ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত কয়েকটি মৌলিক অধিকার

বাবাই


Nov. 19, 2024 | | views :282 | like:0 | share: 0 | comments :0

অনেকেই, বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর কে ভারতীয় সংবিধানের জনক হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। উনি ছিলেন সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান। সর্বপ্রথমে আম্বেদকর মহাশয় বেশকয়েকটি দেশের সংবিধানগ্রন্থ ও আইনি বইপত্র ভালোকরে পড়ে তারপর সেখান থেকে নির্যাস নিয়ে, দীর্ঘ আলোচনার পরে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ২৮৪ জন সাক্ষর করলে এটি গৃহীত হয়। এই দিনটি "জাতীয় আইন দিবস" হিসেবে পরিচিত। গণপরিষদ সংবিধান রচনা করতে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় নিয়েছিল। এই সময়কালের মধ্যে ১৬৬ দিন গণপরিষদের অধিবেশন বসে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার স্মৃতিতে ২৬ জানুয়ারি তারিখটি সংবিধান প্রবর্তনের জন্য গৃহীত হয়েছিল। 

১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন কার্যকরী হয়। এই আইনবলে ব্রিটিশ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়। স্থির হয়, সংবিধান প্রবর্তন পর্যন্ত এই দুই রাষ্ট্র কমনওয়েলথ অফ নেশনসের দুটি অধিরাজ্যের মর্যাদা পাবে। এই আইনবলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ভারত ও পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং উভয় রাষ্ট্রের উপর সংশ্লিষ্ট গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান প্রবর্তিত হলে পূর্বপ্রচলিত ১৯৩৫ সালের ভারতের শাসন আইনেরও অবসান ঘটে এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন প্রত্যাহৃত হয়। এরপরে ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির অধিরাজ্যের বদলে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা অর্জন করে। 

ভারতের সংবিধান, বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। ভারতের সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে মোট শব্দসংখ্যা ১১৭,৩৬৯।  দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়ার দরুন, ভারত সরকার প্রবর্তিত প্রতিটি আইনকে সংবিধান-অনুসারী হতে হয়।

সময়ের সাথে যেমন বিভিন্ন বইপত্র সংশোধন,পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় তেমনই ভারতীয় সংবিধানও হয়েছে। প্রথম সংশোধন হয়েছিল সংবিধান চালু হবার পরের বছরেই, অর্থাৎ ১৯৫১ সালে। প্রসঙ্গত জানাই, ভারতের সংবিধান সংশোধনের জন্য বিল একমাত্র সংসদেই উত্থাপন করা যায়। সংসদের যে-কোনও কক্ষেই এই বিল উত্থাপন করা যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত কোনও বিল উত্থাপন করা যায় না। কেন্দ্রীয় সরকার বা সংসদের যে-কোনও কক্ষের যে-কোনও সাংসদ বিলের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন। সরকার যে বিল উত্থাপন করেন তা সরকারি বিল এবং কোনও সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে যে বিল উত্থাপন করেন তা বেসরকারি বিল হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, ভারতের সংবিধানের সকল অংশকে একই পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। গুরুত্ব অনুসারে বিভিন্ন অংশের সংশোধনীর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। 

১১ আগষ্ট ২০২১ এ পার্লামেন্ট পাশ হয়েছে ১২৭ তম সংবিধান সংশোধনী বিল। এতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ মহাশয় স্বাক্ষর করায় সেটি পরিণত হয়েছে ১০৫ তম সংবিধান সংশোধনী আইনে। ১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্বারা স্বাক্ষরিত ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। 

সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -" We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।

এবারে দেখে নেওয়া যাক সংবিধান আমজনতাকে কিধরনের মৌলিক অধিকার দান করেছে। সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে মুল সংবিধানে ৭ টি মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ ছিল। সেগুলি হল- 

১) সাম‍্যের অধিকার (১৪-১৮ নং ধারা)

২) স্বাধীনতার অধিকার (১৯-২২ নং ধারা)

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩-২৪ নং ধারা) 

4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা)

৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার (২৯-৩০ নং ধারা)

৬) সম্পত্তির অধিকার (৩১ নং ধারা)

৭) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (৩২ নং ধারা) 

বর্তমানে মৌলিক অধিকারের সংখ্যা ৬ টি। (এইখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ১৯৭৮ সালে ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ‍্যমে সম্পত্তির অধিকার কে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে  বর্তমানে সম্পত্তির অধিকার ৩০০এ ধারায় সংযোযিত রয়েছে) যেমন- 

১) সাম‍্যের অধিকার:

(ক) সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আইন সবাইকে সমানভাবে রক্ষা করবে। 

(খ) সংবিধানের ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের সাথে ধর্ম, জাতি, বর্ন, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বেষম‍্যমুলক আচরন করতে পারবে না। 

(গ) সংবিধানের ১৬ নং ধারা অনুসারে সরকারি চাকুরি তে সব নাগরিকদের সমান সুযোগসুবিধা থাকবে।

(ঘ) সংবিধানের ১৭ নং ধারা অনুসারে অস্পৃতাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষনা করা হয়েছে।

(ঙ) সংবিধানের ১৮  নং ধারার সামরিক শিক্ষাক্ষেত্র ছারা সমস্ত ক্ষেত্রে উপাধি গ্রহন ও ব‍্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

২) স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ১৯ নং ধারায় নাগরিকদের ৬ প্রকার স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন- 

(ক) বাক স্বাধীনতার অধিকার

(খ) শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশ 

(গ) সঙ্ঘ ও সংবিধানের ২০ (১) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে কেবলমাত্র সেই আইন অনুসারেই শাস্তি প্রদান করতে হবে।

সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে এক‌ই অপরাধের জন‍্য একাধিকবার শাস্তি প্রদান করা যাবে না। 

সংবিধানের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে নিজের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ দিতে বাধ‍্য করা যাবে না।

সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে কোন ব‍্যক্তিকে তার জীবন ও ব‍্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

২০০২ সালের ৮৬ তম সংবিধান সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার আইনটি (২১এ ধারা) সংবিধানে সংযোযিত হয়েছে। এই ধারায় সকল শিশুদের জন‍্য অবৈতনিক ও বাধ‍্যতামুলক শিক্ষার ব‍্যবস্থা করবে। 

২২ নং ধারা অনুসারে কোন ব‍্যক্তিকে যুক্তি সংগত কোন কারণ ছারা গ্রেফতার করা যাবেনা। 

৩) শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার: 

সংবিধানের ২৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, মানুষ নিয়ে ব‍্যবসা অর্থাৎ মানুষ ক্রয় বিক্রয়, বেগার খাটানো বা অনুরুপ ভাবে বলপূর্বক শ্রমদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সংবিধানের ২৪ নং ধারায় ১৪ বছ‍রের কম বয়সী শিশুদের খনি, কলকারখানা বা অন‍্য কোন বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

৪) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার: 

সংবিধানের ২৫  নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত‍্যেক ব‍্যক্তি নিজের বিবেক এবং বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোন ধর্ম গ্রহন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও নিজ ধর্ম প্রচার করতে পারবে।

সংবিধানের ২৬  নং ধারায় বলা হয়েছে প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্ম প্রচারের জন‍্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষনাবেক্ষন ও পরিচালনা করতে পারবে।

সংবিধানের ২৭  নং ধারায় বলা হয়েছে কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির এবং রক্ষনাবেক্ষণের জন‍্য কোন ব‍্যক্তিকে কর বা চাঁদা দিতে বাধ‍্য করা যাবে না। 

সংবিধানের ২৮  নং ধারায় বলা হয়েছে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত সেগুলিতে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া যাবেনা। 


৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার: সংবিধানের ২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় ভুখন্ডের যেকোন অংশে বসবাসকারী নাগরিক নিজ নিজ ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি সংরক্ষনের অধিকার ভোগ করতে পারবে। 

সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ‍্যালঘু সহ সকল সংখ‍্যালঘুদের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। 


৬) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার: সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার টি কে, ড. বি আর আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

সংবিধানের ৩২নং ধারায় বলা হয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা যদি মনে করেন যে তাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বা খর্ব করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হতে পারেন। 


এছাড়া সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রপতি, ২০ এবং ২১ নং ধারা ব‍্যতীত সমস্ত মৌলিক অধিকার গুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। 

সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট, ২২৬ নং ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার গুলি রক্ষার জন‍্য পাঁচ ধরনের লেখ বা রিট জারি করতে পারেন। যেমন- 

(ক) বন্দী প্রত‍্যক্ষীকরন (Habeas Corpus): এর অর্থ হল To have the body অর্থাৎ "সশরীরে হাজির করা"। 

(খ) পরমাদেশ (Mandamus): এর অর্থ হল Command to. 

(গ) প্রতিষেদ (Prohibition): এর অর্থ হল "নিষেধ করা"। 

(ঘ) উৎপ্রেশন (Certiorari) এর অর্থ হল "বিশেষভাবে জ্ঞাত হ‌ওয়া"।

(ঙ) অধিকার পৃচ্ছা (Quo Warranto) এর অর্থ হল "কোন অধিকারে"।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929