কৈশোরে মিতালি পিসির সৌজন্যে তাঁর সাথে আমার আলাপ। মাধ্যম ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খন্ড। এরপর এই বইটির বাকি চারটি খন্ড ও ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ বইগুলি পড়ে ফেলি। বয়সজনিত মানসিক সক্ষমতা দিয়ে এই বইগুলির মর্মবস্তু সাধ্যমতো উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। এই বইগুলি আমার কিশোরমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সাহিত্য ও ইতিহাস পছন্দের বিষয় ছিল এতদিন, এরপর বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মালো। আমার মানসিকতার ক্রম পরিবর্তন ঘটতে লাগলো।
এ কথা সত্য যে কোনও এক বা একাধিক বই পড়ে রাতারাতি নিজেকে বদলানো যায় না, তবে বইটির বিষয়বস্তু উপলব্ধি করে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তার যথার্থতা অর্জন করা যায়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজেকে মানসিকভাবে বদলাতে আমার সময় লেগেছে অনেকটাই। তবে বইগুলি আমার কিশোর মনে জাগ্রত অজস্র প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। এ কথা আমি অস্বীকার করি না।
অন্যতম প্রিয় লেখক প্রবীর ঘোষ, যিনি আমার চেতনায় বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণ করেছিলেন, তাঁর সাথে আমার মাত্র দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রথমবার তাঁর অসুস্থতার সময়, শেষবার তাঁর মৃত্যুর সময়। এ বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা চলাকালীন গত 5ই ফেব্রুয়ারি সকালে আমি ও অরিন্দম তাঁর দমদমের বাসগৃহে তাঁকে দেখতে যাই। গতকাল 7 ই এপ্রিল, তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে, দুপুরে অরিন্দমের সাথেই যাই তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে। উভয় সাক্ষাৎ বড়ো যন্ত্রণার। প্রথমবার গিয়ে দেখলাম, তিনি রোগশয্যায়, শেষবার মৃত্যুশয্যায়। জ্যোতিষীসহ সকল অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের ত্রাস, সমকালীন সময়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ লড়াকু প্রবীর ঘোষকে এভাবে দেখবো, কখনও ভাবিনি। কথাবার্তাও বিশেষ বলতে পারিনি। তাই একটা অস্ফুট আফসোস রয়েই গেলো।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে”। মৃত্যু জীবনের শেষে এক সুনিশ্চিত ঘটনা। কেবল জীবের নয়, মহাবিশ্বের সকল গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্রের মৃত্যু আছে। সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের চক্র মহাবিশ্বে নিরন্তর আবর্তিত। আমরা কেউই তার উর্ধ্বে নই। আমাদের বেঁচে থাকা আমাদের ‘কাজ’ এর মধ্যে। আমাদের বেঁচে থাকা মৃত্যুর পর আমাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারার অন্তত একজন মানুষ রেখে যাওয়ার মধ্যে। আমাদের বেঁচে থাকা আমাদের গৃহীত আদর্শের মধ্যে। মৃত্যুর পরেও প্রবীর ঘোষ এভাবেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে।
পাঁচটি খন্ডে প্রকাশিত ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ ছাড়াও তিনি আরও যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলি হলো, যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ, অলৌকিক রহস্য সন্ধানে পিংকি, যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি, অলৌকিক রহস্যজালে পিংকি, পিনাকী ও অলৌকিক বাবা রহস্য সমগ্র, জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক, মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ মেডিটেশন, প্রেম, বিবাহ ও অন্যান্য, সম্মোহনের A to Z, গোল টেবিলে সাফ জবাব, রাজনীতির ম্যানেজমেন্ট এবং আরও কিছু, মেমারিম্যান থেকে মোবাইল বাবা,প্রসঙ্গ সন্ত্রাস এবং, যৌবনের বজ্রনির্ঘোষ, আমার ছেলেবেলা, স্বাধীনতার পরে, ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা, প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার-প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার, গেরিলা যুদ্ধের A to Z থেকে আজাদি, ধর্ম, সেবা - সম্মোহন, পিংকি ও অলৌকিক বাবা, অপরাধ বিজ্ঞান, স্বয়ম্ভর গ্রাম, বারে বারে ঘুরে ফিরে তুমি, যুক্তিবাদের চোখে গীতা, রামায়ন মহাভারত ইত্যাদি, কাশ্মীরে আজাদির লড়াই- একটি ঐতিহাসিক দলিল, অলৌকিক দৃষ্টি রহস্য, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস, সেরা যুক্তিবাদী সংকলন, দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্ম, আজকের যুক্তিবাদ কি ও কেন,জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান, ভগবানে ভর ভূতে ভর, জ্যোতিষ একটি অবিজ্ঞান, যুক্তিবাদীর চোখে ধর্ম, ভূতে ভর এবং যুক্তিবাদীদের কথা।
সমকালীন সময়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, জ্যোতিষী সহ সকল অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের ত্রাস, প্রবীর ঘোষ বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। তাঁর পথ অনুসরণ করে আগামী দিনে এগিয়ে যাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন। প্রবীর ঘোষ ‘আলোর পথযাত্রী’ দের আলোর দিশারী হয়ে থেকে যাবেন আগামীদিনে।