আজন্ম দুঃখিনী সীতাদেবী তার একমাত্র গর্ভজাত পুত্র সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছে। কিন্তু লেখাপড়া শিখলেই তো আর সকলেই শিক্ষিত হয়না! কেউ কেউ শিক্ষিত না হয়ে গর্দভও হয়। বিশ্বভুবন তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও বোধহয় সিতাদেবীর একমাত্র ছেলে চিরঞ্জিতের মতো দ্বিতীয় গর্দভ এর সন্ধান পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ?
ভালোবাসা মানুষকে যেমন আপন করে নেয়, তেমনি কখনও কখনও ভালোবাসা কাউকে কাউকে অন্ধ করেও দেয়। চিরঞ্জিত গ্রামেই এক সহপাঠীকে ভালোবেসে একদিন হঠাৎ বুড়ো মাকে একলা বাড়িতে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।সেই দিন থেকে দীর্ঘ কুড়িটি বসন্ত সীতাদেবীর একমাত্র ছেলের পদশব্দটুকু একটিবারের মতো কান পেতে শোনায় জন্য অধীর আগ্রহে,প্রতিটি মুহূর্ত কাটে। অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো মাটির কুঁড়ে ঘরে পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু বসে বসে থাকলে তো আর দিন চলে না। যা কিছু বিষয় আশয় ছিল বিক্রি করে কোনও কর্মে দিনপাত চলে। তাছাড়া এতদিন ধরে গ্রামের পাড়া প্রতিবেশীরা দয়া বশত যথা সাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করেছে।এই পরনির্ভরশীল জীবন সীতাদেবীর আর ভালো লাগে না।তাই একদিন সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, আর গ্রামে থাকবে না। কিন্তু যাবে কোথায়? শরীরে আর তো সেই আগের মতো তেজ নেই। সে ভাবে,গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে ভিক্ষা করে খাবে! তবুও গ্রামে আর থাকবে না।
একদিন রাত্রে হঠাৎ পাড়া প্রতিবেশীকে না জানিয়েই পরনের শতছিন্ন শাড়িটি পরেই সত্তর বছরের রুগ্ন জীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে চুপিচুপি জন্মের মতো গৃহের মায়া ত্যাগ করে।গভীর রাত্রে খালি পায়ে হেঁটে এসে এক ষ্টেশনে একটি পেসেঞ্জার ট্রেনে ওঠে।সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখে এক বিরাট ঝাঁ চকচকে রেল স্টেশনে সে পড়ে আছে। জীবনে কোনোদিন এতবড় ষ্টেশন দেখার সৌভাগ্য সীতাদেবীর হয় নাই। কিন্তু ষ্টেশনটি যতই আধুনিক ঝাঁ চকচকে হোক না কেন, তাতে কি আর দুঃখিনির পেট ভরবে? অগত্যা ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পাশের দোকানগুলোতে ভিক্ষাবৃত্তি করতে লাগে।
একদিন একটি কাপড়ের দোকানে নতুন নতুন জামা কাপড় পরা পুতুলগুলিকে দেখে অবাক হয়ে ভাবে, যার প্রয়োজন তার দেহের লজ্জা নিবারনের কাপড়টুকু নাই,আর এই পুতুল গুলি? মুহূর্তে নজর পড়ে,দোকানে বিশাল আকারের ফ্লেক্সে বড়বড় অক্ষরে পরিস্কার বাংলায় লেখা" চিরঞ্জিত শাড়ি স্টোর।'' সিতাদেবী তার মলিন কাপড়ের আঁচলে অশ্রু মুছে, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমার ছেলের নাম চিরঞ্জিত!"