জলঙ্গী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 27, 2024 | | views :900 | like:0 | share: 0 | comments :0
জলঙ্গী নদী দিন দিন কোমায় চলে যাচ্ছে। নদিয়া মুর্শিদাবাদের অন্যতম এই জলঙ্গী একসময় গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের এক খরস্রোতা নদী হিসাবে লোকমুখে খোড়ে নামে পরিচিত হয়েছিল। আজ জলঙ্গী আই সি ইউ তে। না, কোনও প্রাকৃতিক কারনে নয়, আমাদের নিরন্তর উদাসীনতায়। নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিগত দেড় দুই হাজার বছরে ভূমিরূপের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভূ গর্ভস্থ ভৌম জলস্তর মোটামুটি একই উচ্চতায় রয়েছে। এখনও তিন চারটে পাইপ পুঁতে নলকূপের জল যথেষ্ট পরিমানে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। মোটামুটি একহাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত জলঙ্গী অববাহিকায় প্লেট টেকটোনিক এর প্রভাব পড়া প্রায় অসম্ভব, প্রভাব পড়লে বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপের চরিত্র টাই বদলে যাবে। তাই কালের নিয়মে জলঙ্গী হারিয়ে যাচ্ছে এমন দাবি পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।
গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের নদীয়া মুর্শিদাবাদ এবং পার্শ্ববর্তী যশোর ঝিনাইদহের কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে জলঙ্গী ছাড়াও বাংলাদেশে থাকা ভৈরব, কপোতাক্ষ, রূপসা নদীর অবস্হা অপেক্ষাকৃত অনেক ভালো। অন্যদিকে জলঙ্গীর মত ভারতে থাকা চূর্ণী, ইছামতী নদী গুলোও আজ মরতে বসেছে। কপোতাক্ষ, রূপসার মত ছোট নদীকে জাতীয় জলপথে পরিনত করে বাংলাদেশ তাদের লাভজনক ট্রেড রুট বানিয়েছে। আর আমরা নদী বাঁচাও আন্দোলন করছি।
আসল সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরী করে আমরা ভেবে নিয়েছি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে জলচুক্তিতে হাফ ডজন গোল দেওয়ার আনন্দে আমাদের জামার কলার উপরে উঠেছে আর Sustainable Development করতে পারার আত্মতুষ্টিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাঙালির অর্গ্যাজম হয়েছে। কিন্তু Development কে Sustain করতে যা যা করার দরকার সেগুলো আমরা না করে আমাদের দায় এড়িয়ে গিয়েছি। ফারাক্কা ব্যারেজের বাইপাস সার্জারি হিসাবে যে ফিডার ক্যানাল তৈরী হয়েছে তাতে জলঙ্গী নদীর কোনও লাভ হয়নি। জলঙ্গীর উৎসমুখ গোপালপুর ঘাট পলি পড়ে মজে গিয়েছে। আমরা ড্রেজিং করে পলি না সরিয়ে সেই জায়গায় চাষাবাদ করছি। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার নদী খাত বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ গাছের গোড়া আমরা ইতিমধ্যেই কেটে ফেলেছি। তার উপর নদীর পাড়ে যথেচ্ছ পরিমাণে ঘরবাড়ী, অবৈধ ইটভাটা তৈরী হচ্ছে। নদীর পাড় বাঁধানো নেই। সেচ দপ্তর জেগে ঘুমাচ্ছে।
কৃষ্ণনগরে নতুন রেলব্রীজ তৈরি হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু রেলব্রীজের বড় বড় পিলার গুলো নদীগর্ভে বসানোর ফলে যে পরিমাণ জায়গা দখল করেছে তার সম পরিমাণ জায়গা নদীর দুপাশে ড্রেজিং করে বাড়ানো হয়নি। উপরন্তু পাড়ের জমিতে বীজতালা করে চাষ হচ্ছে। এরফলে নদীখাতের আয়তন কমেছে, সমানুপাতিক হারে নদীর জলধারণ ক্ষমতাও কমেছে। কদমতলা ঘাটে শতাধিক বছর ধরে প্রতিমা বিসর্জনের ফলে নদী গর্ভে মাটি, কাঠামো প্রভৃতি জমা হচ্ছে। হালে বছর দশেক ধরে কৃষ্ণনগর পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিমার কাঠামো তুলে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হলেও, বিগত একশ বছর ধরে যে পরিমান অবক্ষেপ নদীতে জমা হয়েছে তার জন্য পর্যাপ্ত ড্রেজিং কখনই হয়নি। গোলাপটি এলাকায় নদী ক্রমশঃ সরু হয়ে আসছে। জলঙ্গীর শরীর অপুষ্টি গ্রাস করছে। জলঙ্গী নদীকে গলা টিপে মেরে ফেলার সমস্ত রকম ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।
জলঙ্গী নদীর শরীরে এখনও প্রাণ আছে বাংলাদেশের ভৈরব নদীর দয়ায়। ভৈরবের বিভিন্ন উৎস থেকে এখনও যেটুকু জল আসছে তাতেই জলঙ্গী অক্সিজেন পাচ্ছে। ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিয়েছে। পদ্মা দিয়ে যেটুকু জল তারা সারাবছর পেয়ে থাকে সেই জলের পরিপূর্ন ব্যবহার করেছে। তার সুফল হিসাবেই এখনও জলঙ্গী নদীর শরীরে রক্ত সংবহন তন্ত্রটি সচল রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে 54 টি আন্তর্জাতিক নদী আছে যেখানে শুধু গঙ্গা ছাড়া অন্য কোনও নদীর ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু জলবন্টন চুক্তি নেই বলেই জলঙ্গী নদী এখনও বেঁচে আছে। ভৈরব আন্তর্জাতিক নদী। এর বিভিন্ন প্রবাহ কখনও ইছামতী, কখনও রায়মঙ্গল নামে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দুর্বল দেশ বলে আমাদের রক্ষে, নাহলে ফারাক্কা আর তিস্তার বঞ্চনার বিরুদ্ধে যেদিন দক্ষিন বঙ্গের ছোটো ছোটো আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে জলবণ্টন চুক্তি দাবি করে বসবে সেদিন আর কোনও ভাবেই জলঙ্গীকে বাঁচানো যাবে না।
এখনও সময় আছে, বিশল্যকরণী প্রয়োগ করতে পারলে কোমায় থাকা জলঙ্গী আবার বেঁচে উঠতে পারে। সবার প্রথমে পদ্মা থেকে জলঙ্গী নদীতে সরাসরি ফিডার ক্যানাল তৈরী করে নিরবিচ্ছিন্ন জল সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। এরজন্য জলঙ্গী বাঁচাও আন্দোলনকে সামাজিক স্তর থেকে গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করতেই হবে। সেভ জলঙ্গী জাতীয় কর্মসূচী শুধুমাত্র কৃষ্ণনগরের এলিট শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জলঙ্গীর দুই পাড়ে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ সাধারন প্রান্তিক জনগণের মধ্যে এই আন্দোলনের প্রভাব শূন্য। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে আন্দোলন মুখী করা তখনই সম্ভব হবে যখন জলঙ্গীর দাবী সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবী হিসাবে স্বীকৃত হবে। জলঙ্গীর দাবী, তথা জলের দাবী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে সেদিন জলঙ্গী বাঁচবে, তার আগে নয়।
জলঙ্গী নদীর অববাহিকা আর কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র প্রায় সমার্থক। জলঙ্গী একান্ত ভাবেই কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের নিজস্ব নদী। তাই হাতে সময় বেশী নেই, মাত্র এক বছর। আগামী লোকসভা ভোটে দাবি উঠুক জলঙ্গী নদীকে কেন্দ্র করে। " হয় আমাদের জলঙ্গী নদী সারিয়ে দাও, নয়তো আমরা নোটায় ভোট দেবো" এই দাবীতে সোচ্চার হওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। রাস্তাঘাট, রেলপথ সারানোর দাবীতে তো অনেক ভোট হল, একবার নদী সারানোর দাবী নিয়েও আন্দোলন হোক। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার প্রায় সাত লাখ। এরমধ্যে জলঙ্গী দুই পাড়ে বসবাস করেন এমন জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে মাত্র একলাখ মানুষকে নদীর দাবীতে এক জায়গায় সংগঠিত করতে পারলেই সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাতের ঘুম উড়ে যাবে, জলঙ্গী তখন দিল্লীর পার্লামেন্টে আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। শীর্ণ কায়া জলঙ্গী আবার পূর্ণ কায়া হবে। নাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জলঙ্গীর অবস্হা বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীর মত হবে, জলঙ্গী নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে।।
অনুজ বিশ্বাস,
(কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, ভারতীয় ডাক বিভাগ)
কৃষ্ণনগর, নদীয়া।