দাদু কেন ধর্মত্যাগ করলো?
অশোক দাস চার্বাক
Nov. 26, 2024 | | views :2615 | like:2 | share: 2 | comments :0
"Cogito ergo sum : I think, therefore I am" - Descartes
শুধু আহার্য্যগ্রহন বাথরুমগমন আর শয্যাবিনোদনের সময়টুকু বাদ দিয়ে অনবরত চলতো তাঁর মালাজপা। এমন কি ঘুমের মধ্যেও। স্বপ্নের ঘরে প্রায়ই হরিনাম উদ্গিরণ হতো দাদুর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়িয়ে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে 'হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে' গেয়ে হরিনাম, ভোরে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হরিনাম, শুতে যাবার আগে হরিনাম, হাই তোলার পাপ করার পরে হরিনাম, হাঁচিকাশির পরে হরিনাম, আনন্দে হরিনাম, দুঃখে হরিনাম, গড়গড়ার হুঁকো টানতে টানতে হরিনাম - মানে সদাসর্বদা পুন্যকাম। পুন্যকাজে মন তাঁর অটল। মক্কেলদের ট্যাক্স ফাঁকি দেবার কৌশল বাৎলানোর ফাঁকে ফাঁকে, মেজদাদুর সাথে শেয়ারবাজারের পর্যালোচনা, রেডিওর খবর শোনা, পাশের বাড়ির জন্মশত্রু জ্ঞাতিভাইদের দাম্পত্য কলহে এরই পাতা, টিভির উন্মাদনৃত্য উপভোগ - কোনো কিছুই তাঁর মালাজপায় বিঘ্ন ঘটাটার পারতোনা। দাদু আমার সব্যসাচী। সব সময় তাঁর ঠোঁট কাঁপছে - গুরুবাবা গুরুবাবা আধবোজা আধ্যাত্যিক চক্ষুদুটি ভক্তিতে গদ গদ, ভাবের ঘোরে ঢুলু ঢুলু - মালা জপার বিরাম নাই। দিদার বানানো লাল ন্যাকড়ার মধ্যে হাতের মালা লুকিয়ে নিত্য তাঁর গুটি গোনার গুনগুনানি, পুন্যগোনার বিড়বিড়ানি। কপালে তিলক,গলায় তুলসী। শয়নে স্বপনে - বিজনে মননে অনুক্ষন তাঁর একই ভাবনা - পাপক্ষালন, আর পুণ্য অর্জন। বাড়িময় ধূপধুনোর ধূম্রদূষণ, কাঁসরঘন্টার ঝনঝনানি, রামভজনের প্যানপ্যানানি, শ্যাম বিরহের গানকাঁদুনি মধুমাখা কৃষ্ণনাম শুনতে শুনতে কান বিষতেতো যেত মামাবাড়ি এসে।
গঙ্গাতীরে প্ৰাতঃভ্ৰমণের সময় কীর্তনীয়াদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাচতে নাচতে কৃষ্ণনাম করতেন তিনি দুহাত তুলে। শরীর-স্বাস্থ্য, আনন্দ পুন্য বাড়তো তাঁর দেহ মন আত্মায় এক সাথে। পরিচিতদের সাথে দেখা হলে 'নমস্কার' না বলে বলতেন 'জয় গোবিন্দ-জয় নিতাই'। আলাদা কোন পরিশ্রম না করে বাড়তি পুন্য ফোকটে। স্নানের পর ঠাকুরঘরে পাক্কা আধটি ঘন্টা। সে ঘরের ঠাকুর সিংহাসনে ক্লাসিক্যাল ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মধ্যযুগীয় কালী মনসা, নবাগতা সন্তোষীমাতা জয়মাতাদি, অত্যাধুনিক চন্দ্রস্বামী, বালক-নাবালক, জেলমন্দিরবাসী খুনী রাম রহিম বাবা, পরমপূজ্য সপুত্র ধর্ষকবাবা শঙ্করাচার্য সবাই বসে থাকতো চোখবোজাদাদুর চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আশীর্বাদ দিতে দিতে। তাছাড়া দেওয়ালভর্তি দেওয়ালভর্তি অগুনতি ক্যালেন্ডার দেবতারাও পেরেকে দুলতেন পাখার হাওয়ায়। আবার রথের মেলা থেকে কেনা কাঠের যীশু পেরেকবিদ্ধ হয়ে ঝুলতেন সেখানে। মাটির এক বুদ্ধদেবও চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতেন কুলুঙ্গিতে বসে। কোন ভগবান খাঁটি, কোনটি ভেজাল সেসব ধর্মীয় কুটকাচালিতে না গিয়ে সব রঙের সব দেবতাদের আশীর্বাদ সাপটিয়ে শুষে নিতেন আমার দাদু। তাঁর শুধু এক ভয় নরকগমন, আর এক সাধ স্বর্গারোহন।
সব তীর্থ তাঁর সপূর্ণ। হরিদ্বার, হৃষিকেশ, কামরূপ, কামাখ্যা, গয়া কাশী কিচ্ছু বাকি নেই। রামকৃষ্ণ মিশন-ভারত সেবাশ্রমে নিয়মিত চাঁদা, এককালীন টাকা জমা দিয়ে পুরীদেবের কাস্টমার সার্ভিসে নাম রেজিস্ট্রি করে রেখেছেন দাদু। তাছাড়া কুষ্ঠাক্রান্ত ভিখারী, ফুটপাথকালী, বটতলাশিব, প্লাটফর্মশনি, ঝুপড়ীদরগা, বেদখলকারী শীতলা-মনসাদের দিকে পয়সা ছোঁড়া, পিতামাতাদের আত্মাধারী কাক কুকুর গুৰুজনাদিদের জন্য বাসি রুটিমুড়ি ছড়ানো কিচ্ছু বাকি রাখেন না তিনি। কালো পিঁপড়েসহ গৃহদেবতাদের পাতে নিয়মিত নকুলদানা প্রদানে হাড়কেপ্পন দাদু ছিলেন গৌরীসেন দরাজ।
আরো আছে। দাদুর পারিবারিক গুরুবাবা বছরে দু-দুবার দাদুর বাড়িতে দেহ ফেলতেন ক'দিনের জন্য। সাথে আসত একপাল মেদটেপা চেলা, কল্কিসাজানো চামুন্ডা, আর প্রচার টাউট উমেদার। সেদিন তাঁদের সেবার্থে অন্যান্য উপকরণসহ প্রচুর ঘি আর গাঁজা আনতে হতো। সেই ঘি বাবার মেদরক্ষা আর গাঁজার ধোঁয়ায় তাঁর মগজ-আত্মাটা থাকত আধ্যাত্বিক। আর এই সব দানধ্যান, ঘৃত-গঞ্জিকা, রামনাম কৃষ্ণনাম বৈদিক প্রক্রিয়ায় পুণ্যে রূপান্তরিত হয়ে দাদুর আত্মাকে করতো টইটুম্বুর।
এহেন পূর্ণধার্মিক দাদু সর্ব প্রকার ধর্ম অভিনয় ছেড়েছুঁড়ে ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত সাধুপুরুষ হয়ে গেছেন। আশৈশব বয়ে বেড়ানো ধর্মের আবর্জনার গুরুভার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে হয়ে গেছেন সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী ভদ্রলোক - সাহসী মুক্তপুরুষ। চিত্ত হয়েছে তাঁর ভয়ভীতিশুন্য। দেবদেবীদের পাত্তাই দিচ্ছেন না আর। একেবারে ডোন্ট কেয়ার ভাব। দশ আঙুলের তের গ্রহরত্ন আঁটানো আংটি, দুই বাহুতে চার চারটে তাবিজ,গলার রুদ্রাক্ষের মালা - সব নাকি তিনি নর্দমায় বিসর্জন দিয়েছেন প্রবল ঘৃনায়। তিনি এখন বাগান করছেন, ছবি আঁকছেন, উপন্যাস পড়ছেন, দিদার সাথে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন ! না, না, "বাবা তারকনাথ", "জয় সন্তোষীমাতা" নয়, - একেবারে সত্যজিৎ-তপন সিনহা, উত্তম-সুচিত্রা,শাহরুখ-কাটরিনা। এমন কি কদিন আগে নাকি দার্জিলিং আগ্রাও ঘুরে এসেছেন সদিদা।
তীর্থযাত্রা নয় - ট্যুর, ধর্মনিরপেক্ষ ভ্ৰমণ। তাজ্জব কি বাত।
দাদুর কথাবার্তা হাবভাবও অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। বেচারা গুরুদেবের টাউটটা মাসিক তোলা চাইতে আসতে স্রেফ হাঁকিয়ে বলে দিলেন গুরুবাবাকে ভদ্রলোকদের মত খেটে খেতে। গুরুবাবারা নাকি সভ্য লোকেদের মত গতর খাটিয়ে মেদরক্ষা করবেন ! বেচারা দাদুর মাথাটা গেছে একেবারে। মাসকাবারী ঠিকে উড়িয়া দাঁতফোকলা পুরুতটা টিকিতে ফুল গেঁথে,তেলচিটে পড়া মোটা পৈতে দুলিয়ে সাত সকালে আসত ছুটতে ছুটতে। সোজা ঠাকুরঘরে ঢুকে ঠাকুরঘরের গৃহপালিত দেবদেবীদের মুখে ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরনো পানচেবানো লালথুথু ছেটাতে ছেটাতে কি সব দুর্বোধ্য এট্যাং দেহি ওটাং দেহি মন্ত্র বিড়বিড় করে বলেই ঝড়ের বেগে বলে যেত তেনাদের। সবশেষে দাদুর কপালে লাল হলুদের দুরঙা টিপটা লাগিয়ে দিয়েই পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাতো সে পাশের বাড়ির ষাটটার দোকানে ঝুলিয়ে রাখা গণেশকে মালা পরাতে। এখন এ বাড়ির হাতখোলা খদ্দেরটা হয়েছে তার হাতছাড়া। মাসে সাত টাকা আয় গেছে তার কমে। পলিথিন ব্যাগে বন্দি হয়ে গৃহদেবতাগণ ঠাঁই পেয়েছেন গুমঘরে - বাতিল করা ভাঙা আসবাবের সাথে। খালি ঠাকুরঘরে দুটো আলসেশিয়ান বাঁধা। দাদুর নতুন পোষ্য - তাঁর নতুন নেশা।
কী হতে পারে? বুড়ো বয়সে ভীমরতি, না কোনো দুষ্ট গ্রহের বৈদিক অভিশাপের প্রভাব? কোন কুসংসর্গের ফলও হতে পারে। যেভাবে যুক্তিবাদী ছেলে ছোকরারা মনোবিকারের চিকিৎসা করা শুরু করেছে! হয়তো দাদুর পবিত্র আধ্যাত্বিক পাগলামী সেরে গেছে। কিংবা এও হতে পারে - সারা জীবন খেটেখুটে জমানো পুণ্য ফিক্সট ডিপোজিট করে মূল পুণ্য বাড়াচ্ছেন সুদ খাটিয়ে। এখন তাঁর অবসরপ্রাপ্ত পেনশনারদের মত নিশ্চিন্ত অলস জীবন। বিনাশ্রমে পুণ্য বেড়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে। সে পুণ্য ভোগ করবেন পরের জন্মে।
দিদাও তাই। বাংলা ক্যালেন্ডার পঞ্জিকায় যত ব্রত আছে (শুধু শিবরাত্রি ছাড়া - কেন না ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি যদি শিবঠাকুরের মত ড্রাগএডিক্ট হয়ে যান!) সব তিনি পালন করতেন পরম নিষ্ঠায়। গতবারও দেখেছি মামাবাড়ীতে পৌষমাসের পিঠেপুলি খেতে এসে। সকাল সন্ধ্যা পূজাপাঠ, শঙ্খ ফোঁকা, কপালে সিঁদুর লেপা,ঘন্টা বাজিয়ে দেবদেবীদের ঝিমুনি ভাঙানো - কিচ্ছু বাদ দিতেন না দিদা। শরীর মন সদা পবিত্র রাখতে সারাদিন বারে বারে স্নান করছেন, হাত ধুচ্ছেন, মাজা বাসনগুলোও, বারে বারে মাজছেন, বারান্দায় ছেটাচ্ছেন গঙ্গাজল, উঠোনময় গোবরজল - হাতে তাঁর ধর্মজাত পবিত্র হাজা। তাঁর দেহ পবিত্রবাতিকতা দেখে অনেকে পুনর্জন্মবাদীরা অনুমান করতেন দিদা বুঝি আগের জন্মে মেথরানী ছিলেন। তাঁর ধর্মনেশা আর শুচিবাইয়ের ঠেলায় অতিষ্ট হয়ে আমার মামীরা স্বামীপুত্র সহ বেপাড়ায় ফ্লাট বাড়িতে পালিয়ে বেঁচেছেন। মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে রান্নাঘরের উপস্থিত বাসন কোসন, ঘরের আসবাবপত্র কিংবা বাগানের গাছ বা বিড়ালটার কাছে অনুপস্থিত পুত্রপুত্রবধুদের অবিরাম নিন্দা কীর্তনের ফাঁকে পরম নিশ্চিন্তে তিনি দেবসেবা ও পরমগুরু পতিদেবতার চরণবন্দনা করতেন নিরুপদ্রব খালি বাড়িতে।
এহেন দিদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ষোঢ়শীর মত উচ্ছল। হয়েছেন পতি পরম গুরুর অনুগামিনী জীবনমুখী সহধর্মিনী। নিজের হাতে অপবিত্র মুরগীর ঝোল রান্না করছেন নাতির জন্য। তাও আবার তাঁর শুচিশুদ্ধ রান্নাঘরে। হয়তো একদিন আমার বাড়ির মত গোমাংসও ঢুকবে সে রান্নাঘরে। ঐ রান্নাঘর শুচিশুদ্ধ রাখা নিয়ে মামীদের সাথে এই গত বছরেরও দেখেছি নিত্য ঝগড়া। এখন সব অন্য রকম। দিদার গলার হারে লোকনাথের জায়গা দখল করেছে বাহারী লকেটে ! ফুল পাতা দেবতার সিংহাসন থেকে উৎখাত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে টেবিলের ফুলদানিতে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জায়গায় অপবিত্র নজরুল রবীন্দ্রনাথ সেন্টার টেবিলে। কপালের পুরুষতান্ত্রিক সিঁদুর, হাতের নোয়া শাঁখা, মাথার ঘোমটা সব হওয়া। দুনম্বরী লোকদেখানো বাজারচলতি নারীবাদী নয়,একেবারে যুক্তিবিজ্ঞান সম্মত আধুনিক। বুড়ী কলজের এলেম আছে দেখছি। তবে খুব উল্টোপাল্টা গোলমেলে ব্যাপার। পাঠকদের মনে হবে এ সব বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি।
- দুই -
- হটাৎ তোমরা এমন পাল্টি খেলে কেন দাদু?
- ধর্মকর্ম সব ছেড়ে দিলাম দাদুভাই।
- সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তুদিন কেন?
- অনর্থক পুণ্য করতে গিয়ে একটি মাত্র মানবজীবন হেলায় হারাচ্ছিলাম। দিন গেল বৃথা কাজে হরিনাম ভজে .... মানে ঐ সব আর কি। বুড়ো বয়সে মনেও থাকে না শ্লোকগুলো। যাই হোক, better late than never, শেষ জীবনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সব ছেড়ে মনোমধর্ম নিয়েছি। মানুষই আমার দেবতা। দেবপূজার ভড়ং না করে স্বামী বিবেকানন্দের পথ ধরে মানবসেবা, মানবপূজার ধর্ম নিয়েছি।
- তুমি যে মহাপাপী নাস্তিকদের মত কথা বলছ দেখি। মরার পর তুমি ভিখারী হয়ে জন্মাবে, নরকেও ঠাঁই হবে না তোমার। দেখে নিও।
- দেখে নেবার সুযোগ কোথায় রে হতভাগা? Dust thou art, মরার পরে and dust returneth.ধুলায় মিশে যাব আমি মরণের পরে। স্বর্গে বা নরকে গিয়ে অথবা পুনর্জন্ম লাভ করে কেউ কখনো পাপের শাস্তি পেয়েছে, না পুন্যকাজের পুরস্কার ভোগ করেছে বলে শুনেছিস, না দেখেছিস। সবইতো পুরুত সাধুসন্ত গুরুবাবা ধর্মজীবি পরজীবীদের রটানো গুজব।
-এসব অঙ্ক তোমায় কে শেখাচ্ছে দাদু?
- আমার নবগুরু বোস সাহেব। ওনার কাছেই দীক্ষা নিয়েছি আমি। সাহেবগুরু আমার চোখ খুলে দিয়েছেন রে ভাই। এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম। পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখিনি এতদিন। তোদের সুন্দরী দিদার রোমান্টিক মুখটাও এতদিন দেখিনি ভালো করে। ভুবনের আনন্দধারা উপভোগ করিনি। এখন যৌবনের দিনগুলো হারিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে। খুব। যজাতির মত বা আশিতে আসা ভানু ব্যানার্জীর মত যুবক হয়ে আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোর দিদা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না আমার বিয়ে দিতে। প্রেমই করতে দেয় না, তার বিয়ে।
- কে তোমার সাহেবগুরু দাদু?
- তিন -
- চা জলখাবার খেয়েছিসতো?
- একগাদা পিঠেপুলি পাটিসাফটা খেয়ে তোমার জন্য বসে আছি। দিদা বললো তুমি নাকি আজকাল হরিসভায় না গিয়ে মর্নিং ওয়াক করছো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছ। কিন্তু তোমাকে যৌবনধর্মে দীক্ষিত করলো কে?
- তা হলে প্রথম থেকেই বলি। নতুন ট্যাক্স অফিসার জেলায় জয়েন করেছেন শুনে অন্য উকিল যাবার আগে তড়িঘড়ি সাহেবের বাংলোয় ছুটে গিয়েছিলাম। সাথে নিয়েছিলাম ঘোষ সুইটস থেকে কেনা একটা বিশাল সন্দেশের প্যাকেট, আর এক বোতল মোরব্বা আর তোদের দিদার ঠকুরবেদীর কিছু ফুল বেলপাতা। প্যাকেটগুলো ভক্তিভরে টেবিলে রেখে নমস্কার করে বললাম "আপনি এ জেলায় এসেছেন শুনে বাবা বক্রেশ্বরের প্রসাদ নিয়ে এলাম আপনার নাম পুজো দিয়ে। আর সিউড়ির বিখ্যাত মোরব্বা। খেয়ে দেখুন। "
- ওসব প্রসাদ আমার চলে না উকিলবাবু, আমি ঘোর নাস্তিক। অযথা আপনাদের ঠাকুরদেবতাদের চাটুকারিতা খোশামোদ করে সময় নষ্ট করি না। ওগুলো আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। নাতিপুতিদের খাওয়ান ওগুলো।
বললাম," কি বলছেন স্যার, এসব বাক্য উচ্চারণ করা পাপ। এখানকার বাবা বক্রেশ্বরের আর তারাপীঠের তারা মায়ের মহিমা বোধ হয় আপনি জানেননা স্যার। কোনো সাহেব এনাদের আশীর্বাদ না নিয়ে এ জেলার চেয়ারে বসেননি কখনো।
- বেচারাদের জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার। এতো কষ্ট করে আপনারা ধর্মাচরণ করে পুন্য করছেন,, আর আর তার সুফল ভোগ করবেন আপনাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় কোন একজন মানুষ যে এখনো জন্মায়নি এ পৃথিবীতে।
- বুঝলাম না স্যার,একটু খোলসা করে বলুন।
- আপনার পার্থিব শরীরে দেহ ও মন ছাড়াও একটা ২১ গ্রাম ওজনের প্রাকৃতিক অঙ্গ আছে বলে আপনি বিশ্বাস বা অনুমান করেন। আপনার দেহ ও স্নায়ুতন্ত্র চালিত মন নশ্বর। সেগুলো আপনার মৃত্যুর পরে ধংশপ্রাপ্ত হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু শাস্ত্রকল্পিত সেই আত্মাটা অবিনশ্বর। দেখা যাচ্ছে আপনার অনুমিত আত্মাটার কোন মনও নেই, আবার স্মৃতিও নেই। তার প্রমাণ হচ্ছে আপনার শরীরের কোনও এক অনাবিষ্কৃত অংশে আপনার অনুমিত আগের জন্মের মৃত ব্যক্তির আত্মা সাঁটানো আছে সে অঙ্গটি আগের জন্মের সব কিছু ভুলে গেছে। আর এক বার বলি, আগের জন্মে যে মৃত ব্যক্তিটির দেহে যে আত্মাটি বাস করতো তার কথা আপনার মনে নেই।
- মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার আপনার কথা শুনতে শুনতে।
- বিষয়টা যে খুবই জটিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার ভাষার দারিদ্রের কারণে আমিও হয়তো ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। এবার আর একবার আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি। আমার তথাকল্পিত আগের জন্মে যে অজানা মৃত ব্যক্তির দেহে আমার আত্মাটা বাস করতো, সে ব্যক্তির কথা আমার বা আমার আত্মাটার কিচ্ছু মনে নেই। আপনাদের বাপ দাদারা শিশু বয়সেই তাঁদেরও পূর্বপুরুষ থেকে বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধ্যান ধারনার ছাঁচ আমার আপনার সবার অপরিনত কাঁচা মনে ছেপে দিয়েছেন গায়ে কাদামাটিতে টেরাকোটা চাপানোর মত। ছাঁচে ছাপা সেই সনাতনী মৌলবাদী ধ্যানধারনা স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে মননহীন,যুক্তিহীন, প্রশ্নহীন পরিবর্তনভীরু নিশ্চল অলস স্থবির মনে। আমার মত অল্প কিছু কৌতূহলী সাহসী মানুষ নরকের ভয় না পেয়ে মনন করতে করতে নিজের নিজের মনের সেইসব আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ করতে পারে। যারা তা পারেনা তারা মনে করে মৃত্যুর পরে দেহ মন ধংস হলেও আত্মা অমর অবিনশ্বর। তারা ভাবে সেই আত্মা ঈশ্বরের অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ। কোন অজ্ঞাত কারণে ঈশ্বরের সেই অংশ অর্থাৎ আমার আত্মাটাকে পুন্যপুষ্ট করার গুরু দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে, এবং এও ধরে নিচ্ছি যে আমার শরীর ও মন তার কাজকর্মের দ্বারা ঐ আত্মাটাকে পাপে বা পুণ্যে পুষ্ট করে, এবং সেই পুষ্টি অনুযায়ী আমার মৃত্যুর পর আমার আত্মাটা পরজন্মে ফলভোগ করবে অথবা অদৃশ্য কোনো একটা স্বর্গে বা নরকে যাবে। এইতো আপনাদের বিশ্বাস?
- এটা শুধু নিছক বিশ্বাস নয় স্যার, এটাই পরম সত্য। সব ধর্মের সার কথা। এই আধ্যাত্বিক লোভেইতো মানুষ ধর্মাচরণ করে।
- ঠিক আছে, এবার আমার দিকে মন দিন। আপনার মত গন্যমান্য মানুষেরা আমায় কত খাতির করছেন। অন্ততঃ খাতির করার ভান করছেন। আপনাদের শহরের সবচেয়ে ধনী পুরুষোত্তম আগরওয়ালাও এই খানিকক্ষন আগে একটা ঢাউস মিষ্টির প্যাকেট কোনো মিঠাইৰ দোকান থেকে কিনে বাবা বজরংবলীর প্রসাদ বলে ভেট দিতে এসেছিলেন। আমি কিসে তুষ্ট হবো এই চিন্তায় কুল পাচ্ছেন না আপনারা। আমি থাকি বিনি ভাড়ার বাংলোয়, জনগণের পয়সায় তেল পুড়িয়ে ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়াই। ক্ষমতা ও বিলাসের স্বর্গসুখ আমার হাতের মুঠোয়। অথচ আমার মত ধর্মীয় শাস্ত্রসম্মত পাপী ভূ-ভারতে আর কে আছে? আপনাদের বাবা বা গুরুবাবাদের এক ছিলিম গাঁজাতো দূরের কথা এক বান্ডিল বিড়ি দিইনি সারা জীবনে। শনি কালী লোকনাথ রামরহিমবাবাদের পাতে নকুলদানাও দিইনি। বখরি ঈদ খ্রিস্টমাসে মুসলমান ক্রিষ্টান আত্মীয়দের বাড়ীতে নিষিদ্ধ খাদ্য খেয়ে আসি। তবু আমি এত স্বর্গসুখ ভোগ করি কোন বিচারে?
- সে আপনার পূর্বজন্মের পুণ্যফল।
- ধরে নিলাম তাই। অর্থাৎ আপনি বলছেন যে আমার পূর্বজন্মে যে ভদ্রলোকটি হাড়মাস কালি করে জীবনভোর পৃথিবীসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে যে পুন্য সঞ্চয় করেছিলেন সেই পুণ্যফল আমি ভোগ করছি। সে বেচারা কষ্ট করে পুন্য করলো, আর তার ফলভোগ করছে আমার মত মহাপাপী! এতে ঐ ভদ্রলোক, ধরুন ঈশ্বর অক্ষয় ঘোষাল - সে বেচারা কি পেল?
- স্যার, প্রয়াত ঐ অক্ষয়বাবুর আত্মাইতো তার পুণ্যফল ভোগ করছেন আপনার শরীরের মাধ্যমে।
- মেনে নিলাম আপনার কল্পনা বা অনুমান। ধরে নিলাম আপনার যুক্তি একেবারে খাঁটি বাস্তব। কিন্তু মৃত অক্ষয়বাবুর আত্মা আমার মাধ্যমে তাঁর পুণ্যফল ভোগ করলেও সেই অক্ষয়বাবুর যে এতে কোনো লাভ হয়নি সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? তিনিতো আর ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন বা এই বাংলাবিলাস, আপনাদের দেওয়া ভেটবিলাস উপভোগ করতে পারছেননা। ফাঁক থেকে ভোগ করছে আপনাদের এই বোসসাহেব। গাছ লাগলো একজন,আর তার ফল ভোগ করলো তার অপরিচিত অনাত্মীয় অন্য একটি মানুষ। আমি আমার আত্মার প্রাক্তন মালিক ও পুন্যপুষ্টকারী অক্ষয়বাবুকে কৃতজ্ঞতা জানানোতো দূরের কথা, তাঁকে চিনিই না।
- এরকম কথাতো জীবনে শুনিনি। একটু ধাতস্থ হতে দিন। আর একবার আর একটু সরল সহজ করে বলুন স্যার। এরকম ব্যাখ্যা কোনো শাস্ত্রে পড়িনি আগে।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। কয়েকটা কাল্পনিক উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি শীঘ্র আপনার ভগবানের সাথে মিলিত হবার বাসনায় আত্মহত্যা করার জন্য গলায় দড়ি দিলেন। পুলিশ এসে সিলিং ফ্যান থেকে আপনাকে নাবিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তারবাবু 'braught dead' লিখে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। আর কোন দেরি না করে আপনার দেহ থেকে আপনার চোখদুটো উপড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওটাকে একটি অন্ধ মানুষের চক্ষুকোটরে বসিয়ে দিলেন কোন এক চোখের সার্জন। সেই অন্ধ মানুষটি তখন আপনার চোখ দিয়ে পৃথিবীর স্বর্গীয় দৃশ্য দেখবে। কিন্তু আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। কেননা আপনার অপটিক্যাল নার্ভগুলি সেই অন্ধ বেক্তিটির মাথায় জুড়ে গেছে। সেই একইভাবে আপনার মৃত্যুর পর স্বামী নিগুড়ানন্দজীর মত কোন আত্মা স্পেশালিস্ট সার্জন ব্রেনডেথের কারণে মৃত কোন এক আত্মাহারা বেক্তির দেহে আপনার পুণ্যপুষ্ট আত্মাটিকে বৈদিক পদ্ধতির সাহায্যে আপনার দেহের আত্মাকোটরে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই মৃত ব্যক্তির মৃতদেহটি আত্মা ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর আপনার চক্ষু পাওয়া অন্ধ মানুষটির পৃথিবীদর্শনভোগের মত আপনার কষ্টার্জিত পুণ্যফল ভোগ করবে আপনার পবিত্র আত্মার দখল পেয়ে। যেমন আপনার চোখটি অন্ধমানুষটির চক্ষুকোটরে ঢুকে তাকে দৃষ্টিশক্তি দিলেও আপনি কিছু দেখতে পাবেননা, তেমনি আপনার আত্মাটা আপনার পরজন্মের দেহে থাকলেও আপনি অর্থাৎ নবজন্মের দেহটি পাবে লবডঙ্কা।
আবার দেখুন, এই যে সব ধনী,কোটিপতি, দুর্নীতিগ্রস্থ মাননীয় নেতা মন্ত্রী,সম্মানীও কয়লামাফিয়া গরুপাচারকারী অথবা প্রণম্য অসৎ চাকরীচোর শিক্ষক ইত্যাদি চোরাকারবারিরা রাজবিলাস উপভোগ করছে, ঠান্ডা গাড়িতে বেড়িয়ে স্বর্গসুখ ভোগ করছে, তাদের আত্মাগুলি নিশ্চই পূর্বজন্মে সফল গুরুবাবা অথবা আপনার মত পুণ্যাত্মার মানুষের ছিল। সেইসব পূজ্য দেবতাসমান মানুষদের বিদেহী আত্মা পূর্বজন্ম অর্জিত পুণ্যের প্রভাবে আজ এ জন্মে নেতা মন্ত্রীসুখ, চোরাকারবারীসুখ ইত্যাদী নানা সুখ ভোগ করছে। হতভাগ্য ঐসব আহম্মকদের এত কষ্টের অর্জন করা পুণ্যের ফলভোগ করছে কিনা আমার মত পাপী তাঁদের অপরিচিত মানুষেরা !
এবার ঐ রাস্তার কুষ্ঠরোগীটির দিকে তাকান, কিংবা কোন জন্মান্ধ বা কোন জন্মবিকলাঙ্গ শিশুটির কথা ভাবুন। কত কষ্ট পাচ্ছে তারা। জীবিত অবস্থাতেই নরকযন্ত্রণা। অথচ ওরা জন্মের দিন কোনো সুযোগই পায়নি পাপ করবার। ওদের আত্মার পূর্বতন মালিকরা, মনে করুন আমার মত নাস্তিক মহাপাপী কোন বোস সাহেব অথবা পাপিষ্ট চূড়ামনি প্রয়াত হিটলার যত পাপ করেছিল ওদের জীবিত অবস্থায়, তাদের কর্মফল ভোগ করছে ঐ কুষ্ঠরোগীট বা জন্মান্ধ, জন্মবিকালঙ্গ মানুষগুলো! আপনাদের শাস্ত্রীয় অনুমান অনুযায়ী প্রয়াত হিটলারের আত্মা তথাকল্পিত ঈশ্বরদের বিচারে ঐ হতভাগ্য মানুষগুলির শরীরে আশ্রয় পেয়ে শাস্তিভোগ করলেও হিটলার স্বয়ং কিন্তু কোনও শাস্তি পাচ্ছে না। কি অবিচার!
তবে হ্যাঁ, যদি আপনি মারা যাবার পর আপনার মন মগজটাও আপনার আত্মার সাথে সাথে আপনার উত্তরজন্মের মানুষটির দেহে ট্রান্সফার করে দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো আপনার ইহজন্মের পুণ্যফল বা পাপফল আপনিই ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে প্রকৃতি সে ব্যবস্থা রাখেনি। আর আপনাদের পবিত্র শাস্ত্রগুলোও আপনাদের মগজগুলোকে আত্মার মত অবিনশ্বর করে সৃষ্টি করেননি। সাধুসন্তরা আত্মার মত মন অর্থাৎ মগজটাকে শ্রাদ্ধশান্তির সময় দেহান্তরে চালান করবার ফন্দিফিকির শেখাননি পুরুতঠাকুরদের। মরার পর আপনার তথাকল্পিত অবিনশ্বর আত্মা বেঁচে থাকলেও আপনার মন ও স্মৃতি আর কার্যকরী থাকছে না। অর্থাৎ আপনিও আর থাকছেন না। স্বর্গেও না, মর্ত্যেও না। কেন না আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে আপনার মরণশীল স্নায়ুতন্ত্রটি ধংশপ্রাপ্ত হবে। আর আপনার পূর্বজন্মের মন চিন্তা করতে না পারলে আপনার অস্তিত্ব আর থাকে কী করে? আমার বর্তমান মন যদি আমার মৃত্যুর পরেও চিন্তা করতে পারত, অন্তত আমার আত্মাটাও যদি তা করতে পারত, তাহলে আমিই আমার পুন্যকাজের পুরস্কার বা পাপের শাস্তি পেতে পারতাম। আর তা যে সম্ভব নয় তার প্রমান আমি আপনি সবাই। কেউই আমরা তথাকথিত তথাকল্পিত আমাদের পূর্বজন্মের আত্মাধিকারীর স্মৃতির উত্তরাধীকার পাইনি। অতএব আপনার মৃত্যুর পর আপনার পাপ পুণ্যের ফলাফল ভোগ করবার কোন আশা নেই। যান, মরে যাবার আগে বাড়ি গিয়ে বুড়িকে নিয়ে নাইট শো দেখে আসুন।
- চার -
সেদিন বাড়ি ফিরে সারারাত এতটুকু ঘুমাইনিরে দাদুভাই। মনে হলো ধম্মকম্ম করতে করতে আমার মনুষ্যসুলভ যুক্তিবাদী স্বত্বাটি (rationalist) আমার মনের অজান্তে উবে গিয়ে ধর্মময় হয়ে গেছে। যুক্তিবাদী মন হারিয়ে আমি আর মানুষ নেই। মননহীন পশু হয়ে গিয়েছি। সাহেবের কথাগুলো ভাবছি আর ঘামছি। চোখে নিদ্রা নেই। তোদের দিদাকে সব কথা বললাম খুলে। তখন তারও আমার মত সেই একই অবস্থা।
ভোর রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা কুস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখলাম আমি মরে গেছি। আমার দেহটাকে মর্গের থেকে নিয়ে যাবার আগে গবেষণার জন্য বৈজ্ঞানিককে দেখি এক ডাক্তারবাবু আমার মগজ বা মনের কলা, অর্থাৎ পুরো স্নায়ুতন্ত্রটা গোপনে একটা বোয়ামে রেখে দিলো অ্যালকোহলে চুবিয়ে। তবে আমার আত্মাটাকে কব্জা করতে পারল না সে। ফুড়ুৎ করে উড়ে মর্গের ঘুলঘুলি দিয়ে পালিয়ে গেলো সে আত্মাটা। সেঁধিয়ে গেল সেটা আমার জন্মশুত্রু রামহারামী ফিরোজ উকিলের পুত্রবধূর পেটের ছেলেটার দেহে। বাকি দেহটা তোদের মামারা 'বলহরি বলহরি' বলতে বলতে চলতে লাগলো নিমতলার দিকে। কিন্তু তখনও আমি, মানে বোয়েমে রাখা আমার মনটা সব ভাবতে পারছে পুরান জীবনের কথা। দেখলাম সে হতচ্ছাড়া আমার আত্মধারী ম্লেচ্ছ নাতিটা আমার পুণ্যাত্মার দখল পেয়ে সুন্দর চেহারা, স্কুল কলেজের পরীক্ষায় সুন্দর ফল, লটারির পুরস্কার, আমার বাঁধা মক্কেল, মদের দোকানের লাইসেন্স - সব কিছু হাতাচ্ছে। অকৃতজ্ঞ অব্রাহ্মণটা আমাকে একটা ধন্যবাদও পর্যন্ত দিচ্ছে না। ম্লেচ্ছ নাতিটার ব্রাহ্মণ আত্মাটা গায়ত্রীমন্ত্র ভুলে আল্লা আকবর বলে আজান দিচ্ছে গলা ফুলিয়ে। কেমিক্যালে ডোবানো আমার মন-আমার মগজের সাহায্যে বোতলের কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম সব।
ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে ঘুম ভেঙে ভাবতে লাগলাম আকাশ পাতাল। আমৃত্যু এত কষ্টে তিল তিল করে জমানো পুন্যগুলো সব ভোগ করবে কিনা ফিরোজ উকিলের নাতি! আমার ডজন ডজন বাঁধা মক্কেলগুলো ওর চেম্বারে লাইন মারবে ! কোভভি নেহি। সেদিন থেকে সব ছেড়েছি। এখন আমার স্বর্গের লোভ নেই, নরকের ভয়ও নেই। আর তাই ধর্ম করার দরকারও নেই। আমি এখন ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সাহসী মানুষ।