লক্ষী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী-র ভবিষ্যত

রাহুল কর্মকার


Nov. 23, 2024 | | views :884 | like:1 | share: 0 | comments :0

প্রথমে সবাইকে দুর্গাপুজোর আন্তরিক ও হার্দিক শুভেচ্ছা। পুজোর এই কটা দিন একটু অন্যরকম আমাদের সবার কাছে। দৈনন্দিন অফিসের কাজের চাপ নেই, পরিবারের সকলের সাথে পূর্ণাঙ্গ সময় বিচরণ। তারই একটি ছোট্ট অংশ হল মন্ডপে মন্ডপে প্রতিমা দর্শন।

এই প্রতিবেদনের উৎপত্তি সেরকমই এক সন্ধিক্ষণে। সেজে-গুজে চোখে চশমা এটে দিব্যি সুন্দর এই মন্ডপ থেকে ওই মন্ডপে ঘুরছি। সাথে বৌ আর একমাত্র পুত্র।

প্রবাদ আছে খালি মাথা শয়তানের বাসা, যেহেতু অফিসের কচকচানি নেই, তো মাথা মোটামুটি খালি, আর বৌ সঙ্গে থাকলে তো মাথা খালি রাখতেই হয় (অরন্যের প্রাচীন প্রবাদ)। তো, অতিরিক্ত ফাঁকা মাথা পেয়ে সেই শয়তান ভর করলো।

কোনোও এক মন্ডপে হঠাৎ চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল, দুর্গার মুখটা পালটে বৌ এর মুখ হয়ে গেল। আমি তারাতাড়ি নিজের আইডেন্টিটি জোগার করতে শিব খুঁজতে লাগলাম। ভবিত-ভব, উনাকে যে এই দূর্বল মুহুর্তে দেখার ক্ষমতা হারাব সেই বোধগম্যতাও আমার খালি মাথা থেকে উধাও। ইতি-উতি তাকাতেই অসুর ব্যাটার দিকে চোখ গেল। ওমা, কি সুন্দর আমার মুখমন্ডলের প্রতিচ্ছবি।  তৎক্ষনাৎ আকাশবাণী ভেসে এল মূর্খ, মেয়েরা বিয়ের আগে আমার মত বর চায়, কিন্তু বিয়ের পরে অসুর বধ করতেই ভালোবাসে। আমি আকাশপানে চাইতেই দেখি জটাধারী মিটমিট করে হাসছেন। কি আর করা যাবে, ঐশ্বরিক বাণী তো মাথা পেতে বরণ করে নিতেই হয়। অগত্যা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। দেখা যাক আর কাকে কাকে দেখতে পাই। জৈবিক সুত্র মেনেই যে কার্তিকের মধ্যে সন্তানকে দেখতে পাব সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এতক্ষন যা বললাম তা আসলে সৌজন্যমূলুক ভূমিকা, মূল প্রতিবেদনের সাথে সাজুজ্য খোঁজা বাতুলতা হবে। আসলে আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত বাবার মত আমিও সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে কিছুটা চিন্তিত তো বটেই।

গোদের উপর বিষ ফোঁড়া অর্থনৈতিক বেহালতা আর নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফীতি। একদম সরল ঐকিক নিয়মের সুত্র মেনে চললে আমরা প্রতিনিয়ত গরিব হচ্ছি।

 গত পাঁচ বছরের গড়পড়তা মুদ্রাস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশ ছিল, আমাদের (মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী) আয় কি সমহারে বেড়েছে? উত্তরটা না এবং না। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির সাথে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সোজাসাপ্টা আমাদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে, মানে প্রতিনিয়ত গরিব হয়েছি, হচ্ছি এবং হব। একটু অংকের হিসেবে আসা যাক, অর্থনীতির মানদণ্ডে সঞ্চয় ও ব্যয়ের অনুপাত ৭০:৩০ হলে তা সচ্ছল আয় হিসাবে ধরা হয়।

 অর্থাৎ ১ লক্ষ টাকা আয় হলে ৩০ হাজার টাকা সাংসারিক জীবনে খরচ করা যেতে পারে। এবার নিজের নিজের যোগবিয়োগ করে দেখুন কি ফলাফল আসছে (যৌথ পরিবারে এক ভাই সবজি বাজার, অন্য ভাই মুদিখানার টাকা দেয় বা বাবার পেনশনের থেকে ইলেক্ট্রিক বিল টা মিটে যায়- এজাতীয় গুলো দয়াকরে হিসাব বহির্ভূত ভাববেন না)।


হিউম্যান লেবার জাতীয় কাজের পরিসর ক্ষুদ্র হচ্ছে টেক্নোলজির কল্যানে এবং এটা অবশ্যম্ভাবী। সাউথ কোরিয়া গভমেন্ট রোবোট-ট্যাক্স এর প্রচলন করেছে। যেসব ইন্ডাস্ট্রি ম্যানুফ্যাকচারিং বা সার্ভিস রিলেটেড কাজ মানুষের বদলে রোবোট দিয়ে করাচ্ছে তারা এই ট্যাক্স দেবে। 

মোদ্দা কথা নিকট ভবিষ্যতে তথাকথিত ক্লারিক্যাল কাজের দায়ভার মানুষের হাতে থাকবে না। একদম বোধগম্য উদাহরণ দিচ্ছি।

 ডিজিটাল ক্যামেরা আসাতে রিলের ক্যামেরা জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। কোডাক নামটাই ইতিহাস হয়ে গেছে যেকিনা একদা ছবির জগতে মুকুটহীন সম্রাট ছিল। মোবাইলের ক্যামেরায় এ-আই এতটাই উন্নত যে এখন আর ফটোসপের দোকানে গিয়ে বলতে হয়না মুখটা আরেকটু ফর্সা করে দাও বা পেছেনের টা ব্লার করে দাও ইত্যাদি। কি মনে হয় আগামি পাঁচ বছর পরে ফটোসপের দোকানের কোনো গুরুত্ব থাকবে? 

আগে মোবাইলের দোকান গুলো গান ডাউনলোড বা রিচার্জ কুপন বিক্রি করেও মুনাফা করত, এখন তারা হয় ব্যবসা পাল্টেছে নয় মাছি তাড়াচ্ছে।

 কোন কোন পরিসরে কতটা করে কাজ হ্রাস পাবে তার পুংখানুপুংখ বিবরণ না পেলেও এটুকু অনুধাবন করতে পারি বিশ্বের সমগ্র কাজের ৫০% এর বেশি কাজ মানুষকে বাদ দিয়েই সম্পন্ন হবে। এবং সেটা তোমরা যতটা ভাবতে পারছো তার থেকে একটু বেশিই। আমরা কি করতে পারি? আন্দোলন!! মানুষকে কর্মহীন করার বিজ্ঞানের অমানবিক পদক্ষেপকে থামানোর আন্দোলন। অনেকদিন আগে এই বংগেই এমন আন্দোলন হয়েছিল, দশ বছর পরে ঘুম ভাংগে মানুষের। তাই আমরা আজও বেংগালুরু হয়ে উঠলাম না সমস্ত পোটেনশিয়ালস থাকা সত্ত্বেও। বিজ্ঞানের চাকা রুদ্ধ করে উন্নতি হয় না, উন্নতির ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের উপর।

তাহলে? বাকি যেটুকু কাজের পরিসর আছে সেখানে আমার সন্তান ফিট বসবে কিভাবে? লেটস গো ফর বেস্ট স্কুল, বেস্ট এডুকেশন, বেস্ট ব্লা ব্লা... সত্যিই কি তাই? যদি ধরেও নিই তাই তাহলেও কি আমাদের আয় সেটার সংগতি দেবে?


এবার আরেকটু আর্থসামাজিক জটিলতায় ঢুকব। পৃথীবির সমস্ত দেশের পরিচলন পদ্ধতিকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক-পুঁজিবাদি গনতন্ত্র, দুই-মুখোশে ঢাকা একনায়কতন্ত্র।

সত্যি বলতে কি এর বাইরে আর যা কিছু বলা হয় সেগুলো শুধুমাত্র প্রচার স্বার্থে। ভারত নির্দিধায় প্রথম ক্যাটেগরিতে আসে। পুঁজিবাদি গনতন্ত্রের চালিকাশক্তি বৃহৎ পুঁজিপতিরাই, তাতে যতই জনগনের সরকার বলে ঢক্কানিনাদ করা হোক। তোমার আমার ট্যাক্সের টাকা থেকেই করপোরেট সাবসিটি দেওয়া হয় যার বাজারি নাম এনকারেজ ফর ইন্ডাস্ট্রিয়ালাজেশন। ক্রনি-ক্যাপিটালিসমের সদব্যবহারে ধনকুবের আরও ধনবান হবে, গরিব আরও গরিব হবে।

কাজেই আদানি বিশ্বের ৩য় ধনকুবের হলেও গড় মাথাপিছু আয় নিম্নগামী রেখাতেই ধাবমান হতে থাকবে। কিন্তু এখানেও একটা টুইস্ট আছে। 

আমরা যদি এতই গরিব হয়ে যায় যে বাড়ি বানানোর সিমেন্ট কেনার পয়সাও নেই, তাহলে আদানির ব্যবসা কিভাবে হবে?


বা এত গরিব হয়ে গেলাম যে ফোন রিচার্জ করাটাও নেসেসারি খরচের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হলাম, তাহলে আম্বানি-বিড়লা দের ব্যবসা দেবে কে? কাজেই একটা ব্যালেন্সের প্রয়োজন। যাতে ধনকুবেরদের মুনাফায় টান না পরে, আবার জনগনের ক্রয় ক্ষমতাতেও টান না ধরে। টেক্নোলজি যে গতিতে ধাবমান তাতে এই ব্যালেন্সটা নষ্ট হয়ে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মতামত। এর প্রতিরোধে বিভিন্ন থিয়োরি উঠে আসছে যা নোবেল পেতে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে কতটা উপযোগী তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অন্তরায়। 

যেটুকু বোধগম্য হয়েছে তা হল - আগামি ২০ বছরে প্রযুক্তি যে সুনামি নিয়ে আসছে তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মে তারাই ভেসে থাকবে যারা বিষয়ভিত্তিক সৃজনশীল দৃঢ়চেতা।

 বাকি খড়কুটোর মতই ওলোট-পালোট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমরা অনেকেই আছি যারা জীবনের জোয়ার-ভাঁটা দেখেছি, অভিজ্ঞতা দিয়ে তা সামলাতেও শিখেছি। কিন্তু ওটা সুনামি, ওখানে আমাদের অভিজ্ঞতার সার্থক প্রয়োগ হতে পারে এমন নিদর্শন এযাবৎ অব্দি পাইনি।

উপসংহার: চেতনা ফিরল বৌ এর ধাক্কাতে - কিগো ক্যাবলাচো হয়ে মূর্তির দিকে তাকিয়ে কেন? আশেপাশে সুন্দরী গুলোকে আড়চোখে দেখলে বুঝতাম সুস্থ-সবল-সচরিত্রে আছো। বৈরাগ্যতে ধরল নাকি? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম না, আজ রাতে একটু লুডোই খেলব।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929