একটা বেশ সাত্বিক সাত্বিক গন্ধ মাখা কথা আমাদের সমাজে বেশ চালু। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না। ধর্ম থাকুক ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি থাক রাজনীতির জায়গায়।
আসলে আমরা ধর্মের ইতিহাস অনেকে জানি না, অনেকে আবার জেনেও অজানাদের মতই অসচেতন। মানব জীবনে রাজনীতি এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার সাথে ধর্মীয় কিছু আবেগ মিশিয়ে দিতে পারলেই স্বার্থ সিদ্ধ হয়, সংগঠিত করার কাজ সহজ হয়। এ কথা বোধহয় আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে ধর্মীয় স্বার্থ আর রাজনৈতিক স্বার্থের সার্থক ককটেল একটা বাজারে ছাড়তে পারলেই, জনগণের মনের তৃষ্ণা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়ে সেই দলটির 'আমি তোমাদেরই লোক' ভাবটির যে ভাবে স্পষ্টকরণ সম্ভব; তা বোধহয় শত বক্তৃতা বা হাজার কাজের বাস্তবায়ণের মাধ্যমেও ফলপ্রসূ দেখি না।
মানুষ মূলগতভাবে প্রথমত একটি প্রাণী। সামাজিক প্রাণী। মানবেতর অন্যান্য প্রাণীর প্রায় খাড়া দ্বিপদ প্রাণী। তিনি মানুষ হয়ে উঠতে পারেন শুধুমাত্র তাঁর যুক্তিবাদী চেতনা গ'ড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে। এই চেতনা গ'ড়ে ওঠার পথে সহস্র প্রতিবন্ধকতা।
প্রথম থেকেই শিশুর শিখনকালে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কুশিক্ষা ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা জগৎ ব্যাপী বিস্তৃত। শিশুর মনে ভূত, প্রেত, ঈশ্বর বিশ্বাস প্রভৃতি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রবিষ্টকরণের কাজে অভিভাবক, প্রতিবেশী, শিক্ষক-শিক্ষালয় এক কথায় সমগ্র সমাজ যেমন উঠে পড়ে লাগে তাতে সেই শিশুটিকে কুসংস্কারাচ্ছান্ন করে গড়ে তোলার লব্ধ মিশন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সামান্যতম সুযোগ থাকে না। এই চক্রব্যুহ ভেদ করেও যাঁরা কেন, কী, কোথায়, কবে, কীভাবে , প্রশ্ন করতে শেখেন, চিন্তা করেন, চিন্তা করার সাহস পান, তাঁদের বলা যায় যুক্তিবাদের পথের পথিক, অর্থাৎ যুক্তিবাদ সম্পন্ন প্রাণী -মনুষ্য। যুক্তিবাদ বিবর্জিত প্রাণী মনুষ্য পদবাচ্য হতে পারে কি?
অবশ্য আজ পর্যন্ত এমন কাউকে আমি দেখিনি, যিনি নিজেকে কুসংস্কারগ্রস্ত, নিজেকে অন্ধবিশ্বাসী মনে করেন। সকলেই নিজেকে যুক্তিবাদী মনে করেন। ধর্মের কুসংস্কার প্রচার করা যারা পেশা হিসাবে নিয়েছেন, তাদের নামের সামনে দেখি, যুক্তিবাদী বিশেষণ। হাসি পেলে হাসি চেপে চুপে থাকাই সেখানে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ দশচক্রে পাথরকেও ভগবান বানানো হয়। হাসি চেপে রাখতেই হয় যখন কাঠের তৈরী ঠাকুরের হেলথ চেক আপ করেন এম বি বি এস, এম ডি ডাক্তারে, কাঠের বুকে সত্যিকারের স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে।
বন্ধু বলার কিছু নেই, এভাবেই কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে শিক্ষার বলি ঘটে প্রতি মুহুর্তে।
রাজনীতি ছাড়া তো সমাজ চলে না। ধর্মকেও এতটাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ব্যক্তিক জীবনশৈলীর প্রতিটি ক্ষেত্র জুড়ে আছে ধর্ম, কুসংস্কার৷ অন্ধবিশ্বাস। যুক্তিবাদীদের নিয়েও মানসিক প্রমোদ লাভের মেনু উপভোগ করতে পারেন কবজি ডুবিয়ে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের খাদ্য ভক্ষণ থেকে পানীয় পান করে ঢেঁকুর তোলা পর্যন্ত। তারপর কুশিক্ষার পান চিবানোর পর্ব সম্পূর্ণও বাদ যাবে না।
ভূতে বিশ্বাসকে অনেকেই যুক্তিবাদের বিপরীত গোষ্ঠীভুক্ত করেন। খ্যাতনামা এক সাহিত্যিক, যিনি নিজেকে যুক্তিবাদ বিবর্জিত প্রাণী বলে আদৌ মনে করেন না বলেই জানি, তিনিও অকপটে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ভূত আছে, চতুর্দশীতে তেঁনাঁরাঁ এসেও থাকেন।
ভূতে অবিশ্বাসী যুক্তিবাদীরা আবার ভগবানে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন।
আরও দেখবেন, ভগবানে অবিশ্বাসীরা আবার জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে চেঁচিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। বিজ্ঞান ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের হাতেও দশ আঙুলে দশাধিক স্টোন সমন্বিত আংটির শোভা দেখে মূর্ছা-ভাব কারুর অভিজ্ঞতায় থাকাটা স্বাভাবিকের থেকেও বাস্তব।
আবার জ্যোতিষকে অবিজ্ঞান অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার বলে বুঝেছেন, তাঁদের মাঝেও অনেকের কাছে হোমিওপ্যাথি নিয়ে বলুন, সেই জ্যোতিষ বিরোধী যুক্তিবাদীমন্য লোকেও রে রে করে উঠবে।
এ হ'ল যুক্তিবাদীদের এক ঝলকের পরিচয়।
খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যখন যুক্তিবাদীরা তাদের একজন গুরুকে খাড়া করে দেন। আবার সেই গুরুর দলে কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর যখন কলিকালাভ না হওয়াতে গুরুবিরোধিতার শক্তি অর্জন করতে ভূতান্বেষী বিজ্ঞানীদের ধরে ঝুলে পড়েন।
এরা নিজেদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে এমনভাবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেন যে এ নিয়ে অলিম্পিকে ইভেণ্ট থাকলে নির্দ্বিধায় সর্ব জাজের সম্মতিক্রমে উভয়পক্ষকেই প্রথম স্থানাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করা যেতে পারতো।
যুক্তিবাদী আন্দোলনের কত বড় ক্ষতি এঁরা করে চলেছেন, তার তল পাওয়া দুস্কর।
তাহলে উপায়? সব ছেড়েছুড়ে হাত গুটিয়ে ব'সে থাকবো?
না হাজার পথ খোলা। পথই পথ দেখাবে।
পেশী শক্তির বিকল্প মসি শক্তি।
কলম ধরতে হবে। ওটাই যুক্তিবাদী চেতনা বিকাশের হাতিয়ার।