প্রসঙ্গ: প্রেম

রাজু দত্ত


Nov. 26, 2024 | | views :285 | like:0 | share: 0 | comments :0

প্রেম হল একটা অনুভূতি, যা দুটি মানুষের পরস্পরের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থেকে জন্মলাভ করে। এই আকর্ষণ হতে পারে শারীরিক বা চারিত্রিক। অর্থাৎ কেউ কারো শারীরিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে, কেউ প্রেমে পড়ে কারো চারিত্রিক গুনাবলীর মুগ্ধতায়। 'ভালো লাগা' জন্ম দেয় 'প্রেম' নামক অনুভূতির যা ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হয়।


সংকীর্ণ অর্থে আমরা 'প্রেম' বলতে বুঝি 'নারী ও পুরুষের এমন এক পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে মিশে থাকে যৌনতা'। নারী পুরুষ উভয়ের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে উভয়ই শারীরিকভাবে মিলিত হয় 'যৌন সঙ্গম' ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ব্যাপক অর্থে 'প্রেম' হল সেই অনুভূতি যা থাকে সকল মানুষের প্রতি সকল জীবের প্রতি।‌ যাতে থাকে না কোনও‌ যৌনতার প্রশ্ন। থাকে না কোনও সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে 'প্রেম' বিশ্বজনীন'। 


আমাদের দেশে নারী পুরুষের যৌন আকাঙ্খা চরিতার্থ করার সাথে 'বিবাহ' নামক প্রাতিষ্ঠানিক কার্যের প্রশ্নটি জড়িত। শারীরিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, 'বিবাহের পূর্বে' নারী পুরুষের পারস্পরিক  'চুম্বন', 'আলিঙ্গন' এর মতো আচরণগুলিও 'সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ‌। অথচ প্রাকৃতিকভাবে নারী পুরুষ উভয়েরই যৌন মিলনের আকাঙ্খা থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ বিবাহ না করলে এই আকাঙ্খা পূরণ 'সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। অথচ দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ, যারা 'প্রেম' এর সম্পর্কে সম্পর্কিত তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে শারীরিকভাবে মিলিত হওয়া অনৈতিক বলে আমি মনে করি না। এটা আইনত 'অপরাধ' বলেও আমার জানা নেই। তবুও রক্ষণশীল সমাজ নারী পুরুষের যৌন মিলনের আচরণটিকে 'বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। আশ্চর্য! 


তাহলে 'বিবাহ' করে নিলেই তো হয়! সেখানেই তো সমস্যা। 'বিবাহ' করতে হলে আপনাকে হাজার একটা শর্ত পূরণ করতে হবে। এই যেমন আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান, জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এরকম হাজারো পরিচয় যদি সমাজসম্মত ও বিবাহে উদ্যোগী দুটি মানুষের উভয়ের পরিবারসম্মত হয়, তবেই আপনি বিবাহের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন।


 মেয়েদের ক্ষেত্রে 'শারীরিক সৌন্দর্য্য' ও ছেলেদের ক্ষেত্রে 'চাকরিজীবি' হওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক। তার ওপর তো উভয়ের পৈতৃক ও‌ নিজ অর্জিত সম্পত্তি থাকাও প্রয়োজন। মেয়ের বাবার তো প্রচুর টাকা পয়সা থাকা দরকার না হলে 'পণ' বাবদ খাট, বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, টিভি, ফ্রিজ, আলমারী, বাইক ও মেয়ের জন্য সামান্য কয়েক ভরি গহনা কিনবেন কোথা থেকে? এগুলো না দিলে সমাজ যে মেনে নেবে না। মেনে নেবে না মেয়ে জামাই ও তার পরিবার উভয়ই। কাজেই…


এই বিবাহ তিনটি উপায় হয়ে থাকে। এক - নিজেদের পছন্দ মতো 'লাভ ম্যারেজ' এবং দুই- উভয়ের পরিবারের পছন্দমতো 'অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ' ও সর্বসম্মতিক্রমে 'লাভ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ'।  শেষোক্ত উপায়টি প্রায় বিরল ঘটনাগুলির একটি। অপর দুটি পন্থার প্রথমটি প্রায় কারোরই 'পরিবারসম্মত' নয়। যদিও এটিই আমি সমর্থন করি। দ্বিতীয়টি আজকাল‌ প্রায় বিরল পন্থা হতে চলেছে।‌ বর্তমানে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য 'অনলাইন ঘটক' রূপে বিভিন্ন অ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বেঙ্গলি ম্যাট্রিমনিয়া, শাদি ডট কম। 


আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, উপরিউক্ত উপায়গুলির‌ মধ্যে বর্তমান প্রজন্মের পছন্দ প্রথম উপায়টি। যেহেতু এই উপায়টি সাধারণত সমাজ ও পরিবার সম্মত নয়, তাই বর্তমানে বাড়ির অমতে‌ (বাড়ি থেকে পালিয়ে) রক্ষণশীল সমাজপতিদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিবাহ করার ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় এই যে, এই সকল বিবাহিত ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নয়। নিজেদের শারীরিক ও মানসিকভাবে গড়ে না তুলে, নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে  প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সন্তানাদি 'মানুষ' করার সুকঠিন সংগ্রামে ব্রতী হচ্ছে। যার ফলে গড়ে উঠছে এক যণ্ত্রসুলভ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যারা সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি অর্জন করতে পারছে না। 


আবার যে সকল ছেলেমেয়েরা পরিবার ও সমাজের অমতে লড়াই করে তাদের প্রেমকে পূর্ণতা দিতে, পারছে না বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে, তারা হয়ে যাচ্ছে 'ব্যর্থ প্রেমিক' 'ব্যর্থ প্রেমিকা'। নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই 'প্রেমের সম্পর্ক' এই ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে একাধিক 'প্রেমের সম্পর্কে'। তাদের এই সকল সম্পর্কের ভিত এতটাই দুর্বল যে একাধিক সম্পর্কে জড়ালেও কোনও সম্পর্কই পূর্ণতা লাভ করছে না। 'প্রেম' এর গভীরতা উপলব্ধি করতে না পেরেই তারা নিজেদের 'ব্যর্থ প্রেমিক, ব্যর্থ প্রেমিকা' মনে করছে। এরপর তারা হয়ে উঠছে 'প্রতিহিংসাপরায়ণ। যার ফল সম্প্রতি আমরা দেখছি একের পর এক 'প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে প্রেমিকাকে খুন' এর মতো ভয়ানক ঘটনায়। সবকিছু 'চাইলেই পাওয়া যায় না, লড়াই করে অর্জন করতে হয় নিজ যোগ্যতায়'। এই শিক্ষা না থাকায় আজকের প্রজন্ম 'প্রত্যাখান' 'ব্যর্থতা' এগুলি মেনে নিতে পারছে না। কখনো হয়ে উঠছে 'আত্মঘাতী' কখনও বা 'ঘাতক'। উভয় ঘটনাই অত্যন্ত উদ্বেগজনক।‌ খুনের ঘটনাও আজকাল প্রতিরোধের চেষ্টা না করে মানুষ তার 'লাইভ ভিডিও ' রেকর্ড করছে। কী অসম্ভব বিকৃতমনস্কতার প্রসার ঘটছে, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। 'লাইভ স্যুইসাইড' এর ঘটনাও আজকাল ঘটতে দেখা যায়।‌ মানসিক অবসাদ কোন্‌ পর্যায় পৌঁছলে এটা করা সম্ভব! 


শুধু তাই নয়। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে 'পরকিয়া' সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। 'মূলত শারীরিক সুখলাভের আশায় সন্তানের কথা না ভেবে বাবা মায়েরা লিপ্ত হচ্ছে অনৈতিক সম্পর্কে। যার গভীর প্রভাব পড়ছে শিশুকিশোরদের ওপর। এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 'অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা' পরকিয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হলেও অনেকসময়ই স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া মানুষ 'লোভ' (অর্থনৈতিক ও শারীরিক) এর বশে এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।  


প্রেমহীনতার এক জটিল আবর্তে আমরা ক্রমশ আবদ্ধ‌ হয়ে পড়ছি। যা থেকে বেরোতে না পারলে, চরম সংকটের সম্মুখীন হবে মানব সভ্যতা। নেমে আসবে প্রেমহীনতার এক অপ্রতিরোধ্য মহামারি। 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929