এক রসসাহিত্যিকের অলৌকিক নরকযাত্রা
অশোক দাস চার্বাক
May 19, 2025 | | views :7 | like:0 | share: 0 | comments :0
চার্বাক চলে গেলেন। আমি ওনাকে তিক্তবাবু বলেই ডাকতাম। মাঝে মাঝে তেতোবাবু। আবার কেউ ডাকতেন ঝাঁজবাবু, কেউ ডাকতেন ঝালবাবু, কেউবা বাঁকাবিহারী, বঙ্কিমবাবু - এমনি সব, মানে শ্রীকৃষ্ণের মত তাঁর মধুমাখা অষ্টোত্তর শতনাম আরকি। টক-ঝাল কষা-নোনতা শতরসের ককটেলে সম্পৃক্ত সদাহাস্যময় সদাকৌতুকপ্রবন রসসাহিত্যিক রসরাজ আমাদের অলরাউন্ডার চার্বাক মহারাজ। আমার রঙ্গব্যঙ্গ পত্রিকার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় লেখক।
মৃত্যুপূর্বকালে সজ্ঞানে তাঁর নিজেরই ড্রাফ্ট করা তাঁর অকাল স্বর্গ /নরকপ্রাপ্তির ‘আনন্দময়’ শোকের বিজ্ঞাপনটি পড়ে সকালের চা’টা তেতো হয়ে গেল। ‘চার্বাক’ কলম নামে তাঁর লেখা রম্যরচনা ও স্যাটায়ারগুলি কটুস্বাদের হলেও বেশ পাঠকপ্রিয় ছিল। আধুনিক পাঠকেরা কটুতিক্তরসাদি পছন্দ করে ও যে সব নেতারা সভা সমিতিতে অসভ্য খিস্তি খেউড় করে তাদের বীরের সম্মান দিয়ে ভোট দেয় বলে ওনার বিশ্বাস ছিল। এজন্য নাকি আধুনিক এসেম্বলি পার্লামেন্টে অসৎ অশিক্ষিত অসভ্য নেতারই প্রাবল্য।
পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তেই থাকুন না কেন, মনে কোন নতুন রসের উদয় হলেই ই-মেল করতেন তাঁর নিজস্ব ঘরানার রসসাহিত্য। উনি যোগ দেবার পর আমার পত্রিকার কাটতি দুগুনের বেশী হয়ে গেছিল। তবে তাঁর উগ্র নাস্তিকতা বড্ড উৎকটভাবে প্রকট হতো তাঁর রঙ্গব্যাঙ্গে। সেগুলো ধর্মভীরু দুর্বল পাঠকদের ধর্মাভ্যাসের আবেগে আঘাত করত প্রবলভাবে। বিরুদ্ধ সমালোচনার জবাবে “ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া একজন মানবপ্রেমী সমাজসেবী সাধুপুরুষের সামাজিক কর্তব্য” বলে উটকো উল্টাপাল্টা বাজে তক্ক শুরু করে দিতেন। এ মহান কর্তব্য না করলে নাকি মানুষের মধ্যে কৌতূহল জন্মায় না, মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে না। তারা কেবল বাপ ঠাকুরদাদের তামাদী হওয়া অভ্যাস বিনা প্রশ্নে তামিল করেন মাত্র।” বলতেন, “বুদ্ধ, যীশু, সক্রেটিস, মহম্মদ, নিমাই, রামমোহন, বিদ্যাসাগররা যদি তাঁদের সমসাময়িক যুগের আধমরা ভীতু মানুষদের আবেগ অভ্যাসে আঘাত না দিতেন, তাহলে এখনও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরপাক খেত, সতী পুড়তো, বাল্যবিধবারা কাশীর রঙিন পল্লীতে নাচতে নাচতে পচতো, গরুর দুধে সোনা ফলত, পাথরের গণেশ ঢক-ঢক করে দুধ খেত, ঈশপের গল্পের শুক সারিরা কৃষ্ণনাম গাইত, পাপীরা তাদের দেহ মন থেকে পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য সাগরজলে ডুব দিতো, নিচুজাত বিদ্বেষী বেলুড় মঠে নাকি শুধু ব্রাহ্মণকন্যাই কুমারীপূজার জন্য মনোনীত হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বলতেন, “এখনও হয়ত আমরা আমাদের আদি গুরুজনদের অনুসরণ অনুকরণ করে উলঙ্গ থাকতাম অন্যান্য জীবজন্তুভাইদের মত। বলতেন, “ধর্মীয় আবেগে আঘাতের বিরুদ্ধে যে অসাংবিধানিক আইন আছে সেটি বাতিল করা উচিত।”এই ছিল তাঁর ফিলোজফি, এমনি তাঁর বাঁকা বাঁকা আজব আজব বোকা বোকা কথা। লেখার ভাষাটাও ছিল গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট। রাস্তাঘাটের নাটুকে নেতা-মন্ত্রী, লুম্পেন-মাস্তানদের বক্তৃতার মতো খিস্তি খেউড়ে ভরা। তবে মাঠভরা শিস মারা হাততালি দেওয়া ভাড়াটে শ্রোতা ও গ্রাম্য ভোটারদের মত, কিংবা বোকাবাক্সের টিভি সিরিয়াল বা ঝগড়াঝাটির দর্শক শ্রোতাদের মত আমার পাঠকেরাও সে অশ্লীলতা অসভ্যতা খেত ভালো। আর ওনাদের বিপুল ভোটে আমার পত্রিকা জিতে গিয়ে কাটতি বাড়াতো। এমনি চরিত্র ছিল চার্বাকের। তবে যে গরু দুধ দেয়, আর যে লেখক পাঠকসংখ্যা বাড়ায় তাদের খুরের লাথি একটু আধটু সহ্য করতে হয়। তাই তাঁর সব কুযুক্তি আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম।
যাক, উনি এখন গত হয়েছেন, মৃত মানুষের নামে নিন্দামন্দ করা পাপ, তাই ওনার চরিত্র সম্বন্ধে নীরব থাকাই শ্রেয়।
বিজ্ঞাপনে জানা গেল একাধিক দেশে রেজিষ্ট্রিকৃত তাঁর অন্তিম উইল অনুযায়ী কিডনি, লিভার চোখ ইত্যাদিসহ সমস্ত পুনর্ব্যবহার ও প্রতিস্থাপনযোগ্য কলাগুলি তাঁর মৃতদেহ থেকে কেটে বার করে নেবার পর তাঁর দেহটি আজ বিকাল চারটায় হাসপাতাল থেকে তাঁর মেট্রোপলিটনের ‘কস্মোপলিটন হাউসে’ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মাত্র দু-এক ঘন্টার জন্য শায়িত থাকবে যাতে করে তাঁর গুনগ্রাহী ও পরিচিতজনেরা তাঁর অবশিষ্ট মরদেহটিকে শেষ দেখা দেখতে পারেন। নানা দেশমহাদেশের নাগরিক ও অধিবাসী তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী আত্মীয় পরিজনদের জন্য অপেক্ষা না করে তাঁর কলামুক্ত সে দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হবে মেডিকেল কলেজে। সেখানে ছাত্র ছাত্রীরা দেহটা চিরে চিরে হাতেকলমে এনাটমি ফিজিওলজি শিখবে। শেষ পর্যায়ে তাঁর অবশিষ্ট দেহাংশটা পচামাংসভুক পশুপ্রাণীদের বিলিয়ে দেওয়া হবে খন্ড খন্ড করে। এটাই তাঁর অশাস্ত্রীয় অন্তিম বাসনা। হাতে উল্কি করে এই মর্মে বিজ্ঞাপনও করা আছে যাতে মরণান্তে তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা তাঁর ইচ্ছাপূরণে কোনও আইনী বাগড়া না দিতে পারে।
আমার পত্রিকার সামনের মাসের সংখ্যাটার ছাপা শেষ। শুধু মলাট আর স্টিচিংটাই বাকি। বেশ গুছিয়ে একটা মর্মর্স্পর্শী শোকবার্তা ড্রাফট করে তেতোবাবুর একটা ছবিসহ মেল করে দিলাম প্রেসে। বলে দিলাম ফাঁকা তৃতীয় মলাটপাতায় ওটা ছাপাতে, আর পাঁচশ কপি এক্সট্রা ছাপাতে। শ্রাদ্ধের আনন্দভোজে, অভাবে স্মরণসভার জমায়েতে বিক্রি হয়ে যাবে ওগুলো। পেটভরা পেটুকরা ঢেকুর দিতে দিতে পান মুখশুদ্ধি চেবাতে চেবাতে আমাদের পত্রিকার কপি কিনতে বাধ্য হবে চক্ষুলজ্জার খাতিরে।
এরপর বন্ধুবান্ধবদের শেয়ার করার অনুরোধ জানিয়ে শোকবার্তাটা পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে। এক ঘন্টার মধ্যে চুয়াল্লিশটা লাইক, বাইশটা অশ্রু গড়ানো মুখ ভ্যাটকানো ইমোজি, তিরিশটি মন্তব্য আর একুশটা শেয়ার! ভাগ্য একটা করেছিলেন বটে! অকালে হলেও তাঁর মরণ স্বার্থক। স্বার্থক তাঁর চির আকাঙ্খিত আদর্শ মরণ। ঈশ্বরকে সত্বর কাছে পাওয়ার মহানন্দ। কোন একজন ঈশ্বরের কাছে তাঁর অশান্ত আত্মার শান্তি কামনা করে নিয়মমাফিক বিজ্ঞাপনও দিতে হবেনা পয়সা খরচ করে।
সৌজন্য রক্ষার খাতিরে সমবেদনা জানানোর জন্য চার্বাকগিন্নীকে ফোন করলাম। ধরলেন না। সারা জীবন যতই ঝগড়াঝাটি ফাটাফাটি চুলোচুলি করুননা কেন, স্বামীহারা হয়ে খুব সম্ভব শোকে কিংবা হয়ত হঠাৎ স্বাধীন হবার আনন্দে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। এ সময়ে ওনাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি যে ভদ্রতা করে ফোন করেছিলাম সেটা মিসডকল লিস্ট থেকেই জেনে যাবেন। সেটাই যথেষ্ট। জানতে পারবেন আমি তাঁকে কতোই না ভালোবাসতাম। এই মওকায় লেখকের বাকি মানুস্ক্রিপ্টগুলো বিনা রয়ালটি দিয়ে হাতিয়ে নেব ওনার কাছ থেকে।
চার্বাকভবনে যাবার পথে লেক মার্কেট থেকে একটা মড়া সাজানো সাদা ফুলের টায়ার ডিজাইনের তোড়া কিনে নিলাম শববাহী গাড়ির গায়ে ঝুলিয়ে দেবার জন্য। তা না হলে আবার কথা উঠবে সমাজের বাজারে। সে বাজারে টিকে থাকার জন্য নেতা, মন্ত্রী, জ্যোতিষ, সেলসম্যান, গুরুবাবা, পত্রিকা সম্পাদকদের কত রকমের নাটক যে করতে হয়! একটা সুদৃশ্য কার্ডে আমাদের পত্রিকার নাম ফুলের তোড়ায় সাঁটিয়ে দেব সেলোটেপ দিয়ে। সামান্য খরচে ভালো একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে ফাঁকতালে।
বাইপাসের মোড় থেকেই ভিড় শুরু। সবাই সাদা ফুলের তোড়া হাতে ছুটছে লেখকের কসমোপলিটান হাউসের দিকে। রাস্তার দু পাশের কোথাও পার্কিংয়ের জায়গা পেলামনা। দূরের একটা গলিতে কোনরকমে গাড়িটা পার্ক করিয়ে হাঁটতে থাকলাম মাথা নিচু করে, মুখ ভারভার ভাব দেখিয়ে। রাস্তার দু পাশে হাঁটতে থাকা পথিকদের বেশির ভাগের হাতে সাদা ফুলের তোড়া। তিনি যে এতো জনপ্রিয় ছিলেন তা জানতাম না আগে। হয়ত সাহিত্যিক নিজেও জানতেন না। জীবিতাবস্থায় এসব দেখে যেতে পারলে তাঁর আত্মা এই পৃথিবীতেই সজ্ঞানে সশরীরে শান্ত হতো। আত্মার শান্তির জন্য মরার পর আত্মীয়দের দেওয়া বিজ্ঞাপনের জন্য অথবা ঘটা করে শ্রাদ্ধ শান্তির নাট্যাভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।
সাহিত্যিকের বাড়ীর পেল্লাই লোহার গেটের পাল্লাদুটোর একটা বন্ধ। অন্যটাকে সিকিউরিটি আগলিয়ে রেখেছে। সিলেক্টেড দর্শনার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। সামনের রাস্তায় সবাই ফুল হাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। মাথা নিচু করে। এক পাশে ‘স্বর্গরথ’ নামাঙ্কিত একটা শববাহী গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত চার্বাকের দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাড়ির ভেতরে। শববাহী যানটির পেছনে নিউজ চ্যানেলের দুটি ভ্যান পার্ক করা আছে। ফটোগ্রাফাররা ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছবি তুলছে রাস্তার জনসমাবেশের। ভাষ্যকারেরা মাইক হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লেখকের গুণগ্রাহীদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করছেন। অনুমতি পেলে শবদেহের ছবি তুলতে ঘরের ভেতরে ঢুকবেন তাঁরা।
দোতলার হলঘরটায় একটা ডিভানে পাতা এম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন চার্বাক। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। বুকে তাঁর ফুলের পাহাড়। মহিলা পুরুষ, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ বৃদ্ধায় ঘর ঠাসা। সবার মুখ গম্ভীর, চোখে কাঁদো কাঁদো অভিব্যক্তি। এতো ভীড়, কিন্তু প্রায় শব্দহীন ঘর। শান্ত গুরুগম্ভীর শোকস্তব্ধ পরিবেশে শুধু টিভির সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে গলা উঠিয়ে নাবিয়ে, থেমে থেমে ধরা ধরা কাঁপা কাঁপা গলায় সুর পাল্টাতে পাল্টাতে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন তাঁদের চ্যানেলের দর্শক শ্রোতাদের শোনানোর জন্য।
তাঁদের প্রশ্নের জবাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে সামান্য একটু বাড়াবাড়ি করেই বললাম, “সঞ্জীববাবু ব্যাঙ্গ সাহিত্যের জগৎ থেকে অবসর নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করার পর বঙ্গের ব্যঙ্গ সাহিত্য সাম্রাজ্যে এই চার্বাকই ছিলেন বর্তমান প্রজন্মের একছত্র অধিপতি। সেই নক্ষত্রপতনে বঙ্গীয় রসসাহিত্য জগৎ অনাথ হয়ে গেল। আর কিছু সত্যি মিথ্যে প্রশংসার কথা মনে মনে খসড়া করার সময় বিশ্বনিন্দুক জয়দেববাবু মুখ বাড়িয়ে দিলেন ক্যামেরার দিকে। তাঁর পত্রিকায় তিনি নিয়মিত মুখর হতেন চার্বাক নিন্দায়। কিন্তু আজ ঐ সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা দেখে সে পথে না গিয়ে ওনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, “ওনার মত গুণবান লেখক দুর্লভ। এমন কি আমার চেয়েও ভালো লিখতেন তিনি.....” ঘুরপথের অশ্লীল আত্মপ্রশংসা শুনে টিভির ভাষ্যকার মাইকটা ওনার মুখ থেকে সরিয়ে নিতে তিনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে মাউথপিসটা ভাষ্যকারের হাত থেকে নিজের মুখের সামনে টেনে নিয়ে বললেন, “তাঁর কৌতুকগুলি বিতর্কিত, বিরক্তিকর ও অসহ্য হলেও অনেকের কাছে সুখপাঠ্য ছিল।” পাশ থেকে একজন মুখ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, “ওনার কথা আর বলবেননা মশাই। উনি সদা সর্বদা রসেবসে বেয়াড়া রকমের টইটুম্বুর হয়ে থাকতেন। রঙরসের মাতাল। স্থান কাল পাত্র কোনও জ্ঞান থাকতোনা তাঁর কোনও রসের কথা মনে উদয় হলে। গুরুজন লঘুজন জ্ঞান নেই। পিকনিকেও যা আবার মন্ত্রীর গুরুগম্ভীর প্রশাসনিক বৈঠকেও তাই।রাস্তার সবজিওয়ালা, থেকে শুরু করে রাশভারী হেডমাস্টারমশাই, এমন কি হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিও রেহাই পেতেননা তাঁর হাসি মস্করার কামড় থেকে।”
আর একজনকে বলতে শুনলাম, “তবে বিপদেও পড়তেন তিনি তাঁর ঐ বদ স্বভাবের জন্য। হয়ত কোন ঝগড়াটে সবজিওয়ালীকে বলে বসলেন, - তোমার মুখের মত ঝাল দেখে লঙ্কা দাওতো একশো। ব্যাস অমনি বাজারে লেগে গেল লংকাকান্ড। মহিলার মুখ তুলে কথা! বাজারের সব সবজিওয়ালা চেপে ধরলো ওনাকে। মার দিতে বাকি রাখল শুধু।”
-আরে সবজিওয়ালী ফলওয়ালা তো দূরের কথা নিজের শালী এমনকি নিজের গিন্নীর সাথেও মাঝে মাঝে বোকার মত মুখ ফস্কে রসিকতা করে ফেলতেন এই রসিক চূড়ামণি। কী দুঃস্বাহস! সন্তানসম্ভবা মেয়ের পেটের মধ্যেকার যমজ নাতি নাতনীর খেলাধুলার লাইভ ছবি সোনোগ্রাফিতে দেখার পর আনন্দে আটখানা হয়ে অফিস ফেরত কর্তার বেল শুনে তাঁর ঘরে ঢোকার আগেই রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন “সুখবর, সুখবর, ডাবল সুখবর......” পরবর্তী বাক্যের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি চটজলদি বলে উঠলেন, “কেন, তোমারও নাকি?” ব্যাস, সাত ডিগ্ৰী স্কেলের ভুমিকম্প শুরু হয়ে গেল সংসারে। সাহিত্যিক তখন সক্রেটিস। ঘরে না ঢুকে সোজা বেরিয়ে গেলেন পাড়ার চায়ের দোকানের সন্ধানে”
এক মহিলা বলে উঠলেন, “ভদ্রলোক জীবিত থাকলে ওনার সম্বন্ধে এভাবে কথা বলতে কি আপনাদের সাহস হতো?”
উত্তরে আর এক বৃদ্ধা মন্তব্য করলেন, “বলা যায় না, ওনার যা স্বভাব চরিত্তির ছিল, হয়ত দেখলেন আপনাদের এ সব কথা শুনে ওনার আকাশমুখী ডেডবডিটা স্থান কাল পাত্র ভুলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে রঙ্গব্যাঙে তুলোধুনো করে সব্বাইকে ঠান্ডা করে দিচ্ছেন।”
লেখকের লেখার ঘরের টেবিলটায় রাখা হয়েছে তাঁর একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। তাতে সবাই মালা পরিয়ে দিচ্চে। পাশে রাখা ধূপদানীতে ধুপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ছবিটা নাকি তাঁর এক নামকরা ফটোগ্রাফার বন্ধুকে দিয়ে তুলিয়ে নিজেই কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শেষযাত্রার জমায়েত বা শ্রাদ্ধের আনন্দভোজের অতিথিদের প্রদর্শনের জন্য।
পাশের ঘরের টেবিলে দুটো সুদৃশ্য চামড়ায় বাঁধানো একটা খাতা। মৃতের গুণমুগ্ধরা লাইন করে দাঁড়িয়ে একের পর এক শোকবার্তা লিখছেন।
মৃতের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে নানা জনের ভালো মন্দ নানান স্মৃতিচারণ ও মন্তব্য শুনছি। কিছু ফিসফিসিয়ে, কিছু সশব্দে।
- এত বড় লেখক হয়েও একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক।
- তবে উনি গোপনে গোপনে যে বেহেড মাতাল ছিলেন সেটা আমি নিজের চোখে দেখতাম রেসের মাঠে, আর বার-এ। উনি আমায় চিনতেই পারতেন না তখন নেশার ঘোরে।
- ফাঁক থেকে ওনার ধার করা আমার দশ হাজার টাকা চোট হয়ে গেল। এখনতো আর ওনার বিধবা স্ত্রীকে .....
- সেকি, আপনার মত ওয়ান পাইস ফাদার মাদার বন্ধক ছাড়া এতগুলো টাকা ..........
- অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। সুখেই বলুন কি দুখেই বলুন, সব সময় মুখে হাসি - মন রঙ্গরসে ভরপুর। ওঁর সাথে কথা বলে বড় সুখ ছিল। নিমেষে মনের দূঃখ ভুলিয়ে হাসিয়ে দিতেন। শত্রুদেরও বন্ধু করে নিতেন হাঁসতে হাঁসতে, হাসাতে হাসাতে।
- আমাদের সাথে তো ওনার একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আমার গিন্নীতো চার্বাক প্রেমে পরকীয়া অজ্ঞান।
- আমার সাথে দেখা হলেই বিড়ি চেয়ে নিতেন আপন বড় ভাইয়ের মত।
- তবে উনি যে সঞ্জীব চাটুর্জেকে নকল করতেন সেটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। ওনার লেখা রঙ্গরচনাই তার প্রমান। পোড়ে দেখবেন।
- তবে ওনার লেখাগুলো বাঁকা ভাষায় হলেও বেশ লাগতো পড়তে। মানে সুখপাঠ্য।
- থামুন মশাই, উনিতো সত্যজিৎ রায়কে নকল করে ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখে বেশ ভালোই কামিয়েছেন।
- তাই নাকি! ভেজালে ভেজালে দেশটা ভরে গেল দেখছি।
- অরে মশাই, ইনিতো সামান্য একজন লেখক। একটু আধটু এর ওর নকল করে, অপরের লেখা সামান্য অদল বদল করে লেখকেরা যে দুনম্বরী সাহিত্যব্যবসা করেন এটা কে না জানে। এতে দোষের কিছু নেই।
- ঠিক বলেছেন। স্কুলের মাস্টার থেকে শুরু করে, স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে, পঞ্চায়েত সভাপতি থেকে শুরু করে, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে, উনিভার্সিটির উপাচার্য থেকে শুরু করে নানান দেশের প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কে যে একনম্বরী, আর কে যে চোরা পথে চাকরি বাগিয়েছেন, কে যে কাল্পনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী বা জ্যোতিষীর স্বর্ণপদক কিনেছেন তা বোঝা দায়। এখনতো আশপাশের সবাইকেই চোর পকেটমার মনে হয়। উঁচুস্তরের মাননীয় নেতানেত্রীদেরও কান্ডকারখানা দেখলে মনে হয় সর্বকালের সর্ববৃহৎ সর্বশ্রেষ্ঠ ডাকাত দলের সর্দার।
- যা বলেছেন। বাসের গায়ে “পকেটমার হইতে সাবধান ---
-ছোটবেলায় আমি বিখ্যাত বহুল প্রচারিত একটা সাপ্তাহিকে ‘যষ্টিমধু’ বিভাগের পাতার ওনার অনেক লেখা পড়ে ওনার ফ্যান হয়ে গেছিলাম। ঐ পত্রিকা ‘যষ্টিমধু’র পাতা বন্ধ করার পর...........
- এমন নক্ষত্রপতনের পর আর এমন লেখা লিখবে কে? বাংলাদেশটা রসশুন্য হয়ে গেল।
- যা বলেছেন, হাসির ক্লাবের হাসিগুলো যেমন আমাদের কাঁদায়, তেমনি রম্য রচনার নামে এখনকার ভাঁড়ামির গল্প পড়েও হেঁচকি ওঠে।
বিভিন্ন দেশবিদেশের ভক্তদের নাম ঠিকানা লাগানো ফুলের তোড়া, ধুপ, মড়ার পোশাকে দেবার জন্য সুগদ্ধি আসছে কুরিয়ার এজেন্ট মারফত। চারদিকে অগুরু অগুরু মড়া মড়া গন্ধ। বিভিন্ন দেশবিদেশে থেকে তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী আপনজনেদের পাঠানো ফুলমালায় আজকের নায়কের বুকে ফুলের পাহাড়। বড় নাতনী বিলেত থেকে অনলাইনে অর্ডার করে এক ক্রেট হুইস্কি পাঠিয়েছে ক্লান্ত শ্মশানবন্ধুদের বিনোদনের জন্য। স্মার্টফোনে আসা গাদা গাদা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার মেসেজ দেখানো হচ্ছে ছাতে লাগনো বিগ স্ক্রিনে।
লেখকের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ভায়রাভাই উপস্থিত শোকগ্রস্থদের আপ্যায়ন করছেন চোখ মুছতে মুছতে। দিল্লিতে থাকা বর্তমান লেখকগিন্নী বিকেলের ফ্লাইট ধরে ফিরে আসছেন চিত্তরঞ্জন পার্কের আজকের কবি সম্মেলনে তাঁর স্বরচিত কবিতাপাঠ না করেই। কী মহান আত্মত্যাগ! লেখকের একাধিক প্রাক্তন প্রেমিকা আর আদিগিন্নীও এক কোনায় ছলোছলো নেত্রে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। একেই বলে বাঙালি রমণী। প্রেম কাকে বলে এরাই জানে। প্রেমভঙ্গ বা ডিভোর্স হবার পরেও প্রেম অটুট। অবশ্য গিন্নীদেবীর প্রাক্তন স্বামীরাও এসেছেন তাঁদের প্রাক্তন স্ত্রীকে সান্তনা দেবার জন্য।
বারান্দা দিয়ে দেখা গেল বিখ্যাত এক ফাস্টফুড কোম্পানীর ভ্যান এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনের রাস্তায়। তারপর একটা ভ্যান বিখ্যাত এক মিঠাই কোম্পানির। একটা আইসক্রিম কোম্পানির গাড়ীও। উপচে পড়া ভিড় ঠেলে ওদের কর্মচারীরা একে একে খাবারের প্যাকেট হুইস্কির বোতলগুলো নিয়ে সোজা তিন তোলার ছাতে উঠে গেল। সাথে সাথে বোতল রসিকরাও মৌমাছির মত উড়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
একটি ঘরে আত্মীয় স্বজনেরা শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্রের খসড়া তৈরি করছেন। ক্যাটারার নির্বাচন নিয়ে তক্কাতক্কিও চলছে। উপস্থিত আত্মীয়দের বাচ্ছাকাচ্চারা বড় বাড়ী পেয়ে লুকোচুরি খেলছে। একটা ঘরে আসন্ন শ্রাদ্ধভোজের মেনু তৈরি করছে কমবয়সী ছোকরারা। মৃদু ডেসিবেলে “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু” বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে। সর্বত্র একটা শোক শোক, উৎসব উৎসব, আনন্দ আনন্দ, দুঃখ-দুঃখ, টক-ঝাল- মিষ্টির পরস্পর বিরোধী এক সাড়ে বত্রিশভাজা স্বাদের পরিবেশ।
অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ছাতে সাজানো হয়েছে নানা রকমের খাবার আলাদা আলাদা কাউন্টারে। চা,কফি, সফ্ট ড্রিঙ্কস, হার্ড ড্রিঙ্কস। ভাইরাভাইয়ের বিনীত অনুরোধে যে যার পছন্দমত খাবার তুলে নিয়ে খাচ্ছেন, পান করে ঢলাঢলি করছেন।
ব্যাপারটা কি? এমন ভোজের কথা ভূ-ভারতে কখনও শুনিনি। কল্পনাও করিনি। একজন মানুষ মারা গিয়েছেন, বাড়িতে তাঁর বাসি মরদেহ শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়, এখনও পর্যন্ত তার সৎকার পর্যন্ত হয়নি - আর কিনা এত খাওয়া দাওয়া ফুর্তি ফারতা! আশ্চর্য! শ্রাদ্ধের দিনের জন্য কটাদিন অপেক্ষা না করেই এত আনন্দফুর্তির আয়োজন! ছি ছি ছি। শত ছি। মানুষ বড় হৃদয়হীন হয়ে উঠছে দিনদিন।
আমার ক্ষোভের উত্তরে চার্বাকভায়রা ভাই বিনয়ে বিগলিত হয়ে সাফাই দিলেন যে তিনি তাঁর প্রয়াত ভায়েরাদাদার মৃত্যুপূর্ব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন মাত্র। তাঁর অতিথি দর্শনার্থীরা আনন্দভোজ ও চিয়ার্স মন্ত্র বলে আনন্দপান করে সন্তুষ্ট না হলে তাঁর দাদার আত্মা নাকি শান্তি পাবে না স্বর্গে কিংবা নরকে যেখানেই থাকেন না কেন!
এতবড় ঘোর উগ্রনাস্তিকও তাহলে মরার সময় নরকভয়ে কাতর হন! মরণকালে এমন ভীমরতির কারণেই পৃথিবীর দিকে দিকে আজও টিকে আছে হাজার হাজার ধর্ম, হাজার হাজার ভগবান। উঠছে চন্দ্র সূর্য সময়মত।
ভাইরাভাইয়ের কথায় উৎসাহিত হয়ে আর একটা প্যাকেট তুলে নিলাম টেবিল থাকে। মটন বিরিয়ানিটা করেছে ভাল। চার্বাক আত্মাকে শান্ত করার দায়িত্ব না এড়িয়ে আর একবার একটা গ্লাসও ভোরে নিলাম বড় করে।
এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের জীপ এসে দাঁড়ালো বাড়ীর সামনে। ভাইরাভাইটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন অফিসারের দিকে। অফিসার বললেন যে তাঁর কাছে নাকি গোপন খবর আছে যে এটা সুইসাইড কেস, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। মার্ডারও হতে পারে। ডেথ সার্টিফিকেট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইত্যাদি না দেখে মৃতদেহটিকে শ্মশানে নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। একথা বলে মৃতের স্ত্রীকে ডাকতে আদেশ করলেন অফিসারটি।
ভায়েরাটি সবিনয়ে হাত জোড় করে বললেন, “আগে একটু মিষ্টিমুখ করে নিন স্যার। নইলে মৃতের পুন্যজীবনের অকল্যাণ হবে। আমি কথা দিচ্ছি আপনার নির্দেশ মেনে সব ডকুমেন্ট দেখিয়ে দেব ডেডবডি রিমুভ করার আগে।
-ঠিক আছে, ডেডদেহটাতো দেখান অন্তত চাদরটা তুলে।
- সেটাতে একটু অসুবিধা আছে। অঙ্গদানের কারণে দেহটা একটু বিকৃত হয়ে গেছে বলে তাঁর স্বামীঅন্তপ্রাণ সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত স্ত্রী অনুমান করছেন। উনি এয়ারপোর্ট থেকে এলেন বলে। তাঁর পৌঁছনোর আগে মৃতের আবরণ উন্মোচন করতে না করেছেন তাঁর শোকগ্রস্থ সহধর্মিনী। এটা স্যার একাধারে ধর্মীয়, অন্যদিকে প্রেমজ আবেগের ব্যাপার। জীবিত অবস্থায় বোমভোলা স্বামীকে পরিপাটি না সাজিয়ে বেরুতে দিতেন না তিনি। আজ তেমনি মৃত স্বামীটিকে না সাজিয়ে.........
- সব ঠিক আছে, কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে কি বাধা?
মহিষাসুরের পার্ট করা তাগড়াই ধৈর্যহারা ভায়রাটি তড়িঘড়ি স্ফীতোদর পুলিশ সাহেবটিকে একরকম জোর করে টেনে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন এক আত্মীয়ের হাত থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট, আর একটা খাম নিয়ে। খানিক বাদে মুখ মুছতে মুছতে খুব হাঃহাঃ করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন অফিসার। পুলিশ হলেও সদ্য মৃতের বাড়িতে এসে তাঁর মৃতদেহের সামনে কি করে একটা মানুষের এত হাসি আসে বুঝতে পারলাম না। তবে বুঝতে পারলাম বেশ বড় অংকের একটা গোপন লেনদেন হয়ে গেল।
কিন্তু সুইসাইড! এমন সদাহাস্যময় সদানন্দ কৌতুকপ্রেমী সফল মানুষ সুইসাইড করেন কি করে! কিসের দুঃখ লুকিয়ে ছিল তাঁর হাসিমুখের অন্তরালে? বাহাত্তরেও এমন সতীসাধ্বী মা লক্ষী গিন্নী, সাত চড়ে রা নেই, এতো যার জনপ্রিয়তা, চার হাজার স্কোয়ার ফিটের বিলাসবহুল বাড়ী, মোটা টাকার সরকারী পেনশন, মোটা অংকের রয়্যালটি, দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ আয়ের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী, নানা দেশের নানা ধর্মের নাতজামাই নাতবউদের নিয়ে ভরা সুখী সংসার - এ রকম লোকের বুকে কি এমন কান্না লুকিয়ে ছিল যে একেবারে সুইসাইড করতে হল? ধন্য মানবের মন, ধন্য ত্রিভুবন। বিচিত্র তাদের মনের প্রকৃতি তথা বিকৃতি! বাট্রান্ড রাসেল ঠিক কথাই বলেছেন।
মৃতের চারিদিকে ঘিরে অভিজাত ক্যাটারারের উপাদেয় প্লেট হাতে সবাই চার্বাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন কি চিরনিন্দুক সমালোচক, ব্যর্থ কবি সাহিত্যিকরাও চার্বাকের অপচিন্তা,অপকর্ম, অপদর্শন,অপকথন,অপসাহিত্যের কথা সৰাই ভুলে গেলেন। লাল জলের এমনি মহিমা। মুহূর্তে সবাই শোক দুঃখ ভুলে হাসি ঠাট্টায় মুখরিত।
অবিচুয়ারি লেখার জন্য টেবিলে রাখা দু’দুটো মোটা মোটা বাঁধানো খাতার সব পাতা শেষ। গদ্যে পদ্যে শোকসাহিত্যের উথাল পাথাল কান্না। নানা ঘরানার প্রতিভার উজ্জ্বল সমাবেশ।
চার্বাকের প্রিয় আলসেশিয়ানটা নীরবে শুয়ে আছে তার প্রভুর ডিভানের গায়ে গা ঠেকিয়ে। সারাদিন কিছু খায়নি। এতো আর বুদ্ধিমান চতুর হোমো স্যাপিয়েন নয়। অবলা এলেবেলে নির্বুদ্ধি পশুমাত্র। মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। হয়ত ভাবছে, এত মানুষ, কিন্তু গিন্নিমা নেই কেন? অনবরত বক বক করা মালিকই বা কেন নীরবে গা ঢেকে শুয়ে আছে দিনভোর। মাঝে মাঝে সবার দিকে তাকাতে তাকাতে যেন বলছে প্রভুর গায়ের সাদা চাদরটা খুলে দিতে। সাহস পাচ্ছেনা। পরিচিত কেউ ঘরে ঢুকলে ছুটে গিয়ে তার পোশাক কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডিভানের দিকে। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!
চার্বাকপ্রিয়া গাড়ী থেকে নেবে আলুথালু বেশে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে উঠে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সোজা উঠে এলেন ওপরে। সবাই হাতের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে হুড়মুড় করে তাঁর পাশে আসার কসরত করতে লাগলেন যাতে টিভির ক্যামেরায় তেনাদের মুখশ্রী ধরা পড়ে। ক্যামেরা লেখকপত্নীর ছবি তুলতে তুলতে যাচ্ছেন পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে। ধারাভাষ্যকার মাউথপিসটা হাতে ধরে পাশে পাশে এগুচ্ছেন -
“এখন কিন্তু আপনারা কিন্তু সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু। চার্বাকের মরদেহ কিন্তু শুয়ে আছেন ডিভানে। তাঁর সম্পূর্ণ দেহ কিন্তু সাদা কাপড়ে ঢাকা। তার ওপরে ফুলের পাহাড়। আপনারা কিন্তু সদ্য স্বামীহারার উচ্চকণ্ঠের বিলাপ শুনছেন। কিন্তু উপস্থিত অনেকে তা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। লেখক যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা আপনারা কিন্তু বুঝতে পারছেন। চার্বাকপত্নী লুটিয়ে পড়লেন স্বামীর পদতলে। গিন্নিমাকে দেখে কিন্তু সাহস পেয়ে অবলা পশুটি লাফিয়ে কিন্তু ডিভানে উঠে পড়লো কিন্তু ঘেউ ঘেউ করতে করতে। অনেক কিন্তু সয়েছে সে। আর কিন্তু অপেক্ষা করতে পারল না। ঢাকা দেওয়া সাদা চাদরটা কামড়ে টান মেরে কিন্তু ফেলে দিল মেঝেতে। আমি প্রকাশকে কিন্তু অনুরোধ করছি ক্যামেরাটা মৃতের মুখের দিকে ফোকাস, মানে কিন্ত ফো-কাস .........
ভাষ্যকার ছোকরাটি তোতলাতে তোতলাতে আচমকা থেমে গেলেন। ডেড সাইলেন্স। যাঁরা ডিভান ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা হঠাৎ করে পরিত্রাহি চিৎকার করে পিছিয়ে গেলেন ডিভানের পাশ থেকে। মনে হচ্ছে যেন বাঘ বা ভুত ঢুকে পড়েছে ঘরে। চারিদিকে হুড়োহুড়ি। কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। পদপিষ্ট হবার ভয়ে সবাই দেয়ালের দিকে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করছেন। বিমূঢ় ভাষ্যকারের ফ্যাকাসে মুখে ভাষা নেই। ক্যামেরার হাত থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে ভাষ্যকার সাহস সঞ্চয় করে অনেক ‘কিন্তু’ সহযোগে আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন, “আপনারা কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন, .......কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন ..... মানে দেখতে পাচ্ছেন, মৃত চার্বাকের দেহ কিন্তু উঠে বসেছেন। আপনারা কিন্ত, মানে কিন্তু দেখছেন তাঁর চোখে সাঁটানো তুলসীপাতাটা উড়ে গেল পাখার হাওয়ায়। চোখ দুটো তাঁর পিট্ পিট্ করছে। মুখে কিন্তু তার সেই পরিচিত কৌতুকের হাসি। চার্বাকপ্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে হাসতে হাসতে তাঁর পিঠে কিন্তু ক্রমাগত মেরেই চলেছেন আদুরে ঘুঁষি, আর কৌতুকের কান্নার মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলছেন, মরবে কেন, তাহলে আমার হাড় মাস খাবে কে? সাহিত্যিকের কুকুরটি তাঁর কোলে উঠে তাঁর গালটা চেটেই চলেছে, চেটেই চলেছে.......
যমালয়যাত্রার পথে মাঝরাস্তা থেকে সাহিত্যিকের ফিরে আসা দেখে সবাই এত আনন্দ পেয়েছে যে তাঁর ভায়রাভাই উপস্থিত সবাইকে ডিনারেরও মৌখিক নেমন্তন্ন করার পর ক্যাটারারকে ফোন করতে লাগলেন নির্দেশমাফিক পুরো অর্ডার শিগগির ডেলিভারি দিতে।
টিভি ভাষ্যকারের অনুরোধে চার্বাক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ আসলে আমার নিজেকে সৎভাবে চেনার ইচ্ছে হয়েছিল। জীবিতাবস্থায় বুঝতে পারতাম না কে আমায় সত্যিকারের ভালোবাসে। সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে এত মানুষের আগমন, মানুষের ভালোবাসা দেখে, সবার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে আমার প্রশংসালোভী আত্মাটা আপাতত স্বর্গে উঠতে অস্বীকার করলো। যমরাজও তাঁর আদেশের টেম্পোরারি স্থগিতাদেশ দিলেন পুনর্বিবেচনা করে। বেয়াড়া আত্মাটার আরও কিছুদিন আনন্দময় পৃথিবীতে থাকার ইচ্ছা। মাঝপথে আকাশ থেকে নেবে এসে সেটা আবার যীশু খ্রিস্ট হয়ে গেল এই বুকের মধ্যে।”
[শেষ অংশ শেষের পাতায় ]
ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি বুকের ওপরের ফুলের তোড়ার পাহাড় সরে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবীর ওপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে “এপ্রিল ফুল”
COSMOPOLITAN
A-128,Metroplitan,
5th Lane,Kolkata 105