টিকে থাকার লড়াইয়ে ‘ধর্মগুলো সব রূপকথা’
জাহিদ রুদ্র
Nov. 24, 2024 | | views :283 | like:0 | share: 0 | comments :0
সম্প্রতি একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কোরানের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত রয়েছেন ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে। সত্যজিৎ রায়ের মহাপুরুষ ছবিটিতে দেখেছিলাম পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি করা এক ভদ্রলোক “ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ” এর অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। ওই ভদ্রলোকের বিশ্বাস ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব দেখতে পারেন।
মহাপুরুষটি দার্শনিক সক্রেটিসের সাথে গ্রিসের এথেন্সে আড্ডা দিয়েছেন তাও আড়াই হাজার বছর আগে। গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্য ছিলেন। ব্যাবিলনের বাজার থেকে তাঁর বর্তমানব সেবক (রবিঘোষ)-কে পেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে নির্মিত ছবিটি রাজশেখর বসু (পশুরাম) এর ছোটগল্প বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে তৈরী। ছবিটিতে ওই মহাপুরুষের প্রচুর ভক্ত ছিল কলকাতা শহরে। তারা সকলেই শিক্ষিত, বড় অ্যাকাডেমিক এবং সমাজের উঁচু মাথা কিন্তু যুক্তি বিবেচনার অভাবে ভোগেন। রাজশেখর বসু গল্পটি লিখেছেন শত বছর আগে। আজ শত বছর পর সেই মহাপুরুষেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ধর্মগ্রন্থীয় ব্যাখ্যা দিয়ে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
“Science without religion is lame, religion without science is blind.” অর্থাৎ “বিজ্ঞান ধর্ম ছাড়া খোঁড়া, ধর্ম বিজ্ঞান ছাড়া অন্ধ।” এই বাক্য বহু বছর অন্ধের মতো ব্যবহার করেছে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা প্রমানের জন্য। এই বাক্যটাকে তারা বিখ্যাত করেছেই তাদের ধর্মকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমানের প্রয়োজনে। কালক্রমে এই বাক্য হাতবদল হয়ে সেটা এখন উপমহাদেশের ধর্মান্ধদের হাতে পড়েছে।
আর্লবার্ট আইনস্টাইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বক্তৃতা দিতেন। শিক্ষার্থীরা তাকে নানাধরণের প্রশ্নে জর্জরিত করতো। সবচেয়ে যে প্রশ্নগুলো বেশি করা হতো তার একটি হল, ভবিষ্যতে কী আছে? জবাবে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে আইনস্টাইন বলতেন, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তা করি না মোটেও। কারণ, এটা এমনিতেও তাড়াতাড়িই আসে।' আইনস্টাইনকে আরও একটি সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত তা হল, “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?” উত্তরে আইনস্টাইন সর্বদা একই উত্তর দিতেন, “বাইবেলের ঈশ্বর নয় বরং আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।” বারুচ ডি স্পিনোজা ছিলেন একজন ডাচ দার্শনিক। দেকার্তের সাথে সপ্তদশ শতাব্দীতে দর্শনের অন্যতম দুর্দান্ত যুক্তিবাদী হিসাবে বিবেচিত হতেন স্পিনোজা। স্পিনোজার ঈশ্বর বলতেন, প্রার্থনা বন্ধ কর। পৃথিবীর পথে বেরিয়ে এসো। তোমার জীবন উপভোগ কর। আমি চাই তুমি নাচ, গাও, আনন্দ কর, মজা কর। আমি তোমার জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছি তার পুরোটা উপভোগ কর।
আমার এক বন্ধু ফিজিক্সে মাস্টার্স করছে তার অভিমত, পৃথিবী সূর্য্যের চারপাশে ঘুরছে এটা কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য এসব পড়তে হবে মাত্র। তার কথায় আরও অবাক হই যখন তার এক পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের কথা সে বলে। সোসিওলজিতে পিএইচডি, তিনি বিশ্বাস করেন তার স্ত্রীর উপর জ্বীনের আছর আছে, স্ত্রীকে মনোচিকিৎসকের কাছে না নিয়ে তিনি হুজুরের পানি পড়া, তেল পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন মানব দেহের হাড় গবেষণা করে আরবি হরফের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্ত হল – “Development of Co-relation Between Interdisciplinary Science and Religion” (আন্তঃবিভাগীয় বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে সহ-সম্পর্কের বিকাশ)। তাঁর মতে মানুষের কঙ্কালের গঠন কোরান তত্বের উপর ভিত্তি করেই গঠিত। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা উনি তার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন জাপান থেকে।'
মানুষের মনে ধর্মবোধ কী করে জাগ্রত হল এই বিষয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম কারণ হল ভয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-ব্যাধি, হিংস্র পশুদের আক্রমণ ইত্যাদি বিপত্তির কারণে মানুষ অসহায় বোধ করে, ভয় পায়। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানুষ বড় পাহাড়, বড় গাছ, সূর্য, চন্দ্র কে ঈশ্বর মেনে সন্তুষ্টি লাভের জন্য বন্দনা শুরু করে। মনে করে এইসব নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। তাকে খুশি করতে পারলে বিপত্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পরবর্তীতে সেই অদৃশ্য শক্তির নাম ঈশ্বর, গড বা আল্লাহ বা জিহোভা। তাকে স্তুতির জন্য তৈরি হয় অর্গানাইজড রিলিজিওন বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। দ্বিতীয় কারণ সমাজে ন্যায়নীতির একটা মানদণ্ড তৈরি করার জন্য মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ তৈরি হয়। তৃতীয় কারণ, যে বিষয় সম্পর্কে যুক্তি তৈরী করা যায় না সেগুলোকে ঈশ্বরের অলৌকিকত্ব হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এই অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। এই অন্ধবিশ্বাসের মূলে একে একে আঘাত করে দার্শনিক বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান ভয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
আবার বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য পড়া একজন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ায় ধর্ম-অবিশ্বাসী হতে পারেন। অন্যদিকে পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞান পড়া একজন মানুষ শুধু বিজ্ঞান-মনস্ক না হওয়ায় ধর্ম-বিশ্বাসী হতে পারেন। এবার চলুন দেখি সাহিত্যে কিভাবে ধর্মীয় প্রচার কাজ করছে। কিছু দিন থেকে সামাজিক মাধ্যমে এসে থাকা ইংরেজি ভাষায় A for Apple, এর বিপরীতে A for Arjuna,. B for Balaram, C for Chanakya, D for Dhruva, E for Eklavya দেখে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। ভুল বললে ক্ষমা করবেন।
এই কনসেপ্ট যিনি নিয়ে এসেছেন হয়তো ভুলে গেছেন যে A ইংরেজি বর্ণমালার একটা শব্দ এবং A দিয়ে শুধু ইংরেজি শব্দ চর্চাই মূলত পড়ুয়াদের জন্য দরকারি। কারণ আমাদের ছেলেমেয়েরা, ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি ভাষা আয়ত্বের জন্য ইংরেজি শব্দভাণ্ডার জানা একান্ত জরুরি। তাই A for Apple, B for Ball, C for Cat, D for Dog জানা আমাদের শিশুদের জন্য প্রয়োজন। আচ্ছা মনে করেন যদি বাংলায় অজগর, আম, ইঁদুর, ঈগল এর পরিবর্তে অন্য কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করি তবে কি নিজের ভাষা জানার কোনও উপায় থাকবে?
ঈশ্বরকে বাদ দিয়েও যে ধর্ম হতে পারে, যেমন বৌদ্ধ ধর্ম, আবার ধর্মকে বাদ দিয়েও ঈশ্বর হতে পারে। যেমন স্পিনোজার ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের বন্দনা হয় না। অনুভব করা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের নিভৃত প্রাণের দেবতা। বিস্ময়ে ভয় নয় -- জাগে প্রাণ। সৃষ্টি হয় আনন্দ। ভালোবাসা। প্রেম। যে ফুলটি ফোটে--মনে হয় ফুলটি আমি। যে শিশুটি টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায়, কেঁদে ওঠে, আবার উঠে পড়ে -- হেসে ওঠে, মনে হয় এই শিশুটিও আমি। আর শিশুটির মা বলে উঠছে--আহা বাছা। সেই মাও আমি। ওর বাবা মানুষটিও আমি। আকাশের তারাটিও আমি। আমিই সকল কিছু। আমিই সে। সে-ই আমি।
এই আমি তাহলে হলো প্রাকৃতিক সুশৃঙ্খলা মাত্র। একেই স্পিনোজা বলেছেন ঈশ্বর। আইনস্টাইন এই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। এই ঈশ্বর কাউকে উদ্বিগ্ন করে না। ভয় দেখায় না। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ম আর ধর্মীয়গ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে, বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিচ্ছে প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ-আয়শারা ধর্মের সাথে প্রতিটা বিভাগের রিলেশন। দেশে ধর্ম ও বিজ্ঞানে আদানকারী মানুষে ভরে গেছে কিন্তু সমাজ সংস্কারে আমাদের দরকার সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাই খুব সংযত ও যুক্তিসংগত ভাবে অটল বিশ্বাসী কুপমূন্ডকগণদের ‘সব ধর্মই ক্ষতিকর এবং অসত্য’ বোঝাতে হবে।