[নাটকটি বর্তমানের বঙ্গসমাজের বাস্তবচিত্র ভিত্তিক একটি কল্পচিত্র। বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব চরিত্রের প্রতিফলন যে এ নাটকে থাকবে এটা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ নাটকে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা নির্দিষ্ট চরিত্রের ইঙ্গিত করে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্মানে আঘাত দেওয়া লেখকের উদ্দেশ্য নয়।]
চরিত্র:
মৃত্যুঞ্জয় - পুলিশ অফিসার
সুরজ - চাওয়ালা
সর্বপ্রিয়া - অফিসারের স্ত্রী
কালীপদ - মন্দিরের পূজারী
শান্তিলতা - অফিসারের শাশুড়ী
নান্টু - বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা
হারাধন - অফিসারের শশুর
দুর্যোধন - অঞ্চলপ্রধান
আশারাম - গুরুবাবা
পরানবাবু - উকিল
ডঃ বোস - নার্সিংহোমের মালিক
রিকশাওয়ালা
শঙ্করবাবু - বৃদ্ধ প্রাক্তন শিক্ষক
টিভি সংবাদ পাঠিকা
(পর্দা ওঠার আগে)
মাইক: ....................নাট্যসংস্থার পরিচালনায় অশোকদাস চার্বাক বিরচিত ও............ দ্বারা পরিমার্জিত যে অনুনাটকটির অভিনয় আপনারা সকৌতুকে উপভোগ করতে চলেছেন, তার হালকা রঙ্গব্যাঙ্গের আড়ালে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে মানব প্রজাতির অবলুপ্তির দিকে অগ্রগতির এক ভয়াবহ ভবিষ্যতচিত্ৰ। হোমিনিড বংশোদ্ভূত হোমো স্যাপিয়েন অর্থাৎ ওয়াইজম্যান প্রজাতির পশুরা তাদের প্রকৃতিলব্ধ পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশঃ বিবর্তিত হতে হতে কিছুটা মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পূর্ণসভ্য মানুষ হবার পথে বেশ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু পশুসুলভ সংগ্রহকারী প্রবৃত্তি, অতিলোভ ও মাত্রাহীন ভোগবিলাসের লাগামছাড়া হাতছানি সদ্যবিবর্তিত অপরিণত মানুষকে পুনরায় পশুস্তরে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষ, অর্থাৎ যে প্রাণীদের আমাদের চলতি ভাষায় ‘মানুষ’ বলে থাকি - তারা ক্রমশ আগের মত মননহীন জন্তুত্ব অর্জন করতে চলেছে। মানুষ ও অন্যান্য পশুর চারিত্রিক পার্থক্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য পশুদের মত প্রতিযোগী পশুর সংগৃহীত করা খাদ্য বা প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ যেনতেনভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে। অপরের পুরুষ বা নারীসাথীকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে বা গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। তারা উন্মত্ত অসভ্য আদিম অর্ধমানবদের মত হাটে বাজারে, রিসর্ট মধুচক্রে নাচছে উদ্দাম উলঙ্গ হয়ে। আর আমরা টিভি সিনেমা থিয়েটার পথেঘাটে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সে সব পশুনৃত্য লজ্জাহীনভাবে উপভোগ করছি আমাদের সন্তানদের সাথে। সেসব মজার দৃশ্য, সেসব রঙ্গব্যাঙ্গের দৃশ্য, সেসব কান্নার দৃশ্য, বিপথগামীদের অসহায় কালমৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার আপনার প্রিয়জন ও সন্তানসন্ততির দুর্ভাগ্যের ভবিষ্যৎ দৃশ্য অনুমান করুন। তারপর নাট্যমঞ্চের শেষ পর্দা নেবে গেলে প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এ সমাজের জতুগৃহ থেকে মুক্ত হবার পথ খুঁজতে থাকুন। অথবা, মানে ‘অথবা’ এ নাটকে দেখা পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, পুরুত, গুরুবাবা, জ্যোতিষ বাবা, নেতাগুন্ডাদের ওপর আপনার একান্ত প্রিয় সন্তানসন্ততিদের রক্ষা করবার ভার অর্পণ করে আরও আরও সম্পদ বাড়াতে থাকুন, আর নিজ নিজ ভোগবিলাস চেটেপুটে উপভোগ করুন হলের বাইরে গিয়ে। আজকের নাটকে এতক্ষণ যা দেখবেন তা ভুলে যান।
প্রথম দৃশ্য
(নামাবলী গায়ে এক পাঠক রামায়ণ পড়ার সুরে পাঁচালী পাঠ করছে দুলে দুলে)
এ নাটকে দেখা যাবে প্রতি ঘরে ঘরে,
স্ত্রী পুত্র পরিবার একে একে মরে।
অসুরের স্বর্নপুরী পোড়ে সারে সার,
রাবনের দর্প ভেঙে হলো একাকার।
অসুর পুড়িছে তার কালো টাকা সনে,
লোভী মানি যোগী ধনী মরে জনে জনে।
ভোগের লালসা ধায় বিলাসীর গৃহদ্বার,
সে আগুন গ্রাস করে সুখী যত সংসার।
নেতা মন্ত্রী অফিসার সে আগুনে ঝাঁপ দেয়,
বৃদ্ধ যুবা শিশু পোড়ে পতঙ্গের মত হায়।
রচয়ে চার্বাক ঋষি কলির এ রামায়ণ,
স্বর্ণলঙ্কা দহনের নব এক রূপায়ণ।
ভাবিতে থাকহ এবে শ্রোতা সুধীজন,
বাঁচাইবে কি উপায়ে পুত্র প্রিয়জন।
অথবা চক্ষু মুদি মজা কর ঘরে,
না চিন্তি আগামী দিন পশু যাহা করে।
পুড়ুক এভাবে তব আপনার জন,
আগামী প্রজন্ম তরে করোনা মনন।
চক্ষু মুদি কর্ণ ঢাকি তিন হনু সম,
মুখ বুজি মন্ত্র জপ অসুরায় নমঃ।
শুষে নাও এ ধরায় আছে যত মধু,
লালসা মেটাতে তুমি ছুটে চল শুধু।
চার্বাক কথা শোন গরল সমান,
পোড়াইচ্ছে সারা ধরা যত হনুমান।
হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল,
হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, হরি-ই-বোল।
দ্বিতীয় দৃশ্য
[গ্ৰাম্য রাস্তার চৌমাথায় এক পথশনির ঠেকের পাশে চায়ের গুমটি। দূর থেকে ভেসে আসছে মোটরবাইকের আওয়াজ। চাওয়ালা চা চাপিয়ে দিল স্টোভে। বাইক থামিয়ে পুলিশ অফিসার মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ]
সুরজ - সেলাম সাহাব।
মৃত্যুঞ্জয় - চা চাপা শিগগির। আটটা বেজে গেল, এখনও উনুনের কয়লা কালো কেনরে শালা।
সুরজ - মনটা বহুত উদাস হো গিয়া সাহাব। ঘরকা বহু প্রোমোটার কলিমুদ্দিনকা সাথ তিন দিন বেপাত্তা। বহুত সরম কি বাত। শুনা কি বকখালিমে ফুর্তিকে লিয়ে গিয়া হোগা।
মৃ - এতে শরমের কি আছেরে পাগলা? এতো তোদের জাতের ছোটলোকদের বাড়ীর আখচার কারবার। ঘর ঘর কা কাহানি। মন খারাপ করিস না, আর একটাকে ধরে নিয়ে আয়। নে, চা চাপা।
সু - চাপিয়েছি সরকার, দূর থেকে আপনার ইনফিল্ডের ডিগ ডিগ শুনে স্টোভেই চাপিয়ে দিয়েছে আপনার ইস্পেশাল চা।
মৃ - বহুত আচ্ছা, কদিনেই বেশ ভালো বাংলা শিখছিস তো! বুদ্ধিটাও বেশ পেকেছে দেখছি বাংলার জল খেয়ে।
সু - সব অপকাহি মেহেরবানী সাহাব।
মৃ - ডাবল হাফ চা দিবি, আর ডাবল ডিম টোস্ট।
সু - সব রেডি হো গিয়া সাহাব, আপকা মর্জি হামারা ধ্যানমে হ্যায়।
মৃ - এইতো চাই। এই ভক্তি-বুদ্ধির জন্য তোরাই ব্যবসা জমাচ্ছিস সারা বাংলা জুড়ে। আর বোকচন্দর আঁতেল বাঙালীর বাচ্চারা শুধু দুর্নীতিবিরোধী মিটিং মিছিল প্রতিবাদ হরতাল করে করেই মরছে। বলে সমাজতন্ত্র আনবে, ন্যায়বিচার আনবে। শালা ওসব তন্ত্রমন্ত্র কি ধুয়ে খাবি? নিজের নিজের সংসার ছেলেমেয়েদের কথা ভাব। ওরা যে দিন দিন রসাতলে যাচ্চে সেটা আগে বোঝ। ইন্টেলেক্চুয়াল হয়েছে সব - বুদ্ধিজীবী!
সু - (চায়ের কাপ আর টোস্টের প্লেট টেবিলে রেখে)আউর কুছ সেবা সাহাব?
মৃ - এক প্যাকেট উইলস ছাড়। ক্লাসিক ফ্ল্যাসিকতো এ গাঁয়ে মিলবেনা।
সু - নেহি সাহাব, স্রিফ আপকা লিয়ে চুপকে চুপকে লে আয়া শাহরসে।
(এদিক ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটের সাথে পঞ্চাশ টাকার নোট রাখলো টেবিলে)
মৃ - এ কিরে শালা, পঞ্চাশেই সারবি নাকি? গত মাসেও তো চা বিস্কুটেই কর্তব্য সেরেছিলি। সেদিন দোকানে লাল পার্টির আগুনখেকো বদ ছোকরাগুলো ছিল বলে কিছু বলিনি। এমন করলে গভর্নমেন্ট চলবে, না দেশের মা মাটি মানুষ বাঁচবে! অন্ততঃ পুরো এক ছাড়।
সু - বেচাকেনা একদম নেহি স্যার।
মৃ - বললে হবে, ছোটঠা কাঁহাকা। একটা বেঞ্চতো বাড়িয়েছিস দেখি। তিন তিনটে বেঞ্চ ভরিয়ে কাদের বসাস। এটা পুলিশের চোখ, বুঝলি। বেশতো জাঁকিয়ে বসেছিস এ রাজ্যে এসে। সরকারি রাস্তা, সরকারী টিউকলের জল - সব তো ফুকোটসে। সরকারী রাস্তার জায়গাটাও তো জবরদখল। আর সেই সরকারের জন্য পঞ্চাশ! যারা তোদের অন্ন যোগাচ্ছে তাদের কথা একটু ভেবে দেখ। তোদের লালু ছাড়তো পঞ্চাশে? সামনের মাস থেকে দুই করে ছাড়বি।
সু - মোর জায়গা সাহাব।
মৃ - তা না হলে ইনকাম ট্যাক্স, সেলটাক্স, উনুনে কয়লা পোড়ানোর জন্য পরিবেশ দূষণ ট্যাক্স, - সব কেস একসাথে। - ধর ধর রিক্সাটাকে। সালা বড্ডো ফাঁকিবাজ। আমার বাইক দেখলেই স্পিড বাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছুট মারে চোট্টাটা। জোচ্চোর একেবারে, অসৎ।
[রুখ রুখ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তার ওধারে গিয়ে রিক্সাটার হ্যান্ডেল চিপে ধরলো সুরজ]
সু - বহুত মেহবান হো গিয়া শালা। সরকারকা বাইক দেখতা নেহি? সাহাবকো সেলাম দেগা কৌন? চল শালা বুড্ঢা।
[কাঁধের গামছাটা কোমরে জড়িয়ে খোঁড়া রিক্সাওয়ালাটাকে টানতে টানতে পুলিশের সামনে নিয়ে এলো সুরজ। দাদুর বয়সী বুড়ো রিকশাওয়ালা পুলিশের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালো।]
রিকশাওয়ালা - বলুন বাবু।
মৃ - বাবু! শালা, আমিকি তোর ইয়ারদোস্ত নাকি? স্যার বল, স্যার। বুড়ো হয়ে মরতে বসেছিস, ম্যানার্স জানিসনা?
রিকশা - ভুল হয়ে গেছে বা- মানে স্যার (একটু জোরে) স্যার, স্যার।
মৃ - বল শালা, রিকশায় প্যাঁপো বেল কিছু নেই কেন?
রিকসা - প্যাঁপো একটা ছিল বা-স্যার, কদিন হলো চুরি হয়ে গেছে।
মৃ - দিনের বেলাতেও ঘুমোস নাকি? লক্ষ্য রাখতে পারিসনা?
রিকষা - আপনারা কিছু একটা ব্যবস্থা করুন সা-স্যার। বড্ড চুরি বেড়ে গেছে এদিকটায়। গত রাতে পঞ্চায়েত মিয়াঁর বিবিটাও বেপাত্তা হয়েছে। নাড়াপুর কালীমন্দিরের পুরুত ঠাকুরের তিন তিনটে শুয়োর, আর চারটে মুরগি চুরি হয়ে গেছে। জাগ্রতা মায়ের পেতলের জিভটাও কেটে নিয়ে গেছে চোরে।
মৃ - তা, আমরা কি করবো? আমরা কি সাইকেলচোর, বৌচোর, মুরগিচোর, চাকরীচোর ধরতে বসে আছি নাকি? তাহলে সরকারী কাজটা করবে কে? যে নিজের মাল নিজে নিজে সামলাগে যা। জাগ্রতা মাকালীকেও বলে দিস নিজের জিভ নিজে সামলাতে।
রিকশা - যা বলবেন স্যার। চলি এখন?
মৃ - চলি কি রে? তিন মাসতো কিছুই দিসনি। এতো ধারবাকিতে চলে? একশো ছাড়। রিকশা - মরে যাবো স্যার, ট্যাঁকে মোটে পনেরো টাকা আছে। বৌ বাচ্চার জন্য চাল কিনতে হবে।
মৃ - বাকি টাকা গেল কোথায়?
রিকশা - ভোর থেকে মাত্র দুটো খদ্দের পেয়েছি। তাও একজন আমার চেয়েও খোঁড়া - থুড়থুড়ে বুড়ি - বিধবা। যখন ওনার বাড়িটা ছিল, তখন উনি দু’দুটো বড় বড় অফিসারের মা ছিলেন। ছেলেদের নামে বাড়িটা লিখে দেবার পর ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় থাকেন, ভিক্ষা করে খান। বড্ডো জ্বর তাঁর। ওনার কাছে পয়সা নিতে পারলাম না স্যার। মানুষের মন, আমার আপনার বাড়িতেও তো বুড়ো বাপ মা আছেন। বুড়িকে হেলথ সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে এলাম এমনি এমনি।
মৃ - কিন্তু সরকারতো ছাড়তে পারে না এমনি এমনি। তাকে নিয়ম আইন মেনে চলতে হয়। তা না হলে দেশে অরাজক হয়। প্যাঁপো না থাকায় সাংঘাতিক একটা কেস খেয়েছিস তুই। তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে সরকারকে কি কৈফিয়ৎ দেব? সরকারতো এজন্যই আমাদের মাসে মাসে মাইনে দিয়ে রেখেছে। এয়াই সুরজ দেখতো সার্চ করে, ওর ট্যাঁকে কত আছে।
[সুরজ রিক্সাওয়ালার ট্যাঁক সার্চ করলো]
সুরজ - পঁয়ত্রিশ রুপিয়া স্যার। সালা ছোটঠা আদমি। সরকারকো ভি ফাঁকি দেতাহা! ইতনা বাদমে তো নবান্ন রাজভবন ভি লুট লেগা শালা।
মৃ - দশ টাকা ওকে দিয়ে বাকিটা নিয়ে আয়। ৭৫ টাকা মাফ করে দিলাম এক কথায়। ১০০ টাকার কেস ২৫ টাকায় নিস্পত্তি। তবু অনেকে পুলিশকে ঘুষখোর বলে। [তাড়াহুড়ো করে রিক্সাওয়ালার ছুটতে ছুটতে প্রস্থান] সুরোজ, এই টাকা থেকে তুই দু’টাকা বকশিস রাখ। তোর ইন্টারভিউ হয়ে গেলো। দারুন কাজ করলি। এবার একটা ভালো সরকারী চাকরী কিনে নে। বড় নেতাকে বলে অল্প দামে সিভিক ভলেন্টিয়ারের চাকুরী করে দেব তোর। এভাবেই আমাকে সাহায্য করবি। সবার সামনে সরকারি কাজ করতে পারি না। চারিদিকে মিডিয়ারা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে। আমার হয়ে ট্রাক লরি থেকে জরিমানা আদায় করবি তুই। সরকারী মাইনে ছাড়া আমার কাছ থেকে কমিশনও পাবি।
[বৃদ্ধ শঙ্করবাবুর প্রবেশ। হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে সবজি দেখা যাচ্ছে। মাথায় তালি দেওয়া ভাঙা ছাতা। চায়ের কাপটা তাড়াতাড়ি শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ছুটে এগিয়ে গেলো ওনার দিকে।]
মৃ - ভালো আছেন স্যার?(প্রণাম)
শঙ্করবাবু – তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলামনা বাবা। চোখেও ভালো দেখিনা ...
মৃ - আমি মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। আপনার ছাত্র ছিলাম। বারে বারে ফেল করতাম বলে ফেলুরাম বোকারাম বলে ডাকতেন আদর করে। আমাকে পাস করানোর জন্য আলাদা করে বিনা পয়সায় পড়াতেন আপনার বাড়িতে।
শঙ্কর - মৃত্যুঞ্জয়, হাঁ হাঁ মনে পড়েছে বটে। আশুর ছেলেতো। বড্ড ভালো মানুষ ছিল তোমার বাবা। খড় দিয়ে ঘর ছাইতো নিখুঁত। নিজে লেখাপড়া করতে পারেনি বলে তোমাকে পড়িয়ে পড়াশুনার স্বাদ মেটাতো। জনমজুর খেটে আধপেটা খেয়ে তোমাকে পড়াতো। স্বার্থক হয়েছে তার পরিশ্রম। পুলিশ অফিসার হয়েছো বুঝি।
মৃ - হাঁ স্যার, ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার। চা খান মাস্টারমশাই।
শ - তা, আশুর মত সোজা সরল সৎ মানুষের ছেলে হয়ে পুলিশ লাইনে এলে কেন? অবশ্য পুলিশের মধ্যে অনেক সৎ মানুষও আছেন। তবে নেতা মন্ত্রী পুলিশের নামে লোকে আজেবাজে কথা বলে, মানসম্মান রাখে না শুনি।
মৃ - মানসম্মান নিয়ে কি ধুয়ে খাব নাকি? ওসব সেকেলে সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দিলে আর করে খেতে হবে না।
শ - তাবলে এ লাইনে? অন্য চাকরী ধর।
মৃ - সব লাইন একই মাস্টারমশাই, সব শালা- সরি, মানে সব ভদ্রলোকই চোর। আপনাদের শিক্ষকরাইতো কোচিং সেন্টার ফেন্টার খুলে কোশ্চেন বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছে। নেতা মন্ত্রীদের ঘুষ দিয়ে নিরক্ষররা সরকারী অফিসার, বোর্ডের চেয়ারম্যান, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়ে যাচ্ছে। এখনকার দিনকাল পাল্টিয়ে গেছে মাস্টারমশাই। এখন মা-মাটি-মানুষের সরকার। সব সময় পাশে থাকে। ডাকলেই দুয়ারে হাজির।
শ - ক্লাস সিক্সে তিন বার আটকিয়ে থেকে স্কুল ছেড়ে বাবার সাথে চাষবাস দিনমজুরি করা শুরু করেছিলে শুনেছিলাম। অফিসারের চাকরি পেলে কি করে? পরে প্রাইভেটে পাস্ করেছিলে বুঝি?
মৃ - সে এক মজার ইতিহাস মাস্টারমশাই। ভোট করাতে গিয়ে রাজনীতি লাইনে একটু নামডাক-চেনাশোনা হয়েছিল। কাউকে ঘেঁষতে দিতাম না বুথে। নয়খুনি নান্টু, মেছো অনুকেষ্টরা এখন বড় বড় নেতা হয়েছেন। টুঁকুলি মন্টুকে মনে আছে স্যার? স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সে ছাত্রনেতা হয়ে গেছিল। সে এখন এম এ পাস করে ডক্টরেট পেয়ে গেল বিহার বিশ্ববিদ্যলয় থেকে। ওখানে বেশ সস্তায় ডিগ্রি পাওয়া যায়। পরীক্ষা টোরিক্ষা কিচ্ছু দিতে হয়না। সে, মানে তিনি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়ে শিক্ষকদেরই সহবত শেখাচ্ছেন। বড় শহরে পোস্টিং পাবার জন্যে কত আচ্ছা আচ্চা শিক্ষক অধ্যাপক, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত ব্যাগে প্যাকেট খাম লুকিয়ে ওঁর চেম্বারে ধর্ণা দিচ্ছে।
শ - বল কি বাবা, এত উন্নতি করেছে মন্টু!
মৃ - ওনারাই বললেন, বাপের অবস্থাতো দেখলি। চাষবাস বা খড়ের ঘর ছেয়ে আর কয় পয়সা কামাবি, এখনকার বৌ বাচ্চাদের খাঁই মেটাতে পারবিনা। দিনকাল পাল্টেছে। চাহিদামত ফুর্তির রসদ না পেলে ছেলেমেয়েরা ঘেন্না করবে, বৌ হেটেল রিসোর্টে ছুটবে রাতের মজা লুটতে। তুইতো বেশ হাতফাৎ চালাতে, খিস্তি খেউর করতে পারিস মাননীয় নেতামন্ত্রীদের মত। সেকারনে গাঁয়ের লোকেরা ভয়ে ভয়ে তোকে সমীহও করে। সামনের ভোটের আগে কদিন স্বেচ্ছায় মানুষের সেবা কর। ভোটের পরে নেতাদের বলে কয়ে সামান্য খরচে পুলিশে ঢুকিয়ে দেব তোকে। তুই আমাদের দেখবি, আমরাও তোরটা। দু বছরে গাড়ি বাড়ি সম্মান - সব হয়ে যাবে। তাই স্যার, বাবার ভিটেটা বেচে লাখ তিনেকে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। মাধ্যমিক সার্টিফিকেটটাও ফ্রি পেয়ে গেলাম এক্সট্রা।
শ - এসবতো অশ্লীল অসভ্য লেখকদের গল্প নাটকের মত মনে হচ্ছে। তুমি কি সত্যি বলছ?
মৃ - একদম সত্যি। এসব হচ্ছে উন্নততর প্রশাসনের আধুনিক টেকনোলজি। নিন আর এক কাপ চা খান। বলেনতো তিন চার লাখে আপনার বেকার ছেলেরও এমনি একটা হিল্লে করে দিতে পারি। বড় বড় জায়গায় আমার কন্টাক্ট আছে। আপনারও ভালো, আবার দু পয়সা আমার পকেটেও ঢোকে।
শ - ছি ছি বাবা। ওসব খারাপ কথা থাক। সৎভাবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন কর। পাপকে কখনও মনে ঠাঁই দেবেনা। পাপের পয়সা কখনও ঘরে ঢোকাবেনা। রাতে ঘুম হবেনা। ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে, সংসার জীবন সুখের হবেনা। তোমার বাবামায়েরা ভাল আছেনতো?
মৃ - অনেকদিন হল ওদের খবর পাইনি।
শ - সে কি! কোথায় থাকেন ওঁরা? বহু কষ্টে মাটির বাড়িটা বানাতে দেখেছিলাম।
মৃ - প্রথমের দিকে আমার সাথে ঐ বাড়িতেই থাকত। আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিধবা দিদির বাড়ী চলে গেলেন আপনার বৌমার সাথে ঝগড়া করে। নিঃসন্তান দিদি মারা গেলে পার্টি সিন্ডিকেটের এক প্রোমোটার দিদির বাড়িটার দখল নিলো আমায় দুই আর পার্টিকে দুই দিয়ে। তারপর দিদির বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওরা কোথায় গেছিল জানা নেই। লোক পরম্পরায় শুনি ওরা নাকি গত বছর একই দিনে মারা গেছেন মাদারের আশ্রমে। ওরাও নিশ্চিন্ত, আমরাও।
শ - সে কি কথা! তুমি ওদের একমাত্র উপযুক্ত ছেলে, গায়ের রক্ত জল করে তোমায় মানুষ করেছেন, মরণকালে শেষ জলটুকু পেলেননা তোমার হাতে!
মৃ - কি করব বলুন,বুড়ো বয়সে বড্ড বেগড়বাই করছিল। সারা বছর বুড়োবুড়ির দাঁত ব্যাথা, হাঁপানি, বাতবেদনা, ছানি - মানে নানা অপব্যয় আর অশান্তি। তারওপর আবার নানা বায়নাক্কা - মাঝ রাত বিরেতে কোথায় যায় বৌমা, চুল ছোট করে কাটে কেন, ফেরার সময় মুখে বাজে গন্ধ কেন, মানে আপনার বৌমা ওদের গোয়েন্দাগিরির ঠেলায় একেবারে অতিষ্ট। সংসার ছারখার।
শ - থাক বাবা থাক, আর বলতে হবেনা। ঠাকুর তোমার সুমতি দিন, তোমাদের চৈতন্য হোক। ছেলেমেয়েরা যেন তোমাদের দেখে বুড়ো বয়সে।
মৃ - আমিও আপনার মত বেলুড় মঠের শিষ্য। আমার ঔরসে, আমার রক্তমাংসে তৈরী আমার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন কুসন্তান হবেনা, এ আমি নিশ্চিত।
শ - তুমিও কি তোমার বাপ মায়ের রক্তমাংসে সৃষ্ট হওনি নাকি। তুমি ওঁদের তাড়ালে কি করে? ওঁরাওতো ধার্মিক ছিলেন তোমার মত। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন, দেব দ্বিজে ভক্তি ছিল, অনুকূলবাবুর সৎসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে নিরামিষ খেতেন .......
মৃ - বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরে বহুত তর্ক শিখে গেছেন দেখছি। পুলিশের সাথেও তক্ক! এত সাহস! পন্ডিত হয়ে গেলেন, না বামবাদী? বাঁকা কথায় গালাগাল দিচ্ছেন! ভালো প্রস্তাব দিলাম, মনে ধরলোনা। বাজে কথা ছেড়ে এবার সরকারী কথায় আসুন। বাজারে গিয়েছিলেন বুঝি?
শ - আমাদের আবার বাজার। ওই কুমড়ো, কুদরী, কলমি, কচু - এইসব আর কি। সবই তো দুনম্বরী প্রোমোটার, পার্টিফড়ে হঠাৎ-বাদশারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
মৃ -সবইতো বুঝলাম, কিন্তু প্লাস্টিক ব্যাগে আনাজ আনতে গেলেন কেন? ফালতু একটা কেস খেয়ে গেলেন সক্কালবেলা।
শ - এইটুকুতো সবজি, ব্যাগটা কদিন আগে ছিঁড়ে গেছে বাবা।
মৃ - পাতলা প্লাস্টিকে বাজার আনা বেআইনী সেটাকি জানেননা?
শ - জানি বৈকি বাবা। কিন্তু সবার হাতেই তো দেখি। তোমাদের পুলিশরাও তো দেখি ঐ ব্যাগে বাজার করে।
মৃ - আপনিকি আজকাল পুলিসের ওপরেও পুলিশগিরি করছেন নাকি? জেল হয়ে যাবে যে। নেতা পুলিশের নামে এমন কুৎসা ছড়ানো ব্ল্যাসফেমির মত কগনিজেবল অফেন্স এটা কি জানেননা? ফের আবার প্রশাসনের নামে এমন কুৎসা করলে সোজা হাজতে পুরে এক্কেবারে অম্বিকেশ করে ছেড়ে দেব।
শ-ছিঃ ছিঃ, পুলিশ হয়েছো বলে কি শিক্ষকদের সাথেও ঠাট্টা মস্করা করবে নাকি? চলি এখন।
মৃ - চলি মানে? কোথায় পালাবেন আমার হাত থেকে। রাস্তায় বিড়ি খাবার কেসটা না হয় ছেড়ে দিয়ে গুরু ঋণ শোধ করলাম। আপনিও আমার বাল্যকালে আমায় বিড়ি খেতে দেখে শুধু আলতো করে কান মলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্লাস্টিক কেসটা চোখ বুজে ছেড়ে দিলে সরকার থাকবে, না আমার চাকরী।
শ - তুমিও আমার কান মোলে ছেড়ে দাও বাবা।
মৃ - একি বলছেন মাস্টারমশায়। আপনি আমার গুরু। শাস্ত্রে বলে আচার্য দেব ভব। আপনার কানে হাত দিয়ে আমি কি মহাপাতকী হবো নাকি। পাবলিকই বা কি বলবে, আবার ভগবানই বা কি বলবে।
শ - তাহলে কি করে তোমার হাত থেকে রেহাই পাবো বাবা?
মৃ - ওটা আমার হাত নয় মাস্টারমশাই। ওটা সরকারের হাত, মানে আইনের হাত। আর ও হাতটা জনগণই বানিয়েছে। আপনিও বানিয়েছেন ভোট দিয়ে। শুনুন মাস্টারমশাই, আমি হিসাব করে দেখলাম পুলিশ কেস হয়ে গেলে আপনার পরিশ্রম, হয়রানি, ছুটাছুটি, দুশ্চিন্তা, তার উপর থানা খরচা, পার্টি খরচতো আছেই। উপরন্তু আদালতে কতবার যে ডেট পড়বে তার ঠিক নেই। তার জন্য প্রতিবারে উকিলের ফি, কেরানির ‘আমরা পেয়ে থাকি’, পিওনের বকশিস, সাক্ষীর জলপানি - রাহা খরচ....
শ - সাক্ষী? সাক্ষী কোথায় এ জনহীন মাঠে?
মৃ - সব আছে মাস্টার, সব আছে। সব কি খালি চোখে দেখা যায়, না সবাই সব কিছু দেখতে পায়। সাক্ষীরা সব দেব দেবীদের মত অলক্ষে অন্তরীক্ষে থাকে। সাধুসন্ত মুনিঋষিরা যেমন গাঞ্জা সেবন করে অদৃশ্য ভগবান দেবদেবীদের দেখতে পায়, তেমনি একমাত্র উকিল আর পুলিশরাও সাক্ষীদের দেখতে পায়, সাক্ষীরা তাদের ডাকে সাড়া দেয়। একবার হাঁকিয়ে দেব, আর জনা বিশেক মান্নিগন্নি বাবুলোকেরা আদালতে গীতা ছুঁয়ে বলবে যে আপনি কর্তব্যরত পুলিশকে জুতোপেটাও করেছেন। তখন ঘটিবাটি বেচেও জেলযাত্রা ঠেকাতে পারবেননা। আজীবন আপনার কেসটা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে। আর আপনার মরার পর উত্তরাধিকার সূত্রে আপনার বেকার পুত্রের ঘাড়ে চেপে বসবে তার দায়। নিন, দশ হাজার ছাড়ুন।
শ - এতো টাকা আমি কোথায় পাবো বাবা। তার চেয়ে আমায় বেঁধে তাঁদের নিয়ে যাও।
মৃ - এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মাস্টারমশায়? পুলিশ বলে আমরা কি মানুষ নই নাকি। আমরাকি একেবারে চশমখোর শুওরের বাচ্চা যে পরম পূজনীয় বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে জেল খাটাবো। আমরা নিরপেক্ষ সরকারী কর্মী হলেও আমাদের পাঁজরের নিচে একটা দুর্বল নরম মন রয়েছে। সে মনে লাজ লজ্জা,ন্যায়বোধ মনুষ্যত্ববোধ যে একেবারেই শূন্য তা নয়। আপনার জন্য সামান্য কিছু করতে পারলে শিক্ষাগুরুর ঋণের বোঝাটার কিছুটা লাঘব হয়। আমাদের মহামান্য মন্ত্রী বলেছেন নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভুলে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তাঁদের সে বাণীতে আনুপ্রানিত হয়ে মাত্র ছয় হাজারে কেসটার ফয়সালা করে দেব। দশ থেকে একেবারে ছয়। সক্কালবেলা স্রেফ ফোঁকেটসে আপনার চার হাজার টাকা ইনকাম। এবার হাসুন। না না, এখুনি দিতে হবেনা। বাজার হয়ে গেছে।এবার বাড়ি যান, ভালোমন্দ খান, আনন্দফুর্তি করুন, সন্ধ্যে হলে দিয়ে সরকারি জরিমানার টাকাটা আমার সিভিক সেচ্ছাসেবক গিন্নীর কাছে জমা করে আসবেন। সরকারী জরিমানা কমিয়ে দিয়েছি বলে আবার পাঁচকান করবেন না যেন। আপনাদের ঐ মিডিয়া, আর অর্ধশিক্ষিত জনগণ তা বুঝবে না। ঘুষ খেয়ে চার হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছি বলে কুৎসা রটাবে। অসভ্য নাট্যকারেরা নাটক লিখবে, অশিক্ষিত লেখকেরা গল্প লিখবে, টিভিতে তর্ক বিতর্ক করে গলা ফাটাবে - মনে হয় সবকটাকে ধরে ধরে অথবা - যান এখন নয়টার বাসটা পৌঁছুবার আগে কেটে পড়ুন।
(শঙ্করবাবুর দ্রুত প্রস্থান) শালা শ্বশুরমশাইয়ের মোপেড মনে হচ্ছে। শালার ব্যাটা হাড়কেপ্পন। বছরের পর বছর জামাইষষ্ঠী, পুজোর কাপড় সব ফাঁকি দিয়েছে সুদখোর হারামির বাচ্চা। পুলিশের শ্বশুর পরিচয় ভাঙিয়ে এর কলা, ওর মুলো, ডিম, মুরগী বিনে পয়সায় বাগিয়ে বৌয়ের কাছে ফাঁট মারে। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে আধা দামে চাল ডাল কেনে, রেশন দোকান আর স্কুলের মিডডে মিলের ডিমের বখরা নেয় রাঁধুনি মাস্টারদের কাছ থেকে। আর জামাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা। শুওরের ইয়েটাকে আজ একটা কেস না দিলে সরকারের মান ইজ্জত থাকবেনা। (হারাধনবাবু মোপেডটা রাস্তায় স্ট্যান্ড করিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। গলায় তুলসীর মালা, কপালে গলায় হাতে চন্দনের ছাপ। মুখে গ্রামীণ সুদখোর সুদখোর ভক্ত ভক্ত ভাব।) ভালো আছেন বাবা?
হারাধন - ও তুমি! চিনতেই পারিনি। টুপিটা বেশ মানিয়েছে কিন্তু। সাহেব সাহেব লাগছে দেখতে। মনে হয় সেই ছোট বেলায় দেখা গোরা পুলিশ। তবে ওদের সোলার হ্যাটটা থাকলে আরও মানাতো। অবশ্য আর সব একই। সেই এক ব্যাটন, সেই লাল লাল চোখ, তেজিতেজি মুখ খিস্তি। তোমার শাসনের প্রশংসা শুনি গ্রামে গ্রামে। মেনিমুখো মিষ্টি মিষ্টি ভদ্র ভদ্র পুলিশ আমার ভালো লাগেনা। সাহেবরা আমাদের দেশটাকে দেশি নেতাদের দান করে গেছে বটে, কিন্তু ওদের বাজখাঁই মেজাজটা শুধু পুলিশকেই দিয়ে গেছে। না হলে এই অশিক্ষিত ছোটলোকদের সামলানো মুশকিল হোত, দেশের আইন কানুন কেউ মানতোনা, অসৎ ছোটলোকগুলো মাথায় চড়ে বসত। বেশির ভাগ না হলেও তোমার মত দু-চারজন কড়া পুলিশ, কড়া নেতামন্ত্রী আছে বলেই দেশে চন্দ্র সূর্য উঠছে এখনও।
মৃ - ঠিক বলেছেন বাবা। কিন্তু ঐ ভুঁইফোঁড় গণতন্ত্রপন্থী মানবাধিকারবাদীরা এই সোজা কথাটা বোঝেনা। (সুরজ চা বিস্কুট টেবিলে রেখে গেল) একটা ডিমটোস্ট দিয়ে যা শ্বশুরমশাইকে। চিনিসনা ওনাকে?
সু - কসুর হো গিয়া সাহেব।
হারা - আশীর্বাদ করি আরও বড় অফিসার হও। ভাটিখানায় চললে বুঝি? শালা লোকনাথটা বড্ড বাড় বেড়েছে। একটু ধমকে দিয়ে এসোতো বাবা। শালা শুদ্দু জল মেশাচ্ছে। দুটো গিলেও নেশা হয়না। যাও ওখানে একটু ফুর্তি করে এস।
মৃ - আমাদের কি ফুর্তি করার সময় আছে বাবা। এ গ্র্রামে সরকারী ডিউটিতে বেরিয়েছি। ডিউটির সময় ওসব চলেনা। কর্তব্য আগে।
হারা - বেশ বেশ, এই তো কর্তব্যপরায়ণ পুলিশের মত কথা। সময় পেলে তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনের সাথে একটু দেখা করে যেও সবাই মিলে। দাদুভাই দিদিভাইদের দেখিনি অনেকদিন। চলি তাহলে।
মৃ - চলি মানে? হেলমেট পারেননি কেন?
হারা - এইতো হেলমেট।
মৃ - হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখলেই কি আইন বাঁচানো হয়ে গেল, ওটা মাথায় পরতে হয়।
হারা - এই, গাঁয়ে গঞ্জে কে আর দেখছে। শহরের দিকে গেলে পুলিশ শালাদের তোলা জুলুমের ভয়ে মাথায় গলিয়ে নেই হ্যান্ডেল থেকে বার করে।
মৃ - খুব বেআইনী করেন। মিছিমিছি একটা কেস খেয়ে গেলেন।
হারা - সেকি, কবে, কখন, কোথায়, কে কেস দিলো?
মৃ - এইতো এখুনি, আমিই তো দেখলাম আপনার হেলমেটের জায়গায় শুধু তেল চকচকে টাকটা ঝিলিক মারছে সকালের রোদ্দুর পেয়ে।
হারা - ওহ, এই কথা, তুমি আমার জামাই হয়ে আমার বিরুদ্ধে কেস দেবে নাকি?
তোমার রসবোধ বেড়েছে দেখছি, হা হা হা, তুমি দেখলেও কেস হবে?
মৃ - হবেনা কেন, এই উর্দিটা পরলে আমি হয়ে যাই শুধু একজন পুলিশ। আপনার জামাইতো তো দূরের কথা, একজন মানুষও থাকিনা তখন। বিচারকদের টেবিলে চোখবাঁধা আইনদেবতার মূর্তী দেখেননি? হাতের দাঁড়িপাল্লার এক পাশে পিনাল কোডের গীতা, আর অন্যটায় জরিমানার টাকা বা জেলখানার চাবি।
হারা - এইবারটি আমায় ছেড়ে দাও বাবা।
মৃ - তা হয়না বাবা। মহাপাপ হবে। গীতা হাতে নিয়ে দিব্যি গেলে চাকরীতে যোগ দিয়েছি। সরকারের সাথে বেইমানি করে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করতে পারবনা। পুলিশের কাজ বড় কঠিন, বড় নির্দয় বাবা। একে বলে ন্যায়দন্ড। আমার কাছে রাস্তাঘাটের দুষ্কৃতী, নিজের বাড়ীর বাপ, শ্বশুরবাড়ীর বাবা, ভাই বোন, স্ত্রীপুত্র, চোর-ডাকাত, কুনাল, নীরব মোদী, সরব মোদী, মোহিত শাহ - নাসিরুদ্দিন শাহ - সব সমান। আপনি যখন আপনার ক্যান্সার আক্রান্ত ভাইপোর কাছে সুদ নেন, তখন আপনি আর জ্যাঠামশাই থাকেননা, শুধু একজন সুদখোর। নিন, সামান্য পাঁচ হাজার খসান।
হারা - সামান্য হেলমেট না পরার জন্য পাঁচ!
মৃ - রাস্তায় পেচ্ছাপ করার জরিমানা যোগ করে পাঁচ।
হা - পেচ্ছাপ? রাস্তায়? কখন পেচ্ছাপ করলাম বাবা? আমিতো মোপেড থাকে নেবে সোজা এই দোকানে ঢুকলাম তোমার চোখের সামনে।
মৃ -বললে হবে, আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনি ঐ-ই বাবলা গাছটার পাশে নামলেন, মোপেডটা স্ট্যান্ড করালেন, তারপর বোতাম খুলে ...আমি পরিষ্কার সব দৃশ্য দেখলাম, ফুটবল খেলার মত ধারাবিবরণ দিয়ে দেব নিখুঁতভাবে। মনে রাখবেন এটা পুলিশের চোখ। পুঞ্জাক্ষী। যেন একশো ডিজিটাল ক্যামেরা এক সাথে জুম করছে। সাধুসন্ত পীর পয়গম্বররা যেমন করে তাদের বৈদিক টেকনোলজিতে ত্রিকাল ত্রিভুবন দেখে। দেখলেও দেখে, আবার না দেখলেও দেখে। একে বলে আধ্যাত্বিক দৃষ্টি। কোন পাপ লুকানো যায়না ভগবান, আর পুলিশের চোখে। তা সে বাবলা গাছের আড়ালেই হোক, কি প্যান্টের ...
হা - তুমি সত্যি সব দেখেছো আমার ইয়ে - মানে। ..
মৃ - তাহলে আর বলছি কি। আপনি আমার বাবা, শুদ্ধ ব্যাকরণে উপবাপ, মানে কোয়াশি বাপ। মানে বাবার মত। জামাই হয়ে ওসব বেআইনি পাপ দেখা একটু অশ্লীল হয়ে গেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জজসাহেবের সামনে বর্ণনা দিতে পারবোনা পুরো দৃশ্যটা। কিন্তু সরকারি কাজ বলে কথা। লাজলজ্জা করলে সরকারি কর্তব্য পালন করা যায়না।
হা - তুমি নিশ্চই ভুল দেখেছো। ও জিনিসটা আমার নয়,অন্য কোন লোকের।
মৃ - পুলিশ ভুল দেখেছে! এরপরতো বলবেন ভগবানের চোখে ছানি পড়েছে। আই সুরজ - হা করে শুনছিস কি? বলনা কি দেখছিস তুই।
সুরজ - হাঁ শাশুড়বাবু, হামিওভি দেখেছে পাপটা। ওটা থেকে ছড়ছড় করে - আমাদের সরকার কখনও ভুল দেখেনা।
মৃ – শুনলেন তো, আর অন্য কোন সাক্ষীর কথা বলছেন? ঐ যে পীরপুরের বাসটা আসছে, ও বাসের প্যাসেঞ্জেররাও সব কিছু দেখেছে বলবে গীতা হাতে নিয়ে।
হা - সব বুঝলাম বাবা, বড্ডো কড়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের আইন। ক্ষুদিরাম-মাতঙ্গিনী, গান্ধী-নেতাজিদের প্রাণ বিসর্জন স্বার্থক। স্বর্গ থেকে তোমাদের ন্যায়বিচার দেখে তাঁদের আত্মার নিশ্চই শান্তি হচ্ছে। আমারও তুমি মনের মত উপযুক্ত জামাই হয়েছো। তোমার আইনজ্ঞান, নীতিজ্ঞান কাজকর্ম জেনে মনে বড় গর্ব হল। বল, এখন কি করতে হবে।
হা - আপনি আমার নিজের বাপের চেয়েও বেশি বাবা। সম্মান দিয়ে বাপ বলে ডাকি। আমার গিন্নীও তার মাতৃবাক্যকে বিশ্বাস করে আপনাকে বাবা বলে স্বীকার করে। কোন সন্দেহ করে না। আমার ভাগের কাটমানি ছেড়ে দিয়ে তিনেই ছেড়ে দেব পিতৃসম্মানে। কি, এবার খুশিতো? গুরুজনদের খুশি করতে পারলে আমার মনে খুব মজা-আনন্দ হয়।
হারা - সেকি বাবা, জামাই হয়ে ঘুষ নেবে আমার কাছে?
মৃ - (কানে হাত দিয়ে) ছি ছি বাবা, এমন কথা শোনাও পাপ। লোকে শুনলে আমায় অসৎ বলে ভাববে। আর যদি ঘুষও হয়, মনে মনে ভাবুননা কেন যে মেয়ে নাতি নাতনিদের মিষ্টি খাবার জন্য ... না না, এখনই না দিলে যে সাধারণ ক্রিমিনালদের মত হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাবো এমন চশমখোর জামাই আমি নই। আমি গুরুজনদের খুব শ্রদ্ধাভক্তি করি। ভাইপোর কাছ থেকে সুদ আদায়ের যে টাকাটা খানিক আগে পকেটে ঢুকিয়েছেন সেটা এখন জমা করে বাকিটা শালাবাবুকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঁচের কেস তিন হাজারেই ফয়সালা হয়ে গেলো। সক্কালবেলা দুই হাজার ইনকাম আপনার। এবার হাসুন। (হারাধনের পা ছুঁয়ে প্রণাম - মাইকে সমবেত হাস্য)
তৃতীয় দৃশ্য
পঞ্চায়েত অফিস। (অঞ্চল পঞ্চায়েত দুর্যোধন চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে সিগারেট টানছে। কয়েকজন গুন্ডামার্কা ছোকরা মেঝেতে এদিক ওদিক বসে মদ খাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)
দুর্যোধন - এস এস সাহেব, টুলটায় বস। পাঁচ মিনিট। (ছেলেদের উদ্দেশে)
তাহলে আজ রাতেই কাজটা শেষ করে আয়। ঐ এরিয়ার থানাকে বলা আছে। কোন চিন্তা নেই তোদের। মাঠের ওপার থেকে নজরে রাখবে। সাদা পোশাকে। লাশটা ন্যাংটো করে মুখটা থেথলে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে পাশের ডোবাটায় পুঁতে দিবি। কেউ এসে গেলে তার নলিটাও চিরে দিবি। তারপর ওর সদ্যবিধবা দুঃখী বৌটাকে সবাই মিলে একটু আনন্দ দিয়ে আসবি। শালা নান্টুর আস্কারা পেয়ে শুওরের ইয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছিল। এবার কে আমার ভাটিখানা তোলে দেখি। আপাতত: এই পঞ্চাশ হাজার রাখ। (টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে দিলো এক ছোকরার দিকে। মৃত্যুঞ্জয় মিটি মিটি হাসতে হাসতে সব কিছু দেখতে থাকলো। ছোকরাগুলো ছোরা ছুরিগুলো ব্যাগে পুরে প্রস্থান করলো) এবার বল মেজসাহেব, কেমন আছো? মেজোয় প্রমোশন হবার পর থেকে তো সাহেবের টিকিটাও দেখতে পাচ্ছিনা আজকাল।
মৃ - কেন স্যার, শুধু গত মাসেরটাই দিতে আসতে পারিনি। টিভি ক্যামেরারা যা পেছনে লাগছে! কারো ভালো দেখতে পারে না ওরা। শুধু হিংসা আর কুৎসা। মন্ত্রীরাই ওদের বাগে আনতে পারছেনা।
দু - কিন্তু তার আগের মাসের ওই মোনার বিধবার উচ্ছেদেরটাওতো বাকি।
মৃ - সব হয়ে যাবে স্যার। প্রমোটারটা একটু ফাঁপরে পড়েছে। রিয়েল এস্টেটের বাজার খুব খারাপ। এদিকে আবার জমি দখল হলেও পাশের পুকুর বোজানোটা বাকি। সেখানেও বাগড়া দিচ্ছে স্থানীয় জলাভূমি বাঁচাও সমিতি। তবে সরকারী অনুদান দেওয়া ক্লাবের মেম্বারদের ম্যানেজ করার প্রসেস চালাচ্ছে প্রোমোটার। তাতেও মোটা টাকার খরচা। সে যাই হোক ফ্লাট বুকিং শুরু হয়ে গেলেই প্রোমোটার আপনাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবে।
দু - চক্রবর্তীটাওতো বেগড়বাই করছে দেখছি। খেলার মাঠটা আর ফুটপাথের অংশ দখল করিয়ে মন্দির বানাতে দিলাম। পার্টির ছেলেদের কোন ঝামেলা করতে দিইনি। প্রচারের গুণে কদিনেই কালীমাতাটা বেশ জাগ্রতাও হয়েছেন দেখছি। প্রণামী পড়ছে থালা ভরে। বাড়তি আয়ের জন্য কালীর পাশে শনিকেও বসিয়েছে কদিন আগে। দেশে যত চুরি বাড়ছে, পাপ বাড়ছে তত ভক্তিও বাড়ছে। মন্দিরও বাড়ছে রাস্তাঘাটে। শনিবার হলেই পাপীদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। কিন্তু আমারটা মেটাচ্ছেনা শালা বামনা। ওর ড্রাগি ছেলেটাকে থানায় ধরে এনে একটু চমকাচ্চোনা কেন।
মৃ - এমএলএ-র আস্কারায় ওতো আবার নান্টু ঘোষের দিকে ঝুঁকেছে।
দু - তাহলে তিনজনকে টপকিয়ে তোমাকে প্রমোশন দিলাম কেন। আমাকেও তো উঁচুতলাদের ম্যানেজ করতে হয়। কিছু একটা ব্যবস্থা কর শিগ্গির। এদিকে আবার এ বছর খরাও হলোনা, বন্যাও না। তাই ত্রাণও এলোনা। আমার কপাল দেখছি খুব খারাপ। চার তলার ছাদ ঢালাইটা এখনও বাকি। অবুঝ গিন্নী মার্সিডিজ গাড়ী কেনার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছে। পাঁচ বছরের দু বছরতো কেটেই গেল। কবে হবে সব। পরের ভোটে যদি দলের টিকিট না পাই তাহলে তো সবই যাবে। শুনছি খুনে সন্যাসী নাকি টাকা ঢালছে উপর মহলে। বাকিগুলো আদায়ের ব্যবস্থা কর। তানাহলে তোমার কপালে লোধাশুলি থানা আছে - এই আমি বলে দিলাম। ওখানকার এসিতো এমএলের বাড়িতে এখন থেকেই মোটা খাম দিয়ে দালাল পাঠাচ্ছে।
মৃ - লোধাশুলির কথা মুখে আনবেন না স্যার। বৌ বাচ্চা নিয়ে একেবারে মরে যাব। ওখানে খাবো কি। জঙ্গলের আদিবাসী পাতা কুড়ানীয়াদের কাছ থেকে আর কত আয় হবে। এদিকে গিন্নীর খাঁইও বাড়ছে দিন দিন। সুদখোর হাড়কেপ্পন বাপের মাটির বাড়ীতে জন্মে আমার এতবড়ো দোতলা বাড়ী পেয়েও তার সাধ মেটেনা। আজ এসি চাই তো কাল বিশ হাজারী শাড়ী। (ব্যাগ থেকে দুটো বোতল বার করে) এদুটো এখন রাখুন স্যার। চন্দনপুরের খুনের আসামীর বাপ পাঠিয়েছিল। ভাবলাম এই ইমপোর্টেড স্কচের কদর পঞ্চায়েত স্যারই বুঝবেন। আর সবতো দেখি দেশী পেলেই বর্তে যায়।
দু - বেশ বেশ, খুব ভাল। আজ রাতে আবার তোমাদের এসি সাহেব আসবেন একটু ফুর্তিফার্তা করতে। ভাবছিলাম শহরে যাবো মালটাল আনতে।
মৃ - সেকি স্যার, আমরা থাকতে থাকতে ......
দু - সে আমি জানি। সাহেবের মেমসাহেব খুব কড়া ধাতের মহিলা। সব সময় চোখে চোখে রাখেন। উনি ওনার বালিকাকালের এক দেবদাসের সাথে হঠাৎ করে যাচ্ছেন মায়াপুর, না তারাপীঠে তীর্থ করতে। সেই সুযেগে এসি সাহেব এখানকার সার্কিট হাউস বুক করেছেন থানা ইন্সপেকশন দেখিয়ে। হাবুলবাবুর মেসের মুটি রাঁধুনীটাকে হায়ার করেছি ওনাকে দেখভাল করার জন্য। উনি যা পান তাতেই খুশি। কোন ছুৎমার্গ নেই। একেবারে সদাশিব, শিবঠাকুরের মত।
মৃ - ঠিক বলেছেন, সাহেব খুবই সজ্জন। সোজা সরল নির্বিবাদী মানুষ। ওদিকে আইনজ্ঞান প্রখর। ধর্ষণ মামলাটা কেমন সুন্দর ধামাচাপা দিয়েছিল বলুন। আমার গিন্নী ওকে দারুন ম্যানেজ করেছিল ডায়মন্ড হারবারের রিসোর্টে চাঁদ দেখাতে দেখাতে।
দু - বড্ড ফেঁসে গিয়েছিলাম মাইরি। কি করে বুঝবো এমন গ্রাম্য এলেবেলে মহিলাটা মাননীয় মন্ত্রী মশাইয়ের শালী। একেবারে কামদুনি করে মেরে ফেলিনি এই রক্ষে। তোমার গিন্নীকে ধন্যবাদ জানাতে ওনাকে একদিন আমার প্রাইভেট বাগানবাড়িতে নিয়ে যাব ডিনার করাতে।
মৃ - ধন্যবাদ স্যার। চলি এখন।
দু - ঠিক আছে। আমার বালি খাদানের ছেলেগুলোকে একটু দেখো।
মৃ - সে আর বলতে হবে না স্যার। (প্রস্থান)
দু - গবা, ও গবা। গ্লাস বোতলগুলো তুলে নিয়ে যা। আর কে এক প্রফেসর এসেছে, পাঠা সে শালাকে।
(পক্ককেশী এক বয়স্ক ভদ্রলোকের প্রবেশ)
প্রফেসর ব্যানার্জী - চিনতে পারিস? মানে চিনতে পারছেন? তোর, মানে আপনার পিতাঠাকুর আমার বাড়ীর মালি ছিলেন। আপনার বাবার অনুপস্থিতিতে আপনিও আমার বাড়ীতে পায়ের ধুলো দিতেন বাগানে জল দেবার জন্য। আপনি আমাদের বাড়ীর ছেলের মত হয়ে পান্তাভাত খেতেন। তারপর আপনি মালির কাজ ছেড়ে মাছের ব্যবসা....
দু - খুব হয়েছে,আর পুরানো ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে না। আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। সেসব পুরানা কাসুন্দি ফরগেট করুন। যে ধান্দায় এসেছেন সেটা ঝটপট বলে ফেলুন। অন্তত: দু ডজন মাল লাইন দিয়ে আছে। পারিনা আর এতো লোকের আবদার রাখতে। কে ডোবা বোজাবে, কে রাস্তায় দোকান মন্দির ভাটিখানা বসাবে, কার ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে হবে - এইভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আর পারিনা। উপরতলার নেতারা এসব বোঝেন না। তাঁরাতো বলে দিয়েই খালাস - জনগণের সেবা করো, তাদের পাশে থাকো, তাদের মুখে হাসি ফোটাও...আমাদের হয়েছে জ্বালা। নেহাত এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন, তাই ঢুকতে দিয়েছি। চটপট বলে ফেলুন আপনার বক্তব্য।
প্রঃ ব্যানার্জী - মানে, ঐ প্রিন্সিপালের প্রমোশনটা।
দু - ইংরেজিতে লেখা আপনার দরখাস্তটা আমি নিজে পড়েছি। ইংরাজীতে আপনার কেমন দখলটা সেটা আমি নিজে আরও ভালো করে যাচাই করতে চাই। তারপর ভেবে দেখবো। কেননা আপনি ইংলিশ মিডিয়াম নন। এত কম যোগ্যতায় আপনি কি করে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেবেন জানিনা। জানিনা কলেজের ছেলেমেয়েদের কি ভুলভাল শিক্ষা দেবেন আপনি। তার ওপরে আপনি ডাক্তারী ছেড়ে এ লাইনে এলেন কেন সেটাও একটা রহস্য।
প্রঃ - আমি ডাক্তার নই স্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে।
দু - তাহলে নামের পাশে ড: লিখেছেন কেন দুনম্বরী করে?
প্রঃ - ভুল হয়ে গেছে স্যার।
দু - এদিকে আবার আপনি তিন প্রফেসরের জুনিয়র। এই বিদ্যে নিয়ে ... এম পি সাহেব তো রেকমেন্ড করে দিয়েই খালাস। কত দিয়েছেন সুপারিশ লেখাতে? আচ্ছা আচ্ছা, - থাক সেসব খারাপ খারাপ কথা। যে যার এলেম মত খিঁচবে। আমি বলার কে? এখানে ত্রিশ লক্ষ লাগবে
প্রঃ - একটু বেশী হয়ে যাচ্ছেনা?
দু- আরে মশাই, প্রিন্সিপাল কি ছাগল, না শুওর যে দরদস্তুর করছেন গরুহাটের ব্যাপারীদের মত? কোশ্চেন বিক্রী, ছাত্র ভর্তি করেতো দু বছরেই উঠে আসবে ইনভেস্টমেন্টের টাকা। কমে পারবোনা। পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। অমুক নেতার শালা, তমুক মন্ত্রীর ভাইপো, ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারী, শিক্ষা বিভাগের অফিসার - বখরাদার কি একজন মশাই। এ ছাড়াতো কালীঘাটের জাগ্রতা জীবন্ত মা কালীর পুজোর খরচতো আছেই। কমে হবে না।
প্রঃ - কবে আসব বলুন?
দু - কালকে এলেই ভালো।
(প্রফেসরের প্রস্থান। অফিসারের প্রবেশ। পেছনে পেছনে একজন পিওন একগাদা সরকারি ফাইল টেবিলে রেখে গেল)
দু - এসো এসো এসডিও সাহেব। আমার অঞ্চলে কেমন আছো বল?
এসডিও - (প্রণাম করে) আপনার ছাতার তলায় ভালোই আছি স্যার। কতগুলো জরুরী ফাইল সই করাতে এসেছি স্যার।
দু - সব ঠিক দেখে নিয়েছো তো? আমার পিএ বলছিল তোমার নোটে নাকি ভুলভাল ইংরাজী থাকছে। কোথায় নাকি জয়েন্টেড এর জায়গায় জয়েন্ড লিখছ, নিমুনিয়া শব্দের আগে অহেতুক একটা পি বসিয়ে দিচ্ছ - এই বিদ্যে নিয়ে তোমরা আইএএস, বিসিএস পাশ কর কি করে?
এসডিও - কাজের চাপে মাঝে মাঝে এমন ভুল করে ফেলি স্যার। অপরাধ ক্ষমা করবেন।
দু - ফাইলগুলো রেখে যাও। পরে দেখেশুনে সই করে দেব। সব। আমার লোকেরা তোমার সব প্রাপ্য দিচ্ছে তো নিয়ম আইন মত?
এসডিও – হ্যাঁ স্যার, সব ঠিক আছে। তবে পার্সেন্টেজটা একটু বাড়ালে ভালো হয়। গিন্নীকে নিয়ে একটু বিদেশ যাত্রার ইচ্ছে আছে।
দু - ঠিক আছে, নতুন চরের বালিখাদান থেকে ট্রাক পিছু একশ তুমি এক্সট্রা পাবে। তবে এখনকার মত যেন মাখনের মত কাজ চলতে থাকে।
এসডিও - থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
(পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে এসডিও সাহেবের প্রস্থান)
মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ী
(সর্বপ্রিয়া টিভি দেখছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)
সর্বপ্রিয়া - দেখলেতো, আমি কী বলেছিলাম? ওই বৌ’টাই খুনি। বরের বসকে নিয়ে হোটেলে যেত ফুর্তি করতে। স্বামী জেনে যাওয়ায় মদের মধ্যে বিষ মিশিয়ে ওকে খুন করেছে। ঐ বৌগুলোকে গুলি করে মারা উচিত।
মৃ - তুমি আবার সিরিয়ালের বৌ’টার মত আমাকেও খুন করো না যেন।
সর্ব- তুমি যেন কি! কিচ্ছু মুখে আটকায় না। যত্ত আজগুবি অলুক্ষুণে কথা।
মৃ - লাল পার্টির অজয় সামন্তের কথাই বোধ হয় ঠিক। সেদিন বক্তৃতায় বলছিল “শুধু টিভি সিনেমার নাটকে নয়, আজকাল এ’সব হচ্ছে ঘরে ঘরে। কাগজে আর ক’টা বেরোয়। স্বামীগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে টাকার ধান্দায়, আর উপোসী বৌগুলো বোল্ড রিলেশন করছে ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবে। সমাজ সংসার সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু খাই খাই,শুধু টাকা আর ভোগের লালসা। একদিন সব ঘরে আগুন জ্বলবে।” লোকটা আমাদের পার্টির নামে যা তা বলে বটে, তবে তার কথাগুলোর ভেতর চিন্তার বিষয় আছে।
সর্ব - তোমার আজ হলো কি? কি সব উল্টোপাল্টা বকছো বুদ্ধিজীবীদের মত! দার্শনিক হয়ে গেলে নাকি?
মৃ - আমার আজকাল কিছু ভালো লাগছেনা। মানুষ ভেতরে ভেতরে যেন ধিকি ধিকি করে জ্বলে উঠছে আগ্নেয়গিরির মত। যেকোন সময় অগ্নুৎপাত হয়ে দেশটাকে পুড়িয়ে দিতে পারে। ভীষণ ভয় হচ্ছে কাজকর্ম করতে। শুনলাম বুড়ো পুলিশ মন্ত্রীর ঘনিষ্ট অল্পবয়সী বান্ধবীর বাড়ী থেকে নাকি কেজি কেজি সোনা আর কোটি কোটি টাকা পেয়েছে পুলিশ!
সর্ব - এত টাকা নিয়ে করবেটা কি?
মৃ - সে আর বুঝছে কে? লাল পার্টির অজয় সামন্ত সেদিন বক্তৃতায় বলছিল, “সবাই একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তারা কি চাচ্ছে, কেন চাচ্ছে, কি করছে তারা নিজেরাই জানেনা। টাকাগুলো খরচই করতে পারবেনা সারা জীবনে। হয় সুইস ব্যাংকে পচবে, না হয় ছেলে মেয়েরা ড্রাগ মদ খেয়ে ওড়াবে।” নাও, টাকাগুলো তুলে রাখ আলমারিতে। আজ আদায়টা ভালো হয়েছে।
সর্ব - শোন, তোমার ছেলের হাজার দশেক লাগবে কালকে।
মৃ - কি ব্যাপার, একেবারে কালকেই? এত্ত টাকা!
সর্ব - তোমার কি ঘর সংসারের দিকে এতটুকু নজর নেই? কাল যে তোমার ছেলেটার জন্মদিন সেটা ভুলে গেলে!
মৃ - ওহো, তাইতো বটে। পায়েস টায়েস বানাও তাহলে।
সর্ব - আজকাল ওসব পায়েস নাড়ুর চাল নেই। যত্ত গ্রাম্য কালচার। সমাজটা অনেক এগিয়ে গেছে। (চা বিস্কুট টেবিলে রাখলো সর্বপ্রিয়া)
মৃ - (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমার মাও জন্মদিন করতো আমার। সে সব কথা মনে হলে বুকটা উদাস হয়ে যায়। শঙ্কর মাস্টারের বাড়ি থেকে এক পোয়া দুধ চেয়ে এনে ফ্যানা ভাতে খানিকটা গুড় আর ওই দুধ মাখিয়ে পায়েশ খাওয়াতো আমায়।মায়ের স্নেহমাখা সে অমৃত এখনও মুখে লেগে আছে। মাকেও তাড়ালাম, মাতৃসুখও হারালাম। এখন বড় আফসোস হয়। তা ছেলের একেবারে দশ লাগবে কেন?
সর্ব - ওরা সব বন্ধুবান্ধব মিলে শহরের হোটেলে পার্টি করবে।
মৃ - পাঁচই দিয়ে দাও।
সর্ব - বলেছিলাম সে কথা। বলে ওতে নাকি শুধু উইস্কির বিলও মেটানো যাবে না।
মৃ -তাবলে এত টাকা পাব কোথায়। এইতো মাইনে।
সর্ব - সেটাও বলেছিলাম। বললো বাবা নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় বলে ওর বন্ধুরা বলাবলি করে। একটু ভদ্রভাবে পার্টি না দিলে ওর খুব দুর্নাম হবে। তোমারও মান মর্য্যাদা থাকবেনা .
মৃ - এটা অবশ্য ঠিক। মেয়েকে দেখছিনা কেন?
সর্ব - ওতো কালই দিঘা, না বকখালি কোথায় একটা গেছে উইকেন্ড কাটাতে। ওর কলেজের অনেক নেতা মন্ত্রী লাখপতি কোটিপতির ছেলেরা ওর বন্ধু হয়েছে কিনা। ওদেরই একজন ট্যুরটা স্পনসর করছে।
মৃ - দেখো, আবার কোনও কেলেঙ্কারি ফেলেঙ্কারি না বাধায়। বড়ি টোরি সাথে দিয়েছো তো।
সর্ব - সেটা তুমি আমায় বলে দেবে? হোটেলে রিসোর্টে আশ্রমে তীর্থে পুরুষমানুষগুলো গাঞ্জা মদের নেশায় কি রকম পাগল পাগল হয়ে যায় সেটা আমার চেয়ে কে বেশি জানে। হাড়ে হাড়ে বুঝেছি সব।
মৃ - মহিলারাও যে কমতি যায়না সেটাও আমি শুধু হাড়ে হাড়ে নয়, একেবারে মজ্জায় মজ্জায় বুঝি।
সর্ব - তুমি কি আমায় সন্দেহ কর নাকি?
মৃ - ছি ছি সর্ব, তুমি কি ঠাট্টা ইয়ার্কিও বোঝোনা?
দৃশ্য - মন্দির
(পূজারী ঘন্টা নেড়ে প্রদীপ নাড়িয়ে আরতি করছেন ভক্তরা হাত জোড় করে বসে। কয়েকজন কাঁসর ঘন্টা বাজাচ্ছে নেচে নেচে। আরতি শেষে পুরুতের হাত থেকে প্রসাদ নিয়ে ভক্তরা সব প্রণামী ঢুকিয়ে দিলো বাক্সের ফোকরে। তারপর সবাই একে একে বেরিয়ে গেলো মন্দির থেকে। প্রণামী নৈবেদ্য সব ব্যাগে পুরে পূজারী ঠাকুর বেরুতে যাবেন, এমন সময় দেখেন কে একজন যেন এক কোনায় বসে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে।)
পূজারী - কে ওখানে? ওকি, মৃত্যুঞ্জয়, এভাবে বসে কেন? তোমার কী হয়েছে?
মৃ - আমায় বাঁচান ঠাকুরমশাই। আমি নরকে যেতে বসেছি। (কান্না)
পু: - বলি হয়েছেটা কী? এত উতলা কেন? এতবড় ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার হয়ে কার ভয়ে মেয়েদের মত কাঁদছো? (পূজারীর কানে কানে মৃত্যুঞ্জয় কিছু একটা বললো) এতো সাংঘাতিক ব্যাপার। মহাপাপ করেছে তোমার মেয়ে। পরিবারসহ তোমাদের সবার নরকগমন অবধারিত। আইবুড়ো মেয়ের এ পাপের ক্ষমা নেই। কয় মাস হলো?
মৃ - জানিনা ঠাকুরমশাই, আমায় উদ্ধার করুন। আমি ঈশ্বরভীরু মানুষ। প্রতি গুরুবারে আমার গিন্নী এসে একশো টাকার প্রণামী দিয়ে পুজো করে যায় এখানে। সৎসঙ্গে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ খাই। হাতের সব আঙুলে নয় গ্রহের নয়টি আংটি পরি। জীবনে কোনও পাপ করিনি। আমাদের মেয়ে মদ সিগারেট খেলেও দেব দ্বিজে খুব ভক্তি। শিবের ব্রত করে, শিবের মাথায় জল ঢালে তারকেশ্বরে গিয়ে। পুরীর মন্দিরেও যাই, দিঘার নতুন মন্দিরেও। তবু আমার এমন কেন শাস্তি হলো ঠাকুরমশাই? নরককে আমি বড্ড ভয় পাই। যাগযজ্ঞ যা করেই হোক আমাদের উদ্ধার করুন।
পু: - সেতো অনেক খরচের ধাক্কা। প্রনামীই শুধু লাখখানেক লেগে যাবে। তার ওপর মায়ের স্বর্ণমুকুট, সোনার জিভ........
মৃ - এত্ত?
পু - এটাকি ছোটোখাটো ব্যাপার বাবা। আইবুড়ো মেয়ের ইয়ে। গোহত্যা বামুনহত্যার সমান পাপ। ফল, অনন্ত নরক। যে মামলায় যেমন খরচ। তোমার এত চিন্তা কিসের। পুলিশের চাকরী, ভালো মাইনে, ভালো উপরি - মায়ের আশীর্বাদে তোমারতো কোনও অভাব নেই। এতো আর পুলিশ, ডাক্তার,উকিলদের দিচ্ছো না, মা’কেই তো দিচ্ছ। দেখবে করুণাময়ী মা সব দুইগুণ ফিরিয়ে দেবেন। যাও, সামনের অমাবস্যার রাতে চলে আসো সব অনুপান নিয়ে। ফর্দটা তোমার গিন্নীর হাতে পাঠিয়ে দেব। তোমার আর কি, একবার হাঁকিয়ে দেবে, আর দশকর্ম, মালী, স্যাকরা সব অনুপান পড়ি কি মরি করে সোজা হোমডেলিভারি করে দেবে এই মন্দিরের ঠিকানায়। আরে বাবা, এতো আর ঘুষ নয়, প্রণামী-প্রণামী। প্রণামী দেবে মাকে। তোমার ভয় ভীতি দানধ্যান দেখে ধন্য ধন্য করবে দেশবাসী। আবার দয়াময়ী মা তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে তার প্রেমিককে বশীকরণ করিয়ে। একই খরচে একসাথে পুরুত জ্যোতিষের দুজনের দুটো কাজ করিয়ে দেব আমি।
মৃ - কিন্তু কে ওর সর্বনাশটা করলো তাতো বলতে পারছে না আমার সোজা সরল মেয়েটা। বশীকরণ করবেন কাকে। ওর ছেলে বন্ধুতো গন্ডা গন্ডা।
পু - সবকটাকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে পিটিয়ে দাও, বাপ বাপ বলে সব বলে দেবে পটাপট। সবই মায়ের ইচ্ছা বাবা। যাও, মন শুদ্ধ করে ব্যবস্থা করে ফেল। চিন্তা করোনা, আমিতো আছি, ভয় কিসের?
উকিলের চেম্বার
মৃত্যুঞ্জয় - ছেলেকে আমার জামিন করিয়ে আনুন উকিলবাবু। শালা সিবিআই পুলিশ ওকে খুব মারছে দিন রাত। আপনার পায়ে পড়ি উকিলবাবু।
উকিল - সেকি, সেদিন জোর গলায় বললেন, আপনি প্রবল পুলিশ অফিসার, কাউকে পরোয়া করেননা, ডজন ডজন এসি, ডিসি, নেতা মন্ত্রীদের সাথে আপনার ওঠা বসা। সবার কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবার এলেম আছে আপনার। সবাই আপনার হাতের মুঠোয়, এমন কি জজ সাহেবরাও নাকি .........আপনার পেয়ারের পার্টি মাস্তানরা লকাপ ঘেরাও করে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনছেনা কেন।
মৃ - সবাই হাত ধুয়ে ফেলেছে স্যার। ঐ মিডিয়াই কাল হচ্ছে। সব ছবি তুলে বারে বারে টিভিতে দেখিয়ে লোকগুলোকে খেপিয়ে দিচ্ছে। সব রিপোর্টারদের সিডিশন আইনে গ্রেপ্তার করা উচিত। সকাল বিকাল ২৪ ঘন্টা মহা আনন্দে এমন কুৎসা রটাচ্ছে যে নেতা মন্ত্রীরাও সামাল দিয়ে কেলেঙ্কারীগুলো চেপে যেতে পারছেনা। সবাই এখন নিরপেক্ষ হয়ে গেছে। কথায় বলে কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজি। যাদের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী দুর্নীতি এতদিন চাপাচাপি দিয়ে এলাম তারা এখন বলে আইন আইনের পথে চলবে। তানাহলে নাকি ভোটের মুখে তাঁদের ভাবমূর্তি কেঁচে যাবে। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা।
উকিল - কিন্তু আপনার ছেলে তার দুগুণ বয়সী মহিলাকে টার্গেট করতে গেল কেন? রাস্তাঘাটের আপনাদের আদুরে ছেলেরা কত্তো কম বয়সী সহজ শিকারদের ধরছে। আর তা আপনারা শুধু দেখছেন, আপনাদের নেতামন্ত্রীরাও আস্কারা দিচ্ছেন।
মৃ - খুব ভুল হয়ে গেছে স্যার।
উকিল - শ্লীলতাহানি করেছে করেছে ঠিক আছে। আজকাল এ রাজ্যে সব জলভাত। আগেও এসব হতো চুপিসাড়ে। শাস্ত্র পুরাণের গল্পগুজবের সাধু সন্ন্যাসী দেবদেবীরাও ছেড়ে কথা বলতেন না। সোশ্যাল মিডিয়ার খোলামেলা কুকুর বিড়ালদের মত ফিল্মি প্রেম দেখে এখন এসব রোগ একটু বেড়েছে মাত্র। তবে আজকাল ওসব নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়না। বেশির ভাগ গুরুজনেরা ঘটনাগুলো চেপে যান লোকলজ্জার ভয়ে। মন্ত্রী আমলারাও। কিন্তু আপনার পুত্তুর খুন করতে গেল কেন?
মৃ - ওর কোন দোষ ছিলনা স্যার। বদমাস মহিলাটা ওকে চিনে ফেলেছিল ঐ মধুচক্রের ঠেকে।
উকিল - তাবলে একেবারে খুন! তাও আবার আইপিএসের বৌকে!
মৃ - আমার ছেলেটা বড্ডো সোজা সরল। তখন ও নরম্যাল ছিল না। সেদিন তার জন্মদিন ছিলতো। বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু বেশি নেশা করে ফেলেছিল। মাথার ঠিক ছিলনা। একটা কোন আইনের ফাঁক দেখিয়ে ওকে বের করে অনুন না স্যার।
উকিল - এতো আর শুধু আইনের ফাঁকে হবেনা। অনেক খরচ আছে। আইন-টাইন সব নোটের ওপরেই লেখা থাকে। এখানে আবার সরকারী উকিলটা মৌলবাদী ধড়িবাজ। বামপন্থী। এক পয়সা খেতে চায়না। তবে আর সবের খাঁই অনেক। প্রথমেই দশ লক্ষ লেগে যাবে।
মৃ - এতো কি করে দেব স্যার?আমি সামান্য নিচু তলার পুলিশ। সামান্য মাইনে। আর্তি যা রোজকার হয় তার বেশির ভাগটাই চলে যায় পর পর উঁচুতলার পেট ভরাতে। একটু কমেসমে করুন স্যার।
উকিল - আপনি একজন দায়িত্ববান অভিজ্ঞ পুলিশ হয়ে কি সব উল্টাপাল্টা বকবক করছেন। আপনারা নিজেরাইতো চা-ওয়ালা, খোঁড়া রিক্সাওয়ালা, ট্রেনের ফেরিওয়ালা, এমন কি মন্দিরের সামনে বসা ভিখারিদের পর্যন্ত মাসকাবারী কমান না এক পয়সা। সব খবরই পাই আমি।
মৃ - বড্ডো ভুল করেছি এতদিন। আর করবো না ওসব পাপ। সহকর্মীদেরও সাবধান করে দেব।
উকিল - আজ থেকে আমি বাল্মীকি হয়ে গেলাম বললে হয়?
মৃ - আমার কেসটা একটু সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করুন স্যার। এমএলএ মার্ডার কেসটায় সরকারি উকিল কি স্ট্রাটেজি নিচ্ছে সে খবর দেব। পরস্পর এভাবে না দেখলে আমরা বাঁচবো কি করে?
উকিল - ঠিক আছে আমার ফিস্টে না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু পুলিশ খরচ,নেতার খরচ, রিপোর্টারদের খরচ ........ আপনি লাখ পাঁচেক নিয়ে আসুন, জামিনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
মৃ - শুধু জামিনের জন্য........
উকিল - শুনুন, এটা আপনার স্টেট পুলিশের কেস নয়, কোর্টের এদেশের জেরে সিবিআই মামলা। দেখছেন না দলেরই সব বাঘা-বাঘা এক নম্বর দুই নম্বর নেতা মন্ত্রীরা মাসের পর মাস জেল খেটে খেটে শুখনো মড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে বুঝুন মফস্বল থানার সেকেন্ড অফিসারের ছেলের কি দশা হবে।
মৃ - বুঝছি উকিলবাবু, কেউ কারো নয়, সুযোগমতো সবাই সবাইকে চুষছে জোঁকের মত। নেতা মন্ত্রী, সিন্ডিকেট, ক্লাব, গুন্ডা বদমাস, ছেলে বৌ - সব্বাই সব্বাই সমান কেউ কারো নয়। এতদিন আপনার বিপক্ষদের সব খবর দিয়ে সব খবর দিয়ে এসেছি। সুযোগ বুঝে আপনিও আমার বুকে
উকিল - এমনকি আপনিও আপনার বসে নেই।
মৃ - ঠিক আছে উকিলবাবু, আমি বিকালেই আসছি।
নার্সিং হোম
ডাক্তার বোস - কি ব্যাপার বাঘা দারোগা? এদিকে কেন?
মৃত্যুঞ্জয় - মানে একটু বিপদে পড়েছি।
ড: - আবার কার বাঁধলেন?আগেকার বান্ধবীটা ভালো আছেতো? পাপীটা কে ছিল জানতে পেরেছেন কি? আপনি যে নন সেটা আমি জানি। কোনও এক পরোকীয়া রসিক আপনার হাতে তামাক খেয়ে আপনাকে ফাঁসিয়েছিল।
মৃ - খুব বাঁচিয়েছেন ডাক্তারবাবু, বৌ জানতে পারলে হুলুস্থুলু কান্ড হয়ে যেত। এবার এসেছি আমার নিজের মেয়ের জন্য।
ড: - আপনার - নি-জের মেয়ে!! এটাও মনে হচ্ছে পরকীয়া কেস। মিহিরবাবু, কুড়ি বয়স বছরের পুরানো সিমেন্স রিপোর্টের ফাইলগুলো খুঁজে অনুনতো। কতদিন হলো?
মৃ - চার মাস ডাক্তারবাবু।
ড: - চা-মাস! এতদিন কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন নাকি। চারমাস ধরে বাড়তে দিয়েছেন পাপটাকে! আশ্চর্য! এত পুরানো কেস আমি অপারেশন করতে পারবো না। আমার যন্ত্রপাতি তত আধুনিক নয়। কলকাতার কোন নার্সিং হোম থেকে মালটা খালাস করিয়ে নিয়ে আসুন।
(মৃত্যুঞ্জয় ডাক্তারের কানে কানে কিছু বললো। ডাক্তার ইশারা করে নার্সকে বাইরে যেতে বললেন।)
মৃ - যত টাকা লাগে করে দিন স্যার। অচেনা জায়গায় যেতে সাহস হয়না। আমার এমন ভালো চাকরি, মানসম্মান সব ভেসে যাবে ডাক্তারবাবু।
ড; - আজকালকার উদার খোলামেলা সমাজে এসবে মান সম্মান যায়না। বড় বড় অভিজাত ঘরে এমন পরকীয়া কাণ্ডতো জলভাত। সমাজ সরকার দ্বারা স্বীকৃত। এইতো সেদিন কলকাতার ভেসেক্টমি করা মস্ত বড় অফিসারের মাঝবয়সী গিন্নি বেড়াতে যাবার নাম করে খালাস করে গেল দশ লক্ষ দিয়ে। চার চারটে দামড়া দামড়া ছেলে, স্বামী-আত্মীয় কাকপক্ষী টেরই পেলোনা। হোটেলে ডিস্কোতে নেশার ঘোরে কি সম্ভ্রান্ত, কি হঠাৎ বাদশা হওয়া প্রোমোটার সিন্ডিকেটের বাড়ির উপোসী মহিলারা তাড়াহুড়ো করে আজকাল ভুলে যান প্রটেকশন নিতে।
মৃ - ওদের কথা ছাড়ুন, এ ব্যাপারে আমাদের গাঁ-গঞ্জও আধুনিক হয়ে গেছে। পুলিশ সব খবর রাখে। আমার মেয়ের ব্যাপারে লাখ দুই দিয়ে দেব।
ড: - কি সব বলছেন আজেবাজে কথা। এটাকি ভাড়াটে উচ্ছেদ? প্রোমোটার টেবিলের তলায় পাতা আপনাদের বাঁ হাতে দু লক্ষ ধরিয়ে দিলো, আর অমনি জনসেবক মা মানুষের স্বেচ্ছাসেবীরা এসে ভাড়াটেকে টেনে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দশ মিনিটে অপারেশন শেষ করে ফেললো। আর আপনি বন্ধুক হাতে ওদের পাহারা দিতে থাকলেন দূরের গাছের আড়ালে। ডায়রিও নিলেননা নিঃসঙ্গ বুড়ি ভাড়াটের। আপনার মেয়ের শরীরে অনুপ্রবেশকারী অবাঞ্চিত দখলদারটাকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে ভালো মন্দ কিছু যদি হয়ে যায় তার হ্যাপা সামলাবে কে। থানা, পুলিশ, পাড়ার মাতব্বর, পার্টির সেচ্ছসেবীদের খরচ কত বেড়েছে জানেন? অবশ্য মায়ের কাছে মাসির গল্প আর কি বলব।
মৃ - ঠিকঠাক বিবেচনা করে বলুন কত দেব।
ড: - কেলেঙ্কারীটা জানাজানি হয়ে গেলে আপনার ভাবি বেহাই মশাই বিশ লক্ষ কাটমানি না নিয়ে ঐ এঁটো মেয়েকে ঘরে ঢোকাবে ভেবেছেন?
মৃ - আপনি আমায় ব্ল্যাকমেল করছেন, ডাক্তারবাবু।
ড: - সে আপনি বলতে পারেন বইকি। কিন্তু সেটাতো আপনাদের কাছ থেকেই শেখা। নেতা মন্ত্রী, সরকারি আমলাদের কালো টাকার গন্ধ পেলে আপনারা কি বেচারাদের ব্ল্যাকমেল করেননা? আর ন্যাকামো করবেননা, মেয়েকে উপোসী রেখে আট লাখ ক্যাশ নিয়ে পরশু আসুন রাত দুটোয়। এপেন্ডিক্স অপারেশনের একটা এস্টিমেট লিখে দিচ্ছি কাছে রাখুন। কেউ জানতে চাইলে ওটা দেখাবেন। আর এই এন্টিবায়োটিকগুলো খাওয়াতে থাকুন নিয়ম করে।
মৃ - ঠিক আছে ডাক্তারবাবু। হাতি এখন কাদায় পড়েছে। তবে ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।
ড: - আরে এসব কাজ গোপনে না করলে আমাদের নার্সিং হোমের ব্যবসাটাই লাটে উঠে যেত। এবার আসুন আপনি। (নার্স এসে ডাক্তারের হাতে একটা কাগজ দিয়ে গেল) আচ্ছা একটু বসুন। এই দেখুন বহু আগে করা আপনার সিমেন্স রিপোর্টের কপি। আপনার স্ত্রী আসল রিপোর্টটা ডেলিভারি নিয়ে গেছেন সই করে। আপনার সিমেন্স কাউন্ট জিরো অর্থাৎ বিজ্ঞানমতে আপনার ছেলেমেয়ে আপনার ঔরসজাত হতেই পারে না। আপনার বান্ধবীর সন্তানটিও আপনার ছিল না। এতো আর আধ্যাত্বিক শাস্ত্রীয় গল্পগুজব নয় যে কবিতা ফাঁদলাম, আর মহাকাব্যের নায়করা টুপ টুপ ঝোরে পড়লো সতী রানীমাতাদের পেট থেকে।
মৃ - কি বলছেন আপনি। আমার ছেলে মেয়ে আমার ঔরসে জন্মায়নি! আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করবো।
ড: - তার আগে আপনার সতীসাধ্বী গিন্নীর কাছে জেনে নিন কে আপনার ছেলেমেয়েদের বাবা। এখনতো দেখছি আপনার পরকীয়া বান্ধবীদের ক্ষেত্রেও কেউ আপনার হাতে তামাক খেয়ে গেছিল। মজা লুটলো অন্য লোক, আর তাদের বাচ্চাদের আপনি নিজের বাচ্চা ভেবে আমাদের অপারেশন ফি মেটালেন ওদের খালাস করাতে।
মৃ - আমি এখন আসি ডাক্তারবাবু। (প্রস্থানোদ্যত)
ড: - আরে, বসুন। বসুন মশাই। এত উতলা হবার কিছু নেই। এই ডাক্তারী লাইনে এসে আমরা সব দার্শনিক হয়ে গিয়েছি। প্রকৃতির নিয়ম যত কঠোরই হোকনা কেন তা মেনে নিতে শিখেছি। সত্যেরে নিন সহজে। এত ভাবাবেগ সেন্টিমেন্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। কেউ সত্যি সত্যি সতী নয়, আপনিও নন, আপনার গিন্নিও নন। অন্যান্য সুখী মানুষদের মত জীবনটাকে উপভোগ করুন - গিন্নি গিন্নির মত, আপনি আপনার মত। মনোবিজ্ঞানের পাঠ্য বই ‘আই আম ওকে, ইউ আর ওকে’ বইটা পড়ে নিন। আপনিও মধুমতীর সাথে দেখা করুন, আপনার স্ত্রীও ডায়মন্ড হারবারে ট্যুর করুক। মাননীয় আদালত বলেছেন পরকীয়া ফস্টিনস্টি সবার সাংবিধানিক অধিকার। সব গ্লানি মুছে ফেলুন। ‘স্ত্রী’ ছবির উত্তমকুমারের মত মিথ্যা আবেগের বশে কোনও কেলেঙ্কারী করে বসবেন না যেন। উইশ ইউ গুড লাক। মেয়েকে নিয়ে চলে আসুন যেমনটি বললাম।
-আশারাম বাবার আশ্রম-
(ধ্যানে বসেছেন গুরুবাবা। ধর্মবাজারের গুরুবাবাদের মতই চোখ ঢুলুঢুলু- হাফবন্দ পদ্মলোচন। মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ভাব। সর্বপ্রিয়া সামনে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ। সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলভার তাকে করে)
মৃ - বল, বল ডাইনি, কে, কে আমার ছেলেমেয়েদের বাপ।
সর্ব: বলছি বলছি, সব যখন জেনে গেছ, সব বলছি, রিভলভারটা নামাও। এই গুরুবাবা আর তার ছেলে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নাম করে রাতের পর রাত আমার ওপর অত্যাচার করেছে। বাপ ব্যাটাদের কোন একজন আমাদের মোহিনীর বাবা। (মৃত্যুঞ্জয় আশারামের মাথা লক্ষ করে গুলি করলো। গুলির শব্দ শুনে গুরুবাবার ছেলে সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী ছুটে আসতে ওকেও গুলি করলো। তারপর সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলবার তাকে করে)
মৃ - এবার বল কে আমার ছেলের বাবা।
সর্বজয়া - বলছিগো, বলছি, বন্দুক নামাও। তোমার এসি সাহেব ...........
ম্রি - তাহলে মর তুই (সর্বপ্রিয়ার মাথায় গুলি)
সার্কিট হাউস
মৃত্যুঞ্জয় - (জানালার দিকে হাত উঁচিয়ে রিভলবার তাকে করে) বল শালা বড়কর্তা, কে আমার ছেলের বাপ। বল, বল, বল শালা বড় কুত্তা।
এসি - (ঘরের ভেতর থেকে) কি সামান্য একটা থানা অফিসার হয়ে এসির প্রাইভেট বেডরুমে উঁকি! তোকে আমি ক্লোজ করবো।
মৃ - তার আগে তোর হৃৎপিন্ডটাকেই আমি চিরতরে ক্লোজ করে দেব লম্পট। কাল সকালে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে তোর ঐ উলঙ্গ চেহারাটা দেখাবে দেশবাসীকে, তারপর পোস্ট মর্টেম করবে মৃত ডিকম্পোজড সমাজটার। (গুলি, দর্শকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে) সবার খেল খতম, এবার তোমার পালা মৃত্যুঞ্জয় ...শেষ বুলেটটা তোমারি জন্য (মাথায় গুলি)
যবনিকা পতন
(হল থেকে বেরুতে বেরুতে পাশাপাশি বাড়ীর জানালা থেকে দর্শকরা টিভির সংবাদ শুনতে পাবেন) এই হলো প্ল্যানেট, আপনারা দেখছেন প্ল্যানেট আনন্দ। আনন্দে থাকে, আনন্দে রাখে। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, হরিহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দুর্যোধন নস্কর খুন। ভেড়ি ও চোলাই কারখানার দখল নিয়ে একই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এই খুন বলে স্থানীয় মানুষের সন্দেহ। সেটা মানতে রাজি নন বিধায়ক মানিক মন্ডল ওরফে গলাকাটা মন্টু। তার মতে পারিবারিক বিবাদের জেরেই এই খুন। অভিযুক্ত নান্টু ঘোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলো উত্তেজিত গ্রামবাসী। নান্টু ও তার দলবল বেপাত্তা। তদন্ত চলছে। * মন্ত্রীপত্নী ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত পুলিশপুত্র গ্রেপ্তার। চোলাই দোকানের মালিক খুনে অভিযুক্ত গুন্ডা বশীর আহমেদ সহ বারোজন আসামির বেকসুর খালাস। নিয়মমতো তদন্ত ও সাক্ষপ্রমান না দেবার জন্য পুলিশকে বিচারকের ভর্ৎসনা। সিবিআই তদন্তের দাবী মৃতের আত্মীয়ের। * উচ্চপদস্থ আমলার ৪৭ বছর বয়সী গৃহবধূর মেদিনীপুরের গরপাড় গ্রামের ‘নিষ্কৃতি নার্সিং হোমে’ গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। নার্সিং হোম ভাঙচুর, ডাক্তার প্রহৃত। * এইমাত্র এক চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যা ও সিরিয়াল হত্যার খবর পাওয়া গেলো। ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল একে একে তাঁর স্ত্রী, পারিবারিক গুরুদেব, গুরুপুত্র এবং তাঁর এসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে গুলি করে নিজে আত্মঘাতী। মৃত্যুঞ্জয়ের অবিবাহিত কন্যার জলে ডুবে মৃত্যু। সন্দেহ মেয়েটি অন্তঃস্বত্বা ছিল। পরিবারটি প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য নাবালক দেবপ্রিয় গৃহবধূ ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ফাঁসিকাঠে ঝোলার অপেক্ষায় হাজতে। মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ীর মেঝে খুঁড়ে কোটি টাকার গহনা ও টাকা উদ্ধার। * পাটনার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষক ও দারোয়ানের গণ ধর্ষণ। * হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে বিদেশপাড়ি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীশ্যালকের।* অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক ও ছাত্রনেতা খুন হলেন নিজের কলেজে। দেশ ও রাজ্যবাপী এমন গণঅপরাধ দেখে নেতা মন্ত্রী সমাজবিজ্ঞানী সাহিত্যিক সব শ্ৰেণীৰ বিদ্বজনেরা উদ্বিগ্ন। কুসংস্কারের প্রসার ঘটিয়ে সরকারী খরচে অযোধ্যায় রামমন্দির, দিঘায় বেআইনী জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের নিন্দা করলেন যুক্তিবাদী সমিতি। চাকুরীচোরদের হারানো চোরাই চাকুরী ও বাজেয়াপ্ত করা চাকুরীবিক্রয়ের চোরাই টাকা চোরদের ফেরতের আবেদন করলেন দয়ালু মন্ত্রী। দেশের একটি রাজনৈতিক দলকে সারা বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ ডাকাতদল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউ এন ও। এখন ছোট্ট একটা বিরতি। শীঘ্র ফিরে আসছি আরও খুন চুরি ডাকাতি ধর্ষণের আরও উত্তেজক খবরের ডালি সাজিয়ে। কোত্থাও যাবেননা। আমরাই আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য সব সময় প্রথম খবর দিয়ে থাকি। আনন্দসংবাদ নিবেদন করলেন, বঙ্গীয় জনতা পার্টি। আগামী নির্বাচনে বজপাকে ভোট দিয়ে দুর্নীতি করার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করুন .........