পূজা প্রার্থনা বা নামাজ পড়ে দেশের উন্নতি হয়েছে?
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | | views :815 | like:2 | share: 2 | comments :0
পূজা প্রার্থনা বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কি পৃথিবীর কোন ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দেশের উন্নতি হয়েছে? এর প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবে? অনেককে দেখেছি সারা জীবন ভক্তিভরে নিয়ম মেনে পূজা আর্চা করার পর শেষ জীবনে প্রায় ছয় মাস কোমাতে থেকে মারা যেতে। আবার একজন মুসলিম ভদ্রলোককে দেখতাম নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর একদিন ট্রাক চাপা পড়ে হাসপাতালে দুর্বিসহ অবস্থায় কদিন কাটিয়ে মারা গেছেন। তার ছেলে কলকাতার হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে ভিড় ট্রেনের থেকে পড়ে মারা যায়। তাহলে প্রার্থনার ফল কি?
আমাদের ছোটবেলায় মা বাড়িতে বিপদতাড়িনি ও বিপিনাশিনীর পুজো করতেন প্রতি আষাঢ় মাসে, এছাড়াও নানান ব্রত করতেন। কিন্তু মা মাত্র ৬৬ বছর বয়সে প্রচুর রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন।পুজো করে কি আদৌ কোন ফল হয় বা হয়েছে? কোনো বিপদ কেটেছে? আসলে ভগবান থাকেন ধনীদের গৃহে; সেখানে ধনীর সম্পদ বাড়ান গুনিতক হারে। আদানি আম্বানি বিড়লা --------- প্রভৃতিদের দেখুন। ওরা পুজো নামাজ প্রেয়ারে সাধারণ মানুষকে ডুবিয়ে রাখতে চায়। এতে ওদের দুদিক থেকেই লাভ হয়। একদিকে নিজের দ্রব্য বিক্রি আর একদিকে শ্রমিকদের মধ্যেই ধর্মীয় বিভেদ তৈরী করে শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য। গরিব মধ্যবিত্তরা পুজো ঈদ বড়দিন বা অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎসবে যা খরচ করে তার সিংহ ভাগ ধনীদের কাছেই যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। নোয়াখালী দাঙ্গার পরেই ভয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কলকাতায় সেটেল হয়ে আমাদের এতগুলি ভাইবোনকে মানুষ করতে করতে মা প্রচণ্ড লড়াই করে ক্ষয়ে গেছেন। দেশভাগে বিপর্যস্ত উদ্বাস্তু পরিবারকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে মা অনেকটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে গেছেন। উদ্বাস্তু না হলে উদ্বাস্তু শব্দের অর্থ পরিস্ফুট হয়না। আমাদের জীবনে যা কিছু হয়েছে মায়ের অবদান তাতে সিংহভাগ; বাবা সেই অর্থে সংসার সন্যাসী, সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন এবং ঠাকুর দেবতা নিয়ে বেশ একটু নির্বিকারই ছিলেন । মা সংসার নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ফলে চরম অনিযম করে মা মাঝে মাঝে অসুস্থ হতেন, হাসপাতালে ভর্তি হতেন। কোনোদিন পুরো সুস্থ ছিলেন না। কিন্তু প্রতি আষাঢ় মাসের মঙ্গল ও শনিবার পুরোহিত ডেকে পুজো করতেন ভক্তিভরে এবং লাল কালো তাগাতে হাত ভরে থাকতো, শুধু তাই নয় বাড়িতে মনসা লক্ষ্মী কার্তিক সরস্বতী সূর্য পূজা এবং আরো অনেক ব্রত হতো। তাবিজ কবজ মাদুলিও কম করেননি। কিন্তু মায়ের কোন বিপদ কাটেনি বা বিপদ নাশ হয়নি। আবার অসুস্থ হলে মন্দিরেও হত্যে দিতে যাননি, বারেবার হাসপাতালেই গিয়েছিলেন। এইসব দেখে ছোটবেলা থেকেই আমার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছিল। মা আবার দেওয়ানগাজি এলাকার পীরের থানেও প্রদীপ জ্বালাতেন, ফল কি? শূন্য ঋণাত্মক। আমি বলতাম কবজ তাবিজ মাদুলি বিপদতাড়িনীর তাগা পরেও তোমার বিপদ কাটছেনা; ওসব ছেড়ে দাও। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে অবশ্য সব পূজা আর্চা কবজ মাদুলি তাগা বাদ দিয়েছিলেন এবং আমাদের বাড়ি সর্বধর্মের বন্ধুদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আসলে এই রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এবং ভয় অনিশ্চয় ও সংশয়ে ভরা। সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষের নিদারুণ অসহায় অবস্থা মানুষকে দুর্বল করে দেয় ফলে বিশ্বাস ভয় মাথায় চড়ে বসে এবং সেই ভয় থেকেই ভক্তি তৈরি হয় এবং তারপর ঐ ভক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পূজার নামাজের ব্যবসা।গড়ে ওঠে মন্দির মসজিদ গির্জা, তৈরি হয় পুরুত ইমাম পাদ্রী। আসে রাজনীতি এবং ধর্ম ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, মানুষের জীবনকে করে তোলে দুর্বিসহ।
প্রতিটি ধর্ম তৈরির সময় সমাজ ছিল অস্থির অভাবে ভরা এবং মানুষের জ্ঞানও ছিল একদম আদিম স্তরে। প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভয় থেকেই চিন্তা করতে পারা একমাত্র জীব মানুষের ধর্ম জন্ম নিয়েছে । প্রকৃতির আর কোন জীব ধর্মপালন করেনা; সুন্দরবনে হিন্দু বাঘ বা মুসলিম শুয়োর বা খ্রিস্টান হাতি দেখেছেন??। ধর্ম আবিষ্কারের পরেই এটাকে নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা । সবাই নিজের লোক বাড়াতে চেয়েছে ভয় অথবে অস্ত্রের জোরে। মুহাম্মদের মদিনার জীবনী রাজনীতি ছাড়া কি?? রাজানুগ্রহ না পেলে কোনো ধর্মই এমনভাবে প্রসারিত হতোনা । সম্রাট অশোকের সহায়তা না পেলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ হতোনা। গুপ্ত রাজাদের সহায়তা না পেলে হিন্দু ধর্মও পুন:প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল ছিল। সব ধর্মের ইতিহাসই প্রায় এক এবং ধর্মগ্রন্থগুলি রূপকথা ভয় লোভ দেখানো ঘৃণা হিংসায় ভরা রক্তাক্ত। আমিই ঘোর নাস্তিক বোধহয় ভারতের প্রায় সব রাজ্যের অধিকাংশ বড় বড় তীর্থস্থানে ঘুরেছি একফোটা ধর্ম বিশ্বাস না নিয়ে । তবে ভারতের নামী তীর্থস্থান গুলি প্রকৃতির অপূর্ব জায়গায় স্থাপিত; অমরনাথ কেদার বদ্রী গঙ্গোত্রী মণিমহেশ হেমকুণ্ড গোয়ার কিছু গির্জা বা কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ ---সবের পথের শোভা অসাধারণ। সেই পথের সৌন্দর্যের টানেই ছুটে যাই; দেব দেবীর টানে নয় । কোনো মন্দির মসজিদ গির্জায় বিশেষ স্থাপত্য না থাকলে সাধারণত ঢুকিনা। যারা প্রচুর পূজা আর্চা করে তাদের অধিকাংশই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে পারেননি।যারা বেশী পূজা করে বেশী নামাজ পড়ে তাদের দেখেছি অধিকাংশই অসৎ । আবার পাড়ায় অনেককে দেখেছি যারা সারা জীবন ধরে পুজো আর্চা নিয়ে আছে এবং সৎ জীবনযাপন করে তারা গরীব খেতে পায়না এবং তারা কোনোদিন গ্রামের বাইরে বেরোতে পারেনি। তাহলে এই পূজা প্রার্থনার নীটফল কি শূন্য নয়??
কোন ধর্ম পালন না করেও মানুষ সৎ ভাবে বাচতে পারে । অনেক লোককে দেখেছি ধর্মের ধ ও মাথায় না তারা ভীষণ সৎ। আমি কোন ধর্মেই বিশ্বাস করিনা এবং ধার্মিকদের সঙ্গ এড়াই ও পারলে বিরোধীতা করি। বাষট্টি বছর পর্যন্ত লড়াই করে বেঁচে আছি এবং ভালোই বেঁচেছি, অন্যদের থেকে খুব একটা খারাপও নেই। রোগের কথা যদি বলেন তবে বলব যারা প্রচুরপূজা আর্চা করে তাদের ঘরে টিভি ক্যান্সার হয় কেন??। প্রকৃতির সৃষ্ট মানুষ আমি প্রকৃতি প্রদত্ত হাত পা মগজ দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করি সবার পাশে থাকার আর কি? এভাবে চলে গেলেই হয়।