মেঘনাদ সাহার সমালোচনা করে শ্রীঅনিলবরণ রায় (পন্ডিচেরি প্রবাসী) ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন সাহা নাকি হিন্দুর দর্শন ও হিন্দুর ধর্ম নিজে না পড়িয়া অন্যের মুখে ঝাল খেয়েছেন। সাহার বক্তব্য - কোনও লোক যত বড়ই হোক না কেন স্বীকার না করিয়া তাঁহার কথার প্রতিধ্বনি করা আমার কাজ নয়। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ মৌলিক।
সাহার সমালোচক মোটের উপর এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা গঠনের এমনকি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা গঠনের সমস্ত আদর্শ বর্তমান আছে। তাঁহার বিশ্বাস যে হিন্দুর দর্শন ও বিজ্ঞানে ক্রমবিবর্তনবাদ (Theory of Evolution), পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিনবাদ (Heliocentric Theory of the solar system) ইত্যাদি বর্তমান বিজ্ঞানের যাবতীয় মূলতত্ত্ব, এমনকি National Planning পর্যন্ত স্পষ্ট ভাবে স্বীকৃত আছে, না হয় বীজাকারে প্রচ্ছন্ন আছে। কিন্তু সাহা সমালোচকের এই মতকে শুধু ভ্রান্ত বলেননি, সঙ্গে এটাও বলেছেন যে এ ধারনা অজ্ঞতাপ্রসূত। সাহার মতে সমালোচক আর সকলের মতো মনে করেন “হিন্দুধর্ম ও দর্শনের মূল বেদ”। সমালোচক কি অবগত আছেন বিগত ১৯২৩ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুপ্রদেশের মহেঞ্জাদড়োর দুটি প্রাচীন নগরীর আবিষ্কার করে, ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও মোটামুটি ভারতীয় সভ্যতার উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। সমস্ত প্রাশ্চাত্য পন্ডিত ও অধিকাংশ দেশী পন্ডিতদের মতে (যেমন: রমাপ্রসাদ চন্দ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজাশঙ্কর গুহ) এই সভ্যতা প্রাকবৈদিক ও প্রাকআর্য। এই সভ্যতা তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতার মতো উন্নত ছিল। বর্তমান পণ্ডিতেরা প্রমাণ করেছেন হিন্দুর ধর্ম ও দর্শনের অধিকাংশ উপাদানই প্রাক আর্যসভ্যতা থেকে গৃহীত - যেমন শিব-পশুপতির পূজা, ধ্যান, যোগ, ফুল-নৈবেদ্য দিয়ে পূজা পদ্ধতি এবং সম্ভবত পশু, সর্প ও বৃক্ষদেবতার পূজো (সূত্র-Science and culture)।
“কাজেই হিন্দুর সমস্ত 'ব্যাদে' আছে একথা প্রস্তরীভূত(fossilized) পান্ডিত্যাভিমানী ব্যতীত এই যুগে কেহ বলিতে সাহসী হইবেন।”
“বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ সূচনা করিয়াছিল সেই উভয় ধর্মেই বেদকে সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। তিনি কি জানেন না যে লোকায়ত মতে ‘ত্রয়ঃ বেদকর্ত্তারঃ ভন্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ।’
অর্থাৎ খৃষ্টের কিছু পূর্বে ভারতবর্ষে একদল যুক্তিবাদী ছিলেন, যাহারা মনে করিতেন যে বেদের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা দুরূহ; শুধু কতকগুলি ভদ্রলোক বেদের অর্থ না জানিয়াও বেদের দোহাই দিয়া ভ্রান্ত প্রচার করে। এখনও এই শ্রেনীর লোকের অভাব নাই।"
সমালোচনা উত্তর।
মেঘনাদ সাহা-র লেখা থেকে নেওয়া।