বিজ্ঞানের বিকাশ ও শোষণের প্রক্রিয়া বদল
প্রবীর ব্যানার্জি
Nov. 23, 2024 | | views :283 | like:0 | share: 0 | comments :0
সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো পাল্টে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবর্তনে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে পঞ্চদশ - ষোড়শ শতকে নবজাগরণ (রেনেসাঁস) এবং ধর্মসংস্কার (রিফরমেশন) আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী রূপান্তরের এই পর্বে পুঁজিবাদ সহায়তা করেছিল বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান পুঁজিবাদকে। সমাজ বলতে এখানে আর্থসামাজিক অবস্থাকে ধরা হচ্ছে।
কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেল এবং আগেকার স্থানীয় চাহিদা নির্ভর যে উৎপাদন ব্যবস্থা তা বদলে গিয়ে কৃষিতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হলো। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন কেন্দ্র করে সামুদ্রিক বাণিজ্য বিকাশ ঘটলো। অবশ্যই নৌ-পরিবহনে তা উদ্দীপনা প্রদান করলো। অর্থাৎ আগেকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদল হবার জন্যই হাত পাততে হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে। কম্পাসের উদ্ভাবন নাবিকদের অকূল সমুদ্রে দিকনির্দেশ করতে সহায়তা করলো। আবিষ্কৃত হলো অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্র, যার সাহায্যে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চর্চা আর্থসামাজিক প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। জলপথে সড়কপথের তুলনায় কম খরচে ও কম সময়ে অন্যত্র পৌঁছানোর সম্ভব হলো। ধাতু এবং কাঠ ব্যবহার করে জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে উন্নত করতে দ্বারস্থ হতে হলো আবার বিজ্ঞানের। সামাজিক প্রয়োজনে বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটল। আবার অন্য ভাবে বললে বিজ্ঞানের বিকাশ সামাজিক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল।
নৌবাহিনীতে শক্তিনালী দেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য দেশ হলো স্পেন ও পর্তুগাল, পরবর্তীতে ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড। ফান্স ও জার্মানি তাদের আগের ক্ষমতা হারাতে থাকে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছে।
আবার যুদ্ধে বারুদের ব্যবহার নির্ণায়ক হয়ে উঠলো। উদাহরণ - ১৪৮৫ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বসওয়ার্থের যুদ্ধ। বারুদের সাহায্যে যুদ্ধ জয়ের পর টিউডর রাজতন্ত্র সূচনা হয়। মাত্র আটত্রিশ বছর পর ১৫২৬ এ পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন।
আবার এই বারুদ ও গুলির ক্ষত নিরাময়ের জন্যও বিজ্ঞানের ডাক পড়ল। অ্যামবোয়াজ পারে (Ambuois Pare) শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে অস্ত্রপচারের কৌশল দেখালেন। এর পাশাপাশি বিকাশ ঘটল শারীরতত্ত্ব (ফিজিওলজি) এবং বিকারতত্ত্ব (প্যাথোলজি)। শল্য চিকিৎসার বিকাশের স্বার্থে শরীরসংস্থানবিদ্যা (অ্যানাটমি)-র বিকাশের প্রয়োজন ছিল। উল্লেখযোগ্য নাম এই বিষয়ে বেলিলিয়াস, যিনি লিখলেন মানব শরীরের গঠন (De Humani Corpoloris Fabrica)।
জাঁ ফার্নের প্যাথোলজি সম্বন্ধে চর্চা করলেন। একইসঙ্গে রোগ নিরাময়ে এবং শিল্পকলা চর্চাকে এই জ্ঞান ভীষণ ভাবে সহায়তা করলো।
অ্যানাটমি রেনেসাঁস শিল্পীদের প্রভাবিত করে। শিল্পীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তির বিকাশ ঘটে। এর জন্য শিল্পীরা আলবের্তীর কাছে ঋণী। যিনি বলেছিলেন মানবদেহের স্তরভেদে আঁকা উচিত; অর্থাৎ প্রথমে অস্থির কাঠামো আর শেষে চর্ম আবরণ, মাঝে পেশিকলা, শিরা-ধমনী ইত্যাদি। এই বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটার ফলে সমৃদ্ধ হলো শিল্প। আর্নল্ড হসারের লেখা বই Social History of art এ প্রকাশ পায়, জ্যামিতি, গণিত, বলবিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান ইত্যাদি হলো এই শিল্পকলার নানান উপাদান।
রেনেসাঁস শিল্পীরা একাধারে শিল্পী আরেক দিকে কেউ কেউ বিজ্ঞানেও বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আলোকবিদ্যা, শরীরসংস্থানবিদ্যা, প্রাণীকূল, গাছপালা, শিলাপাহাড় প্রভৃতি নানা বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছিলেন এ যুগের এক সার্থক প্রতিনিধি।
আরেকটা মাইলফলক বিজ্ঞানের পক্ষে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র। বই ও কাগজপত্রের মাধ্যমে ছাপার অক্ষরে জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও বিস্তার লাভ ঘটল। বুর্জোয়াদের আগ্রহ বাড়ল শিল্পকলা, ভ্রমণ ও ভূগোল বিষয়ক লেখাপত্তরে।
এতদিনের ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার বদলে চর্চা শুরু হলো মানবতাবাদী শিক্ষার যার হাত ধরে উঠে এলো নতুন চিন্তক শ্রেনী, যাদের বলা হতো মানবতাবাদী বা হিউম্যানিস্ট।
এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ। বিনা প্রশ্নের মেনে নেওয়ার বদলে জন্ম হলো জিজ্ঞাসার।
ক্যাথলিক চার্চের বাইবেল ছিল সাধারণের দুর্বোধ্য (আমাদের সংস্কৃতের মতো) ল্যাটিন ভাষায়। মার্টিন লুথার জার্মান ভাষায় এর অনুবাদ ছাপালেন। বাইবেল আর সাধারণের নাগালের বাইরে রইলো না। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের ভাষায় এর অনুবাদ ছাপালেন। চার্চের কর্তৃত্ব খর্ব হতে লাগল।অর্থাৎ বলা যায় যে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন (রিফরমেশন) বিকাশকে সম্ভব করে তুলল।
এবার বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত অন্য বিষয়ে শুরু হলো। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কিভাবে গঠিত এই বিষয়ে প্রাচীন ধারণার সাথে নব্য আধারিত জ্ঞানের। টলেমি এবং অ্যারিস্টটলের ভূ-কেন্দ্রীয় মতবাদ বনাম ব্রুনো/কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ। ততদিনে জ্যোতির্বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়ে গেছে।নিকোলো কোপার্নিকাশ দেখালেন পৃথিবী তার নিজ অক্ষকে ঘিরে সূর্যের চারপাশে পাক খাচ্ছে। চার্চের মত ছিল ঈশ্বর পৃথিবীর জন্মদাতা, তাই পৃথিবী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে আসীন। তাকে কেন্দ্র করে গ্রহ ও নক্ষত্র ঘুরছে।বিতর্ক শুরু হলো। যদিও কোপার্নিকাশ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। সেগুলো সমাধান করলেন কেপলার, টইকো ব্রাহে, গ্যালিলিও প্রমুখেরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই মতবাদ আসলে চার্চ আর বাইবেলের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।এককথায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান স্পৃহা সামাজিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করলো।
আবার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে বিজ্ঞানের বিকাশ অনেকাংশে সাহায্য করল।পুঁজিবাদের বিকাশ বিজ্ঞানের হাত ধরে উঠে এলো। খনি শিল্প, ধাতুবিদ্যায় এবং রাসায়নিক শিল্পের ক্রোমোন্নতি, পুঁজি বিনিয়োগ ও বিকাশের সহায়ক হয়ে উঠলো। খনিজ গবেষণা রসায়নের বিকাশকে ত্বরান্বিত করলো। রসায়নের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ডে রে মেটালিকা(De Re Metallica)। নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কার হলো।অর্থাৎ বিজ্ঞান চর্চার লক্ষ্য হলো সামাজিক চাহিদা পূরণ।
সামরিক প্রযুক্তি, মুদ্রণ ব্যবস্থা, ভৌগলিক অভিযানের সহায়ক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন যেমন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অনেকাংশে পরিবর্তিত করেছিল, তেমনি বিশ্ববীক্ষণকেও বদলে ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদির অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করেছিল। এই পুরো বিষয়টি ছিল দ্বিমুখী। একদিকে যেমন বিজ্ঞান সমাজকে প্রভাবিত করেছিল, অন্যদিকে আবার সামাজিক প্রয়োজনেই বিজ্ঞানের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। আর এই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির বিকাশে এবং পুঁজিবাদের উত্থানে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞান
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
সুজিত রাজবংশী