মুফতি সাহেবের সাথে যুক্তি-তর্ক
আব্দুল হালিম বিশ্বাস
Nov. 20, 2024 | | views :766 | like:0 | share: 0 | comments :0
গত রবিবার একটি পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম। সেমিনার শেষে দেখলাম ঐ মঞ্চে একজন নববধূ ও একজন সাংবাদিক অতি সহজে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করলেন। অতি সহজে কথাটি এই কারণে ব্যবহার করলাম, যে সমাজে আমি বড়ো হয়েছি সেখানে মরণোত্তর দেহদান শুধু কঠিনই নয় প্রায় অসম্ভব।
মরণোত্তর দেহদানের উপকারিতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি মনের মধ্যে অনুরণন হচ্ছিল। পরদিন সকালেই একজন মুফতি সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তিনি স্থানীয় একটি খারিজি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকও।
আমি: মুফতি সাহেব, ইসলামে মরণোত্তর দেহদান প্রসঙ্গে বক্তব্য কি?
মুফতি সাহেব: না, একদম জায়েজ নয়।
আমি: কেন নয়, ধরুন আমি মৃত্যুর পর চক্ষু দান করব। তাতে তো একজনের অন্ধত্ব দূর হতে পারে।
মুফতি সাহেব: দান করুন। জীবিত অবস্থায় করুন। কোনো বাধা নাই। অনেকেই তো কিডনি দান করে।
আমি: জীবিত অবস্থায় আমি দুচক্ষু ব্যবহার করলাম। মৃত্যুর পরে কর্ণিয়া দান করলাম। তাতে তো আমার ক্ষতি নাই, বরং অপর একজনের উপকার আছে।
মুফতি সাহেব: এত ইচ্ছে হলে এখনই করুন। মৃত্যুর পরে অনুমতি নাই।
আমি: কিন্তু কারণটা কি? কেন দিতে পারব না?
মুফতি সাহেব: মৃত্যুর পর লাশের কাটাছেঁড়া করলে লাশের অসম্মান হয়। কাটাছেঁড়া করা যাবে না।
আমি: আমার তো মনে হয় তাতে লাশের সম্মান বাড়ে। জীবিত অবস্থায় যা পারলাম করলাম। মৃত্যুর পরে অন্তত একজনের জীবনে উপকার করতে পারলাম।
মুফতি সাহেব: এটা বোঝার ভুল। ইহকালের থেকে পরকালই দীর্ঘস্থায়ী না?
বস্তুতঃ মুসলিম সমাজ তথা ইসলামিক বিশ্বের এটাই গোড়ার কথা। অর্থাৎ মৌলবী মৌলানা সাহেবদের ভাষায় ইহকাল হলো "দুদিনের দুনিয়াদারি"। একজন একনিষ্ঠ মুসলমানের ভাবনা চিন্তা কর্ম শ্রম সবই পরকালের জন্য। আরও ঠিক ঠিক বলতে গেলে জান্নাত হুর গেলেমান প্রভৃতির জন্য। সেখানে এই পৃথিবীর সুখ শান্তি আনন্দ বেদনা সবই তুচ্ছ। আর তাই, পৃথিবীতে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রযুক্তি উদ্ভাবনা প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়েছে।
আমি: তাছাড়া, মুফতি সাহেব, মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ছাড়াও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যানাটমি বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের অধ্যায়ন ও হাতে কলমে শিক্ষার জন্য মৃত দেহ প্রয়োজন। তার জন্য আমাদের মরণোত্তর দেহদান করা উচিত।
মুফতি সাহেব: জীবিত অবস্থায় মানুষের হাড়গোড় ভাঙাচোরা করলে যেমন কষ্ট পায়, কাটাছেঁড়া করলে লাশও কষ্ট পায়। ওটা করা যাবে না।
আমি: তাহলে দেশে ইসলামিক বিধান চালু হলে কোনো ছাত্রছাত্রী হাতেনাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবে না। বড়ো মানের সার্জেন দেশে তৈরি হবে না। এইভাবে ইসলামিক বিধিনিষেধের কারণেই কি ইসলামিক দেশগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে পিছিয়ে যাবে না?
মুফতি সাহেব: কি হবে তাতে? সবচেয়ে বড় সার্জেন তো আল্লা স্বয়ং। ইসলামের দলিল তো পাল্টানো যায় না।
মরণোত্তর দেহদানে ইসলামিক প্রতিবন্ধকতার প্রতিফলন আরব ভুখন্ডে লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবের প্রায় সকল হাসপাতালে নামী ডাক্তার বা সার্জেন বলতেই ভারতীয় অথবা ইউরোপীয়। আরব সন্তানদের বড়ো একটা দেখা যায় না। কয়েকজন ডাক্তারের যে নাম পাওয়া যায় প্রত্যেকেই ইউরোপ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত।
তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশরের মতো মুসলমান প্রধান দেশগুলো মরণোত্তর দেহদানকে উৎসাহিত করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানও প্রভূত উন্নত। এবং উন্নতির জয়যাত্রায় ধর্মের বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
কয়েক বছর আগে দিল্লির একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরণোত্তর দেহদানের প্রচার চালালে অঙ্গীকারবদ্ধদের তালিকায় দেখা যায় একশো শতাংশ দাতাই অমুসলিম। এবং অতি আশ্চর্যের, ঐ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপর একটি রিপোর্টে দেখা যায়, পূর্বে প্রতিস্থাপিত অঙ্গ গ্রহীতার পঁয়তাল্লিশ শতাংশই মুসলিম।
অর্থাৎ লাশের অঙ্গ, জীবনের জন্য গ্রহণ করা যায়। কিন্তু ধর্মের বিধিনিষেধে দান করা যায় না। এই স্বার্থপরতা বড়ো একমুখী, দৃষ্টিকটু। ভারতবর্ষের মতো বহুধর্মের দেশে বড্ড বেমানান। দান সকল সমাজেই শ্রেষ্ঠ, সে দেহ হোক বা ধনসম্পদ হোক। আমাদের মনের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করতে হবে। তাতে ধর্মের বেড়া ভেঙে গেলে যাক।