শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতা‌‌

রাজু দত্ত


Nov. 25, 2024 | | views :282 | like:0 | share: 0 | comments :0

মূলত তিনটি সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতার বিকাশে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের গুরুত্ব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই রেনেসাঁর উদ্ভব। মানবসভ্যতাকে সুস্থ স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে, জনমানসে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার অত্যন্ত জরুরি।  শৈশবেই শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণ করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য। 


প্রথমেই বলে‌ রাখি, আমি মনোবিজ্ঞান বিষয় সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দীর্ঘদিন শিশুদের সাথে থেকে, তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে আমি যা বুঝেছি, তার ভিত্তিতে তাদের মনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণের চেষ্টা করে গেছি। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার সেই ব্যর্থতার দুটি কারণ উপলব্ধি করেছি। এক - আমার জ্ঞানের অস্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা ও দুই - বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে অভিভাবকদের তীব্র বিরোধীতা। 


শিশুরা অসম্ভব কৌতুহলী, আবেগপ্রবণ ও কল্পনাপ্রবণ হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা কম থাকায় ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুব সামান্য হওয়ায়, যে সকল ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করে, তার অধিকাংশ তাদের কাছে‌ দুর্বোধ্য থাকে। তারা বড়োদের কাছে সেই সকল বিষয় নানারকম প্রশ্ন করে থাকে। বড়োরা তাদের প্রশ্নের সাধ্যমতো উত্তর দিলেও, অধিকাংশ সময় তারা প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যান। এতে শিশুর কৌতুহলের নিরসন তো হয়ই না, উপরন্তু, তাদের জিজ্ঞাসু মন ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, ফলে একসময় তারা প্রশ্ন করতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে তার মানসিক বিকাশ প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।  


শিশুদের কৌতুহল নিরসন সবসময় সম্ভব হয়না। এর মূলত তিনটি কারণ। এক - প্রশ্নোল্লিখিত বিষয়  আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, দুই - বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক এখনো সেই প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হয়নি এবং তিন - অদ্ভুত, অবাস্তব বা হাস্যকর প্রশ্ন। 


প্রথমোক্ত সমস্যা দূর করতে আমাদের নিজেদের সচেষ্ট হতে হবে। বিভিন্ন বিষয় জ্ঞানলাভের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সহজতম পদ্ধতি হলো, বই পড়া। আমাদের প্রচুর বই পড়তে হবে ও পঠিত সকল বিষয় স্বচ্ছ ধারনা গড়ে তোলার প্রয়োজনে উক্ত বিষয়গুলি খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। বুঝতে না পারলে যিনি সেই বিষয় জানতে পারেন, তেমন কারও কাছে বিষয়টি বোঝার জন্য স্বচেষ্ট হতে হবে।  গুগল মাধ্যমেও আমরা বিকল্প উপায় বহু বিষয় জ্ঞানলাভ করতে পারি। তবে একটা কথা সর্বদা মনে রাখা দরকার, পঠিত সকল বিষয় যুক্তি দিয়ে যাচাই করা প্রয়োজন। বইতে যা লেখা আছে তা অভ্রান্ত সত্য নাও হতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যা, শিশুর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নটির সঠিক উত্তর অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক অজ্ঞাত থাকলে আপনি সেটা তাকে সরাসরি বলুন। বলুন যে এই বিষয় এখনো বৈজ্ঞানিকরা জানতে পারেননি। তবে জানার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। আপনি প্রশ্নটির সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো একটি প্রশ্ন তার মনে জাগিয়ে তুলুন, যার উত্তর বিজ্ঞান জানে।  শিশুর প্রশ্ন অদ্ভুত ও হাস্যকর হলে আপনিও আপনার রসবোধ ব্যবহার করে হাস্যকর উত্তর দিন। শিশুরা হাসতে ভালোবাসে। তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, আপনি কখনোই শিশুর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না। এতে শিশুর কৌতুহল বাধাপ্রাপ্ত হয়। যা একটি শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। 


শিশুমনে বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ বপণের কয়েকটি উপায় আমি উল্লেখ করছি। উল্লেখিত উপায়গুলি প্রয়োগ করে আমি বহুক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি। আপনিও চেষ্টা করে দেখুন। 

(১) শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কল্পনাপ্রবণ হয়। তাদের মনে কাল্পনিক প্রাণী, ডাইনি, জুজু, ভূতপ্রেত, ঈশ্বর জাতীয় অবাস্তব কল্পনার বীজ বপণ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না। বরং বিভিন্ন গাছপালা, জীবজন্তুর সাথে তাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটান। 


(২) কার্টুন যথাসম্ভব কম দেখান তাদের। বরং তাদের দেখার উপযুক্ত শিক্ষামূলক সিনেমা দেখান।    শিশুসাহিত্যিকদের রচনা পড়ান। তারা পড়ে মজা পাবে, তাদের পড়ার অভ্যাসটাও গড়ে উঠবে। 


(৩) সূক্ষ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দিন। 

বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সহজবোধ্য বিশ্লেষণ করে বোঝান। বিভিন্ন ছোটখাটো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হাতে কলমে করে দেখান। 


(৪) মাঠে খেলাধুলা করতে উৎসাহিত করুন। এর ফলে অন্যান্য শিশুদের সাথে তার ভাবের আদানপ্রদান গড়ে উঠবে।‌ যা তার মানসিক বিকাশের সহায়ক হবে।‌ দাবা খেলান। দাবার চালে তার ভুলগুলি সহজবোধ্য করে বোঝান। শিশু বলে তাকে জিতিয়ে দেবেন না। 


(৫) শিশুর যুক্তি দিয়েই তার অযৌক্তিক ভাবনার অবসান ঘটান। এর ফলে সে একজন তার্কিক হয়ে উঠবে। যুক্তির পাল্টা যুক্তি দিতে শিখবে। কারণ সে সবসময় চাইবে তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে। আপনিও তা ভাঙার চেষ্টা করে যাবেন (তা যদি অযৌক্তিক হয়) এই দ্বন্দ্ব তাকে তার্কিক করে তুলবে। মনে রাখবেন যুক্তিবাদী হতে হলে তর্ক করতে শিখতে হবে। 

পরিশেষে বলি, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটানো  কোনো তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। অসীম ধৈর্য্যের সাথে আপনাকে কাজটি করতে হবে। শিশুদের মনে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটাতে অপেক্ষাকৃত অধিক ধৈর্য্য প্রয়োজন হয়। ওদের মন যে বড়োই চঞ্চল। তার নাগাল পাওয়া সহজ নাকি!

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929