গল্পের ফাঁকফোঁকর : যুধিষ্ঠিরের ধর্মাচরণ
Guitar K Kanungo
Dec. 18, 2024 | | views :149 | like:10 | share: 2 | comments :0
যুধিষ্ঠির মহাভারতের নায়ক, যেখানে দুর্যোধন প্রতিনায়ক – সাধারণভাবে এভাবেই দেখা হয়, যদিও আমি মনে করি ঘটোৎকচপুত্র বর্বরিকের কথাটাই যথার্থ। মহাভারতের আসল নায়ক বাসুদেব কৃষ্ণ; যুধিষ্ঠির তো নন, এমনকি অর্জুনও নন, যদি বীরত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। হোমারের ইলিয়াড-এ আকিলিসই নায়ক —সন্দেহাতীতভাবে। ইলিয়াড শুরুই হয়েছে আকিলিসের ক্রোধের বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু মহাভারতে বাসুদেব কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটবে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার পূর্বাহ্নে। এরপর সমগ্র মহাভারতে যা ঘটেছে, সবকিছুতেই তিনি আছেন, পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে।
ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও এবং যকের প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে সেই পরিচিতি সবার কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেও গোটা মহাভারত জুড়ে যুধিষ্ঠির এমন কিছু কাজ করেছেন, যা গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করে। দ্রোণাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলা—অর্ধসত্য মিথ্যা, যা আসলে মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর—এদের মধ্যে একটি। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরা আরেকটি, এবং যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দ্রৌপদী যে আইনগত 'আর্গুমেন্ট' তুলেছিলেন, আজকের দিনে এটি হলে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের 'রেফারেন্স' হয়ে যেত। রাজ্য হারানোর পাশাপাশি যুধিষ্ঠিরের জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারত। কোনো অর্থেই এটি যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সদাচার ছিল না।
যুধিষ্ঠিরের এই আচরণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে—পক্ষে-বিপক্ষে; যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপক্ষে। এই একই জুয়ার আসরে তিনি আরও একটি অধর্মের কাজ করেছেন, যা অনেকের চোখে ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। এই কাজটা তিনি করেছিলেন নকুল ও সহদেবকে নিয়ে। নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র কিনা—সেই আলোচনা এখানে করতে চাই না—কিন্তু তারা মাদ্রীর গর্ভজাত, কুন্তীর গর্ভজাত নয় একথা সত্য । সেই হিসাবে, এই দুই ভাই যুধিষ্ঠিরের সহোদর নয়। এই জন্যেই কি যুধিষ্ঠির ভাইদের বাজি ধরার সময় প্রথমেই নকুল ও সহদেবকে বাজি ধরেছিলেন? সৎ ভাই ছিলেন বলেই কি ? তিনি যদি অর্জুন কিংবা ভীমের মধ্যে একজনকে সবার আগে বাজি ধরতেন, তাহলে সেটিই ধর্মের কাজ হত।
দ্রৌপদীকে অর্জুন জয় করেছিলেন, এবং দ্রৌপদী নিজেও মনে-প্রাণে অর্জুনকেই কামনা করছিলেন। পারিবারিকভাবেই তাঁর মধ্যে এই অনুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। নইলে তিনি বিনা দ্বিধায় কর্ণকেই বরং বরন করতে পারতেন। রূপে, গুণে, বীরত্বে কর্ণ কোনো অংশে অর্জুনের তুলনায় খাটো ছিলেন না—স্বর্গীয় কবচ ও কুন্ডল নিয়েই যাঁর জন্ম। স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে কর্ণই একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন। রূপবান তো ছিলেনই, কেবল শিক্ষাকেই যদি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে অর্জুন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, যেখানে কর্ণ হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে এসেছেন। মহাভারত-এর রথী-মহারথীদের মধ্যে কেবল দুজনের এই শিক্ষাগত পটভূমি ছিল: দেবব্রত ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণ; এঁরা দুজনই কর্ণের মতো ভার্গব পরশুরামের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় পরশুরামের আশ্রমটাই ছিল সেই সময়কার হার্ভাড কিংবা স্ট্যানফোর্ড যেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ অস্ত্রবিদ স্বয়ং পরশুরাম ছিলেন সে আশ্রমের আচার্য।
দ্রৌপদী এমন একজন কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অর্জুনকে পাওয়ার জন্য, কিন্তু সেই অর্জুনকেও তাঁর পাওয়া হয়নি যুধিষ্ঠিরের লালসার কারণে। যুধিষ্ঠির নিজের অর্জিত নয় জেনেও দ্রৌপদীকে ভোগ করেছিলেন; নিজের অধিকার নেই জেনেও, পাশা খেলায় হেরে যাবেন জেনেও, দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, অদ্ভুদ এক নিয়ম চালু করেছিলেন যুধিষ্ঠির এবং সেই নিয়মের ফাঁদে ফেলে অর্জুন যাতে অচিরে দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হতে না পারে সেই ব্যবস্থাকেও পাকাপোক্ত করেছিলেন অর্জুনকে এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে। অর্জুনের অপরাধ তিনি কামাতুর হয়ে পড়েছেন এবং তাঁর চারিত্রিক শুদ্ধতা ফিরে পাবার জন্য অন্ততপক্ষে এক বছরের জন্য নির্বাসনে যাবার প্রয়োজন। কিন্তু অর্জুন যে কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন সেটা ছিল অস্ত্রাগার ; সেখানে যুধিষ্ঠির দিনে দুপুরে দ্রৌপদীকে নিয়ে যা করছিলেন সেটাকেও যে কামাতুরতা বলে চলে সে প্রশ্ন কেউ তুলল না।
ভাগ্যিস! অর্জুন একিলিস ছিলেন না। একিলিস তাঁর প্রেয়সী ব্রিসেইসের জন্যে গ্রীকবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আগামেমননের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন; তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং ট্রোজানদের সঙ্গে গ্রীকদের যে যুদ্ধ চলছিল, সেই যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলত, আগামেমনন ব্রিসেইসকে একিলিসের কাছে ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্জুন এসবের কিছুই করেননি। তিনি অগ্রজের আদেশ মেনে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। অগ্রজের আদেশ মান্য করা ধর্ম; অর্জুন সেটা করেছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কি ধর্মাচরণ করেছেন?