গল্পের ফাঁকফোঁকর: মহাভারতে কি মাল্টিভার্সের কথা বলা আছে?
Guitar K Kanungo
Jan. 19, 2025 | | views :71 | like:4 | share: 4 | comments :1
তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের ধারণা, আমাদের মহাবিশ্ব ছাড়া আরও অনেক মহাবিশ্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। এই প্রতিটি মহাবিশ্ব যেখানে আমাদের মতো একাধিক সৌরজগৎ আছে, কিন্তু আলাদা সব বৈশিষ্ট্য এবং নিয়ম মেনে চলছে। তবে এই মাল্টিভার্স তত্ত্বটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। কল্পবিজ্ঞানে মাল্টিভার্স নিয়ে নানান গল্প আছে। দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল তার মধ্যে একটি। দ্য লং আর্থ সেরকম আরেকটি উপন্যাস, যেখানে লেখক বলছেন মানবসভ্যতা এরকম এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে প্রবেশ করার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যেটা দিয়ে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাওয়া আসা করছে।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যশোয়া ভ্যালেন্টের মধ্যে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাবার সহজাত ক্ষমতা আছে। হিন্দু পুরাণে এরকম একজন চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। পুরাণে তো আছেনই, মহাভারতেও তিনি আছেন। তিনি দেবর্ষি নারদ। মথুরার দেবকী এবং বসুদেবের বিয়ে শেষ হয়েছে। দেবকীর ভাই কংস মহাসমারোহে বোন এবং বোনের স্বামীকে রথে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় নারদ এসে হাজির হন, অনেকটা যশোয়া ভ্যালেন্টের মতোই । নারদ বলেন এই যুগলের অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে। শুরু হবে অন্য এক গল্পের। যে ঢেঁকির মতো দেখতে যন্ত্রটায় নারদ চড়ে বেড়ান, সেটা কি যশোয়া ভ্যালেন্টের 'স্টেপার' যেটার মাধ্যমে সে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে চলাচল করছে?
পার্বতী অন্দর মহলের প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য একজন দ্বারপাল তৈরি করলেন। "তৈরি" শব্দটা ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ যিনি দ্বারপাল নিযুক্ত হলেন, তিনি স্বয়ং বিনায়ক গণেশ। যেহেতু পার্বতীই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, অতএব গণেশ কেবল পার্বতীকেই মা বলে জানেন। মুশকিলের ব্যাপার হল, মায়েদের যে স্বামী থাকে, এবং তাদেরকে যে বাবা বলে ডাকা হয়, এবং মা'দের প্রাইভেসি বিনষ্ট করার অধিকার বাবাদের সবসময়ই থাকে—এই তথ্যটা গণেশের জানা ছিল না। মহাদেব কার্যোপলক্ষে বাইরে ছিলেন। কৈলাসে ফিরে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলেন মহাদেব। গণেশ তাঁকে ঢুকতে দিলেন না, কারণ মা কাউকে ঢুকতে দিতে বারণ করেছেন। এই "কাউকে"র মধ্যে যে শিব পড়েন না, সেটা পার্বতী পরিষ্কার করে বলেননি। ফলে শিব বাড়ি ঢুকতে না পেরে ভুত-প্রেতদের সঙ্গে গাঁজার আসর জমালেন। একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলো, এরকম অবস্থায় দেবর্ষি নারদ থাকবেন না—সেটা কী হয়! তিনি ঢেকিতে চড়ে হাজির হলেন। ফলে অনেক জল ঘোলা হল এবং এক পর্যায়ে গণেশের মাথা শিবের হাতে কাটা পড়ল। এর পরের কাহিনী প্রায় সবারই জানা। বলবার বিষয় হল, এখানেও নারদ আসছেন, আসতে পারছেন অনায়াসে। শিবের কৈলাস; এটা ব্রহ্মলোক, অমরাবতী নয়, বৈকুণ্ঠও নয়।
দেবর্ষি নারদ পিতামহ ব্রহ্মারই পুত্র। অর্থাৎ, তাঁর জন্ম হয়েছে ব্রহ্মলোকে। কিন্তু ব্রহ্মলোকে জন্ম হলেও তিনি সেখানে থাকেননি। তিনি ঢেরা বেঁধেছেন বৈকুণ্ঠে, যেখানে ভগবান বিষ্ণু অবস্থান করেন। ভগবান বিষ্ণুর স্তব করেই তাঁর সময় কাটে। সেই স্তব কঠিন মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে নয়; তিনি গানে গেয়ে বিষ্ণুর অর্চনা করেন। কথিত আছে, তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। দেবর্ষি নারদ ছিলেন তার চাইতেও বড় সংগীতজ্ঞ। কতটা বড়? তার একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে। একবার নারদ তাঁর আরাধ্য দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বীণায় এমন সুর ধরলেন যে, ভগবান বিষ্ণুর শ্রীচরণ গলে এক জলের ধারা সৃষ্টি হয়ে ত্রিভুবন ভাসিয়ে নেবার উপক্রম হল। আশুতোষ সেই জলের ধারাকে নিজের জটায় ধারণ করে সৃষ্টি রক্ষা করলেন। শিবের জটা থেকে সেই নদীকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনবেন রাজা ভগীরথ। সেই থেকে গঙ্গা ভাগীরথী নামেই পরিচিত হবেন। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, কৈলাস আর মর্ত্যলোক সব একাকার হয়ে গেল।
এতক্ষণ বলতে চাইলাম, হিন্দু পুরাণে মাল্টিভার্সের এরকম উল্লেখ অসংখ্যবার করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণের মহাবিশ্ব কেবল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেমন গ্রিকদের আছে কিংবা আব্রাহামিক ধর্মগুলো বিশ্বাস করে। হিন্দু পুরাণে স্বর্গ আছে, কিন্তু সেটা দেবতাদের আবাস—মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই, অতীতের দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। নরকের আদলে যমলোক একটা আছে, কিন্তু সেখানে মৃত ব্যক্তির আত্মা পরবর্তী জন্মের জন্য অপেক্ষা করে মাত্র। হিন্দু পুরাণে এর বাইরেও অনেক লোক বা জগতের কথা বলা হয়েছে। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক—এর কোনোটিই স্বর্গের অংশ নয়। এগুলো সবই আলাদা আলাদা জগৎ, এবং এইসব জগতে যাওয়া আসার ক্ষমতা বিশেষ কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নারদ তাদের একজন। মহাভারতে অর্জুনকে একবার সশরীরে স্বর্গে যেতে দেখা যায়, অবশ্য তবে তাঁকে নেবার জন্য তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্র রথ পাঠিয়েছিলেন। সেই রথটা কি বিশেষ কোনো মহাকাশ যান, অথবা যশোয়া ভ্যালেন্টের স্টেপার? তবে মহর্ষি ভৃগু কোন পদ্ধতিতে ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, এবং শিবলোকে ভ্রমণ করছিলেন, সেই তথ্য মহাভারতের কবি দেননি।
তবে আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা মাল্টিভার্স তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে যে সমস্ত দিক নিয়ে চিন্তা করছেন—অর্থাৎ, এক মহাবিশ্বের সঙ্গে আরেক মহাবিশ্বের সময়ের যে একটা তফাৎ থাকতে পারে, সেটা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস কিন্তু ধারণা দিয়েছেন। কতটা জেনে বা বুঝে তিনি এটা তুলে ধরেছেন, বলা মুশকিল। তবে আধুনিক কালের কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা এই তথ্যটা জানলে বেশ পুলকিত হতেন, কারণ মহাভারত রচিত হয়েছে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। মহাভারতে উল্লেখিত ঘটনাটার কথা বলি। সত্যযুগে রৈবত কুকুদ্মী নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর এক সর্বগুণসম্পন্ন কন্যা ছিল—নাম রেবতী। তিনি রেবতীর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজছিলেন। খুঁজতে গিয়ে মনে হলো প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছেই যাওয়া যাক, তিনি হয়তো একটা ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে পারবেন।
তাঁর সেই অনুযায়ী কন্যা রেবতীকে নিয়ে রাজা কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হলেন। যে মুহূর্তে কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হয়েছিলেন, ঠিক তখন ব্রহ্মা এক সংগীতের আসরে মগ্ন ছিলেন। চমৎকার সব সংগীত পরিবেশিত হচ্ছিল একের পর এক। ব্রহ্মা পঞ্চমুখে বলছিলেন, "তোফা! তোফা!" কুকুদ্মী এবং রেবতীও সেই গানের আসরে যোগ দিলেন। একপর্যায়ে গান শেষ হল। কুকুদ্মী যথাবিহিত সম্ভাষণপূর্বক প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তাঁর আসার কারণ জানালেন। সব শুনে ব্রহ্মা বললেন, "দ্বাপরযুগে মথুরায় ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে জন্ম নেবেন। তাঁর বড় ভাই বলদেবই হবেন রেবতীর উপযুক্ত পাত্র।" রাজা কুকুদ্মী কিছুক্ষণ বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলেন। তিনি জন্মেছেন সত্যযুগে, ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়েছেন ব্রহ্মলোকে, আর ব্রহ্মা কিনা তাঁর মেয়ের পাত্র দেখছেন দ্বাপরযুগে জন্ম নেবে এমন একজনকে ! ব্রহ্মা অন্তর্যামী। তিনি মুখ টিপে হাসছিলেন কুকুদ্মীর দুরবস্থা দেখে। বললেন, " পৃথিবীর সময় আর ব্রহ্মলোকের সময় এক নয় - মহারাজ ! আপনি পৃথিবীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাবেন দ্বাপর যুগ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, আপনার রাজ্যে কেউ বেঁচে নেই । বলদেব অনেক আগেই জন্ম গ্রহণ করছেন। বলরামের সঙ্গে আপনার কন্যা রেবতীর বিয়ে দিন। "
ব্রহ্মদেবের কথা মিথ্যা হয়নি। এটা কি মাল্টিভার্স তত্বকে প্রতিষ্টা করে সেরকম একটা উপাখ্যান নয়? ভবিষৎ এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
"ব্রহ্মদেবের কথা মিথ্যা হয়নি। এটা কি মাল্টিভার্স তত্বকে প্রতিষ্টা করে সেরকম একটা উপাখ্যান নয়?" না, নয়। কোন মিথ বা কল্প কাহিনী কোন বৈজ্ঞানিক তত্বকে প্রতিষ্ঠা করে না। তাত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের থিওরি ম্যাথমেটিকেল মডেল দিয়ে দাঁড় করা হয় এবং সেটা প্রমাণ করার পদ্ধতিও প্রস্থাবে থাকতে হয়। তারপর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তত্বের সত্যতা যাচাই করা হয়। তাই মিথ দিয়ে কোন তত্বকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাছাড়া এক মহাবিশ্বের মানুষ কেন, তার অনু পরমানু বা বলের ধর্ম আর এক মহাবিশ্বে থিওরি অনুসারে অচল। তাই মহাবিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে মানুষ বা দেবতাদের আনাগোনা অলীক কল্পনা মাত্র।