ধর্মীয় মৌলবাদ আসলে কতটা ধর্মীয়?
শ্রীকুমার মন্ডল
Nov. 21, 2024 | | views :285 | like:2 | share: 2 | comments :0
না মানে আমরা যদি ইতিহাস দেখি তাহলে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী যেই সময় বেড়ে উঠছে ঠিক তার কাছাকাছি প্রায় একই সময়ে হিন্দু মৌলবাদ বা হিন্দুত্ববাদ বড় হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে। খ্রিস্টান মৌলবাদ আবার সেদিকে আমেরিকায় তৈরি হয়ে গেছে আগেই। আর ধর্ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু মৌলবাদের কনসেপ্টগুলো একই, “আমাদের ধর্ম বিপদে পড়েছে আর তাই আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের ধর্ম রক্ষা করতে হবে।” তাহলে কি ধর্মীয় মৌলবাদ কি সত্যি ধর্মীয় না কি মৌলবাদের পেছনে অন্য কোনো মৌলিক কারন আছে যা সমস্ত ধর্মকে ব্যবহার করে মৌলবাদের মাধ্যমে নিজের কার্য সিদ্ধি করছে?
মৌলবাদ সাধারণত ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ বা religious revivalism এর কারনে ঘটে থাকে, যেটা বিজ্ঞান বিরুদ্ধ। অর্থাৎ যখন সমাজ থেকে প্রিডোমিনেন্ট ধর্মীয় প্রভাব ও বিশ্বাস ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করে হয় আধুনিকতা বা নতুন ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণে বা অন্য কোনো কারণে, তখন
ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মীয় ঠিকাদার, ধর্ম রাজারা আবার সেই পুরোনো ধর্মকে ফিরিয়ে আনতে সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে আশা প্রগতিশীলতার পথে বাধা দিতে চায়।
ভারতীয় সংস্কৃতির ঠিকাদার, আমেরিকান সংস্কৃতির ঠিকাদার, আরব সংস্কৃতির ঠিকাদার টাইপের যেকোনো সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলরাই আসল মৌলবাদী। অর্থাৎ কেউ যদি বলে যে এটা আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি, তাই আমাদের পালন করে চলা উচিত, তাহলে চোখ বন্ধ করে বুঝে নিতে হবে সে মৌলবাদী। তাহলে ধর্মীয় মৌলবাদ এখন জাতীয়তাবাদী মৌলবাদের রূপ নিয়েছে। আমরা আবার দেখলাম যে মৌলবাদ আলাদা ধর্মের মধ্যেও হয়, আবার এমনকি জাতীয়তাবাদী মৌলবাদও হয়। এখন সমধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করার বহু প্রচেষ্টা হয়েছে, যেখানে মেজরিটি ধর্ম বিশ্বাসীরা মাইনরিটি ধর্মীয় বিশ্বাসীদের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মতো অত্যাচার করে তাই জাতীয়তাবাদী মৌলবাদ পুরোটাই ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে জড়িত যদি না সেই জাতি বা রাষ্ট্র পুরোপুরি স্যাকুলার রাষ্ট্র হয়। এই যেমন ভারতীয় সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি ছাড়া আসলে কিছু না। যদিও ভারতে মুসলিমের সংখ্যা কম নয়, তবুও মুসলিম দের সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলেনা। মুসলিম দের সংস্কৃতি কে আরবীয় সংস্কৃতি বলে, তা সে হোক না ভারতীয় মুসলিম। ঠিক একই ভাবে আমেরিকায় চলে খ্রিশ্চিয়ান মেজরিটি সংস্কৃতি।
অর্থাৎ পরিষ্কার ভাষায় মেজরিটি যার ক্ষমতা তার, সংস্কৃতি তার, মৌলবাদও তার। তাহলে মৌলবাদ কি ধর্মের ওপর নির্ভর করছে না কি ক্ষমতার ওপর?
তাহলে আমরা আমেরিকায় যেখানে মৌলবাদের জন্ম তার ইতিহাসটা একবার যদি দেখি তাহলে আমরা দেখবো ঊনবিংশ শতকে যখন বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আমেরিকা যাচ্ছে, তখন সেখানকার কনজারভেটিভ খ্রিশ্চিয়ান ইউরোপিয়ান আমেরিকানরা (যারা নিজেরাই অবৈধ বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী) দেখলো যে বিভিন্ন কালচারের মিশ্রনের ফলে খ্রিস্টান মেজরিটি কালচার বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে তারা খ্রিস্টান ধর্মের 5টি অবশ্য করণীয় ডক্ট্রাইন (Doctrine) ওপর একটি লেখা প্রকাশিত করে, যার নাম দেয় "fundamentals"। আর এইখান থেকেই জন্ম হয় fundamentalism বা মৌলবাদের।
এই ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম যে খ্রিস্টান চার্চ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্যই এত কলাকুশলী করেছিল। যদিও তাদের ফুটসোলজাররা মনে করতো যে তারা এইসব পসলন করে আর জোর করে অন্যদের পালন করিয়ে নিজেদের ধর্ম রক্ষা করছে। কিন্তু আসলে তারা কনজারভেটিভদের ক্ষমতা আর পজিশানকে রক্ষা করছে। যদিও এর বিনিময়ে ফুট সোলজাররা কিছুই পায়না, দিনের শেষে রক্ত ঝরিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। কিন্তু তবুও ওরা নিজেদের শোষকদের হয়েই কাজ করে। তাহলে মৌলবাদ যতটা না ধর্মীয় তার থেকে অনেক বেশি সমাজের প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ দের ক্ষমতা ও নিজেদের আগের অবস্থানে টিকে রাখার প্রতিক্রিয়াশীল দ্বন্দ্ব। অবশ্য সমাজে ধর্ম আর ধর্মান্ধতা না থাকলে এই প্রতিক্রিয়াশীল বাধা সৃষ্টি করা সহজ হতো না। ফুট সোলজার জোগাড় করা মুশকিল হতো, অর্থাৎ ধর্ম মৌলবাদের জন্য সবথেকে বড় সহায়ক হলেও মৌলবাদের কারন নয়, মৌলবাদের কারন হলো ক্ষমতায় টিকে থাকার স্ট্রাটেজিক যুদ্ধ। হিন্দু মৌলবাদ ও একই কারণে উঠে এসেছিল আমেরিকার পরে পরেই। যখন ভারতীয়রা (বিশেষ করে so called লোয়ার কাস্ট হিন্দুরা) হিন্দু ধর্মীয় গোঁড়া আর বার্নবাদী সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি চরম নারকীয় ভয়াবহতা থেকে রাম মোহন, বিদ্যাসাগরেরা যখন মানুষকে নবজাগরণের দিকে মুখ ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে ঠিক সেই সময়ে
বিবেকানন্দ/সভারকর দের মতো কনজারভেটিভ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় বাবারা হিন্দু মৌলবাদের মাটি তৈরি করতে শুরু করে, যেগুলোকে আজ আমরা RSS, হিন্দু মহাসভা, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দুপরিষদ ইত্যাদি রূপে দেখতে পাই।
হ্যাঁ এদের গোড়া পত্তন করেছে বিবেকানন্দ, সভারকররা। কিন্তু এরা একা একা কিছু করেনি। এরা করেছে আমেরিকার শিকাগোর আয়োজন করা ধর্মীয় সভায় নিজেদের মার্কেটিং এর মাধ্যমে, হ্যাঁ সেই থেকে শুরু। কি অদ্ভুত সমাপতন, এদিকে আমেরিকা নিজেদের খ্রিশ্চিয়ান মৌলবাদ গড়ে নিয়েছে, সেদিকে ব্রিটিশ কলোনি ভারতে খ্রিশ্চিয়ান দের প্রাদুর্ভাব কম দেখে হিন্দু ধর্মকেই ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী কান্ডকারখানা চালানোর জন্য। এদিকে সভারকর আবার এডলফ হিটলারের ফ্যানবয় ছিল। ন্যাৎসিজম এর ভারতীয় সংস্করণ হিন্দুত্ববাদ এর স্রষ্টা ছিল স্বয়ং সভারকর, যা ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি চালাতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এবং ইংরেজ দের উত্তর সুরি কংগ্রেস আর BJP আজপর্যন্ত তাই করে যাচ্ছে। আবার 1400 বছর আগে ইসলামের জন্ম হলেও মুসলিম জঙ্গী গোষ্ঠী গুলোর আবির্ভাবও আমরা দেখেছি এই ঊনবিংশ শতকে কোল্ড ওয়ারের সময়ে। যখন ওই মুসলিম কান্ট্রি গুলো আমেরিকা আর USSR এর ওয়ার বেস হয়ে উঠেছিল, হ্যাঁ এখানেও আমেরিকা। তাহলে আমরা দেখলাম মৌলবাদ আসলে যতটা না ধর্মীয়, তার থেকে অনেক বেশি সমাজের স্বাভাবিক প্রগতিশীলতাকে বাধা দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য একটা প্রতিক্রিয়াশীল অপচেষ্টা। এখন এই অপচেষ্টার নাম হলো ফ্যাসিবাদ, কারন ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় কনজারভেটিভ ক্যাপিট্যালিস্ট সাম্রাজ্যবাদীরা। আর পুঁজিবাদ নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে যা যা করে, তাকে বলে ফ্যাসিবাদ।
এবার দেখবো এই মৌলবাদ কখন জঙ্গিবাদ বা টেরোরিজম হয় আর কখন হয়না। হ্যাঁ মৌলবাদ আর টেরোরিজম এর মধ্যে পার্থক্য আছে। মৌলবাদীরা যতক্ষন ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার হয়ে লড়বে ততদিন তাকে জঙ্গি বা টেরোরিস্ট বলা হয় না (সাবঅল্টারন ভাবে যাকে বলে দেশদ্রোহী)। কিন্তু পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদের তৈরি সেই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরাই যদি কোনো ভাবে তাদের সৃষ্টিকর্তার (ক্ষমতার) বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়, তখন তাকে জঙ্গী বা টেরোরিস্ট বা দেশদ্রোহী বলা যাবে। আরেক ভাবে বললে এটাও বলা যেতে পারে যে সংখ্যা গুরুর মৌলবাদ হলো ভালো মৌলবাদ কিন্তু সংখ্যা লঘুর মৌলবাদ হলো জঙ্গীবাদ/টেররিজম/দেশদ্রোহীতা। আরেক ভাবে বললে এ ও বলাযায় যে ফ্যাসিবাদি মৌল বাদীরা ভালো মৌলবাদী কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিরোধী মৌলবাদীরা জঙ্গী/টেরোরিস্ট/দেশদ্রোহী।
এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো, জয় শ্রী রাম বলে খুন করলে তাকে জঙ্গি বলা হবে না কিন্তু আল্লাহু আকবর বলে খুন করলেই তাকে বলা হবে জঙ্গি। কারন জয় শ্রীরাম বলে খুন করা হলো এই দেশে সংখ্যাগুরু মৌলবাদ, এবং এই দেশের পুঁজিবাদী ফ্যাসিস্ট দের স্লোগান ও হলো জয় শ্রীরাম। কিন্তু আল্লা হু আকবরের ক্ষেত্রে তা নয়, সেটা কোনো না কোনোভাবে জেনে হোক বা তাদেরই অজান্তে সংখ্যা গরিষ্ঠ ও ফ্যাসিবাদের সরাসরি পক্ষে নয়। যদিও পরোক্ষ ভাবে ফ্যাসিবাদ এদের ও ব্যবহার করে। এদের কাগুজে বাঘ বানিয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ মৌলবাদী রিএক্সনিস্ট দের ভয় দেখিয়ে ভেড়ার পাল কে নিজের খোঁয়াড়ে ঢোকানোর জন্য।
ঠিক একই ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ যখন সংখ্যা লঘুদের খুন করে মাটিতে পুঁতে তার ওপর ফুলকফি চাষ করে সেটাকে জঙ্গিবাদ বা টেররিজম বলে না।
কিন্তু এই কাজ যখন সংখ্যা লঘু বা ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বিরোধীরা (পরোক্ষ ভাবে যদিও ক্ষমতারই লাভ হয়) করে তখন সেটা জঙ্গিবাদ হয়ে যায়। ঠিক একই ভাবে ডাব খাওয়ার নাম করে সংখ্যা গরিষ্ঠ ক্ষমতার দালালরা যখন ঘরে ঘরে অস্ত্র জমানোর আহ্বান দেয় তখন সেটা আর জঙ্গীবাদ থাকে না। কিন্তু সংখ্যালঘুরা করলেই সেটা হয়ে যায় জঙ্গীবাদ। এর আরো ভালো উদাহরণ হলো তালিবান, আলকায়েদা নামক জঙ্গী গোষ্ঠী গুলো যতদিন আমেরিকা ও পুঁজিবাদের হয়ে লড়েছিল তখন এরা জঙ্গী গোষ্ঠী নামে পরিচিত হয়নি। যেই এরা আমেরিকার বিরুদ্ধে গেল, তবে থেকেই এরা জঙ্গী নামে খ্যাত হলো। আর খ্রিস্টান মৌলবাদীরা কোনোদিন ক্ষমতার বিরুদ্ধে যায়নি, বরং এরা সবসময় ক্ষমতার পক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাই খ্রিস্টান মৌলবাদীরা আজও ‘জঙ্গী’ উপাধি পায়নি।
আমি জঙ্গীবাদ কে জাস্টিফাই করছি না। বরং আমি বলতে চাইছি যে জঙ্গীর জন্ম একসময় সাম্রাজ্যবাদী ক্যাপিট্যালিস্ট ফ্যাসিস্টদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল, কিন্তু আজ ওরা কোনো ভাবে নিজেদের অজান্তেই প্রত্যক্ষ বিরোধী হয়ে উঠেছে, যদিও পরোক্ষ ভাবে ওরা ওই ফ্যাসিবাদের আগুনেই তেল দিয়ে চলেছে। আমি শুধু বলছি যে মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের জন্ম দেয় ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। অবশ্য ধর্ম এর জন্য খুব ভালো মিডিয়াম। ধর্ম না থাকলে ফ্যাসিস্ট দের কাছে এই ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ব্যবহার করা সহজ হতোনা। কিন্তু মৌলবাদের বড় কারন ধর্ম নয়, এর বড় কারণ হল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ বা আরেক ভাষায় কনজারভেটিভ ক্ষমতাশালীরা।