গল্পের ফাঁকফোঁকর: অভিশপ্ত কেতকী ফুল

Guitar K Kanungo


Dec. 22, 2024 | | views :77 | like:3 | share: 2 | comments :0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা’য় সম্ভবত কেতকী মিত্রের নামটি পেয়েছিলাম, কিন্তু কেতকী নামের যে একটি ফুলও আছে, সে কথা জানা ছিল না। আবার সেই ফুল যে অভিশপ্ত, সেটিও সম্প্রতি জানলাম। শিব পুরাণ পড়ছিলাম, সেখানেই কেতকী ফুলের অভিশাপ কুড়ানোর গল্পটি পড়লাম। বিশেষ একটি কারণে এই গল্পটি বলার মতো; সেই কারণটি পরে বলছি, আগে গল্পটি বলে নিই।

রাম ও সীতা বনবাসে আছেন, সঙ্গে লক্ষণ। রাম বনবাসে যাওয়ার কিছুদিন পরেই দশরথের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় এল। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য উপকরণ প্রয়োজন; রাম লক্ষণকে পাঠালেন আশপাশ থেকে কিছু উপকরণ সংগ্রহ করতে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু লক্ষণ ফিরল না। রাম চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে তো বসে থাকা যায় না, এবার রাম নিজেই বেরিয়ে পড়লেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো—রাম কিংবা লক্ষণের কারোরই দেখা নেই। সীতা কুটিরে একা। এদিকে শ্রাদ্ধের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সীতা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করবেন। তিনি পাশের ফল্গু নদীতে গিয়ে স্নান সেরে যা কিছু কুটিরে ছিল, তা দিয়েই পিণ্ড দিলেন।

পিতৃপুরুষগণ হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করলেন। তাঁদের মধ্যে দশরথও ছিলেন। দশরথ বললেন, "তোমার শ্রাদ্ধ সফল, আমরা পরিতৃপ্ত।" কিন্তু সীতার মনে একটু সন্দেহ রইল। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনারা যে পরিতৃপ্ত হয়েছেন, হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করেছেন, সে কথা আপনার পুত্র বিশ্বাস করবে না।" দশরথ বললেন, "সাক্ষী রাখো।" সীতা বললেন, "ফল্গু নদী, এই ধেনু, অগ্নি আর কেতকী আমার সাক্ষী।"

এর কিছুক্ষণ পরই রাম এলেন, সঙ্গে লক্ষণ। এসেই বললেন, "শিগগির স্নান করে এসো! রান্না করতে হবে, শ্রাদ্ধের সময় চলে যাচ্ছে!" অথচ স্নানে যাবার কোনো তাড়া সীতার মধ্যে দেখা গেল না। রাম কিছুটা বিরক্ত হয়ে আবারও তাড়া দিলেন। এবার সীতা সব খুলে বললেন, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, এবং সেই পিণ্ড পিতৃপুরুষরা একেবারে হাতে হাতে গ্রহণ করেছেন।"

রাম সীতার কথা শুনে হেসে উঠলেন। পাশে দাঁড়ানো লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমরা শাস্ত্রমত ডেকেও ওঁদের দেখতে পাই না, আর উনি কোনো রকম ডাকতেই ওঁরা দেখা দিয়ে গেলেন! আসলে তোমার বৌদি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং ঘুমের মধ্যে ওই সমস্ত স্বপ্ন দেখছিলেন।" তারপর সীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তাই না! ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই তো!"

সীতার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। রাম তাঁকে মিথ্যাবাদী ভাবছেন! তিনি রামকে বললেন, "রাঘব! আমি ঘুমাইনি, স্বপ্নও দেখিনি। আমি যা বলেছি, সবই সত্যি। আমিই পিণ্ডদান করেছি এবং তোমার পিতৃপুরুষরা সেটা গ্রহণ করেছেন। এই ফল্গু নদী, এই ধেনু, এই অগ্নি এবং এই কেতকী ফুল সবাই সাক্ষী।"

রাম তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই বলল, এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই মিথ্যাচারটি কেন এই সাক্ষীরা করল? বিশেষত অগ্নি কেন এমন কাজ করতে গেল? এমন তো নয় যে সীতা তাঁদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন। এর কোনো উত্তর রামায়ণে পাওয়া যায় না। আমরা শুধু এটুকুই জানি, তাঁরা মিথ্যাচার করেছেন।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। সময় বয়ে যাচ্ছে। সীতা সব কিছু প্রস্তুত করে দিলেন। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।" এবার রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। সূর্যের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।"

সূর্যদেবের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সীতা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেননি, উল্টো হাসাহাসি করেছেন। রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। তাঁদের উচিত ছিল দেবী জানকীকে বিশ্বাস করা। রামচন্দ্রের মনে একটা খটকা থেকেই গেল। কেতকী, ফল্গু, ধেনু এবং অগ্নি তো সাক্ষী ছিল। তাহলে মিথ্যে বলল কেন? লক্ষণও তাই ভাবছিলেন।

এমন সময় দুজনেরই কানে এলো সীতার কথা। সীতা বলছেন, "ফল্গু নদী, জেনেশুনে তুমি সত্য বলনি, তুমি পাতালে প্রবাহিত হও। অগ্নি, তুমি না দেবগণের মুখ! আজ থেকে তুমি সর্বভুক হবে। ধেনু, তুমি মুখে মিথ্যে বলেছ, আজ থেকে তুমি মুখে অশুচি, পবিত্র কেবল পুচ্ছদেশে। কেতকী, তুমি শিবের প্রিয় ছিলে, কিন্তু আর থাকবে না। তাঁর পূজায় তুমি অযোগ্য।"

কেতকী ফুল মহাদেব কতটা ভালোবাসতেন, কিংবা পূজার অযোগ্য হয়ে কেতকী ফুলের কতটা ক্ষতি হলো, তার চাইতেও বড় একটি প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই গল্পের ফাঁকফোঁকরে। সেটা হলো—হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি প্রথা। এই গল্প থেকে জানা গেল, পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদানের অধিকার একচেটিয়াভাবে শুধু পুত্রদের নয়; কন্যা তো বটেই, এমনকি পুত্রবধূদের সেই অধিকার পুরোদমে আছে। নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, যা রামায়ণের যুগেও স্বীকৃত ছিল।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929