হিন্দুত্ববাদের ধারণা বনাম ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদ

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়


Nov. 20, 2024 | | views :901 | like:0 | share: 0 | comments :0

এম এস গোলওয়ালকর ও তার হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনা 

এক দেশ- হিন্দুস্তান। তাতে আছে এক জাতি (রেস)- হিন্দু জাতি। সেই জাতি ধারণা সম্পূর্ণতা পায় হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ভাষার মাধ্যমে। এই হিন্দু ভাষা হল সংস্কৃত ও তার থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলি। এক জাতি, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি, এক ভাষা মিলে তৈরি হয়েছে এক নেশন- হিন্দুস্তান। 


১৯৩৯ সালে নাগপুর থেকে প্রকাশিত ভারত পাবলিকেশন্সের ‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইণ্ড’ গ্রন্থে নেশন নিয়ে দীর্ঘ আলাপের শেষে এম এস গোলওয়ালকর আলোচনার নিস্পত্তি করেছেন হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার মাধ্যমে। নেশনের এই ধারণার বাইরে যারা আছেন, অর্থাৎ যারা হিন্দু জাতি নন, বা হিন্দু ধর্মে আস্থা নেই, অথবা হিন্দু সংস্কৃতির থেকে দূরে অবস্থান করেন বা হিন্দুভাষী নন, সেই সব মানুষ হিন্দুস্তানে নিছক থাকতে পারেন তবে তাদের জাতীয় জীবনে কোন স্থান থাকতে পারে না। একমাত্র যদি তারা হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু ভাষা ও হিন্দু জাতি-র অংশ হয়ে যেতে পারেন তবেই তাদের জাতীয় জীবনে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া যায়। এই একশৈলিক নেশন হল এম এস গোলওয়ালকরের ভবিষ্যতের ‘হিন্দুস্তানের’ রূপরেখা।


এম এস গোলওয়ালকর ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রধান। তাঁর এই লেখা এখনও আরএসএসের মূল  মতাদর্শ।


গ্রন্থটিতে তিনি রেস বা জাতি, তার সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রেস বলতে তিনি এমন এক জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়েছেন যাদের অভিন্ন রীতিনীতি আছে, যারা এক ভাষায় কথা বলে, যাদের সংস্কৃতিও অভিন্ন। অতীত থেকে যেসব রীতি, আচারানুষ্ঠান, প্রথা, দর্শন ও ধর্ম অনুসরণ করা হচ্ছে তার একত্রিত প্রভাবে তৈরি হয় জাতির সংস্কৃতি। তিনি বলেছেন, ধর্ম ও সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। ধর্মের ওপরে ভিত্তি করেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সংস্কৃতির আরেক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল ভাষা। প্রতিটি জাতির নিজের দেশে নিজস্ব ভাষা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়। 


তিনি বিশ্বাস করেন, দেশ ও জাতির শিরদাঁড়া গড়ে ওঠে তার ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে। সুতরাং, জাতি ধারণায় তার উপাদানগুলোকে আলাদা করা যায় না। আসমুদ্রহিমাচল সকলের সাধারণ ভাষা হল সংস্কৃত। আর সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত আধুনিক ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি প্রায় সকলে বুঝতে পারে এবং বিভিন্ন রাজ্যে এটিই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দু জাতি হিন্দুস্তানে বসবাস করে। এদের উৎস, সংস্কৃতি এক। এক হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই দেশে বিশুদ্ধ, খাঁটি দেশজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষা ছিল। শেষ এক হাজার বছর ধরে মুসলমান ও ব্রিটিশদের সাথে সংস্পর্শে এলেও এই সংস্কৃতি এখনও পৃথিবীর মহত্তম।  


গোলওয়ালকরের হিন্দুস্তানে বিভিন্ন ধরনের ধর্ম, ভাষা বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্থান কোথায়? যে জনগোষ্ঠীগুলি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দুস্তানে বসবাস করে না, যারা ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন আচার নিয়ে হিন্দুস্তানে এসেছে তারা ভারতের জনজীবনে কীভাবে অংশ গ্রহণ করবে? 


যদি ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন আচার নিয়ে কোন জনগোষ্ঠী হিন্দুস্তানে আসে, তাদের সামনে দুটি বিকল্প থাকবে। 


এক, তারা হিন্দু নেশনের অংশীদার হবার জন্য নিজের ভাষা, জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতি ও ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুস্তানের মূল প্রবাহে সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের আলাদা কোন সত্ত্বা থাকবে না। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক জীবনে নয়; ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষায় মাতৃভূমির প্রধানতম জাতির (অর্থাৎ হিন্দু জাতি) মধ্যে তাদের লীন হতে হবে। 

দুই, যদি সেই ভিনদেশি জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের ভিন্ন সত্ত্বা নিয়ে অবস্থান করে তবে তারা দেশে থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় জীবনের অংশীদার হতে পারবে না। 


এম এস গোলওয়ালকর তার কল্পনামাফিক হিন্দুস্তানের ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় প্রথমে আলোচনা করা দরকার কবে থেকে এই দেশে মানুষ বসবাস করছে। সেই মানুষ কারা? যেমন গোলওয়ালকার দাবি করেছেন, সত্যি কি এই দেশে ৮-১০ হাজার বছর আগে থেকে হিন্দুরা বসবাস করেছে? হিন্দু কারা?

কীভাবে ভারতে এতগুলি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এল? কেন আমি বা আপনি দক্ষিণ ভারতের ভাষা বুঝতে পারি না? আন্দামানের ওঙ্গেদের সাথে পঞ্জাবের মানুষের চেহারা তুলনীয় নয়, পরিধান বা খাদ্যেরও কোন সাদৃশ্য নেই, আর তাদের ভাষাও একেবারে ভিন্ন। অথবা একজন নাগা বা মিজোর সাথে দক্ষিণ ভারতীয় তামিলের কীবা সাদৃশ্য? কোন অভিন্নতা আছে এক বাঙালি উচ্চবর্ণের মানুষের সাথে সাঁওতাল পুরুষের? বাঙালি উচ্চবর্ণের খাদ্য কেন উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ খায় না? ভারতবর্ষে এত ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের মানুষ কেন আছে?

কোথায় আমাদের মিল? কোথায় আমাদের অমিল?


ভারতবর্ষে বিভিন্ন পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন:


এম এস গোলওয়ালকর যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব জার্মানির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একমাত্রিক স্বাধীন নেশনের কল্পনা করছেন, সেই একই সময়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস। প্রথমে তারা পুরাবস্তু, দেহাবশেষ ইত্যাদি খুঁজে বার করে, পরীক্ষা করে তার ইতিহাস লিখেছেন। আবার এই শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্সের সাহায্যে আরও সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারা যাচ্ছে কিছু চিরন্তন প্রশ্নের। কোথায় মানুষের সৃষ্টি? কবে ভারতে মানুষ এল?


ভারতবর্ষে প্রথম পরিযান ও তার পরম্পরা:


প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বারবার পরিযান করেছে। জিনবিদ্যার সাহায্যে শরীরের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীর খোঁজ পাওয়া যায়। প্রমাণ করা যায়, মানুষের উদ্ভব আফ্রিকাতে। তারপর আজ থেকে ৭০-৭২ হাজার বছর আগে খাদ্যের অন্বেষণে একদল মানুষ শুষ্ক শীতল পূর্ব-আফ্রিকা ছেড়ে শুরু করে প্রব্রজন। সেই ছোট্ট গোষ্ঠীর সন্ততিরাই আজ আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মানুষের পূর্বজ। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে যত মানুষ আজ এশিয়া, ইউরোপ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে আছে, তাদের সকলের পূর্বজরা ছিল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা সেই গোষ্ঠীতে।


আফ্রিকা থেকে বহির্গত সেই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ করে অন্তত ৬৫ হাজার বছর আগে। ওরা ছিল শিকারী ও সংগ্রাহক। ওরাই আদি ভারতীয়। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর নিকটতম প্রতিনিধি। এমনকি আজকের সমগ্র ভারতের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ মাতৃক্রমের (maternal lineage) দিক দিয়ে সেই আফ্রিকা-আগত মায়ের সরাসরি বংশধর। অর্থাৎ ওই সময়ে যে নারীরা সোজাসুজি এদেশে এসেছিলেন আজকের ভারতের অধিকাংশ নরনারী মাতৃক্রমে সরাসরি তাদের উত্তরসূরি।


পিতৃক্রমের (paternal lineage) হিসেবটা ভিন্ন। সেই যে ৬৫ হাজার বছর বা তার আগে ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ এসেছে তার পরেও এই দেশে আরও কিছু পরিযান হয়েছে। তারা পূর্বোক্ত জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী পরিযানগুলিতে পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে যে জনগোষ্ঠীগুলি ভারতবর্ষে এসেছে তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের জিনগত ছাপ ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে অধিক মাত্রায় রয়ে গেছে। 


ভারতবর্ষে ইরান থেকে দ্বিতীয় পরিযান ও হরপ্পীয় সভ্যতা:


সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষে হরিয়ানার রাখিগর্হিতে হরপ্পীয় মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই সময়কালের আরও কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।  

এই দেহাবশেষগুলির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, আফ্রিকা থেকে প্রথম পরিযানের অনেক পরে, মাত্র ১২ হাজার বছর আগে, পূর্ব ইরানের দিক থেকে ভারত অভিমুখে এক জনগোষ্ঠীর পরিযান শুরু হয়। এদের সাথে আদি আফ্রিকাজাত শিকারি-সংগ্রাহকদের মিশ্রণের ফলে এক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে এদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে তারাই হরপ্পীয় সভ্যতা গড়ে তোলে। 


সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পীয় সভ্যতা এক বিস্ময়। এই সভ্যতা উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। 

আবহাওয়ার পরিবর্তন ও তজ্জনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে আজ থেকে ৩.৯ হাজার বছর আগে হরপ্পীয় সভ্যতা ভেঙে পড়ে। তখন সিন্ধু তীরের সেই মিশ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যের আশায় সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। এরা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে এসে আবার ওখানকার প্রাচীন আফ্রিকা-আগত শিকারী-সংগ্রাহকদের সাথে আরও একবার মিশ্রিত হয়। আর সেই মিশ্র মানুষ সমগ্র ভারতে জাতিগোষ্ঠী গঠনে পরবর্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।


আজও ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষাপরিবার হল দ্রাবিড় ভাষাপরিবার, এতে প্রায় ১৯.৬৪% ভারতীয় কথা বলে। আজ থেকে চার হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষা ছিল না, সেই সময়ের মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ইন্দো-ইউরোপীয় জিনও পাওয়া যায়নি। ইন্দো-ইউরোপীয় জিন কাকে বলে? কবে এই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এল? কী করে বুঝব ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষ থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়নি, বরং বিপরীতে বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছে? এবার সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।


হরপ্পীয় সভ্যতার লিপিগুলির পাঠোদ্ধার করা যায়নি। তবে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য বেদ নিয়ে ভাষাতত্ত্ববিদরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। কারা বেদ লিখেছিল? তারা কবে ভারতবর্ষে এল?


ভারতবর্ষে ইন্দো-ইয়োরোপীয় আগমন:


বেদ রচয়িতা বৈদিক-সংস্কৃতভাষীদের উৎপত্তি ও তাদের সময়কাল জানতে একত্রিতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, শব্দতাত্ত্বিক ও জিনবিদদের চর্চার প্রয়োজন। কারণ উত্তর ভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এক অভিন্নতা অনেকদিন ধরেই ভাষাতত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় সংস্কৃত ভাষা ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষা, যেমন গ্রিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অথচ তুলনামূলকভাবে উত্তরপ্রদেশের অনেক কাছে তামিলনাড়ু অবস্থিত। 


এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে অতীতে এদের মধ্যে কোন এক সংযোগ ছিল। সমগ্র ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে এক আদি ভাষার খোঁজ চলে। শেষ পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্যে এই ভাষাগুলিকে নিয়ে এক ভাষাবৃক্ষ তৈরী করা হয়। তার চূড়ায় যে আদি ভাষা আছে তার নাম দেওয়া হয় ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’। সেই আদি ভাষা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন শাখাপ্রশাখাগুলিকে প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। আজকে অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে পন্টিক-স্তেপ অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক দল পশুপালক ওই ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’ ভাষায় কথা বলত। এদের সাথেই ওই ভাষা ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উপভাষা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকে ও পরবর্তীকালে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে।   


আজকে ভারতবর্ষে প্রায় ৭৮.০৫% ভারতীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে কথা বলে। 

বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে যারা কথা বলে তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশের পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ (যা পুরুষরা পিতার কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পায়) রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপীয় পুরুষের ওই ডিএনএ-র এক বিশেষ উপশাখার অনুরূপ। প্রায় ৪.৭ হাজার বছর আগের সেন্ট্রাল এশিয়াতে সেই বিশেষ উপশাখার প্রাচীনতম রূপটি এক প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আমাদের উত্তর ভারতের কিছু মানুষের মধ্যে যে ডিএনএ-উপশাখা আছে তার সবচাইতে প্রাচীন রূপটি পাওয়া যায় সেন্ট্রাল এশিয়াতে। ভারতবর্ষে নয়।


দ্বিতীয়ত, মধ্য এশিয়ার সেই প্রাচীন দেহাবশেষে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আফ্রিকাজাত শিকারী-সংগ্রাহক বা ইরান থেকে আগত জনগোষ্ঠীর ডিএনএ পাওয়া যায়নি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ওই অঞ্চল পরিযানের ফলে সেন্ট্রাল এশিয়াতে এই ডিএনএ-উপশাখার বিস্তার সম্ভব নয়; বরং এ থেকে এর উল্টোটাই, অর্থাৎ স্তেপভূমির মানুষের এইদেশে প্রবেশ প্রমাণিত হয়।


স্তেপের পশুপালকরা ইউরোপেও গিয়েছিল। চার হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় বৈদিক সংস্কৃতভাষী স্তেপ পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। হরপ্পীয় সভ্যতার মানুষ তখন দেশের দক্ষিণ দিকে চলেছে। যত দক্ষিণে যাচ্ছে তত মিশ্রিত হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় শিকারি-সংগ্রাহকদের সাথে। ইতিমধ্যে,যে হরপ্পীয় মানুষ উত্তর ভারতে থেকে গেছে স্তেপের পশুপালকদের সাথে তারা মিশে যাচ্ছে। এই মিশ্রণের প্রয়োজন হয়েছিল নারীর জন্য। ইন্দো-ইউরোপীয়দের মধ্যে নারী ছিল কম।

 

ভুলে গেলে চলবে না যে, যদিও ক্ষীয়মান তবুও এই দেশে তখনও যে সংস্কৃতি ছিল সেটা উপাদানগত বিচারে বৈদিক আর্যদের থেকে ছিল শ্রেষ্ঠতর। গুণগতভাবে এই শ্রেষ্ঠতর সংস্কৃতি পশুপালক বৈদিক আর্যদের উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার জন্যই বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিকে এক মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। আর প্রাচীন বৈদিক আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে দেশজ প্রাগার্য ধর্মীয় চিন্তা।তবে এই মিশ্রণ সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ছিল না। দেশের অঞ্চল, ভাষা ও বর্ণভেদে মানুষের মধ্যে মিশ্রণের আনুপাতিক পরিমাণ ছিল ভিন্ন। 


সংস্কৃতভাষী জনগোষ্ঠীর ভারতে প্রবেশের আগে অন্তত দুটি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ভিন্ন অঞ্চল থেকে এই দেশে এসেছে। তাদের বংশ পরম্পরা আজও চলেছে। এমনকি স্তেপভূমির সেই হালকা বর্ণের মানুষ এই দেশে এসে নারীর প্রয়োজনে ক্রমাগত মিশ্রিত হয়েছে আগে আসা জনগোষ্ঠীর সাথে। আবার পরে যখন নারীর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তখন ওরা বর্ণপ্রথা দৃঢ়ভাবে প্রচলন করেছে।


পূর্বভারতে কয়েকটি পরিযান:


এতো গেল উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে তিন মূল জনগোষ্ঠীর ভারতবর্ষে প্রবেশও মিশ্রণের ইতিহাস।


এছাড়াও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে কয়েকটি জনগোষ্ঠী পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেছে।


পূর্ব ও মধ্য ভারতে দেখা যায় মুণ্ডা, হো, বিরহোর, সাঁওতাল, খাসি ইত্যাদিদের। এরা কারা? 

এই জনগোষ্ঠীগুলি এক বিশেষ ভাষাপরিবারের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তাকে বলে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাপরিবার। 


মূলতঃ মধ্য, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ১.১ কোটি অস্ট্রো-এশিয়াটিকভাষী মানুষ বাস করেন। আজকে অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পিতৃক্রমের বিচারে ওদের পুরুষরা বহন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ডিএনএ। সম্ভবত লাওস থেকে ৫ হাজার বছর আগে বিভিন্ন দলে ওরা ভারতে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ ওরা ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতে প্রব্রজনের আগেই এই দেশে এসেছে। 


এছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে কিছু আদিবাসীগোষ্ঠী আছে যারা বিভিন্ন তিব্বতী-বর্মী ভাষাতে কথা বলেন। ত্রিপুরার ত্রিপুরী, জামাতিয়া, উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা, মণিপুরি বা মেইতেই, মিজো, বাংলাদেশের চাকমা, মারমা এই শ্রেণীভুক্ত। প্রায় ০.৭% ভারতীয় তিব্বতী-বর্মী ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে খুব সম্প্রতি ,২.৫-১ হাজার বছর আগে,‘প্রাচীন তিব্বতী-বর্মী’ জনগোষ্ঠীএই দেশে আসে। ওরা মূলতঃ দুই বাংলার পূর্ব সীমান্ত ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাস করে। 


এক জাতি, এক ভাষা,এক ধর্ম, এক সংস্কৃতিঃ


হিন্দু জাতি- ভারতবর্ষে কোন একটি রেস্ বা জাতি নেই। একটি জনগোষ্ঠী এই দেশ তৈরি করেনি। অন্তত ৫টি পৃথক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে। এদের উৎস এক নয়। তবে প্রথম তিনটি জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মিশ্রিত হয়েছে। আর তাই ভিলদের মধ্যেও পাওয়া যায় উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণের ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএ। অবশ্য দেশের অঞ্চল, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদে মিশ্রণের তারতম্য আছে। এদের সার্বজনীন কোন রীতি নেই। এরা এক ভাষায় কথা বলেন না।

মুণ্ডারি ও দ্রাবিড়দের আত্মগৌরব তুলনীয় নয়।


আজকে প্রমাণিত প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে যদি কোন তিনটি জিন সর্বব্যাপী হয় সে তিনটি হল আন্দামানের ওঙ্গে জনজাতির জিন (মাতৃক্রমে) এবং হরপ্পীয় ও স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকদের জিন (পিতৃক্রমে)।


হিন্দু ভাষা- সংস্কৃত ও তার থেকে উদ্ভূত ভাষাপরিবারের বাইরে এই দেশের ২২% মানুষ কথা বলেন। তামিল ভারতের প্রথম আইন স্বীকৃত শাস্ত্রীয় ভাষা। কোন অজুহাতেই হিন্দির জন্য তামিলরা তাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দেবে না। এই প্রসঙ্গে বলি, ভারতবর্ষে আছে ২২টি মূল ভাষা। তবে ছোট বড় মিলিয়ে ১৯,৫০০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। এই বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে শেষ ৫ হাজার বছর ধরে।


হিন্দু ধর্ম-হরপ্পীয় মানুষ সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতিপূজারী ছিল। সম্ভবত ওরা শিশ্নপূজা অর্থাৎ লিঙ্গপূজা করত। মৃত্যুর পরে দেহ মাটি চাপা দিত। ওখানে ধর্মীয় উত্সর্গীকরণ যেমন মহিষ-বলি, শোভাযাত্রা, স্বস্তিকা চিহ্নর ছবি পাওয়া গেছে। 

ভারতে আগত ইন্দো-ইউরোপীয়রা মূর্তিপূজক ছিল না। ওরা ঘৃণা করত শিশ্নপূজাকে। অগ্নিসংস্কার ও যজ্ঞে রাখত আস্থা, আস্থা ছিল বেদের মহত্বে। মনে করত মানুষ নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর। 

 

তারপর বহু শতাব্দী ধরে হরপ্পীয় ও বৈদিক সংস্কৃতভাষী মানুষের মিশ্রণ হয়েছে। আর ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্ম আজকের রূপ নিয়েছে। এবার ভাবুন হিন্দুদের প্রধান জীবনচর্যা ও সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান প্রণালীর কথা। হিন্দু ধর্মের বৈবাহিক ও শ্রাদ্ধ ক্রিয়ার মূলে আছে অগ্নিসংস্কার, যজ্ঞ। এছাড়াও বিবাহে আছে আরও অনেক স্ত্রী-আচার যেগুলি মূলতঃ হাজার হাজার বছরের দেশজ প্রথা। মৃতদেহ সৎকার হয় বৈদিক প্রথায়। মূর্তিপূজা, শিশ্নপূজা, ধর্মে বৃক্ষ ও পশুর গুরুত্ব এসেছে হরপ্পীয় সভ্যতা থেকে। তার সঙ্গে স্থানীয় নানা ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর নানা আচার হিন্দুধর্মের নানান স্থানীয় রূপভেদের মধ্যে এসে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচারসমগ্র এক ধর্মের রূপ নেয়। তবু আজও খাদ্যাভ্যাস, বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরির নিয়মবিধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। 


ভারত সরকারের ‘এনথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’-র ‘পিপল অফ ইন্ডিয়া’ প্রজেক্ট দেশের ৪৬৩৫ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করে বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, গোত্র, বংশনাম নিয়ে এক তালিকা প্রস্তুত করে। প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে এই সমস্ত তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। নিরীক্ষণ করা জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বর্তমানে হিন্দু ধর্মে ৩৫৩৯টি আলাদা সম্প্রদায় আছে, মুসলিমদের মধ্যে আছে ৫৮৪টি সম্প্রদায়, খৃস্টানদের মধ্যে ৩৩৯টি, শিখদের মধ্যে ১৩০টি, জৈনদের মধ্যে ১০০টি আর বৌদ্ধদের মধ্যে ৯৩টি সম্প্রদায়। এছাড়াও আছে পার্সি, ইহুদি এবং আরও ৪১১টি ট্রাইবাল সম্প্রদায়। অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মতো আছেই, সেই ধর্মগুলির মধ্যেও আছে আলাদা সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়গুলি তাদের বিভিন্নতা ধরে রাখতে আগ্রহী।


হিন্দু সংস্কৃতি- সংস্কৃতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক থাকে। তবে তার বাইরেও সংস্কৃতির একটা বিরাট পরিসর আছে। খাদ্য, বস্ত্র, আচার এবং অনুষ্ঠান, উৎসব, ঐতিহ্য ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে তৈরি হয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি।


সময়ের সাথে সাথে ভারতবর্ষে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। আবার একই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভ্যাস হয়েছে ভিন্ন। বিগত ১০০ বছর ধরে হরপ্পীয় সভ্যতার বিভিন্ন সাইটগুলিতে পাওয়া গেছে প্রভূত পরিমাণে গবাদি পশু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, পাখি, শূকর ইত্যাদির কঙ্কাল। প্রাচীনকালের মাটির বাসনে অনেক সময়ে লেগে থাকে পশু চর্বিজাত লিপিড। ওরা লিপিড বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, সেই সময়ে হরপ্পীয় জনগোষ্ঠী শূকর, ভেড়া এবং গরু, মহিষের মাংস প্রভূত পরিমাণে খেত।

আবার পরবর্তীকালে স্তেপভূমির আর্যভাষীদের মূল খাদ্য ছিল ফল, দুধ, ক্ষীর এবং আগুনে ঝলসানো গো ও অন্যান্য মাংস। পরবতীকালে এরা প্রাগার্যদের থেকে কৃষিকাজ শেখে। তবে উপনিষদের যুগে খাদ্যাভাব রুখতে গরু ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা আসে। 


মনুর সময়ে বর্ণবিভক্ত সমাজে বর্ণবিশেষে খাদ্যও হয়ে যায় ভিন্ন। মনুর বিধান ছিল ব্রাহ্মণের খাদ্য হবে সাত্ত্বিক। সে খাবে ফল, দুধ, মধু, অন্ন। ক্ষত্রিয়র খাদ্য ছিল রাজসিক- শিকার করা মাংস। ময়ূর বা হরিণের মাংস রাজসিক গুণসম্পন্ন বলে ধরা হত। অধিকাংশ শূদ্র মাংস খেত। তবে দরিদ্র মানুষ কোনকালেই খাদ্যবিচার করে না। সেই বৈদিক যুগেও চণ্ডালরা অনেক সময়ে খেয়েছে কুকুরের মাংস, কারণ একমাত্র এই মাংসই বিনা পয়সায় পাওয়া যেত।

এই খাদ্যবিভাজন দেশের বিভিন্ন অংশে সমান ভাবে বাস্তবায়িত হত না। খাদ্যবিধির মূল কারণ হল আর্থ-সামাজিক। বাংলা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্রভূমি থেকে দূরে অবস্থিত ছিল। তাই বাঙালির খাদ্যবিধান উত্তরপ্রদেশের মনুর বিধান অনুযায়ী পুরোপুরি চলেনি। 


শুধু তো খাদ্য নয়। বাঙালি হিন্দুর বিবাহ অনুষ্ঠান হয় রাতে, দক্ষিণ ভারতে দিনে। উত্তর ভারতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে মামা-ভাগ্নি বা মামাতো, পিসতুতো ভাই-বোনে বিবাহ কাম্য। 


বাৎসরিক মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। বাঙালির দুর্গাপূজা, মারাঠির গণেশ চতুর্থী, উত্তর ভারতের বৈষ্ণবদের গোবর্ধনপূজা। ঐতিহাসিককালে ভারতবর্ষ একই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একত্রিতভাবে দীর্ঘদিন থাকেনি। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক রীতিনীতি, প্রথা, খাদ্যাভ্যাস।

এই বিভিন্নতা আমাদের সংস্কৃতি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।


পরিশিষ্ট:


পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তাই প্রাগিতিহাস বা ইতিহাসের দীর্ঘ সময়কাল ধরে ভারতবর্ষ বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধারণ করেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন মিশ্রিত হয়েছে, তখন অন্যের থেকে কিছু শিখেছে, কিছু নিজেরা উদ্ভাবন করেছে। আবার মানুষের আঞ্চলিক মিউটেশন সাহায্য করেছে প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে, বেঁচে থাকতে, উন্নততর প্রজন্মের জন্ম দিতে। 


গোলওয়ালকর ইতিহাসকে স্বনির্মাণ করেছেন। আজ থেকে ৯০ বছর আগেও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে তাঁর তত্ত্বের ত্রুটি দেখানো সম্ভব ছিল। কিন্তু এদেশের প্রকৃত প্রাগিতিহাস তখনও অনেকটা অজানা ছিল। আজ সেটা বিশদভাবে, নিশ্চিতরূপে জানা গিয়েছে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের কোথাও বিশুদ্ধ জাতি বা ‘রেস’ নেই। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণের দেহেও আছে আফ্রিকান শিকারী-সংগ্রাহক আর প্রাচীন ইরানীয় শিকারী-সংগ্রাহকের জিন। আছে ইন্দো-ইউরোপীয় রক্ত। একমাত্র আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে বা অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা হল খাঁটি অবিমিশ্র জনগোষ্ঠী। আদি অধিবাসীরা এখনও শিকারী ও সংগ্রাহকের জীবন যাপন করে।


সভ্যতার বীজ রয়েছে জনগোষ্ঠীর মেলামেশায়, জ্ঞানের আদান প্রদানে। ভারতবর্ষ এর ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তারা এই দেশকে নিজভূমি করে নিয়েছে। আমার আপনার পূর্বজ পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই আসুক আজ আমরা সবাই ভারতবাসী।


প্রধান কয়েকটি তথ্যসূত্র:

১) M. S. Golwalkar, “We or Our Nationhood Defined”, Bharat Publications, Nagpur, 1939

২) Stephen Oppenheimer, “Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: tracing uniparental gene trees across the map,” Phil. Trans. R. Soc, B367770–784, (2012) 

৩) V. M. Narasimhan et al., “The formation of human populations in South and Central Asia,” Science, 365(6457), (2019)

৪) Priya Moorjani et al., “Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India,” Am Journal of Human Genetics, 93(3), (2013)

৫) Iain Mathieson et al., “Genome-wide patterns of selection in 230 ancient Eurasians,” Nature, 528, (2015): 499–503

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929