নাস্তিক বনাম নাস্তিক

রাজু দত্ত


May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0

ভজহরিবাবু নাস্তিক। তিনি দৈনন্দিন জীবনযাপনে কোনওপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে চলেন না। কোনও উপাসনালয় যান না। ভূত-প্রেত-জ্যোতিষসহ সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হন এইসকল বিশ্বাসীরা‌। বাবার মৃত্যুর পর তিনি ‘শ্রাদ্ধ’ জাতীয় অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াননি। এমনকি চৌদ্দ দিনের ‘অশৌচ বিধি’ও তিনি মানেননি। 


তাঁর পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও পরিচিত সকলেই জানেন যে ভজহরিবাবু ঘোর নাস্তিক। তবে তাঁরা কখনও তাঁকে এবিষয় কোনওরকম ব্যক্তি আক্রমণ করেন না। কারণ ভজহরি বাবু বিপদে আপদে সবসময় সবার আগে শত্রু-মিত্র সবার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “আমি মানবতায় বিশ্বাসী। মানবতাই আমার ধর্ম।”  তিনি  জোর জবরদস্তি কারো বিশ্বাসে আঘাত হানেন না। স্পষ্ট বলেন “আমার যুক্তি তুমি যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে দেখাও, তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নেবো।”। তারা জানেন ভজহরিবাবুর সাথে যুক্তি-তর্কে পেরে ওঠা অসম্ভব, তাই তাঁর সাথে তর্কে জড়ান না। তারা বলেন, “নাস্তিক বটে, তবে ভজহরিবাবুর মত মানুষ আজকের দিনে বিরল বৈকি।” এহেন ভজহরিবাবুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল, তারই কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ‘নাস্তিক’ বন্ধু বান্ধবের সৌজন্যে। 


এই জনৈক নাস্তিকের ফেসবুকে একটি সাম্প্রতিক আলোকচিত্র (ফটো) পোস্ট করার পর যত গোলমালের সূত্রপাত। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সস্ত্রীক একটি মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই মন্দিরের পুরোহিতের সাথে তিনি কথা বলছেন। আসলে তিনি একটি জরুরী কাজে গিয়েছিলেন, ফেরার পথে জনৈক পরিচিত, যিনি পেশায় পুরোহিত তার সাথে কথা বলছিলেন। ব্যস্! একজন নাস্তিকের এহেন আচরণ মেনে নিতে পারলো না ‘নাস্তিক সমাজ’ এর অনেকেই। তারা ভজহরিবাবুর ছবিটির উৎস, কার্যকারণ কিছুই বিচার-বিবেচনা না করে ছবিটি ব্যাপক হারে শেয়ার করতে লাগলেন। 


ছবির সাথে যে ক্যাপসনগুলি তারা লিখলেন তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন ভজহরিবাবু। একজন লিখেছেন, ‘সস্ত্রীক পুজো দিয়ে ফিরছেন নাস্তিক ভজহরি।” একজন লিখেছেন, ‘নাস্তিকও মন্দিরে যায়, দেক্লে হবে খচ্চা আচে।” একজন বিনম্র নাস্তিক যিনি বিভিন্ন সময়েই সামাজিক- রাজনৈতিক আন্দোলনে তীব্র ফেসবুকীয় প্রতিবাদে সামিল হোন, তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লিখেছেন, “এইসব ভন্ড নাস্তিকদের জন্য প্রকৃত নাস্তিকদের বদনাম হয়। এদের বয়কট করুন।” সরস ভঙ্গিতে একজন লিখেছেন, “ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে।”


উক্ত পোস্টগুলির কমেন্টবক্সে কমেন্টগুলিতে ভজহরিবাবুর প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিদ্রুপ উপচে পড়ছে। কমেন্ট, পাল্টা কমেন্টের স্ক্রিনশট ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে। নাস্তিক-আস্তিক একযোগে আক্রমণ করেছে ভজহরিবাবুকে। ব্যতিক্রম বলতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নাস্তিক। যাঁরা ভজহরিবাবুর পক্ষে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করছেন। তাদের সেই মন্তব্যের আবার স্ক্রিনশটও পোস্ট করছেন অন্য নাস্তিকরা। এইসব ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপই কেন্দ্রবিন্দু এখন।


ভজহরিবাবুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।‌ পথে-ঘাটে, বাড়িতে, অফিসে সর্বত্র তাকে কটূক্তি-অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। আজ সকালে পাড়ার এক নাস্তিক বন্ধু তাকে ‘নাসসস্ তিকক্’ বলে বিদ্রুপ করেছেন। উপস্থিত সবাই হো-হো করে হেসে উঠেছে। নাস্তিক ভদ্রলোক বললেন, ‘নাস্তিক হওয়া অত সহজ নয় বুঝলি হরি, অনেক পড়াশোনা করতে হয়”। ভজহরিবাবুর বিরুদ্ধাচরণ করার একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে যেন। নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁরই কয়েকজন নাস্তিক বন্ধু-বান্ধব। 


গভীর অস্ফুট যন্ত্রণার আবেগ আর মানসিক অবসাদে তাঁর যুক্তিবোধ ঢেকে গেল। তিনি এই দুর্দিনে কাউকেই পাশে পেলেন না। দু-একজন বন্ধুর (নাস্তিক) পরোক্ষ সান্ত্বনাতেও মানসিক অবসাদের কণামাত্র দূর হল না । বৃদ্ধ ভজহরিবাবু চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। সকলের অলক্ষ্যে তীব্র বিষাক্ত কীটনাশক পান করলেন। তারপর...


না, মৃত্যু হয়নি ভজহরিবাবুর। তাঁর স্ত্রী, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রবল আস্থাশীল এবং পাড়া প্রতিবেশীরা যারা সকলেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী এদের তৎপরতা এবং মুষ্টিমেয় কয়েজন বন্ধুর (নাস্তিক) ঐকান্তিক সহযোগিতা ও সর্বোপরি ডক্টর সৈফুদ্দিন (নাস্তিক)-এর সুচিকিৎসায় তিনি বেঁচে গেলেন।‌ তার এই কঠিন সময় মিশে গেলো আস্তিক-নাস্তিক সকলে। জয় হল মানবতার। 


ভজহরিবাবুর গল্পটা কাল্পনিক।‌ তবে সাম্প্রতিক সময় নাস্তিকদের এই রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সবাই হয়ত আত্মঘাতী হবার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেন না, কিন্তু একদল নাস্তিকের এইরকম আচরণে আর একদল নাস্তিককে চরম মূল্য দিতে হয়। নাস্তিক বনাম নাস্তিক লড়াইটা চলতেই থাকে।


দৈনন্দিন জীবনে আমরা যাদের সাথে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কে জড়িয়ে তারা অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, জ্যোতিষ, ভূত-প্রেতসহ বিবিধ কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আমরা যে মুদি দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকি ও রাত্রে  পরিবারের যে সদস্যদের সাথে ঘুমোতে যাই, তাদের অধিকাংশই আস্তিক। তাদের সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে নাস্তিকদের নিজস্ব একটা পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে রাতারাতি। 


আমাদের পৃথিবীতে এখনও আস্তিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী থেকে সাহিত্যিক, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পীসহ সকল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশ আস্তিক। যে স্কুলে বা কলেজে আমরা পড়াশোনা করি, যে কর্মস্থল আমাদের উপার্জনের সম্বল, সেখানে আমাদের সহপাঠী ও সহকর্মীরা অধিকাংশই আস্তিক। ট্রেনে, বাসে, বিমানে, জাহাজে আমাদের সহযাত্রীদের অধিকাংশই আস্তিক। যে কৃষক ফসল ফলান, যে শ্রমিক পণ্য উৎপাদন করেন, আমাদের বাড়ি থেকে  রাস্তাঘাট সমস্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন, যে সকল বিক্রেতাদের দোকান থেকে আমরা পণ্য ক্রয় করি, যে চালক আমাদের গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেন, যে পরিচারিকা আমাদের গৃহকার্যে সহায়তা করেন, যে সকল মানুষ আমাদের অব্যবহার্য বর্জ্য পরিষ্কার করে পরিবেশ পরিষ্কার রাখেন, যে সেবিকা আমাদের অসুস্থতার সময় শুশ্রুষা করেন, তাদের অধিকাংশই আস্তিক। এদের সকলকে এড়িয়ে আমরা বাঁচতে পারবো কি?

মনে রাখবেন, নাস্তিকদের নিজস্ব পৃথিবী এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিপুল সংখ্যক আস্তিকদের ভিড়েই তাদের থাকতে হয়। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে তো থাকা সম্ভব নয়। কাজেই, সকলের কাছে আমার বিনীত আবেদন, একটি ছবি ভিডিও বা স্ক্রিনশট দেখিয়ে কোনও একজন নাস্তিককে রাতারাতি ভন্ড প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না। তার উৎস, কার্যকারণ সম্পর্ক বিবেচনা করে যদি প্রমাণিত হয় তিনি ভন্ড তবে এর দায় কেবল তাঁর। সকল নাস্তিকদের  ঘাড়ে দ্বিচারিতার দায় চাপিয়ে তাঁদের আদর্শকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টাও অনুচিত। মনে রাখবেন আগামী দিনগুলি কেবল মানবতার। সেখানে থাকবে না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অস্তিত্ব। মানুষ বাঁচবে ‘মানুষ’ হয়ে।


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929