একটি নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞ কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমি যে বিশ্বাস করি না, এর কারণ কি আমার আত্মম্ভরিতা? আমি কখনও কল্পনা করিনি যে আমাকে এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে আমার মনে হচ্ছে যে, আমার বন্ধুদের কয়েকজন (তাঁদের বন্ধু বলে ভেবে যদি না আমি অনেক বেশি দাবি করে থাকি) আমার সঙ্গে তাঁদের স্বল্প পরিচিতির ফলে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা আমার দিক থেকে খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং কিছুটা আত্মম্ভরিতাই আমার অবিশ্বাসের কারণ! এমন অহংকার আমার নেই যে আমি এই সমস্ত মানবিক বৈশিষ্ট্যের উপরে। আমি একজন মানুষ এবং তার চেয়ে বেশি কিছু না। এর চেয়ে বেশি দাবি কেউ করতেও পারেন না। আমাদের কমরেডদের মধ্যে আমাকে একজন স্বেচ্ছাচারী বলা হত। এমন কি আমার বন্ধু বি. কে. দত্তও কখনও কখনও আমাকে এই সব বলেন। কোনো কোনো সময় স্বেচ্ছাচারী বলে আমাকে ধিক্কারও দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বন্ধু খুব গুরুত্বের সঙ্গেই অভিযোগ করেন যে, আমি নাকি আমার মতামত ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের উপর চাপিয়ে দিই এবং আমার প্রস্তাব পাস করিয়ে নিই। এ যে কিছুটা পরিমাণে সত্য তা আমি অস্বীকার করি না। এ আত্মশ্লাঘা হতে পারে। অন্যান্য জনপ্রিয় মতাদর্শের পাশাপাশি আমার মধ্যে এবং আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও আত্মম্ভরিতা আছে, কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কিছু নয়। হয়তো আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে এ আমার ন্যায়সঙ্গত গর্ব, দম্ভ নয়। কারও মধ্যে অহেতুক গর্বের আতিশয্যই হল দম্ভ অথবা সঠিকভাবে বলতে গেলে অহংকার। এই রকম কোন অহেতুক গর্ব আমাকে নাস্তিকতার দিকে টেনে এনেছে না কি এবিষয়ে সযত্ন চর্চার ফলে এবং যথেষ্ট বিবেচনার পরই আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করতে আরাম্ভ করেছি, সেই কথাই আমি এখানে আলোচনা করতে চাই। প্রথমেই আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আত্মশ্লাঘা এবং দন্ত দু'টি আলাদা জিনিস।
প্রথমত, আমি একেবারেই বুঝতে পারি না যে কি করে অহেতুক গর্ব বা আত্মশ্লাঘাবোধ কোন মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের অন্তরায় হতে পারে। বিখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত না হয়েও বা প্রয়োজনীয় গুণাবলীর অধিকারী না হয়েও কিছুটা খ্যাতি যদি আমি অর্জন করে ফেলি তাহলে প্রকৃতই মহৎ এমন কোন ব্যক্তির মহত্ত্বকে আমি হেয় করতে পারি। এটুকু না হয় বোঝা যায়। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দম্ভের জন্য কিভাবে একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী, অবিশ্বাসীতে পরিণত হতে পারে? শুধুমাত্র দু'টি উপায় আছে। হয়, সেই ব্যক্তিকে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবতে হবে, নয়ত তাকে নিজেকেই ঈশ্বর বলে ভাবতে হবে। কিন্তু এরা কোনভাবেই যথার্থ নাস্তিক হতে পারছে না। প্রথম ক্ষেত্রে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্বই অস্বীকার করছে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও সে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে পর্দার আড়ালে কোনো সচেতন সত্তার উপস্থিতিকে স্বীকার করছে। সে নিজেকেই ঐ পরম সত্তা মনে করে কিনা কিংবা পরম সত্তাকে তার থেকে স্বতন্ত্র কোন কিছু ভাবে কিনা আমাদের কাছে তার কোন গুরুত্ব নেই। মূল কথাটা ঐখানে। তার বিশ্বাস ঐখানেই। কোন মতেই সে নাস্তিক নয়। তাহলে, প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কোন দলেই আমি পড়ি না। কেননা ঐ সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্বকেই আমি অস্বীকার করি। কেন করি সে আলোচনা পরে করা যাবে। এখানে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই, তা হল আমার দম্ভ আমাকে নাস্তিকতার তত্ত্ব গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছে - এটা ঠিক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী অবতার বা স্বয়ং সেই পরম সত্তা ইত্যাদি কোনো কিছুই আমি নই। একটা বিষয় তাহলে স্থির হয়ে গেছে যে, এমন একটা চিন্তাধারায় পৌঁছানোর কারণ আমার দম্ভ নয়। এই অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য ঘটানাগুলোর বিচার করা যাক। আমার এই বন্ধু-বান্ধবদের মতে আমার অসার আত্মশ্লাঘার কারণ সম্ভবত দিল্লির বোমা মামলা এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে আমার অহেতুক জনপ্রিয়তা অর্জন। বেশ, তাহলে তাদের যুক্তি সঠিক কিনা দেখা যাক। আমার নাস্তিকতার জন্ম খুব সাম্প্রতিককালে নয়। আমি যখন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক ছিলাম তখন এই বন্ধুরা কেউ আমায় চিনতেন না, তখনই আমার মধ্যে থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস চলে গেছে। সামান্য একজন কলেজ ছাত্রের মধ্যে কোন দাম্ভিকতা থাকতে পারে না, যা তাকে নাস্তিকতার পথে ঠেলে দিতে পারে। যদিও আমি কিছু অধ্যাপকের প্রিয় ছিলাম, কয়েকজনের অপ্রিয়ও ছিলাম, ছাত্র হিসেবে কিন্তু কখনই পরিশ্রমী বা মনোযোগী ছিলাম না তাই দাম্ভিকতার মতো কোনো অনুভূতি পোষণ করার সুযোগই আমি পাইনি। বরং বলা যায় আমি ছিলাম বেশ লাজুক স্বভাবের ছেলে, ভবিষ্যৎ জীবনধারা সম্পর্কে যার মনোভাব ছিল নৈরাশ্যজনক। ঐ সময়ে আমি পরিপূর্ণ নাস্তিক ছিলাম না। আমার ঠাকুরদা, যাঁর প্রভাবে আমি লালিত পালিত তিনিই ছিলেন একজন গোঁড়া আর্য সমাজী। একজন আর্য সমাজী আর যাই হোক নাস্তিক নন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আমি লাহোরের ডি এ ভি স্কুলে ভর্তি হই এবং পুরো এক বছর ওখানকার ছাত্রাবাসে ছিলাম। সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা ছাড়াও আমি ঘন্টার পর ঘণ্টা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতাম। ঐ সময় আমি পুরো ভক্ত ছিলাম। পরবর্তীকালে আমি আমার বাবার সঙ্গে বাস করতে আরম্ভ করি। ধর্মীয় পোঁড়ামি সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদারচেতা। স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার জন্য আমার যে ইচ্ছা জাগে তা তাঁরই শিক্ষার ফলশ্রুতি। কিন্তু তিনি নাস্তিক নন। তিনি একজন দৃঢ় আস্তিক, প্রতিদিন পূজার্চনা করতে তিনি আমাকে উৎসাহিত করতেন। সুতরাং, আমি এইভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি ন্যাশনাল কলেজে যোগদান করি। সেখানেই আমি চিন্তার ক্ষেত্রে উদার হতে থাকি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যা, এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা- সমালোচনা করতে থাকি। কিন্তু তখন আমি ঘোরতর আস্তিক। ঐ সময় আমি না- ছাঁটা অবিন্যস্ত লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদেও আমি কখনও আস্থা রাখতে পারিনি। তবুও, ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
পরবর্তীকালে আমি বিপ্লবী দলে যোগদান করি। প্রথমে আমি যে নেতার সংস্পর্শে আসি তিনি দৃঢ় ঈশ্বর-বিশ্বাসী না হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বে অস্বীকার করতে সাহস পাননি। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার বারবার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন, “যখন তোমার ইচ্ছা হয়, প্রার্থনা কর।” এ হল নাস্তিকতাবাদের তত্ত্ব গ্রহণ করতে যে সাহসের প্রয়োজন, তা ছাড়াই নাস্তিক হওয়া। দ্বিতীয় যে নেতার সংস্পর্শে আমি আসি, তিনি ছিলেন পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় কমরেড শচীন্দ্রলাল সান্যাল, যিনি তখন করাচী ষড়যন্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর বিখ্যাত ও একমাত্র বই ‘বন্দী জীবন' - এর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই প্রচন্ডভাবে ঈশ্বরের মহিমা গাওয়া হয়েছে। ঐ চমৎকার বইটার দ্বিতীয় অংশের শেষ পৃষ্ঠায় বেদান্তবাদজনিত চিন্তা থেকে ঈশ্বরের প্রতি যে অতীন্দ্রিয় প্রশংসাবাণী বর্ষিত হয়েছে তা তাঁর চিন্তার একটি বিশিষ্ট অংশ। ১৯২৫ সালের ২৮ শে জানুয়ারি সমগ্র ভারতবর্ষে যে ‘বিপ্লবী প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়, মামলার বাদীপক্ষের বক্তব্য অনুসারে তা তাঁরই চিন্তার ফসল। গোপন কাজকর্মে যা অবশ্যম্ভাবী বিশিষ্ট কোনো নেতা নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করেন যা তাঁর নিজের কাছে খুবই প্রিয় এবং মতের ভিন্নতা থাকলেও অন্য কর্মীদের তাতে মৌন সম্মতি দিতে হয়। ঐ প্রচারযন্ত্রের পুরো একটা প্যারাগ্রাফ সর্বশক্তিমান এবং তাঁর লীলা ও কর্মের প্রশংসায় মুখরিত। এ সবই অতীন্দ্রিয়বাদ, আমি যা দেখতে চাইছি তা হল নাস্তিকতার ধারনা বিপ্লবী দলে অঙ্কুরিত হয়নি। বিখ্যাত কাকরি শহীদদের সকলেই তাদের শেষ দিনগুলো প্রার্থনা করে কাটিয়েছেন। রামপ্রসাদ বিসমিল ছিলেন একজন গোঁড়া আর্যসমাজী। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা থাকা সত্ত্বেও রাজেন লাহিড়ী উপনিষদ ও গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার স্পৃহা চেপে রাখতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনকেই আমি জানি যিনি কখনও প্রার্থনা করেননি। তিনি বলতেন, দর্শন হল মানুষের দুর্বলতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফল। তিনি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের শাস্তি ভোগ করেছেন। কিন্তু তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মতো সাহস দেখাননি।
ঐ সময় পর্যন্ত আমি ছিলাম শুধুই একজন কল্পনাপ্রবণ ভাববাদী বিপ্লবী বিশেষ। তখনও পর্যন্ত আমরা কেবল অনুসরণই করতাম। তারপর এলো সমস্ত দায়িত্ব বহন করার সময়। অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ার ফলে কিছুদিনের জন্য দলের অস্তিত্ব রক্ষাই অসম্ভব হয়ে উঠল। শুধু নেতারা নন অতি উৎসাহী কমরেডরাও আমাদের প্রতি বিদ্রূপ বাক্য বর্ষণ শুরু করলেন। কিছুদিনের জন্য আমি ভীত হয়ে পড়লাম যে কোনদিন হয়তো আমিই আমাদের কর্মসূচীর অসারতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ব। ঐ সময়টা আমার বিপ্লবী জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ। আমার মনের আনাচে- কানাচে একটাই কথা বাজতে লাগল - ‘জানতে হবে'। প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলি খণ্ডন করার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হলে গভীর ভাবে জানতে হবে, পড়তে হবে। নিজের মতবাদের পক্ষে যুক্তি দ্বারা নিজেকে তৈরি করাতে হলেও পড়াশুনা করতে হবে। আমি পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার আগের বিশ্বাস ও বিশ্বাসগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল। পূর্বসূরিদের থেকে সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে ফাঁকা আবেগ পেয়েছিলাম, এখন তার জায়গায় সুচিন্তিত ধারণা গড়ে উঠল। ভাববাদকে বিদেয় করে দিলাম, অন্ধ বিশ্বাস থেকেও মুক্ত হলাম। বাস্তববাদ (realism) আমাদের আদর্শ হয়ে দাঁড়াল। বড় রকম প্রয়োজনের সময়ই শক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি সমর্থনযোগ্য এবং নীতি হিসাবে সমস্ত রকমের গণ-আন্দোলনে অহিংসা অপরিহার্য। এই হল পদ্ধতি সম্পর্কিত কথা। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল, যে বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সংগ্রাম করছি সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলা দরকার। বাইরে যেহেতু সে সময়ে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল না তাই বিশ্ব বিপ্লবের বিভিন্ন তত্ত্ব ও আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করার বিস্তর সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিন, সাম্যবাদের (communism) মার্ক্সের কিছু এবং লেনিন ও ট্রটস্কি এবং অন্যান্যদের অনেক লেখা পড়লাম যাঁরা তাঁদের দেশে সাফল্যের সঙ্গে বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। এরা সকলেই ছিলেন নাস্তিক। বাকুনিনের ঈশ্বর ও রাষ্ট্র (God & State) টুকরো টুকরো হলেও ঐ বিষয়ে কৌতুহলোদ্দীপক গবেষণা, আরও পরে নিরালম্ব স্বামী লিখিত 'সাধারণ জ্ঞান' (Common sense) নামে একটা বই পেলাম, এটা ছিল একরকম অতীন্দ্রিয় নাস্তিকতাবাদ, আমার কাছে বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন এমন সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কিত তত্ত্বের অসারতায় আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল ১৯২৬ সালের শেষাশেষি, আমার অবিশ্বাস আমি প্রকাশ করলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম এবং আমি একজন সুস্পষ্ট নাস্তিক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে অবস্থাটা কিরকম দাঁড়াল তা আমি আলোচনা করছি।
১৯২৭ সালের মে মাসে আমি লাহোরে গ্রেপ্তার হলাম। ধরা পড়াটা হয়েছিল হঠাৎ, পুলিস যে আমায় খুঁজছে তা আমি একেবারেই জানতাম না। আমি যাচ্ছিলাম একটা বাগানের মধ্যে দিয়ে, হঠাৎ দেখি পুলিস আমায় ঘিরে ফেলেছে, খুব অবাক লাগে ঐ সময় আমি খুব শান্ত ছিলাম। কোনোরকম অনুভূতি বা উত্তেজনাও আমার হচ্ছিল না। আমাকে পুলিস হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন আমাকে পাঠানো হল রেলওয়ে পুলিস হেফাজতে। সেখানে আমাকে পুরো একমাস কাটাতে হয়। পুলিস অফিসারদের সঙ্গে অনেকদিনের আলাপ-আলোচনায় আমি বুঝতে পারলাম যে কাকোরি পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ সম্পর্কে ও বিপ্লবী আন্দোলনে আমার অন্যান্য কার্যকলাপ সম্পর্কে তাদের কাছে কিছু তথ্য আছে। তারা বললেন যে, লখনৌতে যখন কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল তখন আমি নাকি সেখানে ছিলাম এবং বন্দীদের মুক্ত করার জন্যে আমি কয়েকটি পরিকল্পনা এঁটেছিলাম। তাদের সমর্থন পাওয়ার পরই আমরা কিছু বোমা সংগ্রহ করেছিলাম এবং পরীক্ষামূলকভাবে সেগুলির একটি নাকি ১৯২৬ সালে দশহরা উৎসবের ভিড়ের মধ্যে আমরা ছুঁড়েছিলাম। আমার প্রতি দয়া দেখিয়ে তারা আরও বলেছেন যে বিপ্লবী দলের গোপন কাজকর্ম সম্পর্কে কোনো হদিশ যদি দিই তাহলে আমায় বন্দী তো করা হবেই না, বরং ছেড়ে দেওয়া হবে এবং রাজসাক্ষীরূপে কোর্টে না দাঁড় করিয়ে আমায় পুরস্কার দেওয়া হবে। এ প্রস্তাব আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, এ সমস্তই ছিল ফালতু কথা! আমাদের মতো আদর্শ যাঁরা নিয়ে চলেন তাঁরা কখনই নিজেদের নির্দোষ দেশবাসীর উপর বোমা ছুঁড়তে পারেন না। একদিন সকালে তখনকার সি আই ডি-র সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ নিউম্যান এলেন। অনেক দরদভরা কথাবার্তার পর তিনি খুব দুঃখের খবরটি দিলেন যে, তাঁরা যেমন চাইছেন তেমন কোনো বিবৃতি যদি আমি না দিই তাহলে কাকোরি মামলায় যুদ্ধ বাধানোর যড়যন্ত্রে ও দশহরার দিন বোমা ছুঁড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্য আমাকে বিচারের জন্য পাঠাতে তারা বাধ্য হবেন। তিনি আমায় আরও জানালেন যে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার ও ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ তাঁর হাতে আছে। ঐ সময় আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি নির্দোষ হলেও পুলিস আমাকে ফাঁসি দিতে পারত। ঐদিনই কয়েকজন পুলিস অফিসার দু'বেলাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য আমায় প্ররোচিত করতে লাগলেন, তখন আমি একজন নাস্তিক। আমি চাইছিলাম নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। শুধু কি শান্তি ও আনন্দের সময়ই আমি নিজেকে নাস্তিক বলে জাহির করার ক্ষমতা রাখি, না কি এই রকম দুঃসময়েও আমি আমার আদর্শে অবিচল থাকতে পারব। অনেক বিবেচনার পর আমি ঠিক করলাম যে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে ও প্রার্থনা করতে আমি পারব না। আমি কখনও করিনি। এটাই ছিল আসল পরীক্ষা এবং তাতে আমি উত্তীর্ণ হলাম। মুহূর্তের জন্য অন্য কিছুর পরিবর্তে নিজের গর্দান বাঁচানোর ইচ্ছা আমি পোষণ করিনি। সুতরাং আমি ছিলাম একজন একনিষ্ঠ নাস্তিক এবং তারপর থেকে আমি তা-ই রয়ে গেছি। ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশ্বাস কষ্টকে হালকা করে। দেয়।। এমনকি কখনও কখনও তাকে মজাদারও করে তুলতে পারে। ভগবান মানলে মানুষ প্রায় সময়ই যথেষ্ট সান্ত্বনা ও সমর্থন পেতে পারে। আর তা না হলে মানুষকে নিজের মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে নিজের মানসিক শক্তির ওপর নির্ভর করা ছেলেখেলা নয়। যদি কোনো দম্ভ থাকে, ঐ রকম মুহূর্তে তা কোথায় উড়ে যাবে আর প্রচলিত বিশ্বাসকে মানুষ আঁকড়ে ধরতে চাইবে। যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেই কেউ স্থির থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে শুধু দম ছাড়াও অন্য কোনো না কোনো শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। এখন হচ্ছে ঠিক সেই অবস্থা। বিচারের রায় সকলেরই জানা, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তা ঘোষিত হবে। একটা আদর্শের জন্যই যে আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি এছাড়া আমার আর কি সান্ত্বনা থাকতে পারে? ঈশ্বর-বিশ্বাসী একজন হিন্দু রাজা হিসাবে পুনর্জন্মের আশা করতে পারেন। একজন মুসলমান অথবা খ্রিষ্টান স্বর্গের বিলাসিতা উপভোগ করার ও দুঃখ-কষ্ট ত্যাগের জন্য পুরস্কৃত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু আমি কি প্রত্যশা করতে পারি? আমি জানি যে-মুহূর্তে আমার গলার দড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে এবং আমার পায়ের তলা থেকে আড়কাঠ সরিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই হবে চরম মুহূর্ত এবং শেষ মুহূর্ত। আমি এবং অধিবিদ্যার (metaphysics) ভাষ্য অনুযায়ী আমার আত্মা, সব সেইখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর কিছুই থাকবে না। একটা খুবই ছোট জীবনের কোন মহৎ কীর্তিহীন, গৌরবহীন সমাপ্তি! এটাকেই যদি সাহসের সাথে মেনে নিতে পারি, সেটাই হবে আমার জীবনের সবথেকে সেরা পুরস্কার।
এটাই হল আসল কথা। ইহজগতে ও স্বর্গলোকে গিয়ে পুরস্কার পাব এমন ইচ্ছা বা বাসনা আমার নেই। একেবারেই নিঃস্বার্থ ভাবে আমি আমার দেশের মুক্তির জন্যে গোটা জীবন উৎসর্গ করে গেলাম, কারণ এটা ছাড়া আমার আর কিছু দেওয়ার ছিল না। যেদিন আমরা দেখতে পাব, এক বড় সংখ্যক নরনারী যখন শুধুই শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য, মানব জাতির সেবার জন্যে দলে দলে এগিয়ে আসছে, সেদিনই আমার মতো মানুষের জীবন উৎসর্গ সার্থক হবে। তখন শুরু হবে মানব জাতির সত্যিকারের মুক্তির দিন। মৃত্যুর পরে “স্বর্গে গিয়ে বা ‘পরের জন্মে রাজা’ হতে নয় বা এই জন্মে কোন পুরস্কার লাভের জন্যেও নয়, গোটা মানব জাতির থেকে দাসত্বের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে অত্যাচারী ও শোষকদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বাধীনতা ও শান্তির পথ তৈরি করতেই ব্যক্তিগত আত্মঘাতী পথে নিজেদের মহৎ প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন এমন পথটাই হল - গর্বময় জীবনের পথ। এই মহৎ কাজের জন্য যে গর্ববোধ, তাকে কী শুধু “অহংকার' বলে খাটো করতে হবে? যারা এই রকমের ঘৃণাভরা বিশেষণ ব্যবহার করে তাদের আমরা বলি হয় নির্বোধ, নয় শয়তান।
যদিও এই মহান আত্মত্যাগের মধ্যে যে অনুভূতির প্রাচুর্য, যে ভাবালুতা, যে উদ্দীপনা, যে মহানুভবতা ও বিশালতা আছে তা বুঝতে না পারার জন্য আমরা তাদের ক্ষমা করতে পারি। কারণ তাদের হৃদয় মৃত ধ্বংসস্তূপের মত, দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ, অন্য কোন স্বার্থের নিচে তাদের মন চাপা পড়ে আছে।
আত্মবিশ্বাসকে প্রায়ই অহংকার বলে ভুল করা হয়। এটা যতটা দুঃখজনক, ততটাই শোচনীয়। কিন্তু তবুও কিছু করার নেই।
যখন দেখি, কোনো প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধিতা করতে অথবা সাধারণ মানুষের চোখে সবসময় অভ্রান্ত এমন কোনো নেতা বা মহান ব্যক্তির সমালোচনা করতে, অমনি অসংখ্য লোক দল বেঁধে তেড়ে আসবে আপনাকে দাম্ভিক বা হামবড় বলে হেয় প্রতিপন্ন করতে। সমালোচনা ও স্বাধীন চিন্তা একজন বিপ্লবীর পক্ষে দুটো খুবই দরকারি গুণ। যেহেতু মহাত্মাজী মহান, সেহেতু কারও উচিৎ নয় তাঁর সমালোচনা করা। যেহেতু তিনি উঁচুতে উঠে গেছেন, সেজন্যে রাজনীতি বা ধর্ম, অর্থনীতি বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে যা কিছু তিনি বলেন সবটাই ঠিক। আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন আপনাকে বলতেই হবে, হ্যাঁ, এটাই ঠিক। এ মানসিকতা প্রগতির পথে বাধা। সোজা কথায় এ জিনিষ প্রতিক্রিয়াশীলতা।
যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষরা এক পরম সত্তার, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সম্পর্কে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস তৈরি রেখে গেছেন যার ফলে যদি কোন লোক সেই প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা সেই 'পরম সত্তার' বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানান, তবে তাকে স্বধর্ম ত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক বলে গাল দেওয়া হবে। যদি তার যুক্তিগুলো এমন জোড়ালো হয় যে পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাকে থামানো বা হারানো যাচ্ছে না তখন তাকে পরম সত্তার অভিশাপের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়া হবে এবং তখন তাকে হামবড় বলে নিন্দে করা হবে, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাকে দম্ভ বলে অপমান করা হবে। তাহলে ফালতু এই আলোচনায় সময় নষ্ট করে কী হবে? সবার আগে এইরকম একটা প্রশ্ন সাধারণ মানুষর সামনে আসছে এবং এর একটা বাস্তবসম্মত সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে - এই জন্যেই এত বড় আলোচনার আয়োজন করা।
ফলে, প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আমি বলব, দম্ভ যে আমায় নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়নি এ বিষয়টা আমি পাঠকদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পেরেছি।। যুক্তিসঙ্গতভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কিনা সে বিচারের দায়িত্ব পাঠকদের। আমি জানি, আমার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস থাকলে আমার জীবনকে তা অনেক স্বচ্ছন্দ করে তুলতে পারত, মনের চাপ হালকা করতে পারত। অন্যদিকে ঈশ্বরে অবিশ্বাস আমার চারপাশের পরিবেশকে নীরস করে তুলেছে, হয়ত তা আরও কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে, আবার একটুখানি আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া তাকে অনেকটা কাব্যময় করে তুলতে পারত। কিন্তু ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে গিয়ে আমি কোন অহেতুক উন্মাদনার সাহায্য নিতে চাই না। আমি একজন বাস্তববাদী, শাণিত যুক্তিবিজ্ঞানই আমার হাতিয়ার, তাই দিয়েই আমি আমার ভিতরের প্রবৃত্তিকে জয় করতে চাই। এই ব্যাপারে যে আমি সবসময়ই সফল হয়েছি তা নয়, কিন্তু আমাদের উচিত বারে বারে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, কেননা সাফল্য নির্ভর করে ঘটনাচক্র আর বাস্তব পরিস্থিতির উপরে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, দম্ভ যদি কারণ না হয়, তাহলে প্রচলিত আস্তিক্যবাদে অবিশ্বাস করার অন্য কোন কারণ থাকা উচিত? হ্যাঁ, অবিশ্বাস করার মত যথেষ্ট যুক্তি আমার আছে। আমি এখন সেই আলোচনায় আসব। আমার মতে, যার এতটুকু যুক্তিতর্কের ক্ষমতা আছে তিনি বিচার বিশ্লেষণ করেই বাস্তব পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করেন। সরাসরি প্রমাণ যেখানে নেই সেখানে ধর্মীয় দর্শন মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। আমি আগেই বলেছি আমার এক বিপ্লবী বন্ধু বলতেন- “মানুষের দুর্বলতাতেই ধর্মীয় দর্শনের জন্ম।” প্রাচীনকালে বিশ্বব্রহ্মান্ডের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এবং এক কার্যকারণ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার করার যখন সুযোগ ছিল কিন্তু সরাসরি বোঝার মত যথেষ্ট উপাদান ছিল না, তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা মনগড়া উপায়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতেন। সেইজন্যেই বিভিন্ন ধর্মমতগুলোর মূল তত্ত্বের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় যেটা কোনো কোনো সময়ে পরস্পর বিরোধী রূপ নেয়, নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-মারামারি ও অশান্তির জন্ম দেয়। শুধুমাত্র পূর্ব-পশ্চিমের ধর্মের মধ্যেই পার্থক্য দেখা যায় তা নয়, এমনকি একই গোলার্ধে নানা ধর্মমতের মধ্যেও বড় পার্থক্য দেখা যায়। যেমন আমাদের প্রাচ্যের হিন্দুধর্মের সঙ্গে মুসলিম ধর্মের মধ্যে কোনো মিল নেই। এই ভারতবর্ষেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে কত আলাদা, আবার এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যেই আছে সনাতন ধর্ম ও আর্যসমাজের মতো মতামত যারা একে অপরের প্রায় উল্টো। ‘চার্বাক’ আমাদের দেশের আরেক প্রাচীন চিন্তাবিদ, যিনি এক স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা, তিনি সেই কোন সুদূর অতীতেই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। অর্থাৎ কিছু মৌলিক প্রশ্নে এই ধর্মগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার যথেষ্ট বিরোধ আছে, আর প্রত্যেকেই ভাবে তার নিজের ধর্মটাই ঠিক। সমস্যাটা ঠিক এখানেই। কিন্তু আজকের দিনে প্রাচীন মুনি-ঋষিদের চিন্তা ও বানীকে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের এগিয়ে চলার পথে অবলম্বন হিসাবে আমরা গ্রহণ করছি না, বা এই রহস্যের দরজা খোলার চেষ্টা করছি না, উল্টে জড়তার শিকার হয়ে গিয়ে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার তৈরি করছি, তাঁদের বক্তব্যের প্রতি অনড় ও অচল বিশ্বাস গড়ে তুলেছি, আর এইভাবেই গোটা সমাজে এগিয়ে চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছি।
যে মানুষ প্রগতির পক্ষে, পুরানো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে তাকে সমালোচনা করতে হবে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে ও প্রয়োজনে অবিশ্বাসও করতে হবে। প্রচলিত বিশ্বাসের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে লাগবে। অনেক তর্কাতর্কি ও আলাপ-আলোচনার পর যদি কেউ কোন মতবাদ বা দর্শনে আস্থা রাখে তবে তাকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। যদি তার বিচারের ধারা সঠিক পথ নাও খুঁজে পায় বা ভুল পথে এগোয় তবুও তাকে সংশোধন করে সঠিক পথে নিয়ে আসা সম্ভব, কারণ যুক্তিই হল তার জীবনের ধ্রুবতারা। কিন্তু সবথেকে ক্ষতিকারক পথ হল অন্ধবিশ্বাস। কারণ, সে জিনিষ মাথার বুদ্ধিকে ভোঁতা করে দিয়ে মানুষকে ভুল পথে ঠেলে দেয়। যিনি নিজেকে বস্তুবাদী বলে দাবি করেন তাঁকে সমস্ত সনাতন ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যুক্তিতর্কের শাণিত আক্রমণের মুখে যদি দাঁড়াতে না পারে তবে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। তখন তার প্রথম কাজ হবে পুরানো চিন্তা-ভাবনার সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নূতন দর্শন সৃষ্টির জমি তৈরি করা। এটা হল নেতিবাচক দিক, পুরাতন কে বাদ দেওয়ার দিক। এরপর শুরু হবে ইতিবাচক দিক, সেখানে পুরাতন চিন্তার মধ্যে থেকে দরকারি উপাদানকে নতুন চিন্তাধারার মধ্যে আত্মস্থ করে নিতে হতে পারে। আমার নিজের কথা বলতে গেলে মানতে হবে এ বিষয় নিয়ে আমি বেশি পড়াশুনা করতে পারিনি। প্রাচ্য দর্শনের নানা দিক নিয়ে পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছা ছিল, যদিও তার সুযোগ আর পেলাম না। কিন্তু পুরানো বিশ্বাসের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার প্রশ্নে আমার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে, এ ক্ষেত্রে আমি খুব নিশ্চিন্ত বোধ করি। এমন কোন পরমসত্তা নেই যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের গতি প্রকৃতি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিন্ত। বিশ্বপ্রকৃতির অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস আছে এবং সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের উদ্দেশ্যই হল সমাজের প্রয়োজনে প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এটাই হল আমাদের দর্শনের মূল কথা।
এখন নেতিবাচক দিক দিয়ে আস্তিক্যবাদীদের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই। আপনাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যদি সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ এক ঈশ্বর থেকে থাকেন যিনি এই পৃথিবী বা বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আপনাদের উত্তর দিতে হবে তার এই পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? দুঃখ-দুর্দশায় ভরা কত অসংখ্য হৃদয়ভাঙ্গা ঘটনার শাশ্বত রঙ্গমঞ্চে যেখানে একটা মানুষও পরিপূর্ণ সুখভোগ করতে পারে না?
বলবেন না এ তাঁরই বিধান অনুরোধ করছি। যদি তিনি কোনো বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন। তিনি আমাদের মতোই আরেকজন ক্রীতদাস। দয়া করে এটা বলবেন না যে, এসব তাঁর লীলা। সম্রাট নিরো এক রোম নগরী জ্বালিয়েছিলেন। খুবই অল্প সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছিলেন তিনি। তার পরিপূর্ণ আনন্দের জন্য তিনি খুবই কম পরিমাণ মানুষের মৃত্যুর কাহিনী তৈরি করেছিলেন। ইতিহাসে তিনি কী স্থান পেলেন? ঐতিহাসিকেরা কী নামে তাকে চিহ্নিত করেন? সমস্ত রকমের বিদ্বেষপূর্ণ বিশেষণ তার ওপর বর্ষিত। অত্যাচারী হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নিরোর প্রতি যে তীব্র নিন্দা ভরা গালাগাল জুটেছে তাতে ইতিহাসের পাতা কালো রঙ ধারণ করেছে। এক চেঙ্গিস খাঁ কয়েক শত জীবন নষ্ট। করেছিল নিজের আনন্দের জন্য এবং আমরা এই নামটাকেও পর্যন্ত ঘৃণা করি। তাহলে কিভাবে আপনারা আমাদের সর্বশক্তিমান শাশ্বত নিরোকে সমর্থন করছেন যিনি প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রতি মিনিটে অসংখ্য হত্যার কাহিনী তৈরি করেছেন এবং করছেন? কিভাবে আপনারা তাঁর দুষ্কর্মকে সমর্থন করতে পারেন যিনি প্রত্যেক মুহূর্তে চেঙ্গিস খাঁর দুষ্কর্মকে অতিক্রম করে যায়? আমার কথা হল কেন তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে গেলেন যা যথার্থই নরক, যা প্রতিনিয়ত তীব্র অশান্তির ক্ষেত্র? কেন এই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করতে গেলেন যখন তাঁর তা না করার ক্ষমতাও ছিল? এ সবের যৌক্তিকতা কোথায়? আপনারা কি পরজন্মে নির্দোষ ভুক্তভোগীদের পুরস্কারের কথা এবং দুষ্কর্মকারীদের শাস্তিবিধানের কথাও বলতে চান? ভাল, ভাল, যে ব্যক্তি আপনার শরীরে প্রথমে আঘাত করে ক্ষত বানিয়ে পরে খুব কোমল ও আরামদায়ক মলমের প্রলেপ দেওয়ার সাহস পায় তাকে আপনারা কতটা সমর্থন করবেন? গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠকরা ক্ষুধার্ত হিংস সিংহের সামনে মানুষকে ছেড়ে দিত, আর সেই মানুষ যদি কোনরকমে ঐ জন্তুর হাতে মৃত্যুর থেকে বেঁচে যেত তবে তাদের পরবর্তীকালে ভালভাবে দেখাশোনা করা হত। এ ব্যাপারটাই বা কতটা ন্যায্য ছিল? এ জন্যই আমার প্রশ্ন - কেন সেই সচেতন পরম সত্তা এই পৃথিবী ও তার অন্তর্গত মানুষগুলোকে সৃষ্টি করলেন? মজা পাওয়ার জন্য? তাহলে তাঁর ও নিরোর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের কাছে জানতে চাই - হিন্দু দর্শন আরও একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবে সেই প্রশ্নের জবাবে আপনারা কি বলবেন? আপনারা তো পূর্বজন্মে বিশ্বাস করেন না। হিন্দুদের মতো, আপাত নির্দোষ দুর্দশাগ্রস্থদের পূর্বজন্মে করা কোন পাপকাজের যুক্তি আপনারা দেখাতে পারবেন না। আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি কথার মাধ্যমে জগত সৃষ্টি করার জন্য কেন সর্বশক্তিমান ছয়দিন ধরে পরিশ্রম করলেন এবং প্রতিদিন কেন 'সব কিছুই ভাল আছে' বললেন। আজ তাঁকে ডাকুন। অতীত ইতিহাস তাকে দেখান, বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করতে দিন। দেখা যাক তিনি বলতে সাহস পান কিনা - ‘সব ভাল আছে’।
অন্ধকার কারাগার থেকে কুঁড়ে ঘরে ও বস্তিতে বস্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কুরে কুরে খাওয়া অনাহারের গহ্বর থেকে, রক্তচোষা পুঁজিপতিদের দ্বারা নিজেদের রক্ত চুষে নেওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে অত্যন্ত ধৈর্যশীল অথবা উদাসীন শ্রমিকদের থেকে, সামান্যতম বোধশক্তি আছে এমন মানুষও শিউরে উঠবে মনুষ্য শক্তির যে অপচয় দেখে সেখান থেকে, এমন কি অতিরিক্ত উৎপাদন বন্টন করার পরিবর্তে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো পছন্দ থেকে তাকে দেখানো মানুষের হাড়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধনীর প্রাসাদ, তিনি বলুন 'সব ঠিক আছে'। আমার প্রশ্ন কেন? কোন কারণ?' আপনারা নীরব, ঠিক আছে, তাহলে আমি এগিয়ে যাই।
হিন্দুরা, আপনারা বলেন, বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্থরা সকলেই আগের জন্মের পাপী। ভাল কথা। আপনারা বলেন, এখনকার অত্যাচারীরা আগের জন্মে সৎ মানুষ ছিলেন এবং এ জন্য তারা এখন ক্ষমতা ভোগ করেন। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনাদের পূর্বপুরুষরা বেশ চালাক লোক ছিলেন। যুক্তি ও অবিশ্বাসের সকল তত্ত্বকে চুরমার করার জন্য যথেষ্ট মজবুত তত্ত্ব বের করার চেষ্টা তারা করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি কতটা ধোপে টেকে সেটাই দেখা যাক।
খুব বিখ্যাত আইনজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কেবল তিন বা চারটি দিক থেকে অন্যায়কারীদের যে শাস্তি প্রদান করা হয় তা সঠিক বলে মানা হয়। এগুলো হল, প্রতিশোধাত্মক (মৃত্যুদণ্ড জাতীয় শাস্তি), প্রতিরোধাত্মক (ভয় দেখিয়ে থামানো) ও সংশোধনাত্মক (চরিত্র সংশোধন বা পরিবর্তন)। অগ্রগামী সকল চিন্তাবিদ প্রতিশোধাত্মক তত্ত্বকে নিন্দা করেন। প্রতিরোধাত্মক তত্ত্বেরও একই দশা। সংশোধনাত্মক তত্ত্বই একমাত্র মানব প্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হল, দুষ্কৃতকারীকে অত্যন্ত যোগ্য ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকরূপে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নিই যে সেই মানুষেরা দুষ্কৃতকারী তাহলে তাদের উপর ঈশ্বর যে শাস্তিবিধান করেন তার প্রকৃতি কী রকম? আপনারা বলেন তিনি তাদের গরু, বিড়াল, গাছ, লতাপাতা অথবা পশুরূপে জন্মগ্রহণ করার জন্য পাঠান। আপনারা মনে করেন যে, এ সকল শাস্তি চুরাশী লক্ষ রকমের। আমি জিজ্ঞাসা করি, মানুষের উপর এর সংশোধনাত্মক প্রতিক্রিয়া কি রকম? কতজন লোকের সন্ধান আপনারা পেয়েছেন যারা স্বীকার করে যে দুষ্কর্ম করার জন্য তারা আগের জন্মে গাধা হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল? কেউ না। পুরাণের লাইন টেনে আনবেন না। আপনাদের পৌরাণিক গল্প ছোঁয়ার সুযোগ আমার নেই। তারপরেও আপনারা কি জানেন যে গরিব হওয়া এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ? দারিদ্র্য একটা পাপ একটা শাস্তি! আমি জিজ্ঞাসা করি, কোন অপরাধতাত্ত্বিক, আইনজ্ঞ - অথবা আইনসভার সদস্য যদি এমন শাস্তি দেন বা যদি এমন প্রস্তাব আনেন যা অনিবার্যভাবেই মানুষকে আরও বেশি রকমের গর্হিত কাজ করতে বাধ্য করে, তাহলে তাদের মূল্য কি বিচার করবেন? এ চিন্তা কি আপনাদের ভগবান করেননি, নাকি তাঁকেও ঐ সব জিনিষ শিখতে হয়েছে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, মানুষের অকথিত দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে। গরিব এবং অশিক্ষিত চামার কিংবা মেথর পরিবারে জন্মেছে এমন একজন মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে আপনার মতামত কী? সে গরিব, তাই লেখাপড়া করতে পারে না। তার পাশের মানুষের দ্বারাই সে ঘূণিত ও বর্জিত। তথাকথিত উঁচু জাতে জন্মেছে বলে যারা নিজেদের মানুষ বলে মনে করে তার অজ্ঞতা, তার দারিদ্র্য এবং তার প্রতি যে ব্যবহার করা হয়, সব মিলিয়ে সমাজের প্রতি তার হৃদয় কঠিন হয়ে উঠবে। ধরুন সে একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, কে তার ফল ভোগ করবে? ভগবান সে নিজে অথবা সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা? উদ্ধত এবং আত্মম্ভরি ব্রাহ্মণেরা ইচ্ছাকৃতভাবে যে সব লোককে অজ্ঞাত রেখেছে এবং আপনাদের পবিত্র জ্ঞানগ্রন্থ বেদের কয়েকটা বাক্য শ্রবণ করে পরিচালিত হওয়ার দলে পড়ে যাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাদের শাস্তি সম্পর্কে কী হবে? যদি তারা কোন অপরাধ করেও থাকে, কাদের তার জন্য দায়ী হওয়া উচিত এবং কাদের আসল ফলটা ভোগ করার কথা? বন্ধু, এ তত্ত্বগুলো সুবিধাভোগীদের আবিষ্কার। এই সব তত্ত্বের দ্বারা তারা তাদের দখলীকৃত ক্ষমতা, সম্পদ ও কৌলীন্য সমর্থন করে। সম্ভবত আপটন সিনক্লেয়ারই কোথাও লিখেছিলেন যে, কোন মানুষকে একবার শুধু অমরত্বে বিশ্বাসী করে তোলো এবং তারপর তার থেকে সমস্ত সম্পত্তি লুটে নাও। সে তোমায় নির্দ্বিধায় সাহায্য করবে। ধর্মপ্রচারক ও ক্ষমতালোভী শাসকদের মিলিত স্বার্থের প্রয়োজনে জেলখানা, ফাঁসিমঞ্চ, চাবুক ও এ ধরনের তত্ত্বগুলো আমদানি হয়েছে।
যখন কোন মানুষ কোন পাপ বা অপরাধমূলক কাজ করছে, তখন কেন আপনাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাদের সবাইকে থামিয়ে দিতে আসেন না? তিনি তো খুব সহজেই এটা করতে পারেতেন, কেন তিনি যুদ্ধবাজদের অন্তরেই যুদ্ধোন্মাদনাকে নিঃশেষ করেন না এবং মহাযুদ্ধ মানবতার ওপর যে দুর্যোগ নিয়ে আসে, কেন এভাবে তিনি তা পরিহার করেন না? কেন তিনি ব্রিটিশ জাতির অন্তরে ভারতবর্ষের স্বাধীন করে দেওয়ার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলেন না? কেন তিনি পুঁজিপতিদের অন্তরে একটুখানি ভাল কাজ করার উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন না যাতে তারা সামাজিক উৎপাদনের হাতিয়ারগুলোর উপরে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার পরিত্যাগ করতে পারে এবং এইভাবে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে - না, সমগ্র মানবসমাজকেই পুঁজিবাদী বন্ধন থেকে মুক্তিদান করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে আপনারা আলোচনা করতে চান, আমি আপনাদের সর্বশক্তিমানের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিলাম। সামগ্রিক মঙ্গলসাধন যখন বিবেচ্য তখন সমাজতন্ত্রের গুণাবলী সবাই স্বীকার করেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয় এই অজুহাতে তারা এর বিরোধিতা করেন। সেই সর্বশক্তিমানকে এসে সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে সাজাতে বলুন। উল্টো-পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না কাজ হবে না। আমি বলতে - চাই, ঈশ্বর ইচ্ছা করেন বলেই ব্রিটিশ রাজ এখানে আছে এমন নয়। বরং বলা যায় তারা এখানে আছে কারণ তাদের ক্ষমতা আছে এবং তাদের বিরোধিতা করার মতো সাহস আমাদের নেই। ঈশ্বরের সাহায্যে নয়, বন্দুক ও রাইফেল, বোমা, গুলি, পুলিস ও সেনাবাহিনীর সাহায্যেই তারা আমাদের অধীন রেখেছে এবং আমাদের অনীহার জন্যই এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির জঘন্য রকমের শোষণের মতো একটি নগ্ন সমাজ-বিরোধী পাপ তারা সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে পারছে। কোথায় ঈশ্বর? কী করছেন তিনি? মানবজাতির এই দুর্দশা কি তিনি উপভোগ করছেন? তিনিও তো এক নিরো, তিনি এক চ্যাঙ (চেঙ্গিস), নিপাত যান তিনি।
এই পৃথিবীর উৎপত্তি, মানবজাতির উৎপত্তি আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করি সে সম্পর্কে কি আপনারা প্রশ্ন করেছেন? ঠিক আছে, আমি আপনাদের বলি, চার্লস ডারউইন এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন, তাঁর লেখা পড়ুন। সোহম স্বামীর “সাধারণ জ্ঞান” পড়ুন। কিছুটা পরিমাণে তাতে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর মিলবে। এ হল প্রাকৃতিক ঘটনা। বিভিন্ন রকমের গ্যাসীয় পদার্থের আকস্মিক সংমিশ্রণের ফলে এ জগতের উদ্ভব হয়েছে। কখন? ইতিহাস পড়ুন। একই প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে জীবজন্তুর এবং দীর্ঘদিন পরে মানুষের। ডারউইনের Origin of Species পড়ুন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিরাম দ্বন্দ্ব ও তাকে উত্তরণ করার প্রচেষ্টা থেকেই পরবর্তীকালে সমস্ত রকমের প্রগতি, এ ঘটনার এই হল সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সম্ভবপর ব্যাখ্যা।
আপনারা আর একটা প্রশ্ন তুলতে পারেন যা কিন্তু আসলে বাচ্চাদের মতো, যদি ঈশ্বর না-ই থাকেন তাহলে মানুষ কি করে তাকে বিশ্বাস করে? আমার উত্তর সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার। যেভাবে তারা ভূত ও অশুভ আত্মায় বিশ্বাস করতে শিখেছে, সেভাবেই তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেও শিখেছে। শুধুমাত্র তফাৎ হল এটাই যে, ঈশ্বর বিশ্বাস প্রায় সর্বজনীন এবং এই দর্শনটাও বেশ উন্নত। অন্য কিছু প্রগতিপন্থীর মতো এ কথা আমি বলি না যে, ঈশ্বরের আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে শোষকদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা যারা এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রচার করে মানুষকে নিজেদের অধীন রাখতে চেয়েছিল ও দাবি করেছিল যে তাদের সুবিধাভোগী অবস্থানের পেছনে সেই পরম সত্তার অনুমতি বা সম্মতি আছে। মৌল প্রশ্নে এই মতের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই যে, সমস্ত ঈশ্বর বিশ্বাস, ধর্ম, ধর্মমত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরবর্তীকালে অত্যাচারী ও শোষক প্রতিষ্ঠান মানুষের সমর্থকে রূপান্তরিত হয়। সমস্ত ধর্মমতে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সব সময়ই পাপ।
ঈশ্বরের উৎপত্তি নিয়ে আমার নিজের মত হল এটাই যে, মানুষের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে এবং তার দুর্বলতা ও অক্ষমতা বিবেচনা করে কল্পনায় ঈশ্বরের সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহসের সঙ্গে বিপজ্জনক সমস্ত ঘটনার মুখোমুখি হতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য এবং প্রতিপত্তি ঐশ্বর্যে তার যে বিস্ফোরণ তাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তার ব্যক্তিগত বিধিনিয়ম ও পৈত্রিক উদারতা সহ ভগবানের চিত্রটি বিশেষভাবে কল্পনা করা হয়েছে ও আঁকা হয়েছে। তাঁর ঐশ্বরিক শক্তি ও রুদ্ররোষের কথা এই কারণে বলা হয়, যাতে মানুষের ক্ষোভ প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার পক্ষে বিশেষ বিপদের কারণ হয়ে উঠতে না পারে। ঈশ্বরের এই প্রতিরোধক শক্তির কথা এইজন্যই বলা হয়।
আর যখন তাঁর পিতৃসুলভ গুণাবলীর প্রশান্তি কীর্তন করা হয় তখন তাঁকে কখনো বাবা, কখনো মা কখনো ভাইবোন বা রক্ষাকারী বন্ধু রূপেই তাঁকে তুলনা করা হয়।
বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত, আত্মীয়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে মানুষ যখন চরম বিপদের মুখে পড়ে, তখনই এই ভেবে শান্তি ও সান্ত্বনা পায় যে, সবসময় একজন পরম বন্ধু আছেন যিনি অবশ্যই দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কারণ, তিনি 'সর্বশক্তিমান' ও 'বিপদত্তারণ'।..... এবং তিনি 'ইচ্ছাময়'। ইচ্ছা হলেই তিনি এসে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
প্রকৃতপক্ষে সমাজ সৃষ্টির আদিম যুগে হয়তো এর দরকার ছিল। তখন মানুষের দুঃখ বিপদে ‘ঈশ্বর' বড়োই এক সহায়ক শক্তি বা দারুণ ওষুধ ছিল।
এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা যুদ্ধ- ঘোষণা করে যেতে হবে। সেইসঙ্গে পুতুল-পূজা বা ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যখন মানুষ নিজের পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখবে এবং সত্যিকারের বাস্তববাদী হবে, তখন এইসব বিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সত্যিকারের মানুষের মতোই যতকিছু দুঃখ-কষ্ট ও সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করতে পারবে।
এই হল আমাদের বর্তমান অবস্থা। তাই বন্ধুরা, এটা আমার অহংকার নয়, এটা হল আমারই নিজস্ব চিন্তার পদ্ধতি যার ফলে আমি নাস্তিক হয়ে উঠেছি।
যে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও প্রতিদিনের প্রার্থনাকে আমি বড়ই স্বার্থপরতা ও হীনতার উদাহরণ বলে মনে করি, সেই ঈশ্বর-বিশ্বাস ও প্রতিদিনের প্রার্থনা আমার বর্তমান অবস্থার পক্ষে সহায় হবে না। আরও শোচনীয়তার কারণ হবে, তা আমি জানি না।
আমি বই পড়ে জেনেছি যে, নাস্তিকরা সব বিপদে সাহসের সাথেই রুখে দাঁড়ায়। ফলে, আমিও সমস্ত বিপদকে তুচ্ছ করে শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করেই দাঁড়াতে চাই, এমন কি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও। দেখা যাক, আমি তা পারি কি না। একজন বন্ধু আমায় প্রার্থনা করতে বলেছেন। তিনি বললেন 'তোমার জীবনের শেষ দিনগুলোতে তুমি আবার বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবে'। আমি বলেছি ‘না আমি তা পারব না। আমার পক্ষে সেটা হবে একটা অধঃপতন ও নিজেকে ঠকানো কাজ, স্বার্থপর হওয়ার জন্যে আমি প্ৰাৰ্থনা করতে পারব না।' পাঠক ও বন্ধুরা, এটা কি আমার দম্ভ? যদি তাই হয় তাহলে বলি আমি তার পক্ষে।