গত ৫ জুলাই ২০২১ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এ ডাইনি সন্দেহে একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবী জানিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক কে ইমেল করেছি। খবর পেয়েছি সরকার এখনও নাকি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এই সূত্র ধরেই
কথা হচ্ছিল ফ্রিথিংকার এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিঃ দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার (Activist Dr Dibyajyoti Saikia) সাথে।
গত ১৪ আগষ্ট ২০১৫ সালে অসম বিধানসভায় পাশ হয়েছে ডাইনি হত্যা প্রতিরোধ আইন। " THE ASSAM WITCH HUNTING ( PROHIBITION, PREVENTION AND PROTECTION) ACT 2015 " অসম বিধানসভায় আলোচনার পর বিলটি গৃহীত হয় এবং ২৯ জুন ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইনে কোনো মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ডাইনি অপবাদে কাউকে অত্যাচার করা হলে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা জড়িত থাকলে সকলের কাছ থেকে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান থাকছে। ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় বিচার হবে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। তদন্তে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে ১০ হাজার টাকা। সরকারের দাবি, অসমের এই আইন বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের চেয়েও কড়া হবে। উল্লেখ্য, কিছু সময় আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির মাণ্ডরে ডাইনি অপবাদে পাঁচ মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়। অন্য রাজ্যগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে মাঝেমধ্যেই ডাইনি অপবাদে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে।
অসমে পাশ হওয়া আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার চালানো, একঘরে করা বা হত্যার ঘটনায় তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজার সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে উক্ত আইনে হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেআইনি অনুশীলন ও সালিশি সভা বন্ধেরও কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ডাইনি অপবাদে একঘরে হওয়া, জখম হওয়া, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মহিলা বা পুরুষকে ক্ষতিপূরণ এবং ডাইনি-শিকারের বলি হওয়া পরিবারের অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হবে।
এই আইনটি লাগু করার পেছনে দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার অবদান অনেক। অসমে গত ৭ বছরে ডাইনি অপবাদে প্রায় ৭০ জনের বেশি খুন করা হয়েছে। এই ঘটনা বেশি ঘটেছে শোণিতপুর, লখিমপুর, মাজুলি, বড়ো ও সাঁওতাল অধ্যূষিত জেলাগুলিতে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে দেখেছে, অনেক ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। রাজ্য পুলিশ ডাইনি হত্যা রোধে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। পাশাপাশি বীরুবালা রাভা ও দিব্যজ্যোতি সাঁইকিয়া ডাইনি হত্যা রোধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু, তার পরও এই সব ঘটনা আটকানো যাচ্ছিল না।
দিব্যজ্যোতিবাবু জানান, প্রায় ছ’বছর ধরে তাঁরা ডাইনি হত্যা রোধে কড়া আইনের জন্য সুপারিশ করছিলেন। অসম সরকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া বিল তৈরি করে। মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘ছ’বছরের চেষ্টায় বিল পাশ হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু, ওঝাদের রমরমা বন্ধ করতে কোনও দল মুখ খুলল না। এটা খুবই মর্মান্তিক। অসম সরকারের হিসেবে, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৬ জন ও ২০১৪ সালে ডাইনি অপবাদে ৯ জনকে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে বিধানসভায় এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুল রহিম খান, অপরাধীদের জরিমানার টাকা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। অগপ বিধায়ক কেশব মহন্ত বলেন, ‘‘শাস্তি দিয়ে ডাইনি-হত্যার রাশ টানা যাবে না। স্কুলে স্কুলে অন্ধবিশ্বাস রোধে সচেতনতা শিবির ও এই বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’’
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রদদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"। " অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি " র প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র দাভলকর এর বিশেষ উদ্যোগে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " চালু হয়েছে। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies ( Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং
" The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।
ভারতে এতোগুলো আইন থাকা সত্বেও ডাইনি বলে দেগে দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। অন্যান্য রাজ্যে আইন রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে না আছে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার কিংবা হত্যার কোনো তথ্য আর না কঠোর আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ।
প্রসঙ্গত জানাই, গত ১৪ ই আগষ্ট ২০১৮ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কে একটা RTI করেন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি র পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি মধুসূদন মাহাতো। তথ্য জানার অধিকার আইন ২০০৫ এর মাধ্যমে মধুসূদন মাহাতো, সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ডাইনি সন্দেহে কতজন মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনার তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে।
৩০ আগষ্ট ২০১৮ তে স্টেট ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো থেকে উত্তর আসে যা সত্যিই অবাক করার মতন। সরকারের কাছে নাকি কোনো তথ্যই নেই!
বাহঃ চমৎকার।
কয়েকজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা মহারাষ্ট্রের ধাঁচে এই পশ্চিমবঙ্গে একটি কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। আইনটির নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill 2016। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।