গল্প নয় সত্যি

সুমন কর্মকার


Nov. 20, 2024 | | views :101 | like:0 | share: 0 | comments :0

আজ একটা ঘটনা শুনলাম। সাদামাটা হলেও 'রসালো' বটে। ভাবলাম আপনাদেরও শোনাই। এই বাদলা রাতে জমবে ভালো। 

আমাদের জেলারই আশেপাশের এক গ্রামের ঘটনা। একটা বৌ ছিল। একদম সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ। বরটা কোনো এক সরকারি দফতরে  চুক্তিভিত্তিক ঠিকে কেরানীগিরির কাজ করতো। শ্বশুর শাশুড়ি বিয়ের কয়েক বছর আগেই গত হয়েছিলেন। তাই স্বামী স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে তিনজনের ছোট্ট সংসার। তো একদিন হল কি, বলা নেই, কওয়া নেই  শ্বশুর বাড়ি থেকে সপরিবারে ফেরার পথে বৌ আর আঠেরো বছরের ছেলেকে ফেলে রেখে বরটা হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। হঠাৎ মানে হঠাৎই। হাসপাতাল অবধি নিয়ে যেতেও হলো না। জ্বর জ্বালা নেই, কষ্ট পাওয়া নেই, একদম শান্তির মরণ। 

তো বরটা শান্তিতে পটল তুললেও বৌ আর ছেলেটা কিন্তু খুব একটা শান্তিতে থাকতে পারল না। কন্ট্র‍্যাকচুয়েল কাজের বেতন তো আপনারা জানেনই। রোজকার সংসার খরচ আর ছেলের পড়াশুনো চালাতেই বেশিরভাগটা বেরিয়ে যেতো। যেটুকু জমানো ছিল তাতে মাস খানেকের বেশি চালানো সম্ভব ছিলনা। তাই অন্যকোনো উপায় না দেখে বিধবা বৌটা ছেলেকে নিয়ে চলল মৃত স্বামীর অফিসে। অফিসে ঢোকামাত্রই সহানুভূতির বন্যা বয়ে গেল। 'আপনার হাজব্যান্ড দারুণ কাজের মানুষ ছিলেন', 'অমুক দাকে আমরা কক্ষণো ভুলতে পারব না' এসব আর কি। কিন্তু যেই না বৌটা বলল মৃত স্বামীর জায়গায় ছেলেকে যদি কোনোভাবে কাজে রাখা যায়, সবার ভীষণ তাড়া পড়ে গেল। 'আজ না আমার টেবিলে অনেকগুলো ফাইল পড়ে গেছে। কাজের ভীষণ চাপ। আপনি বরং অমুক বাবুর কাছে যান। উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন' বলে বাবুরা একে একে নিজেদের গা বাঁচিয়ে সটকে পড়তে লাগলেন। আপনারা আবার বাবুদের জাজ করবেন না যেন। আজকের বাজারে কেই বা এসব উটকো ঝামেলা যেচে মাথায় নিতে চায় বলুন তো? আপনি নিজেই নিতেন কি? যাই হোক, অমুকবাবু তমুকবাবু্র টেবিল ঘুরে বৌটা শেষ অবধি পৌঁছালো বড়বাবুর কেবিনে। দেখা গেলো বড়বাবু মানুষটা কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের। পরিচয় পাওয়া মাত্র প্রাক্তন সহকর্মীর স্ত্রীকে যথোচিত খাতির করে বসালেন এবং সব শুনে একটা তারিখ দিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতে বললেন। উনি আগে থেকেই অফিসারকে সবটা বলে রাখবেন। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। বৌটা একরাশ আশা নিয়ে দেবতুল্য মানুষটার মঙ্গল কামনা করতে করতে উজ্জ্বল মুখে বাড়ি ফিরে এলো। নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে নিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতেও গেল। বড়বাবু সত্যিই এক কথার মানুষ। অফিসার দেখামাত্র সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। ছেলের কাজ হয়ে গেল। মা খুশি, ছেলেও খুশি। কিন্তু বৌটার কপালে সুখ মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার নয়। একদিন বিকেলবেলা, ছেলে তখনও অফিস থেকে ফেরেনি, 'দেবতুল্য' বড়বাবুর পেয়ারের আর্দালি এসে পান চিবোতে চিবোতে বৌটাকে বলল, 'বড়বাবু আজ সন্ধ্যের দিকে আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। ওই সাতটা নাগাদ গেলেই হবে।' ব্যপারটা প্রথমে বোধগম্য না হলেও আর্দালি যখন বেরোতে বেরোতে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হেসে বলল, 'বৌদি বাপেরবাড়ি গেছেন তো তাই আর কি...' বৌটার বুঝতে কিছুই বাকি রইলো না। হতবাক হয়ে আর্দালির চলে যাওয়া দেখতে কখন যে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল বুঝতেই পারল না। যথাসময়ে ছেলে ফিরে এলো। ছেলেকে খেতে দিতে দিতে বৌ টা বলল, 'বাবু, তুই বরং একটা অন্য কাজ দ্যাখ। এটা বোধহয় আর থাকবে না।' মায়ের কথা শুনে ছেলে যতোটা না আশ্চর্য হল, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হল যখন দেখল পরেরদিনই মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়ে একটা সামান্য ভুলের জন্য বড়বাবু দারুণ অপমান করে সত্যিই অফিস থেকে তাড়িয়ে দিলেন।' 

কাজ্টা চলে যাওয়ার পর মা-ব্যাটা পড়ল অকুল পাথারে। ঘোর বর্ষাকাল। বাড়ির টালি ফেটে ঝরঝর করে জল পড়ছে।  থালা বাটিগুলো পাতার সাথে সাথে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। ছেলের এই মাসের বেতন  ঢুকলে মিস্ত্রী লাগানোর কথা। মিস্ত্রীকে বলাও আছে সেরকম। কিন্তু সব কেমন ভেস্তে গেল। বর্ষাটাও আগেভাগে চলে এলো, চাকরিটাও আর রইলো না। যাই হোক, সারা রাত ধরে জল বাঁচিয়ে বিছানা পত্তর এদিক ওদিক করে সকাল হতেই ত্রিপল যোগাড় করতে পঞ্চায়েত অফিস ছুটলো বৌটা। প্রধান নেই। অফিসে ঢুকে ত্রিপলের কথা বলামাত্র উপপ্রধান জানালেন 'ত্রিপল শেষ। পরের লট আসলে খোঁজ নিয়ে যাবে।' পরের লট কবে আসবে জিজ্ঞেস করাতে ব্যস্ত উপপ্রধান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে জানালেন তার জানা নেই। অফিস থেকে বেরোতেই প্রধানের এক চ্যালা 'ও বৌদি ও বৌদি' বলে দাঁড় করিয়ে বৌটাকে আগাপাশতলা মেপে নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল, 'আরে, যাচ্ছেন কোথায়? আপনাদের বাড়ি তো আমি দেখেছি। আজ রাতে বৃষ্টি এলে একদম ভেসে যাবেন। ত্রিপল তো লাগবেই।' তারপর গলাটা অল্প নামিয়ে বলল, 'আসলে জানেনই তো আমাদের উপপ্রধানের এখনও বিয়ে হয়নি। ঘর সংসার নেই। রক্ত গরম। তাই মাঝে মাঝে মেজাজটা একটু খিঁচড়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন একেবারে মাটির মানুষ।' চ্যালার লোলুপ চাওনিই বলে দিচ্ছিল আলোচনাটা আস্তে আস্তে কোন দিকে যাচ্ছে। এরপর ছেলেটা যখন ভুরু নাচিয়ে সরাসরি বলল, 'শুধু ত্রিপল কেন? দাদাকে খুশি করে দিতে পারলে আরও অনেককিছুই পাবেন’ তখন ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। নিজের ছেলের বয়সী একজনের কাছে এহেন 'দারুণ' প্রস্তাব পেয়ে বৌটার চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠলো। উদভ্রান্তের মতো অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ছেলেটা তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে 'ও বৌদি রাগ করলেন নাকি? শরীর তো আর বয়স মানেনা বুঝলেন কিনা'। বৌটা বাড়ির পথ ধরলো।

গল্প হলে এটা এখানেই শেষ হয়ে যেতো। আপনারাও পটাপট হাততালি দিতেন। বলতেন এই তো চাই। একটা সৎ মানুষের আপোষহীন লড়াইয়ের গল্প। দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমি নিরুপায়। এটা তো গল্প নয়, ঘটনা। তাই শেষটা এভাবে হলো না। আজকের মতোই কোনো এক বৃষ্টিভেজা রাতে পাড়ার মাতব্বররা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে গ্রামের উপপ্রধানের বাড়ি থেকে আলুথালু বেশে বৌটাকে বেরিয়ে আসতে দেখলেন। তাদের বিশেষ কিছু বলার ছিল না। কারণ পঞ্চায়েত অফিস থেকে বেরিয়ে বৌটা যখন উপপ্রধানের 'ইন্টারেস্টিং' প্রস্তাবের কথা এনাদের জানিয়েছিল, এনারা ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'কি জানি বাপু! গ্রামে তো তুমিই একা মেয়েমানুষ নও। তোমার চাইতে ঢের বেশি দেখতে শুনতে ভালো আরও অনেকেই আছে। কই তাদের তো কখনও এমন বলতে শুনিনি। দেখে দেখে তোমাকেই তার মনে ধরল?' 

আজ বৌটার বাড়ির পাকা ছাদ। ছেলেটাও শুনলাম পঞ্চায়েতেই কি একটা কাজ করছে। দুহাতে কামাচ্ছে। আজ আর ওদের কোনো অসুবিধে নেই। কে বলে মন দিয়ে পূজো করলে 'ভগবান' সন্তুষ্ট হন না? শুধু সঠিক মন্ত্রটা জেনে নিতে হবে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929