অশৌচের নিয়ম কানুনেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের এত ফারাক কেন?
শম্ভুনাথ চার্বাক
May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
পূর্বে সমাজ ছিল প্রায় অনড় স্থির। জীবিকা অর্জনের উপায় ছিল খুবই সামান্য। সেই সময়ে বর্তমানের মতো মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা ছিল না। মৃতের উত্তরাধিকার নির্ণয়ের জন্য সামাজিক শংসাপত্র ছিল সাদা থান পরিধান করে ঘোরা এবং লোককে জানান দেওয়া। সন্তানসম্ভবা মহিলার সাধ ও বাচ্চার অন্নপ্রাশন একই ধরণের অর্থাৎ আগামী উত্তরাধিকারীর পরিচিত ঘটানোর জন্য। ঐ সাদা থান পরিহিত ব্যক্তি দেখলেই বুঝি সেই ব্যক্তির পিতা বা মাতার বিয়োগ হয়েছে। যদিও বর্তমানে কিছু মানুষ এই সাদা কাপড় ভিক্ষা জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। মৃতের জন্য মৃতের পুরুষ সন্তানদের অশৌচে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়, নারীদের কোনও অধিকার নেই। অশৌচের ক’দিন একবেলা আতপ চালের মণ্ড কাঁচাকলা সেদ্ধ ও ফলমূল খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। ব্রাহ্মণরা কিন্তু দুধ-ঘি-মিষ্টি যোগে ভাল করে খায়। এখানেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের লোকেদের ফারাক ছিল।
আবার পালনের দিন সংখ্যাতেও অনেক ফারাক ছিল, যথা- ব্রাহ্মণ-১০ দিন, ক্ষত্রিয় -১২ দিন, বৈশ্য - ১৫ দিন, শূদ্র- ৩০ দিন অর্থাৎ সব থেকে গরীব যে শ্রেণী সেই শ্রমজীবী শূদ্র মানুষদের কাজ থেকে বিরত রেখে কু-খাদ্য খাইয়ে শরীর শেষ করিয়ে এক্কেবারেই শেষ করে দেওয়ার রীতি। দুধে ভাতে থাকা ব্রাহ্মণদের এই কম দিনের সুবিধা কেন? এই প্রশ্ন কোনও শূদ্র করে না, শুধু গাধার মতো ভার বয়ে যায়। বর্তমানে সমাজ অনেক গতিশীল, বৃত্তির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। পারিবারিক বৃত্তিতে থাকাও সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এখন চর্মকারের পরিবারের সন্তান শিক্ষক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন আবার ব্রাহ্মণ সন্তান জুতোর/মাছের দোকান খুলে বসেছেন, বেয়ারা/ঝাড়ুদাড়ের কাজ করছেন। বৈদিক যুগে ঋক বেদের দশম মণ্ডলে জাতপাতের ভেদাভেদ দৃঢ় করা হয় এবং তখন থেকেই ভারতীয়দের পতন শুরু হয়। সমাজের এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে শূদ্র নামে অভিহিত করে তাদের শ্রম চুরি করে, তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বাতিল করে ক্ষত্রিয় শাসক ও সহযোগী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গুটি কয়েক পরিবার ধনী হয়ে ওঠে।
গীতার অনেক শ্লোক এর পক্ষেই প্রচার করে এবং সরাসরি জাতপাতের ভেদাভেদকে সমর্থন করে। যাদের দমিয়ে রাখার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থগুলি তারাই গীতাকে মাথায় করে রাখে। মনুস্মৃতির মত প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থ ব্রাহ্মণদের দ্বারাই রচিত শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেদের ওপর প্রভূত্ব করার জন্য। ভারতবর্ষকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণও জাতপাতের ভেদাভেদ এবং নিয়তিবাদ। প্রতিবাদ ও ধ্বনিত হয়েছিল চার্বাকদের আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বেদ বিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের আন্দোলনে, ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কিছুটা স্তিমিত হলেও শৈব মতাবলম্বী গুপ্ত সম্রাটদের উত্থানে ও সহযোগিতাতে চতুর্থ শতকে পুণরায় সমাজ ব্রাহ্মণদের কুআচার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের দখলে চলে যায়। বাংলাদেশে শৈব মতাবলম্বী শশাঙ্কের উত্থান ও অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতন শুরু হয়। শশাঙ্ক নির্বিচারে বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এর ফলে ব্রাহ্মণদের কুআচারের শাসন বাংলাদেশেও শূদ্রদের গলা টিপে ধরে। সেন যুগে বল্লাল সেনের সহযোগিতাতে ব্রাহ্মণদের রমরমা চলতেই থাকে। মাঝে পাল যুগে বৌদ্ধদের আধিপত্য বজায় ছিল। অর্থাৎ শাসকের সহায়তা ভিন্ন ধর্ম এগোতে পারে না। পরবর্তীকালে ইংরেজদের আগমনে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে মানুষের চিন্তাভাবনাতেও পরিবর্তন আসে। ধনতন্ত্রের আগমনে সামন্ততন্ত্রের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠা শুরু করে। যদিও ভারতবর্ষে পশ্চিম ইউরোপের মতো ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি। ইংল্যান্ডে ধনতন্ত্রের আগমনে জিওনার্দো ব্রুণো, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, স্ট্যুয়ার্ট মিল, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যিকদের মানবিকতাবাদী লেখনী ইউরোপিয়ান সমাজকে নাড়িয়ে দিলেও ভারতীয়দের তেমন নাড়া দিতে পারেনি। বাংলার রেঁনেসাসে রামমোহন, ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন প্রসার লাভ করলেও তা আবার নবকৃষ্ণ দেব, রাধাকান্ত দেবেদের মতো সামন্ত প্রভুদের দখলে চলে যায় এবং ভাববাদের প্রসার লাভ ঘটে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দদের মাধ্যমেই। সমাজ আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের আধার হতে শুরু করে। আর আমাদের বর্তমান শাসকদের বৈদিক আমলের ঐতিহ্যের গুণগান ও ক্রিয়াকলাপ দেখে বোঝা যায় সমাজে এরা আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চায়।
এই গতিশীল সমাজে পিতা মাতার বিয়োগের পরে এতদিন ধরে অশৌচ পালন করলে শ্রমের যোগানে টান পড়বে এবং উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং লোকেদের আর এই আচারে আবদ্ধ রাখলে ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ শুরু হবে। তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর আগে অশৌচের দিনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হল। এখানেও পার্থক্য রয়ে গেল, ব্রাহ্মণদের ১০ দিন আর শূদ্রদের ১২ দিন। সব আচারের ব্যাপারেই ব্রাহ্মণরা সুবিধাভোগী। এটা নিয়ে কোনও শূদ্র প্রশ্ন করে না। আর বর্তমানে ডেথ-সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা আছে ঐ সাদা থান পরিধানের দরকার কি? ১২ দিন ধরে আচার পালন করে শরীরকে কষ্ট দেওয়ার অর্থ কী? এর ফলে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই অপ্রয়োজনীয় প্রথাকে গাধার মতো শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেরা বয়ে নিয়ে চলেছে। শূদ্ররা ডিগ্রি অর্জন করলেও প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি। ফলে তাদের দাবিয়ে রাখার জন্য যে আচারের ব্যবস্থা ব্রাহ্মণদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তারা ভয় পায়। ফলে এই শোষণ ব্যবস্থা এই দ্বাবিংশ শতকে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার যুগেও টিকে আছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শিব্রাম চক্রবর্তী মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী বইতে এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন। পুরোহিত ব্রাহ্মণদের উনি নরখাদকের সাথে তুলনা করেছেন। সমাজকে শোষণ করার জাতপাতের ভেদাভেদের ব্রাহ্মনীয় পদ্ধতি এক কথায় ইউনিক। অ্যাডাম স্মিথ বা স্ট্যুয়ার্ট মিল ও এগুলি ভাবতে পারেননি। চার্লস ডারউইন পড়া ডিগ্রি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতেরাও গাধার মতো এই ভার বয়ে চলেছে, এদের শিক্ষার সাথে জীবনের কোনও যোগ নেই।
মূল বাল্মীকির রামায়ণে দশরথের পুরোহিত জাবালিও রামচন্দ্রকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন কে দেখছে মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে? রামচন্দ্র শাসকের প্রতিনিধি তিনি জাবালিকে তস্কর বৌদ্ধ বলে তিরস্কার করেছিলেন। অর্থাৎ রামায়ণ রচনা সমাপ্ত হয়েছিল বুদ্ধের আবির্ভাবের পরেই। বুদ্ধদেব তখন ব্রাহ্মণদের আচারের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মে আত্মার কোনও সংস্থান রাখেননি। ফলে এই আচারগুলি রহিত হয়েছিল এটা বোঝা যায়। দুহাজার বছর আগের মানুষ এর প্রতিবাদ করলেও আধুনিক মহাকাশ যুগের মানুষ এর প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।
বাবা-মা জীবিত থাকাকালীন নিজের আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী সেবা করুন; তবেই প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখান হবে। আর বাবা-মাকে দেখলাম না, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে নিষ্ঠাভরে আচার পালন করে বিশাল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলেও বাবা মাকে শ্রদ্ধা দেখানো যায় না।
আত্মার ধারণাও বিদেশ থেকেই (ব্যাবিলন) ভারতে এসেছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কে আত্মাকে দেখেছে? আসলে পরলোক ও আত্মার ব্যবসা না থাকলে ধর্মের গোড়া ধরে টান পড়বে। ইহলোকে অত্যন্ত কষ্টে থাকুন ওপরের তিন শ্রেণীকে সেবা করে যান বিনা প্রশ্নে তবেই পরলোকে আপনি দেবদেবীদের সাথে স্বর্গের পারিজাত বনে দ্রাক্ষা খেতে খেতে ইন্দ্রের ঐরাবতে করে ঘুরতে পারবেন। তাই এই আচার চলবে শাসকের সহযোগিতাতেই। শাসক মন্দির মসজিদ গির্জাতে ভোটের জন্য ঘুরে বেড়াবেন আর অবিরাম ধর্মের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে যাবেন।