তেত্রিশ কোটি দেবতার সত্যতা
কৃষ্ণ সরকার
Nov. 24, 2024 | | views :294 | like:2 | share: 1 | comments :0
তেত্রিশ কোটি দেবতা - কথাটি কম বেশি সকলেরই শিরায় শিরায় প্রবাহিত। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন এত বেশি সংখ্যক দেবতা কি থাকা সম্ভব? অবশ্যই না। বেদ -উপনিষদ -পুরাণ ইত্যাদি সব মিলিয়েও তেত্রিশ কোটি দেবতা পাওয়া যায় না। তবে কি তেত্রিশ কোটি দেবতার ধারণাটি ভুল? অবশ্যই ভুল নয়।
আসলে ‘কোটি’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। একটি হল ‘প্রকার’ ও অপরটি হল ‘কোটি(Crore)!’ এবার প্রশ্ন হল দেবতা সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি,নাকি দেবতা তেত্রিশ প্রকারের? উত্তর হল দেবতা তেত্রিশ প্রকারের।অবশ্যই সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি নয়।
এবার এই তেত্রিশ কোটি দেবতা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক:
ঋক বেদের 3/9/9 ও 10/52/6 ঋকে 3339 জন দেবতার কথা বলা হয়েছে এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও দেবতার সংখ্যা বলা হয়েছে 303 ও 3003,এদের মধ্যে প্রধান দেবতা 33 জন(বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ 3/9/1 -2) অর্থাৎ এখানেও মোট 3339 জন দেবতার কথা বলা হয়েছে। কোথাও কিন্তু সংখ্যায় তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বলা নেই। তাহলে আমরা মোট দেবতা পেলাম 3339 জন।
এবারে আসা যাক 33 প্রকার দেবতার প্রসঙ্গে। ঋক বেদের 1/139/11, 8/28/1 ঋকে দেবতার সংখ্যা বলা হয়েছে 33 এবং তেত্তিরীয় সংহীতাঃ 1/4/10/1,
শতপথ ব্রাহ্মণঃ 7/5/7/2 ঐতরেয় ব্রাহ্মণঃ 2/18 ইত্যাদি সবখানেই 33 জন দেবতার কথাই বলা হয়েছে।এখানে আরও একটা সমস্যার সৃষ্টি হল - আগে আমরা পেলাম দেবতা 3339 জন আর এখন পেলাম 33 জন, তবে কোনটা সঠিক আর কোনটাই বা ভুল?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই বৃহদারণ্যক উপনিষদে (3/9/1-11)। এখানে শাকল্য, যাজ্ঞবল্ক্যকে এক এক করে প্রশ্ন করেন এবং যাজ্ঞবল্ক্য এক এক করে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেন।
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন দেবগণ মাত্র 33 জন। বাকি সব তাদের বিভূতি (বৃহঃ উপঃ 3/9/2)।অর্থাৎ 3339 জনের মধ্যে 33 জন দেবতা আর বাকি 3306 জন তেত্রিশ জন দেবতারই বিভূতি।
এই তেত্রিশ জন দেবতা হল - অষ্ট বসু,একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি, এই মোট তেত্রিশ জন দেবতা।
অষ্টবসু হলেন: অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক ও নক্ষত্র সমুহ।
একাদশ রুদ্র হলেন: পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রীয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্ব, ত্বক) পাঁচটি কর্মেন্দ্রীয় (হাত, পা, মুখ, পায়ু, জনন্দ্রীয়) ও আত্মা বা মন।
দ্বাদশ আদিত্য হলেন: বৎসরের বারটি মাস। এই সর্বমোট তেত্রিশ কোটি দেবতা অর্থাৎ তেত্রিশ প্রকারের দেবতা। পরে এদের বিভিন্ন কার্যকে আলাদা আলাদা দেবতা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। যা 3339 জন। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে দেবতা তেত্রিশ প্রকারের। বাকি সব এদের বিভূতি।
তবে পুরাণে যে এত এত দেব-দেবীর কাহিনী লেখা আছে তারা কি দেব-দেবী নন। যেমন -কালী, দূর্গা, মহাদেব ইত্যাদি ইত্যাদি। এর উত্তর জানার জন্য আমাদের আগে জানতে হবে দেবতা বলতে কি বোঝায়? নিরুক্তকার যাস্ক দেবতা শব্দের অর্থ করেছেন -'যিনি দান করেন বা যিনি দীপ্ত হন বা যিনি দ্যোতিত হন বা যিনি দ্যুস্থানে থাকেন তিনিই দেবতা (নিরুক্ত: 7/11)। এই সংজ্ঞা অনুসারে বৈদিক ঋষিদের দেবতা নির্বাচন যথার্থ। কিন্তু পুরাণকার জানিনা কেন দেবতার সংখ্যা তেত্রিশ প্রকার থেকে তেত্রিশ কোটিতে নিয়ে গিয়ে তাদের ইচ্ছে মতো কাহিনী রচনা করেছেন? হয়তো বা তাদের কোনো অভিপ্রায় থাকতে পারে? তবে সেটা গবেষণার বিষয়। আমাদের শুধু একটা বিষয় জানা দরকার যে দেবতা তেত্রিশ প্রকারের এবং এরা সবাই বস্তুগত। কেউ সেই পৌরাণিক বা কাল্পনিক দেবতা নন। পুরাণের দেবতার সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরাণের লেখক হয়তো অজ্ঞতার বশেই তেত্রিশ কোটি কাল্পনিক দেব দেবীর সৃষ্টি করেছেন, যাদের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও আমাদের সমাজে এই কাল্পনিক ভিত্তিহীন দেব দেবীরা পূজা পেয়েই যাচ্ছে।