কৃষ্ণকে দেওয়া গান্ধারীর অভিশাপটি যুক্তিসঙ্গত ছিল না।

Guitar K Kanungo


March 21, 2025 | | views :32 | like:0 | share: 0 | comments :0

মহাভারত বলেছে কুরুবংশের মতো বাসুদেব কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই গান্ধারীর অভিশাপকে দায়ী করে থাকেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে পুত্রশোকে কাতর মাতা গান্ধারী বাসুদেব কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যেভাবে তাঁর কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেভাবে একদিন কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে যাবে।

গান্ধারীর এই অভিশাপ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—তিনি তাঁর পুত্রদের মৃত্যুর জন্য প্রধানত কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন। এই অভিযোগের সঙ্গে ঘটোৎকচ পুত্র বরবরিকের একটা মন্তব্যের মিল পাওয়া যায়। বরবরিক আঠারো দিনব্যাপী চলা কুরুক্ষেত্রের ওই যুদ্ধটা প্রত্যক্ষ করছিলেন। যুদ্ধের শেষে যখন তাঁকে এই যুদ্ধ সম্পর্কিত মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল শ্রীকৃষ্ণকেই দেখতে পেয়েছেন। কথাটা রূপক অর্থে বলা। সহজ করে বললে, এই গোটা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়েই তিনি এই কাজটি করেছিলেন।

মহাভারত একটি মহাকাব্য। মহাকাব্যকে মহাকাব্য করে তোলার জন্য এক বা একাধিক ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ চরিত্রের প্রয়োজন হয়। বাসুদেব কৃষ্ণ সেরকমই একটা চরিত্র। ব্যাসদেবের কাছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণতম অবতার। কৃষ্ণকে অবতার প্রমাণ করার একটা দায় ব্যাসদেবের ছিল। সেইজন্যে কেউ যদি মনে করেন অর্জুন এই মহাকাব্যের নায়ক, তাহলে ভুল করবেন। ইলিয়াডে আমরা হেক্টর এবং একিলিসের মধ্যে একটা জবরদস্ত লড়াই অন্তত দেখতে পেয়েছিলাম। এরকম একটা লড়াই দেখার সম্ভাবনা মহাভারতেও তৈরি হয়েছিল। কর্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে সেরকম একটা লড়াই হতে পারত। কিন্তু কৃষ্ণ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে—এটা দেখানোর জন্য ব্যাসদেব সেই লড়াই উপভোগ করার আনন্দ থেকে পাঠকদের কার্যত বঞ্চিত করেছেন।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বাসুদেব কৃষ্ণই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কিন্তু কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনের সমস্ত দায় তাঁর—গান্ধারীর এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। কুরুবংশ ধ্বংসের অন্তত সত্তর শতাংশ দায় এককভাবে দুর্যোধনের। বাকি ত্রিশ শতাংশ দায় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এবং দুর্যোধনের মাতুল শকুনির। ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্রয় দিয়েছেন, শকুনি প্ররোচনা দিয়েছেন। কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে বাসুদেব কৃষ্ণ লাভবান হননি। মগধ রাজ জরাসন্ধকে বধ করা কৃষ্ণের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, এবং জরাসন্ধকে বধ করার কাজটা তিনি দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমকে দিয়েই সেরে ফেলেছিলেন, এবং সেটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই।

‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী’—এ কথাটা দুর্যোধনই বলেছিলেন। অতএব যুদ্ধটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মহারাণী কুন্তী চাইছিলেন তাঁর পুত্ররা তাঁদের পিতার জবরদখল হয়ে যাওয়া সিংহাসন ফিরে পাক—অতএব যুদ্ধটা হোক। দ্রৌপদী চেয়েছিলেন যুদ্ধটা হোক—বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে তাঁর প্রতি যে অন্যায় এবং অসভ্য আচরণ দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা করেছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এত কিছুর পরেও একটা সময় পর্যন্ত পাণ্ডবরা যুদ্ধটা এড়াতেই চেয়েছিলেন। এমনকি যে ভীমকে আমরা ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক বলে জানি, সেই ভীমও দ্রৌপদীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধটা যাতে না হয়, সে চেষ্টাই করেছিলেন। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে পাণ্ডবদের দূত হয়ে স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ গিয়েছিলেন হস্তিনাপুরের রাজসভায় সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাব দুর্যোধন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, দূত অবধ্য জেনেও বাসুদেব কৃষ্ণকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিলেন।

দুর্যোধনের আরেকটা প্রকাণ্ড ব্যর্থতা আছে। তিনি আগাগোড়াই বাসুদেব কৃষ্ণকে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। যদি আমরা ধরেও নিই কৃষ্ণ কোনো অবতার নন, কিন্তু তিনি যে কত বড় স্ট্র্যাটেজিস্ট, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় তিনি যে তাঁর সময়ের চাইতে হাজার বছর এগিয়ে, এই ব্যাপারটা দুর্যোধন বুঝতে পারেননি। পাণ্ডবেরা সেটা বুঝতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই তারা কৃষ্ণের কয়েক অক্ষৌহিনী নারায়ণী সৈন্য নয়, বরং কৃষ্ণকেই তাঁদের পক্ষে টানতে চেয়েছিল। মহাভারতের যুদ্ধটা সেদিন অর্ধেকটাই জিতে নিয়েছিল যেদিন বাসুদেব কৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি হতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। চৈনিক সমরবিদ সান জু যেকোনো যুদ্ধকে যুদ্ধক্ষেত্রে গড়ানোর আগেই জিতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্জুন সেটাই করেছিলেন; দুর্যোধন সেটা করতে পারেননি, যদিও সেই সুযোগটা উন্মুক্তই ছিল।

এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কিছুটা দায় তাঁর নিজেরও ছিল। অথবা এমনও হতে পারে তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাক। শুরু থেকেই গান্ধারীর হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজকুমারের সঙ্গে বিয়েতে মত ছিল না। তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল এই বিয়েতে সম্মত হতে। সম্মত হয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। ভীষ্মের আদেশে তাঁর পিতাসহ গান্ধার রাজ্যের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাইকে কারারুদ্ধ করে খুন করা হয়েছিল। যে হত্যার প্রতিশোধ নিতে শকুনি হস্তিনাপুরে থেকে গিয়েছিলেন। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, শকুনির এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে গান্ধারী জড়িত থাকতে পারেন। সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় যখন বলা হয় দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা কেউ আসলে গান্ধারীর গর্ভজাত নয়। তিনি আসলে একটা মাংসপিণ্ডই প্রসব করেছিলেন। দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা আসলে ধৃতরাষ্ট্রের ওরসে দাসীদের গর্ভজাত সন্তান।

নিজের দোষ দেখতে না পাওয়া মানুষের সহজাত স্বভাব। গান্ধারী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস আমাদের জানিয়েছেন, গান্ধারী বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। এদিকে বাসুদেব কৃষ্ণ বিষ্ণুরই অবতার। যদিও ধরেও নিই তিনিও চেয়েছিলেন কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাক, কিন্তু সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা যে কী ভয়াবহ হতে পারে, সেটা চাক্ষুষ করার পর গান্ধারীর মধ্যে তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয়েছিল। তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণকে সামনে দেখে তাঁর ওপরেই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করতে চেয়েছেন। গান্ধারী হয়ত দেবতার গ্রাস কবিতার বিধবা মোক্ষদার মতো বলতে চেয়েছিলেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি কুরুবংশের ধ্বংস চাইলেও ঈশ্বর কেন সেটা হতে দিলেন? ঈশ্বর চাইলেই সবকিছু অন্যরকম করে দিতে পারতেন!

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929