আমরা পিতামহ ভীষ্মকে যতই মহৎ বলি না কেন তাঁকে দিয়ে ব্যাস মোটা দাগে দুটো অপরাধ করিয়েছেন। দুটো অপরাধই বড় রকমের অপরাধ। এই দুটো অপরাধ এমন যে এই অপরাধগুলো সংঘটিত না হলে কুরুক্ষত্রের যুদ্ধটাই হত না।
ভীষ্মের প্রথম অপরাধ করেছেন গান্ধারী এবং তাঁর পরিবারের সাথে। তিনি গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গান্ধার থেকে তুলে এনেছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে। এই পর্যন্ত যদিও মেনে নেয়াও যায় কিন্তু এর পরে তিনি যে কাজটা করেছেন, সেটা পুরোপুরি ক্ষমার অযোগ্য। তিনি গান্ধারের রাজা সুবল, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের আরো কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনকে হস্তিনাপুরে ডেকে এনে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। শুধু তাই নয় ভীষ্ম এটাও নিশ্চিত করেছেন এরা সবাই যেন না খেতে পেয়ে মৃত্যবরণ করে।
ব্যাপারটা কতটা অমানবিক সেটা বোঝা যায় যদি আমরা গোটা ব্যাপরটাকে গান্ধারীর দিক থেকে দেখি। গান্ধারী ওই রাজ্যের রাণী অথচ তিনি জানেনই না যে রাজপ্রাসাদে থাকছেন সেই রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও কোন এক কারাগারে তাঁর বাবা-মা-ভাই বন্দি এবং তারা না খেতে পেয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে কেবল গান্ধারীর ভাই শকুনিই রেহাই পেয়েছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের কোন প্রয়োজন ছিল না। একথা ঠিক গান্ধার রাজ সুবল, বিশেষত, শকুনী বোনের এই বিয়েতে একেবারেই রাজী ছিল না। কিন্তু তাদের কোন উপায়ও ছিল না। হস্তিনাপুরের মত প্রতাপশালী রাজ্যের বিরুদ্ধে কিছু করার মত সামর্থ্য এবং সাহস কোনটাই তাদের ছিল না। বিয়ের আগে মুহূর্তে শকুনি যদি কিছু বলেও থাকেন সেটা অক্ষমের অসুফলন ছাড়া কিছুই নয়। ভীষ্ম অযথাই একটা গণহত্যা চালিয়েছেন। গণহত্যা এইজন্যে যে শকুনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধারে ফিরে যায় নি। রাজা সুবল হস্তিনাপুরের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। হতে পারে গান্ধার অত্যন্ত ছোট একটা রাজ্য কিন্তু সেখানেও তো কিছু মানুষের বসবাস ছিল। রাজার অবর্তমানে তাদের কি দশা হয়েছিল মহাভারতের রচয়িতা আমাদের সেই খবর দেননি।
ভীষ্ম দ্বিতীয় অপরাধটি করেছেন কাশীর রাজকন্যা অম্বাকে ফিরিয়ে দিয়ে। গান্ধারীর মতই কাশীর তিন রাজকন্যাকে তিনি তুলেই এনেছেন। এক্ষেত্রেও কাজটা তিনি গায়ের জোরেই করেছেন। স্বয়ম্বর সভা চলছে; যিনি বিয়ে করতে ইচ্ছুক তিনি স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত থাকে। ভীষ্ম নিজে বিয়ে করবেন না কিন্তু তিনি রাজকন্যাদের তুলে নিয়ে আসলেন ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য। এই কাজটা তিনি জোরপূর্বক না করে বিচিত্রবীর্যকেই কাশীতে পাঠাতে পারতেন। বিচিত্রবীর্য নিজের ক্ষমতাবলে কাশী রাজকন্যাদের জয় করতে পারলে ব্যাপারটা অনেক শোভন এবং গ্রহণযোগ্য হত। ভীষ্ম নিশ্চয়ই জানতেন বিচিত্রবীর্যের পক্ষে সেই কাজটা সম্ভব নয়। সেইজন্যে দায়িত্বটা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং গোটা ব্যাপারটাকে লেজে গোবরে ছেড়ে দিলেন।
অম্বা সৌভ্য দেশের রাজার শল্যকে ভালোবাসতেন। স্বয়ম্বর সভায় শল্য উপস্থিতও ছিলেন কিন্তু ভীষ্মের কারণে সব ওলট পালট হয় গেল। অবশ্য তখন পর্যন্ত ভীষ্ম জানতেনই না যে অম্বা শল্যকে ভালোবসেন। সেটা তিনি জানলেন রাজকন্যাদের হস্তিনাপুরে নিয়ে আসর পর। বাকি দুই রাজকন্যার বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে আপত্তি না করলেই অম্বা বেঁকে বসলেন। অম্বা বললেন তিনি যেহেতু শল্যের বাগদত্তা সেহেতু তিনি শল্য ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন না। ভীষ্ম তাৎক্ষণিকভাবে অম্বাকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অম্বাকে সৌভ্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু স্বয়ম্বরের পরপর ভীষ্মকে ঠেকাতে গিয়ে শল্য ভীষ্মের কাছে যে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন, সেই অপমানের কথা ভীষ্ম ভুলে যাননি। তিন অম্বাকে গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। তিনি অম্বাকে ফিরিয়ে দিলেন।
রাজকুমারী অম্বার কাশীতে ফিরে যাবার উপায় ছিল না। তিনি হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছে ফিরে এলেন। ভীষ্মকে বললেন শল্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে কাশীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার এই দুরাবস্থার জন্যে ভীষ্মই দায়ী । ভীষ্ম তাঁকে জোরপূর্বক তুলে না আনলে এই অবস্থার সৃষ্টি হত না। ভীষ্মের উচিত এখন তাঁকে বিয়ে করা। কিন্তু ভীষ্ম বিয়ে না করার ভীষণ শপথ নিয়ে বসে আছেন। তিনি রাজী হলেন না; তাঁর কাছে অম্বার জীবনের চাইতে শপথের মূল্য অনেক বেশী। দুচারটা জীবন ধ্বংস হয়ে গেলেও তাঁর কর্তব্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যাবে না।
এই গোটা ব্যাপরটা ভীষণ রকমের স্বার্থপরতামূলক। এই মহাভারতেই এক ঋষির কথা বলা হয়েছে যিনি মিথ্যা না বলার অপরাধে নরকে গেছেন কারণ ওই মিথ্যাটা বললে একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষা পেত। একই যুক্তি ভীষ্মের ক্ষেত্রেই খাটে। অম্বাকে বিয়ে করলে তিনি সত্যচুত হতেন সেকথা ঠিক কিন্তু অম্বার জীবনটা বেঁচে যেত, যে জীবনটা তিনি নিজের হাতে নষ্ঠ করেছেন। যে গুরুর কাছ থেকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছেন সেই গুরুর আদেশও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। গুরু পিতারই মত। দেবব্রতের কাছে ভীষ্ম হয়ে ওঠাটা অনেক বড়। ভীষ্মের কারণে অম্বার জীবনটা অকলে ঝরে গেল। এটাও এক ধরণের হত্যাকাণ্ডই। ভীষ্ম এই হত্যাকাণ্ডের দায় কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না।