঠান্ডা মাথায় পড়বেন। এই রিপোর্ট টি নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তির বক্তব্য পড়েছি বা শুনেছি। যাদের মোদ্দা কথা " বেশ্যাবৃত্তি কি অপরাধ? আরে ওরা তো গতরটা খাটিয়ে রোজগার করছে। চুরিচামারি থোড়াই করছে নাকি? পেটে ক্ষিদে থাকলে নৈতিক - অনৈতিক তত্ত্বকথা এসব মাথায় থাকেনা। তাছাড়া কেউ যদি এটাকে পেশা বানাতে চায় স্বইচ্ছায় তাহলে আপত্তির কি আছে? সিগারেটের প্যাকেটে ধূমপান ক্যান্সারের কারন মার্কা ছবি দিয়েও তো দিব্যি বিক্রি হচ্ছে তাহলে বেশ্যাবৃত্তির বেলায় এতো প্রশ্ন কেন উঠবে? "
বাহঃ, চমৎকার। এই প্রসঙ্গ মনে পরছে " thehindu " অনলাইন পোর্টাল এ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ছিল - "Prostitution not a criminal offence : Bombay HC orders release of 3 sex workers "। অর্থাৎ বোম্বে হাইকোর্ট তার একটি রায়ে জানিয়েছে,
বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যাবসা আইনত অপরাধ নয়। খবরটির লিংক-
https://www.thehindu.com/news/cities/mumbai/prostitution-not-a-criminal-offence-bombay-hc-orders-release-of-3-sex-workers/article32701646.ece
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে,
" Prostitution is the business or practice of engaging in sexual activity in exchange for payment. Prostitution is sometimes described as sexual services, commercial sex or, colloquially, hooking. It is sometimes referred to euphemistically as "the world's oldest profession" in the English-speaking world. A person who works in this field is called a prostitute and is a type of sex worker ".
১৯৫০ সালের মে মাসে নিউইয়র্ক এ আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের ফল হিসেবে ভারতে " The Immoral Traffic (prevention) Act 1956 " এর সূচনা হয়। এই " PITA " আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় পতিতাবৃত্তি নিয়ে যা বলা আছে, তাতে একজন সাধারন মানুষের ও বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, পতিতাব্যাবসা বা যৌনতা ব্যাবসা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বা Criminal Offence।
আমাদের এই ভোগবাদী সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি, অনেক এনজিও আছে যারা মুখোশের আড়ালে দুর্দান্ত ভণ্ডামি করে খায়। এরা যেনতেন প্রকারে বেশ্যাবৃত্তি কে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। এই মুখোশধারীরা এটা ভুলে যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি ঠিকে আছে শুধুমাত্র ভোগবাদী গ্রাহকদের ওপর নির্ভর করে এবং এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় রয়েছে।
কথাপ্রসঙ্গে একটা আলোচনায় সাংবাদিক এবং 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সংযুক্ত সম্পাদক সন্তোষ শর্মা জানাচ্ছেন, " উত্তর প্রদেশ একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল। National Crime Record Bureau এর রিপোর্ট অনুসারে,২০১৯ সালে ভারতে প্রতিদিন ৮৭ টা ধর্ষণ ঘটেছে যার বেশিরভাগই উত্তরপ্রদেশে। এই পরিস্থিতিতে বেশ্যাগিরিকে আইনের তমকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আমার কয়েকজনের মুখেও বেশ্যাবৃত্তি বা প্রস্টিটিউশনকে লাইসেন্স দেওয়ার কথা শুনেছি। তাঁদেরকে আমি কিছু কড়া কথা বলেছিলাম যেমন, এই লকডাউনে এমন অনেকে আছেন যাঁরা কাজ হারিয়ে বাড়িয়ে বসে আছেন। বিশেষ করে মহিলারা। কোথাও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না?চিন্তা কেন করছেন হে পুরুষ, একবার ভেবে দেখুন আপনি বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে মৌজমস্তি করছেন আর অন্যদিকে আপনার স্ত্রী আপনার জন্য টাকা রোজগার করে চলেছেন। কিন্তু যদি আমাদের দেশে বেশ্যাগিরি আইনত হত তাহলে টুক করে আপনার স্ত্রীর নামে দেহবিক্রির লাইসেন্স নিয়ে ঘরেই বেশ্যালায় খুলে বসলেন। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত যখন খুশি আপানার বেশ্যালয়ে গ্রাহকদের আনাগোনা। যত বেশি স্ত্রী গতর খাটাবে তত বেশি টাকা। এই সুযোগে পাড়ার যে সব ফালতু মদমাতাল আপনার স্ত্রীকে কে দেখে লালা ঝড়াতো তারা এই সুযোগে চেখে দেখার সুবর্ণ সুযোগও পেয়ে যাবে। থানা পুলিশ, পাড়ার মাস্তানের কোনও বালাই নেই। কারণ আপনার স্ত্রী লাইসেন্স ধারি বেশ্যা যে। এখানেও শেষ নয়। হয়তো বাড়িতে অবিবাহিতা বোন রয়েছে, টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না। বোনের নামেও বেশ্যাগিরির লাইসেন্স নিয়ে নিন। স্ত্রী আর বোন দুজনের ডবল রোজগারে ঘরে টাকার বন্যা বইবে। কি! আমার এই কথা শুনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ? জানেন, আমারও রাগ হয়। যারা চাইছেন বেশ্যাগিরিকে আইনত করা হোক, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনি কি নিজের স্ত্রী বা বোনকে বেশ্যা বানাতে যদি চান, তাহলে এখনই স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলুন। কথা দিচ্ছি এই সাংবাদিক আপনাকে খবরের শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
আমি, সন্তোষ শর্মা বেশ্যাগিরিকে আইনত করার সবথেকে বড়ো বিরোধী। আমি চাই না দেশটা বেশ্যাখানায় পরিণত হোক। তাই মুক্তমনা যুক্তিবাদী বন্ধুদের কাছে একটি বিনীত অনুরোধ, যে বা যারাই বেশ্যাগিরিকে আইনত করার দাবি তুলছে, তাদের প্রশ্ন করুন সবার আগে, তারা কি নিজের বাড়ির মা, স্ত্রী বোনকেও বেশ্যা বানাতে রাজি আছেন কি? "
আসুন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক কি রয়েছে PITA আইনে। এই আইনের ২ নং ধারায় পতিতালয় বা Brothel এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে কোনও স্থান, বাড়ি, গাড়ি - সম্পূর্ণরূপে বা অংশকে বোঝাবে যেখানে বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যে, লাভের আশায় যৌনতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকেই পতিতালয় বা Brothel বলে চিহ্নিত করা হবে।
' Prostitute ' বলে সেইসব মানুষকে চিহ্নিত করা হবে, যারা বাণিজ্যিকভাবে নিজের যৌনতাকে লাভের আশায় ব্যবহার করে। পতিতাবৃত্তি বা Prostitution হল যৌনতাকে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহার।
শিশু বলতে তাদের বলা হয়েছে, যাদের বয়স ১৬ বছরের কম। এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের ' শিশুপতিতা ' হিসবে গণ্য করা হবে।
অপ্রাপ্তবয়স্ক তারাই, যাদের বয়স ১৬ বছরের ওপর কিন্তু ১৮ বছর অতিক্রম করেনি এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাদের ' অপ্রাপ্তবয়স্ক পতিতা ' বলে গণ্য করা হবে। ১৮ বছর যারা পার করেছে, তারাই আইনের চোখে অপ্রাপ্তবয়স্ক।
PITA আইনের ৩ নং ধারায় পতিতালয় চালানোর বিরুদ্ধে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কোনও ব্যক্তি যদি মালিক হিসেবে, ভাড়াটিয়া হিসেবে অথবা লিজ হোল্ডার হিসেবে কোনো পতিতালয় চালায়, তবে তার প্রথম অপরাধের জন্য এক থেকে তিন বছরের জেল এবং দু হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। দ্বিতীয় বা পরবর্তী অপরাধের জন্য দুই থেকে পাঁচ বছরের জেল ও দু হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
PITA আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে - কোনও পতিতার আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে দু বছরের জেল ও সঙ্গে এক হাজার টাকা জরিমানা। এছাড়া, কোনো শিশুকে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে সেই আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে সাত থেকে দশ বছরের জেল ও জরিমানা।
PITA আইনের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহিত করলে বা কাওকে পতিতা হিসবে নিয়োগ করলে সেই ব্যক্তির যাবজ্জীবন জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে।
এই আইনের ১৩ নং ধারায় পতিতাবৃত্তি নিবারণের উদ্দ্যেশ্যে বিশেষ পুলিশ অফিসার ' স্পেশাল পুলিশ অফিসার ' নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে বিশেষ পুলিশ অফিসার, পতিতাবৃত্তি চালানোর সন্দেহে যে কোনো স্থানে বিনা ওয়ারেন্টে প্রবেশ ও অনুসন্ধান করতে পারে।
১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনওভাবে খবর পান যে, কাওকে পতিতাবৃত্তিতে নামানোর উদ্দ্যেশ্যে আটক করা হয়েছে, তবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে আদেশ দিতে পারেন। ১৭(ক) ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ধার করা মানুষটিকে তার মা, বাবা অথবা অভিভাবকের হাতে তুলে দেবেন। তবে তার আগে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখবেন ওই মা, বাবা কিংবা অভিভাবক ওই উদ্ধার করা মানুষটির ভরণপোষণে সক্ষম কি না। ১৮ ধারামতে ম্যাজিস্ট্রেট খবর পাওয়ামাত্র পতিতাবৃত্তি চালানোর উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত যে কোনো স্থান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন ।
আইনের এতগুলো ধারাগুলি ভালোভাবে পড়লে যেকেউ বুঝবেন যে পতিতাবৃত্তি বে-আইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইফাঁকে আমরা জেনে নিই পতিতাবৃত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো বা হয়। যেমন, দেহপসারিনী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, গণিকা, বিজর্জরা, আসুগো ইত্যাদি। আবার কামসূত্র গ্রন্থর লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনিষ্টা, রুপজীবা, গণিকা ( সূত্র- চতুর্থ ভাগ, ষষ্ঠ অধ্যায় -২৪)। আবার ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে রয়েছে - " সুবন্ধবে যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা "। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ 'মরিস ভিন্টারনিৎস' এর মতে এখানে বিশ্যা শব্দটি থেকেই নাকি বেশ্যা কথাটির উৎপত্তি। এছাড়া, George Ryley Scott তার " A history of prostitution from antiquity to the present day " বইতে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন- পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।
পরিশেষে বলাই যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি টিকে রয়েছে শরীর লোভী গ্রাহকদের চাহিদার ওপরে। সেইসব গ্রাহক যাদের কাছে নারী শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী, পায়ের জুতো এবং সন্তানের জন্মদেওয়ার যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ সর্বতোভাবে, কোনোরকম রাখঢাক না করেই। সুস্থ সমাজে বেশ্যাবৃত্তি অভিশাপের ন্যায়। একে সমূলে উৎপাটন করতে ব্যপক প্রচার ও প্রসার করতেই হবে।
বিশেষ সংযোজন : বিগত কয়েক বছরে অ্যামিটি,প্রত্যয়, উত্তরাপথ, স্বীকৃতি ইত্যাদি নামের কয়েকটি গোষ্ঠী ' মানস বাংলা ' নামক এক সংস্থার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠছে। এইসব গোষ্ঠীগুলোর কাজ HIV র বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, সমকামীদের সামাজিক স্বীকৃতির পক্ষে প্রশ্ন তোলা এবং সবচেয়ে যেটা বড় লক্ষ্য তা হলো গণিকাবৃত্তিকে আইনী করার লক্ষ্যে আন্দোলন করা ইত্যাদি। এদের ফান্ড আসে বিদেশ থেকে মোদ্দা কথায় ফান্ডেড এনজিওর আড়ালে এরা বেশ্যাবৃত্তিকে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। ' মানস বাংলা ' র চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনীশ রায়চৌধুরী তার জুলাই ২০০৯ এর হিসেব অনুযায়ী জানিয়েছিলেন এই সংস্থার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। ভাবা যায়!