বাঙালির, অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যৎ

অভিষেক দে


Nov. 20, 2024 | | views :818 | like:0 | share: 0 | comments :0

দিনকয়েক আগেকার কথা। কিছু প্রয়োজনীয় কাজে গিয়েছিলাম আসানসোলে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা একটা চিরকুটে কয়েকটা জিনিসের নাম লিখে দিয়ে বলেছিল সময় পেলে আসানসোল বাজারে ঢুকে জিনিসগুলো কিনে আনতে। কাজ সেরে বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ বাজারে ঢুকে উক্ত জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ( অবশ্য এই অভিজ্ঞতা আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে)। এইখানে জানিয়ে রাখি আমার জন্ম এবং বেড়েওঠা আসানসোলে। বর্তমানে দুর্গাপুর শহরে আপাতত স্থায়ী ঠিকানা হলেও, জীবনের ২৯ টা বছর কাটিয়েছি এখানে। শহরটাকে হাতের তালুর মতন চিনি। এখানে অনেকেই আমাকে যেমন বেশ ভালোরকম চেনেন তেমন ভালোওবাসেন। 


যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আসানসোলে বাজারে একটা বহুপুরোনো মাড়োয়ারি ব্যক্তির দোকান রয়েছে। দোকানে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে বানানো বিভিন্ন পাঁপর, চিপস, বিউলিডাল বড়ি ইত্যাদি পাইকারি দরে বিক্রি হয়। দোকানে একজনই কর্মচারী, বাঙালি ( বয়স আন্দাজ প্রায় ২৪)। দোকানে কিছুটা ভীড় থাকায় দাঁড়াতেই হলো। মাড়োয়ারি ব্যক্তিটি তার কর্মচারীকে বারেবারে তাড়া দিচ্ছিল কারন আমাকে বাদ দিলে বাকি সবাই চরম ব্যস্ত যে। দোকানদার, বাঙালি ছেলেটির উদ্দ্যেশ্যে বলছে -"আরে বিট্টু, থোড়া হাত জলদি চালাও। আজ কুছ খায়াপিয়া নেহি ক্যায়া। ইতনা ঢিলা কাম করনে সে তুম মেরা দুকান মে হি তালা লগবা দোগে"। 


খুব খারাপ লাগছিল ছেলেটির এই দুর্দশা দেখে। খোঁজ নিলাম, মাত্র ৪৫০০ টাকা (যা আজকের মুদ্রাস্ফীতির বাজারে অপ্রতুল বলাই যায়) র জন্যে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ( মানে ১২ ঘন্টা) পরিশ্রম করছে এই বাঙালি ছেলে, বিট্টু। না, আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াই নি। যা কিনতে গিয়েছিলাম সেসব না কিনেই এগিয়েছি অন্য দোকানে। 


আজ এই প্রশ্নটা উঠে আসা খুবই প্রয়োজন যে, বাঙালিরা কি অথবা কেন ব্যাবসায় বিমুখ? বাঙালিদের ব্যাবসা প্রসঙ্গে, কবিগুরুর সমসাময়িক ১৮৬১ সালে জন্মেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাঙালিদের বুঝতে একটুও ভুল করেননি। তাই হয়তো “ অন্ন সমস্যা ও বাঙালির নিশ্চেষ্টতা ” প্রবন্ধ সমেত নিজের অনেক লেখাতেই সেই সুর স্পষ্ট শোনা গেছে। উনি লিখেছেন- 

“আলস্যের নিদ্রায় সুখের স্বপ্ন” দেখে, "বুদ্ধির অহংকারে অন্ধ হইয়া” জীবন সংগ্রামে ফাঁকি দেয়। ফলে “বাঙালি সকল দিকের সকল ক্ষেত্র হইতে পরাজিত হইয়া পশ্চাদপদ হইতেছে। মাড়োয়ারি, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা ব্যবসাবাণিজ্যের সকল ক্ষেত্র করতলগত করিতেছে, আর আমরা বাঙালিরা তাদের হিসাব লিখিয়া মাসমাহিনা লইয়া পরমানন্দে কলম পিষিতেছি। বাঙালি শ্রমজীবির দশাও কিছু ভাল নহে।” হিন্দু কেমিস্ট্রির লেখক, বাঙালিদের উদ্দ্যেশ্যে লিখেছেন- “আমাদের জীবনটা যেন দিনগত পাপক্ষয়। শুধু আলস্যের আরাম শয্যায় শয়ন করিয়া আমরা পদে পদে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা করিতেছি। আজ বাঙালির পরাজয় পদে পদে।” 


প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১০০ বছর আগে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তেমনই উনি লিখে গেছেন। তবে ওনার বক্তব্য নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালিদের বলেছেন অলস, কুঁড়ে কথাটা কিছুটা ঠিক আবার খানিকটা ভূলও। মাছেভাতে বাঙালিদের একটা বড় অংশ কিন্তু সত্যিই ব্যাবসা বিমুখ। তারা সরকারি (অথবা বে-সরকারি) চাকরিজীবী হয়েই বেঁচে থাকায় অপরিসীম আনন্দ পায়। একটা উদাহরণ দিই। সেটা ২০০৩ সালের ঘটনা। আমার পরিচিত একজন দিদির শ্বশুরের দোকান ছিল আসানসোল বাজারে একেবারে রাস্তার ওপর। দিদির জীবনসঙ্গীর একবার বেশকিছু টাকার প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক লোনের জন্য ঘুরেঘুরে নাজেহাল হয়ে শেষে দোতলা দোকানটাই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। আমার বাবা সেই জামাইবাবুকে অনেক বুঝিয়েছিল, দোকান বিক্রি না করে গোডাউন হিসবে ভাড়া দিতে ( দোকানটি ছিল শাড়ি, অন্তর্বাসের। ব্যাবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তো পুঁজি প্রয়োজন। আবার পুঁজি থাকলেও যে ব্যাবসা দারুন ভাবে এগিয়ে যাবে এটাও ভুল। লাভ-ক্ষতি নিয়েই ব্যাবসা। তাছাড়া জামাইবাবুদের দোকান সেভাবে চলছিলও না)। কিন্তু একদিন চুপিচুপি সেই দোকানটি একজন হিন্দিভাষী ব্যক্তির কাছে ২২ লক্ষ টাকাতে বিক্রি হয়ে গেলো। প্রিয় পাঠকবন্ধুরা, এখন একটিবার ভাবুন, ২০০৩ সালে যেটা ২২ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছিল আজ ২০২২ সালে সেই দোকানের দাম কতটা বৃদ্ধি পেতো? দোকানটি বিক্রি করে সেইটাকা জামাইবাবু কি কাজে ব্যবহার করেছিলেন জানা নেই, তবে বর্তমানে উনি একটি বে-সরকারি সংস্থার অফিসে সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ০৬টা পর্যন্ত কাজ করেন ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে। এইকারনেই কি প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন- “আমরা দোকান করিয়া ফেল মারি। কারণ সর্বপ্রকার কষ্ট সহ্য করিয়া কৃতিত্ব অর্জনের প্রয়াস আমাদের যুবক গণের মধ্যে দেখা যায় না।” 


"বাঙালি ব্যাবসায় বিমুখ অথবা বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হবে না" কথাগুলো আমি অন্তত মানিনা। আসলে এগুলো একপ্রকার অপপ্রচার এবং খুব সুকৌশলে আমাদের মননে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চালানো হয়েছে এবং হচ্ছেও। একসময় কলকাতা শহরজুড়ে বাঙালিদের দোকান ছিল চোখে পরার মতন। তাদের ব্যবসাও ছিল রমরমা। কিন্তু আজ সেসব অতীত। এখন পশ্চিমবঙ্গে মাড়োয়ারি, গুজরাটি কিংবা বিহার, উত্তরপ্রদশ থেকে আগত 'বেওসায়ীরা' তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করে ফুলেফেঁপে উঠলেও বাঙালিরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আটকে রয়েছে। বাঙালিদের একটা বড় অংশের আজ নিজের মাতৃভাষার বদলে হিন্দিপ্রীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধিও পাচ্ছে। ভারতীয় সংবিধান কোনো রাষ্ট্রভাষা না থাকলেও খুব কৌশলে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা বানানোর কাজ চলছে, চলবেও। দুঃখের বিষয় বাঙালিরাও এটা একপ্রকার প্রচার চালাচ্ছেন। আজ উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবার তাদের সন্তানদের নামীদামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তী করিয়ে অত্যাধুনিক বানানোর একটা প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে কারন " আমার সন্তানের বাংলাটা ঠিক আসেনা " জাতীয় কু-যুক্তিও শোনানো হচ্ছে। 


আরেকটি গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তরুণতুর্কী বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন হাতে অস্ত্র তুলে লড়াইয়ের ময়দানে, তখন কিছু বেইমান বাঙালি ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করতে ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসেব বলা যায়, মাস্টারদা সূর্যসেনের মাথার দাম যখন ব্রিটিশেরা ১০০০ টাকা ধার্য করে তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ব্রিটিশদের দেওয়া ৬০ টাকার চাকরি করতেন এবং মাস্টারদা কে ধরিয়ে দিতে বিশেষ ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যখন অসংখ্য তরুণ প্রাণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকালে ঝড়ে যাচ্ছিল তখন একদল বেনিয়ারা ব্রিটিশদের পদলেহন করে সুদের টাকা গুনে মুনাফা কামানোর দিকে বেশি নজর ছিল। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে অসহায় জনগণ যখন সামান্য ভাতের ফ্যানের জন্য হাহাকার করছে তখনও এই বেনিয়াদের দল অগুনতি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চালের কালোবাজারি করেছে এবং বলে গেছে 'বাঙালি লোগো সে বেওসা নেহি হোগা। উ লোগ মাছলিভাত খাকে গেহেরি নিন্দ মে যানে ওয়ালা বড়াহি আলসি কিসম কা জাতি হায়'।


পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের সুদিন কি সত্যিই ফিরেছে? ফিরলে আজ সেই বিট্টু অন্যের দোকানে ৪৫০০ টাকা রোজগারের জন্য এতো পরিশ্রম না করে হয়তো নিজস্ব দোকানে কোনো ব্যবসা করতো, নিদেনপক্ষে মুদিখানা। 


কয়েকমাস আগে বন্ধু সুপ্রিয়র সাথে হাওড়া গিয়েছিলাম দিল্লিগামী ট্রেন ধরবো বলে। হাওড়া ব্রিজের (রবীন্দ্রসেতু) ওপর দাঁড়িয়ে বন্ধুটি বলছিল - "ব্রিটিশদের আমরা যতই গাল পারি তাদের উগ্রতা ও ফ্যাসিস্ট আচরণের জন্য, কিন্তু এটা মানতেই হবে তারা নিজেদের প্রয়োজনে দেশটাকে খোলনলচে বদলেছিল অনেকটাই। এই যেমন হাওড়া ব্রিজের কথাই ধরা যাক। অসংখ্যা গাড়ি যানবাহনের ভার নিয়েও ব্রিজটা আজও কেমন সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ বর্তমানে কোনো ব্রিজের টেন্ডার ডাকা হলে সেটা অন্যরাজ্যের লোকেরা এসে বানাচ্ছে। এই বানানোতেও কোটিকোটি টাকার দুর্নীতি আর ব্রিজটাও তেমন টেকসই হয়না।উদাহরণ, বিবেকানন্দ সেতু।" 


বন্ধু সুপ্রিয়র কথাগুলো খুব ভুল নয়। আজ দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। এই রাজ্যের শ্রমিকেরা নিজেদের সংসারে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয় অথচ অন্যে রাজ্যের শ্রমিকেরা এখানে সুন্দর ভাবে কাজ করে অন্নসংস্থান করছে ( মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলের অনেক হিন্দু বাঙালি বা বাঙালি মুসলিমরা কাজের জন্যে ভীন রাজ্যে যায় না এটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না)। আজ কলকাতার বড়বাজার থেকে হাওড়া, ডানকুনি, রানিগঞ্জ, আসানসোল প্রায় সর্বত্র মাড়োয়ারি, গুজরাটি দের রমরমা ব্যাবসা এবং সেখান থেকে কোটিকোটি আয়। 


দিনেরশেষে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় যে, বাঙালিরা কি পারবে সেই হারানো দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে? অলস, কুঁড়ে ইত্যাদির তকমা পাওয়া মাছেভাতে বাঙালিরা কি পারবে ব্যাবসায়ী রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে? মাড়োয়ারি, গুজরাটিরা যেভাবে এই রাজ্যে শেকড়গেঁড়ে বসে কোটিকোটি টাকা ব্যাঙ্কে ভরছে, ঠিক তেমন কিছু কি বাঙালিরাও পারবে? 


লেখাটি শেষ করবো দেশের ডাক বইএ তরুণের স্বপ্ন প্রবন্ধে (পৃ. ৬-১০) সুভাষচন্দ্র বসুর একটি দারুন উক্তি দিয়ে যা উনি ১৯৩৮ সালে লিখেছিলেন। " অনেকে দুঃখ করে থাকেন, বাঙ্গালী মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া হলো না কেন? আমি কিন্তু প্রার্থনা করি, বাঙ্গালী যেন চিরকাল বাঙ্গালীই থাকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম্ম ভয়াবহঃ”। আমি এই উক্তিতে বিশ্বাস করি। বাঙ্গালীর পক্ষে স্বধর্ম্ম ত্যাগ করা আত্মহত্যার তুল্য পাপ।"

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929