গল্পের ফাঁকফোঁকর: কে বড়— রাধা নাকি রুক্মিণী ; কৃষ্ণ, নাকি বিষ্ণু?
Guitar K Kanungo
Jan. 13, 2025 | | views :55 | like:3 | share: 4 | comments :0
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ঈশ্বর নিজেকে তিনভাবে প্রকাশ করেন: সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, এবং ধ্বংসকর্তা। সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্মা, পালন করেন বিষ্ণু, এবং ধ্বংস করেন শিব। এইভাবে প্রকাশের মধ্যে একটি সমস্যা আছে। সেটি হল—সৃষ্টি করার পর ব্রহ্মার আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। সেইজন্যেই বোধ হয় ব্রহ্মার কোনো মন্দির নেই; তাঁকে কেউ পূজা করে না। এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হবার এক মুহূর্ত আগে শিব আবির্ভূত হলে খুব একটা অসুবিধা হবে না, কারণ ধ্বংস করা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো কাজ নেই।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, পালনকর্তা বিষ্ণুই সার্বভৌম—একেবারে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রয়োজন রয়েছে মর্ত্যের মানুষের কাছে। মর্ত্যে কংসের মতো বা বালির মতো কারো বাড় বেড়ে গেলে, এই বিষ্ণুকেই ধরাধামে অবতীর্ণ হতে হয় পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার প্রয়োজনে। কিন্তু, আবার একথাও তো ঠিক—ব্রহ্মা যদি সৃষ্টিই না করতেন, তাহলে বিষ্ণুর সেই সৃষ্টিকে রক্ষা করারই প্রয়োজন হত না; শিবের ধ্বংস করারও। তাহলে, ব্রহ্মাই কি শ্রেষ্ঠ? নাকি বিষ্ণু? নাকি শিব? কে বড় ত্রিমূর্তির মধ্যে?
এই প্রশ্নটাই মহর্ষি ভৃগুর মনেও জেগেছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা বা শিব নয়, ঈশ্বরের তিন প্রধান প্রকাশের মধ্যে বিষ্ণুকেই শ্রেষ্ঠ বলে রায় দিয়েছিলেন। ভৃগু বিষ্ণুর এই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেছেন নম্রতার মাপকাঠি দিয়ে। ভৃগু এর আগে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং দেবাদিদেব মহাদেবকেও পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কিন্তু নম্রতার মানদণ্ডে এদের দুজনের কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
বুকে পদাঘাত করার পরেও বিষ্ণু ভৃগুকে কোনো শাস্তি দেননি; বরং পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিয়েছেন। এই গল্পটা সম্ভবত ব্যাস আমাদের শুনিয়েছেন মহাভারতে। অবশ্য, এখানে কিছুটা পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারও থাকতে পারে। কোনো কোনো পুরাণ বলে ভগবান বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগুরই আত্মজা। কন্যার স্বামীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকতেই পারে, বিশেষত সে স্বামী যদি ভগবান বিষ্ণু হন। যদি হিমালয়কে এই দায়িত্ব দেওয়া হত, তিনি নিশ্চিত চাল-চুলোহীন শিবকেই বেছে নিতেন।
কিন্তু, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ আমাদের ভিন্ন কথা বলছে। সেখানে কৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছুর মূল। তিনিই পরমব্রহ্ম। সৃষ্টির ইচ্ছাও তাঁর মধ্যেই প্রথম প্রকট হয়েছিল—বিষ্ণুর মধ্যে নয়। কৃষ্ণই নিজেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারীতে বিভক্ত করে রমনে লিপ্ত হলেন। এই রমনের ফলে নারী অংশটি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে একটি গোলাকার পিণ্ড প্রসব করেন। সোনালী রঙের এই পিণ্ডটিই আমাদের মহাবিশ্ব। অনেক বছর সেই পিণ্ড ভেসে থাকল। তারপর একদিন সেই পিণ্ডটি ভেদ করে বিষ্ণু বেরিয়ে এলেন এবং সৃষ্টিকর্মের বাকিটা শেষ করলেন।
এখানে ব্রহ্মার কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না; মহাদেবের অস্তিত্বেরও উল্লেখ নেই। স্পষ্টতই কৃষ্ণই সবকিছুর মূল।
মহাভারত বলছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর অবতার। মহাভারত আরও বলছে—তাঁর একাধিক স্ত্রী থাকলেও রুক্মিণীই কেবল লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। এদিকে, মথুরায় আসার আগে কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে ছিলেন, সেখানে চুটিয়ে প্রেম করেছেন শ্রীমতি রাধার সঙ্গে এবং অন্যান্য ব্রজবালাদের সঙ্গেও।
মজার ব্যাপার, রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমটা স্বকীয়া ছিল না। রাধা বিবাহিত ছিলেন এবং বয়সে কৃষ্ণের চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। কৃষ্ণ কেবল রাধাতেই মজে ছিলেন না; অসংখ্য ব্রজবালার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। এই সমস্ত ব্রজবালার অনেকেই বিবাহিত ছিলেন। রাধা এই নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছুটা মান-অভিমান করলেও কৃষ্ণের বহুগামিতা নিয়ে রুক্মিণীর মতো তিনিও নিস্পৃহ ছিলেন।
কিন্তু রাধা একজন সাধারণ গোপী। তিনি লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নেননি। মজার ব্যাপার হল, কৃষ্ণ নাম উচ্চারিত হলেই রাধার নামই আসে; রুক্মিণীর নয়। তাই, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে—রাধা আর রুক্মিণীর মধ্যে কে বড়?
কেউ কেউ বলবেন, যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই বিষ্ণু; যিনি ব্রহ্মা, তিনিই শিব। সবকিছু মিলেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম। তাঁরা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেন। শুনেছি বটে এরকম কথা। ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।
আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!
যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম?শুনেছি বটে এরকম কথা।
ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।
আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!
যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম? কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম?