নক্ষত্রদের ঘূর্ণন

সরোজ নাগ


Nov. 25, 2024 | | views :898 | like:0 | share: 0 | comments :0

যখনই আপনি গভীর মহাবিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে তাকান, তখনই আপনি দেখতে পান অজস্র আলোর বিন্দু। আপনি জানেন সেগুলো হলো নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি। সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে বৃহদাকার নক্ষত্রগুলির আয়ুষ্কাল সবচেয়ে কম। কারণ তারা তাদের চেয়ে কম ভরের নক্ষত্রদের তুলনায় অনেক দ্রুত তাদের জ্বালানিকে পুড়িয়ে দেয়। একবার তারা জ্বালানির সীমায় পৌঁছে গেলে এবং উপাদানগুলিকে আর ফিউজ করতে না পারলে, তারা তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং তারা হয়ে যায় নক্ষত্রের মৃতদেহ।


এই মৃতদেহগুলি একাধিক প্রকারের দেখা যায়। সর্বনিম্ন ভরের (যেমন, সূর্যের মতো) নক্ষত্রের জন্য শ্বেত বামন, পরবর্তী স্তরের জন্য নিউট্রন নক্ষত্র এবং সর্বাপেক্ষা বিশাল নক্ষত্রের জন্য ব্ল্যাক হোল। প্রতিটি মৃতদেহ নিজের অক্ষের চারপাশে তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলগুলি ঘোরে প্রায় আলোর গতিতে।

আমাদের সূর্য তার নিজের অক্ষের চারপাশে একবার আবর্তন করতে গড়ে প্রায় 27 দিন সময় নেয় (সূর্যের নিরক্ষরেখার কাছে প্রায় 25 দিন এবং মেরুবলয়ের কাছে এই সময়সীমা প্রায় 35 দিন)। অন্য দিকে একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র একটি সম্পূর্ণ 360° ঘূর্ণন এক ঘন্টার কম সময়ে সম্পন্ন করে। এটি উদ্ভট মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি যদি কখনও ফিগার স্কেটিং দেখে থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এটা দেখেছেন যে একজন ঘূর্ণায়মান স্কেটার যখন তাঁর ছড়ানো হাত দুটি গুটিয়ে নেন তখন তাঁর ঘূর্ণন গতি বেড়ে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি হলো কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের নিয়ম (law of conservation of angular momentum)।


কৌণিক ভরবেগ হল "একটি ভরের সাথে কতটা 'রোটেশনাল' এবং/অথবা 'অরবিটাল' গতি আছে?" আপনি যদি সেই বৃহদাকার বস্তুটিকে ফুলিয়ে দেন যাতে এর ভরের বিস্তার তার ঘূর্ণন কেন্দ্র থেকে দূরে থাকে, তাহলে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য এটিকে তার ঘূর্ণন গতিতে ধীরগতি করতে হবে। একইভাবে, যদি আপনি একটি বৃহদায়তন বস্তুকে সংকুচিত করেন, যাতে এর ভরের বেশির ভাগ তার অক্ষীয় ঘূর্ণনের কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে, তবে সেই বস্তুটিকে তার ঘূর্ণন গতি বাড়াতে হবে, প্রতি সেকেন্ডে আরও বেশি ঘূর্ণন ঘটাতে হবে। এইভাবে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত হয়।


যদি আপনি আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রকে তার ভর, আয়তন এবং ঘূর্ণন গতি সহ বিচার করেন এবং এটিকে পৃথিবীর আকারের আয়তনে সংকুচিত করেন, যা একটি শ্বেত বামনের একটি সাধারণ আকার, তাহলে কী ঘটবে? বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনি যদি অনুমান করেন যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত আছে এবং সূর্য ও সূর্যের সংকুচিত সংস্করণ দুটিই আমরা গোলক হিসেবে ভেবে নিই তাহলে সত্যিই হিসাব করে বলা যায় কী ঘটবে। যদি আমরা ধরে নিই যে সূর্যের সম্পূর্ণটি প্রতি 35 দিনে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে এবং সূর্যের কেবলমাত্র ভিতরের কোরের 40% একটি শ্বেত বামন হয়ে যায়, তখন সেই সংকুচিত শ্বেত বামন হওয়া সূর্য মাত্র 25 মিনিটের মধ্যে একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করবে।


সেই নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশের ভরকে ঘূর্ণনের অক্ষের (axis of rotation) কাছাকাছি নিয়ে এলে তার ঘূর্ণন গতি অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। সাধারণভাবে দেখা যায় যদি আপনি একটি বস্তুর ঘূর্ণনের সাথে সাথে তার ব্যাসার্ধের পরিমাণ অর্ধেক করেন, তার ঘূর্ণন গতি চারটি ঘাত বা ফ্যাক্টর দ্বারা বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণন গতি একটি ঘূর্ণমান ভরের ব্যাসার্ধের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক (inversely proportional)। বাস্তবে, শ্বেত বামনগুলি সাধারণত একটু বেশি ধীরে ঘোরে, কারণ নক্ষত্রের বাইরের স্তরগুলি উড়ে যায় এবং শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ "কোর" উপাদানগুলি একটি সাদা বামন গঠিত হওয়ার জন্য সংকুচিত হয়।


একটি নিউট্রন তারকা সাধারণত অনেক বেশি বড়ো নক্ষত্রের সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার পর পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ। এর কেন্দ্রের কণাগুলো অত্যাধিক চাপের ফলে এত সংকুচিত হয় যে এটি প্রায় একচেটিয়াভাবে (90% বা তার বেশি) নিউট্রন দিয়ে গঠিত একটি দৈত্যাকার পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো আচরণ করে। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি সাধারণত গড়ে আমাদের সূর্যের ভরের দেড় গুণ থেকে দ্বিগুণের মধ্যে। তবে সেই পরিমাণ ভর মাত্র 10 থেকে 40 কিমি ব্যাসার্ধ্য বিশিষ্ট গোলকের মধ্যে আবদ্ধ। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি যেকোনো সাধারণ তারকা বা শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ঘোরে।


আপনি যদি পুরো সূর্যকে একটি ছোট আয়তনে সংকুচিত করার পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করেন, কিন্তু এইবার মাত্র 40 কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট সংকুচিত আয়তনে নিয়ে আসেন তাহলে আপনি শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত হারে ঘূর্ণন পাবেন। সেই পরিমাপটি হলো প্রায় 10 মিলিসেকেন্ড! কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ সম্পর্কে আমরা পূর্বে ফিগার স্কেটারের যে নীতিটি প্রয়োগ করেছিলাম, সেই একই নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্তে আসা যায় যে নিউট্রন নক্ষত্র এক সেকেন্ডে 100 টিরও বেশি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে পারে।


প্রকৃতপক্ষে, এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। কিছু নিউট্রন তারকা পৃথিবীর দৃষ্টিরেখা বরাবর রেডিও পালস নির্গত করে, সেগুলোকে পালসার বলা হয়। আমরা এই বস্তুর পালস পিরিয়ড পরিমাপ করতে পারি। দেখা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি তারকা একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করতে প্রায় এক সেকেন্ড সময় নেয়, তাদের মধ্যে কিছু 1.3 মিলিসেকেন্ডের মতো কম, সর্বাধিক 716 ঘূর্ণন-প্রতি-সেকেন্ড (rotations-per-second) পর্যন্ত ঘোরে। সর্বাধিক হারে ঘূর্ণিত পালসারের নাম হলো PSR J1748−2446ad, এটি 2004 সালে আবিষ্কৃত হয়েছিলো।


সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারাগুলিকে মিলিসেকেন্ড পালসার বলা হয় এবং তারা সত্যিই অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত গতিতে ঘোরে। তাদের বাইরের পৃষ্ঠে এই ঘূর্ণন হারগুলি প্রকৃতপক্ষে রিলেটিভিস্টিক (relativistic)। যার অর্থ তারা আলোর গতির একটি উল্লেখযোগ্য ভগ্নাংশ নিয়ে গতিশীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই গতি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির 50% এর বেশি গতিতে পৌঁছাতে পারে!


কিন্তু এটি মহাবিশ্বে পাওয়া সত্যিকারের অ্যাস্ট্রোফিজিকাল সীমার কাছেও যায় না। নিউট্রন তারা মহাবিশ্বের ঘনতম বস্তু নয়, সেই সম্মানটি ব্ল্যাক হোলের প্রাপ্য। সেটি নক্ষত্রের সমস্ত ভরকে মহাকাশের এমন একটি অঞ্চলে সংকুচিত করে (সিঙ্গুলারিটি!) যার ফলে আলোর গতিতে চলমান একটি বস্তুও সেখান থেকে পালাতে পারে না। 


আপনি যদি সূর্যকে প্রায় মাত্র 3 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি আয়তনে সংকুচিত করেন, তাহলে এটি একটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। এই মাপকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius) বলে যা নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে। স্থান-কালের ফ্যাব্রিককে এই ব্ল্যাক হোল এতো বিকৃত করে যে ব্ল্যাক হোলের শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের বাইরেও অতিরিক্ত frame-dragging এর প্রভাব অনুভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে যত বেশি আপনি সেই ভরকে সংকুচিত করবেন, স্থানের (এবং সময়েরও) ফ্যাব্রিকটি তত দ্রুত টেনে আনা হবে।


বাস্তবিকভাবে আমরা একটি ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে স্থানের ফ্রেম-টেনে নেওয়ার পরিমাপ করতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই স্থানের মধ্যে উপস্থিত থাকা বস্তুর উপর ফ্রেম-ড্র্যাগিং প্রভাব পরিমাপ করতে পারি। এর অর্থ হল পদার্থ সমৃদ্ধ পরিবেশে বিদ্যমান এই ব্ল্যাক হোলের চারপাশে পাওয়া অ্যাক্রিশন ডিস্ক (accretion disk) এবং তার প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা।


তাই এগুলো এই ফ্রেম ড্র্যাগিং প্রভাবগুলি পরীক্ষা করার জন্য সেরা পরীক্ষাগার তৈরি করবে। সত্যিই এমন একটা পরীক্ষাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তা হলো গ্যালাক্সি NGC-1365 -এর কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল (যা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দ্বারা চিত্রিত প্রথম ছায়াপথগুলির মধ্যে একটি)। এটির বাইরের অঞ্চল থেকে নির্গত বিকিরণ সনাক্ত করা হয়েছে। তাকে পরিমাপ করে তার গতিও নির্ণয় করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন উপাদানগুলি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির প্রায় 84% গতিতে ঘোরে এবং তাঁরা মনে করেন অবশ্যই এর মধ্যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের প্রভাব বর্তমান।


পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা LIGO (Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) এবং Virgo-এর মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মহাবিশ্বে একত্রিত হওয়া ব্ল্যাক হোলগুলির ঘূর্ণনের অনুমান করেছেন। তাঁরা নির্ণয় করেছেন কিছু ব্ল্যাক হোল প্রায় 95% আলোর গতিতে ঘোরে। এটি তাত্ত্বিক ভাবে সর্বাধিক পরিমাপ। যে নক্ষত্রগুলি থেকে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় সেগুলি অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘোরে। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্ল্যাক হোলগুলিকে প্রায় আলোর গতিতে ঘুরতে হবে।


আপনি যদি মহাকাশে বস্তুকে সংকুচিত করে খুব ছোট করেন, তাহলে সেই বস্তুগুলোর অন্য কোনো বিকল্প নেই। যদি কৌণিক ভরবেগকে সংরক্ষণ করতে হয়, তবে তাদের ঘূর্ণন গতি বাড়াতেই হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রায় আলোর গতিতে পৌঁছায়। সেই মুহুর্তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হস্তক্ষেপ করবে এবং সেই শক্তির কিছু (এবং কৌণিক ভরবেগ) বিকিরিত হয়ে যাবে তার ফলে এটিকে তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ মানের নীচে ফিরিয়ে আনবে। এই মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোলের অসাধারন গতিতে ঘোরার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো কোনো দিন আমরা সরাসরি তাদের ঘূর্ণন পরিমাপ করতে সক্ষম হব।

চিত্র পরিচিতি (প্রথম ছবিটি) – The barred spiral galaxy NGC 1365. সৌজন্যে NASA/JPL Caltech/Judy Schmidt.

তথ্যসূত্র –

 (১) Evidence from K2 for Rapid Rotation in the Descendant of an Intermediate-mass Star. J. J. Hermes et al 2017. The Astrophysical Journal Letters, Vol 841, No 1

(২) Hessels, J. W. T.; Ransom, S. M.; Stairs, I. H.; Freire, P. C.; Kaspi, V. M.; Camilo, F. (2006). "A Radio Pulsar Spinning at 716 Hz". Science. 311 (5769)

(৩) LIGO Caltech, MIT.

(৪) NASA ও Wikipedia.

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929