রামমোহন ও বিদ্যাসাগর : প্রাণদাতা ও জীবনদাতা

হুমায়ুন আজাদ


Nov. 18, 2024 | | views :477 | like:0 | share: 0 | comments :0

"রামমোহন তাঁর ‘সম্বাদ’ লিখেছেন নৈর্ব্যক্তিক রীতিতে; কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে তার সকাতর আবেগ। তাঁর প্রস্তাবগুলো অভিসন্দর্ভ হিসেবে অসামান্য, কিন্তু তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কেঁপেছেন আবেগে। তিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে, ওই পিতৃতন্ত্র তাঁর সাথে যে-নিষ্ঠুরতা করেছে, তা তিনি ভোলেন নি। তিনি নারীকে শুধু নিশ্বাসের অধিকার নয়, দিতে চেয়েছেন জীবনের অধিকার, তাই তাঁর লড়াই ছিলো আরো রক্তাক্ত। সহমরণ নৃশংস বলে তার নিবারণও সহজ, সহজেই মানুষ ও জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে নারীকে পোড়ানো নৃশংসতা। কিন্তু যাদের সংবেদনশীলতা আদিম, তাদের বোঝানো অত্যন্ত কঠিন যে ব্ৰহ্মচর্য পালন করে বেঁচে থাকা চিতায় ছাই হওয়ার থেকেও মর্মান্তিক। নারীর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা চাওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিলো না, তিনি তা চান নি; চেয়েছেন জীবনযাপনের অধিকার। তিনি নারীর দেহকে মূল্য দিয়ে, নারীর দেহকে স্বীকার ক’রে হয়ে উঠেছেন একজন আমূল নারীবাদী; এবং ঊনিশ শতকের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। একটি আদিম পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি একজন আধুনিক মানুষ দাঁড়ালে তাঁকে যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তার সবখানিই ভোগ করেছেন বিদ্যাসাগর; তাঁর বুকে ক্ষোভও জেগেছে অশেষ। হিন্দু পিতৃতন্ত্র তাঁকে সহ্য করে নি; অমূল্যচরণ বসু জানিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাঁহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভুক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে। কলিকাতার কোন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুৰ্বত্তেরা প্রভুর আজ্ঞা পালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদগণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ-প্ৰহারের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন’ (বিনয় /১৯৭৩,- ২৬৮)। এ হচ্ছে বিপন্ন পিতৃতন্ত্রের ইতির আচরণ। প্রিয় বালিকা প্রভাবতীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (প্ৰভাবতী সম্ভাষণ, ৪১৯) :

‘তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয়া, আমার বোধে অতি সুবোধের কার্য করিয়াছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয় ত, অদৃষ্টদ্বৈগুণ্যবশতঃ অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জীবনযাত্রা সমাধান করিতে পারিতে না।‘

বেঁচে থাকার চেয়ে ভারতে নারীর ম’রে যাওয়াও তার কাছে মনে হয়েছে ‘সুবোধের কাৰ্য’; বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব-এ (১৮৫৫খ, ৮৩৯) বলেছেন, ভারতবর্ষে যেনো ‘হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’, আর্তনাদ করেছেন, ‘হা অবলা গণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর।’ এ-ক্ষুব্ধ বিলাপ থেকেই বোঝা যায়। এ-মহৎ আমূল নারীবাদীকে কতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিলো নির্বোধ হিন্দু পিতৃতন্ত্র।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর সহমরণ নিবারণে, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণে বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের চেষ্টা করেন : শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে বাতিল ক’রে প্রবর্তন করেন নববিধান। তাঁরা কি বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে ? রামমোহন হয়তো কিছুটা করতেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ওই শাস্ত্রে বিশ্বাস ছিলো না বিন্দুমাত্র; কিন্তু তাঁরা জানতেন মধ্যযুগীয় এ-অঞ্চলে এটাই উপায়। যুক্তি এখানে মূল্যহীন, মূল্যবান এখানে পুরোনো শ্লোক। বিদ্যাসাগর ( ১৮৫৫ক, ৬৯৫-৬৯৬) বলেছেন, ‘যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এদেশে শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে।’ তাই তাঁরা দুজনেই ঘেঁটেছেন শাস্ত্র, শাস্ত্র থেকে নিয়েছেন সেইসব অংশ, যা তাঁদের পক্ষে। তাঁরা শাস্ত্রকে প্রমাণ হিসেবে নিয়েছেন এজন্যে নয় যে তাঁরা ওই শাস্ত্রের সাথে একমত, তাঁরা ওই শাস্ত্র নিয়েছেন কেননা ওই শাস্ত্র তাঁদের সাথে একমত। তাঁদের দুজনের জন্যে এটা ছিলো বিশেষ সুবিধাজনক; পাণ্ডিত্যে ও মেধায় তাঁরা তাঁদের প্রতিপক্ষের থেকে এতো শ্রেষ্ঠ ছিলেন যে তাঁদের পরাজিত করা ছিলো অসম্ভব। তাঁরা শাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন আইনে; তাই শাস্ত্র দিয়ে তাঁরা প্রথাগ্রস্ত দেশবাসীদের কাবু ক’রে প্রবর্তন করেন আইন। তাঁরা জানতেন আইন ছাড়া অসম্ভব হবে সহমরণ নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন; এবং এও জানতেন যদি তাঁদের দেশবাসী তাঁদের যুক্তি মেনে নেয়, কিন্তু আইন প্রণীত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আবার দেখা দিতে পারে সহমরণপ্রথা, নিষিদ্ধ হ’তে পারে বিধবাবিবাহ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যদি উনিশ শতকে ওই আইন পাশ না করাতেন, তাহলে বিশ শতকে গান্ধির ভারতবর্ষে ওই আইন কখনো প্রবর্তিত হতো না; কেননা বিধবা হতো দুষ্ট রাজনীতিকদের জন্যে চমৎকার রাজনীতি। বিদ্যাসাগর ( ১৮৭১, ৮৮৪-৮৮৫ ) কেনো আইন চেয়েছেন, তা শোনার মতো :

" কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন,... বহুবিবাহ সামাজিক দোষ ; সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য; সে বিষয়ে গবর্ণমেন্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া কোনও ক্রমে বিধেয় নহে। এই আপত্তি শুনিয়া আমি, আমি কিয়ৎ হাস্য সংবরণ করিতে পারি নাই। সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য, এ কথা শুনিতে আপাততঃ অত্যন্ত কর্ণসুখকর।...যাঁহারা এই আপত্তি করেন, তাঁহারা নব্যসম্প্রদায়ের লোক। নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁহারা অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ ও বহুদর্শী হইয়াছেন, তাঁহারা অর্বাচীনের ন্যায়, সহসা এরূপ অসার কথা মুখ হইতে বিনির্গত করেন না। ইহা যথার্থ বটে, তাঁহারাও এক কালে অনেক বিষয়ে অনেক আস্ফালন করিতেন;... কিন্তু এ সকল পঠদ্দশার ভাব। তাঁহারা পঠদ্দশা সমাপন করিয়া বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ক্রমে, পঠদ্দশার ভাবের তিরোভাব হইতে লাগিল। অবশেষে, সামাজিক দোষের সংশোধন দূরে থাকুক, স্বয়ং সেই সমস্ত দোষে সম্পূর্ণ লিপ্ত হইয়া, স্বচ্ছন্দ চিত্তে কালযাপন করিতেছেন। "

বাঙলা ও বাঙালি এখনো এমনই আছে; ছাত্রজীবনেই তারা প্রগতিশীল পরে প্রতিক্রিয়াশীল। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন এদের বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেছেন আইনে।.. "

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929