প্রাতস্নান সেরে, গরদের থান পরে, মুখে একটা ভক্তি ভক্তি ভাব মেখে শয়তানের ঠাকুমা নিস্তারিণীদেবী সেই কোন কাকভোরে ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলেন। বেদীতে সাজানো কয়েকটি বহুল প্রচলিত দেবদেবী, জনপ্রিয় মহাদেব, নানা রঙের মাকালী, কালো কৃষ্ণ, ফর্সা কৃষ্ণ, শনি মনসা ইত্যাদি প্রাচীন ঠাকুরদেবতাদের ছবি, আধুনিক সন্তোষী মা, অবাঙালী বজরংবলী, বিদেশি যীশু, বুদ্ধ, গড়গড়া সেবনরত মিষ্টি মিষ্টি করে হাসা মেদবহুল সবে দেবত্ব পাওয়া প্রেমময় গুরুদেব ইত্যাদি গুনে গুনে ছাব্বিশটি ফুল দেবতা, হাফদেবতা, কোয়াসি দেবতা, সব প্রজাতির দেবদেবী ও ভক্তদের দ্বারা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপিত উঠতি গুরুবাবা ভবিষ্যতের দেবতার ছবিগুলিতে একটি একটি করে মালা পরিয়ে এক এক করে পুজো সেরে প্রশান্ত মুখে এতক্ষনে বেরুলেন তিনি পাক্কা দুই ঘন্টা পরে। পাপের ভয়ে বেদীতে নিরাকার আল্লার ছবি না থাকায় তাঁকে মনে মনে নমস্কার করেছেন। কোনও ঝুঁকি নেননি তিনি। স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত। হাতে তাঁর পাথরের থালায় কিছু নকুলদানা ও ফুলবেলপাতা। এ বাড়ীর সবার হাতে একটি করে নকুলদানা প্রসাদ দিয়ে তাদের মাথায় ফুল বেলপাতা ছোঁয়াবেন কপালে প্রদীপের তাপ দিয়ে। সারাদিন ভালো থাকবে সবাই। কোনো কাজে বিঘ্ন হবে না কারো।
ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েই ৫-৬ বছরের নাতি শয়তানের সাথে দেখা। শয়তান বলে উঠলো, - "এতক্ষন ঠাকুরদেবতাদের তেল মেরে কি আদায় করলে ঠাকুমা?"
- ছোটোকাকার কাছে এইসব শিক্ষা হচ্ছে, না? ছিঃ এত বড় বাড়ীর ছেলের মুখে কিনা এমন সব অসংসদীয় অভদ্র অভদ্র ভাষা! এরকম কথা আর বলো না।
- তাহলে বল ঠাকুরের কাছে কি চাইলে তুমি। নিশ্চই একটা ধান্দা আছে।
- কিচ্ছু চাই না ভাই, শুধু ঠাকুরের শ্রীচরণে একটু আশ্রয় চাই।
- কেন, তুমি কি রাস্তায় থাক, তোমার কি আশ্রয় নেই নাকি?
- তা, থাকবে না কেন। তবে সারা জীবনে তো অনেক পাপ করেছি, পরকালের জন্যও তো কিছু করতে-টরতে হবে।
- পাপের ফল তো তুমি পাবেই। পুজো করলেও পাবে, না করলেও পাবে। ঠাকুররাতো নেতা মন্ত্রী বা সরকারী অফিসার নয় যে তেল/ঘুষ খেয়ে, প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে তোমার সব পাপ মকুব করে দেবে। আর মরার পরে দেবে স্বর্গে একটা দক্ষিণ খোলা ফ্লাট বা বাংলো।
- (স্বগতোক্তি: এ সব হচ্ছে অজিতের শেখানো বুলি। তোতা পাখীর মত মুখস্ত করেছে কিচ্ছু না বুঝে।) আর পাকামো করতে হবেনা তোমায়। ছোট তুমি, ছোটর মত থাকবে। বড়দের কথা শুনবে।
- ছোটকাকুও তো বড়, আমিতো ওর কথা শুনি। চার্বাকদাদুর কথাও শুনি।
- আবার তক্কো। নাও, প্রসাদ নাও।
- ই: রোজ রোজ শুধু নকুলদানা! তোমার কেষ্ট আর গুরুবাবদের যে ডায়াবিটিস হবে। মাটনরোল, চিকেন বিরিয়ানী, বিফ কাবাব, চকোলেট, আইসক্রীম - এসব দিতে পারোনা?
- আবার আজবাজে কথা। ঠাকুরদেবতারা কি এসব খাবার খান?
- কি খান তুমি জানলে কি করে? ছোটকাকু বলেছে যে, যারা ঠাকুর দেবতা, শাস্ত্র টাস্ট্র ফেঁদেছিলো তারা নিজেরা যা খেত তাইই ঠাকুরদেবতাদেরকে দেবার ব্যবস্থা করে গল্প লিখে গেছে। আসলে তখনতো আর চাউমিন, নোডলস, ফুচকা টুকচা ছিলো না। তাহলে দেখতে তাদের অন্য রকমের মেনু বানাত কবিরা। এতদিনে মডার্ন ঠাকুরদেবতারা নিশ্চই আমাদের মত ফুড হ্যাবিট পাল্টিয়েছে। রিমোর্টে না খেয়ে কাঁটা চামচও ব্যবহার করছে। তাঁরা এখন তোমাদের ওই সেকেলে খাবার ছুঁয়েও দেখেন না। তুমি ওদের জন্য ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করো। আমার ভালো লাগেনা ওদের পচা পচা প্রসাদ খেতে। ওনারাতো সর্বভুক, যে যা নৈবেদ্য দেয় বিনা প্রতিবাদে খান। নররক্ত নরমাংসও খান নরবলির পর। ওনাদের মেনু পাল্টাও তুমি।
কানে হাত দিয়ে ঠাকুমা বলে উঠলেন, "ছি ছি, এসব কথা শোনাও পাপ। ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে এসব কি রকম কুৎসা! তোমার মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খাচ্ছে ঐ অজিতটা। যাচ্ছি তোমার বাবার কাছে। একটা বিহিত করতেই হবে।"
সোজা বড়ছেলের ঘরে ঢুকলেন নিস্তারিণী দেবী। রোজকার মত হাতে একটা নকুলদানা দিয়ে মাথায় ফুল বেলপাতা ছুঁইয়ে বললেন, "ছেলেটা যে অজিতের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাচ্ছে সেটা কি তুই দেখেছিস? পরলোকে যে জল পাবিনা ও ছেলের হাতে।"
শয়তানের বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে নকুল দানাটা চেবাতে চেবাতে দার্শনিকসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, "সবই ওপরওয়ালার হাত মা, সব তিনিই করাচ্ছেন, তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র। শাস্ত্রে লিখেছে।"
- সেটা অবশ্য আমিও মানি। তবে শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী, আর গীতার বাক্যের ওপর ভরসা করলেতো চলবেনা। নিজের ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপার বলে কথা। চোখ কান খোলা রাখতে হবে সব সময়। বলি শোন, শয়তানের নামে করা মাকালীর জোড়া পাঁঠার মানতটা এবার শোধ দিয়ে দে। মায়ের আশীর্বাদে কেউ ওর মাথা বিগড়ে দিতে পারবেনা।"
বাবা মারা যাবার পর মাতৃদেবী সারাদিন স্বর্গলাভের চিন্তায়/দুশ্চিন্তায় একপ্রকার মানসিক রোগী হয়ে গেছেন ঈশ্বরভক্তদের মত। খুব প্রেম ছিল দুজনের। মরার পর স্বর্গবাসী স্বামীর কাছে যেতে চান। মাকে খুশি করবার জন্য বড়কত্তা বলে উঠলেন, "কথাটা তুমি মন্দ বলোনি। আমারও তাই ইচ্ছা। অজিতকে বলে কালই পুরুত/জহ্লাদ ডেকে পূজোর দিন ঠিক করে ফেল।"
এমন সময় অজিত ঢুকলো ঘরে। বললো,"এতো হইচৈ কেন মা। আমার নামে কি চুকলি কাটছো দাদার কাছে?"
- হৈচৈ হবেনা! নিজেতো জাতধর্ম খুইয়ে দেশসেবা ছোটোলোকসেবা করে বেড়াচ্ছো, বাপ চোদ্দপুরুষদের মুখে চুনকালি দিয়ে পৈতেটাও খুলে ফেলে দিয়েছো। ইহকাল পরকালতো ঝরঝরে। কিন্তু দুধের ছেলে ভাইপোটাকে নাস্তিক বানাচ্ছিস কেন বলত। ঠাকুর দেবতাদের বই না শুনিয়ে যত বাজে বই পড়ে শোনাচ্ছিস, আজেবাজে কথা শেখাচ্ছিস, যুক্তিবাদী ক্লাবে বক্তৃতা শোনাতে নিয়ে যাচ্ছিস। তোদের কুশিক্ষায় মুখে মুখে তক্কো করতে শিখেছে আজকাল - আমাদের সাথে এমন শত্রুতা করছিস কেন বলতো, কেন?"
- ঐটুকু বাচ্চার অপরিণত মাথায় ঠাকুদেবতার বদ চিন্তা ঢোকাচ্ছো কেন তোমরা? কেনইবা ওকে আস্তিক বানানোর চেষ্টা করছো? তোমাদের যেমন অধিকার আছে মনসা শনির পাঁচালী পড়ানোর, আমারও তেমনি কর্তব্য আছে ওকে বুঝিয়ে বলা যে ওগুলো সাহিত্যিকদের কাল্পনিক গল্প মাত্র। তোমার জটায়ু-গরুড়, ব্যাঙ্গমা - ব্যঙ্গমী, সুখ-সারির আজগুবি গল্পের মত। তুমিও ওকে ওর কাঁচা মগজটা ধোলাই করে আস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দাও, আমিও নাস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দেব। বড় হলে নিজের স্বাধীন চিন্তায় যেটা ভালো মনে করে করবে। আসলে আমি ডিফেন্সে খেলছি কিনা। তোমাদেরকে আক্রমণ নয়, তোমাদের আবেগে আঘাত করা নয়,আমি শুধু তোমাদের সংস্কারের বিষ থেকে শিশুটাকে বাঁচাতে চাই। আস্তিক্যরোগের ছোঁয়াচের আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে ওকে আস্তিক্যরোগের প্রতিষেধক খাওয়াচ্ছি।
- দেখ, সেদিনকার ছেলে তুই, বড় বড় কথা বলিসনা। তুই নাস্তিক, তুই তোর মত নিয়ে থাকিস। আমরাতো কিছু বলিনা। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসে তুই আঘাত দিস কেন? আমাদের বিশ্বাস নিয়ে আমাদের বাঁচতে দে।
- তোমাদের গুরু ধর্মপ্রচারকরাও আমার মত অন্যের বিশ্বাসে অন্যের আবেগে আঘাত দিয়েছেন। মোহাম্মদ যীশু থেকে শুরু করে চৈতন্যদেব রামকৃষ্ণ - সবাই। সমসাময়িক আধমরা সমাজের প্রচলিত আবেগে আঘাত দিয়ে ওনারা যদি অন্যায় না করে থাকেন,আমি কী অন্যায় করলাম? তুমি কি বল বড়দা?
- তাই বলে বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষের রীতিনীতি, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সনাতন ধর্ম বিসর্জন দিতে হবে নাকি?
- বিসর্জন তো দিয়েছিই। তুমিও দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। আবার মা-ও দিয়েছে। তা না হলে তো বাল্যবিধবা পিসিমাও নতুন পিসেমশাইকে বিয়ে না করে কাশীর নোংরা পাড়ায় পচতে থাকতো,আর মাকেও বাবার চিতায় পুড়িয়ে মারতে হতো আমাদের।
নিস্তারিণীদেবী আর পারলেন না। সক্রোধে বলে উঠলেন, "সেটাই উচিত ছিল। তাঁর সাথে স্বর্গে যেতে পারতাম। আজ আর এমন হেনস্থা হতে হতোনা। তোদের কাছে এমন নরকযন্ত্রণাও সহ্য করতে হতোনা। ওগো তুমি কাদের কাছে রেখে গেলে গো"
- বিলাপ কোরোনা, কেউই এই পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে যেতে চায়না মা। তুমিও না। যতই নরকতুল্য হোক, যতই দুঃখকষ্ট থাক না কেন সবাই চায় এই পৃথিবীতে থাকতে, পৃথিবীটাকে ভোগ করতে।
ছেলের সাথে তর্ক করা বৃথা। পাশে দাঁড়ানো নাতির দিকে ঘুরে বলে উঠলেন, এয়াই শয়তান, কি শুনছিস হাঁ করে? ছোটকাকার কথা খুব মন দিয়ে শুনিস, তাই না? খুব মিষ্টি লাগে? চলে আয় আমার সাথে। নাড়ু বানাবো দেখবি। ছোটোর সাথে একদম মিশবিনা। নরকে যাবি।
এক মনে নাড়ু বানানো দেখতে দেখতে শয়তান বলল, "ঠাকমা,তুমি কি সত্যি সত্যি স্বর্গে যেতে চাও?"
- স্বর্গে যেতে কে না চায় ভাই। সেখানে দেবতারা থাকেন। তোমার দাদুও থাকেন। আমিও তাঁদের কাছে যাবো। সেখানে না আছে কোন দুঃখ, না আছে কোনো জ্বালা যন্ত্রনা। শুধু অপার আনন্দ সেখানে। আমি পাপী, তাই এ বয়সেও পড়ে আছি এই পৃথিবীতে। মা কালীকে সারাদিন ডাকি কোলে তুলে নিতে। কিন্তু আমার পাপের শেষ না হলেতো তিনি নেবেননা। পৃথিবীর যন্ত্রনা সইতে হবে।
- তুমি কি তাহলে আমাদের চেয়ে দেবতাদের বেশি ভালোবাসো ঠাকুমা?
- ওরে আমার সোনাভাই, তা কখনো হয়! তুমি যে আমার নাড়ুগোপাল।
- শোনো ঠাকুমা, তুমি যখন স্বর্গে যাবে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে কিন্তু। আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না। এই আমি বলে দিলাম সাফ কথা।
- বালাই ষাট, এমন কথা মুখে আনতে নেই।
- কেন? সবাইতো সে দেশে যেতে চায়। মজার জায়গা। মামাবাড়ীর থেকেও মজার। তুমি এতো ভয় পেলে কেন। স্বর্গে আমি যাবোই তোমার সাথে।
- ছি: ভাই, এমন কথা বলো না। আমি বুড়ো হয়েছি। আর কটা দিনই বা বাঁচবো। তুমি এখন ছোট, কত বড় হবে, টুকটুকে বৌ আসবে, কত্ত আনন্দ করবে। এখন এসব কথা ভাবতে নেই।
- তুমি যে বলো স্বর্গেই আনন্দ, পৃথিবীতে শুধু যন্ত্রনা। পাগলা বোঁচাও এ কথা বলে।
- বড়দের সাথে এমন মুখে মুখে তর্ক করতে নেই। ঠাকুর পাপ দেয়। এখন তুমি ছোট আছ্, বড় হলে সব বুঝতে পারবে।
- আমি ছোট বলে ঠাকুরের কথা, স্বর্গের কথা বুঝতে পারিনা, তবে সেসব কথা আমায় বোঝাও কেন? ঠাকুর দেবতাদের মূর্তিকে 'নমো কর নম্ কর' বলে প্রণাম করতে শেখাও কেন?
উত্তর খুঁজে না পেয়ে যেন কিছুই শোনেননি ভাব দেখিয়ে উঠে গেলেন ঠাকুমা অন্তরের রাগ চেপে। আজকালকার এতটুকু বাচ্চাদের সাথে কথায় পারা যায়না। শুধু প্রশ্ন, আর প্রশ্ন। সক্রেটিস থেকে অমর্ত্য সেনরা ওদের শেষ করে দিলো।
দেখতে দেখতে কালীপূজার দিন এসে গেল। নাস্তিক হলে কি হবে, ছোট কাকার কালীপূজায় খুব উৎসাহ। পাঁঠার মাংসের ওপর ওর একটু দুর্বলতা আছে। শয়তানকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ঠাকুর কিনে নিয়ে এলো পছন্দ করে। ও অবশ্য মূর্তিটিকে পুতুল, আর পুজোকে পুজো-পুজো খেলা বলে। ছাতের ওপর নিজের হাতে তৈরী করে প্যান্ডেল। আর্টিস্ট মানুষ, সাজিয়েছে সুন্দর। ঠাকুরের মুখের খুঁতটা তুলি দিয়ে ঠিক করে দিল। শয়তান তার প্রিয় কাকুকে সাহায্য করে রং, তুলি, কাঁচি ইত্যাদি জিনিস এগিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুমা ফল কাটছেন, নৈবেদ্য সাজাচ্ছেন। শয়তানের মা মশলা বাটছেন আগামীকাল বলির মাংসপ্রসাদ রান্নার জন্য। ঠাকুর সাজাতে সাজাতে শয়তানের এটা ওটা হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তার ছোটকাকু। মা কালীর মুখটা রক্তাক্ত কেন, তিনি কি কাঁচা মাংস খান? তিনি কি আফ্রকার মেয়ে?
ঠাকুমা কি জন্য একটা কাজে নিচে গেলেন। শয়তানকে বলে গেলেন নজর রাখতে যেন কাকেরা নৈবেদ্যে মুখ না দেয়।
ছোটকাকু ঠাকুর সাজাতে সাজাতে বললো, দেখলি শয়তান, মা কালী নিজের খাবারটাও বাঁচাতে পারে না সামান্য কাকের থেকে। যেটা তুইও পারিস। এটা তোর ঠাকুমাও জানে। শুনেছি সবচেয়ে বড় কালীঘাটের কালীর সোনার জিভটা চোরে খুলে নিয়ে গেছে। এই ঠাকুর নাকি বড় বড় শত্রুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে!
শয়তান হঠাৎ করে তোতা পাখীর মত খুব গম্ভীর হয়ে বললো, "তুমি আমার সাথে এমন কথা বলবেনা। ঠাকুমা শুনতে না করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি নরকে যাবো নাকি?" একেবারে ঠাকুমার ভাষা।
ওর বলার ভঙ্গি দেখে অজিত হো হো করে হেসে উঠলো। এমন সময় নিস্তারিণী দেবী ফিরে এলেন। অজিতকে বললেন, "আজকের দিনটা রেহাই দে বাবা। ওর নামে উৎসর্গ করা পূজা। ওর মাথাটা আর খাসনা।
গভীর রাতে পুজো। চারিদিকে একটা ভয় ভয়,ভক্তি ভাব। পুরুত ঠাকুরের চোখ রক্তবর্ণ। প্রচুর কারণবারি পান করেছেন। পরনে লাল চেলী। কপালে বড় একটা লাল তেলতেলে টিপ। গলায় জবাফুল ও রুদ্রাক্ষের মালা। বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক। নরবলি দেওয়া মড়ার ওপর বসে কালীসাধনা করে 'সিদ্ধ' পুরুষ হয়েছেন বলে আধ্যাত্মিক গুজব।
অনেক সময় নিয়ে তিনি গুরুগম্ভীর গলায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে পূজার্চনা ও মন্ত্রপাঠ করলেন দক্ষ অভিনেতাদের মত। এবার বলি হবে। কালো কালো নধর দুটি ছাগশিশু দু তিন দিন আগে রাজাবাজারের পাঁঠাবাজার থেকে এসেছে। ছাগলদুটিকে ভালোবেসে ফেলেছে শয়তান। পার্ক থেকে ঘাস ছিঁড়ে এনে খাইয়েছে, পাউরুটি খাইয়েছে। ওদের বলি হয়ে যাবে এখুনি। শয়তানের মন তাই খারাপ। তার দুদিনের বন্ধু আজ মরে গিয়ে কালীঠাকুর আর তাঁর ভক্তদের পেটে ঢুকবে।
ছাগলদুটিকে চান করিয়ে নিয়ে আসা হলো। তাদের গলায়ও জবার মালা। কপালে লাল টিপ্। শয়তান ওদের অবস্থা দেখে চোখে আর জল রাখতে পারছেনা। ওদের প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল শয়তান। বাবা,মা,ছোটকাকু কেউ ওর কথা শোনেনি। ঠাকুমাকে বলেছিল, "ওদের না মারলে হয়না?"
ঠাকুমা ওর মুখ চেপে ধরে বলেছিলো, "ওকথা বলতে নেই, মাকালী পাপ দেবেন "
শয়তান বললো, "ওরা কি দোষ করেছে যে ওদের গলা কেটে ফেলা হবে?"
ঠাকুমা বললো, "ওরে বোকা, ওরা অনেক ভাগ্যবান। মা ওদের গ্রহণ করবেন। ওরা স্বর্গে যাবে। ওদের জীবন স্বার্থক"
প্রচণ্ড জোরে ঢাক বাজছে। ছাগলদুটির মাথা একসাথে হাড়িকাঠে ঢোকানো হলো। চিতায় জোর করে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরা সতীদের আর্তনাদ যেমন ঢাকের আওয়াজে ঢাকা পড়ে যেত, ছাগলগুলির ব্যা ব্যা শব্দও চাপা পড়ে যাচ্ছে।
শয়তান আর থাকতে পারছেনা। খুব জোরে জোরে নিঃস্বাস নিচ্ছে। বুকটা বোধ হয় ফেটে যাবে তার। এমন সময় বিকট শব্দে "মা মা" বলতে বলতে বিশাল খাঁড়া হাতে মাতাল সিদ্ধ পুরুষটি এক কোপে কেটে ফেললেন ছাগল দুটিকে। কাটা ধড় দুটো ছটপট করতে লাগলো মাটিতে লুটিয়ে। একবার চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল শয়তান।
চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে ওর ঠাকুমা ওকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লেন। শয়তানকে বললেন,"ছাগলদুটোর কি ভাগ্য! মা কালী ওদের দেহ ভোগ করলেন। আমরা কালকে মায়ের প্রসাদ খাবো। ওরা স্বর্গে চলে গেল। ওদের জন্য দুঃখ করতে নেই।"
- তাহলে তোমাকেও বলি দিতে ঐ রাক্ষস পুরুতটাকে বললেনা কেন? তুমিওতো স্বর্গে যেতে চাও। কালকে পুরুতকে বলে আমি তুমি দুজনেই বলি হয়ে স্বর্গে চলে যাবো"
এ কথা শুনে ঠাকুমা ভয়ে আঁতকে উঠলেন। ছেলে বলে কি। ঠাকুমা উত্তরহারা। শেষ রাতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
ভোরবেলা হঠাৎ ঢাকের শব্দ আর ঠাকুমার ভয়ার্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল শয়তানের। ঘুমের ঘোরে ঠাকুমা হাড়িকাঠে ঢোকানো পাঁঠার মত আর্ত চিৎকার করে বলছেন, "আমায় বলি দিওনা, আমি স্বর্গে মা কালীর কাছে যাবোনা, আমি এই পৃথিবীতেই থাকতে চাই"।
শয়তান ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "কেঁদোনা ঠাকুমা, আমি আর স্বর্গে যেতে চাইনা। তুমিও যাবেনা, আমিও যাবনা, কালীর প্রসাদও খাবনা "
হুঁশ পেয়ে ঠাকুমা বললেন, আজ থেকে তিনি পুজো আচ্ছা ছেড়ে দেবেন। স্বর্গের স্বাদ তাঁর মিটে গেছে। ঠাকুমার কথা শুনে দরজায় দাঁড়ানো অজিত হাততালি দিতে লাগলো হাসতে হাসতে।
মূল রচনা - কলকাতা ডিসেম্বর ১৯৯৫
সামান্য সংশোধিত - সানফ্রান্সিসকো - ২০১৮
সমালোচনা: asokdas.godless@gmail.com