হুজুগ হলো সেই আচরণ যা সাময়িকভাবে কোনও এক বা একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে, যা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে দ্রুত সঞ্চারিত হয়। হুজুগ সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় হতে পারে। এই রচনায় আমি শুধুমাত্র বিনোদনমূলক হুজুগেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
এক বা একাধিক বিষয় কোনও একজন ব্যক্তির আগ্রহ থাকে, যা তাকে আনন্দ প্রদান করে, সাধারণভাবে আমরা তাকেই বিনোদন বলে থাকি। বিনোদন শব্দটিকেই ইংরেজিতে এন্টারটেইনমেন্ট বলা হয়, যে শব্দটির সাথে আমরা সকলেই সুপরিচিত।
বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। যেমন, বই বা সংবাদপত্র পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা, সিনেমা দেখা, আড্ডা মারা ইত্যাদি। বর্তমানে অন্তর্জালীয় বিশ্বে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সহ বিনোদনের হাজারো বিকল্প মাধ্যম বিনোদনের দুনিয়াকে আরো সম্প্রসারিত করেছে।
যখন প্রথম দূরদর্শনের প্রসার ঘটলো, তখন বিনোদনের এই মাধ্যমটির প্রতি আমাদের অমোঘ আকর্ষণ ছিল। বর্তমানে স্মার্টফোনের প্রতি আমাদের আকর্ষণ মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। আগামীদিনে এই মাধ্যমটির প্রতি আকর্ষণ থাকবে না। তার স্থান দখল করবে অন্য কোনও মাধ্যম। অর্থাৎ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিনোদনমূলক মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটে।
সাম্প্রতিক সময় কিছু সাময়িক বিনোদন আমাদের কিছু সময়ের জন্য এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখছে, যে আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, পারিপার্শ্বিক পরিবেশে সংঘটিত ঘটনাবলী, উদ্ভুত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় এই সকল বিষয়কে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন করে দিয়ে, মেতে উঠছি সেই সকল সাময়িক হুজুগে বিনোদনে। অতি সম্প্রতি এইরকম একটি হুজুগে মেতে উঠেছিলাম আমরা। 'কাঁচা বাদাম' হুজুগ। যা এই বিষয় একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
উল্লেখ্য হুজুগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও একটি সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে হয় থাকে। টুনির মা, কোলাভেরিডির হুজুগ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম টুম্পা সোনা হুজুগে। তারপর, ম্যানিকে মাগে হিতে, কমলা নৃত্য করে এর হুজুগ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম কাঁচা বাদাম হুজুগে। তারপর এলো পুষ্পা, শ্রীবল্লি। এইভাবে আসতেই থাকছে হুজুগে গানের সম্ভার। গান শুনুন, একবার নয় ভালো লাগলে দশবার শুনুন ক্ষতি নেই, ক্ষতিটা নিজেদের বিপুল সময় এইসকল গানের পেছনে অপব্যয় করাটা।
শুধু গান নয়, আমরা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি দেখে এতটাই অনুপ্রাণিত হয়ে উঠছি, যে সেইসকল ঘটনাবলীকেই মূল আলোচ্য বিষয় করে নেওয়াকেই কর্তব্য মনে করতে শুরু করেছি। কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনেদের প্রতিটি আচরণ তো বটেই যে কোনও তুচ্ছ ঘটনাকেও অত্যধিক গুরুত্ব দিতে একেবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। কখনো কখনো আমিও এই সকল হুজুগের স্রোতে গা ভাসাই।
প্রশ্ন হলো, কেন এই সকল হুজুগের উৎপত্তি? কেনই বা খুব সহজেই স্বেচ্ছায় এইসকল হুজুগে মেতে উঠছি। এর মুখ্য কারণ, সমাজের পরিচালকরা এইসকল হুজুগে মাতিয়ে রেখে সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা ভুলিয়ে রাখতে চায়। যাতে করে আমরা এই সকল সমস্যা সমাধানে কোনওপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণ না করতে পারি। সকল প্রকার বৈষম্য, কুসংস্কার, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, নারী নির্যাতন, দূর্নীতি ও অন্যয়ের বিরুদ্ধে আমরা যাতে লড়াই না করতে পারি, আমরা যাতে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলে দূর করতে পারি সকল প্রকার অসাম্য। সমাজপতিরা তাই চায়। তাতে তাদের স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্নটি জড়িত যা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের স্বার্থ আর সংখ্যালঘু শোষক শ্রেণীর স্বার্থ এক হতে পারে না। একথা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
কাজেই আমরা যদি জাতপাতহীন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কুসংস্কারমুক্ত, সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে এই সকল হুজুগে বিনোদনে অংশগ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। তা না হলে আমরা গড়তে পারবো না, আমাদের কাঙ্খিত সেই নতুন সমাজ। আমরা লড়তে পারবো না, সেই কাঙ্খিত সমাজ গঠনের অত্যন্ত কঠিন লড়াইটা। কারণ আমরা লড়বো উন্নত চেতনা দিয়ে, অযৌক্তিক, অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক হুজুগে বিনোদন আমাদের মনে সেই চেতনার জাগরণ ঘটাতে পারবে না। কাজেই হুজুগে বিনোদন থেকে দূরে থাকুন, দূরে রাখুন সকলকে।