পাখিপ্রাণ সালিম আলি
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 24, 2024 | | views :292 | like:2 | share: 2 | comments :0
১৯৫০ সাল। সুইডেনের উপশালাতে বসেছে পক্ষীবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। প্রথম অধিবেশন শুরু হতে তেমন দেরি নেই, পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সবাই। একজন ভারতীয় অবশ্য তখনও পৌঁছননি। কী হবে? কোথাও আটকে গেলেন নাকি? অনুপস্থিত থাকবেন? এমন ভাবনা যখন ঘুরছে আয়োজকদের মনে তখন হঠাৎ মোটরসাইকেলের গর্জন। একটা সানবীম মডেল ব্রেক কষে দাঁড়াল সভাঘরের বাইরে। নামলেন সেই ভারতীয়। মুহূর্তের মধ্যে খবর চাউর হয়ে গেল যে ভারত থেকে সোজা বাইকে করে উপশালা পৌঁছেছেন এক ভারতীয় পক্ষীবিদ! যার কথা হচ্ছে তিনি সালিম আলি।
চুয়ান্ন বছর বয়সে ফিল্মি হিরোর মত বাইকে করে আবির্ভূত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যাঁর। এতটাই আকর্ষণ মোটরবাইকের প্রতি যে একটা মডেল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না তিনি, শুধু হার্লে-ডেভিডসনেরই তিন রকম মডেল ছিল তাঁর কাছে। এছাড়াও একটা করে ডগলাস, স্কট, নিউ হাডসন এবং জেনিথ মোটরবাইক চালিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। অবশ্য সানবীমের গল্পটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ভারত থেকে গোটা পথ ঐ বাইকে পাড়ি দেননি তিনি। বম্বে থেকে জাহাজে করে ইউরোপে আনান বাইকটা, উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনের আগে সেটাতে করে ইউরোপ চক্কর দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে ফ্রান্সে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পড়লেন, জার্মানীর মসৃন, বাঁধানো রাস্তায় আছাড়ও খেলেন বেশ কয়েকবার। তাতে কী? ভালবাসার জন্য কতকিছু করা যায়, হাত-পায়ে চোট তো সামান্য ব্যাপার। প্রবন্ধের শুরুতে ঝাঁকুনি খেয়ে পাঠক হয়ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন, সালিম আলি কোনটা বেশী ভালবাসতেন, পাখি না মোটর বাইক? জানা নেই উত্তরটা, তবে বাকি প্রবন্ধ তাঁর পক্ষীপ্রেমের আলোচনায় নিবেদিত।
সালিম আলির পক্ষী-পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা।
যে কোনো শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে। নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কাজটা করেছিলেন ‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’-র মাধ্যমে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চ। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষীচর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু হয় বাবরকে দিয়ে। সালিম আলির মন্তব্য, চালু ধারনাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন না সম্রাট বাবর। একটা উদাহরণ - শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট (monal pheasant) নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। ওড়ার পথে ফিজ্যান্টের দল যদি কোনো আঙুরক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে যায় সেখানেই। বাবর লিখছেন, ‘এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু।’ ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনায় যে সেগুলোকে কোনো স্থান দেননি তিনি, এটা তার দৃষ্টান্ত।
তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে, তিনি জাহাঙ্গীর। তার সম্পর্কে বলা হয়, সম্রাট না হয়ে তিনি যদি কোনো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন তবে হয়ত অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তার পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুর-কে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। জাহাঙ্গীরের আগ্রহ জানতেন তাঁর সাম্রাজ্যের সবাই, এমনকি বিদেশীরাও। তাই নজরানা হিসাবে তারা নিয়ে আসতেন তাদের এলাকার বিশেষ প্রজাতির পাখি। সেগুলো সম্রাটের হাতে পৌঁছনো মাত্রই তিনি মনসুরকে নির্দেশ দিতেন পাখির নিখুঁত ছবি আঁকতে।
সৌভাগ্যক্রমে, এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরেও সম্ভবত রয়েছে তার নমুনা। ছবির পাশাপাশি পাখির চেহারা, বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করতেন জাহাঙ্গীর।
সেইসব বর্ণনা ধরা রয়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়। ১৬২৪ পর্যন্ত চলে জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা রচনা। এই সময়ের মধ্যে কত যে পাখির বৈজ্ঞানিক বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সালিম আলি জানিয়েছেন যে তাঁর দরবারে ডোডো পাখিও পৌঁছেছিল। তবে সেটা ১৬২৪ সালের পরে। ফলে সেটার ছবি থাকলেও স্মৃতিকথায় কোনো উল্লেখ নেই।
জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বা আরো পরে মুঘল সাম্রাজ্য ছারখার হওয়ার পরে সম্রাটের সংগৃহীত বহু নমুনা বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। স্রেফ লুটের খেলা চলছিল তখন। যিনি পাখির নমুনা চুরি করছেন, তিনি হয়ত জানেনও না তার গুরুত্ব। লুটেরাদের দলে অবশ্যই ছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু তাঁদের অপরাধের পাশাপাশি গুণপনাও কিছু কম ছিল না। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের অনেকেরই আগ্রহ ছিল পাখিদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতে প্রথম পাখি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক সংকলন তৈরী করেছিলেন ব্রিটিশ সাহেব জার্ডন। ১৮৬২ এবং ১৮৬৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘বার্ডস অফ ইন্ডিয়া’-র দুটো খন্ড। এর পরে যে খামতি ছিল তা পূরণ করেন দুজন ভারতীয় - সালিম আলি এবং সিডনি ডিলো রিপলে। দশ খন্ডে তাঁরা প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’। প্রকাশকাল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩। এতগুলো খন্ড প্রকাশের পরও, যে বিষয়টা সালিম আলিকে চির-অতৃপ্ত রেখেছিল তা হল পাখিদের স্থানীয় নামের নির্ভরযোগ্য তালিকা সম্পূর্ণ করতে না পারা। এর অভাবে জনপ্রিয় বই যে তৈরী করা মুশকিল তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি।
জনপ্রিয়করণের এই আগ্রহ যে সারা জীবন তাঁর মধ্যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। পরিণত বয়েসে একবার তিনি প্রতিষ্ঠিত পক্ষীবিদ রিপলেকে বেশ রাগ করেই লেখেন যে পক্ষীচর্চার সবটাই যদি কাঠ-কঠিন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তিনি ছেড়েই দেবেন বিষয়টা। অরণ্যে পাখিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অধ্যয়ন ছেড়ে তিনি এমন ট্যাক্সোনমির যুদ্ধ করতে আগ্রহী নন। মজার কথা, প্রাণীবিজ্ঞানে সালিম আলির প্রশিক্ষণ মাত্র এক বছরের। ১৯১৭ সালে দুটো কলেজে একসাথে ভর্তি হন তিনি। একটাতে পড়াশোনার বিষয় ছিল আইন ও হিসাবশাস্ত্র। অন্যটাতে প্রাণীবিজ্ঞান।
দুটোই সম্পূর্ণ করেন তিনি। অবশ্য শুধু সময়ের ‘দৈর্ঘ্য’ দিয়ে এই সময়টাকে মাপলে চলবে না। এই সময়েই তিনি যুক্ত হতে শুরু করেন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সঙ্গে। তার কেরিয়ার গঠিত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকে। তবে ওই সোসাইটির সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় যে নিতান্ত শৈশবে, তা তো পাঠক মাত্রেই জানেন। ঘটনাটা এইরকম। একটা চড়ুই পাখি মেরেছিল ছোট্ট সালিম, তাঁর খেলনা এয়ারগান দিয়ে। সোসাইটির সম্পাদক মিলার্ড সাহেব সেই পাখি দেখে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পাখির শরীরে ব্যতিক্রমী রঙের বিস্তার দেখে মনোযোগী হলেন তিনি। চিহ্নিত করলেন পীত্কন্ঠ চড়ুই হিসাবে। এরপরে, বলা যায় পুরস্কার হিসাবে, সোসাইটির stuff করা পাখির সংগ্রহ দেখালেন। এই বিশেষ চড়ুইয়ের কথা সালিম আলি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’ তে। মৃত চড়ুই তাঁকে পাখির জগতের দরজা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রির সঙ্গে তাঁর যোগ যে কতটা নিবিড় ছিল তা বোঝাতে ১৯৮৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করব। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বায়োলজি আন্ডার দ্য রাজ’। সোসাইটির শতবর্ষ পূর্তিতে এর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লেখা হয়েছে (অনুবাদ):-
“১৯৩০ থেকে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির কাহিনী নির্ধারিত হয়েছে সালিম আলি নামে এক ক্ষীণদেহীর দ্বারা। কোনো ডিগ্রী নেই, জীববিজ্ঞানের প্রশিক্ষণও দূর অস্ত, তিনি বার্মায় কাঠ ব্যবসায়ীর পেশা ছেড়ে নিজের জীবন নিয়োজিত করেন পক্ষীচর্চায়। আজ ৮৭ বছর বয়সেও তিনি সমান সক্রিয় এবং দেশে বিদেশে সোসাইটির সঙ্গে তাঁর নাম সমার্থক। তাঁর ভূমিকার তাৎপর্য দুরকম: প্রকৃতিবিদ হিসাবে এবং প্রশাসক রূপে। যদিও প্রানীদের সমীক্ষার সাথে মূলত যুক্ত ছিলেন তিনি, প্রান্তরে-অরন্যে গিয়ে প্রাণীর আচরণ ও বাস্তুতন্ত্রের সংস্কারমুক্ত, সরল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ইতিহাস চর্চার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলেন। বিশেষ করে বাবুই পাখির সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, মুক্ত ভাবনা এবং স্পষ্টতার দিক দিয়ে কিছু বছর আগে great crested grebes এর উপর জুলিয়ান হাক্সলির করা গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়।”
প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সালিম আলি ভরতপুরকে চাষের ক্ষেতে পরিবর্তিত হওয়া থেকে বাঁচান।
তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পরেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন রাজস্থানের ভরতপুরে মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করে, তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজননের ঋতুতে শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা পড়ে। পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি তিনি। অবশ্য নেহাৎ আবেগের বশে একাজে লিপ্ত হননি সালিম আলি। তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে দেয় অনেক কিছু - গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বোঝে সরকার। পাশ হয় ভরতপুরের অরণ্য ও জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত।
এই ভরতপুরকেই ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম আলি। এই আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবি - গবাদি পশুকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না এই এলাকায়। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে সোসাইটির করা এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে গবাদি পশু না ঢুকলে এক বিশেষ ধরেণের আগাছা বাড়ছে হু হু করে। এরা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। ফলে মাছের সংখ্যা কমছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে কমে যাচ্ছে জলের পাখি। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেট্স ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড চালিনর ১৯৮০ সালে আসেন এই সমীক্ষায় অংশ নিতে। হতবাক হয়ে তিনি চিঠি লেখেন রিপলেকে। রিপলে বিষয়টা নিয়ে লেখেন সালিম আলিকে।
তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্বাধীনতার পর যখন রাজস্থানে ভরতপুরের মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজনন ঋতুতে শিকারে নিষেধাজ্ঞা পড়ে, পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে যেতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। অবশ্য শুধু আবেগের বশে এ কাজে লিপ্ত হননি সালিম, তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে অনেককিছু দেয়-গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বুঝে সরকার পাস করে ভরতপুরের অরণ্য এবং জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত। ভরতপুরকে ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম। এই আগ্রহর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন দাবি যেমন, গবাদি পশু প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। কিন্তু সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা যায় গবাদি পশু ঢুকতে না দিলে আগাছার সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে যা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেটস ফিশিং অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড ১৯৮০ সালে ভারতে আসেন এই সমীক্ষা তদারকি করতে। তিনি গবাদি পশুর অবাধ বিচরণের পক্ষে রায় দেন। প্রায় এক দশক ধরে চলা বিতর্কের পর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় সোসাইটির প্রতিবেদন। তখন সালিম এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ক্রমেই গবাদি পশুর জন্য ভরতপুরের পাখিদের দৈন্যদশা প্রকট হতে শুরু করেছে।
১৯০৬/০৭ বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি।...’
নয়-দশ বছর বয়সে এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছিলেন সেলিম আলি! উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয়দের কাছে ‘পক্ষী সংরক্ষণ’ ব্যাপারটা ছিল কল্পনাতীত। বরং পশুপাখি শিকারে যে যত কামাল দেখাতে পারবে সে তত বড় পুরুষসিংহ। শিকার-শিকার খেলতে খেলতেই সেলিম হয়েছিলেন বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া।
মাত্র তিন বছর বয়সে সেলিম মা-বাবাকে হারান। অনাথ হয়েও পাঁচ ভাই ও চার বোনের সঙ্গে সেলিম নিঃসন্তান মামা-মামির কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মামা আমিরউদ্দিন ছিলেন বড় শিকারি। সাহেবরা তাঁকে নেকনজরে দেখতেন। নয় বছরের ছোট্ট সেলিমকে তিনি একটি এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই মাসে ২ টাকা হাতখরচ পেতেন সেলিম। সেই টাকা জমিয়ে মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের পাখির বাজার থেকে নানা ধরনের পাখি কিনে, তারের জাল ও প্যাকিং বাক্স জুড়ে খাঁচা বানিয়ে তাতে পাখিগুলিকে রাখতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে মেহমানদের জন্য বস্তাবন্দি তিতির বা বটের পাখি এসেছে। সে সব সুস্বাদু পদ হওয়ার আগেই বস্তা খুলে জ্যান্ত পাখি চুপিসারে সরিয়ে ফেলতেন। সেই সব পাখিদের জায়গা হত খাঁচায়।
বড়দের অলক্ষে খুদেদের এই সব কাজে সাহায্য করত বাড়ির পুরনো ভৃত্য নান্নু। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে সেলিম লিখেছেন, তিনি বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না খাঁচার বন্দি পাখিগুলিকে। তার পরেই হাতে আসে এয়ারগান। সেলিমের বাড়ির ভিতরে ছাদে বারান্দায় ছিল অগুনতি চড়াইয়ের বসবাস। চোখের সামনে এত চড়াই ছিল প্রশিক্ষণের জন্য মোক্ষম। তিনি জেনে নিয়েছিলেন, মুসলমান সন্তান হিসেবে চড়াইয়ের মাংস গ্রহণে পাপ নেই। কিন্তু তা উপযুক্ত হালাল হওয়া চাই। মৃত চড়াইকে হালাল করার পদ্ধতি, কী ভাবে তেল মশলা দিয়ে এদের সদগতি করতে হবে, সবই শিখেছিলেন নান্নুর কাছেই!
এমনই এক দিন, শিকারের পর এক চড়াইপাখি হালাল করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল পাখির গলায়। এ তো ঠিক পরিচিত চড়াইয়ের গলার মেটে দাগ নয়। তা হলে? মৃত পাখিটির গলায় ঝোল পড়ার দাগের মতো হলদে ছাপ। হালাল না করে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গেলেন মামার কাছে। মামাও এর বিহিত করতে না পারায় একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন অবৈতনিক সেক্রেটারি ডব্লু এস মিলার্ড-এর কাছে। সোসাইটির ভিতরে দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো কেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেওয়ালে টাঙানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি... প্রথম বার এই সব দেখে সেলিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সেলিমের জীবন বদলে দিয়েছিল। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এটা নিশ্চয় ১৯০৮ সালের কোনও একটা সময়ে ঘটে থাকবে। বি এন এইচ এস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’
পাখি ও প্রকৃতির বাইরে সেলিম আলি পাগল ছিলেন আর একটি ব্যাপারে। সেটি হল মোটরসাইকেল! কাজের সূত্রে মায়ানমারে গিয়ে প্রথম তাঁর হাতে আসে মোটরসাইকেল, ‘জেনিথ’। ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’ এবং ‘মেক’... সেরা কোম্পানিগুলির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল বিএমডব্লু-র মোটরসাইকেল ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বলে! বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরবাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নাল আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। নতুন মোটরসাইকেল হাতে এলেই, তিনি তার ইঞ্জিন খুলে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোম্পানি নতুন কী যন্ত্রপাতি তাতে দিল এবং কেন দিল। সপ্তাহান্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন মোটরসাইকেলের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে।
১৯৫০-এ সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেস-এ তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাইক ‘সানবিম’। একটাই উদেশ্য, ওই বাইকে করে গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ানো। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।
সালিম আলি সারা জীবন নিজেকে দেখেছেন একজন শখের বা অ্যামেচার পক্ষীবিদ হিসাবে। অথচ তিনিই তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন পেশাদারিত্বের সুউচ্চ মান। বিজ্ঞানী মাধব গ্যাডগিল-এর মতে তাঁর পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা।
হয়ত আবেগের বশে কোথাও-কোথাও তিনি কিঞ্চিৎ সরে গিয়েছেন যুক্তির নিগড় থেকে। তবে তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় ছিল পাখিদের সংরক্ষণ। কেবল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি নয়, নিখাদ অর্থনৈতিক মূল্যে পাখি যে কত দামী তা বুঝতেন তিনি, বুঝিয়ে গিয়েছেন আমাদের।
ঝুলি ভর্তি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও ঝুলি ভরে গেছিল সম্মানে। ১৯৫৩ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল কর্তৃক প্রদত্ত জয় গোবিন্দ গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে দিল্লি ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৭৮ সালে অন্ধ্র ইউনিভার্সিটিও তাঁকে একই সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৬৭ সালে তিনিই হন প্রথম অব্রিটিশ মানুষ, যিনি ব্রিটিশ অর্নিথলজিস্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। সেই বছরই তিনি জ্য পল ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশনের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ডলারের পুরস্কার পান, যা তিনি নিজের নামের একটি বার্ড কনজারভেশন ফান্ডকে দান করে দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জন সি ফিলিম মেমোরিয়াল মডেল পান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনজারভেশন অফ নেচার অ্যান্ড নেচার রিসোর্সের পক্ষ থেকে। ইউএসএসআর অ্যাক্যাডেমি অফ মেডিক্যাল সায়েন্স তাঁকে প্যাভলস্কি সেন্টিনারি মেমোরিয়াল মেডেলে ভূষিত করে। সেই বছরই তিনি কমান্ডার অফ নেদারল্যান্ডস সম্মানে ভূষিত হন, সেই দেশের যুবরাজ বার্নার্ডের দ্বারা। ভারত সরকার তাকে হাজার ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি রাজ্যসভার সাম্মানিক সদস্য রূপেও মনোনীত হন।
সালিম মূলত উইভার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। লেখালেখির কাজ করার জন্য তিনি বেছে নেন তাঁর শ্বশুরবাড়িকেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল মুম্বইয়ের একটি ছোট্ট গ্রাম কিহিমে। গাছপালায় ঢাকা শান্ত পরিবেশের সেই গ্রামে একমনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন সালিম। ১৯৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন উইভার গোত্রের পাখিদের বৈশিষ্ট্য এবং কার্য পদ্ধতি নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম আর্টিকেল। এই আর্টিকেল তাঁকে পক্ষীবিশারদ মহলে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে দেয়। এই সময়ের পর থেকেই সালিম ঘরে বসে গবেষণার বদলে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে পাখিদের সম্পর্কে সার্ভে এবং বিশদ গবেষণা চালাতে শুরু করেন। দশ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস।’ এরপরে তিনি অপর এক বিখ্যাত পক্ষীবিদ এস ডিলন রিপ্লের সঙ্গে যৌথভাবে ১০ খণ্ডের ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ প্রকাশ করেন। যেটা করতে তিনি প্রায় ১০ বছর সময় নিয়েছিলেন। এখানে তিনি আরও গভীরভাবে উপমহাদেশীয় পাখিদের গঠন, চালচলন, বাসস্থান, প্রজনন, পরিগমন ইত্যাদি নানান ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘কমন বার্ডস’ এবং ১৯৮৫ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ স্প্যারো।’
সালিম আলি পক্ষী পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর এবং জাহাঙ্গিরের মতোই - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ বজায় রাখা। যেকোনও শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চে। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষী চর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলি নির্ভরযোগ্য ছিল না। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু করেন বাবর। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সালিম বলছেন, “চালু ধারণাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন সম্রাট বাবর একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে পথে এদের দল যদি কোনও আঙুর ক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে সেখানেই।” বাবর লিখেছেন, ”এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু। ‘ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনার যে সেগুলোকে কোনও স্থান দেননি, এটাই তার দৃষ্টান্ত। তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে তিনি হলেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যদি সম্রাট না হয়ে কোনও ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন, তাহলে হয়তো অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তাঁর পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুরকে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা।
বিখ্যাত পক্ষীবিশারদ ছাড়াও তিনি ছিলেন এক বাইক পাগল মানুষ। তাঁর জীবনের প্রথম গাড়ি ছিল ৩.৫ এইচ পি এনএসইউ। পরবর্তীকালে একটি সানবিম এবং তিনটি আলাদা আলাদা মডেলের হার্লে ডেভিডসন, একটি ডগলাস, একটি স্কট একটি নিউহাডসন এবং একটি জেনিথ তাই বাইকের সংগ্রহশালাকে শোভান্বিত করেছিল।
১৯৯০ সালের ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে কোয়েম্বাটুরে সালিম আলি সেন্টার ফর অর্নিথলজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটিতে স্থাপন করা হয় সালিম আলি স্কুল অফ ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স। গোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করেন সালিম আলিবার্ড স্যাংচুয়ারি এবং এবং কেরালাতে ভেম্বানাদের কাছাকাছি এক জায়গায় তাঁর সম্মানে সূচনা ঘটে থাট্টাকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি। ১৯৭২ সালে কিট্টি থংলঙ্গা একটি বিরল প্রজাতির বাদুড়ের স্পিসিজ আবিষ্কার করেন যার নাম রাখা হয় Latidens salimalii. এছাড়াও রক বুস কোয়েলের একটি সাব স্পিসিসকেও তাঁর নামেই Perdicula argoondah salimalii পরিচিতি দেওয়া হয়। এছাড়াও ফিন-এর উইভারের একটি প্রাচ্যীয় সাব স্পিসিসকেও নাম রাখা হয় তাঁরই নামে Ploceus megarhynchus salimalii. ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেম ব্যাক উডপেকারের একটি সাব স্পিসিসকে নাম রাখা হয় তাঁর স্ত্রীর নামে (তেহমিনা) Dinlopium benghalenese tehmainae.
১৯৮৭ সালের ২০ জুন প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর ৯০ বছর বয়সে তিনি জীবনযুদ্ধে হার মানেন এবং আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দেন। এরকম মানুষের শুরু তো আছে, কিন্তু তার যেন শেষ নেই। তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, তা যেন কম পড়ে যায়।
ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে তাঁর খুব প্রিয় ছিল মোটরসাইকেল। এই নভেম্বরে তাঁর ১২৬-তম জন্মদিবস। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- (১) ডঃ মানস প্রতিম দাস, অনুষ্ঠান কার্যনির্বাহক, আকাশবাণী কলকাতা, আকাশবাণী ভবন, (২) বিজ্ঞান ডট ওআরজি ডট ইন, (৩) ঊর্মি নাথ, (৪) আনন্দবাজার পত্রিকা, (৫) বিজ্ঞান পত্রিকা - কিছু ইতিহাস-কিছু বিজ্ঞান, ১৩ নভেম্বর ২০১৫, (৬) পক্ষীবিশারদ সালিম আলি - রেজা খান। (৭) ফেমাস সাইন্টিস্টস - সালিম আলি ১৮৯৬-১৯৮৭, (৮) ফল অফ স্প্যারো - সালিম আলি, (৯) দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস - সালিম আলি, (১০) দ্য হিন্দু - হাইড অ্যান্ড সিক উইথ সালিম আলি, ১১ নভেম্বর ২০১৭, (১২) ইন্ডিয়া টুডে - রিমেম্বারিং সালিম আলি : দ্য বার্ড ম্যান অফ ইন্ডিয়া, (১১) মাই সেপিক ডট কম ও (১৩) উইকিপিডিয়া।
★ পাখী সংক্রান্ত কয়েকটি সুন্দর ওয়েবসাইট :- Bird Count India, eBird, eBird India, Cornell Lab of Ornithology, Audubon Society.