ধর্মকারার প্রাচীর

মহম্মদ মহসীন


Dec. 3, 2024 | | views :926 | like:13 | share: 0 | comments :0

 দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ মালাউই (Malawi)।  সে দেশের প্রধান ভাষা চেচুয়া (chichuwa)।  সে ভাষায় একটা কথা আছে।  "M' mera mpoyamba". ইংরাজি করলে হয় catch them young. 

অর্থাৎ বোধবুদ্ধি গজানোর আগেই পাকড়াও করো। সারাজীবন, সেই ধারণাতেই বাঁধা থাকবে। এমন বন্ধন যে সে বন্ধন খুলে দিলেও সে বুঝতেও পারবে না। কথাটি এত সত্য যে বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শণের অনুসারী দল এটাই বাস্তবায়িত করে থাকে। ফলও ফলে। 

একমাত্র যুক্তিবাদ বলে, মানুষ বড় হোক, চিন্তা করতে শিখুক, তবেই তার মধ্যে যুক্তিবাদের আলো দাও। তার জীবনে কোন পথে চলবে, বড় হোক,  বড় হয়েই তা ঠিক করবে। তার মধ্যেকার অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধত্ব দূর হলে তবেই মানবিক গুণের বিকাশ ঘটবে। 

 কিন্তু সমাজ  মানুষকে বড় হতে দেয় না। মানুষের বয়স বাড়ে, সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে, নাম ডাক বাড়ে, কিন্তু সেই মানুষ কখনো বড় হয় না।

 সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছেন, “এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ থেকে গেল

কিছুতেই বড় হতে চায় না

এখনো বুঝলো না যে ‘আকাশ’ শব্দটার মানে

চট্টগ্রাম কিংবা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়

মানুষ শব্দটাতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই

ঈশ্বর নামে কোনো বড়বাবু এই বিশ্বসংসার চালাচ্ছেন না

ধর্মগুলো সব রূপকথা

যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে

তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না।”


মনোবিদ বলেন, শিশুমনে যে ধারণা প্রোথিত করা হবে ছোটবেলাতেই, তা থেকে নট নড়ন-চড়নের মানসিকতা তার  ষোলোআনা। 

ঠিক এইকারণেই ধর্মের অন্ধবিশ্বাস প্রোথিত হয়ে যায় ছোট থেকেই। ভক্তি গ্রাস করে যুক্তিশীল মানসিকতাকে। 

  ধর্মের প্রতি অন্ধভক্তি মানুষের মধ্যেকার র‍্যাশানাল চিন্তনশীলতাকে গ'ড়ে উঠতে দেয় না। জন্মগতভাবে মানুষ যে যুক্তিশীল মানসিকতা পেয়ে থাকে, তাকে বাঁচতে দেয় না রাজনীতিক ও সামাজিক স্বার্থনীষ্ঠ মদতে পুষ্ট অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী জগৎ। মারতে মারতে, মেরেই ফেলে। 

 কিভাবে এই অন্ধবিশ্বাস একটি শিশুকে, তার পরিবার ও সমাজকে বিপথে চালিত করে তা উপলব্ধি করলে দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।


 একটি উদাহরণ দিলে বক্তব্যটি হয়তো আর কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। আমার বাস্তব জীবনে দেখা ঘটনা। মুসলিম পরিবারেই বিভিন্ন সামাজিক স্তরে, ছোট শিশুদের আরবী শিখতে চাপ দেওয়া হয়, নামাজ পড়া শিখিয়ে দেওয়া হয়। সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার রমজান মাসে এইসব ছোট ছোট শিশুদের শেখানো হয় সারাদিন নিরম্বু উপবাসের মাধ্যমে কৃচ্ছসাধন করেই ঈশ্বরের কৃপালাভ করা যায়। যার কাছে ক্রিকেট, ডাংগুলি, নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব, লেখাপড়া এইসব বিষয় হল জীবন্ত সেখানে কিম্ভুতকিমাকার ঈশ্বর ধরে এনে তাদের মনের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়, সর্বক্ষণ তার 

অস্তিত্বহীনতাকে ঢাকতে নানান ফাঁদ ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয় তার মাঝে প্রশ্ন করার মানুষটাকে। ছাঁচে ঢেলে তাকে বানিয়ে ফেলা হয় হিন্দু অথবা মুসলিম। যাতে মানুষ হতে না পারে তার চেষ্টা থাকে নিরন্তর।

 

 শিশু থেকে একটু বড় হওয়া কিশোরী-কিশোরদের কাছে কষ্টকর কাজগুলি সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই একটা এ্যাডভেঞ্চার। জীবনের প্রকৃত এ্যাডভেঞ্চার, জীবনের প্রকৃত কষ্টকর কাজগুলিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে তা অতিক্রম করার পরিবর্তে তাদের সামনে রাখা হয় সারাদিন না খেয়ে দিনাতিপাত করার মেকি চ্যালেঞ্জ। জীবনে একটি মেকি ও পলায়নপর জীবনশৈলী গড়ে তোলা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এভাবেই যুবসমাজের মধ্যে মুক্তিকামী চেতনা গড়ার পরিবর্তে ইংরাজদের মদতপুষ্ট এইধরণের মেকি চ্যালেঞ্জকে যুবসমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল ধর্মগুরুরা। এভাবে যুবসমাজ বাস্তব দায়িত্বের থেকেও এক অলৌকিক দায়কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। ক্ষতি করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে। জনৈক বিপ্লবীর এভাবেই মগজধোলাই হয়। বিপ্লব ছেড়ে ধ্যানট্যানে মনোযোগ দেন, আমরাও তার বিল্পবী জীবন নিয়ে যত না আগ্রহী, তার শতগুণ বেশি আগ্রহ নিয়ে লম্ফঝম্ফ করি তার এই ধর্মান্ধীয় 

জীবন নিয়ে। 


 আসলে আবার বলি, ধর্ম হলো পরিশ্রম না করে জীবিকার্জনের সহজতম উপায়। 

যেহেতু ধর্ম রাজনীতির এক মোক্ষম হাতিয়ার, যেহেতু ধর্মকে ব্যবহার করে সম্প্রদায়গত আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটবাক্সে সাফল্য পাওয়া যায়, যেহেতু ধর্মনেশায় আচ্ছন্ন জনগনকে তাদের নেশার বস্তুটি সরবরাহ করতে পারলেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়, তাই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার সমস্যা হয় না। ধর্ম নেশাগ্রস্তদের ধর্মীয় আকাঙখা পূরণ করতে পারলেই অনেক দায় পূরণ না করলেও রাজনীতিগত কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, তাই মানুষ ধর্মের অন্ধকারে বাস করুক, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই সেটি চায়। ধর্মনেশায় উৎসাহ যোগায়, ধর্মান্ধতা প্রসারে ইন্ধন যোগাতে চায়। ইংরাজ শাসনও চেয়েছিল, সেই বিপ্লবী আরো কিছু যুবককে বিপথে চালিত করে ধর্ম ধর্ম করুক, তাতে তাদের শাসন কায়েম রাখায় অনেক সাহায্য করা হবে। ইংরেজদের দেখা যায় অনেক "মহাপুরুষের" পাশে দাঁড়াতে। “মহাপুরুষ” গুলিকেও দেখা গেছে, ইংরেজদের পাশে দলবল নিয়ে সমর্থন দিতে। 


 আজ যা বলতে এসেছি, ধর্মের যাপন, অভ্যাস শিশুদের মধ্যে প্রোথিত করে। সেই শিশুদের মধ্যে জিজ্ঞাসার মানসিকতাকে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেয়। কেন রাতদুপুর থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত মাইক্রোফোন বাজিয়ে নিজ ধর্মাচরণের কারণে অপরের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি, এ প্রশ্ন তাদের মনে আসার বীজটিকে মেরে মেরে মৃত করেই ছাড়ে, সুনাগরিক হওয়া তো দূরস্থান, কেন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে জিইয়ে জিইয়ে মানুষের সমাজকে ইতরপ্রাণীর জীবন থেকেও নিকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে ধর্মের যাপনে,  সে প্রশ্ন তাদের মনে আসে না। ধর্ম কেন পুরুষতান্ত্রিকতায় পক্ষপাতিত্ব করে নির্লজ্জভাবে, এ প্রশ্ন আসেনা, কেন দিনের পর দিন ভোরের আজানে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হবে, কেন সংকীর্তনে অবিরাম মাইক বাজিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হবে, কেন ধর্মের আশ্রয়ে থেকে মানুষের উপর অত্যাচার করা হবে, এসব প্রশ্ন তাদের মনে আসে না। এক্কেবারে বোধ বুদ্ধি সহমর্মিতার দরজা জানালা বন্ধ করে অচল থাকার নেশায় বদ্ধপরিকর এই সকল মৃতমনের রোবটেরা শুধু চিন্তা করতে শেখায় নিজের কথা, শুধুই নিজের কথা। এসেছি একা (কে, কোথা থেকে?),  যেতে হবে একা (কোথায়?) এসব পাতি কথাগুলি তাদের মনে গভীর জীবনদর্শণ। 

এমন নির্লজ্জ স্বার্থপরতার শিক্ষা দেয় সকল ধর্মদর্শণ। 

কেন নারী কন্ঠে আজান শুনি না, কেন নারীকে ধর্মগ্রন্থে আপনার অধিকার আদায়ের পথে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়, সে বিষয়ে পিছনপানে ঘোরা সমাজের চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্দোলনের কথা ধার্মিকেরা চিন্তাও করতে পারে না।

  শিশু থেকে কিশোরী/কিশোরদের ধার্মিক করে গড়ে তোলা হয় এভাবেই, যাতে তাদের বোধের দ্বার রুদ্ধ থাকে চিরকাল। বিজ্ঞানের সারতথ্যের সাথে ধর্মগ্রন্থের সংঘর্ষ থাকলে ধর্ম তাদের মিথ্যাকে জোর দবরদস্তি চাপিয়ে দিতে মরিয়া। এজন্য বিজ্ঞানীদের পোড়াতে, অত্যাচার করতে, হত্যা করতেও তাদের হাত কাঁপে না

 এরা আসলে এক বোধহীন রুদ্ধমনের প্রাণী। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে না, যেখানে ছয়মাস দিন, ছয়মাস রাত্রি, সেখানকার অধিবাসীরা কিভাবে সারাদিন নিরম্বু উপবাস  পালন করবে? "পৃথিবী ঘোরে" এই সামান্য তথ্যটিও যার অজানা সেই ধর্মগ্রন্থ প্রণেতা কিভাবে মহাবিশ্ব নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা দেখান।  বিজ্ঞানের ভবিষ্যত নিয়ে যার সামান্যতম ধ্যান ধারণা নেই, তিনি কিভাবে শ্লোক-সত্য লেখেন যে গর্ভস্থ ভ্রুণের লিঙ্গ,  শিশুর জন্মের পূর্বে স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া  যেখানে গর্ভস্থ ভ্রুণের লিঙ্গ কোনো মানুষ জানতে পারবে না?

 এসব প্রশ্ন ধার্মিকদের বিব্রত করে না, অস্থির করে না, ধর্মের প্রশ্নাতিত আনুগত্যে সন্দেহ জাগাতে পারে না। 

  ধর্ম যুবতী/যুবকদের মনকে আলোড়িত করে প্রশ্ন জাগায় না, কেন রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গের" জগমোহন বালবিধবা ননীবালার বিধবা-মাতৃত্বকে সমর্থন করেন, কেনইবা শচীশের সঙ্গে বিবাহে উদ্যোগী হন। তাঁর কথা, “দেখ্‌ বাবা, আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমারা কিছুকে মানিনা বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।” 

যুবতী/যুবকদের মনে নাস্তিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে পারে না। 

 আকাশের পাখিকে  বেড়ি পরিয়ে খাঁচার ভিতর রাখতে রাখতে যেমন তাকে খাঁচাতেই অভ্যস্ত করে ফেলা হয়, খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে যা রে উড়ে যা রে পাখি বলে পীড়াপীড়ি করলেও খাঁচা থেকে  বেরিয়ে ওড়ার ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি তার আর থাকে না, তেমনই 

ধর্মকারার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে থাকতে বদ্ধমনা ধার্মিকেরাও নিজেদের মুক্তিস্পৃহাকে কখন যেন হত্যাই করে ফেলেছে, তা তাদের চেতনাতেই আসে না। 

  ধর্মকারার প্রাচীরে  বজ্রহানার কথা তো তাদের মাথায় স্বপ্নেতেও আসে না। সেই প্রাচীরের দরজা খোলা থাকলেও প্রকৃতির বুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা তারা ভাবতেও পারে না। 


তাদের  চেতনার দ্বার খোলার জন্য আমাদের নিরলস প্রয়াস তাই জারি থাকবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, নিরবধি কাল পর্যন্ত। দেশ থেকে দেশান্তরে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929