সম্রাট হলেও তিনি যে একজন স্নেহময় পিতা এই ব্যাপারটা প্রমান করেছিলেন মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। সম্রাট তখন দিল্লীতে, কিছুটা অসুস্থ বোধ করছেন। দিল্লীর আবহাওয়া এমনিতেই বিশেষ রকমের অস্বস্তিকর, বিশেষ করে সেই সম্রাটের জন্য, যিনি তাঁর জীবনের চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন ফারগানা, সমরখন্দ এবং কাবুলের মত তুলনামূলক শীতল জায়গায়।
বাবুরের পুত্র হুমায়ুন তখন সাম্রাজ্যের আরেক প্রান্ত কাবুলে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানকার শাসনকর্তা। পিতার অসুস্স্থতার খবর শুনে তিনি সম্রাটের পূর্বানুমতি না নিয়েই দিল্লী এসে উপস্থিত হলেন। বাবুর হুমায়ূনের এইভাবে কাবুল ত্যাগ করে দিল্লিতে এসে হাজির হওয়াটা ঠিক পছন্দ করতে পারলেন না। তাঁর আশংকা ছিল হুমায়ুনের অনুপস্থিতে কাবুলের মসনদ অন্যের দখলে চলে যেতে পারে। বাবুর হুমায়ূনকে অবিলম্বে কাবুল ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।
হুমায়ূনের পিতার নির্দেশ না মেনে কোন উপায় ছিল না। তিনি দিল্লী থেকে কাবুলের উদেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। দিল্লী থেকে কাবুলের দূরত্ব প্রায় একহাজার কিলোমিটার; এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সেইসময় প্রায় মাসখানেক সময় লাগত। যাই হোক, আগ্রা পৌঁছাতে না পৌঁছাতে এবার হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিল্লী থেকে আগ্রার দূরত্ব প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার। তখনকার দিনে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পাঁচ থেকে ছয়দিন সময় লেগে যেত। হুমায়ুনের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকল। একপর্যায়ে এতটাই অবনতি হল যে আগ্রা থেকে দিল্লীতে খবর পাঠানো হল যেন সম্রাজ্ঞী মাহাম বেগমকে আগ্রায় পাঠানো হয়। পুত্রের এই পর্যায়ের অসুস্থতার খবর শুনে সম্রাজ্ঞী তো বটেই, সম্রাট বাবুর নিজেও অবিলম্বে আগ্রা এসে পৌঁছালেন।
তারপর সেই ইতিহাস-বিখ্যাত ঘটনাটা ঘঠল। প্রচলিত সব রকমের চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করার পরও হুমায়ূনের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হল না। সম্রাট বাবুর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর জীবনের বিনিময়ে তাঁর পুত্রের জীবন ভিক্ষা চেয়ে প্রার্থনা করলেন। তখন সম্রাট বাবুরের বয়স তখনো পঞ্চাশও হয়নি ; নিজের প্রাণ উৎসর্গ করবার মত বয়স সেটা মোটেও নয়। প্রাচীন ভারতের আরেক রাজা যযাতির মত জীবনকে আরো অনেকটা সময় ধরে উপভোগ করার প্রয়োজনে সন্তানদের সঙ্গে নিজের জরা বিনিময় করার বদলে সন্তানের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছেন।
ইতিহাস বলছে ঈশ্বর বাবুরের সেই আবেদন গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত কার্যত সেরকমই ঘটতে দেখা গেছে। ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে বাবুর ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকবেন। বিপ্রতীপ এই দুটি ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদৈ কোন ভূমিকা আছে কিনা সেটা বলা মুশকিল, যদিও বাবুরের জীবনীকারেরা ব্যাপারটাকে সেভাবেই দেখতে চেষ্ঠা এবং দেখাতে করেছেন। গোটা ব্যাপারটাকে একটা অধ্যাত্বিকতার মোড়কে মুড়ে সম্রাটকে একজন অত্যন্ত নিষ্টাবান এবং ধার্মিক পুরুষ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা।
হতে পারে গোটা ব্যাপরটা একটা কাকতাল মাত্র। হুমায়ুন কিছুটা দেরীতে হলেও যে সমস্ত ঔষুধ তাঁকে দেয়া হয়েছিল, সেইসব ঔষুধে সাড়া দিতে শুরু করেছিলেন । অন্যদিকে বাবুর নিজে যে খুব একটা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন সেকথা বলা যাবে না। তিনি যথেষ্ঠ পরিমানে সূরাসক্ত ছিলেন। তাঁর নিশ্চয়ই কোন শারীরিক সমস্যা ছিল একমাত্র উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেলার যে একটা তীব্র উৎকণ্ঠা সেটা হয়ত তাঁকে শারীরিকভাবে আরো অসুস্থ করে তুলতে পারে।
বাবুর এবং হুমায়ূনের মধ্যকার এই ঘটনার মধ্যে যে কোন অলৌকিকতা নেই, কোন অধ্যাত্বিকতার লেশমাত্র নেই, সেটা বোঝার জন্য আমাদের সময়ের পরিক্রমায় হাজারখানেক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদের পুত্র ইব্রাহীম অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী। হুমায়ূনের মত মুহাম্মদও একজন পিতা হিসেবে আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তানের জীবন ভিক্ষা করেছিলেন; কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি ।
ইব্রাহীম বিন মুহাম্মদ মাত্র দুইবছর বয়সেই মৃত্যু বরণ করবে এবং তাঁর অল্পকয়েক দিন পরেই তার পিতা মুহাম্মদেরও মৃত্যু হবে। ঈশ্বর চাইলেই হুমায়ূনের মত ইব্রাহীমের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতেন, তার পিতা মুহাম্মদের জীবনের বিনিময়ে। আল্লাহ স্বয়ং যাকে মনোনীত করেছেন নবী হিসাবে, সেই মুহাম্মদের আবেদনই যেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেখানে বাবুরের আবেদন গৃহীত হয়েছিল এমনকরে ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই।