সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতার অভাবই সমস্ত সমস্যার মূল কারণ?
মাধর রঞ্জন সরকার
May 19, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
সততাই মহৎ গুণ, সততাই জীবনের মূলমন্ত্র, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ ইত্যাদি বহুল প্রচলিত বাক্যগুলি আমরা সর্বত্র শুনে থাকি। এছাড়াও জনগণকে বলতে শোনা যায় সৎ মানুষজন দেশ পরিচালনা করলে দেশের এমন দুর্দশা হত না। অর্থাৎ সততা এমন এক যোগ্যতা যা দিয়ে সবকিছু জয় করা সম্ভব। এই রচনাটিতে আমরা সততার প্রচারিত দিক এবং প্রয়োগের বাস্তবিক দিক নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করব।
আমরা যদি কখনও নিজের ভেতরে উঁকি দিই তাহলে দেখব কখন আমরা অপরকে দুঃখ দিয়েছি অথবা দুঃখ দেবার কথা ভেবেছি। যখন সোজা পথে কাজ হয় না কেবলমাত্র তখনই বাঁকা পথ নিতে বাধ্য হয়েছি। একটি কথা আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন ‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করে নিতে হয়’। এর অর্থ মানুষ প্রথমে সোজা আঙ্গুল দিয়ে ঘি বের করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী চলার চেষ্টা করে। তাতে যদি সফল না হয় তখন সংবিধানের বিপরীত পথ ধরে নেয়। সমাজে এইসব ঘটনাগুলিকে আমরা বিভিন্ন অপরাধের নামে জেনে থাকি। মানুষ সর্বকালে এভাবেই জীবন কাটিয়ে এসেছে। প্রথমে মানুষ সংবিধান অনুযায়ী জীবনযাপনের সাধ্যমত চেষ্টা করে। এমনকি সংবিধানের নিয়ম কঠোর হলেও মানুষ প্রথমে সেইমত চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই সময়কালে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়। তারপরও মানুষ চেষ্টা করে যায়। যখন সোজা পথে জীবন অসম্ভব হয়ে পড়ে তখনই বিকল্প পথের সন্ধানে পা বাড়ায়। বলা যায় অপরাধের পথ গ্রহণ করে অগ্রসর হয়ে যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় এছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যেখানে ১,০০০ মানুষের সুখসুবিধা প্রয়োজন সেখানে সুখসুবিধা রয়েছে কেবলমাত্র ১০ জন মানুষের জন্য। যেখানে ১,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান প্রয়োজন সেখানে কর্মসংস্থান রয়েছে কেবলমাত্র ১০ জন মানুষের জন্য। বর্তমান ব্যবস্থা ১০ জনকে কোনও প্রকারে কর্মসংস্থান প্রদান করলেও ৯৯০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের পরিস্থিতির উপর। সিংহভাগ মানুষ কিভাবে বেঁচে রয়েছে সে সম্পর্কে সকলে অবগত। দুর্দশায় জর্জরিত মানুষ তারপরও যেমন তেমন করে দরিদ্রতার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থায়, অসহায় অবস্থায় কয়জন কতদিন সৎ হয়ে থাকতে পারে? প্রেমপূর্ণ মনোভাব কিংবা সততা বজায় রেখে চলতে পারে? হাতে গোনা কিছু মানুষ জর্জরিত অবস্থাতেও অন্যকে প্রতারণা করে না। তারা পরিত্যক্ত অবস্থা, জীর্ণ অবস্থা ভবিতব্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক গঞ্জনা ইত্যাদি চাপে মানুষ প্রতিনিয়ত হয় আত্মহত্যা করে চলেছে নাহয় মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে চলেছে। মনের দিক থেকে চাইলেও কেন সকলে সততা ধরে রাখতে পারে না? কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না? উত্তর হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বারংবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শতভাগ মানুষের উচ্চতর আয়ের সুনিশ্চিত জীবিকার বন্দোবস্ত ব্যতীত শুধুমাত্র সততা বা নৈতিকতা দ্বারা কিভাবে জীবনযাপনের অভাব পূরণ সম্ভব? এইরূপ অসহনীয় অবস্থায় অধিকাংশ মানুষ একটা সময় পর অনৈতিক পথ ধরে নিতে বাধ্য হয়। দেখা যায় সমাজ তাদেরকেই সরাসরি দোষারোপ করে থাকে। সমাজের এই অভিযোগ কি সঠিক বিচার বলে মনে হয়? কয়েকজন লোক মিলে তো সমাজ তৈরি হয় না। সমাজ সকলে মিলে তৈরি হয়। সেখানে শক্তিশালীরা থাকে, দুর্বলরা থাকে, শিশুরা থাকে, মহিলারা থাকে। বলার অর্থ সমস্তপ্রকার মানুষজন থাকে। ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থায় সকলের কাছে নৈতিকতা কিভাবে আশা করা যায়? বরং নৈতিকতাকে একটি সঠিক ব্যবস্থার ‘পরিণাম’ অথবা ‘মাপকাঠি’ হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত। সততা বা নৈতিকতা মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সঞ্চারিত হলে বুঝতে হবে ব্যবস্থা সঠিক রয়েছে। অন্যথায় বুঝতে হবে ব্যবস্থায় কোথাও না কোথাও ত্রুটি রয়েছে। ব্যবস্থা যখন সঠিক হয়ে যাবে পরিণামস্বরূপ নৈতিকতা স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। নৈতিকতা বা অনৈতিকতা কোনও না কোনও ব্যবস্থারই পরিণাম। ব্যবস্থা ভাল হলে নৈতিকতা আপনিই চলে আসবে। জোর করে নিয়ে আসতে হবে না। বর্তমান ব্যবস্থা একইরকমভাবে চলমান থাকলে এটি নিশ্চিত যে ৯৯০ জন সুখসুবিধা থেকে সর্বদা বঞ্চিতই থাকবে। নিঃস্ব মানুষকে, বঞ্চিত মানুষকে, অসহায় মানুষকে কোন নৈতিকতার পাঠ পড়াবেন?
তাকে পুনরায় কি ত্যাগ করার উপদেশ দেবেন? অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী নৈতিক ও মানবিক বলেই তারা বঞ্চিত, নিঃস্ব। মানবিকতা বা নৈতিকতা কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা নয় যা দিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু-পরিষেবা ক্রয় করা যায়। ব্যবস্থা একদিকে সুযোগসুবিধা রেখেছে মাত্র ১০ জনের জন্য। অপরদিকে উপদেশের বাণী শোনাচ্ছে সৎ হতে হবে, নৈতিক হবে হবে, মানবিক হতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন মনোভাব রাখতে হবে। যেখানে পূর্বেই অনুমান করা যাচ্ছে ৯৯০ জন অসফল হবেই, প্রতারিত হবেই। এইরূপ অমানবিক ও অসম্পূর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির সততা বা নৈতিকতাকে দোষারোপ করা যায়? দোষ তাহলে কোথায় রয়েছে? ব্যক্তির যোগ্যতায় নাকি অযোগ্য ব্যবস্থায়? সংশোধন কিসের প্রয়োজন? ব্যক্তির নাকি ব্যবস্থার? ১,০০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনই যোগ্য এই সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক? শুধুমাত্র যোগ্যতার মনোবলও কি ১০ জনের তালিকায় প্রবেশের পক্ষে যথেষ্ট? অসম্পূর্ণ ব্যবস্থায় যারা বাধ্য হয়ে কৌশল অবলম্বন করবেন তাদের অমানবিক বলবেন নাকি ব্যবস্থাকে অমানবিক বলবেন? ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সংশোধন প্রয়োজন নাকি অসম্পূর্ণ ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন? ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেখানে শতভাগ মানুষের জন্য সুযোগ-সুবিধা সর্বদা সুনিশ্চিত থাকবে। বিষয়টি ব্যক্তিগত নয় সামাজিক। সমাজকেই নতুন করে চিন্তন-মনন করতে হবে।
যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কৌশল অবলম্বন করে, মেধা-অর্থ-শ্রম-শক্তি ব্যয় করে সম্পদশালীদের মধ্যে যায়গা করে নিয়েছেন তারাও সর্বদা এই ভেবে ভয়ে ভয়ে থাকেন যেকোনও সময় বঞ্চিতরা দল বেঁধে অর্জিত সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারে। কারণ বর্তমান ব্যবস্থা সকলের জন্য সুযোগ-সুবিধা বা সম্পদের সুরক্ষিত বন্দোবস্ত করতে পারেনি। এমনকি বর্তমান দর্শনও মানুষের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন এমন সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট করে রেখেছে। নিঃস্ব, অসহায়, পরিত্যক্তদের কথা ছেড়েই দিন, যাদের দখলে কিছু না কিছু রয়েছে তারাও সর্বদা ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।
এই প্রকার অস্পষ্ট দর্শন এবং অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকলে নিশ্চিন্তের জীবন হবে এমনটি কিভাবে আশা করা যায়? কঠোর সংগ্রাম কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে যে সামান্য কিছু মানুষ সুখসুবিধা অর্জন করেন কিংবা সমাজের চোখে তথাকথিত সফল বলে পরিচিত সেইসব মানুষজনও অর্জিত সম্পদ ঠিকমত উপভোগ করতে পারে না। কেননা তারা এই ভেবে সর্বদা দুশ্চিন্তায় থাকে কি জানি এই সুখ-সুবিধা কতদিন আমাদের কাছে থাকবে। কবে কে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে কে জানে। কেননা বহু মানুষ লুণ্ঠনের চেষ্টায় প্রচেষ্টারত রয়েছে। কি জানি কখন তারা সফল হয়ে যায়। পরিবারের কাউকে অপহরণ না করে ফেলে। আত্মীয় বন্ধুদের উপরও সর্বদা সন্দেহ থাকে এই ভেবে কে কখন প্রতারণা করে ফেলে। কিংবা মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যেতে হয়। যে কারণে নিকটজনের সম্পর্কও একরকম সন্দেহজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলে। যেটুকু সুখসুবিধা তাদের কাছে থাকে সেটুকুও ভয়ে ভয়ে উপভোগ করতে হয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত এটিই বেরিয়ে আসে পেয়েও অসুখী জীবন না পেয়েও অসুখী জীবন। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা আবশ্যক যাদের কাছে সম্পদ রয়েছে তারাও যেন সুরক্ষিত জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখ উপভোগ করতে পারে এবং যাদের কাছে কিছুই নেই তারাও যেন সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়ে সুখী জীবনযাপন উপভোগ করতে পারে।
সীমিত সুযোগ-সুবিধা দখল করতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা পিছিয়ে পড়ে তাদের বহু উপমা দ্বারা ভূষিত করা হয়। বাস্তবে কেউই অলস অবস্থায় কিংবা অদক্ষ অবস্থায় পড়ে থাকতে চায় না। কেউই অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। প্রতিটি মানুষ আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীন জীবনযাপন উপভোগ করতে চায়। পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও জীবিকার বন্দোবস্ত পেতে চায়। সকলেরই কোনও না কোনও বিষয়ে রুচি রয়েছে, মেধা রয়েছে। এমনকি পছন্দের কর্ম সম্পাদনেও আনন্দ আছে। সকলেই সেই আনন্দ উপভোগ করতে চায়। সুতরাং শতভাগ মানুষের সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত না করে কাউকে অলস, অনৈতিক ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা আদৌ যুক্তিযুক্ত? এমনতর অবস্থা কি সততা বা নৈতিকতার অভাবের কারণে ঘটে চলেছে? অসম্পূর্ণ ব্যবস্থাই একমাত্র দায়ী নয় কি? অনেকে পূর্বজন্মের কর্মফলকে দায়ী করেন এবং মানুষের মধ্যে জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তি রয়েছে এমনটি মনে করেন। প্রথমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক একটি শিশু পৃথিবীতে পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ে আসে নাকি নিষ্পাপ অবস্থায় আসে। সে কি পূর্বজন্মের পাপ বয়ে নিয়ে আসে নাকি শুদ্ধ অবস্থায় আসে। নিজেদের পরিবারের সন্তানদের দেখে কখনও এমন মনে হয়েছে তাদের মধ্যে জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তি রয়েছে? নাকি প্রতিটি শিশু নিজের পরিবার, পরিজন, পরিবেশ, বাহ্যিক অবস্থা-ব্যবস্থা যেমন তেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে শেখে এবং সেই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করে থাকে? তাহলে বাহ্যিক অসম্পূর্ণ অবস্থা-ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন নাকি নিষ্পাপ মনের? তথাকথিত এই সিদ্ধান্তটি প্রচলিত আধ্যাত্মিক জগতের ভ্রান্ত ধারণা নাকি সঠিক সিদ্ধান্ত? এ বিষয়ে পুনরায় বিবেচনা করা উচিত নয় কি? গবেষণা-অনুসন্ধান-আলোচনা-পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তই উঠে আসবে বাহ্যিক অবস্থা-ব্যবস্থার রূপান্তর আবশ্যক। যে কারণে ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এবার অপরাধের বিষয়টি নিয়ে সামান্য পর্যালোচনা করা যাক। একজন অপরাধীর ক্ষেত্রে সমাজ এই আশা করে সে যেন সঠিক শাস্তি পায়। ধরুন শাস্তি পেয়ে জেলবন্দি বা ফাঁসি হল। উপদেশ হিসেবে প্রচারও করা হল আর কেউ যেন অপরাধ না করে। করলে ওইরকম শাস্তি পেতে হবে। এতেই কি সব মিটে যায়? সমাজ কি অপরাধ মুক্ত হয়? অপর কেউ একইরকম অপরাধে লিপ্ত হয় না? যারা অপরাধ করে তারা কি জানে না ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি হবে কিংবা মৃত্যুও হতে পারে? তারপরও মানুষ কেন অপরাধে লিপ্ত হয়? কোন প্রবৃত্তি তাকে অপরাধের পথে প্রেরিত করে? কেন প্রেরিত করে? সেই প্রবৃত্তি কি অপরাধী জন্মজাত নিয়ে আসে? নাকি সমাজ থেকে গ্রহণ করে? তাহলে সমস্যা কি মনুষ্যের অভ্যন্তরে রয়েছে নাকি সমাজের মধ্যে রয়েছে? আপনারা যেকোনও একটি সমস্যা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারবেন প্রতিটি সমস্যা সরাসরি ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত।
সুতরাং বিষয়টি প্রথমত দর্শনগত, তারপর ব্যবস্থাগত। এটি নিশ্চিত মানুষের অভ্যন্তরে কোনও সমস্যা নেই। বাহ্যিক পরিস্থিতিই ধাপে ধাপে বাধ্য করে অনৈতিকতার পথে ঠেলে দেয়। যদিও বাস্তবে সামান্য কিছু মানুষ আছেন যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনৈতিক পথ গ্রহণ করেন না। তারা সমস্ত দুঃখ সহ্য করে চলেন। সৎ, মানবিক, নৈতিক মানুষের জীবন পরিত্যক্ত হবে, অসহায় হবে, জীর্ণ হবে এটিই বা কি প্রকারের বিধান? তাদের কি সুখসুবিধার প্রয়োজন নেই? দেখা যায় সৎ মানুষকে অধিক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়। তাদের পরিবারের সদস্যরাও এমন কষ্টের জীবন চায় না। নীতিবান মানুষদের বাড়ি গেলে দেখা যায় তাদের পরিবার কত দুঃখে রয়েছে। তাদের আত্মীয় পরিজনরাও এইসব নীতিবান মানুষদের তিরস্কার করতে থাকে। শিক্ষা, জীবিকা, সুখসুবিধার বন্দোবস্ত না হলে সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতা দ্বারা বাস্তবিক চাহিদার অভাব পূরণ কিভাবে সম্ভব হবে? মূল কথা সততা, নৈতিকতা কিংবা মানবিকতা কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা নয় যা দিয়ে সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন সম্ভব। নিষ্ঠাবান, নীতিবান হয়ে আজীবন দুর্দশার জীবন ধারণ করে প্রাণ ত্যাগ করাও যেমন সঠিক বিধান নয় তেমনই সম্পদ অর্জন করে অসুরক্ষিত জীবনযাপনও সঠিক বিধান নয়। আবার ব্যবস্থা যেমন তেমন নির্মাণ করে জনতা ভাল হলে ব্যবস্থা ভাল হবে এবং জনতা মন্দ হলে ব্যবস্থা বিফল হবে এটিও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। মানুষকে বাধ্য হয়ে অসম্পূর্ণ ব্যবস্থার নীতিকে মেনে নিতে হবে এটিও সঠিক বিধান নয়। মানুষ অন্তরে যেমন বাহ্যিক জগতের ব্যবস্থাও তেমন হওয়া উচিত। জাতি, ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি, মূর্খ, জ্ঞানী, দরিদ্র, বিত্তশালী সকলকে প্রথম সারিতে রেখে ব্যবস্থা নির্মাণ করা উচিত। এমন ব্যবস্থা আবশ্যক যেখানে প্রতিটি মানুষের সমৃদ্ধশালী জীবন আজীবন সুরক্ষিত থাকবে। মানুষ সমৃদ্ধশালী হলে, সুনিশ্চিত হলে, সুরক্ষিত হলে পশু-পক্ষী-জলবায়ু-প্রকৃতি ইত্যাদি দিকগুলিকেও সুরক্ষিত করা সম্ভব হবে। তবেই বাস্তবিক স্বাধীনতা তথা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তই বেরিয়ে আসে যে, সকলের মিলিত উদ্যোগে বাস্তবিক জীবনের সাথে সমন্বয় রয়েছে এমন কোনও দর্শনকে বিকিশিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। আমাদের কাছে সমস্ত প্রকার সুখ উপভোগের জন্য সঠিক বন্দোবস্ত থাকলে কেউই অনৈতিক পথ নির্বাচন করত না। কারোর কিছু হারানোর ভয় থাকতো না এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোপন অভিসন্ধি ইত্যাদির আশ্রয় নেবার প্রয়োজন হতো না। সকলের কাছে সমস্তরকম সুখসুবিধা বরাবর সুনিশ্চিত থাকতো। আমরা সকলে মিলেমিশে সম্পূর্ণরূপে সুখী জীবন উপভোগ করতাম। এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান তত্ত্ব আমাদের কাছে এসেছে। দিল্লী নিবাসী দার্শনিক প্রেমজিৎ শিরোহী মহাশয় দীর্ঘ গবেষণা-অনুসন্ধান-পর্যালোচনার পর এমন এক দর্শন এবং এমন এক ব্যবস্থা জনগণের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন যার দ্বারা সকল প্রকার সুখসুবিধা সকলের জন্য স্থায়ীরূপে বন্দোবস্ত করা সম্ভব হবে। ULM সংস্থা এই নতুন ব্যবস্থার রূপরেখাটিকে বিভিন্ন মাধ্যমে সমাজের কাছে প্রচার করে চলেছে। এই ব্যবস্থায় মোট ছ’টি মডেল রয়েছে। নতুন অর্থনীতি, নতুন রাজনীতি, নতুন সামাজনীতি, নতুন শিক্ষানীতি, নতুন পরিবারনীতি ও নতুন জীবন দর্শন। “সম্পূর্ণ সমাধান – এক নতুন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থব্যবস্থার রূপরেখা” ও “সম্পূর্ণ জীবন দর্শন – এক নতুন দর্শনশাস্ত্রের রূপরেখা” নামক পুস্তকে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। দুটি পুস্তকের ইবুক সকলের জন্য বিনামূল্যে অর্পণ করা হয়েছে। অনলাইন-অফলাইন মাধ্যমে কাগজের পুস্তকও উপলব্ধ রয়েছে।
এবার একটিই কর্ম অবশিষ্ট রয়ে যায় তা হল এই ব্যবস্থাটিকে অধ্যয়ন করে বুঝে নেওয়া ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে স্পষ্ট হওয়া। যেকোনও তত্ত্ব প্রয়োগের পূর্বে তত্ত্বগত দিক দিয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া আবশ্যক। এই সমাধান সঠিক বলে বিবেচিত হলে সমাজের উচিত দ্রুত এই ব্যবস্থাটিকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সরকারি স্তরে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস শুরু করা। আমরা জানি চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী জনগণ যে নীতিকে চাইবে তাই প্রতিষ্ঠিত হবে। জনসাধারণের উচিত এই ব্যবস্থাটিকে সার্বিকভাবে যাচাই করে নেওয়া। যেমন এই ব্যবস্থা নিজের ও পরিবারের সমস্ত সমস্যার সমাধান কিভাবে করবে, বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, মধ্যবিত্ত ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গ কেন সমর্থন করবে, সকলের অর্থনৈতিক চাহিদা কিভাবে পূরণ করবে, মুদ্রা কিংবা মুল্যাংকনজনিত সমস্যা কিভাবে নির্মূল করবে, আর্থিক দুর্নীতির সমস্যাটি কিভাবে নির্মূল করবে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনের সমস্যাটি কিভাবে সমাধান করবে, জনগণ এবং সাংবিধানিক প্রতিনিধিদের মধ্যে সামঞ্জস্য কেমন থাকবে, বিপক্ষে রায় দেবার কোনও কারণ অবশিষ্ট থাকবে কিনা, এই ব্যবস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, কারা প্রতিষ্ঠা করবে, কবে প্রতিষ্ঠিত হবে ইত্যাদি। যদিও ‘সম্পূর্ণ সমাধান’ পুস্তকে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব, আলোচনা, চিন্তন-মনন ইত্যাদির জন্য ULM Bangla, ULM Hindi সহ অন্যান্য ভাষার ইউটিউব চ্যানেলে অনলাইন মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। আপনারা যে স্থানে রয়েছেন সেই স্থান থেকেই অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হতে পারবেন। ইতিমধ্যে বহু বিষয়ে আলোচনার অডিও-ভিডিও উপস্থাপন করা হয়েছে। সেসবও দেখে নিতে পারেন। বিষয়টি সামাজিক। তাই সিদ্ধান্তের বিষয়টিও সমাজের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আপনাদের অংশগ্রহণ ও মতামত বিনিময় সমাজের সুখের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যে দেশ এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করবে সেই দেশের সকল নাগরিক ৫ বছরের মধ্যেই সমস্ত প্রকার সুখের অধিকারী হবে এবং অবিরত সকল প্রকার সুখ পেতে থাকবে। এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে গতানুগতিক বিপ্লব, আন্দোলন, সংঘর্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদির প্রয়োজন না পড়বে না। সকলের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, সমস্ত প্রকার সুবিধাযুক্ত আবাস, যাতায়াত, নিত্যদিনের বস্তু-পরিষেবা, ভ্রমণ-বিনোদন, সমস্ত প্রকার সামাজিক সুখসুবিধাসহ সকল প্রকার নিরাপত্তা স্থায়ীরূপে সুনিশ্চিত থাকবে। সমগ্র বিশ্ব এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করলে প্রতিটি দেশের নাগরিক সকল প্রকার সুখসুবিধা সহজেই উপভোগ করতে পারবে। সমস্ত দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদের আদান প্রদান সহজ হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের অবসান ঘটবে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও লড়াই, দাঙ্গা কিংবা অরাজকতার সমস্যা উৎপন্ন হবে না। যুদ্ধ সামগ্রীতে বিনষ্ট হওয়া বিপুল সম্পদ মানুষের সুখসুবিধা বৃদ্ধির কাজে লাগবে। সুখসুবিধা পেতে আর অর্থের প্রয়োজন পড়বে না। এই ব্যবস্থার নতুন অর্থনীতি অনুযায়ী সকলে অর্থ ছাড়াই সরকারীভাবে সবকিছু পেতে থাকবে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে অনেকে সম্পূর্ণ সমাধান ব্যবস্থার তত্ত্বকে সমাজবাদ এবং সাম্যবাদের সাথে তুলনা করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘সম্পূর্ণ সমাধান’ এবং ‘সম্পূর্ণ জীবন দর্শন’ পুস্তক দুটি গভীরভাবে অধ্যয়নের পর তারা বুঝতে পারেন এই তত্ত্ব অন্যান্য তত্ত্বগুলির তুলনায় মূল স্থানেই পৃথক। দর্শনের তত্ত্বগত সিদ্ধান্ত পৃথক, জীবনের উদ্দেশ্যজনিত ব্যাখ্যা পৃথক, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পৃথক, রাজনৈতিক পরিকাঠামো পৃথক, রূপান্তরজনিত প্রক্রিয়া পৃথক ইত্যাদি। এর অর্থ এই নয় পূর্বের যা কিছু সঠিক রয়েছে তা বর্জন করা হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ সমস্ত প্রকার সামাজিক সুখসুবিধা প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা বরং এই তত্ত্বকে ‘ব্যক্তিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করতে পারি। কারণ এই ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি সরাসরি ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত। অপর কোনও ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী সুস্থ্য নারী-পুরুষের যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী একটি জীবিকা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের জন্যও সমস্ত সুযোগ সুবিধার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি মানুষের জন্য কোনও প্রকার কর্ম সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সমস্ত প্রকার সুখসুবিধা স্থায়ীরূপে বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ব্যবস্থায় কাউকেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে কাউকেই গোপন অভিসন্ধির আশ্রয় নিতে হবে না। পারিবারিক অশান্তি স্থায়ীরূপে নির্মূল হবে এবং সকলের সাথে সমস্ত সম্পর্ক স্থায়ীরূপে মধুর থাকবে। নতুন ব্যবস্থা বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত পুস্তক, অডিও-ভিডিও, বুকলেট, আর্টিকেল ইত্যাদি উপলব্ধ রয়েছে। বিষয়টি সামাজিক এবং জনগণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত। আলোচনা এবং মতামত আদান প্রদানের জন্য সকলে আমন্ত্রিত। ধন্যবাদ।
ইমেল- ulmbangla@gmail.com
ইউটিউব চ্যানেলে ও ফেসবুক পেজ- ULM Bangla